ঝিঁঝিঁ – ১৫

১৫

প্রার্থনা কক্ষে সবাই মাথায় টুপি পরে বসেছে।

শুভ্র জায়গা নিয়ে বসল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রার্থনা হল।

সবার দেখাদেখি শুভ্র আচারগুলো পালন করল।

প্রার্থনা শেষ হতেই শুভ্রকে লতিফ ডেকে নিল। কাঁধে হাত দিয়ে বলল “কেমন ছিল কালকের অভিজ্ঞতা?”

শুভ্র মুখে কৃত্রিম উচ্ছাস ফুটিয়ে বলল “খুব ভাল”।

লতিফ বলল “ঠিক। এখানেই এই। তাহলে ভাবো তো আতিক জন্নতে কী হবে। তোমাকে ঘিরে থাকবে এরকম হুর পরীরা। যা চাইবে তাই পাবে। শুধু তোমাকে সেখানে যাবার জন্য যা করার তাই করতে হবে”।

শুভ্র ঘাড় নাড়ল।

লতিফ বলল “আজ মিলিট্যান্ট ট্রেনিং হবে তোমাদের। কালকের থেকেও বেশি কঠিন। শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে বুঝতেই পারছ। যত বেশি তোমার শারীরিক সক্ষমতা থাকবে, তত বেশি তুমি শত্রুপক্ষকে দমন করতে পারবে। দুবলা পাতলাদের জন্য উপরওয়ালার কোন দয়া নেই। তুমি কখনও দেখেছো যারা শারীরিকভাবে অক্ষম তারা কখনও ভাল থেকেছে? এর কারণ হল ওদের আগের জন্মের পাপ ছিল। ওরা জন্ম থেকেই কোন না কোন পাপ করে এসেছিল, যার জন্য ওদের এত কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে এ জীবনে”।

শুভ্র কিছু বলল না। তার কাকার মেয়ে শারীরিকভাবে অক্ষম। সে কী পাপ করেছিল? জন্ম থেকেই বোন এরকম। তার মুখে অনেক কথা এল কিন্তু লতিফকে কিচ্ছু বলল না।

লতিফ তাকে প্রস্তুতি কক্ষে নিয়ে এসে বলল “যাও, পোশাক পরে নাও। আজ তোমাদের ট্রেনিং নেবেন কম্যান্ডার উসমান। কম্যান্ডার ইরাকে ছিলেন অনেক দিন। কম্যান্ডারকে আমাদের কাছে আমাদের বন্ধু সুলতান বিশেষভাবে পাঠিয়েছেন”।

শুভ্রর জন্য পোশাক তৈরী ছিল। হাফ প্যান্ট আর কালো টি শার্ট। তৈরী হয়ে মাঠে গিয়ে দেখল একজন খুব লম্বা চওড়া টকটকে ফর্সা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। অনুমানে বুঝল ইনিই উসমান।

লতিফ এসে উসমানের কানে কানে কিছু বলল। উসমান তাকে কাছে ডেকে নিলেন। শুভ্র উসমানের চোখ দেখল। শীতল কালো চোখে। শুভ্র ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল। এ চোখ কোন জীবন্ত মানুষে হতে পারে না।

উসমান লতিফকে অজানা ভাষায় কিছু বলল। শুভ্র বুঝতে পারল না। লতিফ একই ভাষায় উসমানকে উত্তর দিল। উসমান এবার শুভ্রর দিকে তাকাল। পা থেকে মাথা জরিপ করল এবং পরক্ষণেই সপাটে শুভ্রকে চড় মারল।

যেন মাথার ওপর ভারি কিছু ভেঙে পড়ল। শুভ্র ছিটকে পড়ল।

উসমান হো হো করে হেসে উঠল। বাকি ছেলেরা ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

আকাশে উজ্জ্বল সূর্য, সব পুড়িয়ে দিচ্ছে।

লতিফ চেঁচিয়ে বলল “উসমান তোমার শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা নিচ্ছেন। সহ্যশক্তির। তোমাকে পাশ করতেই হবে আতিক”।

শুভ্রর মাথা ঝিম ঝিম করছিল। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় মাথায় ঝিঁঝিঁ ডেকে উঠল “যা বলছে করে যা বাবান”।

শুভ্র রাগতে পারল না, কারণ তার সে ক্ষমতাটুকুও ছিল না। উসমান এসে তার পিঠে প্রবল জোরে লাথি কষাল। সে আবার মুখ থুবড়ে পড়ল।

এর পরের দশ মিনিট তার ওপর যেন ঝড় চলল। উসমান তাকে আধমরা করে দিল।

লতিফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।

শুভ্রকে ছেড়ে দিয়ে যখন অন্য ছেলেকে ধরল উসমান, তখন তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। মুখে নোনতা স্বাদ।

লতিফ তার কাছে এসে মাঠের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে বলল “কো অপারেট উইথ হিম। হি ইজ দ্য বেস্ট”।

শুভ্র মাথা নেড়ে সম্মতি দেওয়ার চেষ্টা করল।

লতিফ তার কাঁধে হাত রেখে উঠে চলে গেল।

ঘন্টা খানেক পরে তাদের দশজনকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হল।

দশজনই মৃতপ্রায়।

দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে টিয়ার গ্যাস চালিয়ে দেওয়া হল।

সবার দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।

একটা ছেলে আর্তনাদ করে উঠল। কেউ শুনল না।

বেশ কিছুক্ষণ এরকম চলার পর ঘরের দরজা খুলে তাদের বের করে নিয়ে গিয়ে রোদের মধ্যে ফেলে রাখা হল।

শুভ্রর রক্তবমি শুরু হল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১৬

যে ছেলেগুলো রোবটের মত ট্রেনিং করে যাচ্ছিল, উসমানের মার খেয়ে তারাও এক প্রকার শয্যাই নিয়েছে। শুভ্রর বমি দেখে উসমানের নির্দেশমত তার মাথায় জল ঢালা হয়েছে। হাসপাতালের মত একটা জায়গায় তাদের সবাইকে বেডে দেওয়া হল।

সবাই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। একটা ছেলের কানের পাশ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হল। কোথায় নিয়ে গেল বোঝা গেল না।

শুভ্র চোখ বন্ধ করে বসেছিল, তার পাশের বেডের ছেলেটা বলল “সালাম ওয়ালাইকুম। আমার নাম সোহেল। তোমার কী নাম?”

শুভ্র নিজের আসল নাম বলতে গিয়ে মনে পড়ায় থমকে গিয়ে বলল “আতিক। তুমি বাঙালি?”

সোহেল জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল “হ্যাঁ। রাজশাহী বাড়ি আমার”।

(সোহেল রাজশাহীর বাঙাল অ্যাক্সেন্টেই কথা বলেছিল, আমরা সবার সুবিধার্থে স্বাভাবিক বাংলাই রাখলাম)

শুভ্র বলল “ও”।

সোহেল বলল “আজ খুব কড়া হয়ে গেল দোস্ত। এতটা হবে বুঝি নি। কিন্তু উসমান শেখ কামেল আদমি আছে। হুজুরের কাছে শুনেছি ইউকেতে একটা বড় অপারেশন করে এসেছিল। কেউ ধরতেও পারে নি”।

শুভ্র বুঝল না “অপারেশন মানে?”

সোহেল তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল “বোঝ না? অপারেশন মানে? টিউব ট্রেনে গুলি মেরেছিল তো। তাও লন্ডনের মত জায়গায়। তারপর পুরো ছদ্মবেশ ধরে পালিয়ে এসেছিল। সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে”।

শুভ্র ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলেও বাইরে স্বাভাবিক থেকে বলল “আচ্ছা”।

সোহেল বলল “তুমি কোথা থেকে এসেছ?”

শুভ্র বলল “কলকাতা”।

সোহেলের চোখ উজ্জ্বল হল “খুব ভাল। কলকাতায় চিনি পাওয়া যায়?”

শুভ্র অবাক হয়ে বলল “চিনি কেন পাওয়া যাবে না?”

সোহেল খুক খুক করে হেসে বলল “ধুস, তুমি দেখি বাচ্চা ছেলে। কিছুই বোঝ না। চিনি মানে ব্রাউন সুগার”।

শুভ্র বলল “ও হ্যাঁ, পাওয়া যাবে না কেন?”

সোহেল বলল “তুমি নাওনি না কোন দিন?”

শুভ্র বলল “না না। নিই নি”।

সোহেল বলল “আমার মনে হয়েছে। তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় তুমি এসব কোন দিন নাও নি। আমি নিই”।

শুভ্র বলল “এখানে পাও?”

সোহেল বলল “কেন পাব না? আমি কি এখানে এমনি এমনি এসেছি নাকি? হুজুর আমাকে চিনি না দিলে আমি আসতামই না কোন দিন। এসে অবশ্য ভাল হয়েছে। বুঝতে পারছি, আমাদের জন্য কত ভাল কিছু হচ্ছে এখানে”।

শুভ্রর গা হাত পা ব্যথার সঙ্গে মাথাও ধরছিল। ছেলেটা ভীষণ বক বক করে। তবু সে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল “কী হচ্ছে?”

সোহেল চারদিকে তাকিয়ে বলল “তুমি কলকাতার ছেলে, তুমি বোঝ না? কীভাবে তোমাদের ওপর অত্যাচার করা হয়। তোমাকেও কি সব খুলে বলতে হবে”?

শুভ্র না বুঝে মাথা নাড়ল “হ্যাঁ হ্যাঁ তা ঠিক”।

সোহেলের মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল, যেন অন্য কোন মানুষ তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, সোহেল উঠে বসে পড়ে বলল “সব শেষ করে দেব আমরা। সব। আমাদের উপর হওয়া প্রতিটা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেব”।

সোহেলের কথাটা পাশের বেডের ছেলেগুলোও শুনল। তারা সবাই মিলে একটা অদ্ভুত স্লোগান দিতে শুরু করল।

শুভ্র ভাষাটা বুঝল না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল স্লোগানটা এত বড় হলঘরের প্রত্যেক কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই হই হই করে উঠছে। সোহেল বলল “কী হল? তুমি চুপ কেন? তুমি জানো না?”

শুভ্র বলল “না। আমি তো সবে এলাম”।

সোহেল বলল “ওহ, তোমাকেও শিখিয়ে দেবে। দেখবে যত কষ্টই হোক, এটা বললে শরীরে শক্তি পাবে। আলাদা শক্তি আছে এই কথাগুলোতে। এর মানে হল হে আল্লা, আমরা তোমার খাস বান্দা। আমাদের জন্য তুমি যে পথ বেছে দিয়েছো, আমরা সে পথে গিয়ে তোমাকে পাব। বুঝলে? তুমি আরবী জানো না?”

শুভ্র মাথা নাড়ল।

সোহেল তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল “তুমি এখানে এলে কী করে?”

শুভ্রর মাথার ভেতর ঝিঁঝিঁটা ডেকে উঠল “বল লতিফ এনেছে”।

শুভ্র সেটাই বলল।

সোহেল বলল “ওহ, তার মানে তুমিই সেই। যার জন্য সবাই বসে ছিল”।

শুভ্র অবাক হয়ে বলল “কী আমি?”

সোহেল উত্তর দিল না। রহস্যময়ভাবে হাসল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১৭

শুভ্র অচৈতন্যের মত শুয়ে ছিল, ছেলেগুলো কেউ স্লোগান দিচ্ছিল, কেউ বা যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিল, আবার কেউ বা জোরে জোরে প্রার্থনা করছিল।

কিছুক্ষণ পরে একদল লোক এসে তাদের ইঞ্জেকশন দিয়ে গেল। ইঞ্জেকশন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র জ্ঞান হারাল।

জ্ঞান ফিরল যখন, তখন দেখল সে একটা ছোট ঘুপচি ঘরে শুয়ে আছে। তার সামনে একটা চেয়ারে লতিফ এবং উসমান বসে আছে। তার জ্ঞান ফিরেছে দেখে লতিফ খুশি হয়ে বলল “শুভানাল্লাহ। আল্লাহর অসীম রহমত। তোমার শরীর কেমন লাগছে?”

শুভ্রর মাথা ঝিম ঝিম করছিল। সে উঠতে চেষ্টা করল, পারল না। লতিফ হাঁ হাঁ করে উঠল “শুয়ে থাকো উঠতে হবে না। আজ তোমাদের স্ট্রেস টেস্ট ছিল। কে কতটা কষ্ট সহ্য করতে পারে। তুমি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছ”।

শুভ্র মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানাল কোন রকমে। লতিফ বলল “নিউ ইয়র্কে আমাদের এক ভাইকে দিনের পর দিন ওরা অকথ্য অত্যাচার করে মেরে ফেলেছে। তোমরা যদি এই অত্যাচার সহ্য করতে না পারো তাহলে কী করে হবে?”

উসমান তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে লতিফকে কিছু একটা বলল যে ভাষা শুভ্র জানে না।

লতিফ শুভ্রকে বলল “আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। তোমার আরেকটা স্ট্রেস টেস্ট বাকি। উসমান এখন সেটা নিতে চান। তুমি প্রস্তুত?”

শুভ্র একবার ভাবল বলে সে প্রস্তুত না, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল সেটা বললে মাথায় আবার ঝিঁঝিঁর উপদ্রব বাড়তে পারে। সে বলল “হ্যাঁ আমি প্রস্তুত”।

লতিফ উসমানকে শুভ্রর উত্তর শোনাল। উসমান প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে এসে শুয়ে থাকা শুভ্রকে জোরে করে তুলে খাটের ওপর বসাল। শুভ্র ককিয়ে উঠল যন্ত্রণায় কিন্তু তাতে উসমানের মুখের কোন রকম পরিবর্তন দেখা গেল না।

লতিফ বলল “টি শার্ট খোল”।

শুভ্র টি শার্ট খুলে ফেলল। কষ্ট হচ্ছিল তবু খুলল।

 উসমান শুভ্রকে চমকে দিয়ে ঘরের কোণ থেকে একটা কঞ্চি নিয়ে শুভ্রর পিঠে জোরে মারল। শুভ্র যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল। লতিফ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

বেশ কয়েকবার পিঠে মারার পর উসমান দাঁড়িয়ে পড়ল। পিঠটা প্রায় অবশ হয়ে এসেছিল শুভ্রর। চোখে জল। ওঠার পর্যন্ত শক্তি রইল না শুভ্রর। সে খাটেই শুয়ে পড়ল।

উসমান শুভ্রর যন্ত্রণার জায়গাতেই একগাদা নুন ছুঁড়ে মারল। শুভ্র এবার জোরে আর্তনাদ করল।

উসমান হো হো করে হাসতে শুরু করল।

লতিফ হেসে বলল “এই টেস্টটাই আমার ফেবারিট বুঝলে আতিক। কেমন লাগছে তোমার?”

শুভ্র চিৎকার করে কাঁদতে থাকল। উসমান তার খাটের সামনে চেয়ার নিয়ে এসে বসে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

শুভ্র লতিফকে বলল “ওনাকে প্লিজ ছেড়ে দিতে বলুন। আমি আর পারছি না”।

লতিফ তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে বলল “আমাদের পথ কি এতই সোজা ভেবেছিলে তুমি আতিক? ধরা পড়লে এর থেকে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হবে তোমাকে।”

শুভ্র বলল “ধরা পড়ব না। সেরকম পরিস্থিতি হলে নিজেকেই মেরে ফেলব”।

লতিফ হো হো করে হেসে তার কথাটা উসমানকে শোনাল। উসমানও জোরে জোরে হাসল তার কথা শুনে। লতিফ বলল “তোমার বেঁচে যাওয়ার চান্স এক শতাংশেরও কম আতিক। তোমাদের অনেক আগেই জন্নত নসীব হবে। এগুলো করা হচ্ছে সেই এক শতাংশ প্রোবাবিলিটির জন্য। উসমান ট্রেনিঙে কোন রকম ফাঁক রাখতে চান না”।

শুভ্রর পিঠ যন্ত্রণায় জ্বলে যাচ্ছিল। সে কোন উত্তর দিতে পারল না।

উসমান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

লতিফ শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল “বল তো টেন প্লাস থ্রি অ্যাডিশন করলে কত হয়?”

শুভ্র কাতরাতে কাতরাতে বলল “থারটিন”।

লতিফ খুশি হল “গুড। আমাদের তোমার মত শিক্ষিত ছেলেদের দরকার আতিক। বাকিগুলো বেশিরভাগই নিরক্ষর। তাই ওদের টিম লিডার নেই। আজ থেকে তুমি ওদের টিম লিডার”।

কথাগুলো বলে লতিফ তার কাঁধে হাত দিল।

শুভ্র কথা বলতে পারছিল না।

লতিফ চলে গেলে তার মাথার ঝিঁঝিঁটা ডেকে উঠল, “এই শুভ্র, এই”।

শুভ্র উত্তর দিল না। তার একই সঙ্গে রাগ, দুঃখ, ভয় সব হচ্ছিল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১৮

শুভ্র শুনতে পারছিল তাকে ডাকা হচ্ছে, কিন্তু সে সাড়া দিল না। দূর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছিল।

কিছুক্ষণ পরে দুজন এসে তাকে তুলে একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে বড় একটা ঘরে নিয়ে এল। বাকি ছেলেদের সেখানে মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। লতিফ, উসমান সবাই আছে।

উসমান বাকিদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলল। লতিফ শুভ্রর কাছে এসে তার কাঁধ চাপড়ে বলল “উসমান তোমাকে এই গোটা মিশনের টিম লিডার ঘোষণা করলেন। শুভানাল্লাহ। ওকে শুক্রিয়া বল”।

শুভ্র কথা বলতে পারছিল না। কোনভাবে মাথা নাড়ল। বাকি ছেলেদের দিকে তাকিয়ে উসমান কিছু বলল। তারা সবাই হাঁটু গেড়ে বসল।

লতিফ প্রসন্ন গলায় বলল “এই নিরানব্বই জন ছেলের দায়িত্ব আজ থেকে তোমার। ইন্ডিয়ার কোথায় কোথায় আমরা টার্গেট করব, তার ব্লু প্রিন্ট কালকে আমরা তোমায় দেব। কিন্তু এদের লিড করবে তুমিই”।

শুভ্রর মাথা ধরে গেছিল। সে মাথা নাড়ল। উসমান জোরে কিছু একটা বলে উঠল। বাকি সবাই সেটা সজোরে সমর্থন করল।

লতিফ একজন ছেলেকে ইশারা করল। সে শুভ্রকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল। শুভ্র আচ্ছন্নের মত বসেছিল। তাকে ঘিরে কী হচ্ছিল তা বোঝার ক্ষমতা পর্যন্ত তার ছিল না।

শুভ্রর আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ছেলেটা তাকে আফরোজার ঘরে রেখে চলে গেল।

আফরোজা শুভ্রকে হুইল চেয়ার থেকে নিয়ে খাটে শোয়াল। মুখে জলের ছিটে দিল।

শুভ্র ব্যথায় ককিয়ে উঠল।

আফরোজা বলল “তুমি পরীক্ষায় সফল হলে তাহলে?”

শুভ্র কথা বলতে পারল না।

আফরোজা শুভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল “কাউকে এমনি এমনি এত বড় ক্ষমতা দেওয়া হয় না। তোমার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু আছে, যার জন্য উসমান তোমাকে নির্বাচিত করল। এত কষ্ট দিল, এত মারল, কিন্তু এত কিছুর পরে তুমি কি বুঝতে পারছ কেন ওরা তোমাকেই লিডার বানাল?”

শুভ্র কোন মতে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে না বোঝাল।

আফরোজা বলল “ওরা এমন কাউকে খোঁজে যে ওদের কথায় হাসতে হাসতে নিজেকে বলি দিতে পারবে। কয়েক মাস আগে লিয়াকৎ বলে একটা ছেলে এসেছিল। তোমারই বয়সী। ট্রেনিং এর শুরু থেকেই ওকেও তোমার মতই আমার কাছে পাঠাত। প্যারিসে নিজেকে সুদ্ধ একটা গোটা বাস উড়িয়ে দিয়েছিল লিয়াকৎ। লিয়াকতের চোখের মধ্যে কিছু একটা ছিল, যেটা দেখলে আমিও ভয় পেতাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তোমার মধ্যে সেরকম কিছু আমি দেখতে পাই না। তোমাকে দেখে বার বার মনে হয় কেউ তোমাকে এখানে জোর করে নিয়ে এসেছে”।

মাথায় ঝিঁঝিঁটা বলে উঠল “শুভ্র ওঠো, জায়গাটার ম্যাপ জোগাড় করতে হবে। শুয়ে থেকো না”।

শুভ্র অবাক হল। এতদিন পরে একটা নির্দেশ এল। সে উঠে বসতে চেষ্টা করল।

পারল না।

আফরোজা করুণ মুখে বলল “আহারে, খুব কষ্ট হচ্ছে না, দাঁড়াও, তোমায় আমি একটু আরাম দেওয়ার চেষ্টা করি”।

আফরোজা তাকে জড়িয়ে ধরল। শুভ্র বাধা দিতে গিয়েও পারল না।

আফরোজা তার কানে ফিসফিস করে বলল “প্রেমিকা রাগ করবে তোমার? ভুলে যাও তোমার আর কেউ আছে। মনে কর আমি আর তুমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই”।

শুভ্রর মাথা এবং শরীর, কোনটাই কাজ করছিল না। তবু সে প্রাণপণ শক্তি দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিল।

আফরোজা কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে বলল “আমারই ভুল হয়েছিল। তোমার মধ্যে জিনিস আছে। সবাই এই জায়গা থেকে এভাবে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে না। ওরা ভুল করে নি কিছু। এত ভালোবাসো তুমি নিজের প্রেমিকাকে?”

শুভ্র চোখ বুজে শুয়ে থাকল। চোখ খুলে রাখতে পারল না সে আর।

#

প্রবল হুটারের শব্দে ঘুম ভাঙল তার। কোনমতে উঠে বসল সে।

আফরোজা বলল “তুমি যেতে পারবে না কাউকে ডাকব? তোমার ডাক পড়েছে”।

শুভ্র মুখ কুঁচকে বলল “গায়ে খুব ব্যথা করছে। আমি কী করে যাব?”

আফরোজা বলল “আচ্ছা। একটু অপেক্ষা কর”।

আফরোজা দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে গেল। কয়েক মিনিট পরে একজন ছেলে এসে তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে একটা ছোট ঘরে নিয়ে গেল। লতিফ, উসমান আর মৌলবী বসে আছে। লতিফ তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল “আজ তোমাকে উসমান শেখাবেন, কীভাবে নিজের শরীরে থাকা বোমকে একটা সুইচ টিপে অ্যাক্টিভেট করে সবাইকে উড়িয়ে দেওয়া যায়। তুমি বাকিদের শেখাবে। ঠিক আছে?”

শুভ্র কোন মতে মাথা নাড়ল।

লতিফ শুভ্রর হাত ধরে বলল “তুমি পারবে আতিক। আমি জানি তুমি পারবে”।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১৯

“যদি সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়, দেখা যাবে, পৃথিবীর সমস্ত কিছুতেই আমাদের ধর্মের লোকেদের টানা হয়েছে। যেন আমরা মানুষ নই, আমাদের ইচ্ছা করলেই দাগিয়ে দেওয়া যায়, আমরা টেরোরিস্ট। আমরা কি সত্যিই টেরোরিস্ট? নিজেদের হকের জিনিস নিজেরা কেড়ে নিলে তাদের কি টেরোরিস্ট বলা হয়? আমেরিকা এক সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের টেরোরিস্ট বানিয়েছে। পরে আমাদেরই দূরে ঠেলে দিয়েছে। পৃথিবীর সব থেকে বড় টেরোরিস্ট যদি কেউ থাকে তবে আমেরিকা। আর এই আমেরিকার মত আমাদের শত্রু ইন্ডিয়াও। এই দেশটা আমাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করে চলেছে, তার উপযুক্ত মূল্য তাদের চোকাতে হবে। দিন আসছে, তোমাদের সবাই তাদের উচিত শিক্ষা দেবে”।

একটানা কথাগুলো বলে থামল লতিফ। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সজোরে স্লোগান দিতে শুরু করল ছেলেগুলো। শুভ্র খানিকটা সিটিয়ে গেল।

লতিফ শুভ্রর দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল “আমার বলতে খুব ভাল লাগছে, পরম করুণাময় উপরওয়ালার নির্দেশে এই কাজে তোমাদের যে নেতৃত্ব দেবে, সে পূর্বে একজন হিন্দু ছিল। কিন্তু আতিক দিনের পর দিন আমাদের কাজকে সমর্থন যুগিয়ে গেছে। যোগাযোগ করে গেছে আমার সঙ্গে, ও আকুতি দেখিয়েছে আমাদের জন্য কাজ করবে বলে। নিজেকে ও আমাদের একজনই মনে করে। এরকম একজন মানুষ আমাদের সঙ্গে এসেছে, এ তো তাঁর পরম নির্দেশ ছাড়া হতে পারে না। এসো আতিক, তুমি সামনে এসো”।

শুভ্র বসে ছিল। উঠে লতিফের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ছেলেরা সবাই হই হই করে উঠল। তীব্র উল্লাসে তারা শুভ্রকে বরণ করে নিল। লতিফ সবাইকে থামিয়ে শুভ্রর কাঁধে হাত রেখে বলল “একই দিন, একই সময়, ইন্ডিয়ার দশটা শহরে একই সঙ্গে বিস্ফোরণ হবে। গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব, আমাদের সঙ্গে শত্রুতা থাকলে কী হতে পারে”।

আবার সবাই হই হই করে উঠল।

লতিফ উসমানের দিকে তাকিয়ে উসমানের ভাষায় কিছু বলল। উসমান শুভ্রকে বলল তাকে ফলো করতে। উসমানের পিছন পিছন শুভ্র হাঁটতে শুরু করল। লতিফ ছাড়া তাদের সঙ্গে আর কেউ এল না।

ছোট ঘর। ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকটা জ্যাকেট মাটিতে পড়ে আছে।

উসমান তার মধ্যে থেকে একটা জ্যাকেট নিজে নিয়ে পরল। শুভ্রকেও ইশারা করল একটা জ্যাকেট পরতে। শুভ্র মেঝে থেকে একটা জ্যাকেট নিয়ে গায়ে দিল।

লতিফ হাসিমুখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল “শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ঠিক পারবে”।

উসমান বেশ কিছুক্ষণ শুভ্রকে অনেকগুলো নির্দেশ দিল। শুভ্র সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। প্রায় আধঘন্টা পরে ছাড়া পেল শুভ্র। লতিফ খুশি মনে বলল “বাকিদের তুমি কাল সকালে পুরো ব্যাপারটা ডেমোনস্ট্রেট করে দেবে। এখন আমার সঙ্গে এসো”।

শুভ্রর ক্লান্ত লাগছিল। উসমানের দেওয়া নির্দেশগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। এত সোজা? একটা সুইচ টিপলেই একটা মানুষ সরাসরি উপরওয়ালার কাছে চলে যাবে? এ কেমন নৃশংসতা?

সে লতিফের সঙ্গে আরেকটা ঘরে গেল। লতিফ কম্পিউটার অন করে তার দিকে তাকিয়ে বলল “আমার যা ব্যবসা আছে,আমার যা ধন সম্পত্তি আছে, ইচ্ছা করলে আমি পৃথিবীর সর্বত্র আরাম আয়েশ করে কাটাতে পারতাম। কিন্তু কেন আমি এখানে এত ঝামেলা করে পড়ে আছি তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। ইন্ডিয়ান থেকে আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স, আমাদের একেকটা ক্যাম্পকে পাগল কুকুরের মত খুঁজে বেড়ায়। পায় না। অতি কষ্টে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে আমরা আমাদের সংযোগ ছিন্ন করে রেখে দি। আমার প্রায় সর্বস্ব এই কর্মকান্ডে ব্যয় হচ্ছে আতিক। কেন হচ্ছে? বিকজ আই কেয়ার ফর মাই পিপল। তুমি যখন আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছ, তখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, এত বড় জায়গা একদিনে গড়ে ওঠে নি। প্রচুর পরিশ্রমের ফসল এ জায়গা। এখান থেকে লিয়াকৎ বেরিয়েছে যেমন, তেমনি এখান থেকে আতিক বেরোবে। গোটা পৃথিবীতে আমাদের সমমনোভাবাপন্ন ভাই বোন যারা আছে, তারা প্রত্যেকে আমাদের সঙ্গে আছে আতিক”।

শুভ্র বুঝতে পারছিল না, লতিফ তাকে কেন এত কথা বলছে। সে আলতো করে মাথা নাড়ল।

লতিফ একটু সময় চুপ করে থেকে বলল “আমাদের হাতে বেশি সময় নেই আতিক। আর সাতদিন। আমি কলকাতার ধ্বংস দেখে চাই। তুমি আমাদের সব আশা। বলতে পারো শেষ আশা”।

শুভ্র চমকে উঠল। আর মাত্র সাতদিন?

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *