ঝিঁঝিঁ – ১০

১০

কতক্ষণ শুয়েছিল খেয়াল নেই, জ্ঞান ফিরতে শুভ্র দেখল তাকে সুলেখা স্যুপ খাওয়াচ্ছে।

শুভ্র শুয়েছিল।

উঠে বসে বলল “আমি কোথায়?”

সুলেখা কোন কথা না বলে তার দিকে স্যুপ এগিয়ে দিল।

শুভ্র বলল “আমি খেতে পারি”।

সুলেখা স্যুপ বোওল তার খাটের ওপর রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

শুভ্রর খিদে পেয়েছিল। সে স্যুপটা শেষ করল।

খানিকক্ষণ পরে সুলেখা খিচুড়ি টাইপের কিছু একটা দিয়ে গেল।

শুভ্র সেটাও খেল।

ব্যথাটাও কমেছে টের পাচ্ছিল সে।

খাওয়া শেষ হতে দেখল একজন পুরুষ এসে তাকে ইশারায় তার পিছনে যেতে বলল।

শুভ্র উঠে লোকটাকে ফলো করল।

লোকটা তাকে একটা বড় ঘরে নিয়ে এল। মেঝেতে কার্পেট পাতা। সেখানে একজন লম্বা লোক বসে ছিল। তাকে দেখে ইংরেজিতে বলল “সিট ডাউন আতিক”।

লোকটার কথায় শুভ্রর নিজের নতুন নামের কথা মনে পড়ল।

লোকটার সামনে বসল।

লোকটা বলল “আমার নাম আলতাফ। কাল থেকে তোমার ট্রেনিং শুরু হবে”।

শুভ্র অবাক গলায় বলল “কী ধরণের ট্রেনিং”?

আলতাফ বলল “ফিজিক্যাল ট্রেনিং। তোমাদের মত নওজওয়ানদের যেমন ট্রেনিং দরকার। তুমি এটা রাখো”।

আলতাফ বুক পকেট থেকে একটা ছবি বের করে শুভ্রর দিকে এগিয়ে দিল।

শুভ্র ছবিটা দেখে অবাক হল। আলতাফের দিকে তাকিয়ে বলল “এটা তো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ফটো”।

আলতাফ মৃদু হেসে বলল “ইয়েস। ইন আ ফাইন মর্নিং এটাই তোমার টার্গেট হবে”।

শুভ্র চমকে আলতাফের দিকে তাকাল।

আলতাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল “এসো আমার সঙ্গে”।

শুভ্র উঠল।

আলতাফ বেশ লম্বা। তেমন ফর্সা। অত্যন্ত সুপুরুষ।

হাঁটতে শুরু করল।

শুভ্র আলতাফের পেছন পেছন হাঁটতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আলতাফ বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে তাকে নিয়ে একটা খোলা মাঠে এসে বলল “ইউ আর দ্য মোস্ট লাকিয়েস্ট পারসন যে এই মিশনে আমরা তোমাকে সিলেক্ট করেছি আতিক। সবাই এই সুযোগ পায় না। প্ল্যান একেবারেই সিম্পল। তোমার সঙ্গে আমরা পাঁচজন ছেলে দেব। ছ জন মানুষ, একটা কজ। ওয়ান অফ দ্য ইজিয়েস্ট জব ইন আর্থ”।

শুভ্র বলল “পুলিশ থাকে তো? ওখানে সিকিউরিটিও থাকে”।

আলতাফ চোয়াল শক্ত করে বলল “সেসব থাকবে বলেই তো তোমাদের ট্রেনিং দেওয়া। তবে ওরা প্রিপেয়ারড থাকবে না, ওরা কখনও ভাবতেই পারবে না কলকাতায় এত বড় কিছু হতে পারে। আমাদের কাছে এটাই সব থেকে বড় সুবিধা হবে”।

দৃশ্যটা কল্পনা করা মাত্র শুভ্র শিউরে উঠল।

আলতাফ বলল “তোমার কোন প্রশ্ন আছে?”

কী বলবে বুঝতে না পেরে শুভ্র বলল “এই মাঠেই ট্রেনিং হবে?”

আলতাফ বলল “হ্যাঁ। এটাই আমাদের ট্রেনিং গ্রাউন্ড। লতিফ বলছিল তুমি আর্মসের ব্যাপারে একেবারেই কাঁচা। কোন দিন কোন আর্মস চালাও নি?”

শুভ্র মাথা নেড়ে বলল “না, চালাই নি”।

আলতাফ বলল “গুড। শুরু থেকে শেখানোই ভাল।

শুভ্র বিস্মিত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার মাথা ঝিঁঝিঁ করে উঠল।

মাথার ভেতর থেকে আওয়াজ এল “ডোন্ট অ্যাক্ট স্মার্ট বাবান। যা বলছে তাই কর”।

শুভ্র চমকে উঠল। বাবান? এই নামে তো তাকে তার বাবা ছাড়া আর কেউ ডাকে না!

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১১

বাবার ডাক শোনার পর থেকে শুভ্রর মাথা কাজ করছিল না।

তাহলে কি তাকে যে নির্দেশ দিচ্ছে, তার সম্পর্কে এতটাই জানে যে তার ডাক নাম থেকে শুরু করে সবই সংগ্রহ করে রেখেছে?

শুভ্র আর কিছু বুঝতে চেষ্টা করল না।

রাতে তাকে স্যুপ আর রুটি দেওয়া হল। চুপচাপ খেয়ে শুয়ে পড়ল। সুলেখা তার ঘরে এলেও শুভ্র তার সঙ্গে কোন কথা বলল না।

এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুম অনেক রাতে এসেছিল।

ঘুম ভাঙল জোর সাইরেনের শব্দে। চোখ খুলে দেখল সুলেখা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উঠতে দেখে বলল “পোশাক রাখা আছে। পরে ট্রেনিং গ্রাউন্ডে চলে যাও”।

শুভ্রর মাথা ব্যথা করছিল। এভাবে কোন শব্দে যদি ঘুম ভাঙে তাহলে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায় তার। বিরক্ত গলায় সুলেখাকে বলল “এরকম সাইরেন বাজানোর মানে কী?”

সুলেখা বলল “এখানে তুমি একা নও। অনেকেই আছে। সবার ঘুম ভাঙার জন্য এই সাইরেন। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে যাও। আর দেরী কোর না”।

কালো টি শার্ট আর ট্রাউজার। শুভ্র সে দুটো নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। বাথরুম সেরে পোশাক পালটে বাইরে দাঁড়াতে দেখল সুলেখা তখনও যায় নি। তাকে বলল “হুজুর বললেন তোমার আজ প্রথম দিন। পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে। চল”।

আর দ্বিতীয় কোন কথা না বলে সুলেখা হাঁটতে শুরু করল।

শুভ্র সুলেখার পিছন পিছন চুপচাপ হেঁটে বিল্ডিং এর বাইরের মাঠে পৌঁছল। জনা বিশেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তারই মত পোশাকে। ভীষণ ফর্সা তাদের গায়ের রং। কাউকে দেখেই বাঙালি বলে মনে হল না তার।

আলতাফ দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে ডাক ছেড়ে বলল “চলে এসো”।

শুভ্র ছেলেগুলোর দিকে আরেকবার তাকাল। যেন “গুপী বাঘা ফিরে এলো”র সম্মোহিত ছেলেদের দল! মরা মাছের চোখ নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।

সে আলতাফের কাছে যেতে আলতাফ বলল “যাও, ওদের সঙ্গে লাইনে মিশে যাও”।

শুভ্র এগিয়ে গিয়ে ছেলেগুলোর পাশে দাঁড়াল।

আলতাফ অজানা ভাষায় চেঁচিয়ে কিছু বলল। পরক্ষণে তার দিকে তাকিয়ে ইংরেজি ভাষায় বলল “মাঠে এক চক্কর লাগাও। একদম মাঠের শেষে দেখো তোমাদের জন্য কী সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। যে জিনিস মানুষকে সর্বশক্তিমান করতে পারে, তোমাদের জন্য রাখা আছে। যাও। নিয়ে এসো”।

ছেলেগুলো দৌড় শুরু করে দিয়েছিল। শুভ্র ওদের পিছনে দৌড়তে শুরু করল।

মাঠের অন্য কোণে একটা খেজুর গাছ। তার নিচে একটা বড় বাক্স।

একজন ছেলে গিয়ে বাক্সটা খুলতেই একগাদা মেশিন গান ঝকঝক করে উঠল। গাছের মধ্যেই মাইক বাঁধা। সেখান থেকে নির্দেশ এল আলতাফের গলায় “প্রত্যেকে একটা করে গান নিয়ে আমার কাছে চলে এসো”।

সবাই যন্ত্রের মত আলতাফের নির্দেশ মেনে নিল।

শুভ্র একটা মেশিন গান তুলল। এতদিন জওয়ানদের হাতে দেখেছে। এখন জিনিসটা ধরামাত্র একটা অদ্ভুত ভয় গ্রাস করল তাকে। আলতাফ চ্যাচাল “আমার কাছে এসো, ওখানে দাঁড়িও না”।

শুভ্র গান হাতে আলতাফের কাছে দৌড়ে পৌঁছল।

আলতাফ তার দিকে তাকিয়ে জোরে বলল “আতিক মিয়াঁ”।

শুভ্র বলল “হ্যাঁ”।

আলতাফ ধমকের গলায় বলল “জি স্যার বল। জোরে বল”।

শুভ্র চেঁচিয়ে বলল “জি স্যার”।

আলতাফ বলল “তোমার অস্ত্র শিক্ষা শুরু হবে এখন থেকে। এই অস্ত্র হাতে কি তোমার নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী মানুষ মনে হচ্ছে না?”

মাথায় ঝিঁঝিঁ ডেকে উঠল “হ্যাঁ বল বাবান”।

শুভ্র কোন কিছু না ভেবে বলল “হ্যাঁ স্যার”।

আলতাফের মুখে হাসি ফুটল। বলল “আলহামদুলিল্লাহ। এবার ভাবো তো ভরা স্টেশনে যদি এই বস্তুটা নিয়ে তুমি ক্রমাগত গুলি চালাতে শুরু কর তাহলে কী হতে পারে?”

শুভ্রর শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা সাপ নেমে গেল।

সে আলতাফের দিকে তাকিয়ে বলল “কলকাতায়?”

আলতাফ তার দিকে এগিয়ে এল “হ্যাঁ কলকাতায়? কোন সমস্যা আছে?”

শুভ্র উত্তর দিতে পারল না। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১২

ট্রেনিং মানে যে কী হতে পারে ধারণা ছিল না শুভ্রর। সারাদিন ধরে কখনও রোদের মধ্যে দৌড় করানো হল, কখনও গাছ বাওয়ানো হল, দুপুরে এক ঘন্টা লাঞ্চের বিরতি দিয়ে অস্ত্র শিক্ষা শুরু হল অটোমেটিক মেশিনগান দিয়ে এম ৬০ দিয়ে।

শুভ্রর গা গুলিয়ে উঠছিল। বার বার মনে হচ্ছিল এই সময়ে তার কলেজের ছেলে মেয়েরা ক্লাস করছে, আর সে এখানে এসে পৌঁছেছে।

ট্রেনিং অবশ্য সম্পূর্ণ করতে পারল না সে। শরীর দুর্বল ছিল।

সন্ধ্যের আগেই সে বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল।

জ্ঞান ফিরল যখন, দেখল রহমান, আলতাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে চোখ খুলতে দেখে রহমান বলল “প্রথম দিনের হিসেবে তুমি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছ তবে শারীরিক সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে আতিক। আমি বলে দিয়েছি, তোমার জন্য আজ থেকে স্পেশাল ডায়েট শুরু হবে”।

শুভ্রর গা হাত পা ব্যথা করছিল। উঠে বসল।

আলতাফ তার কাঁধে হাত রেখে রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল “আমার মনে হয় আতিককে এত হার্ড ট্রেনিং না দিয়ে শুধু গান ট্রেনিং দিলেই হয়। আপনার কি মনে হয়?”

রহমান চেয়ারে বসে পড়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল “আতিক আমাকে যখন ইমেল করত তখন বারে বারেই বলেছিল ও ফিদায়ে হতে চায়। হি ওয়ান্টস টু ডিভোট হিমসেলফ ফর দ্য রিলিজিয়ান। এখনও কি তুমি তাই চাও আতিক?”

শুভ্র অবাক হয়ে বলল “বুঝলাম না”।

রহমান হেসে বলল “তুমি বলেছিলে না ৯/১১র ভাইদের মত হতে চাও?”

শুভ্র এবারে বুঝল। সে মাথা নাড়ল কোনমতে। তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। সে মেইল করেছিল সে আত্মঘাতী জঙ্গী হতে চায়? এসব কে করল!

রহমান আলতাফের দিকে তাকিয়ে বলল “ও যা চায় তাই হবে। তুমি ওকে প্ল্যান ডিটেলস বোঝানো শুরু কর তাহলে”।

আলতাফ বলল “ওকে। এসো আতিক”।

আলতাফ শুভ্রকে নিয়ে অন্য ঘরে গেল।

 তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে একটা টেবিলের ওপর ল্যাপটপটা খুলে প্রোজেক্টর মেশিন চালাল। কয়েক মিনিট পরে শুভ্রর সামনে একটা স্লাইড শো শুরু হল। শিয়ালদা, হাওড়া স্টেশন, বিভিন্ন মেট্রো স্টেশন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, নন্দন সহ কলকাতার বিভিন্ন জায়গার ছবি।

আলতাফ বলল “এই মুহূর্তে আমাদের কণ্ঠস্বর ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টের কানে পৌছনোর জন্য আমরা দেশের মেট্রোগুলোকে টার্গেট করেছি। কলকাতার চার্জে তুমি থাকবে আতিক। আমাদের লক্ষ্য হবে সবচেয়ে কম সময়ে যত বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যায়। প্রসেস ইজ ভেরি ইজি। ইউ হাভ টু ডু অ্যান আজমল কাসভ”।

আলতাফ তার দিকে তাকাল।

শুভ্রর আবার বমি পাচ্ছিল।

আলতাফ বলল “ভয় পাচ্ছ? ভয়ের কিছু নেই কিন্তু। সহজ কাজ। কাসভের ভিডিওটা দেখেছ তো? ও জানতো ওকে মরতে হবে, কিন্তু বীরের মত ও নিজের কাজ কমপ্লিট করেছিল। একজন সত্যি কারের যোদ্ধা কখনও মরতে ভয় পায় না আতিক”।

শুভ্র বলল “আমার হাতে কতদিন সময় আছে?”

আলতাফ হেসে বলল “কলকাতায় সব থেকে বেশি ক্রাউড কবে থাকে?”

শুভ্র বলল “অফিস টাইমে”।

আলতাফ মাথা নাড়ল, “সে তো টাইম। কিন্তু তার থেকেও বেশি ক্রাউড?”

শুভ্র জিজ্ঞাসু চোখে আলতাফের দিকে তাকাল।

আলতাফ বলল “লুক অ্যাট দ্য প্রজেক্টর”।

শুভ্র স্ক্রিনের দিকে তাকাল।

আলতাফ আরেকটা স্লাইড শো চালিয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের দুর্গা পুজোর প্যান্ডেল দেখাচ্ছে তাতে। ছবি দেখাতে দেখাতে বলল “দুর্গা পূজা। সব থেকে বেশি ক্রাউড থাকে এই সময়। পারবে না?”

শুভ্র চমকে আলতাফের দিকে তাকাল।

আলতাফ বলল “সিকিউরিটিও সব থেকে বেশি এই সময়েই থাকে। তোমার সঙ্গে আরও ন জন থাকবে। গোটা দেশে একশো জন। দেশের দশটা জায়গায় একই সঙ্গে একই দিনে দশেরা পালন করব আমরা”।

শুভ্রর মাথা ঘুরে উঠল। সে দুর্বল গলায় বলল “আমি পারব না বোধ হয়”।

মাথার ঝিঁঝিঁটা ডেকে উঠল এই সময়ে, “কী হচ্ছে বাবান? চুপচাপ যা বলছে মেনে নে”।

আলতাফ তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল “পারবে না?”

শুভ্র হতাশ গলায় বলল “উইল ট্রাই”।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১৩

প্রার্থনা হল খেতে বসার আগে। সবাইকে নিয়ে জড়ো করা হল হল ঘরে। প্রার্থনা করে মেঝেতেই বসিয়ে দেওয়া হল। আলতাফ, মৌলবী, রহমানরা একদিকে বসল।

শুভ্র বাকিদের সঙ্গে বসল।

পাঁচ জন করে গ্রুপ করা হয়েছে। মাঝে একটা মস্ত বড় প্লেটে পোলাও আর মাংস। একই থালা থেকে সবাই হাত দিয়ে নিয়ে খাচ্ছে। শুভ্রর ঘেন্না লাগছিল। ছোঁয়া বাঁচিয়ে যতটা পারল খেলো।

খেয়ে উঠে একটা টেবিলে বোরহানি রাখা ছিল। একটা গোটা গ্লাস বোরহানি খেতে হল তাকে রহমানের নির্দেশে। খাওয়া শেষে রহমান বলল “চল আতিক, আমরা একটু হেঁটে আসি”।

শুভ্রর ক্লান্ত লাগছিল। তবু না করল না। রহমান তাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোল বিল্ডিঙের বাইরে।

পাহাড়ি অঞ্চল। ঠান্ডা আছে। রহমান বলল “তুমি আগে কখনও বাংলাদেশে এসেছ?”

শুভ্র বলল “না। এটা কি বাংলাদেশ?”

রহমান বলল “হ্যাঁ। ইন্ডিয়ার নর্থ ইস্ট করিডর। বাংলাদেশের নর্থ”।

শুভ্র বলল “এখানে প্লেনে করে এলাম কী করে?”

রহমান বলল “আমরা ত্রিপুরা থেকে গাড়ি করে এসে বর্ডার ক্রস করেছি”।

শুভ্র কিছু বলল না। চুপচাপ হাঁটতে লাগল।

রহমান বলল “তোমার ফোকাস ঠিক আছে?”

শুভ্র আমতা আমতা করে বলল “হ্যাঁ, মানে আমি একটু টায়ার্ড হয়ে পড়েছে। বাকিটা ঠিক আছে”।

রহমান বলল “এখানে আসার সুযোগ সবাই পায় না। তুমি পেয়েছো কারণ তোমার প্রতিটা ইমেল আমরা মন দিয়ে পড়েছি। তোমার মধ্যে সে আগুনটা দেখতে পেয়েছি। আমরা সবাই নিশ্চিত তুমি একজন সত্যিকারের মুজাহিদিন হবে”।

শুভ্র চুপ করে রইল।

রহমান বলল “তোমার গ্রুপে যারা যারা ডিনার করল সবাইকে ভাল করে লক্ষ্য করেছ?”

শুভ্র বলল “না, খেয়াল করি নি”।

রহমান হাসল, “কলকাতা, ভুবনেশ্বর, গৌহাটি, পাটনা, লক্ষ্ণৌ। তোমরা পাঁচজন টিম লিডার একসঙ্গে বসে খেয়েছে। তোমাদের ওপরেই প্ল্যান এক্সিকিউশনের দায়িত্ব থাকবে”।

শুভ্র আর চমকাল না। এসব অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে এখন। বলল “আচ্ছা”।

রহমান বলল “রফিক বলে যে ছেলেটা ভুবনেশ্বরের চার্জে থাকবে, ওর বয়স তেরো। কিন্তু দুর্দান্ত এইম ওর। তোমার একটাই ব্যাকলগ আতিক। এর আগে তুমি কখনও আর্মস ধর নি। তোমার প্র্যাকটিসের ওপর সমস্ত কিছু ডিপেন্ড করছে এখন”।

শুভ্র একটু আশান্বিত হল “যদি আমি আর্মস না চালাতে পারি তাহলে কি মিশন অ্যাবর্ট করা হবে?”

রহমান তার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। বেশ কয়েক মিনিট ধরে হেসে বলল “তুমি ভয় পাচ্ছো, তাই তো?”

শুভ্র জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “না না সেসব কিছু না”।

রহমান গম্ভীর হয়ে বলল “গান না চালাতে পারলে তোমাকে সরাসরি ইউজ করা ছাড়া আমাদের কোন উপায় থাকবে না। সেক্ষেত্রে কাজটা একটু কঠিন হবে। কিন্তু আমি জানি, তোমার ভেতরে যে আগুন আছে, তাতে তুমি এই মিশন সাক্সেসফুল করবেই”।

শুভ্র বুঝল না, বলল “সরাসরি ইউজ করা মানে বুঝলাম না”।

রহমান তার কাঁধে হাত রেখে বলল “হিন্দি সিনেমায় যেমন দেখায়। তুমি চিন্তা কোর না, তোমাকে আমরা ঠিক তৈরী করে নেব”।

শুভ্র কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার মাথার ভেতরের ঝিঁঝিঁ ডেকে উঠল “বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে বল বাবান”।

শুভ্র হাঁটছিল। থমকে দাঁড়াল।

রহমান বলল “কী হল আতিক? দাঁড়িয়ে গেলে যে”।

শুভ্র মাথা নিচু করে বলল “অপারেশনটার আগে একবার বাড়ির লোকেদের দেখতে পারলে ভাল হত”।

রহমান তার দিকে স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল “হোমসিকনেস। ন্যাচারাল। এসো। তোমার জন্য অন্য ব্যবস্থা করছি”।

শুভ্র বুঝল না। রহমানে তাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিল্ডিং এর অন্য দিকে চলে এল। একটা বড় দরজার সামনে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে খুটখুট করল। দরজাটা খুলে গেল। বিরাট একটা বড় ঘর। চোখ ধাঁধানো আলো। রহমান ঘরের ভিতর ঢুকে বলল “এসো”।

শুভ্র রহমানের পিছন পিছন গেল।

রহমান শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল “শো দেম, ইউ আর এ ম্যান”।

শুভ্র বুঝল না।

রহমান এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের দরজা খুলল। শুভ্র এগিয়ে গিয়ে দেখল ঘরের মধ্যে একটা তারই বয়সী মেয়ে বসে রয়েছে। রহমান গলা তুলে বলল “আফরোজা, টেক হিম টু দ্য হেভেন। গুড নাইট”।

রহমান শুভ্রকে ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

শুভ্র অবাক হয়ে গেল। মাঝারি মাপের একটা ঘর। সেখানে এ মেয়ে কোত্থেকে এল?

আফরোজা এগিয়ে তার হাত ধরে বলল “এসো”।

শুভ্র সভয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল।

আফরোজা তার ঘাড়ে চুমু খেল।

শুভ্র শিউরে উঠে সরতে যাচ্ছিল, পারল না। আফরোজা তাকে জোরে চেপে ধরে কানে কানে বলল “ভয় পেও না। চুপচাপ বস খাটে এসে”।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

১৪

আফরোজা তাকে খাটে বসিয়ে দরজা বন্ধ করল।

শুভ্র বলল “তুমি আমাকে চেনো?”

আফরোজা মাথা নাড়ল “চিনি না। কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি তুমি এখানে নিজের ইচ্ছায় আসো নি। তুমি ভয় পেও না। এই ঘরে তুমি যখন ঢুকেছ আর কেউ আসবে না এখন”।

শুভ্র বলল “ওহ। তুমিও এখানে থাকো?”

আফরোজা মাথা নাড়ল, “না, আমি ঢাকায় থাকতাম। আব্বু মারা গেলেন। খালাম্মা বললেন চাকরি আছে। একটা লোক এসে নিয়ে এল এখানে। যেদিন থেকে এনেছে সেদিন থেকেই ওরা… তারপর থেকে আমি এখানেই থাকি”।

শুভ্র বলল “এখানে কী করে ওরা?”

আফরোজা বলল “তুমি খুব ভয় পেয়েছো তাই না? আমিও ভয় পেতাম প্রথম প্রথম। অবশ্য তোমার ভয় একরকম। আমার অন্যরকম”।

শুভ্র বলল “তোমার ভয় কী রকম?”

আফরোজা বলল “তখন ছোট ছিলাম তো, ওই বড় বড় লোকগুলো আমাকে অসহ্য যন্ত্রণা দিত। ওই যে একজন আছে, সবাইকে জিহাদ শিখায়, সেই সব থেকে বেশি কষ্ট দিত”। আফরোজা ব্লাইজ খুলে দিল। স্তনের ওপরে কালশিটে দাগ।

শুভ্র শিউরে উঠল দেখে।

আফরোজা বলল “তোমাকে দেখে একেবারেই এদের মত মনে হয় না। অথচ তোমাকে ওরা আমার কাছে পাঠিয়ে দিল। তুমি কে? এখানেই বা কী করে এলে?”

শুভ্র বলল “আমিও জানি না। এখান থেকে পালানোর চেষ্টা কর নি?”

আফরোজা বলল “অসম্ভব ব্যাপার। গুলি করে মেরে ফেলে দেবে। আমার সঙ্গে আরও বারোটা মেয়ে আছে। তাদের মধ্যে দুজনের বয়স দশেরও কম”।

শুভ্র বলল “সেকী?”

আফরোজা বলল “হ্যাঁ। এদের কাছে নানারকম অস্ত্র আছে। সেসব দিয়ে ভয় দেখিয়ে নানারকম শারীরিক কষ্ট দেওয়া হয়”।

শুভ্রর মাথা কাজ করছিল না।

হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে এল। শুভ্র চমকে উঠে বলল “কী হল?”

আফরোজা শান্ত গলায় বলল “বড় হুজুর। বাচ্চাদের ঘরে ঢুকেছেন”।

শুভ্র বলল “কী করেন উনি?”

আফরোজা বলল “মেয়েদের সঙ্গে যেমন করে। কেউ কেউ মরেও যায়। তখন নতুন কাউকে নিয়ে আসা হয়। সারাদিন এত কাজ করেন এরা, মনোরঞ্জনের জন্য এটুকু না থাকলে হয়?”

শুভ্র দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল। কলকাতায় থেকে কোন দিন স্বপ্নেও সে ভাবতে পারে নি পৃথিবীতে এরকম পাশবিক কাজকর্মও হয়। কোথায় সে কলেজ যাচ্ছিল, মেসে ফিরে সৌমিতার সঙ্গে কথা বলে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল, এ কোন দুঃস্বপ্নের জগতে সে চলে এল?

আফরোজা তার কাঁধে হাত দিল “তুমি শোও। আমি বুঝতে পারছি তোমার মধ্যে দিয়ে কী চলছে। আমি একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দি”।

শুভ্র সরে গিয়ে বলল “প্লিজ না। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে”।

আফরোজা হেসে বলল “গার্লফ্রেন্ড আছে? তার জন্য তোমার মাথায় হাত দেওয়া বারণ বুঝি? এখানে তো কারো কারো দশের বেশি বউ আছে। তাও তাদের এই হাওয়া মহলে আসতেই হয়। তুমি চিন্তা কোর না। তুমি শোও। আমি তোমায় বেশি জ্বালাতন করব না”।

শুভ্র সবেগে মাথা নাড়ল “না না, তার কোন দরকার নেই”।

মাথায় ঝিঁঝিঁটা ডেকে উঠল “যা বলছে কর”।

শুভ্র রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল “কী যা বলছে করব? মামার বাড়ি চলছে নাকি আমায় নিয়ে? তখন থেকে যা বলছে কর যা বলছে কর বলে চলেছ! কী করব? কেন করব? কী হচ্ছে এগুলো? কেন হচ্ছে?”

আফরোজা অবাক হয়ে বলল “কার সঙ্গে কথা বলছ তুমি?”

শুভ্র কিছু বলার আগেই মাথায় দু তিন সেকেন্ডের জন্য অসহ্য একটা শক খেল সে। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল।

আফরোজা তার হাত ধরল “কী হল? এরকম করছ কেন?”

শুভ্র দেখল তার মাথায় সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কোন মতে বলল “জল খাব”।

আফরোজা তাকে জল দিল। শুভ্র খানিকটা জল খেয়ে বাকিটা চোখে দিল।

আফরোজা বলল “স্বাভাবিক হয়েছে?”

শুভ্র বলল “জানি না”।

আফরোজা বলল “তুমি এবার শুয়ে পড়। ভোরে কিন্তু আবার ট্রেনিঙে নিয়ে যাবে।রাতে না ঘুমালে ভীষণ কষ্ট পাবে সারাদিন। তুমি শোও। আমি ঘুম পাড়াচ্ছি তোমায়”।

শুভ্র এবার আর আপত্তি করল না। শুয়ে পড়ল।

আফরোজা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

#

“এই শুভ্র। এই”।

শুভ্র দেখল মা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মাঝে জেলখানার গারদ। সে মাকে ছুঁতে পারছে না।

মা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুভ্র প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।

চেঁচিয়ে উঠতে চেষ্টা করল কিন্তু গলা থেকে স্বর বেরোচ্ছে না। এরমধ্যেই তীব্র শব্দে হুটারের শব্দ মাথায় বাড়ি মারল।

শুভ্র ধড়মড় করে উঠে পড়ল।

দেখল আফরোজা বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বলল “স্বপ্ন দেখছিলে? আমিও দেখি ভয়ংকর সব স্বপ্ন”।

শুভ্র বলল “ক’টা বাজে?”

আফরোজা বলল “প্রার্থনা কক্ষে চলে যাও। সময় হয়ে গেছে”।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *