ঝিঁঝিঁ – ৩০

৩০

নতুন দিল্লি।

প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বাইরে চারজন চুপ করে বসে আছেন।

যে কোন সময় তাদের ডাক পড়তে পারে।

ঘরটির নিস্তব্ধতা অতুলনীয়। পিন পড়লেও শব্দ পাওয়া যাবে।

সত্যজিত বর্মণের কানের ব্লু টুথ হেডফোন নিরাপত্তাজনিত কারণে জমা রেখে আসতে হয়েছে। সত্যজিত উশখুশ করছিলেন।

প্রফেসর শর্মা সেটা বুঝতে পেরে বললেন “মাথা ঠান্ডা কর সত্যজিত। এটুকু সময়ে বিরাট কিছু হবার সম্ভাবনা নেই”।

রজত হেসে বললেন “সত্যজিত কোন আপডেটই মিস করতে চায় না প্রফেসর”।

সত্যজিত বললেন “কাল রাতের পর থেকে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে স্যার। ওরা শুভ্রকে সন্দেহ করছে নাকি বুঝতে পারছি না”।

রজত বললেন “ছেলেটাও তেমন হয়েছে। আফরোজার রুমে গিয়ে অভিনয়টাও ঠিক করতে করতে পারছে না”।

পট্টনায়েক বললেন “তুমি ভুলে যাচ্ছ রজত, শুভ্রকে উইদাউট এনি ট্রেনিং পাঠানো হয়েছে। ও কী করে জানবে কোথায় অভিনয় করতে হবে, কোথায় না? আমি এক্ষেত্রে ওর কোন দোষ দেখতে পারছি না”।

প্রফেসর শর্মা বললেন “দেখার প্রশ্নই আসে না। একটা সাধারন মানুষকে আই এস আই এসের ডেনে পাঠালে আর মাথায় এরকম সিগনাল পাঠালে সে পাগল হয়ে যেত। ইওর সান ইজ আবাভ এভারেজ রজত। ওকে নিয়ে কোন রকম সমালোচনা আমি মানতে পারব না। বাই দ্য ওয়ে, সত্যজিত”… প্রফেসর শর্মা সত্যজিত বর্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমি ভেবো না। ওরা এখন প্রিপারেশন মোডে আছে। শুভ্রর সঙ্গে কনট্যাক্ট করতে হবে আজকে। মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে আমাদের কী কী প্ল্যান আছে”।

সত্যজিত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ডাক এল। চারজনে উঠে দাঁড়ালেন।

প্রধানমন্ত্রী একা ছিলেন না তার ঘরে। চারজন ঢুকে দেখলেন দুজন বসে আছেন।

প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর প্রফেশর শর্মাকে দেখে সহাস্যে বললেন “গুড মর্নিং প্রফেসর। বলুন কী বলবেন”।

প্রফেসর বললেন “স্যার, যদি একটু প্রাইভেসী পাওয়া যেত তবে কৃতজ্ঞ থাকতাম”।

প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়লেন “সারটেনলি”। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাকি দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রী বললেন “বলুন প্রফেসর”।

শর্মা বাকিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয়পর্ব মিটলে বললেন “স্যার, রিটায়ারমেন্টের পর ভেবেছিলাম গ্রামের বাড়িতে যাব, বাগান করব, নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করব। এবং অবশ্যই, আর অন্য কোন কিছু নিয়ে ভাবব না”।

প্রধানমন্ত্রী হেসে বললেন “প্রত্যেক কর্মঠ মানুষ সেই স্বপ্নই দেখে প্রফেসর এবং তারপরে আবার তাকে সেই ব্যাক টু ওয়ার্কই করতে হয়। আপনি কি এরকমই কিছু…”

প্রধানমন্ত্রী কথা শেষ করলেন না। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

প্রফেসরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন “আপনি ঠিক ধরেছেন স্যার। আমার সঙ্গেও ঠিক তেমনই হয়েছে। ডি আর ডি ও তে থাকাকালীন আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছি। কোন কোন সাবজেক্টে খুব ভাল রেজাল্ট পেয়েছিলাম, আবার কোন কোন সাবজেক্টে একেবারেই অকৃতকার্য হয়েছিলাম। আমি দেশের বাড়ি গেছিলাম জাস্ট আফটার মাই রিটায়ারমেন্ট। গ্রাম হলেও ইন্টারনেট আছে। শহুরে ব্যস্ততায় মানুষ বলেই হয়ত গ্রামের জীবনে অভ্যস্ত হতে পারছিলাম না। ঠিক করেছিলাম ল্যাপটপ নিয়ে গেলেও সেটা আর খুলব না। কিন্তু দেখা গেল কিছুক্ষণ পর থেকেই আমি বোর হতে শুরু করলাম। অগত্যা সেই ল্যাপটপের শরণাপন্ন হতেই হল। ল্যাপটপ অন করে প্রয়োজনীয় ইমেল সহ বিভিন্ন কাজ সারছিলাম, হঠাৎ একটা ইমেলা চোখ পড়ল। ইমেলটা ভুল করে এসেছিল। কোডেড মেইল। আমার যা স্বভাব, ডি কোড না করা অবধি শান্তি পাচ্ছিলাম না। শুরু করলাম ডি কোডিং এর কাজ। টানা ষোল ঘন্টা লেগেছিল আমার মেইলটার পাঠোদ্ধার করতে। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য একটা মেইলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক মারাত্মক খবর। আই এস আই এস নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশে সক্রিয় হওয়া শুরু করেছে এন্ড দে আর প্ল্যানিং রিয়েলি সামথিং বিগ”।

প্রধানমন্ত্রী অস্ফূটে বললেন “মাই গড”!

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

৩১

আফরোজার ঘরে শেষ রাতে ঘুম এসেছিল শুভ্রর। বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারল না। ভোর পাঁচটার সময় দরজা ধাক্কানো শুরু হল। আফরোজা দরজা খুলতে হুকুম এল শুভ্রকে মাঠে যেতে বলেছে। শুভ্র কোন রকমে বাথরুম সেরে মাঠে যেতে দেখল মাঠে পাকিস্তানি ছেলেগুলোর সঙ্গে আসাদ শেখ দাঁড়িয়ে আছে।

রহমান গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।

শুভ্র তাদের কাছে যেতে আসাদ শেখ রহমানকে বলল “এই ছেলেকে যে নিয়ে এসেছ, এর সম্পর্কে সব জেনে এনেছো?”

রহমান বলল “হ্যাঁ। অবশ্যই। কলকাতায় পড়াশুনা, বাবা ক্ল্যারিকাল পোস্টে আছে এক নগণ্য সরকারি চাকুরে। মা হাউজ ওয়াইফ। ভারতের বিরুদ্ধে এর চরম ক্ষোভ আছে। প্রতিবার ইমেল করে আমার কাছে ওর ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে। সব কিছু যাচাই করেই ওর মুসলমানি করানো হয়েছে জনাব”।

আসাদ শেখ এই সকালেই চোখে সুরমা দিয়েছে। শুভ্রর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল “তুই আফরোজার ঘরে গিয়ে কিছু করিস না কেন? এই বয়সে তো অনেক কিছু করতে ইচ্ছা যায়? তুই কেন কিছু করিস না?”

শুভ্র মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। তার পা কাঁপছিল। অনেক কষ্ট করেও সে নিজের পা কাঁপানো থামাতে পারছে না।

আসাদ শেখ চেঁচিয়ে বলল “উত্তর দে”।

শুভ্র কেঁপে উঠে বলল “আমার একজন ভালোবাসার মানুষ আছে”। বলেই বুঝল ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু কথা বেরিয়ে গেছিল মুখ থেকে, সেটা আর ফেরত নেওয়া সম্ভব না।

আসাদ শেখ রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল “কী ব্যাপার? ভালবাসার মানুষ মানে? তুমি জানো?”

রহমানের মুখে অস্বস্তি এল। সে বলল “সেসব ছিল। এখন আর নেই। কী বল আতিক?”

শুভ্র এবার খানিকটা জোর দিয়ে বলল “হ্যাঁ। ছিল। ওকে আমি ভুলতে পারি নি”।

রহমানের মুখে স্বস্তি ফিরে এল, “আমি ঠিক জানতাম। নির্ঘাত সে মেয়ের বিয়ে কোন ইন্ডিয়ান সোলজারের সঙ্গে হয়েছে, সে জন্য আতিকের ইন্ডিয়ার ওপর এত রাগ”।

আসাদ ক্রুর চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল “তাই নাকি? তা কী রকম রাগ?”

শুভ্র ঘামছিল। কোন মতে এতদিন শেখানো বুলি জোরে জোরে আউড়ালো “আমি ইন্ডিয়ার বরবাদি চাই। আমি চাই প্রতিটা হিন্দু ইন্ডিয়ানকে কুরবানি দিতে। শেষ করে দিতে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে। দেশটা যেন ছাই হয়ে যায়”।

আসাদ শেখ শুভ্রর সামনে এসে দাঁড়াল। শুভ্রর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে জোরে চুল টেনে ধরল। শুভ্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল।

পাকিস্তানি তিনটে ছেলে শুভ্রর দুর্দশা দেখে হাসছিল মুখ টিপে, কিন্তু যেহেতু আসাদ শেখ বাংলায় কথা বলছিল, তাই কী হচ্ছিল বুঝে উঠতে পারছিল না।

আসাদ শেখ শুভ্রর চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বলল “আমার সামনে নাটকবাজি করে লাভ নেই। ইন্ডিয়াকে তুই কতটা ঘেন্না করিস তার প্রমাণ এখনই দিতে হবে। ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ পুড়িয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে লাথি মারতে হবে। কীরে? পারবি তো?”

শুভ্রর মাথা ব্যথা করছিল। আসাদ শেখের কথা শুনে মাথা ঘুরিয়ে উঠল। কিন্তু বুঝল এই কথা না শুনলে তার আজকে আর বেঁচে থাকা সম্ভব না। সে কোন মতে বলল “পারব”।

আসাদ শেখ শুভ্রর মাথার চুল ছেড়ে রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল “দাও”।

রহমান হাতের প্লাস্টিক থেকে ভারতের জাতীয় পতাকা বের করে শুভ্রর হাতে দিয়ে বলল “পোড়াও তো আতিক। বড় হুজুরের বিশ্বাস হোক। আসলে উনি কিছুতেই মালাউনদের বিশ্বাস করেন না। ওকে কে বোঝাবে তুমি এখন মালাউন নও। পোড়াও। এ নাও লাইটার নাও”।

শুভ্র জাতীয় পতাকা হাতে নিল। তার চোখ ফেটে জল এল। বহু কষ্টে চোখের জল আটকালো সে। রহমান হাতের দেশলাই এগিয়ে দিল তার দিকে। আসাদ শেখ শুভ্রর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্র বুঝতে পারছিল আসাদ তার প্রতিটা মুখভঙ্গি দেখতে চাইছিল।

পাকিস্তানি ছেলেগুলোর চোখে মুখে উল্লাসের ছবি। ভারতের পতাকা পোড়ানো হচ্ছে এর থেকে খুশির দৃশ্য আর কী হতে পারে?”

শুভ্র মাটিতে পাতল জাতীয় পতাকা।

কঠিন মুখে দেশলাই কাঠি থেকে কাঠি বের করে আগুন জ্বালিয়ে পতাকার কাছে নিতে যাবে, ঠিক এমন সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। শুভ্রর হাতের দেশলাই নিভে গেল। রহমান বলল “আসাদ মিয়াঁ কাজটা কালকে করে দেবে আতিক। তুমি চিন্তা কোর না, ও একদম আমাদের নিজের লোক। আমি ওকে নিজের হাতে বাছাই করেছি”।

পাকিস্তানি ছেলেগুলো বৃষ্টি দেখে ছাউনির জন্য দৌড়েছে। আসাদ বৃষ্টি সত্ত্বেও কোথাও গেল না। দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে থাকল ঠান্ডা চোখে।

শুভ্রর ভিতরটা কেঁপে উঠল।

মাথা নিচু করল সে। তিরঙ্গার দিকে চোখ পড়ল।

হঠাৎ মনে হল জাতীয় পতাকা যেন তাকে বরাভয় দিচ্ছে। একটা জড় পদার্থেরও যে এত শক্তি থাকে শুভ্র আগে বোঝে নি।

নিমেষের মধ্যে মনে এক প্রবল শক্তি এল তার।

সব ভয় চলে গেল।

আসাদ শেখের চোখের দিকে তাকাল সে।

কোথাও গেল না।

দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

৩২

প্রধানমন্ত্রী অবাক চোখে রজতের দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনি যে কাজটা করেছেন সেটা কত ভয়ংকর বুঝতে পারছেন? নিজের ছেলেকে আই এস আই এস শিবিরে পাঠিয়ে দিলেন?”

রজত হেসে বললেন “চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম স্যার। আমি না পাঠালে কারো না কারো ছেলেকে তো পাঠাতেই হত”!

প্রধানমন্ত্রী বললেন “কোন ট্রেইনড কম্যান্ডোকে পাঠানো যেত! এত বড় রিস্ক নিয়ে নিলেন?”

রজত বললেন “ওদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে তাকে বাঁচিয়ে রাখত না”।

প্রধানমন্ত্রী বললেন “সেটা আপনার ছেলের ক্ষেত্রেও অ্যাপ্লিকেবল, তাই না?”

রজত শ্বাস ছেড়ে বললেন “কিছু করার ছিল না স্যার। গোটা প্রজেক্টটা এই ঘরে চারজন ছাড়া আর কারো সঙ্গে ডিসকাস করে কিছু করা হয় নি”।

প্রধানমন্ত্রী গম্ভীর হয়ে বললেন “কিন্তু এখন আপনাদের র আর ইন্ডিয়ান আর্মির হেল্প লাগবে, তাই তো?”

প্রফেসর শর্মা বললেন “ওদের যে প্ল্যান আছে, সেটা আটকাতে হলে তো লাগবেই স্যার”।

প্রধানমন্ত্রী বললেন “আপনাদের অনেক আগে আমাকে ইনফর্ম করা উচিত ছিল। এত বড় একটা প্ল্যান করছে ওরা, আমরা আগে জানলে আরও ভাল করে প্রিপারেশন নেওয়া যেত”।

প্রফেসর শর্মা বললেন “বেশ কয়েকটা সমস্যা ছিল স্যার। র আমাদের কাছ থেকে জানলে ব্যাপারটা আমাদের অপারেট করতেই দিত না। আই এস আই এস ক্যাম্পে এভাবে কাউকে মাথায় চিপ সেট করে পাঠাতেও দিত না। আমি যেভাবে ভেবেছি, তাতে এদের গোটা ইউনিটটাকেই ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে বাংলাদেশকে ইউজ করে নর্থ ইস্ট দিয়ে ইন্ডিয়ায় ঢোকার কথা ওরা ভাবতেও না পারে, তার ব্যবস্থাও করতে চেয়েছি”।

প্রধানমন্ত্রী রজতের দিকে তাকিয়ে বললেন “ক্যাম্প ধ্বংস করবেন বলছেন। সে ক্ষেত্রে আপনার ছেলের কী হবে?”

রজত বললেন “ওকে জীবিত অবস্থায় যাতে ফিরিয়ে আনা যায়, আমরা তার চেষ্টা করব”।

প্রধানমন্ত্রী অবাক গলায় বললেন “আপনারই ছেলে তো? নাকি অ্যাডপ্টেড?”

রজত হেসে ফেললেন “এরকম কেন বলছেন স্যার?”

প্রধানমন্ত্রী বললেন “এত নির্লিপ্ত গলায় একজন বাবা কী করে কথা বলতে পারে আমি সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি। আপনি ভাবেন নি কত কিছু হতে পারে?”

রজত বললেন “হয়েছে স্যার। আমার ছেলেকে কনভার্ট করা হয়েছে, ওকে আর্মস ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে যাতে ও একজন পারফেক্ট মিলিট্যান্ট হতে পারে। ওকে প্রায় রাতেই একজন মেয়ের কাছে শুতে পাঠাতে হচ্ছে যাতে ও ঠিক ঠাক জিহাদ করার ইন্সপিরেশন পায়”।

প্রধানমন্ত্রী চোখ বড় বড় করে বললেন “মাই গড! আপনি কেমন বাবা?”

রজত বললেন “দেশের জন্য কাজ করছে তো। আমি একজন গর্বিত বাবা স্যার”।

প্রধানমন্ত্রী মাথা নেড়ে বললেন “না না না। আমি এটা এভাবে মেনে নিতে পারি না। আপনারা খুব বড় রিস্ক নিয়ে ফেলেছেন। প্রফেসর, আপনার অ্যাটলিস্ট রজতবাবুকে বোঝানো উচিত ছিল এর ভয়াবহতা সম্পর্কে। এরা তো মানুষ নয়! মানুষের চেহারায় পশুরও অধম কোন প্রাণী, যাদের একটাই ধর্ম, ঘৃণা। এরকম একটা জায়গায় একটা ছোট ছেলেকে…”

প্রফেসর বললেন “আমরা ওকে বুঝিয়েছিলাম স্যার। ও বোঝে নি। মানতেও চায় নি। শুরু থেকেই বলেছিল, ওর ছেলেই এ কাজের জন্য প্রথম প্রেফারেন্স। আমরা ভেবে দেখলাম আর কারো কাছে অ্যাপ্রোচ করার চেয়ে ওর ছেলেকেই নেওয়া আমাদের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক হবে। তাই আর বেশি জোর করলাম না”।

প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত গলায় বললেন “ডিজাস্টার করে ফেলেছেন আপনারা। আমি শুভ্রকে নিয়ে ভীষণ ওয়ারিড হয়ে গেলাম। যাই হোক। এখন কী চাইছেন? কোন প্ল্যান?”

প্রফেসর বললেন “আমাদের বাংলাদেশে ওদের ক্যাম্পেই ডিরেক্ট অ্যাটাক করতে হবে। নইলে ওদের ইন্ডিয়াতে ঢোকার অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখন অবধি যা বুঝতে পারছি, ওদের মাথাগুলো বাংলাদেশের ক্যাম্পেই থাকবে। এখানে যারা আসবে, তারা তো ব্রেইনওয়াশড ছোট ছোট ছেলে। কেউ শুভ্রর বয়সী, কেউ ওর থেকে একটু বড়, কেউ বা ছোট। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্যাম্পে বেশ কয়েকটা চাই এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা যদি ঠিক ঠাক প্ল্যান করে ওদের ক্যাম্প অ্যাটাক করতে পারি, বিরাট সাফল্য আসবে”।

প্রধানমন্ত্রী মাথা নেড়ে বললেন “বাংলাদেশে আমরা অ্যাটাক করলে ইন্টারন্যাশনাল ইস্যু হয়ে যাবে। এভাবে সম্ভব না”।

প্রফেসর বললেন “স্যার, চোদ্দই আগস্ট ওরা ইন্ডিয়াতে ঢোকার প্ল্যান করছে। যদি একজনও ওদের প্ল্যানে সফল হয়, আবার কতগুলো নিরীহ মানুষের জীবন যাবে। আপনি বলুন আমরা চুপ করে বসে থাকব?”

প্রধানমন্ত্রী উত্তর দিলেন না। গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

৩৩

“জিহাদ কী?”

হলভর্তি ছেলেদের সামনে উর্দুতে প্রশ্ন করল আসাদ শেখ।

প্রায় সবাই হাত তুলল।

আসাদ শুভ্রর দিকে আঙুল তুলে বলল “তুমি বল”।

শুভ্র বলল “নিজেদের রক্ষা করার জন্য গ্রেটার শত্রুকে মুছে ফেলার নাম”।

আসাদ চোখ ছোট ছোট করে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি নিজেদের বলতে কাকে বোঝাচ্ছ? হিন্দু, খ্রীষ্টান না আমাদের?”

শুভ্র বলল “আমাদের”।

আসাদ বলল “তুমি কী? হিন্দু না মুসলমান?”

শুভ্রর অস্বস্তিটা আবার শুরু হল। কানে ঝিঁঝিঁটা ডেকে উঠল “বল আমি একজন গর্বিত মুসলমান”।

শুভ্র সেটাই বলল।

আসাদ শুভ্রর দিক থেকে এবার বাকিদের দিকে চোখ দিয়ে বলল “আমরা কি গর্বিত মুসলমান?”

ভিড় থেকে আওয়াজ উঠল “হ্যাঁ”।

আসাদ কানে হাত দিয়ে বলল “আমি শুনতে পাচ্ছি না। জোরে বল। আমরা কি গর্বিত মুসলমান”।

এবার সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলল “হ্যাঁ”।

আসাদ বলল “জন্নত মানে জানো? জন্নত সেই জায়গা, যেখানে মানুষের কোন দুঃখ কষ্ট থাকে না। আল্লাহপাক তার সব থেকে প্রিয় জনেদের জন্য জন্নতে জায়গা রেখে দেন। তাকে নিজের কাছে এনে রাখেন। সেখানে কোন রোগ নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, স্বজন হারানোর বেদনা নেই। যেখানে তাকাবে, শুধু সুখই দেখতে পাবে। আমরা, আমাদের মাধ্যমে তোমাদের সেই জন্নতে পাঠানোর মহান ব্রত নিয়েছি। যারা আমাদের ধর্মকে নষ্ট করছে, আমাদের ধর্মের মানুষদের মারছে, আমাদের ধর্মগ্রন্থকে কলুষিত করছে, তাদের আমরা জাহান্নামে পাঠানোর ব্রত নিয়েছি। প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা প্রাণী, ভবিষ্যতে যেন শুধু আমাদের ধর্মে দীক্ষিত হয়, আমাদের লক্ষ্য সেটাই। তার জন্য আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদের কুরবানী দিতে হবে। কুরবানী দিতে হবে আমাদের সব থেকে প্রিয় মানুষ, আমাদের নিজেদেরকেই। তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমরা যেন গর্ব করে বলতে পারি, হ্যাঁ প্রভু, আমরা আমাদের কাজে সফল হয়েছি। একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমরা কাফেরদের মুছে দিতে পেরেছি। এই মুহূর্তে আমাদের সব থেকে বড় শত্রু হতে চলেছে ইন্ডিয়া। সেখানে আমাদের মানুষদের ওপর প্রবল অত্যাচার চলছে। ধর্ষণ হচ্ছে, আমাদের প্রিয় খাবার খেতে গেলে বাড়ি থেকে ট্রেন থেকে বের করে করে তাদের ওপর হত্যালীলা চলছে। আমাদের কাজ হবে তাদের বরবাদ করে দেওয়া। একটা গোটা দেশের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দেওয়া। ক্ষমাহীনভাবে তাদের তছনছ করে বুঝিয়ে দিতে হবে আমাদের গায়ে হাত দেবার পরিণাম কী হতে পারে। বাস স্ট্যান্ড, স্টেশন, মেট্রো স্টেশন, যেখানে পাবে, যাকে পাবে, শেষ করে দেবে। নিজের গায়ে বুলেট এসে লাগলেও থামবে না। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাবে জিহাদের জন্য। তাহলেই আমরা অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। জন্নতে যেতে পারব। লতিফ”।

লতিফ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল “জি হুজুর”।

আসাদ চোখ বন্ধ করে নিজের দাড়িতে কয়েক সেকেন্ড হাত বুলিয়ে বলল “আমি ঠিক করেছি, ১৪ই অগস্ট না, আমাদের অপারেশন তার সাতদিন আগে, মানে আগামীকাল হবে। আল্লাহপাকের এমনই ইচ্ছা। আমি আর কোন রকম ধৈর্য ধরতে পারছি না”।

লতিফ চমকে উঠে বলল “কালকের মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে?”

আসাদ বলল “হ্যাঁ। আমার কাছে বার্তা এসেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের ইন্ডিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে। আজ রাতেই ওদের মেঘালয় বর্ডারে নিয়ে চলে যাও। ও পারে আমাদের লোকেরা থাকবে। ওদের নিয়ে গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। আই কার্ড তৈরী হয়ে গেছে। কোন অসুবিধা হবার কথা না”।

লতিফ মাথা নিচু করে বলল “জি জনাব কিন্তু আমার মনে হয় ওদের আরও ট্রেনিং এর দরকার ছিল”।

আসাদ হল ভর্তি ছেলেদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল “তোমরা প্রস্তুত নও তার কাছে কুরবানী দিতে?”

ছেলেরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল “জি জনাব”।

আসাদ দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসিমুখে লতিফের দিকে তাকিয়ে বলল “তোমার ক্যাপ্টেন প্রস্তুত? আতিক?”

লতিফ শুভ্রর দিকে তাকাল। ঝিঁঝিঁ ডেকে উঠল “বল জি জনাব”।

শুভ্র কোন দিকে না তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল “জি জনাব”।

আসাদ সেখের মুখ হাসিতে ভরে উঠল, “নাহ। লতিফ। তুমিই ঠিক ছিলে। ছেলের মধ্যে দম আছে”।

শুভ্রর ঘাম দিচ্ছিল। পা কাঁপছিল। সে বুঝতে পারছিল না কী করবে।

হলের বাকি ছেলেগুলো আনন্দে উল্লাস করা শুরু করল। জোরে জোরে স্লোগান দিতে লাগল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

৩৪

দিল্লি। বিকেল পাঁচটা।

দরজা খুলে কন্ট্রোল রুমে দেখতে রজত দেখতে পেলেন পাগলের মত পায়চারি করছেন সত্যজিৎ।

রজত বললেন “কী ব্যাপার সত্যজিৎ? তুমি এত চিন্তিত কেন?”

সত্যজিৎ বললেন “পট্টনায়েক স্যার আর প্রফেসর শর্মা কোথায় স্যার?”

রজত বললেন “আমার সঙ্গেই তো আসছে। টয়লেটে আছে সম্ভবত। কেন বলত? আমাকে একা বলা যাবে না?”

রজতের কথা শেষ হতে না হতেই পট্টনায়েক আর প্রফেসর শর্মা রুমে প্রবেশ করলেন।

রজত সত্যজিৎকে বললেন “এই তো, ওরা এসে গেছেন। এবারে বল, কী হয়েছে”।

সত্যজিৎ সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন “স্যার, ওরা ঠিক করেছে আজ রাতেই ওরা মুজাহিদিনদের ইন্ডিয়াতে এন্ট্রি করাবে। সাত দিন এগিয়ে নিয়ে এসেছে ওদের প্রোগ্রাম”।

রজত ভ্রু কুঁচকে বললেন “তুমি শিওর?”

সত্যজিৎ বললেন “হ্যাঁ স্যার। শুভ্রর সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারছিলাম সেই সময়টা”।

প্রফেসর শর্মা মাথায় হাত দিয়ে বসলেন “সর্বনাশ। সবে তো পি এম কে বলা হল। র’কে ইনভলভ করতে হবে, আর্মি হেল্প নিতে হবে। আজকে রাতের মধ্যে এটা কী করে হবে?”

পট্টনায়েকের চোয়াল শক্ত হল “আমার মনে হয় যেভাবেই হোক, আজকে আমাদের স্টেপ নিতেই হবে। পি এমের সঙ্গেই না হয় আরেকবার দেখা করি। উনি হেল্প করবেন কথা দিয়েছেন যখন… কিছু তো করার নেই”।

প্রফেসর শর্মা বললেন “দেখো, র চিফের সঙ্গে আমার ঝামেলা আছে বলেই তো আমি ইন্ডিপেন্ডেন্টলি এই প্রোজেক্টটা করার কথা ভেবেছিলাম। এখন, এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে, সুশান্ত আমার কথা মেনে নেবে পি এম বললেই, আমার তো সেটা মনে হয় না”।

রজত সত্যজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন “এই মুহূর্তে ক্যাম্পে কে কে আছে সত্যজিৎ?”

সত্যজিৎ বললেন “সবাই। আই এস আই এসের তিনটে বড় মাথা, রহমান লতিফ, আসাদ সেখ আর ওদের পুরো ইউনিটের অতগুলো মুজাহিদিন আছে”।

প্রফেসর শর্মা মাথা নেড়ে বললেন “ওরা কালকের মধ্যে কান্ট্রিতে ঢুকে গিয়ে গা ঢাকা দিলে মারাত্মক রিস্ক হয়ে যাবে। দেখো, কোথাও যেতে হবে না, ওরা যদি গুয়াহাটিতেও একটা ছোটখাটো ব্লাস্ট করে, সেক্ষেত্রেও ভয়াবহ ব্যাপার হতে পারে”।

রজত বললেন “আর দেশের সব শহরে ছড়িয়ে পড়লে তো বুঝতেই পারছেন কী হতে পারে”।

পট্টনায়েক বললেন “আমার মনে হয় এই চিন্তাগুলো আমরা খামোখাই করছি। আমরা র’কে জানিয়ে দিয়ে চুপ করেও তো যেতে পারি। প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ তো আমাদের কাছে আছেই। সেগুলিও দিয়ে দিতে পারি। তারপর না হয় চুপ করে দেখি কী হতে পারে”।

প্রফেসর শর্মা ম্লান হেসে বললেন “আর শুভ্র?”

রজত একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন “ওর চিন্তা করতে হবে না”।

সত্যজিৎ রেগে গিয়ে বললেন “এটা কী কথা বলছেন স্যার? একটা নিরীহ ছেলে, যে কিনা কিছুই জানল না কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না?”

রজত প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে বললেন “প্রফেসর ওরা রাতে রওনা দেবে। এই মুহূর্তে ওদের ক্যাম্পে ওদের মাথা সহ সব মুজাহিদিনরা আছে। আমরা যদি চিপের ডেস্ট্রাকশন মোড অন করে দি, সেক্ষেত্রে তো সব ক’টাকে মেরে দেওয়া সম্ভব?”

সত্যজিৎ লাফিয়ে উঠে বললেন “আপনি পাগল হয়ে গেছেন স্যার। এটা কী কথা বলছেন? ডেস্ট্রাকশন মোড?”

প্রফেসর শর্মা রজতের দিকে তাকিয়ে বললেন “চিপের সেলফ ডেস্ট্রাকশন মোড অন করলে তোমার ছেলে একজন অতি শক্তিশালী মানব বোমায় পরিণত হয়ে যাবে রজত। সেক্ষেত্রে যে বিস্ফোরণটা হবে, সেটা অবশ্যই বিরাট কিছুই হবে, কিন্তু তাতে গোটা ক্যাম্প উড়ে যাবার কোন চান্স থাকবে না। হ্যাঁ, ওরা যদি কোন মিটিং বা নামাজ পড়ার সময় একসঙ্গে থাকে, সেক্ষেত্রে ইট উইল ডেফিনিটলি হেল্প আস”।

রজত চুপ করে শুনলেন। সত্যজিৎ পট্টনায়েককে অস্থির হয়ে বললেন “স্যার, আপনি তো কিছু বলুন? এটা হতে দেওয়া যায়? যদি শুভ্রকে বের করে আনতেই না পারি তাহলে আমাদের মিশনটা সাক্সেসফুল হয়েছে কীভাবে বলব? শুনুন না, আমরা র কে ইনভল্ভ করি। ওদের জানাই আমাদের কী করার আছে, ওরা নিশ্চয়ই হেল্প করবে”।

রজত বললেন “মাথাগুলো বাংলাদেশেই থেকে যাবে সত্যজিৎ। তারপর আবার কোথাও কোন ব্লাস্ট করবে”।

পট্টনায়েক রজতকে বললেন “তুমি যে কথাটা ভেবেছ এটাই অনেক রজত। দয়া করে এর বেশি কিছু ভেবো না। আমরা র এর মাধ্যমেই এগোব”।

রজত বললেন “ওরা অতগুলো ছেলে কুরবানী দিতে রাজি হয়ে গেল, শুভ্র কী দোষ করল? যদি দেশের জন্য ওকে বলিদান দিতে হয়, তাহলে দেবে। কী সমস্যা?”

সত্যজিৎ প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনি কিছু বলুন স্যার”।

প্রফেসর শর্মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “শুভ্রর কো অরডিনেট দাও সত্যজিৎ। কী করা যায় দেখি”।

সত্যজিৎ অবিশ্বাসী চোখে প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *