ঝিঁঝিঁ – ১

এখন পর্যন্ত

মেট্রোতে পাশে বসে থাকা লোকটা শুভ্রর গায়ে ঢুলছিল।

শুভ্র বিরক্ত হয়ে লোকটাকে কনুই দিয়ে ঠেলল।

লোকটা উঠে শুভ্রর দিকে কড়া চোখে তাকাল।

শুভ্র বলল “কী? দেখতে পান না”?

লোকটা কোন কথা বলল না।

এম জি রোড এসে গেছিল। শুভ্রর সঙ্গে লোকটাও নামল। রাস্তায় উঠেই শুভ্র টের পেল পিঠে কিছু একটা খোঁচা মারছে। সে চিড়বিড়িয়ে উঠে পিছন ফিরে দেখল সেই লোকটাই। হাতে রিভলভার। তাকে বলল “চল, একটাও কথা না”।

একটা লঝঝরে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার পাশে।

লোকটা শুভ্রকে বলল “ওঠ গাড়িটায়”।

শুভ্র হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল।লোকটা কোমরে আবার খোঁচা দিল।

শুভ্র নিতান্ত নিরূপায় হয়ে গাড়িটায় উঠল। লোকটা তার পাশে বসল। ড্রাইভারকে বলল ” চল”!

রাস্তায় থাকা লোক, পুলিশ, বাস কোন কিছুই শুভ্রকে স্পর্শ করছিল না। সে বলল “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

লোকটা হেসে বলল “জন্নত।”

দুপুরবেলা। রাস্তাঘাটে ভালো লোকজন আছে। শুভ্র ভাবছিল গাড়ি থেকে ঝাঁপ দেবে নাকি। ড্রাইভারটা একটা বিড়ি ধরাল।

লোকটা বলল “রিভলভার চালাতে পারিস”?

শুভ্র মাথা নাড়ল।

লোকটা বলল ” আবে দিওয়ালি, ঈদে কোনদিন খেলনা পিস্তল নিয়ে খেলিস নি?”

শুভ্র বলল “একই ভাবে চালায় নাকি?”

লোকটা তার পেটে বন্দুকের নলটা চেপে বলল “দেখবি?”

শুভ্র ভয় পেয়ে গেল “কী চাই বলুন না। ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”

লোকটা পকেট থেকে পানমশলার প্যাকেট বের করে মুখে দিল।

চাঁদনিতে একটা গলির সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। লোকটা বলল ‘ নাম গাড়ি থেকে৷ চালাকি করলে সব গুলি তোর পোঁদে ভরে দেব”।

শুভ্র নামল। লোকটা বলল “হাঁটতে থাক”!

খানিকটা হেঁটে একটা ইলেকট্রনিক জিনিসের ভাঙা দোকান পড়ল। লোকটা বলল ” চল”!

শুভ্র দোকানের ভেতরে গেল। একটা দরজা ছিল। লোকটা দরজায় তিনটে টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল। লোকটা শুভ্রকে বলল,”ভেতরে চল”!

শুভ্র ভেতরে গিয়ে নিভু নিভু আলোতে দেখল দশবারোজন বসে আছে। প্রত্যেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র।

সে চমকে লোকটার দিকে তাকাল।

লোকটা তার মাথায় পিস্তল রেখে ধমক দিল “বস। বস শুয়োরের বাচ্চা”!

শুভ্র মাটিতে বসে পড়ল।

শুভ্রর ভয় লাগছিল। এদের হাতের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বেশ দামী মনে হচ্ছে। কলকাতায় বসে এরা এত আগ্নেয়াস্ত্র কোথায় পেল?

সম্বিত ফিরল এক বয়স্ক লোকের কথায়, যে তাকে নিয়ে এসেছিল তাকে ধমকে হিন্দিতে বলল “একে কী করতে নিয়ে এসেছিস এখানে? এ কে?”

লোকটা বয়স্ক লোকের দিকে তাকিয়ে বলল “দিমাগ গরম হয়ে গেছিল তাই নিয়ে এসেছিলাম। একে খরচা করে দাও”।

বয়স্ক লোকটা একটা চড় মারল তাকে যে নিয়ে এসেছিল সে লোকটাকে। বলল “চিরকাল বেত্তমিজি করে কাটিয়ে দিলি। কখন কী করতে হয় কিছুই জানিস না। একটা ভাল কাজে যাব এর মধ্যে অকারণ ঝামেলা না বাধালেই হচ্ছিল না? এই ছোকরা তোমার নাম কী?”

বয়স্ক লোক তার দিকে ফিরল।

শুভ্র উঠে দাঁড়িয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল “শুভ্র রক্ষিত”।

বয়স্ক লোকটা বলল “আই কার্ড হে কোই?”

শুভ্র পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বের করে দিল।

বয়স্ক লোকটা ড্রাইভিং লাইসেন্স পড়ে বলল “ঠিক বলেছে। ঝুট বলে নি”।

শুভ্র কাঁদো কাঁদো গলায় বলল “আমায় প্লিজ ছেড়ে দিন আমি কিছু করি নি”।

বয়স্ক লোকটা হো হো করে হেসে বলল “এখানে এসে পড়লে তো আর যেতে দেওয়া হয় না বাপজান। সে রাস্তা তোমার বন্ধ হয়ে গেছে”।

শুভ্র অবাক হয়ে তাকে যে এনেছে তার দিকে তাকাল।

সে লোকটা তার দিকে রিভলভার নিয়ে তেড়ে এল “এই, চোখ দেখাচ্ছিস কাকে? জানে মেরে দেব একদম”।

শুভ্র ভয়ে সরে গেল। বয়স্ক লোকটা আবার একটা চড় মারল লোকটাকে। বলল “ঝামেলা বাড়ানো ছাড়া কিছু শিখিস নি ইবলিশের বাচ্চা। বেরো এখান থেকে। যা”।

লোকটা তার দিকে লাল চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।

হঠাৎ একটা বন্দুকের বাট দিয়ে শুভ্রর মাথায় কেউ মারল।

শুভ্র জ্ঞান হারাল।

ছোট একটা ঘরে ঘুম ভাঙল শুভ্রর। কতক্ষণ শুয়েছিল খেয়াল ছিল না তার।

মাথায় ব্যথা। ঘরটার কোন জানলা নেই। এক কোণে একটা জলের বোতল রাখা।

সে বোতল থেকে জল খেতে গিয়েই থুতু দিয়ে ফেলে দিল সবটা। বিচ্ছিরি গন্ধ জলটায়।

বাইরে গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

কোনমতে উঠে দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।

একটা বড় ঘর। এক কোণে একটা বড় আলমারি। আরেক কোণে একটা সিঙ্গল খাটে বয়স্ক লোকটা শুয়ে আছে।

তাকে দেখে হিন্দিতে বলল “ঘুম ভেঙেছে?”

শুভ্র বলল “আমি কোথায়?”

লোকটা বলল “ট্রেনিং ক্যাম্পে”।

শুভ্র অবাক হয়ে বলল “মানে? কীসের ট্রেনিং ক্যাম্প?”

লোকটা হাসতে হাসতে বলল “আমাদের উপরওয়ালা এই পৃথিবীতে কিছু কাজ করার জন্য আমাদের পাঠিয়েছেন। ধরে নাও সেই কাজের ট্রেনিং হবে এখানে”।

শুভ্র বলল “কলকাতায় আছি তো? সেটা বলুন প্লিজ। কাল থেকে আমার কলেজে পরীক্ষা”।

বয়স্ক লোকটা বলল “ওসব দিয়ে কোন লাভ নেই। ভালই হয়েছে ইমতিয়াজ তোমাকে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। এখানে বস”।

একটা ছোট টুলের দিকে দেখাল লোকটা।

শুভ্র শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে বলল “আগে বলুন আমি কোথায় এসেছি”।

বয়স্ক লোকটা রিমোট নিয়ে টিভি চালাল। খবরে দেখাচ্ছে কলকাতায় সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে। মেট্রোতে, বিধানসভাতে, নন্দনে সর্বত্র বন্দুকবাজরা দাপিয়ে বেরিয়েছে। হাজারের উপর মানুষ হতাহত। র‍্যাফ নেমেছে, সেনা নেমেছে। এখনও বেশ কয়েকটা বিল্ডিং দখল করে রেখেছে জঙ্গীরা।

শুভ্র চমকে লোকটার দিকে তাকাল।

লোকটা ঠান্ডা গলায় বলল “কালকে যাদের দেখেছিলে, তারা সবাই জন্নতে গেছে ইনশাল্লাহ। ওয়ান অফ দ্য লারজেস্ট টেরর অ্যাটাক ইন ইন্ডিয়া। উই হ্যাভ ক্রিয়েটেড হিস্ট্রি”।

শুভ্র কেঁপে উঠল।

“এই শুভ্র এই”।

গায়ে মাথায় জলের ছিটে দিয়ে শুভ্রর ঘুম ভাঙিয়ে দিল সৌমিতা। শুভ্র ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল সে কমন রুমে ঘুমাচ্ছিল। বলল “আমি ঘুমাচ্ছিলাম?”

সৌমিতা বলল “হ্যাঁ, আতাক্যালানে কোথাকার! তোর মত ঘুম কাতুরে আমি জীবনেও দেখিনি। পারিস কী করে এত ঘুমাতে?”

শুভ্র বড় বড় চোখ করে বলল “তুই জানিস না আমি কী স্বপ্ন দেখলাম”।

সৌমিতা বলল “টেররিস্টের স্বপ্ন নিশ্চয়ই”?

শুভ্র বলল “হ্যাঁ রে। কলকাতা অ্যাটাক করেছে”।

সৌমিতা বলল “হবেই তো। সারাক্ষণ এসব নিয়ে পড়ে যাচ্ছিস। সারাক্ষণ যুদ্ধ যুদ্ধ করে মুখে রক্ত তুলে যাচ্ছিস। যা বাড়ি যা। গিয়ে ঘুমো”।

শুভ্র বলল “মাইরি বলছি, মেট্রোতে পাশে যদি কোন লোক ঘুমায়, আমার গায়ে এসেও পড়ে, আমি কিচ্ছু বলব না। উফ, কী দুঃস্বপ্ন”।

সৌমিতা বলল “বুঝেছি বুঝেছি, বীরপুরুষ কোথাকার!”

কলেজ থেকে বেরোল তারা একসঙ্গে। সৌমিতা বাসে উঠে গেলে শুভ্র হাঁটতে শুরু করল।

মাথাতে স্বপ্নটাই ঘুরছিল। ঠিক তো, যদি এরকম কোন দিন হয়? এত লোক থাকে শহরটায়, দশটা আত্মঘাতী জঙ্গী যদি বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মারাত্মক ব্যাপার হয়ে যাবে তো! কী সাংঘাতিক!

ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল সে। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে একটা লোকের ওপর গিয়ে পড়ল।

লোকটা বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল “দেখে চলতে পারেন তো”।

শুভ্র অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকাল। এ যে অবিকল স্বপ্নের লোকটার মত!

সে তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে সরি বলল।

লোকটা বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে বাস স্ট্যান্ডের উল্টোদিকের গলি দিয়ে হাঁটা শুরু করেছে

কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে শুভ্রর কী মনে হল লোকটাকে ফলো করতে শুরু করল খানিকটা দূরত্ব রেখে।

নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে সে। যে লোকটাকে কোন দিন দেখে নি, তাকে স্বপ্নে দেখে ফেলল? এটা কেমন ব্যাপার হল।

লোকটা অনেকটা রাস্তা হেঁটে একটা বাড়ির দরজায় নক করল। শুভ্র দাঁড়িয়ে ঘুরে গেল। ভাবটা এমন সে ফিরে চলেছে।

লোকটা গলা বাড়িয়ে তাকে ডাকল “ওই ছেলে, এদিকে শোন তো, অনেকক্ষণ ধরে দেখছি ফলো করে যাচ্ছে!”

শুভ্র অবাক হবার ভান করে বলল “আমাকে বলছেন?”

লোকটা রাগী গলায় বলল “এই গলিতে তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই। এদিকে এসো দেখি। ফলো করছিলে কেন?”

শুভ্র আমতা আমতা করে বলল “ফলো করছি না তো। আমি আসলে একটা ঠিকানা খুঁজছি”।

লোকটা বলল ” কোন ঠিকানা?”

শুভ্র একবারও না ভেবে বলল “তেত্রিশের বি বৈকুন্ঠ মল্লিক লেন”।

লোকটা ভ্রু কুঁচকে বলল ” ইয়ার্কি হচ্ছে? এটা বৈকুন্ঠ মল্লিক লেন?”

শুভ্র না জানার ভাব করে মুখে অবাক ভাব ফুটিয়ে বলল “ওহ, তাহলে ভুল হয়ে গেছে হয়ত। আচ্ছা সরি।”

লোকটা বলল “সরি না। এসো আমার সঙ্গে”।

শুভ্রর স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল, বলল ” না না।আমার খুব তাড়া আছে। আমি বাড়ি যাব”।

লোকটা বলল “এই তো তুমি বলছিলে বৈকুন্ঠ মল্লিক লেন খুঁজছ, এর মধ্যে বাড়ি চলে যাবে বলছ?”

লোকটার কথার প্রত্যুত্তরে শুভ্র কী বলবে ভেবে হিমসিম খাচ্ছিল ঠিক এই সময়ে এক স্বল্প পোশাক পরিহিতা মহিলা দরজা খুলে বাইরে এসে লোকটাকে বলল “কী হয়েছে? চ্যাচামেচি করছ কেন?”

শুভ্র মহিলাটিকে দেখে চমকে উঠল। একে তো সে চেনে!

তাদের পাশের পাড়ায় মেয়েটা থাকে। গোপালদার দোকানে প্রায়ই দেখেছে৷ কিন্তু এই মেয়েটা একেবারে ভোলবদল করে এই পোশাক পরে এখানে কী করছে?

লোকটা মেয়েটাকে ধমকে বলল “তুমি ভেতরে যাও।”

মেয়েটা তার দিকে তাকাল।চিনতে পারল সম্ভবত।

তড়িঘড়ি বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

লোকটা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল “এক থেকে দশ গুণব। এই সময়ের মধ্যে যে পথে এসেছিলে সে পথে চলে যাবে। নইলে তোমার কপালে দুঃখ আছে, এক…।”

লোকটা গুণতে শুরু করতেই শুভ্র পিছন ফিরে হাঁটা লাগাল।পিছন থেকে লোকটার গোনার শব্দ ভেসে আসছিল, “দুই, তিন,চার…”

দৌড়তে দৌড়তে শুভ্র গলির বাইরে এসে রাস্তায় এল। যে বাস যাচ্ছিল তাতেই উঠে পড়ল।

হাঁফ ধরে গেছিল। শুভ্র একটা সিট পেল। তাতে বসে পড়ল। ঘেমে জবজবে হয়ে গেছে জামা।

সে যে একটা মেয়ের পাশে বসেছে প্রথমে দেখে নি সে।। মেয়েটা তার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলল “আপনি লেডিস সিটে বসেছেন”।

শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মেয়েটা তার দিকে কড়া চোখে তাকাচ্ছে।

শুভ্র অন্যদিকে তাকাল। এতক্ষণে খেয়াল পড়ল সে বাড়ি যাওয়ার উল্টোদিকের রুটের বাসে উঠে পড়েছে।

সে বাস থেকে নেমে পড়ল। ফোন করার চেষ্টা করল সৌমিতাকে, কিন্তু সৌমিতার ফোন বার বার সুইচ অফ বলছে। তার মাথা কাজ করছিল না। যে লোকটাকে স্বপ্নে কিছুক্ষণ আগে দেখল, সেই লোকটা বাস্তবে এল কোত্থেকে? স্বপ্ন তো অবচেতন মন থেকে আসে। যে লোকটাকে কোনদিনও দেখেই নি সে, সে লোকটা কেন স্বপ্নে আসতে যাবে?

একটা চায়ের দোকানে বসল সে। এক কাপ চা খেল। চোখে মুখে জল দিল। ঠিক করল, কলেজ থেকে মেসে ফিরতে হবে এবং সেটা এখনই। মানিব্যাগ বের করে পকেটের হাল দেখল। ট্যাক্সির টাকা হয়ে যাবে। সে দেখল পরপর দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।

একটা ট্যাক্সির কাছে গিয়ে বলল “গড়িয়া যাবে?”

ট্যাক্সিওয়ালা পাত্তাই দিল না তাকে।

পরের ট্যাক্সির কাছে গিয়ে আবার বলল “গড়িয়া যাবে?”

লোকটা বলল “উঠে যান। মিটারে যা উঠবে”।

শুভ্র ট্যাক্সিটায় উঠে চোখ বন্ধ করল। লোকটার ওখানে পাশের পাড়ার মেয়েটা কী করছিল? তাহলে মেয়েটা কি এসকর্ট টাইপের কিছু?

রাস্তায় জ্যাম হয়েছে৷ গাড়ি এগোচ্ছে না।

শুভ্র বলল ” কী হয়েছে?”

ট্যাক্সিওয়ালা ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখে এসে বলল “অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে টাইম লাগবে”।

শুভ্র বিরক্ত হয়ে বসে রইল।

ফোন বাজছিল। শুভ্র দেখল সৌমিতা ফোন করছে।

ধরল ” কীরে ফোন অফ করে রেখেছিলি কেন?”

সৌমিতা বলল “অফ হয়ে গেছিল। বল কী হয়েছে?”

শুভ্র বলল “অনেক কথা। গিয়ে বলছি।”

সৌমিতা কিছু বলতে যাচ্ছিল শুভ্র দেখল সেই মেয়েটা একটা ছেলের বাইকের পেছনে বসে আছে। বাইকটা ট্যাক্সির থেকে একটু দূরে।

মেয়েটা এখন আর স্বল্প পোশাক পরে নেই৷

একটা হলুদ সালোয়ার পরা।

ওপাশ থেকে সৌমিতা চিৎকার জুড়ল “কীরে, কী হল? কী বলবি বল তাড়াতাড়ি”।

শুভ্র বলল ” একটা মেয়ে”।

সৌমিতা রেগে গেল “অ! তা মেয়ে দেখা হচ্ছে সেটা আবার ফলাও করে আমাকে বলছিস?”

শুভ্র বলল “না না, উফ, আরে সেটাই তো তোকে বলছি। অনেক কথা বলার আছে। অনেক কিছু ঘটে গেল এর মধ্যে”।

সৌমিতা বিরক্ত হয়ে বলল ” কী যে হেয়ালি করে যাচ্ছিস তুইই জানিস শুধু। আমি আর নিতে পারছিস না। মেসে ফিরে ফোন করিস।”

ওদিক থেকে গাড়ি আসা শুরু করেছে।শুভ্র দেখল বাইকটা মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার তর সইছিল না। পাড়ায় গিয়েই প্রথম কাজ হবে মেয়েটার সম্পর্কে খোঁজ লাগানো। পাড়ার কেউ না কেউ ডিটেলস বলেই দেবে। তাছাড়া স্বপ্নের লোকটা বাস্তব জীবনেও অত্যন্ত আক্রমণাত্মক। এই মেয়েটা কি লোকটার প্রেমিকা বা রক্ষিতা টাইপ কিছু?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হল শুভ্রর। সে স্পষ্ট শুনতে পেল “মেয়েটাকে পাওয়া অত সহজ নয়৷ আরো ভাবো। ভাবো। আমরা অপেক্ষা করছি”।

শুভ্র মনে মনেই বলল ” কে আপনি?”

মাথায় তরঙ্গ ভেসে উঠল “জন্নত থেকে এসেছি”।

তরঙ্গটা মিলিয়ে যেতে শুভ্র কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। এটা কী করে সম্ভব? নাকি সবটাই তার মনের ভুল!

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। শুভ্র চুপ করে বসে থাকল বাকি রাস্তাটা। মেসে পৌঁছে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

অতীনদার জন্মদিন আজকে। পার্টি আছে। রান্না শুরু হয়ে গেছে৷ সন্ধ্য হতেই মদ নিয়ে বসে যাবে সবাই।

সৌমিতা ফোন করছে। সে ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে সৌমিতার রেগে যাওয়া গলা ভেসে এল “কীরে,এখনও মেসে পৌঁছাসনি?”

শুভ্র বলল “এই তো জাস্ট এলাম”।

সৌমিতা বলল ” কী হয়েছে বলত তোর? এবার তো বল?”

শুভ্র বলল “বুঝতে পারছি না কী হয়েছে তবে আমাদের পাড়ার ভবা পাগলার কথা মনে পড়ছে। ভবা পাগলা যখন সুস্থ থাকত তখন বলত কেউ নাকি ওর মাথায় কথা বলত বলে ও পাগলের মত আচরণ করত”!

সৌমিতা বলল ” সে তো আমারও মনে হচ্ছে তুই পাগল হয়ে গেছিস। ঘটনা কী ঘটেছে?”

শুভ্র দুপুরের লোকটার কথা বলতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে মাথাটা ঝি ঝি করে উঠল। সে ফোনটা ছুড়ে মারল।

শুভ্রর মনে হচ্ছিল তাকে কেউ যেন ইলেকট্রিক শক দিয়েছে।

কিন্তু শরীরে কোন সমস্যা হচ্ছিল না। তার মানে কি কেউ চাইছে না সে সৌমিতাকে এই ব্যাপারে কিছু বলে? আশ্চর্য তো! কীভাবে হচ্ছে এসব?

শুভ্র ফোনটা তুলল। স্ক্রিনে একটা দাগ পড়ে গেছে। মন খারাপ হয়ে গেল।কত ঝামেলা করার পরে বাবা ফোনটা দিয়েছিল।

সে ফোন অন করার চেষ্টা করল অন হল না।

গেছে তার মানে।

রুমমেট অভিরূপ কলেজ থেকে এসে তাকে দেখে বলল “কী রে এরকম মুখ করে বসে আছিস কেন? কী হল?”

শুভ্র অভিরূপকে ফোনটা দেখাল।

অভিরূপ অবাক গলায় বলল “কী করে হল?”

শুভ্র বুঝল এখন সত্যি বললে আবার যদি শকটা আসে! তাই মিথ্যা করে বলল “রাস্তায় হাত থেকে পড়ে গেল”।

অভিরূপ ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল ” সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে। গেছে”।

শুভ্র কিছু না বলে সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

সৌমিতাকে খবর দিতে হবে। কিন্তু যার ফোন থেকেই ফোন করবে সেই সৌমিতাকে বিরক্ত করতে পারে। মেসে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। শুভ্র রেডি হয়ে বেরোল। বুথ থেকে ফোন করবে ঠিক করল। হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের কাছের বাজারে গেল।

ফোন বুথটা খোলাই আছে। সৌমিতার নাম্বার ডায়াল করল। সৌমিতা ধরছে না। আননোন নাম্বার বলেই হয়ত। শুভ্র দ্বিতীয়বার নাম্বার ডায়াল করল।

হঠাৎ চোখে পড়ল সেই হলুদ সালোয়ার পরা মেয়েটা হেঁটে যাচ্ছে।

শুভ্র ফোনটা রেখে মেয়েটাকে ফলো করা শুরু করল।

মেয়েটা চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। কোন উত্তেজনা নেই, কোন তাড়াহুড়ো নেই। বাড়ি ফিরছে বোঝা যাচ্ছে।

এর আগে শুভ্র কোন মেয়েকে এভাবে ফলো করে নি। তার অস্বস্তি হচ্ছিল। একবার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েও গেল। মেয়েটা খানিকটা এগিয়ে যেতে আবার ফলো করা শুরু করল। কিছুটা পথ হাঁটার পর মেয়েটা একটা দোতলা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। শুভ্র বুঝল এটাই মেয়েটার বাড়ি। বাড়ির নাম “স্বর্গোদ্যান”।

শুভ্র একটু চমকে গেল। এরকম নাম কেন? এটাই কি তবে জন্নত?

সে বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে গেল বাড়িটা ছাড়িয়ে।

এ পাড়াটা ঘিঞ্জি নয়। রাস্তা ঘাটে লোকজন কম। খানিকটা গেলে একটা মাঠ পড়ে।

শুভ্র মাঠ অবধি গিয়ে আবার উলটো পথে হাঁটতে শুরু করল।

বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে আবার হাঁটতে হাঁটতে বুথের সামনে এসে সৌমিতাকে ফোন করল।

এবারে সৌমিতা ফোন ধরল। বলল ” কে?”

শুভ্র বলল “আমি রে। আমার ফোন ভেঙে গেছে”।

সৌমিতা অবাক হয়ে বলল ” সেকী? তুই তো আমাকে বলতে যাচ্ছিলি কী হয়েছে। এর মধ্যে ফোন ভাঙল কী করে?”

শুভ্র বলল “সেটা বলা যাবে না। সেটা বলতে গেলেই তো সমস্যা হচ্ছে”।

সৌমিতা বলল ” আমি কিছুই বুঝতে পারছি না”।

শুভ্র বলল “বললাম তো বলা যাবে না”।

সৌমিতা রেগে গিয়ে বলল ” বলা যাবে না মানেটা কী? আমাকে বলবি না তো কাকে বলবি?”

শুভ্র বলল “আরে বলতে পারলে তো আমিই সব থেকে খুশি হতাম। এর মধ্যে আবার মেয়েটাকে ফলো করতে গিয়ে…”

শুভ্র জিভ কাটল।

সৌমিতা বলল “মেয়ে? মানে? মেয়ে ফলো করছিস?”

শুভ্র মাথায় হাত দিয়ে বলল “উফ। বলছি তো অনেক গল্প কাউকে বলা যাবে না। বললেই…”

শুভ্রর মাথাটা চিনচিন করে উঠল আবার।

সৌমিতা থমথমে গলায় বলল “বললে কী?”

শুভ্র বলল “আমায় মেসে যেতে হবে। কাল দেখা হবে। বাই।”

সৌমিতা কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিল শুভ্র।

“শুভ্র”…

মাথায় চিনচিনে ব্যথাটা ফিরে এল। শুভ্র কিছু বলল না। সে শুনতে পেল “শকগুলো ঠিক ঠাক যাচ্ছে তো? আমি চেষ্টা করছি তোমায় যত কম ব্যথা দেওয়া যায়”!

শুভ্র বলল ” কে আপনি? আমার পিছনে পড়েছেন কেন? ছেড়ে দিন প্লিজ”।

“তার আগে বল স্বর্গোদ্যানে কী দেখলে?”

“কী আর দেখব? মেয়েটা বাড়িটায় ঢুকে গেল ব্যস”!

” আর কিছু জানতে ইচ্ছা হয় নি?”

“না। ইয়ে মানে মেয়েটা ওখানে ওরকম উৎকট ড্রেস পরেছিল কেন বুঝিনি”।

” আমি তথ্য দি। মেয়েটার নাম সুলেখা রায়। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা। বয়স চব্বিশ। নাবালিকা থাকা অবস্থায় মেয়েটির সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়। বর মাতাল, নেশাখোর। মেয়েটিকে বদসঙ্গে নামায়। মেয়েটার বদসঙ্গ তুমি সকালে দেখেছ”!

শুভ্রর মাথায় ব্যথা হচ্ছিল। সে যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে ব্যথাটা চলে গেল। শুভ্র স্থির হয়ে দাঁড়াল।কয়েক সেকেন্ড পরে আবার ব্যথাটা ফিরে এল। শুভ্র বলল “কী চাই আপনার বলুন প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে”!

” অত্যন্ত দুঃখিত। তবে তোমার ব্যথা কমানোর চেষ্টা চলছে। তুমি শুধু আজকের ব্যাপারে আর আমার ব্যাপারে কাউকে কিছু বোল না, তবেই হবে”!

“আপনার ব্যাপারে বলবই বা কী করে? কে আপনি”!

ব্যথাটা কমে গেল। শুভ্র কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল।

শকটা যখন আসছে তখন শরীরে একটা অসহ্য ব্যথা হচ্ছে। শুভ্র বুঝে উঠতে পারছিল না কী হচ্ছে। সে কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেসে ফিরে এল। দেখল একটা শপিং অ্যাপ থেকে একজন দাঁড়িয়ে আছে। ভাবল অতীনদার জন্মদিন বলে কেউ কোন গিফট পাঠিয়েছে হয়ত। সে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল “কার নামে?”

লোকটা তাকে অবাক করে তার নাম বলল।

শুভ্র অবাক হয়ে গেল। সে তো কিছু বলে নি। পারসেলটা নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঘরে এসে দেখল একটা স্মার্ট ফোন।

বেশ দামী। হাঁ করে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। মাথায় আবার ব্যথাটা ফিরে এসে বলে গেল “ক্ষতিপূরণ। নাও ইউ ক্যান কল ইওর গার্লফ্রেন্ড।”

শুভ্র কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ব্যথাটা কমে গেল।

অভিরূপ ঘরে এসে ফোনটা দেখেই বলল “আরে কাকা! হেবি জিনিস তো! কে দিল?”

শুভ্র বলল “বাবা পাঠিয়েছে!’

অভিরূপ বলল “উফ! ভাবা যায়? কী আদর ছেলেকে! লাগা লাগা। সিমটা লাগা”!

শুভ্র পুরনো ফোনটার থেকে সিমটা বের করে নতুন ফোনে লাগাল।

অভিরূপ বলল ” সেলফি তোল ভাই”।

শুভ্র সেল্ফি তুলল অভিরূপকে নিয়ে। বেশ ভাল ক্যামেরা। অভিরূপ বলল “চ ওই ঘরে চ। আসর বসে গেছে।”

শুভ্র বলল “তুই যা আমি যাচ্ছি”!

অভিরূপ চলে গেল।

ফোনের গ্যালারিতে গেল সে। সুলেখার একগাদা ছবি। সঙ্গে সে লোকটারও।

শুভ্র বেশ কিছুক্ষণ ফটোগুলো দেখল।

কী যে হচ্ছিল তার সাথে কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না তার।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

৩ (১ আর ২ এখন পর্যন্ততেই আছে)

ফোনটা বেশ ভাল। তার ফোনের র‍্যাম কম ছিল। ক্যামেরাও খুব একটা ভাল ছিল না। এ ফোনের সব কিছুই অত্যন্ত ভাল।

শুভ্র বেশ কিছুক্ষণ ঘাটল ফোনটা। তারপর সৌমিতাকে ফোন করল।

সৌমিতা ধরেই বলল “ফোন ঠিক হয়ে গেছে?”

শুভ্র এবারেও বুঝল না সৌমিতাকে কী বলবে। কোন রকমে আমতা আমতা করে বলল “হ্যাঁ। ওই ঠিক হল কোনরকমে”।

সৌমিতা বলল “তুই এবারে বলবি কী হয়েছে?”

শুভ্র বলল “সেমিস্টার কবে রে?”

সৌমিতা বলল “কথা ঘোরাবি না। যেটা জিজ্ঞেস করছি জবাব দে”।

শুভ্রর ফোনটা কেটে গেল। শুভ্র বুঝল শক দেওয়ার পরিবর্তে ফোন কেটে যাবে এর পর থেকে। সে খুশি হল। ফোনটা রেখে মদের আসরে গিয়ে বসল।

অতীনদা তাকে দেখেই খুশি হয়ে বলল “আয় রে শুভ্র। তুই না এলে জমছিলই না। বস বস”।

শুভ্র বসল। গ্লাসে করে মদের মধ্যে জল মিশিয়ে দিল তাকে অতীনদা। চানাচুর মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে সব কিছু ভোলার চেষ্টা করতে লাগল।

অভিরূপ বলল “শুভ্রর বাবা ভাল ফোন দিয়েছে অতীনদা”।

অতীনদা বলল ‘কী ফোন রে?”

অভিরূপ বলল “আই ফোন, এক্স টেক্স হবে। হেবি জিনিস। অনেক দাম”।

অতীনদা বলল “বাহ। দারুণ। আমার বাবা ভাই গরীব মানুষ। ফোন দেওয়ার ক্ষমতা নেই”।

শুভ্র মনে মনে বলল “সে আমার বাবারও নেই। কিন্তু কে ফোনটা দিল বুঝব কী করে?”

এক চুমুকে মদটা শেষ করে দিল সে। একটু একটু ভাল লাগছে। দুপুরের পর থেকে যে কী শুরু হয়েছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

ফোনে মেসেজ টোন এসেছে।

শুভ্র উঠে দেখতে গেল। দেখল মেসেজ এসছে “স্বর্গোদ্যানের সামনে যাও তৈরী হয়ে। সুলেখাকে ফলো কর”।

শুভ্রর মাথাটা একটু হালকা হয়েছিল। মেসেজটা কে করেছে দেখতে গেল। দেখা গেল না। সার্ভিস মেসেজের মত আননোন কোড থেকে মেসেজ এসেছে।

সে তৈরী হল। অভিরূপ তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল “কোথায় যাচ্ছিস?”

শুভ্র বলল “তোরা খা। একটা জরুরি কাজ মনে পড়ে গেল। আসছি”।

শুভ্র বেরোল। আবার মোবাইলে মেসেজ এসেছে “তোমার অ্যাকাউন্টে দু হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তুলে নাও। রাস্তা ঘাটের খরচ”।

শুভ্র চমৎকৃত হল। ভালই তো। এরকম অজানা চাকরি মন্দ কী? নতুন ফোন এল, অ্যাকাউন্টে টাকা আসছে, যা বলছে করে দেখা যেতেই পারে।

সে পা চালাল। “স্বর্গোদ্যানে”র সামনে খানিকক্ষণ পরে পৌছতেই দেখল সেই হলুদ সালোয়ারটা পরে সুলেখা বেরিয়েছে।

শুভ্র একটু দূরত্ব রেখে সুলেখাকে ফলো করা শুরু করল।

সুলেখা মোড়ের মাথা থেকে একটা ট্যাক্সিতে উঠল।

শুভ্র তার পিছনের ট্যাক্সিটাতে উঠে ফেলুদার সিনেমার কায়দায় বলে উঠল “ওই ট্যাক্সিটার পিছন পিছন চলুন তো”!

ট্যাক্সি ড্রাইভার তার কড়া চোখে তাকিয়ে বলল “ফলো করব, পুলিশ কেস খাওয়াবে নাকি?”

শুভ্র আমতা আমতা করে বলল “কোন ভয় নেই। ফলো করুন। জরুরি দরকার”।

ট্যাক্সিওয়ালা গজগজ করতে করতে সামনের ট্যাক্সিটা ফলো করতে করতে বলল “ও মেয়ে কে আর কী ফলো করবে, বদ মেয়ে। আমার গাড়িতেও মাঝে মাঝে ওঠে। কোন সম্বন্ধ কেস নাকি?”

শুভ্র কিছু না ভেবে বলল “ওরকমই। কোথায় যায়?”

“বড় বাবু ধরেছে এখন। এলিট সিটি এনক্লেভে যায়। সামনে ছেড়ে দিয়ে চলে আসবে দেখবে”।

শুভ্র বলল “আমাকেও সামনেই ছেড়ে দিও”।

ট্যাক্সিওয়ালা আয়নায় তাকে দেখে বলল “মেয়েটার পাল্লায় পড় নি তো?”

শুভ্র হাসল “না না, সেসব কিছু না”।

ট্যাক্সিওয়ালা বকবক করে যেতে লাগল। শুভ্র জানলার বাইরে তাকাল।

হুইস্কির প্রভাবে কাজটায় একটা উত্তেজনা আসছে।

চুপচাপ বসে থাকল ট্যাক্সিতে।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

দেখা গেল ট্যাক্সিওয়ালা ঠিকই বলেছিল। সুলেখা এলিট সিটি এনক্লেভের সামনেই নামল।

শুভ্র টাকা মেটালে ট্যাক্সিওয়ালা ব্যাজার মুখে বলল “ডিটেলস বলে দিলাম তো, এর পরও সম্বন্ধ হবে নাকি?”

শুভ্র বলল “জানি না তো পার্টি কী চায়, কোথায় যায়, কী করে দেখে জানিয়ে দেব”।

ট্যাক্সিওয়ালা বলল “দাঁড়াব?”

শুভ্র বলল “না চলে যাও”।

ট্যাক্সিওয়ালারও সুলেখাকে নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিল বোঝা যাচ্ছে। শুভ্র সেটাকে পাত্তা না দিয়ে এলিট সিটি এনক্লেভের গেট দিয়ে ঢুকল। সুলেখাকে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।

শুভ্র সুলেখাকে লক্ষ্য করে এগোতে যেতে গেটে সিকিউরিটি আটকাল। বলল “কোন ফ্ল্যাটে যাবেন? এন্ট্রি করে যান”।

শুভ্রর মোবাইলে মেসেজ টোন এল। শুভ্র মেসেজ পড়ল “বল বি থ্রি টাওয়ারে চারশ তিনে যাব”।

শুভ্র সেটা বলে খাতায় উল্টো পালটা নাম ফোন নাম্বার লিখে হাঁটতে শুরু করল। এলিট সিটি অনেকটা জায়গা জুড়ে। শুভ্র জোর পায়ে হেঁটে সুলেখার থেকে একটু দূরত্ব রেখে হাঁটতে থাকল। দেখা গেল সুলেখা বি থ্রি টাওয়ারেই গেছে।

শুভ্র বুঝতে পারল না তার অদৃশ্য নির্দেশদাতা কী করে এত সব জানল।

সুলেখা লিফটে উঠে গেল। শুভ্র দেখল চার তলায় নেমেছে। সে আগুপিছু না ভেবে লিফটে উঠে চার টিপল। এগারোতলার এক একটা ফ্ল্যাট। সুসজ্জিত এনক্লেভ।

চার তলায় নেমে চারশো আট নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াল। নেমপ্লেটে লেখা “ইমতিয়াজ হাসান”।

করিডরে আর কেউ নেই।

শুভ্র বুঝতে পারল না কী করবে। ফোন হাতে নিয়ে নির্দেশের অপেক্ষা করল। কোন নির্দেশ এল না। নিজের মনেই বলল “আছেন?”

কোন উত্তর নেই।

শুভ্র হতাশ হল। এ তো মহা জ্বালা হল। এই ইমতিয়াজ হাসান কী চায়, তাকে কী করতে হবে, কোন রকম নির্দেশ না এলে তো সে কী করবে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়।

দশ সেকেন্ড কলিংবেলের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপে দিল সে।

এবং তারপরেই বুক ঢিপ ঢিপ শুরু হল।

কাজটা কি ঠিক হল?

দরজা খুলতে দেরী হচ্ছিল, শুভ্র যে মুহূর্তে ঠিক করল লিফটে চলে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে দরজাটা খুলে গেল। সালোয়ার পরিহিতা এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে বললেন “কিসকো চাহিয়ে?”

শুভ্র বলল “রাহুল আছে?”

রাহুল বলে কাউকে চেনে না সে। নামটা এমনিই মাথায় এল, বলে দিল।

মহিলা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জানালেন এই নামে এই ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না।

শুভ্র সরি বলল। ভদ্রমহিলা “কোই বাত নেহী” বলে দরজা বন্ধ করলেন।

শুভ্রর নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল। কী দরকার ছিল কোনরকম ইন্সট্রাকশন ছাড়া কলিং বেল টেপার!

আর কিছু না ভেবে লিফটের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে।

দরজা খোলার আওয়াজ এল।

শুভ্র পেছন ফিরে দেখল চারশো নয়ের দরজা খুলে গেল আর তার থেকে একটা লম্বা মিশমিশে কালো লোক তাকে পেরিয়ে লিফটের দিকে এগোল। দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি গান, অ্যালকোহলের কড়া গন্ধ আর কোন মেয়ের হাসির শব্দ করিডোরে ভেসে এল।

লোকটা বেরনোর কয়েক সেকেন্ড পরে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

লোকটা লিফটে করে চলে গেল। তার দিকে একবারও দেখল না।

শুভ্র কোন কিছু না ভেবে চারশো নয়ের কলিং বেল টিপল।

একজন সাদা পাঞ্জাবী পরা লোক এসে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই হালকা মিউজিকের শব্দ ভেসে এল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলল “ইয়েস”।

শুভ্র বলল “সুলেখা আছে?”

লোকটা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল “কে সুলেখা”?

লোকটার শরীরের ফাঁক দিয়ে শুভ্র ফ্ল্যাটের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। হ্যাঁ। সুলেখা আছে। প্রায় অর্ধনগ্ন হয়ে সোফায় বসে আছে। নিজের নাম শুনে শুভ্রর দিকে তাকিয়েছে।

শুভ্র আবার লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল “সুলেখা আছে?”

লোকটা কড়া গলায় “এখানে সুলেখা বলে কেউ থাকে না” বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।

শুভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *