চ্যাপ্টার ৯ : ঠু গুড টু বি ট্র

চ্যাপ্টার ৯ : ঠু গুড টু বি ট্র

এর পরের কয়েকদিন, আমি বাধ্যগত ছিলাম। খাবারের সময় ছাড়া বাইরে যাইনি, নিজের ছোট বাসায় থেকেছি। স্টেশনারী দোকান থেকে টনের উপরে কেনা অরিগামি পেপার দিয়ে কাগজের সারস বানাতে লাগলাম।

সবগুলো সারসকে টেবিলে লাইন ধরে রাখতে দেখে মিয়াগি জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি থাউজেন্ড ক্রেইন চেন বানাবেন নাকি?”

“হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছ।”

মিয়াগি ডজন খানেকের ভিতর থেকে নীল রঙের একটা তুলে নিয়ে দুই ডানা চেপে ধরে আগ্রহ ভরে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল। “আপনি কি একা একাই সবকিছু করার চিন্তা করছেন না কি? কীসের জন্য?”

“মৃত্যুর আগে জীবনে সুখ লাভের আশাতে” আমি উত্তর দিলাম।

অর্থহীন কাজটা করে বেশ মজা পেলাম। সম্পূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টটা রঙিন কাগজের সারস দিয়ে ভরে ফেললাম। গোলাপি সারস, লাল সারস, কমলা সারস, হলুদ সারস, হলুদ-সবুজ সারস, সবুজ সারস, হালকা নীল সারস, আকাশী নীল সারস, বেগুনী সারস।

সারসে সম্পূর্ণ টেবিলে ভরে গিয়েছে। ফ্যানের বাতাসে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মেঝে ভরে যাবে। রুমটা রঙিন হয়ে উঠবে

সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি কিছুটা সন্তুষ্টি অনুভব করলাম। অর্থহীন তবুও সুন্দর কোনো কাজ করার চেয়ে খাঁটি কোনো ইচ্ছে আছে নাকি?

সারসগুলো ভাঁজ করতে করতে অনেকবার মিয়াগির সাথে কথা বলার তাড়না অনুভব করলাম। ওর সাথে যতটা সম্ভব কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলাম। যদিও আমি ওর উপর নির্ভর করতে চাচ্ছি না।

কিন্তু এর মাঝেই আমার প্রতি মিয়াগির আচরণ নমনীয় হয়ে এলো। যখন আমাদের চোখ মিলিত হলো, একটা জড় বস্তুর মতো তাকানোর বদলে ও আসলেই আমার চোখের দিকে তাকাল। আমার মতে ও আগের চেয়ে বেশি সস্নেহে তাকাতে লাগল।

হয়তো বা সেদিনের রেল স্টেশনের হওয়া কথোপকথনের ফলে আমার প্রতি মনটা একটু খুলে দিয়েছে। অথবা মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে সাবজেক্টের সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য পর্যবেক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া আছে।

যে কারণেই হোক, ও আমার সাথে আছে ওর কাজের জন্য। যদি আমি সেটা ভুলে যাই তাহলে সেটা নিশ্চিতভাবেই ব্যাকফায়ার করবে।

পাঁচ দিন পরে, অবশেষে আমার কাজ শেষ হলো। যখন ওগুলো আবারো গুণতে গেলাম, দেখলাম অনেকগুলো সারস খুব বেশি মাত্রায় ভালো। এগুলো আমি বানিয়েছি বলে বিশ্বাস হয় না।

আমি যখন ঘুমে ছিলাম তখন একজন ছোঁকছোঁক করা মানুষ এগুলো ভাঁজ করেছে।

আমি থাউজেন্ড ক্রেইনের ভিতরে দিয়ে তার ঢুকিয়ে দিয়ে আমার সৃষ্টিটা সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিলাম।

********

এখন, চিঠিটা সম্পর্কে কথা বলা যাক।

যে রাতে আমি সারসগুলো ভাঁজ করা শেষ করেছিলাম, সে রাতে ধোলাই করার আগে জিন্সের পকেট চেক করে ভাঁজ করা একটা চিঠি পেলাম।

এটা ছিল আমার দশ বছর পরে ভবিষ্যতের নিয়ে আমিকে লেখা চিঠি যেদিন আমি টাইম ক্যাপসুল খুঁড়ে বের করেছিলাম; সেদিন থেকে এটা আমার পকেটেই ছিল।

জিন্সের পকেট ওলটপালট করে তারপরে সেটা ওয়াশিং মেশিনে দিলাম। এর আগে একবার নজর বুলিয়ে চিঠিটা আবার পড়লাম।

চিঠিতে যা লেখা ছিল সেটা হলো–

দশ বছর পরের আমার উদ্দেশ্যে:

তুমিই একমাত্র লোক যার উপর আমি ভরসা করতে পারি।

যদি বর্তমান আমি এখনো আগের আমির মতো থাকি, আমি চাই তুমি হিমেনোর সাথে দেখা করো।

কারণ, আমি ছাড়া হিমেনো অকেজো

এবং হিমেনো ছাড়া আমি অকেজো।

আমি সাহস করে মিয়াগিকে চিঠিটা দেখালাম।

“আশ্চর্যজনকভাবে দশ বছর আগে আপনি সৎ এবং দয়ালু ছিলেন।“ চিঠিটা পড়ার পরে সে অভিভূত হয়ে মন্তব্য করল। “তাহলে, এখন কী করবেন আপনি”

“হিমেনোর সাথে দেখা করবো” আমি উত্তর দিলাম। “আমি বুঝতে শুরু করেছি এটা কী রকম বোকামী এবং অর্থহীন একটা পদক্ষেপ। প্রায় এক যুগ দেখা না হওয়া ছোটবেলার কোনো বন্ধুর প্রতি টান অনুভব করা যে কী রকম বোকামী; সেটা আমি স্পষ্টতই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এটা আমার প্রতি আমাকে করা অনুরোধ। যা দশ বছর আগের আমি বর্তমানের আমির প্রতি করেছিলাম। আমি এটাকে সম্মান দেখাতে চাই। নিশ্চিতভাবেই, এটা আরও বেশি যন্ত্রণার কারণ হতে পারে। এমনও হতে পারে আমি আরও বেশি হতাশ হবো। কিন্তু নিজ চোখে দেখার আগ পর্যন্ত হাল ছাড়তে পারবো না।”

“…আমি ওর সাথে অন্তত একবারের জন্য হলেও কথা বলতে চাই। এবং আমার জীবনদানের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। আয়ুষ্কাল বিক্রি করে পাওয়া ৩০০,০০০ ইয়েন ওকে দিতে চাই। আমি যদিও কিছুটা খরচ করে ফেলেছি। তুমি হয়তো এটা নিয়ে বিরোধিতা করবে; কিন্তু আমি পরোয়া করি না। এটা আমার আয়ুষ্কাল এবং আমার টাকা।’

“আমি আপনাকে থামাবো না” মিয়াগি বলল। “আমি আপনার অনুভূতিটা বুঝতে পারছি না; এই কথাও বলতে পারি না।”

মিয়াগি এত সহজে রাজি হয়ে যাবে আশা করিনি, সুতরাং কিছুটা হোঁচট খেলাম আমি। একইসাথে ওর কথার পিছনের তাৎপর্যও বুঝতে পারিনি।

কিন্তু পরে পিছন ফিরে তাকাতে, এখন কথাগুলোর মাজেজা বুঝতে পারি।

মিয়াগি শুধুমাত্র অনুভূতিটা “অনুধাবন”ই করেনি; ও জানতো। যা আমি জানার অনেক আগ থেকেই।

“আমি আগামীকাল হিমেনোর বাসায় যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি। ও কি ওর বাবা-মায়ের সাথে থাকে? এই ব্যাপারে তুমি কি জানো?”

“মনে হচ্ছে উনার স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর থেকে উনি ওনাদের উপরই নির্ভর করছেন।”

কথাটা বলার পরে, মিয়াগি ওর চোখ তুলল; মনে হলো সে আমার মুখ পর্যবেক্ষণ করছে। ও আমার সামনে হিমেনো সম্পর্কে কথা বলতে দ্বিধা করছে। আমি বিরক্ত হবো চিন্তা করে।

আমি ওকে ধন্যবাদ জানালাম।

“কোনো প্রয়োজন নেই” মিয়াগি স্বস্তির সাথে বলল।

***********

হিমেনো কোথায় থাকে সেটা আমি কিভাবে জানি, তা ব্যাখা করতে গেলে প্রথমেই আমাকে একমাত্র চিঠিটার কথা বলতে হয়। যা কিনা হিমেনো স্কুল বদলানোর পরে, আমার সতেরো বছর বয়সে এক গ্রীষ্মে পেয়েছিলাম।

চিঠিটা পড়ার পরে, আমার কোথাও ভুল হয়েছে মনে হতে লাগল। আমি ভেবেছিলাম, মনে হয় না ও এরকম কিছু লিখবে।

এটা ছেলেমানুষি জিনিসপত্র দিয়ে ভর্তি ছিল। কিভাবে সে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত, কিভাবে পড়ার সময় বের করে, কিভাবে তাকে হোমওয়ার্ক এবং এই চিঠিটা লেখার জন্য সময় বের করতে হয়েছে; কোন কলেজে যাওয়ার আশা করছে সে, শীতের ছুটিতে কিভাবে ও দেখা করতে আসতেও পা েকিছু।

দেখে মনে হচ্ছে এসব জিনিস দশ বছরের বাচ্চার লেখা, কিন্তু হাতের লেখা সতেরো বছরের মেয়ের।

আর এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত। যদি এটা কোনো সাধারণ সতেরো বছরের মেয়ে হতো, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু এটা হিমেনো। যে মেয়েটা, আমার মতো না, ও ‘গড়পড়তা মান-এর চেয়ে আরও এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

তবুও ওর কথাতে আমি বিদ্রূপ অথবা অমর্যাদার একটা ইঙ্গিতও পেলাম না। এর মানে কী? আমার পরিচিত সেই হিমেনো কোথায়? সতেরোতে পৌঁছালে কি মানুষ এতটা পরিবর্তন হয়ে যায়?

অথবা সহজে বলতে গেলে, ও যেভাবেই কথা বলুক না কেন; লেখাটা সবসময় এমনভাবে লেখে যাতে মনে হয় ও সাধারণ কোনো মেয়ে?

সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে দুই সপ্তাহ পরে, আমি যেরকম চিঠি পেয়েছি; সেরকম বিষয়বস্তুর একটা চিঠি পাঠালাম।

কিভাবে পরীক্ষার জন্য পড়ালেখা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে চিঠির উত্তর দেওয়ার সময় বের করতে পারছিলাম না, কোন কলেজে আমি যেতে চাই, এবং হিমেনো বেড়াতে আসলে কী রকম খুশি হবো এসব।

আমি ধৈর্যসহকারে ওর উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক সপ্তাহ গেল, এক মাস গেল, হিমেনোর কাছ থেকে আর কোনো উত্তর এলো না। শীতের ছুটিতে বেড়াতেও আসল না।

আমি কি কোনো ভুল করেছি? সেসময়ে, আমার মনের সত্যিকারের অনুভূতির কথা লিখেছিলাম যাতে হিমেনোর সাথে দেখা করতে পারি।

সেসময়ে আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আমি ভালোভাবে লিখতে পারিনি। কিন্তু… ততদিনে হিমেনো ইতোমধ্যে অন্য একজনের সন্তান বহন করেছিল। তা আমি জানতাম না। বাচ্চার বাবাকে সে আঠারো বছর বয়সে বিয়ে করে। তারপরে, একবছর পরেই ডিভোর্স হয়ে যায়। পিছনে ফিরে তাকালে, আমি বলবো না এটা ভালো কোনো স্মৃতি। কিন্তু যে চিঠিটা ও আমাকে দিয়েছে তাতে ও কোথায় থাকে সেটা জানা গেছে। আমি আপাতত এটা নিয়েই খুশি।

*******

যদিও আমার স্কুলে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। হিমেনোর সঠিক অবস্থান জানার জন্য আমার ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীর কম্পিউটার ধার নেওয়া প্রয়োজন।

আমার মোপড-এ চাবি ঢুকিয়ে প্যাডেলে পা রেখে কিক মারতেই মিয়াগির বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল।

“ওহ, হ্যাঁ। আমি তোমার থেকে একশো মিটারের বেশি দূরে যেতে পারবো না, তাই না।”

“একদম” মিয়াগি নিশ্চিত করল। “মাফ করবেন, আপনাকে একা একা এতদূরে যেতে দিতে পারি না… যদিও এই বাইকে দুই সিট আছে, আছে না?”

“হয়ে যাবে” আমি বললাম। সেকেন্ড হ্যান্ড কাব ১০১টা আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য কিনেছিলাম। আমার কাছে অতিরিক্ত হেলমেট ছিল না। কিন্তু কেউ তো মিয়াগিকে দেখবে না। আর এমন না যে কেউ এসে আমাদের থামাবে।

“এটাকে ব্যবহার করা সম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি বিরোধিতা করছেন।”

“প্রশ্নই আসে না। এ-নিয়ে চিন্তা করো না।“

আমি ইঞ্জিন চালু করে পিছনের দিকে নির্দেশ করলাম। মিয়াগি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে পিছনে বসল। ওর হাত আমার কোমরে জড়িয়ে ধরল।

আমি সচরাচর যে পথে যাই সে পথেই স্বাভাবিকের চেয়ে কম স্পীডে চলতে লাগলাম। সকালটা ছিল মনোরম এবং স্মৃতি রোমন্থনপূর্ণ।

সোজা আর লম্বা একটি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আকাশে মেঘের বিশাল টুকরোর দেখা পেলাম।

ক্যাম্পাসে অনেকদিন আসিনি আমি। ফলে কেমন যেন নীরস এবং সম্পর্কহীন লাগছে। স্টুডেন্টরা এমনভাবে হাঁটছে যেন তারা অন্য কোনো জগতে বাস করা জীব।

এমনকি পাশ কাটিয়ে যাওয়া বিরল অসুখী মানুষকেও দেখে মনে হচ্ছে তারা অসুখী হওয়াটা উপভোগ করছে।

ম্যাপটা প্রিন্ট করে ব্যাগে রেখে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এলাম। দোকানপাট এখনো খোলেনি, তো আমি ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা অ্যানপ্যান এবং ড্রিপ কফি কিনে লাউঞ্জে ব্রেকফাস্ট করলাম। মিয়াগি ডোনাট কিনে সেগুলো চিবাতে লাগল।

“আচ্ছা শোনো, এটা যদিও কোনো কাজের প্রশ্ন না। ধরো যদি তুমি আমার জায়গায় থাকতে তাহলে শেষ কয়েকটা মাস কিভাবে কাটাতে?” আমি মিয়াগিকে জিজ্ঞেস করলাম।

“উম… আমার মনে হয় ওই পরিস্থিতিতে না পড়ার আগ পর্যন্ত বলতে পারবো না” ও উত্তর দিয়ে আশপাশে তাকাল। “আমার মনে হয় আমি আপনাকে আগে একবার বলেছি। এরকম কোনো জায়গায় আপনার আমার সাথে কথা বলা উচিত নয়। ওরা ভাববে আপনি অদ্ভুত কোনো লোক, যে কিনা নিজের সাথে নিজেই কথা বলছেন।’

“ভাবতে দাও। আমি তো অদ্ভুত-ই।”

সত্যিই, শূন্যের সাথে কথা বলতে দেখে লাউঞ্জের মানুষজন আমাকে দিকে সতর্কদৃষ্টিতে তাকাতে লাগল।

আমি কিছু মনে করলাম না। সত্যি বলতে, আমি অদ্ভুত আচরণ করতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়, একেবারে মনে না রাখার চেয়ে অদ্ভুত হিসাবে মনে রাখাই ভালো।

ব্রেকফাস্ট শেষ হলে মিয়াগি আমার পাশে এসে বসল।

“আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন তার উত্তর নিয়ে চিন্তা করলাম। এটা… সম্ভবত একটু বেশিই রাশভারী উত্তর। আমি যদি এরকম অবস্থায় থাকতাম, তিনটি জিনিস নিশ্চিতভাবেই আমি করতে চাইতাম।”

“বলো বলো। শোনার জন্য আর তর সইছে না।“

“যদিও আমার সন্দেহ আছে এগুলো আপনার উপর কাজ করবে কি না” মিয়াগি ব্যাখ্যা করল। “…প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট লেকে যাবো, দ্বিতীয়ত, নিজের জন্য একটা কবর বানাবো, আর তৃতীয়ত, আমার কাছে যে গুরুত্বপূর্ণ; তার সাথে দেখা করতে যাবো, যেটা আপনি এখন করছেন।”

“আমি জানি না; আমি ঠিক ধরতে পেরেছি কি না। আরও একটু তথ্য দিলে কেমন হয়?”

“হৃদটা… শুধুই হৃদ। যাহোক, ওখানে অবিশ্বাস্যরকম তারকাখচিত আকাশ দেখা যায়। এটুকু মনে আছে আমার। আমার নিকৃষ্ট জীবনের এটাই মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা। কোনো সন্দেহ নেই পৃথিবীতে এর চেয়েও সুন্দর জায়গা আছে। কিন্তু এর মধ্যে যতটুকু আমি জানি তারকাখচিত সেই হৃদটাই সবচেয়ে সুন্দর।“

“আচ্ছা… আর কবর, তুমি তোমার জন্য এক খণ্ড জায়গা কিনতে চাও?”

“না। সত্যি বলতে, যদি আমি একটা বড়ো পাথর খুঁজে পাই এবং সিদ্ধান্ত নিই ‘এটাই হবে আমার কবর’ তবুও চলবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হলো, আমার কবর হবে যে জায়গাটা; সেটা যেন অন্ততপক্ষে কয়েক দশক টিকে থাকে আর ‘আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ’ এমন লোকের ক্ষেত্রে…” মিয়াগি মাথা নত করল। “আমার মনে হয় আপনাকে না বলাই ভালো হবে, মি. কুসুনোকি।”

“ওহ। ধরে নিচ্ছি কোনো ছেলেই হবে?”

“আপনি ঠিকই ধরেছেন।”

স্পষ্ট করে বেশি বিস্তারিত বলতে ইচ্ছুক না ও।

আমি ভাবতে লাগলাম। মিয়াগির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ও দশ বছর বয়সে পর্যবেক্ষক হয়েছিল, এবং কেউ একজন ওর কাছে “এক সময়” গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ও সম্ভবত ওই সময়ের আগের কথাই বলছে।

“আমার মনে হয়, সেটা আমাকে যতই আঘাত করুক, যতই হতাশ করুক না কেন; আমি তবুও শেষ পর্যন্ত ওর সাথে দেখা করতে যেতাম। যার মানে, আপনি এখন যা করছেন; সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার কোনো অধিকার আমার নেই, মি. কুসুনোকি।”

“কথাগুলো ঠিক তোমার মনে হচ্ছে না। তোমার নিজের স্বরূপ; তার চেয়ে ভীত মনে হচ্ছে এটা, কী বলো?” আমি হাসলাম।

“সত্যি বলতে, আমি আমার নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুই জানি না” মিয়াগি বলল।

*****

এত সহজে মিয়াগির বাসা খুঁজে পেলাম যে, আমি আরেকবার নিশ্চিত হয়ে নিলাম।

প্রথমে, আমি খুব সহজে বিশ্বাস করতে পারিনি যে, এটা ওর বাড়ি। আমার সন্দেহ হলো এটা হয়তোবা একই শেষ নামের অন্য কোনো ফ্যামিলি হবে। কিন্তু আশপাশে “হিমেনো” নামের আর কোনো বাড়ি নেই। হিমেনো কোথায় থাকে এই নিয়ে কোনো সন্দেহ রইল না।

স্কুল পরিবর্তন করার আগে হিমেনো প্রকাণ্ড জাপানিজ স্টাইলের বাসায় থাকতো। যে মেয়ের নামের সাথে ‘প্রিন্সেস’ আছে, এমন মেয়ের পক্ষে একদম মানিয়ে যায়। আমার শিশুতোষ মনে তখন তাই মনে হতো।

কিন্তু ম্যাপে উল্লেখিত জীর্ণ দেখতে যে বাসাটা আমি খুঁজে পেলাম; সেটা খুবই বিশেষত্বহীন। যে কেউ পাঁচ সেকেন্ডের জন্য মুখ ফিরিয়ে নিলেই ভুলে যাবে।

ডোরবেল বাজাতে গিয়ে আমি দ্বিধা করলাম না কারণ, আমার মনে এখনো ক্ষুদ্র আশা আছে; ওকে এখানে পাবো না। তিনবার ডোরবেল বাজালাম। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না।

ভাবলাম যদি রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করি তাহলে কেউ একজন নিশ্চয় আসবে। সুতরাং ওই এলাকায় কিছুক্ষণ সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। স্কুল থেকে প্রিন্ট করা ম্যাপটার দিকে তাকালাম রাত নামার আগে সময়টা কাটানোর মতো জায়গার খোঁজে।

“পাবলিক লাইব্রেরি”তে আমার চোখ আটকে গেল। আজকে সকালে স্কুল লাইব্রেরিতে যাওয়ার পর থেকে বই পড়ার ইচ্ছে চাগিয়ে উঠেছে।

বাহির থেকে লাইব্রেরিটা দেখতে একদম পরিষ্কার। কিন্তু ভেতরে এক পা দিয়েই বুঝতে পারলাম; খুবই পুরাতন একটা লাইব্রেরি।

লাইব্রেরিটার একটা জোরালো ঘ্রাণ আছে। পরিত্যক্ত স্কুল বিল্ডিংয়ের মতো নোংরা। কিন্তু বইগুলো সব ঠিকমতো সাজানো।

ভাবতে লাগলাম মৃত্যুর আগে ঠিক কোন কোন ধরনের বই পড়া যায়। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, “মৃত্যুর আগে সম্ভাব্য কী ধরনের বই কাজে লাগবে?”

আমি শুধু ওই বইগুলোই পড়বো। সেসকল বই পড়তে চাই না; যেগুলো মূলত এই যুক্তিতে তাদের মূল্য হারিয়েছে এবং পড়ার পরে এই ভেবে অনুতাপ করতে হবে না যে, “এটা পড়ার মাঝে উপভোগের কী আছে?”

হতে পারে এক মাস পরে হলে বিষয়টি অন্যরকম হতো। তাহলে সেক্ষেত্রে, আমার পছন্দ ছিল পল অস্টার, কেঞ্জি মিয়াযাওয়া, ও. হেনরি, এবং হেমিংওয়ে।

যে বইগুলো নিলাম সেগুলো ছিল ছোট গল্পের। সম্ভবত এজন্য না যে আমি ওগুলো পছন্দ করি, আমি বড় গল্প পড়তে চাই না বলেই। একটা নির্দিষ্ট পরিসরের চেয়ে বড় কোনো গল্প পড়ার মতো এনার্জি আমার আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না।

যখন আমি ও. হেনরির ‘দ্য গিফট অভ মাজি’ পড়ছিলাম, মিয়াগি তখন আমার মুখোমুখি বসে ছিল। সেখান থেকে উঠে আমার পাশে বসে আমার দিকে লক্ষ রাখতে লাগল। একই সাথে আমি যে পাতায় আছে সেদিকেও চোখ বুলাতে লাগল।

“একই সাথে নজর রাখতে আর পড়তে চাচ্ছো?” আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।

“ওরকমই” আরও কাছে ঘেঁষে মিয়াগি জবাব দিলো।

ওর মাঝে প্রশান্তিকর একটা ঘ্রাণ আছে, আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম। সন্ধ্যা ছয়টায় লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি পড়লাম। মাঝেমধ্যে বাইরে গেলাম চোখকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। আর ধূমপান করার জন্য স্মোকিং এরিয়াতে গেলাম।

অন্য কারো সাথে বই পড়ার এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। মনে হলো এভাবে পড়লে জ্ঞান অনেক বৃদ্ধি পায়। যেহেতু আমি শুধু আমার কেমন লাগছে ভাবছি না, একই জিনিস পড়ে মিয়াগির কেমন লাগছে সেটাও চিন্তা করা লাগছে।

আমরা হিমেনোর বাসার দিকে ফিরে গেলাম। কিন্তু তখনো ডোরবেল বাজালে কেউ আসল না। প্রতিবেশীরা কী ভাববে সে সম্পর্কে অবগত হয়েও, কারো আসার অপেক্ষায় হিমেনোর বাসার সামনে আরও এক ঘণ্টা যাবৎ অপেক্ষা করলাম।

সূর্য অস্ত গেল। চালু হলো পাওয়ার পোলের সেফটি লাইট। সিগারেটের গোড়া দিয়ে আমার পায়ের নিচে স্তূপ হয়ে গেল। মিয়াগি ওগুলোর দিকে অনুমোদন না দেওয়ার চোখে তাকাল। সুতরাং আমি ব্যাগ থেকে একটা প্রোটেবল অ্যাশট্রে বের করে ওগুলো সংগ্রহ করলাম।

মনে হচ্ছে আজকের মতো ইস্তফা দিয়ে অন্য কোনো সময় চেষ্টা করা উচিত।

অস্বীকার করতে পারবো না; হিমেনোর সাথে দেখা না হওয়াতে আমি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি।

আমার মোপড-এ চাবি ঢুকিয়ে প্যাডেলে পা রেখে কিক মারতেই, মিয়াগির বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল।

ফিরে যাওয়ার পথে আমরা সম্ভবত ভুল দিকে চলে গিয়েছিলাম। কাগজের লণ্ঠন ও শপিং ড্রিস্ট্রিকের লাইন দেওয়া একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। যেহেতু আমি এই পথে আগে কখনো আসিনি; তাই এই পথ যে আমার বাবা- মায়ের বাসার কাছাকাছি আমাদের নিয়ে আসবে তা বুঝতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগল।

সামনের মন্দিরে সামার ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আমি ক্ষুধার্ত অনুভব করতে লাগলাম। সুতরাং কাবটা পার্কিং লটে থামিয়ে খাওয়ার মতো কিছুর খোঁজে সসের সুবাসযুক্ত একটা স্যান্ডে হেঁটে গেলাম।

আমি দশ বছরের মধ্যে কোন ফেস্টিভ্যাল দেখিনি। হিমেনো চলে যাওয়ার পরে লোকাল ফেস্টিভ্যালগুলোতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

এটা ছিল খুব ছোট ফেস্টিভ্যাল। মাত্র পনেরোটা স্ট্যান্ড ছিল। কিন্তু এটার নিজস্ব একটা প্রাণ ছিল। একটা এরিয়াতে চিত্তবিনোদনের আয়োজন যত কম; লোকজন তত বেশি উত্তেজিত থাকে।

সুকিয়াকি এবং ফ্রাংকফুটার কেনার আগ পর্যন্ত সবকিছুই আমার পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছিল। কিন্তু এরপরে আমার উপর পাগলামি ভর করল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সবগুলো স্ট্যান্ড থেকে কিছু-না-কিছু কিনবো

আমি অক্টোপাসের ডামপ্লিং, শেইভড আইস, ব্রয়েলড সুইট কর্ন, ইসুইয়াকি, ডিপ-ফ্রাইড চিকেন, ক্যান্ডি অ্যাপেল, চকলেট বানানা, গ্রিলড চিকেন, গ্রিলড স্কুইড এবং ট্রপিক্যাল জুস কিনলাম। তারপরে সবগুলো নিয়ে পাথরের সিঁড়ির ধাপে বসলাম।

“এতকিছু কিনে আপনি কী করবেন?” মিয়াগি জিজ্ঞেস করল, বিস্মিত হয়ে।

“বালকসুলভ স্বপ্ন পূরণ করছি। আমি একা সবকিছু খেতে পারবো না। সুতরাং তোমার সাহায্য লাগবে।”

আমি ওগুলো নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। মিয়াগি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে আমার ব্যাগের কাছে এসে ইসুইয়াকি খাওয়া শুরু করল।

ইতোমধ্যে যখন আমরা বারোটা আইটেমের সবগুলো মোটামুটি চেখে দেখা শেষ করলাম, মিয়াগি এবং আমার খাবারের ঘ্রাণের উপর বিরক্তি এসে গিয়েছে। কারণ, আমাদের দুজনের পেটই ছোট। এটা অনেকটা ওখানে ভলিবল ফিট করার মতো।

ভরপেটে, আমাদের দাঁড়ানোর মতো অবস্থা রইল না। মিয়াগি নির্লিপ্তভাবে অ্যাপেল ক্যান্ডি চাটতে লাগল।

যেখানে বসে আছি, ওখান থেকে আমরা ফেস্টিভ্যালের উদ্যান দেখতে পাচ্ছি। মন্দিরের দিকের সরু পথটা কার্ট দিয়ে ভর্তি। দুই সারি কাগজের লণ্ঠন সোজা এমনভাবে লাগানো যেন সেগুলো রেললাইনের আলো। সেগুলোর অনুজ্জ্বল লাল আলো আশপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

পাশ কাটিয়ে যাওয়া সবাইকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল… সংক্ষেপে, এটা দশ বছর আগের দিন থেকে একটুও ব্যতিক্রম ছিল না।

সেদিনও, আমি এবং হিমেনো, নিচের হেঁটে চলা মানুষজনকে দেখতে দেখতে সিঁড়িতে এভাবে বসে ছিলাম। আমরা স্বীকার করে নিয়েছিলাম; সবার সাথে মেশার আমাদের কোনো অধিকার নেই।

আমরা ‘কিছু একটা’র জন্য অপেক্ষা করছিলাম যা কি-না আমাদের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিবে এবং আমাদের সম্পূর্ণভাবে বুঝবে

আর তারপরেই হিমেনো ওর সেই ভবিষৎবাণী করেছিল, “ভালো কোনো কিছু” ঘটবেই, আর দশ বছর পরের গ্রীষ্মে, একদিন আমরা ‘বেঁচে থাকার জন্য সুখী হবো।

এরপরেও, ও আরও বলেছিল দশ বছর পরে যদি আমরা বিয়ে করার মতো কাউকে খুঁজে না পাই, তার মানে আমরা দুজনেই “সেলফে অবিক্রিত” আমাদের উচিত একসাথ হওয়া।

ঠিক আছে, আমি এখন সেই গ্রীষ্মে আছি। আর যে মেয়েটি এই প্রতিজ্ঞা করেছিল সে সেলফে অবিক্রিত থাকেনি, বরং সেকন্ড হ্যান্ড পণ্যে পরিণত হয়েছে। আর আমার জীবন শুধু অবিক্রিত অবস্থায়ই শেষ হবে না, বিক্রির যোগ্যই হয়নি।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত, আমাদের দুজনেরই কোনো মালিক নেই। আমাদের আবারো একাকী ছুড়ে ফেলা হয়েছে।

হিমেনো এখন কোথায়? আর ও করছেই বা কী?

আরেকবার ঘুর্ঘুরে পোকার ডাকে পরিবেষ্টিত মন্দিরে প্রার্থনা করলাম।

আমি খেয়াল করলাম বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। নোটবুকে মিয়াগির পেন্সিলের খসখসে আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফেস্টিভ্যাল প্রায় শেষ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। ইতোমধ্যে কমে আসা শুরু হয়েছে লোকজনের ছায়া।

ট্রাশে ফেলার জন্য আবর্জনা সংগ্রহ করে মাথা তুললাম আমি। তারপরে ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়ালাম।

একটা অবয়ব সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে।

অন্ধকারে চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমি ওকে চিনতে পারলাম। সময় আমার জন্য থমকে গেল।

তো লোকে যা বলে, কিছু কিছু মুহূর্ত সত্যি সত্যিই খুব বেশি ভালো। আমি অনুভব করলাম আমার সারাশরীর আনন্দে কাঁপছে।

ও প্রতিটা ধাপে পা দেওয়ার সাথে সাথে চার বছর বয়সে আমাদের পরিচয় হওয়ার প্রথম দিন থেকে, ও চলে যাওয়ার গ্রীষ্মের সেই দিনটা পর্যন্ত সবকিছু আমার মনে স্লো মোশনে চলতে লাগল।

যদিও দশ বছর আগে থেকে ওকে এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। আসলে ও কী রকম পরিবর্তন হয়েছে সেটা কোনো বিষয় নয়। ব্যাপারটা এরকমও না যে, আমি ওকে চিনতে পারবো না।

আমরা একে অন্যের চেহারা দেখার মতো নিকটে আসতেই, আমি ফ্যাসফ্যাসে গলায় ওর নাম ধরে ডাক দিলাম।

“হিমেনো।”

মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল।

ওর প্রতিক্রিয়া ধীরে-ধীরে সম্পূর্ণ বিস্ময়ে রূপ নিতে লাগল।

“…কুসুনোকি?”

হিমেনো ওর সেই সুপরিচিত স্বচ্ছ কণ্ঠে আমার নাম ধরে ডাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *