চ্যাপ্টার ৩ : দ্য অবজার্ভার উইথ হার নি’স আপ
খারাপ লাগটাই শেষ ছিল না। রাতটা ছিল গরম এবং অস্বস্তিকর। পুরো ব্যাপারটাকে ধন্যবাদ। আমি একদম স্পষ্ট একটা স্বপ্ন দেখলাম।
এমনকি জেগে উঠেও, আমার ম্যাট্রেসে বসে স্বপ্ন রোমন্থন করতে লাগলাম। এটা খারাপ কোনো স্বপ্ন ছিল না। সত্যি বলতে সুখী স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সুখের স্বপ্নের চেয়ে নিষ্ঠুর কিছু নেই।
স্বপ্নে আমি একটা পার্কে ছিলাম। আমি হাইস্কুলে পড়ি। পার্কটা আমার পরিচিত না। কিন্তু আমার এলিমেন্টারি স্কুলের ক্লাসমেটরা সেখানে ছিল। মনে হচ্ছে কোনো ধরনের ক্লাস রিইউনিয়ন।
সবাই আতশবাজি দেখে আনন্দ পাচ্ছিল। আতশবাজির আলোটা লাল বর্ণের। আমি পার্কের বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে লাগলাম।
হঠাৎ হিমেনোকে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ও যখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, হাইস্কুল কেমন চলছে?
আমি ওর দিকে তির্যকভাবে তাকালাম। কিন্তু ওর চেহারাটা অস্পষ্ট। ওর দশ বছর বয়সের পর থেকে আর কিছুই জানি না। ও দেখতে কেমন হতে পারে সেটা সত্যিই কল্পনা করতে পারলাম না।
তবে আমার স্বপ্নে মনে হলো ওর চেহারাটা একদম মনোমুগ্ধকর। এত বছর ধরে ওর সাথে পরিচয় থাকার জন্য নিজেকে গর্বিত মনে হতে লাগল।
‘খুব উপভোগ করছি তা বলতে পারবো না’ আমি সত্যি কথাই বললাম। ‘এটা জঘন্য থেকেও জঘন্য।
‘আমার উত্তরটাও অনেকটা এরকমই হবে হিমেনো মাথা ঝাঁকাল।
ও আমার মতো বয়ঃসন্ধি পার করেছে বলে গোপনে আমি খুবই খুশি হয়েছি।
ও বলল, ‘জানো, ভেবে দেখলাম, আগের দিনগুলো বেশ মজারই ছিল।’
“কোন আগের দিনের কথা বলছ তুমি?” আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
হিমেনো উত্তর দিলো না। উবু হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কুসুনোকি, তুমি কি এখনো আগের মতোই আছো?”
‘আমার তাই মনে হয় আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ওর কী প্রতিক্রিয়া হয় সেদিকে নজর দিয়ে।
‘আচ্ছা” হিমেনো বলল বিস্মিত হওয়ার হাসি দিয়ে। ‘আসলে, জানো তো, আমিও তাই আছি।’
তারপরে, লাজুক হয়ে, ও আরও যোগ করল, ‘ভালো, একদম নিখুঁত।’
‘হ্যাঁ, দারুণ’ আমি সায় জানিয়েছিলাম।
এটাই ছিল স্বপ্ন।
এটা এমন কোনো স্বপ্ন নয় যা কেউ বিশ বছর বয়সে দেখবে। এরকম শিশুসুলভ স্বপ্ন দেখার জন্য আমি নিজেকে ভর্ৎসনা করলাম। একই সাথে স্বপ্নটাকে আমার স্মৃতিতে রাখতে চাচ্ছি। যদি পরে ভুলে যাই তবে অনুশোচনা
হবে।
আমি নিশ্চিত, যখন আমার বয়স দশ বছর ছিল, হিমেনোর প্রতি আমার তেমন কোনো আকর্ষণ ছিল না। হয়তো বা সামান্য পরিমাণে ছিল। সমস্যা হচ্ছে এরপর থেকে আমি অন্য কারো প্রতি সেই “সামান্য পরিমাণে”ও আকর্ষণ অনুভব করিনি।
সম্ভবত সেই ক্ষুদ্র পরিমাণ আকর্ষণই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কিছু ছিল। যা কিনা ও চলে যাওয়ার অনেক বছর পরে বুঝতে পেরেছি।
******
হিমেনোকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের খুঁটিনাটি স্মৃতিতে গেঁথে রেখেছিলাম আর একইসাথে গতকালকের ঘটনার কথা শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিলাম। তিন মাস বাদে আমার বাকি আয়ুষ্কাল জরাজীর্ণ পুরাতন বিল্ডিংয়ে বিক্রি করে দিয়ে এসেছি।
গতকালকের কথা চিন্তা করার সময় আমার একবারও মনে হলো না, ওহ, এটা তো দিবাস্বপ্ন ছিল। আমি ঘটনাটা একদম বাস্তব বলেই ধরে নিলাম।
আমি বলছি না, আমার আয়ুষ্কালের বেশিরভাগ মুহূর্তের উত্তজেনায় বিক্রি করে দিয়ে অনুশোচনায় ভুগছি। আমি বলছি না যে, হারিয়ে ফেলার পরে এখন আমার যা কিছু ছিল তার গুরুত্ব বুঝতে পারছি। তার বদলে, এটা আমার কাঁধে ভার হয়ে চেপে আছে বলে মনে হলো।
এতদিন পর্যন্ত আমাকে যেটা জীবনের সাথে জড়িয়ে রেখেছিল তা হলো, ‘কোনো একদিন ভালো কিছু ঘটবে’ এই ক্ষুদ্র আশা। এটা ছিল ভিত্তিহীন আশা। এটাকে বাতিল করে দেয়া ছিল কঠিন কাজ।
কেউ যতই অকর্মণ্য হোক না কেন, তাদের উপর যে সৌভাগ্য কৃপা করবে না; সেটা কে বলতে পারে? আর আগে এসব কিছুই ঘটেনি এমনটা ভেবে নিয়ে নতুন করে সবকিছু লেখার অনুমতি পেতে কতক্ষণ।
এটা ছিল আমার মুক্তি। একই সাথে এটা ছিল একটা ফাঁদ। যে কারণে নিজেকে আমি স্পষ্টভাবে বললাম “তোমার জীবনে ভালো কিছুই ঘটবে না” আমি এটাকে আশীবাদ হিসাবে দেখছি।
আমি এখন শান্তিতে মরতে পারবো।
আশা করছি আমার জীবনের শেষ তিন মাস উপভোগ করতে পারবো। সময়টাকে এমনভাবে ব্যয় করতে চাই যেন ভাবতে পারি, “আমার জীবনটা হতাশাজনক, অন্ততপক্ষে একবার মৃত্যুকে স্বীকার করে নিলে আমার জন্য সুখী তিনটে মাস অপেক্ষা করছে।”
প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলাম, বইয়ের দোকানে যাব। ম্যাগাজিন পড়ব, তারপরে ভাববো এরপরে কী করা যায়। কিন্তু সেই মুহূর্তেই, ডোরবেল বেজে উঠল।
আমি কোনো দর্শনার্থী আশা করছিলাম না। গত কয়েক বছরে আমার কাছে তেমন কেউ আসেনি। এবং গত কয়েক মাসে তো নিশ্চিতভাবেই কেউ আসেনি। ওরা কি ভুল রুমে ডোরবেল বাজাল? ঋণ সংগ্রাহক? ব্যাপারটা সুবিধার লাগছে না।
ডোরবেল আবারো বেজে উঠল। বিছানা থেকে উঠার সাথে সাথেই গতকালকের বমি-বমি ভাব, হ্যাংওভার ফিরে এলো। তবুও, জোর করে নিজেকে দরজায় নিয়ে গেলাম। একটা অপরিচিত মেয়েকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তার পাশেই একটা লাগেজ রাখা; যাতে মনে হচ্ছে মেয়েটার জিনিসপত্র আছে।
“…আপনি কে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
আমার দিকে মেয়েটা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে চশমা বের করে পরল। তারপরে আমাকে “এখন ঠিক আছে?” ধরনের জিজ্ঞাসুর চাহনী দিলো।
তখনই আমি মেয়েটাকে চিনতে পারলাম, “আমার হিসাবনিকাশ করেছিলে যে, তুমি সেই মেয়েটা না…” নিজের অজান্তেই তুমিতে নেমে এলাম আমি।
“হ্যাঁ” মেয়েটি বলল।
আমার মনে স্যুট পরিহিত দৃশ্যটার কথা ভেসে উঠল। ক্যাজুয়াল পোশাকে ওকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। ও একটা কটন ব্লাউজ এবং স্যাক্স ব্লু স্কার্ট পরেছে।
কাঁধ সমান লম্বা চুল একদম শেষে ভিতরের দিকে কিছুটা কুঁচকে পিছনে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমি গতকাল ব্যাপারটা খেয়াল করিনি।
চশমার ভিতর দিয়ে তার চোখের দিকে খেয়াল করে দেখলাম, চোখ দুটোতে কিছুটা বিষাদমাখা।
ওর সরু মসৃণ পায়ের দিকে তাকাতেই, ওর ডান হাঁটুতে বড়ো ব্যান্ড এইড দেখতে পেলাম।
ওর সাথে প্রথম দেখায়, বয়সটা আনুমানিক আঠারো থেকে চব্বিশ বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সম্পূর্ণভাবে ওর বয়স ধরতে পারলাম। ও হয়তবা আমার বয়সি-ই। উনিশ কিংবা বিশ হবে। কিন্তু সবকিছু বাদ। ও এখানে কেন এসেছে? প্রথমেই যে ধারণাটা আমার মাথায় আসল সেটা হলো ‘হিসাবনিকাশে কোথাও ভুল হয়েছে’ কথাটা বলতে এসেছে।
ওরা এক কিংবা দুই ডিজিট ভুল করেছে। অথবা ওরা ভুলক্রমে অন্য কারো সাথে আমার হিসাব গুলিয়ে ফেলেছে। আমার কাছে ক্ষমা চাইলে এসেছে এই আশাটা কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না।
মেয়েটা চশমা খুলে ব্যাগে ভরে রেখে আমার দিকে আবেগশূন্য চোখে তাকাল।
“আমি মিয়াগি। আজকে থেকে আমি আপনার পর্যবেক্ষক। “
মিয়াগি নামের মেয়েটা আমার দিকে সামান্য বো করল।
পর্যবেক্ষক… আমি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ। মেয়েটা এরকম কিছু একটা বলেছিল বটে।
মিয়াগির সাথে বলা গতকালকের কথাবার্তা মনে করতে চেষ্টা করছিলাম এমন সময় বমি-বমি ভাবটা ফিরে এলো। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে আবারো সব উগড়ে দিলাম।
পাকস্থলী খালি করে বাথরুমে থেকে বেরিয়ে আসতেই, মিয়াগিকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা হোঁচট খেলাম। ধরে নিলাম এটা তার দায়িত্ব। তবে ও কিছুতেই লাজুক মেয়ে নয়।
ওকে গ্রাহ্য না করে আমি সিঙ্কের দিকে গেলাম। মুখ ধুলাম, গড়গড়া করলাম, একটা কাপ থেকে পানি পান করলাম, তারপরে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার ভয়ঙ্কর রকম মাথা ব্যথা করছিল। আর অতিরিক্ত তাপমাত্রা এটাকে বাড়তে সাহায্য করছে।
“গতকাল যখন আপনাকে ব্যাখ্যা করেছিলাম” মিয়াগি বলল। হঠাৎ আমার বিছানার পাশে ওকে দেখতে পেলাম, “যেহেতু আপনার আয়ুষ্কাল এক বছরের কম সময় বাকি আছে, আজকের পর থেকে আমি আপনাকে পর্যবেক্ষণ করবো। অতএব…”
“এসব কি আপাতত বন্ধ রাখা যায় না?” আমি বিরক্তি নিয়ে কাঠখোট্টাভাবে বাধা দিয়ে বললাম।
“বুঝতে পেরেছি, তাহলে পরেই বলি।”
মিয়াগি ওর লাগেজ রুমের কর্ণারে নিয়ে গেল। তারপরে দেয়ালে পিঠ দিয়ে, হাঁটু উঁচু করে বসে পড়ল।
এরপরে, ও শুধু আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার উদ্দেশ্য সম্ভবত যতক্ষণ আমি অ্যাপার্টমেন্টে থাকি ততক্ষণ পর্যন্ত আমার দিকে নজর রাখা।
“ধরে নিন আমি এখানে নেই” মিয়াগি ঘরের কোণা থেকে বলল। “আপনি একা থাকলে যা করতেন সেটাই করুন।”
আমার চেয়ে দুই বছরের বড় কিংবা ছোট একটা মেয়ে আমার দিকে সর্বদা তাকিয়ে আছে, ওর মুখের কথাতে এই বাস্তবতার কোনো হেরফের হচ্ছে না।
কিছুতেই অস্বস্তি কাটাতে পারছিলাম না, বারেবারে মিয়াগির দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। ও মনে হচ্ছে নোট বইতে কিছু একটা লিখছে। হয়তো এটা পর্যবেক্ষণ লগ ধরনের কিছু একটা। একতরফা নজরদারি বিরক্তিকর। আমার যে অর্ধেক অংশের দিকে ও তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছিল ওর নজরে সেই অংশটুকু ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। অবশ্যই, আমাকে গতকাল এই “পর্যবেক্ষণ” বিষয়টা ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
মিয়াগির কথা মতো, আয়ুষ্কাল বিক্রির পরে এক বছরের নিচে সময় চলে আসলে অনেক মানুষই মরিয়া হয়ে ওঠে। আর যদি একা থাকে তাহলে থাকলে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করে। কী ধরণের ঝামেলা সেটার ব্যাখ্যা জানতে চাইলাম না। কিন্তু আমি কিছুটা কল্পনা করতে পারি। কারণ মানুষজন নিয়মাবলি অনুসরণ করবে এই বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি হলো বেঁচে থাকা। যদি কেউ নিশ্চিত হয়ে যায় খুব শীঘ্রই তার জীবন শেষ হতে চলেছে; তাহলে সবকিছু বদলে যাবে। পরকালে কেউ নিশ্চয় বিশ্বাস নিয়ে যেতে পারে না।
.
তখন পর্যবেক্ষণ সিস্টেমের সূচনা করা হলো। যাতে মরিয়া মানুষজন অন্যের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
মূলত, যাদের আয়ুষ্কাল এক বছরের নিচে থাকে তাদেরকেই পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা হয়। যদি অনুচিত কাজ কারবার করে তাহলে পর্যবেক্ষক দ্রুত হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করেন। এবং স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল বাদ দিয়ে, তাদের জীবন সেখানেই শেষ করে দেওয়া হয়।
এর অর্থ হচ্ছে কোণায় হাঁটু উঁচু করে বসে থাকা মেয়েটার একটা ফোন কল মুহূর্তেই আমার জীবন শেষ করে দিতে পারে।
মৃত্যুর তিন দিন আগে, মানুষ অন্যের বিষয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে দেয়; এটা সম্ভবত পরিসংখ্যান দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং আয়ুষ্কালের তিনদিন বাকি থাকা অবস্থায় পর্যবেক্ষক চলে যায়।
জীবনের শেষ তিন দিন একা থাকা যায়।
আমি সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে উঠার পর দেখলাম আমার মাথাব্যথা এবং বমি-বমি ভাবে চলে গিয়েছে। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা দেখাচ্ছে। বলা যেতে পারে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তিন মাসের প্রথম দিন প্রায় জঘন্যভাবে কাটালাম। মিয়াগি আগের মতোই কোণা থেকে তাকিয়ে আছে। ওর উপস্থিতি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে, সচরাচর যা করি তাই করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম।
ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে, আমার রুমেই জামা-কাপড় ছাড়লাম। বহু আগেই নীল রং হারানো একটা জিন্স এবং একটি ছেঁড়া টি-শার্ট পরে ডিনার করতে বের হলাম।
আমার পর্যবেক্ষক মিয়াগি পাঁচ কদম পিছন থেকে আমাকে অনুসরণ করতে লাগল।
পশ্চিমের উজ্জ্বল আকাশ আমাকে ঝলসে দিতে লাগল। আজকের সূর্যাস্তটা পুরোদস্তুর হলুদ।
দূরের ঝোপে সন্ধ্যার ঘুর্ঘুরে পোকার ডাক শুনতে পেলাম। রাস্তার পাশের ট্র্যাক দিয়ে অবিন্যস্তভাবে রেলকার যেতে লাগল।
আগে জাতীয় হাইওয়ে ছিল এমন একটা রাস্তার পাশের অটো-রেস্টুরেন্টে পৌঁছালাম আমি। বিল্ডিংটা বিশাল। এর পেছনের বেড়ে উঠা গাছ ছাদটা ঢেকে ফেলেছে।
রেস্টুরেন্টের ভিতরে সারিতে এক ডজন করে ভেন্ডিং মেশিন আছে, প্রত্যেকটার সামনে দুই চেয়ার বিশিষ্ট সরু টেবিল পাতা। টেবিলে গোলমরিচ এবং অ্যাশট্রে রাখা।
কোণায় এক দশক আগের পুরনো আর্কেড ক্যাবিনেট রাখা। যার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক জনশূন্য জায়গাটার আবহাওয়া কিছুটা রাঙিয়ে তুলেছে।
আমি নুডলসের ভেন্ডিং মেশিনে ৩০০ ইয়েন রাখলাম। তার পরে পুরো প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা করে ধূমপান করতে লাগলাম। মিয়াগি একটা টুলে বসে ঝিকিমিকি জ্বলতে থাকা লাইটের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে ও খাবে কীভাবে? আমার মনে হয় না ও খাওয়াদাওয়া ছাড়া থাকতে পারে। কিন্তু ওর মধ্যে একটা ভুতুড়ে ভাব আছে। যদি ও বলে ওর খাওয়াদাওয়ার প্রয়োজন নেই, মনে হয় আমি সেটাও মেনে নিবো।
বলা যায়, ওকে দেখে মানুষের থেকে বরং অনেকটা যন্ত্রের মতো মনে হয়।
গরম এবং সস্তা স্বাদের তেম্পুরা সোবা গোগ্রাসে খাওয়ার পরে, আরেকটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে কফি নিলাম। আইস কফির মিষ্টতা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।
যদিও আর তিন মাস বেঁচে আছি, আমি এখনো ভেন্ডিং মেশিনের অপুষ্টিকর সস্তা খাবার খাচ্ছি কারণ, কেবলমাত্র এটা সম্পর্কেই জানাশোনা আছে আমার।
অল্প কয়েকদিন আগেও জাহির করে দামী হোটেলে খাওয়াদাওয়া করা আমার জন্য কেবলই দুঃস্বপ্ন ছিল। আমি অনেকগুলো বছর দারিদ্রের সাথে বসবাস করে আসছিলাম। সে সময়ে নিশ্চয় সব কল্পনাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি।
*******
খাওয়াদাওয়ার পরে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে একটা কলম নিয়ে নোটবুক খুললাম। তারপরে কী কী জিনিস করবো তার একটা তালিকা করলাম।
যদিও প্রথমদিকে কোন কোন জিনিস করবো না; সেটার তালিকা করা সহজ ছিল। যতই হাত ঘোরাতে লাগলাম; ততই যে জিনিস করতে চাই তা মনে আসতে লাগল।
মৃত্যুর আগে যে জিনিস করতে চাই:
-স্কুলে যেতে চাই না
-কাজে যেতে চাই না
-কোনো আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রাখতে চাই না
-মজার কিছু খেতে চাই
-সুন্দর জিনিস দেখতে চাই
-নিজের উইল লিখে যেতে চাই
-নারুসে’র সাথে দেখা এবং কথা বলতে চাই
-হিমেনোকে আমার অনুভূতি জানাতে চাই
“আমি এটার বিপক্ষে। “
আমি ফিরে তাকালাম। মিয়াগি আর কর্ণারে বসে নেই। ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কী লিখছি সেটা দেখছে।
সে বিশেষভাবে শেষের লাইনের দিকে আঙুল তুলল, “হিমেনোকে আমার অনুভূতি জানাতে চাই।”
“পর্যবেক্ষকদের কি এরকম কে নো কিছুর মাঝে নাক গলানোর অধিকার আছে?” আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
মিয়াগি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। তার বদলে আমাকে বলল,
“…মিস হিমেনোর ব্যাপারে বলে রাখি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা উনাকে সতেরো বছর বয়সে বাচ্চা জন্ম দিতে বাধ্য করেছে। এরপরে উনি হাই স্কুল ছেড়ে দিয়ে আঠারো বছর বয়সে বিয়ে করেছেন। কিন্তু এক বছর পরেই ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে উনার। বর্তমানে বিশ বছর বয়সে উনি একা একা বাচ্চা বড় করছেন। দুই বছর পরে, একটা করুণ সুইসাইড নোট রেখে লাফ দিয়ে মৃত্যুবরণ করবে। আপনি যদি এখন উনার সাথে দেখা করতে যান তাহলে ভালো কোনো কিছুই হবে না। দিন শেষে, মিস হিমেনো আপনাকে বলতে গেলে মনেই রাখেনি। অবশ্যই, দশ বছর বয়সে আপনারা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেটাও এর মধ্যে আছে।”
আমার গলার স্বর সরছে না। মনে হচ্ছে ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বের হয়ে গিয়েছে।
“…তুমি আমার সম্পর্কে এত কিছু জানো?” অবশেষে দম নিতে পারলাম। আমি যে কেঁপে উঠেছি সেটা লুকাতে চেষ্টা করতে লাগলাম। “যেভাবে তুমি কথা বলছ… তবে সামনে কী ঘটবে সব কি তুমি জানো?”
মিয়াগি কয়েকবার চোখ পিটপিট করল, তারপরে মাথা নাড়ল।
“আমি শুধুমাত্র আপনার এবং আপনার জীবনকে ঘিরে ঘটা সমস্ত সম্ভাবনা সম্পর্কে জানি, মি. কুসুনোকি। অবশ্যই, এখন এগুলো সব মূল্যহীন তথ্য। যেহেতু আয়ুষ্কাল বিক্রির পরে আপনার ভবিষ্যৎ চূড়ান্তভাবে বদলে গিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলোর মাঝেও আমি কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো জানি।”
তখনো ওর নোটবুকের দিকে তাকিয়ে মিয়াগি ধীরে-ধীরে ডান হাত তুলে চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো।
“দেখা যাচ্ছে মিস হিমেনো আপনার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মি. কুসনোকি। আপনার জীবনের ‘সারাংশ শুধুমাত্র উনাকে দিয়েই পরিপূর্ণ।”
“এটা তাত্ত্বিক কথাবার্তা” আমি অস্বীকার করলাম। “যেমনটা অন্য সবকিছুর মতো এটাও আমার কাছে খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না, তাই না?”
“এটাও হতে পারে” মিয়াগি বলল। “যাহোক, আপনি যদি আমার কাছে পরামর্শ নেন তো বলতে পারি, মিস হিমেনোর সাথে দেখা করা আপনার জন্য সময়ের অপচয় হবে। তার যে স্মৃতি আপনার কাছে আছে; সেটা নষ্ট হয়ে যাবে।”
“আমাকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এটা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
“কিন্তু আপনার তো সময়টা সঠিকভাবে বিবেচনা করে ব্যবহার করা উচিত, তাই না?”
“হ্যাঁ, হয়তো। তুমি কি সত্যিই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে আলাপ আলোচনা করতে পারো?”
মিয়াগি মাথা কাত করল। “বরং আপনাকে আমি প্রশ্ন করি, আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি পারবো না?”
আমার কাছে এর কোনো উত্তর নেই। এমনকি যদি কোনো ঝামেলা বাধাই, মিয়াগি পট করে হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করে আমার জীবন শেষ করে দিবে।
“আমরা মন থেকে চাই, যে আপনি শান্তিপূর্ণভাবে আপনার জীবন শেষ করবেন” মিয়াগি বলল। “এর জন্য, আমি আপনার ভবিষ্যৎ আন্দাজ করে আপনাকে সতর্ক করে দিতে পারবো।”
আমি মাথা চুলকাতে লাগলাম। মেয়েটাকে কিছু একটা বলে উত্তর দিতে চাইছিলাম।
“দেখো হয়তো বা তুমি আমাকে একথা বলছ কারণ, তুমি ভাবছ আমি আঘাত পেয়ে আশা হারিয়ে ফেলবো। কিন্তু আমার আঘাত পাওয়ার এবং আশা হারানোর কারণ কিছুতেই বলতে পারো না তুমি? হ্যাঁ… যেমনটা, আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি ভাবছ আমি যদি তোমার কাছ থেকে সরাসরি না শুনে হিমেনোর কাছ থেকে শুনি, আমি আরও বেশি আঘাত পাবো। তুমি খুব বেশি অনধিকারচর্চা করে ফেলছ।”
মিয়াগি ক্লান্তভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। “তাই নাকি। ঠিক আছে, আমার উদ্দেশ্য ভালোই ছিল। কিন্তু এটাই যদি ঘটনা হয় তাহলে… হয়তো আমি জোরপূর্বক বেশি অনধিকারচর্চা করে ফেলেছি। আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত।”
ও খুব দ্রুত বো করল।
“…কিন্তু আমি একটা কথা বলবো। সামনে যা ঘটবে তা নিয়ে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না। নিজের আয়ু বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে আপনার সামনে যে জগতটা অপেক্ষা করছে সেখানে যুক্তির কোনো বালাই নেই। মুক্ত চিন্তা কিংবা স্বাধীন সিদ্ধান্তের আশা করাটাও বোকামি। কারণ, স্বেচ্ছায় এই পথটা বেছে নিয়েছেন আপনি” এটুকু বলে ঘরের কোণায় ফিরে গেল মিয়াগি।
“আপনাকে আর জ্বালাতন করবো না। আপনার এই ‘কষ্ট আর আশাহীনতার কারণটা দূর করার জন্যেই এসেছিলাম। তালিকার বাকি কাজগুলো যেভাবে ইচ্ছে করতে পারেন। অন্যদের যাতে অসুবিধে না হয়, সেই বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।”
আমাকে বলতে হবে না, আমি ভাবতে লাগলাম।
মিয়াগির মলিন চেহারাটা আমি ভুলে যাইনি।
কিন্তু সেটার মানে কী হতে পারে, এই নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করিনি আমি।