চ্যাপ্টার ৭ : টাইম ক্যাপসুল রাইডিং

চ্যাপ্টার ৭ : টাইম ক্যাপসুল রাইডিং

আমি যখন উইল লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম, খুব দ্রুতই লক্ষ করলাম কে এটা পড়বে; সেটা অনুমান না করে আমি কিছুতেই লিখতে পারছি না।

কাছের একটা স্টেশনারী থেকে কিনে আনা কলমটা ধরে রেখে, কী লিখবো সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ চিন্তা করতে লাগলাম।

বাইরের বিদ্যুতের খুঁটিতে ঘুর্ঘুরে পোকা অবস্থান নিয়েছে। বজ্জাতগুলো এতটাই আওয়াজ করতে লাগল যে মনে হচ্ছে ওরা ঘরের ভিতরে থেকে ডাকছে।

ঘুর্ঘুরে পোকা যখন ওখানে ছিল, কলম একটুও না নড়াতে পারার জন্য খুব সহজে ওদের উপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু ওগুলো উড়ে যাওয়ার পরেও; একটি শব্দও লিখতে পারলাম না।

কে আমার এই উইল পড়বে বলে আশা করছি আমি? একটা উইলের মানে হলো মৌলিকভাবে যোগাযোগের মাধ্যম। এমন কারো কাছে আমার সম্পর্কে এমন কিছু লিখতে হবে যা ওরা অন্যথায় দেখতে পেত না। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন আমার অন্য কাউকে বলতে হবে? অবশ্যই, তৎক্ষণাৎ আমার ছোটবেলার বন্ধু হিমেনোর কথা মনে পড়ল। তো এই উইলে হিমেনোর প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকবে নাকি আমার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি?

পরীক্ষামূলকভাবে, ওকে একটা চিঠি লিখতে আমার এক ঘণ্টা লাগল। যখন আমি শেষ করলাম সংক্ষেপে যা দাঁড়াল:

তুমি এই মুহূর্তে আমার সম্পর্কে কী ভাবছ আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে দশ বছর আগের সেদিন থেকেই ভালোবেসে এসেছি। আমি বিশ বছর পর্যন্ত টিকে ছিলাম কারণ, তোমার সাথে থাকার মুহূর্তগুলো আমার সাথে ছিল বলে। আমি বিশ বছরের পরে টিকে থাকবো না কারণ, আমি তোমাকে ছাড়া পৃথিবী কল্পনা করতে পারবো না।

এখন মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, আমি বুঝতে পেরেছি। আমি অনেক বছর আগেই মরে গিয়েছি। যেদিন থেকে তোমার আমার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল।

বিদায়, আমি প্রার্থনা করছি দশ বছরের আমি তোমার ভিতরে কিছুটা হলেও বেশ কিছুদিন টিকে থাকবে।

চিঠিটা আরেকবার পড়ে, আমি ভেবে দেখলাম; চিঠিটা মেইল করা যাবে না। কোথাও একটা ভয়ঙ্কর ঝামেলা আছে।

এর মাধ্যমে আমি এরকম কিছু বলতে চাইনি। আমি যা বলতে চাই সেটা লেখাও আমার মৃত্যুর আগে বলতে গেলে অসম্ভব।

আমার মনে হয় শেষ লাইনে আমার অভিপ্রায় ফুটে উঠেছে। হিমেনোর প্রতি দশ বছরের আমাকে আরেকটু মনে রাখার অনুরোধ

এটাই যদি হয় আমার চিঠি লেখার উদ্দেশ্য তাহলে মনে হচ্ছে, আমার উচিত কোনো কিছু না লেখা।

যদি হিমেনোকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো হয় এবং আমি যদি প্রেরক হই তাহলে যে-কোনো খাম হলেই চলবে। এটাই যথেষ্ট। এতে ন্যূনতম ভুল বুঝাবুঝিও হবে না।

যদিও একটা খালি শিট দেখতে বেশি অদ্ভুত লাগে, তাহলে একটি বাক্যে লিখতে পারি: “আমি এই চিঠিটা লিখতে চেয়েছিলাম।”

অথবা আরেকটা উপায় হলো আমার মৃত্যু নিয়ে একদমই কথা না বলা। তার বদলে প্রতিদিনকার সাধারণ কথাবার্তা সম্পর্কে লেখা। আমি কলমটা টেবিলে নামিয়ে রেখে চিঠিটা দুমড়েমুচড়ে দিলাম। যাতে মিয়াগি চিঠিটা পড়তে না পারে। তারপরে সিলিংয়ে ছুঁড়ে দিলাম।

…যাহোক, শেষ কবে আমি চিঠি লিখেছি? স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম।

চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা প্রচলিত কোনো বিষয় নয়। এলিমেন্টারি স্কুলের পর থেকে আমি কাউকেই নিউ ইয়ারের কার্ড কিংবা এরকম কিছু পাঠাইনি। আমার সম্পূর্ণ জীবনে আমি হাতেগোনা অল্প কয়েকটি চিঠিই লিখেছিলাম।

সতেরো বছর বয়সে বাদে, আমার লেখা শেষ চিঠি ছিল- চতুর্থ গ্রেডের গ্রীষ্মে।

সেই গ্রীষ্মে, যখন আমার দশ বছর বয়স ছিল, আমাদের সম্পূর্ণ ক্লাস জিমের পিছনে একটা টাইম ক্যাপসুল পুঁতে রেখেছিল। এটা ছিল নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া সেই শিক্ষিকার পরামর্শ। যিনি কিনা আমাকে প্রথমবারে মতো জীবনের মূল্য সম্পর্কে চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন।

ছাত্র-ছাত্রীরা সকলেই গোল ক্যাপসুলে রাখার জন্য চিঠি লিখলো।

“আমি চাই তোমরা এখন থেকে দশ বছর পরের তোমাদের উদ্দেশ্যে চিঠিগুলো লিখ” তিনি বলেছিলেন। “যেহেতু আমি হঠাৎ করেই বলেছি, আমি জানি হয়তো তোমরা নিশ্চিত নও কী লিখবে, তোমরা যে কোনো কিছু লিখতে পারো যেমন ‘তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে?’ অথবা ‘তুমি কি সুখী?” অথবা ‘তুমি কি এটা মনে করতে পারছ?’ অথবা ‘তুমি আমাকে কী বলতে চাও?’ অনেক অনেক কিছুই আছে জিজ্ঞেস করার মতো। তুমি এমনকি তোমার নিজের আশার কথাও লিখতে পারো। যেমন ‘দয়া করে আমার স্বপ্ন সত্যি করো” অথবা ‘দয়া করে সুখী থেকো’ অথবা ‘দয়া করে এই সম্পর্কে ভুলে যেয়ো না।’”

উনি অনুমানও করতে পারেননি যে এক দশক পরে, বাচ্চাদের মধ্যে কয়েকজন তাদের স্বপ্নের পেছনে ছোটা ছেড়ে দিবে। কয়েকজন সুখী হবে না এবং অনেকেই এই সম্পর্কে ভুলে যাবে।

সম্ভবত এটা ভবিষ্যতের তোমার জন্য লেখা চিঠি নয়। কিন্তু তখন চিঠিটা লেখা হয়েছে সেই সময়ের তোমার জন্য।

তিনি আরও বলেছিলেন।

“চিঠির শেষে, দয়া করে লিখে দিয়ো এই মুহূর্তে তোমার সেরা বন্ধু কে… ওরা তোমার সম্পর্কে কী ভাববে এই নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করো না। যদি এরকম কিছু হয় তাহলে, ‘ওরা আমাকে ঘৃণা করে, কিন্তু আমি ওদের পছন্দ করি!’ দয়া করে এইটুকু লিখো। চিন্তা করো না, আমি নিশ্চিত করলাম কেউই দেখবে না, এমনকি আমিও না।”

নিজেকে উদ্দেশ্য করে কী লিখেছিলাম মনে করতে পারছি না। এমনকি মনেও করতে পারছি না কার নাম লিখেছিলাম।

টাইম ক্যাপসুল দশ বছর পরে তোলার কথা ছিল। আর সেটা এই বছর। কিন্তু আমি এখনো এই সম্পর্কে তেমন কিছুই শুনিনি।

এমনও হতে পারে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। ওরা আমার সম্পর্কে ভুলে গিয়েছে। এই সম্ভাবনাই বেশি।

মৃত্যুর আগে আমার ক্লাসমেটরা কী লিখেছে সেটা পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোনো ক্লাসমেটের সাথে দেখা করে নয়। শুধু আমি একা।

“আজকের দিন কিভাবে কাটাবেন বলে স্থির করেছেন?” মিয়াগি জিজ্ঞেস করল।

“টাইম ক্যাপসুলে চড়ে” আমি উত্তর দিলাম।

*********

প্রায় এক বছর পরে আমার নিজ শহরে ফিরে এসেছি। তালিজোড়া দেওয়া জীর্ণ কুটিরের মতো স্টেশনটা সামনে আসতেই পরিচিত বেশ কিছু দৃশ্য দেখতে পেলাম।

সবুজ পাহাড়ের শহর। পোকামাকড়ের ডাক এবং সবজির উগ্র গন্ধ। বর্তমানে যেখানে বাস করি তার সাথে এ-জায়গার তুলনা করা যায় না। এমনকি কান পেতেও, আমি পোকা এবং পাখির ডাক ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না।

“অবশ্যই আপনি ছিঁচকে চোরের মতো দিনে দুপুরে এলিমেন্টারি স্কুলে ঢুকে গর্ত অন্তত করবেন না?” আমার পেছনে হাঁটতে-হাঁটতে মিয়াগি জিজ্ঞেস করল।

“অবশ্যই না, আমি রাতের জন্য অপেক্ষা করবো।”

আমি আবেগের বসে এতদূর এসে পড়েছি। সন্ধ্যা নামার আগে কিভাবে কোনো চিত্তবিনোদন এবং রেস্টুরেন্ট ছাড়া সময় কাটাবো, সে সম্পর্কে চিন্তা করিনি।

এমনকি হাঁটা দূরত্বেও কোনো কনভেনিয়েন্স স্টোর নেই। উচিত ছিল আমার মোপডটা নিয়ে আসা। যদিও এটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল।

যতই হাতে নষ্ট করার মতো সময় থাকুক, বাবা-মা’র বাসায় যাওয়ার কোনো ইচ্ছা-ই ছিল না আমার। কোনোবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করাও বলতে গেলে সম্ভব না।

“আপনার হাতে যদি বেশ সময় থাকে তাহলে আপনার উচিত অতীতের স্মৃতি বিজড়িত কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসা?” মিয়াগি পরামর্শ দিলো। ‘ধরুন, এমন সব জায়গা যেগুলোতে আপনি ছোটবেলায় যেতেন কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যান না।”

“আমার অতীতের স্মৃতি বিজড়িত জায়গা, হাহ… এখানে আমি তেমন ভালো কোনো অতীত অতিবাহিত করিনি।“

“মিস. হিমেনো বাদে, ধরে নিচ্ছি।”

“এত সস্তাভাবে ওর নাম উচ্চারণ করবে না। আমি সত্যি ওর নাম তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই না।”

“তাই নাকি। এরপর থেকে আমি আরও সতর্ক থাকবো। যা হোক, আমি যদিও নাক গলাতে চাই না তবুও আমার উপদেশ হচ্ছে কারো সাথে দেখা না করাই উত্তম।”

“সেরকম কোনো ইচ্ছাও নেই।”

“ভালো, আপনি যদি তাই বলে থাকেন” মিয়াগি বলল। কিছুটা নরম হয়ে।

সূর্যের আলো আমার চামড়া ভেদ করে ঢুকে যেতে লাগল। আরেকটি আগুনের মতো উত্তপ্তগরম দিন হতে যাচ্ছে। স্টেশনের বাইরের বেঞ্চে বসে আগপিছু চিন্তা করতে লাগলাম।

হঠাৎ পাশে তাকাতেই মিয়াগিকে সানস্ক্রিন মাখতে দেখলাম। আমি সবসময়ই ভেবে এসেছি ও সত্যিই উজ্জ্বল ত্বকের মেয়ে। ও সম্ভবত সেটাই ধরে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

ও এটা নিয়ে এতটাই সিরিয়াস ছিল যে, আমি আশা করেছিলাম ওর বাহ্যিক উপস্থিতি অন্যরকম হবে। সেজন্য বিষয়টা আমার কাছে বিস্ময়কর লাগল।

“আমি ছাড়া বাকি সবার কাছে না তুমি অদৃশ্য?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

“সবসময়?”

“হ্যাঁ। আমাকে একমাত্র তারাই দেখতে পায়; যাদের আমি পর্যবেক্ষণ করি। যাহোক, আপনি তো জানেনই, অনেকক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যখন প্রথম দোকান গিয়েছিলেন। আমি তখন পর্যবেক্ষণের ডিউটিতে ছিলাম না। আমাকে শুধু তারাই দেখতে পেত যারা আয়ুষ্কাল, সময়, অথবা স্বাস্থ্য বিক্রির চিন্তা-ভাবনা করছে। কোনো সমস্যা নাকি?”

“নাহ। আমি ভাবছিলাম কেউ যদি তোমাকে নাইবা দেখে তাহলে তোমার বাহ্যিক উপস্থিতি নিয়ে এত হৈচৈ করার কী আছে।“

অপ্রত্যাশিতভাবে, মিয়াগি মনে হচ্ছে মন্তব্যটাকে আক্রমণ হিসাবে নিলো।

“আমি এটা আমার নিজের জন্য করি” মিয়াগি এমনভাবে উত্তর দিলো যেন কষ্ট পেয়েছে। “কারো সাথে দেখা করার পরিকল্পনা না থাকলে আপনি গোসল করেন না নাকি?”

ও সত্যিই রাগ করেছে বলে মনে হচ্ছে। যদি অন্য কোনো মেয়ে হতো, আমি এতক্ষণে ক্ষমা চেয়ে নিতাম। কিন্তু ওকে আঘাত দিতে পেরেছি বলে আমি খুব খুশি। আমি চাচ্ছিলাম ও আমার অসাবধাণতাবসত করা মন্তব্য সম্পর্কে সমালোচনা করুক।

কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করে এদিক-সেদিক ঘুরতে-ঘুরতে আমার পা আমাকে; আমার এবং হিমেনোর পুরাতন বাসস্থানের নিকট নিয়ে গেল। যেখানে আমরা ছোটবেলায় প্রায়ই খেলাধুলা করতাম।

কিভাবে মিয়াগির পরামর্শের ফাঁদে পড়লাম তা চিন্তা করে অনুতাপ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমার কাজ-কারবার কী রকম বিরক্তিকর এবং সাধারণ; তা মনে করে ও নিশ্চয় মনে মনে উৎফুল্ল হচ্ছে।

বেশ কয়েকটি বাঁক নিয়ে আমার বাবা-মায়ের বাসা থেকে দূরে থাকার জন্য চেষ্টা করলাম। আমি একটা ক্যান্ডি স্টোরে গেলাম; যেখানে প্রায়ই যেতাম। কিন্তু দোকানটা বন্ধ ছিল এবং চিহ্নটা উধাও হয়ে গিয়েছিল।

ঘন ঝোপের ভিতর দিয়ে পথ করে আমি হাঁটতে লাগলাম। তারপরে ট্রেইল ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটার পরে আমার গন্তব্যে পৌঁছলাম।

সেখানে একটা ভাঙাচুরা বাস ছিল যেটা কিনা হিমেনো এবং আমার জন্য তথাকথিত “গোপন আস্তানা” হিসাবে কাজ করেছিল আমাদের কৈশোরে।

দূর থেকে বাসের অবশিষ্ট লাল রং-কে মরিচার মতো লাগছিল। কিন্তু যদি ভিতরে গিয়ে, সিট এবং মেঝের বালির স্তূপ উপেক্ষা করা যায়, তবে এটা অপ্রত্যাশিতভাবে সুন্দর লাগবে। মনে হচ্ছে আমি পোকামাকড়ের সাথে হামাগুড়ি দিচ্ছি। আসলে বলতে গেলে একটাও পোকা দেখিনি আমি।

আমি সম্পূর্ণ বাস ঘুরে বেড়াতে লাগলাম হিমেনো এবং আমার চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুই খুঁজে না পেয়ে; যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, অবশেষে ড্রাইভার সিটে কিছু একটা লক্ষ করলাম।

সিটের দিকে নীল স্থায়ী মার্কার দিয়ে কিছু একটা লেখা হয়েছে। খুব কাছ থেকে জিনিসটা দেখে বুঝতে পারলাম এটা একটা অ্যারো।

প্রায় ছয়টা অ্যারো দ্বারা দিক-নির্দেশ করার পরে অবশেষে, একটি সিটের পিছনে যা খুঁজছিলাম সেটা দেখতে পেলাম। দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা আই- আই-গাসা। একটা হাস্যকর এলিমেন্টারি স্কুলের খেলা; যেখানে নিজের নাম এবং যাকে গোপনে ভালোবাসে তার নাম একটা ছাতার নিচে লিখতে হয়।

স্বাভাবিকভাবেই, আমার এবং হিমেনোর নাম লেখা ছিল ছাতার নিচে। এরকম কিছু আঁকার স্মৃতি মনে পড়ছে না আমার। শুধুমাত্র হিমেনো এবং আমি এই জায়গাটা সম্পর্কে জানতাম। তো সেই হিসাবে এটা হিমেনোই হবে।

এমন মেয়েলি জিনিস ও করবে বলে আমি কখনো ভাবতেও পারিনি। তবুও আমার ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠল।

আমি ছাতাটার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মিয়াগি পেছন থেকে সব দেখতে লাগল। কিন্তু কোনো ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করল না।

চোখ জ্বলা শুরু হলে আমি বাস থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট থাকা অবস্থায় যা করতাম, একটা উপড়ে পড়া গাছ বেয়ে ছাদে উঠলাম। কিছু ঝরা পাতা সরিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম।

আমার দাদুর কবর থেকে ঘুরে আসতে আসতে রাত হয়ে গেল।

তারপরে এলিমেন্টারি স্কুলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম।

শেড থেকে একটা শাবল ধার নিয়ে জিমের পিছেন গেলাম। জিনিসটা কোথায় আছে তার একটা মোটামুটি ধারণা নিয়ে খুঁড়তে শুরু করলাম। এলিমেন্টারি এক্সিটের সবুজ আলো আমার চারপাশ উদ্ভাসিত করে তুলল।

ভেবেছিলাম যা খুঁজছিলাম সেটা খুব সহজে পেয়ে যাবো। কিন্তু হয় আমার স্মৃতি আমার সাথে প্রতারণা করেছে অথবা ইতোমধ্যে জিনিসটা খুঁড়ে বের করে নেওয়া হয়েছে। আমি প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ খুঁড়ে যাচ্ছি, বিনিময়ে পেলাম শুধু প্রচুর ঘাম। কোনো টাইম ক্যাপসুল পেলাম না।

গলা শুকিয়ে গিয়েছে। হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে। গতকালের ব্যাটিং সেন্টারে কাটানো সময় সেই প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করল। মিয়াগি আমার পাশে বসে গর্ত খুঁড়তে দেখতে দেখতে ওর নোটবুকে কিছু একটা লিখতে লাগল।

ধূমপান করার জন্য বিরতি নিতেই অবশেষে আমার স্মৃতি ফিরে এলো। ঠিক, আমরা ওটাকে জিমের পিছনের গাছের নিচে পুঁততে নিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ একজন তখন বলেছিল যে একটা নতুন গাছ হয়তো রোপণ করা হতে পারে, তো একারণে আমরা অন্য কোথাও পুঁতেছিলাম।

ব্যাকস্টপের পেছনে প্রায় দশ মিনিট খোঁড়াখুঁড়ির পরে শক্ত কিছুতে আঘাতের আওয়াজ পেলাম। সতর্কতার সাথে গোলাকার বস্তুটা খুঁড়ে বের করলাম যাতে কোনো প্রকার ক্ষতি না হয়। তারপরে সেটা আলোয় নিয়ে এলাম। ভেবেছিলাম এটা হয়তোবা লক করা থাকবে, কিন্তু এটার মুখ খোলা ছিল।

আমার মূল পরিকল্পনা ছিল শুধু আমার নিজের চিঠিটা নিয়ে বাকিগুলা আগের জায়গায় রেখে দিবো। কিন্তু এত কষ্টের পরে, সবগুলো চিঠি খুলে দেখার ইচ্ছে হলো। কয়েক মাস পরে মারা যাওয়া একজন ব্যক্তির নিশ্চয় এইটুকু করা জায়েজ।

এলোমেলোভাবে একটা তুলে নিয়ে খুললাম। আমি শুধু “ভবিষ্যতের তোমাকে” এবং “ভালো বন্ধু” অংশটা পড়লাম।

পড়া হয়ে গেলে একটা নোটবুক খুললাম। চিঠির লেখকের নাম লেখলাম এবং ওদের বেস্ট ফ্রেন্ডের নামের দিকে অ্যারো চিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করলাম। 

আরও বেশ কিছু চিঠির এরকম পুনরাবৃত্তি করার পরে, নামের সংখ্যা এবং অ্যারোর সংখা বাড়তে লাগল। ধীরে-ধীরে একটা রিলেশনশীপ চার্ট তৈরি করল। কে কাকে পছন্দ করে, কাকে কে পছন্দ করে। কোনটা প্রয়োজন, কোনটা প্রয়োজন নেই।

যেমনটা আমি আশা করেছিলাম, সমস্ত চিঠি পড়া শেষে দেখলাম, চার্টের একমাত্র একাকী নামটা ছিল আমার। একজনও আমাকে ওদের “ভালো বন্ধু” হিসাবে বাছাই করেনি।

এবং যখন আমি টাইম ক্যাপসুলে হিমেনোর চিঠি খুঁজলাম, ওটা খুঁজে পেলাম না। হয়তোবা এমন হতে পারে সেদিন ও স্কুলেই আসেনি।

যদি ও আসতো তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমার নাম লিখতো, আমি ভাবলাম। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের গোপন আস্তানায় ও গোপনে আমাদের নাম দিয়ে আই-আই- গাসা এঁকেছে। ও নিশ্চিতভাবেই আমার নাম লিখতো। হয়তোবা দুই একটা হৃদয়ও আঁকতো।

যদি হিমেনোর চিঠিটা এখানে থাকতো।

আমার নিজের চিঠিটা জিন্সের পকেটে পুরে নিয়ে টাইম ক্যাপসুলটা আবার পুঁতে দিলাম। শাবলটা জায়গামতো রেখে দিলাম। হাত এবং মুখ ধুয়ে ফেললাম কাছের কল থেকে। তারপরে স্কুল ত্যাগ করলাম।

ক্লান্ত শরীরটা রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগলাম আমি। মিয়াগি পিছন থেকে কথা বলে উঠল।

“আশা করবো আপনি এখন বুঝতে পেরেছেন। অতীতের সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরা উচিত নয় আপনার। তার উপরে, আপনি কারো সাথেই সম্পর্ক রাখেননি। মিস. হিমেনো স্কুলে পরিবর্তন করার পরে কি আপনি একটি চিঠিও উনাকে লিখেছিলেন? হাই স্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন করার পরে আপনি কি একবারও মি. নারুসের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন? কেন মিস. ওকাভা আপনাকে পরিত্যাগ করেছে? আপনি কি কোনো ক্লাস রিইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলেন? মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য দুঃখিত, আপনার কি মনে হয় না এখন অতীত আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়ে খুব বেশি কিছু চেয়ে ফেলছেন?”

চরম সত্যি কথাগুলো শুনে আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেল। কিন্তু ওকে ফিরতি বলার মতো তেমন কিছুই নেই আমার।

হয়তো মিয়াগি ঠিকই বলেছে। আমি যা করছি তা অনেকটা এরকম যে, কোনো স্রষ্টায় বিশ্বাস করি না, কিন্তু খারাপ সময়ে শুধু সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য মন্দির, মঠে এবং চার্চে যাই।

কিন্তু যদি এটাই ঘটনা হয়; অতীত এবং ভবিষ্যৎ আমার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, আমি তাহলে কী করবো?

ট্রেন স্টেশনে ফিরে এসে, আমি টাইম টেবিল দেখলাম। শেষ ট্রেন অনেক আগেই চলে গিয়েছে।

যখন এই এলাকাতে ছিলাম খুব একটা ট্রেন ব্যবহার করতাম না। কিন্তু এরকম গ্রাম্য পরিবেশের শেষ ট্রেন এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে আশা করিনি।

ট্যাক্সি ডাকতে পারি। ব্যাপারটা এরকমও না আমি বাবা-মা’র ওখানে যেতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত আমি স্টেশনেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

এভাবে চিন্তা করে দেখলে, আমি বরং মানসিক যন্ত্রণা থেকে শারীরিক যন্ত্রণা পেতে আগ্রহী। নিজেকে যথেষ্ট কষ্ট দিয়ে আমার মনোযোগ সেদিকে ঘুরিয়ে নিতে পারি।

শক্ত বেঞ্চে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। ফ্লুরোসেন্ট লাইটের সাথে আচমকা ঠুকে যাওয়া পোকাদের অবিরাম আওয়াজ হতে লাগল।

ভাবতেই পারিনি পরিশ্রান্ত থাকার কারণে ঘুম আসবে না। সাথে যোগ হয়েছে অদ্ভুত আলোকসজ্জা। পোকাগুলো আমার পায়ের তলায় ঘোরাফেরা করছে। আমি জানি শান্তিতে বিশ্রাম নেওয়ার আমার কপালে নেই।

পিছনের বেঞ্চ থেকে মিয়াগির কলম চলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি ওর সহনশীলতা দেখে অবাক হলাম। আমাকে পর্যবেক্ষণ করা দিনগুলোতে ও খুব বেশি ঘুমানোর সুযোগ পায়নি।

দেখে মনে হচ্ছে এমনকি রাতেও সে এক মিনিট ঘুম তো পাঁচ মিনিট সজাগ থাকার চক্রে আছে। ওর নিশ্চয় আরও কোনো উপায় নেই। ওর মতো কম বয়সি একটা মেয়ের জন্য পর্যবেক্ষকের কাজ একটু বেশি কঠোর চাকরি।

অবশ্যই ব্যাপারটা এরকম না আমি ওর প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আমি শুধু কামনা করছি ও যেন চাকরি করা বন্ধ করে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *