চ্যাপ্টার ১২ : অ্যা লায়ার অ্যান্ড অ্যা লিটল প্রেয়ার
মিয়াগি যখন পর্যবেক্ষক হিসাবে প্রথম আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসেছিল, আমি ওর চাহনী দেখে বিচলিত হয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল “যদি আমার পর্যবেক্ষক ঠিক ওর বিপরীত হতো; কুৎসিত, নোংরা এবং মধ্যবয়সী কেউ তবে আমি নিশ্চিত, আমি আরও বেশি আয়েশ করতে পারতাম এবং যা করার দরকার ঠিক সেটাই করতে পারতাম।”
মিয়াগির বদলে আমার সামনে যে পর্যবেক্ষক দাঁড়িয়ে আছে তিনি বলতে গেলে সেরকমই।
লোকটি খাটো, মাথায় টাক, মুখটা লাল আর তেলতেলে; যেন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রয়েছে। লোকটি ঘনঘন চোখ পিটপিট করে। শ্বাস নিতে গেলে হ্রেষাধ্বনি করে। কথা বলতে মনে হয় গলায় শ্লেষ্মা জমে রয়েছে।
“মিয়াগি কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ছুটিতে গিয়েছে” লোকটি স্পষ্টভাবে বলল। “আমি আজকে আর আগামীকাল ওর জায়গায় ডিউটি করবো। “
বুকের উপর হাত রাখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পর্যবেক্ষকরা শিফট অনুযায়ী কাজ করে না; সেজন্য কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম। দুই দিন পরেই মিয়াগি চলে আসবে।
“তাহলে পর্যবেক্ষকরাও ছুটি নেয়” আমি বললাম।
“অবশ্যই নিতে হয়। আপনার মতো তো না। আমাদের অনেক বছর বাঁচতে হবে” লোকটি ব্যঙ্গাত্মক স্বরে উত্তর দিলো।
“হুহ, যাক, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দুদিন পরে ওর ছুটি শেষ হবে। আর সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ, এটাই যন্ত্রণা” লোকটি বলল।
আমি ঘুমাকাতুরে চোখ ডলে কর্ণারের লোকটির দিকে আবারো তাকালাম। লোকটি আমার অ্যালবাম হাতে ধরে আছে। আমার ভেন্ডিং মেশিনের ছবির সকল অ্যালবাম।
“কী বালের জিনিস এগুলা?” লোকটি জিজ্ঞেস করল।
“আপনি কি ভেন্ডিং মেশিন সম্পর্কে জানেন না?” আমি রসিকতা করে বললাম।
“ধ্যাত। আমি বলতে চাচ্ছি ছবিগুলো কেন তুলেছেন?”
“একই কারণে, যে কারণে যারা আকাশ পছন্দ করে বলে আকাশের ছবি তোলে। যারা ফুল পছন্দ করে বলে ফুলের ছবি তোলে। ট্রেন পছন্দ করে বলে যারা ট্রেনের ছবি তোলে। আর আমি ভেন্ডিং মেশিন পছন্দ করি।“
লোকটি বিরক্তি নিয়ে কয়েক পাতা উল্টালো। তারপরে “আবর্জনা” ঘোষণা করে অ্যালবাম আমার দিকে ছুড়ে দিলো।
তারপরে সে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পেপার ক্রেইনে দিকে তাকিয়ে নাক সিটকালো।
“এভাবেই আপনি দিন কাটাচ্ছেন, অ্যাহ। বেকুব কোথাকার। এর চেয়ে ভালো কিছু করার মতো পাননি।“
লোকটার আচরণ মোটেই আমার কাছে বিরক্তিকর লাগল না। সত্যি বলতে গেলে আমি যা ভেবেছিলাম, লোকটার সাথে কাজ করা বেশ সহজ ছিল। কোণা থেকে একটা বস্তুর মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেউ, এটাকেই আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।
“হয়তো পেতাম। কিন্তু আমি যদি এর চেয়ে মজার কিছু করতাম, আমার শরীর হয়তো সেটা নিতে পারতো না” আমি হেসে বললাম।
একইভাবে লোকটা সব কিছুতে খুঁত ধরার চেষ্টা করল। আমি ভাবতে লাগলাম, এই পর্যবেক্ষকটা বেশি আক্রমণাত্মক।
লাঞ্চের পরে যখন ফ্যানের নিচে শুয়ে মিউজিক শুনছিলাম, তখন জানতে পারলাম কেন লোকটা এতটা আক্রমণাত্মক।।
“এই যে, আপনাকেই বলছি” লোকটি বলল, আমি উনার কথা না শোনার ভান করলাম। লোকটি গলা পরিষ্কার করে বলল, “আপনি ওই মেয়েটাকে কোনো কষ্ট দিচ্ছেন নাতো?”
“ওই মেয়েটা” বলতে কাকে বোঝাচ্ছে হিসাব করে দেখলাম তা একজনের দিকেই ইঙ্গিত করে। মিয়াগি সম্পর্কে এভাবে কথা বলবে সেটা আমি লোকটার কাছে আশা করিনি। তাই দেরিতে উত্তর দিলাম।
“সেই মেয়েটা বলতে, আপনি মিয়াগিকে বোঝাচ্ছেন?”
“আর কে?” লোকটি ভূ কুঁচকালো যেন ওর নাম নেওয়াতে নাখোশ হয়েছে। সেটা বুঝতে পেরে, লোকটার প্রতি কিছুটা কোমল হলাম। তাহলে আপনি আমার মিত্র।
“ধরে নিচ্ছি, আপনার সাথে মিয়াগির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“…না। সেরকম কিছু না। আমাদের খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।” লোকটার গলা হঠাৎ স্তিমিত হয়ে এলো। “কাগজপত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র অল্প কয়েকবার কথা হয়েছিল, শুধু এইটুকুই। ওর সময় কেনা মানুষটা হচ্ছি আমি, তো সেজন্য অনেক অনেক দিন আগে, ওর সাথে দশ মিনিট কথা হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম। “
“তো কী মনে হয়েছিল ওকে দেখে?”
“দুর্ভাগা মেয়ে” লোকটি বলল। “সত্যিই, ওর জন্য করুণা হয়।”
লোকটা মনে হলো সত্যি সেটা বুঝিয়েছে।
“আমার আয়ুষ্কাল ওর আয়ুষ্কালকালের সমমূল্যের। বেচারি, তাই না?
“চুপ করুন। আপনি এমনিতেই কয়েকদিন পরে মরে যাবেন।”
“সবকিছু সঠিকভাবে দেখার এটাই সম্ভবত সঠিক উপায়।” আমি সম্মত হয়ে বললাম।
“কিন্তু মেয়েটা, ও এমন জিনিস বিক্রি করেছে যা বিক্রি করা ঠিক হয়নি। ওর বয়স তখন মাত্র দশ বছর ছিল। ওটুকু মেয়ের কাছ থেকে যুক্তিসঙ্গত সমাধানের আশা করাও যায় না। আর এখন বেচারি মেয়েটাকে আপনার মতো মরিয়া লোকজনের সাথে থাকতে হবে।”
“যাহোক, আগের কথাই ফিরে যাই। আপনি ওকে কোনো প্রকার কষ্ট দিচ্ছেন নাতো? আমার প্রশ্নের উত্তরের উপর ভিত্তি করে আপনার জীবনের শেষ কয়েকটা মাস; অনেক আরামদায়ক হতে পারে আবার নরকের আগুনের মতো জ্বলতে পারে।”
আমি ধীরে-ধীরে লোকটাকে আরও বেশি পছন্দ করে বসেছি।
“আমার মনে হয় আমি ওকে বেশ কষ্ট দিয়েছি” আমি সত্যি কথাই বললাম। “আমি ওকে এমন কথা বলেছি যেন ও কষ্ট পায়। প্রায় বলতে গেলে শারীরিক আঘাতের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। তারও কিছুটা আগে আমি প্রায় ওকে ধর্ষণও করে ফেলেছিলাম।”
লোকটার মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল। যখন মনে হচ্ছিল লোকটা যে কোনো মুহূর্তে আমার টুটি চেপে ধরবে; আমি মিয়াগির নোটবুকটা উনার দিকে ছুড়ে দিলাম।
“এটা কী?” লোকটি জিজ্ঞেস করল, নোটবুকটা তুলে নিয়ে।
“ওখানেই আপনার সবকিছু বিস্তারিত পেয়ে যাওয়ার কথা। এটা মিয়াগির পর্যবেক্ষণ লগ। যাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে; সে নিশ্চয় এটা পড়তে পারবে না, তাই না?”
“পর্যবেক্ষণ লগ?” লোকটি থুতু দিয়ে আঙ্গুল ভিজিয়ে নোটবুকটা খুলল।
“আপনাদের চাকরির হিসাব-নিকাশ কিভাবে হয় আমি জানি না। আর আমার মনে হয় না আপনাদের নিয়ম-কানুন খুব কড়া। কিন্তু হতে পারে এটা ফেলে দাওয়ার দরুন মিয়াগির শাস্তি হতে পারে। আমি আসলে সেটা চাচ্ছি না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ওর পক্ষে আছেন। তাই আপনাকে দিলাম।”
লোকটি পাতা উল্টিয়ে যেতে লাগল। দুই মিনিটের মধ্যে তিনি শেষ পাতায় পৌঁছে গেলেন। আর তার পরে মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই বললেন, “ওহ হো।”
ওখানে কী ছিল আমার জানা নেই। কিন্তু এরপর থেকে, লোকটাকে তুলনামূলক কম আক্রমনাত্মক মনে হলো।
মিয়াগি নিশ্চয় আমার সম্পর্কে ভালো কথাই লিখেছে। পরোক্ষ প্রমাণ পেয়ে আমি খুশিই হলাম।
********
আমার যদি সেই মুহূর্তে নোটবুক কেনার আইডিয়া মাথায় না আসতো, আমি এখন এই লেখাটা লেখতাম না।
লোকটাকে মিয়াগির নোটবুক দেখানোর পরে, আমার নিজের একটা নোটবুক থাকার খায়েশ হলো। আমি স্টেশনারী দোকানে গিয়ে সুবামে বি-৫ নোটবুক কিনলাম। সাথে একটা সস্তা ফাউন্টেনপেন। তার পরে চিন্তা করতে লাগলাম কী লেখা যায়।
আমি জানি এই বিকল্প পর্যবেক্ষক থাকার এই দুই দিনই আমার জন্য সুযোগ। মিয়াগি সাথে থাকা অবস্থায় যা করতে পারি না; সেটা করার এখনই সময়।
প্রথম দিকে আমি বিকৃতরুচির কিছু নিয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু মিয়াগির সাথে পরবর্তীতে দেখা হলে এমনকি আমি যদি ধরা নাও খাই, নিজেকে অপরাধীই মনে হবে। মিয়াগিকে দেখাতে চাই না এমন কিছুই করলাম আমি। কিন্তু আরও ভালো উপায়ে।
পুরাতন বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠা থেকে কিভাবে চারতলায় আমার আয়ুষ্কাল বিক্রি করে দিয়ে এসেছিলাম, সেটা থেকে বর্তমান পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সব লিখে রাখলাম।
প্রথম পাতায় স্কুলের শেখা নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে লিখলাম। চিন্তা না করেই আমি জানি পরবর্তী পাতায় আমার কী লেখা উচিত।
প্রথম দিন জীবনের মূল্য সম্পর্কে আমি কি ভাবতাম। একদিন বিখ্যাত কেউ হবো সে-সময়ের আমার সেই বিশ্বাস। হিমেনোর সাথে আমার প্রতিজ্ঞা। বইয়ের এবং সিডির দোকানে আয়ুষ্কালের ব্যবসা সম্পর্কে জানা। সেখানে মিয়াগির সাথে দেখা হওয়া।
শব্দগুলো এক নাগাড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। ধূমপান করতে গিয়ে, খালি ক্যানকে অ্যাশট্রে বানালাম। আর গল্পের মোড় ঘুরাতে লাগলাম।
ফাউন্টেনপেন কাগজের উপরে বেশ আরামদায়ক শব্দ করতে লাগল। ঘরে প্রচুর গরম, গরমে ঘাম চুইয়ে পড়ে অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়ে উঠল।
“কী লিখছেন আপনি?” লোকটি জিজ্ঞেস করল।
“এই মাসে যা যা ঘটেছে সব লিখে রাখছি।”
“মানে কী? কে পড়বে এটা?”
“জানি না। তাতে কিছু যায় আসে না। লেখালেখি আমাকে সবকিছু ঠিকঠাক করতে সাহায্য করে। সবকিছু আমি যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে পারি।“
এমনকি গভীর রাতেও, আমার হাত চলতে লাগল। এটা সুন্দরতম গদ্য হলো না। কিন্তু কী রকম সহজে লিখতে পারছি দেখে আমি নিজেও বিস্মিত হয়ে গেলাম।
ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরে, অবশেষে আমি হঠাৎ করে থামলাম। আজকে আর এরচেয়ে বেশি লিখতে পারবো বলে আমার মনে হয় না।
ফাউন্টেনপেন টেবিলে রেখে কিছুটা তাজা বাতাসের জন্য বাইরে গেলাম আমি। লোকটি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে আমার পেছন-পেছন আসতে লাগল।
বাইরে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কিছুক্ষণ হাঁটার পরে, আমি কোথায় জানি তাইকো ড্রামের আওয়াজ শুনলাম। সম্ভবত কোনো ফেস্টিভ্যালের জন্য অনুশীলন করছে।
“যেহেতু আপনি একজন পর্যবেক্ষক, আপনিও আপনার সময় বিক্রি করেছেন?” আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি যদি হ্যাঁ বলি, আপনি কি আমার প্রতি সহানুভূতিও দেখাবেন নাকি?” লোকটি হ্রেষাধ্বনি করে হাসল।
“হ্যাঁ। দেখাবো।”
লোকটি আমার দিকে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকাল। “আসলে, পারলে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতাম। কিন্তু সত্যি বলতে আমি কোনো আয়ুষ্কাল, কোনো সময়, কোনো স্বাস্থ্য বিক্রি করিনি। আমি চাকরিটা করছি কারণ, ‘আমি কাজটা করতে চাচ্ছি তাই।’
“বাজে অভিজ্ঞতাই বলতে হবে। এতে মজার কী আছে?”
“খুব মজার কিছু তা বলবো না। এটা অনেকটা মানুষের কবর ভ্রমণ করার মতো। আমিও কোনো একদিন মারা যাবো। যতদিন পারি আরও বেশি মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিতে চাই।”
“একেবারে বুড়ো লোকজনের ধ্যান-ধারণা।”
“হ্যাঁ, কারণ, আমি বুড়ো।” লোকটি বলল।
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আমি গোসল করলাম। বিয়ার খেলাম, দাঁত মাজলাম, তার পরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আবারো পাশের ঘরে থেকে আওয়াজ আসতে লাগল। তিন কিংবা চারজন লোক জানালা খুলে কথা বলছে।
মনে হচ্ছে ওখানে রাত-দিন সবসময় অতিথি থাকে। আমার রুমের সাথে তুলনা করতে গেলে যা বিশাল পার্থক্য গড়ে দিবে; যেখানে আমার রুমে আছে শুধু পর্যবেক্ষক।
আমি হেডফোনের মতো দেখতে কানবন্ধনী পরলাম। বাতি নিভিয়ে বন্ধ করলাম চোখ।
হয়তো আমার মস্তিষ্ককে ধন্যবাদ দিতে হয় কারণ, ওটা সাধারণত আমি ব্যবহার করি না। একবারের জন্যও না জেগে, আমি পাক্কা এগারো ঘণ্টা ঘুমালাম।
পরেরদিনও আমি নোটবুক লিখে কাটালাম। রেডিয়োতে বেসবল নিয়ে কথা হচ্ছিল। সন্ধ্যার মধ্যে আমি বর্তমান কাল পর্যন্ত চলে এলাম।
হাত থেকে কলম খসে পড়তেই আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল। কবজি এবং হাতের মাসল ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। মাথা ব্যথা করতে লাগল আমার। ঘাড়ের ব্যথাযুক্ত স্থানে ডলতে লাগলাম।
তবুও কোনো কিছু সম্পন্ন করার অনুভূতি অতটা খারাপ লাগল না। সেই সাথে, স্মৃতিগুলো শব্দের মাধ্যমে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়াতে স্মৃতিগুলো জমা করতে সুবিধা হবে, আর খারাপ স্মৃতিগুলো মেনে নেওয়া সহজ হবে।
আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম। তার পরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা বড় কালো দাগ দেখতে পেলাম, জানিনা সেটা কিভাবে ওখানে এলো। একটা পেরেক দেয়াল থেকে বেরিয়ে আছে। এমনকি কর্ণারে মাকড়সার জালও দেখা গেল।
স্থানীয় মাঠে মিডেল স্কুলের একটা বেসবল খেলা দেখার পরে, মার্কেটের একটা মেলা ঘুরে দেখে, একটা ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে লেফট-ওভারিস ডিনার খেলাম।
ভাবতে লাগলাম, মিয়াগি আগামীকাল ফিরে আসবে।
আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। খোলা নোটবুকটা বন্ধ করে বুকসেলফে রেখে বিছানায় গিয়ে উঠলাম।
তখন বদলি পর্যবেক্ষক কথা বলে উঠল।
“এটা আমি প্রায় সবাইকেই জিজ্ঞেস করি, যে টাকা পেয়েছেন সেটা দিয়ে কী করেছেন?”
“পর্যবেক্ষণ লগে বলা নেই?”
“বিস্তারিত পড়িনি”
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতে হাতে সবাইকে বিলি করে দিয়েছি” আমি উত্তর দিলাম। “জীবনযাপনের জন্য কিছুটা ব্যবহার করেছিলাম, কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল নির্দিষ্ট একজনকে দিয়ে দেওয়া। কিন্তু সে পালিয়ে গিয়েছে, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম অপরিচিত লোকজনকে বিলিয়ে দিবো।”
“হাতে হাতে?”
“হ্যাঁ। হেঁটে হেঁটে ১০,০০০ ইয়েনের বিল বিলিয়েছি।”
লোকটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
“মজার, তাই না?” আমি বললাম। কিন্তু লোকটি মৃদু হেসে উত্তর দিলো, “না। আমি একারণে হাসিনি।”
হাসিটা ছিল অদ্ভুত। মনে হচ্ছে না লোকটি মজা পেয়ে হাসছে।
“আসলেই আপনি আয়ুষ্কাল বিক্রির সম্পূর্ণ টাকা অচেনা মানুষজনকে মুফতে বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন?”
“তাই করেছি আমি।” আমি বললাম।
“আপনার মতো গাধাকে নিয়ে কোনো আশা নেই।”
“ঠিক। এরচেয়ে অনেক অনেক ভালো উপায় ছিল টাকাটা ব্যবহার করার। ৩০০,০০০ ইয়েন দিয়ে অনেক কিছুই করা যেত। “
“না। একারণেও আমি আপনার সাথে মজা নিচ্ছি না।”
লোকটির কথার মাঝে কিছু একটা ছিল।
তার পরে অবশেষে সে বলল।
“আপনি সত্যি সত্যি বলুন তো, আপনি সত্যিই ভেবেছিলেন আপনার আয়ুষ্কালের মূল্য ৩০০,০০ ইয়েন?”
প্রশ্নটা আমাকে একদম ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো।
“কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?”
“আর কী বলবো? আমি যা বলেছি সেটাই বুঝাচ্ছি। আপনাকে কি সত্যিই বলা হয়েছিল আপনার আয়ুষ্কালের দাম ৩০০,০০০ ইয়েন? আর আপনি, অ্যা, অ্যা, হাহ। একদম ঠিক, পুরো ৩০০,০০০ ইয়েন নিয়ে নিলেন?”
“হুহ… হ্যাঁ। প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম খুব কম।”
লোকটা হাসতে-হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
“ঠিক, ঠিক, আসলে, আমি কিছুই বলতে চাই না, কিন্তু…” লোকটি পেট ধরে, এখনো হাসতে লাগল।
“পরেরবার মেয়েটার সাথে দেখা হলে, ওকে জিজ্ঞেস করবেন। আপনার আয়ুষ্কাল কী সত্যিই ৩০০,০০০ইয়েন নাকি?”
আমি লোকটাকে আরও প্রশ্ন করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটি দেখা গেল আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আগ্রহী না।
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ঘরে ঘুমাতে না পেরে, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
লোকটার কথার অন্তনিহিত অর্থ চিন্তা করতে লাগলাম।
******
“শুভ সকাল, মি. কুসুনোকি।”
জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোতে আমার ঘুম ভেঙে যেতেই মিয়াগি বলে উঠল।
রুমের কোণা থেকে আমাকে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দেওয়া মেয়েটা আমার সাথে মিথ্যা বলেছে।
“আজকের দিন কিভাবে কাটাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”
মুখ থেকে কথা বের হতে গিয়েও কথাগুলো গিলে ফেললাম আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এমন ভান করবো যেন কিছুই জানি না। আমি জানি সত্যটা মিয়াগিকে বিপদে ফেলে দিবে।
“যেভাবে সাধারণত কাটাই” আমি উত্তর দিলাম।
“ধরে নিচ্ছি ভেন্ডিং মেশিন ট্যুর দিয়ে” মিয়াগি খুশি-খুশিভাবে বলল।
আমরা বলতে গেলে সর্বত্র ঘুরে বেড়ালাম। নীল আকাশের নিচে, ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে, আঁকাবাঁকা গ্রামীণ পথ দিয়ে।
আমরা রাস্তার পাশের একটা স্টেশন থেকে সল্ট-ব্রয়েল্ট কার এবং সফট- সার্ভ আইসক্রিম খেলাম। তার পরে দরজাওয়ালা অনেকগুলো বিল্ডিং এবং অনেকগুলো ভেন্ডিং মেশিন-সহ, একইসাথে জনমানবহীন একটা অদ্ভুত রাস্তায় ছবি তুললাম।
চোখের পলকে রাত নেমে এলো।
আমরা একটা ছোট বাঁধের সামনে কাব থামালাম। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটা হাঁটা-পথে উঠে এলাম।
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
আমি হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞেস করলাম, “যদি আমি তোমার সাথে প্রতারণা করে ভয়ানক কোথাও নিয়ে যাই, কী করবে তুমি?”
“মানে আপনি এমন কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন সেখান থেকে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়?” মিয়াগি বুঝদারের মতো বলল।
“তুমি ভুল বুঝেছ” আমি বললাম। কিন্তু ও যা বলেছে আসলে সেটাই সত্যি।
একবার যখন আমরা ছোট একটা ব্রিজ পার হলাম, নদীর পাশ-ঘেঁষে একটা ছোট ঝোপ আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। ও আমার উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছে।
মনে হচ্ছে, ও দৃশ্যটা দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছে।
“প্রশ্নটা শুনে মনে হতে পারে মূল বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু জোনাকি পোকা সত্যি আলো বিলায়, তাই না।”
“হ্যাঁ, এগুলো জোনাকি” আমি হাসলাম, কিন্তু ও কী বলতে চাইছে সেটা ধরতে পেরেছি। মিয়াগি সম্ভবত একইরকম অনুভব করছে যেমনটা আমি হৃদের পাড়ে অনুভব করেছিলাম।
আমরা জানি এরকম জিনিসের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত সেটার সৌন্দর্য যে অন্য কিছু থেকে বেশি হতে পারে সেটা জানা যায় না।
আমরা সরু পথটা দিয়ে আস্তে-আস্তে হাঁটতে লাগলাম। অসংখ্য সবুজ জোনাকি আশপাশে জ্বলছে আর নিভছে।
এগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে যে কারো দৃষ্টি সরে যাবে এবং কিছুটা মাথা ঘুরাবে।
“এই প্রথমবার আমি জোনাকি পোকা দেখলাম।” মিয়াগি বলল।
“ইদানীং এগুলো খুব কম দেখা যায়। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় না গেলে এগুলোর দেখা পাওয়া কঠিন। পরেরবার এলে আমিও হয়তো আবার এগুলো দেখা পাবো না।”
“আপনি কি এখানে প্রায়ই আসেন নাকি, মি. কুসুনোকি?”
“না। আমি শুধু একবার মাত্র এসেছিলাম, গত বছর এসময়ে। মাত্রই গতকাল মনে পড়ল।”
জোনাকির আলোর বিচ্ছুরণ একদম চরম পর্যায়ে চলে এসেছে। আমরা যে পথে গিয়েছিলাম সে পথেই ফিরে আসলাম।
“…আমি কি এটাকে সেদিনের হৃদ দেখানোর পরিবর্তে ধন্যবাদস্বরূপ ভেবে নিবো?” মিয়াগি জিজ্ঞেস করল।
“আমি সেদিন গিয়েছিলাম কারণ, আমি নিজেই দেখতে চেয়েছিলাম। তবে তুমি যা খুশি ভেবে নিতে পারো।”
“বুঝেছি। আমি আমার ইচ্ছেমতো ভেবে নিবো।“
“আমাকে ছোটখাটো বিষয় বলতে হবে না।”
সেদিনের মতো ছবি তোলা শেষ করে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেলাম।
বিছানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম আমি। মিয়াগির “শুভ রাত্রি”র প্রতিউত্তর দিলাম। ঠিক বাতি নিভানোর আগে, আমি ওর নাম ধরে ডাকলাম।
“মিয়াগি।”
“হ্যাঁ? কী হয়েছে?”
“তুমি কেন মিথ্যা বলেছ?”
মিয়াগি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল।
“আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। “
“আরেকটু সহজ করে দিই। আমার আয়ুষ্কালের দাম কি সত্যিই ৩০০,০০০ ইয়েন?”
সে চাঁদনী রাতে, আমি মিয়াগির চোখের রং পরিবর্তন হতে দেখলাম। “অবশ্যই” ও উত্তর দিলো। “অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আপনার দাম খুব বেশি হয়নি। আমি ভেবেছিলাম আপনি অনেক আগেই আপনার ভাগ্য মেনে নিয়েছেন।”
“আসলে, আমি মেনে নিয়েছিয়াম। গতকাল রাতের আগ পর্যন্ত।” আমি বললাম।
মিয়াগি মনে হচ্ছে বুঝতে পেরেছে আমি কী ধারণা করছি।
“আমার বিকল্প যে এসেছিল উনি কি কিছু বলেছিলেন?” সে জিজ্ঞেস করল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“উনি শুধু বলেছেন তোমার সাথে মিলিয়ে নিতে। শুধু এটাই। এরচেয়ে বেশি কিছু বলেনি উনি।”
“হ্যাঁ, তো ৩০০,০০০ ইয়েন তো ৩০০,০০০ ইয়েন-ই।” ও না জানার ভান করল।
“যখন আমি প্রথমে শুনেছিলাম তুমি আমার সাথে মিথ্যা বলেছ। আমি প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম তুমি আমার পাওনা টাকা থেকে কিছু টাকা মেরে দিচ্ছ।“
মিয়াগি আমার দিকে চোখ তুলে চাইল।
“আমি ভেবেছিলাম এটা হয়তো ৩০ মিলিয়ন অথবা ৩ বিলিয়ন, আর আমাকে একটা মিথ্যা মূল্য বলে তুমি আমার টাকা আত্মসাৎ করেছ। এটাই ছিল আমার প্রাথমিক ভাবনা। কিন্তু আমি এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাইছিলামও না যে, তুমি একদম প্রথম থেকেই আমাকে বোকা বানিয়ে আসছ। তুমি তোমার হাসির পেছনে মিথ্যাটা লুকিয়ে রেখেছ। আমি চিন্তা করতে লাগলাম এটা প্রাথমিক কোনো ভুল নাকি। আমি সারারাত চিন্তা করলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝতে পারলাম আমি একদম গোঁড়া থেকেই ভুল করে বসে আছি।”
আমার শিক্ষিকা আমাকে ইতোমধ্যে দশ বছর আগেই বলেছিলেন।
আমি চাই তুমি সেটা বাদ দিয়ে চিন্তা করো।
“কেন আমি বিশ্বাস করেছি বছরে ১০,০০০ ইয়েন হচ্ছে সবচেয়ে কম মূল্য? কেন আমি বিশ্বাস করেছি সাধারণ আয়ুষ্কাল দশ কিংবা একশত মিলিয়ন হওয়া উচিত? হয়তো আমি আমার দিক থেকে খুব বেশি চিন্তা করছি। নিজের জীবন অন্যদের চেয়ে বেশি মূল্যবান এটা সম্ভবত সবাই গভীরভাবে বোকার মতো বিশ্বাস করতে চায়। যেভাবেই হোক, এক্ষেত্রে সাধারণ বিচারবুদ্ধির তুলনায় আমি একটু বেশিই চিন্তা করে ফেলেছি। আমার আরও নমনীয় হয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন ছিল।”
“তো সত্যি করে বলো, আমার মূল্য কত?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
একটা নীরবতা আমাদের ঘিরে ধরল।
“…ত্রিশ ইয়েন” মিয়াগি ফিসফিস করল।
“ত্রিশ মিনিটের ফোনকল” আমি হাসলাম। তোমার ৩০০,০০০ ইয়েন এভাবে ব্যবহার করার জন্য দুঃখিত।”
“একদম। আমি আশা করেছিলাম আপনি সেগুলো আপনার নিজের জন্য খরচ করবেন।“
মিয়াগির কথার মধ্যে রাগের আভাস পাচ্ছিলাম। কিন্তু কণ্ঠ ছিল একদম শান্ত।
“আমি বুঝতে পারছি আপনি কেমন বোধ করছেন, মি. কুসুনোকি। সম্ভবত যে কারণে আমি আপনাকে ৩০০,০০০ ইয়েন দিয়েছি আর আপনি সেটা অপরিচিত লোকজনের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন, দুটোর কারণ একই। আমি একাকী, বিমর্ষ, শূন্য, মরিয়া অনুভব করেছিলাম। তাই আমি অযৌক্তিকভাবে পরোপকারী কিছু একটা করতে গিয়েছিলাম। যদিও, এখন চিন্তা করে দেখলে মনে হয়, আমি যদি আপনাকে ৩০০,০০০ ইয়েনের মিথ্যাটা না বলে সত্যিটা বলে দিতাম, সম্ভবত আপনি কিছুই বিক্রি করতেন না। তাহলে অন্ততপক্ষে আপনি আরও অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারতেন। আমি যা করেছি তার জন্য দুঃখিত।”
হাঁটু গেড়ে বসে, চিবুক হাঁটুর মাঝে রেখে, নখের দিকে তাকিয়ে মিয়াগি বলল।
“হয়তো শুধুমাত্র একবারের জন্য, আমি কাউকে কিছু একটা দিতে চেয়েছিলাম। আমি সেটা নিজেকেই দিতে চেয়েছিলাম। সম্ভবত আমি এমন কাউকে দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম যে কিনা আমার মতো করুণ অবস্থায় আছে। যে অবস্থায় আমাকে কেউ কোনো সাহায্য করেনি। অন্যভাবে বলতে গেলে, ঘটনাটা ছিল আমার ভালো কিছু করতে চাওয়ার ফসল। আমি দুঃখিত।”
“এটা সত্যি নয়” আমি অস্বীকার করলাম। “যদি তুমি প্রথমেই বলতে ‘আপনার মূল্য ৩০ ইয়েন’ আমি সত্যিই উন্মাদ হয়ে গিয়ে সবকিছুই বিক্রি করে দিতাম; তিন মাস তো দূরের কথা, তিন দিনও বাকি রাখতাম না। তুমি যদি মিথ্যে না বলতে আমি ভেন্ডিং মেশিনের ট্যুরে যেতে পারতাম না। ক্রেইন বানাতে পারতাম না। তারা দেখতে যেতে কিংবা জোনাকি দেখতে যেতে পারতাম না।”
“আপনার হতাশ হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। ত্রিশ ইয়েন হচ্ছে একটা মূল্য যা উপরের দিকের লোকজনের সিদ্ধান্তে হয়েছে” মিয়াগি দৃঢ়তার সাথে বলল। “অন্তত আমার কাছে, মি. কুসুনোকি, আপনি এমন কেউ যার মূল্য ৩০ মিলিয়ন অথবা ৩ বিলিয়ন ইয়েন।”
“চুপ করো, এটা হাস্যকর রকমের সান্ত্বনা” আমি হেসে বললাম।
“এটাই সত্যি!”
“তুমি যদি আমার প্রতি খুব বেশি দয়া দেখাও, আমি নিজেকে করুণা করা শুরু করবো। আমি জানি তুমি খুব ভালো একটি মেয়ে। এরচেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার নেই।“
“আপনি খুব বেশি জ্বালান। চুপ করে থাকুন আর আপনাকে অনুপ্রেরণা দিতে দিন।”
“আগে কেউ একথা বলেনি।”
“তাছাড়া, এটা সান্ত্বনা কিংবা দয়া দেখানো নয়। আমি আপনাকে তাই বলছি যা অনেকদিন ধরেই বলতে চেয়েছিলাম। আপনি এই নিয়ে কী ভাবলেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না” মিয়াগি কিছুটা বিব্রত হয়ে, মাথা নিচু করে বলল।
তারপরে ও সবকিছু খুলে বলল।
“প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আপনি ৩০ ইয়েনের-ই উপযুক্ত। যখন আমি আপনাকে ৩০০,০০০ ইয়েন দিলাম, সেটা ছিল সম্পূর্ণ আমার নিজের আত্মতুষ্টির জন্য। এটা আপনি বা অন্য কেউ হলেও কিছু যেতো আসতো না, মি. কুসুনোকি। কিন্তু ধীরে-ধীরে, আপনার সম্পর্কে আমার মতামত বদলে যেতে লাগল। ট্রেন স্টেশনের সেই ঘটনার পরে আপনি আমার গল্পটা হৃদয়ে নিয়ে নিয়েছিলেন, তাই না? আমার সময় বিক্রি করার পরিস্থিতি নিয়ে আপনি সহানুভূতি অনুভব করেছিলেন। সেসময় থেকে, মি. কুসুনোকি, আপনি আমার কাছে পর্যবেক্ষণ করার বস্তু ছিলেন না। এটা একটা মাত্র ঘটনা, কিন্তু এরপরে আরও অনেক কিছুই ঘটেছে।”
“আমি জানি এটা আপনার কাছে খুবই তুচ্ছ। কিন্তু আপনি আমার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলছেন দেখে খুবই ভালো লেগেছিল। কারণ, আমি সবসময়ই অদৃশ্য ছিলাম। উপেক্ষিত হওয়া আমার চাকরির একটা অংশ। এমনকি রেস্টুরেন্টে খাওয়া এবং কথা বলার মতো তুচ্ছ বিষয়, কেনাকাটা করতে যাওয়া, শহরজুড়ে হেঁটে বেড়ানো, হাতে হাত রেখে নদীর পাড়ে হেঁটে যাওয়া। এগুলো সবই আমার কাছে স্বপ্ন ছিল। আপনিই প্রথম ব্যক্তি যে কিনা আমার সাথে এমন আচরণ করেছেন। যে কোনো সময়, যে কোনো পরিস্থিতিতে।”
কিভাবে উত্তর দিবো আমি বুঝতে পারছিলাম না।
আমি কখনই ভাবতে পারিনি কেউ আমার প্রতি এতটা কৃতজ্ঞ হবে।
“তোমার পছন্দ হলে আমি সেগুলো এখনো করে যেতে পারি।” আমি রসিকতা করে বললাম। মিয়াগি মাথা নাড়ল।
“আমার ভালোই লাগবে, যেহেতু… আমি আপনাকে পছন্দ করি।”
যদিও খুব দ্রুত মারা যাবে এমন কাউকে পছন্দ করার মাঝে কোনো ফায়দা নেই।
ও করুণভাবে হাসল।
আমার দম বন্ধ হয়ে এলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য মুখ নাড়াতে পারলাম না। যেন সবকিছু স্থবির হয়ে গিয়েছে। আমি কিছু বললাম না। এমনকি চোখের
পাতাও ফেলতে পারলাম না।
“জানেন, মি. কুসুনোকি। আপনাকে আমি আরও অনেক মিথ্যা বলেছি।” মিয়াগি বলল কিছু গম্ভীর স্বরে। “আপনার আয়ুষ্কালের মূল্য এবং হিমেনো ছাড়াও। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি কোনো ঝামেলা পাকান তাহলে আপনার আয়ুষ্কাল শেষ করে দেওয়া হবে, ওটা মিথ্যা ছিল। আবার যদি আপনি আমার থেকে ১০০ মিটার দূরে চলে যান তাহলে আপনার মৃত্যু হবে, সেটাও মিথ্যে ছিল। নিজেকে রক্ষা করার এর চেয়ে আর কোনো পথ ছিল না আমার কাছে। মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।”
“সত্যি নাকি?”
“যদি আপনার রাগ হয়, আপনার যা ইচ্ছে আমার সাথে করতে পারেন।“
“যে কোনো কিছু?” আমি বললাম।
“হ্যাঁ। যত ভায়ঙ্কর ইচ্ছাই হোক।”
“তাহলে সানন্দে…”
আমি মিয়াগির হাত ধরে দাঁড় করালাম। তার পরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
ঠিক কতক্ষণ আমরা এভাবে ছিলাম নিশ্চিত নই আমি।
আমি সবকিছু মনে গেঁথে রাখতে চেষ্টা করলাম। ওর নরম চুল, ওর সুগঠিত কান, ওর সরু গ্রীবা, ওর কাঁধ এবং পিঠ, ওর সুগঠিত বুক, ওর মসৃণ বাঁকানো ঠোঁট।
আমি আমার সম্পূর্ণ চেতনাকে কাজে লাগিয়ে সবকিছু স্মৃতিতে গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
যা-ই ঘটুক না কেন; আমি যেন মনে করতে পারি। যেন আমি কখনই ভুলে না যাই।
“এটা খুবই ভয়ঙ্কর ছিল” মিয়াগি বলল, নাক টেনেটেনে। “এই কাজ করার পরে, এখন আমি জানি আমি কখনই আপনাকে ভুলতে পারবো না। “
“ঠিক আছে। আমার মৃত্যুতে অনেক শোক করো তাহলে” আমি বলালাম। “যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করবো সেটা।”
তার পরে মিয়াগি হাসল।
একমাত্র তখনই অবশেষে আমার শেষ কয়েক উদ্দেশ্যহীন মাসের জন্য একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেলাম।
মিয়াগির কথাগুলো আমার মাঝে এক অভাবনীয় পরিবর্তন নিয়ে এলো।
দুই মাসও বাকি না থাকলেও, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম; যা-ই ঘটুক না কেন, আমি মিয়াগির ঋণ সম্পূর্ণভাবে পরিশোধ করবো।
আমি, যার জীবনের মূল্য দিয়ে একটা জুসের বক্সও কেনা যাবে না।
আমার মনে হয় আমি এটা বলতে পেরেছি কেবল এই কারণে যে, আমি আসলে আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি না।