চ্যাপ্টার ১৪ : দ্য ব্লু পিরিয়ড

চ্যাপ্টার ১৪ : দ্য ব্লু পিরিয়ড

আমার আয়ুষ্কালের মেয়াদ পঞ্চাশ দিনের নিচে চলে আসতেই একটা পরিবর্তন টের পেতে শুরু করলাম।

আগে যেমনটা বলেছিলাম, অনেক মানুষই আমার কার্যকলাপে খুঁত খুঁজে পেতো। যা কিনা একই সাথে বিখ্যাত এবং কুখ্যাত। অনেক মানুষই আমাকে অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলতে দেখে আনন্দ পেতো। আমাকে এবং পাশ কাটিয়ে যাওয়া লোকজনকে শুনিয়ে জোরে-জোরে নিষ্ঠুর কথাবার্তা বলতো।

অবশ্যই আমার নালিশ করার মতো কোনো অধিকার নেই। যেহেতু আমিই ওদেরকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছি।

একদিন বারে আমার সাথে তিনজন লোকের একহাত হয়ে গেল। তারা প্রাপ্ত সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেদের কত কঠোরভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটা নিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে লাগল। তাদের সংখ্যা এবং দৈহিক উচ্চতা দেখে বুঝলাম এদের না ঘাঁটানোই আমার জন্য ভালো।

সম্ভবত শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে যখন আমাকে একা একা ড্রিঙ্ক করতে এবং পাশের খালি সিটের সাথে কথা বলতে দেখল; তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার পাশে বসে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল। আমাকে খেপানোর চেষ্টা করতে লাগল ওরা।

হয়তো এক সময় আমি দাঁড়িয়ে নিজের পক্ষে কিছু বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এর জন্য আর কোনো শক্তি ক্ষয় করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ওরা বিরক্ত হয়ে যায়।

কিন্তু ওদের মাঝে বিরক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ওদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবো না বুঝতে পেরে ওরা সুযোগটা নিলো। ওদের অঙ্গভঙ্গি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে লাগল।

আমি বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বিবেচনা করে দেখলাম। কিন্তু ওদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে দেখে ভাবলাম ওরা সম্ভবত আমাকে অনুসরণ করতে পারে।

“ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে যাচ্ছে।” মিয়াগি বলল চিন্তিতভাবে।

যেই মুহূর্তে কী করবো চিন্তা করছিলাম; সেই মুহূর্তে পিছন থেকে একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম, “আরে মি. কুসুনোকি নাকি?”

কণ্ঠটা একজন পুরুষের। কেউ আমার সাথে এই স্বরে কথা বলতে পারে বলে মনে পড়ছে না। তাই আমি বেশ অবাক হয়েছি। এরপরে লোকটার কথোপকথন যে দিকে গেল সেটা আমাকে এবং মিয়াগিকে স্তব্ধ করে দিলো।

“আপনি কি আজকেও মিস. মিয়াগির সাথে আছেন নাকি?”

লোকটাকে দেখার জন্য ঘুরলাম আমি। দেখা গেল লোকটাকে আমি চিনি।

লোকটা আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। মিয়াগির সাথে বাইরে যাওয়া আসার সময় আমার দিকে বিরক্তিকরভাবে তাকাতো সেই লোকটা।

লোকটার নাম শিনবাসি।

শিনবাসি ঠিক আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপরে আমাকে বিরক্ত করা একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি দুঃখিত, দয়া করে কি আপনি অন্য চেয়ারে বসবেন?”

তার কথাগুলো ছিল নম্র, কিন্তু গলার স্বর ছিল কঠোর। শিনবাসির উচ্চতা ছয় ফুটের উপরে এবং লোকটার দিকে এমনভাবে তাকাতে লাগল যেন সে অন্যদের শাসিয়ে অভ্যস্ত। সুতরাং লোকটার কথা বলার ভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেল।

শিনবাসি আমার পাশে বসে, আমার দিকে না তাকিয়ে সোজা মিয়াগির দিকে তাকাল। “আমি সবসময়ই মি. কুসুনোকির কাছে আপনার কথা শুনেছি। কিন্তু আমি নিজে কখনো আপনার সাথে কথা বলিনি। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। আমি শিনবাসি।”

প্রচণ্ড বিস্ময়ে মিয়াগির চেহারা জমে গেল। কিন্তু শিনবাসি এমনভাবে মাথা নাড়ল যেনবা মিয়াগি তার কথার উত্তর দিয়েছে। “হ্যাঁ। একদম ঠিক। আপনি মনে করতে পেরেছেন জেনে কৃতজ্ঞ হলাম। অ্যাপার্টমেন্টে চলতি পথে আমাদের অনেকবার দেখা হয়েছে।”

এটাকে ঠিক কথোপকথন বলা যায় না। যদিও এটা নিশ্চিত শিনবাসি মিয়াগিকে আসলে দেখতে পারছে না। হয়তো লোকটা মিয়াগিকে দেখার ভান করছে, আমি ভাবলাম।

আমাকে জ্বালাতন করা লোকগুলো দেখা যাচ্ছে শিনবাসির উপস্থিতিতে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ওরা তিনজন চলে যাওয়ার পরে শিনবাসি স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর উনার মুখের নম্র হাসি ছুড়ে ফেলে স্বাভাবিক গোমড়া মুখে ফিরে গেল।

“প্রথমেই বলে নেই” শিনবাসি ব্যাখ্যা করল। “মিয়াগি মেয়েটার অস্তিত্বে বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”

“আমি জানি। আপনি কেবলই সাহায্য করছেন, তাই না?” আমি বললাম। “ধন্যবাদ, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।”

সে মাথা নাড়ল। “না, এটা সত্যিই তেমন কিছু না।”

“তাহলে কী?”

“আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি অন্তত এটাই বিশ্বাস করি। আমার মনে হয় আপনি এক প্রকার অভিনয় করছেন, মিয়াগির অস্তিত্ব সত্যি-সত্যি আছে এমনটা বিশ্বাস করিয়ে যতজনকে পারা যায় বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন। অভিনয়ের মাধ্যমে আপনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন যে চাইলেই সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানকে একটু হলেও নাড়া দেওয়া যায়। আর আপনি আমার ক্ষেত্রে কিছুটা সফল হয়েছেন।”

“আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি আশপাশে মিয়াগির উপস্থিতি অনুভব করতে পারছেন?”

“আমার স্বীকার করতে ইচ্ছে করছে না তবুও আমি বিশ্বাস করি” শিনবাসি বলল, কাঁধ ঝাঁকিয়ে। “আমি আসলে এই ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী। ভাবছি যদি আমি সত্যি সত্যি মিস. মিয়াগির অস্তিত্ব মেনে নিই, যেমনটা আপনি আমাকে বাধ্য করাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত উনাকে সত্যি সত্যি দেখতে পারবো?”

“মিয়াগি” আমি বলতে শুরু করলাম, “ঠিক অতটা লম্বা নয়। আমার মতে ও অনেকটা পলকা। সচরাচর ওর চোখগুলো গম্ভীর ধরনের। কিন্তু মাঝে-মাঝে

ওর হাসিটা বিনয়ী মনে হয়। ওর চোখের জ্যোতিতে একটু সমস্যা আছে। যখন ওর ছোট অক্ষর পড়ার দরকার হয়, ও সরু ফ্রেমে গ্লাস পরে। আর সেগুলো ওকে দারুণভাবে মানিয়ে যায়। ওর চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। চুলগুলো একদম শেষের দিকে কিছুটা কোঁকড়ানো।”

“আমি জানি না কেন” শিনাবাসি বলল, মাথাটা কাত করে। “আমি যেভাব মিয়াগিকে কল্পনা করেছি এর সাথে আপনার বলা প্রতিটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মিলে গিয়েছে।”

“মিয়াগি ঠিক আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?”

শিনবাসি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করল। “এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।”

“ও আপনার সাথে হ্যান্ডশেক করতে চায়” আমি বললাম। “আপনার ডান হাত তুলে ধরুন।“

সে তাই করল। তার চেহারায় দ্বিধা দেখতে পেলাম। মিয়াগি তার হাতের দিকে সানন্দে তাকিয়ে দুই হাত দিয়ে তা ধরল।

নিজের হাতকে উপরে নিচে উঠা-নামা করতে দেখে, শিনবাসি বলল, “আমি কি ধরে নিবো মিস. মিয়াগি আমার হাত নাড়াচ্ছে?”

“হ্যাঁ। আপনি ভাবছেন আপনি হাতটা নাড়াচ্ছেন, কিন্তু আসলে মিয়াগি নাড়াচ্ছে সেটা। ও মনে হচ্ছে অনেক খুশি হয়েছে।”

“আপনি কি মি. শিনবাসিকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিবেন?” মিয়াগি অনুরোধ করল।

“মিয়াগি আমাকে বলেছে ওর পক্ষ থেকে আপনাকে ‘অনেক-অনেক ধন্যবাদ’ জানাতে।” আমি বললাম।

“কিভাবে যেন আমার মনে হয়েছিল উনি এটাই বলবেন” শিনবাসি বলল বিস্মিত হয়ে।

আমাকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে, মিয়াগি এবং শিনবাসি বেশ কিছু কথা আদান-প্রদান করল।

উনার নিজের টেবিলে ফিরে যাওয়ার আগে শিনবাসি আমার দিকে ফিরে বলল, “আমার কিছুটা সন্দেহ আছে যে একমাত্র আমিই মিস. মিয়াগির অস্তিত্ব টের পাচ্ছি কিনা। আমার মনে হয় সবাই সাময়িকভাবে সেটা অনুভব করেছে। কিন্তু খুব সহজে বিভ্রম বলে খারিজ করে দিয়েছে। যদি তাদের অনুভূতিটা বিভ্ৰম নয় বলে প্রমাণ করার সুযোগ পাওয়া যায়, মিস. মিয়াগির অস্তিত্ব খুব দ্রুত সবাই মেনে নিলে আমি বিস্মিত হবো না। অবশ্যই আমি যা বলছি তার কোনো ভিত্তি নেই। তবে আমি আশা করছি আমি সঠিক কথাই বলছি।”

শিনবাসি ঠিকই বলেছিল।

এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর কিন্তু সেই ঘটনার পরে, আমাদের চারপাশের মানুষজন মিয়াগির অস্তিত্ব মেনে নিতে শুরু করেছিল।

অবশ্যই এমন নয় যে মানুষজন সত্যি-সত্যি অদৃশ্য কারো অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছে। এটা ছিল অনেকটা এরকম যে, মানুষ আমার অর্থহীন কথাবার্তা মেনে নিয়েছে, ঠিক পারস্পারিক সম্মতি এবং একই সাথে তাল মিলিয়ে

মিয়াগির অস্তিত্ব ঠিক ‘অনুমেয় অস্তিত্ব’এর পর্যায়ে পৌঁছেনি। কিন্তু তবুও, এটা ছিল অনেক বড় পরিবর্তন।

আমরা বারে-বারে শহরের বিনোদনের জায়গাগুলোতে, হাই স্কুলের কালচারাল ফেস্টিভ্যালে এবং স্থানীয় ফেস্টিভ্যালে উপস্থিত হতে লাগলাম। এতে আমি কিছুটা বিখ্যাত হয়ে গেলাম।

হাস্যরসাত্মক আনন্দ উপভোগ করার ব্যক্তি হিসাবে, আমাকে অভাগা কৌতূহলোদ্দীপক মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হলো।

আমার কাল্পনিক গার্লফ্রেন্ডের সাথে হাত মেলাতে এবং জড়িয়ে ধরতে, বেশ অনেকজন মানুষ আমাকে দেখতে এলো।

একরাতে, আমাকে এবং মিয়াগিকে শিনবাসির ঘরে আমন্ত্রণ জানানো হলো।

“আমার অ্যাপার্টমেন্টে কিছুটা অ্যালকোহল আছে। বাড়িতে যাওয়ার আগে পুরোটা শেষ করতে হবে। মি. কুসুনোকি, মিস. মিয়াগি আপনারা কি আমার সাথে ড্রিঙ্ক করবেন?”

আমরা পাশের রুমে যেতেই দেখলাম সেখানে ইতোমধ্যে ওর আরও তিনজন বন্ধু ড্রিঙ্ক করছে। একজন পুরুষ, দুজন মেয়ে।

মাতালরা ইতোমধ্যে শিনবাসির কাছ থেকে আমার সম্পর্কে শুনেছে। তারা মিয়াগির ব্যাপারে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগল। আমি ওদের প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিলাম।

“তাহলে ছোট্ট মিয়াগি ঠিক এখানেই আছে?” লম্বা এবং কড়া মেকআপ দেওয়া সুজুমি জিজ্ঞেস করল। যে কিনা মাতালভাবে মিয়াগির হাত স্পর্শ করতে লাগল। “আপনি বলার পরে, আমার মনে হচ্ছে ও এখানেই আছে।”

সে আসলে স্পর্শ করে কিছুই অনুভব করতে পারছে না। কিন্তু তাতে মিয়াগির উপস্থিতি সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়নি।

মিয়াগি ধীরে-ধীরে সুজুমির হাত ধরল।

আসাকুরা যে কিনা দ্রুত চিন্তা করতে পারে, অসঙ্গতি খুঁজে বের করার চেষ্টায় মিয়াগির ব্যাপারে আমার কাছে কিছু প্রশ্ন করল।

কিন্তু যেভাবে সবকিছু খাপে খাপে মিলে গিয়েছে; তাতে তার কাছে জিনিসটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। এবং সে অদ্ভুত কাজ-কারবার করা শুরু করল। যেমন সে যে কুশনটা ব্যবহার করছিল সেটা মিয়াগি যেখানে ছিল সেখানে ছুড়ে দিলো, মিয়াগির দিকে এক গ্লাস অ্যালকোহল এগিয়ে দিলো।

“আমি এরকম মেয়ে পছন্দ করি” আসাকুরা বলল। “মিস. মিয়াগিকে আমি দেখতে পারছি না এক হিসাবে সেটা ভালোই হয়েছে, না হলে আমি ওর প্রেমে পড়ে যেতাম।“

“কোনো লাভ নেই। মিয়াগি আমাকে পছন্দ করে।”

“এভাবে সবাইকে বলে বেড়াবেন না তো” মিয়াগি বলল, আমাকে কুশন দিয়ে আঘাত করে।

রিকো, ছোটখাটো সুশ্রী চেহারার মেয়েটা সবচেয়ে বেশি মাতাল ছিল। মেঝেতে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বলল, “মিস্টার… কুসুনোকি, মিস্টার… কুসুনোকি, আপনি মিস. মিয়াগিকে কতটুকু ভালোবাসেন আমাদের দেখান তো!”

“আমিও দেখতে চাই” সুজুমি সম্মতি দিলো। শিনবাসি এবং আসাকুরা আমার দিকে প্রত্যাশার চাহনী দিলো।

“মিয়াগি?” আমি ডাকলাম।

“হ্যাঁ?”

আমি মিয়াগির হালকা লালছে গালে চুমু দিলাম। মাতালরা আমাকে হর্ষধ্বনি দিলো।

কী রকম হাস্যকর একটা কাজ করেছি চিন্তা করে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এখানকার একজন মানুষও সত্যিকারভাবে মিয়াগির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। ওরা নিশ্চয় আমাকে পাগল, সুখী গর্দভ ভাবছে।

কিন্তু এতে ভুল কী আছে?

সে গ্রীষ্মে আমি ছিলাম শহরের সেরা ভাঁড়। ভালো কিংবা খারাপ অর্থে।

এরপরে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন রৌদ্রোজ্জ্বল বিকালে আমার ডোরবেল বেজে উঠলে আমি শিনবাসির কণ্ঠ শুনতে পেলাম। দরজা খোলার পরে, সে আমার দিকে কিছু একটা ছুড়ে দিলো। ওটা ছিল আসলে গাড়ির চাবি।

“আমি বাড়িতে যাচ্ছি” শিনবাসি বলল। “আপাতত কয়েকদিন গাড়িটা লাগবে না। আপনি চাইলে গাড়িটা ধার নিতে পারেন। মিস. মিয়াগির সাথে পাহাড় কিংবা সমুদ্র তীরে ঘুরে আসলে কেমন হয়?”

আমি তাকে বারবার ধন্যবাদ জানালাম। চলে যাওয়ার আগে শিনবাসি আমাকে বলল,

“জানেন, আমি কিছুতেই মানতে পারছি না আপনি মিথ্যা বলছেন। আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারছি না মিস. মিয়াগি মূক অভিনয়ের গালগল্প। হয়তো কোনো এক ঘটনাচক্রে আপনি এমন একটা পৃথিবী দেখতে পান; যা আমরা দেখি না। আবার এমনও হতে পারে আমাদের এই পৃথিবীতে সত্যি-সত্যি যা কিছু রয়েছে এটা তার একটা অংশ। আমাদের শুধুমাত্র এইটুকু দেখার অনুমতি আছে।”

উনাকে বাসে চড়ে চলে যেতে দেখে, মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। সবসময়ের মতো, সূর্য কিরণ দিচ্ছে। বাতাসে শরতের ক্ষীণ আভাস পেলাম।

গ্রীষ্মের শেষ ঘোষণা করে ঘুর্ঘুরে পোকা একযোগে ডাকতে লাগল।

রাতে, বিছানায় আমি মিয়াগির পাশে ঘুমালাম। মাঝের বর্ডারটা কিভাবে কিভাবে যেন বিলীন হয়ে গেল। মিয়াগি আমার দিকে মুখ করে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চার মতো শান্তিপূর্ণ, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ও। ঘুমের মাঝে আমি ওর মুখে আদর করতে লাগলাম। কাজটা করতে কখনই বিরক্ত কিংবা ক্লান্ত হই না।

আমি সাবধানে বিছানা ছাড়লাম, যাতে ওর ঘুম না ভেঙে যায়। রান্নাঘর থেকে পানি পান করলাম। যখন আমার রুমে ফিরে এলাম, ড্রেসিং রুমের দরজার সামনে একটা স্কেচবুক পড়ে থাকতে দেখলাম।

ওটা তুললাম, সিংকের পাশের লাইটটা জ্বালিয়ে ধীরে-ধীরে প্রথম পাতা খুললাম।

আমার প্রত্যাশার তুলনায় অনেক বেশি কিছুই ছিল সেখানে।

স্টেশনের ওয়েটিং রুম। নারুসের সাথে দেখা করার সেই রেস্টুরেন্ট। টাইম ক্যাপসুল পুঁতে রাখা সেই এলিমেন্টারি স্কুল। আমার এবং হিমেনোর গোপন আস্তানা। হাজার খানেক পেপার ক্রেনে প্লাবিত রুম। পুরাতন লাইব্রেরি। সামার ফেস্টিভ্যালের জাঁকজমক। হিমেনোর সাথে দেখা করার আগের দিন যে নদীর তীরে আমরা হেঁটেছিলাম। অবজার্ভেশন প্লাটফর্ম। আমরা যে কমিউনিটি সেন্টারে থেকেছিলাম। কাব, ক্যান্ডির দোকান, ভেন্ডিং মেশিন, পাবলিক ফোন, তারা খচিত হৃদ, পুরাতন বইয়ের দোকান, সোয়ান বোট, ফেরিস হুইল।

এবং ঘুমানো আমি।

আমি একটা নতুন পাতা উল্টিয়ে তাতে মিয়াগি ঘুমিয়ে থাকার ছবি আঁকা শুরু করলাম।

প্রায় অনেক বছর হয়েছে আমি টানা ছবি আঁকিনি।

আঁকাআঁকি, যা কিনা আমি শুধুই হতাশা হিসাবে ধরে নিয়েছিলাম।

যখন আমি সম্পূর্ণ হওয়া ড্রয়িংয়ের দিকে তাকালাম, আমি বিস্মিতভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু কিছু একটা ভুল করার ছোট্ট অনুভূতি মনকে খোঁচাতে লাগল।

খুব সহজে উপেক্ষা করা যায়। এতই ছোট একটা ভুল যে আমিও ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমি এটাকে উপেক্ষা করে যেতে পারতাম। স্কেচবুক বন্ধ করে মিয়াগির বিছানার পাশে রেখে, সুখীভাবে সকালে ওর প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষা করে ঘুমাতে পারতাম।

আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। ভুল খুঁজে পাওয়ার জন্য আমার ইন্দ্রিয়শক্তির উপর জোর দিলাম।

অন্ধকার, ঝড়ো সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোর অক্ষরের মতো আমি ভুলটা খুঁজে চলেছি। সেটাকে ধরতে যেতেই আমার হাত ফস্কে পড়ে যেতে লাগল।

কয়েক মিনিট পরে আমি যখন পরাজয় বরণ করে হাত সরিয়ে নিলাম। সেটা ঠিক আমার হাতের তালুতে এসে পড়ল।

আমি খুব-খুব সতর্কতার সাথে সেটাকে পানি থেকে তুললাম, এবং হঠাৎ,

আমি বুঝতে পারলাম।

পরমুহূর্তে, যেন আমি আবিষ্ট হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে পেন্সিলটা স্কেচবুকে ঘোরাতে লাগলাম।

সারারাত ধরে কাজটা চালিয়ে যেতে লাগলাম।

***********

কয়েকদিন পরে, আমি মিয়াগিকে আতশবাজি দেখাতে নিয়ে গেলাম। অস্তগত সূর্য আর ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে, রেইলরোড পার হয়ে, শপিং ডিস্ট্রিক পাশ কাটিয়ে, আমরা এলিমেন্টারি স্কুলে পৌঁছালাম।

এটা ছিল স্থানীয় বিখ্যাত আতশবাজি প্রদর্শন অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান এত বিশাল হবে যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। এত বেশি অতিথি ছিল যে, আমি চিন্তা করতে লাগলাম; শহরে এত লোকের থাকার জায়গা এলো কোথা থেকে।

বাচ্চারা যখন আমাকে মিয়াগির হাত ধরে হাঁটতে দেখল, তারা হাসতে হাসতে বলল, “আরে এটা কি মি. কুসুনোকি নাকি?”

তাদের হাসিটা ছিল অনুমোদনের। মিয়াগির ধরে থাকা হাতটা উঁচু করলাম ওদের বিদ্রূপের জবাব হিসাবে।

আমি যখন গ্রিলড চিকেনের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম, হাই স্কুলের একদল ছেলে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে উত্যক্ত করতে লাগল, “দারুণ একটা মেয়ে বাগিয়েছেন আপনি! “

“দারুণ, তাই না? কিন্তু তোমরা ওকে পাবে না” আমি বললাম, মিয়াগির কাঁধ ধরে। ওরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

ব্যাপারটা দেখে আমি খুশি হলাম। এমনকি যদিও তারা আমার কথা বিশ্বাস করেনি, তবুও সবাই আমার “মিয়াগি ঠিক এখানেই আছে” অর্থহীন কথাটা বিশ্বাস করল।

কোনো গার্লফ্রেন্ড না থাকার চেয়ে বরং কাল্পনিক গার্লফ্রেন্ড আছে মনে করাটাই বেশি ভালো।

একটু পরে ঘোষণা এলো শো শুরু হতে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরে, প্রথম আতশবাজিটা আকাশের দিকে উড়ে গেল। কমলা আলোতে আকাশ ছেয়ে গেল। জনতা উল্লাস করে উঠল। এবং দেরি করে আসা শব্দে বাতাস প্রকম্পিত হয়ে গেল।

অনেকদিন হলো এত কাছ থেকে আতশবাজি দেখেছি। আমার প্রত্যাশার তুলনায়, এগুলো ছিল অনেক বড়, অনেক বেশি রঙিন, এবং খুব দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছিল।

আমি এও ভুলে গিয়েছি যে বড় আতশবাজি ছড়িয়ে পড়তে কয়েক মিনিট সময় লাগে। কল্পনাও করতে পারিনি বিস্ফারণের শব্দ পাকস্থলিতে কী রকম প্রতিধ্বনি করতে পারে।

কয়েক ডজন আতশবাজি আকাশে উড়ে গেল। একা-একা থাকার জন্য আমরা একটা বিল্ডিংয়ের পিছনে শুয়ে আতশবাজি দেখতে লাগলাম।

হঠাৎ, মিয়াগির মুখের দিকে চুপিসারে দেখতে ইচ্ছে হলো। আকাশে আলো ছড়িয়ে পড়তেই আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে মনে হলো মিয়াগি’ও একই চিন্তা করছে। আমাদের চোখ মিলিত হলো।

“জুটি হিসাবে আমরা বেশ ভালো” আমি হেসে বললাম। “এটা আগেও ঘটেছে, বিছানায়।”

“ঘটেছে তো ঘটেছে” মিয়াগি লাজুকভাবে হেসে বলল। “আপনি আমাকে যখন খুশি তখন দেখতে পারবেন, মি. কুসুনোকি। এখন আপনার উচিত আতশবাজি দেখা। “

“আপাতত সেটা নাও ঘটতে পারে।”

হয়তো আমার টাইমিং আরও ভালো হতে পারতো।

আমি আতশবাজি দেখতে দেখতে কথাটা বলতে পারতাম।

“আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার আগামীকাল ছুটি। কিন্তু আমি পরের দিনই চলে আসবো। গতবারের মতো দু’দিন না, একদিন পরেই আসবো আমি।”

“সেটা সমস্যা না।“

“তাহলে কী সমস্যা?”

“…মিয়াগি। আমি এখন শহরে বেশ খানিকটা জনপ্রিয়। অর্ধেক লোক আমার দিকে টিটকারির হাসি দেয়। কিন্তু বাকি অর্ধেক লোক আমাকে পছন্দের হাসি দেয়। যে কোনো প্রকারের হাসিই হোক না কেন, আমি এই নিয়ে গর্বিত আমি নিশ্চিত ভালো কিছু ঘটবে।”

আমি উঠে বসলাম। হাত মাটিতে রেখে মিয়াগির দিকে নিচু হয়ে তাকালাম।

“আমি যখন এলিমেন্টারি স্কুলে ছিলাম, একটা ছেলে ছিল যাকে আমি ঘৃণা করতাম। ছেলেটা সত্যিই স্মার্ট ছিল। কিন্তু সে সেটা লুকিয়ে রেখেছিল এবং বোকার মতো আচরণ করতো; যেন মানুষ ওকে পছন্দ করে। ইদানীং আমি বুঝতে পেরেছি। আমি ওর প্রতি হিংসা না করে পারছি না। আমার মনে হয় ও প্রথম থেকেই যা করে আসছিল আমি সেটাই করতে চাইতাম। তোমাকে ধন্যবাদ মিয়াগি, সেটা সম্ভব হয়েছে। আমি মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে পেরেছি।”

“এটা কি ভালো না?” মিয়াগি নিজেও উঠে একইভাবে বসলো। “…আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?”

“সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ” আমি বললাম। “আমি সত্যিই জানি না এছাড়া আর কী বলা যায়।”

“আর সবকিছু বলতে?” মিয়াগি প্রশ্ন করল। “আপনার এখনো এক মাস বাকি আছে। ‘সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ’ বলার জন্য একটু তাড়াতাড়িই হয়ে গেল না।“

“আসলে, মিয়াগি? তুমি বলেছিলে তুমি আমার ইচ্ছা জানতে চাও। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ভেবে তোমাকে জানাবো।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো।

“হ্যাঁ, আমার সাধ্যের মধ্যে যা থাকে সব করবো।”

“ঠিক আছে তাহলে। আমি তোমার সাথে সত্যি কথাই বলবো। আমি মারা গেলে, আমাকে সম্পূর্ণ ভুলে যেও। এটাই আমার ছোট্ট ইচ্ছা।”

“না।”

ওর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার পরে, মনে হলো মিয়াগি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে।

ও বুঝতে পারলো কালকে আমি কি করতে যাচ্ছি।

“…উম, মি. কুসুনোকি। আমি জানি আপনি আমার কথা শুনবেন না। কিন্তু দয়া করে উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না। আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি।“

আমি মাথা নাড়লাম।

“ভেবে দেখ। মাত্র ত্রিশ ইয়েন মূল্যের আমার জীবনটা শেষ দিনগুলোকে এতটা চমৎকার হবে কে ভেবেছিল? সম্ভবত কেউ ভাবেনি। মূল্য নির্ধারণ কিংবা যেটাই তোমরা দেখ না কেন; সেটা দেখে, এমনকি তুমিও কোনো পূর্বাভাস পাওনি। কল্পনারও বাইরে বাজে জীবন কাটানো উচিত ছিল আমার, কিন্তু আমি দারুণ কিছু সুখের মুহূর্তের দেখা পেয়েছি। তোমার ভবিষ্যৎ একদম অনিশ্চিত মিয়াগি। হয়তো উপযুক্ত কেউ তোমার জীবনে আসবে এবং তোমাকে এর চেয়েও বেশি সুখী করবে।”

“কেউ আমাকে সুখী করতে পারবে না।”

“কিন্তু তোমারও আমার জীবনে আসার কথা ছিল না, মিয়াগি। তো সুতরাং…”

“কেউ আমাকে সুখী করতে পারবে না।”

কোনো উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়েই, মিয়াগি আমাকে মাটিতে ফেলে দিলো।

আমি শুয়ে পড়তেই, ও আমার হাতের ভিতরে নিজেকে লুকালো।

“…মি. কুসুনোকি, আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি।”

এই প্রথমবারের মতো আমি ওকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলতে দেখলাম। “আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি, অন্তত শেষ মাসটা আপনি আমার সাথে থাকে থাকুন। আমি বাকি সবকিছু সহ্য করতে পারবো। আপনি খুব দ্রুতই মারা যাবেন, আমার ছুটির দিনগুলোতে আপনাকে দেখতে পারবো না, আমাদের হাত ধরা অন্য কেউ দেখতে পারবে না, আমাকে আরও ত্রিশ বছর একা-একা থাকতে হবে। সবকিছুই আমি সহ্য করে নিতে পারবো। কিন্তু অন্তত যতক্ষণ আপনি আমার সাথে আছেন, নিজেকে বিলিয়ে দিবেন না। আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি।”

ও আমার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে মিয়াগি এবং আমি হাত ধরাধরি করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

শেষ মুহূর্তের জন্যও ওর কান্না থামেনি।

মাঝরাতে মিয়াগি অ্যাপার্টমেন্টে ছেড়ে চলে গেল।

সামনের দরজায় আমরা দু’জন দু’জনকে আবারো জড়িয়ে ধরলাম। আমাকে বিষণ্ণ হাসি এবং অনুতাপের আভাস দিয়ে ও চলে গেল।

“বিদায়। আপনি আমাকে সুখী করেছেন।”

এটা বলেই, ও আমাকে দিকে বো করে ঘুরে চলে গেল।

ও ধীরে-ধীরে হারিয়ে গেল জ্যোৎস্নারাতে।

পরেরদিন সকালে, আমার বিকল্প অবজার্ভারকে সাথে নিয়ে সেই পুরাতন বিল্ডিংয়ে গেলাম।

যেখানে মিয়াগি এবং আমার প্রথম দেখা হয়েছিল।

সেখানে, আমি আমার ত্রিশ দিন বিক্রি করে দিলাম।

সত্যি বলতে, আমি সম্পূর্ণটাই বিক্রি করে দিতাম। কিন্তু ওরা শেষ তিন দিন বিক্রি করতে দেয়নি।

পর্যবেক্ষক ফলাফলের দিকে তাকিয়ে বিস্মিয় হয়ে গেল।

“আপনি কি ফলাফল জেনেই এখানে এসেছিলেন নাকি?”

“হ্যাঁ।” আমি উত্তর দিলাম।

কাউন্টারের ত্রিশোর্ধ্ব মহিলা আমার দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল।

“আমি সত্যিই আপনাকে এটা করতে উৎসাহিত করবো না। এই অবস্থায়, টাকা কোনো বিষয় হতে পারে না, পারে নাকি? দিন শেষে… পরবর্তী ত্রিশ দিনে, আপনি এমন একটা ছবি আঁকতে যাচ্ছিলেন যেটা কয়েক বছর পর টেক্সট বইয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতো।”

মহিলাটি হাতে ধরে রাখা স্কেচ বুকটার দিকে তাকিয়ে রইল

“খুব মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আপনি যদি এটা না করেন, তাহলে একান্তভাবে ছবি আঁকার জন্য আপনি ত্রিশ দিন পাবেন। এই সময়ে, আপনার পর্যবেক্ষক আপনার পাশে থাকবে। আপনাকে সাহস যোগাবে। ও কিছুতেই আপনার বেছে নেওয়াটাকে দোষ দিবে না। আপনার মৃত্যুর পরে, আপনার নাম আর্টের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। আপনার তো এসব জানার কথা, তাই না?….কি জন্য আপনি এত অসন্তুষ্ট? আমি বুঝতে পারছি না।”

“আমার মৃত্যুর পরে টাকা যেমন অর্থহীন ঠিক তেমনি খ্যাতিও অর্থহীন।”

“আপনারা কি অমর হতে চান না?”

“এমনকি আমি-বিহীন এই পৃথিবীতে অমর হলেও, খুশি হওয়ার কিছু নেই” আমি বললাম।

*****

“পৃথিবীর সবচেয়ে মৃসণ ছবি।”

আমার ছবিগুলো সম্পর্কে এটাই বলা হতো। যদিও এটা বেশ বিতর্ক ছড়াতো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগুলো সবচেয়ে বেশি দামে বিকোতো।

তবে যেহেতু আমি ত্রিশ দিন বিক্রি করে দিয়েছি, এটা এখন আর “সম্ভাবনা না, বরং এখন এটা এমন একটা ঘটনা যা কখনো ঘটেনি।”

আমি এটাই ভেবে নিয়েছি। হয়তো আমার একদম আসল জীবনে, অনেক বছর পরে আমার আঁকাআঁকির ক্ষমতা ধীরে-ধীরে প্রস্ফুটিত হতো। আর সেটা হবার আগেই, বাইক এক্সিডেন্টের কারণে আমার সে সুযোগটা হারানোর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু আয়ুষ্কাল বিক্রির পরে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মিয়াগিকে পাওয়ার পরে, যে বিপুল পরিমাণ সময় আমি পাইনি যেটা কমে চরম আকারে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। আমার আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার আগে অন্তত আমার প্রতিভার বিকাশ ঘটতো, সেজন্য ধন্যবাদ

আমি এটাই ভেবেছিলাম।

****

আমি আঁকাআঁকিতে বেশ দক্ষ ছিলাম।

আমার সামনের যে কোনো দৃশ্য আমি হুবুহু নকল করতে পারতাম। যেন তেমন কোনো ব্যাপারই না বিষয়টা। যে কোনো দৃশ্য এক অবস্থান থেকে আরেক অবস্থানে রূপান্তর করার জন্য বিচারবুদ্ধিকে খুব সহজে প্রয়োগ করাতে ওস্তাদ ছিলাম আমি। আর এজন্য কেউ আমাকে কিছু শেখানোর কোনো প্রয়োজন পড়েনি।

গ্যালারিতে আমি পেইন্টিংয়ের দিকে তাকিয়েই খুব সহজে বুঝতে পারতাম। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে মূল ভাষা থেকে সম্পূর্ণ অন্য ভাষাতে। কেন “কোন কিছু ওভাবে আঁকা হয়নি” কেন “কোনো কিছু এভাবে আঁকা হয়েছে” এসব আরকি। আমার কোনো কিছুর প্রতি দেখার ভঙ্গি যে একদম ঠিক ছিল তা না। আসল ঘটনা হচ্ছে কোনো কিছু মনে করার ক্ষেত্রে আমার দারুণ প্রতিভা ছিল।

সতেরো বছর বয়সের এক শীতে, আমি আঁকাআঁকি ছেড়ে দিলাম। ভেবেছিলাম আমি যেভাবে চালিয়ে নিচ্ছিলাম, সেভাবে হিমেনোকে করা প্রতিজ্ঞার মতো বিখ্যাত হতে পারবো না। আমি আরও বেশি সফল হলে “সকল কাজের কাজি” ধরনের শিল্পী হতে পারবো।

যদিও অনেকের চোখে এটাও বিবেচনাযোগ্য সাফল্য হতে পারতো। কিন্তু হিমেনোর প্রতি আমার প্রতিজ্ঞা রাখার জন্য আমাকে অনেক বেশি অসাধারণ হতে হতো। আমার অমূল পরিবর্তন দরকার ছিল। যেন আমি মুহূর্তের উপর নির্ভর করে আঁকার জন্য নিজের উপর নির্ভর না করি।

পরেরবার আমি যখন পেইন্ট ব্রাশ হাতে তুলে নিবো সবকিছুই আমার নিজ থেকে আসতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি অন্য সবাই যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে; সেটা বাদ নিয়ে ভিন্নভাবে জগতটা আয়ত্বে আনতে না পারছি, আমি আঁকাআঁকি করবো না। এটাই ছিল আমার সিদ্ধান্ত।

হয়তোবা সিদ্ধান্তটায় কোনোভুল ছিল না। কিন্তু আমার বয়স উনিশ হওয়ার গ্রীষ্মে, তখনো দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। তো হাতে সময় কম বিধায়, আমি আবারো ব্রাশ তুলে নিলাম।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি বুঝে গেলাম যে আঁকাআঁকির জন্য একদম উপযুক্ত সময় তখনো আসেনি।

ফলশ্রুতিতে, আমি আঁকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। আমি এমনকি একটা আপেল’ও সঠিকভাবে আঁকতে পারছিলাম না। যখন কোনো কিছু আঁকার চিন্তা করতে লাগলাম, নিদারুণ দ্বিধায় ভুগতাম আমি। মনে হতো যেন আমি চিৎকার দিয়ে উঠবো।

রাতে শূন্যে হাঁটার মতো দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হলাম আমি। কোন লাইন এবং কোন রং প্রয়োজন সে সম্পর্কে কোনো প্রকার বিচারবুদ্ধি রইল না।

আমি বুঝতে পারলাম আমি আমার প্রতিভা হারিয়ে ফেলেছি। তার উপরে, সেটা ফিরে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। একদম প্রথম থেকে শুরু করার জন্য খুব বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে। আমি ব্রাশ তুলে রাখলাম, প্রতিযোগিতা থেকে পালিয়ে এলাম, এবং নিজেকে আবদ্ধ করে ফেললাম।

এক সময়, বাকি সবার দ্বারা আমার আর্ট অনুমোদিত হওয়ার জন্য এতটা মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার মনে হয় এটাই আমার দ্বিধার প্রথম কারণ।

সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা ছিল মারাত্মক ভুল। যখন ভুলটা একদম চরম পর্যায়ে পৌছাল; তখন আর আঁকার পরিস্থিতি রইল না।

সার্বজনীনত্ব মানুষের অনুকুল্যে নিয়ে আসে না। আপনি যা চান তাই পাবেন; যদি সেটার একদম গভীরে যেতে পারেন। তারপরে কিছু ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য পরিশ্রম করেন, এবং এমন কিছু সৃষ্টি করেন যা এক নজরে আলাদা কিছু বলে মনে হয়।

সেটা লক্ষ করার জন্য আমার সব চিন্তা-ভাবনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রয়োজন ছিল। এবং শুধু আনন্দের জন্য, আমার নিজেরও আঁকার প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে মিয়াগি আমাকে সে সুযোগটা করে দিয়েছে। ওকে “বিষয়” হিসাবে ব্যবহার করে, আমি আগে যা “আঁকাআঁকি” বলে মনে করতাম; সেটা থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম কিছু আঁকলাম।

এরপরে, সারারাত আমি প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁকে কাটালাম। যেটা কিনা আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে দেখতাম।

যে জগতে আমি বসবাস করতে চাইতাম, সে স্মৃতি কখনই আমার হওয়া সম্ভব ছিল না এবং এমন কোনো জায়গা যেখানে আমি কখনই যাইনি, এমন কিছু দিন যা অতীত কিংবা ভবিষ্যতের কোনো একদিন হতে পারে।

আমি আগে বুঝতে পারিনি, কিন্তু অনেকদিন ধরেই সেগুলো জমে ছিল। মিয়াগির ছবি আঁকার পরে, আমি বুঝতে পারলাম কিভাবে সেগুলো প্রকাশ করতে হবে।

হয়তো আমি এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যদিও সেটা আমার মৃত্যুর মাত্র অল্প কিছুদিন আগে। অবশেষে আমার প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে।

আমার মূল্য নির্ধারণ করা মহিলার কথা অনুযায়ী, শেষ ত্রিশ দিনে আমি যে ছবিটা আঁকতাম সেটা “এমনকি ডি চিরিকো ও খুব বেশি আবেগ তাড়িত বলে বিবেচনা করতেন।“

একমাত্র এই ব্যাখ্যাটাই দিলেন তিনি।

হ্যাঁ, শুনে মনে হচ্ছে আমি এরকম কিছু করতেই পারি।

যে দিনগুলোতে আমি আঁকাআঁকি করে ইতিহাসের ছোট্ট কর্ণারে আমার নাম লেখাতে পারতাম, জীবনের সে অংশটুকু বিক্রি করে যে অসম্ভব মূল্য পেলাম, সেটা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল।

মাত্র ত্রিশ দিনেই, আমি মিয়াগির ঋণ মওকুফের জন্য অল্প কিছু বাদে বাকিটা দেওয়ার মতো টাকা পেয়ে গেলাম। তবুও, ওকে আরও তিন বছর কাজ করতে হবে।

“ত্রিশ বছর থেকে ত্রিশ দিন বেশি মূল্যবান, হুহ?” আমরা আলাদা হয়ে যাওয়ার সময় পর্যবেক্ষক বলল।

এবং এভাবেই আমি অমরত্ব কে অস্বীকার করলাম।

সেই গ্রীষ্মে হিমেনো যা ভবিষৎবাণী করেছিল সেটার খুব কাছে চলে এলাম।

যদিও ওর ভবিষৎবাণীতে অর্ধেক ভুল ছিল।

শেষ মুহূর্তে আমি ধনীও হইনি, কিংবা বিখ্যাত কেউ হইনি।

কিন্তু ওর ভবিষৎবাণী অর্ধেক সত্যি হয়েছিল।

“সত্যিই ভালো কিছু” ঘটেছে। এবং যেমনটা ও বলেছিল, একদম অন্তরের অন্তস্থল থেকে, আমি “বেঁচে ছিলাম” বলে কৃতজ্ঞ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *