চ্যাপ্টার ১১ : পুশিং ফর অ্যা ভেন্ডিং মেশিন ট্যুর
কমিউনিটি সেন্টার থেকে চার ঘণ্টা হাঁটার পরে, অবশেষে আমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌছালাম। আমার ঘরের ঘ্রাণ নস্টালজিক করে তুলল।
শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে। পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে। শাওয়ারের দরজা খুলতেই, হঠাৎ আমার মনে হলো; আমার কি মিয়াগিকে আগে সেটা ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত কি-না। কিন্তু আমি যদি খুব বেশি উদ্বেগ দেখাই, তাহলে হয়তোবা আমাদের মাঝের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটা নষ্ট করে ফেলত পারি।
গায়ে আরও পানি ঢালার ইচ্ছেকে কোনোমতে দমন করে, দ্রুত নিজেকে সাফ সুতরো করে জামা-কাপড় বদলিয়ে লিভিং রুমে গেলাম।
এ-পর্যন্ত আমি যা বুঝেছি, আমি ঘুমালে মিয়াগি ইচ্ছেমতো গোসল করতে এবং খেতে পারে। সুতরাং আমি তখনই ঘুমিয়ে পড়তে গেলাম।
যখন ঘুমানোর ভান করছিলাম, মিয়াগিকে শাওয়ারের দিকে যেতে শুনলাম। যখন উঠতে নিলাম, ওর ফিরে আসার পদশব্দ শুনে দ্রুত চোখ বন্ধ করলাম।
“মি. কুসুনোকি” মিয়াগি বলল।
আমি ওর কথা না শোনার ভান করলাম।
“মি. কুসুনোকি, আপনি কি ঘুমিয়ে গিয়েছেন?” মিয়াগি আমার বালিশের কাছে এসে ফিসফিস করতে লাগল। “আমি জিজ্ঞেস করছি, কারণ মনে হচ্ছে আপনি ঘুমের ভান করে আছেন। তাহলে, খুবই ভালো হবে যদি সেটা আপনি আমার জন্য করে থাকেন… শুভ রাত্রি। আমি আপনার শাওয়ারটা ধার নিচ্ছি।”
শাওয়ারের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শোনার পরে, উঠে বসে সচরাচর মিয়াগি ঘরের যেখানে বসে সেই কোণের দিকে তাকালাম।
আজকে রাতেও ও ওখানে ঘুমাবে, তাই না। এমন একটা অবস্থায় ও ঘুমাবে; যা দেখে মনে হয় না কেউ ওখানে ঘুমাতে পারবে। কয়েক মিনিট ঘুমাবে তো কয়েক মিনিট নজর রাখবে।
পরীক্ষামূলকভাবে, মিয়াগি যেভাবে বসে সেভাবে নকল করে ওখানে বসলাম আমি। এবং ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বললেই ঘুম চলে আসে না।
মিয়াগি ফিরে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে সতর্ক কণ্ঠে বলল, “আপনি এখানে কী করছেন? আপনার বিছানায় ঘুমানো উচিত।”
“এটা তো আমার কথা। তোমার উচিত বিছানায় ঘুমানো। এভাবে ঘুমানো হাস্যকর।”
“এটা হাস্যকর হতে পারে। কিন্তু আমি এতে অভ্যস্ত।“
আমি বিছানার বাম পাশে সরে এলাম। “আমি এখন থেকে বাম পাশে ঘুমাবো। যাই ঘটুক না কেন, আমি ডান পাশে যাবো না, এমনকি দেখবোও না। আমাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য এটা খুবই নিখুঁত জায়গা। তুমি এটা ব্যবহার করতে চাও কী চাও না সেটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। কিন্তু যে কোনো মূল্যেই হোক আমি বাম পাশেই ঘুমাবো।”
আমি মেঝেতে ঘুমাবো আর ও বিছানায়, এরকম কিছু মিয়াগি গ্রহণ করবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। যদিও আমি ওকে বলেছি আমার পাশে ঘুমানোতে কোনো সমস্যা নেই। তার মানে এই না যে ও সেটা গ্রহণ করবে।
“আপনি কি এখনো আধো ঘুমে, মি. কুসুনোকি?” মিয়াগি জিজ্ঞেস করল যেন সে আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিতে চাচ্ছে।
ওকে অগ্রাহ্য করে চোখ বন্ধ করে রইলাম। প্রায় বিশ মিনিট পরে অন্য পাশে মিয়াগির অস্তিত্ব অনুভব করলাম।
দুজনে পিঠ একে অন্যের দিকে দিয়ে আমরা একটা বিছানা ভাগাভাগি করে নিলাম। আমি বুঝতে পারলাম পরামর্শটা ছিল আসলে আমার নিজের প্রশান্তির জন্য। এভাবে, আমি আসলে মিয়াগিকে আবারো ঝামেলায় ফেলছি।
ও এসব চায়নি। আমার মহানুভবতায় সাড়া দিতে গিয়ে ওর এত বছরের পর্যবেক্ষকের অধ্যাবসায়ে ক্ষতি হতে পারে।
তার উপরে, মৃত্যুর কাছাকাছি থাকা কারো খামখেয়ালিপূর্ণ মহানুভবতা অস্থির লাগবে পারে। এরকম জিনিস মানুষকে সাহায্য করে না; উলটো মানুষকে কষ্ট দেয়।
তবুও মিয়াগি আমার কোমলতার নিষ্প্রভতা আরও বেশি কোমলতা দিয়ে গ্রহণ করে নিয়েছে। আমার মনে হয় ও আমাকে শ্রদ্ধা দেখাচ্ছে। অথবা হতে পারে ও খুবই ক্লান্ত।
ঘুম ভেঙে গেলে দেখলাম, রক্তিম সূর্যাস্ত পুরো ঘর রাঙিয়ে দিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম মিয়াগি অনেক আগেই জেগে উঠেছে। কিন্তু ও মনে হচ্ছে একটু বেশিই ঘুমাচ্ছে। আমি বিছানা থেকে উঠে তেছরা চোখে উজ্জ্বল সূর্য কিরণের দিকে তাকালাম। যে মুহূর্তে আমাদের চোখে চোখ মিলল, আমরা দুজনেই চোখ সরিয়ে নিলাম। গভীর ঘুম ঘুমানোর ফলে ওর চুল এবং জামা-কাপড় এলোমেলো হয়ে রয়েছে। ওকে প্রায় অরক্ষিত লাগছে।
“আমি আজকে একটু বেশি ক্লান্ত ছিলাম” মিয়াগি অজুহাত দেওয়ার মতো করে বলল। “আগামীকাল থেকে আমি আমার নিয়মিত জায়গায় ঘুমাবো।” তারপরে ও যোগ করল, “আপনাকে অনেক-অনেক ধন্যবাদ।”
মিয়াগির সাথে আমি সূর্যাস্তের সময় হাঁটতে লাগলাম। ঘুর্ঘুরে পোকা গুনগুন করে চলেছে।
হয়তো বিছানার ঘটনাটার জন্যই, মিয়াগি আজকে বেশ দূর থেকে অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে।
কনভেনিয়েন্স স্টোরে, আমার অল্প যে টাকা বাকি ছিল সেটা এবং আমার মাসিক পার্ট-টাইম জবের টাকা তুললাম।
এটা আমার শেষ যুদ্ধের তহবিল।
আমাকে খুব সচেতনতার সাথে এটা ব্যবহার করতে হবে।
পথচারী চলাচল করে এমন একটি ব্রিজের উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখার পরে, বিফ বোল শপের দোকানে একটা স্পেশাল মেন্যু অর্ডার করলাম। এটাতে মিল টিকেট সিস্টেম ব্যবহার করতে হয়। সুতরাং মিয়াগি ওর নিজের টিকেট কিনে আমার হাতে দিলো।
“করার মতো কিছু পাচ্ছি না” আমি বললাম মিশো স্যুপ শেষ করার পরে। ‘মৃত্যুর আগে করতে চাই’ লিস্টের সবকিছু করা হয়ে গিয়েছে, তো এখন কী করণীয়?”
“যা মনে চায় করুন। আপনার নিশ্চয় শখ কিংবা এরকম কিছু থাকার কথা, তাই না?”
“হ্যাঁ। ওগুলো হচ্ছে গান শোনা এবং বই পড়া। কিন্তু এখন চিন্তা করে দেখলাম, এদুটো আসলে বেঁচে থাকার জন্য। মিউজিক এবং বই পড়াকে আমি জীবনের সাথে আপোষ করার জন্য ব্যবহার করতাম। এখন যেহেতু বেঁচে থাকার জন্য জোর করার কিছু নেই, এগুলো আগের মতো আর অতটা প্রয়োজনীয় নয়।”
“সম্ভবত, আপনি সেগুলো যেভাবে উপলব্ধি করতেন, সেটা কিছুটা পরিবর্তন করা উচিত। তাহলে এখন থেকে আপনি ওগুলোর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।“
“হ্যাঁ, কিন্তু সেখানে একটা সমস্যা আছে। যত বই-ই আমি পড়ি না কেন কিংবা যত মিউজিক আমি শুনি না কেন। সেগুলোর সাথে কোনো সম্পর্ক অনুভব করি না, যেন এর সাথে আমার করার কিছুই ছিল না। ভালো করে চিন্তা করো। এই পৃথিবীর প্রায় সব কিছুই তৈরি করা হয়েছে বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য। অবশ্যই তা খুবই স্বাভাবিক। যে সকল মানুষ মারা যাবে; ওদের জন্য তো কেউ কিছু তৈরি করবে না।“
প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স্ক একজন লোক বিফ বোল খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল। আমাকে একা-একা মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করল।
“আপনি কি এগুলো ছাড়া সাধারণ কিছুর কদর করেন না? উদাহরণস্বরূপ, আপনি কি পরিত্যক্ত জায়গার দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন? অথবা ট্র্যাকে একা-একা হাঁটা অথবা রেলপথের গিঁট গণনা করা? অথবা এক দশক আগে পরিত্যক্ত হওয়া আর্কেড ক্যাবিনেট খেলা পছন্দ করেন?”
“এগুলো একদম নির্দিষ্ট করা। আমার ধারণা ঠিক হয়ে থাকলে, তুমি এ ধরনের লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করেছ?”
“হ্যাঁ। এমনকি এমন একজন ছিল যিনি উনার জীবনের শেষ মাসটা পিকআপ ট্র্যাকের উপরে শুয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। আয়ুষ্কাল বিক্রির সকল টাকা অচেনা একজন বৃদ্ধ লোককে দিয়ে অনুরোধ করেছিল পিকআপ ট্র্যাকটা এমন জায়গা দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতে যেখানে কেউ তাকে থামাবে না।”
“অবিশ্বাস হলেও সত্যি, আমার কাছে বেশ শান্তিপূর্ণ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। মনে হচ্ছে লোকটি সবচেয়ে বুদ্ধিমান কাজ করেছে।”
“বরং এটা এর চেয়ে বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। উড়ে যাওয়া দৃশ্য দেখার মধ্যে আলাদা একটা সতেজ অনুভূতি আছে।”
আমি চেষ্টা করলাম সেটা কল্পনা করার। নীল আকাশের নিচে, গ্রাম্য পথে, আরামদায়ক মৃদুমন্দ বাতাস অনুভব করার চেষ্টা করলাম। আমার সমস্ত স্মৃতি এবং অনুশোচনা মাথা থেকে রাস্তায় পর্যবসিত হবে। যতই সামনে এগুবে, ততই দূরে সরে যাওয়ার অনুভূতি হবে। অনেকটা মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির মতো।
“আমি কি এরকম আরও কিছু শুনতে পারি? যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার ব্যবসায়িক কারণ অথবা গোপনীয়তার কারণে বলতে সমস্যা না হয়” আমি অনুরোধ করলাম।
“অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আমি আপনাকে এরকম ভুরি-ভুরি বলতে পারবো” মিয়াগি বলল। “আপনি এখানে এভাবে কথা বলতে থাকলে, আপনার দিকে মানুষ বরং সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে।”
ফিরে আসার সময় আমরা বিশাল বাঁক নিয়ে একটা ছোট সূর্যমুখীর মাঠ পাশ কাটিয়ে এলাম। অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে আমি কাবে চড়ে বসে আবারো বেরিয়ে পড়লাম।
হয়তো আমরা দুজনেই হালকা জামা-কাপড় পরেছিলাম। আমি পরিষ্কারভাবে ওর শরীরের স্নিগ্ধতা অনুভব করতে পারলাম। বিষয়টা আমাকে অস্থির করে তুলল।
ঘটনাক্রমে রেড লাইট খেয়াল করিনি বলে আমাকে দ্রুত ব্রেক চেপে ধরতে হলো। বিষয়টা আমাদের দুজনকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলল। আশা করছি ও আমার দ্রুগতির নাড়ি স্পন্দন টের পায়নি।
আমরা পাহাড়ে উঠলাম। কাবটা পার্ক করলাম শহরের সেরা দৃশ্য দেখার বিবেচিত সেই জায়গায়। একটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে দুটি ক্যান কফি কিনে দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম।
আমাদের ঠিক নিচে আবাসিক এরিয়াতে কমলা আলো বিচ্ছুরণ হচ্ছে। কাছ থেকে দেখা শহরের আলোর তুলনায় এখন খুব ছোট দেখাচ্ছে আলোটাকে।
ফিরে এসে, আমি দাঁত মাজলাম। তারপরে বিছানায় শুয়ে মিয়াগি কথা শুনতে লাগলাম। ও আমাকে বাচ্চাদের গল্পের বই পড়ে শোনানোর মতো ছন্দে ওর আগের পর্যবেক্ষণ করা লোকদের তুলনামূলক কম বেদনাদায়ক কাহিনি বলতে লাগল।
সত্যি বলতে, গল্পগুলোতে বিশেষত নতুনত্ব নেই। কিন্তু ওগুলো আমাকে চলতি সাহিত্যকর্ম থেকে বেশি সান্ত্বনা দিলো।
পরের দিন যখন বাকি অরিগামি পেপার দিয়ে কাগজের সারস বানাতে- বানাতে চিন্তা করতে লাগলাম; এখন কী করা উচিত। মিয়াগিও টেবিলে বসে সারস বানাতে শুরু করল।
“কাগজের সারসে ডুবে মরতে পারলে খারাপ হবে না” আমি বললাম হাতের কোষে কয়েকটা নিয়ে সেগুলো উপরে ছুড়ে দিয়ে। একইভাবে মিয়াগি অনেকগুলো সংগ্রহ করে আমার মাথায় ঢেলে দিলো।
অরিগামি নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, বাইরে গেলাম তাজা বাতাসের জন্য। সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনে জায়গাতেই একটা ধরালাম। এবং ভেন্ডিং মেশিন থেকে ক্যানের কফি কিনে খাওয়ার পরে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম।
যা আমার নাকের ডগায় থাকা স্বত্বেও দেখিনি।
মনে হয় মুখ ফস্কে কিছুটা বিড়বিড়ানি বেরিয়ে গিয়েছিল। কারণ, মিয়াগি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে?”
“না, আসলে, এটা সত্যিই বোকামি। মাত্রই মনে পড়ল, বাস্তবে আমার পছন্দনীয় কিছু একটা করার আছে।“
“প্লিজ, আমাকে বলুন।”
“আমি ভেন্ডিং মেশিন পছন্দ করি” মাথা চুলকে বললাম আমি।
“ওহ” মিয়াগি মনে হলো একটা বিট মিস করল। “…ওগুলোর কোন ব্যাপারটা আপনার পছন্দ?”
“হুমম। আমি নিজেও নিশ্চিত করে জানি না কী বলবো। কিন্তু ছোট থাকা অবস্থায়, বড় হয়ে ভেন্ডিং মেশিন হতে চাইতাম।”
মিয়াগি ধীরে-ধীরে মাথা হেলিয়ে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল।
“উমম… শুধু নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করছি। ভেন্ডিং মেশিন বলতে আপনি কি সেই মেশিনের কথা বলছেন যেটা কফি, সোডা এসব জিনিস বিক্রি করে? আপনি যেগুলো ব্যবহার করেন সেগুলোর মতো?”
“হ্যাঁ। কিন্তু এর চেয়েও বেশি কিছু। সিগারেট, ছাতা, উদন, বরফ, আইসক্রিম, হ্যামবার্গার, ওডেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কৰ্ণ বিফ স্যান্ডউইচ, কাপ নুডুলস, বিয়ার, মদ… যে ভেন্ডিং মেশিন সব ধরনের জিনিস বিক্রি করে। জাপান হচ্ছে ভেন্ডিং মেশিনের ভূমি। কারণ, তারা জায়গামতো রাখার জন্য একদম উপযোগী।“
“তাহলে, আপনার ভেন্ডিং মেশিনের প্রতি ভালোবাসা আছে।”
“হ্যাঁ, তা আছে। আমি এগুলো ব্যবহার করতে পছন্দ করি। এমনকি আমি এগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতেও পছন্দ করি। পুরাতন সাধারণ ভেন্ডিং মেশিনেও আমার চোখ আটকে যায় এবং কাছ থেকে দেখতে বাধ্য করে।“
“হুম… নিজস্বতা আছে শখটার মধ্যে।” মিয়াগি আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করল। এটা সত্যিই অর্থহীন শখ। একটুও কাজের মতো কোনো কাজ নয়। যা শুধু অর্থহীন, নিষ্কর্ম জীবনের প্রতীক, আমি চিন্তা করলাম।
“আমার মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি” মিয়াগি আমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলল।
“আমার ভেন্ডিং মেশিন হওয়ার খায়েশ?” আমি হেসে বললাম।
“না, আমার মনে হয় না আমি সেটা বুঝতে পারবো। কিন্তু, দেখতেই পাচ্ছেন… ভেন্ডিং মেশিন অনেক আগে থেকেই আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি টাকা দিয়ে যাবেন; সেগুলো আপনাকে আন্তরিকতা প্রদান করবে। দ্রবের মূল্যের চেয়েও বেশি আন্তরিকতা প্রদান করবে।”
আমি ওর ছোট-বক্তৃতায় কিছুটা প্রভাবিত হলাম। “দারুণ, আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তুমি সেটা আরও ভালোভাবে বলে দিলে।”
“ধন্যবাদ” বলে বো করল মিয়াগি। ওকে বিশেষ একটা খুশি মনে হলো না। “ভেন্ডিং মেশিন আমাদের পর্যবেক্ষকদের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্লার্কদের মতো ওরা আমাদের উপেক্ষা করে না। তো আপনি ভেন্ডিং মেশিন পছন্দ করেন এটা খুবই ভালো কথা। তাহলে, আপনি আসলে এখন কী করতে চান?”
“আরে, পছন্দ করি এমন আরেকটা জিনিসের কথা বলতে দাও আমাকে। প্রতিবারই আমি এই সিগারেটের দোকানে এলে, এটা আমাকে পল অস্টারের “স্মোক”-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিদিন সকালে সিগারেটের দোকানের সামনে যা ঘটে তা আমি পছন্দ করি এবং এমন কিছু একটার ছবি বারেবারে তুলতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এরকম সাধারণ কিছুর উপর বিনিয়োগ করা সত্যি দারুণ থ্রিলিং। আমি অগি রেন-কে অনুকরণ করতে চাই। এমন ছবি তুলতে চাই যেগুলো প্রথম দেখাতে এক নজরে অর্থহীন মনে হয়। এমনভাবে সাধারণ ভেন্ডিং মেশিনের অগণিত ছবি তুলে যাওয়া, যা অন্য কেউ পারবে না।”
“আমি এখনো নিশ্চিত না ব্যাপারটা কিভাবে নিবো” মিয়াগি বলল। “কিন্তু আমার মনে হয় আমি এটাও পছন্দ করছি।”
তো এভাবেই, আমার ভেন্ডিং মেশিনের ট্যুর শুরু হলো।
*******
সস্তায় কেনা যায় এমন একটা দোকান থেকে আমি একটা সিলভার হ্যালিডে ক্যামেরা, একটা স্ট্র্যাপ, এবং ফিল্মের দশটা রোল কিনলাম। একমাত্র এই প্রস্তুতিটাই আমার নেওয়ার ছিল।
আমি জানি একটা ডিজিটাল ক্যামেরা সস্তা এবং সহজে পরিচালনা করা যায়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল “ছবি তোলার” জন্য এটাই ভালো হবে।
আমি ক্যামেরাটা ফিল্ম দিয়ে ভর্তি করে, কাবে চড়ে বসলাম। এবং আমার চোখে পড়া সবগুলো ভেন্ডিং মেশিনের ছবি তুলে গেলাম।
যতবারই ছবি তুলি না কেন, যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি ভেন্ডিং মেশিনের চারপাশের জিনিসপত্র যাতে ছবিতে থাকে।
ছোটখাটো পার্থক্য নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না যেমন কী ধরনের ড্রিঙ্ক রাখা হয়েছে এবং বাটনের লেআউট কেমন। আমি কেবল ভেন্ডিং মেশিন কী অবস্থায় আছে এবং কোথায় আছে; সেটার ছবি তুলতে চেয়েছি।
একবার খোঁজা শুরু করার পরে, শহর জুড়ে অনেক-অনেক ভেন্ডিং মেশিনের সন্ধান পেলাম। অ্যাপার্টমেন্টের চারপাশেই কয়েক ডজন ছবি তুললাম।
এতদিন অনেক-অনেক ভেন্ডিং মেশিনকে উপেক্ষা করে গিয়েছিলাম। যতবারই এগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাই না কেন, হঠাৎ এগুলো আবিষ্কার করতে পেরে আমার হৃদয় খুশিতে নেচে উঠেছে।
মাঝে-মাঝে একই ভেন্ডিং মেশিন সকালে এবং রাতে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। যখন কিছু-কিছু ভেন্ডিং মেশিন চমকাতে এবং পোকামাকড় আলোতে ভনভন করতে থাকে; অন্যগুলো তখন শুধু বাটন জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে অন্ধকারে মিশে থাকে।
আমি জানি, এমনকি এরকম হাস্যকর শখের বেলায় আমার চেয়েও সিরিয়াস মানুষ আছে। ওদের সাথে তুলনা করতে পারবো না নিজেকে।
কিন্তু মনেপ্রাণে আসলেই বিষয়টা পাত্তা দিই না আমি।
প্রতিদিনের শুরুতে, আমি ফটো স্টুডিওতে যাই এবং ফিল্ম ডেভেলাপ হতে হতে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে সকালের নাস্তা করি। দিন শেষে, প্রতিদিন সকালে যে ছবিগুলো ডেভেলাপ করেছিলাম; সেগুলো টেবিলের উপরে রেখে মিয়াগির সাথে মিলে দেখি। তারপরে সতর্কতার সাথে প্রতিটি অ্যালবামে রাখি।
সবগুলো ছবির মধ্যে যোগসূত্র হচ্ছে-ছবিগুলো সব ভেন্ডিং মেশিনের উপর ফোকাস করা।
অনেকটা এরকম যে, একজন লোক সবার মাঝে দাঁড়িয়ে একই ছবি তুলছে। সবসময় একই পোজ এবং একই অভিব্যক্তি সহকারে।
কিভাবে আমি প্রতিদিন সকালে ভেন্ডিং মেশিনের ছবি ডেভেলাপ করার জন্য চলে আসি, ব্যাপারটা দেখে ফটো স্টুডিয়োর মালিক লোকটা আমার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করল।
লোকটার বয়স চল্লিশের মতো হবে। চুলগুলো অনেক ধূসর। লোকটি ভীষণভাবে শীর্ণ এবং খুব বিনয়ী। একদিন তিনি আমাকে সাধারণভাবে শূন্যের সাথে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল।
“তো, ওখানে কেউ একজন আছে, তাই না?”
মিয়াগি এবং আমি একে অন্যের দিকে তাকালাম।
“ঠিক ধরেছেন। মিয়াগি নামের একটা মেয়ে। তার কাজ হচ্ছে আমাকে পর্যবেক্ষণ করা” আমি বললাম। যদিও মিয়াগি জানে এটা অর্থহীন। তবুও ও মাথা নিচু করে বো করল।
আমি আশা করিনি উনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন। কিন্তু তিনি সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে “বেশ ভালো” বুঝিয়ে দিলেন এবং দ্রুত মিয়াগির অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেন।
দৈবাৎ এরকম অদ্ভুত লোকের দেখা পাওয়া যায়।
“তাহলে এসব অদ্ভুত ছবি, তবে কি তুমি আসলে মেয়েটার ছবি তুলছো?” লোকটি জিজ্ঞেস করল।
“না, এরকম কিছু না। এগুলো কেবলই ভেন্ডিং মেশিনের ছবি। আমি মিয়াগির সাহায্য নিয়ে ভেন্ডিং মেশিনের ট্যুর দিচ্ছি।”
“এতে মেয়েটার কোনো লাভ হবে?”
“না। এটা আসলে আমার শখ। মিয়াগি শুধু আমার সাথে আছে। এটাই ওর চাকরি।”
দোকানের মালিকের চেহারাই বলে দিলো ঠিক কতটুকু বুঝেছেন তিনি। “ঠিক আছে, মনে থাকবে” তিনি বললেন।
দোকান থেকে বের হয়ে মিয়াগি কাবের পিছনের সংযুক্ত সিটের পাশে দাঁড়াল। সেই অবস্থায় আমি ওর একটা ছবি তুললাম।
“কী করছেন আপনি?” ও জিজ্ঞেস করল মাথা হেলিয়ে।
“দোকানের মালিক বলার পরে মনে হলো একটা ছবি তুলি।”
“ছবিটা অন্যদের কাছে অর্থহীন বাইকের ছবি মনে হবে।”
“আমার সকল ছবিই অন্যদের কাছে অর্থহীন মনে হবে।” আমি বললাম। অবশ্যই, স্টুডিয়োর মালিকের মতো লোকও আছে। কিন্তু এদের সংখ্যা হাতেগোনা।
একদিন সকালে আমরা যখন একটা আস্তাকুঁড়ের উদ্দেশ্য অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হচ্ছিলাম, আমি দরজা ধরে রেখেছিলাম মিয়াগিকে জুতা পরার সময় দেওয়ার জন্য। সেই মুহূর্তে আমার এক প্রতিবেশী নেমে আসছিল। লম্বাচওড়া সে লোকটির চোখ থেকে আগুন ঝরছিল।
মিয়াগি বের হয়ে এসে দেরি করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করল। আমি ওর পিছনে দরজা বন্ধ করে বললাম, “ঠিক আছে। এবার যাওয়া যাক।“
লোকটি আমার দিকে বিরক্ত হওয়ার চাহনি দিলো।
***********
দিনটা ছিল একদম পরিষ্কার, তেমন ঝড়ো নয়। কখনো নামও শুনিনি এমন একটা অঞ্চলে হারিয়ে গেলাম আমি। দুই ঘণ্টা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘোরার পরে অবশেষে পরিচিত একটা জায়গায় উপস্থিত হলাম। আবারো আমার এবং হিমেনো’র-আদি শহরে উপস্থিত হলাম আমি। হয়তো আমি হারিয়ে গেলে অপরিহার্য দিকনির্দেশনা স্বরূপ এখানে পৌঁছে যাই। নাহয় এটা অনেকটা স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সহজাত প্রবৃত্তি মতো।
অবশ্যই, এতে জায়গাটা যে ভেন্ডিং মেশিনে পরিপূর্ণ; এই সত্যিটা পরিবর্তন করা যাবে না। আমি ছবি তুলতে তুলতে কাবটা চালিয়ে গেলাম।
আমি একটা ক্যান্ডির দোকানে আইসক্রিমের ভেন্ডিং মেশিন খুঁজে পেলাম। ছোট থাকতে প্রায়ই যেতাম ওখানে। আমার নির্দিষ্ট পছন্দ ছিল চকলেট বার্লি পাফস, কিনাকো স্টিকস, ডাইস ক্যারামেল, অরেঞ্জ গাম, বোটান রাইস ক্যান্ডি। চিন্তা করে দেখলাম, আমি মিষ্টি ছাড়া কিছুই খাইনি।
ক্যান্ডির দোকানটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু লাল জং ধরা, ধসে যাওয়া ভেন্ডিং মেশিনটা প্রথমবার যেমন দেখেছিলাম তেমনই আছে।
রাস্তার অপর পাশের ফোন বুথ দেখে বাহির থেকে পাবলিক টয়লেট বলে মনে হয়। সেটাও সেসময় থেকে আছে। ভেন্ডিং মেশিনটাকে দেখে এখনো কোনোমতে কাজ করে বলে মনে হলো।
মিয়াগি এবং আমি জংলা পার্কের বেঞ্চে বসলাম। গাছের ফাঁক দিয়ে আশা সূর্যের আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে গিয়েছে। আমরা আজকে সকালে নিজেদের বানানো ওনিগিরি খেলাম।
আশপাশে জনমানুষের কোনো দেখা নেই। কিন্তু একটা কালো এবং বাদামি বিড়ালকে দেখা গেল। বিড়ালগুলো দূর থেকে দেখতে লাগল যেন কোনো বিপদ আঁচ করার চেষ্টা করছে। তারপরে ধীরে-ধীরে আমাদের কাছে আসতে লাগল।
আমার কেবলই মনে হচ্ছিল ওদের দেওয়ার মতো খাবার যদি আমার কাছে থাকতো। দুঃখজনকভাবে আমার কাছে এমন কিছু নেই যা বিড়ালদের আকর্ষণ করবে।
“আমার এখন মনে পড়ল মিয়াগি, বিড়ালরা কি তোমাকে দেখতে পায়?”
মিয়াগি উঠে দাঁড়িয়ে বিড়ালদের কাছে গেল। কালো বিড়ালটা দৌড়ে পালিয়ে গেল। বাদামি বিড়ালটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়াল, তারপরে কয়েক সেকেন্ড পরে প্রথম বিড়ালের পথ অনুসরণ করল।
“অবশ্যই, কুকুর এবং বিড়াল আমাকে দেখতে পায়।” মিয়াগি বলল, ঘুরে দাঁড়িয়ে। “এক প্রকার বলা যায়, ওরা আমাকে পছন্দ করে না।”
খাওয়ার পরে আমরা ছোটখাটো একটা বিশ্রাম নিলাম। মিয়াগি ওর নোটবুকে পেন্সিল দিয়ে আঁকতে শুরু করল।
আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বিড়ালগুলোকে খুঁজে পেলাম। ওগুলো একটা দেয়ালের উপর উঠেছে। মনে হচ্ছে মিয়াগির দৃশ্যটা মনে ধরেছে।
ওর এরকম শখ আছে জেনে আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। হয়তো এতদিন ধরে ওকে দেখে মনে হতো; ও ওর পর্যবেক্ষণ লগ লিখছে। কিন্তু ও আসলে ওর নিজের বিনোদনে মগ্ন ছিল।
“দেখা যাচ্ছে তোমারও শখ আছে?” আমি মন্তব্য করলাম।
“হ্যাঁ, আপনি কি অবাক হয়েছেন?”
“হ্যাঁ, যদিও তোমার কাজ তেমন সুবিধার না।“
“সে কারণেই আমি অনুশীলন করে যাচ্ছি। এটা দারুণ না?” মিয়াগি বলল, কোনো কারণে গর্বিত হয়ে।
“তুমি কী আঁকছ আমাকে দেখাতে পারো?”
ও হঠাৎ ওর নোটবুক বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল।
“আমাদের এখন উঠা উচিত” মিয়াগি বলল, দ্রুত চলতে-চলতে।
*****
আমার নিজের শহরে প্রায় আধা দিন কাটানোর পরে, পরবর্তী শহরে যাওয়ার সময় যখন ক্যান্ডি স্টোরটা আবারো পাশ কাটাচ্ছিলাম। দোকানের সামনের স্নো ব্র্যান্ড বেঞ্চে কাউকে বসে থাকতে দেখলাম। বেঞ্চে বসে থাকা মহিলাকে আমি চিনি।
কাবটা রাস্তার পাশে পার্ক করলাম। ইঞ্জিন বন্ধ করে বেঞ্চে বসা বৃদ্ধ মহিলার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি
“এই যে শুনছেন।“
উনার প্রতিক্রিয়া জানাতে বেশ সময় লাগল। কিন্তু আমার কণ্ঠ উনার কানে ঠিকই পৌঁছেছে। তিনি আমার দিকে চোখ ফেরালেন।
উনার বয়স ৯০ বছরের উপরে হবে নিশ্চিত। মুখ এবং কোলের উপর ভাঁজ করে রাখা হাতে হাজারের উপর বলিরেখা। খাড়া সাদা চুল ঝুলে রয়েছে নির্জীবভাবে। এবং উনার বিমর্ষ চাহনি একেবারে করুণ। আমি বেঞ্চের সামনে উবু হয়ে বসে আবারো অভিবাদন জানালাম।
“আপনি সম্ভবত আমাকে মনে করতে পারছেন না, তাই না?”
মনে হচ্ছে উনার নীরবতাকে অনুমোদন হিসাবে ধরে নিতে হবে।
“বুঝতে পেরেছি। প্রায় দশ বছর আগে শেষবার আমি এখানে এসেছিলাম।”
যা প্রত্যাশা করেছিলাম। উনি কোনো উত্তর দিলেন না। বৃদ্ধা মহিলার দৃষ্টি কয়েক মিটার সামনে নিবদ্ধ রইল। আমি একা একাই কথা চালিয়ে গেলাম।
“কিন্তু আমি আপনাকে ভালোভাবেই মনে করতে পারছি। তরুণ থাকলে ভালো স্মৃতি থাকবে এটা বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই। আমার বয়স বিশ হলেও অতীতের অনেক কিছু আমি ভুলে গিয়েছি। সুখের কিংবা দুঃখের যাই হোক না কেন, আপনি যদি ঘটনাটা মনে না করেন তাহলে খুব দ্রুত ভুলে যাবেন। মানুষ উপলব্ধি করে না যে, তারা ভুলে যাওয়াই ভুলে যায়। সবাই যদি অতীতের সুখের মুহূর্তগুলো নিখুঁতভাবে জমিয়ে রাখে, তাহলে তারা তাদের অপেক্ষাকৃত নিঃসাড় বর্তমান জীবনে দুঃখের জীবনযাপন করবে। যদি সবাই অতীতের দুঃখের স্মৃতি নিখুঁতভাবে জমা রাখে, তবুও তারা দুঃখী থাকবে। সবাই শুধু তাই মনে রাখে যা মনে রাখা অস্বস্তিকর নয়।”
কোনো প্রকার তর্ক কিংবা সম্মতির ঝামেলা নেই। বৃদ্ধা মহিলা এখনো কাকতাড়ুয়ার মতো স্থির হয়ে আছে।
“যদিও স্মৃতি অস্থায়ী তবুও আপনি আমার মন থেকে মুছে যাননি। কারণ, সেই সময়ে আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। এটা খুবই বিরল ঘটনা। অবশ্যই, দশ বছর আগেও, আমি মানুষের প্রতি কদাচিৎ কৃতজ্ঞ ছিলাম। এমনকি যখন প্রাপ্তবয়স্করা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতো; আমি ভাবতাম এমন ব্যবহার করাটাই তাদের নিয়ম। সুতরাং আমি ভাবতাম তাদের বন্ধুত্ব খাঁটি নয়। হ্যাঁ, আমি আকর্ষণহীন এক শিশু ছিলাম। এরকম বাচ্চাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। যখন আমার বয়স আট অথবা নয় ছিল; ঠিক কবে ভুলে গিয়েছি, আমার মায়ের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলাম। আমরা ঠিক কী নিয়ে ঝগড়া করেছিলাম আমার এখন মনে নেই। নিশ্চিতভাবেই কোনো ফালতু বিষয়ই হবে।”
আমি বৃদ্ধা মহিলার পাশে বসে বেঞ্চের পেছনে হেলান দিয়ে, দূরের তোরণ এবং নীল আকাশের মেঘের দিকে তাকালাম।
“আগপিছু চিন্তা করিনি আমি। তো আমি ক্যান্ডির দোকানে গেলাম সময় কাটানোর জন্য। আমার বয়সের কোনো বাচ্চা, দিনের ওই সময়ে একা-একা বাইরে ঘোরাফেরা করার মতো সময় ছিল না এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি বাসায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই?” বাবা-মায়ের সাথে বাকবিতণ্ডার পরে, আপনাকে উল্টাসিধা কিছু একটা বলেছিলাম। আপনি সেটা শুনে রেজিস্টারের পেছনের একটা দরজা খুলে দিয়ে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন। ভেতর থেকে কিছু ক্যান্ডি এবং চা নিয়ে এলেন। কয়েক ঘণ্টা পরে, আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে একটা কল এলো আর যখন উনারা জিজ্ঞেস করলেন আমি ওখানে আছি কিনা। আপনি উত্তর দিয়েছিলেন “ও আছে, কিন্তু ধরে নিন আরও এক ঘণ্টার জন্য নেই” এবং ফোনটা রেখে দিলেন। হয়তো এই স্মৃতির কোনো অর্থ আপনার কাছে তেমন কিছুই মনে হবে না। কিন্তু আমার কাছে এই অভিজ্ঞতা বিশেষ অর্থ বহন করে; তার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।”
“আপনি কি আমার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে চান?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
বৃদ্ধ মহিলা চোখ বন্ধ করল। মনে হচ্ছে অত্যধিকরকম শক্ত হয়ে গিয়েছেন উনি।
“আপনি যদি আমাকে ভুলে গিয়ে থাকেন তাহলে আপনি হিমেনোকেও ভুলে গিয়ে থাকবেন। আমি সবসময় ওর সাথেই দোকানে আসতাম। ওর নামের অর্থ বোঝানোর মতোই, ও ছিল রূপকথা থেকে উঠে আসা রাজকন্যা। আমি আঘাত দিতে চাই না, কিন্তু ওর সৌন্দর্যের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যা এই শহরের সাথে ঠিক খাপ খায় না। আমি এবং হিমেনো দুজনেই স্কুলে কুলাঙ্গার ছিলাম। আমাকে ঘৃণা করার কারণ ছিল সম্ভবত আমি উন্নাসিক ধরনের ছিলাম বলে। কিন্তু হিমেনোকে ঘৃণা করতো কারণ, ও সবার থেকে ভিন্ন ছিল বলে। আমি জানি এটা আমার পক্ষে উদ্ধত হয়ে যায়, কিন্তু আমি এর জন্য কৃতজ্ঞ অনুভব না করে পারি না। কারণ, গ্রুপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার ফলেই, হিমেনো এবং আমি একজোট হতে পেরেছিলাম। আমি তখন ভাবতাম শুধু হিমেনো পাশে থাকলে, আমি সকলের কাছ থেকে সকল অপবাদ সামলাতে পারবো। যেভাবেই হোক, ওরা আমার এবং হিমেনোর সাথে একই আচরণ করতো।”
প্রতিবার যখন আমি ‘হিমেনো’ বলি, বৃদ্ধ মহিলা খুব অল্প পরিমাণে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এতে আনন্দিত হয়ে আমি কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম।
“ফোর্থ গ্রেডের গ্রীষ্মে হিমেনোকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। কারণ, ওর বাবা-মা চাকরি পরিবর্তন করেছিল। সেটাই ওর ভাবমূর্তিকে আমার দৃষ্টিতে দেবত্বারোপ করার ট্রিগার হিসাবে কাজ করেছিল। ‘যদি বিশ বছরের মধ্যে আমরা কাউকে খুঁজে না পাই; তাহলে দু’জনে একসাথ হবো’ ওর এই কথাটাকে অবলম্বন করে আমি পুরো দশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি মাত্র সেদিন জানতে পারলাম, আমার প্রতি হিমেনোর একসময়ের অনুরাগ মারাত্মক ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। ও এমনকি আমার চোখের সামনে আত্মহত্যা করার পরিকল্পনাও করেছিল। এরপরে, আমার হঠাৎ মনে পড়ল হিমেনোর সাথে দেখা হওয়ার আগে, আমি টাইম ক্যাপসুল তুলতে গিয়েছিলাম। যেটা আমাদের পুরো ক্লাস চিঠি দিয়ে ভর্তি করে এলিমেন্টারি স্কুলের পিছনে পুঁতে রেখেছিল। আমি জানি আমার সত্যিই কাজটা করা উচিত হয়নি। কিন্তু কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি খুব দ্রুতই মারা যাবো। তাই আমি ভেবেছি আমার অন্তত এইটুকু করার অনুমতি পাওয়া উচিত।”
এখন।
উত্তরগুলো মিলিয়ে নিলে কেমন হয়।
“সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, হিমেনোর চিঠি ওখানে ছিল না। আমি ধরে নিয়েছিলাম সেদিন হিমেনো ক্লাসে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম, আমি যা ভাবছি সেটা সম্ভব নয়। চিঠিগুলো আমাদের শিক্ষিকা যথেষ্ট সময় নিয়ে আমাদের প্রস্তুত করতে দিয়েছিলেন। শিক্ষিকা এমন মানুষ ছিলেন না যে, কেউ একজন উপস্থিত ছিল না বলে তার চিঠি ছাড়াই টাইম ক্যাপসুল পুঁতে ফেলবেন। খুব সহজেই অনুমান করা যায়, আমার আগেই কেউ টাইম ক্যাপসুল খুলেছিল এবং হিমেনোর চিঠিটা সরিয়ে ফেলেছিল। যদি তাই ঘটে; হিমেনো ছাড়া আর কেউ কাজটা করতে পারে বলে আমার মনে হয় না।“
আমি আসলে এটা প্রথমে বুঝতে পারিনি।
এরপরেই, সবকিছু আমার মনে বানের জলে মতো ভেসে আসতে লাগল। “আমার যখন সতেরো বছর বয়স, আমি হিমেনোর কাছ থেকে একটা চিঠি পাই। চিঠি বিশেষত তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা ছিল না। আমি ছিলাম প্ৰাপক, আর হিমেনো হচ্ছে প্রেরক। এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। অন্যদের চিঠি দেওয়া কিংবা ফোন করার মতো মেয়ে ছিল না হিমেনো, ও যতই বন্ধুত্বপূর্ণ হোক না কেন। তো যে মুহূর্তে ওর কাছ থেকে চিঠি এসেছিল আমার বুঝা উচিত ছিল।”
হ্যাঁ।
আমার অনেক অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল।
“সেই চিঠিটা ছিল হিমেনোর পক্ষ থেকে এক প্রকার সাহায্যের আবেদন। ও নিশ্চয় চিঠিটার মাধ্যমে আমার সাহায্য চেয়েছিল। অনেকটা আমার মতো যখন ও কোণঠাসা হয়ে পড়ল। ও অতীত আঁকড়ে ধরতে চাইল। তাই টাইম ক্যাপসুল খুঁড়ে বের করেছিল এবং তার একমাত্র ছোটবেলার বন্ধুর কথা মনে পড়ল। আর আমাকে চিঠি লিখল। ওর উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে, আমি সেই পদের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হইনি। আমি হিমেনোকে হারিয়েছি। ও ব্যর্থ হলো, এবং যে মুহূর্তে আমি সেটা বুঝতে পারলাম, আমিও ব্যর্থ হয়ে গেলাম। খুব শীঘ্রই হিমেনো আত্মহত্যা করবে, আর আমিও অল্প কিছুদিন পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বো। ক্ষান্ত দেওয়ার জন্য এটা সঠিক সময় না। কিন্তু বিষণ্ণ গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আপনাকে এভাবে বসিয়ে রাখার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
চলে যাওয়ার জন্য আমি উঠে দাঁড়াতেই, বৃদ্ধ মহিলা বলে উঠলেন “বিদায়”। এমন কণ্ঠে যা ঠোঁট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই বিলীন হয়ে গেল।
এই খাপছাড়া শব্দটাই একমাত্র কথা যা তিনি আমাকে বললেন।
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বিদায়।” ক্যান্ডির দোকানটা পিছনে ফেলে এসে, আমি উত্তর দিলাম।
অতীতের বন্ধুরা আমাকে ভুলে গিয়েছে বলে আমার খুব একটা কষ্ট হয়নি। স্মৃতির দ্বারা প্রতারিত হতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমি।
একইসাথে, আমি সম্পূর্ণভাবে অন্য একটা সম্ভাবনা উপেক্ষা করে গিয়েছি। যে মেয়েটা সবসময় আমার পাশে আছে। আমার প্রতিটি হতাশার অভিজ্ঞতায় আমাকে সমর্থন যু-গয়ে যাচ্ছে।
যে মেয়েটা আমার মতো হতাশ, কিন্তু তবুও আয়ুষ্কালের বদলে সময় বিক্রি করা বেছে নিয়েছে, যে কারণে ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
সে মেয়েটি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, এই সম্ভাবনার কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়েছি আমি।
******
“মি. কুসুনোকি? মি. কুসুনোকি”
আমি বাইক চালাচ্ছিলাম। মিয়াগি আমাকে পিছন থেকে খোঁচাতে লাগল। মিয়াগি বাইকে চড়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরতে দ্বিধা করছে না আর
বাইকের গতি কমিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী?”। যেন সে আমাকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ও বলল, “আপনাকে একটা কাজের কথা বলি।”
“আমার হঠাৎ মনে পড়ল। এই রাস্তা দিয়ে অনেক অনেক দিন আগে একবার এসেছিলাম। আমি পর্যবেক্ষক হওয়ার অনেকদিন আগে। যদি আপনি এই রাস্তা ধরে আরেকটু এগিয়ে যান, তারপরে ডান দিকে মোড় নিয়ে সোজা চলে যান, আপনি তারা খচিত হৃদে উপস্থতি হবেন।”
“তারা খচিত হৃদ?”
“যে হৃদের কথা আমি আপনাকে বলেছিলাম। ওই যে মৃত্যুর আগে যে হৃদে ঘুরে আসতে চাই। আনুষ্ঠানিকভাবে সেটাকে কী নামে ডাকা হয় আমার জানা নাই।”
“ওহ। হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে।”
“এটা দারুণ না?
“হ্যাঁ। ভালোই” আমি স্বীকার করে নিলাম। মেজাজটা কিছুটা হালকা করার চেষ্টা করলাম। “আমাদের নিশ্চয় যাওয়া উচিত।”
“আপনার বাইকে পর্যাপ্ত গ্যাস আছে নাকি?”
“কোনো এক জায়গা থেকে ভরে নিবো।”
পরবর্তী গ্যাস স্টেশন থেকে পুরো গ্যাস ভরে মিয়াগির নির্দেশনা অনুসারে চলতে লাগলাম।
ইতোমধ্যে মাঝরাত পার হয়ে গিয়েছে। আমরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে চললাম। যখন প্রয়োজন ইঞ্জিন বন্ধ করলাম এবং ও যে হৃদটাকে তারা খচিত হৃদ নামে ডাকছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে সেখানে পৌঁছালাম।
কাছের একটা কনভেনিয়েন্স স্টোর থেকে কাপ রামেন কিনে, বাইরের বেঞ্চে বসে সেটা খেলাম। কাবটা পার্কিং এরিয়াতে রেখে প্রায় অন্ধকার রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম।
মিয়াগি যখন চারপাশের বিল্ডিংয়ের দিকে কোমলভাবে তাকাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে ও আমাকে বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলল, “আপনার এখনই তাকানো উচিত না।” দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে আমি সত্যিই দারুণ তারকাখচিত রাত দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু মিয়াগির কথামতো মাথা নিচু করে রাখলাম।
“আমি যা বলি মন দিয়ে শুনুন।” মিয়াগি বলল। “আমি আপনাকে পথ দেখাবো। আমি চাই আমি বলার আগ পর্যন্ত আপনি চোখ বন্ধ রাখবেন।”
“তুমি একেবারে শেষ মুহূর্তের আগে আমাকে দেখতে দিতে চাও না?”
“হ্যাঁ। এত কষ্টের পরে, আপনি কী চান না তারাগুলো একদম সঠিক অবস্থায় দেখতে, মি. কুসুনোকি? এখন চোখ বন্ধ করুন।”
আমি চোখ বন্ধ করলাম। মিয়াগি আমার হাত ধরে ধীরে-ধীরে “এই দিকে” বলে পথ দেখাতে লাগল। চোখ বন্ধ করে হাঁটার ফলে আমি এমন সব শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম যা আগে কখনো শুনিনি।
আগে মনে করতাম গ্রীষ্মে ডাকা পোকাগুলোর সবগুলোর আওয়াজ একই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি চারটা ভিন্ন-ভিন্ন ধরনের আওয়াজ আলাদা করতে পারলাম। নিচু স্বরে গুনগুন করা পোকা, তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকা পোকা, পাখির মতো ডাকা পোকা, কানে তালা লেগে যাওয়া ব্যাঙের ডাকের মতো পোকা।
মৃদুমন্দ বাতাস এবং ক্ষীণ ঢেউয়ের শব্দও শুনতে পাচ্ছি আমি। এমনকি মিয়াগির পায়ের শব্দ থেকে আমার পায়ের শব্দও আলাদা করতে পারছি।
“মি. কুসুনোকি, বলুন তো। আমি যদি আপনাকে ধোঁকা দিই এবং ভয়ানক কোনো জায়গায় নিয়ে যাই আপনি কী করবেন?”
“ভয়ানক, কীভাবে?”
“হুমম… যেমন ধরুন ক্লিফ অথবা কোনো ব্রিজ। এমন কোনো জায়গা যেখান থেকে আপনার পড়ে যাওয়ার ভয় আছে।”
“আমি এটা চিন্তা করিনি এবং করবোও না।”
“কেন?”
“তোমার এরকম কিছু করার কোনো কারণ দেখছি না।”
“তাই নাকি” মিয়াগি বলল। বিরক্ত মনে হচ্ছে ওকে।
পায়ের তলায় পিচ-ঢালা রাস্তার কোনো অস্তিত্ব পেলাম না, বালুর ও না। তারপরে হঠাৎ কাঠের অস্তিত্ব পেলাম। আমার ধারণা আমরা কাঠের জেটিতে পৌঁছেছি।
“দাঁড়ান, চোখ বন্ধ রাখুন।” মিয়াগি বলল আমার হাত ছেড়ে দিয়ে। “সাবধানে পা ফেলে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন। তারপরে আপনি চোখ খুলতে পারবেন।”
আমি নিচু হয়ে সবধানে পিঠটা মেঝেতে ছোঁয়ালাম। একটা গভীর দম নিয়ে চোখ খুললাম।
আমার জানা “আকাশভরা তারা”র যে সংজ্ঞা আমি জানতাম; সেটার সাথে এই দৃশ্যের মিল নেই।
হয়তো এভাবে বললে ভালো হয়; সেদিন প্রথমবারের মতো আমি জানতে পারলাম তারা দেখতে কেমন হয়।
বই এবং টিভিতে আমি তারা “দেখেছিলাম”। আমি এমন একটা আকাশকে চিনি যেখানে সামার ট্রায়াঙ্গাল আছে, যার মধ্যে দিয়ে মিল্কিওয়ে বিচরণ করে। যা কিনা অসীমের মধ্যে এক বিন্দুর মতো।
কিন্তু সেসব লাইনের রেফারেন্স দিয়ে, এমনকি রং এবং আকৃতি দেখেও, আমি সত্যিই সেটার আকার কল্পনা করতে পারিনি।
আমার চোখের সামনের দৃশ্যটা আমি যা কল্পনা করেছিলাম, এরচেয়েও অনেক অনেক বড়।
আমার পাশে থাকা মিয়াগিকে বললাম, “আমার মনে হচ্ছে আমি এখন বুঝতে পেরেছি কেন তুমি মৃত্যুর আগে আবারো এটা দেখতে চেয়েছিলে।”
“সত্যি নাকি?” ও বলল আত্মতুষ্টি নিয়ে।
জেটির উপর শুয়ে থেকে অনেকক্ষণ ধরে তারার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা।
আমরা তিনটা তারাকে খসে পড়তে দেখলাম। আমি ভাবছিলাম পরবর্তী তারাটা খসে পড়তে দেখলে কী চাইবো।
সে মুহূর্তে আমার আয়ুষ্কাল ফিরে পাওয়ার কোনো চিন্তা মাথায় ভর করেনি। আমি হিমেনোর সাথে দেখা করতে চাই না। সময়কে পেছনে ফেরত নিতেও চাই না। নতুন করে সবকিছু শুরু করার মতো শক্তি ছিল না আমার।
আমি শুধু এখানে শান্তিতে মরতে চাই। ঠিক ঘুমিয়ে যাওয়ার মতো করে। এটাই আমার চাওয়া। এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার মানে হবে আমার বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে থেকে খুব বেশি কিছু চেয়ে ফেলা।
মিয়াগি কী চাইতে পারে এ-নিয়ে এমনকি চিন্তাও করার প্রয়োজন ছিল না। পর্যবেক্ষকের চাকরি ছেড়ে দেওয়াই ছিল ওর ইচ্ছা। যাতে ওকে আর অদৃশ্য হিসাবে না থাকতে হয়।
ও যাদের পর্যবেক্ষণ করে তারা ছাড়া বাকি সবাই ওর অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে। এক বছরের মধ্যে আমি ওর নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পারছি। যতটুকু সহনশীলতা মিয়াগি দেখিয়েছে তার মানে এই নয় ও আগামী ত্রিশ বছর এভাবে চালিয়ে যেতে পারবে।
“মিয়াগি” আমি বললাম, “তুমি আমার খাতিরে মিথ্যা বলেছিলে, তাই না? যেমন ধরো হিমেনো আমাকে কদাচিৎ মনে রেখেছে।
মিয়াগি শুয়ে থেকেই আমার দিকে ফিরল। জবাব দেওয়ার বদলে বলল, “আমারও একজন ছোটবেলার বন্ধু ছিল।”
আমি মনে করার চেষ্টা করে বললাম, “কে ‘তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ” সেই লোকটা? যার কথা তুমি একবার বলেছিলে?”
“হ্যাঁ। আপনার মনে আছে দেখি।”
আমি চুপ করে রইলাম। মিয়াগি বলতে শুরু করল।
“এক সময় আমার জীবনে এমন একজন ছিল ঠিক মিস. হিমেনো আপনার কাছে যেরকম। আমরা বাস্তব জগতে বেঁচে থাকাতে অভ্যস্ত হতে পারিনি। তাই আমরা দু’জন দু’জনের উপর ভরসা করতাম। আমাদের নিজস্ব জগতে পারস্পারিক নির্ভরতার উপরে বাস করতাম। পর্যবেক্ষক হওয়ার প্রথমদিনে যে কাজটা করলাম তা হলো, ওকে দেখতে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম আমার অন্তর্ধান নিয়ে ও বেশ দুঃখ পাবে। ও নিজেকে ওর খোলসে আবৃত করে ফেলবে, আর আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করবে। এই নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। যাহোক, আমাকে ছাড়া কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পরে, ও খুব দ্রুত আমি- বিহীন জগতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলো। না, তাও না। আমি গায়েব হয়ে যাওয়ার অল্প কয়েক মাস পরেই, যারা আমাদের ‘ভিন্ন’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের জগতে মিশে গেল।”
মিয়াগি আবারো আকাশের দিকে তাকাল, ওর ঠোঁটে একটা উষ্ণ হাসি দেখা গেল।
“সেই সময় আমি বুঝতে পারলাম। ওর কাছে, আমি ছিলাম ক্ষুদ্র বেড়ি। সত্যি বলতে, আমি ওকে অসুখী দেখতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম ও দুঃখ পাক, হতাশ হোক, এবং ওর খোলসে বন্দি হয়ে থাক। আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করুক। যা আদতে কখনই সম্ভব ছিল না। কিন্তু তবুও কোনোমতে শ্বাস নিক। ও সুখী কিংবা দুঃখী যাই হোক না কেন, এটা শুধু আমাকে বিষণ্ণই করবে।”
“মৃত্যুর আগে তুমি কি শেষ পর্যন্ত ওর সাথে দেখা করতে চাও?”
“হ্যাঁ, কারণ আমি আর কোনো কিছু সম্পর্কে জানি না। শেষ পর্যন্ত, একমাত্র এটাকেই আঁকড়ে ধরতে পারি।”
মিয়াগি উঠে হাঁটু উঁচু করে বসল। “তাই আপনি কেমন অনুভব করছেন আমি অনেকটা বুঝতে পারছি। যদিও আপনি চান না আমি তা বুঝি।”
“নাহ” আমি বললাম। “বোঝার জন্য ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই” মিয়াগি চাপা হেসে বলল।
আমরা আশপাশের ভেন্ডিং মেশিনের ছবি তুলে, বাসায় ফিরে এলাম।
“যেহেতু আজকে খুব ক্লান্ত তাই শুধুমাত্র আজকের জন্য” এই অযুহাতে মিয়াগি আমার বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। যখন আমি মিয়াগির দিকে গোপনে এক পলক তাকালাম, দেখা গেল সে-ও একই কাজ করছে। আমরা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম এবং দুজন দুজনের দিকে পিঠ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমি খসে পরা তারার দিকে তাকিয়ে অন্তত এইটুকু ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারতাম; যেন সবকিছু এভাবেই চলে।
পরেরদিন যখন আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি মিয়াগি চলে গিয়েছে। শুধু ওর নোটবুকটা বিছানার পাশে রাখা।