বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন কৃষক আন্দোলনের ঘোর বিরোধী
রক্ষণশীল হিন্দু সনাতন ধর্মের মহিমা কীর্তন ছাড়াও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীও এ দেশীয় জমিদার শ্রেণীর অন্ধ সমর্থক এবং কৃষক আন্দোলনের ঘোর বিরোধী হিসেবে বঙ্কিম প্রতিভার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ইতিপূর্বে নানা প্রসঙ্গে বহু তথ্য উপস্থাপনা করা সত্ত্বেও ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ‘আনন্দমঠ’ সম্পর্কে অন্ততঃপক্ষে কিছুটা আলোকপাত করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। এ সম্পর্কে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও বঙ্কিমভক্ত ডঃ অশিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের মত হচ্ছে, ‘আনন্দমঠের’ মধ্যে প্রধান ও প্রবল সুর দেশাত্মবোধ। এই সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মারফতে দেশ, সমাজ, ধর্ম ও জাতীয়তা সম্বন্ধে নতুনভাবে চিন্তা করছিলেন। এই উপন্যাস দু’টিতে সেই তত্ত্বদর্শনের কিছু ছাপ পড়েছে। উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কাল্পনিক গৌরবময় ভূমিকায় স্থাপন করে বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠে দেশাত্মবোধের মহাকাব্য রচনা করেন ‘বন্দে মাতরম্।’ সঙ্গীতটিও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ……সর্বোপরি উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী হাঙ্গামার মতো একটা লুটতরাজের বিশৃঙ্খল ঘটনাকে জ্যোতির্ময় দেশপ্রেম ও বলিষ্ঠ আত্মত্যাগের আধারে পরিবেশন করাতে কাহিনীটির বস্তুগত যথার্থ কিছু ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কারণ, ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে একদল উপদ্রবকারী সন্ন্যাসী (উত্তর প্রদেশের অধিবাসী) বাংলাদেশে কিছুকাল ধরে যে নির্যাতন, লুটতরাজ ও আরও নানা ধরনের অত্যাচার চালিয়েছিল, তার সঙ্গে দেশপ্রেম কেন, কোনও প্রকার মহৎ বৃত্তির কিছুমাত্র সম্পর্ক ছিল না।” (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তঃ পূঃ ৫৪১-৪২: সংশোধিত ৪র্থ সং; কলিকাতা ১৯৭৮) অবশ্য আরও গভীরভাবে বঙ্কিম রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস আলোচনার লক্ষ্যে পশ্চিম বাংলার মার্কসীয় গবেষক সুপ্রকাশ রায়-এর মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার ‘আনন্দমঠ’-এ বিরাট গণঅভ্যুত্থানকে (ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরবর্তী কৃষক বিদ্রোহ) পাশ কাটাইয়া গিয়া এই উপলক্ষে আধ্যাত্মিক ভক্তিতত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন। ইংরেজদের হস্তের ক্রীড়নক মীরজাফরের শাসনের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষক জনসাধারণের সংগ্রামকে তিনি এরূপভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন যেন তাহা মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দু সংগ্রাম এবং মুসলমান শাসনের কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্যই প্রয়োজন ইংরেজ প্রভুত্বকে বরণ করা। সংগ্রামের শেষ পর্যন্ত জয়ী হইয়াও সংগ্রামের নায়কগণ স্বাধীন রাজ্য স্থাপন না করিয়া ইংরেজের হস্তে রাজ্যভার ত্যাগ করিয়া তীর্থ দর্শন করিতে গেলেন। দেশ ইংরেজের হস্তে পতিত হইবে শুনিয়া বিদ্রোহীদের নায়ক সত্যানন্দ আক্ষেপ করিলে বঙ্কিমচন্দ্র চিকিৎসকের মুখ দিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিয়াছেন :
“সত্যানন্দ, কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখনও পবিত্র ফল হয় না। অতএব, তোমরা দেশ উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর ফল যাহা হইবে ভালই হইবে, ইংরেজ না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ৩য় সং কলিকাতা)।
বেদান্ত দর্শনের গোড়া সমর্থক বিবেকানন্দের আবির্ভাব
বাংলা সাহিত্যের সম্রাট ও ঋষি হিসেবে বর্ণিত বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমগ্র জীবনব্যাপী রক্ষণশীল ধারায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তাঁর মৃত্যুর ৮৬ বছর পর প্রখ্যাত গবেষক সুপ্রকাশ রায় সে সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর মূল্যায়ন করেছেন। মার্কিস্ট রা লিখেছেন।
“সামন্ত প্রথার সমস্ত রক্ষণশীল কুসংস্কারের এমন ঘোরতর সমর্থক বলিয়াই বঙ্কিম-সাহিত্য এত আদরণীয় হইয়া উঠিয়াছিল এদেশের সমাজের গোঁড়া হিন্দু ও উচ্চশ্রেণীর নিকটে। বঙ্কিমের উপন্যাসে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনের কোন সমর্থন নাই, সামন্ত অভিজাত সমাজের রীতিনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কোন আহবান নাই। বঙ্কিমের আবেদন কেবল প্রগতির পথরোধকারীদের কাছে। বঙ্কিম-সাহিত্য হইল প্রগতি বিরোধী (হিন্দু) অভিজাত-গোষ্ঠী ও মধ্যশ্রেণীর সমাজের মুখপত্র। তাই ইহাকে আপোস করিয়া চলিতে হইয়াছে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ত প্রথার সঙ্গে। ………. বঙ্কিম চন্দ্রের মতে, দেশ ইংরেজ শাসনের পদানত হইবার ফল ভালই হইবে। কারণ, ইংরেজ না আসিলে সনাতন ধর্মের জয়ের সম্ভাবনা নাই। বঙ্কিমচন্দ্র বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, মুসলমান শাসনে হিন্দুধর্ম বিনষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু ইংরেজ শাসন তাহা পুনরুদ্ধার করিতে এবং তাহা জয়যুক্ত হইবে। যে সময় মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ব্যস্ত সেই সময় এইভাবে তিনি হিন্দুদের মুসলমান-বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইয়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করিয়াছেন। ………ভারতের জাতীয়তাবাদের তথাকথিত গুরু বঙ্কিমচন্দ্র সকলকে বুঝাইয়া দিলেন, ইংরেজের সহযোগিতা করাই এখন জ্ঞান ও ধর্মের লক্ষণ। অতএব ইংরেজের সহিত সহযোগিতা এবং তাঁহাদের গুণগান করাই এখন সকলের কর্তব্য। কারণ, “ইংরেজ বাংলাদেশকে অরাজকতার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছে।” (আনন্দমঠ)। ইহাই দেশবাসীদের প্রতি জাতীয়তাবাদের ‘জনক’ বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশ। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা চলে, ‘আনন্দমঠ’ জমিদার শ্রেণীর ইংরেজ-ভক্তিরই সাহিত্যিক রূপ মাত্র। বঙ্কিমচন্দ্র কেবল ‘আনন্দমঠ’ এ-ই ইংরেজের জয়গান করেন নাই, তাঁহার বহু বিখ্যাত প্রবন্ধও ইংরেজের জয়গানে মুখর। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সহিত সহযোগিতা তাঁহার নিকট ছিল ভারতের জাতীয় মুক্তির একমাত্র পথ এবং সেই পথকেই তিনি অন্তরের সমস্ত বিশ্বাস লইয়া দেশবাসীর সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়াছেন। ……এইভাবে বঙ্গীয় “রিনাসান্স আন্দোলনের” শ্রেষ্ঠ নায়ক বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদের যে পথ প্রস্তুত করিয়া গিয়াছেন, সেই পথেই পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত হইয়াছিল। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন : ৩য় সঃ ১৯৮০ কলিকাতা)
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে ইংরেজ ভারতের রাজধানী ও এদেশীয় সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্ৰ কোলকাতায় বসে যখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কর্মতৎপরতার মাধ্যমে উপমহাদেশের সবচেয়ে অগ্রয়মান ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী সম্প্রদায়কে বিপথগামী করে পুনরায় রক্ষণশীল এবং সংকীর্ণমনা ও ধর্মান্ধ করতে সক্ষম হলেন; ঠিক তখনই হিন্দু ধর্ম ও বাহুবলের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে একদিকে যেমন ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে গুজরাটি ব্রাহ্মণ স্বামী দয়ানন্দ “আর্য সমাজ” গঠন করলেন, অন্যদিকে তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (১৮৩৪-৮৬) কোলকাতার অদূরে দক্ষিণেশ্বরীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে এক নতুন আংগিকে হিন্দু ধর্মীয় আন্দোলনের প্রবর্তন করলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর ভাবশিষ্য এবং বেদান্ত দর্শনের গোড়া সমর্থক স্বামী বিবেকানন্দের কর্মকাণ্ডের কিঞ্চিৎ ইতিহাস এক্ষণে উপস্থাপনা করা সমীচীন মনে হয়। কেননা এসময় মাদ্রাজে প্রদত্ত এক বিখ্যাত বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ পরিষ্কার ভাষায় বললেন যে, “ভারতের সকল প্রকার উন্নতির পক্ষে যাহা সর্বপ্রথম আবশ্যক তাহা হইল ধর্মীয় জাগরণ। সমাজতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক ভাবধারায় ভারতবর্ষকে প্লাবিত করিবার পূর্বে এখানে আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্লাবন আনায়ন করিতে হইবে।” (স্বামী বিবেকানন্দ : ওয়ার্কসঃ খণ্ড তিন, পৃঃ ২২১)।
স্বামী বিবেকানন্দ-এর প্রচারিত দর্শনের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে তৎকালীন বঙ্গদেশের বিরাজমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং ইউরোপের সামাজিক বিবর্তন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা অপরিহার্য। কারণ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর ভাবশিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ যখন হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশ তথা ভারতের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত নানা সভা-সমিতিতে বক্তৃতাদান করে বেড়াচ্ছিলেন, তখনও সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ ও ঐতিহাসিক নীল বিদ্রোহের পরিসমাপ্তিজনিত পরিবেশ সমাজজীবনে বিশেষভাবে বিদ্যমান ছিলো। উপরন্তু দুই-দুইবার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিভ্রমণকালে পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিকট রূপ ও তার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারার উপর এ সময় বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো বলা যায়। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, একদিকে যখন ইংরেজ ভারতে জমিদার-বিরোধী কৃষক আন্দোলন ও বিদ্রোহের ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং অন্যদিকে চা বাগান ও কয়লা অভ্র খনিগুলোতে নির্যাতিত শ্রমিকরা ছাড়াও বোম্বে-কোলকাতা-মাদ্রাজ এলাকায় যন্ত্রশিল্পের বাল্যকাল শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে শোষিত শ্রমিক শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছে, তখন তাঁর প্রচারিত দর্শনে সমাজতন্ত্রের কিছুটা প্রলেপ না থাকলে তা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিবেকানন্দের বর্ণিত সাম্যবাদের সংগে প্রকৃত সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক নেই
এ জন্যেই স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু উপনিষদের “সর্বভূতে বিরাজমান আত্মার” ধারণা থেকে ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-মুচি-মেথর সকলকে সমান আখ্যায়িত করে “ধূম্রজাল” সৃষ্টির প্রচেষ্টা করেছিলেন। এটুকু করেই স্বামীজী সেদিন সোচ্চার কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমার পদাংক অনুসরণ করো, আই এ্যাম এ স্যোশালিস্ট অর্থাৎ আমিই হচ্ছি একজন স্যোশালিস্ট।” তিনি শ্ৰেণীসত্তাবর্জিত ‘মুচি’, ‘মেথর’, ‘চণ্ডাল’ প্রভৃতি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করে ‘সমাজতন্ত্রের’ দাবীদার হয়ে জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করতে প্রচেষ্ট হলেন বলা যায়। কারণ কার্যক্ষেত্রে স্বামীজী বিবেকানন্দ বর্ণিত ‘সাম্যবাদের সংগে বিজ্ঞানসম্মত ‘সোশ্যালিজম’-এর কোনই সম্পর্ক নেই। পারতপক্ষে একটু বলা যায় যে, সে আমলে কোলকাতা কেন্দ্রিক হতাশাগ্রস্ত বর্ণবিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীর জন্য বিবেকানন্দের এ ধরনের কথাবার্তা কিছুটা মানসিক সান্ত্বনার সৃষ্টি করেছিলো বৈ কি! সাহিত্য সম্রাট ও প্রকারান্তরে রাজনীতিবিদ বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেখানে স্বীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইংরেজী শিক্ষিত সংস্কারপন্থীদের অগ্রগতি নিষ্প্রভ করা ছাড়াও উলংগভাবে কৃষক বিদ্রোহের বিরোধিতার মাধ্যমে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সমর্থকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ সেচতুরভাবে আরও একধাপ এগিয়ে’ হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কিত স্বীয় দর্শন প্রচারে লিপ্ত হলেন। এই ‘সুচতুরভাবে আরও একধাপ এগিয়ে’ যাওয়ার সময় স্বামীজী ‘মুচি’, ‘মেথর’, ‘চণ্ডাল’ প্রভৃতি সমাজতন্ত্র মার্কা শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁর মোদ্দা উদ্দেশ্যই ছিলো শ্রেণী স্বার্থে সচেতন কৃষক জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহকে এড়িয়ে যাওয়া। এজন্যেই তাঁর অসংখ্য বক্তৃতা, চিঠিপত্র, প্রবন্ধ ইত্যাদির কোথাও তিনি বঙ্গদেশে জমিদারদের বল্গাহীন শোষণ কিংবা শতাব্দীব্যাপী কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি।
সমসাময়িককালে বঙ্গীয় এলাকায় বিরাজমান পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবনের লক্ষ্যে এখানে ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড লিটনের (১৮৭৬–৮০ খ্রী) কৃষি সচিব এ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম-এর (ইংরেজ আইসিএস অফিসার এবং সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা) লিখিত বক্তব্যের উল্লেখ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কৃষক বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে এ সময় ভীত-সন্ত্রস্ত এ্যালান হিউম লিখলেন, “দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব খবর এসে পৌঁছুচ্ছিলো তাতে … আমার মনে এ রকম ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিলো যে, আমরা এক ভয়ংকর অভ্যুত্থানের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। … এসব সংবাদ-এর বেশীর ভাগ ছিলো দেশের জনগোষ্ঠীর নিম্নতর অংশের (কৃষকদের) সম্পর্কে। এ থেকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, দেশের জনসাধারণ প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়েছে; তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলো যে, তাদের অনাহারে মৃত্যুকে বরণ করতে হবে। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা একটা কিছু করার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিলো। ……আর এই একটা কিছু সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছাড়া আর কিছুই নয়। (এ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমঃ লাইফ অব স্যার উইলিয়াম ওয়াডারবার্ণ পৃ ৮০-৮১)
এ ধরনের এক ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্বামী বিবেকানন্দের প্রচারিত দর্শনের স্বরূপটা পরীক্ষা করা সমীচীন মনে হয়। পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত গবেষক গোপাল হালদারের মতে “স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন অদ্বৈতবাসী সন্ন্যাসী। স্বামীজীর স্থির বিশ্বাস হচ্ছে, জগৎকে যদি আমাদের কিছু জীবন-প্রদ তত্ত্ব শিক্ষা দিতে হয় তবে তাহা এই অদ্বৈতবাদ। (বাসিক পরিচয় ৩২শ বর্ষ ৭ম সংখ্যাঃ শ্রী গোপাল হালদার রচিত ‘স্বামী বিবেকানন্দের জন্মশতবার্ষিকী’ প্রবন্ধ।
আপাতদৃষ্টিতে বিবেকানন্দের যে দর্শন বেশ কিছুটা পরস্পর বিরোধী ভাবধারার দর্শন বলে মনে হয় সে সম্পর্কে আরও কিছু তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপনার প্রাক্কালে “অদ্বৈতবাদ” সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখ্যা দান করা দরকার। সংক্ষেপে “অদ্বৈতবাদ” দর্শন বলতে যেটুকু বোঝা যায় তা হচ্ছে, “ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নাই— বাকী সবই মায়া।” এরই পাশাপাশি তিনি ছিলেন স্বদেশপ্রেমের দাবীদার। তিনি বলেছেন, “ভারতের মাটি আমার পরম স্বর্গ। . . এই একমাত্র দেবতা যে জীবন্ত— আমার স্বজাতি। কিন্তু এই স্বর্গ অর্থাৎ মাতৃভূমির উদ্ধার কেবলমাত্র অদ্বৈতবাদের দ্বারাই সম্ভব। এই অদ্বৈতবাদ কার্যে পরিণত না হইলে আমাদের এই মাতৃভূমির আর উদ্ধারের আশা নাই।” একই সংগে বিবেকানন্দ ছিলেন মূর্তিপূজারী শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর ভক্ত শিষ্য। অথচ রামকৃষ্ণের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, “যদি সেই মূর্তিপূজা ব্রাহ্মণের পদধূলি আমি না পাইতাম, তবে আজ আমি কোথায় থাকিতাম?” আবার পরবর্তীতে বিবেকানন্দের কর্মকাণ্ডের সমীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাই যে, যেখানে তিনি ইউরোপীয় সভ্যতাকে বর্জন করার লক্ষ্যে ঘৃণার আহবান জানিয়েছেন, সেখানে তিনিই আবার পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে ‘বিশ্বমানবের ভ্রাতৃত্ব’, ‘রজোগুণের অনুশীলন’ এবং ‘শক্তির সাধনা কামনা করেছেন। তিনি বললেন, “সাম্যের দিক দিয়ে, স্বাধীনতার দিক দিয়ে কর্ম ও শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যকে হার মানাও, কিন্তু ধর্মসাধনায় ও ধর্ম বিশ্বাসে হিন্দুত্ব যেন তোমার অস্থিমজ্জার মধ্যে মিশে থাকে।”
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পূরক
এই প্রেক্ষিতে পশ্চিম বাংলার মার্কসীয় গবেষক সুপ্রকাশ রায় সম্প্রতি বিবেকানন্দের প্রচারিত দর্শন ও জাতীয়তাবাদের যে মূল্যায়ন করেছেন তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি লিখেছেন, “এই প্রকার পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারা লইয়া বঙ্গীয় ‘রিনাসান্সের’ অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক বিবেকানন্দ ভারতের জাতীয়তাবাদের পথ নির্দেশ করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকারের বহু নিবন্ধ ও বক্তৃতার মারফত ভারতবাসীকে সেই পথের সন্ধান দিয়াছিলেন। কতিপয় দৃষ্টান্ত :
১। ভারতের মুক্তির পথঃ “শক্তিনাশক অতিন্দ্রীয়তাবাদ পরিহার করিয়া শক্তিমান হও। উপনিষদের মহাসত্যগুলো তোমার সম্মুখে রহিয়াছে। সেই সকল সত্য গ্রহণ কর, তাহা অনুসরণ কর— তাহা হইলেই ভারতের মুক্তি নিকটবর্তী হইবে।”
২। ভবিষ্যৎ ভারত গঠনের উপায়ঃ “…সুতরাং ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষ গঠনের পক্ষে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধর্মের ঐক্যসাধন। ইহা বলিতেছি না যে, রাজনৈতিক বা সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজন নাই। কিন্তু আমার মতে ধর্মই সর্বাগ্রে প্রয়োজন।”
৩। বিশ্ব জয়ের পরিকল্পনাঃ “এখন এরূপভাবে কাজ করিতে হইবে যাহাতে ভারতের আধ্যাত্মিক ভাবধারা পাশ্চাত্যে গভীরভাবে প্রবেশ করিতে পারে। আমাদের ভারতের বাহিরে যাইতে হইবে, আমাদের আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের মারফত সমগ্র বিশ্বজয় করিতে হইবে। … উপনিষদের শিক্ষা গ্রহণ— য়ুরোপকে কেবল উপনিষদের ধর্মই রক্ষা করিতে পারে।”
পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদিগণ কর্তৃক স্বামী বিবেকানন্দ “জাতীয় বীর” বলিয়া স্বীকৃত হইলেও তিনি কোন সুগঠিত রাজনৈতিক মতপ্রকাশ অথবা স্বাধীনতা লাভের জন্য কোন রাজনৈতিক পথ-নির্দেশ করেন নাই।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম : ৩য় সং ১৯৮০ কলিকাতা)।
এখানেই শেষ নয়। সুপ্রকাশ রায় মহাশয় দুইটি মাত্র বাক্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের অন্যতম পুরোধা স্বামী বিবেকানন্দের মূল দর্শন এবং বাঙালি হিন্দু মধ্যশ্রেণীর মন-মানসিকতা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সত্য ভাষণ করেছেন। শ্রীরায়ের বক্তব্য হচ্ছে, “তিনি (স্বামী বিবেকানন্দ) ছিলেন হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু-ভারতের ঐক্যসাধন ও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের প্রচারক। তথাপি পরবর্তীকালে মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ, বিশেষত সন্ত্রাসবাদীগণ তাহার ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের বাণী হইতে যথেষ্ট প্রেরণা লাভ করিয়াছিলেন।
তাই আমরা ইতিহাস-ভিত্তিক তথ্য থেকে দেখতে পাই যে, স্বামী বিবেকানন্দ এ সময়ে ঢাকায় আয়োজিত কয়েকটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেয়ার উদ্দেশ্যে আগমন করলে, হেমচন্দ্র ঘোষের (পরবর্তীকালের বিখ্যাত সন্ত্রাসবাদী) নেতৃত্বে একদল শহুরে হিন্দু যুবক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উপদেশ প্রার্থনা করেন। স্বামীজী এসব যুবককে এ মর্মে উপদেশ দেন যে, “প্রথম কাজ প্ৰথম করিতে হইবে। শরীর গঠন ও দুঃসাহসিক কার্যে ঝাঁপাইয়া পড়া তরুণ বাংলার প্রাথমিক কর্তব্য। শরীর সাধনা এমন কি ‘ভগবতগীতা’ পাঠ করা অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ।” এ ধরনের বক্তব্যের পর স্বামীজী এই যুবকদের চার দফা বক্তব্যের নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশগুলো নিম্নরূপ :
ক) মাতৃভূমির সেবাই তোমাদের প্রথম কর্তব্য।
খ) ভারত বর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
গ) জনগণের মধ্যে যাও— অস্পৃশ্যতা দূর কর, ব্যায়ামাগার ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা কর। এবং
ঘ) বঙ্কিমের রচনা বারংবার পাঠ কর, আর তাঁহার দেশভক্তি ও সনাতন ধর্মের অনুসরণ কর।
এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে একথা আজ পক্ষপাতিত্ব করে বললেও বলতে হয় যে, বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়ের প্রচারিত উগ্ররক্ষণশীল হিন্দু ধর্মীয় দর্শনের মতামত থেকে বিবেকানন্দের দর্শনকে খুব একটা পৃথক করে দেখার ক্ষেত্র অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। বরং সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হবে যে, স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পূরক শক্তি। হিন্দু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গঠনের লক্ষ্যে অসম্পূর্ণ অবস্থায় বঙ্কিমের যেখানে সমাপ্তি স্বামী বিবেকানন্দের শুরুটা কিন্তু সেই ভিত্তি থেকেই। বৈষ্ণবী বিনয় প্রকাশ না করে সহজ ও সরলভাবে বলতে হয় যে, স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র প্রবর্তিত ‘নবহিন্দুবাদ’ ও ‘হিন্দুজাতীয়তাবাদের’ই সমর্থক। এ জন্যই স্বামীজী স্পষ্ট ভাষায় সে আমলের হিন্দু যুব সম্প্রদায়কে সামন্ততন্ত্র ও ইংরেজ শাসনের প্রশান্তি গানে মুখর বঙ্কিম-সাহিত্য বারংবার পাঠ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের সনাতন ধর্ম অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়াছেন। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিবেকানন্দ কিন্তু বঙ্কিম-এর মতো স্পষ্টভাবে কৃষক সংগ্রামের বিরোধিতা এবং ইংরেজ শাসনের অবিচলভাবে আনুগত্য প্রকাশ করেননি। কিন্তু আবার একথাও বলতে হয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী কৃষকদের বৈপ্লবিক উত্থান প্রত্যক্ষ করেও বিবেকানন্দ এ সম্পর্কে অর্থবহ কারণে বরাবর নিশ্চুপ ছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ কোলকাতা কেন্দ্রিক তথা সমগ্র বঙ্গীয় এলাকার বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীর নিকট হিন্দু ভারতের ধর্মীয় আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বাণী প্রচার করে যে জাতীয়তাবাদ-এর স্বপ্নকে উপস্থাপিত করেছিলেন, সে সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার অপর এক গবেষক অমলেন্দু সেনগুপ্তের মন্তব্য এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
শ্রী সেনগুপ্ত মহাশয় লিখেছেন, “তাহাদের এই জাতীয়তাবাদ ছিল স্বদেশ সম্বন্ধে গৌরববোধ হিন্দু-সম্প্রদায়ের পুনরুত্থান, মানুষের নতুন মহিমাবোধ, ভারতের প্রাচীন আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ সাধন প্রভৃতি ধারণার সমষ্টিবদ্ধরূপ।” (বিবেকানন্দের সমাজ চিন্তা’ প্রবন্ধ— অনুশীলন, শারদীয় সংখ্যা ১৩৬৯)।
মার্কসসিস্ট গবেষক বিনয়ঘোষ এ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য হচ্ছে, “শিক্ষা সংস্কারে ক্ষেত্রে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের উচ্চ মধ্যবিত্তসুলভ মনোভাব যেভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, তা আরও বিস্ময়কর মনে হয়। বিদ্যাসাগরের মতো হৃদয়বাদ নির্ভীক সমাজসংস্কারকও মেকলের ‘ফিলট্রেশন পলিসির’ (পরিশ্রুতি নীতি) অসহায় ‘ভিকটিম’ (ভুক্তভোগ) হয়ে নিজের মধ্যবিত্তসুলভ মানসিক সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং জনশিক্ষা ও শ্রমিকশ্রেণীর শিক্ষার নীতি প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। কেশবচন্দ্র সেনের মতো তেজস্ব সংস্কারক কতরকমের পরস্পর-বিরোধী আদর্শের আবর্তে পড়ে শেষ পর্যন্ত দিকভ্রান্ত হয়েছিলেন তাও আমরা জানি। বিধবা বিবাহ ও বহু বিবাহের সমস্যার প্রবল আন্দোলন বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে হওয়া সত্ত্বেও, ঊনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলার উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ কিভাবে তাঁর প্রেতাত্মা খুঁড়ে তোলে, তীব্র বাদানুবাদের মধ্যে নিজেদের রক্ষণশীল হিন্দুভাব প্রধান মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন, তা ভাবলেও মাথা হেঁট হয়ে আসে। আর আদর্শের দিক থেকে যাঁরা হিন্দু অবতারবাদ ও সাম্প্রদায়িক ধর্মের পুনরুজ্জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যাও অল্প নয়। রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসও এই একই মনোভাব জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত আগাগোড়া ব্যক্ত হয়েছে। (বাংলার বিদ্বৎসমাজ : ২য় সংঃ ১৯৭৮: প্রকাশ ভবন কলিকাতা)।
সবশেষে স্বামী বিবেকানন্দের প্রচারিত দর্শনের মূল্যায়ন করলে গবেষক সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায় বলতে হয় যে, “তিনি ছিলেন হিন্দুধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু-ভারতের ঐক্যসাধন ও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের প্রচারক।”
তাহলে সবার মনে এ মর্মে একটি প্রশ্ন জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক যে, “কিন্তু কেন এমনটি হলো?” যেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে রামমোহনের সংস্কারপন্থী আর ইয়ং বেংগল-এর পাশ্চাত্যমুখী আন্দোলনের মাধ্যমে যাত্রার শুরুটা হয়েছিলো, সেখানে এই শতাব্দীর শেষভাগে এসে যখন পূর্ণ অবয়বে একটি “জাতীয়তাবাদ’রূপী শিশুর ভূমিষ্ট হওয়ার আগমন বার্তা এসে গেছে, ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্কিম-বিবেকানন্দের আবির্ভাবে ইতিহাসের কোন প্রেক্ষিতে ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দু মধ্য শ্রেণী একযোগে মন্ত্রযুদ্ধের মতো ‘হিন্দু বাহুবল’ আর ‘হিন্দু শোর্যবীর্যের জয়গানে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো?’
আর এই জের হিসেবে উপমহাদেশের সমস্ত নেতৃস্থানীয়রা উদগ্রীব নয়নে দেখতে পেলো “এক বিকলাংগ জাতীয়তাবাদ-রূপী শিশুর” এই ধরাধমে আগমন হয়েছে। তার ললাটে চন্দন তিলক এবং কণ্ঠে রূদ্রাক্ষরের মালা আর শিশুটি লালিত-পালিত হতে শুরু করেছে শ্বেতাংগ ধাত্রীর ক্রোড়ে।
বংগীয় এলাকার হিন্দু জমিদারী শ্রেণী এবং মহারাষ্ট্র ও গুজরাট এলাকার উঠতি শিল্পপতিদের মিলনে এবং জনাপাঁচেক অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ আইসিএস অফিসারের সক্রিয় সহযোগিতায় ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে বোম্বাই নগরীতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর জন্ম হলো। প্রথম সভাপতি হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ আইসিএস এবং বড়লাট লর্ড লিটনের এককালীন কৃষি সচিব এ্যালন অকটাভিয়ান হিউম। আর এই প্রতিষ্ঠানের অঘোষিত পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন বৃটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ডারিন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বঙ্গীয় এলাকায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান চিন্তাধারা সম্পর্কে বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক এবং বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি লিখেছেন, “ঊনিশ শতকের শুরু থেকেই হিন্দু সমাজের সংস্কার আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারা প্রকাশের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। এই কর্মপ্রচেষ্টা ও ভাবধারা পাশ্চাত্য শিক্ষাজাত। পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের সঙ্গে যখন যুক্ত হল বাস্তব আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রেরণা ও অভাব-সঙ্কটের তাড়না, তখনই সূচনা হল রাজনৈতিক আন্দোলনের।” (মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্যঃ লেখক সংঘ প্রকাশনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ অক্টোবর ১৯৬৪ ঢাকা)
তা’হলে ইংরেজী-শিক্ষিত কোলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের তাগিদের ধাপগুলো কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো সংক্ষেপে তার উল্লেখের প্রয়োজন রয়েছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রভাবিত বিশিষ্ট লেখক এবং ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ (১৮৭৩ খ্রীঃ) গ্রন্থের রচয়িতা রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯ খ্রীঃ) কোলকাতায় ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দে যে “জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা” নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন, তারই প্রস্তাবনাপত্রের বর্ণিত উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে মাত্র ৬ বছরের মধ্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলো “হিন্দু মেলার”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে গঠিত ‘হিন্দু মেলা’ স্থাপিত হওয়ার ৫ বছরের মধ্যেই ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র পরিচালিত ‘বঙ্গ দর্শন’ পত্রিকার যাত্রারাম্ভ
এর পরের ধাপেই আমরা দেখতে পাই যে, পূর্ণতাপ্রাপ্ত কোলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী ভারতবাসীদের অধিকার আদায়ের আড়ালে নিজেদের রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধার কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। এরই প্রেক্ষাপটে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে গঠিত হলো “ভারত সভা”। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সমগ্র ইংরেজ ভারতের পক্ষ থেকে কোলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় এসব দাবী-দাওয়া উত্থাপনের ক্ষমতা পেলো কোত্থেকে? এর জবাবে শুধু এটুকু উল্লেখ করতে হয় যে, এঁরা যে শুধুমাত্র দেড় শতাধিক বছর ধরে ইংরেজদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে এবং এসময় উপ-মহাদেশের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষায় সবচেয়ে অগ্রসর ছিলেন তাই-ই নয়; ভৌগোলিক দিক দিয়ে এঁদের আবাসভূমির অবস্থানটাও সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো বলতে হয়।
১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দে জঙ্গলাকীর্ণ সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এই ৩টি মাত্র গ্রামের জমিদারীর ইজারা লাভের মাধ্যমে যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর যাত্রা শুরু হয়েছিলো, মাত্র ৭৫ বছরের মধ্যে সেই ইংরেজ শাসনাধীন “বাংলার ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সী” নামের এলাকাটা বিশালাকায় হয়ে দাঁড়ালো। উপরন্তু নিত্য-নতুন ঘটনা প্রবাহের মাঝ দিয়ে ইংরেজ এলাকা বেড়েই চললো। এসময় মধ্য ভারতের অঞ্চল বিশেষ থেকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত এবং পূর্বে চট্টগ্রামের অদূরে সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত এক বিশাল ভূখন্ড এই শেতাংগ বণিকদের পদানত হলো। এজন্যই বৃটেনের হাউস অব কমন্স-এ ১৭৭৩ খৃষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারের সনদ পরবর্তী ২০ বছর পর্যন্ত নবায়নকালে দেখা যায় যে, রাজধানী কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এই সর্বপ্রথম ৪-জন কাউন্সিলরসহ একটি গভর্ণর-জেনারেলের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ওয়ারেন হেষ্টিংস হলেন ইংরেজদের প্রথম গভর্ণর-জেনারেল এবং তাঁর তিনজন কাউন্সিলর হচ্ছেন যথাক্রমে ক্লেভারিং, বারওয়েল এবং ফিলিপ ফরানসিস। আরও ২০ বছর পর ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ পার্লামেন্টে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যিক সনদ ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত শেষবারের মতো এবং প্রশাসন সংক্রান্ত চার্টার-এর রুটিন নবায়নের সময় একটি ডেপুটি গভর্ণর-এর পদ সৃষ্টি করতে হলো। বাংলাদেশের এলাকা দাঁড়ালো ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৬ বর্গ মাইল ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ আধুনিক উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের প্রায় সবটাই ইংরেজদের পদানত হলো। সে আমলে এই প্রদেশের নামকরণ হলো “উত্তর পশ্চিম প্রদেশ।” এরপর ১৮১৬তে নেপাল ও ছোট নাগপুর এবং ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে মধ্য ভারতীয় মারাঠা অধিকৃত অঞ্চলে ইংরেজদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। বেঙ্গলের অধীনে এই নবগঠিত এলাকা সাগর ও ও নর্মদা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হলো। ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দ আসাম, কাছাড়, জয়ন্তিয়া ও মনিপুর ছাড়াও বিশাল বর্মী এলাকায় উত্তোলিত হলো ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা।
কিন্তু প্রশাসনের দিক দিয়ে এ বিশাল ভূখন্ডের সবটাই বাংলার ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর আওতায়। এর পরবর্তীতে ১৮৩৯-৪০ সাল নাগাদ রণজিৎ সিং-এর মৃত্যুর পর ইংরেজদের পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশ দখলের কর্মকান্ড তো আর এক বিরাট ইতিহাস। এদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকে বিরাটকায় বাংলা প্রেসিডেন্সীর প্রশাসন পরিচালনায় মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হওয়ায় ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর প্রদেশকে বঙ্গীয় এলাকা থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্ণর-এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা প্রেসিডেন্সীর প্রশাসনও একজন লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের দায়িত্বে দেয়া হয়। এতদসত্ত্বেও শুধু দুর্বল প্রশাসনের জের হিসেবে ১৮৬৫-৬৬ খ্রীষ্টাব্দে উড়িষ্যার ১২ হাজার বর্গমাইল এলাকায় ৪০ লাখ লোক এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। (সূত্রঃ সিই বাল্যান্ড রচিত বেঙ্গল আন্ডার লেফটেন্যান্ট গভর্ণরস) লেখক ও গবেষক সখারাম গণেশ দেউস্কর রচিত এবং ইংরেজ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্তকৃত “দেশের কথা” গ্রন্থে বর্ণিত তথ্য মোতাবেক ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষে শুধু উড়িষ্যা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনাহারে প্রায় ৬ লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছিলো।
এটা এমন এক সময় যখন ইংরেজদের অধীনে বাংলা নামে দেশটার এলাকা দাঁড়িয়েছিলো ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৬ বর্গমাইল। পূর্ব থেকে পশ্চিমের চিহ্নিত সীমানার দূরত্র প্রায় ৮০০ মাইলের মতো। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে এসময় দেখা দিলো দুর্যোগের ঘনঘটা। দুর্ধর্ষ প্রকৃতির নাগা উপজাতি ১৮৬৭-৬৮ খ্রীষ্টাব্দে আসামের শিবসাগর জেলায় কয়েক দফায় হামলা চালালো। ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দের শীতের মওসুমে নাগা বিদ্রোহীরা সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কাছাড় ও ত্রিপুরা রাজ্যের বহু এলাকা লন্ডভন্ড করে বেপরোয়াভাবে লুণ্ঠন করলো। এরপরেই শুরু হলো আসামের চা-বাগানগুলোতে উপজাতীয়দের উপর্যুপরি আক্রমণ। ফলে ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে সিলেটসহ আসামকে আলাদা প্রদেশ হিসেবে বাংলা থেকে পৃথক করে একজন চীফ কমিশনারের হাতে ন্যস্ত করা হলো। এরপরেও বাংলার ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর অধীনে অবিভক্ত বাংলা ছাড়াও বিহার, ছোটনাগপুর এবং উড়িষ্যা প্রদেশ রয়ে গেলো। এর এলাকা ১ লাখ ৮৯ হাজার বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ৭ কোটি ৮০ লাখের মতো।
বাঙালি মধ্য শ্রেণীর সঙ্গে ইংরেজদের প্রথম মান-অভিমান
এ সময়ের বিরাজমান অবস্থা সম্পর্কে একটা সঠিক ও স্বচ্ছ ধারণা লাভ এবং আলোচনার সুবিধার জন্যই উপমহাদেশের মানচিত্রে বিভিন্ন জাতির অবস্থান, বিশেষ করে ইংরেজ রাজত্বের সম্প্রসারণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস উপস্থাপনা করতে হলো। এটা হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। এ সময় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু সমাজের আর এক বিরাট ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করাটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এই প্রতিভাবান মনীষীর নাম সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডে যখন ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী অন্ধ পতঙ্গের মতো ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর অগ্নিশিখার দিকে ধাবিত হচ্ছিলো, ঠিক এ সময় সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জির আবির্ভাব এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী (১৮৪৮-১৯২৫ খ্রীঃ) ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজ সরকারের চাকরিতে যোগদান করার মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে চাকরিচ্যুত হন। পরবর্তীতে তিনি সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা পেশায় লিপ্ত হন। ১৮৯৫ এবং ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষ জীবনে ব্যানার্জী মহাশয় ১৯২১-২৩ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গীয় সরকারের অন্যতম মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় ১০ বছর পূর্বে এই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি শিক্ষিত বর্ণ হিন্দুদের দাবী-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে “ভারত সভা” বা ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এর অনেকগুলো উদ্দেশ্যের অন্যতম ছিলো আই সিএস পরীক্ষা দেয়ার সর্বনিম্ন বয়সের সীমা বাড়াতে হবে, ভারতীয় বিচারপতিদের শেতাংগ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করার অধিকার দিতে হবে, ভারতীয় মিলে প্রস্তুত কাপড়ের উপর ধার্যকৃত কর বাতিল করতে হবে এবং ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জারিকৃত ‘ভার্নাকুলার প্রেস এ্যাক্ট (১৮৭৬ খ্রীঃ) ও নাটক নিয়ন্ত্রণ এ্যাক্ট (১৮৭৬ খ্রীঃ) বাতিল করতে হবে।
আপাতঃদৃষ্টিতে যদিও মনে হয় যে এসব দাবী-দাওয়া সামগ্রিকভাবে ভারতীয়দের স্বার্থে উপস্থাপিত করা হয়েছিলো, তথাপিও কিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আলোচ্য দাবী-দাওয়াগুলো আদায় হলে কেবল একটিমাত্র ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মুষ্টিমেয় উঠতি বস্ত্র শিল্পপতিরা ছাড়া বাকী সবগুলো ক্ষেত্রেই ইংরেজী শিক্ষার অগ্রসর কোলকাতা কেন্দ্ৰিক মধ্য শ্রেণীর উপকৃত হওয়ার কথা। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রগতিশীল গবেষক অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান-এর বক্তব্য হচ্ছে, “কিন্তু যেহেতু এই উদীয়মান উচ্চরিত শ্রেণী ছিল ইংরেজ বণিক ও শিল্পপতিদের পার্শ্বচর, তাই ইংরেজ শাসকদের শুভেচ্ছায় এঁদের আস্থা ছিল যথেষ্ট। তেমনি বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্কট মধ্যবিত্তকে জাতীয় আন্দোলনে প্রেরণা দিলেও পাশ্চাত্য শিক্ষা আনয়নকারী ইংরেজ শাসকের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা তাঁদের কম ছিল না। বাংলার উদীয়মান উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে হিন্দু প্রধান্য দেখা দিয়েছিল নানা ঐতিহাসিক কারণে। (মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্যঃ পৃষ্ঠা ৬৪: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা)।
ভবানীপুরে ইংরেজ যুবরাজ এডওয়ার্ডকে কুলবধূরা চন্দন তিলক দিয়ে বরণ করলো
এখানে একটা বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত না করলে আলোচনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে মনে হয়। যে ইংরেজের সংগে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দুদের একটা হরিহর আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো, সেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকে এসে সেই সম্পর্কের খানিকটা ভাংগনের সৃষ্টি হলো কেমন করে? সিপাহী বিপ্লবের পরবর্তী ২০ বছর পর্যন্ত উপমহাদেশে অরাজকতার প্রেক্ষিতে বিরাজমান পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শনের লক্ষ্যে ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের যুবরাজ এডওয়ার্ড (পরে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড) ভারতের রাজধানী কোলকাতা সফরে আগমন করেন। এই যুবরাজকে সম্বৰ্ধনা প্রদানের প্রশ্নে সেদিন কোলকাতার বর্ণহিন্দু সমাজ দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যায়। ভবানীপুরের প্রখ্যাত উকিল ও ব্যবস্থাপক সভার সদস্য জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় মহাশয় শুধু যে দলবল নিয়ে ইংরেজ যুবরাজকে সম্বর্ধনা জানালের তাই নয়, শেষ পর্যন্ত যুবরাজকে স্বীয় বাসভবনে আমন্ত্রণ করে আনলেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, সেদিন ভবানীপুরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো। জগদানন্দের বসতবাটির সম্মুখের রাস্তার দু’পাশে হিন্দু যুবতীরা দাঁড়িয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে এবং উলুধ্বনি দিয়ে যুবরাজ এডওয়ার্ডকে অভ্যর্থনা জানালো। এরপর বসতবাটির প্রবেশ দ্বারে কুলবধূরা দাঁড়িয়ে যুবরাজের ললাটে চন্দন-তিলক পরিয়ে বরণ করলো।
যুবরাজ এডওয়ার্ড যথাসময়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেও ঘটনার পরিসমাপ্তি হলো না। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় এ মর্মে মন্তব্য প্রকাশিত হলো যে, জাতীয় চেতনাকে বলৎকার করা হয়েছে। পশ্চিম বাংলার গবেষক ডঃ প্রভাতকুমার গোস্বামী এ সম্পর্কে লিখেছেন ১৮৭৬-এর ১৯শে ফেব্রুয়ারী গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার জগদানন্দকে বিদ্রুপ করে গজদানন্দ ও যুবরাজ নামে এক প্রহসন মঞ্চস্থ করে। সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে দ্বিতীয় অভিনয় রাতেই এই প্রহসনের অভিনয় বন্ধ করে দেয়। উদ্যোক্তারা দমে গেলেন না। তারা হনুমান চরিত্র নাম দিয়ে ২৬শে ফেব্রুয়ারী প্রহসনটি আবার অভিনয় করালেন। রাজভক্ত প্রজাদের মান রক্ষার জন্য পুলিশ এবারেও অভিনয় বন্ধ করে দিল। এরপরে পুলিশ কমিশনার স্যার স্টুয়ার্ট হগ এবং সপারিনটেনডেন্ট ল্যাম্বকে ব্যাংগ করে ‘পুলিশ অব পিগ এন্ড শীপ’ নামক প্রহসন রচিত হল। এটার অভিনয়ও পুলিশ বন্ধ করে দেয়” (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক : সাহিত্য প্রকাশ কলিকাতা ১৩৮৫ বাংলা)।
কোলকাতায় যখন পরিস্থিতিটা কিছুটা উত্তপ্ত, ঠিক সে সময়েই অর্থাৎ ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ পার্লামেন্টে আইন পাস করে মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী করা হলো। ভারতের বড়লাট লর্ড লিটনকে এ সময় এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হলো যে, দিল্লীতে দারুণ জাঁকজমকের মধ্যে দরবার বসিয়ে মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সম্রাজ্ঞী হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে।
এটা এমন এক সময় যখন দাক্ষিণাত্য, মধ্যপ্রদেশ ও পাঞ্জাব এলাকায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ লোকের অনাহারে মৃত্যু (মৃতের সংখ্যা ৫০ লাখ) হচ্ছে এবং অন্যদিকে রাজধানী কোলকাতায় এক শ্রেণীর যুবক নাটকের মাধ্যমে বিরক্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য প্রয়াসী হয়েছে। ফলে অতি সম্প্রতি জারিকৃত নাটক নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্স ছাড়াও এই ১৮৭৬ সালেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন ও দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা নিয়ন্ত্রণ এ্যাক্ট বলবৎ করা হয়।
ঠিক এমনি এক সময় ইতিপূর্বে বর্ণিত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মত ব্যক্তিত্ব বাঙালি মধ্য শ্রেণীর স্বার্থে ইলবার্ট বিল ইত্যাকার দিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন। লর্ড লিটনের পর বড়লাট হিসেবে লর্ড রিপনের (১৮৮০-৮৪ খ্রীঃ) আগমনে বাঙালি বর্ণহিন্দু ও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের আবার উন্নতি হলো।। লর্ড রিপন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে কারাগার থেকে মুক্তি করা ছাড়াও এদেশীয় ও ইউরোপীয় বিচারপতিদের সমান ক্ষমতা প্রদান, স্থানীয় সরকারে এদেশীয়দের অধিকতর অধিকার প্রদান প্রভৃতি অনেক ক’টি বিষয়ে কনসেশন প্রদান করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, লর্ড রিপন ছিলেন ১৮৬৮ থেকে ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালীন মুক্ত বুদ্ধির বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্লাড স্টোন-এর ভাবশিষ্য। ১৮৮০ খৃষ্টাব্দের নির্বাচনে গ্লাড স্টোন জয়লাভ করেই রিপনকে ভারতে বড় লাটের দায়িত্বে পাঠান। লর্ড রিপনের শ্লোগান ছিলো “ইংল্যান্ড আর ভারত হচ্ছে পরস্পর পার্টনার শাসক আর প্রজার সম্পর্ক নয়।” কিন্তু রিপনের কার্যকলাপে বিশেষ করে কোলকাতার স্থানীয় শ্বেতাংগরা খুবই উষ্মা প্রকাশ করে। ইংরেজ ঐতিহাসিক পারসিভাল স্পিয়ার-এর মতে এ সময় কোলকাতার ইংরেজরা বড়লাট রিপনকে অপহরণের কথাও চিন্তা-ভাবনা করেছিলো। কিন্তু কোন কিছুই রিপনকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, লর্ড রিপনের তখন একটাই মাত্র ভাবনা। এদেশে ইংরেজদের সবচেয়ে বনেদী ও শক্তিশালী সমর্থক সম্প্রদায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু যেনো কোন অবস্থাতেই বৈরী হতে না পারে।
এজন্যই তো লর্ড রিপনের অনুসৃত পথ অবলম্বন করে পরবর্তী ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন-এ পৃষ্ঠপোষকতায় মূলতঃ বাঙালি বর্ণহিন্দুদের বিপথগামী হওয়ার পর রুদ্ধ করার লক্ষ্যে ১৮৮.৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।
তাহলে ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সময়কালের বঙ্গীয় এলাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একদিকে যেমন দ্বিতীয় দফায় ইংরেজ বিরোধী ওহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তিতে বহু প্রতিবন্ধকতার মাঝ দিয়ে ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যশ্রেণী একটা অবয়ব নিতে শুরু করেছে, অন্যদিকে তেমনি এর পাশাপাশি বাঙালি বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত আর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্কের স্তরগুলো দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই স্তরগুলো হচ্ছে:
১) মান-অভিমান ও মন কষাকরিষর স্তর, ২) আবেদন-নিবেদন ও দাবী-দাওয়ার স্তর, আন্দোলন এবং ১৯০৫ সাল নাগাদ, ৪) সন্ত্রাসবাদ-এর স্তর।
এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে যখন নানা ঘটনা প্রবাহের মাঝ দিয়ে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সংগে পূর্ণতাপ্রাপ্ত কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীর মধ্যে মান-অভিমান এবং মন কষাকষির পর্ব শুরু হয়ে গেছে, ঠিক সে সময় অর্থাৎ ১৮৭১-৭২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯০৫-০৬ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছরকাল সময়ে সদ্য ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশের সূচনাটা কিভাবে হলো তার পটভূমির প্রতি আবারও কিছুটা আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করছি। এ কথা আজ স্বীকার করতেই হয় যে, ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর প্রায় ১১৫ বছর যাবৎ নানা পন্থায় ইংরেজ বিরোধিতার পর ১৮৭১-৭২ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ওহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তিতে দিল্লী আলিগড়ে সৈয়দ আহমদ এবং কোলকাতায় সৈয়দ আমীর আলী, আবদুর রহিম, সৈয়দ হাসান ইমাম, আবদুল লতিফ খাঁ এবং জৌনপুরের মওলানা কেরামত আলীর নিরলস প্রচেষ্টায় যখন মুসলমানরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো যে, এদেশে ইংরেজ শাসনকে এক্ষণে মেনে নেয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে— ঠিক সে সময় থেকেই প্রকৃত অর্থে ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের সূচনা হলো।
বাঙালী মুসলিম উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বিলুপ্তির কারণ
এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হবে যে, ১১৫ বছর আগে অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালেও মুর্শিদাবাদ-ঢাকা তথা বঙ্গীয় এলাকায় মুসলিম শাসনামলে যে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্বজায় ছিল, সেই সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি কিভাবে হয়েছিলো? এর পিছনে প্রধানতঃ তিনিট কারণ দেখা যায়। প্রথমেই বর্ণহিন্দুদের কর্মকান্ডের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করতে হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করে অন্ততঃ এটুকু বলা যায় যে, নবাবী আমলে বঙ্গীয় এলাকায় বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী হিন্দু ও মুসলমানরা মিলিতভাবে সৃষ্টি করেছিলো। এ জন্যেই মুসলিম নবাবদের আমলে দেখা যায় যে, রাজস্ব, বিচার ও সৈন্য বিভাগ ছাড়া সর্বত্রই বর্ণহিন্দুদের প্রাধান্য সানন্দে গৃহীত হয়েছিলো। তবে এসব নেতৃস্থানীয় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বর্ণহিন্দুরা সবাই রাজভাষা ফারসীতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন, ইতিহাসের নানা ঘটনা প্রবাহে এঁরা প্রথম সুযোগেই (কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে) মুসলিম নবাবদের বদলে ইংরেজ কোম্পানীর শাসনকে বরণ করে নিলেন এবং অতিরিক্ত রাজভাষা যেখানে ফারসী শিখতে হতো, সেখানে এর বদলে নতুন শাসকগোষ্ঠীর ভাষা ইংরেজী ভাষাকে সহজেই রপ্ত করে ফেলে। তাই বাঙালি বর্ণহিন্দুদের পক্ষে সে আমলে আনুগত্য পরিবর্তনের বিষয়টা খুব একটা অসুবিধার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। নবাবী আমল এবং ইংরেজ কোম্পানীর শাসন— এই দু’টো সময়কালেই বর্ণহিন্দুদের ভূমিকা হচ্ছে সম্পূরক শক্তি হিসেবে।
দ্বিতীয়তঃ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর কার্যকলাপের কথা বলতে হয়। পলাশীর যুদ্ধ বিজয় থেকে শুরু করে সিপাহী বিপ্লব— ঠিক একশ’ বছর সময়কালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসকগোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলো, স্বাভাবিকভাবে তার সবগুলোই সিংহাসনহারা মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এ সম্পর্কে লর্ড এলেনবরার বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি লন্ডনে ডিউক অব ওয়েলিংটনের কাছে প্রেরিত এক পত্রে এ মর্মে লিখেছেন যে, এ কথা বিশ্বাস করে আমি নিজের চোখ বন্ধ রাখতে পারি না যে, এই সম্প্রদায় (মুসলিম) মূলতঃই আমাদের শত্রু। হিন্দুদের সন্তুষ্ট রাখাই আমাদের সত্যিকার নীতি হওয়া উচিত। (ডব্লুউসি স্মিথঃ মডার্ণ ইসলাম ইন ইন্ডিয়া ১৯৪৫, লন্ডন)।
১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়াও পরবর্তীতে ওয়াকফ ও লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং সরকারী কাজকর্মে ও আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজী ভাষা চালু করা প্রভৃতি প্রতিটি পদক্ষেপ বিশেষ করে বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম সমাজের অভিজাত (আশরাফ) শ্রেণীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎও নিশ্চিহ্নের পথে ঠেলে দিলো।
তৃতীয় বিষয়টা কিন্তু নবাবী আমলে বঙ্গীয় এলাকায় সৃষ্ট মুসলিম আশরাফ শ্রেণীর ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত। প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে, এঁদের প্রায় সবাই ছিলেন বহিরাগত অবাঙালি মুসলমান। তাঁরা ছিলেন দিল্লীর মোগল সম্রাটদের আশির্বাদপুষ্ট এবং এঁদের মাতৃভাষা ছিলো ফারসী। বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংগে এঁদের সম্পর্ক একরকম ছিলো না বললেই চলে। এঁদের যথার্থভাবেই সে আমলের সমাজের পরগাছা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অবস্থার প্রেক্ষিতে ফারসী ভাষা এসব আশরাফ শ্রেণীর পরিবারগুলো বাঙালি মুসলমানদের এতিম করে উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে সেদিন পাড়ি জমিয়েছিলো। অবশিষ্ট হাতেগোনা বাঙালি মুসলিম উচ্চবিত্তের লোকগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিকের ভাষায় বলতে হলে “…..সকল প্রকার সুখ-সুবিধা হারিয়ে (এঁরা) গ্রামাঞ্চলের দিকে পা বাড়ালো। সেখানে তাঁদের উন্নতির আশা সুদূরপরাহত। বর্তমান সরকারের (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী) অধীনে রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারিয়ে পূর্ব বাংলার শহরগুলো যেভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো তা ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা। কিছুসংখ্যক মুসলমান যারা এসব শহরে বসবাস করছিলো তারা উন্নতির কোন সুযোগই পেলো না। অপরপক্ষে কোলকাতার হিন্দুরা অসম্ভব রকম সাহায্য ও সহনুভূতি লাভ করলো।” (বৃটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান বাংলা একাডেমী ১৯৮২)।
জৌনপুরীর ফতওয়াঃ বাঙালি মুসলমানদের ম্যাগনাকার্টা
এজন্য এ কথা আজ বলা যায় যে, প্রায় শতবর্ষ পর্যন্ত বঙ্গীয় এলাকায় মুসলিম উচ্চবিত্ত এবং মধ্য শ্রেণী মোটামুটিভাবে অনুপস্থিত ছিলো। এ সম্পর্কে ডক্টর মল্লিকের মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
তিনি উল্লেখিত গ্রন্থে আরও বলেছেন যে, মুসলমানদের সব চাইতে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শ্লথ অভ্যুত্থান। অথচ আধুনিককালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই একটি জাতির সকল প্রকার উন্নতির সোপান। ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম দিতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং তাদের দাবী-দাওয়ার প্রতি সমর্থন জানাবার আর কেউ রইলো না।
এভাবেই যুগের পর যুগ অতিবাহিত হয়ে গেলো। অবশেষে ইংরেজ বিরোধী ওহাবী আন্দোলনের একেবারে শেষ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই যে, আবদুল্লাহ নামক জনৈক পাঞ্জাবী ওহাবী যুবক কোলকাতায় প্রকাশ্য দিবালোকে ১৮৭১ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন হাইকোর্টের চীফ জাষ্টিস নর্মানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ফাঁসিতে আত্মাহুতি দিলো। আন্দামান দ্বীপে যাবজ্জীবন কারাদন্ডভোগকারী শের আলী খান নামক অপর এক পাঠান ওহাবী মাত্র ৫ মাস সময়ের ব্যবধানে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই ফেব্রুয়ারী আন্দামান জেল সফররত ইংরেজ বড়লাট লর্ড মেয়োকে হত্যা করে ফাঁসির রজ্জু বরণ করে নিলো। এই সঙ্গে ইংরেজবিরোধী ওহাবী আন্দোলনের যবনিকাপাত হলো।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, এর মধ্যেই ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দেই মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী সেই ঐতিহাসিক ফতওয়া জারি করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে, “ইংরেজদের বিরুদ্ধে জ্বেহাদ কেবল অসিদ্ধ তা নয় তেমন সংগ্রাম দেখা দিলে মুসলমানদের কর্তব্য হবে তথাকথিত জ্বেহাদীদের বিরুদ্ধে শাসককে সাহায্য করা।
আপাতঃদৃষ্টিতে কেউ কেউ এই ফতওয়াকে ইংরেজদের দালালী হিসেবে আখ্যায়িত করলেও বিরাজমান পরিস্থিতিতে এই ফতওয়াকে বঙ্গীয় এলাকার ‘মুসলমানদের ম্যাগনাকার্টা’ বলে চিহ্নিত করা যায়। কেননা এসময় থেকেই এ দেশে প্রকৃত অর্থে ইংরেজী শিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশের গতি দ্রুততর হলো। বাংলাদেশের প্রগতিশীল চিন্তাধারার গবেষক ডক্টর আনিসুজ্জামানের মতে, “তবে অনতিবিলম্বে বাঙালি মুসলমানও নবোৎসাহে আধুনিক জগতের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। হিন্দু সমাজের চেয়ে একটু পরবর্তী সময়ে হলেও একই পথ ধরে সামাজিক অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ গঠনের চেষ্টায় তাঁরাও আত্মনিয়োগ করেছিলেন।”
বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গঠনের ধারা এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে অনুধাবনের লক্ষ্যে এ ব্যাপারে আরও কিছুটা আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়। এ সম্পর্কে গবেষক বিনয় ঘোষের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় সমাপ্তিকাল পর্যন্ত সময়কালে বাঙালি মুসলমানদের বঞ্চিত এবং সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে আমলে ইংরেজ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় বাঙালি বর্ণহিন্দুদের যে শক্তিশালী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছিলো,বিনয় ঘোষের মতে সেটাই হচ্ছে এক বিরাট ‘ট্রাজেডি’। তিনি লিখেছেন, “কিসের ট্রাজেডী?’ প্রথম ও প্রধান ট্রাজেডী হল, বাংলার এই নতুন বিদ্বৎসমাজ প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলমান বর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং সেইজন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালি বিদ্বৎসমাজ’ না বলে, বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসঙ্গত। আমরা যখন নব্যবঙ্গের বা নবযুগের বাংলার ইতিহাস আলোচনা করি তখন কতকটা সচেতনভাবেই বাঙালি মুসলমান সমাজের এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাই। কিন্তু কোন সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস তো নয়ই। বাংলার বিদ্বৎসমাজের বিকাশের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে তাই বাঙালি মুসলমান সমাজের কথা না বললে আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন বাংলার পুরাতন সমাজবিন্যাসের ভাঙাগড়া চলছে এবং ইংরেজ আমলের নূতন সভ্রান্ত ধনিকসমাজ গড়ে উঠেছে, তখন মুসলমান সমাজের অবস্থা কি? বাঙালি সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবার সেই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছেন। …হিন্দু সমাজে ক্রমবর্ধমান একটি শিক্ষিত ও চাকরিজীবী মধ্যশ্রেণীর বিকাশ হয়েছে, পাশ্চাত্য ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একটি বিদ্বৎসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে মুসলমান সমাজে নতুন মধ্যশ্রেণীর বিকাশতো একেবারেই হয়নি, পুরাতন অভিজাত সমাজ ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে এবং দরিদ্র ও নিঃস্বশ্রেণীর সংখ্যা বেড়েছে। …ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে বাংলার মুসলমান সমাজের এই ভয়াবহ চিত্রের কথা মৰ্মে করলেই নব্যবঙ্গের বিদ্বৎসমাজের বিকাশের মধ্যে ‘ট্রাজেডি’ কোথায় ও কেন তা পরিষ্কার বোঝা যায়।” (বাংলার বিদ্বৎসমাজঃ ২য় সং প্রকাশ ভবন ১৯৭৮ কলিকাতা)।
তাহলে আলোচ্য সময়ে ‘সমাজের এলিট শ্রেণী’ বলতে আমরা একটি অসম্পূর্ণ চিত্র দেখতে পাই। এই চিত্রের প্রায় সবটাই জুড়ে রয়েছে ‘হিন্দু বাহু বল’ ও ‘হিন্দু শৌর্যবীর্যের জয়গানে মুখরিত ইংরেজ শাসক সম্প্রদায়ের সমর্থক গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত উচ্চবর্ণের সঙ্গতিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত ‘এলিট শ্রেণী’। তারা এখন পরিণত ও প্রাপ্তবয়স্ক।
তাই সরকারের কাছে এঁদের ‘আব্দার ও ‘দাবী-দাওয়ার’ তালিকাটা বেড়েই চলেছে। স্বীয় শ্রেণী স্বার্থের তাগিদে রাজনীতির নিষিদ্ধ আংগিনায় এঁদের এখন পদচারণা শুরু হয়ে গেছে। অথচ এ সময় ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গঠনের সবেমাত্র শৈশব।
ইংরেজের আনন্দের দিনগুলো হচ্ছে ১৮৫৮ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত
বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গঠনের ধারা সম্পর্কে আরও আলোকপাত করার প্রাক্কালে প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানে সংক্ষেপে হলেও সে আমলে উপমহাদেশের অর্থনৈতিক অবয়ব-এর দ্রুত পরিবর্তনের কথা বলতে হয়। ইংরেজী সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি টনিসন জীবনে প্রথমে রেলপথে ভ্রমণ করেছিলেন ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে লিভারপুল থেকে ম্যাঞ্চেষ্টার পর্যন্ত। এরমাত্র ২৩ বছরের মধ্যে ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ ভারতে রেলপথ চালু করার কাজ শুরু করা হয়। এবং ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ রেলপথ সম্প্রসারণের বিষয়টা পূর্ণোদ্যমে অব্যাহত ছিলো। পরাধীন ভারতবাসীদের আরাম-আয়েশের চেয়েও সেদিন এই বিশাল ইংরেজ রাজত্বে দ্রুত সৈন্য যাতায়াত এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চা, কার্পাস, পাট, নীল প্রভৃতি কাঁচামাল ছাড়াও আফিম ও খনিজ সম্পদ রফতানীর লক্ষ্যে বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছাবার জন্যই এই রেলপথের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিলো।
ইংরেজ গবেষক পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের মতে, “বিদ্রোহের সমাপ্তিতে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে ক্যানিং-এর ঘোষণার সময়কাল থেকে শুরু করে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পর্যন্ত সময়কেই ভারতে ইংরেজ রাজত্বের ‘আনন্দের দিনগুলো’ বলে বর্ণনা করা যায়।” এ সময়কালের মধ্যে ইংরেজদের প্রতি বাঙালি বর্ণ-হিন্দুদের সর্বাত্মক সমর্থন অব্যাহত থাকা ছাড়াও মুসলিমদের ইংরেজ বিরোধী মনোভাব দ্রুত স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ সময়ে একটার পর একটা মঞ্জুরীপ্রাপ্ত বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে ইংরেজী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার এবং ইংরেজ ও ভারতীয়দের উদ্যোগে শিল্প স্থাপনের সূচনা হয়। ভারতের রেলওয়ের ব্যাপক প্রসার এবং মিসরে সুয়েজ খাল খননের দরুন জলপথে ইউরোপের দূরত্ব প্রায় তিন সহস্রাধিক মাইল হ্রাস পাওয়ায় বহির্বাণিজ্যে নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আরও দেখা যায় যে, এ সময়ে বহুসংখ্যক চা-বাগান স্থাপিত হওয়া ছাড়াও কোলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পাটকল এবং বোম্বাই এলাকায় কাপড়ের কল স্থাপিত হতে শুরু করে। পাট কলগুলো ইংরেজদের উদ্যোগে স্থাপিত হলেও কাপড়ের কলগুলো ভারতীয়দের বিশেষ করে পার্সীদের প্রচেষ্টায় চালু হয়। অবশ্য উপমহাদেশে ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে নাগপুরে প্রথম স্থাপিত ‘ইমপ্রেসমিল’ এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জে এন টাটা। এরই পাশাপাশি পশ্চিম বাংলা ও বিহার অঞ্চলে ইংরেজ ব্যবস্থাপনায় কয়লা খনিগুলো সম্প্রসারিত হলেও ভারতের সর্ব বৃহৎ লৌহ ও ইস্পাত কারখানা ছিলো পার্সী টাটা পরিবারের মালিকানাধীন
এই সময়কালেই বৃটেনের ইংরেজ উদারপন্থী মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন-এর প্রেরিত গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপন শহর ও গ্রামাঞ্চলে সর্বপ্রথম নিয়ন্ত্রিতভাবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রবর্তন করা ছাড়াও ইলবার্ট বিলের মাধ্যমে ভারতীয় সেশন জজদের শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিদের বিচারের অধিকার প্রদান করায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং শাসকগোষ্ঠী বর্ণবৈষম্যের অভিযোগের হাত থেকে রক্ষা পায় বলা যায়। এ জন্যই দেখা যায় ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে বিদায়ের প্রাক্কালে লর্ড রিপন কোলকতায় যে রকম প্রাণঢালা বিদায় সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন, আর কোন গভর্নর জেনারেলের পক্ষে তা লাভ করা সম্ভব হয়নি।
তবুও কথা থেকে যায়। এটা এমন এক সময় যখন একদিকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের প্রক্রিয়া বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়ে গেছে তখন অন্যদিকে তেমনি কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীর চাহিদা ও উচ্চাশা বলতে গেলে সীমাহীন এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে তা পূরণ করার সুযোগ সেই অনুপাতে অনেক কম। অন্যতম কারণ হিসেবে এটুকু বলা যায় যে, বাঙালি মুসলমান মধ্যশ্রেণী তখন প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার নতুন ভাগিদার হিসেবে কিছুটা সোচ্চার হতে শুরু করেছে। আর এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শ্বেতাংগ শাসকগোষ্ঠীর সংগে বাঙালি বর্ণহিন্দু বিদ্বৎসমাজের নতুন করে ‘মান-অভিমান’ এবং ‘বিরোধের সূত্রপাত হলো। আগেই উল্লেখ করেছি যে, ‘ভারতীয় ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে বাংলার ভাগ্যাকাশে বঙ্কিম বিবেকানন্দের প্রদর্শিত পথে বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণী সেদিন মোহবিষ্ট হয়ে পড়েছিলো। মার্কসিস্ট গবেষক বিনয় ঘোষের ভাষায় বলতে গেলে, যুক্তির বদলে এল সেই সনাতন ভক্তি, সংস্কারের বদলে এল কুসংস্কার, উদারতার বদলে সঙ্কীর্ণতা, মানবতার বদলে সাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু মধ্যশ্রেণী ও বিদ্বৎসমাজ যে পৌঢ়. হয়েছেন তা বোঝা গেল। বার্ধক্যের উপসর্গ বিদ্বৎসমাজের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠল। মুসলমান বর্জিত তথাকথিত রিনেস্যান্স ও রিফর্মেশন আন্দোলনের প্রায়শ্চিত্ত করা হল চরম প্রতিক্রিয়াশীল রিভাইভ্যাল আন্দোলনের সূত্রপাত করে, বিদ্যাবুদ্ধি যুক্তি সব বিসর্জন ও বন্ধক দিয়ে। সেই তরুবাদ, ভক্তিবাদ ও অবতারবাদের অতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল ইয়ং বেঙ্গল ও বিদ্যাসাগর যুগের যুক্তিবাদ, স্বাতন্ত্রবাদ, যা কিছু ভাল সব। ‘এজ অব রিজন’ (যুক্তির যুগ), ‘হিউম্যানিজম’ (মানবতাবোধ), ও ‘ফিলসফি অব এন্লাইটেনমেন্ট’ (আলোকপ্রাপ্তির দর্শন)-এর উত্তরাধিকারীরা গুরু অবতারের পাকের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়লেন। আজও সেই পাক থেকে তাঁরা গাত্রোত্থান করতে পারেননি।” (বাংলার বিদ্বৎসমাজ : প্রকাশ ভবন কলিকাতা ১৯৭৮)
তাহলে একথাটা বলা যায় যে, ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় একচেটিয়াভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে অগ্রগতির চূড়োয় পৌঁছে যখন বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অধোগতি শুরু হয়ে গেছে, প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই বাঙালি মুসলমান বিদ্বৎসমাজ ও মধ্যশ্রেণীর উত্থান আরম্ভ হলো। এজন্য দেখা যায় যে, পরবর্তী ৬০/৭০ বছরের মধ্যে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় শাসকগোষ্ঠীর সংগে সরাসরি সংঘর্ষের পথ পরিহার করে ‘কোটা’ বা ‘হিস্যা’ আদায়ের রাজনীতি করেছে।
ইতিপূর্বে গবেষক ডক্টর আনিসুজ্জামানের এ সম্পর্কিত বক্তব্যের যে উদ্ধৃতি দিয়েছি তারই জের ধরে একটা কথা বলা যায় যে, ১৮৭১-৭২ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে বঙ্গীয় এলাকার মুসলমান সম্প্রদায় মোটামুটিভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ-এর প্রবর্তিত “আলীগড় আন্দোলনের” পথ অনুসরণ করেছে। এখানে ‘সংক্ষেপে আলিগড় আন্দোলনের” কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যাদান প্রয়োজন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হবার এক বছরের মধ্যেই সৈয়দ আহমদ “মোহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স” স্থাপন করেন। এর মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিলো মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার করতে হবে। এ সময় স্যার সৈয়দ আহমদ এ মর্মে মুসলমানদের প্রতি আহবান জানান যে, ইংরেজী শিক্ষা লাভের মাধ্যমে হিন্দুদের সমকক্ষ না হওয়া পর্যন্ত মুসলমানদের পক্ষে জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে না। স্যার সৈয়দের এই প্রচেষ্টাই ইতিহাসে ‘আলিগড় আন্দোলন’ নামে আখ্যায়িত হয়ে রয়েছে। (আলিগড় কলেজ : স্থাপিত ১৮৭৫ খ্রীঃ) পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দের ২৮শে মার্চ সৈয়দ আহমদ-এর মৃত্যুর পর এই আন্দোলন শুধু অব্যাহত থাকে তাই-ই নয় নতুন অবয়বে এই আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে দাঁড়ায়। এসময় উত্তর ভারতের আটোয়ার মহসিন উল মুলক্ নবাব সৈয়দ মেহেদী আলী ‘আলিগড় আন্দোলনের’ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এঁরই প্রচেষ্টায় ১৯০৩ সাল নাগাদ মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন নেতা ও জাতীয় কংগ্রেসের এককালীন সভাপতি বদরুদ্দীন তায়েবজী এবং তাঁর সমর্থক রহিমতুল্লাহ্ সায়ানী ‘আলীগড় আন্দোলনে’ যোগদান করেন। ১৯০৩ সালেই বদরুদ্দীন তায়েবজী “মোহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স”-এ সভাপতিত্ব করেন।