কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ২

নীল দর্পণ ও জমিদার দর্পণ নাটক এবং সে আমলের বুদ্ধিজীবী

১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ এবং ১৮৫৯ সালের নীল চাষীদের সার্থক বিদ্রোহের বহ্নিশিখার মাঝে দাঁড়িয়ে ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র নীল দর্পণ নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকে বাংলার কৃষকদের গৌরবজনক প্রতিরোধ সংগ্রামের সার্বিক প্রতিচ্ছবি অনুপস্থিত এবং নাটকের ভূমিকায় মিত্র মহাশয় নীলকর সাহেবের চরিত্র সংশোধন আর ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর মহানুভবতার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। মোদ্দা কথায় নাটকটি নীল বিদ্রোহের সমর্থনে লেখা হয়। তবুও নীলকরদের নির্যাতনের কথা এত স্পষ্ট করে এর আগে আর প্রকাশিত হয়নি।

দীনবন্ধু মিত্র পেশায় সরকারী চাকরিজীবী ছিলেন। মিত্র মহাশয় চাকরির প্রথম জীবনে ডাক বিভাগে পোস্ট মাস্টার ছিলেন। পরে তিনি সুপারিনটেনডেন্ট পদে প্রমোশন লাভ করেন। এই ডাক বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করেন এবং মানব-চরিত্র সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। শুধু তাই-ই নয়, এসময় তিনি প্রত্যক্ষ করলেন নীল চাষীদের উপর ইংরেজ কুঠিয়ালদের ভয়াবহ ও পৈশাচিক অত্যাচার। দীনবন্ধু মিত্র আরও লক্ষ্য করেছিলেন যে, বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় মিলিতভাবে হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা অস্ত্র হাতে সাফল্যজনকভাবে পাল্টা আঘাত হানতে শুরু করেছে। শাসক গোষ্ঠী তখন ভীত ও আতংকিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ‘নীল দর্পণ’ নাটকটিতে বাংলার কৃষকদের এই গৌরবজনক প্রতিরোধ সংগ্রামের সার্বিক প্রতিচ্ছবি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। (কেবলমাত্র দু’একটি জায়গায় ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন নবীন মাধবকে লক্ষ্য করে কৃষক তোরাপ আলীর বক্তব্য : “বড় বাবু সমিন্দির কি এমান আছে তা’ ধরম কথা শোনাবে। ও ঝ্যামন কুকুর মুই তেমনি মুগুর সমিন্দির ঝ্যামন চাবালি, মোর তেমনি হাতের পোঁচা।”)

নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তিনি নাটকে শুধু একটিমাত্র দিকই তুলে ধরেছেন। তা হচ্ছে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং সেই ভয়াবহ অত্যাচারের মোকাবেলায় কৃষকদের করুণ অবস্থা। অথচ এদিকে তৎকালীন গ্রামবাংলার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির প্রেক্ষিতে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে ১৮৬০ সালের ৩১শে মার্চ নীল চাষীদের এ ধরনের সশস্ত্র পাল্টা হামলার কারণ অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের ‘ইনডিগো কমিশন’ বা ‘নীল কমিশন’ গঠন করতে বাধ্য হয়েছিল। এই কমিশনের দাখিলকৃত রিপোর্টের ভিত্তিতে এ মর্মে আইন বিধিবদ্ধ করা হয় যে, “নীলের চাষ করা কৃষকদের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন ব্যাপার। কোনও নীলকরই আর রায়তদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক কৃষকদের দিয়ে নীলের চাষ করাতে পারবে না”। এটাই হচ্ছে উপ-মহাদেশের ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীর ১৯০ বছরকাল শাসনকালে কৃষকদের সর্বপ্রথম সফল সশস্ত্র অভ্যুত্থান। এই কৃষক বিদ্রোহকে অনায়াসে একটা সফল বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

নীল দর্পণ নাটক রচনার চমকপ্রদ পূর্ব ইতিহাস রয়েছে। এসময় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত এবং হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় একটি ক্ষুদ্র সংবাদের প্রতি নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ঘটনাস্থল যশোর জেলার বেগুনবেড়ের কচিকাটা নীল কুঠি। অদূরে সমৃদ্ধশালী স্বরপুর গ্রাম। সংবাদটি ছিলো নিম্নরূপঃ

“আর্চিবলড্ হিলস্ নামক একজন ইংরেজ কুঠিয়াল এক কৃষক কন্যার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন। ঐ কৃষক কন্যার নাম হরমণি। বালিকা যখন একদিন দীঘি হইতে জল আনিবার জন্য বাড়ীর বাহির হয়, তখন আর্চিবলড্-এর লোক হরমণিকে জোর করিয়া ধরিয়া তাহার কুঠিতে লইয়া যায় এবং দ্বিপ্রহর রাত্রি পর্যন্ত আটক রাখে”।

নীল দর্পণ নাটকে কৃষক বিদ্রোহ অনুপস্থিত

এই নির্দিষ্ট ঘটনা এবং তৎকালীন সমাজ জীবনের আরো কিছু ঘটনার ভিত্তিতে দীনবন্ধু মিত্র রচনা করলেন প্রখ্যাত নাটক ‘নীল দর্পণ’। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এই নাটকে ইংরেজ নীলকর কুঠিয়ালদের ভয়াবহ অত্যাচারের বিস্তারিত চিত্র উপস্থাপিত করা হলেও, বাংলার কৃষকদের অবস্থা অসহায় হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অবস্থাটা হচ্ছে বেশ কিছুটা ভিন্নতর। বাংলার কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রামের জের হিসেবে শাসক গোষ্ঠী তখন আতংকগ্রস্ত। কিন্তু নাট্যকাব তাঁর রচিত নাটকে প্রচ্ছন্নভাবেও এই প্রতিরোধ সংগ্রামের এবং বিদ্রোহের কিছুই চিত্রিত করেননি। বরং নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র নীল দর্পণ-এর ভূমিকায় নীলকর সাহেবদের চরিত্র সংশোধনের এবং ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর মহানুভবতার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। ভূমিকায় তিনি ইংরেজ কুঠিয়ালদের সম্পর্কে লিখেছেন :

“এক্ষণে তাঁহারা নিজ নিজ মুখ সন্দর্শনপূর্বক তাহাদিগেরে ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা-কলংকতিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোক্ষভাবে শ্বেত-চন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখ রক্ষা হয়। হে নীলকরগণ! তোমাদের নৃশংস ব্যবহারের প্রাতঃস্মরণীয় সিডনী, হাইয়ার্ড, হল প্রভৃতি মহানুভব দ্বারা অবলংক ইংরেজকুলে কলংক রটিয়াছে”।

ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর মহানুভবতার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে দীনবন্ধু মিত্র ভূমিকায় স্পষ্টভাবে আরও লিখেছেন :

“প্রজাবৃন্দের সুখ-সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে। দাসী দ্বারা সন্তানকে স্তনদুগ্ধ দেওয়া অবৈধ বিবেচনায় দয়াশীলা প্রজাজননী মহারাণী ভিক্টোরিয়া প্রজাদিগকে স্বক্রোড়ে লইয়া স্তনপান করাইতেছেন। সুধীন সুবিজ্ঞ সাহসী উদার চরিত্র ক্যানিং মহোদয় গভর্নর জেনারেল হইয়াছেন। প্রজার দুঃখে দুঃখী প্রজার সুখে সুখী, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, ন্যায়পরায়ণ গ্রান্ট মহামতি লেফটেন্যান্ট গভর্নর হইয়াছেন এবং ক্রমশঃ সত্যপরায়ণ ইডেন, হার্সেল প্রভৃতি রাজকার্য পরিচালকগণ শতদলস্বরূপে সিভিল সার্ভিস সরোবরে বিকশিত হইতেছেন। অতএব ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, নীলকর দুষ্টরাহুগ্রস্ত প্রজাবৃন্দের অসহ্য কষ্ট নিবারণার্থে উক্ত মহানুভবগণ যে অচিরাৎ সদ্বিচাররূপ সুদর্শন-চক্র হস্তে গ্রহণ করিবেন, তাহার সুচনা হইতেছে”।

নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের নিশ্চিত ধারণা এই যে, দর্পণে মুখ দেখার পরও যদি অত্যাচারী ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজেদের চরিত্র সংশোধন না করে, তাহলে অন্ততঃ ইংল্যাণ্ডের শাসক শক্তি এক্ষেত্রে ন্যায়ের সপক্ষে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবে।

নাট্যকারের মতে, মহারাণী ভিক্টোরিয়া যখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে উপ-মহাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেছেন এবং মহারাণীর নিজস্ব প্রতিনিধিরা যখন শাসন কার্যের দায়িত্বে রয়েছেন তখন ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংঘবদ্ধ সংগ্রামের কোন চিত্র নীল দর্পণে নেই। বরং এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে পাশ কাটিয়েও নাটকের বলিষ্ঠতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে নাট্যকার পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। ‘নীল দর্পণ’ নাটকটির অভিনয় দেখে কিংবা নাটকটি পড়ার পর ইংরেজ কুঠিয়ালদের প্রতি মানুষের মনে তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হয়। কিন্তু অব্যাহতি লাভের কোনও পথ উন্মুক্ত নেই। মনে হয় ক্রন্দন ও মৃত্যুই হচ্ছে এসবের স্বাভাবিক পরিণতি। এজন্যই নাটকে একের পর এক মৃত্যুর দৃশ্য প্রদর্শিত হয়েছে। ক্ষেত্রমণি, গোলকচন্দ্র ও নবীন মাধবের মৃত্যু এবং মা সাবিত্রীর মস্তিষ্ক বিকৃতি ও পুত্রবধূ সরলতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর করুণ মৃত্যু সবকিছুই লোকের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। কিন্তু নাটকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের কোনও প্রচ্ছন্ন ইংগিত বা ইশারা পর্যন্ত কিছুই নেই। সবকিছুর শেষে নাট্যকার যেন বোঝাতে চাচ্ছেন যে, “মাথাবনত অবস্থায় করজোড়ে স্বৈরাচারী রাজশক্তির কাছে সুবিচারের আবেদন করাই বাঞ্ছনীয়। ইংল্যাণ্ড থেকে আগত কোনও কোনও রাজপুরুষ অত্যাচারী হইলেও আসলে এই রাজশক্তিই হচ্ছে প্রজাহিতৈষী। অতএব ‘বিদ্রোহ’ আর ‘প্রতিরোধের পথ কোনও অবস্থাতেই সঠিক ও সুষ্ঠু হইতে পারে না”।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে সে আমলে কেন এই ধরনের ‘দাসসুলভ’ মনমানসিকতা বিরাজ করছিল? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে, তৎকালীন অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকালীন (বিদ্রোহী) এবং তৎপরবর্তী সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা অপরিহার্য।

সংস্কারপন্থী নীল দর্পণ নাটকও সহ্য করা সম্ভব হয়নি

এর পরেও সে যুগের ইংরেজ শাসকরা এবং ইংরেজ রাজপুরুষরা এই ‘নীল দর্পণ’ নাটকের কাহিনী সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম যশোর জেলার বেগুনবেড়ের কচিকাটা নামক নীলকুঠিতে কুঠিয়াল আর্চিবলড্ হিলস্ কর্তৃক কৃষক কন্যা হরমণির উপর নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হলে হিলস্ সাহেব এই পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটা মানহানির মোকদ্দমা দায়ের করেন। মোকদ্দমা চলাকালীন সময়েই সম্পাদক হরিশচন্দ্রের মৃত্যু হয়। তখন হরিশচন্দ্রের বিধবা স্ত্রীর নামে এই মামলা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ বিচারকের রায় মোতাবেক এক হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে হরিশচন্দ্রের স্ত্রীকে এই মোকদ্দমা মেটাতে হয়। তবুও কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এ ব্যাপারে সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি।

এ সময় ফাদার জেমস্ লং নামে কোলকাতার জনৈক ইংরেজ পাদ্রী ‘নীল দর্পণ’ নাটকের অনুবাদ করেন। তিনি এই অনুবাদ পুস্তকাকারে প্রকাশ করে ইংল্যাণ্ড ও ইউরোপে প্রেরণ করেন। ফলে লণ্ডনস্থ সুপ্রীম কোর্টে ফাদার লং-এর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা আনীত হয়। এই মামলায় অভিযুক্ত ফাদার লং-এর এক মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়।

মজার ব্যাপার এই যে, নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজী সংস্করণের কোথাও রেভারেণ্ড জেমস্ লং মূল লেখক দীনবন্ধু মিত্রের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। ফলে মিত্র মহাশয়কে এই মামলায় আসামী হিসেবে জড়িত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাংলা সরকারের তৎকালীন চীফ সেক্রেটারী মিঃ সিটন কারকে ইংরেজী নীল দর্পণ নাটকের জন্য চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে হয়। কারণ মিঃ কার-এর নির্দেশে এই ইংরেজী সংস্করণ নাটকটি বাংলা সরকারের নিজস্ব ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়েছিল। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, প্রকৃতপক্ষে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নীল দর্পণ নাটকটি জেমস্ লং-এর পক্ষে কোন রকম স্বীকৃতি ছাড়াই অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। ফলে মাইকেল মধুসূদন দত্তকেও এই মামলায় আসামী হিসেবে জড়িত করা যায়নি। কিন্তু তাঁকেও প্রকারান্তরে শাস্তি ভোগ করতে হয়।

দীনবন্ধু মিত্র গ্রন্থাবলীতে (বসুমতী সংস্করণ ১ম ভাগ, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৪) এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। “আর নাটকটির ইংরেজী অনুবাদ করার জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোপনে তিরস্কৃত ও অপমানিত হইয়াছিলেন…… শেষে তিনি তাঁহার জীবন নির্বাহের উপায় সুপ্রীম কোর্টের চাকুরী পর্যন্ত ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন”।

মধুসূদন কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী ছিলেন। কিন্তু এরই পাশাপাশি তৎকালীন কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহলের ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গবেষক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামীর মতে, “প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্বাভাবিক মমতাবোধ থাকলেও বিদ্রোহকে এঁরা ভয় পেতেন। তাঁরা জানতেন কৃষক বিদ্রোহ শুধু সাম্রাজ্যবাদী শাসনকেই উৎখাত করে থামবে না, সেই সাম্রাজ্যবাদ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যে সহযোগী সমাজের পত্তন করেছিল তারও ভিত্তি ধ্বংস করে দেবে। এইসব বুদ্ধিজীবীরা যে সমাজ থেকে এসেছিলেন সেই সমাজের একাংশই একদিন নিজের এলাকায় রাজার জাতকে (নীলকর সাহেবদের) ডেকে এনে জমি দিয়ে বসিয়েছিলেন”।

নীল দর্পণ নাটকের ভূমিকায় দীনবন্ধু মিত্র স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, মুষ্টিমেয় নীলকর সাহেব খারাপ হতে পারে, কিন্তু ইংরেজ জাতি কলংকশূন্য। সর্বোপরি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে মহারাণী ভিক্টোরিয়া যখন ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর সাক্ষাৎ প্রতিনিধিরা যখন দেশ শাসন করেছেন তখন সুবিচার পাওয়া যাবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যেখানে মহারাণী ভিক্টোরিয়া, ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং ইংরেজ সিভিল সার্ভিসের উপর এরকম অগাধ বিশ্বাস সেখানে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র নিশ্চিতভাবে নির্যাতিত চাষীদের সাফল্যজনক নীল বিদ্রোহের মধ্যে মুক্তির সন্ধান করতে পারেন না। তাই দীনবন্ধু বাবু নীল বিদ্রোহকে ভিত্তি করে এ নাটক রচনা করেননি। নাটকে নীল বিদ্রোহের নায়কদের চরিত্র নেই বললেই চলে। এতে রয়েছে নীলকরদের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে চাষীদের গুটিকয়েক বলিষ্ঠ সংলাপ আর অসহায় ক্রন্দন ও মৃত্যুর ঘনঘটা।

এতদসত্ত্বেও সে যুগের বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর এই ‘নীল দর্পণ’ নাটকের ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর কোলকাতার শ্যামবাজারে নাট্য সমাজে ‘নীল দর্পণ’ নাটক মঞ্চস্থ হবার পর, তৎকালীন কোলকাতার ইংরেজ সমাজে মারাত্মক ও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নাটকটি দ্বিতীয় রজনী (২১/১২/১৮৭২) অভিনীত হওয়ার আগেই ইংরেজদের মুখপত্র দি ইংলিশম্যান পত্রিকায় (বর্তমানে স্টেটস্ম্যান) নীল দর্পণের অভিনয় বন্ধ করার দাবী উত্থাপিত হয়। ১৮৭২ সালের ২০শে ডিসেম্বরের ইংলিশম্যান পত্রিকায় মন্তব্য করা হয় যে, “একটা নেটিভ পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, জোড়াসাঁকোর ন্যাশনাল থিয়েটারে শীঘ্র এই নাটক আবার অভিনীত হতে যাচ্ছে। এই নাটকটি অনুবাদ করার দরুন ইউরোপীয়দের মানহানি হয়েছে বলে হাইকোর্টের বিচারে রেভারেন্ড মিঃ লং-কে যেখানে এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, সেখানে সরকার কর্তৃক একটা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সেন্সরের মাধ্যমে মানহানির অংশগুলো বাদ দেয়ার ব্যবস্থা ছাড়াই নাটকটি মঞ্চায়নের বিষয়টি আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে।”

এ ধরনের মন্তব্য প্রকাশ হওয়ার সংগে সংগে শ্যামবাজারের ন্যাশনাল থিয়েটারের সেক্রেটারী ‘দি ইংলিশম্যান’ পত্রিকার সম্পাদকের কাছে লিখিত এক পত্রে জানান যে, “২১শে ডিসেম্বর নাটকটির দ্বিতীয় রজনী অভিনয়ের সময় নাটকের মানহানির অংশ বাদ দেয়া হয়েছে”। সেক্রেটারী মহোদয় উল্লিখিত পত্রে বিনীতভাবে আরও জানান যে, নীল দর্পণ নাটক অভিনয়ের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের গ্রাম্য জীবনযাত্রার চিত্র দেখান, ইংরেজদিগকে বিরূপ করা নয়। ইংরেজ চরিত্রের প্রতি তাঁদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। (২৩/১২/১৮৭২ তারিখে দি ইংলিশম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত ন্যাশনাল থিয়েটারের সেক্রেটারীর পত্র)।

‘মানহানির অংশ’ বাদ দিয়ে সে আমলের সংস্কারপন্থী এবং পরোক্ষভাবে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজশক্তির ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থাশীল নাটক ‘নীল দর্পণ’ এভাবেই রক্ষা পেলো। আজও পর্যন্ত ‘নীল দর্পণ’ নাটকে উক্ত ‘মানহানির’ অংশের সংযোজন হয়নি।

এতদসত্ত্বেও কোলকাতা কেন্দ্রিক উক্ত বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহলের শ্রেণী স্বার্থে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘নীল দর্পণ’-এর মতো সংস্কারপন্থী নাটককে সহ্য করতে পারেননি। তিনি ১৮৭৩ সালে (ভাদ্র ১২৮০) ‘বংগদর্শন’ পত্রিকায় নীল দর্পণ নাটকের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন, “নীল দর্পণকার প্রভৃতি যাহারা সামাজিক কু-প্রথার সংশোধনার্থে নাটক প্রণয়ন করেন আমাদিগকে বিবেচনায় তাঁহারা নাটকের অবমাননা করেন। নাটকের উদ্দেশ্য গুরুতর যে সকল নাটক এইরূপ উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়, সে সকলকে আমরা নাটক বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। কাব্যের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি, সমাজ সংস্কার নহে। মুখ্য উদ্দেশ্য পরিত্যক্ত হইয়া সমাজ সংস্কারাভিপ্রায়ে প্রণীত হইলে নাটকের নাটকত্ব থাকে না”।

এ প্রসঙ্গে মীর মোশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। লেখক মীর মোশাররফ হোসেন স্বয়ং জমিদার-নন্দন। তিনি ১৮৭৩ সালে এই নাটক রচনা করেন। ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জ এলাকায় যে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়, তারই চৌহদ্দির একটা বিশেষ দিক নিয়ে এই নাটকটি রচিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে জমির উপরে এ দেশের কৃষকদের যে অধিকার ছিল ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অত্যন্ত সন্তর্পণে সেসব অধিকার হরণ করে জমিদারদের হাতে অর্পণ করলো। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট এসব জমিদার বাংলার গ্রামীণ এলাকায় লাগামহীন অত্যাচার আরম্ভ করে। এসব অত্যাচারের মধ্য দিয়ে ‘দফায় দফায় অবৈধ আদায়, নতুন জরিপ প্রণালী প্রবর্তন করে জমি চুরি, খাজনা বৃদ্ধি ও কবুলিয়ত গ্রহণ’ প্রভৃতি ছিল অন্যতম। পাবনার সিরাজগঞ্জ এলাকায় জমিদারদের এসব লাগামহীন অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের মধ্যে অচিরেই বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং এই বিক্ষোভই সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাহায্যে অত্যন্ত নির্মমভাবে এই বিদ্রোহকে দমন করা হয়। অবশ্য এই রক্তাক্ত বিদ্রোহের মাঝ দিয়ে কৃষকরা তাঁদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী শক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করে।

জমিদারদের অত্যাচারের চিত্র অঙ্কন দুঃসাহসিক কাজ

আগেই উল্লেখ করেছি যে, জমিদার-নন্দন মীর মোশাররফ হোসেন সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি রচনা করেননি। এমনকি কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিতেও নাটকটি রচিত হয়নি। মোদ্দা কথায় নাটকটির মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী জমিদাররা শ্রেণী সৃষ্টি করে সরাসরিভাবে প্রজা পালনের যে দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিয়েছে, জমিদার তা সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পালন করছে না। জমিদাররা চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করছে।

নাটকের ভূমিকায় মীর সাহেব লিখেছেন, “নিরপেক্ষভাবে আপন মুখ দর্পণে দেখিলে যেমন ভালমন্দ বিচার করা যায়, পরের মুখ তত ভাল দেখা যায় না। জমিদার বংশে আমার জন্ম, আত্মীয়-স্বজন সকলেই জমিদার। সুতরাং জমিদারের ছবি অঙ্কিত করিতে বিশেষ প্রয়াস আবশ্যক করে না”।

‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকরা যে সম্মিলিত সংগ্রাম করে নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তার কোন দিক-নির্ণয় কিংবা ইংগিত পর্যন্ত লেখক দেননি। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী কৃষক সমাজের অন্তর্ভুক্ত বিধায় নাটকে এদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি প্রদর্শন করা হয়েছে এবং জমিদারদের অত্যাচারের মুখে কৃষকদের অসহায় অবস্থা উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি সূক্ষ্ণভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, এই নাটকে জমিদারের শ্রেণী চরিত্র অপেক্ষা ব্যক্তি-চরিত্রকেই অঙ্কন করার প্রয়াস বিদ্যমান। দীনবন্ধু মিত্রের সংস্কারপন্থী ‘নীল দর্পণ’ নাটকে তবুও কৃষক তোরাপের মত একটি বলিষ্ঠ চরিত্র রয়েছে। কিন্তু ‘জমিদার দর্পণে’ তোরাপের মত প্রতিবাদমুখী চরিত্রও অনুপস্থিত। এই নাটকে প্রজাদের দেখানো হয়েছে জমিদারদের শিকার হিসেবে।

নাট্যকার মীর মোশাররফ হোসেন সমস্যার সুরাহা হিসেবে একাধিকবার তৎকালীন ভারত-ঈশ্বরী মহারাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন জানিয়েছেন।

“কাতরে ডাকি তোরে শুন মা ভারতেশ্বরী।
অবহিত অবিচারে আর বাঁচিনে মরি মরি।
…… ….. …..
রক্ষা কর প্রজা কিঙ্কয়ে বিনয়ে করি মিনতি।”

তবে একটা কথা ঠিক যে, ১৮৭২-৭৩ সালে যখন সিরাজগঞ্জ এলাকায় জমিদার তথা শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কৃষকদের সশস্ত্র ও রক্তাক্ত বিদ্রোহ অব্যাহত ছিল, ঠিক তখনই স্বয়ং একজন জমিদার-নন্দন হয়েও মীর মোশাররফ হোসেনের পক্ষে ১৮৭৩ সালে রচিত তার ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে জমিদারদের বীভৎস অত্যাচারের নমুনা উপস্থাপনা করাটাও দুঃসাহসিকতার কাজ বলে আখ্যায়িত করা যায়।

“জমিদার দর্পণ” নাটক সম্পর্কে মন্তব্য প্রকাশকালে গবেষক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামী ‘দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক’ গ্রন্থে (১৩৮৫: সাহিত্য প্রকাশঃ কলিকাতা) লিখেছেন “সাধারণভাবে দেখতে গেলে সে যুগের এটাই বাস্তব অবস্থা। ইংরেজ জজ সাহেবের সামুনে ইংরেজ ডাক্তার (যারা ব্যক্তিগতভাবে পরস্পরের অতি পরিচিতি) বাইবেল ছুঁয়ে মিথ্যা রিপোর্ট দিচ্ছেন। যে মেয়েটির মৃত্যু ঘটেছে পাশবিক অত্যাচারের ফলে এবং ডাক্তার রিপোর্টে ‘স্ত্রী লোকটির অধোদেশ হইতে রক্ত নির্গত হয়েছে’, ‘গলার চর্মের নীচে রক্ত জমা’ হয়েছে এসব

বলেও “ব্রেন ডিজিজ”-এ তাঁর মৃত্যু ঘটেছে বলে ঘোষণা করেছেন এবং জজ সাহেব তা মেনে নিচ্ছেন। অন্যদিকে জমিদারের হিন্দু দালাল নামাবলী গায়ে, কৌপিন পরে সর্বাঙ্গে তিলক লেপে, তুলসীর মালা হাতে হরিনাম জপ করতে করতে’ আবোল-তাবোল মিথ্যা সাক্ষী দিচ্ছে এবং জজ সাহেব তা মেনে নিচ্ছেন। সর্বোপরি থানা-পুলিশ সবই জমিদারের হাতে। এই অবস্থায় সুবিচার পাওয়ার আশা কোথায়? তাই আকুল কান্না ছাড়া গতি নেই এবং নাট্যকারের পক্ষে সেই ক্রন্দনের সংগে সুর মিলিয়ে নট ও নটীর বেদনার্ত গান (‘কবে পোহাইবে এই দুঃখ বিভাবরী)’ দিয়ে নাটক শেষ করাই হয়তো স্বাভাবিক। নাট্যকার তাই-ই করেছেন। নির্যাতিত প্রজার দুঃখে তাঁর যথেষ্ট সহানুভূতি আছে— নির্যাতিত ও অত্যাচার দূর হোক এটাও তিনি চান। নটীর উক্তির মধ্যেও এই সহানুভূতি ও আশা প্রকাশিতঃ

“হবে না কি দরিদ্রের এ দুঃখ মোচন
রবে না কি অবলার সতীত্ব রতন?“

নাট্যকার মীর মোশাররফ হোসেন পরোক্ষভাবে নাটকে একথাটাই বলতে চেয়েছেন যে, প্রজা সাধারণের উপর জমিদারদের এই লাগামহীন অত্যাচার বন্ধ না হলে পরিণাম শুভ বলে মনে হয় না।

বংকিমচন্দ্র কর্তৃক জমিদার দর্পণ বেআইনী ঘোষণার দাবী

প্রসংগত এ সময়ে কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে সিরাজগঞ্জের ইংরেজ এসডিওপি নোলান-এর প্রদত্ত রিপোর্ট (২৩শে এপ্রিল ১৮৭৪) বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “আগে থেকেই কয়েকটি গ্রামের কৃষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে জমিদারের উৎপীড়ন, লুন্ঠন ও গৃহদাহ প্রভৃতি সত্ত্বেও সাফল্যের সংগে জমিদারের অতিরিক্ত কর আদায় ও কবুলিয়ত আদায়ে বাধা দিয়ে আসছিল। তারা তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃসাহসিক কাজের দ্বারা অন্যসব কৃষকের সম্মুখে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করছিল যে, একতা ও দৃঢ়তা দ্বারা জমিদারের সব অবৈধ দাবী এবং উৎপীড়নে বাধা দান করা সম্ভব”।

এরই প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, সিরাজগঞ্জের সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের ফল হিসেবে ইংরেজ সরকার ১৮৮৫ সালে প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তনে বাধ্য হয়। এই আইনে ইচ্ছামত খাজনা বৃদ্ধি এবং চাষীদের কৃষিভূমি থেকে উচ্ছেদ রদ হয়ে কৃষি ভূমির ওপর চাষীদের দখলীস্বত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়।

এখন বিচার করা দরকার যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসব ব্যাপারে কোলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মনমানসিকতা ও ভূমিকা কিরূপ ছিল। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এঁরা ১৮৫৭ সালের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতি দেখানো তো দূরের কথা; বরং প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে ইংরেজদের মদত যুগিয়েছে। এরপর নীলকর সাহেবদের ভয়াবহ অত্যাচারের পটভূমিতে ১৮৬০ সালে লেখা সংস্কারপন্থী নাটক দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’কে এঁরা সহ্য করতে পারেনি। প্রধানতঃ বাঙালি হিন্দু শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালীদের সমবায়ে গঠিত কোলকাতা কেন্দ্রিক এই নব্য সমাজ এ সময় শ্ৰেণী স্বার্থে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো বলা যায়। সাম্রাজ্যবাদ ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এঁরা লালিত-পালিত এবং আশ্রিত। তাই বাংলার রেনেসাঁ (নবজাগরণ) এবং মানবতাবোধের আদর্শ সম্পর্কে এঁরা যত ‘ফুটানী’-ই করুক না কেন, শ্রেণী স্বার্থে কিংবা আশ্রয়দাতা ইংরেজদের স্বার্থবিরোধী সব রকম কর্মকান্ডকে এঁরা ধিক্কার দিয়েছে এবং পরিত্যাজ্য হিসেবে বিবেচনা করেছে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই সংস্কারপন্থী ও আপোষকামী হওয়া সত্ত্বেও ‘জমিদার দর্পণের মতো নাটককেও কোলকাতা কেন্দ্রিক এই নব্যসৃষ্ট সমাজ সহ্য করতে পারলো না। সে যুগের বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের অগ্রণী ও প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কৃষকদের অসহায় ও করুণ চিত্র সংবলিত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক সম্পর্কে বিষোদগার করলেন। কারণটা আরো সুস্পষ্টভাবে বলতে হলে বলতে হয় যে, নাটকটি রচনার সময় সিরাজগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ চলছিলো। আর সমাজের এসব নিম্নশ্রেণীর বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থানকে কোলকাতা কেন্দ্ৰিক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরা খুব বেশী ভয় করতো।

১৮৭৩ সালে ‘বঙ্গ দর্শন (ভাদ্র ১২৮০ সংখ্যা) পত্রিকায় বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিতভাবে ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি বেআইনী ঘোষণার দাবী জানালেন। (তখনও পর্যন্ত ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী নাটক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কোন আইন প্রণয়ন করেনি। কুখ্যাত ‘ড্রামাটিক পারফরমেন্স কন্ট্রোল’ বিলটি ১৮৭৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আইনে পরিণত হয়। )

বংকিমচন্দ্র লিখলেন, “বঙ্গ দর্শনের জন্মাবধি এই পত্র প্রজার হিতৈষী এবং প্রজাহিত কামনা আমরা কখনও ত্যাগ করিব না। কিন্তু পাবনা জেলার প্রজাদিগের আচরণ শুনিয়া বিরক্ত ও বিষাদযুক্ত হইয়াছি। জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। আমরা পরামর্শ দিই যে, এ সময়ে এ গ্রন্থের (জমিদার দর্পণ) বিক্রয় ও বিতরণ বন্ধ করা হউক”।

সম্প্রতি এ সম্পর্কে পশ্চিম বংগের গবেষক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামী যথার্থই লিখেছেন, “বঙ্কিমচন্দ্রের এই আচরণে বিস্মিত হবার কিছুই নেই। কারণ সমাজের মধ্যশ্রেণীর যে অংশ ভূমিস্বত্বের অধিকারী বা প্রধানতঃ ভূমিস্বত্বের ওপরে নির্ভরশীল, বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সেই অংশেরই লোক। সুতরাং তাঁর পক্ষে কৃষক বিদ্রোহকে ভয় করারই কথা। এ বিষয়ে তিনি অনেক বেশী সচেতনও ছিলেন। তাই ‘বংগদেশের কৃষক’ (দেশের শ্রীবৃদ্ধি) প্রবন্ধে স্বশ্রেণীকে সতর্ক করে লিখেছিলেন— “তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশের কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী। তোমা হইতে আমা হইতে কোন্ কার্য হইতে পারে? কিন্তু সকল কৃষিজীবী ক্ষেপিলে কে কোথায় থাকিবে?”

ডঃ গোস্বামী আরও লিখেছেন, “ভূমিস্বত্বের ওপরে নির্ভরশীল বুদ্ধিজীবী বঙ্কিম কতখানি শ্রেণীস্বার্থ-সচেতন ছিলেন এই উক্তি তার দৃষ্টান্ত। এজন্যই বঙ্কিম যে শ্রেণীর লোক সেই শ্ৰেণী যে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহযোগী, তাদের ভিত্তিকে যে নাড়া দেয় তাকে বঙ্কিম সমর্থন করতে পারেননি…… শুধু ‘জমিদার দর্পণ’ নয়, ‘নীল দর্পণকেও’ বঙ্কিমের পক্ষে সহ্য করা কঠিন”। (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক : ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামী : কলিকাতা)

‘বাংলা নাটকের মুক্তি’ এবং ‘একটি অতিকথা’

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কোলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে বাঙালিত্বের নামে যে হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টি হয়ে দ্রুত পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো, সে অবস্থাটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে আরও কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা অপরিহার্য বলে মনে করছি।

১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর কোলকাতার জোড়াসাঁকোর শ্রীযুক্ত মধুসূদন সান্যাল-এর বাড়ীতে প্রথম সাধারণ রংগালয় (থিয়েটার) স্থাপন করে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটক অভিনীত হয়। এর আগে কোলকাতার বিত্তশালীদের বাসভবনে যে সৌখিন নাট্যাভিনয় হতো, এদিন থেকে তা সর্বপ্রথম পেশাদার-এ পরিণত হয়। এটাকেই ‘বাংলা নাটকের মুক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এক কথায় বলতে গেলে, “এদেশে যখন নাট্যশালার সৃষ্টি হয়, তখন দেশে একটা অন্তর্বিপ্লবের সূত্রপাত হইয়াছে। ইংরেজী শিক্ষা, ইংরেজী ভাব, ইংরেজী চিন্তা, ইংরেজী সভ্যতা, ইংরেজী আচার ব্যবহার নিষ্ঠা বাংলার অচলায়তনের শতমুখী যে শিকড়, তাহাকে শতদিক হইতে নাড়াইয়া দিয়াছে ও বাঙালি জীবনের ধারা এই সময় হইতে সকল দিকেই বদলাইতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহার সাহিত্যও এই সময় নবকলেরব ধারণ করে”। (বাংলা নাটক ও গিরিশ যুগ— অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় : রূপ ও রংগ কলিকাতা, আশ্বিন—১৩৩২)

শুধু নাটক কেন, তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় নানাদিক দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর ঘটনাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটা সংস্কারমূলক উদ্দেশ্যে এবং দলে দলে হিন্দু শিক্ষিত যুবকদের খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার প্রবণতাকে রোধ করার তাগিদে এসব কর্মকান্ডের আগেই রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তিত হয়েছে। ১৮২৮ সালে তিনি ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। অবশ্য রাজা রামমোহন ইংরেজী ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার গোড়া সমর্থক ছিলেন।

এরই পরবর্তীতে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (১৮৩৪-৮৬) হিন্দু ধর্ম সংস্কারের জন্য সোচ্চার হন। শ্রীরামকৃষ্ণের পদাংক অনুসরণ করে তাঁরই ভাবশিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু দর্পণ প্রচারে লিপ্ত হন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের প্রবর্তন করেন।

সমসাময়িককালে ডিরোজিও-র নেতৃত্বে ‘ইয়ং বেংগল’-এর সমর্থকরা সমাজ জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এঁরা মূলতঃ বুদ্ধিজীবী হওয়া সত্ত্বেও এঁদের সংগে বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এঁদের মধ্যে সে আমলে পান্ডিত্য ও বাগ্মিতায় অসাধারণ কর্মপূরুষ রাম গোপাল ঘোষ প্রথমে ইহুদী ব্যবসায়ী জোসেফের অফিসে চাকরি করতেন। পরে তিনি আর জি ঘোষ এ্যান্ড কোং’ নামে নিজস্ব কোম্পানী স্থাপন করেন।

‘ইয়ং বেংগল’-এ অর্থনৈতিক আদর্শ ছিল ‘অবাধ বাণিজ্যের আদর্শ এবং অনেক গবেষকের মতে, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এঁদের অবদান ‘যুগান্তকারী’। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক সামাজিক উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরও এই ‘ইয়ং বেংগল’-এর অন্ধ সমর্থক ছিলেন। তিনিও ‘কালাচাঁদ শেঠ এ্যান্ড কোম্পানীতে’ ১৮৩৯ সালে একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৫৫ সালে তিনি স্বয়ং ‘প্যারীচাঁদ মিত্র এ্যান্ড সন্স’ কোম্পানী গঠন করেন। প্যারীচাঁদ মিত্র গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোং লিঃ, পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোং, হাওড়া ডকিং কোং লিঃ, বেংগল টি কোম্পানী এবং ডারাং টি কোং লিঃ-এর অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন।

অন্যদিকে প্যারীচাঁদ ১৮৩৮ সালে ‘সোসাইটি ফর দি এ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ’-এ রামতনু লাহিড়ীর সংগে প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ১৮৪৩ সালে প্যারীচাঁদ “দি বেংগল বৃটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির’ অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইংরেজ ব্যবসায়ী জর্জ টমাসন ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। এছাড়া প্যারীচাঁদ মিত্র মহাশয় ‘দি বৃটিশ ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন’ (১৮৫১), ‘বীটন সোসাইটি’ (১৮৫১), দি ক্যালকাটা সোসাইটি ফর দি প্রিভেনশন অফ ক্রয়েলটি টু এ্যানিমেলনস’ (১৮৬১), ‘এ্যাগ্রিকালচার এ্যান্ড হটিকালচার সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’ (স্হাঃ ১৮২০) প্রভৃতি সংস্থার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৮৬৭ সালে তিনি ‘বেংগল সোশ্যাল সায়েন্স’-এর যুগ্ম-সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত গবেষক শ্রী বিনয় ঘোষ-এর দু’টি মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই দু’টি মন্তব্য তিনি ৩০ বছরের ব্যবধানে করেছেন। ১৯৪৮ সালে তিনি লিখেছেন, “রামমোহনের যুগ থেকে ‘ইয়ং বেংগলের’ যুগের প্রসারতা ও ব্যাপকতাই এখানে উল্লেখযোগ্য। এই ব্যাপক শক্তিসঞ্চার ও আলোড়নের ফলেই নবজাগৃতির প্রবাহ উত্তাল তরংগের সৃষ্টি করেছে এবং পরে সামাজিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রবল গতিশীলতার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে আত্মস্থ হয়েছে। এই ধারাতেই সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধ হয়েছে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং এই ধারাই বিংশ শতাব্দীর বিস্তৃত ক্ষেত্রে জাতীয় আন্দোলনের জোয়ারের সংগে মিশে গেছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই ধারা রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, রাজেন্দ্রলাল, বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বিহারীলাল, রবীন্দ্রনাথের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে প্রবাহিত হয়েছে নবজাগরণের এই ধারার পাশাপাশি আর একটি ধারাও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে প্রবাহিত হয়েছে। এই ধারাকে আমরা রাধাকান্ত, ভূদেব, রমকৃষ্ণ বিবেকানন্দের ধারা বলতে পারি। এই দুই ধারা ঠিক প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দু’টি পরস্পর-বিরোধী নির্দিষ্ট ধারা নয়।………… প্রগতির সাধারণ ধারাই নতুন-পুরাতনকে স্বীকৃত করে নিজস্ব গতিবেগে সমন্বয়ের পথে প্রবাহিত হচ্ছিল।….. …….. (বাংলার নবজাগৃতিঃ পূঃ ১৩৮-১৩৯, বিনয় ঘোষঃ ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলিকাতা)

প্রায় ৩০ বছরের ব্যবধানে গবেষক বিনয় ঘোষ তাঁর এই বক্তব্য সংশোধন করেছেন। ১৯৭৯ সালে তিনি স্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করলেন, “মাত্র তিরিশ বছরের ব্যবধান যা এক পুরুষের ব্যবধান হওয়ার কথা, তা ১৯৭৮-৭৯ সালে মনে হয় যেন বহু পুরুষের ব্যবধান। তাই এই এক পুরুষকালের দূরত্বের মধ্যেই ‘বাংলার নবজাগৃতি’— যা একদিন ঐতিহাসিক সত্য বলে মনে হয়েছিল— আজ তা মনে হয় ‘একটি অতিকথা’ …. …চিন্তাধারার কেন পরিবর্তন হয়েছে, এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হল, যেহেতু সমাজের রূপ ও প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে এবং সমাজতত্ত্বের বিভিন্ন আলোকরশ্মির সাহায্যে আমরা সেই পরিবর্তনের স্বরূপ আগের চেয়ে অনেক বেশী বুঝতে পেরেছি এবং পারছি”।

(বাংলার নবজাগৃতি : ১৯৭৯ পরিবর্ধিত সংস্করণঃ ভূমিকা বিনয় ঘোষ )

গবেষক বিনয় ঘোষের সৎসাহস রয়েছে। তাই তিনি ৩০ বছরের ব্যবধানে স্বীয় ভ্রমাত্মক চিন্তাধারা এবং এতদূসম্পর্কিত বিশ্লেষণের সংশোধন করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন যে, ‘বাংলা নবজাগৃতি’— যা একদিন ঐতিহাসিক সত্য বলে মনে হয়েছিল— আজ তা’ মনে হয় ‘একটি অতিকথা’। এই প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোলকাতা তথা বাংলাদেশের সমাজ জীবনের ঘটনাবলীর বিবর্তন আরও কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে হয়।

কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এবং ইংরেজ রাজশক্তিকে সহযোগিতা প্রদানের উদ্দেশ্যে এ সময় নানা ধরনের সমিতি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সিপাহী বিদ্রোহের প্রায় চার বছর আগে ১৮৫৩ সালে কোলকাতায় সর্বপ্রথম ‘বেঙ্গল ল্যাণ্ড লর্ড এসোসিয়েশন’ গঠন করা হয়। অবিভক্ত বাংলার বনেদী হিন্দু জমিদাররা নিজেদের “বক্তব্য ও আব্দার” সুষ্ঠুভাবে ইংরেজ সরকারের নিকট উপস্থাপনা করার জন্য এই সমিতি গঠন করে।

এরপর কোলকাতার বাঙালি হিন্দু বিত্তশালী এবং হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর উদ্যোগে ১৮৫৬ সালে ‘বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ নামে আর একটি সমিতি স্থাপিত হয়। এই সমিতিতে অভিজাত ও জমিদার শ্রেণীর সদস্য ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার পর্যন্ত ছিল না।

কোলকাতা ‘হিন্দু মেলার’ প্রথম অধিবেশন

এর পাশাপাশি পরোক্ষভাবে ইংরেজ রাজশক্তির মত যোগানো এবং ইংরেজের ছত্রছায়ায় বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার জন্য শ্রী রাজনারায়ণ বসুর নেতৃত্বে ১৮৬১ সালে কোলকাতার ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ স্থাপিত হল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনা-পত্র প্রকাশিত হলে বাঙালি হিন্দু শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৬৭ সালে (১২৩৭) সালের চৈত্র সংক্রান্তির দিন কোলকাতার ‘বেলগাছিয়া ভিলায়’ প্রস্তাবিত ‘হিন্দু মেলার’ প্রথম অধিবেশন হয়। এই প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনায় যেটুকু বলা হয়েছে, তাতে স্পষ্টতঃই বোঝা যায় যে, এতদিন পর্যন্ত রাজশক্তির সহযোগিতাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী লালিত-পালিত হচ্ছে, অতঃপর পরাশক্তির সেই সহযোগিতাকে গৌণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এখন থেকে ‘আত্মনির্ভর হওয়ার জন্যই এই ‘হিন্দু মেলার জন্ম।

এরপর বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক দাবী-দাওয়া আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হল ‘ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ বা ‘ভারত সভা’। পদচ্যুত প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন।

অবশেষে লর্ড এ, ও, হিউম-এর উদ্যোগে ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বোম্বাই শহরে আয়োজিত এক বৈঠকের মাধ্যমে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের’ জন্ম হয়। বাংলাদেশের ভূস্বামী এবং বোম্বাই-এর ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় সৃষ্ট এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে মাত্র ৭০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ১৯০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সমগ্র উপমহাদেশে এই প্রতিষ্ঠান বিস্তৃতি লাভ করে। প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, তৎকালীন ইংরেজ ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন পরোক্ষভাবে এই প্রতিষ্ঠান গঠনে সমর্থন দান করেন এবং বেশ কিছুসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সরকারী কর্মচারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ পর্যন্ত লাভ করেন। এদের মধ্যে মিঃ এ, ও, হিউম কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এমনকি ১৯০০ খৃষ্টাব্দে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটিতে তিনজন ইংরেজ রাজপুরুষের (অবসরপ্রাপ্ত) নাম পাওয়া যায়।

১৮৬৭ সালে স্থাপিত ‘হিন্দু মেলা’ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যাদান বাঞ্ছনীয় মনে হয়। হিন্দু মেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ভাষায় বলা হয়েছে, “আমাদের মিলন সাধারণ ধর্মকর্মের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য ভারত ভূমির জন্য। ইহার আরো একটি উদ্দেশ্য আছে, সেই উদ্দেশ্য আত্মনির্ভর। এই আত্মনির্ভর ইংরেজ জাতির একটি মহৎ গুণ। আমরা এই গুণের অনুকরণে প্রবৃত্ত হইয়াছি। আপনার চেষ্টায় মহৎ কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া এবং সফল করাকেই আত্মনির্ভর কহে। ভারতবর্ষের একটি প্রধান অভাব— আমাদের সকল কর্মেই আমরা রাজপুরুষদের সাহায্য যাঞ্চা করি। ইহা কি সাধারণ লজ্জার বিষয়….. যাহাতে এই আত্মনির্ভর ভারতবর্ষে স্থাপিত হয়- ভারতবর্ষে বদ্ধমূল হয়, তাহা এই মেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য”। (“মুক্তির সন্ধানে ভারতঃ যোগেশ চন্দ্ৰ বাগল)।

দেশ মাতৃকার শৃংখল মোচনের উদ্দেশ্য নয়

তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোন ‘রাজবিরোধী কার্যকলাপ’ কিংবা দেশ মাতৃকার শৃংখল মোচনের’ জন্য আলোচ্য ‘হিন্দুমেলা’ গঠিত হয়নি। এটা গঠিত হয়েছিল রাজদন্ডের ছত্রছায়ায় সৃষ্ট বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে।

এই হিন্দুমেলার প্রথম উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘মিলে সব ভারত সন্তান, একতান মনঃপ্রাণ’) এবং গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘লজ্জায় ভারতযশ গাইব কি করে) সংগীত রচনা করলেন। এই অনুষ্ঠানেই গঠিত হলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্বোধনী কবিতা “জাগ জাগ সবে ভারত সন্তান। মাকে ভুলি কতকাল রহিবে শয়ান?” এরপরেই দেশে একই ধরনের ন্যাশনাল সংগীত রচিত হওয়ার জোয়ার বইলো। কিন্তু সর্বত্রই জাতীয়তাবাদের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগীর অভাব। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, সমসাময়িককালে রচিত প্রায় সবগুলো নাটকে একই ধরনের মনোভাব বিরাজমান। নাট্যকার হরলাল রায় রচিত ‘বংগের সুখাবসান’ (১৮৭৪) নাটকে ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাবলীকে যথেচ্ছভাবে বিকৃত করার প্রচেষ্টাকে এখানে উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপনা করা যায়।

আদিতে পশ্চিম ভারতের কর্নাটক থেকে আগত অবাঙালি হিন্দু রাজবংশের শেষ বংশধর রাজা লক্ষণ সেনের ভয়াবহ অত্যাচারে নিম্নবর্ণের হিন্দু প্রজাসাধারনের জীবন যখন অতিষ্ঠ, তখন (১১৯৯) খৃষ্টাব্দে তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন অনুচর নিয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী নবদ্বীপ আক্রমণ করলে, স্থানীয় অধিবাসীদের কেউই অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য এগিয়ে না আসার প্রেক্ষিতেই রাজা লক্ষণ সেনের পলায়নই হচ্ছে ইতিহাস-ভিত্তিক তথ্য। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডক্টর অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতে, সেন রাজাগণ বিদেশী ছিলেন বলে বাংলা ভাষা সম্বন্ধে বিশেষ কৌতূহলী ছিলেন না। উপরন্তু তারা ঘোরতর ব্রাহ্মণ্য-মতাবলম্বী ও স্মার্ত সংস্কারপন্থী ছিলেন।— (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তঃ সংশোধিত চতুর্থ সংস্করণ)

অথচ নাট্যকার হরলাল রায় ‘বংগের সুখাবসান’ নাটকে অবাঙালী হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকে দেশপ্রেমিক বীর হিসেবে উপস্থাপিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। আলোচ্য নাটকে রাজা লক্ষণ সেনের মুখের সংলাপ হচ্ছে, “বংগভূমির কি রক্ষক নাই, রাজা নাই? যবনেরা জয় পতাকা তুলে, জয় বাদ্যে গগণ প্রতিধ্বনিত করবে আর বংগভূমি বিনা বাতাসে শুষ্কপত্রের ন্যায় নিঃশব্দে পতিত হবে এবং কাপুরুষ লাক্ষণ্য সেন জীবিত থাকবে।………. গুরুদেব, লাক্ষণ্য সেন বৃদ্ধ বটে, ভীরু নয়। যুদ্ধ করবো”।

বাংলা নাটকে ভয়াবহ মুসলিম বিদ্বেষ

কিরণচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় রচিত অন্যতম দেশাত্মবোধক (?) নাটক হচ্ছে ‘ভারত যবন’। এই নাটকের— ভারত মাতার দুঃখে ভারত সন্তানেরা যবন (মুসলমান) বধ করে স্বাধীনতা (?) অর্জনের জন্য কিভাবে প্রচেষ্টা করছে তাই-ই উপস্থাপিত করা হয়েছে। নাট্যকারের লিখিত বক্তব্য হচ্ছেঃ

“স্বাধীনতা সম কি আছে আর?
পামর যবনে করি কি ভয়?”

প্রায় একই সময়ে প্রখ্যাত নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুর ‘পুরুবিক্রম’ (১৮৭৪), ‘সরোজিনী’ (১৮৭৫), ‘অশ্রুমতী’ (১৮৭৯) এবং ‘স্বপ্নময়ী’ নামে চারটি নাটক রচনা করেন। প্রথম নাটকটি আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে রাজা পুরুর লড়াই-এর শৌর্যবীর্যের ঘটনা। বাকী তিনটি নাটক হচ্ছে (এক) ‘সরোজিনী’- সম্রাট আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মেবারের রাজপুত রাজা লক্ষণ সিংহের লড়াই (দুই) অশ্রুমতী— সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে রাজা প্রতাপ সিংহের লড়াই। (তিন) ‘স্বপ্নময়ী’— সম্রাট আওরংগজেব-এর বিরুদ্ধে শুভ সিংহ-এর বিদ্রোহ।

এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সমালোচক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামীর মতে, “… … … মুসলমান আমলের বিষয়বস্তু লিখিত নাটকেও মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিন্দু রাজাদের বীর্যবত্তা। আর এই নাটকগুলোতে যে দেশাত্মবোধ বা জাতীয়তাবোধ রয়েছে তার মধ্যে হিন্দু-প্রবণতা লক্ষ্যণীয়”। (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটকঃ সাহিত্য প্রকাশ, ১৩৮৫, কলিকাতা)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর এসব লেখকদের দৃঢ় ধারণা ছিল যে, এরই ফলে গণমানুষের হৃদয়ে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হবে এবং জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের সবচেয়ে জনপ্রিয় (জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুর রচিত) ‘সরোজিনী নাটকের (১৮৭৫) সংলাপে নমুনা হচ্ছে:

“সরোজিনী”।। মা চতুর্ভূজা! যাদের জন্য পিতার আজ এরূপ বিষম ভাবনা হয়েছে, সেই দুষ্ট মুসলমানদের শীঘ্র নিপাত কর!

লক্ষণ।। বৎসে! মুসলমানদের নিপাত সহজে হবার নয়। তার পূর্বে অশ্রুপাত করতে হবে”। জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুরের আর একটি নাটক ‘স্বপ্নময়ী’র (১৮৮২) অন্যতম চরিত্র সুরজমল-এর সংলাপ হচ্ছেঃ

“যেখানে মুসলমান থাকে সেখানকার বাতাসও যেন আমার বিষতুল্য বোধ হয়।”

এই ‘স্বপ্নময়ী’ নাটকের আর এক জায়গায় বিশিষ্ট চরিত্র শুভ সিংহ-এর সংলাপ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সংলাপটি কবিতার মাধ্যমে রয়েছেঃ

“…… দেব মন্দিরসকল,
চূর্ণ চূর্ণ করিতেছে ম্লেচ্ছ পদাঘাতে,
বেদ-মন্ত্র ধর্ম করিতেছে লোপ,
গো-হত্যা নির্ভয়ে করে রাজপথ মাঝে।”

এরচেয়ে মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য আর কি হতে পারে? ঠাকুর মহাশয় এখানে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চেয়েছেন যে, … … … মুসলিম রাজশক্তিই শুধু অত্যাচারী নয়, বরং পুরো মুসলমান সমাজটাই এই পদাংক অনুসরণ করছে।

এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সমালোচক ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, “বিধর্মী ঔরংগজীব হিন্দুদিগকে নানা দিক হইতে উৎপীড়ন করিতেছেন, এই জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে শুভ সিংহের বিদ্রোহ। অতএব, ধর্ম ইহার লক্ষ্য নয়, দেশ ইহার লক্ষ্য নহে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ‘হিন্দুমেলার’ ভিতর দিয়ে যে দেশাত্মবোধের উন্মেষ হইয়াছিল, তাহা এই সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এই নাটকখানির মধ্যে তাহারই পরিচয় পাওয়া যাইবে।” (বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড ১৯৬০ কলিকাতা)- ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য)।

মাইকেল মধুসূদন-এর উদার মনোভাব

অবশ্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত বেশ কিছুটা উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণ কুমারী’ নাটককে বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এটাকেই প্রথম ঐতিহাসিক নাটকের মর্যাদা দেয়া বাঞ্ছনীয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্বয়ং শ্রীকেশব বন্দোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে ‘কৃষ্ণ কুমারী’ নাটককে ‘হিস্টরী অফ ট্র্যাজেডী (ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে, সে আমলে কোলকাতায় পেশাদার নাট্যমঞ্চ হিসেবে একমাত্র বেলগাছিয়া নাট্যশালার অস্তিত্ব ছিলো। এই মঞ্চের মালিকদের অভিরুচি অনুসারেই নাট্যকারদের নাটক রচনা করতে হত। প্রস্তাবিত নাটকে ক’টি পুরুষ এবং ক’টি স্ত্রী চরিত্র থাকবে সেটাও মঞ্চের কর্তৃপক্ষ পূর্বাহ্নেই বলে দিতেন। এমনকি নাটকের মূল বক্তব্য ও পরিণতি সম্পর্কেও বেলগাছিয়া নাট্যশালার কর্তৃপক্ষ নির্দেশিকা দিতো। তাই যুগোপযোগী স্বাদেশিকতা ভাবাপন্ন বলিষ্ঠ নাটক রচনার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা বিরাজমান ছিল। মাইকেল মধুসূদনকেও এই অদ্ভূত প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয়েছে।

তিনি নিজে আগ্রহী হয়ে যেসব নাটক রচনা করেছেন, সেসব তৎকালে কোলকাতার একমাত্র পেশাদার ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালায়’ অভিনীত হতে পারেনি। এরই ফলে তাঁর ‘সুভদ্রা’ নাটক অসমাপ্ত রয়ে গেছে। প্রহসনমূলক দু’টি নাটক ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ওই নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয়নি। এজন্য নাটক দু’টি প্রকাশিত হওয়ার পর মঞ্চায়ন করার জন্য তাঁকে প্রায় ছ’বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। গবেষক ডঃ প্ৰভাত কুমার গোস্বামীর মতে, “মাইকেলের মত নাট্যকারও এঁদের দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেখানেই তিনি নিজের ভাবনা-চিন্তা প্রয়োগ করবার চেষ্টা করেছেন সেখানেই তাঁকে বিড়ম্বিত হতে হয়েছে।” ইতিহাস থেকে মুসলমান চরিত্র গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন ‘রিজিয়া’ নামে একটা পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনায় হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু কোলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যশালার মালিকরা এ ধরনের নাটকের প্রবল বিরোধিতা করেন এবং মঞ্চায়ন করতে দেয়া হবে না বলে পূর্বাহ্নেই মধুসূদনকে জানিয়ে দেন। ফলে ‘রিজিয়া’ নাটক রচনার প্রয়াস তিনি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত তিনি এ সময়ের প্রভাবশালী অভিনেতা কেশবচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের পরামর্শে রাজপুত জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে রচনা করেন ‘কৃষ্ণ কুমারী’ ট্র্যাজেডী নাটক।

বাংলা নাটকে রাজপুত কাহিনীর প্রভাব ও অন্তর্নিহিত কারণ

এই প্রেক্ষিতে ১৮৮০ সাল থেকে শুরু করে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ২৫ বছর সময়কালের নাটকগুলো (১৮৭৬ সালে নাটক নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হওয়ায় নাটকে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বক্তব্য প্রায় অনুপস্থিত) ইংরেজ সামরিক কর্মচারী লেঃ কর্ণেল জেমস টড-এর রচিত ‘এ্যানালস এ্যাণ্ড এ্যানটিক্স অব রাজস্থান’ ‘গ্রন্থের উপাদানে ভরপুর। ইংল্যান্ড-এর রাজা ৪র্থ জর্জকে পুস্তকটি উৎসর্গ করে লেখক জেমস টড এ মর্মে উৎসর্গ-পত্রে লিখেছেন যে, “বৃটিশ শক্তি স্বাধীনতা হারানো রাজপুত জাতি এবং বাঙালি জাতি…… এই দু’টো জাতিকেই চরম অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছে”। “অথচ ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে ইংরেজরা বংগীয় এলাকা এবং ১৮১৭ সাল নাগাদ রাজপুত রাজ্যগুলো কিভাবে ছলে বলে ও কৌশলে কুক্ষিগত করেছে, তা শিক্ষিত ব্যক্তির কাছে অজানা ছিল না। এই গ্রন্থের ভূমিকায় একদিকে আটশ’ বছরের মুসলিম রাজত্বের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার করা হয়েছে এবং অন্যদিকে হিন্দুদের অতীত মহত্ত্বের কথা ও হিন্দু ধর্মীয় দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে। লেখক বলতে চেয়েছেন যে, ইংরেজরাই হচ্ছে বাঙালি হিন্দু এবং রাজপুতদের মুক্তিদাতা।

পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণী প্রায় এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত টড-এর প্রণীত আলোচ্য গ্রন্থ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন। লেঃ কর্ণেল জেমস টড কৃত এ্যানালস এ্যাণ্ড এ্যানটিক্স অব রাজস্থান বইটি সর্বপ্রথম বরদা কান্ত মিত্র ‘রাজস্থানের ইতিবৃত্ত’ নামে অনুবাদ করেন। এরপর অঘোরচন্দ্র বরাট এবং উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামে আরও দু’জন ‘রাজস্থান’ নাম দিয়ে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ প্রকাশ করেন।

গবেষক ডঃ গোস্বামী যথার্থই মন্তব্য করেছেন টড সাহেবের প্রভাব এড়ানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। কারণ ঐতিহাসিক তথ্যের নানা অসংগতির মধ্যেও যেমন বংকিমের প্রতিপাদ্য ছিল ‘হিন্দু বাহুবল’, তেমনি ইতিহাসের কাহিনী নিয়ে নাট্যকারেরা যে দেশাত্মবোধক নাটকগুলো লিখেছিলেন তার মধ্যে বহুসংখ্যক নাটকের জাতীয় ভাব প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদ…. প্রায় সর্বত্রই দেখা যাবে যে, নাট্যকারেরা ঐতিহাসিক ঘটনাকে যথাযথভাবে আঁকড়ে থাকেননি। ইংরেজকে সোজাসুজি আক্রমণ করার অসুবিধা থাকার জন্যও কেউ কেউ রাজপুত— মোগল বা রাজপুত-মারাঠা সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। সেখানেও হিন্দু-মানসিকতা এড়ানো যায়নি। এর ফল জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুখকর হয়নি, তাকে অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উদগীরিত হয়েছে।” (ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামীঃ দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটকঃ ৩০-৩৯ সাহিত্য প্রকাশঃ কলিকাতা ১৯৭৯)

প্রসংগত উল্লেখ্য যে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্র বাংলা রংগমঞ্চে সিপাহী বিদ্রোহের যুগে একটা নতুন দিগন্তের উন্মোচন করলেও এই ধারা বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনি। শীঘ্রী কোলকাতার রংগালয় হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী, ইতিহাসের নামে কাল্পনিক রোমাঞ্চ এবং হিন্দু ধর্মীয় প্লাবনে ভেসে গেল। এই প্লাবন সৃষ্টি করলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর পদাংক অনুসরণকারী নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। ইনিই রংগমঞ্চে ‘সামন্তবাদ’ ও ‘হিন্দু রিভাইভালিজম’-এর পতাকা উড়িয়ে দিলেন। আর কোলকাতার বড়বাজারের মাড়োয়ারীরা একটা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভংগী থেকে এসব নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করলো।

মোদ্দা কথায় বলতে গেলে, “গিরিশচন্দ্র এসময়ের পূর্ব পর্যন্ত সদাগরী অফিসে চাকরি করিতেন। মারবাড়ী ব্যবসায়ীদের হাতে পড়িয়া থিয়েটার ব্যবসায়ের কেন্দ্রে পরিণত হইলে গিরিশচন্দ্র অফিস ছাড়িয়া থিয়েটারে কায়েমীভাবে যোগ দিলেন। সে ১৮৮০ খৃষ্টাব্দের কথা নাট্যকার, অধ্যক্ষ ও নাট্যচার্য গিরিশচন্দ্রের প্রতিষ্ঠা এই প্রতাপ জহুরীর থিয়েটারেই আরম্ভ হইল।” (অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ‘রংগালয়ে ত্রিশ বছর (১৯৭২) পূঃ ২৮-২৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *