কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৮

১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পাশাপাশি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম

উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ হচ্ছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বছর। এই বছরে একদিকে যেমন এদেশে ইংরেজ আগমনের শতবর্ষ পূর্তির প্রেক্ষাপটে রক্তাক্ত সিপাহী বিদ্রোহ (বিপ্লব) অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, অন্যদিকে তেমনি কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুদের সন্তুষ্টি এবং এই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে ও দ্রুত ইংরেজী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে স্থাপিত হয়েছিল ভারত উপ-মহাদেশের প্রথম কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এটা এমন একটা সময়, যখন (১৮৫৩ খ্রীঃ) এদেশে রেলপথ স্থাপিত হয়ে তার সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রধানতঃ সৈন্যদের যাতায়াত ত্বরান্বিত করা এবং ভারতের সুলভ কাঁচামাল ও কৃষিজাত দ্রব্য বৃটেনে রফতানীর জন্যই এসব রেলপথ স্থাপিত হয়েছিলো। অথচ এই সময়কালের প্রশংসায় কোলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা “বঙ্গীয় রেনেসাঁ”র ডঙ্কা-নিনাদে তখন মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলো। সেদিন এঁরা সোচ্চার কণ্ঠে বক্তব্য রেখেছিলেন যে, ভারতে রেলপথ এবং টেলিগ্রাম লাইন স্থাপন হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার অবিস্মরণীয় অবদান। এসম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক শ্রী সুপ্রকাশ রায়ের মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন,

…“আর অপরদিকে কৃষক সংগ্রামের ভয়ে ভীত জমিদার ও মধ্য শ্রেণীর প্রধান মুখপাত্র অর্থাৎ বঙ্গীয় “রিনাসাসের” প্রধান নায়ক রামমোহন, দ্বারকানাথ, বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি সকলে ভারত বর্ষে ইংরেজ শাসনকে অব্যাহত রাখিবার জন্যই ব্যগ্রতা দেখাইয়াছেন। বঙ্গীয় “রিনাসাসের” জনক বলিয়া কথিত রামমোহন ফরাসী বিপ্লবের পতাকাকে অভিনন্দন জানাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু ভারত ভূমিতেও সেইরূপ এক বিপ্লবের দ্বারা ইংরেজ শাসন এবং জমিদার-মধ্যশ্রেণীর ভূম্যধিকারের অবসান ঘটাইবার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করিয়াছেন সারা জীবন। …… সুতরাং বঙ্গীয় তথা ভারতীয় “রিনাসাসের” জাতীয়তাবাদ ছিল আপোসমুখী। বৃটিশ প্রভুত্বকে ভারত-ভূমিতে অক্ষত রাখিয়া শাসকগণের নিকট হইতে কিছু সুবিধা-সুযোগ আদায়ের জন্য যে আন্দোলন “রিনাসাসের” নায়কগণ আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহা ছিল রাজনৈতিক সংস্কারের আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম নহে। .. ভারতের দুর্ভাগ্য যে, ইংরেজ-সৃষ্ট ভূম্যধিকারী গোষ্ঠীর হস্তে জাতীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার ন্যস্ত হইয়াছিল।” ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (৩য় সংস্করণ): ডি এন বি এ ব্রাদার্স কলিকাতা ১৯৮০)

আলোচনার সুবিধার্থে আবারও উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, এদেশে ইংরেজদের ১৯০ বছর রাজত্বকালের শেষের দিকের ৩৫ বছর (দিল্লীতে রাজধানী) বাদ দিলে প্রথম ১৫৫ বছরকাল কোলকাতাতেই ছিলো ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে ইংরেজ শাসক-গোষ্ঠীর প্রতি কোলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু, সুবর্ণ শ্রেণী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, মধ্যশ্রেণী এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রশ্নাতীত আনুগত্য।

দরজায় ‘বাঙালি বাবুজ’ লেখা থাকলে গোরা সৈন্যদের ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল।

এ ব্যাপারে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের (বিপ্লব) সময় কোলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দুরা সম্প্রদায় হিসেবে যেভাবে পরাশক্তি ইংরেজদের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জুগিয়েছিলো তা ইতিহাসে বিরল বলা চলে। সে আমলে কোলকাতার পত্র-পত্রিকাগুলো থেকে শুরু করে বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের মতো সমিতিগুলো পর্যন্ত জনসভার আয়োজন করে ইংরেজদের প্রতি সমর্থনের কথা ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। এজন্য ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, সিপাহী বিদ্রোহের (বিপ্লব) পর এর সমর্থকদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ইংল্যাণ্ড থেকে নতুন করে গোরা সৈন্য আমদানী করে পূর্ব ও উত্তর ভারতের ১৪টি শহরে মার্শাল ল’ জারি করে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিলো, সেই তালিকা থেকে অত্যন্ত সযত্নে কোলকাতা নগরীর নাম বাদ দেয়া হয়েছিল। এমনকি উত্তর ভারতের শহরগুলোর প্রবাসী বাঙালি হিন্দু মহল্লাগুলোতে যাতে করে গোরা সৈন্যরা প্রবেশ না করে সেজন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। এ জন্যই প্রখ্যাত নাট্যকার অমৃতলাল বসু তাঁর স্মৃতি ও আত্মস্মৃতি (ডঃ অরুণ কুমার মিত্র সম্পাদিত) গ্রন্থে লিখেছেন, “সিপাহীরা পরাস্ত হবার পর প্রতিহিংসাপরায়ণ গোরারা অন্ধ হয়ে অত্যাচার আরম্ভ করে। তখনও এলাহাবাদ, কানপুর, লক্ষ্নৌ প্রভৃতি শহরে যে সব বাড়ীর বাইরের দেয়ালে কয়লা দিয়ে ‘ক্যালকাটা বাবুজ’ লেখা ছিল, সেসব বাড়ী তাদের চক্ষুতেও পবিত্রবোধে উৎপাত হতে রক্ষা পেয়েছিল।”

এরকম এক প্রেক্ষাপটে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দেই কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলো উপ-মহাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এই সময় বৃটিশ ভারতে সরকারী চাকরিজীবীদের অবস্থাটা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করা অপরিহার্য। গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, “বস্তুতঃ ব্রিটিশের অধীনে প্রায় সমস্ত রকম চাকরিতে বাঙালিদের (বর্ণ হিন্দু) অধিকার ছিল প্রায় একচেটিয়া। ১৮৩০-৪০ এর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁরা আমূল সংস্কারপন্থী হিসেবে সবচেয়ে উচ্চ কণ্ঠ, যাঁরা ইয়ং বেঙ্গল নামে খ্যাত, এমনকি যাঁরা নেতৃস্থানীয় সংগ্রামী, তাঁরাও প্রত্যেকে ছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের সহযোগী— ব্যবসায়, বাণিজ্যে এবং প্রশাসনে ১৮৫৬-৫৭ পর্যন্ত সরকারী কাজ-কর্মে শিক্ষিত বাঙালিদের প্রায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা … …।

এ সম্পর্কে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের চাঞ্চল্যকর মন্তব্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, “সিপাহী বিদ্রোহের উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গদেশের ও সমাজের এক মহোপকার সাধিত হইল; এক নবশক্তির সূচনা হইল; এক নব আকাঙ্ক্ষা জাতীয় জীবনে জাগিল।” (রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ পূঃ ২২৪-২৫)

প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, সরকারের অর্থ, স্বরাষ্ট্র, জনশিক্ষা, রাজস্ব, মহাগাণনিক, সদর দেওয়ানী ও নিজামত আদালত এবং সরকারী সচিবালয়ের মোট ৭১৪টি পদের মধ্যে ইউরোপীয়দের ২৮৬টি পদ বাদ দিলে ৪২৮টির মধ্যে ৩৯৫টি (২/৩টি বাদে) বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের দখলে। অর্থাৎ অবশিষ্ট বিরাট ভারতবর্ষের অন্যান্য সমস্ত ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী মিলিয়ে সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা হচ্ছে তখন মাত্র ৩৩ জন।

তাহলে একথা বললে অন্যায় হবে না যে, ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী অবস্থিত থাকায় এবং নানাভাবে দালালি করার বদৌলতেই কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দুরা অন্য ভারতীয়দের তুলনায় ইংরেজী শিক্ষায় দারুণভাবে অগ্রসর হয়েছিলো। এমনকি বাঙালি মুসলমানতো দূরের কথা, প্রতিবেশী আসাম, বিহার, উড়িষ্যা এবং উত্তর ভারতের অন্যান্য প্রদেশকে বঞ্চিত করেই কোলকাতা কেন্দ্রিক আলোচ্য সম্প্রদায় ইংরেজদের অনুগ্রহে ব্যাপক সুবিধা ভোগ করেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইংরেজী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান পরিস্থিতি অনুধাবনের লক্ষ্যে একটা সুষ্ঠু মূল্যায়ন করা অপরিহার্য মনে হয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা না করে কয়েকটি নমুনা উপস্থাপনা করাই যথেষ্ট হবে। বিহার এবং উড়িষ্যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের আগে কোন কলেজ পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। এতদঞ্চলের প্রথম দুটি কলেজ হচ্ছে যথাক্রমে পাটনা কলেজ এবং কটকের রাভেশ কলেজ। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে বিহারের সব ক’টি কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্র সংখ্যা ছিলো মাত্র ২০৫ জন আর ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ কটকের রাভেশ কলেজ থেকে বি, এ পরীক্ষার্থী ছিলো মাত্র ২ জন। অন্যদিকে আসাম এলাকায় সর্ব প্রথম কলেজ স্থাপিত হওয়ার বছরটা হচ্ছে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ এবং ছাত্র সংখ্যা মাত্র ৩০ জন। ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তো আসামের সমস্ত স্কুলে বাংলা ছাড়া আর কোন দেশীয় ভাষাই পড়তে দেয়া হতো না।

পাশাপাশি কোলকাতার চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে যেখানে ২৪৪ জন প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী নিয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, সেখানে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ এই সংখ্যা (অধিকাংশই বর্ণহিন্দু) দাঁড়ালো তিন হাজারে। অর্থাৎ প্রায় ২৫ গুণ বৃদ্ধি পেলো। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে বি, এ পরীক্ষার্থী ছিলো মাত্র ১৩ জন, ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে তার সংখ্যা হলো ১৭১২ জন। এর মধ্যে মাত্র ২১৮ জন অবাঙালি। ১৮৬৩ সালে যেখানে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম,এ পরীক্ষার্থী ছিলো মাত্র ৬ জন, ১৮৮১-তে সেই সংখ্যা দাঁড়ালো ৪২৩ জনে। এর মধ্যে ৩৪৪ জনই বাঙালি।

এই প্রেক্ষাপটে কোলকাতার সদ্য স্থাপিত আইন, চিকিৎসা, শিক্ষকতা ও প্রকৌশল বিদ্যায়তনগুলো দলে দলে বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের সন্তান-সন্ততি দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। এজন্যই কোলকাতার বর্ণ-হিন্দু সমাজপতিরা অদূর ভবিষ্যতে বেকারত্বের অভিশাপের হাত থেকে শিক্ষিত যুব পরদায়কে রক্ষা করার উপায় উদ্ভাবনে প্রচেষ্ট হলেন।

কিন্তু ইংরেজী শিক্ষিত এদেশীয়, বিশেষ করে কোলকাতা-কেন্দ্রিক যুব সমাজ তথা বৃদ্ধিজীবী শ্রেণীর স্বরূপ কি রকম হবে, সে সম্পর্কে লর্ড মেকলের উক্তি হচ্ছে, এদেশে এমন এক শ্ৰেণী বানাতে হবে, “যার বর্ণ এবং রক্ত ভারতীয়দের, কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ, এবং বুদ্ধিশীলতা ইংরেজের।” এ ব্যাপারে মেকলের নিকট-আত্মীয় ইংরেজ প্রশাসক ট্রেভেলিয়ন-এর চাঞ্চল্যকর বক্তব্য রয়েছে।

বৃটিশ শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে তিনি স্পষ্টভাবে বললেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় জনগণ বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তি চাইবেন এবং এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার দুটো রাস্তা তাদের সামনে খোলাঃ হয় “বিপ্লব’ নয় ‘সংস্কার’। ‘সংস্কারপন্থা’ অবশ্যই বৃটিশ শাসকদের কাছে অধিকতর বাঞ্ছনীয়। ভারতীয়দের ইংরেজী শিক্ষিত করে তোলাই এই পন্থাকে সফল করার প্রকৃষ্টতম উপায়। কেননা, ‘শিক্ষিত শ্রেণী স্বভাবতঃই আমাদের আঁকড়ে থাকবেন। এঁরা জানেন যে, আমাদের আশ্রয়চ্যুত হলে ঐ আদর্শের ভিত্তিতে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব।’

গবেষক বিনয় ঘোষ এ সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তা হচ্ছে, “এই নীতিকে পরিপূর্ণভাবে সফল করার জন্য শিক্ষা— বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষা হল কঠোরভাবে নির্বাচিত। উচ্চ এবং মধ্য শ্রেণীগুলি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণগুলির সঙ্গেই তার গাঁটছড়া বাঁধা হল।”

তাহলে অবস্থাদৃষ্টে এ কথা নিংসন্দেহে বলা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বৃটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতাকে কেন্দ্র করে এদেশীয় সমাজ ব্যবস্থায় চাঞ্চল্যকর ঘটনার অবতারণা হয়েছে। ১৮৭১ খ্রীষটাব্দ পর্যন্ত উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় যখন দ্বিতীয় দফায় ইংরেজ বিরোধী ওহাবী আন্দোলনে ব্যস্ত, সেই সময়কালে অর্থাৎ ১৮৫৯ খ্ৰীষ্টাব্দেই পণ্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো উদারমনা ও সর্বকালের পূজনীয় ব্যক্তিত্বও স্বীয় শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের স্বার্থে সরকারের কাছে উচ্চ শিক্ষাকে সীমিত করার দাবী উত্থাপন করেছেন। অথচ সঠিকভাবে বলতে গেলে তখনও পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান ছাত্রদের ইংরেজীর মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার হাতেখড়ি পর্যন্ত হয়নি। ইতিপূর্বে এ মর্মে নানা তথ্য উপস্থাপনা করে দেখিয়েছি যে, বাঙালি মুসলমান তো দূরের কথা, ঊনবিংশ শতাব্দীর তিন দশক থেকে শুরু করে মাত্র ৩০/৪০ বছর সময়ের মধ্যে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু ইংরেজী শিক্ষিত যুব সমাজ কি রকম সর্বভুকের মতো আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, ছোটনাগপুর প্রভৃতি এলাকার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলেছে। এবং আরও সুবিধা আদায়ের জন্য দাবী জানাতে শুরু করেছে। এ সম্পর্কে ইংরেজ গবেষক পারসিভ্যাল স্পিয়ার তাঁর রচিত “এ হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া (দ্বিতীয় খন্ড)” গ্রন্থে চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, “এটা এজন্যই হয়েছে যে, এই মধ্য শ্রেণীর সম্প্রসারণটা এতো দ্রুত যা সাধারণ পর্যবেক্ষকদের ধারণার বাইরে বলা যায় কিন্তু এখন এই সংখ্যালঘুদের একটা ভাষা রয়েছে এবং এদের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাও অভিন্ন আকারের। এদের মনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ এবং বক্তব্য উপস্থাপনা এতোই সমমনা যা ভারতের অন্যত্র অনুপস্থিত। এমনকি এদের বক্তব্যকেই সমগ্র ভারতের চিন্তাধারা হিসেবে গণ্য করা যেতো। লর্ড ডাফরিন সম্ভবতঃ একটা কথা যোগ করতে ভুলে গেছেন যে, সংখ্যালঘুরা যদি চরিত্রের দিক দিয়ে ভয়ংকর গতিশীল হয় সেক্ষেত্রে তারা একা জাতির অবয়ব পর্যন্ত বদলে দিতে সক্ষম। একদিকে সম্মিলিত উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং অন্যদিকে বিরক্তি এই দুই-এর মিলনে এই শ্রেণী সুসংগঠিত হয়ে দাঁড়ায়। আইসিএস পরীক্ষার প্রবর্তন, রাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণা এবং মেয়োর অধীনে স্বায়ত্তশাসনমূলক পৌরসভার প্রবর্তন প্রভৃতি সরকারী নীতির ফল আংশিকভাবে এই মধ্য শ্রেণীর উৎসাহ-উদ্দীপনার কারণ বলা যায়। বাকীটুকু এসেছে প্রাচ্যের বিদ্বৎসমাজের কর্মকান্ডের মাধ্যমে। এই বিদ্বৎ সমাজই এদের সম্মুখে প্রাচীন ভারতের মহান সভ্যতাকে জ্ঞানগর্ভ দর্শন হিসেবে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে আলোচ্য সময়ে অর্থাৎ ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত সময়ে আমরা বাঙালি বর্ণহিন্দু শ্রেণীক্রম বিবর্তনের চমকপ্রদ ঘটনাবলী অবলোকন করতে পারি। যেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশ দশকে ডি রোজারিও, কালী প্রসন্ন সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গলের দল এবং রাম মোহন রায়ের উদ্যোগে প্রবর্তিত সংস্কারপন্থী ও উদারমনা দর্শনের উত্তাল তরঙ্গে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু সমাজ মুক্তির সন্ধান খুঁজে বেড়াচ্ছিলো এবং সনাতন হিন্দু ধর্ম রক্ষার তাগিদে ১৮৩০ সালে ধর্মসভা স্থাপন ও তৃতীয় স্রোত হিসেবে রামকৃষ্ণ পরম হংসদেব হিন্দু ধর্মকে অন্যান্যের গ্রহণযোগ্য করে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন — সেখানে ৫০/৫৫ বছরের ব্যবধানে আমরা কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনমানসিকতা ও চিন্তাধারায় একটা বিরাট অর্থবহ পরিবর্তন দেখতে পাই।

ঊনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশকে আমরা এই সমাজের যেটুকু অর্থবহ পরিবর্তন দেখতে পাই তা হচ্ছে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর প্রভাব কর্পূরের মতো উবে গেছে, আর রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত সংস্কারপন্থী ও উদারমানা দর্শনের পরিধি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। বঙ্গীয় এলাকা বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় এই পাঁচ দশক সময়ে উপমহাদেশে ইংরেজী শিক্ষায় সবচেয়ে অগ্রগামী। কিন্তু স্বীয় শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের স্বার্থে অনেকটা সংকীর্ণমনা এবং সমগ্র ভারতে হিন্দু রিভাইভালিজমের প্রচেষ্টায় লিপ্ত।

এটা এমন এক সময় যখন বাংলার ভাগ্যাকাশে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্রের আবির্ভাব হয়েছে। ১৮৮৪ সালে তাঁর রচিত উপন্যাস ‘আনন্দ মঠ’-এর ‘বন্দে মাতরম’ গান তখন ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের হৃদয়কে আপ্লুত করতে সক্ষম হয়েছে। কমরেড মুজাফফর আহমদ-এর মতে, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ মঠ’ হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এর মূল মন্ত্র ছিল বন্দে মাতরম গান। (আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পৃষ্ঠা-১০)। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গবেষক ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মত কিন্তু ভিন্নধর্মী। তিনি লিখেছেন, “বাঙালির জীবনকে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্য আদর্শের মিলনভূমিতে স্থাপন করে মননশীল সাহিত্য, কথা সাহিত্য, দেশ ও দশের কথা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবনরস ও প্রাণবাণীতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বাঙালির মনকে মননের দ্বারা সুদৃঢ় করে, সংস্কারকে যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে, প্রাচীন ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে, স্বাদেশিক মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে তিনি যে নতুন মানববোধের পন্থা নির্দেশ করেন, এক শতাব্দীর বাঙালি সেইপথ ধরেই চলেছিলেন। তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্র বেন আধুনিককালের ঋকমন্ত্র, যার দেবতা হচ্ছেন দেশমাতৃকা। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির নবযুগ চেতনা বা রেনেসাঁসের মূলসুর যে একটি ব্যক্তিকে কেন্দ্ৰ করে আবর্তিত হয়েছে— তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।” (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তঃ সংশোধিত ৪র্থ সংস্করণঃ মডার্ণ বুক এজেন্সী কলিকাতা, ১৯৭৮)।

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে পুনরায় উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, কোলকাতায় এদের স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরণ থেকেই উদ্দেশ্য অনুধাবন করা সম্ভব হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেঃ

১৮৫৩: বেঙ্গল ল্যান্ড লর্ডস এসোসিয়েশন

১৮৬১: জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা।

১৮৬৬: বৃটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশন।

১৮৬৭: হিন্দু মেলা।

১৮৭৬: ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশন।

১৮৮৫: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।

আলোচ্য সময়কালে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের কর্মকান্ড, মনমানসিকতা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার মার্ক্সীয় গবেষক বিনয় ঘোষের মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেনঃ

“হিন্দু সমাজের উদারতা ও সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের পুনরুভ্যুত্থান আন্দোলনে পরিণত হল। ‘হিন্দু’ প্রীতি ক্রমে ‘হিন্দুত্ব’প্রীতির ভিতর দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতায়’ পর্যবসিত হল। রামমোহন-ইয়ং-বেঙ্গল বিদ্যাসাগরের উদারতা ও যুক্তিবাদের যুগ ধীরে ধীরে অস্ত গেল …….। “ (বাংলার বিদ্বৎসমাজঃ প্রকাশ ভবন মার্চ ১৯৭৮, কলিকাতা)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশক নাগাদ ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক ইংরেজী শিক্ষিত বৰ্ণহিন্দু মধ্যশ্ৰেণী বুদ্ধিজীবীরা যখন একদিকে বঙ্কিম-ভূদেব-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের হিন্দু ধর্মের ‘রিভাইভালিজমের’ মাধ্যমে উপ-মহাদেশের নেতৃত্ব দানে এগিয়ে এসেছেন এবং অন্যদিকে প্রাক্তন আই সি এস সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর উদ্যোগে বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর কাছে নানা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে “আবদার” করতে শুরু করেছেন; সে সময় এদের মধ্যে বিরাজমান মন-মানসিকতা সম্পর্কে পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট মার্কসীয় গবেষক সুপ্রকাশ রায়ের পরিচ্ছন্ন মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “… ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর দেওয়া ভূমিস্বত্বের অধিকারবলে জমিদার শ্রেণী ও মধ্যশ্রেণী (বর্ণহিন্দু) একদিকে কৃষক শোষণের ব্যবস্থা দৃঢ়তর করিবার জন্য এবং অপরদিকে ইংরেজসৃষ্ট নূতন সমাজের নেতৃত্ব লাভের জন্যই তাহাদের তথাকথিত “রিনাসান্স”-আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিল। এই “রিনাসান্স” আন্দোলন হইতেই শিক্ষিত “ভদ্রশ্রেণী” হিসাবে মধ্যশ্রেণী নতুনভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে। কেরানী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ভারতবর্ষে যে ব্যববহুল ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন করিয়াছিল, জমিদার শ্রেণীর সহিত মধ্যশ্রেণীও প্রাণপণে তাহার সুযোগ গ্রহণ করিয়া ইংরেজী শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীতে পরিণত হয়। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ হইতে এই ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন লর্ড টমাস ব্যারিংটন মেকলে (১৮০০-১৮৫৯ খ্রীঃ)। ……তাঁহার লক্ষ্য ছিল, এদেশে এরূপ একটি ইংরেজী শিক্ষিত শ্ৰেণী সৃষ্টি করা যে শ্রেণীটি উহার উন্নত ইংরেজী শিক্ষার গুণে ভারতবর্ষকে নহে; ইংল্যাণ্ডকে “স্বদেশ” ও ইংরেজদের পরমাত্মীয় বলিয়া মনে করিবে এবং কোনকালেই ইংরেজ শাসনের বিরোধী হইবে না। মেকলের এই উদ্দেশ্য যে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সর্বাংশে সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রত্যেকটি কৃষক-বিদ্রোহ, বিশেষতঃ সাঁওতাল-বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭) ও নীল-বিদ্রোহের সময় কৃষকদের সংগ্রামের প্রতি মধ্যশ্রেণীর প্রবল বিরোধিতা এবং ইংরেজ শাসনের প্রতি অবিচল সমর্থন হইতে। ……ঊনবিংশ শতাব্দীতেই যখন বিহার ও বঙ্গদেশের উপর দিয়া কৃষক-বিদ্রোহের ঝড় বহিতেছিল, তখন এই শিক্ষিত মধ্যশ্রেণী গণসংগ্রামের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া বিদেশী ইংরেজ প্রভুদের শাসনকে “ভগবানের আশির্বাদ” রূপে বরণ করিয়া ইংরেজী শিক্ষাদানের ভিত্তিতে নিজেদের নতুনভাবে গড়িয়া তুলিতে ব্যস্ত হইয়াছিলেন। সভ্য শ্রেণীরূপে নিজেদের গড়িয়া তুলিবার জন্য সর্বপ্রথম সাহিত্যের প্রয়োজন। সুতরাং নতুন সাহিত্য সৃষ্টি আরম্ভ হইলো। বঙ্কিমচন্দ্র হইলেন এই সাহিত্য সৃষ্টিকার্যের প্রধান নায়ক এবং তাহার সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্য দিয়াই মধ্যশ্রেণীর (কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী) এই ‘রিনাসান্স’ পূর্ণ-বিকশিত রূপ গ্রহণ করিল। ..”রিনাসান্স আন্দোলনের মধ্য দিয়াই ভারতের “জাতীয় আন্দোলন”-এর আরম্ভ। …..বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহিত সহযোগিতা ও আপসের নীতি বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের “রিনাসান্স” আন্দোলনের অন্যতম অবদান। এই নীতিই রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্ৰ প্রভৃতি ঊনবিংশ শতাব্দীর (হিন্দু) জাতীয়তাবাদের নায়কগণকে বৈদেশিক ইংরেজ শাসনের মহিমা কীর্তন করিতে বাধ্য করিয়াছিল।” (ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ৩য় সংস্করণ ১৯৮০ ডিএলবিএ ব্রাদার্স কলিকাতা)।

তাহলে এ ধরনের প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশক নাগাদ যখন অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী কোলকাতায় উপমহাদেশের ইংরেজী শিক্ষিত এবং সবচেয়ে অগ্ৰয়মান বাঙালি বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় জাতীয়তাবাদ তথা রাজনীতির কথাবার্তা বলা থেকে শুরু করে “দাবী দাওয়া” উত্থাপন করতে আরম্ভ করেছে, তখন আলোচনার সুবিধার্থে এক নজরে পূর্ববর্তী ১২৮ বছরের সামাজিক স্তরগুলো উল্লেখ করা নিতান্তই অপরিহার্য বলে মনে হয়

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর কর্মকাণ্ড

বাংলার রাজধানী মুর্শিবাদে মুসলিম শাসকদের অনুগ্রহে ফার্সী ভাষায় দক্ষ বহু উজালী বর্ণ-হিন্দু কর্তৃক উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরিতে অবস্থান। মুসলিম শাসকদের সমার্থক বিধায় বংগীয় এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বর্ণহিন্দু জমিদারের অস্তিত্ব। ১৬৫১ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান প্রদত্ত ফরমান হাতে বাংলায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম আগমন হলে একশ্রেণীর নিম্নবর্ণের ব্রাহ্মণ কর্তৃক কোম্পানীর এজেন্ট, বেনিয়ান ও মুৎসুদ্দি হিসেবে সর্ব প্রথম সুযোগ গ্রহণ। ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে মাত্র ১৬ হাজার টাকায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক কলিকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের জমিদারী স্বত্ব ক্রয় এবং ফোর্ট উইলিয়াম দর্গ স্থাপনের মাধ্যমে কোলকাতা মহানগরীর গোড়াপত্তন হলে ইংরেজদের কেন্দ্র করেই বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীর অভ্যুদয়। ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং ১৭২৭ খ্রীষ্টবব্দে বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর মৃত্য হলে, মুর্শিদাবাদ ও কোলকাতায় উভয় জায়গাতেই বর্ণহিন্দু জমিদার, সরকারী কর্মচারী এবং সুবর্ণ শ্রেণীর ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের সময় এঁদের চাঞ্চল্যকর কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ।

বংগীয় এলাকায় চরম অস্থিরতা, অরাজকতা এবং মন্বন্তরের (এক কোটি ৩০ লাখ লোকের অনাহারে মৃত্য) সময়কাল। মুর্শিদাবাদে নামকা ওয়াস্তে মীরজাফর (১৯৫৭-৬০), মীর কাশেম ১৭৬০-১৭৬৩), মীর জাফর দ্বিতীয়বার (১৭৬৩-১৭৬৫) নাজম-উদ-দৌলা (১৭৬৫-১৭৬৬), সাইফ-উদ-দৌলা (১৭৬৬-১৭৭০) এবং মোবারক-উদ-দৌলা (১৭৭০-১৭৯৩), নবাবের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন কোলকাতায় ইংরেজ শাসকবৃন্দ যথাক্রমে ক্লাইভ (১৭৫৭-১৭৬০), হলওয়েল (১৭৬০-১৭৬৫) ক্লাইভ দ্বিতীয়বার (১৭৬৭-১৭৭২) এবং ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময়ে বিশেষ করে কোলকাতায় বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীর বিপুল অর্থ অর্জন ও পরিপক্বতা লাভ। অতঃপর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গভর্নর জেনারেল পদে ওয়ারেন হস্টিংস (১৭৭৩-১৭৮৫), স্যার জন ম্যাকফারসন (১৭৮৫-১৭৮৬) এবং লর্ড কর্নওয়ালিশ-এর (১৭৮৬-১৭৯৩) সময়কালে ইংরেজদের নগ্ন পৃষ্ঠপোষকতায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বিত্তশালী বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীর ঐতিহাসিক কারণেই গোত্রান্তর।

লর্ড কর্নওয়ালিশের আমলেই ৫-সালা, ১০ সালা এবং ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারী প্রথা চালু করায় অবিভক্ত বৃহত্তর বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমিদার নিলামের ফলে বনেদী হিন্দু ও মুসলমান জমিদারের জমিদারী হস্তচ্যুত এবং আদিতে নিম্নবর্ণের ব্রাহ্মণ ও পরবর্তীতে ইংরেজের সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক সুবর্ণ শ্রেণী কর্তৃক নিলামে জমিদারী ক্রয়ের মাধ্যমে নব্য বর্ণহিন্দু জমিদার শ্রেণীর অভ্যুদ্বয়। কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্ৰেণী ও নব্য জমিদার শ্রেণীর নির্ভেজাল দালালিতে আস্থাভাজন হওয়ার জের হিসেবে ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দেই ইংল্যাণ্ডের কমন্সসভায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যিক সনদ আইন পাসের মাধ্যমে পুনরায় নবায়নের সময় ভারতের ইংরেজ শাসিত এলাকায় ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত খৃষ্টান মিশনারীদের খৃষ্ট ধর্ম প্রচার বে-আইনী ঘোষণা। ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস তর্ক কোলকাতায় সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হলে, এই কোর্টকেই কেন্দ্র করে কাজ চালাবার মতো অর্থাৎ ‘ইয়েস-নো-ভেরী গুড’ মার্কা ডজন কয়েক ভাংগা ইংরেজী শব্দ রপ্ত করে কোলকাতাকেন্দ্রিক যে বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণী গঠনের সুত্রপাত হয়, মাত্র ৪৩ বছরের মধ্যে ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে হিন্দু কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে সেই মধ্যশ্রেণী ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বুজিীবী হিসেবে রূপান্তরিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শ্রীরামপুর মিশনের কর্মকাণ্ড ছাড়াও সংস্কারপন্থী রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রীঃ) কর্তৃক ইংরেজ রাজত্বের মহিমাকীর্তন ও ইংরেজী ভাষা প্রচারে ও সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব নগ্ন সমর্থন প্রদান এবং ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা। এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান হেনরী লুইস ডি রোজারিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রীঃ) কর্তৃক পাশ্চাত্য কৃষ্টি ও সভ্যতা হুবহু অনুকরণের লক্ষ্যে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে রাধাকান্ত দেব, ভবানীচরণ, রামদুলাল দে, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন প্রমুখের উদ্যোগে হিন্দু ধর্ম রক্ষার্থে ধর্মসভা গঠন। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে তিতুমীরের বিদ্রোহ ইংরেজবিরোধী ওহাবী আন্দোলনের সুত্রপাত। ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে নীলকর সাহেবদের আগমন এবং ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেনটিংক কর্তৃক ইংরেজী ভাষাকে সরকারী ভাষায় মর্যাদা দেয়ার প্রাথমিক ঘোষণা দান।

১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে অফিস-আদালত থেকে ফার্সী ভাষা অপসারিত এবং ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর-এর সরকারী নির্দেশে ইংরেজী শিক্ষিত ব্যতীত অন্য কাউকে চাকরি প্রদান নিষিদ্ধ ঘোষণা। ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ইংরেজ বিরোধী ওহাবী আন্দোলন। ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ মোতাওয়াল্লীরা ওয়াক্ফ ধরনের লাখেরাজ সম্পত্তির প্রয়োজনীয় দলিলপত্র প্রদর্শনে অক্ষম হলে অধিকাংশ ওয়াকফ সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্তের ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ১৮৫৭ সালে একদিকে সিপাহী বিপ্লব ও কোলকাতা কেন্দ্রিক বৰ্ণহিন্দু বিত্তশালী ও বুদ্ধিজীবীদের ইংরেজদের প্রতি উলংগ সমর্থন এবং অন্যদিকে শাসক শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থন কোলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।

১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে মাত্র ২০/২৫ বছর সময়কালের মধ্যে রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত কোলকাতা কেন্দ্রিক উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মোকাবেলায় উগ্র পাশ্চাত্যবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ইয়ং বেঙ্গল-এ প্রভাব দ্রুত হ্রাসপ্রাপ্ত। এরই পাশাপাশি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, গৌরমোহন বিদ্যালংকার, মদনমোহন তর্কালংকার, শিবনাথশাস্ত্রী প্রমুখের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত প্রাচ্যবাদী হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর সঙ্গে উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অর্থবহ সংমিশ্রণ। অন্যদিকে সংস্কারের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের পুনঃজাগরণের লক্ষ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর (১৮৩৪-৮৬ খ্রীঃ) আবির্ভাবে গোঁড়াপন্থীদের ব্যাপক শক্তি সঞ্চয়।

‘মাতৃ জঠরে জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভ্রূণ’

এমনকি এক যুগ-সন্ধিক্ষণে যখন ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ দ্বিতীয় পর্যায়ে ওহাবী আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার প্রেক্ষিতে আবদুল লতিফ খাঁ, সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমীর আলী, আবদুর রহিম এবং মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী প্রমুখ নেতা কর্তৃক ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সহযোগিতা প্রদান ও মুসলমানদের অনতিবিলম্বে ইংরেজী শিক্ষার আহবান জানানো হয়, ঠিক তখনই কোলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানসপুত্র বঙ্কিম প্রতিভার অভ্যুদয়।

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে বৃটিশ ভারতের তৎকালীন রাজধানী কোলকাতায় উপমহাদেশের সবচেয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায় বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের চাঞ্চল্যকর কর্মকাণ্ডের জের হিসেবে “মাতৃজঠরে জাতীয়বাদী আদর্শের ভ্রূণ”-এর সৃষ্টি হলো। এজন্যেই ঊনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশকে যে বাঙালি তথা ভারতীয় “জাতীয়বাদ” মাতৃগর্ভে পূর্ণতার পথে এগিয়ে গেলো তার স্বরূপটা সঠিকভাবে অনুধাবন করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। পশ্চিম বাংলার মার্কসীয় গবেষক শ্রী সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে লিখেছেন, “ধর্মের ক্ষেত্রেও বঙ্কিমচন্দ্র সমান প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিচয় দিয়াছেন।…. সামন্তবাদ বিরোধী ফরাসী বিপ্লবের অভিনন্দনকারী বঙ্কিমচন্দ্রই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষে সেই সামন্ততন্ত্রকে কৃষি বিপ্লবের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে নতুন করিয়া আধ্যাত্মবাদ আর ধর্মের কুসংস্কার প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালে পাশ্চাত্যের ভাবধারা ও বিজ্ঞানের প্রভাবে বঙ্গদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রের অনুশাসন এবং হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও সন্দেহের প্রবল জোয়ার দেখা দিয়াছিল। বঙ্গীয় “রিনাসান্সের” সমকালের নায়ক বঙ্কিমচন্দ্র সেই প্রবল জোয়ারকে প্রতিহত করিয়া ‘নবহিন্দুবাদ’-এর প্রতিষ্ঠা দ্বারা ধর্মের ক্ষেত্রেও বঙ্গীয় “রিনাসান্সের” প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী চরিত্রটিকে স্পষ্ট রূপদান করেন। এইকার্যে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যিক অস্ত্র হইলো তাহার ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘কৃষ্ণ-চরিত্র’, ‘ধর্ম ও সাহিত্য’ এবং ‘শ্রীমদ্ভবদগীতা’ এই সকল রচনার মধ্য দিয়া তিনি নতুন যুক্তিতর্কের দ্বারা সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ধ্যান-ধারণাকে প্রকৃত ধর্ম বলিয়া প্রচার এবং নতুন প্রগতিশীল ভাবধারাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করিয়াছেন। এইভাবে ‘রিনাসান্সে’র প্রথম যুগের নায়কগণ যে গলিত হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামির (ইয়ং বেঙ্গল ও রামমোহন রায়ের যুগে) বিরুদ্ধে আঘাত করিয়াছিলেন, সেই হিন্দু-সমাজের রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামির মধ্যেই নূতন প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা দ্বারা বঙ্কিম সামন্ততন্ত্রের বুনিয়াদ দৃঢ়. করিয়া তুলিবার প্রয়াস করিয়াছিলেন। এইভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের নেতৃত্বে বঙ্গীয় “রিনাসান্স” ‘হিন্দু রিনাসান্স’ পর্যবসিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই ‘হিন্দু রিমাসান্স’ হিন্দু অভিজাত ও হিন্দু মধ্যশ্রেণীরই নবজাগরণ। বঙ্কিমের পর রামকৃষ্ণ পরমহংশ ও তাঁহার শিষ্য বিবেকানন্দ বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক আরদ্ধ এই ‘হিন্দু রিনাসান্সকে’ আরও গভীর ও ব্যাপকভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক রূপদান করেন।’ (ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (৩য় সং) ডিএনবি ব্রাদার্স, কলিকাতা ১৯৮০)।

তা হলে একথা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আলোচ্য সময়ে যে ‘জাতীয়বাদের আদর্শ মাতৃগর্ভে ছিলো তা ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের উদারপন্থী বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের চৌহদ্দীতে তো দূরের কথা, ঊনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশকের ‘হিন্দু বাহুবল’ ও ‘হিন্দু শৌর্য-বীর্যের’ আর ‘হিন্দু ধর্মের পুনঃ জাগরণের’ আদর্শে লালিত-পালিত হচ্ছিল। সেখানে জাতীয়তাবাদ আদর্শের মূল ধর্ম নিরপেক্ষতার শর্ত সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিলো। আর এ জন্যেই বঙ্গীয় এলাকায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বাঙালি ছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের কথা পর্যন্ত এই কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা হিসাবের মধ্যে রাখেনি। এ সময় বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্য হচ্ছে, “অনেকে রাগ করিয়া বলিবেন, তবে কি স্বাধীনতা পরাধীনতার তুল্য? তবে পৃথিবীর তাবজ্জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রাণপাত করে কেন? যাহারা এইরূপ বলিবেন, তাহাদের নিকট আমার নিবেদন এই যে, আমরা সে তত্ত্বের মীমাংসায় প্রবৃত্ত নই। আমরা পরাধীন জাতি, অনেককাল পরাধীন থাকিব — সে মীমাংসায় আমাদের প্রয়োজন নাই।” (ভারত বর্ষের স্বাধীনতাঃ ও পরাধীনতা বিবিধ প্রবন্ধ ১ম খণ্ড)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে যখন “বাঙালি তথা ভারতীয় (হিন্দু) জাতীয়তাবাদ” মাতৃগর্ভে মারাত্মক প্রসব যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছিলো, তখন অনাগত ভবিষ্যতের জাতীয়তাবাদরূপী এই শিশুর স্বরূপ, প্রকৃতি ও অবয়ব কেমন হতে যাচ্ছে তা সঠিক ও পরিচ্ছন্নভাবে অনুধাবনের লক্ষ্যে বঙ্কিম-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের কর্মকাণ্ডের আরও কিছু বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপনা করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ বলে মনে হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ অশিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতামত এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, উপন্যাসের কথা ছেড়ে দিলেও বাঙালি মননের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের নেতৃত্ব সুপরিচিত। রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র— এই তিনজনেই বাঙালি মনোজীবনে ও আদর্শলোকে নতুন আলোড়ন তুলেছিলেন, পথের দিশারী হয়ে সমগ্র জাতিকে অগ্রবর্তী করে দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব সকলের চেয়ে গভীর হয়েছিল। বাঙালির জীবনকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শের মিলনভূমিতে স্থাপন করে মননশীল সাহিত্য, কথাসাহিত্য, দেশ ও দশের কথা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবনরস ও প্রাণবাণীতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বাঙালির মনকে মননের দ্বারা সুদৃঢ় করে, সংস্কারকে যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে, প্রাচীন ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে, স্বাদেশিক মন্ত্ৰ দীক্ষা দিয়ে তিনি যে নতুন মানববোধের পন্থা নির্দেশ করেন, এক শতাব্দীর বাঙালি সেই পথ ধরেই চলেছিলেন। বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন (১৮৭২) পত্র শুধু মাসিক পত্রের আদর্শ নয়, এর মধ্য দিয়ে সমগ্র (হিন্দু) বাঙালিসমাজ আত্মদর্শনের বীজমন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। “…. এমনকি স্বদেশী আন্দোলনের যুগে তাঁর ‘আনন্দমঠ’ ইংরেজী ও অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় অনুদিত হয়ে সারা ভারতেই স্বাদেশিক ও বিপ্লবী আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাঁর ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্ৰ যেন আধুনিককালে ঋকমন্ত্র, যার দেবতা হচ্ছেন দেশমাতৃকা।” (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত (পৃঃ ৫৩৫-৩৬) সংশোধিত ৪র্থ সংস্করণ ১৯৭৮ কোলকাতা)।

কিন্তু পশ্চিম বাংলার অপর এক বিশিষ্ট গবেষক বিনয় ঘোষ নানা তত্ত্ব এবং তথ্য উপস্থাপনা করে ডঃ অশিত বন্দোপাধ্যায়ের উপরোক্ত মন্তব্য ও মূল্যায়ন সম্পর্কে ভিন্নমত প্রদান করেছেন। তাঁর পরিচ্ছন্ন বক্তব্য হচ্ছে, • মর্যাদাবান ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীগুলোতে পৌত্তলিকের সংখ্যা ভয়ংকর রকমের বিশাল। যতো দিন গেল, মধ্যযুগীয় প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামোর প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ঊনবিংশ শতাব্দীতে— যে যুগকে আমরা না দিয়েছি ‘রিনেস্যান্সের যুগ’। জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিভেদ প্রবণতা; মূর্তিপূজা, বহু-ঈশ্বরবাদ, গোঁড়ামি— এইসব মধ্যযুগীয় ব্যাপারগুলোর একটি অথবা অপরটির কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছিলেন ‘আধুনিক’ বুদ্ধিজীবীরা, যাদের ইংরেজী শিক্ষার ওজন বেশী ভারী · :: ঊনিশ শতকের শেষদিকে বাংলার উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ কিভাবে তাঁর প্রেতাত্মা খুঁড়ে তুলে, তীব্র বাদানুবাদের মধ্যে নিজেদের রক্ষণশীল হিন্দুভাব প্রধান মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন, তা ভাবলেও মাথা হেঁট হয়ে আসে। আর আদর্শের দিক থেকে যাঁরা হিন্দু অবতারবাদ ও সাম্প্রদায়িক ধর্মের পুনরুজ্জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদর সংখ্যাও অল্প নয়। রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসেও এই একই মনোভাব জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত আগাগোড়া ব্যক্ত হয়েছে।… তাই বিধবা বিবাহ ব্যর্থ হয়েছে, নারীর পরাধীনতা, যৌথ পরিবার সবই বজায় থেকেছে এবং বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ নিবারণের জন্য শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই (একান্ত বশংবদ বর্ণ হিন্দুরা মনে আঘাত পাবে বিধায়) কোন আইন পাস করতে চাননি। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো পাশ্চাত্য বিদ্যায় শিক্ষিত শ্ৰেষ্ঠ ও আইন প্রয়োগ করে এ ধরনের সমাজ সংস্কারের বিরোধী ছিলেন। (বাংলার বিদ্বৎ সমাজ ১৯৭৮ এবং বাংলার নবজাগৃতি ১৯৭৯ কলিকাতা)।.

এই প্রেক্ষিতে এক্ষণে সংক্ষেপে বঙ্কিম রচনাবলীর মূল্যায়ন করা বিশেষ সমীচীন বলে মনে হয়। প্রথমেই বঙ্কিম-রচিত উপন্যাসের উল্লেখের প্রয়োজন। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী মোট ২২ বছরে বঙ্কিমচন্দ্র ১৪টি উপন্যাস রচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে এবং সর্বশেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলোর মধ্যে ইতিহাস ও রোমান্সধর্মী ৭টি উপন্যাস যথাক্রমে দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপাল কুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), যুগালাঙ্গরীয় (১৮৭৪), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রাজসিংহ (১৮৮২) ও সীতারাম (১৮৮৭); তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক ২টি উপন্যাস যথাক্রমে ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪) ও ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৫) এবং সমাজ ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস ৫টি ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩), রাধারাণী (১৮৮৬) বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), রজনী (১৮৭৭) ও কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮)।

সাম্প্রতিককালে ডক্টর অশিত কুমার বন্দোপাধ্যায় আলোচ্য উপন্যাসগুলো সম্পর্কে যেসব অর্থবহ মন্তব্য করেছেন তার কয়েকটি নিম্নরূপ:

ক) ইতিহাস ও রোমান্সধর্মী উপন্যাসঃ “কেউ কেউ মনে করেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র যতই প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হোন না কেন, ঐতিহাসিক উপন্যাসে তিনি বহুস্থলে ইতিহাসকে উপেক্ষা করেছেন, বরং রমেশচন্দ্র দত্ত এ বিষয়ে অনেক বেশী সতর্ক এবং একনিষ্ঠ। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল, বঙ্কিমচন্দ্র ঐতিহাসিক তথ্য সব সময়ে গ্রহণ না করলেও ঐতিহাসিক রস সৃষ্টিতে তাঁর সমকক্ষ ঔপন্যাসিক বাংলাদেশে দ্বিতীয় কেউ নেই। বিশুদ্ধ ইতিহাস লেখা ঐতিহাসিক-ঔপন্যাসিকের কাজ নয়, সে কাজ করবেন তথ্যানুসন্ধিৎসু ঐতিহাসিক।”

খ) তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস : “শেষ জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র নীতি, আদর্শ, ধর্ম ও সদাচার সম্বন্ধে নিষ্ঠাবান হিন্দুর দিক থেকে যা ভাবছিলেন, তার কিছু গাঢ়. প্রভাব এই যুগের উপন্যাসে পড়েছে। অবশ্য এই প্রভাব সর্বদা যে উপন্যাসের পক্ষে ভালোই হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না।”

গ) সমাজ ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস : “অবশ্য একথাও ঠিক যে, হিন্দুর নৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্র নরনারীর সম্পর্ক বিচার করেছেন এবং সামাজিক নীতির সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক কামনার সংঘর্ষ হলে অর্থাৎ আর্টের সঙ্গে মরালিটির দ্বন্দ্ব হলে আদর্শবাদী এবং হিন্দুর সামাজিক নীতির সংরক্ষক বঙ্কিমচন্দ্র আর্টের কথা অস্বীকার করে আদর্শ ও নীতির জয় ঘোষণা করতে কখনও সঙ্কুচিত হতেন না।”

বাংলার ভাগ্যাকাশে সেদিন এ কোন্ প্রতিভার উদয় হয়েছিল?

তা’হলে দেখা যাচ্ছে যে, পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদগ্র বাসনায় ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচিত ইতিহাস ও রোমান্সধর্মী উপন্যাসগুলোতে ইতিহাস বিকৃত করে যথেচ্ছভাবে কাল্পনিক ঘটনাবলীর আশ্রয় গ্রহণ করেছেন; তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাসগুলোতে রক্ষণশীল ও সনাতন হিন্দুধর্মের নীতি, আদশর ও সদাচারের জয়গান করেছেন এবং সমাজ ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাসগুলোতে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার নৈতিকতার পতাকাকে সমুজ্জ্বল রাখার স্বার্থে আর্টের মোদ্দা বিষয়গুলোকে বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি।

এজন্যই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ অশিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতো সমালোচককেও (যিনি বঙ্কিম-প্রতিভাকে “বিস্ময়কর রাজনৈতিক ও সামাজিক তত্ত্বজ্ঞানের পরিচয়সম্পন্ন” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন) এ মর্মে মন্তব্য করতে হয়েছে যে, “কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাবের ফলে পৌরাণিক প্রেরণার প্রতি শিক্ষিত (বর্ণহিন্দু) বাঙালির বিশ্বাস আবার ফিরে আসতে লাগল এবং আপ্তবাক্য ও ব্যক্তিগত ধর্মোপলব্ধির স্থলে আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ যুক্তিবাদ আধুনিক মনকে অধিকতর আকৃষ্ট করল। বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিগত উপলব্ধিকে বাদ দিয়ে যুক্তির ওপর শাস্ত্রসংহিতা ও পুরাণ প্রভৃতিকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করলেন। অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে (বাঙালি হিন্দু) জনচিত্তে জ্ঞান-ভক্তি-কর্ম একটি সমন্বয়ী সত্তা লাভ করল” (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত (পৃঃ ৪১৯) সংশোধিত ৪র্থ সংস্করণ ১৯৭৮ কলিকাতা)।

আলোচনার সুবিধার্থে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বঙ্গীয় এলাকায় বিরাজমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রাসংগিক বিধায় বঙ্কিম-প্রতিভার প্রতিটি সৃষ্টিকেই পুংখানুপুংখভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করে দেখা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। কেননা বাংলার ভাগ্যাকাশে সেদিন এ কোন্ প্রতিভার উদয় হয়েছিলো, যার রথচক্রে ইয়ং বেঙ্গলের পাশ্চাত্যমুখী উদারতা থেকে শুরু করে রামমোহনের পাশ্চাত্য শিক্ষাভিত্তিক সংস্কার আন্দোলন আর বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহের ‘সীমিত প্রগতির’ পদক্ষেপ সবকিছু হয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো— না হয় ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দুরা সেসব উচ্ছিষ্টের মতো বর্জন করে “হিন্দু বাহুবল এবং হিন্দু শৌর্য-বীর্যের” জয়গানে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো? এ কোন্ প্রতিভা যিনি দীনবন্ধু মিত্র রচিত “নীল দর্পণ” এবং মীর মোশাররফ হোসেনকৃত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক দু’টিকে শ্রেণীস্বার্থে অবিলম্বে বেআইনী ঘোষণার লক্ষ্যে স্বীয় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মাধ্যমে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন? ইনিই হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক’ এবং ‘সাহিত্য সম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

“সমাজ-বিপ্লব সকল সময়েই আত্মপীড়ন মাত্র” – বঙ্কিম

তবে বঙ্কিমচন্দ্রকে শুধুমাত্র সাহিত্যের গণ্ডির মধ্যে রেখে তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন করা মহাপাতকের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। সক্রিয়ভাবে রাজনীতি না করলেও অবস্থাদৃষ্টে এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ও যৌক্তিকতা রয়েছে যে, বঙ্কিমের মুখ্য পরিচয় হচ্ছে, এক বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিন্দু ভারতের অনন্যসাধারণ রাজনীতিবিদ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় পূর্ণতাপ্রাপ্ত কোলকাতা কেন্দ্রিক বিত্তশালী ও ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পথপ্রদর্শক ও দীক্ষাগুরু হিসেবে বঙ্কিমের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর লেখনীর প্রতিটি বর্ণ রাজনীতির মাদকতায় ভরপুর। তিনিই সার্থকভাবে কোলকাতা কেন্দ্রিক বৰ্ণহিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অহিফেন সেবনে সক্ষম হলেন।

শাসকগোষ্ঠীকে বিরাগভাজন না করে বঙ্গীয় এলাকায় প্রায় অর্ধ শতাব্দীব্যাপী ইংরেজী শিক্ষিত সমাজ-সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় সংস্কারপন্থী আন্দোলন সম্মুখপানে ধাবিত হচ্ছিলো, এরকমভাবে বলতে গেলে বঙ্কিমের একাকী কর্মকাণ্ডে তা রুদ্ধ হয়ে গেলো। মোদ্দা কথায় তাঁর বক্তব্য হচ্ছে দু’টি মাত্র। পরাশক্তি ইংরেজের বিরুদ্ধাচারণ কোন অবস্থাতেই বরদাশত করা হবে না এবং রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে হিন্দু ‘রিভাইভালিজম’ করতে হবে। এজন্যই ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় বঙ্কিমের দাম্ভিক বক্তব্য হচ্ছে, “সমাজ-বিপ্লব সকল সময়েই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী!”

বঙ্কিমচন্দ্র শংকাহীনচিত্তে ঘোষণা করলেন যে, “ইংরেজ ভারতবর্ষের পরমোপকারী। ইংরেজ আর্যদিগকে অনেক নূতন কথা শিখাইতেছে। যাহা আমরা জানিতাম না, তাহা জানাইতেছে, যাহা কখনও দেখি নাই, শুনি নাই, বুঝি নাই তাহা দেখাইতেছে, শুনাইতেছে, বুঝাইতেছে, যে সকল অমূল্য রত্ন ইংরেজদের চিত্তভাণ্ডার লাভ করিতেছি, তাহার মধ্যে দুইটির আমরা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করিলাম— স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা এবং জাতিপ্রতিষ্ঠা।” (বিবিধ প্রবন্ধ ১ম খণ্ডঃ ভারতবর্ষ পরাধীন কেন?)

ইংরেজদের বশংবদ এদেশীয় জমিদার শ্রেণীর গার্জিয়ান হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীলতার মূর্ত প্রতীক বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং আত্মপ্রসাদে ভরপুর। তিনি লিখেছেন, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গ-সমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ ইংরেজদিগকে দিই না। যেদিন ইংরেজদের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেইদিন সে পরামর্শ দিব।” (বঙ্গ দেশের কৃষক, পৃঃ ৮৪-৮৫)

আগেই উল্লেখ করেছি যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের মাঝামাঝি সময়ে বাঙালি বর্ণ হিন্দু তথা ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষের প্রাক্কালে নানা কারণে বাংলা সাহিত্যের সম্রাট ও ঋষি বঙ্কিম চন্দ্রের ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই হিন্দুধর্ম সংস্কারের বিরোধিতার কথা বলতে হয়। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর পুরোধা বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েই এ মর্মে উপলব্ধি করলেন যে, ইতিমধ্যেই রামমোহন প্রবর্তিত সংস্কারপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব ছাড়াও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পর্যন্ত পাস হয়ে গেছে এবং বাংলার ইংরেজী শিক্ষিত সম্প্রদায় বহু বিবাহ বন্ধের কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। এ জন্যই তিনি ‘ধর্মতত্ত্ব’ পুস্তকে এ মর্মে সুপারিশ করলেন যে, স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকার করলে “বিবাহ প্রথার বিলোপ এবং সমাজও বিনষ্ট হয়ে যাবে।” অর্থাৎ বিরাজমান সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি বিনষ্ট হবে। ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র সুস্পষ্ট ভাষায় লিখলেন :

“গুরু! নারী আত্মপালন ও রক্ষণে অক্ষম…..অথচ যদি পুনশ্চ তাহাদিগের সে শক্তি পুনরভ্যাস পুরুষ-পরম্পরায় উপস্থিত হইতে পারে, এমন কথা বল, তবে বিবাহ-প্রথার বিলোপ এবং সমাজও বিনষ্ট না হইলে তাহার সম্ভাবনা নাই।….

“সাম্য কি সম্ভবে? পুরুষ কি প্রসব করিতে পারে, না শিশুকে স্তন্যপান করাইতে পারে? পক্ষান্তরে স্ত্রী লোকের পল্টন লইয়া লড়াই চলে কি?” (ধর্মতত্ত্ব ১৮৮৮)।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রচিত বহু প্রবন্ধ ও উপন্যাসে স্বীয় প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে উদার ও সংস্কারপন্থীদের অগ্রগতির ধারাকে হয় রুদ্ধ করেছেন, না হয় বিপথগামী করে একটি চরম রক্ষণশীল বাঙালি হিন্দু সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। বঙ্কিম রচনাবলী থেকে একথা বলা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্রের অন্তরের কথা হচ্ছে— ‘নারী সম্প্রদায় পুরুষের সহিত সমানাধিকার লাভে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত’ (১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ‘সাম্য’ পুস্তকের প্রচার ও বিক্রি বন্ধ করে এটাই হচ্ছে বঙ্কিমের সংশোধিত মতবাদ)। এ জন্যই ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ ব্যঙ্গরস ও হাস্য-কৌতুকের ভেতর দিয়ে তাঁর লেখনীতে নারী-বিদ্বেষ ও নারী সম্প্রদায়ের প্রগতিমূলক আন্দোলনের বিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে বঙ্কিমের আবির্ভাব হয়েছে সামন্ততান্ত্রিক হিন্দু সমাজের রক্ষক হিসেবে। এজন্যই লেখক বঙ্কিমচন্দ্র নায়ক প্রতাপকে দুরসম্পর্কের আত্মীয়া নায়িকা শৈবালিনীর মিলন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে মিলন প্রতিষ্ঠিত করেননি। কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে আত্মীয়া নারীর প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে নায়ক প্রতাপ প্রাচীন সমাজের নীতিবোধ ও ধ্যান-ধারণাকে প্রচণ্ড আঘাত করেছিলো।

‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে বঙ্কিম সরাসরিভাবে সনাতন হিন্দু ধর্মের জয়গান করা ছাড়াও বহু বিবাহ সমর্থন করেছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য হচ্ছে যে, বহু বিবাহের মাঝ দিয়েও সংসারের সুখ ও শান্তিলাভ সম্ভব। এজন্যই এ উপন্যাসের সমাপ্তি লগ্নে আমরা দেখতে পাই যে, নায়ক ব্রজেশ্বর এতো কিছু করার পরেও দেবী চৌধুরাণীসহ তার তিনজন স্ত্রীকে নিয়েই আবার সুখের সংসার পাতলো। এই উপন্যাসের মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, ‘হে ইংরেজী শিক্ষিত যুব সমাজ, বহু বিবাহ প্রথা বন্ধের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের দাবীতে কোন আন্দোলন সৃষ্টি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে না’।

বঙ্কিম রচিত ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সনাতন হিন্দু ধর্মে যেখানে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য ভয়ংকরভাবে বিদ্যমান, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বিধবাদের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত রয়েছে। অথচ আলোচ্য উপন্যাসের বিধবা নায়িকা রোহিনীর সর্বত্রই হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। এ জন্যই ঔপন্যাসিক বঙ্কিম নায়ক গোবিন্দলালকে ক্ষমা করলেও নায়িকা রোহিনীকে ক্ষমা করতে পারেননি।

অবস্থাদৃষ্টে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসটি প্রকারান্তরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রবর্তিত বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে বঙ্কিমের প্রচার পদ্ধতির সাহিত্যরূপ। রক্ষণশীল হিন্দু সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বিধবা বিবাহের মতো এই সীমিত সংস্কারপন্থী পদক্ষেপও বঙ্কিম বরদাশত করতে পারেননি। এ জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র বিধবা বিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করার লক্ষ্যে এবং বহু বিবাহের সমর্থনে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধাচরণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বিধবা বিবাহ জনপ্রিয় করার উদগ্র বাসনায় বিদ্যাসাগর যেখানে স্বীয় পুত্রের সঙ্গে বিধবা বিবাহ দেয়ার পর নিজে অর্থ ব্যয় করে জনাকয়েক পড়শীর বিধবা কন্যাদের বিয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছিলেন, সেখানে তিনি কিছুদিন পরে দেখতে পেলেন যে, সে সব উপকৃত ব্যক্তিরাই “একঘরে” হওয়ার অছিলায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিরুদ্ধেই বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। এরই জের হিসেবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্বকেও শেষ জীবনে সাঁওতাল পরগনায় কার্মাটার নামক গ্রামে একাকীত্বের মাঝে কাটাতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *