কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৫

ওহাবী আন্দোলনের গোড়ার ইতিহাস

তা’হলে এই উপমহাদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে অনুষ্ঠিত ইসলামী কট্টর শরিয়ত পন্থীদের সংস্কার আন্দোলনগুলোর কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কয়েক দশক ধরে যে ওহাবী আন্দোলন ভারত উপমহাদেশের বংগীয় এলাকা থেকে শুরু করে সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো, এক্ষণে আলোচনার সুবিধার্থে সেই ওহাবী আন্দোলনের গোড়ার কথা বলতে হয়। ওহাবী আন্দোলনের প্রবর্তক মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব-এর সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায়নি। (কোন গবেষকের মতে ১৭৩০ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম) তবে তিনি ছিলেন সৌদি আরবের নজদ প্রদেশের জনৈক সম্ভ্রান্ত সরদারের পুত্র। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আবদুল ওহাব মুসলমানদের পবিত্র তীর্থস্থানসমূহে অনৈসলামিক আচার-অনুষ্ঠানের কর্মকান্ডে খুবই রুষ্ট হন এবং এর প্রতিকারের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন। তিনি ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপকভাবে অধ্যয়নের পর বিভিন্ন এলাকা পরিভ্রমণকালে প্রকৃত ইসলামের দৃষ্টিতে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যাদান করেন এবং তীব্র ভাষায় শাসক কর্তৃপক্ষের সমালোচনায় মুখর হন।

এ সময় আরবের অধিকাংশ এলাকাই তুরস্কের সুলতানের (খলিফা) অধীনে ছিলো। তাই স্বাভাবিকভাবেই আবদুল ওহাবের এ সব বক্তব্য তুর্কী সুলতানের জন্য খুবই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং অচিরেই তাঁকে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শুধু তাই-ই নয়, তুর্কী শাসন কর্তৃপক্ষ আবদুল ওহাবকে সরকার বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে সিরিয়ার দামেস্ক শহর থেকে বহিষ্কার করে। সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহর মতে, “তিনি এস্থান, সেস্থান পরিভ্রমণে বহুদিন অতিবাহিত করিয়া অবশেষে দেরইয়ার সরদার মোহাম্মদ ইবনে সৌদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইহারই সাহায্যে তিনি বেদুঈনদের সমবায়ে একটি ক্ষুদ্র সশস্ত্র বাহিনী গঠনপূর্বক প্রথম সুযোগে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া দেন। ….এরূপে অতি অল্পকালের মধ্যে মরু অঞ্চলে বিশেষ করিয়া নজদ প্রদেশে আবদুল ওহাবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়া যায়। মোহাম্মদ ইবনে সৌদের সহিত তাঁহার এক কন্যার বিবাহ দিয়া আবদুল ওহাব সমগ্র নজদের শাসন ক্ষমতা তাঁহার হস্তে অর্পণ করিয়া শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে স্বয়ং সর্বময় কর্তা হইয়া রহিলেন। পবিত্র কোরআনে নির্দেশিত নিয়ম-কানুন অনুসারে এই নতুন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা রচিত ও প্রবর্তিত হয়।” (আমাদের মুক্তি সংগ্রামঃ বাংলা একাডেমী, ঢাকাঃ ১৯৭৮)

বাগদাদের তুর্কী শাসনকর্তা নজদ-এর আবদুল ওহাবকে দমন করার লক্ষ্যে ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে বিরাট সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু যুদ্ধে তুর্কী বাহিনী পরাজিত হলে আবদুল ওহাব একটি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই আল্লামা আবদুল ওহাব ইন্তেকাল করেন। কিন্তু এঁর অনুসারীরা অচিরেই আরও শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। ১৭৯১ সালে ওহাবীরা পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে। কিন্তু সম্পূর্ণ সফলকাম হতে পারেনি। ১৭৯৭ সালে এঁরা বাগদাদ আক্রমণ করে ইরাকের একটি এলাকা নজদ-এর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। প্রসংগতঃ উল্লেখ্য, তুর্কীর সুলতান এই ওহাবীদের কার্যকলাপে এতোদূর বিরক্ত হয়েছিলেন যে, এঁদের হজ্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত জারি করেছিলেন।

এখানে আরও একটি ব্যাপার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আবদুল ওহার-এর অনুসারীরা সব সময়েই নিজেদের মুজাহিদ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ইংরেজরাই এঁদের ‘ওহাবী’ নামকরণ করেছে। ১৮০১ সালে এ ধরনের প্রায় লক্ষাধিক মুজাহিদ পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে। কয়েক মাসব্যাপী এই যুদ্ধে মক্কা নগরী মুজাহিদদের দখলে আসে এবং মক্কায় তুর্কী শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। ১৮০৩ সাল নাগাদ মুজাহিদরা পবিত্র মদিনা নগরীর উপর কর্তৃত্ব বিস্তারে সক্ষম হয়। কিন্তু মুজাহিদরা কবরপূজা ও এ ধরনের অন্যান্য অনৈসলামিক কার্যকলাপ বন্ধের লক্ষ্যে এসব যুদ্ধের সময় মক্কা ও মদিনায় অবস্থিত দরবেশ ও পীর-ফকিরদের কবরের উপর নির্মিত কতিপয় সৌধ ভেংগে দেয়। “এমনকি হজরত মোহাম্মদের (দঃ) রওজার একটা অংশ তাঁহাদের হাত হইতে সে সময় রক্ষা পায় না।”

এদিকে পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী দু’টি হস্তচ্যুত হওয়ায় তুর্কী খলিফা খুবই রাগান্বিত ছিলেন। তাই ওহাবীরা (মুজাহিদ) হজরত মোহাম্মদের (দঃ) রওজার অংশবিশেষ ভেঙ্গে দিয়েছে…… এই কথাটা এবং অন্যান্য কয়েকটি অভিযোগ তুর্কীরা সমগ্র বিশ্বে বিশেষতঃ মুসলিম দেশগুলোতে রটিয়ে দিলো। এরই দরুন ১৮০৩ থেকে ১৮০৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আরবের বাইরে থেকে হজ্বযাত্রীদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেলো।

এ রকম এক পরিস্থিতিতে মিসরের শাসনকর্তা (খেদিব) মোহাম্মদ আলি পাশা তুরস্কের সুলতানের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং এঁদেরই সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে কন্সটান্টিনোপল-এর (ইস্তাম্বুল) নিকটবর্তী এলাকায় সংঘটিত লড়াই-এ মুজাহিদরা পরাজিত হয়। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে মিসরীয় বাহিনীর সেনাপতি স্কটিশ টমাস কীথ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদিনা দখল করে। ১৮১৩ খৃষ্টাব্দে সেনাপতি কীথ মক্কা নগরীও অধিকার করে নেয়। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে মুজাহিদদের সামরিক শক্তি একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর নজদ প্রদেশকে কেন্দ্র করে আবদুল ওহাব-এর অনুসারী মুজাহিদরা শুধুমাত্র ধর্ম প্রচারে লিপ্ত থাকে।

অন্যদিকে ইসলামী মূল্যবোধ এবং প্রকৃত ইসলামী রীতিনীতি সম্পর্কে আল্লামা আবদুল ওহাব যে ব্যাখ্যাদান করেছিলেন, সেই দর্শন অচিরেই ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর কৃতিত্বের দাবীদার যথাক্রমে হাজী শরিয়তউল্লাহ ও তদীয় পুত্র মুহম্মদ মহসীন ওরফে পীর দুদু মিয়া, নিসার আলী ওরফে তীতুমীর এবং সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী।

হাজী শরিয়তউল্লাহর ফারায়েজী আন্দোলন

প্রথমেই হাজী শরিয়তউল্লাহর কথা বলতে হয়। এঁর জন্ম ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর অঞ্চলের এক অজ্ঞাত পরিবারে। সম্প্রতি এঁরই নামানুসারে ফরিদপুরের দক্ষিণাঞ্চলের একটি নতুন জেলার নামকরণ হয়েছে শরিয়তপুর। হাজী শরিয়তউল্লাহ প্রবর্তিত মতবাদের নাম ফারায়েজী। যদিও ওহাবী মতবাদের মূল আদর্শের সঙ্গে এই মতবাদের বিশেষ কোন তফাৎ নেই, তবুও ফারায়েজী সম্প্রদায় এই সত্যকে স্বীকার করতে চান না। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, হাজী শরিয়তউল্লাহ দুইবার পবিত্র হজ্ব পালনের জন্য গমন করেছিলেন এবং প্রায় ২০ বছরকাল আরবদেশে অবস্থান করেন। এই সময়েই আরবের নজদ প্রদেশে কট্টর রক্ষণশীল ওহাবী নেতাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং তিনি দারুণভাবে প্রভাবান্তি হন।

দেশে প্রত্যাবর্তনের পর হাজী শরিয়তউল্লাহ এদেশকে ‘দারুল হরব’ অর্থাৎ বিধর্মীর এলাকা ঘোষণা করে এ মর্মে নির্দেশ জারি করলেন যে, অতঃপর ফারায়েজীরা দুই ঈদের এবং শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করতে পারবেন না। হাজী সাহেবের বক্তব্য হচ্ছে, ইসলামের এসব ধর্মীয় রীতিনীতি কেবলমাত্র মুসলিম শাসিত রাজ্যগুলোতে উদযাপিত হতে পারে, বিধর্মীর এলাকায় নয়। তিনি কঠোর নির্দেশ দিলেন যে, পবিত্র কোরানকে আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করতে হবে এবং এর বাইরের সবকিছুই বর্জনীয়। হাজী সাহেব মহররম উৎসব উদ্‌যাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন এবং অমান্যকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। তিনি ‘পীর-মুরিদ’ জাতীয় শব্দগুলো উঠিয়ে দিয়ে আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক এবং শিষ্য শব্দ ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই মুক্তবুদ্ধির সুফী মতাবলম্বীদের সংগে ফারায়েজীদের সংঘাত দেখা দিলো। অন্যদিকে তিনি ফারায়েজীদের জমিদার ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় দক্ষিণবংগের ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার প্রায় এক-ষষ্ঠমাংশ মুসলমান এই মতবাদে আস্থা স্থাপন করে।

হাজী শরিয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মুহম্মদ মোহসীন ওরফে পীর দুদু মিয়া তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। এঁর জন্ম ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে। কিন্তু ইনি পিতার মতাদর্শের বেশ কিছুটা সংশোধন করেন এবং অনেক সময় রাজনীতির সংগেও জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি নিজেকে পীর সাহেব ঘোষণা করেন। পিতা শরিয়তউল্লাহর মতো তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব না থাকলেও পীর দুদু মিয়া অভূতপূর্ব সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলাকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। এঁদের কর্তব্য ছিলো স্বীয় অনুসারীদের সুসংবদ্ধ করা এবং ফারায়েজী সম্প্রদায়ের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে চাঁদা আদায় করা। তাই এরপর এই আন্দোলন আর ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলো না। তবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত বাংলার মুসলমান কৃষকদের এ আন্দোলন আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলো এবং এই আন্দোলনের মধ্যে বেশকিছুটা জমিদার বিরোধী ও নীলকর-বিরোধী চরিত্র প্রকাশ পেলো। কিন্তু অনেকেই এ মর্মে মত প্রকাশ করেছেন যে, পীর দুদু মিয়া প্রজাদের তাঁর সম্প্রদায়ভুক্ত করতে বাধ্য করতেন এবং অস্বীকার করলে মারধোর করতেন। এছাড়া সবার নিকট থেকে চাঁদা আদায়ের জন্যও বল প্রয়োগ করা হতো। তাঁর কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্ৰস্থল ছিলো শরিয়তপুরের বাহাদুরপুর নামক স্থানে এবং যেকোন ধরনের কাজ করতে রাজী এরকম শিষ্যের সংখ্যা ছিলো প্রায় কয়েক লাখের মতো। ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর ফারায়েজীরা পান্‌চুর নামক স্থানে অবস্থিত ডানলোপ নামক এক নীলকর সাহেবের ফ্যাক্টরী প্রতিশোধমূলক আক্রমণে ধূলিসাৎ এবং এর ব্রাহ্মণ গোমস্তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ফলে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ফারায়েজীদের ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করে। এরপর থেকে দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দায়ের করা হয় এবং এসব মামলা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে। এমনকি পীর সাহেবকে কিছুদিনের জন্য আলীপুর জেলে রাজবন্দী হিসেবেও আটক রাখা হয়। পীর দুদু মিয়া অগণিত মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত হয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত হন বলা চলে। তাঁর ইন্তেকালের পরেই কট্টর শরিয়তপন্থী ফারায়েজী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা সমীচীন হবে যে, হাজী শরিয়তউল্লাহ এবং তদীয় পুত্র পীর দুদু মিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত এই ‘ফারায়েজী আন্দোলন’ সম্পর্কে আশানুরূপ গবেষণা হয়নি। তবে পীর দুদু মিয়া সম্পর্কে ডঃ এ আর মল্লিকের মত হচ্ছে “কিন্তু তাঁর কোন কার্যকলাপের মধ্যে আমরা এমন কোন নিদর্শন পাইনে, যেখানে তিনি বৃটিশ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলিম শাসন প্রবর্তন করার কথা বলেছেন অথবা কোথাও তাঁর সেভাব প্রকাশ পেয়েছে।”

দক্ষিণ বাংলায় যখন হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং তদীয় পুত্র পীর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে রক্ষণশীল শরিয়তপন্থী ইসলামের আদর্শে ফারায়েজী আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করছিলো এবং উত্তর ভারত ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ওহাবী আন্দোলনের জোয়ার বইতে শুরু করেছিলো, তখন প্রায় একই সময়ে পশ্চিম বাংলার বারাসত অঞ্চলে নিসার আলী ওরফে তিতুমীর নামে আর এক দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, তিতুমীর হজ্ব করার উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করলে সেখানেই ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থানকালে সৈয়দ আহমদ-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিতুমীর ইসলাম ধর্মের সংস্কারক হিসেবে স্বীয় মতাদর্শ প্রচার শুরু করেন এবং অচিরেই বারাসত-এর নারকুলবাড়িয়া অঞ্চলে মুসলমান কৃষক ও তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। তিনি উপমহাদেশের অন্যান্য ওহাবী নেতাদের চেয়েও রক্ষণশীল ছিলেন বলা যায়। তিতুমীর তাঁর অনুসারীদের নিয়মিত নামাজ আদায় ছাড়াও দাড়ি রাখা ও স্বতন্ত্র ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এমনকি বিধর্মীতো দূরের কথা স্বীয় মতাবলম্বী ছাড়া অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে পর্যন্ত পানাহার বর্জনীয় বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনিও অন্যান্য ওহাবীদের মতো মহররম উৎসবের নিন্দা এবং পীরের মাজার পূজার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কোন কোন গবেষকের মতে কঠোরভাবে এসব ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার দরুন তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা সীমিত ছিলো এবং ইংরেজ ও হিন্দুদের বিরোধিতা ছাড়াও এঁরা সুফী মতাদর্শী মুসলমানদের ও বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

তিতুমীর-এর অতুলনীয় দেশপ্রেম ইতিহাসের বিরল ঘটনা

নিসার আলী ওরফে তিতুমীর এবং তাঁর অনুসারীদের কর্মকান্ড ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরকাল সময়ের মধ্যে বিপুলভাবে এতদাঞ্চলে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিলো। এঁরা হিন্দু জমিদার এবং নীলকর সাহেবদের ভয়াবহ অত্যাচারের বিরুদ্ধে এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন, যে, তা নিশ্চিতভাবে প্রশংসার দাবী রাখে। এমনকি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এঁদের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপগুলোও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিলো। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, স্বীয় মতাদর্শের প্রতি এঁদের আন্তরিক নিষ্ঠা ও অবিচল আস্থা এবং অতুলনীয় সাহসিকতা ও দেশপ্রেম ইতিহাসে বিরল।

এই আন্দোলন সম্পর্কে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ওয়ালিউল্লাহর মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘সীমান্তে মোজাহিদ বাহিনী কর্তৃক পেশোয়ার দখলের (১৮৩০ খ্রীঃ) সংবাদ বাংলায় পৌঁছিলে, তিতুমীরের অনুচরদের সাহস অসম্ভব রকম বৃদ্ধি পায়। গোপনে

অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের কাজও জোরেশোরে চলিতে থাকে।পাঞ্জাবী মুসলমানদের উপর অকথ্য অত্যাচার যেভাবে বৃটিশকে বাদ দিয়ে সৈয়দ আহমদকে শিখদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণে বাধ্য করিয়াছিল, বাংলায় হিন্দু জমিদারদের ঔদ্ধত্যও অনুরূপভাবে তিতুমীরকে বৃটিশের পরিবর্তে তাহাদের হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রথমে দন্ডায়মান হইতে বাধ্য করে।’

জমিদারদের অনুরোধে ইংরেজ সরকার প্রেরিত পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী দুই দফায় তিতুমীরের অনুসারীদের নিকট পরাজিত হলে ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ‘ক্যালকাটা মিলিশিয়া’র মেজর স্কট একদল অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে তিতুমীরকে দমনের উদ্দেশ্যে বারাসত অভিমুখে রওয়ানা হয়। ১৯শে ডিসেম্বর তারিখে উভয় পক্ষের মধ্যে কি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। বাঁশের কেল্লার এই যুদ্ধে তিতুমীরসহ ৫০ জন নিহত হন এবং গ্রেফতারের সংখ্যা ছিলো ৩৫০ জন। মেজর স্কট-এর ইংরেজ বাহিনী শহীদ তিতুমীর ও নিহত অন্যদের লাশ পুড়িয়ে ফেলে। প্রাপ্ত নথিপত্র মোতাবেক দেখা যায় যে, বিচারে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি এবং ১২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড দেয়া হয়। বিচার চলাকালীন সময়ে জেলখানায় চারজনের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে তিতুমীরের অনুসারীদের ঘরবাড়ী এবং সহায়-সম্পত্তি সবকিছুই ছিনিয়ে নেয়া হলে এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

এখন ভারতে ওহাবী আন্দোলনের গোড়ার কথা বলতে হলে প্রসঙ্গতঃ দাক্ষিণাত্য এবং মধ্য ভারতীয় অঞ্চলে অষ্টাদশ শতাব্দীর পিণ্ডারীদের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করতে হয়। পিণ্ডারীদের অধিকাংশই ছিলো মুসলমান। ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সময় পিণ্ডারীরা আহমদ শাহ আব্দালীর বিরুদ্ধে মারাঠাদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলো এবং মারাঠাদের মতোই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিপূর্বে দাক্ষিণাত্যে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে এই পিন্ডারীরা হীরু ও বরুণ নামে দুই ভ্রাতার নেতৃত্বে মারাঠাদের সঙ্গে সহযোগিতা আরম্ভ করে। ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে একই বছরে পিন্ডারীদের নেতা হীরু ও বরুণ উভয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। ফলে আমীর খান, করিম খান ও চিতু খান— এই তিনজন পিন্ডারীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। মূলতঃ নিরপরাধ পথচারী ও তীর্থ যাত্রীদের নির্বিচারে হত্যা এবং আকস্মিক আক্রমণে জনপদ লুণ্ঠনই এদের পেশা ছিলো। ইতিমধ্যে মারাঠা শাসক দৌলত রাও সিন্ধিয়ার সঙ্গে হায়দ্রাবাদের নিজামের যুদ্ধে করিম খান মারাঠাদের পক্ষে অপরূপ বীরত্ব প্রদর্শন করলে, তাঁর খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই করিম খান ভূপালের নবাব পরিবারে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সেখানেই এক স্বাধীন নৃপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু করিম খান স্বীয় পিন্ডারী বাহিনী নিয়ে মধ্য ভারত ও রাজপুতনা অঞ্চল ছাড়া ইংরেজ এলাকাতেও লুঠতরাজ অব্যাহত রাখে। এ সময় পিন্ডারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেশীয় নৃপতিরা ইংরেজদের শরণাপন্ন হন। ইংরেজরাও ভারতে তাঁদের রাজ্য আরও বিস্তারের লক্ষ্যে এ রকম একটা সুযোগের প্রতীক্ষা করছিলো।

১৮১৫ সালে ইউরোপে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট চূড়ান্তভাবে পরাজিত হলে সম্পূর্ণ ভারত উপ-মহাদেশকে পদানত করার জন্য ইংরেজরা মনস্থ করে। তখন এদেশে ইংরেজ রাজ প্রতিনিধি ছিলেন মার্কুইস অব হেষ্টিংস। এঁরই পরিকল্পনা মোতাবেক ১৮১৫-১৬ খ্রীষ্টাব্দের যুদ্ধে গুর্খা শক্তিকে চূর্ণ করা হয়। এরপর ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত মারাঠা নেতা পেশোয়াকে পেনশন প্রদান করে কানপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরাজিত পিণ্ডারী নেতা আমীর খানকে রাজপুতনার অন্তর্গত ক্ষুদ্র টংক রাজ্যের নবাবী দিয়ে নিশ্চুপ করে রাখা হয়। প্রায় একই সময়ে গাজীপুরে নজরবন্দী হিসেবে অবস্থানকালে পিণ্ডারীদের অন্যতম নেতা ওয়াসিল মোহাম্মদ বিষপানে আত্মহত্যা করে।

এদিকে আর একজন স্বাধীনচেতা পিণ্ডারী নেতা চিতু খান বিতাড়িত অবস্থায় মধ্যভারত অঞ্চলে পলায়নকালে নর্মদা নদীর তীরে বাগলা উপত্যকার জঙ্গলে ব্যাঘ্রের আক্রমণে নিহত হন। উপায়ান্তরবিহীন অবস্থায় পিণ্ডারী নেতা করিম খান সেনাপতি স্যার ম্যালকম-এর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে গোরক্ষপুর জেলায় বার্ষিক ২০ হাজার টাকা আয়ের ভূসম্পত্তি দানপূর্বক স্বাভাবিক জীবনযাপনের অনুমতি দেয়া হয়। এভাবে ১৮১৮ সাল নাগাদ মূলতঃ পেশাদার নরহত্যাকারী পিণ্ডারীরা নিশ্চুপ হয়ে যায়।

ভারত উপমহাদেশে ওহাবী আন্দোলনের গোড়াপত্তন

ঐতিহাসিক তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন, “যেই পরিবারে তাঁহার জন্ম তাহার সহিত পিণ্ডারী সরদার আমীর খানের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল বলে অনেকের ধারণা।’ (আমাদের মুক্তি সংগ্রামঃ পূঃ ৪৭) কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সৈয়দ ব্রেলভী প্রথম জীবনে সরদার আমীর খানের দলভুক্ত ছিলেন এবং এই সময়ে তিনি অসি বিদ্যা ও অশ্ব চালনায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেন। উপরন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র ঘৃণা-আক্রোশের সৃষ্টি হয়।

এদিকে সরদার আমীর খান ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করলে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে বেরেলী থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য দিল্লীতে গমন করে তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মওলানা শাহ আবদুল আজিজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি রোহিলা খণ্ডসহ উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সফর করেন এবং বহু ধর্মীয় সভায় বক্তৃতা দান করেন। ১৮১৮ সালে তিনি পাটনায় একটি শক্তিশালী প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন। অচিরেই তিনি হজ্ব গমনের উদ্দেশ্যে কোলকাতায় আগমন করলে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ হয়। তিনি কোলকাতা থেকে বিপুলসংখ্যক অনুচর নিয়ে ১৮২২ সালে হজ্ব যাত্রা করেন। এরকম তথ্য রয়েছে যে, সেসময় শুধু তাঁর অনুচরদের জন্য সবশুদ্ধ ১১টি জাহাজ ভাড়া করতে হয়েছিলো।

পবিত্র হজ্ব যাত্রার প্রাক্কালে সৈয়দ সাহেব এ মর্মে সংবাদ লাভ করেন যে, বিশেষ করে পাঞ্জাব অঞ্চলে সেখানকার শিখ শাসন কর্তৃপক্ষ মুসলমানদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে বাধাদান ছাড়াও নানা ধরনের অকথ্য অত্যাচার শুরু করেছে। তিনি বিধর্মী শিখদের এধরনের কার্যকলাপ প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণে অর্থ এবং বিরাট সংগঠনের। ফলে তিনি পাটনা কেন্দ্রের দুইজন বিশ্বস্ত অনুসারী শাহ ইসমাইল ও আবদুল হাইকে তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার অব্যাহত রাখা ছাড়াও অত্যন্ত সংগোপনে জ্বেহাদের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দান করেন। পরবর্তীকালে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, অত্যন্ত গোপনে সমগ্র ভারতব্যাপী একটি সংগঠন সৃষ্টি এবং বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য মুজাহিদ রিক্রুট ও নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

গবেষক মোহম্মদ ওয়ালিউল্লাহর মতে পবিত্র হজ্ব পালনের পর সৈয়দ সাহেব মধ্যপ্রাচ্যে বহু দেশ সফর করেন এবং একমাত্র কনসতান্তিনোপলেই (ইস্তাম্বুলেই) শিষ্য ও দর্শনার্থীদের নিকট থেকে নয় লক্ষাধিক টাকা নজরানা পেয়েছিলেন। এ সময় তিনি মরহুম আল্লামা আবদুল ওহাব-এর বেশ ক’জন অনুসারীর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর চিন্তাধারা পরিধির ব্যাপ্তি ঘটে। অতঃপর সৈয়দ আহমদ ১৮২৩ সালের অক্টোবরে দেশে প্রত্যাবর্তন করে দিল্লীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি ইসলামী দর্শনের যে ব্যাখ্যা দান করেছেন তাকে “তরীক-ই-মোহাম্মদিয়া” বা “মোহাম্মদের নীতি” বলে অভিহিত করেন। কিন্তু দেশে প্রত্যাবর্তনের পর এবার তাঁর মুখে উচ্চারিত শ্লোগান হচ্ছে “মুক্ত ভারতে মুক্ত ইসলাম।” অর্থাৎ খ্রীষ্টান ইংরেজদের অধীনে ভারতবর্ষ হচ্ছে “দারুল হরব”— বিধর্মীর এলাকা। তাঁর এই মতবাদ-এর আরও ব্যাখ্যাদান করলে বলতে হয় যে, যতদিন পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশ খ্রীষ্টানদের পদানত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই “দারুল হরব”-এ ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি

যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব নয়।

দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণের পর দ্বিতীয় দফায় কোলকাতা পর্যন্ত আগমন করেন। প্রতিটি এলাকাতেই তিনি প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন অত্যন্ত সংগোপনে, বিশেষ করে শিখদের বিরুদ্ধে জ্বেহাদে অংশ গ্রহণ অথবা ‘দারুল হরব এই হিন্দুস্থান থেকে হিজরতের আহবান জানালেন। প্রায় তিন বছর ধরে তিনি সবার অলক্ষ্যে এই জ্বেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৮২৬ সালে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী সদলবলে ইংরেজদের করদ রাজ্য টংক-এ উপস্থিত হন এবং সেখানকার শাসনকর্তার সক্রিয় সমর্থনে দুর্গম এলাকার মাঝ দিয়ে সৈয়দ আহমদ তাঁর সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আফগান এলাকায় গিয়ে পৌঁছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় মুসলমানদের সমর্থনে এখান থেকেই শিখ নেতা রণজিৎ সিংহ-এর শাসনাধীন পাঞ্জাব আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করা।

সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী সীমান্ত প্রদেশের আফগান এলাকায় পৌঁছানোর পর তাঁর প্রতিনিধিরা যেভাবে বাংলা ও বিহার এলাকা থেকে অর্থ ও নতুন রিক্রুট করা মুজাহিদদের ট্রেনিং প্রদানের পর নিয়মিতভাবে প্রেরণ করেছে তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এজন্য পাটনা শহরেই প্রতিষ্ঠিত হলো ওহাবীদের প্রধান কেন্দ্র আর দ্বিতীয় কেন্দ্রটি গড়ে উঠলো মালদহে। এ সময় মওলবী বেলায়েত আলী চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল এলাকায় এবং পাটনার এনায়েত আলী পাবনা, রাজশাহী, মালদহ, বগুড়া, রংপুর এলাকায় কট্টর রক্ষণশীল ওহাবী মতাদর্শ প্রচার ছাড়াও অসংখ্য বাঙালি মুসলমান যুবককে মুজাহিদ হিসেবে সংগ্রহ করেন।

অনেক গবেষক দ্বিমত পোষণ করলেও এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইংরেজ গবষেক ডব্লিউ হান্টার রচিত “আওয়ার ইণ্ডিয়ান মুসলমানস” গ্রন্থে বর্ণিত মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

“পূর্ববংগের প্রায় প্রত্যেক জেলা থেকে ওহাবী প্রচারকেরা সাধারণতঃ বিশ বৎসরের কম বয়সের শতশত সরলমতি যুবককে অনেক সময় তাদের পিতামাতার অজ্ঞাতে, নিশ্চিতপ্ৰায় মৃত্যুর পথে সঁপে দিয়েছে। শত সহস্র কৃষক পরিবারে তারা দারিদ্র্য ও শোক প্রবিষ্ট করিয়েছে, আর আশা-ভরসাস্থল যুবকদের সম্বন্ধে পরিজনের অন্তরে একটা স্থায়ী দুর্ভাবনা এনে দিয়েছে। যে ওহাবী পিতার বিশেষ গুণবান অথবা বিশেষ ধর্মপ্রাণ পুত্র বিদ্যমান তিনি জানেন না কোন সময়ে তার পুত্র গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যাবে। এইভাবে যেসব যুবককে উধাও করা হয়েছে তাঁদের অনেকেই ব্যাধি, অনাহার অথবা তরবারির আঘাতে বিনষ্ট হয়েছে।” (অনুবাদ : আবদুল ওদুদ)

অচিরেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় ওহাবী শিবিরগুলোতে নিদেনপক্ষে ১২ হাজার মুজাহিদ জমায়েত হয় এবং প্রতিনিয়তই এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৃটিশ কূটনীতিক মিঃ ওয়েড এ মর্মে তথ্য প্রকাশ করেছেন যে, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সৈন্যবাহিনীতে অসংখ্য লোক যোগদান করে সত্যের পথে (জ্বেহাদ) শহীদ হবার যে আগ্রহ দেখায় তা’ অবিস্মরণীয়। (বেংগল পলিটিক্যাল কনসালটেশন্স : ৩০শে মার্চ, ১৮২৭)। শিখ নেতা রণজিৎ সিং-এর মতে, সৈয়দের সৈন্য সংখ্যা ছিলো ৪০ হাজারের মতো।

১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে প্রকাশ্যভাবে শিখদের বিরুদ্ধে জ্বেহাদ ঘোষণা করেন। এই প্রচারপত্রে পাঞ্জাব এলাকায় মুসলমানদের ওপর শিখদের ভয়াবহ অত্যাচারের বর্ণনা প্রদানপূর্বক প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সৈয়দ আহমদ-এর পতাকাতলে একত্র হওয়ার আহবান জানানো হয়। আলোচ্য প্রচারপত্রের নামকরণ ছিলো, ‘তার্গের আল জ্বেহাদ।’ (জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেংগলঃ ১৮৩২ খ্রীঃ পৃষ্ঠা ৪৮২)।

শিখ-ওহাবী যুদ্ধের সূত্রপাত

সীমান্ত এলাকায় ওহাবীদের দ্রুত শক্তি সঞ্চয়ের সংবাদে লাহোরে শিখ শাসকরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে এবং এদের দমনের উদ্দেশ্যে সেনাপতি বুধ সিং-এর নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্য প্রেরণ করে। ফলে শিখ সৈন্যদের সঙ্গে ওহাবীদের আকুরা নামক স্থানে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সেনাপতি বুধ সিং বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, অতঃপর ওহাবীদের সঙ্গে যোগদানকারী পাঠান উপজাতিরা ছাড়াও সৈয়দ-এর হিন্দুস্থানী অনুসারীরা বেশ কিছুটা উচ্ছৃঙ্খলতার পরিচয় দেয় এবং এদের নিয়ন্ত্রণে অসুবিধার সৃষ্টি হয়।

এতদসত্ত্বেও সৈয়দ আহমদ-এর শক্তি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে সীমান্ত প্রদেশ এলাকায় তিনি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করেন এবং স্বয়ং খলিফা নিযুক্ত হন। এই ঘোষণায় সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আনুগত্য স্বীকার করা সমগ্র মুসলিম সমাজের অবশ্য করণীয় এবং এর বিরোধীরা বিদ্রোহী হিসেবে গণ্য হয়। অচিরেই বিভিন্ন মসজিদে সৈয়দ সাহেবের নামেই জুম্মার নামাজের খোত্বা পাঠ শুরু হলো।

১৮২৯ খ্রীষটাব্দ নাগাদ ওহাবীরা বিচ্ছিন্নভাবে গোটা কয়েক যুদ্ধের পর পেশোয়ারস্থ শিখদের নিযুক্ত গভর্নর ইয়ার মোহাম্মদকে হত্যা করে। অতঃপর পরবর্তী গভর্নর হিসেবে ইয়ার মোহাম্মদের ভ্রাতা সুলতান মোহাম্মদ দায়িত্ব গ্রহণ করলে ওহাবীরা ১৮২৯ খ্রীষটাব্দের জুন মাসে প্রচণ্ড লড়াই-এর পর পেশোয়ার দখল করে। ঐতিহাসিকদের মতে ‘মহিয়ান’-এর এই যুদ্ধে বাঙালি মুজাহিদরা অপূর্ব শৌর্যবীর্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এতো বড় বিজয়ের পর সৈয়দ আহমদ পেশোয়ারে অবস্থান করে তাঁর শক্তি সুসংগঠিত না করেই প্রিয় শিষ্য মাজহার আলীর নিকট পেশোয়ারের দায়িত্ব অর্পণ করে পার্বত্য পঞ্জতর এলাকায় গমন করেন। ফলে শিখ সমর্থিত সুলতান মোহাম্মদ পাল্টা আক্রমণ করে পেশোয়ারের সমস্ত ওহাবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করতে সক্ষম হয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, এতোদিন পর্যন্ত মিত্রভাবাপন্ন ও আশ্রয়দাতা উপজাতি মুসলমানরা এ সময় ওহাবীদের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ে। জ্বেহাদের জন্য কৃষকরা তাদের আয়ের এক-দশমাংশ আল্লাহর ওয়াস্তে দান করতে আপত্তি না করলেও বিবাহযোগ্য কন্যাদের কোনরকম টাকা-পয়সা ছাড়াই সৈয়দ আহমদ-এর উত্তর ভারতীয় অনুসারীদের নিকট বিবাহ দেয়ার বাধ্যবাধকতায় এদের মধ্যে ভয়ানক উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। উপজাতীয় অভিভাবকদের কাছে বিষয়টা বেশ ‘অপমানকর’ ও ‘ন্যক্কারজনক’ বলে বিবেচিত হলো। প্রায় একই সময়ে শিখ নেতা রণজিৎ সিং-এর পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ উপজাতি নেতাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এমনকি এক শ্রেণীর ভাড়া করা মোল্লা-মওলবীরা উপজাতীয় মুসলমানদের মধ্যে এই মর্মে রটনা করলো যে, ‘সৈয়দ আহমদ হচ্ছেন আসলে ইংরেজদের অনুচর এবং এজন্যই বিধর্মী হওয়া সত্ত্বেও ওহাবীরা খৃষ্টান ধর্মীয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেনি।’

পেশোয়ার হস্তচ্যুত হওয়া ছাড়াও উপজাতীয়দের মধ্যে বিরূপ মনোভাব ক্রমবর্ধমানরূপে দেখা দেয়ায় এবং অন্যদিকে নানা কারণে উত্তর ভারতের সঙ্গে সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সৈয়দ আহমদ এসময় বাকী অনুসারীদের নিয়ে আরব ভূখণ্ডে হিজরত করতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু তিনি কাঘান উপত্যকা দিয়ে মোজাফফরাবাদে পৌঁছালে সেনাপতি খড়গ সিং-এর নেতৃত্বে এক শিখ বাহিনী ওহাবীদের আক্রমণ করে। স্থানীয় মুসলমানরা এ যুদ্ধে ওহাবীদের পক্ষে লড়াই করায় শিখ বাহিনী পর্যুদস্ত হয়। এই পরাজয় সংবাদ লাহোরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে শিখ শাসনকর্তা রণজিৎ সিং আটক দুর্গে অবস্থানরত রাজা শের সিংকে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে পুনরায় ওহাবীদের আক্রমণের নির্দেশ দেন।

১৮৩১ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত বালাকোট নামক স্থানে শিখ ও ওহাবীদের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন, “…..সৈয়দ আহমদ তাঁহার মূল বাহিনীর জন্য সংবাদ পাঠাইয়া তাহাদের প্রতীক্ষায় সেস্থানেই শিবির সন্নিবেশ করিলেন। রাজকুমার শের সিংহ ইহার কিছুই জানিতেন না। কিন্তু রণজিৎ সিংহের বিঘোষিত পুরস্কারের লোভে জনৈক পাঞ্জাবী মুসলমান তাঁহার উপস্থিতির কথা গোপনে শিখ সেনাপতির কাছে পৌঁছাইয়া দেয়। ….সৈয়দ আহমদ স্বয়ং তাঁহার প্রধান শিষ্য মওলানা ইসমাইল ও বেশীর ভাগ অনুচরসহ এই যুদ্ধে শহীদ হন। যুদ্ধ অবসানের কয়েক ঘন্টা পর মূল মুজাহিদ বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া দেখে শিখেরা তাহাদের ঘাঁটিতে ফিরিয়া গিয়াছে।

“সৈয়দ আহমদের মৃত্যু সংবাদ দাবানলের ন্যায় উপজাতীয় অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়ামাত্রই অর্থলোভী সরদার এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মোল্লা-মওলবিগণের প্ররোচণায় ধর্মান্ধ লোকেরা মুজাহিদ বাহিনীর হতাবশিষ্ট লোকজনকে যত্রতত্র আক্রমণ করিতে থাকে। ফলে ইহাদের হাতে বহু মুজাহিদ প্রাণ হারান। স্বভাবতঃই এ সময় দলের মধ্যে ভাংগন আরও সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। উপজাতীয়দের বিরুদ্ধাচরণের দরুন পূর্ব এবং উত্তর ভারতের মুজাহিদগণের অনেকের মনে জ্বেহাদের পরিণতি সম্পর্কেও সংশয় জাগিয়া উঠে। ইহাদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক লোক স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করে। জ্বেহাদে একবার বহির্গত হইলে মনস্কাম পূর্ণ হওয়ার পূর্বে গৃহে প্রত্যাবর্তন অধর্মাচরণেরই সামিল, ইহাই ছিল বাঙালি মুজাহিদগণের বিশ্বাস। তাই তাঁহাদের অধিকাংশকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করিতে দেখা যায় নাই।” (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম : ১৯৭৮ : পৃঃ ৫১-৫৩)।

নৃশংসভাবে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীকে শিখরা হত্যা করল

বালাকোটের এই লড়াই সম্পর্কে গবেষক ডক্টর মল্লিক লিখেছেন, “…বালাকোটের প্রধান প্রধান প্রবেশপথ এবং সেতুগুলো পাহারাদানের ব্যবস্থা করা হলো, যাতে শিখরা কোনক্রমেই প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু পাঠান পাহারাদাররা শিখদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা খেয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। ….এই যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ ও শাহ ইসমাইল এবং ওহাবী মতবাদের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ হতাহত হন। সৈয়দ আহমদের মৃতদেহ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ১৮৩১ সালের ২০শে জুনের ইন্ডিয়া গেজেট অনুসারে সৈয়দ আহমদের শবদেহ যে শের সিং-এর সামনে সনাক্ত করা হয়েছিলো তার উল্লেখ আছে এবং শিখরা যে তাঁর মস্তক এবং হস্ত কেটেছিলো এবং অগ্নিদগ্ধ করে ফেলতে চেয়েছিলো তারও উল্লেখ আছে। রাজা এমন নৃশংস কাজ করতে দেননি। শবদেহ শালু কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দাফন-কাফন করে সম্মানের সাথে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেছিলেন।

এস এম লতিফ (ষাট বছর পর লিখেছেন)-এর অভিমত হচ্ছে “সৈয়দ আহমদ এবং শাহ ইসমাইলের মস্তক ছেদন করে রণজিৎ সিং-এর কাছে প্রেরণ করা হয়েছিলো। কিন্তু ক্যাপ্টেন ওয়েড যুদ্ধের এক সপ্তাহ পরে গভর্নর জেনারেলের সেক্রেটারীর নিকট তাঁর রিপোর্টে বলেছেন, সৈয়দের শবদেহ সনাক্ত করে শিখরা অগ্নিদগ্ধ করে ফেলেছে।… শিখরা যে তার নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিতে পারে, সেসব দিক বিচার করে ক্যাপ্টেন ওয়েড-এর অভিমত স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।” (পৃষ্ঠা ১২৫-১২৬: বৃটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান : ১৯৮২)।

এখানে দু’টি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমতঃ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর নেতৃত্বে ওহাবী আন্দোলন মূলতঃ বিধর্মী শিখদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ছিলো। দ্বিতীয়তঃ ১৮৩১ খ্রীষটাব্দে বালাকোটে সৈয়দ ব্রেলভী এবং শাহ ইসমাইল-এর ইন্তেকালের পরেও ওহাবী আন্দোলন দমিত হয়নি। এই আন্দোলনের চরিত্রগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এর ফলে পরবর্তী আরও ৪০ বছর অর্থাৎ ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ওহাবী আন্দোলন এবার বিধর্মী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অব্যাহত থাকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, লাহোর-কেন্দ্রিক শিখ নেতা রণজিৎ সিং-এর ১৮৩৯ সালে স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী শিখদের সঙ্গে একটা সমঝোতার ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলো এবং ওহাবী ও শিখদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষেরই শক্তি ক্ষয় হোক— এটাই ইংরেজদের কাম্য ছিলো। এই প্রেক্ষিতে ১৮৩১ সালে ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ-এর ইন্তেকাল এবং ১৮৩৯ সালে রণজিৎ সিং-এর মৃত্যুর পর লর্ড ডালহৌসী একে একে পাঞ্জাব ও সিন্ধু এলাকা ইংরেজ রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।

এদিকে দ্বিতীয় দফায় রক্ষণশীল ওহাবীরা আটক দুর্গ থেকে ৪০ মাইল উত্তরে সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে মহাবন পর্বতের পাদদেশে সিতানা নামকস্থানে শাহ জামিন শাহ-এর নেতৃত্বে আস্তানা স্থাপন করেন এবং পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করেন। প্রধানতঃ জামিন শাহের প্রচেষ্টায় ওহাবী এবং উপজাতি নেতৃবৃন্দের মধ্যে একাত্মতাবোধের সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ হিসেবে এটুকু বলা যায় যে, ১৮৩৯ সালে রণজিৎ সিং-এর মৃত্যুর পর ইংরেজরা পাঞ্জাব এলাকা দখল করায় সিতানার ওহাবী সম্প্রদায় এবং ইংরেজদের অবস্থান মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। উপজাতি নেতৃবৃন্দ শ্বেতাঙ্গদের রাজ্যসীমা বৃদ্ধির বিষয়টা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। এদিকে দ্বিতীয় দফা ওহাবী আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই বিধর্মী ইংরেজদের বিরুদ্ধে হওয়ায় উপজাতিদের (গোটা কয়েক ব্যতিক্রম ছাড়া) পক্ষে ওহাবীদের প্রতি সক্রিয় সমর্থন প্রদান সহজতর হলো। এ সময় উত্তর ভারতীয় এলাকায় ওহাবীদের মূল প্রাণকেন্দ্র পাটনা ঘাঁটিকে পুনরুজ্জীবিত করে পুনরায় লোকবল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রচারের নামে প্রতিনিধিরা পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণ ভারতসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে ফয়জাবাদের মওলানা আহমদ উল্লাহর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

দ্বিতীয় দফায় ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ওহাবী আন্দোলন

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৮৫০-৫৬ নাগাদ) যখন দ্বিতীয় দফায় ওহাবীদের শক্তি সঞ্চয়ের প্রস্তুতিপর্ব অব্যাহত ছিলো, ঠিক এমনি সময়ে সমগ্র উপমহাদেশব্যাপী বিশেষতঃ পূর্ব ও উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে সিপাহী বিপ্লবের বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত হলো। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, এই সিপাহী বিপ্লবে ওহাবীরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হননি। এর কারণ হিসেবে এটুকু বলা চলে যে, ওহাবীদের সামরিক কেন্দ্রের অবস্থান ছিলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত। এলাকার সিতানা ও মুলকাতে এবং পাঞ্জাব এলাকার ইংরেজ সামরিক ছাউনিগুলো থেকে এঁদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হচ্ছিলো। ফলে ইংরেজ ও শিখ সৈন্যদের ব্যুহ ভেদ করে ওহাবীদের পক্ষে দিল্লী ও উত্তর ভারতীয় এলাকার বিদ্রোহী সিপাহীদের সংগে একত্রিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবুও পাটনা কেন্দ্র থেকে অযোধ্যা ও রোহিলা খন্ডের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় ১২ হাজার ওহাবী গাজী শাহাদৎ বরণ করেছিলো বলে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়।

সিপাহী বিপ্লব দমন করার পর ওহাবীদের শক্তি বিনষ্ট করার প্রচেষ্টায় ১৮৬১ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ইংরেজদের প্রায় দশ বছরকাল সময় ব্যয় করতে হয়। ইংরেজদের এসব প্রচেষ্টা দুই পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় অভিযান। ১৮৫৯ সালে পার্বত্য এলাকা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ সেনাপতি স্যার সিডনী কটন পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে আকস্মিকভাবে ওহাবীদের সামরিক ঘাটি সিতানা আক্রমণ করলে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সংগে মুজাহিদরা (ওহাবী) নিকটবর্তী মহাতব পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেনাপতি সিডনী এরপর সিতানা গ্রামটি উৎমানজাই উপজাতিকে উপহার হিসেবে প্রদান করে।

[ এই উমানজাই পাঠান উপজাতির এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে বর্তমানে জীবিত উপমহাদেশের সবচেয়ে বর্ষীয়ান নেতা ও আজীবন স্বাধীনতা-সংগ্রামী খান আবদুল গফফার খান ওরফে বাদশা খানের জন্ম ]। কিন্তু মুলকাত ঘাঁটিকে কেন্দ্র করেই মুজাহিদরা গেরিলা পদ্ধতিতে ইংরেজদের উপর তাঁদের হামলা অব্যাহত রাখে, এমনকি এঁরা একবার রাওয়ালপিণ্ডির ইংরেজ সামরিক ছাউনিতে পর্যন্ত হামলা চালিয়েছিলো। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, এ সময় মুজাহিদদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিলো।

[ অত্র প্রবন্ধকার প্রায় ৩০ বছর আগে ১৯৫৬ সালে সাংবাদিক হিসেবে তৎকালীন আজাদ কাশ্মীর এলাকা সফরকালে মোজাফফরাবাদ-এর সন্নিকটে এক পাহাড়ের গায়ে বত্ৰিশজন বাঙালি মুজাহিদ-এর কবর পরিদর্শন করেছেন। অনেক ক’টা কবরের উপর রক্ষিত শহীদদের নাম পর্যন্ত উর্দুতে খোদাই করা রয়েছে। কিন্তু লেখাগুলো বেশ কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। প্রবন্ধকার অনুরোধ করায় দোভাষী এরকম একটি ফলকের নাম পাঠ করলেন “শেখ মেঘু বরিশাল, বংগাল” ]

সীমান্ত এলাকার মুজাহিদদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে আরও বছর চারেক পরে ১৮৬৩ সালের ১৩ই অক্টোবর ১০ সহস্র সৈন্যসহ ইংরেজ সেনাপতি স্যার নেভিল চেম্বারলেন সোয়াত এলাকায় উপস্থিত হন। ফলে উপজাতীয় নেতা শেখ আবদুল গফফার শাহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে জ্বেহাদ-এর ঘোষণা দেন। মাত্র মাসাধিককালের মধ্যে সংঘটিত কয়েক দফা সংঘর্ষে উভয় পক্ষে বিপুল পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেনাপতি চেম্বারলেন উপায়ন্তরহীন অবস্থায় আরও সাহায্যের জন্য সংবাদ প্রেরণ করলে ৪ হাজার উট এবং ২ হাজার খচ্চর বোঝাই গোলাবারুদ ও রসদপত্র রাওয়ালপিণ্ডি থেকে পাঠানো হয়। কিন্তু অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি হলো না। ১৪ই ও ১৫ই নভেম্বর মুজাহিদের হামলায় ইংরেজ পক্ষে নিহতের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। ওহাবীদের এই আক্রমণে ইংরেজ সেনাপতি চেম্বারলেন স্বয়ং আহত হন। এধরনের এক নাজুক অবস্থায় ১৮৬৩ সালে ২৫শে ডিসেম্বর ইংরেজ অভিযাত্রী বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। এই অভিযানে প্রায় দুই সহস্র ইংরেজ ও এদেশীয় সৈন্য নিহত হলেও সেনাপতি চেম্বারলেন এ মর্মে রিপোর্ট দান করেন যে, মুজাহিদদের শক্তি চূর্ণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, ১৮৬৪ সালে ওহাবী নেতা আবদুল্লাহ এক অতর্কিত হামলায় সিতানা পুনর্দখল করে নেন। (সিলেকশন্স ফ্রম দি রেকর্ড অব দি বেঙ্গল গভর্নমেন্ট নং-৬২, পৃঃ ১৩৪) শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার অত্যন্ত সন্তর্পণে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে উপজাতীয় সরদারদের নিরপেক্ষ করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করে বহু আকাঙ্খিত ফল লাভ করে।

এদিকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উত্তর ভারতীয় অঞ্চল থেকে ওহাবীদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ক্যাপ্টেন পারসন্স-এর পরিচালনাধীন গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট মোতাবেক ইংরেজ পুলিশ ও সামরিক বাহিনী যুগপৎভাবে ১৮৬৩ সালে থানেশ্বর, আম্বালা, মুলতান, দিল্লী, কানপুর, এলাহাবাদ, পাটনা এবং মালদহের মুজাহিদ শিবিরগুলোর উপর হামলা চালায় এবং ২২ জন ওহাবী নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে। এঁদের মধ্যে ১১ জনই ছিলেন বাংলা ও বিহার এলাকার। এটাই হচ্ছে বিখ্যাত ‘আম্বালা ষড়যন্ত্র মামলা’। এঁদের মধ্যে ১১ জনকে সেশন কোর্টে পাঠানো হয়। বিচারে মওলানা এহিয়া ‘আলী, মুন্সী মোহাম্মদ জাফর এবং মোহাম্মদ শফির ফাঁসি এবং বাকী ৮ জনের দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়। উপরন্তু সবারই সম্পত্তি ক্রোক-এর নির্দেশ জারি হয়। (সিলেকশন্স ফ্রম দি রেকর্ডস অব দি বেঙ্গল গভর্নমেন্ট : ৫২ নং পৃঃ ১৩৮ এবং পৃঃ ১৪২)-এর পর যথাক্রমে ‘মালদহের মামলা’ এবং ‘পাটনার ষড়যন্ত্র মামলা’ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি মামলায় অভিযুক্ত ওহাবীদের হয় দীপান্তর, না হয় ফাঁসির রায় দেয়া হয়। কিন্তু এসব মামলা চলাকালে একটা বিষয় প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীকে হত্যার পরেও অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে ওহাবীরা গোপনে সরকার-বিরোধী মতাদর্শ প্রচার করে যাচ্ছিলো। উল্লেখ্য যে, ১৮৬৯ সালের ১২ই জানুয়ারী সুদূর আন্দামানে বড়লাট লর্ড মেয়ো এবং ১৮৭১ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর দুপুরে কোলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস নর্মানকে ওহাবী মতাবলম্বী দু’জন হত্যা করেছিলো। বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয়।

প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রে দেখা যায় যে, ১৮৭০-৭১ সাল নাগাদ একদিকে নেতৃত্বের অভাব এবং অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠী ইংরেজদের ভয়াবহ দমন নীতির ফলে উপমহাদেশে ওহাবী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর ঠিক এমনি সময়ে দিল্লী ও উত্তর ভারতীয় এলাকায় স্যার সৈয়দ আহমদ এবং বঙ্গীয় এলাকায় ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর হোসেন প্রমুখের ভিন্নধর্মী কর্মকাণ্ড একটা পূর্ণ অবয়ব গ্রহণ করতে শুরু করেছে। প্রায় একশ’ বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠা কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর মোকাবেলায় এঁদের কার্যপদ্ধতি তো’ আর এক বিরাট ইতিহাস।

এই প্রেক্ষাপটে ভারত উপমহাদেশে ১৮৭০-৭১ সাল নাগাদ ধর্মীয় দিক দিয়ে রক্ষণশীল মতাদর্শের ওহাবী আন্দোলন যখন ব্যর্থতার মাঝ দিয়ে দ্রুত পরিসমাপ্ত হতে চলেছে, বঙ্গীয় এলাকায় তখনকার বিরাজমান অবস্থাটা সঠিকভাবে অনুধাবন করা অপরিহার্য মনে হয়। এ সময় নবাবী আমলের বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী অবলুপ্তপ্রায়। অবশ্য দেশের এককালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে মুসলমান আমলে যে বনেদী মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গড়ে উঠেছিলো, তার বিলুপ্তির কারণগুলো ইতিপূর্বেই উপস্থাপিত করেছি। শেষ পর্যন্ত ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবরের ঘোষণায় সরকারের সমস্ত বিভাগে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা প্রবর্তিত হলে দেশরক্ষা, রাজস্ব, বিচার ও শিক্ষা দফতর থেকে বিতাড়িত হয়ে উপায়ন্তর বিহীন অবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী পরিবার উপমহাদেশের অন্যত্র বাস্তুত্যাগে বাধ্য হয়। প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় অবশিষ্টরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেয়ে কৃষিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে অচিরেই বাংলার মুসলিম সমাজ নেতৃত্ববিহীন হয়ে পড়ে এবং এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যে বঙ্গীয় এলাকায় শতশত বছর ধরে উদার মনমানসিকতার সুফী পীর, ফকির, আউলিয়া, দরবেশ ও মনীষীদের প্রচেষ্টায় পবিত্র ইসলাম ধর্ম ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছিলো; সেই বাংলাদেশের অত্যাচারিত, নিগৃহীত ও নেতৃত্ববিহীন মুসলিম সমাজে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রথম দফায় শিখ বিরোধী ও দ্বিতীয় দফায় ইংরেজ বিরোধী রক্ষণশীল ওহাবী আন্দোলনের জোয়ার বয়ে যায়। মূলতঃ এই আন্দোলন ধর্মীয় হলেও, এর রাজনৈতিক চরিত্র খুবই স্পষ্ট ছিলো। উপরন্তু একদিকে ইংরেজ পরাশক্তি এবং অন্যদিকে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর কর্মকাণ্ডের জের হিসেবে ভয়াবহ দুর্গতির মোকাবেলায় বাংলার মুসলমানরা তখন মুক্তির একটা পথ অনুসন্ধান করছিলো।

এখানে পাটনার ইংরেজ কমিশনার কর্তৃক ১৮৫৮ সালে কোলকাতাস্থ বাংলা সরকারের কাছে লিখিত ৩২৫৩ নং পত্র থেকে উদ্ধৃতি দেয়া সমীচীন হবে। প্রচারকদের (ওহাবী) প্রচারের ফলে এ ধরনের নিরক্ষর জনসমাজ অতি সহজেই এঁদের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছে। একবার দীক্ষিত হলে অনুসারীদের দলপতিদের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করাটা বাধ্যতামূলক। এসব লোকের বসবাস হচ্ছে অনুন্নত এলাকায়। শিক্ষার আলো লাভের কোন সুযোগ-সুবিধাই এদের নাই। তাই বর্তমান সমাজের প্রতি এদের মধ্যে অসন্তুষ্টি বিদ্যমান। এজন্যই কোন পথ না পেয়ে ওহাবী নেতারা ধর্মের নামে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের যে বাণী প্রচার করছেন, এরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে এর ব্যাপ্তি খুবই বেশী। কারণ সেখানকার অধিকাংশ মুসলমানের বসবাস হচ্ছে পূর্বাঞ্চলের অনুন্নত এলাকায়। সেখানে সরকার কোন সময়েই শিক্ষার আলো প্রজ্জ্বলিত করেনি।”

এ প্রসংগে গবেষক কাজী আবদুল ওদুদ-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, “এই সমাজ (বাঙালি মুসলমান) মানস-শক্তির দিক দিয়ে তেমন সবল না হলেও ওহাবী প্রভাবকে বাধা দিতে যে চেষ্টা না করেছে তা নয়। লালন ফকির প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলমান বাউলদের গানে রয়েছে সেই প্রতিবাদের ঝংকার। সে চেষ্টা সফল হয়নি…..। বস্তুতঃ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ওহাবী আন্দোলনকে এক রাজনৈতিক আন্দোলন বলেও গণ্য করা যেতে পারে— ধ্বংসশীল মুসলিম জগতের গা ঝাড়া দেবারও এক চেষ্টা। ভারতে অথবা বাংলায় রাজনৈতিক কারণ যে এর প্রভাবের মুলে তা বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসনকালে মুসলমানদের অবস্থার ইতিহাসের কথা ভাবলে। ব্যাপারটি সংক্ষেপে এই : হিন্দু সমাজের পদস্থ ব্যক্তিদের আনুকূল্যে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।….. মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন আরম্ভ হলো দশসালা বন্দোবস্ত থেকে, আর তাদের আর্থিক দুর্গতি চরমে পৌঁছলো সনদ দেখাতে না পেরে যখন তাঁদের বহু নিষ্কর জমিজমা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল— ইংরেজীতে এর নাম ‘রিজাম্পশন প্রসেডিংস’– আর যখন আদালতের ভাষা পার্সীর পরিবর্তে ইংরেজী হলো।”

বাঙলার মুসলমানদের জন্য ‘অতীব দুঃসময়’

তা’হলে বর্ণিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত সময়কালকে বাঙলার মুসলমানদের জন্য অনায়াসে ‘অতীব দুঃসময়’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঠিক এমনি সময়ে বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাঙালি মুসলমানদের সমাজ জীবনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিরাজমান শূন্যতার দরুন উত্তর ভারতীয় অঞ্চল থেকে বংগীয় এলাকায় এক শ্রেণীর অবাঙালি মোল্লা মওলভীর আবির্ভাব ঘটে। এদের কর্মপদ্ধতিও প্রকারান্তে কোলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বুর্জোয়াদের সুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব অবাঙালি মোল্লা মওলভীরা ধর্মের নামে সরলমনা গ্রাম্য মুসলমানদের বিভ্রান্ত করলো। তাঁরা এ মর্মে বোঝাতে শুরু করলো যে, বিধর্মীর ইংরেজী ভাষা শেখা উচিত নয় এবং বাংলা ভাষা হচ্ছে ‘কাফের’-এর ভাষা। এঁদেরই কর্মকাণ্ডে অচিরেই বাঙালি মুসলমানদের জন্য আধুনিকতা বিবর্জিত এক ‘জগাখিচুড়ি’ ভাষার প্রবর্তনের প্রচেষ্টা হয় এবং এতোদিন ধরে বাঙালিত্বের দাবীদার বাঙালি মুসলমানরা বহুলাংশে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে।

পরবর্তীকালে এঁদেরই উত্তরসূরীরা পাকিস্তান আমলে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার দাবী উত্থাপন করার পাশাপাশি ধর্মের দোহাই দিয়ে রাতারাতি বাংলাভাষার চেহারাটা বদলিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। (নমুনা : “….এই বিষয়ে তর্ককরারের গোঞ্জায়েস নাই। …..পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার কাবেলিয়াত উর্দুর রয়েছে।…… আনজামের এন্তেজাম শুধু বাকী। ……মুসলিম হুকুমাতের মারকাজ দিল্লীর সামরিক ছাউনিতে উর্দুর পয়দায়েশ।…. তথাকথিত সাহিত্যিক বাংলা মাশরেকী পাকিস্তানের সাধারণ মাতৃভাষা নহে তাহা অবশ্যই স্বীকার্য। মোকামী জবান এবং আদাবী জবানের পার্থক্য সকল দেশেই বর্তমান। মোকামী জবানই আসলে মাদেরী জবান।”–রচনা মীজানুর রহমান : মাহেনও : ১৯৪৯)।

এর জবাবে জ্ঞানতাপস ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর পরিচ্ছন্ন বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, “একদল যেমন বাংলাকে সংস্কৃত ঘেঁষা করতে চেয়েছে, তেমনি আর একদল বাংলাকে আরবী-পারসী ঘেঁষা করতে উদ্যত হয়েছে। একদল চাচ্ছে খাঁটি বাংলাকে ‘বলি’ দিতে, আর একদল চাচ্ছে ‘জবে’ করতে। একদিকে কামারের খাঁড়া, আর একদিকে কসাইয়ের ছুরি।” (সাহিত্য সম্মেলন-এর উদ্বোধনী ভাষণঃ ১৯৫৪ কার্জন হল, ঢাকা)।

সে যাই হোক; এক্ষণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাটা অনুধাবন করা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। এটা এমন একটা সময়, যখন ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব নিশ্চিহ্ন হয়েছে, ১৮৭০ সাল নাগাদ ধর্মীয় ওহাবী আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে, বঙ্গীয় চাষীদের নীল বিদ্রোহ-এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বুর্জোয়া শ্রেণী ইংরেজের ছত্রচ্ছায়ায় বাল্য ও কৈশোর অতিক্রম করে সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করেছে।

এ কথা ভাবলে আশ্চর্য মনে হয় যে, এ সময় ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর কর্মকাণ্ডে এতদূর সন্তুষ্ট ও নির্ভরশীল ছিলো যে, অনেক সময় সরকারী চাকরিতে লোক নিয়োগকালে “শুধুমাত্র হিন্দুদের মাঝ থেকে নেয়া হবে” বলে প্রকাশ্যে সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রচারে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করতো না। হান্টার সাহেবের রচিত ‘আওয়ার ইণ্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে প্রসঙ্গতঃ এ ধরনের একটা সুস্পষ্ট ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তিনি “দূরবীণ” নামক একটি পত্রিকা থেকে সম্পাদকীয় মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ১৮৬৯ সালের ১৪ই জুলাই তারিখে ফারসী ভাষায় প্রকাশিত ‘দূরবীণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর মন্তব্যটি নিম্নরূপ :

“বড় ছোট সমস্ত রকমের চাকরি মুসলমানদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য জাতীয় লোকদের, বিশেষ করে হিন্দুদের দেওয়া হচ্ছে। সরকার বাহাদুরের কর্তব্য হচ্ছে সর্বশ্রেণীর প্রজার উপরে সমদৃষ্টি হওয়া। কিন্তু এখন এমন কাল এসেছে যখন সরকারী চাকরি থেকে মুসলমানদের বাদ দেওয়ার কথা প্রকাশ্যভাবে গেজেটে লেখা হয়। সম্প্রতি সুন্দরবন কমিশনারের আপিসে কতকগুলি চাকরি খালি হলে উক্ত রাজকর্মচারী সরকারী গেজেটে এই মর্মে বিজ্ঞাপন দেন যে, এইসব পদ হিন্দু ভিন্ন আর কাউকে দেওয়া হবে না। মোটের উপর মুসলমানদের এখন এমন দুর্গতি হয়েছে যে, সরকারী চাকরির যোগ্যতা তাদের লাভ হলেও সরকারী ইস্তাহার সহযোগে ইচ্ছা করে তাঁদের দূরে রাখা হয়। কেউ তাঁদের অসহায় অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করে না। তাঁরা যে আছে এই কথাটাও উচ্চতর রাজকর্মচারীদের মনে স্থান পায় না।”

বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদ ডক্টর আনিসুজ্জামান ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মন-মানসিকতার যে বর্ণনা দান করেছেন এখানে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

“এই হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী চেতনা সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র ও ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের রচনায়। সামাজিক ক্ষেত্রে দয়ানন্দ সরস্বতী, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মান্দোলনের ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধর্মকেন্দ্রিক স্বাতন্ত্র্যবোধ ও উচ্চমন্যতাকেই তখন সকলে মনে করতেন জাতীয়তাবাদী চেতনা বলে। জাতীয়তাবাদ আর হিন্দু জাগরণবাদ যে সমার্থক হয়ে উঠল, এটাই হল সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার। এর আরেকটি অভিব্যক্তি দেখা যায় হিন্দুমেলার মধ্যে। রাজনারায়ণ বসু, নবগোপাল মিত্র এবং ঠাকুর বাড়ীর দ্বিজেন্দ্রনাথ, গনেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমুখের উৎসাহে ১৮৬৭ সালে এর প্রতিষ্ঠা হয়। “যাহাতে আত্মনির্ভরতা ভারতবর্ষে স্থাপিত হয়, ভারতবর্ষে বদ্ধমূল হয়, তাহা এই মেলার উদ্দেশ্য;” কিন্তু এই আত্মনির্ভর ভারতবর্ষে অহিন্দু জনসংখ্যার কথা কেউ ভাবলেন না। জাতি ও হিন্দু কথাটা সমার্থক হয়ে দাঁড়াবার ফলে হিন্দু ও মুসলমানের স্বতন্ত্র জাতিত্বের একটি মূলসূত্র প্রতিষ্ঠিত হল। স্যার সৈয়দের আলীগড় আন্দোলনও মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যের উপরে জোর দিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমানের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধে প্রথম সংঘর্ষ বাঁধল ১৮৮২তে যখন দয়ানন্দ সরস্বতী গোহত্যানিবারণী আন্দোলন শুরু করলেন এবং ১৮৯৫তে যখন বাল গংগাধর তিলক শিবাজী উৎসবের প্রবর্তনা দিলেন।” (মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য : লেখক সংঘ প্রকাশনীঃ ঢাকা ১৯৬৪)।

তা’হলে বলতে হয়, কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত এবং বুর্জোয়া শ্ৰেণী গঠনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হচ্ছে নিম্নরূপ :

ক) পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) ও যুদ্ধোত্তরকালে পরাশক্তি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন।

খ) ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এজেন্ট ও বেনিয়ান হিসেবে বিপুল পরিমাণে সম্পদ সংগ্রহ।

গ) পাঁচ-সালা, দশ-সালা এবং সবশেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩ খ্রীঃ) বদৌলতে ‘কর্ণওয়ালিশ মার্কা’ নব্য জমিদারে পরিণত হওয়ার সুযোগ গ্রহণ।

ঘ) প্রথম সুযোগেই ইংরেজী ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সাদরে গ্রহণ এবং ‘বাংলার রেনেসাঁ’ শ্লোগান উচ্চারণ করে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের বশ্যতা স্বীকার ও সার্থকভাবে সম্পূরক ও সহযোগীর ভূমিকা পালন।

ঙ) হেনরী লুইস ডিরোজিও-র (১৮০৯-৩১) ইয়ং বেঙ্গল, রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) সমাজ সংস্কার এবং রাধাকান্ত-ভূদেব রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে বাঙালি বর্ণ হিন্দু সমাজের ভিত্তি সুদৃঢ়, করা।

চ) ইংরেজ স্বার্থের পরিপন্থী প্রতিটি কৃষক বিদ্রোহ ছাড়াও সিপাহী বিপ্লবের (১৮৫৭) সময়কালে সক্রিয়ভাবে বিরোধিতার ভূমিকা পালন

ছ) বেঙ্গল ল্যাণ্ড লর্ডস এসোসিয়েশন (১৮৫৩), হিন্দু মেলা (১৮৬৭), ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন (১৮৭৬) এবং মারাঠা ও গুজরাটি উঠতি শিল্পপতিদের যোগসাজশে এবং ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৮৫ সালে বোম্বাই নগরীতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা। এবং সবশেষে

জ) সর্ব ভারতীয় ভিত্তিতে ‘হিন্দু রিভাইভালিজম’-এর সন্ধানে জেমস টড-এর (১৭৫২-১৮৩৫) এ্যানালস এ্যাণ্ড এ্যান্টিকস অব রাজস্থান’-এর ভিত্তিতে রাজপুতদের মহিমা কীর্তন এবং একই উদ্দেশ্যে কট্টর রক্ষণশীল বাল গংগাধর তিলক-এর আহবানে কোলকাতায় ১৮৯৫ সাল নাগাদ মারাঠা শাসক শিবাজী পূজার প্রবর্তন।

ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে মুসলমানদের সহযোগিতা শুরুর ইতিহাস

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে সিপাহী বিপ্লবের পরিসমাপ্তিতে দিল্লী ও আলীগড় অঞ্চলে স্যার সৈয়দ আহমদ খান-এর (১৮১৭-১৮৯৮ খ্রীঃ) কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি লাভ করে। শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও স্যার সৈয়দ-এর বক্তব্য হচ্ছে, শাসক শ্রেণীর সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোক লাভ এবং দেশের শাসন ব্যবস্থায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এক্ষণে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

এদেশে ইংরেজদের শাসনভার গ্রহণ করার প্রায় একশত বছর পরে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে এই সর্বপ্রথম মুসলমান সম্প্রদায় বিদেশী শাসন-এর বাস্তবতাকে স্বীকার করতে শুরু করলো। ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দে যখন ধর্মীয় ওহাবী আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে, ঠিক তখনই দিল্লী এলাকায় স্যার সৈয়দ আহমদ এবং প্রায় একই সময়ে বংগীয় এলাকায় খান বাহাদুর মওলবী আবদুল লতিফ খান এবং সৈয়দ আমীর আলীর মতো উদারমনা সংস্কারপন্থীদের আবির্ভাব হলো।

গবেষক ডঃ আনিসুজ্জামানের মতে, “তবে অনতিবিলম্বে বাঙালি মুসলমানও নবোৎসাহে আধুনিক জগতের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। হিন্দু সমাজের চেয়ে একটু পরবর্তী সময়ে হলেও, একই পথ ধরে সামাজিক অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ গঠনের চেষ্টায় তাঁরাও আত্মনিয়োগ করেছিলেন।”

এর বিস্তারিত ব্যাখ্যাদানের প্রাক্কালে ১৮৬৬ সালে নবাব আবদুল লতিফ কর্তৃক কোলকাতায় “মোহামেডান লিটারারী সোসাইটী” স্থাপন এবং এর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে উল্লেখ নিতান্ত অপরিহার্য বলে মনে হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো, ইংরেজ শাসকদের সংগে বাঙালি মুসলমানদের হৃদ্যতা স্থাপন করা

অবস্থাদৃষ্টে একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বাঙালি মুসলমানদের মন থেকে তরীকা-ই মুহম্মদীয়ার অর্থাৎ ওহাবীদের ইংরেজ বিরোধী প্রভাব দূর করার লক্ষ্যে ১৮৭০ সালে কোলকাতায় এই লিটারারী সোসাইটির এক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী। ধর্মীয় বিধানসমূহ আলোচনার পর এ মর্মে সিন্ধান্ত গৃহীত হয় যে, “ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষ হচ্ছে ‘দার-উল-ইসলাম’– ‘দারুল হরব’ নহে এবং এখানে শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ধর্মীয় নির্দেশের পরিপন্থী।” (মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্যঃ পৃষ্ঠা ৮৬)। এ সময় মক্কার হানাফী, শাফায়ী ও মালেকী সম্প্রদায়ের তিনজন মুফতী ভারতবর্ষকে ‘দারউ-উল-ইসলাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৮৭০ সালেই নবাব আমীর হোসেন খান বাহাদুর তাঁর রচিত পুস্তকে এ মর্মে মত প্রকাশ করেন যে, ‘শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জ্বিহাদ অসিদ্ধ।’ এদিকে মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর উল্লেখিত বক্তব্য ১৮৭১ সালে ফতোয়া আকারে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। আবারও বলতে হচ্ছে যে, ১৮৭০-৭১ সাল নাগাদ দ্বিতীয় পর্যায়ে ইংরেজ বিরোধী ওহাবী আন্দোলন সম্পূর্ণ স্তিমিত হয়ে পড়লে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এ মর্মে উপলব্ধি দেখা দেয় যে, উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনকে মেনে নেয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এর প্রবক্তারা হচ্ছেন দিল্লীর স্যার সৈয়দ আহমদ, ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফ, কোলকাতার সৈয়দ আমীর আলী এবং জৌনপুরের মওলানা কেরামত আলী প্রমুখ। কোলকাতা কেন্দ্রিক ‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দুরা যেখানে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে ১৭৫৭ সালের পূর্ব থেকেই নানা অছিলায় ইংরেজদের প্রতি সক্রিয় সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে সম্পূর্ণক শক্তির ভূমিকা পালন করছিলো, সেখানে প্রায় ১১৩ বছর পরে এক শ্রেণীর মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইংরেজ শাসকদের বিরোধিতার পথ পরিহারের জন্য সোচ্চার হলো। এজন্যই কোলকাতায় ১৮৭০ সালে ‘মোহামেডান লিটারেরী সোসাইটী’ স্থাপিত করে সে বছরেই বিশেষ অধিবেশনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, “ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষ হচ্ছে দারুল ইসলাম।” এই অধিবেশনে সুদূর দিল্লী থেকে স্যার সৈয়দ আহমদও যোগ দিয়েছিলেন। এরপরেই প্রচারিত হলো জৌনপুরের মওলানা কেরামত আলীর এতদসম্পর্কিত ঐতিহাসিক ফতোয়া।

স্যার সৈয়দ আহমদের ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ড

কোলকাতা তথা বঙ্গীয় এলাকায় নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনার প্রাক্কালে দিল্লী এলাকায় সমসাময়িককালে স্যার সৈয়দ আহমদের ভূমিকার প্রতি আলোকপাত করা সমীচীন হবে। ১৮১৭ সালের ১৭ই অক্টোবর দিল্লী নগরীতে সৈয়দ আহমদের জন্ম হয়। পিতা সৈয়দ মোহাম্মদ তকী ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-এর (শাসনকাল ১৮৩৭-১৮৫৭) সভাষদ। (উল্লেখ্য যে, সম্রাট আওরংগজেব-এর ১৭০৭ সালে মৃত্যুর পর ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ১৫০ বছরে মোট ১২ জন মোগল সম্রাট দিল্লীর সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়েছিলেন এবং এই দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন ভারতবর্ষে সর্বশেষ মোগল সম্রাট। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব নিশ্চিহ্ন করার পর ইংরেজরা সম্রাট বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে। রেঙ্গুনেই তিনি ইন্তেকাল করেন)। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আহমদ ক্ষয়িষ্ণু মোগলদের সঙ্গে মোটামুটিভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করে দিল্লীতে ইংরেজদের অধীনে ফৌজদারী বিভাগে সেরেস্তার-এর চাকরি গ্রহণ করেন। এরপর চাকরিতে তাঁর পদোন্নতি ঘটে। ১৮৩৯ সালে সৈয়দ আহমদ আগ্রায় কমিশনার অফিসে নায়েব মুশী এবং ১৮৪১ সাল নাগাদ ফতেপুর সিক্রিতে মুন্সেফ-এর পদ লাভ করেন। ১৮৫০ সালে তিনি সাবজজের পদে উন্নতি লাভ করেন। এবং রোহটা নামক স্থানে বদলী হন। ১৮৮৫ সালে তিনি যখন বীজনূর-এর চাকরিরত, তখন সিপাহী বিপ্লবের শুরু হয়ে গেছে। অনেকের মতে এসময় সৈয়দ আহমদ-এর স্থির বিশ্বাস জন্মে যে, দেশীয় সিপাহীদের এই অভ্যুত্থান সফল হবে না এবং এর জের হিসেবে দেশে দুর্যোগ-এর সৃষ্টি হবে। ফলে সৈয়দ আহমদ প্রকাশ্যেই এধরনের বিদ্রোহের বিরোধিতা করেন। আর সিপাহী বিপ্লবের সময় সৈয়দ আহমদের ভূমিকা দারুণভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। আপাতঃদৃষ্টিতে একথা বলা অন্যায় হবে না যে, এসময় কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীরা সামগ্রিকভাবে ও গোষ্ঠীগতভাবে যেরকম ইংরেজদের সক্রিয় সহযোগিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো, দিল্লী এলাকায় সৈয়দ আহমদ-এর এই একমাত্র পরিবার ইংরেজদের সমর্থনে সোচ্চার হয়েছিলো। এর দরুন সৈয়দ আহমদকে দারুণভাবে ‘কাফফারা’ দিতে হয়। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহী সিপাহীগণ কর্তৃক স্বল্প সময়ের জন্য দিল্লী অবরোধকালে সৈয়দ আহমদ-এর চাচা সপুত্র নিহত হন এবং মানসিক দুশ্চিন্তায় মাতার মৃত্যু হয়, কথিত আছে যে, এসময় ইংরেজরা সৈয়দ আহমদের প্রাণ রক্ষার জন্য সামরিক প্রহরার ব্যবস্থা করা ছাড়াও মাসিক ২০০ টাকা অতিরিক্ত ভাতা প্রদান করে।

সৈয়দ আহমদের ভূমিকা সম্পর্কে স্যার জন ষ্ট্রাচীর মন্তব্য হচ্ছেঃ “১৮৫৭ সালে তিনি (সৈয়দ আহমদ) যেভাবে বৃটিশ সরকারের প্রতি সমর্থনে অদম্য সাহসিকতার ও আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছেন, অন্য কারও পক্ষে এর চেয়ে মহৎ প্রমাণ দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি যে নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন, আমার পক্ষে যে ভাষায় তার বর্ণনা দেইনা কেনো তা সঠিক হবে না।”

সৈয়দ আহমদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সিপাহী বিপ্লবের ব্যর্থতার পর থেকেই মুসলমানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হন এবং স্বীয় সম্প্রদায়ের উন্নতির লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৫৮ সালে তিনি “সিপাহী বিদ্রোহের কারণ” এই নামকরণে উর্দু ভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক প্রকাশ করেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, এর দরুন ইংরেজ শাসকদের মুসলিম বিরোধী নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *