স্কুল-কলেজে বিকৃত ইতিহাস পাঠ্য করা হয়েছে
এসবই হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস। কিন্তু পরবর্তীকালে ইংরেজরা ছাড়াও এদেশীয় ইতিহাস রচয়িতারা এসব ঘটনাবলী সযত্নে এড়িয়ে গেছেন এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে কোন জাতীয় অভ্যুত্থান কিংবা ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করেন নাই। এরচেয়ে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক আর কি হতে পারে। অবশ্য সম্প্রতি পশ্চিম বঙ্গের ব্যতিক্রমধর্মী ও মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী গবেষক সুপ্রকাশ রায় ভারতের “কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম” পুস্তকে এ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা যথার্থই বলতে হয়। তিনি লিখেছেন :
“এই বিকৃত ইতিহাস আমাদের দেশের স্কুল-কলেজে অবশ্য পাঠ্য। স্বদেশের ও স্বদেশীদের মিথ্যা পরিচয় লইয়া আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বড় হইয়া উঠে। আমাদের দেশের এই বিকৃতি রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি এড়াইয়া যায় নাই। ভারতবর্ষের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সত্যানুসন্ধান করিতে গিয়া তিনিও এই বিকৃতি লক্ষ্য করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ কবি। তিনি জনসাধারণকে শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিতে দেখেন নাই, দেখিয়াছেন শ্রেণী সমন্বয়ের দৃষ্টিতে। কিন্তু তাঁহার ধারণার জনসাধারণকেও বা তাহাদের কোন পরিচয়ও ভারতবর্ষের কোন লিখিত ইতিহাসে তিনি খুঁজিয়া পান নাই।”
এ প্রসংগে সমাজতন্ত্রী দেশ সোভিয়েট রাশিয়ার স্থপতি ভি, আই লেনিন-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, “যেখানেই জনসাধারণ, সেখানেই রাজনীতির আরম্ভ, আর যেখানে কেবল কয়েক হাজার নয়— লক্ষ লক্ষ কোটি মানুষের বাস, সেখান হইতেই আরম্ভ হয় অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতি।”
এই কথাগুলো স্মরণ রেখে এখন এক্ষণে ইংরেজ আমলের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বংগভংগের (১৯০৫-১৯১১) সম্পর্কে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা অপরিহার্য মনে হয়। এখানে আরও উল্লেখ করতে হয় যে, ভি, আই লেলিন সগর্বে যে আপামর জনসাধারণের কথা বলেছেন, ইংরেজ আমলে বংগীয় এলাকায় সেই জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হচ্ছে বঞ্চিত ও অবহেলিত বাঙালি মুসলমান এবং অবশিষ্টরা নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়
পাঠকবৃন্দ এখন আমরা উপমহাদেশ তথা বংগীয় এলাকার ইতিহাসের এক ভয়াবহ পরিচ্ছদ-এর আলোচনায় নিমগ্ন হতে চলেছি। সঠিকভাবে এই পরিচ্ছদ-এর সারবত্তা অনুধাবন করতে হলে পরিচ্ছন্ন মন, স্বচ্ছ দৃষ্টিভংগী আর উদার হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে। ইতিহাসের এই পরিচ্ছদই হচ্ছে সবচেয়ে বিতর্কিত বংগভংগ (১৯০৫-১৯১১)। এই সময়কালের কেন্দ্রস্থলে আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত গলিত লাভা এবং চারদিক প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। এই বহ্নিশিখায় লর্ড কার্জনের মতো জাঁদরেল ইংরেজ গভর্ণর জেনারেলের ভবিষ্যৎ ভস্মীভূত হয়েছে আর ঢাকার সন্তান নবাব সলিমুল্লাহ মনঃকষ্টে মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যদিকে ইংরেজ ভারতে বাঙালি বর্ণহিন্দুদের একচেটিয়া আধিপত্য বিনষ্টের লক্ষ্যে ১৫৪ বছর পর রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং বাঙালি বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কৈশোর অতিক্রম করে ‘মুসলিম লীগ’ নামীয় একটি রাজনৈতিক প্লাটফরমের সুবিধায় গোষ্ঠীস্বার্থে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। সর্বোপরি সামগ্রিকভাবে কোন গোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত লাভবান হলো সেটাই বিচার্য বিষয়।
তাহলে এক্ষেত্রে বিতর্কিত ‘বংগভংগ’ সম্পর্কে আলোচনার গভীরে প্রবেশ করার প্রাক্কালে এর ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপট উপস্থাপনা করা সমীচীন মনে হয়। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে যখন কোলকাতা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর এলাকা ছিলো ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৮৬ বর্গমাইল (সূত্র এম কে ইউ মোল্লা : নিউ প্রভিন্স অব ইস্টার্ণ বেঙ্গল এ্যাণ্ড আসাম : পূঃ ১৫) অর্থাৎ আসাম; পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার এবং ছোট নাগপুর এলাকা এই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। আগেই উল্লেখ করেছি যে, প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর আসামকে পৃথক করে একজন চীফ কমিশনারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। অবশ্য এই চীফ কমিশনারও কার্যতঃ বেঙ্গল-এর লেঃ গভর্ণরের অধীনে ছিলেন এবং আসামের জন্য কোন আলাদা সার্ভিস করা হয়নি। এ সময় আসামের ৪১,৭৯৮ বর্গমাইল এলাকা পৃথক করা সত্ত্বেও বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার বর্গমাইল এলাকা এবং লোকসংখ্যা ৭ কোটি ৮০ লাখ। বঙ্গভঙ্গের প্রকৃত ইতিহাসের শুরুটা এখান থেকেই।
প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে, ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের জারিকৃত নোটিশে যেটুকু এলাকা পৃথক করে আসাম প্রদেশ গঠন করা হয়েছিলো, তার মধ্যে সিলেট জেলার কোন উল্লেখ ছিলো না। পূর্বেই বলেছি যে, উক্ত বছরের শেষার্ধে অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর অপর এক নোটিশে সিলেট জেলাকে আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উপরন্তু ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দ ‘ নাগাদ লুসাই হিলস এলাকাকে বেংগল থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের কতৃত্বাধীনে দেয়া হয়। এ সময় লুসাই হিলস অঞ্চলে পার্বত্য উপজাতিগুলোর কর্মকাণ্ডে শান্তি ও শৃংখলাজনিত পরিস্থিতির অবনতি হলে দ্রুত সামরিক এ্যাকশন গ্রহণের লক্ষ্যে ইংরেজ শাসকদের এই ব্যবস্থা নিতে হয়। তথাপিও ১৯০৫ সালে বংগভংগের সময় বিরাট বেংগল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর আয়তন দাঁড়িয়েছিলো ১,৮৯,০০০ (এক লক্ষ ঊননব্বই হাজার) বর্গ মাইলের মতো (ম্যাপ দ্রষ্টব্য)।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে যখন বর্মা এবং আসামের চীফ কমিশনারদ্বয় এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সামরিক অভিযানের দৃষ্টিভংগী থেকে লুসাই হিলসকে আসামের অন্তর্ভুককরার সুপারিশ করেছিলো, তখনই এ মর্মে মত প্রকাশ করা হয়েছিলো যে, অবিলম্বে চট্টগ্রাম জেলাকে আসাম প্রদেশের আওতায় দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে। কিন্তু এ সময় চট্টগ্রামে ‘ভূমি সেটেলমেন্ট’-এর কাজ চলছিলো বলে বিষয়টি আপাততঃ ধামাচাপা পড়ে যায়।
প্রথম ১৯ বছরে কংগ্রেসের ৫ জন ইংরেজ সভাপতি
এ কথা আগেই বর্ণিত হয়েছে যে, ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে আসামের তৎকালীন চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড আসামের জন্য পৃথক সার্ভিস চালু করার লক্ষ্যে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার আয়োজন যখন প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছিলেন, ঠিক তখনই কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দুদের সমর্থক স্যার হেনরী কটন নয়া চীফ কমিশনার নিযুক্ত হয়ে তা বানচাল করে দেন। অবশ্য এর পুরস্কার হিসেবে স্যার হেনরী সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করলে ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ইনিই হচ্ছেন কংগ্রেসের জন্মের পর প্রথম ১৯ বছরের পঞ্চম ইংরেজ সভাপতি। অন্যরা ছিলেন জর্জ ইউল (১৮৮৮ খ্রীঃ), স্যার ডব্লিউ ওয়েডারবর্ণে (১৮৮৯ খ্রীঃ), পি চারলু (১৮৯১ খ্রীঃ) এবং আর এ সিয়নী (১৮৯৬ খ্রীঃ)। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখযোগ্য যে, এককালীন বড়লাট লর্ড ডাফরিন-এর পরামর্শক্রমে যে ইংরেজ প্রাক্তন আই সি এস এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্নে এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই ইংরেজ ভদ্রলোকই কিন্তু একনাগাড়ে ২৫ বছরকাল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (১৮৮৫-১৯১০ খ্রীঃ) পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
সে যাই-ই হোক না কেনো বংগ-বিভাগের চিন্তার সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিলো এক্ষণে সে ব্যাপারে আলোকপাত করা অপরিহার্য বলে মনে করি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, আসলে কিন্তু লর্ড কার্জন বংগভংগের চিন্তার উদগাতা ছিলেন না। যে ইংরেজ সিভিলিয়ান কর্মচারীর মাথায় সর্বপ্রথম এই বংগভংগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিলো তাঁর নাম স্যার এ্যানডু হেন্ডারস ফ্রেসার (১৮৪৮-১৯১৯)। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রেসার ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করেন। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত একনাগাড়ে ২৭ বছর মধ্য প্রদেশে চাকরির পর ইনি কিছুদিন কলিকাতাস্থ ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব ছিলেন এবং একই বছর ১৮৯৮ খ্রীষ্টাবেদমধ্য প্রদেশে চীফ কমিশনারের দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে হেন্ডারসন ফ্রেসার তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জনের অধীনে বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর লেফটেনেন্ট গভর্ণর পদে অধিষ্ঠিত হন।
ভারতের বিশিষ্ট ইংরেজী দৈনিক টাইমস অব ইণ্ডিয়া’র অন্যতম সহকারী সম্পাদক (১৯০৭-১৯২২) এবং পরবর্তীতে প্রধান সম্পাদক ল্যোভাট ফ্রেসার তাঁর রচিত “ইন্ডিয়া আন্ডার কার্জন এ্যান্ড আফটার’ গ্রন্থে এ মর্মে তথ্য প্রকাশ করেছেন যে, ১৯০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মধ্য প্রদেশের চীফ কমিশনার হিসেবে স্যার এ্যানডু ফ্রেসার সম্বলপুর জেলার কোর্টের ভাষা ওডিয়ার পরিবর্তে হিন্দী করার অনুমতি চেয়ে গভর্ণর জেনারেল কার্জনের কাছে যে চিঠি লিখেছিলেন সেই চিঠিতে প্রসঙ্গতঃ সুপারিশ করেছিলেন যে, প্রশাসনিক কাজের বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী থেকে উড়িষ্যাকে বিচ্ছিন্ন করে মধ্য প্রদেশের সংগে সংযুক্ত করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে। কিন্তু ভারত সরকারের তৎকালীন কৃষি সচিব বি ফুলার এবং স্বরাষ্ট্র সচিব জে পি হেওয়েট বেংগল প্রেসিডেন্সী থেকে উড়িষ্যাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করে ফাইলে যথাক্রমে ১৯০২ সালের ২৩শে এবং ২৯শে জানুয়ারী স্বহস্তে নোট লিপিবদ্ধ করেন। (কার্জন কালেকশন : খণ্ড ২৪৭)। ল্যোভাট ফ্রেসার আলোচ্য গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন যে, এই গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি নোট সহকারে গভর্ণর জেনারেলের টেবিলে উপস্থাপিত হতে প্রায় ১৪ মাসের প্রয়োজন হওয়ায় লর্ড কার্জন কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। ইতিমধ্যে ইংরেজ ভারতের বেরার অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হলে সব ক’টি ইংরেজ শাসিত প্রদেশের সীমানা পুনঃ নির্ধারণের লক্ষ্যে জরুরী আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। লেখক ও সাংবাদিক লোভাট ফ্রেসারের মতে, এই সম্মেলনে স্যার এ্যানডু ফ্রেসার প্রদেশগুলোর সীমানা পুনঃ নির্ধারণকালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীকে বিভক্ত করার পক্ষে সর্বপ্রথম যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন।
অবস্থাদৃষ্টে একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, লেঃ গভর্ণর ফ্রেসার-এর লিখিত নোট এবং আলোচ্য সম্মেলনে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বক্তব্য গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জনের চিন্তাধারাকে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করে। তিনি ১৯০২ সালের ২৪শে মে তারিখে লণ্ডনে ভারত সচিব লর্ড জর্জ ফ্রান্সিস হ্যামিলটনের (১৮৪৫-১৯২৭) নিকট প্রেরিত প্রতিবেদনে একটা পরিচ্ছন্ন অবয়বে বংগভংগের প্রস্তাব করেন।
১৯০৫ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে পৌরসভার সংখ্যা ছিলো ১৫৮
এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে বেংগল প্রেসিডেন্সীর কোলকাতাস্থ সচিবালয় ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় অবস্থানকারী সরকারী কর্মচারীদের উপর এ সময় কি পরিমাণ কাজের চাপ ছিলো তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সমীচীন মনে হয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ সংস্থা থেকে প্রকাশিত ‘দি নিউ প্রভিন্স অব ইস্টার্ণ বেঙ্গল এ্যাণ্ড আসাম’ গ্রন্থে গবেষক ডঃ এম কে ইউ মোল্লা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র উল্লেখপূর্বক এ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বর্ণনা উপস্থাপনা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, এ সময় বাংলার লেঃ গভর্ণর-এর কাজের দায়িত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, শুধু ১৯০২ সালেই কোলকাতাস্থ রাইটার্স বিল্ডিং-এর সচিবালয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক চিঠিপত্র রিসিভ এবং ইস্যু করার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো ১,৫৩,০১২টি (এক লক্ষ তিপান্ন হাজার বারো)। ১৯০৫ সালে যখন ইংরেজশাসিত মাদ্রাজ প্রদেশে ৬১টি পৌরসভা, ছিলো, তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে পৌরসভার সংখ্যা হচ্ছে ১৫৮টি। উপরন্তু এসময় নানা সমস্যায় জর্জরিত ও ক্রমবর্ধমান কোলকাতা নগরীর (সমগ্র বৃটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী) লোকসংখ্যা ১১ লাখ পেরিয়ে গেছে। যথেষ্ট পরিমাণে স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা না থাকায় কোলকাতাসহ ১৫৮টি পৌরসভার সমস্ত প্রশাসনিক দায়িত্বও বেংগলের লেঃ গভর্ণর-এর উপরেই অর্পিত ছিলো। এছাড়া এই লেঃ গভর্ণর বছরে যে ক’দিন কোলকাতায় অবস্থান করতেন, সেই দিন ক’টি অফিসের শতশত ফাইল দেখে সিদ্ধান্ত প্ৰদান ছাড়াও বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর সংগে সাক্ষাৎদান এবং বহু সরকারী ও বেসরকারী অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হতো। এলাকার বিরাটত্ব ছাড়াও এসময় (১৯০৩ খ্রীঃ) ইংরেজশাসিত ৩টি বড় প্রদেশের মধ্যে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর লোকসংখ্যাও ছিলো অত্যধিক। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের লক্ষ্যে প্রদেশ ৩টির লোকসংখ্যা প্রদত্ত হলোঃ
মাদ্রাজ : সাড়ে ৪২ মিলিয়ন ইউপিঃ সাড়ে ৪৮ মিলিয়ন বেংগল : সাড়ে ৭৮ মিলিয়ন। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মধ্য প্রদেশের চীফ কমিশনার হিসেবে স্যার এ্যানডু ফ্রেসার ১৯০১ সালে কোলকাতায় প্রেরিত এক চিঠিতে প্রসংগত বংগবিভাগের যে সুপারিশ সর্বপ্রথম উপস্থাপন করেছিলেন এবং গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন ১৯০২ সালের ২৪শে মে তারিখে লণ্ডনে ভারত সচিব লর্ড হ্যামিলটনের কাছে প্রশাসনিক কাজের বৃহত্তর স্বার্থে বংগভংগের যৌক্তিকতা প্রদর্শনপূর্বক যে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন তারই জের ধরে ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব হার্বার্ট রিসলে ১৯০৩ সালের ৩রা ডিসেম্বর তারিখে বেংগল, মাদ্রাজ এবং বোম্বের প্রাদেশিক সরকারগুলোর কাছে সেই বিখ্যাত পত্র নং-৩৬৭৮ পাঠালেন। এই পত্রেই ইংরেজ শাসিত প্রদেশগুলোর সীমানা পুনঃনির্ধারণ ছাড়াও আনুষ্ঠানিকভাবে বংগভংগের কথা বলা হলো। আলোচ্য পত্রে সামগ্রিক বিষয়ের প্রেক্ষিতে বর্ণনা করা ছাড়াও প্রস্তাবিত বংগভংগের চিত্রও উপস্থাপিত করা হয়। স্বরাষ্ট্র সচিব হার্বার্ট রিসলের স্বাক্ষরিত এই পত্রে সে আমলের চমৎকার তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি লিখেছেন যে, এক্ষণে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যখন বেংগলের লেঃ গভর্ণর প্রায় সমস্ত বছর ধরে সফর করলেও নিজের এলাকার একাংশের বেশী পরিদর্শনে সক্ষম হবেন না। বেংগলের লেঃ গভর্ণর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও পাঁচ বছর মেয়াদী সময়কালের মধ্যে তাঁর পক্ষে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কটক, রাঁচী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একবারের বেশী সফর অস্মভব বলা যায়। পত্রে যেসব বিষয়ের অবতারণা করা হয় সেগুলো হচ্ছেঃ
(ক) মাদ্রাজের ওড়িষ্যা-ভাষী এলাকা বাংলার সংগে সংযুক্ত করা হবে।
(খ) ছোট-নাগপুরের বিরাট অংশ বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে মধ্য প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
(গ) চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগ এবং পার্বত্য ত্রিপুরাকে আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ফলে বেংগল প্রেসিডেন্সীর লোকসংখ্যা সাড়ে ৭৮ মিলিয়ন থেকে সাড়ে ৬০ মিলিয়নে হ্ৰাস পাবে এবং বেংগলের ২৪,৮৮৪ বর্গমাইল এলাকা আসাম প্রদেশের আওতাভুক্ত হবে। উপরন্তু প্রায় ৩১ মিলিয়ন জনসংখ্যা সম্বলিত সম্প্রসারিত আসাম প্রদেশ চট্টগ্রামের মতো একটি বন্দরের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারবে এবং আসামের প্রশাসনের জন্য একটি পৃথক সার্ভিস চালু করা সম্ভব হবে।
ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী কিন্তু বংগভংগের প্রস্তাব কার্যকরী করার আগেই কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু জমিদার, বুদ্বিজীবী এবং মধ্যশ্রেণীর মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিলো। পশ্চিম বঙ্গের গবেষক সুমিত সরকার ১৯৭৩ সালে ‘দি স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেংগল (১৯০৩-১৯০৮)’ নামক তাঁর রচিত গ্রন্থে এ সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সে আমলে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব রিজনে কোলকাতার বর্ণহিন্দুদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত ১৯০৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী যে প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন তার অংশবিশেষ নিম্নরূপ :
,”বিক্রমপুরের ‘বাবুগণ’ এই ভেবে সন্ত্রস্ত হবেন যে অধঃস্তন সরকারী চাকুরীতে তাঁদের এতদিনকার আধিপত্য বুঝি বিলুপ্ত হলো, প্রস্তাবিত ভাগরেখার দু’পারেই যেসব জমিদারের ভূসম্পত্তি আছে তাঁদের দু’সেট করে প্রতিনিধি ও উকিল নিয়োগ করতে হবে, ভাগ্যকুলের রায়েরা— কোলকাতার হাটখোলাকে কেন্দ্র করে যাঁদের কাঁচা পাট ও চালের বিরাট ব্যবসা- ভীত হয়েছে এজন্য যে, চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি বিকল্প বাণিজ্যপথ খোলা হবে; কোলকাতার আইন ব্যবসায়ীদের ভয় শেষ পর্যন্ত কোলকাতা হাইকোর্টের এক্তিয়ার অনেকটা
হ্রাসপ্রাপ্ত হবে; চীফ কমিশনার শাসিত প্রদেশে (পূর্ববংগ ও আসাম) অবস্থান করতে হলে পূর্ব বাংলার রাজনীতিবিদগণ ব্যবস্থাপক সভায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন; আর কংগ্রেস রাজনীতিতে কোলকাতা এবং বাংলার (বর্ণহিন্দুদের) ক্ষমতা ও আধিপত্য নিশ্চয়ই এক চরম সুপরিকল্পিত আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।”
.
বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে অদ্যাবধি দেশ-বিদেশের গবেষক ও ইতিহাসবিদরা যত মূল্যবান প্রতিবেদন ও গ্রন্থাদি রচনা করেছেন, তাঁরা কিন্তু একটা কথা এক বাক্যে সবাই স্বীকার করেছেন যে, সে আমলে ১৯০৫ সালের প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের জন্য সবচেয়ে বেশী আতংকগ্রস্ত হয়েছিলো, কোলকাতায় বসবাসকারী পূর্ব বঙ্গীয় বর্ণহিন্দু জমিদার গোষ্ঠী। যদিও এঁরা আদতে অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর পদলেহী ছিলেন, তবুও নিজেদের স্বার্থহানির ভয়ে একমাত্র বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারটি এঁরা মেনে নিতে পারেনি। গবেষক ডঃ সুমিত সরকারের মতে এ সময় কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্র নন্দী বাংলার লেঃ গভর্ণর স্যার এ্যানডু হেণ্ডারসন লিথ্ ফ্রেসার-এর (১৮৪৮-১৯১৯) সংগে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেন। তখন বঙ্গভঙ্গের ফলে তাঁর জমিদারীর একাংশ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে এবং অপর অংশ পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। নন্দী মহাশয়ের কণ্ঠে তীব্র অভিমানের সুর। তিনি বললেন, “আমার জমিদারির একাংশের জন্য যদি লেঃ গভর্ণর এবং রাজস্ব দপ্তর ঢাকায় স্থিত থাকে, তাহলে সেখানে আমাকে একদল মুহুরি রাখতে হবে, আবার কলকাতায়ও রাখতে হবে।” (দি স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল পৃঃ ৪২, ১৯৭৩)
এ সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার মার্কসীয় গবেষক এবং রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার-এর (জন্ম ৩রা নভেম্বর ১৯২০) মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “বিচিত্র উপাদান এবং নানাবিধ বৈষয়িক স্বার্থ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে গতি ও শক্তি সঞ্চার করে।…….. জমিদার শ্রেণী— যাদের পুরাতন এবং নতুন উভয় প্রদেশেই জমিদারি ছিল— এই ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন যে, রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থায় তাঁরা এ পর্যন্ত যেভাবে লাভবান হয়ে আসছিলেন বাংলা বিভাগের ফলে তাঁদের আর্থিক ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা! কারণ, আসামে সাময়িক ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারিত হতো এবং ত্রিশ বছর মেয়াদে এর পুনর্বিন্যাস করার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সুতরাং আসামের সঙ্গে পূর্ব বাংলা সংযুক্ত হলে পূর্ব বাংলার জমিদারদের রাজস্ব খাতে আয় হ্রাস নিশ্চিত। অন্যান্য চিন্তার সঙ্গে এইসব ভাবনা যুক্ত হয়ে কোন কোন জমিদারকে, বিশেষ করে ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী এবং গৌরীপুরের ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীকে, স্বদেশী আন্দোলনে অন্তত কিছু সময়ের জন্য অগ্রচারীর ভূমিকা পালনে অনুপ্রাণিত করে; জনশ্রুতি যে, তাঁরা বিপ্লবীদেরও অর্থ সাহায্য করতেন।”
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জমিদারদের চাঁদার তালিকা
১৯০৬ সালের বেঙ্গল পুলিশ রিপোর্ট-এ দেখা যায় যে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য নিম্নোক্ত জমিদাররা বিপুল অর্থ চাঁদা হিসেবে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। এঁরা হচ্ছেন :
১। মহারাজা সূর্যকান্ত : ১০ হাজার টাকা
২। মহারাজা মনীন্দ্ৰ নন্দী : ৫ হাজার টাকা
৩। মহারাজা টি পালিত : ৫ হাজার টাকা
৪। মহারাজা জানকী রায় : ৫ হাজার টাকা
৫। গজেন্দ্রনাথ ঠাকুর : ৫ হাজার টাকা
৬। সন্তোষ ব্রাদার্স : ৩ হাজার টাকা
৭। দিঘাপাতিয়ার মহারাজা : ২.৫ হাজার টাকা
৮। সোবহান চৌধুরী : এক হাজার টাকা
৯। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর : এক হাজার টাকা
১০। নাটোরের মহারাজা : এক হাজার টাকা
গবেষক ডক্টর অরবিন্দ পোদ্দার আরও লিখেছেন, “তার উপর বাংলা বিভক্ত হলে ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের চাকুরীর সম্ভাবনা ও পরিধি সঙ্কুচিত হবে, এইরূপ বাস্তব আশংকায় ও অনেকেই বিচলিত ছিলেন। এ আশংকা আদৌ অমূলক ছিল না। কারণ আইন ব্যবসায় সরকারী চাকুরী, শিক্ষাক্ষেত্রে ইত্যাদি ইতিমধ্যেই জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। পক্ষান্তরে দ্রব্যমূল্য ছিল অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির পথে। সুতরাং বেকারির ভয় বাস্তব।” (রবীন্দ্রনাথ— রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পূঃ ১২১-১২৩। প্রকাশক উচ্চারণ, কোলকাতা ১৯৮২)।
এখানে বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কিত আলোচনার সুবিধার্থে নিম্নেবর্ণিত তারিখ ক’টি স্মরণ রাখা বাঞ্ছনীয় বলে মনে হয়। তারিখ ক’টি হচ্ছেঃ
ক) বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রচার: ৫ই জুলাই, ১৯০৫।
খ) বঙ্গভঙ্গের সরকারী সিদ্ধান্ত ঘোষণাঃ ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯০৫।
গ) আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ : ১৬ অক্টোবর, ১৯০৫।
বাস্তবে কিন্তু ১৯০২ সাল থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী বঙ্গভঙ্গের সপক্ষে যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে প্রকাশ্যেই কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিলো এবং এতদসম্পর্কিত প্রস্তুতি গ্রহণের তথ্যাদি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছিলো।
ফলে আলোচ্য সময়ে একদিকে যেমন গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ সফর করে উন্নত ধরনের প্রশাসনিক সুবিধার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বক্তৃতা করেছিলেন; অন্যদিকে তেমনি কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ আর পূর্ববঙ্গীয় জমিদারগোষ্ঠী ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে লিপ্ত হয়। ১৯০৫ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী লর্ড কার্জন ঢাকায় আয়োজিত এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে বললেন যে, বঙ্গভঙ্গের ফলে নতুন প্রদেশের সৃষ্টি হলে জনসাধারণ ব্যাপক সুবিধা অর্জন করবে। কেননা প্রশাসনের নিকটবর্তী হয়ে জনসাধারণ নিশ্চিতভাবে লাভবান হবে। নয়া প্রদেশের জন্য একজন পৃথক লেঃ গভর্ণর ছাড়াও আলাদা ব্যবস্থাপক পরিষদ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজস্ব কর্তৃত্ব গঠিত হবে। ঢাকায় অবস্থানকালে লর্ড কার্জনের সঙ্গে নবাব সলিমুল্লাহর এক বৈঠক হয়। এই বৈঠকের পর নবাব সলিমুল্লাহ প্রকাশ্যে বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
এর দুইদিন পরে ১৯০৫ সালে ২০শে ফেব্রুয়ারী লর্ড কার্জন ময়মনসিংহের জনসভায় বললেন, “আমি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এ মর্মে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আপনাদের এলাকায় একটি উন্নত ধরনের সরকারী প্রশাসন চালু করাই হচ্ছে এর (বঙ্গভঙ্গের) একমাত্র উদ্দেশ্য। বাংলা তথা সমগ্র বৃটিশ ভারতের জন্য এই ব্যবস্থা হবে সবচেয়ে মঙ্গলজনক।” (‘স্পিচেস্ বাই কার্জন’ ভল্যুম-৩ পৃঃ ২৮৪)।
এখানে একটা বিষয়ের উল্লেখ করতে হয় যে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গভঙ্গের লক্ষ্যে লর্ড কার্জন আনুষ্ঠানিকভাবে যে প্রস্তাব লণ্ডনে পাঠিয়েছিলেন, তাতে কিন্তু পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে প্রস্তাবিত প্রদেশের নাম ছিলো “উত্তর-পূর্ব প্রদেশ।” লণ্ডনে বৃটিশ সরকার কার্জনের প্রস্তাব অনুমোদন করলেও নয়া প্রদেশের নামকরণ অনুমোদন করেনি। তৎকালীন ভারত সচিব বৃটিশ সরকারের অনুমোদন লাভের পর এতদসম্পর্কিত যে অফিসিয়াল তারবার্তা গভর্ণর জেনারেল কার্জনের কাছে পাঠিয়েছিলো, তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ১৯০৫ সালের ১১ই অক্টোবর তারিখে উক্ত তারবার্তায় বলা হয়, “একটি বিষয়ে আমার বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, নয়া প্রদেশের নামকরণে “আসাম” শব্দ না থাকলে আসামের চা শিল্পে লিপ্ত প্রতিনিধিরা যথার্থভাবেই আপত্তি উত্থাপন করবে। কেননা বাজারে ভারতীয় যেসব চা বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে ‘আসাম চা’ হচ্ছে এক নম্বরে। সুতরাং নয়া প্রদেশ গঠনকালে “আসাম” নামটির বিলুপ্তি বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না। এই প্রেক্ষিতে আমার ধারণায় নয়া প্রদেশের নাম “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” হওয়া যথাযথ হবে। (কার্জন কালেকশন, ভল্যুম ১৭৫)
এ ধরনের এক চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ আর পূর্ববঙ্গের জমিদারদের তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ উপেক্ষা করে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’-এর সৃষ্টি হলো। নয়া গভর্ণর হলেন আসামের চীফ কমিশনার স্যার জোসেফ ব্যাম্পফিলডার ফুলার (১৮৫৪-১৯৩৫) এবং রাজধানী স্থাপিত হলো ঢাকা শহরে। এক্ষণে অবিভক্ত বাংলার যে ১৪টি জেলা ও ২টি দেশীয় রাজ্য নয়া প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হলো তা হচ্ছেঃ ১. চট্টগ্রাম, ২. নোয়াখালী, ৩. বাকেরগঞ্জ, ৪. ফরিদপুর, ৫. ত্রিপুরা ৬. ঢাকা, ৭. ময়মনসিংহ, ৮. পাবনা, ৯. বগুড়া, ১০. রাজশাহী, ১১. মালদহ, ১২. দিনাজপুর, ১৩. রংপুর, ১৪. জলপাইগুড়ি, ১৫. কুচবিহার, ১৬. পার্বত্য ত্রিপুরা।
এখানে লক্ষণীয় যে, ১৯০৫ সালে নয়া প্রদেশের সঙ্গে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর সীমান্তবর্তী জেলাগুলো হচ্ছে যথাক্রমে বরিশাল, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, মালদহ, দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ি। অর্থাৎ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে বাকেরগঞ্জ জেলার পশ্চিম সীমা বরাবর মধুমতি নদী দিয়ে উত্তরে গঙ্গা নদীর সংযোগ দিয়ে সাহেবগঞ্জ পর্যন্ত এবং এরপর মালদহ, দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ির পশ্চিম সীমানা দিয়ে হিমালয়ের পাদদেশে ভূটান পর্যন্ত। উল্লেখ্য যে, মালদহ থেকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের সীমানা এমনভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে কোন হিন্দী ভাষাভাষী এলাকা নয়া প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত না হয় (ম্যাপ দ্রষ্টব্য)। ফলে চা ও পাট ছাড়াও বন ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধশালী এই নয়া প্রদেশের আয়তন হলো ১,০৬,৫৪০ বর্গ মাইল এবং লোকসংখ্যা দাঁড়ালো তিন কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে এক কোটি ১৮ লাখ মুসলমান, এক কোটি ১২ লাখ হিন্দু আর অবশিষ্টরা বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও অন্যান্য ধৰ্মীয়।
.
১,৪১,০০০ বর্গমাইল এলাকা পেয়েও ওরা সন্তুষ্ট হলো না
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হওয়া সম্পর্কিত ইতিহাসটুকু যত সহজে বর্ণনা করলাম, আসলে কিন্তু মোটেই ততটা সহজ নয়। দেড় শতাধিক বছর ধরে যে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালীরা ইংরেজ শাসকদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে সক্রিয় সমর্থন প্রদান করে উপমহাদেশে সর্বাগ্রে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে একটা পরিপক্ক সম্পূরক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিলো, তারা কিন্তু স্বীয় স্বার্থে সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে বংগভংগ প্রতিরোধের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। বংগভংগ সম্পর্কে প্রাক্তন আই সি এস এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বলেন, “গোপনে এই (বঙ্গভঙ্গের) চিন্তার সূত্রপাত, গোপনে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে আর গোপনেই এর চূড়ান্তকরণ হয়েছে।” কংগ্রেসের এককালীন সভাপতি ময়মনসিংহের সন্তান আনন্দ মোহন বসু প্রকাশ্যেই বংগভংগ বানচালের শপথ ঘোষণা করলেন।
এ সম্পর্কে পরবর্তীতে বিস্তারিত তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপনা নিতান্ত অপরিহার্য মনে হয়। নচেৎ সামগ্রিক বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এর শুরুতে ১৯৮৩ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বাংলাভাষায় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত এবং প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়-এর রচিত আধুনিক ভারত (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া সমীচীন মনে হয়। প্রণব বাবু লিখেছেন, “…… বাঙালি জাতির (বর্ণহিন্দু) মনে তীব্র ক্রোধ ও উত্তেজনা প্রকাশ পেল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার সর্বত্র আন্দোলন প্রসার লাভ করল। ৬ই জুলাই বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় ভুপেন্দ্রনাথ বসু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। সুরেন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘বেংগলী’ পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গকে “এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয়” বলে মন্তব্য করা হয়। ‘হিতবাদী’ পত্রিকা লিখল যে, “গত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙালি জাতি (বর্ণহিন্দু) এই রকম দুর্দিনের সম্মুখীন হয়নি।
অথচ পূর্ববঙ্গ আসামের সংগে যুক্ত হবার পরও তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর আয়তন হচ্ছে এক লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গমাইল আর লোক সংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ। উপরন্তু ইংরেজ ভারতের রাজধানী তখনও কোলকাতাতেই। কিন্তু কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বিত্তশালী জমিদার এবং বুদ্ধিজীবীরা এরপরেও সন্তুষ্ট ছিলো না।
১৯০৫ সালের প্রথমার্ধে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যখন মূলতঃ প্রশাসনিক কারণে বঙ্গভঙ্গের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছিলো তখন কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালী সম্প্রদায় ছাড়াও কোলকাতায় বসবাসকারী পূর্ব বঙ্গের বর্ণহিন্দু জমিদার গোষ্ঠী কিভাবে এর বিরোধিতায় মেতে উঠেছিল, আলোচনার সুবিধার্থে তার আরও কিছু তথ্য এখানে উপস্থাপনা সমীচীন মনে হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, “১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাস পর্যন্ত অন্ততঃ ৩০০০ প্রকাশ্য সভায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান হয় এবং প্রতিটি সভায় অন্ততঃপক্ষে ৫০০ থেকে ৫০,০০০ শ্রোতা উপস্থিত থাকতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য” (প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় কৃত ‘আধুনিক ভারত— পৃঃ ৮৯: কোলকাতা)। তবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এসময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তাতে দু’ধরনের চিন্তার অপূর্ব সংমিশ্রণ হয়েছিলো। এর প্রথমটি হচ্ছে রাজনৈতিক চিন্তাধারা। সে আমলে এই চিন্তার বহিঃপ্রকাশকে বলা হতো “স্বদেশী”। আর দ্বিতীয়টি এদেশীয় উঠতি পুঁজিপতিদের স্বার্থে বিলাতী পণ্য বর্জন। আন্দোলনের এই অংশের নামকরণ হয়েছিলো “বয়কট”।
এসময় ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে আরও উগ্র করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যিনি ‘স্বদেশী’ কর্মসূচীর সংগে বিলাতী পণ্য বর্জন অর্থাৎ ‘বয়কট’ কর্মসূচীর কথা সুস্পষ্ট ভাষায় সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক। তাঁর পুরা নাম কৃষ্ণকুমার মিত্র। ১৯০৫ সালের ১৩ই জুলাই তারিখে কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয় সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে জোরালো ভাষায় এই প্রথমবারের মতো “বয়কট” পরিকল্পনার কথা প্রচার করা হয়। অবিভক্ত বাংলায় বিশেষ করে কোলকাতায় বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে “বয়কট” আদর্শের তাৎক্ষণিক ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। ফলে প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি থেকে শুরু করে মতিলাল ঘোষ, (অমৃতবাজার পত্রিকা), আনন্দমোহন বসু, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, কৃষ্ণকুমার মিত্র, কালী প্রসন্ন বিদ্যাবিশারদ প্রমুখ বহু খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এই আদর্শ প্রচারে অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে মাত্র ৪ দিনের ব্যবধানে ১৯০৫ সালের ১৭ই জুলাই বাগেরহাটে (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত) এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় সর্বপ্রথম বিলাতী পণ্য বর্জন সম্পর্কিত “বয়কট” প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে, “যতদিন পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ রদ না হবে, ততদিন বৃটিশ পণ্য সামগ্রী বর্জন করা হোক।” দ্বিতীয় প্রস্তাবে এ মর্মে দেশবাসীর কাছে আহবান জানানো হয় যে, বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে পরবর্তী ছ’ মাসের জন্য সমস্ত রকমের আনন্দানুষ্ঠান এবং উৎসব ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ বন্ধ করা হোক।
কোলকাতার রিপন কলেজে এ সময় দু’দিনব্যাপী (১৭ই ও ১৮ই জুলাই) ছাত্র-সমাবেশে বঙ্গভঙ্গের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। উত্তেজিত অবস্থায় বক্তারা এই প্রথম বৃটিশ পণ্য পোড়াবার কথাও উচ্চারণ করলেন। এই ছাত্র সমাবেশেই একটি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
১৯০৫ সালের ২০শে জুলাই বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে দিনাজপুরে (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত) এক বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজা নাথ (?)। এই সভায় গৃহীত অতিরিক্ত ২টি প্রস্তাবে বলা হয় যে, আগামী এক বছরকাল জাতীয় শোক পালিত হবে এবং জেলা বোর্ড, ইউনিয়ন বোর্ড ও পৌরসভা থেকে সমস্ত সদস্য পদত্যাগ করবেন।
এ সময় মফঃস্বল এলাকায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কতদূর ছড়িয়ে পড়েছিলো, সে সম্পর্কে গবেষক ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, “তবে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, কলকাতা যখন তপ্ত বাক্য উচ্চারণে ছিল নিবিষ্ট, মফঃস্বল বাংলায় তখন সৃষ্টি হচ্ছিল ইতিহাস। সেখানে, যেমন বরিশালে, কার্জনের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, আয়োজন হয়; শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অযুতকণ্ঠে যুদ্ধ মন্ত্রের মত ‘বন্দেমাতরম’, বিভক্ত বাংলা পুনর্মিলিত না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্পও গ্রহণ করা হয়।” (রবীন্দ্রনাথ/রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পূঃ ১২৫ : উচ্চারণ, কোলকাতা)
পশ্চিম বঙ্গের কংগ্রেসপন্থী গবেষক প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “স্বদেশী আন্দোলন শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে অশ্বিনী কুমার (১৮৫৬-১৯২৩) এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাঁর জনপ্রিয়তার ফলে এই আন্দোলন বরিশাল জেলায় (বর্তমানে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত) যে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছিল সমস্ত বাংলায় আর কোথাও সেই দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। তার প্রতিষ্ঠিত “স্বদেশ বান্ধব সমিতি” ১৫৯টি শাখার মাধ্যমে বরিশাল জেলায় স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন সংঘটিত করে। অশ্বিনীকুমারের প্রচেষ্টায় বরিশালে স্বদেশী আন্দোলন গণভিত্তিক সংগ্রামে পরিণত হয় এবং বরিশাল জেলা স্বদেশী আন্দোলনের দূর্বেদ দূর্গে পরিণত হয়।”
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় বরিশাল এলাকায় অশ্বিনীকুমার দত্তের ভূমিকার বর্ণনাদানকালে সংক্ষেপে হলেও চারণ কবি মুকুন্দ দাস-এর কর্মকাণ্ডের উপস্থাপনা অপরিহার্য মনে হয়। তবে প্রথমেই ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ নং এ্যাক্ট অর্থাৎ পঞ্চ নাটক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আইনের ১২ নং অনুচ্ছেদের কথা বলতে হয়। এই অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপ :
(১২) যে কোন যাত্রাভিনয় অথবা ধর্মীয় উৎসবগুলোকে যাত্রাভিনয়ের অনুরূপ অনুষ্ঠানের উপর অত্র এ্যাক্ট প্রযোজ্য হবে না।
চারণ কবি মুকুন্দ দাসের কর্মকাণ্ড
সত্যিকারভাবে বলতে গেলে এ কথা বলতে হয় যে, আলোচ্য এ্যাক্টের এই অনুচ্ছেদে যাত্রাভিনয়ের জন্য যে রেয়াতের সুবিধা ছিলো, তারই ফলে মুকুন্দ দাসের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছিলো। এর পিতৃদত্ত নাম যজ্ঞেশ্বর দে এবং ডাকনাম ‘যজ্ঞা’। ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী’ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস প্রায়ই অশ্বিনীকুমার দত্তের সফরসঙ্গী ছিলেন এবং ‘স্বদেশী যাত্রার প্রবর্তক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে সনাতন হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি কোলকাতার বসুমতি সাহিত্য মন্দির প্রকাশিত মুকুন্দ দাসের গ্রন্থাবলীতে এমর্মে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “বরিশালের উপকণ্ঠে কালী মন্দিরকে কেন্দ্র করিয়াই তাঁর সকল স্বপ্ন, সকল সাধনা মূর্ত হইয়া উঠিয়াছিল। জাতীয় সংগঠন সফল করিবার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন ‘আনন্দময়ী আশ্রম।’ … …. …. ‘মাতৃপূজা’ তাহার প্রথম প্রকাশ্য যাত্রাভিনয়?” তাঁর অন্যান্য যে সব পালা এ সময় বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো সেগুলো হচ্ছে, ‘ব্রহ্মচারিণী’, ‘কমলোত্র’, ‘পথ’, ‘সমাজ’, ‘সাথী’ প্রভৃতি। প্রতিটি পালার মধ্যে মুকুন্দ দাসের ব্যবহৃত গানগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যে গানটির জন্য তৎকালীন ইংরেজ সরকার ‘মাতৃপূজা’ যাত্রাভিনয় বেআইনী ঘোষণা করে মুকুন্দ দাসকে অভিযুক্ত করেছিলো তার কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপঃ
“মুকুন্দের কথা ধর, এখনো সামলে চল,
সাহেবী চালটি ছাড়, যদি সুখ চাও কপালে।
বন্দে মাতরম বাজাও ডঙ্কা,
জাগুক ভাই সকলে
দেখে মুকুন্দ ডুবে যাক আজ
প্রেমময়ী প্রেম সলিলে।”
বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে আরও যেসব যাত্রাওয়ালা পালা রচনা করেছিলেন তাঁরা সবাই ‘বন্দে মাতরম’-এর জয়গান করা ছাড়াও কট্টর দক্ষিণপন্থী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রশস্তির লক্ষ্যে হিন্দু বীর পূজায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এসব পালাগুলোর নামকরণ থেকেই লেখকদের মনমানসিকতা অনুধাবন করা সম্ভব। এর মধ্যে মথুর সাহার “পদ্মিনী” ও “ভরতপুরের দূর্গাজয়”, ভূষণ দাসের “মাতৃপূজা”, শশী অধিকারীর “প্রতাপাদিত্য”, ভূপেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ““রামলীলাবসান”, “মণিপুরের গৌরব” ও “মনোজয়ের মহামুক্তি” এবং হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের “রণজিত রাজার জীব যজ্ঞ” প্রভৃতি অন্যতম।
সমসাময়িককালে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের রচিত নাটকের বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বেই করেছি। তবুও আলোচনার সুবিধার জন্য এদের চিন্তারাজ্যের হদিস পাওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে অভিনীত নাটকগুলোর গুটিকয়েকের উল্লেখ এখানে সমীচীন মনে হয়।
১৯০২ সাল : নলদময়ন্তী, বিল্বমঙ্গল, অবতার, অর্জুন বিদায়, বিজয় বসন্ত, শিবাজী, রিজিয়া, রাধারাণী, প্রফুল্ল, হারানিধি, ভ্রমর, নন্দ বিদায় এবং লাট গৌরাঙ্গ।
১৯০৩ সাল : সীতার বনবাস, ফণার মণি, অভিমন্যু বধ, রত্নবালা তরুবালা, কপালকুণ্ডলা, সীতাহরণ ও তাজ্জব ব্যাপার, জনা, কৃষ্ণকুমারী, নুরনীহার, প্রতাপাদিত্য, মেবার পতন, রঘুবীর, আলিবাবা, আনন্দমঠ, তারাবাঈ এবং বিল্বমঙ্গল।
১৯০৪ সালঃ বৃন্দাবন বিলাস, জাহানারা, সংসার, সৎ নাম, শ্রী রাধা, বিক্রমাদিত্য, নন্দ বিদায়, লক্ষণ বর্জন, রতনগিরি, চোখের বালি এবং প্রেমের পাথর।
১৯০৫ সালঃ হরগৌরী, বলিদান, সিরাজদ্দৌলা, অদৃষ্ট, শিবরাত্রি, হরিরাজ, শ্রীকৃষ্ণ, পৃথ্বীরাজ, রানা প্রতাপ, বাপ্পারাও, প্রতিফল, ভ্রান্তি, এস যুবরাজ এবং বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ প্রভৃতি।