কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১০

কোলকাতায় যখন শিবাজী উৎসব

এদিকে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের উদ্যোগে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার প্রেক্ষিতে যখন উপমহাদেশে সবচেয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণী এবং পূর্ব বাংলার হিন্দু জমিদার শ্রেণী ‘একচেটিয়া আধিপত্য’ বিনষ্ট হওয়ার আশংকায় ভয়াবহ আন্দোলন-এর পথ বেছে নিলো, তখন সবার অজান্তেই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে মুসলমানরা আরও অধিক পরিমাণে সচেতন হয়ে উঠে।

ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই সব ক’টি ঘটনাই কিন্তু ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ১৯০৬ সালে বৃটিশ পার্লামেন্টের সাধারণ নির্বাচনে উদারপন্থী লিবারেল পার্টির বিজয়ের দরুন লর্ড কার্জনের স্থলে সুদূর কানাডায় অবস্থানকারী লর্ড মিথোকে ভারতের নয়া গভর্ণর হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং ইংরেজ জাতির অন্যতম কৃতী রাজনীতিবিদ গ্ল্যাডস্টোন-এর জীবনীর রচয়িতা জন মরলে ভারত সচিবের দায়িত্বভার লাভ করেন। স্বাভাবিকভাবেই এসময় ইংরেজ শাসকবৃন্দ পুনরায় ‘সামঝোতা’র নীতি গ্রহণ করলে ১৯০৬ সালেই কংগ্রেসের নরমপন্থী মারাঠা নেতা গোখলে এবং মরলে ও মিন্টোর মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকেই কয়েকটি বিষয়ে ভারতীয়দের কনসেশন প্রদান করা ছাড়াও সীমিত আকারে নির্বাচনের মাধ্যমে আইন পরিষদ গঠনের প্রশ্নটি বিশেষ প্রধান্য লাভ করে। অচিরেই এ মর্মে তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, প্রস্তাবিত ৬০ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় পরিষদে নমিনেশন ছাড়া যে ২৭টি আসনে সরাসরি ভোটে সদস্য নির্বাচিত হবেন, সেখানে সার্বজনীন ভোটাধিকার নেই। এর বদলে ভোট নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘সম্পত্তি ভোটাধিকার’ চালু হবে এতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ বেশ আতংকগ্রস্ত হয়ে উঠে। এর কারণটা অত্যন্ত সুস্পষ্ঠ। উপমহাদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ট হওয়া ছাড়াও বিশেষ করে বাংলা বিহার আসাম উড়িষ্যা এলাকায় ভোটাধিকার লাভের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পত্তি না থাকার জের হিসেবে বিপুলসংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার লাভে বঞ্চিত হবে।

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশের মুসলমানদের দাবী-দাওয়া ইংরেজ বড়লাট লর্ড মিন্টোর কাছে পেশ করার লক্ষ্যে আটোয়ার নওয়াব মহসিন উলমুলুক ব্যাপকভাবে এক উদ্যোগ গ্রহণ করে সর্বমোট ৩৬ জন সর্ব ভারতীয় নেতা আগা খানের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধিদলে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে নওয়াব মহসিন-উল্ মুলক, নওয়াব ইমদাদুল মুলক, নওয়াব ভিকার উল্ মুল্ক, হেকিম আজমল খান, স্যার আলি ইমাম, স্যার মোজাম্মেল উল্লাহ খান, স্যার রফিক উদ্দিন আহমদ, স্যার মোহাম্মদ শফি, স্যার আবদুর রহিম, স্যার সলিম উল্লাহ এবং বিচারপতি শাহেদীন প্রমুখ অন্যতম। এটাই ইতিহাসে সিমলা ডেপুটেশন হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে রয়েছে। এই বৈঠকেই বড়লাট লর্ড মিন্টো। নীতিগতভাবে পৃথক নির্বাচনের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং ১৯০৯ সালের গভর্ণমেন্ট অব ইণ্ডিয়া এ্যাক্ট-এ সর্বপ্রথম পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত হয়।

উপরন্তু আলোচ্য ১৯০৬ সালেই নবাব সলিম উল্লাহর আমন্ত্রণক্রমে ঢাকার শাহবাগে বার্ষিক মোহামেডান এ্যাডুকেশন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন চলাকালে নওয়ার ভিকার-উল্ মুল্ক-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক ঘরোয়া বৈঠকে আটোয়ার নওয়াব মহসিন-উল্ মুল্ক এর প্রস্তাবক্রমে জাতীয় কংগ্রেসের মোকাবেলায় সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের জন্ম হয়।

নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্য শ্রেণীর যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো একটা উদার ভাব-ধারার আলোকবর্তিকা নিয়ে, বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে সেই কোলকাতায় ১৯০২ সালে মহা ধূমধামের মধ্যে শুরু হলো ‘শিবাজী উৎসব’ আর ‘গণপতি পূজা’। মনোমোহন গোস্বামীর রচিত “শিবাজী” নাটকের ভূমিকায় লেখা হলো, “মুসলমান অত্যাচারের চিত্র স্থাপন করাও পুস্তক খানির উদ্দেশ্য।” (সূত্র ডঃ প্রভাত গোস্বামী রচিত ‘ঐতিহাসিক বাংলা নাটক)। আর এদিকে ঢাকায় ১৯০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর স্থাপিত হলো মুসলিম লীগ।

তাহলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকের সময়কাল পর্যন্ত বঙ্গীয় এলাকার ৩৫/৪০ বছরের ইতিহাসের বাস্তব অবস্থাটা পর্যালোচনা করলে দু’টো বিষয় বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়। প্রথমতঃ ইংরেজবিরোধী ওহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তিতে ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর ফতোয়া এবং সৈয়দ আমীর আলী ও আবদুল লতিফ প্রমুখের প্রচেষ্টায় বাঙালি মুসলমানরা সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেদের সযত্নে সরিয়ে এনে আন্তরিকভাবে ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যমে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনে সচেষ্ট হয়েছিলো, মাত্র তিন দশক ব্যবধানে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তখন কৈশোর উত্তীর্ণ হতে চলেছে। এরই জের হিসেবে এ সমগ্র মূলতঃ এই নব্যসৃষ্ট গোষ্ঠীকে রক্ষা করা ছাড়াও এর দ্রুত সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কিছুসংখ্যক মুসলিম নবাব নাইটদের সমন্বয়ে গঠিত এঁদের চালিকা শক্তি যে কতিপয় অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ সবের অন্যতম হচ্ছে সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে সর্বত্র মুসলমানদের জন্য পৃথক ‘কোটা’ এবং ‘হিস্যা’ আদায়ের লক্ষ্যে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন করা। এখানে প্রসঙ্গত : একটি কথা বলতে হয় যে, এ ধরনের মনমানসিকতার সৃষ্টি এবং ‘স্ট্রাটেজি’ গ্রহণের পিছনে যথেষ্ট পরিমাণে পরোক্ষ প্রভাবের অবদান বিদ্যমান ছিলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাপ্তি পর্যন্ত সময়কালে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু বিত্তশালী ছাড়াও মধ্যশ্রেণী গঠনের চাঞ্চল্যকর ক্রমবিকাশের ধারা থেকে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এ শিক্ষাই গ্রহণ করেছিলো যে, “শাসক গোষ্ঠীর সম্পূরক ভূমিকায় অবস্থান করে দাবী আদায় করার পদ্ধতিটাই সবচেয়ে নিরাপদজনক।”

এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পশ্চিম বাংলার মার্কসীয় গবেষক বিনয় ঘোষের মূল্যায়ন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, .প্রায় ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষিত মুসলমান এলিট গোষ্ঠীর বিকাশ হয়নি বলা চলে। ব্রিটিশের ক্রমবর্ধমান প্রশাসনযন্ত্রের নানাশ্রেণীর চালক ও কর্মচারী সরবরাহের জন্য যে আধুনিক ইংরেজী শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা হিন্দুরাই বেশী আয়ত্ত করেছিলেন বলে এই স্তরের চাকরিজীবীদের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। ধনিক ও মধ্যবিত্তের স্তরে বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের বিচ্ছেদ তো হয়েছিলই, শিক্ষিত এলিটের স্তরেও হয়েছিল। এই কারণে বাংলাদেশে যে সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ট্রাজিডি ঘটেছে, তাও ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে অস্বীকার করা যায় না। যদি ঐতিহাসিক সত্য, বিকৃত না করে বাংলাদেশ থেকে আধুনিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও ক্রমবিকাশের ইতিবৃত্ত রচনা করতে হয় তাহলে তা মূলতঃ হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিকাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এইভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজ ঊনিশ শতকের শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে, পরবর্তীকালে নতুন উদীয়মান বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত এলিটশ্রেণী স্বভাবতঃই অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে জাতীয় আন্দোলনের ধারার সঙ্গে একাত্মীয়তা স্থাপন করতে পারেননি। তার আগেই উভয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক সামাজিক দূরত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল খণ্ডিত বাংলাদেশ এবং খণ্ডিত ভারত।” (বাংলার নবজাগৃতি পৃঃ ১৫৮-৫৯ ওরিয়েন্ট লংম্যান ১৯৭৯ কলিকাতা)।

আর দ্বিতীয়তঃ আলোচ্য সময়কালে অর্থাৎ ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত সময়ে বঙ্গীয় এলাকায় বিরাজমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং পূর্ণতাপ্রাপ্ত কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণীর মনমানসিকতার প্রতি কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা এক্ষণে অপরিহার্য বলে মনে হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলো অনুধাবনের লক্ষ্যে ইংরেজদের অধীনে ‘বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সী’ (ইংরেজীতে প্রেসিডেন্সী অব ফোর্ট উইলিয়াম ইন বেঙ্গল) নামকরণে কিভাবে বাংলাদেশের আয়তন বৃদ্ধি পেলো এক নজরে তার ধারাবাহিক ইতিহাসটুকুও দেখা দরকার।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক কলিকাতার জমিদার ক্রয় : ১৬৯৮ খ্রীঃ

পলাশীর যুদ্ধজয়ে চব্বিশ পরগণার জমিদারী লাভ : ১৭৫৭ খ্ৰীঃ

মীরকাশেমকে গদিতে বসিয়ে চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর এবং বর্ধমানের জমিদারী লাভ :১৭৬০ খ্রীঃ

বাংলা বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানীর অধিকার অর্জন : ১৭৬৫ খ্রীঃ

বেনারস ও গাজীপুরের সংযুক্তিকরণ : ১৭৭৫ খ্রীঃ

উত্তর প্রদেশের অংশ বিশেষ এবং কটক দখল : ১৮০১-৩ খ্রীঃ

নেপালের গারোয়াল ও কুমাউন এবং নাগপুরের কর্তৃত্ব লাভ : ১৮১৬ খ্রীঃ

মধ্য ভারতের সাগর ও নর্মদা এলাকার সংযুক্তি : ১৮১৬ খ্রীঃ

আরাকান, তেনাসেরিম, আসাম, কাছাড় জয়ন্তিয়া ও মনিপুর দখল : ১৮২৪ খ্রীঃ

ডাচ উপনিবেশ ফলতা, চুঁচুড়া ও কলকাপুর ছাড়াও পূর্ব বঙ্গে ঢাকার শাসনভার গ্রহণ : ১৮২৪ খ্রীঃ

বাংলা থেকে আলাদা করে পৃথক উত্তর পশ্চিম প্ৰদেশ (বর্তমান ইউপি) গঠন : ১৮৩৫ খ্রীঃ

বর্মার উত্তরাঞ্চল ছাড়া অবশিষ্ট বর্মীয় এলাকা দখল এবং কোলকাতা থেকে পেনাং মালাক্কা ও সিংগাপুরের প্রশাসন সম্পর্কিত দায়িত্ব পরিচালনা : ১৮৫২ খ্রীঃ

(সূত্রঃ “দি নিউ প্রভিন্স অব ইষ্টার্ণ বেঙ্গল এ্যাণ্ড আসাম’ : এম কে ইউ মোল্লা

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে আলোচনার সুবিধার্থে আবারও উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে যখন ইংরেজ ভারতের রাজধানী কোলকাতা নগরীতে একটি মনোনীত ব্যবস্থাপক পরিষদ সৃষ্টি করা ছাড়াও হাইকোর্ট স্থাপিত হলো, তখন বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর আয়তন দাঁড়ালো ২,৪৬,৭৮৬ বর্গমাইল (বর্তমান বাংলাদেশের আয়তন ৫৪,১৫০ বর্গমাইল)।

বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের সর্বগ্রাসী রূপের প্রামাণ্য তথ্যাবলী

এক্ষণে অত্যন্ত সহজেই একথাটা অনুধাবন করা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরু থেকেই এই বিশাল ইংরেজ রাজত্বে (মাদ্রাজ ও বোম্বে এলাকা ব্যতীত) এ দেশীয় ভাড়া করা সৈন্য ছাড়াও প্রশাসন, বিচার, শিক্ষা, রাজস্ব আদায়সহ সরকার পরিচালনার জন্য ইংরেজী শিক্ষিত অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত একটা সমার্থক গোষ্ঠীর জরুরী প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। আর এই ভূমিকা সার্থকভাবে পালনের জন্য সে আমলে একচেটিয়াভাবে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, কালক্রমে তাঁরাই হচ্ছে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী সমাজ। এঁদের চরিত্র বোঝার লক্ষ্যে প্রাসংগিক বিধায় এখানে এতদসম্পর্কিত কিছু পরিসংখ্যান উপস্থাপনা বাঞ্ছনীয় হবে।

(ক) ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪০ বছরে ভারতের ইংরেজ শাসিত এলাকায় ইংরেজি শিক্ষার পাঠক্রম সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে এরকম যুবকের সংখ্যা যেখানে ১২০০ জনের মতো, সেখানে শুধুমাত্র বাঙালি বর্ণহিন্দুর সংখ্যা ছিলো ১১৪০ জন।

(খ) ১৮৫৬-৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ সরকারের সরাসরি ব্যবস্থাপনা এবং মঞ্জুরীপ্রাপ্ত ইংলিশ স্কুলগুলোতে অধ্যয়নরত মোট ১৩,৪৮৮ জন ছাত্রের মধ্যে ১২,৪১৮ জনই ছিলো বাঙালি হিন্দু।

(গ) ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে এফ এ পরীক্ষা চালু হবার পরবর্তী ২০ বছরে উত্তীর্ণ ছাত্রের সংখ্যা ৪৭২৪ জনের মধ্যে ৩৮০০ জনের মতো বাঙালি বর্ণহিন্দু। বাকী ৯২৪ জনের মধ্যে রয়েছে বিহার, উড়িষ্যা, বর্মা, ছোট নাগপুর, ও আসামের ছাত্র এবং গুটিকয়েক বাঙালি মুসলমান। (ঘ) ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ২৩ বছরে মোট গ্রাজুয়েট-এর সংখ্যা ১,৭১২ জনের মধ্যে ১,৪৯৪ জনই ছিলো বাঙালি হিন্দু। বাংলা প্রেসিডেন্সীর আওতাধীন অন্যান্য এলাকার গ্রাজুয়েটের সংখ্যা মাত্র ২১৮ জন।

(ঙ) ইংরেজ শাসিত এলাকার ২,৪৬,৭৮৬ বর্গমাইল নিয়ে গঠিত বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর একমাত্র কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে এম এ পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম ২০ বছরে যে ৪২৩ জন ছাত্র উত্তীর্ণ হয়, তার মধ্যে বর্মা, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোট নাগপুরের সংখ্যা মাত্র ৭৯ জন। বাকী ৩৪৪ জনই হচ্ছেন (গুটিকয়েক বাঙালি মুসলমানসহ) বাঙালি হিন্দু।

(চ) ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে যেখানে বিহারের সবগুলো কলেজের মোট ছাত্র সংখ্যা ছিলো মাত্র ২০৫ জন, সেখানে ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দেই শুধুমাত্র কোলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিলো ৫৬১ জন এবং এর শতকরা প্রায় ৯৫ জনই ছিলো বাঙালি হিন্দু।

(ছ) ১৮৯৯-১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে সমগ্র আসামে একটিমাত্র আর্টস কলেজ স্থাপিত হয়েছিলো এবং এ কলেজে মোট ছাত্রসংখ্যা ছিলো মাত্র ৩০ জন। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র আসামে বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষাই শেখানো হতো না।

(জ) উড়িষ্যার কটকে ঊনিশ শতকের ষাটের দশকে রাভেনশ কলেজ স্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে এই কলেজের মোট ছাত্রসংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৯৭ জন এবং এফ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা ৩২ জন। সর্বোপরি ১৯০৫ সালে কটকের রাভেনশ কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ছিলো মাত্র ২ জন।

এখানে প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য সময়কালে সাম্রাজ্যবাদ ইংরেজ-এর সমার্থক শ্রেণী হিসেবে সৃষ্ট কোলকাতা কেন্দ্রিক ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণীর সর্বগ্রাসী চরিত্রের ফলশ্রুতিতে বঙ্গীয় এলাকার নিম্নশ্রেণী হিন্দুরা ছাড়াও বাংলা প্রেসিডেন্সীর ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত বর্মা, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোট নাগপুরের সকল সম্প্রদায়ই চরম বঞ্চনার মধ্যে নিপতিত হয়েছিলো। ১৮৫৬-৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় এদেশীয় উচ্চপদস্থ ৪২৭ জন কর্মচারীর মধ্যে ৩৯০ জনই ছিলেন বাঙালি বর্ণহিন্দু। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ডঃ পুলিন দাস যথার্থই লিখেছেন, “১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহের দিনগুলিতে এঁদের (বাঙালি বর্ণহিন্দু) অনেকে তাঁদের বাড়িতে নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করেছেন।” (বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক’কলিকাতা ১৩৯০)।

এই-ই যখন বাস্তব অবস্থা, তখন একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আসলে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দ নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে এতোই নিমগ্ন ছিলেন যে, এঁরা বঙ্গীয় এলাকার মুসলমানদের কোন হিসাবের মধ্যে নেয়া তো দূরের কথা, এঁদের অগ্রগতির পথে প্রায়শঃই বাধার সৃষ্টি করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডঃ এ আর মল্লিকের প্রদত্ত তথ্যের উল্লেখ করতে হয়। তিনি লিখেছেন, ১৮৫৫ এবং ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে পণ্ডিত ঈশ্বচন্দ্র শর্মার অধীনে কোলকাতা ও হুগলীতে স্থাপিত দু’টি সরকারী মঞ্জুরীপ্রাপ্ত স্কুলে একজনও বাঙালি মুসলমান ছাত্র ভর্তি হতে সক্ষম হয়নি। কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে ভর্তির জন্য নির্দিষ্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের যে ৩টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হতো তা হচ্ছে (১) সীতাবৌদ্ধ শকুন্তলা, (২) বেতালপঞ্চ বিংশতি এবং (৩) সংস্কৃত ব্যাকরণ উপক্রমনিকা। ফলে সরকারী মঞ্জুরীপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আলোচ্য স্কুল দু’টিতে স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি মুসলমান ছাত্রদের জন্য দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।

অথচ ক্ষণিকের তরে এসব বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দ চিন্তাও করে দেখলেন না যে, এই শোষিত বাঙালি মুসলমানরাই হচ্ছে সুজলা-সুফলা বঙ্গীয় এলাকায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। শুধু তাই-ই নয়, আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে একটা সুষ্ঠু ও পরিচ্ছদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে হলে এতদঅঞ্চলে বসবাসকারী হিন্দু, মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কেবলমাত্র তা সম্ভব। কিন্তু সেদিন সমগ্র ইংরেজ ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষায় সবচেয়ে আগুয়ান কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সম্মুখপানে ধাবিত ইতিহাসের রথচক্রকে বিপথগামী করতে প্রচেষ্ট হলেন। তাঁরা বাঙালি বৰ্ণহিন্দুকেই “বাঙালি” হিসেবে চিহ্নিত করে ‘হিন্দু রিভাইভালিজম’-এর জন্য সোচ্চার হয়ে সর্বভারতীয় নেতৃত্ব গ্রহণের স্বপ্নে ‘পথভ্রষ্ট’ হলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, এরই জের হিসেবে আমরা দেখতে পাই যে, ১৯০২ সাল নাগাদ কোলকাতায় ‘শিবাজী উৎসব’ আর ‘গণপতি পূজা’ শুরু হয়ে গেছে। কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী মহল রামমোহন ডি রোজারিও বিদ্যাসাগর মধুসূদনের সংস্কারপন্থী ও উদারমনা পরিমণ্ডলের বাইরে এসে বঙ্কিম-বিবেকানন্দের প্রবর্তিত ‘হিন্দু বাহুবল’-এর আবর্তে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে।

স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের আগোচরে এসব চাঞ্চল্যকর ‘ক্রিয়ার’ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো বাঙালি মুসলমান সমাজে। অত্র পরিচ্ছদের শুরুতেই এই প্রতিক্রিয়াকেই ‘পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আবারও উল্লেখ করতে হয় যে, এই পরোক্ষ প্রভাবের শিক্ষাই হচ্ছে, “শাসকগোষ্ঠীর সম্পূরক ভূমিকায় অবস্থান করে দাবী আদায় করার পদ্ধতিটাই সবচেয়ে নিরাপদজনক।” ১৯০৬ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম নেতৃবৃন্দ তথা মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দর্শনের পর্যালোচনা করলে এই বক্তব্য প্রমাণিত হয়। শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ‘কোটা’ ও ‘হিস্যার’ রাজনীতির চরম পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই যে, ইতিহাসের তাগিদে এই উপমহাদেশে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট “পাকিস্তান” নামে একটা পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। আবার মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে ঐতিহাসিক কারণেই একটা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, ইংরেজদের ছত্রচ্ছায়ায় লালিত-পালিত এবং বঙ্কিম-বিবেকানন্দের সেই কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কিন্তু আজ ভারতবর্ষের বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে হারিয়ে যেতে চলেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সবার অলক্ষ্যে এর প্রক্রিয়া শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে।

একথাটা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, উপমহাদেশের গত এক শতাব্দীর ইতিহাসে তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এগুলো হচ্ছে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের ফল হিসেবে পাকিস্তানের সৃষ্টি এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এক্ষণে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের মতো ‘নাজুক’ বিষয়টি নিয়ে আলোচার প্রাক্কালে তৎকালীন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাধারা ও কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। আগেই উল্লেখ করেছি যে, ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে যধন প্রশাসনের সুবিধার জন্য রাজধানী কোলকাতায় একটি মনোনীত ব্যবস্থাপক পরিষদ গঠন করা হয়, তখনই বিশাল বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর আয়তন ছিলো ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৬ বর্গমাইলের মতো। অবশ্য এরও প্রায় বছর দশেক আগে ইংরেজ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় অবস্থানকারী গভর্ণর জেনারেল-এর কাজের অস্বাভাবিক চাপ হ্রাসের লক্ষ্যে ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে স্থায়ীভাবে একটি লেফটেন্যান্ট গভর্ণর-এর পদ সৃষ্টি করা হয় এবং মিঃ জে এফ হ্যালি ডে ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে এপ্রিল বাংলার প্রথম লেঃ গভর্ণর পদে যোগদান করেন। তখন গভর্ণর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন লর্ড ডালহৌসী।

কিন্তু ১৯৬৫-৬৬ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে উড়িষ্যার ৬টি জেলা বিহারের অংশবিশেষ এবং উত্তরবঙ্গ এলাকায় প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার লোকের মৃত্যু হলে বঙ্গীয় এলাকায় প্রশাসনিক দুর্বলতার বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। তৎকালীন লেঃ গভর্ণর স্যার সি বেডন বিলাতে এ মর্মে কৈফিয়ত পাঠান যে, যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বল্পতাহেতু তাঁকে পরিসিতি সম্পর্কে সময়মত ও যথাযথভাবে ওয়াকেফহাল করা হয়নি এবং তাঁর মনে এ ধরনের ধারণা হয়েছিলো যে, অবস্থা ততটা উদ্বেগজনক নয়। বৃটিশ পার্লামেন্টের রক্ষণশীল দলীয় সদস্য এবং ভারত সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড নট কোট-এর হস্তক্ষেপের ফলে বাংলার লেঃ গভর্ণর স্যার সি বেডন এ যাত্রায় রক্ষা পান। কিন্তু এ সময় থেকেই মাদ্রাজ ও বোম্বের মতো বঙ্গীয় এলাকার জন্যও একজন ক্ষমতাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ গভর্ণর-এর প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই প্রস্তাবের সমর্থকরা ইংল্যাণ্ডে এ মর্মে বক্তব্য উত্থাপন করেন যে, ইংরেজ ভারতের গভর্ণর জেনারেল-এর অফিস কোলকাতায় অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও দেশরক্ষায় সামরিক অভিযান এবং কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাকার বিষয় সংক্রান্ত অস্বাভাবিক ধরনের কাজের চাপ থাকায় গভর্ণর জেনারেলের পক্ষে বাংলা প্রেসিডেন্সীর প্রশাসনিক বিষয়ে ত্বরিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান সম্ভব নয় বলেই অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন একজন পূর্ণাঙ্গ গভর্ণর নিয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

এ সময় ভাইসরয়-এর কাউন্সিলের তিনজন সদস্য যথাক্রমে এইচ মেইন (১৮৬২-৬৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আইন বিষয়ক সদস্য), ডব্লুউ আর ম্যানসফিল্ড (কমাণ্ডার-ইন-চীফ) এবং জি এন টেলর বাংলা প্রেসিডেন্সীর জন্য একটি কাউন্সিলসহ একজন পৃথক গভর্ণর নিয়োগের যৌক্তিকতা প্রদান করেন। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল জন লরেস এ প্রসঙ্গে দ্বিমত প্রদর্শন করেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, যদি বাংলা প্রেসিডেন্সীর জন্য পৃথক গভর্ণর নিয়োগ করতেই হয়, তবে তা কোন কাউন্সিল ব্যতিরেকে করা বাঞ্ছনীয় হবে। অন্যথায় আসাম এলাকাকে বাংলা থেকে পৃথক করে একজন চীফ কমিশনারের অধীনে ন্যস্ত করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে। (সূত্রঃ গভর্ণর জেনারেল্স মিনিট, ১৯শে ফেব্রুয়ারী ১৮৬৮ খ্রীঃ)। ভারত-সচিব স্যার স্টাফোর্ড নর্থকোট শেষ পর্যন্ত গভর্ণর জেনারেল-এর এই বক্তব্য গ্রহণ করেন।

কিন্তু ১৮৬৭-৬৮ থেকে শুরু করে ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী বছরগুলোতে আসাম অঞ্চলে অনুষ্ঠিত কতকগুলো ঘটনাপ্রবাহ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে বেশ বিব্রত করে তোলে। পুনরুল্লেখ পূর্বক বলতে হয় যে, ১৮৬৭-৬৮ খ্রীষ্টাব্দে নাগা উপজাতিরা কয়েক দফায় শিবসাগর জেলায় হামলা চালায়। ১৮৭০-৭১ খ্রীষ্টাব্দের শীতকালে নাগা বিদ্রোহীরা ত্রিপুরা রাজার এলাকা ছাড়াও সিলেট জেলায় আক্রমণ পরিচালনা করে। একই বছরে এই বিদ্রোহীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশবিশেষ এবং কাছাড় জেলা লুট করে। এ সময় নাগাদের আক্রমণে আসামের একটি চা বাগান সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং এর ইংরেজ আবাসিক প্লান্টার মিঃ উইনচেসটার নিহত হন। নাগারা নিহত ব্যক্তির অপ্রাপ্ত বয়স্কা কন্যাকে নিয়ে যাওয়া ছাড়াও আরও কয়েকটি চা বাগান ক্ষতিগ্রস্ত করে। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দেও উপজাতীয় বিদ্রোহীরা আসামের দারাং ও উত্তর লক্ষ্মীপুর এলাকায় হামলা চালায়। (দি নিউ প্রভিন্স অব ইষ্টার্ণ বেঙ্গল এ্যাণ্ড আসাম : এম কে ইউ মোল্লাঃ ১৮৮১)।

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে প্রশাসন কার্যের সুবিধার জন্য এবং শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা প্রেসিডেন্সী থেকে মোট ১০টি জেলাকে আলাদা করে একজন চীফ কমিশনারের অধীনে পৃথক আসাম প্রদেশ গঠন করা হয়। জেলাগুলো হচ্ছে, (১) কামরূপ (২) দারাং (৩) নওগাঁ (৪) শিবসাগর (৫) লক্ষ্মীপুর (৬) গারোহিলস (৭) খাসীয়া এ্যাও জয়ন্তিয়া হিলস (৮) নাগা হিলস (৯) কাছাড় এবং (১০) গোয়াল পাড়া। একই বছরের ১২ই সেপ্টেম্বর এক সরকারী নির্দেশে সিলেট জেলাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে এ সময় আসাম প্রদেশের এলাকা দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৭৯৮ বর্গমাইল এবং লোক সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪১ লাখের মতো। অবশ্য ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ লুসাই হিল্সকে আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবুও বলতে হয় যে, বাংলা প্রেসিডেন্সীর আয়তন বিরাটকায় থেকে যায়। পৃথক আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়া সত্ত্বেও ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা প্রেসিডেন্সীর আয়তন ইউরোপের স্পেন দেশের প্রায় সমান ছিলো। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এ সময় এই প্রদেশের আয়তন ১ লাখ ৮৯ হাজার বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৮০ লাখ।

বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সর্বপ্রথম কিভাবে উত্থাপিত হয়েছিলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক এম কে ইউ মোল্লা সম্প্রতি তাঁর রচিত ‘দি নিউ প্রভিন্স অব ইষ্টার্ণ বেঙ্গল এ্যাণ্ড আসাম’ গ্রন্থে আলোচ্য বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত করেছেন। অধ্যাপক মোল্লার মতে ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর আসামের চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড ভারত সরকারের নিকট প্রেরিত পত্রে সর্বপ্রথম আসামের সংগে ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম এলাকাকে সংযুক্তির প্রস্তাব করেন। স্যার উইলিয়াম এ মর্মে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, এর ফলে আসামের জন্য একটি পৃথক সিভিল সার্ভিস গঠন করা ছাড়াও প্রস্তাবিত সম্প্রসারিত প্রদেশ অচিরে খুবই সমৃদ্ধশালী প্রদেশে পরিণত হবে বলা যায়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ ধরনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার আগেই ইংরেজ ভারতের রাজধানী কোলকাতার উচ্চ মহলে এই প্রশ্নে বাদানুবাদ শুরু হয়। ফলে কোলকাতার ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় ১৮৯২ সালের ৯ই এপ্রিল সংখ্যায় এবং ‘ঢাকা গেজেট’ পত্রিকার ১৮ই এপ্রিল (১৮৯২) সংখ্যায় এ মর্মে মন্তব্য প্রকাশ করা হয় যে, বাংলা প্রেসিডেন্সীর আর কোন এলাকাকে পৃথক করার প্রচেষ্টা সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা এর ফলে চট্টগ্রাম এলাকার (ঢাকা ও ময়মনসিংহের প্রশ্ন অজানা ছিলো) ‘জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হবে।’ এই প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, পদচ্যুত প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারী ভারত সরকারের নিকট এক লিখিত প্রতিবাদ দাখিল করেন। তথাপিও আসামের তৎকালীন চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড আলোচ্য প্রস্তাবটি উপস্থাপিত করায় বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বিত্তশালী মহল ও মধ্য শ্রেণীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর পিছনের মূল কারণ একটাই এবং তা’ হচ্ছে এই যে. কোলকাতায় ইংরেজদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে বসবাসকারী বর্ণ হিন্দুদের পূর্ব বঙ্গীয় এলাকায় অবস্থিত জমিদারীর স্বার্থ। এদিকে ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর তারিখে স্যার উইলিয়ামের উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয় যে, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও ঢাকা এলাকা সংযুক্ত করা হলে সম্প্রসারিত আসামের আয়তন ৮০ হাজার ৯৫০ বর্গমাইলে দাঁড়াবে এবং লোক সংখ্যা হবে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৮০ হাজারের মতো।

এ রকম এক সময় ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের শেষ দিকে আসামে নয়া চীফ কমিশনার হিসেবে স্যার হেনরী জন ষ্টেড্‌ম্যান কটনের আগমন হলে পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। গবেষকদের মতে স্যার হেনরী কটন প্রকারান্তরে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু বিত্তশালী ও মধ্য শ্রেণীর মতামত সমর্থন করেন। তিনি আপাতত বিষয়টি স্থগিত রাখার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলে বাংলা প্রেসিডেন্সীর লেফটেন্যান্ট গভর্ণর স্যার আলেকজাণ্ডার ম্যাকেজী এবং গভর্ণর জেনারেল লর্ড ভিক্টর আলেকজাণ্ডার ব্রুস এলগিন একমত হন। ফলে ভাইসরয় লর্ড এলগিন এ ব্যাপারে ইংল্যাণ্ডের রক্ষণশীল ভারত-সচিব লর্ড হ্যামিলটনের নিকট লিখিত পত্রে যে প্রস্তাব দেন তা যথাযথভাবে গৃহীত হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বিত্তশালী ও মধ্যশ্রেণীর প্রিয়ভাজন ইংরেজ ব্যক্তিত্ব স্যার কটন ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে শুরু করে ১৯০২ সাল পর্যন্ত এক নাগাড়ে প্রায় ৬ বছরকাল আসামের চীফ কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং এরপরেই চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। স্যার কটন অবসরপ্রাপ্ত হয়ে কোলকাতাতেই বসবাস করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। আজকের দিনে একথা আশ্চর্যজনক মনে হলেও এটাই হচ্ছে বাস্তব সত্য যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বৰ্ণহিন্দু মহলের সমর্থনে স্যার হেনরী জন ষ্টেডম্যান কটন ১৯০৪ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।

উপমহাদেশের ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে ভারতের গভর্ণর জেনারেল হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন লর্ড কার্জন। এর পুরো নাম জর্জ ন্যাথনিয়াল কার্জন (১৮৫৯-১৯২৫)। অবিভক্ত ভারতের ইংরেজ রাজত্বে নানা কারণে এই নামটি সবচেয়ে বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এ সম্পর্কে ইংরেজ গবেষক পারসিভাল স্পিয়ার-এর মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ‘এ হিষ্ট্রি অব ইণ্ডিয়া-২’ তিনি লিখেছেন, “এরপর এলেন কার্জন। ভিক্টোরিয়ান সাম্রাজ্যবাদের শেষ পর্যায়ের চিন্তাধারার স্পর্শে উজ্জীবিত রোমান্টিক ধর্মী আভিজাত্যমণ্ডিত হয়ে তিনি একজন জুনিয়ার সরকারী কর্মচারী থেকে উন্নতির সোপান অতিক্রম করে মাত্র ৪০ বছর বয়সে এই দায়িত্ব লাভ করলেন। নেপোলিয়নের মতোই তিনি প্রাচ্য দর্শনে চমৎকৃত হয়েছিলেন। তিনি ভবিষ্যতে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনায় ভারতে অবস্থানকালে মধ্যবর্তীকালীন কর্মকাণ্ডকে সফল করার লক্ষ্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ওয়েলেসলী এবং ডালহৌসির মতো ভারত তাঁকে প্রতারিত করলো এবং এখানে তাঁর কর্মজীবনের প্রায় পরিসমাপ্তি হতে চলেছিলো।”

আর এদিকে এ সময় কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বাঙালিদের মধ্যে বিরাজমান মন-মানসিকতা সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট গবেষক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামীর মন্তব্যের উল্লেখ বাঞ্ছনীয় মনে হয়। ‘দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “কিন্তু বিংশশতাব্দীর শুরুতেই বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে নতুন জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটলো। এটা হিন্দু জাতীয়তাবাদ। বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, তিলক প্রভৃতির প্রভাবে এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ এক নতুন রূপ গ্রহণ করলো।”

ভারতের পরবর্তী গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন-এর কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস উপস্থাপনার প্রাক্কালে ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত প্রায় একযুগ সময়কালের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমেই ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে জারিকৃত ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল এ্যাক্ট-এর কথা বলতে হয়। এই আইনে ভারতীয়দের জন্য অত্যন্ত সীমিত আকারে যে রাজনৈতিক অধিকার দেয়া হয়েছিলো, তা ভারতীয় কংগ্রেসের কোন মহলেরই মনঃপুত হয়নি। ফলে একদিকে ইংরেজ সরকার এবং অন্যদিকে বাঙালি ও মহারাষ্ট্রীয় কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের বাদানুবাদ শুরু হয়। এসব নেতৃবৃন্দের মধ্যে কোলকাতার প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী এবং বোম্বের গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ও বাল গঙ্গাধর তিলক অন্যতম ছিলেন। প্রায় ৬ বছর স্থায়ী এই বাদানুবাদের পর ইংরেজরা কেন্দ্র ও প্রদেশে মনোনীত ব্যবস্থাপক পরিষদের ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়। এসবের মধ্যে কেন্দ্রের মনোনীত পরিষদের সদস্যদের বাজেট আলোচনার ক্ষমতা অন্যতম।

এদিকে সমগ্র উপ-মহাদেশে সে আমলে ইংরেজী শিক্ষার সবচেয়ে অগ্রসর কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীব সম্প্রদায় ইংরেজ ভারতের সর্বোচ্চ সিভিল সার্ভিস চাকরিগুলোতে যোগদানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষের উপর মারাত্মক চাপের সৃষ্টি করে। এঁদের পরিষ্কার বক্তব্য হচ্ছে যে, এদেশে ইংরেজদের জন্য যখন নানাভাবে পরীক্ষিত কোলকাতা কেন্দ্রিক শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের মতো সমর্থক ও সম্পূরক শক্তি রয়েছে, তখন আইসিএস পরীক্ষায় বয়ঃসীমা সংক্রান্ত ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দের সিদ্ধান্ত সংশোধনে আপত্তি থাকার কথা নয়। অর্থাৎ আইসিএস পরীক্ষা দেয়ার সর্বোচ্য বয়ঃসীমা ১৯ বৎসর থেকে বৃদ্ধি করতে হবে এবং লণ্ডনের সঙ্গে কোলকাতাতেও আইসিএস পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। যিনি এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী হৈ চৈ-এর সৃষ্টি করলেন, তিনি হচ্ছেন প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী মহোদয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, নানা বাহানা করলেও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী আইসিএস পরীক্ষার সর্বোচ্চ বয়ঃসীমা ক্রমান্বয়ে শিথিল করে। ফলে সর্বোচ্চ বয়ঃসীমা ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে ২১ বৎসর, ১৯০৫ সালে ২৩ বৎসর এবং ১৯০৬ সালে ২৪ বৎসর করা হয়। প্রসঙ্গতঃ একটা বিষয় চাঞ্চল্যকর মনে হলেও উল্লেখ করতে হয় যে, ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পর্যন্ত ৬৯ বছরে ফরিদপুরের একমাত্র মুজিবুর রহমান ছাড়া বাঙালি মুসলমান পরিবারের কোন সন্তান আইসিএস পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে পারেনি। গাইবান্ধার মরহুম নূরুন্নবী চৌধুরী ছিলেন ওয়ার আইসিএস)।

এক্ষণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অর্থাৎ ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯০৫-৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে বঙ্গীয় এলাকার ঘটনা প্রবাহের পাশাপাশি মহারাষ্ট্রের পরিস্থিতির উল্লেখ বিশেষ অপরিহার্য মনে হয় কেননা উপমহাদেশে বঙ্গীয় এলাকায় বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে বিপুল জমিদারী লাভ করার পরবর্তীতে ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যমে অধিকাংশ সরকারী চাকরি করায়ত্ত করার পর আরও সুযোগ-সুবিধার জন্য অভিমান আবদার আন্দোলন করছে, তখন মহারাষ্ট্রে এদেশীয় মালিকানায় বস্ত্র শিল্পের গোড়াপত্তন হয়ে গেছে এবং ইংল্যাণ্ডের ল্যাংকাশায়ার ম্যাঞ্চেষ্টার প্রভৃতি এলাকার কাপড় আমদানীর বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধেছে। এ জন্য দেখা যায় যে, জাতীয় কংগ্রেসের শুরুতে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু আর মারাঠা ব্রাহ্মণদের কর্মকাণ্ডে ভরপুর। পুনরাবৃত্তি হলেও উল্লেখ করতে হয় যে, এ সময় ভারতের রাজনৈতিক গগণে মারাঠা ব্রাহ্মণদের দু’জন বিশিষ্ট নেতার আবির্ভাব ঘটে। এদের একজন হচ্ছেন রামমোহনের অনুসারী গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং অন্যজন বংঙ্কি বিবেকানন্দের চেয়ে কট্টর রক্ষণশীল চিন্তাধারার বাল গঙ্গাধর তিলক। একজনের পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে সংস্কারপন্থী কথাবার্তা এবং অন্যজনের বক্তব্য হচ্ছে, আর আপোষ নয় – বরং কপালে রক্ত তিলক লাগিয়ে হিন্দু ধর্মের মহিমা প্রচার ও হিন্দু রাজত্বের প্রতিষ্ঠা।

বাংলায় মারাঠা বর্গীর হামলার ভয়াবহ ইতিহাস

কিন্তু এ কথা বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এসব কোলকাতা কেন্দ্রিক বণহিন্দু বিত্তশালী আর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মাত্র দেড়শ’ বছর আগের ঘটনাবলী মারাঠা দস্যুদের পশ্চিম বাংলা আক্রমণের কথা হয় বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা শ্রেণী ও গোষ্ঠী স্বার্থে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের সেই করুণ ও ভয়াবহ ইতিহাসের দিকে চক্ষু মুদ্রিত রেখেছিলেন। সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার গবেষক পূর্ণেন্দুপত্রী মহাশয় এ সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন এখানে তার উদ্ধৃতি বিশেষ সমীচীন হবে। তিনি লিখেছেন :

“মহারাষ্ট্র জুড়ে জেগেছে মারাঠা জাতি। নেতা শিবাজী। অসি, ধনুক, মল্লবিদ্যা আর অশ্বারোহণে তাঁর অসাধারণ নিপুণতা। একরাজ্য ধর্মপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতকে বেঁধে তোলার মহান সংকল্পে তিনি পার্বত্য প্রদেশের অন্তরালে দীর্ঘদিন সুকঠিন রণ-সাধনা করেছেন। অসংখ্য তার বর্গী সৈন্য। অসীম তাদের সাহস। … একের পর এক রাজ্য জয় করে চলেছেন শিবাজী। আজ কঙ্কন, কাল বিজাপুর, পরশু সুরাট। তারপর গোলকুণ্ডা। দেখতে দেখতে সারা দাক্ষিণাত্যে উড়ল মারাঠা জাতির বিজয় নিশান। কিন্তু শিবাজীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আকস্মিকভাবে থেমে গেল সব অগ্রগতি। বড় বড় সর্দার সেনাপতিরা মেতে উঠলেন আত্মপ্রতিষ্ঠার, স্বার্থসিদ্ধির পারস্পরিক কলহে। মারাঠা নায়ক তখন রঘুজী ভোঁসলে। মন্ত্রী পণ্ডিত ভাস্কর রাম কোলহকর। কুটবুদ্ধিতে অতুলনীয়। তাঁরা দুজনে ঠিক করলেন বাংলাদেশকে এইবার জয় করে জুড়ে দিতে হবে নাগপুরের সঙ্গে। কি করে সম্ভব হবে সেটা কেন লুঠপাট, জোর-জুলুম, হত্যা আর অত্যাচারে। নাগপুরের এক পাহাড়ী অঞ্চলের অন্ধকার অরণ্য শিউরে উঠল এই দুই মারাঠা বীরের গোপন ষড়যন্ত্রে।……… কবেকার সেই বর্গী আক্রমণের নৃশংসতা আজও আমাদের দেশে ছেলে ভুলোনো বা ঘুম পাড়ানো ছড়ার মধ্যে ছড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের মা মাসীমা শিশুদের কানে প্রথম যে গানের কলিটি গেয়ে শোনান, সে ঐ ধ্বংসের গান।

ছেলে ঘুমলো পাড়া জুড়লো বর্গী এল দেশে বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে

বালেশ্বর থেকে রাজমহল পর্যন্ত বর্গী আক্রমণে অস্থির। আজ মেদিনীপুর ডুকরে কাঁদছে। কাল বর্ধমান। ওদিকে হুগলীর আর্তনাদ ভাগীরথীর ঢেউ-এ আছড়ে ছুটে আসছে কলকাতার কিনারে। তখন বর্গীরা শিবপুর থানা দুর্গ দখল করেছে।” (পুরনো কলকাতার কথাচিত্র পূঃ ২২৩-২২৭ দে’জ পাবলিশিং কলকাতা)।

এরপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে এই যে, বাংলার বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দী খাঁ ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে দীর্ঘ ১০ বছরকাল বর্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর পর ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দে মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের সংগে সন্ধি করতে সক্ষম হন। এসময় মেদিনীপুর জেলা উড়িষ্যার অন্তর্গত ছিলো। নবাব আলিবর্দী মেদিনীপুরকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলার সংগে জুড়ে দিয়ে খণ্ডিত উড়িষ্যাকে ‘চৌথ’-এর (রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ) প্রাপ্য হিসেবে মারাঠাদের শাসনে ছেড়ে দিলেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত কিন্তু আর দেশে ফিরতে পারেননি। ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দেই ভাস্কর পণ্ডিত আততায়ীর হাতে নিহত হন আলিবর্দী খাঁর শিবিরে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষাপাদে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দ যে মারাঠা জাতির ঐতিহ্য ও বীরগাথা নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে ‘ভবানী পূজা’ আর ‘শিবাজী উৎসবে মেতে উঠলেন, সেই মারাঠাদের পূর্বসূরী বর্গীরা হুগলী পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গীয় এলাকা কিভাবে লণ্ডভণ্ড করেছিলো, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের রচিত “সিরাজুদ্দৌলা’ গ্রন্থ থেকে তার কিঞ্চিৎ উদ্ধৃতি দেয়া এক্ষণে বাঞ্ছনীয় মনে হয়। তিনি লিখেছেন,

“……কিন্তু সেকালে বর্গীর হাঙ্গামাই বাঙালির সর্বনাশের সূত্রপাত করিয়াছিল। চতুর মহারাষ্ট্রীয়গণ জানিত যে, বাঙালির অন্নগত প্রাণ; বাঙলার সমতল ক্ষেত্রে একবার পদার্পণ করিতে পারিলে, অন্নজীবী বাঙালি সম্মুখযুদ্ধে অগ্রসর হইতে পারিবে না। দেশে দুর্গ নাই। রাজধানী হইতে গণ্ডগ্রাম পর্যন্ত সমুদয় দেশ অরক্ষিত; সুতরাং বাংলাদেশে পদার্পণ করিয়া তাহারা একেবারে কাটোয়া পর্যন্ত আসিয়া পড়িল। দেখিতে দেখিতে ভাগিরথীর পশ্চিম তীরস্থ সম্পন্ন জনপদগুলি জনশূন্য হইয়া গেল। লুণ্ঠন-পরায়ণ মহারাষ্ট্র সেনা গ্রাম নগর লুণ্ঠন করিয়া চালে চালে আগুন ধরাইয়া দিল; অশ্বপদ তাড়নায় শস্যক্ষেত্র পদদলিত হইয়া গেল; লোকে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরিয়া হাহাকার করিতে করিতে ভাগীরথী পার হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।”

কবি গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পূরাণ-এ বর্গী হামলার বীভৎস কাহিনী

মারাঠা বর্গীরা অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কিভাবে বঙ্গীয় এলাকার পশ্চিমাঞ্চল দশ বছর ধরে লুণ্ঠন করে শ্মশানে পরিণত করেছিলো, তার বিস্তারিত বিবরণ বাংলা পুঁথি সাহিত্যে পাওয়া গেছে। পুঁথিকারের নাম কবি গঙ্গারাম। পুঁথিটি আবিষ্কৃত হয়েছে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা থেকে। পুঁথির নাম ‘মহারাষ্ট্র পূরাণ’। রচনাকাল ১১৫৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দে। কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে এই সম্পূর্ণ পুঁথি প্রকাশিত হয়েছে। এই পুঁথিতে সমসাময়িককালের মারাঠাদের অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও উৎপীড়নের বর্ণিত কাহিনীর অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ

“তবে সব বরগি গ্রাম
লুটিতে লাগিল।
জত গ্রামের লোক সব পলাইল।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পলাত্র পুঁথির
ভার লাইয়া
সোনার বাইনা পলাএ কত
নিক্তি হড়পি লইয়া।
….

কাএস্ত বৈদ্য জত গ্রামের ছিল।
বরগির নাম শুইনা সব
পলাইল।
ভাল মানুষের স্ত্রীলোক যত
হাঁটে নাই পথে।
বরগির পলানে পেটারি
লইয়া মাথে।
ক্ষেতি রাজপুত জত
তলোয়ারের ধ্বনি
তলোয়ার ফেলাইঞা তারা
পলাএ অমনি।
গোসাঞি মোহান্ত জত
চোপালি-এ চড়িয়া
বোচকা বুচকি লয় জত
বাহুকে করিয়া।
চাষা কৈবর্ত জত জা-এ
পলাইঞা।
বিচন বলদের পিঠে
লাঙ্গল লইয়া।
…..

এই মত সব লোক
পলাইয়া জাইতে।
আচম্বিতে বরগি ঘেরিলা
আইসা সাথে।
মাঠে ঘেরিয়া বরগি দেয়
তবে সাড়া।
সোনা রূপা লুটে নএ আর
সব ছাড়া।
কারু হাত কাটে কারু
নাক কান।
একি চোটে কারু বধ-এ পরাণ।
ভাল ২ স্ত্রীলোক জত ধইরা
লইয়া জা-এ।
আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয়
তার গলাএ।
একজনে ছাড়ে তারে আর
জন ধরে।
রমণের ডরে ত্রাহি শব্দ করে।
এই মতে বরগি যত পাপ
কর্ম কইরা।
সেই সব স্ত্রীলোক যত দেয়
সব ছাইড়া।

…..

এই জাতে জত সব গ্রাম পোড়া
ইয়া।
চতুর্দিকে বরগি বেড়াএ লুটিয়া।
কাহুকে বাঁধে বরগি দিআ
পিঠমোড়া।
চিত কইরা মারে লাথি পা-এ
জুতা চড়া।
রূপি দেহ রূপি দেহ বলে বার
বার।
রূপি না পাইয়া তবে নাকে
জাল ভার।”

(কবি গঙ্গারাম রচিত পুঁথি ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’ ১১৫৮ বঙ্গাব্দ)

এ ধরনের এক নৃশংস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমগ্র উপমহাদেশে সবচেয়ে শিক্ষিত ও অগ্রসরপ্রাপ্ত কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কট্টর রক্ষণশীল ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা থেকে একজন সর্ব ভারতীয় নেতার ‘ইমেজ’কে খুঁজে বেডাচ্ছিলেন। রাজপুত প্রতাপ সিংহকে দিয়ে তা’ ব্যর্থ হবার পর এজন্যই সেদিন এদের কাছে মারাঠা হওয়া সত্ত্বেও ছত্রপতি শিবাজীর বন্দনার প্রয়োজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

এরই জের হিসাবে ১৯০২ সালে কোলকাতায় ‘শিবাজী উৎসব’-এর সূচনা হয়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী উদ্যোগ গ্রহণ করেন শ্রী সখারাম গণেশ দেউসকর। এরই রচিত গ্রন্থ হচ্ছে ‘দেশের কথা’ এবং ‘শিবাজীর দীক্ষা’। ১৯০৪ সালে রচিত ও প্রকাশিত এই ‘শিবাজীর দীক্ষা বই-এর ভূমিকা লিখেছেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভূমিকাটি কবিতায় লেখা। এটাই হচ্ছে কবিগুরু বরীন্দ্রনাথ-এর ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা। অবশ্য এর আগেও শিবাজী সম্পর্কে বাংলা ভাষায় একাধিক পুস্তক রচিত হয়েছে। এ সবের মধ্যে পণ্ডিত শরৎচন্দ্র শাস্ত্রীর ‘ছত্রপতি মহারাজ শিবাজী জীবন চরিত্র’ (১৮৯৫) এবং শ্রী সত্যচরণ শাস্ত্রীর ‘ছত্রপতি শিবাজীর জীবন-চরিত্র’ (১৮৯৫) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এ সময় কোলকাতায় চরমপন্থী হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বিত্তশালীরা শিবাজীকে উপলক্ষ করে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। ছত্রপতি শিবাজী ভবানী দেবীর ভক্ত ছিলেন বলে বংগীয় এলাকায় ‘শিবাজী উৎসব’-এ বিরাট তোড়জোর করে শ্রীব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের উদ্যোগে ভবানী পূজার প্রবর্তন হয়। গবেষক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামীর মতে, ‘তাই শিবাজী উৎসবে ভবানীর মূর্তি নির্মাণ করে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবালুতাকে উত্তেজিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন জাতীয় নেতারা। সে যুগের জাতীয়তাবাদ বহুলাংশে হিন্দু জাতীয়তাবাদে পর্যবসিত হয়েছিল। তাই শিবাজীকে জাতীয় বীররূপে সহজেই প্রতিষ্ঠা করা গেল। (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক নাটক: সাহিত্য প্রকাশ কলিকাতাঃ ১৩৮৫)।

এ জন্যই লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিবাজীকে ভগবানের অবতার হিসেবে চিত্রিত করে নাটক রচনার হিড়িক পড়ে যায়। শ্রী ফকির চাঁদ বসু শিবাজীকে নিয়ে প্রথম বাংলা নাটক ‘শিবাজীর অভিনয়’ রচনা করেন। নাট্যকার স্বয়ং লিখিতভাবে স্বীকার করে গেছেন যে, নাটকটি যথাযথভাবে ইতিহাসভিত্তিক নহে। ফকির চাঁদ-এর নিবেদন হচ্ছে, ‘শিবাজীর বৃত্তান্ত বোলেই যে ইহার বর্ণিত বিষয়গুলির সমুদয় ঐতিহাসিক সত্য, এরূপ বিবেচনা করবেন না। ইতিহাস লিখিত শিবাজীর তাবৎ স্বরূপ লক্ষণ বর্ণনা করা আমার অভিপ্রায়ও নয়। ‘

নাট্যকার শ্রী মনোমোহন গোস্বামী শিবাজীকে নিয়ে ১৯০১ সালে “রোশিনারা” নামে যে নাটকটি রচনা করেন, দ্বিতীয় সংস্করণ-এর সময় এর নতুন নামকরণ হয় “শিবাজী”। নাট্যকার মনোমোহনের সৎসাহস রয়েছে। ভূমিকায় তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, “মুসলমান অত্যাচারের চিত্র স্থাপন করাও পুস্তকখানির উদ্দেশ্য।”

এই ‘শিবাজী’ নাটকের সংলাপ বিশেষভাবে লক্ষণীয় :

জিজাবাঈ : অত্যাচার অত্যাচার যে দিকে নেহারি ধর্মের এ অপমান সহিতে না পারি। হিন্দুর মন্দিরে হেরি গো-অস্থির রাশি, ধৈরেষ ধরিতে নারি; হিন্দু কুলবালা যবে যবন পরশে অমূল্য সতীত্ব-রত্নে দেয় জলাঞ্জলি।

শিবাজী : জন্মভূমি পর পদানত বর্ণাশ্রম ধর্ম হের লুপ্ত প্রায় আজ গো ব্রাহ্মণ সহে নিপীড়ন, শুনি ঔ দেবতার করুণ ক্রন্দন করিব কি জীবন ধারণ।

অবশ্য বছর কয়েক পরে বংগভংগ আন্দোলন-এর সময় এই একই নাট্যকার মনোমোহন গোস্বামীর ‘পৃথ্বিরাজ’ নাটকের সংলাপ আরও ভয়াবহ।

“বীরের প্রধান ধর্ম স্বদেশ রক্ষণ
হিন্দুর প্রধান কার্য যবন নিধন।”

(দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক নাটকঃ ডক্টর প্রভাত কুমার গোস্বামী : কলিকাতা ১৩৮৫)।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, ১৯০২ সাল থেকে কোলকাতায় ‘শিবাজী উৎসব’ প্রবর্তিত হয়। ফলে এই উৎসবকে সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে নাট্য প্রযোজক ও পরিচালক শ্রী অমরেন্দ্র দত্ত মহাশয়ই প্রকৃতপক্ষে ‘রোশিনারা-র নাম পরিবর্তন করেন। তিনি এর নামকরণ করেন ‘শিবাজী’। এই নতুন নামে মনোমোহন গোস্বামী রচিত উগ্র সাম্প্রদায়িক আমেজে রচিত ‘শিবাজী’ নাটকটি ১৯০২ সালের ২২শে মার্চ কোলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনীত হয়। এ থেকেই সে আমলের ‘বাঙালিত্বের’ আবরণে ‘বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যে মারাঠা বর্গীদের নৃশংস এবং পৈশাচিক হামলায় এক সময় মধ্যভারত থেকে শুরু করে পশ্চিম বাংলার শহর ও জনপদগুলো শ্মশানে পরিণত হয়েছিলো। এবং অবলা নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচার আর শিশুর রক্তে রঞ্জিত মারাঠা বর্গীর খঞ্জর ইতিহাসে কালিমাময় অন্যায়ের সংযোজন করেছিলো, বাংলার হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সেই মারাঠা শক্তির জয়গানের ঢক্কানিনাদে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো।

এতোসব ঘটনা সত্ত্বেও ১৯০২ সালে কোলকাতায় প্রথম ‘গণপতি’ পূজা

বাংলা ও মহারাষ্ট্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে বিরাজমান অবস্থা অনুধাবনের লক্ষ্যে পশ্চিম বঙ্গের গবেষক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি বাঞ্ছনীয় হবে। তিনি লিখেছেন, “মোগলের বিরুদ্ধে রাজপুতদের সংগ্রামের কাহিনী যেমন আমাদের দেশাত্মবোধের প্রেরণা যুগিয়েছে, ঠিক তেমনি প্রেরণা যুগিয়েছে মোগলের বিরুদ্ধে শিবাজীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম কাহিনী। বাল গঙ্গাধর তিলক মারাঠাদের সবচেয়ে প্রিয় দেবতা গণপতি (গণেশ)-কে নিয়ে গণপতি উৎসব-এর প্রচলন করেন ১৮৯৩-এ। মহারাষ্ট্রের অনুসরণে ১৯০২-এ কলিকাতায় শিবাজী ‘উৎসবের সূচনা এবং এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে সখারাম গণশ দেউসকর।…….. শিবাজীকে অবলম্বন করে জাতীয় ভাবাবেগ তখন তুঙ্গে উঠেছে। চার বছর ধরে শিবাজী উৎসব চলছিল এই কলকাতা শহরে। চরমপন্থী স্বাদেশিকরা বিশেষ করে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের উদ্যোগে যে শিবাজী উৎসব সম্পন্ন হলো তার অংগস্বরূপ ছিল ‘ভবানী পূজা’। শিবাজী ছিলেন ভবানী দেবীর ভক্ত। তাই শিবাজী উৎসবে ভবানীর মূর্তি নির্মাণ করে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবালুতাকে উত্তেজিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন জাতীয় নেতারা। সে যুগের জাতীয়তাবাদ বহুলাংশেই হিন্দু জাতীয়তাবাদে পর্যবসিত হয়েছিল। তাই শিবাজীকে জাতীয় বীর (?) রূপে সহজেই প্রতিষ্ঠা করা গেল।” (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটকঃ পুস্তক বিপণি, কলিকাতা ১৯৭৮)।

এই একই বিষয়ে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট গবেষক এবং উত্তরবংগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রীডার ডঃ পুলিন দাশ লিখেছেন, “(শিবাজী) উৎসবে যোগদানের জন্য মহারাষ্ট্র থেকে তিলক, খাপার্দে, মুজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে কলকাতায় আসেন। উৎসবের অঙ্গ হিসেবে ভবানী পূজা অনুষ্ঠিত হয় (জুন, ১৯০৬)। এক অখণ্ড ভারতের নির্মাতারূপে জাতীয় বীরের মর্যাদায় ভূষিত হয়ে শিবাজীর উদ্দেশে যখন ভক্তি ও শ্রদ্ধার অঞ্জলি নিবেদিত হচ্ছে গিরিশচন্দ্ৰ (নাট্যকার) তখন সময় ও মঞ্চের চাহিদার সঙ্গতি রেখে সিরাজদ্দৌলা মীরকাশেমের জগৎ ছেড়ে “ধর্মের উপর ভিত্তি করে সনাতন ধর্ম রক্ষার জন্য” শিবাজীর ভূমিকাকে উপজীব্য করে, বাংলা মঞ্চকে উপহার দেন তাঁর ‘ছত্রপতি শিবাজী’ (১৯০৭) নাটক। (বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটকঃ পূঃ ২৬৮: ১৯৮৩: এম সি সরকার এ্যাণ্ড সন্স কলিকাতা)

অবশ্য এর আগেই ছত্রপতি শিবাজীর চরিত্রকে মহিমান্বিত হিসেবে চিত্রিত করে বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে পণ্ডিত শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রীয় ‘ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর জীবন চরিত্র’ (১৮৯৫), সত্যচরণ শাস্ত্রীর ‘ছত্রপতি শিবাজীর জীবন-চরিত্র’ (১৮৯৫), মনোমোহন গোস্বামীর রোশিনারা (সংশোধিত নাম “শিবাজী’ (১৯০২) প্রভৃতি।

নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ সিরাজদ্দৌলা (১৯০৬) এবং মীর কাশিম (১৯০৬) রচনার পর পুনরায় তৎকালীন বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মনমানসিকতাকে প্রতিধ্বনিত করতে সচেষ্ট হলেন। এবার তিনি রচনা করলেন চরম সাম্প্রদায়িক নাটক ‘ছত্রপতি শিবাজী’। ১৯০৭ সালের ১৭ই আগস্ট নাটকটি কোলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হলো। মিনার্ভা থিয়েটারে তৎকালীন স্বত্বাধিকারী এম এম পাণ্ডে এবং ম্যানেজার শ্রী এ এন দত্ত স্বাক্ষরিত ইংরেজী ভাষায় প্রচারিত প্রচারপত্রে ‘ছত্রপতি শিবাজী’ নাটকটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হলো যে, “ ……আমাদের বিশ্বাস, এক্ষণে তাঁহার (শিবাজীর) জীবন এবং চরিত্র দেশবাসী সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন এবং অতঃপর হিন্দুস্থানের এই বাঙালিরা হস্তমিলন করবেন।”

নাটকটি সম্পর্কে গিরিশচন্দ্র তাঁর স্বজনবন্ধু শ্রী কুমুদবন্ধু সেনকে লিখেছিলেন, “শিবাজীতে এই আদর্শ দেখবার চেষ্টা করেছি যে, ধর্মের উপর ভিত্তি করে সনাতন ধর্ম রক্ষার জন্য, অত্যাচারিত, দুর্বল, পীড়িতকে রক্ষার জন্য ত্যাগের ওপর সেই মহাবীর মহারাষ্ট্র গঠন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।”

(গিরিশ চন্দ্র ও নাট্য সাহিত্যঃ পূঃ ১২)

গিরিশচন্দ্র কৃত ‘ছত্রপতি শিবাজী’ নাটকের সংলাপের নমুনা হচ্ছেঃ

(ক) জিজাবাঈ :— তুমি ভবানীর কার্যে অবনীতে অবতীর্ণ হয়েছ, পুণ্যভূমি উদ্ধারের জন্য তোমার জন্ম, সনাতন ধর্ম সংস্থাপন তোমার একমাত্র কর্ম।

(খ) রামদাসস্বামী :— বৎস (শিবাজী), দেবকার্যে তুমি আবির্ভূত, দেবকার্য সুসম্পন্ন করেছ, ঊনবিংশ বর্ষব্যাপী ঘোর যুদ্ধে মুসলমান বল চূর্ণ করে বিরাট হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করেছ। তোমার নাম বিধর্মীর ভয়োৎপাদনকারী, স্বধর্মীর আনন্দবর্ধক, প্রতি হিন্দু জিহবায় ইষ্টমন্ত্রের ন্যায় উচ্চারিত।

(গ) শিবাজী :— একবার নয়ন উন্মীলন করে জন্মভূমির অবস্থা দেখুন, দেবভূমি আর্যভূমি বিধর্মী পীড়িত। যে গো-দুগ্ধে অসহায় বাল্যাবস্থায় শরীর পুষ্ট হয়, আপনার মাতৃভূমে সেই গো-হত্যা; উদাসভাবে আর কতদিন সহ্য করবেন? কতদিন নিত্য আর স্বজাতির দুর্গতি দেখবেন? কতদিন দেবনিন্দা শুনবেন – কতদিন ধর্মের গ্লানি প্রতিমা ভংগ উপেক্ষা করবেন?

অচিরেই ইংরেজ শাসকরা উগ্র সাম্প্রদায়িক বিশ্বে জর্জরিত ‘ছত্রপতি শিবাজী’ নাটকটি বেআইনী ঘোষণা করে।

দুঃখজনক হলেও একথা উল্লেখ করতে হয় যে, ২/১টি (সিরাজদ্দৌলা ও মীর কাশিম ) ব্যতিক্রম ছাড়া এ সময় নাট্য রচনার প্রায় সর্বত্র বর্ণহিন্দু লেখকরা একই মনমানসিকতার পরিচয় প্রদান করেছেন। এক্ষণে এ সময়ে নাট্য আন্দোলনের অগ্রণী গিরিশচন্দ্র ঘোষের কিঞ্চিৎ মূল্যায়নই যথেষ্ট মনে হয়। পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট প্রগতিশীল গবষেক ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামী লিখেছেন, “শিবাজীকে অবলম্বন করে হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন নিয়ে গিরিশচন্দ্র শিবাজীর যে ছবি এঁকেছেন সেটাও তাঁর ‘ছত্রপতি শিবাজী’র পূর্বে লেখা মনোমোহনের রোশিনারা-র [শিবাজীর] অনুসরণ। ……. শিবাজী উৎসবকে অবলম্বন করে জাতীয় ভাবাবেগ যখন তুঙ্গে উঠেছে সেই সময় রচিত হয় গিরিশচন্দ্রের ‘ছত্রপতি শিবাজী’ নাটক। এইরূপ আবহাওয়ায় শিবাজীকে নিয়ে লেখা নাটক যে প্রকৃতই একখানি মঞ্চসফল নাটক হবে এটা গিরিশচন্দ্র জানতেন। তাছাড়া শিবাজী চরিত্রের সঙ্গে গিরিশচন্দ্র তাঁর ধর্মভাবাশ্রিত জাতীয় তার আদর্শের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। শিবাজীর সঙ্গে দেবী ভবানীর সম্পর্ক থাকায় গিরিশচন্দ্রের পক্ষে আরও সুবিধা হয়েছিল। (‘দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক নাটক’ পৃঃ ১৭৬-১৭৭, পুস্তক বিপণি কলিকাতা-৯)

এ সম্পর্কে পশ্চিম বঙ্গের অন্যতম বিশিষ্ট গবেষক ডক্টর পুলিন দাশ লিখেছেন, ‘অচিরকাল মধ্যেই বিশেষভাবে চরমপন্থীদের প্রয়াসে জাতীয় আন্দোলন যখন হিন্দু জাতীয়তার পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ায় সেই সময় এক অখন্ড ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ঔরঙ্গজীবের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বীরের আদর্শরূপে মঞ্চে অভ্যর্থিত হয়েছে ছত্রপতি শিবাজী। ….ঔরঙ্গজীবের সঙ্গে সংগ্রামরত শিবাজীর সংলাপে হিন্দুর ধর্মীয় চেতনা প্রভাবিত দেশাত্মবোধের (?) প্রকাশ ঘটানো সহজসাধ্য হয়েছে। ‘ছত্রপতি শিবাজী’র মাধ্যমে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সনাতন ধর্ম রক্ষার আদর্শকে রূপায়িত করার সুযোগ পেয়ে গিরিশচন্দ্রও তাঁর নাটকের পথ বদল করেছেন। ‘ছত্রপতি শিবাজী’তে পরিবর্তনের সূচনা তা আরো সম্প্রসারিত হয়েছে তাঁর পরবর্তী নাটক ‘শঙ্করাচার্য’, ‘অশোকে’। (পশ্চিম বঙ্গের সিপিএম সরকারের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত ‘বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক’, ১৯৮৩ কলিকাতা)

এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে হয় যে, গিরিশচন্দ্রের নাটকগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী ‘সিরাজদ্দৌলা’ (১৯০৫) এবং ‘মীর কাশিম’ (১৯০৬) নাটক দু’টি কিন্তু ‘ছত্রপতি’ ‘শিবাজী’, শঙ্করাচার্য’ এবং ‘অশোক’-এর আগেই রচিত হয়েছিলো। কিন্তু কেন এমনটি হয়েছিলো, সে সম্পর্কে ডঃ পুলিন দাশ সত্য ভাষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “উৎসবের (কোলকাতায় শিবাজী উৎসব) অঙ্গ হিসেবে ভবানী পূজা অনুষ্ঠিত হয় (জুন, ১৯০৬)। এক অখণ্ড ভারতের নির্মাতারূপে জাতীয় বীরের মর্যাদায় ভূষিত হয়ে শিবাজীর উদ্দেশে যখন ভক্তি ও শ্রদ্ধার অঞ্জলি নিবেদিত হচ্ছে গিরিশচন্দ্র তখন সময় ও মঞ্চের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সিরাজদ্দৌলা মীর কাসিমের জগৎ ছেড়ে ‘ধর্মে ওপর ভিত্তি করে সনাতন ধর্ম রক্ষার জন্য’ শিবাজীর ভূমিকাকে উপজীব্য করে বাংলা মঞ্চকে উপহার দেন তাঁর ‘ছত্রপতি শিবাজী’ নাটক।”

.

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন বংগীয় এলাকায় ইংরেজী শিক্ষিত কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মনমানসিকতা হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শে আপ্লুত হয়ে উঠেছে, তখন মহারাষ্ট্র এলাকায় এদেশীয় উঠতি শিল্পপতিদের সমার্থক গোষ্ঠী হিন্দু ব্রাহ্মণদের চিন্তাধারা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হওয়া বিশেষ বাঞ্ছনীয় মনে হয়। এর শুরুটা কিন্তু ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বোম্বাই-এ অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম বৈঠক থেকে। এটাকেই বাঙালি বর্ণ হিন্দু এবং মারাঠা ব্রাহ্মণদের ‘মহামিলন’ বলে আখ্যায়িত করা যায়। জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজ কর্মচারীরা ভেবেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সর্বগ্রাসী কৃষক বিদ্রোহ এড়ানো ছাড়াও এদেশীয় সমার্থক গোষ্ঠীকে সুশৃংখলভাবে সরকারের কাছে নানা ‘আব্দার’ ও ‘প্রার্থনা’ উপস্থাপনার পদ্ধতি শেখানো সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার মার্কসীয় গবেষক সুপ্রকাশ রায় তাঁর ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (ডিএনবিএ ব্রাদার্স কলিকাতা ১৯৮০) গ্রন্থে লিখেছেন, “এইভাবে দেখা যায়, যে সময় সরকারী উদ্যোগে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আয়োজন আরম্ভ হইয়াছিল, তাহার পূর্ব হইতেই ভারতের শিক্ষিত মধ্যশ্রৌণও নিজস্ব জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য সচেষ্ট হইয়াছিল এবং তাহাদের এই প্রচেষ্টা সাফল্যের নিকটবর্তী হইয়াছিল। তাহাদের সাফল্য যখন আসন্ন হইয়া উঠে তখনই সরকারী প্রতিনিধি এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম ভারতীয়দের সেই জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়াসকে ইংরেজ শাসনের স্বার্থের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখিবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হিউম সেই ষড়যন্ত্রের মারফত ভারতীয়দের জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগকে সাময়িকভাবে সরকারী প্রভাবে আনয়ন করিয়া নিজের উদ্যোগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন আহবান করিতে সক্ষম হন। রজনী পামদত্তের কথায়ঃ

“প্রকৃতপক্ষে বড়লাটের সাহায্যে সংগোপনে রচিত পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে এবং বৃটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ও পরিচালনায় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হইয়াছিল। ক্রমবর্ধমান বিশুদ্ধ গণশক্তি এবং বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্রোধ হইতে ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য অস্ত্ররূপে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আয়োজন করা হইয়াছিল।

বৃটিশ সরকারের পক্ষ হইতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার এই প্রয়াসের উদ্দেশ্য ছিল আসন্ন বিপ্লব (কৃষক বিদ্রোহ) পরাজিত করা অথবা আরম্ভের পূর্বেই উহা ব্যর্থ করা।”

১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম (সভাপতিঃ উমেশচন্দ্ৰ ব্যানার্জী) পরবর্তীকালে নিজেই লিখেছেন :

“সেই সময়ে, এমনকি এখনও আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না বা নাই যে, আমরা সেই সময়ে একটা ভয়ঙ্কর গণ-বিপ্লবের ঘোরতর বিপদের মধ্যে ছিলাম।

বিভিন্ন তথ্য হইতে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, আমরা একটা ভয়ঙ্কর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আসিয়া দাড়াইয়াছি। বিভিন্ন অঞ্চলের রিপোর্ট ও সংবাদের সাতটি বিরাট খণ্ড আমাকে দেখানো হইয়াছিল। ……রিপোর্ট ও সংবাদগুলি বিভিন্ন জেলা, মহকুমা, নগর, শহর ও গ্রাম হইতে প্রেরিত হইয়াছিল। রিপোর্ট ও সংবাদগুলির সংখ্যা অতি বিপুল। এইগুলি ৩০ সহস্রাধিক সংবাদদাতার নিকট পাওয়া গিয়াছিল।” (স্যার উইলিয়াম ওয়োডারবার্ণঃ হিউম, ফাদার অব ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস)।

গবেষক সুপ্রকাশ রায় মহাশয় আরও লিখেছেন, “১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ভাগে হিউম সিমলায় গিয়া বড়লাটের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্ৰস্থল সিমলায় বসিয়াই বড়লাট লর্ড ডাফরিন ও হিউম কর্তৃক ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রচিত হয়। কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ডব্লিউ, সি, ব্যানার্জী মহাশয়ও এই সত্য উদঘাটিত করিয়া লিখিয়াছেন :

“সম্ভবতঃ ইহা বহু লোকের নিকটই একটি নতুন সংবাদ যে, যেভাবে প্রথমে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং তাহার পর হইতে যেভাবে তাহা পরিচালিত হইতেছে তাহা’ ভারতের বড়লাট হিসেবে ডাফরিন ও আভার মার্কুইসয়েরই বড়লাট লর্ড ডাফরিন কীর্তি।”

এদিকে স্বল্পকালের মধ্যেই কোলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের বক্তব্য হচ্ছে, যখন জাতীয় কংগ্রেস একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে চলেছে, তখন ‘আব্দার’ ও ‘প্রার্থনার’ যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এখন ভারতীয়দের নামে ‘দাবী’ আদায় করতে হবে। সেক্ষেত্রে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজী শিক্ষায় সবচেয়ে অগ্রসর বলেই আদায়কৃত দাবীর সিংহভাগ স্বাভাবিকভাবেই কব্জা করা সম্ভব হবে। এরই পাশাপাশি মহারাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বস্ত্রশিল্পের (১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে প্রায় ১০০টি বস্ত্রকল) স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে সোচ্চার হলে মারাঠা বিত্তশালী ব্রাহ্মণদের শর্তহীন সমর্থন লাভ নিশ্চিত বলে গণ্য করা যায়। উপরন্তু ‘মারাঠা বীর’ ‘ছত্রপতি শিবাজী’র ইমেজকে পুনঃ জাগরণের মাধ্যমে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে সনাতন হিন্দু ধর্মের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে।

১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বিশ বছরকাল সময়কে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু এবং মহারাষ্ট্রে স্থাপিত এ দেশীয় বস্ত্র শিল্পের সমর্থক মারাঠা ব্রাহ্মণদের জন্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে “চরম বোঝাপড়ার” প্রস্তুতিকাল বলা যায়।

এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গীয় এলাকার ইংরেজী শিক্ষিত বর্ণ হিন্দুদের পরিপক্ক নেতৃত্ব আরও কিছুদিনের জন্য ধৈর্য্যের পরিচয় দিলেও মহারাষ্ট্রে কিন্তু তেমনটি হলো না। এ জন্যই আমরা দেখতে পাই যে, উপমহাদেশে হিন্দু সন্ত্রাসবাদের সূত্রপাত কিন্তু আদতে বাংলায় হয়নি। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এর শুরুটা হয়েছিলো সুদূর মহারাষ্ট্রে; এর পেছনে এক ক্ষুদ্র ইতিহাস রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষপাদে দাক্ষিণাত্যে হঠাৎ করে মহামারী আকারে প্লেগ রোগ দেখা দিলে ইংরেজ সরকার মিঃ র‍্যাণ্ড নামে জনৈক ইংরেজ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীর সভাপতিত্বে একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করেন। এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মিঃ আয়ার্স্ট নামে অপর এক ইংরেজ কর্মচারী। এই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে, এঁরা দু’জনেই বিশেষ করে হিন্দু গৃহবধূদের সম্পর্কে “অশোভন” ও “ঔদ্ধত্যপূর্ণ” মন্তব্য করেছেন। এতে করে দাক্ষিণাত্যের মহারাষ্ট্রীয় এলাকায় তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে দামোদর চাপেকার এবং বালকৃষ্ণ চাপেকার নামে দুই ব্রাহ্মণভ্রাতা হত্যার মাধ্যমে এর প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের হীরক জুবিলী উৎসবে যোগদানের পর যখন মিঃ র‍্যাণ্ড এবং আয়ার্স্ট বোম্বের লাটভবন থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছিলেন সে সময় এঁরা চাপেকার ভ্রাতৃদ্বয়ের হাতে প্রাণ হারান। উপমহাদেশে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীর হাতে এটাই হচ্ছে প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এরপর দু’জন ভারতীয় নাগরিক পুলিশের কাছে অন্যতম হত্যাকারী দামোদর চাপেকারকে ধরিয়ে দিলে বিচারে দামোদরের ফাঁসি হয়। কিন্তু স্বল্পদিনের ব্যবধানে সন্ত্রাসবাদীরা উক্ত দুই ব্যক্তিকেও হত্যা করে। এরই জের হিসেবে আরও ৪ জনের ফাঁসি হয়।

সন্ত্রাসবাদীরা পদ্ধতির ব্যাপারে ওয়াহাবীদের অনুসরণ করেছে

তবে সন্ত্রাসবাদীরা পদ্ধতিগত ব্যাপারে কিভাবে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সে সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার মার্কসীয় গবেষক সুপ্রকাশ রায় সত্যভাষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে ‘ওয়াহাবী বিদ্রোহের’ নায়কগণের মামলার বিচারকালে বিদ্রোহীপক্ষের ব্যারিস্টার এনেস্টি সাহেব তাঁর বক্তৃতায় চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত করিয়াছিলেন যে, ‘ওয়াহাবী বিদ্রোহ’ কৃষকের স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যতীত অন্য কিছু নহে। পরে এনেস্টি সাহেবের এই বক্তৃতা পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হলে তাহা মধ্যশ্রেণীর নায়কগণকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল।” শ্রী যোগেশচন্দ্র বাগল মহাশয় লিখিয়াছেন : “এনেস্টির এই বক্তৃতাসমেত মোকদ্দমার বিবরণ ওয়াহাবীরা পুস্তিকাকারে ছেপে চারিদিকে বিলি করলে তাহা পাঠ করে বিপিনচন্দ্র পাল বলেন, যৌবনে এই পুস্তিকাখানি পাঠ করে তাঁরা যেন একেবারে মেতে উঠেছিলেন।” (মুক্তি সন্ধানে ভারতঃ পূঃ ৯৯)।

মুসলমানদের দ্বারা সংগঠিত ‘ওহাবী আন্দোলন’ এবং হিন্দুদের ‘সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড’ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মরহুম মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহর বক্তব্য নিশ্চিতভাবে গবেষণার বিষয়বস্তু বলা যায়। তিনি লিখেছেন, “মুজাহিদগণের [ওহাবী] আদর্শ ছিল মুক্ত ভারতে মুক্ত ইসলাম। পক্ষান্তরে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের আদর্শ হইল মুক্ত ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা। ধর্ম ভিত্তি করিয়া জেহাদ এবং সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছিল বলিয়া প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে হিন্দুরা এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করে নাই।” (আমাদের মুক্তি সংগ্রামঃ পূঃ ১৭৬ বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৭৮)

এ প্রসঙ্গে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম স্রষ্টা এবং মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসীদের পথ প্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিত্ব কমরেড মুজাফফর আহমদ-এর সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গীয় এলাকায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সম্পর্কে কমরেড আহমদ লিখেছেন, “বাঙালায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অভ্যুদয় একটি স্মরণীয় ঘটনা। এটা ছিল একটি গোপন আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গের আগেই তাঁদের দল গড়ে উঠেছিল। অবশ্য, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তাঁদের বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। এটা বিশেষ লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বিশেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। বাংলার শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ সম্প্রদায়ের ভিতরেই ছিল তার উর্বর ক্ষেত্র। বাংলার বাহিরেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কর্মপ্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু বাংলার মতো দীর্ঘস্থায়ী তা কোথাও হয়নি। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমার মনের যে অবস্থা ছিল, আর যে রোমাঞ্চ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ছিল তাতে আমার পক্ষে সন্ত্ৰাসবাদী বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তার পথে বিস্তর বাধা ছিল। বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ” হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এর মূলমন্ত্র ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গান। তাতে আছে —

বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
ত্বংহি দুর্গা দশপ্রহরধারিণী ইত্যাদি।

একেশ্বরবাদী কোনো মুসলিম ছেলে কি করে এই মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারত? এই কথাটা কোনো হিন্দু কংগ্রেস নেতাও কোনোদিন বুঝতে পারেননি। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। বারীন্দ্রকুমার ঘোষও আন্দামান হতে ফেরার পরে এই কথাই লিখেছিলেন। তাঁর সেই পুস্তকখানি এখন দুষ্প্রাপ্য। (‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (পৃষ্ঠা ১০-১১): কমরেড মুজাফফর আহমদ : ১৯৭৭: খান ব্রাদার্স এ্যাণ্ড কোং, ঢাকা–১।

কমরেড মুজাফফর-এর বক্তব্যের জের হিসেবে এখানে প্রাসংগিক বিধায় একটা মন্তব্য সহজেই করা যায় যে, ইংরেজ রাজত্বে বাংলা গদ্যের প্রবর্তন থেকে শুরু করে রেলপথ সম্প্রসারণ ও ব্যাপক আকারে উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড এদেশীয় নেতৃবৃন্দ সাদরে গ্রহণ করলেও ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, ইংরেজদের উদ্যোগে ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলো বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এ জন্যই গবেষক বিনয় ঘোষ যথার্থভাবেই মন্তব্য করেছেন যে, “কিন্তু ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হবার পর ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত কয়েকটি মাত্র বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তা অধিকাংশই বিদ্যাসাগরের নিজের উদ্যম ও অর্থব্যয়ে অথবা তাঁর একান্ত ভক্তদের প্রচেষ্টায়। তাও দেখা গেছে বিধবা বিবাহ যাঁরা করতে অগ্রণী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে সাময়িক অর্থলোভে শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, কোনো আদর্শপ্রীতির জন্য বিবাহ করেননি। বিদ্যাসাগর নিজেও তা বুঝতে পেরে শেষ জীবনে হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। বিধবা বিবাহ হিন্দু সমাজ গ্রহণ তো করেননি, শিক্ষিত উচ্চ সমাজে যারা আদর্শের দিক থেকে একদা তা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেননি। ……তাই বিবধা বিবাহ ব্যর্থ হয়েছে, নারীর পরাধীনতা, যৌথ পরিবার সবই বজায় থেকেছে এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নির্ধারণের জন্য শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই কোনো আইন পাস করতে চাননি। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো পাশ্চাত্য বিদ্যায় শিক্ষিতশ্রেষ্ঠও আইন প্রয়োগ করে এই ধরনের সমাজ সংস্কারের বিরোধী ছিলেন।” (বাংলার নবজাগৃতি’ পৃঃ ১৫৭-৫৮: ওরিয়েন্ট লংম্যান ১৯৭৯ কলিকাতা)।

এর পিছনে কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রাধাকান্ত- ভূদেব- রামকৃষ্ণ- বঙ্কিম- বিবেকানন্দ প্রমুখের প্রবর্তিত হিন্দুধর্মের রিভাইভ্যালিজম-এর চিন্তাধারার ব্যাপক প্রভাব। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে ইংরেজ ঐতিহাসিকরা শুধু একটা কথাই বলেছেন যে, “পাশ্চাত্য প্রভাবে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ভারতের যেভাবে অনুকূল প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত ছিলো, বাস্তবে তা হয়নি।” কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এ ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ ছিলো। তারা বিলম্বে হলেও অনুধাবন করতে পেরেছিলো যে কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হলেও অত্যন্ত সন্তর্পণে রামমোহন- ইয়ংবেঙ্গল- প্যারীচাঁদ- বিদ্যাসাগর- মধুসূদনের উদার ও সংস্কারপন্থী ভাবধারার সমাধি রচিত হয়েছে এবং সেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বঙ্কিমের প্রদর্শিত পথে ‘হিন্দু বাহুবল’ ও ‘হিন্দু শৌর্যবীর্যের’ গৈরিক পতাকা শোভা বর্ধন করছে। এজন্যই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড-এর পর সুদীর্ঘ ৬৮ বছরের মধ্যে (১৯২৯ সালের সারদা আইন) হিন্দুদের জন্য আর কোন ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার আইন পর্যন্ত প্রণয়ন করেনি এবং বিধবা বিবাহের সমর্থনে কিংবা সতীদাহের বিরোধী কোন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী হয়নি।

এখানে লক্ষণীয় যে, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বঙ্গীয় এলাকার বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের মন-মানসিকতা যখন “দিনে স্যুট-প্যান্ট আর সন্ধ্যায় ধুতি’, ঠিক তখনই মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এঁদের সেতুবন্ধ রচিত হলো। এই সম্প্রদায়ের চোখে তখন ভবিষ্যতের বিরাট স্বপ্ন। আর এদিকে ভারতের ভাইসরয় হিসেবে সেই ঐতিহাসিক সময়ে আগমন হলো লর্ড কার্জনের।

.

বৃটিশ ভারতের গভর্ণর জেনারেলদের মধ্যে প্রাচ্য দর্শনে যিনি একদিন অবাক বিস্ময়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই মার্কুইস জর্জ ন্যাথানিয়াল কার্জন (১৮৫৯-১৯২৫) মাত্র ৪০ বছর বয়সে গভর্ণর জেনারেল হিসেবে নিযুক্তি লাভের পর এক উন্মুক্ত হৃদয় নিয়ে এদেশে আগমন করলেও নানা ঘটনাপ্রবাহে শেষ পর্যন্ত তিনিই ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত গভর্ণর জেনারেল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইলেন। তাই লর্ড কার্জনের কর্মকাণ্ডকে বিচার করার প্রাক্কলে ইংরেজদের দৃষ্টিকোণ থেকে সমসাময়িককালের ইতিহাসের কিভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে তার উপস্থাপনা অপরিহার্য মনে হয়।

১৮৫৮ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজ রাজত্বের বিপদমুক্ত সময়

ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার ডব্লিউ হান্টার তাঁর রচিত ‘ইন্ডিয়া অব দি কুইন (১৮৮৭ খ্রীঃ)’ গ্রন্থে এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, সিপাহী বিদ্রোহের অবসানে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড ক্যানিং-এর ঘোষণা থেকে শুরু করে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের মধ্যবর্তীকালীন সময়কালকে ভারতে ইংরেজ রাজত্বের সবচেয়ে বিপদমুক্ত সময় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ সময় বৃটিশরা যে কেবলমাত্র নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাই-ই নয়, তাদের এই শ্রেষ্ঠত্বকে প্রাচীন এবং পাশ্চাত্যপন্থী ভারতীয়রা স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন। প্রথমোক্ত দল শক্তির শ্রেষ্ঠত্বকে আর শেষোক্তরা নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় ইংরেজের শ্রেষ্ঠত্বকে বরণ করে নেয়। অন্যদিকে এসব গবেষক ও ঐতিহাসিকরা বৃটিশ জনগোষ্ঠীর কাছে লর্ড ক্যানিং থেকে শুরু করে লর্ড কার্জন পর্যন্ত গভর্ণর জেনারেলদের সম্মিলিত কর্মকান্ডের ইমেজকে ‘সুমহান’ হিসেবে উপস্থিত করে। ইংরেজ কবি কিপলিং এক্ষেত্রে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেন।

গবেষক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার এ ব্যাপারে তার ‘আওয়ার ইন্ডিয়ান আম্পায়ার গ্রন্থে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর কৃতিত্ব দাবী করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমাদের আগে এই বিশাল ঐশ্বর্যশালী সম্রাজ্যের শাসকরূপে যেসব জাতির আবির্ভাব হয়েছে তাদের মত আমরা আসিনি। আমরা হিন্দুদের মত মন্দির অথবা মুসলমানদের মত প্রাসাদ মসজিদ আর কবরখানা নির্মাণের দিকে নজর দিইনি, মারাঠাদের মত দুর্গ কিংবা পর্তুগীজদের মত গির্জাও গড়িনি। আমরা এসেছি আধুনিক নগর নির্মাণের জন্য। এ কাজে আমাদের যোগ্যতা ও প্রতিভা যে অতুলনীয় তা আধুনিক শিল্প বাণিজ্য কেন্দ্রে আমাদের মহানগর নির্মাণের সাফল্যে প্রমাণিত হয়। আমাদের মহানগর নির্মাণের অসাধারণ প্রতিভা ছিল বলেই ভারতবর্ষে নতুন শ্রমশিল্প যুগের সুচনা হয়েছে।” রেভারেণ্ড জেমস লঙ তাঁর রচিত ‘পিপস ইন টু সোশ্যাল লাইফ অব ক্যালকাটা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “কলিকাতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলার তথা ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রগতির ইতিহাস ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, জলাভূমি, জঙ্গল ও গ্রাম থেকে কিভাবে কলিকাতা ধীরে ধীরে আধুনিক শহর ও মহানগরে পরিণত হয়েছে, সে কাহিনী লণ্ডনের ইণ্ডিয়া হাউসে সযত্নে রক্ষিত প্রায় এক লক্ষ সরকারী নথিপত্ররের মধ্যে সবিস্তারে লেখা রয়েছে।”

ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের সুফল দাবী করে ইংরেজ ঐতিহাসিকরা এমর্মে আরও লিখেছেন যে, ভাইসরয় জন ব্যারণ লরেন্স (১৮১১-৭৯) এদেশীয় উচ্চ শ্রেণীর প্রবল বিরোধিতার মুখে বিশেষ করে পাঞ্জাব এলাকার রায়তদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। এরই ফলে বৃটিশদের আপোষ ফর্মুলার জন্ম হয়। পূর্বাঞ্চলে বঙ্গীয় এলাকায় জমিদারদের এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পাঞ্জাব এলাকায় রায়তদের পৃষ্ঠপোষকতাই হচ্ছে এই ফর্মুলার মূল নীতি। আদিতে আইরিশ লর্ড আর্ল মেয়ো (১৮২২-৭২) ভাতীয় প্রিন্সদের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হওয়া এবং আফগানদের ‘হতবুদ্ধি করার পর দেশে ফেরার প্রাক্কালে আন্দামানে কারাগার পরিদর্শনকালে জনৈক মেয়াদী আসামীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

এর পর গভর্ণর জেনারেল পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এককালের ব্যাংকার নর্থব্রুক। তিনি ভারতের প্রশাসনযন্ত্রে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও আইনের শাসন প্রবর্তনে সচেষ্ট হন।

১৮৭৬ থেকে ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চার বছরের জন্য ইংরেজ ভারতের ভাইসরয় হিসেবে আগমন করেন মেধাবী চরিত্রের এডোয়ার্ড রবার্ট বুলার লিটন (১৮৩১-৯১)। তিনি সর্বপ্রথম সিমলায় এক ভোজসভায় কোর্স পরিবেশনের বিরতিকালীন সময়ে চুরুট পান করে উচ্চ মহলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। লিটনের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ভারত উপমহাদেশে পৌনঃপুনিক দুর্ভিক্ষ রোধের লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পের বাস্তবায়ন।

লিটনের পর ভাইসরয় পদে নিযুক্তি লাভ করলেন মুক্তবুদ্ধির জর্জ ফোডারিক রবিনসন রিপন (১৮২৭-১৯০০)। ইনি ১৮৮০ থেকে ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদরা এখানে বিশেষভাবে ইংল্যাণ্ডে উদারপন্থীদের জয়জয়কারের কথা উল্লেখ করেছেন। ১৮৬৮ থেকে ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৮ বছর ধরে উদারপন্থীদের নেতৃত্বদানকারী গ্লাডস্টোন ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েই ভারতে জনকল্যাণকর শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে লর্ড রিপনকে প্রেরণ করেছিলেন। এসময় ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোন প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, “আমাদের দুর্বলতা ও ভাগ্যের ফেরে একথা বলতে হয় যে, আমরা মুক্ত চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ-সুবিধা ভারতীয়দের মধ্যে বিলিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছি।” ভাইসরয় লর্ড রিপন ভারত উপমহাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। কিন্তু ভারতীয় সেশন জজদের ইউরোপীয়দের বিচার করার ক্ষমতা প্রদানকালে ভারতে অবস্থানকারী শ্বেতাংগদের নিকট থেকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এটাই হচ্ছে বিখ্যাত ইলবার্ট বিল। শ্বেতাংগদের বিরোধিতার ফলে ইলবার্ট বিলে কিছু সংশোধন করা হলেও দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে “ভাইসরয় রিপন ভারতীয়দের বিশেষ করে কোলকাতার বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের নিকট থেকে আশাতীতভাবে বিদায় সম্বর্ধনা লাভ করেন। এরপর ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ একে একে এলেন আভা ফ্রেডারিক টেম্পেল ডাফরিন (১৮২৬-১৯০২), লর্ড ল্যান্সডাউন এবং স্কটিশ এলগিন।

ইংরেজ সৈন্যদের দ্রুত যাতায়াতই ভারতে রেলওয়ে স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য

এ ধরনের এক পূর্বাবর ইতিহাস বর্ণানাপূর্বক ইংরেজ গবেষক পারসিভ্যাল স্পিয়ারের মত হচ্ছে, ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ভারতে ইংরেজ রাজত্বের তুংগ অবস্থা। তিনি লিখেছেন, ভারতে রেলওয়ে স্থাপনের জন্য ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিলো ১৯০১ সালের মধ্যে তা’ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ রেলওয়ে পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই একই বছরে অর্থাৎ ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দেই ভারতে টেলিগ্রাফ পদ্ধতিও চালু করা হয়। কিন্তু তিনি একথা উল্লেখ করেননি যে, ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে সিপাহী বিপ্লবের পর সম্ভাব্য সমস্ত রকমের বিদ্রোহকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে দ্রুত সৈন্য প্রেরণের সুবিধার জন্যই ভারতে রেলপথ স্থাপনের কাজ ত্বরান্বিত করা হয়েছিল। উপরন্তু ভারতের চা, পাট, কার্পাস, নীল, অভ্র, আফিম ইত্যাদি সম্পদ বিদেশে রফতানীর জন্যও রেলওয়ের প্রয়োজন ছিলো সর্বাধিক। পারসিভ্যাল এ মর্মে দাবী করেছেন যে, ভারতের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে পাঞ্জাব এলাকার সেচ ব্যবস্থা ইংরেজদের এক অবিস্মরণীয় অবদান। কিন্তু তিনি এ কথাটি স্বীকার করেননি যে, ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবকে নিশ্চিহ্ন করতে যেয়ে ইংরেজরা যেসব নেটিভ সৈন্যদের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছিলো কেবলমাত্র গুর্খারা ছাড়া বাকী প্রায় সবাই ছিলো পঞ্চনদের হিন্দু-মুসলমান-শিখ বাসিন্দা। এজন্য এদের সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে এই সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিলো। ইতিহাস আরও সাক্ষী দেয় যে, ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ইংরেজদের উদ্ধারের জন্য শিখ সৈন্যরাই সর্বপ্রথম দিল্লীতে প্রবেশপূর্বক সিপাহীদের রক্ষাব্যূহ ভেদ করে রক্ত গংগা প্রবাহিত করেছিলো। আর কোলকাতায় এই বার্তা পৌঁছানোর পর বাঙালি বর্ণ-হিন্দুদের মুখপাত্র পন্ডিত গৌরীকিশোর ভট্টাচার্য ওরফে গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যি সম্পাদিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকার মন্তব্য হচ্ছে “…. আমাদিগের (ইংরেজদের) সৈন্যরা দিল্লীর প্রাচীরে উঠিয়া নৃত্য করিতেছে।—ব্রিটিশাধিকৃত ভারত বর্ষবাসী প্রজা সকল নির্ভয় হও…।”

ইংরেজ গবেষকরা একথাটা সঠিকভাবে লিখতে সম্ভবতঃ লজ্জাবোধ করেন যে, “বৃটিশ প্রভূত্বকে ভারত ভূমিতে অক্ষত রাখিয়া শাসকগণের নিকট হইতে কিছু সুবিধা-সুযোগ আদায়ের জন্য যে আন্দোলন “রিনাসান্সের” নায়কগণ আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহা ছিল রাজনৈতিক সংসকারের আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম নহে”। (সূত্রঃ ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম-সুপ্রকাশ রায়)।

এমনকি এসব শ্বেতাংগ ঐতিহাসিকরা ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা কেন্দ্রিক সামাজিক চরিত্রের মূল্যায়ন করতে যেয়ে এ মর্মে মন্তব্য করতেও সাহসী হননি যে, “…ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণী ও শিক্ষিত মধ্য বিত্তশ্রেণীর মধ্যে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।…হিন্দু-প্রধান বাঙালি বুর্জোয়াশ্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীই বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত, এবং তা প্রধানতঃ হিন্দুসমাজের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত।” (সূত্রঃ বাংলার নবজাগৃতি-বিনয় ঘোষ )

৪৭ বছরে ইংরেজ ভারতে দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ২ কোটি ৮৮ লক্ষ

ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সময়কালকে ইংরেজ রাজত্বের পূর্ণ বিকাশের সময় হিসেবে বর্ণনা করে এ মর্মে উল্লেখ করেছেন যে, এ সময়ে রাজধানী কোলকাতায় ইংরেজী শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী পূর্ণ অবয়ব লাভ করেও ভারতীয়দের আংশিকভাবে স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত প্রদান করা হয় এবং বস্ত্র ও লৌহ শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য যান্ত্রিক যুগের সূচনা হয়। সর্বোপরি এ সময়েই ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। কিন্তু এসব ইতিহাসবিদরা একথাটি বলেননি যে, আলচ্য পঞ্চাশ বছরে শুধু বঙ্গীয় এলাকার সাঁওতাল বিদ্রোহ, দ্বিতীয় পর্যায়ে ওয়াহাবী আন্দোলন, নীল চাষীদের বিদ্রোহ, সুন্দরবনের বিদ্রোহ, গারোদের বিদ্রোহ, কুকিদের অভ্যুত্থান, ত্রিপুরার কৃষক বিদ্রোহ, সন্দ্বীপের চতুর্থ বিদ্রোহ এবং সিরাজগঞ্জের ভয়াবহ কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে।

পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদ আর গবেষকের দল একথাটা সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ১৮৫৪ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত মোট ৪৭ বছরে ইংরেজ ভারতে শুধু দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতির দরুন প্রায় ২ কোটি ৮৮ লক্ষ ২৫ হাজার মানব সন্তান এই ধরাধাম থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। (সূত্রঃ ‘দি স্টারভিং মিলিয়ন’–এস কে চ্যাটার্জি)।

ইংরেজ ঐতিহাসিক ও গবেষকদের পক্ষে এধরনের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকার মূল কারণ একটাই এবং তা’ হচ্ছে আলোচ্য সময়ে ভারতে ইংরেজ শাসনের যথার্থতা প্রমাণ করা। সেক্ষেত্রে বিশ্বের সর্ববৃহৎ (বৃটিশ সাম্রাজ্যের আয়তনঃ ১৩ কোটি ৩৫ লক্ষ ৫ হাজার বর্গ মাইল) সাম্রাজ্যের অধিকারী এবং সবচেয়ে পরিপক্ক শাসকগোষ্ঠী এই ইংরেজদের পক্ষে উপমহাদেশের অত্যন্ত বিশ্বাসী ও অনুগত কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়কে নানা তত্ত্বকথা আর আদর্শের বুলি কপচিয়ে একটি সম্পূরক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপগুলো নিতান্তই স্বাভাবিক বলে গণ্য করলে আপত্তি থাকার কথা নয়। এজন্যই লর্ড উইলিয়াম বেনটিং (১৭৭৪-১৮৩৯) ভারতে গভর্ণর জেনারেল থাকাকালীন সময়ে তাঁর আইন উপদেষ্টা টমাস বেবিংটন মেকলে (১৮০০-১৮৫৯) ‘নেটিভদের মাঝ থেকে একটি সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এ মর্মে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, এদেশে এমন এক শ্রেণী বানানো প্রয়োজন “যার বর্ণ এবং রক্ত ভারতীয়দের, কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ এবং বুদ্ধিশীলতা ইংরেজের।”

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে যৌবনপ্রাপ্ত হলো ইংরেজ শাসকের সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত সমর্থক গোষ্ঠী “কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।” তবে ইংরেজরা যেমনটি চেয়েছিলো ঠিক হুবহু তেমনটি হয়নি। রাধাকান্ত—বঙ্কিম-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-দয়ানন্দের বদৌলতে এদের ললাটে শোভিত হলো চন্দন-প্রলেপ। একদিকে যখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নৃশংস দমন-নীতির ফলে একের পর এক সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই এঁরা ইংরেজদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে যথাযথভাবে ভূমিকা পালন অন্তে সনাতন হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের লক্ষ্যে সোচ্চার হলো।

মেকলের সেই বিখ্যাত উক্তির প্রেক্ষিতে উপ-মহাদেশের গতিধারার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এরপরেই রাজধানী কোলকাতাকে কেন্দ্র করে শুরু হলো সেই প্রক্রিয়া। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যেই ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজীকে ঘোষণা করা হলো অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে। শুরু হলো কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দুদের ‘উন্মেষের যুগ। ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে পাশ্চাত্য-ঘেঁষা উদারপন্থী ‘তত্ত্ববোধিনী সভার’ প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৪৩ খ্রীষ্ঠাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রথম প্রকাশের মাধ্যমে ইয়ং বেংগল-এর দাপট তখন তুংগে। এর মধ্যে ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ইংরেজ সমর্থক ‘জমিদার সভা’ এবং ‘বৃটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটি’– এই দু’টি সমিতিকে একত্রিত করে তৈরী হলো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ‘বৃটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশন। সম্পাদক নির্বাচিত হলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে যখন সমগ্র বাংলা এবং উত্তর ভারতীয় এলাকা মহাবিদ্রোহের বহ্নিশিখায় প্রজ্বলিত, সে সময় কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে স্থাপিত হচ্ছে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। রক্তাক্ত সিপাহী বিপ্লবের সময় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সিমলার পাহাড়ে অবস্থান করলেও অন্যান্য বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দ একবাক্যে কিভাবে সোচ্চার কণ্ঠে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন যুগিয়ে আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলো তা অন্যত্র বিস্তারিত বিবৃত করেছি। এ ধরনের এক সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিভংগি তো ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত দেখতে পাই।

পঃ বাংলার সিপিএম সরকারের অর্থে প্রকাশিত গ্রন্থের মতামত

এজন্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর আট দশকে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সমর্থক সম্প্রদায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মনমানসিকতা সম্পর্কে পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক ডক্টর পুলিন দাশ সম্প্রতি (১৩৯০ বংগাব্দ) পশ্চিম বঙ্গের মার্কসীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে তাঁর রচিত “বংগ রঙ্গমঞ্চে ও বাংলা নাটক” শীর্ষক গ্রন্থে যেসব চাঞ্চল্যকর এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দান করেছেন তার কিয়দংশ এখানে উপস্থাপন করা অপরিহার্য মনে করছি। তিনি লিখেছেন :

“১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্ম সমাজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ ও অপর অংশ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় “আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে চিহ্নিত হয়।….. দেবেন্দ্রনাথের পৌরহিত্যে আদি ব্রাহ্ম সমাজের রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ প্রতিপাদক বিখ্যাত বক্তৃতা দেন (১৮৭২)। ‘বংগদর্শন’-এ বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক রাজনারায়ণের বক্তৃতার উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি প্রকাশিত হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে বঙ্কিমচন্দ্রকেও দেখা যায় হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যয়ন ও আলোচনায় নিবিষ্ট হতে। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রচার’ পত্রিকা হিন্দু ধর্মের প্রচার মাধ্যম হয়ে ওঠে। দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত ‘আর্য সমাজ’ (১৮৭৫) আন্দোলন হিন্দু পুনরাভ্যুত্থানে বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। বেদকে অভ্রান্ত গণ্য করে দয়ানন্দ হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যার দ্বারা হিন্দু ধর্মের প্রতি শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। লালা হংসরাজ, লালা লজপত রায়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রভৃতি নেতৃবর্গ অতঃপর দয়ানন্দ প্রবর্তিত মতবাদের অনুপ্রেরণা জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে সঞ্চারিত করেন।…….

“বঙ্কিমচন্দ্রের ‘প্রচার’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের আরও কয়েকটি পত্র-পত্রিকা বিশেষ করে ‘বংগবাসী’, ‘নবজীবন’ হিন্দু ধর্মের পুনরভ্যুত্থান প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। শশধর তর্কচূড়ামণিকৃত হিন্দু ধর্মের ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যার প্রকাশক ছিল ‘বংগবাসী’ পত্রিকা। শশধরের হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বঙ্কিম শিষ্য কোৎপন্থী চন্দ্রনাথ বসু হিন্দু পুনরভ্যুত্থান পন্থায় আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁর ‘নবজীবন’ পত্রিকায় যুক্তিবাদের পথ পরিহার করে দেন। অক্ষয়চন্দ্র বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচরণ করে তাঁর অভিমত দেন আর ‘বংগবাসী স্ত্রী শিক্ষার কুফল প্রদর্শনে ব্রতী হয়।…..”

“বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি বৈষ্ণব ভক্তিবাদে আকৃষ্ট হন। বংগদেশের শিক্ষিত সাধারণের কাছে দয়ানন্দ পরিচিত হয়েছিলেন কেশবচন্দ্রের মাধ্যমে। ইণ্ডিয়ান মিরর’ ও ‘সুলভ সমাচার’ পত্রে প্রধানতঃ কেশবচন্দ্রের রচনাধারার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহিমা প্রকাশ পেতে থাকে। হিন্দুর যে পৌত্তলিকতা নব্য শিক্ষিতদের দ্বারা সম্পূর্ণ বিবর্জিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ ছিলেন সেই পুতুল পূজারী। গ্রাম্য ব্রাহ্মণের প্রতি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে কেশব চন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, মহেন্দ্রনাথ সরকার, অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রভৃতির ন্যায় ভিন্নমার্গী বহু গুণীজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের দৃষ্টান্তে পৌত্তলিক হিন্দুর আত্মপ্রসাদ লাভের যথেষ্ট সুযোগ মিলল। নিরাশ্রিত আশাহত চেতনার অবলম্বন হয়ে উঠলো হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতি।……”

বঙ্গীয় এলাকায় সৃষ্টি হলো শতাব্দীকালের বিষবৃক্ষ

অবশ্য এর সূচনা হয়েছিলো ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী’র প্রথম বৈঠকে। এ কথা চিন্তা করলে আজ বিস্মিত হতে হয় যে, আলোচ্য বৈঠকে রাজনারায়ণ মহাশয় তাঁর অনুষ্ঠানপত্রে ‘হিন্দু ব্যায়াম’, ‘হিন্দু সংগীত’, ‘হিন্দু চিকিৎসাবিদ্যা’ এবং ‘হিন্দু শাস্ত্র’ অবলম্বনে সমাজ সংস্কার সম্পাদনার জন্য বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন এবং কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই আবেদন ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও আবারও উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, রাজনারায়ণের প্রণীত এই অনুষ্ঠানপত্রের ভিত্তিতে পরবর্তী বছরেই অর্থাৎ ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল বেলগাছিয়ার ডানকান সাহেবের বাগান বাড়ীতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র, নাট্যকার মনোমোহন বসু প্রমুখের উদ্যোগে “হিন্দু মেলা” প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে মোট ১৪ বার মেলার বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দু মেলার দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে প্রধান বক্তা মনোমোহন বসুর ভাষণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি এ মর্মে আশা প্রকাশ করেন যে, “হিন্দু মেলায় ‘ঐক্যনামা’ যে মহাবীজ রোপিত তার ফলে অতি শুভ্র সৌভাগ্যপুষ্প বিকশিত হইবে। … তাহার ফলের নাম করিতে এক্ষণে সাহস হয় না, অপর দেশের লোকেরা তাহাকে ‘স্বাধীনতা নাম দিয়া তাহার অমৃতাস্বাদ ভোগ করিয়া থাকে।” (হিন্দু মেলার ইতিবৃত্তঃ সুনীল দাস সম্পাদিত, কলিকাতা ১৯৮১)

পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত জাতীয় সভার অধিবেশনেও মনোমোহনের ভাষণ হচ্ছে, “আমাদের (বর্ণ হিন্দুদের) বিলক্ষণ আশা হইতেছে “স্বাধীনতা” নাম্নী সুর মনোমোহিনী কন্যা জন্মগ্রহণ করিতে পারিবেন।” এখানে উল্লেখ্য যে, এটা এমন একটা সময় যখন ইয়ং বেঙ্গল নির্বাপিত এবং ব্রাহ্ম আন্দোলনও স্তিমিত। কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মনে তখন অনেক আশা। শীঘ্র “স্বাধীনতা” নামক ডুমুরের ফুল তাঁদের ‘কোচরে’ এসে আশ্রয় নেবে। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র তখন ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করলেন যে, “প্রকৃত হিন্দুধর্ম জ্ঞানাত্মক, কর্মাত্মক নহে।” অবশ্য বঙ্কিমের পদাঙ্ক অনুসরণকারীদের অনেকেই হিন্দুধর্মের এই ‘কর্মাত্মক’ দিকটির ওপরেই জোর দিয়ে তাকে আবার আচার-আচরণগত ক্রিয়াকলাপের কুক্ষিগত করে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারে নিমগ্ন হলেন। ফলে সমস্ত রকমের যুক্তিবাদ হলো পরিত্যাজ্য আর সনাতন হিন্দু ধর্মের ভক্তিবাদের জোয়ার প্রবাহিত হলো।

এ জন্যই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ঊনিশ শতকের আটের দশকের সূচনার সময় ছিল এই হিন্দু পুনরুত্থানের মাহেন্দ্রক্ষণ। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত চাতুর্য্যে এতোদিন ধরে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার আপ্লুত রক্ষণশীল সনাতন হিন্দু ধর্মরূপী যে চারাবৃক্ষে জল-সিঞ্চন করছিলো, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে এসে কোলকাতায় সখারাম গনেশ দেউস্কর আর ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘শিবাজী উৎসব’-এর মাধ্যমে তার বিরাট মহীরুহ আকারের চেহারাটা সকলের দৃষ্টিগোচর হলো। আসলে এটাই হচ্ছে বঙ্গীয় এলাকার শতাব্দীকালের বিষবৃক্ষ।

এতগুলো বছর পরে এ কথা আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয় যে, বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপটে যখন রামমোহন-ইয়ং বেঙ্গল-বিদ্যাসাগর- মধুসূদন প্রমুখের সাধনা ও অবদানে উদার ও পাশ্চাত্য-ঘেঁষা সংস্কারপন্থী মনমানসিকতায় বাঙালি বর্ণহিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটা অবয়ব সৃষ্টি হতে চলেছিলো এবং যাকে বাংলার ‘রেনেসাঁ’ বলে চিহ্নিত করে অনেকে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলার আকাশে একে একে উদিত হলেন বঙ্কিম- রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দদের মতো উজ্জ্বল অথচ রক্ষণশীল প্রতিভার। বর্ণ হিন্দু লেখকরা ছাড়াও ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ‘জ্ঞানপাপীর’ মতো রামমোহন-ইয়ং বেঙ্গল-বিদ্যাসাগর- মধুসূদনের কর্মোদ্যমের ধারাবাহিকতায় বঙ্কিম- রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দের কর্মকাণ্ডকে লিপিবদ্ধ করলেন। অথচ কার্যতঃ দু’টো ধারা তো’ সম্পূর্ণভাবে পরস্পর বিরোধী। এর সমর্থনে এটুকু বললেই যথেষ্ট যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর আট দশকে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ‘উদার ও সংস্কারপন্থী মনমানসিকতা’ উচ্ছিষ্টের মতো নর্দমায় নিক্ষিপ্ত করেছে। মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে মেকলের ভবিষ্যৎবাণীর সঙ্গে যুক্ত হলো ‘সনাতন হিন্দু ধর্মের’ শ্রেষ্ঠত্ব’ আর ‘হিন্দু বাহুবলের ‘ আবরণ। ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় বলতে গেলে নীরবেই বরণ করে নিলো এই পশ্চাদমুখী দিক দর্শনকে।

সবার অজান্তেই বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তরা তখন কৈশোরে উপনীত

এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেলো ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সংগে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বৰ্ণ হিন্দু বুদ্ধিজীবী এবং নেতৃস্থানীয়দের “আবদার- অভিমান- আবেদনের” যুগ। ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের শেষ নাগাদ স্থাপিত হলো জাতীয় কংগ্রেস। মহারাষ্ট্রের নব্য শিল্পপতিদের পুরোধা মারাঠা ব্রাহ্মণদের সংগে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের ‘মহামিলন’ আর বংগীয় এলাকায় ভবানী পূজা এবং শিবাজী উৎসবের আয়োজন করতে করতে ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাপ্তিও হয়ে গেলো। কিন্তু বলতে গেলে সবার অজান্তেই এরমধ্যে ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের দল সবেমাত্র কৈশোরে উপনীত হয়ে অবাক বিস্ময়ে এসব কিছু অত্যন্ত সন্তর্পণে অবলোকন করছে। সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষাকল্পে এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিহাসের গতিধারায় এঁদের শুরুটাও হলো সাম্প্রদায়িকতার পথ বেয়ে।

প্রখ্যাত মার্কসীয় গবেষক গোপাল হালদারের ভাষায় বলতে হলে, “সাংস্কৃতিক আয়োজনেও বাঙালি (বর্ণ হিন্দু) শিক্ষিত শ্রেণী দেশের জনসমাজ থেকে কতকাংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। বিশেষ করে দেখি, বিক্ষুব্ধ মুসলমান সমাজকে নবযুগের এই জাগরণ চাঞ্চল্য প্রায় স্পর্শও করতে পারেনি। অপরদিকে, খ্রীষ্টীয় প্রভাব প্রতিহত করার জন্য দেবেন্দ্রনাথ-রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ মনীষীরা প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যের সংগে এই সাধনাকে সংযুক্ত করলেন, তাতে তখন থেকেই হিন্দু জাগরণ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ ক্রমেই আমাদের জাতীয় প্রধান রূপ হয়ে উঠতে লাগল।”

(বাংলা সাহিত্যের রূপ রেখা ২য় খণ্ড গোপাল হালদার)।

এ ধরনের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ইংরেজ ভারতের নয়া ভাইসরয় হিসেবে আগমন হলো লর্ড মার্কুইস জর্জ ন্যাথানিয়াল কার্জনের। ইনি দুই দফায় মোট প্রায় পাঁচ বছরকাল ভাইসরয় হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রথম দফায় ১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ১৯০৪-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯০৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। ইতিহাসে লর্ড কার্জন সবচেয়ে বিতর্কিত ভাইসরয় হিসেবে বর্ণিত হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁরই প্রচেষ্টায় এদেশে বেশ কিছু জনহিতকর কাজের বাস্তবায়ন হয়েছিলো। এসবের মধ্যে কোলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরী) এবং পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য একটি পরত্নতাত্ত্বিক বিভাগ স্থাপন অন্যতম। পৃথকভাবে কৃষি বিভাগের সৃষ্টি এবং পুসা নামক স্থানে আধুনিক কৃষি গষেণাগার স্থাপন তাঁর অমর কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। অবশ্য ১৯৩৪ সালে বিহার ভূমিকম্পের পর পুসার কৃষি গবেষণাগারটি দিল্লীতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। দেশীয় নৃপতিদের আন্তরিক সমর্থন আদায় এবং সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কার্জন ইম্পিরিয়াল সার্ভিস কোর-এর সৃষ্টি করেন। উপরন্তু তিনি প্রশাসন ব্যবস্থাকে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে সচল করে তোলেন।

লর্ড কার্জনের প্রচেষ্টায় ইংরেজ স্বার্থে আফগান সমস্যার সমাধান হয় বলা যায়। তিনি ডুরত্তে লাইন-এর স্বীকৃতি আদায় করা ছাড়াও একটি স্থায়ী সমঝোতার লক্ষ্যে পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে হাজরা জেলাকে আলাদা করে পৃথক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ গঠন করেন এবং জির্গাশাসিত উপজাতীয় এলাকাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দেন। এ সময় কার্জন সীমান্ত প্রদেশকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে রাখার নির্দেশ দান করেন। ইংল্যাণ্ডে নতুন সম্রাট হিসেবে ১৯০৩ সালে যখন সপ্তম এডওয়ার্ড সিংহাসনে অভিষিক্ত হন, তখন এই উপলক্ষে দিল্লীতে আয়োজিত দরবারের সভাপতিত্ব করেন উদারপন্থী গ্ল্যাডস্টোনের ভাবশিষ্য এই লর্ড কার্জন।

এরপর থেকে কার্জন-এর কর্মকাণ্ড বিতর্কিত হতে শুরু করে। ভারতে অবস্থিত ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর চূড়ান্ত প্রশাসনিক কর্তৃত্ব নিয়ে সর্বপ্রথম তাঁর সঙ্গে প্রধান সেনাপতি লর্ড কিচেনারের মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর তিব্বত অভিযান ঈন্সিত সাফল্যলাভে ব্যর্থ হয়। এসময় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান অবস্থা তদন্তের লক্ষ্যে কার্জনের নির্দেশে গঠিত কমিটি কতিপয় সুপারিশ করলে ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট জারি করা হয়। এই অ্যাক্টের ফলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ফ্যাকাল্টি সৃষ্টি ছাড়াও আবাসিক পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। উপরন্তু, আলোচ্য অ্যাক্টের দরুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারণী সংস্থায় সরকারী মনোনীত সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করা হয়। ফলে অনতিবিলম্বে প্রাক্তন আইসিএস সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। ঠিক এমনি এক উত্তপ্ত পরিবেশে প্রশাসনিক কাজের সুবিধা এবং অনুন্নত এলাকায় সমৃদ্ধির কথা বর্ণনা করে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ঘোষিত হলো ‘বংগভঙ্গ’। সেতো আর এক সুদূরপ্রসারী চাঞ্চল্যকর ও অর্থবহ ইতিহাস। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সম্পূরক সম্প্রদায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের ‘আব্দার- অভিমান- আবেদনের” যুগের পরিসমাপ্তি হলো।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ থেকে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ পর্যন্ত অর্থাৎ লর্ড রবার্ট ক্লাইভ পর্যন্ত এই উপমহাদেশে ইংরেজরা ১৯০ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো। এই সময়কালে বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্যে যে দু’টি বিষয়ের ইতিহাসকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী হিসেবে চিহ্নিত করা নিতান্ত অপরিহার্য বলে মনে হয়, খুবই দুঃখজনকভাবে সে দু’টি বিষয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা হয় অত্যন্ত সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন, না হয় বিকৃত তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। এর প্রথমটি হচ্ছে ইংরেজ বিরোধী অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ এবং দ্বিতীয়টি বংগভংগ (১৯০৫-১৯১১)। ইংরেজ-বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা না করলেও প্রাসংগিক বিধায় সংক্ষেপে এসবের উল্লেখ বাঞ্ছনীয় মনে হয় :

১. সন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ : ১৭৬৩-১৮০০ খ্রী:

২. মেদিনীপুরের কৃষক বিদ্ৰোহ :  ১৭৬৬-১৭৮৩ খ্রীঃ

৩. ত্রিপুরায় শমসের গাজীর বিদ্রোহ :  ১৭৬৭-১৭৬৮ খ্রীঃ

৪. সন্দীপের কৃষক বিদ্ৰোহ :  ১৭৬৯ খ্রীঃ

৫. কৃষক তন্তুবায়দের আন্দোলন :  ১৭৭০-১৭৮০ খ্রীঃ

৬. পার্বত্য চট্টগ্রামে রামু খাঁর বিদ্রোহ :  ১৭৭৬-১৭৮৭ খ্রীঃ

৭. নীলচাষীদের প্রথম বিদ্রোহ : ১৭৭৮-১৮০০ খ্রীঃ

৮. রেশমচাষীদের সংগ্রাম :  ১৭৮০-১৮০০ খ্রীঃ

৯. রংপুরে নূরুলউদ্দিনের বিদ্রোহ :  ১৭৮৩ খ্রীঃ

১০. যশোর-খুলনার প্রজা বিদ্রোহ : ১৭৮৪-১৭৯৬ খ্রীঃ

১১. বীরভূম-বাঁকুড়ার বিদ্রোহ :  ১৭৮৯-১৭৯১ খ্রীঃ

১২. বাখরগঞ্জে বোলাকি শা’র বিদ্রোহ : ১৭৯২ খ্রীঃ

১৩. বীরভূম-বাঁকুড়ার ২য় বিদ্রোহ :  ১৭৯৮-১৭৯৯ খ্রীঃ

১৪. করম শা’-র নেতৃত্বে ‘পাগলপন্থী’ আন্দোলন :  ১৭৭৫-১৮০২ খ্রীঃ

১৫. মেদিনীপুরে নায়েক বিদ্রোহ :  ১৮০৬-১৮১৬ খ্রীঃ

১৬. ময়মনসিংহ পরগণায় কৃষক বিদ্রোহ :  ১৮১২ খ্রীঃ

১৭. সন্দীপের কৃষক বিদ্ৰোহ :  ১৮১৯ খ্রীঃ

১৮. ময়মনসিংহে ‘হাতীখেদা বিদ্রোহ’ : ১৮০০-১৮৩০ খ্রীঃ

১৯. ময়মনসিংহে ‘পাগলপন্থী’দের বিদ্রোহ : ১৮২৫-১৮২৭ খ্রীঃ

২০. নীল চাষীদের সংগ্রাম : ১৮৩০-১৮৪৮ খ্রীঃ

২১. তীতুমীর-এর বিদ্রোহ : ১৮৩১ খ্রীঃ

২২. ‘পাগলপন্থীদের’ ৩য় বিদ্রোহ : ১৮৩২-১৮৩৩ খ্রীঃ

২৩. গারোদের বিদ্রোহ : ১৮৩৭-১৮৮২ খ্রীঃ

২৪. ফরিদপুরে ফারাজীদের অভ্যুত্থান : ১৮৩৮-১৮৪৮ খ্রীঃ

২৫. ত্রিপুরায় কৃষক বিদ্ৰোহ : ১৮৪৪-১৮৯০ খ্রীঃ

২৬. মহাজনদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ : ১৮৫৯-৬১ খ্রীঃ

২৭. সিপাহী বিপ্লব : ১৮৫৫-১৮৫৭ খ্রীঃ

২৮. নীল বিদ্রোহ : ১৮৫৭ খ্রীঃ

২৯. সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ : ১৮৭২-১৮৭৩ খ্রীঃ

৩০. যশোরে নীল বিদ্রোহ : ১৮৮৯ খ্রীঃ

বংগীয় এলাকায় অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ রাজশক্তি এবং জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে একের পর এক যে রক্তক্ষয়ী কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে সেসবের প্রকৃত ইতিহাস রচিত হয়নি বললেই চলে। কৃষক বিদ্রোহের যেটুকু ইতিহাস আমরা দেখতে পাই তার প্রায় সবটাই বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের পদাংক অনুসরণ করে এদের সমর্থক গোষ্ঠী সে আমলের ইংরেজী শিক্ষিত কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের লেখকগণও বিকৃতভাবে কৃষক বিদ্রোহগুলো চিত্রিত করেছেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে এবং ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর “একান্ত বাধ্য” হিসেবে নিজেদের ভূমিকা প্রমাণ করার উদগ্র বাসনায় প্রকাশ্যেই আলোচ্য প্রতিটি কৃষক বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছে। এতোগুলো বছর পরে ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গবেষক সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে সত্যভাষণ করেছেন, তিনি লিখেছেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীতেই যখন বিহার ও বংগদেশের উপর দিয়া কৃষক-বিদ্রোহের ঝড় বহিতেছিল, তখন এই শিক্ষিত মধ্যশ্রেণী গণসংগ্রামের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া বিদেশী ইংরেজ প্রভুদের শাসনকে “ভগবানের আশীর্বাদ”রূপে বরণ করিয়া ইংরেজী শিক্ষা দানের ভিত্তিতে নিজেদের নূতনভাবে গড়িয়া তুলিতে ব্যস্ত হইয়াছিলেন। সভ্যশ্রেণীরূপে নিজেদের গড়িয়া তুলিবার জন্য সর্বপ্রথম সাহিত্যের প্রয়োজন। সুতরাং নুতন সাহিত্য সৃষ্টি আরম্ভ হইল। বঙ্কিমচন্দ্র হইলেন এই সাহিত্যসৃষ্টি কার্যের প্রধান নায়ক এবং তাঁহার সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্য দিয়াই মধ্যশ্রেণীর এই “রিনাসাস” পূর্ণ বিকশিত রূপ গ্রহণ করিল।

“ঊনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্ট বাঙলা সাহিত্যের মধ্যে মাত্র দুইখানি নাটক ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থে তৎকালের বংগদেশ ও বিহারব্যাপী কৃষকবিদ্রোহের কোন ছায়ামাত্র নাই, আছে কেবল বিকৃতি। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র ‘সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের’ পটভূমিকায় ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরানী’ নামে দুইখানি উপন্যাস রচনা করিয়া কৃষক বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য বিকৃত করিয়া দেখাইয়াছেন যেন ভারতে ইংরেজ শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার জন্যই কৃষকগণ বিদ্রোহ করিয়াছিল। কৃষক বিদ্রোহের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এইভাবে বিকৃত করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার নিজ শ্রেণীর চরিত্র ও চিন্তাধারাই উদঘাটিত করিয়াছেন। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র কৃষকের দুর্দশার এবং এদেশে ইংরেজ প্রভুদের শোষণ-উৎপীড়নের চিত্র উদঘাটন করিয়া রচিত কোন সাহিত্যও সহ্য করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। দীনবন্ধু মিত্র তাঁহার ‘নীলদর্পণ” নাটকে কৃষকদের কোন সংগ্রামের চিত্র অঙ্কিত করেন নাই, কেবল ইংরেজ প্রভুদের শোষণ-উৎপীড়ন এবং কৃষকের চরম দুর্দশার চিত্রই অঙ্কিত করিয়াছেন। অথচ বঙ্কিমচন্দ্র ‘আর্ট’-এর নাম করিয়া ইহার উপরও আক্রমণ করিতে ইতস্ততঃ করেন নাই। মোশাররফ হোসেনের ‘জমিদার-দর্পণ’ নাটকের বিষয়বস্তু সিরাজগঞ্জের ঐতিহাসিক কৃষকবিদ্রোহ। রঙ্কিমচন্দ্র ইহার প্রচার বন্ধ করিবার জন্য কোন চেষ্টারই ত্রুটি করেন নাই।”

(ভারতের কৃষক-বিদ্রোহঃ সুপ্রকাশ রায়, কলিকাতা)

উপরন্তু প্রকৃত ইতিহাস সন্ধান করলে আরও দেখতে পাওয়া যায় যে, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের দাবানলে যখন সমগ্র পূর্ব ও উত্তর ভারতীয় জনগোষ্ঠী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, তখন বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বসূরী কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় হয় বিত্তশালী ব্যক্তিদের বাগান বাড়ীতে নাটক কিংবা নৃত্যগীত উপভোগ করেছিলো, না হয় প্রকাশ্যেই ইংরেজ-বিরোধী কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনায় মেতে উঠেছিলেন। এঁদের মধ্যে বর্ণহিন্দু মনীষী হিসেবে স্বীকৃত কিশোরী চাঁদ মিত্র, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখের বক্তব্য হচ্ছে, “সিপাহী বিদ্রোহ সিপাহীদের ব্যাপার এবং জনসাধারণের সঙ্গে ইহার কোন সংশ্রব নেই।” বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ এবং পণ্ডিত গৌরীশংকর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ বিশিষ্ট পত্রিকাগুলোতে সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কিত ভয়াবহ মন্তব্য ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। এখানেই শেষ নয়, ১৮৫৭ সালের ২৬শে মে তারিখে রাজা রাধাকান্ত দেব-এর সভাপতিত্বে ‘হিন্দু মেট্রোপলিটান’ কলেজে অনুষ্ঠিত “সম্ভ্রান্ত মহাশয়দের” সভায় প্রকাশ্যেই ইংরেজদের সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়েছিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *