প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৪.১৩

১৩

সেই রাত্রেই সেগুলির শেষকৃত্য করে এসে স্নান করে রঘুকে বললে—একটু কড়া ক’রে চা কর্ রঘু।

রঘু বোতল গ্লাস নিয়ে আসছিল। সে বললে—এ খাবে না?

—না। খেতে তার ইচ্ছে করছিল না। রঘু সেগুলো ব্র্যাকেটের উপর রেখে দিয়ে ও ঘরে যাচ্ছিল চা করতে। সুরেশ্বর আবার জিজ্ঞাসা করলে—শোন। আর একবার ভাল করে দেখে আয় কুয়োর ধারে কিছু পড়ে আছে কি না? ভাল করে দেখবি। না—চল আমি সুদ্ধ যাই।

ওই জিনিসগুলি বিবিমহলের পিছনে যে উঠোনটা আছে সেই উঠোনের মাঝখানে একটা মজা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কুয়োটায় গ্রীষ্মকালে জল থাকে না, বর্ষায় জলে ভরে ওঠে। পুরনো কুয়ো, মেরামতের অভাবে গাঁথনীর গায়ের ছিদ্র দিয়ে গ্রীষ্মে শুকনো কাঁসাইয়ের টানে জল ম’রে যায়, আবার বর্ষায় কাঁসাই ভরলে অর্ধেকের উপর জল ঢুকে ভরে যায়। এখন কুয়োটা শুকনো। তলায় রাজ্যের আবর্জনা জমে আছে, তার মধ্যে কাঁসাইয়ের ওপারের বনের ঝরাপাতা বেশী। ঝড়ে উড়ে এসে পড়ে। কাদাও অনেক। তারই মধ্যে শক্ত জিনিস অর্থাৎ বুলেট, স্প্লিন্টার এবং লোহার খোলগুলো ফেলেছে। অ্যাসিড জাতীয় বস্তু এবং গুঁড়ো বস্তু যা ছিল তা ঢেলে দিয়েছে কাঁসাইয়ের জলে। শিশিগুলোও ভেঙে কাঁসাইয়ে ফেলে দিয়েছে। কাল থেকে কিছু মজুর লাগিয়ে মাটি কেটে কুয়োটাকে বন্ধ করে দেবে। বেশ সতর্কতার সঙ্গেই সব করেছে, আসবার সময় একবার দেখেও এসেছে, তবু আর একবার দেখা প্রয়োজন মনে হল। কয়েকদিন পর সর্বসমক্ষে জানাজানি করে ওই খাস কামরা খুলে ঝাড়ামোছা পরিষ্কার করবে ঠিক করেছে।

বেশ ভাল ক’রে দেখে এসে আবার একটা স্বস্তির দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে।

জীবনে এক-একটা দিন আশ্চর্য দিন আসে সুলতা। এমন আশ্চর্য দিন হয়তো সারাজীবনে দুটো বা চারটে আসে। তার বেশী নয়।

.

কাল রাত্রে বীরেশ্বর রায়ের জীবনের যে স্মরণীয় ঘটনার দিনটির কথা পড়তে পড়তে রাত্রি প্রভাত হয়ে গিয়েছিল, সেই দিনটি এইরকম; যতখানি সে পড়েছিল তারপরও প্রায় দু পাতা আছে। খাতা বন্ধ করবার সময় সেটা উল্টে দেখে নিয়েছিল মনে হয়। মেজদি ব্রজেশ্বর দুজনে এসে পড়েছিলও বটে আবার তার দারুণ একটা ভয় হয়েছিল তাও বটে। ভবানী দেবীর চিঠি! নাজানি তার মধ্যে কি লেখা আছে!

তবে ভবানী দেবীর ছবি যখন রায়বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো আছে আজও, তখন সেটা ভয়ঙ্কর কিছু নয়—সেটা বীরেশ্বর রায়েরই ভ্রান্তি—তাতে সন্দেহ নেই। তিনি বেঁচে ছিলেন, তাঁর শেষ জীবনে কন্যা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের সম্পত্তি নিয়ে মামলা হয়েছিল, রায়বাহাদুর তা মিটিয়ে নিয়েছিলেন। কন্যার জন্মের পূর্বে বীরেশ্বর রায় সস্ত্রীকভাগ্নে কমলাকান্তকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। কমলাকান্ত রায়বংশের বংশধারায় নামে ঈশ্বরত্ব যোগ করে রত্নেশ্বর হয়েছিলেন। ভবানী দেবীর শ্রাদ্ধ করেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। সুতরাং কলঙ্কের দুশ্চিন্তা সেখানে নেই। তবু একটা ভয় হচ্ছিল সুরেশ্বরের।

ভবানী দেবীর চিঠিখানাও সে পড়েছে তারপর। তাতে তার অন্ধকার গাঢ়তরই হয়েছে। যেন একটা হাঁপ ধরছিল। ভাবছিল এই অন্ধকারের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে সেই গাঢ়তম আদিম অন্ধকারের উৎস, যা রায়বাড়ীর বংশধরদের মধ্যে রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। রায়বাড়ীর সম্পদ তার উপর নীলাভ আবরণ দিয়ে চাঁদের কলঙ্ক শোভার মতো করে নিয়েছে। ভবানী দেবীর প্রতি বীরেশ্বর রায়ের সন্দেহ বিমলাকান্তকে নিয়ে-সে কি চাপা পড়েছিল? বাধ্য হয়ে চাপা দিয়েছিলেন বীরেশ্বর? কলঙ্কের ভয়ে?

শিউরে উঠেছিল সে। সেই মুহূর্তে অতুলেশ্বরকে নিয়ে কোলাহল প্রবল হয়ে উঠেছিল কীর্তিহাটে। তারপর থেকে এই মধ্যরাত্রি পর্যন্ত আশ্চর্য আর একদিক! রায়বাড়ীর বংশধারায় যে ঘনতম অন্ধকারের উৎসকে সে সন্ধান করতে গিয়ে সামনে পা ফেলতে ভয় করছিল, সেই অন্ধকার ভেদ করে একটা আশ্চর্য দীপ্ত রশ্মিরেখা বেরিয়ে এসেছিল, সেটার সামনে ছিল অতুলেশ্বর আর অর্চনা! আশ্চর্য মনে হয়েছিল। অন্যের কাছে এ যুগে সেটা হয়তো আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু সুরেশ্বরের কাছে সেটা আশ্চর্য। তারপর এই আশ্চর্য পরমাশ্চর্য হয়ে উঠল অর্চনার সঙ্গে ওই ভবানী দেবীর সাদৃশ্য দেখে।

তফাত রঙের, আর তফাত একটা আঙুলের। চিত্রকর ভবানী দেবীর ডান হাতে ছটা আঙুল বেশ একটু স্পষ্ট করে এঁকেছিলেন শিল্পনৈপুণ্যে।

রঘু এসে চা দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল—কিছু খাবে না?

চায়ে চুমুক দিয়ে আরাম বোধ করে সুরেশ্বর একটি আঃ শব্দ উচ্চারণ করে তারপর বলেছিল—এই রাত্রে আবার কি খাব? খেয়েছি তো!

রঘুর স্বভাব একটা খাঁজেই যেন পেরেক পোঁতা হয়ে আটকে আছে। সে উত্তাপে গলেও না, ঠাণ্ডাতে জমেও যায় না। ওর প্রকৃতির তাপমান সেই এক জায়গাতেই অচল ঘড়ির মতো স্থির হয়ে থাকে। কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ, চলাফেরা সব তাই। সে সেই ঠাণ্ডা গলায় থেমে থেমে বললে—সে কি খেয়েছ? সেই তো ন’টার সময় চারখানা লুচি খেয়েছ। সব তো ফেলে রেখেছ।

খেতে পারে নি সুরেশ্বর। মেজদি এবং অর্চনার কাছে সব শুনে উৎকণ্ঠিত হয়ে সে অপেক্ষা করছিল নিশুদ্ধ নিষুতি মধ্যরাত্রির। কথা ছিল রায়বাড়ীর অন্দরে সব নিষুতি হলে অর্চনা মেজদিকে নিয়ে ছাদে উঠে টর্চ জ্বালবে। সুরেশ্বর এদিকটা দেখেশুনে নিরাপদ বুঝলে টর্চ জ্বালবে। তারপর রঘুকে নিয়ে সে ওই খাস কাছারীর পিছনের গলিতে যাবে। সেই উৎকণ্ঠায় খেতে সে পারে নি। রঘুর তা ঠিক মনঃপুত হচ্ছে না। লালবাবু কাল রাত্রে খায় নি, আজ রাত্রে খাবে না, সে তার ভাল লাগছে না।

সুরেশ্বর বললে—এখন খেলে অসুখ হবে রঘু। যা। খিদে নেই।

—ওটা খাও। খিদে হবে—। আমি টাটকা লুচি ভাজি, মাছ আছে—না। কিছুই খাব না।

রঘু এবার চলে গেল। দুঃখিত হয়েই গেল, কিন্তু সে বোঝবার উপায় নেই। সেই শান্ত ধীর পদক্ষেপেই চলে গেল।

সুরেশ্বর স্তিমিত টেবিল ল্যাম্পটাকে বাড়িয়ে দিল। আজ সন্ধ্যে থেকে ইচ্ছে করেই হেজাক জ্বালে নি। টানাপাখা টানবার লোকটাকে এবং গোমেশ রোজাকেও সন্ধ্যে থেকে বিদায় ক’রে দিয়েছে। সন্ধ্যেবেলা ব্রজেশ্বর এসেছিল, তাকেও অল্পক্ষণ পরে বিদায় করে দিয়েছে। বলেছে—শীত-শীত করছে, আবার বোধ হয় ম্যালেরিয়াটা সাড়া দিচ্ছে। তুমি যাও ব্রজেশ্বরদা, আমি ঘুমোব।

ব্রজেশ্বরকে বিদায় করে টেবিল ল্যাম্পটা বাড়িয়ে দিয়ে সে আবার খাতাটা খুলে বসল।—তারপর? রায়বাড়ীর অন্দরমহলের দিকের জানালাটা বন্ধ করে দিলে।

***

১৯৩৬ সাল থেকে ১৮৫৬ সাল। এ আশী বছর। আশী বছর একটা শতাব্দী থেকেও অনেক বেশী। অনেক। আশী বছর আগের একটি দিনে জানবাজারের বাড়ীতে সে দেখতে পেলে বীরেশ্বর রায়কে।

বীরেশ্বর রায় ভবানী দেবীর চিঠিখানা খুলে স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবছিলেন। ভাবছিলেন এবং ডায়রীতে লিখেছিলেন তিনি—“তাহাকে আমি মারিয়া ফেলি নাই কেন?”

সুরেশ্বর আজ ভবানী দেবীর ছবিটা দেখে এসে অবধি তাঁর সম্পর্কেই ভাবছে। আর অর্চনার সঙ্গে তার সাদৃশ্য দেখে তার ভাবতে ইচ্ছে করছে ভবানী দেবী কি পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে এসেছেন? কোন ঋণ শোধ করতে এসেছেন? না তাঁর পাওনা পেতে এসেছেন?

হেরিডিটি-বিজ্ঞান সে মোটামুটি জানে। রত্নেশ্বর রায়ের বংশে সে বিজ্ঞানের নিয়মে তো ভবানী দেবীর রূপ বা সাদৃশ্য এ বংশে কাউকে আশ্রয় করে আসার কথা নয়।

সুরেশ্বর আবার ডায়রীখানা পড়তে শুরু করলে। মন চলে গেল ১৮৫৬ সালে।

বীরেশ্বর রায় ভাবছিলেন। ভাবছিলেন ভবানীর কথা।

এই চিন্তার মধ্যেই খানসামা এসে দাঁড়িয়েছিল বীরেশ্বর রায়ের সামনে।

বীরেশ্বর বললেন —কি?

—আজ্ঞে হুজুর, সেই পাগলাবাবা—

এতক্ষণে বীরেশ্বর রায়ের মনে পড়ল, লোকটি সকালবেলা ক্লেদাক্ত অবস্থায় জ্বরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তিনি চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন—কি হয়েছে তার? কেমন আছে?

—উঠে বসে শুধু কাঁদছে।

—কাঁদছে?

—হ্যাঁ, চুপচাপ বসে আছে, কাঁদছে, ডাকলে সাড়া দেয় না। পাঁচবার ডাকলে এক-একবার মুখের পানে তাকায়, কিন্তু আবার মুখ ফিরিয়ে বসে সেই কাঁদছে।

—জ্বরটা কমেছে তাহলে?

—তা হুজুর ওঁর অঙ্গে কে হাত দেবেন?

—কেন? যে বামুন সরকারমশাই ওকে ধোয়া-মোছা করেছিলেন?

—তিনি সেই ওকে ধোয়ামোছা ক’রে গঙ্গাস্নানে গিয়েছেন।

—হুঁ। চল দেখি।

ব’লে রায় উঠলেন। কাল রাত্রের কথা মনে পড়ছে। এ তো সে নয়। এ তো নয়। এর ছটা আঙুল! রায় এসে ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন, পরিচ্ছন্ন কাপড় পরানোতে ক্লেদ ধুয়ে দেওয়ার সঙ্গে শরীরের ময়লা উঠে মানুষটাকে অন্যরকম লাগছে। তা ছাড়া মানুষটার মধ্যে সেই অধীর অস্থিরতা আজ যেন অনেক শান্ত। তা ছাড়া কাল রাত্রে অসুখটাও হয়েছিল বেশী। পরিশ্রান্ত, দুর্বল হয়ে গেছে।

রায় ডাকলেন—শুনছেন?

শুনছ বলতে যেন বাধছে। পাগল বলতেও কেমন লাগছে। লোকে পালাবাবা বলে, তাও বলতে পারছেন না।

পাগল হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। তা ছাড়াও তাঁর দিকে পিছন ফিরে বসে রয়েছে সে।

—শুনছেন! বলে পাগলের পিঠে তাঁর হাত রাখলেন বীরেশ্বর রায়। জ্বর সামান্য আছে বলেই মনে হল।

পাগল এবার মুখ তুলে ফিরে তাকালে। রায় দেখলেন, সত্যি, পাগলের চোখ থেকে জলের ধারা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে-তার দাগ চকচক করছে। তাঁকে দেখে পাগল বললে—রায়বাবু!

—হ্যাঁ। কি হল? কাঁদছেন কেন?

একটু হাসলে পাগল। নিঃশব্দ একটুকরো হাসি।

রায় বললেন—কাল ছবি দেখে আপনি কি বলছিলেন? ওকে চেনেন?

—ওকে? পাগলের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দুর্বল শোনাচ্ছে। কাল রাত্রে জ্বরটা খুব বেশী হয়েছিল। বীরেশ্বর বললেন—হ্যাঁ-ও কে?

—ও? ও হ’ল—। ও হ’ল—দয়া। যেন অনেক ভেবে বললেন।

—দয়া? কি বলছ যা-তা? এবার আবার তুমি বলে ফেললেন রায়।

—আমার মন তাই বলছে। বুঝেছ! আমি তো ওকে দেখি নি। তবে-তবে—বুঝতে পারছি। সেই সেই ভয়ঙ্করী—

আতঙ্কে থর থর করে কেঁপে উঠল পাগল, বললে-না-না-বলব না। বলব না। না। বলতে বলতে আবার তার সেই অভ্যস্ত পাগলামি উঠল। নিজের গলা নিজে চেপে ধরলো এমন নিষ্ঠুরভাবে যে মানুষ নিজে নিজের গলা টিপে ধরতে পারে এ কথা বীরেশ্বর রায় এই পাগলের এই আত্মনির্যাতন না দেখলে বিশ্বাস করতেন না।

রায় আগে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস হয়েছে যে অদৃশ্য কেউ তাকে এইভাবে তার হাত দিয়েই তার গলা টিপে ধরে।

ধরে, কোন কথা পাগল বলতে চায় কিন্তু সে বলতে দিতে চায় না! এ দেশের প্রচলিত সংস্কার বিশ্বাসই তো শুধু নয়—মহাকবি শেক্সপীয়র হ্যামলেটের মুখ থেকে বলিয়েছেন—

“There are more things in heaven and earth than are dreamt of in your philosophy.”

তিনি পাগলের দুই হাত নিজের দুই হাত দিয়ে দৃঢ়মুষ্টিতে ধরলেন। আরও ক’বার তিনি জোর ক’রে ছাড়িয়েছেন, তিনি জানেন ওই বৃদ্ধ লোকটার শীর্ণ হাত লোহার সাঁড়াশীর মতো শক্ত হয়ে ওঠে এবং একটা অবিশ্বাস্য শক্তি সঞ্চারিত হয় ওই হাতে।

আজ অবশ্য সহজেই ছাড়াতে পারলেন ওর হাত। কালকের জ্বরে বড় দুর্বল হয়ে গেছে পাগল। সে নেতিয়ে পড়ে গেল। এবং আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

রায় অপেক্ষা ক’রে দাঁড়িয়ে রইলেন—তাঁর মনে হচ্ছে পাগল বলতে পারে ভবানী কোথায়? বলতে পারে ভবানী কে? লোকটা সম্পর্কে রাজাবাহাদুর রাধাকান্ত দেব বলেছেন- লোকটা সাধনা করতে গিয়ে পাগল হয়ে গেছে। হয়তো এই পাগলামির মধ্যেই তার সিদ্ধি একদিন আসবে। এই যে পাগলামি করে বেড়ায়, এরই মধ্যে চলছে ওর সেই সাধনা। এ দেশে তান্ত্রিক সাধক অনেক এমনই করে পাগল হয়, অনেকে পাগলই থেকে যায়। এদের অনেক শক্তি অনেক ক্ষমতা। যদি কিছু সে নাই জানতে পেরে থাকে তবে সে কাঁদছে কেন?

কিছুক্ষণ পর রায় তাকে জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি তো আপনি তো অনেক কিছু পারেন, অনেক কিছু জানেন—লোকে বলে আপনি নাকি সিদ্ধপুরুষ—

ঘাড় নাড়তে লাগল পাগল—না-না-না।

লুকোচ্ছ আমাকে?

—না। ঘাড়ই নাড়তে লাগল।

—তবে গন্ধ আনেন কি ক’রে?

শাক্তভাবে জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে এবার বললে-ওই—ওই—ওই পারি। আর ওই দুই একটা—। দূর-দুর্। ও-আর কি? ওতে কি হয়? ছলনাময়ী সর্বনাশী সে ভুলিয়ে দিলে। ভুলিয়ে দিলে। এখন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কাতরতার ক্লান্তিতে কণ্ঠস্বর যেন ভেঙে পড়ল।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে সে।

রায় এবার জিজ্ঞাসা করলেন—ওই ছবি কার? আপনি ওকে চেনেন? না চিনলে পরশু রাত্রি থেকে এমন করছেন কেন?

—অবিকল সেই সর্বনাশীর মত। কিন্তু সে নয়, সে নয়। এর ছটা আঙুল। সে নয়। সে মোহিনী, এ দয়াময়ী। মুখ দেখে চিনতে পারবে এ দয়াময়ী। তার যে নানা রূপ। কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী! ভয়ঙ্করী ক্ষেমঙ্করী মোহিনী করুণাময়ী। ওকে চেনা ভার, ওকে জানা ভার। ওকে জোর ক’রে জানা যায় না, পায়ের তলায় পড়তে হয়। ও কোথায় আমাকে বলতে পার? ও কি ও কি থেমে গেল পাগল।

—কি?

—ও কি—

—ও আমার স্ত্রী!

—তোমার স্ত্রী? চমকে উঠল পাগল। তোমার স্ত্রী? রায়বাবু! রায়বাবু! দয়া কর—বাবা আমাকে দয়া কর

বিস্ময়ের আর সীমা রইল না বীরেশ্বর রায়ের। তিনি প্রশ্ন করলেন—কি বলছেন আপনি? ওই ওর কাছে ওর কাছে একবার নিয়ে চল আমাকে। একবার-বাবা একবার। বাবা একবার–।

—ও তো নেই, পাগলাবাবা।

―নেই?

—না। জলে ডুবে মরেছে বলেই—

—মরেছে? চীৎকার করে উঠল পাগল।

—কীর্তিহাটে কাঁসাইয়ের দহের ধারে ওর গহনাপত্র পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু দেহ পাওয়া যায় নি। কিন্তু আজ জানলাম সে বেঁচে আছে। কোথায় আছে জানি না। আপনাকে তাই জিজ্ঞাসা করছি, বলুন, আপনি অনেক জানেন জানতে পারেন, বলুন সে কোথায় আছে?

মুহূর্তে পাগল সেই দুর্বল দেহেই উঠে দাঁড়াল—আমি চললাম, আমি চললাম রায়বাবু, আমি চললাম। তাকে খুঁজে আনব। রায়বাবু তাকে খুঁজে আনব—আমি চললাম।

রায় তাকে বাধা দিলেন–না।

পাগল বলে উঠল—না-না-না। ছাড়। আমাকে ছাড়। রায়বাবু আমি যাব। খুঁজব—না। আপনাকে তার আগে সোফিয়া বাঈকে ভাল করে দিতে হবে। আপনি সেদিন তাকে কিছু করেছেন।

—না—না—না। আমি কারুর কিছু করি নি, ছেড়ে দাও আমাকে। ছেড়ে দাও।

—সে হবে না পালাবাবা। সে সেদিন সন্ধ্যেতে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই জ্বরে পড়েছে। বিকারের ঘোরে শুধু আপনার নাম করছে। আপনাকেই তাকে ভাল করে দিতে হবে। যে হাকিম তাকে দেখেছে সেও বলেছে এ ঠিক বেমারীর বুখার নয়। আপনাকে যেতে হবে। আগে সেখানে চলুন, তারপর যেখানে ইচ্ছে যাবেন!

***

সোফিয়া নিঝুম হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। যেন সব শক্তি তার শেষ হয়ে গেছে। সোফিয়ার মা উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিল মাথার শিয়রে। একটি ঝি মাথায় বাতাস করছিল। আজ দুপুরবেলা তাদের যে হেকিমসাহেব দেখে, তার পরামর্শমত বড় হেকিম এনেছিল, সে হেকিম দুই রগে জোঁক বসিয়ে অনেক রক্ত বের করে ফেলেছে, তারপর থেকে এমনি নিঝুম হয়ে গেছে। গায়ের জ্বর কমেছে। সোফিয়ার মুখের গোলাপী রঙ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।

পাগলাবাবাকে একরকম ধরেই এনেছেন বীরেশ্বর রায়। সে বার বার বলেছে- ছেড়ে দাও। রায়বাবু, আমাকে ছেড়ে দাও।

দু-একবার গাড়ীর মধ্যে থেকে লাফিয়ে পড়তে চেষ্টা করেছে। কিন্তু বীরেশ্বর রায় সতর্ক হয়েই ছিলেন। তিনি ধরে আটকেছেন। পাগ্‌গ্লাবাবা অসহায়ের মত চীৎকার করেছে—গোলকধাঁধা। গোলকধাঁধা, ওরে ওরে নরকে পতন-নরকে পতন। ছেড়ে দাও আমাকে, ছেড়ে দাও!

বাড়ির দরজাতেও সে বসে পড়েছিল একেবারে ছোট ছেলের মত। ছোট ছেলের মত কেঁদে মিনতি ক’রে বলেছিল—তোমার হাতে ধরছি রায়বাবু, ছেড়ে দাও।

বীরেশ্বর রায় কঠিন হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস হয়েছে সোফিয়ার অসুখ এই তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর হয় রুষ্ট দৃষ্টির ফলে, অথবা কোন তুকতাকের জন্য হয়েছে। এই তান্ত্রিক সেই কারণেই যেতে চাচ্ছে না। এদের সম্পর্কে অনেক কথা অনেক গল্প শুনেছেন। এদের মধ্যে রামপ্রসাদের মত, কমলাকান্তর মত দেবতুল্য সিদ্ধ তান্ত্রিক, ত্রৈলঙ্গ স্বামীর মত সিদ্ধ মহাপুরুষ যোগী যেমন আছে, তেমনি আছে পিশাচতুল্য ভ্রষ্ট মানুষ, যারা ডাইন ডাকিনের মত লোভী কামাচারী দুষ্ট লোক; রাক্ষসের মতো হিংস্ররক্তপিপাসু। এরা না পারে কি? সব পারে। বান মারার কথা তিনি শুনেছেন। কালি কাঁটা মড়ার হাড় নিয়ে মন্ত্র পড়ে মানুষের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয়, সেইগুলো মানুষের অগোচরে এসে তাদের বেঁধে। তারপর মানুষ যন্ত্রণায় অস্থির হয় অধীর হয়। পঙ্গু হয়ে যায়। কোন চিকিৎসায় কিছু হয় না। এক অনিষ্টকারীর চেয়ে শক্তিমান ওঝা হলে সে তাকে মন্ত্রবলে ঝাড়ফুঁক ক’রে সারাতে পারে নইলে মরতে হয় হতভাগ্যকে। কলকাতা শহরে সাহেবরা পর্যন্ত ঘরে চুরি হলে ওঝা ডেকে চাকর-বাকরদের চালপড়া খাওয়ায়, যে চোর তার মুখের চাল রক্তে লাল হয়ে ওঠে। চোর ধরার জন্য পুলিশ কোতোয়ালরা নল চালাবার ওঝা ডাকে। এ লোকটা ঠিক সেইরকম কিছু করেছে। তিনি তাকে কিছুতেই ছাড়বেন না। তিনি হাতের মুঠো শক্ত করে তার হাত ধরে টেনে তুলে বলেছিলেন—সে হবে না পাগ্লাবাবা। আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। যেতে তোমাকে হবে, আর ওকে সারিয়েও তোমাকে দিতে হবে।

“আমি নিজের জন্য ভয় করি না।” বীরেশ্বর রায়ের ডায়রীতে আছে। তিনি লিখেছেন- “আমার কিছু অনিষ্ট করিলে আমি তাহাকে গুলি করিয়া মারিব। যদি হাত দুইখানাই লোকটা পঙ্গু করিয়া দেয় তবে আমার লোক তাহাকে খুন করিবে, আমি তাহা দেখিব।”

টেনেই একরকম তুলে এনেছিলেন তাকে। সবল শক্তিমান পুরুষ বীরেশ্বর রায়। তার উপর মানুষ হিসাবেও দুর্দান্ত জেদী মানুষ। ওই বৃদ্ধ শীর্ণকায় লোকটাকে তুলে আনতে বেগ পান নি। সে আমলের সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে, তেমনি চড়াই। পাগলকে ঘরে এনে ফেলে দিয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিলেন।

পাগল ঘরে ঢুকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে-যাঃ! যার মানে বোধ হয় এই যে, আর তার কোন উপায় নেই, যা হবার তা হয়ে গেল।

সোফিয়া চোখ বুজে নির্জীবের মত নিঝুম হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল।

সোফিয়ার মা বসেছিল মাথার শিয়রে বোবার মত, সে সাধুকে দেখে ব্যস্ত হয়ে হাতজোড় করে উঠে এসে বলেছিল-হজরত, তুমি সাধু ফকীর, তোমার পায়ের ধুলোতে আমার গরীবখানা ধন্য হয়ে গেল; তুমি মেহেরবান, তুমি জিন্দাপীর, তুমি সব পার, খোদালা ভগোয়ানের মেহেরবানীতে, জানি না আমার বেটী কি কসুর করেছে তোমার কাছে, তবে কসুর করেছে জরুর নইলে তুমি গোস্যা হবে কেন? যা হয়েছে তুমি মাফ কর। তুমি মাজানিন, ফকীর, পীর-উ-মুরশিদিমা, তুমি এখনি আগুন হয়ে যাও, এখনি ঠাণ্ডি পানি হয়ে যাও, খোদাবন্দ, এ বেওকুফ ছোটি লড়কী, এর কসুর তুমি মাফ কর!

পাগল একদৃষ্টে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখছিল সোফিয়াকে। দেখে সে যেন বিহ্বল হয়ে গেছে।

ঘরখানা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাঁদীটা হাতের পাখা নাড়া বন্ধ করে তাকিয়ে ছিল পাগলের মুখের দিকে, সোফিয়ার মা সেও যেন অকস্মাৎ বোবা হয়ে গিয়ে পাগলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, পিছনে বীরেশ্বর রায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি পাগলের মুখের ছবিখানা দেখছিলেন ওদিকের দেওয়ালের ধারে পায়ার উপরে দাঁড়ানো বড় আয়নাটার মধ্যে। পাগলের মুখখানাকে এমন কোমল হতে তিনি এ ক’দিনের মধ্যে একদিন একমুহূর্তের জন্য দেখেন নি। লোকটার মুখের চামড়া কিসের বা কিছুর আঁচড়ের দাগে ক্ষতবিক্ষত, চামড়া গুটিয়ে গেছে, কুঁকড়ে গেছে, তবু তারই মধ্যে আশ্চর্য কোমলতা ফুটে উঠেছে। চোখ দুটি আয়ত এবং অক্ষত, সুন্দরও বটে, তবে সে চোখের দৃষ্টি অধীর অস্বাভাবিক, সে দৃষ্টিও এই মুহূর্তে স্থির, এই মুহূর্তে মমতার মাধুর্য যেন স্থির হয়ে ভেসে রয়েছে।

পাগল আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে বললে—আহা—আহা-হারে! আ-হা-হা!

সোফিয়ার মা আশ্বাসে উৎফুল্ল হয়ে উঠে দু পা পিছিয়ে গিয়ে মেয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে ডাকলে—সোফি, সোফি, বেটী! মেরি জান! দেখ বেটী দেখ, উ মাজানন পীর ফকীর এসে তোর সামনে বসেছেন, তোকে মেহেরবানী করছেন। বেটী, মেরি সোফি! সো—ফি—

এবার ক্লান্তভাবে চোখ মেললে সোফিয়া। তাকালে মায়ের দিকে। মা বললে —দেখ বেটী, ওই ফকীর, পীর-উ-মুরশিদিমা খুদ এসে বসে রয়েছেন। দেখ, ওই—ওই তোর সামনে।

সোফিয়া এবার তাকালে তার দিকে। রাজ্যের ভয় সে দৃষ্টিতে, তার সঙ্গে ভিক্ষুকের আর্তি। তারপর সে দৃষ্টিতে ফুটে উঠল প্রসন্ন একান্ত উজ্জ্বলতা, যেন একটা নিবুনিবু প্রদীপের শিখাটিকে কেউ উস্কে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে তার শুকনো ঠোঁটদুটিতে কেউ যেন টেনে দিলে একটি আশ্বাসের হাসির রেখা।

পাগল এবার নিজেই এগিয়ে গেল তার শিয়রের দিকে—মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললে—ভয় নেই। ভাল হয়ে যাবে। ভয় নেই।

তারপর সে তার মুখে হাত বুলিয়ে দিলে। গভীর স্নেহের স্পর্শের স্বাদ বা গন্ধ যাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরাও অনুভব করলেন।

—যাঃ, ভাল হয়ে গেছে। সব ভাল হয়ে গেছে। যা-কিছু খা! দুধ খা। দুধ। গরম দুধ।

নিজের হাতে গরম দুধের বাটী ধরে চামচে করে তাকে খাইয়ে দিলে পাগল। সোফিয়ার মা বললে—সন্তজী হলোক মুসলমানী, আপনে হাঁত সে উসকে পিলাবেন—

পাগল গ্রাহ্যই করলে না। ভাল লাগল বীরেশ্বরের, তিনি সোফিয়ার মাকে বারণ করে বলেছিলেন—ওঁদের জাত নেই বাঈ সাহেবা। আল্লা খুদা আর ভগবান হরি রাম রহিম কৃষ্ণ করিম বিলকুল ওদের কাছে এক হয়ে গেছে।

পাগল সোফিয়াকে খাইয়েই চলেছিল, আর বলেই চলেছিল—খা-খা! সব ভাল হয়ে গেছে। খা! আমি তোকে কিছু বলি নি, সে তাকে দেখে, তাকে দেখে! খা-খা।

পাগল ফেরে নি। বীরেশ্বর রায় তাকে রেখেই চলে এসেছিলেন। কি করবেন? ফেরবার কথায় পাগল বলেছিল, না-না, তুমি যাও, তুমি যাও, আমি যাব না। আমি যাব না! তুমি যাও।

সোফিয়ার মা বলেছিল- আপনি যাইয়ে রায়বাবু সাব। বেটীর বহুৎ ভাগ্ হ্যায়, আর উ আপকে কৃপাসে মিল গিয়া, সাধুজীর সব সেওয়া ময় করুঙ্গি। ব্রাহমন বুলাওঙ্গি, উ ঊনকে সব সেওয়া করেঙ্গে। ঠিক হ্যায়।

রায় চলে এসেছিলেন।

***

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, সেদিনের স্মরণীয় ঘটনা বীরেশ্বর রায় প্রায় দশ পৃষ্ঠা ধরে বর্ণনা করেছেন। শেষ করেছিলেন বোধ হয় বাড়ী ফিরে এসেই, সন্ধ্যা থেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে লিখে। শেষ দিকে আট-দশটা লাইন আছে—ফিরে এসে বসেছি আজকের ঘটনাগুলো লিখতে। পরপর কটা দিন—আশ্চর্য দিন এসেছে আমার জীবনে। এমন ঘটনাবহুল দিন এমন বিচিত্র বিস্ময়কর ঘটনা এমন পরপর সমাবেশ, এর আগে কখনও আসে নি। লিখে রাখলাম। লেখা শেষ করে ভাবছি। কি ভাবছি? একটার পর একটা ছবি ভিড় করে যেন গোলমাল করে দিচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কলম ধরে আছি, যা মনে হচ্ছে লিখেছি। মনে হচ্ছে, পাগল কি? সত্যকারের মহাপুরুষ? পিশাচসিদ্ধের কথা শুনেছি, ও কি তাই? লোকটা থেকে গেল মুসলমান বাঈজীর বাড়িতে সোফিয়ার সেবা করবার জন্য? ওখানেই থাকবে? ওখানেই খাবে? মহাপুরুষদের জাত নেই জানি। ও কি তাই? তবে এমন যন্ত্রণা ভোগ করে কেন? নিজের গলা নিজে টিপে ধরে ‘ছেড়ে দে, ছেড়ে দে’ বলে চিৎকার করে কেন? ভাবছি। আবার মনে হচ্ছে, ভবানীর ছবির সামনে পাগল যা করলে। বললে-না-না, সে নয়। এর ছটা আঙুল! ভবানী —।

হঠাৎ মনে ভেসে উঠেছে—শ্রাদ্ধ-বাড়ীতে জগদ্ধাত্রী বউদি চিঠিখানা দিলেন। ভবানী বেঁচে আছে! ভবানীর চিঠি!

ভবানী কোথায়? ভবানীর ছবি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, দাদার বিয়ের দিন নাচের আসরে এসে আমাকে ডাকলে গান গেয়ে বরকে গানের দায় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আসরে ওর বাজনার মধ্যে আমার খেই হারানোয় ওর সেই ছোট কৌতুকটি।

মনে পড়ছে বিয়ের রাত্রি।

মনে পড়ছে, প্রথম সন্তান হয়েছে ভবানীর। আমি গভীর রাত্রে ওকে গিয়ে ডাকলাম। ওকে বললাম- ।

না। সে কথা স্মরণেই থাক। স্মরণীয় খাতাতেও লিখে যাব না। লিখতে পারব না। না তা পারব না।

মনে করে রেখেছি, বলে যাব, মৃত্যুর পর এই খাতাখানা যেন আমার চিতায় আমার বুকের উপর দেওয়া হয়। পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আমার দেহের সঙ্গে।

তবু পারব না লিখতে। না-না-না।

No-No-No-তিনটে No বেশ মোটা অক্ষরে লিখেছেন বীরেশ্বর রায়।

সুরেশ্বর বললে-সুলতা, ওইখানেই ওই তিনটে No শব্দের তলায় একটা দাগও টেনে- ছিলেন। অর্থাৎ শেষ করেছিলেন। কিন্তু দাগটা কেটে আবার তার তলায় আবার দুটো-তিনটে ছত্র লিখেছিলেন।

“হঠাৎ মনে হচ্ছে এত সব যে বিচিত্র বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে, জীবনে যা এই কদিন আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটল, এরপর কাল, হ্যাঁ, কাল সকালেই যদি ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠে দেখি, সে এসেছে? আসবে? সে?”

মোটা করে লেখা- ‘She’!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *