প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – ৫

সুরেশ্বর বললে হয়তো কুটিলতম রাজনীতির খেলা খেলেছিলেন দেওয়ান। নবাব-বাদশার দরবার হলে ইতিহাসে এ-ঘটনা পড়ে বিস্মিত হত লোকে।

ব্যবস্থা হয়েছিল—ইস্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন মেদিনীপুরের কালেক্টরসাহেব বাহাদুর; সন্ধ্যায় উৎসব হবে। নৃত্য-গীত এবং উচ্চাঙ্গসঙ্গীত।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পাশে বীরেশ্বর রত্নেশ্বর হাজির থাকবেন। ওদিকে সেই রাত্রে শ্যামনগরে দে-সরকারের বাড়িতে পড়বে ডাকাত। শুধু আগুন দিলে কাজটা সোজা হত, কিন্তু তাতে শ্যামনগরের লোকের উপর সন্দেহ পড়তে পারে। সেইজন্যে হবে ডাকাতি, যার উদ্দেশ্যটা হবে লুঠতরাজ। প্রতিহিংসা প্রতিশোধ বলে চালানো যাবে না।

ঘটনার কয়েকদিন আগে একটি ফৌজদারী হয়েছিল গোপাল সিংয়ের সঙ্গে। সামান্য ঘটনা নিয়ে ফৌজদারী। ইঁদুর গোপাল সিং তখন মামলায়-মামলায় উত্ত্যক্ত। শ্যামনগরে বিমলাকান্তের একজন পাইক রাধানগর গিয়ে সামান্য কথায় খপ করে চেপে ধরেছিল গোপাল সিংয়ের হাত; গোপাল তাকে ঘায়েল করে বসল। এবং ঘায়েল করে তার হুঁশ হল সে পুলিশ কেসে পড়েছে। সে হল ফেরার।

রাধানগরে দে-সরকারের তখন সেই ছিল ভরসা। গোপাল পালাল পুলিশের ভয়ে। নির্বান্ধব দে-সরকার সারারাত্রি মালা জপ করে গোবিন্দ ভরসা করে দিনযাপন করছিলেন।

আচার্য এ-কার্য সমাধা করবার জন্য লোক এনেছিলেন দক্ষিণ কাঁথি অঞ্চল থেকে। বাংলাদেশে এমন দল তখন অনেক ছিল। যারা চিঠি দিয়ে ডাকাতি করত। বিশু ডাকাতের নাম জান। বিশ্বনাথ ঘোষ ডাকাতি করতেন বড় বড় বাড়ীতে, অনেক নীলকুঠীও লুঠেছিলেন। লোকে বলত বিশুবাবু। কোম্পানী সোজা পথে তাঁকে ধরতে পারে নি। দলের লোকের বিশ্বাসঘাতকতা ধরা পড়েছিলেন। হান্টারসাহেব লিখে গেছেন—

“Biswanath Babu exercised his vocation in broad daylight, sending previous notices of his designs to those he intended to plunder.”

বিশুবাবুর মত মহৎ ডাকাত চিরকাল দুর্লভ কিন্তু এই ধরনের দুঃসাহস অনেক দলের তখন ছিল। এত বড় একটা জমিদারপক্ষ সহায় পেয়ে তারা দে-সরকারের মত কৃপণ জমিদার-মহাজনের বাড়ী লুঠতে, জ্বালাতে, বলতে গেলে এক কথায় রাজী হয়ে গিয়েছিল। ছকা ব্যবস্থা। তারা হানা দেবে, হৈ-হৈ করে ঘাঁটি পাতবে। শ্যামনগরের লোকে উঠবে, সভয়ে দুরে দাঁড়িয়ে থাকবে নিজেদের এলাকায়

গ্রামের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে ডাকাতি-চুরি হয় না। এক্ষেত্রে তার অভাব হয় নি, দে-সরকার বাড়ীর পুঙ্খানুপুঙ্খ সংবাদ তারা পেয়েছিল। রাত্রি দুপুরের পর ডাকাতের দল-সে প্রচণ্ড চিৎকার করে মশাল জ্বালিয়ে হানা দিয়ে পড়ল, তখন কান্না উঠল দে-সরকারের অন্দরে, কিন্তু সে চিৎকারে মানুষ সাড়া তো দেয়ই নি, দে-সরকারের ভগবানও সাড়া দেন নি। ডাকাতদের তিনজন এসেছিল ঘোড়ায় চেপে।

মেয়েদের উপর ডাকাতেরা নির্যাতন করে নি। তারা গায়ের গহনা খুলে দিয়েছিল হুকুমমত। কিন্তু দে-সরকারের ছেলে এবং দে সরকারকে বাইরে টেনে এনে জ্বলন্ত মশাল দিয়ে পিঠে ছিঁচকে পোড়া করে দিয়েছিল। এবং ভেঙে দিয়েছিল একখানা হাত। তবু দে-সরকারকে বাহাদুরি দিতে হবে। টাকা কোথায় আছে তিনি বলেন নি। ছেলে একটা জায়গা জানত, সেটা দেখিয়ে দিয়েছিল।

এই সময়েই ফটকের বাইরে ঘোড়ার উপর দেখা গিয়েছিল তরুণ রত্নেশ্বর রায়কে। মাথায় পাগড়ি, মুখে একটা ফেটা বাঁধা, পরনে ব্রিচেস কোট—

তিনি ডেকে বলেছিলেন প্রাণে মেরো না। পোড়ামুখ নিয়ে বাঁচতে দাও।

তারপর আর তাঁকে কেউ দেখে নি।

এ-কাজটি রত্নেশ্বর নিজের মতে ও বুদ্ধিতে করেছিলেন। বীরেশ্বর রায়কে বলেন নি। এমন কি দেওয়ান আচার্যও সময়ে জানতে পারেন নি। তবে রত্নেশ্বর শক্ত করে ঘাঁটি বেঁধে কাজ করেছিলেন।

বীরেশ্বর রায় এবং আচার্য দেওয়ান ডাকাতির দিন ইস্কুল ভিত্তিস্থাপনের ব্যবস্থা এবং রাত্রে নৃত্য-গীত এবং বৈঠকী গানের ব্যবস্থা করেছিলেন ‘অ্যালিবাই’ রাখবার জন্যে। ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যান্য রাজকর্মচারীরা উপস্থিত থাকবেন। তাঁরা নিশ্চয় বলবেন—সে কি? আমরা সেখানে সে-রাত্রে উপস্থিত—কীর্তিহাটে। সারাদিন সেখানে ইস্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠান, রাত্রে উৎসব। তাঁরা ডাকাতি করাচ্ছেন সেই রাত্রে—এ কি করে সম্ভবপর হতে পারে?

রত্নেশ্বর এই সুযোগ নিলেন।

তিনি মজলিশে সাহেবদের আপ্যায়ন করছিলেন। ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তখন সোফিয়া বাঈয়ের বৈঠকী গান সবে শেষ হয়েছে। সোফিয়া বাঈ সন্ধ্যায় বসে প্রায় ঘণ্টাদেড়েক তাঁর অপরূপ গানে মজলিশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন। তাঁর গানের পর আসরে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন দুজন তরুণী খেমটাওয়ালী। বাছাই করে কলকাতার সেরা খেমটাওয়ালী আনা হয়েছিল। রূপে, কণ্ঠস্বরে, নৃত্যদক্ষতায় তারা অপরূপা। ঠিক এই সময় বাপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তিনি অবসন্নের মত বসে পড়েছিলেন।

ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন বীরেশ্বর রায়, তাঁর সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এবং অন্যান্য অতিথিরাও উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারেন নি। গোটা আসরটাই চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। রায়বংশের উত্তরাধিকারী—এমন সুন্দর সুপুরুষ মার্জিতরুচি তরুণটির প্রতি দৃষ্টি সকলেরই আকৃষ্ট হয়েছিল। বীরেশ্বর উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠে রত্নেশ্বরের হাত ধরে বলেছিলেন—কি হল, রত্নেশ্বর?

—মাথা ধরেছে, তার উপর হঠাৎ মাথাটা যেন ঘুরে গেল।

বীরেশ্বর তাঁকে হাতে ধরে তুলে একখানা আসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। একজন পাংখা-বরদার একখানা ছোট হাতপাখা নিয়ে তাঁর মাথায় হাওয়া করতে শুরু করেছিল। একজন এনেছিল গোলাপ জলের বোতল। রত্নেশ্বর হাতে মাথা ধরে কিছুক্ষণ বসে থেকে হেসে বলেছিলেন সাহেবকে—I am very sorry sir that I have disturbed the whole show.

—Are you alright now?

কাঁচুমাচু করে রত্নেশ্বর রায় বলেছিলেন—সুস্থ হয়েছি অনেকটা, তবে ঠিক সম্পূর্ণ সুস্থ হই নি। যদি অনুমতি করেন, তবে আমি একটু বিশ্রাম করি গিয়ে। আমার একটা শিরঃপীড়া আছে, তাতে অনেক সময় প্রায় অজ্ঞানের মত পড়ে থাকি। তবে ভয়ের কিছু নেই।

সাহেব সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিয়েছিলেন। রত্নেশ্বর বাপকে বলেছিলেন—একটুও চিন্তা করবেন না আপনি। আপনি বসুন। আমি একটু শোব।

বাড়ীর ভিতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে বলেছিলেন—কেউ যেন আমাকে না ডাকে। ভবানী দেবী পূজায় ছিলেন। পূজা সেরে উঠে এসে ছেলেকে আর পাননি। পেয়েছিলেন একটা চিরকুট। তাতে লেখা ছিল—আজ আতসবাজি পুড়বে আমি দেখতে যাচ্ছি। বাবা আর দেওয়ানজী ছাড়া কাউকে বলো না। কোন ভয় নেই। ভোর হবার আগেই ফিরব।

গোপনে তিনি সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন। দুজন সওয়ার বরকন্দাজ এবং সঙ্গে একটা বাড়তি ঘোড়াও তিনি নিয়েছিলেন।

শ্যামনগরের পথ দুটো, একটা নদীর পথ। সেটা অনেক ঘুরপথ। একটা ত্রিভুজের দুটো বাহুর মত কাঁসাই আর ভাগীরথী ধরে এক নদীপথ, অন্যটা ত্রিভূজের কর্ণের মত একটা স্থলপথ। কিন্তু দুর্গম। এই পথটাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। নদীপার ছিল পথে। সেখানেও বন্দোবস্ত তিনি করে রেখেছিলেন—পারের নৌকা অপেক্ষা করছিল। মাইল তিরিশেক পথ, মাঝে কুতুবপুরের কাছারী। সেখানে ঘোড়া বদল করে নিয়ে উঠেছিলেন শ্যামনগর, ডাকাতি তখন চলছে, মশাল দিয়ে পিটছে কর্তা দে-সরকারকে।

তিনি গিয়ে ডেকে বলেছিলেন—প্রাণে মেরো না। ছিঁচকেপোড়া মুখ নিয়ে বেঁচে থাকতে দাও।

তিনি আসবেন এ খবরটা কাজের কাজী যারা তারা জানত, বলা ছিল। তারা তাঁকে ঘাঁটিতে ঢুকতে আটকায় নি।

সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ফিরেছিলেন। দু’দিকে ষাট মাইল পথ। যেতে-আসতে ঘণ্টা-আষ্টেক লেগেছিল। কীর্তিহাটে যখন ফিরেছিলেন, তখন বীরেশ্বর রায়, ভবানী দেবী, দেওয়ান আচার্য জেগে পথের দিকে চেয়ে বসেছিলেন।

ভবানী দেবী তিরস্কারের আর বাকি রাখেন নি। বীরেশ্বর রায় গম্ভীরমুখে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। আচার্য হাঁফ ছেড়ে কয়েকবার মৃদু তিরস্কার করে বলেছিলেন—বড্ড ছেলেমানুষি করেছ দাদুসাহেব। বড্ড ছেলেমানুষি। না-না-না আমাদের না জানিয়ে এরকম ভাবে-না-না-না

তবে পরে একান্তে তাঁকে বলেছিলেন—সাবাস দাদুসাহেব। তুমি যা করলে—এ একটা দেখালে বটে। হ্যাঁ, বুকের পাটা আছে তোমার। বুদ্ধিও খেলিয়েছ বটে। সাবাস, সাবাস! তবে এরকম আর করো না।

একটু ভেবে বলেছিলেন—তবে ভাই কাল সকালেই তোমাকে কলকাতা চালান করব সাহেবদের সামনে। রাত্রে অসুখ বেড়েছে, কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিকিৎসার জন্যে। বুঝেছ?

হেসে রত্নেশ্বর বলেছিলেন-ঠিক আছে, আমি তৈরি।

—কষ্ট হবে না তো! সারারাত্রি তিরিশ কোশ ঘোড়া হাঁকিয়েছ।

—না। বলেন তো কালই নমুনা দেখিয়ে দিতে পারি।

—থাক। তাতে আর কাজ নেই।

পরের দিনই সাহেবদের বিদায় দিয়ে বীরেশ্বর রায় ছেলেকে নিয়ে আবার কলকাতায় ফিরেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খুশী হয়ে বলেছিলেন-স্কুলটা তাড়াতাড়ি শেষ কর মিস্টার রায়। স্কুলের ফাউন্ডেশন আমি পত্তন করলাম। ওপনিং দেখে যেতে চাই। এবং আমার ইচ্ছা আমিই সেটা করি।

বিদায়ের সময় রূপোর রেকাবির উপর পঁচিশখানা মোহর সবিনয়ে তুলে ধরেছিলেন বীরেশ্বর সাহেব সকলের সামনেই রেকাবখানাসমেত, সেটা নিয়ে দিয়েছিলেন আর্দালীর হাতে। তাছাড়া রূপোর কর্ণিক এবং আরো অনেক উপহার ছিল, অন্য সাহেবরাও বাদ যান নি। সকলেই সেলামী নিয়ে রায়বাবুর সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সকলেই রত্নেশ্বরের জন্য উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন। রত্নেশ্বর অসুস্থ এবং রাত্রে অসুখ বেড়েছে এ-কথা আচার্য এসে প্রথমেই জানিয়েছিলেন সাহেবদের। বিবিমহলে এসে সকালবেলাতেই সাহেবের সঙ্গের কেরানীকে বলেছিলেন—হুজুরকে একটু বলে দেবেন, কর্তার আসতে একটু হয়তো দেরী হবে। রত্নেশ্বরবাবুর অসুখটা বেড়েছে। ডাক্তার-কবিরাজে বলছে—সাধারণ শিরঃপীড়া নয়, একটু জটিল মনে হচ্ছে। বলছে-কলকাতায় নিয়ে যাওয়া ভাল।

কথাটা কেরানী যথাসময়ে পেশ করেছিল হুজুরের সামনে, এবং তার মিনিট-কয়েকের মধ্যেই বীরেশ্বর রায় এসে হাজির হয়ে বিরক্ত জন্মাবার পূর্বেই দেরীর জন্য মার্জনাভিক্ষা করেছিলেন।

সন্ধ্যার মুখে বজরা রওনা হয়েছিল কলকাতা।

কলকাতায় এসেও রত্নেশ্বর বড় সাহেব ডাক্তারের চিকিৎসাধীনে বিছানায় শুয়ে থাকতেন। রত্নেশ্বরের শিরঃপীড়া-অহরহ যন্ত্রণা। ডাক্তার রোজ আসছেন, দেখছেন, মোটা ফি নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু চিকিৎসা-শাস্ত্রে কোন দিক থেকে কোন হদিস পাচ্ছেন না। ওষুধ আসে, ফেলে দেওয়া হয়।

এই অবস্থায় হুগলী থেকে এল পুলিশের পরোয়ানা। দে-সরকারের বাড়ীর ডাকাতির সময় রত্নেশ্বর রায়কে নিজে দেখেছেন—মাথায় পাগড়ি এবং মুখে ফেটা বাঁধা থাকা সত্ত্বেও চিনেছেন বলে এজাহার করেছেন দে-সরকার এবং তাঁর ছেলে।

সুরেশ্বর বললে—একটা গল্প বোধ হয় তুমিও শুনেছ সুলতা; এক ব্রাহ্মণ বিধবার বাড়ীতে কি একটা পুজো ছিল। ষষ্ঠী পুজো কি সত্যনারায়ণ ধরনের কিছু। কিন্তু বুড়ী পূজারি না পেয়ে গঙ্গার ঘাট গেছল পুরুতের সন্ধানে। হাইকোর্টের জজ স্যার গুরুদাস গঙ্গাস্নান সেরে ঘাটে উঠেছেন, বুড়ি তাঁকে গিয়ে ধরেছিল—ও বাবাঠাকুর, আমার এই পুজো দয়া করে করে দাও। তা স্যার গুরুদাস বামুন হিসেবে সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন নি। বুড়ীর বাড়ী গিয়ে পুজো করে দিয়েছিলেন। বুড়ী তাঁকে বলেছিল—বাবা, তুমি দারোগা হয়ো।

তার অর্থটা অত্যন্ত স্পষ্ট।

এখানে মেদিনীপুরের সাহেবরা সেলামীর চেয়েও বেশী পেয়েছিলেন। রূপোর থালাসুদ্ধ মোহরগুলো পকেটে পুরেছিলেন।

সুতরাং ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোডের ‘অ্যালিবাই’র সুচীছিদ্র দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে গেলেন রত্নেশ্বর। তার উপর সার্টিফিকেট ছিল কলকাতার সাহেব-ডাক্তারের। একটি কঠিন কোন রোগে আক্রান্ত বাবু রত্নেশ্বর রায় তাঁর চিকিৎসাধীনে রয়েছেন। তাঁকে স্থানান্তরিত করা এখন অতীব বিপজ্জনক। আচার্য দেওয়ান মোটা জামিন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওদিকে মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লোক ছুটেছিল চিঠির জন্য। রত্নেশ্বর রায় ঘটনার তারিখে সমস্ত দিন তাঁর চোখের সামনে ছিলেন এবং অত্যধিক পরিশ্রম করেছিলেন, যার ফলে সন্ধ্যার পর সম্ভবত নটা নাগাদ, মাথা ঘুরে পড়ে যান। তিনি শয্যাশায়ী হয়ে ছিলেন। পরদিন প্রাতঃকালে রত্নেশ্বর রায়ের অসুখ বৃদ্ধি পায় এবং ঐদিনই চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতা স্থানান্তরিত করা হয়। এ সমস্তই তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে।

বাবু রত্নেশ্বর রায়কে ওই তারিখের কোন্ ঘটনার জন্য দায়ী করা অসম্ভব। এবং তাঁর মত একজন উচ্চশিক্ষিত মার্জিতরুচি তরুণ যুবকের পক্ষে এমন কাজ কখনো সম্ভবপর নয়।

যে ব্যক্তি এমন কথা বলেছে সে আক্রোশবশত মনের ভুলেই চোখে ছায়াবাজির মত কিছু দেখেছে। অথবা ইচ্ছাকৃত আক্রোশবশতঃই এমন কথা বলেছে।

এই চিঠিতেই রত্নেশ্বর রায় সব দায় থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।

পাগলাবাবার চিঠি নিয়ে লোক এসেছিল এরই মধ্যে। তখনো রত্নেশ্বর আদালত থেকে দস্তুরমত নথিপত্রে লিখিতভাবে খালাস পান নি। তিনি কলকাতাতেই শয্যাশায়ী হিসেবে ঘরের মধ্যে সেরেস্তাখানা পেতে জমিদারী সেরেস্তার কাগজ বুঝছেন। সুতরাং তাঁর যাওয়া হ’ল না। আইনের এই দায়ের বন্ধনে বাঁধা না থাকলে এই যাওয়া নিয়ে হয়তো সমস্যা দাঁড়াত। রত্নেশ্বর রায় যেতে চাইতেন না। এই নিয়ে একটা সংঘর্ষ বাধাও বিচিত্র ছিল না।

তাঁর ডায়রীতে তিনি লিখেছেন—“আমি ধর্মশাস্ত্র পাঠ করিয়াছি। ইংরাজী শিক্ষা ও লাভ করিয়াছি। আমি এদেশের প্রাচীন কালের মানুষের মতো অন্ধবিশ্বাসী নহি। তন্ত্রও আমি পড়িয়াছি। কিন্তু বীরাচার বা কামাচার বলিয়া যাহা প্রচলিত তাহার ফল যে যাহাই পাইয়া থাকুক তাহা পশু বা জন্তুধর্ম। তাহা কখনো মানবধর্ম হইতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে-কোন কর্মসিদ্ধি দুই উপায়েই সম্ভবপর, সৎপথে ন্যায়-অন্যায় বিচার করিয়া সেই মত কর্ম করিয়া ও সিদ্ধ করা যায়; আবার অসৎ উপায়েও করা যায়। বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া যুদ্ধ জয়, মিথ্যা সাক্ষ্যের জোরে মামলায় ডিক্রী ইহা হামেশাই হইতেছে। যে-উপায়ে রবিনসনের উপর শোধ তোলা হইল, যে কৌশলের পথে আইনকে ফাঁকি দিয়া দে-সরকারের অত্যাচারের প্রতিশোধ লইলাম, তাহা আইনসম্মত পথ নহে। কিন্তু ইহা বিষয়ব্যাপার এবং বাস্তবজীবনের ব্যাপার। কিন্তু যাহা ধর্ম, যাহা ভগবত্তত্ত্ব ও সাধনা, তাহা মানবের বিবেকবিরুদ্ধ অশুভ ক্লেদাক্ত পথে কখনোই সমর্থনীয় নহে। ইহাকে ধর্ম-অনুসারেই পাপ বলিতে হইবে। মহাপাপ ঘৃণ্য কর্ম—বিবেকবিরোধী চিন্তা! শক্তিকে আমরা মাতৃরূপে অর্চনা করি। চণ্ডীতেই আছে—জগতের নারীজাতিই তাঁহার প্রতিভূ। নারী লইয়া ব্যভিচার করিয়া বিশ্বজগতের মাতৃরূপিণী শক্তিকে যে ব্যক্তি বন্দিনী রক্ষিতার মত আয়ত্তাধীনে পাইতে চায়, সে ব্যক্তি নরকের কৃমিকীটের তুল্যই ঘৃণ্য। নরকের কৃমিকীট বিষ্ঠার মত কদর্য অভক্ষ্য বস্তু আহার করে; মানুষ তাহা করিতে গেলে তাহাতে তাহার অপঘাত অপমৃত্যু ঘটে। সে প্রেত!”

দীর্ঘ দু পৃষ্ঠা ধরে লিখেছেন তাঁর মনের চিন্তা। এবং বাপ মা এবং বিমলাকান্তের প্রতি কটাক্ষ করে লিখেছেন-তাঁরা কেন গেলেন, কোন্ মুখে গেলেন তা বুঝলাম না। রায়বংশ—ভট্টাচার্য-বংশের স্মৃতি থেকে এই মহাপাতকীর নাম সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া উচিত।

***

পাগলাবাবা নবদ্বীপে ‘পোড়া মাতলার কিছুটা দূরে এক পাশে একটা গাছতলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। বীরেশ্বর রায়, ভবানী দেবী, বিমলাকান্ত, মহেশচন্দ্র এবং সোফিয়া কলকাতা থেকে বজরা করে গিয়েছিলেন নবদ্বীপ। তবে যথাসাধ্য আত্মগোপন করেছিলেন। মনে তাঁদেরও কিন্তু ছিল। পাগলাবাবার সবকিছুই তাঁরা স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু কলমা পড়ে মুসলমান হওয়াটা তাঁরা স্বীকার করে নিতে পারেন নি। সেই কারণে পথে বজরা থেকে নেমে নৌকো নিয়েছিলেন। বজরা বাঁধা ছিল শান্তিপুরের ঘাটে। নৌকো কলকাতা থেকেই সঙ্গে গিয়েছিল। নবদ্বীপে সাধারণ মনস্কামনা পরিপূরণার্থীর মত যেন ওই সিদ্ধ পাগলাবাবার কাছে এসেছেন, এই পরিচয় দিয়েছিলেন। গঙ্গার ঘাট থেকে গিয়েছিলেন পদব্রজে। বীরেশ্বর রায়ের জন্য একখানা গরুর গাড়ীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কারণ তাঁর পক্ষাঘাতের পঙ্গুত্ব সম্পূর্ণরূপে তখনো সারে নি।

পাগলাবাবার নবদ্বীপেও খ্যাতি হয়েছিল। অনেক লোক তাঁর কাছে আসত, এখানে তাঁর নাম পাগলাবাবা ছিল না। লোকে তাঁকে ‘মা-বোলা বাবা’ বা মা-বোলা ফকীর বলত। ফকীর মানে তিনি কলমা পরে মুসলমান হয়েছেন এ কথাটা গোপন ছিল না। প্রকাশ তিনি নিজেই করেছিলেন।

কারুর সঙ্গে কোন কথাই বলতেন না। মৌনী। শুধু মধ্যে মধ্যে বুকফাটানো করুণ আর্তনাদে ডাকতেন- মা, মা, মা! চোখ দিয়ে ধারা গড়াতো! বহুলোক আসত, ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকত, প্রশ্ন করত, কিন্তু তিনি থাকতেন নীরব নিস্পন্দ। গভীর রাত্রে ভাঙা গলায় গান শুনেছে লোকে। তাও তাতে ভাষা নেই। একাক্ষরা গান। মা-মা-মা। মা-মা-মা-মা-মা। মা!

লোকে পয়সা দিয়ে যেত। পড়ে থাকত, তিনি কুড়োতেন না। খেতেন শুধু ফল। কিন্তু এ সত্ত্বেও দু-তিনজন ভক্ত তাঁর জুটেছিল। এদের কাছেই সামান্য কথাবার্তা বলতেন। তাও একান্তে। এদেরই তিনি বলেছিলেন—তিনি মুসলমান, তাঁর উচ্ছিষ্ট যেন হিন্দু কেউ না খায়; কেউ যেন তাঁকে প্রণাম না করে! তিনি হিন্দুই ছিলেন—কিন্তু মায়ের কোপে বিপাকে পড়ে তাঁর হিন্দু জাত গিয়েছে।

রত্নেশ্বর রায়ের কাছে বর্ণনা করেছিলেন বীরেশ্বর রায়। রত্নেশ্বর লিখে রেখেছেন নিজের ডায়রীতে।

তাঁর ওই ভক্তরাই ব্যবস্থা করেছিল সাক্ষাৎকারের। তারাও জানত না ‘মা- বোলা’ ফকিরের সঙ্গে এঁদের সম্পর্কের কথা। এবং সোফিয়া বাঈ-ই ওঁদের মুখ রক্ষা করেছিল। ভক্তরাও বুঝেছিল এবং তারাও যাদের যাদের বলেছিল তারা জেনেছিল সোফিয়াই তাঁর আপনজন। সোফিয়ার সে সময়ের বেশভূষা সাদাজমি লালপেড়ে শাড়ি, এলো চুল, এবং প্রসাধনবর্জিত সাজসজ্জা কারুর মনে কোন সংশয়ই জাগতে দেয় নি। তারা ভেবেছিল সোফিয়াই ফকীরের বেটী আর এঁরা তাঁর প্রসাদধন্য ভক্ত!

দিনের আলোতে নয়, রাত্রে তাঁরা গিয়েছিলেন।

“যুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে।” বীরেশ্বর রায় এই কথাটাই বলেছিলেন। উঠবার শক্তি তখন তাঁর ছিল না। তিনি সোফিয়াকে দেখে খুশী হয়েছিলেন, বলেছিলেন—এসেছিস মা! বস্।

দীর্ঘকাল পরে হলেও মহেশচন্দ্রকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চিনেছিলেন, বলেছিলেন —মহেশ! আঃ বাঁচলাম!

জামাই বীরেশ্বর রায়, পুত্র বিমলাকান্ত, কন্যা ভবানীকে দেখে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন-লজ্জায় আমি মরে যাচ্ছি। দুঃখের আর আমার পার নেই। সামনে কত জন্ম ধরে যে অন্ধকার, কতকাল যে অমাবস্যা তা জানি না। কিন্তু আজ লজ্জা আমার তার থেকে অনেক বেশী অনেক বড়। তোমাদের লজ্জা দিলাম। তোমাকে, বিমলাকান্তকে। তবে —। তবে আমি তো সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছি। সম্বন্ধ তো নেই তোমাদের সঙ্গে। তবু ক্ষমা—ক্ষমা চাচ্ছি।

ভবানী এবার এসে তাঁর মাথার শিয়রে বসে তাঁর মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছিলেন, এবং ডেকেছিলেন—বাবা!

তাঁর মুখের দিকে একাগ্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছিলেন শ্যামাকান্ত। থরথর করে চিবুক ঠোঁট কেঁপেছিল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আবার স্থির হয়ে ঘাড় নেড়েছিলেন—না।

তারপর বলেছিলেন—সেও মরে গেছে। আমি প্রেত।

ভবানী বলেছিলেন—না। বারো বছর আমি সংসার স্বামী ত্যাগ ক’রে আপনার জন্যে তপস্যা করেছি। আপনি ভাল হয়েছেন, জ্ঞান ফিরেছে। এবার আপনি আপনার তপস্যার ফল পাবেন, সিদ্ধি পাবেন।

শ্যামাকান্ত আবার ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন—না। নরক হবে আমার। আমি দেখতে পাচ্ছি। কত জন্ম যে ঘুরতে হবে তা জানি না। হ্যাঁ, তবে সেই দারুণ প্রহার আর করে না। গলাটা টিপে ধরে না। তবে সিদ্ধি-মুক্তি ও অনেকদুর। দক্ষিণেশ্বরে এক জন্মসিদ্ধ সাধক আমাকে বলেছে। লোকে তাকে এখনো চেনে নি। অল্পবয়সী পাগল পাগল মানুষ। ওখান থাকে। পুজুরির ভাই। সে আমাকে বলেছে। পাগলামিটা সে-ই সারালে। সে-ই প্রহার থেকে মুক্তি দিলে। সে বললে—করেছিস কি পাগলাবাবা, মাকে মা চিনলি না—মেয়েছেলে বলে চিনলি রে! মা বলে ডাক। মা বলে ডাক। মা-মা বলে কাঁদ। কিন্তু—

ঘাড় নাড়লেন শ্যামাকান্ত, অর্থাৎ হ’ল না। বললেন—পারলাম কই? আবার ঘাড় নেড়ে বললেন—পারলাম না তো।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন –এই সোফিকে প্রথম ‘মা’ বললাম। বাবা, মনে হল-সব বিশ্বসংসার মধু হল—পূর্ণিমার আলোয় ঝলমল করে উঠল। মনে হল সব তাপ জুড়িয়ে গেল। বাবা, কিছুক্ষণ পর আবার সোফির মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধ্বক করে উঠল। কই মা? মা কেন হবে। যুবতী রূপসী নারী। সেই মোহিনী গো। মজার কথা কি জান—সোফি লজ্জা পেলে। চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালে। মনকে আমি শাসন করলাম। বললাম—মা-মা। ওরে মা!

চুপ করে গিয়েছিলেন শ্যামাকান্ত। কিছুক্ষণ পর বললেন—তাই চলছে সারাজীবন। আজও। আজও বাসনা। সে মোহিনী হয়ে ওই মেয়ের মধ্যে থেকে অহরহ ভোলাচ্ছে। কত জন্ম যে লাগবে তা জানি না। এই মরব। আজই মরব। রাত্রে অমাবস্যা লাগবে—ওই লাগবে আর মরব। ভয় করছে। মা মা বলে ডাকছি। কিন্তু মধ্যে মধ্যে মনে হচ্ছে আসছে জন্মে—আসছে জন্মে—বাসনা যেন পূরণ হয়। সিদ্ধি যেন পাই!

ভবানীকে দেখতে বাসনা ছিল। রায়বাবুর ঘরে ভবানীর ছবিকে তার ছবি বলে ভুল করেছিলাম। দেখি নি ওকে—তাই জানিয়েছি। কিন্তু মহেশ ওর বিয়ে কেন দিলে! না দিলেই ভাল করতে। আমার তো শুধু ওই বাসনাই ছিল না। রাজা হবারও বাসনা ছিল। আমারই বংশ হ’ল তো! যদি আমার পাপ আশ্রয় করে?

ওই প্রশ্ন করেই চুপ করেছিলেন শ্যামাকান্ত, আর কথা বলেন নি!

এই কথাই রায়বংশের গুপ্ত কথা! আর এই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে রায়বংশের বংশধরেরা পুরুষানুক্রমে।

ভবানী দেবীর পিতা, বিমলাকান্তের পিতা—শ্যামাকান্ত মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। রত্নেশ্বর রায় বীরেশ্বর রায়ের আপন পুত্র হয়েও পোষ্যপুত্র। সেও গুপ্ত কথা। সোমেশ্বর রায় অভিশপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর সেই ব্রাত্যনারী মনোহরা বিলাসও গুপ্ত কথা।

হঠাৎ চুপ করে গেল সুরেশ্বর। তারপর বললে-শ্যামাকান্তের শেষকৃত্য হিন্দুমতে হয় নি। ভবানী দেবী বা বিমলাকান্ত অশৌচ পালন করেন নি। তাঁর শেষকৃত্য করেছিল সোফিয়া।

রত্নেশ্বর রায় ডায়রীতে লিখেছেন—এই অন্ধ ধর্মবিশ্বাস মনুষ্যগণকে মানুষ হইতে দেবতা করে না। পিশাচ করিয়া তোলে। ধর্মবুদ্ধিকে বিকৃত করিয়া পাপবুদ্ধি গোটা মানবসমাজকে, বিশেষ করিয়া হিন্দুসমাজকে, অন্ধকারের প্রেত করিয়া ফেলিয়াছে। ইহাকে আমি প্রশ্রয় দিব না। আমি জ্ঞানের আলোক হাতে লইয়া বিচরণ করিব।

যে পাপ আমাদের বংশকে আশ্রয় করিয়াছে, বলিয়াছেন ভ্রান্ত তান্ত্রিক, তাহাকে মুছিয়া দিব। ইহাই প্রতিজ্ঞা করিলাম।

একটু চুপ করলে সুরেশ্বর। অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে ক্লান্ত হয়েছে বোধহয়। ডাকলে—রঘু!

রঘু এসে দাঁড়াল। সুরেশ্বর বললে—একটু চা খাওয়া।

সুলতা বললে—বাবু তোমার আজ খেয়েছেন রঘু? না, না খেয়ে শুধু চা খেয়েই যাচ্ছেন? না খেয়ে থাকলে খাবার দিয়ো। আমি রয়েছি, খাওয়াব। রাত্রের জন্যে কি করছ?

রঘু বললে—উ তো অর্চি দিদি করছেন। সে বহুত্ কিছু করছেন।

সুরেশ্বর বললে–সে কি? কি করছে?

—পহেলে তো লুচি মান্‌সো আর মাছ বানাইবেন বললেন। তারপর বললেন—না লুচি না, ঘি-ভাত বানাইবেন। বিরিজ দাদাসাহেব ভি বললেন কি—হাঁ—ঘি-ভাত বানাও অর্চি। জমিদারী গেইলো তো আজ ভোজ লাগানা!

—কী কাণ্ড! যেমন অর্চি তেমনি ব্ৰজদা! অর্চি তো কাউকে নড়তে ছুঁতে দেবে না। সে তো একাই সব করবে।

রঘু বললে—হাঁ, জলখাবার ভি উনহি বানাইয়ে ফেললেন। হামাকে বললেন দিবার জন্যে। থোড়া কুছ বাকি আছে। ঘিউ মে চুড়া ভাজছেন। হামি চা বানাই? চা না কফি বানাইব?

অর্চনা নিজেই ঘরে ঢুকল, তার দু-হাতে দুখানা প্লেট। নামিয়ে দিয়ে বললে—খাও!

সুরেশ্বর বললে-তুই এসব শুরু করেছিস কি? আমাকে বললি সন্ধের মন্ত্র স্মরণ সেরেই এখানে এসে বসবি; তারপর এইসব শুরু করেছিস? ঘি ভাত কে করতে বললে?

বাধা দিয়ে অর্চনা বললে-ব্রজদার সাধ হ’ল যে! বললে—অর্চি, তুই যখন কোমরে আঁচল বেঁধে তরকারি রাঁধবার জন্যে হাতা-খুন্তিই ধরবি তখন ভালো করেই ধর। বেশ জুত্ করে রান্নাবান্না কর। বললাম-বেশ তো, কি খাবে বল? বললে-দেখ জমিদারী উঠল, তার অনারে একটা ফিস্ট হয়ে যাক। গুষ্ঠীর সকলে থাকলেই ভালো হত, তা ওই কমলেশ্বর খুড়ো দিলে সব তেতো ক’রে। তা ছোট করেই হোক—ঘি-ভাত, মাংস-মাছ- দই-মিষ্টি—ভাজা। এই বেশ হয়ে যাবে। খাইনিও অনেকদিন! দেখ ব্রজদা তোর ভাঙা দেউলে রায়বাড়ীতে জন্মেও খেয়েছে পরেছে ভাল। ওতে খেদ নেই আমার। এখন তো অন্ধ ফকীর। দিনরাত মালা জপি, বলি পার কর—পার কর। আজ কেমন ঘোর লেগেছে। মনে হচ্ছে শেষ জমিদারীটা করে নিই। গানের আসর পাতলে ভাল হত—তা সে হবে না থাক। খাওয়া-দাওয়াটা কর!

একটু হেসে অর্চনা বললে-কি করব? বললাম—তাই করছি। ব্রজদা বসে আছে, মাংস চড়িয়ে এসেছি, সে ব’সে ব’সে ডিরেকশন দিচ্ছে। এতে সর্বনাশ সর্বনাশ করছ কেন? তোমার কাহিনী বলছ শুনছি—বল, শোন—আমি এর মধ্যে সব করে ফেলেছি!

সুলতা অৰ্চনাকে দেখছিল, নিবিষ্টচিত্তে এই মেয়েটিকে দেখছিল। সুরেশ্বর একটু আগে বলেছে তাকে যে, অর্চনা বিধবা হবার পর বি-এ পাশ করেছে। সংস্কৃত নিয়ে এম-এ’র কোর্স শেষ করে রেখেছে। কিন্তু অর্চনার কোথাও তার পরিচয় সে খুঁজে পাচ্ছে না। বেশভূষায় রকমসকমে সেই সনাতন বাঙালী মেয়ে; একটু আগে দেখেছে একখানা মটকার কাপড় সাদামাটা ঢঙে প’রে তার উপর সেই পর্দার চাদর গায়ে জড়িয়ে কালীমায়ের পুষ্প এনে মাথায় ঠেকিয়ে দিয়ে সন্ধে করতে গেল। এখন একখানা নরুনপাড় কাপড় পরেছে, শায়া ব্লাউস আছে কিন্তু সে নেহাতই লজ্জা-নিবারণ মাত্র, তার মধ্যে কোন সৌন্দর্য নেই। কাপড়খানায় সেকেলে বাঙালীমেয়ের মতো হাতের হলুদ তেলের দাগ লেগেছে। শরীর থেকে মশলার একটা গন্ধও উঠছে।

সুলতার দৃষ্টির সঙ্গে হঠাৎ তার দৃষ্টি মিলতেই অর্চনা বললে–কি দেখছেন এমন ক’রে বলুন তো!

হেসে সুলতা বললে–আপনাকেই দেখছি।

—আমাকে? আমার মধ্যে কি খুঁজছেন? পুরুষেরা বেহায়া। কিন্তু আপনি তো তা নন।

—এমন অসাধারণ আপনি, কিন্তু কিছুতেই ধরা যায় না, আশ্চর্য সাধারণ সেজে রয়েছেন। অৰ্চনা বললে-ও নিয়ে তর্ক পরে করব। তর্ক করতে গেলে রান্না নষ্ট হবে। ব্ৰজদা মাংস রান্নার ডিরেক্টার, গন্ধ শুঁকে ডিরেকশন দিচ্ছে, এক্ষুনি হাতা দেবার গন্ধের ইশারা পেলে হয়তো নিজেই হাতা ধরতে উঠবে। চোখে একরকম দেখতেই পায় না। হয়তো হাত-পা পোড়াবে। কিন্তু ডাকবে না।

সুরেশ্বর বললে—তা হলে তুই যা। ব্রজদা এমন অদ্ভুত হয়ে গেল!

অর্চনা যাবার জন্যে ঘুরেছিল, কথাটা শুনে সে ফিরে দাঁড়াল। বললে—ব্রজদা কি বলছিল জান? অদ্ভুতই বটে ও।

—কি বলছিল?

—বলছিল-অৰ্চনা, আমার মধ্যে মধ্যে মনে হয় কি জানিস? আমি বললাম কি? তো বললে-দেখ আমিই সেই শ্যামাকান্ত; বুঝলি ওই যে পতন হল—মরল। নরক ভোগ করে সে ঘুরছে। দু-তিন জন্ম পরে আবার রায়বংশে এসেছি। তেমনি চেহারা। গান গাইতেও পারি। তেমনি ব্যভিচারী ছিলাম। তেমনি রাজ্যসম্পদ ভোগের বাসনা। এই দেখ, মারটাও কেমন খেলাম দেখ, অন্ধ হয়ে গেলাম। এখন জপ করছি দিনরাত, কিন্তু করলে হবে কি, মেয়ের গলায় সাড়া শুনলে জপ ভুল হয়ে যায়! অনুশোচনারও শেষ নেই, কামনারও অন্ত নেই!

সুলতা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলে—আপনারা এইসব বিশ্বাস করেন নাকি?

অর্চনা হেসে বললে—বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি বলুন? এ আবার পৃথিবী নয়, জন্মান্তর। না হয় নাই মানলুম জন্মান্তর, কিন্তু ফ্যামিলি ক্যারেকটার? হেরিডিটি? ব্রজদা যা বলেছে, তাতে এ বংশের সবাই শ্যামাকান্ত। ওই যে বসে সুরোদা। ও সমস্ত জীবনটা একরকম তপস্যা করে মেয়েদের থেকে দূরে থেকেছে। আপনাকে ভালবেসেছিল, সে যে কী ভালবাসা আমি জানি। আপনি হয়তো নাও জানতে পারেন। সেই সুরোদা হঠাৎ একদিন কুইনিকে দেখে পাগল হয়ে গেল। যখন সুরোদা রায়বংশের সব কথাই বলছে তখন এ কথাও বলবে। আমি খানিকটা আগে বলে দিয়ে যতিভঙ্গ, ছন্দোভঙ্গ করে গেলাম!

রঘু কফির কাপ হাতে ঘরে ঢুকল এবং বললে—বিরিজবাবু ডাকছেন আপনাকে।

—ওই! আমি চললাম! আমাকে ব্রজদাকে কফি দিয়ে আসিস রঘু, ঠাণ্ডা হলে গায়ে ঢেলে দেব কিন্তু।

অর্চনা চলে গেল।

সুরেশ্বর খাবারের ডিশটা এগিয়ে দিল। সুলতা কফিটা তুলে নিয়ে বললে—তুমি খাও। তোমার খিদে পেয়েছে আমি বুঝতে পারছি।

—উহুঁ, তুমি ঠিক করেছ। কফিটা জুড়িয়ে যাবে।

—ভাল হবে, কোল্ড কফি হবে।

সুরেশ্বর কফিটা নামিয়ে রাখলে কিন্তু খাবারটা টেনে নিলে না, অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

সুলতা বললে—ভাবতে বসলে যে।

—হ্যাঁ ভাবছি। ভাবছি অৰ্চনা একটা কথা বলে গেল। বলে গেল কুইনীর কথা। হ্যাঁ সুলতা, কুইনির উপর একটা আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। কিন্তু সে আর্টিস্টের আকর্ষণ একটি সুন্দর রূপের উপর। কুইনি রক্তমাংসের মানবী, সুতরাং বলব না ফুলের উপর আকর্ষণের মত। তবে তা ছাড়াও একটা কথা আছে। কুইনির কাছে আমার দেনা ছিল।

সুলতা তার মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুরেশ্বর বললে—১৯৩৭ সালের জানুয়ারী মাসে অতুলকাকার এবং মেজদিদির কনভিকশন হয়ে গেল, আমি তাদের সঙ্গে দেখা করে বাড়ী ফিরলাম। রাত্রে হ্যারিস এল। বলেছিলাম তোমাকে সে যেন একটা সমন নিয়ে এল।

পরদিন ছবি আঁকব ভাবছিলাম, এমন সময় সে আবার এল হিলডার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে, এলিয়ট রোডের বাড়ীর একখানা ঘরের উপর আর কুইনির উপর তার অধিকারের দাবী নিয়ে; আমি কথা দিয়েছিলাম, বিরক্ত হয়ে নিজেই গেলাম গোয়ানপাড়া। সেখানে হিলডা হ্যারিসের মুখের উপর যে জবাব দিলে, তাতে কুইনির মায়ের পিতামহীর কলঙ্ককথা প্রকাশ করে দিলে—বললে ঠাকুরদাস পালের ছেলে গোপাল পাল ভায়লেটকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তারই জরিমানাস্বরূপ ওই বাড়ীখানা রায়বাহাদুর তাকে দিয়েছিলেন। দলিলে লেখা আছে—ওই বাড়ী ভোগ করবে ভায়লার গর্ভের প্রথম সন্তান। এবং তারই ছেলেমেয়েরা। ভায়লার বিয়েও দিয়েছিলেন, তাকে টাকা দিয়েছিলেন। হ্যারিস অন্যবংশের ছেলে। মনে আছে তোমার। কিন্তু আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। মাথা হেঁট করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, কুইনির মাতামহ গোপাল পালের সন্তান নয়, গোপাল পাল নিজের জন্যে ভায়লাকে নিয়ে পালান নি। তিনি তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, রায়বাহাদুরের জ্যেষ্ঠপুত্র রায়বংশের শ্রেষ্ঠ সুপুরুষ এবং শ্রেষ্ঠ বিদগ্ধ মডার্ন ব্যক্তি দেবেশ্বর রায়ের জন্য। রায়বংশের কলঙ্ক ঢাকা দিয়েছিলেন রায়বাহাদুর সেটাকে গোপালের উপর চাপিয়ে। আমি জানতাম বলেই লজ্জা পেয়েছিলাম। কুইনিও এসব কথার উল্লেখে স্বাভাবিক ভাবেই লজ্জিত ক্ষুব্ধ দু-ই হয়েছিল। সে এককথায় হ্যারিসকে দৃঢ়স্বরে ‘না’ জবাব দিয়েছিল। যার অর্থ আমি যাব না তোমার সঙ্গে এবং ঘরের অধিকারও দেব না, দুইই। বলেই চলে গিয়েছিল সেখান থেকে। আমি লজ্জায় মাথা হেঁট করে ফিরবার পথে ওই ছবিখানা কল্পনা করতে করতে ফিরেছিলাম। ওই পরপর উপরে উপরে তিনখানা মুখ।

প্রথমটা শ্যামাকান্তের, তার উপরেরটা সোমেশ্বরের, তার উপরেরটা দেবেশ্বরের। তারও উপরে অনেক মুখ চাপানো যায় সুলতা, আমার বাবার জ্যেঠার জ্যাঠতুতো ভায়েদের, ব্রজদার, কার নয়, সর্বশেষ, ধনেশ্বর কাকার সেই দৈত্যাকার অর্ধোন্মাদ ছেলেটির।

পুরুষ এবং নারীর এই দেহবাদের খেলা মানুষের জীবনে পাপ স্বীকৃত হয়েছে কতকাল তা জানিনে। এবং মানুষের জীবনে যখন থেকে ভালবাসা এসেছে বিবাহ এসেছে তখন থেকে ব্যভিচার সত্যিই পাপ—এতবড় লজ্জাও নেই আর এতবড় ধ্বংসের বীজও আর নেই। কিন্তু পাপ বলে যত সে বর্জন করতে চেয়েছে, তত সে-পাপ তাকে আশ্রয় করেছে বিচিত্রপথে। ধর্মের ছিদ্রপথে, শক্তি ও সম্পদের সিংহদ্বার দিয়ে। রাজা-বাদশাদের ঘরে হাজার দরুনে ক্রীতদাসী থাকত, লুঠে-আনা বাঁদী থাকত। ধনশালীদের ঘরেও কম থাকত না। আবার নিছক ডাকাত বোম্বেটেরাও কম যেত না। রায়বংশে এই দুটো পথ দিয়ে প্রবেশ করেছে এই পাপ প্রবৃত্তি। একে আমি সমর্থন করব কি করে? এবং হয়তো ওই গোয়ানপাড়াতে শাড়ীপরা কুইনি আমার মনের মধ্যে এ প্রবৃত্তির স্পন্দন তুলেছিল। তাই যেন রায়বংশধর বলে আমি ভয় পেয়েছিলাম। বাড়ী এসে রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রী খুলে পড়তে বসেছিলাম। আগাগোড়া পড়ে জানতে চেয়েছিলাম সব।

সারাটা দিন কিছু খাই নি। ১৯৩৭-এর জানুয়ারী মাস। শীতটা একটু বেশীই ছিল। রঘুয়া স্নান করবার তাগিদ দিলে বলেছিলাম -না স্নান করব না। বড় শীত পড়েছে। আর শরীরটাও খারাপ খারাপ করছে। ভাত-টাতও খাব না। চা আর পাঁউরুটি দিয়ে যা এখানে; এখানেই খাব।

রঘুয়া চুপ করে দাঁড়িয়েই ছিল। ওটা ওর স্বভাব। যে কথা মনোমত হয় না তার প্রতিবাদ করে না, কিন্তু কথাটা মেনে চলেও যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি বলেছিলাম—কি?

—ডাকডারবাবুর কাছে লোক ভেজি?

—না। সে ওবেলা হবে’খন।

—কুইনীন খেয়ে নেন—ইটার সাথ—। সে হুইস্কির বোতলটার দিকে ইঙ্গিত করেছিল। আমি সেদিন শিউরে উঠেছিলাম সুলতা। না।

ধর্ম সম্পদ শক্তি তিন যখন ব্যভিচারে প্রমত্ত করে মানুষকে তখন ওই বস্তুটাই তার প্রথম উপকরণ। না। খাব না।

পড়তে শুরু করেছিলাম রায়বাহাদুরের ডায়রী। এই সময় আর একজন এলেন—কালীবাড়ীর পূজক। চরণোদক এবং নির্মাল্য নিয়ে এসেছেন রায়বাড়ীর সবচেয়ে মোটা শরিক এবং সম্পদশালী বংশধরটিকে দেবার জন্য।

এটার ব্যবস্থা করেছিলেন মেজদি। তিনি ধমকে বলে এসেছিলেন- রায়বাড়ীর অন্য শরিকেরা ঠাকুরবাড়ী গিয়ে পাতা পেড়ে খেয়ে আসে। ও যায় না। সকলের সঙ্গে ওর তুলনা চলে না। ওকে নিত্যি এসে দিয়ে যাবেন—চরণোদক পুষ্প!

কথাটা মানতেন পূজকেরা। শুধু ভয়েই নয় খানিকটা শ্রদ্ধাও ছিল। আমি কীর্তিহাটে আসবার পর থেকে; দেবসেবার জন্যে মেজদিদি অনেক ব্যবস্থা করেছিলেন। ঠাকুরদের অভাব মিটেছিল।

আমি পূজককেও বলেছিলাম—না।

তারপরই বলেছিলাম—মানে, ওই তাকে রেখে যান, পরে আমি খাব। পুষ্প মাথায় ঠেকাব। এখনো স্নান করি নি, বাসি কাপড় ছাড়া হয় নি।

ধর্মের উপরে আমার সেদিন হুইস্কির চেয়েও বেশী ভয় হয়েছিল। শুধু ভয় নয়, বিরাগ—তীব্র বিরাগ আমার মনে জেগে উঠেছিল। সম্পত্তি পূর্বপুরুষের, দেবতা তাঁরা স্থাপন করে গেছেন। তাছাড়া মনে পড়েছিল ভবানী দেবীকে। তাই ঘৃণা করতে পারি নি। মানুষের জীবনের বিষ বলতে পারি নি। নইলে—তাই সেদিন বলতাম উচ্চ কণ্ঠে এবং সম্পত্তি দেবোত্তর নইলে বলতাম-আর এক পয়সাও দেব না আমি পুজোর জন্যে।

একটানা পড়ে গিয়েছিলাম রত্নেশ্বর রায়ের দিনলিপির মধ্যে তাঁর বংশকথা। রায়বাহাদুর বংশকথা শেষ করেছেন শ্যামাকান্তের মৃত্যুতে। তারপর রায়বাড়ীর বিবরণ রায়বাহাদুরের দৈনন্দিন ডায়রীতে তারিখে তারিখে লিখে গেছেন।

যখন শেষ করলাম বংশকথা তখন বেলা অপরাহুও পার হচ্ছে। অতিভূত চিত্ত নিয়ে উঠেছিলাম। চোখের উপর ভাসছিল শ্যামাকান্তের মৃত্যুদৃশ্য। কানে যেন শুনতে পাচ্ছিলাম শ্যামাকান্তের শেষ কথাগুলি।

বিশ্বের মহাশক্তিকে আয়ত্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি সনাতনী নারীরূপে। যিনি হবেন তাঁর ভোগ্যা তাঁর দাসী। কী ভয়ঙ্কর বাসনা, কী নিঃসীম স্পর্ধা।

প্রচণ্ড আঘাতে বার বার আহত হয়েছেন—শক্তি বাঘিনীর শিকার নিয়ে খেলার মতো নিষ্ঠুর খেলা খেলেছে, বার বার তিনি মা বলতে চেয়েছেন, গড়িয়ে পড়তে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁর কামার্ত শক্তি পিপাসার্ত চিত্ত বার বার ‘না’ বলেছে। মৃত্যুকালেও তিনি অকপটকণ্ঠে স্বীকার করে গেছেন! বলে গেছেন আবার তাঁকে আসতে হবে বাসনা পুর্ণ করতে। মহেশচন্দ্রকে বলে গেছেন—ভবানীর বিবাহ দিয়ে অন্যায় করেছে। তার গর্ভের সন্তানসুত্রে বংশেও এই বাসনা অর্শাবে!

রায়বাহাদুর দৃঢ়সংকল্প করেছিলেন, তাঁর বংশপরিচয়ের শেষে রয়েছে—আমি এ পাপকে মুছে দিয়ে যাব!

কিন্তু তা হয় নি!

বেদনা ভারাক্রান্তচিত্ত যেন শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। রঘুকে ডেকে বলেছিলাম—ওই ছত্রিঘরে ইজিচেয়ার পেতে দে। নিজে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ছত্রিঘরে। শীতের অপরাহ্ণে সন্ধ্যায় সেদিন আকাশটা গাঢ় লাল হয়ে উঠেছিল। সন্ধ্যা হতে তখনো আধঘণ্টা দেরি, কিন্তু সূর্য তখনই যেন আবীরের থালার মতো হয়ে উঠেছে। ছত্রিঘরের মাথা থেকে পশ্চিমদিক অবারিত। একটা শালবন আছে। তার ওপারে দিগন্ত একেবারে কাঁসাইয়ের বাঁকের ওপার পর্যন্ত দেখা যায়। ছত্রিঘরে চেয়ার পেতে ওইদিকে তাকিয়ে মনটা খানিকটা প্রীত হল। নিজে ছবি আঁকি—রঙের নেশা ধরল। আমার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের মত রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল বললে অর্থহীন কাব্য করা হবে। এবং তা ভাবিও নি। তবে চোখ জুড়ানো লালচে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন খানিকটা সুস্থ হল।

কেমন জান—খুব একটা তীব্র শোকার্ত ক্ষোভ শান্ত হয়ে এলে যেমন হয় তেমনি। রঘুকে বললাম—কফি করে নিয়ে আয়।

মনে পড়ল মেজদিকে—তিনি থাকলে একটা সহজ সান্ত্বনা দিতে পারতেন। হয়তো বলতেন—ওরে তুই ভুল বুঝেছিস—শ্যামাকান্ত মুক্তি পেয়ে গেছেন, সিদ্ধি পেয়েছেন—ছেলের মতই মা তাঁকে কোলে তুলে নিয়েছেন।

না-হয় বলতেন—ওরে ভাই। জগৎসুদ্ধই ওই চলছে রে। কম আর বেশী। বেশ তো, তুই না-হয় এর প্রায়শ্চিত্ত কর। মুক্তি দে রায়বংশকে! দীক্ষা নে—মা ভাব জগৎসংসারকে।

রামকৃষ্ণদেবের কথা বলে বলতেন—স্বয়ং পরমহংসদেব ঠাকুর শ্যামাকান্তের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। ও কি মিথ্যে হয়!

না-হয় একটা লাগ-সই রসিকতা করতেন।

হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকালাম। পায়ের শব্দটা নরম। তার সঙ্গে কাপড়ের খসখস শব্দ। দেখলাম অর্চনা এবং তার পিছনে কেউ!

অর্চনা সেই কাল রাত্রে মেজদিদির জন্যে কেঁদে চলে গেছে। তার সঙ্গে তার বিয়ের সম্বন্ধের সংবাদটাও দিয়ে গেছে। আমি বলেছিলাম—তুই ভাবিসনে, জগদীশকাকার কাছে গিয়ে আমি তাঁকে বলে এর ব্যবস্থা করব। ওই বউ-মরা দারোগা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে দেবো না। আমি সম্বন্ধ করব—টাকাকড়ি যা লাগে ভার আমার। কিন্তু আজ সারাটা দিন তা মনে পড়ে নি। রায়বংশের পুরুষদের পাপের কথা ঘেঁটেই দিন শেষ করেছি। হয়তো তাই বলতে এসেছি। জগদীশকাকার অন্দরে কথাটা নিয়ে অনেকদূর এগিয়েছে।

একনজর দেখেই আমি মুখ ফেরালাম। সামনের দিকে তাকিয়ে বললাম- আয়!

অর্চনা বললে-তোমার শরীর নাকি ভাল নেই? স্নান কর নি সারাদিন খাও নি?

বুঝলাম রঘু বলেছে। কথাটা স্বীকার করে নিয়েই বললাম-হ্যাঁ।

—গোয়ানপাড়ার কুইনী এসেছে। আমার কাছে গিয়েছিল। তোমাকে কি বলবে।—কুইনি?

—হ্যাঁ। এই তো আমার সঙ্গে।

এবার উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালাম-পূর্বমুখে, ওরা পশ্চিমদিকে মুখ করে ছত্রিঘরে ঢুকেছে।। অর্চি আগে, কুইনি পিছনে একটু দুরে। সম্ভ্রম করে অর্চির সঙ্গে এগিয়ে আসতে পারে নি। আমার সম্মতির অপেক্ষা করছে। তাতে ছত্রির ছাদের ছায়াটা ওর মুখে বা গায়ে পড়ে নি, আকাশের লাল রঙের প্রতিফলন পড়েছে। শ্যামবর্ণা মেয়েটিকে বড় চমৎকার লাগল। ওবেলার মত নয়, এবেলা সে একটু পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে। ক্রীশ্চান ঘরের মেয়ে, ওরা আমাদের বাঙালী হিন্দুদের থেকে আগেই ফেরতা দিয়ে কাপড় পরে। ১৯৩৭ সালে তখনো আমাদের মেয়েরা কাপড় পড়ার এ ভঙ্গি আটপৌরে ক’রে তোলে নি। এমন রুখু চুল তখনো রেওয়াজ হয়নি। কিন্তু ওদের সমাজে এটা তখন আটপৌরে ব্যাপার।

তাছাড়া রূপ শুধু চোখই দেখে না, মনও দেখে। আমার মনটাই সেদিন কুইনির উপর মমতাচ্ছন্ন হয়েছিল। ওর সঙ্গে যেন রক্তের আকর্ষণ অনুভব করছিলাম। পরিপূর্ণ গোধূলি আলোর একটা বিশেষ রূপ আছে, যাকে বলে ‘কনে-দেখা আলো’। কালো মেয়েও নাকি এ আলোয় সুন্দরী হয়ে ওঠে। তাই হয়েছিল কুইনি।

অর্চনা বললে—এস কুইনি।

কুইনি বললে-নমস্কার স্যার।

—কি খবর কুইনি? হ্যারিস কি আবার গোলমাল জুড়েছে?

—না স্যার। সে চলে গেছে।

—এস, ভেতরে এস।

বসতে দেবার আসন ছিল না, আমি হেঁকে বললাম—রঘু, দুখানা বেতের চেয়ার আন। অর্চি বললে-আমি যাচ্ছি। পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর খাবার কি আছে দেখি। রঘু বলছে তুমি সারাদিন দু-টুকরো পাউরুটি খেয়ে আছ। শরীর খারাপ তবু ডাক্তার ডাকতে দাও নি। আমি বুঝতে পারছি—মেজদিদির দুঃখ নিয়ে মাথা ভার করে মন খারাপ করে বসে আছ। পুরানো কাগজ ঘাঁটছ, কি খুঁজছ তুমিই জান।

সে চলে যেতে যেতে বললে—কুইনি যা বলবে তা তোমাকে গোপনে বলবে। তার জন্যেই আমার কাছে গিয়েছিল। তুমি বল কুইনি, আমি ভিতরে যাচ্ছি। কথাটা তুমি সেরে নাও।

বুকটা ধ্বক করে উঠল। গোপনে কুইনি কি বলবে? সে কি জানে তার সঙ্গে রায়বংশের সম্পর্কের কথা? তার মুখের দিকে আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। সে দৃষ্টি তার রূপ দেখবার দৃষ্টি নয়, তার মন দেখবার দৃষ্টি!

কুইনি কাপড়ের ভিতর থেকে একখানা পুরনো বড় খাম বের করলে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম—কি ওগুলো কুইনি?

কুইনি মৃদুস্বরে বললে-এলিয়ট রোডের বাড়ীর দলিল আর তিনখানা চিঠি আছে এর মধ্যে। মা আমাকে মরবার সময় দিয়ে গিয়েছিলেন। আপনি প’ড়ে দেখবেন।

হাতে করে নিয়েও আমি বললাম—হ্যারিস যদি চলে গিয়ে থাকে, তবে দলিল দেখার কি দরকার আছে? যদি মামলা-মকদ্দমা করে তখন দেখব বরং!

কুইনি মৃদুস্বরে বলেছিল, কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে ছিল পূর্ণ দৃষ্টিতে। কোন সঙ্কোচ—যে সঙ্কোচ দরিদ্রের থাকে ধনীর কাছে, নারীর থাকে পুরুষের কাছে, তার একবিন্দু ছিল না তার দৃষ্টিতে। সে বললে-কিন্তু পড়ে দেখলে আমি খুশী হব!

–বেশ তাহলে পড়ব।

—তাহলে আমি যাই!

—সে কি? অর্চি আসুক।

—না। আমি যাই। সন্ধে হয়ে আসছে, ওপারে যেতে হবে। দেরী হয়ে যাবে। আমি অর্চিদিদিকে ব’লে যাব।

সে চলে গেল—আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। শীতের সন্ধের মুখটায় সূর্য অত্যন্ত দ্রুত অস্ত যায়। ওই অস্তমান সূর্যকে সামনে রেখেই সে চলে গেল কাঁসাইয়ের গর্ভে নেমে। পিছন দিক থেকে একটা সিলুয়েটের ছবির মত মনে হচ্ছিল। অর্চনা এসে বললে—আর বাইরে না, এর মধ্যেই কনকনে ঠান্ডা পড়েছে। ভেতরে এস, ঠান্ডা লাগবে। কি দেখছ?

আঙুল দেখিয়ে বললাম—কুইনি যাচ্ছে। সিলুয়েট ছবির মত।

অৰ্চনা বললে-মেয়েটা ওদের পাড়ায় খাপ খায় না।

—কি ক’রে খাবে। ও শিক্ষিত। তা ছাড়া ও তো বাঙালীই। তারপর যে কথাটা জিভের ডগায় এসে পড়ল তা বলতে গিয়ে থমকে গেলাম। বলতে গেলাম ও বাঙালীই শুধু নয়, ওর মধ্যে রায়বাড়ীর রক্তের সংস্রব আছে।

আমার থমকে যাওয়াটা এত সুস্পষ্ট যে তা অর্চনার নজর এড়ায় নি। সে বললে-আর কি বল তো?

উত্তর খুঁজে যা পেলাম সে আর্টিস্টের উত্তর, বললাম—মেয়েটা বড় ভাল মডেল।

—মডেল? মানে ছবির?

—হ্যাঁ। ফিগারটা বড় ভাল। গোধূলির আলোয় ও দাঁড়িয়েছিল, দেখেছিলি?

—দেখেছিলাম। কিন্তু ওসব মতলব ছাড়। কেলেঙ্কারির বাকী রাখবে না লোকে।

—বলেছিলাম—না। সে মতলব নেই। চল।

.

অৰ্চনা যে বলে গেল সুলতা, আমি কুইনিকে একদিন দেখে পাগল হয়ে গেলাম, সে ধারণার বীজ এই দিনটির এই ঘটনা। তবে–।

একটু চুপ করে থেকে সুরেশ্বর বললে—তবে একেবারে সত্য নয় এও আমি বলব না! সত্য কিছুটা আছে বৈকি। নইলে ওর ঋণশোধের জন্যে এতখানি হয়তো আমি করতাম না!

—ঋণ? সুলতা প্রশ্ন করলে।

সুরেশ্বর বললে—রায়বংশের বা আমার পিতামহের ঋণ!

—সেদিন যে পুরনো খামটা আমার হাতে সে দিয়ে গিয়েছিল, সন্ধের পর সেখানা থেকে বের করেছিলাম তার মধ্যে যা আছে সব। একখানা দলিল। দলিলদাতা রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়। গ্রহীতা ভায়োলেট পিদ্রুস। যা দান করেছেন সে হল এলিয়ট রোডের বাড়ী।

দলিলখানায় বিশেষ কিছু নেই। বাড়ীটি ভায়োলেট পিদ্রুসের প্রথম গর্ভজাত সন্তান রোজারিও পিদ্রুসের সন্তান-সন্ততিরা পাবে। ঈশ্বর-না-করুন যদি রোজারিও বা তার সন্তানের বংশ না থাকে তবে ওই বাড়ী ক্রীশ্চান আইনমতে তার অন্য উত্তরাধিকারী পাবে। দানের কারণ হিসেবে লিখেছেন—ভায়োলেট পিদ্রুসের পিতা পিদ্রুস এবং তার ভাই পিদ্রুস একসময় বীরেশ্বর রায়, রত্নেশ্বর রায়কে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে।

সংক্ষিপ্ত কয়েকটি ছত্র। এর মধ্যে ফাঁক আছে। সে ফাঁক মারবার বা গোপন করবার জন্য কোন চেষ্টা করেন নি। ফাঁকটা এই সুলতা যে, ভায়োলেটের বাপ-ভাইয়ের উপকারের মূল্য হিসেবে যে বাড়ী দান করছেন, সে বাড়ী ভায়োলেটকে দান করছেন না কেন বা তার গর্ভে রোজারিওর পরে যারা আসবে তারাই বা পাবে না কেন? গোপাল পাল বা ঘোষের নাম দলিলে নেই।

এরপর ছিল দুখানা চিঠি।

একখানা রায়বাড়ির এ্যাটর্নীর চিঠি। তিনি ভায়োলেটকে লিখেছেন-রোজারিও পিদ্রুসের মা হিসেবে। লিখেছেন—“ম্যাডাম, তোমার ছেলে রোজারিও পিদ্রুসের লেখাপড়া এবং শিক্ষাকাল সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ভরণপোষণের জন্য আমার মক্কেল মিঃ ডি রায় (জানবাজারবাসী) শর্তসাপেক্ষে মাসিক একশত টাকার ব্যবস্থা করেছেন। এবং আপনার নিজের জন্য আজীবন মাসিক পঞ্চাশ টাকারও ব্যবস্থা করে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। রোজারিও পিদ্রুস সম্পর্কে শর্ত এই যে, রোজারিওকে কোন উপযুক্ত মিশন স্কুলে পড়তে হবে, থাকতেও হবে স্কুলসংলগ্ন বোর্ডিংএ বা অপর কোন উপযুক্ত মিশন বোর্ডিংএ। এই খরচ সে তার আঠার বছর বয়স পর্যন্ত পাবে। কোন কারণেই লেখাপড়া ছেড়ে দিলে এ খরচ সে পাবে না। আপনার সম্পর্কে কোন শর্ত নেই। আপনি এই ৫০ টাকা বৃত্তি আজীবন পাবেন। আপনি রোজারিও পিদ্রুসকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আপিসে এলে এ সম্পর্কে ব্যবস্থা করা হবে।”

দ্বিতীয় পত্রখানা—আমার ঠাকুরদা দেবেশ্বর রায়ের নিজের হাতে লেখা এবং লিখেছিলেন ভায়োলেট পিক্রসকে।

সোজা ভায়োলেট সম্বোধন। ম্যাডাম নয়, প্রিয় নয়—My dear madam তো নয়ই। শুধু—ভায়োলেট!

তোমার পত্র পেয়েছি। রোজারিও লেখাপড়া ছেড়েছে সেই কারণে তার মাসিক খরচ বন্ধ হয়েছে। এই শর্তেই তাকে খরচ দেওয়া হত। আমি অত্যন্ত দুঃখিত ভায়োলেট যে, রোজারিও সম্পর্কে সমস্ত ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও সে এই বয়সেই এমন দুর্দান্ত হয়ে গেল। তাকে শিক্ষিত ও মার্জিতরুচি করে তুলতে আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি, এ মনে করেও সান্ত্বনা পাচ্ছি না। তোমার সম্পর্কেও তাই ভায়োলেট। আমি তোমার সম্পর্কেও সকল খবর রাখি। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না যে একদিন তুমি সত্যই আমাকে ভালবেসেছিলে। এবং আমিও সে-সময়ে তোমাকে ভালবাসতাম। সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভুলতে পারি না যে, তুমি এবং আমি পরস্পর থেকে দূরে সরে গিয়ে ভালই করেছি। না-হলে দুজনেই নিষ্ঠুরতর যন্ত্রণা ভোগ করতাম। ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি না। তবুও এক্ষেত্রে এই কথাটা ছাড়া আর কথা খুঁজে পাচ্ছি না যে, ঈশ্বর যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন। তোমার আজকের দুঃখদুর্দশা এ সবই তোমার কর্মফল। এর দায় বিন্দুমাত্র আমার নেই। তবু পুরনো দিনের কথা স্মরণ করে এ মাস থেকে তোমার ৫০ টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে ১০০ টাকা করে দিলাম।

রোজারিওর প্রতি কর্তব্য আমি অবশ্য অস্বীকার করব না। সে লেখাপড়া করলে না। আমি খবর নিয়েছি শিক্ষকেরা তার সম্পর্কে কোন আশা করেন না। এবং তাঁরা তাকে ইস্কুলে রাখতেও রাজী নন। এক্ষেত্রে আমি মনে করি তাকে এই সময় থেকেই কাজের মধ্যে টেনে আনা উচিত। কাজ করতে করতে সে কাজের মানুষ হয়ে উঠতে পারে। তুমি তাকে আমাদের রে এ্যান্ড কোম্পানী—সোয়ালো লেন ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ো, আমি তাকে চাকরি দেব। সে এখন মাসে ৮০ টাকা পাবে। এবং তাকে বলে দিয়ো, কাজে গাফিলতি হলে কাজ থেকে কোম্পানী যে-কোন মুহূর্তে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

পুরনো কটিদিনের স্মৃতিকে মনে করে তোমাকে আন্তরিক সহানুভূতি জানাচ্ছি।”

আরো একখানা চিঠি ছিল। সেখানা রে এ্যান্ড কোম্পানীর অফিসের চিঠি। চিঠিখানা মিসেস পিদ্রুসের নামে। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত চিঠি।

“মিস্টার রোজারিও পিদ্রুসের আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছি। সে আমাদের একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিল। কোম্পানী তার এই অকালমৃত্যুর কথা বিবেচনা করে তার একমাত্র কন্যার ভরণপোষণ এবং পড়াশোনার জন্য ব্যবস্থা করতে চায়। তুমি এর জন্য অনুগ্রহ করে আমাদের অ্যাটর্নীর সঙ্গে দেখা কর।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *