প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – ৬

চিঠি ক’খানা পড়ে আমি বিস্মিত হলাম সুলতা।

রায়বংশের সঙ্গে সম্পর্কের কথা কুইনি জানে!

সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল কি জান? মনে হয়েছিল এই চমৎকার মেয়েটি কুইনি আমার আপনার লোক। বার বার তাকে মনে পড়েছিল। সুলতা কুইনিকে প্রথম দেখেছিলাম মাস কয়েক আগে সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে হিলডার সঙ্গে। তখন সে ফ্রক পরত। নিতান্ত কিশোরী মেয়ে। তার কোন আকর্ষণই ছিল না। তারপর এতদিন পরে আগেরদিন এবং আজ তাকে দেখলাম, সে শাড়ী পরেছে। একটা নারীত্বের আকর্ষণ এসেছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে যে মোহে পুরুষ মুগ্ধ হয়ে ছুটতে চায়, সে মোহ তখনো তার ছিল না।

অৰ্চনা বলে গেল, তাকে একদিন দেখেই আমি পাগল হয়েছিলাম, সেটা ঠিক নয়। ওটা ওর ভুল ধারণা।

সেদিন রাত্রে আমি ঘুমুতে পারিনি সুলতা! শুধু এই কথাটাই মনের মধ্যে ঘুরেছিল। কথার সঙ্গে কুইনি। বার বার তাকে মনে পড়েছিল। যতবার মনে করেছি ততবার অপরাধীর মত লজ্জাবোধ করেছি। মেয়েটি ওই দলিল এবং পত্র দুখানা দিয়ে কিছু না বলে চলে গেল। কিন্তু তার মধ্যে কিছু বলে গেল নিশ্চয়। সেটা কি তা বুঝতে পারছিলাম না। একবার মনে হ’ল আমি যেমন একটা মমতা অনুভব করলাম, তেমনি কিছু বোধ থেকেই সে দিয়ে গেল! পরক্ষণেই মনই প্রতিবাদ করলে -না -প্রচ্ছন্নভাবে তিরস্কার করে গেল। ঘৃণা জানিয়ে গেল। হয়তো কোন দাবী জানিয়ে গেল।

শেষ পর্যন্ত শেষেরটাই মনে হল। তাই তো স্বাভাবিক। আমার থেকে ধনী যারা তাদের আচার-আচরণ বংশের ইতিহাসের আলোচনা তো ঘৃণার সঙ্গেই আমিও করে থাকি। তবে কুইনিই বা করবে না কেন? এটা সর্বকালের মনের কথা —কিন্তু একালে মন যেন উগ্র হয়েছে।

আগের কালে একথা মনেই থাকত। নালিশ জানালে ভগবানের কাছে জানাতো। একালে হয়তো সরাসরিই নালিশ জানিয়ে গেল মেয়েটি।

এরই মধ্যে একটা যেন পরিত্রাণের পথ পেলাম। পথটা সহজ, এ সংসারের প্রচলিত পথ। অর্থ দিয়ে ঋণ শোধ। এ ছাড়া আর পথই বা কি?

একবার মনে হল কিছু টাকা কুইনিকে দেব। বলব—এটা তোমার পাওনা রায়বাড়ী থেকে, তুমি নাও।

আবার মনে হল—না। টাকা নয়, কুইনি যাতে সত্যি মানুষ হয়ে ওঠে তার ব্যবস্থা করব। ম্যাট্রিক পাশ করুক। হিলডা বলছিল, ওকে মেদিনীপুর ক্রীশ্চান মিশন গার্লস স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেখানে খরচ লাগলে দেবো। আর মায়ের নামে গার্লস স্কুলের বাড়ী তৈরী হয়ে গেছে—সেটাকে তাড়াতাড়ি ওপেন করিয়ে দিই। কুইনি ম্যাট্রিক পাশ করলে ওই স্কুলে চাকরি দেব।

কলকাতায় ক্রীশ্চান সমাজে দুটো ভাগ আছে। একটা ভাগে বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন। তাঁদের সমাজ আলাদা। তাঁরা বাঙালীই। আর একটা সমাজ আছে—এলিয়ট রোডের এলাকাতেই এদের ভিড়-তারা ক্রীশ্চান, কিন্তু বাঙালী নয়, ভারতীয়ও নয় আবার ইংরেজও নয়। সেখানে গিয়ে যেন কুইনি হারিয়ে না যায়। ভেবে ঠিক করেছিলাম—পরের দিন সকালে উঠেই যাব গোয়ানপাড়ায়, কুইনিকে ডেকে বলব—কুইনি, তোমার কাছে আত্মীয়ের দাবী নিয়েই কয়েকটা কথা বলব। তুমি শোন!

সকালে উঠেই শুনলাম রাত্রে একটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। অতুলকাকার এবং মেজদিদির মামলায় সরকারী পক্ষে সাক্ষী দিয়েছি ছত্রিদের ছেলে শিবু সিং, তাকে কেউ জখম করেছে। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে তাদের গ্রামের ধারে একটা জঙ্গলের মধ্যে। তার ডান হাতের কব্জির নিচে থেকে আঙুল সমেত হাতখানা প্রায় সম্পূর্ণ কেটে গেছে—সামান্য মাত্র চামড়ায় লেগে আছে।

শিবু সিং রাত্রে শৌচে উঠেছিল। ওদের বাড়ি গ্রামের প্রান্তে। বাড়ির পরেই একটা পুকুর, সেই পুকুর-পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে শৌচে বসেছিল। এ ধরনের আক্রমণের ভয় তখন যথেষ্ট ছিল মেদিনীপুরে। গোটা মেদিনীপুরে পেডি, ডগলাস, বার্জ মার্ডার কেসে সরকার সাক্ষী পান নি

মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের হেডমাস্টার, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার পুলিশের কথামত সাক্ষী দেন নি বলে ট্রাইবুন্যাল ব্যর্থ হয়েছে। আর একটা কেসে নাড়াজোল খাঁ রাজাদের এক কর্মচারীর ছেলে সাক্ষী ছিল, কিন্তু রাজাসাহেবের নির্দেশে ছেলের বাপ তাকে উল্টো কথা বলিয়ে কেস নষ্ট ক’রে দিয়েছে। সেই মেদিনীপুরে, শিবু সিংহের বাপ সরকারী দফাদার হরি সিং পদোন্নতির লোভে আর রায়বাহাদুরের ওপর বংশগত আক্রোশের বশে ছেলেকে উত্তেজিত করে সাক্ষী দিইয়ে, এ সম্পর্কে চিন্তিত এবং সতর্ক ছিল না তা নয়, খুব সতর্কই ছিল। ছেলের সঙ্গে হরি সিং পাহারা দিতেও এসেছিল। এবং দাঁড়িয়েছিল জঙ্গলের বাইরে একটু দূরে।

হঠাৎ ছেলের চীৎকার শুনে বাপ ছুটে যখন গেল তখন জঙ্গল ঠেলে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল কেউ। পিছন থেকে দেখেছে, চিনতে পারে নি। শিবু তখন পড়ে কাতরাচ্ছে; তার হাতখানা পড়ে আছে মাটির ওপর।

আর পড়ে আছে একখানা কুকরীর খাপ। আনকোরা নতুন। সেই খাপখানা নিয়ে পুলিশ এসেছে ওবাড়ী। খাপের চামড়ার ওপর কালি দিয়েই মালিক নাম লিখেছে শখ করে; নামটা জগদীশ্বর রায়।

সুলতা জগদীশ্বর কাকার কথা বলেছি। অর্চনার বাবা; সবে দুদিন ফিরেছেন তীর্থ থেকে। কোন তীর্থ থেকে শখ করে তিনি কুকরী কিনে এনেছিলেন, এবং খাপটার উপরে নিজেই শক্ত কলমে কালি বুলিয়ে বুলিয়ে নাম লিখেছিলেন। এ খাপ্ সেই খাপ্

বুকটা আমার কেঁপে উঠল সুলতা।

দুটি নাম এবং অসংখ্য প্রশ্ন মনের মধ্যে একসঙ্গে জেগে উঠল। জগদীশ্বর কাকার কুকরীর খাপ! অর্চনা তাঁর মেয়ে। অতুলের সহকারিণী! তারপর অসংখ্য প্রশ্ন। কিন্তু সে-সব প্রশ্ন ঢাকা দিয়ে অর্চনাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠল বড় হয়ে। তাই বা কেন, ওই প্রশ্নটাই একমাত্র প্রশ্ন হয়ে উঠল। এবার ওকে বাঁচাব কি করে? এ কাজ কে করেছে সে জানে ওই সর্বনাশী মেয়েটা এবং কুকরীটা যে সে-ই বের করে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহই ছিল না আমার।

অর্চনা পুরনো শ্যাওলাধরা রায়বাড়ীর মেয়ে হয়েও এ-কালের মেয়ে। অতুলের সহযোগিনী হিসেবে যা করেছে তা জানি আমি। সেদিন রাত্রে ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে আমাকে খাস কাছারীর কোথায় কি লুকানো আছে তা বলে দিয়েছিল, সে সব মনে পড়ল আমার। মন থেকে সব মুছে গেল, ছুটে গেলাম ভিতর বাড়ী। সেখানে গিয়ে দেখলাম, একজন ইনস্পেকটার এসে বসে আছেন। সঙ্গে একদল দশ-পনেরজন কনস্টেবল। চতুরঙ্গ বাহিনী নিয়ে আসবার সুযোগ হয় নি। ভোরবেলা খবর পেয়ে হরি সিংয়ের বাড়ী এসে সমস্ত দেখে, শিবুকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েই, ওই খাপটায় জগদীশ্বর রায়ের নাম পেয়েই সরাসরি চলে এসেছেন। জগদীশ্বর রায়কে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবেন। তার যে ছেলে কটার বারো বছরের বেশি বয়স তাদেরও ছাড়বেন না।

এ বাড়ীকে বিশ্বাস নেই। শুধু ছেলেরাই নয়, এ বাড়ীর গৃহিণীও এতে জড়িয়ে আছেন, এ প্রমাণিত হয়ে গেছে।

শিবু তার এজাহারে বলেছে যে, আমি শৌচে বসেছি সেই সময় ঝোপের ভিতর থেকে একজন মুখে ফেটা বাঁধা লম্বা রোগা লোক বেরিয়ে আসে, আমি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকি, যখন লোকটা হাত তুলেছে উপরে, চমকে দেখলাম হাতে একটা দায়ের মত কিছু চক্‌চক্‌ করছে। মাথায় মারবে বলে লক্ষ্য করেছে দেখে আমি ডানহাতখানা তুলেছিলাম রুখবার জন্য—আঘাতটা পড়ল হাতের উপর। আমার চিৎকারে বাবা ‘কি হল’ বলে ছুটে আসতে আসতে লোকটা এদিক দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। তাকে চিনতে আমি পারি নি। তবে লোকটি অল্পবয়সী ছেলেছোকরা নয়, বয়স হয়েছে, আর তার গায়ে মদের গন্ধ ছিল।

বিবরণ প্রায় বারো আনা জগদীশ্বর রায়ের সঙ্গে মিলে যায়। তবে জগদীশ্বর কাকা রোগা নন, তাঁর শরীর এখন যে রকম, তাতে তাঁকে স্থূলকায়ই বলা যায়!

এছাড়া আরো একটা জায়গায় গরমিল হচ্ছে। সেটা হল এই যে, গতকাল সকালবেলা থেকেই রায়বাড়ীর বড় মেজতরফ অর্থাৎ শিবেশ্বর রায়ের প্রথমপক্ষের সন্তানদের কেউই বাড়ীতে নেই। তাঁরা সকালে এখান থেকে বেরিয়ে গেছেন। বাড়ীতে নেই। তাঁরা গেছেন তাঁদের মামার বাড়ী। হাওড়া জেলার ‘বাগনান’ স্টেশনে নেমে মাইল দেড়েক পথ; প্রাচীন জমিদারবাড়ী; তাঁদের বাড়ীতে ‘রটন্তী কালী’ পুজো হয় সমারোহ ক’রে।

হয়তো তুমি জানো না সুলতা, রটন্তী কালীপূজা হয় মাঘ মাসের প্রথম কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী ছিল ঘটনার দিন।

ধনেশ্বর কাকা এবং জগদীশ্বর কাকার মামাতো দুই ভাই শুধু জমিদার সন্তান নন, তাঁরা সরকারী চাকরিতে দিকপাল ব্যক্তি। বড় ভাই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থেকে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। তিনি রায়বাহাদুর। ছোটভাই আর্মিতে ডাক্তার হিসেবে মেজর হয়েছিলেন। দুজনেই বসবাস করেন কলকাতায়, কিন্তু রটন্তী কালীপূজায় তাঁরা সপরিবারে আসেনই আসেন। এই কালীপূজার উপর তাঁদের অচলা ভক্তি। রায়বাহাদুর-মেজর সে যাই হয়ে থাকুন-তা এই মায়ের কৃপায়, এ বিশ্বাস তাঁদের হিমালয়ের মত দৃঢ়। তাঁদের জীবনে নজীর আছে, যে যখনই তাঁরা বিপদে পড়েছেন, তখনই এই দেবতাটি তাঁদের কৃপা করেছেন। সেই কৃপায় তাঁরা অনায়াসে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন। এবং যেবারই কোন প্রকারে কোন অঙ্গহানি বা অবহেলা হয়েছে সেইবারই তাঁরা বিপদে পড়েছেন।

ছোটভাই মেজর সাহেব একবার বলেন, পেশবারে তখন পোস্টেড তিনি, তাঁর পুজোর তারিখ ভুল হয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন সব বার আসতে পারতেন না, কিন্তু পূজার দিনে নিরম্বু উপবাস করতেন। তারিখ ভুলের জন্য তাঁর উপবাস করা হয়নি। তাঁর ডায়রীর নোট অনুযায়ী উপবাসের কথা পরের দিন। ওখানে একটু গোলমাল হয়। ত্রয়োদশী সংযুক্ত চতুর্দশী, আর পুর্ণিমা সংযুক্ত চতুর্দশী নিয়ে গোল বাধে। যাই হোক, মেজর সাহেব তখন মেজর নন, ক্যাপ্টেন। রাত্রে সেদিন তাঁর জীবন সঙ্কট হয়েছিল। তার বিস্তৃত বিবরণ থাক, আমি সঠিক জানিনে, কিন্তু তিনি সেই সঙ্কটে মায়ের নাম জপ করেই পরিত্রাণ পান। এবং পরে দাদার চিঠিতে জানতে পারেন, সেইদিনই গিয়েছিল মায়ের পূজা। এবং একটি বলি নাকি দ্বিচ্ছেদ হয়েছিল!

রায়বাহাদুরেরও এমন অভিজ্ঞতা অনেক

শুধু তাঁরাই নন, কীর্তিহাটে শিবেশ্বর রায়ের প্রথমপক্ষের তিন সন্তান ধনেশ্বর জগদীশ্বর সুখেশ্বর এঁদেরও পক্ষ থেকেও সেখানে বলি হয়। এবং দৌহিত্র হিসেবে পূজাতে সঙ্কল্পও হয়ে থাকে। এঁদের তার জন্য অর্থনৈতিক চিন্তা করতে হয় না, বলি ও ভোগের খরচ আসে তাঁদের মাতামহের দেওয়া জমি ও জমিদারীর আয় থেকে। বৎসরে পাঁচশো টাকা মুনাফা আজও তাঁরা পেয়ে থাকেন। জমির উৎপন্ন ধান থেকেও টাকা পান। এই রটন্তী কালীপূজার সময় গিয়েই তাঁরা মুনাফার টাকা এবং ধানের ভাগ নিয়ে বিক্রী করে টাকা নিয়ে বাড়ী ফেরেন। আগে সপরিবারে যেতেন, এখন মেয়েদের এবং ছোটছেলেদের নিয়ে যান না। যারা শক্তসমর্থ হয়েছে, যারা অসুবিধা ভোগ করতে পারবে তাদের নিয়েই যান। তাই বারো বছরের বেশি বয়সের ছেলেদের নিয়ে তাঁরা কাল সকালে চলে গেছেন। বাড়ীতে থাকবার মধ্যে বড় মেজ তরফের মেয়েরা ছাড়া কেউ নেই।

থাকবার কথা, শিবেশ্বর ঠাকুরদার দ্বিতীয়পক্ষের দুই ছেলের, তাদেরও একজন কমলেশ্বর, গাঁজাখোর, চোর, সেও দাদাদের সঙ্গে গেছে। রটন্তী পুজোর ভোজ খেতে। আছে একা বিমলেশ্বর। মুখচোরা শান্ত কুনো লোক বিমলেশ্বর কাকা। বিশ্বসংসারের কাছে নিজেকে অপরাধী অক্ষম জ্ঞান ক’রে ঘরের কোণেই বাস করে। আর মালা জপ করে, ত্রিসন্ধ্যা পূজা করে। বৈষ্ণবধর্মে তার দীক্ষা। মাছ খায় না, মাংস খায় না, গলায় কণ্ঠীও পরে। চৈতন্য-চরিতামৃত পড়ে নিয়মিত ভাবে। এক হাজার আটবার পড়বার সঙ্কল্প তার, তার মধ্যে দুশো বার পড়া হয়ে গেছে। সে ঘরের কোণেই বসে আছে পুজোর আসনে।

ইনস্পেকটর নায়েবকে ডেকে তার সামনে জগদীশ্বর কাকার ঘর সার্চ করেছেন। খুড়ীমাকে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন। অর্চনাকেও করেছেন। অর্চনা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। জগদীশ্বর কাকার বন্দুকটা পড়ে আছে তক্তাপোশের ওপর, লাইসেন্সটাও পড়ে আছে। তার সঙ্গে বহু পুরানো একখানা সরকারী চিঠি। লাইসেন্সটার সঙ্গে পিন দিয়ে গাঁথা রয়েছে। চিঠিখানায় মেদিনীপুরের ডি-এম জগদীশ্বর রায়ের অসমসাহসের প্রশংসা করেছেন একটা নরখাদক বাঘ মারার জন্য এবং লিখেছেন—সরকার এর জন্য খুশি হয়েছেন এবং তোমাকে একটা ডি-বি-বি-এল ব্রিজলোডিং গানের লাইসেন্স দিচ্ছেন।

আমি যেতেই ইনস্পেকটর বললেন-কি মশাই? আপনি কিছু জানেন নাকি?

কণ্ঠস্বর কঠিন দুর্বিনীত। কুটিল ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ এবং বাঁকা।

বললাম —কিসের?

—জানেন না কিছু, ন্যাকা সাজছেন, না? শিবুকে কোপালে কে? বললাম—জানি না।

—কাল রাত্রে কি করেছেন? কোথায় ছিলেন?

—বাড়ীতে।

—বাড়ীতে? তাহলে এ বাড়ীর কুকরী নিয়ে ভূতে কুপিয়ে এল নাকি?

বললাম—বলতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু না জানলে কি করে বলব?

—আপনারা জানেন। আপনাদিগে বলতে হবে। বলাব আমি।

ভিতরের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। কিন্তু কি করব? একলা আমি হলে হয়তো জবাব দিতাম। মার খেতাম। মারতে পারতাম না। কিন্তু জবাব দিয়ে মার খেয়েও অন্তত তৃপ্ত হতাম যে সহ্য করি নি, নির্যাতন ভোগ করেছি। কিন্তু সামনে আমার ওই সর্বনাশী অর্চনা। তার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছে! মাটির উপর দৃষ্টি রেখে দরজার একটা বাজুতে ঠেস দিয়ে পাথরের মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।

ইন্সপেক্টর কুকরীর খাপটা সামনে ধরে বললেন-কি লেখা রয়েছে চামড়ার উপর কালি দিয়ে, পড়ুন। এই লেন্স দিয়ে দেখুন। কি এটা?

—জগদীশ্বর রায়, কীর্তিহাট!

—এটা ওখানে গেল কি করে? বলুন কি করে গেল? বলুন? বল না খুকি –অৰ্চনা, অর্চনা তোমার নাম, বল না কাকে দিয়েছ তোমরা? কে চেয়ে নিয়ে গেছে? বল? সুরেশ্বরবাবু? এ বাড়ীতে তো কাল থেকে লোক দুজন, ও বাড়ীতে ইনি। আর এ বাড়ীতে ওই বিমলেশ্বর—কুনো কাদার তাল লোকটা। ওর দ্বারা এটা হয় না। লোকটা মদ খায় না, বৈষ্ণব মানুষ। শিবু মদের গন্ধ পেয়েছে। আমার বিশ্বাস এটা এই এঁরই কাজ, নিজে করেন নি, টাকা-পয়সা আছে। মদ খান ছবি আঁকেন, নিজের এতখানি ক্ষমতা হবে না, তবে পারেন, টাকাপয়সা খরচ করে লোক দিয়ে করাতে পারেন। ওই অতুলেশ্বরের আর তার মায়ের কেসে টাকা জলের মত ঢেলেছেন। কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার আনিয়েছেন। এ কীর্তি ওঁর। কুকরীর খাপটা না পেলে কথা ছিল, ভাবতাম দলের কারুর কীর্তি। কিন্তু এই খাপ বলছে এ এই বাড়ির কারুর কীর্তি!

হঠাৎ প্রচণ্ড ধমক দিয়ে উঠল অভদ্র শয়তানটা-এই অৰ্চনা!

চমকে উঠল অৰ্চনা।

—বল। বল। বল বলছি!

আমি থাকতে পারলাম না আর। আমি দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলাম—ওরই সমান চিৎকার করে বলে উঠলাম—ভদ্রভাবে কথা বলুন বলছি!

—হোয়াট? বিকট চিৎকার করে উঠল ইন্সপেক্টরটা!

আমি অপেক্ষাকৃত শান্ত কণ্ঠে বললাম-আপনি এই দেশেরই লোক, হয়তো ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ বা বৈদ্য হিন্দু। ভদ্রবংশের সন্তান আমরা—

—চোপ্ চোপ্ চোপ্—। ওসব বাক্যি বাসী হয়েছে, ওসব রাখ—সত্যি কথা বল। নইলে বুটসুদ্ধ তোর বুকে চড়ে নাচব। আর এই রুল-তাকাল সে অর্চনার দিকে।

শিউরে উঠেছিলাম। অর্চনা থরথর করে কাঁপছিল। দুহাতে শক্ত ক’রে সে দরজার বাজু চেপে ধরলো। ঠিক এই সময় সুলতা, যা ঘটল, তার মতো বিস্ময়কর ঘটনা আমার জীবনে বোধহয় ঘটে নি!

পিছন দিক থেকে একটি মৃদু কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত হল—ওরা নয় ইন্সপেক্টর বাবু, আমি—আমি শিবুকে কুপিয়েছি।

চমকে ফিরে দেখলাম—দাঁড়িয়ে আছে বিমলেশ্বর। লম্বা রোগা মানুষটি, হাতে তার একটা কুকরী। কুকরীটা নামিয়ে দিয়ে বললে—এই নিন সেই কুকরীটা।

অবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই। ইন্সপেক্টর পর্যন্ত।

বিমলেশ্বর বললে—কাল সকালে যখন মেজদা’রা বাগনান গেল, যখন বউদি, অর্চনা ওঁদের সঙ্গে নীচে নেমে গেছিল, তখন ফাঁক পেয়ে ঘরে ঢুকে আমি কুকরীটা চুরি করে এনেছিলাম। এনেছিলাম এই জন্যে। মদ আমি খাইনি জীবনে। আমার বষ্টুম মন্ত্র। কিন্তু এই গোপাল সিং-এর নাতি হরি সিংয়ের বেটা আমাদের বাড়ীর পাইকের বাচ্চা, আমাদের ইস্কুলে ফ্রি-শিপে পড়ত, যে ভাবে আমার মায়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে জেল খাটালে, সেটা—।

হঠাৎ চুপ করে গেল সে!

আমরাও সকলে চুপ করে রইলাম। কারুর কথা বলবার শক্তিও ছিল না। একটা শব্দে আমাদের সে ভাবটা কাটল। দেখলাম—অর্চনা মেঝের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে। সম্ভবত চেতনা হারিয়েছে; এই অবস্থা আর সহ্য করতে পারে নি।

মেজখুড়িমা ঘোমটা টেনে ঘরের মধ্যে সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে অর্চনার পাশে বসে ডাকলেন-অৰ্চনা! অর্চনা!

অর্চনার সাড় ছিল না। ইন্সপেক্টর বললে—সেন্সলেস হয়ে গেছে। মুখে চোখে জল দিন। বিমলেশ্বর অর্চনার এই অবস্থায় বিচলিত হল না। সে বললে-আমি দেশ-টেশ বুঝি না; স্বাধীনতা-টাধীনতা নিয়েও আমি মাথা ঘামাই না। আমি ভগবানকে ডাকি, আর ঘরের মধ্যে থাকি। কারুর অনিষ্টে নেই ইষ্টেও নেই। কিন্তু হরি সিংয়ের বেটা শিবু সিং, যার ঠাকুরদার বাবা গোপাল সিংকে আমার ঠাকুরদা রায়বাহাদুর পথের ভিখারি করে সাজা দিয়ে একটা ভাঁড় দিয়েছিলেন হাতে। দয়া করে জমিজেরাতও কিছু দিয়েছিলেন। তার এই শয়তানি, রায়বংশের গিন্নীর হাতে দড়ি পরানোর শয়তানিতে আমার মনে বুকে আগুন জ্বলেছিল। বসে বসে ঘরে ভেবেছি আর কপালে ঘা মেরেছি। পরশুর আগের দিন খবর এসেছিল, মায়ের জেল হয়েছে। সুরেশ্বর তখনো ফেরেনি। পরশু সারাদিন যত ভেবেছি, তত পাগল হয়েছি। রাত্রে তুলসীমালা ফেলে দিয়েছি। কালী মায়ের কাছে প্রণাম করে বলেছি, মা তোমার শরণ নিলাম। তুমি বল দাও, সাহস দাও। কাউকে কিছু বলি নি। মনে মনে সঙ্কল্প করেছি শোধ নেব। আগের রায়বাড়ী হলে বরকন্দাজ পাঠাতাম, ধরে আনত বাপ-বেটাকে। কাছারীর থামে বেঁধে চাবকাতাম। ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতাম। ঘরে আগুন লাগাবার কথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু তাতে ওদের মেয়েছেলেগুলো কষ্ট পেত। ঘর আবার নতুন হত। ভুলে যেত। তাই মনে মনে বিচার ক’রে ওই শিবুকেই সাজা দেব ঠিক করেছিলাম। খুন—খুনই করে ফেলব। নয় এমন জখম করব যে, যেন সারাজীবন মনে থাকে। রাত্রে বাবাকে স্বপ্ন দেখেছি! কাল সকালে উঠে ভেবেছিলাম জগদীশদার বন্দুকটা চুরি করে গুলি করে মারব বেটাকে। সকালে যখন দাদারা বাগনান গেল, তখন মেয়েছেলেরা সব নিচে, ঘরখানা খোলা পড়েছিল, আমি ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। কিন্তু বন্দুকটা নিতে গিয়ে নিলাম না। এতবড় জিনিসটা সামলাব কি করে? আর হয়তো সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ হবে। চোখে পড়ল নতুন কুকরীটা রয়েছে মেজদার বিছানার তলায়। ওইটেই বের ক’রে নিয়ে এলাম। লুকিয়ে রাখলাম। সারাদিন কালীমন্ত্র জপ করলাম। সন্ধের সময় স্ত্রীকে বললাম—আমি যাচ্ছি বলরামপুর বাবাজীর আখড়ায়, ওখানে আজ কীর্তন হবে, ফিরতে রাত্রি হবে আমার। এখন যেতে হবে আটদিন। অষ্টাহ নামগান। স্ত্রী সন্দেহ করে নি। মধ্যে মধ্যে যাবার মধ্যে বলরামপুর যাই আমি। কালীমায়ের প্রসাদী কারণ সন্ধেবেলা বড়দা খায়। আজ বড়দা নেই। আমি সেই প্রসাদটা খাব ভেবেছিলাম। কিন্তু সাহস হয়নি চাইতে। গোয়ানপাড়ায় চোলাই মদ মেলে। দু’একজন গোপনে চোলাই ক’রে বিক্রি করে। আমি তাদের কাছে গিয়ে বড়দা’র নাম ক’রে মদ এনে মাকে নিবেদন করে খেয়ে গিয়েছিলাম। লুকিয়েছিলাম হরি সিংয়ের বাড়ীর পাশের পুকুরপাড়ের জঙ্গলে। মতলব করেছিলাম, এমনি করে লুকিয়ে থাকব, একদিন, দুদিন, তিনদিন, চারদিন—একদিনও কি খিড়কিতে হাত-পা ধুতেও বের হবে না! আমার ভাগ্য ভাল যে, সেইদিনই বের হল। হাতে লাঠি আর লণ্ঠন নিয়ে হরি সিং আর আগে আগে শিবু। শিবু এসে শৌচে বসল পাশের জঙ্গলটাতেই। আমি সট্ করে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকলাম। তারপর—!

চুপ করলে বিমলেশ্বর।

নীরবে স্তম্ভিত হয়ে শুনে গেলাম সবাই। সে সেই অতি কুৎসিত অতি অশ্লীল ইন্সপেক্টর পর্যন্ত। ওদিকে ততক্ষণে অর্চনার জ্ঞান ফিরেছে। সে স্থির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছে বিমলেশ্বরের কথা!

বিমলেশ্বর বললে—আমার রক্তমাখা জামাটা আছে। সেটা নষ্ট করতে পারি নি। সেটাও আমি এনে দিচ্ছি।

এতক্ষণে ইন্সপেক্টর বললে—না। দাঁড়ান। আপনার সঙ্গে আমি যাব। ঘরটা সার্চ করব। একলা আপনাকে যেতে দেব না। আপনাকে আমি অবিশ্বাস করি না। আপনাদের বাড়ীর নাড়ীনক্ষত্র আমরা সংগ্রহ করেছি। আপনি এ কাজ পারেন এ কথা কেউ ভাবতে পারে না। কিন্তু । একটু হেসে বললে—মানুষ সব পারে। কিছু অসাধ্য নাই।

সুরেশ্বর চুপ করলে। তারপর বললে—বিমলেশ্বরকে হাতকড়ি দিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল। যাবার সময় আমাকে বললে বিমলেশ্বর-সুরেশ্বর, দাদারা কেউ নেই, কমলেশ্বর ও নেই, তোমাকেই বলে যাচ্ছি, ওরা রইল। দেখো একটু। ওরা তোমার সঙ্গে একই বংশের। আর আমার জন্যে মিথ্যে উকিল-টুকীল দিয়ে টাকা খরচ কর না। আমার কোন আপসোস নেই। আমি রায়বাড়ীর বেইজ্জতির শোধ নিয়েছি।

***

বিমলেশ্বরকে নিয়ে গেল, আমি অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন অভিভূত আমি জীবনে হই নি। বিমলেশ্বরের স্ত্রী এবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বিমলেশ্বরের স্ত্রীকে আজকেই যাকে ভাল করে দেখা বলে, তা প্রথম দেখলাম। বিমলেশ্বর ব্রজদার বয়সী। হয়তো দু-তিন বছরের বড়। কাকীমা আমার থেকে বয়সে ছোট। বর্ধমান শহরের উকীলের মেয়ে। শুনেছিলাম শক্ত কঠিন মেয়ে। বিমলেশ্বরের অংশমাফিক টাকা-কড়ি, ধান-পান তিনি বুঝে নিতেন। বাইরে বের হতেন না, অন্তরালবর্তিনী থেকেই এ কাজ করে যেতেন। বিমলেশ্বরকে যে কথার যন্ত্রণা-গঞ্জনা দিতেন, সে নাকি বিমলেশ্বর ছাড়া কারুর সহ্য করার শক্তি ছিল না। তাঁর বড় মেয়ে—তার বয়স বছর বারো, সেই ছিল তাঁর সেক্রেটারী থেকে পাইক বরকন্দাজ পর্যন্ত সবকিছু। নিজে পর্দা একটু বেশী মানতেন। জগদীশ্বর কাকা যে জগদ্বীশ্বর কাকা, তার স্ত্রীর থেকেও বেশী মানতেন তিনি।

তিনি আজ বাইরে এসে দাঁড়ালেন, মাথার ঘোমটা মাথার মাঝখানে দিয়ে। তিনি কাঁদেন নি। প্রথমেই এসে কঠিন ভাষায় অর্চনাকে বললেন—হল, হল? তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হল মা?

অর্চনা বিবর্ণ হয়ে গেল। আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। কি বলছেন উনি? উনি কি অর্চনার সঙ্গে যোগাযোগের কথা জানেন?

তাড়াতাড়ি আমি এগিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম—খুড়ীমা, সর্বনাশ হতে যাবে! খুড়ীমা! রায়বংশের—বুঝতে পারছেন না এ কথা ছড়ালে। বাকীটা বলতে পারলাম না।

আমার মুখের দিকে তাকালেন তিনি। তারপর ঘোমটাটা একটু টেনে দিয়ে বললেন—আমি উকীলের মেয়ে, আমি বুঝি! থাক। বলে তিনি গিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করব? ফিরে চলে আসব? না, আর একটু বুঝিয়ে বলে আসব! কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে কয়েকটা কথা বলাই স্থির করে ডাকলাম—খুড়ীমা!

বিমলেশ্বরের মেয়ে শোভনা কাঁদছিল। খড়ীমা বললেন ভিতর থেকে, আসতে বল ভেতরে। ভিতরে গিয়ে দেখলাম, এসে তিনি বিছানায় উপুড় হয়ে পড়েছেন, কাঁদছিলেন বোধহয়। তখনো চোখ মুছছিলেন। উঠে বললেন—কিছু বলছ বাবা?

—বলছি খুড়ীমা!

—বল?

—যে কথাটা আপনি বলছিলেন খুড়ীমা-অর্চনার নাম ক’রে—

—সে তো সঙ্গে-সঙ্গেই বন্ধ করেছি বাবা। আমি বুঝি। তিনিও আমাকে একথা বুঝিয়ে গেছেন। কাল শেষরাত্রে যখন ফিরে এলেন ওইসব করে, তখন চীৎকার করে উঠতে গিয়েছিলাম। উনি মুখ চেপে ধরে বলেছিলেন—চেঁচালে এখুনি আমি নিজে মরব। সমস্ত কথা শুনে আমি কুকরীটা, রক্তমাখা জামাটা, কাপড়খানা সব নষ্ট করতে বলেছিলাম। উনি বলেছিলেন—খাপটা হাত থেকে পড়ে গেছে বর্ধমানের বউ। ওটা যদি পায়, তাহলে বিপদ হবে। মেজদার ঘাড়ে দায় গিয়ে পড়বে। অর্চনা ধরা পড়বেই। কিন্তু তা তো হতে দেব না আমি। তবে আর শিবুকে মেরে এলাম কেন? সেই ছোটমায়ের জেলের কারণ বলেই তো! এ যে তার থেকেও সর্বনাশ। রায়বংশের কুমারী মেয়ে, পদ্মফুল; লোকে বলে-সতীবউরানী ঘুরে এসেছেন। এগুলো থাকবে। দরকার হলে বের করে দিতে হবে প্রমাণ হিসেবে। কিন্তু

একটু চুপ করে থেকে বললেন—কিন্তু ওকে ক্ষমা আমি করতে পারব না বাবা। চিরজীবনে পারব না। এ কাজ উনি নিজে করতেন কিনা জানি না। ইন্সপেক্টর ঠিক বললে—মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। উনি সেই গোড়া থেকেই; এই কথাটা নিয়ে মধ্যে মধ্যে—হায়রে কপাল, আর আমরা এমন অপদার্থ যে ব্যাঙে লাথি মেরে গেল, তাই সইতে হল? ছোটমায়ের অতুলের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলে হরি সিংয়ের বেটা শিবু সিং? নিজে থেকে থানায় গিয়ে বলে এল! আমরা তার কিছু করতে পারলাম না! বলতেন আর ডাকতেন, হে রাজরাজেশ্বর, তুমি তো এখনো রয়েছ রায়বাড়ীতে! মা-কালী, তুমিও তো রয়েছ মা। এর বিচার তোমরা করবে না? অতুল ছোটমা রাজদ্রোহ করেছে, তোমাদের বিচারে শাস্তি হয়তো প্রাপ্য, হয়েছে শাস্তি হোক। কিন্তু এই নেমকহারাম, এই অকৃতজ্ঞ শিবু সিং-এর বিচার কর! রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় ওর প্রপিতামহকে শেষ করে দিতেন; তাঁকে রক্ষা করেছিলেন সতী বউরানী। তার এই প্রতিদান? এর বিচার করবে না?

বাবা, একদিন অর্চনা বারান্দায় যেতে যেতে বোধহয় শুনেছিল, সে হঠাৎ ঘরে ঢুকে বললে—ন’কাকা, চুপ কর, আর লোক হাসিও না। চুপ কর! কথাগুলো শুনলে লোকে হাসবে।

উনি অবাক হয়ে চুপ করে গেলেন, আমিও গেলাম বাবা! উনি বললেন-কেন অৰ্চনা?

হেসে অর্চনা বললে—সে কি হাসি বাবা, দেখলে মরা মানুষের অঙ্গেও জ্বালা ধরে, বললে—রাজরাজেশ্বর কি তোমার দারোয়ান না বরকন্দাজ, যে শিবু সিংকে তোমার হুকুমে ঘাড় ধরে লাঠিপেটা করতে যাবে? না মা-কালী রায়বাড়ীতে নবাবী আমলের তাতারিণী প্রহরিণী যে, তলোয়ার হাতে শিবুকে কাটতে ছুটবে! ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! দুঃখ হয়েছে, ভগবান দুঃখ দুর কর ভগবান ঝাড়ু হাতে জমাদারের মত দুঃখের জঞ্জাল সাফ করতে আসবেন, সুখ রয়েছে আরো সুখ দাও, তো ভগবান ঝুড়ি ভর্তি আরো সুখ মাথায় করে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হবেন। চারটি খেতে দাও, পরতে দাও কি এই জন্যে? যারা নিজের দুঃখ নিজেরা দূর করতে পারে না, তার দুঃখ ভগবানের বাবা এসেও ঘোচাতে পারে না। বলি হ্যাঁ ন’কা, খাবার সময় তো নিজে জোগাড় করে এনে রেঁধে-বেড়ে হাতে তুলে খাও। তা দুঃখ নিজের হাতে ঘোচাতে পার না কেন? অপমানের শোধ তাই বা নিজে হাতে নিতে পারো না কেন?

অবাক বাবা, অবাক হয়ে গেলাম। উনি বললেন—তুই তো মিথ্যে বলিসনি অর্চনা! কথা তো ঠিক! কিন্তু শিখলি কার কাছে?

—বললে কি জান? বললে-তুমি যে গোবিন্দের পুজো কর—সেই ঠাকুরের কাছ থেকে। মহাভারত পড়, পুণ্যের জন্যে পড়। ভাবো তো কুরুক্ষেত্রের কথা; ঠাকুর তো দেহধারী, তখন—তিনি তো ইচ্ছে করলেই পারতেন পাণ্ডবদের অপমানের প্রতিকার করতে—তাঁর চক্রকে ডেকে বললেই পারতেন—যাও চক্র, কৌরবদের সবংশে ধ্বংস করে দাও। কে আটকাতো বল? কিন্তু তিনিও তা করেন নি, পাণ্ডবরাও তা বলে নি। পাণ্ডবরা যুদ্ধ করে রাজ্য উদ্ধার করেছে—অপমানের শোধ নিয়েছে।

বলে আর দাঁড়ায় নি তখন—চলে গিয়েছিল। আমি বাবা তখনো ভাবতে পারিনি-এর ফল এই হবে। বরং ভালই মনে হয়েছিল—মনে হয়েছিল এই যে ওঁর উঠতে-বসতে ঠাকুর আর ঠাকুর, যা করেন তিনি, এটা যদি এতে ঘোচে তো ঘুচুক। জান তো কোন কাজ করতেন না, যা করতাম আমি। উনি বছরে গোটা কুড়ি টাকা খরচ করে লটারির টিকিট কিনতেন। যতবার বলেছি—কিছু কর, তা করেন নি! ভেবেছিলাম—অর্চনার কথায় যদি এই ঘোরটা কাটে তো কাটুক!

এরপর বাবা অর্চনার কাছে উনি যেতেন। ডেকে কথা বলতেন। আমি কান দিই নি। অৰ্চনা বলছে বলুক।

কাল দুপুরে, রান্নাঘর থেকে দেখলাম-অৰ্চনা একটা কালো কিছু হাতে করে ঘরে ঢুকল—কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে গেল। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি—অর্চনা নিজে কুকরীটা ওঁকে দিয়ে গিয়েছিল। হয়তো উনি চেয়েছিলেন তা হতে পারে। তবে দিয়ে গিয়েছে ও। ওই সৰ্বনাশী।

আমি খুব বিস্মিত হই নি! কুকরী অর্চনা বের করে দিয়েছে—এ সন্দেহ আমার গোড়া থেকে। কিন্তু অৰ্চনা যে—তার বুকে আগুনও জ্বালিয়েছে, এ সন্দেহ হয়নি। অর্চনার এই নতুন চেহারায় আমি ভয় পেলাম।

খুড়ীমা বললেন—আমি ওকে অভিসম্পাত দেব বাবা সুরেশ্বর। দেখো তুমি, ও যেমন একটা নিরীহ মানুষের এমন সর্বনাশ করলে–আমার কপালে এমন করে আগুন জ্বালিয়ে দিলে, এর ফল ওকে পেতে হবে। ও জীবনে সুখী হবে না। বিয়ের বাসরে বিধবা হবে। হয়তো নিজের স্বামীর মৃত্যুর হেতু হবে ওই। এই আমার মত—আমার মত—দুঃখ ওকে পেতে হবে।

আমি নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বলুন। মনের ক্ষোভটা বেরিয়ে যাক! পরে যা হয় হবে—এখন পুলিশের হাত থেকে অর্চনা বাঁচুক।

হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন —তোমার অনেক টাকা আছে সুরেশ্বর। আর সম্পত্তি সমস্ত পত্তনী দরপত্তনী হয়ে তোমার হাতে। তুমি ওই সিংদের উচ্ছেদ করবে -বল! এর শোধ নেবে!

কি করব? বললাম—করব।

বিবিমহলে ফিরে এসে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম, মনে হচ্ছিল এই অভিভূত অবস্থা থেকে বুঝি কোনোদিন মুক্তি পাব না। এই রায়বাড়ীর মধ্যে থেকে কিছু একটা, কিছু একটাই বা বলি কেন, তার ভাল-মন্দ সব কর্মের ফল একটা অজগরের মত কোন্ গর্ত থেকে বেরিয়ে আমাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে। এ থেকে বোধহয় আমার আর মুক্তি নেই। শ্যামাকান্তের, সোমেশ্বরের, বীরেশ্বরের, রত্নেশ্বরের, দেবেশ্বরের, আমার জ্যেঠামশাইয়ের, বাবার সব কর্মফলের স্বাদ কেউ যেন আমার বুকে বসে আস্বাদন করাচ্ছে। শুধু তাই বা কেন, ব্রজদার কর্মফলের স্বাদ গ্রহণ করে তার দামও আমাকে মাথায় ব’য়ে দিয়ে আসতে হয়েছে।

ভাগ্য নিয়তি এ মানতাম না। আজও মানি না। তবে কর্মফলের ফলভোগ করতে হয় এবং বংশানুক্রমে সে বহুদুর প্রসারিত, এ-কথা আর না মেনে পারি না। সবিস্ময়ে সেদিন ভাবছিলাম গোপাল সিংয়ের কথা। সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা হচ্ছিল, ওই অর্চনা মেয়েটার জন্যে। এ-মেয়েটাও এই পাকচক্রে জড়িয়ে পড়েছে। পুড়ে ছাই না হয়ে যায়। ন’ কাকীমা ওকে অভিসম্পাত দিলেন। অভিসম্পাতে কিছু হয় না, কিন্তু কর্মচক্রের ঘুরপাকের পাকই শুধু নেই, ওর একটা নেশাও আছে। সে-নেশা কি ছাড়বে ও?

ভাবছিলাম। হঠাৎ আমার নায়েব এসে ঢুকল। বললে—বিমলেশ্বরবাবুকে হাতকড়ি দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে গোটা গ্রামটা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সামনে দশজন কনস্টেবল, পিছনে দশজন।

কি বলব! চুপ ক’রে রইলাম। নায়েব বললে—উদ্দেশ্য ভয় দেখানো। সরকারের তরফে সাক্ষী দিয়েছিল শিবু, তাকে জখম করার ফল দেখ। শিবুর বড় ভাই তাদের সঙ্গে যাচ্ছে আর বলছে-দেখ বাবা, গোপাল সিং ছত্রির অপমানের শোধ দেখ!

কথাটা যেন খচ ক’রে বুকে এসে বিধল সুলতা। গোপাল সিংয়ের অপমানের শোধ! কিন্তু গোপাল সিংয়ের অপরাধ!

হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ যেন ডাকলে —সুরেশ্বর রয়েছ?

নায়েব বললে—দয়াল ভটচাজমশায়। শুনলাম উনি দেখে হাউ-হাউ করে কেঁদেছেন। বোধহয় এই কথাই বলতে এসেছেন।

বললাম—যান, নিয়ে আসুন।

প্রায় আশী বছরের বৃদ্ধ। এখনো বেশ সবল আছেন। নিজে এখনও সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে যান। তিনি এসেছেন।

একা তিনি নন, আমাদের জ্ঞাতি উরু ভটচাজ, তিনিও এসেছেন।

দয়াল ভটচাজ রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের জ্ঞাতিভাই। বয়সে অনেক ছোট। রায়বাহাদুরের মেজ ছেলে শিবেশ্বর রায়ের বন্ধু। বয়সে বড় ছেলে দেবেশ্বর রায়ের থেকে দু-চার বছরের বড়। কিন্তু দেবেশ্বর রায় ছিলেন সে আমলের এলিট, ইংরিজীতে অতি পারঙ্গম, সাহেবী মেজাজের মানুষ। আর আভিজাত্য গৌরবে অতি উচ্চ শীর্ষ। সম্পদের এবং বংশ- গৌরবের উচ্চপীঠ থেকে কখনো মাটিতে নামতেন না। বাল্যবয়সে গোপাল পালের সঙ্গে যে প্রীতি হয়েছিল, সেটা ঠিক প্রীতি নয়, ভক্তের প্রতি দেবতার বাৎসল্যের মত প্রেম। কীর্তিহাটের লোকেরা তাঁর নাগাল পেত না। তাই তাঁদের বয়সীরা সকলে আশ্রয় করেছিল শিবেশ্বর রায়কে। দয়াল ভটচাজেরা বংশানুক্রমে রায়বংশের গুণমুগ্ধ, প্রেমমুগ্ধ। সে কুড়ারাম রায় ভটচাজের আমল থেকে। দয়াল ভট্টচাজের প্রপিতামহ কুড়ারাম রায় ভটচার্জের অনুগত জ্ঞাতিভাই হিসেবে তাঁর সম্পত্তির তদ্বির-তদারক করতেন। কুড়ারাম রায় ভটচাজ তাঁকে বেতন দিতেন। তাছাড়াও তাঁকে সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। ওই সিদ্ধাসনের জঙ্গল, রায় যদুরামের দেওয়া লাখরাজ ছিটমহল, চিতারং-এর আবাদী জমির সবটুকুই তাঁকে দিয়ে যজমান-সেবী ব্রাহ্মণ থেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সৎ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারে। একে জ্ঞাতি, তার উপর উপকৃত এই পরিবারটি দয়াল ভটচাজ পর্যন্ত চারপুরুষ ধরে রায়বাড়ীকে সম্ভ্রম ও মমতা দুই নিয়ে আঁকড়ে ধরে আছেন। কখনো রায়বংশের নিন্দা শুনতে পারেন না। তাঁদের দুঃখের দিনে তার ভাগ নিতে এগিয়ে আসেন সর্বাগ্রে। আজ দয়াল ভটচাজ এসেছেন। সঙ্গে উরু ভটচাজ এসেছেন। উরু ভটচাজ ধনেশ্বর রায়ের বন্ধু, থিয়েটার-পাগল, নিঃসন্তান, উল্লাসময় মানুষ। শিবেশ্বর রায়ের আমলে ধনেশ্বরের সঙ্গে থিয়েটার করেছেন। আমোদে-প্রমোদে-উল্লাসে শিবেশ্বর রায়ের সঙ্গী। সেই প্রীতির সম্পর্কটুকু তিনি ভুলতে পারেন না, তিনিও এসেছেন।

.

সুরেশ্বর বললে—বড় মিষ্ট লেগেছিল তাঁদের সেদিন। আত্মীয়তা যে এত মধুর এর আগে ঠিক অনুভব করিনি! মেজদি, অর্চনা আমার জ্ঞাতি আত্মীয় নয়, ওরা আমার আপনজন। সম্ভ্রম করেই সেদিন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম- আসুন। বসুন! চেয়ার এগিয়ে দিতে পা বাড়িয়েছিলাম। নিজেই চেয়ার নিয়ে বসে দয়ালদাদু বিনা ভূমিকায় কিছু বলতে উদ্যত হয়েও বলতে পারলেন না। তাঁর ঠোঁট-দুটো কাঁপতে লাগল।

উরুকাকা কথা বললেন—বললেন—ঠাকুরদা সেই তখন থেকে কাঁদছেন। বিমলেশ্বরের কোমরে দড়ি বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে। ওঃ, সে বড় মর্মান্তিক দৃশ্য, ওঃ।

দয়ালদাদু বলে উঠলেন—কাঁদতে কাঁদতেই বললেন—এই কি দেখতে পারা যায়!

—ওঃ! ঠিক বলেছেন। আবালবৃদ্ধবনিতা কাঁদছে। কাঁদবে না। রায়বংশের ছেলে। কীর্তিহাট- কীর্তিহাট রায়বংশের কীর্তিতে। তার বংশধর, তাও বিমলেশ্বরের মত ধর্মপ্রাণ ছেলে। ওঃ! কালের কি কুটিল গতি। অতুলকে ধরে নিয়ে গেল, মেজখুড়ীমাকে নিয়ে গেল। লোকে গৌরব করেছে। সাবাশ রায়বংশ। দেশের স্বাধীনতার জন্যে-ওঃ! আর এ?

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলাম আমি। ভাল লেগেছিল, লোকে বিমলেশ্বরের জন্যে কাঁদছে। দয়ালদাদু বললেন—জামিনের চেষ্টা করবে না ভায়া? তুমিই তো বলতে গেলে রায় বংশের পঞ্চপ্রদীপের একটি জ্বলন্ত প্রদীপ। আর তো সব প্রদীপে তেল ফুরিয়েছে।

বললাম—হ্যাঁ, করব।

—বিমলেশ্বর নাকি বারণ করেছে?

—তা করুন। ম্লান হেসে আমি বললাম—তিনি আমার টাকা খরচের কথা ভেবেছেন কিন্তু আমার সে শুনলে চলবে কেন?

উরুকাকা বললেন—শুধু তাই নয় ভায়া, এর শোধ তোমাকে নিতে হবে। হ্যাঁ।

দয়ালদাদু বললেন—যেমন ক’রে রায়বাহাদুর নিয়েছিলেন শোধ। ওঃ ঋণের শেষ আর রণের শেষ—এ রাখতে নেই। নিষেধ আছে। রায়বাহাদুর তা রাখতেন না। ক্ষুরধার বুদ্ধি। তেমনি বিচার! রণের শেষ তিনি রাখতেন না। কিন্তু তাঁর ভালো-মায়ের হুকুম। কি করবেন তিনি। গোপাল সিংয়ের স্ত্রী এসে দাঁড়াল তাঁর সামনে নাটমন্দিরে। দয়াময়ী সতী-বউরানী—তিনি প্রার্থী ফেরাতেন না। কি করবেন? থেকে গেল রণের শেষ। বীরেশ্বর রায় হুকুম করলেন –থাক। সতী-বউরানী অভয় দিয়েছে। থাক। তবে চোখের সামনে এনে রাখ। নজর রাখবে। থাক—বাঘ-ভালুক খাঁচায় পুরে রাখা জমিদারীর একটা অঙ্গ। থাক।

উরুকাকা বললেন—হ্যাঁ। গোপাল সিং একটা বাঘ ছিল। এটা ঠিক। হরি সিংয়ের মতো সাপ নয়।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *