প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ২.৩

পাঁচালীতে আছে—

দেবী সিংহ রেজা খান হইলেন হতমান
বন্দী হয়্যা শেষে যান কোম্পানীর ফাটকে

মহম্মদ রেজা খাঁ—রাজা দেবী সিং তখন কোম্পানির রেভেন্যু বোর্ডের সর্বেসর্বা। তারা নিদারুণ অত্যাচারে খাজনা আদায় করে দেশ উৎসন্ন দিলে। তবু কোম্পানির খাঁই মিটল না। বিলেতে কোম্পানীর অংশীদাররা শতকরা সাড়ে বারো টাকা লাভ পেলে। ইংলন্ডের পার্লামেন্ট বছরে চল্লিশ লক্ষ টাকা ট্যাক্স আদায় করলে কোম্পানীর কাছে। জগৎশেঠের দেনা শোধ হল না। ছিয়াত্তরে মন্বন্তর হল। রেজা খাঁ, দেবী সিং গেল। রেজা খাঁ ফাটকে গেল। নন্দকুমারের ফাঁসি হল। রায়রাঁইয়া অর্থাৎ কোম্পানীর রাজস্ব বিভাগের দেওয়ান হলেন রাজা দুর্লভরামের পুত্র রাজবল্লভ। ডেপুটি দেওয়ান হলেন গঙ্গাগোবিন্দ সিং। তারপর দেওয়ান। ফ্রান্সিস সাহেবের সঙ্গে হেস্টিংসের পিস্তল লড়াই হল। জখম হলেন ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস সাহেবের দলের একজন সায়েব মারা গেলেন। হেস্টিংসের হল জয়জয়কার, তার সঙ্গে দেওয়ানজীর। তার সঙ্গে কুড়ারামের।

দেওয়ানজীকে কতজনে কত বললে। দেওয়ানজী ছিলেন পাহাড়ী। তিনি নড়েননি। তাঁর আড়ালে কুড়ারাম ঢিপি হলেও উইটিপি ছিলেন না-একটা পাথরের ডাঁই ছিলেন। দেওয়ানজীকে দেওয়ানী থেকে একবার নামালে। কিন্তু দেওয়ানজী আবার উঠলেন। বললেন—নিজের কাম করে যাও কুড়ারাম। যার জন্যে আছ, সে কাজ তুমি করো। কেউ তোমাকে নামাতে পারবে না। আজ নামালে কাল উঠবে। বুঝেছ? আমাকে কোম্পানী রেখেছে কোম্পানীর আয় দেখতে বাড়াতে; আদায় করতে। আমাকে করতেই হবে। না করলে নিশ্চয় অধর্ম হবে আমার। রাজা সেপাই রাখে সান্ত্রী রাখে বদমাশকে দুশমনকে মারতে। সে তার কাম। দয়া সেখানে তুমি করবার কৌন হো? কোই নেহি হো। সে কাম না করলেই হবে বেইমান। নিমকহারাম। কি করব? দেখো ভট্টচার্য, দুনিয়া যে বানিয়েছে সেই বানিয়েছে বাঘ—সেই বানিয়েছে হরিণ। সেই বানিয়েছে ঘাস লতাপাতা। হরিণ ঘাস যায়, বাঘ হরিণ খায়। মানুষ বাঘ মারে। মানুষও মরে। ওসব বিচার আমার নয়। তোমার নয়। আপনা কাম। যে সাধু সে জপ করুক। সে ভিখিরি সে ভিখ মাঙুক। তুমি তোমার কাম করো।

হেস্টিংস চলে গেলেন দেশে। সেখানে পার্লামেন্টে ঝড় উঠল। হেস্টিংস সাহেবের পর ভান্সিটার্ট সাহেব এল—তারপর এল বুড়ো লর্ড কর্নওয়ালিশ। দেওয়ানজীর চাকরী থাকবে এ কেউ ভাবেনি। কিন্তু দেওয়ানজী তবু রইলেন। দেওয়ান থেকে, খারিজ হয়ে জমা বাকী সেরেস্তার ভার পেলেন। কুড়ারাম তাঁর দপ্তরেই এলেন। এই সময়ে মারা গেল ললিতা। তখন থাকতেন দেওয়ানজীর সঙ্গে বেলুড়ে। দেওয়ানজীদের পাইকপাড়ার বাড়ী তখনও হয় নি। বেলুড়েই মারা গেল ললিতা। দেওয়ানজী বললেন-এবার বিয়ে করে সংসার কর ভটচাজ। যা হয়ে গেছে গেছে, শেয়াল চাঁদে খেয়েছে। এবার ফের নতুন করে আরম্ভ কর।

কুড়ারাম চমকে উঠেছিলেন। দেওয়ানজী বলেছিলেন, হেসেই বলেছিলেন—আমি সব জেনেছি ভটচাজ, লজ্জা পেয়ো না।

রায় ভটচাজের পাঁচালীতে আছে—

দেওয়ানজীর রাজবুদ্ধি      ডেকে কন শোন যুক্তি
বংশ বিনে নাহি মুক্তি নরক রৌরবে।
অতএব বিভা কর      মিছা কেন কাল হর
স্থাপ বংশ বংশধর মায়াময় ভবে।
ললিতার এস্তাকালে      স্নান করি গঙ্গাজলে
দাড়ি গোঁপ চেঁছে ফেলে প্রায়শ্চিত্ত করি।
দর্পণে দেখিনু মুখ      হইল আশ্চর্য সুখ—
যৌবন রয়েছে অটুট হরি হরি হরি।
দেখিলাম বক্ষপাটা      ঢিলা নয় আঁটাসাঁটা
এ যেন জীবন গোটা সব আছে পড়ি।

অতএব রায় ভটচাজ বিয়ে করবার অভিলাষী হলেন। কিন্তু বয়স্কা কন্যা চাই। সুন্দরী কন্যা চাই। এবং বংশও উচ্চ চাই। পেতেও বিলম্ব হ’ল না। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের প্রিয়পাত্র, কোম্পানীর দেওয়ানী দপ্তরে বিচক্ষণ কর্মচারী, শক্তসমর্থ রূপবান মানুষ, লোকে বলে অর্থ তাঁর অনেক, তাঁর কি আর কন্যার অভাব হয়? বিবাহ করলেন পছন্দ করে; কালীঘাট গ্রামে, তখন কালীঘাটকে তার বাসিন্দারাই বলত গ্রাম। সুন্দরী বয়স্কা কন্যা; কিন্তু বংশের খুঁত ছিল। লোকে বলত ফিরিঙ্গী সংস্পর্শে দোষ। সেই কারণেই এমন সুন্দরী মেয়ের বিয়ে হয়নি, কিন্তু কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্য, যিনি মুসলমান হয়ে যাওয়া বামুনের মেয়েকে গোবর খাইয়ে গঙ্গাস্নান করিয়ে ললিতা করতে পেরেছিলেন তাঁর পক্ষে এ বাধা বাধাই হয় নি। বিয়ে করে নবদ্বীপে গিয়ে পোড়া-মা-তলায় আগমবাগীশ কৃষ্ণানন্দ- ভট্টাচার্যের বংশধরদের কাছে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে পাকা ভিত গেড়ে সংসার শুরু করেছিলেন। কলকাতায় তখন জানবাজারে রাণী রাসমণির কাছে জমি পেয়েছেন। বাড়ী করলেন ছোটখাটো। এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলেন নিজের গ্রাম নিজের ভিটেকে। দৃষ্টি স্বপ্নের মধ্যেই হোক আর গভীর চিন্তার মধ্যেই হোক, কীর্তিহাট ছাড়িয়ে কাঁসাই নদীতে তরী ভাসিয়ে হলদীতে পড়ে চলে গেছে মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘নিমক-মহল’ পর্যন্ত। অর্থাৎ যেখানে নুন তৈরী হত সে সব অঞ্চল—হিজলী তমলুক কাঁথি পর্যন্ত।

কোম্পানী হেস্টিংস সাহেবের আমল থেকে নুনের কারবার একচেটে করেছে। খালারি বা নুন তৈরীর খালগুলি কোম্পানীর খাস, সেখানে জমিদারের দাপট চলে না। কোম্পানী দাদন দেয়, ঠিকাদারদের নুন কেনে। ওদিকে দক্ষিণে মারাঠা এলাকায় নুন আমদানি বন্ধ হয়েছে। দেশে নুনের দর চড়েছে, নিমক মহলের ইজারার এলাকায় এখন পূর্ণিমা অম্যাবস্যার জোয়ারের মধ্যে মা লক্ষ্মীর মল বা নুপুরের ঝম ঝম শব্দ শোনা যায়। মা লক্ষ্মী এখানে লক্ষ্মী মেয়ের মতো আস্তে হাঁটেন না, চঞ্চলা চপলা দুরন্ত মেয়ের মত দৌড়ে আসেন।

নুনের দেওয়ানীর পদ তখন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তার থেকেও ইজারাদারির উপর নজর ছিল বেশি। কীর্তিহাটে পোক্ত আরামদায়ক মাটির কোঠাবাড়ী করিয়ে ওখানেই কারবার শুরু করবার বাসনা করেছিলেন। হঠাৎ বাধল বিপর্যয়। মেদিনীপুরে হল চুয়াড় হাঙ্গামা। প্রথম কোম্পানীর সঙ্গে রাজস্ব নিয়ে লেগেছিল ওখানকার জমিদারদের। লড়াইও দু’চারজন জমিদার করেছিল। সে লড়াই কলকাতার ময়দানে মনুমেন্টের তলায় সন্ধ্যার পর হিন্দুস্থানিদের কপাটী খেলার মত লড়াই। লড়াইয়ে হেরে জমিদারেরা বাগ মানলে, কিন্তু চুয়াড় পাইকেরা পাইকান জমি বাজেয়াপ্তির জন্যে হাঙ্গামা বাধালে। চুরি ডাকাতি খুনখারাপী দিয়ে শুরু, ক্রমে পাঁচশো সাতশো হাজার দেড়হাজার চুয়াড় পাইক জবরদস্তি করে কোম্পানীর নতুন জমিদারদের কাছারী লুঠ করতে আরম্ভ করেছে, রায়তদের ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, বাজার হাট গঞ্জ লুঠ করে খুনখারাপী করতে শুরু করেছে। তখন ১৭৯৮-৯৯ সাল।

দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিং তখনও কাজে রয়েছেন। লর্ড কর্নওয়ালিশ দেশে চলে গেছেন। দেওয়ানজীও কাজ ছাড়বার কথা ভাবছেন। কুড়ারামও তাই ভাবছেন—আর কেন? এইবার কাজ ছেড়ে স্বাধীন হবেন। অনেক ব্রহ্মত্র করেছেন দেশে। কলকাতায় নানান কাজ এখন। টাকা তাঁর আছে, সেই টাকা সায়েবদের ধার দিয়ে বা তাদের কারবারে দিয়ে মুচ্ছদ্দীর কাজ করলে প্রচুর উপার্জন হতে পারবে। স্ত্রী তার আগেই পাঁচ বছরের সোমেশ্বরকে রেখে মারা গেছেন। বিবাহের কথা তাঁর মনে হয় নি—তবে অন্য লোকে বলেছিল। কিন্তু তাতে তাঁর মন সায় দেয় নি। মনে কেমন একটা বৈরাগ্য এসেছে। মন গেছে ইষ্টের দিকে। এখন সাধ মায়ের মন্দির ক’রে তার আশ্রয়ে সোমেশ্বরকে নিয়ে একটি সুখের সংসার করেন। আর তার সঙ্গে নুনের খালারির ইজারাদারি। নইলে থাকবেন কি নিয়ে? শুধু জপে কি কাল কাটে? আর আট-নয় বছর পার হলেই সোমেশ্বর ষোল বছরের হবে। সোমেশ্বরকে মানুষ করবার জন্য একটি ব্রাহ্মণ বিধবা এবং একটি শুদ্র ঝি রেখে দিয়েছেন। লোকে হাসত। বলত—ভটচাজ রাম কিপ্পন! এত টাকা, তাই রাখবি রাখবি একটা ভাল বাঈজী রাখ। দুটো কসবী আনকী রাঁড় রাখ। তা না—দুটো ঝি। কিন্তু কুড়ারাম পাঁচালীতে এই বামুনের মেয়েকে মা বলেছেন—আর শূদ্র ঝিটিকে বলেছেন কন্যা।

হঠাৎ একদিন ডাক পড়ল দেওয়ানজীর কাজে। দেওয়ানজী বললেন, মেদিনীপুর কালেক্টরীতে যেতে হবে তোমাকে। তোমার নিজের এলাকা। ওখানে হাঙ্গামা বেধেছে, জান তো? এখন কোম্পানির ফৌজ গিয়েছে। রাজারা ওই দু চারদিন কেল্লা ক’রে থেকে এবার কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তি করছে। ওখানকার হস্তবুদ ঠিক করে কালেক্টরী ধার্য করবে। আর মারাঠী আমলে ওদের যে পাইকান জমি ছিল, যে জমি পাইকরা ভোগ করত মাইনের বদলে তা বাজেয়াপ্ত করে বিলি ক’রে দেবে। এই সব নিয়ে রেভেন্যু হবে। বুঝলে? রাজাদের তো আর পাইক পুষবার দরকার নেই। আর বর্গী আসছে না। এলে খোদ কোম্পানীর সরকার তার সমঝোতা করবে লড়াই দেবে। আর নিজের জেলায় যাচ্ছ—ব্রহ্মত্র মাল জমি

—সে আপনাকে জানাব, হুজুর, তারপর।

—এইজন্যেই তোমাকে ভালবাসি, ভটচাজ।

কুড়ারাম মেদিনীপুরে যেদিন পৌঁছলেন, সেইদিনই পাইকদের সর্দার নষ্টগুড়ের খাজা গোবর্ধন দলপতির ফাঁসি হয়ে গেল। লোকটা বিপর্যস্ত করে তুলেছিল অঞ্চলটাকে। মেদিনীপুরের রাণী শিরোমণি তখন কোম্পানীর একরকম নজরবন্দী।

রেভেন্যু ধার্য করলেন কুড়ারাম। ধর্ম তাকিয়ে কোম্পানীর স্বার্থ ষোল আনার জায়গায় দু আনা বেশী ক’রেছিলেন—

ধর্মকে মাথায় রাখি      কোম্পানীর স্বার্থ দেখি
কুড়ারামে দিতে ফাঁকি কেহ নাহি পারে—
যেখানে দু পয়সা পাই      নুন খেয়ে গুণ গাই
দিই কিছু সুবিধাই মনিবে না মেরে।

সে সময়ের কালটা সকলে জানে। মেদিনীপুর বাঁকুড়ায় জমিদার-বিদ্রোহ সে সামান্য হলেও পাইক চুয়াড় বিদ্রোহ বাংলার শেষ বিদ্রোহ। কোম্পানীর শক্তিকে ঝড়ের মত বইতে হয়েছিল- শালবন তালবন সমৃদ্ধ মেদিনীপুরের বনস্পতিগুলির মাথা নোয়াতে। পাঠান মোগল আমল থেকে যে সব রাজা উপাধিকারী সামন্তেরা বংশের কুর্শীনামা অক্ষুণ্ণ রেখে প্রাচীন বৃক্ষের মতো মাটির গভীরতম প্রদেশে শিকড় চালিয়ে বসে ছিল—তারা এই ঝড়ের মুখে ভগ্নশাখা হয়েছিল সবগুলিই।

কিছু কিছু মধ্যকাণ্ডে দুমড়ে দুটুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছিল—কিছু কিছু একেবারে মূল ছিঁড়ে উল্টে পড়েছিল মুখ থুবড়ে আছাড় খেয়ে। পাইকানের গোঙানির কেন্দ্রে বসে কুড়ারাম এই লীলা দেখেছিলেন আর মনে মনে ভেবেছিলেন—ওই ভাঙাগাছের খালি জমির উপর বংশের চারাগাছটি পুঁতলে হয় না? হঠাৎ চোখে পড়ল বাকী দায়ের তালিকায় দেনদার ময়নার রাজার নাম। উপরি উপরি খাজনা বাকী পড়েছে রাজার। এবার রাজার রক্ষা থাকবে না—রাজা যাবে। ময়নার মধ্যেই কীর্তিহাট!

যদি —।

ময়নার রাজা—সেই ধর্মরাজের আশ্রিত হাজার দু হাজার বছরের পুরনো লাউসেনের বংশধরদের কাছ থেকে মারাঠাদের আশ্রয় নিয়ে রাজ্য কেড়ে নিয়ে রাজা হয়ে থাকলে যদি তাদের দোষ না হয়ে থাকে, তা হলে এদের এই বাকী খাজনার দায়ের সময় একটু উস্কে আস্কে দিয়ে ওদের ঠেলে ফেলেই যদি কেউ দেয়, তবে তাতে আর অপরাধ কোথায়?

ময়নার রাজার জমিদারী থাকবে না, এ নিশ্চিত।

ওই তো ময়না পরগণার ওপাশে কাঁসাইয়ের উত্তরে মহিষাদল। মহিষাদল ছিল মহাপাত্রদের; কল্যাণ রায় মহাপাত্রদের শেষ পুরুষ; জনার্দন উপাধ্যায়কে বিশ্বাস করেছিলেন, সে তাকে পথে বসিয়ে নিয়ে নিয়েছিল মহিষাদল। উপাধ্যায়দের শেষ রাণী জানকী। রাণী পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। সে অন্ধ হল। মহিষাদল এল গর্গ বাহাদুরের হাতে। লক্ষ্মী ভূমি কখন যে কার বাড়ী ঢোকেন কেউ বলতে পারে না।

ভাবনাটা মনের মধ্যেই ঘুরছিল। মনে মনে কুড়ারাম মাকে ডাকছিল—বল না, তুমি বল!

এরই মধ্যে এল কোম্পানীর পরওয়ানা।

আসছে কলকাতা থেকে। রেভেন্যু বোর্ডের হুকুমে যেতে হবে তাঁকে বাঁকুড়া।

বৈশাখ মাস, ঝড়বৃষ্টির সময়। কিন্তু উপায় ছিল না। কাজ জরুরী।

***

হঠাৎ সুলতার কণ্ঠস্বরে সুরেশ্বর ১৭৯৮ সালের কুড়ারাম ভট্টাচার্যের পাঁচালী থেকে এসে পড়ল ১৯৫৩ সালের ২৫শে নভেম্বরে। সামনে দেওয়ালে ছবিগুলি ঝুলছে। এতক্ষণ এরাই যেন সজীব হয়ে তার সঙ্গে কথা বলছিল। সুলতার গলার সাড়ায় ছবির মধ্যে ছবি হয়ে মিশে গেল।

—কি, তুমি ধ্যানস্থ হয়ে গেছ মনে হচ্ছে!

ছবিগুলো বাস্তব হয়ে উঠেছিল। সুলতার গলার সাড়ায় তারা যেন ছবি হয়ে ছবির মধ্যে মিলিয়ে গেল।

সুরেশ্বর বর্তমানে ফিরে এসে সুলতার দিকে তাকালে।

সুলতা বললে-আমি দু’বার এসে ফিরে গেছি। ধ্যানভঙ্গ করিনি হাতে কাজ ছিল বলে।—কি এত ভাবছিলে? সেকাল?

সুরেশ্বর বললে—হ্যাঁ, সেকাল! তবে ঠিক এই মুহূর্তটিতে টাকার অঙ্কে এসে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম রায়বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুড়ারাম ভট্টাচার্য-রায় ভট্টাচার্য নামক ব্যক্তিটি যেদিন দশ এগার বছরের ছেলের বিয়ে দিয়ে জমিদারী কিনে বরকনে নিয়ে কীর্তিহাট গ্রামে প্রবেশ করলেন—যেটা আমার প্রথম ছবির বিষয়বস্তু —সেদিন তাঁর সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। তখন জমিদারী কেনার টাকা দেওয়া হয়ে গেছে—কালী প্রতিষ্ঠা, তাঁর মন্দির, পাকা বাড়ী এসব খরচ শেষ হয়েছে। অর্থাৎ ওসব বাদ দিয়েও পাঁচ লক্ষ টাকা। অথচ মাইনে ছিল যৎসামান্য। শতের কোঠায় পৌঁছে আর বেশী দিন চাকরী করেন নি।

সুলতা বললে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে। সে রাজত্বটাই তো লুঠের রাজত্ব। ঘুষ আর কোম্পানীর সাহেবদের লাথি এ দুটো এত সস্তা ছিল যে ছিয়াত্তুরের মন্বন্তরে মানুষের প্রাণ এত সস্তা হয়নি এবং কুলীনের ছেলেদের বিয়ে এত সস্তা হয়নি। তবে একটা কথা বলতে পার যে কুড়ারামেরা ঘুষ নিয়ে দশ বিশ লাখ আটকে বা পুঁতে রেখেছিলেন বলেই দেশে থেকে ছিল, নইলে সবই চলে যেত বিলেতে।

হাসলে সুরেশ্বর। ঘুষ তুমি বল আমি আপত্তি করব না। তবে কুড়ারাম রায় ভট্টচাজ সামনে থাকলে তিনি প্রতিবাদ করতেন। ঘুষ? আমার ন্যায্য পাওনা। সাক্ষী মানতেন ধর্মকে, সেকালের ধর্মরাজকে। তিনি এসে তাঁর স্বপক্ষে সাক্ষী দিতেন হলফ করে বলতে পারি। মিনিস্টার হলে আজকাল নমস্কার পায়, মিনিস্টারী গেলে পায় না। সুতরাং মিনিস্টার থাকাকালীন পাওয়া নমস্কারটা ন্যায্য পাওনা নয় বললে তো চলবে না। কিন্তু ও-কথা থাক। এতক্ষণ করছিলে কি?

সুলতা বললে-বাড়ীতে টেলিফোন করে ফিরে আসবার সময় দেখলাম—রঘু ময়দা মাখছে। আমি ভাবলাম আমার জন্যে করছে। বললাম—এসব কেন করছ? দরকার নেই। রঘু বললে—তা বলো না দিদিমণি। তুমি খাও, তা হলে সঙ্গে লালবাবুরও খাওয়া হবে। আজ সারাটা দিন বলতে গেলে কিছু খায়নি। কেন, খাওনি কেন? জমিদারী যাওয়ার শোকে?

—যেটা থাকে সেটার বিয়োগেই শোক, বলতে পার। কিন্তু ঠিক তা নয়। কীর্তিহাটে গিয়ে খাওয়ার পর পিতৃপুরুষের দিবানিদ্রাটা অভ্যেস করেছি। এবং ওর আমেজ এমন যে খাওয়ার পর ঘুমুবার ব্যবস্থার অভাব হলে খাওয়াটাই তাকে তুলে দিতে হয়। কিংবা বমি হয়ে উঠে যায়। আজ সকাল থেকে ছবি টাঙিয়েছি। তিনটের পর অ্যাসেম্বলীতে গিয়েছি। সুতরাং ঘুমুবার সময় কোথায়? তাই খাই নি।

—এসেও তো কিছু খাওনি!

—ঠিক খেয়াল হয় নি। তোমাকে ছবি দেখাবার ব্যগ্রতাটাই সব থেকে বড় হয়ে উঠেছিল। তুমি সময় দিয়েছিলে একঘণ্টা। তার মধ্যে ছবিই বা কখন দেখাই, খাই-ই বা কখন। ছবি দেখাবার তাড়ায় মনে ছিল না। কিন্তু তুমি রঘুর সঙ্গে হাত লাগালে নাকি? কেন?

—তা একটু লাগালাম। লুচি বেলে দিলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারেস্টিং কিছু পেলাম, পড়ছিলাম—পড়া হয়ে গেল।

—কেন যে এসব করতে গেলে? ছি-ছি-ছি!

—তাতে কি হয়েছে? উদর নামক যন্ত্রটি তো আমারও আছে। সেখানে খাদ্যরসের মোবিল না পড়লে যে যন্ত্রটি জ্বলে যাবার সম্ভাবনা আছে। হলামই বা অনার্ড গেস্ট, একটু হাত লাগালাম। তুমি ক্ষিদে ভোল—তুমি শিল্পী। কিন্তু আমি মাটির জীব।

হেসে সুরেশ্বর বললে তার ওপর তুমি সোসালিস্ট। গান্ধীজী যে গান্ধীজী তিনি ছিলেন স্পিরিচুয়াল সোসালিস্ট। তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন-দেশ এখন একটিমাত্র কবিতা চায়—সেটির নাম অন্ন। তুমি তার থেকে বড়ো নিশ্চয়, যদি প্রশ্ন করি খাওয়ার জন্যে বাঁচা-না বাঁচার জন্যে বাঁচা তা হলে কি উত্তর দেবে হলফ করে বলতে পারি না।

—এ তকরার খেতে খেতে হবে। তাও না। তকরার একেবারে বাদই থাক। তুমি তোমার কড়চার কাহিনী বল। তার আগে তোমাকে বলে নিই। তোমার আদিপুরুষের নামাঙ্কিত একটা পাঁচালী, অবশ্য সেটা তোমার হাতে নকল করা, সেটা তোমার টেবিলের উপর পড়ে আছে। বলছিলাম না, ময়দা মাখতে মাখতে ইন্টারেস্টিং কিছু পড়ছিলাম—সেটা ওইটেই। খুব ভাল করে পড়েছি বলব না। তবে মোটামুটি পড়েছি। সমাজে সেকালে যারা বংশ প্রতিষ্ঠা করেছে, তারা এমনি না হলে হয় না।

রঘু এসে দাঁড়াল।

সুলতাই বললে—কি? খাবার দিয়েছ?

রঘু বললে—হ্যাঁ দিলম।

সুলতা বললে—এস। খেয়ে নাও আগে। এবং খেতে খেতেই বল। তোমার কথা তো অনেক। আমাদের আসরের পরমায়ু এই রাত্রিটুকু। দশটা বেজে গেছে। বসো।

তারা রঘুর পিছনে পিছনে খাবার ঘরে ঢুকল। বসল সামনা-সামনি। রঘু খাবার সাজিয়ে রেখেছিল। আয়োজন দেখে সুরেশ্বর বললে-এত করতে গেলি কেন? লুচি বেগুনভাজা আলুভাজা ছেঁচকি—মাংসটা তো না হয় খাবোই। এ যে অনেক।

সুলতা হেসে বললে-আমি বলেছি।

—কেন এত ঝঞ্ঝাট করলে?

সুলতা বললে—আজ না-হয় আমি অতিথি, আমি আমার অনারেই করেছি। অবশ্য তোমার মান রাখতে। কারণ বলতে তো পারি, সুরেশ্বর গল্প শোনাবার ছবি দেখাবার জন্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে সারারাত্রি উপোস করিয়েছিল।

সুরেশ্বর অপ্রতিভ হয়ে গেল এবার। বললে—দেখো, আমার কমন সেন্স যেন কমে যাচ্ছে! সত্যিই তো!

সুলতা বললে—সারাদিন তুমি খাওনি। ক্ষিদের খুব বোধ রয়েছে বলেও মনে হল না। রঘু বলেছিল—দিদিমণি, আমার সেই লালবাবু যে কি রকম হয়ে গেলো! খায় না। খেতে দিলে পড়ে থাকে। কীর্তিহাটে মেঝলা ঠাকুর-মাই ছিলেন, উনহি উনকে খাওইতেন। লালবাবু বিলায়েত চলে গেলেন, ঠাকুর মাই গেলেন বৃন্দাবন। আর আইলেন না। উসকে বাদসে এহি হাল। আজ সাত আট বরিষ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম- কেন, এমন হল কেন? বললে হামি নোকর, হামি কি করিয়ে বলি। উনকে পুছিয়েউ বলবে। উ ঝুট তো বোলে না!

সুরেশ্বর সুলতার আগেই খেতে শুরু করেছিল। সুলতা বললে—কত ক্ষিদে পেয়েছিল বল তো?

—কেন?

—না-হলে আমি খেতে শুরু করলাম কিনা তা লক্ষ্য না করেই খেতে শুরু করেছ তুমি?

—ওই দেখ। ছত্রিশ সাল থেকে তেপ্পান্ন সাল-সতের বছর কীর্তিহাটে একলা থেকেছি, ভেবেছি, নানান দেশ ঘুরেছি, তার মধ্যে এইরকম হয়ে গেছি। প্রথম মেজঠাকুমাকে পেয়েছিলাম সেখানে।

একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—মেজঠাকুমা আমার মেজদি, আমার জীবনের পরম সম্পদ। একাধারে মা ছিলেন আবার ঠিক বড়দিদি ছিলেন; হয়তো বা রায়বংশের প্রতিষ্ঠা করা যে যুগলবিগ্রহ আছে তারই মুর্তিমতী রাধা ছিলেন। আমার জন্যে কলঙ্কের ভারও মাথায় নিয়েছেন তিনি।

—কলঙ্ক? কি কলঙ্ক?

—কলঙ্ক সংসারে নারীর একটিই সুলতা। ভালবাসার কলঙ্ক। রায়বংশ এমন পচে গেছে যে নিজের বংশের শ্রেষ্ঠ পুণ্যের আশ্রয় মেয়েটিকে কলঙ্কিনী বললে তারাই।

—থাক সুরেশ্বর, ওসব তোমার ঘরের কথা। তার থেকে তুমি বল—তোমার কড়চার কথা বল! আমার পূর্বপুরুষ ঠাকুরদাস পাল খুন হয়েছিলেন। বাবাকে আমি টেলিফোন করলাম, বললাম—আজ ফিরব না বাবা। সেই সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম- আমাদের পূর্বপুরুষ ঠাকুরদাসের কি পাল উপাধি ছিল? বললেন—হ্যাঁ, তখন তাই ছিল। কিন্তু আসল উপাধি আমাদের ঘোষ। জিজ্ঞাসা করলাম—তিনি কি খুন হয়েছিলেন? বললেন—শুনেছি তাই। একজন দেশী ক্রীশ্চান গুণ্ডা তাঁকে খুন করেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম- ঘটনাটা কি জান? বললেন—সে তো আমারও তিন পুরুষ আগে। তাছাড়া ওই উনি খুন হলে আমার পিতামহ কলকাতায় এসে ব্রাহ্ম হন, দেশের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে যায়। তারপর তিনিও আমার বাবাকে ছেলেমানুষ রেখে মারা যান। আমি মামার বাড়ীতে থেকে পড়েছি, বিলেত গেছি। ওসব পিছনের খবর আমাদের ঠিক জানা নেই। জানিনে। বাবা কারণ জানতে চাইলেন, বললাম—কাল বলব। তোমার পূর্বপুরুষ কি ওই ক্রীশ্চান গুন্ডাটাকে দিয়ে খুন করিয়েছিলেন বলছ? কি করে জানলে তুমি? কে বললে তোমাকে?

—বলেনি কেউ, আমি খাতা থেকে পেয়েছি।

—খাতা থেকে?

—হ্যাঁ, প্রথম পেলাম জমাখরচের খাতা থেকে।

অবাক হয়ে গেল সুলতা। জমাখরচের খাতা থেকে? তার হাতে ধরা লুচি আলু-হেঁচকি সে ধরেই রইল।

***

সুরেশ্বর বললে—রায় বংশের সাত পুরুষের পাপপুণ্য ভালোমন্দ সব-কিছুর ফিরিস্তী বুঝি বিধাতার ইচ্ছায় গচ্ছিত ছিল আমার ওই মেজঠাকুমা —মেজদির কাছে। মেজদিকে কলঙ্কিনী অপবাদ না দিলে হয়তো এ ফিরিস্তী তিনি আমাকে দিতেন না! তাই সেই কথাই বলছিলাম তোমাকে। এবং তার সঙ্গে আমার জবানবন্দী যেটা তোমার কাছে প্রথম দেবার আছে সেটাও দেওয়া হয়ে যাবে।

সুলতা বললে—বল।

সুরেশ্বর বললে—মেজঠাকুমাকে ওরা কলঙ্ক দিলে। সেই বৃত্তান্ত থেকেই বলি। মেজঠাকুরদার মৃত্যুর পর থেকে মা ওঁর পঞ্চাশ টাকা মাসোহারা বরাদ্দ করেছিলেন। মা মারা গেলেও সেটা আমি বন্ধ করিনি। আমার সঙ্গে একটি স্নেহের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাবার শ্রাদ্ধের সময়। সেটেলমেন্টের সময় মেজতরফ আমাকে ন্যায্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছে বুঝতে পেরে উনিই ছুটে এসেছিলেন কলকাতায়, আমার ওখানকার নিজস্ব নায়েবকে নিয়ে। আমি তোমাকে জানালাম। তুমি তাড়া দিয়ে বললে—যেতে হবে বইকি। যাও। ঠাকুমা নায়েবের সঙ্গে রঘু চাকরকে পাঠিয়ে দিলাম আগে, পরের দিন আমি কীর্তিহাটে পৌঁছলাম এগারোটার সময়; শেষ চৈত্র তখন। ওখানে গ্রীষ্ম, কীর্তিহাটে বলে ‘খরা’, তখন প্রখর হয়ে উঠেছে। মেদিনীপুরে নেমে জীপ ট্যাক্সিতে গিয়েছিলাম—ফলে সর্বাঙ্গ ধূলি ধূসরিত হয়ে গিয়েছিল।

মেজঠাকুমা বিবিমহলের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। নায়েব ছিল, ডিকু, রোজা, ওরা চাকরী করত, সেই বাবার শ্রাদ্ধের সময় থেকে তারা ছিল; কিন্তু অভ্যর্থনা করলেন মেজঠাকুমা। রায়বংশের যেটুকু স্নেহ আমার প্রাপ্য সেটা যেন ওঁর কাছে জমা ছিল সুলতা। অপরাধ বোধহয় তাঁর এইখানেই।

সব মনে পড়ছে আমার। ছবিতেও এঁকে রেখেছি। সে ছবি অবশ্য অনেক পরে আসবে, কিন্তু তখন আর আমাকে বলে দিতে হবে না সুলতা যে এইটে মেজঠাকুমার ছবি, তিনি সুরেশ্বরকে হাত ধরে বলছেন—

—এস ভাই আমার সোনার নাতি এস।

আমি প্রণাম ক’রে বলেছিলাম—তাই তো ঠাকুমা, নিজের সম্বন্ধে তো তাহলে এবার সাবধান হতে হবে। চোরে ডাকাতে না লুঠে নিয়ে যায়!

মেজঠাকুমা হেসে বলেছিলেন—ভয় কি ভাই! আমি তোমাকে তক্তি করে বুকে ঝুলিয়ে রাখব। নাত-বউ এলে তাকে পরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হব।

***

কথার জবাব খুঁজে পায়নি সুরেশ্বর। মেজঠাকুমা বলেছিলেন—নাও, মুখ হাত ধোও। চায়ের জল চড়ানো আছে। রঘু চা দিক। চা খেয়ে স্নান করে ফেল। আমি তরকারী রেঁধে ফেলেছি। ভাতটা বাকী। চড়িয়ে দি। স্নান করে ঠাকুরবাড়ী প্রণাম করে এসে খেয়ে নাও। তারপর জিরিয়ে নাও।

—এসব—মানে এত কষ্ট আপনি কেন করলেন ঠাকুমা? রঘু যা হয় করতো।

—কেন? আমি থাকতে রঘু কেন? তুমি আমার নাতি। ছেলে টাকা, নাতি সুদ। টাকার মুখ দেখিনি, ভাগ্যি আমার ভগবান আমাকে সুদ পাবার হকদার করেছেন। ভাতের উপর মিষ্টান্ন। তোমার মেজঠাকুরদার ধুলোয় ফেলে দেওয়া পোঁটলাটা তুমি মাথায় তুলে নিয়েছ। আমি থাকতে রঘু কেন?

দুফোঁটা চোখের জলও পড়েছিল তাঁর।

খাওয়ার সময় কাছে বসে খাইয়েছিলেন। সুন্দর রান্না মেজঠামায়ের। মেজঠাকমা বলেছিলেন—আমি জানি তুমি মাংস খাও। কিন্তু তোমার মেজঠাকুরদার বৈষ্ণব মন্ত্র, আমারও তাই। ওটা আমি ছোঁব না। ওই গোয়ানদের বললে ওরা গুলতিতে পাখী মেরে দেবে। ওইটে বরং রঘু রেঁধে দেবে তোমাকে।

অভিভূত হয়ে গিয়েছিল সুরেশ্বর। তিনি তাঁর কাছে মাসোহারা পান বলে তোষামোদ করছেন এ ধারণা তার একেবারে মুছে গিয়েছিল।

এই সময়ে বাইরে কাঁসাইয়ের ধারের জঙ্গলে সেই বউ-কথা-কও পাখী ডেকে উঠেছিল। চৈত্র মাস। সেটা ওদের পাগল হয়ে ডাকারই মাস।

কথার ধারাটাকে ঘোরাবার জন্যেই সুরেশ্বর বলেছিল- সেই পাখী ডাকছে, না ঠাকুমা? সঙ্গে সঙ্গে গালে হাত দিয়ে মেজঠাকুমা বলেছিলেন—ও-মা! তাই তো!

অবাক হয়ে সুরেশ্বর তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

মেজঠাকুমা বলেছিলেন—এতদিন ছিল না ভাই পোড়ারমুখো পাখী। অন্তত আমার কানে আসেনি। তাই তো ও-মা বলে গালে হাত দিচ্ছি! মনে হচ্ছে তোমার মেজঠাকুরদা পাখীটা তুমি হয়ে ফিরে এলে তাহলে!

সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠেছিলেন।

সেই স্নেহশীলা মায়ের মত মেয়েটি যে এমন যত্ন করে খাওয়াচ্ছিলেন, তিনি যেন মুহূর্তে পরিহাসমুখরা সখী হয়ে উঠেছেন।

সুরেশ্বরের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। সেই দিন রাত্রেই মেজঠাকমা তাকে বলেছিলেন- আজ থেকে আমি তোমার মেজবউদি। ঠাকুমা বললেন, কেমন বুড়ী হয়েছি বলে লজ্জা করে। কেমন?

সুরেশ্বর বলেছিল—না।

—কেন?

—একটু পাল্টিয়ে নেব।

—কি, মেজবউ? হেসে উঠেছিলেন তিনি।

—না, মেজদিদি!

—বাঃ সে খুব ভাল। আর একালে কি বলে—মডার্ন না কি তাও হবে। তাহলে কিন্তু তুমি বলো, আপনি নয়।

—বলব।

মেজঠাকুমা বলেছিলেন—এইবার চলি, তুমি ঘুমোও একটু। আমার অনেক কাজ। গোপালকৃষ্ণের ভোগ হল, এইবার মন্দিরে যাই, সেখানে আমার নাগরকৃষ্ণের ভোগ আছে। তারপর পোড়া পেটের পিণ্ডি আছে। সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরের চরণোদক—তুলসীমায়ের বেলপাতা নিয়ে আসব।

.

এই ভূমিকা সুলতা।

ওই সর্ববঞ্চিতা বিধবা যুবতী ঠাকুমাটি তাঁর সব স্নেহরসভরা জীবনকুম্ভটি আমার মাথার উপর ঢেলে দিলেন।

সন্ধ্যেতেও তিনি এলেন কিন্তু কথাবার্তার সুযোগ হল না। সেরেস্তার আসর পড়েছিল। আমার নায়েব দেবোত্তরের নায়েব সকলে এসেছিলেন; কথাবার্তা হচ্ছিল। সেটেলমেন্টে স্বত্বের সমস্যা তাঁরা বোঝাচ্ছিলেন আমাকে।

আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

দেবোত্তরের নায়েব বললেন–মেজতরফ বলছেন—বাড়ী—সবই দেবোত্তর। অন্দর, বিবিমহল সব।

—কিন্তু পার্টিশন দলিলে তো সই করেছেন।

—করেছেন। সে করেছেন শিবেশ্বর রায়। তিনি মৃত। ছেলেরা দেবোত্তরের সেবায়েত হিসেবে আপত্তি করছে এরকম পার্টিশন অসিদ্ধ। বাড়ী সব দেবোত্তর।

—তারই বা প্রমাণ কি?

—প্রমাণ? হেসে দেবোত্তরের নায়েব বললে—আমি ওঁদের নায়েব, আপনারও নায়েব। আমি এঁদের বলেছি—কাগজ যা বলবে, আমার কাছে যা আছে বের করে দেব। কিন্তু আমি ওর মধ্যে নেই। প্রমাণ ওঁরা জানেন। আমাদের ঘোষালও জানেন। বল না ঘোষাল!

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, আমার নায়েব এবার বললেন, ব্যাপারটা গোলমেলে বটে। ওঁরা সোমেশ্বরের ট্রাস্ট ডিড, রত্নেশ্বর রায়ের ট্রাস্ট ডিড বের করছেন, তার নকল আমাদেরও আছে। তাতে আছে কীর্তিহাটের যাবতীয় জমিদারীপত্তনী সম্পত্তি দেবত্রীকৃত হইল। এবং এই আয় হইতে যে সকল সম্পত্তি অর্জিত হইবে, তাহাও দেবত্র বলিয়া গণ্য হইবে। এঁরা বলছেন-বাড়ীগুলি দেবত্রের আয় থেকে তৈরী, সুতরাং এও দেবত্র। বিভাজ্য নয়। তবে যে যেমন দখল করছেন, দখল করবেন। দান-বিক্রয় চলে না।

দেবোত্তরের নায়েব বলেছিলেন এবার —ব্যাপারটা আরও একটু জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, বড়তরফ এতে যোগ দিয়েছেন; আপনার জ্যেষ্ঠতাতের বড় ছেলে প্রণবেশ্বরবাবু আসছেন, তিনি এতে যোগ দিয়েছেন। তিনিই বোধহয় বুদ্ধি জোগাচ্ছেন কলকাতা থেকে। এবং সে বুদ্ধি হাইকোর্টের উকিল-ব্যারিস্টারের। তাঁদের জন্য ব্যাপারটা আরও জটিল হয়েছে, আপত্তির দাবী আরও মজবুত হয়েছে। ধরুন, তিনি আপনাদের বড়তরফের অর্ধেকের শরিক। বড়তরফই বিবিমহল পেয়েছে। বড়তরফই ছোটতরফ অর্থাৎ রামেশ্বর রায়ের বাড়ীর অংশ কিনেছে। ওঁদেরই বাপ তাঁর অংশ আপনাদের বিক্রী করেছেন। তাঁরা আপত্তি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার দোষ হয়ে যাচ্ছে যে, দেবেশ্বর রায় যে পার্টিশনের সময় বিবিমহল নিয়েছিলেন টাকা দিয়ে, সে অসিদ্ধ, আবার রামেশ্বরের অংশ খরিদ অসিদ্ধ, আবার যজ্ঞেশ্বর রায়ের বিক্রী অসিদ্ধ।

বিরক্তিভরে আমি বলেছিলাম সুলতা, বেশ তো, বাড়ীর একটা ভাগ তো আমার যাবে না। সেটা তো থাকবে। নিন, ওরা বাড়ীর ভাগ নিয়েই যদি তুষ্ট হন তো হোন।

এবার বেরিয়ে এসেছিলেন মেজঠাকুমা। তিনি যে এখনও পর্যন্ত ঘরের মধ্যে আমার প্রতীক্ষায় বসে আছেন, তা জানতাম না। এসে বলেছিলেন—কেন নায়েবাবু, সে আমলের কর্তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের এস্টেটের খাতাপত্র আছে। তা থেকে বের হবে।

তারপর আমাকে বললেন —তুমি ওসব কথা কখনও মুখে আনবে না নাতি। নিয়ে সুখী হয় হোক-এ কথা বলা মানে হার মানা।

দেবোত্তরের নায়েব বললে-খাতা যে সব নেই মা। কোথায় গেল তা কেউ জানে না। সে কি ছোটবাবুর নায়েবকে আমি খুঁজে দেখতে বলিনি? খাতা তো মেজকর্তার আমল থেকে কোথায় কি গেল কেউ বলতেও পারে না। কি ঘোষাল, বলুন না!

ঘোষাল বললে-খাতা নেই।

আমি হেসে মেজঠাকুমার মুখের দিকে তাকালাম।

মেজঠাকুমা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন –আমি গিয়ে সাক্ষী দিলে হয় না?

—সে স্বত্বের মকর্দমার সময় দেওয়ানী আদালতে দিতে পারেন, বলতে পারেন—এই শুনেছেন, শুনে আসছেন। তার দাম কতখানি হবে, কাগজপত্রের ওপরে, তা হাকিমের বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সেটেলমেন্ট কোর্টে ও শুনবেই না তারা।

মেজঠাকুমা আমার দুঃখে দুঃখ পেয়েই চলে গিয়েছিলেন।

* * *

পরের দিন সকালে সেটেলমেন্ট আদালতের দুর্ভোগ যা হয়েছিল, তা তোমাকে পত্রে আমি লিখেছিলাম। চারটে পর্যন্ত বসে থাকা, হাকিম হরেন ঘোষের সঙ্গে আলাপ। এসব তুমি জান। একটা কথা লিখিনি। দুপুরবেলা গাছতলায় বসে জমিদার হওয়ার দুর্ভাগ্যের জন্য আপসোস করছি, ক্ষিদে পেয়েছে, ঠিক সেই সময়টিতে রঘু তোয়ালে ঢেকে খাবার নিয়ে গিয়েছিল, মেজঠাকুমা পাঠিয়েছেন।

এরপর আমায় ছবি আঁকতে দেখে হরেন ঘোষ হাকিমের মুগ্ধ বিস্ময়ের কথাও লিখেছি। ঘোষ আমার বন্ধুত্বের জন্য কিছু কিছু মূল্য দিয়েছিলেন। কয়েকটা ব্যাপারে আপত্তির ক্ষেত্রে তিনি ওদের ধমক দিয়েছেন। কাগজ দেখাতে বলেছেন। সেসব ছোটখাটো ব্যাপার।

মুল বাড়ী নিয়ে ব্যাপারটার তখনও দেরী আছে। আমিও তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য কিছু করেছি। কলকাতা থেকে বই আনিয়েছি, শরৎবাবুর সব বই। কিছু আধুনিক লেখকদের বই, বিভূতিভূষণ, প্রেমেন্দ্র, আচিন্ত্য, বুদ্ধদেব, শৈলজানন্দ, প্রবোধকুমার—এই সব, আর খানকয়েক মাসিকপত্রও নিয়েছি। সবই হাকিমের জন্য বলতে গেলে। তবে দোহাই ধর্ম, এটাকে তুমি ঘুষ দেওয়া বলো না। ওঁর জন্যে একখানা বাড়ীও দেখে দিয়েছি, ওঁর স্ত্রী আসবেন। মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। কথা দিয়েছি—মেয়েদের জন্যে যে ইস্কুলটা করছি আমি মায়ের নামে, সে বাড়ীটা তাড়াতাড়ি করিয়ে ওঁকে দেব, যতদিন উনি থাকবেন। সুখেশ্বরকাকার ছেলের কল্যাণেশ্বর তার ঠিকেদার, তাকেও বলে দিয়েছি। হাকিমের জন্যে সেও প্রাণপণে খাটছে।

এদিকে খাতাপত্র সন্ধান করে পাওয়া যায়নি। আমি ছেড়েই দিয়েছি সব আশা!

মেজঠাকুমা কেমন হয়ে গেছেন। মধ্যে মধ্যে বলেন—তোকে আমি মিছেই নিয়ে এলাম ভাই। লজ্জায়, দুঃখে যে মরে যাচ্ছি রে।

—কেন ঠাকুমা? এতে তোমার লজ্জা কি?

—ওরে তোর মেজঠাকুরদা যে এর হেতু!

—তা আর তুমি কি করবে?

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলতেন—বুঝতে পারছি না রে! মনকে বোঝাতে পারছি না।

আমার করুণা হত।

এই সময় হঠাৎ মেজঠাকমাকে ওরা কলঙ্কিনী বললে!

.

কিছুদিন পর। দিনবিশেক পর। সেদিন রবিবার, বিকেলে গিয়েছিলাম হরেন ঘোষের ওখানে। ওঁর স্ত্রী এসেছেন। দেখা করতে গিয়েছিলাম। রবিবারের সকালটা জমে উঠেছিল। ১৯৩৬ সালের আধামডার্ন অর্থাৎ ম্যাট্রিক পাশ মেয়ে। যে মেয়ে অন্ততঃ হাকিম-গৃহিণীর মর্যাদা রাখতে পারে। অর্থাৎ আবদার করতে পারে। বেশ লাগল, চা খাওয়ালেন। প্রথমেই বললেন স্বামীকে—ওই ওঁকে বল। তোমায় দিয়ে হবে না।

আমি বললাম-কি?

—একটা ছুতোর, মিস্টার রায়। এই ফার্নিচারগুলো একটু ঠুকেঠেকে দেবে।

হরেন ঘোষ বললেন—দেবেন মশায়। নইলে মান আমার আর থাকে না।

—মান তোমার উনি পাঠিয়ে দিলেও থাকবে না। কারণ, উনি তো আমারও বন্ধু। তোমার এতগুলো পিওন, এতগুলো ক্লার্ক, এত ক্ষমতা, তার দামটা তাহলে কি?

আমি বললাম—দেব। নিশ্চয় পাঠিয়ে দেব, এর জন্য নতুন পাতা ঘরে অশান্তি করবেন না।

হাকিম-গৃহিণী বললেন—আর সেই কথাটা বললে না? বললেন স্বামীকে।

হরেন ঘোষ বললেন—তুমি বল না, তোমারও তো বন্ধু।

—বলতাম নিশ্চয়। কিন্তু এ-কথাটা তোমার বলা উচিত।

বললাম-কি? বলুন?

—ছবি মশাই। একখানা ছবি ওঁর এঁকে দিতে হবে।

—দেব। খুশী হয়েই বললাম-দেব।

—আমার কলকাতা যাবার আগে দেবেন কিন্তু। সেখানে দেখাব আমি।

—কখন কলকাতা যাবেন? এই তো এলেন।

—মাসতিনেক পর।

—তাহলে কথা দিলাম।

বলে চলে আসছিলাম। বোশেখ মাস পড়ে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, তবু এখনও প্রচণ্ড উত্তাপ। বাড়ী ফিরতে কষ্ট হল। মেজাজও খারাপ হল। এর উপর ঠাকুরবাড়ীর কাছে এসে ধনেশ্বরকাকার গর্জন শুনে ভুরু কুঁচকে উঠল আমার। এরা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমার নীরবতা এবং ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে। আজ যেন গর্জনটা বেশী, তবু চলে এলাম। বিবিমহলের সামনে রোজারিওকে পেলাম, বললাম—ওরে, একটা ছুতোর ডেকে হাকিমের বাসায় কাল নিয়ে যাবি তো। মজুরী আমরা দেব। আর—। বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। বলতে যাচ্ছিলাম, ধনেশ্বরকাকাকে বলে আসুক বাবু জিজ্ঞেস করছেন, এত চেঁচাচ্ছেন কেন? কিন্তু না, থাক। শুধু ছুতোরের বরাত করেই ক্ষান্ত হলাম।

রোজা বললে-যাব হুজুর।

হন হন করে উঠে গেলাম। ভাবছিলাম, একবার তোমাকে আসতে লিখলে কি হয়। হরেন ঘোষের বউয়ের সঙ্গে আলাপ করে যাবে। মন্দ লাগছিল না আইডিয়াটা। উপরে উঠে গিয়ে দেখলাম, মেজঠাকুমা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন শোকাতুরার মতো, অতি ক্লান্তের মতো। দু চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। তিনি কাঁদছেন।

.

সেদিন মেজদিকে ঘরে বসে এমন করে কাঁদতে দেখে সে আঘাত পেয়েছিল। একটু চিন্তিত হয়েই প্রশ্ন করেছিল —কি হল মেজদি? কাঁদছ কেন?

মেজঠাকুমা মেজদি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি থেকে তুমি হয়েছিলেন।

মেজঠাকুমা চোখ মুছে চোখের জল গোপন করতে পারেন নি, আরও বাড়িয়ে ফেলেছিলেন।

যেন ভেঙে পড়ে গিয়ে বসেছিলেন —সুরেশ্বর, আমাকে তুই বৃন্দাবন পাঠিয়ে দে ভাই। নয়তো নবদ্বীপ। যা দিস তুই তার বেশী আমার লাগবে না। আমাকে শুধু পাঠিয়ে দে।

মেজঠাকুরদার বড় ছেলে, মেজদির বড় সতীনপো এবং তার মেজ ছেলে তাঁকে কুৎসিত কথা বলেছে। চরমতম কুৎসিত কথা। এর থেকে বড় অপমান আর কিছু হতে পারত না মেজদির। শুধু মেজদিরই নয়, তারও।

.

সুরেশ্বর বললে—আমি লজ্জায় মরে গেলাম সুলতা। তার সঙ্গে কি যে দুরন্ত ক্রোধ আমার হল, তা বলতে পারব না। মনে হল, ওই ভাঙাভগ্ন দেহ, ফাটলধরা মানুষটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষাক্ত কীট সরীসৃপে ভরা। রায়বংশের ধ্বংসবীজ বিষাক্ত বাষ্প ওর মধ্যে জমাট বেঁধে আছে। ওটাকে আমার ধ্বংস করা উচিত। এখুনি ছুটে গিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে আসি। তিরিশ সালে জেলে যখন গিছলাম, তখন পুলিশ আমাদের বন্দুক-রিভলবার বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। আমি স্টেটসম্যানে অনুতাপ করে চিঠি লিখে স্পাই নাম কিনেছিলাম। কিন্তু বন্দুকটন্দুক নিইনি আর। কলকাতায় নায়েব হরচন্দ্র ঘোষাল বলেছিলেন। তাতে মা-আমি দুজনেই না করেছিলাম। বন্দুক থাকলে সেটা নিশ্চয় আমি কীর্তিহাট নিয়ে যেতাম এবং সেই দিনই আমি খুন করে বসতাম এবং নিজেও খুন হতাম!

উপলক্ষ্য একখানা সাবান। দামি ল্যাভেন্ডার সোপ ব্যবহার করত সুরেশ্বর। মেজদি একদিন বলেছিলেন—বাহারের খুসবু ভাই নাতি। একে কি সাবান বলে?

—ল্যাভেন্ডার সোপ বলে মেজদি!

—খুব দামী বুঝি?

—তা দামী বইকি। খাস বিলিতী জিনিস। এক-একখানা আড়াই টাকা।

—ওরে বাপরে! তাই। তারপর হঠাৎ হেসে বলেছিলেন—জানিস ভাই, আমার দাদাশ্বশুর, তোর ঠাকুরদারও বাবার মামা—বুঝতে পারলি?

—হ্যাঁ, বীরেশ্বর রায়।

—হ্যাঁ তিনি। খুব জাঁদরেল লোক ছিলেন। নীলকুঠীর সাহেবদের তখন কুঠী ছিল। তাদের ছেলেদের সঙ্গে খেলা করতেন। তাদের কাছে ইংরিজী শিখেছিলেন। একজন পাদরীসাহেব ছিল, সে পড়াতো। সে নাকি ডাল-ভাত আর কড়াইবাটা খেতে খুব ভালবাসত। তা আমার দাদাশ্বশুর হয়ে উঠলেন সায়েবী মেজাজের লোক। বন্দুক দিয়ে বাঘ মারতেন, কুমীর মারতেন। ঘরে নাকি, এই বিবিমহলে, খাঁচায় করে বাঘ পুষেছিলেন। তাঁর কুকুর ছিল। এই বড় বড় কুকুর-ডালকুত্তা। কুকুর মণ্ডা খেত। ঘিয়ের মিষ্টি খেলে রোঁয়া উঠবে—তাই খাস মণ্ডার বরাদ্দ ছিল। তিনি মহলে যেতেন, কুকুর সঙ্গে যেত, যেত পাল্কিতে। এগাঁয়ে তখন সরকারদের বাড়ীতে স্বন্নপিসী ছিল গাঁয়ের পিসী। তা স্বন্নপিসী বলত—মরে এবার ফিরেশ্বরের কুকুর হব। তাই ভাই আমারও বলতে ইচ্ছে করছে-এবার মরে তোর বেটী হয়ে জন্মাব, নইলে নাতনী হয়ে। হেসে সুরেশ্বর এক বাক্স সাবান তাঁকে দিয়ে বলেছিল—তার জন্যে মরতে হবে জন্মাতে হবে এত ঝঞ্ঝাট করতে হবে কেন? যাঁর নাতি এমন সাবান মাখে, তিনি কি নিজে এ সাবান মাখতে পারেন না?

লজ্জিত হয়ে মেজঠাকুমা বলেছিলেন-না-না-না, সুরেশ্বর। আমাকে কি সাবান মাখতে আছে? তা আবার ওই সাবান!

—আছে ঠাকুমা। কে বললে নেই?

—তুই পাগল!

—না। পাগল নই। এ তোমাকে নিতেই হবে। মাখতেও হবে। না মাখলে আমার দিব্যি রইল।

—এই দেখ! কি করলি বল তো?

বলে তিনি নিয়েছিলেন সাবানের বাক্সটি।

সুরেশ্বর বললে—আমার মায়ের থেকে মেজদি বয়সে ছোট ছিল। আমার থেকে আট-দশ বছরের বড়। তখন তাঁর বয়স ছত্রিশের বেশী নয়। সন্তান-সন্ততি হয়নি। রূপ ছিল, যৌবনও ছিল। দেখতে যুবতী মেয়ে মনে হত। মনে মনেও তাই ছিলেন, একটি সরস কৌতুক, দুর্লভ নির্মল জলের জোয়ার তাঁর জীবনকে ভরে রেখেছিল। তার সঙ্গে ছিল সাধ-আহ্লাদ: এ-সাধ বোধহয় বুড়ো-বুড়ীরও থাকে। তাঁর অপরাধ তিনি যুবতী, সুন্দরী। তার উপরেও অপরাধ ছিল—আমার প্রতি তাঁর স্নেহ এবং বিষয়ের ঝগড়ায় আমার দিকে তাঁর পক্ষপাত। ফলে—

.

দুর্নাম রটল কয়েক দিনের মধ্যেই।

ওই সাবান মাখতেন মেজদি। প্রথম ক’দিন ধরে সকলের অগোচরে মুখে মাখতেন। তারপর একদিন ঘাটে গিয়ে স্নানের সময় গায়ে মেখেছিলেন। ল্যাভেন্ডারের গন্ধে ঘাট ভরে গিয়েছিল। তাঁর গায়েও সে গন্ধ লেগে ছিল।

সে-খবরটা রটিয়েছিল প্রথম ধনেশ্বরের মেজছেলে, ব্রজেশ্বরের ভাই। তারপর ধনেশ্বর রুদ্রমূর্তিতে সমায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল।

—সাবান মাখছ? খুসবু সাবান? সুরেশ্বর দিয়েছে? লম্পটের পুত্র ওই সুরেশ্বর দিয়েছে তোমাকে খুসবু সাবান?

হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন মেজগিন্নী।

ধনেশ্বর এবার অ্যাটিংয়ের ভঙ্গিতে চীৎকার করে উঠেছিল, তুই স্রষ্টা, তুই পাপিষ্ঠা। তুই কলঙ্কিনী!

—কলঙ্কিনী, ও যে তোর পৌত্র! ছি-ছি-ছি!

বলতে বলতে চলে এসে ঠাকুরবাড়ীতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে শুরু করেছিল, তিরস্কার করতে শুরু করেছিল মরা বাপ শিবেশ্বর রায়কে—

—নরকস্থ হও। অনন্তকালের জন্য নরকস্থ হও তুমি। তুমি শিবেশ্বর রায়—তুমি কামার্ত পশু ছিলে, ফলভোগ কর তার। কর ফলভোগ। রত্নেশ্বর রায়, তোমার স্বর্গ সিংহাসন নড়েছে। পড়ছে। পড়ছে নরকমুখে। কাদছ, তুমি কাঁদছ? তারপর অট্টহাস্য করে উঠেছিল- হা-হা-হা-হা! ধনেশ্বরের পিতৃদত্ত শিক্ষার মধ্যে নাটুকেপনা একটি বড় সম্পদ।

.

লোক জমেছিল চারিদিকে। পঙ্ক- পল্বলে ঝাঁকবন্দী ঘেয়ো মাছির মত।

মেজদি ভয়ার্ত হয়ে ঘরে খিল দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। মরবার সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু ভয় হয়েছিল। নিদারুণ ভয়। তবে কি করবেন? তবে কি করবেন? ওদিকে গোটা মেজতরফের কুৎসিত কথাগুলি গোটা বাড়ীটার খিলানে খিলানে যেন বেজে বেড়াচ্ছিল। মেজদি থাকতেন সুরেশ্বরের অংশের বাড়ীতে। যে-ঘরে মেজকর্তা থাকতেন, সেখানেই থাকেন। বাকী ঘরগুলিও ওদের দখলে। সেখান থেকেও ভেসে আসছে কুৎসিত বিস্ময় প্রকাশের শব্দ ও ধ্বনি। শিউরে ওঠা, একটি লম্বা টানা শব্দ।—ও মাঃ! কোথায় যাব গো! কি লজ্জা, কি ঘেন্না! ঘাটে সুগন্ধি সাবান মাখা। এমন গন্ধ যে, গায়ের পাশে মৌমাছি উড়ছে। ছি-ছি-ছি-! তা-ও আবার কে দিয়েছে? না—নাতি! আপন ভাসুরপোর ছেলে! ছি-ছি-মা! ও যে ছেলের বয়সী গো! সেকালে বারো বছরের মেয়ের ছেলে হয়েছে। কি রুচি, কি প্রবৃত্তি! আর ওই ছেলে, ওই কুলাঙ্গার!

মেজদির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল, বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড যেন মাথাকুটে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল। হঠাৎ এক সময় তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে প্রায় উন্মাদিনীর মত ছুটে এসে উঠেছিলেন বিবিমহলে।

—সুরেশ্বর! সুরেশ্বর! দাদুভাই! ওরে!

সুরেশ্বর তখন বাইরে বেরিয়েছিল। তখন থেকে তিনি এখানেই ভয়ার্ত হরিণীর মতো লুকিয়ে বসে আছেন। কাঁদছেন।

সুরেশ্বর ফিরে এসে তাঁকে কাঁদতে দেখে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল—কি হল মেজদি? কাঁদছ কেন?

মেজদি হু-হু করে কেঁদে উঠেছিলেন, বলেছিলেন-সুরেশ্বর, আমাকে দয়া করে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দে ভাই। নয়তো নবদ্বীপ। ওরে, যা দিস তুই তার বেশী লাগবে না। আমাকে শুধু পাঠিয়ে দে। ওরে, জগদীশ্বর সেই খুনে পাষণ্ড নেই, সে এলে আমার লাঞ্ছনার বাকী থাকবে না।

***

বহু কষ্টেই কি হয়েছে তা মেজদি বলেছিলেন। সুরেশ্বরের মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল। হাতের কাছে বন্দুক থাকলে বা রিভলবার থাকলে সে আজ নির্বংশ করে আসত রায়বংশকে। শেষ গুলিতে নিজে মরত।

কিছু করবার জন্য সে অধীর হয়ে উঠেছিল। ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করেছিল শুধু হাতেই। ইচ্ছে হচ্ছিল ধনেশ্বরের তৃতীয় পুত্র, সেই অতিকায় দানব যেমন সুখেশ্বরের বুকে চেপে বসে গলা টিপে তাকে হত্যা করেছিল, তেমনিভাবেই সে-ও গিয়ে ওই ধনেশ্বরের বুকের উপর চেপে বসে গলা টিপে হত্যা করে তাকে, তার কলুষিত কণ্ঠটাকে চিরদিনের মত স্তব্ধ করে দেয়।

মেজঠাকুমা বললেন-আমাকে ঠাকুরবাড়ীতে ঢুকতে দেবে না বলেছে। আমি তিনবেলা গোবিন্দের কাছে যাই, সন্ধ্যায় গিয়ে তাঁকে প্রণাম করি, মালা গেঁথে দিয়ে আসি, ভয়ে যেতে পারিনি সুরেশ্বর। মরবার আমি সাহস পাচ্ছিনে, নইলে মরতাম রে। কিন্তু আমি গ্রামে মুখ দেখাব কি করে?

একটা অজুহাত পেয়ে সুরেশ্বর চমকে সজাগ হয়ে উঠল মুহূর্তে। সে মেজঠাকুমাকে বললে-ওঠ। এস আমার সঙ্গে।

—কোথায়?

—ঠাকুরবাড়ী। এস। দেখি। যা হবার হয়ে যাক। এস।

—না সুরেশ্বর। তুই ওদের জানিসনে। ওরে—

—ওদের আমি জানি মেজদি –তুমি আমাকে জান না। এস। দেখি কার সাহস কত, তোমাকে কি বলে?

—না-রে। ওরে আমার কলঙ্ক মাথায় করে আমি মরব, তুই ওদের—

বাধা দিয়ে সুরেশ্বর বলেছিল—তোমার কলঙ্ক তুমি সইবে, কিন্তু আমি সইব না। এস। যদি না এস, তবে—

—বেশ, তোর কাছে আর আসব না।

—না। চীৎকার করে উঠেছিল সুরেশ্বর।

এবং মেজদির হাতখানা চেপে ধরে আকর্ষণ করেছিল।—এস। ওঠ। তারপর ডেকেছিল—রঘু!

রঘু পাশের ঘরেই উৎকর্ণ হয়ে সব শুনছিল। সে এসে দাঁড়াতেই বলেছিল—রোজা, ডিকু এরা আছে?

—রোজা আছে। ডিকু আজ সনঝা বেলাসে ছুটি নিয়েছে।

—বেশ, তুই সুদ্ধ আয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *