প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – ৩

বীরেশ্বর রায়ের প্রথম চিঠিখানা পুড়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় চিঠিখানা ভালো-মা পেয়েছিলেন। সেখানা এসেছিল শ্যামনগর যে রাত্রিতে পোড়ে তার পরদিন। চিঠিখানা পড়ে চমকে উঠেছিলেন তিনি। চিঠিখানা পড়েছি, তোমার মনে আছে, কমলাকান্তের সেই বজ্রের মত পত্রখানা পেয়ে এবং আচার্যের চিঠিতে গোপাল সিংয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগের সংবাদ জেনে তিনি লিখেছিলেন, ‘তোমার স্পর্ধিত পত্র পাইয়া স্তম্ভিত হইলাম এবং শঙ্কিত হইলাম যে এবম্বিধ পত্রের জন্য তোমার নরকেও স্থান হইবে না!”

চমকে উঠে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন—ওরে, তুই তাঁকে কি লিখেছিলি রে, কমলাকান্ত? কি লিখেছিলি তাঁকে?

রত্নেশ্বর রায় লিখেছেন, “প্রথমে নির্বাক রহিলাম। ভালো-মা সব পত্রখানি পাঠ করিলেন। মধ্যে মধ্যে অংশ বিশেষ পড়িয়া উচ্চ কণ্ঠেই তাহা বলিতেছিলেন, ‘তোমার সহিত পত্রালাপ করিয়া আমার মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা হইতেছে।’ এবং সঙ্গে সঙ্গে বলিতেছিলেন- ‘ওরে তুই কি এমন কথা লিখিয়াছিস রে?’ আমি নিরুত্তরই ছিলাম। আবার পড়িলেন, “তোমার ভালো-মাকে বলিবে আমি ব্যাকুল হইয়া তাঁহার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছি।”

তিনি পরিশেষে ক্রুদ্ধ হইয়া প্রশ্ন করিলেন-”কমলাকান্ত! কি লিখিয়াছিস বল?”

সে কণ্ঠস্বর শুনে কমলাকান্ত রত্নেশ্বর রায় চমকে উঠেছিলেন। লিখেছেন—“বজ্রের মত কঠোর। তাঁহার চক্ষের দৃষ্টি দেখিয়া মনে হইল অগ্নিবৎ জ্বলিতেছে, আমি ভস্ম হইয়া যাইব।”

রত্নেশ্বর বলেছিলেন সব। ভয় পেয়েই বলেছিলেন। ভালো-মা নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে বসেছিলেন। এরই ঘণ্টা দুয়েক পর কীর্তিহাটের সওয়ার এসেছিলেন গিরীন্দ্র আচার্যের পত্র নিয়ে। বীরেশ্বরের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা! কমলাকান্তের পুড়ে যাওয়ার সংবাদ শুনে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন!

তখনো গোয়ানদের ছিপ ঘাটে বাঁধা ছিল।

সেই ছিপেই তিনি রওনা হয়ে চলে এসেছেন কীর্তিহাট।

রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতেই আছে—ভালো-মা, আমার গর্ভধারিণী সতী শিরোমণি শ্ৰীমতী ভবানী দেবী ইষ্টদেবীকে এবং সৌভাগ্যশিলা রাজরাজেশ্বরকে প্রণাম করে স্বামীর কক্ষে প্রবেশ করিয়া তদীয় পদতলে উপবেশন করিলেন পুরাণের সাবিত্রীর মত।

সেইদিনই শেষরাত্রে পিতা বীরেশ্বর রায়ের জ্ঞান হইল।

রাত্রি তৃতীয় প্রহরের শেষ। স্বামীর শিয়রে বসিয়াছিলেন মাতৃদেবী। ভৃত্যেরা তালবৃত্ত দিয়া ব্যজন করিতেছিল। গৃহের মধ্যে চিকিৎসক বসিয়া ঢুলিতেছিল। বাহিরে দেওয়ান, কবিরাজ প্রভৃতি নিদ্রিত হইয়াছে। আমার মাতারও কখন চক্ষু মুদ্রিত হইয়াছে। তিনি কণ্ঠস্বর শুনিয়া চমকিয়া উঠিলেন—তুমি কে? তুমি!

দেখিলেন নির্নিমেষ নেত্রে স্বামী তাঁহার দিকে চাহিয়া আছেন।

তিনি করুণ হাস্যসহকারে বলিলেন—আমি আসিয়াছি। আমি তোমার ভবানী!

সুরেশ্বর বললে—বীরেশ্বর রায় এরপরই জিজ্ঞাসা করেছিলেন—রত্নেশ্বর?

—ভালো আছে। কিন্তু এখনো ঘা শুকোয় নি! ভালো হলেই আসবে!

—না! কালই আমাকে কলকাতা নিয়ে চল। পথে তাকে তুলে নেব। কলকাতায় চল। পাগলাবাবাকে বের করতে হবে। তিনিই তিনি। আমি চিনতে পারিনি। আমি কলকাতায় যেতে চাই। তাছাড়া আমাকে ভাল হতে হবে।

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, রত্নেশ্বর তাঁর ডায়রীতে সমস্ত বিশদভাবে লিখেছেন এবং তারপর শপথ করে লিখেছেন-আমার সতীসাবিত্রীর মত জননীকে যাহারা যাহা বলিয়াছে তাহা লিখিয়া রাখিলাম। যাহারা কটু বলিয়াছে তাহাদিগকে আমি ক্ষমা করিব না। কখনো না। তাহা হইলে অনন্ত নরক হইবে আমার। পিতার ওই মাসিটিকে কয়েক দিনের মধ্যেই মাসোহারা দিয়া কাশী পাঠাইব। এখানে রায়বাড়ির অন্দরে ‘কর্তামা’ সাজিয়া বিচরণের শেষ করিব।

আর জমিদারী গ্রহণ করিলাম, এখন আমার প্রধান কর্ম গোপাল সিংহের দমন। সে আমার এই জননীকে কুৎসিত বাক্য বলিয়াছে। এক চপেটাঘাতে সে দমিত হয় নাই। সে আমাকে পুড়াইয়া মারিতে চেষ্টা করিয়াছে, গোপাল সিংহ ধ্বংস যজ্ঞের সকল সমিধ প্রস্তুত। এবার অগ্নি প্রজ্বলিত করিব।

“প্রথমেই পিতৃদেব আমার পৃষ্ঠদেশের ক্ষত দেখিতে চাহিলেন।” রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতে আছে। ব্র্যাকেটে লেখা আছে—তখনো তাঁহাকে মাতুল বলিয়াই জানিতাম।

রত্নেশ্বর রায়ের ডায়ারীতে আছে—আর তিনদিন পর কীর্তিহাট থেকে বীরেশ্বর রায় ভবানী দেবীকে নিয়ে বজরায় কলকাতা রওনা হয়েছিলেন। সঙ্গে লোকজন, ডাক্তার-বৈদ্য, সেবক- কর্মচারীর কথা অনুমান করতে পার। বর্ণনা করব না। কিন্তু রত্নেশ্বর রায় তার বর্ণনা করেছেন। তিনি অজ্ঞাতবাস থেকে জয়ী হয়ে যৌবরাজ্যে আপন অধিকারে প্রথম পদার্পণ করলেন, রায়বাড়ীর খাস বজরায়, যার নাম ছিল ‘কীর্তিহাট’। এ বজরা তৈরী করিয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়, তখন কুড়ারাম রায়ের ‘ললিতা’ পুরনো হয়েছে। সে বজরা কমলাকান্ত জ্ঞান হয়ে প্রথম দেখলেন। তার বিশদ বর্ণনাই করেছেন।

কীর্তিহাট থেকে আসবার পথে হলদীর মোহনার কাছাকাছি গুলমহম্মদ শরীফ, হজরতপুরে বজরা লাগিয়ে ভবানী দেবী নায়েব আচার্যকে পাঠিয়েছিলেন ঠাকুরসাহেবের কাছে, সঙ্গে গিয়েছিলেন মহেশচন্দ্র। উপঢৌকনও পাঠিয়েছিলেন। কমলাকান্তের জন্য কলকাতা থেকে আসবাব আনিয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়, তার মধ্য থেকে একখানা উৎকৃষ্ট গালিচা পাঠিয়েছিলেন। গালিচাখানা বড় নয়, একজনের আমীরীচালে বসবার মত। তার সঙ্গে তার উপযুক্ত মসলন্দ অর্থাৎ তাকিয়াও ছিল। আরো কিছু ছিল,—একটা হাতীর দাঁতের কাজকরা মেহগনি কাঠের বই রেখে পড়বার কাঠা, একটি রূপার শামাদান, কিছু আতর এবং একটি ছোট সোনার রেকাবিতে কিছু মেওয়া ফল।

আচার্য গিয়ে ঠাকুরসাহেবকে সেলাম করে সব সামনে নামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন-আমার মালিকের খুব অসুখ, মা তাঁর শিয়রে বসে আছেন, কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মা তাঁর ঠাকুরসাহেব বাপুজীকে এইগুলি পাঠিয়েছেন।

ঠাকুরসাহেব অভিভূত হয়ে বলেছিলেন–বা রে নসীব বাঃ! খেল বটে তোর। কদিন আগে শ্যামনগরের বামুনরা চিঠির মারফৎ পাওনা বকেয়া সেলাম নজরানা মিটিয়ে দিয়েছে। আজকে কীর্তিহাটের রায়বাবু পাঠালে আমারে খেলাত। কিন্তু নিয়া করব কি?

মহেশচন্দ্র বলেছিলেন—ওই গালিচায় বসে নামাজ করবেন, ওতেই বসে এই তেকাঠার উপর কোরান শরীফ রেখে এই শামাদানে আলো জ্বেলে পড়বেন। এই মেওয়া ফল-কটি আপনি খাবেন!

ঠাকুরসাহেব ভবানী দেবীর পরিচয় পেয়েছিলেন এই সেদিন, যেদিন ওই গোয়ানদের ছিপে শ্যামনগর থেকে কীর্তিহাট যান!

কয়েকটা লোক কয়েকটা নতুন কাপড়ের গাঁট এনে নামিয়ে দিয়েছিল, এখানকার লোকেদের জন্য পাঠিয়েছেন ভবানী দেবী।

ঠাকুরসাহেব তখন আশি পার হয়েছেন, তবু সমর্থ মানুষ ছিলেন। খুব সমর্থ, লাঠি হাতে গ্রামে ঘুরতেন রোজ। তখনো পাখোয়াজ বাজাতেন, সূচে সুতো পরাতে পারতেন এবং তাঁর মত মিহি সেলাইয়ের কাজ নাকি ঠাকুরবাড়ির বিবিসাহেবরাও করতে পারতেন না।

ঠাকুরসাহেব বলেছিলেন—চল, আমি যাই, বাপজানকে, আমাদের সিদ্ধাই আছে, তার দোয়া দিয়া আসি!

হেঁটেই গিয়েছিলেন তিনি নদীর ঘাট পর্যন্ত। একটা ডুলি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিল। বজরার কামরায় ঢুকেই তিনি বলেছিলেন—কুছ ডর নাই বাপজান! আমার ফকীরির ইমান আর পিতিপুরুষের সিদ্ধাইয়ের যদি কিস্ম‍ থাকে তবে তুমি এই নদীর বাতাসেই ভাল হয়ে উঠবা। আর এই আমার মা জননী, ইনি সতী, ইনি দেবতা বাবা। ইয়ার তপস্যা সি কখনো বরবাদ হয় না। সাবিত্রীর কথা জানি বাবাজান, আমি পড়েছি, জানি। বাবাজান, যিবার খরা খুব কড়া হয়, সূয্যির তেজে যিবার দুনিয়া ফাটে, সিবার বর্ষা নামে তুফানে। তুমাদের বারো বছরের ছাড়াছাড়ি, মার এমুন তপস্যা, মিল হবার সময় এমন তুফান না হলে হয় বাবা!

আশীর্বাদ করে চলে এসেছিলেন। বীরেশ্বর রায়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু মন্ত্রতন্ত্রও পড়ে দিয়েছিলেন। ভবানী দেবী তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন। বৃদ্ধ চোখের জল ফেলে বেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়িয়ে আবার ঘুরে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—একটা বাত বলব বাবা?

বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—বলুন। হুকুম করুন।

—হুকুম রাখবে বাবা?

—সাধ্য ভোর কসুর করব না!

ভিতরে ঢুকে বলেছিলেন-নফরেরা বাইরে যা তো বাবা। আর কামরার দরজাটা বন্ধ করে দিস।

তারপর বলেছিলেন—তামাম শ্যামনগর পুড়ায়ে দিলে ওই বেটা ফিরিঙ্গী। তোমার ভাগ্নাকে ঘরে শিকল দিয়া পুড়ায়ে মারবার চেষ্টা করলে! তুমি তার শোধ লিবে না? পারবে না?

আশ্চর্য ঠাকুরসাহেব, শান্ত ফকীরের মত মানুষ, চোখ দুটো তাঁর ধক ধক করে জ্বলে উঠেছিল। বলেছিলেন—কলিজায় আমার বড়া লেগেছে বাবা। লাট যুগলপুর আমাদের সিদ্ধাইয়ের বকশিশ, জাতের দাম। বাবা, ফিরিঙ্গীকে এনে ঠাকুরদের চোট্টা নফর আজ পুড়ায়ে দিলে। আমি কিছু করতে পারলাম না। তুমি পারবে না শোধ লিতে?

বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—তাঁর চোখ দুটোও জ্বলে উঠেছিল—মনে এ আমার ছিল, তার উপর আপনি ফরমায়েশ করলেন, তামিল জরুর হবে!

—সাবাস সাবাস! দিল আমার খুশ করে দিলে।

তিনি চলে গিয়েছিলেন।

.

শ্যামনগরের ঘাটে বজরা এসে লেগেছিল। তার আগেই ছিপ এসেছিল খবর নিয়ে। স্বয়ং ভবানী দেবী পত্র লিখে কমলাকান্তকে আদেশ করেছিলেন প্রস্তুত থাকতে। কঠোর নির্দেশ ছিল তাঁর। লিখেছিলেন—“আদেশ অমান্য করিলে তুমি মাতৃহত্যার পাতকী হইবে। পিতৃহত্যার পাতক অর্শিলেও আশ্চর্যের হইবে না। দাদা বিমলাকান্ত তোমার মুখদর্শন করিবেন না!”

কমলাকান্ত বীরেশ্বর রায়ের অসুখের সংবাদে এবং শ্যামনগরের এই দুর্ঘটনায় নিজেও অনুতপ্ত এবং হয়তো নিঃসহায় বোধ করছিলেন। তিনি আদেশ অমান্য করেন নি। শ্যামনগরের ঘাটে আসেন নি; লোক রেখেছিলেন। এবং নিজে বাড়িতে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ঘাটে এসে জুটেছিল গোটা শ্যামনগর। বীরেশ্বর রায় এ সারা অঞ্চলে তখন গল্পের মানুষ। বজরা, ভাউলে নৌকো, ছিপ নিয়ে সে একটি ছোটখাটো নৌবহর ঘাটে যখন লেগেছিল, তখন এ অঞ্চলের মানুষের বিস্ময়ের সীমা ছিল না!

গিরীন্দ্র আচার্য ঘাটে নেমে গ্রামের প্রধানদের নিয়ে কমলাকান্তকে আনতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে লোক-লস্কর নিয়েই গিয়েছিলেন। কমলাকান্ত জ্ঞাতি ভট্টাচার্যদের বাড়ীতে ছিলেন, সেদিন তখন প্রস্তুত হয়ে তাঁদের পাকা দেবমন্দিরের বারান্দায় বসেছিলেন।

ডুলি আনানো ছিল। দুখানা ডুলি।

।কমলাকান্ত ঠাকুরদাস পালকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন—ঠাকুরদাস দাদা কিন্তু আমার সঙ্গে যাবে!

আচার্য হেসে বলেছিলেন—বেশ তো বাবুজী; শুধু ঠাকুরদাস কেন গো, শ্যামনগরের দশ- বিশজন-পঞ্চাশজন যত জন খুশী নিয়ে চল না! তোমার হুকুম! অমান্যি করে কার সাধ্যি!

সমবেত লোকজনেরা দুঃখের মধ্যেও হেসে উঠেছিলেন। কমলাকান্ত একটু লজ্জা পেয়েছিলেন। ডায়রীতে লিখেছেন—“দেওয়ানজীর একপ্রকার উক্তিতে আমি গৌরব এবং লজ্জা উভয়ই অনুভব করিলাম।”

দেওয়ান আচার্য কমলাকান্তকে নিয়ে রওনা হবার সময় কীর্তিহাটের বিচক্ষণ কর্মচারী বল ঘোষ এবং দুজন পাইককে রেখে এসেছিলেন; বিমলাকান্তের পোড়া বাড়ীর চাল বর্ষা চালানোর মত মেরামতের জন্য। এবং ঠাকুরদাস পালের বাড়ীর মাথা ভেঙে নতুন দেওয়াল চড়িয়ে মজবুত করে তৈরীর জন্য। বর্ষার পর ইট পুড়িয়ে বিমলাকান্তের বাড়ী পাকা হবে। সুতরাং কোনরকমে বর্ষা কাটানোর মত করে রাখা হবে। ক্রোশ দুয়েক দূরে কুতুবপুরের কাছারী, কীর্তিহাটের এলাকা, সেখানকার কাছারীর সমস্ত সাহায্য এখানে আসবে। আর প্রধানদের ডেকে শ্যামনগরের লোকেদের বাড়ীঘর মেরামতের জন্য দু হাজার টাকা দিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন—এ হ’ল কমলাকান্তবাবুর প্রণামী। বলতে গেলে এক রকম আগুনটা তাঁর ফুঁয়েই জ্বলে উঠেছে! টাকা কর্মচারীর কাছে রইল। তাঁরা যাকে যা দিতে বলবেন, বলু অর্থাৎ বলরাম ঘোষ তাকে তাই দেবে। এছাড়া কাঠ তাঁরা কুতুবপুর জঙ্গল থেকে পাবেন।

রত্নেশ্বর লিখেছেন—ইহাতে আমি বড়ই সন্তোষ লাভ করিলাম। অনুভব করিলাম—হ্যাঁ, আমি জমিদার।

আচার্য আর একটি কথা বলেছিলেন কমলাকান্তকে—বাবুজী, সকলের কাছে বলুন, আপনার বাড়ীর বিগ্রহকে সাক্ষী করে বলুন—এই নিগ্রহের প্রতিকার না করে শ্যামনগরে আর ঢুকবেন না। লাট যুগলপুর আপনার এই গৃহদেবতার নামে কিনে, সেবায়েৎ হয়ে এ গ্রামে ঢুকবেন। আপনি ব্যাঘ্রশাবক, শৃগালের অত্যাচার নিবারণ করা আপনার ধর্ম। ইজ্জত।

একাল হলে রত্নেশ্বর রায় তা পারতেন না। কিন্তু সেকালে তিনি তা পেরেছিলেন। ডায়রীর পাতায় মোটা মোটা করে লিখেছেন কথাগুলি।

তারপর লিখেছেন—ওই কথা।

ডুলিতে চড়িয়া ঘাটে আসিলাম। শ্যামনগরের সমস্ত লোক আসিয়া আমাকে বিদায় দিল। আমি বিজয়ীর মত আসিয়া বজরায় আরোহণ করিলাম। ওই প্রতিজ্ঞা করিয়া মনের সকল গ্লানি আমার মুছিয়া গিয়াছিল। বজরায় উঠিতেছি এমন সময় পিছন হইতে ঠাকুরদাস দাদা বলিল-দাদাঠাকুর, শালা সাহেব! ঘোড়ায় চড়িয়া ওই দেখ, অনেকটা দূর হইতে দেখিতেছে। দেখিলাম—তাহার কথা সত্য, অনেকটা দূরে জন রবিনসন ঘোড়ায় চড়িয়া দেখিতেছে! পিঠে কাঁধের উপর বন্দুকের নলটা উঁচু হইয়া আছে। আমি গ্রাহ্য করিলাম না। বজরায় আরোহণ করিলাম। মাতাঠাকুরানী বজরার কামরায় দরজার মুখে পর্দা সরাইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। আমি অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিতে উদ্যত হইতেই তিনি আমাকে নিবারণ করিয়া বলিলেন—না। আগে আমাকে নহে, আগে তাঁহাকে। আয়! সুসজ্জিত কামরার অভ্যন্তরে বিছানার উপর মোটা তাকিয়া হেলান দিয়া তিনি দরজার দিকেই তাকাইয়া ছিলেন। বুঝিলাম, আমারই আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন! তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই আমার দৃষ্টি আনত হইল। গভীর লজ্জা ও অনুশোচনা অনুভূত হইল! শালপ্রাংশু মহাভুজ রাজসদৃশ আকৃতি, তাঁহার আয়ত চক্ষুদ্বয়ের দীপ্ত দৃষ্টি আমাকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। আমি অগ্রসর হইয়া চরণে প্রণত হইতে উদ্যত হইতেই তিনি আদেশ করিলেন—অগ্রে তোমার পৃষ্ঠের ক্ষতস্থান দেখাও! দেখি!

—না, আগে প্রণাম করুক।

—প্রণাম! তাই হোক। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী! তাই কর, তোমার ভালো-মায়ের আদেশই শিরোধার্য কর!

প্রণাম করে উঠে এবার অপরাধীর মত হেসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। বীরেশ্বর রায়, প্রস্তর-মনুষ্য, লোকে বলত পাথরে গড়া মানুষ। সে কী দেহে, কী মনে! সেই মানুষের চোখ থেকে জল গড়িয়ে এসেছিল!

রত্নেশ্বর রায় কিন্তু সেদিনও স্পর্শ করতে পারেন নি অন্তর্নিহিত এই পাথর ফাটানো ভোগবতী উৎসটিকে।

.

সুরেশ্বর বললে—তিনি মানে রত্নেশ্বর রায় খুব বিস্ময় বোধ করেছিলেন, কলকাতার ঘাটে পাল্কীতে চড়েই বীরেশ্বর রায় ওখানকার প্রধান কর্মচারী ঘোষকে ডেকে প্রথম যে কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন—সেই কথা শুনে।

ভবানী দেবীর সামনেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন—সোফিয়ার ওখানে গিয়েছিলে?

—হ্যাঁ, হুজুর।

—খোঁজ পেয়েছ?

—না, হুজুর। তিনি ওখানে নেই। চলে গিয়েছেন।

—কোথায় গিয়েছেন?

—তা ওরা জানে না বললে।

—কে বললে? সোফিয়া নিজে?

—না হুজুর, বাঈ এখন কারু সঙ্গে দেখা বড় করে না। অনেক কষ্টে ওর মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে-ই বললে। বললে—তিনি চলে গিয়েছেন, তারা কোন পতা জানে না! ভবানী দেবী শুনছিলেন। পাশে রত্নেশ্বর রায়ও দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি মনে মনে বিদ্রোহী হয়ে উঠছিলেন এবং ভাবছিলেন—তিনি ভুল করেছেন এসে!

“আমি তখন ভাবিয়াছিলাম—আমি মহাভ্রম করিয়াছি; পবিত্র অশ্বত্থ বৃক্ষ ভাবিয়া কণ্টকময় শিংশপা বৃক্ষকে আলিঙ্গন করিয়াছি। আর ধিক্কার দিয়াছিলাম ভালো-মাকে। মনে পড়িয়াছিল পুরাণের গল্প, এক সতী তদীয়া মহালম্পট কুষ্ঠরোগগ্রস্ত স্বামীর আদেশে তিনি ওই পাপাচারী স্বামীকে স্কন্ধে করিয়া বেশ্যালয়ে লইয়া যাইতেছিলেন। দারুণ অন্ধকারের মধ্যে পথিপার্শ্বে ধ্যানমগ্ন এক ঋষির অঙ্গে উক্ত পাপাচারীর পা ঠেকিবামাত্র পাপস্পর্শে তাঁহার ধ্যানভঙ্গ হয়। তিনি তাঁহাকে অভিশাপ দেন যে, সুর্যোদয় হইবার সঙ্গে সঙ্গে, রে মহাপাপী, তোর মৃত্যু ঘটিবে। সতীশিরোমণি নাকি সদর্পে বলিয়াছিলেন—অন্ধকারে অজ্ঞানবশত সঙ্ঘটিত এই অপরাধের জন্য তুমি আমার স্বামীকে অভিশাপ প্রদান করিলে। আমি তোমাকে প্রত্যভিশাপ দিব না। তবে ইহাও বলিব যে, যদি আমি সতী হই, তবে এই রজনীরও আর কখনো অবসান হইবে না। সূর্য উদিত হইবে না। শেষে অবশ্য দেবগণের মধ্যস্থতায় সর্পও মরে নাই, ষষ্টিও ভগ্ন হয় নাই, সতী এবং ব্রাহ্মণ উভয়ের মহিমাই রক্ষিত হইয়াছিল; দিব্যদেহ ধারণ করিয়া দিব্যরথে আরোহণপূর্বক সতী তাঁহার স্বামীকে লইয়া স্বর্গে আরোহণ করিয়াছিলেন। এবং ব্রাহ্মণের বাক্য রক্ষিত হইয়া রজনীশেষে সূর্য উদিত হইয়াছিল, সৃষ্টিও রক্ষা পাইয়াছিল। এই প্রকারের সতীত্ব-মহিমা-কীর্তন যাঁহারা করিয়াছেন, তাঁহারাই এদেশের সর্বনাশ করিয়াছেন! ভালো-মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা কমিয়া গেল। এবং যখন তিনি নিজে প্রশ্ন করিলেন, তখন আমার অশ্রদ্ধা জন্মিল।

ভবানী দেবী জিজ্ঞাসা করেছিলেন বীরেশ্বর রায়কে—আমি চিঠি লিখে সোফি বাঈকে ডেকে পাঠাব? হয়তো আমি ডেকে পাঠালে আসবে, আর বলবে ও!

বীরেশ্বর বলেছিলেন—তুমি চিঠি লিখবে?

—হ্যাঁ। তুমি লিখলে ভয়ে না আসতে পারে। আমি লিখলে আসবে। অন্তত আসার ভরসা পাবে সে। লিখব তোমার অসুখ খুব

একটু ভেবে বীরেশ্বর বলেছিলেন—দেখ!

বাড়ী এসে ডাক্তার কবিরাজের ব্যবস্থার মধ্যেও এ-কথাটা ওঁদের দুজনের একজনও ভোলেন নি। চিকিৎসক এসেছিলেন দুজন, একজন বড় সাহেব ডাক্তার এবং একজন বড় কবিরাজ। অসুখের উপশম বারো আনাই হয়ে গিয়েছিল; চার আনা অবশিষ্ট ছিল। মাথার যন্ত্রণা ছিল না কিন্তু বাঁ হাত এবং বাঁ পা অবশ হয়ে গিয়েছিল, সেটা তেমনই আছে। ডাক্তার বলেছিলেন-প্যারালিসিস। কবিরাজও তাই বলেছিলেন।

ডাক্তারি মতেই ওষুধের ব্যবস্থা হল। পূর্ণ বিশ্রামের কথা দুজনেই বলে গেলেন। সুরা, মাংস ইত্যাদি বন্ধ। আর ব্যবস্থা হল মালিশের। সে মালিশের তেল দিয়েছিলেন কবিরাজমশাই।

সেদিনই সন্ধ্যাবেলা বসে ভবানী দেবী পত্র লিখেছিলেন সোফিয়া বাঈকে। লিখেছিলেন—“রায়বাবুর খুব অসুখ। বিশেষ প্রয়োজনে তোমাকে আমি নিজে পত্র লিখছি, তুমি আমার সঙ্গে একবার দেখা কর।”

বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—দাঁড়াও আগে খোঁজ করি।

—হ্যাঁ। খোঁজো। জানি, সোফি এখন অন্য কার কাছে রয়েছে। এরা তো—। হেসেছিলেন হাসিতেই বাকী অংশটা বলা হয়ে গিয়েছিল। ঘোষকে ডাকতে বল। জলধর, ঘোষকে ডাক।

ঘোষ এসে মাথা চুলকে বলেছিল—বাঈ এখন কোন বড়লোক বা আমীরের বাঁধা নেই। মানে—। অন্যরকম হয়ে গেছেন। ওই কাজ করে না। তবে গান-বাজনার বায়না হলে যায়। তাও নাচে-টাচে না। বৈঠকী গায়। সেও খুব বড় আসরে। নাহলে বাড়ীতে থাকে, কি সব জপতপ করে। ওই পাগলাবাবার পর থেকে আর এক রকম হয়ে গেছে।

—হুঁ! একটু চুপ করে থেকে বীরেশ্বর বলেছিলেন—আমি তোমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে আসতে বলেছিলাম। সেটা দেওয়া হয়েছিল? আমার এই একটা হয়েছে দেখছি—কথাবার্তা সব ঠিক মনে পড়ছে না।

ঘোষ বলেছিল—হাঁ নিয়েছিল। তবে বাঈ নিজে নয়—বাঈসাহেবার মা নিয়েছিল।

রত্নেশ্বরের ঘৃণা জন্মাচ্ছিল। শুধু বীরেশ্বর রায়ের উপরেই নয়, ভালো-মার উপরেও চিত্ত তাঁর বিমুখ হয়েছিল। বাঙালীর ছেলে, ইংরিজী শিখেছেন, সে কালের আধুনিক, রামমোহন রায়ের বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেন। তাঁর সহ্য হয় নি এই ধরনের লজ্জাহীন ব্যবহার। বাড়িতে মহেশচন্দ্র রয়েছেন, মহেশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত হৃদ্য ছিল; তাঁর সঙ্গে মতে তাঁর মিলত, তাঁর কাছে গিয়ে বলেও তিনি খুশী হন নি। তিনি বলেছিলেন—এ নিয়ে কোন ঔৎসুক্য প্রকাশ তোমার উচিত হবে না ভাই।

রত্নেশ্বর বলেছিলেন-আপনি ভালো মাকে বারণ করুন।

—না। সে অধিকার আমার নাই।

রত্নেশ্বর ডায়রীতে লিখেছেন—“অতঃপর আমি এই বাড়ীতে থাকিয়াও তাঁহাদের সহিত সম্পর্ক ত্যাগ করাই স্থির করিলাম। তাঁহারা যে দিকটায় ছিলেন সে দিকটা ত্যাগ করিয়া একেবারে পশ্চিমের অংশটায় বাসস্থান স্থির করিলাম। সঙ্গে সঙ্গে এও স্থির করিলাম মাতুল মহাশয় একটু সুস্থ হইলেই সমস্ত সম্পত্তি ইত্যাদি আমার অংশমত পৃথক করিয়া লইব। তিনি এক্ষণে একরূপ অক্ষম হইলেন, তাঁহাকে বলিব—তিনি তাঁহার অংশের মালিকানার পাওয়ার অব অ্যাটর্নী আমাকে প্রদান করুন। তাঁহার খরচপত্রাদি সমুদয় যথাবিধি আমি সরবরাহ করিব। এবং তাঁহার সন্তানাদি যদি অতঃপর হয় তবে তাহাদিগকে যথাসময়ে বুঝাইয়া দিব। এবং শর্ত করাইয়া লইব যে, উৎসব আনন্দ ব্যতিরেকে ভদ্রাসন বাটী মধ্যে কোনপ্রকার অনাচার করিতে কেহই পারিবেন না। প্রয়োজন হইলে এমতে একটি বাগানবাটী ক্রয় করা যাইতে পারে।

সেইরূপ ব্যবস্থাদি করিয়া লইয়া আমি একদা জানবাজার বাটীর সেরেস্তাখানায় আসিয়া বসিলাম। বলিলাম—আগামীকল্য হইতে আমি আসিয়া কাছারীতে বসিব। আমার বসিবার ঘর ও আসবাবাদির ব্যবস্থা করুন!

পিতা কাশী হইতে আসিবেন। তাহার পূর্বেই আমি শক্ত হইয়া বসিতে চাই। অন্যথায় পিতাকে আমার আশঙ্কা আছে। তিনি বলিবেন—বীরেশ্বর বর্তমানে কদাপি তাহা হইতে পারে না।

তিনি পিতা। কিন্তু তিনি ভুলিয়া যান যে সম্পত্তির মালিক তিনি নহেন, মালিক আমি। তিনি আমার বাল্যকালে আমার ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা করিলে আমি বালককালে অনেক সুখে থাকিতে পারিতাম। সুখ ছাড়াও আমার কর্তব্য আছে। ভগবান সে কর্তব্য অর্পণ করিয়াই এই রায়বংশের অর্ধেকের মালিক করিয়া আমাকে ভূমণ্ডলে প্রেরণ করিয়াছেন। রায়বংশের মর্যাদা, ধর্ম, দেবতার তুষ্টিসাধন আমার অবশ্য কর্তব্য।”

পরদিন থেকে তাই হয়েছিল সুলতা।

কাছারীতে রত্নেশ্বরের বসবার ঘর নির্দিষ্ট হয়েছিল —বীরেশ্বর রায়ের ঘরে-তাঁরই আসন তাঁর বসবার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল। পাশে তক্তাপোশের উপর বসেছিলেন গিরীন্দ্র আচার্য। বীরেশ্বর রায় তাঁকে যেতে দেন নি।

গিরীন্দ্র আচার্য তাঁকে সম্ভাষণ করে বলেছিলেন-এস, ভায়া এস। বাবুজীর হুকুম হয়েছে এই ঘরে এই আসনে তুমি বসবে। কাগজপত্রে সই করবে। যা বুঝতে না পারবে তা আমাকে বলবে। আমি বুঝিয়ে দেব তোমাকে!

প্রথম দিনই আচার্য তাঁকে কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্যের আনন্দময়ী দেবোত্তরের অপূর্ণনামা এবং সোমেশ্বর রায়ের ট্রাস্ট দলিল পড়তে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—এই দুখানা থেকেই কাঠামোটা বুঝতে পারবে। আর সম্পত্তির আয়-ব্যয় বিলিব্যবস্থা সবই পাবে। পড়। কাল দেখাব, ওঁদের নিজের নগদ টাকা কারবারের হিসেবপত্র। মজুত টাকা, কত লগ্নী, তার সুদ। এবং তাই থেকে হাল পর্যন্ত কত সম্পত্তি আবার কেনা হয়েছে, তার বিবরণ তৈরীই আছে, তা দেখাব।

সম্পত্তি অনেক। তোমরা রাজাতুল্য ব্যক্তি! সরকারের কাছে একটু ধরাপাড়া করলেই খেতাব পাবে। কতবার বলেছি তোমার মাতুলকে, তা তিনি তো এতকাল একরকম পাগলই ছিলেন। এবার মামাকে বল তুমি। তুমি বললে না করবে না। একটা খেতাব না হলে মানাচ্ছে না!

বলতে বলতেই উঠে বেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন আচার্য। ঘরখানা থেকে কাছারীর বারান্দা দেখা যাচ্ছে; সেখানে দুজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে চিনতে পেরেছিলেন রত্নেশ্বর। সে পিদ্রুস গোয়ান। জোসেফ পিদ্রুস। ভালো-মাকে পৌঁছে দিতে এসেছিল শ্যামনগর।

আচার্য তাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে, তাদের বসিয়ে, উপরতলায় চলে গিয়েছিলেন। বুঝতে বাকী ছিল না যে, তিনি বীরেশ্বর রায়ের কাছে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে চিত্ত তাঁর বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। এ কি কথা? তাঁকে এই কর্তার আসনে বসিয়ে রেখে আচার্য চলে গেলেন উপরে। তাকে কোন কথা বলা প্রয়োজন মনে করলেন না। তা হলে তো এ সঙ সাজা!

তিনি হর্করাকে বলেছিলেন-ডাক্ ওই লোকটাকে।

পিদ্রুস এসে তাঁকে সেলাম করে হেসে বলেছিল—আরাম হয়ে গেলেন হুজুর? আচ্ছা আচ্ছা, মাদার মেইরির কৃপা, মেহেরবানী!

—কি খবর তোমাদের? কি জন্যে এসেছ?

আবার হেসে পিদ্রুস বলেছিল—এতালা ভেজলাম বড়া হুজুরের কাছে। একটা কাম আছে।

—কি কাম? বল!

—উ তো বড়া হুজুরকে কাম। উনকে পাশ শুনবেন!

–হুঁ।

তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বাইরে এসে উপরে উঠে গিয়েছিলেন। একেবারে বীরেশ্বর রায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। দরজাটা বন্ধ ছিল। বাইরে দাঁড়িয়েছিল চাকর জলধর, আর একজন হরকরা। তিনি তাদের গ্রাহ্য না করে দরজা টেনেছিলেন। জলধর সভয়ে বলেছিল—হুজুর—

নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—কি?

—নায়েববাবু কি পরামর্শ করছেন, বলেছেন—

তার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে তিনি ডেকেছিলেন—ভালো-মা!

চড় হজম করেই জলধর বলেছিল—মা ও-ঘরের মধ্যে নাই হুজুর।

—নাই? একমুহূর্ত চিন্তা করে সে এবার একটু জোরেই দরজা ঠেলে ওই ভালো-মাকেই ডেকেছিলেন। ভালো-মা!

ভিতর থেকে আচার্য বলেছিলেন-আসছি। কয়েক মুহূর্ত পরেই আচার্য দরজা খুলে দিয়ে তাঁকে আহ্বান করে বলেছিলেন—এক্ষুনি তোমাকে ডাকবার কথা হচ্ছিল!

বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন রত্নেশ্বর, তাঁর আর রাগ বা অভিযোগ করবার কারণ ঘটে নি।

বীরেশ্বর রায় তাঁকে বলেছিলেন—বস। পাখাখানা নিয়ে মাথায় হাওয়া কর।

রত্নেশ্বর তাই করেছিলেন।

বীরেশ্বর বলেছিলেন-যে কথা হচ্ছে তা তোমার মা—মানে ভালো-মাও জানবেন না। জানব আমরা তিনজন—আমি, তুমি আর দেওয়ান খুড়োমশাই।

অবাক হয়ে গিয়েছিলেন রত্নেশ্বর। একটু ভয়ও হয়েছিল।

–শোন! জন রবিনসনকে আমি শাস্তি দিতে চাই! দেওয়ানী মামলা তার নামে দায়ের হয়েছে, কিন্তু তাতে এর শোধ হবে না! আমি ওকে—।

চমকে উঠেছিল রত্নেশ্বর। কি করতে চান বুঝতে তাঁর বাকী থাকে নি। মুহূর্তে একটা দুরন্ত ভয় যেন তাঁকে চেপে ধরেছিল।

বীরেশ্বর রায় তা বুঝেছিলেন। বলেছিলেন, ভয় পেয়ো না। জমিদারী ধর্ম বড় কঠিন। এটা একরকম রাজধর্ম। দুষ্টকে শত্রুকে দমন করতেই হবে। না পারলে জমিদারী চলবে না। দেওয়ানী মামলা করেছি, ওর কাছে আমরা আজও হাজার বিশেক টাকা পাব। কিন্তু তাতে অনেক দেরী লাগবে। একটা দাঙ্গা বা—। দাঙ্গার চেয়ে গোপনে ওকে—। লোক পেয়েছি।

রত্নেশ্বরের শরীর হিম হয়ে আসছিল। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।

এবার আচার্য বলেছিলেন-আমি বলছি, তাতে অনেক হাঙ্গামা হবে। কোনরকমে প্রকাশ পেলে গভর্নমেন্ট হুজ্জোতের বাকী রাখবে না। এই সবে মিউটিনি গেল। তেতে আছে। আমি বলি—বেটার তো নানান বাতিক আছে, মেয়েমানুষ, শিকার টোপ ফেলে কবজায় নিয়ে এসে বেটাকে এমন করে দিক যাতে কাজের বাইরে যায়! সব থেকে ভাল হত, বিশুবাবুর দলের মত দল থাকলে। কুবী মেরে দিয়ে জখম করে দিয়ে চলে যেত। এরা তা পারবে না। দলটল এদের ঠাকুরসাহেব ভেঙে দিয়েছেন।

এই সময় ঘরে ঢুকেছিলেন ভবানী দেবী। তিনি এতক্ষণ পূজায় ছিলেন পাশের ঘরে। ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—আমি পুজোয় বসে সব শুনছিলাম। কিন্তু দুদিনও কি তর সইছে না তোমার? ভাল হয়েই ওঠো!

—না, তুমি জান না—

—জানি!

—রত্নেশ্বর যদি জীবন্ত পুড়ে মরত—

—তা যখন হয় নি, তখন যদি হত বলে রোগ বাড়িয়ে ফল কি?

—না। সে আমি ভুলতে পারছি না।

—ওসবের ভার খুড়োমশায়ের হাতে দাও, রত্নেশ্বরকে নিয়ে উনি যা হয় করবেন। এসবে আমি দুঃখ পাই। সহ্য করতে পারিনে। তবু জেদ যখন তোমার যাবে না, তখন সর্বনাশা পাপ না করে খুড়োমশাই যা বলেন তাই কর! বিপদ ডেকে আনা হবে। পাপ হবে।

—টাকা বিপদ কাটিয়ে দেবে। আর পাপ? না—তাও হয় না। রাজ্য করতে গেলে বিদ্রোহী দমন করতে হয়। শত্রুকে ধ্বংস করতে হয়। রাজধর্ম জমিদারীধর্মে তাতে পাপ অর্শায় না। আইন বাঁচাতে পারলেই হ’ল।

কথাটা কতক্ষণ চলত তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু সমস্ত কিছুর মোড় ফিরে গেল পাল্কীর বেহারাদের হাঁকে।

ভবানী দেবী বললেন—থাক এখন ওসব কথা। পাল্কী এল। সোফিয়া বোধ হয় এল! জলধর, দেখ তো বাবা কে এল পার্শ্বীতে?

জলধর বারান্দায় ঝুঁকে বললে—বাঈ সাহেবা।

ভবানী দেবী বললেন—তুই নীচে যা রত্ন।

আচার্য সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন। রত্নেশ্বরকে বললেন-এস বাবুজী ভায়া। এস—। আমরাই যা হয় করব।

তিনি বেরিয়ে গেলেন। রত্নেশ্বর বেরিয়ে এসে বারান্দায় বেরিয়ে ডাকলে—ভালো-মা! ভবানী দেবী সাড়া দিয়েছিলেন—কি?

—আমার কয়েকটা কথা আছে তোমার সঙ্গে। তোমাকে একলা বলতে চাই।

বীরেশ্বর রায় বললেন—ভিতরে এস। বাইরে একলা বলা হয় না। যাও পুজোর ঘরে যাও!

পুজোর ঘরে গিয়ে ইচ্ছে করে বীরেশ্বর রায়কে শুনিয়েই একটু উচ্চকণ্ঠে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—এ আমার আর সহ্য হচ্ছে না ভালো-মা!

—কি?

—এই সোফি বাঈকে ডেকে আনছ

—তুই অন্তত এ কথাটার মধ্যে থাকিস নে। তুই নিচে যা।

—তুমি একে পাপ মনে করছ না? আশ্চর্য!

এ ঘর থেকে বীরেশ্বর ডেকেছিলেন—সতীবউ!

ভবানী ব্যগ্রভাবে বলেছিলেন—ওরে, আমি তোকে মিনতি করছি। রত্ন, তোকে মিনতি করছি!

—সতীবউ!

—যাই।

—যাই নয় শোন; রত্নেশ্বর, তুমিও শোন। নইলে আমাকেই কোনরকমে বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে।

ভবানী এ ঘরে এসে বলেছিলেন-ও যাচ্ছে। এখুনি যাচ্ছে। রত্ন!

বীরেশ্বর বললেন—না! তুমি যে চিঠিখানা লিখেছিলে, আর শ্বশুরমশাই যেখানা লিখেছিলেন, চিঠি দুখানা ওকে পড়তে দাও।

–পড়তে দেব?

—হ্যাঁ পড়তে দেবে। দাও দাও।

ভবানী দেবী স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে চিঠি দুখানা বের করে রত্নেশ্বরের হাতে দিলেন।

বীরেশ্বর বললেন—চিঠি দুখানা তুমি নির্জন ঘরে পড়ে শেষ করে আমাদের কাছে এস। যাও। তারপর তোমার সঙ্গে কথা হবে। তোমার জানার সময় হয়েছে। যাও। এখন সোফি এসেছে, তার সঙ্গে আমাদের কথা আছে, কিছু সেরে নিই!

রত্নেশ্বর পাশের ঘরে গিয়েই পড়তে বসলেন চিঠি দুখানা।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *