২
একজন চাকর এসে ঢুকল হাতে ট্রে নিয়ে। নামিয়ে দিল সামনের টেবিলে। বুড়ো চাকর। সে সুলতাকে দেখে নমস্কার করে বললে—ভালো আসেন দিদিমণি?
সুলতা তাকে এবার চিনলে। এ তো সেই রঘু। রঘু বুড়ো হয়ে গেছে, চুল গোঁফ একেবারে সাদা হয়ে গেছে। সে বললে—তুমি তো রঘু!
—হ্যাঁ। হমি রঘু। রঘুর বাংলায় এখনও হিন্দি টান যায়নি!
—এখনও আছ বাবুর কাছে? ভাল আছ?
—হ্যাঁ। ই বাবুকে ছোটা উমরসে মানুষ করলাম। কাঁহা যাই আর কেমন করে যাই ছোড়কে সুরেশ্বর কোন সাড়াই দিলে না। সে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। রঘু ট্রেতে চা এবং কিছু কেক মিষ্টি এনে নামিয়ে দিয়েছে। সে চায়ের কাপটা তুলে নিলে। চায়ের তৃষ্ণা এবং ক্ষিদেও তার পেয়েছিল। সুরেশ্বরকে জানে, সে হয়তো নাও বলবেই না। সেই বরং সুরেশ্বরকে বললে—চা নাও।
তেমনি ভাবে অনেক দুরের দিকে তাকিয়ে সুরেশ্বর—বললে না। তারপর বলেই গেল—সুলতা, ভেবেছিলাম—১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করব। সে ছবিও আমার আঁকা আছে। কিন্তু দেখলাম তাহলে ১৯৪৭ সালে কড়চা শেষ করতে হয়। এবং তাতে রায়বংশের ভুমিকা ছোট হয়ে যায়। যাকে বলে সাইড ক্যারেক্টার তাই দাঁড়ায়। তারপর ভেবেছিলাম—ইম্পীচমেন্ট অব হেস্টিংস ছবি দিয়ে শুরু করব। সে ছবিও আঁকা আছে। হাউস অব লর্ডসে ইম্পীচমেন্টের পালা শেষে হেস্টিংস বেকসুর খালাস পেয়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু মনে হল, তা হলে শেষ করতে হবে অন্ততঃ আরও একখানা বা দুখানা ছবি এঁকে। হেস্টিংস জবানবন্দী করেনি নিজে। সুরেশ্বর জবানবন্দী করছে, যাদের সামনে করছে, তাদের মধ্যে তুমি আছ, সে ছবি না-হলে শেষ হয় না। সে ছবি মনে কল্পনায় ছিল কিন্তু আঁকা হয়নি। তাই শুরু করেছি একেবারে বর-বেশী দশ বছরের সোমেশ্বর রায় জমিদার হয়ে কীর্তিহাটে ঢুকছেন সেখান থেকে। ১৮০১ সাল সেটা।
সতেরো শো সাতান্নতে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলা হেরে গিয়ে নিমকহারামের দেউড়িতে মীরনের হুকুমে মহম্মদী বেগের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। তারপর মীরজাফর, তারপর মীরকাশেম নবাব কাশেম আলি খাঁ! উধুয়ানালা-ঘিরিয়া থেকে বকসারে শেষ। আবার মীরজাফর। এবার কোম্পানী দেওয়ানী পেলে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ। বাংলা ১১৭১-৭২ সাল। কোম্পানীর হাতে সব এল। মায় দেশরক্ষা পর্যন্ত।
পটভূমিকা তোমায় বোঝাচ্ছি সুলতা। ইতিহাসে তুমি পড়েছ। কিন্তু ইতিহাস ঘটনা বলে যায়, অবস্থার ভিতরটা বোঝায় না। এ বোঝানো বড় শক্ত!
আমি একখানা পুরনো পাঁচালীর পুঁথি পেয়েছি। সেখানা সোমেশ্বর রায়ের বাবা কুড়ারাম ভট্টাচার্যের লেখা।
ওগো মা শিবজায়া গো,
অধম সন্তানে কর দয়া গো
অন্তিমেতে অভয়া গো—
কুড়ারামে দিয়ো পদছায়া গো
হরজায়া গো!
মস্ত পাঁচালী। তার মধ্যে আছে সুলতা, সেদিন লোকে ইংরেজকে পরিত্রাতা ভেবেছিল। মুসলমান আমলে বর্গী হাঙ্গামায় যে অত্যাচার করেছিল বর্গীরা তা তো জান। তবু সেকালে এক কবি মহারাষ্ট্র পুরাণ লিখেছিল, তাতে আছে, পাপে সব পূর্ণ হয়ে গেছে দেখে স্বর্গ থেকে দেবতারা এসে বর্গী পেশোয়া থেকে নানান সেনাপতির মধ্যে তাঁদের শক্তি সঞ্চারিত করেছিল, দেশময় পাপীদের শাস্তি দিতে। এতেও তাই আছে—নবাবের সঙ্গে নবাবী আমল শেষ হতে অন্তত হিন্দু সমাজের সাধারণ লোক ইংরেজের উপর কৃতজ্ঞ হয়েছিল।
অত্যাচার তো কম হয় নি।
ওই পাঁচালীর গোড়াটা আমার মুখস্থ আছে। বলে সুরেশ্বর আবৃত্তি করে গেল—
কালে কালে পাপের ভারা পূর্ণ হইলে কাঁপে ধরা
ব্রহ্মা বিষ্ণু দিশেহারা যাচে তোমার দয়া গো।
হরজায়া গো।
তখন তোমার তাথৈ নাচে পাপী মরে পুণ্যাত্মা বাঁচে
পতি তোমার পদ যাচে শবরূপী হয়্যা গো
হরজায়া গো!
পলাশী ঘিরিয়া উধুয়ানালা হইল এমেতে নৃত্যশালা
ফুরালে নবাবী পালা সাহেবানে কৈলে দয়া গো।
হরজায়া গো!
রাঙা চুল লাল মুখ দেখিলে মা কাঁপে বুক
তবু মনে ভাবি সুখ সুবিচার প্যায়া গো।
হরজায়া গো!
সে পাঁচালী রচিতে সাধ হয়েছে দীনের চিতে
শিবরাম মম পিতে কুড়ারাম বাছা
কীর্তিহাটে আদি বাস বর্গী আইল মহাত্রাস
নবাবের সৈন্য নাশ, পালায় খুলে কাছা।
তারা পালাবার কালে গ্রামে গ্রামে অগ্নি জ্বালে
লুঠ করে মেরে ফ্যালে দরিদ্র প্রজারে
পিতা শিবরাম মরে অগ্নি জ্বলে বাস্তুঘরে
জননীর হাত ধরে বনে ও বাদাড়ে
পলাইয়া প্রাণ রক্ষা দ্বারে দ্বারে অন্ন ভিক্ষা
তুমি কালী সর্বরক্ষা দিলে স্নেহছায়া গো
হরজায়া গো!
সে দয়াতে কুড়ারাম ফিরিল আপন গ্রাম
ভট্ট নয় রায় নাম কোম্পানীর কাছে পায়া গো
হরজায়া গো!
বর্ণিব সে সব কথা কোথায় জল মরে কোথা
ভিক্ষুকের রুখু মাথায় দিলে পাগ পরায়া গো।
হরজায়া গো!
তোমার মন্দির ক’রে তোমারে বসাই ঘরে
মাগি মাগো জোড় করে থাক অচলা হয়া গো।
হরজায়া গো!
অবাক হয়ে সুলতা শুনছিল! সুরেশ্বর চুপ করলে সে বললে—ওয়ান্ডারফুল। সেটা আছে তোমার কাছে?
—আছে। জাল নয়। কীর্তিহাটের রায়বাড়ীর সেরেস্তাখানা খুঁজতে খুঁজতে পেলাম এটা। সেটেলমেন্টের জন্য কাগজ দেখতে গিয়ে রায়বংশের স্বরূপের কিছু ছবি তখন পেয়েছি। তার মধ্যে এমন কিছু পেয়েছি যাতে আমি আমার বংশকে আমার রক্তকে চিনে যেমন শিউরে উঠেছি, তেমনি নেশাগ্রস্ত হয়েছি। তখনই পেলাম এটা।
এতে অনেক কিছু আছে সুলতা। সেদিনের বাংলাকে চেনা যায় জানা যায়। বোঝা যায়। সে বাংলা দেশ এ দেশ নয়! প্রথম ছবিখানিকে ভাল করে দেখ। বুঝতে পারবে। নতুন খড়েছাওয়া ছোট-ছোট ঘর, কোঠাবাড়ীও তখন সারা গ্রামে দুখানা বা একখানা। কীর্তিহাটে ১৮০১ সালের দশ বছর আগে প্রথম কুড়ারাম যে বাড়ী করেন সেখানাই গ্রামের প্রথম কোঠাঘর। পাঁচালীতেই আছে। তখন কুড়ারাম ভটচাজ দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের দেওয়ান। ১৭৯১ সাল। ১৬৬০ পরগণার রাজস্ব স্থির করছেন, দশশালা বন্দোবস্ত হবে। মেদিনীপুরের ময়নার পুরনো রাজবংশের তখন সম্পত্তি গেছে, সে সম্পত্তি গোয়ালপাড়া সরকারের ভুক্তান হয়ে কাশিজোড়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কাশিজোড়াও তখন যাই-যাই করছে। ইতিমধ্যে কিছু লাট বের করে নিয়ে কোম্পানী বিলি করেছে, ছোট ছোট তালুকদারেরা নিয়েছে। কুড়ারাম তখন কলকাতার বাসিন্দে দেওয়ানজীর সঙ্গে। ঘর ছেড়েছিলেন বাপের মৃত্যুর পর আর ফেরেন নি! পাঁচালীতে আছে—
পরগণা ষোলশো ষাট কত মৌজা কত লাট
কত জল কত মাঠ কষি দিন রাত
তারই মাঝে চোখে পড়ে ময়না মেদিনীপুরে
কাঁসাই নদীর পাড়ে তারই সাথে সাথ
কীর্তিহাট বাস্তুভিটা কি মাটি আঠালো চিটা
লাল চাল কত মিঠা-কাঁসাইয়ের পাড়ে ঘন বন
বামুন কায়েথ বদ্যি সদ্গোপ মাহিষ্য ছত্রি
চুয়াড় চামার মধ্যি আপনার জন।
রাত্রিকালে স্বপ্ন পাই, কীর্তিহাটে ফিরে যাই
খুঁজে ফিরি ভিটি তাই পাই বহু দুঃখে
হয়েছে জঙ্গল ঘোর শিয়াল চেঁচায় রাত্রিভোর
বহু হল কষ্ট মোর স্বপ্ন মাঝে বুকে।
সে হেতু বানালাম কোঠা মাটির দেওয়াল মোটা
শাল কাঠ দিয়ে গোটা মজবুদ চাল
শত তঙ্কা পুরাপুরি খোলা হাতে খরচ করি
হইলাম খুশী ভারী বাদে এতকাল!
সুলতা বললে—তুমি নিজে তৈরী কর নি তো?
সুরেশ্বর বললে—অবিশ্বাস করো—কি বলব? বাদপ্রতিবাদ করব না। প্রমাণ-প্রয়োগ হাজির করে ইতিহাস নিয়ে লড়াই করব না। শুধু বিশ্বাস করতেই বলব। পাণ্ডুলিপিতে বানান অনেক ভুল আছে। শব্দ দু-চারটে দুর্বোধ্য আছে। সে আমি পুরণ করেছি, হয়তো ভাষা কিছু আমার একালের জিহ্বায় একালের হয়ে গেছে। তবে তার কাহিনীটা শুনে! যাও ওই ছবিতে যে পাকাঘরটা দেখা যাচ্ছে সেখানা সতেরো শো নিরানব্বইয়ে আরম্ভ হয়ে আঠারো শো সালে শেষ হয়েছে। মানুষেরা তখন আটহাতি ধুতি, কাঁধে গামছা ফেলে বেড়াত। খালি পা। ওই দেখ কজন ভট্টাচার্য রয়েছেন। তাঁদের পরনে দশ হাত ধুতি, তাও চল্লিশ ইঞ্চি, কাঁধে উড়নি। পায়ে তালতলার চটি। তাও শোভাযাত্রায় বেরিয়েছেন বলে। শুধু কুড়োরাম যাচ্ছেন ওই দেখো—পরনে লম্বা ধুতি গায়ে চাপকান তার উপর চাদর। মাথায় একজন ছাতা ধরে রয়েছে। তিনি জমিদার রায়বংশের প্রতিষ্ঠাতা। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের ডান হাত। পালকিতে সোমেশ্বরের হাতে যে কাগজখানা সেখানা জমিদারি নীলামে কিনেছেন তারই কাগজ!
কিছু কৌশল—বলতে গেলে চুরি, তাই বা কেন, ডাকাতি করে কিনেছেন লাট কীর্তিহাট। টাকা তিনি অনেক উপার্জন করেছিলেন। ঘুষ বলো ঘুষ, উপরি বলো উপরি। যা বলবে তাই মানব আমি।
তাইতো বলছিলাম—নিজের বংশের স্বরূপ দেখে আমার আমাকে যেন আমারই ভয় হয়েছিল সেদিন। শিউরে উঠেছিলাম। কিন্তু কুড়ারামকে দোষ দিইনি। কৃতী পুরুষ হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। হয়তো তোমার মতের সঙ্গে মিলবে না। তা না মিলুক। তা নিয়ে এ কৈফিয়তও দেব না যে, যারাই সংসারে বড় হয়, অন্তত বিষয়ের সংসারে, তারা কর আবওয়াব আদায় করে থাকেন। জোর করে যারা বাহুবলে রাজ্যজয় করে, অন্য দেশ লুঠ করে, তাদের কথা বাদ দিলাম সুলতা। কারণ তারা কারুর মতামতের ধার ধারে না। গ্রাহ্য করে না। কিন্তু যাঁরা তা না করেন, মানুষের প্রচলিত পথে বড় হন, তাঁরাও কিছুটা কর আদায় করেন। প্রভুত্ব অর্জন করলেই মানুষের আনুগত্যটা জমিদারি সেরেস্তার খাজনার উপর চাঁদার মতো লোককে দিতেই হয়। না দিলে যাঁর যেমন প্রভুত্ব তেমনি পেনালটি আদায় না করে ছাড়েন না। মন্ত্রীদের কথা ভাবো না। মানে স্বাধীনতার পরের মন্ত্রীদের কথা। এই তো স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত গুলি তো কয়েকবার চলল। লাঠিচার্জ তো বাদই দিচ্ছি। এবং এই পদ অর্জনের জন্য ভোট-ভোট করে পরস্পরের সমালোচনার নামে যে তত্ত্ব—সত্যি মিথ্যা প্রকাশ পেলে তাই থেকে বিচার করো না। দেখো না, কত স্থানে কত প্রতিশ্রুতি। কতরকম প্রতিশ্রুতি। কোন দল বললে সব জমিগুলো ওদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তাদের দেব। কেউ বললে—তোমাদের জীবন সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে দেব। তার উপর তোমরা সত্যিকারের স্বাধীন থাকবে। তারপর এগায়ে কুয়ো, ওগাঁয়ে ইস্কুল, ওগাঁয়ের রাস্তা—এসব খুচরো প্রতিশ্রুতি বা ঘুষ যাই বলো না কেন—দেওয়ার তো হিসেব নেই। এর ছেলের চাকরি, ওর এটা, তার সেটা এ-সবের ফিরিস্তি নাই তুললাম। সুতরাং এ ধরনের ব্যাপার চিরকাল আছে। ব্যাপারের ঢং পালটেছে। কিন্তু যাঁরা লোকনায়ক হলেন, তাঁদের অস্বীকার করব কি করে? কুড়ারাম ভট্টাচার্যকে তাই আমি অভিনন্দন জানিয়েছিলাম সেদিন।
কুড়ারাম ভট্টাচার্যের পাঁচালী আমাকে খুব বেশি আকর্ষণ করত না বা এত মূল্য তাকে দিতাম না সুলতা যদি আমি আর একটা বিচিত্র এবং নিষ্ঠুর তথ্য আবিষ্কার না করতাম। তাতে তুমি জড়ানো সুলতা। অন্ততঃ তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরঙ্গ বন্ধন হবার কথা—প্ৰতিশ্ৰুতি দিয়েছি একরকম—তার মাঝখানে এই তথ্যটা এসে দাঁড়িয়ে আমাকে শিউরে দিয়েছিল। আমি সেই তথ্যটার অন্তরালে সত্য কি তাই আবিষ্কার করতে পুরনো কাগজ হাঁটকে দেখেছি সারাদিন—সেই ধূলা সর্বাঙ্গে মেখে ভূত হয়ে সন্ধ্যায় স্নান করে বিবি মহলের ছত্রি-দেওয়া রেলিংঘেরা বারান্দায় বসে ভেবেছি।
সুলতা ভুরু কুঁচকে বিরক্তিভরেই বললে—কি বলছ পাগলের মত? আমার সঙ্গে কোথায় সম্পর্ক আবিষ্কার করলে?
—তোমার চারপুরুষের নাম জান সুলতা?
—কেন?
—বল! চারপুরুষ আগে তোমার পূর্বপুরুষের কারুর নাম ছিল ঠাকুরদাস পাল?
—ঠাকুরদাস! হ্যাঁ, ঠাকুরদাস ঘোষ।
—হ্যাঁ। তখন তিনি পাল ছিলেন। তাঁর ছেলে ছিল জগন্নাথ পাল। তিনিই ঘোষ হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে নরেশ ঘোষ কলকাতায় অ্যাডভোকেট হয়েছিলেন। তিনিই ব্রাহ্ম হন। তাঁর ছেলে তোমার বাবা আর সি ঘোষ, রমেশচন্দ্র ঘোষ ব্যারিস্টার।
অবাক হয়ে সুলতা তাকিয়ে রইল সুরেশ্বরের মুখের দিকে।
সুরেশ্বর বললে—ঠাকুরদাস ছিলেন আমার প্রপিতামহের বড়ভাইয়ের মত, ভক্তের মত। তাঁর বাড়ী ছিল কীর্তিহাট থেকে পনের-বিশ ক্রোশ দূরে, হুগলী জেলায়, গঙ্গার ধারে শ্যামনগরে। আমার প্রপিতামহের বিবাদ হয়েছিল তাঁর মামা বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে। বীরেশ্বর রায় দুর্দান্ত পুরুষ। সেই বিবাদে আমার প্রপিতামহকে ঠাকুরদাস পাল জীবন বিপন্ন করে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু তার জন্যে তাঁর প্রথম পক্ষের সংসার স্ত্রী-পুত্র সব পুড়ে মারা গিয়েছিল। আমার প্রপিতামহই আবার তাঁর বিবাহ দেন। সেই ঠাকুরদাস পাল, সুলতা, খুন হয়েছিলেন। কাগজ দেখতে দেখতে সন্দেহ হল—সে খুন করিয়েছিলেন আমার প্রপিতামহ। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়। শরীরের রক্ত যেন বিষ হয়ে গেল সুলতা। মাথার খেয়াল যাদের থাকে, মস্তিষ্কের উগ্রতা তাদের স্বাভাবিক। সেই উগ্রতা চিন্তায় চিন্তায় এমন উত্তপ্ত হল যে, আমি পাগলই হয়ে গেলাম। আমার এই উদ্ভট মন যাকে লোকে খেয়ালী বলে পাগল বলে, তার পাগলামি জাগল—আমি সুলতার পাশে দাঁড়াব কি বলে?
সুলতা স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।
ক্লক-ঘড়িতে ঢং-ঢং করে দশটা বেজে গেল। সুলতা বললে—বল। থামলে কেন?
* * *
সুরেশ্বর বললে–খুন তিনিই করিয়েছিলেন। আমার প্রপিতামহ, তোমার পূর্বপুরুষকে।
—কেন? জমিদারীর ব্যাপারে?
—সে সুদীর্ঘ কথা সুলতা। সেই তো কীর্তিহাটের কড়চা। সেই তো আমার জবানবন্দী। গোটা রায়বংশ তার সঙ্গে জড়ানো। জমিদারীর দায়ে তিনি খুন করাননি। জমিদার ছিলেন বলেই খুন করিয়েছিলেন। করাতে পেরেছিলেন। সংসারে বংশ গৌরব, জন্ম-গৌরবের মূল্য সব মানুষেরই আছে। অনেক বিদগ্ধ মানুষের কাছে শুনবে -পাঁচপুরুষ সাতপুরুষ আগে হয় পূর্বপুরুষ রাজা ছিল—নয় সিদ্ধপুরুষ ছিল, নয় কোন অবিস্মরণীয় মানুষ ছিল। কিন্তু এই বংশগৌরব যখন সম্পদের আর বিষয়ের সঙ্গে একসঙ্গে হয়, তখন সে হয় যত দীপ্ত তত উত্তপ্ত। দীপ্তি যখন কেউ ম্লান করে দিতে চায়, তখন তাকে উত্তাপ দিয়ে পুড়িয়ে মারে। সম্পদ যার না থাকে, তাদেরও এতে উন্মত্ত হবারই কথা। কিন্তু এখানে সম্পদবিষয়ও ছিল জড়ানো। বিষয়—মাতৃকুল পিতৃকুল, মাতামহপিতামহ, পিতা-মাতা, রত্নেশ্বর নিজে সকলে এতে জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু কলঙ্কই বল আর অগৌরবই বল, সবটাই ভ্রান্তিবশে একটি অকিঞ্চিৎকর সত্যকে গোপন করতে গিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন নিজেরাই! তাঁরা সত্যকে প্রকাশ করতে পারেননি, সেই সত্যকে প্রকাশ করে জবানবন্দী দিয়ে আমি মুক্ত হতে চাই।
হাসলে সুরেশ্বর। তারপর সে ঠান্ডা চায়ের কাপটা তুলে নিলে।
সুলতা বললে—ওটা জল হয়ে গেছে।
রেখে দিলে সুরেশ্বর
সুলতা ডাকলে—রঘু!
রঘু ঘরের দরজার ওপাশেই বোধহয় বসে বসে ঢুলছিল। এ অভ্যাস তার আছে। সুরেশ্বরের প্রতি তার মমতা আসক্তি—উদরানের দায়ে নয়—এর মধ্যে একটা নেশা আছে। খেয়ালী সুরেশ্বরকে মানুষ করে তার রূপ-গুণ-দোষ-ত্রুটি সবের নেশায় পড়েছে; সব থেকে বেশী সুরেশ্বরের খেয়ালীপনার অত্যাচারের নেশা। সে তাকে ছাড়তে পারে না। সুরেশ্বর ছবি আঁকে, সে দাঁড়িয়ে তুলি-রঙ এগিয়ে দেয়—ধরে-সুরেশ্বর বাজনা বাজায়, সে দরজার পাশে বসে শোনে। সুরেশ্বর মদ্য পান করে, সে উপকরণ তৈরী করে সন্ধ্যা থেকে। সুরেশ্বর রাত্রি জেগে বসে ভাবে, নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে বসে বসে ঘুমোয়, কিন্তু সামান্য শব্দে জেগে ওঠে।
রঘু এসে সামনে দাঁড়াল।
সুলতা বললে—একবার চা কর রঘু। তোমার লালবাবু চা খাননি, জুড়িয়ে গেছে।
রঘু বললে—চা খাবে এতো রাতে? উটা খাবে না?
—না।
সুলতা বললে—কি? ব্র্যান্ডি-হুইস্কি? আমি তো জানি তুমি খাও। তা খাও না?
—না সুলতা। আজ আমি এমন একটা কথাও বলতে চাইনে, যার উপর কোন মাদকের একবিন্দু প্রভাব পড়ে। চা নিয়ে আয় রঘু।
—তাই আন তাহলে। এক কাজ কর। বেশী করে তৈরি করে ফ্লাস্কে পুরে দাও। দরকার মত আমরা ঢেলে নেব। আর চল, আমি একটা ফোন করব।
সুলতা, রঘু চলে গেল। সুরেশ্বর এসে কাচের জানালায় দাঁড়াল রাস্তার দিকে চেয়ে। সামনে ফ্রিস্কুল স্ট্রীট।
রাস্তাটা নির্জন হয়ে এসেছে। মধ্যে মধ্যে রিকশা যাচ্ছে—আর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে দু-চার জন ফিরিঙ্গী এবং লুঙ্গীপরা মুসলমান। এ রাস্তাটায় এদের বাসই বেশী। রাণী রাসমণির শ্বশুর প্রীতিরাম মাঢ়ের কাছে জমি সংগ্রহ করেছিলেন কুড়ারাম ভট্টাচার্য। এক বিঘা জমি ব্রাহ্মণকে দিয়েছিলেন তাঁরা।
কুড়ারাম অর্থ উপার্জন করে জমিদারী কিনেও তাঁর বাল্যকালের অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। প্রথম জীবনটা গেছে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে। বাপের মৃত্যুর পর মায়ের হাত ধরে পথে পথে বেড়িয়েছেন ভিক্ষা করে। মা বেশী দিন বাঁচেননি। ঘর থেকে বেরিয়ে ছ’মাসের মধ্যেই আত্মহত্যা করেছিলেন। কাল হয়েছিল তাঁর রূপ। ভট্টাচার্য-বংশে রূপ আছে অনেকদিন থেকে। গৌরবর্ণ রঙ, ব্রাহ্মণপণ্ডিতি চেহারা। এটার অবশেষ কীর্তিহাটের বিশ-ত্রিশ ঘর ভট্টাচার্যের বাড়ীতে আজও আছে। কুড়ারামের মা রূপের সে প্রদীপশিখাকে আরও উস্কেই শুধু দেননি, সে প্রদীপে কিছু ঘৃতসিঞ্চনও করেছিলেন। তাঁর রূপ ছিল প্রতিমার মত।
হেরে পালালো—হিজলীর নবাবের সৈন্যরা ঘর জ্বালিয়ে লুঠে শিবরামকে হত্যা করে যেদিন রাত্রে, সে রাত্রে প্রথমেই ছেলের হাত ধরিয়ে স্ত্রীকে শিবরাম জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে ছিলেন কিছু ঘুষ দিয়ে ঘরটাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু তারা সব লুঠে ঘর জ্বালিয়ে তাঁকে হত্যা করে চলে গিয়েছিল। কুড়ারামের মা গ্রামে পরদিন ফিরে স্বামীর সৎকার করে আশ্রয়ের জন্য গ্রামের লোকের সঙ্গেই পথে বেরিয়েছিলেন—গোটা গ্রাম পুড়ে গেছে। সবাই নিরাশ্রয়। তার উপর বর্গীর ভয়। কিন্তু বর্গীরা এদিকে আসেনি, তারা চন্দ্রকোণা মেদিনীপুর দিগনপুর খিরপাই হয়ে চলে গিয়েছিল বর্ধমানের দিকে। পাঁচালীতে আছে—
“তবে কোন কোন গ্রাম বৰ্গী
দিল পুড়াইয়া।
সে সব গ্রামের নাম শুন
মন দিয়া।
চন্দ্রকোণা মেদিনীপুর আর দিগনপুর খিরপাই পোড়ায়ে যায় বর্ধমান শহর।”
.
লোকে ভাগীরথী পার হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল নানান স্থানে। হুগলী জেলায় গিয়ে উঠেছিলেন কুড়ারামের মা ছেলের হাত ধরে। কটা ছেলে মরে হয়েছিল কুড়ারাম—কয়েকটি সন্তানের জননী কুড়ারামের মা, কিন্তু রূপ তাঁর যথেষ্ট ছিল। ছেলেও রূপবান। তাঁদের দেখে মমতা করে আশ্রয় দিয়েছিলেন একটি বর্ধিষ্ণু ঘরের প্রবীণা মহিলা। রান্নার কাজ দিয়েছিলেন। কুড়ারামকে দিয়েছিলেন পূজার ফুল তোলার কাজ।
মাসছয়েক পর মা তার একদিন রাত্রে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন।
কুড়ারাম জানত—তার মাকে উত্ত্যক্ত করে তুলেছিল ওই বংশের একটি ছেলে। সে বুঝতে পারত। প্রথমটা নিরাপদেই ছিল ওই বৃদ্ধা গৃহিণীর কৃপায়। তিনি তাঁর মাকে আপনার ঘরে নিয়ে শুতেন। তিনি মারা গেলেন। তাঁর শ্রাদ্ধশান্তি চুকতেই একদিন রাত্রে মা চীৎকার করে উঠলেন। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘরের একটা দরজা খোলাই শুধু দেখেছিলেন—আর কিছু তিনি দেখেননি—মা উদ্ভ্রান্তের মত হাঁপাতে হাঁপাতে দরজাটায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। দরজাটার খিল ছিল না। তারপর তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সকালে দেখেছিলেন তাঁর মা ঘরে নেই। বাইরে অনেক গোলমাল। ওই বাড়ীরই খিড়কির পাড়ের একটা গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে মা ঝুলছেন। কুড়ারাম মায়ের সংকারও করেনি। ভয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল।
তারপর ভিক্ষা করতেন। রাত্রে কোন গ্রামে কারুর দাওয়ায় কিংবা গাছতলায় খুঁজে নিতেন আশ্রয়। একান্ত অনাহুতের মত। এরই মধ্যে আবার একটা আশ্রয় তাঁর মিলল। সেও তাঁর রূপের জন্য। তিনি এসে পড়েছিলেন হুগলী শহরে।
তখন মস্ত শহর হুগলী। হুগলীতে নবাবের ফৌজদার থাকেন। রাজা তখনও হননি—বাবু নন্দকুমার তখন হুগলীর ফৌজদার। হুগলীতে তখন ইংরেজদের কুঠী। তখন সুতানুটিতে তারা নতুন শহর পত্তন করে কুঠী তৈরি করে কলকাতা নাম দিয়েছে বটে, কিন্তু হুগলীর তখনও খুব জমজমাট। পাশেই চুঁচড়োতে ওলন্দাজদের কুঠী ও আড্ডা। চন্দননগরে ফরাসীরা রয়েছে। দিনেমাররা শ্রীরামপুরে। এর সঙ্গে আরমানী মুসলমান ব্যবসাদাররা আছে। এ এক নতুন রাজ্যে এসে পড়েছিলেন কুড়ারাম। ব্রাহ্মণের ছেলে, ছেলেমানুষ, একটা ভয় তাঁর ছিল। এই ম্লেচ্ছের শহরে এসে কোথায় জাত চলে যাবে। সেই ভয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন দেবস্থলে। চুঁচড়োর ষাঁড়েশ্বরতলায়। এই রূপবান খুদে বামুনের ছেলেটিকে যাত্রীরা সমাদর করত। মেয়েরা বামুন ধরে খাওয়াতো, কিছু দক্ষিণে দিত। ওখানেই কিছু মন্ত্রতন্ত্র শিখেছিলেন। সেই শেখার দায়ে লেখাপড়াও, কিছুটা বাংলা, কিছু মুখস্ত করে সংস্কৃত পড়ে এই জীবনের গোড়াপত্তন করে নিয়েছিলেন।
সময়টা তখন কিন্তু মানুষের সুখেশান্তিতে বাঁচার পক্ষে নিরাপদ ছিল না। বর্গী গিয়েছে। কিন্তু তারপর থেকেই এই সব সাহেবান লোক, এই শান্ত নিরীহ দেশের বুকে নিদারুণ দাপাদাপি শুরু করলে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। নবাবের সঙ্গে ঝগড়া এসব লাগিয়েই রাখলে। আজ ফরাসীর সঙ্গে ইংরেজের ঝগড়া হয়, ইংরেজরা চন্দননগরে গিয়ে কামান দাগে, কাল ফরাসীরা হামলা করে।
এরই মধ্যে খবর রটল—নবাব আলিবর্দী খাঁর ইন্তেকাল হয়েছে, তাঁর নাতি সিরাজুদ্দৌলা নবাব হয়েছেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজদের ওপর চটা। ফরাসীদের সঙ্গে আঁতাত বেশী। সুতরাং হুগলী অঞ্চলের অনেক লোক মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল। তখন কুড়ারাম ভট্টাচার্যের বয়স পনের-ষোল। তিনি ঠাকুরের স্থান ছাড়েননি বটে কিন্তু এ এলাকা ছাড়িয়ে অন্য এলাকাতে আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। এদেশে তখন অনেক ছোটখাটো বিদেশী ব্যবসাদার ব্যবসা করে যারা লিখতে পড়তে জানে না। এদের মধ্যে মুসলমান বেশী। আফগানিস্থান, পারস্য, আরব দেশ থেকে এদেশে এসে কাঁধে করে মাল বয়ে ব্যবসা শুরু করে; খাতা একটা রাখে, তাতে ধারে মাল যাদের দেয়, তাদের নাম লিখিয়ে নেয় অন্যকে দিয়ে। এবং এ থেকেই তারা কেউ কেউ হয়েছে ইতিহাস বিখ্যাত মীরহাবিবের মত রাজনীতি ক্ষেত্রের ধুরন্ধর। ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় গদী ফেঁদে বসে ধনী হয়েছে এমন লোকও অনেক আছে। বাংলাদেশে কাবুলীরা এখনও আছে। সুরেশ্বর যখন কীর্তিহাটে প্রথম যায় পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে, তখন কাবুলীওয়ালাদের টাকা আদায়ের সময়। সে তাদের লাঠি এবং খাতা হাতে ঘুরতে দেখেছে। সে-খাতা বাংলায় লেখা।
সে আমলে এ ধরনের ব্যবসাদার ছিল প্রচুর। এই কুড়ারাম ভট্টাচার্য তাদের খাতা লিখে দিতেন। এই কর্মযোগেই তিনি চেষ্টা করে পারসী লিখতে-পড়তে শিখেছিলেন।
কুড়ারামের রূপ শুধু দেহেই ছিল না তাঁর হাতের লেখাতেও রূপ ছিল। লেখা ছিল গোটা গোটা ছাপার হরফের মত। ফলে দেবমন্দিরের যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্যের দান ও দক্ষিণার এলাকা ছেড়ে সামনে এই শহরগঞ্জের মুনাফার প্রশস্ত ক্ষেত্র তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডেকে অনায়াস প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। তিনি ধনী মুসলমান ব্যবসায়ীর গদীতে মুন্সী নিযুক্ত হয়েছিলেন মাসিক পাঁচ সিকা তঙ্কা বেতনে। এখানে তিনি পাকা হিসাবনবীশ হয়ে ওঠেন। তখনও বয়স বিশ হয়নি। সেই সময়ে খবর রটল নবাব সিরাজুদ্দৌলা কলকাতা দখল করে কেল্লা উড়িয়ে দিয়েছেন। ইংরেজরা পালিয়েছে ফলতার ওদিকে। হুগলীতেও কি হয় কি হয় অবস্থা। বহুজন কারবার বন্ধ করে পালাচ্ছে। হাঙ্গামা মিটলে আসবে, খুলবে।
কুড়ারামও সরে এসেছিলেন হুগলী থেকে। গঙ্গার স্রোত এবং বাদশাহী সড়ক এই দুটো পথ থেকে যে যতদূর যেতে পারে, সে তত নিরাপদ। লোকে তাই পালাচ্ছিল। কুড়ারামও হুগলী থেকে সরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারকেশ্বরে। আবার ধরেছিলেন দেবতাকে। এখানে থাকতেই খবর পেয়েছিলেন, পলাশীতে নবাবের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানীর লড়াই হয়ে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে গেছে। নবাব সিরাজুদ্দৌলা হেরেছেন। শুধু তাই নয়, হেরে তিনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর বেগমকে নিয়ে কিন্তু ভগবানগোলা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এনে, নতুন নবাব সিরাজুদ্দৌলার সিপাহসালার মীরজাফর আলী খাঁয়ের ছেলে মীরন তাঁকে খুন করিয়েছে। সুতরাং এখন মোটামুটি আর লড়াইটড়াই হবে না। এবং ইংরেজ কোম্পানীরই এখন পাশার দানের পোওয়া বারো। যে যেখানকার সে সেখানে ফিরল। হুগলীতে বরং বেশী লোক ফিরল। কিন্তু কুড়ারাম ফিরলেন না। তখন তাঁর জীবনে যৌবনের নেশা লেগেছে। তিনি তারকেশ্বর মন্দিরে পূজক-পুরোহিতদের আশ্রয়েই ছিলেন। পুজোয় সাহায্য করতেন। লোকরঞ্জনে ক্ষমতা ছিল। উপার্জন বলতে গেলে সামান্য। কিন্তু ওই তারকেশ্বরে আসত এক সম্পন্ন ঘরের কিশোরী কন্যা। তার মানত ছিল। আসত সে সপ্তাহে দু’দিন করে। রূপবতী কিশোরী। কোষ্ঠীতে আছে চৌদ্দ বছরে বৈধব্যযোগ। এইজন্যই তারকেশ্বরে নিয়মিত অর্চনার সংকল্প ব্রতের মতো পালন করে। প্রাচীন জমিদার বংশ। কিন্তু সম্পদ এখন যাবার পালা। তাতেও অবশ্য কম কিছু নেই। বাড়ীতে হাতী আছে। পাল্কি আছে। চাকরানভোগী বেহারা আছে। ঘোড়া তো আছেই। ও অঞ্চলে নামডাক যথেষ্ট। লোকে রাজাই বলত। তাঁর ওই একটি কন্যা। কুড়ারাম এই কন্যার রূপে মুগ্ধ হলেন এবং নিজের রূপ এবং ব্রাহ্মণবংশের বৈশিষ্ট্য-গৌরবে মনেও করলেন না যে, ব্রাহ্মণ-পুত্র হলেও তিনি রাখাল এবং সে রাজকন্যা।
মেয়েটিও মুগ্ধ হয়েছিল।
পাঁচালীতে তাই বলেছেন কুড়ারাম।
দুরু দুরু কম্পে বুক হস্ত কম্পে শুষ্ক মুখ
বাক্যবদ্ধ হইনু মুক আশীর্বাদী দিতে
মিটি মিটি কন্যা হাসে কপট রোষের ভাসে
বোবা ঠাকুরের পাশে পুষ্প নারি নিতে।
চোখের পলক ঠারি জানাইয়া দেয় কুমারী
মন সমর্পণ করি দিয়াছি তোমাকে।
আমি পাগল হইলাম তারকেশ্বরে ধেয়াইলাম
পূর্ণ কর মনস্কাম পাওয়াও কন্যাকে।
কিন্তু তারকেশ্বর সে মনস্কামনা পূর্ণ করেননি। বরং কপালে লিখেছিলেন লাঞ্ছনা। মাস চারেক মধ্যে কথাটা প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে আসতেন বৃদ্ধা ঠাকুমা, দাসী, পাইক, গোমস্তা। ঠাকুমাই নাতনীকে নিয়ে পুজার্চনা করাতেন, দাসীও থাকত অবশ্য একটু দূরে। ক্রমে ক্রমে ইসারা-ইঙ্গিত থেকে কথাবার্তাও হয়েছিল। বুড়ি ঠাকুমা এই রূপবান যুবককে দেখে ভুলেওছিলেন। তাঁর ক্রমে ক্রমে ধারণা হচ্ছিল—বাবা তারকনাথই এই কুড়ারামের ছদ্মবেশে বা কুড়ারাম হয়ে জন্মে তাঁর নাতনীর বর হতে এসেছেন। পাঁচালীতে তার বর্ণনা আছে।
ইসারা-ইঙ্গিত হইতে হাতে হাতে ছুঁতে ছুঁতে
দোঁহে যায় মজি দুহুতে ঠাকুমাও বোঝে।
এই ঠাকুমাই বলেছিলেন ছেলেকে দেখ, এই ছেলেই বুঝি বর। এরই সঙ্গে বিয়ে দে। একেবারে সাক্ষাৎ শিব রে, সাক্ষাৎ শিব!
কিন্তু ছেলে তাতে তুষ্ট তো হন-ই নি—রুষ্ট হয়েছিলেন প্রচণ্ডভাবে। একটা পুজুরী বামুন—ওই পাণ্ডাশ্রেণীরও চাকর, সে হবে তাঁর জামাতা! তিনি মুখে কিছু বলেননি মাকে। কিন্তু কন্যা ও মায়ের পরের আসবার নির্দিষ্ট দিনের আগেই হাতী চড়ে এসেছিলেন এবং মোহান্তের সঙ্গে কথা বলে গিয়েছিলেন। মোহান্ত তারকেশ্বরের মোহান্ত, তিনি কুড়ারামকে ডেকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে অপমান ও লাঞ্ছনার শেষ রাখেন নি। দেবতার পূজা সেবা করতে গিয়ে যাত্রী কুমারী কন্যার উপর পাপদৃষ্টি দাও তুমি পাষণ্ড! তুম বদমাস শয়তান, পাপী হো। তারপর হুকুম দিয়েছিলেন—সেইদিনই সূর্যাস্তের পূর্বে সে যেন তারকেশ্বর ছেড়ে চলে যায়। না গেলে দুনিয়াতে সে আর থাকবে না। তাতেই ক্ষান্ত হননি; পাইক সঙ্গে দিয়ে হুগলী পর্যন্ত তাঁকে তাড়িয়ে রেখে আসবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
হুগলী এসে তিনি কয়েকদিন মুহ্যমান হয়ে পড়ে আবার মহোদ্যাম নিয়ে অর্থোপার্জনের জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন। টাকা রোজগার করে বড়লোক হয়ে ওই কন্যাকে তিনি বিবাহ করবেন। ব্যবসা তিনি পারবেন না তা জানতেন। তিনি চেয়েছিলেন চাকরী। এমন চাকরী যাতে মাইনেটা কিছু নয়, তার থেকে অনেক বেশী পাওয়া যায় ঘুষ। ঘুষকে তখন ঘুষ বলত না। স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র নাম ছিল। পাইকের উপরি-তলবানা। গোমস্তার উপরি-তহুরী। নায়েবের নায়েব সেলামী। আমলাদের—পার্বণী। দালালের-দালালীর উপরেও দস্তুরী। সাহেবেরভেট। ডালি। কুড়ারাম বেছে বেছে জমিদারী সেরেস্তা পছন্দ করেছিলেন এবার এবং এসে উঠেছিলেন প্রাচীন উত্তররাঢ়ী কায়স্থ জমিদারী বাড়ী বাঁশবেড়ের কাছে। দাতার বংশ—নিত্য প্রভাতে উঠে ব্রাহ্মণকে নিষ্কর দিতেন কিছু। বাঁশবেড়ে জমিদারদের রাজা খেতাব আজও লোকসমাজে বহাল আছে। সকালে রাজার কাছে দর্শনপ্রার্থী হলে রাজা বলেছিলেন তাই তো ঠাকুর, সাক্ষাৎ দেবতার মত তোমার রূপ, তা বিলম্বে এলে! এক্ষুনি যে নিয়মমতো দান একজন নিয়ে গেল বাবা। তুমি কাল এস।
কুড়ারাম বলেছিলেন—হুজুরের কাছে নিষ্কর দানপ্রার্থী হয়ে আসিনি আমি। আমি একটি কর্মপ্রার্থী হয়ে এসেছি।
—কর্ম? তা দেবকর্ম লোকজন তো যথাযথ রয়েছে এখন। তা—
হাতজোড় করে কুড়ারাম বলেছিল-দেবকর্ম আমি জানি হুজুর। কিন্তু তার প্রার্থনায় আসিনি ঠিক। এসেছি হুজুরের সেরেস্তাখানায় কোন কর্মের জন্য। আমি পার্সী জানি, বাংলা জানি, হিসাবনিকাশ রাখতে পারি।
—বল কি! কই তোমার হস্তাক্ষর দেখি!
হাতের লেখা দেখে খুব খুশী হয়ে কাজ দিয়েছিলেন তিনি। এখানে বছরখানেক কাজ করে পাকা জমিদারী সেরেস্তার পাটোয়ার হয়ে উঠেছিলেন। আমিনের কাজ তাও শিখেছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে খবর তিনি পেয়েছিলেন যে, সেই কন্যার বিবাহ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। শুনে প্রথম ভেবেছিলেন, কাজকর্ম ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন। কিন্তু কয়েকদিন পর মদ্যপানে দীক্ষা নিয়ে এই বিরহ ভুলেছিলেন। পাঁচালীতে লিখেছেন—
ভুলিতে বিরহ জ্বালা লইনু জপের মালা
ভরিয়া নারিকেল মালা খাইনু কারণ
পাইনু সান্ত্বনা তাতে জননী চরণ প্রসাদে
কর্ম করি সাথে সাথে হয় উপার্জন।
.
সুরেশ্বর হাসলে। এই ধরনের শক্ত বস্তুনিষ্ঠ মানুষ না হলে কুড়ারাম ভটচায বাংলার জমিদারী বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে অজ্ঞাতনামা কীর্তিমান ব্যক্তি হতে পারতেন না। রায়বংশ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না। তবে তাঁর এই পথে কঠিন পরিশ্রমে দৃঢ়পদে অগ্রসর হওয়ার কারণটা বোধ হয় ছিল এই কন্যাটির পিতৃবংশের সর্বনাশ। সেটা তিনি সচেতন মনে জানতেন না বোধ হয় তবে অচেতন মনের গভীরে ছিল এই বাসনা। না হলে তিন বছর পর যখন খবর রটল নবাব জাফর আলীকে নবাবী গন্দী থেকে নামিয়ে কোম্পানী তাঁর জামাই মীর মহম্মদ কাসেম খাঁকে তক্তে বসাচ্ছেন এবং কাসেম খাঁ খুব কাজের লোক তখন বাঁশবেড়ের চাকরী ছেড়ে তিনি মুরশিদাবাদ রওনা দিতেন না। বাঁশবেড়ের কর্তাই তাঁকে সুপারিশপত্র লিখে দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন কান্দীর উত্তররাঢ়ী কায়স্থবংশের সন্তান নবাব সরকারের কানুনগো (তখন নাম ছিল বঙ্গাধিপ) প্রাণগোবিন্দ সিংহের কাছে। কুড়ারামের হাতে তখন পাঁচ হাজার টাকা জমেছে। তখনকার দিন, পথ নিরাপদ ছিল না। তারপর নবাব বদলের কাল। কুড়ারাম হুগলীতে গিয়ে কোম্পানীর কুঠীতে টাকাটা জমা দিয়ে বরাত নিয়েছিলেন কাসিমবাজারের কুঠীর উপর।
মুরশিদাবাদে এসে পড়েছিলেন মরসুমের সময়। নবাব কাসেম আলী খাঁ তখন শ্বশুর মীরজাফরের আমলের যত বিশ্বস্ত কর্মচারী তাদের প্রত্যেককে হিসাবনিকাশের দায়ে ফেলে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন। জাফর আলীর রাজস্ব বিভাগের কর্তা ছিলেন কিনুরাম এবং মণিলাল। তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষান্ত হলেন না, তাদের প্রাণদণ্ড দিলেন। ছ বহন হরকরা জাফর আলীর পেয়ারের হরকরা ছিল। তারও দশা হল তাই। এমন কি হারেমের দাসীবাদীরাও দায়ে পড়ল। রাত্রে কান্না শোনা যেত। তামাম অবস্থাপন্ন কর্মচারীর তখন হিসাব হচ্ছে, সুমার হচ্ছে পরগনাওয়ারি। নতুন বিচক্ষণ পাটোয়ারের প্রয়োজন হয়েছে নবাব সরকারে। প্রাণগোবিন্দ সিংহের। নির্দেশমত নবাবের প্রিয়পাত্র মুৎসুদ্দিনের প্রধান আলী ইব্রাহিম খাঁর বিশ্বাসভাজন মুন্সীর হাতে। এক হাজার টাকা নজরানা দিয়ে কানুনগোদের অধীনে কর্ম পেলেন কুড়ারাম। পেলেন প্রাণগোবিন্দ সিংহের অধীনে নয়, তাঁর ভাই কানুনগো গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের অধীনে।
শুধু কর্মই পান নি। জীবনে প্রথম সঙ্গিনীও জুটে গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যার পর কানুনগো গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ যাচ্ছিলেন কান্দী মোকাম। খাগড়া ঘাটে গঙ্গা পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠবেন পাল্কিতে। পাল্কিবেহারা সিপাহী পাইক সেখানে হাজির থাকবে। গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত তিনি সিংহজীকে নৌকায় তুলে দিতে গিয়েছিলেন। ফিরবার পথে তখন রাত্রি প্রায় এক প্রহর। লালবাগ মুরশিদাবাদের পর বাকী সবই তখন পল্লীগ্রাম। অন্ধকার পথ। গঙ্গার ধারে সিদ্ধির জঙ্গল। বড় বড় আমবাগান। পথের দুধারেও জঙ্গল। তিনি সন্তর্পণে আসছিলেন একলাই। জীবনের প্রথম থেকে পথে পথে ঘুরে গাছতলায় রাত্রি কাটিয়েছেন তিনি; দুঃসাহস তাঁকে যেন আশ্রয় করেছিল ভাগ্যফল হিসাবে। হাতে ছিল এক গাছি গুপ্তি লাঠি। লাঠি হিসাবেও মজবুত। একেবারে ডগায় পরানো ছিল লোহার বোলো। হঠাৎ এক সময় কে যেন ছায়ামূর্তির মত ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসে একেবারে তাঁর উপরেই আছড়ে পড়েছিল। ধাক্কাটা আচম্বিতে অতর্কিতে। পাশের একটা বাগান থেকে বেরিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ওপরের জঙ্গলে ঢুকবার মতলব ছিল তার। কিন্তু কুড়ারামের উপর আছড়ে পড়ল। কুড়ারাম পড়ে গেলেন, সে ও পড়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য হলেন কুড়ারাম, যার ধাক্কা খেয়েছেন সে অত্যন্ত হাল্কা মানুষ, হাল্কাও বটে কোমলও বটে, হয় বালক, না হয় স্ত্রীলোক। আঘাত তিনি পাননি, পড়েই গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে তিনি তাঁর গুপ্তিটা কুড়িয়ে নিয়ে ডান হাতের মুঠোয় ধরে বললেন—কৌন হো তুম?
উত্তর পান নি। দেহটা প্রায় নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। তখন হেঁট হয়ে তার গায়ে মুখে হাত বুলিয়ে বুঝেছিলেন সে স্ত্রীলোক। গন্ধেও বুঝেছিলেন। চুলের গন্ধ পেয়েছিলেন। আবার নেড়ে দেখেছিলেন তার মুখ, নাকের কাছে হাত দিয়েছিলেন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে কিনা দেখবার জন্য। শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছিল। তার সঙ্গে হাতে ঠেকেছিল বেসর। নাকের বেসর। মুসলমানী?
এবার পোশাক নেড়ে দেখছিলেন। হ্যাঁ, গায়ে কাঁচুলি ওড়না রয়েছে। কি করবেন ভেবে পাননি। ফেলে চলে যাবেন? যাওয়াই উচিত ছিল কিন্তু দুঃসাহসী নব-যুবক কুড়ারাম এই রাত্রে নির্জনে এমন একটি বিচিত্র রোমান্স ত্যাগ করে যেতে পারেন নি। তাকে ধরে তুলতে গিয়েছিলেন। ততক্ষণে সে কাতরে বলে উঠেছিল—ছোড় দো মুঝে ছোড় দো। খোদা কসম কুছ নেহি মেরি পাস।
কুড়ারাম বলেছিলেন—লেঃ বাবাঃ! যা ভেবেছি। প্যাজ রসুনের গন্ধ বাবা! উঃ! সঙ্গে সঙ্গে সে বলেছিল খাঁটি বাংলায়-তোমার পায়ে পড়ি। তোমার পায়ে পড়ি। কুড়ারামের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। বলেছিলেন-কে তুমি?
—তুমি কে?
—একজন রাহী।
—নবাবের লোক নও? সিপাহী নও?
—চাকরী করি নবাব সেরেস্তায়, সিপাহী নই। তুমি কে?
—নবারমহলের বাঁদী। বুড়ো নবাবের ছেলে মীরন আলীর বাঁদী। হিন্দু বামুনের মেয়ে ছিলাম, আমাকে ধরে এনেছিল। নবাবজাদা মরে গেল, বাঁদীদের কতক দিয়ে দিয়েছিল একে-ওকে, আমি মণিবেগমের কাছে ছিলাম। নতুন নবাব সব বাঁদীদের খোজা দিয়ে মারপিট করাচ্ছে, ছেঁকা দিচ্ছে, বলছে—নবাবী টাকা জহরত কার কাছে কি আছে নিকাল। যা ছিল দিয়েছি। তবু রেহাই নেই। একটা হীরের আংটি ছিল সেটা ঘুষ দিয়ে আমি পালিয়েছি। পালাব আমি। আমাকে ছেড়ে দাও। কিছু নেই আমার।
.
সুরেশ্বরের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। একটা মানুষের ব্যস্তত্রস্ত উচ্চ পদক্ষেপের শব্দে। জুতো পায়ে দেওয়া বিংশ শতাব্দীর মানুষ। ছুটে চলেছে।
কর্পোরেশন স্ট্রীট থেকে মোড় ফিরে একটা লোক ছুটে পালাচ্ছে। তার পিছনে তিনজন যেন তাকে ধরবার জন্যই ছুটছে। হয়তো একটু পরই শোনা যাবে কোলাহল। কেউ কাউকে ছুরি মেরেছে অথবা দুজনেই দুজনকে মেরেছে। ফ্রী স্কুল স্ট্রীট এখান থেকে খানিকটা দক্ষিণে গিয়েই। এখনও সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ—যখন ইংরেজের জীবন উদ্দাম হয়ে উঠে ফিরিঙ্গী সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল—সেই সভ্যতার রাজ্য বা সাম্রাজ্য। তার সঙ্গে আছে মুসলমান আমলের ওই কালের জের যে-কালে কুড়ারাম ভটচাজ ওই মেয়েটিকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।
মেয়েটিকে কুড়ারাম ছেড়ে দেন নি। ঘরে এনেছিলেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন। মীরজাফরের ছেলে মীরন বজ্রাঘাতে মারা গেছে তখন—বছর খানেক আগে। লোকে বলছে ঢাকায় পথে নৌকোতে নির্বাসনে যাচ্ছিলেন সিরাজজননী আমিনা বেগম আর সিরাজের প্রধান শত্রু তাঁর মাসী ঘেসেটি বেগম। ঘেসেটি বেগম বলতে গেলে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জাফর আলি খাঁয়ের চেয়েও বড় ছিলেন। এঁর চরিত্র নিয়ে কুৎসিত কথা এবং গল্পের আর অন্ত নেই। তবুও তো নারী। আলিবর্দীর কন্যা। ঢাকায় পাঠানো হচ্ছিল যেন আর কোন গণ্ডগোল না হয়। মীরন ছিল প্রধান উদ্যোগী। কিন্তু তার আসল মতলব ছিল অন্য। সিরাজের বেগম যারা ছিল তাদের এক লুৎফুন্নিসা বেগম আর উমদৎউন্নিসা বেগম ছাড়া বাকীদের সব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়েছিল মীরন আমির-ওমরাহদের মধ্যে। ক্লাইভ সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরাও নাকি সব থেকে খুবসুরতি যারা তাদের বেছে নিয়েছে। কিন্তু এই কয় বেগমকে নিয়ে ছিল সমস্যা। লোকের ভয়ে লুৎফুন্নিসা আর উমদকে বিলি করতে পারে নি বা নিজেও নিতে পারে নি মীরন। লুৎফুন্নিসাকে নাকি বলা হয়েছিল কাকে পছন্দ কর তুমি বল!
লুৎফুন্নিসা বলেছিল—হায় মেরী নসীব। হায় সরম কি বাত্!
—কেন?
—কেন? হাতীর উপর যার চড়া অভ্যেস বা হাতীতে যে চড়েছে তাকে কতকগুলো গিধ্ধড় দেখিয়ে বলছে—বল কোন্ গিধ্ধড় তোমার পসন্দ!
উমদৎউন্নিসা ছিল সিরাজের বিয়ে করা বেগম। তাকে কিছু বলতে সাহসই করে নি। কিন্তু যতদিন আমিনা ঘেসেটি বেঁচে আছে ততদিন বিপদ কাটবে না। নবাব আলিবর্দী খাঁর বেটী যদি কোন রকমে বেরিয়ে একটা আশ্রয় পায় এবং সিপাহীদের সামনে দাঁড়ায় তো কি হবে কেউ বলতে পারে না। মীরন তাদের ঢাকা পাঠাবার নাম করে নৌকোয় চড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পদ্মার বুকে নৌকোটা ডুবিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিল। কেউ জানবে না কেউ দেখবে না, পদ্মার বুকের উপর কোন সাক্ষী থাকবে না। তাই ডুবিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমিনা ঘেসেটির নৌকো যখন ডুবছে তখন তার উপর দাঁড়িয়ে উপরের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে বলেছিল—আরে বেইমান, বিজলী গিরে রে তেরা শিরপর, বিজলী গিরে রে মীরন, তেরা শিরপর বিজলী গিরে। তারপর ডেকেছিল আল্লাহতায়লাকে। ডাকতে ডাকতেই ডুবেছিল নৌকো। এবং এই চিৎকারঅভিশাপ গঙ্গার ধারের অনেক লোক শুনেছিল, তাই আর গোপন থাকেনি। মিথ্যে হয়নি বেগমদের অভিশাপ। সুরেশ্বর জানে এটা কাকতালীয়। অভিশাপ ফলে না। কিন্তু মীরন মরেছিল বজ্রাঘাতে। কুড়ারাম ভট্টাচার্য সে কালের লোক, তিনি অভিশাপ মানতেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন এতে।
“বেগমদের অভিশাপে মীরন মরে বজ্রাঘাতে সাতটি ছিদ্র ছিল মাথে দেখেছে সকলে।”
পূর্ণিয়ায় বিদ্রোহ দমন করতে যাচ্ছিলেন মীরন শাহজাদা। সঙ্গে কোম্পানীর পল্টনকাপ্তেন। মীরনের সঙ্গে বাঈ ছিল, হাত-পা টেপার খানসামা, কাহিনী বলার লোক—এরাও ছিল সেদিন তাঁবুতে। আকাশে মেঘ উঠতেই মীরন ভয় পেয়ে আসর মজলিস সব ফেলে বড় তাঁবু ছেড়ে ছোট্ট একটা তাঁবুর মধ্যে এসে ঢুকেছিল, যেমনভাবে লোকে চোরকুঠীতে লুকোয়। কিন্তু হঠাৎ আকাশ ঝলসে উঠল বিদ্যুতে-কড় কড় কড়াৎ শব্দে চারিদিকটা থরথর করে কাঁপিয়ে ডেকে উঠল মেঘ। বাজ পড়ল মীরনের সেই ছোট তাঁবুতেই। তার মাথায় সাতটা ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল, মুখখানা ঝলসে গিয়েছিল। সেই সঙ্গেই ছিল এই মেয়ে। অন্য তাঁবুতে। নাম ছিল ফয়জান ফয়জান তখন মাসছয়েক এসেছে। গঙ্গার ঘাটে স্নানে এসেছিল, মীরন নৌকো থেকে হুকুম দিয়েছিল—লে আও উয়ো ছোকরীকে। সিপাহীরা তুলে এনেছিল। ব্রাহ্মণের ঘরের বালবিধবা মেয়ে, সুন্দরী মেয়ে। সত্যকার সুন্দরী মেয়ে। মীরনের সঙ্গে বাঈজী বেগম চাকর নফর এরা ফিরল মুরশিদাবাদ। মীরন শাহজাদা হেরে গিয়ে মরে নি, তাহলে তার তাঁবুর হীরা-জহরত টাকা লুটের সঙ্গে এরাও লুট হত। কিন্তু মীরন তখন শাহজাদা মীরন। বাপ জাফর আলি মুরশিদাবাদের তক্তে বসে আছেন। সুতরাং খুব ইজ্জত সম্ভ্রমের সঙ্গেই মীরনের তাঁবুর সব এসে ঢুকেছিল মুরশিদাবাদ হারেমে।
মণিবেগম এককালে সিরাজের বিয়ের সময় বাঈজী হিসেবে নাচতে এসেছিল। সে আর ব্বু। দুই বাঈজীকেই নিকা করে ঘরে ঢুকিয়েছিলেন জাফর আলী খাঁ। মণিবেগম হয়ে উঠেছিল প্রধান বেগম। মণিবেগম রূপসী মেয়েটাকে দেখে নিজে নিয়েছিলেন বাঁদী করে। হয় জাফর আলী খাঁর হাত বাড়ানো বন্ধ করতে কিংবা হয়তো জাফর আলীর নজর তাঁর দিক থেকে সরে অন্যদিকে ফিরতে চেষ্টা করলে এই মেয়েটাকে দিয়ে সেই নজর বন্ধ করতে। কোনটা ঠিক জানতেন এক মণিবেগম।
.
মেয়েটাকে ঘরে এনে তুলেছিলেন কুড়ারাম। রূপ সম্বন্ধে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। বেশ একটু বিশদ বর্ণনা। এ যুগেও রীতিমত অশ্লীল। কাজী নজরুলের বসন্ত কবিতাটি নিয়ে এ যুগের একজন বিশিষ্ট মহিলা সাহিত্যিক নিষ্ঠুর কথা বলেছিলেন। সে কবিতা এর কাছে কিছুই নয় সেদিক দিয়ে।
ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর জাতের। ভারতচন্দ্রের কাব্যগুণ এতে নেই। তারপর কুড়ারাম মেয়েটাকে বলেছিলেন—দেখ, মুসলমান থাকতে তোকে ঘরে ঠাঁই দিতে পারব না। বাজারে বাঈজী হলে সেখানে তুই আমার কথা ভুলবি। আর নবাবের নজর ফের পড়বে। তখন আবার পাকড়াও হবি। তা হলে কি করি বল তো!
মেয়েটা কি বলবে? সে বলেছিল—তুমি যা বলবে।
সেও মুগ্ধ হয়েছিল কুড়ারামকে দেখে তাতে সন্দেহ নেই। কুড়ারাম একটু ভেবে নিয়ে বলেছিল-পথ আছে। হয়েছে।
—কোন পথ?
—তার আগে বল—পিঁয়াজ রসুন গোস্ত ছাড়া ভাত রুচবে তো তোর?
মেয়েটা বলেছিল-আমি তো হিন্দু ঘরের বিধবা। তাই তো খেতাম।
কুড়ারাম বলেছিলেন—সেইজন্যেই তো বলছি। হিন্দু বিধবা একবার ও সব খেতে ধরলে ছাড়তে পারে না। মুসলমানীর চেয়ে বেশী খায়।
মেয়েটা বলেছিল, পারব। তুমি দেখ।
কুড়ারাম বলেছিল—তাহলে তোকে বোষ্টোমী হতে হবে। মহাপ্রভুর ধর্ম, ওতে বাধা নেই। চল তোকে জিয়াগঞ্জের হরিদাস বাবাজীর কাছে নিয়ে গিয়ে ভেক দিয়ে নিয়ে আসি। ভাল হবে। ফোঁটা তিলক কাটলে চুড়ো করে চুল বাঁধলে কার সাধ্যি ধরবে তুই নবাব হারেমে বেগম সাহেবের বাঁদী ছিলি। তোর নাম ছিল ফয়জান!
কথা হচ্ছিল কুড়ারামের বাড়ীতে বসে। কুড়ারাম হিসাবের দিক থেকে অত্যন্ত পাকা এবং সেদিকে বুদ্ধিবিচার তীক্ষ্ণ ছিল। নিজে লিখেছেন—
যাহা করি রোজগার তিন ভাগ করি তার
এক ভাগে ব্যয়ভার নিজের পেটের
এক ভাগ পুঁতে রাখি পিত্তলের ঘটি ঢাকি
অন্য ভাগ লগ্নী রাখি বিশ্বাসী শেঠের।
হিসাবী লোকটি মুরশিদাবাদে পাঁচ হাজার টাকার বরাত হুণ্ডী নিয়ে এসে টাকা ভাঙিয়ে হাজার টাকা নজরানা দিয়েছিলেন চাকরীর জন্য। বাকী চার হাজারের কিছু টাকা হাতে রেখে একটা সামান্য বাড়ি কিনেছিলেন খাগড়ার প্রান্তে। নবাবী শহরের ধার ঘেঁষে। সামান্য দু কুঠুরী দালান। নবাবের কাছে যারা সাজা পেয়েছিল পূর্বতন নবাব-প্রীতির জন্য তাদেরই একজনের বাড়ী। বাকী টাকাটা ওই বাড়ীর মেঝেতেই পুঁতে রেখেছিলেন। কথা হচ্ছিল সে বাড়ীতে। বেশ খিল কপাট বন্ধ করে।
মেয়েটা আবারও বলেছিল—যা বলবে তুমি, তাই করব। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। প্রাণের ভয়ে যা ছিল সব দিয়ে কোন রকমে বেরিয়ে জঙ্গল ভেঙে বাগানের পাশ দিয়ে পড়ো বাগানের তলা দিয়ে কোথা পালাচ্ছিলাম জানি না। হয়তো সাপে খেতো নয়তো কোথাও খানাখন্দকে পড়ে জান যেতো—
—উঁহু উঁহু। জান নয় জীবন বল! জানে পেঁয়াজের গন্ধ ছাড়ে।
মেয়েটা হেসেছিল, বলেছিল- অভ্যেস হয়ে গিয়েছে এমন—
—ছাড়তে হবে।
—ছাড়ব।
হঠাৎ কুড়ারাম বলেছিল—এক কাজ কর।
—কি?
—দাঁড়া। বলে একটা ধারালো দা দিয়ে বলেছিলেন—ওই লম্বা বেণীটা আগে কাট। ওই চুল বাধা। চুল একেবারে কামাতে হবে। নইলে ওই বাহারে চুল আর সিঁথির ঢং যাবে না। কাট!
মেয়েটা তাই কেটেছিল। অনেক কষ্টে অবশ্য। চোখ দিয়ে জল পড়েছিল একদিকে, অন্যদিকে হাসছিল; এ যেন এক কৌতুক। নিজে কাটতে পারেনি, বলেছিল—তুমি কেটে দাও।
—চেঁচাস নে।
—না।
জোরে খড় কাটার মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কেটেছিলেন কুড়ারাম। তারপর বলেছিলেন—আর এক কাজ কর।
—বল।
বাইরে বেরিয়ে খানিকটা গোবর এনে তাকে দিয়ে বলেছিলেন —খা। খেয়ে শুদ্ধ হ। বামুনের মেয়ে তো, বুঝিস না? নে।
বেশ খানিকটা গোবর নিয়ে সে কোঁত করে গিলেছিল অম্লান মুখে।
কুড়ারাম বলেছিলেন—হ্যাঁ, তুই বামুনের মেয়ে বটিস।
তারপর কলসীতে গঙ্গাজল ছিল, এনে খানিকটা খেতে দিয়েছিলেন, বাকিটা হড় হড় করে তার মাথায় ঢেলেছিলেন, তারপর বলেছিলেন যা শুদ্ধ। বল দশবার—কি বলবি বল দেখি?
মেয়েটা বলেছিল, শ্রীহরি শ্রীহরি, শ্রীহরি শ্রীহরি, শ্রীহরি শ্রীহরি, শ্রীহরি শ্রীহরি, শ্রীহরি শ্রীহরি।
—বাস শুদ্ধ। এবার এই ঘাঘরা-মাগরা ছেড়ে আমার কাপড় পর একখানা। কাল শাড়ী কিনে এনে দেব!
কুড়ারাম জীবনে বহুবার শাস্ত্রকে নিজে নিজের মনোমত করে ব্যাখ্যা করে নিয়েছেন। অন্যের ব্যাখ্যার ধার ধারেন নি, কিন্তু কখনও শাস্ত্র মানি না বলে ফেলে দেন নি। বলতেন-শাস্তর হলো বৈতরণী পারের নৌকো, বাইব আমি নিজে। ওপারে পৌঁছুলেই হল।
বৈতরণী পার হতে হলে শাস্ত্র তরী ভূমণ্ডলে
আমি নিজ বাহুবলে বাহিব ওপার।
মোট কথা এই ভাবেই ব্রাহ্মণ বালবিধবা শ্যামা দাসীকে মীরন ধরে এনে ঘাঘরা কাঁচুলি ওড়না পরিয়ে নাম দিয়েছিল ফয়জান, কুড়ারাম তাকে ঘরে এনে মাথা নেড়িয়ে গোবর খাইয়ে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে তিলক ফোঁটা রসকলি কাটিয়ে নাম দিয়েছিল ললিতা বৈষ্ণবী। চুল যখন আবার নতুন করে গজিয়ে এক পিঠ হয়েছিল তখন তাকে বৈষ্ণবীর চেহারায় ফয়জান থেকেও ভালো লেগেছিল। প্রথম প্রথম ঘরে বন্ধ করে যেতেন সেরেস্তাখানায়। এসে ঘর খুলবার আগেই গলার সাড়া দিতেন, অমনি জানালাটা খুলে ললিতা মুখ বাড়িয়ে হাসত।
ললিতার পয় ছিল। এবং ললিতা নতুন জীবনে সত্যই কুড়ারামগতপ্রাণ ছিল। ঘর করেছিলেন পনেরো বছর। এর মধ্যে যত উন্নতি হয়েছিল কুড়ারামের তত তিনি সুখী হয়েছিলেন ললিতাকে পেয়ে। এবং বিশ্বাস এমনি গাঢ় হয়েছিল যে, তাঁর টাকা কোথায় মাটিতে পোঁতা আছে তাও কুড়ারাম ললিতাকে দেখিয়েছিলেন। সৌভাগ্য কুড়ারামের যে, তাঁদের সন্তান হয় নি।
গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ জানতেন কুড়ারাম বিবাহিত। ললিতাই তাঁর স্ত্রী। তিনিই তাঁকে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দের বর্ষার সময় সাবধান করে দিয়েছিলেন—ভটচাজ, তুমি একা নও, শুনেছি পরিবার নিয়ে বাস করো, লোকে বলে স্ত্রী সুন্দরী। সেইজন্যে সাবধান করছি হে, সময় থেকে অন্তত পরিবারকে ঘরে রেখে এসো। কোম্পানির সঙ্গে কাশেম আলীর বনছে না!
কুড়ারাম সঙ্গে সঙ্গেই সাবধান হয়েছিলেন। নবাব কাশেম আলী রাজধানী সরিয়েছেন মুঙ্গেরে; কোম্পানীর কেল্লা কলকাতা থেকে দুরত্ব বাড়িয়েছেন। সুতরাং কুড়ারাম ভুল করলেন না, তিনি কলকাতার দিকেই এগিয়ে এলেন। মারামারি রক্তারক্তি যা হবার মুরশিদাবাদ থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত হবে। বলতে গেলে মুরশিদাবাদকে একরকম খালিই করছেন নবাব। তিনি কৃষ্ণনগরে এসে এক আস্তানা গেড়ে রাখলেন। দরকার হলেই ওখানে এসে উঠবেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন মীরকাশেমের কোপ থেকে রেহাই পেয়ে কৃষ্ণনগরে ফিরেছেন। মহারাজ তাঁকে জানতেন। জানবার কারণ, নবাব তখন আয় বাড়াচ্ছেন; পরগনায় পরগনায় রাজস্ব বৃদ্ধি করছেন, আবওয়াব চাপাচ্ছেন। সে সব যাদের কলমে হচ্ছে তাদের মধ্যে কুড়ারাম ভট্টাচার্য অন্যতম। কুড়ারামের হিসাব অনুযায়ী দিনাজপুরের রাজার রাজস্ব আগের থেকে ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার বেড়েছে। নাটোরের বেড়েছে ৮ লক্ষ। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সে অনুপাতে কমই বেড়েছে, ১ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা। সুতরাং আশ্রয় পেয়েছিলেন সহজেই। সেখানে ছোটখাটো আস্তানা তৈরী করে রেখেছিলেন। দরকার হলেই সরবেন। নগদ টাকাটা জিম্মা দিয়েছিলেন তাঁর মালিকের মত উপরওয়ালা গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের হাতে। তার পরিমাণ তখন প্রায় দশ হাজার।
গঙ্গাগোবিন্দ প্রশ্নও করেননি—এত টাকা কোথা পেলে?
টাকা আরও বেশী হলেও জিজ্ঞাসা করতেন না। করবেন কেন? ব্যাপারটা তো বলতে গেলে প্রকাশ্য। নবাব কোম্পানী জমিদার সকলেই আয় করছেন। নবাব কাশেম আলী নবাবী নেবার সময় পনেরো লক্ষ টাকা দিয়েছেন কোম্পানীর সাহেবদের। ভান্সিটার্ট সাহেবই নিয়েছে পাঁচ লাখ, হলওয়েল দু লাখ সতেরো হাজার। তা ছাড়া কোম্পানীর আলাদা। মীরজাফর আলী দিয়েছিলেন ষাট লাখ টাকা। একা ক্লাইভকেই দিতে হয়েছিল কুড়ি লাখ।
নবাবেরা দিয়ে সেটা প্রজার ঘাড়ে না তুললে পাবে কোথায়? সে দিক থেকে নবাব কাশেম আলী জবরদস্ত। রাজস্ব বাড়িয়ে পূর্বের আয় থেকে এক কোটি দশ লক্ষ টাকা বাড়িয়ে পাকা আয় করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় জমিদারদের কাছে খেলাতই হোক আর জরিমানাই হোক আদায় করেছিলেন কোটি দরুণে। তার সঙ্গে সেরেস্তার কর্মচারীরা পাবে না এ কি কথা! অন্তত সে আমলে কুড়ারামেরও মনে হয় নি, ঘুষের টাকা উপরওয়ালাকে দেখালে তিনি তাকে ধরবেন এবং গঙ্গাগোবিন্দ সিংহও তা ধরেন নি, বেশ সহজভাবেই নিয়ে রেখে স্মরণার্থ একটা রসিদ দিয়েছিলেন। মানুষের শরীর, তিনি যদি নাই থাকেন তবে পুত্র পৌত্র যে থাকুক তিনিই দেবেন।
কয়েক মাসের মধ্যেই লড়াই বাধল। এক কাটোয়াতেই যা মুরশিদাবাদের আগে যুদ্ধ হল, নইলে কুড়ারামের কথাই হল সত্য। যুদ্ধ হল ঘিরিয়ার উধুয়ানালায়—মুরশিদাবাদের উত্তর-পশ্চিমে। কুড়ারাম আগেই সরে গেলেন গঙ্গা পার হয়ে পশ্চিম তীর ধরে নবদ্বীপ পর্যন্ত, তারপর গঙ্গা থেকে জলঙ্গী ধরে কৃষ্ণনগর।
কাশেম আলী গেলেন, আবার বুড়ো নবাব এলেন। এবার আর কুড়ারাম ফিরলেন না। ওই কৃষ্ণনগরে রাজার সেরেস্তাতেই কাজ নিয়েছিলেন। ঠিক ভাল লাগে নি ঝঞ্ঝাট। সে সময় ললিতাকে নিয়ে সুখে থাকবার একটা মোহ তাঁকে পেয়েছিল। কিন্তু বছর খানেক পর বুড়ো নবাব মারা গেলেন। ছেলে নজুমউদ্দৌলা নবাব হল। মণিবেগম তার অভিভাবিকা। তখন ললিতা বললে-ফিরে চল মুরশিদাবাদ। বেগম আমাকে খুব ভালবাসতেন।
কুড়ারাম ভেবে-চিন্তে ফিরেছিলেন।
ললিতা মণিবেগমের কাছে কিছু বকশিশও পেয়েছিল। বেগম সব শুনে খুশী হয়ে কিছু অলঙ্কার দিয়েছিলেন আর দিয়েছিলেন একখানা কুঠী। কুড়ারামের মিলেছিল চাকরী নবাব দপ্তরে। নবাবদপ্তরের রস আর বিশেষ ছিল না। নতুন কুঠীতে একটু ভালোভাবেই সংসার পেতেছিলেন তিনি।
দেওয়ানী তখন কোম্পানীর হাতে গিয়েছে। আদায় তহশীল সব। নবাববাড়ীতে নবাব থেকে বেগম এবং নবাবজাদা নবাবজাদীরা সব কোম্পানীর তনখাভোগী। শুধু আশে-পাশে কিছু কিছু সম্পত্তির আদায় আছে এই পর্যন্ত। পাওনা গণ্ডা বিশেষ নেই। কোম্পানীর দেওয়ানী সেরেস্তায় ঢোকা সহজ নয়। তার মুরুব্বি সব কলকাতায়। কিন্তু কলকাতায় নোনা লাগে, বাঘ আসে, ডোরা বাঘ; তা ছাড়া মুরব্বিরা অচেনা, কলকাতা তার থেকেও বেশী অজানা। কিন্তু কুড়ারাম লিখেছেন—
ভাগ্যে যার থাকে বল শুষ্ক বৃক্ষে ধরায় ফল
মরুভূমি মিলায় জল—বর্ষে বিনা মেঘে।
ব্যাপারটা ঠিক তাই। গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ হঠাৎ পড়ে গেলেন হেস্টিংস সাহেবের সুনজরে। ঘটনাটা অদ্ভুত। নবাব সিরাজুদ্দৌলা যখন কাশিমবাজার কুঠীর উপর চড়াও হয়ে হামলা করেন, তখন হেস্টিংস সাহেব পালিয়ে গিয়ে এক মুদীর দোকানে আশ্রয় চেয়েছিলেন। মুদীও দিয়েছিল। তাকে রন্ধনঘরে একটা জালায় পুরে তার মুখটা ঢেকে রেখেছিল। তাতে প্রাণে বেঁচেছিলেন তিনি। তিনি গভর্নর হয়েছেন এখন। তিনি খুঁজছিলেন কান্ত মুদীকে। কিন্তু সঠিক কান্ত মুদী কিনা নিঃসংশয় হতে পারছিলেন না। জনকতক লোকই কান্ত মুদী বলে এলেও তিনি ঠিক চিনতে পারছিলেন না, কিন্তু ঠকবার লোক তিনি নন। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাদের। এদেশের লোকের কাছে সাদা মানুষেরা যেমন সব একরকম দেখতে, সাদা মানুষের কাছে কালো মানুষেরাও প্রায় সেই রকম। গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ বুদ্ধিমান লোক, হেস্টিংস সাহেব কি জন্যে কান্ত মুদীকে চান তা খানিকটা বুঝে খোঁজ করে ঠিক কান্ত মুদীকে নিয়ে গিয়েছিলেন হেস্টিংস সাহেবের কাছে। এবং বলেছিলেন—মি লাড, আপ উসকে এইসা কোই বাত গুছিয়ে যো বাত আপ জানতে হেঁ আউর ই জানতে হেঁ। আউর কোই নো নট।
সাহেব বলেছিলেন—ঠিক বাত। দ্যাটস রাইট! আচ্ছা উসকো পুছো—কোই সাহেব কো উসকো সাথ কাশিমবাজার কুঠী লুট হোনেকা বক্তমে মোলাকাৎ হুয়া?
কান্ত মুদী বলেছিল—এক সাহেব প্রাণের ভয়ে আমার কাছে এসেছিল, আমি আমার মুদীখানায় লুকিয়ে রেখেছিলাম।
—হ্যাঁ। কিস্ কায়দসে উসকো ছিপাকে রাখা?
—জালার ভেতর পুরে মুখে ঢাকা দিয়ে রেখেছিলাম।
সাহেব বলেছিলেন-ক্যা বোলতা? জালাকে অন্দর রাখ্যা—মু বন্ধ করকে। উ তো মর যাগা!
—না হুজুর, আমি জালাতে বাতাসের জন্যে ফুটো করে দিয়েছিলাম।
—হাঁ। হোনে সেতা হ্যায়। লেকিন খানে ক্যা দিয়া? রোটী–গোস?
—না হুজুর—পান্তা ভাত আর আমানি দিয়েছিলাম।
—আচ্ছা। আচ্ছা। বহুত আচ্ছা। লেকিন তুম উ সাবকে পহছানতে পারে?
—না হুজুর।
—হম হ্যায়। উ হম হ্যায় কান্তবাবু। অজসে তুম বাবু বন গেয়া। তুম হামারা জান বাঁচায়া, হুম তুমকো বাবু বানায়েগা, রাজা বানায়েগা।—
আর গঙ্গাগোবিন্দ সিংহকে বলেছিলেন—আচ্ছা কামদার হুঁসিয়ার আদমী হো তুমি সিংবাবু। তুম হামারা কোম্পানীকে দেওয়ানী সিরাস্তামে কাম করো। আই এ্যাম ভেরী প্লিজড উইথ ইউ।
বহুত খুস হুয়া হম।
গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ কাজ পেয়েই লোক পাঠালেন মুরশিদাবাদ। আপনার অনুগত লোকদের ডেকে আনলেন। তার মধ্যে প্রথম ব্যক্তি ছিলেন কুড়ারাম।