প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ১.৬

বিবি-মহলের দুর্নাম যাই থাক সে তার অবস্থান-গুণে গঠন-সৌন্দর্যে কিন্তু বিবির মতই মনোহারিণী ছিল। এদেশে ইংরেজদের প্রথম আমলের কুঠীবাড়ীর মতো সামনে গোল থামওয়ালা বারান্দা ঘেরা দোতলা বাড়ী। তারও সামনে প্রশস্ত গাড়ীবারান্দার উপর ছিল বসবার বা আসর পাতবার জায়গা। চারিদিকে আলসের ঘেরা। তার মধ্যে মধ্যে জোড়া গোল থাম। থামের উপর দিকে শৌখীন কাঠের ঝিলমিলি, তার উপর পাকা ছাদ। গাড়ী বারান্দার পরই গোল থাম ঘেরা বারান্দা। তারপরই বড় হল। এই হলকে ঘিরে তিনদিকে তিনখানা ঘর। পশ্চিমে, দক্ষিণে, উত্তরে। এর ফলে প্রতি ঘরেই তিনদিক ছিল অবারিত। শুধু কোলে কোলে টানা বারান্দা ছিল লোহার রেলিং ঘেরা। তাতে আলো-বাতাস বা সামনের দিগন্ত অবরোধ করেনি। গোটা বাড়ীখানা ছিল পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা, দক্ষিণ গায়ে কংসাবতী নদী। কংসাবতীর কিনারায় পোস্তা বাঁধিয়ে বাড়িখানা তৈরি করা হয়েছিল। সদরে ওই গাড়ীবারান্দার দক্ষিণ গায়ে বাঁধানো ঘাট। আগে ওইখানে প্ৰকাণ্ড একটা দহ ছিল। পশ্চিম দিকে কংসাবতীর কুলে ঘন জঙ্গল একেবারে বাড়ীর প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে। কংসাবতীর ওপারেও জঙ্গল।

সুরেশ্বর মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল এখানে এসে।

সব থেকে ভাল লেগেছিল দক্ষিণ দিক। নিচেই কংসাবতী নদী, তার ওপারে ঘন জঙ্গল। ওই জঙ্গলের মধ্যে ছিল এক সিদ্ধ শক্তিপীঠ। একটা বিশাল শিমুল গাছ সকলের উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। আর তারই খানিকটা দূরে ওই কংসাবতীর বন্যার সীমারেখার ঠিক প্রান্তেই একখানি বিচিত্র গ্রাম। যেদিন রাত্রে সে এসেছিল সেদিন ছিল শুক্লপক্ষের নবমী বা দশমী। জ্যোৎস্নার আবছা আলোর মধ্যে সে শিমুল গাছটার পত্রহীন শাখাগুলিকে আকাশের গায়ে ছবির মত দেখতে পেয়েছিল। নীল পটভূমিতে কালো রঙে এঁকে রেখেছে কোন শিল্পী। আর দেখতে পেয়েছিল ওই গ্রামখানায় এখানে-ওখানে জ্বলন্ত আলোকবিন্দু। বাড়ীর নীচেই চৈত্রের কংসাবতীর স্বপ্ন জলস্রোতে চাঁদের প্রতিবিম্ব, জ্যোৎস্নার ছটা বহুদুর পর্যন্ত একটা গলিত রুপোর স্রোতের মত মনে হচ্ছিল, তারপর সেটা কালো কৃষ্ণাভায় ঢাকা পড়ে গেছে।

এসেছিলেন অনেকে দেখা করতে। জ্ঞাতি ভট্টাচার্যেরা, দেবোত্তরের কর্মচারীরা, ইস্কুলের হেডমাস্টার, গ্রামের লোক অনেকে এসেছিলেন। রায়বাড়ির জ্ঞাতিদের মধ্যে এখানে সকলেই শিবেশ্বরের বংশাবলী । তাদের মধ্যে শিবেশ্বরের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম অর্থাৎ ছোটগুলি—কমলেশ্বর, বিমলেশ্বর, অতুলেশ্বর এসেছিল, তার সঙ্গে ছিল ধনেশ্বরের বড় ছেলে। সে সুরেশ্বরের থেকে বয়সে বড়। বেশ শৌখীন লোক। চেহারাটি ভাল। নাম ব্রজেশ্বর। সুরেশ্বরের সঙ্গে ঠিকাদারী করে। খোঁয়াড় ডাকে। তারা তরুণ। কমল, বিমল সুরেশ্বরের সমবয়সী, অতুলেশ্বর বয়সে ছোট। আরও এসেছিল পরবর্তী পুরুষের প্রায় সকলেই। ছোটদের মধ্যে রায়বংশের কোন ছাপ জ্যোৎস্নার মধ্যে সে দেখতে পায়নি। পোশাক-পরিচ্ছদ শুধু অপর্যাপ্তই নয়, অপরিচ্ছন্নও বটে। কয়েকটা পাঁচ-ছ বছরের ছেলে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে হি-হি করে হাসছিল। ওই হাসি দেখে তার এত কুৎসিত মনে হয়েছিল যে সে কোন মতেই ভাবতে পারেনি যে এরা তারই নিকট জ্ঞাতি খুড়তুতো ভাই। মন তার ছোটই হোক আর বড়ই হোক; মন বিদ্রোহ করে বলেছিল, না, এদের আত্মীয় আপনজন একরক্ত এ স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছে, ঘৃণা হচ্ছে।

এরই মধ্যে হ্যারিকেন হাতে একটি ব্রাত্যশ্রেণীর মেয়ের পিছনে পরিচ্ছন্ন লালপাড় শাড়ী-পরা এক অল্পবয়সী মহিলা এসে দাঁড়িয়েছিলেন ভিড়ের ওপাশে।

ঝিটা বলেছিল—পথ দাও ক্যানে গো। মেজ-মা এয়েছেন। দেখছ না?

সঞ্চলে সম্ভ্রমভরে পথ করে দিয়েছিল।

মহিলাটি ভিতরে চলে গিয়েছিলেন তার মা হেমলতার কাছে। কিছুক্ষণ পরই সুরেশ্বরের কলকাতার চাকর রঘুয়া এসে তাকে ডেকেছিল—মা ডাকছেন ভিতরে।

নায়েব সুরেশ্বরের কাছেই ছিল, সে বলেছিল—যাও, মেজ-মা এসেছেন, তিনিই ডাকছেন। কথা তাই বটে; সুরেশ্বর ভিতরে গিয়ে দেখেছিল তার মায়ের পাশেই তাদেরই একখানা রাগজাতীয় কম্বলের উপর সেই লালপাড় শাড়িপরা মেয়েটি বসে আছেন।

হ্যাজাকের বাতি জ্বলছিল। উজ্জ্বল আলো। মহিলাটির মাথায় চুলের সামান্য অংশ বের করে ঘোমটাটি তোলা, লাল পাড়ের বেড়ের মধ্যে মুখখানি আশ্চর্য শান্ত, প্রসন্ন এবং মিষ্টি। বয়স তাঁর হেমলতার থেকে পাঁচ-সাত বছর কমই হবে। টকটকে রঙ, সুন্দর দুটি চোখ, নাকটি একটু খাটো কিন্তু তাতেই তাঁর রূপ যেন বেড়ে গেছে।

মা বলেছিলেন—মেজ-খুড়িমা। তোকে দেখতে চাচ্ছিলেন।

সে অবাক হয়ে গিয়েছিল, এই তার মেজ-ঠাকুরদার স্ত্রী! মেজ-ঠাকুরদার বয়স তো সত্তরের কাছে।

তিনি বলেছিলেন—বোসো ভাই নাতি, বস। আমি তোমার ঠাকুমা, তুমি নাতি। সুরেশ্বর তাড়াতাড়ি প্রণাম করতে গিয়েছিল কিন্তু তিনি তার হাতখানা ধরে ফেলে বলেছিলেন—না ভাই, অশৌচের সময় প্রণাম করতে নেই। বস। বস, এই কাছে বোসো। তোমাকে দেখি। তুমি বড় সুন্দর হে! বলে তার চিবুকে হাত দিলেন।

লজ্জা সুরেশ্বর পায় না। সে সুন্দর ঐ কথাটা সে নিজেই জানে। তার উপর লোকের মুগ্ধদৃষ্টি এ কথা তাকে নীরবে বার বার জানায়। কিন্তু এই অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েটি তার চিবুক ধরে এমন করে বলায় সে লজ্জা পেয়েছিল।

তিনি বলেছিলেন—তা হবে না কেন। ভাসুরপো যোগেশ্বর যেমন সুপুরুষ ছিলেন, বউমার তেমনি রূপ, তাদের গোপালের এমন রূপ হবে না তো হবে কার!

হেমলতা একটু বিষণ্ণ হেসেছিলেন। হয়তো তাঁর রূপের ব্যর্থতার কথাই তাঁর মনে হয়েছিল।

তিনি বলেছিলেন—দুঃখ পেলে বউমা! তা এ বাড়ীর বউ হলেই তাকে দুঃখু পেতে হয়। বলে আশ্চর্য হাসি হেসেছিলেন।

হেমলতা বললেন—না খুড়ীমা, দোষ আমি এ বংশকে দেব না। তাঁকে আমার থেকে ভাল কেউ জানে না। এমন কি এখান থেকে চলে গিয়ে দুখানা চিঠি তিনি লিখেছিলেন, তাতে তিনি একটি কথাও গোপন করেননি। যা করেছেন তা তিনি অন্যায় করেছেন তাও আমি বলতে পারব না। দোষ আমার ভাগ্যের। একেবারে আমার ভাগ্যের। সুরোর পর ছেলে হয়ে মরতেই বসেছিলাম, মরাই ভাল ছিল, কিন্তু বাঁচলাম। সে ওই নামেই বাঁচলাম।

—শুনেছি বউমা। থাক ওসব কথা। এখন আমি যার জন্যে এসেছি, তাই কর। সুরেশ্বরকে আমার সঙ্গেই পাঠিয়ে দাও। মেজ-কর্তার কাছে ওর এসে এসে যাওয়াই ভাল, খুঁত যেন ধরতে না পারেন। তোমার নায়েবের খুব বুদ্ধি, প্রথম প্যাঁচেই কর্তাকে বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও উনি বড় ছেলের সঙ্গে গজগজ করেছেন। তার উপর শুনলাম মেজ তরফের নিচের তলা থেকে সব কাল ঝাড়াইমোছাই হবে। মানে দরকার হলে ওই বাড়ীতেই চলে যাবেন তোমাদের অংশ খালি করে দিয়ে। মতলব ভাল নয়। সুরেশ্বরের এখুনি যাওয়াই ভাল।

একটু—মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত—চুপ করে থেকে আবার বললেন—দেখ, মানুষটার মধ্যে এখনও একটা ভালোমানুষ আছে। আমি তো দেখছি। হয়তো আসলে মানুষটা ভালই। বড় বাপের ছেলে, আমার শ্বশুর শুনেছি দেবতুল্য মানুষ ছিলেন। ধার্মিক চরিত্রবান। লোকে এখনও বলে আগুনে কালি আছে, তাঁর মধ্যে কালি ছিল না। ইনিও লেখাপড়া শিখেছিলেন, এফ.এ. পাশ। প্রথম জীবন থেকে গোঁড়া ধার্মিক। গীতা ভাগবত কণ্ঠস্থ। আজও পড়েন। কিন্তু মা, বড়লোকের ছেলে জমিদারী জেদে মামলা করা ছাড়তে পারলেন না আর। একটু হেসে বললেন-সুরেশ্বর রয়েছে, বলতে লজ্জা করছে, ওই পরিবার বাতিক। মা, আমার বিয়ে হয়েছে তেরো বছর। এই তের বছরে একবার আমার বাবার মৃত্যু হলে শ্রাদ্ধে গিয়েছিলাম। বাস, আর যাইনি। শুনেছি আমার বড় সতীন—ওঁর প্রথম পরিবার —পনের বছর বেঁচে ছিলেন, দশটি সন্তান হয়েছিল, সাতটি বেঁচেছে, তিনটি মরেছে। তিনি মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যে আবার বিয়ে করেছিলেন। দ্বিতীয় সতীন কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন। তাঁর ছেলে-মেয়েতে ছটি, তার পাঁচটি বেঁচে। তিনি গেলেন, ওঁর তখন চুয়ান্ন বছর বয়স। সেই বয়সে টোপর চেলি পরে আমাকে বেনারসী চাদরে গলায় বেঁধে এনে ঘর বাঁধলেন। আমার একটা ভাগ্য আছে মা, ভগবানকে প্রণাম করি আর বলি, রক্ষে করেছ তুমি আমাকে। বাঁচিয়েছ। আমাকে সন্তান দাওনি। এতেই দুই পরিবারের ছেলেমেয়েতে বারোটি, হয় মেয়ে ছয় ছেলে। এর উপর আমার গণ্ডাখানেক হলে ষোলকলায় পুন্নিমে হত মা। নাতিনাতনীতে সতেরোটা। ওদের পেট ভরাতে বিষয় যেতে যেতে অভাবে স্বভাব মন্দ যাকে বলে তাই হ’ল। মধ্যে মধ্যে আপসোস করেন। ভালমানুষটা জাগে। কিন্তু কি করবেন? বড় বড় নাতিগুলো থেকে ছেলেরা একধার থেকে দায়ী করে ওঁকে। বলে—; সে জঘন্য কথা মা। সুরেশ্বরের সামনে বলতে বাধছে।

সুরেশ্বর উঠে গিয়েছিল। যেতে যেতেই শুনতে পেয়েছিল, মেজঠাকুমা বলছেন—বড় ছেলে বলে কি জান? বলে—ছয় পুত্র সন্তান থাকতে বিয়ে করেছিলেন, কেন করেছিলেন? যদি বিয়ে না করে না থাকতেই পেরেছিলেন তবে একটা রক্ষিতা রাখলেই পারতেন। একটা দুটো যটা ইচ্ছে। তবে সত্যি কথা বলব মা, ওই মামলা-মকদ্দমার নেশা, ও ওঁর গাঁজার নেশার চেয়েও বেশী। জ্বরজারি হলে গাঁজা খান না, ভাল লাগে না, কিন্তু মামলা-মকদ্দমার খোঁজ তার মধ্যেও না করে পারেন না। ওটা তো হিংসের কাজ, এ তো অস্বীকার করলে চলবে না! আর নারী ধ্যানজ্ঞান এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত, এই বা অস্বীকার করি কি করে?

হেমলতা বেশ বিস্ময়ের সঙ্গেই শুনছিলেন এই গ্রাম্য মেয়েটির কথা। মেয়েটি রায়বংশের বৃদ্ধের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী হয়েছে নিতান্তই দুর্ভাগ্যবশে। খুবই দরিদ্রের মেয়ে, সম্ভবত এমন দরিদ্র যে কন্যার বিবাহে সামান্য কিছু খরচ করবারও সঙ্গতি ছিল না, থাকলে এমন রূপসী মেয়ের বিয়ে একটা হয়ে যেত। হয়তো বা জমিতে জেরাতে কিছু পরোক্ষ মূল্য নিয়ে বিক্রীই করেছে। সেই মেয়ে এমন কথাবার্তা কইছে, সেটা তাঁকে কিছুখানি বিস্মিত করছে বইকি। সব থেকে আশ্চর্য লাগছে কথাগুলির মধ্যে ক্ষোভ নেই, বেদনা কিছুটা আছে, কিন্তু অপ্রসন্ন নয়। এবং বিচার আছে। এবং একটি ন্যায়বোধও রয়েছে।

মেজগিন্নীর হঠাৎ চোখে পড়ল হেমলতার বিস্মিত দৃষ্টি। তিনি কথা বলছিলেন হেমলতার চোখে চোখ রেখে বা মুখের দিকে তাকিয়েও নয়। তাঁর দৃষ্টি অধিকাংশ সময়েই তিনি নিবদ্ধ রেখেছিলেন তাঁর কোলের উপর পড়ে থাকা নিজের হাত দুখানির উপর। নিটোল দুখানি গৌরবর্ণ হাতে শুধু দুগাছি শুভ্রবর্ণ শাঁখা ছাড়া কোন অলঙ্কার ছিল না। দু-একবার চোখ তুলে অনেকটা অন্যমনস্কের মত খোলা জানালাটা দিয়ে বাইরের রাত্রির বায়ুমণ্ডল বা আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলে সেই দিকেই তাকিয়ে থেকেছেন। এতক্ষণে হেমলতার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জিত হয়ে পড়লেন। বললেন—আমি তো মুখ্যু মেয়ে, গরীবের মেয়ে,, যা মনে হয় তাই বললাম। কিন্তু কিছু অন্যায় বললাম মা?

হেমলতা বললেন—না খুড়ীমা। সেই তো আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম মা।

মেজগিন্নী বলেছিলেন—গরীব ঘরের মেয়ে, বাপ ছিলেন এঁদের বাড়ির পুজুরী। চালকলা বাঁধা বামুন। কিন্তু ধর্মভীরু ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে এ বিয়ে হত না। বাবা মারা গেলেন, নিজের মা ছিল না। দেড় বছরের রেখে মা মরেছিলেন। সৎমা বিধবা হলেন, তখন বয়স আমার চৌদ্দ। গাঁয়ে ঘরে বিয়ের কাল পেরিয়েছে, গলায় কাঁটা লাগার মত লেগেছি। মেজকর্তা লোক পাঠালেন। পাঁচ বিঘে জমি দেবেন ভাইদের। বিয়ে হয়ে গেল। আমিও বাঁচলাম। লোকে বললে শিবের মত স্বামী হল। আমিও তাই ভাবলাম। বাপের কাছে শেখা পাপপুণ্য বোধ ছিল। মেজকর্তাও তখন এমন ছিলেন না। তখনও থিয়েটার করতেন। ঘরে নাটক পড়তেন। তাঁর থেকে অনেক শিখলাম মা। কিন্তু যাঁর কাছে শিখলাম, অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে তিনিই সব ভুলে গেলেন।

হেমলতা বললেন—ভারী ভাল লাগল মা আপনাকে!

খুশী হয়ে মেজগিন্নী বললেন—জান মা, কাল খবর পেয়ে অবধি কতবার মনে মনে বলেছি যোগেশ্বর ভাশুরপো না গিয়ে যদি ইনি যেতেন! আমি যদি বিধবা হতাম! কত দাম তাঁর জীবনের, কত নাম! আর ইনিও দারিদ্র্য-দুঃখ থেকে রেহাই পেতেন!

—ও কথা বলে না খুড়ীমা। উনি বাঁচুন, অনেকদিন বেঁচে থাকুন। ওঁর দুঃখ ঘুচুক। ছেলেরা কাজ-কর্ম করুক—

—ছেলেরা? মা, বড় সতীনের ছেলেরাও তো বুড়ো হয়ে এল বলতে গেলে। বড় ধনেশ্বরের বয়স যোগেশ্বর ভাসুরপোর প্রায় সমান। ছেলেরাই সব উপযুক্ত। বড় ছেলে ব্রজেশ্বর, সুরেশ্বরের থেকে বড়। ধনেশ্বর সিঁদুরের ফোঁটা পরে, কালীমন্দিরে কালী কালী করে, মদ খায়। লোককে শাসন করে বেড়ায়। ভাবে সেই আমলই বুঝি আছে। ধর্মের ষাঁড়কেও যে আজকালকার আইনে খোঁয়াড়ে দেওয়া যায় তা ভুলে যায়। সেজছেলে সুখেশ্বর একটু উপযুক্ত। এখানে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। দু-চার টাকা এদিক-ওদিক থেকে রোজগার করে, তা নিজের কুলোয় না বাপ-ভাইকে কি দেবে! কত আর বলব মা, সব ছেলেই অপগণ্ড। দ্বিতীয় পক্ষের বড় ছেলে কমল—কমলেশ্বর বাপকে নেশার পয়সার জন্যে মধ্যে মধ্যে বলে—নেশার পয়সা দিতে পার না বাপ হয়েছিলে কেন? জন্ম দিয়েছিলে কেন? গাঁজা খায়। ছোট ছেলেটা অতুলেশ্বর একটু ভালো। লেখাপড়া করছে। তাও স্বদেশী বাতিক। বন্দেমাতরম করে বেড়ায়। নাতিগুলোও তাই। ওঁর কষ্ট দেখি আর ভাবি আরও কত কষ্ট উনি পাবেন! মধ্যে মধ্যে এমন কাণ্ড ঘটে বড় ছেলের বড়ছেলে আর অতুলের বড় বিমলকে নিয়ে, আর মেজ ছেলে জগদীশ্বরকে নিয়ে যে উনিও বলেন-হে গোবিন্দ, মৃত্যু দাও। পরিত্রাণ কর! অথচ মৃত্যুকে ওঁর বড় ভয়।

—কেন? কি করে? ওঁকে মারেটারে নাকি?

—না না। সে সাধ্যি নেই। সে ভয় করে। উনি এখনও সব নিজের হাতে রেখেছেন তো! বন্ধ করে দেবেন সব! যা করে সে কেলেঙ্কারি। এখানে ছোটজাতের মেয়েদের নিয়ে—বিশেষ করে ওই নদীর ওপারে গোয়ানপাড়া বলে একটা ক্রীশ্চানপাড়া আছে, তাদের মেয়েগুলো খারাপও বটে, তাদের নিয়ে কেলেঙ্কারি করে। ওদের পুরুষ জাতটা আবার আমাদের ছোটজাতের মত নয়—তারা সব চোখোল-মুখোল, বদমাশ, গুণ্ডা, তারা আসে মারমুখী হয়ে! ওঁকে তার ঝাপটা সইতে হয়। এক-একদিন বলেন–মেজবউ, আমার অজান্তে আমার ক্ষীর কি সন্দেশে বিষ মিশিয়ে দিতে পার? আর বাঁচতে আমি পারছিনে, চাইনে। কিন্তু জেনে, নিজে উস্যুক করে মরবার মতো সাহস আমার নেই। মরণকে আমার বড় ভয়। জানো, বি.এ. পরীক্ষার সময় কলকাতায় প্লেগের হুজুগ হয়েছিল, কলকাতায় প্লেগ এসেছে। আমি পালিয়ে এসেছিলাম পরীক্ষা না দিয়ে। বাড়ীতে কেউ পাঁচবার দাস্ত করলে গাঁজা খাই। ঘর বন্ধ করে বসে থাকি। কিন্তু এ যন্ত্রণা যে আর সহ্য হচ্ছে না।

আবার কয়েক মুহূর্ত পরে বললেন-আগে শুনেছি দয়া ছিল মায়া ছিল। কেউ মারা গেলে হাউমাউ করে কাঁদতেন—বটঠাকুর মানে তোমার শ্বশুর, ঠাকুরপো মানে ওঁর ছোট ভাই, বন্দুকে পাখী মারতেন, উনি কাঁদতেন। মিথ্যে কথা বলতেন না। সেই মানুষ ওই দুটো দোষে কি হয়ে গিয়েছে।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস তিনিও ফেললেন, হেমলতাও ফেললেন। হেমলতা কোন উত্তর দিতে পারলেন না। কি উত্তর দেবেন? একটু নিস্তব্ধ হয়ে রইল ঘরখানা। তারপরেই মেজগিন্নী বললেন—তাহ’লে উঠি বউমা। তুমি সুরেশ্বরকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দাও। ও একবার কাছে বসে মিষ্টি করে বলুক, ঠাকুরদা, আমার তো অভিভাবক আপনি। আপনার থেকে বড় অভিভাবক তো কেউ নেই। জ্যাঠামশাই তো সেই দূরে। আমি ছেলেমানুষ, আমাকে যেন আপনি দেখবেন। হয়তো… হয়তো কাজ কিছু হবে না। তবু বলা! বিষণ্নভাবে হাসলেন মেজগিন্নী।

হেমলতা সচেতন হয়ে উঠলেন, তিনি যেন অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন—এই তাঁর চেয়েও কমবয়সী তাঁর শাশুড়ীটির জন্যে। সচেতন হয়ে উঠে বললেন—যাবে বৈকি সুরেশ্বর। যাওয়া উচিত ছিল। সুরো! সুরেশ্বর। রঘু, সুরো বোধহয় বাইরে—

সুরেশ্বর বাইরে যায়নি। পাশের ঘরেই ছিল। বাইরের ওই জঙ্গলের ও কংসাবতীর দিকের জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নার ফুটফুটে রাত্রির আকাশ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে ছিল। জঙ্গলে কোথায় দুটো কোকিল পাল্লা দিয়ে ডেকেই চলেছে। ‘চোখ গেল’ পাখীর ডাকও সে শুনেছে, পাপিয়া ওর নাম, জানবাজারে পাশের একটা বাড়ীতে কেউ পুষেছিল—ডাকত। আর একটা পাখী ডাকছে ভারি চমৎকার সুরেলা ডাক। নাম জানে না। ওই ডাকও শুনেছিল সে, আবার কথাও শুনছিল মেজঠাকুমার। সম্ভবত মনটা মেজঠাকুমার কথার দিকেই আকৃষ্ট ছিল বেশী। পাখির ডাক এবং গান কানের পাশ দিয়ে বেজে চলেছিল বাতাসের প্রবাহের মতো, বৃষ্টির শব্দের মতো, দুরান্তের কোলাহলের মতো। ধ্বনিতেই তার পরিবেশন শেষ-কোন ব্যঞ্জনার স্বাদ নেই, কোন অর্থবোধের ঔৎসুকা নেই।

মায়ের ডাকে সুরেশ্বরের যেটুকু মন বাইরে ছড়িয়েছিল, যেটুকু কথার মধ্যে মগ্ন ছিল সব একত্রিত হয়ে সজাগ হয়ে উঠল। সে সাড়া দিয়ে বললে-আমায় ডাকছ?

বলে সে এসে ঘরে ঢুকল।

—পাশের ঘরেই ছিলি বুঝি? বাইরে সব বসে রয়েছেন—

মেজগিন্নী বললেন—ভালই করেছে মা। ওর বাইরে গিয়ে গাঁয়ের লোকের কঙ্কচি না শোনাই ভাল। এখানে খবর আসা অবধি এদের ছয় ভাইয়ের তো মুখের বিরাম নেই। নানান গল্পগুজব রটিয়ে বেড়াচ্ছে। বড় ছেলে তো সকাল থেকে মদ খেয়ে চিৎকার করছে। মেজকর্তার মন্দ স্বভাবে সেটা ভাল লাগছে। তবে মধ্যে মধ্যে বলছেন, না—না। এ বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে। যাক আজ উঠি

—আপনি কিন্তু আসবেন খুড়ীমা। যে যা বলুক করুক আপনি যেন পরিত্যাগ করবেন না।

—আসব। আমার পথ কেউ আটকাতে পারবে না বউমা। তোমার শ্বশুর আমাকে ভয় করে। হাজার হলেও তৃতীয়পক্ষ তো।

বলে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন—কিন্তু একটি শর্তে।

—বলুন।

—শর্ত হল, তুমি মা আমাকে আপনি আজ্ঞে করো না। আমি তোমাকে তুমি বলছি, তুমিও আমাকে তুমি বলবে।

—সেকথা কেমন ক’রে বলব খুড়ীমা—তাই কি পারি?

—মা, এখানে ছেলেরা মাকে তুই বলে। রাগলে বাপকেও বলে। সেকথা থাক্। তোমার সুরেশ্বর তোমাকে তো তুমি বলে। তুমিও আমাকে তুমি বলবে। কেমন লাগে মা। চাকর-বাকর ছাড়া কেউ তো আপনি বলে না। তাছাড়া বয়সে আমি তোমার থেকে ছোটই হব।

হেসে হেমলতা বললেন—বেশ, তাই বলব!

মেজগিন্নী বললেন—এস ভাই নাতি। চলো, ঘুরে আসবে। দেখে আসবে ঠাকুরদাকে।

হেমলতা বললেন—ম্যানেজারবাবুকে বলে সঙ্গে লোক আর আলো নিয়ে যা!

.

নায়েব বা ম্যানেজার হরচন্দ্র একটু খুঁতখুঁত করলেন। কিন্তু যোগেশ্বরের এখানকার পুরানো কর্মচারী গোবিন্দ ঘোষ বললে—মেজমায়ের সঙ্গে যাচ্ছেন, কোন খুঁতখুঁত করবেন না। বলে তিনিই ডেকে বলেন—ওরে ডিকু, তুই যা আলো নিয়ে।

একটি অদ্ভুত মুর্তি—অন্তত তাই মনে হল সুরেশ্বরের আলো এবং লাঠি হাতে সেলাম করে দাঁড়াল। লোকটার গালপাট্টা আছে, পাকানো গোঁপ আছে, পরনে পাজামা আছে, গায়ে একটা ছেঁড়া কোট আছে। বাঙালী তো নয়ই—হিন্দুস্তানী বলেও মনে হয় না, কিন্তু মুসলমানের সঙ্গেও মেলে না।

মেজঠাকুমা বললেন-ডিকু!

—হাঁ মাইজী!

—বহাল হলি বুঝি?

—হাঁ মা। হলদির কাছে আদমী গিয়েছিল তিন আদমীর জন্যে—বুড়ী আমাকে রোজাকে ভেজেছে, কাল আর কোইকে ভেজবে। আচ্ছা আদমী ছাড়া তো দিবে না! হামরা তো নোকরী ছুঁড়ে ঘুরছি মা, মিলছে না। আর নতুন হুজুর আইলেন, নোকরী মিলল।

সুরেশ্বর বললে—কি নাম তোমার?

—গোবিন্দ ডিক্‌কুরুজ! হামি লোক গোয়ান আছি হুজুর! হারমাদ ছিলাম হামরা! হুজুরেরা হামাদের এনে এখানে জমিন দিয়ে ঘর দিয়ে বৈঠালেন।

মনে পড়ল সুরেশ্বরের। পুর্বপুরুষ বীরেশ্বর রায়ের আমলে এরা এখানে এসে বাস করেছিল। বাস করিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে। গোয়ানীজ পোর্তুগীজদের বংশধর। মনে পড়ল মেজঠাকুমা মাকে বলেছিলেন গোয়ানপাড়ার মেয়েদের কথা। কিন্তু সেকথা নিয়ে কৌতূহল জাগবার মত তার মনের অবস্থা ছিল না। সে একটু শঙ্কিত হয়েই চলেছিল বিচিত্র মেজঠাকুরদার সঙ্গে দেখা করতে। তার বাবাকে সে দেখেছে রায়বংশের প্রাসাদের একটি শ্বেতশুভ্র গম্বুজের মত মহিমায়। তাতে আকাশ থেকে অন্ধকারের কালি ঝরে কালো হয়ে যেতেও দেখেছে। তার চূড়ার কলসে কলঙ্ক ধরতেও দেখেছে। এখন চলেছে দেখতে আরও পুরনো এক গম্বুজ বা মিনারকে—যেটা ভূমিকম্পে ফেটে গেছে; ফাটলে ফাটলে সরীসৃপের বাস; যেটার তলায় দাঁড়ালে যে-কোন মুহূর্তে খানিকটা ভেঙে পড়বার সম্ভাবনা, যেটার রং বিবর্ণ হয়ে কদর্য—হয়তো বা ভয়ঙ্কর—হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে গেল।

মেজঠাকুমা বললেন—দাঁড়ালে ভাই?

ঠিক পথের ধারেই একটা গাছে যেন মাথার উপরেই সেই অজানা সুরেলা শিদেওয়া পাখীটার ডাক শোনা যাচ্ছে। অত্যন্ত কাছে ঠিক মাথার উপরে বলেই মনটা যেন ছেলেমানুষের মত ওরই কাছে ছুটে চলে গেছে। সে বললে—ওই পাখীটা! অনেকক্ষণ থেকে ডাক শুনছিলাম নদীর ওপারের জঙ্গলে। এখানে বোধহয় এই গাছটাতেই ডাকছে।

পাখীটা আবার ডেকে উঠল। মেজগিন্নী হেসে উঠলেন—বললেন ওটা তোমার মেজঠাকুর্দার পাখীভাই!

—মানে?

—বুঝতে পারলে না? ওকে বলে ‘বউ কথা কও’ পাখী।

—মেজঠাকুমা পাখীগুলো তাহলে কি বলে মেজঠাকুমা?

—হরি হরি হরি! তাও জান না। তারা ডাকেই না। পাখীদের মেয়েগুলো ডাকে না গো। যদিই ডাকে—তবে নাতি কথা কও বলে!

তারপরই বললেন—এসে পড়েছি আমরা। দেখো, একটু সহ্য করে যেয়ো ভাই। বয়স সোত্তোরের কাছে, কিন্তু অভাবে অভাবে, আর স্বভাবেও বটে, মেজাজ মন বাহাত্তুরের অধম হয়েছে!

এতক্ষণে বাঁদিকের গাছটা থেকে ডানদিকে চোখ ফেরালে সুরেশ্বর। জ্যোৎস্নার মিষ্টি সাদা আলোয় শেওলাপড়া কালচে রঙের প্রকাণ্ড একটা ফটক। দুপাশে দুটো যেন কি? জানোয়ারের মূর্তি। দুটো সিংহ। ফটক দুটো কাঠের ভাঙা-ভগ্ন। ওপাশে একরাশ কালো জমাট পাথরের মত বাড়ীখানা স্পষ্ট হয়ে উঠল।

ঢুকে মেজঠাকুমা বললেন—এটা ঠাকুরবাড়ী। প্রণাম করে যাবে ভেতরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *