প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ১.৪

সুরেশ্বরের বয়স তখন চৌদ্দ পনের। উনিশ শো চব্বিশের শেষ, পঁচিশের আরম্ভ। ষোল আনা বুঝবার বয়স না হলেও বারো আনা বুঝবার বয়স হয়েছিল। হেমলতা প্রথম কথাটা চাপাই রেখেছিলেন; বলেছিলেন, যোগেশ্বর ইয়োরোপ বেড়াতে গেছেন। সারা ইয়োরোপ বেড়িয়ে তবে ফিরবেন। স্বামীকে দায়ী করেননি এমন নয়, তবে যতখানি করা উচিত তা করেননি। করেননি নিজের দৈহিক অক্ষমতার জন্য। দ্বিতীয় সন্তান মৃতকন্যা প্রসব করার পর থেকে তিনি স্বামীর মনের সঙ্গিনী ছিলেন, গৃহের গৃহিণী ছিলেন, তাঁদের জীবনের ধর্ম যেটা ছিল সে ধর্মানুযায়ী সহধর্মিণীও ছিলেন, কিন্তু নারী হিসাবে তো তাঁর কোন মূল্য ছিল না স্বামীর কাছে। মানুষের জীবনের তৃষ্ণা স্বভাবধর্ম। সেই তৃষ্ণায় যে জল জমে বরফ নয়—পাথর হয়ে গেল, তার কোন মুল্য থাকে তৃষ্ণার্তের জীবনে? যোগেশ্বর তৃষ্ণাকে যদি জয় করতে পারতেন, তবে তাঁর চেয়ে সৌভাগ্যবতী কেউ হত না। জীবনের অশ্বমেধ যজ্ঞ রাম করেছিলেন স্বর্ণসীতা নিয়ে। তা যদি যোগেশ্বর নাই পেয়ে থাকেন, তবে তাঁকে কোন দোষে দোষী করবেন? একান্ত নীরবে অটল ধৈর্যের সঙ্গে তিনি গ্রহণ করেছিলেন ঘটনাটিকে। এবং সংসার ও বিষয় এবং সুরেশ্বর এই দুটি তটের মধ্য দিয়ে সাগরসঙ্গমের অদূরবর্তিনী নদীর মত অনুচ্ছ্বসিতভাবে প্রবাহিত রেখেছিলেন নিজেকে।

কোন কিছুর বদল করেন নি। অর্থাৎ জীবনযাত্রার প্রণালীর। আক্ষেপের মালা নিয়ে জপ করতে বসেননি। ছেলের ধ্যান-ধারণারও পরিবর্তন করতে চান নি। কিন্তু ছেলে বদলেছিল।

কথাটা হেমলতা চেপে ছিলেন, কিন্তু বাইরের লোকেরা চাপেনি। তারা প্রকাশ করেই দিয়েছিল। পনেরো বছরের সুরেশ্বরের কানে সেটা পৌঁছেছিল। স্বাভাবিকভাবে অনিবার্য আঘাতে সে আহতও হয়েছিল। তার ফলে সে হঠাৎ হতে চেয়েছিল গোঁড়া হিন্দুর ছেলে। অর্থাৎ মনে মনে সে এর কারণ হিসেবে স্থির করেছিল যোগেশ্বরের অহিন্দু অভারতীয় মনই এ অনর্থের মূল। নতুন করে ধরেছিল খদ্দর। চরকাও কিছুদিন কেটেছিল। এবং মাকে তাগিদ দিয়ে উপনয়নের ব্যবস্থা করে উপবীতধারী হয়ে বছরখানেক সন্ধ্যা-আহ্নিক করেছিল, নিরামিষ খেয়েছিল, খালি পায়ে হেঁটেছিল, বাড়ীতে খালি গায়েও থেকেছিল। সংস্কৃতও পড়েছিল। বছর খানেকের পর অনুভব করেছিল সন্ধ্যা-আহ্নিকে সময় যায় অনেক—সুতরাং সন্ধ্যা-আহ্নিক ছেড়ে—শুধু গায়ত্রীমন্ত্র জপ করত। সেটার আরম্ভ হল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার সময় থেকে। পরীক্ষা দিয়েছিল সে ষোল বছর বয়সে। কিন্তু পাস করতে পারেনি। ফেল হয়েছিল অঙ্কে। শুধু একবার নয়—পর পর দুবার ফেল করে পড়া ছেড়েই দিল। এবং ছবি আঁকায় ঝুঁকল। চিত্রকর হবে সে। আদর্শ তার প্রথম নন্দলাল। তারপর যামিনী রায়। ভর্তি হল আর্ট স্কুলে। সেখানে বছর তিনেক পড়ে পরীক্ষা দিলে না-পড়া ছেড়ে দিলে এবং আবার ম্যাট্রিক দেবার জন্য পড়তে লাগল। অর্থের অভাব ছিল না। জমিদারির আয়, কলকাতার বাড়ীভাড়া, এক লাখ টাকার কোম্পানীর কাগজের সুদ-এ সবের কল্যাণে তার বর্তমান জীবন কেন, আমরণ ভাবী জীবনের দিগন্তও কি করব এ নিয়ে একবিন্দু সমস্যা ও এক ফোঁটা কালো মেঘের ছিটে বা ছায়া বুলোতে বা ফেলতে পারেনি। তার মা হেমলতাও এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হননি কারণ তিনি এই কয়েক বছরে সম্পত্তি পরিচালনা করে সম্পত্তিকে বাড়িয়েই তুলেছিলেন, তার হানি করেন নি। তবে সে কেমন মানুষ হবে এ নিয়ে তাঁর চিন্তা ছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত এমন কিছু কারণ ঘটেনি যাতে তাঁকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হয়।

এই বছরই খবর এসেছিল—ইয়োরোপে যোগেশ্বর মারা গেছেন। এতদিনের মধ্যে তিনি একখানা চিঠিও দেন নি। শেষ চিঠি এসেছিল—আমি হাসপাতালে। মরব কয়েকদিনের মধ্যে তাতে সন্দেহ নেই। একলা শুয়ে আছি। চন্দ্রিকা দেড় বছর আগে আমাকে ছেড়ে গেছে। আমি তাকে সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি তোমাকে ছেড়ে তাকে পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। একের পর যখন দুইয়ের দিকে মন ছোটে তখন সে দুয়েই বা থাকবে কেন? সে দশক পার হয়ে শতকের দিকে ছোটে। তারপর ডিজিটের পর ডিজিট বাড়ে। কিন্তু মজা কি জান—এক ডিজিট দু ডিজিটে, দু ডিজিট তিন ডিজিটে পরিণত যখন হয় তখন শূন্য বসিয়ে তা হয়। তার মানে আজ বুঝছি—ওর মূল্যটাই হল শূন্য। পূর্ণ ওই একটি সংখ্যা ওই এক। আর একটা সত্য বুঝলাম। সেটা সবার জীবনের কি না তা জানি নে, আমার জীবনের বটে। সেটা হল এই আমার প্রাক্তন—নারী হতে সর্বনাশ। আমার জন্য শোক করো না। আমি নিজে এর জন্য দুঃখিত নই। আমার অভিযোগ নেই আমার লজ্জা নেই-সংকোচ নেই ভয়ও নেই। এর জন্যে এক বছরের মধ্যে প্রহার খেয়েছি, জরিমানা দিয়েছি, জেলও খেটেছি মাস দুয়েক। তবু মরবার সময় মনে যেটা হচ্ছে সেটা কি তা ঠিক বলতে পারব না—ফ্রাস্ট্রেশন বললে আপত্তি করব না, তবে আমি তা মানি না। মনে হচ্ছে বুক জুড়ে রয়েছে শুধু বিরহ-অনন্ত বিরহ। ভেবে দেখেছি, তুমি যদি পাশে থাকতে তবুও তাই মনে হত। আমার কেউ নেই, আমি কাউকে পাইনি।

অনুরোধ করব আমার শ্রাদ্ধ তোমরা কোরো। কি জানি কল্পনা করে আনন্দ পাচ্ছি।

হেমলতা এতদিনে ভেঙে পড়েছিলেন। ঝড়ে যে গাছ ভাঙেনি সে গাছ একটি দমকা হাওয়ায় যখন একেবারে শুয়ে পড়ল—তখন দেখা গেল গোড়াটি ভিতরে ভিতরে একেবার ক্ষয়ে শেষ হয়ে গেছে। মাটি বা মূলের সঙ্গে সংযোগ আর ছিল না।

আগের চিঠি পড়ে হেমলতা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে পড়ে ছিলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে মনে মনে ভেবে নিয়ে উঠে বলেছিলেন—হঠাৎ ইয়োরোপ রওনা হয়েছেন মহারাজার কাজে। জানতে পেরেছিল শুধু অ্যাটর্নিরা—যাদের হাত দিয়ে দলিল এসেছিল। পরে হয়তো সবটাই প্ৰকাশ পেয়েছিল, কিন্তু হেমলতা অস্বীকার করেছিলেন। সেই হেমলতা ওই চিঠি পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। দিন তিনেক পর টেলিগ্রাম এসেছিল হাসপাতাল থেকে—যোগেশ্বর রায় মারা গেছেন…. তারিখ। তখন দশদিনে শ্রাদ্ধ করতে হলে হাতে আছে চারদিন। সেদিন অজ্ঞান হননি, বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন মুখ গুঁজে। সুরেশ্বর ছিল বাড়ীতেই। তিনদিন আগে হেমলতা চিঠি পেয়ে যখন অজ্ঞান হয়ে গেলেন তখনও সে বাড়ীতে ছিল। ঘরে বসে পড়ছিল সেকালের অতি আধুনিক সাহিত্যের মাসিকপত্র; পরীক্ষা দিয়ে অবধি সে আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হয়েছে। সময়টা চৈত্রের শেষ। তখনও পরীক্ষার খবর বের হয়নি।

যুগের হাওয়াটা তাকে কাঁচা সরল তরুণ বয়সের গাছের মতো দোলা দিচ্ছে। তার চেহারায় এর ছাপ লেগেছে। তখন বিরোধ চলছিল সাহিত্য ধর্ম ও সাহিত্যে অশ্লীল সত্যের সীমানা নিয়ে-যার পক্ষে শরৎচন্দ্র নরেশচন্দ্র বিপক্ষে শনিবারের চিঠির দ্বন্দ্ব চলছে। স্বয়ং কবিগুরু এতে মধ্যস্থতা করতে উদ্যত হয়েছেন। সে সময়টা একটা দারুণ উত্তেজনার কাল। সে উত্তেজনা তার রক্তেও সঞ্চারিত হয়েছে। ওই প্রবন্ধই পড়ছিল সে সেদিন। হঠাৎ ঝিয়ের চিৎকার শুনে ঘরে এসে মাকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে সে চিঠিখানা তুলে নিয়েছিল। চিঠিখানা পড়ে রেখে সে ডাক্তার ডেকেছিল। এবং সেইদিন থেকেই সে এই টেলিগ্রামের প্রত্যাশা করছিল। সে কাতর খুব হয়নি। বাপের উপর ক্রোধ তার একদিন হয়েছিল —আহ্নিক করেছে, খদ্দর ধরেছে, খালি পায়ে ঘুরেছে, নিরামিষ খেয়েছে—কিন্তু এখন সে খদ্দর ছাড়েনি বটে, তবে বাকীগুলো ছেড়েছে এবং বলতে গেলে আর একরকম হয়ে গেছে। মনে মনে বাপকে সমর্থন করার পথ খোঁজে।

হয়তো তাতে তার পরিচয়ের গৌরবটা বৃদ্ধি পাবে—প্রগ্রেসিভ বাপের প্রগ্রেসিভ ছেলে বলে এটাও কিছুটা কারণ হতে পারে, কিন্তু সবটা নয়। ওর মধ্যে ঝড় আছে—সেটা এলোমেলো ই বয়—কিন্তু যখন যেদিকে বয় তখন সেইদিকেই তার সমান গতি।

সে যাক। হেমলতা বেশিক্ষণ মুখ গুঁজে পড়ে থাকেন নি। অল্পক্ষণের মধ্যেই উঠে বসে সুরেশ্বরকে ডেকেছিলেন নায়েবকে ডেকেছিলেন।

নায়েব একজন আছেন, সে যোগেশ্বরের আমল থেকেই। একটা ছোট সেরেস্তাও আছে, কয়েকজন কর্মচারীও আছে। তাঁদের কলকাতায় বাড়ীভাড়া—দেশের জমিদারীর হিসেব আদায় তার ব্যবস্থা করতে হয়; মামলা-মকদ্দমাও আছে। সব থেকে জটিল হল জমিদারীর ব্যাপার। দু’পুরুষ আগে জমিদারীর পত্তন—তা তিন পুরুষ ধরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির মুখে চলেছিল এবং ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়নি। প্রথম পুরুষ কুড়ারাম ভটচাজের পুত্র সোমেশ্বর ভটচাজ—এফিডেবিট করে রায় খেতাব নিয়েছিলেন—তাঁর এক ছেলে বীরেশ্বর রায়; বীরেশ্বর ছিলেন নিঃসন্তান—তিনি আপনার ভাগ্নে কমলাকান্তকে পোষ্যপুত্র নিয়ে নাম রেখেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। রত্নেশ্বরের তিনি ছেলে—দেবেশ্বর, শিবেশ্বর, রামেশ্বর। দেবেশ্বরের দুই ছেলে—যজ্ঞেশ্বর, যোগেশ্বর। শিবেশ্বরের তিন বিবাহে সন্তান ষোলটি—তার মধ্যে জীবিত দ্বাদশটি। আটটি পুত্র চারটি কন্যা। রামেশ্বর ব্যারিস্টার, থাকেন এলাহাবাদে। তিনি বংশের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছেন ব্রাহ্ম হয়ে। অবশ্য দেবোত্তরের নিজের অংশের সম্পত্তি তিনি অতি সামান্য মুনাফা রেখে পত্তনী দিয়ে হস্তান্তর করেছিলেন অপর দুই ভাইকে এবং নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রী করেছিলেন মেজভাই শিবেশ্বরকে। ভগবানের অংশ বিক্রী করেছিলেন বড়ভাইকে। এসব করার পর ব্রাহ্ম হয়েছিলেন তিনি।

হেমলতা উঠে বলেছিলেন—এঁদের সকলকে খবর দিতে হবে। টেলিগ্রাম করুন।

নায়ের বলেছিল-তা দিচ্ছি। কিন্তু টেলিগ্রাম কেন? চিঠি দিলেই তো হয়। আজ লিখলে কাল পাবেন সব।

—না। টেলিগ্রাম করুন। সকলকে অশৌচান্তের কামানোর জন্য আসতেও লিখুন।

—বড়বাবুর (অর্থাৎ যজ্ঞেশ্বরবাবুর) তো আসবার উপায় নেই—ইনসলভেন্সির কেস চলছে! তিনি ওয়ারেন্টের ভয়ে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে হার্টের রোগী সেজে পড়ে আছেন। ছেলেরা

—আমাদের কর্তব্য করুন। মেজ খুড়শ্বশুর গোঁড়া হিন্দু ধার্মিক লোক—তিনি তো আসবেন। নায়ের বলেছিল—তার থেকে চলুন না আমরাই কীর্তিহাটে যাই। সেখানেই কামান হবে। ঠাকুরবাড়ীতে হবে। মানে–তাতে—

চুপ করে গিয়েছিল নায়েব। হেমলতা তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কথাটার শেষ শুনবার জন্য। নায়েবকে থামতে দেখে বলেছিলেন—বলুন।

—মানে, মেজকর্তা তো খুবই গোঁড়া। এখানে কামান হলে না-আসতেও পারেন। পরে বলতে পারেন—অশৌচ আমরা নিইনি। ইয়োরোপে মরেছে—জাত গেছে—ক্রীশ্চান হয়ে গেছে এসব তো মাঝে মাঝে বলেন সেখানে শুনতে পাই। উনি তো মামলাবাজ লোক। এর পর অশৌচ জাতিরা নেয়নি সুতরাং দেবোত্তরের সেবায়েত স্বত্ব নিয়ে একটা কিছু বাধানো বিচিত্র নয়। ওখানে গেলে যা হয় মুখোমুখি হয়ে যাবে। আর শ্রাদ্ধটা ঠাকুরবাড়ীতে হলে—উনি যাই করুন—টেঁকবে না!

হেমলতা অ্যাডভোকেট মামার কাছে মানুষ, কুড়ি বছর পর্যন্ত সেখানে মামলা মকদ্দমার কথা শুধু কানে এমনি শুনতেন না-চৌদ্দ বছর বয়স থেকে মামাকে তাঁর বরাত মত আইনের রেফারেন্সের বইও টেনে বার করে দিতেন। তারপর যোগেশ্বরের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে যোগেশ্বর তাঁকে জমিদারী আইন এবং বিশেষ করে তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তির মূল গ্রন্থির যে দলিল তার সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। যোগেশ্বরের বিদেশ চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি নিজেই সব চালিয়েছেন। সুতরাং কথাটা তার বুঝতে কষ্ট হল না।

সুরেশ্বরও বুঝেছিল। বুঝবার বয়সও তার হয়েছে। আইনমতে সে এখন সাবালক। একুশে পা দিয়েছে। এতদিন নাবালকের গার্জেন ছিলেন মা হেমলতা। কারণ যোগেশ্বর ইয়োরোপে যাবার সময় সব ছেলেকে দিয়ে গিয়েছিলেন।

ব্যাপারটা হল হিন্দু দেবোত্তরের সেবায়েত অহিন্দু হয়ে গেলে থাকতে আর পারে না, তখন সে অংশ এসে বর্তায় অন্য অংশীদারদের বয়সে যিনি জ্যেষ্ঠ তাঁর কাছে। সে হিসেবে মেজকর্তা শিবেশ্বর রায়ের ব্যঘ্র হয়ে ওঠারই কথা। শিবেশ্বর রায়ের তিন বিয়ে, ষোলটি সন্তান—তার বারোটি বেঁচে এবং তার ছয়টি পুত্র। এবং শিবেশ্বর ইতিমধ্যে আকণ্ঠ ঋণে আবদ্ধ। ঋণের দায়ে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির সবটুকুই চলে যাবে তা সকলেই বোঝে। দেবোত্তর বিক্রী হয় না তবে পওনী বিলিবন্দোবস্ত হয়—তাও তাঁকে করতে হবে, কিছু করেছেনও। এই অভিনব ফন্দিটি রামেশ্বরের আবিষ্কার। আইনের সুচী-ছিদ্রপথে যে চালাতে পারে সে হাতীও পার করে নিয়ে যায়। রামেশ্বর বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেবার আগে এই ফাঁকটি আবিষ্কার করেছিলেন। দেবোত্তর জমিদারীর আয় ছিল বত্রিশ হাজার টাকা। এই দেবোত্তরে ছ-আনা রকমের মালিক ছিলেন। দেবেশ্বর এবং শিবেশ্বর রামেশ্বর পাঁচ আনা হিসেবে অংশীদার ছিলেন। দেবোত্তরে দেবসেবা ইস্কুল টোল দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতির খরচ বরাদ্দ ছিল বারো হাজার টাকা। বাকী কুড়ি হাজার টাকা সেবায়েৎ অর্থাৎ এই বংশের ছেলেদের পড়াশুনা খাওয়াপরা এবং চিকিৎসাপত্রের ব্যবস্থা ছিল এবং শর্ত ছিল কোন প্রকার অহিন্দুজনোচিত কর্মে বা ভোগে-বিলাসে ব্যয় করতে পারবেন না। দলিলকর্তা রত্নেশ্বর রায় ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন- ইচ্ছামত ব্যয়ের অধিকারী হলেও এ থেকে দান-ধ্যান করেন এই তাঁর কাম্য। একটা ফাঁক তিনি রেখেছিলেন ইচ্ছা করেই শর্ত রেখেছিলেন—ঈশ্বর-না-করুন যদি কোন সেবায়েতের অবস্থাবিপর্যয় ঘটে তবে কন্যার বিবাহ পুত্রদের শিক্ষা পিতৃমাতৃ শ্রাদ্ধের কালে অভাব ঘটিলে দেবসেবা প্রভৃতির বরাদ্দ বারো হাজার টাকা বজায় রাখিয়া উদ্বৃত্ত লাভ—যাহা আমার বংশধরেরা সেবায়েত হিসাবে ভোগ করিবার হকদার রহিলেন—তাহা অর্থাৎ কুড়ি হাজারের মধ্যে আপন লভ্যাংশ—পত্তনী দরপত্তনী দরাদর পত্তনী বিলি করিতে পারিবেন। কোন কারণে বিক্রয় করিতে পারিবেন না।

রামেশ্বর এই ফাঁক দিয়ে ফাঁকি দিয়েছিলেন স্বর্গত রত্নেশ্বর রায়ের অভিপ্রায়কে। তিনি বিয়ে করে বিলেতে গিয়েছিলেন–বিলেতে থাকতেই সে স্ত্রী মারা যান। একটি মাত্র কন্যা ছিল তাঁর। সেই কন্যাটির রাজপুত্র দেখে বিবাহ দেওয়ার অজুহাতে দেবোত্তর সম্পত্তি পত্তনী বিলি করে মুনাফা বিক্রি করেন। সে সম্পত্তি নিয়েছিলেন তখন দেবেশ্বর এবং শিবেশ্বর। রামেশ্বর দেবেশ্বরকে কথাটা গোপন করেননি, বলেছিলেন-আমি একটি মেয়েকে বিয়ে করব, অসবর্ণ, তারা অবশ্য ব্রাহ্ম। কিন্তু সে হলে তো মেজদা আমাকে দেবোত্তরের সেবাইত থাকতে দেবে না। সুতরাং আমি যেটা পাব সেটা আমি নিয়ে নিতে চাই।

দেবেশ্বর বিচিত্র চরিত্রের লোক ছিলেন। বলেছিলেন—কর তুমি বিক্রী, আমি বাধা দেব না। কারণ সম্পত্তির অধিকারের জন্য স্বাধীনতা যাবে-তার সমর্থন কখনই করব না। আমার কাছে ধর্মের চেয়ে জীবন বড়—দেবতার চেয়ে মানুষকে বেশী ভালোবাসি। তুমি যদি মেয়েটিকে ভালবেসেই থাক তবে নিশ্চয় বিয়ে করবে এবং তোমার অংশের মুনাফা সবই তুমি পত্তনী দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বিক্রী করে দিতে পার। আমি আপত্তি করব না—প্রকাশও করব না।

কিনেছিলেন দেবেশ্বর অগ্রণী হয়ে। সুতরাং শিবেশ্বর পিছিয়ে থাকেন নি। দেবেশ্বর অর্ধেক পত্তনী নিয়েছিলেন—শিবেশ্বরও অর্ধেক নিয়েছিলেন।

তারপর এই দীর্ঘকালের মধ্যে শিবেশ্বর অনেক সম্পত্তি ওই পথেই পত্তনী দর পত্তনী বিলি করে করে এখন শুধু দেবোত্তরের আয়টুকুর উপর নির্ভর করে আছেন।

খরচ অনেক। তিনটি বিয়ে-বারোটি সন্তান বেঁচে-ছয় কন্যার বিয়ে দিয়েছেন-অনেক মামলা করেছেন। অনেক যাগযজ্ঞ করেছেন। প্রথম প্রথম উৎসবে কলকাতার থিয়েটার আনিয়েছেন। কীর্তিহাটে মহাকালী অ্যামেচার থিয়েটার খুলেছিলেন, নিজে নায়কের পার্ট করতেন, ড্যান্সিং টুপ পুষতেন মাইনে দিয়ে—তিনটি গাইয়ে সুদর্শন ছোকরা রেখেছিলেন ফিমেল পার্টির জন্যে।

এখন সে সব নেই, এখন আছে ছয় ছেলের সংসারে ছেলে-বউয়ে এগারজন, তাদের ছেলে মেয়ে সতেরোজন। ছোট ছেলে অতুলেশ্বরের তখনও বিয়ে হয়নি। ছেলেরা প্রথম আমলে বাবু ছিলেন; ঘোড়ায় চড়তেন, শিকার করতেন, মদ খেতেন। হাতীও একটা কিনেছিলেন শিবেশ্বরবাবু। এখন হাতী-ঘোড়া নেই। ছেলেরাও লেখাপড়া কেউ ভাল শেখে নি। আটজনের মধ্যে দুজন এন্ট্রান্স পাশ করেছিল গ্রামের ইস্কুল থেকে। বাকীরা কেউ ফোর্থ ক্লাস—কেউ থার্ড ক্লাস—কেউ সেকেন্ড ক্লাস অবধি, একজন ম্যাট্রিক ফেল।

নাতিরা কয়েকজন সুরেশ্বরের থেকে বড়, কয়েকজন সমবয়সী-বাকীরা ছোট। এরই মধ্যে সাতষট্টি বছর বয়সের শিবেশ্বর তৃতীয় পক্ষের ত্রিশ বছরের স্ত্রীকে নিয়ে ধর্মকর্ম যাগযজ্ঞ করেন, স্বতন্ত্র থাকেন ছেলেদের সংসার থেকে। জমিদারীতে বসেছিলেন, মামলা-মকদ্দমা ভাল বোঝেন, বাকী খাজনার প্যাচে গরিব প্রজার অনেক রায়তী জোত ছেলেদের নামে কিনে দিয়ে তাদের আলাদা করেছেন। দেবোত্তরে যে অন্নভোগ হয়—তা তিনি কমান নি, সেই ভোগের অন্ন ছেলেরা নাতিরাই খায়। মা-কালী আছেন-মৎস্যভোগ হয় নিত্য। এ ছাড়া তারা সব কিছুটা ভাজাভুজি করে নিয়ে সেইগুলি নিয়ে চলে যায় নাটমন্দিরে। থাকে থাকে বা আলাদা আলাদা সারিতে বসে। গৃহিণী বধুরা দাঁড়িয়ে থেকে আপন আপন সংসারকে খাওয়ান। নিজের নিজের তরকারি পরিবেশন করে দেন।

রাত্রের আহারটা শুধু বাড়ীতে।

শিবেশ্বর কিন্তু বাড়ীতেই খান। তিনি ছেলেদের থেকে পৃথক। থাকেন পৃথক খান পৃথক! ওই প্রসাদ আসে—পায়সান্নের প্রসাদ। রাত্রে শীতলে লুচির সঙ্গে ক্ষীর মিষ্টের ব্যবস্থা আছে—সেইটে তাঁর জন্যে যায়। আর যায় সকালে বাল্যভোগের ছানা-মিষ্টান্ন।

শিবেশ্বর নিজে বৈষ্ণব। বাড়ীতে কালী আছেন—আর রাজরাজেশ্বর শালগ্রাম শিলা আছে—খোদ আদিকর্তা সোমেশ্বরের প্রতিষ্ঠিত। তারপর রত্নেশ্বর রায় যুগলবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

বংশ হিসাবে শাক্তের বংশ। কিন্তু শিবেশ্বর বৈষ্ণবমন্ত্র চেয়ে নিয়েছিলেন। তবু বাড়িতে মা-কালী আছেন বলে মাছ-মাংস খান। মদ খান না। গাঁজা খান।

প্রথম যখন গাঁজা ধরেন তখন গাঁজা তৈরী করবার লোক ছিল। গোলাপজলে ভিজানো গাঁজা অগুরু চন্দনের তক্তি বা ছোট্ট পার্টার উপর রেখে কাটা হত। রুপোর কল্কে ছিল-সেই কল্কেতে গাঁজা সেজে পরিচারক হাতে ধরত এবং শিবেশ্বর টানতেন মুখ লাগিয়ে। গাঁজা হাতে ধরে খেলে হাতে গন্ধ ওঠে—সেই জন্যে ওই ব্যবস্থা ছিল। তারপর আতর মাখতেন, গায়ের গন্ধ ঢাকতে।

এখন সে সব দিন নেই, এখন নিজে সেজে নিজের হাতে ধরেই খেয়ে থাকেন। নিজে তিলকফোঁটা কাটেন—গলায় কণ্ঠী আছে। স্ত্রীকেও কাটতে হয় ফোঁটা তিলক। গলায় তুলসীর কণ্ঠীও পরতে হয়।

এই শিবেশ্বর রায়। যোগেশ্বরের খুড়ো। তিনি এখন বেঁচে, বেশ শক্ত হয়েই বেঁচে আছেন। আজও নিত্য সকালে মামলা সেরেস্তা নিয়ে বসেন।

সুতরাং হেমলতা একটু থমকে গিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন—কিন্তু সে তো তাঁর বলতে গেলে নিজের এলাকা। সেখানে যদি গোলমাল করে সব পণ্ড করে দেন।

নায়েব বলেছিল—তা হোক মা তাঁর নিজের এলাকা। একটা কথা তাঁর এলাকাতেও সত্যি বলে সবাই জানে। সেটা হল তিনি ওখানকার লোকদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে রেখেছেন। ওখানে উনি ছাড়া আপনার আরও অনেক ক’ঘর দশরাত্রির জ্ঞাতি আছে। তাদের আপনাদের সঙ্গে বৈষয়িক শত্রুতা নেই। তাঁরা সব এসে কামান করবেন, খাবেন।

—আসবেন?

—আসবেন। হেসে নায়েব বলেছিল—আমি ওখানকার লোক, ব্রাহ্মণ, আপনাদের জ্ঞাতি নই—তবে আপনাদের জ্ঞাতিরা সবই আত্মীয় বন্ধু। আমি তাদের জানি। তা ছাড়া এতকাল জমিদারি সেরেস্তা চালালাম, কলকাঠি কিসে কোন প্যাঁচে নড়েচড়ে তাও জানি। কোন ভয় নেই চলুন। ক্রিয়া করতে হবে ভালো করে। সমারোহ করে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বিদায় করবেন মোটা করে। আর দরকার বুঝলে কোন কিছুতে একটা মোটা দান! বুঝলেন কালটা এখন আলাদা। এখন ঘোড়া হাতী পালকী পালঙ্ক দিয়ে দানসাগর থেকে কোন কিছুতে দান করলেই লোক খুশী। কিছুতে, ধরুন ইস্কুল কি ডিসপেন্সারি কি যাতে হোক হাজার পাঁচেক টাকা দান করুন-লোকে খুশী হয়ে যাবে। তাছাড়া ব্রাহ্মণদের মোটা ভোজন-দক্ষিণা। ছাঁদা। আর কাঙ্গালি বিদায়। খুড়োমশায় যত খেলুন সে খেলা চলবে না।

সুরেশ্বর বসে বসে অবাক হয়ে শুনছিল।

এই একুশ বছর বয়েসে তার চোখের উপর অনেক ওলোট-পালোট হল। ছেলেবেলা থেকে ইংরেজীনবীশ বাপের সঙ্গে ইংরেজীনবীশ হয়েই গড়ে উঠেছিল। বাপ মদ খেয়েছে সে দেখেছে। মাকে নিয়ে থানা টেবিলে বসে খেয়েছে। বাপ তাকে গান-বাজনার উৎসাহ দিয়েছেন। মন তার তৈরী হচ্ছিল—দেশী উনোনের উপর চড়ানো চাটুতে দেশী রুটির মত নয়, ইংরেজী অনুকরণে দেশী ‘বেকারির তন্দুরিতে পাঁউরুটির মত। তারপর হঠাৎ একুশ সালে আধকাঁচা অবস্থায় অসহযোগ আন্দোলনের ওলোট-পালোটে চড়ে বসেছিল দেশী উনোনে চড়ানো চাটুর উপর। কিন্তু সেখানেও সে পুরো তৈরী হবার আগেই ইয়োরোপের নতুন নতুন বাদের জোয়ারে দেশী উনোনের আগুন গেল নিভে। তবুও তার বাপের শেষ আচরণের জন্য কিছুকাল ওই গরম চাটুর উপরেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু চাটু ঠান্ডা হয়ে গেল। সে এবার আবার এসে ঢুকল খাস ইয়োরোপীয় বেকারিতে। যেখানে মানুষের হাতের ছোঁয়াচও নিষিদ্ধ—সবই মেসিনে হয়। যাকে বলে মেসিন মেড ব্রেড।

তবুও বলতে কি, কীর্তিহাটের পিতৃপুরুষের রাজরাজেশ্বর এবং রাধাগোবিন্দের ভোগের জন্য যে পদ্মপাতার মত পাতলা এবং ওই আকারের রুটি তৈরি হয় তার প্রতি একটা গোপন প্রশংসা তার মনে মনে ছিল। ধর্ম ভগবান এ নিয়ে একটা সপ্রশংস কিন্তু উৎসাহহীন আকর্ষণ তাকে টানত। মেজ ঠাকুরদার ধর্মজীবন সম্পর্কে সে অনেক কথা শুনেছে। ভাল লাগত। কিন্তু মেজ ঠাকুরদার তিনটি বিয়ে তার ভাল লাগত না। মামলা মকদমার কথাও শুনত। সে খানিকটা মন্দ লাগত, খানিকটা আবার ভালও লাগত। বিশেষ করে মামলাবাজ জোতদার প্রজাদের সঙ্গে এবং বর্ধিষ্ণু পত্তনীদের এবং প্রতিবেশী জমিদারদের সঙ্গে কঠিন জেদে মামলা করে জেতার গল্পগুলি খুব ভালো লাগত। কিন্তু সেদিন নায়েবের মুখের কথাগুলি তার কপালে প্রশ্নের কয়েকটি কুঞ্চন-রেখা তুলে দিল। সেগুলি কীর্তিহাটে গিয়ে ত্রিপুণ্ড্রকরেখার মত দাগ টেনে স্থায়ী হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *