কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – ১৭

১৭

কলকাতায় বেলা বারোটার মধ্যেই পৌঁছেছিলাম এবং মোহনডাঙ্গার খুড়ীমার নির্দেশমত অর্চনার ফটো নিয়ে বিকেলবেলাতেই গেলাম ভবানীপুরে। অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়ী!

বাড়ীটা নিশ্চয় চেনা বাড়ী। এককালে অ্যাডভোকেট বি এন মুখার্জি ছিলেন কলকাতার একটা মস্ত নাম। যত বড় উকীল—তত ছিল দয়া। দয়াটার উৎস ছিলেন তাঁর মা অন্নপূর্ণা দেবী। ভবেনবাবু কত বঞ্চিত দরিদ্রের পক্ষ নিয়ে যে বিনা ফীতে লড়েছেন এবং জিতেছেন, তার সংখ্যা নেই। টাকা নিতেন জমিদার ব্যবসাদারদের কাছে। জমিদার প্রজার যে সব মকর্দমা হাইকোর্টে আসে সে সবই প্রায় স্বত্বের মকর্দমা। তাতে জমিদার পক্ষের ব্রীফ তিনি নিতেন না। মায়ের বারণ ছিল। তবে জমিদারে জমিদারে, কি জমিদার বাড়ীর পার্টিশন স্যুট-এ তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। তাঁর ছেলে এন. এন. মুখার্জি—তাঁর ছিল ক্রিমিন্যাল প্রাকটিস। অধিকাংশ স্বদেশী মকদ্দমায় তিনি থাকতেন। ফিস নিতেন না। ভবেনবাবু ক্রিমিন্যাল প্রাকটিস করতেন না এবং কোন কেসে তিনি কারুর নিচে কাজ করতেন না, কিন্তু মানিকতলা বোমার কেসে একজন সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। সে তাঁর মায়ের আদেশে। বলেছিলেন—ওরে, আমি মেদিনীপুর জেলার মেয়ে। ক্ষুদিরাম মেদিনীপুরের ছেলে। সে-ই বাংলা দেশে প্রথম ফাঁসি গেল। এ কেসে ছোট হয়েই তুই থাক। তাতে তোর মান যাবে না। মূল ডিফেন্সের কাজ করবেন সি আর দাশ। সে তো এই নাড়ির লোক। তাকে তো জানিস। লজ্জা কি?—

ভাবতে ভাবতেই যাচ্ছিলাম—অর্চনার এসব কথা তাঁকে বলব কি না। মধ্যে মধ্যে সব চিন্তা ভাবনা ওলোট-পালোট করে দিয়ে হঠাৎ ভয় হচ্ছিল, যদি নাম শুনেই অন্নপূর্ণা ঠাকরুণ বলেন, বলে দে আমার দেখা করবার সময় নেই। কি বলবার আছে তা যেন নিচের কাউকে বলে দেয়। কিংবা নগেনের সঙ্গে দেখা করতে বল।

গাড়ীখানা ময়দানের দিক থেকে হরিশ মুখুজ্জে রোডে ঢুকে খানচারেক বাড়ীর পরেই দাঁড়াল।

পি জি হসপিটাল থেকে একটু দক্ষিণে—যে দিকটায় মুরশিদাবাদের এক রাজাবাহাদুরের বাড়ী আছে সেই দিকটায়।

বাড়ীটা সকলেই চেনে। তুমি ব্যারিস্টারের মেয়ে। অ্যাডভোকেট এন. এন. মুখার্জির নাম বোধ হয় জান।

প্রথমেই দেখা হল নগেনবাবুর সঙ্গে। সুন্দর সুপুরুষ চেহারা। রায়বাড়ীর সৌন্দর্যের স্পর্শও আছে, আবার একটা স্বাতন্ত্র্য্যও আছে। এঁদের রঙ রায়বংশের মত উজ্জ্বল নয়। এক ধরনের খুব মাজা রঙ আছে শ্যামবর্ণের মধ্যে—এ-রঙ সেই রঙ। রায়বংশের চোখ বড় এবং একটা প্রখরতা আছে দৃষ্টিতে; নগেনবাবুর চোখ ছোট নয়, টানা চোখ এবং দৃষ্টির মধ্যে গাম্ভীর্য সত্ত্বেও একটি মাধুর্য আছে।

গাড়ীটা বাড়ীর কম্পাউন্ডে ঢুকে গাড়ীবারান্দায় দাঁড়াতেই নগেনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু এগিয়ে এলেন। তিনি দাঁড়িয়েই ছিলেন বারান্দার উপর

আমি মনে মনে সম্বন্ধ নিয়ে অনেক হিসেব করে গিয়েছিলাম। আসবার সময় মোহনডাঙ্গার খুঁড়ীমা আর মনোহরপুরের খুড়ীমা আমাকে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে মাথায় পুষ্প ঠেকিয়ে বলেছিলেন—দেখ বাবা, কোনমতে যেন সম্পর্ক ভুল করবিনে। অন্তত অন্নপূর্ণা ঠাকুমার কাছে। বুঝলি? উনি তোর বাবার ঠাকমা, রায়বাহাদুরের বোন। ওঁর বোধহয় তিন নাতি–নগেনবাবু উকীল, সুরেনবাবু

ধনেশ্বর কাকা বলেছিলেন—কর্পোরেশনের কাউন্সিলার উনি। কন্ট্রাক্টারী করেন। ছোটর নাম বীরেন; তিনিও কন্ট্রাক্টারী বিজনেসে আছেন। তাঁকে বোধ হয় পাবে না। এঁরা হলেন অন্নপূর্ণা ঠাকুমার নাতি—সম্পর্কে তোমার কাকা। বুঝেছ? ঠাকমা—তোমার তাহলে প্রপিতামহী—কি বলবে গো তাহলে? অ-সৌরভবউ!

জগদীশকাকা বসে ছিলেন চুপচাপ। তিনি সেদিন থেকে একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। শুনেছিলাম গাঁজা বেশী খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন—ওই ঠামাই বলবে। ঠাকুমা থেকে উপরের সবাই ঠাকুমা।

ধনেশ্বর কাকা বলেছিলেন—যেমন তোমার বুদ্ধি। তার উপর ওই ছাইগুলো চব্বিশ ঘণ্টা খাচ্ছ।

হয়তো এই নিয়েই ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া একটা বেধে যেত। কিন্তু মোহনডাঙ্গার খুড়ীমা বলেছিলেন—বড়-মা বলিস বুঝলি! বড়-মা!

জগদীশ্বরকাকা বলে উঠেছিলেন—ঠাকুরমার মা-বড়-মা—

ধমক দিয়েছিলেন—অবশ্য মৃদুস্বরে মনোহরপুরের খুড়ীমা অর্চনার মা—হ্যাঁ। তাই বলবে। দিদি বলছেন শুনছ না।

—তবে তাই বলুকগে।

তর্কটা ওখানেই শেষ হয়েছিল-আমার বড়-মা কথাটা ভাল লেগেছিল। ভারী মিষ্টি হৃদ্য মনে হয়েছিল।

নগেনবাবু আমার কাছে এসে বললেন—আসুন।

আমি টপ করে তাঁকে প্রণাম করে বললাম—আমি আপনার ভাইপো, আমার নাম সুরেশ্বর রায়, ঈশ্বর যোগেশ্বর রায়ের ছেলে।

সবিস্ময়ে তিনি বললেন—তুমি যোগেশ্বরদার ছেলে! তুমি তো আর্টিস্ট শুনেছি। এসো, বললেন—তুমি এসো, এসো। ভেতরে এসো।

বাড়ীর ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম। প্রশস্ত হল। দামী ফার্নিচার। সোফা-কৌচের ঢাকাগুলো ধবধবে খদ্দরের। নগেনকাকাও খদ্দরের কোঁচানো ধুতি আর আধবাঁইয়া পরে রয়েছেন।

একটু মিইয়ে গেলাম সুলতা। কারণ দেখলাম এঁদের বাড়ীতে গান্ধীয়ানাই হোক আর কংগ্রেসীই হোক, বেশ একটু চড়া সুরেই বাঁধা আছে।

বসেই বললেন—অনেককাল তোমাকে দেখিনে হে! ১৯১৬।১৭ সালে সেই যে যোগেশ্বরদা আসা বন্ধ করলে, তারপর আর এল না। তখন তোমাকে দেখেছিলাম। তুমি আসতে। ফুটফুটে ছেলেটি। ঠাকুমা বলতেন—অবিকল আমার দেবু। মানে তোমার পিতামহ দেবেশ্বর রায়। মায়ের ভাইপো তো উনি!

—আমার মনে আছে।

—মনে আছে? তোমার মেমরি তো খুব শার্প। কিন্তু এমন চেহারা হল কি করে? রঙটা পুড়ে গেছে। একটা কালচে ছাপ পড়েছে। তারপর একালে, সেই সেকালের মত দাড়ি-গোঁফ—

—আজ এক বছরের ওপর কীর্তিহাটে রয়েছি—ওখানকার রোদে—

—আজকাল কীর্তিহাটে গেছ নাকি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। সেটেলমেন্ট হচ্ছে, তার টানে যেতে হয়েছে।

—আই সী। হ্যাঁ, আমরাও ক’খানা নোটিশ পেয়েছিলাম—ওখানে কি কি যেন ঠাকুমার বাবা দিয়ে গিয়েছিলেন। তা আমরা ও ক্লেম করিনি। ওখানে খানিকটা জমি-পুকুর নিয়ে কি করব ‘আমরা।

—আমি সেসব আপনাদের নামে রেকর্ড করিয়েছি।

—করিয়েছ? তোমাদের মেজতরফ রেকর্ড করাতে দিলে?

—তা দেবে বইকি!

—নো-নো-নো। আই নো দেম। দে আর—আই মীন দি হোল ফ্যামিলী অব শিবেশ্বরকাকা; একটু থেমে বললেন—দেখ দারিদ্রদোষো গুণরাশিনাশী। অবশ্য ধনেও তাই হয়। ধন থেকেই সূত্রপাত, দোষগুলো তখনই ধরে, তারপর ধন ফুরিয়ে গেলে দারিদ্র্যের ছোঁয়াচ লাগলে তখন পচতে শুরু করে। সুখেশ্বর মধ্যে মধ্যে সাহায্যের জন্য চিঠি লিখত আমাকে। কিছু কিছু দিয়েছি তখন। তারপর বুঝলাম এটা ওর স্টান্ট। তারপর ধনেশ্বরের ছেলে ব্রজেশ্বর এসেছিল বার-দুই। হি ইজ এ স্মীক।

আমি চুপ করে রইলাম। এবং অনুভব করলাম রায়বংশের প্রতি বিদ্বেষ এঁদের মজ্জাগত বা বংশগত ধারায় পরিণত হয়ে গেছে।

নগেনকাকা এবার বোধহয় অনুভব করলেন—কথাগুলো বলা অন্যায় হয়ে গেছে। তিনি এবার বললেন—থাক ওসব কথা। সত্যং ব্রুয়াৎ প্রিয়ং ব্রুয়াৎ—অপ্রিয় সত্য সত্য হলেও না বলাই ভালো। এখন কি খবর বল। সব ভালো তো?

বললাম- ভালো নয়। অনেকটা ঝড়ঝাপ্টা বয়ে গেল।—

—কি? মামলা-মকদ্দমা?

—হ্যাঁ। তবে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে নয়। মেদিনীপুরের কাণ্ড তো জানেন সব। পরপর তিন-তিনটে ম্যাজিস্ট্রেট মার্ডার হল—

—খুব জানি। মেদিনীপুর ওয়েস্ট বেঙ্গলে, রাজস্থানের চিতোর। বাংলাদেশে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বলি ষোল বছরের ক্ষুদিরাম। ১৯২১ সাল থেকে সারা বাংলায় ইউনিয়ন বোর্ড হল, মেদিনীপুর হতে দেয়নি। কীর্তিহাটে সুখেশ্বর ইউনিয়ন বোর্ড করেছিল। পেডি মার্ডার কেসে বিমল দাশগুপ্তকে প্রসিকিউটর করে হাইকোর্টে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল হয়েছিল। সে-কেসে ডিফেন্সে আমি ছিলাম। কলেজিয়েট ইস্কুলের হেডমাস্টার, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হীরালাল দাশগুপ্ত আর নারায়ণ মুখুজ্জেমশায়কে সাক্ষী দিতে কিছুতেই রাজী—রাজী কেন বাধ্য করাতে পারেনি পুলিশ। নমস্য ব্যক্তি তাঁরা। এমন শিক্ষক না হলে এমন ছাত্র হয়!

আমি বললাম—যেন একটা সুযোগ পেলাম, বললাম—আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই ঝড় এসে বেজেছে কীর্তিহাটের রায়বাড়ীতে।

—বল কী? চমকে উঠলেন নগেনজ্যাঠা। সেই ঝড়? তুমি বাধিয়েছ নাকি? বিদায় সত্যাগ্রহের প্রায়শ্চিত্ত! হাসলেন। তারপর বললেন—কি করেছ? টাকাকড়ি দিয়েছ, সেটা জেনেছে পুলিশ? না, আরো কিছু? কংগ্রেস-ফ্ল্যাগ-ট্যাগ তুলেছ? মিটিং-টিটিংয়ে প্রিজাইড করেছ?

বললাম—না। তার থেকে অনেক বেশী।

—অনেক বেশী?

.

অতুলেশ্বরের বিবরণ থেকে মেজদির জেল, বিমলেশ্বর কাকার অ্যারেস্ট পর্যন্ত সব বললাম তাঁকে। তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে শুনলেন। ঘন ঘন মুখের ভাব তাঁর বদলাচ্ছিল। অবশ্য অর্চনার নাম একটুখানি উল্লেখ করে ছেড়ে দিলাম। বললাম—জগদীশ্বরকাকার অর্চনা বলে একটি মেয়ে আছে, তাকে সুদ্ধ পুলিশ জড়াতে চেষ্টা করেছিল।

—মানে?

—মানে, মেয়েটি মেজদিকে খুব ভালোবাসত। আর বিমলেশ্বরকাকা যখন ঘরে বসে কাঁদতেন আর বলতেন—মা কালী, তুমি তো সাক্ষাৎ বিরাজ করছ; প্রভু রাজরাজেশ্বর, তুমি তো সব দেখছ, তবু তার প্রতিকার করছ না তোমরা? অর্চনা শুনে বলেছিল—ন-কাকা, একটা কথা বলব? তোমাদের মা কালী কি বাদশাহী আমলের তাতারিণী-প্রহরিণী, না রাজরাজেশ্বর তোমাদের দারোয়ান-পাইক যে, তোমাদের হয়ে খাঁড়াচক্র নিয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে ছুটবেন? দাও তো দুবেলা ফুল—জল। আর একথালা করে আতপের ভাত। দাও না, দেখাও। দেখিয়ে নিয়ে নিজেরা খাও। এগুলো যারা বলে, তারা ভক্ত না মাথা, কাপুরুষের দল। প্রতিকার দেবতা করে দেয় না—মানুষকেই করতে হয়। তিনি অভয় দেন, সাহস দেন। এমন করে ঘরে বসে কালী কালী আর কেষ্ট কেষ্ট করে কেঁদো না।

কথাটা চাপা আছে। আছে তাই পুলিশের হাত থেকে বেঁচেছ।

স্তম্ভিতের মতে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন—এমন মেয়ে? রায়বাড়ীতে এতবড় পরিবর্তন ঘটে গেছে? বল কি হে? কিন্তু হাইকোর্ট থেকে ব্যারিস্টার নিয়ে গেলে আর আমাকে জানালে না? বল—এখন কি করতে হবে? বিমলেশ্বরের কেসে যেতে হবে?

বললাম- বিমলেশ্বর কাকার কেসে কনভিকশন হবেই। কারণ তিনি অত্যন্ত ধর্মবাতিকগ্রস্ত লোক; কনফেশন তিনি করেছেন, কুকরিখানা বের করে দিয়েছেন। শুধু অর্চনার কোন কথা তিনি বলেন নি। বলবেনও না। এবং যা বলেছেন তা উইদড্রও করবেন না।

—স্ট্রেঞ্জ! একটু চুপ করে থেকে বললেন—তবু আমি যাব। কাগজপত্র এনেছ? একটু চুপ ক’রে থেকে বললাম-আমি ও-কথা নিয়ে আসি নি। আমি একবার বড়মার কাছে এসেছি। অর্চনার সম্বন্ধে কথা বলব।

—মানে?

—মেয়েটির অবিলম্বে বিয়ে দিতে হবে। জগদীশ্বরকাকার শালা রেলে চাকরি করেন, তার এক শালা সে পুলিশের দারোগা। প্রথমপক্ষের বউ মারা গেছে। ক’টা ছেলে আছে। তার সঙ্গে বিয়ে দেবার সম্বন্ধ করেছেন। কিন্তু অর্চনা জেদ ধরেছে এ বিয়ে সে কিছুতেই করবে না। বিষ খাবে। অথচ—

—কি অথচ?

—অথচ আমাদের বাড়ীতে সবাই বলে-অর্চনাই নাকি সতীবউরাণী, মানে বড়মার মা। চেহারাতে অবিকল তাঁর মতো! তাই তাঁর কাছে এসেছি, একটু পরামর্শ নেব।

ফটোখানা বের করে তাঁর হাতে দিলাম। আমারই তোলা ফটো। ফটো দেখে চমকে উঠলেন নগেনকাকা।

****

সুরেশ্বর বললে—এইখানে তোমাকে এই বাড়ীটির একটি পটভূমি দিয়ে রাখি সুলতা। অন্নপূর্ণা দেবীর যে টুকরো-টাকরা ছবি পেয়েছ, তাতে তাঁর সম্পর্কে অনায়াসে তাঁর একটা ছবি গড়ে নিতে পারো। সে ছবিটা হবে পটভূমিহীন মানুষের ছবি। একান্তভাবে ফটোগ্রাফের মত।

এই বাড়ী তাঁর নিজের তৈরি বাড়ী। তাঁর যে বাড়ীতে বিয়ে হয়েছিল, সে বাড়ীর সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক ছিল না।

মা মারা গিয়েছিলেন তাঁকে তিন বা চার দিনের শিশু রেখে। চিঠিতে লিখে গিয়েছিলেন-এর নাম হবে অন্নপূর্ণা আর একে মানুষ করবার জন্য যেন বিমলাকান্তের স্ত্রীকে দেওয়া হয়। তাঁর সন্তান নেই। রত্নেশ্বরকে দিয়ে আবার তাকে আমরা কেড়ে নিয়েছি।

বীরেশ্বর রায় সম্পর্কে বলেছি—চব্বিশ-পঁচিশ বছরের বীরেশ্বর রায় ভবানী দেবীকে পাবার জন্যে অথবা তাঁকে হারিয়ে প্রায় পাগল হয়েছিলেন। ক্রোধে আক্রোশে বাঈজী—মানে সোফি বাঈকে নিয়ে উন্মত্ত জীবনযাপন করেছিলেন, কিন্তু আবার ফিরে পেলেন ভবানী দেবীকে; তখন তিনি একরকম অর্ধপঙ্গু। কিন্তু সেবায় যত্নে চিকিৎসায় নিয়মপালনে ভাল হয়ে উঠলেন আবার।

তার ফল এই অন্নপূর্ণা দেবী। অন্নপূর্ণা দেবী রায়বংশের দ্বিতীয়া কন্যা। প্রথমা ছিলেন উন্মাদ-রোগগ্রস্তা বিমলা দেবী। যাঁর জন্যেই বলতে গেলে রায়বংশে বীরেশ্বর রায় পর্যন্ত একটা সর্বনেশে ঝড় বয়ে গেছে। রক্ষা পেয়েছেন ভবানী দেবীর তপস্যায়

এ ঝড়ের সব বিবরণ মূল কথা রত্নেশ্বর রায়ের পর বোধ হয় কেউ জানতে পারে নি। জেনেছিল ঠাকুরদাস পাল। তাকে খুন করিয়ে রত্নেশ্বর নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। তবু কি খেয়ালে ডায়রীতে লিখে গিয়েছিলেন। শেষের দিকে কথাটা মনে হয়েছিল বলে দপ্তর বেঁধে তার উপর লিখেছিলেন—“আমার চিতায় যেন এগুলি দগ্ধ করা হয়। যে এসব খুলিবে বা পড়িবে তাহার সর্বনাশ হইবে এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দশ পুরুষ নরকস্থ হইবে।”

সুখেশ্বর রায় এগুলো পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অতি চতুর অতি কুটিল মানুষ। স্বার্থের জন্য সব পারতেন। তিনি এগুলি পড়েছিলেন কিনা জানি না। হয়তো পড়েছিলেন, কিন্তু তিনি রায়বংশের একটা কামার্ত দৈত্যের হাতে জীবন দিয়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। ব্রজদা পড়তে গিয়েও পড়েন নি। পড়লাম আমি। তাই বলছি—বিমলা দেবী যে রায়বংশে কতবড় অশুভের উৎস তা রায়বংশে কেউ জানত না। আর ভবানী দেবীর তপস্যা যে কত বড় কল্যাণ করেছে, তাও কেউ জানে না। আমি নাস্তিক হয়েও এরই জন্যে আস্তিক হতে চেয়েছি। কিন্তু তা পারিনি। আমি না-আস্তিক না-নাস্তিক।

এক-একবার মনে হয় ভবানী দেবী বোধহয় রত্নেশ্বরকে দিয়ে ফিরে নেওয়ার অপরাধ সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। আবার মনে হয় ভবানী দেবী বীরেশ্বর রায়ের উপর কন্যার ভার দিয়ে যান নি—স্বামীর উপর বিশ্বাস ছিল না বলে। ভবিষ্যৎ তিনি অনুমান করেছিলেন।

জীবনের শেষ ক’মাস তিনি কাশীর বাড়ীতে একপ্রান্তের ঘরে এইটে জেনেই একান্তে বাস করতে চেয়েছিলেন। তিনি থাকতেন একেবারে পুবের ঘরে। তারপর ছিল তাঁদের সন্ধ্যার আসরের ঘর। যে ঘরে সোফিয়া এসে গান শোনাতো। তার ওপাশে ছিল বীরেশ্বর রায়ের ঘর। তারপর তিন-চারখানা ঘর একরকম খালি পড়ে থাকত, তারপর ও প্রান্তে থাকত সোফিয়া বাঈ। বুঝতে পারছ, স্বামীর স্বেচ্ছাচারের পথে কোথাও একটা পর্দার আড়ালও দেন নি।

সত্য যাই হোক, তিনি কন্যাটিকে দিয়ে গিয়েছিলেন বা স্বামীকে শেষ অনুরোধ করেছিলেন, কন্যাটিকে তাঁর নিঃসন্তান ভাই বিমলাকান্তের স্ত্রীকে দেবার জন্য। তাতে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। হয়তো এমন ভয়ও ছিল যে বীরেশ্বর রায় সোফিয়াকেই দেবেন মেয়েকে মানুষ করতে।

অন্নপূর্ণা দেবী পুজোর সময় একবার আসতেন দেশে। বিমলাকান্ত পুজোর ছুটিতে আসতেন। থাকতেন শ্যামনগরে। ওখানে যে বিষয় তাঁর ছিল এবং লাট শ্যামনগর-রাধানগর দিগরের যে জমিদারি সম্পত্তির মুনাফা তিনি পেতেন তা সাধারণের কাছে তুচ্ছ ছিল না। রায়বংশের কীর্তিহাটের তুলনায় সেটা হয়তো পঁচিশ-তিরিশ ভাগের এক ভাগ। অবশ্য বীরেশ্বর রায়ের সময়ের কথা বলছি। রত্নেশ্বর রায়ের আমলে কীর্তিহাটের আয় তিন গুণ বেড়েছিল।

শ্যামনগর কেনা হয়েছিল বিমলাকান্তের মাতামহের বিগ্রহের নামে। তখন জমিদারী মুনাফা ছিল চার হাজার টাকা। বিমলাকান্তকে জমিদারী স্বত্ব দিয়ে রত্নেশ্বর রায় সম্পত্তিটি পত্তনী নিতে ভোলেন নি।

একটু থেমে—হেসে সুরেশ্বর বললে—রত্নেশ্বর রায় এই চারহাজার মুনাফা বিমলাকান্তকে দিয়ে শ্যামনগরের জমির উপর দু-দু-বার বৃদ্ধি করে নিজের মুনাফা করেছিলেন ন’ হাজার টাকা। অথচ জবরদস্তি বে-আইনী কিছু করেন নি। এবং সেই নিয়েই ঠাকুরদাস পাল, যিনি তাঁকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছিলেন যিনি তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে গোটা পিঠটা পুড়িয়েছিলেন, যাঁকে তিনি দাদা বলতেন—তাঁর সঙ্গে প্রথম বিরোধের সূত্রপাত রত্নেশ্বর রায়ের।

অবশ্য তিনি শ্যামনগরে ইস্কুল এবং ঠাকুরদাস পালের স্মৃতিতে একটা চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারিও করে দিয়েছিলেন। যা সেকালে এই ন’ হাজার টাকা মুনাফা থেকেই চলবে বলে চিহ্নিত করা ছিল।

রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর বিচিত্র চরিত্র। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে তিনি অন্যায় কিছু করেছেন। স্নেহ করুণা দয়া ক্রোধ বিদ্বেষ সবের মধ্যে তাঁর চুলচেরা বিচার ছিল, তাঁর কথা থাক পরে বলব। অন্নপূর্ণা দেবীর কথা বলি।

তেরো বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। ভবানীপুরের মুখুজ্জে পরিবারে। তাঁরা ব্যবসায়ী লোক, ধনী। কলকাতায় অনেক সম্পত্তি। কর্তার নাম ছিল দেবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর তিন ছেলে বড় ছেলে নরেন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ হ’ল। নগদ টাকায় অলঙ্কারে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। বিবাহের সময় রায়বাড়ীর সম্পত্তি নিয়ে একটি কথা তাঁরা তোলেন নি। বছর তিনেক পর অন্নপূর্ণা দেবীর ষোল বছর বয়স তখন, প্রথম সন্তানের জননী হলেন। ছেলের জন্মের মাসখানেকের মধ্যেই, শ্বশুর তাঁর দাবী তুললেন–রায়বাড়ীর অর্ধেক অংশের মালিক এই নবজাতক পুত্র। ওই উইল—যে উইল বীরেশ্বর রায় ভাগিনেয় পোষ্যপুত্র রত্নেশ্বরের নামে করে গেছেন তা ক্যানসেল হতে বাধ্য; প্রথম কারণ, তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় কোন ক্রিয়া বা দলিল করলে তা সিদ্ধ হয় না। দ্বিতীয় কারণ, পরে তাঁর নিজের কন্যাসন্তান হয়েছে, এবং সেই কন্যার গর্ভজাত সন্তানই তাঁর প্রকৃত পিত্তাধিকারী, উত্তরাধিকারী।

মধ্যস্থতার জন্য ছুটে এলেন বিমলাকান্ত। তিনি অন্নপূর্ণাকে ডেকে সমস্ত বিবরণ বললেন এবং রত্নেশ্বর রায় বের ক’রে দিলেন মায়ের শেষ চিঠি।

অন্নপূর্ণা দেবী শুধু প্রশ্ন করলেন—কিন্তু শ্বশুরকে আমি কি বলব বলতে পারো? বেশ, কলকাতার সম্পত্তি ছেড়ে দাও আমাকে। বুঝিয়ে বলব!

রত্নেশ্বর বলেছিলেন না। তা পারব না। আমি সম্পত্তির মালিক নই। আমি রক্ষক। রায়বংশের যা তা রায়বংশের।

এর উত্তর অন্নপূর্ণা রত্নেশ্বরকে দেন নি, দিয়েছিলেন বিমলাকান্তকে। তাঁকে তিনি ছেলেবেলা থেকে বাবাই বলতেন; বলেছিলেন বাবা, তাহলে তুমি আমাকে কাশী নিয়ে চল। ও-বাড়ী আমি ঢুকতে পারব না।

বিমলাকান্ত তাঁকে বুঝিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দেবেন মুখুজ্জের কাছে। এবং নগদ একলক্ষ টাকা দিয়ে মিটমাট করতে চেয়েছিলেন।

দেবেনবাবু হেসে বলেছিলেন-ফিরে নিয়ে যান। রত্নেশ্বর রায়কে ফিরে দেবেন। বলবেন—সোজা আঙুলে তোলা দু ফোঁটা ঘি দিয়ে ভাত খাওয়া দেবেন মুখুজ্জের অভ্যেস নেই।

বিমলাকান্ত বলেছিলেন-আমার যা কিছু কাশী-কলকাতা এবং শ্যামনগরে, সব আমি লিখে দিচ্ছি।

—আমাকে কি বীরেশ্বর রায়ের শ্রাদ্ধের কাঙালী ভোজনের কাঙালী পেয়েছেন বেইমশাই? না সভায় নিমন্ত্রিত চালকলা-বাঁধা পুরুত পণ্ডিত? আমি বীরেশ্বর রায়ের দৌহিত্রের পিতামহ।

অন্নপূর্ণা দেবী দরজার আড়ালে ছিলেন। তিনি বেরিয়ে এসে শ্বশুরের সামনেই ঘোমটা খুলে বলেছিলেন–বাবা, তুমি বাড়ি যাও।

বিমলাকান্ত মাথা হেঁট করেই উঠে এসেছিলেন এই জানবাজারের বাড়ীতেই। অনেক বোঝাতে চেয়েছিলেন রত্নেশ্বর রায়কে কিন্তু তিনি বলেছিলেন—না। সত্যসত্যই যদি পোষ্যপুত্ৰ হতেন, তা হ’লে অর্ধেকই নিশ্চয় ছেড়ে দিতেন। কিন্তু তিনি যখন রায়বংশের বংশধর, বীরেশ্বর রায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান তখন তা তিনি দেবেন না। তাতে তাঁর জন্মমর্যাদার হানি হবে।

দিন চারেক পর একদিন একখানা পাল্কীগাড়ী এসে লাগল এই বাড়ীতে। নামলেন অন্নপূর্ণা দেবী।

দেবেন মুখুজ্জে তাঁকে এ-বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন চিরদিনের মত। গয়নাগাঁটি এমন কি ছেলে পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছেন এবং ছেলের আবার বিবাহ দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। কারণ, কি-কি মামলার কাগজে তিনি অন্নপূর্ণাকে সই করতে বলেছিলেন, তা তিনি করেন নি।

পরের দিন নরেন্দ্র-জামাই ছেলেটিকে বুকে ক’রে নিয়ে পায়ে হেঁটে এসে হাজির হয়েছিলেন এ-বাড়ি। ছেলেটিকে অন্নপূর্ণা দেবীর কোলে তুলে দিয়ে আবার ফিরে চলে গিয়েছিলেন।

তার পরদিন থেকে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। দেবেন মুখুজ্জেমশায় ছেলেকেও ক্ষমা করতে জানতেন না। তাঁর বাক্যবাণ তিনি সহ্য করতে পারেন নি।

অন্নপূর্ণা দেবী বিমলাকান্তের সঙ্গে কাশী গিয়ে ওই সন্তান—ভবেনকে নিয়ে জীবন আরম্ভ করেছিলেন। যাবার আগে তিনি গিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছে। তখন তাঁর প্রকাশ হয়েছে। দেশের মধ্যে যেন একটা নতুন হাওয়া বয়েছে। জানবাজারের পাশেই রাণী রাসমণির বাড়ী। বিমলাকান্ত নিজে একদিন তাঁকে দর্শন করে এসে মুগ্ধ হয়ে বিক্ষুব্ধচিত্ত অন্নপূর্ণাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

অন্নপূর্ণা তাঁর মধ্যে যাই দেখে থাকুন, তাঁর ক্ষোভ যেন মিটে গিয়েছিল। তাঁর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়েছিল। পরমহংসদেব হেসে বলেছিলেন—গঙ্গা গঙ্গা—গঙ্গা গড়াচ্ছে রে বেটী, দে–দে ওই জল একফোঁটা দে আমাকে।

অন্নপূর্ণা দেবী দুহাতে চোখের জল মুছে তাঁর পায়ে মাখিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাকুর বলেছিলেন- ভগীরথ—ভগীরথ হবে তোর ছেলে।—ভগীরথ হবে। অন্নপূর্ণাকে হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন। তিনি সারাজীবন ঠাকুরের নামই জপ করেছেন। সেই তাঁর দীক্ষা।

বিমলাকান্তের সম্পত্তি তাঁর টাকা যা ছিল তার সব তিনি অন্নপূর্ণাকে দানপত্র লিখে দিয়েছিলেন। আর নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, যেটা একটা চিঠিতে বীরেশ্বর রায় কন্যার বিবাহে খরচ করতে বলেছিলেন, সেই টাকাটা নিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী।

ওটার বেলাতেও তিনি হিসেব-নিকেশ করে নিয়েছিলেন। পঞ্চাশ হাজার টাকার সুদসমেত কষে অঙ্ক স্থির হয়েছিল আশী হাজার। টাকাটা বীরেশ্বর রায়ের চিঠির কাল থেকে সুদে খেটেছে। তার থেকে বাদ দিয়েছিলেন বিবাহের যৌতুক তিরিশ হাজার টাকা।

ছেলেকে উকীল করে হরিশ মুখুজ্জে রোডের এই মোড়ে বাড়ী তৈরী করিয়ে কলকাতা এসেছিলেন।

অতি কঠিন মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী। অত্যন্ত কঠিন। কলকাতায় এসেও স্বামী বা শ্বশুরের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেন নি। দেবেন মুখোপাধ্যায়ের তখন বৃদ্ধাবস্থা, কিন্তু শক্ত মানুষ, তখন বাড়বাড়ন্ত ও খুব। স্বামী তখন আবার সংসারী। ছেলেমেয়ে হয়েছে। এদিকে বিমলাকান্তের মিতব্যয়িতা এবং হিসাব করে টাকা খাটানোর গুণে নগদ টাকা সুদে আসলে বেড়ে দেড় লক্ষে গিয়ে পৌঁছেছে।

দেবেন মুখুজ্জের কানে কথাটা গিয়ে পৌঁছেছিল। তিনি একটা খবর পাঠিয়েছিলেন নাতির কাছে। ‘একবার আসবে। দেখা ক’রে যাবে।’

ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। বলে দিয়েছিলেন—একটিও উত্তর করে আসবি নে। সব কথায় বলবি—মাকে জিজ্ঞেস করে বলব।

ছেলেও তাই করেছিল। কুশল প্রশ্নের পালা শেষ করে ঠাকুরদা দেবেন মুখুজ্জে বলেছিলেন—কত বড় বাড়ী করেছ? আমার বাড়ী থেকে বড়?

ভবেন্দ্র বলেছিল—তাই কি হয়, না-পারি?

—তবে?

চুপ করে ছিলেন ভবেন্দ্র। ঠাকুরদা বলেছিলেন-এ বাড়ীতে তোমার ঠাঁই হত না? প্র্যাকটিস চলত না?

এতেও চুপ করে ছিলেন ভবেন্দ্র। দেবেন মুখুজ্জে বলেছিলেন—যা হয়ে গেছে গেছে। এমন অনেক হয়। আমার যা আছে, তা তোমার কীর্তিহাটের পুষ্যিমামার থেকে কম না। এর দাম অনেক। যাও, এ বাড়ীতে এস সব নিয়ে। মস্ত বড় কারবার আমাদের, ল’ ডিপার্টমেন্ট আছে। তা দেখাশোনা কর। প্র্যাকটিস কর। বুঝলে? ও-বাড়ী একটেরে ময়দানের ধারে। ভাড়া দিয়ে দাও। সাহেব-টায়েবরা এখুনি নেবে

এবার ভবেন্দ্র বলেছিল—মাকে জিজ্ঞাসা ক’রে বলব।

—মাকে? আচ্ছা। তা হলে উত্তর পাঠাতে হবে না। উত্তর জানি আমি। ষোল বছরের বউ, ঘোমটা কপালে তুলে আমার সামনে এসে বলেছিল—বিমলাকান্তবাবুকে বলেছিল—তুমি উঠে যাও বাবা। আর্জিতে সই করাতে পারি নি।—আচ্ছা এস।

বাপ কথা অল্পই বলেছিলেন। বলেছিলেন—মন দিয়ে কাজকর্ম কর। আমি আশীর্বাদ করছি।

এর পাঁচ বছর পরেই, দেবেন মুখুজ্জের বয়স তখন পঁয়ষট্টি, রাণীগঞ্জের কয়লাকুঠী কিনে তার সীমানা নিয়ে বেঙ্গল কোল কোম্পানীর সঙ্গে ফৌজদারী করে আসামী হয়ে গেলেন। কুঠীতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ফায়ারিং-এর হুকুম দিয়েছিলেন, বেঙ্গল কোলের দুজন লোক ছররায় আহত হয়েছিলেন। একজন মারা গিয়েছিল।

বর্ধমানের সেসন্‌স কোর্টে মামলা। কাঠগড়ায় দেবেন মুখুজ্জে, তাঁর মেজছেলে এবং ভবেন্দ্রর সৎভাই দাঁড়িয়েছিলেন আসামী হয়ে। বেঙ্গল কোলের কোম্পানীর মালিক ইংরেজ। অঢেল টাকা। রাজার জাতের খাতির তাঁদের। দেবেন মুখুজ্জের টাকা কম ছিল না। তিনিও হাটকোর্ট থেকে ব্যারিস্টার এনেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ভবেন্দ্র মুখুজ্জে জুনিয়রের কাজ করেছিলেন কিছুদিন। তিনি নিজে থেকে গিয়ে বলেছিলেন—এ কেসে আপনাকে সাহায্য করবার জন্য নিলে আমি সুখী হব।

ব্যারিস্টার বলেছিলেন—তুমি তো এখন নিজে কাজ করছ, নাম হয়েছে, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে যাবে?

—আমি যেতে চাই।

—ওঁরা যদি না চান?

—আমি ফীজ দাবী করব না স্যার।

—কেন?

যতটা বলা চলে, ততটা বলেছিলেন ভবেন্দ্র। ব্যারিস্টার তাঁর পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—তুমি যাবে। এবং আমি তোমাকে স্কোপ দেব।

মামলাটায় দেবেন মুখুজ্জেরা সেসনসে হেরেছিলেন। বাঙালী জজ সাহেব বাঙালী মেশানো জুরি। ওঁদের কারুর চার বছর কারুর তিন বছর জেল হয়ে গিয়েছিল।

হাইকোর্টে সেই মামলার রায় ওল্টালো। এবং তাতে পুরো আরগুমেন্ট করেছিলেন ভবেন্দ্র।

খালাস হয়েছিলেন মুখুজ্জেরা কিন্তু কোলিয়ারী হারাতে হয়েছিল। গোটা ব্যবসাটাই প্রায় শেষ হতে বসেছে তখন।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *