প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ১.১০

১০

মাতৃশ্রাদ্ধ তাকে যেন হঠাৎ একটা নতুন জীবনে নতুন রাজ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। অতি সাধারণ এবং ভাবসর্বস্ব মানুষ হ’লে সে নিশ্চয়ই ভাবত—তার মা মরজগতের ওপার থেকেই পরম স্নেহে তাকে হাত ধরে এনে এই জীবনে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন। দুঃখ ভুলিয়ে দিতেই করলেন এটা। কিন্তু সুরেশ্বর তা ভাবলে না। এটা হবেই সে এটা জানত, দুদিন আগে আর দুদিন পরে। এবং এর কারণ তার কাছে স্পষ্ট।

মায়ের শ্রাদ্ধ সে কলকাতাতেই করলে এবং সংক্ষেপে করতে গিয়ে করতে পারলে না শেষ পর্যন্ত। মনটা কেমন খচ খচ করতে লাগল।

নায়েব তাকে প্রথম দিনই তার আর্থিক এবং বৈষয়িক সম্পত্তির একটা পরিষ্কার হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছিল। কীর্তিহাটের সাড়ে আট আনা দেবোত্তর এখন তার হাতে এসেছে। তার পিতামহ ছোট ভাইয়ের পাঁচ আনা অংশের মহাল অর্ধেক পত্তনী নিয়েছিলেন এবং তিনি ব্রাহ্ম হয়ে গেলে মূল স্বত্বেরও অর্ধেক তাঁতে বর্তেছিল। তাতে হয়েছিল তাঁর সাড়ে আট আনা। এর অর্ধেক চার আনা পাঁচ গণ্ডা ছিল তার জ্যেঠামশায়ের। বৎসরখানেক পূর্বে তার মা হেমলতা দেবী ভাসুরের দেবোত্তরের মুনাফা পত্তনীর সামিল করে বন্দোবস্ত নেওয়ায় বলতে গেলে সাড়ে আট আনাই তার হয়েছে। বার্ষিক দেবখরচ বরাদ্দ বারো হাজার বাদে ঝুড়ি হাজার মুনাফার সাড়ে আট আনা এখন তার। এ ছাড়া কলকাতার বাড়িভাড়া মাসিক তিন শো টাকা হিসাবে ছত্রিশ শো টাকা এবং কেনা শেয়ারের ডিভিডেন্ড থেকে বার্ষিক চার পাঁচ হাজার আসে। নগদ টাকা তার অংশের পঞ্চাশ হাজার বেড়ে এখন পঁয়ষট্টি হাজারে পৌঁচেছে। তার মায়ের টাকা সামান্যই মজুত আছে, হাজার আষ্টেক, বাকী টাকা অর্থাৎ ভাসুরের সম্পত্তি এবং বাড়ী তিনি কিনবার জন্য তাঁকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।

হরচন্দ্র বলেছিল—বাবা, আয় এখন তোমার বিশ হাজার টাকা। এ যদি তুমি হিসেব করে চলতে পার তবে তোমার পর আর দুপুরুষ পর্যন্ত সুখে চলে যাবে। তোমার বাবা তার নিজের জীবন নিয়ে বেহিসেবী চালে চলেছেন। সম্পত্তিতে বেহিসেব করেন নি। দু লাখ টাকা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিজে জীবনে কোনদিন বসে খান নি। দু হাতে রোজগার করেছেন। তোমার মা ছিলেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। তাঁর টাকা থেকে বড় কর্তার ওই সম্পত্তি কিনে যে কাজ করে গিয়েছেন, তার তুলনা হয় না।

সুরেশ্বর বলেছিল—মায়ের টাকাটা দিয়ে আমি কীর্তিহাটে মেয়েদের জন্যে একটা ইস্কুল করে দিতে চাই। ম্যাট্রিক ওখানে চলবে না—এম.ই. স্কুল এবং ওটা ফ্রি হবে। মায়ের সম্পত্তি থেকে খরচ চলবে।

হরচন্দ্র বলেছিলেন—খুব ভাল কথা। তিনি পুণ্যবতী মহিলা ছিলেন। তোমার মা, তাঁর জন্যে করবে এ তো খুব ভাল কথা। আর শ্রাদ্ধ? সে কি রকম করবে? আজ খবর আমি দিলাম। অবশ্য কীর্তিহাটেই সকলে। এক বড়বাবু আর বড়মা, তাঁরা তো কাল ছেলেদের কাছে শুনলাম এখানে আসছেন। কি একটা গোলমাল করেছে ছেলেরা তাই মেটাতে আসবেন। তা ওখানেও টেলিগ্রাম করে দিলাম। আমাদের কর্তব্য করতে হবে তো! কীর্তিহাটে করতে গেলে অনেক ঝঞ্ঝাট, আমি বলি এখানেই কর। এখানকার মতো ক’রে কর। কাল থেকে ভেবেছি। ছোটবাবু সায়েবী মেজাজের লোক ছিলেন। সামাজিক খুব ছিলেন না। এ-বাড়ির সঙ্গে আগে কলকাতার বড় বড় বাড়ীর যোগাযোগ ছিল। পাইকপাড়ার রাজারা, ওঁরা বলতে গেলে এ-বাড়ীর মূল পত্তন ক’রে দিয়েছিলেন। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংজী রায়রাঁয়া, তিনিই লাট কীটিহাট কিনিয়ে দিয়েছিলেন। এঁরা আসতেন। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ী, মহারাজার দেওয়ানবাড়ী এঁরা ছিলেন এক রকম অভিভাবক। বড়ই স্নেহ করতেন। রাণাঘাটের পালচৌধুরীরা আছেন ওঁরা খুব ভক্তি করতেন কর্তাদের। ঠাকুরবাড়ীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। পত্রপত্র ছিল প্রায় সব রাজারাজড়াদের সঙ্গে। শুনেছি তোমার পিতামহ স্বর্গীয় দেবেশ্বর রায় মহাশয়ের বিবাহে দুটো বউভাত হয়েছিল। একটা কলকাতায় একটা কীর্তিহাটে। সব এসেছিলেন, এবং একটা ঘর ভরে গিয়েছিল জিনিসপত্রে। মূল্যবান মূল্যবান জিনিস দিয়েছিলেন। তারপর তোমার পিতামহ তো এখানে মহানামী মহামানী লোক ছিলেন। বড়বাবুর মানে তোমার জ্যাঠামশায়ের বিবাহেও এঁরা এসেছেন, তা ছাড়া বড় বড় সাহেব-সুবো এসেছেন। ছোটবাবু তোমার বাবাই এসব একরকম তুলে দিয়েছিলেন। কাগজে লিখতেন, কারুর খাতির করতেন না, যেতেন। না বড় একটা কোথাও, ওই পার্টিটার্টি। তাতে তো সামাজিকতা বজায় থাকে নি। তা তুমি এবার সেটা কর। মায়ের শ্রাদ্ধে পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নাও। কত খরচ হবে? শ্রাদ্ধে দশ হাজার টাকা খরচ করলে প্রচুর হবে। একবার কেবল নিজে যাওয়া। সে তো ভাল হবে, পরিচয় হয়ে যাবে!

.

সত্যই সে যেন এক নতুন জগতে এসে পড়ল। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক তিরিশ সালে পার হয়েছে। আইন অমান্য আন্দোলন পার হয়ে গেছে। আন্দোলন সফল হয় নি এ কথা সত্য কিন্তু বছরের মধ্যে যেমন ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু গাছের ফুল ফোটা শেষ হয়ে ফুলগুলি ঝরে, নতুন গাছে ফুল ধরে, নতুন ফসল ওঠে। মানুষের পরিচ্ছদ পাল্টায়, মন পাল্টায়, তেমনিভাবে আগেকার কাল, যে কালে এই সব বড় বড় বাড়ীর দিকে বিস্ময় এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকিয়ে থাকত, সে কাল এখন বিগত ঋতুর মতো; এই সব বাড়ী এই সব মানুষ এখন শুকিয়ে আসা ফুলের মতো আকর্ষণহীন। এদের সম্পর্কে সুরেশ্বরের নিজের মনোভাবও সুপ্রসন্ন নয়। তার কারণ সে জন্মাবধি তার সাহেবমনোভাবসম্পন্ন বাপের প্রভাবে প্রভাবান্বিত; তিনি সাংবাদিক হিসাবে ইংরেজকে সমর্থন করলেও এই সব দেশীয় জমিদার ধনীদের সমর্থক ঠিক ছিলেন না। এদের সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যা ছিল নিজের বংশাবলী থেকে তার সঙ্গে পরিচয়ও সুরেশ্বরের প্রত্যক্ষভাবে ঘটেছে কীর্তিহাটে গিয়ে। তা ছাড়া এই নতুন কালের বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া নতুন মানুষ সে। জমিদার বংশধর হয়েও—জমিদারির সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকার জন্য তার মন জোর পেয়েছিল—মনে মনে অনুভব করত এর জন্যে কোন কালি কোন গ্লানিই তাকে স্পর্শ করেনি। বাপের জোর ছিল, তিনি খেটে খেতেন। এই মনের জোরে সে এদের থেকে নিজেকে আলাদা ভেবেছে-আলাদা থেকেছে এবং মনে মনে অবজ্ঞা ঘৃণাও করেছে। কিন্তু নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে এদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে সে বিস্মিত এবং মুগ্ধ হল।

মুগ্ধ করলে তাকে তাদের সৌজন্য, তাদের শীলতা। বিস্মিত হল সে এই দেখে যে, তারাও তার চেয়ে কম আধুনিক নয়। ভাল লাগল তাদের রুচি। চমকে গেল সে এই দেখে যে এদের অবস্থার চারিদিকটা পুরনো আমলের ভারী অলঙ্কারের গড়নের মত বেমানান এবং স্থূল হয়ে গেলেও—জহরতের ছটায় ও শোভায় জৌলুসের মত একটা জৌলুস এখনও বুকে ধরে রেখেছে।

কিছু কিছু এ সব মানুষের ধারা-ধরন চাল-চলনে দত্ত আছে, বিলাসের উগ্রতাও আছে; অনেকের ব্যভিচার মদ্যপানের প্রকাশ্য অখ্যাতিও আছে, কিন্তু এদের মধ্যে এমন সব লোক রয়েছে যারা ধারালো ছুরির মত বুদ্ধিদীপ্ত। বিদ্যানুরাগী। এটা হল তার প্রথম অভিজ্ঞতা। প্রথম আত্মীয়বাড়ী নিমন্ত্রণ সেরেই সর্বাগ্রে সে গেল পাইকপাড়ার রাজবাড়ী। রাজা বিগত। তাঁর মা আছেন তিনি মানুষ করেছেন তিন পৌত্রকে। কুমার বিমলচন্দ্র সিংহ, কুমার অমরেশচন্দ্র সিংহ, কুমার বৃন্দাবনচন্দ্র সিংহ। কুমার বিমলচন্দ্রের সঙ্গে তার দেখা হল। তার থেকে কম বয়স। সদ্য ম্যাট্রিক পাস করে প্রেসিডেন্সিতে পড়ছেন। কাঁচা সোনার মতো দেহবর্ণ। বুদ্ধি বিদ্যা-দীপ্ত মন। এই বয়সেই সুরসিক ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। কিছুদিন আগেই এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে এনেছিলেন—তাঁর সঙ্গে বসে ফটো তুলিয়েছিলেন—সেই ফটোটা সামনেই টাঙানো রয়েছে। যামিনী রায় নন্দলালের ছবি দেওয়ালে ঝুলছে।

মিষ্টভাষী মানুষটির মুখে হাসি লেগেই আছে। অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে গ্রহণ করলেন তিনি। বললেন—নিশ্চয় যাব। আপনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তো অতিনিকট এবং খুব প্রীতির। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের দুর্নাম দেশের লোক যাই করুক—সেদিন তিনি পার্মামেন্ট সেটেলমেন্টের সময় এগার ভাগের দশ ভাগ রেভেন্যু করেছিলেন বলেই আজও গভর্নমেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। এবং যদি কোন দিন জমিদারী উচ্ছেদ হয় তবে সেদিন কম্‌পেনশেসন দেবার সময় এর উপকারিতা বোঝা যাবে। হেস্টিংস সাহেব যাবার সময় বলেছিলেন—The regret which I cannot but feel, in relenquishing the service of my honourable employer’s- would be much embittered, were it accompanied by the reflection that I have neglected the merits of a man who deserves no less of them than of myself Gangagobinda Singh.

মস্ত বড় প্যাসেজ একটা। তা দেওয়ানজী রায়রাঁয়া বলতেন-হেস্টিংস সাহেব আমার জন্যে যা বলেছে আমাকে তাই বলতে হবে—কুড়ারাম ভট্টাচার্যের জন্যে।

আরও কয়েকজনের কাছেই সে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছিল। আবার বেশ কয়েকটা বাড়ীতে প্রাচীনত্বের কড়াকড়ি এবং মনের স্থূলতা দেখে তিক্ত হয়েছিল মনে মনে। দু-একজন বলেছিলেন তাই তো হে–তোমার বাবা তো সাহেব বলে আমাদের খাতা থেকে নাম কাটিয়ে নামকাটা সেপাই হয়েছিল। আমাদের গাল দিয়েই তো করে খেয়েছে বলতে গেলে। তা তুমি আমাদের

খাতায় আবার নাম লেখাতে যাচ্ছ যে? তা বেশ বেশ!

এ ছাড়া সে তার কয়েকজন বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্রকেও নিমন্ত্রণ করে এসেছিল। শিল্পী যামিনী রায়, অতুল বোস এবং তার বাপের বন্ধু কয়েকজন নামজাদা সাংবাদিক হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, তুষারকান্তি ঘোষ, সত্যেন্দ্র মজুমদার প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিকেও নিমন্ত্রণ করেছিল। শিল্পী যামিনী রায় তাকে স্নেহ করতেন। শিল্পরসিক তরুণ ছেলেটিকে ভালো লাগত তাঁর। অতুলবাবুও ভালবাসতেন।

এই যোগাযোগ বিচিত্রভাবে তাকে যেন অকস্মাৎ ফ্লাশলাইটের আলোর সামনে দাঁড় করিয়ে তাকে সুপরিচিত করে দিলে, খ্যাতিমান করে তুললে। সে ভাবেনি এমন ঘটবে।

ব্যাপারটা ঘটল এইভাবে। সভামণ্ডপে দুখানি অয়েল পেন্টিং কলকাতার আধুনিক রীতি অনুযায়ী মালা দিয়ে সাজিয়ে দুখানি কাঠের চৌকির উপর রাখা হয়েছিল। তার মায়ের এবং তার বাপের।

সুরেশ্বর মাথা কামিয়ে শ্রাদ্ধে বসেছিল—অভ্যর্থনা করেছিলেন তার মামা। প্রায় প্রত্যেকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হল ওই ছবি দুখানির দিকে। ছবি দুখানির বৈশিষ্ট্য হল- যেন জীবন্ত বলে মনে হচ্ছিল। প্রতিজনেই বললেন —বাঃ, ছবি দুখানি তো সুন্দর হয়েছে! সুন্দর ছবি!

মামা প্রবীর চ্যাটার্জি প্রত্যেককেই বললেন-ও সুরেশ্বরের নিজের আঁকা।

অতুল বোস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে বললেন—খুব চমৎকার হয়েছে। মিস্টার রয়কে আমি দেখেছি। ছবি শুধু জীবন্ত নয়—তার সঙ্গে ক্যারেক্টার এসেছে। ওই যে হাসিটুকুতে ঠোঁট দুখানা অল্প একটু বাঁকা করে দিয়েছে একদিকে এবং চোখের তারাদুটোকে একটু করে একপেশে করে দিয়েছে তাতেই বলে দিচ্ছে What was he. ওর মাকে দেখিনি। বলতে পারব না—কিন্তু জীবন্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে অসাধারণ ছিলেন তিনি। And তাই ছিলেন তিনি। কিন্তু সুরেশ্বর ছবি আঁকে নাকি? কই একদিনও তো বলেনি!

তারিফ সকলেই করলেন। এবং একটু পরে মিষ্টমুখ করাতে উপরের ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রবীরবাবু বললেন-দেওয়ালে ছবিগুলোর অধিকাংশই ওর আঁকা!

যামিনীবাবু আসেননি, তিনি ধ্যানী মানুষ এবং বেশী লোকসমাগমের মধ্যে তিনি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তা ছাড়া সেটা উনিশ শো চৌত্রিশ সালের শেষ—তখনও তাঁর সাধনার খ্যাতি বিস্তৃত হয় নি। জীবনের সঙ্গে তিনি যুদ্ধই করেছেন।

অতুলবাবু বললেন—যামিনীদাকে তো বলতে হবে!

কুমার বিমল সিংহ বললেন—একদিন এসে তো ভাল করে দেখতে হবে সব!

***

এরপর বেশীদিন লাগল না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার শিল্পী বলে খ্যাতি রটে গেল। যে আড়াল তার ছিল তার মা, তাঁর মৃত্যুর পর যেন শেষ আশীর্বাদে তাকে ঘুচিয়ে দিয়ে গেলেন। সে বিখ্যাত হয়ে গেল তার মায়ের ছবি থেকেই। এতকাল ধরে মায়ের বিষণ্ণ বেদনাময় জীবনের আবেষ্টনীর মধ্যে বাবার শেষজীবনের কৃতকর্মের গ্লানির জন্য সে যে পলাতকের বা আত্মগোপনকারীর জীবন যাপন করেছিল সেটা থেকে তার নিজের খ্যাতির আকর্ষণে বেরিয়ে প্রশংসার প্রসন্নদীপ্ত আলোকে এসে দাঁড়িয়ে উল্লসিত এবং কিছুটা প্রগল্ভ হয়ে উঠল।

মাস দুয়েকের মধ্যেই সে নিজের ছবির একজিবিশন করলে। উদ্বোধন করলেন যামিনী রায়। এবারে তিনি এলেন এবং প্রশংসা করে গেলেন। তিনি বক্তা নন তবে অকপটে সাদাসিধে

কথায় বললেন -আমার ভাল লেগেছে। বেশ ভাল লেগেছে।

কাগজে প্রশংসা বের হল। কয়েকখানা ছবির ব্লক ছাপা হল। ভিড়ও হল। আলাপ হল নবীন শিল্পীদের সঙ্গে। কয়েকজন সাহিত্যিক এলেন, তাঁদের সঙ্গেও আলাপ হল। প্রবাসীর কেদার চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন অমল হোম। কেদারবাবু দুখানা ছবি প্রবাসীতে ছাপতে চাইলেন।

সেইদিনই, সকলে চলে গেলেন আর সদলে এসে তাঁকে আমন্ত্রণ করলে সীমা এবং অসীমা। সদল মানে সঙ্গে কয়েকজন বান্ধবী!

—কী মহাশয়?

হেসে একটি সিগারেট ধরিয়ে সুরেশ্বর বললে-এস। সুস্বাগতম। কিন্তু প্রশ্নটা কি?

ভ্রূ কুঞ্চিত করে অসীমা বললে—সে প্রশ্ন যাই হোক আপাততঃ থাক। কিন্তু এটা কি? আঙুল দেখিয়ে মুখের সিগারেটটাকে দেখিয়ে দিল!

—ওটা সিগারেট। বেশ মূল্যবান সিগারেট। ফাইভ ফিফটি ফাইভ। গেস্টদের জন্য আনানো ছিল। তাঁরা খেলেন, আমার নাকে ধোঁয়াটা গেল, প্রশংসার মদ্যের নেশার চিত্ত ভূষিত হল বস্তুটার জন্য। মনে হল নেশা জমবে বেশ! তাই আরম্ভ করলাম।

—ভাল! মাকে বলে দেব। সুরোদা পিসীমার মৃত্যুর দুমাস না যেতেই সিগারেট ধরেছে!

—আর এক মাস পরে বলো। তখন কামানো দাড়ি আরও ঘন এবং চাপ বেঁধে বেরুবে এবং আমাকে একজন ঋষি বলে মনে হবে। সুতরাং বলবেন না, এ ছেলে মহাপুরুষ ছেলে, একে কিছু বলা উচিত নয়। এর বদলে ঘুষ চাও তো খুব ভাল জর্দা অথবা বিলিতী দামী লিপস্টিক যা চাও এনে দিতে প্রস্তুত আছি।

বলাবাহুল্য অসীমার মুখে পান ছিল-খুব সুবাসিত জর্দার গন্ধও উঠছিল এবং একটি বান্ধবীর ঠোঁটে লিপস্টিকের অনুরঞ্জনও ছিল।

লিপস্টিকমাখা মেয়েটি বললে—আপনার ছবি যত দুর্বোধ্য—আপনি কিন্তু তত সহজ এবং অকপট!

—আপনি সত্য বলেছেন। আপনার দৃষ্টি প্রখর।

—মিলিয়ে যাচ্ছি যে। আপনি সত্যই শাম্মলী তরু।

—হ্যাঁ। ভাগীরথী তটে কীর্তিহাট নামক গ্রামে বিশাল শাম্মলী তরু আছে একটি। আমি তারই চারা গাছ। কিন্তু আপনি মনে হচ্ছে বেত্রবতীতটের বেতসলতার সেই লতাটি যাকে সুলতা বলা চলে। যার আঘাতে শুধু কাঁটাই ফোটে না দাগও বসে। কালসিটে পড়ে কেটে রক্তও পড়তে পারে!

সীমা খিলখিল করে হেসে উঠল গরবিনীর মত। তার দাদার ঠিক মনে আছে, এবং ওই একটি কথার উত্তরে দশটি কথা শুনিয়েছে! জয়টা তার। সুলতা উত্তর খুঁজছে, পাচ্ছে না।

সুলতা লাল হয়ে উঠেছিল। সে আধুনিকা। বি.এ. পড়ে। অতি আধুনিক মনের ব্যারিস্টারের মেয়ে। পোশাকে তার ছাপ আছে। পরনে তার খদ্দরের শাড়ী। ঠোঁটে তার লিপস্টিক, পায়ে স্যান্ডাল। মাথায় রুখু চুলে বেশী। গোপনে রাজনীতি করে বলে রটনা আছে। ছাত্র-আন্দোলনে সবে যেটা তখন শুরু হয়েছে তাতে সে প্রকাশ্যে পাণ্ডা।

সুলতা বললে—ছবিতে আপনার ট্র্যাডিশন ভাঙার চেষ্টা সুস্পষ্ট কিন্তু সোশ্যাল কনসাসনেস নেই। কেন?

—দুরূহ প্রশ্ন। সম্ভবতঃ আমার নিজের নেই বলে। না হলে ধরুন আর্টিস্ট হিসেবে আমি মনে করি ওটা ছবিতে না আসাই ভাল।

সুলতা তর্কোদ্যত হয়ে উঠেছিল।—কেন?

কিন্তু কথায় বাধা পড়েছিল। একজন চাকর এসে বলেছিল—দুটি মেয়েলোক এসেছে, বলছে আপনার সঙ্গে দেখা করবে।

—ইডিয়ট। মেয়েলোক কিরে? মহিলা বলতে হয়। তা ডাক না এখানে।

—তারা বলছে একটু নিরিবিলি কথা বলবে।

—হ্যাঁ

—তা হলে?

সীমা বললে—আমরা বসি। তোমার বাজনা না শুনে যাব না। তুমি শুনে এস কে কি

বলছে! কারা-মেয়েছেলে আবার কে?

—কি করে এখান থেকে বলব?

—যাও তা হলে শুনে এস। আমরা ছবি দেখছি, চা খাচ্ছি। যাও।

সুরেশ্বর বাইরে বসবার ঘরে এসে অবাক হয়ে গেল। একটি প্রৌঢ়া, একটি যুবতী। সুন্দরী। পোশাক-পরিচ্ছেদে চেহারার মার্জনায় এমনি একটা ছাঁদ তাদের মধ্যে রয়েছে যে ঠিক তার এতকালের জানা-চেনা কারুর সঙ্গে মেলে না, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। না মেলে সীমাদের সঙ্গে, না মেলে কীর্তিহাটের বাড়ির সঙ্গে, না মেলে সচরাচর কলকাতার পথে-ঘাটে রেলস্টেশন যে সব বাঙালী মেয়েকে দেখা যায় তাদের সঙ্গে। এদের চেহারায় কোথায় প্রগল্ভতা আছে, মালিন্যের মত একটা কিছু আছে। প্রৌঢ়ার বিধবার সাজ কিন্তু হাতে সামান্য গহনা আছে। ফিতেপাড় কাপড় পরনে। গালে পানের একটা পুঁটলি, ঠোঁট দুটো কালো। মাথার চুলে আছে সে আমলের পাতা কাটা! সুন্দরী যুবতী মেয়েটির পোশাক-পরিচ্ছেদ এমন যে যৌবন রূপ সবকিছু একটা অত্যুগ্রতায় আক্রমণত্মক ভঙ্গিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। না চিনলেও একটা আভাস যেন মিলছে, সবকিছু মিলিয়ে বলে দিচ্ছে দেহ এবং রূপ নিয়েই এদের কারবার।

তার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল। সে বললে-কি বলুন! কি চাই আপনাদের?

তার মুখের দিকে তাকিয়ে তারা একটু বিহ্বল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে—আমরা বাবুর সঙ্গে মানে সুরেশ্বর রায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনি আমাদের চেনেন।

—আমার নামই সুরেশ্বর রায়।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তারা। প্রৌঢ়া আবার বললে-এ বাড়ির মালিক। আমিই এ বাড়ীর মালিক।

—কিন্তু আপনি তো তিনি নন।

—তাহলে?

প্রৌঢ়া আবার বললে—নং জানবাজার সুরেশ্বর রায়। দেশ হল কীর্তিহাট।

—সে সব আমার পরিচয়!

—তাই তো বাবু! তবে কি জোচ্চুরি করে গেল কেউ?

যুবতীটি বললে-না-না, জোচ্চোর সে নয়।

—হ্যাঁ। সুন্দর চেহারা। আপনার মত এমন সুন্দর নয়। তবে সুন্দর। একটু বয়স বেশী। তিরিশ বত্রিশ। গান-বাজনা জানে, সুন্দর কথাবার্তা—

সুরেশ্বর বললে—আপনারা কে?

—আমরা! আমরা বাবু—। একটু ভেবে নিয়ে বললে-বাবু, আমরা গান-বাজনা করে খাই। এ আমার মেয়ে। মিনার্ভা থিয়েটারে নাচত। আমরা থাকতাম বাবু রামবাগানে। সেখানে এই বাবু থিয়েটারে একে দেখে বাড়ীতে এসেছিল। তারপর মাসখানেক খুব খরচপত্র করলে; আমোদ আহ্লাদ করলে। নাম বললে সুরেশ্বর রায়। বাড়ী বললে এই ঠিকানা। আমরা অবিশ্বাস করিনি। তারপর হঠাৎ বললে-শেফিকে বাঁধা রাখবে! বাড়ী ভাড়া করবে। এখানে আসতে লজ্জা করে। বড়ঘরের ছেলে। বলে ভদ্রপাড়ায় বাড়ী ভাড়া করে মেয়েকে চাকরী ছাড়িয়ে রাখবে। তারপরে হঠাৎ আজ পনের দিন একেবারে নি-পাত্তা! খোঁজ নেই খবর নেই। মেয়েটা অধীর হয়েছে। ওদিকে বাড়ীওলা ভাড়ার তাগিদ দিচ্ছে। আমাদের হাতেও পয়সা নেই। অগত্যা এসেছিলাম বাড়ীতে তার খোঁজ করতে। ভাবনাও হচ্ছিল। অসুখ-বিসুখ কিছু হল কিনা? তা আপনি তো—।

স্তম্ভিত হয়ে গেল সুরেশ্বর।

মেয়েটি বললে—তাহলে আমরা যাই বাবু, কিছু মনে করবেন না। আমরা তো জানতাম না!

কি বলবে সুরেশ্বর ভেবে পেলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা দুজনে উঠে দরজার কাছে গেল। মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে বললে—মা!—

—কি?

দরজার পাশে টাঙানো সুরেশ্বরের মায়ের শ্মশানে চিতায় তুলবার আগের একটা গ্রুপ ফটো টাঙানো ছিল। সেই ফটোর দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বললে—এই যে মা, এই দেখ! সে।

প্রৌঢ়া ঝুঁকে দেখে বললে—হ্যাঁ, এই তো!

সুরেশ্বর এগিয়ে গেল।

তরুণীটি বললে—এই—এই! এই সে। সে আঙুল দেখালে।

সুরেশ্বর দেখলে। সে ব্রজেশ্বর, ধনেশ্বরের বড় ছেলে। সেই, তাকে যে রাজা বলে তার প্রজাত্ব স্বীকার করেছে অত্যন্ত সহজ হাসিমুখে। যাকে তার মিষ্ট মনে হয়েছে। যার স্নেহ-প্রীতির মধ্যে এক বিন্দু কপটতা আছে সন্দেহ করে নি। যাকে সে মধ্যে মধ্যে আসতে বলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *