একটি সন্ধের যবনিকা – ১

‘সামান্য একটা টাইয়ের নটের কারণে কি একটা সন্ধ্যা বরবাদ হতে পারে?’

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই আয়নার দিকে তাকাল আরিয়ান শফিক। আয়নার দিকে তাকালেও সে আসলে আয়না দেখছে না। বরং আয়নার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে ওর পেছনে বিছানায় বসা মানুষটার দিকে। অত্যন্ত আয়েশি ভঙ্গিতে নিজের দামি লেহেঙ্গাটা বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে, কালো জমিনের ওপরে সোনালি সুতোর কারুকাজের ওপরে তৃপ্তির সঙ্গে হাত বুলাচ্ছিল মানুষটা। আরিয়ান আগেও খেয়াল করেছে নিজের পছন্দের জিনিস, হোক সেটা দামি পারফিউম, শো-পিস, দামি গহনা, কিংবা পোশাক, মাঝেমধ্যেই একাকী কিংবা নিজের খেয়ালের বসে সেগুলোতে হাত বুলাতে পছন্দ করে মনিকা। হাত বুলানোটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। আরিয়ান খেয়াল করেছে সেগুলোতে হাত বোলানোর সময়ে মনিকার চোখে অদ্ভুত এক তৃপ্তি ফুটে ওঠে।

‘কি ব্যাপার বললে না!’ আরিয়ান বাঁধতে থাকা টাইয়ের নটটা আবারো আলগা করে নতুন করে বাঁধতে বাঁধতে বলে উঠল। এবার আরেকটু জোরে। আগেরবার কাজ না হলেও এবার কাজ হলো। নিজের দামি পোশাকের তৃপ্তির জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো মেয়েটা। ‘কি বললে?’ আরিয়ানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চট করে বলে উঠল মনিকা। ‘তুমি দ্রুত রেডি হচ্ছো না কেন? আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে না!’

‘বলছিলাম, আজকের মতো এরকম একটা সন্ধ্যার জন্যে আমার টাইয়ের নটটা পারফেক্ট হওয়া কতটা জরুরি?’ আরিয়ান এবার নটটাকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ঘুরিয়ে ভেতর দিকে টান দিতেই নটটা যখন ও আঙুলের ওপরে শক্ত হয়ে এঁটে বসল নিজের ভেতরে দারুণ একটা প্রশান্তি অনুভব করল ও। ওসেন ব্লু রঙের নিটেড টাইয়ের নটটা শক্ত করে সাদা শার্টের সামনের বোতামের ওপরে বসিয়ে কলারটা খাঁজ করে টাইট করে দিয়ে মনিকার দিকে ঘুরে তাকাল আরিয়ান। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। আরিয়ান ঘুরে দাঁড়াতেই এক গাল হেসে ওর দিকে এগিয়ে এলো সে। হাতে ধরা কালো পিন স্ট্রাইপের স্যুটের জ্যাকেটটা ওকে পরিয়ে দিতে দিতে সে বলে উঠল, ‘তোমার জন্যে আজকে শুধু টাইয়ের নট না প্রতিটা জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রতিটা মানুষ আসবে শুধু তোমাকে দেখার জন্যেই। তোমার কথা শোনার জন্যেই। মাইন্ড ইট, এরকম ঘটনা এর আগে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে আর ঘটেছে বলে তো মনে পড়ে না,’ মনিকা ওকে কোটটা পরিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল।

কোটটা পরে নিয়ে টাইয়ের নটটা আরেকবার চেক করে নিলো আরিয়ান। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে টাইয়ের সঙ্গে ম্যাচ করা পকেট স্কোয়ারটা বিশেষ কায়দায় ভাঁজ করে ওটাকে চেস্ট পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে একবার মনিকার হাসিমুখের দিকে ফিরে তাকাল সে। মনিকার এই হাস্যোজ্জ্বল সুখী চেহারাটা দেখতে দেখতে প্রথম যে কথাটা আরিয়ানের মাথায় এলো, এই মেয়েটার অনেককিছুই ওর পছন্দ নয়, কিন্তু বারবার এই হাসির মোহে আটকা পড়ে যায় ও। ওর খুব কাছাকাছি থাকাতে মনিকার পারফিউমের স্মেলটাও পরিষ্কার টের পাচ্ছে ও। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই মেয়েটার এই হাসি আর গায়ের সুগন্ধ ওকে সবচেয়ে বেশি পাগল করে। ওদের ব্রেকআপ হওয়ার সময়টাতেও এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি মিস করেছে আরিয়ান। আনমনেই নিজের একটা হাত তুলে মনিকার এক কাঁধে রাখল। ‘হঠাৎ করেই সবকিছু এমনভাবে বদলে গেল,’ আপনাতেই মাথা নাড়তে নাড়তে আরিয়ান আবার আয়নার দিকে ফিরে তাকাল। ‘ঠিক যেন বিশ্বাস হতে মন চায় না। গত বছর ঠিক এই সময়টাতেই সবকিছু—’

—তাতে কী হয়েছে, ওসব সময় তো তুমি—’ আরিয়ানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মনিকা বলে উঠল। কিন্তু বলতে গিয়েও সে মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। তুমি শব্দটা বলেও আবার দ্রুত শুধরে নিল নিজেকে। মানে আমরা পার করে এসেছি। আর যদি বদলে যাওয়ার কথা বলো তবে জীবন তো বদলাবেই। কিন্তু সেই বদলটা পজিটিভ দিকে যাচ্ছে না নেগেটিভ দিকে যাচ্ছে—সেটাই গুরুত্বপূর্ণ,’ আরিয়ানের গলায় ঠিক যতটা আবেগ মনিকার গলায় ঠিক ততটাই বাস্তবিক কাঠিন্যের ছোঁয়া।

‘এটা ঠিক যে—এর চেয়ে বেশি পজিটিভ কিছু আমার লাইফে এর আগে কখনো কিছু হয়নি,’ আরিয়ান আয়নার দিকে তাকিয়েই হেসে ফেলল। আয়নাতেই দেখতে পেল মনিকাও হাসছে। ‘আমিও সেটাই বলছিলাম,’ আরিয়ান তার দিকে তাকাতেই সেও বলে উঠল।

‘তবে বিষয়টা কি জানো, আরিয়ান শার্টের কাফ লিংক ঠিক করতে করতে মনিকার দিকে ফিরে তাকাল। ‘আমি ছোটবেলা থেকে যখন যা ভেবেছি, যা পরিকল্পনা করেছি, সবসময় ঘটেছে তার উলটোটা,’ আনমনেই একবার মাথা নাড়ল আরিয়ান। ‘ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করব, শিক্ষক হবো, গবেষক হবো, ইন্টার পাস করতেই জয়েন করলাম আর্মিতে, তারপর সেখান থেকে স্পেশাল ফোর্সে। কিন্তু মাথার ভেতরে লেখালেখির পোকাটা কোনোদিনই সুস্থভাবে কাজ করতে দেয়নি আর্মিতে। আর্মি ছাড়লাম, লেখালেখিতে এলাম। ধীরে ধীরে ফুলটাইম এবং সেখান থেকে ব্যর্থ লেখকে পরিণত হলাম। এত বছরের পরিশ্রম, এত বছরের অধ্যবসায় স্রেফ জলে, আরিয়ান ফিরে তাকাল আয়নার দিকে। নিজেই নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে নিজের অনুভূতির সবচেয়ে গভীরতম স্তরটাকে। ‘যখন আমি সব হারিয়ে-’ বলে মনিকার দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি দিল। ‘সেই হারাবার দলে তুমিও আছো,’ বলে খানিকটা শব্দ করে হেসেই আবার আয়নার দিকে ঘুরে গেল। যাকগে, সব হারিয়ে বলতে গেলে প্রায় দিশেহারা সেইসময়ে এই বইটা, একেবারে সত্যি কথা হলো, এটাই ছিল আমার শেষ লেখা। এটা যদি কাজ না করত আমি লেখা ছেড়েই দিতাম। কিংবা দেশও, অথবা জীবনও,’ বলে আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কিন্তু এই বইটা সব বদলে দিল। রীতিমতো ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এলাম আমি নিজেরই ধ্বংসস্তূপ থেকে। এই পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল। কিন্তু এরপর যা শুরু হলো, সেটাকে কী বলব—ভাগ্য, পরিশ্রম, ধৈর্যের ফল! কে জানে। একের পর এক সেলিং রেকর্ড, লাখো কপি বিক্রি, ইন্টারেনেট ভাইরাল, রীতিমতো—’ কথা শেষ না করে আরিয়ার আয়নান দিকে তাকিয়ে আছে। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে নিজের প্রতিফলনের দিকে।

পেছন থেকে ওর কাঁধের ওপরে হাত রাখল মনিকা। আরিয়ান তাকিয়ে দেখল, ও কথাগুলো যেভাবেই বলুক না কেন মনিকার চেহারা বেশ সিরিয়াস হয়ে গেছে। আরিয়ান অনুধাবন করতে পারে, ওর ভেঙে পড়ার সময়টাতে মনিকার সঙ্গে ব্রেকআপের বিষয়ে কথা বলাটা সম্ভবত সে ভালোভাবে নেয়নি।

‘আরিয়ান,’ মনিকা কিছু একটা বলার আগেই আরিয়ান ঘুরে দাঁড়িয়ে এবার মনিকার কাঁধে হাত রাখল। ‘আমি জানি তুমি কী বলবে, এই প্রসঙ্গে আমাদের আগেও কথা হয়েছে, আর এই মুহূর্তে এই নিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয় না, ক্ষণিকের জন্যে মনিকাকে বলার জন্যে সরি শব্দটা আরিয়ানের জিভের ডগায় প্রায় চলে এসেছিল কিন্তু ইচ্ছে করেই শব্দটা বলল না আরিয়ান। বরং মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল ও। মৃদু হাসির অনেক অর্থ থাকে, কখনো প্রশংসা, কখনো ভরসা, কখনো শুধুই সম্মতি। আরিয়ানের মৃদু হাসির অর্থ এর কোনোটাই না বরং খানিকটা যেন আত্মঅহমিকা। দুজনেই তাকিয়ে আছে দুজনার জন্যে। ক্ষণিকের জন্যে যেন পুরো কামরা এবং সময়ও থমকে দাঁড়াল ওদের দুজনার সঙ্গে।

আরিয়ানের মৃদু হাসিটা মৃদুই রইল তবে ওটার আবহটা অহমিকা থেকে বদলে গিয়ে কাঠিন্যে রূপ নিতে শুরু করেছে এমন সময় মনিকার মুখটাই নরম হয়ে উঠল। প্রতিঘাতের ছায়াটুকু সরে গিয়ে সেখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল ভরসার প্রতিফলন। আরিয়ানের টাইয়ের নটটা ধরে সেটাকে টাইট করতে করতে বলে উঠল, ‘সব বাদ দাও, সব ভুলে যাও। আজকের সন্ধ্যা তোমার সন্ধ্যা।’ এনজয় ইট, ‘তুমি চিরকাল যে-স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া করেছ, যে-স্বপ্নের কারণে তুমি এত স্যাক্রিফাইস করেছ সেটারই একটা স্বীকৃতি তুমি পেতে যাচ্ছ আজ রাতে। পুরো দেশের সাহিত্য সমাজ তাকিয়ে আছে আজকের সন্ধের দিকে,’ এইটুকু বলে আরেকটু ক্লোজ হলো সে আরিয়ানের মুখের কাছাকাছি। আরিয়ানের মুখ থেকে মনিকার ঠোঁটের দূরত্ব ইঞ্চিখানেকেরও কম। মনিকার পারফিউমের স্মেল আরিয়ানের নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করার পাশাপাশি তার গরম নিঃশ্বাসও নিজের মুখের ওপরে অনুভব করতে পারছে আরিয়ান। ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারাবে সে, দিনের পর দিন স্ট্রাগলে তার হারাবার পরিমাণ তো কম নয়, কাজেই প্রাপ্তির খাতা যখন খুলতে শুরু করেছে…

বুম বুম শব্দে পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করতে শুরু করল আরিয়ানের।

নিজেকে সামলে নিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনের ওপরে ফুটে ওঠা নামটা দেখে স্বস্তির একটা পরশ বয়ে গেল আরিয়ানের শরীরে। যে-মানুষটা কল করেছে, তার ভেতরে অদ্ভুত এক জাদুকরী শক্তি আছে। যেকোনো সময়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে এই লোকটা নিজের মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামলাতে পারে। পোশাক-আশাকে একেবারেই ইমপ্রেসিভ নয়, দেখতেও ছোটখাটো মানুষটার ভেতরে কী যেন একটা ব্যাপার আছে, আরিয়ান রীতিমতো মুগ্ধ এই বিষয়টা নিয়ে। এই মানুষটার সঙ্গে নিজের জীবনের খারাপ এবং ভালো দুটো সময়ই পার করেছে সে, আর এই কারণেই তার প্রতি একটা অন্যরকম ভালোলাগা এবং নির্ভরতা কাজ করে আরিয়ানের ভেতরে। মানুষটা আর কেউ না, ওর তরুণ প্ৰকাশক।

‘হ্যালো, সাবের, কী অবস্থা বলো?…আমি তো প্রস্তুত,’ সাবেরকে এইটুকু বলেই আরিয়ান ইশারা করল মনিকার দিকে তাকিয়ে, ইশারায় ওকে বাইরে দেখিয়ে ইঙ্গিত করল বাসার বাকিরা কতদূর রেডি হলো সেটা দেখার জন্যে। মনিকা বেরিয়ে যেতেই ও সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিছু ফেলে যাচ্ছে কি না দেখার জন্যে। সব ঠিক আছে দেখে নিয়ে সন্তুষ্টির সঙ্গে মাথা নেড়ে, কামরার বাইরের দিকে এগোল। ‘…ঠিক আছে সাবের, আমরা সবাই দশ মিনিটের ভেতরেই প্রস্তুত থাকব, তুমি বাসার নিচে এসে একটা মিস কল দিলেই আমরা বেরোব। বাই,’ সাবেরের সঙ্গে কলটা কেটে দিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে এলো আরিয়ান। ‘কী ব্যাপার তোমরা কতদূরে, জলদি করো সাবের আসছে আধা ঘণ্টার ভেতরে…ওহ মাই গড,’ কামরার বাইরে বেরিয়ে থমকে দাঁড়াল আরিয়ান।

ওর কামরার ঠিক বাইরেই ডাইনিংরুমে দাঁড়িয়ে আছে ওদের পরিবারের প্রায় সব সদস্যরা। আরিয়ান ভেবেছিল সবাই রেডি হতে সময় লাগাবে, কিংবা সবাইকে তাড়া দিতে হবে, বাসার লোকেরা বের হতে দেরি করে ফেলবে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে সে যা দেখল তা অবাক করার মতোই। খানিকটা যেন চমকে উঠল, সবশেষে বেশ খানিকটা গর্ববোধের সঙ্গে আরিয়ানের মুখে ফুটে উঠল একটু আগের সেই অহমিকা মিশ্রিত মৃদু হাসিটা। ‘আরে চাচাজান,’ চাচা বলেও খানিকটা দ্বিধাবোধ করল আরিয়ান। কারণ আর্মিতে থাকার সময়ে চাচাকে সে স্যার বলে সম্বোধন করত। আর ও আর্মি ছাড়ার পরে একরকম বলতে গেলে ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল, আর তাই আর্মি ছাড়ার পরে চাচার সঙ্গে ওর কোনো যোগাযোগ হয়নি, কথা কিংবা সম্বোধনের তো প্রশ্নই আসে না। আর তাই চাচা হলেও শেষবারের সময়ে তাকে স্যার ডাকার স্মৃতিটাই রয়ে গেছে ওর ভেতরে। বহুদিন পর চাচা ডাকতে গিয়ে সেই দ্বিধাই এসে ভর করেছে ওর ওপরে। ছোটবেলা থেকে ওর এই একমাত্র চাচাই ছিল বলতে গেলে ওর আদর্শ। এমনকি এসএসসি পাস করা পর্যন্ত ও চাচার বাসাতেই ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে।

ছোটবেলা থেকেই ওর চাচা চাইতো আরিয়ান আর্মিতে জয়েন করুক। এইচএসসিপাস করার পর যখন আরিয়ান সত্যি সত্যি আর্মিতে জয়েন করে ওর বাবা-মার চাইতে বেশি খুশি হয়েছিল ওর চাচা। কিন্তু তারপর যখন আরিয়ান সিদ্ধান্ত নিল আর্মি ছেড়ে স্পেশাল ফোর্সে যাবে তখনো ওর চাচা খুশিই হয়েছিল। কিন্তু তারপর যখন ওকে সব ছাড়তে হলো, সেই সময়টাতে ও জানত সবচেয়ে বেশি কঠিন হবে ওর মেজর জেনারেল চাচার মুখোমুখি হওয়াটাই। আর তাই সবার আগে সেটাই করতে গিয়েছিল ও। সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করেছিল ওর চাচার সঙ্গে। ওর আজো পরিষ্কার মনে পড়ে ওর জীবনের সবচেয়ে তিক্ত সন্ধেটার কথা। শুধু ওর জন্যেই না, সম্ভবত ওর চাচার জন্যেও, যে কি না আরিয়ানকে সবসময় নিজের ছেলে বলেই মনে করত।

‘চাচাজান, আসসালামুআলাইকুম,’ বলে ডায়নিং রুমের ভেতরের দিকে দুইপা এগিয়ে গেল আরিয়ান। কামরার সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আরিয়ান দেখল ওর চাচা, যিনি ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল ওকে দেখে মুখ তুলে তাকাল। বেশ কয়েকবছর চলে গেলেও মানুষটার ভেতরে এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। সেইরকমই ফিট, আগের মতোই সুদর্শন এবং একইরকম রাশভারি রয়েছেন উনি। আরিয়ানের সালামের জবাবে শুধু মাথা নাড়ল সে। আরিয়ান ঠিক বুঝতে পারছিল না, তাদের ভেতরে কথোপকথনটা আসলে কেমন হবে এবং পরিস্থিতিটা আসলে কোনোদিকে মোড় নেবে। যেহেতু তার চাচা আজকের দিনেই উপস্থিত হয়েছে, একেবারে এই সময়টাতেই, কাজেই ও জানে ব্যাপারটা র‍্যান্ডম হতেই পারে না। পুরো দেশ যেখানে জানে আজকের সন্ধের ব্যাপারে—কাজেই উনি জানেন না, এটা হওয়া সম্ভবই না। উনি আজকের সন্ধেটা উদযাপন করার জন্যেই এসেছেন। কিন্তু ওকে আসলে কী বলবেন এবং ও কী বলবে বুঝে ওঠাটা একটা ভীষণ কঠিন ব্যাপার হবে। ‘চাচাজান, আপনি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি,’ শব্দগুলো উচ্চারণ করতে করতে আপনাতেই ওর মুখ নিচের দিকে নেমে গেল। চারপাশে সবাই চুপ হয়ে আছে অনুভব করতে পেরে আরিয়ান চোখ তুলে দেখল ওর চাচা দৃঢ় পায়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

একেবারে ওর সামনে এসে থেমে দাঁড়িয়ে সে ওর চোখে চোখ রাখল। আরিয়ান দেখল, ইস্পাত কঠিন মানুষটার চোখ জোড়া খানিকটা ভেজা ভেজা। আরিয়ানের কাঁধে নিজের একটা হাত রাখল সে, তারপর মৃদুস্বরে বলে উঠল, ‘আমি তোকে নিয়ে গর্বিত শফিক, আরিয়ানের পুরো নাম শফিকুল ইসলাম। আর লেখালেখির নাম আরিয়ান শফিক। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরা ওকে আরিয়ান নামে ডাকলেও ওর চাচা সবসময় ওকে শফিক নামেই ডাকত। ‘মানুষের জীবনে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছোটাটা যে কোনো বোকামি নয়, এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ তুই। তুই আমার ভাতিজা হতে পারিস কিন্তু আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তুই ঠিক ছিলি, আমিই ভুল ছিলাম,’ কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেল সে। আরিয়ান স্তম্ভিতের মতো ক্ষণিকের জন্যে দিশেহারা বোধ করল, একবার আশপাশে দেখল, ওর মা- বাবা, মনিকা, চাচি এবং চাচাতো বোন ইলা সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

নিজেকে সামলে নিয়ে বড়ো করে একবার নিঃশ্বাস নিল আরিয়ান, তারপর ফিরে তাকাল ওর চাচার দিকে। মানুষটা মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও ফিরে তাকাতেই বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল ওকে। চোখের পানি সামলে নিয়ে চাচাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ওর পিঠে জোরে জোরে দুটো চাপড় দিয়ে চাচা বলে উঠল, ‘স্বপ্ন দেখলে তোর মতোই দেখা উচিত,’ আরিয়ান শুধু শক্ত করেই জড়িয়ে ধরে রইল ওর চাচাকে। হাজারো কথা বলতে চাইছে কিন্তু ওর মুখের সেই ক্ষমতা নেই মনের তীব্র অনুভূতিগুলোকে ফুটিয়ে তোলে তাই শুধু জড়িয়ে ধরেই রইল।

এভাবে কতক্ষণ ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে রাখল আরিয়ান নিজেই জানে না কিন্তু ওর চাচাই বলে উঠল, ‘এই চল চল দেরি হয়ে যাবে,’ বলে সে আরিয়ানকে ছেড়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে যোগ করল। ‘আমি আমার গাড়ি নিয়ে এসেছি, একটা জিপও আছে, কাজেই আমাদের সবার জায়গা হয়ে যাবে।’

‘না, চাচা, ওর প্রকাশক গাড়ি নিয়ে আসছে, ওদের পাশ থেকে মনিকা বলে উঠল। আরিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দিল। কথাটা ও সরাসরি হয়তো ওর চাচাকে বলতে পারত না এরকম একটা আবেগঘন মুহূর্তে। ‘চাচা, ও মনিকা,’ বলে আরিয়ান ইশারা করল মনিকাকে সালাম করার জন্যে।মনিকা ঝুঁকে সালাম করতেই ওর চাচা তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতে করতে বলে উঠল, ‘আরে থাক থাক, আজকাল আর কেউ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে! বেঁচে থাকো মা, সুখী হও।’

‘ভাইয়া!’ আরিয়ানের পাশে এসে রীতিমতো চিৎকার করে উঠল ইলা, ওর চাচাতো বোন। আরিয়ান ওর দিকে ফিরে তাকাতেই প্রায় লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। আরিয়ানের নিজের কোনো বোন নেই। তাই ছোটবেলা থেকেই ইলাদের বাসায় থাকত এবং ইলাকেই চিরকাল নিজের ছোটবোনের মতোই শাসন- আদর করেছে আরিয়ান। ‘তুই কত বড়ো হয়ে গেছিস রে,’ আরিয়ান ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠল।

‘কতদিন পর ভাইয়া!’ ইলা ওকে ছেড়ে দিয়ে আবারো প্রায় চিৎকার করে উঠল। ‘তুমি কত বিখ্যাত হয়ে গেছ, আমার সব ফ্রেন্ডরা তোমার ফ্যান, ওমা এটা বুঝি ভাবি,’ বলেই সে মনিকার দিকে ফিরে তাকাল। ‘ওমা কি সুন্দর,’ বলেই সে মনিকাকেও জড়িয়ে ধরল।

‘কি ব্যাপার, কি হচ্ছে আমরা এখনো বের হচ্ছি না কেন? আমি তো মিস কল দিতে দিতে—’ আরিয়ানের প্রকাশক সাবের ডায়নিং রুমে ঢুকে ভেতরের দৃশ্য দেখে থমকে উঠল। ‘অহহহ সরি, কোনো ডিসটার্ব করলাম নাকি?’ কান থেকে মোবাইল নামাতে নামাতে সে বলে উঠল।

‘নাহ, কোনো সমস্যা নেই,’ এখন আমরা বেরোব। চলো সবাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘অনেককিছুই তো হলো, এবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো তোদের বিয়েটা,’ ওদের গাড়ি অডিটরিয়ামের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যেখানে আজকের সাহিত্য পুরস্কার বিতরণীটার আয়োজন করা হয়েছে। বাবার বলা কথাগুলো শুনে আরিয়ান মোবাইলে সময় দেখে নিয়ে আপনাতেই একবার ওর পাশে বসা মনিকার দিকে দেখল। ওর হাঁটুর ওপরে মনিকার হাত রাখা ছিল, আরিয়ানের বাবা কথাগুলো বলতেই মনিকা ওর হাতটা ধরে তাতে মৃদু চাপ দিল। ‘কি রে কথা বলিস না কেন?’ ওর বাবা আবারো পেছন থেকে মৃদু ধমকের সঙ্গে জানতে চাইল।

‘আরে ওদের দুজনরে বলতে দিলে এই জীবনে আর হবে না, চাচা,’ সামনে ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে আরিয়ানের প্রকাশক সাবের বলে উঠল। যা করার আমাদেরই করতে হবে। আগামী মাসে আপনি রিটায়ারমেন্টে গেলে পরে আমি আর আপনি মিলে সময় করে বসে সব ঠিকঠাক করে পরিকল্পনা করে ফেলব, কি বলেন?’

আরিয়ানের বাবা কিংবা মা কিছু বলার আগেই আরিয়ানের পাশ থেকে ওর চাচাতো বোন ইলা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘দারুণ, দারুণ হবে চাচা, আমাদের পরিবারে কতদিন হলো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না। আসলে পরিবারের সবাই মিলে মজা করার মতো কোনো অনুষ্ঠানই হয় না। আরু ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে আমরা অনেক মজা করব।’

‘তোর বিয়ে নিয়ে এত আগ্রহ, তোরেই ধরে বিয়ে করিয়ে দিই,’ আরিয়ান মোবাইল পকেটে রেখে ইলার কান ধরতে ধরতে বলে উঠল

‘শোন, এসব বলে আর পার পাওয়া যাবে না, বহুত প্রেম প্রেম করছো তোমরা, যোগাযোগ না থাকলে কী হবে, সব খবরই ছিল আমার কাছে। কী বলেন চাচা? এবার এদের ধরে ফ্যামিলির সবাই মিলে আয়োজন করে বিয়েটা পড়িয়ে দিতে হবে। এরপরে আমরা দেখব মজা—’

‘একদম ঠিক বলেছ তুমি ছোট বোন,’ সামনের সিট থেকে সাবের বলে উঠল। তুমিও থাকবে আমার আর চাচার সঙ্গে।’

‘বেশি কথা বলিস না, তাহলে তোর নম্বর আগে নিয়ে আসব। আচ্ছা বাদ দে,’ বলে আরিয়ান সামনের জ্যামের দিকে দেখল। আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে? সময় তো হয়ে এলো প্রায়।’

—তুই চিন্তা করিস না, চলে এসেছি প্রায়। আর আমি ওদের ফোন করে আপডেট নিচ্ছি,’ বলে সাবের ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওর মোবাইল নিয়ে। আরিয়ান একবার সামনে জ্যামের দিকে দেখে নিয়ে পেছনে তাকিয়ে ওর বাবা-মা আর ইলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘আর বেশি সময় লাগবে না। আর একবার ওখানে গেলে, পরে আর কোনো ঝামেলা নেই। এবার পুরস্কার কমিটি বেশ কিছু ক্যাটাগরি বাদ দিয়েছে, তাই পুরস্কার বিতরণীর হাইলাইট পুরোটাই আমরা যে তিনজন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি তাদের ওপরে।’

‘আর নন-ফিকশন, শিশু সাহিত্য আর তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কারের ভেতরে তিন নম্বরটাই সবসময় সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে,’ কথাটা বলে মনিকা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হাসি দিল। আরিয়ান মনিকার ধরে রাখা হাতটাতে আলতো করে একবার চাপ দিল।

‘আচ্ছা ভাইয়া, এত দারুণ একটা বই তুমি লিখলে কীভাবে?’ পেছন থেকে ইলা উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইল। মূলত ওদের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে গল্প করার জন্যেই সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে আর্মি গাড়িতে যায়নি। আর তাই এখন একের পর এক উত্তেজিত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।

তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস, আমি এত ভালো উপন্যাস লেখার ক্ষমতা রাখি না?’ আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল।

‘না না, আমি সেটা বলিনি, এই যে তুমি হঠাৎ এমন বিখ্যাত হয়ে গেলে, কেমন লাগছে তোমার,’ বলে সে উত্তেজিত ভঙ্গিতে আরিয়ানের বাবা-মায়ের দিকে ঘুরে গেল। ‘চাচা-চাচি বিশ্বাস করবেন না, আমার সব বান্ধবী ভাইয়ার ফ্যান। আমাদের ক্লাসের এক ছেলে বুক অ্যানালিসিস অ্যাসাইনমেন্টে ভাইয়ার বই নিয়ে যেদিন অ্যানালিসিস প্রেজেন্ট করল, বিশ্বাস করবেন না চাচি, আমি যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন, বলার বাইরে! আমি যখন সবাইকে বললাম, এই বইয়ের লেখক আমার ভাইয়া, সবার চেহারা যদি দেখতে, আই অ্যাম সো প্রাউড অব ইউ ভাইয়া।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, এখন বল তোর দিনকাল-পড়ালেখা কেমন চলছে?’ আরিয়ান প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্যে বলে উঠল। ওরা কথাবার্তা বলছে সামনে থেকে সাবের বলে উঠল, ‘আমরা চলে এসেছি, আর পাঁচ মিনিট। আমরা ভেন্যুতে পৌঁছালে ওদের একটা টিম আমাদের রিসিভ করে অডিতে আমাদের জন্যে নির্ধারিত টেবিলে নিয়ে বসাবে। আরিয়ান, পুরস্কার রিসিভের আগে কোনো মিডিয়া স্টেটমেন্ট, বা পাঠককে মতামত বা সমসাময়িক কাউকে নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করা যাবে না, মনে আছে তো?’

আরিয়ান কিছু না বলে স্রেফ মাথা ঝাঁকাল। সাবের ভিউ মিররে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান মাথা ঝাঁকাতেই সে আবারো বলতে শুরু করল। ‘কারণ পুরস্কারটা দেয়ার ঠিক পরেই আমরা ভেন্যুতেই একটা মিডিয়া সেগমেন্ট রেখেছি। তুই পুরস্কারটা নিবি, আমরা পাশের মিডিয়া রুমে গিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল দেব, এবং ওখান থেকে বেরিয়ে ঠিক বাইরেই থাকবে সরাসরি লেখক-পাঠক সেগমেন্ট। এটাই আমাদের প্ল্যান। কর্তৃপক্ষ এবারের আয়োজনে অনেক কিছু পরিবর্তন করেছে, আর সেই সুযোগে আমরা এই সেগমেন্টগুলো যোগ করেছি তিন প্রকাশক মিলে। কাজেই এই নতুন সেটাপটার পূর্ণ ফায়দা নেব আমরা, মনে থাকবে?’ আরিয়ান আবারো মাথা ঝাঁকাল। ‘আর তোর স্পিচ যেটা আমরা রিহার্সেল করেছিলাম, ওটা ঠিক আছে তো? রেডি একদম?’ আরিয়ান পেছন থেকে নিজের বুড়ো আঙুল দেখাল। ‘গুড, আমরা চলে এসেছি, এখন নামব।’

‘আব্বু, আম্মু, দোয়া রেখ,’ বলে ও ইলা ও মনিকাকে দেখে নিল এক ঝলক। ‘লেটস গো।’

সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নাটক, সিনেমাতে যেমন দেখায় সেরকম ওদের গাড়ি গিয়ে থামতেই, ওরা নামতেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ শুরু হয়ে যাওয়া, বিছানো লাল গালিচাতে হেঁটে যাওয়া, মোটেই সেরকম কিছু না হলেও আয়োজনটা একেবারে খারাপ না। বরং বেশ জাঁকজমকপূর্ণই বলা যায়। সে অর্থে লাল গালিচা না বিছালেও যে অডিটরিয়ামে আয়োজন করা হয়েছে, তার বাইরেই বেশ সুন্দর করে ফুলের টব দিয়ে অতিথিদের যাওয়ার জন্যে পথের মতো করা হয়েছে, মাঝখানে বিছানো হয়েছে সুন্দর নীল কার্পেট। গাড়ি থেকে নেমে সেই নীল কার্পেট ধরে খানিক এগোতেই সুন্দর মতো দেখতে শাড়ি পরা একটা মেয়ে এসে ওদের রিসিভ করে নিল। ‘আপনি নিশ্চয়ই আরিয়ান স্যার?’ বলে সে আড়চোখে আরিয়ান এবং ওর সঙ্গের বাকিদের দেখে নিল। ‘স্যার, আপনি আমার সঙ্গে আসুন প্লিজ,

অডির রিসিপশনের ঠিক পাশেই টেম্পোরারি টেবিল বসিয়ে আলাদা একটা এন্ট্রি পয়েন্ট করা হয়েছে। তাতে বসে আছে শাড়ি পরা আরো দুটো মেয়ে। ওরা এগোতেই আরিয়ানসহ সবাইকে একটা করে গেস্ট কার্ড, টোকেন, সঙ্গে একটা ছোট গিফট ব্যাগ।

‘আমাদের চাচা-চাচির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে,’ আরিয়ান কথাটা বলতেই ওর পাশে থেকে সাবের বলে উঠল, ‘নাহ আর অপেক্ষা করতে হবে না, উনারা চলে আসছেন,’ বলে সে আরিয়ানের দিকে ঘুরে গেল ওকে বেশ কয়েকটা নির্দেশনা দিয়ে শেষে যোগ করল, ‘তোরা গিয়ে টেবিলে বসিস একসঙ্গে, আমার জন্যে একটা চেয়ার রাখিস। আমি এসে জয়েন করব। বাই,’ বলে সাবের ওকে ইশারা করে চলে গেল। আরিয়ান ওর চাচা-চাচিকে রিসিভ করে ওরা সবাই মিলে অডিটরিয়ামের ভেতরের দিকে এগোল। পথিমধ্যে সাবেরকে দেখল আয়োজক থেকে শুরু করে গণ্যমান্য লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে। আরিয়ানকেও ডেকে নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সে। নতুনদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি পূর্বপরিচিত অনেকের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল আরিয়ান। বাংলা সাহিত্য জগতের অনেকেই উপস্থিত আজ এখানে। সেই সঙ্গে অনেকে আরিয়ানকে শুভেচ্ছাও জানাল ওর পুরস্কারপ্রাপ্তিতে। কথাবার্তা শেষ করে ওরা অডির ভেতরে গিয়ে ওদের জন্যে নির্ধারিত করে রাখা টেবিলে গিয়ে বসল।

‘বেশ চমৎকার আয়োজন করেছে,’ টেবিলে বসতে বসতে আরিয়ানের চাচা মেজর জেনারেল আশফাকুর রহমান বলে উঠল। ‘আমি এতটা চমৎকার আয়োজন আসলে আশা করিনি। আরিয়ানের ঠোঁটটা মৃদু ফাঁকা হয়ে উঠল, আপনাতেই ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল যে, আপনার কি ধারণা ভালো আয়োজন শুধু আর্মিতেই করা হয়। আরিয়ান কথাটা ভেবেও সারতে পারল না, তার আগেই ওর পাশে থেকে চাচি ঠিক ওর মনের কথাটাই বলে উঠল। ‘তোমাদের আর্মিতেই বুঝি ভালো প্রোগ্রাম হয়, বাকি দুনিয়াতে আর অন্যরা বুঝি ভালো আয়োজন করতে পারে না?’ কথাটা বলতে বলতে আরিয়ানের চাচি ওর মার দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু চোখ টিপল। আরিয়ান দেখল ওর বাবা-মা থেকে শুরু করে ইলা সবাই খুক খুক করে মৃদু হাসছে। আরিয়ান একবার মনিকার দিকে তাকিয়ে দেখল সে ছোট আয়না বের করে লিপস্টিক ঠিক করতে ব্যস্ত। পরিবারের সবার দিকে তাকিয়ে আরিয়ান নিজের ভেতরে দারুণ একটা প্রশান্তি অনুভব করল। অনেকদিন পর পরিবারের সবাই মিলে এত দারুণ একটা সময় কাটাচ্ছে। আরিয়ান মাঝেমধ্যেই ভাবে বিগত কয়েক বছরে আসলে কি ওদের পরিবারের অন্তরটাই শুকিয়ে গেছিল, নাকি ও-ই অনেক বেশি দূরে সরে গেছিল পরিবারের বাকিদের থেকে। সবচেয়ে বেশি স্বস্তির বিষয় হলো ওদের পরিবারের পুরনো সেই দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে এবং এই ক্ষেত্রে ওর নিজেরও খানিকটা ভূমিকা রয়েছে।

‘কি ব্যাপার, সবাই এত খুশি কেন? কী নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে?’ কান থেকে মোবাইল নামাতে নামাতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে বসে গেল সাবের। বসতে বসতে জানতে চাইল কী নিয়ে আলাপ করছে ওরা। সাবের বসতে বসতে আরিয়ান ওর চাচার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সাবেরের। কারণ বাসায় খুব ভালোভাবে কথা হয়নি দুজনার মাঝে। আরিয়ানের চাচার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে সাবের বলে উঠল, ‘আরিয়ান, সব ঠিক আছে। আর বাকি কয়জন গেস্ট এসে পৌঁছালেই প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। আর তোকে যা যা বলেছি ঠিক সেভাবেই সব বলবি। আর আমরা সেই শিডিউলটাই ফলো করব, বলে সে জিজ্ঞাসাসূচক একবার মাথা নাড়ল। আরিয়ানও মাথা নেড়ে সায় জানাল।

ওরা গল্প করতে করতেই কিছুক্ষণের ভেতরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। খানিকটা অবাক করার মতোই ব্যাপার যে অনুষ্ঠানটা শুরু হলো একেবারেই সময়মতো। বরং নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগেই শুরু হলো অনুষ্ঠান। কারণ সময়ের আগেই আয়োজকদের সবাই চলে এলো জায়গামতো। অতিথিদের ভেতরে দুয়েকজন এলো হয়তো খানিকটা দেরি করে কিন্তু তাতে মূল অনুষ্ঠানের খুব বেশি ব্যাঘাত ঘটল না। কারণ উপস্থাপিকা মূল অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ঘোষণা করার জন্যে আয়োজনের মহাপরিচালককে অনুরোধ জানাতেই উনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে বললেন। শুরুতেই ছোট কিন্তু বেশ চমৎকার একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। এই ব্যাপারটাও আরিয়ানের কাছে ব্যতিক্রম লাগল। কারণ এসব অনুষ্ঠানে সাধারণত বোরিং লেকচার চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তারপর পুরস্কার এবং সবশেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাখা হয়। কিন্তু এরা আয়োজনটা ভিন্নভাবে করেছে। ছোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা শেষ হতেই আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই সমসাময়িক সাহিত্য বিষয়ে নিজেদের মতামত এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। এখানেই খানিকটা ব্যতিক্রম করেছে এরা। অতিথিদের বক্তব্য না রেখে এরা মতামত ও অভিজ্ঞতা বলেছে সবাই। যে-কারণে বক্তব্যগুলো সংক্ষিপ্ত এবং উপভোগ্যও হলো। বক্তব্যের পালা শেষ হতেই পুরস্কার বিতরণী প্রথমেই গবেষণা গ্রন্থের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। তারপর শিশু সাহিত্য এবং সবশেষে তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার।

তৃতীয় কোটায় আরিয়ানের নাম ঘোষণা হতেই উঠে দাঁড়াল ও। পুরো হলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তালি দিতে শুরু করেছে। উঠে দাঁড়িয়েই মা-বাবা এবং চাচা- চাচিকে সালাম করে সাবেরকে একবার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল আরিয়ান, তারপর একবার মনিকা এবং ইলার দিকে দেখে নিয়ে স্টেজের দিকে রওনা দিল ও। পুরো আয়োজনের মূল কেন্দ্রে থাকে সাধারণত এই পুরস্কারটাই। তাই সবসময় সাধারণত প্রধান অতিথিই এই পুরস্কারটা দিয়ে থাকেন। এবারের আয়োজনে শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী পুরস্কার তুলে দিলেন আরিয়ানের হাতে। ছবি তোলা, পুরস্কার নেয়া, ইত্যাদি সব সেরে আরিয়ান যখন মাইকের সামনে এলো তখনো করতালির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে পুরো হলরুম। তালির জোয়ার খানিকটা কমে এলো, আরিয়ান একহাতে পুরস্কারটা নিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়াতে হাসিমুখে থাকা সত্ত্বেও চোখ দুটো ভিজে উঠেছে ওর।

মাইকটা ডান হাতে চেপে ধরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ও দুবার। তারপর যখন মুখ খুলল, প্রথম যে-কথাটা বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে, ‘আমি আক্ষরিক অর্থেই আসলে জানি না এই সম্মানের ভাগিদার আমি আসলে কতটুকু,’ বলে ও খানিকটা থেমে আবারো বলতে লাগল। ‘কথিত আছে মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর ভেতরে অন্যতম দুটো হলো, যে-মুহূর্তে সে জন্ম নেয় এবং যে-মুহূর্তে সে আবিষ্কার করতে পারে সে আসলে কেন জন্ম নিয়েছে। প্রথমটার ওপরে কারো হাত থাকে না আর দ্বিতীয়টা বেশির ভাগ মানুষ উপলব্ধি করতে করতেই তাদের জীবন কেটে যায়,’ আরিয়ান এটুকু বলতেই হলরুমে থাকা অনেকে হেসে উঠল। ‘আজকে এই মঞ্চে আপনাদের সবার সামনে দাঁড়িয়ে,’ নিজের হাতে ধরা পুরস্কারটার দিকে তাকাল সে। ‘এত বড়ো একটা সম্মাননা পেয়ে আমার কাছে বারবার শুধু দ্বিতীয় মুহূর্তটার কথা মনে পড়ছে। জীবনের কোনো এক বাঁকে কোনো এক সময় খুব কাছের কোনো এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, আমি নাকি এক ইমোশনাল ফুল। কথাটাতে তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু পরবর্তীতে যখনই ভেবেছি ওই মুহূর্তটাই আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে,’ বলে ক্ষণিকের জন্যে থামল আরিয়ান। ‘কেন জানেন? কারণ আমার মনে হয়েছে আমি আসলেই একটা ইমোশনাল ফুল, আর তাই সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিই, ঠিক আছে। যদি সত্যি তাই হয়, আমার আবেগই যদি আমার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হয়, তবে সেই আবেগকেই আমি আমার সবচেয়ে বড়ো শক্তিতে পরিবর্তন করব। আমি আমার আবেগকেই প্রবাহিত হতে দেব, আমার জীবনে, আমার কর্মে,’ বলে ও বাম দিকে ফিরে তাকাল মঞ্চের একপাশে, সেখানে বড়ো করে প্রজেক্টরে দেয়ালজোড়া করে ফুটে উঠেছে বিরাট একটা ছবি। ওর বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি। ‘আর সেই আবেগকেই প্রবাহিত হতে দিই আমি আমার গল্পে, আরিয়ান শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করতেই পুরো অডিটরিয়াম করতালিতে ফেটে পড়ল। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আরিয়ানের শরীরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। তার মনে হতে লাগল ভিড়ের এই উচ্ছ্বাস, এই তালির শব্দ যেন বাতাসে ভাসছে না, যেন বায়বীয় কিছু নয়, এ-যেন সলিড কিছু, এর যেন শক্তিশালী আকৃতিগত কোনো শক্তি আছে। তীব্র বৃষ্টিতে ভেজার সময়ে ঠিক যেমন অনুভূতি হয়, ঠিক তেমনি ওর মনে হতে লাগল প্রতিটা করতালি, প্রতিটা মানুষের উচ্ছ্বাস যেন ওর শরীরে ঠিক বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে লাগল। আরিয়ানের চোখে সত্যি সত্যি পানি চলে এলো।

করতালি আর উচ্ছ্বাস খানিকটা কমে আসতে, আরিয়ান আবারো বলতে শুরু করবে, হঠাৎই ওর দৃষ্টি চলে গেল অডিটরিয়ামের দরজার দিকে। সেখান দিয়ে সদ্য প্রবেশ করেছে দুজন মানুষ। মানুষ দুজন সাধারণ পোশাক পরা থাকলেও তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিশ। দলটার সামনের লোক দুজনই সরাসরি তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকেই। নিজে ও আর্মিতে ছিল, সেই সঙ্গে স্পেশাল ফোর্সেও, কাজেই সেই অভিজ্ঞতা আর ইনটুইশন থেকে জানে, সাধারণ পোশাকে থাকলেও এই দুজন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোক। কে জানে হয়তো এরা স্রেফ রুটিন ডিউটিতে আছে। আরিয়ান আরো কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল তালির শব্দ পুরোপুরি থেমে যাওয়ার জন্যে। ও আবারো বলতে শুরু করবে ঠিক তখনই দেখতে পেল সেই দুজন এগিয়ে আসছে অডিটরিয়ামের সামনের দিকে। ‘একজন মানুষ যখন কোনোকিছু অর্জন করে তার যাত্রাটা হয়তো একা হয় কিন্তু সেই যাত্ৰা সম্পন্ন করতে হলে তার সঙ্গে সঙ্গী হতে হয় অনেককেই। আর আমার এই অর্জনও একার নয়,’ লোক দুজন আর ওদেরসঙ্গে পুলিশেরা ঠিক ওর পরিবার এবং সাবের বসে আছে যে-টেবিলে সেটার পাশে এসেই থেমে গেল। আরিয়ান দেখল এবার শুধু ও নয় বরং অনেকেই ওদিকে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে একে একে ধন্যবাদ জানাল সবাইকে। ওর বক্তব্য শেষ হতেই আবারো সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়ে তালি দিল, কিন্তু এবার সেটার জোর কম। মঞ্চের ঠিক সামনেই আরিয়ানের পরিচিতদের টেবিলের পাশে খানিকটা যেন উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। আরিয়ান মঞ্চ থেকেই দেখল সাবের উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত নাড়ছে।

আরিয়ান দ্রুত নেমে এলো মঞ্চ থেকে। ‘কি ব্যাপার, কি হচ্ছে?’

ঘরের ভেতর থেকে সাবের বলে উঠল, ‘এই লোকগুলো স্পেশাল ফোর্সের অফিসার, সাবেরের কথা শুনে মনে মনে আরিয়ান ভাবল, এটা তো বুঝতেই পেরেছি। কিন্তু সাবের পরের বাক্যে যা বলল পুরোপুরি চমকে উঠল ও। ‘এই অফিসারেরা তোকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে,’ কথাটা শুনে আরিয়ান যতটা অবাক হলো বাকি কারো ভঙ্গিই তারচেয়ে কম নয়।

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে। আর আরিয়ান তাকিয়ে আছে অফিসার দুজন আর পুলিশদের কঠিন চোখের দিকে।

আফিসার দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে আরিয়ান মৃদু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু সে দেখতে না পেলেও নিজের কল্পনাতেই পরিষ্কার টের পেল হাসিটা ঠিক সেভাবে জমছে না। ও প্রায় নিশ্চিত যে হাসিটা ও হাসার চেষ্টা করছে সেটাকে সম্ভবত মুখ ভেঙচানোর মতো দেখাচ্ছে। ‘আপনারা কি মজা করছেন আমার সঙ্গে?’ মুখ ভেঙচানোর মতো হলেও আরিয়ান নিজের হাসিটাকে আরেকটু বাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তেমন একটা কাজ হলো না। ‘এটা একটা প্র্যাংক, তাই না?’

আরিয়ানের সামনে বসা ডান দিকের সুদর্শন দেখতে অফিসারটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল বামের অফিসার। এই মানুষটা দেখতে দ্বিতীয়জনের মতো এতটা সুদর্শন নয়, উচ্চতা এবং আকৃতিও ঠিক পুলিশ অফিসার বলতেই আমরা যেমন বুঝি তেমন নয়। কিন্তু তার কাঁধ জোড়া আর দুই হাত দারুণ পেশিবহুল, মাথার চুলগুলো বেশ যত্নের সঙ্গে ব্যাকব্রাশ করা, তারচেয়ে বেশি যত্নের সঙ্গে সুন্দর করে কাটা তার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, তাতে সামান্য কাঁচাপাকা একটা ভাব আছে। তবে এগুলোর কোনোটাই মানুষটার মূল বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে না। মূল বিষয়টা তার চোখে, একেবারে ঠান্ডা এবং ঝড়ের আগে হঠাৎ থমকে যাওয়া প্রকৃতির মতো শান্ত চোখ মানুষটার।

‘মিস্টার আরিয়ান,’ পাশেরজনকে থামিয়ে দিয়ে সে বলে উঠল, ট্রাস্ট মি,’ তার ইংরেজি অত্যন্ত পরিষ্কার এবং কথার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত চোখ এবং কাঁধ নড়ে ওঠে মানুষটার। ‘ব্যাপারটা যদি প্র্যাংক হতো কিংবা জোক হতো আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হতো না। প্রথমত, আমরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোক হলেও অশিক্ষিত না, দিন দুনিয়ার খবর রাখি। আমরা জানি আপনি কে? দ্বিতীয়ত, আমার ওয়াইফ আপনার পাঠক এবং ভক্ত, নিজের পারিবারিক কলহের ভয়ে হলেও আপনাকে হ্যাসাল করব না আমি,’ বলে সে এরকম টান টান অবস্থাতেও খানিকটা হাস্যকর ভঙ্গিতে আরেকবার কাঁধ ঝাঁকাল। ‘বিবাহিত জীবনে পুরুষদের কত কী মানিয়ে নিতে হয়, আপনার কোনো ধারণা আছে?’

‘অফিসার—’

‘আমার কথা শেষ হয়নি, মিস্টার আরিয়ান,’ কোনো ধমক নয়, কিছু নয়, কিন্তু আরিয়ানের কথার মাঝখানে নিজের একটা আঙুল তুলে এমনভাবে ওকে থামিয়ে দিল রীতিমতো চুপসে গেল আরিয়ান। ট্রাস্ট মি, এখানে কোনো জোক চলছে না, আমরাও আপনার সঙ্গে কোনো প্র্যাংক করছি না,’ বলে নিজের মুখটাকে সে খানিকটা সামনে নিয়ে এলো। আপনার কোনো ধারণাও নেই আপনি এই মুহূর্তে কী ধরনের বিপদে আছেন, ইউ আর ইন রিয়েল ডিপ শিট মিস্টার আরিয়ান, ডিপ ডিপ শিট,’ শেষ প্রতিটা শব্দ সে কেটে কেটে উচ্চারণ করল। ‘আই হোপ ইই নো, হোয়াট ডিপ শিট ইজ,’ লোকটার প্রতিটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের রং বদলায়, ঠিক যেমনটা ঝড়ের ঠিক আগে ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতি আর মেঘের রং বদলায়। লোকটা কথাগুলো শেষ করে একবার নিজের সুদর্শন পার্টনানের দিকে দেখে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিল। আরিয়ান অনুভব করল ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে, আনমনেই একবার কামরার খোলা দরজার দিকে ফিরে তাকাল ও, দুজন গার্ড বাইরে, তাদের ওপাশে মিডিয়ার লোকজন হুড়োহুড়ি করছে, তার ভেতরে পলকের জন্য মোবাইল কানে লাগানো সাবেরকেও দেখতে পেল আরিয়ান, আনমনেই মাথা নাড়ল ও, আজকের সন্ধ্যে কী হওয়ার কথা ছিল, আর কী হচ্ছে।

‘ঠিক আছে, বলুন কী জানতে চান আপনারা?’ শব্দগুলো ও নিজে উচ্চারণ করল নাকি আপনাতেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, নিজেই ঠিক বুঝতে পারল না আরিয়ান। ওরা এই মুহূর্তে বসে আছে অনুষ্ঠান চলতে থাকা সেই অডিটরিয়ামের পাশের কামরাতে, যেখানে আরিয়ানের পুরস্কার নেবার পর মিডিয়ার সঙ্গে ‘মিট দ্য রাইটার’ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল সেখানে। কামরাটা ছোট কিন্তু প্রেস বা মিডিয়ার সঙ্গে কনফারেন্স করার জন্যে একেবারে পারফেক্ট। ছোট কামরাটার একপাশে টেবিল সেটাপ বসানো, সেটার সামনে সুন্দর করে সাজানো চেয়ার। আর সেই চেয়ারগুলোর দুটো টেনে নিয়ে বসেছে দুই পুলিশ অফিসার, আর টেবিলের অন্যপাশে বসে আছে আরিয়ান। একটু আগে আরিয়ান যখন মঞ্চে পুরস্কার নিচ্ছিল হঠাৎই অডিটরিয়ামে অফিসারদের আগমন ঘটে এবং এরপরেই মঞ্চ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওকে জানানো হয় একটা বিশেষ দরকারে আইনের লোকজন ওর সঙ্গে কথা বলতে চায়। অনুষ্ঠানের আয়োজনের লোকজন, ওর পরিবার, আরিয়ানের মেজর জেনারেল চাচা, ওর প্রকাশক কারো কথাই স্পেশাল ফোর্সের অফিসারেরা কানে নেয়নি। কাউকে সেভাবে কিছু জানায়ওনি, তাদের সরাসরি দাবি ছিল, আগে ওরা আরিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে চায়, এরপরে বাকি সব। যদি তাতে কেউ বাধা দেয় কিংবা দেয়ার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করার মতো প্রস্তুতি তারা নিয়েই এসেছে, এমনকি আরিয়ান যদি তাদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানায় সঙ্গে সঙ্গে যাতে তারা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে অসহযোগিতার অভিযোগে তাকে অ্যারেস্ট করতে পারে সেই বিশেষ অনুমতিপত্রও তারা নিয়ে এসেছে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে পুলিশ যা করে না, এই দুই পুলিশ অফিসার সেটাই করেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা শান্ত কিন্তু শক্ত ছিল, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে ডকুমেন্ট ছিল এবং সেগুলো তারা দেখিয়েছেও। কথোপকথনের এক পর্যায়ে পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত হতে শুরু করে সেই সময়ে আরিয়ান বাধা দেয়, ও নিজে থেকেই পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়। সাবেরকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে ও পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হতেই তারা তাকে নিয়ে আসে অডিটরিয়ামের পাশের সেই কামরাটাতে। শুরু থেকেই দুই পুলিশ অফিসারের আচরণ ছিল একেবারে শান্ত এবং ভদ্র। সুদর্শন অফিসার নিজের নাম জানায় জোনায়েদ এবং ছোট-খাট ফ্রেঞ্চকাট অফিসার জানায় তার নাম রহমান, তারা স্পেশাল একটা কেস নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চায় এবং এরপরেই এমন একটা প্রশ্ন করে যেটা শুনে আরিয়ান ঠিক বুঝতে পারেনি সে হাসবে না কাঁদবে।

‘বলুন কী জানতে চান আপনারা?’ দুই অফিসারকেই নিশ্চুপ দেখে আবারো একই প্রশ্ন করল আরিয়ান।

‘আপনাকে তো বলেছিই আমার নাম রহমান,’ বলে সে মৃদু হেসে উঠল। ‘আপনার নাম তো শফিকুল ইসলাম, তাই না?’

‘জি, ওটাই আমার প্রকৃত নাম, আরিয়ান আমার ডাক নাম আর আরিয়ান শফিক পেন নেম বা লেখালেখির নাম বলতে পারেন।’

‘আরিয়ান শফিক, সুন্দর নাম, বেশ একটা লেখক বা নায়কসুলভ ভাব চলে আসে আপনাতেই, নামটা শুনলেই,’ বলে সে তার সুদর্শন সঙ্গী জোনায়েদের দিকে তাকাল। কিন্তু জোনায়েদের চোখে কোনো আলাদা ভাব নেই। সে বেশ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে।

‘আপনারা নিশ্চয়ই আমার নামের ইতিহাস জানতে এখানে আসেননি, আর পেন নেম রাখাটা কোনো অপরাধ বলেও তো আমার জানা নেই।’

‘মিস্টার আরিয়ান, আপনি কামাল আহমেদ নামে কাউকে চেনেন?’ রহমান আবারো ফিরে তাকিয়েছে আরিয়ানের দিকে। এবার তার দৃষ্টিতে কোনো মজার ভাব নেই। পুরোটাই পাথরের মতো স্থির আর মরা মাছের মতো ভাবলেশহীন, এই ভাবটা সে সম্ভবত অর্জন করেছে নিজের অভিজ্ঞতা আর ট্রেনিং দিয়ে। রহমান ভাবলেশহীন থাকলেও আরিয়ানের প্রতিক্রিয়া হলো প্রায় বোমা বিস্ফোরণের মতো।

যদিও ওপরে ওপরে বলতে গেলে সে প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আক্ষরিক অর্থেই ওর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। নামটা শোনামাত্রই প্রথম যে-কথাটা ওর মাথায় এলো,

আজ রাতেই কেন? এই মানুষটাই কেন?

প্রশ্ন দুটো যেন আপনাতেই ওর মাথার ভেতরে উচ্চারিত হয়ে উঠল। নামটা শোনামাত্রই আরিয়ানের মনে হলো, কেউ ওর বুকের ওপরে একটা পা তুলে দিয়ে তিনমণি একটা চাপ সৃষ্টি করছে। আপনাতেই একহাতে নিজের হাঁটু চেপে ধরল ও, এতটাই শক্ত করে যে ক্ষণিকের জন্যে ওর মনে হলো পরনের প্যান্ট ভেদ করে হাঁটুতে নখ বসে যাবে। নিজেকে সামলানোর জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করল ও, বিশেষ করে যাতে ওর মুখে কোনো এক্সপ্রেশন ফুটে না ওঠে। কিন্তু খুব বেশি সফল হতে পারল বলে মনে হলো না ওর কাছে। ‘কামাল কে?’ খুবই যেন স্বাভাবিকভাবে জানতে চাইছে এরকম একটা গলায় প্রশ্ন করল ও। কিন্তু প্রশ্নটা উচ্চারণ করেই সামনে তাকিয়ে যা দেখতে পেল তাতে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারল ওর অভিনয় খুব একটা কাজে দেয়নি। ছোট বাচ্চারা শিক্ষক বা গার্ডিয়ানের সামনে খুব সিরিয়াসভাবে যখন কোনো অপরাধ লুকানোর চেষ্টা করে কিন্তু মুরুব্বিরা সবই বুঝতে পারে তখন ছোটদের হাস্যকর চালাকি দেখলে মুরব্বিদের মুখে যে ধরনের হাসি ফুটে ওঠে সেরকম একটা হাসি মুখ নিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে রহমান।

‘কেন অস্বীকার করছেন লেখক সাহেব?’ আরিয়ান চোখ তুলে তাকাতেই ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রহমান। ‘আপনি ঠিকই জানেন আমি কার কথা জানতে চাইছি। ঠিক আছে আপনার মেমোরি শার্প করতে হেল্প করছি আমরা। কামাল আহমেদ নাম মানুষটার। তাকে আপনি হয়তো কামাল শরীফ নামে চেনেন,’ বলে সে তার পার্টনারের দিকে তাকাতেই লোকটা তার সামনে রাখা ফোল্ডার থেকে কাগজের মতো কিছু একটা বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিল। আরিয়ান দেখল একটা ছবি। ‘দেখুন ভালো করে তারপর বলুন আপনি উনাকে চেনেন কি না?

আরিয়ান আড়চোখে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছে এটা সেই মানুষটারই ছবি। ছবিটার দিকে তাকাতেই এলোমেলো কোঁকড়া চুল, আর ভাসাভাসা চোখগুলো দেখতে পেল ও। কত স্মৃতি আর সুন্দর সময় কেটেছে একসময় এই মানুষটার সঙ্গে, সম্ভবত ওদের দুজনারই জীবনের সবচেয়ে স্ট্রাগলিং একটা সময়ে। আরিয়ান সেইসব স্মৃতির ঝাঁপিগুলো আটকে দিয়ে রহমানের দিকে চোখ তুলে বলে উঠল। ‘আর ইউ জোকিং অফিসার,’ ওর চোখ জোড়া কুঁচকে উঠেছে। ‘আমার ফ্রেন্ডকে আমি চিনতে পারব না। আমার সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ডদের একজনকে, হতে পারে সে মারা গেছে। কিন্তু মৃত বলেই একটা মানুষকে আমি চিনতে পারব না! এটা কেমন প্রশ্ন!’ বলে সে ফিরে তাকাল সুদর্শন জোনায়েদের দিকে। ‘এরকম একটা পরিস্থিতিতে হুট করে তার নাম, তাও আবার আসল নাম বলাতে চট করে ধরতে পারিনি। আপনারা হঠাৎ কামালের কথা জানতে চাইছেন কেন?’

‘আপনার বন্ধু মারা গেছে, সেটা তো আপনি বললেনই,’ রহমান টেবিলের ওপরে নিজের কনুই রেখে তার ওপরে ঝুঁকে ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে উচ্চারণ করল প্রশ্নটা। ‘কীভাবে মারা গেছিল সে?’

আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল একবার। ওর ভ্রু জোড়া এখনো কুঁচকেই আছে। ‘আপনারা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা রাতে আমার জন্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে আমারই মৃত বন্ধুকে নিয়ে প্রশ্ন করছেন, কারণটা জানতে পারি?’

‘মিস্টার আরিয়ান,’ অফিসার রহমান হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসল। ‘আপনাকে এবং আপনার লোকদেরকে আগেই বলা হয়েছে আপনাকে জেরা করার এবং আপনাকে অ্যারেস্ট করার স্পেশাল পারমিশন আমাদের কাছে আছে। কাজেই যা জানতে চাইছি সেটার রেলেভেন্স অবশ্যই আছে। উলটাপালটা কথা না বলে যা বলি সেটার জবাব দেবেন সরাসরি। বলুন, আপনার বন্ধু মারা গেছিল কীভাবে?’ তার কথার শেষ অংশটুকু সে উচ্চারণ করেছে পুরোপুরি পুলিশি ধমকের সুরে।

তাও আরিয়ান চট করে জবাব দিল না। সে তাকিয়ে আছে রহমানের চোখের দিকে। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আরিয়ান অনুভব করল, তার চোখে কোনো ভাব নেই, পুরোপুরি মরা মাছের মতো ভাবলেশহীন একজোড়া চোখের মণি। ‘ও সুইসাইড করেছিল,’ শব্দগুলো ও যেন উচ্চারণ করল না, চট করে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

‘ভেরি গুড মিস্টার আরিয়ান, এই তো লাইনে আসছেন,’ বলে সে মৃদু হেসে উঠল। ‘এবার বলুন কেন সুইসাইড করেছিল আপনার বন্ধু?’

‘আমি জানি না,’ এই শব্দগুলো আরিয়ানের বুকের একেবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। ‘আমিও জানতে চাই কেন সে সুইসাইড করেছিল।’

‘দারুণ দারুণ,’ বলে টেবিলের ওপরে খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে একটা চাটি মারল রহমান। ‘দেখেছ জোনায়েদ, শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে কাজ করার এই এক মজা। এদের সঙ্গে চট করে মতের এমন মিল হয়ে যায় বলার বাইরে। শুষ্ক পুলিশি জীবনে এরকম ক্রিমিনালই তো চাই—’

‘এক মিনিট আপনি—’ আরিয়ান রাগের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল রহমান আবার ওকে থামিয়ে দিল।

‘মজার ব্যাপার কি জানেন,’ আরিয়ান দেখল রহমান লোকটা কথায় কথায় খুব বিচিত্র এক ভঙ্গিতে ঠোঁট চাটে এবং ফ্রেঞ্চকাটে হাত বুলায়। এটা কি মুদ্রাদোষ নাকি ইচ্ছে করেই করে কে জানে। ‘আচ্ছা আমি আপনাকে মিস্টার ‘এ’ ডাকতে পারি,’ বলে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে খলখলে ভঙ্গিতে হেসে উঠল। ‘আসলে আমি আবার হিন্দি সিনেমার বিরাট ফ্যান। আপনারা হয়তো ইংরেজি সিনেমা দেখেন কিন্তু আবার হিন্দি না হলে চলে না। হৃতিক রোশান বলতে পাগল, ওর একটা চরিত্র আছে না, ধুম টু সিনেমায়, ওরও নাম থাকে আরিয়ান, যে কি না মিস্টার ‘এ’ নামে চুরি করত,’ বলে সে আবারো সুদর্শন জোনায়েদের দিকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘উনি কিন্তু দেখতেও সুদর্শন,’ বলে আবারো সে একই খলখলে ভঙ্গিতে হেসে উঠল।

আরিয়ান এবার রাগের সঙ্গে জোনায়েদের দিকে তাকাল, ওর মনে হচ্ছে রহমান লোকটা ওর সঙ্গে মজা করছে। কথাটা ও বলেই ফেলল, ‘আপনি কি মজা করছেন আমার সঙ্গে অফিসার?’ আরিয়ানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠেছে।

‘মোটেই না,’ বলে চট করে ওর দিকে ফিরে তাকাল রহমান। পলকের ভেতরে তার খলখলে চোখ জোড়া গনগনে হয়ে উঠেছে। ‘মিস্টার এ, একটা বিষয় কি জানেন, এটা আমিও জানতে চাই, আপনার সঙ্গে সঙ্গে। কেন সুইসাইড করেছিল আপনার বন্ধু,’ বলে সে একেবারেই হুট করে বলে উঠল, ‘আপনার বন্ধু যেদিন মারা যায়,’ বলে সে একটা হাত তুলল। ‘মানে সুইসাইড করে সেদিন রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?’

‘অদ্ভুত কথা, এতদিন আগের কথা কি আমার মনে আছে নাকি!’ আরিয়ানের ভ্রুতে কুঞ্চনের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, সেদিন কি আপনার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল?’

‘তার মৃত্যুর খবর আপনি জানতে পারেন কখন?’ দুই অফিসার পরপর দুটো প্রশ্ন করল ওকে।

‘দেখুন আপনাদের কোনো প্রশ্নের জবাবই আমি দেব না। আমি ল-ইয়ার ছাড়া কোনো কথাই বলব না,’ হুট করেই কথাটা মাথায় এলো আরিয়ানের। প্রথমে কথা বলতে রাজি হয়েছিল কারণ ও ঠিক বুঝতে পারেনি এরকম একটা সময় পুলিশ কেন এসেছে। ও ভেবেছিল হয়তো কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, কথা বললে হয়তো সেটার সমাধান হবে। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারছে পুরো আলোচনাটা এমন এক দিকে টার্ন নিচ্ছে যেটা ওর কল্পনাতেও ছিল না।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝলাম আপনার এসব কিছুই মনে নেই,’ যেন ওরা কথা শুনতেই পায়নি এমন এক সুরে রহমান বলে উঠল। ‘আমাকে অন্য একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো,’ রহমানের গলায় কোনো বিশেষ ভাব নেই এখন। খুবই সাধারণ আলোচনা করছে যেন এমন সুরে বলে উঠল। ‘বুঝলাম আপনি সেদিন রাতে কোথায় ছিলেন, আপনার বন্ধুর সঙ্গে সেদিন আপনার দেখা হয়েছিল কি না এসব আপনার মনে নেই। তবে এই প্রশ্নটার জবাব দিন তো। আপনার বন্ধুর মৃত্যুর পর একবারও আপনি তার পরিচিত কেউ, তার কোনো আত্মীয় কিংবা অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি কেন?’ রহমান তার ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল। ‘কেমন বন্ধু ছিল কামাল আপনার?’ আবারো ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল। ‘বন্ধু বাদ দিন, খুব স্বল্প পরিচিত কেউও যদি মারা যায় মানুষের একটা প্রতিক্রিয়া দেখায়, আপনি এমনকি সেটাও দেখাননি। যেদিন আপনার বন্ধু মারা যায়, তার পরেই আপনি স্রেফ তাকে ভুলে যান, কোনো ধরনের যোগাযোগ না, কিছুই না, কোনো ধরনের সহানুভূতি প্রকাশ না, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা, কিছুই না। মানুষটা মারা গেল আর আপনি স্রেফ ভুলে গেলেন তাকে। কারণ কি বলেন তো মিস্টার এ?’

ওরা জানে, ওরা অবশ্যই বিষয়টা জানে, আরিয়ানের মনে হতে লাগল ওর অন্তরাত্মা চিৎকার করে করে কথাগুলো বলছে ওকে। এই ঠান্ডার ভেতরেও আরিয়ান অনুভব করতে পারল ওর পিঠ দিয়ে ঘাম ছুটছে। সেই সঙ্গে সে এটাও অনুভব করতে পারল ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল।

‘কি মিস্টার এ?’ রহমানের ঠোঁটে সবজান্তা টাইপের টিটকিরির হাসি। ‘কথা বন্ধ হয়ে গেল কেন?’

জিভ দিয়ে নিজের শুকনো ঠোঁট চাটল আরিয়ান, না চাইতেও আপনাতেও ঢোক গিলল সে একবার। ‘অফিসার, আপনি আমাকে মিস্টার এ ডাকছেন, আমি কি আপনাকে রহমান সাহেব বলতে পারি। আমার এক বস ছিল মিস্টার রহমান, তাকে আমি রহমান সাহেব বলে ডাকতাম।’

আরিয়ানের কথা শেষ হওয়ার আগেই আবারো খলখল করে হেসে উঠল রহমান। ‘আপনার সাহস আছে মিস্টার আরিয়ান, আপনাকে প্রিয় চরিত্রের নামে ডেকে আমি আসলে ভুল করিনি। ভেতরে ভেতরে কলিজা ফেটে যাচ্ছে তাও মুখে স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখেছেন,’ রহমান হেসেই চলেছে।

এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেও এই প্রথমবারের মতো তার সঙ্গে জোনায়েদ ও হেসে উঠল। ‘আপনি উকিল ডাকুন আর মিলিটারি ডাকুন, আজ রাতে আপনাকে কেউই বাঁচাতে পারবেন না।’

‘আমরা বলছি আপনি কেন আপনার বন্ধুর মৃত্যুর পর কারো সঙ্গে কোনোদিন যোগাযোগ করেননি, যেন আপনার জীবনে ওই মানুষটার কোনো অস্তিত্ব ছিল না এমনভাবে ভুলে যাওয়ার ভাব করেছেন।

আরিয়ান ক্রমাগত দুই অফিসারকে দেখছে।

সে কিছু বলার আগেই রহমান তার দিকে পিস্তলের মতো করে একটা আঙুল তুলল। ‘কারণ আপনার বন্ধু কামাল আহমেদ আসলে সুইসাইড করেনি, তাকে আপনি খুন করেছেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *