একটি রাত্রির দহন – ৫

খাওয়াদাওয়া বেশ দ্রুতই সম্পন্ন করল জুলহাস। খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে এসে বসল টেবিলের সামনে। মনের গভীরে ঢংঢং করে একটা ঘণ্টা বেজে চলেছে, সময় নেই সময় নেই। কিন্তু সময় না থাকলেও কিছু করার নেই কারণ সিগারেট হাতে নিয়ে ভিডিও বানাবে না ও, আর সময়ের টানাটানি থাকলেও আসলে ওর নিজের সব প্রস্তুতি নেয়াই আছে। একবার ঘটনা ঘটতে শুরু করলে ও ঠিকই দ্রুত মুভ করতে পারবে আরেকটা ঝামেলার কাজও বেশ সুন্দরভাবেই সেরে ফেলেছে ও, খাওয়া। কথাটা মনে হতেই মৃদু হেসে উঠল জুলহাস। খাওয়াদাওয়া নিয়ে ওর কখনোই খুব একটা আগ্রহ ছিল না, ওর কাছে খাওয়া হলো স্রেফ একটা প্রয়োজন, আর টোকনের খুব শখ ছিল খাবার, নতুন নতুন খাবার রান্না করে কিংবা বাইরে থেকে এনে খাওয়াটা ওর জন্যে শখের মতো ছিল, নিজেও খেত সেই সঙ্গে জোর করে জুলহাসকেও খাওয়াতো। আবারো বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো জুলহাসের। কত চমৎকার সব সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে ওরা, আর এভাবে কি না নিজের বন্ধুকে তার সবচেয়ে বড়ো বিপদের সময়ে সে একা ছেড়ে দিয়েছিল। হয়েছিল কি আসলে ওর ভেতরে, দোষটা কার বেশি ছিল, টোকনের নাকি, ওর নিজের, কে আসলে বেশ নিরাসক্তি দেখিয়েছে, আর কেই বা বাড়াবাড়ি করেছে এগুলো মাঝেমাঝেই মনে এলেও এখন আর এসব হিসেব করে লাভ নেই ওর জন্যে। ওর জন্যে এখন একটাই সত্য, আর সেটা হলো ওর বন্ধু আর নেই, চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে সে, আরো বড়ো সত্য হলো বন্ধুর বিপদের সময়ে সে কিছুই করতে পারেনি। আর তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বন্ধু যা করতে চেয়েছিল সেটাকে পূরণ করা। যদি সেটা করতে পারে তবেই ওর মনের ভেতরে শান্তি পাবে ও। আর পরিস্থিতি যতটুকু বুঝতে পেরেছে ও তাতে এটা পরিষ্কার যে টোকন যে-ব্যাপারটার পেছনে লেগেছিল, সেটা শুধু টোকনের মৃত্যু রহস্য ভেদ করার জন্যে নয়, এটা এখন সময়ের দাবি এবং মানবতার জন্যে হলেও এই রহস্য ভেদ করা প্রয়োজন, সেই সঙ্গে সম্ভব হলে পুরো ব্যাপারটা সবার সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। কাজেই আগে এই ভিডিও শেষ করতে হবে।

সিগারেটটা শেষ করে ওটার গোড়াটা অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে আবারো ল্যাপটপের দিকে ফিরে তাকাল জুলহাস। কাজ করতে হবে, এত কথা ভেবে লাভ নেই। ছোটবেলা থেকে কঠিন পরিশ্রমেই একমাত্র ফল পেয়েছে, এখনো তাই বিশ্বাস করে ও, মরণের আগ পর্যন্ত তাই করবে, তবে কিছু কাজ থাকে যা ফলাফল কিংবা লাভ- লোকসান দেখে করা সম্ভব হয় না, স্রেফ কর্তব্যের প্রয়োজনে, মনের টানে করতে হয়, যে কাজটা সে টোকনের সঙ্গে করতে পারেনি। জুলহাস ল্যাপটপ ওপেন করে আবারো ভিডিও শুরু করল।

‘টোকন চলে গেল, আমি আবারো ধীরে ধীরে আমার জীবন শুরু করলাম। বিশেষ করে পরিকল্পনা করেছিলাম যে আমি আর টোকন একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে দেশের বাইরে আবেদন করব। না টোকন পরীক্ষা দিল, না আমি পরীক্ষায় ভালো করে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার মতো অবস্থায় রইলাম। সব মিলিয়ে খুব ফ্রাস্ট্রেটেড অবস্থায় কিছুদিন কাটল। পরীক্ষা বা আবেদনের চেয়ে টোকনের এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা বেশি কষ্ট দিচ্ছিল। কিছুদিন খুব বাজেভাবে কাটল, না পারছিলাম আবারো পুরোপুরি পুরনো জীবনে মনোযোগ দিতে—না পারছিলাম আবার সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে। তবে যত দিন যাচ্ছিল এটা বুঝতে পারছিলাম, আসলে পরিকল্পনা যাই বদলে গিয়ে থাকুক না কেন, যা ভেবেছিলাম, সেখান থেকে এভাবে সরে যাওয়া যাবে না। টোকনের দূরে সরে যাওয়াতে হয়তো কষ্ট পেয়েছি কিন্তু তাতে দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিছুদিন আগের মতোই অফিস করতে করতে মনটাকে খানিকটা স্থির করার চেষ্টা করে আবারো পড়ালেখা শুরু করলাম। এবার বেশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে। আমার কোনো আত্মীয়স্বজন তো নেই-ই, সেই সঙ্গে বন্ধুবান্ধবও বলতে গেলে তেমন নেই। কাজেই খুব যে সামাজিক জীবন আমার আসলে ছিল, বিষয়টা এমন নয়। পরীক্ষা আর ব্যক্তিগত জীবনে ধাক্কা খেয়ে যখন পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এ দেশে আর থাকব না তখন নিজেকে আরো গুটিয়ে নিলাম। আগে তো পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ছিলামই এবার আরো বিশদভাবে পড়ালেখা শুরু করলাম। সারাদিন অফিস করি, সন্ধেতে বাসায় ফিরে গভীর রাত পর্যন্ত পড়ালেখা করি, পুরো জীবনটাই এই গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেল। একেবারে যে খারাপ চলছিল, তা বলা যায় না কোনোভাবেই। এমন সময় আবারো এমনকিছু ঘটে যা আসলে এই ভয়াবহ ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল।’

জুলহাস সামান্য নড়েচড়ে বসল। ‘টোকনকে আমি মিস করতাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক যেভাবে এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে তার প্রতি আমার বেশ অনেকটাই রাগ এবং অভিমানও কাজ করছিল। তাই কি করছে ইত্যাদি বিষয়ে আমার আগ্রহ থাকলেও সেভাবে কল দেয়া কিংবা কথা বলা হয়ে ওঠেনি। তবে মাঝেমধ্যে ওর ফেসবুক প্রোফাইল ইত্যাদি দেখতাম। বেশ কয়েকবার চেক করে দেখলাম সব বন্ধ, রীতিমতো শাটডাউন করে রাখা। ব্যাপারটা আমাকে অবাক করেছে, কারণ টোকন ফেসবুক ইত্যাদি সেভাবে ব্যবহার না করলেও বলতে গেলে সবসময় সে অ্যাকটিভ থাকত অনেকটা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। আরো একটা কারণ ছিল তার এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকটিভ থাকার পেছনে, সেটা হলো সে এইসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু কাজ করত। যাই হোক ওর সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুপস্থিত খানিকটা অবাক করে আমাকে। সে ওই দিন রাতে গায়েব হয়ে যাওয়ার পর কয়েকমাসে একাধিকবার চেক করেও যখন ওর কোনো অ্যাক্টিভিটি পেলাম না, তখন একদিন হুট করে ওর মোবাইলে কল করে বসলাম। মোবাইলও বন্ধ। এবার যেন উৎকণ্ঠা আরো বাড়ল, এতটা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ কি—মনে মনে আবার এটাও ভাবলাম, হয়তো ছয় মাসের চুক্তিতে যে-কাজটা করছে সেটার কারণে হয়তো সেও সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি থেকে দূরে আছে। যদিও মনকে বুঝ দিয়েছিলাম কিন্তু দিলেই কি আর হয়। তাও মাঝেমধ্যে ওর মোবাইলে কল করা সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকটিভিটি চেক করা ইত্যাদি করতাম কিন্তু নড়াচড়া নেই। এভাবে ছয় মাস কেটে গেল। আমিও আবার পরীক্ষা দিলাম। এবার বেশ ভালো ফল করলাম। আর তাই দেশের বাইরে আবেদন করার জন্যে জোর দিয়ে লেগেছি। ইউনিভার্সিটির লিস্ট করা, প্রফেসরদের ই-মেইেল করা কাজের শেষ নেই। এভাবে ছয় মাস কেটে গেল এবং তখনই ঘটনা ঘটতে শুরু করল।  

‘এরই মধ্যে ছয় মাস পার হয়ে গেছে, হঠাৎ একদিন কী মনে করে মোবাইলে কল করলাম, দেখি ও-মা মোবাইল তো খোলা। রিং বাজছে, আমি আশা করিনি ও কল রিসিভ করবে, করলও না। দুইবার কল দিলাম। তৃতীয়বারের সময় কল রিসিভ করল টোকন। আমি তো খুশিতে আত্মহারা কিন্তু ওপাশ থেকে ও যা বলল, তাতে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। যেখানে তীব্র আবেগের সঙ্গে বলতে গেলে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে কল করেছি আমি, সেখানে সৈ কল রিসিভ করে বলতে গেলে প্রায় যা তা ভাষায় কথাবার্তা। প্রথমে শুরুই করল ও দোষারোপ করে। আমি ওর বিপদের সময় কীভাবে ওকে ইগনোর করেছি। আমি একটা বিরাট আকারের বেইমান এবং আমার মুখও দেখতে চায় না ও জীবনে, আবার কল করলে কী করবে—সেই বিষয়ে বেশ ভালো এবং নোংরা ধরনের থ্রেটও দিয়ে কল কেটে দিল ও। আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আসলে হলোটা কি, প্রথমে রাগ হলো তারপর দুঃখ পেলাম এরপর মনে মনে শক্ত সিদ্ধান্ত নিলাম এই ছেলের সঙ্গে আর না। যে আবেগটা আমার ভেতরে ছিল সেটা পুরোপুরি উবে গেল ক্ষণিকের ব্যবধানে। এরপর থেকে ফেসবুক ইন্সটাগ্রামে নিয়মিত ওর ছবি পোস্ট এসব দেখতে পেতাম, নতুন এক চাকরিতেও জয়েন করেছে দেখলাম। এর-ওর সঙ্গে বেড়াতে যায় ছবি পোস্ট করে, দামি জিনিসপত্র কিনে রীতিমতো শো-অফ করে পোস্ট করে। আমি একবার ভাবি সবকিছু থেকে ওকে ব্লক করে দেব, এরপর আবার অবাক হয়ে ওর কাজকর্ম দেখি আর ভাবি একে ব্লক করাটা ঠিক হবে না। একটা মানুষ ঠিক কতটা বদলাতে পারে, ঠিক কতটা হারামজাদা হতে পারে—তা হাতে এলে সেটা জানার এবং বোঝার জন্যে হলেও একে ব্লক করা ঠিক হবে না। কিন্তু অদ্ভুত এবং মজার বিষয় হলো যত দিন যেতে থাকে কোথায় যেন একটা গড়মিল খুঁজে পেতে থাকি আমি। আমি ওর সব পোস্ট দেখি এবং আমার সঙ্গে ওর কনভারসেশন মনে করি, আর এই ভাবনাটা আমার দিনকে দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেন জানি আমার মনে হতে থাকে টোকন আসলে যা করছে আর যা হচ্ছে, তার ভেতরে একটা বিরাট গড়মিল আছে। যত দিন যেতে থাকে আমার ভেতরে এই ভাবনা জেঁকে বসতে থাকে। এর কিছুদিন পরেই সরাসরি এর প্রমাণ পেয়ে যাই। সেদিন অফিস থেকে বের হয়ে টঙ দোকানে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে চায়ের জন্যে বলেছি মামাকে—এমন সময় ঝুপঝাপ করে নামল বৃষ্টি। লোকজন সমানে এসে দাঁড়াচ্ছে দোকানের ভেতরে, ওদিকে টঙের টুটা- ফাটা পলিথিনের ফাঁক দিয়ে পানি পড়ে পুরো ভিজে যাওয়ার অবস্থা। চা-টা হতেই এক দৌড়ে পাশের অন্ধকার গলির ভেতরে একটা বন্ধ গ্যারেজের সানশেডের নিচে দাঁড়ালাম। এখানে অন্তত লোকজনের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে হবে না। চায়ে চুমুক দিয়ে বিড়িতে টান দেব—দেখি পাশেই পলিথিন মুড়ি দিয়ে এক লোক বসে আছে। ভাবলাম ফকির-টকির হবে হয়তো। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আমার মতোই আশ্রয় নিয়েছে শেডের নিচে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আর সমাজের শ্রেণিবিভাগ বোঝে না। রাষ্ট্র-ধর্ম- কমিউনিজম-ক্যাপিটালিজম কিংবা সমাজ যা পারে না, প্রকৃতি সেটাই করে বসে যখন- তখন। এক ছাদের তলায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয় সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে। যাই হোক ওকে ওর মতো থাকতে দিয়ে আমি বিড়িতে আরেক টান দিতেই ভীষণ চমকে উঠলাম পাশ থেকে টোকনের গলা শুনে।’

‘ক্ষণিকের জন্যে ভেবেছিলাম বুঝি ভুল শুনেছি। কিন্তু না, টোকনই, সেই পলিথিন মুড়ি দেয়া লোকটা আর কেউ নয়, টোকন।

‘কেমন আছিস জুলহাস?’ কেমন জানি বিষণ্ন, চুপসে যাওয়া গলা টোকনের। সে মাথা ঢেকে রাখা পলিথিনটা সামান্য সরিয়ে বলে উঠল। আমি এতটাই অবাক হয়েছি, কিছু করা তো দূরে থাক এমনকি কিছু বলতেও পারলাম না চট করে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলাম, ‘তু তুই এখানে?’

টোকন কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলাম না কি চাইছে ও। পরে খানিক অবাক হয়ে বুঝতে পেরে হাতের বিড়িটা এগিয়ে দিলাম ওর দিকে। টোকনের চেহারা একেবারে বিষণ্ন, ফেসবুকে দেখা সেই চকচকে চেহারা তো নয়ই, এমনকি ওর আগের যে চেহারা ছিল সেটাও সেই কেমন জানি গর্তে বসা চোখ, মুখের সব শিরা দেখা যাচ্ছে। সেই চুপসে যাওয়া চেহারাতে আবার কেমন জানি অদ্ভুত এক ভাব। আমি প্রশ্ন করলেও টোকন কিছু বলেনি বরং সে মাথা মুড়িয়ে রাখা পলিথিনের মতো জিনিসটা সামান্য সরিয়ে এদিক-সেদিক দেখতে দেখতে বিড়িতে কষে টান দিল।

‘তুই এখানে কী করছিস, তুই না—’ আমাকে কথা বলতে না দিয়ে হঠাৎ করেই সে মুখের সামনে খালি বাঁ হাতের একটা আঙুল তুলে চুপ থাকার ইশারা করল। ওর ইশারাটার সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা কেমন জানি শিউরে উঠল আমার। ওর গলায় বিষণ্নতার সঙ্গে আরেকটা টোন ছিল যেটা আমি ধরতে পারিনি, ওর অবয়বে শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ভাব ছিল যেটা আমি বুঝতে পারিনি, ও আমাকে চুপ থাকার ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ধরতে পারলাম। ভয়, টোকন ভীষণ ভয় পাচ্ছে। আর সেই ভয়ই ফুটে উঠেছে ওর গলায় আর সেই ভয়ই জেঁকে বসেছে ওর সমস্ত অবয়বে। সঙ্গে সঙ্গে আমার ভ্রু কুঁচকে উঠল।

‘কি ব্যাপার টোকন, তুই কি কোনো বিপদের ভেতরে আছিস?’ আমি প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে চট করে উঠে দাঁড়াল টোকন এবং তৎক্ষণাৎ যা করল এর জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। সে চট কর শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আমাকে। ধরার সঙ্গে ওর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। ‘টোকন তুই—’ আমি আসলে ঠিক কীভাবে রিঅ্যাক্ট করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। টোকন কেঁপে কেঁপে কেঁদে চলেছে। আমি ওকে আর কিছু বললাম না। কাঁদার জন্যে সময় দিলাম, নিজেকে শান্ত করার জন্যে সময় দিলাম। কিন্তু টোকন বেশি সময় নিল না। সে চট করে সোজা হয়েই আমার দুই হাত ধরে বলে উঠল, ‘জুলহাস, আমার আসলে তোর কথা শোনা উচিত ছিল, দুনিয়াতে কোনোকিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করা উচিত না।’

‘টোকন—’

‘শোন জুলহাস, আমি খুব বিপদে আছি,’ বলে সে আবারো এদিক-সেদিক দেখল। ‘আমি এখানে এসেছি প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে। আসলে এখানে আসাটা আমার উচিত হয়নি, হয়তো তাকেও বিপদে ফেলে দিলাম,’ আমি কথা বলতে চাইছিলাম কিন্তু ও আমাকে বলতে দিল না। ‘শোন, আমার যদি কিছু হয় তুই, একমাত্র পারবি,’ টোকনের গলায় অস্থিরতা বাড়ছে। ‘কোনো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, কোনো পত্রিকা, কোনো মিডিয়া কেউই পারবে না—’

‘টোকন—’  

চুপ, যা বলি স্রেফ শুনে যা। আমি তোর সঙ্গে যে-ব্যবহার করেছিলাম ওটা—’

‘আমি বুঝতে পেরেছি—’

টোকন আবারো আমাকে চট করে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে উঠল। ‘আমার এখন যেকোনো সময় কোনো কিছু হতে পারে। তুই ভুলেও আমার ধারে-কাছে আসবি না। আর আমার সিগন্যালের জন্যে অপেক্ষা করবি,’ বলেই ও আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তীব্র বৃষ্টির ভেতরে পানিতে ছপ ছপ পা ফেলে পলিথিনে মাথা মুড়িয়ে অন্ধকার গলির ভেতর হারিয়ে গেল। আমি স্থাণুর মতো বসে রইলাম। আসলে ঠিক হলোটা কি—আমি বোঝার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঠিক গভীরতা মাপতে পারছিলাম না। কিছু ঠিকঠাক বুঝতেও পারছিলাম না কী বলব। কোনো মানুষও নেই যার সঙ্গে ব্যাপারটা ঠিকঠাক শেয়ার করা যায়। যা হাতে নেই, তার জন্যে আক্ষেপ করে অস্থির হয়েও লাভ নেই তাই সিদ্ধান্ত নিলাম অস্থির না হয়ে অপেক্ষা করব। আর কিই বা করার ছিল! কিন্তু কিছুই হলো না। বেশ অনেকদিন অপেক্ষা করলাম। সত্যি কথা বলতে অপেক্ষা না, বরং আমার নিয়মিত জীবনযাপনই করছিলাম। আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে টোকনের স্বাভাবিক জীবনযাপন দেখি। কিন্তু আমার কাছে ভেতরে ভেতরে মনে হতে থাকে আসলে টোকন যা করছে, এর পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। কিন্তু ঠিক যেভাবে আগের দিন রাতের গভীরে দেখে ভয় পাওয়া হরর সিনেমাকে পরের দিন দিনের আলোতে হাস্যকর মনে হয়, ঠিক তেমনি যত সময় যেতে থাকে টোকনের কাজ-কারবার আমার হাস্যকর মনে হতে থাকে। সেই সঙ্গে একটা পর্যায়ে এটাও মনে হয় যে টোকন আসলে আমার সঙ্গে ফাজলামো করেছে। কিন্তু এর ভেতরেই একদিন একটা টেক্সট আসে আমার নম্বরে। এখন যখন সেই টেক্সটটার কথা মনে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে যেটা মনে হয়, টোকন যদি সেই টেক্সটটা না পাঠাতো তবেই হয়তো ভালো হতো। যাই হোক যা ঘটে গেছে, তা তো আর বদলানো যায় না।  

‘ছোট একটা টেক্সট, কোনো নাম নেই, এসেছেও আননোন নম্বর থেকে। কিন্তু সেটা দেখামাত্রই বোঝা যায় কে পাঠিয়েছে। ‘আমি হরিকে ঠিকই খুঁজে পেয়েছিলাম, তার কী হয়েছিল সেটাও’। সঙ্গে সঙ্গে নম্বরটাতে কল দিলাম। কথা হলো না, কেউ কল রিসিভ করল না কিন্তু রিং বাজল। একটু পর সেই নম্বর থেকেই আবারো টেক্সট এলো। ‘কিন্তু না জানলেই বোধহয় ভালো ছিল কিংবা কে জানে!’ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। কল দেব কি দেব না ভাবতে ভাবতে কল দিয়েই ফেললাম, কিন্তু এবার বন্ধ পেলাম। এর কয়েকদিন পর আরেকটা আননোন নম্বর থেকে আবারো একই ধরনের টেক্সট পেলাম, এবার টেক্সটটা পেয়ে খানিক চমকে গেলাম। ওটাতে লেখা ছিল, ‘কামালের কথা তো তোকে বলেছিলাম, আমাদের সঙ্গেই এতিমখানাতে বড়ো হয়েছিল।’ টেক্সটটা পেয়ে দারুণ চমকে উঠেছিলাম। আবারো কামালের নাম। ওর সঙ্গেই টোকন প্রজেক্টে কাজ করেছিল। কিন্তু হঠাৎ এরকম পরিস্থিতিতে আবারো কামালের নাম কেন। কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ভাবছি কল করব কিন্তু এমন সময় আরেকটা টেক্সট এলো ভিন্ন আরেকটা নম্বর থেকে, ‘কামালের নামটা মনে রাখিস।’

আজব সব কথাবার্তা, অস্থির হয়ে কল করেই বসলাম কিন্তু ততক্ষণে বরাবরের মতোই নম্বর বন্ধ হয়ে গেছে। বলতে গেলে প্রায় হতাশ হয়ে মোবাইল রেখে দিলাম। এর কয়েকদিন পরই হঠাৎ ভোররাতের দিকে একটা ফোন কল এলো। রিসিভ করতেই ওপার থেকে জানাল লোকাল এক থানা থেকে এক সাব ইন্সপেক্টর কল করেছে। সে জানাল টোকন নামে একজনের অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে আমি তাকে চিনি কি না,’ এই পর্যন্ত বলে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগল জুলহাস। বন্ধুর মৃত্যুর স্মৃতি তার মস্তিষ্ককে গরম করে তুলছে। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে সে আবারো শুরু করতে যাবে তার আগেই ধাম ধাম করে দরজায় শব্দ হলো।

ভীষণ চমকে উঠে টেবিলের পাশে রাখা পিস্তলের ওপরে হাত চলে গেল ওর আপনা থেকেই। ব্যাপার কি, এই সময়ে কে নক করল, কাউকে তো এক্সপেক্ট করছে না ও।

পিস্তলটাকে আলগোছে আবারো কোমরের পেছনে বেল্টের ভেতরে গুঁজে দিয়ে জানালার কাছে চলে এলো ও। সাবধানে উঁকি দিয়ে দরজার সামনে দেখতে পেল মোটামতো এক ভদ্রলোককে। আনমনে বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল জুলহাস। ওর এক কামরা পরে থাকে এই লোক। অত্যন্ত বিরক্তিকর। যখন তখন এসে এটা-ওটা চায়। কখনো চা পাতা, কখনো চিনি তো কখনো লবণ। তবে তারচেয়েও বড়ো কথা এই লোক একবার ভেতরে আসলে ওঠবার নামও নেয় না। জুলহাস মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এই লোককে ভেতরে আসতে দেয়া যাবে না এরকম একটা সেনসেটিভ টাইমে। কিন্তু ওর ভাবনা হওয়া সারা, সঙ্গে সঙ্গেই আবারো দরজায় ধাম ধাম করে থাপ্পড় মারল লোকটা। টেবিলের দিকে ফিরে আসতে যাচ্ছিল জুলহাস, ধাম ধাম শব্দে বিরক্ত হয়ে রাগের সঙ্গে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। লোকটা অবশ্যই জানে ও ভেতরে আছে, আর যতক্ষণ পর্যন্ত ও দরজা না খুলবে লোকটা এরকম শব্দ করেই যেতে থাকবে। আর এরকম শব্দ হলে ও ভিডিও শ্যুট করতে পারবে না। জুলহাস রাগের সঙ্গে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটানে খুলে দেখল।

‘কি?’ লোকটা খুব আয়েশ করে মুখ বাঁকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জুলহাসের ঘামে ভেজা থমথমে চেহারা আর ততধিক কঠিন ভাব দেখে মুখ

বন্ধ করে আমতা আমতা করতে লাগল।

‘কি? কথা বলেন না কেন?’ জুলহাস পুরো ধমকের সুরে বলে উঠল।

‘আমি আমি,’ ভীষণ মোটা লোকটা তার থলথলে চর্বিদার থুতনিটা চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠল। জুলহাস প্রায় নিশ্চিত সে কোনো কাজে আসেনি। ভেবেছিল খোশগল্প করবে কিন্তু জুলহাসের ভারী চেহারা আর ধমকে থতমত খেয়ে এখন বুঝতে পারছে না আসলে কী বলবে।

‘কোনো কাজ না থাকলে পাতলা হোন এখন,’ ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল জুলহাস। দরজা বন্ধ করে দিতে গিয়ে ও আবারো সেটাকে ধাম করে খুলে ফেলল। আর যদি কোনো কাজ না থাকে আবার শব্দ করেন তো আজকে আপনার খবর আছে। লোকটার হাঁ হয়ে থাকা মুখের ওপরে ধাম করে দরজা লাগিয়ে দিল জুলহাস। সাধারণত না পারতে ও মানুষের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে। কিন্তু আজ এই লোকটাকে ধমকে দিয়ে যারপরনাই শান্তি পাচ্ছে। বিগত কিছুদিন ধরে বহুত জ্বালিয়েছে লোকটা। জুলহাস দ্রুতবেগে টেবিলের কাছে ফিরে এসে আবারো ল্যাপটপের ডালা তুলল।

‘টোকন মারা গেছে,’ না চাইতেও দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর গলা দিয়ে। ‘গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে তার। আমাকে আর ওর তৎকালীন অফিসের বসের নম্বরে কল করেছে পুলিশ। কারণ তার মোবাইলে এই দুটো নম্বরই সেভ করা ছিল মাত্র। আমি কল পেয়ে স্থাণুর মতো বনে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। সাধারণত থ্রিলার উপন্যাসে কিংবা সিনেমাতে এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় এতিম ছেলের মৃত্যুর পর তার বন্ধু ধীরে ধীরে আবিষ্কার করে তার আসলে অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়নি, বরং তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমি কল পাবার সঙ্গে সঙ্গেই জানতাম যে টোকন আসলেঅ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়নি। তাকে খুন করা হয়েছে। বেশি কিছু ভাবার সময় হলো না। আমি বিস্তারিত জেনে নিয়ে স্পটে গিয়ে হাজির হলাম। পুলিশ জানাল, বেশ কিছুদিন যাবৎ টোকন বাইক চালাচ্ছিল, সে ভোররাতের দিকে মুন্সীগঞ্জের রাস্তায় ছোট রাস্তা থেকে হাইওয়েতে উঠতে যাচ্ছিল তীব্র গতির এক ট্রাক তাকে মেরে দিয়ে চলে যাওয়ার পর স্পটেই তার মৃত্যু ঘটে। ক্লিয়ার কেস অব হিট অ্যান্ড রান। পুলিশের কাছে সব শুনলাম, বুঝলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। কেন বললাম না সেটা নিজেও বুঝতে পারছিলাম সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছিলাম বললে কোনো ফায়দা তো হবেই না বরং বিপদ নিজের ঘাড়ের ওপরে আসতে পারে। আমি এই কারণে বিপদের ভয় করছিলাম না যে আমার কোনো ক্ষতি হবে বরং আমি বিপদের পরোয়া করছিলাম একেবারেই ভিন্ন এক কারণে।’

জুলহাস সামান্য বিরতি নিল। ‘আমি এমন একজন মানুষ যে মারা গেলেও আসলে পৃথিবীর তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। আমার আগে-পিছে কেউ নেই। আমার ওপরে নির্ভর করে এমন কেউও নেই। একমাত্র কাছের মানুষ ছিল টোকন। সেও চলে গেছে, কাজেই জাগতিক ক্ষতির কারণে বিপদের ভয় আমার ছিল না। কিন্তু সেদিন টোকনের মৃত্যুর পর, তার লাশ দাফন করে আসার পর বুঝতে পারলাম আমার ভেতরে মারাত্মকভাবে কিছু একটা বদলে গেছে। সেদিন সব সেরে বাসায় ফেরার পর আমার ভেতরে কোনো দুঃখবোধ কাজ করছিল না, না করছিল কোনো ক্ষোভ, কেমন জানি অদ্ভুত এক গ্লানির স্রোত আমাকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলছিল। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল টোকনের এই পরিণতির জন্যে আসলে আমি দায়ী। সে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল, সে আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছিল কিন্তু আমি দিইনি। এই পুরো দুনিয়াতে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ, বলতে গেলে একমাত্র কাছের মানুষ যার সঙ্গে আমি বিছানা-বালিশ তো বটেই এমনকি খাবারের থালাটাও ভাগ করে খেয়েছি এক সময়, সেই মানুষটাকে স্রেফ জাগতিক কারণে, স্রেফ নিজের ক্যারিয়ার আর নিরাপত্তার কারণে আমি তার পাশে থাকিনি। আমি একথা কোনোভাবেই বলব না যে টোকন খুব যুক্তিযুক্ত কাজ করেছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো আমরা মানুষেরা কি সবসময় স্রেফ যুক্তিযুক্ত কাজই করি। আসলে আমরা জীবনের বেশির ভাগ সময় যুক্তি ছাড়াই চলি। যুক্তিহীন কাজই করি। কিন্তু যে-ক্যারিয়ার সাফল্য আর নিরাপত্তার জন্যে আমি টোকনের পাশে থাকিনি ওর মৃত্যুর পর সেটাই সবচেয়ে বেশি ফিকে মনে হচ্ছিল। আমি ওইখানে বসে ওইদিন রাতেই অনুধাবন করতে পারি, আমার জন্যে এখন একটাই পথ খোলা আছে। টোকনের সঙ্গে আসলে কী হয়েছিল, সে কিসের পেছনে লেগেছিল সেটা আমাকে জানতে হবে। উদ্ঘাটন করতে হবে এই পুরো রহস্য। কিন্তু পরদিন ঘটে আরো আজব ঘটনা। আমি ব্যাংক থেকে কল পাই।’

‘টোকনের দাফন-কাফনের দিনই ওর অফিসের বসের সঙ্গে কথা হয়েছিল যে অফিসিয়াল সব ফর্মালিটি পরদিন গিয়ে আমি সেরে আসব। তো সেই অফিসের কাজ সেরে বের হচ্ছি এমন সময় ব্যাংক থেকে কল পেয়ে জানতে পারি, টোকনের একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল আর সেটার নমিনি ছিলাম আমি। আমি ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারি টোকন বেশ ভালো একটা অঙ্কের টাকা রেখে গেছে আমার জন্যে। টাকার অঙ্ক দেখে আমি বেশ অবাক হই, কারণ আমি আর টোকন প্রায় একই সঙ্গে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম। আমরা প্রায় একই ধরনের চাকরি করতাম। ও কেমন টাকা সঞ্চয় করছে সেটাও আমার কমবেশি জানা ছিল। এত টাকা ওর থাকার কোনো কারণ নেই। ব্যাংকের স্টেটমেন্ট চেক করে জানতে পারি এই টাকাটা সাম্প্রতিক সময়ে এসেছে ওর অ্যাকাউন্টে এবং সেই সময়টা টোকন সেই ছয়মাসের প্রজেক্ট শেষ করার কিছুদিন পর দিয়েই। এখান থেকে আমি প্রথম ক্লু পাই। সেই প্রজেক্ট এবং টাকা জমা হওয়ার সেই প্রজেক্টের নামটা টুকে নিই। কিন্তু আমি তখনই কিছু করিনি। এর পেছনেও কারণ ছিল। আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিলাম, টোকনের মৃত্যু এবং ওর সঙ্গে আসলে কী হয়েছিল, এটা বুঝতে হলে আমাকে বেশ আঁটঘাঁট বেঁধে নামতে হবে। আর সেটার জন্য একদিকে প্রয়োজন ছিল টাকার, অন্যদিকে প্রয়োজন ছিল পুরো বিষয়টা বোঝার এবং পরিকল্পনার।’

‘আমি বুঝতে পারছিলাম টোকন অনেক বড়ো কিছু একটার সঙ্গে জড়িয়ে গেছিল, কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে ও আসলে কিসের সঙ্গে জড়িয়েছিল, আর সত্যিকার অর্থেই কী হয়েছিল ওর সঙ্গে। আমি পুরো বিষয়টাকে কয়েকটা ধাপে সাজিয়ে ফেলি। প্রথমে এটা খুবই নিশ্চিত ছিল, ওর সঙ্গে যাই হয়ে থাকুক কিংবা যারাই কিছু করে থাকুক, তারা যে অত্যন্ত বড়ো কেউ এবং শক্তিশালী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই আমার মতো চুনোপুঁটি ওদের বিরুদ্ধে লাগা তো দূরে থাক, স্রেফ আমার বন্ধুর আসলে হয়েছিল কি—সেটা বুঝতে হলেই আমাকে অনেক বেশি আঁটঘাঁট বেঁধে নামতে হবে ময়দানে। এখানে একটা ব্যাপার আমার পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আমি যখন এই ভিডিও করতে শুরু করি আমি একেবারে টু দ্য পয়েন্ট জানতাম না আমি আসলে কেন এই ভিডিও করছি। ভেবেছিলাম যদি আজ রাতে আমি যা করতে যাচ্ছি তাতে আমার কিছু একটা হয়ে যায়, তবে হয়তো এটা কারো হাতে পড়লে সেটা ভাইরাল হবে, কিন্তু ভিডিওটা করতে করতে উপলব্ধি করলাম, যা ঘটেছে সেটা লজিক্যালি বর্ণনা করতে করতে এবং পুরো বিষয়টা সবাইকে বিশদ জানাতে গিয়ে ভিডিওটা এত বড়ো হয়ে যাচ্ছে যে বড়ো ভিডিও আসলে ভাইরাল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, পুরো বিষয়টা আমাকে জানাতে হবে। আমি কিংবা আমারা যারাই আজ রাতের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হই না কেন, আমাদের যাই ঘটুক না কেন, অন্তত একটা রেকর্ড তো থাকবে আসলে কী ঘটেছিল।’

কথা বলতে বলতে খানিক উত্তেজিত হয়ে জুলহাস বড়ো করে একবার নিঃশ্বাস নিল, তারপর একবার ঘড়ি দেখে আবারো বলতে শুরু করল। ‘এখানেই আমার দ্বিতীয় পয়েন্টটা ক্লিয়ার করতে চাই। যে আমি নিজের ক্যারিয়ারের জন্যে খানিকটা নিরাপত্তার জন্যে নিজের একমাত্র বন্ধুর পাশে ছিলাম না, সেই আমি সে মারা যাওয়ার পরে কেন এত উতলা হচ্ছি পুরো বিষয়টা নিয়ে, জুলহাস ক্ষণিকের জন্যে থামল। ‘কথাটা হয়তো এই যুগে শুনতে অদ্ভুত শোনাতে পারে। কিন্তু সত্যি কথা হলো আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেছিল টোকনের মৃত্যুতে। টোকন যখন আমার থেকে দূরে সরে গেছিল, ক্ষণিকের জন্যে আমি খানিক স্বস্তি পেয়েছিলাম বিগত কিছুদিন ধরে ওর পাগলামির কারণে। কিন্তু ওর মৃত্যু আমাকে ধসিয়ে দিয়েছিল। আমার ভেতরে এমন এক ক্ষত তৈরি হয়েছিল যার একমাত্র মলম ছিল টোকনের পরিণতির কারণ জানা এবং সম্ভব হলে কিছু করা। আমার কাছে ওই মুহূর্তে এরচেয়ে বড়ো গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই ছিল না দুনিয়াতে। এখনো নেই।’

যাক গে, কাজের কথায় ফিরি। আমি পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করি। আমি জানতাম হয়তো বা যারাই টোকন কিংবা হরি বা ওদের সঙ্গে যাই করে থাকুক না কেন এমন হতেও পারে, টোকনের একমাত্র কাছের মানুষ হিসেবে আমার ওপরে নজর রাখছে। কাজেই কোনো বিষয়ে হুট করে কিছু করা যাবে না। অন্তত যতদিন টোকনের বিষয়টা ঠান্ডা না হয়, ততদিন তো না-ই। এই সময়টা আমি কিছু হিসেবের জন্যে কাজে লাগার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথম কথা রিসোর্স কালেকশন। আর রিসোর্সের ভেতরে এক নম্বর টাকা। টাকার আমার অভাব ছিল না, নিজের কিছু সেভিংস তো ছিলই সেই সঙ্গে টোকনের রেখে যাওয়া অনেক টাকা তো ছিলই। দ্বিতীয় রিসোর্স এবং তথ্য।’

‘প্রথমেই আমি সম্ভাব্য যেসব বিষয়গুলো নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করব সেগুলো একসঙ্গে করে সিদ্ধান্তে আসি, টাকা জমা হওয়ার ট্রেইল ধরেই এগোব। কিছুটা সময় পার হওয়ার পর যে ব্যাংকে টোকনের অ্যাকাউন্ট ছিল সেটায় আমার এক বন্ধুকে বহু অনুরোধ করে টাকাটা কোন সোর্স থেকে জমা হয়েছে সেটা বের করি। সেখান থেকে একটা এনজিওর ঠিকানা পাই। এই এনজিওর এক প্রজেক্টেই টোকন কাজ করেছিল বিগত ছয় মাস। খোঁজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করি যে প্রজেক্টে টোকন কাজ করেছে, সেটা একেবারেই ভিন্ন বিষয়, খুবই ম্যানুয়াল কাজ করেছে সে এবং প্রজেক্টটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের নিয়ে আসা ফান্ডের টাকায় দেশের গ্রামে গঞ্জে বা বিভিন্ন জায়গায় থাকা এতিম বাচ্চাদের পুনর্বাসন নিয়ে একটা প্রজেক্ট। সঙ্গে সঙ্গে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠি। কারণ এখানে একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে। আমি আর টোকন আমরা এতিম, হরিও এতিম ছিল। হরিকে খুঁজে পাওয়া এবং অন্তর্ধান থেকেই সব শুরু আর টোকনের কথায় যা মনে হচ্ছিল, হরিকে সেই পরিবারের কাছে দেয়ার ব্যাপারটাতে হয়তো গড়মিল ছিল, না হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। কাজেই আমি এই বিষয়টা নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম খুব সাবধানে। কিন্তু কিছুদিনের খোঁজখবর করেই রীতিমতো হতাশ হয়ে আবিষ্কার করলাম, একেবারেই ছোট এই এনজিও কাজ-কারবার খুবই পরিচ্ছন্ন এবং ক্লিনকাট। একেবারেই ছোট হলেও এদের রেপুটেশন মার্কেটে খুবই ভালো এবং কোনো ধরনের কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এখানেই কিছু একটা পাওয়া যাবে। কিন্তু এতদিন লেগে থেকে কিছুই না পেয়ে খানিক হতাশ হয়ে গেলাম।’  

‘এরপর দ্বিতীয় মাধ্যম ধরে আগাব সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটা ধরে প্রথমেই টোকনের মোবাইল ফোন, তার মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো এবং সেই সঙ্গে যেই সময়টাতে সে হরির অন্তর্ধানের পর অ্যাকটিভ ছিল সেই সময়টার ব্যাপারে খোঁজখবর করার চেষ্টা করি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমি কিছুই পাইনি। একেবারে ক্লিন পরিষ্কার এবং স্বাভাবিক সবকিছু। কীভাবে সম্ভব। এতগুলো মাস ধরে দিনের পর দিন খুব গোপনে সাবধানে চেষ্টা করে কিছুই না পেয়ে রীতিমতো হতাশ লাগছিল। আরো বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে গেল একেবারেই কিছু করতে পারছিলাম না আমি। বুঝতে পারছিলাম, টোকন যাই করে থাকুক না কেন, সেটা বের করা আমার মতো আনাড়ির পক্ষে সম্ভব হবে না—এমন সময় ঘটতে শুরু করে ঘটনা। আমি একটা চিঠি পাই।

‘আসলে চিঠি না, একটা পোস্ট কার্ড। এই যুগে আমাদের দেশে চিঠি সেভাবে কেউ লেখে না। একমাত্র অফিসিয়াল আর ব্যাংক ডকুমেন্ট আর স্টেটমেন্ট ছাড়া কোনো চিঠি আসেও না আমার কাছে। আমি যে বিল্ডিংয়ে থাকতাম সেখানে আমাদের মতো ভাড়াটিয়াদের কাছে কোনো চিঠি এলে কেয়ারটেকারের কাছেই থাকত। আমার কাছে কার্ডটা এসেছিল আরো আগে কিন্তু কার্ডটাই এমন যে লোকটা বুঝতে পারেনি যে ওটা একটা চিঠি। ছোট করে আমার নাম দেখে সে আমার অন্যান্য চিঠির সঙ্গে রেখে দিয়েছিল। আমার কাছে কুরিয়ার আর ডাকে আসা অন্য চিঠিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ কার্ডটার দিকে নজর পড়াতে খানিক অবাক হলাম। কারণ এরকম কিছু আমার কাছে এর আগে কখনো আসেনি। কার্ডটা এমনকি কোনো ব্যক্তিবিশেষ পাঠায়নি। পোস্ট কার্ডটা পাঠানো হয়েছে সিলেটের লাউয়াছড়া ফরেস্ট লজ থেকে। পোস্ট কার্ডটা কেমন, এরকম জায়গায় বেড়াতে গেলে দেখা যায় ওখানকার বিভিন্ন সুন্দর দৃশ্য বা প্রাণীর ছবি পোস্ট কার্ড আকারে কিনতে পাওয়া যায়, চাইলে এগুলোকে সুভেনিয়রের মতো কেনা যায় কিংবা প্রিয়জন কাউকে পাঠাতে চাইলে নাম ঠিকানা বা কিছু লিখে দিলে ওগুলো পোস্ট করে দেয় টুরিস্ট লজ থেকে।’

‘এরকম সিষ্টেম আগে ছিল, এই কম্পিউটার আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই সিস্টেম টিকে আছে কি না, সেটাই জানতাম না। পোস্টকার্ডটার বিপরীতে একটা প্রজাপতির ছবি, আর অন্যপাশে কিছু লেখার জায়গায় একটা নম্বর লেখা ৩৩১০। আর নাম-ঠিকানার জায়গায় আমার নাম ঠিকানা লেখা। কিন্তু কোনো প্রেরকের নাম নেই। অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি লাউয়াছড়া থেকে আমাকে পোস্ট কার্ড কে পাঠাবে, আর কেনই বা পাঠাবে কোনো নাম-ঠিকানা ছাড়া। ভেবে বোঝার চেষ্টা করছি হঠাৎ বুকের ভেতরে ধক করে উঠল। এটা টোকনের হাতের লেখা। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম এটা পাঠানো হয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে। নিশ্চয়ই টোকন কিছু একটা বোঝার কিংবা বলার চেষ্টা করেছে আমাকে এটার মাধ্যমে।

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বাসায় ফিরে পোস্ট কার্ডটা নিয়ে পড়লাম। কিন্তু আবার কানাগলি। ওটার ছবিটা, ওটাতে দেয়া নম্বরটা বারবার দেখে, বুঝে উলটে পালটে দেখে, কিংবা ওটাতে কোনো অদৃশ্য কালি আছে কি না, ইস্তিরি দিয়ে ঘষে ডলে প্রায় পুড়ে ফেলার অবস্থা হলো কিন্তু না কোনো অদৃশ্য কালি বা কিছুই পেলাম না। ওটা নিয়ে কয়েকদিন খুব উত্তেজনায় কাটলেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। আবারো কানাগলি আবারো হতাশা। আবারো কিছু নিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। ওটা নিয়ে উত্তেজনা খানিকটা স্তিমিত হয়ে আসছে—এমন সময় আরেকটা প্রায় কাছাকাছি ধরনের কার্ড পেলাম আমি। এবারেরটা খানিকটা ভিন্ন, এবার কোনো টুরিস্ট স্পট থেকে নয়, এবার এসেছে একটা অ্যাকশন ফিগার শপ থেকে। অ্যাকশন ফিগার কি—যারা জানেন না তাদের জন্যে বলছি। অ্যাকশন ফিগার হলো অনেকটা দেখতে পুতুলের মতো কিন্তু জিনিসটা আরো অনেক বেশি দামি আর কমপ্লিকেটেড। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুপার হিরো, রেসলার, টিভি সিরিজ কিংবা গেইম বা, কমিক্স বা অ্যানিমেশনের বিভিন্ন চরিত্রের আদলে গড়া হয় এগুলো। এবারের কার্ডটাতে একটা থ্রিডি রুবিকস কিউবের ছবি। আবারো উত্তেজনা, আবারো অনুসন্ধান এবং আবারো একইরকম কানাগলি এবং হতাশা। তবে এবার একটা কাজ হলো। ঢাকায় অ্যাকশন ফিগারের দোকান খুব বেশি নেই, আর যেখান থেকে কার্ডটা এসেছে, ওদের নাম তো ছিলই ওখানে। আমি ওখানে ফোন করে জানতে পারলাম যে এক ভদ্রলোক কয়েক মাস আগে ওদের ওখানে গিয়ে টাকা পেমেন্ট করে এই কার্ডটা পোস্ট করতে বলছিল আমার এখানে। শুধু কার্ড না চাইলে তাদের যেকোনো জিনিস এভাবে গিফটের আদলে যে কাউকে পাঠানো যায়, এমনকি চাইলে ক্রেতা কিংবা গিফটদাতার নাম লুকিয়েও রাখা যায়।’

‘যে কার্ডটা পাঠিয়েছে সে যে টোকন ছাড়া আর কেউ না—সেটা বোঝার জন্যে আমার খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ও আসলে বলতে চাইছে কি! টোকনের এই কার্ড পাঠানোর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে। আর এই কার্ডগুলোর মাধ্যমে সে বলতে চাইছে কিছু একটা। কিন্তু কী, এবার নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উলটে-পালটে তাপ দিয়ে কিছুতেই কিছু হলো না। প্রজাপতি, নম্বর আর রুবিকস কিউব পাশাপাশি রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করলাম কিন্তু কিছুই ধরতে পারলাম না। চেষ্টা করে এবার কেন জানি মনে হচ্ছিল, এরকম আরো কিছু একটা আসবে আমার জন্যে। সেটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ল টোকন আমাকে কামালের কথা বলেছিল—টোকন যদি আমাকে আরো কিছু পাঠিয়েও থাকে তবে সেটা আসতে আসতে এই ফাঁকে এই ছেলেটাকে খুঁজলে কেমন হয়। এই পুরো বিষয়ে নিশ্চয়ই কামালের কোনো না কোনো ভূমিকা আছে, না হলে টোকন আমাকে ওর নাম বলত না। কিন্তু চেনা নেই, জানা নেই হুঁট করে এভাবে একটা লোককে কি খুঁজে বের করা যায়। শুরু করলাম ফেসবুক থেকে। কাজ হলো না, হয় ছেলেটার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, আর না হয় সে বহু আগেই ওটাকে ডিঅ্যাকটিভেট করে ফেলেছে। ফেসবুকে খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে একে একে অন্যান্য বাকিসব মিডিয়ামগুলোও এক্সপ্লোর করতে শুরু করলাম। ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, পিনটারেস্ট কিছুই বাদ দিলাম না। কিন্তু খুব যে কাজ হলো তা কিন্তু না। কোথাও খুঁজে পেলাম না ছেলেটাকে। ভার্চুয়ালি খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম একচুয়ালি চেষ্টা করব। সেই এতিমখানায় যোগাযোগ করলাম, যেখানে আমরা বড়ো হয়েছি। কিন্তু সেখান থেকেও কিছু বলতে পারল না। কামালকে নিয়ে খোঁজখবর করছি এমন সময় সবচেয়ে মোক্ষম বিষয়টা ধরতে পারলাম। আমি অপেক্ষা করছিলাম আবারো কোনো চিঠি বা এরকম কিছু একটা আসবে, কিন্তু সেরকম কিছু আসেনি। পরবর্তীতে আমি একটা ব্যাপার খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। টোকন যা করেছে খুব সাবধানতার সঙ্গে এবং সতর্কভাবে করেছে। সেই সঙ্গে এমন টেকনিক্যালি করেছে, যা অনেকটাই ধোঁয়াটে ছিল। টোকন খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল—সে খুব শক্ত পাল্লায় পড়েছে এবং সম্ভবত সে বাঁচবে না। কাজেই ওর একমাত্র ভরসা ছিলাম আমি। কাজেই সে যা বোঝাতে চায় সেটা যেন একমাত্র আমি বুঝতে পারি। আর সেজন্যেই পুরো ব্যাপারটা খুব সাবধানে এবং টেকনিক্যালি সাজিয়েছিল সে। আর তাই পুরো ধাঁধাটার ভেতরে একের পর এক লেয়ার সাজানো ছিল—আর সেই লেয়ারের একটা ভেদ করে আরেকটায় যেতে হলে প্রতিটা বুঝে যেতে হবে, আর সেগুলোও এমনভাবে সাজানো ছিল, যা একমাত্র আমার দ্বারাই বোঝা সম্ভব ছিল।’

‘যা হোক, টোকনের ধাঁধার পরের কোনো ক্রুর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে যখন কামালের খোঁজ করে পেলাম না, তখন প্রথমে খানিকটা হতাশ লাগছিল। কিন্তু এমন সময় এমন একটা জিনিসের সন্ধান পেলাম, যা পুরো ব্যাপাররটায় আমাকে বেশ অনেকটা এগিয়ে দিল। আমি বারবার সেই প্রজাপতির ছবির কার্ডটা দেখছিলাম আর নম্বরটা পড়ছিলাম, সেই সঙ্গে রুবিকস কিউবের কার্ডটাও। টোকনের রুবিকস কিউব নিয়ে খেলার শখ ছিল। আসলে শুধু শখ বললে ভুল হবে, বলতে গেলে রীতিমতো নেশা, যেখানেই যেত সবসময় সঙ্গে একটা কিউব অবশ্যই থাকত। কার্ডটা দেখতে দেখতে মনে হলো,আমার আসলে টোকনের জিনিসপত্র  ঘেঁটে দেখা উচিত। টোকন আর আমি দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিলাম। বাসা পরিবর্তনের সময়ে নিয়ে গেলেও আসলে সবকিছু একেবারে ঝেড়েপুছে নিয়ে যায়নি। অনেক জিনিসই রয়ে গেছিল, আবার ওর মৃত্যুর পরে ওর উত্তরসূরি হিসেবে অফিসে থাকা ওর সব জিনিসপত্রও আমার এখানেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। কাজেই ওর সব জিনিস ঘাঁটতে লাগলাম। ঘাটতে ঘাটতে মোট তিনটা কিউব পেলাম ওর জিনিসপত্রের ভেতরে। খুবই সাধারণ রুবিকস কিউব যেমন হয় ওরকমই। কিউবগুলো বাদে ওর জিনিসপত্রের ভেতরে আর বিশেষ কিছু পেলাম না। কয়েকদিন কাটালাম কিউবগুলো নিয়ে। রুবিকস কিউব নিয়ে আমার আগ্রহ কোনোদিনই ছিল না, এটা নিয়ে কয়েকদিন ঘেঁটে বুঝতে পারলাম, এটার সমাধান করা আসলে আমার কাজ নয়, সবাইকে দিয়ে সব হয় না। কিন্তু ইউটিউব দেখে দেখে বেশ কিছু জিনিস শিখলাম রুবিকস কিউব নিয়ে, শিখলাম কীভাবে এটা এলোমেলো করতে হয়, কীভাবে যেকোনো এলোমেলো অবস্থা থেকে এটার সমাধান করা যায় এসব জিনিস। রুবিকস কিউব নিয়ে অনেক জ্ঞান বাড়লেও এটা কীভাবে টোকনের রহস্যের সঙ্গেজড়িত সেটা বুঝতে পারছিলাম না। রুবিকস কিউব নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে যে- কটা মজার জিনিস আবিষ্কার করেছিলাম এর ভেতরে অন্যতম একটা ছিল, এই কিউবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে। যারা এই কিউব নিয়ে নানা ধরনের খেলাসহ বিভিন্ন ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করে থাকে। ঘাটতে ঘাটতে আরো জানতে পারলাম, রুবিক কিউব যারা খেলে, তাদের নিজেদেরও বেশ কিছু সংগঠন এবং প্ল্যাটফর্ম আছে। এর ভেতরে অন্যতম একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে নিয়মিত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ সলভ করা হয় এর নাম ‘ক্রেজি কিউবার্স’।

‘ঘাঁটতে ঘাঁটতে ক্রেজি কিউবার্সের নামটা সামনে আসতেই খানিকটা উত্তেজিত বোধ করতে শুরু করলাম। কারণ এই প্ল্যাটফর্মের নাম আমি টোকনের মুখে শুনেছি। এটা নিয়ে অনেক পাগলামি করত ও এবং এ-নিয়ে আমার কাছে বকাও শুনত ও। আমার পরিষ্কার মনে আছে ও আমাকে সিগারেট নিয়ে টিটকারি মারত, আর আমি ওকে এটা নিয়ে। যাই হোক ক্রেজি কিউবার্সের সাইটে ঢুকে খানিকটা ঘাঁটাঘাটি করতে করতে বুঝতে পারলাম—এটা অনেকটা রুবিকস কিউব নিয়ে যাদের নেশা তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার মতো। অনেকটা সাহিত্যপ্রেমীদের যেমন গুডরিডস আছে তেমন টাইপের। যা হোক, আমি ক্রেজি কিউবার্সে ঢুকে বুঝতে পারলাম যে, এখানে তাদের অনেক ধরনের অ্যাক্টিভিটিস আছে, তবে মূল কাজ হলো—এরা একসঙ্গে সবাই কানেকটেড থাকা। তবে সেক্ষেত্রে মূল একটা কন্ডিশন হলো এই সাইটে সবারই নিজস্ব একটা আইডি, বা প্রোফাইল থাকতে হবে। আমি প্রায় নিশ্চিত টোকনেরও এখানে কোনো একটা প্রোফাইল ছিল। আমি টোকনের কমন জি-মেইল জানতাম সেটা পাঞ্চ করতেই পাসওয়য়ার্ডের অপশন চলে এলো। আমি বলতে গেলে খুশি হয়ে উঠলাম, কারণ টোকনের একটা কমন পাসওয়ার্ড ছিল, সেটা আমি জানতাম। সেই পাসওয়ার্ড পাঞ্চ করে ভাবছি কাজ হয় গেছে। এমন সময় আমাকে পুরো ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দিয়ে বলে উঠল ভুল পাসওয়ার্ড। মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেল আমি ভেবেছিলাম কাজ হয়ে যাবে। দুই-তিন দিন ধরে একের পর এক পাসওয়ার্ড ট্রাই করে গেলাম কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। দুই দিন আমি প্রায় ধৈর্য হারাতে বসেছি এমন সময় টোকনের পাঠানো কার্ড দুটো দেখছিলাম হঠাৎ দ্বিতীয় কার্ডের কোনায় একটা ছোট প্রায় আবছা লেখার মতো চোখে পড়ল। খুব ভালো করে দেখে বুঝলাম কার্ডটা যারা পাঠিয়েছে, তাদেরই কিছু একটা হবে। আরো ভালোভাবে দেখে বুঝলাম এটা অর্ডার নম্বর। বিশেষ কোনো কারণ নেই, হাতের কাছে যা পাচ্ছি তাই ট্রাই করছি, তাই ক্রেজি কিউবার্সের প্রফাইলের পাসওয়ার্ডের ঘরে এটাই বসিয়ে দেখলাম। আমাকে খুবই অবাক করে দিয়ে প্রোফাইলটা ওপেন হয়ে গেলো। খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম। টোকনের প্রোফাইলের নাম টি-বার। টি সম্ভবত টোকন রিপ্রেজেন্ট করে, আর বার শব্দটা নিয়েছে সে কিউবার থেকে, মিলিয়ে টি-বার। আমি ওর অ্যাকাউন্টে ঘুরে ইনবক্স চেক করলাম, ওর প্রোফাইলের থাকা নানা রুবিক কিউবার ইউজারদের মেসেজ এসে ভরে আছে। কাজের কিছু নেই। সেন্ট মেসেজসহ পুরো প্রোফাইলের সব চেক করলাম কিন্তু কাজে লাগার মতো বা আমি যা খুঁজছি সেরকম কিছু পেলাম না কোথাও। প্রফাইল থেকে বেরিয়ে যাব এমন সময় চোখে পড়ল ড্রাফটে একটা মেসেজ সেভ হয়ে আছে। ড্রাফটে ঢুকে দেখতে পেলাম কোনো মেসেজ না, সেখানে একটা লিংক রাখা। লিংকটাতে ক্লিক করতেই একটা সাইট ওপেন হতে শুরু করল।’ ,  

‘এখানে একটা কথা বলে রাখি, এই সাইটই আসলে টোকনের মূল ইনভেস্টিগেশনের জায়গা ছিল। আমাকে বিভিন্নভাবে সে আসলে এই সাইটটায় নিয়ে যেতে চাইছিল। আমিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোমতে সেই সাইট পর্যন্ত চলে যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু মূল খেলা তখনো শুরু হয়নি। আসল খেলাটা শুরু হলো এরপর। সাইট লোড হতে দেখতে পেলাম খুবই ওয়েল ডিজাইন্ড একটা সাইট সেটা। পুরো সাইটে আর কিছু নেই স্ক্রিনের ঠিক মাঝ বরাবর একটা থ্রিডি রুকিবস কিউব যেন ঝুলে আছে। সাইটটা যে টোকনের বানানো সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। আর এরকম দারুণ একটা সাইট তার পক্ষে ডিজাইন করা পসিবল ছিল—কারণ সে এই কাজই করত প্রফেশনালি। প্রশ্ন হলো এই সাইট কি আর এই থ্রিডি কিউবটাই বা কি,’ এটুক বলে টোকন কাঁধ ঝাঁকাল। সত্যি কথা হলো সেই প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো খুঁজছি, পুরোটার জবাব খুঁজে পাইনি। স্ক্রিনে থাকা কিউবটাতে ক্লিক করতেই ওটা ভাগ ভাগ হয়ে খুলে যেতে লাগল। খুবই সুন্দরভাবে প্রতিটা কিউব আলাদা হয়ে স্ক্রিনে ঝুলতে শুরু করল ক্লিক করা মাত্রই। আমি প্রথমেই আলাদা হয়ে থাকা কিউবগুলোর একটায় ক্লিক করলাম। ওটা পাসওয়ার্ড প্রটেকটেড। অন্য একটায় ক্লিক করলাম একই অবস্থা, আরেকটায়, প্রতিটাই আলাদাভাবে পাসওয়ার্ড প্রটেকটেড। কিন্তু মজাটা হলো সারির চতুর্থ কিউটাতে ক্লিক করতেই, ওটাতে ক্লিক করামাত্র সঙ্গেসঙ্গে পুরো কিউবটা ঘুরে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এই থ্রিডি কিউবটা আসলে বাস্তবের রুবিক্স কিউবের মতোই কাজ করে, পার্থক্য হলো এটা অ্যানিমেটেড এবং পুরো কিউবটার সমাধান করতে হলে এর এক একটা কিউবের আলাদা আলাদা কিউব বা অংশ পাসওয়ার্ড দিয়ে ভেঙে ভেঙে এগোতে হবে। অসম্ভব জটিল একটা খেলা কিংবা বলা যায় ধাঁধার ভেতরে নিয়ে ফেলেছে আসলে টোকন আমাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন?’

‘অসম্ভব সুন্দর কিন্তু দারুণ জটিল এক ধাঁধার রেখে গেছে টোকন আমার জন্যে। টোকন জানত আমি জানতে চাইব ওর আসলে কী হয়েছিল। আর নিজের মৃত্যুর আগেই সে জানান দিয়ে গেছিল যা তার মৃত্যুর পর আমি জানতে চাইব। টোকনকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনতাম এবং এটাও জানতাম যে, সে অসম্ভব মেধাবি একটা ছেলে। সত্যি কথা হলো, আমি আর ও একসঙ্গে বড়ো হলেও এবং আমাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও আসলে অমিলও কম ছিল না। এর ভেতরে আমাদের দুজনার মধ্যে একটা বড়ো অমিল ছিল, আমি বরাবরই ছিলাম একেবারে টিপক্যাল ক্যারিয়ারিস্ট টাইপ, নিজের পড়া নিজের কাজ, এর বাইরে আমি খুব বেশি জিনিস বুঝতাম না, বুঝতে চাইতামও না। বিশেষ করে বই পড়া, সাহিত্য চর্চা, পেইন্টিং, একটু গভীর থিমের সিনেমা দেখা, আমার জন্যে এগুলো ছিল অ্যালার্জির মতো। এসব নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি আমার কাছে সময় নষ্ট মনে হতো। আমি হলাম কাজ করো, চিল করো, ঘুমাও টাইপ মানুষ। আমি বরাবরই যতটা ঘুমানো দরকার তার চেয়ে বেশি ঘুমাই, যতটা আজেবাজে সিরিজ আর সিনেমা দেখা উচিত, তারচেয়ে বেশি দেখি। কিন্তু টোকন এমন ছিল না।’

পেশাগতভাবে ইঞ্জিনিয়ার হলেও টোকনের অপরিসীম আগ্রহ ছিল সাহিত্য, ক্লাসিক্যাল মিউজিক, চিত্রকলা এমনকি আর্কিটেকচার বিষয়ে। ব্যাপারটা অদ্ভুত, কারণ এতিমখানায় বড়ো হওয়া একটা ছেলে, যে ছোটবেলা থেকে না পেয়েছে ঠিকমতো আদর-ভালোবাসা কিংবা পড়ালেখার সুযোগ, সে-ছেলেটা কতটা স্ট্রাগল করে উঠে এসেছে এই পর্যন্ত সেটা একমাত্র আমি জানি। অন্যদিকে এমন একটা ছেলে যাকে অন্যসব বাদ দিলেও স্রেফ খাবারের জন্যে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে সেই ছেলেটার এমন ডাইভার্স আগ্রহ অবাক করার মতোই বটে। তারচেয়েও অদ্ভুত বিষয় হলো এত কষ্ট করে বড়ো হওয়া একটা ছেলে যাকে পৃথিবী সমাজ এতটা যন্ত্রণা দিয়েছে, তার পৃথিবীর প্রতি অনেক রাগ থাকা উচিত ছিল—কিন্তু ওর ব্যাপারটা ছিল উলটো। অপরিসীম ভালোবাসা ছিল ওর, এই কারণেই হয়তো হরিকে নিয়ে ও এতটা গভীরে জড়িয়ে গেছিল। তবে রুবিকস কিউবের এই থ্রিডি মডেলটা উন্মোচিত হতে একদিকে ভালো লাগছিল, অন্যদিকে আমি জানতাম এটা টোকন আমার জন্যেই সৃষ্টি করেছে। আর সে-কারণে আমি খানিকটা মজা কিংবা কৌতূহলও হচ্ছিল, আমি জানতাম টোকন এখানে আমার জন্যে অনেক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে রেখেছে। সারাজীবন ওর বই পড়া, চিত্রকলার প্রতি আগ্রহ নিয়ে টিটকিরি মেরেছি আমি, সেটার প্রতি মৃদু প্রতিশোধও বলা যায় এটাকে। রুবিকস কিউবের এই ফোর ডাইমেনশনাল মডেলটা দেখে আমি এটা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে টোকনের সঙ্গে যা হয়েছে কিংবা সে যা বলতে চেয়েছে আমাকে, সেটার পুরোটাই এখানে আছে। কিন্তু সেটা বের করতে হলে এই পাজল ভাঙতে হবে আমাকে। সেই সঙ্গে আমি এটাও বুঝতে পারছিলাম যে, এখানে টোকন ওর সমস্ত নলেজ লাগিয়েছে, কাজেই এটাকে ক্র্যাক করা মোটেও সহজ কিছু হবে না। কারণ সে এমন কিছু করবে না যেটা সবাই বুঝে ফেলে। আমি বাকিসব কাজ সামলে আঁটঘাট বেঁধে নামলাম এটা সমাধানে। প্রথমে কিউবটাতে ক্লিক করলাম

‘প্রথম কিউবটাকে ক্লিক করতেই আগের বারের মতোই অন্য কিউবগুলো থেকে এটা আলাদা হয়ে গেল। আমার ফিল্ডে আমি একজন প্রফেশনাল হওয়াতে এটাও বুঝতে পারছিলাম টোকন শুধু পাজল তৈরিতে কিংবা পুরো ব্যাপারটার উন্মোচনে ইনোভেশন দেখায়নি। সে তার লাইন অব ওয়ার্ক মানে ওয়েবসাইট ডিজাইন করতেও রীতিমতো রেভলুশান ঘটিয়েছে। যে সাইটটাতে পুরো জিনিসটা সাজানো অছে একেবারেই ক্র্যাক করা অসম্ভব একটা জিনিস তৈরি করেছে সে। যা হোক প্রথম ডাইমেনশনটাতে ক্লিক করতেই আবারো অদ্ভুত সেই প্রজাপতির ছবিটা দেখতে পেলাম, যেটা ওর পাঠানো সেই কার্ডে ছিল, প্রজাপতিটার ঠিক নিচেই ছয়টা ঘরের একটা কোড বক্স দেয়া। খুব পরিষ্কার যে, এই প্রজাপতিটাই ক্রু এবং এটা দেখেই আমাকে কোডটা বের করে বসাতে হবে, আর তাহলেই আমি বুঝতে পারব আসলে এখানে কী আছে। কিন্তু এই প্রজাপতি মালটা আসলে কি? শুরু করলাম প্রজাপতি নিয়ে পড়ালেখা। প্রথমত, ফ্যাক্টস-ইনফরমেশন এগুলো। এরপর অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু বিষয় নিয়ে। যেমন, প্রজাপতিকে যেকোনো মিডিয়ামে ট্রান্সফরমেশনের প্রতীক বলা হয়ে থাকে। এই সিম্বল নানাভাবে সাহিত্যে ব্যবহার করা হয়, লোগো ডিজাইন থেকে শুরু করে এমনকি করপোরেট জগতেও এটা ব্যবহার করা হয়। প্রজাপতি নিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা আমি প্রজাপতি নিয়ে পড়ালেখা করছি কিন্তু যেখান থেকে কার্ডটা এসেছে সেখানে কী ধরনের প্রজাপতি পাওয়া যায়, সেটা তো জানা দরকার। ওই বিশেষ এলাকার প্রজাপতি নিয়ে পড়তে গিয়েই মজার বিষয়টা টের পেলাম। আসলে একেবারে শুরু থেকে আমি যে জিনিসটাকে প্রজাপতি ভেবে আসছি ওটা আসলে প্রজাপতিই নয়, এক ধরনের মথ। এটাও ওই ধরনই, কিন্তু প্রজাপতি আর মথের ভেতরে অনেক অনেক পার্থক্য। আমার ক্ষুদ্র আবিষ্কারটা আমাকে ঠিক যতটা উত্তেজিত করে তুলল তার সঙ্গে বোনাস হিসেবে যুক্ত হলো আরেকটা প্রাপ্তি। কার্ডের সেই ছবিটা দেখতে গিয়ে হঠাৎই চোখে পড়ল নম্বরটা, ৩৩০১। নম্বরটা দেখে প্রথমে খুব উত্তেজিত হয়ে সেই কিউবে পাঞ্চ করতে গিয়ে মনে পড়ল, ধুর ওটাতে তো ছয়টা ঘর, আর এখানে নম্বর আসলে চারটা। আর তখনই মনে হলো আচ্ছা মথ আর এই নম্বরটার ভেতরে কি আমাদের কোনো যোগসূত্র আছে? দুটোকে একসঙ্গে গুগলে দিয়ে সার্চ করে দেখলে কী দাঁড়ায়। মথ আর নম্বরটা লিখে গুগলে সার্চ দিতেই রীতিমতো রেভলুশন ঘটে গেল। আমি সোজাসুজি গিয়ে পড়লাম পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ইন্টারনেট মিস্ট্রিগুলোর একটাতে। সিকাডা ৩৩০১,’ এই পর্যন্ত বলে জুলহাস আনমনে মাথা নাড়ল। এখন পর্যন্ত আমি যা বলেছি এর ভেতরে আমার এই আবিষ্কারটা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলোর একটা। সিকাডা বিষয়ক আলোচনায় আসি। সিকাডা ৩৩০১, ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো রহস্যগুলোর একটা। যে কেউ যদি কখনো আমার এই ভিডিও শোনেন বা দেখেন, সঙ্গেসঙ্গে ফোন বা ল্যাপটপটা নিয়ে গুগলে CICADA৩৩০১ লিখে সার্চ দিন, সঙ্গেসঙ্গে আপনার সামনে এই বিস্ময়কর জগৎ উন্মোচিত হবে। অদ্ভুত এই হেয়ালি রহস্য আর কন্সপিরেসির এক বিস্ময়কর জগৎ, যে-জগতের তল কিংবা সমাধান আজ পর্যন্ত কেউ খুঁজে পায়নি। আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে আমি সংক্ষেপে বলছি, সিকাডা আসলে কি।’

সহজভাবে বলতে গেলে সিকাডা ৩৩০১ একটা ইন্টারনেট মিস্ট্রি, আনসলভড অবশ্যই। সিকাডা এক ধরনের মথের নাম। আর এই রহস্যের মূলেও আছে সেই মথের ছবি। সিকাডা আসলে এক অদ্ভুত রহস্যময় জটিল আর উচ্চবুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এক ভার্চুয়াল ধাঁধা, এমন এক অমীমাংসিত রহস্য, যা নিয়ে আজো মানুষের ভেতরে উত্তেজনা, বোকামি, ইচ্ছা, অপূর্ণতা আর আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নেই,’ জুলহাস কথা বলতে বলতে আপনাতেই আনমনে একবার মাথা নাড়ল। ‘অনেকগুলো বেশ শক্তিশালী শব্দ ব্যবহার করলাম। এর পেছনে কারণও আছে। সিকাডা ব্যাপারটাই এমন। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ফোর চ্যান নামক এক ওয়েবসাইটে প্রথমবারের মতো এই ধাঁধা পোস্ট করা হয়, এরপর থেকে পুরো ইন্টারনেট দুনিয়া এই ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কেউই পেরে ওঠেনি এখন পর্যন্ত, একক ব্যক্তিবিশেষ কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান যখনই বা যারাই এর সমাধানের কাছাকাছি পৌছেছে, তখনই আবার ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রথমেই জেনে নেয়া যাক কারা কিংবা কী উদ্দেশ্যে পোস্ট করেছে এই মাল্টিলেয়ার ধাঁধা। প্রথমেই আসে এই ধাঁধার স্রষ্টা কারা কিংবা কেন তারা এই ধাঁধা পোস্ট করেছে। সিআইয়ের রিক্রুটমেন্ট প্রসেস থেকে শুরু করে, বিশ্বের সেরা মেধা বা সেরা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার থেকে শুরু করে এলিয়েনরা এই ধাঁধা প্রস্তুত এবং পোস্ট করেছে এরকম কথাও প্রচলিত আছে, কিন্তু কোনোটারই কোনো সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিংবা কেউই এর তলও খুঁজে পায়নি। মানে কারা এই সিকাডার স্রষ্টা তা অজানা। এবার আসা যাক কী আছে এতে। এই কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে কথাটা মনে আসে, সেটা হলো কী নেই এতে। সংখ্যার খেলা থেকে শুরু করে বিচিত্র কোড, মিউজিক, পেইন্টিং, মধ্যযুগীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের রেডিট, এমনকি উন্নত বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ এবং তাদের টুরিস্ট ডেস্টিনেশন—এমন কিছু নেই যার সংশ্লিষ্টতা নেই এর সঙ্গে। এরপরের যে-ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতে হয় এতে আসলে কী হয় এবং কেন কেউই এর সমাধান করতে পারেনি। সিকাডার রহস্য সমাধানের সবচেয়ে গভীরতম পর্যায় পর্যন্ত যেতে পেরেছিল এমন একজনের বয়ানে যদি পুরো ব্যাপারটাকে দেখা যায়, তবে শুরুটা হয় অনেকটা এভাবে :

হ্যালো! আমরা খুব উচ্চ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একজনকে খুঁজছি। কিন্তু তা বের করা খুব সহজ নয়। তাই আমরা একটি ধাঁধার পরীক্ষা নিচ্ছি। এই বার্তার শেষে একটি ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই ছবির ভেতর আরেকটি গোপন বার্তা লুকানো রয়েছে। যদি নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করো, তাহলে সেটা বের করো। এই ধাঁধার সমাধান তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবে। আমরা তোমার অপেক্ষায় আছি। শুভ কামনায়, ৩৩০১’

‘শুরুটা হয় এভাবে। এরপর ওদের সাইটে ছবি এবং বার্তা মিলিয়ে সেখান থেকে পরের ধাপে যাওয়ার জন্যে হয়তো কোনো একটা লিংক কিংবা সাইটের নির্দেশনা পাওয়া যায়। সেটাতে যাওয়ার পর শুরু হয় একের পর অঙ্ক কিংবা নম্বরের খেলা কিংবা প্রশ্নোত্তর পর্ব। যদি সফলভাবে সেগুলো ভাঙা যায় কিংবা সমাধান করা যায় সেখান থেকে যাওয়া যায় পরবর্তী ধাপে। এভাবে একের পর এক যত গভীরতম ধাপে যেতে থাকে খেলা তত কঠিন হতে শুরু করে। আগেই বলেছি, নম্বর আর কোডের খেলা তো আছেই, এর সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগ হতে শুরু করে রেডিটের মতো বিখ্যাত কোনো সাইট, আবার কখনো অখ্যাত কোনো গেমিং সাইটের নির্দেশনা। আর খেলা যত গভীরে যেতে থাকে তত বৈচিত্র্য আসতে শুরু করে। কখনো কোনো বাস্তবের ল্যাম্পপোস্টে আঁটা কিউ আর কোডের নির্দেশনা, আবার কখনো ফ্রান্স কিংবা স্পেনের কোনো অখ্যাত লোকেশনে যাওয়ার নির্দেশনা। এতেই শেষ নয়, খেলার  নানা ধাপে আবার আসতে থাকে এর স্রষ্টাদের বার্তা। আবার কখনো একেবারেই অযাচিতভাবে নানা অজুহাতে খেলোয়াড়দের বাতিল করে দেয়ার প্রক্রিয়া। সবমিলিয়ে বিচিত্র দুর্বোধ্য, ব্যয়বহুল এবং প্রায় অসম্ভব এক যাত্রা যেটার শেষ পর্যায়ে কেউই যেতে পারেনি আজ অবধি। প্রশ্ন হলো টোকন কেন আমাকে সিকাডার মথের মতো লাউয়াছড়ার মথের কার্ড পাঠাল, তাতে সিকাডার নম্বরই বা কেন লেখা আর সেটা কেনই বা টোকনের সৃষ্ট ধাঁধার একেবারে প্রথম কিউবে মেনশন করা।’

‘আগেই বলেছি প্রথম কিউবটাতে স্রেফ একটা মথের ছবি আর নিচে পাঞ্চ করার জন্যে ছয়টা ঘর। সিকাডার বিষয়টা আবিষ্কার করার পর এবার ভালোভাবে দেখে অনুধাবন করলাম টোকন আমাকে লাউয়াছড়ার যে মথের ছবিটা পাঠিয়েছে সেটার সঙ্গে এই মথের সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য আছে। এই মথটা একেবারেই হুবহু সিকাডার মথের ছবি। আমি গুগলে ইমেজ সার্চ দিয়ে আবারো নিশ্চিত হলাম। সিকাডার নম্বরটা আগেই পরখ করে দেখেছি যে, ওটা পাঞ্চ-কি’তে সেট হচ্ছে না। কাজেই সিকাডার সঙ্গে এই পাঞ্চ কি’র কী সম্ভাব্য যোগাযোগ থাকতে পারে—সো ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে হলো আরে আমি তো আসল জায়গাতেই ক্লিক করতে ভুলে গেছি সিকাডা শব্দটা। সিআইসিএডি এ, ছয়টা লেটার। খুব বেশি আশা না নিয়েই শব্দটা পাঞ্চ করলাম, এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রথম কিউবটা খুলে গেল। আশা আর স্বস্তির একটা পরশ বয়ে গেল শরীরে। প্রথম কিউবটা ওপেন হতেই দুটো ঘটনা ঘটল। প্রথমত কিউবের ভেতরে একটা ছোট্ট বার্তা ফ্ল্যাশ করতে লাগল; বার্তাটায় বড়ো করে লেখা, ওয়েলকাম টু টিকে’স কিউব, সেই সঙ্গে ছোট্ট করে নিচে লেখা ফলো দ্য সিকাডা প্যাটার্ন। ওয়েলকামটা বুঝতে পেরেছি কিন্তু সিকাডা প্যাটার্ন ব্যাপারটা কি সেটা বুঝতে পারিনি তখন, জুলহাস আপন মনে মাথা নাড়ল। ‘তবে খানিক পরে বুঝতে পেরেছিলাম। আসলে দ্বিতীয় কিউবে প্রবেশ করতেই খানিকটা বুঝতে পেরেছিলাম। আর দ্বিতীয় কিউবে প্রবেশের রাস্তা খুলে গেছিল প্রথম কিউবটা ওপেন হতেই। এটাই ছিল সেই দ্বিতীয় ঘটনা যেটা ঘটতে শুরু করেছিল। টেক্সটটা ওপেন হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই দ্বিতীয় কিউবের রাস্তা খুলে গেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় কিউবের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম ওটা প্রায় ফাঁকাই বলা যায়, শুধু ছোট্ট করে লেখা, ওয়েট ফর দ্য কু।’

‘এই ব্যাপারে বলতে গেলে প্রায় কোনো সন্দেহই নেই যে, টোকন যা বলতে চেয়েছে সেটাকে আমার কিংবা অন্য কারো কাছে পৌঁছানোর মতো সরাসরি কোনো রাস্তাই তার ছিল না। আর সে এটাও বুঝতে পারছিল যে, তাকে যেকোনো সময় মেরে ফেলা হবে। আর তাই সে যা বলতে চেয়েছে, সেটাকে প্রকাশ করার জন্যে একজন মানুষই ছিল আর একজন বার্তাবাহকই ছিল। সেটা ছিলাম আমি। টিকে’স কিউব যে আসলে টোকন’স কিউব সেটা বুঝতে তো আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন ছিল না, আর টিকে’স কিউব নামে টোকন আসলে একটা ভার্চুয়াল রুবিক’স কিউব তৈরি করেছিল। প্রশ্ন হলো, এই সাইটের লিংক এবং এতে প্রবেশ করে প্রথম কিউবটা খুলতেই যে-পরিমাণ বেগ পেতে হয়েছে, সামনে না জানি আর কী আছে। আর সিকাডা প্যাটার্ন অনুসরণ করার ব্যাপারটাই বা কি? জানতে হলে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমি অপেক্ষায় রইলাম। পোস্ট কার্ড, গিফট কার্ড এরপর গেইম সাইট, এবার কীভাবে বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে টোকন আমি ধরতে পারছিলাম না। এবার কী ধরনের প্রযুক্তির ব্যবস্থা করেছে সে, কে জানে। কিন্তু বার্তাটা যেভাবে এলো সেটা অভাবনীয়।’

‘আমি যেখানে অপেক্ষা করেছিলাম কোনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিংবা এমন কিছুর, সেখানে বার্তাটা এলো একেবারেই সনাতনী পদ্ধতিতে। সেই পুরনো স্পাই ক্রাফটের যুগে খুবই লুকানো পদ্ধতিতে বার্তা পৌঁছানোর জন্যে কিছু অদ্ভুত আর বিচিত্র পদ্ধতির ব্যবহার করত, এর ভেতরে একটা ছিল তথ্য ছড়িয়ে দেয়া। মানে

হলো যেখানে প্রয়োজন সেখানে একেবারে সবার চোখের সামনে এমনভাবে থাকবে যে, সবাই দেখবে কিন্তু কেউ টের পাবে না। ব্যাপারটা বিভিন্নভাবে করা হতো। কখনো কখনো পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে, কখনো কখনো চিঠির মাধ্যমে, কখনো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, এমনকি কখনো কখনো লোকের মুখে মুখে তথ্য ছড়িয়ে দিয়েও এটা করা হতো। সত্যি কথা হলো আমার কাছে তথ্য পৌঁছানোর জন্যে টোকন দারুণ ব্রিলিয়ান্ট কিছু টেকনিক ব্যবহার করেছে। যার ভেতরে একেবারে পুরনো স্পাই থ্রিলার বইতে ব্যবহার করা নানা ধরনের টেকনিক তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে একেবারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এমনকি একেবারেই আনকনভেনশনাল কিছু টেকনিকও আছে।

যা হোক পরের কু যেভাবে এলো সেটা বলি। আমার চারপাশে কী ঘটছে সেই বিষয়ে আমি ইদানীং খুব সচেতন থাকি। ফোনকল থেকে শুরু করে ই-মেইেল, সোশ্যাল মিডিয়া নোটিফিকেশন, কী চিঠি আসছে আমার কাছে, এমনকি আশপাশে কেউ নজর রাখছে কি না কিংবা কোনো লোকজন যাওয়া আসা করছে কি না, যেটা সন্দেহজনক সব কিছুতেই। কয়েকদিন যাবৎ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেখানে আমাদের কেয়ারটেকারের ঘর, তার ঠিক বাইরেই একটা দেয়াল আছে যেখানে টিউশনির বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন দেয়া থাকে এরকম একটা দেয়াল আছে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই এ-ধরনের বিজ্ঞাপনে ঠাসা দেয়াল দেখা যায়। আমার বাড়িটার ঠিক বাইরেই এ-ধরনের একটা দেয়াল আছে। অন্য সময় হলে হয়তো খেয়াল করতাম না কিন্তু পরিস্থিতির কারণেই আমি একটু ওভারকনশাস হয়ে আছি। এই কারণেই আশপাশে সব কিছুতেই অস্বাভাবিক কড়া নজর রাখছি। আর এ-কারণেই কি না কে জানে দেয়ালটার দিকে তাকাতেই দেখতে পাই ওখানে অন্য সব সাধারণ বিজ্ঞাপনের সঙ্গে দেয়ালে সেঁটে রাখা একটা বিজ্ঞাপনের দিকে। চোখে পড়ার কারণ হলো এই বিজ্ঞাপনটা অন্য সব বিজ্ঞাপন থেকে একেবারেই আলাদা। এটাতে কিছুই লেখা নেই স্রেফ একটা কিউ আর কোড প্রিন্ট করা। ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক না, আবার খুব অস্বাভাবিকও না। স্বাভাবিক না, কারণ এভাবে বিজ্ঞাপনের চল আমাদের দেশে এখনো সেভাবে চালু হয়নি। আবার অস্বাভাবিকও না, কারণ এটা বিজ্ঞাপনেরই দেয়াল, এখানে হাজারো বিজ্ঞাপনের ভিড়ে একটা এরকম বিজ্ঞাপন যেটাতে সরাসরি কোনো কনটেন্ট নেই, সেটাতে চট করে লোকজনের চোখ নাও পড়তে পারে। যা হোক আমার চোখে পড়ল। সরাসরি কোড স্ক্যান না করে ছবি তুলে আনলাম। অফিস থেকে আসার সময়ে সেটাকে প্রিন্ট করে বাসায় এসে স্ক্যান করলাম। ফালতু এবং হালকা ধরনের একটা ওয়েট পেইজ, কোনো একটা স্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল টাইপের কিছু একটা। সাধারণ ওয়ার্ড প্রেসে বানানো এমন এক সাইট যেটার এমনকি কেউ পরোয়াও করবে না। নিউজটাও যে খুব সুবিধার কোনো নিউজ তাও না। হাবিজাবি কনটেন্টে ভরা। তার ভেতরে সামান্য সামান্য উঁকি দিচ্ছে কোনো পর্নস্টারের অনুবাদ করা বিজ্ঞাপন।’

‘অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ট্যাব বন্ধ করে দিলাম। এটা টোকনের দেয়া কোনো ব্লু নয়। অতীব বিরক্ত হয়ে ঘুমাতে গেলাম এবং এমন সময় প্রায় লাফিয়ে উঠে বসলাম আবার। পুরো ব্যাপারটা এমন যে কেউ দেখলে বিরক্ত হবে কিংবা ভাববে এটা আবার কী, কিংবা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ওয়েব পেইজের সামনে আসা হাজারো হাইপার লিংক কিংবা বিজ্ঞাপনের মতো কিছু একটা। কিন্তু আমি এর ভেতরেই একটা প্যাটার্ন দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। এটা সিকাডার পুরো ইতিহাস পড়ার কারণেই হোক কিংবা টোকনকে খুব ভালোভাবে চেনার কারণেই হোক পুরো ব্যাপারটাতে আমি একটা পরিষ্কার প্যাটার্ন দেখতে পাই। খুবই আনকনভেনশনাল প্যাটার্ন এভাবে কেউ কাউকে কোনো বিষয়ের ক্লু দিতে পারে, তাও আবার নিজস্ব চয়েস, জানাশোনা আর সাবকনশাস মাইন্ড ব্যবহার করে, এটা ভাবাটাও ডিফিকাল্ট। আমি লাফ দিয়ে উঠে বসে আবারো ল্যাপটপ ওপেন করলাম। পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারার একটাই কারণ, যে-পর্নস্টারে নিউজ ছিল ওখানে ওটা টোকনের ফেভারিট পর্নস্টার।’

‘আমি লাফ দিয়ে উঠে বসে আবারো ল্যাপটপ ওপেন করলাম। আবারো নিউজটা পড়লাম, একবার-দুবার বারবার। আগেই বলেছি খুবই ক্র্যাপি, আর সাধারণ একটা ওয়েব পেইজ, এমনকি স্কুলের একটা বাচ্চাও ওয়ার্ড প্রেসে একটা অ্যাকাউন্ট ওপেন করে এমন পেইজ খুলতে পারে। বৈশিষ্ট্যটা পেইজে না নিউজে। পর্নস্টারের ইন্টারভিউটা বারবার পড়লাম। এই পর্নস্টার শুধু পর্নস্টার, সে এক ধরনের ফেমিনিস্টি মুভমেন্টের সঙ্গেও জড়িত। সেসব বিষয়েই বলেছে সে। খুব বাজেভাবে অনুবাদ করা হয়েছে লেখাটা। এই অনুবাদ যে টোকন করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওর বাংলা ভাষা জ্ঞান এমনই হওয়ার কথা। আমি ইন্টারভিউটা পড়ে বলতে গেলে কিছুই ধরতে পারলাম না। এরপর লেখাটার ঠিক নিচেই মূল ইংরেজি ইন্টারভিউটার হাইপার লিংকও আছে। সেটায় ক্লিক করে মূল সাইটে চলে গেলাম সেখানে গিয়ে মূল ইন্টারভিউটা পড়লাম এবং আবিষ্কার করলাম মূল ইন্টারভিউটা বেশ বড়ো এবং টোকন অনেক কিছু স্কিপ করে ইন্টারভিউটা বাংলা করেছে। পরের দিন দুটো ইন্টারভিউই প্রিন্ট করে পাশাপাশি নিয়ে বসলাম।’

দুটো ইন্টারভিউয়ের মাঝে ঠিক কোন কোন জায়গায় পার্থক্য—খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। দুটো ইন্টারভিউয়ের পার্থক্য লোকেট করে আবারো বাংলা ইন্টারভিউটা নিয়ে বসলাম। নিশ্চয়ই টোকন এটাতে এই জিনিসিগুলো বাংলা করেছে, এর মাধ্যমে সে আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও কিছু না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে পড়েছি, এমন সময় মনে হলো টোকন তো একেবারেই কনভেনশনাল ওয়েতে কাজ কিংবা চিন্তা করত না। কাজেই ওর মতো করে ভাবতে গেলে বরং যা সে অনুবাদ করে রেখেছে সেটা নয় বরং যে-অংশটা সে বাদ দিয়েছে সেটাতে দেখতে হবে। আবারো দুটো ইন্টারভিউ নিয়ে বসলাম, এবার ফোকাস ইংরেজিটা। কোন অংশটুকু বাংলা থেকে আলাদা, সেটা আগেই মার্ক করেছি। কাজেই এবার শুধু সে-অংশগুলো নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। আগেই বলেছি পর্নস্টার হলেও শুধু পর্ন নয় বরং ফেমিনিস্ট আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছে সে। কোন বিষয়টা নিয়ে হতে পারে টোকনের ক্লু। বারবার পড়তে পড়তে চোখে পড়ল সে বিভিন্ন পর্ন সাইট এবং ওদের ব্যাপারে নানা ধরনের কমেন্ট করেছে সে। এর ভেতরে একটা পর্ন সাইটের কথা মহিলা বারবার বলেছে, খুবই পপুলার পর্ন সাইট, কিন্তু পুরো ইন্টারভিউতে টোকন প্রতিবার এই সাইটের ব্যাপারটা স্কিপ করে গেছে। এটা একটা সম্ভাব্য ক্লু হতে পারে। আমি সেই সাইটে ঢুকে এই নির্দিষ্ট মহিলার নাম লিখে সার্চ দিলাম। সাড়ে আটাশ হাজার ভিডিও আসল সাজেশনে। এখন কি আমাকে এই সাড়ে আটাশ হাজার ভিডিও দেখতে হবে? খুব ভালো একটা কাজ হয়েছে।’

‘ব্যাপারটা ঠিক কতটা হতাশা আর বিরক্তির বলে বোঝানো মুশকিল। নিজের আনন্দের জন্যে পর্ন দেখা আর কাজের জন্যে পর্ন দেখা কেমন হতে পারে—এটা ভদ্রসমাজে বলার মতো কোনো বিষয় না। আমি খুব ভালোভাবেই যারা পর্ন শ্যুট করে, এডিট করে, ওদের পেইনটা বুঝতে পারছিলাম। যা হোক শুরু তো করতে হবে। আমি কিছু স্কিপ করে মোস্ট পপুলার দিয়ে শুরু করলাম। মানুষ খড়ের গাঁদায় সুচ খোঁজে, আর আমি পর্নের স্তূপে ক্লু খুঁজছি, তাও আবার এমন কু সেটা আদৌ এখানে আছে কি না আমার নিশ্চিতভাবে জানার কোনো উপায় নেই। এক একটা ভিডিও, এর সঙ্গে এর কমেন্ট সেকশন ইত্যাদি ঘাঁটা। দুই দিন ধরে ঘাঁটতে ঘাঁটতে, ত্যক্ত বিরক্ত অসহ্য হয়ে গেলাম। পুরো ব্যাপারটা বাদ দেব কি না সেটাও ভাবতে শুরু করলাম। এমন সময় মনে হলো এভাবে আসলে হবে না। এভাবে করে টোকন ভাবেনি আমি নিশ্চিত, কারণ এভাবে কিছুই বের করা সম্ভব নয়। টোকন নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যবস্থা করেছে। আমি এবার পর্ন বাদ দিয়ে পর্ন স্টারকে নিয়ে পড়লাম। তার জীবনী থেকে শুরু করে, ইন্টারভিউ ঘাঁটতে শুরু করলাম। এবার খানিকটা আলোর সন্ধান পেলাম। এই মহিলার অন্তত দুটো ইন্টারভিউতে তার পর্ন লাইফের উইয়ার্ড অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছে সে। এই একই ভিডিওর কথা সেই ইন্টারভিউতেও ছিল, যেটা টোকন অনুবাদ করেছে। যেটা আবার টোকন মূল ইন্টারভিউ থেকে বাদ দিয়েছিল। এই ভিডিও খুঁজে বের করতে হবে আমাকে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই ভিডিও একাধিক সাইট ঘেঁটে না পেলেও পেলাম গিয়ে সেই সাইটে, যেটার ক্লু টোকন দিয়েছিল। এবার বুঝলাম টোকন কেন এই সাইট বেছে নিয়েছিল। টোকন খুব বুদ্ধিমান মানুষ ছিল, এটা আমি জানতাম কিন্তু এরকম চাপের মুখে সে যে দুর্দান্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিটা ব্লু সাজিয়েছে এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। আমি সেই ভিডিও কমেন্ট সেকশনের প্রায় হাজার দেড়েক কমেন্টের ভেতরেই খুঁজে পেলাম সেই আরাধ্য জিনিসটা, যেটার  খোঁজে আমি বিগত কয়েকদিন ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি পরবর্তী ক্রু। টোকনের একটা ই-মেইেল আইডি থেকে কমেন্টটা করা হয়েছে। টোকনের এই ই- মেইলে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি। কমেন্টটাও খুবই রিলেট করার মতো। ছয় ডিজিটের একটা নম্বর। নম্বরটা কপি করে সোজা চলে গেলাম সেই রুবিক’স কিউব সাইটের দ্বিতীয় ডাইমেনশনে। নম্বরটা পাঞ্চ করতেই দ্বিতীয় ডাইমেনশনটা খুলে গেল। অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয় ডাইমেনশনের কিউবটা খুলতেই সেটার ভেতরে যা দেখতে পেলাম, এটার জন্যে অন্তত আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভেতরে জাস্ট একটা লোগো। একটা ব্র্যান্ডের লোগো, আমাদের আশপাশে না থাকলেও বিশ্বব্যাপী খুবই পরিচিত একটা ব্র্যান্ডের লোগো। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো এত কাহিনি করে শেষ পর্যন্ত আমি দেখতে পেলাম কি না এমন একটা জিনিস, যা আমাদের আশপাশে তো বটেইএমনকি আমাদের দেশেও নেই,’ বলে জুলহাস বড়ো করে দম নিল। ম্যাকডোনাল্ডের লোগোর সঙ্গে টোকনের এই বিরাট আর বিচিত্র রহস্যের যোগাযোগ কি আসলে?’

আবারো বড়ো করে দম নিয়ে জুলহাস ভিডিওটা পজ করে দিল। টানা কথা বলতে বলতে দম ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু সে সময় দেখে খানিক অবাক হলো। খুব বেশি সময় গেছে যে তা নয়, বরং ওর হিসেবের তুলনায় সময় অনেক কমই গেছে। আসলে টানা কথা বলাও কম কষ্টের কাজ না, বিশেষ করে যারা এভাবে টানা কথা বলায় অভ্যস্ত নয়। শিক্ষকদের জন্যে মনে মনে খানিক মায়াই লাগল জুলহাসের। একটা সিগারেট ধরিয়ে ও উঠে দাঁড়াল। শরীরটাকে টান টান করে আড়মোড়া ভেঙে ধোঁয়া টানতে টানতে আশপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল সব ঠিক আছে কি না। টিভির সামনে এসে রিমোট হাতে নিয়ে অস্থিরভাবে নাড়াচাড়া করল, কিন্তু টিভি ছাড়ল না। মোবাইলটার দিকে তাকিয়েও আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে ধোঁয়া টানা চালিয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে। যা আশা করছে আজ রাতে সে, তার কোনো কিছুই ঘটেনি এখনো। কিন্তু ঘটনা না ঘটলেও ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে ও। এই উত্তেজনার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে।

প্রথম কারণ এই ভিডিওটা। প্রথমত, ও যা বলবে বলে ভেবেছিল ভিডিওটায় বলতে শুরু করার পর মনে হচ্ছে, ভিডিওটা তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে যাই থাকুক না কেন, ওকে সব ডিটেইল বলতে হতো। কারণ যে-উদ্দেশ্যে ও ভিডিওটা বলতে শুরু করেছে সেটা পূরণ করতে হলে এই ডিটেইলিংটার প্রয়োজন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো ও কি আদৌ এই ভিডিও পুরোটা শেষ করতে পারবে ঘটনা ঘটতে শুরু করার আগে। দেখা যাক। আসলে ওর এই ভিডিওটা বানানোর পরিকল্পনা মাথায় এসেছে অনেক পরে, তা না হলে অনেক আগেই এই ভিডিও বানিয়ে ফেলত ও। বিগত কয়েকদিন বলতে গেলে বসেই ছিল ও। যা হয়েছে সেটা ভেবে তো এখন আর লাভ নেই, কাজেই যা হবে করতে হবে। এরপরের অস্থিরতার কারণ হলো, ওর আসলে সত্যিকার অর্থে জানা নেই আজ রাতে কী ঘটতে যাচ্ছে। আর যেই অবস্থার ওপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই সেই অবস্থা নিয়ে উত্তেজনা, ভয়, শঙ্কা কাজ করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে ওসব সেট করা আছে, ঘটনা ঘটতে শুরু করলেই সবার আগে খবর পাবে ও। কাজেই এখন ওর মনোযোগ দেয়া উচিত ভিডিওটা শেষ করাতে। সিগারেটের আগুন মোথার কাছাকাছি পৌঁছাতেই সেটাকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলতে গিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল ও। আরেকটু হলেই সর্বনাশ করতে যাচ্ছিল ও। সিগারেটের মোথাটা উপড়ে পড়া অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে আবারো বসে গেল ও ল্যাপটপের সামনে।

‘ম্যাকডোনাল্ড’ বলে জুলহাস হেসে উঠল সামান্য। তখন ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর লাগলেও, এখন যখন সেই পাজল সমাধানের স্মৃতিগুলোর দিকে ফিরে তাকায় ও খুব বিচিত্র এক অনুভূতি হয় ওর। ম্যাকডোনাল্ডের বিষয়টা তখন খুব সিলি লাগলেও পরে পুরো ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর সেটা আসলে কতটা সিরিয়াস, এটা বুঝতে পারার পর সেই হালকাভাবের ছিটেফোঁটাও আর ছিল না।

‘এত কষ্ট করার পর স্রেফ এই ম্যাকডোনাল্ডের লোগো দেখে বেশ হতাশ হয়ে গেছিলাম প্রথমে। আমি ভেবেছিলাম এই লোগো যেহেতু আছে, এর মানে এখানেই কোনো একটা কু আছে আর সেটা ধরেই আমাকে এগোতে হবে। আর সেই হিসেবেই আমি লোগো নিয়ে পড়ালেখা শুরু করলাম। কোকের লোগো, হুন্দাইয়ের লোগো থেকে শুরু করে অ্যামাজনের লোগো, কত বিচিত্র ইতিহাস আর সিক্রেট মিনিং যে আছে লোগোতে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। হুন্দাইয়ের লোগো যেমন আসলে দুজন মানুষের হ্যান্ড শেইক করার প্রতীকী চিত্র, কিংবা অ্যামাজনের লোগোতে থাকা এ টু জেড তীর চিহ্ন, ইত্যাদি হেনতেন কিছু নেই, যা বাদ রাখলাম কিন্তু ফলাফল লবডঙ্কা। ম্যাকডোনাল্ডের লোগো আর এর ইতিহাসও ঘেঁটে ফেললাম। এমনকি ম্যাকডোনালে ফাউন্ডার রেমন্ড এবং তার জীবনী নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘দ্য ফাউন্ডার’ পর্যন্ত দেখে ফেললাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু মেলাতে পারলাম না। না পারলাম, এক বিন্দু পরিমাণ আগাতে। মনে হলো অন্যদিকে ট্রাই করা উচিত। কারণ, এই পথে আসলে কোনো কাজ হচ্ছে না। এবার শুরু করলাম ম্যাকডোনাল্ডের ব্যবসা এবং বিস্তৃতি নিয়ে, ওদের পলিসি নিয়ে। কিন্তু এ-লাইনেও খুব বেশি কাজ হলো না। কিন্তু ওদের বিজনেস পলিসি নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ওরা আসলে কেন বাংলাদেশে ব্যবসা করে না, এখানে এত বড়ো একটা ক্ষেত্র থাকার পরও। এটার সঙ্গে টোকনের ক্রুর আসলে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তবে এটা ঘাটতে গিয়ে মূল যে-ব্লু সেটার ক্লু পেয়ে গেলাম। ম্যাকডোনাল্ড ইন বাংলাদেশ সার্চ করছিলাম গুগলে। গুগল থেকে পাওয়া বিভিন্ন সাজেশন ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ একটা লিংকে একটা ছবি চোখে পড়ল, ছবিটা দেখে খুব অবাক হলাম আবার, খানিক চেনাচেনাও লাগছিল। ছবিটা অনেক পুরনো একটা স্থাপত্যের। লিংকটাতে ক্লিক করতেই বুঝতে পারলাম কেন আসলে স্থাপত্যটা চেনা চেনা লাগছিল। কারণ স্থাপত্যটা বহুবার চোখে পড়েছে। সত্যি কথা হলো এতবার এতভাবে স্থাপত্যটা দেখেছি যে, ওটা স্রেফ স্বাভাবিকভাবে চোখে সয়ে গেছে, যে- কারণে জিনিসটা বরাবর এবং প্রাত্যহিকভাবে আমাদের চোখের সামনে থাকার পরও আমরা এটাকে স্রেফ দেখতে পাই না। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, জিনিসটা আসলে কোথায় দেখেছি এবং ওটা আসলে কি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *