একটি মুক্ত ভোরের শুরু – ৫

‘প্রথমে আমরা ভার্চুয়াল ধাঁধার পরের অংশটা চেক করি, কী বলেন?’ আরিয়ান বলে উঠল। বাকি দুজনে মাথা নেড়ে সায় জানাল।

জুলহাস ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে ধাঁধার অংশটা আবার ওপেন করল। ‘আপনাদের সঙ্গে মোলাকাতের আগ পর্যন্ত আমি টোকনের ধাঁধাটার প্রথম লেয়ার পর্যন্ত সমাধান করতে পেরেছিলাম। যদিও আমি খানিকটা বলেছি কিন্তু ধাঁধাটা এই পর্যন্ত আসলে কীভাবে সমাধান করেছি সেটার বিস্তারিত বলা হয়নি, কাজেই আমি সংক্ষেপে আপনাদের বলছি। এতে করে দুটো সুবিধা হবে। প্রথমত ধাঁধাটার প্যাটার্নের ব্যাপারে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। সেই সঙ্গে পরবর্তী অংশে সম্ভাব্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হতে পারে বা সম্ভাব্য স্ট্যাটেজি কী হতে পারে সেই ব্যাপারেও খানিকটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।’

‘বুঝতে পেরেছি, কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে এই ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করছি কেন?’ মাথা নেড়ে রাসনা জানতে চাইল। প্রশ্নটা সে করেছিল জুলহাসের দিকে তাকিয়ে কিন্তু তার আগে আরিয়ানই জবাব দিয়ে দিল।

‘কারণ এতকিছুর পরেও আমরা এখনো জানি না আসলে পুরো ব্যাপারটা কী নিয়ে এবং আমরা আসলে কীসের মোকাবিলা করছি। কেন টোকন এবং কামালকে খুন করা হলো, কেন আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারা করছে কিছুই জানি না।’

‘জানার ভেতরে শুধু এটুকু জানি যে একদল করাপ্টেড অফিসার আমাদের ধাওয়া করছে কিন্তু এটাও পরিষ্কার যে এরা স্রেফ ক্রীড়ানক, পুতুল এদের পেছনে কারা আছে এবং মোটিভ কি এসব কিছুই আমরা জানতে বুঝতে বা বের করতে পারিনি। আর এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার একটা সম্ভাব্য উপায় হতে পারে টোকনের এই ধাঁধা।

‘একটা ব্যাপার মনে রাখবেন, এই ধাঁধাই কিন্তু আমাদের এক সঙ্গে নিয়ে এসেছে, আর এই ধাঁধাই আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে,’ বলে সে রাসনার দিকে তাকিয়ে মাথা জানতে চাইল। ‘আপনার কি মনে হয় আমরা ঠিক পথে আছি?’ রাসনা মুখে কিছু না বললেও সে মাথা নেড়ে জবাব দিল ঠিক আছে। কিন্তু তার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে এখনো সে পুরোপুরি কনভিন্সড না।

‘যাই হোক শুরু করি,’ বলে জুলহাস একেবারে প্রথম থেকে কীভাবে ধাঁধাটা শুরু করল, কীভাবে সিকাডা থেকে শুরু করে গ্রিক মন্দির এবং ফ্রি-ম্যাসনদের মিটিং হাউস হয়ে ধাপে ধাপে কীভাবে সে কামালের বই পর্যন্ত জানতে পারল এটা বলে গেল সে বিস্তারিত। তারপর কামালের বই থেকে কীভাবে আরিয়ানের খোঁজ পেল এবং কীভাবে ওদের বের করল সব বলে শেষ করে সে ভার্চুয়াল ধাঁধাটার শেষ ধাপটা দেখাল। ‘আমি এই পর্যন্তই বের করতে পেরেছি।’

‘অসাধারণ,’ কথাটা আপনাতেই বেরিয়ে গেল রাসনার মুখ দিয়ে। ‘আপনার বন্ধু জিনিয়াস ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ বলে সে খানিক বিরতি দিয়ে বলে উঠল। ‘আপনি যা করেছেন সেটারও কোনো তুলনা নেই।’

‘ধন্যবাদ, কিন্তু এর কোনো দামও নেই যদি আমরা পুরো বিষয়টার সমাধান করতে না পারি,’ জুলহাস মাথা নেড়ে দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘আর এখানেই দেখা দিয়েছে আপনাদের ভূমিকা। প্রথমত, ধাঁধার এই পর্যায়ে পরিষ্কার বলা আছে বইটার গল্প এবং এর লেখককে অনুসরণ করতে। আমি জানি না টোকন কি মি. আরিয়ানকে মিন করেছিল না প্রয়াত মি. কামালকে কিন্তু মি. কামাল যেহেতু নেই, মি. আরিয়ানই একমাত্র ভরসা। সেই সঙ্গে,’ বলে সে হাত নেড়ে রাসনাকে দেখাল। ‘আপনি যেহেতু মি. কামালকে খুব ভালো চিনতেন কাজেই মি. আরিয়ানকে কু দিয়ে বা মি. কামালের ব্যাপারে তাকে আরো বিশদ বুঝতে আপনি হেল্প করতে পারবেন,’ জুলহাসের কথা শুনে রাসনা এবং আরিয়ান দুজনেই মাথা নাড়ল।

‘সবই বুঝতে পেরেছি কিন্তু শুরুটা করব আমরা কোথা থেকে? আমি তো গল্পটার কিছুই বুঝতে পারছি না। এটা—’

‘অ্যানিথিং,’ আরিয়ানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জুলহাস বলে উঠল ‘ধাঁধায় বলা হয়েছে গল্পটাকে অনুসরণ করতে। আমরা সেখান থেকে শুরু করতে পারি।’

‘সমস্যা হলো, এটা স্রেফ সাধারণ একটা গল্প, মানে উপন্যাস, এখানে না আছে নম্বর, না আছে অন্য কিছু, যা এরকম একটা ধাঁধার সামাধানে হেল্প করতে পারে। আমার মাথায় কিছুই খেলছে না। গল্প অনুসরণ করা আসলে কী হতে পারে। গল্পের প্লট হতে পারে, চরিত্র হতে পারে…’ আরিয়ান আবারো অসহায়ভাবে মাথা নাড়ল। ‘এখানে হাজারো সম্ভাবনা, হাজারো ভুল হওয়ার সুযোগ,’ তাকে সত্যি সত্যি খুব অসহায় দেখাচ্ছে।

‘এক মিনিট, জুলহাস কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগে তাতে রাসনা থামিয়ে দিল। আমরা একেবারে শুরুতেই হতাশ না হই। ধাপে ধাপে শুরু করি, বলে সে আরিয়ানের দিকে তাকাল। ‘আপনি বলেছিলেন কামালের গল্পটা খুব ছোট এবং সাধারণ ছিল। কিন্তু ধারণাটা ছিল অসাধারণ। আপনি সেটাকে মূল লাইন আপ ধরে নিয়ে আপনার উপন্যাসটা নির্মাণ করেছিলেন।’

হ্যাঁ কামালের গল্পটা ছিল একশ দশ পৃষ্ঠার একটা নভেলা সাইজের লেখা।’

‘আর আপনার উপন্যাসটা প্রায় চার শ পৃষ্ঠার একটা বিরাট উপন্যাস।’

‘সাড়ে চার শ পৃষ্ঠা, টু বি প্রেসাইজ।’

‘এক কাজ করতে পারি আমরা, জুলহাস মাথা নাড়ল। ‘আমি জানি আপনি একজন সাহিত্যিক, আর আমি একজন অঙ্কের মানুষ। আর এখানে গল্পের সাখে অঙ্ক মেলাতে হবে, কাজেই আমরা পরস্পরকে হেল্প করব।’

‘ভেরি গুড,’ আরিয়ান মাথা নাড়ল। ‘আমার একটা আইডিয়া এসেছে, আপনার ওই অঙ্ক আর সাহিত্য মেলানোর বিষয়টা শোনার পর। প্রথমে আমরা গল্পটা আরেকবার শুনি। এরপর কামালের গল্পটার সঙ্গে আমার গল্পটার পার্থক্য যেসব জায়গায় ছিল, সেগুলোকে আলাদা করে, সেখান থেকে কামালের গল্পটার একটা মূল আউটলাইন করব, আর সেই আউটলাইনকে ফলো করে দেখব সেখান থেকে কোনো ক্লু বের করা যায় কি না।’

‘ভেরি গুড, আপনি গল্পটা বলুন আমাদের প্রথমে। আমি নোট নিচ্ছি।’

‘গল্পটা একজন তরুণের, বেশ সফল একজন তরুণ। সে কীভাবে সমাজের রুট লেভেল থেকে উঠে এসে সফলতার চূড়ায় আরোহণ করল মূলত পুরো উপন্যাসজুড়ে সেই যাত্রাই বলা হয়েছে। গল্পটা আসলে খুব অসাধারণ কিছু না, এরকম গল্প হাজারে হাজার আছে। কিন্তু গল্পটার স্বাতন্ত্র্য ভিন্ন জায়গায়।’

‘লেখায়,’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল জুলহাস। ‘কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন কামালের লেখা নাকি একেবারেই ভালো ছিল না।’  

‘না লেখায় নয়,’ আরিয়ান চৌকির ওপরে একটা বালিশ টেনে নিয়ে খানিকটা আরাম করে বসল। ‘নো অফেন্স,’ কথাটা সে রাসনার দিকে তাকিয়ে বলল। ‘কামাল আমার বন্ধু ছিল, তার লেখা দিয়েই আমি বিখ্যাত হয়েছি, কিন্তু সত্যি কথা বলতে সে লেখক ছিল না। তার লেখা নিয়ে খুব বেশি প্যাশনও ছিল না। বরং সে কিছু একটা লেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। কেন আমি তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। আসলে লেখা নয় সে বরং লেখার মাধ্যমে ক্লু দেওয়ার জন্য অস্থির ছিল। যাই হোক, লেখা নয় কামালের গল্পটার স্বাতন্ত্র্য ছিল গল্পটা যেভাবে বলেছে সে সেভাবে। আমি খানিকটা ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিকদের ছাপ পেয়েছি ওটাতে। চা পাওয়া যাবে কি?’ একটু আগে বলে যাওয়া ছেলেটা কি সত্যি বলেছে কি না সেটা যাচাই করার জন্য হালকা করে ডাক দিল তাকে সে, বলতে গেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটা দৌড়ে এসে জানতে চাইল ওদের কিছু লাগবে কি না। ছেলেটার কাছে চা পাওয়া যাবে কি না জানতে চাইলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার দৌড়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা, আরিয়ান আবারো বলতে শুরু করল।

‘গল্পের শুরুটা একটা বাসার ছাদে এবং সেখান থেকে একটা প্রেস কনফারেন্স ইন্টারভিউ দিয়ে। দেশের প্রতিষ্ঠিত এক তরুণ ব্যবসায়ী এশিয়ার তরুণ ব্যবসায়ীদের ভেতরে অন্যতম এবং সে সম্প্রতি এশিয়ার তরুণ উদ্যোক্তাদের সেরা একজন হিসেবে পুরস্কার অর্জন করাতে সেই পুরস্কার আনতে সে বিদেশে পাড়ি দেবে। তার আগে প্রেস কনফারেন্স করছে। সেই প্রেস কনফারেন্স করে সে এসে গাড়িতে ওঠে। সেই গাড়িতে করে প্রেস ক্লাব থেকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে একটা একটা জায়গা চোখে পড়ে আর সেই জায়গাগুলো নিয়ে এক একটা স্মৃতি তার মানসপটে ভেসে ওঠে। এর ভেতরেই প্রেম, ছাত্র আন্দোলন, ধর্মীয় ইস্যু, থেকে শুরু করে বলতে গেলে প্রায় পুরো নব্বইয়ের দশকটা উঠে এসেছে পুরো উপন্যাসে।’

‘গল্পটা সুন্দর,’ জুলহাসের কথাটা শুনে আরিয়ান আরেকটু হলেই ধন্যবাদ জানাতে যাচ্ছিল, যা সে করে এসেছে উপন্যাসটা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে, কিন্তু এবার আর করল না, ধন্যবাদটাকে ঢোক গিলে পেটের ভেতরে চালান করে দিল। জুলহাস জানতে চাইল, ‘আপনি তো মনে হয় বেশ অনেক জায়গাতেই পরিবর্তন করেছেন। বিশেষ কোন কোন জায়গা বলতে পারবেন?’

‘মোটামুটি বলতে পারব। প্রথম পরিবর্তন যেটা আমি করেছি সেটা হলো কামাল মূল চরিত্রটাকে দেখিয়েছিল একজন তরুণ পরিচালক মানে সিনেমা নির্মাতা হিসেবে কিন্তু আমি সেটাকে পরিবর্তন করে একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে দেখিয়েছি। কামালের গল্পটা ছোট ছিল এবং সেটা ছিল আর্লি টু থাউজেন্ডের শিল্প সাহিত্যের মুভমেন্ট নিয়ে। আমি সেটাকে পরিবর্তন করে অনেক বেশি বাস্তবিক করতে চেয়েছি মানে, রাজনৈতিক ও ব্যাবসায়িক প্রেক্ষাপট দেখাতে চেয়েছি। আর সেকারণেই আমার কাছে মনে হয়েছে আমি বাস্তবিকভাবে সময়টাকে তুলে আনতে চাইলে সিনেমা নির্মাতা কিংবা সাহিত্যক দেখানোর চাইতে আমি যদি তরুণ উদ্যোক্তা দেখাতে চাই সেক্ষেত্রে একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলের স্ট্রাগল অনেক বেশি ভালোভাবে তুলে ধরতে পারব সেই সঙ্গে এটার বাস্তবিক অ্যাঙ্গেলটাও অনেক বেশি পরিষ্কার হবে।’

‘বুঝলাম, কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো এটা থেকে কী এমন ক্লু বের করা সম্ভব হতে পারে যেটা দিয়ে আমাদের এই ধাঁধার সমাধান করা সম্ভব হবে,’ রাসনা কথাটা বলে শেষ করার আগেই সেই ছেলেটা ঘরে ঢুকল এক হাতে ছোট একটা ফ্লাস্ক আর তিনটা ছোট প্লাস্টিকের কাপ হাতে নিয়ে।

‘বাহ দারুণ, চা চলে এসেছে,’ আরিয়ান আধ বসা থেকে উঠে বসে আন্তরিক খুশি হয়ে ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানাল। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জুলহাস একবার বাইরে দেখে নিল। ভোর হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। বড়জোর আর কয়েক ঘণ্টা। এর ভেতরেই এই ধাঁধার সমাধান না করলে বিপদ। ‘আপনি আমাদের কি কোনোভাবে হেল্প করতে পারেন,’ জুলহাস রাসনার দিকেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিল। ‘আমি তো তাকে চিনতামই না কোনোভাবে, আর আমার ধারণা আরিয়ান সাহেব তার বন্ধু হলেও আসলে সেভাবে তাকে চিনতে পারেনি। কাজেই—’ বাক্যটা শেষ না করে সে কাঁধ ঝাঁকাল।

তার দেখাদেখি কি না কে জানে রাসনাও কাঁধ ঝাঁকাল। ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি তাকে ভালোভাবেই চিনতাম, হয়তো মি. আরিয়ানের চেয়েও বেশি কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমাদের সম্পর্কের সময়সীমাও আসলে খুব বেশি ছিল না। আর কামাল খুব ঠান্ডা ধরনের কম কথা বলা টাইপের মানুষ ছিল। তার ভেতরে এমন এক সময় ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল যখন সে ছিল একেবারেই ভিন্ন ধরনের এক বিপদে। আর এই বিপদের কথা সে এমনকি আমাকেও বলেনি। ঠিক যেমনটা আপনার বন্ধু টোকন আপনাকে বলেনি,’ জুলহাস তার কথা শুনতে শুনতে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

‘তবে আপনি যখন গল্পটা বলছিলেন,’ কথাটা সে আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল। আমি খুব ভালোভাবে কানেক্ট করতে পারছিলাম, কামাল এরকম একটা গল্প লিখেছে এটা বেশ বিশ্বাসযোগ্য। কারণ আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি মূল চরিত্রটা অনেকটা ওর মতোই। বরং ওর জীবন আরো অনেক বেশি কঠিন ছিল। ওর কোনো পরিবার ছিল না, একটু ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মানুষ ছিল সে, আর তাই খুব বেশি বন্ধুবান্ধবও হতো না ওর। বাইরে থেকে লোকে ওকে ভুল বুঝত। ওকে ঠান্ডা হৃদয়ের মানুষ ভাবত, কিন্তু বাস্তবিকভাবে ভেতরে ভেতরে সে বেশ ইমোশনাল ধরনের মানুষ ছিল। এতিমখানা থেকে উঠে এসে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেছে কিন্তু এ-নিয়ে ওর ভেতরে তেমন কোনো অহংবোধ তো ছিলই না, তার ওপরে এ-ধরনের বেশির ভাগ ছেলেরা যেমন হয়, প্রচুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে,’ এই কথাটা বলে সে জুলহাসের দিকে দেখে নিয়ে মৃদু হাসল। আমি বলছি না যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকাটা খারাপ। আমি বলছি কামালের ছিল না। বরং সে কেমন জানি অতীতে বসবাস করা ধরনের মানুষ ছিল সে। তার এতিমখানা, পুরনো ছোট ছোট স্মৃতিগুলোকে খুব মূল্যায়ন করত সে, খুব মনে করত সবার কথা। বিশেষ করে কবে কোন জায়গাতে সে বড়ো হয়েছে, কোন জায়গাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হয়তো সামান্য আড্ডা দিয়েছিল সেসব প্রতিটা স্মৃতিও সে মনে করত। ছোট থেকে ছোট বিষয়গুলোও ভুলত না।’

রাসনার কথা শুনে আরিয়ানও মৃদু হেসে উঠল। ‘হ্যাঁ, এটা একদম ঠিক, এমনকি আমার সঙ্গে স্বল্প পরিচয়েও কামাল যে-পরিমাণ স্মৃতিকাতরতা দেখাত সেটা বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব।’

‘সেটা এই কারণেই তার উপন্যাসে সে একটার পর একটা জায়গা আর সেই জায়গাগুলোকে ঘিরে স্মৃতি বর্ণনা করে মূল চরিত্রের জীবনের এক একটা অধ্যায় সে বর্ণনা করবে এটা কামালের জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর—’

‘এক মিনিট,’ আরিয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটা ভেবে বোঝার চেষ্টা করছে। ‘আচ্ছা এই ধাঁধাটায় কয়টা ধাপ?’

জুলহাসও আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে, ‘চারটা, মানে প্রথম ধাপে চারটা ছিল এর পরের ধাপে আরো চারটা। আপনি কি—’

আরিয়ান সোজা হয়ে উঠে বসেছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে কিছু একটা নিয়ে। ‘দুটো ব্যাপার, সে নিজের আঙুল তুলে বলে উঠল। ‘প্রথমত, আপনি জানতে চেয়েছিলেন না আমি মূল গল্পটা থেকে আমার উপন্যাসটাতে কী পরিবর্তন করেছিলাম, মূল চরিত্রের পর সবচেয়ে বড়ো যে- পরিবর্তনটা আমি করেছিলাম সেটা ছিল, মূল গল্পে প্রধান চরিত্র যে স্মৃতিচারণাটা করে সেটা ছিল মূল চারটা জায়গাকে কেন্দ্র করে।

‘আচ্ছা, কিন্তু—’

‘তার চেয়েও বড়ো আরেকটা কথা হলো,’ আরিয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে সে দারুণভাবে নিশ্চিত এই বিষয়ে। ‘আপনি আবারো বলেছিলেন যে এটা এমন একটা ধাঁধা যেখানে সাহিত্য আর আতঙ্কে একসঙ্গে মেলাতে হবে,’ বলে সে বড়ো করে একবার দম নিল। ‘পুরো উপন্যাসে স্রেফ চার জায়গাতে চারটা নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে, আর সেই চারটা নম্বরও এই চারটা জায়গাকে কেন্দ্র করে,’ বলে আরিয়ান মৃদু হাসি দিয়ে জুলহাস আর রাসনার দিকে দেখল।

.

‘কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে কোথাও থেকে?’ টকটকে লাল চোখে সিগারেটের ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে রহমানের চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে জোনায়েদের ছোটবেলায় নানির মুখে শোনা একটা কথা মনে পড়ে গেল। আগে গ্রামদেশে রাতের বেলা একটা পাখি আসত। সাধারণত বাড়ির কোনে বসে কু কু ডাক ছাড়ত। এই পাখিটাকে কেউ পছন্দ করত না। নানি বলত, এইটা অলক্ষুণে পাখি, কখনো এইটার চোখের দিকে তাকাবি না। এর পেছনে মূল কারণ ছিল এই পাখিটার চোখদুটো ছিল অস্বাভাবিক টকটকে লাল। আর এই পাখির চোখ নিয়ে গ্রামদেশে প্রবাদও ছিল, বিশেষ করে টকটকে লাল চোখের মানুষের অশুভ দৃষ্টিকে পাখিটার নামে বলা হতো ‘কুক্কার চোখ।

বহুদিন পর রহমানের টকটকে লাল চোখের দিকে তাকিয়ে জোনায়েদের মনে হয় একেবারে পারফেক্ট কুক্কার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। ‘না, স্যার,’ আপনাতেই সে একবার দেখে নিল চারপাশে। কন্ট্রোল সেন্টারে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসা অন্তত পনেরো জন কাজ করছে এই মুহূর্তে। কমিউনিকেশন কন্ট্রোল সেন্টারের ভেতরে সিগারেট খাওয়া বারণ, এখানে ফায়ার অ্যালার্মের জায়গায় পলিথিন প্যাচিয়ে সেটাতে টেপ মেরে দেওয়া হয়েছে যাতে এখানে তারা সিগারেট টানতে পারে। মূল কন্ট্রোল সেন্টারের বাইরের এটা ছোট কিন্তু বেশ পাওয়ারফুল একটা কমিউনিকেশন সেন্টার যেটা বিশেষ অপারেশনের সময় ব্যবহার করা হয়। জোনায়েদ মনে মনে ভাবছে খোদা জানে রহমান কীভাবে এটার জন্য অনুমতি আদায় করেছে। মাঝরাতে সব কমিউনিকেশন এক্সপার্টদের তুলে আনা হয়েছে তাদের বাড়ি থেকে। সিগারেট কফি, পিজ্জা থেকে শুরু করে খাবার দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হয়েছে পুরো কমিউনিকেশন রুম। কর্মীদের অনেকে গাঁইগুই করছিল কিন্তু যেই মুহূর্তে রহমান ঘোষণা করেছে কাজ করতেই হবে, সেই সঙ্গে যে-কেউ প্ৰথমে লেখক আরিয়ান শফিক এবং তার সাথিদের কারো খোঁজ বের করতে পারবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে তিন লাখ টাকা দেওয়া হবে, সবাই চুপ করে কাজে লেগে গেছে। একই কথা প্রযোজ্য মাঠ লেভেলের ইনফরমারদের জন্য।

একচুয়াল আর ভার্চুয়াল দুই জগতেই হাজারো লোক হন্যে হয়ে খোঁজ করছে লেখক এবং তার সঙ্গীদের এই মুহূর্তে। জোনায়েদ না বলেও তাকিয়ে আছে রহমানের দিকে। না শোনার পরও রহমান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। নীরবে সিগারেট টেনে গেল সে কিছুক্ষণ তারপর শেষ হয়ে আসতে থাকা সিগারেটের মোথাটা সামনে রাখা শেষ হয়ে আসা কফির কাপে ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে নামল সে টেবিলের ওপর থেকে। কমিউনিকেশন রুমের ছোট পরিসরে সে পায়চারি করতে শুরু করল। জোনায়েদ ভেবেছিল সে রাগ দেখাবে অথবা নতুন কোনো নির্দেশনা দেবে। কিন্তু যখন সে মুখ খুলল এবং যা বলল খুবই অবাক হয়ে গেল। ‘ডোন্ট ওরি জোনায়েদ, খোঁজ ওদের পাওয়া যাবেই,’ জোনায়েদ অবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভাবল কথাগুলো কি রহমান ওকে শোনাল নাকি নিজেকে। সে কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় জানাল।

‘খোঁজ পাওয়া যাবেই, একই কথার পুনরাবৃত্তি করল সে। ‘হয় ওরা কোনো না কোনো ভুল করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেবে, আর না হয় আমাদের গ্রাউন্ড ফোর্স কোনো না কোনোভাবে ওদের বের করে ফেলবে। স্রেফ সময়ের ব্যাপার। তবে তার আগে বেশ কিছু কাজ আছে,’ বলে সে একজন কমিউনিকেশন কর্মীকে ইশারা করে লিস্ট আনতে বলল। তারপর তারা কীসের ওপরে নজর রাখছে সেগুলো শুনে গেল চুপচাপ। সঙ্গে কিছু নির্দেশ দিল। কর্মীটা চলে যেতেই সে জোনায়েদের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘কাল আধাবেলার ভেতরে আরিয়ান শফিকের বইটা যেন বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। কালরাতের ভেতরে ঢাকার সব কপি সরিয়ে ফেলা হয় যেন মার্কেট থেকে। বাকি সাতদিনের ভেতরে দেশের এবং ইন্টারনেটের সব কপি। সেই সঙ্গে,’ বলে সে খানিক থামল। ‘লেখকের ইমেজের বারোটা তো বেজেছে খানিক, এটাকে পুরোপুরি পোক্ত করাতে হবে। কীভাবে করা হবে, শোন,’ বলে জোনায়েদকে বিস্তারিত বলে গেল সে। ‘ওদের যেকোনো একটা অপশন বেছে নিতে হবে। এটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দাও। আর আরিয়ানদের একটা ভুল করতে দাও, স্রেফ একটা ভুল,’ বলে সে হাত মুঠো করে ফেলল। ‘স্রেফ একটা ভুল।’

‘প্রথমেই যে-জিনিসটা আমাদের প্রয়োজন হবে,’ জুলহাস দারুণ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল। ‘সেই চারটা ঠিকানা আর নম্বরগুলো, আমরা প্রথমে সেগুলো লিস্ট ডাউন করব। তারপর একটা একটা করে সেগুলোবে ভার্চুয়াল কিউবগুলোতে এন্ট্রি দেব, কী বলেন?’

‘না,’ আরিয়ান মাথা নাড়ল। ‘আপনি যেটা বলছেন সেটা ভালো পন্থা, কাজ এগোনোর জন্য। কিন্তু এতে একটা সমস্যা আছে। সেটা হলো প্রথমত, আমরা জানি না, এই নম্বর কিংবা ঠিকানাগুলো আদৌ এই ধাঁধা সমাধানে কাজ করবে কি না। এটা আমার স্রেফ একটা অনুমানমাত্র। আর তার ওপরে, সব ঠিকানা আর নম্বর আমার মনেও নেই। কাজেই প্রথমেই সব ঠিকানা আর নম্বরের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট না করে বরং আমাদের উচিত প্রথমে একটা যাচাই করে দেখা, যদি তাতে কাজ হয় তাহলে পরেরগুলো ট্রাই করা। আর প্রথমটাতে কাজ না হলে ভিন্ন পন্থা যাচাই করা। আপনি কি বলেন?’ আরিয়ান প্রশ্নটা উচ্চারণ করেছে রাসনার দিকে তাকিয়ে।

‘আমার মনে হয় মি. আরিয়ান ঠিকই বলছেন, রাসনাও মাথা নেড়ে সায় জানাল।

‘ফেয়ার এনাফ, তাহলে আমরা একটা দিয়েই শুরু করি,’ সে ল্যাপটপটা ওদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজেও খানিকটা ঘুরে বসল। ভার্চুয়াল ধাঁধাটা ওপরে করে দ্বিতীয় সারির প্রথম কিউবটাতে ক্লিক করতেই সেটা খুলে দিয়ে তাতে তিন ডিজিট এন্ট্রি দেওয়ার মতো পাশাপাশি তিনটা বক্স ওপেন হয়ে গেল। প্রথম বাক্সটাতে কারসর রিংক করছে। ‘কি মনে হয়—’ প্রশ্নটা শেষ না করেই জুলহাস থেমে গেল। ‘প্রশ্ন হলো, আপনার যদি ঠিকানা আর নম্বরগুলো মনেই না থাকে তবে কীভাবে—’

‘আমি বলেছি চারটা ঠিকানা আর সেগুলোর সব মনে নেই, কিন্তু প্রথমটা আমার মনে আছে, কারণ কামালের এবং আমার দুটো উপন্যাসেই মূল চরিত্র প্রেসক্লাব থেকে রওনা দেওয়ার পর প্রথম যে—জায়গাটা ক্রস করে সেটা ছিল টিএসসি, আর এখান থেকেই স্মৃতিচারণা শুরু হয়। প্রথম ঠিকানাটা ছিল আসলে টিএসসির একটা রুম যেখানে উপন্যাসের মূল চরিত্র এবং তার বন্ধু-বান্ধবেরা আড্ডা দিত। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে গল্পের নায়ক এবং তার প্রেমিকা দুজনেই একটা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং সেই কামরায় ওরা নানা ধরনের সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের রিহার্সেল করত। ওই কামরায় দুজনের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দুটো গল্প মানে, কামাল এবং আমি আমাদের দুজনারই উপন্যাস। এই কারণেই আমার কামরাটার নম্বর পরিষ্কার মনে আছে। এমনকি দুটো উপন্যাসে একই নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে,’ বলে মুদৃ থেমে সে যোগ করল, ‘নম্বরটা তিন ডিজিটের,’ বলে সে নম্বরটা বলে গেল আর জুলহাস সেটাকে এন্ট্রি দিল ক্লিক করতে থাকা বক্সগুলোতে। ডিজিট তিনটাই এন্ট্রি দিয়ে তিনজনেই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে এবং ওদের খুশির সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে আনলক হয়ে গেল প্রথম কিউবটা।

‘সর্বনাশ! এ তো কাজ করছে,’ আরিয়ান সত্যি সত্যি অবাক হয়েছে ডিজিট তিনটা কাজ করাতে। ‘ভেতরে কী আছে?’

জুলহাস কিউবটা ওপেন করে ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ভেতরে একটা লিংক দেওয়া।’

‘কীসের লিংক, ওপেন করছেন না কেন?’ রাসনা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, যদিও আসলে বলার প্রয়োজন ছিল না, কারণ জুলহাস এরই মধ্যে লিংকে ক্লিক করে দিয়েছে। লিংকটাতে ক্লিক করতেই একটা পোর্টাল ওপেন হয়ে গেল। ‘একটা খবরের লিংক,’ আরিয়ান বলে উঠল, তিনজনেই তীব্র মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। ‘ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ার নিউজ, ২০১৬ সালের,’ বলে তিনজনেই নিউজটা পড়তে শুরু করল। খুব বড়ো নিউজ না, তাই পড়তে খুব বেশি সময় লাগল না এবং তিনজনেই নিউজটা পড়ে শেষ করল প্রায় কাছাকাছি সময়ে। নিউজটা পড়ে শেষ হতেই তিনজনেই একে অপরের দিকে ফিরে তাকাল অবিশ্বাসের সঙ্গে। তিনজনের ভেতরে আরিয়ানই কথা বলে উঠল প্রথমে। ‘এর অর্থ কি?’ জুলহাস অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল, রাসনার অবস্থাও প্রায় কাছাকাছি। আরিয়ান আবারো কিছু বলার আগেই জুলহাস বলে উঠল, ‘কিউবটাতে আরো কয়েকটা লিংক আছে,’ অন্য কেউ প্রশ্ন করার আগেই আবারো সে বলে উঠল, সবগুলো একই খবরের নিউজ, কোনটা দেশি কোনটা বিদেশি। সবগুলো নিউজের বক্তব্যও একই। কিন্তু এর অর্থ কি?’

‘আমার জানা নেই,’ বলে আরিয়ান আবারো স্ক্রিনের দিকে ফিরে তাকাল। সেখানে প্রথম খবরের লিংকটাই ওপেন করা। ‘২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ফরিদপুরের শিবরাম রোড অ্যাকাডেমি স্কুলে হঠাৎ করেই একজন শিক্ষার্থী নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়ে অস্বাভাবিক বোধ করতে শুরু করে। একরকম বলতে গেলে অজ্ঞাত কারণেই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো তার অসুস্থ হওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরেই স্কুলের আরো প্রায় চল্লিশজনের মতো শিক্ষার্থীও প্রায় একই উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে স্কুলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাচ্চাদের একাডেমিক ভবন থেকে সরিয়ে মাঠে নেওয়া হয়, এরপর তাদের স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরও তাদের নির্দিষ্ট কোনো রোগের কারণে এমনটা হচ্ছে ডাক্তাররা সেটা ধরতে পারেনি। বাচ্চাগুলো সুস্থ হয়ে উঠলে পরে এ-নিয়ে আর খুব বেশি মাথাও ঘামানো হয়নি, কিন্তু,’ বলে আরিয়ান থেমে গেল। ‘পরদিন একই উপজেলা সদর এবং আশপাশের এলাকা তো বটেই এমনকি জেলা সদরেও বিভিন্ন স্কুলে ম্যাস হিস্টিরিয়া দেখা দেয় এবং সমানে প্রায় একই ধরনের লক্ষণ নিয়ে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার ধারণ করে যে, কর্তৃপক্ষ কী করবে বুঝতে না পেরে প্রায় ষাটের কাছাকাছি স্কুল প্রায় একই সময়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।’

আমার ঘটনাটা মনে আছে,’ রাসনা বলে উঠল।

‘তারপর কী হয়?’

‘আরিয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে চলল, ‘এরপর আর কিছু হয়নি, কিছুদিনের ভেতরে সব ঠিক হয়ে এলে এ-নিয়ে আর কেউ কিছু বলেনি, ধীরে ধীরে পত্রিকাগুলোও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু কী কারণে এমনটা হয়েছিল আর জানা যায়নি, কেউই বেরও করতে পারেনি। কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের ব্যাখ্যা দিলেও সঠিকভাবে কিছুই জানা যায়নি। এই হলো সবগুলো নিউজের মর্মার্থ।’

‘এই ঘটনার সঙ্গে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সংযোগ কী?

‘নো আইডিয়া,’ আরিয়ান খানিকটা অসহায়ভাবেই রাসনা আর জুলহাসের দিকে দেখল। ‘আমার মনে হয় পরে কিউবটা ট্রাই করা উচিত আমাদের। হয়তো সেখানে যা পাওয়া যাবে, তাতে পুরো বিষয়টা কিছুটা সেন্স মেইক করতে পারে।’

‘আপনার কি দ্বিতীয় ঠিকানাটা মনে আছে?’

‘না, মনে নেই, এটুকু মনে আছে ওটা কাওরান বাজারের ওদিককার একটা মেসের ঠিকানা ছিল। কামালের গল্পে শাহবাগের কাহিনি শেষ হওয়ার পর মূল চরিত্রের গাড়ি ধীরে ধীরে পরীবাগ পার হয়ে কাওরান বাজার দিয়ে এগোতে থাকে, ওইখানে শুরু হয় গল্পের দ্বিতীয়ভাগ। ওখানে মূল চরিত্র একটা মেসে থাকত, সেখানে তার জীবনের স্ট্রাগল তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি উঠে এসেছে।’

‘ঠিকানাটা নির্দিষ্টভাবে পাব কীভাবে?’

‘কামালের বইটা আমার ড্রপ বক্স কিংবা ই-মেইলে পাব আশা করি।’

আরিয়ান কথা শেষ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জুলহাস ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে দিল আরিয়ানের দিকে। আরিয়ান ল্যাপটপটা নিয়ে প্রথমে ড্রপবক্সে লগ ইন করল। জুলহাস রাসনার অনুমতি নিয়ে সিগারেট ধরাতেই আরিয়ানও একটা চাইল। ঠোঁটে সিগারেট লাগিয়ে ড্রপ বক্স তন্নতন্ন করে খুঁজেও সে পেল না ফাইলটা। ‘আমি তো পাচ্ছি না। সে কি আজকের কথা নাকি?’

‘কামাল আপনাকে লেখাটা দিয়েছিল কীভাবে? হার্ড কপি নাকি ই-মেইলের মাধ্যমে?’ রাসনা জানতে চাইল। সে আরেক কাপ চা ঢেলে নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন করল।

‘এটা ভালো প্রশ্ন, কারণ এর মাধ্যমে ফাইলটা সম্ভাব্য কোথায় থাকতে পারে সে-বিষয়ে একটা জবাব পাওয়া যেতে পারে,’ আরিয়ান বলে উঠতেই রাসনা মৃদু হাসি দিল। এর অর্থ সে প্রশ্নটা করেছে এই উদ্দেশ্যেই। ‘আরিয়ান বলে চলেছে। ‘কামাল আমাকে হার্ড কপিতে দেয়নি। সে আমাকে ফাইলটা ই-মেইেল করেছিল। কাজেই ই-মেইলে ফাইলটা পাওয়া যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। আরিয়ান ল্যাপটপ নিয়ে নিজের কাজ করছে, জুলহাস আরো আগেই সিগারেট হাতে উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানালার কাছে। বাইরে এখনো একেবারেই অন্ধকার। কিন্তু দূর- দিগন্তে খুব হালকা একটা লালচে আলোর রেখা দেখা দিয়েছে, সে বুকের গভীর থেকে উঠে আসা হাই চেপে গিয়ে মুখ খুলল কিছু একটা বলার জন্য, কিন্তু তার আগেই বাইরে ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা গেল। আজান শেষ হতে হতে আরিয়ান প্রায় চিৎকার করে জানান দিল, ‘পেয়েছি।’

‘ভেরি গুড,’ হাতের শেষ হয়ে আসা সিগারেটের মোথাটা মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল জুলহাস। ‘আপনি ঠিকানাটা বের করুন, আমি সেটাকে কিউবে এন্ট্রি দিচ্ছি দেখা যাক এই আজব-গজব ধাঁধা এবার কি বয়ান করে।

.

কমিউনিকেশন রুমটা সাউন্ডপ্রুফ হলেও আজানের ধ্বনি শোনা গেল একেবারেই পরিষ্কার। রহমান তো বটেই এমনকি বাকিরাও অবাক হয়ে ফিরে তাকাল আজানের উৎসের দিকে। একজন কমিউনিকেশন কর্মীর মোবাইলে আজান বাজছে। লোকটা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই অফিসার রহমান উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল জোনায়েদের দিকে। সে ধকলে অভ্যস্ত, বিনিদ্র রাত্রি তার জন্য একেবারেই অভ্যস্ত একটা ব্যাপার। কিন্তু তাকে কাহিল করে ফেলেছে স্ট্রেস এবং টেনশন। তবে ব্যাপার না, সে এটাতেও অভ্যস্ত। একটা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে জোনায়েদ মোবাইল টিপছিল, রহমান তার পেছনে গিয়ে কাঁধে একটা হাত রাখল। ‘কি ঘুম পাচ্ছে?’ জোনায়েদ খুব অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। রহমানের জন্য এটা একেবারেই স্বাভাবিক কোনো আচরণ না, লোকটা কি পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি। সে এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে যে জবাব দিতে চাইলেও মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। ‘কি ক্লান্তি লাগছে?’ বলে সে জোনায়েদের কাঁধে একটা চাপড় মারল। ‘চল, বাইরে যাই, ভোরের খোলা হাওয়ায় মাথাটাকে খানিক পরিষ্কার করা যাবে।’

‘জি স্যার।’

দুজনে মিলে বাইরে বেরিয়ে এসে কমিউনিকেশন রুমের বাইরের ঠিক লনে এসে দাঁড়াল। বাইরে এখনো অন্ধকার তবে আজান শেষ হয়েছে সেই সঙ্গে আকাশে খুবই সূক্ষ্ম এবং হালকা একটা আলোর রেখা ফুটে উঠতে শুরু করেছে। দুজনে বাইরে এসে দাঁড়াতেই রহমান সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা ধরিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল জোনায়েদের দিকে। জোনায়েদের আরেকটু হলে চোয়াল ঝুলে যেত, সে আসলেই পুরোপুরি ধরতে পারছে না, লোকটার আজ হলো কি। ‘স্যার আমি—’

‘ঢং বাদ দাও জোনায়েদ, আমি জানি তুমি সিগারেট খাও। ধরাও,’ জোনায়েদ বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে সিগারেট বের করতে গিয়ে দেখল প্যাকেটে আর দুই-তিনটা সিগারেট অবশিষ্ট আছে, লোকটা সারারাত উন্মাদের মতো সিগারেট টেনেছে। জোনায়েদ সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে লাগাতেই রহমান সেটা ধরিয়ে দিল।

‘স্যার, কি মনে হয় আমরা কি ওদের সন্ধান পাব?’ সিগারেটে কষে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জোনায়েদ প্রশ্ন করল রহমানকে। সারারাত ব্যাপক সিগারেটের নেশা পেলেও বেরও হতে পারেনি, সিগারেটও খাওয়া হয়নি।

‘ভুল প্রশ্ন জোনায়েদ,’ রহমান মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলে উঠল। ‘সন্ধান ওদের পাওয়া যাবেই, ওদের ট্রেস করা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। আমি ভাবছি ভিন্ন কথা। ভাবছি—’ বলে সে বাক্যটা শেষ না করে থেমে গেল। জোনায়েদও কিছু না বলে তাকিয়ে আছে। ‘–আচ্ছা জোনায়েদ, আমাকে তোমার কেমন মানুষ মনে হয়? রহমান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে জোনায়েদের দিকে।

জোনায়েদ হাসে এটা রহমানের একটা ট্রিকস। রহমান যখন এ-ধরনের প্রশ্ন করে তখন বিপদ দুদিক থেকেই সঠিক উত্তর সে আসলে চায় না। আর ভুল উত্তর দিলে তাকে আরো শক্ত করে ধরবে, সে কারণেই জোনায়েদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কী বলবে। ‘ভালো না স্যার,’ জোনায়েদের জবাব বের হতেই রহমান এমনভাবে হেসে উঠল তার মুখের ভেতর থাকা ধোঁয়া ফক করে খানিকটা বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে, বাকিটা আটকে কাশি চলে এলো তার। রহমান হাসি আর কাশি মিলিয়ে বিচিত্র এক শব্দ করল কতক্ষণ। তাতে কী স্যার, আমিও তো ভালো না,’ রহমান হাসলেও জোনায়েদ ঠান্ডা দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে রহমানের দিকে।

‘একটা বিষয় কী জানো জোনায়েদ, আমি হলাম পুরোপুরি বাস্তববাদী মানুষ। একেবারে গরিব পরিবারের সন্তান আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সময়ে পরিষ্কার বুঝে গেছিলাম জীবনে আমি আসলে কী চাই। জীবনে আমার তিনটা জিনিস দরকার: প্রচুর টাকা, প্রচুর ক্ষমতা আর একটা পরিবার। আর আমাদের দেশে এইসব ঠিকঠাক পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ভালো একটা সরকারি চাকরি। যেই ধর্মভীরু মানুষের দেশে মসজিদ আর মন্দিরের সামনে থেকে সবচেয়ে বেশি জুতা চুরি হয়, সেই দেশের মানুষের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা স্রেফ বিলাসিতা, কারণ কী জানো যেই মাদারচোতটা করাপশন নিয়ে সবচেয়ে বেশি লেকচার দেয় সেই ব্যাটাই প্রকাশ্যে তার এলাকার তূলনামূলক দরিদ্র সরকারি কর্মচারীকে বোকচদ বলে গালি দেয় আর সম্পদশালী বাড়ি-গাড়ির মালিক অসৎ লোকটাকে সালাম দেয়, সমাজের হিরো মনে করে। কাজেই এ-দেশের মানুষের দুর্নীতিকে দোষারোপ করা স্রেফ চায়ের দোকানের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। যে- সেক্টরেই থাক না কেন, এই দেশে ওপরে উঠতে হলে চাটতে হবে, গলা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে যেতে হবে। সেভাবেই আমি জীবন আর ক্যারিয়ার গড়েছি,’ বলে রহমান কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আমার কোনো আফসোস নেই।’

বলে রহমান কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানল। ‘সাহিত্য-ফাহিত্য নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই, নীতিকথা মানা তো দূরে থাক, ওগুলোর প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধও নেই। কিন্তু তোমার ভাবির আবার এগুলোর দিকে খুব ঝোঁক, সে মাঝেমধ্যে কিছু জিনিস পড়ে শোনায়, ভালোই লাগে। কবি নজরুলের একটা কবিতা নাকি আছে যেখানে সে বলেছে আমরা সবাই অন্যের পাপ মাপি নিজের পাপের বাটখারা দিয়ে। কথাটা কিন্তু সত্যি, তবে আমার জন্য না। আমি জানি আমি কি, আর এ-নিয়ে আমার কোনো মর্মপীড়াও নেই। কিন্তু পাপের একটা সমস্যা কী জানো, পাপ হলো শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করার মতো একটা বিষয়। তুমি যা চাইবা শয়তান তোমারে সব দেবে, কিন্তু কোনো একদিন সে এসে তোমার আত্মা চাইবে, সেদিন তোমার আর বাঁচার উপায় নাই, পালাবার কোনো পথ নাই, ‘ বলে সে সিগারেটে টান দিয়ে মোথাটা ছুড়ে ফেলে দিল।

‘তোমারে এত কথা ক্যান শোনাইলাম জানো। আজ রাত আমার সেই রাত,  শয়তান তার আত্মা চায়, কিন্তু আমি দেব কি দেব না, সেইটা আমার সফলতার ওপরে নির্ভর করতেছে। আর তুমি আজকে আমার ডান হাত, জোনায়েদ দেখল রহমানের দৃষ্টি চলে গেছে অনেক দূর। ‘আজ রাতে আমি যা বলি সেভাবে করো, জীবন বদলাইয়া যাবে,’ রহমান কথা বলতে বলতে হঠাৎ হঠাৎ তার সুরে স্থানীয় টান চলে আসছে। ‘আজকের দিন টিকে গেলে জীবন বদলে যাবে। ধরা ওরা পড়বেই, কিন্তু আমি ভাবতেছি ওদের কীভাবে—’

পেছন থেকে কারো দৌড়ে আসার শব্দ শোনা গেল। দুজনেই ফিরে তাকিয়ে দেখল, আজান বাজছিল যে কর্মীর সে দৌড়ে আসছে ওদের দিকে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে উঠল, ‘স্যার, একটা ট্রেস পাওয়া গেছে। লেখক আরিয়ান শফিকের পুরনো একটা ই-মেইলে কেউ একজন লগ ইন করেছে।’

‘লোকেশন বের করেছ?’

‘এখনো না, তবে আর কয়েক মিনিটের ভেতরে হয়ে যাবে।’

জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে রহমান একটা মুচকি হাসি দিল, যে-হাসির অর্থ, বলেছিলাম না ভুল ওরা করবেই।

‘এইতো এখানে,’ ই-মেইল থেকে কামালের পাঠানো ফাইলটা বের করতেও কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি আরিয়ানকে। কিন্তু অবশেষে সেটা পাওয়া গেছে আর সেই আনন্দে খুশিতে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল জুলহাস। ফাইলটা নামিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাতে এসে ঠিকানাটা দেখিয়ে ল্যাপটপটা জুলহাসের দিকে ঘুরিয়ে দিল আরিয়ান। জুলহাস এবার দ্বিতীয় কিউবটা ওপেন করল।

‘কিন্তু একটা প্রবলেম আছে,’ কিউবটা ওপেন করে চিন্তিত মুখে বলে উঠল জুলহাস।

‘কী সমস্যা?’ আরিয়ান এত কাঠখড় পুড়িয়ে ঠিকানাটা বের করে খানিকটা রিল্যাক্স ভঙ্গিতে চৌকিতে হেলান দিতে যাচ্ছিল তার আগেই জুলহাসের মুখে সমস্যার কথা শুনে চট করে আবার সোজা হয়ে বসল।

‘সমস্যা হলো, এই ঠিকানাটায় প্রথম যে নিউমেরিক ডিজিটগুলো আছে মানে যে নম্বরগুলো আছে, সেগুলো সংখ্যায় দুটো কিন্তু কিউবে পাসওয়ার্ডের যে খোপ আছে তার সংখ্যা চার,’ বলে সে মুখ তুলে আরিয়ানের দিকে তাকাল। ‘মানে এই দুটো সংখ্যা দিয়ে হবে না।

আরিয়ানও উঠে এসে জুলহাসের কাঁধের ওপাশ থেকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘কিন্তু ঠিকানা তো এটাই আন্দাজে বললেও না হয় বুঝতাম ভুল বলছি কিন্তু এখন তো সেই অবকাশও নেই। তাহলে কি আমরা ভুল করলাম,’ বলে খানিক ভাবল আরিয়ান। ‘এক মিনিট, এখানে যে ঠিকানাটা দেওয়া আছে সেটা একটা মেস বাড়ির। যে-মেসে গল্পের মূল চরিত্রটা থাকত সেখানে কিন্তু একটা কামরাও ছিল। সেটার নম্বর সম্ভবত দুই ডিজিটের।’

‘গ্রেট এটাতে কাজ হতে পারে,’ জুলহাস খুশিতে তালি দিয়ে উঠল। ফাইলটা বের করতেই আরিয়ান ফাইলটা ঘেঁটে সেই রুম নম্বরটা বের করে সংখ্যাটা জানাতেই জুলহাস আগের দুটো নম্বর আর পরের দুটো নম্বর মিলিয়ে চারটে নম্বর পাশাপাশি বসিয়ে কিউবে এন্ট্রি দিল। তিনজনেই খুশি খুশি মুখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু তিনজনকেই বোকা বানিয়ে স্ক্রিনে ফুটে উঠল রং পাসওয়ার্ড।

‘শিট আবারো ভুল পাসওয়ার্ড!’ হতাশায় গুঙিয়ে উঠল আরিয়ান

‘এবার তাহলে করণীয় কী, জুলহাসও হতাশ ভঙ্গিতে ল্যাপটপের সামনে থেকে হাত সরিয়ে এসে মাথা চেপে ধরল। আরিয়ান অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল তার দিকে তাকিয়ে।

‘এক মিনিট, আমরা মনে হয় ভিন্নভাবে ট্রাই করতে পারি,’ জুলহাস আর আরিয়ান দুজনকেই অবাক করে দিয়ে রাসনা বলে উঠল। তিনজনের ভেতরে একমাত্র সেই এখনো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আঙুল মাউস প্যাডে। ‘একটা ব্যাপার দেখ, যে-ঠিকানাটা কামালের বই থেকে পাওয়া গেছে সেটার প্রথম নম্বরের ঠিক পরের যে-শব্দটা সেটা কিন্তু চার অক্ষরের। আমরা এটা দিয়ে ট্রাই করছি না কেন?’ বলেই সে চোখ তুলে তাকাল জুলহাস আর আরিয়ানের দিকে।

সাধারণ অক্ষর, মানে অ্যালফাবেটি লেটার তাও আবার বাংলা—সেটাতে কী কাজ হবে?’ রাসনার পরামর্শ শুনে আরিয়ানকে খুব একটা উত্তেজিত মনে হচ্ছে না। ট্রাই করতে সমস্যা কী?’ জুলহাস আবারো চট করে ঝুঁকে এলো স্ক্রিনের ওপরে। ‘বাংলা আমার এখানে সেট করাই আছে। কন্ট্রোল অল্টার ভি চেপে সে ঠিকানার দ্বিতীয় শব্দটা দেখে নিয়ে খটখট করে শব্দটা টাইপ করে এন্ট্রি দিয়ে তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে। তিনজনকেই খানিকটা এবং আরিয়ানকে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে খুলে গেল কিউবটা। আরিয়ান আবারো চট করে সোজা হয়ে বসল। ‘ম্যাজিক, দেখ তো কী আছে ভেতরে?’ তার গলা এবার ছোট বাচ্চাদের নতুন খেলনা পাওয়ার মতো উত্তেজিত।

জুলহাস কিউবটা ওপেন করতেই ওদের সামনে আরো একটা লিংক খুলে গেল। ‘আবারো একটা লিংক,’ লিংকটাতে ক্লিক করতে করতেই সে বলে চলল, ‘—এবং এবারো একটা খবরের লিংক কিন্তু এমন কেন?’

তিনজনই অবাক হয়ে দেখল, এবারেরটা সরাসরি কোনো নিউজ পোর্টালের খবরের লিংক না এবং বেশ কিছু পুরনো খবরের কাগজের কাটিং। ‘এগুলো তো আগের দিনের মানুষজন পত্রিকা ম্যাগাজিন কেটে যেভাবে খবর সংগ্রহে রাখত সেরকম, নিউজ মনে হচ্ছে এবং তারিখটাও—’

‘—সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিককার,’ জুলহাসের কথাটা শেষ করে দিল আরিয়ান।

‘নিউজটা কি?’ তিনজনের ঠেলাঠেলিতে রাসনা পড়তে পারছে না।

‘এক মিনিট,’ আরিয়ান মনোযোগ দিয়ে নিউজটা পড়ছে। ‘দুই হাজার ষোলো থেকে একেবারে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এবার। আগেরবার ছিল ম্যাস হিস্টিরিয়া এবার গণ মৃত্যু,’ বলে সে ফিরে তাকাল বাকি দুজনার দিকে। আমি জানি না, হয়তো আপনারা দুজনেই তখন বেশ ছোট ছিলেন। কিন্তু খুব আবছাভাবে হলেও আমার ঘটনাটা মনে আছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে প্যারাসিটামল সেবনে বেশ কিছু শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। সংখ্যাটা একেবারে কম নয় শয়ের ওপরে।’ ‘মানে কি শখানের ওপরে শিশু মারা গেছিল ভেজাল প্যারাসিটামল সেবনে?’ রাসনা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল।

হ্যাঁ এখানে তিনটা নিউজ আছে। একটা নব্বইয়ের দশকেই সেই আলোচিত ঘটনা নিয়ে, দ্বিতীয়টা প্রায় কাছাকাছি ধরনের ঘটনা ঘটে ২০০৯ সালে এবং তৃতীয়টা একটা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট, এটা একেবারে সম্প্রতি। এখানে তৃতীয় রিপোর্টটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে এক সাংবাদিক একেবারে তথ্য-প্রমাণ সহ দাবি করেছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় বরং একই সূত্রে গাঁথা এবং উভয় ক্ষেত্রেই স্থানীয় কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের ফ্রি ওষুধ ভুয়াভাবে নিজেদের নামে বাজারজাত করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। যদিও সেই রিপোর্টে সেই আন্তর্জাতিক সংস্থার নাম উল্লেখ করা হয়নি।’

সেই সাংবাদিকের নাম কি?’ জুলহাস চিন্তিত মুখে জানতে চাইল। আরিয়ান অনুধাবন করার চেষ্টা করছে আসলে এসব বিচ্ছিন্ন খবরের একটার সঙ্গে আরেকটার লিংক কোথায়। ‘সাংবাদিকের নামটা গুরুত্বপূর্ণ নয়,’ বলে আরিয়ান থামল। রাসনা এবং জুলহাস দুজনেই তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে। ‘কারণ এখানে তিনটা নিউজের কাটিং শুধু আছে তা নয়। আরো একটা ছোট নিউজের কাটিংও আছে। সেই সাংবাদিকের মৃত্যু সংবাদ। লোকটা আত্মহত্যা করেছিল,’ আরিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাকি দুজনার দিকে।

জুলহাস কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আমি অনেক কিছুই অ্যাজিউম করতে চাচ্ছি আবার করছিও না, কারণ আমার ধারণা আমাদের এই মুহূর্তে তৃতীয় কিউবটা নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত। তথাস্তু,’ বলে আরিয়ান আবারো ঘুরে গেল ল্যাপটপের দিকে। সে কামালের পাঠানো বইয়ের ফাইলটা ঘেঁটে বেশ সময় নিয়ে বের করল তৃতীয় ঠিকানাটা। এবার আর আগের মতো ভুল করল না ওরা। আগে ঠিকানাটা লিখল তারপর জুলহাস তৃতীয় কিউবটা ওপেন করল, এরপর ঠিকানা আর কিউব মিলিয়ে দেখা গেল এবার কিউবে এন্ট্রির সংখ্যা পাঁচটা। এটা মিলে গেল ঠিকানার তৃতীয় অংশের সঙ্গে। অক্ষর পাঁচটা এন্ট্রি দিতেই ওপেন হয়ে গেল কিউবটা। এবার আবারো আরো একটা খবরের নিউজ। আগেরবারের মতোই আরিয়ান মনোযোগ দিয়ে নিউজটা পড়ল, তারপর ওদের দুজনার দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপটা ফিরিয়ে দেখাল দুজনকে। দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিল নিউজটার দিকে।

‘মানে কি এসবের হচ্ছেটা কি এখানে আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলবেন?’ জুলহাস প্রায় রাগের সঙ্গে নিজের মাথার চুল চেপে ধরল, তাকে পাগল পাগল দেখাচ্ছে। কিন্তু আরিয়ান কিংবা রাসনা কেউই তার প্রশ্নের উত্তর দিল না, ওরা নিজেরাই বুঝতে পারছে না কিছু।

.

‘এবার আর কোনো ভুল করা যাবে না,’ বলেই রহমান ফিরে তাকাল তার দলের একজনের দিকে। ঠিক কতক্ষণ লাগবে আমাদের লোকেশনে যেতে,’ লোকটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রহমান আঙুল নেড়ে তাকে থামিয়ে দিল। ‘সময় ঠিকমতো বলবা, একটু যেন এদিক-সেদিক না হয়। সকাল বেলা এখন জ্যামের দোহাই দিলে সোজা গুলি করে দেব।

লোকটা সময় জানাতেই খুশি হয়ে উঠল রহমান। ‘শাবাশ, খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে কীসের মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমাদের,’ বলে সে সবার দিকে দেখে নিয়ে জোনায়েদের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। বিশেষ করে গতবারের মতো ভুল আর এবার করা যাবে না। সেই সঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে, ওরা ভুল করেছে ঠিকই কিন্তু সেটা ধরে ফেলতেও খুব বেশি সময় লাগবে না ওদের। আমি নিশ্চিত ওদের ভেতরে কেউ না কেউ ভুলটা ধরে ফেলবেই। প্রথম প্রশ্ন, লোকেশনটা কার এবং ওরা কোথায় আছে?’

‘স্যার, যে প্রপার্টিতে ওদের সম্ভাব্য লোকেশন পাওয়া গেছে পুরোটাই আফজাল নামে এক গ্যারেজ মালিকের। লোকটা স্থানীয়, এলাকাতে বেশ পরিচিত এবং প্রভাবশালীও বলা যায়।’

‘কী ধরনের প্রভাবশালী? রাজনৈতিকভাবে নাকি—’

‘স্যার, এলাকার লোকজন তাকে পছন্দ করে, এলাকাতে ব্যাপক সুনাম আছে তার।’

‘এসবে লাভ হবে না,’ বলে সে জোনায়েদের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আমাদের নিজেদের ফোর্স কাজে লাগাও, প্রথম পুরো এলাকা নিশ্ছিদ্রভাবে কর্ডন করে ফেলতে বলো। এরপর তোমরা রওনা দাও, কারণ তোমরা ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওরা বিষয়টা টের পেয়ে যেতেই পারে। কাজেই কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।’

‘স্যার, আমি রওনা দেব মানে?’ জোনায়েদ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল। ‘আপনি যাবেন না?’

‘এই মুহূর্তে না,’ রহমান হাতের একটা আঙুল তুলে বলে উঠল। ‘লেখক আরিয়ান এবং ওখানে সম্ভাব্য যারা আছে তাদের বিষয়ে কিছু তথ্য চেয়ে আমি রিকোয়েস্ট করেছি। সেগুলো কিছুক্ষণের ভেতরে এসে পৌঁছাবে। ওগুলো দরকার আমার। এর ভেতরে তুমি ওখানে গিয়ে কী কী করবে সেগুলো আমি বলে দিচ্ছি, ‘ সে বিস্তারিত কথা শেষ করে জোনায়েদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছ আমি কী করতে বলেছি?’

‘ইয়েস স্যার,’ জোনায়েদ বুট ঠুকে বলে উঠল।

‘ভেরি গুড তুমি রওনা দিয়ে দাও, মনে রেখ কোনো ভুল করা চাই না। এবার আর কোনো সুযোগ নেব না আমরা। এবার আর কোনো ভুল করার কোনো স্কোপ নেই। উই উইল গেট দোজ বাস্টার্ডস।

জোনায়েদরা রওনা হয়ে যেতেই ঘড়ি দেখল রহমান।

আরেকটু সময় দরকার তার, স্রেফ আরেকটু সময়, এবার আর ছাড়াছাড়ি নেই।

.

‘মানে কি এর, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,’ জুলহাস এই প্রথমবারের মতো খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে কথা বলছে। কাম ডাউন জুলহাস, এত কাঠ খড় পুড়িয়ে এই পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়েছে আমাদের, তোমার বন্ধু কামাল, ওরা জীবন দিয়েছে এই জিনিসগুলো আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য, তারমানে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কানেকশন আছে এসবের। আমাদের স্রেফ—’   

‘স্যার, এসবের কানেকশন কোথায়, প্রথমে ম্যাস হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত একদল ছেলেমেয়ের নিউজ, এরপর ওষুধ খেয়ে একদল শিশুর গণমৃত্যুর, এরপর এখন এই,’ বলে সে স্ক্রিনের ওপরে ফুটে থাকা বিচিত্র আকৃতিটার দিকে দেখার। ‘পুরনো দিল্লির এই নর-বানর, অর্থ কী এসবের, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কানেকশন কোথায় এসবের। বাকিসব বাদ দিন, টাইমলাইনটাও তো কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছে না। প্রথম নিউজ দুই হাজার ষোলো সালের, এরপরের নিউজ নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিককার, এবারেরটা দুই হাজার চার সালের নিউজ, তাও আবার দিল্লির, এমনকি বাংলাদেশেরও নয়। অর্থ কী এসবের, কানেকশন কোথায়?’

‘সবাই শোন, আমরা একটা জিনিস মিস করছি এখানে,’ জুলহাস আর আরিয়ানের কথোপকথনের সুযোগে রাসনা স্ক্রিনের ওপরে চোখ বুলাচ্ছিল, সে শান্ত সুরেই বলে উঠল। ‘কাম ডাউন জুলহাস, এখানে আরেকটা নিউজ আছে, এটা বাংলাদেশের।’

আরিয়ান এবং জুলহাস দুজনেই অবাক হয়ে ফিরে তাকাল স্ক্রিনের দিকে। সেখানে এখন দ্বিতীয় একটা নিউজ দেখা যাচ্ছে। এটা স্থানীয় কোনো অখ্যাত পত্রিকার নিউজ কিন্তু নিউজটার বিষয়বস্তু দারুণভাবে প্রথম নিউজটার সঙ্গে মেলে।

‘এক মিনিট,’ আরিয়ান নিজের দুই হাত তুলে শান্ত হতে বলল সবাইকে। ‘আমরা কেউই সারারাত ঘুমাইনি তার ওপরে স্ট্রেস, কাজেই মাথা গরম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এখন যে-পরিস্থিতি তাতে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। কাজেই চলো আরেক রাউণ্ড চা খেয়ে সিগারেট খেয়ে নিউজ দুটো অ্যানালিসিস করি আবার।’

ওরা চা খেতে খেতে আলোচনা চালিয়ে গেল। ‘এই নর বানরের ঘটনাটা কী?’ জুলহাস জানতে চাইল।

‘ঘটনাটা আমার খুব হালকাভাবে মনে আছে, কোনো একটা সিনেমাতেও এটা নিয়ে একটা পার্ট ছিল। তবে এখানে নিউজে যা বলা আছে আমি সেটাই বলব, ‘ আরিয়ান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠল। সম্ভবত দুই হাজার তিন বা চারের দিকে, সময়টা এখানে নির্দিষ্টভাবে দেওয়া আছে, পুরনো দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় একটা অদ্ভুত আকৃতি দেখা দিতে শুরু করে। অনেকটা বানরের মতো দেখতে প্রাণীটাকে কেউ বলে আকৃতিটা একেবারে বন্য প্রাণীর মতো, কেউ বলে ওটার শরীরে হেলমেট থেকে শুরু করে একেবারে আধুনিক গ্যাজেটে মোড়ানো ছিল, কেউ বলে আসলে এরকম কিছু দেখাই যায়নি।’

‘করত কী ওটা?’

‘এইটা নিয়ে অনেক ডিবেট ছিল, কেউ বলে ওটা মানুষকে সাহায্য করত লোকে এমনও বলেছে ওটা ব্যাটম্যানের মতো রাতের বেলা ক্রিমিনালদের বিনাশ সাধন করত। আবার কেউ বলে ওটা আসলে নিজেই ক্রাইম করত, অনেককে নাকি রাতের অন্ধকারে সুযোগ পেয়ে ছিনতাই করেছে। আবার কেউ বলতে শুরু করে, ওটা ভগবানের মসিহা, দিল্লির অস্থির সময়ে খোদ ভগবান ওটাকে পাঠিয়েছে। আবার এমনও শোনা গেছে, এটা নাকি আদতে সত্যিকারের সুপার হিরো। লোকে অনেক কিছুই বলেছে, প্রচুর জলঘোলা হয়েছে এটা নিয়ে, দেশ- বিদেশের পত্রিকাওয়ালারা বেশ কিছুদিন মেতে ছিল এ-নিয়ে। তারপর যা হয় ধীরে ধীরে সব ঠান্ডা হয়ে আসতে থাকে, এক সময় হারিয়ে যায়।’

‘আমাদের এই ধাঁধার সঙ্গে এই ঘটনার সম্পৃক্ততা কী?’ জুলহাস ঠান্ডা স্বরে জানতে চাইল। আমি তো কোনো কানেকশন দেখতে পাচ্ছি না।’

‘কানেকশন আমিও এখনো দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু এই নর বানরের ডিবেট আবারো চালু হয় দুই হাজার দশের দিকে,’ বলে আরিয়ান মৃদু হাসল। ‘এবার বাংলাদেশে।

‘রিয়েলি?’ রাসনা তো বটেই নিরাসক্ত জুলহাসও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে।

‘হ্যাঁ এবার বাংলাদেশে, অন্তত কিউবে থাকা লিংক তাই বলছে, এবার বাংলাদেশে এবং খানিকটা ভিন্নভাবে। দুই হাজার দশের ডিসেম্বর মাসে শীতের সময়ে মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর এবং মানিকগঞ্জ—মানে তিন জেলার বর্ডারে নদী বিধৌত এলাকায় বেশ বড়ো একটা জঙ্গল আছে, নাম হাতিয়াখালী বন। খুব বেশি বড়ো না, আবার একেবারে ছোটও না এলাকাটা। নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা, ওখানে বালু তোলার, কাঠের ও কুচি পাথরের কাজ চলে। ওই জঙ্গল এলাকাতে হঠাৎ এক ধরনের বিচিত্র প্রাণীর উৎপাত শুরু হয়। কেউ বলে সাধারণ বানর জাতীয় প্রাণী, কেউ বলে জিন-ভূত, কেউ বলে বামন আকৃতির ভূত। ওটা নাকি বনে-জঙ্গলে বিচরণ করতে করতে লোকলয়েও হানা দিত। কারো কোনো ক্ষতি না করলেও সে- সময়ের মিডিয়া নিউজটা নিয়ে মেতে ওঠে। আবারো দিল্লির সেই নর বানরের কাহিনি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ঠিক একইভাবে ওটারও আর কোনো দিশা পাওয়া যায় না এবং এই কাহিনিও হারিয়ে যায় আর দশটা গল্পের মতো।’

‘আর এই আজাইরা কাহিনির বোঝা এসে চেপেছে এখন আমাদের ওপরে। আমার মনে হয় এটা বেশি না ঘেঁটে পরের স্টেপে যাওয়া উচিত এবং ওটা যেহেতু এই লেয়ারের পাশে কিউব কাজেই ওটাতে কি আছে দেখা জরুরি,’ হাইম ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠল জুলহাস।

‘আর হয়তো ওটাতেই সব ক্লিয়ার হবে কিংবা টুকরো টুকরো বিষয়গুলোর একটা কানেকশন পাওয়া যাবে,’ বলে আরিয়ান আবারো ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে কামালের ফাইলটা বের করে সময় নিয়ে চতুর্থ ঠিকানাটা বের করল। ঠিকানাটা দেখতে দেখতে সে মন্তব্য করার মতো বলে উঠল, ‘এই ঠিকানাটা মগবাজারের একটা স্টুডিও এবং এডিটিং হাউজের ঠিকানা। মনে আছে কামালের গল্প আর আমার গল্পের ভেতরে একটা বড়ো পার্থক্য হলো, কামালের গল্পে মূল চরিত্র ছিল একজন আর্টিস্ট, যে পরে সিনেমা বানাতে শুরু করে সফল হয়। আর আমার গল্পে একজন উদ্যোক্তা। কামাল পুরো গল্পটাকে দেখিয়েছিল শিল্প-সাহিত্যের অ্যাঙ্গেল থেকে, আমি তুলনামূলক বাস্তবিক প্রেক্ষাপট থেকে, এছাড়া সবই এক, এমনকি ঠিকানা ইত্যাদিও মেলে কয়েক জায়গায়।’

‘এই কারণেই যে বা যারাই আছে এর পেছনে, আপনার উপন্যাস এবং আপনাকে থ্রেট ভেবেছে এবং সেটা সত্যি। আচ্ছা ঠিকানাটায় কী আছে?’

‘প্রথমটাতে নম্বর দ্বিতীয়টায় ঠিকানার দ্বিতীয় অক্ষর, তৃতীয়টায় তৃতীয় এবারেরটায় চতুর্থ অক্ষর হওয়ার কথা, কিন্তু চতুর্থ অক্ষর তো আবারো ডিজিট, মানে জিপ কোড,’ আরিয়ান খানিক অবাক হয়ে বলে উঠল

‘চিন্তার কিছু নেই, দেখুন চতুর্থ কিউবেও চারটা ডিজিটই দেখাচ্ছে।,’ বলে জুলহাস গল্পের জিপ কোডটা আরেকবার দেখে নিয়ে সেটাকে এন্ট্রি দিতেই খুলে গেল চতুর্থ কিউবটা, আবারো আরেকটা নিউজ লিংক। ‘শাবাশ,’ বলে জুলহাস আর আরিয়ান দুজনেই লিংকটা ওপেন করে পড়তে শুরু করল।

‘কী ব্যাপার, কী আছে এবারের লিংকে?’ রাসনা পড়তে না পেরে অস্থির হয়ে ওদের পাশ থেকে জানতে চাইল।

‘আগের সমস্ত কিছুর জবাব এবং সংযোগ,’ এবারের লিংকটা পড়তে পড়তে আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল, নিউজটা পড়া শেষ করে সে জুলহাসের দিকে তাকিয়ে দেখল, জুলহাসের দুই ভ্রু ওর মতোই একসঙ্গে জোড়া লেগে গেছে। কারণটাও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে আরিয়ান। যদিও এখনো অস্পষ্ট তাও খানিকটা সংযোগ দেখতে পাচ্ছে সে এবং এটাই আপসেট করেছে জুলহাসকে।

হাতে ধরে থাকা, এক তাড়া কাগজের দিকে ঘোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রহমান। যে-কাগজগুলো উদ্ধার করতে এত কাঠ-খড় পেড়াতে হয়েছে সেগুলো হাতে পাওয়ার পর কেন জানি সেভাবে পড়ার কোনো আগ্রহ বোধ করছে না সে। আসলে অতিরিক্ত স্ট্রেস, ক্লান্তি এবার খানিকটা কাবু করে ফেলেছে তাকে, কিন্তু সে জানে ক্লান্ত হওয়ার যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। আরো বহুক্ষণ ধরে ক্লান্ত হয়ে যেতে হবে তাকে।

ফাইলের কাগজগুলো হাতে ধরে একবার ঘড়ি দেখল, জোনায়েদরা এতক্ষণে কাছাকাছি চলে যাওয়ার কথা। ঘড়ি থেকে চোখ তুলে সে জানালা দিয়ে বাইর দেখল, ভোরের সোনালি আলো রাস্তার দুপাশের সবুজের ওপরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। অপরূপ দৃশ্য কিন্তু তার মনের ভেতরে কুৎসিত ভাবনাগুলো তাকে এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দিচ্ছে না। বড়ো করে একবার নিঃশ্বাস নিয়ে সে ফাইলটা আবারো পড়তে শুরু করল। এর আগে প্রতিবার সে ধরা খেয়েছে সবকিছু না বুঝে শত্রুকে আন্ডার এস্টিমেট করে। এবার আর সেই ভুল করবে না সে। ফাইলের প্রথম ডকুমেন্টটা লেখক আরিয়ান শফিকের ব্যাকগ্রাউন্ড, বহু কষ্টে এটা জোগাড় করছে সে। এর পরেরটা অফিসার রাসনার, এর পরেরটা ওদের সঙ্গে যে আছে সেই ছেলের। এই তাদের সম্ভাব্য সব কানেকশনের। এখানে তার সব প্রশ্নের জবাব এবং সম্ভাব্য পরিকল্পনার ক্লু আছে, তাকে স্রেফ ডুব দিতে হবে।

ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে ফাইলে ডুবে গেল রহমান। আর তার জিপ ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলল নারায়ণগঞ্জের দিকে।

.

‘তাহলে সবকিছুর শুরু কী তাহলে ওখান থেকেই?’ আরিয়ান চোখ নাচিয়ে জানতে চাইল।

‘এখনো তা বলা যায় না, তবে কানেকশন যে কিছু একটা আছে তাতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই,’ বলে সে ফিরে তাকাল স্ক্রিনের দিকে। তারপর নিজে নিজেই বলতে শুরু করল। ‘এটা ১৯৯৬ সালের নিউজ, আওয়ামী লীগ-বিএনপির ব্যাপক রেষারেষি চলছে। একদিকে আওয়ামীলীগ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, অন্যদিকে বিএনপিও কোনো নাড়াচাড়া করছে না। এমন সময় দেশে শিশু পাচারের ঘটনা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। সেই সময়ে এটা বেশ আলোচিত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে বেশির ভাগ শিশু অপহরণ এবং শিশু পাচার করা হতো মধ্যপ্রাচ্যে উটের জকি হিসেবে, আবার নানা ধরনের মিথও প্রচলিত ছিল। এখানকার একটা নিউজ এ-নিয়ে আরেকটা নিউজ সেই কাছাকাছি সময়ে একটা এতিমখানা নিয়ে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তারা নাকি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এতিম বাচ্চা সংগ্রহ করে তারপর তাদের একটা অংশকে পাচার করে দেয়। যদিও পুলিশ বা সেই সাংবাদিক কেউই কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। আর প্রমাণ না পাওয়ায় পত্রিকা এবং পুলিশ উভয় পক্ষ থেকেই ক্ষমা চাওয়া হয় এতিমখানা কর্তৃপক্ষের কাছে।

‘আর এটা সেই এতিমখানা ছিল, যেখানে আপনি, কামাল, টোকন বড়ো হয়েছেন তাই না?’ রাসনা জানতে চাইল।

জুলহাস কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় জানাল। ‘হ্যাঁ এটাই কিন্তু না এখানে না অন্য কোথায় কোনো কংক্রিট এভিডেন্স আছে এটা নিয়ে,’ জুলহাস মাথা নাড়ল। ‘আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। প্রথমে একটা ম্যাস হিস্টিরিয়ার নিউজ, স্কুলের বাচ্চারা অজ্ঞাত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এরপর ভেজাল ওষুধের কারণে শতের ওপরে বাচ্চার মৃত্যু। এরপর নরবানর, এবার শিশু অপহরণ এবং সেজন্য এতিমখানাকে দায়ী, সব মিলিয়ে আসলে কীসের ইঙ্গিত দেয়? এবং টাইম ফ্রেমটাও, খাপছাড়া, একবার ২০১৬, আরেকবার নব্বইয়ের দশকের শুরু, তারপর আবার ২০০৪, এরপর ২০১০ আবার ১৯৯৬, মানে—’  

‘এক মিনিট, নিউজগুলো এলোমেলো হলেও একটা প্যাটার্ন কিন্তু আছে, জাস্ট এটাকে লিনিয়ারলি বসালে দেখেন, আর্লি নাইনটিজ, এরপর ১৯৯৬, এরপর আর্লি টু থাউজেন্ড, এরপর ২০০৮/২০০৯, এরপরই ২০১০, এরপর আবার ২০১৬, রাসনা বলে উঠল।

‘এবং আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন প্রায় প্রতিটা নিউজ স্রেফ ধোঁয়াশা, কোনো নিউজ এবং কোনো খবরের কোনো কংক্রিট এভিডেন্স নেই। তবে টামইলাইন নিয়ে আমারও একটা মতামত আছে,’ আরিয়ান বলে চলেছে। ‘যে ধাঁধাটা সাজিয়েছে সে অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। সে কিন্তু চাইলেই এটাকে টাইমলাইন ধরে লিনিয়ার ওয়েতে সাজাতে পারত কিন্তু সেটা সে করেনি, কেন?’

‘আমার বিশ্বাস এটাই নেক্সট স্টেজে যাওয়ার ব্লু, জুলহাস টেবিলে চাপড় দিয়ে বলে উঠল। ‘কারণ,’ সে ল্যাপটপটাকে তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে কিছু একটা করতে করতে বলে চলল। ‘গতবার প্রথম স্টেজ কমপ্লিট করার পর একটা কু দিয়ে ধাঁধাটা সরাসরি দ্বিতীয় স্টেজে চলে গেছিল এবার কিন্তু সেটা হয়নি। এবার দেখুন,’ বলে সে ল্যাপটপটা রাসনা আর আরিয়ানের দিকে ঘুরিয়ে দিল। ‘এবার আরো একটা বড়ো কিছুর এন্ট্রি দিয়ে তারপর পরের স্টেজে যেতে হবে।’

‘সর্বনাশ এত বিশাল, এটা এখন খুঁজে বের করতে তো—’

স্ক্রিনে একটা বড়ো স্পেস ক্রিয়েট হয়েছে যেখানে অনেক খোপ একের পর এক সাজানো এবং পরিষ্কার মেনশন করা পরের স্টেজে যেতে হলে এটার সমাধান করে যেতে হবে।

‘এক মিনিট, আমার মনে হচ্ছে আমি বুঝতে পেরেছি এটা কী,’ জুলহাস বলে উঠল। ‘এটাই সম্ভবত কারণ ধাঁধাটাকে ওভাবে সাজানোর। সে মেশিনের গতিতে কিছু একটা টাইপ করছে। নিজের কাজ শেষ করে সে আবারো ল্যাপটপটা ফিরিয়ে দিলওদের দিকে। দেখুন।’

দুজনেই দেখতে পেল যে-চারটা ঠিকানা ওরা বের করেছিল সেগুলো পরপর লেখা, সেগুলোর যে অংশগুলো দিয়ে এক এক কিউব আনলক হয়েছে, সেগুলো বোল্ড করা। তার নিচে সেগুলোকে একসঙ্গে একের পর এক বসাতেই সেটা নিজে একটা সম্পূর্ণ ঠিকানায় পরিণত হয়েছে।

‘অ্যাবসল্যুটলি ব্রিলিয়ান্ট। এই ভাঙা ভাঙা ঠিকানাগুলোর এক এক পার্ট মিলিয়ে এটা নিজেই একটা আস্ত ঠিকানা এবং ডিজিটগুলো দেখেন পাসওয়ার্ডের সংখ্যার সঙ্গে মিলে যায়। বসাও তো দেখি।’

জুলহাস গুগল টাইপ করতেই সেগুলো খাপে খাপে বসে গিয়ে একটা মেসেজ ফুটে উঠল সেখানে। একজন ব্যক্তির নাম লেখা এবং নিচে সেই ঠিকানাটা। সেই সঙ্গে একটা মেসেজ, ধাঁধার পরের ধাপে যেতে একে খুঁজে বের করতে হবে।

.

জোনায়েদ গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই রহমানকে কল দিল কিন্তু রহমান তার কল ধরল না। তার ইচ্ছে ছিল রহমানকে সব বিস্তারিত জানিয়ে তারপর কাজে নামা কিন্তু সেটা করা সম্ভব হলো না। কিন্তু দেরি করারও উপায় নেই, কাজেই তাকে যে- ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেই অনুযায়ী কাজে নেমে গেল সে।

প্রথমেই নিশ্চিত করল পুরো এলাকা খুব ভালোভাবে নিশ্ছদ্র করা হয়েছে কি না। এরপর নিজের সোর্সদের নিয়ে বসে গেল সে ওদের সম্ভাব্য অবস্থান এবং সম্ভাব্য পালানোর রুটের ব্যাপারটা নিশ্চিত করার জন্য, তবে তার আগে স্থানীয় ইনফরমারের কাছ থেকে আফজাল মিয়ার ব্যাপারে খুব ভালোভাবে আরো বিস্তারিত জেনে নিল সে। তার কাজের জায়গা কোথায় কোথায় আছে সেগুলোও খুব ভালোভাবে জেনে নিল সে।

‘ঠিক আছে, আমি মোটামুটি বুঝতে পেরেছি কোথায় কি আছে, আর এটাও মোটামুটি বোঝা গেছে ওরা কোথায় থাকতে পারে এবং পালানোর সময়ে ওরা কীভাবে পালানোর চেষ্টা করতে পারে। কাজেই এবার কাজে নামতে হবে। সবাই মনে রেখ, কোনো ভুল করা চলবে না,’ কথাগুলো নিজের দলকে শোনানোর পাশাপাশি নিজেকেও শোনালো সে।

‘চেক,’ বলে সে তার সমস্ত জিনিস চেক করে নিয়ে নির্দেশের সুরে বলে উঠল, ‘চলো সবাই।’

.

‘তারমানে এবার আমাদের এই ঠিকানায় গিয়ে এই লোককে খুঁজে বের করতে হবে?’ রাসনা সরল স্বরে জানতে চাইল।

‘ধাঁধা তো তাই বলছে,’ আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল, আর এবার তো কোনো ধরনের লুকোচুরিও নেই, একেবারে সরাসরিই বলেছে যা বলার। আর নিউজগুলোর ওভাবে সাজানোর কারণটাও বোঝা গেছে, সেই সঙ্গে কামাল কেন বই লিখেছিল এবং কামালের এবং আমার বই নিয়ে কোনো এত জলঘোলা সেটাও এবার একেবারেই পরিষ্কার। এই ধাঁধা এবং কামালের বই পরস্পরের সঙ্গে কানেকটেড।’

কিন্তু আমি ভাবছি অন্য জিনিস, জুলহাস স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিল, সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে ফিরে তাকাল নিজের মোবাইলের দিকে। ‘দুটো ব্যাপার আমাকে ভাবাচ্ছে, প্রথমত, যে-নামটা এখানে দেখা যাচ্ছে কোনো এক অদ্ভুত কারণে নামটা আমার খুব পরিচিত লাগছে। কেন, কোথায় কীভাবে আমি জানি না, কিন্তু পরিচিত লাগছে।’

‘আর দ্বিতীয়ত?’ আরিয়ান এবং রাসনা দুজনেই তাকিয়ে আছে জুলহাসের দিকে।

‘দ্বিতীয়ত, যে-ঠিকানা এখানে উঠেছে সেটা, এটা দেখুন,’ বলে সে দুজনার দিকে নিজের মোবাইলের স্ক্রিনটা দেখাল। যে, ঠিকানাটা তৈরি হয়েছিল সেটাকে প্রথমে ম্যাপে এন্ট্রি দিয়েছিল সে, সেটা যে জায়গাটা শো করছে সেটাকে জুম করে বড়ো করে ওদের দুজনার দিকে দেখাল সে ভালোভাবে। ‘দেখেছেন?’ ভ্রু নাচিয়ে মৃদু হেসে প্রশ্নটা করল।

‘এই বালের ঘটনায় কি সোজা কিছুই নেই?’ রাসনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে গালিটা তার মুখ দিয়ে আপনাতেই বেরিয়ে গেছে।

কিন্তু জুলহাসের হাসি কিংবা রাসনার গালি কোনোটার দিকেই নজর নেই আরিয়ানের, সে এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকেই। ‘পাগলা গারদ, একটা পাগলা গারদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে আমাদের! নিজের অবিশ্বাস লুকানোর কোনো অবকাশই নেই আরিয়ানের গলায়।

.

নিজের ফোর্স এবং ইনফরমারকে নিয়ে জোনায়েদ যখন আফজাল মিস্ত্রির গ্যারেজের সামনে গিয়ে পৌঁছাল পরিস্থিতি দেখে খুব খুশি হয়ে উঠল সে। একেবারে নিশ্ছিদ্রভাবেই ঘিরে ফেলা হয়েছে পুরো গ্যারেজ এলাকাটাকে। ঠিক এমনটাই চেয়েছিল সে। গেটের কাছে আসতেই মোবাইল বাজতে লাগল, রহমানের কল। কলটা রিসিভ করে চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল সে। কলটা কেটে দিয়ে নিজের লোকদের ইশারা করল গেট খোলার জন্য। কোনো ধরনের নক না করে, গেটে ধাক্কা দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল সে।

ভেতরে পাহাড়ের মতো বিশাল এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। ‘কী ব্যাপার, আইন্নেরা আমার এন কেল্লেগা? আমি কি এনু—’ বলে সে নিজেকে শুধরে নিল। ‘আইন্নেগো সার্চ ওয়ারেন্ট কই?’ জোনায়েদ লোকটার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে নেই। আশপাশে দেখছে। চারপাশে দেখে নিয়ে সে সোজা দৃষ্টি স্থির করল বিশাল পাহাড়ের মতো লোকটার চোখের ওপরে।

আমার ধারণা তুমি আফজাল মিস্ত্রি, তোমার এইখানে তুমি কয়েকটা ক্রিমিনালকে আশ্রয় দিয়েছ,’ বলে সে আরিয়ান আর রাসনার বিরুদ্ধে জারি করা পরোয়ানাটা ছুড়ে দিল আফজাল মিস্ত্রির দিকে। ‘অস্বীকার করে কোনো লাভ নেই, আমার কাছে পাকা খবর আছে, তুমি ওদের পরিচয় জেনে-বুঝে তারপর আশ্রয় দিয়েছ।’

আফজাল মিস্ত্রি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল নিজের লোকদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ওদের খোঁজার জন্য নির্দেশ দিল। আফজাল মিস্ত্রি তড়বড় করে কিছু বলছিল তার কথা না শুনে জোনায়েদের সঙ্গে আসা ইনফরমার এবং ফোর্সের লোকেরা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্যারেজে সার্চ করতে শুরু করেছে। নিজের একজন ইনফরমারের দিকে তাকিয়ে চোখে সামান্য ইশারা করল জোনায়েদ।

‘পাগলা গারদ বলাটা আসলে উচিত না, বরং বলা উচিত মানসিক হাসপাতাল, জুলহাস ঠিকানাটা বের করার পর আরিয়ান প্রতিষ্ঠানটার ব্যাপারে গুগলে সার্চ দিয়ে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটা আসলে কী—আর কাদেরকে নিয়ে অপারেট করে। ‘একটা প্রাইভেট মানসিক হাসপাতাল এবং রিহ্যাব সেন্টার। মোটামুটি পরিচিত, বেশি বড়ো না কিন্তু পুরনো প্রতিষ্ঠান এবং এলাকাতেও মোটামুটি নামডাক আছে।’

‘ওই এক কথাই, পাগলা গার্দ, কিন্তু প্রশ্ন হলো এই পাগলা গারদ,’ বলে নিজেকে শুধরে নিল জুলহাস। ‘মানে মানসিক হাসপাতালের ঠিকানা কেন দিল আর এই লোকটাই বা কে, তারচেয়ে বড়ো কথা—’

‘—নামটা আপনার কাছে পরিচিত লাগছে কেন?’

‘এভাবে উলটা-পালটা প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই,’ আরিয়ান গম্ভীর সুরে বলে উঠল। ‘যে-জঞ্জালের ভেতরে পড়েছি এর সমাধানের একটাই পথ, ওখানে গিয়ে দেখতে হবে। কে এই লোক, কেন তার নাম এখানে লেখা, আমরা মানসিক হাসপাতাল বলেই ভাবছি লোকটা হয়তো রোগী, কিন্তু সে ওখানকার কর্মকর্তাও হতে পারে। আমাদের গিয়ে দেখতে হবে। মুন্সীগঞ্জে হাসপাতালটা। আমরা আছি নারায়ণগঞ্জে, খুব বেশি দূরেও না এখান থেকে। কাজেই গিয়ে দেখতে সমস্যা কোথায়?’

‘সমস্যা তো আর—’

‘আচ্ছা আমাকে আবার ল্যাপটপটা দাও তো একটা জিনিস…শিট!’ কথা বলতে বলতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল আরিয়ান। উন্মাদের মতো সে ফিরে তাকাল জুলহাস আর রাসনার দিকে। ‘পাজল সলভ করার উত্তেজনায় আমরা কত বড়ো একটা ভুল করেছি তোমরা কি বুঝতে পেরেছ! শিট শিট, এমন ভুল কীভাবে হলো!’ আরিয়ার উন্মাদের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে।

‘কি’

‘আমরা এত সাবধানতার পরও ই-মেইলে লগ ইন করেছি,’ আরিয়ানের গলায় সব হারানোর আওয়াজ। ‘কামালের পাণ্ডুলিপিটা বের করতে গিয়ে, এরমানে—’

‘শত্রুরা আমাদের লোকেশন জেনে গেছে আরো অনেক আগেই—’

‘শিট শিট—’

‘এতক্ষণে ওরা হয়তো পৌঁছেও গেছে আমাদের কাছাকাছি,’ আরিয়ানের উন্মাদ গলা শান্ত হতে শুরু করেছে। ‘পালাতে হবে আমাদের—জলদি—’

‘আমরা এরই মধ্যে দেরি করে ফেলেছি, ওই দেখুন।’

রাসনা কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই বাইরে ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা গেল। সেই ছেলেটা, যাকে ওদের প্রয়োজনের জন্য রাখা হয়েছিল সে দৌড়ে এসেছে। তিনজনে ফিরে তাকাতেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল। ‘পুলিশ আইছে, আফজাল মামুর গ্যারেজ পুরা ঘিরা ফালাইছে, আপনেগো পলাইতে অইবো।

পুরো গ্যারেজ না শুধু বলতে গেলে গ্যারেজের টিনের বাড়ি, পেছনে থাকার জায়গা, পুকুরপাড়সহ প্রতিটা জায়গা একরকম বলতে গেলে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ফেলা হয়েছে কিন্তু কারো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আফজাল মিস্ত্রির প্রতিটা কর্মীকে গ্যারেজের সামনের উঠানে জড়ো করা হয়েছে, ছেলে থেকে বুড়ো কেউ বাদ যায়নি। তাদের সবার সামনে বীরদর্পে পকেটে দুই হাত আর মুখে জ্বলন্ত পাতার বিড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফজাল মিস্ত্রি। কিছুই পাওয়া যায়নি দেখে তার মুখের তাচ্ছিল্যের হাসিটা আরেকটু চওড়া হলো। ‘কী অপিসার, কিছুই তো পাইলাইন না। আমি কইছিলাম না—’

জোনায়েদ মুখে মৃদু হাসি লটকে তার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার এক হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল, সেটাতে প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে সাইলেন্সার লাগাতে শুরু করল সে। পিচিক করে জোনায়েদের পায়ের কাছে থুতু ফেলল আফজাল মিস্ত্রি, হুনুইন অপিসার, একাত্তর সালে ঠিক এমনি আমাগোর বাড়ির উডানে এক পাকিস্তানি মিলিটারি আমার আব্বারে ধমকাইতেছিল। আমগোর বাড়িত মুক্তিরা পলাইয়া ছিল। মিলিটারি জানত হেরা আমগো বাড়িতই লুকায়া আছে, পুরা এলাকার মাইনষে জানত, কিন্তু হেরা খুঁইজ্জা পাইতাছিল না। আমার আব্বারে ঠিক এমনেই ধমকাইতে ছিল, তারপর মারতে থাহে, আমরা দেখতাছিলাম। আব্বারে প্রথমে মারল, তারপর কাটল, হেনু লবণ মরিচ লাইগাইল, আমাগো চোখের সামনে। মারতে মারতে মাইরাই ফালাইলো আমাগো চোখের সামনে। না, মিলিটারি না রাজাকারেরা কেউই একটা শব্দও আব্বার মুখ দিয়া বাইর করতে পারে নাই। আর স্বাধীন দেশের মাটিত তুমি হেদিনের পোলা আমার ডর দেহাও,’ সে আবারো পিচিক করে থুতু ফেলল, খিক খিক করে হাসছে।

জোনায়েদ এখনো মুখে হাসি লটকে রেখেছে। ‘তোমার কথার উত্তর আমি অনেককিছুই বলতে পারতাম আফজাল মিস্ত্রি। কিন্তু সমস্যা দুইটা। এক তুমি কেমন মানুষ সেই খবর নিয়া তারপর আমি আসছি এইখানে, কাজেই আমি জানি তুমি কিছুতেই কিছু বলবা না, দুই, আমার হাতে আসলে সময় নাই। কাজে কাজেই  মিলিটারি যেই ভুল করছিল আমি সেই ভুল করব না,’ বলে সে নিজের একজনকে ইশারা করল। ‘আমি জানি তোমারে মেরে ফেললেও তুমি একটা কথাও বলবা না। কাজেই দেখ আমি কী করি।’

তীব্র চিৎকারের চোটে আফজাল মিস্ত্রি থেকে শুরু করে সবাই ফিরে তাকাল উঠানের কোনার দিকে। সেখানে জোনায়েদের একজন লোক পিচ্চি একটা ছেলেকে ধরে আছে। ছেলেটা প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। ‘আফজাল মিস্ত্রি শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করতেছি বলো, না হলে,’ জোনায়েদ কথা শেষ না করে পিচ্চি ছেলেটার পায়ে গুলি করল। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলে ধুপ করে একটা শব্দ হলো কিন্তু ছেলেটার চিৎকারটা হলো বোমার মতো। বাজ পড়ার মতো একটা তীব্র চিৎকার করেই ছেলেটা লুটিয়ে পড়ল উঠানের মাটিতে।

আফজাল মিস্ত্রির হা করা মুখের ভেতরে আলাজিহ্বা দেখা যাচ্ছে। সে এতটাই বিস্মিত হয়েছে যে, কথাও বলতে পারছে না। ‘আফজাল মিস্ত্রি আমার সময় নাই, জলদি বলো, এইবার ওই বুড়াটারে ধরা হবে, জোনায়েদের চোখে কোনো ভাব নেই। সে ইশারায় সেই বুড়োকে দেখাল যে আরিয়ানের পট্টি বেঁধে দিয়েছিল। ‘তুমি সহ্য করতে পারবা?’ এরপর আরেকজনকে কি দরকার, বলো, তারচেয়ে দেখায়ে দাও আমরা চলে যাব, আর যাদেরকে বাঁচাইতে চাচ্ছ ওগোরে মারা হবে না। কাজেই—’

আফজাল মিস্ত্রির চোখ দিয়ে গড় গড় করে পানি ঝরছে, সে বিড়বিড় করে গ্যারেজের পেছনে যেখানে তার লোকেরা থাকে সেটার অবস্থান বলে দিল। ‘ভেরি গুড, চলো সবাই,’ সবাইকে নিয়ে ইশারায় বের হতে বলে একবার গেটের বাইরে দেখে নিল, সেখানে তার ইনফরমার দাঁড়িয়ে আছে, লোকটা সরে পড়েছিল, মাত্র আবার ফিরে এসেছে। ওরা বের হতে হতে লোকটা আড়চোখে জোনায়েদকে ইশারা করে কিছু একটা নিশ্চিত করল।

.

‘অক্ষণ পলান, হেরা সামনের গ্যারেজে আইয়া পড়ছে, বাড়িত ঢোকার আগেই মামু আমারে পিছে দিয়া পলায় দিছিল দেইখা আসতে পারতেছি। জলদি জলদি পলান।

যা বুঝতে পারছি আমরা কোথায় আছি, সেটার রেডিয়াস ওরা জানে কিন্তু পিন পয়েন্টেড লোকেশন বের করতে হলে আরেকটু সময় লাগবে, কাজেই জলদি জলদি পালাতে হবে,’ বলে আরিয়ান ছেলেটার পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করল। রাসনাও এগিয়ে এসেছে, খানিক পেছনে পড়ে গেছে। জুলহাস। ছেলেটা দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের নিয়ে বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটুকু পার হয়ে গেটের কাছে চলে এলো, আরিয়ান ছেলেটাকে ছাড়িয়ে এক ধাক্কায় গেটটা খুলে বাইরে বেরিয়েই দ্রুত দুপাশে চোখ বুলিয়ে ডানেবামে দেখে নিল।

বাইরে একেবারেই শান্ত পরিবেশ, সকালের কাঁচা রোদে গ্রাস করছে পুরো এলাকাটা। গাছে গাছে পাখি কিচিরমিচির করছে, লোকজন মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আসছে, অনেকে খোশগল্প করতে করতে কিংবা সকালের পত্রিকাতে চোখ বুলাতে বুলাতে অলস চুমু দিচ্ছে চায়ের কাপে, একটা মফস্বল শহরের সকালের চিত্র যেমনটা হতে পারে ঠিক সেরকমই একটা সকাল। আশপাশের পরিবেশ দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই কী ধরনের মৃত্যুদূত ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। একে তো গতকালের ক্লান্তি তার ওপরে রাতে একেবারেই ঘুমায়নি, হঠাৎই বাইরে এসে সকালের রোদে মাথাটা চক্কর মারল আরিয়ানের, দৌড়ানোর পরিবর্তে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ঠিক গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে গেছে আরিয়ান, পেছন থেকে রাসনা এগিয়ে এসে ধাক্কা মারল ওর গায়ে। ‘কী ব্যাপার, আপনি—’ সে প্রশ্ন শেষ করতে পারল না, দেখতে পেল ছেলেটা ওদের ছাড়িয়ে গিয়ে ডানে ঘুরে দৌড়াচ্ছে। ‘এ যাচ্ছে কোথায়, কই কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না, জুলহাসও চলে এসেছে গেটের বাইরে, সে এখনো একহাতে ব্যাগ সামলে অন্যহাতে ল্যাপটপের চার্জারটা ওটাতে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। তিনজনই স্থির দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে ছেলেটা ডানে ঘুরে একটা বাউন্ডারি দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে।

‘তাত্তারি আইয়ূন, সময় নাই, হেরা দেইখা ফালাইলে সব্বোনাশ অবো।’

‘তুমি নিয়ে যাচ্ছ কোথায় আমাদের?’ জুলহাস ব্যাগটাকে গুছিয়ে সেটাকে পিঠে চাপিয়ে এখন একেবারে প্রস্তুত কিন্তু এভাবে ছেলেটার উদয় হওয়া এবং পালাতে শুরু করার বিষয়টাকে এমনকি সেও ঠিক পুরোপুরি মেনে নিতে পারছে না, রাসনার মতোই তার গলাতেই খানিক সন্দেহের সুর।

‘আরে, তাত্তারি—’ ছেলেটা চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল কিছু একটা দেখে। তার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। ছেলেটার দৃষ্টি অনুসরণ করে তিনজনেই চট করে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল, ওদের বিপরীত দিক থেকে বেশ বড়ো বড়ো একটা দল এগিয়ে আসছে ওদের দিকে, দলের সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে আছে রহমানের সঙ্গে থাকা ফরসা করে সুদর্শন সেই স্পেশাল ফোর্স অফিসার।

.

‘সর্বনাশ!’ আপনাতেই বেরিয়ে এলো আরিয়ানের মুখ দিয়ে। জলদি চলেন,’ রাসনাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ডানে ঘুরিয়ে জুলহাসের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করেই সে নিজেও দৌড়াতে শুরু করল ছেলেটার দিকে। ছেলেটা প্রাথমিকভাবে চমকে উঠলেও ভয় কাটিয়ে সে চট করে নড়ে উঠেই অদৃশ্য হয়ে গেল দেয়ালের অন্যদিকে। বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকা দলটা ওদের দেখতে পাওয়া মাত্রই ধাওয়া করতে শুরু করেছে, বিশেষ করে দলের আগে থাকা অফিসার রীতিমতো দৌড়াতে শুরু করেছে। এগিয়ে আসতে আসতেই সে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে কিছু একটা বলে উঠল। আরিয়ান এক পলক দেখেই বুঝতে পারল লোকটা খালি হাত নয় নিজের অস্ত্র ধরা হাতটা উঁচু করে ধরেছে।

ঐদিক কোনো গুলি হয়নি তাও মাথা নিচু করে ফেলল সে। রাসনা এবং জুলহাস দুজনেই দেয়ালের অন্যপাশের দিকে এগিয়ে গেল অনেকটাই, আরিয়ানও মাথা নিচু করে এক হাতে নিজের অস্ত্রটা বের করে এনেই দৌড় দিল দেয়ালের অন্যপাশের দিকে। পেছনের দলটা কিছু করার আগেই তিনজনেই নিরাপদে সরে এলো দেয়ালের অন্যপাশে। ছেলেটা ওদের থেকে বেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে, প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল ওরা তিনজনে।

‘এ যাচ্ছে কোথায়?’ আনমনেই পেছনে একবার দেখে নিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে দৌড়াতে লাগল জুলহাস।

‘জানি না, জানার উপায়ও নেই,’ আরিয়ানও একবার পেছনে দেখে নিল। ধাওয়া করতে থাকা দলটার কাউকেই এখনো দেখা যাচ্ছে না, সে সামনের দিকে মনোযোগ দিল। দেয়ালের অন্যপাশে ঘুরতেই ওরা একটা সরু গলিতে এসে পড়েছে। পাশাপাশি দুটো বাউন্ডারির ভেতর দিয়ে গলিটা এগিয়ে গেছে অনেকদূর। দৌড়াতে দৌড়াতেই হঠাৎ আরিয়ানের মাথায় বিষয়টা খেলে গেল। ও সঠিকভাবে জানে না, ওদের ধরার জন্য ধাওয়া করতে থাকা দলটা গুলি করবে কি না, কিন্তু যদি করে তবে এই সরু লম্বা গলিটা ওদের জন্য একেবারে সহজ একটা টার্গেট হয়ে যাবে ওরা। আরিয়ান জোরে দৌড়ে সামনের ছেলেটাকে পেছন থেকে জামা টেনে ধরে থামিয়ে দিল। ছেলেটার থামার সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল পেছনের দুজনও।

‘তুমি কই নিয়ে যাচ্ছ আমাদের’ জোরে জোরে বলে উঠল আরিয়ান।

‘ওই পিছে মামু আপনেগো লাইগা একটা গাড়ি রাখছে,’ বলে সে চট করে একটা চাবি বের করে দেখাল। আরিয়ান চাবিটা দেখে নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই পদশব্দ শুনে চট করে ফিরে দেখল ওরা ঢুকে পড়েছে গলিতে, সামনের ফরসা লোকটার হাত এখনো উঁচিয়ে রাখা। এক খাবলা দিয়ে ছেলেটার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে তুলে দিল দেয়ালের ওপরে। ‘জলদি, সবাই দেয়াল টপকে ওপাশে চলো। ছেলেটাকে দেয়ালের ওপরে তুলি দিয়ে নিজেও লাফিয়ে দেয়ালের একপাশ ধরে ফেলল আরিয়ান। পাশেই দেখতে পেল এক লাফে দেয়ালের ওপরে উঠে রাসনার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জুলহাস। কিন্তু সে বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দেয়ালের ওপরে উঠে আর ভারসাম্য রাখতে পারল না, এক হাতে চাবি আরেক হাতে অস্ত্র নিয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে উলটে পড়ে গেল আবার গলির ভেতরে। দেয়াল খুব বেশি উঁচু না হওয়াতে সেরকম ব্যথা পেল না কিন্তু লোকগুলো ওদের দিকে এগিয়ে এসেছে অনেকটাই।

আরিয়ান চট করে উঠে বসে প্রথমে চাবিটা চালান করে দিল কোটের পকেটে, যাতে হারিয়ে না যায়। তারপর মাটিতে পড়ে থাকা অস্ত্রটা তুলে ধরল এগিয়ে আসতে থাকা লোকগুলোর দিকে। ঝড়ের বেগে দৌড়ে আসতে থাকা লোকগুলো ওকে অস্ত্র তুলতে দেখে থেমে গিয়েই মাটিতে শুয়ে বসে পড়ল। আরিয়ান এক গড়ান দিয়েই দেয়ালের দিকে এগিয়ে একলাফে ধরে ফেলল দেয়ালের একপাশ, সময় নিয়ে নিজেকে স্রেফ এক টান দিয়ে তুলে লাফিয়ে নেমে এলো অন্যপাশে। ওপাশে খোলা একটা জায়গা, জঙ্গল আর আগাছায় ছেয়ে আছে, আরিয়ান দেখতে পেল বন্ধ বাউন্ডারির অন্যদিকে একটা খোলা ভাঙা গেট। রাসনা আর জুলহাস অনেকটাই এগিয়ে গেছে গেটের দিকে, আরিয়ান প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল ওটার দিকে। পেছন থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারল ধাওয়ারত লোকগুলোও দেয়াল টপকাচ্ছে কিংবা টপকানোর চেষ্টা করছে। আরিয়ান অন্ধের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে ভাঙা গেটটা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো অন্যপাশের খোলা রাস্তায়।

বেরিয়েই প্রথমে ডানে দেখল একবার তারপর বামে। স্বস্তির পরিবর্তে আরো ভয়ের একটা ছায়া খেলে গেল মনের ভেতরে, ওর ডানে প্রথমে জুলহাস দৌড়াচ্ছে, তার কোলে ছেলেটা, তার ঠিক পেছনেই রাসনা। আর বাম দিক থেকে ওর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে ফোর্সের প্রায় চার-পাঁচজন লোক। ক্ষণিকের জন্য দ্বিধায় পড়ে গেল আরিয়ান। অস্ত্রটা বের করে আনবে নাকি আনবে না, কারণ এর আগেরবার ওদের গলিতে পেয়েও ওরা গুলি করেনি, কিন্তু এবার অস্ত্র বের করলে ওরা নির্দেশ না থাকলেও ভয়ে হলেও গুলি করবে। ভাবাভাবি বাদ দিয়ে প্রায় কাছে চলে আসা প্রথমজনকে বাউলি কেটে এড়িয়ে গিয়ে, লোকটাকে সামনে পা দিয়ে ঠেলা মারতেই ধাম করে পড়ে গেল লোকটা, চেঁচিয়ে উঠল তারস্বরে। লোকটার পেছনের অপরজন বেশ অনেকটা পেছনে।

এই সুযোগে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল আরিয়ান। কিন্তু সামনে থেকে অদৃশ্য হয়েছে জুলহাস আর রাসনা। দৌড়াতে দৌড়াতে একবার পেছনে দেখে নিয়ে সামনে খোলা রাস্তার বাঁকের কাছে চলে এলো আরিয়ান। ডানে-বামে তাকিয়ে দেখতে পেল ওর থেকে শখানেক গজ নামনে বাম দিকে রাসনা আর ছেলেটা। যদিও দৌড়ানোর ফাঁকে আর কোনো সময় নেই তাও বুঝতে পারল, আনলে ওরা কোনদিকে এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে দৌড়াচ্ছে। ওরা যেদিকে দৌড়াচ্ছে, সেখানে একটা খোলা টিনের চালের নিচে গ্যারেজের মতো, সেখানে কয়েকটা গাড়ি রাখা। আরিয়ান নিশ্চিত এটা আফজালের গ্যারেজের ছোটোখাটো কাজ করার একটা শাখা। ওদের জন্য গাড়িটাও এখানেই রাখা আছে।

আরিয়ান দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল, কারণ জুলহাস আর রাসনা এগিয়ে গেলেও গাড়ির চাবি ওর কাছে। জুলহাস আর রাসনা প্রায় গাড়িগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে, ওর আর গজ পঞ্চাশেক বাকি এমন সময় প্রথম গুলি হলো পেছন থেকে, গুলি লাগল না কিন্তু আতঙ্কে আরিয়ানের লোম খাড়া হয়ে গেল, কারণ ওরা চাইলেও

এখন থামতে বা আড়ালে যেতে পারবে না। সামনে জুলহাস আর রাসনাকে দেখল গাড়িগুলোর আড়ালে বসে পড়তে। আরিয়ান দৌড়ের গতি আরো বাড়িয়ে দিল, পেছন থেকে আবারো গুলি হলো, গাড়িগুলোর দূরত্ব আর গজ বিশেক নিজের নার্ভ আর ঠিক রাখতে পারল না আরিয়ান, মাটিতে ডাইভ দিয়ে পড়ল, এক গড়ান দিয়ে উঠে দেখল লোকগুলো এগিয়ে এসেছে অনেকটাই, এবার একাধিক লোক অস্ত্র হাতে তুলছে, জান দিয়ে দৌড় দিয়ে গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই কয়েক রাউন্ড গুলি হলো এবার, সামনে এক লাফ দিয়ে মাটিতে পড়েই গাড়ির অন্যপাশে চলে এলো ও, সেই সঙ্গে চাবিটা ছুড়ে দিল জুলহাসের দিকে।

হাত, পা ও মুখ ছিলে রক্ত পড়ছে। জুলহাস চট করে একটা সাদা গাড়ির দরজা খুলে ছেলেটাকে সিটের ওপরেছুড়ে দিয়ে নিজে উঠে বসেছে ড্রাইভিং সিটে। সে গাড়ি স্টার্ট দিয়েই গাড়িটাকে ঘুরিয়ে ফেলল এক রাউন্ড, রাসনা লাফ দিয়ে উঠে বসল পেছনের সিটে, কিন্তু ও উঠে বসার আগেই ঘুরতে থাকা গাড়ির বামপার এসে বাড়ি মারল ওর গায়ে। ওঠার পরিবর্তে বরং মাটিতে গড়ান দিয়ে ধাওয়ারত লোকগুলোর দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল আরিয়ান।

একদিকে লোকগুলো এগিয়ে আসছে, অন্যদিকে জুলহাসও গাড়িটা ঘুরিয়ে ফেলেছে। অস্ত্রহাতে ধাওয়ারত মানুষগুলো আর গাড়িটার ঠিক মাঝখানে আরিয়ান। প্রায় কিছু না ভেবেই, মাটিতে এক গড়ান দিয়ে লাফ দিয়ে গাড়ির পেছনের বাম্পার ধরে ফেলল ও। গাড়িটাও ঘুরতে শুরু করল। জুলহাস গাড়িটাকে সোজা করে ফেলতেই পেছন থেকে গড়িয়ে গাড়ির একপাশে চলে এলো আরিয়ার। সঙ্গেসঙ্গে গাড়ির পেছনের খোলা দরজা দিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে ওকে ভেতরে টেনে নিল রাসনা। পেছন থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি হলেও গাড়ি থামল না পেছনের সিটে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে আরিয়ান জোরে জোরে বলে উঠল, ‘আমি ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম এবার আর পালাতে পারব না। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখল ধাওয়ারত লোকগুলো পেছাতে শুরু করেছে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই অফিসার, তার ফরসা মুখ লাল হয়ে আছে, রাগে না ধাওয়া করাতে বুঝতে পারল না আরিয়ান, বোঝার চেষ্টাও করল না। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে।

.

এখনো ওরা আফজাল মিস্ত্রির গ্যারেজের সামনেই অবস্থান করছে, যদিও মিস্ত্রি আর তার লোকদের তাদের মতো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুরো ফোর্স নিয়ে বসে ছিল জোনায়েদ, কথা বলছিল নিজের ইনফরমারদের একজনের সঙ্গে এমন সময় কালো রঙের একটা জিপ এসে থামল ওদের সামনে সামনে। জিপ থেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নেমে এলো অফিসার রহমান, তার পরনে নীল ফেড জিন্স, সাদা শার্ট, চোখে সোনালি ফ্রেমের কালো সানগ্লাস। হাতে এক গাদা কাগজ ছিল, সেগুলো রেখে খুব ধীর পায়ে এগিয়ে এসে জোনায়েদের সামনে দাঁড়াল সে।

একটা জিপের হুডের ওপরে বসে ছিল জোনায়েদ, রহমানকে এগিয়ে আসতে দেখে, হুডের ওপর থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াল। রহমান ওর ঠিক সামনে এসে থেমে গেল, খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে খুলে ফেলল সানগ্লাসটা। তার লালচে চোখ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক, ফ্রেশও লাগছে তাকে খানিকটা। তার চোখে বিশেষ কোনো ভাবও নেই। জোনায়েদও তার দিকে তাকিয়ে আছে, সেও তাকিয়ে আছে। ‘আমি তোমাকে একটা কাজ দিছিলাম, জোনায়েদ,’ বলে সে শার্টের কোনা দিয়ে সানগ্লাসটা মুছতে লাগল। ‘কাজটা কঠিন ছিল, কিন্তু—’ সে থেমে গিয়ে আবারো তাকাল জোনায়েদের চোখের দিকে তারপর মৃদু হেসে জড়িয়ে ধরল তাকে, ‘কিন্তু কাজটা তুমি এত সুন্দরভাবে করতে পারবা আমি ভাবি নাই।,’ বলে সে জোনায়েদকে ছেড়ে দিয়ে তার দুই কাঁধ ধরে শক্ত করে একটা ঝাঁকি দিল। ‘এখন আমরা জানি ওরা কই যাবে, এইবার খেলা পুরোপুরি জমবে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হবে। ধন্যবাদ, ছোটভাই আমার।,’ দুজনার মুখেই হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *