১০
‘এইটাই’ আরিয়ান মুখ কুঁচকে জানতে চাইল। ছিলা মুখ নাড়ালেও ব্যথা লাগছে ওর।
‘ক্যান ভাই, গেটের ওপরে এত্তো বড়ো করে লেখা নামটা দেখার পরেও সন্দেহ আছে আপনার?’
‘না তা নেই, কিন্তু প্রাইভেট মানসিক হাসপাতাল শুনে যেমন ভেবেছিলাম এটা তো তারচেয়ে অনেক বড়,’ বলে সে মাথা নাড়ল। ‘এখানে অ্যাক্সেস করা তো সহজ হবে না,’ আরিয়ান মুখ বাঁকিয়ে ক্ষতটার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছে,
যদিও খুব হালকাভাবে একটা ড্রেসিং করিয়েছে সে রাস্তার পাশের একটা ফার্মেসি থেকে।
‘অ্যাক্সেস করতে সমস্যা হবে কেন,’ জুলহাস মানসিক হাসপাতালটার দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে উঠল। ‘আমরা সরাসরিই যাব কথা বলতে কারণ এ-ছাড়া আর কোনো উপায় নেই,’ সে মানসিক হাসপাতালটার দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরিয়ানের দিকে ফিরে তাকাল। ‘যদি এমন হতো লোকটা কে আমরা জানি, তার চেহারা চিনি তাহলে হয়তো নিজে থেকে একটা চেষ্টা করতে পারতাম,
যদি সে এখানে বন্দি থেকে থাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু যাকে চিনিই না, যার ব্যাপারে কিছুই জানি না, তাকে কীভাবে ট্রেস করব, তাও আবার গোপনে। আপনি বলেন ঠিক বলেছি কি না?’
‘কথা সত্য, এইটাই করতে হবে। আর উপায় নেই।’
হ্যাঁ, যদি এটাতে কাজ না হয় তবে না হয় ভিন্ন পন্থা ধরলাম, কী বলেন?
‘হুমম, সেটাই। চলো,’ বলে আরিয়ান আর জুলহাস রওনা দিল রেস্টুরেন্টটার দিকে, যেখানে রাসনাকে বসিয়ে রেখে এসেছে। ওরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে সেই মানসিক হাসপাতালটার ঠিক সামনেই বলতে গেলে যেটার ঠিকানা ওরা পেয়েছে সেই ভার্চুয়াল ধাঁধা থেকে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ধাওয়া খেয়ে পালানোর পর কিছুক্ষণ টানা গাড়ি চালিয়ে হাইওয়ের কাছে এসে থামিয়ে ওদের সঙ্গে থাকা ছেলেটাকে কিছু টাকা দিয়ে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করে, ওরা টানা গাড়ি চালিয়েছে। মাঝে রাস্তার পাশে একবার থেমেছে স্রেফ। ওখানে একটা ফার্মেসিতে আরিয়ানের ড্রেসিং করিয়েছে, আর গাড়িতে গ্যাস ভরেছে ওরা। এছাড়া প্রায় পুরো সময় টানা গাড়ি চালিয়ে সোজা চলে এসেছে সেই মানসিক হাসপাতাল এবং রিহ্যাব সেন্টারের কাছে। হাসপাতালটার ঠিক সামনেই একটা রেস্টুরেন্টে ভালোভাবে ফ্রেশ হয়ে নাশতা সেরে রাসনাকে বসিয়ে রেখে আরিয়ান আর জুলহাস মিলে আশপাশটা রেকি করতে বেরিয়েছিল এবং সেই সঙ্গে পরিকল্পনাও ঠিক করতে যে-কীভাবে লোকটাকে ট্রেস করবে। ওরা দুজনে আশপাশটা দেখে সিন্ধান্ত নিয়ে ফিরে এসে দেখল রাসনা একেবারে শুকনো মুখে বসে আছে।
‘আমরা ঠিক করেছি সরাসরি গিয়ে কথা বলব,’ জুলহাস রাসনাকে ভালোভাবে খেয়াল না করেই বলে উঠল। তারপর তার শুকনো মুখ দেখে জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার, আবার কী হলো?’ চট করে একবার আরিয়ানের দিকে দেখে নিল সে। আরিয়ান মাথা নেড়ে জানাল সে কিছু জানে না।
‘সরাসরি যে গিয়ে কথা বলবেন, এই দেখেন,’ বলে সে জুলহাসের রেখে যাওয়া মোবাইলটা ওদের দিকে এগিয়ে দিল, ওখানে একটা ভিডিও চলছে। আরিয়ান এবং জুলহাস দুজনেই মন দিয়ে দেখতে লাগল। ভিডিওটা একটা খবরের ক্লিপ, লেখক আরিয়ান শফিককে নিয়ে। সে কীভাবে নিজের বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে মিলে তাকে হত্যা করে তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে সাজিয়েছে এবং ডিবি অফিসার রাসনা কীভাবে পুরো বিষয়টা তাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে সে-নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, সেই সঙ্গে গতকাল লেখক আরিয়ান শফিককে গ্রেপ্তার করার পর সে এবং তার বাইরের সহযোগীরা মিলে আহত করে পালিয়েছে। সেই সঙ্গে বিশেষ সূত্রে এও জানা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক প্রফেসরকে হত্যার পেছনেও তার এবং তার দুই সহযোগীর হাত রয়েছে। সংবাদ পাঠিকা এও জানিয়েছে, লেখক আরিয়ান শফিকের বাগদত্তা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে লেখক আরিয়ান শফিকের মানসিক ভারসাম্যে সমস্যা আছে। তার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়েছে, এসব বিষয়ে কথা বলাতে তার ওপরে বিভিন্ন সময়ে শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার ও করেছে বলে জানিয়েছে সে, লেখক আরিয়ান শফিকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে লেখক আরিয়ান শফিকের বাগদত্তা তাকে সমাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়ে জনসাধারণকে অনুরোধ করেন তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। এরপর রাসনা, জুলহাসের ছবিসহ তিনজনের বিস্তারিত বিবরণ এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা জানিয়ে সংবাদটা শেষ হয়েছে।
‘কী বুঝলেন?’ রাসনা চোখ নেড়ে জানতে চাইল।
আরিয়ান ঝিম মের বসে আছে। জুলহাস আনমনে মাথা নেড়ে বলে উঠল, ‘শুধু তিনি না, আমরা সবাই এখন এক্সপোজড, বলে সে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে একটু পর ফিরে এলো, মাথায় পুরনো একটা ক্যাপ পরে। রাসনা তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মৃদু হাসি ক্যাপটা মুখের ওপরে যতটা সম্ভব টেনে দিতে দিতে বলে উঠল, ‘গাড়িতে ছিল, কিছু তো কাজে দিবে।’
‘আমাদের জলদি করতে হবে,’ আরিয়ান গম্ভীর মুখে বলে উঠল। সে মুখের একপাশের পট্টিতে হাত বুলাচ্ছে, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে তার চেহারা পট্টির আড়ালে খানিকটা নিরাপদ কি না।
‘এত ঝামেলা করে লাভ নেই বরং তিনজনে তিনটা মাস্ক পরে নিলেই হবে, ‘ রাসনা বলে উঠল। আপনার কি মনে হয় আপনার বাগদত্তাকেকি ওরা থ্রেট করেছে কোনোভাবে?’
‘না লোভ দেখিয়েছে,’ আরিয়ান মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল। ‘আমি নিশ্চিত ওকে ভালো একটা অঙ্কের টাকা অফার করা হয়েছে,’ বলে সে আবারো মাথা নাড়ল। ‘আমারই ভুল আসলে এই বিচ্ছুটার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরো অনেক আগেই ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কী করব,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘মানুষ সম্ভবত তার ভালোবাসার কাছেই সবচেয়ে বেশি অসহায়।’
‘কেন থ্রেটও তো দিয়ে থাকতে পারে?’ জুলহাস জানতে চাইল।
আরিয়ান চোখ তুলে তাকাল জুলহাসের দিকে। ‘না, গতকালও যদি কেউ আমাকে বলত, তাও হয়তো বিশ্বাস করতাম কিন্তু আজ না, নিজেকে বহু বছর ভুল বুঝিয়ে রেখেছি স্রেফ দুর্বলতার কারণে কিন্তু আর না। আমি যখন অসহায় হয়ে পড়ি প্রতিবারই সে এই কাজ করে, একবারই প্রথম না। কাজেই এটাই ইনিভিটেবল।’
‘আপনার পরিবারের লোকজন সেফ আছে তো?’ রাসনা জানতে চাইল।
‘তারা, ক্যান্টনমেন্টে আমার চাচার সঙ্গে থাকার কথা, তিনি মেজর জেনারেল কাজেই তাদের ওপরে কোনো থ্রেট আসবে না,’ আরিয়ান মাথা নেড়ে বলে উঠল I ‘প্রশ্ন হলো কতদিন!
‘আসলে ওরা আপনার ইমেজ নষ্ট করছে, সেই সঙ্গে আমাদেরকে জড়াচ্ছে। আপনার বই বাতিল করতে হলে এটা খুবই জরুরি,’ জুলহাস যোগ করল।
‘তা তো বটেই, আমার বিশ্বাস যদি এরই মধ্যে বাজেয়াপ্ত না হয়ে গিয়ে থাকে, তবে আজকের ভেতরেই বই নিষিদ্ধ হবে—’
‘—এবং খুব দ্রুতই সেগুলোকে মার্কেট থেকে তুলে নেওয়া হবে।’
‘এর মানে প্রমাণ লাগবে, খুব সলিড প্রমাণ লাগবে আমাদের এবং খুব দ্রুত,’ আরিয়ান সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘সলিড প্রমাণ ছাড়া কোনোভাবেই আসলে যে কিছুই করতে পারব না আমি,’ আপনারাও না। বলে সে রাসনার দিকে তাকাল, ‘আপনার চাকরিও যদি এরই মধ্যে না গিয়ে থাকে খুব দ্রুত সাসপেন্ড হবেন আপনি। আপনার পরিবারের কী অবস্থা?’
‘পরিবার সেফ আছে, আমার পরিবার নিয়ে ভাববার নেই। আর চাকরি, আমার বস খুব শক্ত মানুষ এবং আমার ওপরে বিশ্বাস রাখবে। তাকে এত সহজে টলানো যাবে না। কিন্তু ওই একই প্রশ্ন, কতক্ষণ, ওদের হাতে এরই মধ্যে আমাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ আছে, আর আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত তাম্বুরা। কী হচ্ছে সেটাই বের করতে পারছি না।’
সমস্যা নেই করে ফেলব, জুলহাস হেসে উঠল। ‘তাহলে এখন পরবর্তী পরিকল্পনা কী? আমরা সরাসরি গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব?’
‘এটাই করতে হবে, কারণ কিছুই জানি না আমরা মানুষটার ব্যাপারে। সরাসরি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা না বললে হবে না। আর তাছাড়া এখন এক্সট্রিম মেজারে না গেলে হবে না। চলো,’ বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে মানসিক হাসপাতালের দিকে রওনা দিল ওরা।
.
‘কী অবস্থা জোনায়েদ? আপডেট কী?’ রহমান একেবারে শান্ত সুরে জানতে চাইল। তারাও হাইওয়ের পাশেই একটা অস্থায়ী স্টেশন বানিয়ে সম্ভাব্য টার্গেটের গতিবিধির ওপরে নজর রাখার চেষ্টা করছে। রহমান ক্রমাগত কথা বলে চলেছে, একবার মোবাইলে, তারপর ভিন্ন মোবাইলে তারপর অন্য কোনো মাধ্যমে। সে একদিকে কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়েছে লেখক আরিয়ান শফিক কতটা ভয়ংকর এবং তাকে ধরাটা কতটা জরুরি। আবার অন্যদিকে ঢাকায় তার পরোক্ষ টিম কাজ করছে মিডিয়া এবং ইত্যাদির বিষয়ে, অন্যদিকে ছায়া সংস্থা যাদের জন্য সে পরোক্ষভাবে কাজ করে তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে।
স্যার, রহমানের ডাক শুনে অস্থায়ী স্টেশন থেকে একটা কাগজ নিয়ে দৌড়ে এলো তার কাছে। ‘স্যার, ওরা বেশ কিছুক্ষণ এই জায়গাতে থেমে আছে। ‘এটা তাদের কোনো একটা টার্গেট জোন হতে পারে বলে মনে করছে আমাদের কমিউনিকেশন অফিসার।’
‘প্রথম প্রশ্ন, ওরা এখান থেকে ঠিক কতটা দূরে?’ রহমান চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে সরাসরি তাকাল জোনায়েদের চোখের দিকে। ‘একেবারে সঠিক এস্টিমেট চাই আমার।’
স্যার, আমাদের এখান থেকে গাড়িতে ওরা পনেরো বিশ মিনিটের দূরত্বে আছে।’ জোনায়েদের কথা শুনে রহমান মাথা নেড়ে সায় জানাল। দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেন আমাদের কমিউনিকেশন অফিসারের মনে হচ্ছে ওরা এখানেই কিছু একটা করতে চাচ্ছে? এমনও তো হতে পারে ওরা হয়তো গাড়িটা ডাম্প করতে চাচ্ছে?’
জোনায়েদ বড়ো করে দম নিল, এই লোককে খুশি করা খুব টাফ। ‘স্যার, প্রথমত, ওরা এখানে থামার আগে জায়গাটা খুব ভালোভাবে রেকি করেছে, গাড়ি নিয়েই চক্কর দিয়েছে বেশ কয়েকবার। মানে তারা বেশ ভালোভাবে রেকি করেছে, তারপর এখন সেখানে অপেক্ষা করছে কিছু একটা করার জন্য।’
‘এটা কোনো যুক্তিই না,’ রহমান একেবারেই শান্তভাবে মাথা নাড়ল, কিন্তু তার গলায় কাঠিন্য। ‘তারা হয়তো গাড়ি ডাম্প করার জন্য জায়গা খুঁজেছে, সঠিক জায়গা পেয়ে এখন গাড়ি ডাম্প করে সরে পড়েছে। আমি তুমি যখন গল্প করছি এখানে, ততক্ষণে ওরা সরে পড়েছে বহুদূর।’
‘নারায়ণগঞ্জে ওদের লোকেট করার পর রহমান সরাসরি সিদ্ধান্ত নেয় এবার কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে, সে ধারণা করে ওরা কিছু একটা পেছনে লেগেছে। সম্ভবত নিজেদের নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ খুঁজছে, আর সেজন্য ওরা কিছু একটা করছে, সেটা কী হতে পারে বোঝার চেষ্টা করছে সে। আর সে জন্য ওদের না ধরে বরং ওরা কীসের পেছনে লেগেছে সেটা জানার এবং বোঝার চেষ্টা করবে, তারপর সেখান থেকে একেবারে এমনভাবে ওদেরকেও ধরবে এবং এই পুরো ব্যাপারটাকে একেবারে গোড়া থেকে সমাধান করবে। সেজন্য আফজাল মিস্ত্রিকে ভয় দেখিয়ে তাকে ওদেরকে ধরিয়ে দিতে না বলে বরং বলে ওদেরকে তাড়িয়ে এমনভাবে নির্দিষ্ট একটা গাড়ির কাছে ওদেরকে নিয়ে যেতে যেটাতে ওরা ট্র্যাকার লাগিয়ে রেখেছে। আর তাড়া করার এবং ওদেরকে পেছন থেকে গুলি করার বিষয়টা ছিল পুরোপুরিই নাটক, যাতে তারা সন্দেহ না করে। আর সেটা কাজেও লেগেছে।
‘স্যার, আমি মেইন পয়েন্টটা বলিনি, যে-জায়গায় ওরা অবস্থান করছে এখন এটা সেই জায়গা,’ বলে সে একহাতে ধরা প্রিন্ট করা লোকেশনটা দেখাল, তারপর অন্যহাতে মোবাইলে জায়গাটা বের করে দেখাল। ‘মানসিক হাসপাতাল!’ রহমান বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল। সে এখনো স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে আছে।
‘স্যার—’ জোনায়েদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রহমান তাকে মৃদু ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। ‘এক মিনিট জোনায়েদ, আমি এই জায়গা চিনি, ‘
বলেই সে নিজেকে শুধরে নিল। ‘পুরো ঘটনার কোথায় যেন এই জায়গার একটা সংযোগ আছে,’ সে অনেকটা বিড়বিড় করে বলছে। মানে আমি এই জায়গার নাম পড়েছি কোথাও,’ বলেই সে লাফ দিয়ে নেমে এলো জিপের হুডের ওপর থেকে। একজনকে নির্দেশ দিল তার কাগজপত্রের ব্যাগটা নিয়ে আসতে।
এক গাদা কাগজ মেলে ধরল সে জিপের হুডের ওপরে। জোনায়েদ আর অন্য লোকটা চোখাচোখি করছে পরস্পরের সঙ্গে। করছে কি মানুষটা! উভয়েরই মনে প্রশ্ন।
কিন্তু রহমানের এসব কোনোদিকে খেয়াল নেই। সে ফাইল ঘেঁটে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ ঘাঁটার পর মুখ তুলল সে ওপরের দিকে, হাতে একটা কাগজ ধরা, মুখে ফুটে উঠেছে বিজয়ের হাসি। ‘এই কারণেই যেকোনো কেসে ব্যাকগ্রাউন্ড খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া জরুরি। গাড়ি বের করতে বলে জোনায়েদ, এখন আমি জানি ওরা ওখানে কেন গেছে, কী করতে গেছ এবং পুরো কেসের সঙ্গে এই জায়গার সংযোগ ঠিক কোন জায়গাতে। আমাদের পরিকল্পনা কাজে দিয়েছে। এবার আর ওদের ধরতে খতম করতে এবং এই যন্ত্রণা গোড়া থেকে উৎখাত করতে আর কোনো বাধা নেই।
‘কি নাম বললেন?’ মানসিক হাসপাতাল এবং রিহ্যাব সেন্টারের রিসিপশনে বসা রিসিপশনিস্ট মৃদু হেসে জানতে চাইল।
‘নাইম, আবু সালেহ নাইম,’ নামটা আবারো পরিষ্কার করে উচ্চারণ করল জুলহাস। বলে সে রিসিপশনের সোফায় বসে থাকা আরিয়ান এবং রাসনার দিকে একবার দেখে নিল। তিনজনেই মুখে হালকা মাস্ক পরে আছে।
ওরা হাসপাতালে ঢুকেছে খুব বেশি সময় হয়নি। হাসপাতালটা বেশ বড়ো এটা ওরা বাইরে থেকেই দেখেছিল কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল বাইরে থেকে যা দেখায় হাসপাতালটা, ভেতরে অরো সুন্দর এবং সাজানো গোছানো। ওরা গেটে যায় একজন পেশেন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বলার পর ওদের ভেতরে রিসিপশনে পাঠান হয়। সেখানে এসে যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তার নাম জানতে চাইলে নামটা বলে জুলহাস।
‘স্যার, তিনি কী আমাদের এখানে এমপ্লয়ি?’ রিসিপশনিস্ট আগের মতোই হাসিমুখে জানতে চাইল কিন্তু তার হাসি আগের চেয়ে একটু যেন কমেছে। জুলহাস কী বলবে ভেবে না পেয়ে কিছুই বলল না, সামান্য মাথা নাড়ল শুধু।
মেয়েটা স্ক্রিনের দিকে দেখছে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে পরীক্ষা করে সে জুলহাসের দিকে তাকিয়ে আবারো প্রশ্ন করল, ‘স্যার, আপনি কী নিশ্চিত তিনি আমাদের এখানকার এমপ্লয়ি?’ মেয়েটা তাকিয়ে আছে সরাসরি ওর দিকে। তার মুখে হাসি আছে কিন্তু সেটা প্রায় তলানিতে ঠেকেছে।
জুলহাস গাঁইগুই করে এড়াতে চেয়ে পারল না, এবার আর সরাসরি জবাব না দিয়ে উপায় নেই। ‘জি, মানে, হুমমম।’
মেয়েটার হাসি এবার পুরোপুরি উবে গেছে। ‘স্যার, এই নামে আমাদের এখানে কোনো এমপ্লয়ি নেই,’ তার গলার সুরও বদলে গেছে অনেকটা।
‘কী ব্যাপার কোনো সমস্যা?’ পাশ থেকে ফরমাল পোশাক পরা মধ্যবয়স্ক একজন এসে দাঁড়িয়েছে রিসিপশনের একেবারে কাছে। তার একহাতে একটা ওয়াকিটকি। জুলহাস অনুমান করল লোকটা সিকিউরিটির কেউ হতে পারে।
‘স্যার, তিনি আবু সালেহ নাঈম নামে একজনকে খুঁজছে—’
‘এক মিনিট রিতা,’ বলে সে জুলহাসের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে বলে উঠল, ‘স্যার, আপনি একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ,’ সে আরিয়ান আর রাসনা যেখানে বসে আছে সেই সোফা দেখিয়ে বলে উঠল। ‘আমি আপনাদের জন্য কফি দিতে বলছি।’
‘জুলহাস সোফায় এসে ধপ করে বসে পড়ল, আরিয়ান আর রাসনা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকলেও কোনো জবাব দিল না। ‘কিছু পেলে?’ রাসনা আর থাকতে না পেরে প্রশ্নই করে বসল।
‘কফি খাও সবাই,’ বলে সে একজন মেসেঞ্জারের নিয়ে আসা কফির কাপটা ট্রে থেকে তুলে নিল। ‘কফি খাও আর খোদারে ডাক।
‘আরে—’ আরিয়ান কিছু একটা বলতে যচ্ছিল সেই ফরমাল পোশাক পরা লোকটাকে টকি হাতে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল ওরা।
‘স্যার, আপনি যে-নাম বলেছেন, এই নামে আমাদের কোনো এমপ্লয়ি নেই, বলে সে তিনজনের বোকার মতো হয়ে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘তবে এই নামে একজন পেশেন্ট আছে আমাদের এখানে।’
পেশেন্ট, মনে মনে বলে উঠল আরিয়ান, মানে পাগল, সে রাসনা আর জুলহাসের দিকে তাকিয়ে বুঝল ওদের মনেও একই ভাবনা চলছে।
১১
‘আপনারা আসলে ওর কী হন, আমাকে সঠিকভাবে বলুন তো?’ সেক্রেটারিয়েট ডেস্কের ওপাশ থেকে কেমন জানি ছেলেমানুষ চেহারার বয়স্ক মানুষটা ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল। এরকম মানুষ প্রায় সব সেক্টরেই দেখা যায়, বেশ বয়স হয়েছে, মোটামুটি কোয়ালিটিও আছে, হয়তো মানুষ হিসেবেও ভালো কিন্তু এদের সমস্যা একটাই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটা ঠিক ম্যাচিউর হয়ে ওঠেনি। ফলে অনেকেই এরকম মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য ঠিক যোগ্য বলে মনে করে না। তাই প্রায়ই এরকম মানুষকে দেখা যায়—হয় মোটা গোঁফ রাখতে অথবা, চোখের সমস্যা না থাকলেও বেমানান ভারী চশমা পরতে, স্রেফ চেহারাটাকে ভারিক্কি করার জন্য, যাতে তার পজিশন অনুযায়ী লোকে তাকে সিরিয়াসলি নেয়। ঠিক যেমন এই মানসিক হাসপাতাল এবং রিহ্যাব সেন্টারের প্রধান পরে আছেন এবং আরিয়ানদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বেশ সিরিয়াস একটা ভাব ধরে রেখেছেন চেহারায়।
ওদের রিসিপশনে লোকটা এসে বলার পর প্রথমে ভেতরে নেওয়া হয়, তারপর কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে জানানো হয় একজন ডাক্তার ওদের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু যখন ভেতরে নেওয়া হয়, তখন ওরা দেখতে পায় ওদের সরাসরি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একেবারে প্রতিষ্ঠান প্রধানের কামরায়। সেখানে নেওয়ার পর ভদ্রলোক ওদের কাছে জানতে চায় কেন নাঈমের সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে ওরা এবং ওদের সঙ্গে নাঈমের সম্পর্ক কী? প্রথম জুলহাস কথা বলার পর তাকে খুব একটা সন্তুষ্ট মনে না হওয়াতে সে বিস্তারিত জানতে চায় কেন আসলে ওরা নাঈমের সঙ্গে দেখা করতে চায় এবং তার সঙ্গে আসলে ওদের সম্পর্ক কী।
‘স্যার, আমি বলছি,’ আরিয়ান চেয়ারে হেলান দেওয়া থেকে খানিকটা সোজা হয়ে বসল। ‘নাঈম আসলে আমাদের কারোরই কিছু হয় না,’ পাশ থেকে জুলহাস কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিল আরিয়ান। ‘আমাদের আসলে সময় নেই। আমাদের এক বন্ধু ছিল, টোকন নাম, আসলে ওর বন্ধু,’ জুলহাসের দিকে দেখাল। ‘টোকন কিছু একটার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং কিছুদিন আগে সে মারা যায়, কিন্তু মারা যাওয়ার আগে তার মাধ্যমে কোন না কোনোভাবে আমরা নাইমের নাম জানতে পারি। এখন সেই বিষয়ে তথ্যের জন্যই তার সঙ্গে কথা বলাটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি,’ আরিয়ান সরাসরি তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। ‘স্যার, আমি খুব বিস্তারিত বলব না, এটা আমাদের সবার জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে, শুধু এটুকু বলব, নাঈমের কাছে এমন কিছু তথ্য আছে যার ওপরে আসলে আমাদের সবার জীবন নির্ভর করছে,’ লোকটা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। হঠাৎ প্রায় ওদের চমকে দিয়ে সে একটা বেল বাজাল, মেসেঞ্জার লোকটা আসতেই সে একজন ডাক্তারের নাম বলে তার কাছ থেকে একটা ফাইল আনার নির্দেশ দিল।
মেসেঞ্জার চলে যেতেই সে আরিয়ান, জুলহাস এবং রাসনাকে দেখে নিল। ‘আপনাদের বন্ধুর নাম টোকন, তাই না?’ সে মৃদু হেসে বলে উঠল। ‘আপনাদের কী কামাল নামে আরেকজন বন্ধু ছিল?’
লোকটার প্রশ্ন শুনে ওরা তিনজনে প্রায় একসঙ্গেই চমকে উঠল। ‘আপনি জানলেন কীভাবে?’ আরিয়ান প্রায় ধমক দেওয়ার মতো করে জানতে চাইল। কিন্তু শিশু চেহারার বয়স্ক লোকটা তাতে কিছু মনে করল না। বরং সে আবারো মৃদু হেসে যোগ করল, ‘কীভাবে জানি বলছি, ফাইলটা আসুক, শুধু বলছি না দেখাচ্ছি। আমার ধারণা আপনারা কোনো না কোনোভাবে কামাল কিংবা আপনাদের বন্ধু টোকনের মাধ্যমে নাঈমের নাম জেনেছেন, ও সরি, আপনি তো বললেনই, টোকনের মাধ্যমে। কিন্তু আমি প্রায় নিশ্চিত, আপনারা জানেন না টোকন কিংবা কামালের সঙ্গে নাইম কীভাবে কানেকটেড ছিল।’
তিনজনে প্রায় একসঙ্গে ডানে বামে-মাথা নাড়ল, আর যাই হোক এরকম কিছু লোকটার কাছ থেকে আশা করেনি ওরা, বা এখানে এসে এরকম তথ্য পাবে সেটাও আশা করেনি। ‘কীভাবে?’
‘আপনারা ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের প্রফেসর রফিকুজ্জামানের নাম শুনেছেন?
‘হ্যাঁ, মানে—’
‘কামাল টোকন এবং নাঈম ওরা তিনজনেই এই প্রফেসরের সঙ্গে একটা প্রজেক্টে কাজ করেছিল, মানুষটা বলে উঠল। ‘এই প্রফেসরের মাধ্যমেই ওরা পরিচিত হয়, আমি জানি না টোকন কিংবা কামাল আগে থেকে পরিচিত ছিল কি না কিন্তু নাঈম ওদের সঙ্গে আগে থেকে পরিচিত ছিল না। ওদের সঙ্গে ওই প্রজেক্টে কাজ করার সময়েই তার পরিচয়।
আরিয়ান আনমনেই একবার মাথা নেড়ে জুলহাসের দিকে দেখে নিল। ওদের মনেও একই ভাবনা খেলে যাচ্ছে, এই লোক যা বলছে তা সেন্স মেইক করে। ‘এই কারণেই নাঈমের নামটা আমার কাছে পরিচিত ঠেকছিল, বারবার মনে হচ্ছিল কোথায় শুনেছি। আসলে এই নাম আমি টোকনের কাছেই কোনো কোনো সময় শুনেছিলাম। ওরা তিনজনে একসঙ্গে সেই প্রজেক্টে কাজ করেছিল,’ জুলহাস মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল।
‘হ্যাঁ, ওই প্রজেক্টেই হবে.’ মেসেঞ্জার ফাইল দিয়ে যেতেই সেটাকে সে টেবিলের ওপরে মেলে ধরল। ‘আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি কীভাবে জানলাম। আমি জেনেছি নাইমের কেস ফাইল রেডি করতে গিয়ে, ওর কনসাল্টিং ডক্টর হিসেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কী জানেন, আমি এটুকুই জানি আর সেই সঙ্গে আফসোসের সঙ্গে এটাও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনারা হয়তো কোনো না কোনোভাবে নাঈমের নাম বের করেছেন কিন্তু আপনাদের কী তথ্য আমি সেটা জানি না—তবে এটা জানি, সেই তথ্য নাঈমের কাছ থেকে আপনারা জানতে পারবেন না,’ বলে সে ইচ্ছে করেই থামল। ‘কারণ সেই প্রজেক্টে কাজ করার পর থেকেই নাঈম বলতে গেলে বদ্ধ উন্মাদ, আপনাদের আমার কথা বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই, আপনারা আমার কামরার বাইরে থাকা মেসেঞ্জারের সঙ্গে যান, সেই আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, আপনারা নিজে গিয়ে দেখে আসুন,’ বলে সে আবারো থামল। ‘আচ্ছা এক কাজ করি, আমিই আপনাদের নিয়ে যাই।’
ওরা একে অপরের দিকে মুখ দেখাদেখি করছে, এতদূরে এসে কী আশার আলো তবে সব নিভে গেল। ডিরেক্টর সাহেব উঠে দাঁড়াতেই ওরা তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। ‘নাঈমের হয়েছিল কী?
‘সেটা আমরাও পুরোপুরি বের করতে পারিনি। নাঈম আমার দূর সম্পর্কের এক ধরনের আত্মীয় হয়, ছোটবেলাতেই ওর বাবা-মা মারা গেছে,’ ডিরেক্টর এই পর্যন্ত বলতেই ওরা আবার একে অপরের দিকে দেখে নিল, আবারো এতিম আরেকজনের রেফারেন্স। ‘ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট করে বড়ো হয়েছে ছেলেটা। তবে ও আবার আত্মীয়স্বজনের থেকে সাহায্যও পেয়েছে। ইন্টার পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সে পড়ালেখা করেছে, খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। কিন্তু ওর মানসিক সমস্যার রেকর্ড ছিল ছোটবেলা থেকেই। ভালোই চাকরি করছিল, তারপর কী একটা প্রজেক্টে কাজ করতে গেল, এসেই ওর মাথায় গোলমাল দেখা দিল। সম্ভবত প্রজেক্টের কাজের সময়ে কাজের প্রেসারে বা অন্য কোনোভাবে চাপ পড়েছিল মাথায় বেশি, সেটা ওর মাথা নিতে পারেনি। সেই প্রজেক্ট থেকে আসার পর পরই আমার এখানে আসে ও, তখন অনেকটা ভালো ছিল, দুঃখজনক বিষয় হলো, এখানে এসে ওর অবস্থা ভালো না হয়ে আরো খারাপ হয়েছে ধীরে ধীরে, আমরাও খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। এখন তো পুরোপুরি উন্মাদ,’ ওরা করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে খোলা জায়গাতে বেরিয়ে এলো।
‘আপনি টোকন কামাল ওদের কথা জানলেন কীভাবে? সেই সঙ্গে প্রফেসরের নাম ওর প্রজেক্টের কাজ? প্রজেক্টের কাজ কী নিয়ে ছিল সেই ব্যাপারে কিছু জানেন কি আপনারা?’
লোকটা আবারো হেসে উঠল। দুঃখজনকভাবে আমি তেমন কিছুই জানি না। টোকন কামাল এবং প্রফেসরের নাম ওর কাছ থেকেই জেনেছি, প্রথমে যখন এখানে এলো তখন এতটা খারাপ ছিল না, সেই সময় বলেছিল আমাকে, কিন্তু আফসোস প্রজেক্ট কী নিয়ে কেন এত চাপ পড়েছে ওর মাথায় সেই ব্যাপারে আমরা কিছু জানতে পারিনি। হয়তো ভালোই হয়েছে,’ বলে সে সামনে তার দিয়ে ঘেরা ছোট একটা উঠানের দিকে দেখাল। আমরা চলে এসেছি। আপনারা হয়তো ওকে চেনেন না, ওই যে,’ বলে সে সামনের দিকে দেখাল।
হালকা তারের বেড়া দেওয়া জায়গাটার অন্যপাশে বেশ অনেকটা জায়গা খোলা উঠানের মতো, মাঝখানে ফাঁকা তার চারপাশে কিছু বেঞ্চ পাতা আছে, কিছু খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে, টুকটাক করার মতো আরো কিছু জিনিস আছে। তার ভেতরেই আকাশি-নীল রঙের পোশাক পরে ইতস্তত এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে রোগীরা, দেখলেই বোঝা যায় বেশির ভাগ মানসিক রোগী।
‘এখানে বেশির ভাগই মানসিক রোগী,’ ঠিক আরিয়ানের মনের কথাটাই বলে উঠল ডিরেক্টর লোকটা। ‘আমাদের ইনডোরেও প্রায় কাছাকাছি ধরনের সেটাপ আছে, তবে আবহাওয়া ভালো থাকলে মাঝে মাঝে পেশেন্টদের এখানে খোলা জায়গাতে সামাজিক হওয়ার খানিকটা সুযোগ দেওয়া হয়। তবে খুব কড়া নজরদারির ভেতরে অবশ্যই। ওই যে, জটলাটার পাশে, বেঞ্চে বসা ছেলেটাই নাঈম,’ বলে সে ওদের নির্দিষ্টভাবে দেখাতেই ওরা দেখতে পেল, এলোমেলো লম্বাচুলের শুকনো-পাতলা একটা ছেলে ঝিম মেরে বেঞ্চে বসে আছে, জটলাটার পাশে হলেও কেউ তার সঙ্গে সেভাবে কথা বলছে না কিংবা কোনো ধরনের কমিউনিকেশনও করছে না। ওরা দেখতে দেখতেই উঠে দাঁড়াল ছেলেটা—পাশে জটলায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করল কিন্তু কাজ না হওয়াতে আবার হেঁটে উলটোদিকে চলে গেল। শারীরিক ভঙ্গি থেকে শুরু করে চেহারার নিরাবেগ এক্সপ্রেশন কোনোকিছুই ঠিক নেই, দেখলেই বোঝা যায় ছেলেটা একেবারেই স্বাভাবিক না, তার ওপরে এলোমেল চুল আর দূর থেকেও পরিষ্কার দেখতে পাওয়া লাল চোখ তাকে খানিকটা যেন উম্মাদ ভাব এনে দিয়েছে চেহারায়।
‘কোনোভাবে কী কথা—’
ডিরেক্টর হেসে উঠল জুলহাসের অসমাপ্ত প্রশ্ন শুনে। ‘আপনারা যদি খুব জোরাজুরি করেন আমি চেষ্টা করতে পারি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হবে না। শেষবার যখন আপনাদেরই মতো এরকম একজন এসেছিল, লোকটা খুবই ইনসিস্ট করছিল দেখা করে কথা বলার জন্য। আমি আয়োজনও করেছিলাম, এমনকি আমার ডাক্তারেরা মানা করার পরও। কিন্তু সেটার ফল হয়েছিল খুবই ভায়োলেট, কাজেই—’ সে অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আপনারা চাইলে আরো কিছুক্ষণ এখানে থেকে ওকে অবজার্ভ করতে পারেন, আমার কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে,’ আর যদি যেতে চান এখনি আমার সিকিউরিটি আপনাদের পথ দেখাবে।
আরিয়ান, জুলহাস আর রাসনা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, এই ছেলের যে-অবস্থা তাতে এখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেই বা আর লাভ কী। আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ‘না, আমরা যাব।’ বাকি দুজনও অ্যাগ্রি করল। ওরা ডিরেক্টরের সঙ্গে মূল ভবন পর্যন্ত এলো, এরপর সিকিউরিটি ওদের পথ দেখিয়ে বাইরে দিয়ে এলো। ওরা ফিরে এসে গাড়িতে বসল। পুরো পথ জুড়ে তিনজনের আর কেউই কোনো কথা বলেনি। গাড়িতে উঠে বড়ো করে দম নিয়ে জুলহাস জানতে চাইল, ‘এরপর কি?
১৩
‘আপনারা কেউ বি এফ স্কিনারের নাম শুনেছেন?’ আরিয়ান অনেকটা স্বগোতক্তির মতো বলে উঠল।
রাসনা আর জুলহাস দুজনেই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, একেবারেই অযাচিতভাবেই আরিয়ান ভিন্ন কথা বলে ওঠাতে দুজনেই বেশ অবাক হয়ে ফিরে তাকাল তার দিকে। ‘কী?’ জুলহাস জানতে চাইল।
‘বোরহাস ফ্রেডরিখ স্কিনার, একজন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী, বিহেভিয়রিস্ট হিসেবে বেশি পরিচিত। আপনারা কেউ তাকে চেনেন?’ বলে আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। রাসনা আর জুলহাস একে অপরের দিকে দেখল, অতিরিক্ত প্রেসারে কি লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! কিন্তু আরিয়ানের ওদের দিকে কোনো খেয়াল নেই, সে তাকিয়ে আছে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। ‘বি এফ স্কিনার ছিল গত শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী মনোবিজ্ঞানীদের ভেতরে একজন, বিতর্কিতও বটে। যাই হোক বি এফ স্কিনার এবং গত শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত দশটা মানসিক এবং মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত পরীক্ষা নিয়ে আরেক সাইকিয়াট্রিস্ট লরেন সেটার একটা বই লেখেন। বইটার নাম ‘ওপেনিং স্কিনার’স ‘বক্স,’ বলে সে রাসনা আর জুলহাসের অবাক চেহারার দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি দিল।
‘লেখক হওয়ার একটা মজা হলো, শুধু নিজের বিষয় নয়, দুনিয়ার সবকিছু নিয়ে অবাধ পড়ালেখা করা যায়। তো যা বলছিলাম এই ওপেনিং স্কিনারস বক্স বইতে বর্ণনা করা দশটা পরীক্ষার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত একটা পরীক্ষা করেছিলেন ডেভিড রোজেনহান নামের এক মনোবিজ্ঞানী। তার এই পরীক্ষা ইতিহাসে নানাদিক থেকে বিখ্যাত, কুখ্যাত এবং বিতর্কিত হয়ে আছে। এমনকি ও হেনরির মতো গল্পকারেরাও এই পরীক্ষা নিয়ে গল্প লিখেছে।’
‘আমাদের বর্তমান এই আধখেচরা অবস্থার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?’ রাসনা খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল, জুলহাস দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল তাকে।
‘বলছি, কিন্তু তার আগে অবশ্যই পরীক্ষাটা কী নিয়ে ছিল সেটা একটু শুনে নিন প্লিজ। পরীক্ষাটা ছিল পাগলাগারদে পাগল ঢোকানোর আগে যে পদ্ধতিতে মানসিক পরীক্ষা চালানো হয় সেটার সমস্যা বের করা। কিন্তু শুরু করার পর পরীক্ষাটা আর সেটার ভেতরে থাকেনি সেটার বিস্তার বাড়তে থাকে,’ বলে আরিয়ান নড়েচড়ে বসল বহুদিন পর নিজের জ্ঞান ঝালাই করার সুযোগ পেয়ে তার পুরনো শিক্ষক সত্তা জেগে উঠেছে। ‘পরীক্ষাটা ছিল এই মনোবিজ্ঞানী সাহেব, বিভিন্ন পাগলাগারদে সত্যিকারের মানসিক রোগীদের সঙ্গে পাগল সাজিয়ে বেশ কিছু প্রফেশনাল অভিনেতাদের ঢুকিয়ে দেন। তার ইনটেনশন ছিল সত্যিকারের পাগল আর পাগলের অভিনয় করতে থাকা রোগী সেজে থাকাদের অথরিটি বের করতে পারে কি না।’
‘তাই নাকি?’ এবার অন্যরাও মজা পেতে শুরু করেছে। যদিও খুবই বাজে অবস্থার ভেতরে আছে তাও সত্যিকারের ইন্টারেস্টিং গল্প সবাইকেই আকর্ষণ করে, এটাই গল্পের শক্তি। ‘এটা কোন সময়ের ঘটনা?’
‘সত্তরের দশকের শুরুর দিকের।’
‘তো অথরিটি কী ধরতে পেরেছিল?’
‘না পারেনি,’ বলে আরিয়ান হেসে উঠল। ‘অথরিটি সত্যিকারের পাগল আর পাগলের অভিনয় করতে থাকা অভিনেতাদের ভেতরে কোনো পার্থক্যই করতে পারেনি, প্রথমত, অভিনেতারা ছিল খুবই দক্ষ প্রফেশনাল অভিনেতা এবং অথরিটির পাগল বা মানসিক রোগী শনাক্ত করার পদ্ধতি ছিল পুরোপুরি ভুল। অভিনেতারা পাগলদের সঙ্গে পাগল সেজে বেশ কিছুদিন থাকার পরও কেউ ধরতে পারেনি আনটিল—’
আরিয়ান থেমে রাসনা আর জুলহাসের দিকে তাকিয়ে হাসি দিল। ‘এখানেই গল্পের মজা এবং টুইস্ট। এই এক্সপেরিমেন্টের একটা মারাত্মক ফলাফল ছিল এই অভিনেতারা যখন সত্যিকারের পাগলদের মাঝে বসবাস করছিল অথরিটির ডাক্তার এবং নার্সেরা ধরতে না পারলেও কারা পেরেছিল জানো—’
‘কারা?’ জুলহাস অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে সে, সম্ভবত খানিকটা হলেও কানেক্ট করতে পারছে ওদের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে।
‘এটা ধরতে পেরেছিল সত্যিকারের মানসিক রোগীরা, মানে পাগলেরা,’ বলে আরিয়ান ওদের দুজনের দিকে নিজের তর্জনী তাক করল। ‘অভিনেতারা যখন পাগলদের মাঝে বিচরণ করত ওরা পরিষ্কার ওদের থেকে সেপারেট হয়ে থাকত এবং নিজেদের গোত্র বা দলভুক্ত করত না, যেটা আমাকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য করছে, একটু আগে আমরা যা দেখে এসেছি তার পুরোটাই নাটক। নাঈম নামের এই ছেলেটার আসলে কোনো মানসিক সমস্যা নেই, সে কোনো না কোনোভাবে অথরিটির সঙ্গে একটা লিংক করেছে,’ বলে আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কারণ এই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর লোকটা তার রিলেটিভ, এবং এই নাঈম ছেলেটা খুবই ভালো অভিনেতা, সম্ভবত তার থিয়েটারে বা এরকম কোথাও কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে। আমি অনুমান করতে পারি সে টোকন আর কামালের সঙ্গে ওই প্রফেসরের অধীনে কাজ করার পর, ওদের মতোই সে যখন বুঝতে পারে, বড়ো ধরনের কোনো ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়েছে এবং এটাও বুঝতে পারে, সে আসলে এদের থেকে পালাতে পারবে না, সে তখন নিজের আত্মীয়ের মানসিক হাসপাতালের ডিরেক্টর হওয়ার সুযোগ নিয়ে এমনভাবে নিজেকে মানসিক রোগী সাজিয়ে রাখে—যাতে তাকে কেউ বিপদ মনে না করে।’
‘এই কারণেই সাধারণ এক রোগীর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এলে ডিরেক্টর তার সঙ্গে কথা বলে, এত এত রোগীর ভেতরেও সিকিউরিটি প্রধান নির্দিষ্ট রোগীর নাম জানে—’
‘—এবং ওরা এমনভাবে একটা সেটাপ করে রেখেছে যাতে যে-কেউ এলে দেখা করতে পারে এবং সম্ভবত বহুবার রিহার্সেল করা নাটকটা ওরা আবারো মঞ্চস্থ করতে পারে এবং কারো মনে কোনো সন্দেহ না থাকে সে আসলেই পাগল,’ বলেই আরিয়ান গাড়ির দরজা খুলে ফেলল। ‘আমাদের এখনি ওর সঙ্গে গিয়ে কথা বলতে হবে,’ বলেই গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমেই আরিয়ান দৌড় দিল হাসপাতালের গেটে দিকে। হতভম্ব জুলহাস আর রাসনাও নেমে এলো তার পিছু পিছু। ওরা দূর থেকে দেখতে পেল আরিয়ান গেটের দারোয়ানের সঙ্গে কিছু একটা বলতে বলতে দারোয়ানকে এক ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল, পেছনে দারোয়ান চিৎকার করতে করতে ওরা পৌঁছে গেল, প্রথমজনকে সামলাতে সে এতটাই বিজি ছিল। ওদের দেখতে পায়নি। ওদের দেখে আরো দুজন গার্ড বেরিয়ে এলো, কিন্তু রাসনা আর জুলহাসও ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। প্রথম দারোয়ান আগেরজনের পিছু নেবে না এদের থামাবে ভাবতে ভাবতে জুলহাস এবার তাকে আরেক ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দৌড় দিল ভেতরের দিকে, পেছনে তিন দারোয়ানই ত্বারস্বরে চিৎকার করছে। ওরা দুজনেই ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল আরিয়ান মানসিক হাসপাতালের সামনের মাঠের ভেতর বরাবর প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করেছে। সেই ছোট্ট তার দিয়ে ঘেরা জায়গাটার দিকে, ওরাও তার পিছু নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। হাসপাতালের কোথাও অ্যালার্মের মতো কিছু একটা বেজে উঠেছে, লোকজনের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। ওরা কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে চলে এলো সেই তার দিয়ে ঘেরা জায়গাটার কাছে। এসে হাঁপাতে হাঁপাতে এদিকে-সেদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেল আগের রোগীরা সব আগের মতোই আছে, কিন্তু নাঈমকে দেখতে পেল না কোথাও। ‘রাউন্ড দাও,’ বলে সে গোল করে ঘেরা জায়গাটা রাউন্ড দিতে শুরু করল। ছোট্ট জায়গা আধ মিনিটের ভেতরেই তিনজনে দুদিক থেকে রাউন্ড দিয়ে দেখতে পেল ভেতরে নাঈম নেই।
পেছন থেকে হইহল্লা ভেসে আসছে, সেদিকে তাকিয়ে দেখল অনেকেই দৌড়ে আসছে, তাদের ভেতরে সেই ডিরেক্টরকেও দেখতে পেল। ‘আরিয়ান ওদিকে দেখ,’ বলে রাসনা ওদের মাঠের একদিকে নির্দেশ করলে দেখতে পেল, ছোট তারে ঘেরা জায়গাটা ও একপাশে একটা ছোট দরজা খোলা—সেটা খুলেছে একটা পায়ে চলা পথের ওপরে, সেখানে একজন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে আসছে তার হাতে একটা ফ্যাকাশে আকাশি পোশাক। সাধারণভাবে খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য কিন্তু ওরা দেখেই অনুধাবন করতে পারল এই পোশাকটাই নাঈমের পরনে ছিল এবং তাকেই কোথাও সরিয়ে পোশাকটা পালটে দিয়ে শুধু পোশাকটা নিয়ে ফেরত আসছে লোকটা।
তিনজনেই লোকটার দিকে দৌড় দিতেই লোকটা ঘাবড়ে উলটোদিকে দৌড়াতে শুরু করল। আরিয়ানই সবার আগে পৌঁছাল লোকটার কাছে, হাতে বেরিয়ে এসেছে ওর পিস্তলটা। সময় নেই, পেছন থেকে আসতে থাকা লোকগুলো আরেকটু এগিয়ে এলে আর সময় পাওয়া যাবে না, সিকিউরিটির লোকটাকে পেছন থেকে ধরে, পিস্তলটা সোজা ঠেকাল তার দুই চোখের মাঝে, ‘হাঁপাতে হাঁপাতেই আরিয়ান বলে উঠল, ‘আমি জানি তুমি কোনোভাবে জড়িত না, স্রেফ কাজ করছ এখানে,’ আড়চোখে দেখল ডিরেক্টর আর তার টিম প্রায় চলে এসেছে। ‘বলো নাঈম কোথায়, না হয় আমি সোজা গুলি করব, বলেই লোকটার কানের পাশ দিয়ে পেছনে ফাঁকা গুলি করল আরিয়ান। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিকিউরিটির লোকটার প্যান্টের নিচের অংশ ভিজে গেল, সে একটা হাত তুলে পেছনে দেখাল। ‘ওই যে ঘরে ভিতরে কাপড় পরতাছে, বাইর হয় নাই,’
পেছনের চালা ঘরটার দিকে দৌড়াল তিনজনে। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ফেলেই দেখতে পেল পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল একটা ছায়া। জলদি জলদি,’ বলেই ওরা ঘরটার ভেতর দিয়ে দৌড় দিল। পেছনের দরজার কাছাকাছি যেতে যেতেই দেখতে পেল, চালা ঘরটা আর হাসপাতালে পেছনের বাউন্ডারির মাঝখান দিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে নাঈম ছেলেটা। ‘ধরো ধরো,’ বলেই ওরা দৌড়াতে লাগল, কিন্তু ছেলেটা অনেকটাই এগিয়ে গেছে।
ছেলেটা বাউন্ডারির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, আরিয়ান পিস্তল বের করে চিৎকার করে উঠল, ‘থামো নইলে গুলি করব,’ নাঈম ছেলেটা ভ্রুক্ষেপও করল না। ওরা তিনজনেই দম হারিয়ে গতি কমে গেছে, পিস্তলের ভয় দেখাতেই ছেলেটা উলটো গতি বাড়িয়ে বাউন্ডারির কাছাকাছি পৌঁছে গেল। ওরা ভেবেছিল ছেলেটা বাউন্ডারি টপকে পালানোর চেষ্টা করলে ওরা কাছাকাছি পৌঁছে যাবে, কিন্তু ছেলেটা বাউন্ডারির কাছাকাছি গিয়ে টপকানোর চেষ্টা না করে নির্দিষ্ট জায়গাতে হাত দিতেই একটা ছোট নিচু দরজার মতো খুলে গেল। ওটা দিয়ে টপ করে ওপাশে চলে গেল সে। দেখেই বোঝা যায়, কীভাবে পালাবে এটাও ওরা আগে থেকেই বারবার রিহার্সেল করে রেখেছিল।
ওরা দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে মাথা নিচু করে দরজাটা পার হয়ে ওপাশে এসে দেখল বাউন্ডারির ওপাশে রাস্তা ফাঁকা।
‘কোনদিকে গেল?’ আরিয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে জানতে চাইল।
‘ওই যে,’ জুলহাস রাসনা শেষ মাথায় বাঁ দিকে একটা ছায়াকে সরে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠল। জান নিয়ে তিনজনে আবার দৌড় দিল এবং রাস্তার ওপর পাশে এসে বামে মোড় নিয়ে ঠিক যেভাবে সাইকেল হার্ড ব্রেক করে থেমে যায়, ওরাও ঠিক সেভাবে থেমে গেল। তিনজনেই দম হারিয়ে হাঁপাচ্ছে হাপরের মতো কিন্তু নড়ার শক্তিও নেই, কারণ সামনের দৃশ্যটাই এমন।
ওপাশের রাস্তা পুরোটা ব্লক করে আছে আড়াআড়িভাবে রাখা দুটো জিপ, তার সামনে অস্ত্র হাতে কয়েকজন, আর সবার সামনে এক হাতে পিস্তল নিয়ে অপর হাতে শার্টের পেছনের কলার ধরে প্রায় ঝুলে আছে নাঈম ছেলেটা, আর তাকে ধরে আছে আর কেউ না খোদ অফিসার রহমান। তার মুখে কোনো ভাব নেই, যেন এইমাত্র তার প্রিয় দল ক্রিকেট খেলায় হেরে গেছে কিংবা সে দাঁতের ট্রিটমেন্ট করার জন্য ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকবে এমনভাবে ওদের দিকে পিস্তল নেড়ে আগাতে বলল।
আরিয়ান ভেবেছিল আগাতে বলছে কিন্তু তা না বরং রহমান পিস্তল নেড়ে পেছনে দেখাচ্ছে। তিনজনেই ওদিকে তাকিয়ে দেখল রাস্তার বিপরীত পাশে নিজের লোক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফোর্স অফিসার এবং ওরা যেদিক থেকে বেরিয়ে এসেছে সেটায় ব্লক করে আছে দুজন।
‘জলদি আসো, অনেক কথা আছে তোমাদের সঙ্গে।’
আরিয়ান রাসনা আর জুলহাস পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
তাই বলে এভাবে ধরা পড়ে গেলাম শেষে,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল জুলহাস।
১৩
মৃদু লয়ে চলতে থাকা পুলিশি ভ্যান গাড়িটার সঙ্গে সঙ্গে রহমানের সিগারেটের ধোঁয়া যেন পাক খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না ওদের, কারণ ভ্যানটার একদিকে খোলা জানালা থাকাতে ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে সেদিক দিয়ে। আরিয়ান আর জুলহাসকে নিজের সিগারেটের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে মৃদু হাসল রহমান, তারপর নিজের সিগারেটের প্যাকেটটা ছুড়ে দিল আরিয়ানের কোলের ওপরে। তারপর ওদের দিকে পিস্তল ধরে থাকা এক সেন্ট্রির দিকে ইশারা করল, লোকটা বসা সিট থেকে হাঁটু মুড়ে বসে গেল ওদের সামনে, প্রথমে আরিয়ান এবং তারপর জুলহাসের মুখে সিগারেট লাগিয়ে ধরিয়ে দিয়ে রোবটের মতো সরে গেল লোকটা। এর পেছনে কারণ হলো, ওদের এমনভাবে বাঁধা হয়েছে হাত দিয়ে সিগারেট ধরা বা টানা তো দূরে থাক, নড়ারও উপায় নেই, তার ওপরে আবার ভ্যানের অন্যপাশ থেকে জোনায়েদ এবং সেই সেন্ট্রি দুজনে দুটো অস্ত্র তাক করে আছে ওদের দিকে
নিজের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতায় এবার ওদের খুব সাবধানে এবং ভালোভাবে হ্যান্ডেল করছে রহমান এবং জোনায়েদ দুজনেই। ওদের সেই মানসিক হাসপাতালের পেছন থেকে অ্যারেস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত ওখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। প্রথমেই কড়া পাহারায় ওদের ভ্যানে তুলেই ভ্যান চালু করে দেওয়া হয়, ভ্যানের ভেতরে প্রথমে রহমান অস্ত্র হাতে প্রস্তুত ছিল, সেই সেন্ট্রি আর জোনায়েদ। প্রথমেই ওদের খুব ভালোভাবে হাতকড়া পরানো হয়, তারপর পায়েও বেড়ি পরিয়ে সেটাকে চেইনের সঙ্গে আটকে দেওয়া হয় হাতকড়ার সঙ্গে। এমনভাবে ওদের আটকানো হয়েছে নড়াচড়ারও কোনো উপায় নেই। ওদের ভাবভঙ্গি দেখেই পরিষ্কার বোঝা যায় রহমান কোনো চান্সই নেবে না এবার। ওদের ভ্যানে তোলার পর রাসনা প্রথমে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি, রহমান সোজা বলে দিয়েছে যদিও রাসনা ডিবিএস অফিসার তবুও যদি তেড়িবেড়ি করে, তবে সোজা গুলি করবে সে আগে, পরে অন্য কথা বলবে। ওদেরনিয়ে ভ্যান চালু করার পর প্রথমে ভালোভাবে আটকানো হয়, আটকানোর পুরো সময়টা রহমান ওদের দিকে অস্ত্র তাক করে ছিল, আটকানো হয়ে যেতেই জোনায়েদ এবং সেন্ট্রি সরে গিয়ে ভ্যানের অন্যদিকে বসে অস্ত্র তাক করে ওদের দিকে, রহমান নিজের অস্ত্র নামিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ওদের সিগারেট টানার ব্যবস্থা করে।
ভ্যান চলছিল মৃদু লয়ে, ভ্যানের গতি দেখে বোঝা যাচ্ছে ওরা কোনো তাড়াহুড়া করছে না, তিনজনেই নীরবে সিগারেট টানছিল, সবাই যার যার ভাবনায় মগ্ন, রহমানই প্রথম নীরবতা ভাঙল। ‘এরকম অবস্থায় সিগারেট খেতে দিলাম সে- জন্য একটা ধন্যবাদ কি পেতে পারি না?’ রহমান হাসিমুখে নিজের ফ্রেঞ্চকাটে হাত বুলাতে বুলাতে বল উঠল।
রহমানের কথায় জোনায়েদ ভ্যানের অপর প্রান্ত থেকে মৃদু হেসে উঠল, আরিয়ান জুলহাস আর রাসনা তিনজনেই মুখ তুলে তাকাল তার দিকে, প্রায় একই সময়ে, নাঈম ছেলেটা আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল তার দিকে। রহমান খুব চেষ্টা করছে তার গলার সুরে ভাবলেশহীন একটা ভাব ধরে রাখার জন্য কিন্তু সে এমন একটা অবস্থায় আছে—না চাইলেও তার গলা থেকে খুশির সুর উপচে পড়ছে, কোনোভাবেই চাপা দিতে পারছে না সে।
‘ধন্যবাদ,’ আরিয়ানও খুবই তরল গলায় বলে উঠল, মাথাটাকে নিচু করে সে ঠোঁট থেকে সিগারেটটা হাতে নিয়ে ওটার ছাই ফেলল। এরা ওদের এমনভাবে আটকেছে চাইলে পুরোপুরি সোজাও হওয়া যায় না কিংবা হেলান দেওয়াও যায় না, আবার পুরোপুরি নিচু হয়েও থাকা যায় না, অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি। ‘আমাদের নিয়ে কী করতে চাচ্ছেন?’ আরিয়ান চাইলেও এবার তার গলায় সেই তরল সুরটা আর থাকল না, বরং কৌতূহল শঙ্কা আর বেপরোয়া ভাবটাই প্রকট হয়ে পড়ল।
সুন্দর এবং সময়োপযোগী প্রশ্ন মিস্টার এ,’ রহমান সিগারেটটা আরিয়ানের দিকে তাক করে বলে উঠল। ‘আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘সরি, অনুমতি না নিয়েই তুমি বলে ফেললাম। তুমি আর আমি সম্ভবত ব্যাচমেটই হবো। যে-স্পেশাল ফোর্সে আজকে কাজ করি, ওতে তো একেবারে শুরুতে তুমিও ছিলে,’ রহমানের মুখে কথাটা শুনে হঠাৎই এই অবস্থাতেও খানিক ঠান্ডা অনুভব করল আরিয়ান, চেহারার ভাবলেশহীন ভাবটা না চাইতেও ভেঙে পড়ল। রহমান খুব টিটকিরির একটা হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, মনোযোগের সঙ্গে অবজার্ভ করছে আরিয়ানের চেহারা। ‘ইয়েস মাই ডিয়ার, আমি তোমার ফাইল পড়েছি। যদি তুমি ফোর্স না ছাড়তে,’ বলে হাসিটাকে খানিক চওড়া করল সে, মানে না তাড়িয়ে দেওয়া হতো তোমাকে—তাহলে হয়তো আজকে আমরা কলিগ থাকতাম, তাই তোমাকে তুমি বলা যেতেই পারে। যাই হোক, তোমার প্রশ্নে ফিরে আসি, আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে?’
‘কোনো নির্জন জায়গায় নিয়ে গুলি করতাম, তিনজনকেই, তারপর গতকাল সন্ধ্যে থেকে যা যা ঘটেছে সব মিলিয়ে সুন্দর একটা গল্প বলে মিডিয়া এবং আমজনতাকে বুঝিয়ে দিতাম, কত বড়ো একটা থ্রেট থেকে রক্ষা করতে পেরেছি আমি তাদেরকে,’ আরিয়ান একেবারে শান্ত গলায় যেন ক্রিকেটের কমেন্টারি করছে এমনভাবে বলে উঠল। কিন্তু রহমানের প্রতিক্রিয়া হলো একেবারেই ভিন্ন, ভ্যান কাঁপিয়ে হেসে উঠল সে।
‘শাবাশ, এই হলো অভিজ্ঞ এবং ঠান্ডা মাথার মানুষের সঙ্গে কথা বলার মজা। সাধে আমি তোমাকে মিস্টার এ বলে ডাকিনি,’ বলে সে আনমনে মাথা নাড়ল। ‘গতকাল সন্ধ্যায় যখন আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করতে যাই, বারবার তোমার কাছে নাজেহাল হয়েছি আমি, তারপর রাতের শেষ প্রহরে ভাবতে শুরু করলাম কারণটা কী? তারপর জবাব পেলাম তোমার ফাইলে,’ রহমানের চোখ সরু হয়ে এসেছে। ‘তুমি আর আমি একই ট্রেনিং পেয়েছি, তুমি হয়তো মিলিটারি থেকে এসেছিলে আর আমি পুলিশ, কিন্তু একটা পর্যায়ে আমরা একই আর এই কারণে আমার সঙ্গে ফোর্স এবং সব পাওয়ার থাকার পরও আমি পারিনি। কারণ তুমিও ঠিক আমার মতোই ভাবতে পারো,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তুমি এবং তোমরা গতকাল থেকে যা দেখিয়েছ রীতিমতো অবিশ্বাস্য, শত্রুর প্রশংসা করতে আমার দ্বিধা নেই কোনো।’
‘নিজেকে এত হেয় করার কোনো কারণ নেই,’ আরিয়ানও সিগারেটটা শেষ করে নিচে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে চেপে নেভালো ওটাকে। ‘তোমার সঙ্গে যেমন ফোর্স করাপ্টেড অথরিটি ছিল, আমিও আনএক্সপেকটেডভাবে হেল্প পেয়েছি,’ বলে সে রাসনা আর জুলহাসের দিকে দেখাল। ‘তাদেরকেও তোমার ক্রেডিট দেওয়া উচিত।
‘হুমম, অবশ্যই। তবে এত কথা বলার পেছনে একটাই কারণ,’ রহমানের চেহারা আবারো সিরিয়াস হয়ে উঠেছে, ‘তোমার নিজেকে হিরো মনে করার কোনোই কারণ নেই, আমি আর তুমি একই, মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। আমি সুযোগ পেয়ে করাপ্টেড হয়েছি, তুমি সুযোগ পেয়ে নিজের বন্ধুর গল্প চুরি করেছ, উই আর দ্য সেইম পিস অব শিট, তুমিও এই গল্পের নায়ক না, আর আমিও এই গল্পের ভিলেন না, আমরা দুজনেই এই সমাজের প্রতিচ্ছবি।’
‘আপনি কি সবসময় লোকজনকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার আগে এভাবে লেকচার মারেন?’ জুলহাস বিরক্তির সুরে বলে উঠল। ‘এক সিগারেটের বিনিময়ে লেকচারটা বেশি হয়ে গেল না?’ জুলহাস এমন সুরে কথাটা বলেছে, এরকম বিপজ্জনক অবস্থাতেও রাসনা হেসে উঠল।
‘আপনারা কী শুরু করেছেন বলেন তো?’ এই প্রথমবারের মতো অসহিষ্ণু গলায় ওদের পাশ থকে বলে উঠল নাঈম ছেলেটা। ‘এমনভাব করছেন আপনারা যেন টিভি টক শোতে কথার মেলা চলছে, হচ্ছেটা কি এবং আপনারা কী করতে যাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলেন।’
‘তুমি না পাগল!’ রহমান টিটকিরির সুরে বলে উঠল। ‘তুমি এত কিছু জানতে চাও কেন?’ বলে সে নিজের দুই হাত ওঠাল। ‘ওকে কাজের কথায় আসি। আসলে আমাদের হাতে সময় আছে। কারণ প্রথমত, আমাদের একটা জায়গায় যেতে হবে, দ্বিতীয়ত, মুল আলোচনার আগে এই আইস ব্রেকিংটা দরকার ছিল,’ বলে সে আড়মোড়া ভাঙল, ‘বহুত দৌড়ান দৌড়েছি গতকাল থেকে, আর চাই না,’ বলে সে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘তোমার করা প্রশ্নেই ফিরে আসি। হ্যাঁ, তুমি যা বলেছ, তাই করা হবে তোমাদেরকে, আমরা সঠিক জায়গায় যাচ্ছি কাজটার সমাধা করার জন্য। তোমাদের একজনকেও ছাড়া হবে না, তুমি পরিষ্কার মরবে,’ আরিয়ানকে দেখাল সে, ‘সঙ্গে তুমিও, এবার রাসনা। ‘তোমাদের দুজনকে গল্পের সঙ্গে জড়ানো খুবই সহজ হবে। ‘আর তোমরা দুজন—জুলহাস আর নাঈমকে দেখিয়ে বলে উঠল, তোমরা দুজন স্রেফ হারিয়ে যাবে, পরিষ্কার গুম।’
রহমান এমন সহজ সুরে সবার মৃত্যু ঘোষণা করল, না চাইতেই সবাই চুপ হয়ে গেছে। আরিয়ান দেখল সবাই আগে থেকে জানলেও ঘোষণাটা আসা মাত্রই চেহারা থেকে রং উড়ে গেছে সবারই। নাঈম ছেলেটা ডুকরে কেঁদে উঠল আরিয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রহমান আবারো কথা বলে উঠল।
‘তবে,’ বলে সে মাথা নাড়ল। ‘গল্পে এখনো একটা তবে আছে। তোমাদের এখনো টিকে থাকার একটা সম্ভাবনা আছে,’ বলে সে নিজের দিকে দেখাল। ‘সিদ্ধান্তটা আমার, আমরা যে-স্পটে যাচ্ছি সেখানে যেতে যেতে যদি তোমরা আমাকে আর জোনায়েদকে কনভিন্স করতে পারো যে, তোমরা আসলে থ্রেট নও, তবে একটা সম্ভাবনা আছে,’ আরিয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিল রহমান। ‘না আমি ব্লাফ দিচ্ছি না, আসলেই আমি চেষ্টা করব। তোমরা এখন আর এমন কোনো প্রাণী নেই তোমাদের আমার ব্লাফ দিতে হবে। হিসাবটা খুব সহজ, কিছু জিনিস আমি জানি, তোমরা যদি জানতে চাও আমি জানাব। কিছু জিনিস তোমরা জানো, সেগুলো আমাকে জানাতে হবে। দুই দলই আমরা দুই দলকে তথ্যের পাল্লায় মাপব, যদি তোমাদের তথ্যের পাল্লা ভারী হয় তবে, একটা সম্ভাবনা আছে।’
‘আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করব কীভাবে?’ রাসনা ঝামটা দিয়ে জানতে চাইল।
‘আপনি হয়তো স্রেফ আমাদের ঝাঁকিয়ে তথ্য জানতে চাইছেন মেরে ফেলার আগে, বোঝার চেষ্টা করছেন আমরা আসলে কতটা জানি। কতটা ক্ষতি করেছি আমরা আপনারা যাদের জন্য কাজ করেন, তাদের। বিশ্বাসের উপায় কী?’
‘কোনো উপায় নেই, কী ঠিক বলেছি জোনায়েদ?’ রহমান জোনায়েদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। জোনায়েদ মাথা নেড়ে সায় জানাল। ‘তুমি যা বললে, আমি তোমাদের মারার আগে ঝাঁকি দিয়ে তথ্য বের করতে চাইছি, হয়তো বা আমি তাই করছি,’ সে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল। ‘তোমাদের ভেরিফাই করার উপায় নেই। তবে তোমরা যদি কথা বলো, হয়তো বা আসলেই সম্ভাবনা আছে বেঁচে যাওয়ার, আর যদি তোমরা কথা বলতে না চাও, তাহলেও রাস্তা আছে,’ বলে সে জোয়ায়েদ আর সেন্ট্রির দিকে দেখাল, ‘আমি স্রেফ ইশারা করলে ওদের চারটা গুলি চারজনের খুলিতে ঢুকে যাবে, তোমরা দুজন গায়েব হয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে, আর তোমরা দুজন একগাদা কলঙ্ক নিয়ে দাফন হবে, পরিবার-পরিজনের মুখ কালি করে। চয়েস ইজ ইয়োরস।’
১৪
‘আমি রাজি, ওরা কিছু বলার আগে ওদের পাশ থেকে নাঈম বলে উঠল।
রহমান হেসে উঠল, ‘নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, পুরনো প্রবাদ কিন্তু কাজের প্রবাদ, মি. পাগল,’ এখানে আমরা যারা আছি এদের ভেতরে তুমিই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। আমি যদি ভুল না করে থাকি তবে তোমার কাছেই সবচেয়ে বেশি তথ্য আছে। কাজেই তোমাকে কথা বলতেই হবে, তবে সবার পরে। আগে আমরা কথা বলব। কী রাজি? নাকি এখনি মরবে?’
আরিয়ান একবার জুলহাস আর রাসনার দিকে তাকাল, জুলহাস মাথা নেড়ে মানা করছে, আরিয়ান চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল, রাসনার চোখে নীরব সম্মতি। ঠিক আছে আমরা যা জানি বলব কিন্তু একটাই শর্ত—’
‘তোমাদের কেমন এখনো মনে হচ্ছে তোমরা শর্ত দেবার মতো অবস্থায় আছ?’ রহমান হাত নাচিয়ে বলে উঠল। ‘তোমার শর্ত আমি এমনকি শুনতেও রাজি না। যা জানো পরিষ্কার করে বলো আগে।’
‘ঠিক আছে আমি শুরু করছি, জুলহাস হাত তুলল আরিয়ানের পাশ থেকে। সে একেবারে শুরু থেকে বলে গেল কীভাবে ওরা এতিমখানাতে একসঙ্গে বড়ো হয়েছে। সে এতিমখানার গল্প বলতে শুরু করতেই রহমান থামিয়ে দিতে যাচ্ছিল কিন্তু জুলহাস তাকে উলটো থামিয়ে দিয়ে জানাল এটা বোঝার প্রয়োজন আছে। সে খুব বিস্তারিত না হলেও সংক্ষেপে বলল সেই অংশ—তারপর কীভাবে টোকনের সঙ্গে হরির দেখা হয়েছিল এবং সে কীভাবে গায়েব হয়ে যায় এবং টোকন সেখান থেকে পেছনে লাগে, টোকনের সঙ্গে ওর দূরত্ব, টোকনের চাকরি ছেড়ে সেই প্রজেক্টে কাজ করা, এই পর্যন্ত বলতেই আরিয়ান দেখল রহমান আনমনেই মাথা নাড়ল, তারমানে এখান থেকে কমবেশি সে জানে। জুলহাস বলে চলেছে, টোকনের হঠাৎ ফিরে আসা, তার মৃত্যু এবং তার মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া সেই ধাঁধা, এটুকু বলতেই রহমানের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। জুলহাস ধাঁধাটার ব্যাপারে বলে চলেছে এক পর্যায়ে আসতেই রহমান হাতের তালু দিয়ে নিজের হাঁটুতে চাটি মারল, ব্রিলিয়ানট, শালা মরার বাচ্চা এরকম কিছু করে গেছে কে জানত, তারপর?
‘এরমানে এই ধাঁধার ব্যাপারে তোমরাও কেউ কিছু জানতে না, তাই না?’ আরিয়ান প্রশ্নটা করতেই সে খেয়াল করল রহমান আর জোনায়েদের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেল। আরিয়ান নিশ্চিত হলো এই বিষয়ে এদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না।
‘তারপর?’ আরিয়ানের প্রশ্নটা সরাসরি ইগনোর করে রহমান জুলহাসের কাছে জানতে চাইল। জুলহাস বলে গেল সে কীভাবে একের পর এক ক্লু বের করে লেখক আরিয়ান শফিকের গল্প পর্যন্ত বের করেছে তারপর কীভাবে ওদের উদ্ধার করেছে এবং পরে কী হয়েছে। জুলহাস থামতেই সে আরিয়ানের দিকে তাকাল। আরিয়ান বয়ান করে গেল কামালের সঙ্গে তার পরিচয়, কামালের আত্মহত্যা—এই পর্যায়ে রহমানের মুখে মৃদু হাসি দেখে সে বুঝল কামালকেও এই মেরেছে—তার গল্প চুরি তারপর গতকাল কী হয়েছে, রাসনা কীভাবে তাকে সাহায্য করেছে। আরিয়ান থামতেই এবার আর রাসনাকে বলতে হলো না, সে নিজে থেকেই কামালের সঙ্গে তার পরিচয়, তাদের সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর প্রেম এবং সেখান থেকে কীভাবে সে আরিয়ানের ব্যাপারে জানতে পারল সে বলে গেল, সে নিজের কথন শেষ করল একেবারে মানসিক হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে।
‘এক মিনিট, পুরো বিষয়টা আমার মাথায় এসে গেছে,’ রহমান আবারো চাটি মারল হাঁটুতে। ‘পাগল সাহেবের কথা পরে, তার আগে আমি পুরো বিষয়টা বলে নেই। টোকন আর হরি ছোটবেলার হারানো বন্ধু ছিল, হারানো বন্ধু যেমন থাকার কথা তেমন ছিল না, তাকে রাস্তার পাশে একদিন খুঁজে পেয়ে টোকন বুঝতে পারে তার সঙ্গে খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে। সেটা বের করার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। সেখান থেকে কোনো না কোনোভাবে সে জানতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রফিকুজ্জামানের কথা এবং তার প্রজেক্টের সঙ্গে সে ইনভলভ হয়ে যায়। সম্ভবত সেই কামালকেও ইনভলভড করে। আর নাঈমকে নেয় প্রফেসর নিজে। ওরা প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে অনুধাবন করতে পারে ওরা যা ভেবে এসেছিল এখানে—বিষয় তার থেকেও অনেক অনেক বড়ো আর গভীর, আর এই বিষয়ের অনেকটাই তারা জেনে ফেলেছে। কাজেই তাদের রেহাই নেই। প্রজেক্ট শেষে ওরা বিভিন্ন দিকে সরে পড়ে। টোকন চলে যায় ঢাকায়, সে যা জানত সেগুলোকে সাজিয়ে এই ধাঁধা বানায়। অন্যদিকে কামাল যা জানে সেগুলোকে কু সাজিয়ে সে একটা গল্প লেখে, আর তৃতীয়জন সে বুঝতে পারে রেহাই নেই, কাজেই নিজের আত্মীয়দের সুযোগ নিয়ে নিখুঁত এক নাটক বানিয়ে পাগল সেজে বসে যায়। অন্যদিকে ওই প্রজেক্টের যারাই ছিল তারা ধীরে ধীরে এদের শেষ করতে লেগে যায়। টোকনকে অ্যাক্সিডেন্টের নাটক সাজিয়ে মারে, এরপর কামালকে মেরে আত্মহত্যার নাটক সাজায়। কিন্তু এই পাগলকে খুঁজে পেলেও ওরা ভাবে এ আসলে ক্ষতিকর না। এর ভেতরে ঘটে যায় ভিন্ন ঘটনা।’
‘প্রশ্ন হলো যারাই এর পেছনে ছিল তারা ওদের যেতে দিল কেন? প্রজেক্ট শেষ হতেই সরিয়ে দিল না কেন?’
রহমান কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ওরা যখন বুঝতে পারে ছেলেগুলো কিছু একটা বুঝতে পেরেছে তখন সম্ভবত তারা ভেবেছে, এরা এই প্রজেক্টের কাজে আগে কাদেরকে জানিয়ে এসেছে সেটা ওরা নিশ্চিত ছিল না, কিংবা কে জানে হয়তো ওরা ভেবেছে, তিনজনকে একসঙ্গে ওখানে শেষ করলে ঝামেলা হবে। তারচেয়ে ওদের পরে একে একে নিকেশ করাই বেটার। কিন্তু ওদের ছেড়ে দেয়াতে ফল হয় উলটো। রহমান মৃদু হেসে উঠল। ‘সত্য চাপা রাখা বড়ো মুশকিল, সত্য হলো লাভার মতো, হাজার চাপা দিলেও ফেটে বের হবেই। এরা তিনজনকেই একরকম শেষ করে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে কাজে ফিরে যায়। কিন্তু একদিকে টোকনের রেখে যাওয়া ধাঁধা আবিষ্কার করতে থাক তুমি জুলহাস, অন্যদিকে কামালের মৃত্যুর ব্যাপারটা মেনে নিতে না পেরে বিষয়টা নিয়ে লেগে থাকে রাসনা। আর একইসঙ্গে,’ বলে রহমান মৃদু হেসে দেখাল আরিয়ানকে, ‘আমাদের বিশিষ্ট সাহিত্যিক সাহেব করেন আরো সুন্দর কাজ। তিনি নিজের বন্ধুর মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে পুরো বইটাই মেরে দিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেন,’ বলে জোরে জোরে হেসে উঠল রহমান। দুনিয়াতে সবাই ভালো, খালি আমরাই গল্পের ভিলেন, কী বলো জোনায়েদ?’ জোনায়েদও মৃদু হেসে উঠল। তবে তুমি আফজাল মিস্ত্রির ওখানে যা দেখিয়েছ মারাত্মক ছিল জোনায়েদ, তোমার লোকদের মুখেই শুনেছি,’ বলে সে হাত নাড়ল। ‘যাক গে কাজে ফিরি, এরপর ধীরে ধীরে একটা সময় গিয়ে এক হলো তিনজনে?’
জুলহাস মাথা নেড়ে সায় জানাল। ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে?’ আরিয়ান বলে উঠল। ‘আপনারা যাদের জন্যই কাজ করেন, যাই করেন, যেহেতু এখনো আমরা জানি না পুরো বিষয়টা কী নিয়ে, আপনারা টের পেলেন কীভাবে—পুরো বিষয়টা আপনারা যেভাবে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন, সেভাবে আসলে হয়নি, কিছু কিছু জিনিস বের হয়ে গেছে?’
রহমান মাথা নাড়ল, ‘বলতে যেহেতু চেয়েছি, বলি, সমস্যা নেই। আসলে আমরা যাদের জন্যই কাজ করি এদের রিসোর্সের কোনো ঘাটতি নেই। এরা নিজেদের সিক্রেসি বজায় রাখার জন্য সবই করতে পারে। আমরা যেমন এদের একটা অংশে কাজ করি, অনেকটা স্ট্রাইকিং ফোর্সের মতো। এটা একটা দিক মাত্র, এদের আরো কিছু সেকশন আছে, যাদের কাজই হলো যেকোনো মূল্যে এদের সিক্রেসি বজায় রাখা। আমি পুরো ব্যাপারটা জানি না কিন্তু ওরকমই কোনো একটা টিমের কোনো একটা অংশ বা কেউ একজন বিষয়টা বের করে। প্রথমত, কামাল কিংবা টোকনকে শেষ করা হলেও, ওরা বিগত কয়েক মাসে পালিয়ে গিয়ে এরা কী করেছে, সেটা পুরোপুরি বের করতে পারেনি এরা। কাজেই ওদের শেষ করা হলেও একটা টিম লেগে ছিল ওই অংশটুকু ক্লিয়ার করার জন্য। টোকন খুব চালাক ছিল যে কী করেছে, কীভাবে করেছে এটা আজকের আগ পর্যন্ত কিছুই জানা যায়নি। তবে টোকনের মৃত্যুর পর তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বিচিত্র আচরণ খানিকটা সন্দেহের সৃষ্টি করেছিল বটে কিন্তু সেখান থেকে কংক্রিট কিছু বের করা যায়নি। কিন্তু কামাল অতটা চালাক ছিল না, সে আড়ালে থাকার সময়টায় পুলিশ স্টেশনে যাতায়াত করেছে এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এটা একটা সন্দেহের কারণ ছিল, কিন্তু নানাভাবে খোঁজ নিয়ে এটা নিশ্চিত করা যায় ওখানে সে কিছু করেনি। তুমি,’ রাসনাকে দেখাল সে। ‘তার মৃত্যুর পর কিছু ঝামেলা করেছিল ব্যাস ওটা ওখানেই শেষ। কিন্তু সার্চ টিমের কারো একজনের সন্দেহ লাগে যে, কামাল সব রেখে লেখালেখির ট্রেনিং কেন নিতে গেল। তার ওপরে তার ব্যাক গ্রাউন্ড ছিল এই বিষয়ে, এমনকি হতে পারে তার মৃত্যুর আগে সে কিছু একটা লিখে রেখেছিল যেখানে হয়তো পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কোনো ক্লু রেখে গেছে সে। বাস্তব জগৎ ধরে যখন কিছু পাওয়া যায় না তখন তার ডিজিটাল ফুট প্রিন্ট ফলো করা শুরু হয়। অনেক লম্বা কাহিনি, তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে জানা যায়, তার যে ই-মেইেল আইডি ছিল সেটার সঙ্গে লিংক করা তার আরেকটা ই-মেইল আইডি ছিল। এটার কথা তেমন কেউ জানত না, কিন্তু এই নতুন ই-মেইলের রেফারেন্স ছিল পুরনো ই-মেইলে। সমস্ত কিছু ঘাটতে গিয়ে দেখা যায় সে এই ই-মেইল থেকে একজনকে একটা লেখা ই-মেইল করেছিল। সেই ই-মেইল আইডিধারীর খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায় সেই বিশিষ্ট ভদ্রলোক কামালের মৃত্যুর পর সেই লেখাকে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এই অথরিটির রিসার্চ টিম দুটো লেখা অ্যানালিসিস করে শতভাগ নিশ্চিত না হলেও প্রায় নিশ্চিত হয় যে এখানে অবশ্যই অবশ্যই কোনো একটা ঘাপলা আছে এবং পুরো লেখার
স্ট্রাকচারের ভেতরে অবশ্যই কোনো না কোনো ক্লু লুকিয়ে আছে।’
‘যেটা আসলে কামাল রেখে গেছে, তাই না?
ঠিক, সেটা আসলে কী—জানা ছিল না কিন্তু কিছু অবশ্যই আছে, এবং সেটা সত্যি তা তো জানাই গেছে,’ রহমান মাথা নাড়ল। ‘প্রশ্ন হলো কামাল তো শেষ, তার লেখারও কোনো হদিস নেই, কিন্তু তার লেখার ওপরে ভিত্তি করে যা লেখা হয়েছে, সেখানে রয়ে গেছে সব, আর সেটা এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে। এখন উপায় কী?’ রহমান খানিকটা মাথা ঝাঁকাল।
‘তখন ডাক পড়ে এই অধমের। আপনার এই গল্প নকল করার বিষয়টা সামনে এনে, গল্প চুরির কারণে কীভাবে আপনি আপনার বন্ধুকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে সাজিয়েছেন, এগুলোকে সব সুন্দরভাবে ফ্রেম করে আপনার ইমেজের বারোটা বাজিয়ে গ্রেপ্তার করে আপনাকে শেষ করা হবে এবং বই বাজেয়াপ্ত করে সরিয়ে ফেলা হবে মার্কেট থেকে। তবে হ্যাঁ আপনাকে মারলেও তার আগে আপনি আসলে কী জানেন সেটা জেনে নেবার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তুমি তো তুমি,’ রহমান মনে হয় ভুলে গেছিল সে আরিয়ানকে আপনি ডাকছে না তুমি, তাই একেকবার একেক সম্বোধন করছে। ‘তার ওপরে আবার ম্যাডাম এসে হাজির হলেন স্পটে। সেই সঙ্গে পরে যোগ হলো টোকনের বন্ধু মানে তুমি জুলহাস। অবশ্য ম্যাডাম স্পটে আসাতে সুবিধাই হলো, বলে আবারো খনখনে গলায় হেসে উঠল রহমান। ‘ম্যাডাম আসাতে আপনার ইমেজটাকে আরো কালারফুল করা যাবে, বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে মিলে কীভাবে বন্ধুকে হত্যা করে সেটাকে আবার আত্মহত্যা সাজিয়ে তার গল্প চুরি করেছেন—একজন লেখক এটা পাবলিক থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সেরকম খাবে, কী বলো জোনায়েদ?’
‘জি, স্যার,’ জোনায়েদ হাতে ধরা পিস্তল নেড়ে বলে উঠল। ‘আমাদের দেশে এসব জিনিসই খায়। শুধু গল্প চুরি করার বিষয়টা অত জমত না। আর ভদ্রলোকের ফিয়ন্সে তো এরই মধ্যে খানিকটা রং চড়িয়েছেন,’ বলে এবার সে জোরে জোরেই হেসে উঠল। আরিয়ানের ক্ষণিকের জন্য মনে হলো নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারাবে কিন্তু সে ভাবার আগেই ওর পাশ থেকে ঝনঝন শব্দে শিকল টানাটানি করতে লাগল রাসনা। মুখ দিয়ে গালির ভান্ডার রীতিমতো উজাড় করে দিচ্ছে সে, সেই ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি একেবারে খারাপ না।
‘এই চুপ,’ রহমান খুব ক্যাজুয়াল সুরে ধমকে উঠল তাকে। ‘কাজের কথা হচ্ছে। ‘তো তুমি তো পালালে ম্যাডামকে সঙ্গে নিয়ে, অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে, টোকন এবং এই ভার্চুয়াল ধাঁধার বিষয়টা জানা ছিল না,’ রহমান এটুকু বলতেই আরিয়ান একবার আড়চোখে জুলহাসের দিকে দেখে নিল। জুলহাস খুব শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে তার পুরো জার্নিটা বললেও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যাপারটা খুব সাবধানে এড়িয়ে গেছে। ওরা যদি শেষও হয়ে যায়, এই একটা জায়গাতেই মৃদু আশার আলো আছে।
আরিয়ান রহমানের দিকে ফিরে তাকাল। আমরা যা জানি, করেছি, সবই তো বললাম, এখন আপনার পালা,’ বলে সে বড়ো করে দম নিল। ‘আপনি বলুন, পুরো ব্যাপারটা আসলে কী নিয়ে। এত কাহিনি এত কিছু হলো অথচ এখনো আমরা জানিই না কী কারণে হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে?’