একটি সন্ধের যবনিকা – ১০

১০

আরিয়ান খুব তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ওর একটা হাত সদ্য চড় খাওয়া গালে। একবার মুখ খুলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল আরিয়ান। মেয়েটাকে দেখছে। বড়ো বড়ো চোখ দুটো মেলে আধো অন্ধকারে তাকিয়ে আছে সামনের রাস্তার দিকে। কিন্তু আরিয়ান প্রায় নিশ্চিত মেয়েটা সামনের রাস্তাটা দেখছে না, আসলে সে শুধুই দৃষ্টি মেলে আছে। তার মন পড়ে রয়েছে অন্য কোনো জায়গায়। আরিয়ান আরেকবার মুখ খুলতে যেতেই মেয়েটা আবারো হাত তুলল। ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো আবারো ওকে হয়তো চড় মারবে, আপনাতেই খানিকটা পিছিয়ে নিল ও নিজের মাথাটা। কিন্তু মেয়েটা আগেরবারের মতো কিছু করল না, বরং হাতটা ওর দিকে তুলে ধরে রেখেই সে আবারো ফিরে তাকাল সামনের দিকে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝর ঝর করে কাঁদতে শুরু করল। আরিয়ান প্রথমে অস্বস্তি বোধ করছিল, এরপর সে বেশ অবাক হতে শুরু করেছিল, এবার রীতিমতো বোকা বোকা অনুভব করতে লাগল। কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল, এভাবে ক্রন্দনরত মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকাটাও শোভন হচ্ছে না, গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো আরিয়ান।

হালকা শীতের রাত, এখনো ঠান্ডা সেভাবে পড়েনি, ফলে খুবই মনোরম আবহাওয়া। বাইরে বেরিয়ে বুক ভরে দম নিয়ে আরেকবার অনুভব করল বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো আনন্দ আর কিছু হতেই পারে না। দম নিতে নিতে এবার নিজেকে পরীক্ষা করে দেখল। পায়ের স্ট্র্যাপ ছিঁড়তে গিয়ে জুতোর এক পাশ ছিঁড়ে গেছে, প্যান্টের ফুটো হওয়ার পাশাপাশি পায়ে ব্যথাও পেয়েছে। ওটা বাদ দিলে টুকিটাকি ছিলেটিলে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কিছু হয়নি। গাড়ির একপাশে হেলান দিয়ে আবার বুক ভরে দম নিতে নিতে আরিয়ান একবার পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে আনল। চমৎকার একটা নাইন এম এম লুগ্যার সার্ভিস পিস্তল। পুরনো অভিজ্ঞ হাতে ম্যাগজিন খুলে স্লাইড টেনে পরীক্ষা করে দেখল, ম্যাগজিনে এখনো বেশ কিছু গুলি আছে। আবারো আনলোড করে ওটাকে রেখে দিল বেল্টের সঙ্গে আটকে। এটা বাদে ওয়ালেট থেকে শুরু করে মোবাইল, সবই রেখে দিয়েছিল ওরা। কাজেই ওর কাছে আর কিছুই নেই। বড্ড সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই। আজ রাতে হওয়ার কথা ছিল কি, আর হয়ে গেল কি। অনেক প্রশ্নের জবাব জানতে হবে ওকে, বুঝতে হবে অনেক কিছু। মাথার ভেতরে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যে সোজা হতেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল ওর। অন্ধকারের ভেতরে ওর ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। কখন এসেছে খেয়ালই করেনি আরিয়ান।

‘উফফ, আরেকটু হলে —

‘কনফেস ইট,’ শিকারের আগে নেকড়ে কিংবা কুকুর ঠিক যেভাবে গড়গড় করে অনেকটা সেরকম গলায় প্রায় গড়গড় করতে করতে বলে উঠল মেয়েটা।

‘সরি,’ আরিয়ান এক পা এগিয়ে গেল তার দিকে।

একটা আঙুল তুলল মেয়েটা আরিয়ানের দিকে। ‘প্রথম কথা, ডোন্ট ফাক উইথ মি,’ মেয়েটার শারীরিক ভঙ্গি অত্যন্ত বিপজ্জনক। নেকড়ে যেভাবে শিকারের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা সেরকম।  

‘ইজি, লেডি,’ আরিয়ান ওর শরীরের পাশে দুই হাত তুলল। ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কী বলছেন,’ আরিয়ান সরাসরি তাকিয়ে আছে মেয়েটার অশ্রুতে ভেজা বড়ো বড়ো লাল চোখ দুটোর দিকে।

‘ওকে, আমি আপনাকে চান্স দিচ্ছি, কিন্তু ট্রাস্ট মি, আপনি একটু উলটোপালটা কথা বলবেন, তাহলে আমি ঠিক সেটাই করব যেটা ওরা করতে যাচ্ছিল। আরিয়ান দেখল মেয়েটার বাঁ হাত কোমরের একেবারে কাছে। ও আন্দাজ করল হুডির নিচে ঠিক ওখানেই মেয়েটার অস্ত্রটা রাখা থাকতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ডান হাত তুলে বাঁ হাত কেন রাখবে সে অস্ত্রের কাছে। ডান হাতই ওটার কাছাকাছি রাখার কথা।

‘রিল্যাক্স,’ আরিয়ানও নিজের ডান হাতটা শরীরের পাশে নামিয়ে আনল। তাতে প্রয়োজনে ওটাকে অস্ত্রের কাছে নিতে ওর সুবিধা হবে। মেয়েটা জানে না যে, ওর কাছেও অস্ত্র আছে। ‘আপনি আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন, কোনো সন্দেহ নেই,’ আরিয়ান আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। ‘সেজন্যে ধন্যবাদ, কিন্তু আমি আসলেই বুঝতে পারছি না আপনি কী বলার চেষ্টা করছেন।

‘ও ইয়া, আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি,’ মেয়েটার হাত আরেকটু এগিয়ে গেল কোমরের একপাশে। আরিয়ান আবারো নিজেকে প্রশ্ন করল বাঁ হাত কেন। ‘আপনি আপনার বন্ধু কামালের সঙ্গে যে অন্যায় করেছিলেন, যে- অন্যায়ের কোনো প্রতিকার হয় না। যে-অন্যায়ের কারণেই আপনার আজকে এই পরিণতি। বলেন, স্বীকার করেন বিষয়টা, কথার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার গলা চড়তে শুরু করেছিল, শেষ শব্দ দুটো বলার সময়ে সে প্রায় গর্জন করে উঠল।

এই মেয়েটাও জানে, ওরা সব জানে,কথাগুলো আরিয়ানের মাথার ভেতরে আপনাতেই উচ্চারিত হয়ে উঠল। কিন্তু এই মেয়েটা কীভাবে জানল, এরা সবাই কীভাবে জানে, এই মেয়ে আসলে কে? দেখুন রাসনা,’ আরিয়ান অরেক ধাপ এগোতেই চট করে মেয়েটা সরে গেল একপাশে। আরিয়ান স্রেফ মেয়েটাকে শান্ত করতে চাইছিল, কিন্তু ওর আচরণে ফল হলো উলটো। একেবারে গরম কড়াইতে পানি ছিটিয়ে দিলে যেভাবে পানি উলটো ছিটকে ওঠে, মেয়েটা ঠিক সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাল। আরিয়ান এগোনো শুরু করতেই সে চট করে একপাশে সরে গিয়েই সাপের ছোবলের মতোই বাঁ হাতে হুডির নিচ থেকে টান দিয়ে বের করে আনল নিজের পিস্তল। মেয়েটার পিস্তল ধরা হাতটা উঠে আসছে—খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার বশে নিজের অস্ত্রটাও বের করে আনার জন্যে হাতটা এগোতে শুরু করেছিল কিন্তু ও থেমে গেল কয়েকটা কারণে। একে তো মেয়েটা ওকে একটু আগে প্রাণে বাঁচিয়েছে কাজেই এত সহজে মারবে না, কিন্তু ও অস্ত্র বের করে আনলে উলটো ঘটনা ঘটতে পারে। যুদ্ধ চাইছে না আরিয়ান, বরং পাহাড় সমান প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছে। কাজেই মেয়েটার অস্ত্র উঠিয়ে আনতে আনতে নিজের হাতটাকে সরিয়ে শরীরে পাশে তুলে ফেলল সারেন্ডারের ভঙ্গিতে।

‘ওকে ওকে ওকে, এক মিনিট,’ আরিয়ান দুই হাত তুলে মেয়েটার পিস্তলের দিকে তাকাতেই দেখল, মেয়েদের জন্যে একেবারে পারফেক্ট একটা গ্লক পিস্তল। মেয়েটা পিস্তল তুলে আনতেই শুধু পিস্তল নয়, আরো একটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল ও। কেন বাঁ হাত? কারণ মেয়েটা বাঁহাতি। এই কারণেই সে ওই হাতটা রেখেছিল অস্ত্রের কাছাকাছি। ‘দেখুন মিস রাসনা, মেয়েটা মিস না মিসেস সেটা ভাবার মতো অবস্থা নেই এখন। ‘আপনি আগে শান্ত হোন, আপনি যা জানতে চান সব বলব আমি কিন্তু এভাবে নয়,’ আরিয়ান নিজের হাত দুটো শরীরের পাশ থেকে ধীরে ধীরে নামাতে শুরু করল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবেগের বশে লাল হয়ে থাকা চোখের বড়ো বড়ো মণিদুটোর দিকে। ‘আপনি চাইলে গুলি করতে পারেন, বলেই সে দ্রুত যোগ করল। ‘কিন্তু আমি জানি আপনি সেটা করবেন না। যদি তাই করতেন তবে, আমাকে একটু আগে ওই হায়েনাগুলোর থেকে বাঁচাতেন না।’

‘শাট আপ, আরিয়ান শান্ত হয়ে কথা বলতে বলতে হাত নামাতে শুরু করেছিল এক ধমক খেয়ে আবারো হাত তুলে ফেলল। ‘শালা, কুকুরের ছাও, তুই কী করে ভাবলি তোর মতো একটা চোরের জন্যে আমার মনে সিম্প্যাথি আছে। ওদের থেকে বাঁচিয়েছি দেখেই তোর জন্যে আমার মনে এক বিন্দু সিম্প্যাথি নেই। বল শালা কুত্তার বাচ্চা, কী করেছিলি তুই তোর বন্ধুর সঙ্গে?’ মেয়েটা পিস্তল নাচিয়ে বলে উঠল।

‘আমি যা-ই করেছি, কিন্তু আপনিও জানেন আমি কামালকে খুন করিনি, ‘ আরিয়ান কোথা থেকে শক্তি পাচ্ছে নিজেও জানে না। কিন্তু সন্ধে থেকে একের পর এক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতেই কি না কে জানে, ওর নিজের কাছেই মনে হচ্ছে নিজের ভেতরে অদ্ভুত এক শক্তির উদ্‌গিরণ ঘটতে শুরু করেছে। তবে সেই সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে এই শক্তির উৎস আসলে ভিন্ন এক জায়গায়। নিজের ভেতরে অসততার যে বীজ সে লুকিয়ে রেখেছিল, সেটা ভেতর থেকে মহীরুহে পরিণত হতে হতে ওকে কাহিল করে তুলেছিল যেই মুহূর্তে ওটাকে গোড়া ধরে উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভেতর থেকে লাভার মতো অদ্ভুত এই শক্তি উদ্‌গরণ করতে শুরু করেছে। আরিয়ান এক পা এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। তার উত্তপ্ত লাল চোখ জোড়ার দূরত্ব দুই ফিটেরও কম আর উত্থিত পিস্তলের মুখটা এক ফুটেরও কম।

‘আমি কি করেছি আমি সেটা জানি। আর সেটা স্বীকার করতেও আমার কোনো দ্বিধা নেই আমার ভেতরে কিন্তু এভাবে নয়, আর অল্প খানিক এগিয়ে গেল ও। পিস্তলের কালো নলটা এখন ওর নক ছুঁই ছুঁই প্রায়। আরিয়ান অনুভব করল ওর ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো সড় সড় করে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ঠান্ডা ঘামের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে ওর পিঠের ওপর দিয়ে। পিস্তলের মাথাটাকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ওর মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতেই মেয়েটার চোখ জোড়া আবারো চোখে পড়ল ওর। সেগুলোতে রাজ্যের ঘৃণা আর দ্বিধা কিন্তু তাতে উত্তাপ আর রাগের পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। আমাদের সবার ভেতরেই পাপ আছে। আমিও পাপ করেছিলাম। দিনের পর দিন ব্যর্থতা কষ্ট আর যাতনার চাপে পিষ্ট হয়ে ভেবেছিলাম, বিজয়ী হওয়ার জন্যে সবই ঠিক। এরপর যখন সফলতা আসতে শুরু করে, আমার সেই ধারণা আরো পোক্ত হয়েছিল কিন্তু যেই মুহূর্তে পতন হলো সেটা একেবারে পর্বতের চূড়া থেকে অতল খাদে। পাপ কাউকে ছাড়ে না, আমাকেও ছাড়েনি,’ আরিয়ান সরাসরি মেয়েটার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। ‘আমার বন্ধুর মৃত্যুর ফায়দা তুলেছি আমি, কিন্তু তাকে হত্যা করিনি। এটা আপনিও জানেন,’ আরিয়ান আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কথা হারিয়ে থেমে গেল।

‘যেসব মানুষ জীবিত বন্ধুকে ব্যবহার করে তাদের আমরা ধোঁকাবাজ বলি,’ মেয়েটার চোখ আর গলার স্বর দুটোই আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ‘আর মৃত বন্ধুকে ব্যবহার করে যে-মানুষ, তাকে আমরা কী বলব?’ মেয়েটা পিস্তল নেড়ে বলে উঠল।

‘আমি জানি আমি কী করেছি, আর এর পরিণতি তো দেখতেই পাচ্ছেন,’ আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। ‘জীবনের সবচেয়ে বড়ো সাফল্যের চূড়া থেকে,’ চুটকি বাজাল আরিয়ান। ‘স্রেফ পলকের ভেতরে ছিটকে পড়েছি আমি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, কেন? আমি খারাপ কাজ করেছি কিন্তু এমন কিছুও করিনি যার বদৌলতে আমাকে প্রাণ হারাতে হবে। একটা লেখা—’

‘শাট আপ, খারাপ কিছু করেননি, আপনার মতো মানুষকে আসলে,’ মেয়েটা আবারো এগিয়ে এলো ওর দিকে। পিস্তলটা সোজা চেপে ধরল আরিয়ানের বুকের ওপরে। ‘বলেন কী করেছেন আপনি, জাস্ট সে ইট।’

‘ওকে ওকে, আমি আমার বন্ধুর লেখা চুরি করেছি,’ এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে ফেলল আরিয়ান। একদিন নিজের কাছে প্রমিজ করেছিল কথাটা কোনোদিনই মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবে না কিন্তু সেই প্রমিজ তীব্র আগুনের সামনে ছোট্ট এক টুকরো মোমের মতো গলে পড়ল। আরিয়ানের চোখ জোড়া ছোট হয়ে এলো এবং তীব্র আবেগ আর কষ্টের চোটে এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো চোখ দিয়ে। ‘শুধু চুরিই না, আমি আমার মৃত বন্ধুর লেখা চুরি করেছি,’ তীব্র কষ্টের বোঝাটা হঠাৎ করেই যেন আরিয়ানের বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই আবেগ সেই তীব্র আবেগের ঝোঁকটা এতটাই শক্তিশালী আর সেই বোঝামুক্ত হওয়ার অনুভূতি এতটাই তীব্র যে সেই ঝোঁকটা সামলাতে না পেরে মাটিতেই বসে পড়ল আরিয়ান।

১১

টিভি খুলে সে আঁতিপাতি করে খুঁজল কিছুক্ষণ কিন্তু কোনো চ্যানেলে কিছুই না পেয়ে ত্রস্ত পায়ে ফিরে এলো নিজের স্ট্যাডিতে। অনেকটা ক্ষ্যাপার মতোই ল্যাপটপটা খুলল। সে নিজে ফেসবুক, ইন্সটা বা টুইটার কোনোটাই ব্যবহার করে না। কিন্তু তার একাধিক আইডি অছে প্রায় প্রতিটা মিডিয়াতে। কোনোটা তার রিসার্চ আইডি, কোনোটা ফেইক আইডি, কোনোটা প্রাতিষ্ঠানিক। সত্যিকথা হলো সে নিজে সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়াতে না থেকেও প্রকটভাবে বিদ্যমান। এর পেছনে বেশ কিছু কারণও আছে। প্রথমত, সে যে-ফিল্ডে কাজ করে সেটার জন্যে এই আইডিগুলো তার প্রয়োজন, দ্বিতীয়ত, তার ফিল্ড অবশ্যই অবশ্যই ম্যাস পিপল মেন্টালিটি বোঝার একটা মাধ্যমও বটে। আর এখনকার দিনে ম্যাস পিপল মেন্টালিটির একটা বড়ো অংশ যে সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রতিটা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে ঢু মারল সে। প্রায় প্রতিটা বড়ো গ্রুপ যেগুলোতে সে নিজের ফেইক আইডি দিয়ে সংযুক্ত, সেগুলো ঘেঁটেও কিছু না পেয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল। আনমনেই ল্যাপটপের সামনে থেকে উঠে চলে এলো নিজের কাঠের আলমারিটার সামনে। সেটার মাঝের তাকের এলোমেলো কাপড়গুলোর পেছন থেকে বের করল একটা ভদকার বোতল। উত্তেজনার চোটে কয়েক ঢোক টানা মেরে দিয়েই কেশে উঠল সে।

কাশি সামলে একটা সিগারেট ধরিয়ে লিভিং রুমের সোফায় এসে বসল। অত্যন্ত শার্প এবং চতুর ধরনের মানুষ সে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই ভাবতে পারছে না ঠিকভাবে। আনমনেই সে একবার মোবাইলের দিকে তাকাল। ইলেকট্রনিক কিংবা সোশ্যাল কোনো মিডিয়াতেই কোনো খোঁজ না পেয়ে এবার সে খবরটার সত্যতা নিয়ে খানিকটা সন্দেহে পড়ে গেছে। যে-দুঃস্বপ্ন সে পেছনে ফেলে এসেছিল, ভেবেছিল এটা নিয়ে আর কোনোদিন ভাবতে হবে না, সেই দুঃস্বপ্ন আবারো ফিরে এসেছে, এবার নতুন রূপ নিয়ে, একেবারে ভিন্নভাবে, আরো ভয়ংকর হয়ে। কিন্তু  সে আগে কিছু জানতে পারল না কেন এটা ভেবে সে বেশ অস্থির বোধ করতে লাগল। সিগারেট শেষ করে আনমনেই একবার দম নিল বড়ো করে, কে জানে হয়তো অনেক বেশি চিন্তা করছে সে। কে জানে হয়তো আরো দু ঢোক ভদকা মেরে দিয়ে ঘুমানো উচিত তার। কিছুই হয়তো হয়নি। স্বনামধন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার ওপরে সে অত্যন্ত ওয়েলকানেকটেড। কে তার কী করতে পারবে।

আরো দু ঢোক ভদকা মারার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই বিষয়টা মাথায় এলো তার। তবে একটা উপায় আছে ব্যাপারটা ভেরিফাই করার। আবারো ল্যাপটপের সামনে এসে ওটা ওপেন করে এক মুহূর্ত ভাবল সে। গুগলে ঢুকে গুডরিডস সার্চ দিয়ে ওটাকে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট বইটার নাম সার্চ দিল, কিন্তু পেল না। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো অকারণেই অতি চিন্তা করছে সে। কিন্তু কী ভেবে লেখকের নামটা ধরে সার্চ দিতেই চলে এলো বইটা। ভুল নাম পাঞ্চ করেছিল সে।

আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বইটার সিনোপসিস পড়তে পড়তে দুই কান গরম হয়ে উঠতে শুরু করল তার। সিগারেট আর বইয়ের সিনোপসিস দুটোই যখন শেষ হলো, তার মনে হতে লাগল নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে।

শিট শিট শিট, ব্যাপারটা এতদিনে কোনোভাবেই জানতে পারল না কেন সে। কথাগুলো মনে মনে বলতে বলতেই উঠে দাঁড়াল সে। পালাতে হবে, পালাতে হবে, মনের ভেতরে বাজতেই লাগল কিন্তু কোথায় পালাবে সে। নিজের ঘরটার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সে। বিশ-ত্রিশ বছরের আয়োজন ফেলে কি ত্রিশ মিনিটে পালানো যায়!

.

‘ঘটনার শুরু, আমাদের রাইটিং ক্লাসে,’ হাতে ধরা গোল্ড লিফে টান দিয়ে আপনাতেই ওর চোখে পানি চলে এলো। সেই স্ট্রাগলের দিনগুলোর পর আর গোল্ড লিফ খায়নি ও। মৃদু কাশি দিয়ে গাড়ির বনেটে হেলান দেয়া মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখল। বাহাতি মেয়েটা বাঁ হাতের দু-আঙুলে ধরে অবলীলায় গোল্ড লিফ সিগারেট টানতে টানতে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়ছে।

‘ধানমণ্ডিতে, তাইনা?’ আড়চোখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে রাসনা মেয়েটা বলে উঠল।

‘হুমমম, ব্রাইট ইনস্টিটিউট অনেকটা মাস্টারক্লাসের মতো করে এক একটা প্রোগাম চালায়—ওখানে পিয়ানো, গিটার বাজানো থেকে শুরু করে ক্লাসিক্যাল ডান্স, কবিতা আবৃত্তি, লেখালেখি ইত্যাদি সব বিষয়ের ওপরেই ট্রেনিং দেয়া হয়। তিনমাস থেকে শুরু করে ছয়মাস, এক বছর, যে-যেরকম শিখতে চায় তার ওপরে ক্লাস নেয়া হয়। ওই প্রোগামেই কামালের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার সেই সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল,’ আরিয়ান একবার আশপাশে দেখে নিল। বেড়িবাঁধের এদিকটাতে এক সময় অনেক আসা-যাওয়া ছিল, বিশেষ করে রাতের বেলা বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই এদিকে আসা হতো। ওর মনে পড়ল, কামালের সঙ্গেও একবার এসেছিল এদিকে। দুজনেই ওরা মোহাম্মদপুরে থাকত, হঠাৎ একদিন রাতের বেলা কামাল ফোন করে ওকে বলে, দেশি খাবার খেতে ইচ্ছে করছে, ওরা রাতের বেলাতেই দুজনে বাসে চেপে চলে আসে বেড়িবাঁধের কাছাকাছি দেশি খাবারের জন্যে বিখ্যাত এক রেস্তোরাঁতে। রাতের বেলা সমাগম থাকার কারণে সারারাতই প্রায় খোলা থাকে রেস্তোরাঁটা। ওরা সেখানে গিয়ে জমিয়ে খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে বিরুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত চলে গেছিল। সেখানে গিয়ে সারারাত, একেবারে ভোর পর্যন্ত গল্প করেছিল দুজনে। সেই একই জায়গা, অথচ সেই রাত আর আজকের ভেতরে কত পার্থক্য।

‘প্রথমত, আর্মির মতো চাকরি ছেড়ে দিয়েছি নিজের প্যাশনকে ফলো করার জন্যে। সারাজীবন বই পড়তাম, লেখালেখি করতাম টুকটাক, সবাই প্রশংসাও করত, ভাবতাম লেখালেখিতে এলে ভালোই করব। কিন্তু ময়দানে নেমে দেখলাম ব্যাপারটা আসলে উলটো। ভালো পাঠক হওয়া এক জিনিস আর লেখালেখি করা ভিন্ন জিনিস। আমরা বই পড়ে, ফেসবুকে বইয়ের রিভিউ দিয়ে, টুকটাক লেখার পোস্ট দিয়ে সবার প্রশংসা পেয়ে মনে করি বই লেখা কিংবা উপন্যাস লেখাটাও খুব সহজ বিষয়। আসলে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। প্যাশন তো বটেই, সবচেয়ে বেশি লাগে ধৈর্য, সেই সঙ্গে বই পড়ার জ্ঞানের পাশাপাশি লাগে বেসিক কিছু নলেজ। অনেকটা গ্রামারের মতো, আরিয়ান শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসল।

‘আমার প্যাশন ছিল, পড়ালেখা ছিল, আর্মিতে থাকলেও আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছিলাম বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু দুটো উপন্যাস লিখতে গিয়ে যেটা অনুভব করছিলাম বেশ ভালোভাবে—সেটা হলো আমর বেসিক কিছু বিষয়ে জানা নেই। যেমন প্লট কীভাবে কন্সট্রাক্ট করলে ভালো হয়, কীভাবে চরিত্রায়ন আরো সুন্দর করা যায়, কীভাবে গল্পের আবর্তন তৈরি করা যায়, কীভাবে সাধারণ কিছু টেকনিক ব্যবহার করে গল্পে দারুণ সাসপেন্স তৈরি করা যায়,’ আরিয়ান অস্বস্তির সঙ্গে নড়ে উঠল। ‘বিষয়টা এমন না যে লিখতে গেলে এসব বিষয়ে জানতে হবে। এসব বিষয়ে খুব না জেনেও অনেকে বেশ ভালো গল্প-উপন্যাস লিখেছে। বরং অনেকের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে অনেক বেশি জেনে উলটো ফলও হয়েছে। যেমন যেকোনো ভাষা শিখতে বা বলতে গেলে আপনাকে গ্রামার বা বেসিক রুলগুলো জানতে হবে। গ্রামার বা ব্যাকরণ ছাড়া আপনি

আপনি বলতে বা লিখতে পারবেন না। কিন্তু ব্যাপারটা যদি এমন হয় আপনি কথা বলার সময়ে সর্বক্ষণ গ্রামার বা নিয়ম ভাবতে থাকেন—আপনি ঠিকমতো কথাই বলতে পারবেন না। তবে আমার মনে হচ্ছিল, আমি লেখার জগতে ভালো করতে গেলে আমার এরকম কিছু বিষয় জানা দরকার। সে কারণেই ব্রাইট ইনস্টিটিউটে যাওয়া। আমি জানতাম অলিয়াস ফ্রঁসে বা গ্যাটের মতো ওদেরও বিশ্ব সেরা কিছু ট্রেইনার আছে। আর গিয়ে ভুলও করিনি। ওখানেই আমার পরিচয় হয় কামালের সঙ্গে। এলোমেলো কোকড়া চুল, ভাসা ভাসা চোখ, হ্যাংলা-পাতলা লম্বা এক যুবক। বলতে গেলে প্রায় কারো সঙ্গেই সেভাবে মেশে না বা কথা বলে না। কিন্তু আমার সঙ্গে কীভাবে জানি বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। সত্যি কথা হলো আর্মি ছাড়ার পর আমারও অনেকটা ওর মতোই সামাজিকতা নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। ও আচ্ছা,’ আরিয়ান আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘আরো একটা কারণে ওর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমরা দুজনেই কিছু একটা লেখার জন্যে একেবারে ডেসপারেট হয়ে উঠেছিলাম। কামাল নিজের বা পরিবারের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলত না। কিন্তু যতটুকু বলেছিল, তাতে জানতে পারি—ও এতিম ছিল, এতিমখানায় বড়ো হয়েছে এবং পড়ালেখা করেছে। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হওয়ার কারণে পরে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ালেখা করে একটা এনজিওর জার্নাল সেকশনে কাজ করেছে দীর্ঘদিন। এরপর অনেকটা আমার মতোই প্যাশনকে ফলো করতে গিয়ে সব ছেড়েছুড়ে লেখালেখিতে চলে আসে।

‘আপনি আমাকে কামালের জীবন কাহিনি শোনাচ্ছেন কেন!’ রাগের সঙ্গে সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আরিয়ানের দিকে ফিরে বলে উঠল রাসনা। ‘আপনার কাছে এত কথা কে শুনতে চেয়েছে। আপনি তার সঙ্গে কী করেছিলেন সেটা বলেন।’

‘সেটা বলতে হলে তো আগে কনটেক্সটটা বলতে হবে নাকি?’ এবার আরিয়ানেরও একটু মেজাজ খারাপ হলো। মেয়েটার ব্যবহার খুবই অভদ্র। অবশ্য ওর কাজটাও অভদ্রই ছিল। ‘যা হোক, কামালের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। একসঙ্গে অনেক কিছুই শেয়ার করতাম আমরা। আমার সাহিত্যজ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা, কামালের নলেজ ছিল প্রখর। আবার আমার লেখার হাত ছিল খুব ভালো। তাই একসঙ্গে আইডিয়া শেয়ার করাটা খুব জমত। একসঙ্গে লেখার চর্চাটাও চলত খুব ভালো। কামাল ওর লেখার ব্যাপারে খুব বেশি কারো সঙ্গে শেয়ার করত না একমাত্র আমি বাদে।’

‘ওই সময়ে কি কখনো আপনার মনে হতো কামাল কোনোকিছু নিয়ে খুব ভয় পেত, বা কেউ তার পিছু নিচ্ছে—এরকম কখনো কিছু বলত সে?’ রাসনার গলা এবার বেশ শান্ত। সাধারণ কৌতূহলী গলাতেই জানতে চাইল সে।

‘আগেই বলেছি ও কথা বলত খুব কম। আমি এরকম কখনো কিছু শুনিনি ওর কাছ থেকে। তবে ও এমনিতে শান্ত স্বভাবের হলেও মাঝেমধ্যে খুব অস্থির হয়ে উঠত।’

‘কি রকম?’

‘বিশেষ করে ওর খুব অদ্ভুত এক অস্থিরতা ছিল,’ আরিয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘দেখুন লেখালেখির একটা বিষয় কী—এখানে জোর করে কিছু হয় না। আপনার মাথায় একটা গল্প এলো বা গল্পের কিংবা উপন্যাসের আইডিয়া এলো, আপনাকে সেটা নিয়ে লম্বা সময় ভাবতে হবে। আবার একই সময়ে একাধিক আইডিয়াও আসতে পারে। এর ভেতরে আইডিয়াগুলোকে আপনার সময় দিতে হবে, ভাবতে হবে। অনেকটা ছোট গাছের চারা যেভাবে সময় নিয়ে যত্ন দিয়ে পরিচর্যা করলে বেড়ে ওঠে সেভাবে করতে হবে কাজটা। এখানে জোরজবরদস্তি করলে কিছু হবে না। কিন্তু কামাল মাঝেমধ্যেই খুব অস্থির হয় পড়ত লেখার জন্যে। আগেই বলেছি আমি কামাল আমরা দুজনেই কিছু একটা লেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। আমার অস্থিরতা ছিল সফলতা পাবার, ভালো কিছু সৃষ্টি করার অস্থিরতা। কিন্তু কামালের অস্থিরতা ছিল ওকে একটা উপন্যাস দাঁড় করাতেই হবে। আজকেই হবে, এখনই হবে, এরকম একটা ভাব। এভাবে লেখা হয় না। আরেকটা সিগারেট হবে?’ আরিয়ান রাসনার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। ওর সিগারেটের তৃষ্ণা পায়নি। আসলে ওর ক্ষুধাও লেগেছে সেই সঙ্গে পিপাসাও। রাসনা ওর দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিতেই আরিয়ান সেটাকে ধরাতে ধরাতে বলে উঠল। ‘আমরা খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতির ভেতরে আছি। আমার পরিবার বা অন্য কাউকে—’

‘আপনি আগে কথা শেষ করুন। কী হয়েছিল আমি আগে সেটা শুনব, তারপর বাকি পৃথিবী,’ বাক্যের শেষে ঠিক যেভাবে মানুষ দাড়ি টেনে দেয় ঠিক সেরকম ভাবে কথাটা বলে উঠল রাসনা। তার সুরটাই এমন, এর ওপরে কোনো কথা চলবে না। আরিয়ান তার দিকে একবার দেখে নিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। ও আবার বলতে শুরু করল।

১২

পরিস্থিতি সামলাতে রহমানকে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। প্রতিবারের মতো এবারও সে অনুভব করল, যেকোনো কাজ পেশা কিংবা পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞতার আসলে কোনো বিকল্প নেই। অভিজ্ঞতা হলো এমন একটা ব্যাপার যার মাধ্যমে আপনি যেকোনো বিষয়ের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ধরতে পারবেন। ধরে নিন আপনি একজন শিক্ষক, যদি আপনার প্যাশন থাকে তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি বুঝতে পারবেন কোন পড়াটা ক্লাসে পড়াতে কতটা সময় লাগে, কোন বিষয়টা পড়তে ছাত্র-ছাত্রীরা আগ্রহ বোধ করে, আর কোন টপিকটা বোরিং, ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে আসলে মনোযোগ দিচ্ছে, নাকি আড়ালে শিক্ষককে নিয়ে মজা করছে। একজন নতুন শিক্ষক সবসময় এসব বিষয় নিয়ে অতিসচেতন থাকবে, কিন্তু একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক যে-কি না এরই মধ্যে এসব বিষয় অনেকটাই আয়ত্ত করে ফেলেছে তার কাছে এগুলো কোনো বিষয় না। যদি শিক্ষকতা নিয়ে তার প্যাশন থাকে তবে এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ার পর সে বরং উচ্চমার্গীয় বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগ দেবে। যেমন, আসলে পড়ানোটা কেমন হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা আসলেই কতটুকু শিখছে।

রহমানের ক্ষেত্রেও বিষয়টা এখন অনেকটাই এমন। মাঠের বিষয়গুলো কীভাবে কভারআপ করতে হবে এটা এখন সে খুব ভালোভাবেই জানে। সত্যি কথা হলো, এগুলো তাকে এখন আর দেখতেই হয় না। বরং জোনায়েদ কিংবা তার এরকম অন্যান্য সহযোগী যারা আছে তারাই এসব সামলাতে পারে। সে এখন মনোযোগ দেয় হত্যাশিল্পের উচ্চমার্গীয় বিষয়গুলোতে। আর তাই ছোট একটা ভুলে লেখক আরিয়ান পালিয়ে গেলেও সে কীভাবে আক্রমণ করেছে, কীভাবে ভ্যান থেকে পালিয়েছে এসব সাজানোতে তাকে কোনো মনোযোগই দিতে হলো না। সে বরং মনোযোগের সঙ্গে প্রতিক্ষণে আপডেট নিল—কীভাবে আরিয়ানের অতীতকে সামনে এনে, কীভাবে তাকে জনগণের সামনে রঙিন করে তোলা হবে। এরপরের ধাপে কীভাবে কী করা হবে সেগুলোও সাজানো হয়ে গেল। সব ঠিক হওয়ার পর সে ওদের টাইম টেবিলসহ কখন এবং কোনটার পর কোনটা কীভাবে ছাড়তে হবে সেগুলো বুঝিয়ে দিল। সব বুঝিয়ে দিয়ে সে নিজের লোকদের দিকে তাকাল। পুলিশের গাড়িতে ছেয়ে গেছে জায়গাটা। রহমান মৃদু হেসে উঠল, এবার শুরু হবে আসল খেলা। হাতের ইশারায় সে জোনায়েদকে ডাকল। আড়চোখে একবার দেখে নিল মৃত সেন্ট্রির লাশটাকে কীভাবে রাখা হয়েছে। ‘শোন, তুমি এখান থেকে আমাদের পুলিশ ট্রাকটা নিয়ে সেই অডিটরিয়ামে যাবে,’ বলে সে ঘড়ি দেখল। বেশ সময় পার হয়নি। ‘সেখানে এখনো মিডিয়ার লোকজন উপস্থিত থাকারই কথা। যাদেরকেই পাবে ট্রাকে উঠিয়ে সোজা এখানে নিয়ে আসবে। তবে অবশ্যই আগে তাদের হালকা একটা ব্রিফ করে নেবে কী হয়েছে। আর হ্যাঁ যাওয়ার আগে অবশ্যই ব্যান্ডেজটাকে বড়ো করে বেঁধে নেবে,’ জোনায়েদের চলে যাওয়ার জন্যে রওনা দিতেই সে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে পেছন থেকে ডাক দিল। ‘শোন তুমি যাওয়ার আগে মেডিককে পাঠিয়ে দিও এখানে,’ কথা শেষ করেই সিগারেটটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে সে মোবাইল বের করল। ওটার ফাটা স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে মেসেজ টাইপ করতে করতে মনে হলো এটা এসএমএস তো না বরং যার কারণে স্ক্রিনটা ফেটেছে তার কপাল ফাটানোর জন্যে মোক্ষম আঘাত। এসএমএসটা টাইপ করতে করতে সিগারেট চেপে ধরা ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার।

.

‘আপনি যেটা বলেছেন, সেরকমটা কখনো হয়নি শুধু সেই দিনটা বাদে,’ বলে আরিয়ান ধোঁয়া ছাড়ল। ‘সেই দিনটার কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে,’ আরিয়ান আবারো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল। ‘ওই দিনের কথা কোনোদিনই ভোলার নয়। লেখালেখির ওপরে ট্রেনিং কোর্সটা শেষ করে আমার খুব একটা লাভ হয়নি। বরং আমার জন্যে উলটো ফল বয়ে আনে ওটা। যেটা বলছিলাম ভাষা শেখার জন্যে গ্রামার বা নিয়ম শেখা বা জানাটা খুব জরুরি কিন্তু আমরা যদি কথা বলার সময়ে বা লেখার সময়ে সর্বক্ষণ গ্রামার বা নিয়ম চিন্তা করতে থাকি তবে কিন্তু কথাই বলতে পারব না,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগল আরিয়ান। ‘আমার লেখার ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই ঘটছিল। আমি বারবার লিখতে গিয়ে থেমে যাচ্ছিলাম, সমস্যায় পড়ছিলাম। লেখালেখিতে আমার একটা বিরাট শক্তির জায়গা ছিল লেখনী। সমস্যা ছিল প্লট আর গল্পে। এবার ঘটে ভিন্ন ঘটনা। আগের সেই প্লট আর গল্পের সমস্যা অনেকটাই সমাধান হলেও দেখা যায় লেখনীতে অনেক সমস্যা হচ্ছে, কারণ আমি সাহিত্যের বিভিন্ন ক্রম-উপক্রম, নিয়ম-কানুন নিয়ে অনেক বেশি ভাবছি। যা হোক, মন-মেজাজ খুব খারাপ, যত সময় যাচ্ছিল খুব হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। এমন সময় একদিন কামাল আমাকে একটা ই-মেইল করে। এর মধ্যে কয়েক মাস পার হয়ে গেছে। ই-মেইলটা পড়ে বেশ ভালোই লাগে। আমি সমস্যায় থাকলেও কামাল এই কয়েকমাসে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছে। প্ৰায় লিখে শেষ করে ফেলেছে একটা আস্ত উপন্যাস। উপন্যাসটা আমাকে ই-মেইলে পাঠিয়েছে। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটা পড়তে শুরু করি এবং যত পড়ি তত অবাক হতে থাকি। আগেই বলেছিলাম, কামালের প্লট এবং গল্পের ভাবনা দারুণ ছিল, ওর সমস্যা ছিল মূলত লেখনীতে। লেখনীর সমস্যা সে কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে, পুরোপুরি নয়। কিন্তু যে গল্পটা সে লিখেছে ওটা স্রেফ আগুন। আমার মনে আছে, বলতে গেলে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে একরকম এবং পরের দিন টানা উপন্যাসটা পড়া শেষ করে আমি স্রেফ স্থানুর মতো বসে থাকি। একবাক্যে দুর্দান্ত একটা উপন্যাস লিখেছে সে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমি তখন চরম খারাপ অবস্থার ভেতরে আছি—মানসিক, আর্থিক পারিবারিক সবদিক থেকে। এমন সময় বন্ধুর এমন একটা কাজ দেখে ভালোও লাগে, আবার হিংসাও লাগে। আমি অনেস্টলি বলি, সিদ্ধান্ত নিই কামালের যদি কোনো হেল্প লাগে আমি করব। ওর লেখার দুর্বল জায়গাগুলো দেখিয়ে প্রয়োজনে ঠিক করে দেব। আমি কামালকে কল দিয়ে দেখা করতে চাই। সেদিন বিকেলেই কামালের সঙ্গে দেখা করি।’  

‘ওইদিনই সে মারা যায়, তাই না?’ রাসনা মেয়েটার গলা একেবারে থমথমে।

আরিয়ান মাথা নেড়ে সায় জানাল। ‘আমি কামালের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ওর বাসার কাছেই এক পার্কে। আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা এত দারুণ একটা লেখা লিখে খুব উৎফুল্ল মুডে থাকবে কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।’

আরিয়ান দেখল রাসনা মেয়েটা মুখ তুলে তাকিয়েছে। তার চোখে আগ্রহ এবং কৌতূহল।

‘কামাল খুবই বিষণ্ন মুডে ছিল ওইদিন। আমি খুব উৎফুল্ল মুডে বারবার ওর লেখার প্রশংসা করছিলাম কিন্তু ওর যেন মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও। আপনি যা জানতে চাইছিলেন, কেউ ওর পিছু নিয়েছিল কি না বা এরকম কিছু, এসব বিষয়ে সে কিছুই বলেনি। কিন্তু খুব মনমরা কথাবার্তা বলছিল। জীবনের কোনো মানে নেই, কী হবে এসব লিখে ইত্যাদি ইত্যাদি ধরনের কথাবার্তা। আমি অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে ঠিক করার চেষ্টা করি, কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না। সে বারবার আমাকে বলছিল বইটা সে প্রকাশ করতে চায় না। আমি ওকে পাগলামি করতে মানা করে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে বলি। কামাল চলে যায় কিন্তু ও চলে গেলেও আমার ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করতে থাকে। বারবার শুধু মনে হতে থাকে, ছেলেটা যদি সত্যিই বইটা প্রকাশ করতে না চায়—সেক্ষেত্রে এমন দারুণ একটা গল্প নষ্ট হবে। তারচেয়ে এমনকি হতে পারে না, ও প্রকাশ করতে না চাইলেও আমি ওটাকে ঠিক ঠাক করে দুজনের দ্বৈত নামে প্রকাশ করতে পারি।’

‘চুরির ধান্ধা—’

আরিয়ান চোখ তুলে তাকাল মেয়েটার দিকে। ‘মিস রাসনা, আপনি হয়তো আমাকে ফ্রড ভাবছেন, সেটাই স্বাভাবিক। আমি আমার মৃত বন্ধুর লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সত্যি কথা হলো, সেই সময়ে আমার এমন কোনো নিয়ত ছিল না। আমি দ্বৈতভাবে প্রকাশের কথাই ভেবেছিলাম। বেশ অনেকক্ষণ সেই পার্কে বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করে ভাবতে থাকি বিষয়টা নিয়ে এবং একটা পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেই ওর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে আমাকে। আমি ওর বাসার উদ্দেশে হাঁটা দিই। ওর বাসায় পৌঁছে দেখতে পাই, ওর দরজা ভেজানো কিন্তু খোলা। ভেতরে ঢুকে যা দেখি—’ আরিয়ান থেমে গেল। রাসনা এবং আরিয়ান দুজনেই চুপ, বিচিত্র বীভৎস স্মৃতিচারণার মাঝে বিষণ্ন নীরবতা ভারী হয়ে ঝুলে রইল।

‘কামাল এক কামরার একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকত। সেই রুমেরই সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল ও। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ভেতরে ঢুকে ওর দিকে ছুটে গিয়ে দেখি, পা জোড়া ঠান্ডা হয়ে গেছে। মারা গেছে আরো বেশ আগেই। আমি চিৎকার করে লোক ডাকব নাকি মোবাইলে কাউকে কল দেব—সে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই মাথার ভেতরে পাকিয়ে উঠতে থাকল ভিন্ন কিছু।

আরিয়ান বড়ো করে একবার দম নিল। আমি এখন আজ এখানে দাঁড়িয়ে যাই বলি না কেন—অন্যায় আর ভুলের কোনো জাস্টিফিকেশন হয় না।’

‘আপনি তো ভুল করেননি,’ রাসনার গলায় আগের সেই খসখসে ভাবের জায়গায় বরং এক ধরনের আর্দ্রতা। ‘আপনি আপনার মৃত বন্ধুর প্রতি চূড়ান্ত অন্যায় করেছেন।’

‘আগেই বলেছি, আমি যাই বলি না কেন তার জাস্টিফিকেশন, হয় না। আসলে অভাবে স্বভাব নষ্ট বলে না, আমার হয়েছিল ওই দশা। দিনের পর দিন একের পর এক ঝুঁকি আর স্ট্রাগল আমাকে ডেসপারেট করে ফেলেছিল। আমি ওখানেই বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, ওর নভেলটাকে আমি নিয়ে নেব। কামাল আমাকে বলেছিল এটার কথা আমি বাদে আর কেউই জানে না। আমি খুঁজতে শুরু করি, ওর ওখানে এটার কোনো প্রিন্ট কপি আছে কি না। ওর খাটের তলায় বাজে কাগজের ভেতরে এলোমেলো একটা কপি পেয়ে সেটা নিয়ে নিই। এরপর ছিল সফট কপি নষ্ট করা। আমি ওর ল্যাপটপ খুলে খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার আবিষ্কার করি, ওর ল্যাপটপের ড্রাইভগুলো আগে থেকেই ফ্ল্যাশ করা। আমি ওটা নিয়ে খুব বেশি ভাবিনি। ভেবেছিলাম মারা যাওয়ার আগে হয়তো ও নিজেই সব মুছে দিয়ে গেছে। আমি পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে খুব সাবধানে আমার উপস্থিতির সব চিহ্ন মুছে আমি ওর ফ্ল্যাটের পেছন দিয়ে বেরিয়ে আসি। আগে যেহেতু আর্মিতে ছিলাম এবং সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে আমার পড়ালেখা ছিল, কাজেই মোটামুটি ধারণা ছিল কীভাবে ঝামেলা এড়িয়ে ক্লিনভাবে আমি ওখান থেকে সরে পড়তে পারব। আর হয়েছিলও তাই।’

‘আপনি আপনার বন্ধুকে ওখানে পচেগলে শেষ হওয়ার জন্যে রেখে তার সবচেয়ে মূল্যবান সৃষ্টিটাকে হাতিয়ে নেয়ার জন্যে স্রেফ পালিয়ে এলেন ওখান থেকে! আপনি কি

‘আমি এতটা অমানুষ না,’ আরিয়ান খানিকটা রেগে গেল এবার। ‘আমার সব ঠিক করার জন্যে এক রাতের প্রয়োজন ছিল। পরদিন সকালে উঠেই আমি আনরেজিস্টার্ড একটা সিম থেকে কামালের বাড়িওয়ালাকে কল করে ভুয়া পরিচয় দিয়ে জানাই—কাল রাতে ওই ফ্ল্যাট থেকে শব্দ শুনেছি চেক করার জন্যে ইত্যাদি। এরপর—’

‘ওর উপন্যাসটার কী করলেন?’

‘আমি দীর্ঘ সময়ের স্ট্রাগলে এটা জানতাম যে আমার হাতে খনি থেকে তোলা হীরা রয়েছে। কিন্তু এই হীরাটাকে কাজে লাগাতে হলে ওটাকে অনেক অনেক পালিশ করতে হবে। প্রথম কিছুদিন ঢাকায় থাকার প্রয়োজন ছিল। আমি খুব সাবধানে কামালের কেসটা প্রত্যক্ষ করছিলাম। তারপর একটা সময় পরে যখন দেখলাম ওটা ঝিমিয়ে গেছে, তখন সোজা এক আর্মি ফ্রেন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে

চলে গেলাম বান্দরবন। প্রথমত, আমার তখন ঢাকা থেকে সরে পড়ার দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, আমার ঠান্ডা মাথায় দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার দরকার ছিল। বান্দরবনে গিয়ে বন্ধুর সহায়তায় কমদামি একটা লজ ভাড়া করে টানা তিনমাস নভেলটা নিয়ে কাজ করলাম। যা যা দুর্বলতা ছিল সব বারবার করে চেক করে ঠিকঠাক করে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে ঢাকা ফিরে এলাম,’ আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। ‘এরপর আপনি জানেন—’ একটু থামল আরিয়ান। একবার ঘড়ি দেখল। মনের ভেতরটা আনচান করছে ওর পরিবারের মানুষগুলোর জন্যে। ‘এবার আপনার অংশটা বলুন, আরিয়ান বুঝতে পারছে এই গল্পের বাকিটা না বুঝতে পারলে আসলে পরের ধাপের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

রাসনা মেয়েটা বড়ো করে একবার দম নিল। ‘আমি ডিবিএস-এ জয়েন করার আগে পুলিশে ছিলাম,’ বলেই মেয়েটা থেমে গেল। এক মুহূর্ত ভেবে সে বলে উঠল। ‘আমি বুঝতে পারছি আপনার জন্যে আপনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। কিন্তু ট্রাস্ট মি, আমার সাইডের গল্প শোনাটাও আপনার জন্যে জরুরি। আর আপনার পরিবারের সঙ্গে কথা বলার আগে আপনাকে আরো দু-একটা বিষয় বুঝতে হবে এবং কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারপর আমরা সেই ঝুঁকিতে যেতে পারব। যা বলছিলাম, আমি পুলিশে ছিলাম ঢাকার বাইরে। শহরের বাইরে একটা থানায়। ওই সময়ে কামালের সঙ্গে আমার পরিচয়। শান্তশিষ্ট একটা ছেলে, মাঝেমধ্যে থানায় আসত, তার নাকি কিছু সমস্যা আছে কিন্তু কাউকে বলতে ভরসা পেত না। সে মাঝেমধ্যেই আসত, এসে বসে থাকত, আবার চলে যেত। প্রথম দিকে বিরক্ত লাগত, তারপর ছেলেটার প্রতি কেমন জানি এক ধরনের মায়া লাগত আমার। টুকটাক কথা হতো, আবার বেশি কথাও বলত না। এভাবে ওর সঙ্গে খানিকটা সখ্য গড়ে উঠতে শুরু করে। যে শহরের কথা বলছি, ওটা মফস্বলের একটা শহর, অনেকটা শহরতলি বলা যায়। আমি ঢাকায় বড়ো হওয়া, পড়ালেখা করা মেয়ে ওরকম একটা শহরে আসলে আমার চূড়ান্ত বোর লাগত। এমন সময় কামালের সঙ্গে পরিচয়, কথা বলা ভালোই লাগত। একটা সময় আমরা মাঝেমধ্যে বাইরে যেতাম, ঘুরে বেড়াতাম নদীর তীরে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো—কামালের কী সমস্যা ছিল সেটা সে কখনোই আমাকে বলত না। আমি মাঝেমধ্যে জানতে চাইলে বলত বাদ দাও, ওসব তেমন কিছু না। আমিও ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো কারণে ভয় পেত বা থ্রেট ফিল করত-আমার সঙ্গে অ্যাফেয়ার হওয়ার পর সেগুলো কেটে গেছে।’  

মেয়েটা আবারো থেমে আরেকটা সিগারেট ধরাল। এই মেয়ে সমানে সিগারেট খায়। ‘বয়ফ্রেন্ড হিসেবে কামাল ভালো ছিল, বাই নেচার সে খানিকটা বিষণ্ণ এবং নীরব প্রকৃতির কিন্তু মানুষ হিসেবে ভালো। আমি ওর ব্যাকগ্রাউন্ড জানতাম, তাই ভাবতাম হয়তো নিজের অতীতের কারণে সে ওরকম। আমি ওকে নিয়ে সুখী ছিলাম, আমি তখন পুলিশ থেকে ভিন্ন কোনো ফোর্সে জয়েন করার কথা ভাবছিলাম। ও আগে ভালো একটা চাকরি করত, কিন্তু তখন বেকার ছিল, ভাবছিল নতুন চাকরিতে ঢুকবে। ভেবে রেখেছিলাম, আমরা নির্দিষ্ট একটা সিদ্ধান্তে এলে ঢাকায় এসে বিয়ে করব। কিন্তু হঠাৎই কামালের মধ্যে আবারো পাগলামি দেখা দিতে শুরু করে। একদিকে সে আবারো ভয় পেতে শুরু করে, তার ধারণা, কিছু মানুষ বা একটা গ্রুপ তার পিছু লেগে আছে, নানাভাবে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। ও মাঝে মধ্যেই খুব ভয় পেত কিন্তু জানতে চাইলে নির্দিষ্ট করে কিছু বলত না।’

‘আসলেই কী—’

‘আমি জানি না,’ রাসনা কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আমি কখনো কিছুই দেখতে পাইনি। সত্যি কথা যেটা। বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেছি, পরখ করেছি। আমার চোখে কিছুই ধরা পড়েনি। হয় পুরোটাই কামালের ভ্রম ছিল, যেটা এখন আর মনে হয় না। আর যদি কেউ তার পিছু নিয়েও থাকে তবে তারা অসাধারণ দক্ষ। যা-ই হোক আমি কামালের কাছে জানতে চাই কেন কেউ ওর পিছু নেবে, ওকে থ্রেট করবে। এমন না যে ও খুব বড়ো কোনো চাকরি করে কিংবা ওর অনেক টাকা আছে। কিছুই না, কোনো কারণ নেই।’

‘আপনি বলছিলেন আরো একটা বিষয় ছিল—’

‘আরেকটা হলো, দিন দিন ওর মাথায় লেখার ভূত চেপে বসেছিল, কোনোকিছুতে মনোযোগ ছিল না। সারাক্ষণ হয় কেউ তার পিছু নিচ্ছে, ষড়যন্ত্র করছে, আর না হয় ওকে লিখতে হবে,’ রাসনা সিগারেটের মোথা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজের মাথার দুই পাশ চেপে ধরল। ‘লিখতে হবে, লিখতে হবে করতে করতে মাথাটা স্রেফ খারাপ করে ফেলেছিল আমার। একটা পর্যায়ে ওর এই প্রায় সিজোফ্রেনিক বিহেভিয়ার আর লেখার পাগলামি আমি আর নিতে পারছিলাম না। তখন আমারও ডিবিএস-এ নিয়োগ হয়ে গেল, আমি ওকে জানালাম, বিয়ে করার আগে আমাদের আসলে পরস্পরকে আরেকটু স্পেস দেয়া উচিত এবং আরেকটু ভাবা উচিত। এর পেছনে মূল কারণ ছিল আমার মনে হচ্ছিল, কামাল মানসিকভাবে পুরোপুরি সাউন্ড না। কিন্তু এটাও জানতাম যে ও ছেলে হিসেবে খুবই গুড হার্টেড, কাজেই ওর প্রতি টান আমার এতটুকু কমেনি। তবে এই স্পেসটার প্রয়োজন ছিল। আমি চলে গেলাম ডিবিএস-এ ট্রেনিং-এর জন্যে, আর কামাল চলে গেল ঢাকায়। প্রথমে কিছুদিন যোগাযোগ ছিল, তারপর হঠাৎ করেই আর কল রিসিভ করছিল না। আমিও তখন কড়া ট্রেনিং প্রসিজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, মোবাইল ব্যবহার করা সম্ভব হতো না সবসময়। ছয় মাস পর যখন ট্রেনিং শেষ করে আমার পোস্টিং হলো তখন ওর সিম, হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক সব হয় বন্ধ না হয় ডি-অ্যাকটিভেট করা। আমি জানতাম যে ও লেখার ওপরে কোর্স করছে, ঢাকায় থাকছে কিন্তু যোগাযোগ ছিল না। আমিও বিজি ছিলাম নতুন পোস্টিং, নতুন অফিস নিয়ে। আরো বেশ কিছুদিন পর আমার ঢাকায় ট্রান্সফার হলো এবং নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে আমি যখন ভাবছি এবার সিরিয়াসলি ওকে খুঁজে বের করব—এমন সময় ওর সুইসাইডের খবর জানতে পারি।’

‘আপনার কাছে কি মনে হয়েছিল তখন, ও সত্যি সুইসাইড করেছিল?’

‘সত্যি কথা বলি, কামালকে যতটুকু চিনেছিলাম তাতে সুইসাইড করার মতো ছেলে ও ছিল না। তবে শেষ দিকে ওর বিহেভিয়ারের ওপর আমি ঠিক ভরসাও করতে পারছিলাম না। আর তাই অনেকটা সেধেই কেসটা আমি নিজে নিয়ে নিই। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই—আমি কিছুই পাইনি। আর তাই ওপর থেকে বারবার চাপ প্রয়োগ করছিল কেসটা বন্ধ করার জন্যে, আমিও কিছু পাচ্ছিলাম না। শেষে বন্ধই করে দিল,’ রাসনা মেয়েটা আরিয়ানের দিকে ফিরে তাকাল, ‘কিন্তু বিশ্বাস করেন, একটা দিন নেই যেদিন কামালকে আমি মিস করিনি, ওর কথা মনে পড়েনি। আমি ওকে ভালোবাসতাম, আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসত। সব প্রেমেই উত্থানপতন হয় স্পেস দরকার হয়, আমি স্রেফ সেটাই চেয়েছিলাম কিন্তু কিন্তু—’ রাসনা থেমে গিয়ে তোড়জোর করে আরেকটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতে লাগল, আরিয়ান ভয় পেতে লাগল মেয়েটা না আবারো ভেঙে পড়ে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ওকে অনেকটাই নির্ভর করতে হচ্ছে মেয়েটার ওপরে। নিজের প্রয়োজনে হলেও মেয়েটাকে ঠিক রাখতে হবে ওর।

‘আজকের ব্যাপারটা কী, আর আপনি আমার লেখার ব্যাপারেই বা জানলেন কীভাবে?’ মেয়েটাকে ঠিক রাখতে হলে এখন কথার ওপরে রাখতে হবে।

‘গতকাল আমার অফিসে এক কলিগ হঠাৎ করে আমার কাছে জানতে চায় কামালের সুইসাইডের বিষয়ে। আমি খুব অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে সে জানায় স্পেশাল ফোর্স থেকে দুই অফিসার এসে নাকি একাধিকবার এ কেসের ব্যাপারে খোঁজখবর তো নিয়ে গেছেই—কেসের ফাইলও নিয়ে গেছে। আমি খুব অবাক হয়ে আরেকটু খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারি, কামালের কেস ফাইল রি- ওপেন করা হয়েছে আরো এক মাস আগে।’

‘তারমানে ওরা আমার পেছনে লেগেছে প্রায় মাসখানেকের ওপরে,’ আরিয়ান বিড়বিড় করে বলে উঠল। ‘তারপর?’

‘গতকাল আমি যখন এই রি-ওপেনের ব্যাপারে জানতে পারি তখন অলমোস্ট বিকেল হয়ে গেছে, চাইলেও বেশি খোঁজ করা সম্ভব ছিল না। আজ সকালে উঠেই আমি জরুরি কারণ দেখিয়ে অফিস থেকে ছুটি নেই বেশ কয়েকদিনের। এরপর স্পেশাল ফোর্সে যোগাযোগ করে কিছুই জানতে পারি না। এরপর সরাসরি ওদের অফিসে গিয়ে এক প্রাক্তন কলিগকে খোঁজ করতে বলি। সে খানিকটা খোঁজ নিয়ে আনঅফিসিয়ালি আমাকে জানায়—কোনো এক অদ্ভুত কারণে কামালের এই কেসটা খুব হাই প্রোফাইল অফিসাররা হ্যান্ডেল করছে এবং এই কেসের সব বিস্তারিত একেবারে টাইট করে রাখা হয়েছে। তবে সে কোনো না কোনোভাবে আপনার নাম জানতে পেরেছিল এবং সে এটাও জানায়, কামালের কেসের নতুন এক লিড পাওয়া গেছে তার কোনো এক লেখক সঙ্গী—সম্ভবত তার লেখা উপন্যাসের গল্প চুরি করার জন্যে তাকে খুন করে থাকতে পারে। আর তাই এই কেস আবারো চালু করা হয়।’

‘আর সেটা আমি?’ আরিয়ান পুরো জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করছে।

‘হুমম,’ রাসনা বলে চলেছে। ‘এটা শোনার পর আমার মাথায় স্রেফ আকাশ ভেঙে পড়ে। একদিকে নিজের ফিলিং, আরেকদিকে এরকম ঢাক গুড়গুড় একটা কেস। আমি সোজা চলে যাই ব্রাইট সেন্টারে। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আপনি কামালের ক্লাসমেট ছিলেন ওখানে। ব্রাইট সেন্টারে আপনার বিরাট একটা পোস্টার লাগানো কংগ্রাচুলেশন্স জানিয়ে। আপনার পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্যে। আমি দুয়ে দুয়ে চার মেলাই, বুঝতে পারি কামাল বারবার শুধু লেখার কথা বলত, সে নিশ্চয়ই কিছু একটা লিখেছিল, আর সে ভয়ে দ্বিধায় ভুগত—এর পেছনেও কারণ ছিল। জোর সম্ভাবনা, যদি সত্যি সে পুরোপুরি মেন্টালি সাউন্ড হয়ে থাকে, সত্যি যদি তার ভয়াবহ কোনো অতীত থেকে থাকে, সেটা সে তার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছিল,’ রাসনা মেয়েটা এইটুকু বলতেই আরিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়াল। পুরো বিষয়টা সেন্স মেইক করতে শুরু করেছে এখন।

‘আর যারাই তার অতীতের শত্রু কিংবা যা-ই হয়ে থাকুক না কেন—তারা তাকে খুন করে সেটা সুইসাইড হিসেবে চালিয়ে দেয়। আর ঠিক সেই কাছাকাছি সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সেই উপন্যাস চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিই,’ আরিয়ান অনুভব করল, এই শীতের রাতে আবারো সে ঘামতে শুরু করেছে। ‘ফাক,’ শেষ শব্দটা আপনাতেই বেরিয়ে গেল ওর মুখ দিয়ে।

১৩

‘আমার ধারণা আপনি ঠিকই বলেছেন,’ রাসনা মেয়েটা মন্তব্য করার মতো করে বলে উঠল। ‘আমি আগে আমার কথাগুলো শেষ করি। তো ব্রাইট সেন্টারে এটা দেখার পর ওদের কাছ থেকে আপনার প্রোগ্রাম ইত্যাদির বিস্তারিত জেনে নিয়ে আমি একটা গাড়ি ভাড়া করি,’ বলে সে হেলান দেয়া গাড়ির টায়ারে পা দিয়ে দুবার ঠুকে দিল। ‘এটাকে কো-ইন্সিডেন্স বলতে পারেন, আপনার কিংবা আমার ভাগ্য বলতে পারেন এবং পুলিশি ইন্সটিংকট বলতে পারেন, আমার মনে হচ্ছিল আজ বড়ো কিছু একটা হতে যাচ্ছে। একটা সাধারণ ছেলের সাধারণ সুইসাইডকে স্পেশাল ফোর্সের হাই প্রোফাইল কেস বানানো হয়েছে। এটাকে একেবারে কনফিডেন্সিয়াল কেস হিসেবে স্পেশাল প্রটোকলে স্পেশাল পারমিশনে সুপার সিক্রেসি মেইনটেইন করে হ্যান্ডেল করা হচ্ছে। কারণ কী?’ রাসনা অবাক ভঙ্গিতে নিজের দুই হাত তুলল। ‘একটা সুইসাইড! এরকম হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে আমাদের দেশে প্রতিদিন। কেউ কেয়ার করছে না। একজন লেখক, লেখা গল্প চুরি! আমি আপনাকে ডিজরেসপেক্ট করছি না, আমাদের দেশের মানুষ বা সরকারি অফিসার কিংবা রাজনৈতিক নেতারা এসব পোছেও না। যাদের এসব লাইনে আগ্রহ আছে তাদের হিসাব আলাদা, বাকিদের কাছে এসব কিছুই না। আপনি যতবড়ো লেখকই হননা কেন, আমাদের দেশে একজন সেকেন্ড গ্রেড সরকারি অফিসারের সমান সামাজিক সম্মানই আপনি কোনোদিন পাবেন না। এটাই সত্যি কথা। তাহলে কারণ কী?’ এইটুকু বলে রাসনা থেমে গেল।

‘কারণ আরো অনেক বড়ো কিছু, অনেক গভীর কিছু,’ আরিয়ান গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে উঠল। ওর আবারো সিগারেটের তৃষ্ণা পেতে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে চায়েরও।

‘একদম ঠিক,’ মেয়েটা আবারো বলতে শুরু করল। ‘আর আমি পুরস্কার বিতরণীর অডিটরিয়ামে পৌছে অনুভব করতে পারলাম, আমি যা ভেবেছিলাম তাই। অফিসার রহমানকে তার কলিগরা ডাকে বাংলার কসাই। তাকে দেখেই আমি বুঝেছি ওরা আপনাকে অ্যারেস্ট করবে কিন্তু থানা পর্যন্ত পৌঁছাতে দেবে না। তার আগেই মেরে ফেলবে। পুরো ব্যাপারটা যা-ই নিয়ে হোক না কেন। ওরা এটা স্রেফ ধামাচাপা দিয়ে দেবে।’

‘আর তাই—’

হ্যাঁ আমি পিছু নিই ওদের। প্রথমে দুটো জিপ ছিল, সঙ্গে আশুলিয়ার বেড়িবাঁধ এলাকায় প্রবেশ করতেই জিপ দুটো স্পিড বাড়িয়ে সরে পড়ে।’

‘আসলে এরা এসব কাজ এতবার এতভাবে করেছে, এদের দক্ষতা প্ৰায় আর্টিস্টের পর্যায়ে,’ আরিয়ান মন্তব্য করার মতো করে বলে উঠল। ও ফিরে তাকাল রাসনা মেয়েটার দিকে। ‘আজরাতে আপনি না থাকলে আমি হয়তো এতক্ষণে—’ ইচ্ছে করেই ও বাক্যটা শেষ করল না। ‘আমি কামালের সঙ্গে কী করেছি সেটা জানার পরও আপনি হেল্প করেছেন—’

‘আপনাকে আমার প্রয়োজন। এখানে আর কোনো—’

‘হোক প্রয়োজন, তাও তো আমাকে আপনি বাঁচিয়েছেন। বলুন এবার কী?’ বলে আরিয়ান বড়ো করে একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। ‘আমি তো শেষ কিন্তু আমাকে আমার পরিবারের কথা ভাবতে হবে, যেকোনো উপায়েই হোক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে,’ আরিয়ান এখনো মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে আছে।

‘আপনি কী এটা ভেবেছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উলটো তাদেরকে আরো বড়ো বিপদে ফেলে দেবেন না তো।’

‘ভেবেছি, কিন্তু বিপদে ফেলে দিলেও করতে হবে। আমি মরি বাঁচি পরে, কিন্তু আগে ওদের নিরাপদ করতে হবে।’

রাসনাকে দেখে মনে হলো, সে ভাবছে। ‘ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তাতে বেশ কয়েকটা বিষয় আছে। প্রথমত, জোরদার সম্ভাবনা, ওরা এই মুহূর্তে আপনার পরিবার এবং তাদের কমিউনিকেশন ডিভাইসগুলোর ওপরে নজর রাখবে। যেই মুহূর্তে আমরা তাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করব সেটা কলে হোক, সোশ্যাল মিডিয়াতে হোক, অনলাইনে হোক, ওরা ট্রেস করবে আমাদের এবং ধরে ফেলার চেষ্টা করবে। কাজেই যোগাযোগ করলেও খুব দ্রুত আমাদের মুভ করতে হবে। আর যেখানে ওরা আপনাকে এনকাউন্টার করতে যাচ্ছিল, সেখান থেকে এই জায়গা খুব দূরে না। কাজেই এমনিতেও আমাদের মুভ করা উচিত। আসলে আপনি ঠিকই বলেছিলেন আরো আগেই করা উচিত ছিল। দ্বিতীয়ত, একটা ব্যাপার তো বুঝতে পারছেন, পুরো ব্যাপারটা কী নিয়ে সেটার একটা প্রাথমিক ধাপ আমরা অনুমান করতে পারছি। কিন্তু আপনি যদি এই অবস্থা থেকে উদ্ধার হতে চান, সোজা বাংলায় জানে বাঁচার কথা ভাবতে চান, তবে আপনাকেও বুঝতে হবে গোটা ব্যাপারটা আসলে কী নিয়ে এবং এর সম্ভাব্য সমাধান বের করতে হবে। আর আমি জানতে চাই কামালের আসলে কী হয়েছিল, কারা তাকে খুন করেছিল এবং কেন সে খুন হয়েছিল।’

তাহলে আপনার প্রপোজাল কী?’ আরিয়ান জানে, মেয়েটার এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে অনেক কিছু ডিপেন্ড করছে।

‘আমি আপনার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করব, বিনিময়ে আপনি আমাকে মানে আমরা পরস্পরকে হেল্প করব পুরো বিষয়টার একটা সুরাহা করতে। চলুন গাড়িতে গিয়ে বসি,’ আরিয়ান আর রাসনা দুজনে মিলে গাড়িতে এসে বসল। মেয়েটা ড্যাসবোর্ড খুলে নিজের ছোট একটা হ্যান্ডব্যাগ বের করে সেটার ভেতর থেকে একটা ছোট কৌটা বের করে আনল। আরিয়ান দেখল, ওটার ভেতওে বেশ কয়েকটা সিম। ‘এগুলো আন রেজিস্টার্ড সিম, এখানে একটা হ্যান্ড সেট আছে। আপনার কি বাসার কারো মোবাইল নম্বর মুখস্থ আছে?’

‘আব্বারটা আছে,’ আরিয়ান মোবাইল আর সিম নিতে নিতে বলে উঠল।

‘অন্য কারোটা হলে বেটার হতো। যাক গে, আমি গাড়ি স্টার্ট করছি,’ মেয়েটা গাড়িতে চাবি লাগাল। ‘আপনি আপনার বাবাকে কল করে এক মিনিটের কম সময় কথা বলবেন। তারপর সেটটা অফ করে ওটাকে হয় রাস্তার ওপরে জোরে আছাড় দেবেন, না হলে রাস্তার পাশে পানি আছে—এমন কোনোদিকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। গট ইট?’

আরিয়ান মাথা নেড়ে ফোনটা ওপেন করল। রাসনা মেয়েটা গাড়ির গতি ধীরে ধীরে বাড়াতে শুরু করেছে। ওর বাবার নম্বরে ডায়াল করল আরিয়ান। রিং হচ্ছে ওপাশে, একবার দুবার। কিন্তু কেউ কল রিসিভ করল না। ব্যাপার কী—’  

‘আবার কল করুন, আর এবার রিসিভ না করলে আর কথা বলা যাবে না মোবাইলটা—’

রাসনা কথাশেষ করার আগেই মোবাইলটা বেজে উঠতেই আরিয়ান চমকে উঠল।

রিসিভ করুন, এক মিনিটের কম,’ মেয়েটা স্পিড বাড়াতে শুরু করেছে।

‘হ্যালো বাবা আমি,’ আরিয়ান রিসিভ করতেই ওপাশে ওর বাবা এক গাদা প্ৰশ্ন করতে শুরু করল। ‘আব্বা আব্বা শোন, একটাও কথা বলবে না, আমি যা বলি শোন। প্রথমেই, আমি ঠিক আছি,’ ওর বাবা আবারো কথা বলতে শুরু করেছিল ও থামিয়ে দিল। পাশ থেকে ওর মায়ের গলাও পাওয়া যাচ্ছে। ‘আব্বা, শোন, আমি ঠিক আছি, যে যাই বলুক কিছু বিশ্বাস করো না, সব মিথ্যা, সব ষড়যন্ত্র। আর  রাতে তোমরা চাচার বাসায় ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে চলে যাও, মনিকা আর সাবেরকেও বলো সাবধানে থাকতে,’ রাসনা আরিয়ানের কোট ধরে টান দিল দুইবার। ‘আব্বা রাখছি, আবেগের স্রোতে ওর গলা বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করেছিল নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন কেটে দিয়ে ওটাকে ছুড়ে দিল রাস্তার পাশে একটা ঝিলের দিকে।

‘আর ইউ ওকে?’ মেয়েটা জানতে চাইতেই আরিয়ান মাথা নেড়ে সায় জানাল। ‘গুড অ্যাডভাইস, উনারা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে থাকলেই নিরাপদে থাকবেন।’

‘এবার কী?’

‘আপনি বলুন, আমরা প্রথম যেটা গেস করছি কামালের বইতে কিছু একটা ছিল, যেটার জন্যেই এতকিছু। আপনি তো ওর বইটা পড়েছেন, সম্ভবত আপনিই একমাত্র বইটা ভালোভাবে পড়েছেন। আপনি বলুন কী থাকতে পারে ওটাতে?’

‘কিছুই না,’ আরিয়ান মাথা নেড়ে অস্বস্তির সঙ্গে না জানাল।

‘মানে!’ রাসনার গলা শুনে মনে হলো সে খুবই অবাক হয়ছে। অবশ্য অবাক হওয়ারই কথা। ‘যে-বই নিয়ে এত কথা, এত কাহিনি, সে বইয়ের ভেতরে কিছুই নেই, মানে কি? গল্পটা কী নিয়ে?’

‘আমিও সেটাই বলতে চাইছি, বইটার গল্প ভালো তবে সেটাতে এমনকিছু চোখে পড়েনি যেটা বিরাট কোনো স্ক্যান্ডাল, বিরাট কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা বিরাট কোনো রহস্যের দিকে ধাবিত করবে বা কোনো ব্লু দেবে।’

রাসনা কিছু বলল না, সে বেড়িবাঁধ ধরে এগিয়ে চলেছে মিরপুরের দিকে। ‘গল্পটা কী নিয়ে?’ আবারো একই প্রশ্ন করল।

‘গল্পটা কী নিয়ে সেটার চেয়ে বড়ো প্রশ্ন বইটার জনরা কি। আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি এবং যা ভাবছি, সেক্ষেত্রে এটা খুবই কমন এবং পরিষ্কার একটা বিষয় যে বইটা যদি কোনো থ্রিলার হতো, বিশেষ করে ক্রাইম থ্রিলার বা কন্সপিরেসি থ্রিলার, কিংবা এমনকি যদি পলিটিক্যাল কোনো থ্রিলার হতো বা হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার হতো তাহলে খুব সহজেই ধরে নিতাম—গল্পে যা বলা হয়েছে সেটা কোনোদিকে লিড করছে। ধরেন বইতে কোনো ক্রাইম কন্সপিরেসি বা রাজনৈতিক স্ক্যান্ডাল আছে। মানে যদি থাকত তবে সেই পথে চিন্তা করতাম আমরা। কিন্তু বইটা সেরকম কিছু নয়। বইটা খুবই সাধারণ তবে সুন্দর একটা সামাজিক উপন্যাস। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ একটা ছেলের উদ্যোক্তা হিসেবে স্ট্রাগলের এবং সাফল্যের গল্প,’ আরিয়ান সামান্য থেমে একবার মাথা নাড়ল। ‘তাহলে খুব সহজেই একটা প্রশ্ন চলে আসে যে এরকম একটা সাধারণ গল্পকে আমি এত অসাধারণ কেন বললাম শুরুতেই। বই উপন্যাস কিংবা গল্প, যাই বলি না কেন এটার অসাধারণত্ব যতটা না এর গল্পে—তারচেয়ে অনেক বেশি এর গল্পটা বলার ধরনে। উদাহরণ দিই, উপন্যাসটার শুরুটাই হয় পুরনো একটা বাড়ির ছাদে। একজন মানুষ ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে তার স্মৃতি চলে যায় বহু বছর আগে এক বৃষ্টির রাতে, ঠিক এই জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে ছিল সে, অসহায় ভঙ্গুর বিবর্জিত অবস্থায়, আত্মহত্যার জন্যে লাফিয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে, হঠাৎই মানুষটার ম্যানেজার এসে জানায় নিচে সবাই তার জন্যে অপেক্ষা করছে। নিচে নেমে আসে সে। শত শত মিডিয়াকর্মী, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট, সবার হাজারো প্রশ্ন তার জন্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি উদ্যোক্তা পুরস্কারগুলোর একটার বিজয়ী সে। বিদেশে যাচ্ছে সেই পুরস্কার আনার জন্যে। নিজের পুরনো পৈতৃক বাড়িতে প্রেস মিটিং করেই সে সরাসরি যাবে এয়ারপোর্টে। সেখানে কথোপকথন সেরে সে রওনা দেয়। পুরো গল্পটাই সেই এয়ারপোর্ট যাত্রার, পথিমধ্যে একটা করে জায়গায় দৃষ্টি পড়ে তার আর একটা করে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া আর অনলাইন প্ল্যাটফর্মের উত্থান, সমাজ-রাজনীতি-ব্যবসার বদলে যাওয়া ল্যান্ডস্ক্যাপ, ফিলোসফি কী নেই—’

‘এক মিনিট, গল্প বলতে বলতে আরিয়ান ঠিক যতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, রাসনা ঠিক ততটাই বোর হচ্ছিল। ‘তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন পুরো উপন্যাসে সেরকম কোনো কন্সপিরেসি, ক্রাইম বা বড়ো কোনো ইস্যু কিছুই নেই?’

‘অন্তত আমার চোখে পড়েনি কিছুই।’

‘রাসনা গাড়ির গতি কমিয়ে ওটাকে রাস্তার পাশে থামিয়ে ফেলল। ‘উপন্যাসে যদি কিছু না পেয়েই থাকেন আপনি, তাহলে, রাসনার ভ্রু কুঁচকে গেছে। ‘তাহলে আমরা শুরু করব কোথা থেকে?’

‘অনেস্টলি স্পিকিং, আমার কোনো ধারণাই নেই,’ আরিয়ান আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল।

রাসনা মেয়েটা ভাবছে। ভাবতে ভাবতে সে হঠাৎই বলে উঠল। যদিও ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু আমাদের হাতে যেহেতু কোনো ক্লু নেই, কোনোকিছু নিয়ে কোনো ধারণাই নেই তাহলে আমাদের শুরু করতে হবে অ্যাবসলুট বেসিক থেকে।’

‘সেটা কী?’ আরিয়ান কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘কামালকে দিয়ে।’

‘মানে তার ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু সে তো—’

‘না তার ব্যাকগ্রাউন্ড একটা পন্থা হতে পারে কিন্তু সেখান থেকে কিছু পাওয়া খুব কঠিন হবে। কামালের রেখে যাওয়া জিনিসপত্র থেকে। যেখানে তার মৃত্যু হয়েছিল।’  

আরিয়ান আপত্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল, ‘আপনার কথা শুনতে ভালো লাগছে কিন্তু এটা কতটা প্র্যাকটিক্যাল। প্রথমত, কামাল যেখানে থাকত বাড়িওয়ালা নিশ্চয়ই সেই কামরা এখনো সেভাবে রেখে দেয়নি। আর কামালের কোনো পারিবারিক উত্তরসূরিও ছিল না, সেক্ষেত্রে কামালের জিনিসপত্রের সন্ধান পাব কীভাবে আমরা।’

‘পাব,’ রাসনা কনফিডেন্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন আমি কামালের কেস হ্যান্ডেল করছিলাম। কামালের মৃত্যুটা সাধারণ মৃত্যু ছিল না। যদিও কেস ক্লোজ করা হয়েছিল। এমনকি শেষ পর্যন্তও পুরোপুরি আত্মহত্যা বলে মেনেও নেয়া হয়নি। এ কারণেই তার জিনিসপত্র সব এক করে বাড়িওয়ালাকে বলা হয় ওগুলো প্রিজার্ভ করার জন্যে। বাড়িওয়ালা প্রথম খুব গাঁইগুঁই করলেও শেষে চাপের মুখে তার বাড়ির ছোট একটা স্টোর রুমে সেগুলো রেখে দেয়। আমিও সব ওখানে রেখে কামরা সিল করে তালা দিয়েছিলাম,’ বলে রাসনা আবারো তার ব্যাগটা টেনে নিল। ‘চাবিটাও থাকার কথা,’ ব্যাগ হাতড়ে সেটার ভেতর থেকে বড়ো একটা চাবির রিং বের করল সে। ওটা ঘেটে একটা নির্দিষ্ট চাবি দেখে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল, ‘এটাই সেই চাবি,’ চাবি পেয়ে রাসনা হেসে উঠলেও আরিয়ান খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারল না।

১৪

‘আমরা কী ঠিক জায়গাতে এসেছি?’ শংকরের এই গলিতে বহুবছর পরে এলো আরিয়ান। আশপাশটা দেখতে দেখতে অনেক স্মৃতি ভিড় করে এলো ওর। কিন্তু সেগুলোকে দমিয়ে দিয়ে রাস্তা আর বাড়িঘরগুলোর দিকে নজর দিল ও, কারণ প্রশ্নটা রাসনা মেয়েটা করেছে। সে বাড়িটা ঠিক চিনতে পারছে না।  

‘আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি,’ আরিয়ান আনমনে বলে উঠল, যদিও কামালের মৃতদেহের পাশ থেকে উপন্যাসটা চুরি করে নেবার পর আর এখানে আসেনি ও—কিন্তু জায়গাটা চিনতে পারছে পরিষ্কার। মানুষের স্মৃতি হয় তিন ধরনের। এর ভেতরে একটা হলো অস্থায়ী স্মৃতি, অনেকটা কম্পিউটার র‍্যামের মতো, আর অন্যটা হলো স্থায়ী স্মৃতি, অনেকটা কম্পিউটার হার্ড ড্রাইভের মতো, যেখানে স্থায়ীস্মৃতিগুলো স্টোর থাকে। মানুষ মূলত বাঁচে তার অস্থায়ী স্মৃতির ওপরে, আর যেসব ঘটনা অনেক বেশি দাগ কাটে সেগুলো চলে যায় স্থায়ী স্মৃতিতে। বিশেষ কোনো ঘটনা, গভীর আবেগের স্মৃতি ইত্যাদি। জায়গাটা দেখেই আরিয়ানের মনে হলো, এই জায়গা ওর স্মৃতিতে রয়ে গেছিল চিরস্থায়ীভাবে। কম্পিউটারে ক্লিক করলেই যেমন কোনো প্রোগ্রাম হার্ড ডিস্ক থেকে র‍্যামে চলে আসে। ঠিক তেমনি জায়গাটা দেখামাত্রই ওর সব মনে পড়ে গেল।

‘আপনি সামনে গিয়ে বামে মোড় নিয়ে ডানে ঘোরালে একটা বাড়ির পেছনের অংশ দেখতে পাবেন। ওখানে পার্ক করবেন, ওখান থেকে সবার নজর এড়িয়ে আমরা বাড়িটায় ঢুকতে পারব পেছন দিয়ে।’

‘আপনি নিশ্চিত তো?’ রাসনা ঠিক ভরসা করতে পারছে না আরিয়ানের কথার ওপরে।

আরিয়ান অস্বস্তির হাসি হাসল। ‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন, ওদিক দিয়েই আমি কামালের উপন্যাস চুরি করে সবার নজর এড়িয়ে পালিয়েছিলাম। আমি নিজের বাড়ির ঠিকানা ভুলে যাব কিন্তু এই জায়গা জীবনেও ভুলতে পারব না। চলুন।’

আরিয়ানের নির্দেশনা অনুযায়ী এগাতেই রাসনা দেখল, সত্যি সত্যি ওদিক দিয়ে পুরনো চেপ্টা বাড়িটাতে ওঠার জন্যে একটা লোহার রেলিংওয়ালা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে। এমনিতে রাত খুব বেশি হয়নি, তার ওপরে এটা অত্যন্ত ব্যস্ত একটা এলাকা, আর বাড়িটাও অনেকটা ম্যাস বাড়ির মতো, আবার অনেক পরিবারও থাকে এখানে, কাজেই লোকজনের যাতায়াত চলতেই আছে। খুব যে লুকিয়ে ওদের বাড়িতে প্রবেশ করতে হতো তা নয়, তবে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকাই বেটার। ‘আমরা একটু অপেক্ষা করি, কী বলেন, জাস্ট নজর রাখার জন্যে, ‘ রাসনার কথাটা শুনে আরিয়ান মাথা নেড়ে সায় জানাল। ‘এরকম বাড়িগুলোতে তো আজকাল এমন লোহার সিঁড়ি দেখাই যায় না। এই বাড়িতে থাকার কারণ কী?’ রাসনা জানতে চাইল।

‘অদ্ভুত হলেও কারণটা আমি জানি,’ আরিয়ান মৃদু হেসে উঠল। ‘আর জানি বলেই যেদিন মানে,’ আবারো অস্বস্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘মানে কামালের নভেলটা চুরি করি সেদিন এদিক দিয়ে পালিয়েছিলাম, যাতে আমাকে কেউ না দেখে। আমি আর কামাল প্রায় একসঙ্গে হাঁটতাম। তো একদিন হাঁটতে হাঁটতেই বাড়ির পেছন দিকে এই সিঁড়িটা দেখে অবাক হয়ে ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই সিঁড়ির কারণ কী? তখন কামাল বলেছিল, এই পুরনো বাড়িটা নাকি আগে একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি ছিল। মালিক লসে যাওয়ার পরে ভাড়া দিতে পারেনি বা ব্যাংক লোন শোধ করতে পারেনি। তখন ব্যাংক গার্মেন্টের সব জিনিস করায়ত্ত করে বিক্রি করে দেয়, আর বাড়িটাও বর্তমান মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। মালিক পরে এটাকে ম্যাস বাড়ি, ছোট ছোট পরিবারের থাকার জায়গা হিসেবে ভাড়া দেয়। বাড়িটা সংস্কার করা হলেও পেছনের এই সিঁড়িটা রয়েই যায়। এটাকে আর সরায়নি কেউ। প্রতি ফ্লোরের সিঁড়ি ঘরের সঙ্গে সংযুক্ত এটার একটা দরজা আছে। সেদিক দিয়ে নামা যায়। আচ্ছা আপনার কাছে টাকা হবে? ক্যাশ?’ শেষ কথাটাও খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বলে উঠল আরিয়ান।

‘কোনো দরকার?’ রাসনার স্বাভাবিক কৌতূহল।

‘না মানে, এক প্যাকেট বেনসন কিনতাম আর, সেই পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল, বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে যেমন অস্বস্তি লাগত, সেরকম অস্বস্তি লাগছে। ‘না মানে একটু ক্ষুধাও লেগেছিল। আর ভেতরে ঢোকার আগে বাড়িটার সামনের অংশটাও একবার দেখে আসতাম।’

রাসনা মেয়েটা চোখ তুলে তাকাল আরিয়ানের দিকে। এই প্রথমবারের মতো একজন লেখকের দৃষ্টিতে মেয়েটার চোখের দিকে তাকানোর মতো স্থিরতা পেল আরিয়ান। ভাসাভাসা চোখে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে তার স্বভাবসুলভ কড়া গলায় বলে উঠল। ‘আপনি একটা অসভ্য লোক, মেয়েটার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্যে ভড়কে গেল আরিয়ান। মেয়েটা আবার ভাবেনি তো যে ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে। আমি—’

‘আপনার ক্ষুধা লেগেছে এটা আপনি আমাকে আগে বলবেন না!’ বলে সে হ্যান্ডব্যাগ থেকে টাকা বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। ‘আর লাগবে?’

‘না ঠিক আছে,’ টাকাগুলো কোটের পকেটে ভরে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে আরিয়ান যোগ করল। ‘আমি পাঁচ মিনিটের ভেতরে আসছি,’ বলে আরিয়ান আশপাশে দেখে নিয়ে চলে এলো গলির মুখে। সেখানে ছোট টঙ দোকান থেকে কয়েকটা প্যাকেট বন, কোক আর এক প্যাকেট সিগারেট কিনে চারপাশে চোখ বুলাল। বনের প্যাকেট ছিঁড়ে কয়েক কামড়ে খেতে খেতে আড়চোখে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে লাগল চারপাশে। বন আর কোক শেষ করে প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার রওনা দিল গলির পেছনের দিকে।

‘আপনার জন্যে,’ আনকোড়া একটা কোকের বোতল আর দুটো প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল।

‘না, না, আমি—’

‘ভেতরে রেখে দিন যেকোনো সময় কাজে লাগতে পারে, আর আমি চারপাশে খুব ভালোভাবে চোখ বুলিয়েছি, কিছু চোখে পড়েনি। চলুন,’ দুজনে বেরিয়ে এসে বাড়ির পেছনে লোহার সিঁড়ির নিচে এসে ওটা বেয়ে উঠতে লাগল। ‘যেখানে জিনিসগুলো রাখা সেটা কি কামালের আগের থাকার কামরাটার কাছে?’

‘নাহ, একেবারে সিঁড়ি ঘরের পাশে।’

‘বেটার, সিঁড়ি দিয়ে সোজা ছাদে চলে যাব,’ দুজনে ধীরে ধীরে নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে এলো ছাদের কাছে। দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো থাকলেও আরিয়ান কাঁধ দিয়ে দুবার ধাক্কা মারতেই খুলে গেল। ‘এবার আপনি পথ দেখান।

আরিয়ানকে পেছনে রেখে রাসনা এগিয়ে গেল এবার। ‘এদিকে,’ ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি ঘরটাকে একপাশে রেখে সামনে এগিয়ে গেল মেয়েটা। যত সামনে এগোচ্ছে আলো তত কমছে। মোবাইলে লাইট জ্বেলে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। ‘এখানেই আছে।’

.

‘স্যার, আপনি যা ভেবেছিলেন সেটা ভুল না,’ সাধারণ একটা পুরনো দিনের কালো ক্যাবের মতো দেখতে গাড়ির ভেতরে বসে লোকটা তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তাকে দেখলে যে কেউ ক্যাব ড্রাইভারই ভাববে। এখন অবশ্য আর ক্যাব ড্রাইভের খুব একটা চল নেই, তাই তার ছদ্মবেশটাও সেরকমই। কেউ যদি তাকে চার্জ করে খুব সহজেই সে নিজেকে একজন উবার ড্রাইভার হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে, কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় একেবারেই ভিন্ন কিছু। প্রথম বাক্যটা বলে সে ওপারের কথা শুনল, তারপর মৃদুস্বরে বলে উঠল, ‘একটা ছেলে এবং মেয়ে আপনাদের বর্ণনা দেয়া গাড়িটার মতোই একটা গাড়িতে করে সেই ছেলেটার ঠিকানায় এসে বাড়িটাতে ঢুকেছে একটু আগে।’

.

‘আপনি নিশ্চিত?’ প্রশ্নটা করেই আরিয়ান বুঝতে পারল, এটা জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল না, কারণ দরজাটার ঠিক বাইরেই একপাশে পুলিশি সিল এবং ‘ডু নট ক্রশ’-এর লাইনটা ছিঁড়ে দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে। ‘সিল তো বহু আগেই গেছে। দেখি ভেতরে কিছু আছে কি না।’

রাসনা মোবাইলের আলোটা আরিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দরজার তালাটা খোলার জন্যে চাবিটাসহ হাত বাড়াল। কিন্তু কবজাটা ধরে তালা খুলতে যেতেই মরিচা ধরা কবজাটা খুলে হাতে চলে এলো। ‘এই হলো অবস্থা!’

‘চলুন দেখি ভেতরে কী অবস্থা,’ আরিয়ান খানিকটা হতাশ গলাতেই বলে উঠল। ওর মনে হচ্ছে, এখানে না এসে অন্য পন্থায় চেষ্টা করা উচিত ছিল। দরজা খুলতেই ভেতর থেকে ভ্যাপসা একটা গন্ধ নাকে এসে বাড়ি মারল। কিন্তু ভেতরে অবস্থা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিল, ততটা খারাপ না। ওরা ভেতরে ঢুকে আশপাশে তাকিয়ে একটা সুইচ বোর্ড দেখতে পেল, ওটাকে খানিক টেপাটেপি করতেই ঘোলা একটা বাল্ব জ্বলে উঠল, যেটা ওদের দুজনার কেউই আশা করেনি। বাল্বের হলদে আলোতে দুজনে দেখতে পেল ছোট একটা কামরা, দেখলেই বোঝা যায় এটা একটা স্টোর রুম। ওপরে টিনের শেড দেয়া। সিঁড়ি ঘরের পাশে ওপরে ঢালু হয়ে থাকা একটা কামরা। ছোট কামরাটাকে স্তূপ করে রাখা বিভিন্ন জিনিস। ‘এইখানে—’

‘ওই যে,’ রাসনা মোবাইলের টর্চটা অফ করে, ছোট কামরাটার একপাশে দেখাল। ওখানে বেশ কিছু জিনিসপত্র, বই আর হালকা-পাতলা কিছু ফার্নিচার আর একটা বড়ো ট্রাংক একটা পুরনো জাজিম ছাড়া খাটের ওপরে রেখে সেগুলোকে পুলিশের ডু নট ক্রশ লেখা হলদে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ‘কিছু থাকলে ওখানেই আছে, চলুন।

দুজনেই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে হাত লাগাল। খুব বেশি জিনিস নেই আসলে। যতটা সম্ভব কম শব্দ করে প্রথমেই ট্রাংকটাকে খাটের ওপরে থেকে টেনে নামাল। ‘আপনি ট্রাংকটা দেখুন, আমি এদিকটা দেখছি, রাসনাকে ট্রাংকটা চেক করতে বলে আরিয়ান প্রথমেই ফিরে তাকাল খাটের ওপরে রাখা বইগুলোর দিকে। যদিও ধুলোয় ঢেকে আছে কিন্তু কিছু করার নেই। খাটের একপাশে বসে একটা একটা করে বই ঘেঁটে দেখতে শুরু করল। বইয়ের সংখ্যাটা অনেক, সব শেষ করে ওর মনে হলো, ধুলোয় গোসল করে ফেলেছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বই শেষ করে প্রতিটা ফার্নিচার চেক করল, উলটেপালটে দেখল কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না।

‘পেলেন কিছু?’ রাসনার গলা শুনে তার দিকে ফিরে তাকিয়ে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘ওর ল্যাপটপ মোবাইল, ল্যাপটপে অবশ্য কিছুই ছিল না,’ মন্তব্য করার মতো করে বলে উঠল আরিয়ান।

‘মোবাইল আমি তখনি খুব ভালোভাবে চেক করেছিলাম, ফেসবুক বা এগুলো সে বেশি ব্যবহারই করত না, আর ওগুলোতেও ছিল না কিছুই।’

ট্রাংকে ভালো করে দেখেছেন?’ আরিয়ান এসে ট্রাংকের সামনে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। ট্রাংকের সামনে এক গাদা কাগজ ও ফাইলগুলো ছড়ানো। ‘আমি তো কিছু পেলাম না, আপনি ট্রাই করে দেখেন আরেক রাউন্ড—আমি বইগুলো দেখি,’ দুজনেই কাজে লেগে গেল। দশ মিনিটের ভেতরে আরেক রাউন্ড সব চেক করে দম নিতে দিতে উঠে দাঁড়াল আরিয়ান, ‘কিছুই না?’ রাসনাও হাফ ছেড়ে সরে দাঁড়াল ওর দিকে। ‘নাহ,’

‘তাহলে আর কি, অন্য কিছু ভাবতে হবে, বলে আরিয়ান পা দিয়ে ট্রাংকটা ঠেলে দিল খাটের দিকে। এমন সময় জিনিসটা চোখে পড়ল পুলিশের হলুদ ফিতের সঙ্গে আটকানো এক টুকরো কাগজ। ধুলো-ময়লায় প্রায় ধূসর হয়ে আসা কাগজটার দিকে এগোল আরিয়ান। কাগজটাতে প্রিন্ট করে লেখা—প্রয়োজনে হস্তান্তরের জন্যে, একজন মানুষের নাম, মোবাইল নম্বর আর ঠিকানা লেখা। ‘এটা কী কামালের কারো?’ আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে। ‘আপনি না বলেছিলেন আরিয়ানের কেউ নেই তবে?’

‘এটা তার কোনো আত্মীয় বা কেউ না, কামাল মারা যাওয়ার পর যখন কেউই কিছু ক্লেইম করতে আসেনি, অবশ্য ছিলও না বেশি কিছু। তখন ওর এই জিনিসগুলো যদি হস্তান্তরের প্রয়োজন হয় তার জন্যে এই ভদ্রলোকের নাম লিখে রাখা হয়েছিল। ওর এক টিচার, এই ভদ্রলোকই কামালকে এনজিওতে ঢুকতে সহায়তা করেছিল। উনার অধীনে কামাল বেশ কিছু প্রজেক্টেও কাজ করেছে।’

‘রফিকুজ্জামান, প্রফেসর রফিকুজ্জামান,’ নামটা দেখে আরিয়ানের কিছু একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। ‘আপনি কী এই লোককে দেখেছিলেন বা চেনেন?’

‘কামালের দাফন-কাফন সরকারি ব্যবস্থাপনায় করা হলেও এই ভদ্রলোক তখন এসেছিলেন এবং উনিই অনুমতি দেন প্রয়োজনে তাকে হস্তান্তরের অনুমতি দিয়ে রাখতে।’

‘এক মিনিট,’ আরিয়ান কাগজটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘সুন্দর ফরসা করে দেখতে, এলোমেলো কোঁকড়া চুল, চোখে গান্ধি চশমা পরে,’ ও কাগজটা তুলে ধরল চোখের সামনে। ‘…এবং অবিবাহিত ব্যাচেলর একজন মানুষ, অনেক মোটা।’ ‘অবিবাহিত কি না তা তো জানি না, তবে আপনার বাকি বর্ণনা ঠিক আছে। আপনি চেনেন কীভাবে উনাকে?’

‘আমাকে সঙ্গে নিয়ে কামাল একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল,’ আরিয়ান দেখল ঝাপসা হয়ে আসা কাগজটাতে ভদ্রলোকের ঠিকানা লেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের একটা পুরনো কোয়ার্টার। ‘আমার যদি ভুল না হয় তবে এই ভদ্রলোক আমাদের একটা পসিবল লিড হতে পারে,’ আনমনেই বলে উঠল আরিয়ান। ‘আর যদি ভুল না হয় আমি জানি ইনি কোথায় থাকেন।

‘কেন আপনার কাছে মনে হচ্ছে সে কিছু জানতে পারে?’ এবার রাসনাকে খানিকটা দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে।

‘আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারব না, তবে ডেফিনেটলি যদি কামালের ব্যাপারে অল্প কিছুও কারো জানা থাকে তবে অবশ্যই সেটা এই ভদ্রলোক হতে পারে। সে তার প্রফেশনাল লাইফের ব্যাপারে কিছুটা হলেও জানে, হয়তো খানিকটা তার পারসোনাল লাইফ বা সম্ভাব্য তার ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যাপারেও খানিকটা। আর তাছাড়া কামালের অতীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই একজনকেই পেয়েছি আমরা। কাজেই আমার মনে হয় এটা আমাদের এক্সপ্লোর করা উচিত, জাস্ট একটা গাট ফিলিং,’ আরিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। রাসনাকে কনভিন্স মনে হচ্ছে না। ‘কাম অন, লেটস ট্রাই, আমাদের হারাবার কী আছে!’

রাসনা মুখ খুলে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই বাইরে একাধিক মানুষের পদশব্দ শোনা গেল। কেউ এগিয়ে আসছে কামরাটার দিকে।

আরিয়ান আর রাসনা দুজনেই ফিরে তাকাল একে অপরের দিকে। কেউ কী জেনে গেল ওরা এখানে?

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *