একটি সন্ধের যবনিকা – ১৫

১৫

প্রথমেই আরিয়ান চট করে কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর আলগোছেই একহাতে রাসনাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে ওর অন্যহাতটা চলে গেল কোটের পকেটের ভেতরে যেখানে রহমানের কাছ থেকে আনা পিস্তলটা রাখা আছে। কিন্তু ও ভুলে গেছিল যে রাসনা নিজেই একজন পুলিশ অফিসার। আরিয়ান তাকে সাইড করে দিলেও সে চট করে বের করে আনল নিজের পিস্তলটা। সোজা সেটা তাক করল দরজার দিকে আর সঙ্গে সঙ্গে সেখান দিয়ে ভেতরে ঢুকল লুঙ্গি পরা ভুড়িওয়ালা এক লোক, এক হাতে উলটো করে ধরা একটা শলার ঝাড়ু।

দৃশ্যটা হলো দেখার মতো। আরিয়ান সতর্ক হলেও সে অস্ত্র বের করেনি বা থ্রেটেনিং কিছুও করেনি। অন্যদিকে, রাসনা প্রায় চট করেই বের করে এনেছে নিজের পিস্তল, পরিস্থিতির বিবেচনায় সে হয়তো ভেবেছিল ভয়ংকর কেউ আক্রমণ করতে আসছে। আর অন্যদিকে, লোকটা কে আরিয়ানের জানা নেই—সে খুব বীরদর্পে ঝাড়ু হাতে কামরাটায় এসে ঢুকেছিল সম্ভবত চোর বা এরকম কিছুর প্রত্যাশায়। লোকটা ভেতরে এসে ঢুকতেই একেবারে চোখের সামনে ভয়াল দর্শন পিস্তলের নল দেখে পুরোপুরি ঘাবড়ে গেল। শুধু ঘাবড়ে গেলেও এক কথা ছিল, মোটা মানুষটা ঠিক যে গতিতে কামরায়প্রবেশ করেছিল সেই গতিতেই হঠাৎ থামার চেষ্টা করতেই সে নিজের শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। তার ঠিক পেছনেই ছিল একজন মহিলা, সম্ভবত তার স্ত্রী বা এমন কিছু, মহিলার হাতে লাঠির মতো কিছু একটা। মোটা লোকটা পিস্তল দেখে ছোট একটা চিৎকার করেই থেমে যাচ্ছিল, তার স্ত্রী পেছন থেকে এগিয়ে আসতে গিয়ে ধাক্কা খেল তার সঙ্গে, মোটা লোকটা স্ত্রীর হাতে থাকা লাঠিটার গুতো খেয়ে হেলে পড়তে শুরু করল একপাশে সঙ্গে টেনে নিয়ে চলল তার স্ত্রীকে, দুজনেই প্রায় ভবন কাঁপিয়ে পড়ে গেল মেঝেতে, সেই সঙ্গে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

অন্যদিকে রাসনা উত্তেজনার চোটে প্রায় গুলিই করে দিতে যাচ্ছিল, লোকটা এবং তার মহিলা সঙ্গীকে দেখে কোনোমতে সামলে নিয়ে পিস্তলটাকে তুলে ফেলল ওপরের দিকে। কিন্তু সামনে এগোবে, গড়াগড়ি দিতে দিতে তারস্বরে চেঁচাতে থাকা দুজনকে সামলাবে নাকি নিজেকে সামলাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। আরিয়ান সামনে এগিয়ে গিয়ে একহাতে রাসনার পিস্তলটা নিচের দিকে নামিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত থাকতে বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। লোকটা আর তার মহিলা সঙ্গী তখনো তালগোল পাকিয়ে আছে। আরিয়ান সামনে এগিয়ে ধমকে উঠল। ‘থামুন, আপনারা ঠিক আছেন,’ বলে সে লোকটার এক হাত ধরে তাকে শক্ত হাতে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। ‘ঠিক আছেন?’

লোকটা একবার আরিয়ানকে দেখছে আরেকবার পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রাসনাকে দেখছে। ‘উনাকে ওঠান আগে,’ মহিলাকে দেখিয়ে বলে উঠল আরিয়ান লোকটা অনেকটা হতভম্বের মতো মহিলাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিতেই মহিলা আরো হাস্যকর কাজ করে উঠল। সে উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় কিছু একটা বলে উঠতে যাচ্ছিল রাসনার হাতে পিস্তল দেখেই সে সারেন্ডারের ভঙ্গিতে সটান সোজা করে তুলে ফেলল নিজের দুই হাত। আরিয়ান দেখল এই দুজন আরো পাগলামি করবে, তাই ওরা কিছু করার আগেই সে ধমকে উঠল আবারো।

‘আরে হাত নামান, আপনাদের কোনো সমস্যা নেই,’ একবার আড়চোখে রাসনাকে দেখে শান্ত থাকতে বলল।

‘আইন্নেরা কেডা?’ একেবারে খাস ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলে উঠল লোকটা। বারবার আড়চোখে শুধু রাসনা আর ওর পিস্তলটাকেই দেখছে। আরিয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই পিস্তলটা কোমরে হোলস্টারে রেখে রাসনাই এগিয়ে এলো। পিস্তল রেখে ওর হাতে বেরিয়ে এসেছে আইডি কার্ড। ওটাকে লোকটার চোখের সামনে তুলে ধরে বলে উঠল, ‘আমরা পুলিশ, আপনারা কারা?’ লোকটা জবাব দেয়ার আগেই রাসনা আবারো বলে উঠল, ‘আর এখানে এই কামরাতে থাকা কিছু জিনিস পুলিশ এভিডেন্স, এই কামরা সিল করে দেয়া হয়েছিল পুলিশের তরফ থেকে। এটাকে খুলেছে কে?

লোকটা একবার ওদের দেখছে আরেকবার তার পাশে থাকা মহিলাকে দেখছে। ‘ও সুমাইয়ার মা, হেরা কি কয়?’

সুমাইয়ার মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আরিয়ান বলে উঠল, ‘আপনি কী এই বিল্ডিংয়ের মালিক?’

‘কী হলো কথা বলেন না কেন?’ রাসনা এত জোরে ধমকে উঠল, আরেকটু হলে আরিয়ানই ভয় পেয়ে যাচ্ছিল।

‘আফা আমরা মালিক না,’ লোকটা এটুকু বলতেই তার পাশ থেকে সুমাইয়ার মা বলে উঠল, ‘কিয়ারটিকার।’

আরিয়ান বুঝতে পারল এরা মালিক নয়। এদের ঠিক মালিক হিসেবে মেলানোও যাচ্ছিল না। ‘বুঝতে পেরেছি আপনারা কেয়ারটেকার। তো এই মালিকের সঙ্গে কথা ছিল এই কামরা পুলিশে সিল করা, এটাকে খুলেছে কে?’

‘আফা,’ যদিও প্রশ্ন করেছে আরিয়ান কিন্তু কথা বলার সময়ে সম্বোধন করে উঠল রাসনাকেই লোকটা। ‘আমরা কিয়ারটিকার, আমরা ক্যামনে জানমু কেডা কী কইছে। আমগোরে, থানায় নিয়েন না।’

আরিয়ান রাসনার দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় এখান থেকে বের হওয়ারকথা বলল। রাসনা একবার মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলে উঠল, ‘শুনুন কেয়ারটেকার হন আর যাই হন, এই কামরা আর খুলবেন না, আর আপনাদের মালিক এলে জানাবেন,’ বলে আরিয়ানকে ইশারা করল বাইরে বের হওয়ার জন্যে।

হতভম্ব কেয়ারটেকার আর স্ত্রীকে পেছনে রেখে ওরা বের হয়ে আসতে যাচ্ছিল করিডরে, আরিয়ান আবার ফিরে গেল পেছন দিকে। ‘শুনুন, আজকে আমরা এখানে এসেছিলাম, কাউকে বলার দরকার নেই, বুঝেছেন?’

‘বুঝছি, আইন্নেগরে কী টেকা দিওন লাগব?’ লোকটা খুব গদগদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে। ‘পুলিশগরে তো টেকা দিওন লাগে।’ আরিয়ান রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, ‘গপ্পো বাদ দিয়ে যা বলেছি সেটা মনে রাখবেন।

‘কী বলছিল লোকটা?’ আরিয়ান ফিরে আসতে রাসনা জানতে চাইল।

আরিয়ান বলতে গিয়েও থেমে গেল, এই মেয়ের মাথা যে-গরম—কি না কি করে কে জানে। ‘কিছু না চলেন।’ ওরা সামনের দিক দিয়ে না নেমে কয়েক মিনিটের ভেতরে পেছনের সিঁড়ি দিয়েই রাস্তায় নেমে হেঁটে চলে এলো গাড়ির কাছে।

‘তাহলে আপনি বলছেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ওই প্রফেসরের কাছে অনুসন্ধান করা উচিত?’ বলে সে এক মুহূর্ত ভেবে যোগ করল, ‘কল দিব নাকি, একটা নম্বর দেখলাম কাগজে।

‘পাগল নাকি?’ গাড়িতে উঠতে উঠতে আরিয়ান বলে উঠল। ‘কল দিলে স্রেফ রেগে যাবে। তারচেয়ে চলেন সরাসরি যাই কথা বলি, তাতে যদি কিছু পাওয়া যায়।’

রাসনা মাথা নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

.

আরিয়ানদের গাড়িটা গলি থেকে বের হতেই আবারো সেই কালো ক্যাবওয়ালা নিজের মোবাইল তুলে ডায়াল করল একটা বিশেষ নম্বরে। ‘স্যার, আপনার কথামতোই কিছুই করা হয়নি। এবার ওরা মুভ করতে শুরু করেছে। নির্দেশনা কী?’

ওপারে খানিক নীরবতা, লোকটা ক্ষণিকের জন্যে ভাবল কল কেটে গেল নাকি। চেক করতে যাবে তার আগেই ওপাশ থেকে শান্ত গলা কথা বলে উঠল। পিছু নাও, কোনোভাবেই যেন এড়িয়ে না যায়। আর দেখ এরপর কই যায়।

‘আর কিছু?’

‘হ্যাঁ, অ্যাকশনের জন্যে প্রস্তুত থাকো, যেকোনো সময় নির্দেশনা আসলে যেন মুভ করতে পারো,’ ওপারের শেষ কথাটা শুনে তার মুখ হাসিতে ভরে উঠল, এমনটাই তো চাই। আড়চোখে সে দেখতে পেল, সিআরভিটা গলি থেকে বেরিয়ে মোহাম্মপুরের মূল রাস্তায় উঠে যাচ্ছে। তার চিন্তিত হওয়া উচিত ওরা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে কীভাবে পিছু নেবে সেটা নিয়ে—কিন্তু সে হলো না। বরং হাসিমুখে সে একটা প্যাড তুলে সেটাতে একটা অ্যাপ ওপেন করল। ওটাতে একটা লাল বিন্দু ক্লিক করে সিআরভিটার অবস্থান জানাচ্ছে। পিছু নিতে হবে সে পরিষ্কার জানত আর তাই আগে থেকেই গাড়িতে ট্র্যাকার বসিয়ে দিয়েছে। মুখে মৃদু হাসি নিয়েই সে নিজের ভাঙাচোরা কালো ক্যাবের ছদ্মবেশে থাকা শক্তিশালী গাড়িটার স্টার্ট দিল।

এবার খেলা সত্যি সত্যি জমে উঠতে যাচ্ছে।

১৬

‘কী দেখছেন?’ মেয়েটা গাড়ি চালাতে চালাতে এভাবে মোবাইলের মনিটরে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে—ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগছে না আরিয়ানের কাছে। ‘এভাবে মোবাইলে দেখাটা কী ঠিক হচ্ছে?’ আরিয়ান দেখল ওদের গাড়ি নীলক্ষেত ক্রসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত গেটগুলোর একটা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। রাত যথেষ্ট হলেও, এলাকা এখনো একেবারে সরগরম। জ্যাম নেই এখন আর, তবে মানুষজনের কোনো কমতি নেই। ‘আপনাকে তো বলেছিই আমি চিনি উনি কোথায় থাকেন।’

‘না আমি ম্যাপ দেখছি না,’ রাসনা সামনে চোখ রেখে রেখে গাড়ি চালালেও বারবার এখনো মোবাইলে দেখছে। ‘আসলে দেখছিলাম ফেসবুকে বা অনলাইন পোর্টালগুলোতে আপনাকে নিয়ে কোনো নিউজ ছেড়েছে কি না,’ মেয়েটা এটুকু বলতেই আঁতকে উঠল আরিয়ান। বলছে কি মেয়েটা। ওকে জাস্ট একটা কল করে মোবাইল ফেলে দিতে বলেছে, আর সে নিজে কি না ফেসবুকে ঢুকে ঘাঁটছে।

‘আপনি কি পাগল নাকি? এভাবে—’

‘রিল্যাক্স,’ আরিয়ান দেখল মেয়েটা মোবাইল অফ করে সেটাকে ড্যাশবোর্ডে রেখে দিল। ‘এটা আমার নিয়মিত মোবাইল নয়, আর এই আইডিটাও আমার নিজের আইডি নয়। কাজেই এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমরা কি ফুলার রোডে যাচ্ছি নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

নীলক্ষেতের মোড়ে আধাঘণ্টা বসে থেকে ওরা মল চত্বরের সামনে আসতেই আরিয়ান সামনে দিয়ে বামে ঘুরে ফুলার রোডে ঢোকার জন্যে ইশারা করল মেয়েটাকে। মূল চত্বর আর ফুলার রোডের ঠিক মাঝখানের বৃত্তটাতে ভিসি ভবনের সামনে সবসময় পুলিশ বসে থাকতে দেখেছে আরিয়ান। কাজেই রাসনা যখন ঘুরতে শুরু করল আপনাতেই আরিয়ানের দৃষ্টি ঘুরে গেল সেদিকে। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে আজকে ওখানে কোনো পুলিশ দেখতে পেল না সে। মনের ভুল!  শিফট চেঞ্জ, নাকি অনেক বেশি সৌভাগ্য! কোনটা কে জানে। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ও ফিরে তাকাল ফুলার রোডের দিকে। ওর যতটুকু মনে পড়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলে যাওয়ার ঠিক আগে যে কোয়ার্টারের গেটটা আছে সেটা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। রাসনা মেয়েটা এগিয়ে যাচ্ছে আরিয়ান বুঝে ওঠার আগেই সে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে চলে এলো।

আমরা মনে হয় অনেক সামনে চলে এসেছি, পেছাতে হবে।’

‘আপনি নিশ্চিত তো?’ রাসনা ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে পেছাতে পেছাতে আড়চোখে একবার আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। তার গলা শুনেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সে আরিয়ানের কথার ওপরে ঠিক ভরসা রাখতে পারছে না। ‘কতদিন আগে এসেছিলেন এখানে?’

আরিয়ান মেয়েটার কথার কোনো জবাব না দিয়ে বরং সে মনোযোগ দিয়ে রাস্তা এবং কোয়ার্টারের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, সঠিকভাবে কোনো জায়গাটাতে এসেছিল ওরা। ‘ওই যে, ওই গেটটাই,’ আরিয়ান স্বস্তির সঙ্গে মাথা নেড়ে আঙুল তুলে দেখাল। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ঠিক পাশেই একটা ছোট মুদির দোকানের মতো—ওটার পরের গেটটাই ছিল, মুদির দোকানটা দেখে ও পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে। কারণ মুদির দোকানটার পাশের দেয়ালে লোকজন পানের পিক ফেলে মোটামুটি বিচিত্র এবং আর্টিস্টিক এক দেয়ালচিত্র সৃষ্টি করেছে। যেদিন ও কামালের সঙ্গে এখানে এসেছিল, সেদিন এই দেয়ালচিত্রটার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনেছিল, আর কামাল ভেতরে গিয়েছিল এই লোক, মানে তার শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে। সেই দোকান এবং সেই আর্টিস্টিক দেয়ালচিত্র আজো বিদ্যমান। ওটা দেখেই ও নিশ্চিত হলো এই কোয়ার্টারের গলির ভেতরেই সেই ভদ্রলোক থাকে। সেদিন আরিয়ান ভেতরে না গেলেও কামাল আর ওই ভদ্রলোক দুজনে মিলে বের হয়ে এসেছিল, আর তাই ভদ্রলোকের চেহারাটাও মনে আছে ওর। ম্যুরালটা দেখে সার্ফ এক্সেলের বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে গেল ওর, দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে দাগই ভালো, পানের পিক থেকে যদি পুরনো ঠিকানা মনে পড়ে, তবে পিকই ভালো।

‘হুমম,’ আপনি কিছু বলছিলেন?’ আরিয়ানের মনে হলো মেয়েটা ওকে কিছু একটা বলেছে কিন্তু ও শুনতে পায়নি। আরিয়ান প্রশ্ন করলেও মেয়েটা সেটার জবাব দিতে পারল না। কারণ ওদের গাড়ি ততক্ষণে কোয়ার্টার এলাকার গেটের কাছে চলে এসেছে। গাড়ি ঢোকার রাস্তাটা ছোট একটা পলকা বাঁশ দিয়ে আটকানো। ওদের গাড়িটা গিয়ে সেটার সামনে থামতেই গার্ডের কামরা থেকে একজন মাথা বের করে জানতে চাইল কোথায় যাবে। রাসনা জানাল শিক্ষকের নাম, সেই সঙ্গে এও জানাল ওরা পুলিশের লোক এবং একটা বিশেষ প্রয়োজনে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। গার্ড লোকটা মহামনোযোগ এবং খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে রাসনার আইডি কার্ডটা দেখল, তারপর ওদের দুজনকে দেখল মনোযোগ দিয়ে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে না ঘুমের আগে তাকে এভাবে ডেকে তোলাটা তার পছন্দ হয়েছে, না রাসনা কিংবা আরিয়ানের চেহারাটা তার পছন্দ হয়েছে। লোকটা মনে হয় রাসনার আইডি আর ওদের চেহারার দিকে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকত কিন্তু হঠাৎ রাসনার ধমক খেয়ে সে চমকে উঠল, তারপরও কিছুক্ষণ বিরস বদনে সেদিকে তাকিয়ে থেকে সে জানাল, তাকে আগে ওই কোয়ার্টারে ফোন করে নিশ্চিত হতে হবে। আরিয়ান এর আগেও এখানে এসেছে। সে খুব ভালো করেই জানে সাধারণত গার্ডরা কল দেয় না। ভিজিটরের নাম ঠিকানা লিখে রেখেই ছেড়ে দেয়। ‘ঠিক আছে কল করো,’ আরিয়ান আপত্তি জানাতে যচ্ছিল কিন্তু তার আগেই রাসনা একমত পোষণ করে ফেলল। কিছু করার নেই। গার্ড লোকটা চলে যেতেই আরিয়ান বলে উঠল, ‘কল করতে দেয়াটা কি ঠিক হলো?’

‘কিছু কি করার ছিল, এখানে ঝামেলা বাড়ানোর দরকার কি?’ মেয়েটা ঝামেলা কমানোর কথা বলছে কিন্তু তার গলা শুনে আরিয়ানের কাছে কেন জানি মনে হলো মেয়েটা খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। আরিয়ানও কাঁধ ঝাঁকিয়ে আর কিছু বলল না। গার্ড লোকটা ফিরে এলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তাকে দেখে এখন আরো বেশি অসুখী মনে হচ্ছে। ‘কি বলল?’ রাসনার গলার সুর প্রায় ধমকের পর্যায়ের।

‘কেউ তো ফুন ধরল না, লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অন্য কারো জন্যে অপেক্ষা করছে। সম্ভবত আরেকজন গার্ড থাকে এখানে, হয়তো রাত হওয়াতে কিংবা অন্য কোনো কারণে এই মুহূর্তে অনুপস্থিত সে। ‘আইন্যেরা পরে—’

এবার আর সহ্য করতে পারল না রাসনা। সে একটা হাত তুলে বলে উঠল, তুমি কথা বেশি বলো। উনার ফ্ল্যাট নম্বর বলো। আর খাতায় আমার নাম লিখে রাখো,’ গার্ড লোকটার মনে হয় মৃদু আপত্তি ছিল, কিন্তু সেটা দেখানোর আগেই রাসনার ধমক খেয়ে সে এতটাই ভড়কে গেল যে ফ্ল্যাট নম্বর তো বললই সঙ্গে কী নাম লিখবে সেটাও আর জিজ্ঞেস করল না। খানিকটা হতভম্ব, সঙ্গে আরো খানিকটা বেশি বোকাটে অবস্থায় গার্ড লোকটাকে রেখে ওদের সিআরভি প্রবেশ করল কোয়ার্টার এলাকায়।

আপনি এত চট করে রেগে যান কেন বলুন তো?’ রাসনা মেয়েটার এই অসহিষ্ণু ভাবটা আরিয়ানের পছন্দ হচ্ছে না। সে নিজেও উত্তেজিত এবং শঙ্কিত হয়ে আছে কিন্তু এখন পরিস্থিতি যা তাতে সবার আগে সবকিছুর ওপরে যা প্রয়োজন সেটা হলো মাথা ঠান্ডা রাখা এবং যেকোনো মূল্যে পুরো বিষয়টার মূল উদ্ধার করা। আরিয়ানের কথা শুনে সে মনে হয় আরো খানিকটা রেগে গেল কিন্তু ওর কথাই যুক্তিযুক্ত সেটা অনুধাবন করেই মনে হয় চুপ করে রইল সে।  

আপনি ঠিকই বলেছেন, ও বেচারা তো স্রেফ নিজের ডিউটি করছিল, আমিই বেশি উত্তেজিত হয়ে আছি। ভবনের নম্বরটা দেখলে জানাবেন। আপনি কি চেনেন উনার বাসা?’

‘না আমি আসলে সরাসরি ভেতরে আসিনি তখন,’ আরিয়ান গাড়ির জানালা দিয় বাইরে দেখে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে, সেই সঙ্গে খোঁজারও চেষ্টা করছে সম্ভাব্য ভবনটা। ঢাকা ইউনিভার্সিটির এই এলাকাটা সবচেয়ে পুরনো কোয়ার্টারগুলোর মধ্যে একটা। এই এলাকাতে সেইরকম কোনো হাইরাইজ বিল্ডিং তো নেই, সেই সঙ্গে বাড়িগুলোও বেশ ছড়ানো-ছিটানো, ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর গাছপালা। ফলে এই এলাকাটাকে ঠিক ঢাকার অন্যান্য এলাকা কিংবা কোয়ার্টারের মতো মনে হয় না, বরং মনে হয় ঢাকার বাইরে কোথাও চলে এসেছি। ‘ওই যে, ওটাই মনে হচ্ছে।’ ভবন নম্বরটা মিলিয়ে আরিয়ান বলে উঠল। পুরনো দিনের একটা ভবন, তবে রাতের বেলা দেখে চারপাশে গাছপালা দিয়ে ঘেরা থাকায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু দিনের বেলা নিশ্চয়ই দারুণ এলাকাটা। রাসনা ভবনটার সামনের কারপার্কে অন্য আরেকটা গাড়ির পাশে এনে পার্ক করল।

দুজনেই বাইরে বেরিয়ে এসে আশপাশে তাকাল। রাতের সময় হওয়াতেই কি না অন্যান্য সময়ের চাইতে একটু বেশিই নীরব মনে হচ্ছে চারপাশ। দুয়েকজন হাঁটতে থাকা লোকজন বাদ দিলে আর কেউই নেই। আপনার কী মনে হয় ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের কথোপকথন কেমন হওয়া উচিত?’ বলে আরিয়ান আরেকবার চারপাশে দেখল। ‘উনি কী আমাদের আদৌ হেল্প করবে নাকি আবার পুলিশ টুলিশে ধরিয়ে দেবে?’

রাসনা মৃদু হাসল ওর কথা শুনে। ‘দেখা যাক কী বলে সে, আদৌ যদি হেল্প করে তো ভালোই, না হলে প্রয়োজনে হেল্প আদায় করে নিতে হবে,’ বলে সে নিজের কোমরের বেল্ট ঠিক করতে লাগল। আরিয়ান অনুভব করল মেয়েটা নিজের পিস্তলের অবস্থানটাও চেক করে নিল এই সুযোগে। ‘আর সে যদি ভালোভাবে সহায়তা করে তো ভালো না হলে,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আর সে যাতে পুলিশে খবর দিতে না পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে, হয় কথা দিয়ে আর না হয়—চলুন এগোই,’ রাসনা কোয়ার্টারের সিঁড়ির দিকে এগোতে শুরু করতেই আরিয়ানও তার পিছু নিল। অন্ধকারের ভেতরেই একবারের জন্য ও কোটের ভেতরের পকেটে থাকা নিজের পিস্তলটাও চেক করে নিল।

ভদ্রলোক তিনতলায় বাঁ পাশের কোয়ার্টারে থাকেন। ওরা দুজনে মিলে সিঁড়ি বেয়ে তিন তলা পৌঁছাতেই দেখতে পেল, বেশ বড়ো একটা ব্যাগ ঠেলাঠেলি করে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল এক ভদ্রলোক। ওদের দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে একবার হাত নাড়ল সে। ওরা দুজনেই মানুষটাকে ছাড়িয়ে সামনে চলে আসতেই আরিয়ান হালকা করে রাসনা মেয়েটার কনুইয়ে টোকা দিল।

‘কি?’ বলে সে আধ ভেজানো একটা ফ্ল্যাটের দরজার দিকে ইশারা করল। ‘এটাই মনে হয়,’ আবারো আরিয়ানের টোকা খেয়ে সে দরজা থেকে মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে। ‘কি?’

‘ওই ভদ্রলোক, উনিই রফিকুজ্জামান,’ ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো রাসনা মেয়েটা ওর কথা বুঝতে পারেনি। ‘আরে যে ভদ্রলোক ব্যাগ টানাটানি করছে ওটাই কামালের পরিচিত প্রফেসর,’ বলে আরেকবার ইশারায় লোকটাকে দেখাল আরিয়ান। রাসনা মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘ওহ, তাই তো।’

কথাটা বলেই সে ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে মৃদু কাশি দিয়ে বলে উঠল, ‘এক্সকিউজ মি, মিস্টার রফিক?’

লোকটা কাঁধে একটা ঝুল ব্যাগ নিয়ে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে নিজের বিরাট ক্যারি ব্যাগটা টানাটানি করছিল, রাসনার প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল। আরিয়ান দুটো ব্যাপার খেয়াল করল: এক, লোকটার ক্যারি ব্যাগের একটা চাকা ভাঙা, যে-কারণে ওটাকে নিয়ে ভদ্রলোকের এত হাঙ্গামা পোহাতে হচ্ছে। আরেকটা বিষয় শুধু খেয়াল নয়, রীতিমতো অবাক করল ওকে। রাসনা তার নাম বলাতে রীতিমতো যেন চমকে উঠল সে।

‘জি জি,’ ঘর্মাক্ত মুখটা লাল হয়ে আছে মানুষটার। ‘আপনারা?’ সে একবার রাসনাকে আরেকবার আরিয়ানকে দেখছে। ‘আপনারা আমাকে মানে—’ বলেই হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেল আরিয়ানের মুখের ওপরে। ‘অহ শিট, আপনি আপনি লেখক আরিয়ান শফিক! শিট!’ কথাটা বলেই সে নিজের দুই হাত তুলে মাথার দুই পাশ চেপে ধরল, তার বিরাট ক্যারি ব্যাগটা ঠকাস ঠকাস শব্দ করে গড়িয়ে পড়ে যেতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে।

১৭

‘আসুন ভেতরে আসুন,’ প্রফেসর শফিক আর লেখক আরিয়ান শফিক দুজনে মিলে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রফেসরের ভারি ব্যাগটা ভেজানো ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকাল। ভেতরে একটা লাইট জ্বালানোই ছিল, আরেকটা লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে দ্রুত বেগে হাত নেড়ে রাসনাকে ভেতরে ঢোকার ইশারা করল সে। রাসনা ভেতরে ঢুকতেই অনেকটা যেন চোরের মতো দুপাশে চোখ বুলিয়ে ধাম করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ওদের দুজনার দিকে ফিরে তাকাল প্রফেসর।

ভেতরে ঢুকে আরিয়ান দেখল বেশ বড়ো একটা অ্যাপার্টমেন্ট, দরজা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই পুরনো দিনের ছোঁয়া কিন্তু ফ্ল্যাটটা বাদ দিলে বাকি যা কিছু আছে, অত্যন্ত আধুনিক আর দামি। বিরাট আকারের ডিভান সোফা, দেয়ালজোড়া কাঠের প্যানেলিং করা বুক শেলফ, শো-কেস, সেটা ভর্তি আবার নানা দেশের শো- পিস আর অ্যান্টিক, দুটোর মাঝখানে থাকা কাঠের প্যানেলের ওপরে বসানো টিভিটা আশি ইঞ্চির কম হবে না। লিভিং রুমের একপাশে বিরাট একটা অ্যাকুরিয়াম। তাতে নানা রঙের মাছ ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে।

‘আপনারা এখানে কীভাবে মানে কেন—’ লোকটা দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতেই জানতে চাইল। আরিয়ান খেয়াল করে দেখল, গত এক বছরের মতো সময়ে লোকটা অনেক বেশি মোটা হয়েছে। কামালের সঙ্গে যখন একে দেখেছিল এত মোটা ছিল না সে। পাতলা একটা ট্রাউজার আর পুরনো ধাঁচের টি-শার্ট তার পরনে।

এই পোশালে রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছিল লোকটা?

‘তারচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে?’ আরিয়ান কড়া সুরেই জানতে চাইল।

‘আপনাকে কে না চেনে, বিশেষ করে আজ রাতে—’

‘মানে?’ আরিয়ানের চোখ সরু হয়ে কুঁচকে উঠল ভ্রু জোড়া।

লোকটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিয়ানের দিকে, তারপর সে চোখ বড়ো বড়ো করেই রাসনাকে দেখল একবার। ‘আপনাদের অবশ্য জানার কথা না। কারণ আমিও একটু আগেই দেখেছি। কয়েক মিনিটের বেশি হবে না।’

 ‘আরে যন্ত্রণা!’ রাসনার গলা উঁচু হয়ে প্রায় ধমকের রূপ নিয়েছে। দেখছেনটা কী?

লোকটা এখনো নড়ছে না, কেন জানি আরিয়ানের মনে হলো সে ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ভাবার এবং সম্ভবত কোনো একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছে। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সে বড়ো করে একবার দম নিল, যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে এমন একটা ভঙ্গি করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল, তারপর বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, আমি সরাসরিই দেখাচ্ছি,’ বলে সে লিভিং রুমের মাঝামাঝি এগোতে এগোতে যোগ করল, ‘যদি আপনাদের কপাল যথেষ্ট ভালো হয় আরকি,’ বলে সে নিজের বিরাট দেহটা নিয়ে লিভিং রুমের মাঝামাছি এসে সেন্টার টেবিল থেকে টিভির রিমোটটা তুলে নিয়ে বিরাট এলইডি স্মার্ট টিভিটার দিকে তাক করে টিপে দিল ওটার বাটন। কয়েকবার চ্যানেল পালটে একটা খবরের চ্যানেলে আসতেই থেমে গেল সে। ‘এই দেখুন,’ বলে ওদের নির্দেশ করল খবরটা দেখার জন্যে।

আরিয়ান মনোযোগ দিয়ে দেখল রংপুরে কি একটা নতুন ধানের চাষ করছে সেটার নিউজ দেখাচ্ছে। ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রাসনা বলে উঠল। ‘পাগল হয়ে গেলেন নাকি, এখানে—’

‘আরে ধান চাষের নিউজ না, নিচের স্ক্রল হতে থাকা বিশেষ ব্রেকিং নিউজটা দেখেন।

আরিয়ান আর রাসনা দুজনেই মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে আরিয়ানের কান গরম হয়ে উঠল। টিভি চ্যানেলের স্ক্রিনের নিচে যেখানে কারেন্ট নিউজ স্কুল করতে থাকে সেখানে লেখা উঠছে, লেখক আরিয়ান শুভকে আজ সন্ধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান থেকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করে স্পেশাল ফোর্সের দপ্তরে নেয়ার পথে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক সদস্যকে আহত এবং একজনকে হত্যা করে ফেরারি হয়ে গেছে। তাকে যেখানে পাওয়া যাবে গ্রেপ্তার এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সরকার থেকে। সেই সঙ্গে তাকে সহায়তা করছে ডিবিএসের একজন অফিসার বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। তাকেও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুজনেই হা করে স্কুল হতে থাকা নিউজটা দেখছে, প্রফেসর শফিক রিমোট টিপে পরের চ্যানেলে দিতেও দুজনে পরিষ্কার দেখতে পেল, ওদের ছবিসহ সংবাদ পাঠিকা প্রায় কাছাকাছি খবর প্রচার করছে। এটার ভাষা আরো আকর্ষণীয়। দুজনেই মনোযোগ দিয়ে খবর দেখতে লাগল। মূল সংবাদ প্রচারের পরে, ওকে গ্রেপ্তারের ফুটেজ, গ্রেপ্তারের সময়ে ওর পরিবারের সদস্যদের দেখানো হলো দেখে আপনাতেই আরিয়ানের হাত মুঠি হয়ে গেল। ফুটেজ দেখানোর পরই দেখানো হতে লাগল আরিয়ানের ব্যাকগ্রাউন্ড।

‘এটাও দেখুন,’ বলে প্রফেসর শফিক দুজনার দিকে নিজের মোবাইল এগিয়ে দিল। আরিয়ান মোবাইলটা নেয়ার আগেই রাসনা নিয়ে নিল সেটা। মোবাইল স্কুল করতে করতে তার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যেতে লাগল। ‘কী ব্যাপার কী হয়েছে?’ আরিয়ান অবাক হয়ে জানতে চাইল। কিন্তু রাসনা কোনো জবাব দিল না ওর কথার। সে স্থাণুর মতো মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে আছে। আরিয়ান আবারো জিজ্ঞেস করতে যাবে কিন্তু তার আগেই সে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল আরিয়ানের দিকে।

অনলাইনে সব ছড়িয়ে পড়েছে,’ রাসনা আনমনেই বলে উঠল। ‘আপনার পুরস্কার বিতরণী থেকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া, পালানো, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে খুন করা,’ আরিয়ান মোবাইল ঘেঁটে চলেছে, রাসনা বলে যাচ্ছে। ‘এমনকি আপনি কেন কামালকে খুন করেছিলেন সেটাও, আপনার গল্প চুরি থেকে শুরু করে সব ফাঁস হয়ে গেছে।’

‘আশ্চর্য কাণ্ড!’ আরিয়ান মোবাইল নামিয়ে বলে উঠল। ‘একটু আগেও আপনি চেক করেছিলেন, তখনো কিছু ছিল না। এই আধাঘণ্টার ভেতরে সবকিছু এরকম ভাইরাল হয়ে গেল কীভাবে?’ আরিয়ানের কপালের পাশের রগটা দপ দপ করে লাফাতে শুরু করেছে। ওর সত্যিকার অর্থেই মনে হচ্ছে টলে পড়ে যাবে যেকোনো সময়। ‘সমানে শেয়ার হচ্ছে নিউজ পোস্টগুলো। প্রায় প্রতিটা বইয়ের গ্রুপে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এ নিয়ে।’

‘আপনার পাবলিক ইমেজের চৌদ্দটা বেজে গেছে,’ এতক্ষণে মানুষটার গলা শুনে দুজনেই ফিরে তাকাল তার দিকে। প্রফেসর শফিক এই শীতের রাতেও দর দর করে ঘামছে।  

ক্ষণিকের জন্যে নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারাল আরিয়ান, এক লাফে উঠে দাঁড়াল সে। সোজা গিয়ে টুটি চেপে ধরল মোটা প্রফেসরের। ‘ব্যাটা তুই সব জানিস, বল আমাদের কী হচ্ছে আসলে, এক ধাক্কায় প্রফেসরকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল আরিয়ান।

‘আরে আরে করেন কি!’ আরিয়ানের পেছনে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রাসনা। পেছন থেকে ওকে টেনে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, আরিয়ানই ছেড়ে দিল প্রফেসরকে একটানে বসিয়ে দিল একটা সোফার ওপরে। ‘এই ব্যাটা সব জানে,’ কামরার মাঝখানে সরে এসে মানুষটার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল আরিয়ান।  

‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, যা খুশি তাই বকে চলেছেন,’ ছি ছি করার মতো চিকন গলায় বলে উঠল সে। আরিয়ানের চাপ খেয়ে গলা বসে গেছে তার।

আরিয়ান আবারো এগোতে যাচ্ছিল, রাসনা ওকে টেনে ধরে সরিয়ে দিল। ‘কুল ডাউন!’ আবারো ধমকে উঠল সে।

বড়ো করে দম নিল আরিয়ান। ঠিক আছে, আমি শান্ত হচ্ছি, কিন্তু এই লোকটাকে জিজ্ঞেস করো, আমাদের সে চেনে কীভাবে এবং ঠিক আজকের রাতে আমাদের এখানে আসতে দেখে অবাক না হয়ে উলটো সে আমাদের নিউজ দেখাচ্ছে। পুলিশে কল না করে সে আমাদের সঙ্গে গল্প করছে,’ এইটুক বলে আরিয়ান ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল। ‘এটা কী স্বাভাবিক আচরণ?’ লোকটার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল সে। ‘তার কাছে জানতে চাও কারণ কী?’

‘আপনাকে এমনিতেই অনেকে চেনে,’ এবার অনেকটা স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল প্রফেসর শফিক। লোকটা এখনো স্রোতের মতো ঘামছে, মুখ-চোখও লাল হয়ে উঠেছে। ‘আজ রাতে আপনার কথা অনেকেই জেনে গেছে এরই মধ্যে। আর উনাকে,’ রাসনাকে দেখিয়ে বলে উঠল সে। ‘উনি কামালের সুইসাইড কেসে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘উনাকে না চেনার কোনো কারণ নেই।’

‘তাই বলে আমি আপনার এখানে আসব কেন, এটা আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?’

‘আপনি কামালের ফ্রেন্ড ছিলেন,’ এই প্রথমবারের মতো আরিয়ানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে উঠল লোকটা। ‘একবার আমার এখানেও এসেছিলেন, ‘ বলে সে আরিয়ানের মতোই ভ্রু নাচাল। ‘কি ভুল বলেছি? তাহলে আপনাকে না চেনার বা এখানে আসতে পারার সম্ভাবনা কী একেবারে বাতিল করে দিতে পারি আমি, যেখানে একটু আগেই জানতে পেরেছি কামালের লেখা চুরি করেই আপনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তার লেখা চুরি করেই পুরস্কার বাগিয়ে নিতে যাচ্ছিলেন।’

কামরার ভেতরে নীরবতা ভারী হয়ে ঝুলে আছে। আরিয়ান কিছু বলার জন্যে মুখ খুলল কিন্তু কিছু বলতে পারল না সে। প্রফেসর একবার আরিয়ানকে দেখছে একবার রাসনাকে। ‘বলুন আপনারা আমি কী ভুল বলেছি?’

‘এক মিনিট,’ রাসনা দুজনার মাঝখানে এগিয়ে এলো আরো খানিকটা। ‘শান্তি, প্রফেসর,’ তার দিকে ফিরে তাকাল সে। ‘আপনিই একমাত্র কামালের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বলতে গেলে তার একমাত্র কাছের মানুষ। কাজেই আপনি জ্ঞাতসারে হোক আর অজ্ঞাতসারে, আপনি অবশ্যই কিছু জানেন। কাজেই—’

‘রাসনা আপনি ভুলে যাচ্ছেন, লোকটা তার ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে যাচ্ছিল, আরিয়ান আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, নিজেকে শান্ত করে গলা নামিয়ে নিল। ঠিক আজকের রাতেই, এই সময়ে তার বাইরে যাওয়া। তাও আবার ব্যাগ গুছিয়ে এবং একেবারেই সাধারণ পোশাকে। তাকে দেখেন ভালোভাবে, তার ড্রেসাপ, চেহারা দেখেন। দেখে কি মনে হচ্ছে সে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে বের হচ্ছিল?’

‘আরে অশ্চর্য কাণ্ড—’

‘এক মিনিট এক মিনিট, রাসনা একেবারে দুজনার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘তুমি শান্ত হও, প্লিজ।’ মেয়েটার কথা শুনে আরিয়ান বেশ চমকে উঠল। প্রথমত, সন্ধে থেকে দেখে তাকে মাথা গরম মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল, সে এরকম অবস্থায় এতটা শান্তভাবে রিঅ্যাক্ট করবে ভাবতেই পারছে না আরিয়ান, তার ওপরে আবার হুট করে ওকে তুমি বলাতেও খানিকটা অবাক লাগছে ওর কাছে।

‘আমি বলছি তুমি শান্ত হও,’ রাসনা মেয়েটা তার বড়ো বড়ো চোখজোড়া স্থির করে আছে আরিয়ানের ওপরে। আরিয়ান মুখে কিছু না বলে সামান্য মাথা নেড়ে সায় জানাল। রাসনা ফিরে তাকাল প্রফেসর শফিকের দিকে। লোকটা এখনো দরদর করে ঘামছে, ক্লান্ত তো লাগছেই সেই সঙ্গে তাকে দেখে মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় মূর্ছা যাবে। ‘প্রফেসর, আপনি যাই বলেন না কেন, যে-ব্যাখ্যাই দেননা কেন, আপনার কথা এবং কাজের ভেতরে অনেক অসামঞ্জস্য। আপনি আমাকে আর আরিয়ানকে দেখে চমকাননি খুব একটা, অবাকও হননি তেমন। এরমানে আপনি জানতেন আমরা আপনার এখানে আসতে পারি, প্রফেসর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রাসনা তাকে থামিয়ে দিল। ‘আমাকে শেষ করতে দিন, আপনি কিছুক্ষণ আগেই আমার আর আরিয়ানের নিউজ দেখেছেন এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি পালাবেন। কারণ আপনি জানতেন, হয় আমরা কিংবা কেউ না কেউ আসবে আপনাকে খুঁজতে, তাই আপনি স্পট থেকে সরে পড়তে চাচ্ছিলেন,’ রাসনা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে।

‘তাও না,’ আরিয়ান বলে উঠল পাশ থেকে। ‘কারণ আধাঘণ্টা আগেও নেটে দেখে তুমি কিছু পাওনি। এরমানে আমাদের এই নিউজ প্রচার এবং ভাইরাল হয়েছে এইমাত্র কিছুক্ষণ আগেই। এই লোক আরো আগেই কিছু একটা টের পেয়েছে, যে- কারণে সে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা না হলে মাত্র আমাদের নিউজ দেখে এত দ্রুত সে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারত না। এরমানে এই লোক অবশ্যই কিছু জানে।’

রাসনা দৃষ্টি ফিরিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই প্রফেসর কাশি দিয়ে উঠল। ‘প্রফেসর আপনি ঠিক আছেন?’ লোকটাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে ওদের কাছে। আরিয়ান একবার রাসনার দিকে দেখল। রাসনা ওর দিকে তাকিয়ে একবার কাঁধ ঝাঁকাল অসহায়ভাবে।

‘প্রফেসর?’

‘আমি ঠিক আছে সরি, হুট করে বেশি ড্রিংক করে ফেলেছিলাম,’ প্রফেসর সোফায় থাকা বালিশ নিয়ে নিজের ভেজা মুখ ঘষতে লাগল। আরিয়ান আবার রাসনার দিকে তাকাল। লোকটা করছে কী?

‘প্রফেসর মুখ খুলুন, আমি তো ফেঁসেছিই, আজ রাতে কারোই মুক্তি নেই। কাজেই আপনি আমাদের বলুন কী জানেন আপনি। কামালের অতীতে কী হয়েছিল কারা খুন করেছিল ওকে? পুরো ব্যাপারটা আসলে কী নিয়ে?’ এবার আরিয়ান আরো জোরে বলে উঠল।

ওদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে প্রফেসর হেসে উঠল। মুখ মুছে নিয়ে বালিশটা সোফায় রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। টিভির র‍্যাকের সামনে গিয়ে সে একটা স্বচ্ছ বোতল তুলে নিল র‍্যাকের এক কোনায় বইয়ের সারির পেছন থেকে। আরিয়ান দেখল, অ্যবসলিউট ভদকার বোতল। লোকটার এই উলটোপালটা আচরণের কারণ কি—এবার খানিকটা বুঝতে পারল ওরা দুজনেই।’

বোতল থেকে সমানে ঢকঢক করে গিলে চলেছে প্রফেসর। অ্যালকোহল তো দূরে থাক এভাবে মানুষে কোকও খেতে পারবে না। প্রফেসর মাথা নাড়তে নাড়তে আবারো হেসে উঠল। ‘কামাল একটা উপন্যাস বা এরকম কিছু লিখেছিল,’ লোকটা আরিয়ানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘আর আপনি সেটা চুরি করেছেন, প্রফেসর এই কথা বলতেই আনমনেই মাথা নাড়তে লাগল সে। ‘কী ভাবছিলেন আপনি? কেউ টের পাবে না?’ প্রফেসর আবারো বোতলে মুখ লাগাতে যাচ্ছিল কিন্তু বোতলটা মুখের কাছে নেয়ার আগেই মোবাইলে একটা মেসেজ এলো তার। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেটা দেখতে দেখতে আবারো কেশে উঠল সে। কাশতেই থাকল।

তার কাশির দমক দেখে আরিয়ান আর রাসনা দুজনেই এগিয়ে গেল তার দিকে। ‘প্রফেসর–’

‘আমি ঠিক আছি,’ লোকটা রীতিমতো ঢুলতে শুরু করেছে এখন। আমার একটু ফ্রেশ হতে হবে, আর একটা মেডিসিনও নিতে হবে। আপনারা বসেন এখানেই, খুব বেশি সময় নেই আমাদের হাতে,’ বলে সে ফিরে তাকাল ওদের দুজনার দিকে। ‘আপনারা ঠিকই বলেছেন। আমি অনেক কিছুই জানি। এ এক ভয়াবহ অভিশাপের নাম,’ বলে সে বড়ো করে দম নিল। ‘ভেবেছিলাম কামালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তা হয়নি। আপনি, সে আরিয়ানের দিকে দেখাল। ‘এই লোকটা স্রেফ একটা গল্প চুরি করতে গিয়ে সব বরবাদ করে দিয়েছে। নিজে তো গেছেই এবার সবাই সহ—’ বলে সে বোতলটা হাতে নিয়েই পাশের ঘরের দিকে রওনা দিল। আরিয়ান তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে, রাসনা হাত নেড়ে মানা করল। প্রফেসর নিজের কামরায় গিয়ে ধাম করে দরজা লাগিয়ে দিল

‘লোকটা যদি ওই কামরায় গিয়ে—’ আরিয়ান তড়বড় করে বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল রাসনা।

‘সে যা হোক আর যেমনই হোক, তাকে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। ভরসা রাখতে হবে, এই লোক ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। সেই এখন আমাদের একমাত্র পথ প্রদর্শক হতে পারে,’ বলে সে সোফার পাশের একটা মোবাইল দেখাল। আর সে মোবাইল রেখে গেছে এখানে। কাজেই—’

আরিয়ান মাথা নাড়ল আফসোসের সঙ্গে। অবস্থাটা ওর একদমই ভালো লাগছে না। আর কথা না বলে সে টিভি ছাড়ল। চ্যানেল উলটে-পালটে দেখতে লাগল। চুপচাপ কিছুক্ষণ টিভি দেখে হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি একটা জিনিস বুঝলাম না এখনো। আমরা নীলক্ষেতের মোড়ে থাকতে তুমি চেক করে দেখলে কোথাও কিছু নেই। ওখানের জ্যাম ঠেলে আসতে আধাঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট, এরপরে এখানে এসে বাসা খুঁজতে হয়তো আরো দশ-বিশ মিনিট। মোট এক ঘণ্টাও যদি ধরি, এর ভেতরেই সব চ্যানেলে খবরটা ছেয়ে গেল, ফেসবুকে, গ্রুপগুলোতে এভাবে খবর চাউর হয়ে গেল, ভাইরাল হয়ে গেল, কীভাবে?’

রাসনা টি-টেবিলটার ওপরে বসতে বসতে বলে উঠল, ‘এত অল্প সময়ে এভাবে সব ছড়িয়ে পড়া একটা ব্যাপারই প্রমাণ করে—এটা এমনিতে হয়নি, হওয়ানো হয়েছে,’ রাসনা মুখ তুলে তাকাল আরিয়ানের দিকে। ‘আমার যদি ভুল না হয় তবে অফিসার রহমান বা এর সঙ্গে যারাই জড়িত আছে। তাদের একটা ডেডিকেটেড সাইবার এবং মিডিয়া সেল আছে। মিডিয়াতে তো খবর প্রচারের ব্যবস্থা হয়েই ছিল, হঠাৎ সেগুলোকে একসঙ্গে ছাড়ার নির্দেশ এসেছে। আর ভাইরালটা সাইবার সেল থেকে করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস একটু আগে আমরা যখন এখানে এসেছি—এখন এই মুহূর্তে তোমার নিউজ আরো বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। হ্যাশ ট্যাগ এবং শেয়ার কমেন্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এরকম সাইবার সেলগুলোতে হাজারো ফেইক অ্যাকাউন্ট থাকে, সেগুলোর মাধ্যমে এরকম ঘটানো সম্ভব। এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও আজকাল এসব করে,’ সদা উত্তেজিত

রাসনার গলার সুর একেবারে শান্ত।

‘কিন্তু–’

আরিয়ান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ রাসনা তাকে থামিয়ে দিল। ‘ব্যাপার কি’

‘শশশ,’ ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে বলল সে আরিয়ানকে। ‘তুমি কি কোনো শব্দ পাচ্ছো?’

আরিয়ান টিভিটা বন্ধ করে দিল। ‘না তো কীসের?’ প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই আরিয়ানও শুনতে পেল শব্দটা। কিছু একটার সঙ্গে অপর একটা জিনিসের ঠোকাঠুকির শব্দ। দুজনেই একসঙ্গে ফিরে তাকাল প্রফেসরের বেডরুমের দিকে শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। দুজনে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকে রওনা দিল।

দরজায় কান পাততে হলো না, বেশ জোরেই শব্দটা আসছে এখন ভেতর থেকে। ‘প্রফেসর?’ বলেই দরজায় দুই-তিনটে থাবা মারল আরিয়ান। ‘প্রফেসরের কোনো সাড়া শব্দ নেই। শব্দের তীব্রটা বাড়ছে, ঠোকাঠুকির গতিও।

‘ব্যাপার কী?’ আরিয়ান বলতে বলতে আবারো থাবা মারল। আর রাসনা চোখ লাগাল দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে।

‘কী ব্যাপার ভেতরে—’

চট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল রাসনা। ‘আরিয়ান,’ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে আরিয়ানের দিকে। ‘প্রফেসর শফিক আত্মহত্যার জন্যে সিলিং থেকে লটকে পড়েছেন।’

আরিয়ানের মনে হলো ওর মাথায় সরাসরি বজ্রপাত হয়ে গেল যেন।

১৮

কথাটা বলে মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে রইল রাসনা।

কিন্তু আরিয়ান চমকে উঠলেও ওর ভেতরেই প্রতিক্রিয়া হলো আগে। ‘প্রফেসর!,’ দরজায় জোরে জোরে থাবা মারতে লাগল ও। ‘প্রফেসর কী করছেন আপনি?’ আরিয়ান জোরে জোরে থাবা মারছে রাসনা ওর হাত চেপে ধরল একপাশ থেকে।

‘আরিয়ান, আমার মনে হয় না প্রফেসর আর কথা শোনার মতো অবস্থায় আছে—তাকে থামাতে হবে,’ বলেই সে আরিয়ানের হাত ছেড়ে দিয়ে জোরে লাথি মারল দরজায়। দুবার লাথি মেরে পিছিয়ে যেতেই আরিয়ান খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে সর্ব শক্তিতে লাথি মারল। একবার, দুবার তিনবারের সময় পায়ে ব্যথা পেয়ে থেমে গেল ও। ‘পুরনো দিনের দরজা, এত শক্ত কেন?’

‘পুরনো দিনের দেখেই এত শক্ত,’ রাসনা দ্রুতবেগে দরজাটা পরখ করতে শুরু করেছে। ‘এভাবে হবে না,’ বলে সেও পিছিয়ে এসে আরিয়ানের পাশে এসে দাঁড়াল। ‘দুজনে একসঙ্গে, এক দুই তিন,’ বলতেই দুজনে প্রায় একসঙ্গে দরজাটায় লাথি মারল। খুলে না গেলেও এই প্রথমবার ভালোভাবে কেঁপে উঠল দরজাটা। ‘আবার,’ আগেরবার দুজনের লাথির টাইমিংটা খানিক এদিক-সেদিক হয়ে গেছিল, এবার অনেকটাই একসঙ্গে হলো, মনে হলো একটা সিটকিনি ভেতর দিকে বেঁকে গেছে। ‘আরেকবার,’ বলেই দুজনে একসঙ্গে লাথি মারল। এবার দুজনারই টাইমিং- এ এতটুকু গড়বড় হলো না, তীব্র ধাক্কার চোটে দজটার একপাশের পাল্লা হেলে গিয়ে কাঁত হয়ে রইল একপাশে। ‘জলদি জলদি।’

দুজনেই দৌড়ে যখন কামরার মাঝখানে পৌঁছাল ততক্ষণে ওপরে সিলিঙের ফ্যান আটকানোর পাল্লার সঙ্গে আটকানো দড়িটার সঙ্গে ঝুলতে থাকা দেহটা স্থির হয়ে গেছে। দেহটা থেকে খানিক দূরেই একটা স্ট্যান্ডিং চারপায়া লোহার মই কাত হয়ে পড়ে আছে। এ-ধরনের মই সাধারণত বাসা বাড়িতে ফ্যান পরিষ্কারসহ টুকিটাকি মেরামতির কাজ, ঝুল পরিষ্কার ইত্যাদি কাজে ব্যহার করা হয়। একা ব্যবহারের জন্যে খুবই উপযুক্ত কিন্তু বেশ মজবুত হয় এসব মই। ওটার সঙ্গে ঝুলন্ত দেহটার পায়ের বাড়ি খাওয়াতেই শব্দটা হচ্ছিল। সম্ভবত মরতে থাকা মানুষটার দেহ তীব্র ব্যথার প্রতিক্রিয়াতে লাথি মারছিল ওটাতে। ওরা দুজনে মিলে মইটাকে সোজা করে ধরল দেহটার ঠিক নিচে প্রথমে। তারপর আরিয়ান বলে উঠল, ‘আমি উঠছি, তুমি মইটাকে শক্ত করে ধর,’ বলেই সে লোহার মইটা বেয়ে ওপরে উঠে গেল আরিয়ান কিন্তু এরকম ভারী একটা দেহ ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে আনতে জান ছুটে গেল ওর। প্রথম কয়েকবারের চেষ্টায় দড়িই ছোটাতে পারল না। এরপর রাসনা রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি এনে দিলে সেটা নিয়ে ওপরে উঠে প্রথমে, মানুষটাকে ধরে ছুরি দিয়ে দড়িটা কাটল, তারপর তাকে ধরে প্রথমে মইয়ের ওপরে বসাল, এরপর খানিক নেমে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। শেষদিকে গড়িয়ে পড়েই গেল মানুষটা। তার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে স্ট্যান্ডের মতো মইটা নিয়ে গড়িয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল আরিয়ান। একটুর জন্যে মাথাটা মইয়ের সঙ্গে জোরে বাড়ি খেয়ে দুই ভাগ হওয়া থেকে বেঁচে গেল ওর। হুড়ুম ধাড়ুম করে মেঝেতে পড়ে আর উঠতে পারল না ও। মাটিতে শুয়েই বড়ো বড়ো করে দম নিতে লাগল। আড়চোখে দেখল প্রফেসরের দেহটাকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে তার বুকে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করছে রাসনা। বুকে চেপে, হাতের পালস পরখ করে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে।

‘লাভ নেই আরো আগেই মারা গেছে লোকটা।’

‘আশ্চর্য অবস্থা লোকটা কী এমন—’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়াল আরিয়ান। ‘কী এমন হলো যে লোকটা মারাই গেল।’

‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ কী?’ আরিয়ান উঠে দাঁড়িয়েছে আর রাসনা প্রফেসরের দেহের পাশে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়েছে তার মৃত্যু হয়েছে বুঝতে পেরে। কেমন জানি হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি তার শরীরে। আরিয়ানের নিজেরও প্রচণ্ড হতাশ লাগছে। যতটা না প্রফেসরের মৃত্যুতে তারচেয়ে অনেক বেশি হতাশ লাগছে ওদের রহস্য সমাধানের সম্ভাব্য শেষ গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটাও হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে। ‘কী খেয়াল করব?’ রাসনার প্রশ্নের জবাবে জানতে চাইল আরিয়ান।

‘লোকটার যে বিশাল সাইজ তাতে এই যে সে এত সহজে ওখানে উঠে লটকে পড়ল কীভাবে?’ রাসনা মেঝেতে পড়ে থাকা মই আর প্রফেসরের দিকে দেখছে বারবার।

‘এটা এত জটিল কিছু না,’ বলে ও মইটা দেখাল। ‘এই ধরনের মইগুলো বানানোই হয় এমনভাবে যাতে বয়স্ক মহিলারাও এগুলো দিয়ে ওপরে উঠে ফ্যান, মাকড়শার জাল এগুলো পরিষ্কার করতে পারে,’ আরিয়ান প্রফেসরের জিভ বেরিয়ে থাকা চেহারাটা দেখে মুখ বিকৃত করে ফেলল। বিছানার দিকে এগিয়ে ওটা থেকে টান দিয়ে চাদর উঠিয়ে এনে লাশের ওপরের অংশটা ঢেকে দিল

‘আমার প্রশ্ন সেটা না,’ লাশটাকে ঢেকে আশপাশে দেখতে দেখতে আরিয়ান বলে উঠল। ‘এই দড়ি সে পেল কোথায় এভাবে হুট করে?’

‘আমিও আসলে সেটাই জানতে চাচ্ছিলাম, এই লোকটা যেভাবে সুইসাইড করল এতে আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে, এরকম একটা প্রস্তুতি তার আগে থেকেই ছিল।’

‘হতে পারে, আরিয়ান মৃত প্রফেসরের বিরাট বেডের পাশের বেডসাইড টেবিলটা ঘেঁটে দেখতে দেখতে বলতে লাগল। ‘কামালের অতীতে কোনো বড়ো একটা ঘাপলা অবশ্যই ছিল, আর এই লোক কোননা কোনোভাবে কামালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। তারমানে অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা জানত।’

‘সম্ভবত,’ আরিয়ানের দেখাদেখি রাসনাও তার ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার খুলে চেক করতে শুরু করেছে। ‘এই লোকটা সন্ধের পর দিয়ে তুমি এবং তোমার সঙ্গে ঘটা ঘটনা জানতে পারে। এরপরই সে পালানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু সে পালানোর আগেই আমরা এসে হাজির হই। মনে আছে লোকটা কীভাবে ড্রিংক করছিল আর ঘামছিল?’

‘তার আচরণ মোটেই স্বাভাবিক মনে হয়নি আমার কাছে। বিশেষ করে যেভাবে সে ঘামছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার আর পালানোর উপায় নেই। এরপর—’

‘তার মোবাইলে একটা মেসেজ আসে—’  

দুজনেই চট করে ফিরে তাকাল দুজনার দিকে। ‘মোবাইল।’

দুজনেই প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে। সেখানে সোফার পাশে রাখা সেটটা তুলে নিয়ে দেখল ওটা লক করা। ‘আইফোন, ফেস রিকভারি অপশন দিয়ে খুলবে, চল,’ ওরা আবারো বেডরুমে ফিরে এসে, লোকটার মুখটা চাদরের নিচ থেকে বের করে ধরল মোবাইলের সামনে। কিন্তু জিভ বেরিয়ে এমনভাবে বিকৃত হয়ে আছে চেহারা, ফোন খুলল না। অনেক কায়দা করার পর অবশেষে মোবাইল আনলক হলো কিন্তু মেসেজ অপশনে গিয়ে দুজনেই অবাক হয়ে গেল।

‘এটা তো একটা মোবাইল গেমের অ্যাড, এটা দেখে লোকটা সুইসাইড করল, আরিয়ান খুব অবাক হয়ে ফিরে তাকাল রাসনার দিকে।

‘কই দেখি?’ রাসনা মোবাইলটা ওর হাত থেকে নিয়ে পরখ করে অবাক হয়ে টেক্সটা দেখল।

‘শোন প্রফেসর যাই জানত জোরদার সম্ভাবনা আছে এই বাড়িতে তার কোনো না কোনো ক্লু আছে। সেটা এই মোবাইলে হোক, তার পিসি বা ল্যাপটপে হোক, তার ব্যাগেজে হোক কিংবা অন্য কোথাও। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। এখানে যদি আমরা ফেইলিওর হই, তাহলে আমি তো শেষই, তুমিও মহামুসিবতে পড়বে। কাজেই—’ আরিয়ান তার বাক্য শেষ করার আগেই দুজনে ছড়িয়ে ঘরে খুঁজতে শুরু করল। রাসনা চলে গেল অন্য কামরাগুলোতে, আর আরিয়ান খুঁজতে লাগল বেডরুমে। যতটা সম্ভব বিস্তারিতভাবে দেখার চেষ্টা করল ও। বেডসাইড টেবিল আর ক্যাবিনেট আগেই দেখা হয়ে গেছিল, ও সোজা চলে গেল বিরাট কাঠের আলমারিটার কাছে। ওটার একপাশের পাল্লা খোলাই ছিল, তিন পাল্লার আলমারিটা খুলে ধরে কাপড়চোপড় মেঝেতে ফেলে প্রতিটা তাক-ড্রয়ার তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল ও। কিন্তু কাজে লাগার মতো কিছুই পেল না।

‘পাওয়া গেল না কিছুই?’ দরজার কাছ থেকে রাসনার গলা শুনে সেদিকে ফিরে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কপালের ঘাম মুছল আরিয়ান। কিচ্ছু না,’ হতাশ ভঙ্গিতে এলোমেলো বেডরুমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ও। ‘তুমি কিছু পেলে?’

রাসনাও দম নিতে নিতে আলমারিটার কাছে চলে গেল। ‘একজন মানুষের দীর্ঘদিন ধরে বাস করা একটা বাসা। পুরোটা ডিটেইলে খুঁজে দেখতে গেলে তো একদল লোকের একাধিক দিন লাগবে। কাজেই সেভাবে তো দেখিনি কিন্তু মোটামুটিভাবে দেখে লিভিং রুম ডায়নিং রুম দেখে কিছুই তো পাবার মতো আছে বলে তো মনে হলো না।’

‘বুক সেলফ?’ আরিয়ান রাসনার সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে নেই। সে আঁতিপাতি করে কামরার চারপাশে দেখার চেষ্টা করছে।

‘আলমারিতে কোনো গোপন চেম্বার বা এরকম কিছু কি থাকতে পারে?’ রাসনা মনোযোগের সঙ্গে কাঠের আলমারিটার লাইনিংগুলো ধরে ধরে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে কিছু আছে কি না।

তার প্রচেষ্টা দেখে এবং কথা শুনে মৃদু হেসে উঠল আরিয়ান। ‘এটা কি নব্বইয়ের দশক পেয়েছ নাকি যে বাথরুমের টাইলস আর আলমারির লাইনিংয়ের ভেতরে মূল্যবান কিছু লুকানো থাকবে!’ বলে আনমনেই মাথা নাড়ল আরিয়ান। ‘এই যুগে এভাবে কেউ কিছু লুকায় না। লুকানোর মাধ্যমই বদলে গেছে—’ বলেই সে ফিরে তাকাল বিরাটাকায় পড়ার টেবিলটার দিকে। ওটার ওপরে একটা বিরাট আইম্যাক রাখা। ‘আমার মনে হয় আমরা ভুল পন্থায় খুঁজছি।’

‘আমি বুঝতে পারছি তুমি কীসের কথা বলছ,’ রাসনা আরিয়ানের পাশে এসে সেও তাকিয়ে আছে ডাবল মনিটর আইম্যাকটার দিকে। ‘আরো একটা জায়গায় আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। তার ব্যাগ।’

রাসনার কথা শুনে আরিয়ান চট করে ফিরে তাকাল ওর দিকে। তাই তো তার ব্যাগটা দেখার কথা মাথাতেই আসেনি। যেহেতু সে পালাচ্ছিল কাজেই তার সঙ্গের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু যদি থেকেই থাকে তবে সেটা সে অবশ্যই ওই ব্যাগে করে ক্যারি করার কথা। আমাদের মনে হয় আগে ব্যাগ—’

দাঁড়াও আরিয়ান, আমরা বোকামি করছি। প্ল্যান করে কাজ করতে হবে। প্রফেসর কেন ভয় পেল এবং এভাবে সুইসাইড করল—এটা আমরা বুঝতে না পারলেও এটা পরিষ্কার যে এক্সট্রিম ট্রমায় না পড়লে বা এমন কিছুর মুখোমুখি হওয়ার ভয় না থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক এভাবে সুইসাইড করার কোনো কারণই নেই। তার কামরা আর জিনিসপত্রগুলোর দিকে দেখ।’

রাসনার কথা শুনেই আরিয়ান আবারো চারপাশে তাকাল কিন্তু মেয়েটা আসলে কীসের ইঙ্গিত করছে ঠিক বুঝতে পারল না।

‘এই লোকটার,’ মৃত প্রফেসরের দেহটার দিকে নির্দেশ করল। ‘বাসায় যা দেখছ একটা কমদামি জিনিস নেই। তার প্রতিটা জিনিস দামি এবং বেশ দামি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা ভালো আর্ন করে, বিভিন্ন প্রজেক্ট, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, ভালো ইনকাম, ভালো লাইফ স্টাইল তাদের। কিন্তু এই লোকের মতো এতটা লাক্সারিয়াস হওয়ার কথা নয়। তার বাসায় একটা কমদামি জিনিস দেখিনি আমি এখন পর্যন্ত এবং প্রতিটা জিনিস এক্সপোর্ট করা।’

‘তারমানে এই লোক বড়ো কিছুর সঙ্গেই জড়িত ছিল এবং,’ আরিয়ান ভাবার চেষ্টা করছে। ‘সে যে-কারণেই পালানোর চেষ্টা করুক না কেন কিংবা শেষ পর্যন্ত সুইসাইড করুক না কেন, সেটা এমন কিছুই ছিল যার কারণে তার পরিণতি মৃত্যুর চেয়েও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।’

‘এই কারণেই সে সুইসাইডই বেছে নেয়।’

ঠিক, প্রফেসরের এখানে অবশ্যই কিছু না কিছু আছে,’ ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ান ভাবল। ‘এক কাজ করো, তুমি প্রফেসরের ব্যাগটা চেক করো। আমি তার মোবাইল, পিসি আর ল্যাপটপটা নিয়ে বসছি। আমাদের দ্রুত কাজ সারতে হবে।’

দুজনেই নিজেদের মতো কাজে লেগে পড়ল। আরিয়ান লিভিং রুম থেকে ল্যাপটপ আর মোবাইলটা এনে ম্যাকটার পাশে রাখল। সবগুলোই অ্যাপলের জিনিস, কাজেই, সব একই পন্থায় লক থাকার কথা এবং অবশ্যই একটাই সিঙ্গেল অ্যাপল অ্যাকাউন্ট দিয়ে সিংক করা থাকার কথা। সেক্ষেত্রে অন্তত একটাতে ঢুকতে পারলেও হয়তো মূল ই-মেইেলটা বা অ্যাকাউন্টটার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আরিয়ান প্রথমে ম্যাকটায় ট্রাই করল ওটা, পাসওয়ার্ড প্রটেকটেড। ল্যাপটপেরও একই হাল।

আরিয়ান কাজ করছে রাসনা মেয়েটা চলে এলো একটু পরেই।

‘কাজ হলো কিছু?’ আরিয়ান দ্বিতীয় দফা ট্রাই করতে করতে জানতে চাইল।

‘নাহ,’ প্রফেসরের ব্যাগে অনেক জিনিসপত্র কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমাদের কাজে লাগার মতো কিছু পেলাম না। তুমি কিছু পেলে?’

‘নাহ,’ আরিয়ান বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘এগুলোর কোনোটাই কোনো কাজে লাগছে না, সবই পাসওয়ার্ড প্রটেকটেড। মোবাইলটাই একমাত্র ভরসা। ওটাকে নিয়ে আগের মতো করে কাজে লাগাতে হবে,’ বলে ও চট করে টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘হেল্প করো,’ বলে ও মোবাইলটা নিয়ে এসে দাঁড়াল মৃত প্রফেসরের দেহের পাশে, হাঁটু গেড়ে বসে রাসনার দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘তুমি হাত দুটো ধর, আমি মুখটা ধরে মোবাইলটা আনলক করছি,’ বলেই কাজে লেগে গেল ও। আগের মতোই বেশ কিছুক্ষণ টানাহেঁচড়ার পর মোবাইলটা আনলক হতেই খুশি হয়ে উঠল ও। এবার আর আগের মতো বোকামি করল না। আনলক মোবাইলটার ই-মেইেল অপশনে চলে গেল প্রথমেই। সিংক করা জি- মেইলটা ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করছে রাসনা পেছন থেকে ডাক দিল ওকে একবার। খানিকটা বিরক্ত হয়েই হাত নাড়ল সে, কিন্তু আবারো ডেকে উঠল রাসনা। তার গলায় এমন কিছু একটা ছিল শুনে ঝট করে তার দিকে ফিরে তাকাল আরিয়ান। ‘কী ব্যাপার—’

রাসনা মেয়েটা কেমন জানি অদ্ভুত ভঙ্গিতে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে, হাতে ধরে আছে কিছু একটা। আরিয়ানকে ডাক দিলেও ওর দিকে তাকিয়ে নেই সে। বরং তাকিয়ে আছে হাতে ধরা জিনিসটার দিকে।

‘কী ব্যাপার?’ আরিয়ান খানিক বিরক্ত হয়েই আবারো একই প্রশ্ন করল।

‘আরিয়ান,’ এবার চোখ তুলে তাকাল সে আরিয়ানের দিকে। ‘এটা প্রফেসরের হাতে ধরা ছিল,’ বলে জিনিসটা এগিয়ে দিল সে আরিয়ানের দিকে।

হাতে ধরা ছিল মানে?’ আরিয়ান বিরক্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইল। ওর কাছে মনে হচ্ছে মোবাইল চেক করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে। রাসনা হাত বাড়িয়ে দিলেও সে ওটা ধরার জন্যে হাত বাড়াল না।

‘এটা লাশের মুঠোর ভেতরে ছিল,’ মেয়েটা এখনো সেই আগের মতোই হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান একবার রাসনাকে দেখল, তারপর ফিরে তাকাল মেয়েটার হাতের দিকে। ‘কি…কাগজ, মেয়েটার হাতে ধরা একট টুকরো দলা পাকান কাগজ, নিজের হাতে নিয়ে নিল আরিয়ান। ‘এটা তো চোখে পড়েনি। ‘শিট,’ কাগজে লেখা একটাই মাত্র শব্দ, আর সেটা পড়েই সঙ্গে সঙ্গে রাসনার দিকে ফিরে তাকাল আরিয়ান। দুজনেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে।

কাগজটাতে একটাই শব্দ লেখা, পালাও।

দুজনার ভেতরে কেউই কিছু বলার আগে, চট করে বাতি নিভে গেল পুরো ফ্ল্যাটের, সেই সঙ্গে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল ফ্ল্যাটের একাধিক জানালার কাচ। সেগুলো দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা ক্যানের মতো জিনিসগুলো দিয়ে ইটের ভাটার চিমনির মতো গল গল করে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

১৯

অ্যানথ্রোপলজির এভুলুশনারি থিওরির একটা সেকশন আছে যেটা জিনগতভাবে মানুষের পাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ডিল করে। যেমন কেন আমরা অন্ধকারে ভয় পাই। কেন মাকড়শা, সাপ কিংবা জোঁক দেখলে আমাদের বাজে অনুভূতি হয়। কেন যুক্তির চেয়ে ভয়ের অনুভূতি সবসময়ই অনেক বেশি প্রবল, এরই ধরনের বিষয়াদি। এই বিষয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো প্রতিক্রিয়া কেন আমরা একটা নির্দিষ্ট অবস্থায় নির্দিষ্টভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাই। কোনো কোনো অবস্থায় কেন আমরা রেগে উঠি আবার, কোনো কোনো অবস্থায় কেন আমরা একেবারে ভাবলেশহীন হয়ে উঠি। আবার কেন মাথার সামনে লাঠি তুললে চট করে হাত তুলি সেটাকে থামানোর জন্য।

প্রফেসরের হাতে সেই টুকরো কাগজের লেখাটা দেখা এবং প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাড়ি অন্ধকার হয়ে যাওয়া এবং একাধিক জানালার কাচ ভেঙে টিয়ার গ্যাসের শেল ফ্ল্যাটের ভেতরে এসে পড়া, আরিয়ানের মনে হলো ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন কিংবা পর পর ঘটা ঘটনা নয়। বরং সব যেন একসঙ্গে ঘটে গেল এবং ঘটনাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আরিয়ানের প্রতিক্রিয়া হলো অনেকটা চট করে পেছনে কেউ চলে এলে আমরা যেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই, দরজার ওপাশ থেকে কেউ লুকিয়ে ‘হাউ’ করে চমকে দিলে লাফিয়ে উঠি, কিংবা কেউ খামচি দিতে চাইলে আপনাতেই মুখ ঢেকে ফেলি। ব্যাপারটা এমন নয় যে আমরা কাজটা খুব সচেতনভাবে করি, বরং অনেকটা আপনাতেই যেন ঘটে যায়।  

বাতি নিভে যেতেই ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে উঠেছিল, আর জানালার কাচ ভেঙে টিয়ার শেলগুলো ঢুকতেই ও বুঝে ফেলল আক্রমণ হয়েছে। আর যারাই করে থাকুক ওদের এইটুকু ক্ষমতা যেহেতু আছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার এলাকায় এভাবে মেইন সুইচ অফ করে দিতে পারে, রেসিডেন্সিয়াল এলাকার ভেতরে তিন তলায় টিয়ার শেল পাঠাতে পারে, কাজেই তারা যে-বেশ আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই আরিয়ান খানিকটা এগিয়ে চট করে রাসনা যেখানে ছিল সেখানে পৌঁছে গেল। মেয়েটার এক হাত চেপে ধরে বলতে গেলে টেনে মাটিতে নামিয়ে আনল, নিজেও শুয়ে পড়ল মেঝেতে।

আরিয়ান নিজে একহাত ভাঁজ করে মুখের সামনে ধরে রাখলেও ওর মনে হচ্ছে চোখমুখ জ্বলে যাচ্ছে। রাসনা মেয়েটা তীব্র বেগে কাশতে কাশতে হিস্টিরিয়ার মতো আচরণ করতে শুরু করেছে। শান্ত হও, শান্ত হও,’ বলে আরিয়ান নিজেই কাশতে শুরু করল। দুটো টিয়ার শেলই এসে পড়েছে লিভিং রুমে, ওগুলো থেকে সমানে ধোঁয়া এসে ঢুকছে বেডরুমে। আরিয়ান মেয়েটাকে খানিকটা শান্ত করার চেষ্টা করে অনুধাবন করতে পারল কোনোমতে এই ধোঁয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে কিছুই করা সম্ভব হবে না। রাসনাকে চোখমুখ চেপে মাটিতে শুয়ে থাকতে বলে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল অন্ধকারের ভেতরে।

বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমটা কোনদিকে মনে করার চেষ্টা করছে ও। বেডরুমটা বেশি বড়ো না, অনেকটা আন্দাজে হাতড়ে হাতড়েই বাথরুমের দরজার কাছে এসে জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল ওটা। চোখে মনে হচ্ছে আগুন ধরে যাচ্ছে, নাক-মুখ ভেসে যাচ্ছে চোখ থেকে বের হওয়া পানি দিয়ে। বাথরুমে ঢুকেই আধো অন্ধকারের মধ্যে বেসিন বের করতে গিয়েই দুড়ুম করে এক আছাড় খেল। ব্যথার চোটে অন্ধকারের ভেতরে আরো অন্ধকার দেখলেও এক ভালো হলো পড়তে পড়তে দেয়ালের কাছে খামচে ধরতে গিয়ে একটা টাওয়াল পেয়ে গেল। সোজা হয়ে বসে বেসিনের কাছে এসে কল ছেড়ে দিল ও। টাওয়ালটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে কয়েক দফা জোরে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল মাঝখান থেকে। টাওয়ালটা পানিতে চুবিয়ে ওটার অর্ধেক অংশ কোনোমতে নিজের নাকে মুখে বেঁধে নিতেই কানে ভেসে এলো চিৎকার। টাওয়ালের বাকি অংশটা তুলে নিয়ে কোনোমতে দরজা ঠেলে বাইরে আসতে আরেকটু হলে রাসনার গায়ের ওপরে পড়ে যাচ্ছিল, নিজেকে সামলে নিয়ে নাক মুখের পানিতে ভেসে যাওয়ার জোগাড় রাসনার মুখে বেঁধে দেবার চেষ্টা করল ভেজা টাওয়ালটা। ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ান কী করতে যাচ্ছে-সেটা বুঝতে না পেরে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করল মেয়েটা, কিন্তু আরিয়ানের দিকে তাকাতেই ইশারায় বুঝিয়ে দিল ও। টাওয়ালটা বেঁধে বাইরের দরজার দিকে ইশারা করল আরিয়ান। রাসনার এক হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল ও দরজার দিকে। দুজনেই অন্ধকারের ভেতরে দরজার চৌকাঠে পা দেবে এমন সময়ে আরিয়ানের মাথায় খেলে গেল একটা বিষয়। রাসনাকে সামনে এগোতে বলে ও পিছিয়ে এলো বেডরুমে।

অন্ধকারের ভেতরে ধোঁয়ার চোটে বলতে গেলে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তাও কোনোমতে হাঁচড়েপাঁচড়ে চলে এলো স্টাডি টেবিলটার কাছে। যে জিনিসটা খুঁজছিল সেটা হাতড়ে পাতড়েও খুঁজে পেল না। মুহূর্তের জন্যে দিশাহারা বোধ করলেও হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই চলে এলো বিছানার কাছে, জিনিসটাকে ঠিক বালিশের পাশে দেখে চট করে ওটা তুলে নিয়ে ছুটে রওনা দেবে দরজার দিকে, প্রফেসরের মৃতদেহের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল আরিয়ান। হাত থেকে ছুটে গেল জিনিসটা। রাগের সঙ্গে গাল বকে উঠল ও, পাগলের মতো মেঝেতে হাতড়াতে শুরু করল জিনিসটার জন্যে কিন্তু বেশি খুঁজতে হলো না। মৃতদেহটার পাশেই পেয়ে গেল তার ল্যাপটপটা। জিনিসটা নিয়ে এবার আর উঠে দাঁড়াল না। শার্টের দুটো বোতাম খুলে ল্যাপটপটা শার্টের ভেতরে চালান করে দিয়ে বেল্টের ভেতরে ঢুকিয়ে শক্ত করে আটকে নিল, তারপর হামাগুড়ি দিয়েই রওনা দিল দরজার দিকে। বেডরুমের দরজাটা পর হয়ে ডায়নিং-এ এসে ডানে- বামে তাকিয়ে জানালা দিয়ে আসা বাইরের আলোতে ধোঁয়ার ভেতরেও পরিষ্কার দেখতে পেল—রাসনা মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার বোকামিতে নিজেকে গালি দেবে না মেয়েটাকে গালি দেবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই হামাগুড়ি দিয়ে সেদিকে এগোতে শুরু করল আরিয়ান। রাসনা দরজার দিকে এগোচ্ছে যে গতিতে, আরিয়ান তারচেয়ে দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। কিন্তু এতটাও কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত কাজ হলো না, আরিয়ান তাকে ডেকে ধমকে, এই অন্ধকারের ভেতরেও যতটা সম্ভব ঝোড়ো গতিতে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরার আগেই মেয়েটা পৌঁছে গেল দরজার কাছে। মেয়েটাও পৌঁছে গেছে, আরিয়ানও তাকে উদ্দেশ্য করে লাফ দিল ধরার জন্যে যাতে দরজাটা খোলার আগে অন্তত তাকে থামাতে পারে কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আরিয়ানও রাসনার কাছ পৌঁছাল, রাসনাও দরজা খোলার জন্যে হাত বাড়াল কিন্তু দুজনের কেউই সফল হওয়ার আগেই তীব্র বিস্ফোরণের সঙ্গে ভেঙে পড়ল দরজাটা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ডায়নিং রুমের একদিকে ছিটকে পড়ল আরিয়ান।

তীব্র বিস্ফোরণের ধাক্কা, আঘাতের চোট আর ভয়াবহ শকে ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে ও। আসলে মুহূর্তের জন্যে আরিয়ান ঠিক বুঝতে পারল না, সে কি আদৌ জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে না ফেলল। কারণ সে সবই শুনতে এবং অনুভব করতে পারছে কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করার পর পিটপিট করে চোখটা খুলতে পারল সে অবশেষে। কিন্তু সেই ব্যাপারেও সে ঠিক নিশ্চিত হতে পারল না, আদৌ কি চোখ খুলেছে না বন্ধই আছে। কারণ তার মস্তিষ্ক বলছে সে চোখ খুলেছে কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে না কিছুই। আরো কয়েকবার পিটপিট করার পর বুঝতে পারল সে আসলে চোখ খুলেছে কিন্তু ধোঁয়া অন্ধকার আর শকের কারণে দেখতে পাচ্ছে না সে কিছুই।

সময় হারিয়ে যায়, স্মৃতি মুছে যায় কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে শরীর আর মনের গহিন কোনে জমা হওয়া কিছু অনুভূতি স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসে থাকে, যেটাকে কেউ বলে রিফ্ল্যাক্স, কেউ বলে মাসল ইমপাল্স, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাসল মেমোরি, আবার এটাই কখনো কখনো ইন্সটিংকট। বহু বছর আগে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ট্রেনিং ঠিকই বিশেষ মুহূর্তে স্রেফ প্রয়োজনের তাগিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল স্মৃতির অতল থেকে। ক্ষণিকের জন্যে ভেজা তোয়ালেটা মুখের ওপর থেকে চোখের ওপরে নিয়ে এলো ও ঝটকা দিয়ে।

.

চোখটা মুছে নিয়েই চট করে আবার মুখটা বেঁধে ফেলল ও। এখনো মাটিতেই শুয়ে আছে আরিয়ান। মুখটা বেঁধে কোনোমতে উঠে বসল ও। তীব্র ধোঁয়ার চোটে নাক- মুখ আর চোখের পানি এক হওয়ার জোগাড় কিন্তু ও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে এখন যদি এখান থেকে সরে পড়তে না পারে তবে খবরই আছে দুজনেরই। আরিয়ান কোনোমতে উঠে বসেই দেখতে পেল রাসনা মেয়েটা দরজা থেকে খানিকটা দূরেই পড়ে আছে। মাটিতে পড়ে থাকলেও নড়াচড়া করছে, তারমানে সম্ভবত জ্ঞান হারায়নি। আরিয়ান আধো অন্ধকার আর নীলচে ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে মেয়েটার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে উঠে দাঁড়াল। আরিয়ান এগোতে এগোতে দেখতে পেল মেয়েটাও এক হাতে চোখ ঢেকে কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করছে। আর কয়েক কদম এগোলেই মেয়েটার কাছে পৌঁছে যাবে—এমন সময় পরিষ্কার দেখতে পেল ধোঁয়া ফুঁড়ে যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে উদয় হলো ছায়ার মতো একটা মূর্তি। আরিয়ানের মনে হলো বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা একটা লাফ দিল। ও যতই চেষ্টা করুক ছায়ামূর্তিটার আগে কোনোভাবেই পৌঁছাতে পারবে না রাসনার কাছে। একেবারে কমান্ডোর সাজে সজ্জিত মুখে গ্যাসমাস্ক পরা মূর্তিটা দেখে আরিয়ানের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে এরা সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে ওদেরকে ধরার জন্যে এবং কোনো অবস্থাতেই ওদের ছেড়ে দেবে না।

আরিয়ান জানপ্রাণ দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে কাছাকাছি যাওয়ার আগেই অস্ত্র হাতে কমান্ডোটা পৌঁছে গেল রাসনার কাছাকাছি। আরিয়ান এগিয়ে যাচ্ছে কমান্ডোটা নিজের অস্ত্র তাক করছে মেয়েটার দিকে। মুহূর্তের জন্যে আরিয়ান ভাবল মেয়েটাকে গুলি করবে লোকটা, সঙ্গে সঙ্গে নিজের কোটের পকেটে থাকা অস্ত্রটা বের করে আনার জন্যে হাত বাড়াল। এতক্ষণ ভুলেই গেছিল ওটার কথা। আরিয়ানের আঙুল পৌঁছে গেল অস্ত্রটার বাটের কাছে—সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। আধো অন্ধকার হলেও এটা পরিষ্কার বুঝতে পারল কমান্ডো লোকটা মেয়েটাকে গুলি করবে না, কারণ অস্ত্রটা মেয়েটার দিকে তাক করেও সে ওটাকে উঠিয়ে নিতে শুরু করল ওপরের দিকে, একজন প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারী এই কাজটা কখন করে আরিয়ান খুব ভালোভাবেই জানে, এটা একজন প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারী তখনই করে যখন সে গুলি না করে বরং অস্ত্রের বাট ব্যবহার করে কাউকে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলতে চায়। দ্বিতীয় আরেকটা জিনিস যেটা ধরা পড়ল সেটা হলো—একজন কমান্ডো যে তার এতটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এটা রাসনা মেয়েটা দেখতে পায়নি আবার কমান্ডো লোকটা রাসনার দিকে এতটাই মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে যে সে আরিয়ানকে খেয়াল করেনি। অন্যদিকে এই কমান্ডোর খানিক পেছনেই আরেকটা ছায়ার অবয়ব টের পাওয়া যাচ্ছে পরিষ্কার। আরিয়ানের মস্তিষ্ক চলছে ঝড়ের বেগে, এই কমান্ডো লোকটা পুরো মনোযোগের সঙ্গে রাসনাকে ‘একোয়ার’ করাতে ব্যস্ত—কারণ তার ঠিক পেছনেই একজন ব্যাকআপ আছে। নিয়ম হলো, সে রাসনাকে অজ্ঞান করেই এদিকে এগোবে আরিয়ানকে ধরার জন্যে, আর মেয়েটাকে সেই সময়ে টেইকওভার করবে পেছনের কমান্ডো কিংবা তাদের পেছনে থাকা আরেকজন। কিন্তু আরিয়ান তো সেটা হতে দিতে পারে না।

ক্ষণিকের জন্য ঝড়ের বেগে ভাবনাগুলো মাথায় খেলে যেতেই আরিয়ান করণীয় ঠিক করে ফেলল। কমান্ডো লোকটার অস্ত্রের বাট ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, আরিয়ান এগোতে এগোতেই লাফ মারল লোকটার দিকে। হাওয়ার ওপরে কয়েক ফিট এগিয়ে ওর চওড়া কাঁধটা ল্যান্ড করল কমান্ডো লোকটার ভেস্ট আর ট্যাকটিকেল প্যান্টের সংযোগস্থলের অ্যাবডোমিনাল এরিয়ায়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আরিয়ান জানে এসব ফুল প্রুফ কমান্ডো পোশাকে যে-কয়টা দুর্বল এবং অরক্ষিত পয়েন্ট থাকে এই জায়গাটা তার ভেতরে অন্যতম। হাওয়ার ওপর দিয়ে বাউলি কেটে শক্তিশালী কাঁধ লোকটার পেটে বাড়ি মারতেই আরিয়ান মাস্কের ভেতর থেকেও পরিষ্কার শুনতে পেল লোকটার মুখ দিয়ে হুক জাতীয় একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। আরিয়ান এত জোরে লাফ দিয়েছে যে লোকটার পেটের সব বাতাস তো বেরিয়ে গেছেই সেই সঙ্গে এত জোরে ধাক্কা লেগেছে—ও সহ লোকটা প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল পেছনে দ্বিতীয় কমান্ডোর গায়ের ওপরে। তিনজনে মিলে প্রায় তালগোল পাকিয়ে ছিটকে পড়ল সিঁড়ির গোড়ায়। তিনজনের ভেতরে সম্ভাব্য ধাক্কার জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত ছিল আরিয়ানই কিন্তু কমান্ডো লোকটাকে আঘাত করার সময়ে তার ওপরে ওঠানো অস্ত্রের বাটটা রিফ্ল্যাক্সের বশেই ওর কাঁধের ওপরে নেমে এসেছিল, সেই সঙ্গে তীব্র ধাক্কা আর পতনের চোটে মাটিতে পড়ে ওর মনে হলো—ওঠা তো দূরে থাক নড়তেই পারবে না। ওর ঠিক নিচেই পড়েছে সেই প্রথম কমান্ডো, পুরোদস্তুর ভারী পোশাক থাকার পরও লোকটা পুরনো সিঁড়ির প্রথম ধাপে এমন বেমক্কাভাবে পড়েছে, তার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে কি না কে জানে। কোনোমতে লোকটার ওপর থেকে সিঁড়ির নিচের মেঝেতে নেমে এলো আরিয়ান। সোজা হয়ে চোখ খুলে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারল না হাতুড়িসদৃশ যে জিনিসটা নেমে আসছে সেটা আসলে কি, স্রেফ সহজাত প্রবৃত্তির বশেই খানিকটা সরার চেষ্টা করতেই ভারী জিনিসটা নেমে এলো ওর ওপরে। ক্ষণিকের জন্যে আরিয়ানের মনে হলো, কেউ ওর ফুসফুস আর পেটে পাইপ লাগিয়ে ড্রেজিং করে সব বাতাস শুষে নিয়েছে, সেই সঙ্গে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মেঝে আর পিঠের চামড়ার ভেতরে। আসলে মাটিতে পড়ে থাকা আরিয়ানের পেটের ওপরে ভারি বুট পরা পায়ে লাথি মেরেছে ওদের সঙ্গে বাইরে ছিটকে পড়া দ্বিতীয় কমান্ডো লোকটা। ওদের সঙ্গে বাইরে ছিটকে পড়লেও তেমন আহত হয়নি সে কিংবা আঘাতও পায়নি। তাই ওদের আগেই নিজেকে সামলে উঠে প্রথম সুযোগেই আঘাত করেছে মাটিতে পড়ে থাকা আরিয়ানকে।

কিন্তু তবুও আঘাত যতটা হওয়ার কথা ছিল ততটা হয়নি কারণ ওর পেটে লাথি মারলেও সেখানে থাকা ল্যাপটপটা আঘাতের তীব্রতা কমিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। দ্বিতীয় কমান্ডো লোকটাও লাথি মেরে খানিক অবাক হয়ে গেছে আরিয়ানের এমন শক্ত পেট দেখে। কিন্তু অবাক হলেও সে থামল না, প্রথম আঘাত সেভাবে কাজে লাগেনি দেখে এবার সোজা পা তুলল ওর মুখ বরাবর। শোয়া অবস্থাতেই চট করে একপাশে খানিকটা সরে গেল আরিয়ান। সেই সঙ্গে ধরে ফেলল লোকটার শূন্যে থাকা পা। সেটাকে উলটোদিকে ঠেলে দিতেই আবারো ভারসাম্য হারাল লোকটা। যত কষ্টই হোক এভাবে মাটিতে পড়ে থাকলে মরতে হবে, এটা খুব ভালোই বুঝতে পারছে আরিয়ান। লোকটা খানিকটা সরে যেতেই হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল ও। লোকটাও ততক্ষণে ভারসাম্য হারিয়ে সোজা হয়েছে, আরিয়ানের দিকে ফিরে তাকাতেই শার্টের নিচ থেকে বের করে আনা ল্যাপটপটা দিয়ে লোকটার অস্ত্র ধরা হাতে সর্বশক্তি দিয়ে বাড়ি মারল ও। লোকটাও অস্ত্র হারাল সেই সঙ্গে আরিয়ানেরও হাত থেকে ছুটে গেল ল্যাপটপটা। মুহূর্তের জন্যে দুজনেই তাকিয়ে রইল একে-অপরের দিকে।

পরমুহূর্তেই প্রায় একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল একে অপরের ওপরে। ওয়ান টু ওয়ান ফাইটের কিছু বেসিক বিষয় আছে। যেমন কমান্ডো লোকটা পুরোপুরি অস্ত্রে সজ্জিত কিন্তু সে নিজের শরীরে অনেক ওজন বহন করছে, আবার আরিয়ান একেবারে অরক্ষিত কিন্তু ও অনেকটাই হালকা। প্রথম দফা আক্রমণে দুজনেই অনুভব করল প্রতিপক্ষ শক্তিশালী, দুজনেরই প্রায় একই ট্রেনিং আছে এবং দুজনেই এসব বেসিক জানে। আর তাই মারামারিটা হলো অনেকটাই নিয়মের বাইরে আর বুনো জন্তুর মতো।

কমান্ডোটা চেষ্টা করে যাচ্ছে, কোনোমতে হয় নিজের কোনো অস্ত্র বের করে এনে আরিয়ানকে মাটিতে পেড়ে ফেলার জন্যে, আর আরিয়ানের লড়াইটা হচ্ছে কোনোমতে পায়ের ওপরে টিকে থেকে লোকটাকে কাবু করার চেষ্টা করা। কিন্তু বললেই তো আর হলো না। একজন সর্বতো প্রস্তুত কমান্ডো আর অপ্রস্তুত এক্স মিলিটারির লড়াইটা খুব বেশি স্থায়ী হওয়ার কোনোই কারণ ছিল না। আর হলোও তাই, সরাসরি কাবু করতে না পারলেও কিছুক্ষণের ভেতরেই সিঁড়ির গোড়াতেই আরিয়ানকে বুকের ওপরে চেপে ধরে ওর গলায় কনুই দিয়ে চেপে ধরে ছুরি বা পিস্তল বের করার জন্যে হাত বাড়াল কমান্ডোটা। আরিয়ান মরিয়া হয়ে বুকে ঘুসি মারল লোকটার। শক্ত ভেস্টের ওপরে ঘুসি মেরে উলটো হাতে ব্যথা পেয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল। প্রাণপণ টানাহেঁচড়ার ভেতরে থাকার পরও আরিয়ান দেখল ওর অসহায় অবস্থা দেখে লোকটা মাস্কের ভেতরেও বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছে। আরিয়ান হাত বাড়িয়ে লোকটার মাস্ক আর ভেস্টের ফাঁকে যে-জায়গাটা তুলনামূলক অরক্ষিত সেখানে ঘুসি মারার চেষ্টা করল, তাতেও কিছুই হলো না। উলটো লোকটা ওর গলায় নিজের কনুইয়ের চাপ বাড়িয়ে ওর কণ্ঠার হাড় ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল। গলায় চাপ আরো বাড়তেই আরিয়ান আরো মরিয়া হয়ে উঠল, একহাতে নিজের পিস্তলটা বের করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে হঠাৎই বুদ্ধিটা এলো মাথায়। জোরাজুরি করতে করতেই আচমকা নিজের শরীরটা একেবারে ঢিলা করে দিল আরিয়ান। ফলে লোকটা ওকে চেপে ধরা অবস্থাতেই নিজের ভারসাম্য খানিকটা হারিয়ে ফেলল, এই সুযোগে ডাঙায় তোলা মাছের মতো নিজের শরীরটাকে বাউলি মারল। ওর শরীরের ওপরে কমান্ডোর ভারী দেহটা কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার শরীরটাকে বাউলি মারতেই ওর পা জোড়া অনেকটা আলগা হয়ে গেল। হুক এক তীব্র শক্তিতে উলটো দিক থেকে পা জোড়াকে নিয়ে এলো লোকটার ঘাড়ের ওপরে, হুকের মতো পা-দুটোকে আটকে ফেলে উলটোদিক থেকে টান মারল সর্বশক্তিতে। পরম স্বস্তির সঙ্গে অনুভব করল, প্রথমে ওর শরীরের ওপরে লোকটার শরীরটা আলগা হয়ে গেল, তারপর পায়ের তীব্র টানে গড়িয়ে গেল উলটো দিকে। আরিয়ানের ওপর থেকে গড়িয়ে গিয়ে লোকটা পড়ল সিঁড়ির প্রথম ধাপের ওপরে, কোনোমতে শরীরটাকে সোজা করে ভারসাম্য ফিরে পাবার আগেই আরিয়ান ডান পায়ে লাথি মারল লোকটার বুকে। শক্ত লাথি খেয়ে ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল লোকটা। গলা ডলতে ডলতে কোনোমতে উঠে বসে দেখতে পেল, লোকটা সিঁড়ির গোড়ায় বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়ে আছে। নড়ছে খুব সামান্য, নিজের মাথাটাকে সোজা করে ফিরে তাকানোর আগেই পিঠের ওপরে ভয়ানক এক লাথি খেয়ে নিজেই সিঁড়ির ওপরে ছিটকে পড়ল আরিয়ান। পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই বলের মতো গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়ল সিঁড়ির গোড়ায় সেই কমান্ডোর ঠিক পাশেই। মাটিতে পড়েও পরিষ্কার

অনুধাবন করতে পারল কানের পাশ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। আবছাভাবে দেখতে পেল ধোঁয়া আর অন্ধকারের ভেতরে একটা ছায়ামূর্তি নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। সেই প্রথম কমান্ডো।

মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল আরিয়ান। যত আহত হোক কিংবা ব্যথা পাক এখন থেমে গেলে স্রেফ মরতে হবে। কিন্তু সে উঠে বসার আগেই মাজা বরাবর ভারী বুটের লাথি খেয়ে দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেল তারপর গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। চোখ তুলে দেখতে পেল মৃত্যুদূতের মতোই এগিয়ে আসছে প্রথম কমান্ডো। একাধিকবার যেভাবে দুই কমান্ডো ওকে ধরার চেষ্টা করেছে তাতে ওর মনে হচ্ছিল লোকগুলো ওকে বা রাসনাকে আজ রাতে মারতে চায়নি। তা না হলে বারবার ওরা গুলি না করে আহত করতে চাইতো না কিংবা গলায় চেপে ধরত না। কিন্তু ওরা সম্ভবত ওর কাছ থেকে এতটা প্রতিরোধও আশা করেনি। আর তাই নিজের সঙ্গীর পরিণতি দেখে সচেতন হয়ে গেছে। আর তাই আরিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে সোজা অস্ত্র তুলল ওর দিকে, অস্ত্র তোলার ধরন দেখেই আরিয়ান অনুধাবন করতে পারল লোকটা গুলি করতে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করতে চাইলেও অস্ত্রের কালো নলের দিকে স্থাণুর মতো তাকিয়ে রইল ও,

সব খেলা সাঙ্গ হতে চলেছে।

খোদ মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে শেষবারের মতো এই কথাটাই মনে হলো আরিয়ানের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *