॥ সাত ॥
পরদিন সকাল থেকেই কাজে যোগ দেবে, সব ঠিক হয়ে গেল। প্রথম দু’মাস হেড অফিসে, তারপর থেকেই ব্রাঞ্চ শপগুলিতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হবে। প্রথম কাজ স্টক মেলানো। কোন দোকানে কত ওষুধ
সাপ্লাই করা হয়েছে, স্টকে কত আছে এবং পরদিন আর কত সাপ্লাই করতে হবে তার হিসেব রাখা ও রিপোর্ট দেওয়া।
পরদিনই হাসপাতালের চাকরিটা বৈদ্যনাথ ছেড়ে দিল। যতদিন না বাসা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে ততদিন হাসপাতালে থাকার অনুমতি সে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট-এর কাছ থেকে চেয়ে নিল। সকালে যথারীতি ডাঃ রায়ের বাড়িতে বেলা ন’টা পর্যন্ত থেকে চলে গেল ডালহৌসী স্কোয়ারে। অফিসে যেতেই করনক্ সাহেব তাকে বসবার টেবিল-চেয়ার দেখিয়ে দিল, কাগজ- পত্র বুঝিয়ে দিল। মুখে সর্বদাই একটা গম্ভীর বিরক্তি ভাব।
এক ঘণ্টাও পার হয়নি, হঠাৎ বড় সাহেবের খাস বেয়ারা এসে বৈদ্যনাথকে সেলাম ঠুকে বললে—‘সাব আপকো বোলায়া।’
বৈদ্যনাথ তাড়াতাড়ি বড় সাহেবের ঘরে ঢুকতে তিনি বৈদ্যনাথের হাতে একটা টাইপ করা চিঠি দিয়ে বললেন—‘পড়ে দেখো।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। লেখা আছে, বেতন মাসে ষাট টাকা আর কনভেয়েন্স পনের টাকা। অর্থাৎ টাকার পরিবর্তে একটি অল সেকশন ট্রামের টিকিট। চিঠিটা পড়া শেষ হতেই সাহেব বললেন—‘ইজ ইট অলরাইট?’
সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের সীট-এ ফিরে এসে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বৈদ্যনাথ, ভাবতে লাগল তার ভাগ্য পরিবর্তনের কথা। একে একে অনেক সুখস্বপ্নই তার মনে উদয় হল। এবার সে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করবে। অপমান-জর্জর জীবন থেকে মাকে উদ্ধার করে নিজের কাছে এনে রাখবে। এসব স্বপ্নের মূলে রয়েছেন যিনি, সেই ডাক্তার রায়ের কথা বার বার মনে হতেই আবেগে তার দুই চোখ আপ্লুত হয়ে উঠছে।
হঠাৎ সেলস্ ম্যানেজার করনক্ বৈদ্যনাথকে ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢুকেই দেখে সাহেবের মুখ রাগী বুলডগের মতো খিঁচিয়ে আছে।
বৈদ্যনাথকে সে বললে—‘তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কপি এইমাত্র পেলাম। ডাঃ রায়ের লোক বলেই ম্যানেজিং ডিরেক্টর তোমাকে আশাতিরিক্ত মাইনে দিয়ে রেখেছেন। কারণ ডাঃ রায় হচ্ছেন আমাদের কোম্পানির একজন ডিরেক্টর। তোমাকে যে বেতন দেওয়া হয়েছে গ্রাজুয়েটরাও তা পায় না। তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি, ডাঃ রায়ের লোক বলে তুমি অ্যাডভানটেজ নেবার চেষ্টা কোরো না।’
বৈদ্যনাথ বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল করনক্-এর কথা শুনে। আর এসব কথা চাকরির প্রথম দিনেই তাকে এমন চড়া মেজাজে বলার অর্থ কী?
বৈদ্যনাথের মেজাজ তখন একটু চড়েছে। গম্ভীর হয়ে বললে—‘আমার কাজে যদি আপনি সন্তুষ্ট না হতে পারেন, আমাকে ছাড়িয়ে দেবেন। ডাঃ রায়ের নাম এর সঙ্গে জড়াবেন না।’
অবাক হয়ে সাহেব বললে—‘ইজ দ্যাট সো! বেশ একটু শর্ট টেম্পারড মনে হচ্ছে।’ পরমুহূর্তেই রীতিমত ধমকে উঠলেন—‘যাও, নিজের সীট-এ বসে কাজ করে গে যাও। আমাদের কোম্পানির ওষুধের প্রাইস লিস্টটা সম্পূর্ণ মুখস্থ করতে হবে। পনেরো দিন বাদে আমি পরীক্ষা নেব।’
বৈদ্যনাথ নিজের জায়গায় চলে এল বেশ কিছুটা বিষন্ন মনেই। ওষুধের নাম-দাম ঠিকুজিকুষ্ঠি সব বৈদ্যনাথের আগেই জানা। হাসপাতালে এই কাজই করতে হয়েছে তিন বছর ধরে। সুতরাং করনক্ সাহেবের ওষুধের দাম মুখস্থর পরীক্ষা নেবার ধমকটা ওর কাছে হাস্যকর ব্যাপার। খারাপ লাগছিল ওর মনোভাব দেখে।
এই বিরুদ্ধ মনোভাবের কারণ খুঁজে পেতে বৈদ্যনাথের দেরী হল না। ডিপার্টমেন্ট-এর বড়বাবু হচ্ছে করনকের একান্ত অনুগত ও বশংবদ। যখনই নতুন লোক নেওয়া হয়েছে সে-লোক বড়বাবু সরবরাহ করেছেন করনকের সঙ্গে পরামর্শ করে, বড় সাহেব কোনোদিন আপত্তি করেননি। বৈদ্যনাথের বেলায় এই রীতির প্রথম ব্যতিক্রম, তার উপর সে ডাঃ রায়ের লোক।
সকালে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়ি যায়। চিঠিপত্র গুছিয়ে ফাইল করে রাখা বা সদ্য-আসা জার্নালগুলি সামনে রেখে পুরোনোগুলি অন্যত্র সরিয়ে রাখা ওর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। মাঝে মাঝে ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করেন—‘কী হে, চাকরিতে মন বসেছে তো?’
ইতিমধ্যে বৈদ্যনাথ বেলেঘাটা অঞ্চলে দু’ঘরওয়ালা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে পঁচিশ টাকা দিয়ে। ডাঃ রায় আরো পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে ত্রিশ টাকা করেছেন, ওষুধের কোম্পানীর কাজে মাইনে পায় ষাট টাকা, সেই সঙ্গে অল সেকশন ট্রামের টিকিট। সুতরাং বৈদ্যনাথের আর কোনো অভাব-অভিযোগ নেই, এবার মাকে সে কলকাতায় স্বচ্ছন্দে এনে রাখতে পারে। মা’র কাছে যখনই বৈদ্যনাথ এ প্রস্তাব পাঠায় মা চিঠির উত্তরে জানান বৈদ্যনাথকে একবার দেশে যেতে। অনেক বছর দেখেননি, ছেলেকে দেখবার তো সাধ যায়। মামার এখন মায়ের প্রতি খুব সদয়। মাসে মাসে টাকা যাচ্ছে, সে টাকার বেশির ভাগই মা তাঁর ভাইদের হাতে তুলে দেন। সুতরাং শহরের ডামাডোলে মাকে ওঁরা একা থাকতে দিতে চান না। ছেলে তো সকাল থেকে রাত্রি চাকরি করবে। মা সারাদিন একা বাড়িতে পড়ে থাকবে, সে হতেই পারে না। বৈদ্যনাথের মামা শুনেছে কলকাতায় চোরেরা দিনদুপুরে বাড়িতে ঢুকে লোক খুন করে পালিয়ে যায়।
একদিন সকালে ডাঃ রায় বৈদ্যনাথকে বললেন—‘কী হে, তুমি না বলেছিলে মাকে কলকাতায় নিয়ে আসবে, তার কি হল?’
বৈদ্যনাথ মাথা চুলকে কাঁচুমাচু হয়ে বললে—‘মা তো এখন কিছুতেই আসতে চাইছেন না, উল্টে এক ফ্যাসাদ বাঁধিয়ে বসেছেন।’
‘ফ্যাসাদ আবার কী। কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করেছো, ভাল চাকরি করছে—এর মধ্যে ফ্যাসাদটা কোথায়।’
খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে সলজ্জ বৈদ্যনাথ বললে—‘মা বারবার লিখছেন সামনের বৈশাখ মাসে একবার দেশে যেতে। মা’র বয়েস হয়েছে, একা-একা আর ভাল লাগছে না। একটি পাত্রী দেখেছেন, পছন্দও হয়েছে খুব। আমাদের জানাশোনা ঘরের মেয়ে।’
উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন ডাঃ রায়। বললেন—‘তাই তো হে, তুমি যে এখন একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার উদ্ধারকারী উপযুক্ত পাত্র হয়ে উঠেছে, সেটা তো আমার খেয়াল ছিল না। খুবই ভাল কথা, তোমার মা ঠিক কথাই লিখেছেন। এই বয়সেই তো বিয়ে করা উচিত। তাহলে আর কালবিলম্ব না করে এক মাসের ছুটি নিয়ে চলে যাও।’
বৈদ্যনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে। ডাঃ রায় আত্মস্থ হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন—‘বিয়ে তো করতে যাচ্ছ, খরচ আছে তো। টাকাপয়সার কী ব্যবস্থা করেছে। তোমার কাছে বা তোমার মা’র কাছে কিছু থাকবার তো কথা নয়।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘মাকে আমিও সে-কথা লিখেছিলাম এবং আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার কথাও জানিয়েছিলাম। কিন্তু কন্যাপক্ষ আর অপেক্ষা করতে রাজী নন বলে মা ধারকর্জ করেই কাজটা বৈশাখ মাসেই চুকিয়ে ফেলতে চান।’
ডাঃ রায় অবাক হয়ে বৈদ্যনাথের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন—‘ধার-দেনা করে ছেলের বিয়ে দেবেন! এটা কোনো কাজের কথা হল?’
বৈদ্যনাথ উৎসাহিত হয়ে বললে—‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার কথা উল্লেখ করে মাকে লিখে দিই এ-সব হাঙ্গামা না করার জন্যে।’
বৈদ্যনাথের কথায় ডাঃ রায় কোনো সায় দিলেন না। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন—‘শ পাঁচেক টাকা হলে খরচপত্ৰ কুলিয়ে যাবে বলে কি তোমার মনে হয়?’
বৈদ্যনাথ বললে—‘আমার যদিও কোনো ধারণা নেই, তবে এ টাকায় কুলিয়ে যাওয়া তো উচিত।’
‘ঠিক আছে। তুমি আজই ছুটির দরখাস্ত করে দাও। দেশে যাবার সময় আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে যেয়ে। এতে যদি কুলিয়ে যায় ভালো, না কুলোলে চিঠি লিখো, পাঠাব।’