একটি পেরেকের কাহিনী – ৬

॥ ছয় ॥

বেশ কয়েক মাস কেটে যাবার পর ডাঃ রায়ের লেখাও কমে আসতে লাগল, লিখবার সময়ও পেতেন না একেবারেই। হাসপাতালে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, খুব কঠিন কেস না হলে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বড় বেশি একটা করেন না। শুধু সকাল বেলায় বাড়িতে রুগী দেখা আগের মতনই আছে। রাজনীতির সঙ্গে ডাঃ রায়ের পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল চিত্তরঞ্জন দাশের আমল থেকেই, এখন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন। বাড়িতে দেশ-নেতাদের নিত্য আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেল! আসছেন জওহরলাল, আসছেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ, আসছেন সরোজিনী নাইডু। মহাত্মা গান্ধীও কখনো কখনো আসছেন। সেই সঙ্গে সাহেবসুবার আনাগোনা বেড়ে গেল। সব দল আর সব সম্প্রদায়ের মধ্যমণি হলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়।

বৈদ্যনাথ প্রতিদিন সকালে নিয়মিত আসে কিন্তু কাজ কিছুই নেই। লেখা নকল করার আর প্রয়োজন নেই, ডাঃ রায়ের লেখার সময় কোথায়? লাইব্রেরী ঘরের বই আর কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, সে তো পনেরো মিনিটের কাজ। কিন্তু মাসে মাসে মাইনে সে ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে। কাজ নেই, অথচ মাইনে নেওয়া!

বৈদ্যনাথের আত্মসম্মানে ঘা লাগল। সে-কথা ডাঃ রায়কে সে নিজের মুখে বলবে সে ফুরসত কোথায়!

মাস দুই এ-ভাবে কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন বৈদ্যনাথের খোঁজ পড়ল। ডাঃ রায় রীতিমত ধমকের সুরে বললেন—‘তুমি দু’মাস ধরে মাইনে নিচ্ছ না, কী ব্যাপার বল তো।’

বৈদ্যনাথ বললে—‘কাজ কিছুই নেই, শুধু বসে বসে মাইনে নেব কেন?’

‘কাজ নেই মানে? কে বলল কাজ নেই। রোজ নিয়মিত অ্যাটেন্ডেন্স তো দিয়ে যাচ্ছ।’ রুষ্ট হয়েই বললেন ডাঃ রায়।

একটু থেমে গম্ভীর হয়ে বৈদ্যনাথ বললে—‘আপনার বাড়ি রোজ আসি আমার নিজের তাগিদে, তার সঙ্গে চাকরির কোনো সম্পর্ক নেই।’

‘এই দু’মাস তোমার মাকে তুমি টাকা পাঠাওনি?’

‘পাঠিয়েছি, তবে কম। মা লিখেছেন, তাতে ওঁর কোনো অসুবিধা হবে না, হাতে কিছু টাকা আগেই জমেছে।’

‘খুব অন্যায় করেছে বৈদ্যনাথ। এ-কথা তোমার আগেই আমাকে বলা উচিত ছিল।’

‘বলব কখন স্যার। আপনি তো সব সময় এখন রাজনীতি আর লোকজন নিয়েই ব্যস্ত।

ডাঃ রায় চুপ করেই কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর নরম কণ্ঠে বললেন—‘এ সব অভিমানের কথা এখন থাক। যে দু’মাসের মাইনে নাওনি তা আজই নিয়ে নিও।’

কোনো প্রতিবাদ না করে বৈদ্যনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ডাঃ রায় আবার বললেন—‘আচ্ছা বৈদ্যনাথ, তুমি না বলেছিলে তোমার মাকে কলকাতায় এনে রাখবে। তার জন্যও তো কোনো চেষ্টা দেখছি না। ব্যাপার কি বলো তো?’

বৈদ্যনাথ বললে—‘সে ভার তো আপনিই নিয়েছেন, আপনিই আমাকে বলেছিলেন তার জন্যে ব্যস্ত না হতে।’

‘তা না-হয় বলেছিলুম। তোমারও তো উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া আমার তো বয়েস হয়েছে, সব কথা কি আর মনে থাকে?’

চোখ দুটি মাটির দিকে রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বৈদ্যনাথ বলল— ‘আমার বাবাকে আমি কোনোদিন চোখে দেখিনি। কিন্তু আপনাকে দেখার পর থেকে সে দুঃখ আর আমার নেই। আপনি আমার পিতৃতুল্য। আমি সব রকম কাজ করার জন্য প্রস্তুত, শুধু আপনার নির্দেশ চাই।’

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ডাঃ রায় বললেন—‘ওহে বৈদ্যনাথ, আমি তো চিরকাল থাকব না, আমারও যাবার সময় হয়েছে। তাছাড়া হাসপাতালে তুমি যে চাকরি করছ তাতে কতটাই বা আর উন্নতি করতে পারবে। তার চেয়ে বাইরের কোনো আপিসে তোমার উপযুক্ত কী কাজ আছে খোঁজ-খবর নাও। আমাকেও জানিও, আমার সঙ্গে যদি জানাশোনা থাকে আমিও বলে দেখতে পারি।’

বৈদ্যনাথ খুশী হয়ে বিদায় নেবার অনুমতি চাইতেই ডাঃ রায় বললেন—‘তা বলে আমার বাড়ির কাজে কিন্তু ফাঁকি দেওয়া চলবে না। রোজ আসা চাই। কাগজ, চিঠিপত্র, বই ইত্যাদি আগে যেমন গুছিয়ে রাখতে সেরকম রাখবে। তাছাড়া সকালে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য যে-সব লোকজন আসে তাদের অ্যাটেন্ড করাটাও তোমার আরেকটা কাজ হল।’

পরদিন থেকে সকালে এসেই বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়িতে যতগুলি খবরের কাগজ আসে তার ওয়ান্টেড কলমটা মনোযোগ দিয়ে দেখে। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট টাকা মাইনের চাকরিতে অন্তত গ্র্যাজুয়েট হওয়া চাই। বৈদ্যনাথ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।

দু-চার দিন বাদেই ডাঃ রায় বৈদ্যনাথকে ডেকে বললেন—‘ওহে বৈদ্যনাথ, বিলিতি কোম্পানির ওষুধের কারখানায় কাজ করতে পারবে?’

উৎসাহিত হয়ে বৈদ্যনাথ বলল—‘কেন পারব না? আপনি যে-কাজ বলবেন সে-কাজই আমি করতে প্রস্তুত।’

‘ঠিক আছে, তাহলে তুমি আজ হোক কাল হোক ডালহৌসী স্কোয়ারে ওদের হেড অফিসে চলে যাও বেলা সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে আমার বলা আছে, আমার নাম করে দেখা করলেই হবে।’

ডাঃ রায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বৈদ্যনাথ সোজা চলে গেল ডালহৌসী। এক্ষেত্রে কালক্ষেপ সমীচীন নয়। আপিসে ঢুকে বেয়ারাকে বলল ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জানাতে যে, ডাঃ রায়ের কাছ থেকে একজন লোক এসেছে— দেখা করতে চায়।

বেয়ারা গিয়ে সংবাদ দেবার সঙ্গে সঙ্গে এক প্রৌঢ় ইংরেজ কামরা থেকে এসে সমাদরের সঙ্গে তাকে ঘরে নিয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যনাথের মনে পড়ে গেল সেই সেদিনের কথা, যেদিন ডালহৌসী স্কোয়ারের এমন কোনো আপিস বাকী ছিল না যার সিঁড়িতে বৈদ্যনাথ কপাল ঠোকেনি। দেখা করা দূরের কথা, রাস্তার কুকুর-বিড়ালের তো বিতাড়িত হয়েছে।

কামরায় ঢুকেই সাহেব বললে—‘আই হ্যাভ হার্ড এভরিথিং অ্যাবাউট ইউ ফ্রম ডক্টর রয়। তোমার অনেস্টি আর ইনটিগ্রিটির খুব প্রশংসা কর-ছিলেন! অ্যাট দি সেম টাইম আমাকে বলেও দিয়েছেন তোমাকে কোনো হেভী ওয়র্ক না দেবার জন্যে, ইওর হেলথ ওণ্ট পারমিট।’

বৈদ্যনাথ বাধা দিয়ে বললে—‘ডাঃ রায় আমাকে পুত্রের মতো স্নেহ করেন; তাই এ-কথা তিনি বলেছেন। আমার হেলথ এখন ভালই এবং যে-কোনো স্ট্রেনুয়স কাজ করতে আমি প্রস্তুত।’

সাহেব মৃদু হেসে বললেন—‘দ্যাট কান্‌ট্ বী মিস্টার বোস, ডক্টরস্‌ অ্যাডভাইস তোমাকে মেনে চলতেই হবে।’

বৈদ্যনাথ চুপ করে রইল। ওর যা বলবার বলেই দিয়েছে, এখন সাহেবের যা করণীয় তিনি করবেন। তবে চাকরি যে এখানে একটা ওর জুটবেই তাতে আর সন্দেহ রইল না। বৈদ্যনাথকে চিন্তিত দেখে সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললে—‘প্লীজ টেল মি, হোয়াট নেচর অব ওয়র্ক ইউ প্রেফার টু হ্যাভ। কী ধরনের কাজ তোমার পছন্দ?’

বৈদ্যনাথের বহুদিনের বাসনা, একটা অল সেকশন ট্রামের টিকিট নিয়ে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়ায়। কালীঘাট থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত প্রতিদিন দু’বেলা যখন ও হেঁটে আসা-যাওয়া করত, অনেক আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষাই তখন ওর মনে প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, ট্রামের অল সেকশন টিকিট পেলে ইচ্ছেমতো সে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়াবে। এই সুযোগে সে সাহেবকে বলে বসল—‘আমার অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন তো কিছুই নেই, খাতা-পেনসিল নিয়ে লেখালেখির কাজে উপযুক্ত আমি নই। ফীল্ড ওয়র্ক যদি কিছু থাকে সে কাজই আমার পছন্দ।’

উল্লসিত হয়ে সাহেব বললেন—‘দ্যাট্‌স্‌ ফাইন, আমি এখুনি বলে দিচ্ছি।’

ঠং করে টেবিলের ঘণ্টা বেজে উঠতেই বেয়ারা এসে হাজির। সাহেব বললেন—‘সেলস্‌ ম্যানেজার মিঃ করনক্‌ কো সেলাম দেও।’

একটু পরেই মাঝবয়েসী গোলগাল চেহারার এক সাহেব এসে কামরায় ঢুকে মাথাটা একটু নত করে বললে—‘গুড মনিং স্যার।’

সাহেব মুখ না তুলেই বললেন—‘মর্নিং, তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি— মীট মিস্টার বি বোস, ডক্টর রয়জ্‌, ক্যাণ্ডিডেট। স্পোক হাইলি অব হিম। সেলস্ ডিপার্টমেন্ট-এ ফীল্ড ওয়র্কের কাজ করবে। আ’ইল ফিক্স আপ হিজ স্যালারি লেটার অন।’

বৈদ্যনাথকে গুডলাক আর গুডউইস জানিয়ে সাহেব বললেন—‘ইফ ইউ উইশ, কাল থেকেই তুমি কাজে লেগে যেতে পার।’

ধন্যবাদের সঙ্গে সাহেবের কথায় সম্মতি জানিয়ে বৈদ্যনাথ সেলস্ ম্যানেজারের পিছন পিছন কামরা থেকে বেরিয়ে এল। সেলস্ ম্যানেজার মিঃ করনক্ যে একজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান, বৈদ্যনাথের তা বুঝতে দেরী হয়নি। চেহারা এবং ইংরিজি উচ্চারণের ধরনই তার পরিচায়ক। করনক্ সাহেব সঙ্গে করে ডিপার্টমেন্ট-এ নিয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর মুখে চোখে একটা বিরক্তির ভাব—এ আবার কোন্ আপদ এখানে এসে জুটল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *