একটি পেরেকের কাহিনী – ৪

॥ চার ॥

সাড়ে তিন মাস বৈদ্যনাথকে থাকতে হয়েছিল এই হাসপাতালে। এই সাড়ে তিন মাস হাসপাতালের জীবন বৈদ্যনাথকে আরেক মানুষে রূপান্তরিত করেছিল। ওয়ার্ডের প্রত্যেক রুগী থেকে শুরু করে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট, হাউস ফিজিসিয়ান, স্টাফ নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ড বয় সবার মায়ামমতা স্নেহত্ন অকুণ্ঠ এবং অযাচিত ভাবে পেয়ে নিঃসঙ্গ বৈদ্যনাথ মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার আর এক নতুন আস্বাদ পেয়ে ধন্য হল। তার একটা কারণও ছিল। ডাঃ রায় প্রতিদিন ওয়ার্ডে এসে বৈদ্যনাথের কাছে বেশি সময় কাটাতেন এবং শুক্রবার কোনরকম ত্রুটি যাতে না হয় সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন করে দিতেন। সবাই জানত এই রুগীর প্রতি ডাঃ রায়ের একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে এবং সে কারণেই সুপারিন্টেণ্ডেন্ট থেকে ওয়ার্ড বয় সবাই বৈদ্যনাথের বিশেষ যত্ন নিত।

হাসপাতালে যে লোকটি রুগীদের খাবার তদারক করে সে বয়সে বৃদ্ধ, বহুদিনের পুরোনো লোক। তার কাজ হচ্ছে, খাবার দেবার সময় রুগীদের সঙ্গে হেসে দু-চারটি মিষ্টি কথা বলা, আহারবিমুখ রুগীকে অনুরোধে উপরোধে কিছু খাওয়ানো। একদিন সে খাবার দিতে এসে বৈদ্যনাথকে বললে—‘তুমি তো বেঁচে গেলে ভাই। হাসপাতালের ডাক্তাররা তোমাকে দেখে যে-রোগ ঠাওরেছিল তাতে একটা পা অ্যামপুট করতে হত আর তা না করলেও পা-টা চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে যেত। ডা: রায়ের নজরে পড়েছিলে বলেই আজ আবার আগের মতো সুস্থ সবল হয়ে উঠলে। তুমি তো ভাগ্যবান।’

পরের দিন ডাঃ রায় রুগী পরীক্ষা করতে এসে বৈদ্যনাথকে দেখেই সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে বললেন—‘এ ছেলেটিকে তোমরা এখনো হাসপাতালে আটকে রেখেছ কেন? ওকে ছুটি দিয়ে দাও।’

সুপারিন্টেণ্ডেন্ট মাথা চুলকে বললেন—‘আমরা তো ওকে ছুটি দিয়েছি কিন্তু ও যেতে চাইছে না স্যার।’

অবাক হয়ে ডাঃ রায় বললেন—‘যেতে চাইছে না মানে! একটা বেড অকারণে তোমরা আটকে রাখবে?’

সুপারিন্টেণ্ডেন্ট নিরুত্তর। ডাঃ রায় আর কোনো কথা না বলে অন্য রুগীর দিকে এগিয়ে গেলেন। যেতে যেতে সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে বললেন— ‘তবে ওকে বলে দিও, যে-ল্যাবরেটরিতে ও কাজ করত সেখানে যেন ডিউটি বদলে নেয়। ওর পক্ষে দাঁড়িয়ে ল্যাবরেটরির কাজ করা আর উচিত হবে না।’

ডাঃ রায় রুগী দেখে চলে যেতেই সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট বৈদ্যনাথের কাছে এসে বললেন—‘শুনলে তো ডাঃ রায়ের কথা। এবার তাহলে তোমাকে বেড খালি করে দিতে হয়। ডাঃ রায় ফের যদি তোমাকে এখানে দেখেন তা হলে আমাদের ভীষণ বকাবকি করবেন।’

আকাশ ভেঙ্গে পড়ল বৈদ্যনাথের মাথায়। সে ভালো করেই জানে ওর চাকরি আর নেই। নতুন চাকরিতে ঢুকেই যার চার মাস কামাই হয় তার চাকরি থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবার ওকে মহানগরীর পাষাণ দেয়ালে দিনের পর দিন মাথা খুঁড়ে মরতে হবে চাকরির চেষ্টায়।

বৈদ্যনাথকে চিন্তান্বিত ও বিমর্ষ দেখে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট সহানুভূতির সঙ্গে বললেন—‘তোমার এত চিন্তা করবার কি আছে। স্বয়ং চিন্তামণি যখন তোমার উপর প্রসন্ন তখন তাঁর এক কথায় তোমার একটি চাকরি তো আমাদের এই হাসপাতালেই অনায়াসে হয়ে যেতে পারে। অনেক রকমের কাজই তো এখানে আছে।’

কথাটা বৈদ্যনাথের খুবই মনে ধরল। এই হাসপাতালের খাওয়া-দাওয়া যে-রকম ভালো আর স্টাফদের সঙ্গে ওর যে সম্পর্ক এই চার মাসে গড়ে উঠেছে তাতে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে ওর কষ্ট হবে বৈকি। সুপারিন্টেণ্ডেট বৈদ্যনাথকে পরামর্শ দিলেন ডাঃ রায়কে নিজের মুখে বলতে। তবে হাসপাতালে রুগী দেখতে আসবার সময় বলে লাভ হবে না। ওয়ার্ড ভিজিট করার সময় রোগ-সংক্রান্ত নিতান্ত প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা কখনই বলেন না, পছন্দও করেন না। সুতরাং সকালবেলা ন’টার মধ্যে ওঁর বাড়ি গিয়ে দেখা করাই হচ্ছে প্রকৃষ্ট উপায়।

বৈদ্যনাথ মুহূর্তের মধ্যে ওর কর্তব্য স্থির করে ফেললে। পরদিন সকালে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে গেল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ডাঃ রায়ের বাড়ি। ঢুকতে গিয়েই কোলাপসেবল্‌ গেট-এর কাছে দারোয়ান আটকালে।

‘কেয়া মাঙ্গতা?’

‘ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘ছিলিপ লাগাও।’ একটা পেনসিল আর ভিজিটরস্ স্লিপ দারোয়ান সামনে এগিয়ে দিল। বৈদ্যনাথ ইংরিজিতে লিখল—‘Baidyanath Bose of Carmichael Hospital.’

স্লিপ ভিতরে চলে গেল, কিন্তু ডাক আর আসে না। গেট-এর সামনের ফুটপাথে অধৈর্য হয়ে পায়চারি করতে লাগল বৈদ্যনাথ। ন’টা বাজতেই ডাক্তার রায় বেরিয়ে গেলেন, দেখা আর হল না। পরের দিন আবার গেল বৈদ্যনাথ, আবার স্লিপ লিখল, ডাক এল না। সেদিনও যথারীতি কাঁটায় কাঁটায় ন’টা বাজতেই বেরিয়ে গেলেন তিনি।

বৈদ্যনাথ বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগল। ডাক্তার রায় দিনের পর দিন তাকে সযত্নে দেখেছেন, সস্নেহে কথা বলেছেন, অথচ আজ তিনি তাকে এ-ভাবে উপেক্ষা করলেন কেন! গোলমালটা হয়েছিল অন্যত্র। ভিজিটরস্ স্লিপ-এ ‘বিজনেস’ বলে যে-কথাটা লেখা থাকে সেখানে বৈদ্যনাথ কিছুই লেখেনি, লিখবেই বা কি করে! ‘চাকুরী-প্রার্থী’ কথাটা কি লেখা যায়? ও মুখেই বলা চলে। কিন্তু ঐটেই হয়েছিল কাল। দারোয়ান জিপ নিয়ে ডাঃ রায়ের অ্যাসিস্টেন্ট-এর হাতে দেয়, ‘বিজনেস’-এর অংশ ফাঁকা দেখে সে-স্লিপ চাপাই থাকে। এতটা তো আর বৈদ্যনাথের জানবার কথা নয়।

ডাঃ রায়ের তখন নিয়ম ছিল প্রতিদিন সকালে বাড়িতে রুগী দেখা।

পরদিন সকালে ডাঃ রায় যখন বাড়িতে রুগী দেখছেন সেই সময় এল বৈদ্যনাথ। আজ সে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এসেছে, যে-করে হোক দেখা করবেই। গেট-এর দারোয়ান কী একটা কাজে অন্যত্র গিয়েছে, সেই ফাঁকে ঢুকে পড়ল বৈদ্যনাথ। যে-ঘরে রুগীরা বসে আছে সেই ঘরেরই এক কোণায় শেষ বেঞ্চিতে সে বসে পড়ল। ডাঃ রায় একে একে সামনের বেঞ্চির রুগীদের পর পর ডাকছেন, পরীক্ষা করছেন, প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছেন।

অবশেষে বৈদ্যনাথের পালা। ডাঃ রায় কী একটা মনোযোগ সহকারে লিখছিলেন, বৈদ্যনাথও দুরু দুরু বক্ষে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

লিখতে লিখতে ডাঃ রায় বললেন—‘কই, কাগজপত্র দেখি।’

বৈদ্যনাথ নিরুত্তর।

ডঃ রায় লেখা থামিয়ে রুগীর মুখের দিকে তাকিয়েই অবাক।

‘সে কি, তুমি এখানে কেন? তোমার তো রোগ সেরে গিয়েছে।’

বৈদ্যনাথ দ্বিরুক্তি না করে অসংকোচে বলল—‘আপনি আমাকে হাস-পাতাল থেকে ছুটি দিয়েছেন বটে, কিন্তু আমি কোথায় যাব, কোথায় থাকব? আমার তো চাকরিও নেই।’

গম্ভীর হয়ে ডাক্তার রায় বললেন—‘আমার কাজ রুগীর চিকিৎসা করা। কারো চাকরি করে দেওয়া আমার কাজ নয়।’

বৈদ্যনাথ তখন মরিয়া হয়ে গেছে। বলল—‘আমাকে যদি একটি চাকরি না দেন তাহলে আমার মা না খেতে পেয়ে মরবে, আমি না খেতে পেয়ে মরব।’

টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন ডাঃ রায়। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন—‘চাকরির খোঁজে আমার কাছে কেন? আরও তো অনেক লোক আছে শহরে, তাদের কাছে চেষ্টা করে।’

তখনো ডাঃ রায়ের পিছন ছাড়েনি বৈদ্যনাথ। সে বললে— ‘কলকাতায় এসে ছ’মাস আমি পরিচিত অপরিচিত বহু লোকের সঙ্গে দেখা করেছি। বছ আপিসে উমেদারী করেছি। চাকরি পাইনি। শেষকালে ওষুধের ল্যাবরেটরিতে কুড়ি টাকা মাইনের কাজ পেয়েছিলাম, তা-ও আমার ভাগ্যে সইল না। কাল সেখানে খোঁজ নিতে গিয়ে শুনি আমার জায়গায় অন্য লোক নেওয়া হয়েছে, বাড়তি লোক রাখার মতো ক্ষমতা ওদের নেই। আপনি আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন, আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তবু আপনাকে চাকরির কথা বলতে এসে বিরক্ত করছি এই জন্যে যে, আপনার কাছেই শেষ চেষ্টা করে দেখব। যদি ব্যর্থ হই আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।’

একটা কাঁপা উত্তেজনায় এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে বৈদ্যনাথ থামল। ডাঃ রায় ততক্ষণে লিফ্‌টের কাছে এসে গিয়েছেন। লিফ্টম্যান দরজা খুলে তাঁরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। লিফ্টে উঠতে গিয়েও কী ভেবে ডাঃ রায় উঠলেন না। বৈদ্যনাথের মুখের দিকে একবার তাকালেন—যেমনভাবে রুগীর মুখের দিকে তাকান রোগ নির্ণয়ের আগে।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ডাঃ রায় কি একটা চিন্তা করে বললেন— ‘কলকাতায় তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’

‘আছে। কিন্তু তাদের কাছে হাত পাততে যাব না।’ কথাটা দৃঢ়ভাবেই বলল বৈদ্যনাথ।

‘বুঝেছি। তা আমার কাছে তুমি কী চাকরি চাও আর কী কাজই বা তুমি করতে পারবে?

‘হাসপাতালের যে-কোনো কাজে যদি আমায় লাগিয়ে দেন।’

অবাক হয়ে ডাঃ রায় বললেন—‘হাসপাতালের কাজ? ট্রেনিং ছাড়া ওখানকার কোনো কাজই তুমি পারবে না।’

বৈদ্যনাথ বুঝতে পেরেছে ডুববার আগে একটা শক্ত খুঁটির আশ্রয় বুঝি পেল। দৃঢ়তার সঙ্গে সে বললে—‘আমার যোগ্যতা কি আছে না আছে তা আপনি ভালই জানেন। তবে এটুকু আমি বলতে পারি, যে-কাজই আপনি আমাকে দিন প্রাণপাত পরিশ্রমে আমি নিজেকে তার যোগ্য করে নেবই।’

লিফ্টে চড়ে উপরে না গিয়ে আবার রুগী-দেখার ঘরে ফিরে এলেন ডাঃ রায়। টেবিল থেকে একটা প্যাড তুলে কী সব লিখে কাগজটা বৈদ্যনাথের হাতে দিয়ে শুধু বললেন—‘সুপারিন্টেণ্ডেন্ট-এর সঙ্গে এই চিঠি নিয়ে দেখা কর।’

ডাঃ রায় লিফ্‌টে চড়ে উপরে উঠে গেলেন। তাঁর হাতের লেখা কাগজটা মুঠো করে ধরে রইল বৈদ্যনাথ। বহু আকাক্ষিত অমূল্য বস্তু তার হাতের মুঠোয়। এতদিন পরে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার এক অনাস্বাদিত আনন্দে সে অভিভূত হয়ে পড়েছে। অনেক দুঃখের দিন বৈদ্যনাথের জীবনে এসেছে, কোনোদিন চোখের জল সে ফেলেনি। আজ তার দুই চোখ জলে ভরে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *