একটি পেরেকের কাহিনী – ৩

॥ তিন ॥

চাঁদপুর থেকে চলে আসার পর বৈদ্যনাথের সঙ্গে দীর্ঘকাল আর আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। গ্রামের ইস্কুল থেকে ম্যাটিক পাস করে কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বাবা তখন থাকতেন কালীঘাটে, একখানি মাত্র ঘর। মা, আমরা দুই ভাই আর এক বোন—এই নিয়ে আমাদের সংসার। বাবার সামান্য রোজগার, সেই রোজগারের সন্ধানে বছরের বেশিভাগ সময় বাইরে বাইরেই তাঁকে কাটাতে হয়।

দীর্ঘকালের অদর্শনে আমার কৈশোরকালের ক্ষণিকের বন্ধু বৈদ্যনাথের কথা মন থেকে প্রায় মুছে গিয়েছিল। হঠাৎ মা’র কাছে চাঁদপুরের পিসিমার এক চিঠি এসে হাজির। পিসিমা জানিয়েছেন, অর্থের অভাবে বৈদ্যনাথ ম্যাট্রিক পাস করে ঘরে বসে আছে, কুমিল্লায় কলেজে পড়াবার মতো অবস্থা ওর মায়ের নয়। ভাইয়ের বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে আছে, তাতে লাঞ্ছনার শেষ নেই। বৈদ্যনাথ কলকাতায় এসে যে-কোনো উপায়ে একটা চাকরি খুঁজে নিতে চায়। পিসিমা তাই অনুরোধ জানিয়েছেন, যতদিন না একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারছে ততদিন কলকাতায় আমাদের বাসায় একটু মাথা গুজবার জায়গা যেন ওকে দিই।

পিসিমার চিঠি পড়ে কিশোর বালক বৈদ্যনাথের ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা ও শত অপমানের মধ্যেও তার তেজোদ্দীপ্ত রূপটি ভোলার নয়। একগুয়ে ও অভিমানী সে ছিল, কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তার অপরিসীম।

বৈদ্যনাথের সঙ্গে আবার দেবা হবে এই আশায় মা’র হয়ে আমিই চিঠি লিখে দিলাম পিসিমাকে। জানিয়ে দিলাম, বৈদ্যনাথকে অবিলম্বে কলকাতায় আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। মা শুধু একবার চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন—‘একখানা মাত্র ঘর, তার উপর তোরা এতজন। থাকার জায়গা কি করে হবে রে?’

আমি বললাম—‘তার জন্যে ভেবো না মা। খুব অসুবিধা হলে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে। এখন তো চলে আসুক।’

চিঠি পাঠাবার দিন সাত পরেই এক সন্ধ্যায় বৈদ্যনাথ এসে হাজির। চেহারা বদলে গেছে। কিশোর বালক এখন তরুণ যুবা। চোখ দুটি আরো শান্ত কিন্তু আরো উজ্জ্বল। এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও মুখের দীপ্তি কিছুমাত্র কমেনি। একটা ছোট্টো টিনের তোরঙ্গ, দু-এক জোড়া জামাকাপড় শুধু আছে। বিছানাপত্র কিছুই নেই। আমাদের একটিমাত্র ঘর এবং এতজন মানুষ দেখে বৈদ্যনাথ আগেই স্থির করে নিয়েছিল যে ঘরের কোণায় টেবিলটার তলায় খবরের কাগজ পেতেই ও শোবে, বিছানার কোনো প্রয়োজন নেই। ও একবার যা স্থির করেছে তা থেকে এক চুল নড়ানো কারো সাধ্যি নেই, আমি তা জানতাম। অনেক সাধ্য-সাধনার পর মা শুধু ওকে একটা ছোটো মাথার বালিশ ব্যবহার করতে রাজী করাতে পেরেছিলেন, তার বেশি আর কিছুই নয়।

পরদিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল বৈদ্যনাথের প্রাণপাত পরিশ্রম চাকরির সন্ধানে। সকালে বেলা আটটার মধ্যেই দুটি ডাল-ভাত কোনো-রকমে মুখে দিয়েই ও বেরিয়ে পড়ে, ফেরে সন্ধ্যার পর। সম্ভব-অসম্ভব নানা জায়গায় ঘোরাঘুরির পর এক দোকানে খাতা লেখার কাজ পেল, পনেরো টাকা মাইনে। তিন মাস কাজ করার পর দশটা টাকা ছুঁইয়ে দোকানের মালিক বললে, বাজার খুবই মন্দা। আপাতত এর বেশি আর কিছুই দিতে পারছে না। রাগ করে কাজ ছেড়ে দিল বৈদ্যনাথ। কিন্তু টাকাটা সে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিল, প্রথম রোজগারের টাকা। আমার কাছ থেকে নানা আপিসের ঠিকানা সংগ্রহ করে আবার শুরু হল তার পথপরিক্রমা। সেই সকালে বেরিয়ে যায়, রাত্রে ফেরে। অধিকাংশ দিনই রাত্রে সে বাড়িতে খেত না, বলত বাইরেই খেয়ে নিয়েছে। আমি ভালভাবেই জানতাম বৈদ্যনাথ একবেলা অনাহারেই থাকত। ততদিনে ওর চরিত্র আমার জানা হয়ে গিয়েছে। এ-সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে হয়ত ও আমার বাড়ি ছেড়ে ট্রাম ডিপোর গুমটিতে গিয়ে আশ্রয় নেবে। তবু একদিন না বলে পারিনি, মা’র পীড়াপীড়িতেই বলতে হল।

সেদিন রাত্রে শ্রান্ত ক্লান্ত বৈদ্যনাথ বাড়ি ফিরেই মুখহাত ধুয়ে টেবিলের তলায় শুতে যাবে, আমি বাধা দিলাম।

‘বৈদ্যনাথ, বেশ বুঝতে পারছি তোমার রাত্রে কিছু খাওয়া হয়নি। আমাদের সঙ্গে খাবে চলো। না খেলে আমরাও কেউ খাব না।’

বৈদ্যনাথ স্তব্ধ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। চোখের দীপ্তি আরো প্রখর, আরো তীব্র। ও যে প্রচণ্ড বদরাগী আর একগুঁয়ে আমি তা জানতাম। ওর দারিদ্র্যের প্রতি কেউ যদি ইঙ্গিত করে বা ওর আত্মমর্যাদায় যদি কেউ ঘা দেয় কখনও সে তা সহ্য করবে না। ওর চোখমুখের ভাব দেখে মনে হল বোধহয় সে এই মুহূর্তেই আমাদের ঘর ছেড়ে চলে যাবে। ও কিছু বলবার বা করবার আগেই ওকে শান্ত করবার জন্যে বললাম—‘সারাদিন তুমি এতো ঘোরাঘুরি করো, পরিশ্রম করে, তাতে তোমার শরীর ভেঙ্গে পড়ছে তা কি তুমি বোঝো না? তার উপর যদি এই ভাবে একবেলা না খেয়ে কাটাও একটা শক্ত অসুখে পড়তে কতক্ষণ! আমি তোমার স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখেই কথাটা বলেছি, আর কিছুর জন্যে নয়।’

মাথা নীচু করে কী যেন ভাবল বৈদ্যনাথ। তারপর থেমে থেমে আস্তে আস্তে বললে—‘কলকাতায় আমার আর এক মামা থাকেন। সওদাগরী আপিসে পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকরি করেন। তাছাড়া আরো দু-চারজন আত্মীয় যে কলকাতায় নেই তা নয়। কিন্তু কোনো আত্মীয়ের আশ্রয়ে আর আমি থাকতে চাই না বলেই তোমার কাছে এসেছি।’

ওর মনের মধ্যে নিরন্তর একটা জ্বালা তুষের আগুনের মতো জ্বলছে, আজ তা প্রকাশ হয়ে পড়ল। চাঁদপুরে মামার বাড়িতে ওর মায়ের গলগ্রহ হয়ে থাকার নির্যাতন ও মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছে না। এর পরে আর কোনোদিন খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করিনি। রাত্রে বাড়ি ফিরে কোনোদিন ও নিজেই মা’র কাছে চেয়ে খেত, কোনোদিন খেত না।

দু-চারদিন ঘোরাঘুরির পরেই বৈদ্যনাথের একটা চাকরি জুটে গেল। ধর্মতলা স্ট্রীটের এক ওষুধের ল্যাবরেটরিতে, মাইনে কুড়ি টাকা। কালীঘাট থেকে বোজ হেঁটে ধর্মতলায় যায়, রোজ হেঁটে আসে। মাস গেলে সম্পূর্ণ মাইনেটি সে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তার এই কঠোর পরিশ্রমের একমাত্র পরিতৃপ্তি সেইখানে।

একদিন কৌতূহলবশত আমি বললাম—‘আচ্ছা বৈদ্যনাথ, তুমি যে এতটা দীর্ঘ পথ হেঁটে যাও আর হেঁটে ফের, কোনোদিন ক্লান্তি বোধ হয় না?”

সে বললে—‘জানো বিশ্বনাথ, আমি স্বপ্ন দেখতে দেখতে চলি। পথ-ক্লেশ তাই আমি টের পাইনে।’

অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম—‘স্বপ্ন মানে?’

‘মানে অতি সরল। আমি কল্পনা করতে করতে পথ চলি কবে মামার মত পঁচাত্তর টাকা মাইনে আমার হবে।’

এত দুঃখকষ্ট আর বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটিয়েও বৈদ্যনাথ তার মায়ের দুঃখ ঘোচাবার কঠিন সংকল্প থেকে একচুলও বিচ্যুত নয়।

একদিন সন্ধ্যায় বাড়ির রোয়াকে বসে আছি, দূর থেকে দেখতে পেলাম বৈদ্যনাথ আসছে, কিন্তু হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাছে আসতেই বললাম—‘তুমি খুঁড়িয়ে হাঁটছো কেন? পায়ে কোনো চোট লেগেছে নাকি?’

‘এমন কিছু না। চটি জুতোর একটা পেরেক ক’দিন ধরে গোড়ালির তলায় খোঁচা দিচ্ছিল। ইট ঠুকে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। আজ সকালে কাজে যাবার সময় অনেক ঠোকাঠুকি করেও পেরেকটাকে বাগ মানাতে পারিনি। থেকে থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।’

শংকিত হয়ে বললাম, ‘কাজটা ভালো করোনি বৈদ্যনাথ। একজোড়া চটি কিনে নিলেই তো পার। ওটা পুরনো হয়ে গেছে, মুচি দিয়ে মেরামত করেও কাজ চালাতে পারবে বলে মনে হয় না।

একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বৈদ্যনাথ বললে—‘কালই কিনব মনে করেছি।’

রাত্রে কিছু না খেয়েই বৈদ্যনাথ শুয়ে পড়ল। একটা অসোয়াস্তিতে সারারাত ও ছটফট করেছে, ঘুমোতে পারেনি। তবু একবারও আমাদের ডেকে কিছুই বলেনি।

প্রতিদিন সকালে সবার আগেই বৈদ্যনাথ ঘুম থেকে ওঠে। ব্যতিক্রম ঘটল পরের দিন সকালে। টেবিলের তলায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে বৈদ্যনাথ। কোনো হুঁশ নেই। গায়ে হাত দিয়ে দেখি প্রবল জ্বর, চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। বৈদ্যনাথ ঘোরের মধ্যে একবার শুধু বললে, পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা।

ছুটে চলে গেলাম পাড়ার এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে। বৈদ্যনাথকে পরীক্ষা করেই ডাক্তার বললেন—‘ওকে এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যান, বাড়িতে রেখে এ-রোগের চিকিৎসা হবার উপায় নেই।’

বিস্মিত হয়ে বললাম—‘এমন কি হয়েছে যে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে?’

‘পায়ে পচন ধরেছে।’

ডাক্তারের কথা শুনে একটা আসন্ন বিপদের কালো ছায়া আমার চোখের উপর নেমে এল। আমি ঘাবড়ে গেলাম। সুদূর চাঁদপুরে এক নিঃসহায় বিধবা তার একমাত্র পুত্রকে আমাদের ভরসায় পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন। যদি কিছু অঘটন ঘটে যায় তাঁর কাছে কী জবাবদিহি দেব। আমার যা অবস্থা, তাতে বাড়িতে রেখে বড় ডাক্তার দেখিয়ে বৈদ্যনাথের চিকিৎসা করা একেবারেই অসম্ভব। পাড়ায় আমার এক বন্ধু আছে। নাম তার ভোলা। বিপদে আপদে পাড়ার প্রত্যেক বাসিন্দার সে একমাত্র বল-ভরসা।

বিপদের কথা শুনেই ভোলা বললে—‘ডাক্তার যখন বলেছে তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই উচিত।’

‘কিন্তু—’

‘এর মধ্যে আর ‘কিন্তু’ থাকতে পারে না। তুই তৈরী হয়ে নে। আমি এখুনি ট্যাক্সি নিয়ে আসছি।’

সেই মুহূর্তেই ভোলাকে সঙ্গে নিয়ে বৈদ্যনাথকে ধরাধরি করে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে প্রথমেই নিয়ে গেলাম শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। রুগী দেখেই হাসপাতালের ডাক্তার বললেন—‘গ্যাংগ্রিন হলে এখুনি সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি করে নিতাম। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে টিটেনাস ইনফেকশনও হয়েছে। এ-রোগের চিকিৎসা শম্ভুনাথে হবার উপায় নেই, ওকে ক্যাম্বেল কিংবা কার-মাইকেলে এখুনি নিয়ে যান।’

পাড়ার ডাক্তার শুধু নয়, হাসপাতালের হাউস ফিজিসিয়ান পর্যন্ত যখন এ-কথা বললেন তখন আর সন্দেহ রইল না যে বৈদ্যনাথকে নিয়ে এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখে আমরা উপস্থিত। দিশাহারা অবস্থায় আমি বেঞ্চির উপর বসে পড়েছি, কিছু ভাববার বা করবার মতো মনের জোর পর্যন্ত তখন আমার হারিয়েছে।

আমার অবস্থা দেখে ভোলা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললে—‘দেখ বিশে, এখানে বসে হা-হুতাশ করলেই কি বৈদ্যনাথ বাঁচবে? চল, আর এক মুহূর্ত দেরী করা চলবে না। উঠে পড়।’

বৈদ্যনাথকে আবার ধরাধরি করে ট্যাক্সিতে তোলা হল। এখন আমাদের গন্তব্যস্থল কোথায়? ক্যাম্বেল না কারমাইকেল! ক্যাম্বেল যখন কাছে পড়ছে তখন সেখানে যাওয়াই আমি স্থির করলাম।

ভোলা বললে—‘তা হবে না। ক্যাম্বেলে শুনেছি রুগী ঢুকলে আর জ্যান্ত ফেরত আসে না, পোস্টমর্টেমের পর ডাক পড়ে রুগী ফেরত নেবার জন্যে। দেরি হয় হোক, তবু কারমাইকেলেই চল।’

বেলগাছিয়া ট্রানডিপোর কাছে কারমাইকেল কলেজ, এখন যার নাম হয়েছে আর জি কর মেডিকেল কলেজ, সেদিকেই ট্যাক্সি ছুটল তীরবেগে। পিছনের সিট-এ ভোলার কোলে মাথা রেখে বৈদ্যনাথ অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। ড্রাইভারের পাশে আমি, আমার অবস্থাও প্রায় বৈদ্যনাথের মতো। কোনো কথা বলবার শক্তিও যেন আমার ফুরিয়ে গিয়েছে।

কারমাইকেলে আমরা যখন উপস্থিত হয়েছি বেলা তখন এগারোটা। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রুগী নিয়ে উপস্থিত হওয়া মাত্র হাউস ফিজিসিয়ান সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করেই বৈদ্যনাথকে পাঠিয়ে দিলেন সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে। গম্ভীর গলায় আমাদের বললেন—‘বড় দেরি করে ফেলেছেন আপনারা। খুবই সিরিয়স কেস, দেখি কী করা যায়। আপনারা যাবেন না, বাইরে অপেক্ষা করুন।’

বৈদ্যনাথের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। জানি না ওর ভাগ্যে কী আছে। আক্ষেপ থেকে গেল যাবার আগে ওকে দুটো সান্ত্বনার কথা, ভরসার কথাও বলতে পারলাম না। বলবার মতো মনের অবস্থা আমার ছিলই না, শুনবার মতো অবস্থা কি ওর ছিল?

তখনকার দিনে কারমাইকেল কলেজের রুগী এক-একদিন এক-একজন ডাক্তারের ওয়ার্ডে ভর্তি হবার রীতি ছিল। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তখন কার-মাইকেলের ফিজিওলজির প্রধান শিক্ষক, তাছাড়া প্রতিদিন সকালে একবার করে এসে তাঁর ওয়ার্ডের রুগীদের পরীক্ষা করে যেতেন।

ডাঃ রায়ের ছিল ‘এ’ ওয়ার্ড। প্রতি সোম, বুধ ও শুক্রবার তাঁর ওয়ার্ডে রুগী ভর্তি হত। ডাঃ পি নন্দীর ছিল ‘বি’ ওয়ার্ড, বাকি তিন দিন রুগী ভর্তি হত তাঁর ওয়ার্ডে।

কারমাইকেল কলেজের চত্বরে একটা নিম গাছের ছায়ায় আমি ও ভোলা অনিশ্চিত আশংকা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। থেকে থেকে স্টেথস্কোপ গলায় ঝোলানো সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত কাউকে দেখলেই বৈদ্যনাথের খবর জিজ্ঞাসা করি, সঠিক উত্তর মেলে না।

বেলা বারোটা বেজে গিয়েছে। বৈদ্যনাথ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার মতো কোনো হদিস পাচ্ছি না। ভোলাকে কথাটা বলতেই সে ধমকে উঠল— ‘তুই থাম দেখি। বৈদ্যনাথের একটা কিছু খবর না নিয়ে আমাদের যাওয়া উচিত হবে না। তাছাড়া ডাক্তার যখন আমাদের অপেক্ষা করতে বলেছেন।’

হঠাৎ নজরে পড়ল সেই হাউস ফিজিসিয়ানকে। যিনি প্রথম বৈদ্য-নাথকে পরীক্ষা করেছিলেন তিনি আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমাদের ডেকে বললেন—‘আপনাদের আর মিছামিছি অপেক্ষা করিয়ে রাখতে চাই না।’

আমার মুখে কোনো কথা নেই। ভোলা বললে—‘তা কি হয় স্যার? বাড়ি ফিরেই বা নিশ্চিন্ত হই কি করে। আমাদের অপেক্ষা করতে কোনো আপত্তি নেই।

ডাক্তার বললেন—‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু ডাঃ রায় তো এখনো হাসপাতালে এলেন না। আজ বুধবার, আজ ওঁর ভিজিট করার দিন।’

ডাক্তার রায়ের নাম শুনেই আমার ঝিমিয়ে পড়া মন যেন নিমেষে চাঙ্গা হয়ে উঠল। নিজের ঔৎসুক্য চেপে রাখতে না পেরে বললাম—‘ওঁর কি আসবার সময় পার হয়ে গিয়েছে?’

‘ডাক্তার রায়ের কোনো বাঁধাধরা টাইম নেই। তবে সাধারণত বেলা দশটা থেকে বারোটার মধ্যেই ওয়ার্ড ভিজিট করতে আসেন। আজ যখন বারোটা বেজে গিয়েছে তখন কখন আসবেন তার কোনো স্থিরতা নেই।’

আমি কাতরভাবে বললাম—‘ডাক্তার রয় না এলে কি বৈদ্যনাথের কোনো ট্রিটমেণ্ট হবে না?’

হাউস ফিজিসিয়ান এবার হেসে ফেললেন। বললেন—‘এসব কেস-এ কি রুগী ফেলে রাখা চলে? ইনজেকশন যা দেবার তা দিয়েছি। কঠিন সার্জিক্যাল কেস। অ্যানেসথেশিয়া রুগী সহ্য করতে পারবে কি না, সেটুকু ডাক্তার রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করে নেওয়া দরকার ছিল। ডাক্তার রায় এসে পড়েন তো ভালই। অপারেশন আমাদের আজই করে ফেলতে হবে। বিকেল চারটের পর এসে খোঁজ নেবেন।’

এ কথা বলেই ডাক্তার যেমন তড়িঘড়ি এসেছিলেন তেমনি ব্যস্ত হয়েই চলে গেলেন। মনে মনে জেনে গেলাম যে একটা কঠিন পরীক্ষার ভিতর দিয়ে বৈদ্যনাথকে পার হতে হবে, সেই সঙ্গে আমাকেও। আরো আধ-ঘণ্টা সময় গাছতলায় আমরা দাঁড়িয়ে। ফিরে যাবে কিনা সেই কথাই তখন ভাবছি।

সহসা হর্ন বাজিয়ে একটি গাড়ি গেটের ভিতর ঢুকল। গাড়ি থেকে স্টেথস্কোপ হাতে নামলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। সাধারণত ডাক্তার রায় ওয়ার্ড ভিজিট করতে এলে সুপারিন্টেণ্ডেট থেকে শুরু করে হাউস ফিজিসিয়ান, অ্যাসিস্টেন্ট সবাই ভিড় করে ডাক্তার রায়ের সঙ্গে ওয়ার্ডে ঢুকতেন। কারণ প্রত্যেক রুগী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তার সঠিক উত্তর না পেলে ডাক্তার রায় বকাবকি করতেন এবং কেউই রেহাই পেতেন না।

সেদিন বোধহয় সবাই ধরে নিয়েছিল ডাঃ রায় আর আসছেন না। গাড়ি থেকে নেমে ডাঃ রায় প্রতিদিনের অভ্যাসমত আর জি করের স্ট্যাচুর সামনে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়ালেন। তারপর নিঃশব্দে ঢুকে গেলেন বাঁ দিকের একতলায় অ্যালবার্ট ভিকটর ওয়ার্ডে।

হঠাৎ ভোলা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললে—‘দ্যাখ বিশে, এই সুযোগ। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সেই ডাক্তারকে তো দেখছি না। আমরা গিয়ে ডাক্তার রায়কে বৈদ্যনাথের কথাটা বলি।’

উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভোলা আমাকে টানতে টানতে ‘এ’ ওয়ার্ডে গিয়ে ঢুকে পড়ল। ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি ডাক্তার রায় এক প্রত্যেক রুগীর মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, দু-একজনকে শুধু ছোট্টো প্রশ্ন—‘কেমন বোধ করছ।’

ওয়ার্ডের অপর প্রান্তে, একটা বেড ঘিরে একদল ছাত্র। ডাঃ রায়েরই এক অ্যাসিস্টেন্ট লেক্চারার রুগী সম্পর্কে ছাত্রদের কী যেন বোঝাচ্ছেন। ডাঃ রায় সোজা সেখানে গিয়ে উপস্থিত। ছাত্ররা ওঁকে দেখেই দু’পাশে সরে দাঁড়াল। রুগীর কাছে এসেই ডাঃ রায় ভারী গলায় প্রশ্ন করলেন—‘কী হে, কী ব্যাপার। এখানে এত জটলা কিসের।’

অ্যাসিস্টেন্ট লেকচারার বললেন—‘স্যার, এটা সিরিয়াস কেস, নিউমোনিয়া বলেই বোধ হচ্ছে। অক্সিজেন দিতে বলেছিলাম, দেওয়া হচ্ছেও। কেসটা একটু পিকিউলিয়র বলেই ছাত্রদের ওয়াচ করতে বলছিলাম।’

ডাক্তার রায় রুগীর আরো খানিকটা কাছে এসে বললেন—‘নিউমোনিয়া বলে বোধ হচ্ছে? তা নিউমোনিয়া হল কেন?’

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই এবং ডাঃ রায় কোনো উত্তর আশাও করেননি। অভ্যাসমত দুই হাত পিছনে আবদ্ধ রেখে রুগীর মুখের দিকে দেখলেন। রুগী তখন শিবনেত্র হয়ে পড়ে আছে, নাকে অক্সিজেনের নল গোঁজা। ঠোঁট দুটো খোল, খাবি খাচ্ছে। ছাত্ররা তখন রুগীর চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে। ডাঃ রায় রুগীর বুকে টোকা দিলেন, ফুলে-ওঠা পেটটাও বাজিয়ে দেখলেন। পর-মুহূর্তেই বললেন—‘নিউমোনিয়া ঠিকই। তবে আমাশা থেকে ওর লিভার খারাপ হয়ে অ্যামেবিক অ্যাবসেস হয়েছে। ট্যাপ করে পুঁজ বার করে দাও, ভাল হয়ে যাবে।’

অ্যাসিস্টেন্ট লেকচারার এ-কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। ছাত্ররাও হতবাক্। লেকচারার বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন—‘তাহলে স্যার···’

কোনো কিছু মন্তব্য না করে ডাক্তার রায় গট্ গট্ করে চলে গেলেন। লেকচারারের প্রশ্ন আর শেষ হতে পারল না। পরে জানা গিয়েছিল যে, রুগীর পেট ট্যাপ করে প্রায় এক পাইন্ট পুঁজ বার করা হয়েছিল এবং রুগী বেঁচেও উঠেছিল।

ইতিমধ্যে হাসপাতালময় রাষ্ট্র হয়ে গেছে ডাক্তার রায় ভিজিটে এসেছেন। যে যেখানে ছিল হন্তদন্ত হয়ে সবাই ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। হাউস ফিজিসিয়ান, অ্যাসিস্টেন্ট দু’জন, স্টাফ নার্স, এমন কি সুপারিন্টেন্টে পর্যন্ত। ডাঃ রায় ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুগীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আমরা দু’জন গুটিগুটি সেই ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ দেখা গেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের সেই ফিজিসিয়ান হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। তাঁকে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে বৈদ্যনাথের কথা বলবার জন্যেই আসছেন। ডাঃ রায়কে বলামাত্রই তিনি বললেন—‘চলো, একবার দেখে আসি।’

সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে যাবার পথে রুগী সম্পর্কে হাউস ফিজিসিয়ানের কাছে যা কিছু জানবার জেনে নিয়ে বৈদ্যনাথের কাছে এসে দাঁড়ালেন ডাক্তার রায়। অভ্যাস মতো আবার দুই হাত পিছনে আবদ্ধ রেখে বৈদ্য-নাথের চোখ আর মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে দেখলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন—‘তা হলে পা-টা অ্যাম্পুট করাই স্থির করলে?’

‘হ্যাঁ স্যার, কিন্তু অ্যানেসথেটিক স্ট্যাণ্ড করতে পারবে না বলেই আমাদের সকলের ধারণা। আপনি কী পরামর্শ দেন।’

তখনো একদৃষ্টিতে বৈদ্যনাথের রোগযন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার রায়। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন—‘অ্যানেসথেটিক হয়তো স্ট্যাণ্ড করতে পারবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলের পা-টা গেলে ও দাঁড়াবে কার জোরে?’

এ-কথা বলেই ডাক্তার রায় বৈদ্যনাথের একেবারে কাছে এগিয়ে এসে একটা হাত ধরে বললেন—‘তুমি একটু উঠে দাঁড়াতে পারবে? আমার হাত ধরেই ওঠো।’

অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের হাতে ভর দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

ডাঃ রায় বললেন—‘জোড়পায়ে দাঁড়াও আর হাত দুটি একত্র করে সামনের দিকে প্রসারিত করে দাও তালু দুটো চিত করে।’

অঞ্জলি দেওয়ার মতো বৈদ্যনাথ দাঁড়াল। পকেট থেকে কলমটা বার করে ডাঃ রায় বৈদ্যনাথের হাতের চেটোর উপর বোলাতে লাগলেন, মাঝে মাঝে ঠুকেও দেখলেন। তারপর বললেন—‘কোনো সেনসেশন বোধ করছ? শিরশির করছে?’

বৈদ্যনাথ বললে—‘না, সে রকম কিছু বোধ করছি না। তবে পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা।’

‘ঠিক আছে। শুয়ে পড়।’

বৈদ্যনাথ বিছানায় শুয়ে পড়তেই মাথার তালুতে দু-চার বার থাবড়া মেরে ডঃ রায় বললেন—‘এবার?’

বৈদ্যনাথ ঘাড় নেড়ে জানালে, এবারেও সে কিছু বোধ করছে না।

বৈদ্যনাথকে আর কিছু প্রশ্ন না করে ডাঃ রায় হাউস ফিজিসিয়ানকে বললেন—‘টিটেনাস ইনফেকশন হয়নি। মনে হচ্ছে রোগটা পেরিফেরাল নিউরাইটিস। ওকে অবিলম্বে আমার ওয়ার্ডে বদলি করে দাও।’

হাউস ফিজিসিয়ানের কাছ থেকে একটা প্যাড নিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন ডাঃ রায়, সেই সঙ্গে যা-যা করণীয় তাও বলে সোজ। গাড়িতে উঠে বসলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *