॥ বারো ॥
১৯৬২ সালের জুন মাস। বৈদ্যনাথ আপিসের কাজে বিহার অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাটনায় এসে হঠাৎ সে খবরের কাগজে দেখল ডাঃ রায় অসুস্থ! অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, হার্ট-এর ট্রাবল। ডাক্তাররা নির্দেশ দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে।
খবরটা পড়েই বৈদ্যনাথের মনে একটা অমঙ্গলের ছায়া ঘনিয়ে এল। ইলেকশনের সময় ডাঃ রায়কে যে-রকম অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছে বৈদ্যনাথ, তখনই তার মনে আশংকা দেখা দিয়েছিল যে এই বয়সে এই ধকল ওঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে কি না। খবরটা পড়ে আর স্থির থাকতে পারেনি বৈদ্যনাথ। সেদিনই চলে এল আসানসোল।
পরদিন ছিল শনিবার। বিকেলের গাড়িতে কলকাতায় পৌঁছেই হাওড়া স্টেশন থেকে ডাঃ রায়ের বাড়িতে টেলিফোন করে জানতে পারল যে তাঁর অবস্থা আপাতত অনেকটা ভাল, তবে শয্যাশায়ী। ডাক্তাররা বলেছেন পূর্ণ বিশ্রাম নিতে।
পরদিন যথারীতি দুপুরে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়িতে চলে গেল। শোবার ঘরে পিঠের তলায় দুটো বালিশ দিয়ে শুয়ে আছেন ডাঃ রায়। বিছানার একপাশে একটা টেবিলে এক গাদা ফাইল, তারই একটা টেনে নিয়ে মনোযোগ সহকারে দেখছেন। আসবার সময় নিউ মার্কেট থেকে সাদা গোলাপফুলের একটা তোড়া নিয়ে গিয়েছিল বৈদ্যনাথ। ফুলের গুচ্ছ হাতে বৈদ্যনাথকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে ডাঃ রায় বললেন—‘রোগীর ওষুধ হাতে তুমি এসে গিয়েছ বৈদ্যনাথ, ভালই হয়েছে।’
ফুলদানিতে গোলাপগুচ্ছ সাজিয়ে রেখে ডাঃ রায়ের বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেই ডাঃ রায় বললেন—‘চেয়ারটা টেনে এনে আমার কাছে এসে বসো। এতক্ষণে মন খুলে কথা বলবার লোক পেলাম।’
বৈদ্যনাথ একটা চেয়ার টেনে ডাক্তার রায়ের বিছানার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল—‘আপনার কিন্তু স্যার বেশী কথা বলা নিষেধ। ডাক্তার ব্যানার্জি সেই নির্দেশই সবাইকে দিয়ে গিয়েছেন শুনলাম।’
মৃদু হেসে ডাঃ রায় বললেন—‘রামমোহন রায়ের একটা গান মনে পড়ে বৈদ্যনাথ। “মনে করো শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর। অন্যে সবে কথা কবে তুমি রবে নিরুত্তর।” আমার হয়েছে সেই দশা। অন্যে সবে আমার উপর ডাক্তারী ফলাচ্ছে, আমিই রব নিরুত্তর।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘এতকাল আপনি সকলের উপর ডাক্তারী করেছেন, এবার সকলে সুযোগ পেয়েছে আপনার উপর ডাক্তারী করবার। এখন আর আপনি ডাক্তার নন, রুগী। রুগীকে ডাক্তারের কথা মেনে চলতে হবে বইকি।’
ডাক্তার রায় হেসে বললেন—‘কাল পদ্মজাও এসে এই কথাই আমাকে শুনিয়ে গেল। বললে—এতকাল আমরা তোমার কথা শুনে এসেছি, এবার তোমাকে আমাদের কথা শুনতে হবে। আরও বললে—তুমি চীফ মিনিস্টার হতে পার, তবে আমি যে তোমার গভর্নর সেটা ভুলে যেও না। গভর্নেসও বলতে পারো আমাকে, সুতরাং আমার কথা শুনতে তুমি বাধ্য।’ বলতে বলতে রোগযন্ত্রণা ভুলে গিয়ে ডাঃ রায় সরবে হেসে উঠলেন।
বৈদ্যনাথ বলল—‘উনি তো ঠিক কথাই বলেছেন, কিন্তু আপনি তো দেখছি আপনার দফতর নিয়ে এসেছেন বিছানার পাশে।’
ডাঃ রায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—‘দেখো বৈদ্যনাথ, আমার আরোগ্যের একমাত্র উপায় এই সব কাজ নিয়ে থাকা। স্বপ্ন আমি দেখি না কিন্তু সংকল্প আমার অনেক। তার কিছু পালন করতে পেরেছি, এখনো অনেক বাকি।’
বৈদ্যনাথ বলল—‘কিন্তু স্যার, অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনার এইসব কাজ এখন না করাই ভালো। সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া দরকার।’
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ডাঃ রায় বললেন—‘বিশ্রাম, বিশ্রাম, বিশ্রাম। কানের কাছে সব সময় শুনছি বিশ্রাম নিন, বিশ্রাম নিন। বিশ্রাম তো আমি একদিন নেবই, অনন্তকালের জন্য বিশ্রাম। বোধহয় সে দিনের আর বেশি দেরি নেই। তবে কি জানো, কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারলেই আমার মন ভাল থাকে।’
‘কিন্তু শরীর তা মানবে কেন!’
ডাঃ রায় হেসে বললেন—‘সারা জীবন ধরে বহু রুগী নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। শুনেছি লোকে নাকি বলে আমি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। আসলে ব্যাপারটা কি জানো? ও-সব কিছু নয়। মানুষের রোগ থাকে মনে, শরীরে নয়। মনটাকে যদি রোগমুক্ত করা যায় শরীরও সুস্থ হয়ে ওঠে। আমার চিকিৎসাবিদ্যার চাবিকাঠি ছিল সেইটিই।’
বৈদ্যনাথ বিস্মিত হয়ে ডাঃ রায়ের কথা শুনছিল, এমন অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতে তাঁকে এর আগে কোনোদিন সে দেখেনি। ওঁর পক্ষে এত কথা বলাটাও যে উচিত নয় সেটাও বৈদ্যনাথ জানে। বিদায় নেবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে বৈদ্যনাথ বললে—‘আজ আসি স্যার, আগামী রবিবার আপনার জন্মদিন, সেদিন দুপুরে আবার আসব।’
উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ডাঃ রায়। বললেন—‘ঠিক এসো কিন্তু। গত বছর কত লোক এসেছিল, কত আমোদ-আহ্লাদ। তুমি কিন্তু আসসানি, সে-কথা আমার মনে আছে। এবার আসতেই হবে। আমার জন্মদিনে তোমাদের কাছে পেলে আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয়।’
লজ্জিত হয়ে বৈদ্যনাথ বললে—‘গত বছর আপিস থেকে আমাকে টুরে পাঠিয়েছিল বলে আসতে পারিনি। এবার আর সে আশঙ্কা নেই। কারণ ২রা জুলাই থেকে আমি হেড আপিসে ট্রান্সফার হয়েছি এবং সেটা আপনারই চেষ্টায় হয়েছে, সে-খবরও আমি জানি।’
খুশী হয়ে উঠলেন ডাঃ রায়। বললেন—‘যাক্, অর্ডার এসে গেছে? খুবই আনন্দের কথা। তোমার মা নিশ্চয় সবচেয়ে খুশি হয়েছেন।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘মা বলেছেন, এবার একদিন আপনাকে আমার বাড়ি নিয়ে যেতেই হবে।’
ডাঃ রায় আস্তে আস্তে বললেন—‘যাবো বৈদ্যনাথ, নিশ্চয় যাবো। সেরে উঠেই যাবো। যাবার আগে একটা কাজ করবে বৈদ্যনাথ, পড়ার ঘর থেকে ফার্মাকোপিয়াটা একবার এনে দাও।’
লাইব্রেরী রুম থেকে বই এনে টেবিলের উপর রেখে বৈদ্যনাথ বললে— ‘আজ আসি স্যার, সামনের রবিবার নিশ্চয় আসব।’
পায়ের দিকে টেবিলের ফুলদানিতে রাখা শ্বেত গোলাপগুচ্ছের দিকে ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থেকে ডাঃ রায় বললেন—‘নিশ্চয় এসো, আমার জন্মদিনে তোমার যেন দেখা পাই।’