একটি পেরেকের কাহিনী – ১৩

॥ তেরো ॥

বিশুদা থামলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এ কাহিনী আমি শুনছিলাম। টেবিলের উপর ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা তিনটা বেজে গিয়েছে। কোথা দিয়ে যে এতখানি সময় পার হয়ে গেল টের পাইনি। আপিসে প্রচুর কাজ সে খেয়ালও আমার ছিল না। ভারাক্রান্ত মনে বিশুদা স্তব্ধ হয়ে বসে কী যেন চিন্তা করছেন, আমার মুখেও কোন কথা নেই। একটা প্রশ্ন বারবার জাগছিল, বৈদ্যনাথের অবস্থা এখন কী।

প্রশ্নটা বিশুদাকে জানাতেই বললেন—‘আমিও সেই কথাই ভাবছি। ওর ছেলেমেয়েরা আমায় বললে যে কাল সকালবেলা এগারোটায় স্নান-খাওয়া করে বৈদ্যনাথ বেরিয়েছিল। ডাঃ রায়ের জন্মদিন, নিউ মার্কেট থেকে ফুল কিনে নিয়ে সেখানে যাবে, সে-কথাও সে মাকে বলে গিয়েছিল। বেরোবার সময় বৈদ্যনাথের মেয়ে একটি বেলফুলের গড়ে মালা কলাপাতায় মুড়ে বাবার হাতে দিয়ে বলেছিল, দাদুর গলায় এ মালাটা পরিয়ে দিও বাবা, বোলো আমি নিজের হাতে এ মালা গেঁথেছি। বৈদ্যনাথ সেই যে গেল, এখনও ফেরেনি।’

হঠাৎ বিশুদা খাট থেকে উঠে পড়েই বললেন—‘যাই, এতক্ষণে বোধহয় ডাঃ রায়কে শ্মশানে নিয়ে আসা হয়েছে।’

তাড়াতাড়ি রেডিওটা খুললাম। ডাঃ রায়কে শ্মশানে আনা হয়েছে। দাহের পূর্বে কে একজন সংস্কৃতমন্ত্র পাঠ করছেন। হঠাৎ ধপাস করে খাটের উপর বিশুদা বসে পড়েই বললেন—‘আমি অপরাধী। ঘোরতর অপরাধ করেছি সাগরবাবু।’

বিস্মিত হয়ে বললাম—‘কেন, কী অপরাধ!”

একটা কান্নার আবেগকে চাপবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বিশুদা বললেন— ‘আমি যে ওদের স্তোকবাক্য দিয়ে ভুলিয়ে এসেছি।’

‘কাদের?’

‘বৈদ্যনাথের মা-স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের। আমি বলে এসেছিলাম শোক-যাত্রা আসতে দেরী আছে, ততক্ষণ আমি একটু ঘুরে আসছি, এসেই নিয়ে যাবো ডাঃ রায়কে একবার শেষ দেখা দেখাবার জন্যে। ওরা হয়তো এখনো আমার কথায় বিশ্বাস করে আছে।’

বিশুদাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম—‘তা অবশ্য এখন আর নেই, তবে আপনি না গিয়ে ভালই করেছেন। বৈদ্যনাথের শোকাকুল পরিবারকে নিয়ে ঐ প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে আপনার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হত না।’

বিশুদা বললেন—‘বৈদ্যনাথের মা-স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের কান্না যদি দেখতেন সাগরবাবু, অত্যন্ত নিকট-আত্মীয় মারা গেলেও বুঝি মানুষ অমন করে কঁদে না। আসলে আমি তা সহ্য করতে পারিনি বলেই পালিয়ে এসেছি।’

রাস্তায় বেরিয়ে বিশুদা আবার সেই জনারণ্যে মিলিয়ে গেলেন। আপিসে যেতেই হবে, একটা ট্যাক্সির আশায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। বৈদ্যনাথের কথাই বারবার ঘুরে ফিরে মনকে তোলপাড় করছিল। একজন অতি দরিদ্র নগণ্য এক সাধারণ মানুষ, অপরজন বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক অসাধারণ পুরুষ। অথচ দু’জনের মধ্যে কোথায় যেন চরিত্রগত এক আশ্চর্য মিল। বৈদ্যনাথ চেয়েছিল সে তার মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেবে, একটি সচ্ছল সুখী সংসার গড়ে নিজেকে সার্থক করে তুলবে। এইটুকুই ছিল বৈদ্যনাথের আশা, আকাঙ্ক্ষা আর সংকল্প। বৈদ্যনাথের সে-আশা পূরণ হয়েছে, সে-আকাক্ষা মিটেছে, সে-সংকল্প সে কাজে পরিণত করেছে।

ডাঃ রায়েরও ছিল সেই একই আশা, আকাঙ্ক্ষা আর সংকল্প। বঙ্গজননীর চোখের জল তিনিও মুছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ ছিল তাঁর সংসার। সেই সংসারকে সচ্ছল সুখী করে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর আশা; আকাঙ্ক্ষা আর সংকল্প।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *