ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা – ৮১

৮১.

 যার হেতু আমার এই বরাত খুলল, সেই গোরার সঙ্গেও আলাপ হল আমার তার পর।

কিন্তু গোরা যে আমার বই নেবার জন্য তার মামাকে ধরবে এটা একটুও বিস্মিত করেনি আমাকে। কেননা, চিরকাল ধরেই এরকমটা আমি দেখে আসছি। পড়েননি, আমার বই, ছাপাতেও তেমন আগ্রহী নন, আমি কেমন লেখক তাও তাঁদের জানা নেই, নেহাত তাঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা ধরে বসেছে বলেই সেই নাছোড়বান্দা দায় এড়াতেই প্রকাশকরা আমার দায়-পরিগ্রহ করেছেন, পরেও আমি দেখেছিলাম।

গোরার থেকে আরম্ভ হলেও আমার লেখক জীবনের আগাগোড়াই এই কাণ্ড!

অতই ছিল-গোরা সেই বাল্যকালেই। কাস্টারড়, কিন্তু শুধু তাই নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল সে। আশ্চর্য ছিল তার কথাবার্তা–প্রায় সমবয়সী সমকক্ষের মতই ছিল তার আচার-আচরণ। প্রেমেন থেকে বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত তাবড়ো বড়ো লেখকদের সবাইকেই সে অবাক করে দিয়েছিল প্রথম চোটেই। বয়সে অতো ছোট হয়েও সে ছিল সবার বয়স্যের মতই।

অদ্ভুত ছিল তার পড়াশোনা। তার মামার ঘরোয়া পাঠাগারের ঘরভর্তি যতো বই-ইংরেজিই তার বেশির ভাগ–সে পড়ে শেষ করেছিল সেই বয়সেই। তার কাছেই আমি ডিকেসের খবর পাই, কান ডায়েলের-মার্ক টোয়েনের। আরো অনেকেরই। বিশ্বসাহিত্যের পরিচয় লাভ আমার তার সৌজন্যেই। এদিক দিয়ে তার কাছে আমি অশেষ ঋণী।

যেমন পড়ুয়া ছিল, তেমনি গল্পও লিখতে পারত সে। চমৎকার লিখত। তখনই তার কয়েকটা গল্প রামধনু ইত্যাদি পত্রিকায় বেরিয়েছে। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি ছোটদের গল্পের তার এই অপরূপ বইটি, শৈল চক্রবর্তী বিচিত্রিত হয়ে তার ইস্কুলের পঠদ্দশাতেই প্রকাশ পায়। ইস্টার্ন ল হাউস-আরতি এজেন্সির অনাথ দে মশাই, মন্টুর মাষ্টার ইত্যাদি আরো কী কী বই বার করেছিলেন–তার সঙ্গে আমারও সেই সময়েই।

গোরা আমায় তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। গোরার বাবা যাদবেন্দ্রবাবু আলিপুরের অ্যাডভোকেট, ভারিক্কী মানুষ ছিলেন, বেশি কথা কইতেন না, কিন্তু তার মা সস্নেহে আমায় গ্রহণ করলেন। নিজের ছেলের মতই।

অমন পরমাশ্চর্য মহিলা আমি জীবনে দেখিনি। মহিয়সী বললে কিছুই তাঁর বলা হয় না। সহজ আভিজাত্য তো ছিলই, তার চেয়েও বড় ছিল তাঁর মাতৃসত্তা। সেই মাতৃবত্তা–যা আমি কেবল মার মধ্যেই দেখেছিলাম। ভাষায় যা প্রকাশ করা যায় না।

তিনি আমায় বললেন, এখানেই দুটি খেয়ে যাবে আজকেমন?

আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, বাসার থেকে খেয়ে বেরিয়েছি যে! ঘুম থেকে উঠেই আমার খিদে পায়, আর খিদে পেলেই খাই। খালিপেটে থাকতে পারিনে। বেশ, আর একদিন খাব না হয়।

কিন্তু পকেট ভর্তি টাকা ছিল, কোনো বড় রেস্তোরাঁয় গিয়ে পেট ভর্তি করব বলেই যে। ও-কথা বলেছিলাম তা নয়, মূলতঃ পরের বাড়ি কিছু খাবার মানাই ছিল আমার মার।

দেশে থাকতে বামুন পাড়ায় গিয়ে কারো বাড়ি যদি কোনোদিন কিছু আমি খেয়ে আসতাম, জানতে পারলে মা রাগ করতেন। বলতেন, খানে আর। পরের বাড়ি এমন করে খেলে লোকে বলবে লেলটিয়া।

লেলটিয়া কী? তার মানে আমি আজও জানিনে। হ্যাংলামি আর পেটুকপনা দুই মিলিয়েই হয়ত মার ঐ কথাটার অর্থ হবে–তাঁর আশ্চর্য বাগৈশ্বর্যর পরিচয়।

কিন্তু ঐ লেলটিয়া হবার ভয়েই আমি অনেক দিন কারো বাড়ি কোথাও কিছু খাইনি।

আসলে মা আমার তেমন কিছু রাঁধতে জানতেন না–সেটা আমি টের পেলাম গৌরাঙ্গর মার রান্না খাবার পরই। উনি এক ইলিশ মাছকে সাত পাকে সাত রকমের বেঁধে ধ্রুপদী রান্নার সা রে গা মা পা ধা নি সাধতেন যেন! রন্ধনকলার অমন কালোয়াতি আর কোথাও আমি দেখিনি।

আমার মা রাঁধতে পারতেন মোটামুটি। ঐ ডাল ভাত আর মাছের ঝোল চচ্চড়ি আলু ভাতে লুচি সিঙ্গারা আলুর দম এই সব। আমাদের মুখে তাই অবশ্যি অমৃত বলে ঠাওর হত।

কিন্তু জানতেন যে, তিনি মোটেই রাঁধতে জানেন না। অন্য কারো বাড়ি খেয়ে পাছে আমরা টের পেয়ে যাই আর তাঁর হাতছাড়া হই, সেটা বোধহয় তিনি চাইতেন না।

ওই লেলটিয়ামির ভয় দেখাতেন তাই। পাছে আমরা অন্য কারো রান্না খেয়ে তার রান্নায় অরুচি দেখাই! অপর কারো রান্না খেয়ে পর হয়ে যায় নিজের ছেলে-কেমন পেটসর্বস্ব যে আমি জানতেন তো ভালই–আরো ভালো খাইয়ে কোনো পরের মা-ই আমার কাছে পরমা হয়ে ওঠে–আমি তার খপ্পরে গিয়ে পড়ি আর বেহাত হয়ে যাই, সেই ভয়ে আর ঈর্ষাতেই তিনি ছেলেকে নিজের ঘরে বেঁধে রাখতে চাইতেন হয়ত।

বাঃ! আজ আমার জন্মদিন যে! খাবেন না আপনি? বলেছিল গোরা।

জন্মদিন যে কী বস্তু, তাও আমি ভালো করে জানিনে তখন। কেন যে তা অবশ্য পালনীয়–এবং সেটা যে চৰ্য্য চোষ্য খেয়েই, তাও আমার জানা ছিল না। আমার জন্মতিথি কোনোদিনই পালিত হয়নি, নিজের জন্মতারিখই জানা ছিল না আমার।

জন্মদিন তোমার? তাই নাকি? তাহলে তো খেতেই হয়। বলেছিলাম, আর খেয়েও ছিলাম তারপর।

খেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আড়ালে ওকে শুধিয়েছি, এইরকম খাও নাকি হে তোমরা রোজ? রোজ রোজ?

তা, প্রায় রোজই। বাবা খেতে খুব ভালবাসেন। নিজে বাজার করেন। পাঁচ সাত রকমের মাছ মাংস কিনে আনেন রোজ-সে বলেছিল।

তারপর আর বলতে হয়নি। তারপরে প্রায় রোজই ওদের বাড়ি গিয়ে খেয়েছি। কারণে অকারণে। থেকেওছি। ওর মা যেমন নানা রকমের রাঁধতে ভালোবাসেন, তেমনি প্রাণভরে ভালোবাসতেন খাওয়াতে সবাইকে। কিন্তু গোরারই নয় কেবল, সেই দিনটি আমারও জন্মদিন ছিল বোধহয়।

খাওয়া-দাওয়ার পর গোরার মা ওর কপালে চন্দনের তিলক পরিয়ে ওকে আদর করলেন একটুখানি।

গোরা বলল, শিব্রামবাবুকে খেলে না?

.

বারো-তেরো বছরের রহস্যময় বয়সে ছেলেরা যেন অলৌকিকতার রসে লীলায়িত থাকে। এই ধরনের অসম্ভব কথা কয়ে একেক সময়ে অবাক করে দেয় সবাইকে।

ছেলের অদ্ভুত আবদার বাধ্য হয়ে রাখতে হয় মাকে। কপালের ওপর আলতো একটুখানি ছোঁয়া পাই, সেইখানে-যেখানটি ছুঁয়ে আমার মা আরেক কোন্ মায়ের সঙ্গে–যিনি নাকি আমার মা, তোমার মা–সবার মা–সেই জগন্মাতাই!–যোগাযোগ ঘটিয়েছিলেন সব প্রথম।

আরেক আঁচের ছোঁয়াচ লাগা সেই প্রথম দিনটির মতই আমি শিহরিত হই।

আর সঙ্গে সঙ্গেই আমারও নবজন্মলাভ হোলো সেদিন। সেই মুহূর্তে। উনিও আমাকে ছেলের মত গ্রহণ করলেন, আর আমিও সেইখানে সেইক্ষণেই নিজের মায়ের স্থলে তাঁকে বরণ করে নিলাম। তারপর থেকে বরাবরই তাঁকে আমি মা বলেই ডেকে এসেছি। আর তার ফলে কেবল মা, ভাই বা বন্ধুই নয়, যা আমার ছিল না, তিনকুলে ভাইফোঁটা দেবার ছিল না কেউ, সেই আমার মায়ের পেটের বোনের মতন পেলাম কজনকে। আমার বোনের চেয়ে বড়ো, বন্ধুর মতও বলা যায়, তাদের পেয়ে গেলাম তারপরই ডাকামে যারা জবা, জানু, পুতুল, ইতু, ভুতু–আর নামড়াকে যমুনা, জাহ্নবী, সরস্বতী, কৃষ্ণ, কাবেরী ইত্যাদি।

সত্যি বলতে, ওদের বাড়ি এসে ওদের সঙ্গে মিশেই আমি মানুষ হলাম বলা যায়। দেশের থেকে এসেছিলাম প্রায় জংলীর মতই। সেকালের গেয়ো ছেলেরা হোতো যেমন। কালচার-ফালচারের ধার ধারতাম না, জানতামও না কিছু।

মা-বাবার সংস্কৃতজ্ঞান থাকলেও সংস্কৃতির জ্ঞান ছিল না। সংস্কৃতি অবশ্যই ছিল একটা তাঁদের, কিন্তু সেটা নেহাত সেকেলে-একেবারে আলাদা ধরনের। আর কলকাতায় এসে আমার সংস্কৃতির দৌড় যা ছিল, তা ওই জেলেপাড়ার সং পর্যন্তই। এমনকি, আমি নিয়মিত চুল ছাঁটতেও জানতাম না তখন। ঝাঁকড়া রুক্ষ চুলভরা থাকত মাথা, কাজীর মত সুবিন্যস্ত নয়, বুনো ঘাসের মতই–সেই চুলের গোছা উপচে এসে পড়ত কপালের ওপর-শৈলবাবুর আঁকা সেকালের আমার গল্পের ছবিতে যেমনটা দেখা যায়। গোরার পাল্লায় পড়ে সেদিনই। ওদের পাড়ার সেলুনে গিয়ে চুল ছাঁটলাম, সামনের চুলগুলো যেন না কাটে, অমনিই থাকে, একচুল এদিক-ওদিক না হয়–পেছনে যেমন খুসি ছাঁটুক–পরমানিককে সকাতর এই অনুনয় জানিয়ে। ফলে চেহারাটা ওরই ভেতর একটু ভদ্রগোছের হোলা বলতে কি! দেশের থেকে জংলির মত এসে ওই সাংস্কৃতিক পরিবেশে গোরাদের বাড়িতেই খেয়ে পড়ে আমি মানুষ হয়েছি, বলব আমি। গোরার বাড়ি খেয়ে আর ওর মামার লাইব্রেরির যতো বই না পড়ে–যা কিছু আমার বিদ্যে, শিক্ষালাভ আর কৃষ্টিপ্রাপ্তি! ওদের ঋণ আমার এ জীবনে শুধবার না। আর ওদের স্নেহপ্রীতি-তাই কি শুধতে পারব কখনো? ওর মা সবার প্রতিই সমান স্নেহার্টু, সাক্ষাৎ মাতৃরূপা। কিন্তু তাছাড়াও, আমার জীবনের ঊষর মরুভূমির ওপর দিয়ে যে কল্পনদীরা বয়ে গেল…যমুনা, জাহ্নবী, সরস্বতী, কৃষ্ণ, কাবেরী…জবা জানু পুতুল ইতু ভুতু…ইত্যাদির ঋণ আমি কি শুধতে পারব কোনদিনই? আমার প্রায় বইয়েই–সেই আই-এ-পির থেকে ইদানিং আনন্দ পাবলিশার্সের প্রকাশনায়–নিখরচায় জলযোগ-এর থেকে ভালোবাসার অনেক নাম পর্যন্ত বইয়ে ওদের কাহিনী ছড়িয়ে আছে–এই স্মৃতিচারণায় তার পুনরুক্তি করতে চাইনে। কিন্তু সেই প্রবাহিনীর থেকে আমার কৃষিক্ষেত্রেও যে সোনার ফসল আমি তুললাম জীবনভোর…ক্ষণে ক্ষণেই মুহুর্মুহু যে আমার নব নব জন্মলাভ হোলোলা…আমার পতিত ইয়ে যে সোনা ফললো স্পর্শমণির সেই ছোঁয়ায়, তার মর্মকথা কি আমার গল্পগাথায় বলতে পেরেছি।

.

৮২.

কবিরাজ রমেশচন্দ্র সেনের নাতিবৃহৎ ঘরটার উত্তর-পশ্চিম দিকে ছিল তাঁর ওষুধভর্তি আলমারিদেরাজ। ঘরজোড়া প্রকাণ্ড এক তক্তপোষ, সেই তক্তপোষের ওপর কেন্দ্রমণিরূপে তিনি বিরাজ করতেন, তাঁকে ঘিরে বসত সুহৃদ সাহিত্যিক, আর এক কোণে থাকত তাঁর কম্পাউন্ডার আর ছাত্ররা। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে একজনকে আমার মনে আছে আজও, হরিদাসবাবুকে, কবিরাজী ওষুধপত্র পাঁচন মুষ্টিযোগ বানানো ছিল যাঁর কাজ।

সেখানে বসেই রমেশবাবু সাহিত্যিকদের সঙ্গে সাহিত্য আলোচনার সাথে রোগীদের দেখাশোনা করতেন, প্রার্থী সম্পাদকদের লেখাটেখা দিতেন সেখানেই–সাহিত্যপত্র আর ওষুধপত্রের ব্যবস্থা চলত পাশাপাশি।

রমেশবাবুর সেই তক্ততাউসে সাহিত্যের রাজাগজার থেকে প্রজাখাজা, সবার জন্যেই সমান অভ্যর্থনা ছিল। বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠীর, বাহ্যত যাঁদের সাপে-নেউলের সম্পর্ক, তাঁরা সেই তক্তপোষে এসে আপসে মিলেছেন।

দেয়ালঘেঁষা দেরাজ আলমারির খাপে খাপে কবিরাজখানার দাবাইভর্তি শিশি বোতল বোয়েম সব সাজানো, আসব অরিষ্ট মোদক মাদক বৎ স্বর্ণ রৌপ্য লৌহঘটিত বটিকাদের ঘটা। মাঝখানে সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে দিলদরাজ কবিরাজ-লিখিয়ে রমেশবাবু বিরাজমান। সেখানে বেখাপ্পা কিছু হবার যো ছিল না।

তবু সেখানেই একদিন ছন্দপতন ঘটে গেল।

ছন্নচাড়া এই আমাকে নিয়েই।

তারাশঙ্করবাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ আমার সেখানেই–সেই তক্তপোষের ওপরেই। আর সেই আলাপেই প্রথম ছন্দপাত।

প্রথমালাপটি যে মধুরোচক হয়নি তা বলতেই হয়। প্রথম যোগাযোগই দুর্যোগাযোগ!

পরিচয় হতেই আমি বলে ফেলেছিলাম-আপনার লেখা আমার ভালো লাগে না মশাই! এখনো যদি সেই করিয়া খাইয়াই পড়তে হয় তো দামোদরবাবু কী দোষ করলেন? তাঁর গ্রন্থাবলীই পড়বো না হয়। প্রায় সেই একই ধরনের যদি লেখা হয় তো বঙ্কিমবাবু থেকে কী আপনি এগুলেন? শরৎচন্দ্রের থেকেই বা আপনার স্বাতন্ত্র কোথায়? তাঁদের লেখাই পড়ব বরং আপনার লেখা পড়তে যাব কেন?

তিনি সে-কথার জবাবে কোনো রূঢ়তা প্রকাশ করেননি, জবাব দেননি কিছু, শুধু একটু হেসেছিলেন মাত্র।

বোধ করি তাই ছিল তাঁর জবাব।

সে সময়টায় আমি যেন কেমন ধারাই ছিলাম। পাড়াগাঁর থেকে নিয়ে আসা গ্রাম্যতা আমার গা থেকে যায়নি তখন। কলকাতার সভ্যসমাজের আওতায় এসে তার নাগরিকতার ছোঁয়া লাগেনি। তেমন সভ্যভব্য হয়নি তখনো। প্রায় জলই ছিলাম একরকম।

তাছাড়া উঠতি বয়সটারই কেমন যেন একটা নেশা আছে। যে নেশার বিভ্রমে সহজেই ধরাকে সরা জ্ঞান করা যায়।

সে বয়সের দাপটে নওজোয়ানরা দাড়ির স্বকপোলকল্পনায় সাধ করে নিজের গালে বার বার ক্ষুরের চোট খায়, আর নয়া বাছুররা তার শক্তিমত্তা ফলাতে চায় ক্ষুর তুলে, এমন কি বনস্পতির গোড়াতেও গিয়ে টু মারতে কসুর করে না। শিঙ গজাবার মুখে তাদের কপাল বোধহয় সুড় সুড় করে আনাদ ছাড়বার গোড়ায়। (এই হেই বুঝি সুকুমার রায় গানে আর গুতোয় একাকার করে ফেলেছিলেন। ঠিক তেমন ধারাই হয়ত নয়ালিখিয়েরা নিজের বলবত্তা ফলাও করতে বাছবিচার না করে চোট মারতে যায় সবাইকে–গোত্তা মেরেই আরাম পায় বোধ হয়। শিঙ বেরোবার আগে সেটাই বোধ হয় তাদের এক রকমের শৃঙ্গার।

আমিও তেমনি সবাইকে তখন ধরে ধরে গুতিয়ে দিতে শুরু করেছিলাম–উল্লেখ কাউকেই আমার তিরিক্ষে লেখনী রেহাই দেয়নি তখন। রবীন্দ্রনাথ, শ্রীঅরবিন্দ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, শিশির ভাদুড়ি কাকে না? (আমার মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী বইয়ে মস্করার ছলে তাঁদের সেই সপিণ্ডকরণের সবিশেষ সবিস্তারে উল্লেখিত।) জুতসই করে কাউকে মজুতসই গুঁতো মারাটার কেমনতর মজা আছে যেন। তরুণ বয়সীর কাছে সেটা বাহাদুরি বলেই মনে না।

 সেই বাহাদুরির বাহুল্যই তারাশঙ্করের কাছে ফলানো আমার।

তিনি আমার প্রগম্ভতার কোন প্রতিবাদ করেননি, প্রত্যাঘাতও না।

কিন্তু এক বালকের মুখে আমার কথাটার প্রতিধ্বনি শুনে অপ্রস্তুত হতে হয়েছিল আমাকে একটু বাদেই–ঐখানেই।

একটি ছেলে তাদের বাড়ির কার ওষুধ নিতে এসেছিল রমেশবাবুর কাছে। কৌতুক করার মতলবেই হয়ত ছেলেটিকে তিনি শুধিয়েছিলেন-তারাশঙ্করবাবুর লেখা তুমি পড়েছে? কেমন লাগে তোমার?

ততটা ভালো লাগে না। বোধ হয় বুঝতে পারি না বলেই।

আর শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা?

 দারুণ দারুণ! ভীষণ ভাল্লাগে আমার।

ওদের কাউকে তুমি চেন কি?

একদম না।

 তখনো দেখলাম তারাশঙ্করবাবুর মুখে সেই মৃদু হাসি। একটুও অপ্রতিভ হয়নি তার কথায়।

অপ্রস্তুত হতে হয়েছে আমাকেই। আমি তার কথার প্রতিবাদ না করে পারিনি-বড় হও। বড় হয়ে তুমি তারাশঙ্করবাবুর লেখা পড়ো, তখন বুঝবে কাঁচের সঙ্গে হীরের কী তফাত। তোমার বয়সের ছেলেরা চাকচিক্যে ভোলে। কিন্তু জানো তো, অল দ্যাট গ্লিটারস ইজ নট গোল্ড? যখন তুমি তারাশঙ্করের লেখা বুঝবে, তখন ওই শিব্রামের লেখা তোমার একটুও ভাল্লাগবে না।

ছেলেটা অপ্রসন্ন মুখে আমার উপদেশ আর রমেশবাবুর ওষুধ নিয়ে চলে গেল।

একটু আগেই নিজের কথার প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়ে আমি ঈষৎ অপ্রতিভ হলেও তারাশঙ্কর কিন্তু তেমনি সপ্রতিভ। তাঁর মুখে সেই মৃদু হাসিই।

লেখকে লেখকে লেখার তারতম্য, মতামতে পার্থক্য, ব্যক্তিত্বের উনিশ-বিশ থাকেই, কিন্তু তা হলেও আমি বলব, লেখকরা পরস্পরের কাছে বিষতুল্যই। মুখে মধুর হলেও পরস্পরের প্রতি তাঁরা বিষিয়ে রয়েছেন সর্বদাই।

গরুর চেয়ে গরুর দুধ ভালো, লেখকের চেয়ে তাঁর লেখা। এই আমার চিরকালের ধারণা-অভিজ্ঞতার ধারে পরীক্ষিত।

দুধ শুধু খেতেই ভালো নয়, পুষ্টি-তুষ্টিকরও। যেমন প্রেয় তেমনি শ্রেয়। কিন্তু গোরকে অখাদ্য বলেই ধরা উচিত–যেহেতু তার কাছে ঘেঁষলেই গুতো খেতে হবে। নিদেন পক্ষে শিঙ-নাড়া তো রয়েছেই।

লেখার মত লেখক ততটা উপাদেয় না হতেও পারেন।

লেখকে সান্নিধ্যে গেলে তিনি গুতোবেনই, আপনাকে না হলেও অন্য কাউকে-যে-লেখক তখন আপনাদের সামনে নেই। সেই মর্মভেদী কাণ্ড গণ্ডার সদৃশ ভক্তের চর্মভেদী না হলেও অপর সকলের পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন। যা শত্রু পরে পরের মত কারো হয়ত উপভোগ্য হলেও পর-পরস্বৈপদী কর্ণভেদী কটুকাটব্য অবাধ অসহনীয়।

তারাশঙ্করের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার জীবনে খুব কমই হয়েছে। তিনি থাকতেন পাইকপাড়ার এক টেরে আর আমি আমার চোরবাগানের টেরেসে, পরস্পরের টের বিলকুল বাইরে। এধারে পথেঘাটে তাঁর সাথে দেখাসাক্ষাৎ যা ঘটেছে তা দৈবাৎ পথেঘাটেই। আর সাত পাড়া ঠেঙিয়ে ট্রাম-বাসে যাতায়াতের দুর্ভোগ কাটিয়ে পাইকপাড়ায় কে যায়?

আমাদের এলাকায় গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের দোকানের কাছাকাছি একবার তাঁকে দেখেছিলাম কাহিল অবস্থায়। কী হয়েছে, শুধাতে বললেন যে, পাইসে বেজায় কষ্ট পাচ্ছেন। আমি বলেছিলাম, টাকাপয়সা এলেই তা হবে, ঐ আধিব্যাধি। হয় আত্মীয়কুটুমেরা এসে অর্শাবে, নয়তো ঐ অশই। আপনি বোধ করি বেশ উপায় করছেন এখন। আর্নিং পাইলস আফটার পাইলস। শুনে তিনি হেসেছিলেন। কাছাকাছি বিখ্যাত চাঁদসীর মলমের বিজ্ঞাপনদাতা একজনার দোকানে তাঁকে নিয়ে গেছলাম, মনে আছে।

তারপরে এই মাঝে মধ্যেই। তাঁর প্রতিবেশী আমার বন্ধু শৈলজানন্দকে দেখতে যখন গিয়েছি, তখনই যা তাঁর বাড়িত এক-আধটুর জন্য হানা দিতাম–অমরনাথ যাত্রার কালে স্বয়ম্ভু দর্শনে যাবার পথে তীর্থযাত্রী যেমন বদরিকাশ্রম ছুঁয়ে যায়।

সেই সামান্য সংলাপেই যে-পরিচয় পেয়েছিলাম তাতে তাঁর সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি যে, কাউকে খুঁতোনো দূরে থাক, তাঁর কোনো শিঙ-ই আমি দেখতে পাইনি। আর, শিং এবং ল্যাজ এহেন কস্তু, যা থাকলে পরে কিছুতেই তো ঢেকে-টুকে রাখা যায় না। আপনার থেকেই রুখে বেরয়। নিজগুণের প্রকাশ পায়, স্বরূপেই বেরিয়ে পড়ে।

তারাশঙ্করের মুখে কখনো অপর কোন লেখকের নিন্দেমন্দ শুনিনি। এরকম আরেকটি লেখকের কথা এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে, তিনি নারায়ণ গাঙ্গুলি। তাঁর ন্যায় মিষ্টি মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। 

যেমন মানুষের মধ্যে লেখক, তেমনি লেখকের মানুষ। দুজনেই এঁরা। এই আশ্চর্য যোগাযোগ খুব কমই নজরে পড়ে। লেখক হওয়া সত্ত্বেও যাদের মানুষ বলে ভাবতে দ্বিধা হয় না।

নারায়ণ গাঙ্গুলির একটি ইডিয়লজি ছিল অবশ্যি, যা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই নিয়ে বিরুদ্ধমতি কারো সঙ্গে তর্কাতর্কি বা আঘাত দিয়ে কথা কইতে কোনদিন তাঁকে শুনিনি। বিরোধিতা বা বিরুদ্ধবাদকে মৃদু হেসে সায় দিয়ে যাবার অধ্যবসায় ছিল তাঁর। কোন লেখকের কাছ থেকে এটা যেমন অপ্রত্যাশিত শিষ্ট আচরণ, তেমনি অকল্পনীয় মিষ্ট ব্যবহার। এটাকেই আমি তাঁর মিষ্টতা বলেছি। এর স্বাভাবিক সৌরভ তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। সর্বতোভাবে বিজড়িত ছিল।

তারাশঙ্কর অবশ্যই এমনধারা মিষ্ট নন। ব্যক্তিগত ব্যাপারে কারো প্রতি কোনো তিক্ততা না থাকলেও আদর্শগত ক্ষেত্রে ভিন্নধর্মীর প্রতি বিরূপ-জেহাদীর মতই খঙ্গহস্ত।

সেদিক দিয়ে তিনি বীরভূমের মাটির মতই কড়া–যেমন কঠোরতায় তেমনি তীক্ষ্ণতায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিনিন্দার নীচুস্তরে ব্যক্ত হতে তাঁকে কখনো দেখা যায়নি, আমি তো দেখিনি।

না, পরের ওপর শিঙের ধার পরখ করার শৃঙ্গার তাঁর আচরণে আমি দেখিনি কখনো। কাউকেই তিনি কদাপি গুঁতোতেন না। অন্তর্গত শিঙের অভাবেই সেটা পারতেন না বোধ করি। বরং বলা যায় যে, আমিই তাঁকে একবার গুতিয়ে দিয়েছি–তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিকে টু মারতে গিয়েছি–সাহিত্যের ক্ষেত্রে যখন চারধারেই আমার টু টু–সেই কারণেই হয়ত বা।

আমার ঢুঙ্কারের জবাবে তিনি চুপ করেছিলেন, নিরুত্তাপ তাঁর সেই নিরুত্তরতার মধ্যেই বুঝি আমার প্রশ্নের উত্তর নিহিত ছিল। তাঁর নিরুক্তির ভেতর দিয়েই সে কথা নিঃশেষে উক্ত হয়েছিল বুঝি বা।

আমার জবাব পেয়েছিলাম কিছুদিন পরেই–তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে। অনির্বচনীয় সেই রচনা।

পাটনার প্রভাতী মাসিকে তাঁর ‘কবি’ বেরুচ্ছিল ধারাবাহিক। কবি পড়ে আমি তো অভিভূত।

ছোট একটুখানি গোষ্পদের গর্ভে যেমন বিপুল আকাশের ছায়া পড়ে, তেমনি অজ পাড়াগাঁর নিরক্ষর এক ছড়াকারের ভেতরে বিরাট কবির ভূমিকা তিনি ধরে দিয়েছেন ওই বইয়ে। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি একাত্ম হয়ে এখানে যেন বিধাতার মতই যুগপৎ মহৎ।

তারাশঙ্করের ভাষার বহিরঙ্গ দেখে আমি ক্ষুব্ধ ছিলাম। তাঁর অন্তরের অন্তরঙ্গ হবার সুযোগ পাইনি এর আগে।

সেটা ছিল প্রমথ চৌধুরীর যুগ। বাংলাসাহিত্যে বীরবলী Spell তখন–চলতি ভাষাই চালু। এক কথায় অনেক কথা বলা, অল্পের মধ্যে বিস্তরের আভাস-ইঙ্গিতবহ আঁটসাঁট তাঁর বাকভঙ্গীর মায়ায় সবাই আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। এমনকি, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাঁর হস্তাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। সেই সময় তারাশঙ্করের এই ফেলে-ছড়িয়ে লেখায়-বহু কথনের বহুলতর বিস্তার আমার কাছে যেন বাহুল্য বলেই বোধ হয়েছিল। বীরবলের ঋজু তির্যক সংক্ষিপ্ত ভাষণের কাছে আর সব ভাষা–সবার ভাষণই নিতান্ত প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে হত।

তখন আমি দেখতে পাইনি যে, বীরভূমের রুক্ষ ভূঁয়ের পাশ দিয়েই রূপনারায়ণ বয়ে চলেছে। রাঙামাটির রস জমাটি–সেই রসরাপের দেখা পেলাম ওই কবিইে। কবির প্রতাঁকের ভেতর দিয়ে তিনি জগৎ-কবির প্রতিকৃতিই প্রকাশ করেছেন-সেই বিরাট প্রতীকক্রিয়ায় করিয়া খাইয়ার তাবৎ ক্রিয়াকে ছাড়িয়ে গিয়েছে কোথায়।

প্রভাতীতে তার যথার্থ পরিচয় পাবার পর আমার প্রতিক্রিয়া পত্রিকাঁপাঠ পত্রপাঠ তাঁকে জানিয়েছিলাম, তারও কোনো জবাব তিনি দেননি। সত্যদ্রষ্টা মহৎস্রষ্টারা স্বভাবতই সব নিন্দা-প্রশংসার উর্ধ্বে থাকেন, কিছুতেই তাঁরা বিচলিত হন না। রমেশবাবুর আড্ডায় নিজের কুচ্ছায় যেমন অবিচল, সাধুবাদেও তেমনি তিনি অনুচ্ছসিত।

আমার চিঠির জবাব পেয়েছিলাম অবশ্যি পরে–অনেক পরেই। রঙ্গমঞ্চে নাট্যরূপে কবির উপস্থাপনার কালে। কলাবাগানের গলিখুঁজি পেরিয়ে কত কষ্ট করে মেহনত পুইয়ে আমার বাসার ঠিকানা খুঁজে খুঁজে আমার আস্তাবলে তিনি এসেছিলেন-কবির অভিনয় দর্শনের আমন্ত্রণ নিয়ে। রচনার মত রঙ্গমঞ্চে তার উপস্থাপনাও অপরূপ-অবিস্মরণীয়।

পরে আমি তাঁর রচনার আরো পরিচয় পেয়েছি। দেখেছি যে, জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর এহেন বিস্তৃত, বক্তব্য এতই বেশি যে বিস্তারিত না হয়ে তাঁর উপায় ছিল না, সংক্ষেপে বলা অসম্ভব, সব বলা সব কথা বিশদে না বলা পর্যন্ত তাঁর রেহাই নেই। ইঙ্গিত ইশারায় সারা যায় না, বিশল্যকরণী সেই মৃতসঞ্জীবনীকে আনতে হলে গোটা গন্ধমাদনকেই উপড়ে আনতে হয়। মহাবীর্যবান সহিত্যকলার চাল কখনই চটুলগতি ঠুমকির মত হতে পারে না।

তাই তার গতিবেগ রূপনারায়ণের ন্যায় এমনই দুর্দাম যে, কোথাও একটু বসে থিতিয়ে থেমে নিজের ভাষাকে মেজে ঘষে একটু ঘুরিয়ে বলার কসরত করার তাঁর ফুরসত নেই। অনেক কথার ভেতর দিয়ে যে একটি কথা তিনি কন, সেই এক কশারই দাম অনেক। ভাস্কর্যের সৌন্দর্যে সেই এক কণাই কশারক।

এক মণ ভারী কয়লার তুলনায় এক ভরি সোনা যেমন।

 তাছাড়া, ভেবে দেখলে, আঙ্গিকের ভঙ্গিমা ছাড়িয়ে–ছাপিয়েই তো সাহিত্য। অঙ্গভঙ্গীর চেয়ে মানুষটাই বড় যেমন।

তারাশঙ্করের সাহিত্যে সেই মানুষের কথাই।

 রমেশবাবুর আখড়ায় সেই প্রথম আমার সাহিত্যিক সংঘর্ষ। মুখোমুখি যদিও নয় ঠিক, কেননি। আমি মুখিয়ে গেলেও তিনি এড়িয়ে গেছেন, মুখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হননি, কিন্তু দ্বিতীয়বার যথার্থই একটা হাতাহাতি হয়ে গেল। অদ্বিতীয় পবিত্র গাঙ্গুলির সাথেই।

সেখানের বৈঠকে সাহিত্যজিজ্ঞাসায় আমার শেষ ঠোকাঠুকি সেইটাই।

কমলদের বাড়ির সদর চৌকাঠে বসে তার সঙ্গে গল্পগুজব করছি, এমন সময়ে পাশের আসর থেকে সোরগোল এল–কী নিয়ে বেজায় তর্কাতর্কি বেধেছে যেন।

বিতর্কিত ব্যাপারে গলা বাড়াতে না চাইলেও সব সময় পারা যায় কি! হট্টগোলের একটা আকর্ষণ থাকেই, সেটাই আগ বাড়িয়ে এসে কান পাকড়ায়। ইচ্ছে করলেও তর্কাতীত থাকা যায় না।

কৌতূহলবশে হট্টমালার দেশে গিয়ে বসেছি, একটুখানির জন্যেই, রমেশবাবু শুখিয়েছেন শৈলজা আর অচিন্ত্যর মধ্যে কে বড়? বলুন তো, আপনার কী মত?

বিতর্কটা বেধেছে তাই নিয়েই বুঝলাম।

এ আর বলা শক্ত কি! কে কোন্ সালে জন্মেছে জানলেই তো বলা যায়। আমি বললাম।

বয়সের কথা হচ্ছে না…।

তবে কি বিদ্যে-বুদ্ধিতে? তা, অচিন্ত্য যেকালে মুনসেফ–আমি সেফ সাইডে থাকতে চাই-সে-ই বড়ো বলে আমার মনে হয়।

বিদ্যেবুদ্ধির কথা নয়, লেখক হিসেবে দুজনের মধ্যে বড় কে? এইটেই প্রশ্ন। পবিত্রবাবুর হুঙ্কার।

হ্যাঁ, তাই জানতে চাইছি আপনার কাছে। সায় দেন রমেশ সেন।

 সত্যি বলতে, এরকম কোনো প্রশ্ন উঠতেই পারে না। শৈলজা আর অচিন্ত্যর ভেতর কে বড় লিখিয়ে তা কি করে বলা যায়? আম আর আনারসের মধ্যে বড়ো কে, এই ধরনের নয় কি প্রশ্নটা? কোনো ফলের সঙ্গেই কোনো ফলের তুলনা হতে পারে না, মূল্য বিচার হবে কি করে? তুল্যমূল্য করা যায় না ওদের।

রসের জিজ্ঞাসায় তরমুজ বড়ো কি তালশাঁস–এহ্নে প্রশ্ন আসাই উচিৎ নয়। ফলের বিচারে দুজনেই অনন্য, স্বাদ আর রসে পৃথক হলেও উভয়েরই সমান সাফল্য। কারো সঙ্গে কারো তুলনাই হয় না। ওই তরমুজ আর তালশাঁস–দুই-ই সমান তর করে দেয়–দুটোই মজাদার–তারিয়ে তারিয়ে খাবার।

কারো কাছে ওই আনারসই ষোলো আনা, এবং নিচুর স্থানই সবার উচোঁয়। যার কাছে যেমন লাগে।

এঁদের দুজনার মধ্যে কোঞ্জন লেখক হিসেবে বড়, বলুন তাই। শুধান সবাই।

আমার বিবেচনায় কে বড়ো জানতে চাইছেন? অচিন্ত্য আর শৈলজার মধ্যে?…এঁদের দুজনের মধ্যে, আমার ধারণায় প্রেমেনই বড়।

শুনেই পবিত্রবাবু খাপ্পা-এদের মধ্যে প্রেমেন বড়? প্রেমেনের কোনো কথাই হচ্ছে না এখেনে। প্রেমেন এর ভেতর আসছে কোত্থেকে?

কোত্থেকে আসছে কে জানে! আমার জবাব–কিন্তু বলতে গেলে প্রেমেনকেই এদের মধ্যে বড় বলতে হয়।

প্রেমেন বড়ো? সঙ্গে সঙ্গে পবিত্রবাবু আস্তিন গুটিয়ে খাড়া। এই মারেন কি সেই মারেন।

এবার আমি সতর্ক। পবিত্রবাবু বঙ্গদেশীয় কাঠগোঁয়ার আর শৈলজা দারুণ গোঁড়া।

আর, কাঠগোঁয়ার বললে কমিয়েই বলা হয় তাঁকে। শালকাঠ গোঁয়ার বললেই সঠিক হয়। আস্তিন গুটোতেই তাঁর শালপ্রাংশু মহাভুজঃ প্রকাশ হয়ে পড়ল। নাগালের মধ্যে পেলে আমার গালের দফা সারা, বুঝতে আমার দেরি হোলো না।

শুধু গালমন্দর উপর দিয়েই যাবে না, হাতে পায়ে খোঁড়াও হতে হবে আমায়। কিন্তু রুদ্রমূর্তি পবিত্রবাবুকে থামায় কে?

বাহ্বাস্ফোটে তিনি এগিয়ে আসতেই না আমি তাঁকে এইসা এক ধাক্কা লাগিয়েছি…গিয়ে পড়েছেন ঘরজোড়া তক্তপোষের কিনারায় দেয়ালঘেঁষা দাবাইয়ের আলমারিগুলোর ঘাড়ে। তাদের ভেতরে সারে সারে খাড়া-করা থাকবন্দী রমেশবাবুর যত ওষুধ আর বটিকা-টোটকা এবং টুটকি, মকরধ্বজ আর চ্যবনপ্রাশ-ব্রাহ্মঘৃত আর শ্রীগোপাল তৈল, কামেশ্বরমোদক আর ভাস্কর লবণ–কটুক্তিকষায় রসায়ন যত না।

অকুস্থলে পবিত্রবাবুর পাঁচনের ওপর পড়ল গিয়ে বেটর আমার ঐ মুষ্টিযোগ!

তারপর আর কিছু বলতে হল না। ওতেই কাম ফতে! দেখতে হল না তারপর।

পবিত্রবাবু আলমারির ওপরে গিয়ে পড়লেন, আলমারি তাঁকে নিয়ে পড়ল। তার পরে দুজনে মিলে জড়াজড়ি করে ভাস্কর-লবণ-জর্জর পঞ্চতিক্ত কষায়ে কষিত সালসাদের সহিত ওতপ্রোত হরিতকি আমলকি বহেড়ার আলুথালুর মধ্যে বটিকাদের ছড়াছড়ির ছত্রাকারে সেই তক্তপোষের উপরে গড়াগড়ি যেতে লাগলেন।

বিফলাদ্য বিতর্কের ত্রিফলাদ্যযোগে তাবৎ ঈশগুল গুলঞ্চ আর মশগুল সাহিত্যরসিকরা একাকার হয়ে একশা সবাই! ইলাহী কাণ্ড!

পবিত্রর গায়ে জোর আমার অন্তত ছগুণ। ই কবরেজখানার মকরধ্বজের ন্যায় ষণ বলি-জারিত হতে সেখেনে আমি দাঁড়াই আর? পবিত্রবাবুকে ঐভাবে রেখে সেখেন থেকে আমি উধাও! মেষের মতই ল্যাজ গুটিয়ে আমি পলাতক। নিমেষের মধ্যেই নিজের মেসের বিছানায় এসে পর্যবসিত।

হাত থাকতে মুখে কেন? এটাও একটা তর্কের প্রশ্নই।

কেননা, কোনো তর্কের জবাবই মুখে মুখে খেলে না, ওই হাতে হাতেই মেলে। শেষ অবধি হাতাহাতিতেই সব তর্কের নিষ্পত্তি হয়।

তার পরে আর মুখ খোলার দরকার থাকে না, পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। এর চেয়ে ভাল মুখবন্ধ আর হয় না।

.

৮৩.

 নারাণ গাঙ্গুলির অকালমৃত্যুর জন্য আমি নিজেকেই দায়ী মনে করি।

নারাণবাবুর বাড়ি গেছি একদিন, গৌরাঙ্গদের বাড়ি যাবার পথে গোলপার্কের কাছেই তাঁর আস্তানাটা-নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছিল আমাদের।

কথায় কথায় শরীর গতিকের কথা উঠল। আমার হাই ব্লাডপ্রেশার, ওঁর তো তা রয়েছেই, তার ওপরে আবার ডাইবিটিস।

আমার ওই ব্লাডপ্রেশারই ভালো মশাই! ডাইবিটিস আমি চাই না।

চান না?

না। ব্লাডপ্রেশারে নুন না খেলেই চুকে যায়, সল্ট-ফ্রী খাবার হলেই হলো, কিন্তু ডাইবিটিসে সুইট-ফ্রী থাকতে হয়। সে ভারী মুশকিল। মিষ্টি না খেয়ে আমি থাকতে পারি না।

তা বটে।

সঙ্গে সঙ্গে ওঁর বাড়ির ভেতর থেকে ফরমায়েসী গরম গরম রসগোল্লা এসে পড়ল। তার সদ্ব্যবহারে লেগে বললুম, ডাইবিটিস হলে এসব আর মুখে তুলতে পারব কী। শুধু সেই একটিমাত্র মিষ্টি ছাড়া আর কিছুই তো মুখে তোলা যাবে না। এবং সেই মিষ্টিই বা পাব কোথায় এখন? এই বয়সে কে দেবে আমায় আর?

আমার কথায় তিনি মৃদু হাসলেন।

ব্লাডপ্রেশার নিয়ে খাসাই আছি বলতে কি! দুটি মাত্র ভয় তো, করোনারি গ্লুমবোসিস আর সেরিব্রেল হেমারেজ-এর। করোনারি আটকাতে চর্বিজাতীয় কিছু না খেলেই হোলো। চর্বিতচর্বণ বাদ দিয়েছি একদম। আর সেরিব্রেল হেমারেজের হাত থেকে রেহাই পেতে ওষুধ খাই। যা সব চমৎকার ওষুধ বেরিয়েছে না আজকাল!

কী করেন?

ডাক্তার যা বলেছেন। কাজকর্ম সব বন্ধ করে দিই, আডেলফিন উইথ ইসিড্রেক্স এক বটি খেয়েই না লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। সলিড কিছু খাই না আর তারপর। খালি হরলিকস্। ঐ বটি আর বিশ্রাম। দেখতে না দেখতে আরাম!

কি করে টের পান আসন্ন হেমারেজের?

মাথা ক্রিক্ ক্রিক করলেই বুঝতে পারি যে, গড়বড় হয়েছে হেড আপিসে। নইলে অকারণে সহসা তার এই ক্রিংকার কেন? যতক্ষণ না সে ঐ ক্রি রোডের মোড় থেকে ফিরেছে, স্বস্তি নেই আমার। ওষুধ খাবার আর বিশ্রাম নেবার খানিক বাদেই মাথা সহজ হয়ে আসে আমার। ওষুধ খাবার আর বিশ্রাম নেবার খানিক বাদেই মাথা সহজ হয়ে আসে আবার। তার পরে হরলিকস্ খেয়ে টানা ঘুম লাগাই। সেদিন আর কোনো কাজ নেই।

আরে মশাই, আমারো যে মাথা ক্রি করে মাঝে মাঝেই। তিনি জানান।

 কী করেন আপনি?

কিছুই না, কী করব? কাজকর্ম যা করার করে যাই তেমনি।

লেখেন-টেখেন তখনো?

নিশ্চয়।

কোনো ওষুধ-টষুধ খান না? ঐ ইসিড্রেন্স অ্যাডেলফিন…

কেন খেতে যাব অকারণে? তাছাড়া, না লিখে কি থাকা যায়? দায় আছে না মাথায়? ডিউটি ফার্সট।

তা জানি। কিন্তু ওষুধ ফোরমোস্ট। সব কর্তব্য ফেলে রেখে ওষুধ খেতে হয় সবার আগে।

নারাণবাবু যেমন লেখা-পাগলা দেখা গেল, আমার ভয় হল, কোনদিন না ঐ লেখার জন্যেই তিনি শহীদ হয়ে যান।

ওষুধ বেশি খেতে নেই, যখন তখন তো কখনই নয়। ওষুধের একটা প্রতিক্রিয়া আছে-সেই বিষক্রিয়াতেও ভুগতে হয় আবার। তিনি বললেন।

জানি। কিন্তু এই ভোগবতী বসুন্ধরায় ভোগ এড়াবার উপায় নেই। হয় অসুখে ভুগুন, নয় ওষুধে ভুগুন-ভুগতেই হবে আপনাকে। ওষুধে ভোগাটাই ভাল নাকি? হাজার প্রতিক্রিয়া হোক, আরাম আছে তার মধ্যে। আর ব্যারামে ভুগলে আপনারও কষ্ট, আপনাকে নিয়ে আশপাশের আর সবারও ভোগান্তি।

তা বটে। তবে ডাক্তাররাও কারণে-অকারণে ওষুধ খেতে বলেন না…

না বলুন। আমার মনের মধ্যে বলে যে! মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে–খা খা! ওষুধ খা। কাজকর্ম সব ফেলে রেখে শুয়ে পড় চট করে। করছিস কী? একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে তোর? শুনেই আমি শুয়ে পড়ি চট করে–একটা পিল ঠুকেই না। ওষুধের ব্যবস্থা দিয়েছে ডাক্তার-কাজ তার সেইখানেই খতম। তারপর থেকে আমার মতিগতির বাধ্য আমি। মনের কথায় চলি। সব বিষয়ে সব সময়।

জানি বই কি। সেই জন্যেই বাধ্য হয়ে আমায় ডাক্তার বদলাতে হয় যে!

ডাক্তার বদলাতে হয়?

হবে না? বেঘোরে মারা পড়লে কী করা যায়। বিশ বছর আমি হাই প্রেশারে ভুগছি–এর ভেতর আমার তিন তিনটে ডাক্তার ঐ বোগেই স্বর্গীয় হয়েছেন–দুজনে মারা গেছেন, একজন পক্ষাঘাতে পড়ে। চতুর্থ ডাক্তার, আমার বন্ধুতুল্যই, ডাঃ কে. পি. রায়কে ধরেছি এখন, জেনেছি তাঁরও ঐ প্রেশার, তাই করজোড়ে তাঁকে নিবেদন করেছি-দোহাই। আমি মারা যাবার আগে যেন মহাপ্রয়াণ করবেন না দয়া করে। তাহলে আমায় দেখবার কে থাকবে? যে-ঔষধ আমার জন্য ব্যবস্থা করেছেন, আপনিও তাই খাবেন দরকার পড়লে, অন্যথা না হয়।

তবেই বুঝুন, নিজেদের ওষুধ নিজেরাই কেন খান না ডাক্তাররা। ওষুধেরও একটা বিষক্রিয়া আছে যে! বোগের থেকে যার বিপদ কম নয়।

দুই নিয়েই আমাদের চলতে হয়, বাঁচতে চাইলে চলতে হবে–উপায় নেই। যাক গে, ওকথা থাগে, আপনি ওষুধ খাবেন মোটের ওপর। রোগে যতটা ক্ষতি করে ওষুধ নিশ্চয় তার বেশি ক্ষতিকর নয়।

এই কথা বলে, যে কথাগুলি বলতে আমার বেধেছিল, বেশ সঙ্কোচ বোধ করেছি–সে কথা আমার ছিল না, ছিল আমার মার।

মা বলেছিলেন, অসুখ আর ওষুধ দুয়েরই বিষক্রিয়া মার কৃপায় নিরাকৃত হয়ে যায়। তোর বাবা বলতেন, ঔষধে চিন্তয়েৎ বিষ্ণু ওষুধ খাওয়ার আগে বিষ্ণুকে স্মরণ করবে। সেই বিষ্ণু কে? ওই দুর্গাই। তিনিই বিষ্ণুর শক্তি–তাঁকে বাদ দিয়ে বিষ্ণুর কোনো শক্তি নেই। চন্ডীতে বলেছে না? ত্বম্ বৈষ্ণবী শক্তিরনবীর্যা/বিশ্বস্য বীজমপুরমাসি মায়া/সমোহিত দেবি সমস্তমেতৎ/ত্ব প্রসন্না ভূবিমুক্তি হতু। সব শক্তি, সবার শক্তি ঐ মা দুর্গাই। কিন্তু তাঁর বাহন চাই। বাহন না হলে তিনি কাজ করবেন কী দিয়ে। কাকে নিয়ে? ওষুধই সেই বাহন। ওষুধই হলে গিয়ে সেই বাহনসিংহস্বরূপ-যে-বাহনে ভর দিয়ে তিনি অসুখরূপী অসুরকে সংহার করেন, বশীভূত করেন। মার কৃপায় ওষুধ আর অসুখ দুই-ই সমীকৃত হয়ে যায় তার পায়ের তলায়!

কিন্তু ওসব কথা নারায়ণবাবুর ন্যায় বুদ্ধিজীবীর কাছে ফলাও করতে কেমন যেন আমার আটকে ছিল সত্যিই। উনি কি বিশ্বাস করবেন? আমার দুর্বলতায় হাসবেন মনে মনে।

বুদ্ধিদীপ্ত তার সম্মুখে আমার প্রগম্ভ কণ্ঠও কুণ্ঠিত হয়েছে। উনি কি বিশ্বাস করবেন আমার কথাটা?

কিন্তু বিশ্বাস করা না করার কোনো প্রশ্নই ছিল না। মা বলতেন, তাকে জানানো নিয়ে কথা, অবিশ্বাস করে বললেও ফল হবে–বিশ্বাস না করে আগুনে হাত দিলে কি হাত পোড়ে না? সব কিছুই বাজিয়ে দেখতে হয়, এমন কি ঐ ঈশ্বরকেও। জীবনে অসুখবিসুখ দুঃখ দুর্বিপাক ইত্যাদি আসে কেন? ঈশ্বরের পরিচয় পাবার জন্যই তাকে বাজিয়ে নেবার জন্যই তো!

এতই যদি তাঁর স্নেহ, আমি বলেছি, এসব দুঃখ দুর্যোগ আসেই বা কেন আদপে? তিনি কি আগের থেকেই রুখতে পারেন না এসব?।

তা কী করে হয় রে। তবে তো সব গুটি সরিয়ে খেলার ছকটাই গুটিয়ে নিতে হয় তাহলে। গোটা মায়াটাই কেটে যায় তবে-সমস্ত খেলাটাই মাটি। পাত্তাড়ি গুটোতে হয় সবাইকে। এই জগৎ-সৃষ্টি-সংসার, মা ছেলে ভালোবাসাটা কিছুই থাকে না আর!

না না না। আমি প্রতিবাদ করেছি-ভালোবাসাটা চাই আমাদের। চাই-ই। নইলে বাঁচবো কী নিয়ে? থা কী নিয়ে আমরা?

তবে বোঝ। তাহলে এই বসুন্ধরারও দরকার। ঐ ভালোবাসার জন্যই। নইলে সেই কেন্দ্রমূলে গিয়ে বিন্দুমাত্র হয়ে থাকায় কোন লাভ নেই। সেই তন্মাত্র অস্তিত্বের যদি কোন মূল্য থাকত, পরমেশ্বর স্বয়ং সাধ করে নিজের মায়াবৃত্ত ফেদে তার ভেতরে জড়াতে যেতেন না; মজা তো এইখানেই-এর মধ্যেই–এই মায়াবৃত্তে-মহামায়ার বৃত্তান্তে। আমরা ছোটখাট মায়াপাশে বদ্ধ, আর তিনি বেঁধেছেন মহামায়াপাশে আপনাকে। মুক্তি নেই কোথাও।

মার কথায় কবিগুরুর কথাটা আমার মনে পড়েছিল-মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় আছে? আপনি প্রভু সৃষ্টি বাধন পরে/বাঁধা সবার কাছে।

সবই ভালো। কিন্তু কেন যে এই সব দুঃখ দুর্বিপাক দুর্যোগ দুর্ভোগ… আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিলাম। –এসব নইলে কি চলতো না আর?

খেলার নিয়মেই এইসব। অঙ্কের ছকে বাঁধা। সেন্টার রেডিয়াস্ সার্কল–এই তিন নিয়েই তো সব। সার্কল-এ এসে বৃত্তপথে বৃত্তিপথেই এদের উৎপত্তি। বৃত্ত ধরে প্রবৃত্তি পথে এগুলেই পদে পদে বাধা পড়ে, মার নাম করে তাঁর সাহায্যে কাটাতে হয় এসব। কেন্দ্রেও যে বিন্দু, সেই বিন্দু রেডিয়াসেও, আবার বৃত্তপথে এসেও সেই বিন্দুই-একই বিন্দুবাসিনী। সবারই সমান শক্তি-তুল্যমূল্য সব। সর্বত্রই আত্মবিস্তার-প্ৰয়াস। সবাই নিজের গতিমুক্তি খুঁজছে। নিজের বৃত্ত রচনা করতে পারাতেই সেই বিমুক্তি। মনের মুক্তি যেমন মন্ত্রে–সুরে সুরভিতে সৌন্দর্যে। মন্ত্রের ঐ ক্রিয়াগুলি বৃত্তিগুলি আমাদের মধুর বৃত্ত। কিন্তু ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া রয়েছেই। বৃত্তও যখন উল্টে নিজেকে চাউর করতে চায়, সেই চেষ্টায় অসুর সৃষ্টি হয়–অসুখ দুঃখ দুর্ভোগ ইত্যাদিরা জোটে–তাই হচ্ছে বৃত্রাসুর। বৃত্তি থেকে বৃত্ত থেকে যা ত্রাণ পায় তাই। মার সাহায্য নিয়ে বৃত্রাসুরকে সংহার করতে হয়। বধ করেন বিই-মার সেই বৈষ্ণবী শক্তিই।

তুই দুর্গার পটের মধ্যে জীবনের পুরো ছকটাই পাবি। কেন্দ্রমূল, মধুর বৃত্ত, অসুর বৃত্ত সব কিছুর। সবই আছে তার ভেতর-সবটারই দরকার-সমস্তই চাই। নিজের বাহন সিংহের ওপরেও-মার যেমন বুকি, অসুরের প্রতি ঝোঁক তার কিছুমাত্র কম নয়। বেশিই বরং। দেখবি মা ডান দিকেই ঝুঁকে রয়েছে।

ওষুধ হচ্ছে সিংহ, মার বাহন। আর ঐ অসুখ হলো গে অসুর। পরস্পরের অপোজিং পাওয়ার–কিন্তু মাকে টের পাওয়ার জন্য দুটোরই দরকার। মাকে মনে রেখে ওষুধ খেলি, সেরে গেলি, সঙ্গে সঙ্গে মার পরিচয় পেলি। এখন তখন, এই যাস কি সেই যাস, বিপরিত ফলও হতে পারে–কিন্তু মাকে মনে করে খেলে উলটো উৎপত্তির ফাড়াকেটে যায়–তুই রক্ষা পাস।

সব কিছুরই পজিশন আর অপোজিশন আছে–সব সময়েই। জীবনের পদে পদেই বিপদ আর সম্পদের দেখা পাবি-পাবি তোর মায়ের পরিচয়।

দুঃখ দুর্যোগের পাথারেই তো ভগবতীর সাক্ষাৎ। সেই কষ্টিপাথরে কষেই মার অস্তিত্বের বিচার। যে-ঈশ্বর আমার অসুখে-বিসুখে আপদে-বিপদে কাজে লাগে না সে-ঈশ্বরকে নিয়ে আমার কী কাজ?

কিন্তু তাঁর কথাটা মা যেভাবে বলেছিলেন তেমনি ফলাও করে নারায়ণবাবুকে বলাও কী যেত আমার!

কামারশালায় গিয়ে ছুঁচ বেচার মতই গোয়ার্তুমি হত না কি!

ছোট ছেলে হলে বলা যায়। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোন প্রশ্নই থাকে না। ঈশ্বরকে হাতে হতে বাজিয়ে দেখার কথায় তারা মজাই পায়। ঈশ্বরকে নিয়ে খেলাই যেন এক রকমের।–খেলার সাথীকে নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে যায়। তখন তখনই বাজাতে লেগে যায়–আমি যেমন ঐ করে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করতে লেগেছিলাম একদিন। জীবনভোর সেই বাজনা চলে-ঈশ্বর আর নিজের কাজ দুই-ই বেশ বাজানো যায় একসঙ্গে।

এই হেতুই কি সেকালে ঐ ব্রহ্মবিদ্যার প্রথম দীক্ষা কৈশোরের সেই উপনয়নেই দেওয়া হত নাকি?

জীবনের রান্ শুরু হবার গোড়াতেই এই সুরটা ভাঁজবার বোধহয়। নইলে বয়েস গড়িয়ে বুদ্ধিবৃত্তিতে পৌঁছে নারাণ হয়ে যাবার পর এমন কথা আর পাড়া যায় না বুঝি।

অতএব ক্যাম্ দেম্ ইয়ং! এ যুগের উপযোগী করে ইস্কুলের প্রাথমিক পাঠেই সেই নব নবীনদের কাছে এই প্রণবমন্ত্রের দীক্ষাদান হোক। মা-ফতেমা, মেরীমাতা কিংবা গায়ত্রী দেবীর কাছে (আসলে সবই সেই দুর্গাই) এই পুনর্নবনধারণের প্রার্থনা।

তবুও আমার মনে দুঃখ একটা রইলই! কথাটা তাঁকে বলতে আমার কী হয়েছিল? অপদস্থ উপহসিতই হতাম না হয়…তবুও যদি উনি কখনো ভুলেও ব্যাপারটা পরখ করে দেখতেন…মেঠায়ের স্বাদই তার মিষ্টতার প্রমাণ দিত, আমার কথার কোনো অপেক্ষা রাখত না তার পর।

হাজার ঘুণ হলেও তাঁর কাছে কি ঘুণাক্ষরেও কথাটা বলা যেত না!

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে, বাবার কাছেই কেমন নাজেহাল হয়েছিলাম একবার এই কথা কইতে গিয়ে। মার কথাটা পাড়তেই না ফোঁস করে উঠেছেন তিনি-যাঃ যাঃ। আমার কাছে আর তোর দুর্গার মহিমা ফলাতে আসিস না। আমি কি তোর মার মতন শাক্ত নাকি? ত্বমীশ্বরং ঈশ্বরানাং পরমঃ-আমাদের সন্ন্যাসীদের কাছে দেবাদিদেব সেই মহাদেব ছাড়া কিছু নেই। আর আমিই হচ্ছি সেই শিব। বুঝেছিস? চিদানন্দরূপ শিবোহ শিবোহ!

বলেই তিনি ভোম হয়ে রইলেন।

মার কাছে গিয়ে বাবার কথাটা পাড়লে তিনি বললেন–পাগল! ভগবতীর ওপরে আবার কেউ আছে নাকি রে? ভগবত্যাঃ পরং কুতঃ ভগবান নহি বিদ্যতে!

মা কী বলে জানো বাবা? ভগবত্যাঃ পরং কুতঃ ভগবান নহি বিদ্যতে…বাবার কাছে মার কথাটা গিয়ে কুঁথিয়েছি।

কোন্ শাস্ত্রে বলেছে? জেনে আয় গে, কোন্ সুক্তে আছে কথাটা? বললেই আমি। মেনে নেব নাকি? বললেন বাবা-জেনে আয় কার সুক্ত এটা।

কার সুক্ত–তার মানে?

সুক্ত থাকে না। যেমন ধর, তোর ঐ দেবীসুক্ত–চভীর গোড়াতেই রয়েছে। অঙ্কুণী ঋষির কন্যা বিদুষী বাক্-এর সুক্ত সেই–যাতে আছে ঐ–অহমেব রুদ্রেভিঃ বসুভিরামি/অহমাদিতৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।– ও! সেইটে! আমিই ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর সবাইকে রাচ্ছি–সেই কথাটাই বলছো তো? ওটা তো ঠিক মার কথাই, তাই না?

চরামি মানে চাচ্ছি নয়। তোকে ধরে আমি যদি একটা চড় কসাই তাহলে আমার রাগ যায় বটে, তবে চরামি হয় না-শুনেই আমি তিন হাত পিছিয়ে আসি-এখানে রামির অর্থ হচ্ছে তাদের সাথে বিচরণ করি। বুঝেছিস? না, আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেব তোকে?

শুনেই আমি সরে পড়ি সেখান থেকে। সুক্তর কথাটা পাড়ি গিয়ে মার কাছে এবার। জানা যায়, কোনো শাস্তরের কথা নয়

মা বললো যে, ওটা মার সুক্ত। আর কারো না। বুঝেছো?

তোর মার সুক্ত?

হ্যাঁ। বাক্-টাকের নয়। তাই বলল মা।

বুরবাকের মত কথা।

কেন, মার সুক্ত কি হতে পারে না? মা কি বানাতে পারে না নাকি? রোজ রোজ যে সুক্ত রাঁধে মা?

সুক্ত না ছাই! মুখ বিকৃত করেন বাবা–মুখেও তোলা যায় না–যাচ্ছেতাই!

একথাটা তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। মার সুক্তরা ভারী অখাদ্য। এক কথায় সায় দিয়ে বাবার সঙ্গে আমার সন্ধি হয়ে যায়।

কিন্তু নারাণের শোক কিছুতেই ভুলতে পারি না। যখনই কোথাও কোনো অপঘাত ঘটে, বুকটা আমার ছাঁত করে ওঠে, যখনই কোনো ছেলে পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহনন করে, কি দুটি ছেলেমেয়ে ভালোবেসে ছাঁদনাতলায় গিয়ে মিলতে না পেরে পৃথিবীর থেকে পিঠটান দেয়, তখনই আমার মন টন টন করেনতুন করে দুঃখটা উথলায়, মনে হয়, এ আমার অপরাধ-এর জন্যে আমিই দায়ী। আমিই যেন অপরাধী।

কবে সেই ছেলেবেলায় মার কাছ থেকে এই বিশল্যকরণী মৃতসঞ্জীবনীর মন্ত্র পেয়েছিলাম, হেলাফেলায় যার ব্যবহার করে সব ফাড়াকাটিয়ে এসেছি, যে-ভেলায় চেপে অবহেলায় উতরে এলাম ঝাবিক্ষুব্ধ এই জীবনের পারাবার, সেই কথাটাই আমি বলে যেতে পারলাম না কাউকে–আমার ভাইবোনদের, দেশের ছেলেমেয়েদের-কাউকেই না। এই দুঃখটাই বড় হয়ে রইলো আমার।

যদিও ঠিক আমার নয়, আমার মারও নয় কথাটা–আমাদের সাবেক কালের কথাই পরমহংসদেব বলে গেছেন এসব কথাই, কিন্তু একালের ছেলেদের কানে কি করে একথা পৌঁছানো যায় কী ভাবে কোন্ ভাষায় বললে তারা শুনবে–তা কি আমি বলতে পারব। ভারতবর্ষের প্রাণের কথা-সেই ভগবানের কথাই বটে, কিন্তু এ যুগের সংঘাত সমস্যায় কী করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে? কষ্টের পাথর চিরকালই রয়েছে–সর্বজনের সম্মুখেই–দিনদিনই থাকবার–সেই-কষ্টিপাথরে তার যাচাই করার কথাটাই কেবল! কিন্তু কী করে বলা যায়!

সাধুসন্তরা ভগবানের কাজে লাগবার কথা বলেছেন, তাঁর সেবা করবার কথাই। আমার মতন অসাধু স্বার্থপরের কথা হচ্ছে আলাদা–আমরা ভগবানকেই নিজেদের কাজে লাগাতে চাই–তাকেই সেবক বানাবার আমাদের সানা।

কিন্তু ভগবান কখনো কারো কাজে লাগেন না, কাজে লাগাবার নয়, পিতৃতুল্য তাঁর সে রকম কোনো মতলবই নেই আপদে, বলতেন মা। মা-ই ছেলেদের কাজে লাগেনতাদের সেবায় সজাগ রয়েছেন সর্বদাই–সেই মা-ই একমাত্র।

সেই মাকেই আমাদের চাই।

এবং একটু ডাকলেই তাঁকে পাই। যা পাওয়ার, যা যা চাওয়ার, পেয়ে যাই তাঁর কাছেই।

 কী করে তাঁকে পাওয়া যায়? তুমি কি পেয়েছে মাকে? দেখেছো মাকে? ঠিক করে বলো আমায়। শুধিয়েছিলাম আমি।

দুর বোকা! মাকে কি চর্মচক্ষে দেখা যায়? দেখতে পায় কেউ? তাঁর স্নেহের মধ্যেই তাঁর দর্শন মেলে। বরাভয়েই তাঁর পরিচয়। তাঁকে ডেকে যখন কোনো সঙ্কট থেকে ত্রাণ পাই, তখনই তাঁর দেখা পেলাম। যখন তিনি স্তন্য দেন, তখনই তো মা। অন্নপূর্ণা মাকে স্তন্যপূর্ণারূপেই দেখা যায়। দুহিতা হয়েই তিনি দর্শন দেন।

তার মানে?

 মা নিজেই কি তা জানিয়ে যাননি? কতবার তো বলেছেন!

বলেছেন? কোথায় বলেছেন? জানিনে তো।

ঐ বাকসুক্তেই বলেছেন। সেটা অবশ্যি মন্ত্রের ভাষা। তাছাড়াও মার জানাবার ভাষা আছে আরো। তাঁর ওই প্রতিমার ভাষা। সে ভাষা বোঝা একটু শক্তই বটে, কিন্তু খোলাখুলিও বলে গেছেন আবার। রামপ্রসাদের কাহিনীটা জানিস না? তিনি ঘরের বেড়া বাঁধছিলেন, বাঁধনের দড়া ফুরিয়ে গেছে, ঘরের ভেতরে মেয়েকে ডেকেছেন–কাতাটা দে মা! মেয়ে এসে বেড়ার ফাঁকে গলিয়ে বাবার হাতে বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়ে কিন্তু যোগায়নি তা, ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল সে, বাবার ডাক কানেই যায়নি তার। মা কালী মেয়ে সেজে এসে নিজে যুগিয়ে গেছেন।

ঘরের বেড়া বাঁধার ছলনায় ওই রামপ্রসাদকেই মায়ার বাঁধনে বাধতে-যে মায়া নাকি নেহাত মিথ্যেই–নিজে এসে কাতা বাড়িয়ে দিয়েছেন কাত্যায়নী!

হাঁ হাঁ, জানি না। তাঁর গানেই রয়েছে তত-রামপ্রসাদের বাঁধলো বেড়া।

তারপরে কলকাতার কাছেই কোথায় কাঁকনতলার ঘাট আছে জানিস? এক পূজারী বামুন রাতদিন ডাকতো মাকে, কেউ কোথাও ছিল না তার, একদিন এক শাঁখারী এসে বলল, তোমার মেয়ে পুকুরঘাটে পৈঠায় বসে শাঁখা কিনেছে আমার থেকে, তার দাম দিতে বলেছে তোমায়। দামটা দাও।

মেয়ে কোথায়! তিন কুলে কেউ নেই আমার! গরিব মানুষ, কোথা থেকে দেব শাঁখার দাম।

শাঁখারী ফিরে গেল পুকুরঘাটে। পূজারী ঠাকুরের কথাটা মেয়েকে গিয়ে বলতেই সে বললো, বাবাকে বলো গে, লক্ষী ঠাকরুণের ঝাঁপিতে সিঁদুর মাখা টাকা আছে একটা-সেইটে দিতে বলল।

শুনেই ঠাকুর টের পেয়ে যায়–এ মেয়ে তার কে! হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় ঘাটে কোথায় কে! কেউ কোথাও নেই। শাখারী তখন কাঁদতে থাকে এই বলে–কোথায় গেলি মা? আমাকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে গেলি! আর পূজারী কাঁদে এই বলে-শাঁখারীর কী ভাগ্যি, কি ভাগ্যি! সে তোর দেখা পেল। আর আমি কী হতভাগ্য, আমি তোর দর্শন পেলাম না। তখন সেই পুকুরের মাঝ থেকে দু খানি হাত উঠলো শাখা-পরা। দুহতেই শঙ্খকঙ্কন। দেখে সব সন্দেহভঞ্জন হোলো দুজনের। মা যেমন মন্ত্রের ভাষায়, প্রতিমার ভাষায় কথা কন, তেমনি ঐ প্রতীকী ভাষাতেও। তাঁর দেখা পেতে হলে বৃত্তপথে বৃত্তির পথেই দেখতে পাই-দোহন করলেই দেখা পাই তাঁর-দুহিতা রূপেই তিনি দেখা দেন। দুহিতা হলেই। মা নিজেই তো বলে গেছেন কথাটা–বললেন আমার মা।

বাবাও একবার বলেছিলেন যেন এই রকমটাই। গো অর্থে পৃথিবী, গো আবার মাতাও। শ্রীকৃষ্ণের গোদোহনের অর্থ হচ্ছে এই পৃথিবীকে দোহন করা। পার্থিব জগত থেকে অপার্থিব রস আহরণ। তিনি এই দোহনবৃত্তির ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন আমাদের।

মার কথাটা মনে ধরেছিল আমার। যাঁর স্নেহধারায় আমাদের পুষ্টিতুষ্টি–বাছুরের মতন তাঁকে ঢুঁ মেরে মেরে দোহনের জন্যেই আমরা। দোহনের হেতুই ভগবান–দুইবার জন্য, দুয়ে নেবার জন্য তো।

ভগবান কি গোরুর অধম হতে পারে?

– সমাপ্ত –

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *