২১.
অবশেষে একদিন পার্শেলটা এল।
স্কুলের পথে পোস্টাপিসে খবর পেয়েই মামার নামের ফর দিয়ে ফরফরিয়ে আমার সই করে সেটার ডেলিভারি নিয়েছি।
সটান চলে গেছি ইস্কুলে-সিঙ্গিয়ার আমবাগানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করে।
বাংলার সার সীতানাথবাবু ততক্ষণে এসে গেছেন ক্লাসে।
পার্শেলটা দেখেই না লাফিয়ে উঠেছে সতীশ। অবশ্যি, বসে বসেই যতটা লাফানো যায়সারের নজর বাঁচিয়ে।
কী আছে রে ওতে? জানতে চেয়ে ফিসফিসিয়েছে পাশের ছেলেটি।
ডিকসনারি। ফাঁস করেছি আমি। দেখবি নাকি? দেখতে চাস? খুলব?
শুনেই সে আর দ্বিরুক্তি করেনি, দ্বিতীয় বার তাকায়নি সেদিকে–নাড়ানাড়ি করা দূরে থাক।
খানিক বাদে বলেছে, বিয়ের আগে কোনো নারীঘটিত ব্যাপারে থাকতে নেই ভাই! বি এ পাশ করার আগে কি কেউ ডিকসনারি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে?
নারী আর ডিকসনারির মধ্যে মিলটা কোনখানে? আমি জানতে চেয়েছিলাম।
নাড়ির সম্বন্ধ নেই? তার পাল্টা জিজ্ঞাসা।
আমাদের ভেতরে সে একটু পরিপক্ক বলতে হয়, কেননা তার পুরুষ্টু গোঁফ বেরিয়েছিল, বিয়ে হয়েছিল দিন কতক আগে। (তখনকার দিনে পাড়াগাঁয়ে বাল্যবিবাহ চালু ছিল বেশ) হয়ত সেই কারণেই ডিকসনারি নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা সে পছন্দ করেনি।
আমি আর সতীশ আর কথা না বাড়িয়ে পিরিয়ড শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
তারপরে পিরিয়ড কাবার হতেই স্কুল পালিয়ে সতীশ আর আমি চলে গেছি আমবাগানে পিস্তলের তাক বাগাতে।
ছায়াচ্ছন্ন নিরালা এলাকায় খোলা হল পার্শেল।
তিনটে পিস্তল এবং আরো কতকগুলো কী যে দেখা গেল তার ভেতরে!
তিনটে কেন রে? শুধালাম আমি সতীশকে।
এর একটা তোর, একটা আমার। তৃতীয়টা কার জন্যে কে জানে?
কেন, তুই জানিসনে?
লীডার জানে। বলেনি সে আমায়। আমিও জানতে চাইনি। সেরকম চেষ্টা করাও অন্যায়। শুধু জানিয়েছিল যে তিনটে আসবে মোটমাট।
আর এগুলো সব কি রে?
কার্তুজ। আমাদের টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্যে।
এত কার্তুজ?
লাগবে না? সহজে কি কারো নিশানা দূরস্ত হয় নাকি? অবশ্যি প্র্যাকটিসের পরেও বেঁচে যাবে এর অনেক। পরে সেগুলো কাজে লাগাব আমাদের। আমাদের কিংবা আমাদের দলের।
সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি প্র্যাকটিস করতে আসবে না?
তার হাত দূরস্ত আছে–আগের থেকেই। তাছাড়া সে যে কে তাও আমি জানিনা। লীডার আমায় জানাননি। টের পাবো সেই অ্যাকশনের দিন। কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পেলেও হয়ত তাকে দেখতে পাব না। মনে হোল বলতে গিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস যেন সে চাপল।
তিন তিনটে ঝকঝকে পিস্তল! বেশ দেখতে কিন্তু। আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি।
তাকিয়ে দেখার পর তাক করে দেখতে লাগি তারপর।
হাত তৈরি হবার পর সতীশ একদিন এসে জানাল-এই শোন! আমাদের কষ্ট করে সদরেও যেতে হবে না আর। ম্যাজিস্ট্রেট কি পুলিস সাহেবকে জেলায় গিয়ে মারতে হবে না। এখানেই আসছেন তাঁরা কদিন বাদে আর।
তাই নাকি? আমি জানতে চাই–কেন আসছে রে?
দুজন না হলেও ওদের একজন তো আসবেই নির্ঘাত। খবর পেয়েছে আমাদের লীডার।
ইস্কুল ভিজিট করতে বুঝি?
তা নয়। মীটিং করতে এখানে। বিলেতে যুদ্ধ বেধেছে না? বাংলাদেশে বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরি হচ্ছে সেইজন্যে। তার সোলজার রিক্রুট করতেই তাঁরা আসছেন। ইস্কুলের ছেলেদের কি এখানকার যুবকদের কেউ সেই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে চায় যদি।
বেঙ্গল রেজিমেন্ট? হ্যাঁ, দেখেছি বটে কাগজে। স্কুল-কলেজের অনেক ছেলে সৈন্যদলে নাম দিয়েছে তাও জানি।
এখন, আমাদের প্ল্যানটা কিরকম হবে শোন্। সভাটা হবে স্কুলের মাঝখানে ড্রিল মাঠে সামিয়ানা খাটিয়ে–যেমনটা হয়ে থাকে ফি বছর প্রাইজ বিতরণ উৎসবের সময়। তবে এবার জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিস সাহেব আসছেন না? তাই এবার আরো জমকালো হবে সভাটা।
তা তো হবেই। সে আর বলতে হয় না।
যেমন হয়ে থাকে, সভার একধারে হবে ডায়াস–সেখানে চেয়ার সাজিয়ে বসবেন ঐ সাহেবরা, গাঁয়ের গণ্যমান্য যতো লোক, রেকটার, হেডস্যার আর মাস্টার মশায়রা, এমনি আমার আন্দাজ। আর তার সামনে সারি সারি পাতা বেঞ্চে বসব শুধু আমরা যত ছাত্ররা।
ফি বছর বসে যেমন। তার আন্দাজে আমার ঢিল ছোঁড়া।
তুই বসবি গিয়ে একেবারে সামনের সারিতে, বুঝেছিস। পকেটে গুলিভরা পিস্তল নিয়ে। আর আমি বসব ঠিক তোর পেছনে–কয়েক সারি পিছনে–আমার পকেটেও থাকবে পিস্তল।
তোর পিস্তল কিসের জন্যে রে! তুই কাকে মারবি আবার? আমি ভেবে পাই না, ও বুঝেছি। পাছে আমার হাত কাঁপে, তাক ফসকে যায় যদি–তাকে শেষ করার জন্যেই বুঝি তুই…? মানে, আমার লক্ষ্য তেমন ঠিক হয়নি এখনও তোর ধারণা?
না, না, সেজন্যে নয়। সে বলে : তাক কেন ফসকাবে তোর? তোর নিশানা অব্যর্থ। আমি দেখেছি। না, সেজন্যে নয়…
তবে কিসের জন্যে? তোর পিস্তল আবার কেন তাহলে?
তোর জন্যেই রে। বলে সে একটুখানি হাসে।
তার হাসিটা আমার তেমন ভালো লাগে না। হেঁয়ালীর মতই লাগে কেমন! আমার জন্যে তার মানে? আমার পিস্তল তো রয়েছেই, তার ওপরে আবার কেন? আমারটা যদি কোন কারণে জ্যাম হয়ে যায়, যথা সময়ে গুলি না বেরয় যদি?
তোর পিস্তলটা যেমন তোর জন্যে, আবার ওই সাহেবটার জন্যেও যেমন, আমার পিস্তলটাও সেই রকম আমার জন্যেও-ফের আবার তোর জন্যেও তেমনি।
আমার জন্যও তেমনি? তার মানে?
তা আমি বলব না। মানা আছে বলবার। বলে সে একটুখানি ঢোঁক গেলে-সব কথা কি সবাইকে সব সময় বলা যায়?
আমি কি সবাইকার মধ্যে হলুম? আমি তোর বন্ধু না? ফোঁস করে উঠি : এক পার্টির ছেলে না আমরা?
বলতে পারি। গোপনে। কাউকে বলবি না বল?
বলব নে? এসব কথা কি বলাবলির?
যক্ষুনি তুই পুলিস সাহেবকে গুলি কবি, আর সে পড়ে যাবে-সেই মুহূর্তেই তোকে গুলি করতে হবে আমায়। বুঝেছিস? লীডারের এই হুকুম।
আমাকে মেরে ফেলবি! তুই! তার পিস্তলের তাক হবার আগেই যেন আমার তাক লেগে যায়।
আমি না মারলেও তোকে তো মরতেই হবে–তা কি তুই জানিসনে? গুলি করার পরই তো ধরা পড়ে যাবি। পুলিসের হাতে ধরা পড়বি তুই। চেনা ছেলে, সবাই তোকে চেনে, পালাবি কোথায়? আর ধরা পড়লেই তোর ফাঁসি হবে। হবে না?
তা হবে। তা হবে বটে। আমতা আমতা করে মানতেই হয় আমায়। কিন্তু তাই বলে ফাঁসি যাবার আগেই…এই ভাবে মারাটা…মারা যাওয়াটা… আমার কথা আটকে যায়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে কি একটা যেন ঠেলে উঠতে থাকে। কান্নাই নাকি?
সেই তোকে মরতেই হবে। সেই মরবি কিন্তু পুলিসের হাতে অনেক মারধোর খেয়ে, অনেককে মেরে তার পরে মরবি-তার চেয়ে আগেই খতম হয়ে যাওয়াটা কি ভালো নয়? তোর পক্ষেও ভালো, দলের পক্ষেও।
দলের কাকে আমি মারতে যাচ্ছিলাম! কাউকেই তো চিনি না আমার দলের।
ধরা পড়ার পর থানায় নিয়ে পুলিস যা বেধড়ক মার লাগাত না, পুলিসের সেই পিটুনির বহর তো জানিসনে…জানলে তুই ঢের আগেই মরতে চাইতিস–নিজেকেই নিজে গুলি করে মরতিস। কিন্তু তখন আর সে উপায় নেই তোর। লেট হয়ে গেছে।
খুব মারে বুঝি পুলিস? থানায় নিয়ে গিয়ে খুব কষে ঠ্যাঙায়?
মারে না? নখের মধ্যে পিন ফুটিয়ে দেয়, কম্বলে মুড়ে রামধোলাই লাগায়, ঠ্যাং বেঁধে কড়িকাঠে লটকে ঝুলিয়ে রাখে…।
এই উলটো ফাঁসিটা কেন? আগের থেকে আসল ফাঁসির মহড়া দিয়ে রাখতেই নাকি?
কষে চাবকাবার জন্য, আবার কেন? তারও পরে আরো আছে…ন্যাংটো করে বরফের চাপড়ার ওপরে শুইয়ে রাখে…
ন্যাংটো করে? না না, ন্যাংটো হতে আমার ভালো লাগে না একদম।
প্রবল আপত্তি আমার খালি গা হতে লজ্জা করে ভারী।
তোর আপত্তি তারা শুনছে কি না। কারো লজ্জাফজ্জার ধার ধারে কি না তারা!
সতীশ বেআবরু করে। কেন, খালি গা হতে লজ্জাটা কিসের তোর? আমরা তো হেসটেলের ছেলেরা কেউ কেউ ফুটবল খেলার শেষে সন্ধ্যেবেলায় এসে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ি গিয়ে-পাড়ের ওপর প্যান্ট-শার্ট সব খুলে রেখে-খালি গায়ে সাঁতার কাটি কেমন আমাদের কই লজ্জা করে না তো।
আহা, তোর মতন শরীর হত যদি–দেখাবার মত অমন-আমারও খালি গা হতে লজ্জা করত না তাহলে, ইচ্ছেই করত বরং। কিন্তু দেখছিস তো এই প্যাঁকাটির মতন চেহারা, হাড় বার করা জিরজিরে এই শরীর নিয়ে কেউ কি কারো সামনে খালি গা হতে চায়?
সে আমি জানি না ভাই, তবে শোয়বেই ওরা বরফের চাঙাড়ে। এবং একেবারে দিগম্বর করে- কিছুতেই ছাড়বে না। যার যা দস্তুর। বরফের ওপর শুতে কেমন লাগে জানিস?
খেতে তো ভালোই জিনিসটা, শুতে কেমন কে জানে! কখনো তো শুয়ে দেখিনি।
দেখতে পাবি বেঁচে থাকলে। টের পাবি হাতে হাতে তখন। দেখতে চাস নাকি?
না, কিন্তু শোয়াতে যাবে কেন তারা? তাতে লাভ তাদের? তারা তো সোজাসুজি নিয়ে আমায় ফাঁসিতে লটকে দিলেই পারে। শেষমেস তাই যখন লটকাবে, লটকাবেই ছাড়বে না, তখন তার আগে মড়ার ওপর এত খাঁড়ার ঘা মারাটা কিসের তবে?
কনফেসন আদায় করতে তোর। তোর দলে আর কে কে আছে তাই জানবার জন্যেই…
দলের কাউকেও তো আমি জানি না ভাই! কী জানাব? কার নাম করবো?
আমাকে তো জানিস। যন্ত্রণার চোটে আমার নামটা বলে দিবি নিশ্চয়। না বলে পারবি না। পার পাবি না। তখন তারা আমাকে পাকড়ে নিয়ে গিয়ে ওই সব কাভই করবে আবার। মারের চোটে আমিও বলতে বাধ্য হব তখন-যার নাম জানি তার। এই করে করে শেষ পর্যন্ত গোটা দলটাই ধরা পড়ে যাবে আমাদের। সেই কারণেই তোকে এই অঙ্কুরেই বিনাশ করা।
শুনে আমি গুম হয়ে যাই। অঙ্কুরিত কিনাশের সম্মুখে প্রস্ফুটিত হবার কোনো উৎসাহ পাই না।
সে কিন্তু গুমরে ওঠে তার পরেই–পার্শেলের মধ্যে মোট নিটে পিস্তল ছিল, মনে নেই তোর?
হ্যাঁ, ছিল তো। বেশ মনে আছে।
তার মানেটা কী জানিস? বলে সে একটুখানি থামে-অকালে মরার জন্যে মন খারাপ করছে তোর? মনে কোনো দুঃখ রাখিসনে। কিচ্ছু ভাবিসনে। আমিও তোর সহযাত্রী ধরে নে না! তোর পরে আমিও হয়ত এই পৃথিবীতে আর থাকব না। ওই তৃতীয় পিস্তলটি, মনে হচ্ছে আমার জন্যেই হয়ত।
তোর জন্যে? তার মানে? অন্য আরেক ধাঁধার সামনে আমি বাধা পাই আবার।
মানে, সেদিন হয়ত কে জানে, সেখানেই আর কেউ অমনি বসে থাকবে আমার পেছনে আমাকে মারবার জন্যে তা করে! সঙ্গে সঙ্গে সাফ করে দিতে আমায়। কেউ বলতে পারে?
তোদের লীডার না কি? না অন্য কেউ?
কী জানি কে? আমি কী জানি?
নিজের মধ্যে এই খুনোখুনি? না ভাই, ব্যাপারটা আমার একেবারেই ভালো লাগছে না। যাই বল তুই।
ভালো লাগালাগির কথা নয় তে, দলের কানুন। যে বিয়ের যা মন্তর বলে না? তাই।
.
২২.
অমন দুর্ধর্ষ জার্মান ফৌজ য়ুরোপ জুড়ে অতো লড়াই করেও যে ইংরেজদের মেরে ফৌত, করতে পারছে না, আমরা মুষ্টিমেয় বালক এখানে সেখানে তাদের এক আধটাকে কখনো সখনো খতম করে কি করে যে শেষ পর্যন্ত তাদের নিকেশ করব তা আমার হিসেবে আসেনা। আর সেই হেতু অকারণে অকালে এভাবে আমাদের নিজেদের হতাহত হওয়াটা একেবারের ভালো লাগে না আমার।
তাছাড়া এই খুনোখুনি কাণ্ডে একটুও প্রবৃত্তি হয় না, সত্যি বলতে।
কিন্তু কী করা যায়…
কোনদিকে যাই, কী করি, কোন পথ ধরি তাই আমি ঠাওর পাই না। আমার প্রবৃত্তি যে কোনদিকে, কে আমায় তা বলে দেবে?
শেষটায় বাবাকে গিয়ে পাকড়াই–প্রবৃত্তির পথটা আমায় বাতলে দিতে পারো বাবা!
প্রবৃত্তির কোনো কথাই নয়। নিবৃত্তিনিবৃত্তি! আবৃত্তি করেন বাবা-বললাম না তোক বোকা? হাত-পা-মন সব গুটিয়ে এনে পদ্মাসনে বসে একাগ্র হয়ে ধ্যান করতে হবে? এইভাবে নিবৃত্তিটা রপ্ত করতে পারলে, মানে, নিবৃত্তিই হচ্ছে আসল কথা। সত্যিকার পথ। যে পথে নাকি মোক্ষ।
বাবার মোক্ষম কথাটা মার কাছে গিয়ে ফাঁস করে উঠেছন মাতোকে বলেছে! তুই না। হয় হমুদ চেষ্টায় কোনোমতে নিবৃত্তিটা আয়ত্ত করলি, কিন্তু ভগবানকে নিবৃত্ত করে কে? কার সাধ্যি? তিনি তো কার কথা শুনবেন না-হতেই থাকবেন, যেমন কি হচ্ছেন। তেমনিধারা হয়ে যাবেন। নিজেকে গুটিয়ে নেবেন না কখনই। কিছুতেই। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারে? স্রোতের উল্টো মুখে কি যাওয়া যায়? গিয়ে লাভ? মারও সেই আগের কথারই পুনরাবৃত্তি আবার।
মার বক্তব্য আমার ভাষায় ব্যক্ত করি গিয়ে বাবার কাছে-আমি না হয় নিবৃত্ত হলাম বাবা! কিন্তু বাবা, ভগবানকে নিবৃত্ত করা যায় কি করে, করতে পারে কেউ? মা এই কথা বলছিল।
বিপন্নের মত মুখ করে তার জবাবে বাবা মাইকেলের গীতিকবিতা আওড়ান- সখি রে, বন অতি রমিত হইল ফুলফুটনে/পিককুল কলকল/অলিকুল চঞ্চল/চললো নিকুঞ্জে সখি, ভজি ব্রজরমণে। বিপদে পড়লেই, দেখেছি, তিনি মধুসূদনকে স্মরণ করেন।
তারপরে, বোধ করি, বিপদের কিনারা করার পর, তিনি নিবৃত্তির তত্ত্ব ব্যাখ্যায় বসেন ভগবান কি কারো পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন? ভগবতীর পরামর্শেই বোধ হয়–আমার এই গায়ে পড়া কথাটা গায়ে না মেখেই তিনি বলে যান-ভগবানের কথায় আমাদের কাজ কী বাবা? মহাজনরা যা বলে গেছেন তাই না শুনতে হবে আমাদের? মেনে চলতে হবে তাই না? তাঁরা বলে গেছেন, নিবৃত্তিই হচ্ছে পথ। আর সে পথে যেতে হলে… তিনি নাগাড়ে বলে যান : প্রবৃত্তির কোনো কথাই নেই। বলেই চলেন বাবা–নিবৃত্তিই হচ্ছে আসল কথা। নেতি নেতি করে এগিয়ে যেতে হয় কেবল… বলে বাবা তাঁর নেতিবাদের বিস্তৃত বিশদ বিবরণ দেন।
বাবার নেতৃত্বে আমার পথের কোনো হদিশ না পেলেও শোনার মতন বাণী শোনা যায় বিস্তর।
শোনার জন্য যেমন, তেমনি শোনানোর জন্যও বাণীর দরকার জানি, আর, অলঙ্কার গড়তে গেলে সেই সোনাটাই ঝালিয়েও নিতে হয় আবার। যদিও ঝালমরা বাদ দিয়েই খাঁটি জিনিস পাই আমরা, তেমনি বাবার কাছে শোনাটা মার কাছে ঝালিয়ে নিতে যেতে হয়।
শুনেটুনে মা বলেন, তাই করগে যা তবে-যা বলেছেন তোর বাবা। নেতি নেতি করতে করতে নিবৃত্তির পথে এগিয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে নেতিয়ে পড় গিয়ে। তাহলে হাতে হাতে মোক্ষ লাভ হবে।
বাবা তো সেই কথাই বলছেন মা? মোক্ষের কথা, নির্বাণের কথাই।
সব জ্বলা আর জ্বালা চুকিয়ে দিয়ে নিবে যাবার কথা। মুলে গিয়ে হাবাৎ হওয়া? এই কথাই বলেছেন তো তোর বাবা?
তোমার কথাটা শুনে বাবা কি বললেন জানো মা?…কোনো কথাই বললেন না, কেবল মাইকেল, না না, মাইকেলের মেঘনাদ নয়। আরেক আর্তনাদ ছাড়লেন। বলে মহাকবির ফুলকেলির কথাটা আমি প্রকাশ করে দিই তাঁর কাছে।
ওর মধ্যেই তাঁর অজান্তে ঈশ্বরের কথাই দৈববাণীর মত উক্ত হয়েছে…উহ্য রয়েছে… মা জানান : ফুল বরং বৃত্তচ্যুত হয় কিন্তু ভগবানের বৃত্তচ্যুত হবার কোনো কথাই নেই। বৃত্তকে ধরেই তিনি কেন্দ্রমূল। সর্বদাই তিনি তাঁর প্রবৃত্তির পথে ধাবিত। ফুল তিনি ফোঁটাতেই থাকবেন, অফুরন্তই, বনও রমিত হবে বারংবার সে-প্রবৃত্তি তাঁর কোনো কালে ঘুচবে না। অলিকুলের মধ্য দিয়ে তাঁর মাধুশ্রী বৃত্তিও কোনোদিন যাবার নয়। তাহলে?
তাহলে কী হবে তার জবাব আমি কী দেব? আমি বলি তাহলে আমার প্রবৃত্তির পথটা তুমি আমায় বাতলে দাও না! কী যে আমার পথ, কোনদিকে যে আমার প্রবৃত্তি তার। কিছুই তো আমি ঠাওর পাচ্ছিনে। দেখোদ্ধার করব, না, সাহিত্যিক হব, না…না…নাকি…।
নাকি, মাকে কেন্দ্র করে আমার রিনির বৃত্তপথেই ঘুরতে থাকব আমরণ, যেমন ঘুরছি এখন? কিন্তু নানান কথার সেই কথাটায় আর মুখ ফোঁটাতে পারি না, চুপ করে থাকি। মার কাছে আমার নাকি-কান্না কাঁদা যায় না।
কোনদিকে তোর মনের ঝোঁক টের পাচ্ছিসনে তুই? তাহলে তোর মার কাছে গিয়ে চাইগে যা, তিনিই তোর পথ ধরিয়ে দেবেন ঠিক…
আমার মার কাছে?
হ্যাঁ, তোর মা আমার মা সবার মা। আমাদের সবার মনের মধ্যে তিনি আছেন। তাঁর কাছে চাইগে যা। তোর সত্যিকার প্রবৃত্তি কিসে যে, তা তিনিই জানেন কেবল।
তুমি যে সেই ঠাকুরের মতই কথাটা বললে মা। তিনি যেমন মার কাছে পাঠিয়ে ছিলেন নরেনকে–তার যা দরকার তা চেয়ে নেবার জন্য। নরেন কী চাইতে গেল আর কী চেয়ে বসল শেষটায়। মানে, তিনিই চাইয়ে দিলেন বোধহয়। সে চাইতে গেল টাকাকড়ি, আর তাকে চাইতে হল ত্যাগ বিবেক তিতিক্ষা। কী ঝঞ্ঝাট দ্যাখো দিকিন। না, মার কাছে চাইতে আমার ভারী ভয় করে মা। না, তিতিক্ষা-ফিতিক্ষা আমার চাইনে। ওসবে আমার কী হবে? তিতিক্ষা মানে কী?
নরেন তার নিজের নয়, তার বাড়ির চাহিদাটা চাইতে গেছল, তিনি তাকে তার মনের চাওয়াটা ধরিয়ে দিলেন কেবল। নরেন থেকে বিবেকানন্দ বানালেন তাকে। ত্যাগ বিবেক তিতিক্ষার দিকেই অন্তরের ঝোঁক ছিল তার, সংসারের দাবীর কাছে নিজেরটা তিনি দাবিয়ে রেখেছিলেন…মা তাঁর সেই সত্যিকার প্রবৃত্তির পথটা মুক্ত করে দিলেন কেবল। মার কাছে গিয়ে চা তুই। তিনিই আমাদের ঠিক পথে নিয়ে যান হাত ধরে। মা ছাড়া কে আর আছে আমাদের বল?
তুমি আমার হয়ে চেয়ে দিতে পারো না মা? কি করে চাইতে হয় তাই যে আমি জানি না।
যেমন করে আমার কাছে চাস তেমনি করে–আবার কী? তফাৎ এই, আমার কাছে মুখ ফুটে বলতে হয়, তাঁর কাছে মনে মনে। মনে মনেই শুনতে পান, জেনে নেন তিনি।
কিন্তু নিজের মতিগতির হদিশ মার কাছে গিয়ে চাইব কী, মাঝপথে আমার গাইড সতীশ। যে মাঝখানে এসে হানা দেয়–তৈরি আছিস তো শিবু? আসছে হপ্তাতেই সেই সভাটা। পুলিস-সাহেব আসবেন আমি খবর পেয়েছি। খতম করতে হবে তাকে। মনে আছে!
সেই মুহূর্তে আমাদেরকেও তো সেই সঙ্গে–? পরের খতমের সঙ্গে নিজের ক্ষতিটা না খতিয়ে আমি পারি না-কিন্তু যাই বল্ ভাই, কিছুতেই আমার মন টানছে না ওদিকে।
না টানলেও তোর রক্ষে নেই। আমাদের কারোই রক্ষে নেই। করতেই হবে তোক। নইলে আমাদের পাটিই তোকে খতম করে দেবে। রেহাই পাবিনে, মনে রাখিস।
সে কথা কি ভুলবার? আমি বলি-অহরহই মনে রয়েছে আমার।
যেমন ঢিলে শার্ট পরে ইস্কুলে যাস তেমন যাসনে যেন সেদিনটায়। ভারী কোট পরে যাবি, তাহলে তোর পকেটের পিস্তলটা কারো নজরে পড়বে না। তৈরি থাকিস, আমি এসে ঠিক সময়ে নিয়ে যাব তোকে। আমার সঙ্গে প্যান্ডেলে যাবি, ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেব, বুঝেছিস? এই শনিবার, মনে রাখিস।
তার গলায় যেন অশনির আওয়াজ পাই। মনে মনে ভয় খাই।
এদিকে শনিবার শনৈ শনৈ এগুতে থাকে।
এর মধ্যে রিনি এসে বলে গেছে আমাকে জানো শিবরামদা, সামনের শনিবার আমরা চলে যাচ্ছি। এখন থেকে–সেই কলকাতায় আমাদের বাড়িতে। সন্ধের গাড়িতে–মা বাবা সবাই আমারা–চিরদিনের জন্য। আমি গিয়ে চিঠি লিখব তোমায়। উত্তর দিয়ে কিন্তু। বলে তাদের কলকাতার বাড়ির ঠিকানাটা আমায় জানাল।
আমি নিরুত্তর হয়ে যাই। এই প্রথম রিনি দাদা বলে ডাকল আমায়–চিরকালের মতন তার চলে যাবার আগে।
আমার হৃদয়ের দুর্বলতম স্থানে অকস্মাৎ এই দা বসিয়ে একেবারে দু টুকরো করে দিল আমায়।
আমার তো মনে হয়, শুধু আমার কেন, কোনো মেয়ে দা বসালে, আমার ধারণা, রক্ষে নেই কারোই।
উত্তর দিতে পারব কি না জানি না। মুখ ফোটে আমার–আমিও সেদিন যাচ্ছি ভাই! আমিও চলে যাচ্ছি সেদিন।
হ্যাঁ, আমিও তো চিরকালের মতই চলে যাবার পথে। এখেন থেকে–ইহলোক থেকে? শনিবারের বারবেলাতেই!
কোথায় যাচ্ছ শিবরামদা? কলকাতায়? আমাদের সঙ্গেই চল না কেন তাহলে। সারাটা পথ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে, কেমন? কোথায় উঠবে কলকাতায় গিয়ে? মামার বাড়ি? কোনো মাসির বাড়িতে? আমাদের বাড়িতেই ওঠো না কেন? বলব আমি মাকে? নাকি, তোমার মাকেও বলতে হবে আবার?
কলকাতায় কি কোথায় যাচ্ছি আমি জানিনে। তবে যেতে হবে। আমি জানাই তোর মাকে বলার দরকার নেই। আমার মাকেও নয়। যদি যেতেই পারি তাহলে তোদের বাড়িও যাব নিশ্চয়। তোর সঙ্গে দেখা না করে পারি আমি? তুই বল?
যেয়ো তাহলে। এই বলে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে সে চলে যায়।
মাকে কেন্দ্র করে রিনির বৃত্তও যেন আমার চোখের ওপর মুছে যাচ্ছে দেখতে পাই….রিনির বৃত্তান্তের সঙ্গে ইহকালের আমার ইতিবৃত্তেরও ইতি।… কোথায় যাচ্ছি আমি?
অবশেষে শনিবারের সেই মারাত্মক দিনক্ষণ এল। ভারী কোট পরে, তার ওপরে পিস্তলের ভারে জর্জর, ভারিক্কী হয়ে বসে অপেক্ষা করছি–অকুস্থলে অকুক্ষণে নিয়ে যাবার জন্যে যথা সময়ে সতীশ এসে হাজির।-তৈরি?
— হ্যাঁ, ভাই।
দেখি কেমন তৈরি! বলে সে আমার পকেট হাতড়ে পিস্তলটা বার করে পরীক্ষা করল-গুলি ভরে নিয়েছিস দেখছি। বেশ। তার পিস্তলটাও বের করে দেখালো আমায় আমারটাও ভর্তি। দেখেছিস!
আমি আর দেখতে যাই না, নীরবে এগুতে থাকি ওর সঙ্গে।
এই হপ্তাতেই কলকাতায় তোর জীবনী বেরিয়ে যাবে-জানিস? আমাদের অমর শহীদ সিরিজে। যেতে যেতে সে জানায়।
আমার লাভ? আমি তো আর দেখতে পাচ্ছি না।
তা পাবি না বটে, সে কথা ঠিকই, তবে জেনে যা-ক্ষুদিরাম, কানাইলালের সঙ্গে একাসনে স্থান পাবি–এক সাথে নাম উচ্চারিত হবে তোর।
আমার জীবনী? লিখতে গেল কে? আমি যে নিজেই কিছু জানি না আমার জীবনের। বলে আমি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ি আমার জীবন তো শুরুই হয়নি, এখনো।…পরলোকে পাড়ি দিতে চলেছি? আমার জীবন কাহিনী তোরা জানলি কি করে?
জানিনে আমরা? এতদিন একসঙ্গে আছি, দেখছি তোকে, জানিনে? তারপর তোর বাবার পদ্যের বই থেকেও কিছু নেওয়া, কিছুটা বানিয়ে দেওয়া। কে লিখেছে বলছিস? স্বয়ং আমাদের লীডার। লেখার বেশ হাত আছে তার।
আমার জীবনী লেখা হয়েছে এতদিন জানাসনি তো আমায়?
কবে লেখা হয়ে গেছে! ছাপাও শেষ, এখন শুধু বেরুনোর অপেক্ষায়। তোর ঐ কাটার পরেই ছাড়া হবে বাজারে। জানাইনি আগে বটে, তবে এখন, যাবার আগে কথাটা জেনে আনন্দ হচ্ছে না?
আনন্দ? জেনে আমার কিসের সুখ ভাই! অমর শহীদ হবার কোনোই সান্ত্বনা আমি পাই না।–লাভটাই বা কী আমার, বল?
তোর লাভ নয়, আমাদের লাভ। আমাদের পার্টির লাভ। কী লাভ, কেমন করে লাভ, বলছি শোন। বইটা বাজারে পড়তে না পড়তেই তো সরকার থেকে বাজেয়াপ্ত হবে, তল্লাসী করে তার কিছু কিছু বই এখানে সেখানে পেয়ে নিয়ে যাবে পুলিস। কিন্তু বেশির ভাগ বইয়েরই কোনো হদিশ মিলবে না। তখন সেইসব বই লুকিয়ে ছাপা হতে থাকবে আরো।
এডিশনের পর এডিশন। আরো আরো লাভ।
তোর জীবনীও কি আমার সঙ্গে বেরুবে নাকি আবার? আমি জিগ্যেস করি।
বের হতেও পারে, টের পাইনি এখনো। লীডার কিছু বলেনি আমাকে।
যথা সময়ে যথাস্থানে গিয়ে যথাযথ বসলাম আমরা। ডায়াসের সামনের সারিতে আমি, আর আমার ঠিক দু সারি পিছনে আমার উপর নজর রেখে সতীশ। কোটের পকেটে হাত পুরে রেখে বসেছে সে দেখে নিলাম।
আমিও তার মতই পকেটের ভেতরে পিস্তল পাকড়ে বসেছি।
সদর থেকে পুলিস সাহেব এসেছেন, সঙ্গে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক পদস্থ সৈনিক। হাবিলদার-টাবিলদার হবে কেউ, কাবিল হোসেন বলল। আমার ঠিক পাশেই বসেছিল সে।
বিপদে পড়লে মাথা খেলে নাকি মানুষের, কথায় বলে। আমিও ডায়াসের সম্মুখে বিপদের মুখে–বসে বসে নিজের মাথা খেলাই।
আচ্ছা, সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে-তেমনটা রা যায় না কি? আমাদের অভিশাপ ওই সাহেবটাও মোলো অথচ আমার দেহষ্টি অক্ষত রইল-এমনটা হয় না?
অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের পরেই আমি যদি ধুপ করে বসে পড়ি-বসেই না বেঞ্চির সঙ্গে মিশিয়ে যাই, তাহলে, সতীশের তাক না ফস্কালেও, আমার গায়ে তার গুলির আঁচড়টিও লাগবে না। ধরাও পড়তে হবে না, পুলিসের থোলাই থেকেও বেঁচে যাব হয়ত।
যেহেতু, সাহেবের পতন ও মৃত্যুর সাথে সাথেই দারুণ হইচই পড়ে যাবে। হট্টগোলের মধ্যে ভেঙ্গে যাবে সভা। সবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিস, কে কোথায় পালাবে তার ঠিক নেই। আমিও ঘাড় গুঁজে সেই ভিড়ের ভেতরে ভিড়ে গিয়ে হারিয়ে যাব গভীরে। সেখান থেকে সটান চলে যাব সামসিতে। এক দৌড়ে মাইল দশেক দূরের আমাদের রেল স্টেশনে। খানিকক্ষণ কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকে তারপরে কলকাতার ট্রেন ছাড়বার মুখটাতেই চট করে উঠে পড়ব সেই গাড়িতে। সরাসরি চম্পট কলকাতায় তারপরই।
জমজমাট সমাবেশ। এক একজন কিছু বলতে উঠছেন, চটাচট পড়ছে হাততালি। পাঁচশো ছেলের হাজার হাতের হাতুড়িতে গমগম করছে সভা।
প্রথমে বলতে উঠলেন আমাদের রেটর মশাই কামাখ্যাবাবু, তিনি পরিচিতি দিলেন মাননীয় অতিথিদের। বাংলার এককালের শৌর্যবীর্যের উল্লেখ করে বললেন-যে-সামরিক বৃত্তির পথ এতদিন বাঙ্গালীর কাছে অবরুদ্ধ ছিল, ভগবানের কৃপায় আজ তা আবার উন্মুক্ত হয়েছে, আবার কৃপাণ ধরবার সুযোগ পেয়েছি আমরা। বাঙ্গালী যুবকরা–যারা শক্ত সমর্থ–এহেন সুযোগের সদ্ব্যবহারে যেন দলে দলে এই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের মুখোজ্জ্বল করে-সেই আশাই উচ্চারিত হলো তার ভাষণে।
সব শেষে বলতে উঠলেন হাবিলদার সাহেব। বীরোচিত চেহারার সেই বাঙ্গালী সৈনিকটি। রণক্ষেত্রে নিজের বরামাঞ্চকর নানান অভিজ্ঞতার কথা এমন ভাষায় তিনি বর্ণনা করলেন যে, সত্যিই রোমাঞ্চ হল আমাদের। যুদ্ধে না গিয়েই গায়ে কাঁটা-দেওয়া সেদিনের আমার সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
তারপরেই তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হবার জন্য ওজস্বিনী ভাষায় আহ্বান জানালেন সবাইকে।
সেই মুহূর্তেই আমি দাঁড়িয়েছি, পকেটের মধ্যে হাত মুঠো করে। সঙ্গে সঙ্গে সতীশও উঠেছে আমার পিছনেই, আড় চোখে দেখছি তাকিয়ে। আমি উঠতেই না, চারধার থেকে এমন জোর হাততালি পড়ল যে এক লহমায় সব প্ল্যান ভেস্তে গেল আমার।
হালিদার সাহেব আমায় ডাকলেন তার কাছে।
ডায়াসে যেতেই তিনি আমায় বুকে জাপটে ধরলেন; ঘোষণা করলেন এই তরুণই এখানকার প্রথম বীর, আমাদের সৈন্যবাহিনীর। তারপর দুহাতে আমাকে উঁচুতে তুলে সবার সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রদর্শনী করলেন আমার।
তিনি নামাবার পর কামাখ্যাবাবু আমার মাথায় হাত রেখে তাঁর আশীর্বাদ জানালেন। গদ কণ্ঠে বললেন–ধন্য! তুমি আমাদের মুখ রেখেছ। সিদ্ধেশ্বরী ইনস্টিটিউশনের মুখ উজ্জ্বল করেছ তুমি। যাও, বীরের মত যুদ্ধে যাও, বীরের মতই ফিরে এসে আবার। বীরের উপযুক্ত তোমার সংবর্ধনার জন্য সেদিনটির অপেক্ষায় থাকব আমরা।
আবার চটপট হাততালি চারধার থেকে। ছেলেদের সে কী উল্লাস! পুলিস সাহেব আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন সহাস্যে।
আমার পিছু পিছু সতীশও উঠে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দেখাদেখি আরো জনাকতক।
সবাইকে ডাকা হলো সেই ডায়াসের ওপর। রিকুটের দলে নাম লেখা হলো সবাইকার। শুনলাম, সাহেবের সঙ্গে পরদিনই সদরে চলে যেতে হবে সবাইকে।
আমার অপটু দেহের জন্য, বিস্তর বাহবা দিয়েও, শেষ পর্যন্ত আমায় বাতিল করে দেওয়া হল। ওদের সবাইকে কিন্তু ভর্তি করে নেওয়া হলো সৈন্যদলে। সতীশও গেল সেই সঙ্গে।… আমাকে আর কষ্ট করে নিজের মাথা খেলাতে হল না। কার লীলা কে জানে, অবলীলায় বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়।
কী করতে যে কী হয়ে যায়। আমাদের মাথার ওপরে আড়ালে থেকে কে যে নিজের মাথা খেলায়!
.
২৩.
সেদিনের সংগ্রামসভা থেকে ফিরেই সোজা যাচ্ছিলাম রিনিদের কোয়ার্টারে–তার সঙ্গে শেষ দেখা সারতে। সেদিনের সন্ধ্যাতেই তাদের স্টেশনে যাওয়ার কথা-সামসি রওনা হবার আগেই যদি ধরতে পারি তাদের। রাত্রের গাড়িতেই কলকাতায় পাড়ি জমাবে তারা।
বাড়ির সামনেই বাধা পড়ল। আমার ভাই সত্য এসে খবর দিল-বাবা তোকে ডাকছে রে দাদা।
যেতে হোল বাবার কাছে।
বাবা সেই সভায় যাননি, কিন্তু সেদিনকার সব খবরই পেয়েছিলেন আমার ভাইয়ের কাছে।
যেতেই তিনি বললেন, রাম, তোমার শৌর্যে আমি সুখি, একটু গর্বিতও বইকি। কিন্তু এখনও তোমার যুদ্ধবিগ্রহে যাওয়ার বয়স হয়নি। বয়স হলে যেয়ো। যাবে বই কি। লড়াইয়ের কায়দা-কানুন রপ্ত করে রাখাটা ভালো–এখনই তার বেশ সুযোগ ছিল। কিন্তু লড়তে হবে নিজের দেশের জন্যেই, ইংরেজের জন্যে নয়।…।
হ্যাঁ বাবা, তা আমি জানি। দেশের স্বাধীনতার জন্যই আমি প্রাণ দিতে চাই, ইংরেজের স্বার্থে নয়–সেইজন্যেই যাচ্ছিলাম। ইংরেজের কাছ থেকেই তো শিখে নিতে হবে এই যুদ্ধবিদ্যাটা?
এখন যারা তার উপযুক্ত, তারা তা শিখবে বইকি। এবং তারা কি শিখছে না? দলে দলে যুদ্ধে ঢুকছে তারাই এখন। পরে সুযোগ মতন সব বেঁকে দাঁড়াবে। কামানের মুখ, বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দেবে ওই ইংরেজের দিকেই। কিন্তু এখন তোমার সে বয়স আসেনি, তোমার শরীর যুদ্ধে যাবার মতন তৈরি হয়নি–মজবুত হয়নি এখনো…
সেইজন্যই তো নিল না আমায়। আমি সখেদে জানাই-তারাও সেই কথাই বলল বাবা।
এখন তোমার যে কাজ সেইটাই ভালো করে করো। খেলাধূলায়, ব্যায়াম চর্চায় শরীর তৈরি করো। আর পড়াশুনায় মন দাও। যখনকার যা কাজ তাই কমতে হয়; তাহলে পরবর্তী কাজটার জন্য উপযুক্ত হওয়া যায়। বিদ্যার্জন কিছু কম কাজ নয় বাবা। যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ দিলে অমরলোকে যাওয়া যায় জানি, জয়তে লভতে লক্ষ্মী–মৃতেলাপি সুরাঙ্গনা-শাস্ত্রে বলেছে, কিন্তু বিদ্যার দ্বারাও অমরত্ব লাভ করা যায়–মরবার পরে নয়, এই জীবনেই। সেটাও কিছু কম শ্রেয় নয়। বিদ্যয়ামৃতমনুতে-বলে থাকে, জানো?
জানি বাবা। আমার ঘাড় নাড়ি : বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ে ওই ছাপ মারা থাকে আমি দেখেছি, কিন্তু ওর মানে ঠিক জানি না।
বিদ্যয়ামৃতমতে, কিনা, বিদ্যুয়া অমৃতম্ অণুতে– অর্থাৎ বিদ্যার দ্বারা অমৃত অর্জন করা যায়। বুঝলি?
হ্যাঁ বাবা। এখন খেলতে যাই তাহলে? বলে বাবার কাছে বিদ্যার্জন না সেরেই রিনিদের বাড়ির দিকে দৌড়াই।
গিয়ে দেখি তাদের ঘরগুলোর জানালা খড়খড়ি সব বন্ধ–তবু আশায় ভর করে–এখনও হয়ত ওরা রওনা দেয়নি–সেই ভরসায় কাঠের সিঁড়িটা ধরে উপরে উঠলাম। কুয়াতলার পাশ দিয়ে এগিয়ে দেখি, দরজায় মোটা তালা ঝুলছে। আর দরজার গায়ে রিনির হাতের গোটা গোটা আঁচড়ে টাটকা চকের লেখা–রামদা, চলে গেলাম, রিনি।
র-য়ের বদলে ঋ-কার দিয়ে নিজের নাম লিখেছিল সে। বানান ভুলটা চকচক করছিল চোখের উপর। ইচ্ছে করে ঐ রকম বানানো-আমি বুঝলাম।
কিন্তু সে ঋণীটা কিসের? ঋণী তো আমি। আমিই তো। সে তো খালি দিয়েই গেছে, দু হাতে, অন্নপূর্ণার মতন যত পরমান্ন, আর আমি কেবল নিয়েই গেছি–পেয়েছি যত না। বিনিময়ে কিছুই তাকে দিইনি–দিতে পারিনি।
আমার আছেটা কী? চিড়ে গুড় ছাড়া আর দেবার কী ছিল আমার? সে-ই তো মহাজন। আমি ঋণী, চিরঋণী–শিবের মত চিরভিখারী রয়ে গেলাম তার কাছে।
ফিরে এলাম রান্নাঘরে, মার কাছেই। মা লুচি ভাজছিল তখন।
আয় বোস, কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ? কিছু খাসনি তো বিকেলে। মুখটুখ শুকিয়ে গেছে।
খানকয় ফুলকো লুচি আর পটল ভাজা দিলেন একটা রেকাবিতে। খেতে খেতে বলি–মা, তুমি কলকাতায় যাবে বলছিলে না?
কলকাতায়! কেন রে? এত জায়গা থাকতে কলকাতায় যাব কেন হঠাৎ?
বাঃ, বলছিলে না সেদিন? কালীঘাটে তোমার হাত খালাস করতে যাবে। বলছিলে না সেদিন রিনির মাকে?
রিনির মা কী রে? মাসিমা বল। হ্যাঁ, যাব তো কলকাতায়। যেতে হবে বটে, কিন্তু কবে হয়ে ওঠে দেখি।
এর আর দেখাদেখি কি মা? হয়ে ওঠাওঠিটা কিসের? গাড়িতে উঠে বসলেই হয়। আমি মাকে উৎসাহ দিই-বল তো আমি সাইকেলে করে সামসিতে গিয়ে আগে থেকে টিকিট কেটে নিয়ে আসতে পারি। যাব কাল সকালে?
টিকিটের জন্যেই আটকাচ্ছে কিনা! তোর বাবার সময় সুবিধা হলে তবেই তো যাওয়া হবে। দেখা যাক আগে…
বলব গিয়ে বাবাকে? জিগ্যেস করব মা?
না, তাকে জিগ্যেস করতে হবে না। আমিই বলবখন।
সত্যি, হাতটা খালাস করে নেওয়াই ভালো। বাঁ হাতে খেতে তোমার কতো কষ্ট হয়…হয় না মা?
কষ্ট কিসের! অভ্যেস হয়ে গেছে তো। এখন হয়ত ডান হাতে খেতে গেলেই আমার আবার বাধ-বাধ ঠেকবে।
বাঁ হাতে খাওয়াটা কেমন দৃষ্টিকটু নয়? যারা দেখে তাদের তো কষ্ট হয়। হয় না মা?
তা কী জানি! কী করে বলব! আমি তো কাউকে দেখতে দিই না আমার খাওয়া।
কী দরকার অমন করে লুকিয়ে চুরিয়ে খাওয়ার? নিজের পয়সায় খাচ্চি তো? পরের পয়সায় কি চুরি করে খাচ্ছি না যখন?…আচ্ছা মা, কলকাতায় গেলে রিনিদের বাড়িতেই তো উঠব আমরা? মাসিমা এত করে বলে গেছেন তোমায়?
আমার আপন দিদি থাকতে, তোর খুদি মাসির বাড়িতে না উঠে, ওদের বাড়ি যাব কেন রে? সেটা কি ভালো দেখাবে? তবে হ্যাঁ, একদিন ওদের বাড়ি যেতে পারি, যাব বেড়াতে একদিন, বলেছি যখন।
আমি একটা থার্ড ক্লাস ছ্যাকরা গাড়ি ভাড়া করে আনব মা-যেদিন যাব ওদের বাড়ি। আমি খড়খড়ি বন্ধ করা গাড়ির খুপরির ভেতর তোমার সঙ্গে বসব না কিন্তু, বলে রাখছি এখন থেকেই। আমি কোচম্যানের পাশে বসে যাব, নয় তো গাড়ির পেছনে সইসের জায়গায় দাঁড়িয়ে। কেমন তো?
বেশ বেশ, তাই হবে। তাই যাস না হয়। হাসতে থাকেন মা-এখন খেয়ে নিয়ে পড়তে বসগে।
খোলা ফিটন গাড়ি চেপে গেলেও তো হয় মা? হয় না? তাহলে তো আমি তোমার পাশে বসেই দেখতে দেখতে যেতে পারি।
তাও হয়। কিন্তু খোলা ফিটন তো সাহেবপাড়া ছাড়া পাওয়া যায় না রে!
আমি ট্রামে চেপে চলে যাব সাহেবপাড়ায়, সেখেন থেকে ফিটন ভাড়া করে নিয়ে আসব হয়-চেপে বসে আসব তাইতে। আনব তো? কী বল মা?
তাই আনিস না হয়।
তারপরে রিনিদের বাড়ি পৌঁছবার পরে ঐ গাড়ি করেই যদি আমরা–আমি আর রিনি যদি একটুখানি হাওয়া খেয়ে বেরিয়ে আসি মা?
বেশ তো, আসিস না-কে মানা করছে। যা, এখন পড়তে যা তো।
বাবাও তো পড়তে বলছেন মা। বলছেন, বিদ্যায়ামৃতমতে। কিন্তু তার মানেটা কী মা? মুখস্থ করে পাশ করে কী যে আমার চারটে হাত বেরুবে তা তো আমি ভেবে ঠাওর পাইনে। মুখস্থ বিদ্যায় কী অমরত্ব যে পাব তা জানি না। কী তত্ত্ব তার কে জানে!
বলতে না বলতে উসকে ওঠেন মা। তত্ত্বকথায় মাকে একবার পেলে হয়, তক্ষুনি তিনি উন্মত্ত। বাবার তত্ত্ব পেতে গিয়ে মার ব্যাখ্যা শুনি-শুনতে বেশ লাগে আমার। যা কিছু শিক্ষা আমার-সে তো সেই ছোটবেলাতেই–নিজের মার কাছেই। বই পড়ে আর কতটা শিখেছি।
তাই বলছেন নাকি তোর বাবা?
বলছেন তো তাই। বলছেন যে, আবৃত্তি সর্ব শাস্ত্রানা বোধাদপি গরিয়সী। শাস্ত্রটার মানে কী যে, যদি কিছু বুঝতে নাও পারো, শুধু কেবল তুমি আউড়ে-শাস্ত্রবোধের চেয়েও তার ঐ আবৃত্তিটা বড়ো।
সে আবৃত্তি কি তোর মুখস্থ বিদ্যে? তোকে বলেছে!
আমিও তো তাই বলছি মা। মুখস্থ করে কোন্ অমৃতটা আমি পাব যে…
বলতে গিয়ে আমি থমকে যাই। মনের মেঘে বিজলির মতন চমকে ওঠে, হ্যাঁ, একটা অমৃত আছে বটে, যা শুধু মুখস্থ করলেই মেলে, মুখেই যার উদয় আর মুখেতেই অস্ত-মুখের ওপরেই সমস্ত–কিন্তু সর্বক্ষণ অন্তরে যায় নিরন্তর অনুরণন–উদয়াস্তব্যাপী সেই দিলবাহার, আসলে তা কোনো বিদ্যা কিনা জানি না, তবে তার তত্ত্ব যে সেই অল্প বয়সেই আমার আয়ত্ত হয়েছে, মার কাছে তা আমি আর ব্যক্ত করতে যাই না। যেমন ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর ওই বইটাও যে আমি পড়েছি, ফাঁস করতে পারিনি কোনোদিন। বিদ্যাসুন্দরের থেকে শেখা সেই সুন্দর বিদ্যার কথাটা জানাইনি কখনো মাকে, বইটা পড়ার পুনঃ পুনঃ মানা ছিল মার–সেইজন্যেই! মনে হয়, মনে আমার পাপ ঢুকেছিল তখনই।
বিদ্যার মানে আলাদা, একেবারেই আলাদা-সবাই তা জানে না। গঙ্গাড় করে তোর ওই আউড়ে যাওয়াটা বিদ্যে নয়। বিদ্যে কখনও পুঁথিগত হয় না, সেটা অভ্যাসগত। সেই অভ্যাসের মানেও আবার স্বতন্ত্র। প্রত্যেক শব্দের একটা আভিধানিক মানে আছে, কিন্তু তার আড়ালে আরেক অর্থ থাকে, প্রত্যেক বাক্যের অন্তনিহিত আরেক তত্ত্ব। শোন বলি। বিদ্যার মানে হচ্ছে…
কিন্তু মার বিদ্যা জাহিরের আগেই সত্য ভগ্নদূতের মতন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে-জানো মা, কী হয়েছে? সতীশদাকে পাকড়েছে পুলিশে, তার পকেটে রিভলবার পাওয়া গেছে। নাকি। সে কবুল করেছে যে, আরেকটা জিনিস আছে নাকি দাদার কাছে। থানার দারোগা অ্যারেস্ট করতে আসছে দাদাকে। জানায় সে।
ঐ জিনিস-কী জিনিস? জানতে চান মা।
ঐ রিভলবার। আরেকটা আছে নাকি দাদার কাছে।
কোথায় রিভলবার? দেখি তো?
এই যে মা। কোটের পকেট থেকে বার করে দিই।
কোথায় পেলি তুই?
মামার নামে একটা পার্শেল এসেছিল। সেই যে মামার একটা অঙ্কের চিঠি এসেছিল না? তার পরেই তো এল এই রিভলবার দুটো। একটা পার্শেলে।
সুরেন তলে তলে বিপ্লবীদের দলে ভিড়েছে জানতুম না তো। ঘুণাক্ষরেও না…
দারোগাবাবু ততক্ষণে বাবার বৈঠকখানায় এসে পৌঁছেছেন–বাতচিত করছেন বাবার সঙ্গে। দারোগার মুখে আমাদের কীর্তিকাহিনী শুনেও বাবার মুখে কোনো ভাবান্তর আমি দেখলাম না।
মা গিয়ে দারোগাবাবুকে বললেন-রিভলবারগুলো এসেছিল আমার ভাই সুরেনের নামে পার্শেলে…।
জানি। পোস্টমাস্টারবাবু পার্শেলের কথা বলেছেন। পার্শেল যে এসেছিল তা আমি জানি। সেদিনও গিয়েছিলাম পোস্ট-আপিসে, রোজই একবার করে যেতে হয় আমাদের…এইসব ব্যাপারের খোঁজখবর নিতে। পার্শেলটার ওপরে লেখা ছিল মেডিসিন উইথ কেয়ার আমি দেখেছিলাম। শিবপ্রসাদবাবুর কেয়ার অফে এসেছিল বলে আমরা আর ওটা খুলে পরীক্ষা করে দেখিনি…সন্দেহই করিনি কোন।
রামও করেনি আমার। মামার জিনিষ মনে করে নিয়েছিল, খুলে দেখেছে পিস্তল। খেলার জিনিস মনে করে রেখে দিয়েছে কাছে।
রিভলভার তো খেলার জিনিষ নয় ম্যাডাম। তক্ষুনি গিয়ে জমা দিলে হতো থানায়। তা না করে নিজের কাছে রাখাটা… দারোগার মুখ দারুণ গম্ভীর হয়।
খুবই অন্যায়, খুবই অন্যায়। মা সায় দেন তার কথায়। আমি জানলে সেই ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু টের পেলাম তো আজ। এইমাত্র। তা ছাড়া আমার ভাই সুরেন যে তলে তলে বিপ্লবীর দলে গেছে ঘুণাক্ষরেও তা আমরা জানিনে। টের পাইনি কখনও। তা ছাড়া, সুরেন তো বহুদিন এখানে থাকে না…
কোথায় থাকেন সুরেনবাবু এখন?
ভাঙরের কাছে কোন এক আশ্ৰম আছে নাকি, গোঁসাই গুরুর আশ্রমেই থাকে সে। ধর্মকর্ম নিয়েই আছে এখন–সর্বদা হরিনাম কীর্তন করে এই তো জানি। কোনোদিন যদি বিপ্লবী দলে ভিড়েও থাকে, এখন সে বদলে গেছে একেবারে। হলফ করে বলতে পারি আমি।
তা হলে খোঁজখবর নিতে হবে আমাদের একবার।
নিয়ে দেখুন, তাকে দেখলে, তার সঙ্গে কথা কইলেই টের পাবেন–আলাপ হলেই জানতে পারবেন সে এখন আলাদা মানুষ…একেবারে অন্যরকম…
এই সব কাজের প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই পালটে যায়, ধর্মে মতি হয় শেষটায়, দেখেছি আমরা অনেক…
আপনারা কি মামাকে গিয়ে অ্যারেস্ট করবেন নাকি? আমার অন্তরগত বিবেক আমায় কামড় বসায়, আর্তনাদ করে উঠি।
যদি দেখি যে বিলকুল বদলে গেছেন, এনাকির্স্ট দলে তিনি নেই এখন আর, তাহলে কেন তাঁকে হ্যারাস করতে যাব আমরা?
দাদাকে বুঝি ধরে নিয়ে যাবেন থানায়? সত্য জানতে চায়।
শিবপ্রসাদবাবু যদি ওর জামীন হন-অতঃপর ওর গুড বিহেভিয়ারের দায়িত্ব নেন-ওকে নিজের চোখে চোখে রাখেন, বিপথে যেতে না দেন, তা হলে ওকেও আমরা কিছু বলব না। তবে বাবার নজরে ছেলেরা আর কতক্ষণ থাকে বলো! উনি যদি নিজের হেফাজতে রাখেন… মার প্রতি তিনি কটাক্ষ করেন। ছেলেরা মার নজর এড়াতে পারে না কখনই…উনি যদি নিজের হাতে ভার নেন ওর-তাহলে তোমার দাদাকেও আমরা কিছু বলব না।
দারোগার আবেদনে নীরব থাকলেও সর্বদাই যে তাঁর নজরানা আমার প্রতি প্রদত্ত, মার মৌনতাতেই সেই কথাটি সবার সম্মুখে মুখর হয়। আমি বেঁচে যাই।
কিন্তু তার পরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। শেষের সেই প্রশ্নটি আমার আর আমাদের সতীশের কি হবে তাহলে?
যদি সে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয় তো কিছুই হবে না। ভালই হবে তার। যুদ্ধ থেকে বেঁবের্তে যদি ফিরে আসে, আসতে পারে, সরাসরি আমার জায়গাতেই এসে বসতে পারে হয়ত-চাই কি, কোনো থানার দারোগা হয়েই বসবে হয়তো কোনোদিন।
দারোগা? কী হতে গিয়ে কী যে হতে হলো সতীশকে, আমি নিজের মনে খতিয়ে দেখি একবার। লাভ কি ক্ষতি জানিনে, দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে সেই রাজভক্ত হতে হলো তাকে-পেট্রিয়ট না হয়ে পুলিস সেজে পেটের ধান্দায় ঐ পথের আর সব বিপথিকদের ধরে পেটাবার কাজে লাগতে হলো শেষটায়…হায় রে!
কী চাইতে গিয়ে কী যে পায় মানুষ, কী পাবার পরে কী আবার চেয়ে বসে যে–হিসাবের খাতায় তার অঙ্ক কোনোদিনই মেলে না বুঝি!
.
২৪.
সবটা কাল শোনা হোলো না মা আমার, মার কাছে গিয়ে বসলাম আবার : দারোগাবাবু মাঝখানে এসে আমার বিদ্যালাভের পথে বাগড়া দিলেন না কালকে?
কিসের বিদ্যালাভ?
সেই যে…যে বিদ্যায় অমৃতলাভ হয়…বিদ্যয়ামৃতমতে?
অমৃত মানে কী, বল্ দেখি আগে।
কে না জানে? সেই জিনিস, যা নাকি একদিন দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনে উঠেছিল…সুধা আর বিষ।
সুধা আর বিষ?
হ্যাঁ, সুধাটা স্বর্গেই শুধু পাওয়া যায়, কিন্তু বিষ কি কোথায় মেলে আর এখন? সবটুকু তো তোমার নীলকণ্ঠই গিলে বসে রয়েছেন।
গিলেছিলেন ভাগ্যিস!
আমার অনুযোগ : কিন্তু ঐ সুধাও কি তোমার এই বসুধায় মেলে নাকি আবার? বাবা বলছেন যে, বিদ্যার্জনেই কেবল তা পাওয়া যায়।
হ্যাঁ, সুধাই বটে। অমৃতর তাই একটা মানে বটে ঠিকই, কিন্তু বলেছি না, প্রত্যেক শব্দের ভেতরে আরেকটা অর্থ থাকে ফের? অমৃত কি না, অ-এর সঙ্গে যা ঋত, কিনা জড়িত। অ হল গে আদিস্বর, ব্রহ্ম আর ম্ হল তোর অনুস্বর–তার সঙ্গে যুক্ত ব্যঞ্জন,-যার মানে অদ্ভুত ব্যঞ্জনা, অফুরন্ত প্রকাশ। ব্ৰহ্ম আর তাঁর মায়া-স্বয়ং ব্রহ্মময়ী-মা বিন্দুবাসিনী। বিন্দু আর ব্যাস মিলিয়ে ঐ অম্।
অনুস্বরের চেহারাটাও প্রায় সেই রকম-তাই না মা? যেন পয়েন্ট আর তার রেডিয়াস। আমার পয়েন্টেড প্রশ্ন : বিন্দু আর ব্যাস নিয়ে তোমার ঐ বিন্দুবাসিনী। তাই না মা? ভারী আশ্চর্য তো!
আশ্চর্য কি! শব্দ তো ব্রহ্মই। প্রত্যেক শব্দের আড়ালেই তিনি রয়েছেন, বাক্যমাত্রেই তাঁর আভাস মেলে। যেমন সব জলেই ছায়া পড়ে আকাশের। মা জানানঃ শুধু দেখতে জানলে হয়।
যাদের দিব্যদৃষ্টি খুলে যায় তারাই দেখতে পায়, তাই না? যেমন বিবেকানন্দের খুলে গেছল একবার, তোমার ওই ঠাকুর খুলে দিয়েছিলেন, তখন তিনি পৃথিবীর সব জিনিসেই ব্ৰক্ষ দেখছিলেন। গোলদীঘির ধারে দাঁড়িয়ে, হারিয়ে ফেলেছিলেন গোলদীঘিকে। অতবড় গোলদীঘিটা, এমনকি তার রেলিং-টেলিং সব নিয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে, গুলিয়ে একাকার হয়ে গেছল তাঁর চোখের সামনে।
হয়েছিলই তো।
কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিয়ে ঐ গোলদীঘির কিংবা গোলদীঘির সঙ্গে মিলিয়ে তোমার ঐ ব্রহ্মের এই তালগোল পাকানোটা কি ভালো মা? তাতে তো কোনোটাইে ঠিক ঠিক দেখা যায় না–সঠিকরূপে পাওয়া যায় না একদম।
সেও একরকমের দেখা রে! ব্রহ্মকে অখণ্ডরূপে দেখা, আবার খণ্ডরূপে দেখা-দুটো দেখাই সমান দেখাই সমান সত্যি।
খণ্ডরূপে দেখাটাই ভালো আমার কাছে। অখণ্ডরূপে দেখতে গেলে তো অদেখা হয়ে যায়, মনে হয় কিছুই দেখা হল না। সন্দেশকে খণ্ড খণ্ড করে ভেঙে ভেঙে খেলে তবেই না তার স্বাদ মেলে?
এখন যে কথা হচ্ছিল আমাদের, মা তাঁর আদিস্বরে ফিরে যান-অম-এর সঙ্গে ঋত, মানে, জড়িত কী? তার ব্যাস এবং বৃত্ত।সেই বিন্দু-ব্যাস-বৃত্ত-অখণ্ড মণ্ডলাকার-চরাচর ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।
তোমার বিন্দুবাসিনী গিয়ে বিন্দুবাসিনী হয়েছেন শেষটায়! মার কথার ওপর আমার ফোড়ন কাটা–এটা তার বিলাসব্যসন কিংবা ব্যাসনবিলাসো বলা যায় মা।
বিন্দু, ব্যাস, বৃত্ত-অ উ ম তিন মিলিয়ে হল গে ওম। ওঁ-প্রণবমন্ত্র। অনাহত ধ্বনি। বিশ্বসৃষ্টির-বীজ নব নব সৃজনের। বুঝেছিস?
জানি। বাবা হরদম হরি ওম হরি ওম করেন, জানিনে? কিন্তু মন্ত্রবিদ্যা জানতে চাইনি তো তোমার কাছে-আমার বিদ্যালাভের মতরটাই জানতে চেয়েছিলাম!
বিদ্যা হচ্ছে বিদ্যমানতা, আমাদের অস্তিত্ববোধ। বোধের মধ্যে আমাদের বেঁচে থাকা। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগেই আমাদের অস্তিত্ব। অ-এর সঙ্গে ঋত হয়েই আমরা অমৃত আমাদের মৃত্যু নেই তখন। আবার আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, জড়িত হয়েই অস্তিত্ব ঈশ্বরেরও–তিনিও অমৃত তখনই। পরস্পরের এক সঙ্গে একাধারে যুগপৎ এই বিদ্যমানতার বোধই হচ্ছে মহাবিদ্যা। আর এই বিদ্যাতেই অমৃতমনুতে।
ওবাবা! আমার বাকস্ফূর্তি রহিত।–এত কাণ্ড!
বিদ্যা আবার দুরকমের-পবিদ্যা আর অপরাবিদ্যা। মার ব্যাখ্যান পরাবিদ্যা হোলো ঈশ্বরের সঙ্গে বিদ্যমানতা। পর কে? না, ঈশ্বর। পর বলতে তাঁকেই বোঝায় কেবল!
কথাটা ঠিক বলেছো মা। তৎক্ষণাৎ আমার সায় : ভগবানের মতন পর আর হয় না। কখনই তিনি কারো আপনার নন। দ্যাখো না মা, তিনি আপনার হলে পৃথিবীর মানুষের এত দুঃখকষ্ট কেন?
দুঃখকষ্টের কারণ ভগবান নন। আমরা নিজেরাই। সে কথা তোকে বোঝাব আরেকদিন। মা বলেন-এ পর সে পর নয় রে! এখানে পরের মানে আলাদা। পর কিনা, পরাৎপর, পরম। যাঁর ওপরে আর কেউ নেই, কিছু নেই। সেই পরমের সঙ্গে অহরহ আমাদের যে যুক্তবোধ-সেই হলো তোর পরাবিদ্যা। আর অপরের সঙ্গে বিদ্যমানতা হোলো অপরাবিদ্যা।
সেটা আবার কীরকম মা?
দুরকমের অস্তিত্ব না আমাদের! এক, ভগবানের সঙ্গে মনোযোগে আর অপর সকলের সঙ্গে কর্মযোগে? ঈশ্বরের সঙ্গে যোগ মনোবৃত্তে এবং সবার সঙ্গে যোগ জীবনবৃত্তে। মনে মনে তাঁকে আমরা টের পাই, তাঁর অস্তিত্ববোধ জাগে, ঠাকুর যাকে বলেছেন বোধে বোধ। আর বুদ্ধদেব বলেছেন, বোধি।
বুদ্ধদেবের বেলায় বোধি? আর পরমহংসদেবের বেলায় বোষোদয়? আমার প্রশ্ন হয়।
বুদ্ধদেব তো ঈশ্বর মানতেন না, নিজেকে স্বীকার করতেন কেবল। তাঁর বোধি হোলো আত্মবোধ-নিজের অস্তিত্ববোধ। আর শেষ পর্যন্ত তাতেই নির্বাণ লাভ করা।
কিন্তু সেই বোধি তো বুদ্ধ হওয়া–বুন্ধু মেরে যাওয়া! ফুরিয়ে যাওয়া একেবারে–যা নাকি নির্বাণ। সে তো সর্বনাশ। সে তত ভালো নয় মা। আমার বোধশক্তি জাহির করি-অনির্বাণ না জ্বলে একেবারে নিবে যেতে কে চায় মা?
আমার সে কথার জবাব না দিয়ে মা নিজের কথার আবেগে এগিয়ে যান : মনে মনেই সেই পরমকে পাই; আর অপরকে পেতে হলে যেতে হয় জীবনে জীবনে। আমাদের পেশায়। কার্যসূত্রে আমাদের নিত্যকার বৃত্তিতে যোগাযোগ হয় সবার সঙ্গে। সেই হেলো আমাদের অপর এক অস্তিত্ব।
ভগবানের যোগে আমরা মনস্বী, আর অপরের যোগে ধনস্বী-পরমার্থের সঙ্গে টাকাকড়ি দুই মিলে জীবন্ত। মার খোদাইয়ের ওপর আমার কিঞ্চিত খোদকারি।
হ্যাঁ, তাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের জীবনে বৃত্তটাই হল গিয়ে আসল। বৃত্ত নইলে অস্তিত্বই নেই। আবার সেই বৃত্তকে যদি মূল-এর সঙ্গে বিন্দুর সহিত যুক্ত করতে পারি, তাহলেই আমাদের অস্তিত্বের পূর্ণতা। বিন্দুবাসিনী আমাদের বৃত্তে এসেই নিত্য; নিত্যকালীন নৃত্যকালী; তাঁর সঙ্গে সংযোগেই আমাদের অস্তিত্ব। আমরা অ-মৃত।
হ্যাঁ, মা। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না, মার কথায় সায় দিয়ে যাই।
একেই বলে আবৃত্তি। এই আবৃত্তিই হোলো গে…
কী করে হোলো, বুঝিয়ে দাও।
অ হোলো গে ঈশ্বর, অ-র সঙ্গে আরেক অ-কার যোগ হলে হয় আ। স্বরসন্ধিতে পড়েছিস। এই দ্বিতীয় অ-কার হোলো তাঁর অনুরূপ। তুই, আমি, আমরা সবাই-পরস্পরের যোগাযোগে আমাদের আকারলাভ। তারপর বৃত্তপথে এসে, নিজ নিজ বৃত্তির পথে আবৃত্তি হচ্ছে আমাদের। তাঁরও, আমাদেরও। তাঁকে নিয়ে আমরা পুনরাবৃত্ত, এবং আমাদের নিয়ে তাঁর পুনরাবৃত্তি। পুনঃ পুনঃ পুনরাবৃত্তি-অনন্তকাল ধরে চলেছে এই খেলা!
মা অনায়াসে কত সহজে সেদিন বুঝিয়েছিলেন যে! এতদিন বাদে আজ আমার ভাষায় তার আভাসেও পৌঁছতে পারব কি! মোটামুটি যা বুঝেছিলাম, এইভাবে বিন্দুমাত্র তিনি বৃত্তপথে এসে ব্যক্ত হচ্ছেন–আমাদের মনবৃত্তে প্রাণবৃত্তে, আমাদের ব্যক্তিত্বে। দেহবৃত্তে স্নেহবৃত্তে আদান-প্রদানের রূপ ধরে জীবনের নানান বৃত্তিতে। এই আমাদের জীবনবৃত্তান্ত। মূলে তিনিই ফুলে ফুলে ফুটছেন, ফল হয়ে ফলছেন–তাঁকে পাট্টায় বসিয়েই পাটোয়ার আমাদের ফলাও কারবার। মৌলিক তিনিই নিজের অনুকরণ করছেন আমাদের মধ্যে নব রূপে-নিত্য নব হয়ে। নিতুই নব চিরকালের রূপকথাই এই।
তাকে কেন্দ্র করেই বৃত্তাকারে ঘুরছি আমরা, ঘুরব আমরা-এই আবৃত্তিই হচ্ছে শাস্ত্রটাস্ত্র পড়ার চেয়ে বেশি–মা পাড়েন : এই আবৃত্তিই তোর সর্বশাস্ত্রানা বোধদপি গরিয়সী বুঝেছিস এইবার?
হ্যাঁ মা। মার বোঝানো কেমন অবলীলায় মনের মধ্যে মিলিয়ে যায়। পান্ডিত্যের বোঝার মতন মাথার ওপর বোঝাই হয়ে চেপে বসে। ভারালো হয়ে ভারিক্কী করে তোলে না।
আর আমাদের ঠাকুর হচ্ছেন তার প্রমাণ। মা কালীর নিরক্ষর পুরুৎ ছিলেন তো তিনি। পূজা আরতি করতেন মার। আর আরতি মানেও আবৃত্তি। তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকা, শুধু তাকেই প্রদক্ষিণ করা ঘুরে ঘুরে। সমস্ত শাস্ত্রের পার পেয়েছিলেন তিনি ঐ করেই। মার কাছেই–নিজের মনের মধ্যে। পরে অবশ্যি তিনি পন্ডিতদের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনায় জেনেছিলেন, মা তাকে যা যা জানিয়েছেন শাস্ত্রবাণীর সঙ্গে তা সব মিলে যায় ঠিক ঠিক। তাই না?
হ্যাঁ মা।
মা-ই নিজে জানিয়ে দেন, তা নইলে কি আমরা জানতে পারি? তিনিই প্রথমে চিনিয়ে দেন নিজেকে-তারপরে সারা জীবন ধরে চিনতে হয়, জানতে হয় আবার আমাদের বাজিয়ে নিতে হয় বার বার যা নাকি তিনি জানিয়েছেন। পদে পদে হাতে হাতে পাই যখন-তখন তখনই টের পাই, ফের বুঝতে পারি আমরা। এমন কি দেবতাদেরও তাঁকে জানাতে হয়েছিল এই করে–চেনাতে হয়েছিল নিজের থেকে। কথাটা বেদে আছে।
বেদে আছে? দেবতাদেরও চেনাতে হয়েছিল?
দেবতারাও কি তাঁর দেখা পায়? চিনতে পারে তাকে? তিনি নিজে না দেখালে না চিনিয়ে দিলে? এইজন্যেই দেবতাদের কাছে তাঁকে দেখা দিতে হয়েছিল। দেবতাদের সামনে দিব্য জ্যোতিরূপে একদিন আকাশে তিনি আবির্ভূত হলেন। দেবতারা তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল, ঐ জ্যোতিস্বরূপা কে উনি? উমা হৈমবতী আকাশবাণীতে তিনি বলে দিলেন তখন তাদের। আর তাদের পথের সামনে যে তৃণখন্ড পড়েছিল, বললেন, ওটাকে দুখানা করে দেখি। ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ সবাই মিলে হমুদ্দ চেষ্টা করেও সেই একটা কুটোকে দুটো করতে পারলেন না। এমন কি, নাড়াতে পারলেন না একটুও। অমন প্রবলপ্ৰতাপ যে বায়ু–যার দাপটে কিনা বিশ্বব্রহ্মান্ড কাঁপে-সেও সেটাকে একটুখানিও সরাতে পারল না। মা তখন জানালেন, আমিই সেই শক্তি, যার জোরে তোমরা নড়াচড়া করো, নাড়াচাড়া করছ, নড়ছ চড়ছ।… চন্ডীতেও ঐ কথা আছে, প্রথমে উনি ওদের দেখা দিলেন, দিয়ে বললেন, ডাকো আমায়। আমার কাছে চাও। আমিই দেবো তোমাদের, আমিই দিতে পারি। বাঁচাতে পারি তোমাদের। যখন যখনই আমায় ডাকবে আমি দেখা দেবো, আপদে বিপদে সব সময় রক্ষা করব তোমাদের। করেছিলেনও রক্ষা-চন্ডীতে আছে পড়ে দেখিস। আমার শিয়রের কাছেই তো থাকে বইটা, মাথার বালিসের পাশেই। দেখিসনি? সংস্কৃতে লেখা, কিন্তু মানে করে দেওয়া রয়েছে বাংলায়। পড়লেই বুঝবি। পড়বি, বুঝলি।
বাবার গীতার মতন দেখতে, ওই চটি বইটা তো? দেখেছি। পড়বো মা।
দেবতা কি ছাড়, স্বয়ং শিবের কাছেও নিজের স্বরূপ প্রকাশ করতে হয়েছিল তাঁর। তবেই শিব চিনতে পারলেন তাকে ঠিক ঠিক। দশ মহাবিদ্যারূপে দেখা দিয়েছিলেন না তিনি একবার?
হ্যাঁ, পড়েছি অন্নদামঙ্গলে।
কী পড়েছিস? শিব নিঃস্ব হয়ে ভিখারীর ন্যায় অন্নভিক্ষায় বিশ্বময় ঘুরেছিলেন, কোথাও খুদকুঁড়োটাও জোটেনি, এমন কি মা লক্ষীর কাছেও না–শেষটায় অন্নপূর্ণার কাছে গিয়েই তিনি তাঁকেও চিনলেন, আর অন্নও পেলেন নিজের। পরমান্ন, যা নাকি অমৃতই।
হ্যাঁ মা।
মা তাঁকে নিজেকেও চেনালেন, পরমান্ন কী, কোথায় মেলে তাও বুঝিয়ে দিলেন তিনিই। মা বলেন-প্রথমে মা-ই মিলিয়ে দেন, তারপর সেই সত্য টের পাবার পরে তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয়-চেয়ে চেয়ে নিতে হয় বারবার–বরাবর-জীবনভোর।
মিলিয়ে দেখি মনের মধ্যে, হ্যাঁ, মার কথাটা ঠিকই। অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পরমান্ন যে কী, আমার অন্নপূর্ণাও নিজের থেকে চিনিয়ে দিয়েছিল আমায়। তার সম্মুখেই পেলাম প্রথম। তারপর আমাকে চেয়ে চেয়ে নিতে হয়েছে। খেয়ে খেয়ে পেতে হয়েছে। পেয়ে পেয়ে খেতে হয়েছে। বারবার। সত্যি! সত্যিই সত্যি!
সত্য কথাটার তত্ত্বালোচনায় মজে মনে মনে মশগুল হচ্ছি, মাঝখান থেকে সত্য এসে অন্য কথা পাড়ে। কালকের মতই জানান দিয়ে তার হানাদারি।
কী রে দাদা! যাবিনে তুই?
কোথায় যাব রে?
বাঃ, সতীশদারা আজ চলে যাচ্ছে না? ইস্কুল থেকে সভা করে বিদায় অভিনন্দন দেওয়া হচ্ছে সবাইকে। সব ছেলে যাচ্ছে, তুই যাবিনে?
যাব না কী রে! বুঝি বা জন্মের মতন চলে যাচ্ছে তারা। আবার ফিরে আসবে কিনা কে জানে! দাঁড়া।… শার্টটা আমার গায়ে চড়াই।
যাবার মুখে সাড়া পাওয়া যায় বাবার। সেদিনকার সভায় তো পড়িসনি। বলে দিলাম তোকে অতো করে আমি। আজকের সভাটায় মনে করে পড়িস যেন। হেমচন্দ্রের সেই অমর কাব্য এরকম ক্ষেত্রেই পড়বার বস্তু-বুঝলি? আবৃত্তি করিস আজ, কেমন? করবি তো? বলে বাবা নিজেই আওড়াতে শুরু করেন–
বাজ ওরে শিঙ্গা বাজ ঘোর রবে
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে
ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়;
চীন ব্রহ্মদেশ অসভ্য জাপান।
তারাও স্বাধীন তারাও প্রধান…
দাসত্ব করিতে করে হেয় জ্ঞান, ভারত শুধুই…
জানি বাবা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। ফাঁক পেলেই শিঙ্গাটা আমি বাজিয়ে দেবো আজকে। আমি ভরসা দিই।
সেদিন বাজাতে কী হয়েছিল তোর? ফাঁক খুঁজে নিতে হয়। সুযোগ কি আর আপনার থেকে আসে রে? সেটা সৃষ্টি করবার।
সেদিন আর শিঙ্গা ফুঁকবার সময় পেলাম কোথায় বাবা। তার আগেই না সমস্ত কিছু গড়বড় হয়ে প্ল্যান ভেস্তে গেল আমাদের?
.
২৫.
স্কাউটের পোশাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছিল যে সতীশকে। সুগঠিত সুঠাম শরীরে মিলিটারি ড্রেসে সে যেন এক লহমায় যৌবনে গিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। তাদের সবাইকেই চমৎকার মানিয়েছিল, কী বলব!
তোকে সেই মেজর জেনারেলের মতই মনে হচ্ছে মাইরি! বললাম আমি সতীশকে। গদগদ গলায়।
সতীশ গর্বিত হাসি হাসল একটুখানি।
কী করব ভাই! নিলই না যে আমায়। আমার মতন কাউকেই নিল না তো। জেনাব্যালি মাইনরদের নেয় না যে। মেজর জেনারেল হতে পারলাম না তাই।
সতীশ আর আমায়–দুজনকেই বুঝি আমি সান্ত্বনা দিতে চাই।
শরীরটা তৈরি করে নে এর ভেতরে, তাহলেই হবি। যুদ্ধ কিছু এর মধ্যেই ফুরোচ্ছে না। যুদ্ধ আছে আরো। চিরকাল ধরে যুদ্ধ। ঢের চানস আসবে।
তোদের লীডার ভারী রাগ করছে, নয় রে? কী করতে কী হয়ে গেল যে। সত্যি। কিন্তু ভাই, আমার কোনো দোষ নেই, আমি তো মারবার জন্যে তৈরি হয়েছিলাম, এমন কি মারা যাবার জন্যেও, কিন্তু কপাল মন্দ, করব কী! রাগ করছে খুব আমাদের ওপর, তাই না?
না না, রাগ করবে কেন? খুশিই হয়েছে বরং। আমি যুদ্ধে যাবার এই সুযোগটা পেলাম। বলেই। এতে আমাদের কাজের সুবিধেই হবে আরো। সেখানে গিয়ে সৈন্য বাহিনীর মধ্যে আমি রিক্রুট করতে পারব–এনতার আসবে আমাদের এই বিপ্লবী দলে। আমাদের কাজের আরো সুসার হবে তাতে। সেই ভারই দিয়েছেন তিনি আমাদের ওপর।
ভালোই হয়ে গেছে তাহলে, কী বলিস? এই জন্যেই বুঝি বলে থাকে–ভগবান যা করেন সব ভালোর জন্যেই-না রে?
হ্যাঁ রে। এখন যদি সত্যিই আমি মেজর জেনারেল হয়ে ফিরতে পারি তবেই না! ফিরে এসে ফোট জ্বলিয়মের ভেতরে থাকব তখন, আমার দলবল নিয়ে। ভেতর থেকে, ভেতরে থেকে একদিন দখল করে নেব ফোর্ট। তারপর কেল্লার যত ফৌজ স্বদলে পেলে, আর কামান বন্দুক তামাম হাতে এলে ইংরেজ তাড়াতে কতক্ষণ লাগে রে!
পারবি পারবি। নিশ্চয় পারবি। সেইজন্যেই তোর জন্ম হয়েছে, বুঝতে পারছি আমি। নইলে এমন যোগাযোগ হয় কখনো? বল তুই?
গলার মালা দুলিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে মার্চ করে চলে গেল সব্বাই। আমি ফিরে এসে মার কাছটিতে বসলাম আবার।
আচ্ছা মা, যুদ্ধবৃত্তিটা কি খুব খারাপ?
না, খারাপ কিসের! যার ওদিকে ঝোঁক আছে তার পক্ষে ভালোই তো। ন্যায়যুদ্ধ তো ভালোই রে! কেন, তোর বুঝি ভারী খারাপ লাগছে যুদ্ধে যেতে পারলিনে বলে?
না, না। তা নয়। যুদ্ধ-টুদ্ধ আমার মোটেই ভালো লাগে না। মানুষরা কি মারবার? মানুষ তো ভালোবাসার জিনিস মা!
তাই নাকি রে! তুই বুঝি মানুষকে খুব ভালোবাসিস?
ঠিক তা নয়। সব মানুষকে না, তবে তার ভেতরে বেছে বেছে দুচারজনকে তো ভালোই লাগে বেশ। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না তাদের?
মহাপুরুষদের বুঝি? যেমন অশ্বিনী দত্ত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বোস, এঁদের মত? নাকি ওই রবিঠাকুর, পরমহংসদেব…।
না না, ওদের কাউকেই। অত বড়োকে কি ভালোবাসা যায় কখনো? এই ছোট ছোট মানুষদের-মাথায় যারা আমার বড় নয়, আমার মতই…আমার মনের মতন যারা।… আচ্ছা মা, ভালোবাসাবাসিটা কি কারো বৃত্তি হতে পারে না?
বৃত্তিই তো। মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই রে। তবে বৃত্তি বলতে যা বোঝায় তা নয় ঠিক। ওটা তো হৃদয়গত ব্যাপার। বৃত্তি হচ্ছে কর্মগত। তুই যা কাজ কবি-যে কাজটা বেছে নিবি তোর জীবনে, সেইটাই হবে গিয়ে তোর বৃত্তি। বুঝেছিস এবার?
তা তো বুঝেছি। কিন্তু কোন্ কাজটা যে আমি বেছে নেব তাই তো আমি ভেবে পাচ্ছি। কী যে আমার বাঞ্ছনীয়।
যেদিকে তোর মন যায়, যে কাজটা তোর মনের মতন কাজ। সেই কাজই হচ্ছে তোর আসল কাজ। তাই কবি তুই। তাই হবে গিয়ে তোর আসল বৃত্তি।
সেটা আমি টের পাব কি করে মা? সেই কাজটা?
মা-ই বুঝিয়ে দেবে, জানিয়ে দেবে–সে কাজে তোর মন সাড়া দেবে, মার সাড়াও পাবি। নিয়তিই পাইয়ে দেবে তোকে। যথাসময়ে পেয়ে যাবি-ভাবিসনে। মার কাছে চাইলেই পাবি, বলেছি তো তোকে, মাকে ধরতে পারছিসনে? মাকে পেলেই সব পাওয়া যায়। মিলে যায় সব কিছুই।
মাকে আমায় পেতে হবে না মা। কষ্ট করে পাকড়াতে হবে না তাকে, তুমিই বলেছ তো। মা-ই তো ধরে রয়েছে আমাদের সবাইকে? তাই না? মূলধন তো আমার হাতের মুঠোয়, কিংবা সেই কেন্দ্রমূলের মুঠোর মধ্যেই আমরা। সেজন্যে আমি ভাবিনে। আমি মাথা ঘামাচ্ছি আমার বৃত্তিটা কী হতে পারে তাই নিয়ে। আমার বৃত্তিটা কী হবে, বলো না তুমি আমায়!
প্রবৃত্ত হলেই দেখতে পাবি। বুঝতে পারবি তখন।
কিসে প্রবৃত্ত হবে তাই যে আমি জানিনে ছাই।
কাজেই প্রবৃত্ত হবি, আবার কীসে? মা বলেন, যে কোনো কাজে। মনের মত কাজ হলে তো কথাই নেই, যদি কাজের মত মন হয় তাহলেও হবে। মা তো সব কিছুর কেন্দ্রেই রয়েছেন, মনের মূলেও সেই তিনিই–তুই মন দিয়ে তোর কাজ করলেই তাঁর সঙ্গে তোর যোগাযোগ হয়ে যাবে, সহজেই হবে স্বভাবতই-সেটা তোর জাতেই হোক, অজান্তেই হোক। তখন দেখতে পাবি তোর ভেতর থেকে আরেকজন কে যেন তোর কাজে এসে হাত লাগিয়েছে, সব কাজ করে দিচ্ছে তোর, কাজটা হয়ে যাচ্ছে অবলীলায়, তখনই তুই বুঝবি। এ আর কারো কর্ম নয়, মারই কাজ।
যে কোনো কাজ?
হ্যাঁ, যে কোনো কাজ। কাজটা বড় কথা নয়, কাজের ভেতর ভগবানের দেখা পাওয়াটাই আসল। তিনিও যে তোর কাজে তোর সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন, হাতে হাতে ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছে, হাতে হাতে তার প্রমাণ পাবি, তুই চলেছিস আর তোর সঙ্গে তিনিও চলেছেন সাথে সাথে, পদে পদে টের পাচ্ছিস সেটা–মুহূর্তে মুহূর্তে তার পরিচয় পাবার জন্যই তো আমাদের জন্মানো, এই বেঁচে থাকা, আমার আমি হয়ে ওঠা–সম্পূর্ণ হয়ে ওঠা। এই পুনঃ পুনরাবৃত্তি। জন্মে জন্মে এই অমৃতমতে। এই অমরত্ব।
আমি কাজে লাগলেই আরেকজন অলক্ষ্যে আমার কাজে এসে হাত লাগাবে, বলছ তুমি? আমি কই, সমক্ষে সেই প্রমাণ পাবো?
পাবি বইকি। ভেতর থেকে তিনি তো আসবেনই, বাহির থেকেও আসবে কতজনা তোর সাহায্যে এগিয়ে–তাদের মধ্যেও সেই তিনিই। বিরাট কর্মীদের বড় বড় কাজ সব এই করেই তো হয়েছে রে!
আমি বাইরের লোকদের কথা ভাবছি না মা, আসুক না আসুক, বয়েই গেল আমার। আমি ভাবছি ভেতরের…
নিশ্চয়। ঠাকুর কি তবে মিছে কথা কয়েছেন নাকি? বলেননি যে, একজন ধান মাপতে বসলে আরেকজন তার পাশে বসে ধানের রাশ ঠেলে দিতে থাকে–বলেননি তিনি?
হ্যাঁ, বলেছেন তো। তুমি বলছ এই রাশলীলা সেই ভগবানের?
বলছি কি তবে? রামপ্রসাদ যখন নিজের ঘরের বেড়া বাঁধতে লাগলেন তখন ভেতর থেকে তাঁর হাতের কাছে দড়ি যুগিয়ে দিচ্ছিল কে? তিনি কাজটায় লাগলেন বলেই না ভেতরের যোগান পেলেন? এই বাগানদারিটা কার? আবার তিনি যখন নিজের গান বাঁধতে বসলেন তখন সেই গানের ধুনিও কে তাঁকে যোগালো বল্ দেখি?… ঠাকুর কি কখনো মিছে কথা কন?
আবার রবিঠাকুরের বেলাতেও এরকমটা ঘটেছিল মা। রিনি সেদিন একটা গান গাইছিল, শান্তিনিকেতনে শেখা…শুনবে? তার মতন অমন মিষ্টি সুর বার করতে পারব না আমি, তবে কথাগুলো কোনোরকমে ছন্দ করে বলতে পারি
আমার এ গানের তরী ভাসিয়েছিলাম/চোখের জলে
সহসা কে/এলে গোকে এলে গো/সে তরী বাইবে বলে…
রিনি গাইছিল তাই আমার মিষ্টি লাগছিল, কিন্তু গানটার মানে আমি একদম বুঝতে পারিনি, তোমার কথায় বুঝতে পারছি এখন।
সেই একই মানে। কবি যখনই না সুরধুনীর স্রোতে নিজের নৌকো ভাসিয়েছেন, দেখেছেন যে, আরেকজন এসে তাঁর পাশে বসে দাঁড় বেয়ে চলেছে তাঁর সঙ্গে। গীত রচনাই ছিল তাঁর বৃত্তিতে, নিজের বৃত্তিতে তিনি প্রবৃত্ত হলেন বলেই না … গানের পথে পা বাড়াতেই সঙ্গীতের সঙ্গী এসে হাত মেলালেন তাঁর সঙ্গে …এত সুর, এই অফুরন্ত গান কি একজনের কাজ! বলে মা গুনগুন করে সুর ধরলেন তারপর…পথিক, তুমি পান্থজনের সখা হে,/পথে চলা, সেই তো তোমার পাওয়া/যাত্রাপথের আনন্দ গান যে গাহে/তারই কণ্ঠে তোমারই গান গাওয়া…
তাঁর গানে সেই একই কথা মা এখানেও। আমি সায় দিলাম মার কথায়। সত্যি মা, এত গান, এত রকমের গান কখনই একজনের সৃষ্টি নয় সত্যি। এত কাজ একজনের পক্ষে সম্ভব হয় না।
একজনৈর জন্যে কি হয় কিছু কখনো? গাহিতে হবে দুইজনে। পরাবিদ্যায় গায়ক গাইছেন পরমাত্মার সঙ্গে। আর অপর বিদ্যমানতায় এক শ্রোতার জন্য–তার সঙ্গেই। তাকেই বলে গানের সঙ্গত।
নইলে গান গাওয়াটাই অসঙ্গত। তাই না মা? বলে আমি মার উল্লেখিত কবিতাংশটা আজড়ে নিজের স্মৃতিশক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাই-কেবল গায়কের নহে তো গান, গাহিতে হবে দুইজনে/একজন গাবে ছাড়িয়া গলা আরেকজন গাবে মনে।
— হ্যাঁ। তেমনি তুই যদি কখনো কবি হোস…কবি হতে চাস নাকি তুই? তাহলে তোর বেলাও এমনটা ঘটবে দেখবি। রবিবাবুর মতন অত বড় অঘটন হয়ত ঘটবে না, শতদল পদ্ম যেমন তার একশ দলে বিকশিত হয়ে ওঠে তা হয়তো হবে না তোর বেলায় আমার মনে হয় এটা। যার যেমন আধার। না হোক, দুচার দলের ফুলের মতন ফুটতে পারবি তো তুই-তাতেই তুই সম্পূর্ণ হবি, সার্থক হবি।
হলে তো মা! মার কথার পিঠে আমি দীর্ঘনিশ্বাস পাড়ি হওয়াই যাচ্ছে না যে।
হবেই। না হয়ে যায়? ঠিক প্রবৃত্তিটির বৃত্তে তুই এক-পা এগুলেই দেখবি, মা দুপা এগিয়ে এসেছেন, সাথী হয়েছেন তোর পথযাত্রায়, তুই দুহাত বাড়ালেই মা দশ হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন তোকে। দেখবি তুই।
কবিতা লেখা, গল্প লেখা কি কারো বৃত্তি হতে পারে মা? আমি শুধাই।
কেন হবে না? যেখানে পরাবিদ্যায় আর অপরাবিদ্যায় মিলেছে, মাকে ডাক দিয়ে পাচ্ছিস, মার কাছ থেকে আসছে, আর অপরের যোগে প্রকাশিত হচ্ছিস-ডাকিনী আর যোগিনী, মার দুই সখি এসে মিলেছেন যেখানে, সেখানেই আমাদের বৃত্তি, সেই আমাদের বৃত্তপথ-সেইখানেই আমরা প্রবৃত্ত। যেখানে যেখানে এমনটা হয় মার সেখানে এই ছিন্নমস্তারূপ–নিজের কণ্ঠের রুধির ধারা নিজে পান করছেন, পান করাচ্ছেন তাঁর ডাকিনী যোগিনীদের।.সেই ত্রিবৃত্ত এসে মিলেছে যে পথে–সেইখানেই। কোথায় কোথায় এমনটা হয় রে?
কোথায় হয় কে জানে! তুমিই জানো আর মা-ই জানেন।
সঙ্গীতে হয়, সেখানে মা নিজের সুর নিজে শোনেন, যে সেই সুরঙ্গমাকে ডাকে, ডেকে আপন গলায় আনে-সেও শুনতে পায়, আর পায় বিশ্বজন সবাই-তার শ্রোতারা-সেই সুরধুনীতে স্নান করে ধন্য হয় যারা। ডাকিনী আর যোগিনী হল না? মা একটুখানি থামেন : লেখাটেখার বেলাতেও তো তাই হয়ে থাকে, তাই না?
আবার ভালোবাসার বেলাতেও বোধ হয় তাই মা। ভাবলে, প্রায় সঙ্গীতের মতই সন্তুরাগ সমন্বিত সেটাও। কিন্তু সঙ্গদোষে দুষ্ট সেই পঞ্চম ম-কার মার সম্মুখে উচ্চারণ করতে বাবে আমার। একটু ঘুরিয়েই বলি-তাতেও মা একজন ডাক দেয়, আরেকজনা যোগ দেয়, আর মা তাদের মাঝখানে থেকে মিলিয়ে দেন দুজনাকে। প্রায় তাই হল না মা? আমার পুনশ্চ যোগ হয়–মা-ও তো সেই ভালোবাসার ভাগ পান, পান নাকি?
মাকে ভাগ দিয়ে পেলেই, মাতৃভাগ্যে এলেই তো সার্থক হয়, সম্পূর্ণ হয় সেই ভালোবাসা। মা কন, মার প্রসাদ পেলেই তো স্বাদ মেলে, সাধ মেটে।
তবে তুমি যে বলছ মা, ভালোবাসা কোনো বৃত্তি হতে পারে না–বৃত্ত হতে পারলেও। ওটা আমাদের স্বাভাবিক বৃত্তিই নাকি–নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতই। তাই তুমি বলছ তো? তোমার মতে কর্ম না হলে কোনো বৃত্তি হবে না, কিন্তু ভালোবাসা তো কর্ম হতে পারে না কর্মই নয়…। বলে আমার স্বগতোক্তি শুনি এবং কর্ম হলেও তো ঈষৎ কর্ম। সৎ কর্ম কিনা। কে জানে! আর তা যদি কোনো বিদ্যাই হয়, সুন্দর বিদ্যাই। (ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর আমার মনে পড়ে যায়। আর বৃত্তি হলে তো আনন্দবৃত্তি। কিন্তু কর্ম ও কর্ম বলতে যা বোঝায়, এক সঙ্গে হাত পা মাথা খাটিয়ে ডাকিনী-যোগিনীর সহায়তায় রুধির উপায়-রুধির বুলতে টাকাকড়িও বোঝায় নাকি আরার-মাই একবার বলেছিলেন আমায়-একাধারে নেশা আর পেশা সেই ভালোবাসা তা নয় তো! কাউকে ভালোবেসে কি টাকা উপায় করা যায় কখনো? গেলেও সেটা সদুপায় বলে গণ্য হয় না নিশ্চয়, নিতান্তই তা গণিকাবৃত্তি বটে। মনে মনে মাথা ঘামিয়ে এই সব আলোচনার পর নিজের মুখপটে প্রকট হই–কিন্তু তোমার ওই লেখা-টেখাটা বৃত্তি হবে কি করে বলো? সে কর্মে তো টাকা উপায় করা যায় না মোটেই?
কে বললে যায় না? তবে তেমনটা হয় না হয়। কিন্তু জীবনের সব দুঃখ দূর হয় না বোধ হয়–কিন্তু জীবনে তো দুঃখ রয়েছেই, বড়লোকেরও আছে, গরীবদেরও আছে তবে যারা শিল্পকলা নিয়ে থাকে, আপন ছন্দে চলে, একরকমের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য তারা পায় বইকি–সেটা কি কিছু কম?
না, সেটা ছন্দ নয়। আমি ঘাড় নাড়ি– আর চারুদা তো লিখেটিখেই সংসার চালায়। চালায় না মা?
চালায় বই কি! লেখাটাই যদি তোর পেশা করিস তত মাকে স্মরণ করে লিখতে বসলেই…
মনটা গোড়ায় মাকে দিয়ে তারপর তো লেখায় দিতে হবে মা? গোড়ার থেকেই তো আগাতে হয় আমাদের।
হ্যাঁ, তাহলেই দেখবি তোর লেখাটেখা কেমন আপনার থেকেই হয়ে যাচ্ছে যেন। নিজের বেগে বয়ে চলেছে। কোত্থেকে সব কথা আসছে যে! লাইনকে লাইন কে যেন লিখে দিচ্ছে তোর হয়ে…..কত আইডিয়াই যে আসছে তোর মাথার থেকে, ভেবেই পাবিনে। তর তর করে লিখে যাবি তুই।
তাই নাকি মা?
তবে ওই যে বললি, গোড়ার থেকে আগাতে হয়– উল্টোপাল্টা কথা কইলেও কথাগুলো তোর আলতুফালতু না–একেক সময় তার একটা মানে হয় বেশ। কিন্তু আমার ভয়ও হয় সেই সঙ্গে আবার।
কিসের ভয় মা?
তুই যেরকম শব্দের মোহে পড়েছিস না? তার থেকে, ভয় করে এর পরে হয়তো তুই অর্থের মোহে পড়বি নির্ঘাত টাকাকড়ির লালসায় ছুটবি। শব্দ থেকে আর এক পা এগুলেই তো অর্থ। অর্থের জন্য আরেক ধাপ এগুলেই অনর্থ। অনর্থে না পড়ে যাস তুই শেষটায়–সেই ভয়। তবে ভরসা এই, মা-ই তোকে সব অনর্থ থেকে সব সময় সামলে রাখবেন-বাঁচাবেন তোকে সব সময়।
নিশ্চয় নিশ্চয়। আমিও মাকে ভরসা দিই : এখন তুমি গোড়াতেই যে কথাটা বলছিলে … বলে অন্য কথায় গড়িয়ে যাই। শুধুই যে শব্দের মোহে পড়িনি, শব্দের মতন রূপ রস গন্ধ স্পর্শ সব কিছুর মহিমাতেই আমি কাতর, তার দৃষ্টান্ত মার কাছে তুলে ধরিনে আর।
গোড়ার কথা হচ্ছে মা-ই। সবের গোড়ায়–সব কিছুর গোড়াতেই। মার গুঁড়ি ধরেই উঠতে হবে আমাদের।
গোড়াগুড়িই মা? আগাতেও সেই মা-ই আবার? আমার বাগাড়ম্বর-মা আমার ফলেও আছেন ফুলেও রয়েছেন।
হ্যাঁ, মার বোধন করেই আমাদের সব কাজের উদ্বোধন। মাকে ডাকার সাথে সাথেই মার সাড়া পাওয়া যায়-মাতৃসম্বোধনের সঙ্গে সঙ্গেই তোর বোধোদয়-বুঝেছিস? সম্বোধতে কী হয়? প্রথমা। প্রথমা-ই তো? পড়িসনি তোর উপক্রমণিকায়? সব কাজের উপক্রমেই তাই। মা-ই। তিনিই তো এই বিশ্বের আদ্যাশক্তি–প্রথমতমা–তাই প্রথমা। তাই উপক্রমণিকার সম্বোধনেও স্বয়ং তিনিই। আর, সম্বোধনের সাথে সাথেই তাঁর সঙ্গে তোর সম্বন্ধ স্থাপিত। সম্বন্ধে ষষ্ঠী। আর তার পরেই কিনা পরস্পরের প্রতি অধিকারবোধ জাগ্রত-মার তোকে আর তোর মাকে অধিকরণ। অধিকরণে সপ্তমী। আর তার পরেকার ব্যাপার হল গিয়ে তাদের দুজনের সন্ধি-তুই তাঁর বাহন সিংহ হলেও–কি, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অসুর হলেও– সেই অষ্টমীতে।
তারপর? আমার প্রশ্ন। সন্ধিপূজার পর?
তারপরই নবমী। তোর নবীকরণ-নবরূপান্তর। আর সবশেষে তোদের নিরঞ্জন-মার মধ্যে তোর আর তোর মধ্যে মার। আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তের মাতৃপূজার এই-ই নির্ঘন্ট।
ওব্বাবা কটমট ওই ব্যাকরণের মধ্যেও আবার সেই ভগবান? আমি হাঁ হয়ে যাই। সেটাও তোমার গিয়ে দর্শন শাস্ত্র?
আমাদের সব কিছুই দর্শনভিত্তিক। আমাদের সঙ্গীত, আয়ুর্বেদ, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ –সব। আর দর্শন মাত্রেই ভগবদ্দর্শন। ভগবানকে দেখা–তাঁর মূলে এবং তাঁর মায়ায়–তস্মিন দৃষ্টে পরাগরে–সেই পরে তাঁতেই–আর এই অপরে–আর সবকিছুতে। কথাটা পরাবরেও হয় মতান্তরে–এখানে পর হলো তিনি আর আবর হচ্ছে তাঁর মায়া–এই বিশ্বসৃষ্টির আবরুল। এই উভয়ের মধ্যেই, সর্বত্র, সব ক্ষেত্রে তাঁকে দেখাটাই হচ্ছে সত্যিকারের দেখা। এবং সেই কথাটাই আমাদের সব শাস্ত্রে, সব মহাকাব্যে। এবার যা বলছিলাম… মা আবার তাঁর গোড়ার কথায় আগান; তত্ত্বব্যাখ্যার পর মার দৃষ্টাতের আখ্যান : মহাকবি কালিদাসও তাঁর কাব্য রচনার আদিতে পার্বতী পরমেশ্বরের বন্দনা করেছিলেন…।
জানি। বাবাকে আওড়াতে শুনেছি তো। মার উদাহরণে আমার উদ্ধৃতিযোগ : বাগর্থ যত্র সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপওয়ে/জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ। বাবার মুখে বার বার শোনা কালিদাসের পদটা আওড়াই–বুঝেছি মা। কালিদাসের-পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলতে হবে আমাকে। কোনোকালে কালিদাস হতে পারি আর নাই পারি।
হ্যাঁ, আর তাহলেই দেখবি কৃত্তিবাসের উঞ্ছবৃত্তি করতে হবে না তোকে আর। কৃত্তিবাস পণ্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ/সপ্ত কাণ্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ। ভাঙিয়ে তোর ওই–শিবরাম পণ্ডিত এক বিচক্ষণ কবি/সাত কাণ্ডে গাহিলেন রামায়ণ সবি। এইসব ভ্যাজাল আমদানি করতে হবে না আর। তুই নিজেই এক কাণ্ড করে বসবি তখন, যদি সেই কল্পতরুর তলায় গিয়ে হাত পাতিস কেবল। ফল পড়বে টুপটাপ, দেখবি। বলেছেন না ঠাকুর-কালী কল্পতরুমূলে চারি ফল কুড়ায়ে পাবি। বলেননি তিনি?
বলেছেন তো! আচ্ছা ওই চারি ফলটা কী মা? কোনো খাবার জিনিস?
চারি ফল হচ্ছে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ–এই চতুর্বর্গ। জানিসনে?
এর মধ্যে তোমার প্রথম আর শেষটা আমার চাইনে। ধর্মের আমি ধার ধারিনে, আর মোক্ষ? মোক্ষে আমার দারুণ অনীহা।
অনীহা-মানে? মা সচকিতই।
জানি না আমি ঠিক। ভারী ভারী প্রবন্ধে থাকে, দেখা যায়। কী মানে কে জানে, কথাটা বেশ কিন্তু। আমার রচনার খাতায় ফাঁক পেলেই লাগিয়ে দিই যেখানে সেখানে–তোমার সেই পিতাঠাকুরের মতই। বাংলার মাস্টারও বুঝতে পারেন না, হকচকিয়ে যান, তাজ্জব হয়ে থাকেন। আমি জানাই : তবে আমার ধারণা, ওর মানে হয়ত হবে, অনীহ্যাঁ, কিনা, না ইহা–এটা নয়। বাবার ঐ নেতিবাদের মতই কিছু একটা হবে বোধ হয়।
ধর্মই তো আসল জিনিস রে! ধর্ম কি ফ্যানা নাকি? ধর্ম ছাড়া কি একদণ্ডও কেউ বাঁচতে পারে?
ধর্ম-টর্ম আমার ভাল লাগে না। আমি বলি, ধর্মটা কী মা?
কর্মই হচ্ছে ধর্ম। ধর্ম কর্ম বলে না রে? যে-কর্ম তুই ধরে থাকিস আর যে-কর্ম তোকে ধরে রাখে। স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ধর্ম সবার-সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। ভগবানের সঙ্গে আর জীবৎকর্মে যে একান্ত ব্যক্তিগত যোগাযোগ তাই হচ্ছে তোর ধর্ম। তোর যেটা কর্ম তা যদি তুই সবটা মন দিয়ে সুচারুরূপে করতে পারিস তবে সেই করাটাই ধর্ম। ধর, তুই যদি লেখক হোস তো লেখাটাই হবে গিয়ে ধর্ম তোর। কর্মও আবার।
তাই বলে মা! আমি হাঁফ ছাড়ি : বাঁচালে তুমি আমায়।
আর, মোক্ষ হলে গিয়ে, মন দিয়ে লিখতে বসলে যা তোর মনের ভেতর থেকে মুক্তি পাবে… লিখতেই বস বা কি কাউকে ভালোই বাস…তখন তোর অন্তর থেকে যা ক্ষরিত হবে–বিমুক্ত হয়ে আসবে, তাই হচ্ছে গিয়ে তোর মোক্ষ। মোক্ষ কিছু লাভ করার বস্তু নয়–মুহুর্মুহু সেটা ঘটবার। সেই আত্মমোক্ষণে তোর সঙ্গে ভগবানেরও মুক্তিলাভ। ধর্ম হচ্ছে তোর–মাকে ধরে থাকা। আর মোক্ষ হচ্ছে ভগবানের। মা-র। অহরহই সেটা হচ্ছে।
আচ্ছা, আমি যদি চাই তো তোমার ওই কল্পতরু কি গল্পতরু হয়ে ধরা দেবে আমার কাছে? আমি শুধাই, এনতার গল্প পাবো তার কাছ থেকে–চারুদার মতই। কৃত্তিবাসের গাছতলায় গিয়ে কবিতার মিল কুড়োতে হবে না আমায়। মিলটিল সব সেখান থেকেই মিলবে। আমার কীর্তি ফলছে তোমার ওই গাছেই, বলছ তো তুমি?
চেয়েই দ্যাখ না। গাছ মাত্রই তো ফলেন পরিচীয়তে–এমনকি ঐ কল্পতরুও। বেয়ে চেয়ে দ্যাখগে… বাগর্থের মতই পরাবিদ্যা আর অপরাবিদ্যা যেখানে হরিহরাত্ম হয়ে মিলেছে, সেই কালী কল্পতরুর মূলেই পাবি তুই সব।
শিবও তো কল্পতরু মা? বাবা যে আওড়ান-প্রণমামি শিম শিবকল্পতরু…শিবও তো হতে পারে মা…?
শিব দুর্গা কি আলাদা রে? এক দেহেই তো অর্ধনারীশ্বর হরগৌরী হয়েছেন।…দুর্গা স্বয়ং শিবের কাছেও কল্পতরু আবার, তা জানিস? একবার অন্নপূর্ণা হয়ে-
জানি জানি। কিন্তু পরমান্ন আমার চাইনে এখন মা! আমি এখন গল্প পেতে চাই, কবিতা পেতে চাই ঝুড়ি ঝুড়ি।
সব পাবি। কবি তোর নিজেই বলে যাননি কি?–নূতন ছন্দে অন্ধের প্রায় ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়/নূতন বেদনা বেজে ওঠে তায়নুতন রাগিণী ভরে/যে কথা ভাবিনি বলি সেই কথা/যে ব্যথা বুঝিনে জাগে সেই ব্যথা/জানি না এনেছি কাহার বারতা/কারেশোনাবার তরে। ওগো রহস্যময়ি! আমি যে-কথাটি/কইতে চাইছিকিহিতে দিতেছ কই?/পড়িসনি ছেলে-চারুর চয়নিকায়?
— পড়েছি তো। মানে বুঝেছিলাম, কিন্তু মর্ম বুঝিনি তখন।
এই রহস্যময়ীটি কে বল দেখি?
জানিনে বুঝি? মা-ই তো, আবার কে? তোমার মা আমার মা সবার মা।
আমার কথায় হাসতে থাকেন মা-সেই হাসির আড়ালে সর্বময়ীকেই…সবার মার হাসিটি দেখা যায় না কি!
.
২৬.
আমাদের গতিবিধির বৃত্তান্ত শুনবেন তাহলে নিতান্তই? জনাব সাহেবের প্রতি কৃপাকটাক্ষ করে শুরু হয় আমার : কিন্তু শুনলে আপনি হতাশ হবেন, আমি বলছি। কেননা, মানুষের আশা কখনই পুরোপুরি মেটে না–যে গতিবিধি করে তারও যেমন নয়, যে তার ইতিবৃত্ত চায় তারও তেমনটা। তাছাড়া মানুষ স্বভাবতই দ্বিধাগ্রস্ত, জানেন তো? আর এই লেখক-শিল্পী গোত্রের কেবল দ্বিধা নয়, শতধাই বলা যায়। দেহ মন নিয়ে শতদিকে সতত তাঁরা ধাবমানকে তার সন্ধান রাখে, কেই বা কাকে তা দিতে পারে! তাহলেও শুনুন, গোড়াতেই বলে রাখছি কিন্তু…গতিবিধি বলতে যা বোঝায় তা ঠিক হয়ত হবে না। বিধিমত গতি তাকে বোধহয় বলা যায় না কিছুতেই।
উৎকর্ণ ভদ্রলোক বৃথা বাক্যব্যয়ে অযথা বাধা না দিয়ে নিজের মৌন সম্মতিতে উন্মুখর হয়ে আমায় উৎসাহিত করেন।
হেমেনদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ একেবারেই আকস্মিক,আমি আরম্ভ করি: অঘটনের মতই প্রায়। সেকালের নব সংস্কৃতির নানামুখী ভাগীরথী ধারার যাঁরা ভগীরথ-ধারক বাহক ছিলেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আমাদের এই হেমেন্দ্রকুমার রায়। অবশ্য ভাগীরথীর ন্যায় সংস্কৃতির ধারা সব সময়ই বহতা, সেকাল একাল বলে তার কিছু নেই–কখনো তার মোড় ফেরা, কখনো বা তার মুখ ফেরানো।
সে যুগের এক চমকদার লেখক ছিলেন হেমেন রায়। যেমন তাঁর গল্প, তেমনি তাঁর কবিতা, তেমনি আবার ব্যঙ্গ কবিতাও–সেই সঙ্গে কিশোর সাহিত্যও আবার। কিশোর সাহিত্যে তো তাঁর জোড়া মেলে না–তাঁর বন্ধু মণিলাল গাঙ্গুলীকে বাদ দিলে। যথার্থ বলতে দক্ষিণারঞ্জনের রূপকথার রাজ্যে কিশোর কাহিনীর আমদানি তাঁরই একান্ত কীর্তি। সে-পথে আমরা অনুগামী তাঁরই।
আর মানুষ হিসেবে তুলনাই হয় না তাঁর। লেখকদের মধ্যে এমন সহৃদয় আমি খুব কমই দেখেছি, অবশ্যি কটা লেখকই বা দেখেছি আমি আর?
ফুটবল ম্যাচ দেখে মাঠের ফেরতা কল্লোল-এর কয়েকজন আমরা প্রায়ই চাংওয়ায় খেতে যেতাম। চাঁদা করে খাওয়া হোত। প্রত্যেকের ভাগে এক টাকা। অবশ্যি, বিলের টাকা মেটাবার সময় সবার ভাগেরটা প্রেমেনই দিয়ে দিত বেশিরভাগ।
খাবারদাবার দারুণ সস্তা ছিল তখন চাংওয়ায়। এক টাকায় ঢাউস এক প্লেট কুঁচো চিংড়ি, মাংসের কুঁচি দেওয়া ফ্রায়েড রাইস দিত, যা তিনজনের পক্ষে যথেষ্ট। আর এক টাকায় গোটা ছয়েক প্রন কাটলেট মিলত, তার স্বাদের তুলনা হয় না। আর এক টাকায় যে কী নেওয়া হত তা এখন মনে পড়ে না। চপটপ কি কারিটারি কিছু হবে বোধহয়।
এছাড়া এক পেগ করে ছিল আবার আরো প্রত্যেকের। ওটা নাকি অবশ্য গ্রাহ।
প্রেমেন বলেছিল এক টাকায় এত এত খাবার দিয়ে ওদের কী লাভ থাকে ভাই! যা কিছু মুনাফা এই মদ বেচেই। এ না নিলে এখানে পাত্তাই মিলবে না একদম।
নিতেই হত বাধ্য হয়ে। তবে একথাও আমি বলতে বাধ্য,বস্তুটির মতন অখাদ্য আর হয় না। প্রথম চুমুকেই আমার গাল গলা এমন জ্বলে গেছল যে জীবনে আমি আর তার দ্বিতীয় চুমুকে যাইনি।
আমার বিবেচনায় নেশা যদি করতেই হয় তো রাবড়ির। চুমুকে চুমুকে খাওয়া যায় আর প্রতি চুমুকেই চমৎকার।
আর বিশ্বসংসার ভুলবার জন্যেই যদি নেশা, তাহলে বলা যায়। ঐ চুমুকেই।
এক চুমুকেই তামাম দুনিয়া দুলিয়ে দেয়, ভুলিয়ে দেয়, রঙীন করে দেয় ঐ চুমুই। যা কোনো লালপানিতে কখনো পারে না।
ব্যক্তিই কি আর কস্তুই কি, প্রথম পরিচয়টা যুতসই না হলে সম্পর্কটা তেমন মজবুতসই হয় না। প্রাথমিক মদালাপটা ঐ রকমটা না হওয়ার দরুণই হয়ত পরে আমার অনেকবার পান করার সুযোগ এলেও, এমন কি শখ গেলেও, শখটা আর জমল না তেমন।
সিগ্রেটের বেলাও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল আমার।
সেকালে রামরাম, হাওয়াগাড়ি এইসব অদ্ভুত নামের সস্তার সিগ্রেট মিলত–দু-চার পয়সা দামের প্যাকেটে। স্কুলের এক বন্ধুর পাল্লায় একবার তার এক টান না টেনেই চোমুখ কপালে উঠে, দম আটকে কাশতে কাশতে মারা যাই আর কি। তারপর এ পর্যন্ত নামী দামী উপাদেয় কতো রকমের সিগ্রেটই না বেরিয়েছে বাজারে, শুনতে পাই, বিজ্ঞাপনেও নজরে পড়ে বইকি, কিন্তু কোনো সিগ্রেটকেই আর কখনো এমুখো হতে দিইনি।
সেদিনই ধরা পড়ে গেছলাম মার কাছে।
ইস্কুলে যাবার সময় মা যেমন আদর করে ছাড়তেন আমাদের, ইস্কুল থেকে ফিরলেও তেমনিই আদর করতেন আবার।
ধরা পড়ে গেলাম সেই মুহূর্তেই-সিগ্রেট খেয়েছিস বুঝি?
হ্যাঁ মা।
আর খাসনে কখনো।
আর, ধরা পড়েছিলাম রিনির কাছেও-সিগ্রেট টানা হয়েছে বাবুর আজ?
কী করে ধরলি? হাত গুণে নাকি?
ধরতে পারি আমরা। ফের যদি তুমি সিগ্রেট খাও তাহলে আর কক্ষনো আমার খেয়ো না। আমিও আর…
আর বলতে হবে না তোকে। ও জিনিস খায় মানুষ! ছ্যা!
তবুও সে তারপরও আরো বলেছিল–সিগ্রেট খেলে আর কোনো মেয়ে তোমায় চুমু খাবে না, এক তোমার বউ ছাড়া। তাহলে তাকেও সিগ্রেট ধরাতে হবে–মনে রেখো।
আমি মনে রেখেছিলাম।
সেই চাংওয়াতেই হেমেনদার দর্শন পেয়েছিলাম প্রথম।
চাংওয়ার দুধারে দুসারি কেবিনের মাঝখানটায় টেবিল পাতা থাকত তখন। কেবিনের বাইরে তারই একটা টেবিল বেছে নিয়ে আমরা বসতাম।
সেখানে বসেই একদিন একটা কেবিনের ভেতর হেমেনদাকে দেখেছিলাম। কেবিনের পর্দা সরিয়ে বেয়ারা খাবার দিতে যাবার সময়ে নজরে পড়ল।
কে একজন চিনিয়ে দিল আমাদের মধ্যে–ঐ যে! হেমেনদা খাচ্ছেন ঐ কেবিনে।
সঙ্গে দারুণ সুন্দর দুটি মেয়ে ভাই! দেখেছ? আমি উচ্ছ্বসিত হয়েছি।
ওঁরই মেয়ে তো!
সে কি! উনি মেয়েদের নিয়ে এখানে এসে এমনি করে পানভোজন করছেন?
দোষ কি তাতে? বাড়িতে বসে মেয়েদের সামনে খেতে যদি কোনো বাধা না থাকে তাহলে…তাছাড়া, উনি একলা এসে এখানে ভালোমন্দ কতো কী খাবেন, আর ওঁর মেয়েরা তা খেতে পাবে না, ওঁর মতন মেহকাতর পিতার মনে সেটা লাগে। সেকথা উনি ভাবতেই পারেন না।
ভেবে দেখলাম, কথাটা ঠিক। ভালোবাসা সহজেই সব সংস্কারমুক্ত করে, কোনোখানেই গণ্ডী রাখতে দেয় না। আমাদের খণ্ডিত দর্শনে তাকে যতই না জটিল-কুটিলরূপে দেখতে যাই, তার মতন সহজ কিছু আর হয় না।
শুধু নিজের মেয়েকেই নয়, পরকেও উনি খাওয়াতে ভালোবাসেন খুব। এমনি করে আমাদেরও ধরে নিয়ে এসে খাইয়েছেন কতদিন এখানে। প্রেমেনই বলেছিল বুঝি।
তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর আমিও সেই অভিজ্ঞতার ভুক্তভোগী।
ঘনিষ্ঠতা ঘটেওছিল ভারি অদ্ভুত ভাবেই।
শিশিরকুমারের নাট্যমঞ্চে শরৎচন্দ্রের ষোড়শী নিয়েই এই অঘটন। শরৎবাবুর দেনাপাওনা উপন্যাসের নাট্যরূপ ঐ ষোড়শী।
অবশ্য ষোড়শী নিয়ে মারামারি এই প্রথম নয় এবং আজকেরও না–ট্রয় নগরী স্ট্রেয়ের মূলেও ছিল এই ষোড়শীই, এমনকি তারও আগে সুন্দ-উপসুন্দর আমল থেকেই চলে আসছে এই কাণ্ড।
তবে এবারকার লড়াইটা ছিল কাগজে কাগজেই।
আমার সেই তরুণ বয়সে ইবসেনের নাটক পড়ে বিষয়বস্তুতে তো বটেই, আরো বেশি করে তার রচনার টেকনিকে আমি অভিভূত হয়েছিলাম।
আমাদের দেশে সেকালে থিয়েটারের পালা পাঁচ অঙ্কে অসংখ্য গর্ভাঙ্কে বহু পাত্রপাত্রী এবং সুদীর্ঘ দেশকালে বিস্তৃত বেশ এক গন্ধমাদনী কাণ্ডই ছিল। সেখানে অল্প সময়কালে ঘনবিন্যস্ত ইবসেনের নাটকগুলি স্বভাবতই চমকিত করেছিল আমায়।
বাংলায় কি এমনটা করা যায় না?
আমার মাথায় তখনও মৌলিক নাট্য রচনার কোনো প্লট দানা বাঁধেনি। শরৎচন্দ্রের দেনাপাওনা সে সময় সবে ভারতবর্ষে বেরিয়েছে। আমার মনে হল ওই উপন্যাসটিকে নিয়ে এ ধরনের নাট্যরূপের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় বোধ করি।
শরৎচন্দ্রের প্রায় সব লেখাতেই বেশ নাটকীয়তা রয়েছে দেখা যায়। এককালে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ বাংলা রঙ্গমঞ্চে চলেছিল খুব। কিন্তু তারপরে একালে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নিয়ে, সে-সবের অন্তর্গত অত নাটকত্ব সত্ত্বেও, কেন যে তেমনটা হয়নি আমি ভেবে পাইনি।
যাই হোক, ইবসনি কায়দায় সেই বিস্তৃত বইকে চার অঙ্কের-প্রত্যেক অঙ্ক একটিমাত্র দৃশ্যে সম্পূর্ণ নাট্যাকারে ঘনসম্বন্ধরূপে দাঁড় করানো গেল। সেই নাট্যরূপ নিয়ে আমি শিশিরবাবুর কাছে গেলাম, তিনি তখন ঘোষ লেনের বাড়িতে থাকতেন।
কিন্তু কেন জানি না ওটা তাঁর মনে ধরল না।
তখন আমি নাটকটি নিয়ে ভারতী সম্পাদিকা সরলাদেবীকে দিলাম। জগৎ ভট্টাচার্য তখন পত্রিকাটার কার্যনির্বাহক ছিলেন। সম্পাদনা কার্যও করতেন তিনি।
ভারতীর পূজাসংখ্যায়, সেইটাই তার নবপৰ্য্যায়ের শেষ সংখ্যা আবার, বেরিয়ে গেল রচনাটা।
বেরল কিন্তু শরৎবাবুর নামেই। নাট্যরূপান্তর সাধনের জন্য তার কোথাও আমার নামগন্ধ কিছুই ছিল না। সেটা যে ব্যবসায়িক কারণেই তা বোঝা তেমন কষ্টকর হয়নি। তাছাড়া, সেই জগতের নিয়ম–ব্যবসায়ী জগতের ধারাই তাই। এইরকমটাই ধারণা হয়েছিল আমার আমার বন্ধু জগৎ ভট্টাচার্যের ওপর কোনো কটাক্ষ করছিনে।
যাই হোক, ওই প্রকাশের ফলে সাড়া পড়ে গেল থিয়েটার পাড়ায়। স্টার থিয়েটারের প্রবোধ গুহ মশাই ওটা তাঁর পাদপিঠে মঞ্চস্থ করতে চাইলেন। এবং তারপরও টনক নড়ল শিশিরবাবুর।
প্রবোধবাবুর আগেভাগেই তিনি পানিত্রাসে গিয়ে শরৎবাবুর কাছ থেকে নাটকের অভিনয় স্বত্ব নিয়ে এলেন।
মহাসমারোহে অভিনীত হয়েছিল বইটা। দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত সাফল্যে চলেছিল সে পালাটা।
অবশ্যি ভারতীর ষোড়শী আর অভিনীত ষোড়শীতে কিছুটা পার্থক্য ছিলই। ভারতীতে প্রকাশিত নাট্যরূপের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্ক অবিকল রেখে তার প্রথম এবং চতুর্থ অঙ্ক দুটি একাধিক দৃশ্যে ভাগ করে একটু পরিবর্তন সাধিত করা হয়েছিল। আমি যেকালে উপন্যাসের মতই নাটকটিকে বিয়োগান্ত রেখে খোদার ওপর কোনো খোদকারি করতে যাইনি, শিশিরবাবু সেখানে তাঁর রঙ্গলৌকিক প্রয়োগ নৈপুণ্যে কিংবা তৎকালের দর্শকদের মুখ চেয়েই হবে হয়তো বা, কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্যের কথাটা ভেবেই বোধহয় মিলনান্তক মাধুর্য দিয়ে নাটকটা সমাপ্ত করেছিলেন।
যাই হোক, তার জন্য আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না, নাট্যরূপের জন্য আমার নাম না থাকলেও নয় তেমনটা কিন্তু উক্ত প্রয়াসে আমার অংশ হেতু, কৃতিত্ব গৌরবের কিছুটা না হোক, আংশিক অর্থ প্রাপ্তির কিঞ্চিৎ প্রত্যাশা স্বভাবতই ছিল আমার।
একজন সংগ্রামী নবীন লেখকের পক্ষে–যদিও এখনকার ব্যাপকতর ভূমিকায় মহত্তর অর্থের সংগ্রামী নয়–নিছক নিজের তুচ্ছ জীবনধারণের জন্যই যার জীবনসংগ্রাম–তার কাছে নাম বা টাকা কোনটাই নেহাত ফ্যালনা নয়।
কিন্তু এই ব্যাপারে নাম তো হলই না, আর টাকাও যা পেলাম তা নামমাত্রই-শত খানেকের বেশি নয় কোনমতেই।
সত্যিই এই ব্যাপারটা আমার কাছে ভারী মর্মান্তিক ঠেকেছিল তখন।
এবং স্বভাবতই শরৎচন্দ্র আর শিশিরকুমারের প্রতি আমার রাগ হয়েছিল দারুণ।
আর আমার সেই রাগের ঝাল সেকালের পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠায় ঝাড়তেও আমি কিছু কসুর করিনি। যথাসাধ্য সাহিত্যিক ভাষায় কষে গাল দিয়েছি তাঁদের।
আমার সেই ঝাল ঝাল লেখাগুলি-অচল টাকা ইত্যাদি–নবশক্তি, নাচঘর এবং আরো কী কী কাগজে যেন বেরিয়েছিল।
আর রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কিত বিখ্যাত সাপ্তাহিক ঐ নাচঘরের সম্পাদক ছিলেন আমাদের হেমেন্দ্রকুমার রায়। শরৎচন্দ্র ও শিশিরকুমারের, বিশেষ করে শিশিরবাবুর অন্তরঙ্গ হলেও হেমেন্দ্রকুমার তাঁর বন্ধুদের আঘাত-করা আমার লেখাগুলি তাঁর পত্রিকায় স্থান দিতে কোন দ্বিধা করেননি, এমন কি, কোথাও কোথাও হয়ত আমার পক্ষ সমর্থন করে থাকবেন। তাঁর নাচঘরে আমার একটি নাটকও (চাকার নীচে) ধারাবাহিক বেরিয়েছিল তারপর (আমার প্রথম মৌলিক নাটক যখন তারা কথা বলবে বেরয় নবশক্তিতে।) তাঁর সপ্রশংস ভূমিকা নিয়েই।
এমনি অসাধারণ সহৃদয় সাহিত্যিক ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার।
অবশ্যি আমার তখনকার সেই মর্মদাহ বেশিদিন থাকেনি। সে বয়সে সবাই স্বভাবতই সব কিছু ক্ষমা করতে পারে, সহজেই ভুলে যায় সব।
তার পরে যখন আমার প্রবন্ধের বই বেরিয়েছে, মস্কো বনাম পন্ডিচেরি আর ফানুস ফাটাই, তার কোনটাতেই ঐ অচল টাকা বা ঐ জাতীয় লেখাগুলি আমি বার করিনি, ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছি। এবং আমার জীবনের ঐ পর্ব নিয়ে সমস্ত আলোচনা আর বাদ-বিসংবাদ সযত্নে এড়িয়ে গেছি।
(তবে এর পরে যদি কখনো আমার এতাবৎ যাবতীয় গদ্য রচনা নিয়ে কোনো প্রবন্ধসমগ্র বেরয় তাহলে ঐ লেখাগুলি এবং ঐ কালের আরো কিছু কিছু রচনা সে বইয়ের অন্তর্গত করার বাসনা আমার আছে। বিদ্যাসাগর-জীবনীকার ইন্দ্ৰমিত্ৰমশাই অনুগ্রহ করে তৎকালীন পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে সেগুলি আমায় সংগ্রহ করে দেবেন বলেছেন।)।
বলতে গেলে, আমার ভাগ্যে পর্বতের সেই মূষিক প্রসবে আমার কোনো দুঃখ নেই এখন আর। এবং দুঃখিত নই অনেকদিন থেকেই। আমার জীবনের সেই বিষাদ পর্বকে জীবনের স্বাদ-বয়ে-আনা একটা পার্বণ বলেই মেনে নিয়েছিলাম আমি। তখন তখনই। মনে হয়েছিল আমার যে, ইহাই নিয়ম। পৃথিবীর চেহারাই এই। দুনিয়ার হালচাল এই ধারার। এ নিয়ে দুঃখ করে কোনো লাভ নেই। আর সেই দুঃখ মনের মধ্যে পুষে রাখার মতন অপুষ্টিকর কিছু আর হয় না।
ষোড়শীর সূত্রে টাকা আর স্বীকৃতি পেলে তার সাফল্যে আমি নাট্যজগতের বিপথেই চলে যেতাম হয়ত-রঙ্গমঞ্চের চোরাগলিতেই ঘুরে মরতাম এতদিন। সেই পোষ মা আমার সর্বনাশ ডেকে আনত। তার বদলে যে ধারাবাহিক উপোস মাসগুলি আমায় কাটাতে হয়েছিল, হয়ত তার হেতুই আমার জীবনের সত্যিকার পথ আমি খুঁজে পেয়েছি। তার জন্যই আমি ধন্য। আমি কৃতার্থ।
সেই জন্যেই শিশিরকুমার এবং শরৎচন্দ্রের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি আজ। তাঁদের শাপ আমার বরাতে বর হয়ে এসেছে।
নাট্য রচনা অবশ্যই কোনো সাহিত্যিক বিপথ নয়–কিন্তু আমার পক্ষে তা ঠিক স্বধর্ম হত না, পরধর্মের মত বোধ হয়, ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াত শেষটায়। তা না হয়ে ঐ বিতর্কের সুযোগে হেমেন্দ্রকুমারের সান্নিধ্যে এসে সুধীরকুমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘটে মৌচাকের সৌজন্যে কিশোর সাহিত্য রচনার যে রাজপথ দেখা দিল সেই পথেই যেন আমি আমার আমাকে সম্পূর্ণ করে পেলাম, সম্পূর্ণভাবে দিতে পারলাম সবাইকে।
প্রবীণ মানুষদের প্রাজ্ঞ মুখোশের রাজ্য থেকে নির্বাসন লাভ করে তরতাজা কিশোর কিশোরীদের একান্ত আপনার হয়ে তাদের অনন্ত মাধুরী অফুরন্ত মধুর সাম্রাজ্যে আসবার সুযোগ পেলাম আমি।
নাকের বদলে নরুণ নিয়ে নাকাল না হয়ে আমার সম্মুখে এল যত কচি কচি হাসি হাসি মুখ।
বিতর্কিত ষোড়শী নিয়ে কোনো দুঃখই থাকে না আর মনে, নতুন নতুন ষোড়শীরা এসে দেখা দেয় জীবনে। দূরকে করিলে নিকট বন্ধু পরকে করিলে ভাই কবির সেই স্বপ্নটাই সত্য হয়ে ওঠে, সব ঠাঁই নিজের ঘর খুঁজে পাই বুঝি। নিত্যকালের কিশোর-কিশোরীদের চিত্তলোকেই।
.
২৭.
নিত্যকালের চিত্তলোকে। তিনি প্রতিধ্বনিত হন : কথাটা বলেছেন বেশ।
বেশ বলা নয়, বেশি বলা। বাড়িয়ে বলা। আমি বলি : ভালো শোনায়–বলা তাই। মিথ্যে কথামাত্রই তো মিষ্টি শোনায়। শোনায় না? যেমন আপনার ভালোবাসার কথা যত! উদাহরণ স্বরূপ দিয়ে আমার কথাটা যথাযথ করি।
মিথ্যে কথা?
মিথ্যে নয়তো কী? মিথ্যে বলতে আপত্তি থাকে, বলুন অতিরঞ্জিত। আসলে সত্যি নয়। আসল সত্য হচ্ছে নিত্যকালের চিত্তলোকে কারোই কখনো ঠাই হয় না। চিরকালের স্বামীত্ব নেই কারোরই, সবাই ক্ষণকালের আসামী। বর্তমানের বাইরে বলতে গেলে, কারোই কোনো অস্তিত্ব নেই।
অস্তিত্বই নেই? কারোই না?
কোথায় আর! কবিগুরুকেও দুঃখ করতে হয়েছে জানেন না? ঠাই নাই ঠাই নাই ছোট সে তরী/শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি। মহাকাল কাউকে তাঁর সাথী করেন না। বর্তমানের চাকায় ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা সবাই।
কী বলছেন!
খাঁটি কথা বলে গেছেন ঐ ওমর খৈয়াম। নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও, বাকীর খাতায় শূন্য থাক। এর চেয়ে সত্য কথা আর হয় না।
নিত্যকালের চিত্তলোকে কারোই ঠাঁই হয় না? আপনি বলেন কী মশাই?
কই আর হয়! মহাকালই তো কান্ডারী? তিনি যদি ঠাই না দেন, কী করে হবে? ভগবান চিরকালই হাল ধরে থাকেন–মা বলতেন কথাটা। কথার মধ্যে আবার আরেকটা করে মানে থাকে, বলতেন মা। সেই মানেটা সমঝে নিতে হয়। হাল মানে আবার বর্তমান। ভগবান হাল ধরে আছেন সবার, সব কিছুর, অর্থাৎ সর্বদাই তিনি সবার বর্তমানে আবর্তন কমছেন–নিরন্তর পরিবর্তন আর সমাবর্তনে। তিনিই হচ্ছেন, হওয়াচ্ছেন। এই তাঁর হালচাল। তাঁর অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই। আমাদেরও তাই।
হুম্। তাঁর হুঙ্কার শোনা যায়।
পুনশ্চ অনুযোগ করতে হয় আমায় : এইভাবেই আমরা সবাই বর্তাচ্ছি–অফুরও বর্তমানে। তিনিও বর্তে গেছেন, আমরাও বেঁচে বর্তে রয়েছি–অনন্ত কাল ধরে-পরস্পরের দৌলতে।
ভগবানের ওপর ভবিষ্যতেরও কোনো ভরসা রাখব না? সে কী কথা?
এইমাত্র ভরসা রাখতে পারি যে, ভবিষ্যতেও তিনি বর্তমান থাকবেন। যেমন থাকব আমরাও। নিরবধি বর্তমানে তিনি আবর্তিত। নিয়তই তিনি হচ্ছেন, আমরাও হচ্ছি–এই আমাদের নিয়তি।
তত্ত্বকথা থাক, তথ্যকথায় আসুন। তিনি আসলে আসেন-তাহলেও ষোড়শীরা সব এসেছিল তো আপনার জীবনে? এখন সেটা অতীত কথা হলেও তখন সেটা নগদ লভ্যই হয়েছিল। সেটাও কিছু কম লাভ নয় মশাই! বলে তিনি একটুখানি দম নেন-লাভ কথাটারও আরেকটা মানে আছে আবার। ইংরেজি মানে যদিও।
কোন্ দুঃখে আসতে যাবে তারা? আমি প্ৰকাশ করি–ষোড়শীরা সব শরৎচন্দ্রের এলাকায়। তখনকার ষোড়শীরা অন্তত। সবাই তাঁরা পরিণীতা দেবদাসের মুল্লুকেই তখন। আমার পাঠক পাঠিকারা সব একাদশ থেকে চতুর্দশের মধ্যে। যতই চতুর দশায় থাকি মশাই, আমার বরাতে চিরকাল সেই একাদশী। এবং আমার ভাগ্যে তারা প্রথম এলেও জীবনের প্রথম ভাগের পাঠ নিয়েই না একটু বড় হলেই তারা বড় বড় লিখিয়েদের আওতায় চলে যায়। যেমন এখনও, তেমনি তখনও।
যথা? যেমন?তিনি দৃষ্টান্ত দর্শনে উদগ্রীব।
কেউ তাদের প্রে-মেনে গিয়ে পড়ত, কেউ বা প্ৰবোধ লাভ করত। আমি কই কেউ আবার অচিন্তনীয় কোনো কিছুর সন্ধানেই থাকত হয়ত। কেউ বা ফের বুদ্ধবিহারে গিয়ে রজনীদের উতলা করে তুলত কখন!
এমন কি এখনো হতে পারে নাকি! তিনি বিশ্বাস করতে চান না।–পথ ভুলেও কেউ কেউ কোথাও এসে ফের মরে নাকি? এমন কথাও কি বলে যাননি কবি?
আমার ভাগ্যই সেটা বলতে হবে। সত্যি বলতে, আমার বোনের বাইরে কোনো ষোড়শী সপ্তদশীর মুলাকাত আমি পাইনি। পেলেও সেভাবে পাইনি। বোন হয়ে বন্ধু হয়েই এসেছে তারা আমার জীবনে। অন্যরূপে বন্যরূপে দেখা দেয়নি কখনো। সেজন্য ভাগ্যকে আমার ধন্যবাদ। কেননা, ষোড়শীরা চিরকালই কিছু ষোড়শী থাকেন না, অনিবার্যভাবেই সাঁড়াশী হয়ে দেখা দেন একদিন। নাক নিয়ে টানাটানিতে নাকাল হতে হয় তখন। নারীর হ্লাদিনী রূপটিই ভালো, চিত্তচমৎকারী। আহ্লাদিনীরূপে এলে, তাঁকে নিয়ে বেশি আহ্লাদ করতে গেলে, তিনি জহুদিনী হয়ে ওঠেন শেষটায়।
নারী কি তাঁর হ্লাদিনীরূপে থাকতে পারেন না চিরকাল?
সে রূপ তাঁর সেই কিশোরী বয়সেই। এই কারণেই তো বৈষ্ণব কবির ঐ কথা কিশোরী-ভজন, কিশোরী-পূজনা, কিশোরী গলার মালা! গোপবালারা একটু বয়সে গড়াতেই কেষ্টঠাকুর তাঁর সাধের বৃন্দাবন ছেড়ে পালালেন কেন তাহলে?
আজব কথা কইলেন আপনি!
এসব কথা থাক। যে কথা হচ্ছিল আমাদের…হেমেনদার কথা। এমনি আশ্চর্য লোক ছিলেন আমাদের হেমেনদা। ঘনিষ্ঠতা ঘার পর আমাকেও কতদিন তার পানভোজনের সাথী হতে হয়েছে। একদিন দেখি কি, তিনি কাজী, প্রেমেন, নৃপেনকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সি করে আমার আস্তানায় এসে হাজির। শুনলাম নানান জায়গা থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এনেছেন তাদের–আমাকেও সহযাত্রী হতে হবে। সবাইকে ধরে বেঁধে নিয়ে চললেন তিনি চাংওয়ায়।
এক নম্বরের বোহেমিয়ান ছিলেন আমাদের হেমেনদা। বইটই লিখে যা তিনি উপায় করতেন, এমনি করে খেয়ে খাইয়ে উড়িয়ে দিতেন সবটাই। পাথুরেঘাটায় পৈতৃক বাড়িতে তাঁর সঙ্গে প্রথমালাপের পর ইদানীং তিনি বাগবাজার ঘাটের কাছে গঙ্গার কিনারের ওপর ভাস্কর্য এবং শিল্পকলার বিরল সগ্রহে সজ্জিত মিনারের মতন যে বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেখানেও গেছি আমি বহুবার।, তার চারতলার ঢাকা বারান্দার কোণে এক টুকরো জায়গায় ছোট্ট একটা টেবিলের ধারে বসে তিনি লিখতেন-অভ্যাগতরাও বসত গিয়ে সেখানে। বাড়িটিই তাঁর ছবির মত ছিল কেবল, সেখান থেকে বিবেকানন্দ সেতু পর্যন্ত বিস্তৃত উদার গঙ্গার দৃশ্যও দেখা যেত যেন ছবির মতই।
চাংওয়ায় গিয়ে আমাদের নিয়ে মশগুল হয়ে উঠলেন তিনি। পানাহারে সবাইকে পরিতৃপ্ত করে এমন আনন্দ পেতেন হেমেনদা! তার ওপরে সেদিন কাজী সঙ্গী আবার! কাজী যেখানে আনন্দ সেখানে–জীবন যেন তরল পানীয়ের মতই শত ধারায় উচ্ছল-উচ্ছ্বসিত।
ফুর্তির চোটে সেদিন ভারী মজার এক কাত করেছিলেন হেমেনদা।
স্নেহের আবেগে প্রেমেনকে জাপটে ধরে, পাশেই বসেছিল সে, খপ করে এক চুমু খেয়ে বসলেন হঠাৎ।
চাবুকের মতই সপাৎ করে পড়ল সেটা প্রেমেনের গালে।
চাংওয়ার চিকেন কাটলেটও যেন বেগুনি হয়ে উঠলো ওর মুখে।
ব্যাপারটা কিছুই না এমন, বাল্মিকীর সম্মুখীন ব্যাধের সেই ক্রৌঞ্চ নিধনের মতই প্রায়, কিন্তু এমন ঝটিকার বেগে সংঘটিত হল যে, সেই মা-নিষাদের মত দু পঙক্তির পজঝটিকা ছন্দে গজিয়ে উঠল আমার মনে।
গল্প না/বৎস, না/কল্পনা/চিত্র।
হেমেন্দ্র/চুম্বিত/প্রেমেন্দ্র মিত্র।
ভাব, ছন্দ আর যতিঃপতনে নিখুঁত নিটোল এমন দুটি লাইন আর কখনো আমার জীবনে আমদানি হয়নি। প্রেরনায় কী না হয়, বোঝা যায় এইতেই!
পরে যখন প্রেমেনের কাছে পয়ারটাকে পড়েছিলাম, মোটেই সে ভালো মনে নেয়নি। এমন ক্ষেপে গেছল আমার ওপরে যে… তার প্রতি আমার এটা অযথা এবং অতিশয় মন্দ আক্রমণ বলেই সে মনে করেছিল তখন।
কিন্তু আমি কী করতে পারি? ছড়াটা না পালটে আমি ছন্দটাকেই পালটে দিলাম তার পর। বললাম, এটা তাহলে পজঝটিকা হবে না ভাই, মন্দাক্রান্তাই বোধ হচ্ছে। যাই হোক, এটা ওই মা-নিষাদের সমগোত্রই–যতই বিষাদের (নাকি, বিস্বাদের?) হোক না।
(অবশ্যি, মন্দাক্রান্তা বা পজঝটিকা যে কী ছন্দ, কেমন চীজ তা আজও আমার জানা নেই সঠিক!)
আহারাদি সাঙ্গ হবার পর হেমেনদা পাড়লেন, চলো এখন এক জায়গায় গিয়ে গানটান শোনা যাক একটু।
প্রেমেন আমাদের সঙ্গ নিল না। কাটল সেখান থেকেই।
হেমেনদা, নজরুল, নৃপেন আর আমি চারজন চললাম ট্যাক্সি নিয়ে।
হ্যারিসন রোডের কাছাকাছি আসইে প্রায় একটা অ্যাকসিডেন্ট বাধে আর কি! কাজীও চেঁচিয়ে উঠেছে-রোকো রোকো! ট্যাসিটাও দাঁড়িয়ে পড়েছে তক্ষুনি। ড্রাইভারটা ছিল বেশ হুঁশিয়ার।
কিন্তু তারপর আর ছাড়েই না গাড়িটা!
-এই, রোকা কাহে?
–আপ খাড়া করনে বোলা না?
–তুমকো নেহি, ঘোড়াকো।
এক ঘোড়ার এক্কা–একটা ফিটন গাড়ীও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়!
আমাদের চারজনকে নিয়ে চললো ট্যাসি চিত্তরঞ্জন সরণি ধরে সেই চিত্তরঞ্জনী সদনে।
বীডন স্ট্রীট পেরিয়ে মিনার্ভা থিয়েটারের পাশ কাটিয়ে কোথায় যেন জায়গাটা, মনে পড়ে না ঠিক এখন।
মেয়েটি খুব খাতির করেই অভ্যর্থনা করেছিল হেমেনদাকে, মনে আছে।
সেখানে গিয়ে নৃপেন একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গড়িয়ে পড়ল আরামে।
সৌম্য চেহারায় নৃপেন আর আলুথালু চুলের বাবরি আর কবি কবি ভাব নিয়ে সহজেই সবার চোখ টানতে পারত।
তার উদাস উদাস চাউনি দিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাকে বেশ সচেষ্ট দেখা গেল সেখানে।
প্রেমালু চোখে সে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তাকাচ্ছিলাম আমিও…চোখ টানবার মতই মেয়েটা! কিন্তু আমাদের কারো তাকের ওপর দৃষ্টি ছিল না তার। তার যতো খাতির-যত্ন দেখলাম আমাদের হেমেনদাকেই!
আর, তার নজর ছিল ঐ নজরুলের ওপর।
আশ্চর্য কিছু না। তার চমৎকার চেহারা, যেমন পৌরুষব্যঞ্জক তেমনি মোহময়, ভরাট মিষ্টি গলা, প্রাণখোলা হাসি, আয়ত চোখের চাহনি আর কথায় কথায় রসিকতা ছেলেদেরই মজিয়ে দিত, মেয়েদের নজরানা যে সহজেই টানবে সে আর এমন বেশি কি।
মেয়েটি গানও গায়ে বেশ। হেমেনদার অনুরোধে সে কয়েকখানা গাইল। কাজীও গাইল তার নিজের গান, প্রাণমাতানো গজল সুরের কয়েকটা।
-কাজীদা, আপনার গান শেখাবেন আমায়? মেয়েটি অনুরোধ করেছিল কাজীকে।
কাজী সঙ্গে সঙ্গে রাজী। যেমন প্রাণচঞ্চল, তেমনি গান-পাগলা-এ বিষয়ে একবারের বেশি দু বার বলতে হয় না তাকে।
কল্লোলের আসরে যেমন তাকে গজল গানে মেতে থাকতে দেখেছি, তেমনি নিজের গানের টানে বাড়িঘর বিশ্বসংসার সব ভুলে কোথায় না ভেসে গেছে সে!
এই কলকাতায়, এই হুগলিতে, এই ঢাকায়-বাড়ির বা বন্ধুদের কাউকে কোনো খবর না– দিয়েই–এমনি আত্মভোলা জগৎভোলানো মানুষ ছিল নজরুল।
খানিকক্ষণ গানবাজনার পর আমরা উঠে পড়লাম সবাই, কাজী কিন্তু নড়ল না সেখান থেকে।
গান শিখতে চেয়েছে যে। শিখিয়ে যাবো। বলে বসে থাকল।
চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে আনতে পারতাম। হেমেনদা বললেন বাইরে এসে–কিন্তু ভেবে দেখলাম, সেটা ঠিক হবে না। মুসলমান বাচ্চা, যখন চেয়েছে, তখন উচিত মতন শিক্ষা না দিয়ে উঠবে না।
আপনার কি মনে হয় যে কাজী…? তাঁর ইঙ্গিতটা অনুক্তই রাখেন ভদ্রলোক।
না না না, আদৌ না। জনাবের কথার জবাবে আমি কই–সে ধরনের কিছু মনেই হয় না আমার। কি রকম সঙ্গীতমত্ত মানুষ ছিল সে জানেন তো! কাজীর ব্যক্তিত্ব শতধা বিকীর্ণ, সহস্ররূপে বিচ্ছুরিত, অজস্র ধারায় উচ্ছল। যেমন তার শিল্পীসত্তা, বিপ্লবীসত্তা, সাধকসত্তা, তেমনি তার প্রেমিক-সত্তা, আর সব ছাপিয়ে ছিল তার পুরুষসত্তা। সবগুলোই সমান সত্য। তার কোনো ব্যাক্তিরূপকে বাদ দিয়েই কাজী নয়, সব মিলিয়ে মিশিয়েই নজরুল। আমার তো মনে হয়, বাংলার মাটিতে শ্রীচৈতন্যদেবের পর সুভাষচন্দ্র আর নজরুল এক আবির্ভাব। মানুষের গড্ডলিকা প্রবাহে এক ফেনোমেনা। এঁরা সারা বাংলাকে মাতিয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়া …
তা ছাড়া?
তা ছাড়া-আমি আরো ছাড়াই : তেজস্বীদের দোষ হয় না কিছুতেই। তেজীয়সাং ন দোষায়–মহাভারতের কথা। আগুনকে কোনো মালিন্য স্পর্শ করতে পারে না। বহতা নদী সব কিছুই ধুয়েমুছে নিয়ে যায়। আর কাজী তো কেবল প্রবাহিনী নয়, প্রবল বন্যাই।
আমার কথাগুলো হজম করবার পর হাঁফ ছাড়লেন তিনি আপনাদের দৌড় অ্যাঙ্গুর? এই আপনাদের গতিবিধি?
তাঁর কণ্ঠস্বরে মনে হল তিনি রীতিমতন হতাশ।
অবশ্যি, আরেকটা গতিবিধির বৃত্তান্তও দিতে পারি আপনাকে–একান্তই জানতে চান যদি। সেটা প্রায় একরকম রগ ঘেঁষে যাওয়াই।
রগ ঘেঁষে যাওয়া? তিনি কন : শুনি তো রগড়টা।
আমার আওতায় এসে আপনিও প্রায় আমার ভাষার ভাওতা পেয়ে বসেছেন দেখছি! ওঁর রগড়ের কথায় না হেসে পারি না–আমার এক বন্ধুর সঙ্গে গেছলাম সেখানে। সে আমায় বললো-বেড়াতে যাবে এক জায়গায়? মেয়েটেয়ে আছে, গানটান হবে। জমবে খুব। যাবে?
অজানার পথে এগিয়ে যেতে সর্বদাই আমি এক পা বাড়ানো। বললাম, কেন যাব না?
বন্ধুটি কে? কল্লোলের কেউ?
জেনে কী হবে? আমি নিজের মুভপাত করতে পারি, কিন্তু অপরের মাথায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার কি আছে আমার? নাম নাই বললাম, তাতে কাহিনীর কোনো হানি হবে না। কলেজ স্ট্রীটি দিয়ে যেতে মেডিকেল কলেজ ছাড়িয়ে শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে গিয়ে সেই গলিটা। গলির মোড় থেকেই মেয়েদের উঁকিঝুঁকি-কিশোরী যুবতী, নানাবয়সী নারীদের আনাগোনা।
ও বাবা! এ যে দেখছি এক স্বনামধন্য রাস্তায় এনে ফেলেছো তুমি আমায়। রাস্তাটার নাম-ফলক দেখে বললাম। আনাড়ি হলেও জায়গাটার মহিমা আমার অজানা ছিল না।
রাস্তাটার নাম জানতে পারি কি? তিনি শুধান।
তা জানতে বাধা কি আর! জনাব সাহেবকে জানাই-প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রীট।
.
২৮.
এই প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রীট! সেই ডাকসাইটে (নাকি ডাকিনীসাইটে) জায়গা? মহানগরীর নাগর সংস্কৃতির পীঠস্থান? প্রেমের কতটা ছয়লাপ হয় এখানে জানিনে, কিন্তু চাঁদের ছড়াছড়ি দেখি চারধারেই।
সুহৃদ্বরকে সম্বোধন করলান : এ যে একবারে প্রমীলারাজ্যেই এনে ফেললে হে!
বাড়িতে বাড়িতে বারান্দায় বারান্দায় সারি সারি মেয়েরা। এরা কি সব বারাঙ্গনাই? ঘরদোর আনাচকানাচ উপচে রাস্তায় এসে পড়ছে পরীর দল। দারুণ পরিস্থিতি!
রাজপথ না বলে রানীপথ বলাটাই বুঝি সঠিক। এবং যারপর নাই পরাস্ত হবার পানিপথ বুঝি সবার জন্যেই।
অলিন্দে অলিন্দে ফুটন্ত ফুল। গলিতে গলিতে উৎফুল্ল অলি। অলিগলি যদি বলি তো একেই বলা যায় বোধ করি।
ওরই ভেতরে একটি মৌচাকে সুহৃদ্বর আমায় নিয়ে সেঁধুলেন।
খুপরিতে খুপরিতে মক্ষিরাণী। তারই একটা কামরায় বসলাম গিয়ে আমরা।
আঠারো-উনিশ বয়সী বোধহয় মেয়েটি। কচি কচি মুখ। দেখলে মায়া করে।
আমাকে বন্ধু বলে সুহৃদ তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সমভাবেই সে খাতির করছিল দুজনকে। ভারী ভদ্র মেয়েটি। বন্ধুর অনুরোধে খানকয়েক গানও গাইল সে। সুরেলা মিষ্টি গলা।
চা বিস্কুট এল–তিনজনেই খেলাম। বেশ খানিক গল্পগুজবের পর আমরা চলে এলাম সেখান থেকে। আসার আগে সুহৃদ মেয়েটির হাতে কিছু টাকা দিয়েছিল মনে আছে।
চেনা চেনা বলে যেন মনে হোলো মেয়েটাকে। বললাম বাইরে এসে।
তোমাদের দেশের নাকি? শুধোলো সেঃ দেশ পাড়াগাঁ থেকে বেশ কিছু মেয়ে আসে। তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে বার করে নিয়ে আসে এখানে। আর একবার এ পথে বা বাড়ালে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায় একেবারে। চিরদিনের মতই বলতে গেলে।
না, দেশের নয়। দেশের কেউ বেরিয়ে এসেছে বলে আমি জানিনে। দেশের কোনো খবর রাখিনে আমি। কোনো সম্পর্ক নেই সেখানের সঙ্গে আর আমার। আমি কই : এমনিই চেনা চেনা মনে হচ্ছিল কেন যে! কোথায় যেন দেখেছি একে?
ও–তাই! সমঝদারের মত সে হাসল-তাই বলো। বুঝলাম এবার।
কী বুঝলে?
পরীর মত মেয়ে দেখলে এরকমটা মনে হয় বটে। মনে হয় যেন কতকালের পরিচিত। স্বভাবতই এমনটা হয়। না হয়ে পারে না। সবারই হয়ে থাকে। সে হাসে আবার।
মিষ্টি মিষ্টি মুখ দেখলেই চিনি চিনি লাগে–চোখে দেখেই, চেখে না দেখলেও? এই তুমি বলছো তো? মানে কবির ভাষায়, যাকে বলে, দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে?
ঠিক তাই। এখানকার চেনাজানা না হলেও হয়ত বা পূর্বজন্মের পরিচয় বলে ঠাওর হতে থাকে। আশ্চর্য কিছু নয়।
মোটেই তা নয়। এ জন্মেই দেখেছি-ইহলোকেই। আমি জোর দিয়ে জানাই এই কলকাতাতেই দেখেছি কোথাও। এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।
বাদ দাও। এখন বলল, মেয়েটি কেমন? কী রকম লাগল তোমার? তাই কও।
চমৎকার! কেমন টানাটানা চোখ-কী মিষ্টি হাসি!…এমন মেয়ে আর হয় না। বলে তখনই তার প্রুফ সংশোধন করিঃ অবশ্যি, সব মেয়ের সম্বন্ধেই তা বলা যায়। সবার লোই একথা খাটে। মেয়ে মাত্রই তো সুন্দর হয়ে থাকে।
তোমার ভালো লাগলো ওকে? ভালো লাগবার মতই মেয়ে! লেখাপড়া জানে, কালচার মেয়ে। কে জানে, কারো প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল, তারপর কিছুদিন ফুর্তির পর ছেলেটা ওর গয়নাগাটি সব নিয়ে ওকে পথে বসিয়ে উধাও হয়েছে। এমনিই তো হয়ে থাকে আকচার।
আহা! মুখখানা দেখলে ভারী মমতা হয়। সত্যি।
আরেকদিন আসা যাবে তাহলে। আসবে? সে শুধায়। নাকি, তুমিই একাই আসতে চাও এখানে? তাও আসতে পারো। বাড়িটা তো চিনেই গেলে। ওর নাম হচ্ছে মায়া। বললেই ওর ঘর দেখিয়ে দেবে সবাই।
না।
না, কেন? কেউ কিছু বলবে না তোমাকে। কোনো ভয় নেইকো।
না, ভয়ের কথা নয়। আবার এলে হয়ত আরো আমার মায়া পড়বে। আবার আবার আসতে ইচ্ছে করবে। অত টাকা আমি পাব কোথায়? টাকা কই আমার?
সেজন্যে ভেব না। যা দেবে তাতেই ও খুশি হবে। ভারী ভালো মেয়ে। তবে একটা কথা মনে রেখো, এদের সব বাঁধা বাবু থাকে, এরও আছে নিশ্চয়। সে যে সময়টায় আসে, এখানে থাকে, তখন যেন তুমি এসো না। তবে তার আবার দিনক্ষণ ঠিক করা আছে। সেটা কৌশলে জেনে নিতে হবে।
না, ভাই! আমার সাহস হয় না। আমি দারুণ মায়াবদ্ধ জীব। ওর মায়ায় জড়িয়ে পড়ব তাহলেই আর রক্ষে নেই আমার। এ পথে এলে আর ফেরা যায় না জানি।
কী করে জানলে? তুমি তো এ পথে আসোনি কখনো এর আগে?
আহা, বই পড়ে জেনেছি। বই পড়ে জানা যায় না? এ পথে এলে কি রেসের মাঠে গেলে কত লোক সর্বস্বান্ত-কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়-কে না জানে। আমি জানাই : বটতলার কত নভেলেই এদের কাহিনী লেখা হয়েছে। জানিনে?
আবার চন্দ্রমুখীরও তো দেখা মিলে যায় কোথাও কোথাও? বটতলার থেকে সে শরৎচন্দ্রের দিকে মুখ ফেরায় : দেবদাস পড়োনি তুমি? সে তো একালেরই কাহিনী।
একালের পাঁক-এও তো পড়েছি গো আবার! কিন্তু পাঁকে পা নামাতে আমার ভরসা হয় না। ডুবে যাই যদি?…..তাছাড়া মায়ার কথা কি কিছু বলা যায়? আমি ভারী মায়ালু। জীব-যদি জড়িয়ে পড়ি ঐ মায়ায়? মেয়েটার নামও নাকি মায়া আবার, বলছো তুমি!
জীবনকে জানার জন্য লেখকদের সব জায়গাতেই যেতে হয়, জানতে হয় সবাইকে-সব কিছুই দেখতে হয়। জীবন না দেখা হলে তা লেখা হবে কি করে? এখানেই জীবন, জীবন তো এই-ই। তাছাড়া তুমি যে উপন্যাসের নায়কদের কথা বলছে-বটতলার উল্লেখ করে সে কয় : সে কথা সব ক্ষেত্রে খাটে না।…লেখক শিল্পীদের স্বাভাবিক নিঃসঙ্গতাবোধ থাকেই। সেই সঙ্গে একটা আত্মচেতনা, সেটাই তাঁদের বাঁচায়। পাঁকাল মাছ যেমন পাঁকে কখনো জড়ায় না, পিছলে বেরিয়ে যেতে পারে…তুমি কেমন জড়িয়ে পড়তে যাবে?
কেন কে জানে! মিষ্টি মুখ দেখলেই আমার কেমন যেন আদর করতে ইচ্ছে করে। আজও করছিল একটু একটু।
করলেই পারতে! করলে না কেন? সে বলে : কিচ্ছু বলত না তোমাকে।
কি করে করি বলো? তুমি ওকে ছুঁলে না পর্যন্ত! একবারটিও হাত দিলে না ওর গায়ে? আমি কি করে একেবারে ওকে আদর করে বসি। তুমি যদি একটু কিছু করতে…আশ্চর্য! এখানে যেজনে লোকে আসে তার তো কিছুই তুমি করলে না!
সেইজন্যেই আসা বুঝি? দেহের পরিতৃপ্তি? মনের আনন্দটা বুঝি কিছু নয়? একটি রূপসী তরুণীর ক্ষণকালের সাহচর্য-তার দাম কি কিছুই না? নারীসঙ্গে কাটানো গেল খানিকক্ষণ, গানটান শোনা হলো, গল্পগুজব করলাম, সময়টা কাটল বেশ–এই ফুর্তি–এই তো যথেষ্ট ভাই!
সঙ্গসুখই ঢের, মানলাম তোমার কথাটা। কিন্তু আসঙ্গ সুখ নাই হোলো, সেই সঙ্গে সামান্য একটুখানি অনুষঙ্গ সুখে কী ক্ষতি ছিল ভাই? আমি কইতে যাই।
ছিল বই কি ক্ষতি। সে খতিয়ে দেখায়ঃ তাতে কী হানি হতে পারে, সেটা কতখানি ঘটতে পারে–তা জানা নেই তোমার। জানো, কী সব শক্ত শক্ত অসুখ থাকে এদের? দূষিত সংসর্গে সেইসব বোগ এদের দেহে এসেছে–এদের থেকে অন্যদের দেহে–সারা সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়বে। এদেশে এসব ব্যাধির সুচিকিৎসার এখনো কোনো সুব্যবস্থা হয়নি। সে রোগ, এই যৌবনকালে রক্তের তেজে এখন চাপা থাকলেও বয়ে একটু পড়ে এলেই প্রকট হবে। তাতে কানা কালা বোবা হয়ে যেতে পারো, পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যায় কেউ কেউ, বংশানুক্রমে ছড়াতে পারে সেই ব্যারাম। ছেলেমেয়েরা কানা, বোবা, হাবা হয়ে জন্মাবে। ছেলেপিলে নাও জন্মাতে পারে তোমার-যদি তুমি এই ব্যারামে বাঁজা হয়ে যাও। সেটা এক পক্ষে মন্দের ভালো। এক পুরুষেই পরিত্রাণ! নইলে কী সর্বনাশ হয় ভেবে দ্যাখো একবার তোমার, তোমার স্ত্রী-পুত্রদের-তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আরো আরো সব পরিজনের-পরিবারের সবাইকার। ক্রমে ক্রমে গোটা সমাজের…আর ধরো তোমাকেই যদি প্যারালিটিক হয়ে বিছানায় পড়ে যোবা মেরে সারা জীবন কাটাতে হয় তাহলেই তো চমৎকার।
উপদংশিত সংক্রামক যেসব দুষ্টব্যাধির খবর কার্তিক বসুর স্বাস্থ্যসমাচারের দৌলতে বহুকাল আগেই আমার পাওয়া, সেইসবই সে নতুন করে আওড়াতে থাকে আমার কাছে। তথ্যবহুল তত্ত্বগুলি সবিস্তারে,শুনিয়ে বোঝাই করে আবার আমায়–এই রাস্তাতেই তুমি দেখতে পাবে, বেশি বয়সী মেয়েদের। উপদংশক্ষত-জর্জর দূষিত দেহ নিয়ে ভিক্ষে করচে এখানে সেখানে–লক্ষ্য করলেই চোখে পড়বে। এই পথেরই শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে তার:-যে পথের গোড়ায় এখন পা দিয়ে রয়েছে এই মেয়েটি।
শুনেই আমি চমকে উঠি, আর আমার মনেও চমক দেয় তৎক্ষণাৎ! আমার মনে পড়ে হয় হঠাৎ
হ্যাঁ! হ্যাঁ! এবার আমার ঠাওর হয়েছে। চিনতে পেরেছি মেয়েটাকে। বুদ্ধদেবের মতন
মুখ ওর–লক্ষ্য করোনি?
গৌতম বুদ্ধ?
গৌতম কি গধাদর তুমিই জানো! সপ্রতিভ কি প্রগতিবান–তাও তোমার অজানা নয়…আমি ঠারেঠোরে কইতে যাই।
শুনি না কে, আহা! এত ভণিতা কিসের? কোথায় দেখেছ এমন মেয়ে আরেকটাকে…
এই কলকাতাতেই। এমন কি তোমার ঐ কল্লোল আপিসেও…
কল্লোল আপিসে। কল্লোল আপিসে মেয়ে?
আহা, মেয়ে কেন হবে গো! ছেলেই তো! আমি প্রাঞ্জল হই, ছেলে-ছেলে মুখ না মেয়েটার? দেখেই তাই চেনা চেনা ঠেকেছিল আমার।
ওরকমটা হয়ে থাকে। অনেক ছেলে মেয়েলি মুখ নিয়ে জন্মায়, অনেক মেয়ে দেখতে হয় যেন ছেলের মতই… বলে সে জৈব প্রকৃতির দৈবলীলার আরেক ফিরিস্তি বিস্তারিত করতে চায়।
থামো। বুঝেছি। কেন যে তুমি এখানে আসো টের পেয়েছি এবার। এই গলির মধ্যে এত মেয়ে থাকতে ওকেই বা কেন বেছে নিয়েছ তাও বুঝতে আমার বাকী নেই আর।
কেন, মেয়েটা কি সুন্দর না? তুমি তো ওকে আদর করতে চেয়েছিলে হে!
সুন্দর না ছাই! আদর করতে চেয়েছিলাম বলে নিজের উপর আমার রাগ হচ্ছে এমন। ওই তোমার সুন্দর? সুন্দর না ঢেঁকি!
বিনা উপরোধেই তো তুমি ঢেঁকি গিলতে যাচ্ছিলে হে।
তাই বলি। তা, তুমি এখানে না এসে সেই বালিগঞ্জে গেলেই পারতে! সোজাসুজি বুদ্ধদেবের ফ্ল্যাটেই। ওর রসিকতায় আমার রাগ আরও জ্বলে ওঠে : এখানে যা খেলে সেখানে গেলেও তা মিলত। ঐ চা আর বিস্কুট।
চা বিস্কুট?
তাছাড়া কী? তাছাড়া সেখানে তোমার একটি পয়সা লাগত না আবার। এই সঙ্গসুখ, এমন সুন্দর মুখ, সেখানেও পেতে তো। সেখানে গিয়ে ঐ আহামরি রূপসুধা পান করার অসুবিধাটা কী ছিল শুনি?…এখানেও তো তুমি কিছু করলে না, সেখানেও করবার কিছু ছিল না।
— কী আজেবাজে বকচো সব! মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার?
এই যদি তোমার মনের ইচ্ছা…তা এত ঘুরিয়ে বলার কী দরকার ছিল আমাকে? এখানে এই মেয়েটার কাছে আমায় নিয়ে এসে এমন ঘুরিয়ে নাক দেখানোর কী প্রয়োজন ছিল? সোজাসুজি বললেই পারতে যে বুদ্ধদেবের ওপরেই তোমার বেশ টান। যাও, আর–আমি…এ জীবনে আমি আর তোমার সঙ্গে মিশবো না।
বলে ওর নামলাঞ্ছিত সেই রাস্তার মোইে ওকে ত্যাগ করে মার মানা না মেনে পাণ তুচ্ছ করে সামনের চলতি ট্রামে লাফিয়ে উঠেছি। উলটো দিকে রওনা দিয়েছি সটান?
.
২৯.
ইস্কুলের ছুটির পর বিষ্টু সুকুলের সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরছিলাম, ডাকঘরের শিয়নের সাথে দেখা হয়ে গেল মাঝরাস্তায়। মহানন্দার পুলের ঠিক ওপরটাতেই।
আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হোলো বাবু। আপনাদের বাড়ি পর্যন্ত আর যেতে হল না আমাকে। একটা চিঠি ছিল আপনার। বললে সে।-ভালোই হোলো যে পেয়ে গেলাম আপনাকে এখানে। পলকমাত্র দেখেই না সেটা পকেটে পুরে ফেলেছি। লেখাতেই চিনতে পেরেছিলাম আমার রিনির চিঠি। কলকাতার থেকে লিখেছে। ডাকপিয়নের কাছে অভাবিত বাবু ডাকের মর্যাদালাভে উৎসাহিত হয়েছিলাম। তারপর খামখানা হাতে পেয়ে মন আনন্দে থই থই করে উঠল।
হ্যাঁ, ভালোই হয়েছে। প্রতিধ্বনিত হয়েছি আমি পিয়নের কথায়। বাড়িতে গিয়ে চিঠিখানা মা-বাবার হাতে পড়েনি-ভাগ্যিস্! কার চিঠি রে? তোর মামার? বিঃ ওবোয়।
হ্যাঁ, আমার। অনুনাসিক সুরে বলার জন্য আমার কথাটা আমার মতই শোনায় অশ্বথামা হত ইতি গজ-র মত সত্যভাষণ হয়ে যায়।
চল বাণিজ্যা ঠাকুরের দোকানে যাই। রসগোল্লা খাই গে চল। সে বলে।
প্রায় প্রাত্যহিক রুটিন আমাদের ওখানে গিয়ে ঐ রসগোল্লা খাওয়া। গরম গরম রসগোল্লা, খাসা খাসা মডা নামায় ওরা বিকেলেই–খেতে যে কী মজা।
দাম দেবারও দায় ছিল না আমাদের। মাস-কাবারে গিয়ে হিসেব দিয়ে বাণিজ্যা ঠাকুরই আদায় করে নেবে বাবার কাছ থেকে। তাছাড়া আমাদের বাড়ির জন্যও যায় রোজকার রসগোল্লা সন্দেশ ওখান থেকেই। গোটা গাঁ জুড়েই বাণিজ্য ঠাকুরের অবাধ বাণিজ্য।
বসে বসে খাচ্ছি আমরা দুজন, এমন সময় বছর ত্রিশ-বত্রিশের এক ভদ্রলোক আসতেই বাণিজ্যাঠাকুর উঠে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালেন তাঁকে–আসুন, আসুন বন্দীবাবু! আসতে আজ্ঞা হোক। কী সৌভাগ্য আমার আজ। চেয়ার এগিয়ে দেয় বসবার।
অবাক হয়ে তাকাই আমরা। বন্দীবাবু আবার কী রে বাবা! কে রে বাবা! এত খাতির কিসের জন্য ওনাকে?
ভদ্রলোক বসেই হাঁকলেন-দিন যা ভালো ভালো খাবার আছে আপনার আজ। কী কী হয়েছে শুনি? পাঁচ দশ টাকার দিয়ে দিন। খাওয়া যাক বসে বসে। খানার খাতির দেখেই তাঁর খাতিরখানার অর্থ জানা যায়!
আজ্ঞে খাজাও হয়েছে আজ। বালুসাইও বানিয়েছি। গরম আছে এখনও–দেবো? তাছাড়া, বড়ো বড়ো বঁদিয়া। রামবোঁদে যার নাম। আর রসগোল্লা মন্ডা রসকদম্ তো রয়েছেই আমাদের।
দিয়ে যান এনতার! যত আপনার প্রাণ চায়।
প্রকান্ড এক থালায় সব সাজিয়ে এনে ধরে ঠাকুরমশাই ভদ্রলোকের সামনে।
বুঁদিয়াগুলোর চেহারা কী মোটা মোটা রে দেখেছিস? কেমন সব হৃষ্টপুষ্ট বোঁদে। বিষ্ণু আমাকে দেখায়।
রসে বুঁদ হয়ে রয়েছে। সজিভ হয়ে আমার রায়।
খাজাগুলোও তো খাসা দেখছি রে! খেলে বেশ মজা হোতো।
খেলে তো ভালোই হতো রে, কিন্তু আমার বরাদ্দের বাইরে গেলে রাগ করবেন বাবা।
তবে থাক্।
ওর ওই ক্ষুণ্ণ কণ্ঠ শুনে ভদ্রলোক বুঝি অক্ষুণ্ণ থাকতে পারেন না। তাকান আমাদের দিকে।
আহা, তুমি সেই ছেলেটি না? বলে ওঠেন আমাকে দেখেই-যুদ্ধে যাবার জন্য যে নাম লিখিয়েছিল সেদিন সব প্রথম? তিনি কন।-শিবরাম না কী যেন নাম?
— হ্যাঁ। শিবরাম চক্রবর্তী। আপনি কী করে জানলেন?
আমিও যে ছিলাম সেদিনকার সভায় গো! আমন্ত্রিত হয়ে গেছলাম। লক্ষ্য করেছি তোমাকে। এ ছেলেটি কে?
আমার বন্ধু। এক ক্লাসে পড়ি।
বেশ বেশ। মন দিয়ে পড়াশুনা করবে-বুঝলে? আর, ব্যায়াম-ট্যায়াম করে শরীরটা বাগাতে হবে। বাণিজ্যামশাই, আমাকে যা যা দিয়েছেন ওদেরও তাই তাই দিন সব। দাম যা লাগে আমি দিয়ে যাচ্ছি।
দুখানা দশ টাকার নোট ফেলে দিয়ে তিনি চলে যান।
ভারী বড়লোক তো লোকটা। কে মশাই উনি? আমি বাণিজ্যাঠাকুরকে শুধাই।
রাজবন্দী ভদ্রলোক, জানো না বুঝি? এখানে ইনটার্ন হয়ে রয়েছেন এই কিছু দিন থেকে। সরকার থেকে মোটা টাকার ভাতা পান কিনা! মাস মাস আসে ওঁর টাকা–দুতিন শ করে হবে বোধ হয়। ঠিক জানি না। পুরো টাকাটা সেই মাসের মধ্যেই খরচ করার নিয়ম সরকারকে। প্রতি মাসে খরচার হিসেব দিতে হয় সরকারকে-খরচ নাহলে যা বাকী থাকে ফেরত পাঠাতে হয় সরকারকে। সেই কারণে ওঁরা মরীয়া হয়েছে খেয়ে না খেয়ে খরচা, করেন. সারা মাস ধরে। এই ব্যাপার।
বাঃ, বেশ তো! শুনেই আমার উৎসাহ হয়। উপায় করার কড়ার নেই অথচ খরচ কার কড়াকড়ি-এর চেয়ে ভালো ধরাধামে আর কিছুই হতে পারে না।
সরকারী কান্ডই আলাদা। ওনাদের হালচাল কি জানার উপায় আছে দাদা? বাণিজ্য ঠাকুর বাতলান।
আমি তো জানতাম, দারুণ অত্যাচার করে ওরা রাজবন্দীদের ওপর। এ তো দেখছি একেবারে উটোই এখানে। ভেবে আমার তাক লাগে। একদিকে যেমন এই বদ বাবহার, অন্যদিকে তেমনি এই বদান্যতা কেমন যেন সরকারী অন্যথা বলেই মনে হতে থাকে আমার।
ও তাই। আমার মনে পড়ে যায় তখন।…
এর আগেও দেখেছি আমি ভদ্রলোককে এখানকার হাটবাজারে কয়েকবার-মার ফরমাস মতন টুকিটাকি কিনতে গিয়েই-উনি আসা মাত্তর সারা বাজারে যেন সাড়া পড়ে যেত অকস্মাৎ।
ঐ বন্দীবাবু আইছে! বন্দীবাবু আইছেন! উল্লাসের হুল্লোড় খেলে যেত কেমন।
আর, আসার সঙ্গে সঙ্গে দর চড়ে যেত বাজারে। দু টাকা সের মাছের দর উঠে যেত সাত টাকায় চড়াৎ করে। বাজারের সব কিনতেন উনি সবাইকে টেক্কা মেরে। নোট ছড়াতে ছড়াতে উনি যেতেন, আর থলে হাতে সঙ্গের লোকটা মোট কুড়াতে কুড়াতে যেত।
মাছ মাংস তরিতরকারি আনাজপাতি মিলিয়ে সে এক ইলাহী মোচ্ছ। তাকিয়ে দেখবার মতই ব্যাপার।
একবার এক দোকানী শুধিয়েছিল ওনাকে, শুনেছিলাম আমি–আচ্ছা বাবু, কী করলে বন্দীবাবু হওয়া যায় কইবেন সেটা একবার আমাদের? আমরাও হতাম তাহলে।
ভদ্রলোক কোনো জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে চলে গেছেন। ভুরু কুঁচকেছিল আমার।
সেই থেকেই একটা কৌতূহল ছিল। আজ চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে সব কিছুর হদিস মিলে গেল এখন।
রাত্তিরে বাবা মা সত্য সকলের শোবার পর আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। আলো জেলে বইয়ের ভেতর থেকে রিনির চিঠিটা বের করলাম… একটু আদর করলাম চিঠিটাকে।
এত রাত্তিরে আলো জেলে কি হচ্ছে আবার? পড়াশোনার সময় পেলিনে আর?
— মা কি ঘুমের মধ্যেও সজাগ? কি করে যে তিনি বুঝতে পারেন সব। চোখ বুজেও বুঝি টের পান মা।
না মা। বেশিক্ষণ না। একটা ভেরি আরজেন্ট হোমটাসকের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। কালকে ক্লাসের ফার্স্ট পীরিয়ইে সেটা আবার। সেরে রাখছি তাই এখন।
কেন, কাল সকালে করলে কি হত না? রাত জেগে পড়াশোনা করলে শরীর খারাপ হয়। পরীক্ষা-টরীক্ষার সময় সে আলাদা কথা।
— কাল সকালে উঠেই মুসলিম হোস্টলে যেতে হবে আমায়। কাবিল হোসেনের কাছে অঙ্ক শিখতে। ফিরে এসেই নেয়ে-টেয়ে ইস্কুল যেতে হবে। এখনই করে রাখছি তাই। বেশিক্ষণ লাগবে না মা, তুমি ঘুমোও।
কত কথাই লিখেছিল রিনি! তুমি কেমন আছ, আমি ভালো আছি ইত্যাদি মামুলি সাত সতেরর পর আনকোরা একটা খবর দিয়েছিল সে…
কলকাতায় এখন বেজায় হইচই বুঝলে। মহাত্মা গান্ধী এসেছেন। অসহযোগ আন্দোলনের খবর পেয়েছে নিশ্চয়। সেই সম্পর্কেই এসেছেন তিনি এখানে। টাকা তুলছেন তিলক স্বরাজ ফান্ডের। লাখ টাকা আয়ের ব্যারিস্টারী ছেড়ে দিয়ে সি আর দাশ রাস্তায় নেমেছেন আজ। আর তাঁর সঙ্গে বিলেত-ফেরত আই-সি-এস সুভাষ বোস হাকিমি না করে। কি চমৎকার দেখতে তাঁকে-দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ইস্কুল কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে পথে। মদ আর বিলিতি কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করছে তারা। পাঁজা পাঁজা বিলিতি কাপড় পোড়ানো হচ্ছে পার্কে পার্কে। সবাই মেতে উঠেছে একসঙ্গে। আমার ইচ্ছে করছে ইস্কুল- টিস্কুল সব ছেড়েছুঁড়ে আমিও ওদের সঙ্গে গিয়ে ভিড়ে যাই। তুমিও কেন চলে এসো না এখানে এখন? দুজনায় একসঙ্গে দেশের কাজে লাগা যাবে কেমন!
জানতাম বইকি। ততটা উত্তাল না হলেও এই সুদূর গ্রামাঞ্চলেও আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছিল আমাদের। অসহযোগের সব খবর নিয়মিত পেতাম আমরা খবর কাগজের মারফতে। বাবার আসত সাপ্তাহিক হিতবাদী আর সঞ্জীবনী। আর আমার জন্য তিনি আনাতেন অমৃতবাজার পত্রিকার হিতবাদী সংস্করণ, যাতে কিনা, চালু ইংরেজিটা শিখে ঐ ভাষায় আমি একটুখানি সড়ড় হতে পারি।
তা, বিদ্যায় না সড়গড় হই, সংবাদে সরগরম ছিলাম বইকি।
বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়িয়ে বিছানায়।… রিনির আমন্ত্রণের কথাটা ভাবি শুয়ে শুয়ে। কি কর যে যেতে পারি আমি কলকাতায়।
মনে পড়ে একদা হেডমাস্টার মশায়ের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলাম যে, আই ওয়ান্ট টু বি এ পেট্রিয়টু। তারপরে হিংসার পথে সতীশের সঙ্গে দেখোদ্ধার করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি দারুণ। উদ্ধার পেয়েছি দৈবক্রমে। এবার কি তবে অহিংসাব্রতে দেশ সেবার কাজে লেগে পড়তে হবে? রিনির সাথে?
দেশোদ্বারই কি আমার বৃত্তি হবে শেষটায়? বৃত্ত হবে এই জীবনের? শুয়ে শুয়ে ভাবি তাই।
ঘুম আসতে চায় না কিছুতেই।
কুরুক্ষেত্রে সাক্ষাৎ ভগবান পথ দেখিয়েছিলেন পার্থকে। তার জন্মগত ক্ষাত্রবৃত্তির কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যথাকালে। এইভাবে যথোচিত প্রবৃত্ত করে তার বৃত্তপথেরতার রথের সারথি হয়েছিলেন স্বয়ং।
ক্ষত্রিয়সন্তান অর্জুনের ক্ষাত্রবৃত্তি হলে, ব্রাহ্মণসন্তান আমার কী বৃত্তি হবে তাহলে? ব্রাহ্মবৃত্তিই নাকি?
বাবা বলেন যে, ব্ৰহ্ম জানাতি যঃ সঃ ব্রাক্ষণ। ব্রহ্মকে জানতে পারলে তবেই নাকি বামুন হয়। এদিকে ব্রহ্মকে নাকি কিছুতেই জানা যায় না আবার–তিনি সবার বাক্যমনের অতীত, অবাঙমনসোগোচর–বলে থাকেন বাবাই।
বাবার কথাটা মাকে বলায় মা বলেছিলেন যে, অবাক্ মনসোগোচর–কথাটার মানে কিন্তু ই নয় রে! ওর ভেতরের মর্ম আরেক। আ মানে ব্রহ্ম, তিনিই তো আদিস্বর আর বাক্-এর অর্থ হচ্ছে বা পানি পাদ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়াদি, মানে, পৃথিবীর আর জীবনের সব কিছু জড়িয়ে বেবাক, ব্রহ্মের বৃত্তপথ, সেই জীবনবৃত্ত আর ইন্দ্রিয়বৃত্তির পথে মনের যে প্রকাশ, তার মধ্যেই তিনি গোচর, তিনি প্রত্যক্ষ। আবার গোচরের অর্থও আছে আলাদা। বামনের সাহায্যে অঙলীন তিনি, যে গোচারণা করছেন, গো অর্থে পৃথিবীও হয় ফের, এইভাবে যে পৃথিবীকে চালাচ্ছেন সেই পৃথিবীতেই তিনি পরিদৃশ্যমান, সবার গোচরীভূত। এই সূত্রে প্রতীকী অর্থে শ্রীকৃষ্ণেন্দ্র গোচারণাকে শুদ্ধ টেনে এনে বাবার কথাটার প্রতীকক্রিয়া তাঁর আলোচনায় প্রকাশ পায়।
আধ আধ ঘুমে মার কথাটা মনের মধ্যে খেলে যায়।
তা না হয় হলো, গোলোকেই থাকলেন না হয় ভদ্রলোক, আর ব্রহ্মও নয় ব্রহ্মলোকে বিরাজ করলেন শাতিতে, যথার্থ বৃত্তপথে প্রবৃত্ত করতে তাদের কেউই এখন আগ বাড়িয়ে আসছেন না আর আমার কাছে।
এদিকে বামুনের বৃত্তি বলতে ইহলোকে তো দেখতে পাই তিনটি ফুৎকার মাত্র–শাঁখে ফু, কানে যু, আর উনুনে ফুঁ মানে শাখ ঘন্টা বাজিয়ে মন্দিরের ঠাকুরের পুরুৎগিরি প্রাত্যহিক দেবসেবায় ভাগ বসাবার–নিয়মিত আলোচাল কাঁচকলা আদায়ের ফিকির, আর কানে ফুঁ হলো কান পাকড়ে মন্ত্র দিয়ে শিষ্যদের ধনেপ্রাণে সর্বস্বান্ত করার চক্রান্ত; এবং এর কোনোটাই যদি না হয়, অগত্যা সেই উনুনে ফু–নিজেই রান্নাঘরের ঠাকুর বনে বিরাজ করা শেষ পর্যন্ত। বামুনের এই তিন বৃত্তির কোনোটাতেই আমার প্রবৃত্তি হয় না। এই তিনটি ফুৎকারই এক ফুৎকারে আমি উড়িয়ে দিয়েছি।
ফুৎকৃত হয়ে নিজেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি কখন।
পরদিন খুব ভোরেই হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। যে আমার সাত সকালের আগে ভোর হয় না কখনো, সেই কুম্ভকর্ণের এই পাঁচ সকালে ঘুম ভাঙাটা আশ্চর্যই। একটা কোকিল একটানা ডেকে যাচ্ছিল কোথায় যেন!
আর, সেই ডাকে পেটের মধ্যে কী যেন গজ গজ করতে লাগল আমার! মনের ভেতরে গজিয়ে উঠছিল আপনার থেকেই।
অভ্যন্তরের সেই গঞ্জনাকে টেনে এনে খাতার ওপর পেড়ে ফেলতে কেন যে বাসনা জাগলো কে জানে…
মাথার কাছে একটা ছোট্ট টীপয়ের ওপর বইখাতা সব থাকত আমার। টেনে নিয়ে লিখতে বসলাম ফসফস করে। আর খাতার পাতায় যেন লেখা হতে লাগল আপনার থেকেই
কোকিল ডাকে ভোরের ফাঁকে আম্রশাখে
ভোরের বাতাস যায় যে চিরে…
ব্যথার তীরে হঠাৎ ধীরে।
সেই ব্যথা কি যায় চারিয়ে চারি দিকে?
যায় হারিয়ে স্মৃতির পাকে?
নাড়িয়ে দেয় কি জীবনটাকে?
মনে পড়ে ছেলেবেলার বন্ধু খেলার
মিলনমেলার সঙ্গিনীকে
প্রতিদিনের রঙ্গিনীকে।
কথায় গভীর ব্যাথায় নিবিড়
সেই মোহিনীর সঙ্গটাকে!
কোকিল ডাকে।
এই রকম প্রায় আট স্ট্যানজাই। তার পর আর মনে পড়ে না আমার। অভাবিত এই লেখাটা কোথেথকে এল এমন হঠাৎ? এই ছন্দ মিল শব্দের ঝর্ণা প্রপাত-যার মধ্যে কাশীরামী কৃত্তিবাসী পয়ারকীর্তির বিন্দুমাত্র ছায়াপাত নেই? এ কৃতিত্ব কার? অবাক হয়ে আমি ভাবি। নিজের বলে দাবী করতে পারি না কিছুতেই।
সেদিনই কবিতাটা প্রবাসী আর ভারতী–দুই পত্রিকাতেই পাঠিয়ে দিই ছাপার জন্যে।
.
৩০.
দিনকতক বাদে লেখাটা আমার ফেরত এল প্রবাসীর থেকে। সঙ্গে চারুদার এক চিরকুট। চিঠিটার মর্ম মোটামুটি : তোমার কবিতাটা মন্দ হয়নি। কিন্তু এটি প্রবাসীতে ছাপিয়ে তোমাকে উৎসাহ দিতে আমি চাই না। সমস্ত মন দিয়ে এখন তোমার লেখাপড়া করাই উচিত, অন্য কোনোদিকে ঝোঁক যাওয়াটা ঠিক হবে না। লেখা একটা মারাত্মক নেশা, এই বয়সে তোমাকে পেয়ে বসলে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। লেখকও হবে না-মানুষও হতে পারবে না। বরং পরে বড় হয়ে যথাসময়ে এসবের চর্চা কোরো না হয়। সঙ্গীত,কবিত্ব আর ল্যাজ কারো ভেতরে থাকলে তা আটকানো যায় না। তোমার মধ্যে যদি তা থাকেই প্রকাশ পাবেই–যথাকালে দেখা দেবে–অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোনো দরকার নেইকো।…ইত্যাকার পত্রখানা সদুপদেশ নিঃসন্দেহেই; কিন্তু মর্মান্তিক। কথাগুলো আমার মর্মে মর্মে গাঁথা হয়ে ছিল অনেকদিন।
কিন্তু ভারতীর থেকে এদিকে কোনো সাড়াশব্দই নেই। বুঝলাম, চারুদা নেহাৎ সম্পর্কিত বলেই লেখাটা পড়েছেন এবং পাঠিয়েছেন পত্রপাঠ-ভারতীর তেমন কোনো গরজ নেই, সেখানকার কারো সাথে চেনাজানার বালাই নেই আমার। নির্ঘাৎ লেখাটা তাঁদের ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে পাচার হয়েছে।
যাকগে, বয়েই গেল আমার। চারুদার কথাটা মনে পড়ল, ল্যাজ যদি আমার থাকেই, বেরুবেই একদিন। কেউ চাপতে পারবে না। নিজের ল্যাজের প্রতি বেশি টান দেখানোর কোনো মানে হয় না। নাই বেরুলো কোনো পত্রিকায়, প্রকাশ পাওয়া নিয়ে কথা। একেলা গায়কের নহে তো গান, গাহিতে হবে দুইজনে। তেমনি কেবল লেখকের নয় তো লেখা; পাঠকের অপেক্ষা রয়েছে সেখানে।
হাতে লিখে লিখে বিলিয়ে দেবো নাহয় জনে জনে–তার কী হয়েছে? পড়ুয়া নিয়ে হল কথা, পড়ানো নিয়ে ব্যাপার।
কিন্তু কাঁহাতক লেখা যায় বসে বসে? কাগজের পিঠে কলম ঘষে ঘষে রাতদিন? বিলির চেয়ে অন্য কোনো বন্দোবস্ত করাটাই ভালো না কি?
তাই করলাম। ডিমাই সাইজের প্রকান্ড একখানা কাগজ নিয়ে ছোটখাট সাইজের গল্প কবিতা ছাড়া প্রবন্ধ হাস্যকৌতুক, এমনকি, ক্রমশ প্রকাশ্য ধারাবাহিক উপন্যাসেরও একটুখানি দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে, আষ্টেপৃষ্টে ভরে দিলাম। তারপরে শ্রীশিবরাম চক্রবর্তী কর্তৃক সম্পাদিত লিখিত এবং প্রকাশিত সেই পত্রিকাটি হাটখোলার কালী মন্দিরের গায়ে গিয়ে তাঁদের সাহায্যে মুদ্রিত করে দিয়ে এলাম। আঠা দিয়ে উত্তমরূপে সাঁটার পর গদ্গদভাবে তাকালাম তার দিকে।
হট্টমন্দিরের দেয়ালে আমার খেয়ালটা সেই প্রথম দেয়ালা!
আমাদের হাটখোলা জায়গাটা একটুখানি নয়। অশ্রদ্ধা করবার মতন না। কলকাতার শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের মতন চারখানা আঁটে গিয়ে সেই জায়গাটা। প্রতি বুধবারে সেখানে বিরাট হাট লাগে। বিশাল জনসমাবেশ। আশপাশের পঞ্চাশখানা গাঁয়ের খদ্দের পসারীরা আসে। বহুত ইতরভদ্র জমায়েত হয় সেখানে।
দুপুরের আগেই থেকেই পসারীরা আসতে শুরু করে। দেড়টা-দুটোর মধ্যে হাট জমজমাট। লাখখানেক লোক কেনাবেচায় আসে নির্ঘাৎ। তার ভেতর জনকতকের নেকনজর কি পড়বে না আমার লেখাটার ওপর? কেউ কি দয়া করে পড়বে না একটুখানি দাঁড়িয়ে?
হাটের দিন বুধবার। সেদিন সকালেই ঐ দেয়ালপত্র লাগিয়েছি কালীমন্দিরের গায়।
ইস্কুল ছুটির পর বিকেলে একলাই ফিরছিলাম সেদিন। বিষ্ণু ইনটার-ক্লাস-টুর্নামেন্টের ম্যাচ খেলতে সকাল সকাল ছুটি নিয়ে নেমেছে গিয়ে ফুটবল মাঠে। একা-একাই ফিরতে হচ্ছিল আমাকে।
বাণিজ্যাঠাকুরের দোকানে বাণিজ্য একলাই সারতে হোলো। তারপর বুধবারি ভিড় ঠেলে হট্টমন্দিরের কিনারায় গিয়ে ঠেকলাম।
দুয়েকজনের নজর পড়ছিল দেখলাম আমার কাগজটায়–কিন্তু দেখে দাঁড়িয়ে পড়া, কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার তেমন গরজ কারো বিশেষ দেখা গেল না।
সবাই নিজের বেচাকেনা নিয়েই ব্যস্ত। সাহিত্যোৎসাহী কেউ নয়। একটু-আধটু তাকিয়েই না অবহেলাভরে চলে যাচ্ছিল সবাই। আমি অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে নজর রাখছিলাম।
খানিক বাদে সেই বন্দীবাবুকে দেখা গেল সেইখানে।
আরো দেখা গেল তাঁকে স্থাণুর মতই সেখানে দাঁড়াতে। সকৌতুক আগ্রহে তিনি পড়ছিলেন সব দেখলাম।
সবটা পড়ার পর তিনি ফিরে দাঁড়াতেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল আমার।
তুমি তো দেখছি দস্তুরমতন লেখক হে! একটু এগিয়ে এলেন তিনি আমার দিকে।
কী যে বলেন! সলজ্জ আমি বলি–কিচ্ছু হয়নি ওসব। লাগিয়ে দিয়েছি এমনিই। মনে এলো তাই।
না না, বেশ হয়েছে। বেশ হয়েছে। এমনি করেই তো হয়। তোমার একটা কবিতাও বেরিয়েছে বারের ভারতীতে দেখলাম। চমৎকার হয়েছে কবিতাটা!
বলেন কি? শুনেই না আমি লাফিয়ে উঠেছি-কই, আমাদের ভারতী তো আসেনি এখনো। আপনি পেয়ে গেলেন এর মধ্যে?
সব, কাগজই পাই কিনা আমরা। সরকার বাহাদুরের সৌজন্যে। দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিকপত্র সব। আমাদের অ্যালাউন্স থেকেই কাটা যায় দামটা। ইচ্ছে করলে যে-কোন বইও আমরা আনাতে পারি-পলিটিক্সের বই বাদে। যাবে তুমি আমাদের বাসায় বইপত্র সব দেখতে? আজই চল না কেন, এখনই?
না, যাব একদিন। খুব শীগগিরই যাব একদিন। তবে আজ না, এখুনি বাড়ি যেতে হবে। ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে মা ভাববে আবার। মাকে বলে আসিনি তো। মাকে বলে যাব একদিন শীগগির।
বলে আমি পাশ কাটাই। আমাদের ভারতীও এসে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণ। তাড়াটা আমার সেইজন্যেই-মার জন্যে নয়।
এসব কী লিখেছিস রে। বাড়িতে পা দিতে না দিইে মার খববদারি–কী লিখেছিস কাগজে এসব?
কী লিখেছি মা? কোথায়? আমি যেন কিছুই জানি না-হাটখোলার ঐ কাগজটার কথা বলছ বুঝি?
আমার হাটের হাঁড়ির খবরটা মার কাছে কেউ এসে ভেঙেছে বলে বোধ হয় আমার।
হাটখোলা কী আবার? ভারতীতে বেরিয়েছে তো! তোর এই পদ্যটা
ও! ওই ভারতীর লেখাটা! নিরুৎসুকের মত বলি–ওটার কথা বলছো?
দুখানা ভারতী এসেছে এবার আজ। একখানা তোর বাবার নামে-যেমন আসে। আরেকখানা তোর নামেই আবার।
দেখি দেখি। আমি হাত বাড়াই-আগ্রহ দমন করে।
দেখবি তো। কিন্তু তোর এই পদ্যটার মানে কী, তা বলবি তো আমায়?
পদ্য পদ্য বোলো না মা। পদ্য না, কবিতা। আমার রাগ হয়ে যায়–ওকে কবিতা বলে।
কবিতাই হল না হয়, কিন্তু মানে তো ওর থাকবে একটা।
কবিতার আবার মানে কী? কবিতার কি কোনো মানে হয় কখনো মা? ধরতে গেলে, মানে তো খুব সোজাই! কেন, তুমি বুঝতে পারছে না?
বোঝা তো সোজাই রে! তা কি আর বুঝতে পারছিনে। কিন্তু মানের মধ্যে আরেকটা মানে থাকে যে। মার জেদ-তোর এই কিশোরকালের সঙ্গিনীটি কে, শুনি।
কে আবার? কেউ না। মনগড়া সব। কবিরা সব মন থেকে বানিয়ে বানিয়ে লেখেন জানো না কি? যেমন রবীন্দ্রনাথ তেমনি আমি।
তাই নাকি! হাসতে থাকেন মা।
তা না তো কী! রবিবাবুর মানসী যেমন, তা কি আর ছিলো নাকি কখনো! সোনার তরী কি চোখে দেখা যায় নাকি? অপরকে শোনানোর জন্যেই বানানো ওসব।…ভারী খিদে পেয়েছে মা, কী খেতে দেবে দাও এখন।
কথাটা ঘুরিয়ে আমি খাবার ঘরের দিকে মাকে ফিরিয়ে দিই।
তারপরও ভারতীতে আমার কবিতা বেরিয়েছিল আরও। তার এক-আধটার এক আধটু মনে আছে আমার এখনো …..
কবিগুরুর সেই ভুলভাঙ্গা কবিতাটার…বুঝেছি আমার নিশার স্বপন হয়েছে ভোর মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে/ রয়েছে ডোর/ নেই আর সেই চুপি চুপি চাওয়া/ ধীরে কাছে এসে ফিরে ফিরে যাওয়া/ বাহুলতা শুধু বন্ধনপাশ বাহুতে মোর …
জবাবে একখানা লিখেছিলাম আমি এইধারার
সত্য হে কবি, এ যে ভুল ভাঙা
আর এক ভুল ধরিতে।
এ যে তটিনীর এক কূল ভাঙা
আর এক কূল গড়িতে।
প্রেম চলে যায়, বাঁধা তো রহে না;
তাই ফেলে যায়- বোঝা তো বহে না,
কেন চাহো তারে একটি স্বপনে।
ভরিতে?
সুখবেদনার এ যে ফুল রাঙা
কালি নিশাশেষে ঝরিতে।
এইরকম পাঁচ ছ ছত্রই প্রায়। তারপর আর মনে নেই আমার।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই বিদায় অভিশাপের হাসি? হায় সখা, এ ত স্বর্গপুরী নয়। পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণ জেগে রয়…কবিতাটারও একটা উতোর গেয়েছিলাম আবার–ভারতীতে নয়–সাপ্তাহিক সচিত্র শিশির-এর পৃষ্ঠাতেই।
পেয়েছিলে দশ শো বছর দেবযানী,
তবু তোমার মিটলো নাকো তৃষা?
দশটি নিশি পেলেই মোরা ঢের মানি,
তোমার ছিল লক্ষ মধু নিশা।
লক্ষ দিনে সখ্যনীড়ে বন্ধুটিরে/পাওনিকি?
লক্ষ নিশি বঙ্গে মিশি লক্ষ চুমু/খাওনি কি?
লক্ষ চুমুর তুল্য কী?
লক্ষ চুমুর মূল্য কী?
এক জীবন মিললো যাদের
লাখ জীবনে ভুললো কি?
পাইনি মোরা দশ শো বছর–চাইনেও।
সয় না মোদের একটা রাতের/ঘুমহানি।
দুনিয়া আমার স্বর্গ আমার–তাই দেব।
দাও না আমায় এক পলকের
চুমুখানি।
একটি চুমুর/তুল্য কী?/একটি চুমুর
মূল্য কী?
এই জনমে মিললো যাদের/আর
জনমে ভুললো কি?
এ ছাড়া, এর পরে, ভারতবর্ষে বেরিয়েছিল আমার প্রায় শ-দুই ছত্রের দীর্ঘ দুপাতা ব্যাপী এক কবিতা-চুম্বন বলে। সেটাকে চুম্বনের শত নাম–চুমুর হরিহরছত্রই বলা যায়। তাতে ছিলো চুমুর নানা আখ্যানের নানান ব্যাখ্যান। দুঃখের বিষয় সেই ছত্রাকারেরও এক ছিটেও মনে এখন আর পড়ে না আমার।
কবিতাটা এক ফাগুন সংখ্যায় বেরিয়েছিল–যে কারণে সম্পাদককে গাল খেতে হয়েছিল শনিবারের চিঠির কাছে-ফাগুনের ভারতবর্ষে আমাদের জলধরদা বুড়ো বয়সে আগুন ছুটিয়েছেন-ইত্যাকার ব্যঙ্গোক্তির পরিসীমা ছিল না।
তৎকালের লেখা–ভারতবর্ষ উত্তরা কল্লোল প্রভৃতিতে প্রকাশিত-আমার লম্বাচৌড়া কবিতাগুলি মানুষ এবং চুম্বন দুটি বই হয়ে এম সি সরকার থেকে বেরিয়েছিল পরে। সেযুগে কবিতার জন্য একালের মতন পাঠকের তেমন আগ্রহ না থাকলেও বছর খানেকের মধ্যেই বই দুটির সংস্করণ নিঃশেষিত হয়েছিল মনে আছে। কিছু টাকাও এসেছিল আমার পকেটে। কিন্তু তারপরে বই: দুটি আর ছাপা হয়নি। এখন তো তার কোনটারই পাত্তা পাওয়া যায় না আর।
আমার কাছে ওই মানুষ-চুম্বনের কোনো কপি নেই। প্রকাশকের কাছে তো নেইই। এমনকি, খুঁজে দেখেছি ফুটপাথেও তাদের পড়ে থাকতে দেখা যায় না। পাওয়া গেলে হয়তো ছাপানো যেত এখন।
কিন্তু সেই কাঁচা বয়সের এসব লেখা এমন কিছু চমৎকার হয়েছিল আমি মনে করি না। তবে তার ভেতরকার আবেগটা ছিল হয়ত খুব। চমৎকার না হলেও গোড়াকার আমার। লেখাগুলো যে চুমুৎকার হত বেশ, তার কোনো ভুল নেই।
এমনকি, আন্দামান-ফেরত মহাবিপ্লবী বারীনদা উপেনদার সাপ্তাহিক পত্র বিজলীতেও আমার একটা ছোট্ট চুটকি চমত্ মেরেছিল একসময়…মনে পড়ে বেশঃ
এক চুমুকে গভূষ করার মত লেখাই!
জানি জানি/ সবাই সবে/ ছাড়বে।
চলার পথে/ কে কার চুমু কাড়বে?
চুমু যেমন কাড়াকাড়ির তেমনি ছাড়াছাড়ির, তেমনি আবার চিরকালের মত হারাবার জিনিস! তার কি কোনো ভুল আছে আর?
কিন্তু ভাবি আজ, এই সব কবিতা সেই বয়সে আমার মাথায় এল কি করে? খাতার পাতায়ই বা এল কীসে?
আমার লেখা বলে মনেই হয় না যেন।
তার কিছুদিন আগেই তো আমি মহাকবি কৃত্তিবাসের পদাঙ্ক ধরে, শিবরাম পন্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ/ লঙ্কাকান্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ/ ফেঁদে বসেছিলাম…সেই আমিই কি এই আমি? এই কেঁদে কূল পাচ্ছে না যে?
কার পদাঙ্ক এসব? কোন্ অঙ্কশায়িনীর অনুসরণে এই পদাবলী?
কৃত্তিবাসী কীর্তির হনুকরণে লঙ্কাকান্ডে নিজের মুখ না পুড়িয়ে মিষ্টিমুখের কিসকিন্ধ্যা কান্ডে এমন করে কে টেনে নিয়ে এলো আমায়? কার ইঙ্গিতে লেখা আমার এই সব?…
এমনকি, বহুদিন পরেও সেই সংশয় আমার যায়নি এখনো। বহুবর্ষ পরের এই ছত্র দুটিতেও তা ব্যক্ত হয়েছে :
লিখেছি কি আমি অনেক বন্ধু?
আমি তো সেসব লিখিনি।
ছিলো যে লেখিকা অনেক বন্ধু!
ছিলাম আমি তার লেখনী।
কে ছিল সেই লেখিকা? ওহ্নে কৃতিত্ব কার? এই প্রেরণার জন্য কার কাছে ঋণী আমি?…রিনিই কি?
নাকি, সেই তিনিই?