ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা – ৩১

৩১.

সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়, বলে না?

সুখী ব্যক্তি মাত্রেই ভূতের কিল খায়, খেতে বাধ্য হয়। আধি ভূত ব্যাধি ভূত–ডাক্তার উকীলের ছদ্মবেশে এসে নানা মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে বারো ভূতে মিলে কষে কিলোয় তাদের শান্তি-স্বস্তি পায় না। ঝুট-ঝামেলায় জেরবার হয়ে যায়।

শুধুই বহির্ভূত নয়, মনের মধ্যেও ভূত থাকে যে আবার! কিছুতেই সুখে থাকতে দেয় কাউকে।

ছেলেরা কিন্তু এমনিতেই সুখী-স্বভাব গুণে সর্বদাই স্বচ্ছন্দ। খুব দুঃখী দরিদ্র পরিবারের ছেলেরাও মনের আনন্দেই থাকে–বাপ-মারা দুঃখকষ্টে কাটালেও সন্তানদের কখনো তার আঁচ পেতে দেন না–ছেলেবেলাটা বেশ কেটে যায় তাদের। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের বেলাতেই তাই। তা যদি নাও হয়, তাহলেও তারা বাস্তবের দুঃখ মনগড়া স্বপ্নের জগতে বাস করে ভুলতে পারে।

তাই বলে কি ছোটদের মনে সুখদুঃখের ছোঁয়া লাগে না? আশপাশের ছোঁয়া লাগে বইকি। তাছাড়া, কোনো কারণ না থাকলেও, অকারণেও নিজের মনে তারা সুখদুঃখ পায়।

এই সুখী, এই অসুখী তারা-ক্ষণে ক্ষণেই। কেন যে তা কে বলবে! অহেতুক দুঃখসুখের খেলা তাদের মনে লেগেই থাকে সময় সময়। সুখের মধ্যে থেকেও কেন যে তারা কষ্ট পায়, কিসের অভাব বোধ করে কোথায় যেতে চায় কে জানে! ছেলেদের দুঃখ কিসের, কে কইতে পারে।

বাল্য কৈশোর সুখের কাল, বলে থাকেন সকলেই। বয়স্করা পিছন পানে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।

আর হোটদের বয়স্কদের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে বুঝি। বড় হবার, বড়দের মত আচার-আচরণ করার স্বাধীনতার স্বাদ পাবার সাধ জাগে বোধ হয়। অন্তনিহিত অবচেতনের কোনো স্পৃহই কি?

কী সুখেই যে কেটেছিল আমার জীবনের সকালবেলাটা। ক্ৰীচার কমফর্ট বলতে যা বোঝায় তার কোনো কিছুরই অভাব ছিল না আমার। দক্ষিণ পশ্চিমে ভগ্নদশা হলেও এককালে প্রকান্ড প্রাসাদের প্রায় আধখানাই আমাদের। লম্বাচওড়া বড় বড় ঘরে সারি সারি খাট পাতা, তার ওপরে পুরু গদির নরম বিছানা বিছানো। সেই বিছানার কোলে গদিনশীন হয়ে দু ধারে পাশবালিশ নিয়ে সিল্কের মশারির মধ্যে ঘুমানোর কী আরাম। পূবের টানা বারান্দাটার মোটা মোটা থামগুলির খিলানের মাথায় ঝাঁক ঝাঁক পায়রার বাসা–তাদের বকমের মিঠে ডাক শুনে রোজ সকালের ঘুম ভাঙা যেন এক স্বপ্নের মতই।

আর, রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই না বাবার প্রসাদ লাভ!

 প্রসাদ বলতে গত রাত্রের বাবার খাবারের ভাগ আমাদের ভোগের জন্য রেখে দেওয়া।

সকালে বাবার হত হবিষ্যান্ন; আতপ চালের ভাত গাওয়া ঘি দিয়ে ডাল তরকারির সাথে খাওয়া, মাছটাছ কিছু নয়। তিনি ছিলেন পাক্কা নিরামিষাশী। আর রাত্রে হত তাঁর ফলার। সের দশেক দুধ মন্দা আগুনের আঁচে সারা দিন ধরে ফুটে ফুটে মরে মরে ক্ষীর হয়ে থাকত, তার ওপরে সর পড়তে মোটা রুটির মতই। আ মরি মরি! ক্ষীর ভাগের সবটুকু আর সর ভাগের অর্ধেক বাবা খেতেন রোজ রাত্তিরে–সঙ্গে থাকত সেই সুবিখ্যাত মানকি বলা (কলার ফলার বাবার বারো মাসই) আর সেই ঋতুর যা ফলমূল তাই। আর সেই সরের আদ্ধেকটা তিনি রেখে দিতেন আমাদের দুভায়ের সকালে উঠে খাবার জন্যে। রসগোল্লাও দু-এক জোড়া থাকত তার সঙ্গে আবার।

পুরুষ্টু রসগোল্লাগুলো কুঁচিয়ে কুঁচিয়ে পুরু সরের সঙ্গে মিকচার বানিয়ে আমি খেতাম আহা, রসনার সে যেন স্বর্গলাভ!

সকালে আমরা মার রান্না খেয়ে ইস্কুলে যেতাম–মাছের ঝোল আর ভাত। ইস্কুল থেকে ফিরে খেতাম ফুলকো লুচি। রাত্রেও আবার লুচি, মাছের তরকারি। মার রাঁধা চচ্চড়ি দিয়ে খানকতক লুচি, আবার মিস্টি ক্ষীর মিশিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করে তার ওপর। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা সে লুচির সোয়াদই আলাদা। সেই ছোটবেলাতেই যা খেয়েছি–তারপরে আর পাইনি কোনোখানে, খাইনি কোথাও।

আর সেই বিরাট একখানা ছাদ! সকাল সন্ধ্যে যেখানে মুক্তি অবাধ। মজাসে ফুর্তি করে বেড়াও। কতো কবিতাই না ভেঁজেছি সেই ছাদে বেড়াতে বেড়াতেই-কত চতুস্পদীর সঙ্গেই পায়চারি করা আমার সেখানে! কোথায় গেল সেসব কবিতা-আমার মনের আগুনের ফুলকি যতো! কোথায় গেল তারা? কে জানে!

যত মুকুল ধরে তার সবই কি ফুল হয়ে ফোটে? আম গাছে যত বোল আসে কতটুকুই বা তার ফলাও হয়? তবু তাইতেই তো তার বোলবোলাও! সেই সৌরভেই দশদিক আমোদিত।

স্বপ্নমায়ায় বিভোর হয়ে কেটেছে সেই স্বর্গীয় (এবং স্বৰ্গত) দিনগুলি আমার কৈশোরের।

সেই স্বর্গসুখেও অরুচি ধরতে আমার মাঝে মাঝে। মন যেন উধাও হয়ে যেত কোথায়। ভোগ সুখকে তুচ্ছ করে দুখভোগের জন্য কাঁদত বুঝি মন? হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোনোখানে-ভেবে আনচান করত বুঝি প্রাণ?

বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতাম আমি এক-এক সময়। কাউকে কিছু না জানিয়ে এক বস্ত্রে-একলাটি–সঙ্গে একটিও পয়সা না নিয়ে। পয়সা পাবই বা কোথায় তখন? আর, পয়সা সঙ্গে নেবার দরকারও বোধ করতাম না কখনো। অতিথিপরায়ণ সচ্ছল দেশে আতিথ্যলাভ তখন সহজ ছিল বেশ।

বাবা এককালে সন্ন্যাসী হয়ে দিগ্বিদিক ঘুরেছিলেন, তাঁর মাথার সেই ঘূণী পোকাই কি আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল নাকি? কিংবা এ পোকা হয়ত সব ছেলের মগজেই গজগজ করে–বাড়ি থেকে পালিয়ে ঘূর্ণী হাওয়ায় ঘুরিয়ে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় তাকে সেই ঘূণীপাকে পড়লে আর রক্ষে নেই। এবং এই পোকাই বুবি যথাসময়ে ঘুণপোকা হয়ে ভালোবাসার ছলনায় এসে কুরে কুরে খায় তাকে আবার।

ফি বছর দুর্গাপূজার পর আমাদের সবাইকে নিয়ে বাবা তীর্থভ্রমণে বেরুতেন। বিজয়ার পর তাঁর সেই দিগ্বিজয়ে গোটা সংসারটা যেত আমাদের আনুষাঙ্গিক। বাড়ির কুটোটি পর্যন্ত না নিয়ে তিনি নড়তেন না। মোটা মোটা বড় বড় গাঁটরি বাঁধা হতো–একটা থলে ভর্তি যত বাসনকোশন-পেতলের হাঁড়ি কড়াই, হাতা-খুনতি, থালা বাটি গেলাস সব–এমনকি মায় শিল-নোড়াটি অব্দি (বিদেশ বিভুঁয়ে মশলা বাটার জন্য মিলবে নাকি শিল কোথাও? রেঁধেবেড়ে তো খেতে হবে!) আমি সায় দিতাম বাবার কথায়-হ্যাঁ বাবা, শীল হচ্ছে কুল-ক্ষণ, কেউ কি তা কাউকে দিতে চায় কখনো? মার মতে একটা কুলক্ষণ-ঐ ভূতের বোঝা বয়ে বেড়ান। তোর ভর্তি জামা কাপড় গামছা ভোয়ালে পিরান কুর্তা। তার ওপর তোষক বালিশ মশারি-টশারি নিয়ে বিছনাপত্রের গোটা তিনেক গাটরি। টুকিটাকি জিনিস-টিনিসে ভর্তি তদুপরি আরো দুটো বাক্স আবার।

রাজার পিলখানায় হাতী ছিল বিস্তর–সবার সেরা তাদের মোহনপ্রসাদ। যেমন চেহারায় তেমনি দাঁতের বাহারে। বিরাট আকার হাতীর বড় বড় দুটো দাঁত। যেমন লম্বা তেমনিই মোটা। মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হত মোহনপ্রসাদের। ক্ষেপে গিয়ে সোজা সে চলে যেত সেই রাজবাড়িতে-রাজাবাহাদুরের কাছেই সটান। মাহুত সহিস কেউ তাকে সামলাতে পারত না। রাজাবাহাদুর ভারী ভালোবাসতেন তাকে। তিনি স্বহস্তে হাঁড়ি হাঁড়ি রসগোল্লা তাকে খাওয়াতেন। তাই খেয়ে তবেই সে শান্ত হত। রসগোল্লা খাবার জন্যেই সে ক্ষেপে যেত আমার মনে হয়।

মোহনপ্রসাদ ক্ষেপলে বাণিজ্যাঠাকুরের দারুশ বাণিজ্য! হাতীটা ক্ষেপলেই তিনি চার কড়াই রসগোল্লার ভিয়েন চড়াতেন। দুজনের মধ্যে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কিনা কে জানে!

বাবারও ভারী প্রিয় ছিল মোহনপ্রসাদ। সব হাতীর চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন তিনি ওকেই–ওই নামমাহাত্মের জন্যেই কিনা কে জানে। ওর পিঠে চেপে আর মালপত্রের লটবহরে গোরুর গাড়ি বোঝাই করে সামসি রওনা হতাম আমরা। সামসি ছিল আমাদের কাছাকাছি স্টেশন–দশ বারো মাইল দূরই হবে বোধ হয়। কিন্তু স্টেশনে যাওয়ার আগেও বাবার আরেক যাত্রাপর্ব ছিল আবার। মা বলতেন, যাত্রা নয়, ওটা তার নিতান্তই থিয়েটার করা।

সেটা ছিল তাঁর পাঁজিপুথি দেখে যাত্রা। দিনক্ষণ দেখে, কত প্রহর কত দণ্ড পল বাদে কোন সময়টা যাত্রার পক্ষে শুভ সেটা লক্ষ্য করে, তারপর সবার প্রাতঃকৃত্যাদি সারিয়ে, গাড়ি ধরবার তখন আঠারো ঘণ্টা বিলম্ব থাকলেও। হয়ত রাত তিনটেই ঠিক ক্ষণটি, একটু না ঘুমোতেই রাত দেড়টায় সবাইকে হই হই করে তুলে, সবার প্রাতঃকৃত্যাদি সারিয়ে, শয়নঘর ভোজনঘর বাদ দিয়ে, আমাদের সবাইকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে বৈঠকখানার ঘরটায় নিয়ে এসে তিনি বসে থাকতেন। যথাকালে আসল যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতেন সেখানে ঘন্টার পর ঘটা।

মোটঘাট আগের থেকেই বাঁধাছাঁদা হয়ে মজুত থাকত সেইখানে। তিনটেগোরগাড়ি বোঝাই হয়ে যেত আমাদের যত লটবহরে। দশ মাইল রাস্তা গোরুর গাড়িতে টিকিয়ে টিকিয়ে যাওয়া কী কষ্টকর! ইস্টিশনে যাবার পাকা সড়ক হয়নি তখনো। (এখন তো শুনি বাস যায় নাকি পিচমোড়া রাস্তায়।) বেশির ভাগ গোরুর গাড়িইে যেতে হত, কখনো কখনো অবশ্যি রাজবাড়ির থেকে হাতী আসত আমাদের স্টেশনে নিয়ে পৌঁছে দেবার … জন্যে-খবর দিয়ে রাখলে আগের থেকে ফিরতি পর্বেও তেমনি স্টেশন থেকে আমাদের নিয়ে আসার জন্যও হাতীযেত এক এক সময়।

আর হাতী চাপতাম আমরা, সম্বচ্ছরে সেই পূজার সময়। রাজবাড়ির দুর্গোৎসব হত পাহাড়পুরে (এখনও হয় বোধ হয়), সেখানে হাতী চেপেই যেতাম আমরা–আমরা আর বামুনপাড়ার ছেলেরা সবাই। বামুনপাড়ার অনেকে রাজার একরকম আত্মীয়ই হবেন–দূর সম্পর্কিত হলেও। কেউ তাঁদের ডাক্তার, কেউ জোতদার, কেউ বা শুধুই পুরোহিত। পুজোর চারদিন হাতী চাপবার ফুর্তি ছিল আমাদের।

পাহাড়পুর পর্যন্ত চার মাইল রাস্তা হাতী চেপে মসমঁসিয়ে যাবার মজাই ছিল অদ্ভুত! পুজোর আমোদর উপরি আরেক প্রমোদ! এখন, ট্রেনযাত্রার কথাটাই বলা যাক। বাবা আগের থেকেই স্টেশনে লোক পাঠিয়ে গোটা একটা থার্ড ক্লাস কামরা রিজার্ভ করে রাখতেন–লটবহর সমেত আমাদের সবাইকার জন্যে। বাড়ির থেকে শুভযাত্রায় শ্রীদুর্গা স্মরণ করে রওনা হওয়ার পর আমরা সেই কামরায় গিয়ে চাপতাম।

তারপর সারা ট্রেনযাত্রায় সেই লাগেজ তুলতে নামাতে কী কম হাঙ্গামা! গোদা-গাড়িঘাটে ট্রেন ছেড়ে ধরতে হত স্টীমার, ওপারে লালগোলায় গিয়ে চড়তে হত কলকাতার ট্রেনে। অত লাগেজ নিয়ে কুলীদের সে কী চেঁচামেচি-তাদের সঙ্গে কত দর কষাকষি-বকাবকি বাবার! শেয়ালদায় নেমেও সেই ঝঞ্ঝাট ফের! ছ্যাকরা গাড়ির কোচোয়ানের সঙ্গে কচকচিও কম নয়।

 ভেবে আমার অবাক লাগত, একদা সংসারবিরাগী বাবা কেন যে এই সারা সংসারের গন্ধমাদন ঘাড়ে করে তীর্থভ্রমণে বেরুতেন! এ জিজ্ঞাসার জবাব আমি খুঁজে পেতাম না।

অথচ যখন তিনি নিজে বেরুতেন একলাটি, কার্যগতিকে কলকাতায় কি আর কোথাও, তখন কোনো লটবহর নয়, কেবল একটিমাত্র হাতব্যাগ থাকত তাঁর সঙ্গে। আর তার ভেতর থাকত আরেক প্রস্থ তাঁর জামাকাপড়, জমা-খরচের খাতা আর দরকারী কাগজপত্র। এই নিয়েই তিনি যেতেন।

কলকাতায় গেলে তিনি ফিরে আসতেন কিছু মোটঘাট নিয়েই অবশ্যি। হয়ত কিছু আনকোরা বাসনপত্র, ছাতাটাতা, নতুন ধুতি, শাড়ি, মশারি-টশারি, বুড়িখানেক ল্যাংড়া আম, ভীমনাগের সন্দেশ–এই মোটমাট।

আমাদের নিয়ে বেরুলে কখনো যেনে তিনি বৈদ্যনাথ দেওঘর, কখনো পুরী ভুবনেশ্বর, কখনো বা কাশীধামে। কখনো আবার শুধুই কলকাতায়–আমাদের মাসিধামে।

মাসির বাড়ি যাওয়ার সুযোগ এলে আমরা যেমন পুলকিত হতাম, মাকেও তেমনি হাসিখুশি দেখা যেত ভারী।

রামতনুবাবুর গলিতে (নম্বর মনে পড়ে না) বড়মাসির বাড়ি উঠতাম আমরা। সাত বোনের ভেতর ঐ খুদিদিদির ওপরই মার টান ছিল বেশি।

পরে আমিও আবার উধাও হয়ে যেতাম ঐ সব জায়গায়। বাবার সঙ্গে গিয়ে গিয়ে যে সব স্থানের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল, বাড়ির থেকে পালিয়ে সেখানেই যেতাম বেশি বেশি। কিন্তু ঠিক তীর্থের টানে সেটা নয় বোধ হয় আদৌ। কেননা শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে আমি আর দ্বিতীয়বার যাইনি–সমুদ্র বিশেষ আন্দোলিত করেনি আমায়। সাগরের চেয়ে গঙ্গা ঢের প্রিয় ছিল আমার কাছে–তার কিনারায় বসে ঢেউ গুণে সময় কাটাতে কী আরাম! পুরী কি ভুবনেশ্বর মন্দিরের আকর্ষণ আমি কখনো বোধ করিনি। জগন্নাথ দেবের অন্নপ্রসাদে তেমন উৎসাহ পাইনি বলেই হবে হয়ত। কাশীধামে গেছি–সেখানকার মালাই লচ্ছির তুলনা হয় না, ভাগলপুরেও গেছি ভুল করে–সেখানকার হালুইকরের দোকানের পুরু সর একটু গুরুপাক হলেও অতি উপাদেয়–আর বাবা বৈদ্যনাথের প্রসাদী প্যাঁড়া–কী উপমা দেবো তার? কাশী গয়া প্রয়াগের প্যাঁড়া খেয়েছি বাবার সঙ্গে গিয়ে, কিন্তু দেওঘরের প্যাঁড়ার জোড়া নেইকো-প্যারালাল নাস্তি।

কাটিহার দিয়ে কেটে বেরুতাম, তারপর নানাদিক ঘুরে ফিরে, কিউল বরেটনি মতিহারী নানান জংশন হয়ে (ভাগলপুরও ঐ রকম বিপথের মধ্যেই পড়েছিল বোধ হয়) এখানে সেখানে নেমে এক-আধদিন ধরমশালায় কাটিয়ে অবশেষে পৌঁছে যেতাম সেই দেওঘর ধাম–ততটা বাবা বৈদ্যনাথের প্রতি ভক্তিবশত নয় যতটা ঐ আহামরি প্যাঁড়ার টানেই। আন্ধ্যারালান্ডু প্যাঁড়া!

আশ্চর্য লাগে এখন, টিকিট সঙ্গে না থাকলেও রেলগাড়িতে কখনো আমায় কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। প্রায়ই দেখেছি আমার পাশের সহযাত্রী একগাদা টিকিট বার করে দেখিয়েছেন চেকারকে–এবং চেকার ভদ্রলোক আমাকেও ওঁর আনুষঙ্গিক জ্ঞান করে দৃপাত করেননি আমার দিক ফিরে। এবং আহারাদিরও অসুবিধা হয়নি কখনো। যেখানেই গেছি না, সেখানকার কোনো না কোনো প্রবাসী বাঙালী ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা আদর করে বাড়িতে ডেকে নিয়ে খাইয়েছেন আমায়-বাড়ি পালানো ছেলে মনে করেই হবে বোধ হয়-কী সব মানুষই না ছিল যে সেকালে! (এখনও অন্য নামে আছেন তাঁরা নিশ্চিত) কেউ কেউ বাড়ি ফেরার গাড়ি ভাড়াও অযাচিত দিতে চেয়েছেন আবার। দিয়েছেনও জোর করে গছিয়ে-বহুৎ সদুপদেশের সহিত। আজও অত অচেনার ভেতরে একজনের কথা আমার মনে আছে এখনো-আমার সমবয়সী ছেলেটি-বাঙালী নয়, বিহারী। বিহারী হলেও বাংলা বলতে পারত বেশ।

মধুপুর স্টেশনে আলাপ হয়েছিল তার সাথে–কোনো পাণ্ডার সাকরেদ হবে–কিংবা বাচ্চা এক পাণ্ডাই-যাত্রী পাকড়াতে বেরিয়েছিল।

টের পেয়েছিল যে আমার টিকিট নেই–সঙ্গে পয়সাটয়সাও নেই একটা। যশিডি জংশনে গাড়ি থামতে আমাদের প্রায় সবাইকে নামতে হল সেখানে-সেখান থেকে বৈদ্যনাথধাম– যাবার অন্য গাড়ি ধরতে হয়। ছেলেটি নেমেই না চার পয়সা দামের একখানা দেওঘরের টিকিট কিনে হাতে দিল আমার। বলল যে, বাবাকে দর্শন করতে যাচ্ছ তো? মন্দিরেই আমার সঙ্গে দেখা হবে–এখন আমি যাত্রী ধরতে চললাম।

স্টেশনে নেমে সোজা চলে গেলাম মহাদেবের মন্দিরে। রাস্তাঘাট সব চেনাজানা ছিল। মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম আগে। দেখলাম সেইরকম মন্দিরের পথের দুপাশে গালার তৈরি কাঁচ পাথরের চুমকি বসানো ঝকমকে যত চুড়ির দোকানসোনার চুড়িকেও হার মানায় তারা-দোকানে বসেই বানাচ্ছে যত কারিগর, যেমনটি নাকি আগেও দেখেছিলাম।

প্যাঁড়ার দোকান তাদের ধারে ধারেই কিন্তু ধারে খাওয়াবার পাত্র নয় কেউ তারা।

মন্দিরের মধ্যে গিয়ে দর্শন করলাম বাবাকে। কষ্টিপাথরের মত নিকষ কালো লেতেলে মাথায় হাত বুলোতে কী আরাম! ভালো লাগল বলেই বাবার মাথায় হাত বুলালাম খানিক।

বাবার মাথাটা একটু টোল খাওয়া। তার কারণ স্থানীয় পুরাণ কথায় যা বলে, খুদে পাণ্ডাটির কাছে তা জানা গেল।

একদা শিবভক্ত রাবণ কৈলাস থেকে বাবাকে টেনে হিঁচড়ে নিজের কাঁধে তুলে স্বর্ণলঙ্কায় নিয়ে যাচ্ছিল। দেবাদিদেবের কিন্তু মোটেই ইচ্ছা ছিল না সেখানে যাবার। কিন্তু ভক্তের বাহুবন্ধন আর মায়াপাশ কাটানো দায়। অ্যান্দুর এসে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল, নিজের শীর্ষস্থানীয় সুরধনীকে রাবণের পেটের মধ্যে তিনি সেঁধিয়ে দিলেন। ফলে রাবণকে দারুণ প্রেরণায় পেয়ে গেল তারপর। বাবাকে ঐখানে নামিয়ে মুক্তধারায় সে স্বচ্ছন্দ হতে বসল। বাবা বললেন, এপ্রহরের মধ্যে তুমি এলে তো এলে, নইলে এই যে আমি বসলাম, নড়ছিনে আর এখান থেকে। রাবণ বলল, প্রহর কিসের ঠাকুর। এক দণ্ডেই আমি আসছি। কিন্তু সেই অফুরন্ত প্রবাহিনীর বেগ কি একটুখানি? চার প্রহর কেটে গেল রাবণের দেখা নেই। তারপরে কাজ সেরে ফিরে এসে কিছুতেই সে আর বাবাকে তুলতে পারে না। নড়নচড়ন নেই আর তার কথারও নড়চড় হবার নয়। রাবণ আর কি করে? ক্রোধভরে বাবার মাথায় বিরাট এক মুক্কা মেরে না নিজের মক্কায় ফিরে গেল সে। তাঁকে একচোট দেখে নিয়ে সেইখানে রেখে গেল অবশেষে।

আর, রাবণের চোট তো চারটিখানি না। তার বিশখানা হারে বিরাণীমণী ধাক্কাই! একটু টোল খেয়ে তার টাল সামলাতে হলো বাবাকে।

তদবধি ভক্তাধীন ভোলানাথ ভক্তবৎসল নারায়ণের ভৃগুপদ লাঞ্ছনার ন্যায় ভক্তের সেই টিপসই নিজের শিরোধার্য করে রয়েছেন। রাবণের সেই কীর্তি, কর্মনাশা নামে কীর্তিত, এখনো দেওঘর দিয়ে প্রবাহিত নাকি–সেই নদীর জল কিন্তু কেউ পান করে না। স্নান করে না কেউ সেখানে।

সুন্দরীর গালের মত সুচারু না হলেও সেই টোলে হাত বুলোতে গিয়ে গোল বাধল যা! মন্দিরের পাণ্ডারা এমন ধমক লাগালো আমায় যে, টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম।

সঙ্গে আমার কোনো পাণ্ডা ছিল না। বিনা দনীর এই দর্শনাথীর অযথা হস্তক্ষেপ। আর, সব পূজারী পাণ্ডার প্রাণে সইল না বোধ হয়। কে না কে তাদের সর্বত্বসংরক্ষিত দেবতার, মাথায় এসে নিখরচায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। হৈ হৈ করে উঠল সবাই। তাদের তাড়নায় বেরিয়ে আসতে হল বাইরে।

বাইরে এসে মন্দিরটা প্রদক্ষিণ করলাম একবার। বার বার করছিলেন ভক্তদের অনেকে। মন্দির বেষ্টন করে তার গা-লাগাও সারি সারি ঘোট ঘোট খুপরির মতন–তার খোপে খোপে মনোবাঞ্ছাপূরণের প্রার্থনায় বাবার কাছে হস্তা দিয়ে পড়ে রয়েছে কতজন।।

তারই একটা খালি মতন পেয়ে তার পৈঠার ওপর পা ঝুলিয়ে বসলাম আরামে। তার আগে চন্নামৃতের কুণ্ড থেকে পেট ভরে পান করে খিদে মিটিয়ে নিয়েছি আমার।

খিদের মুখে সেই চন্নামৃতের স্বাদ প্রায় অমৃই! রাতদিন কত না পূজাথী ভক্তিভরে বাবার মাথায় দুধ ঘি দুই মালাই গঙ্গাজল ঢালছে, প্যাড়ার ভোগ লাগাচ্ছে, তার সবটাই তো ধুয়েমুছে একটা নালি বেয়ে সেই কুণ্ডে এসে জমা হচ্ছে। সে কস্তু যেমন তুষ্টিকর তেমনি পুষ্টিকর, একাধারে ক্ষুধাতৃ দুই-ই মেটায়, সন্দেহ কি।

বসে রয়েছি চুপচাপ। এমন সময়ে কোত্থেকে সহসা আমার সমবয়সী সেই কিশোর পাণ্ডাটি এসে হাজির।

এসেই সে গোটা চারেক প্যাঁড়া দিল আমাকে। দোনার মধ্যে নিয়ে প্যাঁড়াগুলো হাতে করেই এসেছিল সে।

এই প্যাঁড়ার জন্যেই কি এখানে বসে এতক্ষণ ধরে প্রার্থনা করছিলাম আমি নিজের অগোচরে।

কিন্তু আমার মনের কথা ওই ছেলেটা টের পেলো কি করে?

আগেকার কাল হলে, স্বয়ং বাবাই ওর ছদ্মবেশ ধরে আমার কাছে এসেছেন মনে করে তক্ষুনি তার পায়ের তলায় দৎ হয়ে লুটিয়ে পড়তাম হয়ত।

কিন্তু সেরূপ কোনো প্রেরণাই জাগল না আমার–তেমন বিশ্বাস ছিল না তো। পাওয়ামাত্র অম্লানবদনে খেতে লাগলাম প্যাঁড়াগুলো–বিনা বাক্যব্যয়ে। খিদে পেয়েছিল বেজায়…

তোমাদের পাণ্ডা কে এখানে? ছেলেটা শুধালো আমাকে।

 পাণ্ডা আছে আমাদের-এর আগে যখন মা-বাবার সঙ্গে এসেছিলাম দেখেছি-তবে নাম জানি না তাঁর। ইয়া গাট্টাগোট্টা চেহারা।

এখানকার সকলের চেহারাই ভাই ঐরকম। বাবার প্রসাদে আর রোজ বিকালে ওই ভাঙ খেয়ে। বলে হাসতে লাগল ছেলেটা-ভাঙই বাবার উত্তম ভোগ। পেস্তা বাদাম পিষে মালাই লচ্ছির সঙ্গে মিলিয়ে বানানো হয়। খেতে যা–কী বলব। আহা! তার দুই চোখ নিমীলিত হয়ে আসে।

ভাঙও খেতে দেবে নাকি আমায়? আমি সভয়ে বলি-বাবার ঐ উত্তম প্রসাদ?

না না, তোমাকে দিতে যাব কেন ভাঙ? সে আমার ভয় ভাঙতে চায় : বাঙালীরা ভাঙ সইতে পারে? খেলে তুমি উলটে পড়বে এখনই।

যে কদিন ওখানে ছিলাম মন্দিরের চত্বরেই পড়ে থাকতাম। রাতভোর ভক্তের ভিড়ে গমগম করত জায়গাটা। খিদে পেলেই চন্নামেও আর মাঝে মাঝে সেই ছেলেটা এসে প্রসাদী প্যাঁড়া দিয়ে যেত আমাকে। যজমানদের পুজো করিয়ে বাবার কাছে দেওয়া তাদের ভোগের থেকে পাওয়া নিজের ভাগের খানিকটাই বোধ হয়।

সকালবেলা উঠে বেরিয়ে পড়তাম এদিকে সেদিকে যেদিকে দু চোখ যায়–দেওঘরের যে কোনো রাস্তা ধরে। একদিন গেছলাম ত্রিকূট পাহাড়ে, আরেকদিন নন্দনকাননে। তবে যেদিন যমুনাজোড়ে ( ঝিরঝির বয়ে যাওয়া পাহাড়ী নদীর নাম ) গেছলাম সেদিনটির কথা বিশেষ করে মনে আছে আমার এখনো।

চাষীদের সবিস্তার আখের খেত ছিল যমুনাজোড়ের দুধার ঘেঁষে। যেতেই তারা সমাদরে অভ্যর্থনা করে এক ভাঁড় রস (আহা, কী তার মাধুরি!) খেতে দিয়েছিল আমায়। আমি না না করলেও তারা আমার মানা শোনেনি। দেহাতী লোকের এই স্নেহাতিশয্য বিস্মিত করেছিল আমাকে। কে জানে এখনো আখের চাষ হয় কিনা সেখানে-প্রাণ টানে সেখানে যাওয়ার জন্যে আমার এখনো! আখেরে আর যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও আমার। এখনো কি তারা সেদিনের মতই অচেনা অতিথিকে আমন্ত্রণ জানায়–তেমনিই সরস উপচারে সাদরে?

.

৩২.

 মাঝে মাঝে এমনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বাইরে দীর্ঘদিনের জন্য ডুব মারলেও বাবা-মার মনে আমার জন্য কোনো ভাবনা হতো বলে মনে হয় না–সামান্য একটা মার্বেল ডুবলেও পুকুরের বুকে যতটুকু তরঙ্গ তোলে, আমাদের বাড়ির নিস্তরঙ্গ পরিবেশে ততটুকুও চাঞ্চল্য জাগত না বোধ করি।

বাড়ি থেকে চলে গেলেও যেমন তাঁরা ভাবিত হতেন না, তেমনি দীর্ঘকালের পর আবার বাড়ি ফিরে এলেও অভাবিত কোনো উল্লাস দেখিনি তাঁদের। সব একেবারে স্বাভাবিক। গতকালও যেন বাড়িতে ছিলাম এইরকম ভাব …অতকাল বাইরে কাটিয়ে এলেও। কোথায় ছিলাম, কী করেছি, কিভাবে কাটালাম তার কোনো প্রশ্নই ছিল না, কৌতূহলও নয়, খাপছাড়া তরোয়ালের মই যথারীতি খাপ খেয়ে যেতাম নিজের বাড়ির খোপে আবার।

বাবা-মা যে আমার প্রতি উদাসীন বা স্নেহহীন ছিলেন তা নয়, তাঁরা ছিলেন ঐ একরকমের। একদা সন্ন্যাসে কাটানোর জন্যেই কিনা কে জানে, বাবা ছিলেন সব বিষয়ে নির্বিকার, সব সময় নিরুদ্বিগ্ন। আর মা? মা তো আমার সম্বন্ধে নিশ্চিতই ছিলেন একপ্রকার। বলতেন, তোদের দু জনকে মার পায়ে সঁপে দিয়েছি, আমার কোনো ভাবনা নেই তোদর জন্যে আর। কোনোদিন তোরা কিছু দুঃখকষ্ট পাবিনে, গোল্লায় যাবিনে কখনোই। আমি নিশ্চিন্ত আছি।

মার কথায় নিশ্চিন্ত ছিলাম আমিও। কদাচ নিজের জন্যে কিছু ভাবিনি কখনো। না বর্তমানের না ভবিষ্যতের ভাবনা-কোনোদিন আমায় বিচলিত করেনি একটুকু। ভাবনার কারণ আসার আগেই তা কাটাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দারিদ্রের মধ্য দিয়ে গেছি দুঃখ পাইনি, আগুনের আওতায় থেকেচি আঁচ লাগেনি গায়ে, কে যেন সবসময় আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে আমায়।

রোগা পটকা দুর্বল দেহ নিয়ে পড়াশুনায় কাঁচা, টাকাকড়িতে ফাঁকা, নিতান্ত অপদার্থ এই আমি কি করে আমার যৎসামান্য জীবনে এত কাণ্ড করলাম, ভাবলে অবাক লাগে। প্রকান্ড তার কোনোটাই হয়ত নয়, কিন্তু সব তিলগুলি জড়ো করে যে তাল, তাকে তো আর বাতিল করা যায় না। পঙ্গু-আমি গিরি লঙন করতে পারিনি ঠিকই, (বিশ হারে অমন বাহুবলশালী রাবণও তো স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু প্রায়-মুখ মুক আমি মুখর হলাম যে! মুখ্য নাই বা হলাম। আমার পক্ষে সেটাই কি কম নাকি! তা যার কৃতিত্বে বা কৃপাতেই হই না কেন! আলো যেখান থেকেই আসুক, এই মাটির প্রদীপেই জ্বলছে তো?

এই জীবনে সব কিছুর সোয়াদই তো এক-আধটু পেয়ে গেছি। কিছুর জন্যেই কোনো খেদ নেই আমার। কোনো লোভ না, কোনো ক্ষোভ নয়।

আত্মতৃপ্ত হলে কিছু হয় না; এই আত্মতৃপ্তির জন্যই বোধ করি কিছুই হল না আমার। লেখককর্মে বা কর্মলেখায় উল্লেখ্য তেমন কিছু। কিন্তু কিছু না হওয়ার মধ্যেও যেমন কিছু হয়ে যায়–কিছু কিছু হওয়া যায়, ভেবে দেখলে সেই-কিছুটা তো কিছু কম নয়। যৎকিঞ্চিৎ জীবনে তাই আমার যথেষ্ট।

আধারটাই বড়ো কথা। বড়ো আধারে বেশি ধরে-বেশি ক্ষমতাই বেশি পারে। হ্রদের বুকে যত জল জমে থোষ্পদে কি আর তত! আকাশের ছায়া অবশ্যি দুজায়গাতেই দেখা যায়-দুখানেই ছড়ানো–দুই-ই তার মায়া জড়ানো; কিন্তু হ্রদের বিশালে যে বেশি বর্ষণ হয় নদের প্রবাহ বয়ে সেই স্নেহধারাই দুধারেই তৃষিত শ্যামল অধর সরস করে সমুদ্রের বুকে গিয়ে হারায় আবার। ফের আবার সূর্যের আকর্ষণে উচ্ছ্বসিত সেই স্নেহই আকাশের মেঘপুঞ্জে সঞ্চিত, হ্রদে বর্ষিত আর নদের দ্বারা বাহিত হয়ে যথাসময়ে সাগরমোহনায় গিয়ে গদগদ। এই-ই লীলা।

পরিমিত শক্তির মধ্যে যে স্তিমিত, সীমিত গন্ডীর মধ্যেই তার লিমিট; নিজ সীমান্তের বাইরে কিছুই তার করার নেই। এবং তার হেতু খেদ করে (কিংবা জেদ করেও) লাভ হয় না কোনো।

১৬৩ রবীন্দ্রনাথ যেমন। একাধারে হ্রদ, নদ আর সমুদ্রের সমাহার। এপর্যন্ত মানুষের পরিণতিতে। পরিপূর্ণ মানবতার ঠিক না হলেও, মানবিক পরিপূর্ণতার মাপকাঠি রূপেই ধরা যায় তাঁকে। সেই রবীন্দ্রনাথকেই ধরুন। আধারটা তাঁর কেমন, দেখুন একবার। জন্মসূত্রে পাওয়া স্বাস্থ্য, শরীর আর সম্পদ, মহর্ষিতুল্য পিতৃমাহাত্মে ব্রহ্মসূত্রে টিকি বাঁধা সেই বাল্যকালেই! বৃত্ত এবং মূলের এই একাত্মীয়তাবৃত্ত আর বৃত্তির এমন সমন্বয়-যা প্রায় দেখা যায় না। আগাগোড়া তাঁর জীবনবৃত্তান্তেই তার পরিচয়। পারিবারিক সূত্রে জন্মলব্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সহজ যোগাযোগ, সুযোগসুবিধা। অসাধারণ আভিজাত্য। তিন যুগের ঐতিহ্য। স্বভাবত-অর্জিত সেই মহাসম্পদ স্বচেষ্টায় বহুগুণ বর্ধিত। সুন্দর শরীর আর স্বাস্থ্য নিয়ে জন্মেছিলেন, ব্যায়াম কুস্তি করে তা আরও সুগঠিত করেছেন–হাতের কব্জিটা কি দেখেছিলেন তাঁর? সেই অনুপাতে দীর্ঘায়ত দেহ-রূপে অপরূপ। নিজ আয়াসে যেমন তাঁর দেহগঠন, নিজ প্রয়াসেই তেমনি আত্মশিক্ষণ। সেই সঙ্গে একাত্মভাবে অনন্তযোগে কাব্যে সাহিত্যে শিল্পে সঙ্গীতে সংস্কৃতিসৃজনায় অফুরন্ত তাঁর স্বতোৎসার। আজীবন। অশ্বমেধযজ্ঞে দিগ্বিদিক-বিজয়ে বেরিয়েছেন যেমন, তেমনি আবার শান্তিনিকেতনে ছিল তাঁর রাজসূয়-বিশ্বভারতীর যে মহৎ যজ্ঞে সারা বিশ্বের আমন্ত্রণ। সেখানে নানান দেশ থেকে তাঁর প্রায় সমযোগ্যরা রাজকর নিয়ে এসেছে। নানান কর্মকান্ড আর কল্পকীর্তির নানা রূপে নিজের নব নব উন্মেষে মজে থেকেছেন–নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি দেশবিদেশে।

দৈবকৃপার মূলধনকে পুরুষকারের সাধনায় বহুগুণ বাড়িয়েছেন–তার পুরস্কার তিনি দিয়ে গেছেন শুধু তাঁর স্বদেশীয়দেরই নয়, বিশ্বজনকে। কল্পবৃক্ষের মতই তাঁর অকল্পনীয় বিস্তার যেমন জাতির মেদমজ্জায় বিস্তৃত হয়েছে তার শিকড়, তেমনি ফের নানান কান্ডে ফলাও হয়ে তা দিগ্বিদিকে বিস্তারিত–তাঁর সাফল্যে ফলবান-ফলভোগী আজ সকলেই। তাঁর মৌলিক চেতনার আলোয় আর সাধনার সম্পদে আমূল নতুন করে গড়ে দিয়ে গেছেন তাঁর স্বদেশ-তার স্বজাতিকে।

সেই হিমালয়তুল্য অভিব্যক্তির সম্মুখে ব্যক্তিত্বে আমরা তো ঢিবিই। অবিনশ্বর ঐশ্বর্যের সামনে ক্ষণভঙ্গুরতার পরমাশ্চর্য। কিন্তু হাজার হাস্যকর হলেও পাহাড়ের সঙ্গে উইটিবির তুলনাকরা যায় বোধ হয়। সেই WE ঢিবিদের অন্যতম নগণ্যতম এই আমার তাঁর সঙ্গে তুলনায় কী দেখি?

প্রৌঢ় পিতার ঔরসলব্ধ দুর্বল দেহে জন্মসূত্রে মার হাঁপানির উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মেছি বেড়ে উঠেছি পোছড়া বাড়ির আওতায়, হোক না নাম তার ওল্ড প্যালেস, টাকাকড়ির ঝুলি ফাঁকা, পড়াশুনায় ঘোড়ার ডিম।

উচ্চতর অভিজাত সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ নেই কোনোখানেই। অবশ্যি গায়ে যেমন এক কড়ার ক্ষমতা ছিল না, তেমনি কাঁধের ওপর বোঝা বওয়ারও কড়ার করিনি কোনো– সাংসারিক দায়ধাক্কার সাথে লড়ালড়ির কোনো কড়াকড়ি ছিল না আমার। না দেহে, না মনে, না মস্তিষ্কে, না জ্ঞানে, না বিদ্যায়, না বুদ্ধিতে, এক কড়ার পুঁজি নিয়ে আসিনি, অহংকারের কিছু চাটুতাও ছিল না তাই। কিন্তু এই কড়ার মধ্যেই বুঝি ক্রান্তি মিলে যায়, নিজের মনেই কেমন করে যেন জানি, তাঁর সংযোগের সংক্রান্তি হলেই। সর্বহারা তার সর্বস্ব হাতে পায় বুঝি অবলীলায়।

মানস সরোবরের বিরাট আধার নয় আমার (রবীন্দ্রনাথের যেমনটি ছিল), আমার ফুটো ভাঁড়ে একটি ফোঁটাও জল ধরে না। আমার ভাঁড়ে ভবানী আমি জানি। আমার ছ্যাঁদার খবর আমি ভালোই রাখি, আমার ছিদ্রান্বেষীরা আর কতটা রাখেন তার! কিন্তু এই মাটির ভাঁড়ের ছিদ্রপথেই, কার মায়ায় কে জানে, অলকনন্দার প্রবাহিনী বয়ে যায়–সেই রহস্যের মূল কোথায়! নিজে ফাঁকা হলেও, ফাঁকিতে পড়লেও, নিজের ফাঁক দিয়েই সে বহুজনের তৃষ্ণ মেটাতে পারে–স্বয়ং তৃষিত থেকেও। টালা ট্যাংকের বিপুল পুঁজি কলের কৌশলের ভেতর দিয়ে গলে গেলেও পাইপ নিজে সে শুন্য শুষ্কই থাকে–কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে বসে না সে। সম্পূর্ণ নিজের জলাঞ্জলির মধ্যেই কোথায় যেন তার সার্থকতা থেকে যায়। ভবানীই ভাঁড় পূর্ণ করে থাকেন, রাখেন; তাই সে নিজের ভাঁড়ার শূন্য করে সব উজাড় করে সবাইকে দিলেও তাঁর ভাঁড়ের ভাঁড়ার কখনই আর ফুরোয় না। মধুসূদনদাদার দইয়ের ভাঁড়ের মতই, উপুড় করে ঢেলে দেবার পর চিত করলেই ফের ভর্তি আবার! সেই হেতুই স্বয়ং শঙ্করাচার্যও সোহংতত্ত্বের সবিশেষ বিচারের পরেও তাঁর সর্বশেষ সার কথাটি কয়ে গেছেন–গতিং গতিং ত্বমেকা ভবানী। তাবৎ শূন্য ভাঁড়ের ছিদ্রপথে নিজের গতিমুক্তি দিয়ে যেমন নিজেকে তিনি বিলিয়ে যেতে থাকেন, তেমনি থেকেও যান আবার–আশ্চর্য সেই কেকের মতই বুঝি, যা খাওয়া যায়, সবাইকে খাওয়ানোও যায়, তেমনি আবার হাতেও রেখে দেওয়া যায় সবখানাই।

টইটম্বুর মানস সরোবর আর ফাঁপা জলের কল সমান পাত্র না হলেও সমগোত্রই। দুজনেই জল যোগায়। কার জল কে জানে!

হাওয়ায় উড়তে উড়তে ইস্কুল থেকে ফিরলাম। এট্রেন্স-এর টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল সেদিন। কোনোরকমে পাশ করে গেছি।

 অথচ পাশ করার কোনো আশা ছিল না। ক্লাস টীচাররাই তো আমাদের খাতা দ্যাখেন। এগজামিনারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে আর জনে জনে জিজ্ঞেস করে সব কিছুর ফলাফল আগের থেকেই জানা ছিল আমাদের। কে কোন সাবজেক্টে কেমনতর মার্ক পেয়েছে, কার রেজাল্ট হয়েছে রিমার্কেল।

আমারটাও রিমার্কেবল বলতে হয়। আবার নতুন করে মার্ক দিতে হয়েছে আমায় একটা খাতায় অন্তত। আমার অঙ্কের খাতাতেই, বুঝতে পারলাম।

মার্কামারা সেই খাতাটি আমার-কার না জানা?

ভারতের সনাতন আর্যরাই সবপ্রথম সংখ্যার মধ্যেকার শূন্য-কে আবিষ্কার করেছিলেন শোনা যায়। সেই শূন্যকেই আমি পুনরাবিষ্কার করেছিলাম আমার অঙ্কের খাতায়, জেনেছিলাম আমি। বরাবর যেমনটি হয়ে এসেছে। আর, বরাবরই আমায়, কেন জানি না, ওপর ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়েছে।

অঙ্কে আমি চিরদিনিই কাঁচা। সাংখ্যযোগে চিরকালই আমার ঐ শূন্যলাভ! দেবী অঙ্কশায়িনী কোনোদিনই আমার মুখ তুলে তাকাননি। তাঁর সঙ্গে আমার শুধু মুখের সম্পর্ক।

বাণিজ্যার দোকানের গোল্লা নয়, গোল্লার মোকামে বাণিজ্য করে এবারকার এই পাল্লা উৎরে যেতে পারব সে ভরসা আমার ছিল না। স্বপ্ন দেখেছিলাম কত-যে। এখান থেকে পাশ করে বেরিয়ে কলকাতায় পড়তে যাব, সেখানকার কলেজে ভর্তি হব গিয়ে, সেই কলেজ, কোন কলেজে জানিনে–শুনেছি মাত্র, যেখানে নাকি ছেলেরা মেয়েরা এক সাথে পড়ে–কত মেয়ের সঙ্গে ভাব হবে আমার, কত সঙ্গিনী পাব- সুন্দর সুন্দর মেয়ে সব! বোনের মতই বা বন্ধুর মতই হল না হয়–সেই বা কী কম লাভ? ইংরেজি বাংলা যে বানানেই ধরিনে কেন! আগুনের কাছাকাছি থাকাটাই যে অনেক, আঁচ পাওয়া যায় তো! ছোঁয়াচ লাগেই। আলো আসে–ভালোবাসার ষোলো আনা নাই পেলাম! আলোকিত হই তো। দেহমন গরম রাখতে পারি। সেই কি কম?

মাথায় ওঠার নাই নাইবা দিল কেউ, নাও বা উঠলো মাথায়! একটুখানি মুখোমুখি হওয়ার সেই যে সুখ?

একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু গান শুনি-তাই নিয়ে মনে মনে কি ফাল্গুনীর মৌসুমী আনা। যায় না?

কারো পুরো মন যদি নাও পাই, গুঁড়ো মন তো পাবই; একমন যদি নাই হতে পারি কারো সঙ্গে, এক লি তো হবই। মনেক না হলেও সেই আমার অনেক। তিল তিল কুড়িয়েই না তিলোত্তমা?

তিল তিল তিল মন/মন্দির তাই নিয়ে। কিশা কণা চুম্বন/কনারক তাই দিয়ে। এ রচনা তো আমারই-তখনকার না হলেও ঢের পরের আমারই ছত্রখান সেই! আর, তিল তিল জমে ওঠা সেই যে তাল, তার পাল্লাই কে সামলায় তখন?

কিন্তু পরোক্ষে পাওয়া পরীক্ষার ফল জেনে সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল আমার। অশ্বমেধের দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে ছত্রপতি হবার আগেই আমার ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। কুরুক্ষেত্র কাত্তর আগেই মহাপ্রস্থান!

তখনই আমি মার কাছে শেখানো সেই প্যাঁচ খাটিয়ে মধ্যবিন্দুর মা বিন্দুবাসিনীকে স্মরণ করেছি, শরণ নিয়েছি তাঁর-মা, তরিয়ে দাও আমায় এযাত্রায়। এবার থেকে আমি খুব ভালো ছেলে হব তুমি দেখো। মন দিয়ে পড়াশুনা করব এখন থেকে। কলেজের ক্লাসে গিয়ে প্রসি-টসির ফাঁকি দেব না আমি একদিনও-তুমি দেখে নিয়ে।

তারই প্রতুত্তরে কি উৎরে গেলাম আমি?

মার প্যাঁচের সেই মারপ্যাঁচেই, নাকি বাবার খাতিরেই (যদিও জানি আমার উদাসীন বাবা কারো জন্য কোন কিছুর জন্যেই কখনো কাউকে অনুরোধ উপরোধ করতে যাবেন না কদাচ ) নাকি, ইংরিজি বাংলা ইতিহাস ভূগোল ইত্যাদির খাতায় একটু ভালো করেছিলাম বলেই কি আমায় এই তরিয়ে দেওয়া হয়েছে?

বাড়ি ফিরেই ঢিপকরে পেন্নাম ঠুকলাম মাকে, টেসটে অ্যালাউ হয়ে গেছি মা! এবার আমি কলকাতায় গিয়ে পড়ব তো? মালদা টাউনে তো কোনো কলেজ হয়নি এখনো।

তাই পড়িস। কলকাতার কলেজেই পড়বি তুই।

কো-এডুকেশনের কলেজে ভর্তি হব কিন্তু আমি?

তাই হোস, তার কী হয়েছে!

রিনিদের বাড়িতে থেকেই পড়বো তো মা?

পরের বাড়িতে থাকতে যাবি কেন রে?

মাসিমারা কি পর হয়ে গেল তোমার? আমি ফোঁস করলাম। আমার কাছে যে তা মোটেই পরের বাড়ি নয়, পরীর বাড়িই বরং, সে কথাটা আর ফাঁস করলাম না। গুরুজনদের সামনে কখনই রং সাইডে থাকতে নেই।

না, পর নয়, না হলেও…তাহলেও কেন তুই থাকতে যাবি সেখানে? হোসটেলে থেকে পড়বি তুই। তোর সমবয়সী আর সব ছেলের সঙ্গে সেই তো ভালো রে। ভালো কলেজে ভর্তি হবি, ভালো ছেলেরা সব পড়ে সেখানে, সেইসব ভালো ছেলেদের সঙ্গে এক হোসটেলে থাকবি তুই। কিন্তু…

কিন্তু কী মা? কিন্তু কিসের?

কিন্তু তা হলে তো তোকে ফার্স্ট ডিভিশনে খুব বেশিবেশি নম্বর রেখে পাশ করতে হবে রে। এই কমাস পড়তে হবে দারুণ। নভেল-টভেল পড়া, ঐসব ছাইভস্ম লেখাটেখা ছেড়েছুঁড়ে, তা কি তুই পারবি করতে?

কেন পারবো না মা? খুব পিরবো তুমি দেখো। পড়ার টেবিল ছেড়ে এক মিনিটের জন্যও আমি উঠব না। বেরুকটেরুব না কোথাও–দেখতে পাবে। দিনরাত পড়ব। ফাস্ট ডিভিশনে পাশ তো করবই-প্রথম দশজনের মধ্যে না হই, একশ জনের একজন তো হবোই।

তাহলেই হলো। তুমি একাই একশ। তোকে আর পায় কে তখন!

কটা মাস মা! এই কমাস আর পড়তে পারব না একটু কষ্ট করে?

কষ্ট কিসের! অভ্যেস হলে পড়ায় মন বসে গেলেই দেখবি পড়ার মতন আনন্দ আর হয় না। কী ভালোই লাগে যে পড়াশুনা করতে। দেখতে পাবি তখন।

তাই তো চাই মা আমি, ফি বছরই তো ফেল করতে করতে কোনো গতিকে পাশ করে প্রতিজ্ঞে করি যে, এর পর থেকে একমনে পড়ব আমি একটানা পড়ে যাব। কিন্তু কী করে যে সব গুলিয়ে যায় মা, কোত্থেকে এত ফ্যাকড়া জোটে কিছুই হয় না আমার।

এবার হবে তোর। ভালো কলেজে পড়বি, ভালো হোসটেলে থাকতে পাবি-হতেই হবে তোর এবার। ভালো কলেজে ভালো ভালো ছেলেরাই পড়তে যায়, পড়তে পায়-ফার্স্ট ক্লাস-ফার্স্ট মাস্টাররাই সব পড়ায় সে কলেজে, যত জজ ম্যাজিস্ট্রেট ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ারের ছেলেরাই পড়ে সেখানে-বড় হয়ে তারাও তাই হবে সবাই। তাদের সঙ্গে পড়বি তুই। কেবল পড়াশুনাটাই সব নয় রে, সঙ্গটাও চাই সেইসঙ্গে আবার!

চাই বই কি মা। সোৎসাহে সাড়া দিই : সঙ্গটাই তো আসল। …মধুর বৃন্দাবন মাঝমধুর মধুর রসরাজ/মধুর যুবতী জনসঙ্গ-মধুর মধুর রসরঙ্গ! …পদাবলী আওড়াই। মনে মনেই। বলেই মনের জিভ কেটে ভুল শুধরে নিই তক্ষুনি ক্ষণমিহ সজ্জন সঙ্গতি রেকা/ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা। নিশ্চয় মা।

বিপদাবলীর থেকে সাত পশ্চাদপসরণ আমার তৎক্ষণাৎ।

হ্যাঁ, সঙ্গতির জোরেই তরে যায় মানুষ। সঙ্গ গুণেই সৎ মহৎ হয়, আবার সঙ্গদোষেই অধঃপাতে যায়। এই জন্যেই বলে, পড়াবি তো পড়া পো, নইলে সহবতে থো। ছেলেকে যদি তোর লেখাপড়া শেখানোর সাধ্যি না থাকে, অন্তত তাকে ভদ্রজনের সহবতে রাখ–তাহলে সভ্য আদবকায়দা শিখে ভদ্র চালচলনে রপ্ত হয়ে একদিন না একদিন সে নজর টানবে সবার, প্রশংসা করবে সবাই–তার পেটে বিদ্যে কী আছে না আছে, দেখতে যাচ্ছে কে? তার পরে যদি কখনো কোনো মহৎ জনের নেকনজরে পড়ে যায় এক চোটেই, হিল্লে হয়ে যাবে তার।

হ্যাঁ, মা।

বড় কলেজে বুঝলি, বড় বড় ঘরের ছেলেরা সব পড়ে তাদের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা হয়ে গেলে ভাবনা কি তোর? তারা বড় হলে উঁচুতে উঠলে তোকেও ওপরে টেনে তুলবে। তাদের সমকক্ষ করে নেবে। নীচে পড়ে থাকতে দেবে কেন? আগেকার বন্ধুদের ওপর কি টান থাকবে না তাদের?

থাকবে বই কি মা! আমারও কি টান নেই নাকি?

তোর আবার কার ওপর টান রে?

আমিও আমার বন্ধুদের টেনে তুলব সব! দেখো তুমি। বিষ্টু-টিটু, কাবিল হোসেন টোসেন কাউকে বাদ দেবো না নিশ্চয়।

তাই তো করতে হয়। ওঠা যেমন ভাগ্যের কথা, অপরকে টেনে তোেলা আরো বড়ো ভাগ্যের। ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে অপরকেও ওঠাতে হয়, নইলে তারাই একদিন টেনে নামিয়ে ছাড়ে-তুলে আছাড় মারে আবার! ঐ নিচুতলার মানুষগুলোই!

কবিও তো তাই বলে গেছেন মা! যারে তুমি নিচে ফ্যালোসে তোমাকে টানিবে যে নিচে। পশ্চাতে রেখেছে যারে/সে তোমারে পিছনে টানিছে।

সবাই মিলে উঠতে হয়–সবার সাহায্য নিয়ে সবাইকে সাহায্য করে। এই দুনিয়ার নিয়ম। পরের সাহায্য নিয়ে তবেই লোকে দাঁড়ায়। চলতে শেখে, এগুতে পারে। পরস্পরের ধাক্কায় পরস্পর এগোয়। সবার সাহায্যে সবাই ওঠে। এখানে বাঁচতে হলে, সভ্যসমাজে বাস করতে হলে, কাউকে না হলে কারু চলে না। তুই যার সাহায্য পেলি তাকে যদি ফিরে ফের সাহায্য করার সুযোগ নাও পাস, অন্য কাউকে সাহায্য করে তার প্রতিদান তোকে দিতে হবে।

তা তো হবেই। আমিও তো তাই চাই মা। সবাইকে নিয়ে সবার সঙ্গে উঠতে চাই আমি।

তা যদি চাস তো এখন থেকেই পড়াশুনায় লাগ। ফাঁকি দিসনে আর। এক পা এক পা করে এগুতে হয়–এগুতে থাক তাহলে।

নিশ্চয় মা। এখন থেকেই পড়াশুনায় লাগব মা উঠে-পড়ে, দেখো। বলেই আমি উঠি–এখুনি আমি পড়ার টেবিলে গিয়ে বসছি, দ্যাখো না! তোমার আশীর্বাদে আমার সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি দেখো।

বলেই মার পায়ের গোড়ায় আমার আরেক টিপ। (কিন্তু ঐ টিস্কারের সঙ্গে যে দৈবের ধিক্কার ছিল তা কে জানত!)

না, এবার থেকে তৎপর হতে হবে আমায়। পড়াশুনায় যারপরনাই মন দিতে হবে। অবহেলা করলে চলবে না আর। অনেক দায় আমার ঘাড়ে…বড় দুঃখ বড় দৈন্য, সম্মুখেতে কষ্টের সংসার…ইত্যাদি ইত্যাদি…কবির বাণী মনে পড়তে থাকে ক্ষণে ক্ষণে।

মার কৃপায় যখন ত্রাণ পেয়ে গেছি ঐ যাত্রায়, তখন আর আমায় পায় কে! কিন্তু এক একবার কোনরকমে উৎরে গেলেই তো চলবে না, অনেক উত্তরণ আমার সম্মুখে। শুধু আমার উত্তরণ নয়, অনেকের। অনেকের সহিত আমার।

কিন্তু হায়, ভাগ্যের বিড়ম্বনায় সেই উত্তরুণ যে প্রায় দাক্ষিণ্য লাভের ন্যায়ই দুর্ঘট। এক সঙ্গে সকলের উত্তারায়ণ, সে তো আরো অনেক দূর। তাছাড়া…

তাছাড়া, ভ্রুসন্ধানে মা বিন্দুবাসিনীর করুণাবিন্দু তখনকার মতন পেলেও ক্ষণেকের জন্যে বারেক মা মুখ তুলে তাকালেও সেই কৃপাকটাক্ষের আড়ালে যে তাঁর ভ্রুকুটিও থেকে গেছে তা কি আর জেনেছি তখন! কতো কীই জানার বাকী ছিল যে! . আমার ওই ভিরকুটিতে যে তিনি ভুলবার পাত্রী নন, জানি কি তখন!

.

৩৩.

 ইংরেজ রাজার বিরুদ্ধে অহিংস লড়ায়ের স্বেচ্ছাসৈনিক হয়ে ইংরেজবাজারে পা দিতেই শহরের বড় রাস্তার ধারে ধারে সারে সারে খাজার দোকান নজরে পড়ল আমার।

খাজা কথাটার মধ্যেই যেন একটা আমন্ত্রণ রয়ে গেছে-যদিও ওই রাষ্ট্রভাষাতেইখানে, খেয়ে যাও! খা যা তো বটেই, কিন্তু কাছে গিয়ে হাজার হাঁ করলেও যে একখানা পাওয়া যাবে,-মুখে তুলে দেবে কেউ-তা আমার মনে হয় না। এ তো আর চাঁচলের সেই বাণিজ্যার দোকানের অবাধ বাণিজ্য নয়। এখানে টাকা বাজালে তবেই নাকি খাজা মেলে। কিন্তু কোথায় আমার টাকা যে!

খোঁজখবর নিয়ে স্থানীয় কংগ্রেস কার্যালয়ে পৌঁছতে দেরি হোল না। টাউনের তখনকার প্রথম সারির উকীল বিপিনবিহারী ঘোষ মশাই মালদার কংগ্রেসী পান্ডা, একটুখানি খোঁজ খবর পেলাম, আর খবর নিতেই না তাঁর নাম ঠিকানা মিলে গেল তক্ষুনি।

তাঁর কাছে গিয়ে আমার পরিচয় দিয়ে আগমনের কারণ জানাতে তিনি বললেন- তা বেশ-বেশ তো। তোমার বাবাকে আমি ভাল রকম জানি-সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেনি যদিও। আরো কিছু কিছু ছেলে এসেছে এই জেলার এখা-সেখান থেকে তোমাদের ওধার থেকে এখনও কেউ আসেনি তেমন। তুমিই। প্রথম। তবে আসবে সব, এসে পড়বে সবাই। দেশের ডাকে সাড়া না দিয়ে কি থাকতে পারবে কেউ?

মনের দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর কথায় ব্যক্ত হয়।

সেই ছেলেরা সব কোথায়, যারা এসেছে আরো? আমি জানতে চাই।

স্বরাজ কুটীরে রয়েছে সব। স্বেচ্ছাসেবকদের জন্যে একটা ছোটখাট বাড়ি নেওয়া হয়েছে তো-সেখানেই আছে। সেখানেই তাদের খাওয়াদাওয়া থাকা। সেখানেই পাবে সবাইকে।

কী করে তারা?

চরকা কাটে, মদের দোকানে, বিলিতি কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করে, পথে পথে গান গেয়ে তিলক স্বরাজ ভাভারের চাঁদা তোলে–এই সব আর কি। আপাতত এই। এর পর দাশ মশাই এসে আমাদের যেমন নির্দেশ দেবেন তাই হবে।

কবে আসবেন দাশ মশাই? আমি শুধাই।

আগামী হপ্তায়। তার টেলিগ্রাম এল এই মাত্র।

খুব–খুউব ভালো! খবরটা এমন ভালো লাগে আমার।

এখন যাও, আমার লোকের সঙ্গে গিয়ে স্বরাজ কুটীরটা দেখে এসো গে। ওখানে আরো সব স্বেচ্ছাসেবক আছে না? প্রায় তোমার বয়সীই সবাই। তাদের সঙ্গে তোমার ভাব হবে–তাদের সঙ্গেই থাকবে, কাজ করতে হবে তো?

কী করতে হবে আমায়?

তোমাদের ক্যাপটেন যা বলবেন। চরখা-টরখা কাটতে হবে, পিকেটিং-টিকেটিং-এই সব আর কি। তবে ওখানে রাত্তিরে থাকতে হয়ত কস্ট হবে তোমার। মাটিতে চাটাই বিছিয়ে শোয় কিনা ওরা। তোমার তো অভ্যেস নেই। কোনো চৌকি তক্তপোষ নেই ওখানে। তবে রাত্তিরের খাওয়াটা সেখানে সেরে এখানে আমার বৈঠকখানায় এসে শুয়ো তুমি বরং। কেমন?

এই বিরাট তক্তপোষে? ঘরজোড়া বিস্তারের দিকে আমার অঙ্গুলি বিস্তারিত।

হ্যাঁ। এখানেই দিনে আমার দপ্তরখানা বসে আমার কোর্ট-কাঁচারির কর্মচারী, মুহুরি, তশিলদার সবাই বসে কাজকর্ম করে এখানে সারাদিন। রাত্রেও আমার জনকয়েক কর্মচারী শুয়ে থাকে। তুমিও শুয়ে থাকবে এদের মধ্যে এক পাশটিতেও। অনেকখানি জায়গা। শোয়র কোনো কষ্ট হবে না তোমার। তোমার মতন নজন শুতে পারে এই বিছানায় অক্লেশে। বুঝলে?

ছখানা তক্তপোষ জোড়া নজনের শোবার মত বিছানার সেই নয়-ছয় ব্যাপার–বাস্তবিক, চেয়ে দেখবার মতই।

বিকেলে তো কিছু খাওনি তুমি? ট্রেন থেকে নেমেই চলে আসছ তো? কোনো দোকান থেকে কিছু মিস্টি-টিস্টি কিনে খাও গে। তারপরে স্বরাজ কুটীরে রাত্রের খাওয়াদাওয়া সেরে এখানে চলে এসো, কেমন?

তিনি একটা টাকা দিলেন আমায়।

টাকাটা হাতে আসতেই আমি রাজা! সোজা চলে গেলাম এক খাজার দোকানে।

তিনি একজন লোক দিয়েছিলেন সঙ্গে স্বরাজ কুটীর দেখিয়ে দেবার জন্য। রাস্তায় নেমে, খানিকটা গিয়েই না, প্রায় মাছির মতই ভাগিয়ে দিলাম সেই লোকটাকে। পাছে খাজার ভাগ দিতে হয়, মাছির মতই আমার খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে শেষটায়।

দরকার হবে না। খুঁজে নিতে পারব তোমাদের স্বরাজ কুটীর। যেমন করে বিপিনবাবুর খোঁজ নিয়ে এলুম না আমি–তেমনি করেই খুঁজে নেব। বাতলে বিদায় করে দিলাম লোকটিকে।

খাজায় পেট বোঝাই করে স্বরাজ কুটীরে গিয়ে হানা দিলাম তারপর।

প্রায় আমার সমবয়সী জনকয়েক ছেলে প্রকান্ড একটা থালার চারধার ঘিরে বসেছিল নারকেল আর মুড়ি নিয়ে।

আমিও ভাই তোমাদের একজন ভলান্টিয়ার। এখানে এলাম আজ। নিজের খবর জানালাম।–থাকব তোমাদের সঙ্গে এখানে।

বাঃ বাঃ! বেশ বেশ! সবাই ওরা উৎসাহিত–এসো, বসে পড়ো আমাদের সঙ্গে। থালার এক পাশে একটুখানি জায়গা করে নিলাম।

পেট আমার বেশ ভর্তি আছে, তাহলেও নারকেল মুড়ি খেতে আমার আপত্তি নেই। বলতেই না বসে পড়লাম, খাবার ওপর টান আমার বরাবর–কোনদিনই তা যাবার নয়। খাদ্য অখাদ্য যাই হোক না, পেলেই খাই।

পেলেই খাই, আর খেলেই পাই–এই কথাটাই সব কিছু মিলিয়ে সারা জীবন ধরে জানা আমার।

আত্মসাতের দ্বারা আপনার মত করে না নিলে কিছুই যেন আর আপনার হয় না, এই দুনিয়ায়।

খেতে খেতে পরস্পর জানাশোনা হোলো। মালদা জেলার নানা জায়গা থেকে তারা এসেছিল। আরো আরো ছেলে আছে এখানে, পিকেটিং করতে তারা বেরিয়ে গেছে এখন। ওদের মধ্যে ভূপেন ঝা একজন ছিল, কালিয়াচক না মানিকচক কোন্ থানার, আলাপ হোলো তার সঙ্গে। উদ্দীপ্ত চেহারা ছেলেটার-দেশপ্রেমে জ্বলছিল যেন মনে হয়। কেবল তার কথাটাই এখনো আমার মনে আছে। কাঠখোট্টা জ্বলন্ত ঐ চেহারার জন্যই বোধহয়।

জলযোগের পরই ভূপেন ঝা সুতো কাটতে বসে গেল। চরখায় মন দিল আপনার।

চরখা কাটতে জানো? শুধালো সে আমায়।

 একদম না। খাই দেখিনি সাত জন্মে। এই প্রথম দেখছি।

কাটবে?

 দেখি পারি কিনা।

কেমন করে কাটছিল সে, লক্ষ্য করেছিলাম। সেইভাবে তুলোর পাঁজ নিয়ে টাকুর মুখে লাগিয়ে পাক দিতেই না লম্বা এক সূত্রপাত হয়ে গেল প্রথম চোটেই।

কয়েক টান টেনেই না অরুচি ধরে গেল আমার–প্রথম সিগ্রেট টানার সেই অভিজ্ঞতার মতই।

না, একটানা কোনো কিছুরই টানাপোড়েনে আমি নেই। তাতে সুতোর বা কোনো জুতোর টান যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক না, আমার নিজের পক্ষে সেটা যেন পোড়েন বলেই মনে হয়। অকারণে বিদগ্ধ হতে আমি রাজী নই।

বাঃ, বেশ ফাইন সুতো হয়েছে তো? আগে প্র্যাকটিশ করা ছিল বোধ হয়?

 দেখিইনি কখনো চরখা এর আগে, বলছি না?

তাহলে হোলো কি করে এই? তার বিশ্বাস হয় না-প্রথমেই চরখার এমন হাত তত দেখা যায় না ভাই! কতোবার সুতো ছিঁড়ে যায়, কতো সরু মোটা সুতো বেরয়…

 এটা একরকমের হাত সাফাই ভাই। মার শেখানো একটা প্যাঁচ জানা আছে আমার তাতে শুরু করতেই না, সব কিছুই আমার সুরৎ করে হয়ে যায় অমনি। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তারপর আর হয় না, হয় হয়ত, কিন্তু হওয়াতে আর ইচ্ছে করে না আমার।

ইচ্ছেই করে না?

না। জেনে নিলাম, পেয়ে গেলাম, ফের কেন আবার সেটা? তারপর অন্যটায় হাত বাড়াতে প্রাণ চায়।

সে আবার কী? সে বুঝতে পারে না ঠিক।

ঐ রকম। সাইকেল চড়া তো গোড়ায় কত হপিং করে প্যাড করে পরের সাহায্য নিয়ে, বার বার আছাড় খেয়ে শিখতে হয়,-হয় না? আমি প্রথমে সাইকেলের সীটে বসেই না অবলীলায় চার চক্কর ঘুরেছিলাম, কারো সাহায্য না নিয়েই…।

বলল কি হে?

তারপর সাইকেল সমেত এমন এক আছাড় খেলাম না কাটা ঝাড়ের ওপর গিয়ে! ব্যস, সেইদিনই, সেইখানেই আমার সাইকেল চড়া খতম। আর কোনোদিন ভুলেও তার ওপর চড়াও হইনি।

বুঝলাম। তাহলে ওই গোড়াতেই যা হয় তোমার, শেষরক্ষা হয় না আর?

হ্যাঁ, ভাই। সিদ্ধিলাভ হয় না আমার কোন কিছুতেই শেষ পর্যন্ত। বরাতে আমার সিদ্ধি নেই, ধাতেও না। মা বলে, সাকসেস কখনো ফাঁকতালে পাওয়া যায় না রে, তার জন্যে সাধনা চাই।

চাই-ই তো। কথাটার ওপর জোর দেয় ভূপেন।

ওই সাধনা করইে আমি চাইনে, ভালোই লাগে না আমার। আমি জানাই-না, কোনো কিছুর বা কারুর ওই সাধ্য-সাধনায় আমি নেই।

তাহলে তো জীবনে তোমার কোনো সাকসেসই হবে না দেখছি। কথাটা বলে সে গুম হয়ে যায়।

হবেই না তো, সে আমি ভালোই জানি। ফাঁকতালে যা হবার তাই শুধু আমার হবে। বাবা বলেন, যোগঃ কর্মসু কৌশল! ওই কৌশলের যোগাযোগে যা হয় তাই।

ফাঁকি দিয়ে কিছুই হয় না ভাই! চালাকির দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয় না–বলেননি বিবেকানন্দ? সে গুমরায়।

কোনো মহৎ কাজ করতে চাইনে তো আমি। কোন কিছুর সিদ্ধি-ফিদ্ধি চাইনে আমার। কোনো কিছুই পুরোপুরি পেতে চাই না, কেবল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে চাই। পরমহংসদেব সিদ্ধাই চাননি, চাইতে মানা করেছেন। আমি কিন্তু ভাই ওই সিদ্ধিও চাই না, তার ওপরেও আরেক কাঠি।

ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা বলছ?

হ্যাঁ। পড়োনি তুমি শ্ৰীম কথিত কথামৃত পাঁচ ভাগ।

না ভাই। পাবো কোথায়? আমাদের গাঁয়ে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কেবল পাঁজিই এক মাত্র পড়বার। তাই আমার একশো বার পড়া হয়ে গেছে অনেক কিছু জানা যায় কিন্তু তাই থেকেই। তা জানো?

পাজির পা-ঝাড়া ওর বিদ্যাবত্তার এই বহর জেনে আমার হাসি পায়। কিন্তু আমি হাসি চেপে রাখি।

হাসবার আমার কী আছে? ওর তবু পাঠ্যপুস্তকগুলো ভালো করে পড়া, আমি তো তাও দুইনি কখনো। এক পেয়ালার বিদ্যেকে কি এক কেটলিমাত্র বিদ্যাধরের কটাক্ষ করা সাজে?

সিদ্ধিও চাও না তুমি? কোনো কিছুতেই না? আশ্চর্য!

এইজন্যেই চাইনে যে, যেখানেই আমার সিদ্ধি হোলো সেখানেই তো আমি জমে গেলাম। মজে গেলাম তাইতেই। কিন্তু তাতে ভাই আমার মজা নেই। সেই আমার যমালয়। সেখান থেকে আর গতিমুক্তি নেই আমার। এই হেতুই এমন কি, তোমার ওই ভগবৎ সিদ্ধিও চাইনে আমার।

চাইলেই যেন পাওয়া যায় ভগবানকে? আমার কথায় সে হাসে।

 হাসবার কথাই বটে। আমিও হেসে ওড়াই কথাটাকে-হাজার চাইলেও পাওয়া যায় না ভাই! হাজার মাথা খুঁড়লেও নয়। কেউই পায় না-হাজার সাধ্যসাধনাতেও। মাঝখান থেকে যা পাবার, যাকে পাবার তাও হারায়-বুঝলে ভাই? সত্যি বলতে, পাওয়াই যায় না ভগবানকে। আমরা কখনোই পাইনে, ভগবানই আমাদের পান। তিনি পেলেই হয়। তখন না চাইলেও…না চাইতেই পাওয়া যায় তাঁকে। তাই আমি ভগবানের পেছনে ঘুরিনে, তাঁকে চাইতে যাওয়া বিলকুল বৃথাই তো!

কী চাও তুমি তবে শুনি?

আমি অনেক অনেক অনেক সিদ্ধি চাই, অনেক রকমের সিদ্ধি সাফল্য–কিন্তু তা কেবল ক্ষণেক ক্ষণে ক্ষণেকের জন্যেই। এক জীবনে হাজার রকম বাঁচাই আমার চাই।

না সিদ্ধি চাও নাই চাইলে, চরখা কিন্তু আমাদের সাধতেই হবে। নিজের চরখার প্রতি সে চাড় দেখায় আবার : মহাত্মাজী বলেছেন। রেখা কাটতে আমরা বাধ্য। তুমি কাটবে না?

 আমার চরখা নেই? ও তো তোমার চরখা?

হলই বা। কাটা নিয়ে কথা।

পরের চরখায় কি তেল দিতে আছে? নিজের চরখায় দিতে হয়। যাই, একটুখানি বেড়িয়ে আসি বাইরে। হাওয়া খাইগে। তোমাদের শহরটা ঘুরে ফিরে দেখা যা একবার।

চক্রবর্তীদের চরখাবর্তী-করা সহজ নয়। চরখার চক্রান্তে না পড়ে আমি শহরের চক্করে বেরিয়ে পড়লাম।

মহানন্দার পাড় হয়ে তার ধার ধরে ঘুরে এলাম একবার। শহরের রাস্তাগুলো চষে ফেলা হলো বার দুয়েক। তারপরে চলে গেলাম বিখ্যাত সরকারী ইস্কুলবাড়ি দেখতে। জেলার স্কুল বোর্ডিং-এর চত্বরে গিয়ে পড়লাম।

জেলার সব ইস্কুলের ছেলেরা জমবে এসে এখানে যথাসময়ে-কদিন বাদেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আসবে যখন।

বিষ্টুও আসবে আর সব ছেলের সঙ্গে পরীক্ষার্থী হয়ে। এখানেই সীট পড়বে, এই হোটেলেই এসে থাকবে তারা।

আমিও আসতাম। আলাউ হয়েছিলাম তো। কিন্তু আমি আর আসব না। আডমিট কার্ড নিইনি

তবে বিষ্টুকে দেখতে আসব এখানে নিশ্চয়–যদি সে সময় আমার এই শহরে থাকা হয়।

যে-পরীক্ষা কোনদিনই দিতে চাইনি, দিতে ভালোই লাগত না, দিলাম না–সেই পরীক্ষার জন্যই, কেন জানি না, কেন যেন মন কেমন করে।

যাক, আসছে বছর আমি দেবো নিশ্চয়–দেশ যদি এর মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যায়। হবেই তো স্বাধীন। এবং পড়ও আবার। কো-এডুকেশনের কলেজেই পড়ব তারপর কলকাতায় গিয়ে, মা তো বলেই দিয়েছে।

রিনির সঙ্গেও দেখা হবে আবার। চাই কি, রিনিকেও হয়ত সেই কলেজেই পেতে পারি সেই সময়। কিছু কি বলা যায় কখনো?

কী দেখছ এখানে? হোসটেলের একটা ছেলে গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে আমায়।

দেখছিলাম। এই ইস্কুলেই আমাদের পরীক্ষার সীট পড়বে তো? থাকতে হবে হয়ত এখানে, দেখতে এসেছিলাম তাই।

তুমি বুঝি এগজামিনী?

ছিলাম বটে, কিন্তু এখন আর নই।

 ছেলেটি আমার কথায় একটু অবাক হয়, কিন্তু তারপর আর কিছু জানতে চায় না, তার বন্ধুর সঙ্গে গালগল্পে মশগুল হয়ে চলে যায়।

সেখান থেকে ভারি মন নিয়ে বিপিনবাবুর বাড়ি ফিরলাম।

মনের সেই ভার আজও বুঝি যায়নি এই-আমার। মনের সেই বোঝা আজ বোধহয় আমার অবচেতনায় গিয়ে বোঝাই হয়েছে। এখনো মাঝে মাঝে বই বগলে ইস্কুলে যাবার বিরাট হলে বসে আরো সব ছেলের সঙ্গে পরীক্ষা দেবার স্বপ্ন আমি দেখি। যে-পরীক্ষা পাশ করতে পারলাম না, যে পড়া আমার পাশ কাটিয়ে গেল, আমার ঘুমের ঘরে চারপাশ থেকে এসে তারা হানা দেয়… আমায় উতলা করে তোলে বুঝি!

স্বরাজ কুটীরে ফিরে যাইনে আর-রাত্রের খাবার জন্যে। খাজা খেয়েই পেট ভরে ছিল, তার ওপর আরো ভর্তি করার দরকার ছিল না কোনো, মনের ভার নিয়ে বিপিনবাবুর দরাজ বৈঠকখানায় নিজের দেহভার রাখি। ঢালাও বিছানার ওপর ঢেলে দিই আপনাকে।

সকালে উঠে মুখ হাত ধুয়েই না, চলে যাই সেই স্বরাজ কুটীরে। স্বেচ্ছাসেবকদের সবার দেখা পাওয়া গেল সেদিন। একেকট্টা খোরা সামনে নিয়ে প্রাতরাশে বসে কী যেন খাচ্ছিল সকলে।

কী খাচ্ছো ভাই তোমরা?

 ভূপেনকেই শুধাই। কাউকে কিছু খেতে দেখলেই কেমন যেন খিদে পেয়ে যায় আমার।

 এই যে চক্রবর্তী! এসো এসো। আমাকে দেখেই সম্বোধন করেছিল সে, এখন আমার কথার জবাবে শুধালো, পান্তা ভাত। খাবে তুমি?

পান্তা ভাত! সে আবার কী ভাই? খেতে কেমন?

অবাক হচ্ছ দেখছি। আমার জিজ্ঞাসায় ভূপেনরা সবাই হতবাক।–চরখা না হয় নাই দেখছো কিন্তু পান্তার নামও কি শোনোনি নাকি কখনো?

শুনব না কেন? নুন আনতে আনতেই যা ফুরিয়ে যায় সেই পান্তা তো? নুন আনতে পান্তা ফুরোয়-বলেই দিয়েছ কথায়। আমি কই-তা তোমরা সবাই নুন নিয়ে বসেছ তো?

নুন! অঢেল অঢেল! কতো চাই তোমার? সে জানতে চায়- খাবে চারটি পান্তা? যা খিদে পেয়েছিল তখন আমার–একবার সাধিলেই হয়।

খাব বই কি! চোখে না দেখতে পারি কিন্তু চেখে দেখতে আপত্তি নেই। তা, এই পান্তাটা হয় কী করে শুনি? কী করে বানাও তোমরা?

কালকের রাত্তিরের বাসীভাত জলে ভিজিয়ে রেখে দিলেই হয়, সকালে পান্তা হয়ে থাকে। ভাত কি নষ্ট করবার? বাড়তি ভাত ঐ করে রেখে দেওয়া হয় তাই। সকালে উঠে না, নেবুর রস আর তেঁতুল দিয়ে খেতে যা খাসা! কী বলব–আহ!

ভূপেনের জিভের জল গড়িয়ে পড়ে খোরার উপরে সেই পান্তনিবাসে।

বাসী ভাত খেলে তো অসুখ করতে পারে? না খেয়ে তা বিলিয়ে দিতে পারো বরং। কোনো ভিখিরিকে দিয়ে দিলেই হয়।

ভিখিরি-টিখিরি কেউ নেই এ মূল্পকে। কোথায় পাবো ভাই ভিখিরি?

তা বটে! আমাদের চাঁচলেও কোনো ভিখিরি দেখা যায় না প্রায়। বৈরিগি আছে বটে, তবে তারা তোমার ভিখিরি নয়। ভিক্ষে করে না তারা, খঞ্জনী বাজিয়ে গান গায়, মাধুরী করে, তারা সব বোষ্টম।

না, বৈষ্ণরা ভিখিরি নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায়। জানি আমি। ভূপেন প্রকাশ করে।

আমার মামাও বৈষ্ণব। আমি জানাই। বামুন হলেও বৈষ্ণ। তবে বোষ্টম নন, বৈরিগি হননি। হরিনাম করেন, কীর্তন গান, কর্তাল বাজান। কর্তাল-ভজা না কর্তাভজা কী যে বলে থাকে, সেই সম্প্রদায়ের কেউ হবেন বোধ করি।

সব জাতের থেকেই বৈষ্ণব হওয়া যায় তো। ভূপেন বলে : বামুন, কায়স্থ, বৈদ্য, হাড়ি মুচি ডোম সবাই হতে পারে। এককালে মুসলমানরাও হতো নাকি শোনা যায়। তাদের লেখা গানের পদও আছে নাকি অনেক।

তাই নাকি? তা হবে হয়ত। বৈষ্ণ পদাবলীর মধ্যে আমি পাইনি কিন্তু। তবে মামা বলতেন বটে, বৈষ্ণব চিনিতে নারে দেবেরো শকতি। দেবতাদেরও খ্যামতা নেই যে বৈষ্ণবকে চিনতে পারে।

সে কথা সত্যি। ভূপেনের সায় আমার কথায়।

 চিনতে পেরেছেন শুধু বিষ্ণু ঠাকুর। সেই চিহ্ন তিনি নিজের বুকে নিয়ে রয়েছেন। ভৃগুপদচিহ্ন।

আর চিনেছো তুমি! একটা ছেলে ঠাট্টা করে আমায় শালুক চেনেন গোপাল ঠাকুর।

ততক্ষণে ভূপেন আমাকেও এক খোরা বেড়ে দিয়েছে। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে, ছেলেটার কথা গায়ে না মেখে, নুন দিয়ে নেবুর রস মাখিয়ে পান্তা ভাত চাখতে লেগেছি।

সত্যিই তোফা! বাড়ি থাকতে–আমাদের প্রত্যহের প্রাতরাশ বাবার সেই মহাপ্রসাদ, রসগোল্লা কোঁচানো সেই পুরু দুধের সরের চেয়ে জলভাতের এই ঠাণ্ডা সরোবর আস্বাদে কোনো অংশে কম যায় না। সে যদি সুধাস্বাদ হয় তো এও অমৃতই।

তুমি বলছিলে না যে বাসী ভাত খেলে অসুখ করে-ভিখিরিদের দিয়ে দিলেই হয়। বলছিলে না তুমি? কিন্তু এই ভারতের সবাই তো আমরা ভিখিরি ভাই! ইংরেজ তো সব লুটেপুটে নিয়ে গেছে, কিছু কি ফেলে রেখে গেছে আর? তাছাড়া যে জিনিস তুমি নিজে খেতে পারো না তা কি ভিখিরিদের দেওয়া উচিত? ভিখিরিরা কি মানুষ নয়? এই দেশেরই মানুষ তো! এই ভারতবর্ষেরই তারা। বলতে গেলে তারাই ভারতবর্ষ। এদেশের শতকরা পঁচানব্বই জনই তো দরিদ্র অন্নহীন। তাদের জন্যই তো স্বাধীনতা চাই আমাদের। স্বরাজের জন্যই তো আমাদের লড়াই? সে স্বরাজ তো ওদের জন্যই ভাই। গান্ধীজী কপনি পরেন কে? দেশের পঁচানব্বই জনই ঐ কপনি-পরা–তাই বলেই। সেটা কি তুমি বোঝ না ভাই? বলতে গিয়ে ওর পিঙ্গল উজ্জ্বল চোখ যেন জ্বলতে থাকে আরো। সেই চোখের আলোতেই আমার স্বদেশবাসীদের যেন আমি দেখতে পাই আজ নতুন করে আনকোরা আরেক রূপে।

আর তাছাড়া, দেশ কি তোমার ঐ ম্যাপটা? ভারতবর্ষের ম্যাপটা কি আমাদের দেশ নাকি? ভারতের মানুষ নিয়েই তো ভারতবর্ষ–এমন কি, ভারতের গরু ছাগল ভেড়া সব নিয়ে, বাঘ সিংহ গণ্ডার উলুক সমস্ত। তার নদ নদী পাহাড় পর্বত তাও। এর সবটাই আমার ভারতবর্ষ। সবার স্বাচ্ছন্দ সবার সার্থকতাই আমরা চাই। তাই-ই আমাদের স্বদেশ সাধনা ভাই!

যার খোঁজে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলাম, আজ এই পান্তার তেপান্তরে এসে সেই রাজকন্যা—একদা রাজরাজেশ্বরী এখন ভিখারিণী আমাদের সেই দেশমায়ের সন্ধান যেন পাই আমি–ভুপেনের ওই কথায়।

.

৩৪.

সেই ভুপেনের সঙ্গে আমার দেখা হল আবার বছর কয়েক আগে, এই কলকাতাতেই।

রাস্তায় হঠাৎ মুখোমুখি।

দেখেই সে চিনতে পেরেছে-আরে, চক্রবর্তী যে! কেমন আছ ভাই?

আর, সঙ্গে সঙ্গে সেই সেকেলে ধরনের কোলাকুলি এই একেলে শহরের মাঝখানে আমাকে দেখেই না!

আমিও তাকে চিনেছিলাম। বয়সে হয়ত একটু বুড়িয়ে গেলেও, রুক্ষ সূক্ষ্ণ চেহারায় সেই উজ্জ্বল পিঙ্গল চোখ তত ভোলবার নয়।

যেমন দেখছ? বললাম আমি। অনেকদিন পরে দেখা হল, ভালো আছ তো বেশ? আমি জিগ্যেস করি।

আর ভালো! সে নিশ্বাস ফেলল–ঐ আছি একরকম। কী করছ ভাই এখন?

যা করতাম তাই। লিখিটিখি। লিখে খাই আর খেয়ে লিখিলিখেটিখে চালাই। চলে যায় একরকম। তুমি কী করছ এখন?

সে কথার জবাব না দিয়ে সে শুধায়–ছেলেপিলে কটি হোলো?

 বিয়েই করিনি তো ছেলেপিলে! আমি হাসলাম।

কেন, বিয়েটিয়ে করলে না কেন?

 লিখেটিখে চালাই কোনোরকমে। নিজেই খেতে পাই না তো ছেলে বৌকে কী খাওয়াবো? আমি জানাই : বে-থা করিনি তাই ছেলেপিলের কোনো ব্যথাও নেই-সংসার-যন্ত্রণা নাস্তি!

সংসার-যন্ত্রণা যা বলেছো! স্ত্রীপুত্রের অসুখবিসুখ লেগেই রয়েছে। সেই জন্যেই তো আসা আমার এই কলকাতায়। বিধান রায়ের কাছে।

বিধান রায়?

হ্যাঁ, তিনি ছাড়া দেখবার আর কে আছে আমাদের? বিধানবাবুকে জানো তো?

জানি না? ঘাড় নাড়লাম আমি। খুব জানি।

-বিধানবাবুর গুণগরিমা আমারও অজানা ছিল না। জানতাম যে সঙ্কটকালে তিনি ছাড়া বিপত্তারণ বিপদবারণ কেউ নেই বিশেষ। যার কাছে নেবার তিনি ঠিকই নেন, আবার যাদের দেবার ঠিকঠিকই দেন। অভাবীদের তিনি কেবল ওষুধের ব্যবস্থাপত্রই দিতেন না বিনা ফি-য়ে, ওষুধপত্রের ব্যবস্থাও করে দিতেন অমনি সেইসঙ্গে।

কেবল চোখের দেখা দেখেই তিনি সারেন না, সারে কি না সেটাও দ্যাখেন আবার। এমনি মানুষ বিধান রায়।

আর কী মনে রাখতে পারতেন যে!

আমার ইস্কুলে পড়ার সময়েই তাঁর নামের বহর সেই দূর পাড়াগাঁয়ে গিয়ে পৌঁছেছিল! নামডাকের ডাক্তার ছিলেন তিনি। কে না শুনেছে তাঁর নাম।

মা প্রায়ই ভুগতেন হাঁপানির ব্যারামে আর হাঁপানি এমন বিচ্ছিরি ব্যামো যে কহতব্য নয়। আর সব রোগে শুইয়ে ফ্যালে, হাঁপানি কিন্তু বসিয়ে রাখে। বসিয়ে দেয় একেবারে।

সারারাত বিছানায় বসে ঠায় হাঁপাতেন মা।

দেখেই এমন কষ্ট হতো আমার–যার হতো তার না জানি কী!

আমি তাই করলাম কি, খামের মধ্যে নিজের নাম-ঠিকানা লেখা খাম দিয়ে মার অসুখের কথা জানিয়ে বিধানবাবুকে একটা চিঠি ছেড়ে দিলাম গাঁয়ের থেকে।

কদিন বাদেই তাঁর জবাব এসে গেল ব্যবস্থাপত্রসমেত। প্যালল বলে একটা পেটেন্ট ওষুধের নাম ও সেবনবিধি লিখে দিয়েছিলেন। ওই ওষুধটা খেয়ে বেশ ভালো থাকতেন মা। অনেকদিন পরে যখন কলকাতার আত্মশক্তি কি যুগান্তর নেব পর্যায়ের) সম্পাদনায় জড়িত, কী সূত্রে যেন যেতে হয়েছিল তাঁর কাছে। আমার নাম বলতেই বললেন-শিবরাম? শিবরাম বলে একজনকে আমি জানতাম, একবার চিঠি লিখেছিল আমায়!

সেই আমি–সে-ই আমি! প্রকাশ করতে হল আমাকে।

 এরকম অদ্ভুত স্মরণশক্তি আমি কম দেখেছি।…

তুমি কী করছ এখন শুনি? এবার আমি জানতে চাই।

সেই যা করতাম। কংগ্রেসের কাজ নিয়েই আছি।,বলল ভূপেন-তুমি তো ছেড়েই দিলে কংগ্রেস! সেই কবে ছেড়েচ। খদ্দরের সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিয়েছ। আমরা কিন্তু লেগেই রয়েছি এ পর্যন্ত।

তা তো দেখছি। সেই মোটা খদ্দরেই লেগে আছ তাও দেখছি।

 ফাইন খদ্দর নেতারা পরেন, আমাদের শোভা পায় না বুঝলে ভাই?

কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে সম্বন্ধ একেবারে চুকিয়ে দিলে কেন বলো তো? চার আনার মেম্বর হয়ে থাকতেও কি পারতে না?

কোনো জিনিসই ভাই বেশিদিন ভালো লাগে না আমার। তাছাড়া কংগ্রেসের কাজটা মানে ঐ রাজনীতি ফাজনীতি আমার ধাতে আসে না। আমার স্বধর্ম নয় ঠিক।

কংগ্রেসে লেগে থাকলে একটা মন্ত্রী কি উপমন্ত্রী হতে পারতে যদ্দিন। দাশ সাহেব থেকে বড় বড় নেতাদের সবার সঙ্গেই তোমার জানাশোনা ছিল তো। যোগাযযাগটা রাখতে পারতে।

না ভাই, আমি বলেছিলাম না তোমায়, মনে আছে? সিদ্ধিলাভ আমার পছন্দসই নয়। একটা পথের শেষ পর্যন্ত লেগে থাকলে একটা কিছু হওয়া যায়–কার্য সিদ্ধি হয় বটে, কিন্তু হয়ও না আবার, এই যেমন তোমার হয়নি। তুমি তো লেগে থেকেও আজও কোনো মন্ত্রীটন্ত্রী হতে পারোনি!

না ভাই! আমরা তলার লোক তলাতেই পড়ে রইলাম। উপরে উঠতে পারলাম কই? সে ম্লান হাসল একটুখানি।

তোমাদের জেলা থেকে যাঁরা এসে এখন জাঁকিয়ে বসেছেন, মন্ত্রী কি উপমন্ত্রী হয়েছেন, তাঁদের কাউকেই তো তখন কংগ্রেসের ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। তোমার মতন জেলটেলও খাটেনি কেউ এরা। এরা সব জুটলো কোত্থেকে? কবে জুটলো?

ওপর থেকেই এল। স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়ল। জমিদার, জোতদার সবাই-টাকার অভাব নেই। পাটি ফাণ্ডে মোটা টাকা দিয়ে নমিনেশন পায় ওরা। টাকার জোরে দল ভারী করে কাজ বাগায়। স্যাক্রিফাইস করার সময় কেউ এরা ছিল না বটে, জেল খাটেনি কেউ এরা, তাও ঠিক-সুযোগ বুঝে সুবিধা লুটতে যথাসময়ে এসে জুটেছে। সব!

সুবিধাবাদী যতো! রাজনীতির মানেই এই! এর চেয়ে নোংরা আর কিছু হয় না। এর ভেতর থাকলে আমিও কোথায় তলিয়ে যেতাম! অবশ্যি আমার লাইনেই যে খুব উঠতে পেরেছি তা নয়, এতে অনেক দুঃখ যন্ত্রণা, তবে ভাই, সেটা অন্য ধরনের। তেমনি এতে স্বাচ্ছন্দ্য আছে, আনন্দও আছে আবার।

দেশসেবায় দেশের জন্য ত্যাগ স্বীারেও আনন্দ আছে ভাই!

তা হয়ত আছে। কিন্তু নিজের দুঃখ যন্ত্রণা কোনো রকমে সওয়া গেলেও, ছেলেমেয়ের দুঃখকষ্ট দেখলে সে আনন্দ যেন উপে যায় কোথায়। তাছাড়া এটা কেমন ভাই? একদলের ত্যাগ স্বীকার, আরেক দলের মুনাফা শিকার? কতক লোক সারাজীবন শুধু দিয়ে দিয়ে যায়, আর কতক কিনা উপর উপর এসে মজা লুটে নেয়। একদলের তলায় পড়ে মার খাওয়া, আরেক দলের উপরি পাওয়া? এটা কী রকম?

তাহলেও ভাই, স্যাকরিফাইস ইজ স্যাকরিফাইস। তা কখনো বৃথা যায় না।

যারা করেনি তারা তো বটেই, কিন্তু যারা ছিটেফোঁটাও স্যাকরিফাইস করেছিল তারাও সবাই তাদের সেই স্যাকরিফাইসটুকুও এই তালে ক্যাশ করে নিয়ে নিয়েছে গুছিয়ে নিয়েছে। আর তুমি কিনা, সেই স্যাকরিফাইসটাও শেষে স্যাকরিফাইস করে দিলে! তোমারটাই সবার বড়ো স্যাকরিফাইস!

কিন্তু আমার এই জ্ঞানদানে কোনো দুঃখ না পেয়ে তার সারা মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে ওঠে। পিঙ্গল উজ্জ্বল চোখ আরো যেন জ্বলজ্বল করে তার।…

সেই স্বরাজ কূটীরের কথায় আসা যাক আবার। সকালে পান্তাহার পার হবার পর দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ সেখানেই হোলো। সেই স্বরাজ কুটীরেই।

কচুপাতায় ভাতে ভাত, ডাল সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ–এইসব দিয়ে। মাছ তরকারির কোনো নামগন্ধ নেই। না থাক, সবার সঙ্গে বসে খেতে এমন ভালো লাগল যে বলা যায় না।

একটা ছেলে বাড়ির থেকে গাওয়া ঘি এনেছিল খানিক, সবার পাতেই দিল একটু একটু।

 সেটা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতই চমৎকার!

রাত্রের খাওয়া সারবার পর সেখান থেকে বিপিনবাবুর বৈঠকখানায় সেদিন আর গেলাম না। এইসব তাজা প্রাণ আর কচি কচি মুখের সান্নিধ্য ছেড়ে বিপিনবাবুর গোমস্তাদের গোমড়া উপস্থিতির ত্রিসীমানায় যেতে মন সরল না।

রাত্রে ছাতে গিয়ে শুলাম সবাই। খোলামেলা হাওয়ায় আকাশের তলায় শোয়ার আরাম তারও বুঝি তুলনা হয় না। ফাঁকায় শুয়ে আকাশভরা তারার দিকে তাকানো-অনন্তের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার এক বিচিত্র অপরূপ অভিজ্ঞতা।

 মাঝরাতে কখন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে টেরও পাইনি। যা আমার ঘুম! ভূমিকম্প কখনো টলাতে পারেনি, বৃষ্টির ছাঁটে ভাঙবে কি! সবাই উঠে গেছে কখন, আমি একাই পড়ে রয়েছি ছাতে। ভিজে নেয়ে গেছি, জামাকাপড় আগাপাশতলা শোয়র চ্যাটাইটি পর্যন্ত জলে ভিজে জ্যাবজাব করছে।

কিন্তু ঘুম থেকে আমায় তোলা গেল না। সেই স্যাঁতসেঁতে ছাতেই পড়ে রইলাম সারারাত ঘুমিয়ে পড়লাম, দেখতে না দেখতেই। অঘোরে ঘুমালাম সকাল অব্দি।

ভোরে উঠে দেখি, জামাকাপড় সব শুকনো খটখটে। গায়ের উত্তাপেই শুকিয়ে গেছে বিলকুল। এবং আজন্ম ফ্যাচর ক্যাচর সর্দিকাতর আমার হাঁচিকাশির কোনো লক্ষণমাত্র নেই এই–দারুণ বিপর্যয় সবিস্ময়ে লক্ষ্য করছি, এমন সময় বিপিনবাবুর কাছ থেকে লোক এল আমাদের সবাইকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন।

 দেশবন্ধুর আসন্ন আগমন ব্যাপারে হয়ত কিছু হবে ভেবে আমরা সবাই তক্ষুনি ছুটে গেলাম সেখানে।

তিনি আমাদের প্রত্যেককে এক জোড়া করে মোটা খদ্দরের ধুতি দিলেন আর সেই সঙ্গে কয়েক প্ৰস্থ থান–খান দুই করে পিরান বানাবার জন্য। কলকাতার থেকে আনানো হয়েছিল ওগুলি। দেশবন্ধু আসার আগেই বিলিতি জামাকাপড় বর্জন করে সব স্বদেশী বেশভূষায় সজ্জিত হতে হবে আমাদের।

শহরের এক দর্জির দোকানে গিয়ে গায়ের মাপ দিয়ে জামাটামা বানিয়ে নিতে বাতলে দিলেন আমাদের। আর আমায় বললেন যে, আজকের দুপুরের গাড়িতে তিনি নবাবগঞ্জে যাবেন, কংগ্রেসেরই কী কাজে, ফিরে আসবেন আজ রাত্রেই আবার–আমাকে যেতে হবে তাঁর সঙ্গে!

অতএব এই কঘন্টার ভেতরেই দর্জিকে দিয়ে আমার পিরানকুর্তা যা বানাবার তৈরি করে নিতে হবে আমাকে।

আদ্যিকালের প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীরা বেশ হৃষ্টপুষ্ট হত জানা যায়, আমাদের আদি যুগের খাদিও প্রায় সেইজাতীয় ইলাহী কাণ্ড ছিল-সেকালের জতুর মতন সে যুগের তন্তুজ খদ্দর প্রায় বিরল এখন। এখনকার খদ্দর বেশ শৌখিন ভদ্দর গোছের–অঙ্গে ধরলে শোভা বর্ধন করে।

কিন্তু প্রাককালীন সেই খদ্দর পরলে গা-টা ছড়ে যেত না অবশ্যই, তবে দেহভার কিছুটা বাড়ত বইকি, সেই ভারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার পরুয়াকেও বেশ একটু ভারিক্কিই দেখাত মনে হয়।

এবং পাক্কা দু বছরের ধাক্কা। গীতোক্ত সেই আত্মার ন্যায় বছর দুয়ের জন্য ঐ বস্তু অচ্ছেদ্য অভেদ্য অমেধ্য। কিন্তু পরার দিকে যতই পাকাপাকি হোক না, তার কাঁচা কাজের মতন মারাত্মক আর হয় না। ভেজা ধুতির দুমুড়ো ধরে জল নিঙড়ে বার করতে দুজন লোক হিমসিম খেয়ে যেত। দস্তুর মতই এক ব্যায়াম–সে এক মহামারী ব্যাপার।

নবাবগঞ্জে গিয়ে বিপিনবাবু এক জায়গায় একটি সেকেলে চরকার নমুনা পেলেন, সেটি তিনি সংগ্রহ করে সঙ্গে নিলেন। বললেন, এই মডেলে ইংরেজবাজারের ছুতোরদের দিয়ে অঢেল চরকা বানিয়ে তিনি বাজারে ছাড়বেন–তার ভেতর আমাদের দিয়ে সুতো কাটানোর সদুদ্দেশ্যটা উহ্য রইলই!

চরকায় কাটার জন্য পাঁজ বানাবার এক বস্তা কাঁপাস তুলোও নিতে তিনি ভুললেন না সেই সঙ্গে।

এই লটবহর নিয়ে যাতে ভোরের আগেই শহরে ফিরতে পারেন সেই হেতু আমাকে সঙ্গে করে রাত তিনটের ফিরতি গাড়িতে চড়ে বসলেন তিনি।

গাড়িতে উঠেই তিনি বললেন আমাকে–আমি তখন কামরার জানলায় মাথা রেখে অন্ধকারের নৈসর্গিক শোভা নিরীক্ষণে ব্যাপৃত–দ্যাখো শিবরাম, এই সুযোগে আমি একটুখানি বিশ্রাম করে নিচ্ছি, তুমি তো জাগাই রইলে, ইংরেজবাজারে গাড়ি এসে দাঁড়ালেই তুমি তুলে দিয়ো আমায়, কেমন?

আমি সায় দেবার সাথে সাথেই তিনি শায়িত। আর আমিও এদিকে দেখতে দেখতে কখন যে আকাশের অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে গেছি নিজেই জানি না-ইংরেজবাজারও পেরিয়ে গেছে কখন এই ফাঁকে।

নিমাসরাই–এই হাঁকডাকে বিপিনবাবুর ঘুম ভাঙলো আপনার থেকেই।–নিমাসরাই। নিমাসরাই কেন? এই-এই!! ওঠো ওঠো। আমাদের ইস্টিশন ছাড়িয়ে এসেছি। এখানেই নামতে হবে এখন। নামো নামো। চটপট!

বলতে না বলতেই আমি নেমে পড়েছি তড়াক করে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি নামিয়ে দিয়েছেন তুলোর বস্তাটাও। চরকা হাতে নিজেও নেমে এসেছেন তৎক্ষণাৎ।

ইস্! আমাদের স্টেশনটা কখন যে পেরিয়ে গেল, টেরই পেলাম না। যা এখান থেকেও যাওয়া যাবে ইংরেজবাজার। নদী পার হয়ে অনেকটা হাঁটতে হবে, তা হোক। ঠিক সময়েই গিয়ে পৌঁছব সেখানে।

আমি খুব হাঁটতে পারি। জানালাম।

ইংরেজবাজার ইস্টিশনে নেবার জন্য আমার লোকজন এসেছিল নিশ্চয়। কিন্তু আমি যে এদিকে গান্ধিজীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে থার্ড ক্লাসে ভ্রমণ করছি তা তো তারা ভাবতে পারেনি। ফাস্ট ক্লাস সেকেন্ড ক্লাস কামরায় আমায় না পেয়েই ফিরে গেছে। এদিকে ইস্টিশনে কুলিটুলি মেলে না, রাতবিরেতে লোকজনও বড় একটা থাকে না কেউ। কী করা যাবে? তুমি এই তুলোর কস্তাটা ধরো, আমি চরকাটা হাতে নিলাম।

ঐ তুলোর বস্তা? আমার মনের অবস্থার তখন তুলনা হয় না।

বেশি ভারী হবে না। মণ খানেক বড় জোর। বলে না সেই তুলোর বস্তাটা তিনি আমার ঘাড়ে তুলে দিলেন।

তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। কথাটা মিথ্যে নয়। এবং বস্তা সম্বন্ধেও সেকথা খাটে বোধ হয়।

যাই হোক, মণ খানেকের দুরবস্থা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে সেই আমার একমনে দেশের সেবায় লাগা-সর্ব প্রথম।

এখান দিয়ে আদিনা গৌড় ইত্যাদিতেও যাওয়া যায় তা জানো? এই পথ ধরেই। যেতে যেতে তিনি কন : বাংলার আদি রাজধানী গৌড়-আদিনা। জানো বোধ হয়?

আদি রাজধানীকে আদিনা বলার মানে কী? আমি জানতে চাই। কেমন যেন খটকা লাগে আমার।

আমি জানি না।

আমার মনে হোলো, আদিও যেমন ঠিক নয়, তার আগেও আদি থাকে আবার। অন্তত যেমন একেবারে অন্তিম হয় না, তার পরেও অনন্ত থেকে যায়। তেমনি আমাদের এই বঙ্গমাতাও। সেইরকমই বুঝি আদি অন্ত নেই আমাদের বাংলা মায়ের না-রূপের না-রহস্যের।

সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছিল বুঝি বাংলার আদি রাজধানী এই আমাদের।

আদিনার মসজিদ খুব বিখ্যাত। গৌড় একটা দর্শনীয় স্থান। গৌড়ের রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন, ঐতিহাসিক পুরুষ। সেকালের অনেক ধ্বংসাবশেষ আছে সেখানে। গিয়েছ কখনো?

গেছলাম একবার ছোটবেলায় মামার সঙ্গে। আমি জানাই। রামকেলীর মেলায় মামা নিয়ে গেছিলেন আমায়। হরিভক্ত তো মামা আমার। আর রামকেলী একটা বৈষ্ণর সম্মিলনী। সেবার মেলাটেলা দেখে মামা বললেন যে, চ। এই সুযোগে গৌড়টাও দেখে আসা যাক। প্রায় সন্ধ্যেবেলায় সেখানে আমরা পৌঁছেছিলাম। মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের।

অ্যাাঁ? কী বললে? তিনি যেন চমকে উঠলেন। কোন্ লক্ষ্মণ সেন?

সেই ঐতিহাসিক লক্ষ্মণ সেন। তিনি কি বেচেঁ আছেন এখনো, আপনার মনে হয়? তবে সেই ভদ্রলোক কিন্তু সেই পরিচয়ই দিলেন আমাদের। তাঁর মেয়ের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিলেন, যার নাম নাকি সুলক্ষণা। তার নামেই তিনি নাকি ঐ জায়গাটার নাম রেখেছেন লক্ষণাবতী!

লক্ষণাবতী! লোকটা পাগল।

আমারও তাই মনে হয়েছিল। বেশ গোলমাল ছিল তার মাথার। সেই রকমই দেখলাম আমরা। এই মাথাটা খুলছেন এই আবার পরছেন–নিজেরই আস্ত মাথাটাই–অনেকটা ঠিক পাগড়ির মতই যেন। সত্যি, তার মাথার ঠিক নেই একদম।

তোমরা ভূত দেখেছিলে আমার ধারণা, লক্ষ্মণ সেন নন, তাঁর ভূত।

তাও হতে পারে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল আমার। আর, বলতে কি, ভারী অদ্ভুতভাবেই তিনি দেখা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই মেয়েও…বলব ঘটনাটা?

না। না। বলতে হবে না। এখন নয়, অন্যদিন শুনবখন। দিনের বেলায় সেসব শুনতে হবে… রাতবিরেতে। বাবা! গা ছমছম করে না? রাত্তিরে ভূতপ্রেতের কথা ভাবাই যায় না বাপু! … ভয় করছে না তোমার?

আপনি আছেন যে! সেদিন মামা কাছে ছিল বলে ভয় করেনি। কেউ সঙ্গে থাকলে একদম আমার ভয় করে না।

সেই দুর্লক্ষণ সাক্ষাতের কাহিনী ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং প্রকাশিত আমার ভূতুড়ে অদ্ভুতুড়ে বইয়ে রয়েছে-এখানে তার সবিস্তার নেহাত বাহুল্য মাত্র।

সরু ফালির মতন রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে এগুচ্ছিলাম আমরা। নির্জন পথ অন্ধকার। দুধারে গাছপালা ঝোঁপঝাড়। অনেকটা জঙ্গলের মতই–তার ভেতর দিয়ে চলেছি। চারধার যেন থমথম করছে।

আমার গা ছমছম করছিল বলতে কি!

ভারী বস্তা ঘাড়ে যতটা পারি তাঁর কাছাকাছি থাকার চেস্টা করছিলাম।

 চরকাটা হাতে ঝুলিয়ে পথ দেখিয়ে বিপিনবাবু আগে আগে যাচ্ছিলেন। আর তাঁর চরকার টাকুর সূচ্যগ্র ভাগ ঠিক পিনের মতই মাঝে মাঝে বিধছিল আমাকে।

যেতে যেতে অমন উঃ আঃ করছ কেন হে? তিনি জিগ্যেস করেন : আর এমন করে ঘাড়ের ওপরেই বা এসে পড়ছো কেন আমার, বল তো?

পিনবিদ্ধ হয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে থাকব হয়ত। বস্তা ঘাড়ে আমি ঘাড় নাড়ি-না না, উঃ আঃ করিনি তো। কখন করলাম?

ভয় করছে বুঝি তোমার? না, না–ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই, বুঝেছ?

না, না, ভয় কিসের! আপনি আছেন না সঙ্গে? কেউ কাছে থাকলেই হোলো। একবার ভাবলাম, টাকুর টক্কর থেকে বাঁচতে পিছনে না পড়ে থেকে আমিই না হয় এগিয়ে যাই বরং। কিন্তু উনি যে নেতা-নেতাকে ছেড়ে যাওয়া যেমন উচিত নয়, তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়া তেমনি ঠিক হবে না নিশ্চয়? ইত্যাকার অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে পিছু পিছুই যেতে হয় আমায়।

নেতৃত্বের খোঁচা খেতে খেতে যেতে হয় আমাকে।

.

৩৫.

 জেলার হাটে হাটে সাতদিন ধরে ঢোল শহরতে দেশবন্ধুর আগমনবার্তা জানানো হয়েছিল। যেদিন তিনি এলেন, এক বিরাট উৎসবের মহরৎ সুরু হয়ে গেল যেন। সারা জেলাটাই এসে ভেঙে পড়লো মহানন্দার পাড়ে। বিরাট এক জনসমুদ্র-দশ বিশ পঞ্চাশ কতো লাখ কে জানে-একজনকে শুধু চোখের দেখা দেখার জন্যে এত জন! এক জায়গায় এহেন জনতা এর আগে আমি কখনো দেখিনি।

চাঁচলের বুধবারি হাটে পঞ্চাশখানা গাঁয়ের লোক জড়ো হতে দেখেছি, মহরমের দিন। রাজবাড়ির বারান্দায় বসে সামনের বিরাট প্রাঙ্গণে একশ দলের লাঠিখেলার জমায়েতও দেখেছিলাম–ব্যান্ডবাদ্য আর রকম-বেরকমের তাজিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে, কিন্তু এই বিপুল সমাবেশের সাথে সে সবের তুলনাই হয় না।

আনন্দের সাগর হতে এসেছে আজ বান–গানেই শোনা ছিল, কানেই শুনেছিলাম, চোখের ওপর দেখলাম এখন! সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের মতই দিগদিগন্তব্যাপী এই জনতা চারি ধারে শুধু লোক আর লোক। নারী পুরুষ বালক, চাষী মজুর ভদ্রজন–আপামর সর্বসাধারণের বাদ নেই কেউ।

ফেরিঘাট পেরিয়ে দেশবন্ধুকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসা হোলো শহরে–সেখানে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদেরই অগ্রাধিকার। কিন্তু বিপিনবাবুর আস্তানায় পৌঁছে আর আমরা পাত্তাই পেলাম না তাঁর। তিনি বিশ্রাম করতে লাগলেন বাড়ির ভেতরে। শহরের মান্যগণ্য। সম্ভ্রান্ত লোকরা সব আসতে লাগল মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে নিভৃত আলোচনা হচ্ছিল তাঁর। আমাদের ওপর ভার ছিল শুধু সদরে ভলান্টিয়ারি করার। দেশবন্ধুর জয়ধ্বনি নিয়ে তা-ই আমরা মহাসমারোহে করছিলাম।

দেশবন্ধুর সঙ্গে সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী এসেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন ছোট বড় নেতারাও। বিকেলে সভা বসলো-বিরাট জনসভা। সে সভায় দেশবন্ধু সামান্য কিছু বললেন, কী বলেছিলেন মনে নেই এখন। সুরেন সেন নামে এক নেতা, তৎকালে বেশ প্রসিদ্ধই তাঁর বক্তৃতাটাই হয়েছিল সবার হৃদয়গ্রাহী। বেশ বাগ্মী তিনি। আর বক্তৃতা করেছিলেন পন্ডিত মোদাচরণ সামাধ্যায়ী–তিনিও দেশবন্ধুর সাথে এসেছিলেন। আর রাজশাহীর কলেজ ছেড়ে সদ্য বেরিয়ে আসা মোহিত মৈত্র, ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র বোধকরি তখন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের বৃত্তান্ত দিয়ে তাঁর বক্তৃতাতেও উদ্বেল হয়েছিল অনেকে, মনে আছে।

রাত্তিরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জন্যে লোক সংস্কৃতির আয়োজন হয়েছিল একটা। মালদহের বৈশিষ্ট্য গম্ভীরা গানের আসর বসেছিল বিপিনবাবুর বাড়ির প্রাঙ্গণে। আমন্ত্রিত হয়ে শহরের উল্লেখযোগ্য প্রায় সবাই এসে জমেছিলেন, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও, এমনকি! দেশবন্ধুর পাশের আসনেই বসেছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে আলাপ আলোচনাও চলছিল দুজনের মধ্যে, দেখলাম।

বোলভাইয়ের পালা শিবো হে! দিয়ে শুরু হয়ে নানান সামাজিক সমস্যায় গিয়ে পড়ে। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনীতিক কিছুই বাদ যায় না–সে সব গানে সমস্তই উপস্থিত; নানা রঙ্গের মধ্যে সাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ইতিও থাকত সেই সঙ্গে। যেমনটা এককালে কলকাতার রাস্তায় পয়লা বোশেখের গাজনের যাত্রা-গানে দেখেছিলাম।

সেদিনকার আসরের দু-একটা পর্ব আমার মনে পড়ে এখনো। দু-একটা কলির রেশ এখনো মনের পলিমাটিতে তলিয়ে যায়নি একেবারে।

মজার একটা পালাই ছিল সেটা।

 হঠাৎ গেঁয়ো চাষীগগোছের একজন, মাতালের মতন ভাবভঙ্গী করে গাইতে শুরু করল এসে–তার ছেলেকে সম্বোধন করেই

ওরে বাছা সোনার চান তোর মাকে যাইয়া ডাইকা আন।

সোনার চাঁদ তখনই লাফাতে লাফাতে ডাকতে গেল মাকে। মা আর কোথাও না, সেই আসরেরই এক কোণে ঘাপটি মেরে বসেছিল, উঠে দাঁড়িয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে আরম্ভ করল অমনি

মরে যা পাঁঠা /গারোস্থালি/ব্যাচে খালি/জল খাবার নাই লোটা! মরে যা পাঁঠা!

তারপরে, গানের সঙ্গে সমতালে নেচে, তাড়ি-নেশাতুর তার পতিদেবতাকে তাড়না করে আসরময় যেভাবে ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল–সে এক দৃশ্যই!

তারপরের পর্বটা আরও মজাদার! একটা লোক, স্বাভাবিকই হবে বোধ হয়, হাকিম সাহেবকে দেখে না তক্ষুনি মুখে মুখে গান বেঁধে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী সহকারে ঘুরেফিরেই গাইতে লাগল :

চিনিতে পারো কি এদের?/ কিসকিনধায় বাস/এই বেটারাই করেছিল/রাবণ রাজার সর্বনাশ। /মা জানকীর কোপে পড়ে/মুখখানি গিয়েছে পুড়ে/লেজটি হয়েছে বেঁড়ে/বসে আছেন ভম্বল দাস।

ইঙ্গিতের খোঁচাটায় সভার সবাই খুব আমোদ পেলেও (আমরা তো যার পর নাই!) দেশবন্ধু দেখলাম গম্ভীর হয়ে গেলেন বেশ।

সাহেব অবশ্যি গানের মর্ম বোঝেননি কিছুই। বাংলাভাষাটা কাজ চালানো গোছের রপ্ত হয়ত তাঁর থাকলেও, ভাষাৰ্থ বুঝতে পারলেও, ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে জড়িত ভাবার্থ তাঁর হৃদয়ঙ্গম হবার নয়। তাঁর মুখের কোন বিকার দেখা গেল না।

পরের দিনটাই আবার দেশবন্ধুর কলকাতায় ফেরার।

তিনি একাই ফিরে যাবেন সস্ত্রীক। মোহিতবাবু আর সমাধ্যায়ীমশাই কংগ্রেস সংগঠনের কাজে থেকে যাবেন আরো দিন কয়েক।

 নির্ধারিত ক্ষণে দেশবন্ধু বেরুলেন–বোধ করি, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সৌজন্যে তাঁর মোটর গাড়িটা পাওয়া গেছল, তাতেই চেপেসোফারের পাশে আমি বসলাম দেশবন্ধুর পার্সনাল স্বেচ্ছাসেবক হয়ে, আর পিছনে বসলেন বাসন্তী দেবী, দেশবন্ধু আর বিপিনবাবু।

খেয়াঘাট পর্যন্তই যাওয়া গেল গাড়িতে, তারপরে ফেরি পেরিয়ে একটুখানি রাস্তা হেঁটেই পোঁছলাম আমরা স্টেশনে।

তাঁর আসার দিন কাল কী ভিড়, কী ভিড়! আর আজ এখন, যাবার কালে, লোকজন কেউ কোথাও নেই! বোধহয় জানেও না কেউ যে তিনি চলে যাচ্ছেন। ব্যান্ড বাজনা, স্বেচ্ছাসেবকের শোভাযাত্রা, জনতার জমায়েত-কিছু না!

শারদোৎসবের কথা মনে পড়ল আমার। আগমনীর দিন কী সমারোহ-কী না ঘটা।

বিসর্জনের দিন প্রতিমা বওয়ার লোকই পাওয়া দায়।

স্টেশনে গিয়ে জানা গেল, কলকাতার গাড়ি ছেড়ে গেছে খানিকক্ষণ আগেই। ফিরতি ট্রেন সেই পরের দিন। কাল বিকেলে।

দেশবন্ধু স্টেশনেই থাকলেন ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুমে। শহরে আর ফিরে গেলেন না। কী জানি, কালকেও যদি ফের ট্রেন ফেল করে বসেন।

কলকাতায় সেদিন না যেতে পেরে তাঁর কাজের কতো ক্ষতি হল নিশ্চয়, কিন্তু মুখে একটু বিরক্তির চিহ্নও দেখা গেল না।

পার্সনাল ভলান্টিয়ার আমি, তার পার্শ্বচর হয়ে রইলাম স্টেশনেই।

 রাত্তিরে দেশবন্ধু হানটলি পামারের টিন থেকে খানকয় বিস্কুট আর এক গেলাস দুধ খেলেন মাত্র। বাসন্তীদেবী কী খেলেন দেখিনি।

বিপিনবাবু হাঁড়ি হাঁড়ি ভর্তি মালদার খাজাগজা কী সব দিয়ে গেছলেন দেশবন্ধুর জন্য। বাসন্তীদেবী তার থেকে বার করে খেতে দিলেন আমায়।

খাজা দিলেন গোটা কতক, আর দিলেন দুধের সর কৃষ্ণনগরের মতন সরপুরিয়া নয়, পুরু সর। বিপিনবাবুর অবদান। সেই সরের সঙ্গে রসকদম কুঁচিয়ে সুমধুর সম্মেলনে বাবার মহাপ্রসাদ বানিয়ে খাওয়া গেল অনেক দিনের বাদ।

সন্ধ্যের দিকে ওয়েটিং রুমের দুখানা ইজিচেয়ারই বার করে প্ল্যাটফর্মের ওপরে এনে রেখেছিলাম। দেশবন্ধু আর বাসন্তীদেবী এসে বসলেন সেখানে।

কাছেই একটা টুল নিয়ে বসেছিলাম। তাঁরা দুজনে কত কী আলোচনা করছিলেন, শুনছিলাম বসে বসে–সব ঠিক মতন বুঝতে না পারলেও।

যখন ওঁদের মধ্যে নিতান্ত ঘরোয়া কোনো কথা হচ্ছিল, তখন আমি উঠে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, এধার ওধার।

হঠাৎ দেশবন্ধু ডাকলেন আমায়-চাঁচলের রাজার সঙ্গে তোমাদের কী যেন সম্পর্ক আছে না? বিপিনবাবু বলছিলেন আমাকে। কী সম্পর্ক?

নামমাত্রই, ও কিছু না। এক কথায় আমি উড়িয়ে দিয়েছি কথাটা।

চাঁচলের রাজা দেশের জন্য এককালে প্রচুর টাকা দিয়েছেন, আমি জানি। বিপ্লবের কাজেও গোপনে অনেক টাকা ঢেলেছেন। বিনয় সরকারের কাছে শুনেছিলাম। এখন সরকার থেকে রাজাবাহাদুর খেতাব পাবার পর একটু নাকি রাজভক্ত হয়ে পড়েছেন, আজকাল। তবে সেটা হয়ত বাহ্যতই হবে।

তা হবে। বলেই আমি থামলাম। আমি সেসবের কিছুই জানতাম না।

কলকাতায় যাবে তুমি, আমার সঙ্গে! সেখানে পড়বে। পড়াশুনা ছেড়েচ কেন?

গান্ধীজী যে বলেছেন, এডুকেশন মে ওয়েট বাট স্বরাজ ক্যানট। আর বিপিনবাবু বলেছেন, ইরেজের গোলামখানা থেকে বেরিয়ে এসে তোমরা সবাই দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ো?

দেশের কাজ আর লেখাপড়া কি আলাদা? দুটো কাজ কি একসঙ্গে হয় না? পড়াশুনা করাও তো দেশের কাজ। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হবে কি করে? আর, মানুষ না হলে কি দেশের কোনো কাজ করা যায়? মানুষ হওয়ার কাজ, মানুষ গড়ার কাজ আর দেশের কাজ সবই আমাদের সমানে চালাতে হবে–সমস্ত চলবে একসঙ্গে।

আমি চুপ করে শুনছিলাম।

মানুষ গড়ার কাজ আমরা বন্ধ রাখিনি। গৌড়ীয় সববিদ্যায়তন বলে ন্যাশনাল কলেজ খোলা হয়েছে কলকাতায়। ইস্কুল কলেজ ফেলে যেসব ছেলে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এসেছে, তারা সবাই সেখানে থাকে-দেশের কাজও করে, আবার সেই কলেজেও পড়ে। সুভাষ কলেজের প্রিন্সিপাল। শুনেছি তুমি টেস্ট দিয়েছিলে নাকি এবার–সুভাষকে বলব তোমায় কলেজে ভর্তি করে নিতে। কেমন?

আচ্ছা।

পড়াশুনা করবে, মানুষ হবে। মানুষ না হলে কিছুই হবে না। মানুষ হওয়ার তিনটে লক্ষণ : স্বাস্থ্য বিদ্যা আর অর্থ। স্বাস্থ্য আর বিদ্যা না থাকলে টাকা রোজগার করা যায় না এবং টাকা না হলে নিজের পায়ে দাঁড়াবে কি করে? যে নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি, সে কি এগুতে পারে কখনো! আর যে নিজেই এগুতে পারে না, সে তার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কি করে? অতএব… বুঝতেই পারছো?

আমি ঘাড় নাড়ি। বুঝতে পারি আর না পারি।

কী যেন নামটা তোমার…নামটা কী যেন তোমার…

শিবরাম চক্রবর্তী।

শিবরাম চক্রবর্তী। শিবরাম চক্রবর্তী, নামটা কেমন শোনা শোনা। মনে হচ্ছে… কোথায় যেন নামটা দেখেছি আমি তোমার!

কোথায় দেখবেন–আর!

 কোনো কাগজে-টাগজে দেখেছি বোধ হয়। কোথায় যে, মনে করতে পারছি না এখন।

দেখলে হয়ত ভারতীতেই দেখে থাকবেন। অপরাধীর মতন কবুল করি।

তুমি লেখটেখ নাকি? কিছু লিখেছিলে বুঝি ভারতীতে? কোনো গল্প-টল্প?

 দু-একটা ছোট্ট কবিতাই কেবল বেরিয়েছিল আমার, ঐ কাগজে।

কবিতা? হ্যাঁ…বললেন দেশবন্ধু–হ্যাঁ, কবিতাই তো! মনে পড়েছে এখন। কবিতাটা কী তা অবশ্যি স্মরণে নেই, তবে ভালোই লিখেছিলে মনে হয়। ভালো না লাগলে তোমার নামটা মনে থাকত না আমার।

না না। তেমন ভালো কিছু লিখিনি, তবে নামটাও তত আমার বিদঘুঁটে, সেজন্যেও কারো মনে থেকে যায়।

শুনে, তিনি হাসলেন–ও, তুমি কবি? ছোটখাট একটা কবিই তুমি তাহলে?

আপনার কবিতার বই আমি পড়েছি। সাগরসঙ্গীত। আমাদের বাড়িতে আছে। আমার প্রসঙ্গটা আমি চাপা দিতে চাই।

ভালো লেগেছিল তোমার? ঐ সাগরসঙ্গীত?

সত্যি বলতে আমার ভালো লাগেনি। বুঝতেই পারিনি আদপে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেমন ভালো লাগত, ভালো লাগবার মত, আমার বয়সী, সববয়সী সবারই ভালো লেগে যেত এমনিতেই–তাঁর কবিতা ঠিক তেমনটি যেন ছিল না। নিঝরের স্বপ্নভঙ্গের ন্যায় ছন্দের তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারত না আমাদের।

আমার বাবার খুব ভালো লাগে আপনার কবিতা-তাঁর কথার জবাবে আমি কই: তিনি বলেন, আপনি রবিঠাকুরের চেয়েও বড়। রবীন্দ্রনাথের কবিতা নাকি মেয়েলি ধাঁচের–তার কোনো মাথামুন্ডু হয় না। মাইকেল হেম নবীন-বাবার মতে এঁরাই সব কবি। মহা মহাকবি। আর তাঁদের পরেই আপনার স্থান। তিনি বলেন।

কোথায় রবিবাবু, কোথায় মাইকেল আর কোথায় আমি! রবিবাবুর কবিতার কি তুলনা হয়? উনি বিশ্বকবিদের একজন। কেবল বাঙালীর নন, সারা বিশ্বের।

কিন্তু বাবা যে বলেন…কবিতা ভালোই বোঝেন তিনি। তিনি নিজেও একজন কবি তো। শিবপ্রসাদ বলে তাঁর একটা ছাপানো পদ্যের বইও আছে, জানেন?

তাই নাকি? তাহলে তাঁর থেকেই তুমি কবি হয়েছে বুঝতে পারছি। তোমার রক্তে ছিল কবিতা। কিন্তু তোমার বাবা যাই বলুন না, ওটা কোনো কথাই নয়। এই জন্যই বলছিলাম, তোমার পড়াশোনার দরকার। কলেজে গিয়ে শেলী বায়রন ব্রাউনিং শেকস্পীয়র কীটস্ পড়লে বুঝতে পারবে কবিতা কাকে বলে–কী বস্তু-কবি কাকে বলা যায়। আর তাঁদের সঙ্গে তুলনা করে বিচার করলেই রবিবাবুর মূল্য বুঝবে তখন।…আমি তাঁদের পায়ের নখের যুগ্যি নই।

প্রতিবাদ করলেন বটে, কিন্তু বাবার কথাটায় যে খুশি হয়েছেন খুব, সেটা ওঁর প্রসন্নতায় বোঝা গেল।

পরের দিন দুপুরে স্টেশন মাস্টারের বাড়ি থেকে এক অন্ন পঞ্চাশ ব্যঞ্জন, বড় বড় মাছের মুড়ো, দই মিষ্টি ইত্যাদি সব এল–ওঁদের জন্য। কালকেই এই আতিথেয়তার উনি আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন।

গতকালের ট্রেন ফেলের হেতু নিজেকেই দায়ী মনে করে অনেক ত্রুটি স্বীকার করেছিলেন তিনি। দেশবন্ধুর যাবার খবরটা যদি ঘুণাক্ষরেও তাঁর জানা থাকত, যদি কেউ কাকপক্ষীর মারফতেও একটু আগে জানিয়ে যেত তাঁকে, তাহলে দেশবন্ধুর অপেক্ষায় আরো খানিকক্ষণ ট্রেনটাকে তিনি দাঁড় করিয়ে রাখতেন। কিন্তু কেউ এসে একটা কথাও কয়ে যাননি তাঁকে।

সেই সময়েই আজ দুপুরের এই আতিথ্য স্বীকারের জন্য সপরিবার সনির্বন্ধ তাঁর অনুরোধ। তাঁর ন্যায় দেশবরেণ্যকে তিনি অতিথিরূপে পেয়ে ধন্য হবেন, এই সব বলেছিলেন। তিনি যদি অনুগ্রহ করে…তাঁর ন্যায় নগণ্য লোকের এই আতিথ্য গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি কৃতার্থ বোধ করবেন…ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিকেলের ফিরতি গাড়ি আসার আগে লোকে লোকে ভর্তি হয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম। দেশবন্ধুকে বিদায় সংবর্ধনা জানাতে সবান্ধব বিপিনবাবু এসেছিলেন, এসেছিলেন শহরের গণ্যমান্যরা, ছাত্রছাত্রীর দল আর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী।

ফার্স্ট ক্লাসের গোটা একটা কামরা রিজার্ভ করে রাখা হয়েছিল তাঁর জন্য। তাঁদের সঙ্গে আমিও সেই কামরায় উঠে পড়লাম। বিপিনবাবুরাও উঠলেন।

স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী সার বেঁধে দাঁড়ালো স্টেশনে। দেশবন্ধু কী জয়, মহাত্মা গান্ধীজী কী জয়, বন্দেমাতরম ধ্বনিতে মুখর হয়ে গমগম করতে লাগল প্ল্যাটফর্ম।

গাড়ি ছাড়বার মুখে কামরার থেকে নেমে গেল সবাই, আমি থেকেই গেলাম সেখানে। কেউ লক্ষ্যও করল না সেটা। এমনকি বিপিনবাবুও আমার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করলেন না।

কারো পৌষ মাসে কারো সর্বনাশ হয় শুনেছি, কিন্তু কারো ব্যর্থতা কি অপর কারো সার্থকতা নিয়ে আসতে পারে? কে জানে! কিন্তু দেশবন্ধুর সেদিনের সেই ট্রেন ফেলটা না ঘটলে আমার জীবনের ট্রেন পাশ করত না। আমার ভবিষ্যতের পাশপোর্ট পেতাম কিনা সন্দেহ। তাঁর সেদিনের সেই বৈফল্যই আমার জীবনের যা কিছু সাফল্য নিয়ে এসেছে-ঠিক পুরোপুরি না হলেও, আমার নবজীবনের রথযাত্রা শুরু হয়েছিল সেইদিনই

ফেলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস বলে যে, মিছে না!

.

রসা রোডে দেশবন্ধুর বাড়িটা, যা এখন কিনা চিত্তরঞ্জন সেবাসদন, তার গায়ে কেমন যেন একটা মায়া মাখানো ছিল। সেখানে গিয়েই আমার স্বপ্নের ঘোর লাগল, কে যেন মায়ার কাজল বুলিয়ে দিল আমার দুচোখে। অবাক হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।

অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়িটা। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। চারধারে বিস্তর গাছ-গাছালি। নারকেল গাছও ছিল কয়েকটা-পেছনে একটা ছোটখাট পুকুরের মল, একধারে আবার শিবমন্দির। এইরকম ছিল বলে আমার মনে পড়ে এখন।

যেতেই সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল অল্পক্ষণেই।

দেশবন্ধুর আগমনবার্তা পেয়ে নেতারা সব আসতে থাকলেন একে একে। একেকটা মোটর এসে দাঁড়াতে লাগল গাড়ি-বারান্দাটার তলায়। ছেলেগুলো চিনিয়ে দিতে লাগল আমায়।

ইনি কে এলেন জানো? মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।

 আবুল কালাম আজাদ? নাম শুনেছিলাম। খ্যাতি জানা ছিল খবরের কাগজের খাতিরে।

কী সম্ভ্রান্ত চেহারা, চালচলন। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। মোগল বাদশাদের মই মনে হয়–যেন দিল্লীর তখত্ত তাউস থেকে সদ্য নেমে আসছেন।

ইনি সুভাষচন্দ্র বোস। বিলেত থেকে আই সি এস পাশ করে…

জানি জানি, বলতে হবে না তোমায়।

এই সেই সুভাষ বোস? যার কথা রিনি তার চিঠিতে জানিয়েছিল আমায়। তার সেই প্রথম আর শেষ চিঠিতে।

সত্যি, দেবতার মতই দেখতে বটে। কী মিষ্টি চেহারা যে!

এই যে ভদ্রলোক প্রকান্ড গাড়ি করে এলেন না? ভেতরে গেলেন না? ইনিই হচ্ছেন নির্মলচন্দ্র চন্দ্র। কলকাতার এক নামজাদা অ্যাটনি-জানো?

শুনেছি নাম। তিলক স্বরাজ ফান্ডের মালিক তাই না? ফান্ডামেন্টাল খবরটা সব সময়ই আমার মনে থাকে। নির্মল আনন্দ দেয়।

আর ইনি হেমন্তকুমার সরকার।… ইনি কিরণশঙ্কর রায়। সত্যেন মিত্তির। ইত্যাদি ইত্যাদি। আসতে লাগলেন এক এক করে। চলে যেতে লাগলেন ভেতরে সটান।

আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। দেখছি, গল্প করছি।

এবার আমাদের ক্যাপটেন এলেন।

কী নাম ভাই ভদ্রলোকের? লম্বা চৌড়া চেহারা–জ্বলজ্বল করছে যেন।

 বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী। নাম শোনেননি?

না তো। আমি এক বিপিনবিহারী ঘোষকে জানি। মালদহ জিলা কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট।

ইনি কোনো ঘোষ নন। ঘোষণা করে ছেলেটা-কলকাতার ভলান্টীয়ার কোরের ক্যাপটেন বিপিন গাঙ্গুলি। আশ্চর্য! নামই শোনননি তুমি এঁর?

আমি লজ্জিত হয়ে চুপ করে থাকি।

বাঘা যতীনের নাম শুনেছ কি?

শুনব না কেন? কে না শুনেছে? বালেশ্বর ফাইটের সেই…!

হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই সেই। তাঁরই সহকর্মী এই শ্রীবিপিনবিহারী গাঙ্গুলি। একজন বিপ্লবী নায়ক। এখন গান্ধীমতের অনুবর্তী হয়ে অহিংস পথে এসেছেন।

তাই নাকি? শুনে শ্রদ্ধা হয়।

সত্যি কী আর এসেছেন? ওই বাইরে বাইরে। পুলিসের ছোঁয়াচ এড়াতেই। ভেতরে ভেতরে বিপ্লবের কাজ করছেন আর নিজের দলের জন্যে ছেলে রিক্রুট করে যাচ্ছেন একধার থেকে। যেসব ছেলে এখানে এসেছে, আসছে এখন, তারা সব খাঁটি জিনিস তো।

খাঁটি জিনিস নাকি?

খাঁটি না? দেশপ্রেম খাঁটি নয় তাদের? দেশের সেবা করতে–তার জন্যে প্রাণ দিতেই কি আসছে না তারা? সারা বাংলার সেরা ছেলেরা সব জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। স্কুল কলেজ ছেড়ে এসেছে সবাই। তাদের ভেতরে তাঁর দলের ছেলেরাও সব স্বেচ্ছাসেবক সেজে ঢুকে পড়েছে–গান্ধী মহারাজের জয় দিয়ে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে তারা।

শুনে সতীশের কথা মনে পড়ল আমার। মোসোপটেমিয়ার লড়াইয়ে না গিয়ে এখানে থাকলে তারও দেখা মিলত হয়ত এখন। এখানেই মিলত। কে জানে, এই বিপিনবাবুই, কিংবা তাঁর কোনো সাকরেদই তাদের লীডার ছিলেন কি না?

বিপিনদার নাম শোনননি? আশ্চর্য? ছেলেটার বিস্ময়ের রেশ কাটতেই চায় না। শরৎচন্দ্রের বই পড়নি?

পড়ব না কেন? রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে কত বই পড়লাম। কোষ্টা না পড়েছি? পথের দাবী পড়েছো তুমি?

পেলে তো পড়বো। পাবো কোথায়!

কেন, লাইব্রেরীতে? পাবলিক লাইব্রেরীতে পাওয়া যায় সব। সব বই–সবার বই-ই পাওয়া যায় সেখানে। পড়তে দেয় সবাইকে।

আমাদের দেশে কোনো পাবলিক লাইব্রেরী নেই ভাই। বাড়ির লাইব্রেরী আছে বটে, তবে সবার নয়, কারো কারো। কেউ কেউ হয়ত পড়তে দেয়–চাইলে পরে। কাউকে কাউকে দেয়, সবাইকে না।

দেয় না?

না। কেন দেবে? পড়তে নিয়ে আর তারা ফেরত দেয় না যে রহস্যটা ফাঁস করি : বাবা বলেন, বই আর বউ পরের হাতে একবার গেলে আর ফিরে আসে না কখনো। বেহাত হতে হতে কোথায় যে চলে যায়, পাত্তাই মেলে না।

এখানে সবাইকেই দেবে। যে মেম্বার হবে, তাকেই। বীন স্ট্রীটে হীরণ লাইব্রেরী একটা আছে, আমি তার মেম্বর।

আমাকে তারা মেম্বর করবে?

কেন করবে না? মাসে চার আনা চাঁদা, আর ভর্তি হবার সময় জমা দিতে হবে দুটাকা…

টাকা পাব কোথায়? টাকাই নেই আমার।

তবে আর কী হবে? আমার থেকে নিয়ে পোড়ো না হয়।

 তুমি তাহলে পথের দাবীটা পড়তে দিয়ো। কী আছে তাতে?

দেশের কথা। বিপ্লবের কথা। কেমন করে করতে হয় বিপ্লব আর বিপ্লবের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, কাহিনীর মধ্যে দিয়ে বলা সব।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তার মধ্যে সব্যসাচী বলে একটা অদ্ভুত চরিত্রের বিপ্লবী আছে, তা নাকি ওই বাঘা যতীন আর বিপিনদার মিকশ্চার করে ওদের আদলেই বানিয়েছেন শরৎবাবু।

তবে তো পড়তেই হবে নিশ্চয়।

বিপিনবাবু বেরিয়ে এলেন একটু পরে।–তোমাদের মধ্যে শিবরাম কে? শিবরাম কার নাম?

আমি এগিয়ে গেলাম আমিই শিবরাম।

রেডি হও। আমার সঙ্গে ফর্বেস ম্যানসনে যাবে। বলেই তিনি চলে গেলেন ভেতরে আবার।

ফর্বেস ম্যানসনটা হচ্ছে–ঐ যে ওয়েলিংটন–সেটা? সঙ্গীদের শুধালাম।

ফর্বেস ম্যানসনটা হচ্ছে ওয়েলিংটন স্কোয়ার জানো তো? তার পূর্বদিকের প্রকান্ড বাড়িটাই ফর্বেস ম্যানসন।

ওয়েলিংটন স্কোয়ারটা কোথায়?

ওমা! শুনে যেন তার বিস্ময় ধরে না–তাও তুমি জানো না? স্কোয়ারটা বিধান রায়ের বাড়ির সামনেই। সে খবর দেয় আমায়–ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়।

শুনেই আমি লাফিয়ে উঠি বিধান রায়কে আমি জানি।

কী করে জানলে, কী করে তুমি তাঁকে জানবে! অজ পাড়াগাঁর ছেলে!

জানি হে জানি…পাড়াগাঁর ছেলে, তবে অজ নই। সে এক কান্ড করে জানা। কই, তিনি। তো এলেন না দেশবন্ধুর কাছে? তিনিও তো কংগ্রেসের একজন পান্ডা?

পান্ডাই। তবে ডাক্তার মানুষ, তার সময় কই! কল দিলে তবে আসবেন।

কতো ফী নেন তিনি? তাঁকে কল দিলে কত ভিজিট দিতে হয়?

ওঁর বাড়িতে গেলে বত্রিশ। আর কেউ নিজের বাড়িতে ডাকলে চৌষট্টি।

ও বাবা! শুনেই আমার পিলে চমকায়।

ওমনিও উনি দ্যাখেন আবার–গরিবদের, যারা নাকি টাকা দিতে পারে না। আমাদের সব ওমনি ওমনি।

বটে? ফর্বেস ম্যানসনের মানেটা কী? কী হয় সেখানে?

আমাদের ন্যাশনাল কলেজ আছে না? গৌড়ীয় সববিদ্যায়তন। সুভাষ বোস তার প্রিন্সিপাল। সেখানেই। সেইটাই। আমরা কেউ কেউ সেখানে পড়ি, কাজও করি আবার।

কী কাজ করো? কী করতে হয় তোমাদের? আমি জানতে চাই।

দেশের কাজ। স্বাধীনতার কাজ। আবার কী? যা যা করতে বলবেন বিপিনদা, তাই করতে হবে আমাদের। বুঝেছ?

আমার ঘাড় নাড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিপিনদা বার হয়ে এলেন। বললেন, এস। তাঁর পিছনে পিছনে ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলাম।

দেশবন্ধু সুভাষবাবুকে বলেছেন তোমাকে আমাদের ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি করে নিতে। তুমি তো এবার টেস্ট পাশ করে এসেছে, তাই না? তা হলেও, কলেজে পড়তে হলে আদ্য পরীক্ষাটা তোমায় দিতে হবে। সুভাষবাবু তাই বলেছেন। তিনি ভারী স্ট্রং ডিসিপ্লিনের মানুষ। নিয়মশৃঙ্খলা ভাঙার পক্ষপাতী নন। আমিও চাই যে তোমরা নিয়মানুবর্তী হও। পরীক্ষা তোমায় দিতে হবে। আগামী সপ্তাহেই সেই পরীক্ষা। পড়াশুনা তো সব তৈরিই আছে তোমার। পড়তে হবে না আর। সেই এন্ট্রান্স-স্ট্যান্ডার্ডেরই কোশ্চেন পড়বে তোমাদের।

দেবো পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতে আমি ঘাবড়াই না। ভয় খাই না। আমি জানাই।

ভয় খাবে কেন! কত পরীক্ষা রয়েছে জীবনে। সব পরীক্ষাই পেরুতে হবে। উতরে যাবে সসম্মানে।

চেষ্টা করব।

হ্যাঁ। তবে কলেজের ক্লাসে তুমি অ্যাটেন্ড করতে পারো এখন থেকেই। তাতে কোনো বাধা নেই। দুপুরবেলায় ক্লাস হয়।

কিসের কিসের ক্লাস? কী রকমটা? আমি জানতে চাই।

তোমার সেই ইস্কুলের মতন নয় কিন্তু। লেকচার শুনতে হয়, নোট নিতে হয় তার। খাতা পেনসিল ফাউন্টেনপেন কিনবে সব। বইপত্তর–যা দরকার পড়বে–অধ্যাপকরা যেসব বইয়ের নাম বাতলাবেন, সে-সবও তোমায় নিতে হবে সমস্ত। কিন্তু সেসব তোমার ওই আদ্য পরীক্ষা পাশ করার পরেই–এখন না।

কারা পড়াবেন? অধ্যাপক কারা?

 সুভাষ বোস প্রিন্সিপাল। তিনিও পড়ান। কিরণশঙ্কর রায়, হেমন্ত সরকার এরাও ক্লাস নেন-কে কী পড়ান আমার জানা নেই ঠিক।

একটু গুম হয়ে থাকার পর আমি গুমরে উঠি-পড়ব তো দেশের কাজ করব কখন?

 কলেজ তো সেই দুপুরেই। ঘন্টা কয়েকে।

দুপুরে কোনো দেশের কাজ নেই?

সকালে বিকেলে তোমাদের দেশের কাজ।

 আবার আমি গুম হয়ে যাই। চুপ করে থাকি তারপর।

কী! কোনো কথা কইছ না যে? পড়তে ইচ্ছে করছে না?

করবে না কেন? কিন্তু-কিন্তু-কিন্তু আবার আমি চুপ।

বলল না। বলেই ফ্যালো! এত কিন্তু কিন্তু কিসের।

পড়বো যে, বইখাতা যে কিবো আমার পয়সা কই?

এই কথা! বলে তিনি পকেটে হাত পোরেন-দেশবন্ধু তোমাকে দেবার জন্য এই টাকাটা দিয়েছেন। এর থেকে তোমার যা যা দরকার, জামাকাপড় বিছানাপত্তর কিনবে সব। খদ্দর কিনতে হবে কিন্তু। খাদি প্রতিষ্ঠানের থেকেই কিনবে-কলেজ স্ট্রট মার্কেট-এ। জায়গাটা যদি তোমার না জানা থাকে, এখানকার কোনো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। সেই তোমায় দেখিয়ে দেবে। কোথায় কী পাওয়া যায়, কী কিনতে হবে, সব।

আচ্ছা।

দেশবন্ধুর নোটখানা তিনি আমার হাতে দিলেন-এই নাও। কিনে নিয়ে আজই।

দশ টাকার নোট য্যাতো বড়ো হয়। জানতাম না তো! দেখেই আমার তাক লাগে।

এটা দশ টাকার নোট নাকি? একশ টাকার-দেখছ না?

সেই প্রথম আমার একশ টাকার নোট দেখে ভাবসমাধিতে একশা হয়ে যাওয়া।

তবে প্রথম দর্শন হলেও, প্রথম দর্শনের বোধকরি দর্শনমাত্রেরই প্রথমে একটা আবেশ রয়েছে। প্রায় প্রথম দর্শনের ক্ষেত্রেই বলা যায় বুঝি সেটা। এখনো ঐ একশ দেখলে, অবশ্যি কদাচিৎই ঐ একশ টাকার নজরানা আমার নজরে পড়েছে। তবে কদাচ হলেও, যখনই ঐ বস্তু নিজের করতলে এসছে বা পেয়েছি-এখনও বলতে কি, সেই প্রথম স্পর্শের শিহরণ! সেই রোমাঞ্চ!

ফর্বেস ম্যানসনে পাঁচ-সাতশোর মতন ছেলে ছিল মনে হয়। সবাই তারা কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক।

অনেকেই তাদের গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনেও পড়ত। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের কাজও করত। আমিও তাদের দলে সেই দলে এসে ভিড়লাম।

কয়েকদিন কলেজের ক্লাসে যোগ দিয়েছিলাম মনে পড়ে। কিন্তু বিশেষ উৎসাহ বোধ করিনি। সর্বদাই আমার মন বাইরের জন্য উড়ুউড়ু করত।

বিকেলে আমাদের শোভাযাত্রা করে বেরুতে হতো দল বেঁধে নানান ধ্বনি দিয়ে। বন্দেমাতরম, মহাত্মা গান্ধীজী কি জয়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কি জয় ইত্যাদি ইত্যাদি। মুহুর্মুহু এইসব আওয়াজ ছেড়ে রাজপথ ধরে কুচকাওয়াজ করে যেতাম আমরা। দুপাশের জনতা দাঁড়িয়ে পড়ত, দেখত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিধ্বনিও আসত তাদের দিক থেকে।

কিন্তু দিন কয়েক এই করেই অরুচি ধরে গেল আমার। এ আবার কী কাজ! এই করে কি দেশ স্বাধীন হবে নাকি। এই গলা ফাটিয়ে ডাক ছেড়ে?

এইসব কার্যকলাপের থেকে মাঝে মাঝেই আমি ডুব দিতাম। ডুব সাঁতারে চলে যেতাম, বেশি দূর নয়, সামনের ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। বিকেলে সেখানে রাজ্যের ছেলেরা, কচি আর কাঁচা, বালক আর কিশোরের দল মাততো এসে খেলাধূলায়। পার্কের একটা বেঞ্চে বসে বসে সেইসব দেখতাম-ভালো লাগত বেশ।

ফর্বেস ম্যানসনে আমাদের ওপর নজর রাখতে কয়েকজন পাহারোলাও বসে থাকত সেই স্কোয়ারে–তারা কিছু বলত না আমাদের, আমরাও না, তবে মনে হত আমাদের প্রতি যেন তাদের বেশ সহানুভুতি রয়েছে। গান্ধী মহারাজের ভারী ভক্ত ছিল তারা। আমাদের ভলান্টীয়ারদের তারা হোলটীয়ার বলত।

এমনি একটা পাহারোলার একটা গানের এক কলি এখনো মনে আছে আমার। পার্কে আমাদের ছেলেরা জয়ধ্বনি দিয়ে প্যারেড করছিল, তাতে যোগ না দিয়ে একটা বেঞ্চে চুপ করে বসে আমি দেখছিলাম আর আমার পাশেই বসেছিল হোমরাচোমরা এক কনেস্টবল মাথা নেড়ে বিচিত্র সুরলহরীর এক বাংলা গান ধরেছিল সে।

নৌতুন গাসে নৌতুন নৌতুন
ফুল ফুটিয়েছে!
 আরে নৌতুন গাসে নৌতুন নৌতুন
ফুল ফুটিয়েসে…আরে, নৌতুন
গাসে নৌতুন নৌতুন…

পাহারোলা গান গাইছে! তাও আবার বাংলা গান! তার নৌতুনত্ব শ্রীকান্তর কাবুলিওয়ালার গানের মতই চমৎকৃত করেছিল আমাকে।

সেখানেই প্রায় আমার সমবয়সী একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। খবরের কাগজ বেচত সে। হিন্দুস্থানীদের মতন বাঙ্গালীর ছেলেকে অমন অল্পবয়সে এই হকারের কাজে দেখা সেই আমার প্রথম।

আমায় অমনি অমনি সব কাগজে চোখ বুলোতে দিত সে। ভাব হয়েছিল তার সঙ্গে। প্রথম দিন তো চমকেই গেছলাম আমি আরে, বসুমতীর আবার এ কী চেহারা।

অবাক হবার মতই বটে। যে বসুমতীর আধখানায় শুয়ে বাকী অর্ধেক গা-মুড়ি দেওয়া যায়, তার এই বেজায় বেটেখাটো আবির্ভাব।

কী আবার চেহারা! ছেলেটি বলল : বসুমতী তো এইরকমই। চিরকালই এই রকম। সেও কম অবাক হয়নি আমার বিস্ময়ে।

আমার বিস্ময়ের কারণ ব্যক্ত করার পর সে জানালো, আরে, সে হচ্ছে গে সাপ্তাহিক বসুমতী, মফস্বল সংস্করণের, আর এটা যে দৈনিকতা দেখছ না! সব দৈনিকেরই এইরকমই চেহারা এখন।

দেখলাম বটে, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার সব অভিন্ন আকারে প্রকাশিত। ভারতবর্ষই যেকালে নতুন রূপ ধরতে যাচ্ছে তখন বসুমতী যে চেহারা পালটাবে তা আর বিচিত্র কী?

গোটা দুনিয়াটাই পালটাতে যাচ্ছে গান্ধিজীর মাহাত্মে।

তুমি এই বয়সে কাগজ বেচছ যে? ইস্কুলে পড়ো না?

পড়ি বই কি। মতি শীলের কলেজে পড়ি আমি। আর অবসরের সময় এই কাগজ বেচে দু পয়সা উপায় করি।

কলেজে পড়ো তুমি? বলল কী হে? বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়!–তুমি যে আমার চেয়েও ছোট গো!

এমন কি আর ছোটো! তাছাড়া, নামে কলেজ হলেও আসলে ওটা আমাদের ইস্কুলই। ফ্রী ইস্কুল। সব ছেলেই বিনা বেতনে পড়তে পায় সেখানে। ছেলেটি জানায় : মহাত্মা মতি শীলের হয়ত বাসনা ছিল ইস্কুলের সঙ্গে কলেজ করবার, তাঁর মারা যাবার ফলে সেটা আর হয়ে ওঠেনি বোধ হয়।

তাই বলো। তা বেশ। তা, এই কাগজ বেচে কিরকম উপায় হয় তোমার?

মন্দ নয়। প্রত্যেক কাগজে এক আধলা। শতকরা পঁচিশ হচ্ছে আমাদের কমিশন দুপয়সা দাম তো কাগজের। একশ কাগজ বেচতে পারলে সাড়ে বারো আনা লাভ।

তাই নাকি? খুব লাভ তো। ভালো তো খুব।

চার-পাঁচশ কাগজ দেখতে না দেখতে কেটে যায়। কাগজ পাওয়াই দায়। কাগজের জন্যে রোজ সকালে মারামারি বাঁধে। তা জানো?

তাই নাকি? কোথায় বাধে মারামারিটা? আমার কৌতূহল।

কাগজের আপিসে আপিসে। আমি ভোর বেলায় উঠে গিয়ে কাগজ নিয়ে আসি লাইন লাগিয়ে–আর সব হকারও থাকে সেই লাইনে বেশি কাগজ পাবার জন্য সবাই কাড়াকাড়ি লাগায়।

আমি যদি কাগজ বেচি? বেচতে দেবে তারা আমাকে?

কেন দেবে না? যে যাবে, যে চাইবে, তাকেই দেবে।

নিয়মটা কি শুনি তো, ঐ কাগজ পাবার? খুব সকালে গিয়ে ঐ লাইন লাগাতে হয়–এই?

কমিশন বাদে পুরো দামটা জমা দিয়ে ফাগজ নিতে হয় এই হচ্ছে নিয়ম। এছাড়া কিছু নয়! সে বলে : আর তার জন্যেই পড়ে যায় কাড়াকাড়ি।

হোক গে কাড়াকাড়ি। মারামারি বাধে না তো? মারামারির মধ্যে যাব কেন আমি? নিক না সবাই কাগজ, যার যত খুশি আপত্তি কী? সবার আশ মেটার পর যা থাকবে তার থেকেই নেব না হয়। মারামারির দরকার কী আমার?

তাহলেও লাগবে মারামারি। হিন্দুস্থানী হকাররা সহজে ছাড়বার পাত্র না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেচে তারা। সেখানেই বিক্রি হয় বেশি বেশি। আর, বাঙালী ভদ্রলোকরাই তো কেনে যতো কাগজ। বাঙালীর ছেলে দেখলে তার কাছ থেকেই তারা কিনবে। তাই হিন্দুস্থানীরা তাদের ধারেকাছে কোনো বাঙালীর ছেলেকে দাঁড়াইে দেয় না। পাশাপাশি বেচতে দেয় না। দাঁড়ালেই মেরে ভাগিয়ে দেয় তারা। একদিন এমন পিট্টি দিয়েছিল আমায়।…তারপরই আমি হ্যারিসন রোডের মোড় ছেড়ে দিয়ে বৌবাজার পেরিয়ে এই ওয়েলিংটন স্কোয়ারে এসে বেচতে লেগেছি। সব ভালো ভালো কর্নারেই হিন্দুস্থানী বেচনেওয়ালা! আমরা যাই কোথায়? আমাদেরও তো বেচতে হবে, বাঁচতে হবে।

তুমি আমায় নিয়ে যাবে সেই খবরকাগজের আপিসে? আলাপ করিয়ে দেবে কাগজওয়ালাদের সঙ্গে? আমিও বের কাগজ।

নিয়ে যাব না কেন? দুজনে মিলে পাশাপাশি বেচলে জোর পাওয়া যাবে কলজেয়। দুজনেরই বিক্রি হবে…কিন্তু একটা কথা, কাগজ নিতে হলে টাকা জমা দিতে হয় আগে, আপিসেই জমা নিয়ে.থাকে। সে টাকা তুমি পাবে কোথায়?

সে আমি পেয়ে যাব…।

তা তুমি পাবে। আমিই তোমায় দেবোদিতে পারব গোড়ায়। তারপর তুমি সুবিধা মতন সেটা আমায় শুধে দিয়ে।

না, তোমায় দিতে হবে না। একজনের কাছ থেকে কদিন আগে একশ টাকা পেয়েছি না? জামাকাপড় ইত্যাদি সব কিনেটিনেও পঁচিশ-ত্রিশ, টাকার মতন পড়ে রয়েছে এখন। তাতে হবে না?

খুব খুব। কিন্তু তোমার একশ টাকার এত টাকা এই কদিনেই তুমি উড়িয়ে দিলে কী করে?

খেয়েটেয়ে। আবার কী করে? আমি কই : টাকা তো ওই করেই ওড়ায়। খেয়ে ফতুর হয় না মানুষ?

এত এত কী খেলে হে?

কত কী! কলকাতায় কত যে খাবার জিনিস। কতো রকমের যে, চোখে দেখলে বিশ্বাস হয় না, চেখে দেখতে হয়। দোকানে দোকানে থরে থরে সাজানো। রকমারি সন্দেশ। অবশ্যি রসকদম আর খাজার মতন মেঠাই এখানে মেলে না তা ঠিক, কিন্তু তাহলেও তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম যায় না। তাছাড়া ঐ রাবড়ি! কী জিনিস যে ভাই। বলতেই আমার জিভের জল চলকে ওঠে। এক সন্দেশের দোকানে পুরু দুধের সর পাওয়া যায় কিনা শুধিয়েছিলাম, পেলে রসগোল্লা কুচিয়ে তার সঙ্গে মিশিয়ে খেতাম। সে যে কী চমৎকার খেতে কী বলব! তা, রসগোল্লা সেখানে অঢেল ছিল, বেশ বড়ো বড়ো সাইজেরই, তারা বলল যে, ওগুলো রসগোল্লা নয় ভাই, রাজভোগ। বুঝলাম যে রসগোল্লারই এক রাজসংস্করণ। কিন্তু তার কুচিকুচির সঙ্গে মেশাবো যে সেই দুধের সরই মিললো না। বলল যে সর আর ক্ষীর একাকার করে একটা জিনিস আছে নাকি তাদের সেটা একবার চেখে দেখতে পারি ইচ্ছে করলে। ভাঁড়ে ভরে দিল-হাতে হাতে পরীক্ষা করে দেখলাম–জিভ আর কানের বিবাদ মিটিয়ে…রসগোল্লা আর সরের সংমিশ্রণের চেয়েও সেটা ভাই আরো চমৎকার। সেই জিনিসটারই নাম রাবড়ি। অ্যাতো রাবড়ি এই কদিনে খেয়েছি না…চলো, আজ তোমায় খাওয়াবো।

আমার খাওয়া! সে কয় : তার চেয়েও ঢের খাসা খাসা খাবার আছে কলকাতায়। রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায়।

রেস্টুরেন্ট! সে আবার কী ভাই?

সেও একরকমের খাবারের দোকান। তবে অন্য ধরনের খাবার–অন্য কায়দার দোকান। চেয়ার-টেবিলে সাজানো-সেখানে বসে খেতে হয় সব।

কী খাওয়ায় সেখানে? কী কী খাবার পাওয়া যায় শুনি?

 চপ কাটলেট! কারি কোর্মা, মোগলাই-পরোটা…আরো কতো কী! যেয়োনা আমার সঙ্গে আজ, যাবে? আমি তোমায় খাওয়াব না হয়।

আচ্ছা আচ্ছা, হবেখন। প্রথম দিন আমিই আজ খাওয়াই…তারপর আরেকদিন তুমি আমায় খাওয়াবে, কেমন? তুমি আমায় খবর কাগজের আপিসে নিয়ে যাও তো আগে…টাকা রোজগারের ব্যবস্থা করি…তারপর খাওয়াদাওয়ার দিন তো পইে আছে সামনে। কিন্তু ভাই, একটা কথা। আমরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পাশাপাশি কাগজ বেচব কিন্তু। আমি তোমার খদ্দের ভাঙিয়ে তোমার লাভের কড়িতে ভাগ বসাতে চাই না।

তা কেন? তা কেন? তাতে আমি কিছু মনে করব না।

না ভাই। কলকাতায় কাগজ বেচার কি জায়গা নেই আর? তবে বিকেলের দিকে একটা। নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে এসে আমরা মিলব। কোনো রেস্টুরেন্টে কি কোনো বায়স্কোপে? :

বায়স্কোপও তুমি দ্যাখো নাকি? দেখেচ নাকি?

 বাঃ, আমার অতো টাকা কি খালি খালি খেয়েই উড়ে গেল নাকি? এলমো দি মাইটীর সিরীয়াল দেখেছি–এমন রোমাঞ্চকর, কী বলব! আর চার্লি চ্যাপলিন ম্যাকসেনেটের দুতিন রীলের কমিক ছবি–এমন হাসির যে! দেখনি তুমি?

ক্কচিৎ কদাচ। আমি খালি ঘুরে বেড়াই। রাস্তায় রাস্তায় খালি খালি ঘুরে বেড়াতে এমন ভালো লাগে আমার। কতো কী দেখা যায় যে! সে জানায়।

আমারও রাস্তায় ঘুরতে ভালো লাগে খুব। যদি চেনাশোনা কাউকে নজরে পড়ে যায় কখনো।

কলকাতায় তোমার চেনা লোক আছে নাকি কেউ?

 নেই আবার? আমার এক বন্ধুই থাকে আহিরিটোলায়। তার নাম রিনি।

রিনি! ভারী অত নাম তো! ডাকনাম হবে নিশ্চয়। কতত নম্বর আহিরিটোলা?

নম্বরটাই যে মনে নেই আমার। ভুলে মেরে দিয়েছি–যা আমার মেমারি ভাই! তোমার ঐ আহিরিটোলা কি বড় একটা রাস্তা?

নম্বর না জানা থাকলে কলকাতায় ঠিকানা খুঁজে বার করা ভারী মুশকিল! বলে ঠিকানা জানা থাকলেই মেলে না। তবে তোমার ঐ আহিরিটোলা তেমনটা বড় রাস্তা নয়–চৌরঙ্গী কি হ্যারিসন রোডের মতন না। তাহলেও নেহাত ছোট নয়–শ দুতিন বাড়ি আছে বোধহয় সেই রাস্তাটায়।

থাক না। সেখানেই আমার কাগজ বেচব আমি। রাস্তার এ-মোড় থেকে ও-মোড়। ও-মোড় থেকে এ-মোড়। সকাল থেকে সন্ধ্যে! তার মধ্যেও কি সে একটিবারের জন্যেও ঘরের বার হবে না? তাহলেই তো দেখা হয়ে যাবে তার সঙ্গে আমার।

তা হতে পারে। যদি তুমি সারাদিন ঐ কাগজের তাড়া বগলে করে রাস্তার এ-মোড় থেকে ও-মোড় আর ও-মোড় থেকে এ-মোড়-খালি খালি তাই করো যদি

তাহলে মোড়ে মোড়ে ঘুরে ঘুরে একদিন হয়ত বা বেঁচে উঠতে পারি চাই কি!

.

৩৬.

 সেদিন সন্ধ্যের পরে ফর্বেস ম্যানসনে ফিরতে, দোতলায় উঠবার মুখেই বিপিনদার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেল।

কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

বেড়াচ্ছিলাম।

বেড়াচ্ছিলে? সেই দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরিয়েছে, আর এখন রাত সাড়ে সাতটা। তাঁর হাতঘড়িটা দেখালেন : কী করছিলে এতক্ষণ?

বেড়াচ্ছিলাম।

এতক্ষণ ধরে বেড়াচ্ছিলে? কোথায় বেড়াচ্ছিল এত এত?

 এখানে সেখানে–ইতস্তত। বলতে কোন ইতস্তত করি না।

তাঁর সঙ্গে ছেলেটি তাঁর কানে কানে কী যেন গুজগুজ করল। অনুচ্চ সেই গুঞ্জনধ্বনি দিব্যকর্ণে ধরা পড়ল আমার।

একটা স্পাই। ইলিসিয়াম রো-এ গেছল মনে হয়। তার ফিসফিসানি আমার কানে আসে।

ইলিসিয়াম রো-এ গেছলে তুমি? বিপিনদার চোখ মুখ গলা রীতিমতন কড়া।

কোথায় যে ইলিসিয়াম তাই আমি জানি না। জিনিসটা কী ঐ ইলিসিয়াম? আমি জানতে চাই।

যদি কোনো খাবার জায়গা কিংবা জিনিস হয় তাহলে যেতে কিংবা খেতে আমার দ্বিধা নেই, মনে মনে জানাই।

সেখান থেকেই আসা হচ্ছে আর কোথায় তা তুমি জানো না? বিপিনদা আরো কঠিন।

 ন্যাকা! সেই ছেলেটি উতোর গায়–নেকু!

পিকেটিং নেই, প্যারেড করা নেই। টহল দেওয়া সব চুলোয় গেল, ইলিসিয়াম রো-এ গিয়ে রোজ রোজ এই স্পাইগিরি?…না, না। এখানে থেকে ওসব কাজ তোমার করা চলবে না বাপু।

কোথায় গেছলাম জানতে চান? দেখুন তবে। বলে পকেট থেকে দুখানা সিনেমা টিকিটের কাটা আধখানা ছুঁড়ে দিই সেই সঙ্গে আগাম কাটা নটার শোয়ের পুরো একখানাও।–যদি অ্যালাউ করেন তবে ওই নটার শোয়েও যেতে চাই আবার আরেকটা সিনেমায়।

ছেলেটা টিকিটগুলি কুড়িয়ে নিয়ে বিপিনদার দিকে বাড়িয়ে দেয় তিনি সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করেন না।–বুঝেচি। রোজ তিনটে করে সিনেমা দেখা হচ্ছে বাবু? এত টাকা আসছে কোথা থেকে শুনি?

নির্ঘাৎ স্পাই। ফোড়ন কাটে সেই ছেলেটা-টিকিটগুলো নিজের পকেটে পুরে নেয়! সেখান থেকেই আসছে সব। টাকার অভাবটা কী ওর?

কেন, আপনিই তো সেদিন দিলেন আমায় অতগুলো টাকা… কৈফিয়তের সুরে বলতে চাই। মনে নেই?

দেশবন্ধু কি এর জন্যেই টাকা দিয়েছেন তোমাকে? এই সিনেমা দেখবার জন্যে? টাকাগুলো দাও আমায়। আমার কাছে জমা থাক। তিনি হাত বাড়ান।

আমার পকেটের সিন্দুক থেকে বার করে দিই সব–বিন্দুমাত্রই বাকী ছিল আর।

খুচরো-খাচরা মিলিয়ে এ তো দেখছি সাত-আট টাকা মোটমোট? এই মাত্তর? আর সব?

খরচ হয়ে গেছে…খেয়েদেয়ে আর সিনেমা দেখেই উড়ে গেছে। কবুল করতে হয়।

না বাপু, এখানে থাকা আর পোষাবে না তোমার। তোমার সঙ্গদোষে আর সব ছেলেও নষ্ট হয়ে যাবে এখানকার। ঝুড়ির ভেতর একটা পচা ডিম থাকলে ভাললাগুলোকেও পচিয়ে ছাড়ে। সুভাষবাবুর কাছে আমি রিপোর্ট করব। এখান থেকে যেতে হবে তোমাকে।

আমি চুপ করে থাকি, কোন জবাব দিই না। কোথায় আমার কী গলতি হোলো তারই আমি ঠাওর পাই না কোনো।

কী! কথা কইছো না যে

 আচ্ছা।

এখানে এসেছে দেশের কাজ করার জন্য। যারা মায়ের পায়ে শৃঙ্খল ভাঙতে যাচ্ছে, তাদের নিজেদের কড়া শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। উচ্চুঙ্খল হলে চলে না। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে তারা থাকে। এখানে রোজ বিকেলে প্যারেড করার নিয়ম। রাস্তায় রাস্তায়…

জানি। কিন্তু ওসব কাজ আমার ভাল্লাগে না।

কী তোমার ভালো লাগে তাহলে? ঐ সিনেমা দেখাটা?

 গান্ধীজীর জয়ধ্বনি হেঁকে শহরময় টহল দিয়ে বেড়ালে কি দেশ স্বাধীন হবে? কী করে যে তা হতে পারে আমি তো ভেবে পাই না। খালি খালি পা ব্যথা করা কেবল। এই ছাগল চরানোর জন্যেই কি এখানে রাখা হয়েছে আমাদের?

তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। আসছে হপ্তা থেকে বিদ্যায়তনের আদ্য পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, সেটা তুমি দেবে। সুভাষবাবু বলেছেন, তোমায় দিতে হবে পরীক্ষাটা। তারপর তোমার যা খুশি তুমি করোগে। এখানকার নিয়মশৃঙ্খলা যদি তোমার না সয়না মানতে পারো তো নিজের পথ দেখতে হবে তোমাকে।

দেখব।

কী করবে? কোথায় যাবে? ভেবেছ কিছু?

ইলিসিয়াম রো-এর পথে। ছেলেটির টিপ্পনি।

 ভাবিনি এখনো। ভাববোখন। সময়মতন।

পথ আমার দেখাই ছিল, ভাবাও হয়েছিল, কিন্তু প্রকাশ করাটা সমীচীন বোধ করলাম না। পদ্যাকারে শ্লোকাধারে গাঁথা বাবার কবিতা বইয়ের অসংখ্য সদুপদেশ পড়ে পড়ে আর শুনে শুনে মজ্জাগত হয়েছিল আমার, সারাজীবন ধরে পদে পদে কাজে লেগেছে। তার দুটি ছত্র কখনো আমি ভুলিনিঃ

মনেতে চিত্তিবে কার্য না কবে কথায়।
অন্যতে জানিলে কার্য সিদ্ধি নাহি পায়।

এর আমি কোনোদিন অন্যথা করিনি। তাই, মনে মনে যা আমার ভাবা ছিল, ক্ষণে ক্ষণেই ভেবেছি, নিজের অন্তরালেই তাকে রাখলুম, সম্মুখে ব্যক্ত করলাম না।

আসছে হপ্তায় পরীক্ষাটা চুকে গেলে পর যাবার আগে আমার কাছ থেকে তোমার টাকাটা নিয়ে যেয়ো। আর এর মধ্যে তোমার কিছুর দরকার পড়লে আমার কাছে রেফার করবে, বুঝেচ?

আমার আর কিসের দরকার! বলে আমি চলে আসি।—টাকা নিয়ে আমি কী করব!

রমাকান্ত বলে প্রিয়দর্শন একটি ছেলের সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছিল সেখানে আমার (গাঙ্গুলী ছিল বোধ হয় সে, বিপিনদার সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও), সর্বঘটে বিরাজিত তার কাছে গিয়ে বললাম, ঘটনাটা।

এখানে ঐ রকম। এক কথায় সে উড়িয়ে দিল কথাটাই : সবাই এখানে সবাইকে স্পাই বলে সন্দেহ করে। আরও কিছুদিন থাকে না, দেখতে পাবে।

কিন্তু কেন ভাই? ওর কথায় অবাক হয়ে যাই : গান্ধীজীর আন্দোলন তো লুকোছাপা কিছু নেইকো, রাখাঢাকা নেই কিছুই–সবই তো খোলামেলা। স্পাইয়ের এত ভয় কেন এদের তাহলে? স্পাইরা এখানে এসে করবেটা কী, শুনি?

কে জানে! তোমার ওই বিপিনদাই বলতে পারেন। আর ওঁর ওই চেলারাই।

 দূর ছাই! এসব আমার ভালো লাগে না একদম। আমি হাঁপিয়ে উঠি।

ভালো না লাগলে চলবে কেন ভাই! নিয়মশৃঙ্খলা তো মানতেই হবে। নিয়মশৃঙ্খলা ছাড়া কি কোনো কাজ চলে? চলতে পারে? বিশেষ করে দেশের শৃঙ্খল মোচনের এত বড়ো একটা কাজ? সেই জন্যেই তো বেপরোয়া হয়েও সাধ করে নিয়মের শৃঙ্খলে আমরা নিজেদের বেঁধেছি, তাই না? সোলজারদের কতো কড়া ডিসিপ্লিনের মধ্যে থাকতে হয় তা জানো?

হয়ত তাই। তাই হবে বোধ হয়। দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে গেলে গোড়াতেই নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়। মাতৃভূমির বন্ধন মোচন করতে হলে নিজেকেই বাঁধা রাখা নিয়ম হয়ত বা। সবার স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিরোধ আছে হয়ত কোনোখানে।

কিন্তু দেশের মুক্তির জন্য নিজের অবলুপ্তি–এই অসাধ্য সাধন কি আমার দ্বারা হবার? বাধ্যবাধকতার সাধ্যসাধনা আদপেই আমার ধাতে সয় না যে! কী করে পারব? ছেলেবেলার থেকে বাড়ির আবহাওয়ার বেপরোয়াখানায় বেড়ে উঠে হঠাৎ এখন এত কিছুর পরোয়া করে চলা কি আমার পোষাবে?

না, চলেই যেতে হবে আমাকে এখান থেকে। সহিংসর মত অহিংস পথেও দেশোদ্ধার আমার দ্বারা হল না। কোনো নিয়মনিগড় মেনে চলার ক্ষমতাই নেই আমার। এই শৃঙ্খলাবোধহীনতার জন্যে পরে সুভাষচন্দ্রের কাছেও আমার একবার এই হেনস্তা-এ হেন অবস্থা হয়েছিল। যেমন এখানে তেমনি সেখানেও দোষটা ছিল সম্পূর্ণ আমারই–এই দস্তুর না মানার দোষ। বিশৃঙ্খল আমার কাছে বিশ্রী বলে ঠেকলেও ব্যাপারটার কোথাও কোনো খলতা ছিল না অবশ্যই।

না, বিপিনবিহার, দেখা যাচ্ছে, আমার বরাতে বরদাস্ত হবার নয়। এক বিপিন থেকে আরেক বিপিনের পরিব্রজ্যা শুরু না হতেই খতম হয়ে গেলে দেখতে না দেখতে।

মালদহের বিপিনে সেই পীনোন্নত চরকার খোঁচা খেয়েছিলাম, আর এখানকার ইনি নিজেই পিনের মতন ফুটলেন।

না, চলেই যাব এখান থেকে। এই প্রস্ফুটিত পিনকুসুমের আওতা থেকে। কেবল ওই আদ্য পরীক্ষাটা হওয়া পর্যন্ত থেকে কিংবা আদ্যোপান্ত না দেখেই।

বেরিয়ে পড়লাম তক্ষুনি।

হঠাৎ কী খেয়াল হতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি যে, স্পাই-আইডিয়ার ছেলেটি দূর থেকে নজর রেখে পিছু নিয়েছে আমার।

নিক গে, ইলিসিয়াম রো-র পথে যাচ্ছি না তো, আমার দৌড় ওই ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মোড় অব্দি।

কাগজের হকার ছেলেটার দেখা পাওয়া–গেল সেখানে তখন পর্যন্ত কাগজ বেচছে কোণঘেঁষা হয়ে দাঁড়িয়ে। খবর কাগজের সান্ধ্য সংস্করণ বেচছিল সে তখন।

বসুমতী টেলিগ্রাম! বসুমতী টেলিগ্রাম এক পয়সা, এক পয়সা। হাঁকছিল, সে তেড়ে ফুঁড়ে।

ওঃ! কখন থেকে হন্যে হয়ে আছি তোমার জন্যে। এলফিনস্টোনে নটার শোয়ে যাব না আমারা! এর ভেতর কিছু খেয়েটেয়ে তৈরি হতে হবে না? ব্যস্তভাবে বলল সে।

না ভাই, আমি আজ যাচ্ছিনে।

বারে! আমার টিকিট কিনে রেখেছি যে! দিনভোর কাগজ বেচি-নটায় ছাড়া তো যাবার উপায় নেই আমার।

তুমি যাও। একলাই যাও তুমি। আমার টিকিট বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে আজ। আমি জানাই।

তাতে কী হয়েছে! কিনে নেব আবার।

পয়সা কড়ি আর কিচ্ছু নেই আমার! তামাম ফরফীট!

তোমার না থাক, আমার আছে। আমিই না হয় দেখাবো তোমাকে। তুমি কতত দিন যে খাইয়েছো আমায়?

না, থাকগে। আজকে থাক। তুমি আমায় এই কাগজ ফেরির কাজটা পাইয়ে দাও তো আগে। তারপর দেখা যাবে, কতো সিনেমা দেখা যায়, খাওয়া যায় তারপর।

বেশ, কালকেই আমি নিয়ে যাব তোমায় বসুমতী আপিসে আর আনন্দবাজারে। কর্তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো তোমার…

কিন্তু দাম জমা রেখে কাগজ কেনার টাকা তো নেই আর আমার…?

আমি একটু কিন্তু কিন্তু হই।

তাতে কী! বিশ্বাস করে তোমাকে কাগজ দেবেন তাঁরা, বাঙালীর ছেলেরা নিজের পায়ে দাঁড়াক, তারা চান। সে ভরসা দেয়-তবে প্রথম প্রথম হয়ত কম কম দেবেন। তারপর তাঁদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে, যততা চাইবে, তততা পাবে।

বেশ। কাল ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দেড়টায় যাব ইস্কুলে। এখন যাই। একজন নজর রাখছে আমার ওপর। তা জানো?

তারপর পার্কে তিন চক্কর মেরে মাথা ঠান্ডা করে ফর্বেস ম্যানসনে ফিরি–সেই ছেলেটিকেও তিন পাক ঘুড়িয়ে, তার লেজুড় নিজের পিছনে জুড়ে ফিরে আসি।

তার কদিন বাদে সেই আদ্য পরীক্ষাটা। বাধ্য ছেলের মতই বসে গেলাম পরীক্ষায়।

খাতাপত্তর সব বিদ্যায়তন থেকে যুগিয়েছিল। দেশবন্ধুর টাকায় গোড়াতেই একটা ফাউন্টেনপেন কিনেছিলাম বুক পকেটের শোভাবর্ধনে। আর সস্তা দরের একটা হাতঘড়ি কিনতেও কসুর করিনি সেই সঙ্গে।

কাগজের পিঠে লিখে দিলাম খসখসিয়ে তারপর–যা এল মগজে। আর আমার কলমের ঝর্ণায়।

এবং ঘন্টায় ঘন্টায় খেলাম কত কী যে! বিদ্যায়তনেরই কয়েকজন মিলে পরীক্ষার্থীদের টিফিনের জন্য সাময়িক ক্যানটিন খুলেছিল। গরম গরম চপ কাটলেট বেচত তারা-আর ঘোলের সরবত।

সরবত তো নয়, যেন সুধাই! পরম উপাদেয় সুপেয়টি সেই প্রথম আমার জীবনে চাখা।

তবে ঘোল আমাকে অনেকবারই খেতে হয়েছে, নানা রঙের, নানা রকমের। কিন্তু প্রথম পরিচয়ের সেই সুমধুর স্বাদ এখনো ঘোলাটে হয়ে যায়নি আমার স্মরণে।

সরবত শুধু নিজেই খেলাম না, পছন্দসই আমার বন্ধুদেরও খাওয়ালাম ধরে ধরে। দামটা? রেফার বিপিনদা! তাঁর কাছে আমার টাকা জমা রয়েছে। তাঁর কাছ থেকে পাবেন। তাঁর নাম করতেই রেহাই! ঘোলের সঙ্গে চপ কাটলেট আর মাখন-রূটিরও সদগতি করলাম প্রাণভরে খেয়েছি, খাইয়েছি।

শেষ পরীক্ষাটা দেড়টায় খতম হল যেদিন–মাত্র একখানা পেপার ছিল সেদিন। বাংলার বাংলায় তো আমি দিকপাল, দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন হয়ে পাশ করেছি চিরদিন, এবারও সেইভাবেই তার পাশ কাটালাম।

আদ্য পরীক্ষাটার আদ্যন্ত সেই ছেলেটার নজর ছিল আমার ওপর–বিপিনদার সহচর সেই ছেলেটির।

 শেষ হতে না হতেই এগিয়ে এল সে। এবার তো তোমায় যেতে হচ্ছে এখান থেকে। মনে আছে বিপিনদার কথাটা?

নিশ্চয়! যাব বইকি!

কবে যাচ্ছ? কখন?

এক্ষুনি। চললাম এই। দ্যাখো না! বলেই ফাউন্টেনপেনটা বুক পকেটে খুঁজে হাতঘড়িটা একবার দেখে নিয়েই আমি পা বাড়াই।

কোথায় যাবে শুনি?

যেদিকে দুচোখ যায়। আমি ফোঁস করে উঠি : তোমার কী?

না, আমার কিছু নয়। বিপিনদার কথাটা কেবল মনে করিয়ে দিতে এসেছিলাম আমি।

মনে আছে আমার। সেকথা কি কখনো ভোলবার? আমি জানাই।

যাবার আগে বিপিনদার সঙ্গে দেখা করে যাবে না? দেখা করবে না?

কী জন্যে আবার?

 তোমার টাকা রয়েছে যে তাঁর কাছে…

থাকগে।

নেবে না তোমার টাকা?

কী হবে টাকায়? টাকার আমার কোনো দরকার নেই আর। ইচ্ছে করলে তুমি সেটা নিতে পারো চেয়ে।

শুনে সে একটু খুশি হয়। আর আসবে না এখানে কখনো?

কী প্রয়োজন?

আর কিছু না হোক, তোমার পরীক্ষার ফলাফলটা জানাতে?

 তার জন্যে কোনো মাথাব্যাথা নেই আমার–যা হবার হবে, সারা জীবনটাই তো পরীক্ষা। জীবনভোরই চলবে এই! বলেই আমি পা বাড়াই।

ও পথে যেয়ো না ভাই! মারা পড়বে বেঘোরে। আমার হিতচিকীর্ষায় সে সদুপদেশ দিতে আসে।

কোন পথের কথা কইছো? থমকে দাঁড়াতে হয় আমায়-চমক লাগে ওর কথাটায়।

ঐ ইলিসিয়াম রো-এর পথ। গোয়েন্দাগিরির অনেক ঝামেলা, অনেক জ্বালা। কাঁচা টাকা হাতে আসে বটে, কিন্তু একটু গড়বড় হলেই মারা পড়তে হয়। হয় পুলিসেই মার লাগায় নয়তো অ্যানার্কিস্টদের হাতে খতম হতে হয় শেষটায়।

মনে থাকবে আমার। বলতে বলতে আমি এগোই। আরো সদুপদেশের অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়াই না আর।

এই ভেবে সান্ত্বনা পাই, এই কদিনে নিজেও যেমন খেয়েছি এনতার, তেমনি বিপিনদাকেও খাইয়ে যেতে পারলাম খানিক।

আর কিছু না, ঐ ঘোল!

 ছআনা দামের প্রায় ছত্রিশ গেলাশ বসিয়েছি এই ছদিনে। সবান্ধব চপ কাটলেট যে কতো ধ্বসালাম তার তো লেখাজোখা নেইকো।

আমার কাছে নেই অন্তত। থাকলে তাদের কাছেই রয়েছে-সেই বেচারাম বেচারাদের কাছেই। কেনারামের কোনো দায় নেই তার। তারা সবাই এখন গিয়ে ছিঁড়ে খাবে বিপিনদাকেই–পারে যদি। তাঁর কাছেই রেফার করার কথা।

নামমাত্র তো দাম না। সাতাশ টাকা তো নির্ঘাত, মনে মনে হিসেব কষে পাই।

আর তাঁর কাছে মজুত আমার সাত টাকা মাত্তর?

সাত টাকা থেকে সাতাশ টাকা বাদ দিলে কী থাকে?

মাইনাস বিশ। প্রায় বিষতুল্যই।

কিন্তু আমার কাছে নিছক আনন্দই!

এর চেয়ে ফুর্তি আর হয় না।

আর ফুর্তি নিজের মুক্তি লাভ করেও। সম্মুখে উন্মুক্ত ঐ পথ ধরে…স্বরাজলাভের পথে। পা বাড়াবার আগে রাজপথের স্বরাজ আমার হাতে এসে গেল।

.

৩৭.

 পরদিন দেড়টা না বাজতেই আমি মতিশীলের দেউড়িতে।

টিফিনের ঘন্টা পড়তেই হকার বন্ধু সেই ছেলেটি বেরিয়ে এসেছে। স্কুলের গেটেই তাকে ধরা গেল।–তোমাদের দারোয়ান আমাকে আটকে রেখেছে ভাই। যেতেই দিচ্ছে না। ভেতরে।

দেবে না তো। হেডমাস্টারের হুকুম না হলে বাইরের কাউকে কি যেতে দেয় কখনো?

যাকগে, যেতে দাও। চলো এবার খবর কাগজের আপিসে যাওয়া যাক, কেমন?

মল্লিক বাড়ি যাচ্ছি যে এখন। এখনই যে খেতে দেয়, এই টিফিনের সময়টাতেই ফাঁক পাই খাবার।

খাবার জায়গায় অভাব নাকি কলকাতায়? এই গেটের থেকেই পেটে দিতে থাকে না। এখান থেকেই শুরু করা যাক। কেমন আলুকালি ঘুগনি সব বিক্রি হচ্ছে এখেনেই। ডালমুট, চানাচুর, চিনেবাদাম ছড়ান মোড়ে মোড়ে। খেতে খেতে যাই আমরা, যেতে যেতে খাই।

বাজে খরচা খালি। মল্লিকবাড়ি অমনি অমনি খেলে পেটও ভরে, তেমনি পয়সাটা বেঁচে যায় না আমাদের?

তোমার কোনো খরচা হবে না, আমি খাওয়াচ্ছি তোমায়।

তুমি কোথায় পাবে? কাল যে বললে তোমার কাছে কোনো পয়সাই নেই আর?

কাল ছিল না, আজ হয়েছে। ফাউন্টেন পেনটা বেচে দিলাম না সকালে? কী হবে আর কলম রেখে? লেখাপড়ার পাট চুকেছে, পরীক্ষাটাও মিটে গেল। কলমের আর কী দরকার আমার।

অমন ভালো কলমটা, অত শখের, বেচে দিলে অমনি?

 কিনবো আবার কোনদিন। কাগজের দাম জমা দিতে হবে না আজ? সেইজন্যেই বেচতে হোলো

আহা, বললাম না তোমায় আমি, চেষ্টা করলে টাকা জমা না দিয়েও মিলত কাগজ? আনন্দবাজারের কর্তাদের তুমি জানো না ভাই! কী চমৎকার লোক যে সুরেশদারা! তাঁরা তো বাঙালীর ছেলেদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার জন্যই উৎসাহ দেন, সবরকম সাহায্য করেন সব সময়। কেন নাহক বেচতে গেলে কলম!

ওর চেয়ে ভালো কলম কিনবো দেখো। কাগজ বেচে টাকা হোক না! চলল তো এখন।

আমরা বউবাজারের পথ ধরি। আগে বসুমতীর কাজটা সেরে তার পরে গোলদীঘিতে আনন্দবাজার কার্যালয়ে যাওয়া যাবে। তারপর সেখেন থেকে সে আমায় নিয়ে যাবে ২৩দেলখোশ কেবিন বলে খাসা একটা খাবার জায়গায়। হ্যারিসন রোড়ের মোড়ে।

ডানদিকের ফুটপাত ধরে যেতে যেতে চেরী প্রেস নজরে পড়ল আমাদের। বিজলীর সাইনবোর্ড লাগানো দেখলাম। দেখেই না আমি লাফিয়ে উঠেছি।

আরে, বিজলী যে! সাপ্তাহিক বিজলী। দেশের বাড়িতে যেত আমাদের। বাবা নিতেন। বোমারু বারীন ঘোষদের কাগজ। দ্বীপান্তর থেকে ফিরে এসে বের করেছে ওরা। বাবা ভারী ভক্ত তা জানো?

হপ্তায় একদিন বেরোয় মোটে। সে বললে : দৈনিক নয় তো।

নাই বা হোলো। এ কাগজও তো বেচতে পারি আমরা? পারি না? পাওয়া যায় না বিজলী?

কেন যাবে না। একই কমিশন, ওই টোয়েনটি ফাইভ পারসেন্ট। বিজলীরও খুব বিক্রি, আমি জানি। ভেতরে গিয়ে খোঁজে নেওয়া যাক, এসো।

হৃষীকেশ কাঞ্জিলাল বিজলীর ম্যানেজার। মাটির মানুষ। এমন ঠান্ডা শান্ত প্রকৃতির যে, বোমার দলে কখনো যে ছিলেন তা ভাবাই যায় না। ভোলানাথের মতন চেহারা। আস্তে আস্তে কথা কন।

আমাদের আরজি শুনে সহজেই রাজী হয়ে গেলেন। নাম-ঠিকানা টুকে নিলেন আমাদের।

আমার নামটায় কেমন একটা খটকা লাগল তাঁর। একটুকরো চিরকুটে কী যেন লিখে তিনি পাঠিয়ে দিলেন আমাদের নলিনী সরকারের কাছে।

নলিনীকান্ত বিজলীর সম্পাদক। চিরকুটখানা দেখে তিনি আমার দিকে তাকালেন তোমার নামই শিবরাম? তুমিই কি আমাদের কাগজে লিখেছিলে?

হ্যাঁ। এক-আধটা লিখেছি কেবল। ঐ কবিতাই।

চাঁপদাড়িওয়ালা কোনো বয়স্ক লোকই হবে শিবরাম–এই আমরা ঠাউরেছিলাম।

শুনে আমি গালে হাত দিই। নিজের গালে।

দাড়ি পাবো কোথায়? আমাকে ছেলেমানুষ দেখে ভারী হতাশ হয়েছেন মনে হল।

লেখার হাত আছে তোমার, হাতের লেখাটাও বেশ পাকা। তিনি বলেন–তাই দেখেই ঐ সন্দেহ হয়েছিল। খাতার পর খাতা লিখে লিখে বোঝাই করে হাত পাকিয়েছ বুঝি?

না না। বেশি কী লিখেছি এমন! ঐ দুয়েকটাই। আমি জানাই–ভারতীতে আর বিজলীতেই বেরিয়েছে যে-কটা। আচ্ছা, আপনাদের উনপঞ্চাশী কে লেখেন? আর ওই খড়কুটো? ওগুলো খুব ভালো লাগে আমার।

মার্ক টোয়েনের থেকে আমি হাসির প্রেরণা পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু মনে হয়, ব্যঙ্গরচনার আমার প্রথম উদ্দীপনা ঐ উনপঞ্চাশীতে। সেই উনপঞ্চাশ বায়ুর প্রকোপেই আমি যেন খড়কুটোর মতই ভেসে গিয়েছি-এতদিন ধরে আমার এই অল্পবিস্তর লেখার সেইখানেই বুঝি উৎসাহ। উৎসর থেকেই অঙ্কুরিত আমার এই উৎসার। হাসির গল্পে এত উৎবসব এতদিনকার!

আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে নলিনীদা শুধোলেন–কী ছিল যেন তোমার কবিতাটা?

জানি জানি/সবাই সবে ছাড়বে। চলার পথে/কে কার…।

ঐ অব্দি গিয়েই আমার কেকা-ধ্বনি থামাতে হয়। খট্‌কার ছিটকিনিটা ভেতর থেকেই কে যেন এঁটে দেয়। বাবা! এই বোমারুদের সামনে চুমা দিয়ে এগুবো? সাহস হয় না আমার। যদিও আমার ধারণায় বোমা আর চুমা একই ধরনের প্রায়। দু-ই তোমায় মুহূর্তের মধ্যে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

কে কার চুমু কাড়বে। তিনি নিজেই কবিতাটাকে পদস্থ করেন। তারপরে শোনো শোনো বারীন! হাঁকেন তিনি। শুনছো!

ঘরের কোণায় আরো দুজনা বসেছিলেন। নলিনীদার কথায় তাঁরা মুখ ফেরালেন।

উপেনদা, দেখেছেন ছেলেটাকে? সেই শিবরাম।…যুগান্তকারী লোকদের কাছে যে যুগান্তকারী কবিতা পাঠিয়েছিল।…।

নলিনীদা বিশেষ অত্যুক্তি করেননি। সেকালের বাংলা লেখায় চুমুর ছড়াছড়ি তেমন দেখা যেত না। কবিগুরুর সেই বিখ্যাত সনেটটি বাদে শরৎচন্দ্রের কিরণময়ীই দিবাকরের ভিজে ঠোঁটের উপর একটা চুমু খেয়েছিল যা! শুনে আমি ভিজে বেড়ালটির মত চুপ করে থাকি।

ঘরে ঢোকামাত্র দেখেছি, একটা বর্ণচোরা আম। উপেনদা একটু দৃম্পাত করেন মাত্র। এক নম্বরের এঁচোড়ে পাকা। দেখলেই বোঝা যায়। নিজগুণেই পেকেছে, কাউকে কিলিয়ে পাকাতে হয়নি।

এক নজরেই উপেনদা ঠিক চিনে নিয়েছিলেন আমাকে।

 বারীনদা কিছু বললেন না। তিনি যেন একটু গম্ভীর প্রকৃতির বলেই আমার বোধ হয়।

ছেলেটার সাহস তো কম নয়! বোমার লোকদের কাছে চুমার তত্ত্ব পাঠানো! ঠাট্টার ছলেই কথাটা বলেন যেন নলিনীদা।

উনপঞ্চাশী কে লেখেন তুমি জানতে চাইছিলে না? ঐ উপীনদা, আমাদের উনিই লেখেন। আর খড়কুটোর টিপ্পনীগুলো আমরা সবাই মিলে বানাই, বুঝেছো?

ভারী চমৎকার হয়। ঐ দুটোই। দুটো অবশ্যি দুরকমের চমৎকার।

 তারপর কাজের কথা চুকে গেলে পর সেখান থেকে আমরা বসুমতীতে গেলাম–সেখান হয়ে গোলদীঘির শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেসে। আমার সঙ্গী ছেলেটির সহায়তায় সব জায়গাতেই সহজে কাগজ পাবার ব্যবস্থা হয়ে গেল। কাল সকাল থেকেই কাগজ নিয়ে বেচতে লাগব ঠিক হল। সন্ধ্যেবেলায় কমিশন বাদে কাগজের দাম আপিসে জমা দিয়ে এলে পরের দিন ফের আবার কাগজ পাবার বন্দোবস্ত।

ছেলেটা বলল, ইচ্ছে করলে তুমি ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মোড়েও কাগজ বেচতে পারো কাল থেকে।

আর তুমি? তোমার কোনো অসুবিধা হবে না?

আমি ভাবছি ভবানীপুরের দিকে যাব। সেখানে কাগজ বেশি কাটে বলে শুনেছি।

না। ওখানে কাগজ বেচতে পারব না আমি। আমার একটু অসুবিধা আছে। ফর্বেস ম্যানসন ছেড়ে এসেছি না আমি? তারই সামনে দাঁড়িয়ে…

কোথায় বেচবে তাহলে?

 ঐ ওয়েলিংটনের মোড় ছাড়া যে কোনো জায়গায়। কিন্তু এখান থেকে তুমি চলে গেলে তোমার পাত্তা পাব কোথায়?

মতিশীলের ইস্কুলে। টিফিনের ঘন্টা পড়লেই আমি বেরিয়ে পড়ি। মল্লিকবাড়ি খেতে যাই তো। তখনই খেতে দেয় সবাইকে।

আমাকেও সেখানেই যেতে হবে খেতে মনে হচ্ছে। আমি কই–কাগজ বেচে যা এক-আধ টাকা লাভ হবে তা যদি খেয়েদেয়েই ফুকে দিই তো সিনেমা দেখব কিসে? একটা করে ছবি তত রোজ দেখতেই হবে আমাকে-নটার শোয়ে অন্তত।

শোয়ের পরে শোয়ার কথাটা মনে পড়ে যায়-খাওয়ার ধান্দাটা চুকলো না হয়, কিন্তু শোবো কোথায়? রাত কাটাব কোনখানে হে? তোমাদের ওই ইস্কুলে তোমার কাছে শুতে যাই যদি? যে পাড়াতেই কাগজ বেচো না, শুতে তো হবে তোমায় সেইখানেই।

সেইখানেই শোব বটে, কিন্তু দারোয়ান তো তোমায় অ্যালাউ করবে না ভাই! হেডমাস্টারের পারমিশন পেলে তবে সে দেবে। তাহলে আমাদের ইস্কুলে ভর্তি হতে হবে তোমাকে।

বা রে! ইস্কুলে ভর্তি হব কি! কলেজের ছেলে না আমি? কয়েকদিনের হলেও ন্যাশনাল কলেজে পড়েছি তো।

তাতে কি! লোক দেখানো ইস্কুলে অ্যাটেণ্ড করবে কেবল, তাহলেই হবে। ফ্রী ইস্কুল তো, বেতন-টেন লাগে না তো আর।

তাহলেও ভর্তি হতে গেলে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট লাগে না? সেসব আমি পাচ্ছি কোথায়?

ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিলেই কি না দিলেই কি! ওরা ওসব দেখে ভর্তি করে না। নিজেদের ইস্কুলে ছেলে নেবার আগে তাকে বাজিয়ে দ্যাখে। নিজেরা পরীক্ষা করে দেখে তবে নেয়। যে ক্লাসের যে, উপযুক্ত সেই ক্লাসেই তাকে ভর্তি করে।

তাহলে…তাহলেই বা কি! কোনো ক্লাসেই আমি পাশ করতে পারব না। সব পরীক্ষাতেই ফেল যাবো নির্ঘাত!

ফেল যাবে? ফেল যাবে কেন?

আঁকেই আমার আটকাবে। নিজের আতঙ্ক প্রকাশ করি-সামান্য যোগবিয়োগই কষতে পারব না, ভুল হবে, ফলে মিলবে না, একেকবার একেক রকম ফল হবে। আর গুণ ভাগ…? নিজের গুণভাগ আর জাহির করি না- তাহলে দেখছি সেই কেঁচে গণ্ডুষ করে তোমার ওই ইনফ্যান্ট ক্লাসেই ভর্তি হতে হবে আবার। হাফপ্যান্ট পরে সেই ইনফ্যান্টে।

আমার কথায় আমার গুণপণা প্রকাশ পায়।

 ইনফ্যান্ট ক্লাসে? ছেলেটা হাসে।

এ বি সি ডি আর অ আ ক খ ছাড়া কিছুই আমি জানি না যে। আমার অকপট কবুলতি-অক্ষর পরিচয় হয়েছে শুধু আমার। স্বাক্ষর করতে পারি কেবল।

সেটাও কি দেবাক্ষরে নাকি? আরো তার হাসি দেখা যায়। নাকি তোমার বুড়ো আঙুলের টিপসই দিয়ে?

মা সরস্বতীকে চিরকাল বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এলাম না? তার টিপের ওপর আমার টিপ্পনি।

তাহলে ওই মতিশীলের দরজা তোমার বন্ধ। সে বলে।

বললাম না তোমায়, আহিরিটোলার রাস্তাটা নিয়ে দাও আমাকে সেখানে গিয়ে কাগজ বেচি গে… তা তুমি কেয়ারই করলে না। এখন আবার তুমিই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছো!

সেখানে গিয়ে কোনো লাভ হতো না তোমার। কটা কাগজ বিক্রি হবে সেখানে? আহিরিটোলায় তো খালি হিন্দুস্তানী গয়লাদের খাটাল।

গয়লাদের খাটাল? তাই নাকি? তা, নামটা শুনে তাই মনে হয় বটে, গয়লাদের আহীর বলে থাকে মৈথিলী ভাষায়…বৈষ্ণব পদাবলীতে পড়েছি না? আহরিণী গোয়ালিনী মুঞি কোন্ ছার। পরাণ নিছিয়া দিনু চরণে তোমার…

তার মানে?

তার মর্ম তোমাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। কোনো গোপনারী শ্রীকৃষ্ণকেই বলছে বোধ হয়, সামান্য গয়লার মেয়ে আমি, আমার মনপ্রাণ সব তোমার পায়ে বিকিয়ে দিলাম… আমার ভাষাজ্ঞান প্রকাশ পায়-মর্মটা হচ্ছে এইরকম। মর্মান্তিকও বলা যায়।

কিন্তু ভাই, এই আহিরিটোলায় আমি গেছি তো বার কয়েক, কোনো আহরিণীর দেখা পাইনি কখনো। সেখানে কোনো গোপনারী নেই হে, সব গোপ। ইয়া ইয়া গোঁফ সবার।

বলে সে তা দিয়ে দেখায়–যে গোঁফ তার গজায়নি তাইতেই। তাহলে থাক গে। কাজ নেই সেখানে গিয়ে। আজ নটার শোয়ে আমরা সিনেমায় যাব তো? যাবে তো তুমি? এলফিনস্টোন পিজ্জার প্যালেসে চমৎকার একটা ছবি দেখেছিলাম, সেটা আবার এসেছে সেখেনে। আমি আবার দেখব। দারুন ছবি!

কী রকম শুনি?

একটা ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে। আমাদের চেয়েও ছোট। বাপমার ঠিকানা নেই তার, এক অনাথ বালক। ইস্কুলের সামনের খোলা মাঠে তাকে আর সব ছেলের সঙ্গে খেলা করতে দেখা গেল। বড়লোক মেজলোকের ছেলে সবাই, চমৎকার পোশাক পরা তারা : সে-বেচারার তেমন ঝলমলে জামাটামা কিছু ছিল না। না থাক, ছেলেদের ভেতরে তো কোনো ভেদাভেদজ্ঞান নেই–তাদের সঙ্গে সমানে মিলেমিশে খেলছিল সেও। খেলাধূলার মধ্যে তাদেরই একজন হয়ে গেছল যেন সে। তারপর খেলতে খেলতে, ইস্কুল খোলার ঘন্টা যেই পড়ল না, ছেলেরা সবাই ছুটে গেল ইস্কুলে, সেও ছুটল তাদের সাথে সাথে। কিন্তু আর সব ছেলেরা ভেতরে ঢুকে যাবার পর সে যখন গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো-লোহার রেলিং-দেওয়া দুধারের গেট দুটো আপনার থেকেই এসে বন্ধ হয়ে গেল তার সম্মুখে।

আপনার থেকেই? ম্যাজিক নাকি?

 প্রায় ম্যাজিকের মতই। গেটের ধারেকাছে দারোয়ান-টাবোয়ান কেউ ছিল না, কাউকে বন্ধ করতে দেখলাম না গেট…আপনার থেকেই সেটা তার মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেল যেন কেমন করে।

আশ্চর্য।

ছেলেটার মুখের চেহারা যদি দেখতে তখন! ওধারে অত ছেলে…ক্ষণিক বন্ধুরা ওর…হাসছে লাফাচ্ছে। এধারে সে একলাটি। কেউ তার দিকে ফিরেও চাইছে না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যায় না, কান্না পায় এমন!

সেই কান্না পাবার ছবি দেখতে চাইছো তুমি আবার? সে অবাক হয়।

জানো ভাই, আমিও ওর মতই একটা ছেলে যে! আমার মা ছেলের জন্য মানত করে বিন্ধ্যাচলে পার্বতী দেবীর কাছে পুজো দিতে গিয়ে–পুজো দিয়ে ফিরে মন্দিরের বাইরে এসে কুড়িয়ে পেয়েছিল আমাকে। সেই জন্যেই আমার ডাকনাম পার্বতীচরণ, তা জানো?

দূর! তা কি হয় নাকি?

আমার দশাও ঐ ছেলেটার মতই হবে বোধ হচ্ছে। ওর মতন আমিও কোনোদিন ভদ্রসমাজে ঠাঁই পাব না। আমার সঙ্গেও মিশবে না কেউ। যেদিকেই যাব, সব জায়গায় দরজা আমার মুখে ওপর বন্ধ হয়ে যাবে ওর মতন…ওমনি করেই।

কী সব আজেবাজে বকছো! যা-তা ভেবে মন খারাপ করছো নাহক। সে আমাকে সানা যোগায়; ওসব ভেবে মন খারাপ কোরো না মিথ্যে।

না, মন খারাপ করার কিছু নেই। করছিও না। বাবা বলেন, দৈবায়ত্ত কুলে জন্ম মমায়ত্ত তু পৌরুষ। মহাভারতের কথা, কর্ণ বলেছিল। কাকে বলেছিল জানিনে।

বলেননি সেটা তোমার বাবা?

না, বলেছিল হয়ত বাবা, মনে পড়ছে না আমার। উৎকর্ণ কাউকে বলেছিল নিশ্চয়। অর্জুনকেই বলে থাকবে মনে হয়…

অর্জুনকে?

হ্যাঁ। যে কর্ণপাত করবে তাকেই তো বলবে? আর, অর্জুনই তো কর্ণপাত করেছিল জানি। কর্ণকে সেই নিপাত করেছিল মা?

অন্যায় যুদ্ধে। ছেলেটা বলে : অন্যায় যুদ্ধে কর্ণপাত করাটা ভারী অন্যায় হয়েছিল অর্জুনের। ঐ কথাটার জন্যেই যদি করে থাকে তো আরো অন্যায়। আরো ঘোরর অন্যায়। কেন, কথাটা এমন কিছু খারাপ কথা নয়।

নয়ই তো। কিন্তু আমার কথা আলাদা। কোন কুলে যে জন্মেছি তাও জানিনে, আবার এদিকে এক কড়ার পৌরুষও নেই আমার…

মন খারাপ করো না। বলেছি তো, তোমার সঙ্গে সিনেমায় যাব আমি আজকে। সে আমার দুঃখ দূর করতে চায় : এলফিনস্টোন তো? নটার শোর দুখানা টিকিট কেটে ফোর্থ ক্লাসের গেটে দাঁড়িয়ে থাকব ঠিক সময়ে তোমার অপেক্ষায়…বলছি তো আমি।

দুঃখ কিসের! জন্মেছি যে সেই ভাগ্যি! যে-কুলে যেভাবেই জন্মাই না-হওয়াটাই বড়ো কথা। কিছু যদি নাও হতে পারি, কিছু তো হবোই। হয়েছি তো…হচ্ছি তত…হলেই হোলো!

.

বউবাজারের কর্ণার থেকেই কি শুরু হোলোকাগজ নিয়ে ফেরি করতে দাঁড়াইে না! একশ গজ ঠিকরে পড়লাম।

আরে ইয়ে বংগালি ফিন কাঁহাসে আয়া রে! গুঞ্জন উঠল সেখানকার হকারদের ভেতর। মৌচাকে ঢিল পড়লে যেমনটা হয়।

দো চার মুক্কা লাগা দেও না, আভি ভাগি।

মনে করেছিলাম ওদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব কিন্তু মৌরসী পাট্টার বনেদীরা সহজে বনে না। কায়েমী স্বার্থ আপস করতে জানে না।

মুক্কার কথা উঠতেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিই, বেমক্কা পড়ে পড়ে মার খাওয়ার চেয়ে বেমুক্কা এখান থেকে সরে পড়াই শ্রেয়। এক ধাক্কায় চলে যাই মীর্জাপুরের গোড়ায়।

গোলদীঘির রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে হাঁকি–আনন্দবাজার! আনন্দবাজার! জোর জোর হাঁকতে থাকি।

আমার শোরগোল একজনের কানে লাগে–এমন বিটকেল আওয়াজ ছাড়ছো কেন হে? চেঁচাচ্ছ কেন এখানে দাঁড়িয়ে? এখানে তোমার আনন্দবাজার কিনবে কে? পয়সা দিয়ে কিনতে যাবে কেন শুনি? যখন একটুখানি এগিয়ে গেলে দীঘির ওপারে গিয়ে শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেসের গায়ে লাগানো আনন্দবাজার অমনি অমনি পড়তে পাওয়া যায়?

কথাটা আমার মনে লাগে। আরে, আমিও তো তাই ভেবে রেখেছিলাম আজ সকালবেলায়।

 কাগজ নেবার কালে প্রথমটায় ভাবলাম যে, শেষ কাগজখানা বেচব না, নিজের পড়ার জন্য রাখব। তার পরেই ভেবে দেখলাম, যদি সব কখানাই বেচা যায়, একটা কাগজও বেঁচে যায় মন্দ কী! বিকেলে যখন আপিসে টাকা জমা দিতে আসব তখন বাইরের দেয়ালে সাঁটা (আমার নজরে ঠেকেছিল তখনই) কাগজটা পড়ে নিলেই চলবে তো!

সেখান থেকে সরে চলে গেলাম সোজা হ্যারিসন রোড়ের ধারে-কেষ্টদাস পালের ছত্রতলে।

মর্মর মূর্তির এলাকায় কাগজের ফেরিওয়ালা ছিল না একজনাও। হকারদের জমায়েত ছিল মুখোমুখি ঠিক তার উল্টোদিকে। খদ্দেরেরও ভিড় ওধারেই।

জনাকয়েক বাঙালীর ছেলেও বেচছিল সেখানে দেখলাম। বিক্রি হচ্ছিল বেশ তাদের। কিন্তু হিন্দুস্তানীরা খানিক পরেই রুখে উঠল তাদের ওপর। কিন্তু ছেলেগুলোও দেখলাম বেশ তেড়িয়া, কোনো তাড়নাতেই নড়বে না সেখান থেকে।

পিঠোপিঠি পিটাপিটি শুরু হয়ে গেল। দোরোখা কিলচড়ঘুষি দু তরফে। ছেলেরাও ছাড়বার পাত্র নয়। যেমন মার খাবার তেমনি মারবার জন্যে তৈরি। দু পক্ষই নাছোড়বান্দা।

ঠেকে শেখার চেয়ে দেখে শেখা ভালো, বলতেন বাবা। তাছাড়া, যার বাহুবল নেই, মারামারির মধ্যে যাওয়া তার পক্ষে বাহুল্য। শখ করে ঠোকাঠুকির ঠক্করে না গিয়ে অলক্ষ্যে সেখান থেকে সরে পড়াই সমীচীন বোধ করলাম।

ভবী যেমন নিজের ভবিষ্যৎ ভোলে না তেমনি প্রথম আখর দেখেই আখেরের কথা ঠাউরে নিতে পারে।

দুর্জনদের দূরে পরিহার করে দূর থেকে নমস্কার ঠুকে সুদূরপরাহত হয়ে গেলাম। চলে এলাম ঠনঠনের মুখে।

সেখানে শুধু ভক্তজনের ভীড়। মা কালীর চন্নামৃতের তৃষ্ণা সবাইকার, খবরের খিদে নেই কারোই। বিশেষ সুবিধা না করতে পেরে সেখান থেকেও সরতে হোলো।

শঙ্কর ঘোষ লেন, শিবনারায়ন দাসের গলি, কৈলাস বোস স্ট্রীট একে একে পার হয়ে শেষে দাঁড়ালাম গিয়ে বিবেকানন্দ স্পার-এ। সোড়াপত্তনের কালে বিবেকানন্দ রোড়ের ঐ নামটাই ছিল তখন। সেখানেও কিন্তু কাগজের চাহিদা নেই।

একটা এসপার ওসপার হয়ে যাক তাহলে।

স্পারের পাড়া পার হয়ে কাগজের তাড়া নিয়ে হোদোর মোড়ে গিয়ে খাড়া হলাম। এক ভদ্রলোক বাজারের থলি হাতে হন্তদন্ত হয়ে এলেন।–দেখি তো আজকের কাগজটা।

তাঁর হাতে একখানা তুলে দিলাম। তিনি গোটা গোটা আখরের খবরে মোটামুটি চোখ বুলিয়ে মেজ মেজ ঘোট ঘোট হরফের ছোটখাট সংবাদগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন। আমি অপলক প্রত্যাশায় তাকিয়ে রয়েছি।

মিনিট পনের ধরে কাগজখানার আগাপাশতলা নজর দেবার পর আমার হাতে ফিরিয়ে দিলেন আবার–এই নাও বাপু,তোমার কাগজ।

আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রয়েছি দেখে অযাচিত উপদেশ দিলেন আমায়–এখানে বারা তোমার এক কপিও কাগজ বিক্রি হবে না। হেদোয় লোকে বেড়াতে আসে আর সাঁতার কাটতে আসে, সকালে বিকালে হাওয়া খায়–এখানে কারো কাগজ পড়ার গরজ নেই। কাগজ যদি বেচতে চাও তো চলে যাও হাতিবাগানের মোড়ে, নয়ত সেই শ্যামবাজারের পাঁচমাথায়। এখানে তোমার কাগজ কিনবে কে?

আপনি অন্তত একটা কিনবেন আশা করেছিলাম। আমি বলি। সত্যি, ওঁর হাতেই আজকের বউনিটা হবার ভরসা ছিল আমার। কিন্তু বউনির বদলে পেলাম বকুনি। এবং কিছু কথার বুকনিও।

আমার এখন কাগজ পড়ার ফুরসত আছে নাকি? আমি যাচ্ছি এখন হাতিবাগান, বাজার করতে বেরিয়েছি দেখছ না! দৃষ্টান্তস্বরূপ থলিটা আমার নাকের উপর তুললেন–একদণ্ডও সয় আছে আমার!

বেশ তো মশাই এতক্ষণ ধরে পড়লেন আমার কাগজ। তার তো সময় ছিল খুব। কাগজ পড়ার ফুরসত ছিল আর কেনবার বেলাতেই.ইচ্ছে হলো বলি একবার। কিন্তু বলব কাকে? ততক্ষণে তিনি হাতিবাগানের দিকে সাত হাত এগিয়ে গেছেন।

কাগজের পাঁজা ঘাড়ে হেদোর ধারে দাঁড়িয়ে হেদোচ্ছি, কতক্ষণ ধরে জানি না, হঠাৎ দেখি একটি মেয়ে বইখাতা হাতে ওধারের ফুটপাথ ধরে চলেছে।

কিশোরী মেয়ে! চমক লাগল কেমন! রিনি! রিনিই না?

ট্রাম বাস মোটর কোনোদিকে না তাকিয়ে পড়ি কি মরি হয়ে ছুটে গেছি আমি ওধারে। পড়েছি প্রায় মেয়েটির ঘাড়ের ওপর।

হতচকিত হয়ে সে দাঁড়িয়েছে–কী?

না, রিনি নয়। আমি অপ্রস্তুতের মত বলেছি- কাগজ নেবেন একখানা? আজকের কাগজ? মহাত্মা গান্ধী বলিয়াছেন…

আর বলতে হল না। মেয়েটি কোন কথা না বলে দাম দিয়ে কাগজখানা নিয়ে পাশের গেটের ভেতর দিয়ে সেঁধিয়ে গেল সটান।

দেউড়ির মাথায় দেখলাম, ঘোরালো সাইনবোর্ডে লেখা : বেথুন স্কুল অ্যাণ্ড কলেজ।

দেখেই আমার চক্ষুস্থির! আরে, এখানেই রিনি পড়ে যে! এখানে পড়ানোর জন্যেই তো ওকে চাঁল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।

এ কী! যে পর্বত কিনা মহম্মদের ডাকে সাড়া দেয় না, তাই কি আজ মা পার্বতীর দয়ায় এই আহাম্মকের কাছে এসে গেল–না চাইতেই!

আহিরিটোলার পথ নাই চিনলাম, নাই কেউ দেখালো আমায়-আমার চাইনেকো আর। আহিরিটোলার আহরিণীকে আমি এখানে দাঁড়িয়েই আহরণ করতে পারব। আমার কাগজের ফেরি নিয়ে সেখানে ঘোরাফেরা না করেও সেই বনহরিণীকে আমি ধরতে পারব এখানেই। অনায়াসে।

বেচতে পারি আর না পারি, আমার পসরা নিয়ে এই পথেই আমি দাঁড়াব এসে রোজ। রোজগার হোক বা না হোক।

একটি দুটি করে আরো আরো মেয়েরা আসতে লাগল একে একে। একা একা, জোড়ায় জোড়ায়–বড় মেয়ে, মেজ মেয়ে, ছোট ছোট মেয়ে যত।

আর আমিও হাঁকতে লাগলাম জোর জোর–আনন্দবাজার? আজকের আনন্দবাজার। মহাত্মা গান্ধী বলিয়াছেন, আর দশ মাসের মধ্যে স্বরাজ দিব।

মহাত্মা গান্ধী ঠিক কী কথাটি যে বলেছেন জানি না, কাগজে চোখ বোলানোর ফাঁক পাইনি তখনো, কিন্তু ঐ বড়ো খবরটা মোটা মোটা হরফে গোটা পাতা জুড়ে কাগজের মাথায় জানানো হয়েছিল। যা পথচলতি লোকেরও চোখে না পড়ে যায় না।

সেই কথাটাই হাঁকছিলাম খালি খালি। আর কাগজ বিক্রি হচ্ছিল চোটপাট। আমার হাঁকডাকে চকিত হয়ে প্রায় মেয়েই কিনছিল একখানা করে।

সংবাদ পরিবেশনায় এই বাহাদুরি–এই নিত্য নতুনত্ব এখনকার মত তখনো ছিল ওই আনন্দবাজারের। এই নৈপুণ্য, এই স্বকীয়তা আর এই বৈশিষ্ট্য তার গোড়ার থেকেই।

প্রতিদিনকার জোর খবরটা জোরালো অক্ষরে ছাপানো থাকত পাতা জুড়ে। কাগজের মাথায়। কারো চোখে না পড়ার কোনো ওজর ছিল না।

এতে করে আমার কাগজ কাটানোর যা সুবিধা হতো!

দেখতে দেখতে সব কাগজ কেটে গেল আমার–শেষ মেয়েটিও চলে গেল কলেজের ভেতর।

পড়ে রইল খালি একখানা বসুমতী। এটা আর বেচব না। নিজেই আমি পড়ব এখন এক সময়।

রিনি আজ ইস্কুলে আসেনি কিন্তু। কেন আসেনি? অসুখবিসুখ করেছে নাকি ওর? নাকি বিয়েই হয়ে গেল শেষমেশ?

না না, এখনই বিয়ে হবে কী, ওইটুকুন তো মেয়ে-মায়ের চোখে হলেও, সত্যিই ওর বিয়ের বয়েস হয়েছে নাকি? এনট্রেন্স পাশের আগে বিয়ে করবে না বলেছিল না সে? তাই ভেবেই আমি নিজেকে ভরসা দিতে চাই। সান্ত্বনা পাই।

আজ আসেনি, কাল সে অবশ্যি আসবে। কদিন ইস্কুল কামাই করবে? তবে আমি দেখতে পাবই…একদিন না একদিন…এই এখানেই। নিশ্চয়!

রিনিকে দেখতে পাব ঠিকই, কিন্তু সেই ছেলেটির দেখা বোধ হয় পাব না আর। ভেবে মন ভার হয়। ভবানীপুরের থেকে যদি সে কোনদিনও এধারে আসে, কোনো রাস্তার মোড়েই আমার পাত্তা পাবে না। আমি যে কাগজ ফেরিতে বেরিয়ে ওয়েলিংটন-বউবাজার-হ্যারিসন রোডের সব ফেরিঘাট পেরিয়ে ফেরারী হয়ে শেষে এখানে এসে ঠেকেছি তা সে টের পাবে কি করে?

হাতিবাগান-ফেরত সেই ভদ্রলোককে এবার বাজারের থলি হাতে ফিরতে দেখা যায়।

ও বাবা! তোমার সব কাগজই যে এর মধ্যেই বেচে ফেলেছছা দেখছি! দেখে বিস্মিত হন।–না, একখানা রয়েছি দেখছি এখনো। দাও, তাহলে ওটা আমিই কিনে নি না-হয়।

তিনি ট্যাঁক থেকে পয়সা বার করেন।

না, এখানা আমি বেচব না মশাই!

বেচবে না, তার মানে? তিনি বিস্মিত আরও।

মানে, এটা আমি নিজেই পড়ব বলে রেখেছি।

তুমি পড়বে! তুমি পড়বে কাগজ! তাঁর বিস্ময় যেন ধরে না-পড়তে পারো তুমি? পড়লে বুঝতে পারবে? লেখাপড়া শিখেছ নাকি? পয়সাটা তিনি ফতুয়ার পকেটে ভরেন আনন্দবাজারটা পড়েছি, তখনি পড়া হয়ে গেছে আমার–বসুমতীটা কিনতে চাইছিলুম তাই। তোমার ভালোর জন্যেই বাপু!

আমার ভালোর জন্যে আপনাকে ভাবতে হবে না।

চিনির বলদ চিনি খায়, কাগজের হকার কাগজ পড়ে! অবাক কান্ড! বিড় বিড় করে বিরক্তিভরে তিনি চলে যান।

শুধু পড়ি না মশাই! এই কাগজে আমি লিখিও। লিখেও থাকি তা জানেন? ইচ্ছে হল ডেকে বলি ওনাকে। কিন্তু যেমন হন্যে হয়ে সকালে তিনি বাজার করতে বেরিয়েছিলেন তেমনি হন হন করে বাড়ির দিকে চলেছেন এখন।

এবং বললে পরে কথাটা প্রায় মিথ্যেই বলা হতো নাকি? বসুমতী কি আনন্দবাজারে একছত্রও আমি লিখিনি তখনো, লেখার কল্পনাও ছিল না আমার, (লিখেছিলাম তার অনেক অনেক দিন পরে) তবে বিজলীতে লিখেছিলাম তো ঠিকই। আর বিজলী কিছু বসুমতীর চেয়ে খাটো নয় কোনো দিকেই।

হাতের কাগজখানা নিয়ে হেদোর ভেতরে গিয়ে বসলাম-ঘেরাটোপের ছত্রছায়ায়।

কয়েকখানা বেঞ্চি জুড়ে জনকয়েক ঘুমোচ্ছিল আয়েস করে। তাদের কারো আরামের বিঘ্ন না ঘটিয়ে একজনের পায়ের তলায় একটুখানি ফাঁক পেয়ে সেখানে বসেই কাগজটা পড়তে লাগলাম।

কাগজখানার গোড়ায় সম্পাদক শ্রীহেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ থেকে শুরু করে শেষ লাইনে মুদ্রাকরের ঘোষণা পর্যন্ত গড়িয়ে যেতেই বারোটা বেজে গেল। টনক নড়ল আমার। মাথায় আর পেটে যুগপৎ! এখন তো কিছু না খেলেই নয়।

মল্লিকবাড়ি যেতে হয় এবার। ছেলেটা বলেছিল একটার পরেই নাকি তারা খেতে দেয়। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে একটা বেজে যাবে।

গিয়ে দেখি প্রায় হাজার খানেক ভিখিরির ভিড়। তাদের সারির ভেতর খাড়া হয়ে গেলাম। এক জায়গায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম মার্বেল প্যালেস।

এই সেই বিশ্ববিখ্যাত মর্মর প্রাসাদ! আপাদমস্তক মার্বেল প্রস্তরে গঠিত দেখে চোখ ঠিকরে যায়। দেশবিদেশ থেকে কৌতূহলী পর্যটক যা সাধ করে দেখতে আসে। সেই দানধন্য পুণ্যশ্লোক রাজেন মল্লিকের বাড়ি–যাঁর বদান্যতা ভারতবিদিত।

বিরাট প্রাঙ্গণের মাঝখানে একটা ফোয়ারায় জল উপচে পড়ছিল–এখানে-ওখানে মর্মরমূর্তির ভাস্কর-কীর্তি। সারস পাখিরা চরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত। কয়েকটা হরিণও দেখেছিলাম মনে হয়।

এধারে আমরা সারবন্দী দাঁড়িয়ে-খাবারের প্রত্যাশায়।

আসতে আসতে আমার পালাও এল পাবার।

কিসে দেবো হে তোমাকে? থালাটালা কিছু আনননি? শুধালো পরিবেশক।

আনিনি তো। আনতে হয় জানতাম না। আজ প্রথম আসছি কিনা!

দেখছ না সবাই তাদের সানকিতে নিচ্ছে।

দেখলাম বটে, সানকি কিংবা কলাই-চটে-যাওয়া প্লেটে করেই নিচ্ছিল সবাই।

 দিচ্ছিল খিচুড়ি। চরাচরের খাদ্যাখাদ্যের মধ্যে আমার অন্যতম প্রিয়তম।

আমাকে এই কাগজটাতেই দিন না হয়। কাগজেই খাব আমি।

 কাগজে খাবে? সে কী?

 খাওয়া নিয়ে কথা। কাগজ তো আর খেতে যাচ্ছিনে

পরিবেশক একটু হেসে বললে-তুমি কি পড়োটড়ো কোথাও? ইস্কুলের ছাত্র নাকি?

 হ্যাঁ। ছাত্র বইকি। কলেজে পড়ি আমি। ন্যাশনাল কলেজে।

তাহলে তোমায় এই ভিখিরিদের মধ্যে বসে খেতে হবে না। ছাত্রদের জন্যে ভেতরে খাবার ব্যবস্থা আছে। তাদের সঙ্গে বসে খাবে তুমি।

ভেতরে গিয়ে ছাত্রদের পংক্তি ভোজনে বসলাম। সেখানে খাবার ব্যবস্থা ভালোই। তাদের মধ্যে সেই ছেলেটিকে কিন্তু দেখা গেল না। তার ইস্কুলের টিফিনের ঘন্টা পড়েনি বোধ হয় এখনো, কিংবা হয়তো সে কাগজ বেচে ভবানীপুরের থেকে এসে পৌঁছতে পারেনি যথাসময়ে। ইস্কুল কামাই করেছে আজ।

মার্বেল প্যালেসে খাওয়া আমার সেই প্রথম হলেও সেই শেষ নয়। তার পরেও, অনেকদিন পরে আরো ভেতর গিয়ে খাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল।

প্রায় দশক দুই আগে হবে মনে হয়, মল্লিক বাড়ির ছেলে বীরেন্দ্র মল্লিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসুর সহযোগিতায় সম্প্রতি নামে একটি আধুনিক সাহিত্যপত্র বার করেছিল, আর সব লেখকের সাথে আমার লেখাও ছিল তাতে–তার কয়েক সংখ্যাতেই। সেই সূত্রে বীরেনের সঙ্গে আমার পরিচয়। তার বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ।

সন্ধ্যেবেলায় সম্পাদকের বৈঠক বসত–একতলার বাঁদিক-ঘেঁষা ঘরে বীরেনের নিজের ড্রইংরুমে। ওদের কুলদেবতা জগন্নাথের সান্ধ্য পূজার শেষে মহাপ্রসাদ আসত, প্লেটে করে বড়ো বড়ো সাইজের লুচি আর তরকারি। ঘি দিয়ে রাঁধা তরকারি সব–তার স্বাদই আলাদা। আর সেই সঙ্গে তাদের নতুন বাজারের ইয়া ইয়া কড়াপাক সন্দেশ। তুলনা হয় না যার।

চমৎকার সেতার বাজাত বীরেন। আর খাসা আধুনিক কবিতা লিখত–একেবারে নতুন ধাঁচের। প্রেমেনকে তার কবিতার প্রশংসা করতে শুনেছিলাম।

সেই ছেলেটির লেখাটেখা আর দেখা যায় না। সে কি আর সেই ছেলেটি আছে এখন? তারই হয়ত তার মতন একটি ছেলে হয়েছে এতদিনে, সে ছেলেও হয়ত এখন আর ছেলেমানুষটি নেই।

বীরেনের বাবা কুমার দীনেন্দ্র মল্লিকের ছবি আঁকার প্রতিভা ছিল। আশ্চর্য পোর্ট্রেট আঁকতেন। তাঁর কয়েকখানা ছবি সম্প্রতিতে প্রকাশিতও হয়েছিল। অন্য পত্রপত্রিকাতেও সম্ভবত।

তিনি একদিন আমায় মার্বেল প্যালেসের ভেতরে বিভিন্ন ঘরে বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর আর শিল্পীদের বহুমূল্য ভাস্কর্য আর চিত্রকর্ম দেখিয়েছিলেন ঘুরিয়ে। সেগুলির শিল্পব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

মল্লিক বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাগজ বিক্রির আমার প্রাপ্য কমিশনের লভ্যাংশ থেকে তিনটে সিনেমা দেখলাম সেদিন। তিনটেয়, ছটায়, নটায়। তারই ভেতরে এক ফাঁকে কাগজের আপিসে টাকা জমা দিয়ে এসেছি গিয়ে।

সাড়ে এগারোটায় শেষ শো খতম হবার পর ফিরে এলাম ঠনঠনেয়। সকালে একটা পাঞ্জাবী হোটেল দেখে গেছলাম সেখানে।

সেইখানেই রাত্রের খাবার খাব ঠিক করা ছিল।

পাঞ্জাবী রুটি আর গরম গরম মাংসের চপ খেয়ে পেট ঠান্ডা করা গেল এতক্ষণে। সকালের সেই খিচুড়ির পর এখন এই খাওয়া।

অবশ্যি সারাদিন ধরেই টুকটাক চলেছিল আমার। ডালমুট চানাচুর চিনেবাদামের ব্যত্যয় হয়নি। সেই সঙ্গে ফাঁকে ফোকরে ঝুনো নারকেলের টুকরোটাকাও।

খাবার পরে এবার শোবার ধান্দা।

শোবার আগে সব কাজকর্মের কাবারে সারাদিনের শেষে মায়ের চরণদর্শন করা যাক এবার।

কালীমন্দিরে গিয়ে দেখি, আরে, এখানেই তো সারি সারি শুয়ে আছে কতজনা! ভিখিরিই বোধ হয়। এদের মাঝখানেই তো আমি শুতে পারি। এরই এক কোণে গড়িয়ে পড়ি না কেন? তোফা শোবার জায়গা!

সকালে ভিখিরিদের সামিল হয়ে খেয়েছি, রাত্রে তাদের সঙ্গেই শোয়া গেল না হয়, ক্ষতি কি?

সত্যি বলতে আমি তো ওদেরই একজন।

 ভেবে দেখলে এ সংসারে কে ভিখিরি নয়? সকলেই কখনো না কখনো কারো না কারো কাছে কিছু না কিছুর প্রত্যাশী। স্বয়ং পরম শিবের থেকে অধম এই শিবরাম পর্যন্ত ভিখারী সবাই-পার্থক্য যা কিছু তা কেবল আপেক্ষিক।

কেউ চায় অন্নসুধা, কারো শুধু অন্নক্ষুধা।

 ঘুমোবার আগে আরেক দুর্ভাবনা হানা দিল মাথায়। শোবার ধান্দা তো চুকেছে, এখন ওঠার সমস্যা? আমাকে যে ভোর চারটেয় উঠে ছুটতে হবে, কাগজের লাইনে গিয়ে জুটতে হবে সবার গোড়ায়–সেই সমস্যা? সেটা কে মেটায়?

আমার যে অঘোর ঘুম, তার থেকে টেনে তোলে কে আমাকে?

মতি শীলের ইস্কুলে সেই ছেলেটির কাছে শুতে পেলে তার সহজ সমাধান ছিল। নজের গরজেই উঠত ছুটত, আমাকেও সঙ্গী করে নিত যথাকালে।

কিন্তু এখানে এখন-এই অকালে?

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন।

 গভীর রাত্রে আমার ঘনঘোর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ-কাঁসর ঘন্টার শোরগোলে। মার মঙ্গলারতি শুরু হয়েছে।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। হাতঘড়িতে দেখলাম, চারটে বাজেনি তখনো।

না, রাত গভীর নয়। মন্দিরের সামনেও বেশ ভিড়। ভক্তজনরা জড়ো হয়েছেন সেই অতি ভোরে মার আরতি দর্শনে।

একপলক দেখেই না প্রণাম ঠুকতে হয়েছে আমায়। গোলদীঘির শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেসে গিয়ে এখনি লাইন লাগাতে হবে সবার গোড়ায়। তারপর সেখানকার কাজ সেরে আমহার্স্ট স্ট্রট ধরে বৌবাজারের বসুমতী সাহিত্য মন্দিরে। যাক, মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের এমোড় থেকে ওমোড়ে–সকাল ও দুপুরে মল্লিকবাড়ি আর রাত দুপুরে কালীতলা এই দুই মেরুর মধ্যে আমার গতিবিধির ছকবাঁধা হয়ে গেল। ব্যস্!

খাওয়া শোয়া আর অতি প্রত্যুষে কাজে যাওয়া-এই তিন ধান্দাই মিটে গেল এক যাত্রায়। অবলীলাতেই।

এখন নিশ্চিন্ত।

.

৩৮.

অনেকদিন পরে আবার এক সকালে জনাব সাহেবের স্লিপারের ধুলো পড়ল আমার দোরগোড়ায়।

আরেক খাঁটি স্লিপার তখন আমার ঘরেই–আমার বিছানায় বিলম্বিত। স্বয়ং আমিই।

পরিপাটি ঘুম দিচ্ছিলাম কিন্তু দ্বারদেশে তিনি এসে দাঁড়াতেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে আমার।

কোনো আবির্ভাব ঘটলে অবচেতনায় কেমন করে যেন টের পাওয়া যায়। চটকা ভেঙ্গে যায় চট করে।

তাকিয়ে দেখি তিনি আমার দরজার কড়া দুটি নেড়েচেড়ে দেখছেন। নিঃশব্দে।

কী দেখছেন? জানান দেবার জন্য এখানে কড়া নাড়ার কোনো কড়ার নেই, কড়াকড়ি নান্তি। আমি জানালাম : অহোরাত্র আমার অবারিত দ্বার।

দরজা খুলেই ঘুমান? কিছু চুরিটুরি যায় যদি? তাছাড়া…তাছাড়া যেমন দিনকাল…কোন ভয় করে না আপনার?

ভয় কিসের? চোর ডাকাত ঘাতক কি পকেটমারের দুর্ভাবনা আমার নেই। প্রথমত, আমার প্রাণের কোনো দাম আছে আমি ভাবি না-কারই বা প্রাণের দাম রয়েছে একালে? তাছাড়া চোরের ভয় করতে যাব কোন্ দুঃখে? আমার ঘরের এই পুঞ্জীভূত জঞ্জাল ইনকুডিং নেংটি ইঁদুর আর কাঁকড়াবিছেদের নিতে আসবে কে? এবং আমার পকেট ফুটো। এক পয়সাও নেই সেখানে। কখনো থাকে না। তাহলে?

এত এত টাকা উপায় করেন যে…?

 এত এত? আমার চোখ বুঝি টাকার মতই গোলাকার হয়।

এত এত না হলেও কিছু কিছু তো বটে। সেসব যায় কোথায়?

কে জানে! দু পয়সা উপায় না হতেই কী করে যে তারা উপে যায় দেখতে না দেখতেই–সেইটেই একটা রহস্য আমার কাছে। কখনই আমি তা ভেদ করতে পারিনি মশাই! জলেরমত খরচ করলেও তা চোখে পড়ত, হয়ত তা হাওয়া হয়ে যায় বলেই দেখতে পাই না।…সে কথা থাক, আনি আমার দরজার ওপর অমন নজর দিচ্ছিলেন কেন?

কড়া দুটো দেখছিলাম। একটা লোহার, একটা পেতলের-দরজায় দুটো পাল্লার দুরকম কড়া–অত না? এরকম তো দেখা যায় না কোথাও।…এমনটা কেন বলুন তো?

কড়া পাল্লায় পড়েছিল বোধ হয় একবার।, সেইজন্যই। আমি কই।

কী বললেন? কার পাল্লায়?

কোনো সোনালি হাতের ছোঁয়া লেগে একটা কড়া হয়ত স্বর্ণময় হয়ে গিয়েছে। এই ঘরের দ্বার ভেঙে নয়, ঐ কড়া ভেঙেই ঢুকেছিল একবার–একটি মেয়ে! তার স্মৃতিটা অক্ষয় করে রাখতেই ভাঙা কড়াটার শূন্যস্থান পূর্ণ করতে ঐ অন্য রকমের লাগিয়েছি। অন্য কড়াটা সাবেক, তাই কালো ভূত, আর নয়া আমদানি ঐ সোনা, সোনা! কি রকম কৃষ্ণ-রাধিকার মিলন রহস্যের ইঙ্গিতবহ-তাই না?

আপনার জীবনেও আদিরস এসেছিল তাহলে একদিন?

কার না আসে? অনাদি কাল থেকে আসছে সবার জীবনে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই– আমার বেলাও তার অন্যথা হতে পারে না। তবে আমার আদিম রস সেই আদ্যিকালেই ফুরিয়ে গেছে–ছেলেখেলা যত সেই ছেলেবেলাতেই খতম। তারপরই সব বিলকুল তামাদি।

আপনার ঐ কড়া কথাটা শুনতে চাই মশাই!

কথাটা কী আর! চাবি হারিয়ে গেছল, ঘরে ঢুকতে পারছিলাম না। রাত বারোটা বাজিয়ে বাসায় ফিরেছি, সব নিশুতি। এদিকে আমার ফুরফুরে পাতলা সিল্কের জামা ফুটো। হয়ে ঘরের চাবি গলে রাস্তায় পড়ে গেছে কোথায়। এই রাত দুপুরে কি করি, কোথায় যাই, চাবিওয়ালা কোথায় পাই, এমন সময় মেয়েটা এসে হাজির। দুপাক মুচড়েই ভেঙে ফেলল কড়াটাকে, কব্জির জোর ছিল তার। বস্তির মেয়ে তো।

বস্তির মেয়ে।

শ্রাবস্তীর মেয়ে কোথায় পাব! আমি যখন এ পাড়ায় প্রথম আসি তখন এর চারধারেই বস্তি ছিল। কোকেনের কারবার ছিল গলির ঐ কোণটায়…চোর ছ্যাঁচোর গুভা বদমায়েস কিলবিল করত চারধারে।

আমি ভেবেছিলাম, আপনার কোনো বোনটোন হবে বুঝি! বিনি-টিনি! ইতু-টিতু! তা নয়, বস্তির মেয়ে! হতাশার সুর ধ্বনিত হয় তাঁর গলায়।

ইতুটিতুর দেখা পাইনি তখনো…তখন তারা জন্মায়নি। না, বিনিও না। আকৃতিতে হলেও আমার বোনেদের মত প্রকৃতিই ছিল না মেয়েটার। অন্য প্রকৃতির–একটু বন্য প্রকৃতির। তা ঈষৎ বন্যরূপ হলেও, আমার বোনেদের সঙ্গে এক জায়গায় ভারী মিল ছিল তার। শুধু তার কেন, তার মতই প্রায় আমার সব বন্ধুরই–কী ছেলে কী মেয়ে! সেটা তাদের ঐ লাবণ্যরূপ।

তার কথা বলুন। কথাটায় আমায় পাড়বার জন্য তিনি উন্মুখ।

তার কথা কী শুনবেন। সে কি একটা কথা হলো। সেটা কোনো কথাই নয়। শোনবার মত কোনো কথা না–শোনাবার মতও নয়। এক কথায় উড়িয়ে দিই কথাটা।

ততক্ষণে তিনি আমার দেয়াল-লিখন দেখতে লেগেছেন।

দেয়াল জুড়ে এসব কী লিখে রেখেছেন মশাই? হিসাবপত্তর নাকি?

বেহিসেবী লোকের আবার কিসের হিসেব? নাম-ঠিকানা যত।

কাদের নাম-ঠিকানা?

 বোনদের-বন্ধুদের। বোনদের বন্ধু-বন্ধুদের বোন–এইসব। আবার কার?

দেয়ালে লেখা কেন? খাতায় লিখে রাখলেই হয় তো।

খাতা যে হারিয়ে যায়। খাতায় যেমন আমার হিসেব থাকে না, তেমনি খাতারও কোনো হিসেব থাকে না যে! কোনটা যে কোথায় যায় টেরই পাই না। দরকারের সময় পাওয়া যায় না। আবার কখন হয়ত বিনা প্রয়োজনে আপনার থেকেই আত্মপ্রকাশ করে বসেছে।

তাই দেয়ালে লিখে রেখেছেন?

ঠিক তাই। দেয়াল কখনো হারায় না-নেহাত যদি ভূমিকম্প না হয়। অশোকের শিলালিপির রহস্য এইখানেই। ভূর্জপত্রে না লিখে রেখে প্রস্তরগাত্রে খোদাই। খোদার বানানো পাহাড় ভূমিকম্পেও যাবার নয়, তার ওপর খোদকারি চিরদিনের জন্যই অটুট।

তাই দেখছি। আপনার এগুলোও হুবহু প্রায় তাই-অশোকের শিলালিপির মতই…কিছুতেই কানো পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছে না। কিন্তু আশ্চর্য, বোনদের নাম ঠিকানাও আপনার মনে থাকে না–লিখে রাখতে হয়, এই ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি আরো।

বোনদের মনে থাকে ঠিকই, কিন্তু তাদের ঠিক-ঠিকানা থাকে কি? আমি কই। তাঁর কথাটায় আমিও কিছু কম অবাক হই না-বিয়ের পর পদবীর সঙ্গে তাদের ঠিকানাও কি পালটে যায় না? বিয়ের পর সব মেয়েই তো পর হয়ে যায়-তা বোনই কি আর বন্ধুই কি!

তারপরেই আমার পুনশ্চ অনুযোগ : বিয়ের আগে পরী, বিয়ে হলেই পর!

তাহলেও, যত পরই হয়ে থাক, চিঠি লেখালেখির সম্পর্কটা রাখেই। আর তাদের চিঠিতেই তো ঠিকানা থাকে।

থাকে নাকি! সেই প্রথম চিঠিতেই থাকে যা, তারপর আর না। তারা ভাবে, তাদের মতন তাদের ঠিকানাটাও আমি স্মৃতিপটে চিরদিনের মত অঙ্কিত করে রেখেছি! কিন্তু স্মৃতিশক্তিতে আমি একেবারেই পটীয়ান্ নই, আমার স্মৃতিপট হচ্ছে আসলে সেই যবনিকাই। যে-পটক্ষেপের পরে আর উত্তোলন করা যায় না।

তাহলেও ভায়ের বাড়ি বোনের যাতায়াত থাকেই।…।

কই আর থাকে! দু-একজন বাদে সব বোনই তো প্রায় হারিয়ে যায়–চিরকালের মতই। সহোদরা হলে তেমনটা হয় না অবশ্যি। তারাই যাতায়াতটা বজায় রাখে। কিন্তু তা না হয়ে শুধু সহৃদয়া কাজিন মাত্র হয় যদি? তাহলে? হৃদয় একবার হারালে যেমন আর ফিরে পাওয়া যায় না, সহৃদয়াদের বেলাতেও তাই। সে সব বোন তখন অরণ্য হয়ে যায়। তাদের সংসাব অরণ্যে হারিয়ে আরো গম্ভীর হয়ে রীতিমতই শ্বাপদসঙ্কুল তখন। সেই অরণ্যে রোদন করতে কে যাবে?

বোনদের ব্যাপার থাক, তাদের তো সব ওপর ওপর, গভীর কিছু নয়। আপনি এই বস্তির মেয়েটির কথা বলুন…তার সঙ্গে কতদূর গড়িয়েছিল শুনি…অবশ্যি যদি আপনার তেমন আপত্তি না থাকে।

না, আপত্তি কী, তবে কথাটা এই, আমি তাঁর গভীর কথায় কান দিতে যাই না, নিজের কথার ভিড়েই থাকতে চাই–জীবনের সবরকম সম্পর্কই তো মৌলিকতা : যৌনিক। সব সঙ্গই তো সঙ্গম-কার্যত তেমন গভীরতার গর্ভে না গেলেও আসলে ঠিক তাই নয় কি? এমন কি, নিছক আদর করার মধ্যেও সেই আসঙ্গলিলাই।

ঠিক তাই কি? অবশ্যি ফ্রয়েড প্রমুখ মনস্তত্ত্বের পন্ডিতরা সেই রকমটাই বলেছেন বটে! তবুও যেন তাঁর দ্বিধা থেকে যায়।

জীবনের মূলরস তাই হলেও, আর ওপরেও আরো সাফল্য আরো প্রফুল্লতা থাকে-থাকে? মূলের গর্ভ থেকেই তো ফুল ফোটে-ফল ধরে-জীবনের ডালপালায় সৌরভাহুত পাখি আর মৌমাছিরা এসে জোটে, কিন্তু তাহলেও, মূলতঃ সেক্সই অস্তিত্ত্বের আদি রস হলেও এবং দুনিয়ার সবাই সেই রসে বশে থাকলেও–এমনকি তিনিও নাকি ওই রসের ওপর বৈসে রইলেও-উপনিষদে তাঁকে রসসা বৈ সঃ বলেছে না?–সেই আদি রস অনাদি অনন্ত অফুরন্ত ইত্যাদি হয়েও তাই কিছু জীবনের আদ্যন্ত নয়। বৃন্দাবনের পরও কুরুক্ষেত্র থেকে যায়। এমন কি ঘোড়া বহুত ঐ মথুরাও থাকে! শিবের লিঙ্গপ্রত্যয় আর কৃষ্ণেন্দ্র রাস পঞ্চাধ্যায় বাদেও জীবনের অনেক প্রত্যয়, অনেক প্রকাশ থেকে যায়। আদিম রস ছাড়াও আরও নানা রস রয়েছে। এই জীবনে, যা নাকি অকৃত্রিম। এমন কি ওই কসের মধ্যেও রস রয়ে গেছে–কটু তিক্ত কষায়ের মধ্যেও রসায়ন। কদর্যের ভেতরেও সৌন্দর্য। আদি রসকে ছাপিয়ে উঠে ছাড়িয়ে গিয়েই যত রূপারাপ আর শিল্পরূপ-রসোত্তীর্ণ হয়েই না! আদ্যিকালের থেকে জীবনও, মহাশূন্যের মতই, ক্রমেই আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে না কি? সব হবার পরেও আরও কিছু বাকী থাকে। জীবনের সবখানে সেক্স থাকলেও সেক্সই কিছু জীবনের সবখানি নয়।

আমি হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই তাঁর আরেক লাফ।

যথা? তিনি আরো বিশদের পক্ষপাতী : দৃষ্টান্ত স্বরূপ?

জীবনটা যেন সাতমহলা বাড়ি–তার সবটাই কিছু বাথরুম হয় না। প্রাত্যহিক প্রয়োজনে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বিরাট প্রাসাদের মধ্যে তার জন্যেও একটুখানি আলাদা করা থাকে বটে। কিন্তু সেইটাই তার সর্বস্ব নয়। বিধাতার প্রসাদে কারো যদি এই প্রাসাদে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য হয়, সে কি শুধু সেই বাথরুমেই বসে সারা জীবনটা কাটিয়ে দেবে তার? সে কি তার ঘরে ঘরে ঘুরে-ঘুরেফিরে সবকিছু দেখবে না? তার রঙমহল, রূপমহল, শীষমহল, নাটমহল… মহলে মহলে টহল দিয়ে নিজের কৌতূহল মেটাবে না? এমনকি যেখানে গেলে সে রাজতুল্যই, তার সেই রাজমহলে গিয়েও নিজের সিংহাসন দখল করবে না সে?… তা না হলে তার জীবনজোড়া অভিজ্ঞতার মালাই বা গাথা হবে কি করে? হাটের সব সওদা না সংগ্রহ করলে তার এই ভবযাত্রার পালাই যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

আমার আবোলতাবোলের থেকে কী বোঝেন তিনিই জানেন। জনাব সাহেব আপন মনে ঘাড় নাড়েন তাঁর–কোনো উচ্চবাচ্য করেন না আর। আমার বোঝা তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আমি যেন কিছু হালকা হতে পারি।

মহৎ উপন্যাস যেমনধারা, আমাদের জীবন বিন্যাসেও প্রায় তেমনটাই দেখা যায় না। কি? মহৎস্রষ্টা তাঁর উপন্যাসের পাঠককে সামনের সিংহদ্বার দিয়ে না নিয়ে হয়ত বা পিছনের, মেথরদের যাতায়াতের খিড়কিদোর দিয়ে ঢোকাতে পারেন, কিন্তু নিশ্চয় তাকে সেইখানেই বসিয়ে রাখেন না সব সময়? জগৎস্রষ্টা কোনো মহান্ লেখকের চেয়ে কম যান না–একথাটা মানবেন অবশ্যি?

…জগন্মাতাও তাঁর ছেলেমেয়েদের নিজের সব কক্ষেই নিয়ে যান, ভালো মন্দ সবরকমই দেখান, চাখান–সবার প্রতি তাঁর সমান টান। সম পক্ষপাত। আমার বেলাও তার কোনো অন্যথা হয়নি। লক্ষ্যপথ কী জানিনে, কিন্তু সব কক্ষপথেই ঘুরতে হয়েছে আমাকেও। তাঁর প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে বেড়িয়েছি, বাস করেছি, কিন্তু আটকে রাখেননি তিনি কোনোখানেও। আর, আমাকেও এমন কিছু কোষ্ঠবদ্ধতায় পায়নি যে, তাঁর একটিমাত্র প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে সেই বাথরুমে গিয়ে বসে থাকব সারাটা দিন। আমার প্রাতঃকৃত্য যা কিছু জীবনের সেই প্রাতঃকালেই সারা হয়ে গেছে। সব।

…সেই বস্তি-নন্দিনীর কথা জানতে চাইছিলেন না? হ্যাঁ, তার সঙ্গসুখেও নন্দিত হয়েছি বই কি কিছুকাল, কিন্তু সেটা তেমন কালান্তক হয়নি–সঙ্গীদের মতন সঙ্গিনীরাও এক সময় ছেড়ে যায়–ছাড়িয়ে যায়। এগিয়ে যায় কি পিছিয়ে পড়ে। আর আমার দৌড়ও তো বেশিদূর নয়। আমি ভালোই জানি যে নন্দনকানন আমার জন্য হয়নি।

.

৩৯.

 জনাব সাহেব তারপর পড়াশোনার কথায় এনে পাড়ার চেষ্টা করেন আমাকে-না, ওকথা শুনচি না। বিদ্যাস্থানে ভয়েবচ-র কথায় ভুলচিনে আমি। লেখাটেখার মধ্যে মাঝে মাঝে আপনার বেশ বিদ্যাবত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।

একদম কিছু না জানার ঐ তো মজা মশাই! কিছুই না জেনেও স্বচ্ছন্দে সবজান্তা হওয়া যায়।

তা কি হয় নাকি কখনো? লেখক হতে হলে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। কল্লোল যুগের আপনার বন্ধুরা প্রায় সবাই দারুণ পন্ডিত। তাঁদের বাড়ি গেলে ঘরবোঝাই আলমারি ঠাসা বই দেখতে পাই, একালের সেকালের নামকরা দেশি বিদেশি নানারকম বই।

আমার এখানে দেখছেন কি? আঁতিপাঁতি করে খুঁজলেও আমার নিজের লেখাও একখানা পাবেন না।

তার মানে? তিনি মানতেই চান না–এখানে বই না থাক, লাইব্রেরিতে গিয়ে আপনি পড়াশোনা করে থাকেন নিশ্চয়। অনেক লেখক যেমন ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে যান পড়তে, আবার সেখানে বসে লিখতেও।

রিসার্চ স্কলাররা। কিন্তু ট্রামবাসের ধকল ঠেলে সাত মাইল ঠেঙিয়ে ওখানে যাবার আমার উৎসাহ হয় না। কানেই শোনা, কোনদিন চোখেও দেখিনি, কেমন দেখতে লাইব্রেরিটা। তাছাড়া, আমার রিসার্চ করার কিছু নেই। আমার যা-কিছু রিসার্চ তা শুধু আমাকে নিয়েই।

কিন্তু না পড়লে কি মশাই লেখক হওয়া যায়?

যায় না বোধহয়। গোড়ায় কিছু কিছু পড়তেই হয় বইকি–ঐ লেখার অক্ষরপরিচয়ের জন্যই। কী লিখব, কেমন করে লিখব–সেইটে জানতেই। কথাটা আপনার মিথ্যে নয়, রবীন্দ্রনাথও একদা ঐ কথাই বলেছিলেন আমার বন্ধু শ্রীবিশু মুখোপাধ্যায়কে।

কিরকম?

সাহিত্যিক বিশু মুখোপাধ্যায়ের শৈশব থেকেই লেখক হবার শখ। কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল সেইকালেই। তিনি তাঁকে স্নেহ করতেন খুব। কী করে লেখক হওয়া যায় এই কথা শুধোতে তিনি তাকে বলেছিলেন যে, লেখক হতে হলে তার আগে পাঠক হতে হয়। বড় বড় লিখিয়েরা সব বড় বড় পড়ুয়া। বিস্তর পড়াশুনা না করলে লেখক হওয়া যায় না। লেখাপড়া শেখার কালে যেমন আগে লেখা, তার পরে পড়া। প্রথমে হাতে খড়ি হোলো, তারপরই তুমি প্রথম ভাগ ধরলে–লেখক হবার বেলায় ঠিক তার উল্টোটাই। আগে অনেক কিছু পড়া, তার পরেই লেখাটেখা। আগে তোমায় পড়তে হবে বিস্তর, তবেই তো তুমি লেখক হবে। গোড়ায় পড়ো, পরে পাড়ো।

ভারী চমৎকার কথাটা বলেছেন তো গুরুদেব।

কী ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন জানিনে, তবে কথাটা এইরকমই। আমার ব্যক্তিগত ভাষণে বিবৃত করলাম। তবে এই ধরনের একটা কথা বিশুবাবুর মুখেই আমি শুনেছিলাম অনেক দিন আগে।

তা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে না যান কলকাতায় আরো তত ঢের পাঠাগার আছে, তার থেকেও কি বইটই এনে পড়া যায় না?

পড়েছিলাম। আমার মনে পড়ে-যখন কলকাতার রাস্তায় খবর কাগজ ফেরি করতাম না? আমার সেই কৈশোর কালেই, আমারই সগোত্র একটি ছেলে একটা লাইব্রেরির খবর আমায় দিয়েছিল, হিরণ লাইব্রেরি। বিজ্ঞ স্ট্রীট দিয়ে বাঁ ফুট ঘেঁষে গেলে মিনার্ভা থিয়েটারের ঢের আগেই পড়ে সেই লাইব্রেরিটা, বাতলেছিল সে। সেখানে টাকা জমা দিয়ে মেম্বার হলে চাঁদার বদলে বই নিয়ে পড়তে দেয়, সে বলেছিল। সেখান থেকে বিস্তর বই নিয়ে পড়েছি একসময়। মানে, সেই সময়েই।

আমার মনে পড়ে যায়–কাগজের পাঁজা বগলে নিয়ে সাত-সকালে গিয়ে দাঁড়াতাম তো হেদোর ধারে। আমার আনন্দবাজার, বসুমতীর খদ্দের তো যতো দিদিভাইরা। তখনো ঢের দেরি তাদের আসবার। দশটার আগে তো কোনো দিদিভাই-ই আসছেন না আর!

দিদিভাই? দিদিভাইরাই আপনার কাগজ কিনতেন নাকি? অপত্যস্নেহ বলে একটা কথা আছে জানি, কিন্তু নাতিবৃহৎ বাৎসল্যের ব্যাপার বলে তো শুনিনি কখনো?

আহা, সেই দিদিভাই নাকি মশাই? বাতলাতে হয় আমায়–বেথুন স্কুল আর কলেজের মেয়েরাই তো খদ্দের ছিল আমার না? দিদি আর ভাই পাতিয়ে পটিয়ে ফেলেছিলাম তাদের। মেয়েদের সঙ্গে, চেনাই কি আর অচেনাই কি, ভাব জমাতে আমি ভারী পটু, সেই ছেলেবেলার থেকেই–জানেন তো?

জানলাম। তা কী রকমটা, শুনি একবার?

আমার চেয়ে বড়ো মেয়েদের, কলেজের মেয়ে তারা, তাদের কাছে গিয়ে বলতাম, কাগজ নেবেন দিদি? আর যারা বয়সে ছোট তাদের সাধতাম-কাগজ নেবে ভাই? মহাত্মা গান্ধী আজ কী বলিয়াছেন শুনবে? নাও না একখানা। পড়ে দ্যাখো।

নিত তারা?

না বলত না কেউ। প্রায় সবাই-ই নিত। যত কাগজ আনতাম, যা পেতাম আর কি আপিস থেকে–হুঁ হু করে কেটে যেত সব। তা শুনুন…সেদিন সকালে হেদোর মোড়ে দাঁড়াতেই ছেলেটার কথাটা খট করে আমার মনে পড়ল। সামনেই তো বিডন স্ট্রীট? খটকাটা আজই মিটিয়ে ফেলা যাক না! আমার দিদিভাইরা আসবার আগে হিরণ লাইব্রেরির খোঁজ নিই না গিয়ে।

কাগজের পাঁজা বগলে বিজ্ঞ টি-এর পথ ধরলাম। মাঝে মাঝে এক-আধখানা কাগজও ঐ ফাঁকে বিক্রি হচ্ছিল না তা নয়–এমনি যেতে যেতে মিনার্ভা থিয়েটার পেরিয়ে গেছি তখন আমার চৈতন্যোদয় হোলো। সামনে চৈতন্যোদয় দেখলাম।

সামনে চৈতন্যোদয়? সে আবার কী ব্যাপার? তাঁর বোধগম্য হয় না।

চৈতন্য লাইব্রেরির আবির্ভাব দেখলাম, আমি কই-চৈতন্য লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রী রিডিং রুম। আরে, আরেকটা লাইব্রেরি যে রয়েছে এখানেই। বেশ বড় লাইব্রেরিই বোধ হচ্ছে। এর কথা তোকই বলেনি সেই ছেলেটা। ঢুকলাম ভেতরে। বড় হল-এ বৃহৎ টেবিলে নানান পত্র-পত্রিকা বিস্তারিত-বসে বসে পড়ছিল বহুৎ লোক। আমি ভেতরে যেতেই একজন, হয়ত ঐ পাঠাগারের কর্মকর্তাই হবেন কেউ, বললেন আমাকে–তোমার কোনো কাগজ আমাদের চাই না। খবর কাগজ কি পীরিওডিক্যাল আমাদের কিনতে হয় না, অমনি আমরা ওসব কমপ্লিমেন্টারি পাই। অনেক দিনের বিখ্যাত লাইব্রেরি আমাদের…অমনি মেলে তাই। যাও, এখান থেকে কেটে পড়ো ভাই।

কেটে পড়লেন?

কী করবো? এমন অকাট্য কথার পর আর কি এক মুহূর্ত সেখানে কাটানো যায়? তবু তার মধ্যেই আমার কার্যোদ্ধার করেছি, জেনে নিয়েছি তাঁর কাছ থেকেই হিরণ লাইবেরির ঠিকানাটা। এই রাস্তারই কোথায় যেন হিরণ লাইব্রেরি বলে আরেকটা লাইব্রেরি আছে না? সেখানেই আমি যেতে চাইছিলাম মশাই। আরে, সে তো তুমি ছাড়িয়ে এসেছে অনেক আগে, জানালেন তিনি, এই ডান দিকের ফুট ধরে চলে যাও বরাবর, মিনার্ভা থিয়েটার পেরিয়ে খানিক এগিয়ে গেলেই নজরে পড়বে তোমার। সাইনবোর্ড আছে রাস্তার ওপর। কিন্তু, লাইব্রেরি তো সন্ধ্যের আগে খোলে না বাপু, তাও আবার ঘন্টা দুয়েকের জন্যেই। ছোট্ট লাইব্রেরি। আমাদের মতন এত বড় ফ্রী রিডিং রুম নেইকো তার।

তারপর?

তারপর আর কী? সেদিন ছটার শো-র সিনেমা না দেখে যথাসময়ে গিয়ে পৌঁছলাম যথাস্থানে। তারপর অনেক দিন সেই লাইব্রেরির সদস্য ছিলাম, প্রায় সব বই-ই পড়ে ফাঁক করেছি তার। লোকগুলো ভারী ভদ্র সেই লাইব্রেরির। যে বই-ই চাইতাম, দিয়ে দিত চটপট। চার আনা কি আট আনা দামের তাদের লাইব্রেরির একটা ক্যাটালগও দিয়েছিল আমাকে দেখে দেখে বাছাই করে বই নিতাম। যেমন চমৎকার সেই লাইব্রেরিটা–তেমনি তার লোকগুলোও।

তারপর?

তারপর সেই হিরণ লাইব্রেরি ফাঁক করার পর আর কোথাও তাক করার সুবিধে হয়নি। তাকাব কি, কলকাতার কোথায় কোন্ পাবলিক লাইব্রেরি আছে তার খবরই রাখতাম না। অনেকদিন বাদে একটা সুযোগ এল আবার। তখন আমি চোরবাগানের বাসায় থাকি, চোরবাগান আর কলাবাগান যেখানে এসে গলাগলি করেছে সেই চোরা গলির মোড়ে কি করে সেই গোপালবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল হঠাৎ। পুরো নামটা তাঁর মনে পড়ে না-গোপাললাল শীলই হবেন বোধ হয়। তিনি কী একটা লাইব্রেরির কর্মকর্তাদের একজন, জানলাম। সুহৃদ লাইব্রেরি, মহম্মদ আলি পার্কের কাছাকাছি কোথায় যেন সেই পাঠাগারটা। আলাপের পর তিনি আমায় তাঁর বাড়িতেও নিয়ে গেছলেন একবার। খাইয়েছিলেনও খুব মনে আছে।

সেই জন্যেই তাঁকে আপনার মনে আছে বোধ হয়।

তা ঠিক। জনমভোর তো পরের খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছি আর ওই খাবার ঠেলায় আমার হৃদয়দেশ ডায়ালেটেড হয়ে উদরের কাছেই এসে ঠাই নিয়েছে প্রায়। আমার অন্তরে স্থান পেতে হলে যুগপৎ আমার উদর আর হৃদয় আক্রমণ করতে হয়। শুধু আমার বেলায় নয়, সবার বেলাইে বুঝি তাই করতে হয়। যা গে–গেলাম তো তাঁদের বাড়ি। বাড়ি দেখে মনে হলো তাঁরা অনেকলের বনেদী। পুণ্যশ্লোক মতিলাল শীলেরই কেউ হবেন কি না জানি না।

কি রকম বাড়িটা? খুব জমকালো? মার্বেল প্যালেসের মতন?

তার ধারেকাছে না। বাড়িটার বৈশিষ্ট উচ্চতায় ততটা নয় যতটা গভীরতায়। কারো বাড়ি গেলে সদর দরজা পেরিয়ে উপরেই উঠতে হয় তো? তাঁর বাড়িতে ঢুকতে হলে সদরের চৌকাঠ পেরিয়ে তিন ধাপ নামতে হয়। রাস্তার সমতল থেকে তাঁর গ্রাউফ্লোরের তলদেশ আরো তলায়। জব চার্ণকের আমলের বাড়িই হবে বোধ হয়। তার পরে বলকাতার পথঘাটের উন্নতি হয়েছে কিন্তু তাঁর বাড়িটা আর উন্নীত হতে পারেনি।

তারপর আর যাননি তাঁর বাড়িতে কখনো?

বর্ষাকালে গিয়ে দেখবার কৌতূহল হয়েছিল একবার-সেই সময় তাঁর বাড়ির তলদেশের কী দশা দাঁড়ায় দেখতেই–কিন্তু তার সুযোগ ঘটেনি। তাছাড়া, সাঁতার জানিনে, সেদিক দিয়েও বাধা ছিল আমার।…সে কথা যাক, তার সুহৃদ লাইব্রেরিতে বিদেশী বইয়ের বেশ ভালো সংগ্রহ ছিল। মোপাসা, হার্ডি, হামসূন, গোর্কি, ইবসেন, শ, পীরান্দেলো, মেটারলিঙ্ক, বেনাভেনতে, যোহান, বোয়ের প্রভৃতি কতজনের বইয়ের সঙ্গেই সাক্ষাৎ পরিচয় সেখানেই আমার। সেই শীল মশায়ের সৌজন্যেই যা আমার বিদেশী সাহিত্যের অনুশীলন। আজও আমি কৃতজ্ঞচিত্তে সে কথা স্মরণ করি, চাঁদা না নিয়ে অমন জোর করে আমায় গিলিয়ে না দিলে যথার্থ সাহিত্যের আস্বাদই আমি পেতাম না কোনোদিন। সুহৃদ পাঠাগারেই বিশ্বের সেরা সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় হল।

হয়ে আপনি লাভবান হয়েছেন, একথা আপনি মানবেন নিশ্চয়?

আমার লাভ? না, আমার কী হবে–তবে বাংলা সাহিত্যের যে লাভ হয়েছে তা আমি বলব। লিখতে হলে কী লিখতে হয়, আর কী করে লিখতে হয় টের পেয়ে গেলাম আমি। সাহিত্য সৃষ্টি করতে হলে অমনধারাই করতে হয়–অমনটাই হওয়া চাই। আর বুঝলাম যে তা আমার দ্বারা হবার নয়। ওদিকেই তাই গেলাম না আর বেঁচে গেল বাংলা সাহিত্য-আর বাঙালী পাঠক–একটা উপকার হলো না? সাহিত্যও বাঁচল, আমিও বেঁচে গেলাম। সাহিত্যের পাশ কাটিয়ে চলে এলাম এই সাংবাদিকতায়-যে বিষয়ে রপ্ত হচ্ছি এখনো–যেদিক দিয়ে আমার আমদানি রপ্তানি।

না না, আপনি গল্পটল্পও তো লিখেছেন কিছু কিছু-ছোটদের বড়দের। সাতসতের অনেক কিছুই লিখেছেন আপনি। সাহিত্যিকও বলা যায় বইকি আপনাকে।

ভদ্রলোক তাঁর স্তোকবাক্য শোনান।

ঐ টেনে-বুনে। সাত-সতের অনেক কিছুই লিখেছি বটে, সব মিলিয়ে সংখ্যায় সাত শো তেরই হবে হয়তো বা-লেখার ঐ মোট নামিয়ে মজুরি কুড়িয়েই তো মোটামুটি বেঁচে থাকতে হয়েছে এতকাল–কিন্তু সত্যি বলতে কিছুই কিছু হয়নি। শিশুসাহিত্য শিশুদের হয়নি, বড়দের লেখা বড়দের পড়ার মত নয়।

তবে কাদের জন্য? কী লিখেছেন এতদিন ধরে তাহলে?

আমিও তাই ভাবি। কী লিখলাম তবে? আমার লেখা কী ধরনের ছোট-বড়রা পড়ে বলব? যারা সত্যিকারের ছোট নয়, আকারে ছোট কিন্তু প্রকারে বড়, বয়সে বারো কিন্তু মনের বাড় তার ঢের বেশি-আসলে ভেতরে ভেতরে তারা যুবকই বলতে গেলে। প্রায় যুবক, কিংবা যুবকপ্রায়–যাই বলুন। তারাই আমার লেখায় রস পায়। আর বড়দের কথা শুধপাচ্ছেন? যারা বয়সে অনেক বেড়ে গেলেও অন্তরে সেই শিশুটি কি কিশোেরই রয়ে গেছে–মনের দিকে বদলায়নি বিশেষ–আমার বড়দের লেখা কেবল তাঁরাই পড়ে থাকেন। এককথায়, আমার লেখা-ফর অ্যাডালটস্ ওনলি। আর ঐ মার্কার যা কিছু, ছোটরাই তার গ্রাহক তা জানেন তো? আর, ছোটদের বড়ো হবার শখ-বড়ত্বে ঝোঁক, কে না জানে? এবং বিস্ময়কর শোনালেও বড়রা সব ছোট হতে চায়। তাই যারা ফের মনের কৈশোরে ফিরে যেতে চান–সেই বড়রাই আমার অনুগ্রাহক। এককথায় আমার লেখা আসলে অ্যাডালটারেটেড।

অ্যাডালটারেটেড? মানে, ভেজাল বলতে চাচ্ছেন আপনি?

হ্যাঁ, ভেজাল বইকি? আর এই কারণেই আমি সাহিত্যে না গিয়ে সাংবাদিকতায় এলাম। অবশ্যি, বলতে পারেন, সাহিত্য আর সাংবাদিকতা একাকার হয়ে গেছে একালে। এও এক রকমের ভেজাল। কিন্তু ভেজাল হলেও বেশ মুখরোচক এবং পুষ্টিকারক, নয় কি? তবে, আমার দিক থেকে সেটা বোধ হয় আবো। যথার্থ সাহিত্যিক যেমন হতে পারিনি, তেমনি যথোচিত সাংবাদিকও আমি হইনি সঠিক। গোঁজামিল রয়ে গেছে সেখানেও। হয়ত সেটা গাঁজার মিল। সেই কারণেই হয়ত একটু মৌজ লাগে, একদল অ্যাডিটেড পাঠক চিরকালই পাওয়া যায়–যারা কিনা ওই গাঁজাদারের মজাদারির লোভে তার রুজি-রোজগার বজায় রাখে। কিন্তু এটাকে তো নির্ভেজাল বলা যায় না কিছুতেই।

ওকথা থাক। প্রসঙ্গটা তিনি চাপা দিতে চান-কথা হচ্ছিল আপনার বই পড়ার বিষয়ে। সুহৃদ লাইব্রেরি না হয় গেল কিন্তু ও ছাড়া কি আর সুহৃদ ছিল না আপনার? ঐ কল্লোল গোষ্ঠীর? আপনার প্রায় সব বন্ধুরই তো চমৎকার ঘরোয়া পাঠাগার রয়েছে। আমি দেখেছি। আপনিই খালি ব্যতিক্রম। আপনার ঘরেই বইয়ের কোনো পাত্তা নেই।…তাহলেও আপনি বন্ধুদের বাড়ি কি পা বাড়ান না নাকি? তাঁদের কাছ থেকে বই এনেও তো পড়া যায়।

তা যায়। পা-ও বাড়াই না যে তা নয়। মাঝেসাঝে বন্ধুদের সাক্ষাতে যাই বইকি। অন্তত প্রেমেনের বাড়ি তো গিয়েই থাকি। লেটেস্ট আমদানি আনকোরা বই সব দেখেছি। তার বুকশেলফে। কিন্তু সেলফ-হেলফ করব যে তার সুযোগ কই? হাত বাড়াবো কি, সেদিকে ঘেষতেই দেয় না। বইকে সে প্রায় বউয়ের মই আগলে রাখে। ঐ বই আর বউ পরের হতে গেলে পরীর মত হয়ে যায়, জানেন? পাখা মেলে কোথায় যে উড়ে যায় তার পাত্তাই মেলে না আর। কিংবা…কিংবা…

কিংবা?

কিংবা বোধ হয় মার্ক টোয়েনের সেই বিখ্যাত বয়েটা তাদের মনে রয়ে গেছে এখনো –ভুলতে পারেনি। তাঁর ঘরময় বইয়ের ছড়াছড়ি দেখে কে একজন শুখিয়েছিল-বই তো পড়ার জন্যে পরের কাছ থেকে নিয়ে আসি, কিন্তু ওই আলমারি আমায় কে দিচ্ছে! বই ধারে পাওয়া যায়, কিন্তু আলমারি তো কেউ থারে দেয় না। দুঃখ করেছিলেন মার্ক টোয়েন। …তবে প্রেমেনের কাছ থেকে একেবারেই যে কোনো বই আনিনি তাও নয়। আমার দেওয়া সব বইগুলিই নিয়ে এসেছি এক সময় না একসময়।

নিজের বই বন্ধুকে উপহার দিয়ে কেউ ফেরত নেয় নাকি আবার?

বললাম না, আমি ব্যতিক্রম? আমার কোনো বই-ই তো আমার কাছে কখনো থাকে না৷ হঠাৎ কোনো পাবলিশার এলে, এসে গেলে, তখন আমার বই মেলে কোথায়? প্রেমেনের কাছেই পাওয়া যায়। সে তো কোনো বই সহজে হাতছাড়া করে না, এমন কি, আমার বইও নয়। ওখানে গেলেই মিলে যায়। এই করে আমার সব বই-ই তার কাছ থেকে ফিরিয়ে এনেছি পরস্পরায়।

পাবলিক লাইব্রেরিগুলোয় খোঁজ করলেও পেতে পারতেন আপনার বই।

তাও কি করিনি আর? নিজে না যাই, ভাগনে-ভাগনীদের পাঠিয়েছি। তারা এসে খবর দিয়েছে যে লাইব্রেরির বইয়ের তালিকায় তোমার বইগুলোর নাম আছে-কিন্তু আসল জায়গায় নেই, লাইব্রেরিতে নেই একদম।

তার কারণ? তিনি বিস্মিত হন।

ছেলেদের বই তো যতো আমার। ছেলেরা নিয়ে গেছে। হাতে হাতে ঘুরছে সে-সব বই। তারপর হাতাহাতি হতে হতে তার সামনের পাতাগুলো উড়ে গেছে, শেষের পাতাগুলো খসে গেছে–তখন সেই ছেঁড়াখোঁড়া বই ফেরত দেওয়া তারা বাহুল্যই বোধ করেছে। লোকপ্রিয় লেখক না হয়েও, নেহাত বালকপ্রিয়তার হেই আমার বইয়ের এই বিরলদশা। এই আমার ধারণা। তবে এটা একরকমের আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে। এই ভাবেই বোধহয় আমার বইয়ের কাটতি বেড়েছে। লাইব্রেরিতে পায় না বলে কিনে পড়তে হয়েছে তাদের। কিন্তু আমার বই না পড়লেই বা তাদের কী আসে যায়? খেলাধূলায়, সিনেমা দেখার সময় কেটে যায় তাদের।

তাদের না হয় কাটলো, কিন্তু আপনার কাটে কী করে? একদম কোনো বইটই না ছুঁয়ে, কিছু না পড়ে-উড়ে সময় কাটান কী করে?

কিছু পড়ি না যে কে বললে? পড়তে হয় বইকিবই না হলেও ঐ খবরের কাগজ পড়তে তো হয়ই। তিন-চারখানা কাগজ পড়ি রোজ–আগাপাশতলা খুঁটিয়ে পড়তে হয় আমাকে। তিন শ লাই পড়ে তবে হয়ত একটা লাগসই খবর পাই, যা আমার ওই তিন লাইনের টিপ্পনিতে লাগে। লেখা অল্প–কিন্তু পড়া বিস্তর–এই আমার অল্পবিস্তর লেখাপড়া। এখনকার। বললাম না, সারা জীবনটাই আমার সাংবাদিক? খবরের কাগজ ফেরি করে এই জীবনের শুরু, এখনও সেই ফেরিঘাটেই রয়ে গেছি। খবরের কাগজের হকার থেকে খবরের কাগজের জোকার এখন।

তা আছেন বেশ।

তা আছি। এই খবরের কাগজই আমায় বহালতবিয়তে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেইসঙ্গে এ বাংলা দেশের ছেলেমেয়েরাও। বেথুনে পড়া বাঙালীর মেয়েরা কাগজ কিনত, তা-ই বেচে খেয়েছি এককালে। আর, ছোট-ঘোটরা আমার বই কিনেছে বলেই আমি খেয়ে বেঁচেছি, বড় হয়েছি। এবং যখন আর লিখতে পারব না, এই কলম চলবে না, মগজে কিছুই আসবে না আর, কাগজে আমার কোনো লেখাই নেবে না ভুলেও…তখন…তখন…

তখন কী করবেন?

সেই বেকারি দশায় গিয়ে হয়ত আমায় এই কাগজের হকারিতেই ফিরে আসতে হবে আবার। ঐ একটা কাজ তো কেবল জানা আছে জীবনে। অবশ্যি, এখন এটা আরও লাভজনক হবে আশা করি। তখন দুপয়সার আনন্দবাজারে আধ পয়সা কমিশন মিত মোট, এখন কাগজের দাম বেশি, কমিশনও বেশি। মোটামুটি লাভ। বেশ আনন্দেই কাটাবো।

আমার ধারণায় সাহিত্যের সঙ্গে দায়িত্ব জড়িয়ে আছে…।

জনাব সাহেবের দরবারে আমার জবানবন্দী খতম করি : সমাজ আর সময়ের সহিত গেলেই তার হয় না। তার থেকে এগিয়েও যেতে হয় তাকে। শুধু পথের সঙ্গী হওয়াই নয়, পথ দেখাতেও হয় আবার। সাহিত্য কথাটায় সহিত-ত্বর ওপরই জোরটা বেশি দেওয়া বটে, কিন্তু তার জের ঐখানেই মেটে না। সহিতের মধ্যে যতটা সহ-তা ততখানিই কি হিত-ত্ব নেই আবার? তৎকালীন সমাজ ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে শুধু তাকে প্রতিবিম্বিত করেই তার দায় খালাস হয় না। ভাবীকালের দাবিও মিটিয়ে যেতে হয় সেই সাথেই।…

অর্থাৎ?

অর্থাৎ, যথার্থ সাহিত্যিক, আমার ধারণায়, তাঁর নয়া সাহিত্য সৃজনের সাথে নতুন সমাজও সৃষ্টি করে থাকেন, সমাজব্যবস্থা পালটে দেন, সময়ের ধারা বদলে দিয়ে যান। যেমন রুশো, ভলটেয়ার, গোর্কি, সিক্লেয়ার, ইবসেন ইত্যাদি। আমাদের সাহিত্যে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল আর সুকান্ত।

এক নিশ্বাসে পাঁচটা নাম উচ্চারণ করলেন?

পাঁচজন অবশ্যি পাঁচ ধারা-সেকথা সত্যি। ধার এবং ধারণাও তাঁদের পাঁচ রকমের কিন্তু তাঁদের স্বতন্ত্র সৃষ্টিপ্রয়াস উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে অভিন্নই। সামাজিক গতিমুক্তির উদ্দেশ্যেই সেই প্রয়াস। আর, সেইদিক দিয়েই তাঁদের ঐক্য আর সার্থকতা।

বিশদে বলুন।

বঙ্কিমচন্দ্র অবশ্যই পথিকৃৎ, তাঁর সম্বন্ধে দ্বিরুক্তির অবকাশ নেই। তা হলেও তাঁর সমকালীন প্রায় সকলেই বিপ্লবী। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ–নিজের নিজের পথে কে নন? নিজের নিজের খাতে পুরাতনের উৎখাতে সকলেই উচ্ছ্বসিত নবযুগ নিয়ে এসেছেন। খতিয়ে দেখলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো অনেক ভগীরথের সন্ধান মিলবে।…।

আমরা এখানে সাহিত্যক্ষত্রেরই আলোচনা করছি। জনাব সাহেব আমায় মনে করিয়ে দেন। আনুষঙ্গিক প্ৰসঙ্গাতরে যেতে তিনি নারাজ।

সাহিত্যের কথাই কইছি তো। শরৎচন্দ্রকেই ধরুন না। তিনিও কি তাঁর লেখার ধারে সমাজের রূপরেখা বদলে দেননি? তাঁর কালের পল্লীসমাজের অরক্ষণীয়ারা কি আছে এখনো? তাঁর পথের দাবী কি সমসাময়িক যুগবিপ্লবের প্রয়োজন মেটায় নি? পথ দেখায়নি সেকালের বিপ্লবীদের? অথচ তিনি আমাদের সমাজব্যবস্থা পালটে দিয়ে গেছেন সকলের অগোচরে, তাঁর শিল্পকলার একটুখানিও ক্ষুণ্ণ না করে তাঁর রচনার কোথাও একটুও সোচ্চার না হয়ে। কত বড়ো আর কী নিপুণ শিল্পী দেখুন। একেই আমি সত্যিকারের সাহিত্যিক আর যথার্থ সাহিত্য-সাধনা বলব–যা নাকি সমাজের দাবী, সময়ের দাবী, সেই সাথে ভাবীকালের দাবী মেটায়।

কথাটা ঠিক। মানতে তিনি রাজী।

আর, রবীন্দ্রনাথের কথা তো বলাই বাহুল্য। তিনি তো সব দিক দিয়েই আমাদের জাতির ধারা পালটে দিয়ে গেছেন–তাঁর নানান সাংস্কৃতিক উদ্ভাবনা আর শিল্পসাধনায়-যা নাকি দস্তুরমতই বৈপ্লবিক। রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্র দুজনে মিলে আমাদের হৃদয়মন মথিত করে নয়া মানসিকতায় উন্মথিত উদ্বর্তিত আনকোরা আরেক জাতের মানুষদের নিয়ে এসেছেন এদেশে। নিজের সাহিত্য-শিল্পের দাবী আর নিজের যুগের সঙ্গে যুগোত্তর দাবী দুই-ই তাঁরা মিটিয়েছেন যুগপৎ।

আর নজরুল ও সুকান্ত? তাঁরাও কি তাই?

 তাই না কি? তাদের কাজ সবজনকে নিয়ে হয়ত নয়, কেবল তাঁদের কালের বৈপ্লবিক উদ্বোধনে-বিপ্লবীজনদের জন্যেই। তাহলেও নজরুল নিজেকে যুগের নন হুজুগের কবি বলে গাইলেও সত্যিকারের যুগের দাবীও তিনি মিটিয়ে গেছেন–তাঁর গানেই তাঁর কালের বিপ্লবীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। আর সুকান্তও তেমনি, তাঁর অনুসরণেই একালের বিপ্লবপথিকরা এসেছে সব, দল বেঁধে এগুচ্ছে তারাই–এ যুগের বিপ্লবচেতনা যুগিয়ে গেছে সে-ই তো! 

কিন্তু যুগের দাবী মেটানো ছাড়া কি সাহিত্যের আর কোনো দায় থাকতে পারে না? সাহিত্যিকের নিজের কোনো দাবী থাকতে নেই?

হ্যাঁ, আছে বইকি। তার আত্মপ্রকাশের দাবী। তাও আছে। মনের রূপ তো সাহিত্য; সেই মনোরূপের কলাসম্মত অপরূপ প্রকাশ-ব্যক্তিগত সেই দাবীও সাহিত্যিকের থাকতে পারে বইকি।–সে দায়ও তাকে রাখতে হবে অবশ্যই। যুগের নয়, জাতির নয়, নিছক নিজের গরজে নিজের জন্যই সাহিত্য, হ্যাঁ, তাও আছে। কেউ কলা বাঁচিয়ে যুগের সঙ্গে নিজের দায় দুই মেটায়, দু-ই পারে; কেউ শুধু একটাই বজায় রাখে, একটাই পারে। জাতির এবং সমাজের কথা না ধরে কেবল সাহিত্যের দিক দিয়ে ধরলে কেউই এদের ফ্যালনা নয়। তবে যে কলাও বেচে আবার রথও চালায়, আমার বিবেচনায় সেই বড়ো। একাধারে রথী এবং সারথী যে-সে-ই যুগন্ধর।

তবে কথা কী জানেন? একটা হল শুধুই রূপশিল্প, আরেকটা জীবনশিল্প। তবে উভয়েরই শিল্পরূপসম্মত হওয়া চাই। একজন কেবল নিজের জীবনকেই টেনে বুনে দেখায়, অপরজন সবার জীবনকে গড়ে দিয়ে যায়–তাদের অজ্ঞাতসারে। পার্থক্য এইখানে। একজন শুধুই সাহিত্য সৃষ্টি করে, আরেকজন সাহিত্যের সঙ্গে নয়াসমাজও তৈরি করে দেয়। কোথাও আমাদেরই বদলে দিয়ে নতুন করে বানায়, কোথাও বা নব প্রজন্মে আনকোরা নয়া আমদানির পথ গড়ে যায়। আসে নবীন জাতি, অভিনব জাতীয়তার। যেমন গান্ধীজী, চলতি মানুষদের বদলে নিয়ে কাজ চালিয়েছিলেন; আর রবীন্দ্রনাথ নতুন মানুষদের গড়ে দিয়ে গেছেন–সাংস্কৃতিক, মানবিক দুদিক দিয়েই।

আর, আপনার ক্ষেত্রে? এটা যদিও একটু ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা, মাপ করবেন।

মাপ করব বই কি, আপনাকে আমাকে দুজনকেই। আমাকে আমার মাপাই আছে। যারা নিজের দায় আর যুগের দায় একসঙ্গে মেটায়, সেই মহৎ স্রষ্টা মহারথীদের সগোত্র আমি নই। আমার কোথাও কোনো দায় নেই–নিছক আদায়। আমার ভাগ্যে দায়ভাগ ন্যস্ত, আছে কেবল আদায়ভাগ। দায়সারা কাজে নিজের আদায় সারা। আর কলাকারুর দিক দিয়ে? আদায় কাঁচকলা!

তারপরে হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল আমাদের, সত্যিকারের সাহিত্যিকদের নিয়ে…দেখা যায়, তাঁদের সাহিত্যসাধনার একদিকে দেখি রূপ-শিল্প, অপর দিকে কেবল শিল্পরূপ। বিভূতিভূষণ প্রথম সারির, তাঁর রচনায়, পল্লীরূপ, প্রকৃতিরূপ, প্রকৃতির অনুষঙ্গী নিজের মনোরূপ–তারই আশ্চর্য প্রকাশ; দ্বিতীয় সারিতে আছেন প্রমথ চৌধুরী, যাঁর কাছে শিল্পরূপটাই সার। একের লক্ষ্য কী বলব; আরেকের কেমন করে বলব; একজনের কলা বজায় রেখে বলা, অপরের বলাটাই হচ্ছে কলা।

রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় এই দুই ধারারই অদ্ভুত সংমিশ্রণ দেখি আমরা। তিনি তো সব সময়ই সবাইকে টেক্কা দিয়ে গিয়েছেন–সর্বকালের জন্যই!

বঙ্কিমের কালেও এমনটা দেখা যায়। তারক গাঙ্গুলির স্বর্ণলতায় (এই একটি বইয়েই সমকালীন সবাইকে তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন) অপরূপ শিল্পসুষমায় সেকালের সমাজের নিখুঁত রূপচিত্রণ দেখা যায়, কিন্তু তার পাশাপাশি দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ আর সধবার একাদশী দেখুন, সেখানে পাবেন সামাজিক রূপ আর চেহারা দেখাবার সঙ্গে সেটা বদলাবার বৈপ্লবিক প্রয়াস।

এমনি ধারাই চলছে সাহিত্যে; চলেছে, চলবে বরাবর। শ্রেয়ঃ আর প্রেয়-র দুটি বারাই পাশাপাশি। আবার কোথাও বা এই দুয়ের সংমিশ্রণের সঙ্গে তৃতীয় এক সারস্বত সেই মনোরূপের কলাসম্মত অপরূপ প্রকাশ-ব্যক্তিগত সেই দাবীও সাহিত্যিকের থাকতে পারে বইকি। সে দায়ও তাকে রাখতে হবে অবশ্যই। যুগের নয়, জাতির নয়, নিছক নিজের গরজে নিজের জন্যই সাহিত্য, হ্যাঁ, তাও আছে। কেউ কলা বাঁচিয়ে যুগের সঙ্গে নিজের দায় দুই মেটায়, দুই পারে; কেউ শুধু একটাই বজায় রাখে, একটাই পারে। জাতির এবং সমাজের কথা না, ধরে কেবল সাহিত্যের দিক দিয়ে ধরলে কেউই এদের ফ্যালনা নয়। তবে যে কলাও বেচে আবার রথও চালায়, আমার বিবেচনায় সেই বড়ো। একাধারে রথী এবং সারথী যে-সে-ই যুগন্ধর।

তবে কথা কী জানেন? একটা হল শুধুই রূপশিল্প, আরেকটা জীবনশিল্প। তবে উভয়েরই শিল্পরূপসম্মত হওয়া চাই। একজন কেবল নিজের জীবনকেই টেনে বুনে দেখায়, অপরজন, সবার জীবনকে গড়ে দিয়ে যায়–তাদের অজ্ঞাতসারে। পার্থক্য এইখানে। একজন শুধুই সাহিত্য সৃষ্টি করে, আরেকজন সাহিত্যের সঙ্গে নয়াসমাজও তৈরি করে দেয়। কোথাও আমাদেরই বদলে দিয়ে নতুন করে বানায়, কোথাও বা নব প্রজন্মে আনকোরা নয়া আমদানির পথ গড়ে যায়। আসে নবীন জাতি, অভিনব জাতীয়তার। যেমন গান্ধীজী, চলতি মানুষদের বদলে নিয়ে কাজ চালিয়েছিলেন; আর রবীন্দ্রনাথ নতুন মানুষদের গড়ে দিয়ে গেছেন–সাংস্কৃতিক, মানবিক দুদিক দিয়েই।

আর, আপনার ক্ষেত্রে? এটা যদিও একটু ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা, মাপ করবেন।

মাপ করব বই কি, আপনাকে আমাকে দুজনকেই। আমাকে আমার মাপাই আছে। যারা নিজের দায় আর যুগের দায় একসঙ্গে মেটায়, সেই মহৎ স্রষ্টা মহারথীদের সগোত্র আমি নই। আমার কোথাও কোনো দায় নেই–নিছক আদায়। আমার ভাগ্যে দায়ভাগ ম্য, আছে কেবল আদায়ভাগ। দায়সারা কাজে নিজের আদায় সারা। আর কলাকারুর দিক দিয়ে? আদায় কচলা!

তারপরে হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল আমাদের, সত্যিকারের সাহিত্যিকদের নিয়ে…দেখা যায়, তাঁদের সাহিত্যসাধনার একদিকে দেখি রূপ-শিম, অপর দিকে কেবল শিল্পরূপ। বিভূতিভূষণ প্রথম সারির, তাঁর রচনায়, পল্লীরূপ, প্রকৃতিরূপ, প্রকৃতির অনুষঙ্গী নিজের মনোরূপ–তারই আশ্চর্য প্রকাশ; দ্বিতীয় সারিতে আছেন প্রমথ চৌধুরী, যাঁর কাছে শিল্পরূপটাই সার। একের লক্ষ্য কী বলব; আরেকের কেমন করে বলব; একজনের কলা বজায় রেখে বলা, অপরের বলাটাই হচ্ছে কলা।

রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় এই দুই ধারারই অত সংমিশ্রণ দেখি আমরা। তিনি তো সব সময়ই সবাইকে টেক্কা দিয়ে গিয়েছেন–সর্বকালের জন্যই।

বঙ্কিমের কালেও এমনটা দেখা যায়। তারক গাঙ্গুলির স্বর্ণলতায় (এই একটি বইয়েই সমকালীন সবাইকে তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন) অপরূপ শিল্পসুষমায় সেকালের সমাজের নিখুঁত রূপচিত্র দেখা যায়, কিন্তু তার পাশাপাশি দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ আর সধবার একাদশী দেখুন, সেখানে পাবেন সামাজিক রূপ আর চেহারা দেখাবার সঙ্গে সেটা বদলাবার বৈপ্লবিক প্রয়াস।

এখনি ধারাই চলছে সাহিতে; চলেছে, চলবে বরাবর। শ্রেয়ঃ আর প্রেয়-র দুটি ধারাই পাশাপাশি। আবার কোথাও বা এই দুয়ের সংমিশ্রণের সঙ্গে তৃতীয় এক সারস্বত শিক্ষাদীক্ষার দিকে আমার চোখ ফোঁটানোর ঝোঁকেই হয়ত সেটা হবে। নিজের জ্ঞানতৃষ্ণ নিরসনের পর অপরকে জ্ঞানদান করতে পাগল হয় না মানুষ? …জ্ঞানসমুদ্রের উপকূলে বহুৎ উপলখণ্ড কুড়োবার পর তার এক-আধখানা ছুঁড়ে অপরকে মার লাগাবার সাধ যায় না?

হোলো আপনার জ্ঞান? ওঁর বইয়ের তূপাকার দেখে চোখ ফুটলো আপনার? প্রেরণা পেলেন বই পড়ার? ওঁর বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখার উৎসাহ হয়েছিল? দেখেছিলেন?

নাড়ব কি মশাই, দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে গেছে। বললাম না, ভারী ভারী বই সব। বিদেশী পণ্ডিতদের লেখা ইয়াহ মোটা লম্বা চৌড়া ইলাহী ব্যাপার। সারগর্ভ ভারগর্ভ বই যতো! শ, রাসেল, নীটসে, বার্গ স, বোলাঁ, লরেনস ইত্যাদির! উনি এই বয়সেই ওই সব পড়ে শেষ করেছেন, আমি একশ জন্ম ধরেও পড়ে উঠতে পারব কি না সন্দেহ।

তা হলেও এক-আধখানা হাতে নিয়ে দেখতে হয়েছিল কী!

 দেখব কি, মশাই, অদূরে দাঁড়িয়েই.যা আঁচ পাচ্ছিলাম তাতেই আমার হয়ে গেছল! তাঁর বইয়ের দরবারী আমে গিয়ে আম-জনতার আমি কী আরাম পাব? সেই আঁচেই মনে ফোস্কা পড়ার যোগাড়! তার বেশী ছোঁয়াচে যায় আর? বৈশ্বানরের আঁচড়ে যেমন ঝলসে দেয়, বিশ্বনরের পুঞ্জীভূত ঐ চিন্তানল তার চেয়ে কিছু কম নয় মশাই! জতুগৃহের অগ্নিকুণ্ডে কি খাণ্ডবদাহনের দাবদাহে সাধ করে সেঁধিয়ে বিদগ্ধ হবার বাসনা কোনদিনই আমার নেই। তবে হ্যাঁ, সেই কালেই বিষ্ণুবাবুর ঝলসানো চেহারা দেখে আমার মনে হয়েছিল তখনি যে, হ্যাঁ, উনি রীতিমতই বৈদগ্ধ্য লাভ করেছেন বটে!…

তারপর আর আপনারা পরস্পর সংস্পর্শে আসেননি কখনো?

আর না। আমিও তাঁর বৈদগ্ধ্যের আঁচড় খাবার ভয়ে এগুইনি আর এবং তিনিও বুঝি তার ভালো ভালো বইয়ের প্রতি আমার ঐ আচরণ দেখে মনে মনে চটেছিলেন বেশ। তারপর কখনো আর আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষেননি। বুঝেছিলেন যে, সব জীবের উদ্ধার নেই, সব অধমকে তারণ করা যায় না। বিশেষ করে আমার মতন এই অধমাধমকে, নিজের বাবাও যাকে এত ধমকে একটুও মানুষ করতে পারেননি। তারপর…তারপরে কেমন করে আমরা যেন পরস্পরের থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম।দুজনেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম বোধ হয়।

অদ্ভুত আচরণ আপনার! অমন চমকদার চটকদার চমৎকার বই সব হাতে পেয়েও… কী ভাষায় নিজের বিস্ময় ব্যক্ত করবেন তিনি ভেবে পান না।

হাতিয়ে নিয়ে বাজারে এনে ঝেড়ে দিলে মন্দ হত না নেহাত? দু-পাঁচ টাকা হাতে এসে যেত! তখন ওটা আমার মাথায় খেলেনি কিন্তুক।

মাথায় হাত দিয়ে এখন আমি আপসোস করি। যদিও পোস্তার বাজার পার হয়ে এসে পোস্তর জন্য পস্তানির কোনো মানে হয় না।

না, না, ওকথা আমি বলেছি কি? বলছি কী?

বলতে হয় না বোঝাই যায়। শোনাও যায় বই কি! কানে তো আসেই যে আমাদেরই। কেউ কেউ প্রমথ চৌধুরীর ন্যায় পন্ডিত লোকের ঘনিষ্ঠ হয়ে তাঁদের দুর্লভ পাঠাগারকে দুর্লভতর করে দিয়েছেন… এখন তো সুদুর্লভ।

কি রকম? কি রকম? তারপরই তাঁর কে–কবে-কেন-কোথায়-কাহার? ইত্যাকার প্রশ্নমালার উৎসার হতে থাকে।

কিন্তু আমি উৎসের খবর রাখি না, তাঁর উৎসাহ মেটাই কি করে? আমাকে যেন সন্দেহ করবেন না মশাই! শ্রীচৌধুরীর ত্রিসীমানায় যাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি কখনো। এইটুকুই শুধু বলতে পারি। আর বলি যে, কাজটার মধ্যে আমি তো নিন্দনীয় কিছু দেখি না। নগদ নারায়ণ সর্বদাই নমস্য, তা ছাড়াও, এর দ্বারা সমাজবাদী মতে লক্ষীলাভের সমভাগ্য সবাইকে দিতে না পারলেও এটায় প্রায় সমভাগেই সরস্বতীর সমবন্টন হয়ে যায়। যায় না? সেটা মন্দ কী–বলুন?

সে কথা আমি কইছি না। নতুন বই হাতে পেলে…না না, বউয়ের কথা নয়, কারও বউয়ের বিষয়ে বলছিনে, বইয়ের কথাই হচ্ছে! নতুন বই হাতে এলে কে না একটু নেড়েচেড়ে দ্যাখে! অদ্ভুত লোক আপনি। সেই কৌতূহলটুকুও হল না আপনার! নতুন বই তো আগ্রহভরে শুঁকেও দেখে থাকে অনেকে, আমি শুনেছি। তার ঘ্রাণ নাকি চমৎকার!

আমিও কি দেখিনি নাকি? সত্যি বলতে, ঐ খুঁকে দেখা পর্যন্তই বইয়ের জ্ঞান আমার। ঘ্রাণেই অর্ধভোজন হয়ে যায়, গোটা বইটা গোগ্রাসে গেলার দরকার করে না। ও ছাড়াও কি বই আমি পড়িন নাকি? মস্ত মস্ত বইও পড়ি। আগাপাশতলাই পড়ে ফেলি একরকম। হস্তগত হলেই তার প্রথম প্যারা আর শেষ প্যারাটা পড়ে দেখি একবার চোখ বুলিয়ে নিই বেশ করে–তাতেই আমার আদ্যোপান্ত পড়া হয়ে যায়। তখন আগাগোড়াই বইটা আমার পড়া যে, সে কথা জানাতেও বাধা থাকে না কোথাও, মিথ্যেও বলা হয় না বিশেষ। আমার বিদ্যের দৌড় বইয়ের ঐ প্রথম আর শেষ প্যারা। পড়ার ব্যাপারে আমার প্যারালাল আপনি পাবেন না!

তার কোনো জবাব না দিয়ে শ্রী জনাব, আচ্ছা, বিষ্ণু দে-র কবিতা আপনার কেমন লাগে বলুন দেখি? রগ ঘেঁষে গুলি করার মতই রগরগে প্রশ্নটা তিনি ছুঁড়ে বসলেন হঠাৎ!

ভাবিত হতে হলো। আমাদের কালে সামাদ যেমন তালের মাথার পায়ে বল পেলে কোণের থেকে টুক করে তা গোলের মুখে ফেলে দিত, তেমনি ইনিও যেন এই প্রশ্নটায় আমায় একেবারে কর্নার করলেন! কোণঠাসা করে আমাকে কোনো গোলের মধ্যে ফেলার মতলবেই কি না কে জানে, উনি তো অবলীলায় এই প্রশ্নটা পাশিয়ে বসেছেন–এখন এর ফলে কোনো গোল না বাধলেই হয়। স্বভাবতই আমি গোলমলে কিছুর মধ্যে যেতে চাই না।

গ্রীক ল্যাটিনে লেখা ওঁর কবিতার আমি বুঝবো কী মশাই? আমি তো ওসব ভাষা জানিনে। সবিনয়ে জানাই।

গ্রীক ল্যাটিন! বলছেন কী মশাই? বাংলা ভাষায় লেখা যে?

বাংলা হরফে লেখা হলেই কি বাংলা হয়? বাঙালী পাঠকের বোধগম্য হওয়া চাইনে? সংস্কৃত যদি আমি বাংলা বর্ণমালায় লিখি তা হলেই কি তা আর সংস্কৃত থাকবে না? ওঁর লেখা সব সংস্কৃতের সগোত্রই–ক্লাসিক নয় কি?

ক্লাসিক অবশ্যই এবং ফাস্ট ক্লাস বটে, একটু থেমেই ওঁর পুনশ্চ যোগ : দেখুন, আপনার ছোঁয়াচে এসে আপনার বাকভঙ্গীর ব্যারাম আমাকেও পাকড়াচ্ছে… কিন্তু মাপ করবেন, আপনার কথাটা আমি মেনে নিতে পারলুম না। বেশ, সুধীন দত্তর কবিতা সম্বন্ধে আপনার কী মত?

অভিন্ন মত। ঐ জাতীয়, উনিও পুরোদস্তুর ঐ ক্লাসের। মানে, ঐ ক্লাসিকই। বলার পর আমারও পুনর্বিন্যাস : হ্যাঁ, ঐ সুধীন দত্তই। উনিই বিষ্ণুবাবুর কবিতার সমঝদার হতে পারতেন। আর, সেটা হতে সমান পাল্লার, সমানে সমানে কোলাকুলি-এ গ্রীক মীটিং এ গ্রীক!।

মানতে পারছি না ঠিক। আচ্ছা, বিষ্ণু দে-র এখনকার কবিতা আপনার কেমন লাগে?

এখনকার কবিতা? মহাকবি মাইকেলের মতন উনিও শেষে স্বদেশে এসে পৌঁছেছেন। নিজের মাতৃভাষায় ফিরেছেন এখন। বলতে হয় ওঁর বেশ অবনতি ঘটেছে সম্প্রতি। পাঠকদের পৈঠায় নামিয়ে এনেছেন নিজেকে। ভালোই করেছেন। এখন ওঁর কবিতা আর আগের মতন অস্বচ্ছ নয়। প্রায় মোটামুটি বোঝা যায়। এমন কি, আমিও এক-আধটু বুঝতে পারি।

আর ওঁর আগেকার কবিতা…।

আমার কী মনে হয় জানেন? বাধা দিয়ে আমি মনের কথাটা বলে নিই : মানে হলেও সে-সব লেখা অতিশয় উচ্চ মানের। ওগুলি বাংলায় অনূদিত হলে আমাদের সাহিত্যের সম্পদ বাড়বে যে, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহই।

.

৪০.

এই কাগজ ফেরি করার কালে রবিবারটা ছিল আমার আকালের। সেদিন প্রায় দুর্ভিক্ষপাতি দশায় কাটাতে হত আমায়।

বেথুনের স্কুল-কলেজ বন্ধ সেদিন। দিদি-ভাইয়ের কারোই দর্শন নেই। তাই অন্যদিনের মত ইস্কুল-কলেজ শুরুর আগে আধ ঘন্টার ফাঁকেই পাঁচশো কাগজ কেটে যাবার কোন অর্ধোদয় যোগ ছিল না সেদিন।

হেদোর কিনারে দাঁড়িয়ে হেদায়েৎউল্লা খাঁর মতন রাজত্ব করার কোনো মানে ছিল না সেদিন। চারধারই সেদিন খা খাঁ।

রবিবার তাই অল্প কাগজ আনতাম, শদেড়েকের বেশি নয় কখনই। কিন্তু তাই কাটাতেই হিমসিম খেতে হত আমায়।

সেদিন তাই চলে যেতাম সিনেমাপাড়ায়। হাবািগান এলাকায়। সিনেমা হাউসের সামনেই যা কাগজ বেচার জো ছিল রবিবার।

আমার সেই দেড় শো কাগজ কাটাতেই সিনেমার তিনটে শো লাগত। তিনটে, ছটা, নটায় গিয়ে খতম হত যত কাগজ।

তিনটের শো শুরুর আগেই দাঁড়াতাম গিয়ে হাউসের সামনে। গোড়াতেই নিজের একখানা চার আনা দামের ফোর্থ ক্লাস টিকিট কিনে রাখতাম। তারপর আমার কাগজ বেবার পালা।

আহার আর ওষুধ সেদিন এক যোগেই আমার : সিনেমা দেখা আর কাগজবেচা রথদেখার মেলায় গিয়ে কলা দেখানোর বিদ্যেকে টেক্কা দিয়ে।

সেকালে ঐ হাউসগুলির নাম ছিল বুঝি কর্নওয়ালিস থিয়েটার আর ক্রাউন সিনেমা, উত্তরকালে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হয়ে এখন যা নাকি উত্তরা আর শ্রী-তে দাঁড়িয়েছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল সন্ধ্যের দিকে কারো খবর কাগজের ঝোঁক থাকার কথা নয়, সত্যিকার পড়ুয়াদের সেই সাত-সকালেই কাগজ পড়ে দুনিয়ার সব খবর জেনে নেওয়া হয়ে গেছে। তা ছাড়া, সিনেমা হলের অন্ধকারে বসে কাগজ পড়াও যায় না সেখানে ছবি দেখতেই যাওয়া,কাগজ পড়তে নয়-তা হলেও অপ্রত্যাশিতভাবে আকস্মিক কাগজ কেনার ধুম পড়ে যেত–আর কাগজের গাদা খতম হত আমার তখনই। ভুঁইফোড় পাঠকদের তাগাদায়।

দেখতাম যারা খানিক আগেও আমার কাগজের আবেদনে কর্ণপাত করেনি, অবহেলার নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে আমার দিকে, সিনেমা শুরু হবার একটু বাদেই তারাই আবার হাউসের থেকে ক্ষিপ্তভাবে বেরুচ্ছে–কে যেন ধরে ধরে সেখান থেকে নিক্ষিপ্ত করছে তাদের।

আর চট করে আমার কাছ থেকে কিছু বাছবিচার না করেই দু পয়সার যে কোনো একটা কাগজ কিনেই না তীব্র বেগে ফের হাউসের ভেতর ফেরত যাচ্ছে ফের।

সিনেমার টিকিট পকেটে রেখেও তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে কাগজ বেচে চলেছি।

সিনেমার আসল বই বেশির ভাগই সিরিয়াল ছবি ছিল সেকালে, পার্ট বাই পার্ট দেখানো হত হপ্তায় হপ্তায়) শুরু হবার গোড়ায় বিদেশী নিউজ রীল কি দুরীলের কমিক ছবি কিছু দেখানো হত তখন-তারপর মিনিট পনের বাদেই আরম্ভ হত আসল বইটা। তরপর কাউকে আর তীরবেগে বাহির হতে দেখা যেত না, আমিও তখন হলের ভেতর ঢুকে জায়গা দখল করে বসতাম।

বেশির ভাগ কাগজ তিনটে ছটায় কাটত, বাকী যা থাকত তা নটার শো শুরু হবার পরই শেষ হয়ে যেত–শুধু একটা বাদে। সেই একখানা কাগজ আমি কিছুতেই বেচতাম না, তিন গুণ দাম দিলেও নয়। সেটা আমার নিজের কাজেই লাগত।

সিনেমা হলে, বিশেষ করে চার আনার সিটে যা ছারপোকাদের গুলজারি তখন! মহামারী কান্ড বাধত যেন। তখন এক গন্ডার ছাড়া এক দন্ড বসে থাকে সাধ্যি কার! সিনেমা হল অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে আমার গন্ডা গন্ডা কাগজ মুহূর্তের মধ্যে ফরসা হয়ে যেত।

ভেবে দেখলে, এ দেশে সংবাদপত্র-প্রচারে, আর এই সূত্রে শিক্ষার প্রসারেও, ছারপোকার অবদান নেহাত কম নয়। এমনকি আমি রিকশাওয়ালাকেও বাংলা কাগজ কিনতে দেখেছি, বাংলার ব-বোঝারও যার ক্ষমতা ছিল না। এইভাবে আমি কীর্তিমান জ্যোতিষবাবুর ঢের আগেই লোকসমাজে বাংলা ভাষার বিস্তারে বিশেষ সহায়তা করেছি বলতে পারি।

আর, সত্যি বলতে আমার জীবনে ছারপোকার পৃষ্ঠপোষকতা কিছু কম ছিল না। কেবল যে তারা প্রথম জীবনেই দাঁড় করিয়েছে তাই নয়, সারা জীবন ধরেই আমায় খাড়া রেখেছে…বরাত খারাপ হতে দেয়নি কখনো। যেমন কাগজ কাটাতে তেমনি অবাঞ্ছিত অনাহূত আমার আত্মীয়সঙ্কটের ফাড়াকাটিয়ে দিতেও তাদের জোড়া নেই, আমি বলব। ছারপোকারা এমনই এই ছার জীবনের অঙ্গীভূত যে কেউ আমাকে কখনই নচ্ছার বলতে পারে না। তেমন কটুক্তি কেউ করলে তা আমি অত্যুক্তি বলেই উড়িয়ে দেবো।

রবিবারটায় একশো কি সোয়া শো কাগজ বেচে যা পেতাম তার লভ্য কমিশনের সোল আনাই তিনটে সিনেমার শো আর চিনেবাদামেই ফুকে যেত। শো দেখা আর শোয়া ছাড়া কোনো ধান্দা ছিল না। রাজেন মল্লিকের বাড়ি দুপুরেই সেই যা খেয়েছি বিকেলের দিকে তারা আর খাওয়ায় না। আর, সেদিন শোয়র জন্য ঠনঠনের সেই অ্যালার্মবেলওয়ালীর চত্বরে গিয়ে হাজিরা দেওয়ারও কোনো গরজ নেইকো।

তখনকার কালে সপ্তাহে কাগজ বেরুতে মাত্র ছদিন। রবিবার ছুটি থাকত খবর কাগজের কার্যালয়ে, তাই সোমবারটা কোনো কাগজ বেরুত না একদম। কাজেই সে রাত্তিরে ভোর চারটেয় উঠে কাগজের লাইনে গিয়ে খাড়া হবার কোনো তাড়া ছিল না। চারটে পাঁচটা ছটা পার করে সাত সকালে উঠলেও চলত সেদিন।

রাত্তিরে সেদিন হরিমটর। হরিনাম বাদেই মটর-আস্বাদ। এক পেট খিদে নিয়ে অদূর হেঁটে শোবার জন্যে সেই কালীবাড়িতে সেদিন কে যায়? চতুর্থ প্রহরে সাধ করে নিজের সাধের ঘুমটি ভাঙাতে যাবে কে? সেই ঘুটঘুট্টি ভোরে সজাগ হবার কোনো দায়ই ছিল

আমার সেদিন। মা কালীও সেদিন আমার অতি ভক্তির প্রাতঃপ্রণাম আদায় করতে পারতেন না।

পয়সা চারেকের চানাচুর চিবিয়ে সিনেমা হলের কাছেপিঠে ফুটপাথের ওপর কোথাও তখন গড়িয়ে পড়লেই হল আমার।

অনেককে দেখেছি রাস্তায় শুতে হলেও শোবার আগে চারধারের ধুলোবালি সব ঝেড়েকুড়ে নেয়, হয়ত গায়ের ওড়না দিয়ে ঝেটাতে গিয়ে সেটাকেই ময়লা করে বসে রাস্তা সাফ করার প্রেরণায়। কিন্তু তার কি কোনো মানে হয়? সমুদ্রে শয্যা পাততে গিয়ে শিশিরবিন্দুতে সন্তাপ? হাজার ঝেটিয়েও কলকাতার রাস্তাকে কখনো পরিষ্কার করতে পারে কেউ?

রাস্তায় শুলে ধুলোকে তো ধুলিজ্ঞান করাই উচিত। দুনিয়ার আবর্জনা কি কেউ কখনো সম্মার্জনায় শেষ করতে পারে? এক জায়গার দুঃখ আরেক জায়গায় জমা করে কেবল।

না, আমার ওসব ঝামেলা পোষায় না। পথে বসলাম কি গড়ালাম, আর গড়ালাম কি ঘুমোলাম।

বেশ ঘুমিয়েছিলাম, এমন সময় কে যেন এসে ঠেলে তুলল আমাকে : এই! এই! এখানে ঘুমিয়ে কে?–

ঠেলা খেয়ে উঠে বসতে হল-আমি। নিদ্রাজর্জর স্বরে জবাব দিয়েছি।

আমি! আমি তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে শুয়ে কেন? ভদ্রলোক শুধান।

কোথায় যোবো তা হলে? চোখ মুছতে মুছতে বলি।

ভদ্রলোকের ছেলে, ছোটলোকের সঙ্গে রাস্তায় শোয় নাকি? ওঠো ওঠো। এসো আমার সঙ্গে।

ঘুমিয়ে ছিলাম বেশ ছিলাম। ঠেলার চোটে ঘুম ভাঙার পর এখন পেটের খবর টের পাওয়াচ্ছিল। খিদের চোটে অস্থির হয়ে উঠতে হল।

সামনে সমানে দুর্ভিক্ষ। কাল দুপুরে মল্লিক বাড়ির সেই অন্নসত্রে–তার আগে কোথাও কিচ্ছুটি নেই।

কাগজও পাচ্ছিনে কাল সকালে যে, তাই বেচে কিছু নগদ পাব, কিনে খাবটাব তখন।

এই নিরন্ন মুহূর্তে এই ভদ্রলোক ঈশ্বরপ্রেরিত দেবদূতের মতই এসে যেন দেখা দিলেন। পিছু পিছু যেতে যেতে ভাবি। ওঁর বাড়িতে বোধ হয় ঠাঁই হবে আজ আমার। খাওয়াবেন তো বটেই, কোনো কাজও দেবেন নিশ্চয়। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের পড়ানোর বিনিময়ে কারো কারো বাড়িতে থাকা-খাওয়ার কাজ পাওয়া যায় কলকাতায়। পড়ুয়া ছেলেরাই পেয়ে থাকে, সেই হকার ছেলেটি জানিয়েছিল আমাকে। তেমনি একটা কাজ হয়ত আমার জুটে যাবে এঁর কৃপায়। তাই যদি পাই তো বর্তে যাই-বেশ হয় তা হলে। কাগজ বেচার ওপর এই উপরি পাওনাটা হলে মন্দ কি? তা হলে আর আমার ফি সোমবার এই উপোষ পোয়াতে হয় না। পোষ মাস এসে যায় নগদ।–খুলে যায় আমার বরা-কেটে যায় ধরাশায়ী হবার রাত।

ভদ্রলোকের পিছনে ভাবতে ভাবতে চলেছি আমি। আর কিছু না হোক, আজ রাত্তিরের মত খাওয়া-থাকার ব্যবস্থাটা তো হবে।

কদ্দুর চলেছেন ভদ্রলোক? চলেছেন তো চলেছেনই যে! খিদে পেটে কি হাঁটতে ভালো লাগে কারু?

হেঁটে হেঁটে বিডন স্ট্রীট মোড়ের চৌমাথা পার হলাম আমরা।–এটা হেদো। জানো

জানি বইকি। ঘাড় নাড়লাম আমার। হেদো জানব না? এই এলাকায় আমার রাজত্ব! রোজ সকালে রাজ্যির খবর কাগজ বগলে আমার বিরাজত্ব এইখানেই।

হেদোর প্রথম গেটের পাশ দিয়ে যেতে তিনি বললেন-এটা দেখছি বন্ধ।

 তারপর মাঝখানের মেন গেটের মাঝামাঝি গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন।

ওমা! এখানেও যে তালা মেরে দিয়েছে দেখছি!

তাঁর এই বেতালা কথার কোনো তাল পাওয়া যায় না।

রাত্তিরে পার্কটা বন্ধ করে দেয় বুঝি? এমনি শুধাই।

হ্যাঁ। যত গুন্ডা বদমাসরা ভেতরে গিয়ে গুলতানি করে কিনা! জটলা পাকায় রাতভোর। পার্কগুলো রাত্রে তাই বন্ধ করে রাখে।

ও।

যাক, লাফিয়েই যেতে হবে তা হলে। কী আর করা যাবে? অগত্যার মতন তিনি কন-লাফাতে পারবে তো?

আমি ইতস্তত করি। এই ক্ষুধিত ক্লান্ত দেহে আপাদমস্তক ঘুম নিয়ে লাফিয়ে ওই রেলিং পেরুতে হবে? হাই জাম্পের কসরতে কোনদিনই আমি পোক্ত ছিলাম না, হ্যাঁ, সতীশ হলে পারত বটে অনায়াসেই। স্পোর্টস-এ সে প্রায় অদ্বিতীয়। এক হাই জাম্পেই ঐ রেলিং পার হওয়া তার পক্ষে কিছু না!

ডিঙিয়ে যেতে পারি। আমি বলি-ডিঙোব কেন বলুন তো?

তার জবাব না দিয়ে তিনি বলেন- তা হলে ডিঙাও। ওঠো তা হলে।

রেলিং ধরে উঠি।

 ধরতে হবে? ধরব তোমায়? ধরে নামিয়ে দেবো ওধারে?

না না, ধরতে হবে না আপনাকে। ধৃত হবার আগেই আমি নিজেকে উধৃত করেছি। খাড়া হয়েছি রেলিং-এর মাথায়।

বাঃ! আর কী? লাফিয়ে পড় এবার। বেশ। এবার, সামনে ঐ বেঞ্চি দেখছ তো সব? দীঘিটার চারধারেই রয়েছে। সকালে বিকেলে হাওয়া খেতে এসে বসে এখেনে লোকেরা। এখন সব ফাঁকা। ওর একটায় গিয়ে শুয়ে পড় স্বচ্ছন্দে। নিশ্চিন্তে ঘুমোও। কেউ কিছুটি বলবে না।

বলে আর দ্বিরুক্তি না করে তিনি নিজের পথ ধরেছেন। দেখতে না দেখতে নিরুদ্দেশ।

আমিও আর কী করব? রাত্রের আহার বাসস্থানের দুরাশায় জলাঞ্জলি দিয়ে খিদে তেষ্টা মেটাতে সিধে হেদোর ঘাটে গিয়ে অঞ্জলি ভরে জল খেলাম। এক পেট জল ঠেসে এক পিঠ বেঞ্চির তক্তায় গড়িয়ে পড়লাম এসে। নিমেষের মধ্যে আমিও নিরুদ্দেশ!

একজনের ঠেলায় পড়ে এখানে এসে শুয়েছি, আরেকজনের ঠেলার চোটে উঠে বসতে বলো এখন।

চোখ মেলে দেখি এক বর্ষীয়ান ভদ্রলোকের চোটপাট আমার ওপর।

আজকালকার ছেলেরা যেন কী! কখন সেই পাঁচটায় ভোর হয়েছে, ছটা বাজে এখন। এখনও পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে! দ্যাখো না। সেই কোন্ প্রত্যুষে আমি উঠেছি–উঠে বেড়াতে বেরিয়েছি, এর মধ্যে এই হেদোয় আমার সাত পাক ঘোরা হয়ে গেল আর এখনো পড়ে পড়ে ঘুম বাবুর! আশ্চর্য! ওঠো হে! এটা নাক ডাকানোর জায়গা নয়, লোকজনের বসবার জন্যে। জোয়ান ছেলে, শরীর ভালো করতে চাও তো ওঠে পড়ো চটপট! উঠে দৌড়াও এখন–হেদোর চারধারে চার চক্কোর লাগাও গে… চন্দ্র বতিকে কোরবর্তী করার তাঁর অপপ্রয়াস।

চোখ মেলে তাঁর হিতোপদেশ শুনছি, আলস্যি আমার ভাঙেনি তখনো। আমার পাঁজরায় তাঁর ছড়ির এক টোর লাগিয়ে আমেজটা তিনি ভাঙিয়ে দিলেন তক্ষনি।

উঠে সামনের ঘাটে মুখহাত ধোও গে! দৌড়োতে বলছি না তোমায়? আমি…কখন সেই প্রত্যুষে উঠেছি, উঠে আমার দন্তধাবন সেরেই না…।

এখানে এসে পরের পশ্চাদ্ধাবনে লেগেছেন! ধড়মড় করে উঠে বসলাম-তাঁর ছড়ির খোঁচায়। আমেজ যাওয়ার পর মেজাজ দেখা দিয়েছে আমার।

পাঁজরার খোঁচাটা যেন পেটের মধ্যেও গিয়ে খোঁচাতে লাগল–যেমন কানের গোড়ায় তেমনি যেন আমার প্রাণের গর্ভেও খচখচানি শুরু হয়ে গেল কেমন।

কোনো কোনো রাক্ষসের যেমন ভোমরার মধ্যে প্রাণ লুকোনো থাকে, উপকথায় শোনা গেছে, আমার অন্তরাত্মা তেমনি যেন আমার পেটের অন্তরালে। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই তিনি খিদের জ্বালায় জ্বলে উঠেছেন।

না, উঠতেই হয় এবার। উঠে ঘাটের পৈঁঠেয় গিয়ে আবার এক পেট জল না খেলেই নয়।

রাজেন মল্লিকের মহাপ্রসাদ তো সেই বারোটা বাজিয়ে তারপরেই না!

ততক্ষণ যুঝতে হলে…সারা কলকাতা খুঁজতে গিয়ে ঐ দীঘিটাই নজরে পড়ে!

 ঘাটের থেকে এক-আধ আঁজলা মুখে তুলেছি কি না, অমনি সেখানেও ফের আরেক ঠোকর!

আরে আরে! এই! তুমি করছো কী?

আমার সমবয়সী একজন পৈঠায় বসে দাঁতন করছিল, সে-ই বাধা দিয়েছে : এই, জল খাচ্ছো যে?

কেন, কী হয়েছে?

পুকুরের জল কি খেতে আছে নাকি?

খিদে তেষ্টা পেলে কী করব তাহলে? খালি পেটে থাকলে পিত্তি পড়ে না? সেই পিত্তি। পড়ার দাবাই-পেটে কিছু দিতে হয়। জল পথ্যি করে তাই দিচ্ছিলাম। তোমার তাতে আপত্তি কিসের?

জল খাও না কেন, আমি কি বাধা দিতে গেছি! শুধু ঐ পুকুরের জলটা খেতেই মানা করছি তোমায়। বাইরে রাস্তায় ফুটপাথের ওপর জলের কল আছে-কলের জল খাও না গিয়ে। কলের জলই তো খায় সবাই, পুকুরের জল কেউ খায় না কখনো।

বলেছে তোমাকে! দেশ পাড়াগাঁয় পুকুরের জল খেয়েই বাঁচে মানুষ। সেখানে কল কোথায় গো? কল তো তোমার এই কলকাতাতেই কেবল। কিন্তু দেশে? সেই অজ পাড়াগাঁয়ে?

দেশে কি ওই পুকুর ছাড়া কিছুই নেই আর?

কোথাও কোথাও নদীও আছে বই কি! তারা নদীর জলই খায়। কারও কারও বাড়ি কুপও রয়েছে আবার। আমাদের বাড়ি ইঁদারা আছে একটা–সেই কোন্ সাবেক আমলের। অতি প্রাচীন ইঁদারা। তার জল ভারি মিষ্টি। যেমন মিষ্টি তেমনি হজমি।

আমাদের কলকাতায় ইঁদারা তুমি পাবে না কোথাও। প্রাচীন ইঁদারা তো নয়ই।

 ইঁদারা না থাক, ইঁদুর আছে তোমাদের। বেশ ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর–বেড়ে ইঁদুর সব! লক্ষ্য করলে তেমন প্রাচীন ইঁদুর চোখে পড়ে বই কি!

দেখেছ তুমি?

বিস্তর। তুমি দ্যাখোনি বুঝি? রাস্তায় শোওনি বোধ হয় কখনো?

রাস্তায়? রাস্তায় যোব কেন? শুতে যাব কেন? রাস্তায় কি শোয় নাকি কেউ? সেটা কি শোবার জায়গা? খাটের ওপর গদি পাতা বিছানায় মশারি খাটিয়েই তো শোয় সবাই–কিংবা, চৌকিতেও তোক পেড়ে শোয় কেউ কেউ। রাস্তায় কেউ শুতে যায় নাকি?

কিন্তু যার বাড়ি নেই, ঘর নেই, খাট নেই, পালঙ্ক নেই, এমন কি খাঁটিয়াও নেই একখানা-মশারি খাটিয়ে শোয়া তো দূরস্থান…সে কোথায় শোবে শুনি তবে?

তুমি শুয়েছ কখনো রাস্তায়?

আকচার। রাস্তাই তো আমার শোবার জায়গা হে! নইলে তোমাদের ওসব প্রাচীন ইঁদুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হল কি করে?

রাস্তায় শোয়া কখনই ভালো নয়। নিরাপদও নয় ভাই! রাত্তিরে অবশ্যি ট্রাম চলে না, তা সত্যি, কিন্তু লরি মোটর এসব তো যায়–যদি তোমার ওপর দিয়ে চলে যায় একখানা? আচমকা চাপা পড়ে যাও যদি?

আহা, রাস্তার মাঝখানে কি আর? আশেপাশে। ফুটপাতের ওপর। সেখান দিয়ে কি গাড়িকাড়ি যায় নাকি? আর, রাত একটু গম্ভীর হলেই ফুটপাথে যত ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুররা জড়ো হয়–তাদের যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। তারা কাউকে গেরাহ্যিই করে না। গায়ের ওপর দিয়েও চলে যায় কখনো কখনো। রাস্তায় শোয়ার ভাগ্যি করোনি বলে সে-দেখার সুযোগ তোমার কোনোদিন হবে না।

ছেলেটি সে কথার জবাব না দিয়ে তার দাঁতনের গোছর থেকে একটা কাঠি আমার দিকে এগিয়ে দেয়-নাও, দাঁতন করো।

বাঃ! এ যে নিমের দাঁতন দেখছি। কোথায় পেলে? কলকাতায় এত ঘুরেছি কিন্তু কোনো রাস্তায় নিমগাছ তোকই চোখে পড়েনি আমার!

রাস্তার নিমগাছ নয় হে! জেলখানার।

জেলখানার! দস্তুরমতো অবাক হতে হয় ওর কথায় : জেলখানায় তো ঘানিগাছ আছে জানি, সেই ঘানির তেল বিক্রি হয় বাজারে। কিন্তু নিমগাছের দাঁতনও যে সেখান থেকে যুগিয়ে থাকে শুনিনি তো!

আহা! তারা যোগাতে যারে কেন গো। সেখেন থেকে নিয়ে এসেছি যে! এক গোহা নিয়ে এসেছি বেরোবার সময়।

জেল থেকে নিয়ে এসেছো? জেল কি চিড়িয়াখানার মতই নাকি? ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় সেখানে? দেখেশুনে বেড়িয়ে-টেড়িয়ে ফিরে আসা যায় আবার?

মোটেই তা নয়। জেলে যাওয়া ভারী শক্ত ব্যাপার। গেলে পরে বেরুনো আরো কষ্টসাধ্য। সে জানায় : সহজে সেখানে ঢুকতে দেয় না। সেখান থেকে বেরুনোও সহজ নয়।

তাহলে তুমি জেলের ভেতর গেলে কি করে?

কেন, পিকেটিং করে? রোজ রোজ শত শত ছেলে যে পিকেটিং করে জেলে যাচ্ছে, তুমি কি কোনো খোঁজ রাখো না তার? খবর কাগজ পড় না বুঝি?

পড়ব না কেন? শত শত কাগজ পড়তে হয় রোজ আমায়।

শত শত? ছেলেটি আবার হতবাক : অতগুলো কাগজই নেই আমাদের। কাগজ তো মোটে এই ক খানা-আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, বসুমতী আর স্টেটসম্যান।

আহা, কাগজ কেবল পড়া কেন, কাগজ পাড়াও যে আমার কাজ হে! কাগজের হকারি করি যে! পাঁচশো কাগজ বেচতে হয় আমায় রোজ। আমি বিশদ হই : একখানা কাগজ শুয়ে বসে ধীরে সুস্থে আরাম করে আগাগোড়া পড়ব যে, তার সময় পাই কী! একটুখানি পড়তে না পড়তেই সেটা বিক্রি হয়ে গেল, তখন আরেকখানা নিয়ে পড়লুম। ফের সেখানাও আবার…ঐ যতক্ষণ হাতে থাকে ততক্ষণই যা পড়ি…..এমনি করে একটু একটু পড়ে সব খবর জানতে আমার সন্ধ্যে উতরে যায়, জানো?

তারপর, কী করো? সে কাগজখানাও বেচে দাও?

সেখানা পেড়ে বসি তারপরে। নটার সিনেমায় যাই না? কী ছারপোকা ভাই, তোমাদের ঐ সিনেমায়। পেড়ে না বসলে আর চোখে কানে দেখতে দেয় না–ছবিটার মাথামুণ্ডু বোঝ যায় না কিছুই।

যা বলেছ। হাসতে থাকে সে।

বায়স্কোপ দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার? আমি শুধুই : যাবে তুমি আজ? যাও তো বলল, তাহলে দুখানা কাগজ না হয় বেচব না আজকে। দুজনের পেতে বসার জন্য রাখব তাহলে।

দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এই কি আমোদ-প্রমোদ করার সময় ভাই? ইংরেজের সঙ্গে লড়াই চলছে না আমাদের? আবার আমি জেলে যাব যে। হয়ত আজই, না হয় তো কাল। কাল তো নিশ্চয়ই।

কালই আবার? কালই আবার ফিরে যাবে সেখানে?

নিশ্চয়। কাল বিকেলে মীর্জাপুর স্কোয়ারে সভা আছে না? আইন অমান্যের সভা–যারাই যাবে সেখানে, যোগ দেবে সেই সভায়, তাদেরকেই পাকড়াবে পুলিস। আগের থেকে বলে দিয়েছে। সভা-টভা করার নিষেধাজ্ঞা আছে না এখন? একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা সব জায়গায়। আইন ভাঙলেই ধরে নিয়ে যাবে থানায়, সেখান থেকে একবার আদালত ঘুরিয়ে সটান সেই জেলে চালান দিয়ে দেবে।

তাই বুঝি?

তাই। তোমার জেলে যেতে ইচ্ছে করে না? করছে না?

এক-আধটু করে–একেক সময়। বেশি নয়। গেলে পর সেই নিমগাছটা দেখতে পাব বোধ হয়?

পাবে। তবে তেমনটি পাবে না। সেই নিমগাছ আর সে রকমটি নেই কো।

গেল কোথায় তাহলে? যদ্দুর জানি, নিমগাছরা তো চলাফেরা করতে পারে না। পাদপ বলা হলেও ওদের কোনো পা নেই আদপে। হাঁটতে পারে না একদম।

আহা, হাঁটতে যাবে কেন হে? একটি তো নিমগাছ মোটে। আর চার হাজার ছেলে আমরা জেলখানায়। সারা জেল ছেলেয় ছেলেয় ভর্তি। স্বরাজের আন্দোলনে টইটম্বুর। আমাদের জন্যে এবার আরেকখানা জেল খাড়া হয়েছে তা জানো। সে-ই খিদিরপর ডকেই।

তা হলই বা অতো ছেলে, তা তোমার নিমগাছের কী! লড়াই তো আমাদের ইংরেজের সঙ্গে। নিমগাছের সঙ্গে নয়।

সকাল হলেই আমরা সবাই নিমগাছটার ডালে উঠে বসি। ছেলেরা যতো সব ডাল ভেঙে দাঁতন করতে লাগে…..

কেউ কিছু বলে না?

কে বলবে? বলবার কেউ নেইকো। আমরাই জেলে থাকি কেবল তিন চার হাজার ছেলে। আমি হাঁ করে ওর কথাগুলো গিলি–সেই জেলে আগে যে সব চোর ডাকাত খুনী বদমায়েস থাকত, জেল খালি করে তাদের সব মফস্বলের জেলে ঠেলে দিয়েছে–এখন কেবল কংগ্রেসের ভলান্টিয়ার, তারাই থাকে।

এখন ঐ নিমের ডালে দাঁত বসাচ্ছো, তারপরে দাঁত শানিয়ে ইংরেজের ঘাড়ে গিয়ে বসাবে, তাই না? বলেই আমার অনুযোগ : যার নাম মরণ কামড়?

যা বলেছো! সে হাসে : সকালে ঘুম ভাঙলেই সবাই আমরা সেই নিম গাছটায় উঠে বসি…মুখ ধুতে হবে না আমাদের? কেউ কিছু বলে না–বলবেটা কী?

আর নিম গাছটা?

সে আবার কী বলবে? তার মুখে কোনো ভাষা আছে?

ভেঙে পড়ে না সে? তোমাদের অতজনের ভারে?

 চার হাজার কি একসঙ্গে গাছে ধরে? ক্ষেপে ক্ষেপে ওঠে। নিমগাছটা কিন্তু ক্ষেপে ওঠে না। দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। ক্ষেপেও ওঠে না, জ্বলেও ওঠে না দপ্ করে। তোমার ঐ পাপ হওয়া সত্ত্বেও। কিংবা সেইজন্যেই বোধ হয়। সব সময় এক পায় খাড়া। আমাদের জন্যেই…

অসহায় একলা পেয়ে তার ওপর তোমরা বেজায় অত্যাচার করছ কিন্তু?

সে কথা আর বলবার নয়, আস্ত নিমগাছটাই দাঁতন করে খতম করে দিয়েছি বলতে গেলে।

বল কি হে? একটা গোটা নিমগাছ সবাই মিলে দাঁতন করে ফেললে?

ফেলব না? চার হাজার লোক দাঁতন করলে একটা নিমগাছ কদিন টেকে আর?

ভারী আশ্চর্যি তো! একটু ভাবতে গিয়েই আমার সংশয় জাগে তার শাখাপ্রশাখা সব সমেত?

না না! বড় বড় শাখাপ্রশাখা কী আর? ছোট শাখাপ্রশাখা। তোমার ওই গুঁড়িটাও বাদ।

গোড়ায় দাঁত বসাতে পারোনি তাহলে? গোড়াতেই গলদ!

হ্যাঁ, গলদ নিয়ে তেমনি খাড়াই হয়েছে গাছটা, তবে একেবারে ন্যাড়া করে রেখে এসেছি। কিছু আর নেই তার। যেয়ো না জেলে, দেখবে তখন। চেহারাটা তার দেখতে পাবে গেলে।

যাব তো। কিন্তু কবে যাই কিছু কি তার ঠিক আছে!

মীর্জাপুর স্কোয়ারে এসো না পরশু বিকেলে, আইন অমান্য করার সভা হবে সেদিন। সেদিন ফের আমি জেলে ফিরে যাব এঁচে রেখেছি।

সেই গাছটাকে দেখতে আবার? আমি জিগ্যেস করি : তাকে না দেখে থাকতে পারছো না বুঝি? মন কেমন করছে তোমার?

আমি অবাক হয়ে ভাবি, গাছের জন্যে এমন টান কারো হতে পারে নাকি কখনো। গাছের আবার দেখবার কী আছে? সে তো একবার দেখলেই ফুরিয়ে যায়। তাছাড়া, এ গাছটার তো রূপ যৌবন বলতে কিছুই আর নেইকো। সবটাই প্রায় তার দাঁতন হয়ে গেছে।

আহা, গাছ কেন গো! সেখানে একজন রয়েছে যে আমাদের। তাকে দেখতেই যাব তো আমি।

তোমার কোনো বন্ধু বুঝি?

হ্যাঁ, বন্ধুও বলা যায় বইকি! শুধু আমার নয়, সবাইকার। তবে বন্ধু বলতে যা বোঝায়, সমবয়সী ইয়ার, ঠিক তো নয় অবশ্যি।

তবে? একজন মানুষমাত্রই! তোমার যদি প্রাণের বন্ধু না হয় তবে শুধু একজন মানুষকে দেখেতে ফের আবার জেলে যাবার কোনো মানে হয়? আমি বলি : গাছের মত একটা মানুষকেও তো একবার দেখলেই ফুরিয়ে যায়।

সব মানুষ কি ফুরোয়? সবাই কি ফুরিয়ে যায়? একেক জন এমন মানুষ থাকে না যে নাকি অফুরত, ফুরোবার নয়! কখনো ফুরোয় না! যাকে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে, দেখে দেখে আশ মেটে না, দেখলে পরে চোখ জুড়োয়; মন ভরে যায়!

কে, শুনি না মানুষটা?

যে-সে মানুষ নয়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ঐ জেলেই আছেন এখন। তিনি কারাবরণ করেছেন তুমি জানতে না?

জানব না কেন, কিন্তু ঐ জেলেই যে রয়েছে তা আমি জানতুম না।

দেখেছ কখনো দেশবন্ধু দাশকে? কতোবার!

 খুব ভালো করেই দেখেছি।

কোথায় দেখলে? তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করা তো ভারী মুশকিল। মানে, তোমার আমার পক্ষে। আর সভায়-টভায় সেই দূর থেকেই দেখা যায়। কিন্তু খুব কাছাকাছি পেতে হলে তোমায় যেতে হবে ওই জেলে।

আমি খুব কাছাকাছিই তাঁকে দেখেছি।

 কি করে দেখলে শুনি? দেখলে কোথায়?

আমাদের জেলায়। কিছুদিন আগে তিনি বাংলাদেশের শহরে শহরে সভা করতে বেরিয়েছিলেন না? সেই সময়।

ও, সেই দেখা! জেলায় দেখা আর জেলে দেখা এক দেখা নয়। তুমি দাড়িওলা সি আর দাশ দেখেছো?

না। আমি কই, আমি দেখেছি বেশ চাঁছাছোলা সি আর দাশ!

 জেলে গিয়ে উনি দাড়ি রেখেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে তবে কামাবেন–ওর নিজের নাপিতের কাছে। সে জানায় : জেলে না গেলে এই সি আর দাশকে তুমি আর দেখতে পেলে না। তোৰ্মার এ জীবনে নয়।

ভাবিত হতে হয়। চাঁছাছোলা দেশবন্ধুর গালে চাচাওলা দাড়ি কেমনটা দাঁড়িয়েছে ভেবে আমি ঠাওর পাই না।

গাছপালা নদীনালা খালবিল একবার দেখলেই হয়, দেখবার সাথে সাথেই ফুরোয় মানি, কিন্তু গঙ্গা? সে বলে যায়, গঙ্গা কি ফুরোয়, না ফুরোবার? গঙ্গা অফুরন্ত। গঙ্গার দিকে তুমি অনন্তকাল ধরে তাকিয়ে থাকতে পাবো। দেখে তুমি গঙ্গা?

কে না দেখেছে? তার প্রশ্নটাই আমায় অবাক করে।

সে তো হাওড়া ব্রিজের ওপর থেকে? যেতে আসতেই? তার কথা : তার কিনারে বসে তাকিয়ে থেকেছো তার দিকে?

কতো দিন! দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা, মাসের পর মাস।

কোথায় দেখলে? তোমাদের গাঁয়ে গঙ্গা আছে?

না। সেখানে মহানন্দা। বর্ষাকালেই তার আনন্দটা দেখা যায়-তখন নৌকো যায় তার ওপর দিয়ে। কিন্তু অন্য সময় শুধু তার হাড়পাঁজরা।

তা হলে দেখলে কোথায় অমন করে? ভারী তোমায় হিংসে হচ্ছে আমার।

কেন, এই কলকাতাতেই। কাশীপুরে। বরানগরের পাশ দিয়ে যায়নি গঙ্গা?

সেখানে তোমাদের কেউ থাকে বুঝি?

 কেউ থাকে না। খালি পড়ে থাকে বাড়িটা। প্রকান্ড বাড়ি। অট্টালিকাই বলা যায়।

আমি আরও জানাই : অনেকখানি জায়গা জুড়ে প্রকান্ড এক বাগানের মধ্যে বাড়িটা।

বাগানবাড়ি বুঝি?

হ্যাঁ, বাগানবাড়িইতো। বাগানের ভেতর বাড়িটা, গঙ্গার ঠিক ওপরেই। ছোটখাট বাঁধানো ঘাট রয়েছে আবার। সেখানে বসে দ্যাখো না কেন গঙ্গা যত খুশি। কেউ দেখবার নেই। আমি তো তাই দেখতাম।

বাগানবাড়ি ভারী খারাপ। তার মন্তব্য। খারাপ বলে সবাই।

কেন, খারাপ কিসের? বাড়িটাও খারাপ নয়, বাগানটাও বেশ ভালো। কতত আম গাছ, লিচু গাছ, নারকেল গাছ আছে বাগানে। কী মিষ্টি আম সব! কতো বড়ো বড়ো লিচু। ডাব ধরে রয়েছে এনতার। পাড়ো আর খাও। আর ফুল গাছ তোমার কত রকমের যে! সৌরভে মন ভরে যায়-চাঁপার গন্ধ তো পাগল করে দেয়? আমাদের দেশের সোনালি রঙের চাঁপা নয় কিন্তু এগুলো, যাকে বলে কি না কনকচাঁপা–এগুলোর নাম হচ্ছে কাঁঠালি চাঁপা। কিন্তু গন্ধ দুর্দান্ত।… ফুলবাগানটার কেয়ারি করা রাস্তা আছে কেমন–ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো দুধারে। ছোট্ট লাল সুরকির রাস্তা সব–কী চমৎকার!

তোমাদের বাড়ি?

 না, আমার এক কাকার।

তোমরা খুব বড়লোক তাহলে?

কাকারা বড়লোক। বেজায় বড়লোক।…কাকা বড়লোক তো আমার কী!

 তোমরা হচ্ছে রাজাগজা, বুঝেছি।

ঐ কাকা ভদ্রলোককে বলতে পারো। রাজা খেতাব আছে তাঁর-যুদ্ধের সময় ক লাখ টাকা দিয়ে নাকি সরকার থেকে খেতাবটা পেয়েছেন। আর, গজা তো নিশ্চয়ই। পিলখানায় হাতী পিলপিল করছে–অতিকায় হাতী সব–একটার নাম তাদের মোহনপ্রসাদ! এত বড়ো তার দাঁত।

ঐ হলো! কাকা যদি রাজা হয়, ভাইপোও কিছু কম নয়। একই ঝাড়ের তুমিও ঐ রাজাগজাই।…বুঝলাম! আমার প্রতি সে উপেক্ষার কটাক্ষ করে।

কাকস্য পরিবেদনা! কী সম্পর্কের যে কাকা আমি জানিও না তা ঠিক। তবে রাজা না হলেও গজা তুমি বলতে পারো আমায় অবশ্যি। জিবে গজা। সেই জিবে গজাই আমি। যা ময়রার দোকানে গজায়, জিভে যার সোয়াদ পাই। কিন্তু তাই বা সব সময় পাচ্ছি কোথায়!

বোঝা গেছে। আমার প্রতি তার কেমন একটা নিস্পৃহ ভাব দেখা যায়। রাজা গজা না হলেও, তুমিও প্রায় তার কাছাকাছি।

তা হ্যাঁ, তার কাছাকাছি গেছি বটে আমি কয়েকবার। হ্যাঁরিংটন স্ট্রীটের বাড়িতেও তাঁর থেকে এসেছি বার কয়েক। বাড়ির থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসতাম তো প্রায়ই, তখনই কিছুদিন কাটিয়েছি…সেখানে…

হ্যারিংটন স্ট্রীটেও তাঁর বাড়ি আছে আবার? বরানগরের গঙ্গার ধারে এত বড়ো একখানা থাকতেও?

হ্যাঁ, দশ নম্বর হ্যাঁরিংটন স্ট্রীটে। আর কাশীপুরে রতনবাবু রোড ধরে গেলে, গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িটার কাছেই রতনবাবুর ঘাট। নড়ালের রাজা রতন রায়, নাম শুনেছ? তাদের ঘাটের পাশেই মড়াপোড়ানোর জায়গা। ছোটখাট শ্মশানের মতই। মাঝে মাঝে সেখানে মড়া পোড়ে–আর এমন বিচ্ছিরি গন্ধ বার হয় সেই সময়! সেই গন্ধ বাতাসে ভেসে কাশীপুরের বাড়িটায় আসে। সেই কারণেই উনি থাকেন.না সেখানে, কখনো থাকেননি। খালিই পড়ে আছে এমনি অত বড় বাড়ি।

কেউ থাকে না একেবারে!

দুজন থাকে–এক দারোয়ান আর এক মালী। দারোয়ানটার নাম সীতারাম। বুড়ো দাবোয়ান। তার সঙ্গে যা ভাব হয়েছিল আমার না! সেই ছোটবেলায়! রোজ তাকে একখানা করে চিঠি লিখতাম আমি বেশ লম্বা লম্বা চিঠি।

কী লিখতে?

কে জানে! মনেই পড়ে না এখন। যা মনে আসত, যা খুশি তাই লিখতাম। লিখে লিখে দিয়ে আসতাম। সে তত আর বাংলা জানে না। বলতে জানে, পড়তে পারে না তো তাই আবার তাকে পড়ে শুনিয়ে দিতে হত আমায়। চিঠিগুলো সব সে যত্ন করে জমিয়ে রেখেছে। বাড়ি নিয়ে যাবে, তার নাতিকে বাংলা শেখাবে বলেছে–সে তখন তাকে পড়ে শোনাবে, আবার দুঃখু করে বলত, তার তো ওই বাংলা শেখার বয়স নেই আর।

বা রে সীতারাম! ছেলেটি উচ্ছ্বসিত হয়। লেখাপড়া না জানলেও, লেখানো পড়ানোর দিকে ঝোঁক আছে তার!

আর বাগানের মালী ছিল রহিম। শেখ রহিম। তার সঙ্গেও আমার ভাব ছিল খুব। তার মুর্গি ছিল একগাদা। কতো মুর্গির ডিম খাইয়েছে সে আমায়। বাগানের এক কোণে তার ছোট একখানা ঘর ছিল। সেখানে গেলেই সে ডিম ভেজে দিত। বাজারে বেচত না, বেচতে হতও না তাকে রাজার কাছ থেকে মোটা বেতনই পেত সে বোধ হয়। আর নারকোল গাছের থেকে কচি ডাব পেড়ে এনে কেটে খেতে দিত আমায়। ওরকম ডাবের জল আমি কক্ষনো খাইনি।

সেই জন্যই ভাব হয়েছিল তোমাদের। ডাব পাতিয়ে ভাব। বলে সে হাসে।

 ডাবের জন্য না ডিম!

রহিমের ভালোবাসাকে তুমি ডিম বলে উড়িয়ে দিচ্ছো? তাকে যেন একটু ক্ষুণ্ণ দেখতে পাই।

মোটেই তা দিচ্ছি না। বলছি যে, ভাবটা হয়েছিল তার ই ডিম ভাজার জন্যেই–গাছের পাড়া ভাব আর মুর্গির পাড়া ডিম-দুয়ের জন্যই।

তাই বলো! যাই হোক, তোমার বন্ধু দুটি হয়েছিল মন্দ না। দারোয়ান সীতারাম আর বাগানের মালী শেখ রহিম!

ছোটবেলায় ঐ বয়সে এমন বন্ধু পাওয়া যায়? তুমিই বলো!

একেবারে স্বদেশী গানের মতই মিলে গেছল তোমার বরাতে। সেই যে, গানটায় আছে না–আমরা কতো গেয়েছি তো! ঐ গান গেয়েই জেলে গেছে কতো ছেলে!

কী গানটা? বন্দেমাতরম্? নাকি, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা? নাকি, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়…?

সেই যে, রাম রহিম না জুদা করো ভাই! দিলকো সাচ্চা রাখো জী। হা জী হাজী করতে রহে, দুনিয়াদারী দোখো জী!–তাই করেছে তোমরা রাম আর রহিমকে আলাদা করোনি, এক জায়গায় এনে রেখেছে।

আমি নাকি? এই ধন্যবাদ সেই কাকার প্রাপ্য। তিনিই তাঁর বাগান মন্দিরে ওদের দুজনকে এনে পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যে দেবতার প্রতিষ্ঠা করে সে যেমন ধন্য, তেমনি তার যে পূজারী সেও কিছু কম নয়।

পূজারীটা আবার কে?

তুমিই তো! তুমিও কিছু নগণ্য নও।

আমার তো নিজের পেটপূজো। আমার যা ভালোবাসা আর ভাব তা হোলো ওই ডিম আর ডাব।

তাহলেও, যে কারণেই হোক, ভালোবাসাই তো? ভালোবাসা কি আর অকারণে হয়? আর রবিঠাকুর বলেছেন না, যার নাম ভালোবাসা তারই নাম পূজা এই রকম কী একটা কথা বলেছেন যেন কোথায়!

মোটেই বলেননি। আমার কাছে তুমি রবিঠাকুর কপচাতে এসো না! গুল মারতে এসো না আমার কাছে। রবিঠাকুর আমার গুলে খাওয়া। তিনি বলেছেন, মোরা ধরণীর নর, কথা পাবো কোথা? দেবতারে প্রিয় বলি, প্রিয়রে দেবতার এই কথাই বলেছেন তিনি।

কচ ও দেবযানীতে ওদের দুজনের মধ্যে এই কচকচিটা আছে, মনে করিয়ে দিই।

ওই হলো। একই দাঁড়ালো কথাটা…এখন শুনি ভাব জমিয়ে তুমি কতো হাজার ডিম আর ডাব সাবাড় করেছিলে তার, তাই কও।

হাজার হাজার। আমি কি গুণে রেখেছি? পেটের মধ্যে গিয়ে জমেছে। আর পেট হচ্ছে গিয়ে খাবারের যমালয়, জানো তো? এমন একটা জায়গা, যা যাবে তাই হজম। আমার পেট অন্তত। মা বলে যে, আমি নাকি একটি ক্ষুদ্র রাক্ষস।

বলেন নাকি তোমার মা?

বলবেন না? আমি যে কী আমি নিজেই কি আর জানিনে? গোপালের ন্যায় সুবোধ বালকের মত যাহা পাই তাহা তো খাই-ই, তা ছাড়া যা আমার খাওয়া উচিত নয়, হয়ত উচিত নয়…এমন সব জিনিসও আমি খেয়েছি।

কী রকম? কী রকম?

এমন একটা জিনিস যা নাকি খেলেই পাওয়া যায়, আর পেলেই খাওয়া উচিত।

আহা, শুনিই না জিনিস।

শুনলে তোমার পিলে চমকে যাবে সে জিনিস সাত জন্মেও তুমি কল্পনা করতে পারো। তোমার বয়সের কোনো ছেলে সে খাবার খেতে পায় না বা কদাচিৎ কোথাও কেউ হয়ত খেয়ে থাকতে পারে যদি কেউ তাকে কখনো খাইয়ে থাকে…

কী জিনিসটা শুনিই না!

সে জিনিস হচ্ছে রিনির। বুঝে নাও এইতেই!

রিনিটা আবার কে? রিনির আবার কী জিনিস?

ওই তো! ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ বলে না? যে তা খায় সে তো ঋণীই হয়ে থাকে। হয় না? সেই ঋণীইর থেকে খাওয়া…

ঘি খাওয়ার কথা বলছো তো? সে আর কে না খেয়েছে ভাই!

ঘি বলল, মধু বলল, পঞ্চগব্য বলো। যা বলো তাই বলো। মোটের ওপর অমৃত। খেয়েছো অমৃত?

আলবৎ খেয়েছি, অমৃতি তো? মোটাসোটা সেই জিলিপি রসে টইটম্বুর! সেই জিনিস। তা অমৃতির দোকানদার অমনি দিলে কে না খায়? আমাদের পাড়ার দোকানদারটা ধারে দেয় না যে! ধার চাইলে ধরে মারতে আসে। তার ধারেকাছে ঘেঁষতেই দেয় না।

যাক গে ওকথা। তুমি গঙ্গার কথা বলছিলে না? আমি যেমন করে গঙ্গা দেখেছি তুমি তার একশো ভাগের একভাগও দ্যাখোনি ভাই। ওই রহিম না? গঙ্গার বুকে আমায় নিয়ে বজরা চালিয়েছে–বুঝলে?

বলো কি? বজরাও চালিয়েছ তুমি রহিমের সঙ্গে? শুনে তো সে রীতিমতই অবাক : আটা না, ছাতু?

আটা না ছাতু-তার মানে? আমিও কম অবাক হই না-বজরাই তো। আটা-ছাতুর কথা আসছে কেন?

বজরার আটাও হয়, ছাতুও হয় আবার। কোনটা চালিয়েছিলে তোমরা? অবাক করলে জই! বাঙালীর ছেলে ডালভাত চালাতেই হদ্দ হয়ে যায়, হিমসিম খায় তাই হজম করতেই। আর তুমি কি বজরাও চালিয়েছ তার ওপর। তোমার মা মিথ্যে কন না! সত্যিই তুমি নমস্য। তোমায় দণ্ডবৎ! তোমার ক্ষুরে ক্ষুরেই। সে আমায় নমস্কার করে।

আহা, সে বজরা কেন গো! আমি যেন বজরাহত হই, বজ্রাহত মতই কই-তুমি কী হে! বজরা কাকে বলে তাও তুমি জানো না? দেবী চৌধুরাণী পড়োনি তুমি? বঙ্কিমবাবুর লেখা? তুমি কী একটা!

বঙ্কিমবাবু এখানে আসছে কোত্থেকে? সে বঙ্কিম নেত্রে তাকায় আমার দিকে–হচ্ছে গিয়ে বজরার কথা।

দেবী চৌধুরাণীর বজরা ছিল। গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িওয়ালা বড়লোক মাত্ররই থাকে। সেই বজরায় চেপে তারা গঙ্গার বুকে বেড়ায়। হাওয়া খায়। আমার কাকারও কাশীপুরের ঘাটে একটা বজরা বাঁধা আছে। বড়োসড়ো নৌকোর মতই হচ্ছে বজরা-তবে নৌকো ঠিক নয়কো। ছাদওয়ালা দু-তিনখানা ঘর আছে তার। ছোটখাট বাড়ির মই বলা যায়। ভাসমান বাড়ি। রহিম সেই বজরায় আমায় নিয়ে বেড়াত গঙ্গায়। সেই কথাই বলছিলাম। বলছিলাম যে আমি যেমনতর গঙ্গা দেখেছি তা তুমি দ্যাখোনি। বলছিলাম তাই।

যা দেখেছো গঙ্গা? তাহলেই হলো। জন্ম সার্থক হয়েছে তোমার। সে বলে : আমিও সেই গঙ্গা দেখতে যাবো পরশুদিন আমার জন্ম সার্থক করতেই।

এই যে বললে পরশুদিন তুমি জেলে যাচ্ছো আবার?

আহা, জেলেই এখন গঙ্গা হে! সেখান দিয়েই গঙ্গা বইছে যে!

ও, গঙ্গার ধারেই বুঝি এই জেলখানাটা? সেখান থেকেই গঙ্গা দেখা যায় বেশ?

আহা, কী সে গঙ্গা, কী মহিমা তার! কেমন তার রূপ! আর কত তার ঢেউ যে! পাড়ে বসে ঢেউ গোনো-ঢেউয়ের পর ঢেউগুনে যাও না! আর কিনারায় তোমার পা ডুবিয়ে ঢেউ খাও তার। গঙ্গায় যদি ডুব দিতে হয়, দেশের জন্যে জেলে যাবার এই সময়।

আহা, জেল হত তোমার পড়েই রয়েছে, গঙ্গাও কিছু পালাচ্ছে না। দেশও পালিয়ে যাচ্ছে না কোথাও। যেতে চাও তো যাবে, গেলেই হোলো এক সময়। তার চেয়ে বরং পরশু বিকেলে চলো আমরা কোনো সিনেমায় যাই। এমন তাড়াটা কিসে জেলে যাবার?

তাড়া নেই? তুমি বলল কী? কখন তিনি ছাড়া পান, চলে যান তার কিছু ঠিক আছে? শুনেছি সরকার বাহাদুর যে কোনো মুহূর্তে তাঁকে ছেড়ে দিতে পারেন।…চলে গেলে তো আর দেখা পাব না এ জীবনে। এমনটা করে পাব না তো!

কী সব আবোলতাবোল বকছো গো! দেশের জন্যে জেলে যাবে তো কী হয়েছে। আমার জেলে যাওয়া দেশের জন্য নয়, দাশের জন্যই। সি আর দাশকে দেখতেই। সি আর দাশই সেই গঙ্গা ভাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *