ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা – ১১

১১.

সেদিন সারা বিকেলটা নিমগাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে প্রাণপণে মা দুর্গাকে ডাকাডাকি করলাম কিন্তু কোথায় কী! সেই বৈকালী আর এলো না। কপালগুণটা বাজিয়ে দেখতে রোজ রোজ আসতের বাবা বস্তুর ঘন ঘর সবার খুলবে এইরকম। কালী একটু গিয়ে মাঝখান থেকে খিদে বেড়ে গেল আরো।

বৈকালীর বদলে রিনি এল-বেরুবে না আজকে? বেড়াতে যাবে না?

যাব বইকি। মাঠের পারে কি পুকুর ধারে নয়, নতুন জায়গায় বেড়াতে যাব আজ, দাঁড়া, আগে কিছু খাবার ব্যবস্থা করি। রিনিকে নিয়ে মার কাছে গেলাম। মা, কিছু খেতে দাও না আমাদের। ভারী খিদে পেয়েছে।

সেই কখন খেয়েচিস। খিদে পাবে তার আশ্চর্য কী। কি ছিলি এতক্ষণ?

নিমগাছের ছায়ায় ছাদে শুয়ে তোমার মা দুর্গাকে ফাঁদে ফেলবার তালে ছিলাম। কিন্তু এত করে চাইলাম, বৈকালী তো বই এল না আজ?

রোজ রোজ আসবে না কি? একেকদিন একেকজনের পালা যে? পালা মরে সবার বাড়িতেই যাবে তো। তোর বাবা বয়সে আর মানে সবার চাইতে বড়ো বলে প্রথমদিনের পালাটা তারই পড়েছিল। বামুন পাড়ার ঘ. ঘর সবার বাড়ি যাবে, তারপর বড় বড় আমলাদারদের বাড়িতেও। সারা বোশেখ মাস ভোরই তো চলবে এইরকম।

তা যাই বলল না মা, চাইলেই পাওয়া যায় না সব সময়। তোমার মা কালী একটু খামখেয়ালী আছে।

তা আছে। তবে চাইলেই পাবি-পাবি যে, সেটা নিশ্চয়। কখনো তক্ষুনি, কখনো বা কিছু পরে। পেতেই হবে, না পেয়ে যাবিনে কক্ষনো। কখনো চেয়ে পাবি, কখনো বা গেয়ে চাইবি-কখনো বা না চাইতেই পেয়ে যাবি-এমন ধরা চলতে থাকবে সারা জীবন, পরখ করে দেখিস।

পরখ করে দেখলাম তো এতক্ষণ। আমার দু র শোনা গেল।

আবার চাইবার আগেই পেয়ে যাবি একেক সময়–বললুম না? দেখবি যে না চাইতেই কখন দিয়ে বসে আছেন মা। মা বলেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, জীবনের কোন জিনিসই তো এখনো তোর টেস্ট করা হয়নি। তাই আগে মা একটুখানি করে তাদের বাদ দেবেন। স্বাদ দিয়ে তোর সাধ জাগাবেন। আর, তোর সাধ মেটাকেন চাইলে পরেই তারপর। মেটাতে মেটাতে যাবেন তিনি জীবনভোর বরাবর।

একেই বুঝি সাধনা বলে থাকে? তাই না মা?

তাও বলতে পারিস। তবে সাধনা দুতরফেই-মার পুত্রসাধনা আর ছেলের মাতৃসাধনা। দুজনের দুজনকে নিয়ে সাধ আহ্রদ।

বাঃ বেশ তো! শুনে আমার বেজায় ফুর্তি হয়। হাতে যেন স্বর্গ পেয়ে যাই তক্ষুনি।

যেমন চাইবার আগেই পেয়ে গেছিস আজকে। পরে তুই চাইতে পারিস বলে তার আঁচ পেয়ে আগের থেকেই যুগিয়ে রেখেছেন মা।

কোথায় পেলাম। মার কথায় আমার অবাক লাগে।

আজ সকালেই পৌঁছে গেছে তোদর বিকেলের জলখাবার।

বলোনি তো তুমি? কখন এল? কী এসেছে?

তোরা তো তখন ইলেছিলি–বলব কখন? আজ সকালে তোর বাবা পাহাড়পুরে তোর জ্যাঠাইমাদের বাড়ি গেছলেন না? বড়মা তোদর জন্যে ক্ষীরের ছাঁচ সরের নাড়ু চন্দ্রপুলি তিলকোটা চিড়েমুড়ির মোয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন সব।

দাও দাও। বলেনি কেন এতক্ষণ। আমি ব্যস্ত হয়ে উঠি।

বস। বসে খা। রিনি আর আমাকে আসনপিড়ি হয়ে বসতে বলেন মা।

বসে বসে খায় নাকি মানুষ? রাস্তায় খাব আমরা। বেড়াতে যাচ্ছি না এখন? রিনিকে আমি রাম-সীতার মন্দির দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি আজ। আরতি দেখে ফিরব। যেতে যেতে খাব আর খেতে খেতে যাব। বড়মার অবদানে আমার দুপকেট বোঝাই করে বেরুলাম।

বেশি রাত করিসনে যেন। পই পই করে বলে দিলেন মা।–সামনে ক্লাস পরীক্ষা রয়েছে তোর। এসেই পড়তে বসবি, বুঝেছিস? বেশি রাত জেগে, কি মাঝ রাত্তিরে উঠে আমি পড়তে দেব না।

ঘাড় নেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

তোমার মা আবার কোন মায়ের কথা বলছিলেন গো! যিনি সব জুগিয়ে থাকেন? তোমার পাহাড়পুরের বড়মা?

না না, অন্য মা। আরেক মা। তোর মা, আমার মা, মার মা, বড়আরও মা-সবার মা, যিনি বিশ্বজননী, মা দুর্গা। তার কথাই বলছিলেন মা।

মা দুর্গা?

হ্যাঁ, তিনিই খাবার পাঠিয়েছেন আমাদের–খেতে চাইবার আগেই। রিনির বড় বধু চোখ আরো বড় হয়ে উঠল যেন।–তাই নাকি?

হ্যাঁ, চল না। যেতে যেতে বলছি তোকে সব। আগে কিছু খেয়ে নেয়া যাক। খিদে পেটে তত্ত্বকথায় মন যায় না।

পুলির তত্ত্ব নেবার পর রিনির চাঁদ মুখের তত্ত্ব নিলাম।- তোর মুখে নারকেল নাড়ু

ভয়াশ লেগে রয়েছে। দা, মুখ মুছিয়ে দি তোর।

এ আবার কী ধরনের মুখ মোছানো? পকেটে রুমাল ছিল না? হত ছিল না তোমার? মাঝ রাস্তার মধ্যিখানে …এই সব। আপত্তি করল সে।

হাত ছিল তো কী? আমি বলি-ঝগড়াঝাটির বেলায় অবশ্যি হাত থাকতে মুখ কে?

তখন কষে তোমার দু হাত চালাও। কিন্তু তেমন কারো মুখ মোছাতে হলে অন্য কথা। তখন মুখ থাকতে হাত কেন? তাই মুখ দিয়েই মুছে দিলাম।

বেশ করেছে। এবার শুনি তোমার সেই কথাটা। মা দুর্গার কথা।

তোমার মা দুর্গা আবার কিরে! তোরও মা দুর্গা তো, মা দুর্গা তো সবাইকার। বল, আমাদের মা দুর্গা।

ওই হোলো। এখন শুনি তো কথাটা।

মা দুর্গা আছে না? শিব আছেন, দুর্গা আছেন লক্ষ্মী সরস্বতী দেবতারা সবাই রয়েছে।

আছেন তা তো জানি। একবাকে তার সায়।–ত কে না জানে?

কিন্তু আছেন কোথায়? সেই আকাশের মগডালে নয়, আমাদের এই শরীরে–আমাদের মনের মধ্যেই। যেমন তোর শিব আছেন মাথার এইখানটায়, আর মা দুর্গা রয়েছেন তাঁর পায়ের তলায় বসে–এইখানে কপালের মধ্যিখানে। এখানে মন নিয়ে এসে এমনি করে মা দুর্গাকে ডাকতে হয়। আনতে পারিস এখানে তোর মন?

কি করে আনব?

দাঁড়া, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তোকে। আগে আমার এখেনে ডেকে আনি মা দুর্গাকে…বলাটা হয়তো ভুল হলো…আগে আমাকে ডেকে নিয়ে যাই এখানে মা দুর্গার কাছে, তারপর…

তারপর মার আখ্যানের পুরোটাই তার দেহে মনে মঞ্জরিত করতে লাগিযথাবিহিত পুরঃসর আমার অখ্যানমঞ্জরী নিবেদনের পর ওধাই : কি রকম লাগছিল ব তো, আমি যখন…

তুমি যখন ঠোঁট ঠেকিয়ে রেখেছিলে না, সারা গা কেমন শিরশির করছিল আমার।

করবেই তো! কপালটা শিরোভাগ না? তাই করবেই তো শিরশির!

কপাল নয় গো, গাটা শিউরে উঠছিলো যেন।

আহা, ওই শীর্ষদেশ থেকেই তো যতো শিরা উপশিরা আমাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। মাথার ডাকে সাড়া দিচ্ছিল তারা। নিজের বুদ্ধিমত্ত আমার ব্যাখ্যা করা।

এবার বুঝলাম। বেশ তো, ডাকা গেল না হয় মা দুর্গাকে। কিন্তু কারণে অকারণে নাহক তাঁকে ডাকতে যাব কেন? তাঁকে বিরক্ত করা হবে না?

মা আবার বিরক্ত হয় নাকি ছেলেমেয়ের ওপর? আর অকারণে কেন? কোনো কিছুর দরকার পড়লেই ডাকবি তো। চাইবার জন্যেই ডাকবি, পাবার জন্যেই ডাকবি রে। দেখবি তোর প্রার্থনা পূর্ণ হয় কিনা।

আচ্ছা, আমি কিছু না চাইবার জন্যে ডাকি যদি? সে জানতে চায়।

না চাইবার জন্যে ডাকা? না পাবার জন্যেই সে আবার কী রে? তার কথাটায় আমার ধাঁধা লাগে, বুঝতে পারি না ঠিক।

ধরো, মা তো আমাদের আছে মাসে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছে। আমি এখান থেকে যেতে চাইনে। আমি যদি এখন দুর্গার কাছে না যাবার জন্যে চাই তাহলে আমাদের যাওয়া হবে তো?

না চাওয়ার জন্য চাওয়া যায় কিনা তা আমি জানি না। ওর কথায় আমি ভাবনায় পড়ি–জিগ্যেস করতে হবে মাকে। তারপরে তোকে বলব।

না পাওয়ার জন্য চাওয়াটা কী আবার? ওর কথাটা আমার অদ্ভুত লাগে–সত্যি, তোরা মেয়েরা যেন কেমনধারা। আমরা ছেলেরা চাইবার জন্যেই চাই, পাবার জন্যেই চেয়ে থাকি-পাই আর না পাই। কিন্তু এই তোরা-মেয়েরা! তোরা না চাইবার জন্যেও চাস আবার না পাবার জন্যও চেষ্টা করিস। আশ্চর্য!

চাইলে যদি পাওয়া যায়, না চাইলে তবে না পাওয়া যাবে কেন? তার জিজ্ঞাসা।

কে জানে। তোরা মেয়েরাই তা জানিস। আমরা ছেলেরা যা চাই তাই শুধু চাই, তেরা মেয়েরা তার ওপর আবার না চাইতেও,চাইতে পারিস দেখছি। মামা যে বলেন কথাটা মিথ্যে নয় তাহলে, মামা বলতেন বটে, কিন্তু আমি তার মানে বুঝতাম না তখন।

কী বললে তোমার মামা?

মেয়েরা ভারী নাচাইতে পারে।

তুমি ভারী বোকা! সেটা ঐ না চাওয়া নয় মশাই, তা হচ্ছে গিয়ে তোমায় বাঁদর নাচানো।

তোরাই জানিস। তোরাই নাচাস তো।

বেড়াতে বেড়াতে আমরা মহানন্দার তীরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

আমরা যাচ্ছি কোথায় বল তো? সে শুধায়।

রামসীতার আরতি দেখতে যাচ্ছি না। নদীটা পেরিয়ে যেতে হবে।

জল আছে যে নদীতে।

ও হাঁটুখানেক জল। অক্লেশে হেঁটে পেয়োনো যায়। বর্ষাকালে বান ডাকে। তখন ফেলে ওঠে এখানকার মহানন্দা। অন্য সময় বেচারী মহাবিষণ্ণ হয়ে পড়ে থাকে ওর একটুখানি জল নিয়ে।

ঐ তো দূরে পুল দেখা যাচ্ছে, সাঁকোর ওপর দিয়ে গেলে হয় না?

তাহলে এই ফুটবলের মাঠ ক্রস করে এলাম কেন? সাঁকো দিয়ে পেরিয়ে পাকা সড়ক ধরে গেলে অনেক দূর পড়বে, দেরি হবে বাড়ি ফিরতে। সোজাসুজি নদী পার হয়ে সিঙিয়ার আমবাগানের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করব আমরা।

হাঁটুর বেশি জল হয় যদি? আমার ফ্রক ভিজে যাবে কিন্তু।

কোলে তুলে নিয়ে যাব তোকে? কি, পিঠে করে?

পারবে? জলে ফেলে দেবে না তো?।

তোর কী মনে হয়?…জলেই তোকে বিসর্জন দেব?

রামসীতা ছাড়া আরো কী যেন ঠাকুর আছে বলছিলে-যা দেখতে যাচ্ছি আমরা। আর কী ঠাকুর?

সিংহবাহিনী। এইটুকুন ঠাকুর কিন্তু আগাগোড়া সোনা দিয়ে গড়া।

তাই নাকি?

কিংবা সোনা দিয়ে মোড়াও হতে পারে। জানি না ঠিক।

দেখেছ তুমি?

দেখিনিও বলা যায় আবার দেখেছিও বলা যায় আবার। চোখের সামনেই দেখছি তো এখন। তোর সোনার প্রতিমা দেখছি না?

হয়েছে। খুব হয়েছে।

তুই আমার কাছে সিংহবাহিনী। আর আমি যদি তোকে বয়ে নিয়ে যাই তবে আমি তোর বাহ্ন হব তো? আমি হব গিয়ে তাহলে তোর সিংহ। বুঝেছিস?

তুমি সিহ? সিংহ তত তোমার কেশর কই গো? সে হাসে: তবে তোমার চুলগুলো প্রায় কেশরের মতই বানিয়েছ বটে! এমন ঝাঁকড়া চুল-ছাঁটো না কেন? ছাঁটবার সময় পাও না নাকি?

নাপিতের কাঁচির সামনে উবু হয়ে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকতে আমার এমন বিচ্ছিরি লাগে। কারো খচখচানি আমার সয় না। এমনকি, ওই কাঁচিরও নয়।

ততক্ষণে আমি তাকে কোলে তুলে ফেলেছি।–ই তেমন ভারী মোস তো! হালকা পলকা আছিস। তবে বিয়ের পর শুনছি মেয়েরা নাকি খুব মুটিয়ে যায়। তুইও বেশ মোটা হবি তখন।

বয়স হলে ছেলেরাও মোটা হয়। ভুড়ি হয় তাদের। তুমিও মোটাবে।

সে নেহাৎ মন্দ হবে না–যদি দুজনেই একসঙ্গে মোটাই। ভালোই হবে মোটের ওপর।

মোটামুটি মানিয়ে যাবে বলছ?

হ্যাঁ, দুজনেই যদি মোটামুটি হই-এইতো এসে গেলাম পারে। কই, পড়লি তুই জলে? পর পারে নিয়ে ওকে নামালাম।

কিন্তু নামাবার আগে শরৎচন্দ্রের কথা আমার স্মরণে এল। তাঁর স্বামী বইটা আমার পড়া হয়ে গেছল তার মধ্যেই-কৃজ্ঞরণ সরকারের পাঠাগারের থেকে নিয়ে। দামিনীকে কোলে করে নরেনের সেই নালা পেরুনোর ঘটনাটা আমার অবচেতনের মধ্যে যেন বিদ্যুতের মতই চমকে উঠল অকস্মাৎ। আমাকে নালায়িত করল।

বিশিষ্টরূপে বহন করার মানেই যে বিবাহ, তদ্ধিত প্রত্যয়ের সেই তথ্য বাংলার সারের সৌজন্যে আমার অজানা ছিল না তদ্দিনে। নরেনের মতই তাকে মাটিতে নামাবার আগে আমার স্বামীত্বের স্বাক্ষর তার মুখপত্রে রেখে দিয়েছি।

এটা কী হোলো আবার? ওর দু চোখে দুই সৌদামিনী খেলে যায়।

আমার লায়ন্স শেয়ার। আমি বললাম, মজুরি নিলাম…আমার এতক্ষণ তোকে বয়ে আনতে কষ্ট হল না বুঝি? একটুখানি মিষ্টিমুখ করে সেই কষ্ট লাঘব করা গেল।

হটতে হাঁটতে আমরা সিঙিয়ার আমবাগানের সামনে এসে পড়েছি।

ও বাবা! এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাব নাকি এখন আমরা? ভেতরটা কী দারুণ অন্ধকার।

জঙ্গল বলছিস? সিঙিয়ার বিখ্যাত আমবাগান-এর নাম। হাজার খানেক আম গাছ আছে বাগানটায়। ভালো ভালো আম যতো। ল্যাংড়া বোষই ফজলি গোপালভোগ হিমসাগর ক্ষীরসাপাতি-কত কী! আমের সময় আমরা ছুরি নিয়ে চলে আসি। গাছতলায় কত পাকা আম পড়ে থাকে যে। কাটি আর খাই। আমি জানাই : অনেক ছেলে আবার গাছে উঠেও খায় বসে বসে।

আমিও খাব, এবার যদি আমের সময় আমাদের থাকা হয় এখানে। রিনি বলে আমি কিন্তু গাছে উঠতে পারব না।

আমিও পারিনা। গাঁয়ের অনেক মেয়ে পারে কিন্তু। গেছো মেয়ে কিনা তারা।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এই অন্ধকারে বাগান দিয়ে যেতে ভয় করছে আমার। সাপখোপে কামড়ায় যদি?…কতখানি পথ গো?

তা, আধ মাইলটাক হবে। ইস্কুল যাবার সময় এই বাগান দিয়েই তো আমরা শর্টকাট করি। রাজবাড়ির ডান দিকে রামসীতার মন্দির, আর তার পাশেই আমাদের ইস্কুলটা। সাপের ছোবলের ভয় কছিস? তাহলে, কোলে করে নিয়ে যাই তোকে?

আর ই বলে… আর কিছু সে বলে না। তার চোখের কানিতেই কথাটা বলা হয়ে যায়।–বুঝেছি।

খেতে খেতে যাব আর যেতে যেতে খাব এই কথাই বলছিস তো? বাবা বলেন, মুখের অন্ন সম্মুখের অন্ন ছাড়তে নেই। তা যখন অন্নপূর্ণাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি…

অত অন্ন খাওয়া ভালো নয় মশাই। গরহজম হয়।

তা যা বলিস। আমার জবাব : কিন্তু যতই খাই না কেন, তোর মাথা খেতে পারব না। তোর মাথা অলরেডি খাওনা। মামা বলে, কলকাতায় মাথা না খাওয়া মেয়ে নাকি একটাও নেই–তারাও নাকি আবার জোর মাথাখোর। আমার মামার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করি-আর, তুইও তো কলকাতার মেয়ে। তার ওপর এমন সুন্দর। তোর মাথা কি না-খাওয়া আছে এখনও?

কে খেল শুনি?

কে খেয়েছে কে জানে। কেউ না কেউ খেয়েছেই।

না বাপু, তুমি সড়ক ধরেই চলল। পথ দেখে দেখে যাব আমরা। পথের দুপাশে দেখবার কিছু নেই কি।

অগত্যা তিলকুট আর চিড়ের নাড়ু চিবুতে চিবুতে সড়ক ধরেই চললাম আমরা।

এতখানি পথ! ইস্কুলে যাবার সময় কতটাই না মনে হয়। কিন্তু এখন যেন দেখতে না দেখতে ফুরিয়ে গেল। পকেটের রসদ ফুরোতে না ফুরোতেই পথ খতম।

ও বাবা! কত বড়ো একখানা বাড়ি গো। এই বুঝি তোমাদের সেই রাজবাড়ি? চাঁচোরের রাজার?

হ্যাঁ, নতুন রাজবাড়ি। ওর ডান দিকে রামসীতার মন্দির ই। আর তাঁর পাশেই আমাদের হাই স্কুল।

কলকাতায় এত বড় বাড়ি দেখিনি। রিনি অবাক হয়ে দ্যাখে। তবে কলকাতার কতটুকুই বা দেখেছি।

ভেতরে আবার আরও কত বড়ো। যতখানি চওড়া দেখছিস সামনেটা, ততটাই ডান দিকে, বাঁ দিকেও ততখানি, পেছনেও আবার তাই। কতো কতো ঘর যে কতো বড়ো

একখানা হাদ। ফুটবল খেলা যায়। ছাদে আবার কল আছে–খুললেই জল পড়ে।

কলকাতার মই নাকি? বলল কি গো?

তা হবে। কলকাতার কল দেখিনি তো আমি। …কাসর ঘন্টা বাজছে শোন! আরতি এরু হয়ে গেছে এখন।

আমরা মন্দিরের চত্বরে গিয়ে দাঁড়াই। আরতি দেখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

বাঃ, বেশ ঠাকুর তো। রাম সীতা লক্ষন হনুমান… রিনি গড় হয়ে প্রণাম করে। আমিও। তোমার সিংহবাহিনী কই গো? দেখছি না তো।

এরই মধ্যে আছে কোনোখানে। এতদূর থেকে ভালো দেখা যায় না। এইটুকুন ঠাকুর তো। আমি বলি : সিংহবাহিনী তো দুর্গাই। মা দুর্গারই একটা নাম সিংহবাহিনী। আমি এখানে মন নিয়ে এসে মার কাছে কি প্রার্থনা করলাম এখন জানিস।

কী?

আমি যেন রামের মতন রাজা হই।

রাজা হবে? রাজা হবে তুমি? রাজা হয়ে কী করবে?

সিংহাসনে বসব ঐরকম। তুই সীতা হয়ে আমার পাশে বসবি, আর আমার ভাই সত্য লক্ষণ হয়ে ছাতা ধরে থাকবে আমার মাথায়। আর হরিটা হনুমান হবে।

হরি আবার কে?

আমাদের ছোট ভাই। মামার বাড়ি থাকে কলকাতায়। দিদিমার ন্যাওটা কিনা। দিদিমা ভারী ভাললাবাসেন তাকে। তাঁর কাছেই থাকে। আমি জানাই–সে হনুমানের মত হাত জোড় করে থাকবে আমাদের সামনে।

হনুমানের মতন ল্যাজ আছে ওর?

নেই, তবে ল্যাজ হবে-হয়ে যাবে ল্যাজ।–তুই দেখে নিস।

যা, তারও ল্যাজ হয়েছে আর আমিও সীতা হয়েছি! রিনি হাসতে থাকে।

.

১২.

আরতি দেখে ফিরতে একটু রাতু হল। মা বললেন, কি রে, এত দেরি করলি যে। খাবার সময় হয়ে গেল, পড়তে বসবি কখন? সামনে তোর পরীক্ষা না?

পরীক্ষা কিসের মা। প্রমোশন তো সামনে।

পাশ করেছিস?

কবে! পরীক্ষার ফল জানা হয়েছে, এক অঙ্ক ছাড়া আর সব বিষয়েই ভালো মতন পাশ। জানালাম : বাংলায় তো ফার্স্ট হলাম।

বলিস কি রে! পড়লি না টড়লি না, বাজে বই পড়ে সময় কাটালি, পড়ার বই ছুঁলি না পর্যন্ত। পাশ করে গেলি! মা হতবাক।

তোমার আশীর্বাদে। আমি জানাই : তুমি যে প্যাঁচ শিখিয়ে দিয়েছ না, তাই কষেই তো তরে গেলুম এ যাত্রা। বরাবর এই করেই তরব আশা করছি…কোশ্চেন সব আউট করলাম যে।

সে কি রে! কোশ্চেন আউট করলি কি? অ্যাঁ? মা হতবুদ্ধি-আমি আবার কী প্যাঁচ শেখালুম তোকে।

ঐ যে! ভুরুর মধ্যেখানে মন এনে মা দুর্গাকে ডাকতে–পরীক্ষাতেও সেই ভুরকুটি দেখিয়েছি। ঐ করে কোশ্চেন সব বার করেছি। তাই আমাকে আর কষ্ট করে পড়তে হয়নি, পরীক্ষা পাশ করতে হয়নি, এমনি করেই পরীক্ষার পাশ কাটালাম। পরীক্ষাই আমায় পাশ করে গেল এবার।

শুনি তত ব্যাপারটা। মার আগ্রহ দেখা যায়।

এইরকম আর কি, আমি বিশদ ব্যাখ্যা করে দিই, চোখ বুজে ঐ সন্ধিস্থলে, নাকি সন্ধিক্ষণে- মন নিয়ে আসি আর মা দুর্গার নাম করে একটা বইয়ের একটা করে জায়গা বার করি–এমনি করে পাঁচবার করার পর সেই সব জায়গার দুদিকের পাতার, মোট দশ পৃষ্টার সবখানি দুরস্ত করে রাখি, তার পরে দেখা গেল ঐ দশ পৃষ্টার ভেতর থেকেই বেশির ভাগ প্রশ্ন এসে গেছে। পাশ করার মতন নম্বর পেয়ে গেছি তাইতেই।

এই করে পাশ করেছিস তুই? মার মুখে রা সরে না।

হ্যাঁ। এই করে ইংরেজি বাংলা ভূগোল ইতিহাস সব, শুধু অঙ্কটাতেই সুবিধে হল না মা। পইত্রিশ পেয়ে টায়েটুয়ে কোনোরকমে পাশ।

মোটে পঁইত্রিশ?

হ্যাঁ, সব অঙ্ক জানা ছিল না তো। একটা বড় যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের অঙ্ক, একটা ডেসিমেলের, ফ্র্যাকশনের আক একটা,আর ঐ সিঁড়ি ভাঙা একখানা কষতে পেরেছি কেবল। জিয়োমট্রির একটা থিয়োরেমও করেছিলাম কিন্তু তার জন্য মাত্র আদ্ধেক দিয়েছে।

আদ্ধেক কেন?

আমি এখানে মন নিয়ে এসে মনগড়াভাবে সেটাকে মিলিয়ে দিয়েছিলাম কি না। অঙ্কের স্যর বললেন যে আমি যেভাবে প্রুভ করেছি তাও হতে পারে বটে, তবে বইয়ের মতনটাই ফলো করতে হবে আমাদের। সেই কারণে তার জন্যে পুরো নম্বর দেননি।

বাকী অঙ্কগুলো তোর জানা ছিল না কেন? ঐখেনে মন নিয়ে এসে চেষ্টা করিসনি কেন জাবার?

করেছিলাম। বের করেছিলাম দশটা পাতা, তার ভেতরের আঁকও এসেছে হয়ত বা, এসেছে কি না তাও জানি না, আসতে পারে হয়ত–কিন্তু ঐ অঙ্কগুলো তো আমার জানা ছিল না, কষিনি তো আগে।

কেন, কষিসনি কেন? আর জেনে তখন-তখনি বা কষে নিলি না কেন–ঐ অঙ্কগুলো?

কী করে করব? আগের অঙ্ক না জানা থাকলে, কষে না রাখলে পরের অঙ্ক কি করা যায় নাকি? এ তো আর তোমার মুখস্থ করা নয় যে মুখস্থ করে রাখলেই হবে-স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যাবার ব্যাপার। আগের অঙ্কগুলোই করিনি যে।

অঙ্কের মাস্টার ক্লাসে হোম টাস্ক দেন না তোদের? দেখাতে হয় না প্রত্যেক দিন?

হয় বইকি। সে আমি ম্যানেজ করি। আমি বলি, কাবিল হোসেন আমাদের ক্লাসের ফাস্ট বয়, আমার খুব বন্ধু। হোমটাসূকের অকগুলো আমার খাতায় কষে দেয় সে রোজ রোজ-তাই আমি সেকেন্ড মাস্টারকে দেখিয়ে দিই। প্রতিদানে কাবিলকে আমি মাঝে মাঝে রসগোল্লা খাওয়াই বাণিজ্যার দোকানে।

তাই নাকি রে?

হ্যাঁ। তবে সেও খাওয়ায় মা আমায়। তাদের হোটেলে মুর্গি-টুর্গি হলে ডেকে নিয়ে খাওয়ায়।. মুগি খাওয়া কি খারাপ মা? মুসলমানের খেলে কি জাত যায় আমাদের?

পাগল। হিন্দু মুসলমান আবার কী? জাত বলে কিছু নেই রে! তবে গোরু টোরগুলো প্রাসনে যেন কখনো।

না, তারাও খায় না। আমরা মনে কষ্ট পাব বলে কাটেও না তারা। মাকে আমি ভরসা দিই–আমি তাকে তোমার ওই মা দুর্গার প্যাঁচটা শেখাতে গেছলাম, সে বললে যে, তাদের ওটা করতে নেই। আল্লা ছাড়া আর কোনো দেবতাকে ডাকলে তাদের গুণা হয়। সে বললে বিসমিল্লার কাছে প্রার্থনা করলেও সেই ফলই পাওয়া যাবে–বিসমিল্লা হের রহমানে রহিম-এই মন্তর বলে চাইতে হয় নাকি। তা কি হতে পারে মা?

কেন হবে না? এই তো সব। সব তো একই। সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে সেই ভগবান-সেই কেন্দ্রস্থলে মন নিয়ে যেতে হয় কেবল, তাহলেই হলো। এখন, যে মন্তরে, যা বলে ডেকে সেখানে তুমি যাও না কেন! আসলে সেই একই জিনিস–এক ভগবান। বিসমিল্লা আর দুর্গা এক–সেই এক বিন্দুবাসিনী।

বিসমিল্লা হের রহমানে রহিম আর মা দুর্গা এক? কথার হেরফের কেবল? আচ্ছা, যেমন করে এখানে মন এনে কোশ্চেন জেনে পাশ করলাম তেমনি করেই তো ফাস্টও হতে পারি আমি?

তা কি করে হবে? পড়াশুনা না করে-পাঠ্যবইদের বিলকুল ফাঁকি দিয়ে? তা কি হয় নাকি রে? মা বলেন, যে ছেলেরা রীতিমতন খেটেখুটে পড়ছে তাদের ভেতর থেকেই ফার্স্ট হবে, তুই শুধু কোনোরকমে পাশ করে যাবি কেবল।

তা কেন মা?

সাধনা না করলে কি সিদ্ধি হয় রে? যে ছেলেটা খেটে পড়ছে সে যদি মা দুর্গাকে নাও ডাকে তবুও সেই ফাস্ট হবে–তার ঐ খাটুনিটাই তো আসলে ভগবানকে ডাকা। আর যদি খাটেও আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে ডাকেও–তাহলে সে কোথায় গিয়ে উঠবে বলাই যায় না। উন্নতির চূড়ান্ত হবে তার আর এইভাবে ফাঁকি দিয়ে তরতে গিয়ে তোর তলিয়ে যাওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু যেহেতু ঐ মাকে ডেকেছিস, তাই তুই ডুবে যাবিনে একেবারে, শুধু ভেসে থাকবি কোনোগতিকে। সারাজীবন এইভাবে ভেসে ভেসেই কাটবে তোর।

ভাসা ভাসা জীবন হবে? তুমি বলছ?

আমি কিছু বলছি না। সেটা মার ইচ্ছে। তবে জেনে রাখিস্ সাধনা না করলে কোনই সিদ্ধি হয় না। যেমন তোর ওই অঙ্কের মতন। কী অঞ্চগুলো আসবে জানতে পারলেও কষতে পারলিনি–স্টেপ বরাবর এগুসনি বলে। ওই স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে সাধনা। ফাঁকতালে কিছুই মেলে না রে, অমনি করে এগিয়ে গিয়েই পেতে হয় সব।

অঙ্ক যে আমার একদম ভালো লাগে না মা।

তাহলে কি করে হবে রে। তবে কি করে এখান থেকে উৎরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকোঠ ডিঙোবি? আর তা না হলে…তের বাবা যে তোকে বিলেত পাঠাতে চায় রে। সেখান থেকে আই-সি-এস পাশ করে আসবি তুই। জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবি। তোকে সিভিলিয়ান দেখার স্বপ্ন যে তাঁর অনেক কালের। খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাচ্ছেন সেই জন্যে।

আমি চাই না জজ ম্যাজিষ্ট্রেট হতে। ওসব হতে ভাল লাগে না আমার। কী হয় ওসব হয়ে? ওই তোমাদের এক বিচ্ছিরি শখ মা। ছেলেদের সব সিভিলিয়ান করার মতলব। বামুনপাড়ার আদ্ধেক ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে-বসে বসে পড়তে লেগেছে সবাই। তাদের বাবাদের শখ সিভিলিয়ান করার। হকিম মুনসেফ উকীল ব্যারিস্টার ডাক্তার সাবরেজিস্টার হবে। বাবার শখ মেটাতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা।

সেটা কি খারাপ? মা বলেন : ভালোই তো। তাদের নিজেদের পক্ষেই তো ভালো।

ভালো না ছাই! ওসব হতে চাই না আমি। আমি চাই আমি হতে। তা কী করে হওয়া যায় যে…!

ভেবে কোন কূল পাচ্ছিসনে তার?

পেয়েছিলাম তোত একটা কূল-তোমার কথায়। এখেনে মন এনে মা-দুর্গার কাছে চেয়ে চেয়ে আমার কাজ বাগাতে। তুমি তো বলছ যে কেবল তাতে হবে না। শর্টকাট করলে চলবে না, সারা পথটা হাঁটতে হবে–হেঁটে হেঁটে সারা হতে হবে আমায়। কিন্তু তা কি করে হয়? অমনতর হটবার আমার ক্ষমতা নেই। ইচ্ছেও করে না আমার।

তাহলে আর কি করে হবে। মা সান্ত্বনা দেন-তবে খুব বড় হলেও কিছু একটা হবি। কিছু কিছু হবে তোর। ভিকে-শিকে করে যা হয়। ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ-বলেছে না? ভগবানের কাছে ভিক্ষে চাইলেও প্রায় সেই কথাই। তবে এরই মধ্যে একটুখানি ইর বিশেষ–এই যা।

কেবল প্রার্থনা করে মেলে না কি মা?

চাইতেও হবে, চেষ্টাও করতে হবে–তবেই হবে ষোল আনা। চাই কি, তার চেয়েও বেশি হতে পারে। চেয়ে চেয়ে এগুতে হবে–এগিয়ে গিয়ে আগাবার পর চাইতে হবে–তবেই হবে পথ চলা। পথ চলাটাই তে আসল রে। গন্তব্যস্থল কোথাও নেই।

কী মুশকিল। কী মুশকিল।

মুশকিলটা আবার কোনখানে?

আমি ভেবেছিলাম তোমার সিদ্ধি আমার কাজে লাগাব। তোমার ঐ প্যাঁচটা কষে যা হবার হতে পারব–যা যা চাইবার, যা পাবার পেয়ে যাব সব-এখন দেখছি…

আমার আবার সিদ্ধি কি রে? মা একটু বিস্মিতই।

তুমি তো সিদ্ধিলাভ করে বসে আছ, ভৈরবী বলছিল আমায়।

ভৈরবী তো সব জানে! হাসতে থাকেন মা : ওই সব আজেবাজে কথায় কান দিস তুই! বিশ্বাস করিস?

বা রে। ফল পেয়েছি যে! না পড়ে পাশ করে গেলাম কি করে তাহলে?

ও কিছু নয়। এক-আধবার ওরকম হয়ে যায়। কখনো আবার হয়ও না। কেন যে হয়, কেন যে আবার হয় না তা আমি জানি না। মনে হয়, তুই যে একবার বলেছিলি না? মা কালী একটুখানি খামখেয়ালী, তাই হয়ত এর কারণ হবে।পরমহংসদেবের কথামৃত পড়তে দিয়েছিলাম যে তোকে? পড়েছিলিস?

পাঁচ খন্ডই। কবে শেষ করেছি।

কী বলেছেন তাতে ঠাকুর? এরকমটা হলেও এটা হওয়াতে নেই। এটা একটা ছোটখাট সিদ্ধাই-বুঝেছিস? ঠাকু সিদ্ধাইয়ের বিরুদ্ধে, সেটা টের পাসনি?

পেয়েছি। কিন্তু তিনিই তো আবার বলেছেন যে গুরুকেও বাজিয়ে নিতে হবে? বলেননি? বাজিয়ে না দেখলে সিদ্ধাই কিনা বুঝব কি করে?

তাই কি তুই ই সিদ্ধাইটা বাজিয়ে দেখছিস নাকি?

যদি বলি তোমাকেই। তোমাকেই বাজিয়ে দেখছি আমি। মার চেয়ে বড়ো গুরু তো নেই আর, ভৈরবীর কথা। তুমি তো আমার পরম গুরু।–তাই তোমাকেই তার মানে, তোমার কথাটাকেই বাজাতে লাগলাম। তোমার ওই সিদ্ধাইটাকেই

আমার আবার সিদ্ধাই কিসের।

সিদ্ধাই না বলে যোগ যদি বলি? তোমার যোগবল?

আমি আবার যোগ করলুম কবে রে?

যোগ না করলে তুমি এই কৌশলটা জানলে কি করে তবে? বাবা যে বলেন, যোগ কর্মসু কৌশলম, মানে যে, যোগ হচ্ছে গিয়ে কাজ করার কৌশল, সেটা কি মিথ্যে?

না না, মিথ্যে কেন হবে? শাস্ত্রবাক্যই।

আমি কেবল সেই কৌশলটাই কাজে লাগাচ্ছি তো। ছলে বলে কৌশলে কার্যোদ্ধার করতে হয় না? তাই এই কৌশলেই কাজ হাসিল করছি আমার।

শুনে মা গুম হয়ে যান-কিসের ভাবনায় যেন তাকে কাতর করে : মনে হচ্ছে আমিই তোর সর্বনাশ করলুম বুঝি। তোকে এই প্যাঁচটা শিখিয়ে দিয়ে…যা মা-ই তোকে বাঁচকেন শেষ পর্যন্ত। তাঁর পায়েই তো ফেলে দিয়েছি তোকে।

তুমি কি ব্রহ্মকে জেনেছ মা? আমার আচমকা জিজ্ঞাসা। শুনে মা যেন মকে যান–ব্ৰক্ষ? ব্রহ্মকে কি জানা যায় নাকি? জানতে পারে কেউ?

তুমি জেনেছ।

পাগল! জানলেও কি কেউ কাউকে তা জানাতে পারে? ব্ৰক্ষকে কেউ মুখের থেকে বের করতে পেরেছে কখনো? ব্রঙ্ক অনুচ্ছিষ্ট বলেননি ঠাকুর? কী পড়লি তবে সেই কথামৃতে? ব্রহ্মকে মুখের থেকে বার করা যায় না, নিজে তার স্বাদ পেলেও অমৃততুল্য সে সোয়াদ ভার কাউকে দিতে পারে না কেউ কখনো…

হ্যাঁ পারে। ব্রহ্ম কী তা জানিনে, তবে তার সোয়াদ অপরকে দেওয়া যায় জানি। রিনি একদিন দিয়েছিল আমাকে।

রিনি? তাই নাকি? কী রকমের ব্রহ্ম শুনি তত একবার? কেমন তার সোয়াদ?

সন্দেশ। আমি জানাই। রিনির মুখের থেকে বের করা অমৃত অংশটুকু উহ্য রেখে, ব্রহ্মস্বাদের পনের আনাই বাদ দিয়ে মুখ্য খববের, না, খাবাবের এক আনাটাক ব্যক্ত করি।

সন্দেশ! সন্দেশই বুঝি তোর কাছে ব্ৰহ্ম রে? ব্রহ্মস্বাদ সহোদর ঐ সন্দেশ? বটে বটে? হাসতে থাকেন মা–তবে সেই সন্দেশ নিজে না খেয়ে পিঁপড়েদের খাওয়াতে যাস কেন? তাদের গর্তে-গর্তে রেখে আসিস যে?

সব ভালো জিনিসই সবাইকে দিয়ে খেতে হয়, তুমিই তো বলেছ মা! বিলিয়ে না দিলে ভগবান মিলিয়ে দেন না। এমন কি, তোমার এই প্যাঁচটাকেও আমি অনেক ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছি। সবাই মিলে মা দুর্গাকে জব্দ করুক না। আমি একাই কেন মজা লুটি! তারাও ভগবানের সাহায্যে উৎরে যাক–কার্যোদ্ধার করুক। তোমার ঠাকুর বলেছেন না?…

কী বলেছেন ঠাকুর?

বলেছেন গুরুর মত হাঁড়ি কলসিকেও বাজাতে হবে, নাকি, আঁড়ি কলসির মত গুরুকেও বাজিয়ে নিতে হবে? ভগবানের চেয়ে তো গুরুতর আর কিছু নেই। তাই হাঁড়ি কলসির মতই ভগবানকেও আমি বাজাতে লেগেছি। চাই কি, ভগবানের এই হাঁড়ি হাটেও একদিন

আমি ভাঙতে পারি হয়ত।

সে কি রে।

তাই। ভগবানকে আমি কাজে লাগাতে চাই না। যে ভগবান আমাদের নিত্যকার কাজে লাগবে না, সে-ভগবানে আমাদের কী কাজ মা?

.

১৩.

ভগবানকে কাজে লাগাবি কি রে! ভগবানের কাজে লাগবি তো। আমার কথায় মা হতভম্ব হন। ভগবানের কাজের জন্যেই আমরা এসেছি তো…তার সেবার জন্যেই।

ভগবানের সেবার জন্যেই সবাই? আমি শুধাই: তাঁর সেবা করা ছাড়া আর আমাদের নিজেদের কোনো কাজ নেই?

আবার কী কাজ? তাঁর সেবা তাঁর উপাসনা করাটাই তো মস্ত কাজ। তা ছাড়া আর সমস্ত কাজ? সেবা করাটা আবার কি রকম? উপাসনা কাকে বলে?

উপাসনা মানে তাঁর কাছে বসে থাকা, তাঁর কাছে বসে তাঁর কথা শোনা, তাঁর নামগান। করে তাকে শোনানো।

আর সেবা মানে তো গিয়ে ভোগ দেওয়া? তাই না মা? আমাদের নিজেদেরকেই কি ভোগ দেব তাকে? নাকি, নিজেদের যত ভোগ…? যত না কর্মভোগ…?

সেবা বল পূজা বল ভালোবাসা বল–তাঁকে ভালোবাসার জন্যই আমাদের জন্মানো। তিনি যে ভালোবাসার ধন।

ভগবানকে ভালোবাসব কী মা? তাঁর কথায় আমিও কম অবাক হইনে : ভগবানকে কি ভালোবাসা যায়? যার ধারণাই করতে পারিনে তাকে আমরা ভালোবাসব কি করে?

ভালবাসা যায় না ভগবানকে?

একটা পিঁপড়ে কি একটা হাতিকে ভালোবাসতে পারে? হাতী যে কী, তা তো সে টের পায় না কোনদিন। তার গায়ে হেঁটে চলে বেড়ালেও, তার পায়ের তলায় চাপা পড়লেও নয়। হাতি ও পিঁপড়ের ঠাওর পায় কি না কে জানে!

পায় না? তুই বলছিস?

হাতীর পক্ষেও একটা পিঁপড়েকে ভালোবাসা অসম্ভব। আর পিপত্রে ভালোবাসা পেতে হলে, কি পিঁপড়েকে ভালোবাসতে হলে তোমার হাতাঁকে ওই পিঁপড়ে হয়েই জন্মাতে হবে আমার মনে হয়।

তাই তো জন্মায় রে। ভগবান মানুষ হয়ে জন্মান তো সেই জন্যেই। তাঁর অবতার হওয়া তো সেই হেতুই।

তাই কল মা। তিনি মানুষ হয়ে জন্মেছেন…জন্মাচ্ছেন…আমাদের ভালোবাসা পাবার লালসায়। আমি তো সেই কথাই কইছি মা। …ভগবানকে ভালোবাসাই যায় না। মানুষকেই কেবল ভালোবাসা যায়, কারণ মানুষকে আমরা বুঝতে পারি, তার ভালোবাসাও টের পাই আমরা।

একই কথা। মানুষকে ভালোবাসাও সেই ভগবানকেই ভালোবাসা।

আর, মানুষের ভালোবাসাও সেই ভগবানেরই ভালোবাসা–তাই বলছ তো? আমি হাঁফ ছাড়ি : আর রিনির ভালোবাসা আমার কাছে তাই ভগবানের ভালোবাসাই।

কী বললি? মা চকিত হন।–কার ভালোবাসা বললি?

বলছিলাম যে এই জন্যেই আমরা ভগবানের ভালোবাসার কাছে ঋণী। মানুষের এই ভালোবাসার জন্যেই। এবং তাঁরও এত কষ্ট করে মানুষ হয়ে জন্মে মানুষের মারফতে অন্য মানুষকে ভলোবাসার জন্যে এমন দুঃখ পোহানো–এই ত্যাগস্বীকার–তার জন্য আমরা ঋণী নই কি?

ঋণী বই কি। আর তিনিও তো আমাদের ভলোবাসার স্বাদ পাবার জন্যেই মানুষ হয়ে জন্মান। এই কারণেই তো তাঁর অবতার হওয়া।

অবতার না হয়েও তো তিনি তার মানুষ হয়ে জন্মেছেন–জন্মাচ্ছেন এখনো, যত খুশি তোমরা ভালোবাসো না! যাকে খুশি তাকে। তাই না মা? আমি বলি-কিন্তু আমরা মানুষকে না ভালোবেসে তাঁকে ভালোবাসতে গিয়ে তাঁর সেই স্বাদে বাদ সাধছি কেবল। তাই নয় কি মা?

মানুষকে ভালোবাসলেও সেই তাঁকেই ভালোবাসা হয় রে। মা বলেন, আর ভগবানকে ভালোবাসাও … .ঠাকুর বলেছেন …

অত ঘুরে আমার নাক দেখতে যাব কেন মা? নাকের সামনেই তো মানুষ। সোজাসুজি মানুষকেই ভালোবাসব …মানে রিনিকেই মানে কিনা, যার ভালোবাসায় আমি ঋণী…যার কাছে ভালোবাসার স্বাদ পেলাম প্রথম, সেই মানুষকেই।

ঠাকুরের কথাটা হোলো…

তোমার ঠাকুর যাই বলুন না মা, তাঁর কথায় আমি বাধা দিই-ঠাকুরের বিবেকানন্দ কিন্তু কোনোখানেও ভগবানকে ভালোবাসার কথা বলেননি, মানুষকেই ভালোবাসতে বলেছেন। পড়লাম তো কতো বই-ই তাঁর, কিন্তু কোথাও না। ভগবানকে ভালোবাসবার কথাই নেই।

বলেননি তিনি কোথাও?

কোথায়! তিনি তো বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, বলে আমি তকনি বিবেকানন্দ আওড়াতে যাই।

কোথায় পেলি বিবেকানন্দের বই? পড়লি কবে?

আমার জীব বার করার আগেই মার বাধা পাই। নিজীবের ন্যায় বলি-কলিগায়। কোনা-দার ভারতীভবন লাইব্রেরীর থেকে নিয়ে। তাঁর পাঠাগারে কতো রকমের বই আছে যে! বিবেকানন্দের বই, অশ্বিনী দত্তের ভক্তিযোগ, এমনি সব ভালো ভালো বই। যতো কর্মবীরদের জীবনী। মানে সেই সব বই যা পড়লে নাকি মানুষ হওয়া যায়…গল্পের বই নয়, প্রবন্ধের বই যতো। সেখান থেকেই নিয়ে পড়েছি আমি।

বিবেকানন্দের কথাটা তুই বুঝিসনি ঠিক। ভগবানকে না ভালোবাসলে মানুষকে ঠিক ভালোবাসা যায় না।

ভগবানকে তো ভালোই বাসা যায় না মা!…..ভগবানকে ভালোবেসে কোনো সুখ নেই।

সুখ নেই? বলিস কি রে তুই? ভগবানকে ভালোবাসলে তোর মানুষের ভালোবাসার চাইতে সহস্রগুণে সুখ, তা জানিস? ঠাকুর বলেছেন …

তোমার ঠাকুর যাই বলুন না মা, তাঁর কথায় আর কাজে কোন মিল নেই–আমি বলব। ভগবানকে ভালোবেসেই যদি এত সুখ তবে তিনি শুধু তাই নিয়ে না থেকে মানুষকে ভালোবাসতে গেলেন কেন আবার? তিনি তো মা কালীকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেনও হমুদ্দ, তবে তিনি তাঁর ভালোবাসাতেই তৃপ্ত না হয়ে বিবেকানন্দকে নিয়ে মত্ত হতে গেলেন কেন? মা কালীতেই না মশগুল থেকে তাঁর কাছে নরেনকে এনে দাও, নরেনকে এনে দাও বলে কান্নাকাটি লাগিয়েছিলেন কেন? নরেনতো একটা বাচ্চা ছেলেই তখন। প্রায় আমার মতই হবে। আমি জানাই : মা কালীতেও তাঁর আশ মিটলো না। তাই তাকে পাবার পরেও একটা ছেলের জন্যে তিনি পাগল হলেন শেষটায়।

মা কালীর জন্যেও কি তিনি বালিতে মুখ ঘষেননি একদিন?

তা ঘষেছিলেন। কিন্তু বালিবধের পর হনুমানকে নিয়েই মজে গেলেন তো সেই। সুরেশ সমাজপতির মতন তাঁর সমালোচনা আমার। তার আগের জন্মে যেমনটা ঘটেছিল প্রায় তেমনটাই।

আগের জন্মের…হনুমানকে নিয়ে মজলেন। মা ঠাওর পান না ঠিক।

মজলেন না? যিনি রাম যিনি কৃষ্ণ তিনিই তো সেই রামকৃষ্ণ? তাহলে যিনিই বিবেকানন্দ তিনিই সেই হনুমান। আমার অনুমান ব্যক্ত করি, অবশ্যি আমার মতন হনুমান না, আমাকে তুমি যে হনুমান বলল সে হনুমান নয়, আমার ন্যায় দুর্বল নয়, হনুমানের মহাবীর সংস্করণ। মানে, বলছিলাম কি, আমার ব্যাখ্যা প্রকাশ করি-হনুমান যেমন সমুদ্রমন করেছিলেন, বিবেকানন্দও তেমনি কি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে একালের স্বর্ণলঙ্কা আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার রাক্ষসদের তাক লাগিয়ে দেননি? হনুমান যেমন শ্রীরামের বাহ্ন, বিবেকানন্দও তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের বাহন তো? তাঁর ভাবধারা বহন করে নিয়ে গেছলেন সেখানে। আসলে এটাকে–এই ক্রিশ্চান মুলুকে গিয়ে তোলপাড় করাটাকে আমি তাঁর লঙ্কাকান্ড বানোই বলব মা। তোমার ঠাকুর যেমন কুরুক্ষেত্র কান্ড বাধিয়েছিলেন তাঁর আগের জন্মে কৃষ্ণষ্ঠাকুর হয়ে…যিনি রাম যিনি কৃষ্ণ তিনিই শ্রী…

তোর কথা শুনলে আমার মাথা ধরে। গোঁজামিলের কথা রাখ তো। এলোমেলো কথা যত তোর। এসব কথা থাক, তোর বইখাতা নিয়ে আয় দেখি। পড়াশোনাটা কেমন হচ্ছে দেখা যাক একবার।

খাতাপত্তর নিয়ে আসি সব। উলটে-পালটে দেখে মা বলেন-অঙ্কের খাতাটা কই? দেখছি না তো এর ভেতরে।

বলেছি না তোমায়? মাতৃ অঙ্ক ছাড়া আর অন্য কিছু আমি জানি না। অঙ্কট একদম আসে না আমার।

তাহলেও খাতা একটা থাকবে তো? গেল কোথায়?

কাবিলের কাছে আছে। বলেছি না, আমার বন্ধু মহম্মদ কাবিল হোসেন আমার খাতায় প্রতিদিনের আঁকগুলো সব উতরে দেয়, তাই সে খাতাটা ইস্কুল থেকে নিয়ে যায়, পরদিন আবার নিয়ে আসে ইস্কুলে ঠিকঠাক করে। আমার আকে খাতার মোকাবিলা সে-ই করে।

দেখি তোর কম্পোজিশনের খাতা তবে। ট্রান্সলেশনের খাতাটা দেখি।

ওই তো আছে। তোমার সামনেই তো।

এসব কী লিখে রেখেছিস খায়?

দ্যাখো না।

গদ্যপদ্যের ছড়াছড়ি দেখছি। এসব কী আবার? কিসের মহাভারত?

মহাভারত নয়, রামায়ণ।

রামায়ণ! মা যেন আকাশ থেকে আছাড় খান।

পড়ে দ্যাখো না, কেমন আমি রামায়ণ লিখলাম।

রামপেসাদী কাভ বাধিয়েছিস যে? তিনি যেমন হিসেবের খাতায় মায়ের গান ফেদে ছিলেন, দে মা আমায় তবিলদারি-র গান বেঁধে রেখেছিলেন, তুইও তাই করেছিস দেখছি।

শিবপ্রসাদের ছেলে হয়ে সেটা কি খুব বেহিসেবী হয়েছে মা? বাবা তো পদ্যটদ্য লেখেন, বইও ছাপিয়েছেন সেই সব নিয়ে, আমিও প কৃত্তিবাসের তহবিল তছরূপ করেছি মা। কৃত্তিবাসের মতন আমিও রামায়ণ লিখছি একখানা।

দেখি তোর কান্ডটা। পাতাগুলোর ভেতর দিয়ে ওপর ওপর চোখ বুলিয়ে যান মা।

একটা কান্ড হয়নি এখনো। আমি জানাই : সাতকার সবটাই বাকী। মাঝে মাঝে লিখে গেছি খানিক খানিক। যখন যেখানটা আমার মনে ধরেছে লিখে রেখেছি। আরো আমি বিশদ করি- তবে সপ্ত কাভের শেষ কথাটি আমি লিখে রেখেছি আগেভাগেই।…এই যে! এই পাতাটায় দ্যাখো না!

মা দেখলেন, তার পরে শুরু করলেন সুর করে :

সুপণ্ডিত শিবরাম বিচক্ষণ কবি।
সপ্তকান্ডে গাহিলেন রামায়ণ সবি।।

আওড়াবার পর মার সে কী হাসি। মার এরকম হাসি, এমন উচ্চস্য এর আগে আমি কখনো শুনিনি।

হাসির চোটে আমি রীতিমতন চোট খাই। ঘাবড়েও যাই বেশ। অপ্রতিভের মতন কই-ভালো লাগল না বুঝি তোমার?

কিসসু হয়নি তোর। কৃত্তিবাসের কথাগুলোই উলটে পালটে বসিয়ে দিয়েছিস–তার লেখাই আরেক রকম করে সাজিয়েছিস। তাঁর পয়ারের ভেতর থেকেই মিল টেনে এনে মিলিয়ে দেওয়া কেবল। এই যেমন তোর শেষ ছত্রটাই ধর না– কৃত্তিবাসের রয়েছে-কৃত্তিবাস পন্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ-সপ্তকান্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ। তুমি বাপু, সেই কথাগুলোই ফের ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছ। ফের ফের তাই দেখছি আগাগোড়া।

আমার ফেরেববাজির কথায় আমার প্রাণে লাগে–কিচ্ছু হয়নি তুমি বলছ?

মার কথায় কান্না পায় আমার, বলতে কি! দেখাবো তোমায়?

কি করে হবে? সাধক না হলে কি এসব লেখা যায় রে? কৃত্তিবাস কাশীরাম–এঁরা মহাপুরুষ, মহাসাধক ছিলেন। মহাভক্ত তাঁরা, ভগবানের কৃপাতেই লিখেছেন, লিখতে পেরেছেন। নইলে কি লেখা যায় নাকি? তুই তা লিখবি কি করে?

তাহলে আমি বৈষ্ণব পদাবলীই লিখব না হয়! ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলি-তাও আমার বেশ আসে। আরেকটা খাতায় লিখেছি…দেখাবো তোমায়?

এইরকম তো হবে, তার দরকার নেই, দেখলে আমার হাসি পাবে আরো। না দেখেই হাসতে থাকেন মা : বৈষ্ণব পদাবলী তুই লিখলি কি করে? তোর বাবার পদাবলী সংগ্রহ পড়ে পড়ে?

না পড়লে কি লেখা যায় নাকি? নিজের সাফাই গাই : লেখাপড়া শিখতে হলে যেমন আগে লেখা তার পরে পড়া, আগে হাতেখড়ি অ-আ-ক-খ যতো লিখে লিখে মরি, তার পরে তো বইটই পড়ি? তেমনি লেখক হতে গেলে আগে পড়া তার পরে লেখা। তাই নয় কি? আমার তো তাই মনে হয় মা। আগে পরের লেখা না পড়লে কেমন করে লিখব? কী লিখব, কিরকম করে লিখব টের পাব কি করে?

কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলী কি তাই? পড়লেই কি লেখা যায় নাকি?…তুই কি বৈষ্ণব? কৃষ্ণে ভক্ত কি তুই? সাধন ভজন করেছিস কিচ্ছু কখনো? তা না হলে ওসব লেখার অধিকারী তুই নোস। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, ঐরা গুণী লোক, যেমন সাধক তেমনি ভক্ত, তাই ওই পদাবলী তাঁরা লিখতে পেরেছিলেন। তাঁদের ভক্তির বাধনে বাঁধা পড়েছিলেন ভগবান… যেমন সাধক তাঁরা তেমনি আবার মরমিয়া কবিও।

মরমিয়ার মর্ম তখন আমার মগজে না ঢুকলেও কথাটা আমার মর্মে লাগল বেশ।-তবে আর লিখে কী হবে! আমি যখন পিরবোই না তুমি বলছ। আমি কিন্তু মা, জয়দেবের মতন সমস্কৃত কবিতাও লিখব এঁচে রেখেছিলাম। মর্মান্তিক কথাটা না বলে পারলাম না।

জয়দেব! অ্যাঁ? বলিস কি রে? জয়দেব পড়েছিস নাকি তুই?

পড়ব না, কী মিষ্টি যে! বাবার আলমারিতেই তো রয়েছে-কুমারসম্ভব, শকুন্তলার সঙ্গে। পড়েছিও, বুঝেছিও। সমস্কৃত হলেও বোঝা যায় বেশ, বাংলার মতন সোজাই তো।

তাহলেই বোঝ। বুঝে দ্যাখ তাহলে। কত বড় ভক্ত হলে তবেই না অত বড় কবি হওয়া যায়। তাঁর ভক্তির টানে ভগবান নিজে এসে তাঁর কবিতায় অসমাপ্ত পদ স্বয়ং লিখে সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেছলেন, জানিস তো?

জানি বই কি। স্বরগরলখণ্ডনম মম শিরসি মণ্ডনম দেহি পদপল্লব মুদারম্‌!

আহা! আহা! মার আহাকার-ধ্বনি শোনা যায়।

রাধার মতন অমন আহামরি মেয়ে হলে তেমন পদপল্লবমুদারম করতে সকলেই পারে মা। এমন কি আমিও পারি। সত্যি কথা বলতে কি…

বলতে গিয়ে আমি চেপে যাই। রিনির পদপল্লব নিয়ে নিজের মাথায় না ধরলেও প্রায় তার কাছাকাছি এনে সেই উদারতা আমিও যে দেখেয়েছি সে কথা আর কই না। সে কথা ফাঁস করে নিজের ফাঁসির দড়ি কি কেউ গলায় পরে সাধ করে?

বড্ড পেকে গেছিস তুই! এই বয়সেই। তোর বাবাই তোর মাথাটা খেল-একটুও শাসন করে না তোকে। এমন অনাসক্ত সন্ন্যাসী মানুষকে নিয়ে কি সংসার করা পোয়!

তাহলে আর কী হবে? আমি তো কবি কি লেখক কিছুই হতে পারব না আর। আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে।

পারবি না কেন? তবে কিনা, পরের নকল করে তা হতে পারবিনে। পরের মত করে লিখলে কি হবে? তাহলে চলবে না, নিজের মত করে লিখতে হবে যে। পরের থেকে নিয়ে নয়, নিজের থেকেই হতে হবে তোকে। এই যেমন… মা আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে এক দৃষ্টান্ত নিয়ে আসেন-এই কবি রাজকৃষ্ণ রায়। রাজকৃষ্ণ রায়ের গ্রন্থাবলী পড়েছিস তুই? আছে তো আমাদের। তোর বাবার ঐ আলমারিতেই রয়েছে।

না, পড়িনি তো। এখনো পড়িনি। পড়ে দ্যাখ তো। বাল্মিকীর অনুসরণে তিনিও রামায়ণ লিখেছেন, নানা ছন্দের কবিতায় কিন্তু একেবারে নিজের মতন করে। সাত কাণ্ডের কোনোখানেও কবি কৃত্তিবাসের কোন

অনুকরণ করেননি। যদিও কৃত্তিবাস তাঁর ঢের আগেকার।

করেননি তিনি?

না। করলে তাঁর লেখা কিছুই হত না একেবারে। কিন্তু লিখেও যে কিছু হয়েছে তা নয়! হয়নি কেন জানিস? রামায়ণ বলে কথা! রামের ভজনা না করে শুধু বিদ্যাবুদ্ধির জোরে কি তা লেখা যায়? ভগবানের সাধক না হলে ভগবানের চরিত গাথা গাইবার ক্ষমতা হয় না, রচনাও করা যায় না। তুলসীদাস, কৃত্তিবাস শ্রীরামের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন-তাঁর কৃপাতেই ওই মহাকাব্য লিখতে পেরেছেন। কিন্তু রাজকৃষ্ণ রায় ভক্ত সাধক ছিলেন না তো; লিখলেন বটে রামায়ণ, ভালোই লিখলেন বটে, কিন্তু লিখেও কিছু হল না। তাঁর বই লোকসমাজে চালুই হল না মোটে। অথচ ভারতের ঘরে ঘরে রামচরিতমানস, কৃত্তিবাসী রামায়ণ। এতেই বুঝবি।

মার কথায় রাজকৃষ্ণ রায় নিয়ে বুঝতে বসলাম।

পড়ে দেখলাম চমৎকার লেখা। বিচিত্র ছন্দে রচিত, আশ্চর্য কবিতা সব। নতুন ধরনের মিল দিয়ে, আনকোরা লেখাই। কৃত্তিবাসের ধার-কাছ দিয়েও যায় না, আলাদা রকমের

লেখা, তাঁর চেয়ে আরো ভালো বলেই মনে হেলো, কিন্তু এমন করে লিখেও কিনা…এই। দশাএ-বই কেউ পড়ে না আজকাল? চলে না বাজারে?

কৃত্তিবাসী রামায়ণের পরে এসে লিখতে বসে রাজকৃষ্ণের অমন কীর্তি যদি বাসী হয়ে গিয়ে থাকে তো আমার এই অনাসৃষ্টির দশা কেমনটা দাঁড়াবে তাহলে?

ঘাবড়ে গেলাম বেশ। রাম জন্মাবার ষাট বছর আগে যেমন বাল্মীকির রামচরিত রচিত হয়েছিল, আমার বেলায় সব দিক খতিয়ে দেখে জন্মাবার আগেই আমার রামায়ণ খতম!

.

১৪.

সেই সাংবাদিক ভদ্রলোককে অনেকদিন পরে ফের দেখা গেল আমার ঘরের দোরগোড়ায়।

আইয়ে জনাব! আইয়ে! আসুন, আস্তাজ্ঞে হোক। বহুদিনের বাদ এলেন। তারপর তো আর দেখা পাইনি আপনার…

তাঁকে দেখে একটু সচকিতই হয়েছিলাম বলতে কি!

তাঁকেও যেন একটু চমকিতই দেখলাম-ওমা? একি! খেতে বসেছেন এই সাত সকালে?

সাত-সকাল কোথায়? এখন তো সাড়ে আট সকাল! একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছি। প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে সবে এসে বসেছি এই বিছানায়–ভাত দিয়ে গেল এক্ষুনি।

এক্ষুনি ভাত? এখন তো আপিসের বাবুরা ভাত খায়, খেয়ে আপিস যায় সব। আপনার তো আর আপিস-টাপিস নেই মশাই।

তা নেই, কিন্তু খিদে আছে। রাতভোর মোটেই কিছু খাইনি তো! সেই রাত নটায় যা খেয়েটেয়ে শুয়েছি…তার পরে এতক্ষণ ধরে তো একটানা উপোস। খিদে পাবে তার দোষ কি!…তাছাড়া…।

তাছাড়া?

তাছাড়া, এই মেসবাড়ির রান্না গরম গরম থাকতেই খেয়ে নেওয়া ভালো। নইলে সে আর মুখে উঠতে চায় না। সেই শুকনো ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত খেতে হলেই হয়েছে।

তা বটে। কিন্তু এই শোবার বিছানার ওপরেই খেতে বসেছেন?

ক্ষতি কী? কাজ তো আমার দুই, খাই আর শুই। এক জায়গাতেই হওয়াটা ভালো নয় কি? এইখানেই খেলাম, খেয়েটেয়ে শুয়ে পড়লাম এইখানেই… নিশ্চিন্তি।

খেয়েই শুয়ে পড়বেন নাকি? এইখেনেই? এখনই?

তাই তো করি মশাই! সারা রাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন ক্লান্ত হয়ে পড়ি যে কহতব্য নয়। ঘুম থেকে উঠে শরীরে বলাধানের হেতু একটুখানি খেতে হয়–কী আর খাব? তাই এই ভাত খাই। কিন্তু এই খাবার ব্যাপারটা! এও এমন পরিশ্রমসাধ্য কাজ যে আবার ক্লান্ত হয়ে পড়তে হয় তাইতেই। সেই ক্লান্তি দূর করতেই আবার ঘুম। ঘুমোতে হয় আমায়। শুয়ে পড়ি ফের তার পরেই।

খেয়েই শোয়া? তার চেয়ে শুয়ে শুয়ে খাওয়াটা সারলেই পারেন!

না ঘুমোলে ক্লান্তি যায় না। আর, খেয়েই এমন ঘুম পায় যে… আমি জানাই–এই খেয়ে নিয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে সেই দুপুরবেলায় উঠব…

সেই ক্লান্ত হয়ে উঠবেন তো আবার? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে?

সেই সময় আমার ভাগ্নে রুটি, মাছ, তরকারি ইত্যাদি নিয়ে আসবে তাদের বাড়ি থেকে খেয়েই শুয়ে পড়ব আবার।

আবার ঘুমোবেন?

না, আর ঘুমোব না। তখন একটু কাজটাজ-এই কাগজটাগজ পড়ব। অল্পবিস্তর কাজ করতে হয় সময় সময়। এই সময়টাই তাই করি।

তারপরে কী করেন?

বিকেলে আবার খাবার ব্যবস্থা। কী খাওয়া যায় তার ধান্দা দেখি। কাজু-টাজু বিস্কুট বিস্কুট, ভালোমন্দ যা নাগালে পাই, এই গালে দিই–

দিন-রাত যদি এমনি খালি খান আর ঘুমোন তাহলে লেখেন কখন? লেখেন-লেখেন কখন?

কেন, পরের দিন? আমার সপ্রশ্ন জবাব : পরের দিন তো পড়েই আছে। নেই কি, বলুন?

সে তো চিরদিনই পড়ে থাকে। কোনোদিনই তো আর সে আসে না।

আমার সবই পরের ভরসা মশাই। পরদিনের, পর জনের মানে, ঐ পরি জনের… পরাৎপরের।

পরকাল আপনার ঝরঝরে। হাসতে থাকেন ভদ্রলোক।

ধরেছেন ঠিক। একি, দাঁড়িয়ে রইলেন যে! বসুন। এই বিছানাতেই বসুন-ওপাশটায়। দেখছেন তো অতিথি অভ্যাগতর জন্যে আমার ঘরে কোনো টেবিল চেয়ার কিছু নেই।

সেবারেই দেখে গেছি। এর মধ্যে কোনো শ্রীবৃদ্ধি হয়নি দেখছি ঘরখানার।

বরং কিছু বিশ্রী বৃদ্ধি হয়েছে। জঞ্জাল-টঞ্জাল বেড়েছে আরো একটুখানি। যা গে-এখন বলুন তো কী খবর আপনার। নতুন খবরটবর কিছু আছে?

খবর তো আজকের কাগজে। সে তত আপনি বিছানায় পেতে ভাতের থালা রেখেছেন তার ওপর। দেখেননি কাগজ?

কই দেখলাম। দেখব দুপুরে। তবে এক কাজ করলে হোতো, খাবারটা থালায় না নিয়ে কাগজের ওপর খেলে হোতো-খাওয়াও চলত কাগজও পড়া চলত এক সঙ্গে। খবর আর খাবার একাধারে।

মন্দ হতো না। খেয়েদেয়ে আবার শুয়ে পড়তেন তার ওপরেই।

শুয়ে শুয়ে পড়াও চলত তার ওপর। …বলুন, এখন কী বার্তা নিয়ে এসেছেন এবার?

বলছি দাঁড়ান। কিন্তু তার আগে জানতে চাই আপনি সেবার আমায় ধোঁকা দিয়েছিলেন কেন মশাই?

ধোঁকা?

ধোঁকাই তো। আপনি বলেছিলেন যে ইস্কুল-কলেজের চৌকাঠ আপনি মাড়াননি। অথচ, আপনার এক প্রকাশকের কাছে আপনার খবর নিতে গিয়ে জানলাম আপনি নাকি দস্তুর মতন এম-এ পাশ!

এম-এ পাশ! কী সর্বনাশ! আকাশ থেকে পড়তে হয় আমায়-এমন তথ্য কে প্রকাশ করলেন? কিনি সেই প্রকাশক?

অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দিরের অমিয় চক্কোত্তি। এম-এ পাশ, তাও আবার ইংরেজিতে। লীলা মজুমদার আর আপনি এক বছরেই পাশ করেছেন, গেজেটে একসঙ্গে ছাপা রয়েছে আপনার নাম। অমিয়বাবু স্বচক্ষে দেখেছেন।

বটে?…কার লীলা কে জানে! আমি তো জানি ও-খেলা আমি কোনোদিন খেলিনি। ওই পরীক্ষা পরীক্ষা খেলা। ওদের মায়াপাশে না জড়িয়ে পাশ কাটিয়ে এসেছি চিরটা কাল। বলে একটু থেমে যোগ করি : সত্যি বলতে, আপনাকে বেশ ভয় করছে আমার। আপনি যখন আমার এম-এ আবিষ্কার করেছেন, কোনদিন হয়ত আবার আমার মেয়েও বার করে বসবেন।

করেইছি তো, কিন্তু সে কথা পরে। তবে একথা না বলে পারছি না যে, আপনি ভয়ঙ্কর মিথ্যেবাদী।

যা বলেছেন। একটা সত্যি কথা বললেন এতক্ষণে। গল্প লেখার সময় মিথ্যে লিখতে পারি আর কইতে গেলেই যত দোষ?…তবে হ্যাঁ, আমার ছোট ভাই শিবসত্য ইংরেজিতে ডিস্টিংকশন নিয়ে বি-এ পাশ করেছিল বটে। সে-ই পরে হয়ত এম-এ-টাও দিয়ে থাকতে পারে, আমার জানা নেই। তার নামের সঙ্গে আমার নামটা গুলিয়ে ফেলেননি তো অমিয় বাবু? গোড়ায় শিব আর শেষে চকরবরতি দেখেই আত্মহারা হয়েছেন, ভেতরের সত্যটা তলিয়ে দেখতে যাননি কো আর?

তা কি হতে পারে নাকি? এতদূর দৃষ্টিভ্রম?

অসম্ভব কী? তা না হলে ধরুন না…এই সহজ কথাটাই ধরুন। আমার ভাই যেকালে বি-এ পাশ করে ঘাটশিলা হাই স্কুলের হেডমাস্টার হতে পেরেছে সেকালে আমি এম-এ পাশ করলে, তা সে যে বিভাগেই করে থাকি না কেন, যে কোনো একটা মাস্টারি কি জুটিয়ে নিতে পারতুম না? নিদেন একটা সেকেন্ড মাস্টার হয়ে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে পারতুম না কি? এই থার্ড ক্লাস লেখক হতে যেতাম কোন্ দুঃখে? লেখক হতে কি ভালো লাগে কারো? অন্তত আমার তো লাগে না মশাই!

লেখত হতে চান না আপনি?

একদম না। এই দন্ডে যদি আমি হাজার দশেক টাকা পাই, তো আমার ছোটদের বইগুলোর একটা ট্রা বানিয়ে দিয়ে…ওগুলো তো আর আমার নয়, বাংলার ছেলেমেয়েদের সম্পত্তি…তার প্রকাশ ব্যবস্থাটা করে গঙ্গাস্নান করি গিয়ে আমি। তার পরে একেবারে তোবা তালাক দিয়ে এই লেখাটেখা সব ছেড়ে দিই বেবাক।

বলেন কি?

তাই বলি। কী যন্ত্রনার জীবন যে এই লেখক হওয়া-কী বলব। সাধ করে কি কেউ হতে চায়? নেহাৎ প্রাণের দায়-ও ছাড়া কিছু পারি না তাই। যাক্ গে, সে কথা থাক। এখন বলুন আপনার বার্তাটি কী? সেবার তো আমার কুলের কেচ্ছা নিয়ে এসেছিলেন।

এবার এসেছি আপনার উপকূলকাহিনী নিয়ে।

উপকূল! আবার আমায় হতচকিত হতে হয়।–সে আবার কী মশাই? উপকূল আবার কী?

উপকূল কাকে কয় জানেন না নাকি?

জানব না কেন? নদীর দুই উপকূল থাকে, সেই দুকূলের গভী বজায় রেখেই তাকে বইতে হয়… আমি বলি। আর সাধারণ লোকেরও দুটি কুল থাকে জানি। পিতৃকুল আর মাতৃকুল।

কিন্তু লেখক শিল্পীরা কি সাধারণ লোক? তাঁদের কি কেবল দুকুল হলেই পোয় মশাই?

তা বটে। দুকুলে শুধু সীতা শকুন্তলাকেই শোভা পেয়েছিল, লেখক-টেখকদের একাধিক কুল থাকতে পারে বটে। এতদ্বারা আপনি কি কোনো পরস্বৈপদী পরকীয়া ইঙ্গিত-টিঙ্গিত করছেন?

যা বলেছেন, তাই বটে। কলকাতার চারদিকে আপনার চারটে উপকুলের খবর পেয়েছি আমি… জানি না, তাঁরা আপনার বিবাহিত স্ত্রীও হতে পারেন…

কী সর্বনাশ! এতগুলি নারীর উপনায়ক হয়ত আমি হতে পারি কিন্তু তাদের ভর্তা হওয়া তো আমার পক্ষে অসম্ভব। নিজের ভরণপোষন করতেই আমার প্রাণ যায় তার ওপর এই কান্ড। এমনটা আমি করেছি আমার বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস হয় না?

না মশাই! এতগুলি মেয়েকে বিয়ে করব কি, কোনো মেয়েরই উপযুক্ত আমি নিজেকে জ্ঞান করিনি কখনো। ভেবে দেখলে এদেশের বেশির ভাগ মেয়েরই বেশ দুঃখের জীবন। এদের একটিকে অন্তত আমি সুখী করতে চেয়েছিলাম আমার জীবনে…

কাকে?

যে মেয়েটিকে আমি বিয়ে করিনি। আমার হাতে পড়ে বেচারী অহরহ যে কষ্ট পেত। তার থেকে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।

বিয়েও করেননি, উপটুপও নেই বলছেন। মেয়ের অভাব কখনো বোধ করেননি আপনি?

বরং উলটো। মেয়ের প্রভাবেই একেক সময় ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়তে হয়েছে আমায়। আমার বাবা ততটা বউ পছন্দ করে নয়, যতটা নাকি সাত শালী দেখে বিয়ে করেছিলেন শোনা যায়–রসিক ব্যক্তি ছিলেন নিশ্চয়। আমি স্বয়ং শালীবাহ হলেও তাইতেই পুষিয়ে গেছল আমার, বাবার উত্তরাধিকার-সূত্রে আমার সাত মাসির সৌজন্যে সাতাত্তরটি কাজিন– রত্ন লাভ করেছিলাম…

সাতাত্তর জন? বলেন কি মশাই?

গুণে গেঁথে দেখিনি অবশ্যি, তবে আমার আন্দাজ। তাছাড়া, আমার নিজের স্বোপার্জিত কাজিনও কিছু ছিল বইকি তার ভেতর…

স্বোপার্জিত কাজিন কী রকমটা?

মনে করুন বন্ধুর মাসে তো ঠিক মার মতই। নাকি তাকে আপনি অন্য কোনো উপমা দিতে চান? তাঁর মেয়েরা, মানে আমার বন্ধুর বোনদের তো. বোনই ধরতে হবে? নাকি

আপনি তাদের উপবোন বলবেন, শুনি?

আমি আর কী বলব।

উপবনই বলুন। কারণ সেখানে সেকালে ফলের কোনো আশা নেই, আকাঙ্ক্ষাও নেই কোনো-উপবনই বলা উচিত। তথায় ফুল ছেঁড়ারও অধিকার নেই আপনার, শুধু ওপর ওপর ঘ্রাণ নেওয়াই কেবল। একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকুগান শুনি গোছের আর কি।

কিন্তু তাতে কি আশ মেটে? কাউকে ষোলো আনা পাবার সাধ জাগেনি কখনো আপনার? কেবল ফুল শুঁকে কে কি দুঃখ যায়? ফল কী তাতে?

মা ফলেষু কদাচন। ষোলো আনার সাধ মেটাতে গেলে ষোলো আনাই যে বরবাদ হয়। যদি কোনো মেয়ের মোল আনা আপনি পেতে চান তো বিনিময়ে তাকে ষোলো আনাই দিতে হবে আপনার-তার চেয়ে এক আনা পেয়েই খুশি থাকা কি ভালো নয়? শত শত একানি পেলে মোটমাট কতখানি দাঁড়ায় ভেবে দেখুন একবার।

ভাবতে গিয়ে তিনি গুম হয়ে থাকেন। উপকূলের খবর নিয়ে এসে এখন বুঝি হিসেবের কূল পান না। এ কানার পাল্লায় পড়ে যোবা মেরে যান বোধ হয়। কিন্তু একটু পরেই তিনি গুমরে ওঠেন আবার

কিন্তু যাই বলুন না মশাই, কলকাতার চারদিকে আপনার যে চারজন রয়েছেন তাঁরা কখনই উপবন নন, তাঁরা আপনার…

উপস্ত্রী? তাই বলছেন তো! তাহলে বলি। বলে আমার পঞ্চ ম-কারের পঞ্চমটিকে ধরে টানি, তাহলেও আপনার হাওড়ার সেই মেয়েটির খবর জানা নেই যাকে নিয়ে আমি হাওয়া হয়েছিলাম একদিন…

তাই নাকি? জানি না তো।

জানবেন কি করে? আমি নিজেই জানতাম নাকি! খবরটা ধরা পড়ল হঠাৎ। আমার এক কিশোর বন্ধু একদিন বিবাহ রেজেস্ট্রি আপিসে গিয়ে খবরটা জেনে এসেছিল। তার এক দূর সম্পর্কের মাসির সঙ্গে আমার এক সুদূর সম্পর্কিত খুড়োর অসবর্ণ বিয়ের নোটিশ দিতে গিয়ে রেজেস্ট্রি আপিসে গিয়ে দেখে এসেছিল যে, সেখানকার নোটিশ বোর্ডে হাওড়ার কোন মেয়ের সঙ্গে এক শিবরাম চক্রবর্তীর বিয়ের নোটিশ রয়েছে। জানলাম তার কাছে-তারপর আমি তার সঙ্গে গিয়ে নিজের চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে এলাম।

দেখলেন আপনাদের বিয়ের নোটিশ?

দেখলাম বইকি! তারপর কিছুদিন বাদ একটু সময় সুযোগ পেতেই হাওড়ার ঠিকানাটায় গিয়ে সেই মেয়েটিকেইও দেখে এসেছি।

কী দেখলেন?

দেখতে নেহাৎ মন্দ নয়। তবে ভারী বিষণ্ণ চেহারা। তাহলেও তেমন মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হওয়া যায় মনে হোলো। কিন্তু বিয়ের সুখ তার কপালে সইলো না…তার বিষণ্ণতার কারণ জানা গেল…

বিধবা হয়ে গেল না কি? বিয়ের পর মারা গেল সেই লোকটা? মানে সেই শিবরাম–

তার চেয়েও খারাপ। পড়শীদের কাছে জানতে পেলাম বিয়ের পর লোকটা মেয়েটির গয়নাগাটি সব নিয়ে উধাও হয়েছে। তার কোনো পাত্তাই নেইকো আর।

তাই নাকি?

তাই তো বললেন, প্রতিবেশী সেই ভদ্রলোক। কে লোকটা, শুধাতে জানালেন কোথাকার কে এক লেখক মশাই এই শিবরাম চক্কোত্তি! গল্পটল্প লেখে-টেখে। বইটই আছে নাকি তার। তার লেখা পড়েই নাকি পটে গেছল মেয়েটা, পস্তাচ্ছে এখন। ফুসলে বিয়ে করে এখন তার যথাসর্বস্ব নিয়ে সে হাওয়া!

আপনারই কান্ড নাকি মশাই?

কে জানে! কোনো লেখকের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। তবে এতদিন আমি মেয়েদেরই অঘটন ঘটনপটিয়সী বলে জানতাম। তাদের ওপরেও যে পটীয়ান লোক থাকতে পারে সে ধারণা আমার ছিল না।

.

১৫.

আমি চারুদার মতন গল্প লিখিয়েই হব না হয়। মাকে আমি বলেছিলাম– কৃত্তিবাসের মত কবি নাই বা হলাম। সেও কিছু কম কীর্তি হবে না মা।

ছেলে-চারুর মত গল্প লিখবি তুই? বলিস কী রে?

পারব না লিখতে? চারুদার ভাতের জন্মকথা বইটা বিস্টুর কাছ থেকে নিয়ে পড়েছি চমৎকার! অমনতর লিখতে পারলেও তো মন্দ হয় না।

তুই কী লিখবি? ডালের জন্মকথা? হাসলো মা : চারুকে তো প্রবাসীর পাতায় পাতায় খি। তোকে তা হলে এরপর ডালে ডালে ঘুরতে দেখা যবে!

ঠাট্টা করছো মা? কেন, ডাল নিয়েও লেখা যায় না কি? ডালও তো কত রকমের হয়। ছোলার ডাল, কলাইয়ের ডাল, খেসারির ডাল, অড়হর ডাল, মুসুরির ডাল, মুগের ডাল…। ছোলা কলার থেকে শুরু করে মুগের ইস্তক ভাঁজতে লাগি।

জানি। ডালের আবার কত পালা, শাখা-প্রশাখা, কত কী! কিন্তু তার খোঁজখবর নিতেও ঢের পড়াশোনা করতে লাগে। চারুর মত বিদ্যা হয়েছে তোর? সে বি-এ পাশ। ডালপালার অতো শতো ফ্যাকরায় না গিয়ে বরং তোর বাপের মতন পদ্য লেখ না কেন!

হ্যাঁ, পদ্য লেখেন বটে বাবা। পয়ার, ত্রিপদী, চতুস্পদী-নানা আকারে, নানান ছন্দে বানানো ছোটখাট অনেক রকম পদ্য লিখেছেন বটে, নিজ ব্যয়ে বই করে ছাপিয়েছেনও সেসব আবার, কলকাতার থেকে ছাপিয়ে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন-তা, হাজারখানেক কপি তো হবেই। যে চায়, যে না চায় তাকেও, না চাইতেই বিনামূল্যে বিলিয়ে দিয়ে থাকেন। চাঁচোর আর আশপাশের গাঁয়ে তাঁর বই পেতে বাকি নেই কারও। কবি খ্যাতিও রটেছে নিশ্চয়ই।

নিজের নামেই নামকরণ করেছেন বইটার-শিবপ্রসাদ। নিজে তেমনটা না হলেও তাঁর বইটিকে তিনি স্বনামধন্য করে ছেড়েচেন।

বাবা বললে, সে কবিতাই বা কী আর সেই বনিতাই বা কীসের, পা ফেলার সাথে সাথেই যে হাতে হাতে তোমার মন না কেড়ে নেয়। বেড়ে কথা বলেছিলেন বাবা। পদ্যবিন্যাস মানে মন না মতে যয়া। কথাটার মর্ম বুঝতে আমার একটুকুও বিলম্ব হয়নি। কবিতার পদবিন্যাস কী তখন আমি তা ভালো করে জানি না, কিন্তু বনিতারটা জেনেছিলাম। রিনির পদক্যিাসের সঙ্গে কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দেখেছিলাম সত্যি বটে! বনিতা কাকে বলে কে জানে, কিন্তু অমন মেয়ে না হলে, যে তার পা দিয়েই সহজে যে কারো মন হাতিয়ে নিতে পারে-তার সঙ্গে ছাড়া আর বুঝি বনিয়ে চলা যায় না। আর কেউ তেমন বনবার নয়।

আমার সেই বাল্যকালে বাবার বইটা আমি কয়েক বারই তো পড়েছিলাম, কিন্তু এমনিই আমার বিস্মৃতি শক্তি, এতদিন পরে তার অতগুলো পদ্যর একটাও যদি আমার মনে থাকে।

কেবল তার একটা পদবিন্যাস আমার মনে আছে-যে পদ্যটা সত্যিই আমার মন ভুলিয়েছিল সেদিন। ভারী উপাদেয় পদ!

বাংলার নানান জায়গার কোথাকার কী খাদ্য, কোনখানের কোন খানা খাসা, তার সবিস্তার ফিরিস্তি তাঁর একটি পদ্যের কয়েকটি ছত্রে তিনি ধরে দিয়েছিলেন, তার মধ্যেকার সারাৎসার সেই লাইনটি

চাঁচোরের মানকি কলা সংসারের সার। এখনো আমার মর্মে মর্মে গাঁথা হয়ে রয়েছে। মনের লালায়িত রসে সজিভ হয়ে এখন।

স্বর্গীয় চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ের উদ্ভ্রান্ত প্রেমের (সেই কালেই আমার পড়া) আহা, কী করিয়া বলিব কেমন সেই মুখখানি-র বর্ণনার সঙ্গেই বর্ণে বর্ণে মিলিয়ে বুঝি সেই কলার তুলনা কর চলে। তেমন হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ কলা, মের্তমান জাতীয়ই হবে বোধ হয়, কিন্তু বর্তমানে বিরল) চাঁচোরের বাইরে আর কোথাও আমি পাইনি, খাইনিকো অন্য কোথাও। ফজলি যেমন মালদা জেলার বিশিষ্ট আম (গোপালভোগ, বৃন্দাবনা, ক্ষীরসাপাতি ইত্যাদি আরো সব থাকলেও) তেমনি ঐ মানিক কলা চাঁচোরেরই বিশেষ আমদানি। খানদানি পরিবাররাই খানদান- খান এবং দান করে থাকেন।

বাবার বইটির আরো ছত্র, আমার জন্ম কাহিনীর সঙ্গে জড়ানো বলেই বোধ করি, আমার স্মরণে রয়ে গেছে এখনো–

বঙ্গাব্দ তেরশ দশ প্রাতে রবিবার
সাতাশে অগ্রহায়ণ শিবের কুমার
শিবরাম জনমিল লীলাশ বাজাইল
শিবহৃদে উপজিল আনন্দ-অপার।

লীলাশঙ্খটা কী মা? শুধিয়েছিলাম আমি মাকে : রবিবাবুর কবিতায় লীলা কমলের মতই কোনো জিনিস-টিনিস নাকি? লীলাখেলা করবার?

না রে, তুই যখন জন্মালি না, জন্মানোর সময় শাঁখ বাজাতে হয় তো, তখন যে মেয়েটা তোর জন্মাবার সময় শাঁখ বাজিয়েছিল তার নাম ছিল লীলা। মা জানালেন আর জানিস, তুই যখন হলি না, সূয্যিঠাকুর উঠল ঠিক সেই সময়টায়-একসঙ্গেই এলি তোরা দুজনায়।

সূয্যিঠাকুরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এসেছিলাম বলছ না নিশ্চয়?

কে জানে! আর তুই জন্মেছিলি তোর দুহাত খুলে-সেটা একটা ভারি আশ্চয্যি ব্যাপার। আশ্চয্যি কিসের?

সব ছেলেই জন্মায় দু হাত মুঠো করে-তাই নিয়ম। তুই এসেছিলি একেবারে খোলা হাতে। নানা জনে নানান ব্যাখ্যা করেছিল তার।

কি রকম?

কেউ বলল, এ ছেলে এক নম্বরের উড়চন্ডী হবে, কিছু এর হাতে থাকবে না, কোনো জিনিস ধরে রাখতে পারবে না। কতজন কত কী বলল। তোর বাবা বলল যে, এ ছেলে কাউকে বাঁধবে না, কারো কাছে কোথাও বাঁধা পড়বে না। আমার ছেলে তো! আমার মতই হবে। জন্মসন্ন্যাসী। মুক্ত হাতে এসেছে, মুক্ত হতে যাবে-সর্বদা মুক্ত হও। মুক্ত পুরুষ। এই কথা বলতো তোর বাবা।

মুক্ত পুরষ! মুক্ত পুরুষ কী মা? আমি জানতে চাই; অগাধ সমুন্দরের ডুবুরি যারা, মুক্তো খোঁজে, শুক্তি খুঁজে বেড়ায়, তারাই কি? নাকি, যারা মুক্তি খোঁজে তারা?

যারা মুক্তো খোঁজে তারাও-যারা মুক্তি খোঁজে তারাও।

মুক্তো তো খুঁজতে হয় সমুদ্রের তলায় গিয়ে। আর মুক্তি তো খোঁজে মানুষ ভগবানের কাছেই-তাই না মা? ভগবানই তো মুক্তি দিতে পারে-তাই না? বইয়ে তো সেই কথাই বলে থাকে। আমি শুধাই : আমি যদি মুক্তি চাই তো ভগবানের কাছেই চাইতে হবে আমায়। তাই তো?

চাইতে পারিস। কিন্তু মুক্তিটা দিতে হবে তোকেই। ভগবানের তোকে মুক্তি দেওয়ার মানে হোলো, মানে তার অপর মানেটা, তোরই ভগবানকে মুক্তি দেওয়া অন্য কথায়।

তার মানে? মানে, ভগবান তোকে কী মুক্তি দেবে রে? তোর কাছ থেকেই তাঁকে নিজের মুক্তি নিতে হবে। তুই-ই মুক্তি দিবি ভগবানকে। তুই মুক্তি দিলে তবেই তিনি নিজের মুক্তি পাবেন। সেটা তোর মুক্তি বল বা উন্মুক্তি বল–যা খুশি।

খুলে বলল না মা! খোলসা করে কও?

মা তখন কথাটার খোলস ছাড়াতে লাগেন-যেমন ধর এই সূর্য। সূর্যর ভেতর দিয়ে ভগবান আলো হয়ে মুক্তি পাচ্ছেন, আলো বানিয়ে সূর্যই ভগবানকে মুক্তি দিচ্ছে একথাও তো বলা যায়। সূর্য তাঁর বাহন। বলা যায় যে, ভগবানই আলো হয়েছেন, কিন্তু সূর্যটি না হলে হতে পারতেন কী? সূর্যের যেমন ভগবানের দরকার নিজের আলোর জন্যে, তেমনি ভগবানেরও ঐ সূর্যটিকে চাই আবার। দুজনের না হলে দু-জনার চলে না।

এই জন্যেই কি দেবতাদের সব বাহন থাকে মা? মা দুর্গার যেমন সিংহ, সরস্বতীর যেমন কিনা হাঁস…। আমি ফাঁস করতে যাই।

বলতে পারিস। তা হলে দ্যাখ ভগবান যেমন তোকে মুক্তি দেবেন, তুইও তেমনি তাঁকে মুক্তি দিবি। কেবল নিজেকে নিয়ে কারো চলে কি রে? একক চেষ্টায় মুক্তি মেলে না, আরেক জনকে চাই। নইলে, ভগবান তো গোড়ায় একলাই ছিলেন আপনি, হাজারটা হতে গেলেন নে তবে? ওই জন্যেই তো। হাজার জনের ভেতর দিয়ে হাজার রকমের মুক্তির স্বাদ পাবেন–সেই জন্যেই না! হাজারটার মজাই আলাদা।

হাজা মজা যে বলে থাকে মা, তা বুঝি এই? আমি কই-ভগবান আমাদের হেজে মজে গেছেন?

তোর যতো সব উল্টোপাল্টা কথা! কোনোই তার মাথামুন্ডু নেই! কথার মাঝখানে বাধা পেয়ে মার ব্যাজার ভাব।–বড় হলে বুঝবি এসব।

না না, এখনই বুঝছি। এখনই বুঝব। তুমি বলে যাও। শুনছি তো আমি এই যে! কান খাড়া করে দেখাই।

তা হলে দাঁড়ালো কী? ভগবান যেমন তোর মুক্তিদাতা, তুইও তেমনি তাঁর মুক্তিদাতা– কিংবা উন্মুক্তিদাতাও বলতে পারিস। তোরা দুজনেই, যাকে বলে পরস্পরের পরিপূরক। গতিমুক্তি–আশা-ভরসা।

তাহলে আমি…আমিই তো…না, আমি ঠিক নই…মানুষই তো তাহলে বিধাতার চেয়ে বড়ো হয়ে গেল মা? অত বড় বিধাতাকে, ধারণাই করা যায় না যার, এই একটুকুন মানুষ মুক্তি দিচ্ছে?

হলই তো এক পক্ষে। তার সসীম দেহের ভেতর দিয়ে, তার আয়ুর গভকালের মধ্যে সেই অসীমকে, অখন্ডকে সবার কাছে নিয়ে…গভীর মাঝখানে ধরে বেঁধে ছেড়ে দিচ্ছে এনে…..একপক্ষে হলই তো সে। মুহুর্মুহু মৃত্যুর শিকার হয়েও সর্বদা ভগবানের অঙ্গীকার লাভে সে মহৎ।

আর সব মানুষের কথা থাক, বড় বড় মানুষের কথায় আমার কাজ নেই, আমায় বলল তুমি কী করে আমি মুক্তি পেতে পারি? কিংবা, তোমার কথামতন আমার ভগবানকে মুক্ত করতে পারি আমি? সেই কথাটাই বলো তুমি আমায়।

ভগবান প্রকাশ পান রূপে আর অপরূপে-মানুষের দেহ–সুষমা আর তার শিল্পকলার সৃষ্টি-মহিমায় তিনি ধরা দিয়েছেন। তুই যদি কবি হোস, তা হলে তোর কবিতাই হবে তাঁর মুক্তি, যদি দেখতে সুন্দর হোস, তবে তোর সেই, সৌন্দর্যেই তিনি উম্মুক্তি পাবেন। রকমটা এই আর কি! ভগবানের বাহন হতে হবে তোকে। কাউকে তিনি আপনার থেকেই নিজের বাহুন বেছে নিয়েছেন, কারু আবার তাঁকে যেচে তাঁর বাহন হতে হয়েছে। ঠাকুরকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন, বাণীরূপে তিনি মুক্তি পেয়েছেন সেখানে। আর রবিঠাকুরকে যেচে নিতে হয়েছে…নিজের কাব্যসাধনায় তাঁর সে অন্তরদেবতাইে তিনি উন্মুক্ত করেছেন।

বলে একটু থামেন মা–আর, তুই যদি নিজের চেষ্টায় কখনো খুব বড়লোক হোস, তাহলে তোর নিজের অর্থ অপরকে দিয়েই সেই ভগবানকেই তুই বিলিয়ে দিবি। তোর সেই দানই ভগবান তখন। সেই ভগবানের দান, ভগবানকেই দেওয়া–বুঝেছিস। মানে, যা পাবি…..রূপই হোক, শিল্পই হোক, অর্থই হোক, তা পেয়েই তোকে দিতে হবে-দিলেই তুই পাবি আবার। পেলেই দিবি, দিলেই পাবি–এমনি ধারা একটি মজার খেলা চলছে দুনিয়ায়।

দিলেও তেমনি কিছু পাওয়া যায় না রে! দিলেও তেমনি কিছুই পাওয়া যায় না–এটা একটা রহস্যই।

বুঝেছি মা। আমি যদি বড়লোক হই, তবে আমাকে পেয়ে পেয়ে দিতে হবে, যদি গাইয়ে ই তো গেয়ে গেয়ে দিতে হবে। নইলে সত্যিকারের পেয়েছি কি না, তা আমি টের পাব কি করে? তাই তুমি বলছ তো?

হ্যাঁ, তাই। নইলে, তোর লাখ টাকা মাটির তলায় পোতা থাকলে কার কী! তোরই বা কীসের! অন্য কেউ ভাগ পেল না বলে টাকাটা তোর ভাগ্যেও এল না।

আর যদি আমি কাউকে ভালোবাসি মা, তাহলে কিন্তু খালি দিয়ে গেলেই চলবে না, সেখানে আমায় দিয়ে দিয়ে পেতে হবে–যেমনটা কিনা পেয়ে পেয়ে দিতে হবে। তা নইলে ভলোবাসা হল কোথায়? তা তো কখনো একতরফা হয় না মা। সেখানে আমায় চেয়ে চেয়ে দিতে হবে, দিয়ে দিয়ে চাইতে হবে–তাই তো?

এই বয়েসে তোর এত ভালোবাসার ধান্দা কিসের রে? আমি যে তোকে এত ভালোবাসি আমি কি তোর ভালোবাসা চেয়েছি কখনো চাই কখনো?

তোমার ভালোবাসাই আলাদা। আমি জানাইঃ মার ভালোবাসার কি তুলনা হয় কারো সঙ্গে?

দুটো হাতই মুক্ত রাখতে হয়–পাবার আর দেবার। দেওয়ার আর নেওয়ার। মুক্ত হস্তে দিবি, মুক্ত হস্তে নিবি। আদান-প্রদান একই খেলার এদিক ওদিক। যেমন নিতে হয়, তেমনি দিতে হয়–নইলে, ভগবানের দান মেলে না। মনে কর না, বাইরে ভগবানের ঝড় বয়ে যাচছে, কিন্তু তোর ঘরের একদিকের একটি মাত্র জানালা খোলা রাখলে তার একটু হাওয়াও কি তুই পাবি?

একেবারে পাব না? বাইরে ঝড় বইলেও তার ঝাঁপটা লাগবে না আমার ঘরে? একটুখানিও না? আমি জানতে চাই।

একদিকের একটা জানালা খোলা থাকলে-মা বলেন, সেই হাওয়ার ছিটেফোঁটা হয়ত আসতে পারে তোর ঘরে–কিন্তু ঘরের দুধারের জানালা যদি খুলে রাখিস তো সেই ঝড় তোর ঘরের ভেতর দিয়ে হু হু করে বয়ে যাবে। তাঁর কৃপার জন্য দুটো দরজাই খোলা রাখতে হয়–আসার এবং যাবার।

তা হলেই তাঁর কৃপার পার পাওয়া যায় না-মার কথার ওপর আমার টিপ্পনি কাটি মার লকের ওপর আমার এক কাঠি।

বেশ বলেছিস। কেবল ভগবানের দিকে ওপনিং থাকলেই হবে না, মানুষের দিকটাও ওপন রাখতে হবে, নইলে ভগবান তোর বাতায়নে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবেন। ঈশ্বরের কাছ থেকে যা আমরা পাই তা আবার কড়ায় গন্ডায় আমাদের কিরিয়ে দিতে হয় তাঁকে–কিন্তু সরাসরি তাঁকে দেবো কি করে? তাই পৃথিবীকে দিয়েই তাঁকে দিতে হয়। মানুষকে দিলেই তিনি পান। নইলে পান না-পেতে পারেন না।

মানে, তাঁর দেওয়াটা একেবারে দান না? ধার দেওয়া কেবল? তার মধ্যে ফিরিয়ে দেবার কড়ার রয়েছে আবার? সুদ দেবার-শুধে দেবার কড়াকড়ি?

আছেই তো। কেবল যোগ করলেই হয় না তো, বিয়োগ করতেও হয়–তবেই কিনা অঙ্ক মেলে। যোগবলে কী পেলি বিয়োগ ফলেই তো তা টের পাবি রে। যোগবলের চেয়ে ঐ বিয়োগবল বড়ো-বুঝেছিস?

আর ই বিয়োগ ফলটাই শেষ ফল মা–তাই না? এত যোগবল আর যোগফলের পরেও শেষের তোমার ওই প্রাণ বিয়োগ। আমার দীর্ঘ নিশ্বাস।

মা থাকতে মৃত্যু কোথায়? আবার তিনি এমনি জন্ম দেবেন–ভয় কিসের?…তোকেও। দেবেন আমাকেও দেবেন।

তুমি তো বললে মা যে, ভগবানের কাছ থেকে যা আমরা পাই, তা আমাদের মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হয় আবার। বললে না তুমি? কিন্তু একটা জিনিস আছে মা, যা নাকি কাউকে চেষ্টা করে পেতে হয় না, কষ্ট করে দিতে হয় না। টাকাকড়ি পরকে দিতে গেলে সব দিক দেখতে হয়, এমন কি, তোমার ঐ ভালোবাসাও-কাউকে দিতে যাওয়া তেমন সোজা নয়কো মা। অনেক চেয়ে চেয়ে পেতে হয়–দিতে হয়।

জিনিসটা কী তোর–শুনি?

রূপ। ও তো যে পায়, এমনিতেই পায়, অমনিই পেয়ে থাকে। অপরকে দিতেও তাকে কোনো বেগ পেতে হয় না। যেমনি পাওয়া অমনি তার দেওয়া। না দিয়ে উপায় নেই তার-ঝরনা যেমন আপনার থেকেই সর্বক্ষণ ঝরছে।

রূপ তো ভগবানেরই বিভূতি রে। তাঁরই ঐশ্বর্য-যে পায় তার মতন ভাগ্যবান কে আর? সবাই কি তা পায়?

যেমন কিনা রিনি–মানে যে ঐ জিনিস পেয়েছে, সে তার কাছে ঋণী হয়েও সেই ঋণী নয়–তাকে আর কষ্ট করে পরকে দান করে তা শুধতে হয় না। সে দেখা দিলেই তার দেওয়া হয়ে যায়, তাকে দেখতে পেলেই পাওয়া হয়ে গেল আমার-দর্শন দান আর দর্শন লাভ যুগপৎ! আশ্চর্য নয় মা?

আশ্চর্য বই কি! পরমাশ্চর্যই। পরম ঐশ্বর্যও আবার। মা বলেন-রূপ তো ভগবানেরই প্রকাশ-সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ হয়েছেন।

অমনি আরেকটা জিনিসও আছে মা, যা নাকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া হয়ে যায়-খাওয়ার সাথে সাথেই খাওয়ানো। সেও কিছু কম আশ্চর্য নয় মা! মি বলি-তর চেয়ে বড় অবদান বিধাতার কিছু নেই অর

কিসের কথা বলছিস তুই? কিসের কথাই বলছি তো মা! বলতে গিয়ে আমি ঢোক গিলি-ওর বেশি আর বলি। সব কথা কি সবাইকে বলবার? গুহ্য কথা গুরুজনদের কাছে ব্যক্ত না করাই শ্রেয়ঃ। পূজ্যদের কাছে উহ্য রাখাই বিধেয়।

.

১৬.

তাহলে এই পটানো কাজটি আপনার নয় আপনি বলতে চান? জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক।

কী করে বলি? আপনার সম্বন্ধে কি সঠিক কখনো জানা যায়? নিজের রহস্য কি টের পায় কেউ? আপনার অন্ত মিলেছে কারো? সেই গুরু গোবিন্দর পর বলুন, পেয়েছি আমার শেষ–এমন গুরুতর কথা কটা লোক আর আওড়াতে পেরেছে? হাজার আত্মবিদ্ধ করেও আত্মবিদ্ধ হয় না মশাই! এই কথাই আমি কইতে চাই।

সোজাসুজি বলুন না গো! অত ঘোর প্যাঁচে যাচ্ছেন কেন!

কিন্তু সহজ কথা যায় কি বলা সহজে। আমাদের কর্মকান্ডর বিবরণ বিশদ করা কি সোজা? কটা কাজ আমরা প্রকাশ্যে করি–কতটাই বা আমাদের জ্ঞাতসারে হয়? প্রদীপ জ্বালার আগে যেমনটা সলতে পাকানো, অনেকটা তো আমাদের অন্তর্লোকের অবচেতনায় ঘটে থাকে। ক্রিয়াকলাপের বেশির ভাগই আমাদের অন্তরগত, লোকলোচনের অন্তর্গত হবার নয়।

এমন কাজ আপনি করতে পারেন বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস হয় না যথার্থ। আমারও। আবার অবিশ্বাস করতেও প্রাণ চায় না। এমনতর নিজের নৈপুণ্য মনে মনে আমি কল্পনা করেছি অনেক। পটনকর্ম তো একটা শিল্পকর্মই, মশিল্পও বলা যায়। পটনশিল্পী-পটশিল্পীর চেয়ে কিছু কম নন। আর, আমি কি এককালে (এই লিখিয়ে না হয়ে) পটুয়া হতেই চাইনি? চায় না কি লেখকরা? বিস্তর লেখালেখির পর রেখার হরিহরছত্রেও কি পটুতা দেখা যায়নি কারো কারো?

সুন্দরদের শুধু চিত্তপটে ধরে না রেখে (ক দিনই বা রাখা যায় অমন করে?) চিরদিনের

তরে চিত্রপটে বেঁধে রাখতে চাইনি কি?

দেখুন, এ বিষয়ে আমি সন্দেহবাদী, জনাবাহাদুরের প্রতি আমার জবাব : সব ব্যাপারের মত এখানেও আমার একটুখানি সংশয় আছে। আমার কী মনে হয় জানেন-হয়ত আমিই করেছিলাম এই কর্ম, কিংবা হয়ত…হয়ত বা আমার মন অন্য কোনো ব্যক্তি এই দুঙ্কা করে থাকতে পারেন। পটিয়সীদের ওপর পটিয়স হবার দক্ষতা আমার আছে জানলে স্বভাবতই আমার গর্ব হয়, কিন্তু কে জানে, আমার ওপরেও টেক্কা মারার মন আরও কোনো টেকচাঁদ ঠাকুর থাকতে পারেন। আমার চাইতেও বাহাদুর কেউ নেই কি আর?

তাহলে আপনার কোনো বল? আপনি বলতে চান অবিকল।

ঠিক ধরেছেন আপনি। আমার প্রবল সন্দেহ তাই। ফুরার হিটলারে যেমনটি ছিল বলে শোনা যায়-তারা বোধ হয় কখনো ফুরাবার নন। সুভাষচন্দ্রের নিরুদ্দেশের পর আমি একবার ওয়েলিংটন-ধর্মতলার মোড়ে কল্পতরু আয়ুর্বেদ ভবনে সুভাষচন্দ্রের মতন বজনি একজনকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেছলাম, পরে জানা গেল, উনি সেই গণনায়ক নন, কবিরাজ গণনাথ সেনেরই কে যেন হন। দেখেছিলেন নেতাজীর অন্তর্ধানের পরে? সত্যি?

তা বই কি। সেই রকম কেউ হয়ত আমার অনুরূপ ধারণ করে আমার ওপরে এই হটি করে যাচ্ছেন বারংবার–যদিও তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি ডেড হীট হয়নি এখনো অব্দি। তিনিই হয়ত আমার বিয়ের সাধটা মিটিয়ে গেছেন। আমার বংশরক্ষার শখও মিটিয়েছেন কি না কে জানে।…তাহলে তো আমার…..আমাদের উভয়েরই মৃত্যুর পর জলপিণ্ডির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

পুত্রপিণ্ডের প্রয়োজনেই ভার্যাবরণ করা হয়, শাস্ত্রে বলে। জানি।

যাঁ। আর পুত্রপিণ্ডের ভরণপোষণ, মানুষ করার দায় থেকে বেঁচে গিয়ে নিখরচায় যদি ঐ পুত্রপিন্ড, পুত্র আর পিণ্ড, আলাদা আলাদা, রঙ্গমঞ্চের নেপথ্যে কারো সৌজন্যে পাওয়া যায় মন্দ কি?

আপনি ভাগ্যবান। খেটে মরলো হাঁস, ডিম খেলো দাবোগাসাহেব।

তাই তো হয় মশাই, এক-একজনের বরাত অমনিধারা। বর না হয়েও কনে পায় তারা–ঘরের কোণেই মিলে যায় অবলীলায়। আমার কী মনে হয় জানেন? ঐ মহাপ্রভু। উনিই। আমায় কোনো মেয়ে দিয়েছেন কি না এখনো জানিনে, তবে আমায় ঐ এম-এ ডিগ্রীটা–আমার ধারণা, ওঁরই অবদান।

সেই লোকটার কাণ্ডই বলছেন?

সে ছাড়া কে আর? তিনিই অঙ্ক মিলিয়ে অতগুলো পরীক্ষা পাস করেছেন, আবার অঙ্কশায়িনী মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি–তাঁর দয়ায় কোনো দুঃখ অভাব নেই আর আমার।

দুঃখ ছিল নাকি কখনো?

ছিল না? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ দেখিনি, সেজন্য কেমন যেন একটা নিঃস্ব বোধ করতাম নিজেকে–বৌ নেই বলেই কি কম ক্ষোভ ছিল এককালে? তাঁর কৃপায় নাক গেল না, কিন্তু নরুন মিলল-কষ্ট করে পড়াশুনা করতে হল না, অবহেলায় ডিগ্রী জুটে গেল। সেকালে, জানেন, নামের পেছনে বি-এ, এম-এর লেজুড় লাগানোর রেওয়াজ ছিল বেজায়। একালে কেউ তেমন পোঁছে না, কিন্তু তখন এর যেমন বাজারদর তেমনি নাকি কদর। যাই হোক, এহেন দৌলত তাঁর দৌলতেই তো!

গাছে না উঠেই এক কাঁদি-কোনো কাদাকাঁদি না করেই। আমার কথায় তার সায় দেওয়া-আপনার ভাষায় প্রকাশ করলাম মশাই; মাপ করবেন। ব্যারামটা ছোঁয়াচে কি না।

হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীটা তাঁর সৌজন্যে হলেও, চুয়াল্লিশ ডিগ্রীটা পাওয়া স্রেফ আমার নিজের জন্যেই। সম্পূর্ণ আমার কুতে। বিলকুল স্বোপার্জিত। আমি জানাই।

চুয়াল্লিশ ডিগ্রীটা কী আবার? কোথাকার কলেজের?

আলিপুর জেলের। পাঁচ হাত লম্বা, হাত চারেক চওড়া ছোট ঘোট খুপরি-বাইশটা করে সারি সারি দু লাইনে সাজানো-খুনের আসামীদের ফাঁসি দেয়ার আগে আটক রাখা হয় সেখানে।

শুনেই তিনি চমকে উঠেছেন-ও বাবা! আপনি খুনও করেছিলেন আবার?

না। আমার তরুণ বয়সে কলকাতায় এসে এক যুগান্তকারী পত্রিকা প্রকাশের জন্য খুন। হয়েছিলাম। দেশবন্ধু দাশের অর্থ সাহায্যে আগেকার যুগের যুগান্তর পত্রিকাটার নবপর্যায়ে পুনরুজ্জীবন করেছিলাম। ফলে যা হবার। জেল হয়ে গেল। তখনকার কালে যাতে না পালাতে পারে, সে কারণে ওই রাজবন্দীদেরও রাখা হোতত সেই সব খাঁচায়। উপেন বাঁড়ুজ্যে বারীন ঘোষ উল্লাসকরের আত্মজীবনীতে নিশ্চয় ওর সবিশেষ বর্ণনা পেয়েছেন।

তাই বলুন। তিনি হাঁফ ছাড়লেন–আমি ভেবেছিলুম…

ভেবেছিলেন আমি সর্বগুণান্বিত, এমন কি ঐ খুনান্বিতও? না, মশাই না, হয়ত বা ইচ্ছে থাকলেও অদূর আমি এগুতে পারিনি। সাধ ছিল বটে, সাধ্য ছিল না–কবির ভাষায় বলা যায়। আমার দৌড় ওই মসজিদ অবদিছিঁচকে ব্যাপার-প্রাণ বাঁচানোর দায়ে-করা ছিঁচকেমি যত। ছিচকাঁদুনি আর গাইতে চাইনে। বাঁচতে হলে মানুষকে এক আধটু ক্রাইম করতেই হয়–অবশ্যি সবদিক বাঁচিয়ে আইনের দিকটাও-না হলে চলে না। আর বাঁচার মন বাঁচতে হলে সময় সময় কিছু কিছু সিন না করলেই নয়। এই আমার ধারণা। তবে বাঁচোয়া এই যে, তার অনেকখানিই আমরা মনে মনে সারি–বাহ্যত এবং কার্যত পারি না। বেশির ভাগই আন্তরিক উপভোগ। আমি যোগ করি : আর আসলে সুখ দুঃখ তো আমাদের মনেই মশাই! জন্মভূমির মতন আমাদের মনোভূমিও তো স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এবং স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। স্বপ্নসাধ আর স্মৃতিসুখ–এই নিয়েই তো আমাদের আধখানা বাঁচা। আদ্ধেক জীবন।

সমাজে বাস করে অপরাধপ্রবণ হওয়া উচিত নয়। তাঁর সুচিন্তিত অভিমত।–অপরের চেয়েও নিজের মনেই তার প্রতিক্রিয়া বেশি হয়।

তা তো বটেই। জানি, অপরাধ করলে একটা অপরাধবোধ সর্বদাই মনের মধ্যে খোঁচায়, তেমনি আবার কোনো কোনো অপরাধ না করলে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হয়। পস্তাতে হয় জীবনভোর।

জানি না ঠিক। এবার শুনি আপনার কারাবাসের কাহিনী। সময়টা খুব কষ্টের ছিল নিশ্চয়?

কষ্ট কিসের! অমন সুখের সময় আর আসেনি আমার জীবনে। আমার বিশ্বাস সহজে লোকে জেলে যেতে পারে না বলেই সাধ করে বিয়ে করে-ওই জেলে না যাওয়ার দুঃখ ঘোচাতেই। ওই জাতীয় একটা সুখের লোভে নিজের বাড়িতে জেলখানা এনে বানায়। হাতে পা শেকল বাঁধে।

তবে জেলখানাকে নরক ভোগ বলে কেন মশাই? আমার কথায় তিনি বেশ একটু অবাক হন।

ভিন্ন রুচির লোক হয়ে থাকে না? তাই হবে বোধহয়। জেলখানার বিচার তো জেলের খানা দিয়েই। প্রেসিডেন্সি কি আলিপুরের জেলে থাকতে-কানটায় ছিলাম জানিনে, তবে এটা বলতে পারি, যেখানেই এই চুয়াল্লিশ ডিগ্রী বিরাজিত সেইখানেই–খাওয়াটা ছিল একেবারে যাচ্ছেতাই। একটা জগাখিচুরির মতন খেতে হতো আমাদের নাম ছিল তার লপসি। সহজে গলা দিয়ে গলতে চাইত না। কিন্তু সেখানকার সেল থেকে বেরিয়ে বহরমপুরের জেলে গিয়ে যেন হাতে হাতে স্বর্গ পেলাম। সেখানকার খানাই ছিল আলাদা। মাথাপিছু তিন টাকা করে বাধা ছিল সবার–সেই টাকায় কী ইলাহী খাওয়া হোত যে। তা কহতব্য নয়।

বটে বটে?

সেখানে গিয়ে জে এল বাঁড়ুয্যে, নজরুল ইসলামের দেখা পেলাম। আলাপ হোলে কবি বিজয় চাটুজ্যে, বিপ্লবী বীর পূর্ণ দাসের সাথে। আরো কে কে যেন ছিলেন, মনে পড়ে না এখন-তাঁদের প্রত্যেকেই দিপাল। কাজী বলত, হোটবেলায়, সে নাকি কোথায় বাবুর্চির কাজ করেছে–সব রকমের রান্না জানে! প্রমাণ দেবার জন্যে সবার রান্নাটা সে-ই করত। আর কী খানাই যে বানাত কী বলব! বিরিয়ানি পোলাও থেকে শুরু করে চপ কাটলেট কোপ্তা কোর্মা কাবাব কারি–কাবাব আবার দুকিসিমের-শিক্ এবং নন-শিক্-কারিকুরি কত না!

রান্নাবান্না ছাড়া আর কিছু করত না কাজী?

আর গানে কবিতায় আবৃত্তিতে গল্পগুজবে আড্ডায় মাতিয়ে রাখত। এমন মজার মজার কথা কইত সে! অমন প্রাণোচ্ছল প্রদীপ্ত যুবক জীবনে আমি আর দেখিনি। খানাকুলের থেকে আমি কৃষ্ণাগরের দিকে এগোই–তার প্রেমের গান সেইখানেই শুনেছিলাম। তার বিদ্রোহের কবিতার পাশাপাশি দোলনচাঁপার কাহিনী! প্রেমের স্মৃতিচারণ তার অবিস্মরণীয় যতো গজল। সোজা গজালের মতন গিয়ে গেঁথে যায় মগজে।

বিদ্রোহের গানটান গাইতো না? গাইত না আবার! তার বিদ্রোহী কবিতাটার আবৃত্তি তার মুখে মুখে বার বার শুনলাম। আর বিপ্লবের যততা গান।কারার ঐ লৌহকপাট/ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট রক্তজমাট। শিকল পূজার পাষাণবেদী/ওরে ও পাগলা ঈশান/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/রক্তনিশান/উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি। মনে হয় এ-গানটা তার ঐ জেলেই বাঁধা। কী উল্লাসে গাইত যে।

আর কী করত কাজী?

তাছাড়া কবিগুরুর গানও গাইত একেক সময়। তার মুখে কবির ঋতু পর্যায়ের গানগুলো এমন ব্যঞ্জনা পেত যে বলা যায় না। তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে/ তুমি ধন্য ধন্য হে কবির এ গানটার এমন চমৎকার এক প্যারডি বেঁধেছিল সে। গেয়ে গেয়ে সেটা শুনিয়েছেও আমাদের।

গানটা কী শুনি।

আমি তো গাইতে পারব না, শোনাতে পারি–তোমারি জেলে/পালিছ ঠেলে/তুমি ধন্য ধন্য হে! / তোমারি অশন/তোমারি বসন/তুমি ধন্য ধন্য হে!

আপনারা বেশ আরামেই ছিলেন দেখা যাচ্ছে সেখানে। তবে জেলখানাকে এত মন্দ। জায়গা বলত কেন লোকে?

মন্দের ভালোটা তারা দেখতে পেত না তাই। ভালোর ভালো বলে এই দুনিয়ায় কিছু তো নাই। মন্দের ভালোই সত্যিকার ভালো। তাই নিয়েই খুশি থাকতে হয়। আমাদের কবিও কি সেই কথাই বলে যাননি? অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। সেই তো তোমার আলো/ সকল দ্বন্দ্ববিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভাললা/ সেই তত তোমার ভালো! বলেননি কি তিনি?

জেলখানাটা আপনার বরাতে দেখছি এক রাজঘোটক হয়ে গেছে।

নিশ্চয়। আমার স্বনামধন্য সেই ভদ্রলোক আমার হয়ে কষ্ট করে পাশ-টাশ করেছেন, বে-থাও করেছন, সেজন্যে আমার কোনোই ব্যথা নেই, কিন্তু কী ভাগ্যি, তিনি আমার হয়ে এই জেলটাও খাটেননি–তাহলে, সত্যিই! কী সর্বনাশ যে হতো আমার! এইসব অন্তরঙ্গদের সঙ্গসুখ পেতাম না। যথার্থই সর্বহারা হতাম। রাজযোটক তো বটেই। যত রাজাগজার সঙ্গে যোগাযোগ সেই সুযোগেই আমার ঘটল তো! আর সেই খানা! জেলখানার সেই খানা। আহামরি! কার সঙ্গে তার তুলনা করি। মনে পড়লে এখনো জিভে জল সরে। আমি নিজেকে যেন সজিভ বোধ করি আবার। আহা, তেমনটি আর জীবনে কখনো খাইনি।

কী বলেন যে!

আরে মশাই! এই চেহারা আমি ফিরিয়ে আনলাম সেই জেলের থেকেই। বলব না। আগে তো আমি এই কড়ে আঙুলটির মই টিঙটিঙে ছিলাম। কোনো ব্যায়াম ট্যায়াম সেরে নয়, টনিক-ফনিক মেরে না, জলবায়ুর হেরফেরেও নয়কো, সেই কড়ে আঙুলের ন্যায় চেহারা নিয়ে গিয়ে তেহারা হয়ে ফিরলাম। এই বুড়ো আঙুলের মত হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেরিয়ে এলাম বহরমপুরের সেই গারদ থেকেই। দেখছেন তো বেঁটেখাটো আমার এই প্রতীকচিহ্ন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সরকারকে আমার এই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চলে এলাম। আর, তারপর থেকে…।

তারপর থেকে?

তারপর থেকে জেলখানায় আর জেলের খানায় গড়া এই মোগলাই চেহারা একটুখানি টসকায়নি আমার। সেইরকমটিই রয়ে গেছে প্রায়। অ্যাদ্দিন বাদেও এখনো আমার সেই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠই দেখিয়ে বেড়াচ্ছি সবাইকে।

জবাবে কাজীর প্যারডির একটি পংক্তিই তিনি পুনরুচ্চারণ করলেন- তুমিই ধন্য ধন্য হে!

সত্যি বলতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুদ্রাযন্ত্র তার দুঃশাসনী কারাগারের নিষ্পেষণী খর্পর থেকে আমার এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার অদ্বিতীয় কৃতিত্বের জন্য নিজেকেই কি আমার ধন্যবাদ দেবার ইচ্ছে করে না একেক সময়?

.

১৭.

না বিইয়ে কানাইয়ের মা বলে না? বললেন ভদ্রলোক, আপনি দেখছি সেই রকম বিয়ে না করেই বলাইয়ের বাবা। বলাই বা বালাই যাই বলুন।

এ কথা বলছেন কেন? আমি শুধাই।

মানে, আপনার সেই হাওড়ার পরকীয়া গৃহিণীকে স্মরণ করেই কথাটা মনে পড়ল আমার। এতদিন তাঁর দৌলতে হয়ত আপনি অনেক ছাপোনার বাবা হয়ে বসেছেন …।

কিন্তু বালাই বলছেন কেন তাদের?

মেয়েরা ঘরের লক্ষ্মী হলেও ছেলেরা তো আপদ বালাই-ই। মায়ের কাছে তা না হলেও বাপের কাছে তো তাই বটে। ছেলেদের মানুষ করা যায় না যে। বেশির ভাগই তারা বাঁদর হয়ে যায়। সেই কারণেই।

বংশধররা বংশের ধারা রাখে কি না!

আদমপুর্বিক সেই ডারুইনের সূত্র ধরে তাদের হয়ে আমার সাফাই গাইতে হয়, মেয়েদের মনের মত করে গড়া গেলেও (এমনিতেই মেয়েরা মনের মত স্বভাবতই) ছেলেদের বেলায় সেটা একেবারেই খাটে না। তারা নিজের মতই হয়ে ওঠে। বাপের ধার ধারে না, ধারাও বজায় রাখে না। এই জন্যই কি বালাই? কিন্তু কোনো পুরুষেই তো বাপের ধার ধারেনি-পিতৃঋণ শোধ করতে চায়নি। পারেনি কেউ। আর মাতৃঋণ? মার ঋণ তো শোধ করাই যায় না। এবং……এবং মা তার বড় একটা প্রত্যাশাও রাখেন না। মা মা-ই। তার সঙ্গে কারো কি তুলনা হয়? আমি নিশ্বাস ফেলি-মার ঋণ কখনই আমরা শুধতে পারিনে। তাঁর কাছে আমরা চিরঋণী, আর তাই আমরা থাকতে চাই।

সে কথা তুলছি না। বলছিলাম হাওড়ার সেই আপনার পরকীয়া পত্নীটির খবর নিয়েছিলেন আর? ভদ্রলোক, মানে সেই ওরফে-টি নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন এর ভেতর, সুখে ঘরকন্না করছেন এতদিন।

অসম্ভব না। নানান অশ্বমেধের পর অনেক হৰ খেয়ে নিজের নিশ্চিত নীড়ে ফিরে এসে, রাজসুয়ের যোগ্য হয়ে রাজার মতই শুয়ে পড়েছেন এতদিনে আশা করি।

এবং আপনার আশাও পূর্ণ করেছেন আরো। আপনাকে পুত্র কন্যা খনে ধনী বা ঋনী যাহোক একটা করে আপনার সন্তান দুঃখও মোচন করে বসে আছেন আপনার সেই ওরফে বা বিকল্প–যাই বলুন।

অসম্ভব নয়। একালে আর সেই কল্পতরু তো নেই–এখন সবই বিকল্প–সব কিছুরই বিকল্প নিয়েই সুখী হতে হয় আমাদের। আমিও আমার সেই বিকল্পতরুর থেকে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ চতুর্বর্গ লাভ করলাম। এমনকি, পুত্রকন্যাও পেয়েছি নিশ্চয়। যাকে বলে মোক্ষম লাভ।

তাহলে আপনার সব দুঃখ দুর হয়েছে বলুন।

সুখ আরো যে, নিজে না হতে পারলেও আরেকজনকে আমি স্বনামধন্য করতে পেরেছি। সাহিত্য জগতে দ্বিত্ব লাভ না কালে দ্বিজত্বলাভ করা যায় না; তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, সুনীল গাঙ্গুলির দু নম্বর বেরিয়েছেন। যে কারণে তারাশঙ্করকে শ্ৰী-হীন হতে হল মশাই! বাকী দুজন কী করেছেন জানিনে। আমারও যে অমনি একজন আছেন জানলেও আনন্দ।

কিন্তু তিনি তো লেখেন না আর! লেখক তো নন?

হতে কতক্ষণ? লেখা এমন কি শক্ত কাজ? আর, আমার লেখা এমন উঁচু দরের অননুকরণীয় কিছু নয় যে কারো পক্ষে এ ধরনের লেখা কঠিন হবে। ইস্কুলের থার্ড ক্লাসের ছেলেরাও আমার স্টাইলে আমার চাইতে ঢের ভালো লেখে, আমি দেখেছি–অবলীলায় এমনটা লেখা যায়। কেবল আমার পক্ষে লিখতেই যা দারুণ পরিশ্রম হয় মশাই!

কই, আপনার নাম নিয়ে কাউকে ক্লিখতে তোদেখা যায়নি এ পর্যন্ত। তিনি শুধানঃ আপনার স্বনামধন্য সেই ভদ্রলোকের কোনো লেখা কি চোখে পড়েছে আপনার?

এখন অব্দি না! আমার মতন থার্ড ক্লাস লিখিয়ে হতে চান না বোধ হয়। কিংবা আমার মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছেন। আমি মরলেই তিনি কলম ধরবেন। আমি বিল হবার পরই তাঁর অবিরল হবে।

ভালোই আপনার। এও তো এক রকমের অমরত্বই।

নিশ্চয়ই। তাছাড়া, দেখছেন তো একালে অমর হওয়া শক্ত কত। নামজাদা লেখকরাও মারা যাবার পরই ডুবে যাচ্ছেন। পাঠকরা তাদের ভুলে যাচ্ছে একেবারে। সেকালে এক একটি প্রতিভা বহুদিন বাদ বাদ প্রদীপ্ত হতেন-তিনকাল ধরে প্রতিভূরূপে আলো বিলোনে অন্তত। এখন তো ঘন্টায় ঘন্টায় নতুন নতুন প্রদীপ জ্বলছে,-নিভেও যাচ্ছে তেমনি–এবং আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে দেশ। ভালোই তো বলতে গেলে।

তা বটে। তাহলেও মরবার পরে অমর হতে না পারলেও আপনি অন্তত ধারাবাহিক হতে পারবেন।

পারতাম, কিন্তু আর বোধ হয়এ আশা করা যায় না। আমার কী মনে হয় জানেন? উক্ত ভদ্রলোক বোধ হয় আর বেঁচে নেই।

কেন এমন আশঙ্কা আপনার?

আমি যদি তাঁকে মেরে ফেলে থাকি?…

অ্যাঁ? তাই নাকি? খুন করেছেন তাঁকে? তিনি, শিহরিত হন : আপনি বার বার পিলে চমকে দিচ্ছেন আমার। ঈর্ষাবশতই মেরেছেন বোধ হয়? কী করে মারলেন?

ট্রেন দিয়ে।

ট্রেন দিয়ে? চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন নীচেয়? অ্যাঁ?

না, না–তা নয় ঠিক।

তবে কী? ট্রেন দিয়ে কি কাউকে মারা যায় নাকি? তিনি একটু সন্দিগ্ধই : তবে হ্যাঁ, একজনকে খতম করার দায়ে ট্রেন উড়িয়ে দিয়ে অনেককে ঘায়েল করা যেতে পারে বটে।

মারা যায় না ট্রেন দিয়ে? কী যে বলেন! পাকিস্তান যদি লরী দিয়ে সাতজন বিদেশ ডিপ্লোমাটকে কাত করতে পারে তাহলে কি আমি ট্রেন দিয়ে একজনের মোলাকাত করতে পারব না–যদিও আমি তাদের মতন তেমনটা লড়িয়ে নই।

খুলে বলুন তো, শুনি আপনার কান্ডটা। কী করে খতম করলেন তাকে?

ক বছর আগেকার কথা। সেবার মহাষ্টমীতে বাড়ি থেকে বেরিয়েই দুর্ঘটনা ঘটল মহাষ্টমীতে যাত্রা নাস্তি বলে থাকে পাঁজিতে জানেন তো? আজকাল আমরা তা মানিনে, নিজের সুবিধেটাই দেখি। মহাষ্টমীতে পুজোর ভিড়টা কমে যায় বেশ-ট্রেন যাত্রা ঢের সহজ। তাই ওই দিনই আমি আমার মুল্লুকে যাই। সেবার হাওড়া স্টেশন থেকেই দুর্ঘটনার শুরু-প্ল্যাটফর্মে পৌঁছেই ট্রেনটা পেয়ে গেলাম। ধরতে পারলাম, চড়তে পারলাম কামরায়। আশ্চর্য ব্যাপার।

আশ্চয্য কিসের? দুর্ঘটনাই বা কোথায়?

বরাবর আমায় পরের ট্রেনে যেতে হয়–সিটি বুকিং-এ আগের থেকে টিকিট কেনা থাকলেও। যে ট্রেনের জন্যে মনে করে বেরুই, যে কারণেই হোক, সে ট্রেনটা নির্ঘাত ফেল করে বসি, তাকে আর ধরতেই পারি না। সেই কারণেই পরের গাড়িতে যেতে হয় আমায়……..তবে সবই তো পরের ট্রেন। সেদিক দিয়ে ধরলে, কোন্ ট্রেনটাই বা আমার নিজের বলতে পারি বলুন?

তা বটে! তিনি ঘাড় নাড়েন ট্রেন আর কবে কার! তারপর?

তারপর আর কি! সেই ট্রেনটাতে না যাবার জন্যেই দুর্ঘটনা ঘটল। ঘটল আবার সেই ট্রেনেই।

কোন্ ট্রেনে?

পরের ট্রেনে, যেটাতে আমার যাবার কথা অথচ আমি যেতে পারিনি। আগের ট্রেনটা পেয়ে তাতেই চেপে চলে গেছি। যথাসময়ে ঘাটশিলায় পৌঁছে খেয়েদেয়ে বিছানায় গড়াচ্ছি, এমন সময়ে সেই বিচ্ছিরি ব্যাপারটা ঘটল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই বিদঘুঁটে এক আওয়াজ এল–ঘাটশিলার অদূর থেকেই। সোরগোল উঠল ঘাটশিলার কাছেই নাকি এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে–বে-লাইন হয়ে উলটে গিয়েছে গাড়ি। পরের দিনের কাগজে বিস্তৃত খবর বেরুল-হতাহতের তালিকায় এক শিবরামের নাম।

অ্যাঁ? সে কী মশাই?

হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি। এই দুর্ঘটনার জন্যে আমিই সম্পূর্ণ দায়ী। না না, ঐ ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য না–আমি দায়ী মানে, আমার দোষেই ঐ ভদ্রলোক হতাহত হলেন কি না। আমি যদি পরের ট্রেনে আসতাম তো আমিই মারা যেতাম নির্ঘাৎ। এক বাড়িতে দুবার বজ্রাঘাত হয় না, এক লোককে দুবার কামড়ায় না সাপে-তেমনি এক সাথে দুজন শিব্রাম মারা পড়তে পারে না কখনো।

আপনার পক্ষে ভালোই তো সেটা। তিনি ঠিক ঠাহর পান না-এর ভেতর খারাপটা হলো কোনখানে?

সেই ভদ্রলোকের মারা যাওয়াটা খারাপ হলো না? একজন বিধবা হলো না সেজন্য? কয়েকজন পিতৃহারা হলো না কি? কিন্তু আমি মরলে কার কী যেত? কী ক্ষতি হতো কার? খতিয়ে আমি বলি–চিত্রগুপ্তের খাতায় এক শিব্রামের ট্রেন চক্রে মরবার কথা ছিল সেদিন, সেই খাতে আমায় মিলল না বলেই ওকে মেরে তাঁর খতিয়ানের হিসেব ঠিক রাখতে হলো। কাপুরুষের মতন আত্মরক্ষা করে তাঁর মৃত্যুর জন্য আমিই কি দায়ী নই? বলুন আপনি?

শুনে তিনি গুম হয়ে যান, কিছুক্ষণ তাঁর কথা সরে না। তার পরে তিনি গুমরে ওঠেন অত।

অদ্ভুত তা বটেই। আমাদের বেচে যাওয়াটাও অদ্ভুত, মারা পড়াটাও অদ্ভুত! সবচেয়ে অদ্ভুত আমাদের এই বেচে থাকাটা। মুহুর্মুহু মিরাকে। তাঁর কথায় আমার অক্ষরে অক্ষরে সায়।

খেয়েদেয়ে থালাতেই হাত ধুয়ে মুখ মুছে সকড়ি থালাবাটি গেলাস সব চৌকির নীচে নামিয়ে রেখেছিলাম- এবার আমি শুয়ে পড়ি, কী বলেন? শুয়ে শুয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করা যাক, কেমন?… আপনি পা তুলে ভালো করে বসুন। বাবু হয়ে বসুন বিছানার ওপর।

তা কি হয়! পায়ে ধুলো যে! ধুলো কিসের! আপনি জুতো পরে আসেননি কি? তাঁর পায়ের দিকে নজর দিই, এ কি? আপনার জুতো গেল কোথায়?

ঘরের বাইরে রেখে এসেছি। দরজার ও ধারে।

করছেন কী! খালি পায়ে এসেছেন এই নোরা ঘরে, অ্যাঁ? কেন? ঘরে কি আরো জুতো নেই নাকি? আমারই তোক জোড়া রয়েছে-ঘরময় ছড়ানো। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত-নিক্ষিপ্ত দেখছেন না? এটা তো ঠাকুরঘর নয় আর। জুতো পায়ে ঢুকতে কী হয়েছিল আপনার? জুতোর কি আবার জাতিভেদ শ্রেণীভেদ আছে নাকি?

না, তা নয়। তবে কারো ঘরে কি জুতো পরে ঢুকতে আছে?

অন্য ঘরের খবর রাখিনে, আমার ঘরে কিন্তু তাই নিয়ম। দেখছেন আমার ঘরে কতো ধুলো বালি আবর্জনা জমে রয়েছে। তিন যুগ আগে সেই কবে যে এই ঘরে ঢুকেছি তার পর আর এখানে ঝটপাট পড়েনি। ঝড়পোছ হয়নি কখনো। কে করবে ওসব বলুন? ও সব তত গৃহিণীর কাজ–গৃহিণী গৃহমুচ্যতে, বলে না? মুচ্যতে কিংবা মুচ্ছ্যতে যাই বলুন না।

কেন, বাসার চাকর-টাকর? বললে, বসিস দিলে, তারা কী ঝটপাট দিয়ে ধুলো ময়লা সব সাফ করে দেয় না।

কী হবে দিয়ে? তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে ঘরের ভেতরে পুঞ্জীভূত এই জঞ্জালের মধ্যে কত না জীবাণু জন্মেছে–কত না বোগজীবাণু! কী হবে ঝেটিয়ে তাদের উত্যক্ত করে? ঝাড়লেই তো তারা হাওয়ায় উড়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের নাকমুখের পথে সোজা গিয়ে শরীরে সেঁধুবে? কী দরকার তার? তার চেয়ে লেট দি স্লিপিং ডগস্লাই। আমার এই কথাই।

বেশ কথা। কিন্তু তাহলেও, দোরগোড়ায় একটা পাপোশ তো রাখতে পারেন? লোকে পা-টা মুছে ঢুকতে পারে ঘরে তাহলে।

আমিও সেটা ভেবেছি–রাখব একটা পাপোশ এবার। তবে দরজার বাইরে নয়, আমার ঘরের ভেতরেই রাখতে হবে পাপোশটা।

ঘরের ভেতরে কেন?

বাইরে রেখে কী হবে? বাইরেটা তো বেশ পরিষ্কার, দেখছেন না? রোজ সকালে জমাদারের ঝাড়ু পড়ে। ঘরের ভেতরেই তো যত ধুলোবালি আর জঞ্জাল। ঘরের মধ্যেই রাখতে হবে পাপোশটা–যখন কেউ এ ঘর থেকে বেরুবেন, বেশ করে নিজের পা-টা মুছে-টুছে বেরিয়ে যাবেন সেই পাপোশে।

.

১৮.  

পা তুলে গুটিয়ে বিছানার ওপরে ভালো করে বসুন না মশাই। বললাম আমি জনাব সাহেবকে ঘরের ধুলো বালি আপনার পায়ে লেগেছে বলেছেন? এক কাজ করুন না! আমার এই বিছানাতেই পা-টা মুছে নিন না হয়।

বিছানাতে পা মুছব? তিনি যেন অবাক হন।–বলছেন কী।

কোথায় মুছবেন আর? পাপোশ তো নেই আমার ঘরে? কী হয়েছে? আমিও তো তাই করি সর্বদাই।

বিছানাতে পা মোছেন নাকি?

বিছানাতেই কি আর? তা কি কেউ মোছে নাকি? চাদরের তলাতেই মুছি। চাদর তুলে কম্বলের গায়ে মুছে দিই। চাদর আমার ফিটফাট ধোপদুরস্ত। চাদরের তলায় কী আছে কে দেখতে যাচ্ছে বলুন? ওপরটা চাকচিকন হলেই হল। চাদরের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক। বিছানার কী! নিন, মুছুন।

চাদর তুলে আমার কম্বল শয্যা উন্মুক্ত করি।

আমার কোনো বিষয়াসক্তি নেই। বিছানাকে যে চাদর দিয়েছি সেই ঢের-তার বেশি আদর করা ঠিক হবে না। মাঝে মাঝে পা মুছি তাই–এই, জুতো-টুতো পরার আগে কিংবা বাইরে থেকে ফিরে এসে। মাঝে মাঝে পদাঘাত করতে হয় বিছানাকে–তবেই ব্যাটা দুরস্ত থাকে।

তিনি পা নিয়ে ইতস্তত করেন।

নইলে নাই পেলে বিছানা মাথায় উঠবে যে! অনেকে অবশ্যি বিছানাকে মাথায় করে রাখেন। ঝালর দেওয়া সুজনি টুজনি বিছিয়ে তার ওপর। আমার মতে, বিছানা হচ্ছে ঘুমোবার জন্যে, ঘুমটি হলেই হোলো। শান্তিতে ঘুম-নির্বিবাদ শান্তি। তার জন্যেই বিছানা। বিছানায় বিছা না থাকলেই হোলো। নেই আমার। কামড় বসাবার কেউ নেই। বিয়ে করিনি তো।

সারারাত বিছের কামড় সইতে পারবেন না বলেই নাকি?

আঁক-ফাঁকের দেমাক সয় না আমার। তার ভেতর মাথা গলাই না আমি। অঙ্ক মেলাতে পারতুম না বলে অঙ্কশায়িনীও মিলল না বোধহয়। ভালোই হোলো একরকম। বিছানাকে নাই দিতে হোলো না, বিছানাময়ীকেও নয়।

জীবনমন্থনের বিষভাগকে বাদ দিতে গিয়ে অমৃতের ভাগেও বঞ্চিত হলেন শেষটায়। জীবনটাই বিস্বাদ করলেন। আমার ভাষাতেই যেন তাঁর বিসংবাদ শুনি-ফাঁকি দিয়েছেন নিজেকেই। ফাঁকি পড়েছেন একেবারে।

সাধ্য কী! আমি বলি-ননচার অ্যাভর ভ্যাকুয়াম, বলে না? কোথায় ফাঁক রাখার যো আছে কি? প্রকৃতিই থাকতে দেয় না। ভগবান একেবারে ফাঁকি পড়তে দেন না কাউকেই। সব ফাঁক সবার ফাঁকই ভরাট করে দেন একেক সময়-ভগবানের প্রকৃতিই তাই।

বটে? তিনি জানতে চান তাহলে শয্যাসঙ্গিনীও ঘটে যায় একেক সময় বলছেন? ই বিয়ে না করলেও?

আমি কী বলব? আপনিই বলুন। এসব কথা কি কাউকে কখনো মুখে বলার? নিজের মনে নিজ গুণেই সমঝে নিতে হয়ে। তাবৎ ভাবের কথাই তো ভাববাচ্য মশাই!

তিনি যেন ভাবে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। কথা সরে না তাঁর। তারপর বলেন-আশ্চর্য কিছু নয়!

আশ্চর্য কী! কার কোথায় কখনো বা পুরুষকারের ফাঁকিতে পড়ে না নাকি?

আশ্চর্য কী! কার কোথায় কখন কীভাবে কোন অভাব মোন হয়ে যায় কেউ বলতে পারে? কখনো দৈবাৎ মেলে, কখনো বা পুরুষকারের দ্বারা লভ্য পুরস্কার। মোটের ওপর ভগবতীর রাজ্যে কেউ কদাপি ফাঁক যায় না–একেবারে ফাঁকিতে পড়ে না কেউ। কালী কল্পতরু, কালও আবার তাই। কালক্রমে মেলে সব, মিলে যায় তাবৎ, জানেন নাকি?

কী জানি?

কী জানবেন আর! জানবার কী আছে! ভগবানের অপার রহস্য, কিছু কি তার জানা যায়? নিন, পা তুলে ভালো হয়ে বসুন তো! নইলে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না।…শুতে পারছি না বলে শান্তি পাচ্ছিনে।

পড়ুন না শুয়ে। কে আটকাচ্ছে?

আপনাকে ওই প্রায়োপবেশনে রেখে কি শোয়া যায় মশাই? ভদ্রতায় বাধে যে? সঙ্গে সঙ্গে আমার অনুযোগ : লেখকা যদিও ঠিক ভদ্র নন কখনো-তাহলেও চক্ষুলজ্জা বলে একটা আছে তো।

ভদ্রলোক আমার উপরোধে ঢেকি গেলার মতন সসঙ্কোচে চাদরের এক ধারটা তোলেন এ তো কম্বল দেখছি কেবল। দুখানা কম্বল। এই আপনার বিছানা! তোষক–টোষক নেই?

পাবো কোথায়? কে দেবে? জেলখানার দৌলতে পাওয়া ওই কম্বল দুটোই দুনিয়ার সম্বল আমার।

অ্যাঁ? কী বললেন? জেলখানার কম্বল?

হ্যাঁ। চুয়াল্লিশ ডিগ্রীর অবদান। সেখানে হাজত বাসের সময় ও দুখানা দিয়েছিল–একটা পাতার জন্যে আর একটা গায়ে দেবার। তারপর আদালতে কারাদণ্ড হবার পর সেখান থেকে বহরমপুরের জেলে চালান যাবার কাছে ওদুটো নিতে হহলো-শীতকাল ছিল কিনা তখন! প্রহরী আর কম্বল–পরিবেষ্টিত পৌঁছলাম বহরমপুরে গিয়ে। কম্বল নিয়েই ঢুকলাম সেখানকার গারদে।

তারপর?

সেখান থেকে খালাসের সময় আমায় বললে যে, তোমার যা জিনিসপত্র আছে, যা যা সঙ্গে এনেছিলে নিয়ে যেতে পারো। নিজের বলতে ওই কম্বল দুখানাই ছিল। নিয়ে এলাম সমভিব্যাহারে। বাধা দিলে না কেউ। ব্যবহারে লাগিয়েছি এখন।

পলিটিক্যাল আসামী বলে হৃক্ষেপ করেনি কেউ। সেইজন্যেই আনতে পেরেছেন।

আনন্দবাবুও সেই কথাই বললেন…

আনন্দবাবুটি কে?

এই বাড়ির মালিক। আনন্দমোহন সাহা। তাঁর এই বাসায় তিনিই তো ঠাই দিয়েছিলেন আমায়। দুঃখের বিষয়, এখন আর বেঁচে নেই। সস্ত্রীক স্বত। আহা, তাঁরা বেঁচে থাকতে কতো ভালোমন্দ খেয়েছি যে! পায়েস পিষ্টক ভুনিখিচুড়ি-ভূরি ভূরি খেয়েছি। খিচুড়িটা ঠিক পোলাওয়ের মতই খেতে-প্রায়ই আসত তাঁদের বাড়ি থেকে। আর পায়েস। আহা, সে কী পায়েস! আয়েস করে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার মতন। খাসা চাল, দুধে নয়, ক্ষীরের মধ্যে সেদ্ধ করা আগাগোড়া। তেমনটি আর হয় না। আজকাল কোথাও খেতে পাই না আর। আনন্দ বিয়োগে ততটা নয়, ওই পায়েসের শোকেই আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল–আমার জীবনের আনন্দ তিনি নিয়ে গেছেন। সেই আনন্দবাবুই এই কম্বল দেখে বললেন, আরে ভাই! করেছো কী! জেলখানার মাল নিয়ে এসেছে! কেউ দেখতে পেলে আর রকে থাকবে না–চুরির দায়ে ধরা পড়বে যে! হাতকড়া পড়বে। আর এবারকার জেলটা ঠিক বিরিয়ানি খাবার হবে না, হবে দস্তুর মতন ঘানি টানার।…সরিয়ে ফেল সরিয়ে ফেল এক্ষুনি।

বললেন তিনি। এই কথা বললেন?

হ্যাঁ। শুনেই না আমি সরিয়ে ফেলেছি তক্ষুনি। চাদরের তলায় চাপা দিয়েছি তাদের।

আর ঐ বালিশটা পেলেন কোথায়? নক্সাকাটা ওয়াড় দেয়া খাসা বালিশ তো? ওটাও কি জেলখানার নাকি?

না। ওটা আমার বোন পুতুল দিয়েছিল আমাকে। একদা সে এসে দেখল কি, আমার মাথাটা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে…

মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল? আপনার মাথা?

আহা, ওই হোলো। এই বিছানতেই গেল না হয়। গড়াগড়ি যাচ্ছিল তো ঠিকই। আর টাকা মাটি মাটি টাকা যদি হতে পারে তো বিছানার মাটি হতে বাধা কিসের? তাই না দেখে সে তক্ষুনি বেরিয়ে কোত্থেকে একটা বালিশ কিনে এনে উপহার দিল আমাকে। ওই বালিশটাই। সঙ্গে আবার ওয়াড় দিল খান দুয়েক। দুখানা কেন? শুধিয়েছিলাম তাকে। যাতে আমায় কাঁচাকাচির কাজে না যেতে হয় সেইজন্যেই দুখানা–একটা যোবা বাড়ি কাঁচতে যাবে, আরেকটা পরানো থাকবে। কাঁচাকাচির কাজ করলেও মেয়েরা কখনো কাঁচা কাজ করে না।

তাই বলুন! কিন্তু এই কম্বল শয্যার সঙ্গে ঐ উপাদেয় উপাধানের খাপ খাচ্ছে না ঠিক। কেমন বেখাপ্লাই ঠেকছে।

জেলের কি তার জিনিসের কোনো নিন্দে করবেন না আপনি আমার কাছে। আমি বলে দিই। তার দৌলতেই আমার এমন দেহলাভ আর এই দেহরক্ষার জন্যে এহেন শয্যা–তা জানেন?

জানলাম। কিন্তু এইটে আমি বুঝতে পারছিনে আপনার এমন সব বোন থাকতে তাঁরা কি এই ঘরটার ওপর একটু নজর দেন না? সাফসুফ করতে চাননি কখনো কেউ?

চাননি কি আর? বিনি ইতু পুতুল–যে এসেছে, ঘরের এই চেহারা দেখেছে, সে-ই এর হাবভাব বদলাতে চেয়েছে, কিন্তু দিচ্ছে কে হাত লাগাতে? বিনিকে নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক গল্প লিখেছি এককালে মানি, সে-সবের বিনিময়ে টাকাও পেয়েছি দাদার তা জানি, কিন্তু–তাই বলে দাদার লেখা বিকিয়েছে বলে তার মাথা কিনে নেয়নি, আমার কি আমার ঘরের ওপরে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তাকে দিইনি আমি। আর ইতু কি পুতুল এ-ঘরের জঞ্জালে হাত লাগাতেই না আমার সঙ্গে হাতাহাতি বাঁধার যোগাড়। যতই ইতুদেবীর পূজারী কি পৌত্তলিক আমি হই না কেন, আমার ব্যক্তি-স্বাধীনতায় কারো হস্তক্ষেপ আমি সইতে পারি না। ব্যক্তিত্বহানিতে আমি নারাজ। ব্যক্তিত্বই তো একজনের চরিত্র। চরিত্রহীন হতে চায় কে?

ঘর পরিষ্কারের সাথে ব্যক্তিত্বের, ব্যক্তি-স্বাধীনতার কী সম্পর্ক মশাই? তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না।

ঘর কি আমার ব্যক্তিত্বের অংশ নয় মশাই? আমার ঘরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বও কি জড়িত নয়? কী বলেন! আমার মনের রূপের বহিঃপ্রকাশ তো এই ঘর। খানিকটা অদ্ভুত নিশ্চয়ই। আমার অন্তঃকরণের পুঞ্জীভূত জঞ্জালের অভিব্যক্তি ছাড়া কী আর? সত্যি বলতে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সোফা সেট সাজানো পোশকী ঘরে লোফার আমি যেন ঠিক স্বস্তি পাইনে।

বুঝতে পেরেছি। এই হেতুই কোথায় আপনি হবেন এক বিরাট জমিদারি আর সাত মহলা বাড়ির সুসজ্জিত সাতষট্টিখানা ঘরের মালিক, খাটপালঙ্ক গদি সাজানো ঘর সব, তা না হয়ে. গদির কথায় তাঁকে গদ হয়ে উঠতে দেখি।

আর কোথায় এহেন এক ঘরের এই চৌকিদারি আমার। তাঁর বাক্যটা আমিই সম্পূর্ণ করি : অবশ্যি, সেই সাথে কয়েকটি চটিরও মালিক বটি।

চটি না বলে স্লিপার বলুন বরং।

স্লিপার তো আমিও কিছু কম নই। ওরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, আর আমি সর্বদা এই শয্যায় নিক্ষিপ্ত। তফাৎ এই, ওরা সব জোড়ায় জোড়ায়, আর আমার আদৌ কোনো জোড়া নেই। এ ঘরে নেই অন্তত।

সারা বাংলা মুলুকেই আপনার জোড়া নেই। কথাটা যেন তার ব্যাজস্তুতিচ্ছলেও বলা নয়।–তা জানি।

জুড়ি একজনা ছিল বটে–কিন্তু সে জুড়ি তো আমি হাঁকিয়ে দিয়েছি কোকালে। ঘাটশিলার রেলগাড়িতেই। বললাম না আপনাকে?

অন্য জুড়ি জুটলে এমনটা হতো না। বিয়ে করলে এভাবে থাকতে পারতেন না কিছুতেই। বোন না হয়ে বৌ হলে কি আর এসব আবর্জনা বরদাস্ত করত? দরকার হলে হাতাহাতি করেও সব জঞ্জাল সাফ করে ছাড়ত এক লহমায়।

তা হয়ত হতো, কিন্তু সেই জঞ্জাল সাফ হতো কি করে? আমার প্রশ্ন রাখি।

কোন জঞ্জাল?

সেই জঞ্জাল হটানো জঞ্জাল? তিনি আবার যে পুন্নাম নরক আমদানি করতেন-সেই সব?

স্ত্রীপুত্ররা সব জঞ্জাল নাকি আপনার কাছে? তাদের অবশ্যি মায়াজাল বলেছে বটে শাস্ত্রে, কিন্তু…তাহলে আপনার বোনরাও তো আপনার কাছে জঞ্জাল একরকম?

মোটেই না। আমার কাছে তারা সব নন্দন কানন। নন্দন অংশ বাদ দিলেও–সেই পারিজাত সৌন্দর্য-সুরভির সীমা নেই, তুলনা হয় না। বন উপবন যাই বলুন, সেসব ব্যক্তি-স্বাধীনতার হকারক নয়। স্বচ্ছন্দ বিচরণের স্থান। আস্তে আস্তে তারা সব ছেড়ে যায়, বেঁধে রাখে না, বাঁধা থাকে না। বন ক্রমেই গভীরত্র হয়ে নিছক রোদনের অরণ্যরূপে, কালক্রমে নিজে সংসারসমুদ্রে গিয়ে হারিয়ে যায়। তারা তো ছাড়ান দেয়, ছেড়ে যায় যথাসময়ে, কিন্তু বৌকে তো আর ছাড়ানো যায় না কিছুতেই। কখনই না।

দরকার কি তার?

সিন্ধুবাদের সেই গলগ্রহের ন্যায় সূতহিবুকযোগে লব্ধ গোধূলি লগ্নের উদ্বাহিত সেই ভার্যাকে ঘাড় থেকে আর নামানো যায় না যে! তারপরে শেষকালেতে মাথার রতন লেপটে রইলেন আঠার মতন! কবি ডি এল রায় একথা কেন বলে গেছেন কে জানে! যে জন্যেই বলুন, মোদ্দা কথা এই, তারপর সেই নাছোড়বান্দার নেহাৎ বান্দা হয়ে বন্দীদশায় যাবজ্জীবন কাটানো!

তাই বলছেন আপনি? বৌয়ের বিরুদ্ধে এই আপনার অভিযোগ!

আমি কেন বলব? বৌয়ের বিরূদ্ধে আমার কোনই অভিযোগ নেই। আমি জানাই : আমার আবার অভিযোগ কিসের! বিয়েই করিনি আমি। মাথা নেই তো মাথাব্যথা কিসের? কিন্তু যাঁরা করেছেন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যাঁদের, তাঁদের সেই ফাস্টহ্যাণ্ড নলেজের ফল গল্প-কাহিনীর ছলনায় তাঁদের আত্মচরিতেই ব্যক্ত হয়েছে। আমার বন্ধুরাই মুখে না বলে লিখে জানিয়ে গেছেন।

লিখে জানিয়েছেন? বলেন কি?

কেন, পড়েননি নাকি? কে যেন তার বৌকে কুয়াসার আড়ালে হারাতে চেয়েছিল অবশ্যি মেয়েটি হারায়নি শেষ পর্যন্ত। হারাবার কি হারবার পাত্র নয় মেয়েরা হারিয়ে না গিয়ে উলটে তারাই হারিয়ে দেয় আমাদের।…সেই কার যেন স্ত্রীকে শৃঙ্খলের মত বোধ হয়েছে, কে যেন আবার দেদার পাম্প করে দিয়ে স্টোভ ফেটে বৌয়ের অপঘাতের অপেক্ষায় বসেছিল–বিস্ফোরণের এক যাত্রায় সহধর্মিণীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়াও তার বাঞ্ছনীয় ছিল নাকি–পড়া নেই আপনার?

পড়ব না কেন? বিখ্যাত গল্প সব। কিন্তু আপনার লেখক বন্ধুদের একজনেরই তো গল্প এগুলো–আর কোনো বন্ধুর কেউ কি এরকম দুর্লক্ষণ দেখিয়েছেন? তার উল্লেখ করুন।

দরকার করে না, উনি একাই একশ। আমাদের সবার মুখপাত্র। গৌরবে বহুবচন-তাঁকে। নিয়েই আমাদের গৌরব। হাঁড়ির একটা চাল টিপলেই আর সবার হালচাল জানা যায়। তাঁর লেখাতেই আর সকলের টিপসই রয়ে গেছে। তবে একথা ঠিক, গল্পকথা হলেও এগুলি অল্প কথা নয়। এর মধ্যে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু।

কিন্তু শুনেছি তো, তাঁর মতন পত্নী-বৎসল নাকি হয় না…

ঠিকই শুনেছেন।…স্ত্রী না হলে একদণ্ডও চলে না ওঁর। বউকে ছেড়ে এমন কি আমেরিকায় গিয়েও উনি স্বস্তি পাননি–একদিনও তিষ্ঠোতে পারেননি সেখানে। সম্ভাবিত নোবেল প্রাইজ পাবার লোভ সংবরণ করে দুদিন বাদেই ন্যাড়া মাথায় নিজের সেই বেলতলাতেই ফিরে এসেছিলেন আবার।

কেন এলেন বলুন! তাহলেই বুঝবেন–স্ত্রী কী চীজ।

আসতেই হবে যে। আর সেই কারণেই তো আমার বলা–দাম্পত্য জীবনের পরিণতিতে দাসমলোভাব দাঁড়ায়, অন্য গতি থাকে না আর। হয়ত একটু আত্মতুষ্টির আবহ সৃষ্টি করলেও আত্মস্ফুর্তির পক্ষে ভয়াবহ। বউ কোনো বাড়াবাড়িতে যেতে দেয় না, স্বচ্ছন্দবিহার চলে না, বাড়িতেই বন্দী হয়ে থাকতে হয় সবসময়-অনিচ্ছায় বা স্বেচ্ছায়-কেচ্ছার ভয় আছে না? সেসব বালাই নেই ব্যাচিলারের। বউ অন্তরের আয়ের সব পথ বন্ধ করে দেয়–নিজের কাছে অন্তরীণ রাখে। এইজন্যেই সে ব্যক্তি-স্বাধীনতার অন্তরায়।

কিন্তু অসুখবিসুখে দেখাশোনা করবার…

যেমন সে, নানান আধিব্যাধি আমদানি করতেও তেমনি। বিবাহিত ব্যক্তির নানা অসুখবিসুখ তো লেগেই থাকে, কেন বলুন দেখি?

আপনিই বলুন না।

ঐ বউয়ের জন্যেই মশাই! বোগেই তো বোগ টানে। গোড়াকার বোগ ওই দারাই। দারারোগ দুরারোগ্যই। আবার ই বউয়ের হাতের সেবাসুখ পাবার লোভেই যতো না অসুখ! বউ এসে গায় মাথায় হাত বুলোবে, যত্নআত্তি করবে, তার মুখের আহা উঁহু শোনা যাবে সেইজন্যেই না! যার ঘরে বউ নেই তার কোনো ব্যায়োও নেই, অন্তত তেমনটা নেই এইজন্যেই।

আপনার অসুখবিসুখের সময় আপনি কি চান না আপনার প্রিয়জনরা কেউ এসে গায় মাথায় হাত বুলাক?

মাথায় থাক। অপর কেউ আমার গায় মাথায় হাত বুলোলে আমার গা জ্বালা করে– আমার মা ছাড়া আমার কপালে আর কারো করাঘাত আমি সইতে পারিনে-পাছে কেউ আমায় অসহায় অবস্থায় পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যায় সেই ভয়ে আমার কোনো অসুখই করে না কখনো। এই বছর পঞ্চাশ তো এই বাসায় কাটালাম, জিগ্যেস করুন না বাসার ঠাকুরকে, জানবেন একদিনের জন্যেও আমার কোনো মীল বাদ যায়নি। কোনো অসুখ করেনি কখনো। এমন কি একবার… কথাটা বলব কিনা আমি ভাবি একবার।

একবার? তিনি উসকে দেন আমায়।

একবার এ বাসায় ফুড পয়জন হয়েছিল অনেকদিন আগে। নৈশাহারের পরেই। পরদিন শুনি আগের রাত থেকেই বাথরুমে যাতায়াত শুরু হয়েছিল কারো কারো। পরের দিন সকালে উঠে বেরিয়ে গেছি, কিছু জানিনে, রাত্রিবেলায় ফিরে দেখি রান্নাঘর অন্ধকার। উনুনে আচটাচ পড়েনি, কী ব্যাপার? না, সারাদিন ধরে বাসাড়েরা কেউ বিশ পঁচিশ কেউ বা বাহান্নবার বিগলিত হয়েছেন–কেউ কেউ আবার হাসপাতালেও গেছেন নাকি। আমাদের। বাসার ওড়িয়া ঠাকুর-পরশুরাম পাঢ়ী–সে নাকি সন্ধ্যে পর্যন্ত সঠিক ছিল, কিন্তু তারপরে তাকেও এখন মুক্তকচ্ছ হতে হয়েছে। বাসার সবাই আজ ধারাবাহিক, তাই আজ রান্নাঘরে আঁচ পড়েনি, হাঁড়ি চাপেনি তাই।

বটে?

অথচ সেদিন সকালে যেখানে গেছলাম সেই বন্ধুর বাড়িতে বেদম খেয়েছি–খাবার লোভেই আমার যাবার গরজ তো-তারপরে বাসার ঐ নিরাহার চেহারা দেখে বেরিয়ে পড়তে হলো আবার। দেলখোস কবিনে গিয়ে গিলতে বসে গেলাম।

আপনার জীবনে কখনো কোনো অসুখবিসুখ করেনি তাহলে? এই কথাই বলতে চাইছেন আপনি?

করেছিল বইকি। একবার করেছিল। মোক্ষম অসুখ। প্রায় মোক্ষ প্রাপ্তির কাছাকাছি নিয়ে গেছল বলতে কি! এখানে সেখানে ভালোমন্দ খেয়ে না খেয়ে-বহুকালের ব্লডপ্রেসার তো আমার। দারুণ প্রেসার। তার দরুন একটু স্ট্রোক হয়েছিল হঠাৎ। ব্লাডপ্রেসার মানতাম না, ডাক্তারের মানাটানা না শুনে তার ওপরেও খেতাম–একটানা গিলে যেতাম-মাংস ডিম মাখন ক্রীম–তার ফলেই ওই দুর্ঘটনা! কিন্তু তারপরেই আমি সাবধান হয়ে গেছি খুব। কোথাও যাই না, গেলেও তেমনটা খাই না। কোনো কোনো সাহিত্যিক বন্ধুর জন্মদিনে বেজায় ঘটা করে যোড়শোপচারে খাওয়ানো হয়, সেখানে গেলে পাছে লোভ সামলাতে না পারি–তাই যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি, তাঁরাও বেঁচে গেছেন মনে হয়, কেননা কারো জীবনের শুভদিন অপর কারো শোকাবহ মৃত্যুদিন হয়ে জন্মোৎসবটা নষ্ট হোক, তারাও তা চান না নিশ্চয়। নিজ গুণে ক্ষমা করেছেন আমাকে।…

মুক্তারামের তক্তারামে শুয়ে-অচিন্ত্যবাবুর ভাষায়-শুক্তারাম খেয়ে সুখে রয়েছেন?

সর্বদা মার্কাস স্কোয়ারের দূর্বা-মথিত দুর্বার মুক্ত বায়ু সেবন করে-আমি জানাই-এই, সকালে খাই চারটি ভাত, কত কটি, চোখেই তো দেখলেন? দুপুরে বোনের বাড়ির থেকে আমার ভাগনের নিয়ে আসা একখানি রুটি, কয়েক টুকরো মাছ, একটু তরকারি আর রাত্রে খালি হরলিক। তার সঙ্গে হয়ত এক-আধটা বিস্কুট। তবু আমার রক্তের চাপল্য যায় না মশাই।

কখনো আপনার কোনো অসুখ হয়নি একথা আমার বিশ্বাস হয় না।

হয়নি কি? হয়েছে। ছেলেবেলাতেই হয়ে গেছে। কী অসুখটাই না ভুগেছি তখন–কত রকমের যে অসুখ! যত রকমের সুখ আর অসুখ আছে তার উপভোগ সেই অতি কৈশোরেই হয়ে গেছে আমার। সে সবের লিস্টি দিয়ে কী হবে? যেমন রোগা ছিলাম তখন, তেমনি রোগও ছিল কত না। কিন্তু সেও সেই মা এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। বিছানার পাশটিতে বসে থাকবে দিনরাত, সেই লোভেই তো! আর, ইস্কুলে যেতে হবে না, শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়া যাবে মজা করে–কী আনন্দ! সুখের জন্যই আমাদের যতো অসুখ, বুঝেছেন? আমার বক্তব্যের উপসংহার-তারপর সেই যে বাড়ির থেকে পালিয়ে তীরবেগে বেরিয়ে পড়লাম উদার পৃথিবীতে, তারপর থেকে আমার একটিও অসুখ করেনি কখনো। কার জন্যে করবে?

তা না হয় হলো, কিন্তু এখন আপনার এই বয়সে যদি হঠাৎ কোনো অসুখ বিসুখ করে, কোনো শক্ত অসুখই হয়, এখন তো যে কোনো সাধারণ অসুখই সহসা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। এখানে বাসার সবাই নিজের কাজ নিয়ে আপন ধান্দায় ব্যস্ত এই অবস্থায় একলাটি কী ব্যবস্থা হবে আপনার? বলুন দেখি?

কী হবে আর? মারা যাবো? এই না? তা বলে দৈনন্দিন মার খেয়ে মরতে হবে না তো? মারা যাবার সময় কারো ওই আহা-উঁহু শুনতে পেলাম আর নাই পেলাম। কী ক্ষতিবৃদ্ধি? তখন কি কারো ফোঁসফোঁসানি কানে যায়, না ভালো লাগে মশাই?, বিশেষ করে শুধু আমিই যখন মারা যাচ্ছি–আর কেউ মরছে না আমার সঙ্গে অন্তত, এই মুহূর্তে নয়–তখন আমার অন্তরের সেই হাহাকার তাদের ঐ আহাকারে কি থামবার? সেই কালে তাদের ওই সহানুভূতি আমার মরার ওপর খাঁড়ার ঘার মতই মনে হবে না কি?

কিন্তু আপনার যদি বৌ থাকত এ সময়–

রক্ষে করুন! সারা জীবন ধরে বৌয়ের অসুখ সামলাতে কে? তারা কিছু কি কম অসুখে ভোগে নাকি! তাদের অসুখের হামলা পোহাতে হোতত না দিনরাত? নিজের অসুখের দায় বরং সওয়া যায়, কিন্তু সেই বোঝার উপর বৌয়ের বিসুখের ঐ শাকের আঁটিটি-তার ঠ্যালা কি কম নাকি?

আরে মশাই, দিনরাত অসুখে ভুগবে কেন সে? দেখেশুনে স্বাস্থ্যবতী এক যুবতাঁকে বিয়ে করতে পারবেন না? পরীর মতন একটি বৌ হলে আপনার ঘর আলো করে থাকত নাকি? আপনার দেখাশোনাও করত সে?

সত্যি কথা বলব? পরীর মত মেয়ের কথা বলছেন? আমার জীবনে কোনো পরীর দ্বারাও আমি দৃষ্ট হতে চাইনি, অন্ততঃ এভাবে নয়, শুধু একটি মেয়ের দ্বারাই পরিদৃষ্ট হতে চেয়েছি।

কে সে মেয়েটি, জানতে পারি?

আমার মা।

তিনি তো কবে মারা গেছেন।

মা-রা কি কখনো মারা যাবার? তাঁরা চিরকাল বেঁচে থাকেন, থাকতে হয় তাঁদের। ছেলেকে দেখাশোনার জন্যেই, বুঝলেন? ছেলের মরণের পরও তাঁকে বাঁচতে হয় ছেলেকে কষ্ট করে পুনর্জন্ম দিতেই আবার। ছেলেকে নিজের গর্ভে ধারণ করতে হবে না? জন্মজন্মান্তরের মায়ের সেই ঋণ কি শোধ হবার কখনো? এ জন্মে না–কোনো জন্মেই নয়।

.

১৯.

মাকে একদিন আমি শুধিয়েছিলাম, মা, তুমি কি কখনো ঈশ্বরকে দেখেচ?

দূর খ্যাপা! ঈশ্বরকে দেখবি কি! ঈশ্বরকে কি দেখা যায়?

যায় না? বাঃ! তবে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেখতেন কি করে? আমি বলি–তিনি কি তাহলে মিথ্যে কথা বলেছেন?

না, মিথ্যে বলবেন কেন? তিনি নিজেকেই দেখতেন–নিজের মধ্যে নিজেকে। মা বললেন-ভগবানের কথা ভাবতে ভাবতে উনি নিজেই ভগবত্তা লাভ করেছিলেন। সেই যে, কাঁচপোকার কথা ভাবতে ভাবতে আরশোলা একদিন কাঁচপোকা হয়ে যায়–বলতেন না উনি?

ঈশ্বরপ্রাপ্তি, ঐশ্বর্যপ্রাপ্তি সব। যদি তিনি ধরা দিতেন না, তাঁর ঐশ্বর্য-বিভূতি ব্যবহার করতেন না কখনো।

নিজেকেই নিজে দেখতেন, তুমি বলছ মা, সেটা আবার কী রকম?

তুই যেমন আয়নায় নিজেকে দেখতে পাস না? সেই রকম আর কি! আত্মসমোহিত অবস্থায় চিত্তের আয়নায় আত্মসাক্ষাৎকার হতো তাঁর।.বুঝেছিস এবার?

না তো। কিছু বুঝলাম না।

আমার যদি সন্মোহনবিদ্যা জানা থাকত তাহলে তোক বুঝিয়ে দিতে পারতাম এখুনি–স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নিলোকে ঘুরিয়ে সব দেখিয়ে আনতাম তোকে…মা দুর্গাকে দেখতে পেতিস স্বচক্ষেই।

হিপটাইজম করে দেখাতে?

হ্যাঁ রে হ্যাঁ, সেদিন হিন্দু হোস্টেলের ম্যাজিক খেলায় সেই যাদুকরটা যেমন আকাশ থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি টাকা নোট সব বার করে আনছিল দেখিসনি? তোদের সবাইকে হিটাইজ করেই তো! সেই রকম, ধ্যানের সাহায্যে নিজেকে সম্মোহিত করার এক কায়দা আছে–একদিকে মন রেখে একটানা ধ্যান করে যেতে হয়, তার ফলে যা হয় তাকেই বলে সমাধি। উনি সমাধিস্থ অবস্থায় আত্মদর্শন করতেন।

তা হলেই আমার ভগবানকে দেখা হয়েছে। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম একটানা ধ্যানে বসব কি, একটুক্ষণের জন্যেও মনকে কোথাও আমি বসাতে পারিনে। ভগবানের কথা ভাবতে গেলেই যত রাজ্যের জিনিস আমার মগজে ভিড় করে আসে। কী করি আমি বল তো? ও ছাড়া কি ভগবানকে দেখবার কোনো শর্টকাট নেই? ইংরেজী মেইজির মই?

থাকবে না কেন? সব কিছুরই শর্টকাট আছে। বোম্ ভোলানাথ বলে গজায় কষে দম দিলে মুহূর্তের মধ্যে কৈলাসে শিবদুর্গার সান্নিধ্যে গিয়ে পৌঁছোনো যায়; সাধু-সন্নিসিরা তাই করে থাকেন শুনেছি, অমনি করে ইন্দ্রলোকে অপ্সরাদের নৃত্যগীত দেখেন–শোনন নাকি! তোর বাবা তো সন্ন্যাসী ছিলেন এক সময়, গাঁজাও খেতেন নাকি, তাঁকেই শুধাগে না!

শুধাবার দরকার কি? এখনো তো মাঝে মাঝে খান, আমায় লুকিয়ে। তাঁর খেয়ে রাখবার পর সেই ছিলিমটা নিয়ে একদিন না হয় টেনে দেখব লুকিয়ে-এক টান মাত্তর! দেখি না কী হয়!

এই মরেছে। তাহলে তোর সঙ্গে সঙ্গে কৈলাস প্রাপ্তি ঘটে যাবে। সেইখানেই থেকে যাবি-আমার কাছে ফিরে আসতে পারবি না আর। মহেশ্বরের কাছেই থাকতে হবে তারপরে-নন্দীভৃঙ্গির সাকরেদ হয়ে।

চাইনে আমার ভগবানকে তাহলে। আমার সাফ জবাব–তোমাকে ছেড়ে ভগবানকে চাচ্ছে কে? নন্দীভৃঙ্গির সাকরেদ হবার দায় পড়েছে আমার।

বাঁচালি বাপু! হাসলেন মা-তোর বাবা সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়ে গেছলেন, তুইও যদি আবার তাই করিস তা হলেই হয়েছে।

কী দুঃখে সন্ন্যাসী হব মা! ভগবানের খোঁজে? ভগবানের ওপর অতখানি টান নেই আমার। কলিগায় গৌরদা রামপদদাদের একটা আড্ডা আছে জানো মা? ভারী তর্কাতর্কি হয় সেখানে সব সময়। ভগবান আছে কি নেই–এই নিয়ে তর্ক যততা। আমি সেখানে বসি গিয়ে এক এক সময়। শুনি সব।

তাই নাকি?

কলিগাঁয় ফকির সরকারের বাড়ি থেকে বই আনতে যাই না? রামপদদাদের আড্ডাতেও– যাই তখন। কলিগাঁয় অতুল গোঁসাই আমাদের ক্লাসফ্রেন্ড-তাদের বাড়িতেই সেই আড্ডাটা! …গৌরদা কে হয় যেন তাদের। তাদের বাড়িতেই থাকে। আর, রামপদদা হচ্ছেন গৌর গোঁসাইয়ের বন্ধু!

তার চেয়ে বয়সে বড়ো বুঝি?

অনেক বড়ো। তিরিশ বত্রিশ বছর বয়েস হবে বোধ হয়। তারা বলে যে, তারা নাস্তিক, ঈশ্বর ধর্ম কিছু মানে না। ওসব কিছু নেই নাকি। মানা তো ভারী খারাপ, না মা?

কেন, খারাপ কিসের! মা একেবারে নির্বিকার না মানলে কী হয়? ভগবান রাগ করেন? না,না-হয়ে যান?

বয়সে তারা বড় হলেও আমি তাদের সঙ্গে তর্ক করতে যাই, কিন্তু পারি না কিছুতেই। তারা বলে, ঈশ্বর আছে যে তার প্রমাণ কোথায়? প্রমাণ দাও আগে। আমি কি করে প্রমাণ দেব? কিছুই তো জানি না আমি। তুমি বলে দাও না আমায়-ঈশ্বরকে কি প্রমাণ করা যায়? প্রমাণ আছে কোনো তার অস্তিত্বের?

আছে বই কি। প্রমাণও করা যায় নিশ্চয়।

কী প্রমাণ? আমি জানতে চাই–কী করে প্রমাণ করা যায়–বলে দাও না তুমি আমায়! ঈশ্বরের প্রমাণ বিন্দুমাত্র। মা জানান-বিন্দুমাত্রই প্রমাণ।

বিন্দুমাত্র প্রমাণ?

হ্যাঁ, বিন্দুর যেমন অস্তিত্বই শুধু সার, সেই রকম আর কি! তোর ঐ জ্যামিতি দিয়েই প্রমাণ করে দেওয়া যায় ভগবানকে। মা বিশদ হন–পয়েন্ট থেকে ইচ্ছে মতন রেডিয়া নিয়ে সার্কেল টানা যায় না? রেডিয়াস্ মাফিক কোনোটা বড়ো সার্কেল হয়, কোনটা বা ছোট সার্কেল? হয় না? সেই সার্কেলটাই হচ্ছে পয়েন্টের অস্তিত্বের প্রমাণ তখন। তাই না? পয়েন্ট একটা ছিল বলেই তো তার থেকে রেডিয়াসের সাহায্যে সার্কেল টানা গেল? তেমনি আমরাই হচ্ছি ভগবানের অস্তিত্বের প্রমাণ। আমরাই তাঁর সার্কেল, নিজগুণে তিনি টেনেছেন আমাদের-তাঁর সেই টান থেকে বেরুনো।

ভগবানের সার্কেল আমরা?

হ্যাঁ। কারো বা বড় সার্কেল কারো বা ছোট সার্কেল। কেউ বা সূর্য হয়েছে, কেউ বা শুধুই যুঁই। কেউ রবিঠাকুর, কেউ বা…কেউ বা তোর ওই রিনি! যার যেমন ব্যাস তার তেমনি বৃত্ত। সেই বিন্দুমাত্র ঈশ্বর আছে বলেই জগদ্ব্যাপী আমাদের অস্তিত্ব। ঈশ্বর আছে বলেই আমরা আছি। আমরা হয়েছি, আমরা হচ্ছি। আমরা স্ব।

তা না হয় হলাম, কিন্তু তাই বলে ঈশ্বরকে তোমার তো জানা যাচ্ছে না মা!

জানা যায় না, তবে বোঝা যায়। ঠাকুর যাকে বলতে বোধে বোধ। সেই ঈশ্বর বোধের থেকে যে জ্ঞানের উদয় তাই হলো গিয়ে তোর বেদ। আর, বেদের সেই বোধোদয় থেকে ব্যাস নিয়ে আমাদের এই জীবনের বৃত্ত রচনাই হচ্ছে গিয়ে মহাভারত। যার মানে কিনা, মহাপ্রকাশ। ঈশ্বরপ্রকাশ। আমাদের জীবনে ঈশ্বরের বৃত্তলাভ। আর আমাদের ঈশ্বরবৃত্তিলাভ।

বেদব্যাসের মহাভারত-জানি মা আমি। সায় দিই মার কথায়। সেই মহাভারত কী? ঈশ্বরের কথাই তো। তাঁর লীলাকাহিনী। ভগবান ভূতলে নরদেহ নিয়ে নেমেছেন-বিচিত্র দেহরূপে স্নেহরূপে তাঁর সেই রসায়ন। যেমন তাঁর কথা তেমনি আমাদের জীবনকথাও আবার। ঐ মহাভারতই আমাদের জীবনে কোনো না কোনো রূপে কখনো না কখনো ঘটছেই। ঘটবেই।

আমাদের জীবনবৃত্তান্তই লিখে গেছেন সেই মহাকবি? কবি বেদব্যাস?

আবার একালের তোর ওই রবিঠাকুরও সেই বেদব্যাসেরই আরেক রূপ। আরেক দেহরূপ স্নেহরূপ সেই তাঁরই। তাঁর রচনাও অন্য এক মহাভারত। গীতাঞ্জলি পড়েছিস তো? কী সেটা? ভগবানের কথাই না?

হ্যাঁ মা। আবার তোমার রিনিও তাই। তাই না মা? রিনি অবশ্যি ভগবানের কথা কয় না, কিন্তু তাহলেও সেও ঐ ভগবানের কথাই। ভগবানের শেষ কথাই সে, আমার বোধ হয়।

যা বলিস! এই জীবনবৃত্তেই মরলোকে নরদেহী ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তা ছাড়া ঈশ্বরদর্শনের আর কোনো উপায় নেই। বুঝেছিস?

মার মোদ্দা কথাটা যা আমার মগজে ঢুকেছিল তা হচ্ছে এই যে, আমাদের জীবনের সব কিছুর কেন্দ্রেই তিনিই মূল। সেই কেন্দ্রমূল থেকে বোধের ব্যাস নিয়ে বৃত্তে এসে তিনি কাত হয়েছেন–তাঁর মুলাকাত পেতে হলে সেই বৃত্ত পথে–আমাদের প্রবৃত্তি পথেই যেতে হবে–নানা বৃত্তের নানান বৃত্তান্তে পদে পদে তাঁর সাক্ষাৎ পাব। নইলে তিনি মূলে হাবাৎ। কেবল মূলে তাঁর খোঁজ পেতে গেলে তিনিও নেই। আমরাও নাস্তি!

বহুরূপে সম্মুখে তোমার…এই জন্যেই বিবেকানন্দ বলে গেছেন, তাই না মা?

হ্যাঁ, তাই। ফলেন পরিচীয়তে-বলে না? সবকিছুর প্রমাণ হচ্ছে তার ফলে-ফলোভে। ঈশ্বর কল্পতরু আর কল্পতরুর প্রমাণ তার ফলেই তো মিলবার? তাই না?

হাতে হাতেই পাবার তো মা? আম লিচু যেমনটা আমি পাই?

নিশ্চয়! নইলে পরিচয়টা হবে কি করে? তাঁকে ডেকে তুই তোর কল্পিত ফল, এমনকি তোর অকল্পিতও যা–যদি তুই কল্পনাতীত ভাবে পেয়ে যাস, তাহলে সেটাই, ঈশ্বর যে আছে তার প্রমাণ হবে–নয় কি? ডেকে দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ তুই পাস কি না তবেই তো বিশ্বাস হবে।

অবিশ্বাস করে ডাকলেও তো ফল পাবো? তুমি বলেছিলে না মা আমায়?

ঈশ্বরকে মনে রেখে তোর কর্মবৃত্তির পথে তোকে এগুতে হবে–এগিয়ে যাবি–দেখবি ঈশ্বর হাত ধরে পদে পদে এগুচ্ছেন তোর সঙ্গে–তোর সহযোগিতা করছেন, পদে পদে তার সাহায্য পাবি, হাতে হাতে নগদ, দেখিস। দেখে নিস।

ঈশ্বরের সাহায্য পাব সব সময়?

বলছি তো, তবে ঈশ্বরের সহযোগিতা পেতে হলে আমাদের তাঁর বোধের সাহায্য নিয়ে নিজের মনের মত কর্মে প্রবৃত্ত হতে হবে–তবে তিনিও সেই সুযোগে আমাদের সঙ্গে সহকর্মে প্রবৃত্ত হবেন তাহলে নানান কর্মে প্রবৃত্ত তিনিই তো করছেন আমাদের। আমাদের কর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে তিনিই সারথি।।

তিনি তো তাহলে শ্রীকৃষ্ণ?–সারথি যখন তুমি বলছ? আর আমরা তাহলে?

আমরা পার্থ। পৃথিবীর সন্তান সব।

তাহলে তো আমরা কেউ কম নই মা। তাঁর সাহায্যে কুরুক্ষেত্ৰকাভ করতে পারি আমরা?

পারিই তো। মনের ঠিক প্রবৃত্তিটা ধরতে পারি যদি সেই বোধও তিনিই দিয়ে দেন। তাঁর কাছে চাইতে হয়। তাঁর কাছে চেয়ে পেতে হয় সেই বোধ। সেই বোধকে কর্মে রূপায়িত করতে তিনিই আবার সহায়তা করেন। আমাদের যথার্থ প্রবৃত্তির পথেই তাঁর দেখা পাওয়া যায়–পদে পদে সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটে।

প্রবৃত্তির পথে? এটা তুমি কী বললে মা? প্রবৃত্তি তো ভালো নয়, নিবৃত্তিই ভালো– আমাদের যতো ধর্মশাস্ত্রে এই কথাই তো বলে মা? বলে না?

ধর্মশাস্ত্র পড়েছিস তুই?

তা পড়িনি বটে, আমার সব সেকেন্ডহ্যান্ড নলেজ। এখানে-সেখানে এর ওর তার লেখাটেখা পড়ে এই জ্ঞান হয়েছে–তাই থেকেই বলছিলাম–এমন কি তোমার ঠাকুরও তো ওই কথাই…।

ঠাকুর কক্ষনো অমন কথা বলেননি, বলতে পারেন না। তিনি ঈশ্বরে মন রেখে নিজের নিজের কাজ করে যেতে বলেছেন–যার যেটা কাজ। সবাইকে তিনি তার নিজের মতন হতেই বলেছেন–নিবৃত্ত হতে বলেননি কাউকেই। গিরিশ ঘোষকে তিনি অভিনয় করে যেতেই বলেছিলেন–যেটা তাঁর কাজ। এবং তাঁর প্রবৃত্তি বুঝে মদ্যপানেও কোনো দিন বাধা দেননি তাঁরা।

তাই বটে মা। মেনে নিতে হয় আমায়।

কবীরের কথা শুনেছিস? মুচির কাজ করত কবীর। কিন্তু কবিত্বে আমাদের রবির কাছাকাছি। রবিঠাকুরের যেমন গীতাঞ্জলি, তেমনি কবীরের ই দোঁহা। প্রবাসীর পাতায় ক্ষিতিমোহন সেনের লেখায় তার পরিচয় পাবি তুই, পড়ে দেখিস। তাঁকে একবার কে যেন বলেছিল, গঙ্গাসাগর তীর্থে চল না? কবীর বলল, কী হবে গিয়ে। আমার মন যদি ঠিক থাকে তো এখানেই মা গঙ্গা আমার। মন যদি চাঙ্গা তো কাঠুরিয়ামে গঙ্গা…আমি আমার কাজে লেগে থাকব। গঙ্গা মাঈর যদি খুশি হয় তিনি আমা এই জলের কটোরাইে এসে দেখা দেবেন। দিয়েছিলেন তিনি।…নিজের কর্মবৃত্তির পথেই কবীর পেয়েছিলেন মার দেখা।

তবে নিবৃত্তির কথাও কোন্ কোন্ মহাপুরুষ যেন বলেছিলেন মা, তাঁদের নাম এখন মনে পড়ছে না।

নিবৃত্তির পথে যাওয়া মানে ভগবানের বিরুদ্ধে যাওয়া। তা কি হয় নাকি রে? না, কেউ পারে তা কখনো। এটাই বোঝ না, ভগবান তো গোড়ায় নিজের মূলকেন্দ্রে চিৎরূপে নিবৃত্ত হয়েই ছিলেন, তাতে কোন সুখ নেই দেখে, কোন আরাম না পেয়েই না এই আনন্দের পথে, রূপের পথে অবারিত হলেন-প্রবৃত্তির পথে গা ভাসিয়ে দিলেন নিজের। তাঁর সেই স্রোতের উলটো দিকে কি যাওয়া যায়? কেউ পারে তা? চেষ্টা করলেও তিনি তার ঘাড় ধরে ঘুরিয়ে দেন যে! প্রবৃত্তির পথে আসতে হয় ফিরে আবার।

এখন মনে পড়ছে মা? আমি উসকে উঠি-নিবৃত্তির কথাটা বাবার মুখেই আমি শুনেছিলাম যেন।

যা, তবে তোর বাবার কাছ থেকেই ভালো করে জেনে আয়গে।

শুনেই আমি তক্ষুনি এক ছুটে চলে যাই বাবার কাছে, আর পরমুহূর্তে টেনিস বলের মতন বেয়ারিং পোস্টে ফেরত চলে আসি মার কোর্টে। বাবা বলছেন–সংস্কৃত শ্লোক-টোক

কী সব আউড়ে যেন বললেন, যার মানেটা হচ্ছে যে প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাম, অর্থাৎ কিনা, ভূতদের এইরকমই প্রবৃত্তি বটে, কিন্তু নিবৃত্তিইে নাকি রয়েছে মহাফল। ভূত কী মা?

ভূত কী, তা তুই জানিসনে?

আমিই তো, তাই না? তুমি তো আমায় ভূত বলে ডাকো একেক সময়, হনুমান কথাটা খুঁজে পাও না যখন। আমরাই তো:ভূত মা, তাই না? মারা যাবার পর প্রেত হয়ে যাব সবাই।

তোকে বলেছে! হাসলেন মা-মরবার পর তোকে প্রেত হতে হবে না কখনো–মা তা হতে দেবেন না। মায়ের পেটে জন্ম নিবি তক্ষুনি আবার।

অবশ্যি মার যদি, মানে তোমার যদি তাই অভিপ্রেত হয়। সে তো আর আমার ইচ্ছের ওপর নয়।…কিন্তু মহাফলটা কী জিনিস, যা নাকি নিবৃত্ত হলে মেলে?

কাঁচকলা!

বেলও তো হতে পারে? আমি বলি-বাবা যখন বেল খান রোজ রোজ?।

হ্যাঁ, তা হতে পারে? তবে সন্ন্যাসী হয়ে ন্যাড়া না হতে পারলে তো আর বেলতলায় যাওয়া যায় না রে! তুই কি তাহলে সন্নিসী হতে চাস?

কক্ষনো না। জটাজুট রেখে ছাইভস্ম মেখে কী লাভ? আমি তোমার ওই প্রবৃত্তির পথেই রয়েছি সব সময়।…কিন্তু মা, তোমার ওই প্রবৃত্তির কথাটা বাবাকে যখন বললাম না, শুনেটুনে বাবা কী বললেন জানো মা? বললেন যে, তোর মার কথাটা বিলকুল দর্শনবিরুদ্ধ। আমাদের কোনো দর্শনশাস্ত্রে এমন কথা বলে না।

দর্শন-টর্শন জানিনে, ষড়দর্শন পড়িনি কখনো। এটা হচ্ছে আমারনিজস্ব দর্শন–আমি নিজে যা দেখেছি, যা দেখছি–তাই। মা জানান-এখন বল তো তোর আসল প্রবৃত্তিটা

কোন্ দিকে? কোনদিকে তোর মনের ঝোঁক, বল দেখি আমায়?

বলব? বলব মা?… বলতে গিয়ে আমি আমতা আমতা করি, রিনির নামতা আওড়াতে পারি না কিছুতেই

বলল মা? আমার ঝোঁক খালি তোমার দিকে, তোমাকেই আমি দেখি তো। তোমাকেই দেখেছি, দেখছি সব সময়। বলে দৃষ্টান্তস্বরূপ আমার কথাটায় আরো একটুখানি জোর লাগাই : এটা হচ্ছে আমার নিজস্ব দর্শন।

.

২০.

ভগবদ্দর্শনের প্রশ্নটা বাবার কাছেও পেড়েছিলাম আমি।

বাবা বলনে, ধ্যানের দ্বারা ধরা যায়। ধ্যাননেত্রেই তিনি প্রত্যক্ষ হন। আর ধ্যানে বসতে হলে? এমনি করে পদ্মাসনে নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ ক বসতে হবে–একটানা, যতক্ষণ পারো। বলে তিনি দৃষ্টান্তস্বরূপ হতেন।

এদিকে পদ্মাসনে বসাটা তেমন সোজা নয়, বসতে গেলে উটে পড়তে হয়। আর উলটে যদি নাও পড়ি নেহাত, অমন আড়স্টভাবে বসে থাকাটাও কস্টকর। ওর চাইতে কুশাসনে বসাটাও ঢের সুখের। তাছাড়া ঐভাবে বসে ভগবানের ধ্যান করতে গেলে নাস্ত্রে ডগায় আনব কি, আমার সবটা মনগিয়ে যন্ত্রণাকাতর পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। সেইখানেই ওতপ্রোত হয়ে। মৈনাকের শিখরদেশ থেকে মনের এই পদস্খলনের গতিরোধ করা যায় না।

মাকে কথাটা বলায় তিনি বললেন-তোর বাবার যেমন! নাকের ওপর নজর রেখে জড়ভরতের মত ল্যাজেগোবরে হয়ে বসে থেকে কী লাভ? ভগবান কি ঐ নাকের মাথায় রয়েছেন যে দেখা দেবেন? কুশাসন কেন, তুমি আরাম করে কুশানে কি ইজিচেয়ারে বসে ডাকো না, কি বিছানায় শুয়ে ঠ্যাং-এর ওপর ঠ্যাং তুলে। মন দেওয়া নিয়ে কথা, নাক দেখানো নয়।

বেশিক্ষণ ডাকাই যায় না ভগবানকে, ভালও লাগে না ডাকতে। আমি জানাই। তাছাড়া, ঐ নাক নিয়ে মানে, নিজের নাক নিয়ে মাথা ঘামানো আমার একদম ভালো লাগে না। ফিলানথ্রপিস্ট-কথাটাও ততদিনে জানা হয়ে গেছে ঐ কাগজের কল্যাণেই। হেডস্যারের জবাবে ঐ প্যাট্রিয়টই জিভের গোড়ায় এসে গেল। হেডস্যারের জবাবে ঐ গালভরা কথাটাও আমি আওড়াতে পারতাম, কিন্তু কেন জানি না, ঐ প্যাট্রিয়টই জিভের গোড়ায় এসে গেল। ফিলানথ্রপিস্ট হতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে লাগে, তার আগে বহু কষ্ট করে বড়লোক হতে হয়, তারপরেই না বিশ্বের উপকার করতে বেরুনো? কিন্তু ঐ প্যাট্রিয়ট হওয়াটা তার চেয়ে ঢের সোজাই যেন! সারা জীবন দিলে তো কথাই নাই, সোজাসুভি প্রাণটা দিলেও হওয়া যায়।

কিংবা দেশের ভাবনায় ভাবিত ঐ অর্ধ সাপ্তাহিকের গরম গরম সম্পাদকীয় বা সংবাদের পৃষ্ঠা পাঠেই বুঝি আমি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকব। অথবা বাবার বইয়ের ভাড়ার থেকে বাগানে যোগীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ম্যাজিনি-গ্যারিলডির জীবনকাহিনীর থেকেও হয়ত প্রেরণ পেয়ে থাকতে পারি।

কান্তিবাবু আর কোনো ছেলের উচ্চাশা সম্পর্কে বিশেষ উচ্চবাচ্য করে আমার বিষয়ে কিংবা ওই প্যাট্রিয়টের বিষয়েই বেশ কিছু বলেছিলেন মনে আছে। প্যাট্রিয়ট কাকে বলে প্যাট্রিয়টিজম কী, কী বা তার দায় ধাক্কা তার যেন একটুখানি আঁচ পেয়েছিলাম তার কথায়

সেদিন ইস্কুলের ছুটির পর আমাদের ক্লাসের ছেলে সতীশ আমায় পাকড়ালো।

আয়, এখানে বসি একটু। কথা আছে তোর সঙ্গে।

ড্রিলের মাঠটায় আমরা বসলাম।

প্যাট্রিয়ট হতে চাস বলছিলিস না তুই? তাই ভাবলাম, তোকে তো আমাদের দলে নেওয়া যায় তাহলে। চাপা গলায় বলল ও।

তোদের দল! ক্রিকেট ফুটবলের টীম যদি হয়… আমার সাফ কথা-না ভাই, তার মধ্যে আমি নেই। ঐ সব খেলাধুলায় হাত পা ভাঙতে পারব না আমি। ওসব আসেও না আমার, ভালোও লাগে না। তবে হ্যাঁ, যদি টেনিস কি ব্যাডমিনটন হয়…

আরে না না, সেসব কিছু নয়। তার ভেতরে প্যাট্রয়টিজমের কী আছে? একেবারে অন্য জিনিস। আনকোরা আরেক ব্যাপার।

ব্যাপারটা কী শুনি?

তুই আমাদের বিপ্লবীদের দলে আসবি?

বিপ্লবীদের দল? সে আবার কী রে?

কেন, জানিসনে? ক্ষুদিরাম কানাইলালের কথা শুনিসনি নাকি? ফাঁসি হয়ে গেছে যাদের?

দেশোদ্ধারের দল? জানি বইকি। আছে একটা দল ওরকম। খবরের কাগজ পড়লে জানা যায়। খবর বেরয় বটে মাঝে মাঝে।

আসবি তুই সেই দলে? খুব গোপন কিন্তু। বলবিনে যেন কাউকে।

কী করতে হবে আমায়?

তোর কথা আমাদের লীডার বলছিল একদিন। দলে তোকে পাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখতে, …তোর মন একটা ছেলেকে আমাদের দরকার খুব!

লীডারটা কে শুনি?

তা বলব না। তা ই জানতে চাসনে। জানতে পাবি না কোনোদিন। আমাদের দলে অতটা উন্নাসিক হওয়া কি ভালো? কিন্তু তা না হলে তো আমার আধ্যাত্মিক উন্নতির একেবারেই কোনো আশা নেই দেখছি।

ভগবান যেমন বিন্দুমাত্র, ভগবানকে ডাকার প্রয়োজনও তেমনি মুহূর্ত মাত্রই। গোশৃঙ্গে সর্ষপ, মানে গোরুর শিঙের ওপর সর্ষে রাখলে যতক্ষণ থাকে ততটুকুর জন্যই ভগবানে মন দিলে, মন দিয়ে তাঁর মন পেলেই ঢের। তার ফলে যে গতিলাভ হয়, যেদিকে যাবার প্রবৃত্তি হয়, তিনি যেদিকে নিয়ে যান সেইটেই হোলো তোর ভগবতি। খুব সহজ ব্যাপার। এত সহজে আর কিছু হয় না। প্রায় নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই।

মার মতে, আমার মনে হোলো যে, ঐ নাকই দেখতে হবে বটে, তবে কিনা একটু ঘোরালো পথে। প্রায় ঘুরিয়ে নাক দেখার মতই। বৃত্তির পথে, প্রবৃত্তির পথেই যেতে হবে আমায় ভগবানকে পেতে পেতে। এক সেকেন্ড মাত্র ভগবানকে দিয়ে তার পর থেকে খালি সেকেন্ডহ্যান্ড ভগবানকে পাওয়া। সবার সঙ্গে তার সাথে সাথে চলা। যেতে যেতে আদানে-প্রদানে তাঁকেই দিতে দিতে পেতে পেতে যাওয়া।

বাবা যে বলেছে মা, ভগবানকে পাওয়া নাকি সোজা না। অনেক সাধনার দরকার। বাবার কথার পুনরাবৃত্তি আমার।

ভগবান যদি মা হন তাহলে কি তাঁকে সাধ্যসাধনা করতে লাগে? মাকে তো এমনিতেই পাই-ছেলে হয়ে জন্মানোর সাথে সাথেই। আমরা তো সবাই স্বয়ংসিদ্ধ তো। আজন্ম সিদ্ধি আমাদের। সাধনা যদি করতে হয় তো প্রবৃত্তির সাধনাই করতে হবে-বুঝেছিস? আমৃত্যু সেই সাধনা, জন্মজন্মান্তরের। তোর প্রবৃত্তি কী, মনের ঝোঁকটা কোনদিকে তোর, সেইটে তুই বার কর আগে।

মাথা ঘামাতে লাগলাম আমি তারপর। কোনদিকে মনের ঝুঁকি, মনের মধ্যে মাথা ঠুকি। ঠুকে ঠুকে মরি।

মনের ভেতর দিয়েই যদি ভগবানের প্রেরণা মেলে, তাহলে তাঁকে ডাকতে গেলে যেসব দিকে মন খেলে ( ভগবান নিজেই খেলিয়ে দেন কিনা কে জানে?) সেই দিকেই কি মনের ঝোঁক আমার? বুঝতে হবে তাই?

কী হতে চাই? কী করতে চাই আমি? মাথা খেলাই।

সেদিন ক্লাসে হেড স্যার শুধিয়েছিলেন সবাইকে– কে কী হতে চাই আমরা?

হেড স্যার কান্তিভূষণ ভট্টাচার্য ইংরেজি পড়াতেন আমাদের। এমন জলের মতন বোঝাতেন, এমন চমৎকার পড়াতেন যে, দৌলতপুর কলেজের প্রিন্সিপাল কামাখ্যাচরণ নাগ মশাই আমাদের ইস্কুলে রেকটর হয়ে যোগ দেবার সময় তার সেরা ছাত্র কান্তিবাবুকে হেডমাস্টার করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে।

একমনে পড়িয়ে যেতেন তিনি, আজেবাজে কথা কইতেন না একদম।সৌম্যদর্শন ছিপছিপে চেহারার গুরুগম্ভীর মানুষ। হঠাৎ সেদিন তিনি পড়ার বাইরে ঐ প্রশ্নটা করে বসলেন কেন যে! কেউ বললে সে ডাক্তার হবে, কেউ বললে যে বিজনেস করবে, কেউ হবে অ্যাডভোকেট–এমন কতোজন কতো কী।

আই ওয়ান্ট টু বি এ প্যাট্রিয়ট। আমায় শুধাতে জবাব দিয়েছিলাম।

আমাদের বাড়িতে অর্ধসাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা আসত দেশপ্রেমের বান ডাকত সেই কাগজে। প্যাট্রিয়ট-ঐ শক্ত কথাটা সেখান থেকেই শেখা আমার। অবশ্যি, ফিলনথ্রপিস্ট–কথাটাও ততদিনে জানা হয়ে গেছে ঐ কাগজের কল্যাণেই। হারের জবাবে ঐ প্যাট্রিয়টই জিভের গােড়ায় এসে গেল। হেডস্যারের জবাবে ঐ গালভরা কথাটাও আমি আওড়াতে পারতাম, কিন্তু কেন জানি না, ঐ প্যাট্রিয়টই জিরে গােড়ায় এসে গেল। ফিলানথ্রপিস্ট হতে গেলে অনেক কাঠখড় পােড়াতে লাগে, অর আগে বহু কষ্ট করে বড়লােক হতে হয়, তারপরেই না বিশেষ উপকার করতে বেরুনাে ? কিন্তু ঐ প্যাট্রিয়ট হওয়াটা তার চেয়ে ঢের সােজাই যেন! সারা জীবন দিলে তাে কথাই নাই, সােজাসুজি প্রাণটা দিলেও হওয়া যায়।

কিংবা দেশের ভাবনায় ভাবিত ঐ অর্থ সাপ্তাহিকের গরম গরম সম্পাদকীয় বা সংবাদের পৃষ্ঠা পাঠেই বুঝি আমি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকব। অথবা বাবার বইয়ের ভাঁড়ার থেকে বাগান যােগীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ম্যাজিনি-গ্যারিলডির জীবনকাহিনীর থেকেও হয়ত প্রেরণা পেয়ে থাকতে পারি। 

কান্তিবাবু আর কোনাে ছেলের উচ্চাশা সম্পর্কে বিশেষ উচ্চবাচ্য না করে আমার বিষয়ে কিবা এই প্যাট্রয়টের বিষয়েই বেশ কিছু বলেছিলেন মনে আছে। প্যাট্রিয়ট কাকে বলে, প্যাট্রিয়টিজম কী, কী বা তার দায় ধাক্কা আর যেন একটুখানি আঁচ পেয়েছিলাম তাঁর কথায়। সেদিন ইস্কুলের ছুটির পর আমাদের ক্লাসের ছেলে সতীশ আমায় পাকড়ালাে। 

আয়, এখানে বসি একটা কথা আছে তাের সঙ্গে। 

ড্রিলের মাঠটায় আমরা বসলাম।

প্যাট্রয়ট হতে চাস বলছিলিস না তুই ? তাই ভাবলাম, তােকে তাে আমাদের দলে নেওয়া যায় তাহলে। চাপা গলায় বলল ও।

তােদের দল! ক্রিকেট ফুটবলের টীম যদি হয়… আমার সাফ কথা–না ভাই, তার মধ্যে আমি নেই। ঐ সব খেলাধুলায় হাত পা ভাঙতে পারব না আমি। ওসব আসেও না আমার, ভালােও লাগে না। তবে তা, যদি টেনিস কি ব্যাডমিনটন হয়…

আরে না না, সেসব কিছু নয়। তার ভেতরে প্যাট্রিয়টিজমের কী আছে? একেবারে অন্য জিনিস। আনকোরা আরেক ব্যাপার। 

ব্যাপারটা কী শুনি?’

তুই আমাদের বিপ্লবীদের দলে আসবি? 

বিপ্লবীদের দল? সে আবার কী রে?

কেন, জানিসনে? ক্ষুদিরাম কানাইলালের কথা শুনিসনি নাকি? ফাঁসি হয়ে গেছে যাদের?

দেশােদ্ধারের দল? জানি বইকি। আছে একটা দল ওরকম। খবরের কাগজ পড়লেই জানা যায়। খবর বেরয় বটে মাঝে মাঝে।

আসবি তুই সেই দলে? খুব গােপন কিন্তু। বলবিনে যেন কাউকে।

কী করতে হবে আমায়?

তাের কথা আমাদের লীডার বলছিল একদিন। দলে তােকে পাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখতে, তাের মতন একটা ছেলেকে আমাদের দরকার খুব! 

লীডারটা কে শুনি? 

তা বলব না। অ ই জানতে চামনে। জানতে পারি না কোনােদিন। আমাদের দলে

কে কে আছে তাও না। তুই শুধু আমাকেই জানবি, আমি তোকে রিক্রুট করলাম তো? লীডারের অর্ডার আমার মারফতেই পাবি তুই। সেই মতন তোকে কাজ করে যেতে হবে।

আমি ভেবে দেখি ওর কথাটা। অভিরামের দ্বীপান্তর মা, ক্ষুদিরামের ফাঁসি। বিদায় দে মা ঘুরে আসি। মনে পড়ে মুকুন্দদাসের যাত্রার পালা গানও। জাগো জাগো জননি, আসিছে নামিয়া ন্যায়ের দণ্ড রুদ্র দীপ্ত মূর্তিমান–সাবধান সাবধান! মনে পড়ল কত কথাই।

কাজটা কী করতে হবে শুনি আমায়?

সেন্টার থেকে চিঠি আসবে লীডারের-আসবে তোর নামে–দলের আরো বড় লীডারের চিঠি। সেসব চিঠি খুব দরকারী, কিন্তু তার ভারী রিকস। আমাদের হোস্টেলের ছেলেদের চিঠিপত্র সব পুলিসে খুলে দ্যাখে কি না! ডাকঘরেই দেখে নেয় টিকটিকিরা। তোর নামে, তোর একটা দলীয় নাম দেব আমরা, সেই নামে যেসব চিঠিপত্র, পার্শেল-টার্শেল আসবে, একদম তুই না খুলে সেসব তুলে দিবি আমার হাতে। আমি গিয়ে লীডারকে দেব। আপাতত এই কাজ।

তারপর?

 তারপর, পরে তোকে যা করতে বলা হবে, করতে হবে। ইতস্ততঃ করা চলবে না। কিন্তু সে পরের কথা পরে, এখন…

আমার চিঠিপত্র খুলবে না পুলিস?

তোর বাবার কেয়ার অফ-এ আসবে তো? সন্দেহ করবে না পুলিস। তোর বাবা বয়স্ক লোক, গণ্যমান্য মানুষ–তিনি কি আর এইসব বিপ্লবী দলে থাকতে পাবেন–ভাববে তারা। বুঝেছিস এখন? কেমন, রাজী তো! কথাটায় কি রকম বরামাঞ্চ বোধ করি। সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যাই। প্যাট্রিয়ট হবার বাসনা প্রকাশের সাথে সাথেই প্যাট্রিয়টের মত কাজ করার এই সুযোগ! সৌভাগ্য বলেই মনে হয় আমার।

দুদিন বাদে সতীশ এসে বলল, তোর নাম দেওয়া হয়েছে সুরেন। দলীয় নাম।

আরে! সুরেন যে আমার মামার নাম রে! সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী।

ভালোই হলো আরো। ঐ নামই রইলো তোর তাহলে। বলে চলে গেল সতীশ।

আমিও ভাবলাম, মন্দ কি! নরাণাং মাতুলক্রম বলে নাকি, আমার যদি নামের দিক দিয়েই সেই উপক্রম হয় তোত ধারাবাহিকতাই বজায় থাকে তার।

দিনকতক বাদে একটা চিঠি এল মামার নামে-খামের চিঠি-বাবার কেয়ার অফে, ইস্কুল থেকে ফিরে জানলাম মার কাছে।

মা বললেন, এ কী চিঠি এসেছে রে সুরেনের নামে, দ্যাখ দেখি। এক বর্ণও বোঝা গেল না তার।

 খুললে কেন চিঠিটা? খুলতে গেলে কেন? মামার চিঠি, দেখছ না?

সুরেন তো রাজাপুরেই এখন, তার বাড়িতেই। কোনার ঠিকানায় না লিখে এখানে আবার তাকে লিখলো কে, কলকাতার থেকে খুদিদি, তোর বড় মাসীই হয়তো লিখে থাকবে, মনে। করেছে সে এখেনেই আছে এখো-তাই ভেবেই, খবরটা কী, আর খুলে দেখতে গেছি। কিন্তু দেখছি, এ তো একটা আঁক। কী আঁক কে জানে?

ইকোয়েশনের আঁক বলে ঠাওর হচ্ছে। তার সঙ্গে ফ্রাকশন ট্রাকশন ডেসিমেল সিঁড়ি ভাঙা সব মিশিয়ে বিদঘুঁটে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড!

এ আঁক তুই জানিসনে?

কোনো জন্মে না। কাবিল হোসেন জানে। কিন্তু তাকে তো এই চিঠি দেখানো যাবে না যার চিঠি তার হাতে দিতে হবে।

কার চিঠি শুনি?

সে একজনের। শুনলে তুমি কিচ্ছু বুঝতে পারবে না। বলে চিঠিখানা হাতিয়েই আমি সরে পড়ি।

সতীশকে চিঠিখানা দিই গিয়ে। খাম খোলা দেখেই সে খাপখোলা তরোয়ালের মতই ঝলকে উঠেছে : খুলেছিস কেন?

আমি খুলেছি নাকি? মামার চিঠি মনে করে–মামাকে লেখা মাসির চিঠি তাই ভেবে না  খুলে দেখেছে মা। দেখেও বুঝতে পারেনি কিছু। যা বিচ্ছিরি আঁক একখানা–তার ভেতর নাক গলায় সাধ্য কার। এক সাথে আমি মার আমার সাফাই গাই-মনে হচ্ছে মা আমার মতই অঙ্কে দিগগজ। আমারই মা তো!

মোটেই তোমার আঁক নয়, সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা। লীডার বুঝবে। এই না বলে সে দ্বিরুক্তি না করে চিঠিখানা নিয়ে চলে যায়। কোথায় যায় কে জানে!

 রাত্রে তাদের হোস্টেলে গেলে সে জানায়–লীডার ভারী রাগ করেছে। এরপর থেকে ইস্কুলে যাবার পথে রোজ তুই পোস্ট আপিস হয়ে যাবি। জানবি তোর মামার নামে চিঠিপত্তর পার্শেল-টার্শেল টাকাকড়ি মনিঅর্ডার-টর্ডার এসেছে কিনা। এলে ফর দিয়ে সই করে নিয়ে সোজা চলে আসবি ইস্কুলে।

মনিঅর্ডার টাকাকড়িও আসবে নাকি আবার? শুনে আমার উৎসাহ হয়।

এলেই বা! তাতে তোর আমার উৎসাহিত হবার কিছু নেই। বেল পাকলে কাকের কী পার্টির টাকা–দলনেতাকে গিয়ে দিয়ে দিতে হবে তক্ষুনি।

সতীশের কণ্ঠস্বর পৃথিবীর মতই উত্তর-দক্ষিণে চাপা হয়ে আসে তারপর–এমন কি পিস্তল-টিস্তলও আসতে পারে ঐ পার্শেলে। সেই খবর দিয়েছে ওই চিঠিতে।

পিস্তল! শুনেই আমি চমকে উঠেছি।–পিস্তল-টিস্তল কেন রে!

আমাদের টার্গেট প্র্যাকটিশের জন্যই, আবার কী রে? স্বদেশী ডাকাতি করতে হবে না। টাকার যোগাড় হবে কোত্থেকে? কলিগাঁয় ফকির সরকারের বাড়ি করব ডাকাতি। ওর ভারী মহাজন, অনেক টাকা ওদের।

না না। ওর বাড়ি না। কিছুতেই নয়, ওই ভদ্রলোক দারুণ ভালো। বইটই পড়তে দেয় আমায়–ওর বাড়ি ডাকাতি-টাকাতি নয়।

ঘাবড়াচ্ছিস? হয়তো তোদের বাড়িও করতে হতে পারে আমাদের। তখন তোকেও লাগতে হবে–থাকতে হবে আমাদের সঙ্গে। কালি-ঝুল মেখে মুখোশ পরে থাকবি, বাড়ির কেউ চিনতে পারবে না তোকে।…তোদেরও অনেক টাকা আছে, তাই না?

কাঁচকলা পাবি আমাদের বাড়ি। বাবার যা কিছু আছে সব কোম্পানীর কাগজে জমা রাখা। কাগজ কখানা পাবি কেবল। তবে হ্যাঁ, মার গয়নাগুলো নিতে পারিস। চাইলে মা হয়ত নিজের থেকেই দিয়ে দিতে পারে দেশের কাজে। কেড়ে নিতে হবে না।

টাকা নেই তো চলে কি করে তোদের? শুনি? তোর বাবা তো কোনো চাকরি-বাকরি করেন না।

রাজ এস্টেট থেকে মাসোহারা আসে না বাবার? মাস মাস আসে টাকা। তাতেই আমাদের চলে যায়। তার থেকেও বাবা জমায় আবার। কোথায় রাখে আমার জানা আছে। মাঝে মাঝে বাবার অজান্তে সেখান থেকেও হাত সাফাই করি–ধরতে পারে না বাবা। খেয়ালই করে না বোধ হয়।

যাক গে, ই যখন পাটির, তোদের বাড়ি ডাকাতি হবে না নিশ্চয়। তার আগে তো টার্গেট প্র্যাকটিশ করে হাত-টাত পাকাতে হবে আমাদের।

হাত পাকাবি কোথায়?

কেন, সিঙ্গিয়ার আমবাগানে। হাজার হাজার গাছের আওতায় নিশ্চিন্তে প্র্যাকটিশ করা যাবে। নির্জন জায়গা, কেউ বড় একটা সেখোয় না ওর ভেতর-গুলিটুলির আওয়াজ কারো কানে যাবে না।

যেখানে আম পাকে সেখানেই হাত পাকাবি? তাহলে ভাই আমের সময়টাতেই পাকানো যাবে না-হয়। পাকা আমের দিকে তাক করে লাগালে দু-একটা আম গালে এসে পড়তেও পারে, চাই কি?

সেই সুখেই থাক! আমার কথাটা সে এক কথায় উড়িয়ে দেয়।

কিন্তু এক কথায় পাকা আমের অত বড়ো বাগান ওড়ানো যায় না–আমি আবার তাকে বাগাতে লাগি : ইসব ফলন্ত আম গাছের সামনে দাঁড়িয়ে লোভ সামলাতে পারবি তুই? তোর হাতের তাক তো আমি জানি। শুধু ঢিলিয়েই তুই ফজলি আম নামিয়ে আনিস। পিস্তলের নিশানা না জানি তোর আরো কতো জোর হবে। আর সিঙ্গিয়ার বাগানে কী সব আম রে ভাই! আমের তার আর তার হাতের আরিফ একবাক্যে করে আমি ওর আমড়াগাছি করি।

সে কিন্তু টলে না একদম। বলে যে, হ্যাঁ, সেইজন্যেই আনা হচ্ছে কিনা পিস্তল! আম পাড়বার জন্যে আনছি কিনা আমরা! সে বলে বিলেতে যে একটা জোর লড়াই বেধেছে খবর রাখিস তার? ইংরেজ জার্মানীর যুদ্ধ হচ্ছে জানিসনে?

জানব না কেন? আসে তো খবর কাগজ আমাদের বাড়ি। হিতবাদী, অমৃতবাজার দু-ই আসে। সব খবর পাই আমরা। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের কী! কোথায় বিলেত আর কোথায় আমরা। কার সঙ্গে কার লড়াই আর আমরা কোনখানে।

কী বোকা রে! তার চোখে কৃপাকটাক্ষ। আরে, আমাদের স্বাধীনতা লাভের এই তো মোকা রে! ইংরেজ জার্মানীর সঙ্গে লড়ায়ে বিব্রত–এই সুযোগে আমরাও তৈরি হবো এদিকে।

রণক্ষেত্রের সৈনিক না আমরা? আমাদের অ্যানার্কিস্ট পার্টি ভারতজোড়া, জানিসনে? শুনেছি এক-আধটু। পড়েওছি খবর কাগজে।

এ সব কথা থাক এখন। কদিন বাদে পিস্তলের পার্শেলটা আসবে। কটা পিস্তল আসে কে জানে! ইস্কুলে আসার পথে রোজ খবর নিবি পোস্টাপিসে–এলেই ডেলিভারি নিবি। আর নিয়েই না, সোজা চলে আসবি ইস্কুলে। ইস্কুল পালিয়ে তারপর প্রতিদিন দুপুরে আমাদের পিস্তলের মহড়া শুরু হবে ওই বাগানে-সেদিন থেকেই। বুঝেছিস?

পিস্তল নিয়ে লড়তে হবে বলছিস? কিন্তু লড়বি কার সঙ্গে শুনি? তাহলে তো সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই যেতে হয় আমাদের, ওই বিলেতেই।

কেন, ইংরেজের সঙ্গে লড়ব আমরা। এখানেই লড়াই করব। সারা ভারতই আমাদের রণক্ষেত্র। সর্বদাই আমাদের সংগ্রাম।

এখানে ইংরেজ কোথায় রে, এই গাঁয়? আমি শুধাই–এই অজ পাড়াগাঁয় কই তোর ইংরেজ?

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নেই? পুলিস সাহেব নেই জেলার? সেখানে গিয়ে মেরে আসতে হবে তাদের। লীডারের হুকুম হলেই যেতে হবে আমাদের।

না ভাই, ওসব খুনোখুনি কাণ্ড আমার ভালো লাগে না। আমার আপত্তি : পুলিস সুপারকে প্রাণে মারলে মেম-সুপারির প্রাণে লাগবে না? কাঁদবে না তাঁর ছেলে-সুপাররা? মেয়ে-সুপারিরা? না… মানুষ মারবে কেন মানুষকে? মারবার জন্যে তো মানুষরা হয়নি। ভালোবাসাবাসির জন্যেই হয়েছে।

সব মানুষকে কি ভালোবাসা যায়? ওরা আমাদের ছেলেদের ধরে ধরে গুলি করে মারছে না! লটকে দিচ্ছে না ফাঁসিতে? তুই বল?

হ্যাঁ, সব মানুষকে ভালোবাসা যায় না, তা ঠিক। মানতে হয় আমায়-তবে মানুষের মধ্যে যারা রূপসী মানুষ তাদের ভালো না বেসে পারা যায় না। সেইসব মানুষের ভালোবাসার জন্যে আমরা সব সময় উপোসী। তাদের রূপের উপাসনা করি আমরা।

তোর ওই সব রূপসী মানুষ উপোসী মানুষের ফাতরা কথা যত রাখ তো। দেশের স্বাধীনতা তুই চাস কি চাস না?

নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু ওইসব খুনখারাপি না করে…না ভাই, কাউকে খুন করতে আমি পারব না। ওতে আমার একদম প্রবৃত্তি হয় না।

কিসে তোমার প্রবৃত্তি শুনি?

প্রবৃত্তির প্রশ্নটা খট করে আমার মগজে এসে লাগে। মার কথাটা মনে পড়ে যায়…প্রবৃত্তির পথেই ভগবদ্গতি…আমাদের গতি ভগবানের দিকে, ভগবানের গতি আমাদের দিকে। উভয়ের গতিমুক্তি এক পথে–একসঙ্গে। একাধারে–এক ধারায়। ধারাবাহিক।

কিসে আমার প্রবৃত্তি বলব? আয়, আমরা হাতে-লেখা একখানা পত্রিকা বার করি। মাসিক কি ত্রৈমাসিক। আমার মতে সেই ভালো হবে তার চেয়ে। মাস মাস কি তিন মাস অন্তর বেরুবে কাগজটা। তাতে গল্প উপন্যাস কবিতা সব থাকবে। তুই লিখবি, আমি লিখব, হোস্টেলের আরো সব ছেলেরা লিখবে–বিষ্টু-টিষ্টু সব্বাই। ইস্কুলের লিথো মেশিনটা নিয়ে লিথো করেও বার করতে পারা যায়। কাগজটার নাম রাখা হবে অঞ্জলি। দেবী ভারতীর পায়ে অঞ্জলি আমাদের।

তোর মাথা! দেশের স্বাধীনতা আগে, না, ওইসব তোর ছাতমাথা? দেশ স্বাধীন হোক। সাহিত্যচর্চার ঢের সময় পাওয়া যাবে, কিন্তু ইংরেজ এখন জীবন-সঙ্কট লড়ায়ে বিব্রত, তাকে খতম করার এমন সুযোগ আর মিলবে না। জার্মানরা ওদিকে হারাবে তাদের, আমরা এদিক থেকে তাড়াব।

তার কথাটাও নেহাত ফেলনা নয়, ভেবে দেখি। ভেবে দেখতে হয়।

ভাবছিস কী? আমরা সবাই রণক্ষেত্রের সৈনিক এখন। লড়তে হবে এ সময়-লড়তে হবে, মরতে হবে, মারতে হবে। প্রাণ দিতে হবে, প্রাণ নিতে হবে-বুঝেছিস!

হ্যাঁ, প্রাণ দিতে হবে প্রাণ নিতে হবে-প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার কথাই বটে। ভেবে দেখি, কথাটা রিনির ক্ষেত্রেও যেমন, রণক্ষেত্রেও তাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *