ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা – ১

০১.

প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয়–নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতন লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতেই জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি।

অবশ্য মহাকাল কারো কারো প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন, মানিক বন্দ্যো, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন।

আর, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। কালের স্থূল হস্তাবলেপ তাঁর গায়ে লাগেনি। প্রতিভার নবনবোম্মেষে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি প্রতিভাত, উদ্ভাসিত। নিত্য নব ভাষাভঙ্গি, নব নব ভাবের উদ্ভাবনায় বিভিন্ন শৈলীর শৈলশিখরে স্বচ্ছন্দ বিচরণে বাঁকে বাঁকে অবাক করা, নিতুই নব তিনি। হিমালয়ের মতই চিরন্তনরূপে সর্বকালীন বলে যেন মনে হয় তাঁকে। চিরদিনের অপরূপের।

কিন্তু ওই মনে হওয়াটাই। যথার্থ বললে হিমালয়ও কিছু চিরকালের নয়। কালস্রোতে সেও ক্ষয় পায়। ভেসে যায়।

তাহলেও এই মনে হওয়াটাই অনেক। ক্ষণস্থায়ীদের ঝরতি পড়তির ভিড়ে এই দীর্ঘক্ষণ স্থায়িত্বটুকু বিস্তর। অমরত্বের ভ্রম জন্মায়। তাই কি কম?

তবে সত্যিকার সর্বকালীন লেখা কি নেই? আছে। সেটা বিধাতার নিজের রচনার। যদিও তা মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে বদলে যায়, তবু তাঁর হাতের স্বাক্ষরে এক চিরকালের আদল বজায় থাকে।

আর আছে তাঁর উচ্চারণায়–যা চারিধারে তিনি চারিয়ে দেন তাঁর প্রতিভূদের প্রতিধ্বনিতে। বেদ উপনিষদ গীতা চণ্ডী বাইবেল কোরআন্ কথামৃত–সেই জাতীয়। তা-ই কেবলমাত্র কালজয়ী। সর্বদাই আনকোরা, সর্বকালের মানুষ তার মধ্যে চিরদিনের জিনিষ খুঁজে পায়–চিরকালের প্রেরণা।

তা বাদে আর সব লেখাই কালক্ষয়ী, কালক্ষয় করার জন্য লেখা এবং পড়া। কালের সাথে সাথে ক্ষয় পাবার।

সত্যিকারের হচ্ছে এই কালস্রোত। নদীর জলধারার মতই চিরন্তন, নিত্য নূতন।

বহতা নদীর ধারে আমার কালজয়ী তাজমহল গড়ে তুললাম, অভ্রংলিহ সেই কীর্তিস্তম্ভ দাঁড়ালো বটে সগৌরবে, কিন্তু নদীর পথ পালটালো, নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেও অন্য ধারা ধরলো সে, সঙ্গে সঙ্গে সেই জলপথে যাতায়াতকারী যাত্রীদলেরও মতিগতি পালটে গেল, ভাব-ভাবনা হয়ে গেল আরেক ধারায়। বহতা নদীর তীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুদূরপরাহত বহুকীর্তিত সেই কীর্তিমন্দির কারো কারো কাছে তখনো হয়ত পরিক্রমণীয় তীর্থ হলেও, নিজের দুর্বহতার বোঝা নিয়ে আর সবার কাছেই তখন তা যত্নসাপেক্ষ প্রত্ন গবেষণার; একদার মিউজমহল কৌতূহলী সকলের কাছে তখন মিউজিয়ম হল্ ছাড়া কিছু নয়।

আমার ধারণায়, আমাদের কারো কোনো লেখাই কখনই কালজয়ী হয় না। হতে পারে না। সব লেখকই ক্ষণকালজয়ী–যদি বা হয়। রূপের মতন সেই মুহূর্তের চোখ আর মন ভোলাতে পারলেই ঢের। তাহলেই সে সার্থক। পরমুহূর্তেই আবার নতুন রুপোদ্দামে নব বসন্তের নতুন মধুপদের আসর জমজমাট। পুরানো রূপসীর দিকে তাকাবার কারো ফুরসৎ কোথায়?

আমার নিজের কথা বলতে পারি, আমি কখনই কালজয়ী হতে চাইনি, এমনকি বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠাতেও নয়। সেই বৃথা চেষ্টার অক্লান্ত সাধনায় কালক্ষয় না করে সকলের জীবনের সকালটা, না, জয় করতে নয়, তার সঙ্গী হতেই চেয়েছিলাম আমি। ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় আমার লেখা পড়বে, একটু বেলা হলে, বড় হলেই অক্লেশে ভুলে যাবে আমায়। সেই একটুক্ষণ তাদের একটুখানি হাসি-হাসি করতে পারলেই আমার খুশি।

কিন্তু গোড়াতেই যেকথা বলেছি, ক্ষণজীবীই হোন আর দীর্ঘজীবীই হোন, খোদা কাউকে কখনো পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেন না, স্বেচ্ছায় না সরলে সরিয়ে নেন–শেষ খোদকারি সেই তাঁরই।

পথচারীদের জন্যে সর্বদাই পথ সাফ রাখতে হয়, ট্রাফিক যেন জামতলায় না জমে।

এক জায়গায় এসে দাঁড়ি টানতেই হয়। আর সবার পক্ষে দেহরক্ষার পর হলেও লেখকের বেলায় তার ঢের আগেই। বলবার কথা ফুরিয়ে গেলেই তাঁর কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না আর। আমার নিজের কথা যদি বলি, আমার কী বলার কথা ছিল আমি নিজেই জানি না। এতদিন ধরে কত কথাই বলেছি, বেশির ভাগই তার আজেবাজে আর হাসির কথাই, নিতান্তই টাকার জন্য, বাঁচার তাগাদায় লেখা–কিন্তু আর না। কিছু বলতে পেরে থাকি বা না থাকি, কিছু বলতে পারি আর নাই পারি–এই লেখাটার পরেই আমার দাড়ি। এইটাই আমার শেষ লেখা আমি আশা করি।

এর পরেও যদি প্রাণে প্রাণে থাকি, প্রাণের দায়ে যদি ফের আমায় কলম ধরতে বাধ্য করে, এই দাঁড়ির পরেও কথা বাড়িয়ে আবার আমায় Comma-য় আসতে হয়, তবে সেই সব বাক্য অবশ্যই আমার মৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করবে, আমি জানি, সে হবে আমার আপন স্বাক্ষরে নিজের ডেথ সেনটেনস।

.

রূপোর ঝিনুক মুখে নিয়ে জন্মাইনি ঠিকই; আর, যদি জন্মাতুমও, তাহলেও ঝিনুকের থেকে মুক্ত হতে আমার দেরি হত না। অল্প বয়সেই আমি বুঝেছিলুম মুখ মোটেই ঝিনুকের জন্যে নয়; আর রূপো না, মুখের সম্মুখে যদি কিছু রাখতেই হয় তো সে হচ্ছে রূপ। ঝিনুকের থেকে মুক্তি পাবার পরেই সে মুক্ত!

সেই নব নব রূপে অপরূপ মুক্তি।

আর এই রূপই হল আমার অভিশাপ। এই রূপের জন্যেই জীবনে আমার কিছু হল না এবং যা কিছু হল তা হয়ত ওর জন্যেই হল। এই অনির্বচনীয়ের স্বাদ বাল্যকালেই আমি পেয়েছিলাম আর তার টানে সেই অতি কৈশোরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম বাড়ির থেকে স্বাধীনতার সাথে শুধু কেবল বহুবিচিত্র রূপের আস্বাদে।

মুক্তির রূপ আর রূপের মুক্তি এক হয়ে মিশে গেছে আমার জীবনে।

এই কারণেই আয়াসসাধ্য কোনো সাধনা আমার দ্বারা হল না, সাধনালব্ধ কোনো সিদ্ধিও নয়। এমন কি, লিখে লিখে জীবনটা কাটলেও লেখকের মত লেখক আমি হতে পারলাম না কোনোদিনই। লেখক হতে হলে যে উদয়াস্ত পরিশ্রম বা নিদারুণ পড়াশোনা বা যে দুর্নিবার দুঃখ ভোগ করতে হয় তা আমার কুন্ঠিতে কই?

লেখক হতে চাইওনি বোধ হয় আমি। লিখতে ভাল লাগে না আমার। প্রেরণার বশে নয়, প্রাণের দায়েই, আর কিছু না হতে পেরেই অগত্যা আমার এই লেখক হওয়া–সাংবাদিক হতে গিয়েই লেখক। ঘরকুনো হয়ে ঘাড় গুঁজে কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে লেখক হবার কোনোদিনই আমার সাধ ছিল না, পাঠক হতেই চেয়েছিলাম বরং। বিধাতা সে বর্ণপরিচয়ের কেতাব আমাদের চোখের সামনে চারিধারে মেলে রেখেছেন সর্বদাই, যার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে মুক্তোর ছাঁদে সোনার আখরে আপন স্বাক্ষরে তাঁর অপরূপ কাহিনী লেখা, নতুন নতুন হরফে নব নব মুদ্রণে মুহূর্তে মুহূর্তেই যে–বইয়ের নিত্য নবীন সংস্করণ, সেই-বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের পড়াই আমার শেষ হয়ে উঠল না জীবনে। লিখিয়ে হব কি, পড়ুয়া হয়েই থাকতে হল আমায় চিরটা কাল। কি সেই ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারলুম কি?

.

যে তিনটি কথা মাথায় করে আমার এই আত্মকাহিনীর শুরু, সে-তিনটির সঙ্গেই, যাকে বলে কমফ্রন্টেশন, সেই বাল্যকালেই আমার হয়েছিল।

সত্যি বলতে, সে সময়টা ছিল কেমন ঈশ্বরপীড়িত। আমাদের বাড়িতে বাবা ছিলেন পরম বৈষ্ণব, বিষ্ণুভক্ত; মা ছিলেন শাক্ত, শক্তির উপাসিকা; আর আমার মামা ছিলেন নাম-সাধক, হরিগুণ গানে বিভোর।

বাবাকে আমার মনে হত মহাদেবের মতন। শিবের মতই ছিল তার চেহারা আর ধরনধারণ। রক্তাভ গৌরকর্ণ চেহারা, সদাপ্রসন্ন, প্রশান্ত, আত্মনিমগ্ন। সংসার-উদাসীন আত্মভোলা। ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম ভাঙত তাঁর। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি গোটা গীতাটা আওড়াতেন। তাঁর মুখে শুনে শুনেই গীতা আর উপনিষদের আদ্ধেক শ্লোক আমার মনে গাঁথা হয়ে গেছল– মানে তার বুঝি আর নাই বুঝি। সেই পুঁজিই আমার সারা জীবন ভাঙিয়ে খাওয়া।

মার কাছে প্রায়ই আসত লাল চেলীপরা ত্রিশূলধরা ভৈরবীরা–তিব্বতের কোন মঠ না কামিখ্যে থেকে কে জানে! মার সঙ্গে নিভৃতে আলাপ হত তাঁদের। দিনকতক থেকে ফের কোথায় তাঁরা চলে যেতে যেন।

এক ভৈরবী আমায় ভালোবাসতেন ভারী। পেড়া-টেড়া খেতে দিতেন তার বোলার থেকে। দেবী কামাখ্যার মহাপ্রসাদ। তিনি একবার আমায় বলেছিলেন-তোমার মাকে সামান্য মনে কোরো না বাবা। জগন্মাতার অংশ আছে তার মধ্যে। মাকে কখনো অমান্য কোরো না।

মাকে আমি ভালোবাসি তে।

মা সাক্ষাৎ ভগবতী। মা-ও যা–মা দুর্গাও তাই। তিনি বলতেন।

জানি আমি। জবাবে আমি বলতাম–সবার মা-ই তো তাই। মা দুর্গাই। তাই না?

শুনে শুনেই এসব কথা জানা। আমিও শুনিয়ে দিতে ছাড়তাম না।

তাই বটে। তবে তোমার মা আরও বিশেষ।

কিন্তু কী যে সেই বিশেষ তা তিনিও কোনো দিন খুলে বলেননি, আমিও তা জানতে চাইনি কখনো। মার সেই বিশেষত্ব সারা জীবন ধরে আমায় জানতে হয়েছে। জীবন ভরে জেনেছি। আর, পৃথিবীর সঙ্গে আমার মুখোমুখি হয়েছিল সেই বয়সেই। মাথার মধ্যে কী পোকা ছিল কে জানে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোতো, আর মাঝে মাঝেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম বিবাগী হয়ে। পকেটে একটিও পয়সা না নিয়ে পাব কোথায় পয়সা?) বিনাটিকিটে রেল গাড়ির লম্বা লম্বা পাড়ি জমাতাম-চলে যেতাম বৈদ্যনাথধাম। দেওঘরের দেবতা কি প্যাড়া কিসের টানে তা আমি বলতে পারি না।

চলে এসেছি কলকাতায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, খবরকাগজ ফিরি করেছি, জেল খেটেছি মাঝে মধ্যে, ফুটপাথে পার্কে শুয়ে রাত কেটেছে। কষ্টের মধ্যেও কতো সুখ। স্বাধীনতার স্বাদ।

আর, ভালবাসা? তার পরিচয় কাউকে বোধ হয় চেষ্টা করে পেতে হয় না, সে নিজেই আগ বাড়িয়ে জানান দিয়ে থাকে। ই একটি বস্তু, যা কারোর দ্বারা কিছুতেই লভ্য নয়, (পাওয়াও যায় না বোধ হয়) নিজগুণে আপনার থেকে অযাচিত এসে ধরা দেয়।

চলার পথের মোড়ে মোড়েই তার দেখা মেলে। দেখতে না দেখতেই বেঁচে উঠি, বেঁচে বেঁচে যাই। নতুন করে বাঁচি, নতুনতরো আঁচ পাই জীবনের। কি করে যে একজনকে আরেকজনের এমন ভালো লেগে যায়, আর কী আশ্চর্য, তাকেও ভালো লাগানো যায় তেমনি আবার–কত সহজেই না! আমার কাছে সে এক পরম বিস্ময়-পরামাশ্চর্য রহস্য:

ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা–প্রত্যেকের জীবনেই ওতপ্রোত। কেউ বঞ্চিত নয়। প্রত্যেককেই টের পেতে হয় কখনো না কখনো, না টে: পেয়ে উপায় নেই, যিনি এই নাটের গুরু তিনিই টের পাওয়ান।

আর, বাল্যকালেই এসবের টের পেয়ে যাওয়া এক রকমের ভালোই বোধ করি। কেননা, ব্যাধি হিসেবে এই তিনটিই মারাত্মক–এই ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা। তেমন করে ধরতে পারলে এ বস্তু কাউকে ছাড়ে না, রেহাই দেয় না সহজে, আজীবন ভোগায়, আপাদমস্তক গ্রাস করে বসে। সংসার, সারাৎসার আর…আর ভালোবাসার কী আখ্যা দেব? অন্তঃসার? নেহাৎ অন্তঃস্রাব ছাড়া কী আর ও? এর একটিই যদি কাউকে ধরে তো তার হয়ে গেল। জীবনের মতন ছাড়ান নেই। ঘোর সংসারী, যোরালো প্রেমিক কিংবা ঘোরতর ঈশ্বরসাধক হয়ে গেল সে। হতেই হবে। পরিত্রাণ নেই আর।

তাই কৈশোরেই কারো যদি এসবের টিকা নেয়া হয়ে যায়-খানিক খানিক স্বাদ পায় সেতো জন্মের মতই বেঁচে গেল বেচারা!

সটীক হয়ে থাকলে সঠিকভাবে বাঁচা যায় জীবনভোর। বাল্যে বসন্তের টিকা নিয়ে রাখলে তা যেমন কখনো প্রাণান্তকর হয়ে দেখা দিতে পারে না, দিলেও হামের মতই হামেশার সামান্য ব্যাপার হয় মাত্র, তেমনি প্রাথমিক এই ত্রিবিধ টিকায়–এই ট্রি অ্যানটিজে নেয়া থাকলে সারা জীবন ধরে পৃথিবী, ঈশ্বর আর ভালোবাসার পার্থিব আর অপার্থিব সেই বসন্তকালকে অল্পে অল্পে একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে চেখে চেখে যাওয়া যায়-খাওয়া যায়।

তাকেই খাই, তাঁর খাদ্য হতে হয় না।

পরাৎপর হলেও সেই মহাকাল যেন পরাস্ত হয়ে থাকে।

বিবেকানন্দের ভাষায় অমৃত ভাণ্ডের কিনারে বসে তার কিনারা করা। তার ভেতরে ডুব দিয়ে মজে ভূত হয়ে যাওয়া নয়, তাকে কিনারায় রেখে বহালতবিয়তে থেকে দেখেশুনে চেখে যাওয়া।

ভবানীর ভাঁড়ে হারিয়ে না গিয়ে, মিলেমিশে তাঁর সাথে একাকারে নিজেও ভাঁড়ে ভবানী না হয়ে, নিজের ভাঁড়কেও ভবানী না বানিয়ে ভবানীর ভাড়ার লুঠ করা আর কি!

একদিন বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি মা আমার বিরাট দরদালানে কেমন যেন অভিভূতের মতন দাঁড়িয়ে।

আমাকে দেখে বললেন, জানিস কে এসেছিল আজ?

কে?

মা এসেছিলেন।

দিদিমা? তাই নাকি? কই কই? কোথায় দিদিমা? আমি লাফিয়ে উঠেছি।

না, তোর দিদিমা নয়। তোরও মা। তোর মা, আমার মা, সবার মা। তিনিই একটু আগে এসেছিলেন।

শুনে আমি হতবাক হই। বুঝতে পারি না ঠিক।

মা কালী আমায় দর্শন দিয়ে গেলেন একটু আগে। এই সামনে, ওইখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন–যেখানে তুই দাঁড়িয়েছিস। ওই জবাফুলটা দিয়ে গেলেন আমায়। আমার হাতে তুলে দিতে এসেছিলেন। ভয়ে আমি হাতবাড়িয়ে নিতে পারিনি। হতচ্ছাড়ী আমি!

সামনেই একটা জবাফুল পড়েছিল আমি দেখলাম। দেখেশুনে আমি শিউরে উঠেছি কেমন।

কাছেই একটা গোরু বসে জাবর কাটছিল, কিন্তু জাবর কাটা সে ভুলে গেছে কখন  রোমাঞ্চিত হচ্ছে তখনো। মনে হয় সেও বুঝি মা কালীকে দেখেছে।

আর, সত্যি বলতে, দিব্যদর্শনের গোরুত্ব তখনই আমার মালুম হয়েছিল। সেই দণ্ডেই।

.

০২.

আত্মস্মৃতির পরিক্রমায় এগুবার আগে নিজের কুল পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন আছে বেঙ্গ করি! কিন্তু ছোটবেলাতেই যে নিরুদ্দেশের অকূলে ভেসেছিল আজ এত ঘাট পেরিয়ে, অবশেষের বালুবেলায় এসে জীবনের শেষ তীর্থ আত্মবিস্মৃতির উপকূলে পৌঁছে নিজের কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানো সম্ভব নয় বোধ হয়।

মহাকালের মোহনায় দাঁড়িয়ে গত কালের মোহ না রাখাই ভো ভালো। যখন সামনে চোখ রেখে কিছুই দেখা যায় না তখন পিছনে তাকিয়ে থেকে লাভ? মহাসাগরের অতলে ডুবে যাবার আগে নিজের মনে র দেওয়াই তো বেশ। কিন্তু…

দিন কতক আগে এক ভদ্রলোক এসে এমন বেকায়দায় ফেললেন আমায়! অমুক পত্রের পক্ষ থেকে আমি আসছি। তিনি জানালেন, আমাদের পত্রিকায় আমরা আপনার জীবনকথা ছাপতে চাই…।

শুনেই না আমি চমকে গেছি। আমার প্রতি কোনো পত্রিকার এহেন পক্ষপাতের হেতু খুঁজে পাই না আমার জীবনের কথা আসছে কোথা থেকে? আমি জন্মালাম কবে যে আমার… বাধা দিয়ে বলতে যাই।

আমরা অমুক অমুক অমুক সাহিত্যিকের আত্মপরিচয় ছেপেচি, সেই পর্যায়ে আপনারটাও প্রকাশ করতে চাই আমরা।

তাদের পর্যায়ে আমি পড়ি না। সবিনয়ে জানাই তারা যথারীতি জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন, বাড়ছেন, আরো বাড়বেন–তাঁরা জীবন্ত। তাঁদের পূর্বসূরী উত্তরসুরী দুই-ই আছে। তাঁদের জীবনী অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু আমার কথা আলাদা।

আলাদা কেন?

কারণ এই যে, আমি নিজেকে সাহিত্যিক বলেই মনে করি না। সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা আমি সৃষ্টি করতে পারিনি। গাইতে না পারলেও অনেকের গান বোঝার ক্ষমতা থাকে,আমারও অনেকটা সেইরকম। স্বয়ং সাহিত্যিক না হয়েও আমি সাহিত্য বোঝার সামান্য একটু ক্ষমতা রাখি।

সাহিত্য বলতে আপনি কি বোঝেন? জানতে পারি কি?

যা সর্বকালের সর্বজনের সহিত যায়, যেতে পারে। সহযাত্রার শক্তি রাখে। সর্বজনের সর্বক্ষণের সম্পূর্ণ মনের সঙ্গমক্ষেত্র, আমার মতে, তাই সাহিত্য। সে রকম লিখতে পারে কজনা? আমি তো পারি না। আমি তা পারি না। তাই আমি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর থেকে আলাদা।

সাহিত্যিক নন কী আপনি?

সাহিত্যিকরা সবাই মহৎ স্রষ্টা, স্বভাবতই প্রেরণার বশেই তাঁরা লেখেন। সামান্য লেখকমাত্র, কলমচালক কেবল, আমি লিখি নিতান্তই টাকার জন্যে। লিখে খাই আর নিজের খাই মেটাবার জন্যেই লিখি। প্রেরণার আদায়ে নয়, প্রাণের দায়ে আমার লেখা।

প্রাণের দায়ে লেখা?– হ্য। লিখতে আমার একটুও ভালে লাগে না। যা কষ্ট হয় কী বলব! না লিখতে হলে বেঁচে যাই। লিখতে মেহৎ,বহুৎ পরিশ্রমের ফল সেই লেখার গা থেকে ঘাম মুছতে মেহনৎ আবার। আদৌ সাহিত্যিক নই। আমি মেহনতি জনতার একজন। মজদুরের সগোত্র।

সব লেখকই লিখে টাকা পান, তা বলে টাকার জন্য লেখেন এমন কথা বলা যায় কি?  তিনি বলেন।

গায়ে জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না তার বদলে এই কলম টানি। কলমের ওপর টান আমার এইটুকুই। আমি জানাই।–সাহিত্যের সঙ্গে আমার সংযোগ ততখানিই।

তাহলেও আপনি লেখক তো নিশ্চয়ই। অনেক লিখেছেন, শখের খাতিরে না লিখলেও নেহাৎ মজুরির জন্যেই আপনার এত লেখা এ কথা ঠিক মানা যায় না।

লেখা আমার পেশা হলেও পিষ্ট হয়েই আমার লেখা। বেশ, মজদুর বলতে না চান মুটে বলতে পারেন আমায়। মোট ফেলেই আমার খাওয়া; মোটামুটি লিখে মোটের উপর কিছু পেয়ে যাওয়া।

যাই বলুন, এদেশের মাপকাঠিতে আপনাকে সাহিত্যিকের মধ্যেই গণ্য করা যায়…

আমি গণ্য করি না। সাংবাদিক বলতে পারেন ইচ্ছে করলে। আসলে আমি হচ্ছি ছোটদের লেখক–ছোট লেখক।

বড়দের লেখা দিয়েই আপনি শুরু করেছেন বলে শোনা যায় …

সেসব লেখা দেখা যায় না আর। কোথায় তলিয়ে গেছে কে জানে! আমারও সেই দশা হত, কোথায় চলে যেতাম অ্যাদ্দিন, ভাগ্যিস সেই ছেলেবেলাকার ছড়াটা মনে পড়ে গেল বড়ো যদি হতে চাও ছোট হও তবে-তাই আমি ছোট-র হয়ে গেলুম ছোট লেখক,– ছোটদের লেখক হয়ে গেলুম-রয়ে গেলুম শেষ পর্যন্ত।

বড় হলেন তো শেষ পর্যন্ত।

আমি হইনি ঠিক। আমার পাঠকরা হয়েছে। বেড়ে উঠে তারা দিল হয়েছে একেকটা। তারা আমায় টেনে তুলতে চেয়েছে বলে আজ আমার এই বাড়বাড়ন্ত।

এরকম তো হয় না বড় একটা। বড় হয়ে ছোটবেলার লেখকদের ভুলেই যায় ছেলেরা।

কারণ আছে তার। আমার লেখায় ছোটদের কখনই আমি ছোট বলে ধরিনি, অবোধ শিশু বলে গণ্য করিনি কখনো। আমার সমকক্ষ বলেই ধরেছি তাদের। বয়স্ক বন্ধুর মতন বিবেচনা করেছি। বড় হবার উপদেশ নয়, বড়ত্বের স্বাদ পেয়েছে তারা আমার লেখায়।

সেই আস্বাদ তাদের মনে লেগে রয়েছে এখনো। সেই কারণেই হয়ত এটা হবে।

আপনি ছোটদের একজন প্রিয় লেখক আমি জানি। আপনার শিশুসাহিত্য ছোটরা খুব ভালবাসে।

সে আমি শিশু সাহিত্য করি না বলেই। করি নানা বলে পারি না বলাটাই ঠিক। সত্যিকার শিশুসাহিত্য করেছেন দক্ষিণারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর, কুলদাচরণ, সুখলতা রাও, সুকুমার রায় প্রভৃতিরাই-শিশুদের জন্যই লিখেছেন–শিশুদের মত করেই লেখা। সে কলম আমি পাব কোথায়! এ যুগে সে লেখনী আর সেই লেখা হারিয়ে গেছে বলেই আমার মনে হয়। কারো কারো হাতে সে ধরনের লেখা এখনও খেলা করে বটে, কিন্তু সে অতি বিরল।

একালের সেই বিরল দৃষ্টান্ত কারা? তিনি জানতে চান।

মোহনলাল, সুকুমার দে সরকার, সতীকান্ত গুহর নাম করা যায়। এর পরের ধাপে মানে কিশোর সাহিত্যের পর্যায়ে পড়েন, হেমেনদা, প্রেমেন, নারাণ গাঙ্গুলী। লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, ধীরেন ধরকেও ধরা যায়…

আর আপনি? আমি এঁদের ধারেকাছেও নিজেকে ধরাতে পারি না। আমার ছোটদের লেখায় কিছু পোলা থাকে আর কিছু পান্ থাকে–এছাড়া কী আছে আর? পোলাপানদের জন্যে লেখা আমার শিশুসাহিত্য পড়ে তাই কি আপনার ধারণা হয়নি? আমার লেখায় বেশ ভেজাল আছে, সেই অ্যাডালটারেটেড লেখা ছেলেমেয়েদের অ্যাডাল্ট বানিয়ে ছাড়ে। আর সেই জন্যেই হয়ত তারা তা ভালোবাসে…। কোনো হিতোপদেশ নেই আমার লেখায়, আদর্শ স্থাপনের বালাই নেই কোনো, কোনো বাণী দিইনে আমি সেই জন্যেই হয়ত শোনার যোগ্য মনে করে তারা। বলুন, বাণী দেবার আমার কী আছে, সোনাই আসলে নেই যেখানে। খাঁটি সোনার নয়, পরিপাটি গিটির–সেই কারণেই আমার রচনায় এত ঝুটো অলঙ্কার, এমন পানঝাল, বুঝেছেন? পারা বাদ দিলে আমার লেখায় কী থাকে, আর এই কারণেই একটা গিটি বোধ সর্বদাই আমার মনে।

ভদ্রলোক চুপ। আমার নিজের প্রতি নিজেরই দাক্ষিণ্যের অভাব দেখে বুঝি তিনি নিরুত্তর হয়ে গেছেন।

আমার নিজের কী মনে হয় জানেন? শিশুসাহিত্যের সেই স্বর্ণযুগ আর নেই। শিশুই নেই তো শিশুসাহিত্য। শিশু কোথায় এখন? শিশুরা আর জন্মায় না, জন্মালেও বেঁচে থাকে না বেশিদিন, মানে, ঐ শৈশব অবস্থাটা অতি ক্ষণস্থায়ী এখন। সময় গতিকে শিশুরা সব বয়স্ক হয়েই জন্ম নিচ্ছে, দেখতে না দেখতে বুড়িয়ে যাচ্ছে–দেহের দিকে নয়, মনের দিক থেকে। এখনকার ছেলেমেয়েদের ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প দিয়ে ভোলানো যায় না, পক্ষিরাজ ঘোড়া আর তালপত্রের খাড়াঁয় তারা ভোলে না, চন্দ্রাভিযানের এই যুগে চাঁদের রকা কাটার বুড়ির সুতোর মায়ায় জড়ানো যায় না তাদের। কল্পলোকের গল্পকথা এখন অচল। শিশুসাহিত্যের সেই সত্যযুগ গেছে, এখন তার এই ঘোর কলিতে তাই আমার এই গাঁজার কল্কি।

না, কী বলছেন। আমার তরফে তাঁর ওকালতি–গাঁজা নয়।

গাঁজা কি না আমি জানি না। গাঁজানোই। তবে কী জানেন? লেখা মাত্রই নেশা ধরায়-গাঁজা হোক বা না হোক। নেশা না ধরলে–না ধরাতে পারলে, পেশা চলে না। এটা সব শিল্পেরই কুলকথা, মূলকাহিনী। তবে আসল কথাটা এই, ছেলেমেয়েদের আমি ভোলাতে চাইনি, ঠকাতে চাইনি, সজাগ করে দিতে চেয়েছি তাদের চোখ কান মন ফুটিয়ে দিয়ে…আজকের পৃথিবীর, এখনকার জীবনের একেবারে মুখোমুখি করে দিতে চেয়েছি।

সেই কথা বলুন।

এখনকার ছেলেমেয়েরা যেন তেল সলতে নিয়ে তৈরি হয়েই জন্মেছে, প্রদীপের মতই উন্মুখ। দেশলাই কাঠি ঘষে দিলেই প্রদীপ্ত। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ। শৈশবের থেকে এক লাফেই, এক ধাপেই যৌবনে। সত্যি বলতে, সব শিশুর মধ্যেই সম্পূর্ণ মানুষটি রয়েছে। পরিণত হবার প্রত্যাশায়–পুরোপুরি জেগে উঠতে চায় সে। সোনার কাঠি ছোঁয়ালেই হলো। তাহলেই চোখে কানে মনে সে সজাগ। বালক-বালিকার ছদ্মবেশে বিশ্বজয়ীর দল। সাহিত্যের কাজ হলো তাদের এই জাগিয়ে দেওয়া। এবং শিশুসাহিত্যই বলুন আর কিশোর সাহিত্যই বলুন, সর্বাগ্রে তাকে সাহিত্যই হতে হবে।

নিশ্চয় নিশ্চয়। তিনি মেনে নেন আমার কথাটা।

দুধের বদলে পিটুলি গোলায় ভোলালে তাদের চলবে না। সেকালে যেমন সদ্যকিশোরকে ব্রহ্মবোধের দীক্ষা দিয়ে ঈশ্বর সাক্ষাতে নিয়ে যাওয়া হত, একালে তেমনি জীবনবোধের শিক্ষা দিয়ে তাকে বিশ্বের সাক্ষাতে নিয়ে যাওয়া–সে যুগের উপনয়নের মতই এই উপনয়ন দুনিয়ার দরবারে তাকে পৌঁছে দেওয়া। এই জন্মের মধ্যেই আরেক জন্ম লাভ, শুধু দ্বিজত্ব মাত্র নয়, আরো আরো অনেক জন্ম লাভের বোধ সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা লাভ করি। সাহিত্যই আমাদের তৃতীয় নয়ন তার সাহায্যেই আমরা নিজেকে অপরকে জগতকে যথার্থরূপে দেখতে পাই। সাহিত্যই সেই দৃষ্টি-প্রদীপ। সাহিত্যিকের দায়িত্বও তাই এই মনের চোখ খুলে দেওয়া। হৃদয়কে জাগানো।

সে কথা মানি।

আমিও সেই দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছি–আমার সাধ্যমত। কতটা পেরেছি জানিনে, কিন্তু ছোটবেলাতেই যাতে তারা নিজেদের পরিবেশ-সমাজ সংসার মানুষের ধরণধারণ সম্বন্ধে সচেতন হয়, জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে, প্রয়াস পেয়েছি তার। জীবন আর জগতের সব কিছুই তাদের জানাতে চেয়েছি–যদিও একটু তির্যকভাবে আড় চোখে দেখলে দেখা যায় আরো। সোজাসুজি না বলেও বোঝাবুঝির কোনো অসুবিধা হয় না-বুঝলেন? এমনিতেই ছোটরা আমাদের চেয়ে বেশি বোঝে, বেশি বুঝদার।

এটা কী বললেন?

ঠিকই বলেছি। ছোটবেলায় বোধশক্তি স্বভাবতই তীব্র থাকে। অনুভবের দ্বারা তারা বোধ করে–কেমন করে যেন বুঝতে পারে সব। ছেলেবেলায় সকলেই খুব চালাক চতুর চৌকস থাকে, তারপরে যতই বড় হয়, হতে থাকে, চারধারের ধাক্কা খেয়েই হয়ত বা, ততই আরো ভোঁতা হয়ে বোদা মেরে যায় কেমন! নিতান্ত বোকা কিংবা অতিবুদ্ধি হয়ে, বুদ্ধিজীবী বনে বন্ধু হয়ে যায় বোধ হয়।

হ্যাঁ, ছোটরা যে বড়দের চেয়ে চালাক, চৌকস সেটা লক্ষ্য করেছি–

আর আমার গল্প পড়ে হয়ত তারা আরো একটু চোখা হয়। আমার লেখার পয়েন্ট সেইখানেই… যা এ কথা, আপনি কী বলছিলেন?

আমি এসব কথা আলোচনার জন্য আসিনি। আপনার জীবনকথা জানার জন্যই এসেছিলাম, কিন্তু আপনি ধান ভানতে…

কথাটা যেন তিনি উলটো বললেন মনে হলো। ধান ভানতে শিবের গীত নয়, শিবের গাজন শুনতে এসে টেকির বাদ্যি শুনতে বাধ্য হয়েছেন! টেকির ঢক্কা নয়, শিবের গীত শুনতেই তিনি উগ্রীব।

আমার জীবনকথা আবার কী! সবার জীবনও যা আমারও তাই, আমি জানাই।–এমন কিছু ভিন্নতর নয়, সবার মতই। কোথাও হয়ত বা একটু ইতরবিশেষ, কোথাও একটু বিশেষভাবে ইতর। এই যা।

তা কি কখনও হয় নাকি?

যেখানে আর সবার থেকে আমি আলাদা তা আমার আর্টে। এই আটই লেখক শিল্পীর শিল্পসত্তা। তার বেঁচে থাকা, পেশায় এবং নেশায়। এ ছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব নেই। শিল্পীর এবং তার শিল্পের কোনো অতীত কথা নেই, ভবিষ্যৎ বার্তাও নেই কোনো। সমস্তটাই তার বর্তমান।

বর্তমান?

সব সময়ই বর্তমান। সবার চোখের ওপর–সর্বদাই। মহাত্মা গান্ধীর জীবনই যেমন হ্যাঁ বাণী, শিল্পায়া লেখকেরও তেমনি সে যা বানিয়েছে তাই তার জীবন। তার বাইরে কি নেই। সেই জীবনকাহিনীই তো জানালাম এতক্ষণ আপনাকে।

.

০৩.

বিলক্ষণ! নিশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক : আপনার আর্ট তো খালি কথার খেলায়।

বহির্লক্ষণ তাই বটে। কিন্তু এহ বাহ্য। বাহ্যদশার মতন অন্তর্দশাও থাকে, এমনকি ও শব্দদেরও। আমি বললাম : কথার খেলাকে নিতান্ত খেলার কথা ভাববেন না। শব্দকে ব্র বলা হয়েছে। ব্রহ্মের রহস্য কী, আমি জানিনে, কিন্তু শব্দদের চিরদিনই আমার রহস্যম মনে হয়। একেকটি word যেন একেকটি world! তার মন নিয়ে, মনন নিয়ে স্বত এক একটি শব্দ, প্রায় মন্ত্রের মতই, কেবল যে তার অর্থের সহিতই জড়িত তাই নয়, তা মধ্যে একাধিক অর্থ, বিচিত্র রস, আশ্চর্য দ্যোতনা, সব উহ্ন থাকে। আমি গুহ্য কথাট প্রকাশ করতে যাই।

এ আবার কোন শব্দতত্ত্ব আনছেন?

নিজেই জানি না। এক স্বরে একাধিক ব্যঞ্জনা এক ব্যঞ্জনায়, একাধিক স্বর, ভাবলে অবাৰ হতে হয়। এক কথার পাঞ্জনায় অর্থবহ একাধিক বাক্যের ব্যঞ্জনা। অবাক হয়ে ভাববার শব্দরূপ, শব্দরস, আর শব্দতত্ত্ব–সব মিলিয়ে পরম রহস্য–আমি হয়ত চেয়েছিলাম তা দিয়ে জগন্নাথের ভোগ বানাতে, জগন্নাথ মানেই জগজন। কিন্তু আমার অক্ষমতায় তা হয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নেহাৎ জগাখিচুড়ি।

আপনার ক্ষোভের কারণ নেই। জগজন না হোক, জগতের বালকজন আপনার সে খিচুড়ি খেয়ে বেশ খুশি। জগত বলতে অবশ্যি আমাদের এই বাংলা দেশ।

সুবোধ বালক তারা–যা পায় তাই খায়, তাতেই খুশি। তাদের কথা ছেড়ে দিন।

আপনিও ও কথা ছাড়ুন। কথার কথা থাক্‌, কাজের কথায় আসা যাক। যে জন্যে এসেছিলাম–ভুলে গেলেন নাকি? আপনার জীবনকাহিনী …

আমার জীবন আমার যত কাহিনীর মধ্যেই বিধৃত, বিবৃত। তার মধ্যেই তারা ধরা পড়েছে, ধরা রয়েছে। খুঁজে পেতে সমঝে নিতে হবে। আমার কাহিনীই আমার জীবন, আর জীবনই আমার যত কাহিনী।

তার মানে?

নিজের জীবন নিয়েই আমার যত গল্প লেখা, বুঝলেন কিনা, আমার জীবনটা অনেকটা গল্পের মতই। জীবন দেখে, জীবন থেকেই তো সাহিত্য ছেকে নিতে হয়। আমার জীবনে আমার নিজের জীবনটাই ঘুরে ফিরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছি কেবল, সীমিত ক্ষমতা নিয়ে তার বাইরে আর যেতে পারিনি, তাই ঘুরে ফিরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই জীবনটাকেই দেখিয়েছি আমার রচনায়।

আপনি লিখেছেনও তো নেহাৎ কম না মশাই!

জীবনও তো বিপুল। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, দিগ্বিদিকে বিস্তৃত। ইতো নষ্ট স্ততো ভ্রষ্ট। বেশির ভাগই ট্রাজেডি। তবে কিনা, একজনের দুঃখের কারণ অপরের উপভোগের বস্তু হতে পারে। আমার জীবনের বিয়োগ-যোগগুলি আমি তাই অপরের উপভোগ্য করে তুলেছি। নিজের দুঃখেই কাঁদছি, কতক্ষণেরই বা সে কান্না! তাই দিয়ে আবার অন্যকে কাঁদিয়ে কী লাভ?

তা বটে।

তবে কিনা, সর্বজনীন সাহিত্য সৃষ্টি করতে সবার জীবন দেখে, সকলের জীবন থেকেই নিতে হবে। কিন্তু বলেছি তো, আমার ক্ষমতা অতি সীমিত, উৎসাহও পরিমিত। কুলী কামিনের কাহিনী লিখতে হলে কয়লা-কুঠিতে কাটাও, বস্তির চরিত্র বানাতে পাঁকের মধ্যে মজো, গঙ্গার গল্প লিখতে গিয়ে জেলে হও, জেলেদের সঙ্গে মেশো গিয়ে, আর কয়েদখানার কাণ্ড জানতে হলে কষ্ট করে জেলে যাও। এবং জেলে গিয়ে কষ্ট করো। পাহাড়ে পরিবেশের পরিচয় দিতে বিস্তর চড়াই উতরাই পেরোও। কিন্তু পায়ের হাড় শক্ত নয় যে পাহাড় পার হই, তাই কোনো মহাপ্রস্থানের পথে না গিয়ে ঘরে বসে নিজেকে দেখে নিজের থেকেই আমার এই প্রবোধলাভ।

নিজেকে জানলে সবাইকে জানা যায় বলে যে। তিনি বলেন- তাই বা মন্দ কি?

হ্যাঁ, মন্দ কি! পহেলা, আত্মানং বিদ্ধি। প্রথমে নিজেকে বিদ্ধ করে তারপর আর সবাইকে বিদ্ধ করা। লক্ষ্যভেদ করা নিয়ে কথা। আমিও সেই কথাই বলি। সেই সঙ্গে এই কথাও বলি, আমার সাহিত্য সর্বজনীন, সর্বকালীন এমনকি সর্বাঙ্গীনও হয়নি। সত্যি বলতে, তা সাহিত্যই নয় হয়ত।

সাহিত্যই নয়। তাহলে কী হবে?

বলেছি তো জগাখিচুড়ি। তবে কিনা খিচুড়িও একেক সময়ে ভালো লাগে। বাদলার দিনে তাতেই মজে যায় সবাই। তাই যদি বা কখনো মানুষের পাতে পড়ে, ভোগে লাগে। তার জীবন যন্ত্রণার একটুখানি ভোলানোর জন্যেই আমার এই হাসির পরোয়ানা। দুঃখের পরোয়া না করার। তবে তাতেও কতটা সিদ্ধকাম হয়েছি তা জানিনে।

আপনার গল্পকথা থাক, সে তত আপনার বই পড়লেই জানা যায়। আমি এসেছি আপনার কথা জানতে, আপনার নিজের মুখ থেকে। আপনার ঠিকুজি কুলজি নিতে।

আমার কোনো কুলের খবর আমি রাখিনে। ছোটবেলায় বাড়ির মায়া কাটিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন, পিতৃকুলে, বাবার নামটুকু জানি খালি, ঠাকুর্দার নাম জানিনে। মাতৃকুলে দাদামশায়ের নাম জানতাম, ভুলে গেছি এখন। বেণীমাধব চৌধুরী না কে। কোন না কোথাকার জমিদার ছিলেন, নেহাত জমিদার না হলেও কোনা বলে কোনো জায়গার ভারী জোতদার জাতীয় ছিলেন বোধ হয়, তাঁদের বংশের কে বেঁচে বর্তে আছেন জানা নেই। তিনকুলের পিতৃকুল মাতৃকুল মামাতৃকুল গেল, তারপর জামাতৃকুল। তাও আমার নাস্তি।

জামাতৃকুল?

হ্যাঁ। তাও নেই। মেয়ে থাকলে তো জামাই। মেয়েই নেই, বিয়ে হয়নি বলে।

বিয়ে হয়নি কেন?

পৈতে হয়নি বলে বোধহয়। সেকালে অসবর্ণ বিবাহ ছিল না। পৈতে নেই, অচেনা বামুনকে কে মেয়ে দেবে? আর, বিয়ে যখন হয়নি আমার শ্রাদ্ধও হবে না আশা করি। ছেলে নেই, পিণ্ডি চটকাবে আর ছেরাদ্দ করবে কে?

আপনি খালি কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন। কোথায় গেলে আপনার কুলের খবর পেতে পারি তাই বাতলান।

কোথায় পাবেন। নিজের কুলকিনারা পাই এমন আমার ক্ষমতা নেই। কোথায় যাবেন?

আপনার বন্ধুকুলের কারো কাছে?

বন্ধুকুল। পৃথিবীতে বন্ধু বলে কেউ আছে আমি জানিনে। ধু আমার নয়, কারো আছে কি না সন্দেহ। বন্ধু পাওয়া যায় সেই ছেলেবেলায় স্কুল-কলেজেই। প্রাণের বন্ধু। তারপর আর না। আর না? সারা জীবনে আর না?

জীবন জুড়ে যারা থাকে তারা কেউ কারো বন্ধু নয়। তারা দুরকমের। এনিমি আর নন এনিমি। নন্‌-এনিমিদেরই বন্ধু বলে ধরতে হয়।

আপনার বেলায়?

আমার কেউ এনিমি নয়। এ পর্যন্ত পায়নি একটাও। কিন্তু তারা কেউ আমার কোনো খবর জানে না।

কেন, ভবানীবাবু তো অনেক খবর রাখেন আপনার। তাঁর লেখা অমৃতের কাছে বসে শোনা সিরিজে আপনার কথা বেরিয়েছিল…

তাঁর মহিমা। আগাগোড়া মনগড়া। আমি তাকে কাছে বসে কখনো কিছু শোনাইনি। তাকে শোনাবার আমার কিছু নেই এই কথা তাঁকে জানাতে যেদিন তাঁর বাড়ি গেলাম, শুনলাম তিনি আগের দিনই তার লেখাটা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন কাগজে। যথাসময়ে আমি যেতে পারিনি তাই।

পড়েননি লেখাটা?

পড়েছি। পড়ে আমি তাজ্জব। বাল্মীকির যেমন রাম না হতেই রামায়ণ রচনা, তারও তেমনি এই ব্রিামায়ণ কাণ্ড! আপন মনের মাধুরি মিশায়ে সেই আশ্চর্য সৃষ্টি। তিনি যে অসাধারণ কথাশিল্পী তার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর ছাড়া কিছু নয়।

বলেন কি!

আমার ভাঁড়ে ভবানী তা জানি, কিন্তু–ভবানীর ভাঁড়ে যে এতও আছে তা আমার জানা ছিল না। গল্প লেখায়, মহৎ জীবনী রচনায়, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমীক্ষা, সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর জুড়ি নেই, আর ভাঁড়ারও অফুরন্ত তা জানতাম, কিন্তু একটা নগণ্য ভাঁড়কে এমন কাণ্ড করা–সত্যিই অদ্ভুত! অবাক করা কাণ্ডই! সামান্য ভাণ্ডে ব্ৰহ্মাণ্ড দেখানোর মত বাহাদুরি আর হয় না!

প্রেমেনবাবুও তো আমার বন্ধু শিব্রাম বলে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন কোন কাগজে, পড়েননি? সেটাও কি বানানো?

পড়েছি। কে একজন এনে পড়িয়েছিলেন লেখাটা। না, সেটা বানানো নয়। সত্যি ঘটনাই। প্রেমেনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আমার জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনাই। এক সিনেমা হাউসেই সেটা হয়েছিল। অবশ্যি, তার আগে কল্লোল কার্যালয়ে তাকে দেখেছিলাম, কিন্তু সেখানে কোনো কথা হয়নি–আলাপ হয়নি–আলাপ জমেছিল সেই সিনেমাতেই।

কোন্ সিনেমাতে?

আমার ঠিক মনে নেই। এখনকার এলিট-এই হবে বোধকরি। স্মরণীয় হলেও কোনো কিছু আমার মনে থাকে না, ধরে রাখতে পারে না আমার মন। এমনিই আমার স্মরণশক্তি। কিন্তু আশ্চর্য স্মরণশক্তি ওর, সিনেমা হলের সামান্য খুঁটিনাটিটা পর্যন্ত সে মনে করে রেখেছে। তার সেই লেখাটাতেই দেখা গেল। না মশাই, তাতে আমার বিষয়ে কোনো অত্যুক্তি নেই। প্রায় সব ঠিক কথাই।

প্রায়?

একেবারে ঠিক ঠিক এ দুনিয়ায় কিছুই হয় না, হতে পারে না। সবই যেন প্রায় প্রায় হয়ে যায়।

আবার অচিন্ত্যবাবুও আপনার কথা লিখেছেন তাঁর কল্লোলযুগে।

শুনেছি, কিন্তু পড়া হয়নি। সেটাও নিশ্চয় অচিন্তনীয় কিছু হবে। ওর মন তো কারো কোনো খুঁত দ্যাখে না, সবার ভালো দিকটাই দ্যাখে কেবল, ওর কলমও ঠিক ওর মই, নিতান্ত সাধারণকে অসাধারণ করে দেখায়।

পড়ে দেখেননি? আপনার কথা আপনি পড়ে দেখেননি। তিনি একটু অবাক হন।–আশ্চর্য তো।

কী করে পড়ব! পাইনি তো। কেনাও হয়নিকো, বেজায় দাম বইটার, কিনতে পারিনি তাই। পয়সা কই আমার।

অচিন্ত্যবাবু দেননি আপনাকে?

দিয়েছিল, মানে, দিতে চেয়েছিল। বলেছিল, ডি এম লাইব্রেরী থেকে নিয়ো। চাইতে গেলে গোপালবাবু বললেন, কী করবেন বই নিয়ে? ফুটপাতে বেচে দেবেন তো! নাম খারাপ হবে আমাদের। তার চেয়ে তার দামটাই না হয় দিয়ে দিই। এই নিন পাঁচ টাকা। ধরুন।

কী করলেন?

ধরলাম। তক্ষণাৎ। সমঝদার লোক তো। এ বিষয়ে আমিও বুঝদার বেশ। ওই পাঁচ টাকায় ওঁরই দোকানের সামনে ফুটপাথ পেরিয়ে চাচার হোটেলে গিয়ে নিজেকে বাঁচালাম। কল্লোলযুগে শুনেছি আমার সম্বন্ধে বিস্তর ভালোমন্দ কথা ছিল, পড়া হল না। কিন্তু ভালোমন্দ খাওয়া গেল খুব। ডি এম অচিন্ত্যর দৌলতে কাটলেট খাওয়া গেল মজা করে।…নিজের প্রশস্তি পাঠের চেয়ে সেটা আরও প্রশস্ত ব্যাপার নিশ্চয়।

কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পড়তে পারতেন তো বইটা?

কৌতূহল হয়নি আদৌ। সত্যি বললে, কৌতূহল বস্তুটা আমার কম। কোনো বিষয়েই তেমনটা নেই, নিজের বিষয়ে তো আরো কম। কেননা, আমার কাছে আমার কিছুই বোধহয় অজানা নেই। নিজের বিষয়ে নিশ্চয় আমি অপরের চেয়ে একটু বেশি জানি।

তাহলেও এটা আমার কাছে কেমন যেন ঠেকছে। তিনি বললেন : বইটা হাতে পেলে কি আর আপনি পড়ে দেখতেন না?

ভদ্রলোক ধরেছিলেন ঠিকই। দামী বইটা নিয়ে বেচেই দিতাম আমি, ফুটপাথে ঠিক না হলেও। তবে বইটা আগাগোড়া পড়ার পরেই বেচতাম যদিও। কী করব বই নিয়ে? আমার বাসায় বই রাখবার জায়গা কই? একটাও আলমারি কি বুক-শেলফ আছে? কোনো বই-ই

আমার কাছে নেইকো, এমনকি নিজেরও একখানা নয়। চেয়ে দেখুন, চারধারে।

তাই তো দেখছি। লেখকের ঘরে একখানা কারো বই নেই? আশ্চর্য!

যেমন লেখক, তেমনি আমি পাঠক। যেমন লেখায় তেমনি পড়ায় আমার অনীহা। লেখাপড়ায় আমি সমান চৌখস।

কিন্তু আপনি যে বইটা নিয়ে বেচে দেবেন, গোপালবাবুর এটা ধারণা করা অন্যায়। উনি সেটা টের পেলেন কি করে?

বারে! উনি টের পাবেন না? ওঁর কাছেই তো বেচেছি কত বই! আমার কোনো ৭২ বেরুলে তার কমপ্লিমেন্টারির পঁচিশ কপি তো ওঁর দোকানে গিয়েই বেচে আসতুম, একটু বেশি কমিশন দিয়ে নগদ মূল্যে। উনি কিনতেন আর উনি জানবেন না!

তাই নাকি! নিজের নতুন বইও বাড়ি এনে দেখবার সাধ হতো না আপনার?

সাধ্য হত না। পাড়ার ছেলেমেয়েরা কেড়েকুড়ে নিত রাস্তাতেই। ভাব ছিল তাদের সঙ্গে। তাছাড়া, বাসার লোকরাও পাবার আশা করত। দিলে আর তা ফিরে পাবার প্রত্যাশা ছিল না। কৃথা বাজে বরবাদ না করে তার চেয়ে নিজের আশ মেটানোটা কি ভাল না মশাই?

নিজের আশ মেটানো?

ভালো একটা প্রাতরাশ। টোস্ট মাখন ডিমের পোচ দিয়ে কোনো রোস্তোরাঁয় গিয়ে। তারপর ধরুন, তেমনি পরিপাটি একখানা মধ্যাহ্ন আশকোনো পাইস হোটেলে নানারকমের মাছ মাংসে, সন্ধ্যায় আবার তেমন ধারার একটা সান্ধ্য আশ-দেলখোস কেবিনে চর্বিওলা মাটন চপ সহ। তারপর? না, তারপর আর কোনো আশ নেই। তারপর একটানা সারা রাত্তির লাশের মতন লম্বা ঘুম একখানা।

এরকম করতেন কেন? না, আপনার ঐ খাওয়া কি ঘুমের কথা বলছি না। এই বই। বেচাটা…

ঠিক লেখকসুলভ নয়, এই তো? কিন্তু আমিও তো সুলভ লেখক নই। খবর কাগজ বেচেই জীবিকার্জনের শুরু হয়েছিল বলেই হয়ত অভ্যেসটা এসে থাকবে। তারপর সেই সব কাগজে লেখা শুরু করেই আমার লেখক-জীবনের সূত্রপাত হল। আর সব লেখকের কেমন আয় হত জানি না, আমার প্রায় যায় দশাই ছিল। ভারী টানাটানির সময় গেছে সেটা। যেমন ছিল লেখার দর, তেমনি তার আদর। তিনশ লাইন লিখে তিন টাকা পেতাম তখন।

বলেন কি।

এমন ছিল সেকালটা। এখন অবশ্য তিন লাইন লিখে তিনশ টাকা পাই। তবে তার কতটা আমার আর কতখানি খোদার কুদরং তা জানি না। একটা কথা বলব আপনাকে? কাউকে বলবেন না। প্রেমেন জানলে মনে ব্যথা পাবে, অবশ্যি এখনও যদি তার ব্যথা পাবার মতন মন থেকে থাকে।

বলুন।

প্রেমেনের প্রথম বই পুতুল ও প্রতিমা, বেরিয়েছিল গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় থেকে। গল্পের বই। অতুলনীয় গল্প সব। অনেকদিনের পর তার দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল সিগনেটের থেকে। তার একখানা কপি হাতে পেতে পাতা উল্টে দেখি, বইটা আমার নামেই উৎসর্গ করা। এ কী! আমি অবাক হয়ে গেলাম দেখে। তোমার প্রথম বইটা আমাকেই দিয়েছ দেখছি। গদগদ কষ্টে তাকে বললাম।

সে কি! তুমি জানতে না? সে সুধালো।

না এই দ্বিতীয় সংস্করণ বের হবার পর টের পেলাম। আমি বলি–দ্বিতীয় সংস্করণটাই দিয়েছ বুঝি আমায়? প্রথম সংস্করণটা কাকে দিয়েছিলে?

কেন তোমাকেই তো! তুমি জানতে না? সে তো হতবাক। বইয়ের প্রথম সংস্করণ একজনকে, দ্বিতীয় সংস্করণ আরেকজনকে–এরকম দেওয়া যায় নাকি।… আশ্চর্য! বইটা বেরুবার দিনই তো দিয়েছিলাম তোমায়, তোমার বাসায় গিয়ে, মনে নেই।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে এখন। আমি বাসার থেকে বেরুচ্ছি আর তুমি এলে-পথেই তো দেখা হল, মনে আছে বেশ।

বইয়ের মলাটও উলটে দ্যাখনি নাকি?

উলটে দেখার কী ছিল? তোমার সব লেখাই তো মাসিকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই পড়া। একবার নয়, বারবার। সেই সব জানা গল্প আবার নতুন করে জানতে যাবার কী আছে–তাই কোন কৌতূহল হয়নি আমার।

মনে পড়ল তখন। হাতে পেয়ে বইটার মলাট দেখেই খুশি হয়েছিলাম। মলাটের পাতা উলটে আরো বেশি খুশি হবার সৌভাগ্য আমার ঘটেনি যে, সেটা আমার ললাট। প্রেমেনের বই তখন লোকের হাতে হাতে লত, তাই মনে হয়েছিল এই দুর্যোগের দিনে এটাকেও হাতে হাতেই চালিয়ে দিই এই সুযোগে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এম সি সরকারে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছিলাম বইটা।

.

০৪.

জীবনজিজ্ঞাসু সেই চমকপ্রদ ভদ্রলোকটি কিছুদিন বাদে আবার এসেহজির একদিন আচমকাই।

যতই সচকিত হই না, যথোচিত স্বাগত জানাতেই হয়-আইয়ে জনাব। আসুন।

আপনার কুলকিনারা করে ফিরেছি এবার। ঠিকুজি কুলজী সব নিয়ে। তিনি জানালেন–এর জন্যে মশাই, খোঁজখবর করে আপনার দেশে পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলাম শেষটায়।

আমার দেশ! কোথায় আমার দেশ? চমকাতে হল আমাকে।

কেন, আপনার দেশ কোথায় আপনি জানেন না?

একটা মহাদেশ তো জানি, এই ভূভারত। তাছাড়া একটা খণ্ড দেশের বাসিন্দা আমি বটে–এই চোরবাগানের। আমি জানাই, তবে এটাকে কলাবাগানও বলা যায় আবার। সত্যি বলতে, উভয় দেশের মধ্যপ্রদেশে-চোর আর কলা-এই চাতুর্যকলার মাঝামাবিই আমি রয়েছি। কলাচাতুর্যের নোম্যান-ল্যাণ্ডের সীমান্তে আমার আস্তানা।

আপনি উত্তরবঙ্গের নন? জন্মেছিলেন কোথায় শুনি?

উত্তরবঙ্গে নয়, কলকাতারই কোনো অলিগলিতে হবে বোধ হয়। আমি বলি-মার মুখে শুনেছিলাম দর্জিপাড়ায় জন্ম আমার–দাদামশায়ের বাড়িতেই। নয়ানচাঁদ দত্তের লেন—না কোথায় যেন ছিল সেটা।

কত নম্বর বাড়িতে?

ভুলে গেছি অ্যাদ্দিনে। কানে শোনা মাত্র, কোনোদিন নয়নে দেখিনি সেই গলিটাকে। দেখতে যাইনি, কৌতূহল হয়নি। আমি নিশ্বাস ফেলি-তা ছাড়া সে গলি কি আর রাস্তায় পড়ে আছে অ্যাদ্দিন! কলকাতা এর ভেতর কতবার ভোল পালটালো। পথঘাটের নামঠিকানাও পালটে যাচ্ছে।

হতে পারে জন্ম আপনার দর্জিপাড়ায়, কিন্তু আসলে আপনি উত্তরবঙ্গের কোনো রাজবংশের সঙ্গে জড়িত-সম্ভ্রান্ত পরিবারের থেকে এসেছেন জেনে এসেছি আমি।

কী সর্বনাশ! শুনে এবার চমকে গেছি সত্যিই! রক্ষে করুন, প্ৰলিতারিয়েত, পাতিবুর্জোয়া যা খুশি বলুন, কিন্তু এভাবে আমাকে বংশ দেবেন, এমন কি, কোনো রাজবংশও নয়। ভ্রান্তভাবেও না দোহাই আপনার! আমি রাজবংশীদের কেউ নই।

বললে কী হয়! আপনার মাতামহকুলও প্রায় রাজবংশই; ঠিক রাজগোত্রের না হলেও জমিদারগোষ্ঠীর তো বটে। তখনকার কালে ওই জমিদারদেরই রাজা বলত সবাই। কোনার না কোথাকার জমিদার ছিলেন নাকি তাঁরা।

পৃথিবীর কোন কোনায় কে জানে! আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি। বিশ্বাস করুন, আমার পিতৃকুলে মাতৃকুলে কোনো কুলেই রাজাগজা কেউ নেই কো। তবে হ্যাঁ, মাসতুতো কুলে, তাও আমার আপন মাসির নয়, দূর সম্পর্কের মাসতুতোই, আমার বাবার মাসির, মানে বাবার এক মাসতুতো ভাই একটা রাজাই ছিলেন বটে। খেতাবী রাজা। তবে তাঁর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক! এক রোদে ধান শুকোবার সম্বন্ধেও না।

তাহলেও আপনাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন বলতে হবে।

কি করে ভদ্রলোকের এই সভ্রান্তি দূর করি, ভারি মুশকিলে পড়ি আমি। বংশের খোঁজে– জীবনে জীবনে ঘুরে ঘুরে বাঁশবনে ডোমকানা হওয়ার মতই তাঁর এই দশা বুঝতে পারি। কার স্বকপোলকল্পিত কে জানে, একটা কানা বাঁশ নিয়ে এসে ধরে বেঁধে কষে লাগাতে শুরু করেছেন আমায়।

দেখুন, আমার নিজের ধারণা ছিল আমি কলকাতার কোনো বস্তির থেকে আমদানি কিংবা ফুটপাথের কোনে কুড়িয়ে পাওয়া। কেন যে আমায় এভাবে অযাচিত অবাঞ্ছিত এই বংশ ধারণ করতে বলছেন তা জানিনে। আমি তো জানি, কলকাতার ফুটপাথে ঘুরে ঘুরেই আমি মানুষ। কেয়ার অব ফুটপাথই আমার ঠিকানা ছিল অনেক কাল। সেখান থেকেই উঠে এসেছি এই মেসের বাসায়। কিন্তু ফুটপাথ আমায় ছাড়েনি, চেয়ে দেখুন, আমার ঘরে যত রাজ্যের জঞ্জাল। কলকাতার রাস্তার মতনই পুঞ্জীভূত। ফুটপাতের প্রতি আমার এই স্বাভাবিক আসক্তি, এটা কি আমার রক্তের টান নয়?

হতে পারে। সে খবরও একেবারে মিথ্যে নয় হয়ত। সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু তাহলেও সামাজিক সম্পর্কটাকে তো আর অস্বীকার করা যায়না মাশাই। আপনার বংশধারার বিবরণ শুনুন আমার কাছে–উত্তরবঙ্গে চাঁচোর নামে একটি সমধিক প্রসিদ্ধ গ্রাম আছে, এখন উদ্বাস্তুদের সমাগমে সে গ্রাম প্রায় উপনগরের মতই, যাই হোক, সেই গ্রামে একদা রাজা ঈশ্বরচন্দ্র নামে এক নৃপতি বাস করতেন। তিনি সিদ্ধেশ্বরী এবং ভূতেশ্বরী এই দুই পত্নী রাখিয়া অপুত্রক অবস্থায় দেহরক্ষা করেন…

বটে বটে? আপনি দেখছি বেতাল পঞ্চবিংশতির গল্প এনে ফাঁদলেন–বত্রিশ সিংহাসনের একখানা নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। বেতালের মত বললাম।

উক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর দুই পত্নীকেই পরের পর দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার দিয়ে যান। রাণী সিদ্ধেশ্বরী প্রথমে সেই অধিকার খাটাবেন, তিনি ব্যর্থকাম হলে তারপর দ্বিতীয় রাণী। তাঁর সেই ইচ্ছে মতন রাণী সিদ্ধেশ্বরী দেশের থেকে নিজের বোনের ছেলেকে নিয়ে এসে দত্তকরূপে গ্রহন করেন বা করতে চান…বোনের নামটা কী ছিল কেউ বলতে পারল না।

ধরুন না, প্রেতেশ্বরী। সিদ্ধেশ্বরী ভূতেশ্বরী প্রেতেশ্বরী–এক সুরে না হলেও এক স্বরে মিলে যায় বেশ।

বিন্ধ্যেশ্বরী হবে যেন শুনেছিলাম। যাই হোক, এই বিন্ধ্যেশ্বরীর সন্তান স্বর্গীয় শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী হলেন…

আমার বাবা। এ তো আমি জানতাম। বাবার নাম আমি জানতাম না? এই জানতে আপনি অদূর কষ্ট করে এত নাস্তানাবুদ হতে গেছলেন! 1,

উক্ত ঈশ্বরচন্দ্রেরও মনোগত অভিপ্রায় ছিল যে…তার স্বর্গত হবার পর…

স্বর্গে তত গেছেন। এখন ঈশ্বর ঈশ্বরচন্দ্র বলুন তাহলে। কিংবা চন্দ্রবিন্দু ঈশ্বরচন্দ্রও বলতে পারেন। আমি বাধা দিলাম।

হ্যাঁ। ঈশ্বরচন্দ্রের মনের ইচ্ছা ছিল প্রথমা পত্নীর বোনের ছেলেকেই উত্তরাধিকারী করার…রাণী সিদ্ধেশ্বরী হয়ত তাঁকে দত্তক নিয়েও থাকতে পারেন…

না মশাই, না। নেননি। আমি জোর গলায় বলি- আমার বাবা কারো পোয্যপুত্র হবার পাত্র ছিলেন না, তাঁর স্বভাব-চরিত্রের যর আমার জানা আছে। শালীর প্রতি টান থাকা স্বাভাবিক, আমি মানি। এমন কি অপত্যস্নেহবশে তার ছেলেকে রাজতক্তে বসিয়ে যাওয়ার বাসনা থাকাও শক্ত নয়, কিন্তু সেই ছেলেটির ধনশালী হওয়ার বাসনা ছিল না কোনদিনই। যতটা জানি তিনি রাজাগজা কিছু হননি, হতেও চাননি কখনো। কখনো না।

কেন হননি বা কেন হতে চাননি তার মূলে একটা রহস্য আছে। সে কথা পরে। এখন বলুন তো আপনার বাবা যে সন্ন্যাসী হয়ে গেছলেন এ খবর কি আপনার জানা?

জানি বই কি। এমন কি তাঁর সন্ন্যাসী বেশে ধ্যানমগ্ন চেহারার একখানা ফটোও ছিল আমার কাছে। অনেকদিন অযত্ন করে রেখেছিলাম-কি করে হারিয়ে গেছে কে জানে। নইলে দেখাতে পারতাম আপনাকে। জটাজুট সমন্বিত সেই হোরা।

হরিয়ে গেছে, কি করে হারালো?

কবে কেন কোথায়–কিছুই আমার মনে নেই। কেমন করে জানি না, সব কিছুই আমায় হারিয়ে যায়। কিছুই কখনো ধরে রাখতে পারি না আমি।

তার সন্ন্যাসী হয়ে হঠাৎ এভাবে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে বেরিয়ে যাবার গরুটা আপনি বলতে পারেন?

জায়গাটার দোষ বোধ হয়।

জায়গার দোষ?

হ্যাঁ, ঐ যে চাঁচোর বললেন না? ওটার ইংরেজি নাম হল গে চঞ্চল–সেখানকার ডাকঘরের ছাপেও তাই পাবেন। CHANCHALI। তাই মনে হয়, সেই চাঞ্চলের ডাকে আমাকে যেমন এক সময় বাড়ি ছাড়া করেছিল সেইরকম বাবাকেও বোধ হয়…

মশাই, না। কোনো চঞ্চলতার জন্য নয়। চাঁচোরের খুব প্রাচীন এক ব্যক্তির কাছে জেনে এলাম, অন্য কারণ। তাঁরও কথাটা আবার আরও প্রাচীন আরেক ব্যক্তির মুখ থেকেই শোনা। আপনি শোনেননি হয়ত। যাই হোক, আপনার বাবার হঠাৎ এই সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে পড়ার কারণটা কী হতে পারে আপনার ধারণা?

চাঞ্চল্য তো হঠাৎই হয়ে থাকে–তার আবার কারণ কী। আমার কী মনে হয় জানেন? জায়গার যদি না হয় তবে এটা সেই সময়টারই দোষ। সন্ন্যাসব্যাধি তখন কেবল ব্যক্তিগত বা বংশগতই ছিল না। সামাজিক মহামারির মতনই ছিল অনেকটা। তখন তো খাওয়া-পরার ধান্দা ছিল না কোনো, জীবনসগ্রামই ছিল না বলতে গেলে। এখনকার মতন নয়, কারো কোনো ভাবনা চিন্তাই ছিল না সেকালে। আর নেই কাজ তো খই ভাজ। কোনো ভাষা না থাকলেই যত ভাব এসে মাথায় এসে চাপে। বৈরাগ্যভাবটাও সেইরকম। ঈশ্বরটি মানুষ পাগল হয়। ভগবানের খোঁজ খবর নিতে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়ে অকস্মাৎ। আর বাবাও সেইরকম…

না মশাই, না। এর মধ্যে অন্য রহস্য আছে…

হ্যাঁ, রহস্য তো আছেই। জীবনটাই এক রহস্য। আমি তো আজীবনই সেই রহস্য দেখছি–বিন্দুমাত্রও তার ভেদ করতে পারিনি যদিও। চাঁচোর থেকে এই চোরবাগান অব্দি সেই রহস্যে ওতপ্রোত হয়ে আছি। দেখছেন না আপনি?

কী রহস্যের কথা বলছেন?

সেই রহস্য। দেখছেন না আপনি, চাঁচোর আর চোরবাগান দুয়ের মধ্যেই একটা রহস্য রয়ে গেছে? লক্ষ্য করেননি?

না তো। কী রহস্য?

দুটি জায়গাতেই একই বিশেষণে একই বিশেষ্য-অভিন্ন রূপে এক বিশেষ ব্যক্তি বর্তমান? দেখছেন না?

উহুঁ।

এত বড়ো চোর আপনার নজরে পড়ছে না? আশ্চর্য!

চোর? সারা মুখটাই একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ওঠে ওঁর–কোথায় চোর?

চোরই বলুন আর গোলামই বলুন–আপনার সামনেই। এই নরাধম। হাতের তাস ফেলি।

কী বলছেন মশাই? তাঁর মুখের রেখায় প্রশ্ন জিজ্ঞাসার ওপরে বিস্ময় চিহ্ন দেখা যায়।

হ্যাঁ। চাঁচোরেও যে চোর, এই চোরবাগানেও সেই চোরই–সেই আমিই এই আমি। আমার চোরামি ঠাওর হচ্ছে না আপনার?

আপনার অকারণ এহেন কবুলতির কারণ?

কারণ আবার কি! সত্যি কথা স্বীকার করাই কি ভালো নয়? আর সত্যি বলতে, আমার এই দেশ, এই আর্যাবর্ত ব্রহ্মচর্মর পীঠস্থান। এটা তো মানে? ব্রহ্মসূত্র আর কর্মসূত্র এক চৌর্যবৃত্তির দ্বারা এখানে বিধৃত। এর তুঙ্গ স্থানে সেই ব্ৰহ্ম, আর কর্মস্থলে কেবল চৌর্য-দুহাতে এই উভয়কে আঁকড়ে ধরে আমাদের জীবন। ব্ৰহ্মচৌর্য ছাড়া বাঁচা যায় না। বাঁচতে পারি না আমরা।

ব্ৰহ্মচৌর্য কী বলছেন? ব্রহ্মচর্য বলুন।

একই কথা। বাগর্থ এক হলেও তার বাচ্যার্থ ভাবার্থ গূঢ়ার্থ অনেক থাকে–নানা অর্থে তার, নানান অনর্থ। ব্রহ্মকে চর্যাপদে আনলে পদে পদে ঐ চৌর্যকমই। তাছাড়া পথ কই? বাঁচতে হলে, বাঁচার মত বাঁচতে হলে ব্ৰহ্মবৃত্তি আর চৌর্যবৃত্তি দুই-ই আমাদের চাই যে। পরম ব্রহ্মের সাক্ষাৎ অবতার স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও নিজের জীবনে সেই দৃষ্টাত দেখিয়ে গেছেন। বাঁচার তাগিদে ননী চুরি থেকে গোপিনীর বস্ত্রহরণ কিছুই বাদ দেননি তিনি।

টাকা পয়সা চুরি করাটাকেই আমরা চুরি বলে ধরি, শ্রীকৃষ্ণ তা করেননি।

খাবার অভাবেই লোকে টাকা পয়সা চুরি করে–অভাব মেটাবার স্বাভাবিক তাগাদায়। ছেলেবেলায় চুরি করে থাকে সবাই-অভাববশত নয়, স্বভাবতই। তারা ওটা চুরি বলে মনে করে না। শ্রীকৃষ্ণও বাল্যকালে সেই need ছিল, ননী খাওয়ার লোভ; তার অভাব মেটাতেই ননী চুরি করে তাঁর ওই no-need হতে যাওয়া। কিন্তু খাবার কি তার বিকল্প টাকা পয়সা চুরি করাটাকে চুরি বলেই আমি মনে করি না। শুধু অর্থই নয়, পরমার্থও আমাদের চুরি করে পেতে হয়। সহজে মেলে না।

কিছুই সহজে মেলবার নয় তা জানি। সে কথা ঠিক। তিনি মেনে নেন।

পরকে একপ্লয়েট না করে বাঁচা যায় না। পরকে আত্মসাৎ করে, পরের আত্মসাৎ করেই আমরা বাঁচি, আমরা বাড়ি, আমরা হই। এই চুরি বিদ্যাই হচ্ছে বড় বিদ্যাসুন্দর বিদ্যা। তার সমন্বয়েই এই জীবন বিদ্যাসুন্দর। সেই চৌর পঞ্চাশৎ যেমন কালীপক্ষে তেমনি বিদ্যাপক্ষেও…আমার কথা যদি বলেন, আমি এতাবৎ বেঁচে রয়েছি পরের খেয়ে-পরেই। পরের এবং পরীর।

পরীর?

হ্যাঁ, পরীর তো অবশ্যই। পরের থেকে অর্থ, আর পরীর থেকে পরমার্থ-পেলেই না সর্বার্থসিদ্ধি? একপ্লয়েট এবং সেপ্লয়েট? দুয়ে দুয়ে যেমন চার, তেমনি দু হাতে দুধারের দুয়েই না আমাদের বাঁচার?

কী বলছেন মশাই?

সেই কথাই বলছি…কামিনী আর কাঞ্চন এই দুটিই আমাদের জীবনের সার বস্তু। জীবনের আর পৃথিবীর। এই দুই নিয়েই তো বাঁচা। বাঁচার মত বাঁচার জন্য দুইটাই চাই আমাদের যে করেই হোক। আর ভাবান? হ্যাঁ, ভগবানও বটে। তিনি এই উভয়ের মধ্যে উত্ত। দুই মেরুর মধ্যে দণ্ডের মতই গুহ্য তিনি, তাঁর ওপর ভর করে তাঁর ভরসাতেই পৃথিবীর মতন আমাদের সূর্য প্রদক্ষিণ। শিরদাঁড়া না থাকলে কি বাঁচা যায় মশাই? খাড়াই হওয়া যায় না। ঠিক মতন। তাই ভগবানও আমাদের চাই বই কি। দুই মেরুর মধ্যে একই প্রাণদণ্ডে আমাদের সঙ্গে তিনি সমান সজীব। সেই অক্ষর বস্তু আপন স্বরে আর আমার ব্যঞ্জনায়-সম্মিলিত হয়ে যুক্তাক্ষর-কামিনী আর কাঞ্চন নিয়ে সশরীরে আমাদের মধ্যেই। আপন মহিমার নব নব ভূমিকায়। অবতার রূপ না ধরেও আমরা প্রত্যেকেই তাঁর অবতারণা।

কিসের থেকে কিসের অবতারণা!

আজ্ঞে, সেই কথাই।…এই কামিনী আর কাঞ্চন…পরের থেকেই পেতে হয় আমাদের, পরস্বাপহরণ না করে মেলে না কখনোই। একআধটু চুরি-চামারি না করলে কেউ বাঁচতেই পারে না। এই দুনিয়ায় বোধ হয় বাঁচাই যায় না একদম। অন্তত আমি তো পারিনি মশাই। আমার কথা যদি কই, মার্কটোয়েনের থেকে চুরি করেই আমার হাসির লেখার হাতেখড়ি-আমি লেখক হই। শুধু তিনিই নন, আরো অনেকে কাছে আমি ধারি। মুক্তহস্তের সেই ধার মুক্তকণ্ঠে আমার স্বীকার। চার ধারের মতো আখের রস পেষণ করে আমার এই আখের। এই লেখক পেশা। চোরামির কৌশল মজ্জাগত ছিল বলেই ছ্যারাতে ছ্যাঁচরাতে আসতে পেরেছি অ্যাদ্দিন–জীবদ্দশায় টিকে থেকে কোনো গতিকে। সত্যি বললে, আমি যেমন চোর তেমনি এক ছ্যাঁচোর। সে কথা প্রকাশ করতে আমার কুণ্ঠা নেই।

অসম্ভব না। খুনের ছেলের পক্ষে চোর হওয়া বিচিত্র নয় কিছু।

কী বললেন?

আপনার বাবা যে রাজ্যলোভ সংবরণ করে বিবাগী হয়ে সন্ন্যাসী হতে গেছলেন, সে কোনো ঈশ্বরের খোঁজে নয় মশাই। আপনার মাকে খুন করে তিনি ফেরার হয়েছিলেন।…

.

০৫.

ওমা, সে কী কথা গো। শুনেই না আমি আৎকে উঠেছি : তা কি কখনো হয় নাকি!

হবার কী আছে? তিনি বললেন : সেকালের পতিদেবতারা সাধারণ মানুষ ছিলেন।, তাঁদের পক্ষে এ তো অতি সহজ কাজ। সেযুগে বৌ ঠেঙানো লোকে বিলাসিতা বলেই মনে করত, আর, বৌকে খুন করে ফেলা তো চরম বাহাদুরি। আপনার বাবা কিছু আর তখনকার সমাজবহির্ভূত লোক নন? তবে হ্যাঁ, এই ফেরার হওয়াটা একটু সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার বটে। স্বভাবতই সে সময়ে এসব আপনার থেকেই চাপা পড়ে যেত, থানার দারোগাকে কিছু ধরে দিলেই মিটে যেত হাঙ্গামা। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সদরের পুলিস সাহেবের কানে গিয়ে গড়িয়েছিল কিনা। তিনি স্বয়ং সরজমিনে তদন্তের জন্যে মহানন্দাপথে তাঁর বজরায় এসে পড়লেন একদিন…গেরেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে…

আর, বাবাও অমনি রাজ্যপাটের পরোয়া না করে আমাদের নদীতটে সায়েবের বজরাঘাতের আগেই কেটে পড়লেন সেখান থেকে। আমি অনুযোগ করি : এই তত বলতে চাইছেন আপনি?

অবিকল।

কিন্তু তা কি করে হয় মশাই? আমার মাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি যে…জলজ্যান্ত দেখেছি…বাবা মারা যাবার পরেও অনেকদিন তিনি বেঁচে বর্তে বহাল তবিয়তে ছিলেন।

তাই নাকি? কিন্তু আপনার মা হেমাঙ্গিনী দেবীর নিহত হবার খবর সেখানকার সুপ্রাচীন অনেকের কাছেই জেনে এলাম যে!

হেমাঙ্গিনী–কী বলছেন? আমার মার নাম যে শিবরাণী।…আমি প্রকাশ করি : বাবার নাম শিবপ্রসাদ। আমার ভাইয়ের নাম শিবসত্য, ঘাটশিলার স্কুল কাম কলেজের হেডমাষ্টার বনাম প্রিন্সিপাল। শিব দিয়ে মিলিয়ে নাম সব আমাদের।

শুনে তিনি অবাক হন–এরকম নামের যোগাযোগের মানে?

কে জানে, কেন! আমাদের দুভায়ের নাম বাবার রাখা–তিনিই মিলিয়ে রেখেছেন আর, মার নামটা নাকি হয়েই ছিল আগের থেকে। আর, ঐ নামের মিলের কারণেই বিয়েটা হল নাকি শুনেছি।

মনের মিল হয়ে বিয়ে হয় তা জানি, কিন্তু এই নামের মিল দেখে-আশ্চর্য তো!

আশ্চর্য তো বটেই। বাবা যখন সাধুবেশে মুক্তিলাভের আশায় হিমালয়ের পথে বিপথে ঘুছিলেন তখন এক ঋষিকল্প সন্ন্যাসী নাকি তাকে সংসারে ফিরে গিয়ে বংশরক্ষণ করে নিজের প্রাক্তনখণ্ডনের উপদেশ দেন, আর তিনিই বলেছিলেন যে, তাঁর উপযুক্ত সহধর্মিণী অপেক্ষা করছে–যার নাম লেই তিনি টের পাবেন। আর একটা রাজপ্রাসাদও নাকি তৈরি হয়ে রয়েছে তাঁর জন্যে। ভদ্রলোকের এই দুটো ভবিষ্যবাণীই কিছু কিছু ফলেছিল বাতে হয়।

সেই রাজপ্রাসাদটা আমি দেখে এসেছি এবার ওই চাঁচোরে গিয়ে, যেখানে আপনারা এককালে বাস করতেন। ওল্ড রাজ প্যালেস বলে থাকে লোকে এখনো। তবে তার রাজোচিত চেহারার কিছু আর অবশিষ্ট নেই…তিন বার পড়ে গেছে তার। অনেক- কাল হল তো।

আমার বাবা যখন সন্ন্যাস ছেড়ে সংসারে ফিরে এলেন তখন স্বভাবতই তাঁর বিয়ের কথা উঠল–নানা জায়গার থেকে সম্বন্ধ নিয়ে আসতে লাগল ঘটক। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম শিবরাণী দেখেই না, বাবা ঠিক করে ফেললেন, বললেন যে, ওই মেয়েই আমার সহধর্মিণী।

অবাক কাণ্ড তো?

সেই পরমহংসদেবের মতই না? তিনি ছোটবেলাতেই এক দঙ্গল বালিকার মধ্যে একটিকে দেখিয়ে বলেছিলেন–ই আমার বৌ। পরে তার সঙ্গেই তাঁর বিয়ের ঠিক হয়। তিনিই মা সারদামণি। তাই না?

তা না হয় হোলো কিন্তু বিলকুল গড়বড় হয়ে যাচছে যে! বিশ্বস্তসুত্রে পাওয়া খবর সব… জেনে এলাম আপনার মাকে খুন করে বাবা ফেরার হয়েছিলেন, এদিকে আপনি বলছেন বাবা মারা যাবার পরেও আপনি মাকে দেখেছেন। মনে হচ্ছে, যাকে দেখেছেন তিনি আপনার মা নন, সৎ মা। উক্ত হেমাঙ্গিনী দেবীই মা ছিলেন আপনার…আপনার বাবা দুই বিবাহ করেছিলেন, আপনি তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলে।

আবার আমার প্রতি আপনার এই অযথা পক্ষপাত…

অসম্ভব কিছু নয়ত। সেকালে একাধিক বিয়ের রেওয়াজ ছিল যে। প্রায় লোকেই তা করতেন।

জানি। তবে সেটা কুলীনদের বেলাতেই হতো মশাই! এক কুড়ি দুকুড়ি বিয়ে করা তাঁদের পক্ষে কিছুই ছিল না–এমনকি কুড়িয়ে বাড়িয়ে একশও ছাড়িয়ে যেত কারো কারো শুনেছি। কিন্তু চকরবরতিরা কুলীন নয়, যদ্দুর আমি জানি।

চকরবরতিরা কঞ্জুস হয় একথাটা যেমন আপনার জানা তেমনি তো? তিনি হাসতে থাকেন।

চকরবরতিরা যে কঞ্জুস হয় সেটা কেবল জানা নে, আমার দেখাও যে। আমি জানাই : এই চর্মচক্ষেই দেখা-আয়নার মধ্যে জাজ্বল্যমান।

তাহলেও, কুলীন না হলেও দুতিনটে বিয়ে এমন কিছু কঠিন ছিল না কারো পক্ষেই তখন এমন অন্নসংকট তো দেখা দেয়নি সে সময়। আমার ধারণা আপনার বাবা ফেরার দশার পর ফিরে এসে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন এই শিবরাণী দেবীকে।

তাহলে তো সেই দুর্লভ সৌভাগ্যলাভ হত আমার, যা খুব কম ছেলের বরাতেই ঘটে থাকে… আমি বলি : বাবার বিয়ে দেখতে পেতাম আমি। মানে এই দ্বিতীয় বিয়েটাই। আমার চোখের ওপরই ঘটত তো! আর কিছু না হোক, বৌভাতের দিন অন্তত পানের খিলি বিলি করার পাটটাও আমি পেতাম।

তার জন্যে আপসোস করবেন না। আপনার লেখায় তো তাই বিলিয়েছেন সারা-জীবন। বলে তিনি খিলখিলিয়ে হাসেন।

সে কথা সত্যি, মানতে হয় আমায়। পাঠক-পাঠিকার পাতে আর সব লেখকের নানান উপাদেয় ভুরিভোজ্য পরিবেশনের পর জীবনভোর আমার ঐ পানের খিলি বিলোনোই তো। পুষ্টিকর কিছু নয়, মুখ বদলাবার জন্য তুষ্টিকর হয়ত যৎকিঞ্চিৎ। আমার ফসলে ধান গমের কিছু নেই, তার আবাদেও পারঙ্গম নই আমি, ধার করা ধারালো আমার বরোজে খালি ওই পানই ফলে। চুটকি লেখার চটক! কারো মনের আকাশে খানিকক্ষণ উড়লেও খানিকবাদে ফুরুৎ করে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।

যাক। ওসব কথা থাক, আপনার কুলপঞ্জীতে আসি। আপনার কাছে খবরগুলো যাচিয়ে নেওয়া যাক। আপনার ঠাকুর্দার নামটা কী বলুন তো?

কি করে বলব! আমার বাবাই জানেন।

আপনি জানেন না? শোনেননি কখনো বাবার কাছে?

শুনব না কেন, কত বারই তো শুনেছি। কিন্তু বছরে একবার করে শুনলে কি মনে থাকে নাকি কারো, না মুখস্থ হয়?

বছরে একবার করে?

হ্যাঁ, সেই মহালয়ার দিন পার্বণশ্রাদ্ধর সময়। তখনই বাবা ঊর্ধ্বতন চোদ্দ পুরুষের নাম আউড়ে তর্পণ করতেন…সেই দেবশর্মণদের নাম তখন তখন হলে না-হয় বলতে পারতাম; কিন্তু এখন অ্যাদ্দিন বাদে

কিন্তু অন্তত তিন-চার পুরুষের নাম তো মনে থাকে, মনে রাখে সবাই।

রেখে লাভ মশাই? যখন সেই অতীত কুলকোটিনাম্ সপ্ত দ্বীপনিবাসিনীম কারো নামই আমাদের স্মরণে নেই, তখন হরানো মহাসমুদ্রের এক গণ্ডুষ মাত্র-গণ্ডাকয়েকের নাম মনে রেখে কী হবে? তবে… আমার আরো অনুযোগ–এটুকু আপনাকে বলতে পারি ঠাকুর্দার সম্পর্কে যে, শিব দিয়ে তাঁর নাম নয়। কেননা, আমার বাবা তো তাঁর নামকরণের সুযোগ পাননি আদৌ।

তবে শুনুন সেটা আমার কাছে। আপনার ঠাকুর্দার নাম হচ্ছে নবকুমার। ঈশ্বর নবকুমার চক্রবর্তী। সেই নবকুমারের পৌত্র আপনি, বুঝেছেন?

য্যাঁ? তাই নাকি? আমি যেন চোট সামলাই, তাহলে ইনিই কি সেই নবকুমার যিনি নৌকা থেকে কাঠ কুড়োতে নেমে বালিয়াড়িতে গিয়ে পথ হারিয়েছিলেন?

পথ হারিয়েছিলেন? তার মানে?

মানে, পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছ-র নবকুমার? আপনি কি বলতে চান যে কপালকুণ্ডলা আমার ঠাকুমা? আমার বঙ্কিমকটাক্ষ।–বঙ্কিমবাবুর সেই মানস কন্যা যাকে দামোদরের বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে, কপালকুণ্ডলা ডুবিয়া গেল আর উঠিল না, বলে এক কথায় তিনি খতম করে দিয়েছিলেন, যে নাকি আবার সাঁতরে দামোদর পেরিয়ে মৃন্ময়ীরূপে লোকসমাজে ফিরে দেখা দিয়েছিল আবার?

আপনার ঠাকুমার নাম আমি পাইনি। চেষ্টাও করিনি জানবার। তবে আপনার জন্মবৃত্তান্ত জেনে এসেছি, তাও কিছু কম রোমাঞ্চকর নয়।

হাতী ঘোড়া কিছু নয় নিশ্চয়? আর সবাই, সাধারণ মানুষেরা যেমন করে জন্মায়…

হাতী ঘোড়ার কথা আসছে কেন এখানে?

মানে, আমার জন্ম ব্যাপারে হাতীমার্কা কিছু ঘটেনি, সেই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম। গোপা দেবী গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে হাতীর স্বপ্ন দেখেছিলেন না?

না, তেমন অলৌকিক কিছু না হলেও একেবারে লৌকিকও বলা যায় না ঠিক। মার মুখে আপনি শোনেননি কিছু?

শুনেছিলাম একটুখানি এক সময়। কিছুতেই নাকি আমি হচ্ছিলাম না, তাই বাবা-মা বিন্ধ্যাচলে গিয়ে মানত করেছিলেন ছেলের জন্যে–আর তারপরেই নাকি আমি হলাম। মা বিন্ধ্যবাসিনীর দয়াতেই হওয়া, জগন্মাতার দোয়াতেই আমার পাওয়া। তাই মা আমার নাম রেখেছিলেন পার্বতীচরণ। পরে বাবা আমার সেই প্রথম নামটা পালটে শিবরাম বানিয়ে দেন।

কেমন করে পাওয়া আপনি, জানেন তো? তাঁরা দেবীর পূজো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখতে পান এক নবজাতক শুয়ে রয়েছে মন্দিরচত্বরে, অনেক খোঁজখবর করেও তার বাপ-মার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সেই বেওয়ারিশ শিশুটিকেই মার দেওয়া মনে করে তুলে নিয়ে এসে তাঁরা মানুষ করেন। সেই শিশুই হলেন আপনি।

আশ্চর্য নয়। আমারও সেইরকম মনে হয়। বলেছিলাম না আপনাকে যে আমি কোনো বস্তির আমদানি, নয়ত রাস্তার কোণ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া–মিলে গেল তো?

মেলালেই মেলে। তিনি নিশ্বাস ফেলেন।

তিনিই মেলান। মেলাবার মালিক তিনিই। মেলাবেন তিনি মেলাবেন-অমিয় চক্কোত্তির সেই কবিতাটা স্মরণ করুন। বস্তির সঙ্গে শ্রাবস্তির, কুঁড়ে ঘরের সঙ্গে কুঁড়ের বাদশাকে তিনিই মিলিয়ে দেন–মিলিয়ে থাকেন। সবই তাঁর অবদান।

এবার আপনার বাবার চরিত্রকথা শুনুন তবে– যা জেনে এসেছি। আপনার মনঃপূত হবে কিনা জানি না। আপনি তো বললেন–আমার বাবা পূত চরিত্রের দেবতুল্য আত্মভোলা মানুষ ছিলেন–কিন্তু সুন্দরী ললনাদের প্রতি দারুণ তাঁর ঝোঁক ছিল জানেন সেটা?

নিজের থেকেই জানা যায়-আমার মধ্যেও সেই ঝোঁক যে। আমার দেহে বাবার রক্ত প্রবাহিত কি না জানি না, যদি আমি বিন্ধ্যাচলের সেই বেওয়ারিশ ছেলেই হই, তবে আমার স্নেহে সেটা প্রকট। বাবার দৃষ্টান্তেই মানুষ তো! নামান্তরে সেই বাবাই। সুন্দর মেয়েদের সামনে আমিও আপনাকে সামলাতে পারি না। কেউ পারে কি না কে জানে!

সুন্দরী বধূদের তিনি হীরে চুণী পান্নার আংটি উপহার দিতেন জানেন তা? সে তল্লাটের অনেক গিন্নীই হাতের সেই আংটি দেখালেন আমায়–প্রৌঢ় হলেও প্রথম যৌবনে যে তাঁরা রূপসী ছিলেন দেখলেই সেটা টের পাওয়া যায়। এটা আপনি জানতেন?

জানব না কেন। স্বচক্ষে দেখছি। যখনই তিনি কলকাতায় যেতেন একগাদা সোনার আংটি গড়িয়ে আনতে পাথর বসানো, আর যাঁকে তাঁর ভালো লাগত স্বহস্তে তার আঙ্গুলে। পরিয়ে দিতেন দেখেছি। …আর এটা…এটা অনেকটা তার পাণিগ্রহণের মতই যেন, আমার মনে হত সেই সময়।

আর আপনি এদিকে বলছেন আপনার বাবা ছিলেন নিরাসক্ত দেবতুল্য মানুষ–

তাতে কী হয়েছে! মহাদেবের কি মোহিনীর প্রতি ঝোঁক ছিল না? বাবার হয়ে সাফাই গাই : আর সত্যি বলতে, বাবার ওই আদর্শ থেকেই আমি প্রেরণা পাই। এটাকে মনের দুর্বলতা বলতে পারেন, কিন্তু আমার মনের জোর ওই থেকেই। নিজের মনের দুর্বলতা অনায়াসে কাটিয়ে ওঠার অতি সহজ এই উপায় বাবার দৃষ্টান্ত থেকেই আমি শিখেছি। বাবার ওই আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়–তাঁর ওই আচরণের ছেলেবেলাকার সেই-শিক্ষায় এই অধম জীব বহুৎ বাধা অবলীলায় উৎরে এসেছে।

পরস্ত্রীর প্রতি ওই আসক্তি কি ভালো?

তা আমি জানিনে। তবে বলতে পারি আমার মধ্যে একটুও পরস্ত্রীকাতরতা নেই। পরস্ত্রী ছাড়া কি আর মেয়ে নেই দুনিয়ায়? পরকুমারীরা সব গেল কোথায়? পরীর মত মেয়েরা?

তারা থাকতে-পরধনে হস্তক্ষেপ করবার দরকার! তবে হ্যাঁ, ওই আংটি দেওয়াটা একটু ব্যয়সাপেক্ষ বটে। কিন্তু ও ছাড়াও বিয়ে না করেও পরকন্যার করলাভের অন্য পথ আছে আরো, একেবারে নিখর্চায়। কাজী আমায় শিখিয়েছিল পামিস্ট্রি। মিষ্টি হাতকে হস্তগত করার সহজ উপায় হচ্ছে ঐ হাত দেখা। ঐ করে প্রথম হাতিয়ে না, তারপর শনৈঃ শনৈঃ! আর কী! শনৈঃ পন্থা শনৈঃ কস্থা-শনৈঃ পর্বত লঙ্নম ইত্যাদি! কাজী নাকি ঐভাবেই বাগাতে মেয়েদের। আর সেই কারণেই আমি বলতাম, আমাদের মধ্যে কাজী…কাজীই একমাত্র…

কাজী কি?

Kazi knows rule!

কাজীর কথা থাক, আপনার বাবার কথা কই…তিনিও কিছু কম কাজের কাজী ছিলেন না।

বাবার কুলকুষ্ঠী আর আপনার কাছে কী শুনব? তাঁর কুলকাহিনীর আমিও কিছু কিছু জানি। তাঁর মুখেই শোনা। বলব আপনাকে?

বলুন বলুন।

আমাদের আদি নিবাস ছিল নাকি চোঁয়ায়…মুর্শিদাবাদের কোনখানে যেন সেই জায়গাটা। সেখান থেকে চুঁইয়েই আমরা ওই চাঁচোরে গিয়ে পড়েছিলাম–তারপর সেখান থেকে বিদূরিত হয়ে কোথায় না। যাক, ওই চোঁয়া যে কেমন জায়গা চোখে দেখিনি যাইনি কখনো সেখানে, তবে বাবা একটা ছড়া কাটতেন–ছড়াটা তাঁরই কিনা কে জানে-শীত নেই গ্রিন্থি নেই সব সময়েই ধোঁয়া। সকাল নেই সন্ধ্যে নেই শেয়াল ডাকে হোয়া। গ্রামের নামটি চোঁয়া। এই চোঁয়ায় একবার এক যাত্রা পালার আসর বসেছিল। চাঁচোরেও আমি যাত্রাদল আসতে দেখেছি। মুকুন্দ দাসও এসেছিলেন একবার মনে আছে আমার। এখন চোঁয়ার কথাটাই বলি। যেদিন রাত্রে যাত্রা হবার কথা, সেদিন সকালে বাবা সামনের বাগানে প্রাতঃকৃত্য করতে গেছেন, দেশগাঁয় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে প্রকৃত রসিকের ন্যায় নিঃসর্গ দৃশ্য দেখতে দেখতে মুক্ত বাতাসে নিজেকে বিমুক্ত করাই যে রেওয়াজ তা আপনি অবহিত আছেন আশা করি। এখন, সেই যাত্রাদলের একটি ছোকরাও বসেছিল প্রাক্তকৃত করতে কাছাকাছি–তিনি লক্ষ্য করেননি। এহেন কালে একটা কুল এসে পড়ল তাঁর সম্মুখে। টোপাকুল। দেখে তিনি লোভ সামলাতে না পেরে মুখে পুরে দিয়েছেন, আমাই বাবা তো! কিন্তু সেই ছেলেটা সেটা দেখেছিল।…

তারপর?

তারপর, সন্ধ্যেয় যাত্রার আসর বসতে রাধাকৃষ্ণের পালা শুরু হোলো। সেই প্রাতঃকৃত্যের ছোঁড়াটা জটিলা-কুটিলার একজন সেজেছিল। নাচতে নাচতে আসরে এসে গাইতে লাগল, তোমার কুলের কথা কয়ে দেব, রাধার কাছেই হাত মুখ নেড়ে গাইছিল সে, তারপর গোটা আসরেই ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগল তাই। বাবার কাছে এসে যখন সে হাত নাড়তে লেগেছে–তোমার কুলের কথা কয়ে দেব–বাবা তাকে একটা টাকা প্যালা দিয়েছেন। চলে গেছে। এক চকর ঘুরে ফের সে ফিরে এসে শুরু করেছে, তোমার কুলের কথা কয়ে দেব। অমনি বাবা হাটে হাঁড়ি ভাঙবার ভয়ে পাঁচ টাকা প্যালা দিয়েছেন। ফের আবার। বকশিশ পেয়ে পেয়ে ছোঁড়াটার উৎসাহ বেড়েছে, ঘুরে ঘুরেই আসছিল সে আর গাইছিল ওই কুলের কথার কলিটা-বাবার মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে। আর বাবাও অমনি তেড়ে তেড়ে প্যালা দিচ্ছিলেন ছেলেটাকে তার মুখ চাপা দেবার জন্য। তিনি যত চাপতে চাচ্ছিলেন ততই তার চাপল্য বাড়ছিল যেন। সে ভেবেছিল তার গানটা বুঝি বেমায় মনে ধরেছে বাবুর–তাই সে গানও ছাড়ছিল না,, বাবাকেও না। মাছির মতই ভোঁ ভোঁ করছিল বাবার কাছে এসে। আর বাবাও পাগলের মত প্যালা দিয়ে যাচ্ছিলেন–ঐ করে বাবার আংটি গেল, সোনার ঘড়ি চেন গেল, গায়ের শাল দোশালা আংরাখা, লক্ষ্মেী টুপির কিছুই রইল না, সব চলে গেল বাবার ই গানের ঠ্যালা সামলাতে, কিন্তু প্যালারামকে থামানো গেল না কিছুতেই। শেষটায় কুলের কাঁটার যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে বাবা উঠে পড়লেন আসর থেকে–সর্বশেষে বাবা নিজের পরিধেয় বস্ত্রটি খুলে দিয়ে বললেন, যা ব্যাটা, কগে যা আমার কুলের কথা। হাগতে বসে একটা কুল খেয়েছি এই তো? কয়ে দিয়ে, বয়েই গেল আমর। বলে বিলকুল দিগম্বর হয়ে বেরিয়ে এলেন আসর থেকে।

তাই নাকি?

বাবার এই কুলকাহিনী তো আপনি শুনতে পাননি? সত্যি বলতে, সবার কুলকথা কুলকেচ্ছাই প্রায় এইরকম। আমিও নিজের কুলের কথা কাউকে কইতে চাইনে তো এইজন্যেই। পাছে দিগর সাজে লোকসম জে বেরিয়ে পড়তে হয় সেই ভয়।

.

০৬.

একেবারে পোড় বাড়ি ঠিক না হলেও প্রায় পড়ো পড়োই ছিল বটে বাড়িটা। আড়াই ধার তার পড়েই গেছল, দেড়টা দিক খাড়া ছিল কোনো গতিকে।

তাহলেও নামড়াকে রাজবাড়ি। পুরাতন রাজবাটী। চাঁচোরের রাজা ঈশ্বরচন্দ্র একদা মহাসমারোহে বাস করলে সেই প্রাসাদে।

বিরাট চার মহলা লম্বা চওড়া ছিল যে বাড়িটা তা তার চারধারের ধ্বংসাবশেষ দেখলেই বোঝা যায়। অন্দর মহল, রাণীরা থাকতেন যে ধারটায়, পশ্চিমদিকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখন ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে। দক্ষিণ ধারটাও ভাঙাচোরা চেহারা, তার একটা দিকের খানকয় পরিত্যক্ত ঘর তো আমার চোখের ওপরই ভেঙে পড়ল একদিন।

একশ বছরের ওপর নাকি বাড়িটার বয়স, তখন সেই পড়ন্ত অবস্থায় মনে হতো পড়তে পড়তে পুরোপুরি যেতে আরও একশ বছর লেগে যাবে বাড়িটার। সেকেলে শক্ত গাঁথুনির পোক্ত বাড়ি তো রীতিমতন বনেদী।

দোতলা বাড়ি। আমরা থাকতাম রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের সাবেক তোষাখানায়। পূর্বদিকের এলাকায়। তার বাঁ দিক ঘেষে স্নান করার গোসলঘর। এখন সংক্ষিপ্ত হয়ে গোর, সেটা পেরিয়ে গেলে শীসমহল ইত্যাদি-হলগুলো থাকলেও সে-সবের রঙ-চঙের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট ছিল না আর।

দস্তুর মতন প্রশস্ত তোষাখানার ঘরটায় পর পর আটখানা খাট আটত। সেটাই ছিল আমাদের শোবার ঘর। বাবার নিজের ছিল তিনখানা খাট, যখন যেটাতে খুশি তাঁর দেহভার রাখতেন, তার ভেতরে একটা ছিল আবার পেল্লায়। আমার নিজের দখলে ছিল একখানা, বায়না করে বাগানো, আর আমার ভাই আর মার খাট দুখানা জুড়ে এক-করা, একটা বড় মশারির বিছানা ছিল সেই খাটে। আমি নিজের খাটে তো শুতামই, আবার ইচ্ছে হলে, ইচ্ছেটা প্রায়ই হত আমার, পাশের সেই জোড়া খাটে গিয়ে মধ্যিখানে সেঁধিয়ে পড়তাম এক এক সময়। বাবার পাশেও গিয়ে শুতাম কখনো-সখনো।

আর অষ্টম, বাড়তি খাটখানা ছিল মামা-টামা বা সম্পর্কিত দিদি-টিদি কেউ কখনো সখনো এলে-টেলে তার জন্যে।

রঙমহল শীসমহল ইত্যাদির মানে কী, আমার জানা নেই। মুঘল যুগের ইতিহাসে যাঁদের দখল আছে তারা বলতে পারেন। আমার মোগলাই অভিজ্ঞতার দৌড় ঐ পরোটা পর্যন্ত। আমার মনে হয় ওখানে বসে রাণী আর বেগমরা হয়ত মুখে হাতে নখে মেহেদির রঙ লাগানে আর রাজা কি রাজকুমাররা শীস দিয়ে ইশারা করতেন তাঁদের কিংবা সাড়া দিতেন তাঁদের ইশারায়। আর, তোষাখানাটা আমার ধারণায় ছিল খোসামোদের আখড়া। মোসাহেবদের তোষামোদে রাজাবাহাদুর এখানে আমোদিত হতেন, আমোদ পেত সভাসজ্জন সবাই।

গোলঘরটার উত্তর দিকে আরো অনেক ঘর ছিল, সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ খাড়া ছিল তখন। তারই ভেতর যে দু-একখানা তখনো পড়ে যায়নি তারই একটাতে ছিল আমাদের ভাঁড়ার ঘর আর তার পাশেই রান্নাঘর।

ঐ পর্যন্তই আমাদের এলাকা। তার ওধারটায় সাবেক মহাফেজখানা ছিল যেটা সেখানে থাকতেন এক ডাক্তার, সপরিবারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। রাজ এস্টেটের দাঁতব্য চিকিৎসার ভার ছিল তার ওপর।

কলকাতা থেকে এসেছিলেন তাঁরা। আমার মাও শহুরে মেয়ে। তাই দুই বাড়ির গিন্নীর ভেতর ভাব জমাতে বেশি দেরি হয়নি। আমার বাবা প্রথম পরিচয়েই ডাক্তারবাবুর বৌকে একটা হীরের আংটি উপহার দিয়েছিলেন আমার মনে আছে। কিন্তু সেহেতু মার কোনো রাগ হতে আমি দেখিনি।

ডাক্তারবাবুর ছিল চার মেয়ে আর এক ছেলে। কী যেন তাদের নাম। শুধু একজনের নাম এখনো আমার মনে আছে, সব্বার ছোট, সেই রিনি। প্রায় আমার বয়সী, দশ-বাবোর মধ্যে সবাই, তবে ছেলেটা আমার চেয়ে একটু বড়ই হবে বোধ করি।

আমার বেশ মনে আছে, আমরা দুই ভাই রাম লক্ষ্মণ সাজতাম আর সেই ছেলেটা-কী যেন ছিল তার নাম, সে হতো রাবণ। মোড়ার কাঠি ভেঙে তীর ধনুক বানিয়ে ঘোরতর যুদ্ধ হত আমাদের–যেটাকে ন্যায়যুদ্ধ বলা যায় না কিছুতেই। কেন না রাবণ হারতে চাইত কোনমতেই, সব শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে গায়ের জোরে হারিয়ে দিতে আমাদের। তীর ধনুক সব ফেলে দিয়ে পিটাতে এমন শুরু করত আমাকে-স্বভাবত রাবণের রামের প্রতি আক্রোশ বেশি হবার কথা–অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু আমারই পাশ-বালিশ বাগিয়ে দুমদাম লাগানোটা কি ঠিক? যতই বলি যে গদাযুদ্ধ রাবণোচিত নয়, দুর্যোধনের শোভা পায়, সেকথায় কান না দিয়ে সে বালিশ আর আমাকে একসঙ্গে ফাঁসিয়ে দিত। চোখে নাকে মুখে তুলো ঢুকে হাঁচতে হাঁচতে পালাবার পথ পেতাম না আমি। সে তখন লক্ষ্মণের সঙ্গে সন্ধি করে মার্বেল খেলতে বসে যেত বারান্দায়।

নীচের ডাক্তারখানা থেকে আমি একবার একটা কাঁচের পিচকিরি চুরি করে এনেছিলাম, বিশেষ কোনো কারণে না, এমনিই। ভালো লেগেছিল তাই। তাই না দেখে ভারী রাগ করেছিলেন বাবা, কাঁদতে কাঁদতে সেই পিচকিরিটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হয়েছিল আমায়। কম্পাউন্ডারবাবু পিচকিরিটা নিয়ে সিরাপ খাইয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন আমাকে, মনে পড়ে এখনও।

তোষাখানা আর মহাফেজখানা মাথা উঁচু করে থাকলেও পশ্চিম আর দক্ষিণের মালখানা আর বালাখানার সবটাই প্রায় পড়ে গেছল। এই চারখানার মাঝখানে অনেকখানি শান বাঁধানো ফাঁকা জায়গা ছিল–সেই বিরাট চত্বরে ম্যাজিক বা যাত্রার আসর জমত, পাঁচখানা পাড়ার লোক জড়ো হতো দেখতে। আর সেই চৌহদ্দিতেই ওরা পাঁচ ভাইবোন আর আমরা দুই ভাই মিলে বাতাবি নেবুর বল পিটিয়ে খুব ফুটবল খেলতুম।

আমাকে সঙ্গী করে বড়ো মেয়েটা, নানু বুঝি ছিল তার নাম, মাঝে মাঝে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরুতো। মেয়েটা ছিল দারুণ ডানপিটে। গায়ে জোরও ছিল বেশ। তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পারতুম না আমি কখনোই।– রত্নহারের সন্ধানে বেরুতাম আমরা একেকদিন। মহারাণীর রত্নহার। চারধারেই তো প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সে বলত এরই আনাচে কানাচে কোথাও না কোথাও মোহরের ঘড়ার সন্ধান পাওয়া যাবে। সেকালে তো ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক ছিল না। ধনরত্ন সব মাটির তলাতেই লুকিয়ে রাখত সবাই।

আমাদের বাড়িটার পশ্চিম দিকে রাণী ভূতেশ্বরীর অন্দর মহলের ভগ্নাবশেষে হানা দিতাম, যদি মহারাণীর হীরে মাণিক্যের খোঁজ মিলে যায় দৈবাৎ।

একদিন এঘরে সেঘরে ঘুরতে হঠাৎ একটা সুড়ঙ্গের মতন দেখা গেল। নানু বলল, আয় নেমে যাই, এর ভেতরটায় কী আছে দেখে আসি।

বাবা। আমি ঘাড় নাড়লাম। সাপখোপ থাকতে পারে। কামড়ে দেবে। বাবার কাছে সাপের ওষুধ আছে। সে বলল। ডাক্তারের মেয়ে, সাপের ভয় রাখে না সে।

তেমন তেমন সাপে কামড়ালে টের পাবি তখন। তোর বাবা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবি না। ঢুলে পড়বি এখানেই।

বয়ে নিয়ে যাবি তুই।

আমি? আমি তোকে তুলতে পারি? এখুনি পরীক্ষা করে দেখা যায়না বাবা। তুই যা ভারী। সুড়ঙ্গে সেঁধিয়ে কাজ নেই। এমন সময় সাজগোজ করা একটা মেয়ে থামের আড়াল থেকে ইশারা করল আমাদের।

থমকে দাঁড়ালাম আমরা। এখানে মেয়ে এলো কোথা থেকে রে? আমি নানুর কানে ফিসফিস করি।

রাণী ভূতেশ্বরী হবে বোধহয়। তোকে ডাকছে। হ্যাঁ তোকেই। যা না।

বাবা। গুপ্তধনের সন্ধান পেতে পারিস। বা মোহরের ঘড়ার খবর। যা না রে। ভয় কীসের! আমি তো রয়েছি এখানে?

না বাবা।

গলার হারখানা দেখেছিস? হীরে মুক্তো ঝকমক করছে। রত্নহারটা তোকে দিতে পারে–চাস যদি। চা না গিয়ে।

রত্নহার আমার মাথায় থাক। ও নিয়ে আমি কী করব? আমায় দিবি। পরব আমি আমার গলায়। আমায় দিবি রে!

না বাবা।

সেখান থেকে ফিরে সেদিনকার রাণী ভূতেশ্বরীর সঙ্গে মোলাকাতের কথা মাকে বললাম। মা শুনে ভারী রাগ করলেন। কড়ে আঙুলটা কামড়ে দিলেন আমার। মনে মনে কী যেন আউড়ে সারা গায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

জানো মা, রাণী আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছিলেন। জানো মা, নানু বলছিল, ওর গলার হারটা দেবার জন্যই ডাকছিল আমাকে। আমরা নাকি ওর নিকটাত্মীয় হই?

খবরদার, ওই সব পোড়া বাড়ির দিকে পা বাড়াবিনে কোনদিন। পুনঃ পুনঃ মা সাবধান করে দিলেন আমায়।

সেদিন রাত্তিরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটেছিল নাকি! মার মুখে শুনেছি।

রাত নটার মধ্যেই খাওদাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়তাম আমরা। মার রান্নার কোনো ঘনঘটা ছিল না। লুচি, আলুর তরকারি, আর ক্ষীর–এই ছিল রাত্রের খাবার। বাবা খেতেন অনেক রাত্তিরে–তাঁর জপধ্যান সব সেরে। তাঁর খাবার ঢাকা দেওয়া থাকত গোলঘরটায়।

শুতে না শুতেই সেদিন হাড় কাঁপিয়ে আমার জ্বর এসেছিল নাকি।

দেখতে না দেখতে সে জ্বর চড়ে গিয়েছিল বেজায়। রাত দুপুরে ঘোর বিকারে দাঁড়িয়ে গেল। সান্নিপাতিক সব লক্ষণ প্রকাশ পেতে লাগল তখন।

আর, সেই সময়েই শুরু হয়েছিল দারুণ ভুতুড়ে উপদ্রব। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে যে রকম বর্ণনা রয়েছে–হুম হাম দুম দাম্ অট্ট অট্ট হাসিছে। অবিকল সেই ধরনের সব।

আর, মা আমার পাশটিতে শুয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে মা কালীকে ডাকছেন।

ওকে ছেড়ে দে, ওকে ছেড়ে দে। ওকে আমি নিয়ে যাব। খোনা গলায় বলেছিল কে যেন।

না মা, তোমায় গড় করি। ওকে তুমি নিয়ো না। ওকে ছেড়ে দিয়ে যাও, তোমার দোহাই! মিনতি করছিলেন মা।

না। তা হয় না। ও আমাকে ভেংচি কেটেছে কেন? ছাড়ব না, ওকে নিয়ে যাবই। নিয়ে যেতেই আমি এসেছি। তুই ছেড়ে দে।

মা, তোমার পায়ে পড়ি। তোমাদের বাড়ির বউ আমি। ওর হয়ে আমি মাপ চাইছি–তবধ বালক, ওকে মাপ করো। এবারটির মত ছেড়ে দাও। ওর ঘাট হয়েছে মা।

ওকে না নিয়ে আমি যাব না। আজ রাত না পোয়াতেই নেব।

তখন মা কী করেন, আর কোনো উপায় না দেখে কালীঘাটের মা কালীর কাছে তাঁর ডান হাত বাঁধা রাখলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভূতুড়ে উৎপাত শান্ত হল, আমার জ্বর ছেড়ে গেল, সকাল বেলা যেন দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম। সম্পূর্ণ বহালতবিয়তে।

রাতে যে আমাকে নিয়ে অত টানাপোড়েন চলেছিল তার বিন্দুমাত্রও আমি টের পাইনি। টের পেলাম সেদিন দুপুরে খেতে বসে।

আমি, মা আর আমার ভাই সত্য একসঙ্গে খেতে বসতাম সকাল সকাল। স্নান আহ্নিক সেরে বাবার খেতে বসতে দুপুর গড়িয়ে যেত।

মা বসেছেন আমার সামনেই। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি অবাক হয়ে শুধিয়েছি মা, তুমি ডান হাতে না খেয়ে বাঁ হাতে ভাত খাচ্ছ কেন আজ?

যেই না বলা, অমনি মা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।

সেদিন আর মার খাওয়াই হল না। সারাদিনটা উপোস গেল। খেলেন সেই রাত্তিরে। ভাত আর মার পেটে পড়ল না সেদিন।

তখন জানলাম রাত্তিরের ব্যাপারটা। মার ডান হাত বাঁধা রাখার কথা। মা এখন থেকে বরাবর বাঁ হাতেই খাবেন-যদ্দিন না সেই কালীঘাটে গিয়ে মার মানতের পুজো দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। মার খাওয়া পণ্ড প্রথম আমার থেকেই হয়েছিল। অনেকদিন তিনি অমনি উপোস করে কাটিয়েছেন।

প্রথম পাণ্ডা আমি হলেও তার পরে আরো অনেকের হাতেই তাঁর খাওয়া পণ্ড হয়েছিল। শেষটায় পাড়াপড়শীরা কেউ এলে খেতেই বসতেন না মা। বাঁ হাতে খাওয়া দেখলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগত তাদের মনে, আর তার জবাবে সেদিনকার সে বেলার মতন খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত মার।

তারপর থেকে সাবধান হয়ে গেছেন মা। বাড়ির অতিথি-অভ্যাগতরা নিজ গুণে বিদায় না নেওয়া পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন তিনি। খেতেই বসতেন না। অনেকদিন পরে কলকাতায় এসে কালীঘাটে পুজো দিয়ে তারপর হাত খালাস করতে পেরেছিলেন মা।

মা ডান হাতে খাচ্ছেন, তখন সে আবার আমাদের কাছে আরেক অবাক করা দৃশ্য।…

একটা রহস্যের আজও আমি ঠিক থই পাইনি। মার সেই দিব্যদর্শন আর আমার ওই অত দেখাটার।

মনের ইচ্ছাপূরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়ত বা তার কিছু হদিশ মেলে। যেরকমটা স্বপ্নে দেখে থাকি, সেইরূপ চোখ মেলেও স্বপ্ন দেখা যায়-অবচেতনের প্রার্থিত বস্তু হাতে হাতে পেয়ে যাই তখন।

মনই তো বাঞ্ছা কল্পতরু-বাঞ্ছিত বস্তু মিলিয়ে দেয় আমাদের। সব কিছুর তত্ত্ব মনের গুহাতেই নিহিত। মনের গুণেই ধন মেলে, কখনো বা কল্পনার কল্পলোকে। কখনো অকল্পনীয় ভাবে জীবনের এই বাস্তবে।

মা রাতদিন মা কালীর কথাই ভাবতেন তো! তারপর দরদালানে জবা ফুলটা দেখে তার অনুষঙ্গে তাঁর ভাবনা ঐ ভাবমূর্তি ধারণ করেছিল। এক রকমের আত্ম-সম্মোহন আর কি!

আর আমার ব্যাপারটাও প্রায় তাই। ভূতুড়ে পোড়ো বাড়িতে ভূতপেত্নীর দর্শন মিলেই থাকে, লোকমুখে শুনে শুনে গল্পগাথায় পড়ে জানা। তাই সালঙ্কারা ভূতেশ্বরীকে দেখেছিলাম। কিন্তু রাত্তিরে সেই হঠাৎ জ্বর বিকার হওয়া আর মার মানত করার সাথে সাথেই তার বেপাত্তা হয়ে যাওয়া–এর মানে? এই জিজ্ঞাসার জবাব পাইনে।

অবশ্যি, শেষ পর্যন্ত মহামতি শেপীরের মত তাবৎ প্রশ্ন ভূয়োদশী উক্ত হোরেশিয়োর ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় বইকি!

যদিও মাঝে মাঝে আমার মনে হয় জীবনের যত ভূয়োদর্শনের সবটাই হয়ত ভুয়ে নয়।

.

০৭.

রিনিকে নিয়ে আমি প্রায় দিনই বেরিয়ে পড়তাম বিকেলে বেড়াতে। ইস্কুলের থেকে ফিরে দুপকেটে চিড়ে আর খেজুর গুড়ের পাটালি ভরে নিয়ে কুকুরডিঘির পাশ দিয়ে পাহাড়পুরের পথ ধরে চলে যেতাম একেকদিন। দুজনে মিলে চিড়ে গুড খেতে খেতে মজা করে। কোনোদিন বা আবার চষা ক্ষেতের আল পথ দিয়ে আলগোছে হাঁটতাম আবার আমরা। কোনোদিন নয়া দিঘির পাড়ে বসে থাকতাম, বসে বসে গল্প করতাম দুজনায়।

মাঠের মাঝখানে সেই যুঁই গাছটার তলায় গিয়ে বসতাম একেকদিন। যুঁই ফুল ছড়ানো কেমন গন্ধ জড়ানো জায়গাটা। সেখানে গেলে রিনির সব গল্প ফুরিয়ে যেত হঠাৎ। আমার কোলের ওপর মাথা রেখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভাবত সে, কে জানে! তার মুখের ওপর চোখ নামিয়ে কী দেখতাম আমি কী জানি!

সারা আকাশ রঙে ভাসিয়ে দুর দিয়ে সূর্য অস্ত যেত, আর যে সূর্যমুখী ফুল আ। চিনিনে, দেখিনি কখনো, কি রকম দেখতে কে জানে, আমার মনে হত তাই যেন ফুটে রয়েছে আমার কোলের উপরে।

কোনোদিন বিকেলে আমি ডাকতে যেতাম রিনিকে ওদের দিকটায়। কোনোদিন বা সে, আসত আমাদের এধারে। দুজনে খেতে খেতে হাঁটতাম, আর হাঁটতে হাঁটতে খেতাম। আসবার সময় হাত ধরাধরি করে ফিরতাম আমরা।

সেদিন রিনি ফেরার কালে আমার হাত না ধরে আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে এল– ঠিক ছেলেদের মতই। ছেলেবন্ধুরা যেমন পাশাপাশি গলা জড়িয়ে যায় সেইরকই প্রায়। সত্যি বলতে এই জর্জর অবস্থাটা একটু কেমন কেমন ঠেকলেও তেমন আমার খুব মন্দ লাগছিল না।

রিনির মধ্যে ছেলেমানুষি তো ছিলই, ছেলেদের মতও খানিকটা যেন ছিল কীরকম। একাধারে ছেলে আর মেয়ে–এই কারণেই তাকে আমার ভালো লাগত আরো।

ওর চেহারাটাও ছিল যেমন ছেলে-ছেলে, ওর অনেক আচরণেও তেমনি ছেলেমি প্রকাশ পেত। ছেলেদের মেয়েলিপনা অসহনীয় বোধ হলেও মেয়েদের মধ্যে এই ছেলে ছেলে ভাবটা আনকোরা এক আকর্যণ মনে হয়।

ছেলেদের সঙ্গে ছেলেরা যেমন সহজে মেশে, রিনির সঙ্গে তেমনি অবলীলায় আমি মিশতে পারতাম। কোন কুণ্ঠা সঙ্কোচ ছিল না কোথাও।

সেদিন সারাটা পথ তার অকুণ্ঠ এই গলা জড়িয়ে আসাটা আকণ্ঠ আমার যেন অমৃতে ভরে দিল… মধু ঝরতে ঝরতে এল সারাক্ষণ। এমন কি, বাড়ি ফিরেও অনেকক্ষণ খালি কাঁধটাই আমার কাছে কালাকাদের মতন মিঠে ঠেকতে লাগলো।

বেড়িয়ে ফিরতে প্রায়ই সন্ধ্যে হয়ে যেত, তাই সোজা সে তার বাড়িতে চলে যেত আর আমি উপরে উঠে আসতাম।

সেদিন সে নিজের এলাকায় না গিয়ে আমার সঙ্গে উপরে এল।

তোমার পড়ার ঘরটা দেখব।

পড়ার ঘর বলে আলাদা কিছু নেই আমার। কয়েকটা বড় বড় হল তো। ঘর কোথায় আমাদের? ঘর আছে তোমাদের দিকটায়। ছোটখাট বেশ কয়েকখানা ঘর।

তাহলে তুমি পড়ো কোথায়?

শোবার ঘরেই পড়ি, আবার কোথায়? বাবার টেবিলে প্রকাণ্ড আয়নাটার সামনে গোল একটা কেদারা আছে, বেশ বড়ো কিন্তু বেজায় সেকেলে, সেইটেয় বসে টেবিলে বইপত্তর রেখে পড়াশুনা করি। দেখবে ল।

টেবিলের সামনে একটিমাত্র বড় কেদারায় আমরা ঘেষাঘেষি বসলাম। সে আমার বইখাতা হটকাতে লাগল।

ওমা! একী! কী লিখে রেখেছ সব?

কী লিখেছি! ওর সবিস্ময় শব্দে আমি সচকিত হই।

খাতা ভর্তি যা-তা কী লিখেছ সব? এ কী!

কী জানি। উদাসীনের মত বলি : হাতে কোনো কাজ থাকে না তখন কী করি, যা মনে আসে তাই লিখি।

তাই বলে পাতার পর পাতা জুড়ে খালি রিনি রিনি রিনি রিনি! এ কী! আমার নাম কেন? সে অবাক হয়। এত এত আমার নাম। কেন গো?

কে জানে কেন!

বারে! আর কী কোনো নাম ছিল না পৃথিবীতে? ঠাকুর দেবতার নাম লিখতে হয়। বাবা রোজ সকালে একপাতা করে দুর্গা নাম লেখেন। মা দুর্গার নাম। শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়, শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়। তার মানে বোঝা যায়। তোমার এ কী?

আমি তার কী জবাব দেবো? চুপ করে থাকি।

এ রকম লিখো না আর। কারো চোখে পড়লে কী ভাববে বল তো?

কী ভাববে আবার? ভাববার কী আছে!

ক্ষ্যাপা ভাববে তোমাকে।

এক মাঘে যেমন শীত যায় না, তেমনি এক ক্ষেপেও মানুষ পাগল হয় না কিন্তু তার কথার ঠিক জবাবটি আমি জানতুম কি তখন! খানিক চুপ থেকে বলি-ভাবুক গে। আমার বয়ে গেল।

সে আর কিছু বলে না।

কেন, তুই কি রাগ করলি আমার ওপর? আমি শুধাই : কালী দুর্গা না লিখে তোর নাম লিখে রেখেছি বলে?

সে কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে।

একটা অদ্ভুত নীরবতা যেন দেখা দেয় অকস্মাৎ।

অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে আমি স্তব্ধতাটা ভাঙি-দেখি তত তোমার ইংরেজী হাতের লেখা কেমন? লেখোত।

আমার খাতায় আমারই কপিং পেনসিলটা দিয়ে সে লেখে-ইউ আর এ ভেরী গুড বয়।

বাংলা লেখা দেখি এবার।

আমি তোমাকে ভালবাসি।

গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দেয়।

লিখে সে তার বড় বড় চোখ মেলে তাকায় আমার দিকে। আমিও তাকিয়ে থাকি।

চুপ করে তাকিয়ে থাকি পরস্পর অনেকক্ষণ।

আমার কপিং পেনসিলটা তার মুঠোর মধ্যে তখনো।

আমার পেনসিলটা তোকে প্রেজেন্ট দিলাম। ফর এভার।

সে কিছু না বলে পেনসিলটা মুঠোয় করে চলে গেল তারপরে।

একদিন বিকেলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার দেখা না পেয়ে তার বাড়িতে তাকে ডাকতে গেছি। দেখি তার মা তখন প্রকাণ্ড একখানা ভোয়ালেয় দেহ জড়িয়ে কুয়ো তলায় বিকেলের গা ঘোয়ায় লেগেছেন।

রিনি নেই মাসিমা?

কোথায় যেন বেড়াতে গেল তার দাদার সঙ্গে। নানু-টানু সবাই গেছে। তোমাদের ইস্কুলে কী ফাংশন হচ্ছে না আজ? ম্যাজিক না কী হচ্ছে যে বলল। তুমি যাওনি যে? যাওনি কেন?

রিনিকে নিয়ে একসঙ্গে মাঠঘাট চষে বেড়ানোর যে ম্যাজিক আমি রোজ দেখি তার কাছে কোনো ভেকিই কিছু নয়। কিন্তু সে কথা কি বলা যায়!

এমনি যাইনি। ওকে নিয়ে যাব ভাবছিলাম। নানুদের সঙ্গে চলে গেল? আমার গলায় দুঃখের সুর বেজে উঠল বুঝি।

ও বোধ হয় ভেবেছে ওখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হবে।…

আমি তাহলে যাই মাসিমা।

যাবে কেন? বোসো না। উনিও বাড়ি নেই, কোথায় রুগী দেখতে বেরিয়েছেন গাঁয়ে। বোসো ঐখেনে। নাইতে নাইতে গল্প করা যাবে তোমার সঙ্গে।

শিশি থেকে নিজের মাথায় তেলের মতন কী একটা জিনিস তিনি ঢাললেন ভিজে চুলের ওপর–এখানে বসে বসেই একটা ম্যাজিক দ্যাখো। কেমন? এই দ্যাখো না–এই তেলটা মাথায় দিলাম তো। দেখছো তো তেল? দেখতে না দেখতে এক্ষুনি সাবান বানিয়ে দিচ্ছি এটাকে–মন্ত্রের চোটে–চেয়ে দ্যাখো তুমি?

ওমা! সত্যিই তো! মাথায় একটুখানি ঘষতে না ঘষতেই সেটা সাবানের ফেনায় ফেনায় বদলে গেল–অবাক কাণ্ড! বিস্ময়ে থই পাই না।

একে বলে শাম্পু। শুনেছ এর নাম? না তো!

মাথায় সাবান দিলে–তার ভেতরে ক্ষার আছে তো? তার জন্যে চুল উঠে যায়। শাম্পু দিতে হয়। তুমি মাখবে?

না। ঘাড় নাড়ি আমি।–কি হবে মেখে?

মাথা হালকা হবে। চুল পরিষ্কার থাকবে। খুসকি-টুসকি হবে না মাথায়।

আমার নেই ওসব।

হতে কতক্ষণ! যা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া একমাথা চুল তোমার! ছাঁটো না কেন? ছাঁটবে।

আচ্ছা। ঘাড় নাড়লাম আবার।

মাথার শাপুর পর তিনি মুখে সাবান মাখলেন, তারপরে বললেন আমায়-পিঠের দিকটায় মাখিয়ে দাও তো আমার।

সাবানটা নিয়ে আমি তাঁর পিঠে মাখাতে লাগলাম।

ভালো করে মাখাও।

আমি জোরে জোরে ঘষতে লাগলাম।

এবার এদিকটায়।

আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি বুকের দিকে তোয়ালেটা সরিয়ে দিলেন এবার।

তবু আমি হাত বাড়াই না দেখে তিনি একটু হেসে বললেন–তোমার মনে পাপ ঢুকেছে দেখছি।

পাপের কথায় রাগ হয়ে গেল আমার। আমি চোখ কান বুজে জোরে জোরে সাবান ঘষতে লাগলাম।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর। পায়ে মাখাও এবার।

মাখাতে লাগলাম। কী সুন্দর সুগঠিত পা! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতই। বাবা বলতেন, দেবীর স্তরে পা থেকে বন্দনা শুরু করতে হয়। সরস্বতীর বেলায় কে যেন তা করেনি, তাই তাঁর কোপে সে নাকি গাধা বনে গেছল। আমি তার মর্মটা তখন বুঝতে পারি।

এ কী! থামছ কেন? ওপর পর্যন্ত মাখাও। থেমে যাচ্ছ যে?

আমি তখন ওঁর কোমর অব্দি সাবান মাখাতে লাগি। হাঁটুর ওপরে আরো কী সুষমার রহস্য রয়েছে দেখার কৌতূহল যে না জেগেছিল তা নয়। তবুও কেমন একটা বাধ বাধ, ঠেকছিল বইকি।

আরো ওপরে। আরো।

আরো উপরে মাখাতে গিয়ে তাঁর পরনের তোয়ালে খসে পড়ে। তিনি মোটেই সামলাতে বান না।

আমি ঘাড় হেঁট করে থাকি।

থামলে কেন? মাখাবে তো।

ঘাড় গুঁজে ঘষতে থাকি সাবান।

সব জায়গায় লাগছে না যে। বাদ দিয়ে যাচ্ছ তুমি।

তারপর আমি আর কোন বাদবিসংবাদ রাখি না। ঘাড় হেঁট করে চালিয়ে যাই।

মাথা নীচু করে কেন? কোথায় মাখাচ্ছ দেখছ না? তাকাও ওপরে।

নিজেই তিনি দু হাত দিয়ে মাথাটা আমার তুলে ধরেন। প্রাণপণে আমি সাবান মাখাই। সামনে পিছনে সব জায়গাতেই।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর পা থেকে গলা অবধি বেশ করে রগড়ে দাও তো দেখি। ময়লা কেটে যাক।

রগড়াই বেশ করে। তলার থেকে গলা পর্যন্ত। দেবীর বন্দনায় কোনো অংশই বাদ যায় না।

ক্রমশই ভালো লাগতে থাকে।

এবার কুয়োর থেকে বালতি বালতি জল তুলে ঢালতে পারবে? কুয়োর ভেতরে পড়ে যাবে না তো তুলতে গিয়ে।

পড়ব কেন? এসব কাজ আমি খুব পারি। হাতে হাতে প্রমাণ দিয়ে দি।

কয়েক বালতি ঢালার পর তিনি শুকনো তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে বলেন-এসো এবার সাবান মাখিয়ে তোমার গা ধুইয়ে দি বেশ ভাল করে। কেমন? জামা কাপড় খুলে রাখো ঐখানটায়।

না।

না কেন? গা ধোও না বিকেলে?

না।

বিকেলেই তো নাইবার আরাম গো। নাও, জামা-টামা খোলো। খুলে রাখো ঐখেনে। একী, লজ্জা করছে নাকি খালি গা হতে?

না।

আমি এত বড় মেয়ে খালি গা হয়ে নাইতে পারলাম আর তুমি এইটুকু ছেলে-তোমার লজ্জা! এসো, লজ্জা কিসের? বেশ ভালো লাগবে তোমার।

না।

তখন তিনি গাটা মুছে শুকনো কাপড় পরতে লেগেছেন।

আমি এবার যাই মাসিমা।…দেখি গে, কী হচ্ছে ইস্কুলে।

আচ্ছা এসো। তারপর কী ভেবে বললেন ফেরকাল বিকেলে এসো আবার। কেমন?

তারপর রিনিদের বাড়ি যাইনি আমি। কোনো বিকেলেই যাইনি আর। ওর মার নাইবার সময় কখনই না।

বাধ-বাধ ঠেকত বলে যে, তা না। তাঁর দেহসুষমায় অভিভূত হলেও আমি তেমন কোনো আকর্ষণ বোধ করতাম না। কেমন যেন লাগত আমার।

সেই বয়সেই নগ্ন নারীদেহের মাধুরী দেখেছিলাম অনেক। আমাদের বাড়িতে বিনতি আর্টিস্টের আঁকা রঙীন ছবির অ্যালবাম ছিল বাবার–আমি দেখতাম। লুকিয়ে নয়, খোলাখুলিই। কোনো বাধা ছিল না। মা বাবা কিছু বলতেন না সেজন্যে। ভালোই লাগত দেখতে।

আমাদের বাড়ি ভারতী, সাহিত্য, প্রবাসী, ভারতবর্ষ আর মাসিক বসুমতি আসত। তার কোন কোনটায় বাঙালী মেয়ের নগ্ন দেহ দেখা যেত মাঝে মাঝে। শিল্পী টমাস, হেমেন মজুমদার আর ভবানী লাহার আঁকা সিক্তবসনা রূপসীদের দিকে আমি অপলক চোখে তাকিয়ে থেকেছি।

তবে পূর্ণযৌবনা সুন্দরীর রূপলাবণ্য হাতে হাতে পরখ করে দেখা আমার সেই প্রথম। সেই অল্প বয়সেই সৌন্দর্যবোধের শিক্ষাও আমার হয়ে গেছল।

তারপর রিনিদের বাড়ি আর না গেলেও সে-ই আসত আমার কাছে। বিকেলে বেড়ানোর বেলায় তো বটেই, অন্য সময়েও কোনো দরকার পড়লে চলে আসত সে।

তবে যেতে হলো আমায় তাদের বাড়ি সাত-সকালেই একদিন হঠাৎ।

বাবা কদিনের জন্যে কলকাতায় গেছলেন কী কাজে, ফিরেছিলেন আগের দিন রাত্তিরে। অনেক রাত তখন, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা।

কলকাতা থেকে নতুন গুড়ের সন্দেশ নিয়ে এসেছিলেন বাবা আমাদের জন্যে। মা খুব ভালোবাসতেন নলেন গুড়ের সন্দেশ খেতে। কলকাতার মেয়েতো।

সকালে উঠে হাতমুখ ধুতেই না, মা দুটো বড়ো বড়ো তালশাস সন্দেশ খেতে দিলেন আমার। অমনি আমি সেই সন্দেশ হাতে করে ছুটেছি ওদের বাড়ি। রিনিকে ভাগ না দিয়ে খাওয়া যায়?

ওরা ভাইবোন মিলে তখন গুলতানি করছিল ওদের পড়ার ঘরে, আমি গিয়ে হাতের মুঠো খুলে রিনিকে দেখালাম-দ্যাখ, কি এনেছি তোর জন্যে।

তখুনি সে আমার হাত থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিয়েছে। দুটো সন্দেশই এক সঙ্গে।

ও মা! আমি যে একদম খাইনি রে এখনো।

বলতেই না, সে মুখ থেকে বার করে আমার হাতে নয়, পাখি-মা তার ছানাকে যেমন করে খাওয়ায়, তেমনি করে তার মুখের গ্রাসের খানিকটা আমার মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে। মুখের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে।

সেই প্রথম চুমো পাওয়া আমার জীবনে। সন্দেশের সঙ্গে মিশিয়ে চুমু খাওয়া সেই! প্রথম অমৃত আস্বাদের জন্যে রিনির কাছে আমি চিরঋনী।

প্রথম চুমু অমন করে সন্দেশের সঙ্গে মিশিয়ে পেয়েছিলাম বলেই কি ওই চুমু জিনিসটা এমন মিষ্টি থেকে গেল আমার কাছে চিরদিনই?

নাকি, চুমোর সঙ্গে মাখানো ছিল বলেই কি যতো মেঠাই এমন মিঠে লাগে আমার কাছে?

তাই কি আমি এমন সৃষ্টিছাড়া মিষ্টিশোর হয়ে গেলাম জন্মের মতই? কে জানে!

.

০৮.

সেদিন আমি ছাদেই ছিলাম বিকেলে। একটু বাদে রিনি এল।

কী! বেড়াতে বেরুবে না আজ?

না। ছাদে বসে বসে আজ কাঞ্চনজংঘা দেখব।

এখানে বসে কাঞ্চনজংঘা দেখা যায়? বসল সে।

হ্যাঁ, উত্তরের আকাশ পরিষ্কার থাকলে। আজ তাই আছে। সূর্যের আলো একটু কমে এলেই কাঞ্চনজংঘার ছটা দেখা দেবে। পাহাড়ের শৃঙ্গগুলো সারি সারি এমন সুন্দর দেখায় সারা উত্তর দিকটা জুড়ে কি বিরাট সমারোহ। বোস না আমার পাশে;খতে পাবি। দেখাব তোকে।

সে বসল বেশ কৌতূহল নিয়ে।

চিড়ে গুড নিয়ে আসি গে? খাওয়া যাবে। .

ও জিনিস কি ঘরে বসে বসে খাবার? বেড়াতে বেড়াতে খায়।

বেশ তো, বেড়িয়ে বেড়িয়েই খাওয়া যাক।

বেড়াবে কোথায়?

কেন, এই ছাদেই। কত বড় ছাদটা দেখেছিস। আমি রোজ সকালে উঠে এইখানেই বেড়াই তো। আমাদের এধার থেকে তোদের ওধার অব্দি বার আষ্টেক পাক খেলেই আধ মাইলটাক মনিং ওয়াক হয়ে যায়। এই ছাদেই। তুইও আসিস না তখন! বেড়িয়ে বেড়িয়ে পড়াও যাবে-পড়াও তৈরি হয় বেশ।

কি করে আসব বলো? আমাদের দিক থেকে ছাদে ওঠার কোন সিঁড়ি নেই যে!

একটা বাঁশের মই বানিয়ে দিতে পারি তোদের দিকে–মই বেয়ে তুই উঠতে পারবি?

সে কথার জবাব না দিয়ে সে বললে-কোথায় তোমার কাঞ্চনজংঘা? দেখাবে বললে যে!

দাঁড়া না, দেখবি। বোস না।

বসেই তো আছি। না, কাঞ্চনজংঘা আর দেখা দেবে না আজ। কেমন ধোঁয়াটে কুয়াশার মতন দেখছি যেন উত্তর দিকটা।

না দেখা দিক। তুই তো দেখা দিয়েছিস! তোকেই না হয় দেখব আজ। ভালো করে দেখব আরো।

দেখছই তো। আবার কী দেখবে আমায়!

এ দেখা নয়, ভালো করে দেখব তোকে। আমার সামনে খালি গা হবি?

দূর! তা আবার কেউ হয় নাকি?

সুন্দর মেয়েরা হয়। আর্টিস্টের সামনে হয়ে থাকে। দেখে দেখে তাদের ছবি আঁকে যে তারা। এমন সব খালি গায়ে মেয়েদের ছবি তোকে আমি দেখাতে পারি। বিলিতি অ্যালবামে আছে।

ও! সেই বিলেতেই হয়, এদেশে নয়। সে বলে।

এদেশেও হয়েছে। এদেশের আর্টিস্টরা ছবি এঁকে চিরদিনের মত ধরে রেখেছে তাদের। দেখতে চাস্?

না। দেখে কী হবে? দেখবার কী আছে ওতে?

দেখতে সুন্দর! দেখতে চমৎকার! দেখলে আনন্দ হয়। এই! আবার কী! আমি বলি-তোকেও সেই রকমটি আমি দেখতে চাই।

দেখে কী করবে? তুমি তো আর আঁকতে পারবে না।

মনের মধ্যে একে নেব–চিরকালের মতই।

দেখছ তো! অনেকখানিই দেখছ! মুখ দেখতে পাচ্ছ–কতটা পা দেখতে পাচ্ছ দ্যাখো। এই তো! এতখানি ফ্রকটা তুললাম…দ্যাখো না!

না আমি সবটা দেখতে চাই।

সবটাই তো দেখছ। আবার কী আছে দেখবার?

আরো সব। আমি বললাম-তুই দেখতে সুন্দর না? দেখতে ইচ্ছে করে না আমার?

আর কোনো মেয়েকে তুমি দেখেছ এমন খালি গায়ে?

আবার কে আছে দেখবার? আমি বলি, আবার কে সুন্দর আছে এখানে?

কেন, আমার দিদি! সে তো আমার চেয়ে অনেক সুন্দর।

মোটেই না। আমার কাছে নয়, আমার কাছে তুই-ই কেবল সুন্দর, তোকেই দেখতে চাই।

আমি যদি খালি গা হই তুমি দিদিকে বলে দেবে না তো?

পাগল! তা কি কেউ কাউকে বলে নাকি?

সে চুপ করে থাকে, কী যেন ভাবে।

ছাদে কেউ এসে পড়বে না তো হঠাৎ?

কে আসবে?

মাসিমা, কি তোমার ভাই?

মা তো জলখাবারের লুচি ভাজছেন এখন। আর সত্য? সে এখন নানুর সঙ্গে মার্বেল খেলছে উঠোনে।

তুমি আমার গায়ে হাত দেবে না তো? ছোঁবে না তো আমায়?

কক্ষনো না। তুই সাত হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকিস। খালি এক মিনিটের জন্যে কেবল। খুলবি আর পরবি।

সে ফ্রকটা খোলে। খুলে একটুখানি হাসে-হলো তো এবার?

বারে! কোথায় হলো?

তখন সে ইজেরটাও খুলল আস্তে আস্তে।

কয়েক মুহূর্ত না হতেই লাজুক চোখে তাকিয়ে বলল–পরি এবার?

পর। সত্যি, তুই ভারী সুন্দর। তোর মতন সুন্দর মেয়ে আর হয় না। আমি তো কখনো দেখিনি।

কটা মেয়ে তুমি দেখেছ! সে হেসে বলে-জীবনে কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখতে পাবে। আমার চেয়েও ঢের ঢের।…তখন তো ভুলে যাবে আমাকে।

কক্ষনো না। আর কোনো সুন্দর মেয়েকে আমি দেখব না। দেখতেই চাইনে আমি। তুই-ই আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর। তুই একমাত্র।

ফ্রক-টক পরে সে এক দৌড়ে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল আবার।

কোথায় গেছেলিস?

দোতলায়। বাথরুমে।

তারপর সে আপনার থেকেই ফ্রক খুলল, ইজেরটা খুলে ফেলল আবার, না সাধতেই। আপনমনেই নাচতে শুরু করে দিল তারপর।

ছাদময় ঘুরে ঘুরে নাচল।

তুই এমন নাচতে শিখলি কোত্থেকে রে?

শান্তিনিকেতন থেকে। মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে। থেকেছিলাম দিন কয়েক। দেখে দেখে শিখেছি। শান্তিনিকেতনের মেয়েরা নাচে সবাই।

তাই নাকি? আমি বললাম, বাঃ বেশ তো!

আর মেমরা কেমনতর নাচে জানো? ঠ্যাং তুলে তুলে এমনিধারা। কলকাতার সিনেমায় দেখেছি। কেন যে তার অমন ফুর্তি জাগল হঠাৎ কে জানে, ছাদময় খানিক ছুটোছুটি করে কার্নিশের ধার ঘেঁষে এমন করে সে দৌড়ে এল এক পাক যে, আমার বুকটা ধড়াস্ করে উঠল হঠাৎ-আটপকা নীচে পড়ে যেত যদি?

দৌড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে কোলের ওপর বসে পড়ল সে। আমার মুখের মধ্যে তার মুখ গুঁজে রাখল।

তোর এত ফুর্তি যে হঠাৎ! আমি শুধাই-কেন রে?

এমনিই। তারপর একটুখানি চুপ করে থেকে–ভালো লাগল নাচতে তাই।

গান গাইতে পারিস নাকি?

হ্যাঁ। ঘাড় নাড়ল সে–গাইব? বলে গুন গুন সুরে শুরু করল সে–দাঁড়িয়ে আছে তুমি আমার গানের ওপারে একটুখানি গেয়েই চুপ। বসে রইল চুপটি করে।

একদিন তোর পা থেকে মাথা অব্দি আমি চুমু খাব–বুঝলি?

খেয়ো।

হাজার হাজার।

আচ্ছা। কিন্তু পা থেকে কেন? পা কি চুমু খাবার জায়গা নাকি?

দেবতাদের পাবন্দনা করে আরম্ভ করতে হয় কিনা?

আমি দেবতা নাকি?

আমার কাছে তো।

আমিও তোমার পায়ে খাব তাহলে।

না। তা আমি খেতে দেবো না। একটুখানি থেমে বলি, ছেলেরা কেউ দেবতার মতন হলেও তাদের পাদবন্দনা করে শুরু করার নিয়ম নেই। তাদের মুখে খেলেই হয়।

খাবে পায়ে? সে তার ডান পা-খানা তুলল একটুখানি। পাখির ডানার মত।

আমি আলতো হাতে ধরে তার পায়ের পাতার ওপরে আমার চুমু রাখলাম।

তারপর কী হল যে, সে কান্নায় ভেঙে পড়ল কেন কে জানে! কোলের উপর বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে।

কী হল রে তোর? কাঁদছিস কেন?

কিছুতেই সে ঠাণ্ডা হয় না। কত আদর করলাম, ঠোঁট দিয়ে চোখ মুখ মুছিয়ে দিলাম ওর-বুও না।

একটু বাদে কান্না থামলে সে চোখ তুলে তাকালো উত্তর আকাশে দেখা গেল কাঞ্চনজংঘা? দেখেছিলে?

হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম।

আমি দেখতে পেলাম না। দুঃখের সুর বাজল তার স্বরে-দেখলে তো বললে না যে আমায়?

আকাশে দেখিনি। এই ছাদেই দেখেছি কাঞ্চনজংঘা।… আমি বলি–এখনো দেখছি।

অবাক চোখে তাকায় সে আমার দিকে–এখনো দেখছ

আমি বলি : কাঞ্চনজংঘার ছটা এখানে বসেই দেখছি এখন। এই তো!

দুষ্ট! লাজুক মুখে একটুখানি আদর করে উঠে পড়ল সে কোলের থেকে। ফ্রক-টক পরে মধুর হেসে চলে গেল তারপরে।

তারপরেও আমি বসে রইলাম অনেকক্ষণ সেই ছাদেই। অন্ধকার নামল, তারা উঠল। সারা আকাশ যেন তারায় তারায় রিনি রিনি করতে লাগল।

বিকেলে কিছু খাইনি তো, খিদে পেয়েছিল বেশ। লুচি আর বেগুন ভাজার গন্ধ আসছিল রান্নাঘর থেকে। ভাবলাম মার রান্নার একটুখানি বউনি করা যাক গিয়ে।

বউ নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিল মা আর মাসিমার মধ্যে। দোর গোড়াতেই থমকে দাঁড়াতে

আসছে মাসেই দিদি আমরা চলে যাচ্ছি এখেন থেকে। বলছিলেন রিনির মা।

কেন দিদি, এখানকার জলহাওয়া কি সইছে না তোমাদের? মা বললেন।

তা নয়। মেয়েদের পড়াশোনা কিছু হচ্ছে না। কোনো মেয়ে-ইস্কুল নেই এখেনে। এখনকার কালে মুখ মেয়ে কি বিয়ের বাজারে চলে দিদি?

ইস্কুলের কোনো মাস্টারকে প্রাইভেট টিউটর রেখে দাও না কেন! বাড়িতে এসে পড়িয়ে যাবে মেয়েদের, ফাইনালের জন্যে তৈরি হোক বাড়ি বসে। তারপর কলকাতায় গিয়ে প্রাইভেট পরীক্ষা দেবেখন। তারপর মা অনুযোগ করলেন আবার : আর তাছাড়া, তোমার মেয়েরা তো দেখতে ভালোই। তেমন কিছু লেখাপড়া না জানলেও বেশ ভালো ঘরে বিয়ে হবে দেখো।

সেই বিয়ের কথাটাই ভাবছি দিদি। মেয়েরা সব ডাগর হয়েছে। নানু তত বলতে গেলে বিয়ের যুগ্যিই, ষোলো পেরুলল। তার ছোটটাও পনেরয় পড়েছে, রিনিও চোদ্দয় পা দিল। কলকাতায় আমাদের বাড়িঘর ইষ্টিকুটুম সবাই-এখানে বসে কি বিয়ের সম্বন্ধ করা যাবে।

এটা ভাবনার বিষয় ছিল বোধহয়, কেননা মাকেও একটু ভাবিত দেখা গেল।–তা বটে। নানুর বিয়েটা দিতেই হবে এবার। কিন্তু তোমার এই মেজো মেয়েটিকে আমার পছন্দ, ভারী ঠাণ্ডা মেয়েটি। বেশ লক্ষ্মীশ্রী।…

মেজো মেয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই, মায়ের পাশটিতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কথাটায় মাথা নীচু করল দেখলাম।

মা তার চিবুকে হাত দিয়ে আদর করলেন–বেশ মেয়েটি। রামের সঙ্গে বেশ মানাবে। এটিকে তুমি দেবে আমায়?

তা নিয়ো না হয়। কিন্তু রামের প্রায় সমবয়সী হবে না? অবশ্যি আজকাল কেউ বয়স নিয়ে মাথা ঘামায় না আর। জাত কুল নিয়েই বাছ-বিচার করে না শুনছি।

তা তোমরা কি আসছে মাসেই যাচ্ছ তাহলে? সব ঠিক? প্রায় ঠিক। কর্তা এক মাসের নোটিশ দিয়েছেন–এখান থেকে এখন ছাড়ান পেলেই হয়। কর্তা এর পরে বাড়ি বসে প্র্যাকটিস করবেন ঠিক করেছেন। তোমরা কলকাতায় কখনো এলে আমাদের বাড়ি এসো কিন্তু দিদি?

হ্যাঁ, একবার তো যেতেই হবে কলকাতায়–এই হাতের মানতটা ছাড়াতে হবে আমাকে।

আচ্ছা আসি দিদি, হ্যাঁ, যেজন্যে এসেছিলাম-কাল সকালে দশটার মধ্যে রাম ও সত্যকে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে মনে করে, কেমন?

কেন দিদি?

কাল ভাইফোঁটার দিন না? আহা, ওদের কোনো বোন নেই কী দুঃখু! নিজের দাদার সঙ্গে ওদেরকেও ফোঁটা দেবে মেয়েরা। ভাই-ই তো ওরা।

আচ্ছা, দেবো পাঠিয়ে। হাসিমুখে মা বললেন।

আমাদের রান্নাঘর আর ভাড়ার ঘরটাই ছিল দুতরফের সীমান্ত প্রদেশ।

মাঝখানের একটা দরজার খিল খুলে যাতায়াত করা যেত। দু বাড়ির গিন্নিরাই ঐ পথে যেতেন আসতেন-আমরা ও-পথ কোনোদিন ব্যবহার করতাম না।

রান্নাঘর দিয়ে রিনির মা সেই পথেই চলে গেলেন।

শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আকাশ-পাতাল।

মেজোটার সঙ্গে বিয়ে কেন? রিনির সঙ্গে হলে কী হয়? কেন, রিনির সঙ্গে কি হতে পারে না আমার বিয়ে? সে তো বয়সে ছোটই আমার চেয়ে…ওর মেজদির চেয়ে কি খুব খারাপ মানাবে তাহলে?

না, মেজোকে কোনোদিন আমার চোখে লাগেনি। মনেও লাগেনি কোনোদিন। ওর সঙ্গে বিয়ে কী! ধ্যুৎ!

করলে আমি রিনিকেই বিয়ে করব। সুবিধে মত মাকে বলতে হবে একদিন… ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি।

ঘুম থেকে তুলে খাওয়াতে হয়েছে আমায়।–কিরে, তোর পড়াশুনা কিছু নেই আজ? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটালি সন্ধ্যে বেলাটা। দেখি গা-টা…গা তো গরম হয়নি, ভালোই আছিস তো, ঘুমুচ্ছিলি কেন তবে?

এমনি। ভালো লাগছিল না।

নে, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড় তাহলে। নটা বাজে প্রায়…

খেয়েদেয়ে নটায় শুয়ে উঠলাম পরদিন সকাল নটায়। শুনলাম সত্য কখন গিয়ে ফোঁটা নিয়ে ফিরে এসেছে। ঘুমুচ্ছিলুম বলে আমাকে ভোলা হয়নি। মুখ ধুয়েই চলে গেলাম সটান।

দেখলাম, আসন পাতা। আসনের সামনে পায়েস পিঠে সন্দেশ সব সাজানো। ধান দূর্বা, চন্দন সব তৈরি।

তার আগে জীবনে কোনো বোনের ফোঁটা পাইনি। বেশ লাগছিল কিন্তু, সত্য-টত্য সবার, ফোঁটা হয়ে গেছে আগেভাগেই। আমার বাকী কেবল।

প্রথমে নানু আমায় ফোঁটা দিল কোনরকমে মন্তর আউড়ে। ওর মা বললেন, রামকে একটু আদর কর। রাম তোর ছোেট না? ছোট ভাইয়ের মতই।

আদর আবার কী! বলে সে আলতো হাতের এক চাপড় বসিয়ে দিল আমার ঘাড়ে এই তো আদর।

তারপর মেজোর পালা। না, সে ফোঁটা দেবে না কিছুতেই কাল আমার মা কী বলেছেন না? সেইজন্যেই।

রিনি, তোর রামদাকে ফোঁটা দে এবার। বললেন মাসিমা।

রিনি, ফোঁটা দিল তার পর। বেশ স্পষ্ট করে মরটা পড়ল-যমের দুয়োরে কাঁটা দেওয়া পর্যন্ত বাদ দিল না কিছুই। ফোঁটা দিয়ে আমার পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল তার পর।

জীবনে সেই প্রথম আমি প্রণাম পেলাম একজনের। বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সত্যিই যেমন রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম পরে আরেকবার যেবার আমার উত্তর কৈশোরে একজন প্রায়-যুবকের কাছ থেকে আপনি বলে সোধিত হতে শুনেছিলাম। কিন্তু ওটা যেন আর চেয়েও আরো বেশি মিষ্টি-আপনির চেয়েও আরও যেন আপনার।

ভাবছিলাম, মাসিমা ওকেও হয়ত একটু আদর করতে বলবেন আমাকে।কেন জানি না, তা বললেন না কিন্তু। পাছে সে আমার অন্য ঘাড়ে আরেক থাপ্পড় ঝাড়ে সেই ভয়েই হয়ত

কিন্তু আমি জানি, বললে পরে সেদিনকার সেই সন্দেশ খাওয়ানোর মই সে করে বসত আবার–সবার সামনেই।

যা, আদর না পাই, দাদার প্রাপ্য প্রণাম পেয়েছি তো!

.

০৯.

আমার জীবনে তুই একমাত্র মেয়ে। তুই প্রথম আর তুই-ই শেষ। তোকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে আমি জানি না, জানতে চাই না।

সেদিন ছাদের বুকে বসে কিশোরী রিনিকে বুকের কাছাকাছি পেয়ে কিশোর আমার একথা বলতে এতটুকু বাধেনি। উপন্যাসের নায়কের মতই উপস্থিত কথায় তুখোড় হয়ে উঠেছিলাম আমি সেই ঐচোড় বয়সেই–অল্প বয়েস থেকে উপন্যাস পড়ে পড়েই হয়ত আমার এই উপযুক্ত হওয়া। কিংবা হয়ত ভালোবাসায় পড়লে সহজেই এমন সব উপলব্ধি ঘটে, যাতে মজবুত কথার যুতসই জবাব যতো মুখের ওপর আপনার থেকেই এসে যায়।

খুব ছোটর থেকে নভেল পড়ে পড়ে পেকে উঠেছিলাম। প্রায় কায়মনোবাক্যে পরিপক্ক। কায়ের দিক থেকে ততটা হয়ত না হলেও মনোবাক্যে তো বটেই। পাকা পাকা কথা কইতে পারতাম বেশ।

আর মেয়েদের তো এমনিতেই কথার বাঁধুনি। স্বভাবতই তারা নভেলটি–সর্বদাই।কোনো রোমান্স কাহিনী না পড়েও তারা বোরামান্টিক। আজন্ম নায়িকা। মুহুর্মুহু রোমাঞ্চকর।

তাই সহজেই সে বলতে পেরেছিল, এই তো তোমার জীবনের শুরু গো! আমার পরেও আরও কত মেয়ে পাবে, কতজনাই তোমার জীবনে আসবে–তখন তুমি অনায়াসেই ভুলে যাবে আমায়। দেখে নিয়ে। এই সামান্য বয়সেই নারীসুলভ অসামান্যতার দুঃস্বাভাবিক নৈপুণ্যে জীবনের এত বড় তত্ত্ব দুকথায় ব্যক্ত করতে একটুও তার বাধেনি।

সটান আমার উপন্যাসপাঠের ভূমিকায় আসতে হয় এবার…

সেকালের সব ছেলের মতন আমারও গ্রাম্য পাঠশালায় বাল্যপাঠ শুরু। এখনকার মতন অলিগলিতে কে জি ইস্কুলের পত্তন হয়নি তখন, গগ্রামে তো নয়ই; গেয়ো পণ্ডিতের আটচালায় গিয়ে লেখাপড়া শিখতে হত সবাইকে।

অবশ্যি, তখনো হাইস্কুল হয়েছিল দেশ পাড়াগাঁয়। চাঁচোরের রানী সিদ্ধেশ্বরী ইনস্টিটিউশন ছিল কাছেপিঠেই। এবং ইনফ্যান্ট ক্লাসও নিশ্চয়ই ছিল সেখানে, কিন্তু রামনাথ পণ্ডিতের কাছে নামতার পাঠ না নিয়ে এক পা-ও সেখানে এগুনো যেত না। যুগপৎ গলায় আর চোখে ধারাপাত ঘটিয়ে, সমবেত কণ্ঠে শোরগোল করে গড় আউড়ে গড়াতে গড়াতে তবেই ছিল সেই ধারাবাহিক শিক্ষায়তনের পথে পা বাড়ানো।

প্রথম ভাগের হাতেখড়ি মার কাছে হলেও শিক্ষালাভের প্রথম ভাগ্য আমার রামনাথ পণ্ডিতের কাছেই। গ্রামের সেই পাঠশালার পড়ুয়া হয়েই সেকালের প্রায় সবার মতই আমারও পাঠ্যাবস্থার শুরু।

আর, পাঠশালায় যেতে এমন খারাপ লাগত আমার যে…

একটা যাওয়াই ছিল বটে সেটা। রাজোচিত সমারোহে যাওয়া। পালকি চেপে নয়, পালকি সেজে। পালকির মত দুলকি চালে হেলে দুলে হেইয়ো হেইয়ো করে হট্টগোলের মধ্যে পণ্ডিতমশায়ের আটচালায় আমার প্রবেশলাভ। বলতে গেলে প্রায় প্রত্যহই।

পাঠশালার সময়টা প্রায় প্রতিদিনই খুঁজে পাওয়া দায় ছিল আমাকে। এ ঘরে ও ঘরে, ছাদের ওপরে চিলেকোঠায় কি পায়খানায়, কোথাও আমায় খুঁজে পাওয়া যেত না। শেষটায় পাঠশালার সর্দার পোড়োরা এসে আশ্চর্য অনুসন্ধিৎসায় খাটের তলার থেকে ঠিক খুঁজে বার করতে আমাকে–তারপর সগৌরবে, আমি পায় পায় এগুতে চাইলেও নাছোড়বান্দা তারা আমায় পদস্থ হতে দিত না, অপদস্থ করে সবাই মিলে আমার চার হাত পা পাকড়ে চ্যাং দোলায় দুলিয়ে নিয়ে যেত। অসহায়ভাবে আমতা আমতা করতে করতে ঝুলে ঝুলে যেতে হতো আমায় নামতার ইস্কুলে।

সেই পঠদ্দশার কথা স্মরণে এলে পাঁঠার দশার কথাই মনে পড়ে আমার। মাঠের থেকে বাড়ি ফিরতে অনিচ্ছুক পাঠাকে গায়ের চ্যাংড়ারা যেমন করে চার পা ধরে দখিন হাওয়ার মতই দোদুল দোলায় দুলিয়ে নিয়ে যেত, ব্যা-ব্যা- করা সেই পাঠার মতই তেমনি হত পা ছুঁড়ে প্রাত্যহিক দোলযাত্রার মহোৎসবের মধ্য দিয়ে পাঠশালার পৈঠা পেরিয়ে একদা ইস্কুলের আলাদা ব্যাকরণে গিয়ে পড়লাম।

তবে ঐ সিদ্ধেশ্বরী ইস্কুলে সিদ্ধিলাভের পথে এগিয়ে যেতে কেবল পা ছোঁড়াই নয়, আমার হাত সাফাইও একটু ছিল। তারই সাফল্য আমার হাতে হাতে ফললো।

নামতা ওগড়াতে একদিন একটু গড়বড় করায় পণ্ডিতমশাই কষে কান মলে দিয়েছিলেন। আমিও দ্বিরুক্তি না করে, হাত বাড়িয়ে তক্ষুনি তাঁর কান মলে দিয়েছি। কানের ব্যথার চেয়েও অপমানে আমার বেশি লেগেছিল।

ছিপ্‌টিখানা নিয়ে আয় তো! হুকুম দিলেন তিনি একটি ছেলেকে।

ছিটিহস্তে পণ্ডিতমশায়ের সেই রুদ্রমূর্তি কদাচ আমি ভুলব না। এখন আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে কখনো কখনো সেই চেহারা ভেসে ওঠে। ছিপটি দিয়ে অকাতরে ছেলেদের পিঠের ছাল ছাড়াতে কোনোদিন আমি তাঁর কোনো কসুর দেখিনি, কিন্তু কেন জানি না, আমার পিঠকে তাঁর সামনে অনাবৃত পেয়েও পিটতে গিয়ে তিনি হাত গুটিয়ে নিলেন হঠাৎ।

না, মারব না আমি তোমায়। তোমার বাবাকে বলে মার খাওয়াবো। রাজবাড়ির ছেলে বলেই তুমি বেঁচে গেলে আজকে। নইলে তোমার পিঠের ছাল আমি ছাড়িয়ে নিতুম। তোমার বাবাও সেইরকম করতে বলে দিয়েছিলেন আমায়।

হ্যাঁ, বলেছিলেন বটে বাবা। পাঠশালায় ভর্তি করার সময় বলে দিয়েছিলেন, পণ্ডিতমশায়, আমার ছেলের মাংস আপনার, হাড় আমার। আর সব ছেলের মতই বিধিমত আপনি একে পড়াবেন। কোনো কার্পণ্য করবেন না।

না, কার্পণ্য তিনি করতেন না। ছেলেদের পিঠে ছিপটি প্রয়োগে তাঁর কিপটেপনা কখনো আমি দেখিনি, আগাপাশতলা পিটিয়ে রক্ত বার করে ছাড়তেন। পণ্ডিত হলে রামনাথ মাত্রই বুনো হয় কি না কে জানে, কিন্তু পণ্ডিতের মধ্যে বন্যতায় তিনি ছিলেন অনন্য।

তবুও আমার বেলায় তাঁর এই অন্যথার মূলে বোধ হয় আমাদের সেই পুরনো পোড় বাড়িটা। সেই ভাঙ্গা রাজবাড়িটাই বদাচরণের বদলে তাঁর এই বদান্যতার কারণ হয়েছিল, নইলে বাবার কথাই ছিল তাই, পণ্ডিতমশাই যা বলেছেন, আমার মাংস তাঁর আর হাড় আমার বাবার। মানে, বিদ্যালাভের খাতিরে মারের চোটে আমার দেহের চামড়া খানিকটা ছিঁড়ে গেলেও ক্ষতি নেই, মাংস যায় যাক্, নামমাত্র হাড় কখানা বজায় রেখে প্রাণে প্রাণে নিজের ছেলেকে ফিরে পেলেই তিনি খুশী।

শেলেট বই সেখানেই ফেলে দিয়ে হাড়ে হাড়ে শিক্ষা নিয়ে, কিংবা না নিয়েই, আমি ফিরলাম।

আর কখনো আমায় যেতে হয়নি সেই পাঠশালায়।

আমার ভাইকেও আর পা বাড়াতে হয়নি সে পথে।

সেদিনকার কুরুক্ষেত্রে আমার কর্ণবধের পর্ব পণ্ডিতমশায়ের কাছে শুনেও বা কিছু বলেননি আমায়। বাড়িতেও তুলকালাম কিছু হয়নি। মা বলেছিলেন, পাঠশালায় গিয়ে আর কাজ নেই ওদের। আমার কাছেই পড়বে ওরা। ভারী তো পড়ানো।

বাবাও সায় দিয়েছিলেন তাঁর কথায়-বেশ, তোর মার কাছেই পড়বি তোরা দু ভাই এবার থেকে বাড়িতেই তোদের ইস্কুল।

ভালোই হলো আমার। এতদিনের যেন অকূল জ্ঞানসমুদ্রের কিনারা পেলাম। পড়াশোনার ইস্কুল পেলাম বাড়িতেই।

জীবদ্দশার প্রথম ভাগটাই পঠদ্দশা। অবশ্য, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি, কখনো হাতী কখনো মশা হয়ে মানুষের দশ দশার মধ্যে শিক্ষণীয় দিকটা তো থাকেই। যেমন প্রথম ভাগেরই হাতে খড়ি হয়েছিল মার কাছেই–দ্বিতীয় ভাগ্যও খুলল আমার মার হাতে। অ আ ক খ-র অক্ষর পরিচয়ের মতন ফাস্ট বুকের বর্ণজ্ঞানও পেলাম মার কাছে। বি এ ডি ব্যাড, সি এ ডি ক্যাড, ডি এ ডি ড্যাড পেরিয়ে শনৈঃ শনৈঃ ওয়ান মরু আই মেট এ লেম ম্যান ইন এ লেন পর্যন্ত অবলীলায় উতরে গেলাম।

আরো নানান দিকে লেনদেন হতে লাগল। বাড়তে লাগল এলেম। পিতৃদেবের বিপুল পাঠাগারের দিকেও আমার হাত বাড়ালাম ক্রমশ।

সেখানে থরে থরে যত গ্রন্থাবলী সাজানো ছিল–বসুমতী আর হিতবাদী সংস্করণের। আর মরক্কো বাঁধাই হয়ে কত না মাসিকপত্র। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সাধনা ইত্যাদি থেকে শারীরতত্ত্বের স্বাস্থ্য সমাচার, এমনকি শিশুদের পত্রিকা সন্দেশ পর্যন্ত। তাছাড়াও কতো রকমের বই যে! ম্যাটসিনি গ্যারিবডির জীবন-চরিত থেকে রেনল্ডসের লন্ডন রহস্যের বঙ্গানুবাদ অব্দি কিছুই বাদ ছিল না।

ছিলো মাসিক সাহিত্য, ভারতী, নব্যভারত। মানসী ও মর্মবাণী, আরো কতো যে পুঁথিপত্তর কী জানি! তন্ত্রমন্ত্রের বই-ই কত না।

সব কিছুই আমার হাতের নাগালে এসে গেল। আর, নাগালে আসইে না গালে। সন্দেশের মতই গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম-নির্বিচারে, কোনো বাদবিচার না করে। এদিকে বাবা-মার কাছ থেকে কোনো বাধা ছিল না।

আরব্য উপন্যাস পারস্য উপন্যাস ছাড়াও আরো কত কী উপ-অনুপ-অপ-কথা ছিল আমাদের বাড়িতে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারতও ছিল, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দরের সঙ্গে পদাবলী সাহিত্যও। কালীপ্রসন্ন সিংহের বিরাটকায় মহাভারত, ড্রপ পেল্লায় আকারের সংস্কৃত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম-কালক্রমে সবার মধ্যেই অল্পবিস্তর দম্ভফুট করেছিলাম–দাঁত বসাতে পারি আর নাই পারি।

সেই সঙ্গে বটতলা বাজারের যত রাজ্যের অপকথার বই। খুনীকে খুন থেকে শুরু করে হরিদাস আর হরিদাসীর গুপ্তকথা। আর কী চমৎকার সব পাঁচকড়ি দে-র গোয়েন্দা কাহিনী আর প্রিয়নাথ দারোগার দপ্তর।

বাবা কালী সিংহীর মহাভারত পড়তে বলতেন বার বার কিন্তু বারংবার প্রয়াসেও সেই বাড়াবাড়ির মধ্যে নাক গলাতে পারিনি। পড়লে বোধ হয় মানুষ হতাম। অথচ মার মুখে আরব্য রজনীর কুজ দর্জির গল্পটা শুনেই না, না বলতেই আরব্য উপন্যাসের আগাগোড়া পড়ে শেষ করেছি। আরব্য রজনীর থেকে বঙ্কিমের রাজসিংহ, রজনীতে ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে গিয়েছি একাদিক্রমে।

প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়েই পড়েছিলাম-বর্ণপরিচয় হতেই না–দেবী চৌধুরানী শুরু করে দিলাম। বঙ্কিমের ওই বইটির প্রথম, আমার মনে আছে বেশ।

তার কারণ আর কিছুই নয়। ঐ সন্দেশ।

বইটার প্রথম লাইনেই, পি-পি-প্রফুল্ল মুখপুড়ি বলে ডেকে নয়ান বউ না কে, তার সতীনের পোড়ারমুখে যখন মিষ্টি খুঁজে দিল, এমন মিঠে লাগল যে গল্পটা! বউয়ের পা টেপার ব্রজ-র সেই পদব্রজের অংশটাও মন্দ লাগেনি। বারবার ঐ পরিচ্ছেদ দুটো পড়া আমার সারা শৈশবেই। তারপর রাজসিংহ, দুর্গেশনন্দিনী, বিষবৃক্ষ পার হয়ে গেল, ন্দ্রশেখর, কৃষ্ণকান্তের উইল পাঠ করলাম, কমলাকান্তের দপ্তরও বাদ গেল না। বাবার নির্দেশে কৃষ্ণচ্চরিত্রও পড়ে ফেললাম, মন্দ লাগেনি। আনন্দমঠ পড়ে দস্তুর মতন আনন্দ পেয়েছি। তবে আমার সবচেয়ে মধুর লেগেছে কমলাকান্তের দপ্তর বাদে লোকরহস্য আর মুচিরাম গুড়। এমন মিঠে আর হয় না। প্রায় পাটালি গুড়ের মতই-হ্যাঁ।

আমি তো প্রথম ভাগ খতম করে দ্বিতীয় ভাগের শেষে বঙ্কিমবাবুর গ্রন্থাবলী নিয়ে পড়েছিলাম, আমার ভাই সত্য আবার আমার চাইতেও সরেস। সে অক্ষর পরিচয় সেরেই রমেশচন্দ্রের গ্রন্থাবলী নিয়ে পড়ল, মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত থেকে রাজপুত জীবনসন্ধ্যা পর্যন্ত কেটে গেল তার দেখতে না দেখতেই। তারপরে আমরা দু ভাই পাল্লা দিয়ে বাবার পাঠাগার ফাঁক করতে লাগলাম।

লোকরহস্য থেকে লন্ডনরহস্য হয়ে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্যলহরী অব্দি কোনো কিছুরই রহস্যভেদের বাকী রইল না আমার।

যখন আমাদের অক্ষরপরিচয় হয়নি, মা আমাদের সন্দেশের গল্প আর ছড়া পড়ে শোনাতেন। পুরানো সন্দেশের একটি ছড়ায় তিনি হেসে গড়ানে কতত বার যে।–ওগো রাঁধুনি, শোনো গো শোনন, তোমায় রান্না বলে দি শোনো। সুখলতা রাওয়ের লেখাই হবে বোধ করি ছড়াটা-আস্ত মুড়োটা ভাতে-তে ছেড়েছি, মন্দ হয় নি জেনো-রাঁধুনীর এই মজাদার জবাবটি পর্যন্ত তিনি হাসতে হাসতে গড়িয়ে যেতেন। ওটা আউড়ে তিনি যেমন মজা পেনে, শুনে তেমনি আমোদ লাগত আমাদেরও।

আর মজা পেতাম অঙ্গদরায়রারে। মা যখন সুর করে কৃত্তিবাসী রামায়ণের সাতকাণ্ডের সবচেয়ে চমৎকার ঐ ল্যাজের কাণ্ডটি পড়তেন কী ফুতিই যে হতো না।

রাবণের রাজ্যে গিয়ে বালীনন্দন অঙ্গদ, রাজসভায় রাজপুত্রের উপযুক্ত অভ্যর্থনা আসন না পেয়ে নিজের লেজের কুণ্ডলী করে পাকিয়ে তার ওপরে বসেছে, তার পরে সেই উচ্চাসনে বসে রাজ্যির রাবণের মুখোমুখি হয়ে কোটি যে সত্যিকার রাবণ তার ঠাওর পাচ্ছে না, আর রাবণের ছেলে ইন্দ্রজিতকে তার আসল বাপটকে চিনিয়ে দেবার জন্য সাধছে–

শোন্ রে ইন্দ্রজিতা,
এত বাপের মধ্যে রে তোর কোনটি আসল পিতা?…
বলতে পারিস কে যে?
মোর বাপ তোর কোন বাপেরে বেঁধেছিল লেজে?

তখন অঙ্গদের তেজস্বিতা আর বালির লেজস্বিতায় আমরা দু ভাই চমৎকৃত হয়ে যেতাম যুগপৎ।

রামায়ণ সন্দেশের ওই ছড়াছড়িতে আকৃষ্ট হয়েই আমরা অক্ষর পরিচয়ের প্রথম পাঠে প্রলুব্ধ হয়েছিলাম, আর প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ কষ্টেসৃষ্টে পার হয়েই একেবারে বাংলা সাহিত্যের উপাখ্যান ভাগে এগিয়ে গেলাম-বটতলার থেকে শুরু করে বসুমতীর তাবৎ বইয়ের হরিহরছত্রে ভিড়ে বিদ্যাসাগরের বর্ণবোধ ক্রমে নানান বোধের আস্বাদ নিয়ে একদিন বিদ্যাসুন্দরের গভীরে গিয়ে পড়ল। সাগরযাত্রা শেষ হলো মহবোধির-সুন্দর বিদ্যার সাগরসঙ্গমে।

কিন্তু এ-যাত্রা কি কোনোদিন শেষ হবার?…পালাবদলে পা চালানো বইতো নয়।

.

১০.

বাবাকে একদিন আমি শুধিয়েছিলাম–এত এত বই যে বাবা! কেন তুমি এনেছিলে? এনে এমন করে সাজিয়ে রেখেছিলে কেন?

তুই আসবি বলে–এসে পড়বি বলেই! তোদের জন্যেই তো! বলেছিলেন তিনি।

কেমন করে তুমি টের পেলে বাবা যে, আমরা আসব? তখনও তো কেউ আসিনি আমরা? জানলে তুমি কি করে?

জানা যায়।

নির্লিপ্তের ন্যায় এক কথায় সেরে দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু এখন আমি জানি তাঁর কথাটা সত্যি কতখানি। সত্যিই জানা যায়–আর কারো না তাঁরই খেলা এসব। অমিয়-চরিত কথায়, যেমন, যিনি মেলাবার তিনিই মেলান, যথাসময়ে যথাযথ মিলিয়ে থাকেন। যা মিলবার আপনার থেকেই অঙ্ক আর কবিতার মতই কেমন করে, কি করে যেন মিলে যায়-অসম্ভব মিলন কাণ্ডের পাণ্ডা সেই তিনিই তো!

একদা আমার মতন অর্বাচীন এক বালকের সঙ্গে মেলার জন্যেই এই বইয়ের মেলা! এত মেলাই বই!

তিনি জানতেন, সারা জীবন নিজের লেখার মোট ফেলতে আর মজুরি কুড়োতেই আমার দিনরাত কাটবে, পড়ার ফুরসৎ আর হবে না কোনদিন, লেখাপড়া অদৃষ্টে নেই আমার–তাই কৈশোরকালের এই ফাঁকতালে তাক মাফিক এক-আধটু আমার পড়াশোনার এহেন ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

মোটামুটি যা কিছু জানবার শেখবার তখনই আমি শিখেছি ও জেনেছি। বাবার ঐসব বই পড়েই।

পণ্ডিত হবার পক্ষে এমন কিছু না হলেও একজন মেহনতি মজদুরের পক্ষে, আমার ধারণায়, এই যথেষ্ট। এর বেশি পড়াশোনার দরকার করে না।

মা অবশ্যি বলতেন, বই পড়ে কিছুই জানা যায় না, মন দিয়ে জানতে হয়। চোখে দেখে, পরখ করে তবেই আমরা টের পাই। এর ভেতর ওই মনটাই আসল। মন না দিলে কিছুই ঠিক দেখা যায় না বোঝা যায় না। এমন কি ওই বইও যদি মন দিয়ে না পড়ি তো ওর মর্ম মেলে না আদপেই।

তবে ছেলেরা যে এত পড়ে-পড়ে পড়ে মুখস্থ করে মনে রাখে, তার মানে কী মা? আমি শুধিয়েছি। কত বড় বড় লোককেও তো বই মুখে পড়ে থাকতে দেখেছি আমি দিনরাত। পড়ে যায়, খালি পড়ে যায়।

না বুঝে পড়ার সবটাই বোঝা হয়ে থাকে তাদের মাথায়, বলেছেন মা : কখনই মনের সঙ্গে মিলিয়ে যায় না। জীবনের সঙ্গে মেশে না। জীবনের সঙ্গে মেলে না। সে পড়া শুধু ভার হয়ে থাকে ঘাড়ের ওপর, কাজে লাগানো যায় না কখনো, খাটানো যায় না নিজের জীবনে। যে বিদ্যা জীবন হয়ে ওঠে না, জীবন্ত হয় না, সে আবার কী বিদ্যা রে?

মার কথার মানে সেদিন আমি বুঝিনি, এখনো যে তার অর্থ ঠিক ঠাওর হয় তা আমি বলতে পারি না। এখন আমার মাঝে মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে, কেন আমি বিধিমত লেখাপড়া শিখিনি। আমার বন্ধুদের কত কত পড়াশোনা, বিশ্বসাহিত্যের কত অলিগলিতে যাতায়াত, কী না তাঁরা জানেন? কী না পড়েছেন–কোনো কিছুই তাঁদের অজানা নেই। আর এক কণাও তার পড়া হয়নি আমার। পৃথিবীর কত মহৎ সৃষ্টি আমার অগোচর অপঠিত থেকে গেল, আমার স্বদেশেরই কি সব জানতে পারলাম! মহাকাব্যের কখানা পড়েছি, পুরাতত্ত্বেরই বা কী! বাবার অত অত বলাতেও বাল্মীকি বেদব্যাসের রামায়ণ মহাভারত দুটো আমার পড়া হল না। বিদেশী মহৎ স্রষ্টাদের প্রায় সবাই তো অমনি অচেনা রয়ে গেলেন! বিশ্বের নিত্য নবীন সাহিত্য সৃষ্টির সাথেই বা যোগ রাখলাম কোথায়! সর্বাধুনিক রচনাই বা কী পরিচয় পেলাম। অভয়ঙ্করের বিদেশী সাহিত্যের সমালোচনা পড়েই আমার যা এই ভয়ঙ্কর বিদ্যে।

অবশ্যি উপেনদা (অগ্নিযুগের উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিজলীর সম্পাদন-প্রকাশনায় বিজড়িত ) একদিন সান্ত্বনাছলেই বুঝি আমায় বলেছিলেন, বাঁধাধরা লেখাপড়া তেমনটা তুই শিখিসনি যে তা এক পক্ষে ভালোই হয়েছে, শাপে বর হয়ে গেছে তোর। তোর ওপর অপর কারো প্রভাব পড়েনি, পড়তেই পায়নি একদম। তুই যা হবি আপনার থেকেই হবি, যা লিখবি নিজের মনের থেকেই লিখবি। কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের মতন হওয়াই তো ভালো রে! তোর লেখায় আর কারো প্রভাব পড়বে না। অবশ্যি তোর রচনায় কোনো ঐতিহ্যসূত্র থাকবে না তা বটে, তাতে কি? তা না থাকলেও তুই-ই নিজেই একটা ইতিহাস হতে পারিস হয়ত বা!

বাবার পাঠাগারে নানা ধরনের গাদা গাদা বই থাকলেও রবীন্দ্রনাথের রচনা ছিল না একখানাও। রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পেয়েছিলাম ইস্কুলে ভর্তি হবার পর। বছর কয়েক মার কাছে ঘরে বসে পড়ে বাংলা ইংরাজির কিছুটা রপ্ত করে সাহিত্য ব্যাকরণ গ্রামার ট্রানশ্লেশন একটুখানি দুরস্ত হয়ে পরীক্ষা দিয়ে ইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম সটান ক্লাস সেভেন-এ। আর আমার ভাই এক ক্লাস নীচেয়। সেইকালে ইস্কুলের লাইব্রেরীতে রবীন্দ্রনাথের খবর মিলল। আর পেলাম বাংলার সার-এর কাছে। তখন আমার এমন বিস্ময় জাগল, বঙ্গদর্শন থেকে নব্য ভারত, তত্ত্ববোধনী পত্রিকা থেকে সমাজপতির সাহিত্য, ভারতবর্ষ, প্রবাসী, তা ছাড়া আরো কত পত্রপত্রিকা, এমন কি গৃহস্থ গম্ভীরা মানসী মর্মবাণী, স্বাস্থ্য সমাচার এত ছিল, কিন্তু বাবার ভাঁড়ারে কবিগুরুর বই ছিল না একখানাও!

রবি ঠাকুরের ওপর কেন জানি না, হাড়ে হাড়ে চটা ছিলেন বাবা।

কবি বলতে তার কাছে মাইকেল মধুসূদন, হেমচন্দ্র আর মবীন সেন! তাঁদের কবিতা তাঁর মুখস্থ–আওড়াতেন মুখে মুখে। সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণির থেকে শুরু করে হুররে হুররে হুররে করি গর্জিল ইংরাজ! নবাবের সৈন্যগণ ভয়ে ভঙ্গ দিল রণ, পলাতে লাগিল সবে নাহি সহে ব্যাজ। আর, বাজ রে শিঙা বাজ ঘোর রবেসবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে/সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে/ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়! আর সেই সাথে, হেমচন্দ্রের হায় হায়! ঐ যায় বাঙালীর মেয়ে!

কবিতা তো এই সব! এঁরাই তো কবি। তা নয় তো কী, তোর ঐ রবিঠাকুর। আর বকিস না পায়রা কবি, খোপের ভিতর থাক ঢাকা/তোর বক বক আর রকম সকম সব কবিত্বের ভাব মাখা। তাও ছাপালি পদ্য হোলো, নগদ মূল্য এক টাকা!!

কবিকে ঠাট্টা করা কাব্যবিশারদের গালভরা গাঁট্টামারা এই ছড়াটা বেশ ফুর্তি করে তিনি আওড়াতেন।

বাবার উপরোধে মাইকেল, নবীন সেন, হেমচন্দ্রে এক-আধটু হাবুডুবু খেয়েছিলাম। মাইকেলে হাঁপিয়ে উঠেছি, হেমচন্দ্রে উঠে হাঁপছাড়া গেছে, নবীন সেন মন্দ লাগেনি নেহাত তবে স্বচ্ছন্দ নিশ্বাস ফেলতে পেরেছি ভারতচন্দ্র পেয়ে। তাঁর কাব্যলোকে পোঁছে-তর অন্নদামঙ্গল আর বিদ্যাসুন্দরে এসে রস পেয়েছি সেই বয়েসেই। আহা, কী ছন্দ! কী বাক্যের ছটা! কী রূপরাগের ঘটা! একেবারে যেন মাতিয়ে দিয়েছিল।

পুরানো সাধনা, আর স্বর্ণকুমারী দেবীর সম্পাদনায় ভারতীতে রবীন্দ্রনাথের রচনার কিছু কিছু স্বাদ পেয়েছিলাম, আর তদানীং কালের প্রবাসীতেও কিছু কিছু-কিন্তু ভূরিভোজ শুরু হোলো সেই ইস্কুলের লাইব্রেরীর নাগাল পেয়ে। রবীন্দ্রনাথের গল্প কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধের বইয়ে ঠাসা ছিল গোটা একটা আলমারিই।

পাঠশালার সেই ঝুলনযাত্রার পর যেন শারদীয়া মহাপূজার মহামহোৎসবের মধ্যে এসে পড়লাম।

প্রথম দিনই আমি চারু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা নিয়ে এসেছিলাম। তার প্রথম কবিতাটা ছিল, মনে আছে এখনো, ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে…। ধূপের মতই যেন আমি রবীন্দ্রনাথের কাব্যছন্দে আর ভাবসৌরভে একেবারে মিলিয়ে গেলাম–বিলিয়ে দিলাম আপনাকে।

বইখানা হাতে নিয়ে বাবার সেই নাক সিটকাননা…এখনো যেন আমার চোখে ভাসে। আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন বাবা-আমাদের ছেলে-চারু দেখছি বার করেছে বইটা। পৈতে ফেলে দিয়ে ব্রহ্ম হয়ে গেছে চারু।

ঐ পর্যন্ত, আর কিছু নয়।

লেখক হিসেবে চারুদা আমাদের অচেনা ছিলেন না। প্রবাসীতে তার গল্প আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। তাঁর ভাতের জন্মকথা বইটা তিনি আমার ক্লাস ফ্রেন্ড বিঃ সুকুলকে উৎসর্গ করেছিলেন-বিষ্ণুর কাছ থেকে নিয়ে পড়েছিলাম বইটা। এমন ভালো লেগেছিল যে! সে বইটা বোধহয় পাওয়া যায় না এখন আর।

চাঁচোরের রাজার সম্পর্কে কে যেন হতেন চারুদা আমাদের। রাজাকাকার জামাই চারু বলে আরেকজন ছিলেন, তাই বাবা-মা চারুদের কথা উঠলেই ছেলে-চার বলে বোবাতেন। চাঁচোরের পারিবারিক কাহিনী নিয়ে কয়েকখানা উপন্যাসও লিখেছিলেন চারুদা-পরগাছা, আরও যেন কী কী! প্রবাসীতেই বেরিয়েছিল, পড়েছিলাম।

তাছাড়াও ভাতের জন্মকথা বলে চারুদার হোটদের জন্যে লেখা বইখানা বন্ধু বিঃ সুকুলের কাছ থেকে নিয়ে পড়েছিলাম।

বিষ্ঠু সুকুলকে আমি রীতিমত ঈর্ষা করতাম এক কারণে, ঐ বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্টায় তার নাম ছাপানো ছিল বলে। বিষ্ণুর ভাতের সময় বইটা তিনি তাকে উপহার দিয়েছিলেন। বিষ্ণুর বাবা গৌরীপ্রসাদ সুকুল চারুদার বাল্যবন্ধু ছিলেন। মার মুখে শুনেছিলাম, গৌরীকে একবেলা না দেখতে পেলে তিনি নাকি ছটফট করতেন।

বিষ্টুর জন্যও আমার সেইরকমটাই হতোবোধ করি মাঝে মাঝে। একদিন কেলাসে গিয়ে নিজের পাশেই তাকে না পেলে সেই ছটফটানিই হতো বুঝি। যেদিন সে অপর কোন ছেলের পাশটিতে বসত এমন খারাপ লাগত আমার যে কী বলব! পাঠ্য পুস্তকের আড়ালে গল্পের বই পড়তেও মন লাগত না তখন আমার।

বিষ্টুকে আমি বলতাম, তুই একজন বড় রাইটারের একখানা বই পেয়েছিস তো! আরেকখানাও পাবি তুই এক সময়। আমিই দেব তোকে। আমার একখানা বই উৎসর্গ করব তোর নামে। বড় হয়ে আমিও বই লিখব তো?

আরেকজন বড় রাইটার? চোখ বড় বড় করে সে তাকাত।

তা ঠিক বলতে পারি না, তবে রাইটার হব আমি ঠিকই। বড় হয়ে বই লিখব আমি। তুই দেখে নিস।

আমাকে নিয়েও একটা গল্প লিখিস তাহলে। কেমন, লিখবি তো? নিশ্চয়।

লিখব বইকি।

বই তো তারপর লিখেছি বিস্তর, কিন্তু একখানাও ওর নজরে পড়েছে কিনা কে জানে!

অনেকদিন আগে শুনেছিলাম, বিহার মুলুকের কোথায় যেন সে মাস্টারি করছে, তারপর আর কোনো খবর পাইনি তার, কোথায় যে সে থাকে। আমারও কোনো খবর রাখেনি সে তারপর। আমারও ঠিকঠিকানা তার জানা নেই বোধহয়।

আমার নিখরচায় জলযোগ বইটা আমার বাল্যকালের প্রাণের বন্ধু সেই বিষ্ণু প্ৰসাদ সুকুলের নামে উৎসগীত। আর অদ্বিতীয় পুরস্কার বইয়ের নাম-গল্পটাই তার কীর্তিকাহিনী নিয়ে। কিন্তু দুখানার একখানিও তার কাছে আমি পৌঁছাতে পারিনি। কোনো সুত্রে সে পেয়েছে বা পড়েছে কিনা জানি না।

ছেলেবেলার বন্ধুরা মেয়েদের ভালোবাসার মতই কোথায় যে হারিয়ে যায়! ভাবতে অবাক লাগে একেক সময়। মনে হয় যে, বুঝি একরকম ভালোই। তাদের নির্মেদ দেহ আর নির্মেঘ মন নিয়ে কৈশোরের নিবিড় মাধুর্যে মিশিয়ে নিটোল মুক্তোর মতই চিরদিনের স্মৃতির মধ্যে অক্ষয় থেকে যায় তারা–পরে যে কখনো আর ফিরে দেখা দেয় না তাতে জীবনের মতই সুমধুর থাকে, পলে পলে দন্ডে দন্ডে অবক্ষয়ে টাল খায় না, ক্ষয় পায় না।

নইলে পরে যদি তারা ভূরি ভূরি কামিয়ে আর বিপুল ভূঁড়িভার নিয়ে ফিরে এসে দেখা দিত আবার, তাহলে সংসারের ত্রিতাপদগ্ধ পোড়াকাঠের মত তাদের দেহমন আর পেনসনপ্রাপ্ত অখন্ড অবকাশ আমাদের জীবনে কী দুর্বিষহই না হতো যে!

বন্ধুত্বের সেই পরাকাষ্ঠায় বৃযোৎসর্গের মই আত্মাহুতি দিতে হতো আমাদের।

জীবন মন্থনের প্রথম ভাগেই তাই যত না অমৃত, তার পরে যা ভাগ্যে ওঠে তা নিতান্তই হলাহল। তখন কার ভেলকিতে কেমন করে কে জানে, আগের সব অমিয়ই গরল আর ভেল হয়ে গেছে!

জীবনভোর জীবন-যন্ত্রণাই বাকী আছে কেবল।

চাঁচোরের কাছাকাছি নামডাকওয়ালা এক গ্রাম ছিল–বেশ বধিষ্ণু-কলিগ্রাম। চাঁচোর থেকে পাকা সড়কে পুল পেরিয়ে যাওয়া যেত কলিগাঁয়, আবার আমাদের ইস্কুলের পাশের চাষের খেতের মধ্যে দিয়েও সোজাসুজি যেতে পারতাম সেখানে। কলিগাঁর ছেলেরা চাঁচোরের ইস্কুলে পড়তে আসত। তাদের অনেকের সঙ্গে ভাব হয়েছিল আমার।

কলিগ্রাম যেমন মালদা জেলার এক নামকরা গ্রাম, তেমনি কলিগ্রামের বিখ্যাত নাম কৃষ্ণচরণ সরকার। একজন জমিদার বা মহাজন সেখানকার; একদা স্বদেশী যুগের পাড়া। ছিলেন, পরে অসহযোগ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। স্বনামধন্য বিনয় সরকারের সহযোগে মালদহের বিখ্যাত সংস্কৃতিপত্র গম্ভীরা-র তিনি ছিলেন প্রকাশক সম্পাদক। তাঁর এক বিরাট গ্রন্থাগার রয়েছে খবর পেলাম কলিগাঁর ছেলেদের কাছে। পত্রপাঠ গেলাম তার বাড়ি।

তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর বই কাউকে বড় একটা তিনি নিতে দিতেন না, এইরকম শুনেছিলাম। এই কারণেই বোধহয় বইগুলো টিকে ছিল।

বাবার নাম করতেই সমাদরে তার বইয়ের ঘরে তিনি নিয়ে গেলেন আমাকে। আলমারিতে আলমারিতে সাজানো থরে থরে সব বই। তদানীন্তন লেখকদের বই যত। কত বই যে! ইতিহাস প্রবন্ধ গবেষণামূলক বইও কত! রাখালদাসবন্দ্যোপাধ্যায় যদুনাথ সরকারের বই। শরৎচন্দ্রের বইয়ের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল আমার সেইখানেই। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক আর কবিতার বইও পেয়েছিলাম। আরো কতোরকমের বই–মনে নেই এখন।

গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশিত তাবৎ বই ছিল তাঁর। তার থেকে ইচ্ছেমত কয়েকখানা তিনি বেছে নিতে বললেন। আর বললেন যে, পড়ে-উড়ে ফিরিয়ে এনে দিলে আবার পাব। এমনি করে সেকালের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটল।

সকালে উঠে একখানা বই পড়ে শেষ করি। একখানা দুপুরে পড়ার জন্যে ইস্কুলে নিয়ে যাই। আবার রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরেকটা পার করতে লাগি। দুদিন বাদ বাদ নিয়ে আসি গিয়ে।

বাবা বলতেন, গ্রন্থঃ ভবতি পতিত। যারা গ্রন্থ নিয়ে পড়ে থাকে তারাই পতিত হয়।

মানে, তুমি বলছ যে লাইব্রেরীয়ানরাই? যারা কিনা বই নিয়েই ব্যস্ত থাকে সব সময়?

না, সেভাবে পড়ে থাকা নয়, গ্রন্থ নিয়ে পড়া-সেই কথাই বলছি রে। বই পড়েই বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়।

মা, বাবা কী বলছে জানো? মাকে গিয়ে বললাম, গ্রন্থঃ ভবতি পন্ডিতঃ। কথাটা সত্যি নাকি? মানে কী ওর?

ঠিকই বলেছে তোর বাবা। যারা বই মুখে করে পড়ে থাকে সব সময়, তারা পন্ডিত না। হয়ে আর যায় না। বই ছাড়া চোখের সুমুখে কিছুই তাদের পড়ে না তো আর তাই সবটাই পন্ড হয় তাদের। তার মানেই হোলো গিয়ে পন্ডিত।

তুমি কী বলছ মা? পন্ডিত মানে কি তাই? একেবারে পণ্ড হয়ে যাওয়া?

গ্রন্থি কথাটার আরেকটা মানেও আছে আবার। তার মানে গেরো। কপালে গেরো না থাকলে কি কারো পন্ড হয়? কেউ পতিত হয় নাকি? এ হোলো গে ওই বইয়ের গেরো।

গেরোও বলা যায় আবার গেরোনও বলা যায়, তাই না মা?

বলতে পারিস। বই থেকে কী জানা যায় কিছু? মন থেকেই তো জানা যায় সব। সেই জানাটাই আসল। মনের জানাটা বই দেখে মিলিয়ে নেয়া যেতে পারে কেবল, সত্যিকার জানা তোর ঐ মনেই। মনের মধ্যেই তোর সব রে।

বাবা যে ব্রহ্মগ্রহি দেয় পৈতেয়? সেটা তাহলে? সেটাও কি–?

ঐ গেরোই। ধরতে গেলে, সেই গেরোই একরকমের। ব্রহ্মও একটা গেরো ছাড়া কী? গেরোনও বলতে পারিস। যার কপালে ঐ গেরো আছে, যার বরাতে ঐ গ্রহণ লাগে, মানে যাকে তিনি গ্রহণ করেন, তার কি আর নিস্তার আছে নাকি? ইহকাল পরকাল সব ঝরঝরে।

ভগবানের খর্পরে পড়া তাহলে ভালোই নয় বলছ তুমি?

না, আমি কিছু বলছি না। কারো খর্পরে পড়াটাই বুঝি ভালো নয়। তুই পৈতের ব্রহ্মগ্রন্থির কথা বলছিলিস না? সেটা হচ্ছে গিয়ে উপনয়ন সংস্থার। ভগবানের সঙ্গে জোট পাকিয়ে নতুন করে জন্মানো-ভগবান আর তুই দুজনে মিলে একজোটে দ্বিজত্ব লাভ, বুঝলি?

একদম না।

উপনয়ন মানে উপনীত হওয়া, ব্রহ্মের মুখোমুখি গিয়ে পৌঁছনো। ব্রক্ষ সাক্ষাৎ। উপনয়ন মানে তৃতীয় নেত্রও বোঝায় আবার। তার মানে, যা আমি বলছিলাম, তোর ঐ মনের চোখ। মনের চোখ খুলে যাওয়া। যার মনের চোখ খুলে যায় সে পৃথিবীর সব কিছুই যথার্থরূপে দেখতে পায়। আর তাই হল গিয়ে সর্বত্র ব্রহ্মসাক্ষাৎ।

মনের সেই চোখ কি করে খোলে মা?

মার ইচ্ছে হলেই খোলে। এই জন্মেই খোলে, কারো-কারো আবার সাত জন্ম লেগে যায় খুলতে। আবার এই দভেই খুলে যায় কারো কারো। সবই মার ইচ্ছে।

মানে, তোমার ইচ্ছে!

আমার ইচ্ছে? আমি কে? বলছি না মার ইচ্ছে? আমার মা, তোর মা, সবার মাসেই বিশ্বজননী।

তুমিই তো সেই মা। সেই বিশ্বজননী। তুমিই তো! ভৈরবী বলেছিল আমায়।

দূর পাগলা। মা হাসতে লাগলেন আমার কথায়।–মাথা খারাপ করে দিসনে! আমি শুধু ভাবছি তুই খাবি কি করে রে? পড়ার বই ঠুনে একদম-রাতদিন নভেল নিয়ে পড়ে থাকিস। পাসটাস করতে পারবিনে–চাকরি-টাকরিও জুটবে না তোর কপালে। লেখাপড়া শিখলিনে, মুখ হয়ে থাকলি। কী হবে রে তোর? খাবি কি করে?

তুমি তো আছে। মা থাকতে ছেলের ভয় কি!

আমি কি চিরদিন আছি নাকি? বেঁচে থাকব চিরকাল?

থাকলেও তখনো তুমি থাকবে, আমি জানি। আমার ভাবনা নেই।

তা কি হয় নাকি রে? তুই কি আমায় বেঁধে রাখতে চাস? আমি বাঁধা পড়তে চাই না। কিছুতে না, কারাতে না।

তারপর খানিক কী ভাবলেন তিনি-দাঁড়া, তোর সঙ্গে আসল মা-র পরিচয় করিয়ে দিই। তাহলে আর তোর কিছু ভাবনা থাকবে না। খাওয়া পরার তো নয়ই–কোনো দুখকও পাবিনে জীবনে। দাঁড়া।

দাঁড়িয়েই তো রয়েছি। তোমার সামনেই তো দাঁড়িয়ে।

আমার দুই ভুরুর মধ্যবিন্দুতে আলতো করে তার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটি চুঁইয়ে তিনি বললেন-এইখেনে মন আনতে পারিস? আন দেখি? এই দুই ভুরুর মাঝখানে?

মন?

হ্যাঁ। মন আনতে হবে, এনে স্থির করতে হবে এখানটিতে। সারা দেহময়ই তো তোর মন ছড়িয়ে-তাই না? সেই সবগুলো মনকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এইখেনে নিয়ে এসে জড়ো করতে হবে–মনের মধ্যে মন। সেই মনের মধ্যেই মা দুর্গা থাকেন। সবার মা যিনি, বিশ্বজননী…। এনেছিস মন?

চেষ্টা করছি।

কী মনে হচ্ছে এখন?

কতো কী! কতো কী যে মনে পড়ছে।

মা দুর্গার কথা?

না তো। যত সব আজেবাজে মেয়েদের কথা মনে আসছে কেবল।

তোর মনে আবার মেয়ে কী রে! মা তো শুনে হতবাক।

রিনিটিনিদের কথাই মনে পড়ছে আমার।

তাই বল! শুনে হাসলেন মা-দাঁড়া, আমি তোর মন এনে দিচ্ছি এখেনে। এ বলে তিনি ভ্রুর মধ্যে তাঁর মুখ ছোঁয়ালেন-যতক্ষণ আমি তোকে চুমু খাব ততক্ষণ তোর মন এখেনে থাকবে। তুই মনে মনে মা দুর্গা মা দুর্গা কর–আমিও মাকে ডাকছি মনে মনে। মা আবার আমাদের দুজনকে ডাকছেন। এইখেনে বসে। মিনিট খানেক বাদে মা শুধালেন–এলো মন?

হ্যাঁ।

কি রকমটা বোধ হলো তোর?

শিরশির করছিল গা।

মা দুর্গার আবির্ভাব হলো কিনা, সেই জন্যেই। তারপরে তিনি আমার ব্রহ্মরন্ধ্রে হাত ছুঁইয়ে বললেন-এখানে থাকেন বাবা মহাদেব। পরম শিব। আর, তাঁর পায়ের তলায়, এইখখনে দুই ভুরুর মাঝখানটিতে পার্বতী রয়েছেন। দশভুজা দুর্গা। আর এইখানে, এই কঠদেশে আছেন বাদেবী-মা সরস্বতী। বুকে নারায়ণ, নাভিপরে মা লক্ষী–এমনি সব নানা দেবতা নানান অঙ্গে ছড়িয়ে, বড় হয়ে যখন বই পড়বি, তন্ত্রের বইই পড়বি, তখন টের পাবি। দেহের নানা স্থানে নানান চক্র রয়েছে ভুরুর মাঝখানটিতে আছে আজ্ঞাচক্র। মা দুর্গা এখানে বসে আজ্ঞা করছেন, বলছেন তথাস্তু। তথাস্তু। তাই হোক। তাই হোক। এখানে মন নিয়ে এসে তোর মন দিয়ে যা চাইবি তাই পাবি। পেয়ে যাবি-দেখিস।

তাই পাব? বলছ কি মা?

নিশ্চয়। চেয়ে দ্যাখ না তুই।

চাইব বইকি। আজই চাইব। আমার কিন্তু মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না মা।

বিশ্বাস না হলেও হবে। অবিশ্বাস করে চাইলেও পাবি-শুধু মার কাছে এসে চাইতে হবে…এইখেনে মন নিয়ে এসে…

বিশ্বাস না হলেও?

অবিশ্বাসে কী আসে যায়? মা কি আর মা থাকে না তাহলে? অবিশ্বাস করে আগুনে হাত দিলে কি হাত পুড়বে না তোর? মা তো আগুন রে।

তবে যে মামা বলেন, বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর…!

সে কথা কৃষ্ণের বেলা খাটতে পারে, মার বেলা নয়। মা তো তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সব সময় মিলে রয়েছেন। যাই গে, আমার কাজ পড়ে রয়েছে।

চলে গেলেন মা। আমিও চলে এলাম আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের খোলা ছাদের নিমগাছের ছায়ায়। আমার মোয়ার, শুয়ে শুয়ে বই পড়ার প্রিয় জায়গা ছিল সেইটা। খোলা হাওয়ায় খোলা ছাদে গা গড়িয়ে ভুরুর মাঝখানে মা দুর্গাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম শুয়ে শুয়ে।

বিকেল গড়িয়ে এসেছিল, খিদে পেয়েছিল বেশ। সেই কখন সন্ধ্যে হবে, লুচি ভাজবে, খেতে বসব আমরা। এর মধ্যে যদি কিছু খেতে পাওয়া যায়, কী ভালই না হয় তাহলে। মনে মনে মা দুর্গার কাছে খাওয়ার দাবি জানাতে লাগলাম।

মা দুর্গাকে ছেড়ে কখন ফের রিনিদের কথা ভাবতে লেগেছি টের পাইনি। এদিকে বড় বারকোস নিয়ে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল কজনা। সামনের ছাদে আমায় শুয়ে থাকতে দেখে ইশারায় অরা ডাকলো আমাকে।

কী ব্যাপার? না, মা সিংহবাহিনী আর রামসীতার শীতল ভোগের মহাপ্রসাদ-বৈশাখ মাসের বৈকালী। সারা বোশেখ মাসটা ধরেই প্রতিদিন বিকেলে এমনি ধারা বৈকালিক ভোগ দেয়া হবে তাঁদের, আর সেই প্রসাদ পালা করে বিলোনো হবে একেক জনকে একেক দিন।

আজ প্রথম দিনটিতেই রাজাবাহাদুরের হুকুমে আমাদের পালা পড়েছিল।

প্রকান্ড রূপোর আর শ্বেত পাথরের দু থালায় সাজানো মাখন ছানা ক্ষীর সর বাদাম কিসমিস আখরোট আঙুর খেজুর ভিজে ছোলা শসা কলা ইত্যাদি যাবতীয় ফলটল আর সেই সঙ্গে সন্দেশ-টশে আরো কত কী!

সীতারাম সিংহবাহিনীর শীতল ভোগের মহাপ্রসাদ।

নয়া রাজবাড়ির দক্ষিণ দিকে রামসীতার প্রকান্ড মন্দির। দেখেছিলাম আমি। তার পাশেই সিপাহিদের বকেয়া ব্যারাকে আমাদের হাইস্কুল বসতো।

রোজ সন্ধ্যায় রামসীতার পূজারতি হয় খুব ঘটা করে তাও শুনেছি। কোনো দিন তা দেখা হয়নি। কী করে দেখব? ইচ্ছে থাকলেও অত দূরে সন্ধ্যেবেলায় একলাটি কি আমায় যেতে দেয়? আমাদের এই পুরনো রাজবাড়ি থেকে নয়া রাজবাড়ি তো কমখানি পথ না।

রামসীতার দিনের বেলার পূজার্চনাও দেখিনি কখনো। দুপুরে যে রাজভোগ হয় শত শতলোক তার প্রসাদ পায় নাকি। আর রাত্রির গোয় সন্ধ্যারতি–তা নাকি একটা দেখবার মই। দেখতে হবে একদিন। রিনিকে নিয়ে দেখে আসব না হয়।

রামসীতা রাজবাড়ির ঠাকুর। আর সিংহবাহিনী তাদের কুলদেবতা। সোনার প্রতিমা-ছোট্ট একটুখানি। দূর থেকে দেখা যায় না। খুব কাছে গেলে তবেই দেখা যায়, দেখিনি কখনো। পুজোর সময় পাহাড়পুরে রাজবাড়ির মহাপুজায় বিরাট দুর্গা প্রতিমার পাশেই নাকি সোনার সিংহাসনে সিংহবাহিনীকে রাখা হয়–মা দুর্গার সঙ্গে তাঁরও পূজা হয়ে থাকে তখন। মা দেখেছেন সে ঠাকুর, আমার চোখে কিন্তু পড়েনি।

দুথালা প্রসাদ, একটা শ্বেত পাথরের থালায়, আরেকটা থালা রূপোর।

দুথালা কেন গো? দুরকমের দুটো থালা যে।

রূপোর থালায় মা সিংহবাহিনীর প্রসাদ, আর শ্বেতপাথরে সীতারামের।

প্রসাদ রেখে দিয়ে থালা নিয়ে যাবে তত তোমরা? লোকগুলোকে শুধোলাম।

না। না। থালা এখানেই থাকবে। থালাসমেত রেখে যেতে বলেছেন রাজাবাহাদুর।

রাজবাড়ির ব্যাপার। রাজরাজড়ার চালচলন। তাদের কান্ডকারখানাই আলাদা।

এর আগে আর কখনো আমাদের বাড়ি বৈকালীর পালা পড়েনি। আসেনি কখনো আর। সেই প্রথম এল।

আর, সেই প্রথম আমার ঈশ্বরের প্রসাদলাভ…মার আশীর্বাদে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *