ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা – ৬১

৬১.

 বাসার থেকে কয়েদগাড়ি চেপে সটান লালবাজার। বড় থানায় বেশিক্ষণ কিন্তু দাঁড়াতে হয়নি, খানিক বাদে আর সব আসামীর সাথে ব্যাংশাল কোর্টে আমাদের চালান করে দিয়েছে সরাসরি।

আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে খাড়া হচ্ছে, পরের দিনে হাজির হবার নির্দেশ দিয়ে জেলের হাজতে রাখার হুকুম দিয়েছেন হাকিম।

পুলিসের হেফাজতে নয় আর, সোজাসুজি জেলের হাজতে। হাঁপ ছাড়লেন বীরেনদা-বাচা গেল বাপ! থানার জিম্মায় রাখলে আর রক্ষে ছিল না ভাই! পুলিসে যা পেটায়, জানিস?

কী করে জানব? থানার কার্যকলাপ জানা ছিল না আমাদের।

থানার পাশাপাশি বাড়িতে থাকলে জানা যায়। মারের চোটে সারা রাত এমন চেঁচায় বেচারারা যে কান পাতা যায় না, চোখের পাতা বোজা দায়। নেহাত বাচ্চা আসামীদেরও রেহাই দেয় না ওরা।

কেন বীরেনদা?

কবুল করানোর জন্যেই করে। ওদের কবুলতি ধরে আরো সব আসামীদের পাকড়াতে পারে তখন। ওই করেই ওরা সব কেসের হিল্লে করে, থোমোশন হয়ে থাকে ওদের, বুঝেছিস?

কাঠগড়ার ফেরত, ফৌজদারি আদালতের লক-আপ-এ বসে এই সব বার্তা, কি বার্তালা ঝাড়ছিলেন বীরেনদা। পেটি কেস থেকে চুরি ডাকাতি খুন অবধি সব কেসই ওদের কাছে পেটাই কেস-পেটবার মামলা। পলিটিক্যাল আসামী হলে তো কথাই নেই, যদিও সেক্ষেত্রে কখনো-সখনো দোরোখা পেটাপেটিই আবার! জানা গেল ওঁর কথায়।

ওই পেটনের জন্যেই ওদের বেটন দেওয়া–তাই বুঝি বীরেনদা?

আমি বাতলাই : তাই হবে বোধহয়।

সেই হেতুই ওরা বেতন পায়, বোধ হয়–কী কও?

আবার কী?

বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা বলে না? পুলিসে ছুঁলেও তাই। তবে বাঘের ঘা তার নখদন্তের আঁচড় কামড়ে, আর পুলিসের ঘা-টা হচ্ছে ওই বেটন-পেটার। জানো বীরেনদা, আমাকেও একটা গোরা পুলিস শুট করেছিল একবার?

তাই নাকি? শুনে তিনি হাঁ।–কোথায় লেগেছিল গুলিটা?

কোথাও না। তার চোটে আমি প্রিজন ভ্যানে সেঁধিয়ে গেলাম।

যাঃ! গুল মারার আর জায়গা পাসনি তুই। গুলির চোটে প্রিজন ভ্যানে সেঁধিয়ে গেলি! বললেই হোলো? কোথায় লেগেছিল গুলিটা?

গুলি নয়, বুট। আমি বলি-যেখানে লাগবার ঠিক সেইখানটিতেই।

বুট দিয়ে সুট করেছিল লোকটা? তা, বেশ করেছিল। ভালোই করেছিল। তোর মতন হতচ্ছাড়ার উপযুক্ত ট্রিটমেন্ট তাই।

আমি তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারি না-তোমাকে করলে আরো বেশ হতো। সেও পায়ে আরাম পেতো আরো।

আমি গোরা পুলিশের ত্রিসীমানায় যাই না। তিনি জানান। প্রাণ থাকতে নয়।

আমিই যাই নাকি? সাধ করে কেউ যায় কখনো? গোরা পুলিস আর ঘোড়া পুলিস দুইই সমান দাদা! ঘোড়ার চাট খেলে যেমন, পুলিস সার্জেনের মার খেলেও তাই।। হাড়গোড় আর আস্ত থাকে না, ডাক্তার সার্জনের কাছে যেতে হয় তখন।

আদালত ভাঙ্গার পর আর সবার সঙ্গে আমাদের তিনজনকেও কয়েদগাড়িতে ভোলা হল। সন্ধ্যের আগেই আমরা জেলখানায় গিয়ে পৌঁছলাম।

জেলখানায় আর জেলের খানায়-প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

সকাল থেকে বীরেনদাদের পেটে কিছু পড়েনি, চুই চুই করছিল পেট। আর আমি, যদিও সকালে আমার এলাকার এক মিষ্টান্ন ভান্ডারে ঋণং কৃত্বা দরাজ ভোগের চোষ্য করে চার্বাকনীতির আদর্শ-স্থাপনা করে এসেছিলাম, অ হলেও সে সব এতক্ষণে কখন হজম হয়ে আমার অন্তরাত্মাও, যা কিনা হৃদিস্থিতেন হৃষিকেশের ঠিক তলদেশেই, অনন্তনাগের মতই ফণা বিস্তার করেছেন। তাঁর ছোবলে আমি অস্থির!

আজকে মাংসের দিন। আজ সন্ধ্যেয় রুটি মাংস দেবে। জানিয়েছিল এক কয়েদী। শোনার পর আমাদের আর তর সইছিল না।

কিন্তু দেয়ার ইজ মেনি এ স্লিপ বিটুইন দা কাপ অ্যানড দা লিপ। আদালতের পাঠানো ক্লিপগুলির সঙ্গে জেলখানার নথি মিলিয়ে নেবার ছিল, হাজতের কয়েদীদের সনাক্তকরণের পালা ছিল তার পর। আরো ছিল কত কী।

সেই সব অবশ্যকরণীয় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল পরম্পরায়। মাসিকপত্রের ধারাবাহিকের ন্যায় ক্রমশঃ প্রকাশ্য হতে লাগল।

আমাদের সবাইকে সারবন্দী দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল তার পর।

 জেলর সাহেব এলেন। আসতেই হাঁক পাড়লো হেডওয়ার্ডার; সরকার সালাম্।

শশব্যস্ত সেলাম ঠুকল সবাই। আমরা চুপচাপ। সেলাম-টেলাম কিচ্ছু নেই আমাদের।

তাই দেখে সঙ্গী আসামীদের কারো কারো চোখ একটু ট্যারা হলেও জেলার সাহেব কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করলেন না। সিপাহী কি ওয়ার্ডারদেরও কেউ দৃপাত করল না সেদিকে। পলিটিক্যাল আসামীদের স্বভাবসুলভ বেয়াদবিতে তারা এতদিনে রপ্ত হয়ে গেছে মনে হয়।

কখন খেতে দেবে হে? আমার পাশে দাঁড়ানো মেটের কাছে আমি ফিসফিসিয়ে জানতে চাই-খাবার দেরিকতো আর? এখন খানা কি বাবু? তল্লাসি হোক আগে। তবে না? সে বলেছে।

খানাতল্লাসীর কথা জানা ছিল, কিন্তু খানা আর তল্লাসি আলাদা আলাদা–তা জানতাম না। খানার আগেও আবার এক তল্লাসি আছে এই প্রথম জানলাম। পৃথক পৃথকরূপে তাদের প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাও হল এই প্রথম। যদিও এই জ্ঞানলাভের সবটাই পরস্মৈপদী পরের ওপর পরখ হতে দেখেই তৃপ্ত হতে হয়েছিল আমাদের।

একেকজনকে একেবারে বিবস্ত্র করে তালাস করা হচ্ছিল। কী তালাস, কিসের তালাস কে জানে?

আমাদের পালাও আসছে বীরেনদা। রেডি হও।

 শুনে তিনি সশঙ্কিত-কী সর্বনাশ!

দেরি আছে তার। আমরা সব শেষে দাঁড়িয়েছি না? ভরসা দিই তাকে–মিনিট পনের দেরি আছে বোধহয়।

তিনি মোটেই আশ্বস্ত হন না কিন্তু-কী মুশকিল দ্যাখ তো! তোদের পাল্লায় পড়ে এডিটার হতে গিয়ে কী ফ্যাসাদে পড়া গেল এখন।

তোমার আবার ফ্যাসাদ কী বীরেনদা? তোমার চেহারাটা তো এমন কিছু খারাপ নয়। সুপুরুষই বলা যায় তোমায়…নিজের প্রদর্শনী খুলতে তোমার আবার লজ্জাটা কিসের!

ধুত্তোর সুপুরুষ! প্রদর্শনীর নিকুচি করেছে। বীরেনদার গজগজানি।

মানে, বলছিলাম কি, তোমাকে দিগম্বর করলে দৃশ্যটা এমন কিছু অদর্শনীয় হবে না। খালি গা হতে আমারই লজ্জা, এই হাড় কখানা বার করার মতন বিশ্রী কিছু আছে আর? আর গিরিজা? ও বেপরোয়া। ও তো লাফাতে লাফাতে খালি গা হবে, চাই কি হবার পরেও হয়ত লাফায় ও?

সেটা কি একটা বিসদৃশ হবে না? বীরেনদা জিজ্ঞাসু হবার পরেও যদি লাফায় ও?

হলে তখন দেখা যাবে। আমি বলি-গিরিজাদের লম্ফঝম্প দেখা যাবে তখন। দেখবার পর বুঝব।

কিন্তু আমার পাশের মেটটি বলল, না বাবু, আপনাদের লাঙ্গা হতে হবে না, লাঙ্গা করবে না আপনাদের। কয়েদীদের পোশাকও পরতে হবে না আপনাদের। আপনারা গান্ধীজীর চ্যালা কিনা!

মহাত্মা গান্ধীর মাহাত্ম্য-মহিমায় মনে মনে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।–বটে? বাঃ, ভালো তো তাহলে…কিন্তু, আচ্ছা, ওদের অমনধারা ওঠ-বোস করাচ্ছে কেন গো? নাকি ওরা নিজেরাই ওই ব্যায়াম করছে-খাবার আগে খিদেটা চাঙ্গা করার জন্যে?

জানেন বাবু, ওরা কিনা লুকিয়ে লুকিয়ে গাঁজা আফিং চরস সব নিয়ে আসে, এমনকি পয়সাকড়িও, কেউ কেউ ছুরি-ছোরাও আনে আবার!

কী করে আনবে? কারো হাতে কিছু নেই, দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।

 মালখানায় ভরে আনে যে! সে জানায়, প্রত্যেকেরই মজবুদ মালখানা রয়েছে। ওঠ-বোসের চোটে সেই লুকোনো মাল ওইসব বেরিয়ে পড়ে–দেখতে না দেখতে।

মালখানা! সে আবার কী হে? শুনে আমরা তাজ্জব।–কোথায় মালখানা! কি করে বেরুবে?

সে ইঙ্গিত ইসারায় খোলসা করার চেষ্টা পায় কিন্তু তবু আমরা সঝাতে পারি না দেখে শেষটায় বিশদে আসে। চাপা গলায় বলে–যেমন করে ঝাড়া ফিরে না বাবু?

তখন আমরা টের পাই যে, বিদ্যাসাগর মশায়ের কাছে সমাগত সেই প্রত্যাশীর দুরাবস্থার মতন এখানেও আ-কারের ঐ বাহুল্য প্রয়োগ হয়েছে। মালখানার বিকল্পে ওটা হবে আসলে, আমাদের তাবৎ খানা যে পথে নির্গত হয়ে নিরুদ্দেশ্যাত্রায় বেরয়।

কে জানে হয়ত একদিন সারগর্ভ ধাপার মাঠ পার হয়ে অমন বাঁধাকপির অমল মূর্তি ধরে আমাদের পাতে পড়ে আবার।

ছোরাছুরিও আনে বলছে? আমার কৌতূহল।–হতাহত হয় না?

না বাবু, ছোরাছুরি অমন করে আনলেও কোথাও কেটেকুটে যায় না। আনার কায়দা আছে। জানেন বাবু, একবার একজন ছেনি বাটালি উখো সব নিয়ে এসেছিল ঐ ভাবে। জেলখানার জানালার লোহার শিক কাটবার জন্যেই।…

বলো কি, গারখানার গরাদ কাটবার জন্য গোটা একটা কারখানাই! আমি হতবা।–ঐভাবে আমদানি করা? আশ্চর্য!

হ্যাঁ বাবু! একবার একজন একটা সিঁধকাঠিও এনেছিল নাকি! মাটির তলায় সুড়ং কেটে এখান থেকে বেরুবার মতলবে। সে বলে, কিন্তু ধর্মঠাকুর আছেন না? ধরা পড়ে গেল বেচারা–ঐ ওঠ-বোস করতে গিয়েই বেরিয়ে পড়ল বেবাক।

আছেই তো ধর্মঠাকুর! ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বীরেনদার সায় তার কথায় ধরা না পড়ে যায় কখনো? পড়তেই হবে।

 তিনি কলকাঠি নাড়ছেন বলেই সিধকাঠি বেরুচ্ছে। আমি বলি-কখনো কখনো বেরুচ্ছেও না আবার। তখন সেই লোকটাই বেরিয়ে যাচ্ছে জেল থেকে। অধর্মপথে যদিও! কিন্তু কী করা যাবে?

যাক গে! মেট তাকে অম্লানবদনে বেকসুর খালাস দেয়।–যেতে দিন। কিন্তু সে যা মার খেয়েছিল না বাবু! সিধকাঠি-চোরটা! তার ওপর আবার সেই চুয়াল্লিশ ডিগ্রিতে খাড়াবেড়ি-বাড়া চার মাস।

চুয়াল্লিশ ডিগ্রির চার মাসটা আমার জানার বাসনা ছিল, কিন্তু সবার তল্লাসি খতম হবার পর খানার ডাক পড়তেই তখনকার মত কৌতূহল দমন করলাম।

লৌহঘটিত প্লেটে পরিবেশিত রুট-মাংসের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, গিয়ে আমরা।

 সন্ধ্যের আগেই খাওয়া আর খাওয়ার পরেই শোয়া-জেলখানার এই রেওয়াজ।

বিচারাধীন বন্দীদের জন্যে বরাদ্দ একটা হলঘরে খাওয়ার পরে আমরা সবাই গিয়ে পাশাপাশি লম্বা হয়ে পড়লাম।

আলোগুলো সারা রাত জ্বলবে, না নিবিয়ে দেবে এরপর? বীরেনদা জানতে চান অন্ধকারে বাপু আমার ভয় করে ভারী।

আমারও।…ভূতের ভয় আমার বেজায়। বলতে দ্বিধা করি না।

ভূত নয়, আমার অন্য ভয়। বীরেনদা ফুৎকারে আমার ভয়টাকে ওড়াতে চান জেলখানায় আবার ভূত কিসের রে? সাধ করে কেউ মরতে আসে এখানে যে, মরে ভূত হবে?

জেলখানায় কেউ মরে না বাবু, কী যে কন? আমার পাশের ধরাশায়ী জানায় : যারা ফাঁসি যায় তার তো মরবার পর ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এখানেই। দেখাও দেয় নাকি মাঝে মধ্যে, কে আর তাদের জন্য গয়ায় পিণ্ডি দিতে গেছে বলুন!

বাগে পেলে আমাদেরই পিণ্ডি চটকাবে, আমাদেরকে পিণ্ডি করে চটকাবে এখন।

দ্যুৎ! তোর খালি ভূতের কথা। ভূতের আবার ভয়টা কী? আমি বলি ভূত নয়, অন্য ভয়…

কিন্তু অন্য ভয়টা যে কী হতে পারে আমি ঠাওর পাই না, তিনিও ফাঁস করেন না, আমরাও আঁচ পাই না। এখানে চুরি ডাকাতি রাহাজানি ছিনতাই হবার কিছু নেই। তবে অন্ধকারের সুযোগে অকারণ কে কেউ যদি আদর করে করে গলা টিপে ধরে তো বলা যায় না।

হ্যাঁ, আছে বইকি বাবু অন্য ভয়… আমার পার্শবর্তী কয় : ওই বাবুর…ওনার পাশের লোকটিই তো ভয়ঙ্কর…

মুশকো চেহারার ঐ লোকটা? আমি তাকিয়ে দেখি। একটু কাঠখোট্টা গোছের বটে, কিন্তু ভয়ের তো কিছু দেখি না।

জানেন বাবু, কী কারণে ওর ফাটক হয়েছে? পাকড়েছে কেন ওকে পুলিস? জানেন?

সাংস্কৃতিক বিশেষ্য অশ্বের সহিত ইংরেজি ক্রিয়াপদের এক ফকুড়ি লাগিয়ে এমন সবিশেষ করে সে বলে যে, সেই অকথ্যভাষা সভ্যসমাজে মুখে আনা যায় না। অনুচ্চার্য সেই অকথ্য শুনেই না আক্কেল গুড়ুম!

ইঙ্গবঙ্গীয় এই ফ্ল্যাংগোয়েজের সঙ্গেও পরিচয় আমার এই প্রথম। শুনে আমি স্তম্ভিত।

বীরেনদা কিন্তু আতঙ্কিত-না বাবা, আমি এপাশে শুচ্ছিনে। প্রাণ থাকতে এর পাশে নয়। তুই এধারে আয়, আমি ওদিকে যাই বরং।

ভয় খাচ্ছ কেন বীরেনদা, হলেও অশ্ব কখনই নয়, হতেই পারে না। অশ্বিনী নিশ্চয়। তাই না হে?

যাই হোক না, আমি ওর মধ্যে নেই ভাই।

তুমি তো অশ্বিনী নও, তোমার–আবার ভয় কিসের? এমনকি, তোমার নামটাও অশ্বিনী না। এমন বীরোচিত নাম নিয়ে ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমের অধিকারী হয়েও পরের আক্রমণের ভয় তোমার?

অশ্বই হোক, আর অশ্বিনীই হোক, আমি ওসব রিসূকের মধ্যে যাব না বাবা! বীরেনদা নিজের গোঁ ছাড়েন না-এমন বিপজ্জনক লোকের পাশে আমি…না.না! কখনই না। প্রাণ থাকতে নয়। তাঁর সেই এক কথা।

যাচ্চলে! গিরিজা বলে। সেও এক কথায় সারে।

না বাবু অশ্বিনী নয়, অশ্নই, আমি হলফ করে বলছি। ওর কেসের কাগজে লেখা রয়েছে আমি দেখেছি… সেই লোকটিও নিজের কথায় অনড়।

 তা কি কখনো হতে পারে? কী করে হবে? আমার সংশয় যায় না–দু হাত নইলে বাজে কি তালি? এ ব্যাপারে ঘোঁড়া বা খুঁড়ির সম্মতি থাকা চাই না? তাদের নিজস্ব

মতামত নেই কোনো? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নেই তাদের? তাদের অমতে কি কখনো হতে পারে এ কাজ?

তাদের মতামতে কে কান দিচ্ছে বাবু? ও যা গোঁয়ার আর মারখুনে! বাগে পেলে বাঘকেও ছাড়বে না। ওর কাছে গেলে বাঘও ভড়কাবে। ভয় খেয়ে পালাবে তক্ষুনি। তাছাড়া ঘোড়াটা না বলবে কি করে বলুন? তার কি মুখ আছে? মানে মুখ থাকলেও সে কি কথা কইতে পারে?

বললেও তার ভাষা কি আমরা বুঝবো? গিরিজার বক্তব্য : আর চুপ করে থাকলে ভাবব মৌনসম্মতি।

আহা, একান্তই বলতে না পারুক, চাট মারতে পারে তো? আমার বক্তব্য : অশ্ব কি অশ্বিনী যাই হোক, তার ওপর এমন বিতিকিশ্রি কাণ্ড হতে দেখলে চাট মারতে ছাড়বে না। পায়ে খুর থাকতে মারতে কসুর করবে কেন?

এমন অসম্ভব অব্যাপার দেখে তাজ্জব বনে গেছল বোধহয়, চাট মারার কথা মনেই পড়েনি তার। বীরেনদা ঘোড়াটার সাফাই গান।

তা হতে পারে। মানতে হয় আমায়–এমন দৃশ্য দেখলে মাতালেরই নেশা ছুটে যাবে, চাট মারার কথা মনেই পড়বে না তার–তারও।

তবে? তাহলে? আমার কথায় আমাকেই পেড়ে ফেলেন বীরেনদা।

তাহলেও তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন? তুমি কিছু অশ্বিনী নও। অশ্বশক্তি বিশিষ্টই একজন। হতে পারে হর্স পাওয়ার ওয়ান-তাহলেও তুমি অশ্বই। তবে?

তবে-ফবে জানি না। তুমিও কিছু গাধা নও। বেঁটেখাটো হলেও এক অশ্বই। তাহলে তোমার এধারে শোবার বাধাটা শুনি?

চেহারায় একটু হ্রস্ব হলেও আমি যে অশ্বই, সে কথা অস্বীকার করা যায় না-না, বাধা কিছুই নয়। তবে কিনা…তবে কিনা শুয়ে পড়েছি এক জায়গায়, অকারণে আবার কেম এখান থেকে ঠাই নাড়ানাড়ি-ইতো নষ্ট শুতো ভ্রষ্ট হতে যাওয়া?

তাহলে গিরিজা তুই আয় এধারে, আমি তোদের দুজনের মাঝখানে থাকি। নিশ্চিত হয়ে নিরাপদে ঘুমোতে চাই।

গিরিজা অকুতোভয়, বীরেনদার কথায় অকুস্থলে নিজের স্থান নিতে কোনো দ্বিধা করে না।

বীরেনদা পরদিন সকালে উঠেই জেলখানার রোলল, সরকার সালাম ইত্যাদি পালার কালে জেলার সাহেবের কাছে গিয়ে আরজি পেশ করেছে

রাত্রে আমাদের আলাদা শোবার একটা ব্যবস্থা করে দিন স্যার। ওদের সবার সঙ্গে ঢালাও শোয়াটা যেন কী রকম? ওরা যা সব অসভ্য কথা বলে না! কী বলব স্যার?

বুঝেছি। বুঝতে পারছি। কিন্তু কোথায় আপনাদের দিই বলুন তো? সলিটারি সেল আছে বটে এ জেলে। সব জেলেই থাকে। আমাদের এখানে সেটা চুয়াল্লিশ ডিগ্রির সেল। কিন্তু সেখানে তো ফাঁসির আসামীরা থাকে; জেলের নিয়মশৃঙ্খলা যারা ভঙ্গ করে তাদেরও ওখানে রাখা হয় বটে। ডেমন সেল বলে ওগুলোকে–কিন্তু ওখানে আপনাদের কি বলে রাখি বলুন তো?

কিচ্ছু বলতে হবে না। এমনিতেই আমরা থাকতে রাজী। ফাঁসীর আসামীরা থাকে, তাই বলে সেখানে থাকলেই তো আর কিছু ফাঁসি হচ্ছে না আমাদের?

আর তাহলেও… বীরেনদা আমার কানের গোড়ায় ফিসফিস করেন। তার থেকে তাঁর যে বক্তব্যটা ফাঁস হয় তার মোদ্দা কথাটা হচ্ছে-ধনেপ্রাণে মারা যাওয়ার চাইতে কেবল প্রাণে মারা যাওয়া নাকি ঢের শ্রেয়। অনেক উপাদেয়–অন্তত তাঁর কাছে।

নিজেকে অশ্বমেধযজ্ঞের নিতান্ত অযোগ্য বিবেচনা করে সেই রাজসূয় ব্যাপারে ফেঁসে যাওয়ার চেয়ে বীরেনদা বরং চুয়াল্লিশ ডিগ্রির ডেম সেলে থেকে তার হেতু যদি দরকার হয় তো ফাঁসি যেতেও বুঝি রাজী।

.

৬২.

 গত রাত্রের মতই আরেক চমক দিলেন আজ বীরেনদা, আদালতে গিয়েই না! কেসের ডাক পড়লে আমরা নি মূর্তি আসামীর কাঠগড়ায় গিয়ে খাড়া হতেই সরাসরি তিনি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সম্বোধন করেছেন।

ইয়োর লর্ডশিপ, ইয়োর এসেলেন্সি, হুজুর, সার! আই হ্যাভ এ স্পেশাল আরজি টু পেশ। আই বেগ টু সাবমিট, আই নো নাথিং অ্যাবাউট অল দিস। নাইদার রেসপনসিবল ফর ইট। আই অ্যাম অ্যান ওয়ার্কিং ম্যান অফ দা ক্যালকাটা কর্পোরেশন। আই অ্যাম নট অ্যান এডিটর অব দিস পেপার, নর অ্যাম ইনটারেসটে ইন ইট। টু টেল দা টুথ, নেভার। বোট এ লাইন ইন ইট, নর এভার আই রেড এ লাইন অব দিস। আইদার বিফোর। আফটার প্রিন্টিং! আই অ্যাম এ ভেরি বিজি ম্যান, নো টাইম ফর অল দিস ননসেন্স। (তারপর আমাকে দেখিয়ে )

হি ইজ দা এডিটর, নান বাট হি, অ্যান্ড হি ইজ সো রেসপনসিবল ফর অল দিজ রাইটিংস্-সিডিশাস অর আদারওয়াইজ।

সার, আমাকে না জানিয়ে জোর করে এর এডিটর বলে আমার নাম ছাপিয়ে দিয়েছে কাগজে-উইদাওট অ্যাটু অ ইনফর্মিং মি। কী বলব সার?…।

পুনশ্চ আমার প্রতি তার অঙ্গুলি নির্দেশ-অ্যাট দা রুট অব অল দিস-ইজ দিস্ স্কাউড্রেল, রাদার দিস নটি বয়। মোস্ট হামলি, আই বেগ ইওর পাৰ্জন সার। আই অ্যাম এগ্ৰীয়েবল টু গিভ অ্যান আণ্ডারটেকিং নেভার টু লুক অ্যাট হিজ ফেস। অর হিজ পেপার।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমার দিকে তাকালেন-ইজ দ্যাট রাইট?

আমার বিদ্যের দৌড় বেশি নয়। ইংরেজির তুবড়ি ছোটাতে না পেরে সোজা ইঙ্গ-বঙ্গী হাফ ফিরিঙ্গি ভাষায় আমার বক্তব্য বোঝাই-ইয়েস লর্ড সর, হোয়াট হিসেজ, অ্যাবসলিউটলি রাইট। আই অ্যাম দা অনলি এডিটর; সোললি রাইটার অ্যানড হোললি রেসপনসিবল ফর অল দিস। আমি ছাড়া আর কেউ নয়। নান বাট মি–বাট আমার একটা নিবেদন…আই হ্যাভ টু অবজেক টু হিজ স্টেটমেন্ট ইন দিস রেসপেক্ট…দ্যাট আই অ্যাম নট এ নটি বয়, মে বি নটি বাট নেভার এ বয়-রাদার এ স্কাউণ্ডেল-দ্যাট হিসেজ দ্যাট আই অ্যাম। আই হ্যাভ নো ডাউট অ্যাবাউট ইট।

বীরেনদার আরজি মঞ্জুর হলো। পরের দিন তারিখ পড়ল আমাদের মামলার। কাঠগড়ার থেকে ফিরে এলাম আমরা আদালতের লক্-আপ-এ।

বীরেনদাও এলেন। যতক্ষণ না তাঁর ছাড়পত্র তৈরি হয়ে ছাড়া পাচ্ছেন ততক্ষণের জন্যই যদিও।

লক-আপ-এর এক ধারে আমাকে টেনে নিয়ে আড়ালে তিনি বললেন আমায়–রাগ করিসনি তো, তোকে তখন ওই স্কাউদ্ভুেল বলেছি বলে? কিছু মনে করিসনি ভাইটি।

মনে করব কেন? মনে করার কী আছে? কিছু মিছে কথা তো কওনি তুমি বীরেনদা। রাগ কিসের? ঠিক কথাই বলেছে তো! আমি যে একটা স্কাউণ্ডেল তা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? কিন্তু সে কথা নয়, আমার একটা অন্য কথা ছিল তোমাকে বলার। লজ্জার কথাই সেটা, তাই এখানে আড়ালেই বলি তোমায়। কাল বাসায় ফিরে পুলিসের হাতে ধরা দেবার আগে আমি এক অপকর্ম করে ফেলেছি। ভীষণ খিদে পেয়েছিল দাদা, একটা মেঠায়ের দোকানে…শ্রীমানী বাজারের গায়ে আদর্শ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দেখেছে তো? সেখানে গিয়ে গোটা বিশেক রাজভোগ বসিয়েছি, এখান থেকে বেরিয়ে তার দামটা তুমি দিয়ে দিয়ে তাদের। আর নেহাত যদি না দিতে পারো, তাহলে বোলো তাদের যে, আমি জেল থেকে খালাস পেয়েই ফিরে গিয়ে ধারটা মিটিয়ে দেব আমার।

ও ধারে যাসনে আর–তা হলেই হবে। বীরেনদা বালান আমায়–ও ধার দিয়েই হটবিনে একদম। শ্রীমানীর দিকের ফুটপাথ ছাড়া কি সারা কলকাতায় রাস্তা নেইকো আর? ধার শুখবি কি রে? কেউ কি কারো ধার শুধতে পারে কখনো? কোনো ধার কি কখনো শোধা যায়? ধার করি আমরা নিজের উদ্ধার পাবার জন্য, শোধবার জন্য না। কী বোকা রে তুই? তুই যাবি খাবার ধার মেটাতে পাগল! এ বাজারে যার যত দিকে ধার না, যত না ধার, তার তত বেশি ক্রেডিট। তা জানিস? অতো টাকার মেঠাই তুই ধারে খেয়েছিস, অমনি খেতে পেয়েছিস জেনে তোর সম্বন্ধে আমার ধারণা পালটে গেল রে! স্কাউভেল তুই ঠিকই, জানা গেল এবার যদিও সঠিক, তা হলেও তোর সম্পর্কে আমার একটু উচ্চ ধারণাই হল বলতে কি!

বীরেনদা কিন্তু একটা কথা ঠিকই বলেছিলেন-কারো ঋণই কখনো শোধ করা যায় না। আজন্ম থেকে অজান্তে, কি জ্ঞাতসারে, যতজনের কাছে ঋণী হয়েছি, তাদের ঋণ–সব ঋণ, সবার ঋই এ জীবনে সমান অপরিশোধ্য। শুধু আমার নয়, সবার পক্ষেই সেটা সত্য।

কারও ধারই কখনো শোধ করা যায় না, ধবার নয়, হাজার সুদ দিয়েও-এমন কি! ধরুন, সেই কাবুলিওয়ালার দেনাই কি আমি মেটাতে পেরেছি? আমার বন্ধু পুণ্যশ্লোক সেই বিভূতি বাঁড়ুজ্যের? যখন আমার কোনো উপায় ছিল না সেই দুঃসময়ে অর্থসাহায্যে নড়বড়ে আমাকে নিজের দুপায়ে দাঁড় করাবার যাঁরা প্রয়াস পেয়েছেন? যদিও তাঁদের সেই দুশ্চেষ্টার পরেও হাতী-ঘোড়ার কদরে ওঠা দূরে থাক, তেমনি নড়বড়ে রয়ে গেছি শেষ পর্যন্ত। তাঁদের পানা যেমন দিতে পারিনি, চিরঋণী থেকে গেছি, আদর্শের ধারও মেটানো গেল না তেমনি অনেক চেষ্টা করেও-বলব কী!

জেল থেকে বেরিয়েই আদর্শ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ঢুকেছিলাম আবার–আগের দেনাটা মেটাবার মলবেই।

কিন্তু কথাটা পাড়তেই না কর্তাব্যক্তিটি হৈ হৈ করে উঠেছেন-হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। সেই বোমার মামলার আসামী তো? যার সঙ্গে আমাদের লোক গেছল খাবারের দামটা আনতে? আরেকটু হলেই সে পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যেত। ফাড়াকাটিয়ে খুব বেঁচে ফিরে এসেছে সেদিন! মা-কালীর কৃপা ছাড়া কী! তা, সে ব্যক্তি কি আপনি? আপনি বলছেন আপনিই সেই লোক?

হ্যাঁ, সেই কথাই বলতে এসেছি তো…।

বোমা পিস্তল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন নাকি? পুলিস আপনার পেছনে নেই তো? পিছু নেয়নি তো পুলিশ? জানেন ঠিক? তা কী চাই আপনার বলুন? কতো চাই? চটপট বলুন মশাই! কত টাকার দরকার? গুলি গোলা ছুঁড়তে হবে না আপনাকে, এমনিতেই দেব। দেশের জন্যে কিছুই করতে পারিনে-যদি এভাবেও কিছু করা যায়। এই দ্যাখ তো ক্যাশবাক্সে কত আছে আজ?

আজ তো সকাল থেকে তেমন বিশেষ বিক্রি হয়নি বাবু। এমন কিছু টাকা পড়েনি বাক্সে… বাক্সর জিম্মাদার গাইগুই করে জানায়।

না না, টাকার কোনো দরকার নেই আমার। আপনাদের ভাঁড়ার লুঠ করতে আমি আসিনি। আপনাদের মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের আদর্শ মিষ্টান্নাদিও নয়–হাজার তা উপাদেয় হলেও। আপনাদের সেই পান্নর টাকাটা মিটিয়ে দিতেই আমি এসেছিলাম…

কিসের টাকা? তিনি এবার সত্যিই যেন হতভম্ব।

সেই মেঠায়ের দামটা মেটাতেই…সেদিন যে রাজভোগগুলো খেয়ে গেলাম না? অমনি অমনিই–জেল থেকে আজ খালাস পেয়েই তার দাম দিতে এলাম আপনাদের। এর আগে দেবার ফুরসত পাইনি তো? এখন পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিন আপনারা।

ও! তাই নাকি? তা ভালো। স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো তার।–ভালোতা ভালো। বসুন এই চেয়ারটায়। কটা রাজভোগ খেয়েছিলেন সেদিন?

তা গোটা বিশেক তো হবেই? আমি বিশদ করি-একেকটা ওর দাম কতো? আপনাদের ওই অতিকায় রসগোল্লাগুলোর?

বেশি নয়, চার আনা পিস্। কিন্তু বিশটা রাজভোগ আপনি খেয়েছেন–খেতে পেরেছেন, তা আমার বিশ্বাস হয় না। আপনার ওই পা দেহে অতগুলো রাজভোগ ধরবার জায়গা কোথায়? কটুকুন পেট আপনার?

সপেট আমার সর্বাঙ্গীণ সৌষ্ঠবের প্রতি তাঁর এই অপাঙ্গ দৃষ্টির কটাক্ষপাতে আমি লজ্জিত বোধ করি। নামমাত্র এই পেট নিয়েও আমি যে খাওয়ার ব্যাপারে সপটু, উল্লেখযোগ্য এক পেটুক–কী করে তাঁকে বোঝাই?

ধরবার জায়গা নেই ঠিকই, কিন্তু ধরিয়েছিলাম কোনোগতিকে। পুলিসের হাতে ধরা পড়ার আগে প্রাণের দায়ে খেতে হয়েছিল আমায়। পেটে খেলেই পিঠে সয়, জানেন তো? লালবাজারে গিয়ে কী পিঠে পড়বে কে জানে-সেই পিঠে খাবার আগে গায়ে জোর করার জন্যেই এখানে এসে পেটকে সইয়েছিলাম। এই আর কি! তা দামটা…।

তা হলেও আমাদের পেত্যয় হচ্ছে না মশাই! বিশ-বিশটা রাজভোগ গিলেছেন আপনি! বেশ, খান তো বসে আমাদের সামনে আবার, দেখা যাক। এই, দে তো এনাকে বিশটা রাজভোগ এনে এখেনে। টাটকা যেগুলো আজকের-তাই দিবি।

রাজভোগর সামনে বসতে হল না, বসেই ছিলাম, রাজভোগ আমার সামনে এসে বসল।

খান তো দেখি এবার।

প্রমাণ দিতে বসে পেটের না অপমান করে বসি–ভয় হয় আমার। পেটের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়–তা জানি, কিন্তু যে পরম মিষ্ট (নরম অধরেরে কথা ধরছিনে) উল্লাসবোধে অনায়াসে খাওয়া যায়, তাই উপরোধে গিলতে হলে টেকির মতই মনে হতে থাকে। ঢক করে গেলা যায় না। যাই হোক, কুঁথিয়ে-কাঁথিয়ে তো পার করা গেল কোন রকমে।

তারপর দামের কথাটা ফের পাড়তেই-না না! এর দাম দিতে আর হবে না আপনার। এ তো আমরা খাওয়ালাম। আনন্দে খাইয়েছি আপনাকে। খেয়ে আপনি আনন্দিত হয়ে থাকলেই আমরা খুশি। এ তো বাজি ধরে খাওয়াই একরকমের। বাজি জিতেছেন, তার দরুন আরো বিশটা ওই রাজভোগ আপনার পাওনা। না না, এখানে বসে খেতে হবে না আপনার-আপনাকে খুন করতে চাইনে আমরা। বাড়ি নিয়ে ধীরে সুস্থে খুশিমতন খাবেন। এই, দে তো এনাকে একটা বড়ো হাঁড়িতে করে আরো বিশটা সরেস রাজভোগ গরম দেখে–যেটা নেমেছে আজ সকালে–এক নম্বরের।

তা এটার দাম না নিন, নাই নিলেন, কিন্তু আপনার আগেরটা– চমৎকৃত হয়ে আমি কই।

সে তো আমরা সেদিনই বাঁ দিকে খরচ লিখে রেখেছি, আমাদের লোকের মুখে শুনেই না–তখুনিই! তার কী দাম দেবেন আবার? তা ছাড়া, আপনারা হচ্ছেন খুদিরামের সগোত্র (হায় খুদিরাম, অপদার্থ শিব্রামের সঙ্গে তুল্যমূল্য হয়ে গেলে!) ফাঁসিকাঠে হাসিমুখে প্রাণ দিতে যাচ্ছেন আপনারা (হায় হায়!!) আপনাদের খাওয়াতে পারাটা তো ভাগ্যের কথাই। আপনি যখন খুশি আসবেন এখানে, যা খুশি খাবেন, তার জন্য কখনো কোনো দাম দিতে হবে না আপনাকে। এঁকে চিনে রাখো তোমরা। দেশের জন্যে অক্লেশে প্রাণ দিতে যাচ্ছেন। এরা–আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়। আপনাদের দেখলে পুণ্যি হয়। দোকানে আপনাদের পায়ের ধুলো পড়াটাই বরাত! আসবেন আবার…আসবেন তো?… নিশ্চয় আসবেন। নমস্কার নমস্কার।

রাজভোগের হাঁড়ি হাতে, মুখ হাঁড়ি করে ফিরলাম নিজের মেসবাড়িতে। কিন্তু তারপরে আমি বীরেনদার সেই কথাটা রেখেছিলাম। ওধারের ফুটপাথ মাড়াইনি আর। ওঁদের দোকানে যাইনি আর কখনো। আদর্শ মহাজন অতবার নিশ্চয় করে বলার পরও, এমন কী তাঁর কর্মচারীদের আমায় চিনে রাখতে বললেও আমি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছি। যথার্থই তাঁরা যে এ যুগের আদর্শস্থানীয় তা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম। আহারে আহারেও। সত্যি বলতে, সেই বিনিপয়সার ভোজে কি রকম যেন বিড়ম্বিত বোধ করেছিলাম। তাঁর মুখে খুদিরামের নামোচ্চারণেই বিষম খেয়েছিলাম–আমার সেই বিষম খাওয়াটার ওপর আবার! যে খুদিরামের খুদকুঁড়াও নেই আমার, সেই তার আদর্শ ভাঙিয়ে আরেক আদর্শের ঘাড় ভেঙে এই খাওয়াটা কেমনতর লাগছিল যেন!

কিন্তু ভেবে দেখলে, এ দুনিয়ায় কিছুই মানুষের ইচ্ছায় আদৌ হয় না। কী রাজভোগ, কী রাজদন্ডভোগ-কোনোটাই কখনো ইচ্ছে করলেই মেলে না। পরের রাজভোগের কথা রাখুন, নিজের রানীভোগ কিংবা হয়রানিভোগ, এমন কি তাও নিজের ইচ্ছেমতন হবার নয়।

সেদিন বীরেনদাকে ফৌজদারি কোর্টের মুক্তাঙ্গনে ফেলে রেখেই জেলে ফিরলাম আমরা।

আদালত ভাঙার পর কয়েদ-গাড়িতে আমাদের ওঠার সময় কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সাশ্রুনেত্র হবার সহস্র চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে নিরুপায় শেষটায় হাসিমুখেই বিদায় দিলেন

আমাদের। বিনাবাক্যব্যয়ে উভয় পক্ষের সেই বিদায়।

ফিরে এলাম জেলে। সেটা সেন্ট্রাল জেল কি প্রেসিডেন্সি, আজও আমি ঠিক জানিনে। তখন হয়ত জেনেছি, মনে নেই এখন আর। এইমাত্র বলতে পারি, যেই জেলে সেই সুবিখ্যাত চুয়াল্লিশ ডিগ্রীর অন্ধকূপগুলি বিরাজিত, এ হচ্ছে সে-ই জেল!

সকালেই বীরেনদার আবেদনে ব্যবস্থা হয়ে রয়েছিল, সেই মতন সন্ধ্যেয় খাওয়া খতম হবার পর আজ আর আনডারট্রায়ালদের সেই জেনারেল পিজরাপোলে যেতে হল না, সোজাসুজি চুয়াল্লিশ ডিগ্রীর দুই সেলে দুজনে গিয়ে মজুদ হলাম আমি আর গিরিজা।

যার বর্ণনা, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-আমাদের উপেনদার নির্বাসিতের আত্মকথায় পড়েছিলাম, খুদিরাম প্রমুখদের সতীর্থস্থল না হয়েও, অনুগামী সহযাত্রী না হলেও, বাংলার বাঙালীর সেই তীর্থস্থলে যাবার-তার ধূলায় গিয়ে গড়াবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের।

.

৬৩.

ফৌজদারি কোর্টের ফেরত সন্ধ্যের মুখে জেলে ফিরেই খানার সম্মুখে। আর, খাবার পাট চুকিয়েই আরেক লৌহকপাটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

পিঁজরেগুলি বেঁটেখাটো, একটা নয়, সারি সারি লৌহকপাট-চুয়াল্লিশ ডিগ্রির। পরের পর সাজানো। পূব আর দক্ষিণমুখো বাইশটা করে ছোট ছোট ঘর কোণ ঘেষে রাইট অ্যাগলে কাট-করা দুসারিতে। ফাঁসির আসামীদের থাকার জন্য ডেমড় কুঠরি– জেলের নিয়মভঙ্গকারীদের রাখার জন্য সলিটারি সেল-যার নাম নাকি ঠাভিগারদ। সেই টর্চার সেলের একটার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

হাবিলদারের টর্চের আলোয়ভেতরটা দেখে নিলাম এক নজর। দুখানা কম্বল পাশাপাশি পাতা যায় এতটাই চওড়া আর লম্বায় বোধ হয় আড়াই কম্বলটাক।

খুপরির এককোণে একটা চুপড়ির মতন রাখা, সেটা নাকি প্রাতঃকৃত্যের জন্যই, জানা গেল। রাত্ৰকৃত্যর নিমিত্তও লাগতে পারে দরকার পড়লে। কারাকক্ষের লৌহঘটিত দরজার ওপাশটায় এক বালতি জল, আর এধারে একটা ঘটিমার্কা মগ। পানাহার শৌচকমাদি কৃত্যাকৃত্যের প্রয়োজনে। লৌহদ্বারের রেলিং-এর ফাঁকতালে মগ গলিয়ে অনায়াসে জল আনা যায় দেখা গেল। একটুকরো এই মগের মুল্লুকের আমিই এখন একেশ্বর।

পাশের খর্পরে গিরিজার ঠাঁই হয়েছিল। একটু পরেই তার সাড়া পেলাম– শিব্রাম! এই শিব্রাম!

আমার ঘুম পাচ্ছিল। কোনো সাড়া দিলাম না। কিন্তু তার আগেই হাঁক পাড়ল হাবিলদার অ্যায়, চুপ রহে। বাতচিং মনা হৈ।

বেঁচে গেলাম।

গিরিজার সঙ্গে কতা বলা মানেই তর্ক লাগান। আর, তর্কে তার সঙ্গে পিরবার জো নেই। এঁড়ে তর্ক, কি যুক্তিসহ বেড়ে তর্ক, তা জানিনে, লজিক আমার পাঠ্য ছিল না। (লজিক্যাল নই কোনো কালেই তো ), কী করে বলব। তবে ওর সঙ্গে পেরে উঠি না, তা জানি। তাই সর্বদাই সতর্ক থাকি, পরমব্রহ্মের ন্যায় ওকে তর্কাতীত রাখি। নিজেও আমি তাই থাকতে চাই।

অপরেও প্রায় তাই, আমার মনে হয়েছে। বিমল বলে ওর এক কলেজী বন্ধু ছিল, হাওড়া না কোথায় থাকত যেন, ওর কাছে আসত মাঝেসাঝে। দেখতে শুনতে ভালোই ছেলেটা। কিন্তু দেখতে যত ভালো, শুনতে ততটা নয় নিশ্চয়। তার প্রাণের বন্ধু হলেও মোটেই তার গানের বন্ধু হতে পারেনি।

এক নাগাড়ে গিরিজার বাগড়ম্বর সে সইতে পারে না। ভদ্রছেলে, মুখ ফুটে কোনো আপত্তি করত না বটে, কেননা তা করতে গেলেই তো আরো আরো বাঙুনিষ্পত্তি আর বিপত্তির কারণ হবে সে জানত! তার চেয়ে তার তর্কের পাল্লা কাটিয়ে আমার খোসগল্পের মহল্লায় চলে আসত সটাং! গিরিজার ত্রিসীমা এড়িয়ে, বাসার থেকে বেরিয়ে সামনের মার্লস স্কোয়ারে গিয়ে গল্পগুজবের চক্কর মারতাম আমরা। আর, গিরিজা এমন চটত যে আমার উপর!

আজ জেলের পাহারাদারের সতর্ক প্রহরায় গিরিজার তর্ক পরিপাটি হয়ে উঠবার আগেই পরাস্ত হয়ে গেছে।

যা শত্রু পরে পরে–বলে না? সেই রকমই প্রায়।

 বুট পরে গট গট করে হাঁটছিল লোকটা। থ্রিী এলাকার এমোড় থেকে ওমোড় অব্দি তার পাহারার পায়চারি চালাচ্ছিল সে। সঙ্গীন বন্দুক হাতে।

মাঝে মাঝে খুপরির গোড়ায় এসে টর্চ ফেলে তাকাচ্ছিল ভেতরে-কী করছে কয়েদীরা। চারধার নিশুতি। কোনো শব্দ নেই কোথাও। কেবল সেই সবুট পদধ্বনি; গট গট গট গট।

শব্দ কি ছিল না আর কোথাও?

 ছিল। দক্ষিণা হাওয়া দিয়েছিল বাইরে, প্রায় ঝত্নে মতই বইছিল যেন। ঝড়ের মান গাছপালায়। তার সরসরানি মড়মড়ানি শাখায় শাখায় পাতায় পাতায়। সারা রাত।

ঘুমিয়ে পড়ছি, ঘুম ভাঙছে, ঘুমুচ্ছি ফের, জাগছি আবার। আর রাতভোর শুনছি সেই মর্মরধ্বনি।

বাইরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু খুপরিটার ভেতরে কি এক ফোঁটাও হাওয়া আসতে নেই? পথ ভুলে একটুখানি হাওয়াও কি আসতে পারে না এদিকে? ঘরের মধ্যে গরমের এমন বিচ্ছিরি ভ্যাপসা যে কী বলব! বলতে গেলে আরো ঘামতে হয়।

মা বলতেন মিছে নয়, প্রমাণ পেলাম তার এখন। ভগবানের যা কিছু দান, তা পেতে হলে অপরকে দিয়ে তবে পেতে হয়, বলতেন মা। তার কাছ থেকে পাওয়া তখন তাকেই ফিরিয়ে দেওয়া যায় তাইইে।

রূপগুণ অর্থ সামর্থ্যের মতন জল-হাওয়াও বিধাতার দান বইতো নয়। যাবার পথ তার খোলা না রাখলে আসার পথ খোলা থাকে না। তার আসা হয় না, আমাদের আশা ব্যর্থ হয়।

এই যে, দারুণ বাতাস দিয়েছে বাইরে, মাঝে মাঝে তার এক-আধটা ঝাঁপটা লাগছে এসে গায়ে। কিন্তু আমার ওপর দিয়ে তা বয়ে যেতে পারছে না–কেবল আমার অচলায়তনের এদিকটা উন্মুক্ত নয় বলেই তো? দক্ষিণা হাওয়ার দাক্ষিণ্য লাভে আমি প্রবঞ্চিত তাই।

সকালে খুপরির তালা খোলার পর আমাদের দুজনকে নিয়ে দশ নম্বর ওয়ার্ডে ছেড়ে দেওয়া হল।

প্রশস্ত প্রাঙ্গণ বেবাক ফাঁকা, একবারে চৌবাচ্চা ভর্তি জল। নাওয়া-টাওয়ার ভারী সুবিধে হবে এখানে। গিরিজাকে দেখাই।

দাশসাহেব এই দশ নম্বর ওয়ার্জে থাকতেন, সেনগুপ্ত সাহেবকেও রাখা হয়েছিল এখানেই। জানালো মেট। দাশসাহেব এই চৌবাচ্চাতেই নাইতেন। কোণের ওই ফুলগাছটা উনিই। লাগিয়েছিলেন।

তাই নাকি?

 এই ফুলগাছের ধার দিয়েই সেই ভাগীরথীর ধারা বয়ে গেছে একদিন! জেনে রোমাঞ্চিত হই। ফুলগাছটাকে আমি একটু আদর করলাম কাছে গিয়ে।

ঢং দ্যাখো না! গিরিজার বাঁকা হাসি দেখা গেল।

ঢং কিসের? এখানে আর কাকে পাচ্ছি বলো? খাব কাকে? সাফাই গাই যেন-তাই ওর ওপর দিয়েই একটুখানি মিটিয়ে নেয়া গেল ভাই!

যথার্থই! আদর করার আর একটা পাত্র না পেলে চলে না যেন কারো কারো। এই কিশোর পল্লবটি আমার প্রিয়জন না হলেও প্রয়োজন এখন। সত্যি বলতে, আমার বন্ধু বিভূতিভূষণের ন্যায় প্রকৃতির প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা নেই। কোনোদিনই ছিল না। প্রকৃতি তো পটভূমি মাত্র, তার ওপরেও আরও কিছুর যেন অপেক্ষা থাকে, সেই পরিবেশে পরীর মতন বেশ এমন কিছু, তেমন কেউ। বন্য প্রকৃতির পরেও অন্য প্রকৃতি-সেই অপার মাধুরীর ওপরে অপর কোনো মাধুর্য। তা না হলেও, আলোর মধ্যেও সবটাই কেমন যেন আলুনি।

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, হ্যাঁ ঠিকই। কিন্তু ভুবন হাজার সুন্দর হলেও তার চেয়েও বড় সত্যি, মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। এই সূর্যালোকে এই পুস্পিত কাননে-সুষমায় অপর্যাপ্ত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেই কবি যে ওই বলেছিলেন–জীবন্ত হৃদি মাঝে যদি ঠাই পাই-এম সত্য সেইটাই।

ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণকে দেখেছি প্রকৃতির ক্রোড়ে গিয়ে নিমগ্ন হয়ে যেতে গিয়ে তন্ময় হতেন, তন্ময় হবার জন্যই যেতেন যেন সেখানে। সেই ঘাটশিলায় আমিও গেছি, মাঝে মাঝেই যাই এখনো, তার দেখা সেইসব গাছপালা পাহাড় আমিও দেখেছি, আমারও দেখা। ফুলডুংরির থেকে ডুংরি-এর ফুল কিছুই অদেখা নেই। দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। মুখ মরে গেছে তার রূপসুধায়, বলতে কি! কিন্তু তার মতন তাদের রূপগুণে আমি বিভোর হতে পারিনি।

বন্য প্রকৃতির লাবণ্য দেখতে মন্দ নয়, কিন্তু দেখা যায় বড় জোর পাঁচ মিনিট। তার বেশি আর নয়।

দেখে দেখে একঘেয়ে লাগে কেমন। অরুচি ধরে যায়।

 কিন্তু এই কলকাতায় কখনোই তেমনটা হয় না, এখানে ক্ষণে ক্ষণেই রূপের নতুন মুখ দেখি, মুহূর্তে মুহূর্তে মুখ বদলানো যায়। কিন্তু প্রকৃতির গর্ভে সেটি হবার যো নেই, সেখানে, সেই গাছ সেই ফুল কাল যা দেখেছি আজও তাই, মিনিট পাঁচেক আগেও যেরকমটি, এখনো তদ্রূপ। তার কোনো তারতম্য নেই। ইতরবিশেষ হয় না কোনো। পাহাড় যেখানে যেমনটি ছিল সেখানেই তেমনি ভূপাকার। অবিকল সেই রূপেই-কালকে যেমনটা দেখা গেছে। হেরফের নেই কোথাও। আলাদা আলাদা জাতের ফুল থাকলেও এক জাতীয় ফুলের এক রকমই চেহারা চিরকাল। একবার দেখলেই ফুরিয়ে যায়।

গাছপালা পাহাড়পর্বত নদীনালা চিরকাল একরকমই থাকে। ক্ষণেকের জন্যে বারেক দেখলেই হোলো, দুবার দেখার কিছু নেই। কিন্তু মানুষের বেলাও কি তাই?

মানুষের মধ্যে যারা সুন্দর তাদের বেলায় কি তা বলা চলে?

প্রকৃতির চিত্রপটে এক রূপ, একই রূপ চিরকাল, কিন্তু কোনো কিশোরীর মুখপটে সেই রূপেরই বিচিত্র রূপ–এক রূপসীই নিত্য নব। মুহুর্মুহুই তিনি অপরূপ। ভিন্ন কিশোরী, ফুলের মতন প্রস্ফুটিত হলেও, বিভিন্ন রূপে বিচ্ছুরিত। অন্য কিশোরী ভিন্ন ভিন্ন রূপের বিভিন্ন রূপে দেখা দিলেও প্রত্যেকেই তারা অনন্যা। সৃষ্টির প্রাক্কাল থেকে এক জাতের ফুল এক রূপে দেখা দিলেও এতাবৎ সেই কৈশরের দুটি মুখ কখনই এক রূপে দেখা যায়নি-এক মুখে অসংখ্য রূপ অন্তহীন অফুরন্ত হয়ে দেখা দিলেও কিন্তু এখানে, এই মরুভূমিতে এসে এখন এই ফুল গাছটিকেই যেন আমার দারুণ ভালো লেগে গেল। কেন, কে জানে!

ভালোবেসে ফেললাম, এতবড় মিথ্যে কথা আমি বলতে চাই না, বিভুতির সেই অনুভূতি, কিংবা অনুভূতির সেই বিভূতি আমার নেই, তবে এখানকার এখনকার এই নিঃসঙ্গ দশায় গাছটিকে মিষ্টিত লাগছিল বেশ। তার প্রেমে ঠিক না পড়লেও! তার ডালপালায় ফুল পাতায় আদর করলাম অনেক অনেক। ঘুরে-ফিরে। বারংবার। সে কি জেলখানা বলেই, আমি এখন একেবারে নিঃসঙ্গ বলেই কি? আমার এই অকারণ ভালো লাগাটা, প্রকৃতি প্রবণতা–আমার প্রকৃতিদুর্লভ এহেন আচরণ তা কি এখানকার এই নির্জন অরণ্যবাসের জন্যেই? কিন্তু বিভূতিবাবুর বেলায়…?

বিভূতিবাবু কি ধরাধামকে কারাগার জ্ঞান করতেন? অতঃকরণে কি তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন?

.

৬৪.

 এই লুব্ধ প্রকৃতির হলেও প্রকৃতিলুব্ধ আমি কখনই নয়। প্রকৃতির লীলাখেলা কি রূপ যৌবন কোনদিন আমায় বিচলিত করেনি। যে মহাবোধির সংক্ৰণে আব্রহ্মশুম্ভ বিশ্বচরাচরের সহিত একাত্মবোধে প্রাকৃতিক সহানুভূতি জাগরূক হয়, আর তাত মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে গাছপালা নদীনালা পাহাড় পর্বতের অপার্থিব অভিব্যক্তি ব্যক্ত হতে থাকে, অনুভুতির সেই বিভূতি (কিংবা, বিভূতির সেই অনুভূতি) আমার লেশমাত্র নেই। তাই অতিশয় প্রাকৃতিক (এবং কিছুটা অতিপ্রাকৃতিকও বোধহয়) বিভূতিভূষণ বনভুমির লাবণ্য দেখে যেখানে তন্নিষ্ঠ আত্মহারা হয়ে যান, সেখানে আমি একটুখানিও ঘনিষ্ঠ হতে পারিনে।

জানি গাছপালারা আমাদের অনাত্মীয় নয়, বাঁদররা আমাদের পূর্বপুরুষ। একই পাদপ পিতার শাখার থেকে আমাদের উভয়ের উত্তরণ-কিন্তু আদ্যিকালের এই ঐহিক সম্বন্ধ থাকলেও এবং বৃক্ষলতাগুল্মের সঙ্গে শারীরবৃত্তে ( আর বৃত্তিতেও) আমাদের অভিন্নতা আচার্য বসুর আবিষ্কারের পরে সপ্রমাণ হয়ে দৈহিক সম্পর্কে আমরা সন্নিকট হলেও, কেন জানি না, তাদের সঙ্গে কোনো স্নৈহিক সম্বন্ধ স্থাপন করা বুঝি চলে না। প্রাণের অচ্ছেদ্য বন্ধন সত্ত্বেও হৃদয়ের আদানপ্রদান বাধা পায়। গাছপালাকে যেন কিছুতেই ভালোবাসা যায় না।

 তবুও জেলখানার এই ফুলগাছটিকে আমার এমন ভালো লেগে গেল কেন যে হঠাৎ! প্রাকৃতিক পটভুমির বাইরে, পরিবেশও যেখানে ঠিক প্রাকৃতিক নয়, প্রকৃত তো নয়ই, সব কিছুই একটু অপ্রকৃতিস্থ, আমার স্বভাবের এই অকারণ অন্যথা দেখা গেল। ফুলগাছটির কী মাধুরী ছিল কে জানে, প্রথম দর্শনেই আমাকে যেন অভিভূত করেছিল! কিন্তু কেন যে, তার কোনো মাথামুণ্ডু আমি খুঁজে পাইনি, তখনও না, এমনকি এখনও নয়। অবশ্যি টানের কোনো মানে হয় না জানি। কেন যে হয়, কখন হয়, কার জন্যে হয়, কী কারণে হয়ে থাকে বা হবেই যে, তা কেউ বলতে পারে না। বেশির ভাগ অপদার্থদের দিকেই তার ঝোঁক আমি দেখেছি।

চিরকালই তা এক রহস্য।

দুটি কূল থাকলেই হেলো, সেই দুয়ের আনুকূল্যেই টানাপোড়েনে সে বয়ে চলে, টানের চোটে কোথায় কাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কে জানে!

দুটি কূলই তার যথেষ্ট–সেই দু হাতেই তার জলতরঙ্গের তাল বাজায়-ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল হয়ে বাজে বুঝি। তার মাঝে পড়ে তৃতীয় কোনো প্রতিকূল এসে যদি বাধা দিতে যায় তা যেন সেই টানকে আরো জোরদার করে দেয়। বেজার করে যায়। তিনকোণা ধাক্কায় তখন তা ফুলে ফুলে কূলে কূলে কানায় কানায় ছাপিয়ে ওঠে, দিগ্বিদিক ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

কানায় কানায় ছাপায় যে, সত্যিই! চোখারাও কিছু পার পায় না। ভালোবাসা এমনই অদ্ভুত! তো যেমন বোকাদের চৌকস করে তেমনি আবার চোখাদের ধরে বোকা বানায়। গোড়াতেই কানা করে তারপরে কিনা কানায় কানায় ছাপিয়ে যায়।

গিরিজা চোখা ছেলে, তার নজর পড়তে দেরি হয়নি। সে বললে, তোমাদের দুটিতে মিলেছে ভাল! দুজনেই তোমরা ফুল তো-যদিও আলাদা বানানে। ওটা ফুলগাছ আর তুমি একটি গেছো ফুল।

সে কথা সত্যি! নিজেকে কোনোদিনই আমি চৌকস বলে ভাবতে পারিনে। যখনই যে টানের মাথায় পড়েছি অবলীলায় ভেসে গেছি, চোখ কান খোলা রাখতে পারিনি। টান যদি অন্ধ না করে দেয়, চোখে কানে দেখতে না দেয় যদি, তবে আর সে টান কিসের!

তবে এহেন গেছো প্রেম আমার জীবনে এই প্রথম নয়। এর আগে আরো দুটো ফুলগাছ এসেছিল আমার জীবনে-টেনেছিল মূলসুন্ধু, মনে পড়ে আমার। সেই অনুষঙ্গেই এই গাছটিকে আমার ভালো লেগেছিল কি না কে জানে!

সেই কৈশোর-স্মৃতিই যেন ভেসে উঠল আচম্বিতে।

রোজ বিকেলে পকেটে পাটালি আর চিড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বেড়াতে, রিনি আর আমি–সেই যুই গাছটার তলা দিয়ে, কুকুরদীঘির ধার ঘেঁষে, মেঠো ক্ষেতের আলপথ ধরে চলে যেতাম মহানন্দার কিনারায়। সেখানে একটা চ্যাটালো পাথরের ওপর বসে সরু চিড়ের সঙ্গে খেজুর গুড়ের পাটালির শ্রাদ্ধ করতাম দুজনায়।

একেকদিন রিনি এলিয়ে পড়ত কোলের ওপর। আমার উপকূলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে চিড়ে গুড় চাখত আর আলোয় আলো আকাশের দিকে চোখ তুলে রাখত। গোধূলি বেলার রঙের খেলায় শূন্যের মহাসাগরে বুঝি বান ডাকত তখন। কোনো কথাটি না কয়ে চুপ করে। পড়ে থাকত সে।

অস্তমান সূর্যের মুখোমুখি বক্ষ্যমান চাঁদকে সুমুখে নিয়ে–(রিনির সঙ্গে তুলনা দিয়ে, আমি বলব, মস্ত মান দেওয়া হোলো চাঁদটাকে!) আমি তখন…তখন কি আমি…খেজুর গুড়ের সঙ্গে চাঁদের গুঁড়ো মিশিয়ে চন্দ্রপুলির আস্বাদ পেয়েছি।

সেকালের সেই পাথরটাকে–(উস্কাবেগে কক্ষভ্রষ্ট চন্দ্ৰশিলাই ছিলো নাকি সেটা!) এখনো। আমি ভুলতে পারিনি। আর সেই যুঁই গাছটাকেও নয়। কী মিষ্টি গন্ধ বিলোতত সে চার ধারে–কতো ফুল তার ছড়ানো থাকত তলায়। যুই বিছানো সেই ঘাসের বিছানায়, তার ছায়ায় কতো রবিবার, ভ্যাকেশনের কতত দুপুর হাতে হাত দিয়ে আমরা বসে থেকেছি দুজনে যে!

একেক সময় মনে হয় সেই গাঁয়ে গিয়ে দেখে আসি তাদের–সেই গাছ আর পাথরটাকে। এখনো কি তারা সেইখানে আছে, তেমনটিই রয়েছে? বেঁচে বর্তে আছে এখনো? তেমনিই কি পাপড়ির সঙ্গে যুই ফুলের গন্ধ ছড়াচ্ছে গাছটা? সেই পাথরটায় কোন চাঁদমুখ নিজের সিংহাসন পাতে এখন?

সেদিন জেলের ফুলগাছটিকে দেখে ফেলে-আসা সেই গাছটিকে মনে পড়েছিল আমার। যেমন এখন এই লেখার সময় সেই গাছটাই আমার মনে ফিরে দেখা দিয়েছে আবার।

এখনো মাঝে মাঝে যেতে ইচ্ছে করে বইকি! স্বজন বন্ধু কারো জন্যে নয়, কে আর আমার আছে সেখানে। সেকালের বন্ধুদের প্রায় সকলেরই তো একে একে মহাপ্রয়াণের খবর পেয়েছি, আমার পরিচিত কেউ বোধহয় আর বেঁচে নেই কোথাও…আমার সময়ের সেই গাছ পাথরই কি রয়েছে আর?

আর থাকলেই বা তার দাম কী আর? এক-এর অভাবে শূন্যের কি মূল্য দাঁড়ায়? রিনির বিহনে সে গাছ কি আর সেই গাছ? সেই পাথর আর সেই সিংহাসন নয়; বিবর্ণ, পাণ্ডুর, ধুসর শিলালিপির মতই নিতান্তই এক পাভুরাজার টিপি!

এক চলে গেলে শূন্যের কী থাকে আর? মহাশুন্য ছাড়া আর কী? সংখ্যাহীন শূন্যযোগে তার কিছু দাম কি আর বাড়ে? পাশের একক গিয়ে সেই গাছ-পাথরের মতই আমিও আজ একাকী। চারপাশের শূন্য নিয়ে, আকাশের মত ফাঁকায় পড়ে আজ আমি একান্তই একাকী-নিতান্তই শূন্যাকার।

কিন্তু আমার কালের কেউ নেই, আমার বয়সের গাছ-পাথরও না, অথচ আমি রয়েছি, ভাবতে গেলে বিস্ময় লাগে বইকি। কততকাল ধরে বাঁচছি…বাঁছিই.বেঁচেই যাচ্ছি, মরবার নামটিও নেই। বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।

অবাক হবার কথাই। এমনকি প্রেমেনও অবাক হয়েছিল এক সময়…সেই কালেই। অনেককাল ধরে আমাকে একরকমটি দেখে এবং কোনো বৈলক্ষণ্য না দেখে সে একবার বলেছিল আমায়–তুমি বাবা জীউ!

বাবাজীউ? বাবাজীউ মানে তো জামাই! আমি বলেছি-কারো বাবাজীউ কি হতে পারলাম ভাই আর?

আহা, সে বাবাজীউ না গো। সেই জীউ! জীউদের বাবা-সেই ওয়ান্ডারিং জীউ অনন্তকাল ধরে সে নাকি পৃথিবী জুড়ে…পায়চারি করছে, করেই চলেছে-তুমিই সেই মহেঞ্জোদারোর সময়ে তুমি ছিলে, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের আমলেও–সেই সিপাহী বিদ্রোহে সময়। আবার এখন আমাদের সামনেও তুমি রয়েছে। আমরা মরে যাব, আমাদের নাতি-নাতনিরাও–সবাই মরে ভূত হবে। তুমি কিন্তু বাবা টিকে থাকবে ঠিক চিরকাল এইরকমটিই।

আমার নিত্য বর্তমান দশায় সে বিস্ময় বা বিরক্তিকী প্রকাশ করেছিল জানি না।

সেই কথাগুলোও সেই সঙ্গে মনে পড়ে আমার।

আজ ঘুম থেকে উঠে কী দেখলাম জানো? অন্য কথা এনে গিরিজা আমার ভাবনা মোড় ঘোরায়– আমার সেলের মধ্যে কী দেখেছি জানো?

আমিও দেখেছি–আমার সেলেও রয়েছে। প্রাতঃকৃত্যর নিমিত্ত সুরক্ষিত সেই চুপড়ির কথা বলছে তো?

ধুত্তোর চুপড়ি। দেয়ালের গায়ে কবিতার ছত্র লেখা রয়েছে দেখলাম। রক্তাক্ষরে লিখিত।

আমার দেয়ালেও লেখা আছে দেখেছি। ওইসব সেলে আগে বিপ্লবী কয়েদীরা সব থেকেছিল না? তাদের কর্ম। তাদের মনের কথা ছত্রাকারে লিখে গেছে তারাই।

সরঞ্জাম তারা পেল কোথায় আমি ভাবছি। পেনসিল কি কলম কিছু তো নিয়ে আসতে দেয় না ভেতরে।

নিজের আঙুল দিয়ে লিখেছে হে! ছুরি দিয়ে আঙুল ঠেছে …

ছুরিই বা পাবে কোথায়! ছুরি কি আনতে দেয় এখানে?

 ছুরি তো দাঁতেই রয়েছে। দাঁতে আঙুল কেটেছে।

ওববাবা! শুনেই সে আঁতকায়।

তুমি আমি তা পারব না। তোমার আমার কাছেই বাবা। কিন্তু তাদের কাছে কিছুই না –নিজের আঙুল কাটা তো তুচ্ছ-যারা নাকি ফাঁসিকাঠে হাসিমুখে নিজেদের প্রাণবলি দিতে যাচ্ছে…

শুনে গিরিজা গুম! অনেকক্ষণ আর তার কোনো গুমোর দেখা গেল না। তার পরে গুমরানি শুনলাম সেই আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে।

পাবলিক প্রসিকিউটর তারক সাধুর অভিযোগক্রমে আমাদের নামে চার্জ গঠিত হলে সে বললে, আমাদের বিরুদ্ধে সিডিশনের চার্জ এনেছে জানো? একশো চবিবশ না কতো ধারায়।

পাঠশালার ধারাপাতের মতই আইনের ধারা-জ্ঞান আমার। তার মানে?

তার মানে, ঐ ধারার খপরে পড়ে ধূমকেতুর জন্য কাজীদার দুবছর হয়ে গেছে না?…

কাজীর দুবছরের জেল হয়েছে জানি, কিন্তু ধারার কোনো খবর রাখিনে…কোন ধারায়, কিসে কী হয়, কে তার ধার ধারে।

অমরেশ কাঞ্জিলালের হয়েছে পাক্কা তিন বছর-আমলাতন্ত্রের ভুড়ি ফাঁসাইয়া দাও, শুধু এই একটি লাইন লেখার জন্যই।

তাই নাকি? তা, সিডিশন যখন রাজদ্রোহই, তখন তার জন্য ওরা ফাঁসিও দিতে পারে ইচ্ছে করলে।

তারপরে কাজী আর কাঞ্জিলালের ভুড়ি ফাঁসানো মামলা বাদেও লোকমান্য তিলকের হয়েছিল ছ বছর এই সিডিশনের জন্যই, বলে সে আরো ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি আর উদাহরণমালার সামনে দাঁড়াতে উৎসাহবোধ করি না-ধরো ভাই, আমাদেরও যদি তিন বছর হয়ে যায় তাহলে?

ভাবছি তাই।

তাহলে আমি আর জেল থেকে বেরুতে পারব না সত্যি বলছি। এই হাড় কখানা জেলেই রেখে যেতে হবে আমাকে। দশ দিনের জেলেই একবার যা দশা হয়েছিল না আমার, সেই খিদিরপুর ডকে… তবে আমার মনে হয় তা বোধহয় হবে না এবার।

কী করে বুঝলে?

বোঝা যায়। আঁচ পাওয়া যায় একআধটু। তবে না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই। আইনের আচরণ না দেখা পর্যন্ত কিছু বলা যায় না–সে কথাও ঠিক।

এমন সময় জজসাহেব জিজ্ঞেস করলেন আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে তোমরা কোনো উকীল দেবে না? উকীল দিতে চাও তোমরা?

গিরিজা তার কী যে জবাব দেয় মনে নেই আমার, আমি কিন্তু সাফ জানাই-কোথায় পাব সার উকীল? উকীল লাগাতে তো টাকা লাগে। টাকা কোথায় আমাদের?

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে একটু কথা কয়ে তারক সাধু মশাই তখন আমাদের শুধালেন– তোমাদের আত্মীয়স্বজনদের খবর দিতে পারো। তাঁরা এসে তার ব্যবস্থা করবেন। এক হপ্তা, দু-হপ্তা, কি তিন হপ্তার সময় নাও তোমরা–তৈরি হবার জন্য, বুঝলে?

এখানে কেউ চেনাজানা নেই আমাদের। আত্মীয়স্বজন কেউ না।

সামনে বসে থাকা অ্যাডভোকেটের সারির থেকে একজন তখন দাঁড়িয়ে উঠে জানালেন, তিনিই আমাদের ডিফেন্ড করবেন স্বেচ্ছায়।

মিস্টার পি গাঙ্গুলি, অ্যাডভোকেট, উইল ডিফেন্ড দেম, ইওর অনার। প্রভাত গাঙ্গুলি মশাই তোমাদের পক্ষ সমর্থন করবেন, বুঝেছ? স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রাজী হয়েছেন; তোমাদের কোনো ফী দিতে হবে না ওঁকে।

আমার কেমন চেনা চেনা ঠেকল ভদ্রলোককে। ভারতীর আসরে ওঁকে দেখেছিলাম যেন একবার। ভেবেছিলাম কোনো লেখক হবেন, কিংবা সম্পাদকগোষ্ঠীরই কেউ। এখন দেখা যাচ্ছে উনি উকীলও বটেন।

পরে জেনেছিলাম, সুরেশদা, প্রফুল্লদা, মাখন সেন মশাইরা ওঁকে লাগিয়েছিলেন আমাদের সমর্থনে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল প্রভাতদার।

অবশ্যি তাঁদের সঙ্গে সেই এককালের যোগাযোগ ছিল আমারও

সেই যখন কিনা আমি আনন্দবাজারের হকারি করতাম। কিন্তু সে সম্পর্ক ছিল একেবারে তলার দিকের-ওপর ওপর।

আর, প্রভাতদা ছিলেন একেবারে ওপর তলার–ওঁদের ভেতরেরই একজন। এ খবরটা আমি জেনেছিলাম পরেই।

আমাদের মন রাজদ্রোহঘটিত সেকালের অনেক মামলায় এভাবে আসামীর রক্ষণে অকৃপণ উদারতায় এগিয়ে এসেছেন আনন্দবাজার। অলক্ষ্যে থেকে তাদের পক্ষ সমর্থন করেছেন ঐ পত্রিকাগোষ্ঠী, এ খবর জেনেছিলাম আমি আরো পরে।

ঐ প্রভাতদার মুখেই জানা আমার। তাঁর সঙ্গে আরো ঘনিষ্ট হবার পর।

.

৬৫.

 আসলে আমাদের মামলাটা তেমন সাদাসিধে ছিল না। কিন্তু তারকনাথ সাধুর মতন ধুরন্ধর সরকারী উকীলও তার বিশেষ ঠাহর পাননি। সিডিশনের অভিযোগে আমাদের সোপর করেছিলেন, কিন্তু রাজদ্রোহের কেস এটা ছিল না আদপেই।

পত্রিকায় প্রকাশিত যে কবিতাটার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেটা মূলত রবীন্দ্রনাথের বহুবিখ্যাত এক কবিতার প্যারডি। তাঁর উর্বশী কবিতাটার ব্যঙ্গানুকৃতিতে ভূর্বশী।

আট-দশ স্ট্যানজা রচনার মাত্র গোড়ার দু লাইনই মনে আছে আমার–

নহ পিতা, নহ ভাতা, নহ বন্ধু, নহ প্রতিবাসী
হে ভূপতি চৌরঙ্গী বিলাসী!

তার পরের বাকীটা কেবল আমার মন থেকেই নয়–ত্রিভুবন থেকেই হারিয়ে গেছে। যুগান্তরের কোনো কপিই আমার কাছে নেই, কারো কাছে কোথাও আছে কিনা তাও জানি না।

 কিন্তু কবিতাটা আদৌ ইংরাজরাজের বিরুদ্ধে নয়। ছিল সেকালের জমিদার আর অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধেই। দেড় শত বর্ষ আগে উঠেছিল ক্ষুব্ধ বাংলাতে/ ডান হাতে তেলভাভ, মসিপত্র নিয়ে বাম হাতে… সময় মাফিক ধরতে গেলে, ইংরেজ আর জমিদারগোষ্ঠীর অভ্যুদয় প্রায় সমকালে হয়ে থাকলেও ইংরেজ কাউকে এখানে তেল দিতে আসেননি, এসেছিলেন এখানকার তৈলনিষ্কাশনেই। আর, ই চৌরঙ্গীবিলাস! সাহেব সুবোদের সঙ্গে আমাদের জমিদাররাও সেখানে গা-ঘেঁষাঘেষি বাস করলেও পরস্পর একটু সুদূরপরাহত ছিলেন নাকি?

কাজেই, কবিতাটা প্রায় তরোয়ালের ন্যায় ধারালো হলেও ইংরেজের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। সেই দুঃসাধ্য চেষ্টার অপপ্রয়াসে তারকাবাবুকে বেগ পেতে হচ্ছিল। উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো নেহাত সহজ কান্ড নয় তো। তৎকালীন রাষ্ট্রবিপ্লবের তপ্ত আবহাওয়ায় সমাজবিপ্লবের ধারণাও কেউ করতে পারেনি। কানপুরের বোলশেভিক কনস্পিরেসির কেস তখনও হয়েছ কিনা মনে পড়ে না ঠিক, রাশিয়ার কালান্তরকারী কার্যকলাপের সমূহ খবর তখনো এদেশে এসে পৌঁছয়নি বোধ হয়, মজফফর আহমদ প্রমুখ অগ্রপথিক কয়েকজনের মগজেই খেলা করছিল আইডিয়াটা, কাগজে-কলমে রূপ ধরে প্রকাশ পায়নি তখনো, সেইকালে শ্রেণীবিদ্বেষের এই প্রথম পদক্ষেপ আমরাই যে নিজেদের অগোচরে হঠকারিতায় করে বসেছি, নিজেরাই তা টের পাইনি। তারকনাথের ন্যায় সাধু ব্যক্তি তা আর কী করে সন্দেহ করবেন!

জোরসে তিনি রাজদ্রোহের ধারায় চালিয়ে গেছেন তাঁর মামলা। 

বণিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজদন্ড হয়ে–সেই রাজদন্তের স্বাদ যাতে কিছুটা অন্তত আমরা পাই সেহেতু উনি বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন বোধ হয়।

প্রভাতদা অবশ্যি বলেছিলেন যে এ-মামলা দাঁড়াবে না। দাঁড়াবার নয়।

কিন্তু তাঁর আশ্বাসবাক্যে আমরা তেমন ভরসা পাইনি। তার আগেই বলতে কি, আমরা একেবারে বসে পড়েছিলাম-ওয়ে পড়ার অপেক্ষায়। গিরিজা বলেছিল, তা কি কখনো হতে পারে? যেখানে আমলাতন্ত্রের ভুড়ি ফাঁসাইয়া দাও! নৈর্ব্যক্তিক ঐ এক লাইনের জন্যেই রাজদ্রোহের দরুশ অমরেশ কাঞ্জিলালের তিন বছর হয়ে যায়, সেখানে ছন্দোবদ্ধ এতগুলি মিঠেকড়া লাইনের দারুণ ভূর্বশীকরণের দায় থেকে আমাদের অব্যাহতি কোথায়।

তাই প্রভাতদার কথায় ততটা আমরা আশ্বস্ত হতে পারিনি।

তবু তাহলেও মনের কোণে কোথাও একটুখানি ভরসা যেন ছিল আমার। সেই ভরসাটার ভাগ আমি দিতে গেছলাম গিরিজাকে…..।

দুঃখ করছিল গিরিজা–সে ভেবেছিল যে, কলকাতার কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে বি. এ.পাশ করলে ল পড়বে, বিলেত যাবে, আই-সি-এস হবে–কতো কী! কিছুই আর হল না। তিন বছরের ধাক্কায় তার তাবৎ কেরীয়ার পত্রপাঠ খতম।

আমি তাকে বলতে গেছি-অত ভাবছ কেন হে! শেষ পর্যন্ত দ্যাখো না কী হয়। সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে দেখো তুমি। আমি যা প্যাঁচ একখানা কষেছি…কিছু না হয়ে যায় না, বুঝলে?

কিসের প্যাঁচ?

আমার সেই মারপ্যাঁচ। মার সেই প্যাঁচেই এ যাত্রা আমরা বেঁচে যাব নির্ঘাৎ!

 তোমার সেই ভুরুর মাঝখানে মন এনে মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করার? তোমার মার শেখানো সেই প্যাঁচটা তো? জানি। আগেও বলেছো তুমি আমাকে। ওতে কিছু হয় না ভাই।

ওই করে কতো বিপদ-আপদ থেকে বেঁচে গেলুম আমি কতোবার। আর তুমি বলছো হয় না। তারপরেও বলতে গেছি আমি।

থামো। তোমার ওই ভিরকুটি রাখো। সে কুটি করে : এ বড়ো কঠিন ঠাই। গুরুশিষ্যে দেখা নাই। ইংরেজের আদালত। কোনো মারপ্যাঁচ এখানে খাটে না।

বলে সে উড়িয়ে দিয়েছে আমায় এক কথায়।

মনে পড়ে, উপেনদার ঝাঁপটাতেও আমি উড়ে গেছলাম একবার। তাঁর কাছেও এই প্যাঁচ খাটাতে গিয়েছিলাম। কার যেন কী অসুখ করেছিল, বলতে গেছি-ও তো সহজেই সারানো যায় উপেনদা! কপালের এইখানটায় মন নিয়ে এসে…মা দুর্গাকে বললেই তিনি সারিয়ে দেন তক্ষুনি…

চালাকি পেয়েছিস? আমার কাছে বুজরুকি ঝাড়তে এসেছিস? বললেই মা দুর্গা সারিয়ে দেয়? বটে?

হ্যাঁ, উপেনদা। এই করে আমার অসুখ-বিসুখ সব তো সারাই আমি…আমার তেমন অসুখ হয় না তাই তো, হলেও তেমনটা ভোগায় না, অরেই সেরে যায় দুদিনে। কততবার আমার হলোতে পরীক্ষা করা।

আরে, তোর মা দুর্গা যদি এতই ওস্তাদ–এমন ব্যারাম সারাতে পারে তো নিজের ছেলের ওই ওড়টা সারাচ্ছে না কেন বল তো? ঐ গুডটা সারিয়ে দিলেই আর ঐ ভুড়িটাও–তাহলেই গণেশের চেহারাটাও কার্তিকের মনে হয়ে যায় না?

উপেনদার জবাবে আমি ধাক্কা খাই। বেশ ঘাবড়েই যাই বলতে কি!

যাঁকে নাকি স্বয়ং শ্রীঅরবিন্দ তাঁর তথাকথিত মাতৃসুলভ অতিমানসিক আস্তাবলে বাঁধতে পারেননি, কোনো মহাপুরুষ বা মহানারী-র দিবিজয়ী অশ্বমেধযজ্ঞের উপযুক্ত বলে নিজের প্রতি তার আস্থা ছিল না বলেই বোধ করি-খোদ সেই পীরের কাছে আমি গেছি মামদোবাজি করতে? তাঁর দর্গায় এক কোপেই আমার দুর্গার কোরবানি হয়ে গেল।

প্রভাতদা বলেছিলেন, ভয় খেয়ে না তোমরা। আমার এক ব্যারিস্টার বন্ধুর সঙ্গেও এ নিয়ে কনসাল্ট করেছি–কিছুতেই এই কেস টিকতে পারে না। পিওর ক্লাস-হেটরেডের কেসকে সিডিলানের ধারায় এনে খাড়া করা হয়েছে–এ মামলা কি দাঁড়াতে পারে?

সিডিশান তে জানি। আমি বলি-কিন্তু ওই ক্লাস-হেটরেডটা কী দাদা?

ক্লাস-হেটরেড কাকে বলে জানো না?

জানব না কেন? আমার তো দারুণ ক্লাস-হেটরেড-সেই ছোটবেলা থেকেই। কিছুতেই ক্লাসে গিয়ে বসতে ইচ্ছা করে না। প্রায়ই ইস্কুল কামাই করতাম।

সে ক্লাস-হেটরেড নয়। আমার কথায় তিনি হাসেন। কিন্তু ঐ ক্লাস-হেটরেড যে কী বস্তু, তাও তিনি বিশদ করে দেন না।

তোমাদের বরাত ভালো যে, সেই নিদারুণ ম্যাজিস্ট্রেট সুইহো সাহেব নেই এখন। ইনি আহেল-বিলিতি সাহেব, সদ্য আই-সি-এস হয়ে আসা, এখনো ফ্রেশ, আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচে পড়ে জুডিশিয়াল মাইন্ড খোয়াননি এখনো-তারক সাধু যা বোঝাবেন তাই যে মুখটি বুজে বুঝবেন, সে পাত্র নন। এমন কি এঁর কাছে তোমরা বেকসুর খালাসও পেয়ে যেতে পারো।

ভরসা হয় না, স্যার, বলতে যায় গিরিজা। কাজীদার দু বছর আর অমরেশদার হয়েছে তিন তিন বচ্ছর…তারপরও কি ভরসা হয়।

সুইহো সাহেবের হাতে সেই হচ্ছে শেষ কেসমিস্টার কাঞ্জিলালের। তারপরেই তিনি রিটায়ার করেছেন। আর সেই রকসর্গ এসেছেন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে। তাঁর প্রথম পলিটিক্যাল কেস তোমরা-দেখা যাক না কি হয়।

কী হবে জানাই আছে! গিরিজার কানাকানি আমাকে–জীবনকে সে বেশি মিষ্ট মনে করে না কখনই। এক নম্বরের পেসিমিস্ট।

শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর এগিয়ে এল শেষটায়। বিচারের অভিম লগ্ন এসে গেল অবশেষে।

 পাবলিক প্রসিকিউটর তারকনাথ সাধু অনাথ আমাদের বিপক্ষে সওয়াল করতে দাঁড়ালেন।

 কার সৌজন্যে জানি না, হাইকোর্টের এক নামজাদা ব্যারিস্টার লড়তে এসেছিলেন আমাদের জন্যে। প্রভাতদাই নিয়ে এসেছিলেন ওই বড় ব্যারিস্টারকে শেষদিনটায়।

কার জন্যে হোলো এটা জানো?

মিস্টার গাঙ্গুলির কেরামতি–আবার কার?

তাঁর তো বটেই, কিন্তু তিনি তো নিমিত্ত মাত্র। তা ছাড়াও আমি বলতে যাই : সেই মারপ্যাঁচের কথাটা তোমায় বলেছিলাম না? তুমি তো মানইে চাও না। সেই মার জন্যেই হয়েছে।

তোমার মার জন্যে হয়েছে? মা তো তোমার দেশেই এখন গো। এখানকার এ-সবের কোনো খবরই তিনি রাখেন না।

মানে, আমার মা নয়। আমার মা, তোমার মা, সবার মা সেই মা-।

থামো থামো। আমার উচ্চারণের আগেই সে সমুচ্চারিত–সেই মা দুর্গাকে মুখের বাইরে দূরীভূত করতে দেয়নি দাঁড়াও, খবর নিচ্ছি আমি। অত বড়ো ব্যারিস্টারকে লাগানো চাট্টিখানি কথা না। কার কুদরৎ জানা যাক। হাজার টাকার ধাক্কা–একদিনেই। তা জানো?

প্রভাতদার কাছ থেকে জেনে এসে বললে সে-তোমার প্রফুদা, সুরেশদাদের কাভ। আনন্দবাজারের কর্তারাই ওনাকে আমাদের পক্ষ সমর্থনের জন্য লাগিয়েছেন।

ওই হোলো। এক কথাই। মা কি নিজের হাতে এসে সব করে দেবেন নাকি? অর দশ হাত দশ দিকে বিস্তৃত নয়? দশজনের মধ্যে ছড়ানো না? তারই একটা হাত ওই আনন্দবাজার। ওঁদের দিয়েই উনি এক হাত খেলেছেন এখানে।

হয়েছে। থামো এবার। সরকারী উকীল কী বলছেন শোনা যাক

তারক সাধু মশাই দাঁড়িয়েছেন সরকার পক্ষের সওয়ালে। আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব ছিল না, যথাসাধ্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে একে একে মজুদ করেছিলেন সেগুলো। ই কবিতাটার কোথায় কোথায় এম রাজদ্রোহ ঘটে গেছে, বেছে বেছে দেখাচ্ছিলেন পরম্পরায়, কিন্তু তাঁর অমন অধ্যবসায়ে মনেপ্রাণে যেন সায় দিতে পারছিলেন না সাহেব। বারংবার ঘাড় নড়ছিল তাঁর-বাট আফটার অল ইট ইজ এ প্যারডিনট টু বি টেক সিরিয়সলি। এ থিং টু লাফ অ্যাওয়ে! ইজ ইট?

আমাদের তরফের ব্যারিস্টার আর. রায় মুখ টিপে হাসছিলেন হাকিমের কথায়।

কিন্তু তারক সাধু সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। নানান আইন-কানুন, নথিপত্রে, ধারা উপরা এনে খাড়া করছিলেন ধারাবাহিক। কিন্তু কিছুতেই কিছু দাঁড়াচ্ছিল না তার। নাট-বোল্টর কোথায় যেন কী গরমিল ছিল, গড়বড় হয় যাচ্ছিল সব।

স্কোয়ার লেগে গোল বল্ট লাগাবার মতই গোলমাল বাঁধছিল কেবল।

আসলে তত আমাদের কেসটা রাজদ্রোহের ছিল না ঠিক। সমাজবিপ্লব বা শ্রেণী সংঘর্ষের বলা যায় হয়ত। আমরা যে দেশের কুকুর ধরে আদর করেছি, বিদেশের ঠাকুরদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ না করে–এরকম একটা ফ্যাশানবিরুদ্ধ অসময়োচিত নীতিবিগর্হিত কাজ আমাদের বয়সের কেউ তৎকালে করতে পারে, আমাদের কাছ থেকে এতটা অসাধুতা স্বভাবতই সাধুমশাই প্রত্যাশা করতে পারেননি-ধারণাও ছিল না তাঁর। তাঁর কোনো দোষ ছিল না। সওয়ালেরও কোনো কসুর ছিল না, কিন্তু অমন চৌকস লোক হয়েও নাট-বোল্টর গলতিকে যথাযথ খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না কেমন। আদালতের কাঠগড়ায় এর আগে অবহেলায় আমার মন শত শত আসামীর মুভপাতের পরেও এবারে যেন তাঁর আটকে গেল কোথায়! হাঁড়িকাঠে আমাদের মাথাটাকে যুতসই করে বাগাইে পারলেন না কিছুতেই। কোনমতেই আমাদের কবন্ধ করা গেল না।

 দুর্ভাবনায় তাকে ঘর্মাক্ত হতে দেখলাম।

ফৌজদারির নাটমঞ্চে এতকালের এত নাটের গুরু হয়েও নাট-বোর খেলাপিতে তাঁর নাট্যলীলা জমল না তেমন।

আমাদের তরফে রোলাভ রোডে রোহিণী রায়, বার-অ্যালর হলকর্ষণ শুরু হোলো অরপর। সাধু মশায়ের এত করে চষা জমির বীজ অঙ্কুরিত হবার আগেই কেটে ফসল ঘরে তোলা তো পরের কথা) তছনছ হয়ে গেল সব।

তবে অতখানি সরকারী আরজির পর বেকসুর খালাস তো দেওয়া যায় না, তাই অপ্রমাণিত উক্ত সিডিশনের দায়ে একমাস করে জেল হল আমাদের।

জেল হাজতের প্রায় হপ্তা দুয়েক ধরে মোটমাট দেড় মাসের কারাবাস দন্ড! এ ক্লাসে তার ওপরে! এমন কঠোর কিছু সাজা নয়। একটু মজাই বলা যায় বরং।

যেমন যুগান্তকারী আমাদের মামলাটা, তেমনি যুগান্তকর জাজমেন্ট আর রাজ-দন্ড দেওয়া নয়া হকিম রকস্বর্গ সাহেবের।

ভারত খন্ডে সিডিশনের কেসে অভূতপূর্বই এটা। লোকমান্য তিলকের সুদীর্ঘ সেই ছ বছর মেয়াদের পর বালকগণ্য আমাদের বেলায় এই ছ হপ্তার ঠেলায় রাজদ্রোহ মামলার যেন নয়ছয় হয়ে গেল শেষটায়।

 বাবা তারকনাথের পরোক্ষ কৃপাতেই সম্ভব হল যদিও, কিন্তু তাঁকে বেশ অপ্রসন্ন দেখা গেল যেন। আমরা নাচার! বিচারের গলদ, আমরা কী করব তার?

.

৬৬.

সরকারী মামলার বয়ানে বা বিচারের কোনখানো কী গলদ ছিল জানিনে, গলদেশ থেকে ভারী পাথরটা নেমে গেল আমাদের। মহাত্মা রক্ষোবর্গ বা সাধু তারকনাথ, যার দয়াতেই হোক, বেঁচে গেলাম এ যাত্রায়।

কাঠগড়ার থেকে নেমে আদালতের হাজতঘরে গিয়ে হাঁফ ছাড়ছি, একগাদা খাবার নিয়ে প্রভাতদা এসে হাজির।

প্রভাতদা, কী বলে যে আপনাকে… আমি বলতে যাই।

 কিচ্ছু বলতে হবে না। তিনি বলেন–এগুলো তোমরা খাও এখন। জেল থেকে ফিরে আমার বাড়িতে এসো, নেমতন্ন রইলো তোমাদের। তারপরে আমি তোমাদের নিয়ে মিস্টার রায়ের ওখানে যাব।

আপনাকে তো বটেই, তাঁকেও আমাদের ধন্যবাদ জানাবেন। গিরিজা বলে- অজস্র অজস্র ধন্যবাদ।

আমি যেখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাই না, গিরিজা সেখানে বেশ সড়। আদবে আচরণে টনটনে।

এর মধ্যেই আমি একখানা কাগজে ফসফস করে কয়েক লাইন ছড়িয়েছি-সেই ছত্রাকার প্রভাতদার হাতে গুঁজে দিলাম–এক পদাঘাত ওদের দুজনের প্রতিই।

সেই ক লাইন এখনো মনে রয়েছে আমার।–

কী আছে কবির/সে কী দিতে পারে?/একাকী জীবনে মরণে। আছে শুধু প্রাণ/ দেয় সে যে তাইকারো হাতে, কারো প্রণে।/যেথায় হারায়যত কথা গীতি/যেথা জেগে থাকে ভালোবাসা প্রীতি/সেথায় রহিবে তোমাদের স্মৃতি/অমর মরম-স্মরণে।

খাবার-দাবার সাবাড় করার পর গিরিজাকে বললাম- দেখলে তো মা দুর্গার মহিমা। কী বলেছিলাম তোমায়?

মহিমা না ছাই! সুইনহো থাকলে দেখিয়ে দিত এতক্ষণ। পুরো তিন বছর ঘরে ঘানি টানতে হোত-দেখতে।

সুইনহো থাকবে কেন? থাকতে পারে কখনো? আমি বলি-এই সময়ে আমরা সোপর হব বলেই না মা দুর্গা আগের থেকে ওই সুইনহোকে সরিয়ে দিয়ে আনকোরা এই সাহেবকে এনে বসিয়েছে এখেনে? পরে যখন সেটা হবার, আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ধরা না পড়লেও, তিনি আগের থেকেই তার সব ব্যবস্থা করে রাখেন, তা জানো?

তোমায় বলেছে।

বলেছেই তো। আমার মা-ই বলেছে। বলেছে যে, তুই যদি মা দুর্গাকে ডাকিস না, জীবনে কখনো কোনো দুঃখকষ্ট পাবিনে। কদাচ তোকে বিপদ-আপদে পড়তে হবে না। কোথাও দরজায় ধাক্কা মেরে ঢুকতে হবে না তোকে। তুই যাবার আগেই দেখবি দরজা খুলে গেছে, তার পথ সব সময়ই ভোলা পাবি সামনে…

প্রমাণ?

 প্রমাণ হাতে হাতে। জন্মাতে না জন্মাতেই প্রমাণ পেয়েছি।

মানে?

মানে চাঁচল তো একটা অজ পাড়াগই ছিল সেকালে। পঞ্চাশ কোশের ভেতর কোনো ইস্কুল-ফিস্কুল ছিল না। গেঁয়ো পন্ডিতের পাঠশালায় গিয়ে পড়েতে হতো সবাইকে। মা বলেছিল আমাকে, জানিস, তোরা আসবি বলে তোদের লেখাপড়া শেখার জন্যেই মা-দুর্গা রাজা ঠাকুরপোকে দিয়ে আমার মাস-শাশুড়ির নামে এই হাই ইস্কুল স্থাপিত করলেন চাঁচলে। আমি আসার আগেই আমার জন্যে ইস্কুল। আমিও এলাম আর…

তুমিও হলে আর ইস্কুলও হলো।

ইস্কুল হলো আর আমিও হলাম–এভাবেও বলা যায় কথাটা। তাতেও অর্থের কোন ব্যত্যয় হয় না।…।

আর তুমি একদিন এসে ফিরি করবে বলেই ওই আনন্দবাজার পত্রিকাটা হয়েছিল-তাই তুমি বলতে চাও?

না, তা আমি বলতে চাই না। সেটা আমার জন্যেও যেমন, তেমনি আরো অনেকের জন্যে-অনেক কিছুর জন্যেই। আকাশ ব্যেপে যখন বৃষ্টি ঝেপে আসে, তখন একজনের জন্যে আসে না-একজনের ক্ষেতেই পড়ে না কেবল, সবার মাঠ ভরে যায়, সবারই ফসল ফলায়। সেই ফসলে সবার ঘর ভরে, সবার সঙ্গে আমিও পাই, আমিও খাই। একসঙ্গে বাঁচি সবাই।

বুঝেছি। তার মুখে অপ্রত্যয়ের হাসি।

মা দুর্গার অর্চনামন্ত্রের গোড়াতেই রয়েছে না? সর্বমাঙ্গল্য-মঙ্গলে শিবে সর্বার্থসাধিকে…তার মানে কী? সবার মঙ্গলের সঙ্গে যেমঙ্গল সেই মঙ্গল তিনি করেন, সকলের সঙ্গে প্রত্যেকের, প্রত্যেকের সঙ্গে সবার-যুগপৎ সব প্রয়োজন তিনি মেটান, একসঙ্গে সকলের সার্থকতা-সাধন হচ্ছে তার! যেমন চাঁচলের ইস্কুলটা কেবল আমার জন্যই হয়নি, তোমার জন্যও হয়েছিল, আরো আরো সব ছেলের পড়াশুনা করে মানুষ হবার জন্যই। বলে পুনরায় আমার অনুযোগ : তিনি আমাদের জন্য চতুর্বর্গ নিয়ে বসে আছেন, আমাদের রক্ষা করতে অকুস্থলে এমন অকুসময়ে ওই রক্ষোবর্গকে এই প্রেসিডেন্ট ম্যাজিস্ট্রেট করে পাঠানো কি তাঁর এই কঠিন?

তোমার মা দুর্গার কোনো কেরামতি নয় হে, একে বলে কাকতালীয়।

 কী তালীয়? কথাটার তাল আমি ধরতে পারি না।

 মানে, কাকও এসে তালগাছে বসল আর তালটাও পড়ে গেল তক্ষুনি। মনে হবে যেন কাকই ফেলল তালটাকে। কিন্তু তা তো না, পরিপক্ক হয়ে সেটা পড়বার অপেক্ষাতেই ছিল, আর যেই না কাকটা এসে বসেছে…

ও। সেই কাকতালীয়? কিন্তু ওই কাকতালীয় কবার হতে পারে কারো? কতবার অমন অঘটন ঘটবার? বার বারই কি ঐ কাক এসে তাল সামলায়? বলতে গিয়ে আমি মনের মধ্যে তলিয়ে যাই, খতিয়ে দেখি, আমার এই বেতালা জীবনের আগাগোড়াই তো

ওই কাকতালীয় তালিকা। তাছাড়া কী আর? . মার শেখানো তোমার ওই প্যাঁচে সব সময় কাজ হয় না ভাই। একেকবার কোনো রকমে খেটে যায় হয়তো, কিন্তু সর্বদা খাটে না। খাটবার নয়। তাহলে আর ভাবনা ছিল না। ঐ করেই তরে যেত সবাই। জীবনে স্ট্রাগল বলে কিছু আর থাকত না তাহলে।

কিন্তু আমার জীবনে স্ট্রাগল কোথায়? আমি ভাবি। জীবনের সব ঘোরপ্যাঁচ তেমন ঘোরালো হয়ে আসার আগেই মার শেখানো ঐ প্যাঁচ–সেই মারপ্যাঁচের জোরেই কাটিয়ে এসেছি তো! এই প্যাঁচওয়ার্ক–জোড়াতালির জীবন, জীবনই নয় হয়ত বা, কোনো ধকল না পুইয়ে কেবল ঐ বুড়ি ছুঁয়ে বাঁচার মন বাঁচাটাই হয়ত হয়নি আমার। তাবৎ প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে উত্তরপত্র আমার যথাযথ হয়নি নিশ্চয়, কিন্তু তাহলেও একথা তো ঠিক, কানাকড়ির সম্বল না নিয়ে ফুটো নৌকোয় চড়ে সংসার পারাবার পার হয়ে এলাম শুধু ওর জোরেই। উত্তর না মিললেও উত্তরণে এসে মিলেছি তো ঠিকই।

জেলখানায় ফিরতেই জেলার সাহেব ডেকে জানালেন-কাল সকালে তোমাদের এখান থেকে ট্রান্সফার করা হবে। বহরমপুর জেলে যাবে তোমরা, বুঝেছ? তৈরি থেকো।

বহরমপুর জেল? সেটা তো শুনেছি একটা পাগলা গারদ। সেখানে কেন? আমি শুধাই।

এখন আর পাগলা গারদ নয়। রাজবন্দীদের জায়গা দিতে সেখান থেকে পাগলাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট রাজনীতিক বন্দীরাই সেখানে থাকেন এখন। যেমন কবি নজরুল ইসলাম

জেলার ভদ্রলোক শ্রদ্ধাভরে নজরুলের নামোল্লেখ করেন। এবং জেল ব্যানার্জি।

জেল ব্যানার্জিও? শুনেই গিরিজা উল্লসিত। তিনিও সেখানে আছেন নাকি? বাঃ? বেশ তো!

জেল ব্যানার্জি আবার কে হে? গিরিজাকে আমি শুধাই-জেলের মধ্যে জেল কেন আবার?

জেল নয় হে, জে. এল.। অধ্যাপক জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনননি? আশ্চর্য।

শুনব না কেন? বক্তৃতাও শুনেছি তাঁর–কতোবার! কী জোর যে বলেন উনি?

হ্যাঁ, ইংরেজি বাংলায় সমান। গিরিজার সায় পাই–যেন ঝড়ের মতই বলে যান–তাই না? বাসিদ্ধ পুরুষ ঠিক না হলেও সিদ্ধবাক্ বাগ্মী তাঁকে বলা যায় অবশ্যই। রাষ্ট্রগুরুর বাগ্মিতা শোনার সৌভাগ্য হয়নি আমার। কিন্তু তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া জে, এল, বাঁড়ুজ্যের বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল কবার। শুনেছিলাম, পরে রাউণ্ড টেবল কনফারেন্সের কালে যখন তিনি বিলেতে যান, পার্লামেন্টে ভাষণ দেবার জন্যে আমন্ত্রিত হয়ে এমন একখানা বক্তৃতা ঝাড়েন যে, তাক লেগে যায় সবাইকার। তাদের ভাষায় তাদেরকেই টেক্কা মেরে এমনভাবে ঝড়ের দাপটের মত জোরালো কেউ বলতে পারে ধারণাই ছিল না তাদের। বাকপটু বাশ্মীশ্বর সেই জিতেন্দ্রলাল।

তোমার সঙ্গে আলাপ আছে নাকি ওর।

নিশ্চয়। ওর ইংরেজিতে মুগ্ধ হয়ে আমি গায়ে পড়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছি গিয়ে। ইচ্ছে ছিল উনি যে কলেজে পড়ান সেইখানে ভর্তি হবার। বহরমপুরে গেলে তাঁর সঙ্গে ধরি জমিয়ে তার পথটা এবার খোলসা করা যাবে।

তাহলে জেলে এসেও তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি ভাই, লাভই হয়েছে বরং। পথে এসে গেল কেমন! জেলে এলে বলেই না তোমার এই পথ খুঁজে পেলে! তোমার বেলাতেও কেমন কাকতালীয় হয়ে গেল দ্যাখো। কাকস্য পরিবেদনার কথা বলছিলে না?

পরদিন সকালে লপসিখানা খেয়েই জেলখানার থেকে বেরুলাম। একশো এগারো নম্বরের এক ছ্যাকরা ঘোড়ার গাড়ি চেপে দুজন পাহারাওলার জিম্মায় বহরমপুরের উদ্দেশে শেয়ালদা রওনা হলাম আমরা। লপসির প্রাতরাশের পর সেখানে গিয়ে পড়লাম একেবারে মুর্গির কারি আর বিরিয়ানি পোলাওয়ের ওপর। এক গোরুতর পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়লাম বলতে কি!

আমাদের দেখেই কাজীর সোল্লাস অভ্যর্থনা–লে হালুয়া! দে গোরুর গা ধুইয়ে।

অতুলনীয়-অতুলনীয়।

.

৬৭.

 গোড়াতেই কাজীর কাছে ওই গোরুত্ব লাভ করে সহজেই সেখানে আমরা স্বাগত হলাম। প্রাচীন এবং নবীন প্রসিদ্ধ দেশ্বতী আর বিপ্লব-পথিকদের সঙ্গে অর্বাচীন আমরা অবলীলায় মিশে গেলাম। চিনি যেমন জলের সঙ্গে মিশে যায়, চেনাচিনির অপেক্ষা রাখে না, চিহ্ন থাকে না, অেনি অসারবৎ আমাদের নিছক জলাঞ্জলিও মিশ খেয়ে সরবতের একাত্ম হয়ে গেল।

প্রকাণ্ড একটা হলঘরে অনেকগুলো লোহার খাট পড়েছিল পাশাপাশি। তারই দুটোর ওপর জেলের আপিস থেকে পাওয়া আমাদের দুখানা করে কম্বল বিস্তৃত হল। খট্টাঙ্গের সেই কম্বলবিস্তারে সাষ্টাঙ্গে আমি সবিস্তার হতে যাচ্ছি, বাধা দিল কাজী।

আরে, এখনই শোরে কি হে?

তার মানে? খাওয়ার পরেই শোয়া–এই তো জানি। খাই আর শুই-কাজ তো এই

এখন আমাদের গান, আবৃত্তি, হৈ-হল্লা কত কী হবে…

হোক না! তার শ্রোতাও চাই তো? আমিই সেই শ্রোতা। শুয়ে শুয়ে শুনব এখন। আমি তো আর গায়ক ও আবৃত্তিকারের পার্ট নিতে পারব না ভাই!

দাঁড়াও, এদের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই আগে, এসো।

এখান থেকেই চিনিয়ে দাও না। দূরের থেকেই চিনে রাখা ভালো হত। কিছু মনে কোরো না ভাই, আমি কীরকম বেখাপ্পা। কারো সঙ্গে মিশতে পারি না সহজে। খাপ খাওয়াতে পারি না তেমনটা।

কবিগুরুর কথাগুলো মনে পড়ে যায়–কুসুম সুকুমার কপোলতলকী শোভা পায় প্রেমলাজে গো/ যাহার ঢলঢল নয়ন শতদল/তারেই আঁখিজল সাজে গো/ভালোবাসিলে ভালো যারে বাসিতে হয়/সে যেন পারে ভালবাসিতেমধুর হাসি তার/দিক সে উপহার/মাধুরী ফোটে যার হাসিতে। ঠিক তেমনি ছেলেদের বেলাতেও, মনে হয় আমার। মিষ্ট স্বভাবের মিশ্রির মন যারা, যেমন কি না কাজী, তারাই সহজে সবার সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারে। সবারই তারা আকাঙ্ক্ষীয়। হীনম্মন্যতাই হয়ত তার হেতু হবে, আমি নিজেকে ঠিক তা মনে করতে পারি না। মিশতে ভড়কাই তাই।

ঐ যে সৌম্যদর্শন যুবকটি ওধারে দেখছ না? উনি চারণকবি বিজয়লাল। বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়। চেনো নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ, নাম শোনা আছে। কবিতাও পড়েছি ওনার। আমার যুগান্তরেও এক-আধবার লিখে থাকবেন মনে হয়।

আর তোমার খাটের পাশেই যাঁর খাট। উনি হচ্ছেন বিপ্লবনায়ক শ্রীপূর্ণচন্দ্র দাস। আমাদের পূর্ণদা। ওঁকে তো জানোই।

জানি বই কি। তোমার কবিতার থেকেই জেনেছি। সেই–এসো গো ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর! লম্বাপানা কাঠখোট্টা ঐ ভদ্রলোক…উনিই!

দধীচির হাড় দিয়ে তৈরি। ইংরেজের মাথার বজ্রাঘাত।…আলাপ নেই তোমাদের? বলো কি? জানতে না ওঁকে এর আগে?

একদম না। দেখিওনি কখনো।

সে কী হে! একটা বিপ্লবী কাগজের সম্পাদক তুমি, অথচ, অনুশীলন পাটি, যুগান্তর পাটির নাম শোনোনি? আশ্চৰ্য্য! কাজী তো হতবাক।

যুগান্তরের আবার পার্টি কিসের? একজনই তো জানি যুগান্তরের–এই আমি। আমিই পাটি–এক এবং অদ্বিতীয়। আমার আবার পার্টি কোথায়?

আহা, যুগান্তর পার্টি, অনুশীলন পাটি–নামকরা সব বিপ্লবীদের দল-শ্রী অরবিন্দের গড়ে যাওয়া–জানো না? সেইসব দলের নায়ক তো এঁরাইএই পূর্ণ দাস, পুলিন দাস, যাদুগোপাল, কিরণদা, অমরদা, বিপিনদা…

বিপিনদাকে জানি। বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি তো? ফরবৈস ম্যানসনে থাকতে পরিচয় হয়েছিল। ওপর ওপর ভাসা ভাসা আলাপ-এমনিই। বিপ্লবমূলক কিছু নয়।আর ঐ যাদুগোপালবাবুকেও জানি বেশ। রাঁচিতে যখন থাকতুম আমরা, বর্ধমান গ্রাউণ্ডের পাশের হোস্টেলে, আমাদের পাশের বাংলো বাড়িতেই থাকতেন উনি, অন্তরীণ হয়ে সেখানেই ডাক্তারি করতেন। আমার মার হাঁপানির ব্যারাম, সেই সূত্রে মার চিকিৎসার ব্যাপারে আলাপ আমার। খুব বড় ডাক্তার বলবো ভাই। অদ্ভুত চিকিৎসা। মা ওঁর এক দাগ দাবাইয়েই আরাম! বিধান রায়ের চেয়ে কোনো অংশে নূন নন।

যাদুদা রাঁচিতে থাকেন, জানি। যোগাযোগ আছে আমাদের।

 এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই আমার সঙ্গে। তবে তার চেয়ে তাঁর আলমারিদের সঙ্গেই বেশি সৌহার্দ্য হয়েছিল আমার।

আলমারিদের সঙ্গে, তার মানে?

মানে, বইয়ের আলমারি গো! ডাক্তারির যতো ভারী ভারী বইয়ের। আমার খুব গরের বই পড়ার বাতিক তো, সেই ধরণের বই চাইতে গেছি, তিনি তার আলমারিগুলো দেখিয়ে দিলেন–আমার যতো বই সব ঐ। ইচ্ছে করলে নিয়ে পড়তে পারো। যথাস্থানে রেখে দিয়ে আবার। পাশের এই শেলফটাও ঘেঁটে দেখতে পারো। খানকয়েক বাংলা বই আছে এর ভেতর। তিনি বলার পর তাঁর জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে আমার শেলফুহেলফ শুরু হয়ে গেল। তাঁর ডাক্তারি বই যতো ছিল না, পড়ে পড়ে ফাঁক করলাম–বুঝি আর নাই বুঝি। ডাক্তারির এই পল্লবিত বিদ্যে আমার সেই থেকেই–সেখান থেকেই।!

শুনে কাজী হাসতে থাকে। যাদুদার সত্যিকার পরিচয় তুমি পাওনি। কী করে পাবে? ওঁরা ধরা না দিলে কি ধরা যায় ওঁদের? সাধু মহাত্মাদের মতই প্রায়। যাক্ গে, যেতে দাও। আমার অবাক লাগছে, কোনো বিপ্লবী দলের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ নেই…

দলাদলি আমি সর্বদাই ডরাই–সব সময়ে এড়িয়ে চলি তাই। দল বাঁধলে, দলে ভিড়লে নিজেকেও সেই দলে বাঁধা পড়তে হয়। দলে বাঁধা পড়ে ঐরাবতও মুক্ত হয়ে পড়ে, তা জানো? হাতী যে হাতী, সেও দল বাঁধলে কি দ-য়ে মজলো-হাড়গোড় ভাঙা দ হয়ে গেল। আমি মুক্ত বিহঙ্গের মতই থাকতে চাই।

কোনো বিপ্লবী বা বিপ্লবীদের সঙ্গে সংযোগ নেই, অথচ তোমার কাগজটা বিপ্লবের–ঐ যুগান্তর?

যুগান্তর না বলে হুজুগান্তর বলো বরং! তোমার ধূমকেতু দেখে, তোমার দেখাদেখি আরো সবাই কাগজ বার করেছে দেখে, সেই হুজুগে আমিও ঐ-আমারও ধুমধাম!

আমার সঙ্গে কোনো বিপ্লব বা বিপ্লবীর সংযোগ নেই দেখে, কেন নেই, বলে কাজী যেমন সপ্রশ্ন আর হতভম্ব হয়েছিল, সেইরকমের এক বিমূঢ় জিজ্ঞাসা ছিল বোধ হয় তখনকার সরকারেরও। সে খবর পেয়েছিলাম আমি অনেকদিন পরে মৌচাকের আসরে বসে আমার লেখক-বন্ধু পঞ্চানন ঘোষালের কাছে।

মৌচাক সম্পাদক সুধীর সরকারের জীবদ্দশায় তার ব্যক্তিত্বের টানে গুণীজ্ঞানীদের অনেকেই আসতেন সেখানে। তুষারকান্তি ঘোষ, কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়, চারু রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী,, সৌরীন্দ্রমোহন, আমাদের হেমেনদা, সবাই যেতেন–সুধীরবাবুর ন্যায় তাঁদের অনেকেই এখন ইহলোকে নেই। তুষারবাবু অবশ্যি এখনো আসেন মাঝে মাঝে, কোনো কোনো শুক্রবারে হঠাৎ তাঁকে দেখতে পাই। যেমন দেখতে পাই অচিন্ত্য, প্রেমেন, ভবানী মুখোপাধ্যায়, প্রিয় গুহ আর বিশু মুখোপাধ্যায়কে। কবি হরপ্রসাদ মিত্র, লেখক ডাক্তার নির্মল সরকার, সুশীল রায়ও আসেন কখনো-সখনো। প্রিয়বাবু প্রমুখ আর সবাই কখনো কদাচ, কিন্তু বিশুবাবু আর সুপ্রিয় সরকার সেখানে সর্বদাই।

তখন তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার হয়ে রিটায়ার করেছিলেন। তাই সরকারী গোপন কথা ফাঁস করার তখন আর কোনো বাধা ছিল না তাঁর। পুলিশ কমিশনার হয়ে রিটায়ার করার অ্যামবিশন তাঁর পূর্ণ হল না বুঝি আমার জন্যই-ইদানীং তাঁর কলেবরের ঐ অপর্যাপ্ততার দরুণই নাকি!

কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল কথাটা।

কী মুটিয়েছেন যে মশাই! আমি তো এক মোটা, আর আমাদের হর্ষবর্ধনকেও দেখেছি মোটামুটি-কিন্তু আপনি আমাদের দুজনকেই টেক্কা মেরেছেন। হৃষ্টপুষ্টতায় আপনি অদ্বিতীয়! সেই কবে বৌবাজারের ও. সি-রূপে আপনাকে দেখেছিলাম, কী শ্রী! কেমন ছিমছাম সুঠাম! আর এই দেখছি। এ কী হয়েছেন এখন! খেয়ে না খেয়ে কি এমন করেই মোটাতে হয়।

আপনার সঙ্গদোষেই বলতে কী! দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি ন।

সে কী! আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে গেলাম কখন? সেই কাবুলিওয়ালার দায়ে পড়ে একবার যা গেছলাম আপনার কাছে–তারপর আর কই? তারপর এই দেখছি তো। এখানেই এখন।

জেনেশুনে কি আর সঙ্গ দিয়েছেন। অজান্তে হয়ে গেছে। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি আপনি। তাহলে খুলেই বলি আপনাকে…

আমার সেই যুগান্তকারী কালের কথা বললেন তিনি আমায়। তখন তিনি আমায় ছায়ার ন্যায় অনুসরণ করেছিলেন কিছুদিন–কোন বিপ্লবীদল বা বিপ্লবী কোনো কারো সঙ্গে আমি বিজড়িত কিনা তার খোঁজ নিতে, সরকারী নির্দেশেই।

পেয়েছিলেন কারো খবর? আমি শুধাই।

কোথায়! ফলো করে যাচ্ছি…যাচ্ছি…ফলো করে আপনাকে। দেখলাম হঠাৎ আপনি সড়াৎ করে এক রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লেন। সন্দেহভাজন অন্য কারো সঙ্গে মিলিত হবার জন্যই নিশ্চয়। তাই মনে করে আমিও ঢুকেছি আপনার পিছু পিছু। দেখি আপনি এক কোণে বসে একমনে অর্ডার দিচ্ছেন আর খেয়ে যাচ্ছেন এক ধার থেকে। আপনার কাছাকাছি আরেক টেবিলে বসে আমাকেও খেতে হয়েছে বাধ্য হয়ে…তারপর, আপনি যেমন সেখান থেকে বেরুলেন, আমিও বেরুলাম। যেতে যেতে পাশে একটা সন্দেশের দোকান পেয়ে সেখানে আপনি সেঁধিয়েছেন দেখলাম। আমাকেও সেধুতে হল। দেখি কি, আপনি হরেক রকমের মিষ্টান্ন-সন্দেশ-রসগোল্লা-রাজভোগ সাঁটিয়ে চলেছেন, আমিও তাই চালালুম। এমনিভাবে আপনাকে শ্যাডো করে সারা কলকাতার ভালোমন্দ নানান খানার পাত্তা পাওয়া গেল, কিন্তু আপনার কোন বিপ্লবীসঙ্গীর সন্ধান মিলল না।…আর এদিকে গণ্ডেপিণ্ডে গোগ্রাসে গিলে আপনার সঙ্গদোষে আমার ভোজন বেড়ে গেল যৎপরোনাস্তি!

শুনে আমি অবাক হই-কিন্তু মশাই, আপনি যেমন খেয়েছিলেন, আমিও তেমনি খেয়েছি তো? কিন্তু কই, আপনার মতন এতটা তো আমি মোটাইনি?

আপনি খেতেন নিজের পয়সায়, বুঝেসুঝে হিসেব করে, আর আমার খাওয়াটা ছিল সরকারের ঘাড়ে-গায়ে লাগত না। আপনার চারগুণ খেয়ে বিল করে তার চতুগুণ আদায় করা যেত।…

কিন্তু, বেশিদিন তো আর ফলো করতে হয়নি আমাকে। তার পরই তো, কিছুদিনেই আমি ধরা পড়ে গেলাম…

কোথায় ধরা পড়লেন? ধরতেই পারিনি আপনাকে আমরা!

আহা, সে-ধরা নয়, আমার সঙ্গে বিপ্লব বা বিপ্লবীদের ঘুণাক্ষরেও কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা তো আপনার অচিরেই টের পেয়ে গেলেন, তারপর তো আর আমায় ফলো করতে হয়নি আপনাকে?

তা হয়নি ঠিক। কিন্তু তাতেই যা ফলোদয় হল না–আপনার বাকভঙ্গীতেই বলি খাওয়ার ঐ বদভ্যাসটা থেকেই গেল আমার–এই আপাদমস্তকে তার প্রমাণ।

এই পর্বতপ্রমাণ? আপনি বলছেন আমার পাশাপাশি কাছাকাছি মুখোমুখি বসে এত এত খেয়েছেন, কিন্তু কই মশাই, আপনাকে তো আমি লক্ষ্য করিনি কখনো? এ কী করে হতে পারে?

খাবার সময় কোনদিকে আপনার লক্ষ্য থাকত না কী! কোনো লোকের দিকেই আপনি তাকাতেন না, যা একটু আপনার নেকনজর তা দেখেছি ঐ মেয়েদের দিকেই। দেখেছি একেক সময় আপনিই আবার ফলো করে চলেছেন…

আমি? আমি আবার কার ফলো করলাম?

কোনো তরুণীর। কলেজের পড়ুয়া-টডুয়া হবে হয়তো। যাচ্ছেন যাচ্ছেন, মেয়েটিও যাচ্ছে, আপনার আগে আগে–ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেও মাঝে মাঝে! ভাবলাম পেয়েছি অ্যাদ্দিনে, বিপ্লবীদলের কোনো মেয়েটেয়ে বোধহয়–এদের গোপন ডেরার সন্ধান মিলবে এবার। তারপর যেতে যেতে মিলিয়ে গেল মেয়েটা। আর আপনি চিত্রপুত্তলিকার মতন দাঁড়িয়ে।…

আণ্ডার গ্রাউণ্ডে চলে গেল নাকি? বিপ্লবী ছেলেমেয়েরা সব আণ্ডারগ্রাউণ্ড হয়ে যায় বলে শুনেছি।

কে জানে। কি করে যে চকিতে চোখের ওপর উপে গেল একটি মেয়ে-ভাবাই যায় না। তবে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম, আমার এখনও মনে রয়েছে বেশ, ঘুরে দাঁড়িয়ে পায়ের চপ্পল খুলে উঁচু করে তুলে আপনাকে দেখিয়েছিল।

সে মেয়েটি ভুলবার নয়।

মুখের মতন জবাব দিয়েছিল বলেই বোধহয়?

কী যে কন! আমার মুখের চেয়ে তার জুতোর দাম ঢের বেশি।

তা হতে পারে। তখনকার চপ্পলের বাজারদর আমার ঠিক জানা নেই। তবে হ্যাঁ, স্মরণীয় বটে ব্যাপারটা।

আমারো তাকে মনে আছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে তেমন যুতসই মনে হয় নি, লু বেশ মজবুতসই ছিল মেয়েটা। কী শক্ত সমর্থ দেহ, কীরকম চওড়া তার কবজি–ঠিক আমার বোন ইতুর মতন। তাকে কজ্জা করা কারো পক্ষেই তেমন সহজ হবে না, তন্বী বহ্নি যাকে বলে। তাহলেও, কতো মেয়েই তো ঐ পদযাত্রায় আমার যাত্রাপথে এসে গেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ চকিত চাহনিতে তাকিয়ে একটুখানি হেসেও গেছে হয়ত বা, তারা সবাই আমার স্মৃতির মিছিল থেকে ভেসে গেছে কোথায়! কিন্তু সেই মেয়েটিকে আজও আমি ভুলতে পারিনি। স-চপ্পল সেই চপলাকে এখনো আমার মনে রয়েছে!

.

৬৮.

 কবি, বিপ্লবপথিক আর প্রেমিক একদিক দিয়ে সতীর্থই–তাদের ওই পাগলামিতেই। সেদিক দিয়ে ধরলে পাগলামির তীর্থক্ষেত্র এই বহরমপুরের একদা খ্যাত পাগলা-গারদের এক গোয়ালে সগোত্রদের সবাইকার ঠাঁই করে দিয়ে সরকার বাহাদুর বেশ রসবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন।

রসকষ দুই ছিলো ইংরেজের। সেকালের দৈনিক ইংলিশম্যান পত্রিকার এক কোণায় পাগলামির আড়ত-এর উল্লেখ থাকত। তাদের সেই কলাষ্টার নাম ছিল ক্র্যাংকস্ কর্নার–তাতে গান্ধীজীর খবরাখবর থাকত সব।

বিশ্ববরেণ্য মহাত্মার এই ক্র্যাংক বলে পরিচয় দেওয়াটা মোটেই রসালো নয়, বরং কটু কষায় রসের বলা যায়।

তবে একদিক দিয়ে গান্ধী পাগলই বই কি! পাগলদের রাজা বলা যায় তাঁকে। তাঁর সংক্রামক পাগলামির ছোঁয়াচে তিনি দেশজোড়া সবাইকে ক্ষেপিয়ে তুলছিলেন সন্দেহ কি! কবিগুরুর কবিতায় যে-উল্লেখ পাওয়া যায়–কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ/জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো/ প্রেমিক ওগো/পাগল ওগো/সাধক ওগো ধরায় আসো/…ঘোর বিপদ মাঝে/কোন জননীর মুখের হাসি/দেখিয়া হাসো!

এটা কাকে লক্ষ্য করে তাঁর রচনা, গান্ধীজী কি পরমহংসদেব, সঠিক জানিনে, কিন্তু দু জনের সঙ্গে বেশ খাপ খায়। পরমহংসদেবের ন্যায় গান্ধীজীও পাগলও বটেন, প্রেমিকও বটেন, সাধক তো বটেই। যেমন মানবপ্রেমিক তেমনিই অসাধ্য সাধক।

রাজবন্দীদের মধ্যে কবি ছিল, বিপ্লবী ছিল, আর প্রেমিক? কে নয়? সাধারণ অর্থে প্রেমিক না হলেও তাঁদের নিজেদের আদর্শের প্রেমে উন্মত্তই তো তাঁরা।

আমাদের ভেতর সুস্থ মস্তিষ্কের লোক ছিলেন শুধু একজন–অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরাট ল-এ আমাদের সঙ্গে তিনি থাকতেন না, আমাদের থেকে আলাদা একটা সুসজ্জিত ঘর তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, নেতৃস্থানীয় বিরাট ব্যক্তি বলেই বোধ হয়। সেখানে নিজের বইপত্তর নিয়ে পড়াশোনায় তিনি নিমগ্ন থাকলে। আমাদের হলের এবং কোলাহলের বাইরে।

আমাদের দলের কেউ কখনো তাঁর ঘরে হামলা করতে যেত না। তেমন সাহস বা উৎসাহ ছিল না কারো। গোড়ায় গেল গিরিজা। আমাদের হলের থেকে সেই প্রথমে তাঁর মহলে। তারপর গেলাম আমি–তার ল্যাজ ধরে, নিজের কৌতূহলে।

গিরিজার কয়েকদিন পরেই আমি গিয়ে দেখি, সে বেশ জমিয়ে বসেছে সেখানে। জিতেনবাবু তার সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন।

ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। ক্লাসে লেকচার দেওয়ার বাতিক তাঁর যাবে কোথায়? টেকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, তিনি জেলখানায় এসেও তাঁর অধ্যাপনা শুরু করে দিয়েছেন! গিরিজার মত উপযুক্ত শিক্ষার্থী পেয়ে তাঁর উৎসাহ আর ধরছিল না।

স্কলারশিপ পাওয়া ছেলে গিরিজা ছোটবেলার থেকেই পড়াশোনায় খুব পোক্ত। নিজের ক্লাসের থেকে, বয়সের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে। স্কুলে পড়তেই সে কলেজের পড়ুয়াদের টেক্কা দিত। জিতেনবাবুকে সে যেন গোগ্রাসে গিলছিল।

মনের মত শিষ্য হলে গুরুর আনন্দ কত হয় সেদিনই প্রত্যক্ষ করেছিলাম। জিতেনবাবু যেন তাঁর সব কিছু শত মুখে তাঁকে উজাড় করে ঢেলে দিতেন। মাঝখান থেকে উপরি লাভ হত আমার–শেলি, ব্রাউনিং কীটস, শেকীয়ার প্রমুখের সারাংশ আমার পল্লবগ্রাহী নৈপুণ্যে পেয়ে যেতাম-মুখস্থ না করেও আত্মসাৎ করা যেত।

জিতেনবাবু কী স্নেহের চোখে যে দেখেছিলেন ওকে বলা যায় না। সাহিত্যের সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও সযত্নে শিখিয়েছিলেন। গিরিজা ইংরেজিতে একটু পোক্তই ছিল, যার ফলে সে অচিরেই আরো শক্ত সমর্থ হয়ে উঠল। উত্তরকালে তাঁর শিক্ষার সদুত্তর সে দিতে পেরেছে। কিছুদিন আগে যুরোপ থেকে প্রকাশিত তার ইনসাইড যুবোপ বইটিতে প্রমাণ মিলেছে তার। বইটি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে সৈয়দ মজুতবা আলীর দেশ-এ প্রকাশিত বিস্তৃত সমালোচনা–নিবন্ধে তার পরিচয় পেয়েছি।

জেল থেকে বেরিয়ে (এবং তারও কিছুদিন বাদে জিনেবাবুরও বেরুনোর পর) সে তাঁর কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িতে (বিদ্যাসাগর কলেজের কাছাকাছি) থেকেছিল দিনকতক, সেখানে তাকে এবং নিজের আদরের ভাগনে গাবুকে আর দেবুকে (ভালো নাম জানিনে) সমানে তিনি পড়াতেন আমি দেখেছি।

জিতেনবাবু বিদ্যাসাগর কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক এবং প্রিন্সিপাল নাকি ভাইস প্রিন্সিপাল) ছিলেন, গিরিজা কিন্তু তাঁর কলেজে ভর্তি না হয়ে সেন্ট পলস্-এ গিয়ে ভর্তি হয়েছিল। সেখানকার হোস্টেলে ছিল–সেখানেও মাঝে মাঝে তার কাছে আমি যেতাম।

কিন্তু খুব উৎসাহ পেতাম না, সেও পেত না, বলতে কি! আমার মতন একটা মুখকে মনে হয় সে পছন্দ করত না। আর আমি? আমিও, কেন জানি না, তার পান্ডিত্যের হিংসেয় নয়, এমনিতেই কেমন যেন তাকে বরদাস্ত করতে পারতাম না। কেবল তাকে নয়, তার মতন নির্মন মনস্বীদের কবেই আমি অন্তর থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছি।

তাছাড়া, তার কাছে গেলেই তো তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাঁটি–প্রবল বিতার্কিক গিরিজার প্রচন্ড ঝড়ঝাঁপটার সামনে সাধ করে কে নিজের মুখ বাড়িয়ে মার খেতে যায়?

যাই হোক, উচ্চাভিলাষী গিরিজা তার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে পেরেছিল। অধ্যাপক বড়ুয়ার জামাই হয়ে তাঁর দৌলতে বিলেত গিয়েছিল, সেখানে আরো উচ্চতর শিক্ষালাভের পর সেখানেই বসবাস শুরু করে দেয়–সেখানেও নাকি বিয়ে করেছিল সে আবার, শুনেছিলাম। এখানে যে মিষ্টি মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলে রেখে গেছল (তাদের একটি মিষ্টিতর মেয়েও হয়েছিল শুনেছিলাম), তাদের কী হল জানি না।

তবে গিরিজা পরে বার্লিনে নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের সহায়তায় যোগ দিয়েছিল বলে শুনেছি। সেখান থেকে সুভাষচন্দ্রের সমাচার সহ একখানা চিঠি দিয়েছিল আমায় বসুমতীর ঠিকানায়। চিঠিটা ভুলক্রমে আমার বন্ধু শিল্পী শৈল চক্রবর্তীর কাছে চলে যায়, আমি পাইনি।

এর মধ্যে সে ভারতেও ফিরেছিল একবার–এই তো সেদিন। এক রাত বারোটায় অবোধ সান্ন্যালের সাথে আমার বাসায় এসে হাজির হঠাৎ। আমার ঠিকানার হদিশ বাতলাবার জন্যই প্রবোধকে সঙ্গে করে আনা, জানা গেল। কিছুক্ষণ ছিল, বিশেষ কোনো কথা হয়নি, গোলপার্কের কোথায় যেন উঠেছিল, কিন্তু আমি আর যেতে পারিনি। পরে তার একটা চিঠি পেয়েছিলাম দিল্লির থেকে–সেই কবেকার আমাদের যুগান্তরে পথিক ছদ্মনামে তার দু একটা ছোটখাট কথিকা গোছের লেখা বেরিয়েছিল তারই খোঁজ করে, সেগুলি পাওয়া যায় কিনা জানতে চেয়েছিল সে। কোথায় পাব সে যুগান্তর? গতকাল আমার নিজের যে লেখা বেরিয়েছে তারই কোন পাত্তা নেই আমার, লেখাটেখার প্রতি এতই যে অ-মায়িক প্রকৃতির–তার কাছে অতকাল আগেকার যুগান্তরের খবর থাকে?

কিন্তু আমার বিস্ময় লাগে এই ভেবে যে, বিশ্ববিদিত না হলেও যে নাকি আন্তর্জাতিক লেখকদের একজন বলেই গণ্য, তারও কি মনের কোণে কোণে মাতৃভাষায় লেখা কবেকার সামান্য কয়েক ছত্রের জন্যও মায়া জড়িয়ে থাকে! অবাক হবার কথাই বই কি!

তার কোর্টশিপের কালে গিরিজা আমাকে অধ্যাপক বড়ুয়ার বাসাতে নিয়ে গিয়েছিল একবার–(তাঁর পুরো নাম বোধ করি বেণীমাধব বড়ুয়া, বাড়ি ছিল যেন শ্রীরামপুরেই?) তার ভাবী বউকে দেখাতেই, মনে আছে। ভারী সুশ্রী মেয়েটি, মুখখানি কী মিষ্টি যে। অসমীয়া মেয়েরা স্বভাবতই যেমনটা হয়ে থাকে। সেই বাড়িতে এমন একটা কাভ সে করে বসে যাতে আমি বেশ ধাক্কা খাই। কান্ডটা এমন কিছু নয়–সাধারণের কাছে, সাধারণভাবে দেখলে এমন কিছু মারাত্মক ঠেকবে না, কিন্তু আমার মনে তার চোট দারুণ লেগেছিল। বৈঠকখানায় আমরা বসে গল্প করছিলাম, বাড়ির এক বাচ্চা ছেলে, তার ভাবী শ্যালকই হবে সম্ভব, ভারী দুরন্তপনা করছিল, ছেলেরা যেমনটা করে থাকে সচরাচর। গিরিজা করল কি, তার ঘাড় ধরে নুইয়ে সেই বিরাট তক্তপোষের তলায় ঢুকিয়ে দিল, বলল, থাকো ঐখানে বসে যতক্ষণ না আমরা এখান থেকে যাচ্ছি। আশ্চর্য, ছেলেটা সেখানেই হামাগুড়ি দিয়ে বসে রইল বিনা বাক্যব্যয়ে-বেড়ালের মতই চুপটি করে ম্যাও শব্দটি না করেই। যতক্ষণ আমরা ছিলাম তাকে আর বেরুতে দেখিনি তার পর। বাড়ির ছেলেপিলেরা গিরিজাকে বেশ ভয় খায় দেখলাম।

ব্যাপারটা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। ছেলেটার মনে কতটা লেগেছিল জানিনে, মনের ঐশ্বর্যে তারা অফুরন্ত তাই হয়ত কিছুই তাদের মনে লাগে না। জলের গায়ে আঘাতের ন্যায় খুব মর্মভেদী ঘা-ও মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায়। এতদিনে সে ঢের বড়ো হয়েছে, কবেই ভুলে গেছে সেদিনের কথাটা, তার পরেই হয়ত বা, কিন্তু চোট আমার মন থেকে যায়নি এখনো। সত্যি বলতে, সেই কাভের পরই গিরিজার সঙ্গে যেন আমার কাটান ছাড়ান হয়ে গেল, অন্তরের দিক থেকে অন্তত। যে-টানটুকু তার ওপর তখনো আমার ছিল তারও যেন কাটান হয়ে গেল ঐ কান্ডটাই। তার বিয়েতেও আমি যাইনি আর তার পর।

জিতেন্দ্রলাল ছিলেন মহামনী আর মহামনা। বিদ্যাসাগর গোত্রীয়। যেমন বিদ্যায় তেমনি উদারতায় আর দাক্ষিণ্যে। কেবল গিরিজাইে না, তার মন কত ছেলেকেই যে তিনি অর্থ দিয়ে, আহার্য দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন। আমাকেই বা কিছু কম কি? চিত্তরঞ্জনের তিরোধানের পরে অভাবে পড়ে যখনই না তাঁর কাছে গেছি, অকৃপণ দাক্ষিণ্য লাভ করেছি, এতবার এত এত যে, তা একমুখে ব্যক্ত করা যায় না।

তেমনি পেয়েছি আরেকজনের কাছেও। তিনিও সেকালের এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। মডারেট পাটির এক মুখ্য নেতা অ্যাটর্নিদের অগ্রগণ্য যতীন্দ্রনাথ বসু। তাঁর হৃদয়বত্তারও তুলনা হয় না। আবালবৃদ্ধবনিতা যে-কোন প্রার্থীকেই তিনি বিমুখ করতেন না। মুক্তহস্তে দিনে, এমন কি তাঁর বিপক্ষীয় কেউ এসে তাঁর আনুকূল্য চাইলে কখনো নাকি বঞ্চিত হয়ে ফেরেননি। এ কথা আমাকে বলেছিলেন স্বয়ং হেমন্তকুমার সরকার, তৎকালে স্বরাজ্যদলের, তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার থেকেই। এই ধরনের মানুষ একালে আর দেখাই যায় না বলতে গেলে।

কৃতজ্ঞতার পরিচয়ে আমার প্রথম প্রবন্ধের বই আজ এবং আগামীকাল যতীন্দ্রনাথের নামে উৎস্বর্গ করেছিলাম আর কালানুক লালফিতা বইটি অধ্যাপক জিতেন্দ্রলালকে উৎসর্গীকৃত।

দুটো বইয়ের কোনটাই এখন আর পাওয়া যায় না। তার পর আর তা পুনর্মুদ্রিত হয়নি, কালস্রোতে বিলীন। আমার সেকালের প্রায় সব বইয়ের এই দশা-কালোত্তীর্ণ হতে পারেনি কোনটাই! উত্তরকালের উদ্দেশে রচিত না বলেই বোধ হয়।

জিতেন্দ্রলাল গিরিজাকে আদর করে পথিক বলে ডাকতেনযুগান্তরের কথিকা-রচয়িতার ছদ্মনামটি ধরে বারংবার সেই সম্বোধনেই কি না কে জানে, তার মনে সুদূর যাত্রার দুরাকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, এবং নিজের উদ্দেশ্যপথে অনেক দূর এগিয়েও ছিল সে। যে সুভাষচন্দ্র আমাকে আত্মশক্তিতে ডাকার পরই বিশৃঙ্খল বলে বিষবৎ বিসর্জন করেছিলেন, সেই সুভাষের বিশ্বস্ত দায়িত্ববান পার্শ্বচররূপে জার্মানীতে কাজ করা নেহাত কম কথা নয়। আমি তো তা ভাবতেই পারিনে।

জিতেন্দ্রলালের আদর্শে নিজেকে অতিমানুষরূপে গড়ে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছিল গিরিজা। পড়াশুনা, ধ্যানধারণা, আচার-আচরণে অবিকল তাঁর মতই। জিতেন্দ্রলাল যেমন মহামনস্বী ছিলেন, তেমনি ছিলেন এক অতিমানুষ। বাগ্মিতায়, দেশপ্রেমে, দয়া-দাক্ষিণ্যে, তাঁর মতনটি হওয়া খুব সহজ ছিল না। তাহলেও তাঁর মাপেরটি না হলেও, ছোটখাট একটা অতিমানুষ হতে সে সচেষ্ট ছিল বোধ হয়।

হয়েছিল কি? হতে পেরেছিল কি? হয়ে থাকলেও তাতে তার কী লাভ হয়েছিল আমি জানিনে। অতিমানুষ হওয়ার অত্যাকাঙ্ক্ষা কোনোদিন আমাকে পায়নি, আমার ধাতেই নেই, সে-পথের লাভক্ষতির খতিয়ান আমি দিতে পারব না।

অতিমানুষ আর অতি মানস, সত্যি বলতে, দুই-ই আমার ধরণার বাইরে। আমার মনে হয় কেউ যদি কোনো একটা পেশায় এক মনে একটানা লেগে থাকে তাহলে এককালে হয়ত সে অতীব মানুষ না হয়েও ঐ অতিমানুষের পর্যায় পরিচিত হতে পারে। কিন্তু একমাত্র পেশায় একপেশে হয়ে যাওয়ায়, ভালোটা কোথায়? হিটলারের ন্যায় অতিমানবিক পেশায় নিজের অক্টোপাশে নিজেই জড়ীভূত হয়ে আশেপাশের সবাইকে সমপেষণ ছাড়া আর কী? ছোটখাট পরিধিতে নাতিখর্ব কি খর্বাকার হিটলার হয়ে সবাই মিলে সমান নিস্পিষ্ট হওয়া বইতো নয়। সেটা কি বাঞ্ছনীয়?

আমার মতে, অতীব নয়, সম্পূর্ণ হওয়াটাই সার্থক। সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য বড় হতে হয় না, কাউকে পেষার দরকার করে না; নিজের হওয়ার সাথে সাথে সে-ই হওয়ায়, তার আশপাশের আর সবাইকেও সে হওয়ায়।

সুন্দরই হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সুন্দর সুষম হওয়াই সম্পূর্ণ হওয়া। ফুল যেমন তার ছোট্ট বৃন্তে, সামান্য বৃত্তেই রূপে রসে গন্ধে-Tনন্দের ছন্দে হয়ে ওঠার বৃত্তিতে পরিপূর্ণ।

আমাদের কালে সম্পূর্ণ মানুষ দেখা গেছে রবীন্দ্রনাথকে। নজরুলকেও আমরা দেখেছি। প্রেমেনকেও হয়ত বলা যায়। প্রেমেন দেখতে ভালো, আচারে আচরণে নিখুঁত, মনে আর মগজে সমান দিগজ, স্বভাবে ব্যবহারে সুমধুর। স্বভূমির ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের বৃত্তে দাঁড়িয়ে স্বকীয় আদান-প্রদানের শিল্পবৃত্তিতে সব দিক দিয়ে সে সার্থক। ছোট পরিধিতে হলেও রবীন্দ্রনাথের মতই নিজের রহস্যময় অন্তস্তল থেকে নেওয়া আর বিশ্বজনকে বিলিয়ে দিয়ে যাওয়ার পরম অবলীলায় সে অপরূপ।

এই আদান-প্রদানের বৃত্তিতেই যে কোনো মানুষ সম্পূর্ণ হতে পারে। লেখক, গায়ক, শিল্পী, যে কোনো রূপবান কলাবৎই তা হতে পারে। কিন্তু অতিমানসে কিংবা অতি মানুষত্বে উত্তীর্ণ হওয়া এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। দারুণ বিড়ম্বনা। তেমন সর্বনাশ যেন কখনো কারো না হয়, ভগবান আমাদের রক্ষে করুন!

কিন্তু জিতেন্দ্রলালের পৈঠায় দূরে থাক, তাঁর পাদমূলেও কি পৌঁছতে পেরেছিলো গিরিজা? মনে হয় না।

জিতেন্দ্রলাল যেমন মাথায় তেমনিতর মনের দিকেও বিরাট ছিলেন। বুদ্ধির দিক দিয়ে যেমন অতিমনস্বী, বিদ্যায় বাগ্মিতায় অদ্বিতীয়, মনের দিক দিয়েও তেমন অতিশয় মনুষ্য। তাঁর মনের পরিচয় পেয়েছিলাম সেইখানেই–সেই জেলখানাতেই একদিন।

সেদিন তাঁর ঘরের তকতকে মেজেয় শুয়ে আমি দৈনিক স্টেটসম্যান পড়ছিলাম, আর তিনি কোণের জানালার দিকটায় ডেকচেয়ারে ঠেস দিয়ে একান্ত মনোযোগে পড়ছেন শরৎচন্দ্রের অরক্ষণীয়া। জিতেন্দ্রলালকে জেলের থেকে দৈনিক পত্র আর তাঁর পছন্দসই বই যোগানো হতো।

হঠাৎ ঘরের মধ্যে ফোঁসফোঁসানি শুনে চমকে উঠে তাকালাম। দেখি কিনা, বই পড়তে পড়তে হাপুস নয়নে তিনি কাঁদছেন, ছেলেমানুষের মতন অঝোর কান্নায় চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে তাঁর। বই মুড়ে প্রাণভরে খানিকটা কেঁদে নিয়ে বই খুলছেন, আবার কাঁদছেন আবার মুড়ে রাখছেন–ফের আবার-বারংবারই ঐ কান্ড। তারপর তিনি আর সামলাতে পারেন না, না নিজেকে, না বইটাকে।

ঘরের অন্য কোণে ছুঁড়ে ফেলে দেন বইটাকে। খানিক বাদে চোখ মুছতে মুছতে গিয়ে তুলে আসেন বইটা, খানিক পড়ার পর কেঁদে ভাসিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন আবার। আবার তুলে আনেন। এমনিধারা চলতে থাকে তাঁর বারংবার।

পারছেন নিজেকে রুখতে, না পারছেন বই পড়া রাখতে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তাঁর চোখ মুখ চিবুক প্রশস্ত বুক-শরৎ-রচনার এর চেয়ে বড় প্রশস্তি আর কী হতে পারে? তার এই অশ্রুত অদ্ভুত কাহিনী তাঁর মনশ্চরিত্রের আরেক দিক প্রকাশ করে অনেককেই চমকে দেবে হয়ত। অবন্যায় ভাসমান তাঁকে দেখে অরক্ষণীয়া কন্যার ন্যায় তাঁকেও আমার নিতান্ত অরক্ষণীয় বলেই মনে হয়েছিল সেদিন।

.

৬৯.

 বহরমপুরে কারাবাসের এক মাস দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল আমাদের। এগিয়ে এলো খালাস পাবার তারিখ।

দেখে দেখে আর চেখে চেখে ফুর্তির মধ্যেই কেটেছিল দিনগুলো। দেখবার ছিল একজনই কেবল-সেই কাজী। সে-ই একমাত্র দ্রষ্টব্য। মুহূর্তে মুহূর্তে তার রঙ বদলাচ্ছে, সুর বদলাচ্ছে, মেজাজ বদলাচ্ছে। মূহুর্মুহু সে অপরূপ।

কোনো বিধিনিয়মের রুল দিয়েই তাকে ধরা যায় না, মাপা যায় না, ব্যাখ্যা করা যায় না। সেই অভিব্যক্তির আখ্যান হতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যান নেই। এমন পরমাশ্চর্য বুঝি এর আগে দেখা গেছল সেই নবদ্বীপেই-বাংলার আবালবৃদ্ধনিতাকে যা মাতিয়েছিল আরেকবার। অপর দৃষ্টান্ত দ্বাপরের-বৃন্দাবনের মেয়েপুরুষকে পাগল করে তুলবার সেই!

দ্রষ্টব্যই নয় কেবল কাজী, শ্রোতব্যও বলতে হয়। সুরের তালে অহরহ তার আনাগোনা। নিজেও সে যেমন মাতোয়ারা, তেমনি গানে গানে মাতিয়ে রাখত আমাদের সবাইকে। নিজের গানের চেয়েও বেশি গাইত সে রবীন্দ্রসঙ্গীত।

চোখে দেখার দিকে যেমন, চেখে দেখার দিকেও তেমনি সে। ভালোমন্দ নানান খানা, নানা খাবার চাখা-র চাখাবার সে ছাড়া কে আর? কয়েদখানার পাকিস্তানের কায়েদে আজম নজরুল। কতো রকমের রান্নার কায়দাকানুন জানা তার, তা বলবার নয়।

অবশ্যি আমাদের খানা পাকানোর থেকে তাবৎ পরিচর্যার জন্য জেলের থেকে কয়েকজন মেট মজুদ ছিল, কিন্তু তাহলেও কাজী নিজগুণেই রান্নাঘরের হাতা-খুনতিতে গিয়ে হাত লাগাতত বেশির ভাগ।

কতো দেশবিদেশের রান্নাবান্নাই না জানত সে। শেখদের হারেমের শিককাবাব; (নাকি, শেখদের কাবু করা শেখকাবাব?) থেকে শুরু করে তুর্ক মুলুকের মুৰ্গমসল্লাম (যা খেয়ে বোগদাদের আমীররা তুকীনাচন নাচতেন), আফগানি পোলাও থেকে বেলুচিস্তানের চাপাটি পেরিয়ে পেশোয়ারী প্যাটিহয়ে পাটনাই চাপ পর্যন্ত-হরেক কিসিমের মোগলাই কারিকোর্মা রোস–সেই সঙ্গে আমাদের এদেশী বিরিয়ানি আর চিরদিনের পরমান্ন নিয়ে–কতো রকমের খানদানি খানাপিনা যে!

খেয়ে খেয়ে চেহারা ফিরে গেল আমার, চেকই দেখা দিল। কখানা হাড় নিয়ে কয়েদখানার গেছলাম, অদৃষ্ট হাতে করে সেখানেই এগুলোর সঙ্গতি হবে সেই আশায়, এদিকে নানান খানায় হৃষ্ট হয়ে গায়ে গত্তি গজিয়ে সেখান থেকে বেরুলাম, বেশ পুষ্ট হয়ে।

জেলে গেলেই রাজবন্দীরা লপসীর প্যাঁচে পড়ে ভালো খাওয়ার দাবিতে প্রায়োপবেশন করে এই জানি, না খেয়ে শুকিয়ে টি-বি বানিয়ে ম্লানমুখে ফেরে এইটেই জানা, আমার বরাতে সর্বক্ষেত্রে সব ব্যাপারেই উল্টো উৎপত্তি! বেড়ে ভোজনে ওজনে বেড়ে রীতিমতন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেরুনো!

ছাড়া পাবার দিন জেলখানার আপিসঘরে ডাক পড়লো। সেখানে যেতেই ছাড়পত্রের সঙ্গে দুখানা রেলোয়ে পাশ দেওয়া হল শেয়ালদা পর্যন্ত-ফাসকেলাস পাশ, ফাসকেলাস কয়েদী যখন! কারাবরণের কেরামতিতে সেই প্রথম ফাসকেলাসে চাপার সুযোগ ঘটল আমার।

তোমাদের নিজস্ব জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে পারো, অ্যালাউ করা আছে এই পাশে। বললেন জেলের করণিকটি।

নিজস্ব বলতে, পরনের কাপড়-জামা ছাড়া, জেলের থেকে পাওয়া কম্বল দুটো সম্বল করে নিয়ে বেরুলাম।

গিরিজা নিল না, বলল, গয়ার পাপ গয়াতেই থাক।

শেয়ালদায় নেমে ট্যাকসি ধরে গিরিজা কোথায় গেল জানি না। আমি ট্যাকসি চাপব কোন ভরসায়? তার ভাড়া গোনার কে আছে আমার কলকাতায়? কম্বল ঘাড়ে সোজা হন দিলাম ঠনঠনের দিকে।

বাসায় এসে দেখি, আমার ঘর তালাবন্ধ। শুনলাম, পুলিসে আমাদের ধরে নিয়ে যাবার পরেই বাড়ির মালিক আনন্দবাবু এসে নিজের তালাচাবি মেরে দিয়ে গেছেন।

গেলাম আনন্দবাবুর কাছে।

আমাকে দেকে তিনি আনন্দিত। চা জলখাবার খাইয়ে খালেন আমাকে–এ কম্বল আপনি পেলেন কোথায়?

জেলখানায়। দিয়েছিল আমাকে।

শুনেই তিনি আঁতকে উঠেছেন–অ্যাঁ, করেছেন কী? জেলখানার জিনিস হাতিয়ে এনেছেন? গেটে আটকায়নি আপনাকে? না? আশ্চর্য! আরে মশাই, দেখছেন না জেলখানার ছাপ মারা আছে কম্বলে। এই মার্কা পুলিসের নজরে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। তারপরে এবার যে জেল হবে আপনার তা ওই লুচি আর পোলাওয়ের নয়, দস্তুর মতন ঘানিটানার। বুঝলেন?

তাই নাকি? তা আমি কি জানি! আমায় বলল, তোমার যা আছে সব নিয়ে যাও। নিজের বলতে ত্রিভুবনে এই কম্বল দুটোই দেখলাম। কী করব? কই, তারা কিছু বলল না তো? বাধা দিল না তো গেটে?

খেয়াল করেনি হয়ত। ফাসক্লাস পলিটিক্যাল প্রিজনার বলে ছেড়ে দিয়েছে, আপত্তি না করে। কিংবা হয়ত ওগুলো বহরমপুর জেলের ছিল না বলেই। সেখানকার জেলখানা থেকে নেওয়া হয়নি বলেই জমা দেবার কোনো প্রশ্ন ছিল না। আলিপুর জেলের থেকে বহরমপুরে রপ্তানি করার সময় শীতকাল বলে তাঁরাই দিয়ে দিয়েছিলেন তো।

শুনে আনন্দবাবু বললেন, যাকগে, এগুলোকে এখন সরিয়ে ফেলুন সবার নজরের থেকে। পাচার করে দিন এক্ষুনি।

কোথায় পাচার করবো?

আপাতত চাদরের তলায়। পেতে ফেলুন বিছানায়। আমি একটা বেড কভার দিচ্ছি, তাই দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিন। দিনকতক পুলিসের নজর থাকবে এখন আপনার ওপর, নজর রাখবে তারা। থানার থেকে এস-আই এসে খোঁজ নিয়ে যাবে মাঝে মাঝে, তখন যদি এই কম্বল দেখতে পায় একবার…

আর বলতে হল না। বেড কভারটা নিয়ে বিছিয়ে দিলাম আমার কম্বলের বিছানায়।

 বাসার চৌকির ওপর কম্বলমাত্র সম্বল আমার শয্যা বেডকভার বিছানো এখনো আমার বাসায়। সেই কম্বলের চৌকিদারি এখনও করছি। অবশ্যি, আনন্দের সেই উপহার এতদিনে নেই আর তা ঠিক, কিন্তু আমার বোন পুতুলের অবদান বালিশকে শিরোধার্য করে সেই কম্বলের একখানা এখনো রয়েছে।

জেলের আরেকখানা খুইয়ে এসেছি রেলে। আমার ভ্ৰাতৃভূমি ঘাটশিলায় যাবার কালে ১১১নং কামরার বেঞ্চিতে পেড়ে আরাম করে গেছলাম। ইস্টিশনে নামার তাড়ায় সেখানকার কথা খেয়াল ছিল না। জেল কোম্পানির কম্বল রেল কোম্পানিকে দিয়ে এসেছি।

আর শীর্ষস্থানীয় সেই বালিশটা? আমার বোন পুতুল ওরফে সরস্বতী (তখন বসু, এখন মিত্র) বন্ধুর কাজ করেছিল একবার। হঠাৎ আমার বাসায় এসে বিছানায় বালিশ নেই দেখে সে অবাক।–এ কী? তোমার মাথার বালিশ নেই কেন গো?

পাব কোথায়? তাছাড়া, বালিশের আমার দরকার লাগে না। বিছানায় পড়লেই ঘুম। ঘুমটাই আসল, বালিশটা নয়…।

সে কী হয় নাকি? বালিশ পাব কোথায়, তার মানে? বিছানা যেখানে পেয়েছিলে, খুঁজলে সেই দোকানে তার বালিশটাও পেতে। পেয়ে যেতে অমনি।

হ্যাঁ, দিচ্ছে অমনি! বিছানা তো জেলখানার, কাউকে বলিসনে যেন, তাহলে আবার জেলে নিয়ে পুরবে আমায়। তারা শুধু বিছানাই দেয়, এই কম্বল। বালিশ ফালিশ দেয় না ভাই।

ঘুমুতে কি করে তাহলে? ঘুমোও কি করে শুনি?

 ঘুম তো আমার হাতে। আমার হাতের পাঁচ।

বললেই হোলো! দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি তোমার বালিশ। কাছেই কমলালয় স্টোরস, ট্যাকসি নিয়ে যাই আর আসব।

ওর বলাবলিতে বৈষ্ণব পদাবলীর সেই রতিলালিশ ভুজবালিস সুখআলিশ-এর কথা মনে পড়ল আমার। রতিলালিশ না থাক, ভুজবালিস তো রয়েছেই! পরহস্তগত না হোক। (পরহস্তগতির ভরসা করিনে ), নিজের হাতেরটা যাবে কোথায়?

নিজের হাতে মাথা দিয়ে ছেঁড়া কাঁথায় আয়েশে ঘুমোনো যায়–ঘুমটাই হচ্ছে আসল। ঘুমের মতন শয্যা আর হয় না। খিদের মতন সুখাদ্য নেই।

এত বেলায় বাসায় তো এখন ভাত বাড়ন্ত। খেতে পাবেন না গিয়ে। এখানেই দুটি খেয়ে যান না! গিন্নী খিচুড়ি বেঁধেছেন আজ শুনছিলাম।

খিচুড়ি! শুনেই আমি লাফিয়ে উঠেছি। যে আমি খিচুড়ি-প্রীতির প্রেরণায় জেলখানার লসিকেও খিচুড়ি-ভ্রমে খেয়ে খুসি হয়েছি–সেই আমার আজ অনিবার্য হরিমটরের দিনে (অবশ্যি মল্লিকবাড়ির জগন্নাথপ্ৰসাদ পাওয়ার সময় ছিল তখন, যেতে বাধাও ছিল না। কোনো) এই মেঘ না চাইতেই জলের মত কম্বল চুরি করে আনার পরই এই খিচুড়ি!

ভাগ্যের এমন যোগাযোগ আর হয় না!

জেলখানায় সেই সাতসকালে রুটি মাখন ডিমের প্রাতরাশের পর এতক্ষণের হা পিত্যেশে এমন খিদে পেয়েছিল যে, কহতব্য নয়।

সেদিন আনন্দধামের খিচুড়ি খেয়ে অদ্ভুত আনন্দ পেয়েছিলাম!

খিচুড়িটাও ছিল অদ্ভুত! এমন খিচুড়ি আমি আর কোথাও খাইনি, তার আগেও না, পরেও নয়। চালডালের গলাগলি গায়ে-গায়ে জড়াজড়ি যা সচরাচর খেয়েছি তার থেকে এ স্বতন্ত্র, একেবারে পৃথক। খিচুড়ির প্রত্যেক অণুপরমাণু পৃথক পৃথক। ফ্রায়েড রাইসের মতই অনেকটা, একরকমের বেশ ঝরঝরে খিচুড়ি! আর গাওয়া ঘি দিয়ে খেতে যা উপাদেয় তা বলবার না।

পরিপাটি খেয়ে চাবিকাঠি নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে কম্বলের ওপরে বেডকভার বিছিয়ে সটান হওয়া গেল লম্বা হয়ে।

একটানা একখানা ঘুমের পর বিকেলে উঠতেই দেখি, কেতাদুরস্ত এক চাপরাসী অপেক্ষা করছে আমার জন্য–সুভাষচন্দ্রের চিঠি নিয়ে। সুভাষবাবু তখন কলকাতা কর্পোরেশনের চীফ এজিকিউটিভ অফিসার।

সি-ই-ওর শীলমোহর লাঞ্ছিত সেই খামখানা খুলে জানলাম, সুভাষচন্দ্র আজ সন্ধ্যের পর তাঁর বাড়িতে দেখা করতে বলেছেন আমাকে।

গেলাম তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে যথাসময়ে।

তাঁর কাছ থেকে জানলাম যে, উপেনদা (উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) সম্প্রতি অন্তরীণ, তাঁর কাগজ সাপ্তাহিক আত্মশক্তির ভার দিয়ে গেছেন তাঁর ওপর। আর দেশবন্ধুর ইচ্ছা, আমাকেই যেন সম্পাদক করা হয়। তার ধারণা, উপেন্দ্রনাথের পত্রিকার মর্যাদা আমার হাতে ক্ষুণ্ণ হবে না, সম্পাদকরূপে আমি মোটেই অনুপযুক্ত হব না নাকি।

এই দেখুন না দেশবন্ধুর চিঠি। সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর পত্রটা আমার হাতে দিলেন, পেনসিলে লেখা কয়েক ছত্রের নোট–তার একটি কথা ভুলতে পারিনি এখন। শিবরাম, এ গুড রাইটার অব বেংগলি পোজ বলে পরিচয় দিয়েছেন তিনি আমার।

তারপরে টেলিফোনেও কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে আমার… সুভাষ বললেন তার ওপরে : তাহলে লেগে যান আপনি কাল থেকেই? কেমন?

লেগে গেলাম। তারপরই।

.

৭০.

 জেল থেকে বেরিয়ে আত্মশক্তির সাহায্যে যাতে আমি স্বপ্ৰতিষ্ঠ হতে পারি, তার এই ব্যবস্থা করে রাখা দেশবন্ধুর এই অহেতুক মেহকলার আমি কোনো তুলনা পাই না। যাঁকে সর্বক্ষণ সারা দেশের ভাবনায় সমস্যায় জর্জর হতে হচ্ছে, তাঁর অভিভাবনার এককোণে আমার ন্যায় নগণ্যদের জন্যও যে একটুখানি ঠাঁই রয়ে গেছে ভেবে অবাক হতে হয়।

যে উত্তম রহস্য সন্তানজন্মের আগেই তার জন্য মাতৃস্তন্যের বন্দোবস্ত করে রাখে তাঁর মধ্যে সেই ভগবৎ সত্তার সাক্ষাৎ পাই যেন। যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা–তাঁরই পরিচয় মিলে যায় যেন।

হেদোর পৈঠায় বসে যে ছেলেটি একদা বলেছিল আমায় যে দেশবন্ধু গঙ্গাই, মনে হয় তাই বটে। যে গঙ্গাকে রসালযাত্রায় একদা পাতালবাহিনী ভোগবতীরূপে দেখা গেছে, সেই তিনিই আরেকদিন সর্বত্যাগব্ৰতী হয়ে রসাতলের সেই ভোগবতী-কন্যাদের দেশসেবার দাতে দীক্ষা দিয়েছেন, তারা দলে দলে এসেছে রাজপথ ধরে স্বরাজ ভান্ডারে প্রাণের চেয়ে প্রিয় অলঙ্কার দানের অভিযানে, কে না জানে? পতিতাদের একদা আকর্ষণ করেছিলেন বুদ্ধদেব, যিশুখৃষ্ট, তারপরে পরমহংসদেব আর এই সেদিন আমাদের দেশবন্ধু। পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা–এঁরা সবাই।

গঙ্গাই বটে। যে গঙ্গা মনের মণিপদ্মাসনে আত্মস্থতার গভীরতায়, গাম্ভীর্যে, বিস্তারে, বিরাটের অব্যয় অভিব্যক্তি, সেই তিনিই পদ্মার মতই আবার অথৈ, উত্তাল, অকূলের কূলভাঙ্গা বিপুল ভাঙাগড়ার খেলা–তিনিই ফের মহাভারতের হৃদয়প্লাবী ভাগীরথীর মৃতসঞ্জীবনী। প্রাণপ্রবাহের অজস্রতা। কাব্যলোকের সুরধুনীরূপে সাগরসঙ্গমের মোহানায় গিয়ে যিনি আত্মহারা, তিনিই আবার গঙ্গোত্রীর পথে অলখঝোরা পেরিয়ে ভুবনেশ্বর নগাধিরাজের জটাজুটে অলকনন্দা। মহেশ্বর শিরশ্চ্যুত জাহ্নবীর এই রূপের পঞ্চপ্রদীপে সেই মহাদেবের মহারতি!

ভাবলাম একবার, তাঁর কাছে গিয়ে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসি। যাইনি, জানি তো তিনি তার অপেক্ষা রাখেননি। তাছাড়া কৃতজ্ঞতার ভাষাও আমার জানা নেই। কাউকে কোনো দিনই তা জানাতে পারিনি। তুচ্ছ মুখের কথায় প্রাণের ঋণ পরিশোধ করা যায় তা আমি মনে করিনে, চিরকালই তা অপরিশোধ্য থেকে যায়। তাছাড়া প্রায় ভালোবাসার মতই ঐ কৃতজ্ঞতাও বাইরের স্তরে নয়, অন্তরের অনুভবে।

এক মনের অনুভূতি অগোচরে সহজেই অপর মনে গিয়ে পৌঁছয়–এক কূলের ঢেউ আপনার থেকেই অন্য কূলে গিয়ে লাগে। নিজগুণেই তিনি টের পেয়েছেন, সন্দেহ নেই।

আত্মশক্তির সাধনায় লাগা গেল তারপর। এমন কিছু অসাধ্যসাধন শক্ত কাজ ছিল না। ডবলক্রাউন চার পেজী সাইজের আট পাতার কাগজ–কিংবা ষোলো পাতারই হবে হয়ত, মনে পড়ে না। যুগান্তরের মতন তার আগাপাশতলার সবটাই লিখতে হত না আমায়, আত্মশক্তির লেখকগোষ্ঠী ছিল, উপেনদাই গড়ে দিয়ে গেছলেন। তাঁদের লেখা পাওয়া যেত নিয়মিত। সেসব লেখা দেখেশুনে দেওয়ার কিছু ছিল না–প্রতিষ্ঠিত লেখক তাঁরা। নবীন লেখকদের লেখাও, লেখার মত হলে ছাপাবার আমার কোনো অন্যথা হত না। আগে ছাপতাম।

পরিচালনার কোনো দায় আমার ছিল না। চন্দননগর গোঁদলপাড়ার প্রাক্তন বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কর্মাধ্যক্ষ, সেসব দিক তিনিই সামলাতেন। যুগান্তরের যেমন আগাগোড়া সব লেখার থেকে শুরু করে সম্পাদনা, প্রুফ দেখা এবং প্রেসে চাপানোর আগে তার মেক-আপ-এ সহযোগিতা করা পর্যন্ত সব কিছুর সামাল দিতে হয়েছে আমায়, এমনকি তার পরেও ডাকের কাগজের মোড়কে গ্রাহকদের নাম ঠিকানা লেখাও বাদ ছিল না, ডাকঘরে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসা তো ছিলই–সেসব ঝামেলা পোহাতে হয়নি এখানে।

আর মাসকাবারে ককরে সেই একশো টাকা নিয়মিত। যে কমাস আমার বরাতে ছিল সে সময়টা স্বচ্ছন্দ নির্ভাবনায় কেটেছে। আদাজল খেয়ে লাগতে হয়নি, রাবড়ি বা মটন চপের সঙ্গে লাগসই হয়ে আরামে কাজ চালিয়ে গেছি।

তবে বেশিদিন এই স্বাচ্ছন্দ্যের সুখ আমার কপালে সয়নি। আমার ভেতরে বোধকরি এক ঘূণী আছ, সেই যে, ধূনী হাওয়ায় ঘুরিয়ে দিলো সূর্য তারাকে, সেই ঘূর্ণীই সূর্যতারার সঙ্গে কপাল সমেত আমাকেও ঘুরিয়েছে বারংবার।

আত্মশক্তি আমি নিজেই ছাড়লাম একথা বলা যায় না, কোন কিছু আপনার থেকে ছাড়ার ক্ষমতা বা অহঙ্কার আমার নেই, মায়াবদ্ধ জীব, সহজেই সব কিছু আর সবার প্রতি আসক্ত হই, ছেড়ে যাবার শক্তি রাখি না। ছাড়লাম না বলে ছাড়িত হলাম বলাটাই ঠিক।

আর, সেটা হয়েই থাকে–পৃথিবীর সবক্ষেত্রে জীবনের পথ চলায় স্বভাবতই তা হয়ে যায়, তা নিয়ে কোনো অভিযোগ চলে না। আমারও কোনো অভিযোগ নেই। জাগতিক নিয়মে এরকমটা হবেই সর্বদাই, না হয়ে যায় না।

আমার পরে আত্মশক্তি কর্ণধার হয়েছিলেন বিজলী-সম্পাদক স্বনামধন্য নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত, তাঁর পরে সরোজকুমার রায়চৌধুরী, গোপাললাল সান্যাল। গোপালবাবু আর সরোজ সুভাষচন্দ্রের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। আমার সম্পাদিত আত্মশক্তিতে, যতদূর মনে করি, সবরাজের প্রথমকার লেখা সব বেরিয়েছে।

তারপরে ফরোয়ার্ড পাবলিশিং-এর হাতে গিয়ে আত্মশক্তি নবশক্তি-র নবকলেবর লাভ করে। তখন তার সম্পাদক হন একদা বিপ্লবী তারানাথ রায়। তাঁর সময়ে নবশক্তির আকর্ষণ আর মহিমা অনেক বেড়ে যায়। এর পৃষ্ঠাতেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম একাঙ্ক নাটক বুদ্ধদেব বসুর একটি মেয়ের জন্য প্রকাশ পায়। তারপরের হপ্তায় অচিন্ত্যর নতুন তারা আর বোধকরি তার দু-এক সপ্তাহ বাদেই একাঙ্কিকায় আমার সম্পূর্ণ নাটক যখন তারা কথা বলবে।

প্রথম একাঙ্কিকা লেখার গৌরব বুদ্ধদেব কি মন্মথ রায়ের, পজিপুথি তারিখ মিলিয়ে আমি সঠিক বলতে পারব না। মন্মথ রায়ও এইকালেই একাঙ্কিকা লিখতেন, কল্লোলে এবং অন্যত্র। এই ক্লাসের কে ফাস্ট বয় তা গবেষকরা বিচার করে বলবেন।

প্রেমেন্দ্র মিত্র সমসাময়িক জাগরণী পত্রিকায় আমার ঐ একাঙ্কিকার আলোচনা করেছিলেন। সেটা আমার নাটিকার প্রশস্তি হলেও কাজটাকে আমি প্রশস্ত বলতে পারি না। প্রেমেন সেকালে আমার প্রতি একটু পক্ষপাতদুষ্ট ছিল মনে হয়। তার প্রথম বই পুতুল ও প্রতিমা উৎসর্গ করেছিল আমায়। তার আর সব বন্ধুর তুলনায় আমার অনেক অযোগ্যতা থাকলেও, অভিযোগ করার কিছু নেই, কেননা স্নেহ ভালোবাসা সর্বকালে সর্বত্রই নিতান্ত অযোগ্যর প্রতিই বর্ষিত হয়ে থাকে।

তারানাথ রায়ের পরে নবশক্তির সম্পাদক হন অকালে লোকাতরিত শক্তিধর লেখক অদ্বৈতমল্ল বর্মণ–তাঁর বিখ্যাত বই তিতাস একটা নদীর নাম তাঁর সম্পাদিত কাগজেই ধারাবাহিক বেরয়। তাঁর প্রতিভা প্রায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগোত্রীয়ই বলা যায়। যদিও তা পূর্ণ বিকাশলাভের সুযোগ পায়নি। এই সম্পর্কে এটাও হয়ত উল্লেখ করা চলে, জানিনে ঠিক, তৎকালে ক্যাপটেন নরেন দত্তর তত্ত্বাবধানাধীন নবশক্তির সম্পাদনায় তাঁদের প্রচারসচিব প্রেমেন মিত্রেরও সম্ভবত কিছু সহায়তা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু প্রেমেন বেশীদিন ছিলেন না, কাজে ঢুকেই তিনি পরিস্থিতি টের পেয়েছিলেন এবং বলেও ছিলেন আমাকে যে, ঠিক বুঝতে পারছি না ভাই। দায়িত্ব থাকলেও এখানে কাজের স্থায়িত্বর কোনো সম্ভাবনা দেখছিনে। আমি তাকে বলেছিলাম, বেঙ্গল ইমিউনিটি না? সারা বাংলার সবাই এ সংস্থায় ক্ষণকালের সঙ্গ দিয়ে প্রবেশ ও প্রস্থান করবে–বেংগলের দিকে হচ্ছ তোমরা, আর ইমিউনিটির দিকে একজন মাত্রই–ঐ ক্যাপটেন দত্ত।

যাই হোক, অল্পদিনের হলেও, আত্মশক্তির সম্পাদনা সূত্রে সামান্য আমিও কলকাতার মান্যগণ্যদের মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি। দেশের কৃতি পুরুষরাই কেবল নয়, কলকাতায় সাংস্কৃতিক দিকটারও পরিচয় পেয়েছিলাম সেই সময়। আত্মশক্তির দৌলতে শহরের রঙ্গমঞ্চগুলির আমন্ত্রনপত্র পাওয়া যেত–প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় রজনীতেই। তা ছাড়াও যখন-তখন চাওয়া মাত্র যটা ইচ্ছা পাশ মিলত যে-কোনো রঙ্গমঞ্চে।

প্রথম আমন্ত্রণী পাই শিশিরকুমারের। তাঁর অ্যালফ্রেড রঙ্গমঞ্চে-একালে যেখানে গ্রেস সিনেমা-বসলীলার উদ্বোধন-রজনীতে। সেখানেই সুনীতি চাটুজ্যে থেকে ভারতী গোষ্ঠীর মণিলাল গাঙ্গুলি, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী,হমেন্দ্রকুমার রায় সবারই দেখা পাই। কারো কারো সঙ্গে এক আধটু আলাপও হয়েছিল আমার। নজরুল, নৃপেন চাটুজ্যেকেও সেখানে দেখি। কল্লোলের আরো কাউকে কাউকেও।

তারপর স্টার, মিনার্ভা, মনোমোহন (যাকে ভেঙেচুরে দিয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর রাস্তা বেরিয়ে গেছে) থিয়েটার–সব কটারই। স্টারের কর্ণার্জুন, ইরাণের রাণী থেকে রবীন্দ্রনাথের শোধবোধ, চিরকুমার সভা, গৃহপ্রবেশ, মিনার্ভায় মিসরকুমারী, কিন্নরী, আলিবাবা, ভূপেন বাঁড়ুজ্যের যত প্রহসন, ক্ষীরোদপ্রসাদের নাটকাদিও, মনোমোহনে কী কী দেখেছি এখন মনে পড়ে না, শিশিরবাবুর নানা নামান্তরে নানান রঙ্গমঞ্চের সংখ্যাহীন প্রযোজনা–সেই সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির হলে বসে রবীন্দ্রনাথের নাট্যবিচিত্রা।

শেষ নাটকও দেখা আমার শিশিরকুমারের শ্রীরঙ্গমেই। কী নাটক মনে নেই, দেখতে গেছি, পাশ হলেও সাধারণত টিকিটে নম্বর লাগিয়ে বুকিং থেকে সেটা কেটে নিতে হয়–সেদিন কিন্তু তা হয়নি। অভিনয় আরম্ভ হবার দেরি ছিল না। শিশিরবাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, তিনি ভাইদের কাকে (ঋষীবাবুকে বোধহয়, নাকি মুরারিবাবুকেই, কে জানে) বললেন, ওঁর আবার টিকিট কিসের? ওঁকে নিয়ে গিয়ে প্রথম শ্রেণীর একটা সীটে বসিয়ে দাও গে।

অডিটোরিয়ামে ঢুকে প্রথম সারির ধার ঘেঁষে একটা আসনে বসলাম গিয়ে।

খানিকবাদে এক দর্শক এলেন, তাঁর কাছে ঐ নম্বরের টিকিট। তাঁকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাশের সীটটায় বসলাম তখন। আরেকজনা এলেন তারপর, ওই সীটের নম্বর। তাঁকেও জায়গা ছাড়তে হোলো। সেখানেও এল আবার আরেক। তাঁকেও ছাড়লাম। তারপরও আরেকজন আবার, মার্কামারা টিকিট নিয়ে, তাঁকেও ছেড়ে দিলাম।

এইভাবে অভাবনীয় আবির্ভাবে একটার পর একটা ছাড়তে ছাড়তে লোম দ্বিতীয় সারির প্রথম নম্বরে। সেটাও পার হতে হল ঐভাবে। অমনি করে তৃতীয় সারিও পেরিয়ে গেলাম তারপরে। সরতে সরতে একেবারে শেষ সারির শেষতম আসনে গিয়ে পৌঁছলাম।

কিন্তু সেখানেও নিস্তার নেই। সারগর্ভ প্রেক্ষাগৃহের সারাৎসার সীটেরও একজন অভ্যাগত এলেন।

বাধ্য হয়ে উঠতে হোলো এবারও।

পাশে পাশে চল ভাই!–আমার পার্ষদ সবার পাশ কাটিয়ে শেষটায় শূন্যতার সীমানায় গিয়ে পৌঁছলাম।

কিন্তু মরীয়া হয়ে একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারলাম না এবার। শুধালাম তাঁকে-কিছু যদি মনে না করেন, আপনার টিকিটটা একটু দেখতে পারি কি?

টিকিট কোথায়? পাশ তো!

পাশ! আমি যেন আকাশ থেকে পড়ি।

পাশ তো মশাই সবারই। শিশির ভাদুড়ির থিয়েটার পয়সা দিয়ে দেখে কেউ? তাঁর বসুধৈব কুটুম্বক-দেশে দেশে চ বান্ধবা (তাঁর বকবকম শুনতে হয় আমায়) হোল অডিটোরিয়ামে টিকিট কাটেনি একজনাও। এই যে ফুল হাউস দেখছেন, এর ভেতর ফুল নেই একজনও। সবাই ওয়াইজ। শিশির ভাদুড়ির মায়াপাশেই এই ফুলহাউস, নইলে পাশ বিহনে এ থিয়েটার ফাঁকা হয়ে যেত মশাই–বুঝচেন?

বুঝলাম বইকি। আমি বলি–একজন অবশ্যি ফুল আছেন এর ভেতর। বদান্য বোকা তিনি। ঐ ভাদুড়ি মশাই-ই।

বলে আমি বেরিয়ে আসি। তারপরে আর কোনোদিনই ওমুখো হইনি।

কবিগুরুর গানের কলি মনে পড়ে–সে যে পাশে এসে বসেছিল তবু জাগিনি! সে কি তার এই জাতীয় অভিজ্ঞতার থেকেই বা নিছক কল্পনাকুশলতা?

আমি তো জাগলাম তারপরই, ওধার ঘেঁষলাম না আর, কিন্তু অত জন-বাংলা মুলুকের শত সহস্র জন তাঁর পাশে এসে বসার পরও শিশিরকুমার যথাসময়ে সজাগ হতে পারেননি। কী ঘুম তাঁর পেয়েছিল তিনিই জানেন।

তারপর জেনেছি, শিশিরবাবুর রঙ্গমঞ্চও ঐ পথেই পাশ কাটিয়ে পাশ আউট হয়ে গেছে একদিন–নিজের অবলীলায়।

তাঁর থিয়েটারি পাশা খেলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *