আমি সিরাজের বেগম – ৮

সেইদিনই গভীর রাতে সিরাজ এল। চোরের মতো চুপিচুপি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। তার চোখ-মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, কপাল কেটে রক্ত বার হচ্ছে। পোশাক ছিন্নভিন্ন, ধূলিমলিন, নগ্নমস্তক!

আমার সামনে দাঁড়িয়ে সিরাজ যেন কত সঙ্কুচিত, ‘তোমাকে বিরক্ত করলাম, লুৎফা?’

‘সে কি কথা?’ ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিতে যাই।

সে আমার হাত চেপে ধরে, ‘না-না, ও কী করছ?’

‘এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে?’

‘হ্যাঁ, নইলে ওরা যে দেখে ফেলবে।’

‘কারা?’

‘মিরজাফরের চর। সব জায়গায় আছে ওরা।’

‘তবে কি ঘসেটি বেগমের কথাই সত্যি হল?’

‘ঘসেটি! সে কখনও বাজে কথা বলে না।’

‘কী হবে, নবাব?’

সিরাজ আমার মুখ চেপে ধরে, চুপ, আমি নবাব নই। আমি, আমি…’

‘তুমি আমার নবাব।’

‘এখনও একথা বলছ?’

‘চিরকাল বলব।’

‘আমি আসায় তবে বিরক্ত হওনি?’

এবারে কেঁদে ফেলি, ‘ওকথা কী করে বলছ তুমি?’

‘ওরা বিরক্ত হল কিনা, তাই বলছিলাম।’

‘ওরা কারা?’

‘অন্য বেগমরা। পুরোনো মহলেই আগে গিয়েছিলাম। আমার বেগমরা আজকের চেহারা দেখে হেসেই অস্থির। তাড়িয়ে দিল। বলল, এতদিনে মনে পড়েছে। দূর হও। আর-একজন কে যেন চুপিচুপি ডেকে গঙ্গা পার করে দিল। তাই তোমার কাছে এলাম।’

‘ওরা নিষ্ঠুর, ওরা পাষাণ।’

‘না লুৎফা, ওরাও তো মানুষ। আমি সেটা ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘তবু মানুষ হলে তোমার এ দুর্দিনে এভাবে উপহাস করতে পারত না।’

‘না-না, তারা ঠিকই করেছে।’

‘থাক্ ওসব কথা, এখন ঠান্ডা হও। একটু ঘুমিয়ে নাও।’

‘ঘুমিয়ে নেব!’ সিরাজ চমকে ওঠে। তারপরই পাগলের মতো হেসে ওঠে।

‘কেন, তুমি কী করতে চাও?’

‘পালাব, পালাতে চাই।’

‘কোথায়?’

‘তা তো জানি না। তাই তো তোমার সঙ্গে শেষ দেখা করতে এলাম।’

এবারে আমার হাসির পালা। সত্যিই হাসি।

‘তুমিও শেষে হাসলে, লুৎফা?’

‘হাসির কথা বললে সবাই হাসে নবাব।’

‘আবার নবাব?’

‘হ্যাঁ, নবাব, নবাব, নবাব…আমার নবাব।

‘কেন হাসলে?’

‘তোমার শেষ দেখা করার কথা শুনে।’

‘তুমি ঠিক বুঝছ না ব্যাপারটা।’

‘সব বুঝেছি। তবু বলছি, শেষ দেখা অত সহজে হয় না।’

‘তোমার কথায় হেঁয়ালি।’

‘সব বলছি। একটু বোসো।’

‘বসবার সময় নেই। ‘

‘বেশ, তবে একটু দাঁড়াও। হামিদাকে ডেকে আনি।’

‘না-না, ডেকো না ওকে।’

‘কেন?’

‘ও হয়তো মিরজাফরের চর।’

‘না নবাব, হামিদা আমার অনুগত। একটু দাঁড়াও।’

‘কিন্তু ও যে আমাকে এ অবস্থায় দেখবে?’

‘দেখুক, ক্ষতি কী? তোমার শত্রু নয় ও, বেগমও নয়। দেখে ও হাসবে না, কাঁদবে।’

হামিদা এসে সিরাজকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে কদমকেশী করে। মেয়েটাকে তার কোলে তুলে দিয়ে বলি, ‘নিজের মেয়ে ভেবে মানুষ কোরো হামিদা। যদি ভাগ্যবলে কোনোদিন তোমার দেখা পাই, তাহলে তোমার কাছ থেকে একে চেয়ে নেব আবার।’

‘এসব কী হচ্ছে!’ সিরাজের মুখে বিস্ময়।

তার কথায় জবাব না দিয়ে সামান্য কিছু জিনিস কাঁধের ওপর ফেলে নিয়ে বলি, ‘চলো।’

‘কোথায়?’

‘সে তুমি জানো।’

আমি কোথায় যাব তা তো জানি না, লুৎফা।’

‘আমিও কি জানতে চাইছি? আমি বলছি, তুমি যেখানেই যাবে আমি সঙ্গে যাব।’

‘লুৎফা!’ সিরাজ শিশুর মতো কেঁদে ওঠে।

তার মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরি, ‘ভোর হতে আর দেরি নেই, নবাব।’

‘চলো। মেয়েটাকে কী করবে?’

হামিদা আমাদের সঙ্গে হীরাঝিলের বাইরে পর্যন্ত যাবে। তারপর সে নিজের পথে চলবে। আর আমি চলব তোমার পথে।’

‘আমার পথ তো সহজ নয়, লুৎফা। তুমি কি পারবে? তার চেয়ে হামিদার সঙ্গে চলে যাও মুর্শিদাবাদ ছেড়ে অনেক দূরে কোনো গাঁয়ে।’

‘না, আমি বাংলার বেগম। বেগম কি কখনও নবাবের সঙ্গ ছাড়ে? বেগমরা যেমন সুখ-ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারে, প্রয়োজন হলে তেমনি দুঃখও সহ্য করতে জানে।’

হীরাঝিলের বাইরে আসি সবাই মিলে। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে বেশিদূর অবধি হামিদাকে দেখতে পেলাম না। তবু যতক্ষণ দেখা গেল চেয়ে থাকলাম একভাবে তার কাঁধের ওপর ঘুমন্ত পদ্মফুলের দিকে—বোঁটা ছিঁড়ে নেওয়া পদ্মফুল। অনেক কাঁদিয়েছি মেয়েটাকে, তবু কি কান্নার শেষ হয়েছে? হীরাঝিল থেকে মাটির ঘরে গিয়ে তার হাসি-কান্না দুই-ই হয়তো থেমে যাবে।

‘দাঁড়িয়ে আছ কেন নবাব, যাবে না?’ চোখের জল মুছে ফেলে বলি।

‘হ্যাঁ যাব, চলো।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিরাজ ধীরে ধীরে গঙ্গার পাড় ধরে চলতে থাকে। আমি অনুসরণ করি তাকে।

‘দেখছ লুৎফা, গঙ্গা ভাঙতে ভাঙতে হীরাঝিলের দিকে কী রকম এগিয়ে আসছে? গ্রাস করবে শিগগিরই।

‘সেই ভালো। তাই হোক নবাব।’

.

হঠাৎ ঘসেটি বেগমের কথা মনে পড়ল। সে নদীপথে যেতে মানা করেছিল। সিরাজকে প্রশ্ন করি, ‘আমরা কী ঘোড়ায় চড়ে যাব?’

‘না, বজরায়…মানে নৌকায়। অন্ধকারে যে লোকটা আমাকে গঙ্গা পার করে দিল, সেই ঠিক করে দেবে বলেছে। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষের সাধারণ পোশাকও সে জোগাড় করে এনে দেবে। অথচ মজা কি জানো, তাকে আমি চিনি না। মুর্শিদাবাদে আমার হিতৈষী এখনও কিছু কিছু আছে, লুৎফা।’

‘অনেকেই আছে নবাব। যারা তোমার প্রকৃত পরিচয় জানে, অথচ শয়তানদের জন্যে তাদের কিছু করার উপায় নেই, তাদের অধীনে যে কোনো ফৌজ নেই। কিন্তু তোমার তো নদীপথে যাওয়া ঠিক হবে না।

‘কেন?’

‘ধরা পড়তে পারি। ঘসেটি বেগম বলেছিল।’

‘স্থলপথে যাবার কোনো আয়োজন তো করিনি।’

‘তবু হেঁটেই যাব।’

‘আমার যে আর শক্তি নেই, লুৎফা।’

‘কিন্তু এতে যে ধরা পড়তেই হবে। একটা নদীর দিকে নজর রাখা কত সহজ ওদের পক্ষে ‘এখন সে-কথা বুঝছি। সুযোগ পেলে ঘসেটিকে কৃতজ্ঞতা জানাব, আর যদি কখনও সেদিন আসে, বাংলার মসনদে তাকেই বসাব। ‘

‘নৌকায় যেও না, নবাব।’ সকাতরে তাকে অনুরোধ করি।

‘তাহলে এখানেই থাকি। আমি আর পারছি না, লুৎফা।’ সিরাজ আমার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে বসে পড়তে চায়। দেখলাম, তার কপালের ক্ষত দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

‘না, চলো।’ জানি, যেমন করেই হোক, যেতেই হবে। থামলে চলবে না। হীরাঝিলের মায়া কাটাতে হবে, মুর্শিদাবাদকে ছাড়তে হবে। হয়তো বাংলাকেও ত্যাগ করতে হবে।

.

নিরুপায় হয়ে নৌকোতে গিয়ে উঠতে হয়েছিল। অন্ধকারের মধ্যে একজন পুরুষ সাধারণ কিছু পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে এসে বলে, ‘এগুলো বদলে নিন। আপনাদের পোশাক গঙ্গার জলে ফেলে দেবেন।’

‘ও! বেশ, তাই দেব।’

‘আমি চলি।’ পুরুষটি বলে।

‘যাও। কিন্তু তোমার পরিচয় তো দিলে না। তবু শেষ নিঃশ্বাস ফেলা অবধি তোমার কথা মনে থাকবে।’

‘সেইটুকুই আমার সৌভাগ্য।’ তার কথায় দৃঢ়তা। বিন্দুমাত্র বাষ্প নেই তাতে।

উপকারীর পরিচয় না পেলে ভালো লাগে না, একথা জানো তো?’ সিরাজ বলে। ‘তবে শুনুন, নবাব আলিবর্দির সমাধির ওপরে একখানা লালবস্ত্র দেওয়া হয়েছিল, স্মরণ আছে আপনার?’

‘হ্যাঁ আছে। কে দিয়েছিল নাম জানি না। তবে তাকে ভুলিনি, ভুলতে পারিনি। তাকে আসতে বলেছিলাম চেহেল-সেতুনে, কিন্তু সে আর আসেনি।’

‘আমি তারই ছেলে।’ পুরুষটি অন্ধকারে অদৃশ্য হয়।

‘নৌকার ওপর একভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সিরাজ। সে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক। ভুলে গিয়েছে যে, চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছে সে। বুঝলাম, উপকারী বন্ধুর চিন্তা তার মন অধিকার করে রয়েছে।

‘পোশাক বদলে ফেলো, নবাব।’

‘আর নবাব বলে ডেকো না। অভ্যাসটা বড় খারাপ। অন্ধকারে কে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে কে জানে। পাশেই ওই জেলে-নৌকাটি হয়তো তাদের। দেখলে না, যে-বন্ধুটি পোশাক দিয়ে গেল, সে একবারও নবাব বলে ডাকেনি। কারণ সে জানে, তাতে বিপদ ঘটতে পারে।’

ঠিক সেই সময়ে পারের কোনো গাছ থেকে পেঁচা ডেকে উঠল। সিরাজ আমার হাত চেপে ধরে বলে, ‘দেখলে তো ধরা পড়ে গেলাম।’

‘সে কী!’

‘মিরজাফরের চরেরা চেঁচিয়ে উঠল, শুনলে না?’

‘মানুষ নয়, পেঁচা ডাকল। তুমি স্থির হয়ে বোসো। মাঝ-নদীতে গিয়ে পোশাক বদলালেই চলবে।’ বুঝলাম, পর পর কয়েকদিনের নিদ্রাহীনতা, পরিশ্রম আর দুর্ভাবনায় সিরাজের মস্তিষ্ক সুস্থ নয়।

‘ও, পেঁচা? তাই বুঝি?’ সিরাজ ছেলেমানুষের মতো হেসে ওঠে।

.

ভগবানগোলা অবধি সিরাজ একভাবে ঘুমোল। তবু ভালো যে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা জেনেও এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে সে ঘুমোতে পেরেছে। তবে তার জন্য আমার চোখে একবারে ঘুম নেই।

ভগবানগোলায় মাঝিরা নৌকা ছেড়ে ডাঙায় যেতে চাইল কিছু খেয়ে নিতে। সিরাজের জন্যে ও সামান্য কিছু আনতে বললাম তাদের। তারা আমাদের চেনে। তাই বলেছিলাম, কোনোরকম ভালো খাবার যেন আনতে চেষ্টা না করে। সাধারণ যাত্রীরা যা খায়, তা পেলেই চলবে।

মাঝিরা ফিরে এল, সঙ্গে এক ফকির। বোরখা টেনে দিয়ে মাঝিদের খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করায় তারা বলল, ‘খাবার তো আনিনি, দানাসায়েব নিজেই এলেন।’

‘ইনি কে?’

‘ফকির, খুব বড় ফকির।’

‘কেন এলেন?’ মনের ভয় চেপে রাখি।

‘আমার সঙ্গে যাত্রী আছে শুনে উনি ছুটে এলেন।’

দানাসায়েব এবার নিজেই বিনীতভাবে বলে, ‘আমার কুঁড়েঘর থাকতে বাজারের খাবার কেন খাবেন? মেহেরবানি করে সেখানে চলুন।’

‘না-না, আমরা কোথাও যাব না। আমরা নৌকাতেই থাকব।’

‘আপত্তি থাকলে যেতে বলছি না। তবে গেলে অনেক সুবিধে হত।’

আমাদের কথাবার্তায় সিরাজের ঘুম ভেঙে যায়। সে সমস্ত শুনে দানাসায়েবের কুটিরেই যাওয়ার স্থির করে। গোপনে আমাকে বলে, ‘ভাগ্যই সব, লুৎফা ভাগ্য খারাপ হলে শত চেষ্টাতেও নিজেকে বাঁচাতে পারব না। তাই কোনো ব্যাপারে আপত্তি না করাই ভালো।’

দানাসায়েবের কুটিরে এসে কিন্তু ভালোই লাগল। হীরাঝিলে বাস করে কুটিরের এই শান্ত-শ্রীর কথা কল্পনা করা যায় না। এতটুকু জায়গা, অথচ পরিচ্ছন্ন আর ঝকঝকে, তকতকে

সেখানে বসেই আমার চোখের পাতা জড়িয়ে আসে। আর বসে থাকতে পারি না। সিরাজকে বলে একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

.

ঘুম ভাঙল মানুষের চিৎকারে। ধড়মড় করে উঠে দেখি, দানাসায়েবের কুটির প্রাঙ্গণ সৈন্যসামন্তে ভরে গিয়েছে। সিরাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদেরই মধ্যে। আমাকে উঠে আসতে দেখে সিরাজ হেসে বলে, ‘চললাম, লুৎফা?’

‘কোথায়?’

‘মুর্শিদাবাদে। এরা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।’

‘আবার যুদ্ধ করবে? এরা বুঝি তোমারই লোক?’

‘এককালে আমারই ছিল। এখন আর নেই। দেখছ না…’ একজন পুরুষকে দেখিয়ে দেয় সে। আমি চমকে উঠি। মিরন!

‘তাহলে কি…’

‘হ্যাঁ, বন্দি আমি।’ অদ্ভুত শান্ত তার স্বর।

‘তোমার খাওয়া হয়নি?’

‘খেতে দিল না এরা। তাছাড়া খাবারের ব্যবস্থাও করেননি, ফকির-সাহেব। ওটা এখানে নিয়ে আসার অজুহাত।’

দানাসায়েব নির্লজ্জের মতো হি-হি করে হেসে বলে, ‘মুর্শিদাবাদে গিয়ে নবাব বাহাদুর কত ভালো ভালো খানা খাবেন, আমি শুধু তারই ব্যবস্থা করেছি।’

‘চলো, আমিও যাব।’ সিরাজের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।

‘না, তোমাকে এখান থেকে ঢাকায় পাঠানো হবে। দাদিকেও সেখানে নিয়ে গিয়েছে এরা।’

‘ঘসেটি বেগমদের?’

এতক্ষণে মিরনের মুখে কথা ফোটে। সে বলে, ‘তারা এখনও মুর্শিদাবাদে আছে। তাদের ব্যবস্থা পরে করা হবে।’

‘আমি সিরাজের সঙ্গে যাব।’

‘সম্ভব নয়।’ মিরনের জবাব কঠিন।

‘ওকে নিয়ে গিয়ে তোমরা কী করবে?’

‘ঢাকায় বসে সবকিছুই আপনার কানে যাবে।’

সিরাজ বলে, ‘চলি লুৎফা। জেদ কোরো না, লাভ নেই। ও তোমার সিরাজ নয়।’

‘তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না?’ চোখ দিয়ে আমার জল গড়িয়ে পড়ে। ইচ্ছে হচ্ছিল, উঠোনের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদি, কিন্তু বাংলার বেগমের পক্ষে সেটা দুর্বলতা। সিরাজ কৃষক নয়, আমিও কৃষক-পত্নী নই। কিন্তু হলে বড় ভালো হত। কেঁদে শান্তি পেতাম।

সিরাজ এগিয়ে এসে বলে, ‘দেখা হবেই আমাদের।’ বুঝলাম, তার ইচ্ছে হচ্ছিল আমার চোখের জল মুছিয়ে দিতে, কিন্তু বোরখায় মুখ ঢাকা যে।

.

দেখা আর হয়নি। ঢাকায় এসে কিছুদিনের মধ্যেই সেই ভীষণ সংবাদ আমার কানে এল। শুনে মূর্ছিত হয়ে পড়েছিলাম। ঢাকাতেও হাওয়া বয়। আমি ঢাকায় পৌঁছবার আগেই আমার সিরাজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

কিন্তু পথে সে-কথা আমাকে জানানো হয়নি। ওরা ভেবেছিল, জানালে আমাকে আর ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারবে না। ঠিকই ভেবেছিল।

নেমক-হারামির দেউড়িতে এক গুপ্ত প্রকোষ্ঠে সোফিয়ার স্বামী মহম্মদের তরবারিতে আমার সিরাজ প্রাণ হারিয়েছে।

নবাব আলিবর্দির বেগমও আমার মতো মূর্ছা গিয়েছিলেন, কিন্তু সে-মূর্ছা আর ভাঙেনি। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শ্রেষ্ঠ নবাব আলিবর্দির সময়ে যাঁর পরামর্শে রাজত্ব চলত, তাঁর এই মৃত্যুর কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে কি না জানি না।

.

একা থাকি ঢাকায়। পৃথিবীর সব রস শুকিয়ে গিয়েছে। গাছের পাতা পাংশু বর্ণ, আকাশের রং তামাটে। মানুষের চোখে দেখি রক্তের ক্ষুধা। তবু বেঁচে আছি। বেঁচে আছি ভরা যৌবন নিয়ে।

শুধু একটা ছোট্ট শিশুর মুখ মনের মধ্যে থেকে-থেকে ভেসে ওঠে। সে-মুখের সঙ্গে সিরাজের মুখের কত মিল। তার কথা ভাবতে ভাবতে মনটা আনচান করে ওঠে। তখন ঘরময় পায়চারি করি। সে কি আর বেঁচে আছে? আমাদের মতো হামিদাও বোধহয় পথের মাঝে ধরা পড়েছে। সিরাজের শেষ চিহ্নটুকু তার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে, তারই চোখের সামনে বোধহয় সিরাজের দেহের মতো খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলেছে শয়তানের দল।

ঘসেটি বেগম কোথায় রয়েছে কে জানে? আমিনা বেগমের খবরও রাখি না। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মির্জা মহম্মদ নিরাপদে আছে কি না জানি না। বলতে গেলে এই মির্জা মহম্মদই আমিনা বেগমের নিজের ছেলে। সিরাজ ছিল নবাব আলিবর্দির কাছে, আর এক্রাম ছিল নওয়াজিস খাঁর সঙ্গে মোতিঝিলে। তাঁর সবটুকু পুত্রস্নেহ সে একা ভোগ করেছে, সিরাজ আর এক্রাম ভাগ পায়নি।

হীরাঝিলেও আসত না মির্জা। তার মায়ের ভয় ছিল, পাছে কোনো চক্রান্তে পড়ে সে প্রাণ হারায়। তাকে শুধু আমি একবারই দেখেছি, নবাব আলিবর্দির সমাধিক্ষেত্রে। প্রায় সিরাজের মতো দেখতে, তবে দেহ অত সুঠাম নয়, একটু মেদবহুল আদুরে আদুরে ভাব। এক্রাম বড় হলে কিন্তু ঠিক সিরাজের মতো হত।

বেগমগিরি আমার ফুরিয়ে গেল, কিন্তু প্রাণটুকু গেল না। সিরাজের নবাবি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাণও গেল। সে ভাগ্যবান। নবাব আলিবর্দির আদরের নাতি হিসাবে যার জীবন শুরু, মসনদ হারিয়ে বেঁচে থাকা তার পক্ষে বিড়ম্বনা। কিন্তু আমি তো জারিয়া ছিলাম, আবার কি জারিয়া হব?

দানাসায়েবের কুটির-প্রাঙ্গণে মিরনের চোখে যে ইঙ্গিত দেখেছিলাম, সেদিন তা ভেবে দেখার মতো মনের অবস্থা ছিল না, কিন্তু আজ ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠি। মিরন হয়তো আমাকে অন্যান্য বেগমদের মতো হারেমের আসবাব হিসেবে ধরে নিয়েছে। মূর্খ বুঝতে পারেনি যে, যে-বেগম পরাজিত নবাবের সঙ্গে সাধারণ জেলেডিঙিতে করে হীরাঝিল থেকে বিদায় নেয়, সে শুধু হারেমের শোভা নয়; তার প্রাণ আছে। বুঝবেই বা কী করে? কতই বা বয়স? আমার চেয়ে বোধহয় ছোটই হবে। অথচ সাপের বাচ্চা ঠিক সাপ হয়েছে। মিরবক্‌সিকুল মানে নবাব মিরজাফরের সব দোষটুকু পুঞ্জীভূত হয়েছে তার দেহ-মনে।

আর জারিয়া হতে চাই না। কারণ, তাহলে মিরজাফরের হারেমে থাকতে হবে। সেখানে সোফিয়া থাকবে, মিরনও যাবে।

কিন্তু মিরন যা ভেবেছে তাও হবে না। নতুন করে বেগমগিরি যদি করাতে যায় জোর করে, তার আগে মরব।

সিরাজহীন হয়ে বেঁচে থাকার যে এত জ্বালা জানতাম না। সে যদি অত্যাচারী হত, দুশ্চরিত্র হত, তবু যেন ভালো ছিল। জানতাম, সে বেঁচে রয়েছে। একদিন না একদিন অকস্মাৎ আমার কাছে আসবেই। কিন্তু এখন যে সে নেই। সে আর আসবে না।

মরতেও পারি না। মেয়েটা এখনও বেঁচে রয়েছে হয়তো। হীরাঝিলে একসময় আত্মহত্যা করার জন্যে পাগল হয়েছিলাম। তখনও মেয়েটা আর সিরাজের কথা ভেবে পারিনি। তখন একদিন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে মেয়েটা পেটের মধ্যে নড়ে উঠেছিল, আর আজ সে আমার মনের মধ্যে নড়া-চড়া করে।

ভয় হয়, কবে মিরন সশরীরে এসে হাজির হবে, কিংবা প্রস্তাব পাঠাবে। দিনরাত শুধু সেই ভয়েই থাকি। আমার সিরাজ নেই, এখন আমি অসহায়।

কিন্তু প্রস্তাব এল না। মিরনও এল না। পরিবর্তে এল বাংলার ভূতপূর্ব নবাবের বেগম হিসাবে আমার মাসোহারা। সায়েবরা নাকি এ ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যতদিন বেঁচে থাকব, মাসে মাসে কিংবা বছরে এইভাবে পেয়ে যাব। নিশ্চিন্ত হলাম। একবার যখন সিরাজের বেগম হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছি, তখন আমাকে নিয়ে আর টানা-হেঁচড়া করবে না কেউ। মিরনের কবল থেকেও রক্ষা পেলাম।

.

বুড়ি জবেদা আমার কাছে থাকে। সে জারিয়া নয়। নওয়াজিস মহম্মদ খাঁ যখন ঢাকায় ছিলেন, সে তখন তাঁর কাছে থাকত।

আমি যেদিন ঢাকায় এলাম, তার দু’চারদিন পরে সে এসে কেঁদে আকুল। চিনতাম না তাকে। তাই অপরিচিতা বৃদ্ধার কান্নায় অপ্রস্তুত হয়ে কারণ জানতে চেয়েছিলাম। তখনই আমার জীবনের সব চাইতে বড় সর্বনাশের কথা প্রথম জানাতে পারি। এর আগে সবাই জানত, অথচ আমাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। এত বড় দুঃসংবাদ সেদিন সে দিয়েছিল, অথচ তাকে তাড়িয়ে দিইনি। তারই কোলের ওপর মূর্ছিত হয়ে পড়েছিলাম। মূর্ছা ভাঙলে তাকেই জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। তাকে দেখে মনে হয়েছিল, আমার ছেলেবেলার সেই বৃদ্ধা জারিয়ার কথা, আমাকে মানুষ করেছিল যে। যতদিন সে বেঁচেছিল, নিষ্করুণ বেগম মহলে একটু আদরের স্বাদ শুধু তারই কাছে পেয়েছিলাম।

জবেদার কান্নায় সান্ত্বনা পেয়েছিলাম। মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা কতদূর? অথচ এত দূরেও সিরাজদ্দৌল্লার বিচ্ছেদে কাঁদে এমন মানুষও আছে।

মাসোহারা পেয়ে একটু আনন্দ হয়েছিল এই ভেবে যে, মেয়েটা বেঁচে থাকলে তাকে আর হামিদাকে কাছে এনে রাখতে পারব। সেই খবর জবেদাকে দিতে গিয়ে দেখলাম, প্রথম দিনের মতো সে আবার কাঁদছে।

‘কাঁদছিস কেন, জবেদা?’ আমার বুক দুরুদুরু করে। ঠোঁট শুকিয়ে ওঠে। আজকাল কথায় কথায় অমন হয়।

‘আপনাকে শুধু দুঃসংবাদ দেবার জন্যেই কি আল্লা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন?’

‘কী দুঃসংবাদ? আমার মেয়ে কি বেঁচে নেই?

‘সেইটুকুই শুধু ভালো খবর। আপনার মেয়ে বেঁচে আছে।’

‘সত্যি বলছিস, আমার মেয়ে বেঁচে আছে?’ জবেদার চুপসে যাওয়া গালে অজস্র চুমু খেতে লাগলাম। ভুলে গেলাম যে আমি বেগম ছিলাম।

‘এ কী করছেন?’ তটস্থ হয় বৃদ্ধা।

‘তুই আমাকে আজ কী দিলি জানিস না। তোকে তো কিছু দেবার নেই আমার। শুধু এই মালা-ছড়াটা আছে, নে। সিরাজ থাকলে তোকে আমি কি যে করতাম জানিস নে, জবেদা।’

‘ও মালা আপনি রেখে দিন। আমি কী করব ওটা নিয়ে? আমার কি কেউ বেঁচে আছে? সেবারের বানে সব ভেসে গিয়েছে। জোয়ান ছেলে গিয়েছে, বউ গিয়েছে, নাতি গিয়েছে। বুড়োও মরল তার ঠিক পরেই।’

‘তবু নে। যাকে ইচ্ছে বিলিয়ে দিস।’

আপনার কাছে রেখে দিন। মেয়েকে দেবেন। এতদিন পরে যাচ্ছেন।’

‘কোথায় যাচ্ছি!’ অবাক হই।

‘মুর্শিদাবাদে। আপনাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে।’

‘সে কী! কেন?’ বুকের ভেতরে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মিরনের মুখখানা চোখের সামনে দাপাদাপি করে।

‘খোশবাগে থাকবেন আপনি। নবাব সিরাজদৌল্লা যেখানে রয়েছেন। আপনি খোসবাগের দেখাশোনা করবেন। সায়েবদের হুকুম হয়েছে নবাব মিরজাফরের ওপর।’

খোশবাগ! কি শান্ত কথা! সিরাজ শুয়ে রয়েছে সেখানে। আমি সেখানে যাব। আমার এমন সর্বনাশ করার পরও সায়েবদের এ দয়া কেন? নারীর অভিশাপের ভয়ে? সেসব বালাই কি তাদের রয়েছে? হয়তো আছে, নইলে গাছের গোড়া কেটে আবার তাতে জল ঢালা কেন? তবু এতে যেন মন সত্যিই শান্তি পাচ্ছে।

‘কে বলল এ কথা? কার কাছে শুনলি?’

‘যে খবর এনেছে, সে আবার আসবে। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন বলে ফিরে গিয়েছে।’

‘তুই কি পাগল হলি, জবেদা? তুই তো জানিস, আমি ঘুমোই না।’

‘জানি। কিন্তু আপনি তখন ভাবছিলেন নবাবের কথা। আপনার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। আমি গিয়ে দাঁড়াতেও আপনি টের পেলেন না। সে সুখস্বপ্ন ভাঙাতে চাইনি আমি।’

জবেদা সব বোঝে। সেও যে আমার মতই দুঃখিনী। জেগে জেগে আমারই মতো স্বপ্ন দেখে সে। জেগে জেগেই কত সময় সদ্য ফেলে আসা অতীতের মধ্যে ফিরে যাই আমি। ভুলে যাই যে, আমি ঢাকায় রয়েছি। মনে হয়, হীরাঝিলের সেই সজ্জিত কক্ষে বসে রয়েছি, সিরাজ সামনে দাঁড়িয়ে। সিরাজের স্পর্শও অনুভব করি। কিন্তু তারপরই রূঢ় বাস্তব সে-স্বপ্ন ভেঙে দেয়। তাই আমি কেঁদে ফেলি।

জবেদা বলে, ‘আপনি চলে যাবেন, তাই কাঁদছিলাম।’

তুই বড্ড হিংসুটে জবেদা। এ তো সুসংবাদ। খোশবাগে থাকব আমি, সেখানে সিরাজের কাছে প্রতিদিন বাতি দেব। ধীরে ধীরে আমার দেহে আসবে বার্ধক্য—নুয়ে পড়বে আমার শরীর। তবু কম্পিত হাতে বাতি নিয়ে গিয়েই হয়তো ঢলে পড়ব তার পাশে, আর উঠব না। এর চেয়ে সুখ আর কী আছে রে জবেদা? এর জন্যে তুই কাঁদিস?’

‘আর কাঁদব না, বেগমসায়েবা। সত্যি আমি হিংসুটে। নিজের দিকে শুধু আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখ হয়, ঘসেটি বেগম আর আমিনা বেগমের জন্য। শেষে এই হাল হল তাঁদের।’

‘কী হয়েছে? কোনো খবর এসেছে?

‘হ্যাঁ। সেই কথাই তো বলতে বাধছিল এতক্ষণ। মিরনের হুকুমে তাঁদের ডুবিয়ে মারা হয়েছে। মাঝ-নদীতে বজরা নিয়ে গিয়ে বজরা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

আমার অনুভূতিশক্তি নিশ্চয় অনেক কমে গিয়েছে ঘা খেয়ে খেয়ে। নইলে এ সংবাদে বিশেষ বিচলিত হলাম না কেন? কিংবা সিরাজের কাছে ফিরে যাব বলে, মেয়েটাকে পাব বলে একটু আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি কি?

.

আবার মুর্শিদাবাদে ফিরে এলাম। এ মুর্শিদাবাদের মসনদে সিরাজ নেই। এখানকার পুরোনো মহলে আমিনা বেগম ঘুরে বেড়ান না। মোতিঝিলে নেই ঘসেটি বেগমের দাপট। তবু মুর্শিদাবাদ আছে—আগের মতোই রাস্তায় লোকও চলছে। ছেলেরা খেলা করছে। ভেবেছিলাম এসে দেখব, গাছপালার সব পাতা ঝরে গিয়েছে, গঙ্গার জল শুকিয়ে গিয়েছে। মানুষের মুখ হয়েছে রক্তশূন্য। কিন্তু তা তো নয়। সবই আগের মতো আছে। শুধু সে নেই।

কিরীটেশ্বরীর মেলায় যাবার জন্যে হিন্দুরা আগের মতোই খেয়া পার হচ্ছে। কাটরার মসজিদে তেমনি আজানধ্বনি। গঙ্গা বয়ে চলেছে, যেমন বয়ে চলত মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ে। এমনি বয়ে চলবে চিরকাল—যখন মিরজাফর থাকবে না, মিরন থাকবে না, ইংরেজরা থাকবে না, কেউ থাকবে না। হাওয়ায় এখনও গাছে কাঁপন লাগে।

.

সবাই নেমক-হারাম। কিছুই মনে রাখতে চায় না। কেউ স্বীকার করে না, এই মুর্শিদাবাদের মসনদে কিছুদিন আগেও এক সুন্দর যুবক শোভা পেত। বালক হয়েও যে বর্গির হাঙ্গামার সময় দিনরাত ছোটাছুটি করেছে দেশকে বিপদ থেকে মুক্ত করবার জন্যে, সে আজ নেই। সবাই সব ভুলেছে, শুধু আমি কিছুই ভুলিনি।

জোড়া বলদে টানা একখানা সাধারণ গাড়িতে করে মুর্শিদাবাদের রাস্তা দিয়ে আমি চলেছি খোশবাগের দিকে। আর নাকি বেশিদূর নেই।

বুকের ভেতর কাঁপন ধরেছে। মুখ গরম হয়ে উঠেছে। এমন গরম হলে নাকি মেয়েদের মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে। কেমন যেন লজ্জা-লজ্জা ভাব। কিছুতেই নিজেকে সহজ করতে পারছি না। যুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো কাজে বাইরে গিয়ে বহুদিন পরে সিরাজ ফিরে এসে আমার কাছে এলে অমন হত। কী বলব ভেবে পেতাম না, কী করব তাও বুঝতে পারতাম না। কথা বলতে বাধো বাধো ঠেকত, দু-পা জড়িয়ে আসত, আজ আবার ঠিক তাই হচ্ছে।

গাড়ি যত এগিয়ে চলেছে, বুকের কাঁপুনি ততই বাড়ছে। মনকে কতবার শান্ত করবার চেষ্টা করি, পারি না। মন অবাধ্য—সিরাজের কাছে গেলে চিরকাল যেমন অবাধ্য হয়েছে। গাড়োয়ান শেষে এক জায়গায় এসে থেমে যায়।

‘এখানেই নামতে হবে। গাড়ি আর ভেতরে যাবে না।’ সে বলে।

.

সামনে চেয়ে দেখি, রাস্তা শেষ হয়েছে একটা উঁচু দরজার কাছে এসে। সেটা বন্ধ। এই তো সেই জায়গা। নবাব আলিবর্দির মৃত্যু হলে এখানেই তো এসেছিলাম বটে, কিন্তু তখন তো এত নির্জন ছিল না জায়গাটা।

দেওয়াল দিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভেতর থেকে আমগাছের শাখা-প্রশাখা প্রাচীর ডিঙিয়ে বাইরে এসে ঝুলে পড়েছে। ভেতরে পাখিদের মেলা বসেছে। তাদের কিচিরমিচির ডাকে কান ঝালাপালা।

গাড়ি থামিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও চুপ করে বসে থাকি। জানি যে, উঠে দাঁড়াতে পারব না, পড়ে যাব। ঘন-ঘন নিশ্বাস পড়ে আমার—হাঁপালে যেমন হয়।

যে-বাঁদি এসেছিল আমার সঙ্গে, সে একটু অবাক হয়। বলে, নামুন বেগমসায়েবা। ‘এই নামছি, আমাকে একটু ধরবি? পায়ে ঝিঁঝি লেগেছে।’

সে তাড়াতাড়ি এসে আমাকে ধরে। তার কাঁধে দেহের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে পড়ি।

‘এই হল খোশবাগ-গোরস্থান।’ বাঁদি বলে।

‘ছেড়ে দাও আমাকে।’

‘আপনি যে বললেন…’

কী বিশ্রী কথা! মনে হল, এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিই।

‘ছেড়ে দাও।’ কথাটা একটু জোরে হয়েছিল। সে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়।

‘দরজা বন্ধ কেন?’ প্রশ্ন করি।

‘এই যে চাবি, নিন।’ সে খোশবাগের চাবি আমার হাতে দেয়।

.

প্রকাণ্ড দরজা। দারোয়ান গায়ের জোরে ঠেলে খোলে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে ফুলের গন্ধ এসে মন জুড়িয়ে দেয়। নানান গাছ আর লতাপাতায় মিশে একটা স্তব্ধ কুঞ্জ।

ভেতরে প্রবেশ করতেই পাখির ডাক থেমে যায়। আমাদের দেখে বোধ হয় বিব্রত হয়েছে তারা। প্রাণভরে সিরাজকে গান শোনাচ্ছিল, বাধা পেল আমাদের আগমনে। ফিরে এসে আবার প্রাচীরের বাইরে দাঁড়াই, যদি তারা শুরু করে তাদের গান।

‘ভেতরে যাবেন না, বেগমসায়েবা? ‘

‘চুপ।’ কিন্তু পাখিরা আর ডাকে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও নয়।

হতাশ হয়ে আবার ভেতরে যাই। দরকার নেই পাখির গানে, আমি শোনাব গান আমার সিরাজকে।

তুমি এখন যেতে পারো।’ বাঁদিকে বলি।

‘আপনার এখানেই থাকব আমি।’

‘থাকো, কিন্তু এখন একটু বাইরে যাও।’ সিরাজকে আমি একা পেতে চাই, যেমন পেতাম হীরাঝিলে। প্রিয় মিলনের সময় বাইরের লোকের উপস্থিতি—ছি ছি!

বাঁদি চলে যায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই, যেখানে নবাব আলিবর্দির সমাধি রয়েছে—শুনেছি তাঁর কাছেই রয়েছে সে।

.

রক্তবর্ণ বস্ত্রে আচ্ছাদিত সমাধি। তার পাশেই এ কী! সেই কৃষ্ণবস্ত্র—আলিবর্দির মৃত্যুদিনে সিরাজ যে-বস্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন মূল্যবান বস্ত্রটির অপচয় হবে ভেবে অনেক রাজা-উজির মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন। শেষে মৌলানার কথার জবাবে সিরাজ কী বলেছিল, এখনও কানে স্পষ্ট ঝংকৃত হচ্ছে, ‘নবাব বংশ এখনও নির্বংশ হয়নি।’ কথাটা শেষে এইভাবে সত্যি হল?

লুটিয়ে পড়ি। আমার সিরাজ! মনে হল, কে যেন হেসে উঠল। নবাব আলিবর্দি কি? আদরের নাতিকে কাছে পেয়ে আমার দুর্দশা দেখে হাসছেন তিনি। না, তিনি নন। তিনি হাসবেন না। তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভীষিকার মধ্যে কচি শিশুকে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে শক্ত-সমর্থ করে গড়ে তুলতেন না। মৃত্যুশয্যায় তাকে কাছে ডেকে নিয়ে কোরান স্পর্শ করে শরাব খাওয়া ছাড়াতেন না। ভালোবাসার প্রবল উচ্ছ্বাসের মধ্যেও তাঁর একান্ত সাধ ছিল, সিরাজ হবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সার্থকতম নবাব। তাঁর সে-সাধ পূর্ণ হল না বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে। তাই নাতিকে কাছে পেয়েও এক তীব্র বেদনা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আলিবর্দি হাসতে পারেন না।

খোশবোগের প্রবেশপথে চোখ পড়ে। দেখি, সেখানে বাঁদি গাড়োয়ানের সঙ্গে হাসাহাসি করছে। সেই হাসিই তবে কানে এসেছে।

.

পাখিরা আবার মিষ্টি গান গাইতে শুরু করেছে। তারা বুঝে ফেলেছে, আমি তাদেরই। এই কৃষ্ণ আর রক্তবর্ণ বস্ত্রের পাশে এক শুভ্রবর্ণ বস্ত্র মাত্র। আমার আলাদা কোনো সত্তা নেই।

গাছের পাতা ঝরে পড়ছে, ফুল দুলছে। দুই সমাধির ওপর অজস্র ফুলের গালিচা… আরও ঝরছে। আমার অশ্রু ঝরছে। তারা নিঃশেষিত হতে চায়। কী ব্যথা আর কী আনন্দ!

‘বেগমসায়েবা।’

‘কে?’ পেছন ফিরে দেখি বাঁদি। ‘কে তোমাকে আসতে বলল এখানে?’

সে কথা বলে না।

‘তোমাকে কে পাঠিয়েছে এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে?’

‘নবাব।’

‘নবাব! ও, মিরজাফর?’

‘হ্যাঁ, বেগমসায়েবা। ‘

‘আগে তুমি কোথায় থাকতে?’

‘জাফরাগঞ্জে।’

‘তোমাকে আমি চাই না।’

‘নবাবের হুকুম।’

‘নবাবকে বোলো, তার হুকুম আমি মানি না।’

বাঁদি চমকে ওঠে।

‘হামিদাকে চেনো?’

‘হ্যাঁ, সে আসবে। সে এলে আমি চলে যাব।’

তুমি এখনই যাও। আমি একা থাকব।’

‘আপনার অসুবিধে…’

‘কিছু অসুবিধে হবে না। তুমি চলে যাও।’

বাঁদি চলে যায়।

ছুটতে ছুটতে আসে হামিদা। তার কোলে সিরাজের অবশিষ্ট। হামিদা ছোটে আর হাসে, সে ছোটে আর কাঁদে। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। সে কাছে এলে তাকে জড়িয়ে ধরি।

‘আমাকে নয় বেগমসায়েবা, আমাকে নয়। এই যে একে ধরুন।’ সে মেয়েকে দিতে চায় আমার কোলে।

‘না-না, তুমি হামিদা। ও নয়।’

‘বেগমসায়েবা, আমি জারিয়া।’

‘আমিও জারিয়া ছিলাম, হামিদা। আজ তুমিও জারিয়া নও। তুমি নবাব মহলে নেই এখন বেগম মহলেও নেই। তুমি আছো আমার কাছে। আমার কাছেই থাকবে। তুমি আমার বোন, হামিদা।’

.

মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে সে এতক্ষণে আমাকে দুহাত দিয়ে আকুলভাবে বেষ্টন করে ফেলে। সে-হাত দুটোয় কোনো সঙ্কোচ নেই, কোনো দ্বিধা নেই—বোনের হাতের মতোই মায়া-ভরা। মনে হল, ঘসেটি বেগমের আদেশে তার যে বোনকে একদিন ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তাকেই এতদিনে ফিরে পেয়েছে সে।

পাখির ডাক থিতিয়ে আসে, অন্ধকার নেমে আসে ধীরে ধীরে। এ রাত্রি যদি আর কখনও না কাটে। গাছের পাতায় ঝিরঝিরে বাতাসের শব্দ। এ বাতাস ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে যদি প্রলয় ঘটিয়ে একরাত্রে পৃথিবীকে রসাতলে দেয় খুব ভালো হয়।

‘শুধু নবাব আলিবর্দি আর নবাব সিরাজদ্দৌলা নন, আর একজনও এসেছেন এখানে।’ হামিদা বলে।

‘কে সে? কোন হতভাগ্য?’ নতুন একটা সমাধি আমিও দেখেছি খোশবাগে—নগ্ন হয়ে রয়েছে অবহেলিত অবস্থায়। প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম বুঝি সমাধি নয়।

‘মির্জা মহম্মদ। নবাব সিরাজদ্দৌলার শরীরে যে-রক্ত, তাঁর শরীরেও যে সে-রক্ত ছিল। তিনি কি বেঁচে থাকতে পারেন?’

‘হুঁ। আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল। আমিনা বেগমের স্নেহের পুতুল। তার কাছেও বাতি দেব, হামিদা।’

‘মির্জা মহম্মদ নবাবের চেয়েও হতভাগ্য। নবাবকে মৃত্যুযন্ত্রণা পেতে হয়নি। মিরনের সে ইচ্ছে থাকলেও, নবাবের চোখের দিকে তাকিয়ে শয়তান মহম্মদ বোধহয় কেঁচোর মতো কুঁচকে গিয়েছিল। কোনোরকমে এক আঘাতে শেষ করে পালিয়েছিল। তাই তাঁর মৃতদেহ নিয়ে অত তাণ্ডব চলেছিল।’

‘থাক্ থাক্ হামিদা, আমি শুনতে চাই না।’

‘শুনতে হবে বোন, সব শুনতে হবে। নবাবের দেহ নিয়ে ওরা যত বীভৎস কাণ্ডই করুক না, নবাবকে তা সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু মির্জাকে এরা তিলে তিলে মেরেছে। শরীরের দু’পাশে দুটো তক্তা রেখে চেপে ধরে হত্যা করা হয়েছে।’

‘হামিদা, ওরা কি মানুষ?’

‘হ্যাঁ বোন, এরা মানুষ। পৃথিবীতে অমানুষ জন্মাতে পারে না। তাই স্বার্থের নেশায় প্রলোভনে পড়ে, কিংবা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, মানুষের মনুষ্যত্ব কিছুকালের জন্যে মন থেকে উধাও হলেও, পরে তা আবার ফিরে আসে। ফিরে আসবেই। তখনই হয় অনুশোচনা, তখনই হয় অশান্তি। মহম্মদ শুনেছি পাগল হয়ে গিয়েছে।’

‘আর সোফিয়া?’

‘সে এখন সৈন্যসামন্তদের উপভোগের সামগ্রী।’

‘আম্‌মা. . .’

চেয়ে দেখি, মেয়েটা ডাকছে। আমার সিরাজের মেয়ে-সিরাজের মুখের আদল। দু’হাত দিয়ে তার মুখ উঁচু করে ধরে বলি, ‘ডাকছ আমাকে?’

‘ন্‌না।’ সে হামিদাকে দেখিয়ে দেয়।

‘ও আমাকেই মা বলে জানে।’ হামিদা হেসে বলে।

‘সেই ভালো। আমি আর মা হতে চাই না, হামিদা। আমি শুধু বেগম—আমি সিরাজের বেগম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *