আমি সিরাজের বেগম – ১

আমি জারিয়া—ক্রীতদাসী। শুধু এইটুকুই জানি নিজের সম্বন্ধে। নবাব আলিবর্দির বিরাট মহলের অসংখ্য জারিয়াদের মধ্যে আমি একজন। কোথা থেকে এলাম, কে আমার মা, কে আমার বাবা, তাও জানি না। স্বপ্নের মতো শুধু একটা ছবি মনের মধ্যে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে। সে-ছবি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো। গ্রামে খড়ে-ছাওয়া এক শান্তির নীড় দানবীয় আক্রমণে দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল একদিন। আর্তনাদ করে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে কুটির থেকে ছুটতে ছুটতে বার হয়ে এল এক নারী। বাইরে সারিসারি ঝকঝকে পোশাকে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসুরের দল—মুখে তাদের পৈশাচিক হাসি। তাদের সম্মুখে এক গ্রাম্য-যুবকের সুঠাম নগ্নদেহ রক্তাপ্লুত অবস্থায় পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে। সে-দৃশ্য দেখে আমাকে কোলে নিয়ে নারী চিৎকার করে আছড়ে পড়ে। তারপর তার কী হয়েছিল স্পষ্ট মনে নেই। অসুররা তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল। গৃহদাহের আগুনের সামনে বসে আমি কাঁদছিলাম। গায়ে লাগছিল তাপ, আর মাথায় যন্ত্রণা। নারীটি পড়ে যাবার সময় আঘাত লেগেছিল আমার মাথায়। সেই সময় এক মলিনবেশী পুরুষ চোরের মতো চুপিচুপি এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে পালিয়েছিল।

ব্যস এইটুকুই। আর কিছু মনে নেই। কিন্তু এ হয়তো শুধু স্বপ্নই। কোথা থেকে এলাম—এ কথা বয়স্ক জারিয়াদের জিজ্ঞাসা করলে তারা রেগে ওঠে। বেগমসায়েবাকে প্রশ্ন করতে সাহস হয় না, যদিও তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করেন। আমি চোদ্দো বছরের বালিকা বলেই যে আমার প্রতি তাঁর স্নেহ, তা নয়। আমার নাকি অসাধারণ রূপ! অনেক সময় কাছে ডেকে নিয়ে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকেন বেগমসায়েবা, যে লজ্জা হয়। চারিদিকের বড় বড় আরশিতে নিজের রক্তিম মুখখানা ভেসে উঠতে দেখে মাথা নিচু করি।

বেগমসায়েবা আমার সে অবস্থা দেখে হেসে ওঠেন। আমাকে টেনে নিয়ে আমার বুকের দু’পাশে তাঁর দুই হাত চেপে ধরে বলেন, ‘না, তুই এখনো ছোট আছিস।’ গা শিরশির করে ওঠে। তিনি হেসে তাকিয়ার ওপর গড়াগড়ি যান। আমি পালিয়ে আসি।

কিন্তু পালিয়ে যাবই বা কোথায়? জারিয়াদের মধ্যে আমার স্থান নেই। আমি ওদের দু’চোখের বিষ। তাদের এই ব্যবহারে আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। হামিদা তাই দেখে মুখ ভেঙচিয়ে বলে, ‘কাঁদলে আমাদের মন ভিজবে না। রূপের দেমাকে তো মাটিতে পা পড়ে না। সব সময় শুধু বেগমসায়েবার কাছে থাকিস। এখন আবার এখানে কেন? সেখানে যা।’

হামিদারা সবাই যেন আমাকে হিংসা করে। আমার কী দোষ বুঝি না। বেগমসায়েবা যে মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে কথা বলেন, সে কি আমার অপরাধ? তাঁর কাছে যেতে আমারও তো ভয় করে। সে-কথা হামিদারা বুঝবে? বললেও বিশ্বাস করবে না।

তাই নির্জন এক গবাক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিন কাটে। এ গবাক্ষের পাশ দিয়ে লোক চলাচল করে না। বেগম মহলের একেবারে নির্জন কোণে এটা। এখানে আমি নিশ্চিন্ত। নিজেকে খুঁজে পাই এখানে। সামনের বাগিচা পার হয়ে দূরের রাস্তা নজরে পড়ে এখান থেকে। সেখানে কত লোকের মিছিল। কাটরার মসজিদের আজানধ্বনি এখানে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনি। কিরীটকণা গ্রামে কিরীটেশ্বরীর মেলায় যেতে নানা দেশ থেকে হিন্দুরা এই পথে নদীতে খেয়া পার হয়। আমি চেয়ে দেখি আর ভাবি, এদের সবারই আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা রয়েছে। আমার তো কেউ নেই। আমার মতো কি একজনও এদের মধ্যে নেই?

এই গবাক্ষই আমার সান্ত্বনা, আশ্রয়ও। এখানে হাত রেখে বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জায়গাটা হয়েছে মসৃণ। অজ্ঞাতে চোখের নোনা জল পড়ে পড়ে এর ধার হয়েছে বিবর্ণ সেই মসৃণ বিবর্ণতাই যেন একে টেনে এনেছে আমার আরও কাছে, আমার পরম আত্মীয় করে তুলেছে। প্রাসাদের চাকচিক্য আর হৃদয়হীনতা যেন গবাক্ষ থেকে কিছুদূরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর এগোতে পারে না। স্মৃতির অস্পষ্টতা যেদিন প্রথম দানা বেঁধে স্পষ্ট হয়েছে, সেদিন থেকেই আমার এই গবাক্ষ।

মনে আছে, যখন ছোট ছিলাম, এখানে দাঁড়িয়ে আমি বাইরের দৃশ্য দেখতে পেতাম না। আমার মাথা অত উঁচুতে পৌঁছত না। নবাবের জুতো রাখার একটা ছোট চৌকি লুকিয়ে এনে রেখে দিয়েছিলাম এখানে। তার ওপর দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকতাম বাইরের দিকে। এখন আর সে-চৌকির প্রয়োজন হয় না। বেশ বড় হয়েছি।

সবসময় ভয় হয়, এখান থেকেও একদিন সবাই মিলে আমাকে সরিয়ে দেবে। এখনো কারও নজর পড়েনি, তাই। মহলের এই জায়গাটার গুরুত্ব এত কম যে নজরে পড়ার কথাও নয়।

তবু একদিন ঘসেটি বেগমকে এদিকে আসতে দেখে বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। তাকে সব জারিয়ারাই ভয় করে। তাকে দেখলেই সবার পা কাঁপে। জারিয়াদের দেখে দেখে আমার মনেও তার সম্বন্ধে একটা অজ্ঞাত ভীতিভাব জন্মেছিল। অথচ তার ওই রূপ, অমন টানাটানা চোখের দিকে চাইলে মনে হয় না যে তাতে ভয় পাবার মতো কিছু রয়েছে। অমন রূপ হয় শুধু বেহেস্তের পরিদের।

জারিয়াদের দেখাদেখি আমার মনে ভয় জন্মালেও তাদের মতো থরথর করে আগে কখনও কাঁপতাম না আমি। কিন্তু যেদিন দেখলাম, অমন অপরূপ চোখও আগুনের মতো জ্বলে ওঠে, অমন সুন্দর নাসারন্ধ্র রাগে বীভৎস দেখায়, যেদিন দেখলাম, নবাব নিজে এবং বেগমসায়েবা কন্যার প্রতাপের কাছে অসহায়ের মতো বোবা হয়ে গেলেন, সেদিন থেকে অন্যান্য জারিয়াদের মতো আমিও তার নামে কাঁপতে শুরু করলাম।

সেদিনের কথা আজও আমার মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। মহলের পঞ্চাশটা আরশি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল ঘসেটি। আর সেই ভাঙা কাচ আমরা সবাই মিলে পরিষ্কার করেছিলাম। আমাদের কারও মুখে বিরক্তির মৃদু গুঞ্জনও শোনা যায়নি। কাচে অনেকের হাত ক্ষতবিক্ষত হল, কিন্তু কেউ দাওয়াই-এর জন্যে হাকিম ডাকতে সাহস পায়নি। আরশির কাচে বিষ থাকে জেনেও টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি কেউ।

অথচ সেদিন ঘসেটিকে অন্যায় কিছু বলেনি বেগমসায়েবা। নওয়াজিস মহম্মদ খাঁর সঙ্গে শাদি হয়েছে তার, কিন্তু তাঁর কাছে ঢাকায় যাবে না ঘসেটি, এ কেমন কথা? নওয়াজিস খাঁ মুর্শিদাবাদে এলে সে-কথা বেগমসায়েবা বলেছিলেন কন্যাকে। তাতেই এত কাণ্ড। যে-নবাবের রাজ্যে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খায়, সেই নবাবের চোখের সামনে ঘসেটি উন্মাদের মতো একটার পর একটা আরশি ভেঙে ফেলল। চোরের মতো দাঁড়িয়ে দেখলেন নবাব আলিবর্দি স্বয়ং।

আরশি ভেঙে নবাবের সামনে ছুটে এসে ঘাড় বেঁকিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে ঘসেটি বলল, ‘নওয়াজিস যদি কখনও নবাব হয়, তবেই আমি তার কাছে যাব, নইলে নয়।’

তার কথা শুনে নবাব আলিবর্দির মুখে এক বিচিত্র হাসি ফুটে উঠে, আবার তখনই মিলিয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘তাহলে তুমি এখানেই থাকো।’

সেই ঘসেটিকে গবাক্ষের কাছে এগিয়ে আসতে দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠাই স্বাভাবিক। পালিয়ে যাবার উপায় নেই। আবার না গেলেও যে ভাগ্যে কী আছে কে জানে? পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। ঘসেটি বেগম অন্যমনস্ক হয়ে হাসতে হাসতে আসছিল। নিজের মনে কী ভেবে নিজেই হাসছিল।

আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেল সে। তারপর যেদিক থেকে এসেছিল, সেইদিকে কিছুদূর দ্রুত চলে গেল। সেই সুযোগে গবাক্ষ থেকে চট করে সরে এসে আমি একটা কোণে আশ্রয় নিলাম রাত্রি না হলেও সূর্য ডুবে গিয়েছে তখন। যেখানে আশ্রয় নিলাম। সে জায়গাটা বেশ অন্ধকার, সহসা কারও চোখে পড়ার ভয় নেই।

সেখানে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি পদশব্দের অপেক্ষায়। কিন্তু অনেকক্ষণ কিছু শুনতে পেলাম না। ভাবলাম, হয়তো আর আসবে না। খেয়ালি বেগম আপন খেয়ালে এদিকে চলে এসেছিল, আবার চলে গিয়েছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াব কিনা ভাবছি, এমন সময়ই সেই পদশব্দ। আমার বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ, তার তালে-তালে সর্বাঙ্গ নড়তে থাকে। ঘসেটির কানে সে-শব্দ যাবে, ভয়ে দু’হাত দিয়ে বুক চেপে ধরি।

কিন্তু একী! গবাক্ষের সামনে তো ঘসেটি বেগম নয়। এক অপরিচিত দীর্ঘদেহ পুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। বেগম মহলে কী ভাবে প্রবেশ করল? এত লোকের চোখে ফাঁকি দিয়ে এখানে এলোই বা কী করে? নবাব বংশের কেউ নয়, সবাইকে তো আমি চিনি। তবে কে এই পুরুষ? একবার ভাবি, ছুটে গিয়ে বেগমসায়েবাকে খবর দিই। কিন্তু লোকটির কোমরে দীর্ঘ খরশান ঝুলতে দেখে ভরসা হল না। কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে কে জানে! অমন সুন্দর বীরত্বব্যঞ্জক যার চেহারা, সে কি কখনও খারাপ কিছু করতে পারে? এ চেহারার দিকে যে দু’দণ্ড তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। তবু বলা যায় না। চেহারা মাপকাঠি হলে ঘসেটিও অমন পিশাচী হত না।

নবাবের কোনো অমঙ্গল হবে না তো? ভাবতেই গায়ের মধ্যে ছমছম করে। বেগমসায়েবাকে খবরটা দিতেই হবে। কিন্তু পুরুষটির পাশ দিয়ে যেতে গেলেই মাথা কাটা পড়বে। একদিকে মৃত্যুভয়, অপরদিকে নবাবের কথা ভেবে মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ভয়কে জয় করবার উদ্দেশ্যে, তারপর চোখ খুলি। এবার ছুটতে হবে। মাথার ওড়নাকে কোমরে জড়াই। একবার লোকটিকে দেখতে হবে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে রয়েছে কিনা। বাইরের দিকে সে যদি চেয়ে থাকে তবেই ছুটে যাবার সুযোগ পাব।

উঁকি দিতেই স্তম্ভিত হলাম। অপরিচিত পুরুষটির সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় ঘসেটি বেগম, —ঘসেটির চোখ বাঘের মতো জ্বলজ্বল করে, তার নাক সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে। আমার হাত-পা অসাড় হয়ে এল। পুরুষটির আলিঙ্গনে ঘসেটির সারা দেহ নিষ্পেষিত হচ্ছে, যেন এখনই তার হাড়গুলো সব গুঁড়ো হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরে পুরুষটি ছেড়ে দেয় তাকে, কিন্তু ঘসেটি ছাড়তে চায় না। সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে চায় আরও নিষ্পেষণ।

আমার মাথা ঘুরে ওঠে। মনে হল, একটা ঘোর অন্যায় ঘটে চলেছে বেগম মহলের মধ্যে। পুরুষটির চোখে-মুখেও তারই ছাপ। সে সংশয়চিত্তে এদিকে ওদিকে বারবার দৃষ্টি ফেলে—ধরা পড়ে যাবার ভয়, যেন পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু ঘসেটি উন্মত্ত। আরশি ভাঙার দিনে তাকে যেমন উন্মত্ত দেখা গিয়েছিল, এ তার চেয়েও বেশি। সেদিন তার চোখ-মুখ আজকের মতো রক্তিম হয়নি। এ নিশ্চয়ই অন্যায়। বেগমসায়েবা আমার বুকের দু’পাশে দু’হাত রেখে চাপ দিলে সেটা যেমন অন্যায়, এ তার চেয়েও হাজার হাজার লক্ষগুণ অন্যায়।

চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকি। হঠাৎ ঘসেটির আর্তনাদে চমক ভাঙল। চেয়ে দেখি, ছিন্নভিন্ন পোশাক নিয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে সে, আর পুরুষটি অদৃশ্য হয়েছে।

খুন করে রেখে পালিয়ে গেল না তো? ছুটে ঘসেটির সামনে গিয়ে দাঁড়াই।

আমাকে দেখে চিৎকার করে ওঠে সে, ‘কেন এসেছিস এখানে?’

‘আপনাকে তুলব?’

‘না-না-না। কে তোকে তুলতে বলেছে? ঘসেটি তাড়াতাড়ি পোশাক-পরিচ্ছদ সামলে উঠে দাঁড়ায়।

আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি।

‘কোথায় ছিলি তুই?’ তার চোখে আগুন

আঙুল দিয়ে বিপরীত দিক দেখিয়ে দিই। কথা বলার শক্তি ছিল না আমার।

‘আর কাউকে দেখেছিস?’

‘না তো!’

‘ঠিক আছে। চলে যা আমার সামনে থেকে। দূর হ’…

আমি তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাই।

একেবারে বেগমসায়েবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হই। নবাব আলিবর্দির বেগম তখন আলবোলায় তামাক সেবন করছিলেন। বাইরের ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের দিকে চেয়ে তিনি যেন কীসের চিন্তায় মশগুল। নবাবের জন্যে হয়তো ভাবনা হয়েছে। বর্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত আছেন নবাব।

জারিয়ারা বলাবলি করে যে, নবাব তো শুধু যুদ্ধ করেন, রাজ্যের বাকি চিন্তা সবই বেগমসায়েবার। তাঁর পরামর্শেই নাকি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। আমি অতশত বুঝি না, তবে এটুকু জানি যে, নবাব তাঁর সব কথাই শোনেন। তাঁর কপালে আজ যেমন রেখা ফুটে উঠেছে, নবাবের সঙ্গে আলোচনার সময়ও ঠিক এমনি রেখাই ফুটে ওঠে।

.

বেগমসায়েবার ঘরে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়ে বুঝলাম মস্ত ভুল করেছি। তিনি যদি প্রশ্ন করেন, কী জন্যে এসেছি তাহলে তো ঘসেটি বেগমের কথা বলা যাবে না। সে শুনতে পেলে আমার প্রাণ থাকবে না। হামিদার বোনের মতো দশা হবে। সামান্য দোষে তাকে বেগম মহলের ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেবার হুকুম দিয়েছিল ঘসেটি। শুধু হুকুম দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। সমস্ত জারিয়াদের ছাদের ওপর দাঁড় করিয়ে বলেছিল যে, অবাধ্য হলে জারিয়াদের কী দশা হয় স্বচক্ষে দেখতে। হামিদার বোন তার পায়ের ওপর উপুড় হয়ে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল, কিন্তু ফল হয়নি। নিজের হাতে ঘসেটি নাকি তাকে ঠেলে দিয়েছিল ওপর থেকে

আমি হামিদার বোনকে দেখিনি। অন্তত স্মৃতিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও তার কোনো হদিশ পাই না। তবু সে-দৃশ্য আমার চোখে স্পষ্ট ভাসে।

বেগমসায়েবাকে অন্যমনস্ক দেখে চুপিচুপি পালিয়ে আসব ভাবলাম। কিন্তু দরজা পর্যন্ত যেতেই তাঁর কণ্ঠস্বরে থামতে হল।

‘শোন্।’

আমি তাঁর দিকে ঘুরে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

‘এদিকে আয়।’ গম্ভীর আদেশ। এক-পা এক-পা করে তাঁর কাছে এগিয়ে যাই।

‘কি চাস্‌?’

‘কিছু না।’

‘কেন এসেছিলি তবে?’

‘পা টিপে দেব?’ আমার গলা কেঁপে ওঠে।

‘তুই তো কোনোদিন পা টিপিস্ না।’

‘না টিপলে যে শিখতে পারব না।’ শেষ চেষ্টা করি সহজ হবার।

আমার কথায় বেগমসায়েবার মুখে মৃদু হাসির তরঙ্গ খেলে যায়। তিনি বলেন, ‘তোর এতটুকু হাতে কি আমার আরাম হবে?’

‘তবে থাক্, আমি যাই বেগমসায়েবা।’ যেন পালাতে পারলে বাঁচি। দরজার দিকে এগিয়ে যাই আবার।

‘শুনে যা।’ বেগমসায়েবার মুখে বিরক্তি দেখে ভয় পেলাম। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দাঁড়াই।

কী বলতে এসেছিলি বল?’ তাঁর চোখে ঔৎসুক্য।

‘কিছু বলতে আসিনি, বেগমসায়েবা।’ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিই।

‘মিথ্যা কথা বলছিস। ঠিক করে বল।’ তাঁর স্বর বজ্রকঠিন।

আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। তিনি স্থির হয়ে বসে থাকেন। তাঁর চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ। আপ্রাণ চেষ্টায় তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিই।

‘এবার বল। কী দেখে ভয় পেয়েছিলি, কেন ছুটে এসেছিলি এখানে?’

আমি স্তম্ভিত হলাম। বাইরের দিকে অন্যমনস্কের মতো চেয়ে থাকলেও তিনি আমার সব হাবভাবই লক্ষ্য করেছিলেন প্রথম থেকে। বুঝলাম, ফাঁকি দিতে পারব না। জারিয়াদের কথা এত দিনে বিশ্বাস হল যে, কোনো জিনিসই বেগমসায়েবার দৃষ্টি এড়ায় না।

কিন্তু আমি কী বলব তাঁকে? সত্যি বললে কালই হয়তো ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হবে। মিথ্যে বললে নবাবের আদেশে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। পৃথিবীতে আমার যে কেউ নেই। কোথায় আশ্রয় পাব? তার চেয়ে মৃত্যুই ভালো। কার ওপর অভিমানে জানি না, চোখ ফেটে জল বার হয়ে আসতে চাইল।

বললাম, ‘বেগম মহলে কে যেন এসেছিল।’

‘কী বললি!’ তিনি বিস্মিত হন।

‘একজন পুরুষকে দেখলাম।’

‘কে সে?’

‘চিনি না।’

‘কেমন দেখতে?’

যেমন দেখেছি, আমি বর্ণনা করে গেলাম।

‘হুঁ, আর কেউ ছিল?’

‘না।’

‘ঠিক করে বল বাঁদরি।’ তিনি রীতিমতো উত্তেজিত হন। পালঙ্ক ছেড়ে ছুটে এসে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকান।

‘আর কাউকে আমি দেখিনি, বেগমসায়েবা।’

‘ঘসেটিকে দেখিসনি?’

মনে হল, প্রচণ্ড আঘাতে আমার মন এবং শরীর দুই-ই গুঁড়িয়ে গেল। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

‘বল্ বল্ বল্। চুপ করে আছিস কেন? ঘসেটিকে দেখিসনি?

‘না-না, খোদার কসম।’ বেগমসায়েবার পায়ের কাছে আমি ভেঙে পড়ি। পা দিয়ে তিনি যদি আমার গলা টিপে ধরেন সেও ভালো। তাতে মিথ্যাবাদীর শাস্তি হবে, কিন্তু ঘসেটির হাত থেকে তো বাঁচব।

বেগমসায়েবা কিছুই করলেন না। তিনি সেইভাবে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে গিয়ে তাকিয়ার ওপর মাথা রাখেন। আমি নীচেই বসে থাকি।

খানিক পরে তিনি বলেন, ‘তুই এখন যা।’ আমি উঠে দাঁড়াতে আবার বলেন, ‘যদি তাকে আর কখনও দেখিস, সঙ্গে সঙ্গে এসে বলবি। নইলে তোকেই মেরে ফেলা হবে।’

কুর্নিশ করে চলে আসি।

.

দু-দিন পরে দলবল নিয়ে বেগমসায়েবা ভোরবেলা গিরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সারাদিন তিনি না খেয়ে সেখানে থাকবেন, সন্ধে হলে ফিরে আসবেন। প্রতি বছরই এইদিনে তিনি যান গিরিয়ার প্রান্তরে। এইদিনে সেখানে নবাব আলিবর্দি সরফরাজকে পরাজিত করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদ পেয়েছেন। বেগমসায়েবা দিনটিকে পবিত্রভাবে পালন করেন।

বেগম মহল প্রায় ফাঁকা। নবাব আলিবর্দিও মুর্শিদাবাদে নেই। বর্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। আমার অতি প্রিয় গবাক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াব ভাবছি, এমন সময় সোফিয়া তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে।

জারিয়াদের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ। তারপরই সোফিয়া। তার বয়স ষোলো। শরীরে তার স্বাস্থ্য আছে, দেহের গঠনও সুন্দর, কিন্তু রঙটা বড় কালো। কালো রঙের জন্যে তাঁর দুঃখের সীমা নেই। তার দুঃখ দেখে আমার হাসি পায়। সে আমাকে চুপিচুপি একদিন বলেছিল যে, রঙ যদি তার আমার মতো হত, তাহলে সে কোনো নবাবজাদাকে শাদি করতে পারত।

নবাবজাদাদের শাদি করার জন্যে এদের এত লোভ কেন বুঝি না। চুনি-পান্নার অলংকারে নিজেকে সজ্জিত করা যায় বটে, মসলিন দিয়ে শুভ্র দেহকে ঢেকেও রাখা যায়, কিন্তু তাতে কী সুখ আছে? আমার ধারণা, বেগমদের সুখ নেই। সবাই ঘসেটি বেগমের মতো ভেতরে ভেতরে জ্বলে মরছে। ঘসেটি শুধু প্রকাশ করে, অন্য সবাই মনের মধ্যে চেপে রাখে। সত্যি কি না জানি না, কতটুকুই বা আমার অভিজ্ঞতা, তবু বুঝতে পারি, বেগমদের মন বড় নীচু, বড় কুৎসিত। নিজেদের সাজিয়ে রাখলেও এদের নাসারন্ধ্র দিয়ে পচা মনের দুর্গন্ধযুক্ত দীর্ঘশ্বাস ই শুধু বার হয়। সেদিন গবাক্ষের সামনে ঘসেটির নাক দিয়েও হয়তো তেমনি শ্বাস নির্গত হয়েছিল, যা সহ্য করতে না পেরে সেই বিরাট পুরুষটিও পালিয়ে যায়।

নবাব আলিবর্দির মতো মানুষ আর কয়জন হয়? তাঁর মতো একজন মাত্র বেগম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে কয়জন নবাব পারে? নিজের প্রতিভায় নবাব হয়েও তাঁর মনে আর বাইরে কোনো জাঁকজমক নেই। তিনি যেন বাংলাদেশের সাধারণ একজন মানুষ, একটি মাত্র স্ত্রীকে নিয়ে সংসার পেতেছেন। হাজার বেগমের হীন প্রতিযোগিতায় তাঁর মন দ্বিধাবিভক্ত নয়।

বেগমসায়েবাও তেমনি নবাব ছাড়া কিছু জানেন না। তাঁর মনে সর্বদা একই চিন্তা। সে-চিন্তা নবাবের দেহের জন্যে, তাঁর জন্যে, আর রাজ্যের জন্যে। বেগমসায়েবাকে তাই আমার বড় ভালো লাগে। তিনি যখন তখন আমার বুকে হাত দিয়ে ছোট আছি বলে ঠাট্টা করলেও তাঁর ওপর আমার শ্রদ্ধাও রয়েছে।

কিন্তু সবাই আলিবর্দি আর তাঁর বেগম নন। নবাবের দৌলতে নবাব পরিবারভুক্ত হয়ে, তাঁর আত্মীয়স্বজনদের বেগমের ছড়াছড়ি। বেগমরা যেন মাটির পুতুল। তাদের যেন প্রাণ নেই, মন নেই, সুখ নেই, সাঁধ নেই। অবসর মতো এক-আধ দিন পুরুষ এসে একটু নাড়া দিয়ে গেলে তারই স্মৃতি নিয়ে তারা আনন্দে জাবর কাটবে বাকি দিনগুলি। তবু যদি বোঝা যেত পুরুষদের মন বাঁধা রয়েছে তাদের কাছে

অথচ আশ্চর্য, বেগমরা ঠিক সেই ভাবেই জাবর কাটে। একদিন এসে পুরুষ যদি দু-দণ্ড কারও ঘরে কাটিয়ে যায়, তবে দেমাকে সেই বেগমের একমাস মাটিতে পা পড়ে না। জাফরগঞ্জ প্রাসাদে যখন কিছুদিনের জন্য ছিলাম, তখন সেখানেও ওই রকমই দেখেছি।

তাই সোফিয়ার বেগম হবার শখ দেখে আমার কষ্ট হয়। মনে হয়, যদি সম্ভব হতো, আমার গায়ের রঙ তাকে দিয়ে, তার গায়ের রঙ নিয়ে আমি কোনো সিপাহিকে বিয়ে করে চলে যেতাম তার কুটিরে। কত সুন্দর সুন্দর সিপাহিদের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখি, কত রকম বয়স তাদের। তাদের নিশ্চয়ই ঘর আছে, ঘরে মা আছে, ভাই-বোন রয়েছে। সেখানে দশটা বেগমের প্রতিযোগিতা নেই। আমি গেলে আমিই সব।

সোফিয়া এসে আমার হাত ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘শিগির চল, ছাদে পালাই। ‘ দেখলাম, সব জারিয়াই দুড়দাড় করে ছাদে উঠে যাচ্ছে। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি, ‘কেন? ‘হোসেন কুলিখাঁ আসছেন।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘ন্যাকা, কিছু জানে না যেন। বেগমসায়েবা নেই, ঘসেটি যদি আমাদের এখানে দেখে, তাহলে কি আস্ত রাখবে?’

‘কেন?’

‘যাবি তো চল। অত বুঝিয়ে বলার সময় নেই।’

‘আমি যাব না।’

‘তবে মর।’ সোফিয়া আমাকে ছেড়ে ছুটে পালায়।

.

হোসেন কুলিখাঁকে চোখে দেখিনি কখনও, নাম শুনেছি। ঢাকায় নওয়াজিস খাঁর ডান হাত তিনি তাঁর বুদ্ধি আর বীরত্বের কথা সকলে জানে। স্বয়ং নবাবকেও অনেক সময় তাঁর সম্বন্ধে বেগমসায়েবার কাছে প্রশংসা করতে শুনেছি। সেই হোসেন কুলিখাঁকে দেখে জারিয়াদের এত ভয় কেন, বুঝলাম না। আর ঘসেটি বেগমই-বা কেন এতে বিরক্ত হবে?

হোসেন কুলিখাঁকে দেখার অদম্য কৌতূহল হল। ছুটে গিয়ে বেগম মহলের বাইরের সিঁড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সেই পথেই তিনি আসবেন ঘসেটি বেগমের সঙ্গে দেখা করতে। নওয়াজিস খাঁ কোনো সংবাদ পাঠিয়েছেন বোধহয়?

ভারী পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকাতেই স্তম্ভিত হই, সর্বাঙ্গ পাষাণ হয়ে যায়। মনে হয়, একটু পরেই বুঝি পড়ে যাব। ডান হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি দেয়াল চেপে ধরি। মুহূর্তে বুঝতে পারি, জারিয়ারা কেন সরে পড়েছে।

সেদিনের গবাক্ষের সামনের সেই অচেনা পুরুষ। সেই পুরুষই তবে হোসেন কুলিখাঁ! কাজের তাগিদে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে আসেন আর প্রভুর বেগমের বার্তা নিয়ে যাবার অছিলায় প্রভুর সর্বনাশ করেন। সরল ভালোমানুষ নওয়াজিস মহম্মদ খাঁ। ভৃত্য আর বেগমের ওপর তাঁর অবিচল আস্থা। পৃথিবীতে কি ভালোমানুষেরা শুধু প্রতারিতই হয়?

হোসেন কুলিখাঁ আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। সংযত হয়ে তাঁকে কুর্নিশ করি। তাঁর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

তিনি বলেন, ‘তুমি জারিয়া?’

ঘাড় নাড়ি।

‘খুবসুরত। কিন্তু বড় ছোট।’ আপন মনে শিস দিতে দিতে তিনি এগিয়ে যান। আমি তাঁকে অনুসরণ করি।

ঘসেটি বেগম আগেই ঘর থেকে বার হয়ে এসেছিল। হোসেন কুলিখার পেছনে আমাকে দেখে সে রাগে ফেটে পড়ে। চিৎকার করে ওঠে, ‘এখানে কী করছিস হতভাগী?’

আমি চুপ করে থাকি। ঘসেটি ছুটে আসে আমার দিকে। হোসেন কুলিখাঁ নিমেষে আমাকে আড়াল করে দাঁড়ান।

‘সরে যাও। ওকে আমি শেষ করব। মিটমিটে শয়তান কোথাকার।’

গম্ভীর স্বরে হোসেন কুলিখাঁ বলেন, ‘থাক বেগমসায়েবা, এতটুকু মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে কোনো লাভ নেই। তাছাড়া কোনো অপরাধ তো সে করেনি।’

‘ওকে চেনো না তুমি। আমিই কি চিনতাম? এখন বুঝছি।’

মুখ দেখেই চেনা যায়। একটি সরল সুন্দরী পরি। শুধু ছোট। কিছুদিন পরেই মাথা ঘুরিয়ে দেবে অনেক পুরুষের।’ তিনি হো-হো করে হেসে ওঠেন।

‘তোমারও মাথা ঘুরিয়েছে নাকি?’ ঘসেটি ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। তার ঠোঁট বিকৃত হয়।

‘হ্যাঁ, দূর থেকে দেখে ঘুরেছিল বৈকি। তখন বয়সের তো আন্দাজ করতে পারিনি।’

ঘসেটি আচমকা হোসেন কুলিখাঁর পাশ কাটিয়ে আমার পেটে পদাঘাত করে। অসহ্য যন্ত্রণায় সেখানেই বসে পড়ি। চোখের সামনে সবকিছু ঘুরতে থাকে। তারপর ঝাপসা হতে হতে সব অন্ধকার হয়ে যায়। মরার আগে বুঝি এমনই হয়।

কতক্ষণ পড়েছিলাম জানি না। যখন জ্ঞান হল, দেখলাম, তারা দু’জনেই চলে গিয়েছে। বিরাট মহলের বাইরে আমি একা। চোখের জল এল। মনের মধ্যে আবছা একটা নারী-মুখ ভেসে উঠল—যে-নারী আমাকে কোলে নিয়ে আগুনলাগা কুটির থেকে ছিটকে বার হয়ে এসেছিল। একি শুধু স্বপ্ন? স্বপ্ন হলে এত ঘনঘন ভেসে ওঠে কেন মনের মধ্যে? সেদিন ওই রমণী আমাকে নিয়ে আঙিনায় আছড়ে পড়লে আমার মাথায় যে আঘাত লেগেছিল, সে আঘাতেরই চিহ্ন কি মাথার পেছনের ওই কাটা দাগ? জানি না। বলে দেবার কেউ নেই। যে বৃদ্ধা জারিয়া আমাকে মানুষ করেছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো কিছুটা বলতে পারত।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াই। কাউকে দেখতে পাই না। সবাই ছাদে লুকিয়ে রয়েছে। গবাক্ষের সামনে গেলে হয়, কিন্তু সাহস হয় না। আজও যদি ওরা সেখানে গিয়ে থাকে।

বেগমসায়েবা এলে তাঁকে বলব নাকি, যে পুরুষটিকে আমি সেদিন দেখেছি সে হোসেন কুলিখাঁ। আর হ্যাঁ, ঘসেটি বেগমকেও দেখেছি তাঁর সঙ্গে—দেখেছি, আলবত দেখেছি। কিন্তু তাহলে যে হোসেন কুলিখাঁর প্রাণ যাবে। তাঁর মৃত্যু আমি চাই না। অমন বীরের মতো চেহারা যাঁর, তাঁর মৃত্যু যুদ্ধক্ষেত্রেই হওয়া উচিত। তাছাড়া লোকটা খারাপ নন। তাঁর মিষ্টি কথার মধ্যে সহানুভূতি ঝরে পড়ে।

ভাবতে ভাবতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু আবার বসে পড়তে হল। পেটের ভেতরে ভীষণ ব্যথা করে ওঠে।

কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। মাথায় কার হস্তস্পর্শে চমকেউঠি। চেয়ে দেখি হোসেন কুলিখাঁ। ‘খুব লেগেছে?’

‘না।’

‘নিশ্চয়ই লেগেছে।’

কথা বলি না।

‘আমার সঙ্গে ঢাকায় যাবে?’

‘না।’

‘এখানে তবে অত্যাচার সহ্য করো।’

‘আমরা যে জারিয়া। আমাদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়।’

‘ও।’ চিন্তাকুল অবস্থায় তাঁকে নেমে যেতে দেখি। সুন্দর তাঁর চলার ভঙ্গি। নবাব আলিবর্দির চেয়েও সুন্দর। কী চমৎকার দেহের গঠন। একদৃষ্টে চেয়ে থাকি। পেটের ব্যথার কথাও ভুলে যাই কিছু সময়ের জন্যে।

.

নাকাড়াধ্বনিতে একদিন খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায়। মহলের এত বড় প্রাঙ্গণ পার হয়েও পথের নাকাড়াধ্বনি সকলকে জাগিয়ে তুলল। ছুটতে ছুটতে এসে একজন খবর দিয়ে যায় যে, নবাব বর্গিদের বিতাড়িত করে ফিরছেন। বেগমসায়েবার কাছে খবর পৌঁছল। তিনি উঠে এসে বেগম মহলের প্রবেশ দ্বারে দাঁড়ালেন, হোসেন কুলিখাঁ এলেন আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম। বেগমসায়েবা জানেন যে, নবাব এসে চেহেল-সেতুনে যাবেন না, অন্য কোথাও যাবেন না, প্রথম তাঁর কাছেই আসবেন। নবাবের সঙ্গে তাঁর আদুরে নাতিটিও আসবে। সেও যুদ্ধে গিয়েছিল। তাকে আমি এড়িয়ে চলি। আমার চেয়ে আর কতটুকু বা বড় হবে সে। অথচ তার প্রতাপে নবাব পর্যন্ত কম্পিত। ঘসেটি বেগমের ওপর সে আর-এক কাঠি। কখন যে কী চেয়ে বসে ঠিক নেই। অথচ যা চাইবে, না দিলে প্রলয়কাণ্ড বাধিয়ে বসবে। ঘসেটি বেগম শুধু আরশি নাতিটিকে ভাঙে, এ হয়তো মানুষের মাথা ভাঙবে। নবাবের মুখ দেখে বোঝা যায়, ভালোবাসলেও তার জন্যে তিনি সর্বদা তটস্থ। তাকে যুদ্ধে নিয়ে গিয়ে তিনি ভালোই করেছিলেন। নইলে তাঁর অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই একটা কাণ্ড করে বসে থাকত

ছেলেটার সুন্দর কচি মুখ। দু’দণ্ড চেয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়। অথচ সে যদি দেখতে পায় যে, তার মুখের দিকে আমরা কেউ চেয়ে আছি, তাহলে রেগে উঠে বলবে, হাঁ করে দেখছিস কী বাঁদি? মুখে কি মধু আছে?

মধুই আছে। কিন্তু মুখ ফুটে কি বলতে পারি? কেন জানি না, ওকে দেখলে মায়া হয়। একলা দাদুর কাছে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবে। হয়তো পাটনার কথাই ভাবে। সেখানে তার বাবা-মা রয়েছেন। সবাই তো আমার মতো নয়।

ও যখন চিন্তা করে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি। ভাবতে ভাবতে কখনও ওর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কখনও বা একটা বিষাদের ছায়া সারা মুখখানাকে অন্ধকার করে দেয়। তখন কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু ভরসা পাই না। মাথার মধ্যে ওর দুষ্টুবুদ্ধির তো অন্ত নেই। আমার ঔদ্ধত্য দেখে কী আদেশ করবে কে জানে? বয়স কম হলে কী হবে, কারও তো জানতে বাকি নেই যে, বাংলার মসনদে আলিবর্দির পরে ওই ছেলেই বসবে। আর সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন ও নিজে।

আমার প্রিয় গবাক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার দু’ধারে। নবাবকে তারা অভ্যর্থনা জানাবে।

হর্ষধ্বনির মধ্যে নবাব তাঁর নাতিকে নিয়ে প্রবেশ করলেন। মহলের প্রধান ফটক বন্ধ হল। বাইরের জনতার চাপে সে-ফটক ভেঙে যায় আর কি। দু’জন সিপাহিকে ছুটে যেতে দেখলাম খরশান হাতে জনতার দিকে। নবাব সেদিকে চেয়ে থেমে গেলেন। হস্তীপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে নামলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন বন্ধ ফটকের দিকে। জনতাকে সম্বোধন করে কী যেন বললেন। আবার একটা আকাশ ফাটানো চিৎকার। মহলের সামনের রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায় ধীরে ধীরে। প্রজাদের আনন্দে নবাবও আনন্দিত। আনন্দ তাদের উচ্ছৃঙ্খল করে তুলেছিল। তাতে সিপাহিরা রাগলেও নবাব রাগেননি। তিনি ধীরভাবে তাদের বুঝিয়ে ফিরে এলেন।

এবার আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে বেগমসায়েবার ঘরের সামনে দাঁড়াই। জানি নবাব সেখানেই আসবেন। একটা ঝাড়ন জোগাড় করে নিই। তাঁদের কথাবার্তার সময়ে নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। বয়স কম বলে সুবিধে আছে। অন্য জারিয়ারা ঘরে কিংবা আশেপাশে থাকলে তিনি তাদের চলে যেতে বলেন, কিন্তু আমাকে কিছু বলেন না। ফলে তাঁদের অনেক কথাই আমি শুনতে পাই।

নাতিকে নিয়ে নবাব আর বেগমসায়েবা ঘরে ঢুকলেন। আমি বাইরের আসবাবপত্রে ঝাড়ন বুলিয়ে চলি। ঘরের মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। এখানে দাঁড়িয়েই শুনতে হবে যতটুকু শোনা যায়।

শুনতে পেলাম, বেগমসায়েবা বলছেন, ‘অনেকবারই তাড়ালে ওদের, কিন্তু শেষ তো হয়নি। এবারে কি শেষ করে দিয়ে এলে?’

‘না, পণ্ডিত না মরলে ওরা শেষ হবে না।’

‘তাহলে পণ্ডিতকে মারো।’

‘পারছি কই?’ নবাবের স্বরে হতাশা।

‘কৌশলে চেষ্টা করে দেখো।’

‘পরের বার এলে তাই করতে হবে। অতবড় বীরকে কৌশলে মারতে লজ্জা হয়।’

‘বীর! বলছ কী তুমি? বীরেরা নিরীহ লোকদের ওপর অত্যাচার করে? তারা সামনাসামনি যুদ্ধ করে। তারা লুঠ করে না। সাধারণ লোককে নির্মমভাবে হত্যাও করে না।

‘ওরা বাধ্য হয়ে লুঠ করে। ওদের টাকার প্রয়োজন।‘

‘তাতে আমাদের কী? আমরা বাধ্য হয়ে পণ্ডিতকে বধ করব, আমাদের শান্তি প্ৰয়োজন। শ্রান্ত নবাব আর কোনো কথা বলেন না।

বেগমসায়েবা বলেন, ‘শুনেছি ওরা হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সামর্থ্য থাকলে তা করুক। কিন্তু নিরীহ লোকদের ধন-প্রাণের বিনিময়ে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। ওদের যদি সেটাই আদর্শ হয়, তবে তার পথও হওয়া চাই পাপবর্জিত!’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমার হাতের ঝাড়নটা হাতেই রয়েছে। কিছুই পরিষ্কার করা হয়নি। এবারে দরজার আর একটু কাছে এগিয়ে এসে এটা-ওটা যা সামনে পাই পরিষ্কার করি। ভেবেছিলাম, যুদ্ধ সম্বন্ধে বিচিত্র কাহিনি শুনতে পাব। কিন্তু কোনোরকম আলোচনা হল না দেখে একটু হতাশ হয়ে পড়লাম। যুদ্ধ জিনিসটাও নবাব বেগমদের কাছে যেন সাধারণ ব্যাপার।

হঠাৎ একসময় বেগমসায়েবার গলা শুনি, ‘আমাদের দাদুর খবর কী?’

বুঝলাম, এবারে নাতিকে একচোট আদর জানানো হবে। এতক্ষণের গম্ভীর আলোচনার সুর হঠাৎ পালটে গেল। আমি কান খাড়া করি।

‘আমার খবর এই যে, সিরাজ একটা কিছু দেখাল বলে মনে হয়।’ তেমনি উদ্ধত গলা। এতদিনের অবর্তমানেও একটু বদলায়নি। যুদ্ধক্ষেত্রের পরিশ্রম আর কাঠিন্য ভোগ করে এসেও বেগমসায়েবার স্নেহসিক্ত কথার জবাবে এতটুকু নমনীয়তা প্রকাশ পেল না। তবু কত মিষ্টি। যেমন চেহারা, তেমনি কণ্ঠস্বর। স্বভাবটা আল্লা অমন করে গড়লেন কেন? নবাবজাদাদের কি অমনই হতে হয়? এতটুকু দয়া, এতটুকু মমতা কি থাকতে নেই? তা যদি না থাকে, তবে লক্ষ লক্ষ প্রজার পুঞ্জীভূত ব্যথার কথা কীভাবে জানতে পারবে? প্রজারা যে নবাবের মুখ চেয়েই বেঁচে থাকে। প্রজাদের দুঃখ নিজের বলে অনুভব না করলে নবাব কীসের? নবাব আলিবর্দি তো অমন নন। এই তো একটু আগে হাতি থেকে নেমে নিজে এগিয়ে গেলেন ফটকের দিকে। প্রজাদের মনের খবর তিনি রাখেন বলেই কীভাবে তাদের শান্ত করতে হয়, সে কৌশলও তাঁর জানা। একজন সামান্য সিপাহি যা বুঝতে পারল না, তিনি তা বুঝলেন।

সিপাহি হয়তো বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু নবাবের চোখের সামনে কাজ দেখাবার সৌভাগ্য বড় একটা হয় না তাদের। তাই অতি উৎসাহে খরশান হাতে ছুটে গিয়েছিল প্রজাদের দিকে। নবাব বাধা না দিলে সে কী করত কে জানে? বীরকে অভিনন্দন জানাতে এসে দু’একজনের হয়তো মাথাই কাটা পড়ত আজ। তাতে তাঁর সুনাম বৃদ্ধি পেত না।

আলিবর্দি শুধু প্রজাদের মনের কথাই জানেন, তা নয়। সিপাহির মনের খবরও তিনি রাখেন। তাই তাঁর অতি উৎসাহে তিনি মনে মনে হয়তো হেসেছিলেন। কোনো শাস্তি দেননি তাকে। একেই বলে নবাব। তাঁর নাতিটি কি অমন হবে?

বেগমসায়েবার ভীতিবিহ্বল কণ্ঠস্বর শুনলাম, ‘উঃ, এতখানি কেটে গিয়েছে!’

‘যুদ্ধে গেলে অমন হয়েই থাকে। তোমাদের মতো বেগম মহলে বসে থাকা তো আমাদের কাজ নয়।’ গর্ব ঝরে পড়ে সিরাজের কথায়।

নবাব আলিবর্দির হাস্যধ্বনি শোনা গেল।

বেগমসায়েবা বলেন, ‘তুমি হাসছ? ঘা যে এখনও শুকোয়নি। তখনই বলেছিলাম, একে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। এতটুকু বয়সে কেউ যুদ্ধে যায়?’

‘যায় বৈকি। গিরিয়ার যুদ্ধে জালিম সিং-এর কথা মনে নেই তোমার? সে তো সিরাজের চেয়েও ছোট ছিল। তার মুখের দিকে চেয়ে তুমিই না একদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলে। আজ ভুলে যাচ্ছ কেন?‘

জালিম সিং-এর কথা জীবনেও ভুলব না, নবাব। তার মুখে যা দেখেছি তোমার মুখেও তা দেখিনি।’

‘এবার বর্গির যুদ্ধে আমি সিরাজের মুখে কিন্তু তা দেখেছি। প্রথমে আমারও মনে হয়েছিল, ওকে নিয়ে গিয়ে হয়তো ভুল করেছি। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ওর দিকে চেয়ে আনন্দে আমার বুক ভরে উঠত। সিরাজকে এত ভালোবাসি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যদি সে ফিরে না আসত তবু আপশোস হত না।’

‘তুমি পরিশ্রান্ত নবাব। হিসেব করে কথা বলার মতো অবস্থা তোমার নেই। তাই যা-তা বকে চলেছ।’ মনে হল, বেগমসায়েবা নবাবের ওপর অসন্তুষ্ট হলেন। সিরাজ যে তাঁর নয়নের মণি।

সিরাজ হেসে ওঠে।

‘হাসলি যে?’ বেগমসায়েবা প্রশ্ন করেন।

‘দাদু সারা রাত্রি ঘুমিয়ে ঠান্ডা মাথায় কালও একথা বলেছিল। ‘সত্যি! নবাব কি পাগল হয়েছ?’

না বেগমসায়েবা, পাগল হলে ওকথা বলতে পারতাম না। সিরাজের হাতের ক্ষতচিহ্ন দেখে তুমি দুর্ভাবনায় মরছ, আর আমার গর্ব হচ্ছে। সিরাজেরও হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করে দেখো।

হচ্ছেই তো। এবার ওরা এলে আমি একা যুদ্ধে যাব। তোমাকে যেতে দেব না, দাদু। তুমি বুড়ো হয়ে পড়েছ।’

নবাব মৃদু হেসে বলেন, ‘থাক, খুব বাহাদুরি হয়েছে। এবারে পোশাকগুলো ছেড়ে এসো তো। আমি হাকিম ডাকতে পাঠাচ্ছি।’

তাড়াতাড়ি চলে যেতে চেষ্টা করি, কিন্তু তার আগেই ছুটতে ছুটতে বাইরে বার হয়ে আসে সিরাজ।

‘এই, এখানে কী করছ?’

একটা আরশির ওপর ঝাড়ন বুলিয়ে চলেছিলাম, বললাম, ‘এটা পরিষ্কার করছি, নবাবজাদা।’

‘উঁহু মিথ্যে কথা। এখানে দাঁড়িয়ে আড়িপেতে আমাদের কথা শুনছিলে।’

তার কথায় স্তম্ভিত হই। বেগমসায়েবা কোনোদিন সন্দেহ করেননি, অথচ সিরাজ ঠিক ধরে ফেলল। নবাব হতে হলে এমন বুদ্ধিমান বুঝি হতে হয়।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। জানি, শাস্তি একটা পাবই। কিন্তু সেটা কতখানি গুরুতর হবে ভেবে উঠতে চেষ্টা করি।

সিরাজ এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলে, ‘চলো।’

‘কোথায় নবাবজাদা?’ ভয়ে কেঁপে উঠি। কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম। সোফিয়া! হ্যাঁ, সোফিয়াকেই দেখেছিলাম প্রথমে। ছুটতে ছুটতে সে ছাদে উঠছিল নবাবকে দেখার জন্যে। মনে মনে তার মুণ্ডপাত করি।

‘আমার ঘরে চলো।’

‘আপনার বেগমসায়েবারা যে অসন্তুষ্ট হবে।’

‘বেগমসায়েবাদের কাছে যাচ্ছি নাকি আমি!’

তাঁরা হয়তো বসে আছেন আপনার ঘরে। আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। এতদিন পরে ফিরলেন তো।’

‘তারা বসে থাকে না। আমার জন্য তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা নিজেদের নিয়েই মশগুল।’ কথাটা সাধারণভাবে বললেও তাঁর কচি কণ্ঠস্বরে একটা ব্যথা ফুটে উঠল। বুঝলাম, নবাব আর তাঁর বেগমের বুকভরা ভালোবাসা পেয়েও এই কিশোর-হৃদয় তৃপ্ত নয়। কোথায় যেন ফাঁক রয়ে গিয়েছে, যে-ফাঁক এর বেহিসাবি মনকেও ব্যথিত করে তুলেছে। প্রথম যৌবনে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই বেগমদের ধরন-ধারণ আর তাদের মন যেন চিনে ফেলেছে সিরাজ। তবু সামান্য জারিয়ার কাছে এমনভাবে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলল কেন সে? অল্প বয়স বলেই কি মাঝে মাঝে নিজের মর্যাদা বজায় রেখে চলতে ভুলে যায়? আল্লার কাছে প্রার্থনা করি, সে যেন হামেশাই এমন ভুল করে।

তার ওপর সহানুভূতিতে মন ভরে উঠল। এতদিন তাকে বাংলার নবাবের উদ্ধত আদুরে নাতি বলেই জানতাম। জানতাম, সিরাজের কোনো বাসনাই অপূর্ণ থাকে না। আজ জানলাম, তার মনের নিভৃত কোণে এমনি কোনো কামনা রয়েছে যা আজও অপূর্ণ। ভবিষ্যৎ বাংলার নবাব সেখানে ভিখারী। আমার বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। যদি পারতাম, বুকের রক্ত দিয়েও পূর্ণ করতাম সিরাজের মনের বাসনা। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। আমি যে জারিয়া। ভালোবাসা আমার পক্ষে পাপ। ভালোবাসলেও সে ভালোবাসার প্রকাশ অমার্জনীয় অপরাধ।

আমি কি সত্যিই সিরাজকে ভালোবেসে ফেললাম? এত সহজে কী করে তা সম্ভব? আমি যে কোনো নাম-না-জানা সিপাহির ঘরে যেতে চাই। কিন্তু এই মুহূর্তে যেতে ইচ্ছে করছে না কেন? সিরাজের বলিষ্ঠ হাত আমার বাঁ-হাতখানাকে ধরে রয়েছে বলেই কি?

‘অমন বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো, আমার জুতো খুলে দেবে।’

‘চলুন, নবাবজাদা।’

সিরাজের ঘরে গিয়ে দেখলাম, সত্যি কোনো বেগম নেই সেখানে। তারা নিজেদের মহলে তখনও নিদ্রা যাচ্ছে নিশ্চয়। অথচ স্বামী ফিরছেন শুনে আলিবর্দির বেগম এই বয়সেও ভোরবেলা উঠে কেমন সিঁড়ির কাছে গিয়ে একা দাঁড়িয়েছিলেন। কত তফাত! আলিবর্দি সত্যিই ভাগ্যবান। তাই তাঁর ভাগ্যাকাশের সূর্য কখনও অস্ত যাবে না—যেতে পারে না। বেগমসায়েবাও ভাগ্যবতী। নবাবের গৃহিণী হয়েও কোনো ভাগ না দিয়ে সব সুখ উপভোগ করছেন।

মুখে সিরাজ যাই বলুক, মনে মনে সে অন্তত একজন বেগমকেও আশা করেছিল তার ঘরে। ভেবেছিল, এতদিন পরে ফিরে আসার আনন্দে অভিভূত হয়ে কোনো বেগম ঘরে ঢোকার আগেই ছুটতে ছুটতে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে অভ্যর্থনা জানাবে। কিন্তু কেউ নেই। সিরাজের · আশাহত দৃষ্টিতেও ফুটে উঠল সেই একই কথা—কেউ নেই। তার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাসে সে আমার কাছে ধরা পড়ে গেল।

কিন্তু সামান্য জারিয়ার সামনে সে নিজেকে প্রকাশ করে না। তাই আবোল-তাবোল বকতে শুরু করে। এত কথা তাকে কোনোদিন বলতে শুনিনি। দুঃখের মধ্যেও হাসি পেল। মনে মনে বলি, যতই তুমি চালাক হও না কেন সিরাজ, আমি যে নারী। তোমার এত কথা কোন জিনিসকে চাপা দেবার জন্যে তা কি বুঝি না?

সিরাজ বলে, ‘বুঝলে, এই মুর্শিদাবাদে থাকতে আমার মোটেই ভালো লাগে না। যুদ্ধ করতে কষ্ট আছে ঠিক, কিন্তু আনন্দও আছে।’

যুদ্ধটা তো সব সময়ের জন্য নয়, নবাবজাদা।’ হঠাৎ সাহস পেয়ে যাই।

‘নয় কেন?’

বর্গিরা চিরদিন থাকবে না।’

‘সাদা মুখগুলো আছে।’

‘ওরা আর ক’জন?’

সিরাজ হেসে বলে, ‘ওদেরকে কেউ চিনতে পারেনি। দাদু কিন্তু ঠিক চিনেছে। সামান্য ক’জন হলে কি হবে, ভীষণ শক্তি ওদের।’

‘তবু আপনার কাছে কিছুই নয়। ইচ্ছে করলে ওদের দু’দিনেই তাড়িয়ে দিতে পারেন।’

‘আমি!’ সিরাজ অবাক হয়। বুঝতে পারি, তাকে এতখানি প্রাধান্য কেউ দেয়নি কখনও। তার বেগমরাও নয়। সে যেন এই প্রথম বুঝল যে, সে সাবালক।

‘হ্যাঁ, আপনি নবাবজাদা।’

‘দাদুই তো আছে।’ তার কথা শেষ হয় না।

তাঁর বয়স হয়েছে। এখন আপনার ওপরই ভরসা। আপনাদের কথা আমি সত্যিই লুকিয়ে শুনছিলাম। আপনার বীরত্বের কথাও শুনলাম।’

‘ও!’ সিরাজ অন্যমনস্ক হয়। সে আপন মনে ভেবে চলে।

‘নবাবজাদা।’

‘উঁ।’

‘আপনার জুতো খুলে দিই। হাকিম আসবে যে।’

‘ও, হ্যাঁ দাও।’ সিরাজ তার পা বাড়িয়ে দেয়। বলিষ্ঠ পা, সুন্দর পরিপূর্ণ গড়ন, কোথাও খুঁত নেই। আস্তে আস্তে তার একখানা পা আমার কোলের ওপর তুলে নিই। দেরি করব, যত খুশি দেরি করব তার জুতো খুলতে। এই ভাবেই আমার কোলের ওপর পড়ে থাক তার পা। এই ভারটুকু বহন করার জন্যেই বোধহয় এতদিন উদ্‌গ্রীব হয়েছিলাম।

হয়তো তার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলাম। অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম। নইলে এতক্ষণে শুধু বাঁ-পায়ের জুতো খোলা হবে কেন?

হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে, ‘আবার ওভাবে চেয়ে আছ? মানা করেছি না কত!

কেন যে দুর্মতি হল জানি না। বলে ফেললাম, ‘ক্ষতি কী, নবাবজাদা?’

‘এই দেখো ক্ষতি।’ সে ডান পা দিয়ে আমার হাঁটুর ওপর আঘাত করে। অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে যাই। জুতোর নীচে লোহা আছে নিশ্চয়।

কিন্তু সিরাজের মুখের দিকে চেয়ে নিজের যন্ত্রণার কথা ভুলে যেতে হয়। সেও চিৎকার করে পালঙ্কের ওপর গড়িয়ে পড়েছে।

‘কী হল নবাবজাদা, কোথায় লাগল?’

‘পা-টা আবার মুচকে গেল।’ কাতরাতে কাতরাতে সে বলে।

তাড়াতাড়ি তার ডান পায়ের জুতো খুলে ফেলি। দেখি, গোড়ালির কাছে অনেকখানি ফুলে উঠেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কখনও লেগেছিল হয়তো।

খালি পা আবার কোলে তুলে নিই। কী করব ভেবে না পেয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিই।

কিছুক্ষণ পরে সিরাজ শান্ত হয়। সে বলে, ‘তোমার কি খুব লেগেছিল?’

‘না, নবাবজাদা।’

‘একী, রক্ত এল কোথা থেকে!’ সিরাজ তার পায়ের গোড়ালির দিকে চেয়ে বলে ওঠে। ‘কই না তো?’

‘এই যে! আমার পা তো কাটা ছিল না।’

নিজের হাঁটুর দিকে আমার নজর পড়ে। সেখানকার পোশাক রক্তে ভিজে উঠেছে। সিরাজের পদাঘাতের ফল।

রক্তটা আমার নবাবজাদা।’ শান্তভাবে বলি। অপরিসীম তৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে। আমার রক্ত নবাবজাদার পায়ে।

‘তোমার কী করে হল?’ আমি চুপ করে থাকি।

‘ও, এত লেগেছে! কই দেখি?’

‘না-না, থাক্। বেগম মহলে যদি এভাবে যুদ্ধ করতে পারেন, তাহলে মুর্শিদাবাদে থাকতে আপনার ইচ্ছে হবে, নবাবজাদা।

‘কি বলছ!’ সিরাজের চোখে বিস্ময়।

যদি মুর্শিদাবাদে থাকেন, তাহলে প্রতিদিন এভাবে আমাকে পদাঘাত করে রক্ত দেখতে পারেন। আমি আনন্দের সঙ্গে সহ্য করব। আপনারও যুদ্ধের সাধ মিটবে। মুর্শিদাবাদকেও আর একঘেয়ে বলে মনে হবে না।’

সিরাজ বিদ্যুৎগতিতে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে, হোসেন কুলিখাঁ যেভাবে ঘসেটি বেগমকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এত আনন্দ, এত শিহরন এতে! বিহ্বল হয়ে পড়ি। বেগমসায়েবার হাত যেখানে লাগলে আমার ঘৃণা হত, এখন কতবার সিরাজের হাত সেখানে লাগল। কই, ঘৃণা হচ্ছে না তো, আনন্দ হচ্ছে। অথচ সিরাজ পুরুষ।

তুমি আমায় ভালোবাসো?’ সিরাজ বলে।

‘অপরাধ না নিলে হ্যাঁ।’

‘চিরকাল বাসবে?’

‘যতদিন বাঁচব।’

আমি মরার আগে তুমি মোরো না।’ সিরাজের স্বরে কাকুতি।

‘আল্লা যেন আপনার কথা শোনেন, নবাবজাদা।’

‘তোমার নাম কী?

‘তেমন নাম তো আমার নেই।’

‘তোমার নাম লুৎফা—ভালোবাসা।’

‘নবাবজাদার অশেষ দয়া।’

দূরের ফররাবাগের হাজার ফুলের গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে। সে-গন্ধ আমার মনকে মাতিয়ে তোলে। ফুলের গন্ধের সঙ্গে মনের এ সম্পর্ক আগে কখনও অনুভব করিনি। ঘরের ঝুলন্ত বাতিতে দিনের আলো পড়ে বিচিত্র বর্ণের দ্যুতি ঠিকরে বার হচ্ছে। তারই নানান প্রকাশ চারিদিকের আরশিতে।

সিরাজ আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘তুমি এমন পোশাক পরো কেন?’

‘আমাদের যে ভালো পোশাক পরতে নেই নবাবজাদা।’

‘কেন?’

‘আমি যে জারিয়া।’

‘কে বলল তুমি জারিয়া? তুমি আমার বেগম। আজই মসলিন আনিয়ে দিচ্ছি তোমার জন্যে।’

সোফিয়ার কথা মনে হল। কষ্ট হল তার জন্যে। তার বেগম হবার শখ। রঙটা ময়লা না হলে আজ আমার জায়গায় হয়তো সে থাকত। কিন্তু সিরাজ কি রঙে ভুলল? রঙ তো অনেক দেখেছে সে। আমার চেয়েও রূপসী বেগম তার রয়েছে। সিরাজ যদি রঙে ভুলে থাকে, তাহলে আজ—আমিই সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হলাম।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *