৩
বেগমসায়েবার ঘরে প্রবেশের আগে একবার আমিনা বিবির ঘরে যেতে ইচ্ছে হল। সিরাজ-জননীর কাছে আমি প্রায়ই যাই। তিনি আমাকে স্নেহের চোখে দেখেন। এ সময় তাঁর কাছে গেলেও কোনো সন্দেহের ছায়াপাত হবে না তাঁর মনে।
কিন্তু ঘরের সামনে গিয়ে থেমে যেতে হল। ভেতরে তিনি একা নেই। ঘসেটি বেগমের গলা ভেসে আসছে। মনে হল, চড়া গলায় ঘসেটি কী যেন বলছে আমিনা বিবিকে। বেগম হয়েও লুকিয়ে শোনার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
‘এসেই খেলা শুরু করেছিস আমিনা। ছেলেবেলার অভ্যাস এখনো যায়নি দেখছি।’
‘কী করে যাবে, তোর কাছেই যে হাতেখড়ি।’
মুখ সামলে কথা বল্। তোর মতো বংশের মুখে চুনকালি দিইনি কোনোদিন।’
‘কানে তো অনেক কিছুই ভেসে যেত। মুর্শিদাবাদ থেকে পাটনা বড় কম দূর নয়। অতদূরে ভাসতে ভাসতে গিয়ে খাঁটি সংবাদই পৌঁছত। মিথ্যেটুকু হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।’
‘চুপ কর।’ ঘসেটি চেঁচিয়ে ওঠে।
‘ভয় দেখাচ্ছিস কাকে? নবাব আলিবর্দির মেয়েকে? বাংলার ভবিষ্যৎ নবাবের মাকে?’ আমিনা বিবি হি-হি করে হাসেন।
‘পরবর্তী নবাব সিরাজ নয়, নওয়াজিস।’
‘ও, তাই নাকি? তবু তো নওয়াজিস মরলে এক্রাম নবাব হবে। এক্রাম তোর ছেলে নয়, আমার!’
‘ঘসেটিকে তুই চিনিস না আমিনা। কী রকম ভয়ঙ্কর হতে পারি, সে ধারণা তোর নেই। হাজার ভয়ঙ্কর হলেও আমার পা অবধি পৌঁছতে পারবি না ঘসেটি।’
‘বেশ, দেখা যাবে। আজই নবাবকে বলব তোর সঙ্গে হোসেন কুলিখার সম্বন্ধ।‘
‘আমিও বলব যে, এতদিন সে আমার টানে বেগম মহলে ঘোরাফেরা করত না।’
নবাব সে-কথা বিশ্বাস করবেন না।’
এবারে আমি ভিতরে ঢুকি। দুজনাই অপ্রস্তুত হয় আমার আকস্মিক প্রবেশে।
আমিনা বিবি স্বাভাবিক গলায় বলেন, ‘কী খবর লুৎফা, হঠাৎ এ সময় যে?’
‘বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনাদের ঝগড়া শুনে চলে এলাম।
ঝগড়া শুনতে পেয়েছ?’ ঘসেটি বেগম উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করে।
‘সামান্য শুনেছি।’
‘কী শুনেছ?’ আমিনা বেগম তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ান।
‘আপনার শেষ কথাটুকু শুনেছি——হোসেন কুলিখাঁ এতদিন আমার টানে বেগম মহলে ঘোরাঘুরি করত না।’
আমিনা বেগমের মুখ মৃতের মতো রক্তশূন্য হয়ে যায়। তিনি মাটিতে বসে পড়েন। ঘসেটির চোখে নিদারুণ আতঙ্ক। ঘরে বিন্দুমাত্র শব্দ নেই। জাদুবিদ্যায় সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে যেন- হৃদকম্পন পর্যন্ত। শুধু বাতিগুলো নিঃশব্দে পুড়ে চলেছে। বাতির ওপর পতঙ্গ উড়ে এসে পড়ছে। তারা মৃত অবস্থায় নিচে গালিচার ওপর ঝরে পড়ে। দু’চারটে আমিনা বিবির কোলের ওপর গিয়ে পড়ছে।
আমি স্তব্ধতা ভঙ্গ করি। সোজা ঘসেটি বেগমের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কণ্ঠস্বরে বজ্রকঠিন দৃঢ়তা এনে বলি, ‘হোসেন কুলিখাঁ যে চোরের মতো বেগম মহলে বহুদিন থেকে ঘোরাফেরা করেন তার প্রধান সাক্ষী আমি। একথা আপনি জানেন ঘসেটি বেগম। শুধু ঘোরাফেরা নয়, আরও অনেক কিছু তিনি করেন, যার একটা কথা নবাবের কানে গেলে হোসেন কুলিখার মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। কিন্তু আজ যা নিয়ে আপনাদের ঝগড়া আর মন কষাকষি, তারও প্রধান সাক্ষী আমিই আবার হলাম, এ আমার দুর্ভাগ্য। ঘসেটি বেগম, সেদিন আপনাকে যেখানে ছিন্নভিন্ন পোশাকে পড়ে থাকতে দেখে আমি তুলতে গিয়েছিলাম, ঠিক সেইখানেই আর এক নাটকের অভিনয় হয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে। এর গোড়াপত্তন হয়তো কিছুদিন আগে থেকেই হয়েছে, যার জন্যে আপনি অস্থির হয়ে উঠেছেন। কিন্তু আজ ঠিক কী ঘটেছে, তা আপনি জানেন না। আজ খাঁ সাহেবকে আবার সেখানে দেখে প্রথমে আমি অবাক হয়েছিলাম। আপনার চতুরতা সম্বন্ধে মনে মনে সংশয় উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু সংশয় দূর হল আমিনা বিবিকে দেখে। আমিনা বিবি বহুদিন এখানে ছিলেন না, তাই ওই নির্জন স্থানে যে আমার রীতিমতো যাতায়াত আছে একথা তিনি জানতেন না। কিন্তু হোসেন কুলিখাঁকে অন্তত আপনার বলে দেওয়া উচিত ছিল।’
কথা শেষ হতে দেখি, ঘসেটি বেগম হিংস্র দৃষ্টিতে আমিনা বিবির দিকে চেয়ে রয়েছে। আর আমিনা বিবি ধীরে ধীরে গালিচার ওপর গড়িয়ে পড়েন। অপরিসীম লজ্জা আর আঘাতে তিনি মূর্ছা গিয়েছেন।
সব কথা না বলে আমার উপায় ছিল না। শুধু এখানেই নয়, বেগম সায়েবাকেও বলতে হবে। প্রতিকার চাই। দুই বোনই মরিয়া। ছেলেবেলা থেকে পাকানো অভ্যাস আবার পথ খুঁজে পেয়েছে।
‘আমিনা বিবিকে ধরে তুলুন ঘসেটি বেগম।’ আমি বলি।
‘আমি পারব না।’ সে রাগে ফুলতে থাকে।
‘আপনিই আমিনা বিবিকে সুযোগ দিয়েছেন। হোসেন কুলিখাঁ এখানে এমনিতে আসতেন না কখনও।’
‘বেশ, বেশ।’
‘আমি বেগমসায়েবার ঘরে যাচ্ছি।’
‘মাকে এসব কথা বলবে?’
‘নিশ্চয়ই বলব।’
‘প্রতিজ্ঞার কথা তোমার মনে নেই?’
‘সে প্রতিজ্ঞা এখানে খাটে না। তাছাড়া আমিনা বিবি আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করাননি।’
‘কিন্তু আমিনার কথা উঠলে আমার কথাও কি উঠবে না?’
‘তা উঠবে বৈকি!
‘লুৎফা, তুমি সীমা ছড়িয়ে যাচ্ছ।
‘না, আপনাদের স্পর্ধা সীমা ছাড়িয়েছে। সেটা বন্ধ করতে আমি বদ্ধপরিকর।’
আমিনা বিবি ধীরে ধীরে উঠে বসেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, ‘তুমি এসব কী বলছ লুৎফা’!
‘আমি বেগমসায়েবার কাছে যাচ্ছি, হোসেন কুলিখাঁ সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা করতে।’
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন তিনি। ঘসেটির মতো দৃঢ়তা তাঁর নেই। উঠে এসে আমার হাত দুটো চেপে ধরে বলেন, আমার ছেলের বেগম তুমি। তবু তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। মাকে এসব কথা বোলো না। একে তো লজ্জায় তোমার কাছে মুখ দেখাতে পারছি না, এরপর মায়ের কানে গেলে আমায় আত্মহত্যা করতে হবে।’
তাঁর কথায় আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। মুহূর্তে আমার দৃঢ়তা কোথায় ভেসে যায়। তিনি যে সিরাজের মা।
‘বলো লুৎফা, বলবে না মাকে? বলো, কথা দাও।’
‘বেশ, কথা দিলাম।’ আমি ছুটে বার হয়ে যাই। পেছনে চাইতে পারি না। জানি, তাহলে ঘসেটির বিদ্রুপের হাসি আমার চোখে পড়বে।
তবু বেগমসায়েবার ঘরের দিকে যাই। মনে মনে ভাবি, আমার প্রিয় অতি পরিচিত জায়গাটিতে আর কখনও দাঁড়াব না। একসময় যা আমার একমাত্র আশ্রয় আর সান্ত্বনার স্থল ছিল, আজ তা আমার মন আর জীবনকে এক জটিল ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।
.
বেগমসায়েবা তেমনি বসে রয়েছেন। তাকিয়ার ভর দেওয়া বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপর রাখা সমস্ত শরীরের ভার। কপালে সেই চিরপরিচিত চিন্তার রেখা। বয়সের জন্যে সে-রেখা আরও গভীর, আরও প্রকট।
আমাকে দেখে তিনি বলে উঠলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি তুমি কী করে এলে লুৎফা?’
‘কেন বেগমসায়েবা!’ তাঁর কথায় অবাক হই।
‘হামিদাকে তো এখুনি পাঠালাম।’
‘সে আমার কাছে গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, দেখা হয়নি?’
‘আমি ঘরে ছিলাম না।’
‘ঘসেটির ঘরে ছিলে বুঝি?’
‘না, আমিনা বেগমের ঘরে।’
‘আমিনার ঘরে! কখন গিয়েছিলে?’
‘কিছুক্ষণ আগে। ঘসেটি বেগমও সেই ঘরে আছেন।’
‘তা কী করে হবে! তার তো সেখানে থাকার কথা নয়।’ বেগমসায়েবার উক্তিতে শ্লেষ। এভাবে এই প্রথম তাঁকে কথা বলতে শুনলাম।
আমি চুপ করে থাকি। এমন কিছু ঘটেছে, যা তাঁর মতো স্থির বুদ্ধিসম্পন্না নারীকেও বিচলিত করে তুলেছে। কী বলব ভেবে পাই না।
‘লুৎফা, একদিন যে-পুরুষটির কথা তুমি আমাকে বলেছিলে, এতদিনে তার পরিচয় পেলাম। যদিও আগে আন্দাজ করেছিলাম, আজ নিঃসংশয় হলাম।’
আমি কেঁপে উঠি। নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে বলি, ‘কোন পুরুষ বেগমসায়েবা?’
‘যাকে হারেমে ঘোরাফেরা করতে দেখে আমার কাছে ছুটতে ছুটতে এসে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারোনি একদিন।’
‘কে সে?’
‘হোসেন কুলিখাঁ। কার লোভে আসে জানো? দাসী-বাঁদিদের লোভে নয়, অন্য কোনো বেগমের লোভেও নয়। আসে আমারই গর্ভের এক কলঙ্কিনীর আদেশে তার মনোরঞ্জন করতে। ঘসেটি এখন আমিনার ঘরে? তা তো হতে পারে না। আমার হিসেবে কি তবে ভুল হল?’
হিসেবে তাঁর মস্ত ভুল হয়েছে, কিন্তু সে-কথা বলি কী করে? এই মুহূর্তে যে কথা দিয়ে এলাম আমিনা বেগমকে। বেগমসায়েবা আর কতটুকুই বা জানেন। আসল ঘটনা শুনলে তিনি কী করবেন ভাবতেও ভয় করে।
‘আপনি কী করে জানলেন বেগমসায়েবা?’
‘তুমি কি ভেবেছ তুমি না বললে আমি জানতে পারব না?’ আমাকে যেন ধমক দেন তিনি।
‘আমি তো জানতে পারিনি।’
‘মিথ্যে কথা। অনেক আগেই তুমি জানতে পেরেছিলে। সঙ্কোচে বলতে পারোনি। এই সর্বনাশা সঙ্কোচ ভালো নয় লুৎফা। বেগমদের কাছে সঙ্কোচের স্থান নেই।’
বেগমসায়েবার দুই হাঁটু ধরে আমি কেঁদে ফেলি।
‘কেঁদো না। তোমার অসুবিধে আমি জানি। কিন্তু যারা খারাপ, তারা খারাপই। তাদের জন্যে কোনো দ্বিধা মনে স্থান দেওয়া অন্তত সিরাজের বেগমের শোভা পায় না, যে সিরাজ একদিন মসনদে বসবে।’
‘বেগমসায়েবা।’ মুখ তুলে বলি।
‘হ্যাঁ, বলো। আরও অনেক কিছু জানো তো?
‘জানি। কিন্তু আমার একটা প্রার্থনা আছে।’
‘বলো।’
‘যাঁর সম্বন্ধে আজকে আপনাকে বলব, তিনি যেন কোনোদিন টের না পান যে তাঁর কথা আপনি জানেন।’
‘বেশ, তাই হবে।’
আমিনা বেগমকে কথা দিলেও সে-কথার মূল্য রাখতে পারলাম না। আমি যে সিরাজের বেগম। মহলের মঙ্গল, রাজ্যের মঙ্গল, সবার মঙ্গল দেখাই যে আমার কর্তব্য। যা-যা দেখেছি একে-একে সব বলে গেলাম। আজকের আমিনা বেগমের ঘটনাও বাদ দিলাম না।
আমার কথা শুনে বেগমসায়েবা অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করলেন। মাঝে মাঝে দুই হাত মুঠো করে শূন্যে তুলে আস্ফালন করেন, আবার কখনও আপন মনেই চেঁচিয়ে ওঠেন। স্তব্ধ আতঙ্কে আমি ঘরের এককোণে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
তুমি আমাকে দিয়ে বড় কঠিন প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছ লুৎফা। এ তোমার উচিত হয়নি।’ তিনি দাঁতে দাঁত ঘষে বলেন, যেন তাঁর সমস্ত আক্রোশ আমার ওপর।
‘কী করব, উনি যে নবাবজাদার মা।’
চিৎকার করে ওঠেন তিনি, ‘মা, মা, মা। কে মা? কার মা? এককালে গর্ভে ধরেছিল বলেই মা! খাসা।’ অতিমাত্রায় উত্তেজিত হবার পর বেগমসায়েবা কেমন ঝিমিয়ে পড়েন। ধপাস করে পালঙ্কের ওপর বসে পড়েন।
আমি ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে আসি। সবার অজ্ঞাতে বারুদের স্তূপে আগুন দিয়ে এলাম।
কয়দিন ধরে সিরাজ বড্ড বেশি শরাব খাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, নবাব আলিবর্দি তাকে পাটনার শাসনভার দিয়েছেন বলে সে আনন্দ করছে। এই বয়সে এতবড় মর্যাদা তো যার-তার ভাগ্যে হয় না। তার ওপর সহকারী হিসাবে সে পেয়েছে রাজা জানকীরামের মতো লোককে। জানকীরাম ইতিমধ্যেই পাটনায় রওনা হয়ে গিয়েছেন। সিরাজকে নবাব ছাড়েননি। কবে ছাড়বেন জানি না।
আজও মাতালের মতো টলতে টলতে সে আমার ঘরে এল। তবু যা হোক সে তার কথা রাখছে। দু’বেলা আমার কাছে এসে খানা খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে শরাবের পরিমাণ বেড়ে চলেছে, তাতে কতদিন সে তার কথা রাখতে পারবে জানি না। সে যতক্ষণ আমার কাছে থাকে, মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে সবকিছু করে যাই। কিন্তু সে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আর থাকতে পারি না, কান্নায় ভেঙে পড়ি। নবাবের বেগমদের ভাগ্য কি একরকম হতেই হবে? আলিবর্দির বেগম কি তাহলে সৃষ্টিছাড়া?
.
সিরাজ গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। তার দুটো চোখ সব সময় কীসের চিন্তায় যেন মশগুল। শরাবের শক্তি তার চিন্তাকে এতটুকু বিভ্রান্ত করতে পারছে বলে বোধ হল না। এ কয়দিনে সে ভীষণ শুকিয়ে উঠেছে।
তার সামনে খাবার রাখতে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী এনেছ?’
‘দমপোক্ত।’
‘খাব না।’
তুমি তো ভালোবাসো।’
‘আঃ, বাজে কথা বোলো না! খাব না, ব্যস!’
কী খাবে বলো, আমি এনে দিচ্ছি?’
‘কিসসু খাব না। কিসসু ভালো লাগে না।
‘তাহলে যে শরীর টিকবে না, নবাবজাদা।’
‘কী লাভ বেঁচে থেকে?’
ভাবলাম, শরাবের নেশায় আবোল-তাবোল বকছে নিশ্চয়। চুপ করে বসে থাকি। আগে নেশা কাটুক, তারপর কথা বলা যাবে।
কিন্তু কোনো লাভ হল না। সিরাজের চিন্তার যেন আদি-অন্ত নেই। ভেবেই চলেছে সে। দেওয়ালের দিকে তার দৃষ্টি স্থির, নিবদ্ধ। শেষে কি পাগল হয়ে যাবে? কেউ কিছু খাইয়ে দেয়নি তো? শরাবের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দেওয়া বিচিত্র নয়। শত্রুর অভাব নেই ভবিষ্যৎ নবাবের—ঘরে-বাইরে শত্রু।
‘তোমার কী হয়েছে, নবাবজাদা?’
‘কিসসু হয়নি।
‘না, বলতেই হবে তোমাকে। দিনের পর দিন মুখ শুকনো করে থাকবে তা হবে না।’ সিরাজের হাত চেপে ধরি।
‘আমি উঠে যাচ্ছি।’ সে সত্যিই উঠে দাঁড়ায়।
এবারে তার পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ি। সে পা দিয়ে আমাকে ঠেলে দেয়। কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে নিজেই আমার গায়ের ওপর এসে পড়ে।
‘ফেলে দিলে, লুৎফা?’
‘আমি ফেলি নি, নবাবজাদা। তোমার শরীর দুর্বল, তাই আমাকে লাথি দিয়ে সামলাতে পারোনি নিজেকে।’
‘ও, তাই হবে।’ সে এমনিভাবেই আমার গায়ের ওপর পড়ে থাকে। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টাও করে না। তার সমস্ত শরীরের ভার আমার ওপর। তাই নিজেও উঠতে পারি না। মনে হল, সিরাজ শুয়ে পড়েও ভাবছে। তার চিন্তাসূত্র এতটুকু বিচ্ছিন্ন হয়নি। বাইরের ঘটনাগুলো তার মনে এতটুকু রেখাপাত করেনি।
‘উঠবে না?’
‘ও হ্যাঁ, উঠতে হবে। তোমার কষ্ট হচ্ছে, লুৎফা?’
‘না।’
তাহলে একটু শুয়ে থাকি।’
‘এভাবে শুয়ে থাকবে কেন? ওঠো ভালোভাবে শোও।’
‘না, এই বেশ।’
‘কেউ এলে দেখে ফেলবে যে।’
‘ও, দেখে ফেলবে? তাহলে তো উঠতে হয়, তাই না লুৎফা?’
‘তোমার কী হয়েছে? এভাবে কথা বলছ কেন? ভয় হয় আমার।’
কী ভাবে বলছি? ঠিক বলছি না?’
‘না, মোটেই না।’
সিরাজ চুপ করে থাকে। সে তখনও ভেবে চলে।
‘চলো খাবে।’
‘তোমার রাগ হয়নি, লুৎফা?’
‘কেন?’
‘তোমাকে লাথি মেরেছি বলে।’
‘সেজন্যে তোমার অনুতাপ হয়েছে?’
‘হুঁ।’
‘তাহলে আর রাগ নেই।’
‘অন্য বেগম হলে কিন্তু আমার সঙ্গে কথাই বলত না।’
‘তারা যে বেগম।
আর তুমি?’
‘আমি? আমি তোমার প্রাণের আধখানা। তুমিই তো বলেছিলে।’
সিরাজ আমাকে জড়িয়ে ধরে।
‘তুমি কি পাটনায় যেতে চাও, নবাবজাদা?’
‘কেন?’ সে অবাক হয় আমার কথায়।
‘নবাব যেতে দিচ্ছেন না বলে তোমার দুঃখ হয়েছে?’
‘তা একটু হয়েছে বৈকি।’
বুঝলাম, ঠিক ধরতে পারিনি। সিরাজের আসল কষ্ট পাটনার জন্যে নয়। সহসা একটা কথা ভেবে চমকে উঠি। তবে কি সে হোসেন কুলিখার কথা শুনেছে? বেগসায়েবা কি তাকে সব খুলে বলেছেন?
‘তুমি বেগমসায়েবার কাছে গিয়েছিলে, নবাবজাদা?’
‘ও কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’
‘এমনি।’
‘আজ যাইনি।’
‘কবে গিয়েছিলে?’
‘পাঁচদিন আগে।’
আমার মাথায় বজ্রাঘাত হয়। ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক পাঁচদিন আগে, যেদিন সন্ধ্যাবেলা আমি বেগমসায়েবাকে সব খুলে বলি।
‘সেদিন কখন গিয়েছিলে তাঁর কাছে?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি।
‘রাত্রে।’
আর ভুল নেই। বেগমসায়েবা তাঁর কথা রাখতে পারেননি। সিরাজকে তার মায়ের কেলেঙ্কারির কথা বলে দিয়েছেন। সমালোচনা করা আমার শোভা পায় না। তবু বলব তিনি অন্যায় করেছেন। সিরাজকে না জানিয়ে তিনি অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে পারতেন। তার মনকে ওভাবে ভেঙে দেবার প্রয়োজন ছিল না তাঁর।
সিরাজ ধীরে ধীরে উঠে বসে। সে আমার হাত ধরে তুলে বলে, চুপ করে আছ কেন, লুৎফা?’
‘বেগমসায়েবার কাছে কিছু শুনেই কি তোমার মন খারাপ?’
‘হ্যাঁ। তুমি জানলে কী করে?’ সে শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে।
‘অনুমান।’
‘কখনও নয়। তুমি সব জানো। বলো, সত্যি কি না? বলো…’
‘সত্যি।’ মিথ্যে বলার শক্তি ছিল না।
সে স্থির হয়ে বসে থাকে, যেন মাটির পুতুল—জীবনের কোনো স্পন্দন নেই। আমিও দাঁড়িয়ে থাকি, বলার কিছু নেই। এখন সান্ত্বনার বাক্য বিদ্রুপের মতো শোনাবে।
বহুক্ষণ পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, ‘ভালোই হল লুৎফা, তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল। মনের মধ্যে চেপে রেখে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম বুঝি পাগল হব। কিন্তু কই, তুমি তো আমাকে বলোনি? তুমি বলতে পারতে।’
‘ক্ষমা করো আমাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।
স্বাভাবিক। যাক, ভালোই হল।’
‘বেগমসায়েবা কি তোমাকে আর কিছু বলেছেন?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু যা বলেছেন, আমার দ্বারা তা সম্ভব নয়। দাদি আরও কয়েকবার আমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন, আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’
‘কী বলেছেন তিনি?
‘হোসেন কুলিখাঁকে হত্যা করতে, কিন্তু এ কি সম্ভব? তুমিই বলো লুৎফা, এমন একজন লোককে হত্যা করা যায়? সে কৌশলী, কর্মঠ আর রাজকার্যে বিশ্বস্ত। দোষ তার যতই থাকুক, তার চেয়েও সহস্রগুণ দোষ এ পক্ষের। হোসেন কুলিখাঁ কখনও প্রথমে এগিয়ে আসেনি, আসতে পারে না। তাই বলছি, ব্যবস্থা যদি কিছু করতে হয়, তাহলে মাতৃহন্তা হতে হয়।
‘না-না।’ আমার মুখ দিয়ে আর্তনাদ বার হয়ে আসে। সিরাজের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। ভয় নেই লুৎফা, মাতৃহন্তা হব না, কিন্তু হোসেন কুলিখাঁকে মারতেও পারব না। সে এমন একজন লোক, যাকে হত্যা করলে দাদুর নবাবিও বিপদ-সঙ্কুল হয়ে উঠতে পারে। শত্রুরা এ হত্যার পুরোপুরি সুযোগ নেবে।’
তবে তাঁকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দাও। রাজা জানকীরামকে পাটনা থেকে ফিরিয়ে এনে তাঁকেই সেখানে পাঠাও।’
ঠিক। একথা আমার আগে মনে হয়নি। কালই নবাবকে বলব।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি আমি।
.
চারদিন পর।
সিরাজের জন্যে বসে রয়েছি। আসতে বড় দেরি হচ্ছে তার। দুপুর গড়িয়ে গিয়ে বিকেল হল, তবু দেখা নেই। খাবার ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
সোফিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত। তার উত্তেজিত মুখের দিকে চেয়ে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। একটা ঘোর অমঙ্গলের বার্তা লেখা রয়েছে সে-মুখে। সিরাজের কি তবে কিছু হল?
‘চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বলো কী হয়েছে?’ চিৎকার করে উঠি।
‘আপনি শোনেননি এখনও!’
‘না, বলো।’ চোখে জল এসে যায় আমার।
আপনি কাঁদছেন কেন?’
‘না শুনে কি কাঁদা যায় না? মন বলে কি কোনো জিনিস নেই?’
‘কিন্তু এতে আপনার কাঁদার তো কথা নয়। আমি ভেবেছিলাম, আপনি বোধহয় শুনেছেন সব। তাই বলতে এসেছিলাম যে কাজটা খুব ভালো হল না।’
‘কোন কাজ? বলেই ফ্যাল্ না শয়তানী।’ ছুটে গিয়ে সোফিয়ার চুল চেপে ধরি।
‘ছাড়ুন বেগমসায়েবা, বলছি।’
চুল ছেড়ে দিয়ে তার মুখের দিকে তাকাই।
সে ঢোক গিলে বলে, ‘বলছিলাম, হোসেন কুলিখাঁকে এভাবে মেরে ফেলা উচিত হয়নি।’
‘কী বললে? হোসেন কুলিখাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে? কে মারলে?’
‘নবাবজাদা সিরাজদ্দৌলা।’
‘মিথ্যে কথা! আমি বিশ্বাস করি না।’
‘মিথ্যে নয়। বাজারের মধ্যে নবাবজাদার সামনে হোসেন কুলিখাঁর মাথা কাটা হয়েছে। সেখানে তাঁর দেহ এখনো ঝুলছে একটা বাঁশের মাথায়।’
‘না-না, এ কখনও হতে পারে না। তুমি ভুল শুনেছ সোফিয়া। ‘
‘মহম্মদ সেখানে ছিল।’
‘মহম্মদ সত্যবাদী নয়।’
‘তবে যাকে খুশি জিজ্ঞাসা করুন, সত্য জানতে পারবেন।’ সোফিয়া রাগ করে চলে যায়। তার সামনে মহম্মদ সম্বন্ধে আজই প্রথম বিরূপ মন্তব্য করলাম।
পাথরের মতো বসে থাকি। বেগম, বেগম। বেগম হওয়ার সুখ মর্মে মর্মে অনুভব করছি। হতে চাই না বেগম। সিরাজকে নিয়ে যদি কোথাও পালাতে পারতাম কোনো নির্জন গাঁয়ের কোলে, তাহলে বেঁচে যেতাম। কী হবে ঐশ্বর্যে, কী হবে নবাবিতে? সাধারণ মানুষের সাধারণ সুখ-দুঃখই ভালো। তাতে এত খুনোখুনির ব্যাপার নেই, এত ব্যাভিচারও নেই।
কিন্তু সিরাজ তো যাবে না। নবাবির রক্ত যে তার শরীরের প্রতিটি ধমনিতে ছোটাছুটি করছে। সে চায় উত্তেজনা, উন্মাদনা, আর উচ্ছৃঙ্খলতা। সে চায় যুদ্ধ আর মৃত্যু।
সোফিয়ার কথা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। মহম্মদ বোধহয় তার মুখোশ খুলতে শুরু করেছে। যেমন মহম্মদ, তেমনি মেহেদি নেশার খাঁ— দু’জনেই সমান। দু’জনের আওতা থেকে সিরাজকে মুক্ত করতে হবে।
হোসেন কুলিখাঁকে যে হত্যা করা হয়েছে একথা মিথ্যে হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সিরাজের আদেশে তিনি হত হতে পারেন না। যে সিরাজ তাঁর পক্ষ নিয়ে সেদিন অত কথা বলল, এরই মধ্যে তার মনোভাবের এমন আকস্মিক পরিবর্তন অসম্ভব। তবু মনটা চঞ্চল হল। সিরাজ না এলে কিছুই বুঝে ওঠা যাবে না।
অবশেষে সিরাজ এল। রক্তরাঙা চোখ নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে এল। তবে তার জ্ঞান রয়েছে পুরোমাত্রায়। আমাকে দেখে অস্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠল। বলল, ‘রাগ হল, তাই না? কি করব, একটু খেয়ে এলাম। উপায় ছিল না।’
‘উপায় তোমার কোনোদিনই হবে না, নবাবজাদা।’
‘তুমি অমনভাবে বোলো না লুৎফা, তাহলে দাঁড়াব কোথায়?’
‘আমার মৃতদেহের ওপর। নিজের পায়ে তুমি বেশ ভালোই দাঁড়াতে পারো, অন্যের প্রত্যাশা করো না। ওটা শুধু মুখের কথা।‘
তুমিও একথা বললে?’ সিরাজ আশাহত চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল।
কথাটা সত্যি বলিনি?’
‘না লুৎফা। মিথ্যে, একেবারে মিথ্যে।’
শরাব খেয়েছ তাই মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে এখন। শরাব খাবার আগে একবার ভেবে দেখো, দেখবে আমার কথাই সত্যি।’
সে ধীরে ধীরে দরজার দিকে ফিরে যায়।
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘জানি না।’
‘এখন যাওয়া হবে না।’
সে হেসে ওঠে। কেমন ভাঙা-ভাঙা হাসি। আরও দু’পা অগ্রসর হয়। আমি গিয়ে তাকে ধরে ফেলি।
‘ধরলে কেন? যেতে দেবে না? আমি তো শুধু ছলনা করি।’
‘আমার কর্তব্য রয়েছে।’
‘কর্তব্য? কর্তব্য তো জারিয়াদেরও আছে। আমি আদেশ করলে একশো জারিয়া ছুটে এসে আমার সেবা করবে, যেমন আজ আমার ছোট্ট আদেশে হোসেন কুলিখাঁর মাথা দেহ থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ল।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ সত্যি। নির্মম সত্যি। মুর্শিদাবাদের যে-কেউ জানে। সবাই যা জানে, তুমি জানো না? আশ্চর্য!’
‘না-না, তা হতে পারে না। তুমি কখনও একাজ করতে পারো না। তুমি ভুল বকছ, শরাবের নেশায় যা-তা বলছ।’
‘না লুৎফা, ভুল নয়। আমি নিজেই জানতাম না যে, একাজ আমি করতে পারি, কিন্তু করলাম ও তো।’
‘কেন করলে নবাবজাদা? সেদিন যে তুমি অন্য কথা বললে।’ অবাধ্য জল আমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
‘এখনো আমার নিজের মতও তাই, কিন্তু আমি অক্ষম লুৎফা। আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে। অনুশোচনায় তাই শরাব খেয়েছি। খুব বেশি করেই খেয়েছি। তবু শান্তি পাচ্ছি কই? তাই তোমার কাছে ছুটে এলাম লুৎফা। তুমি তো শান্তি দিয়েছ কতবার, কিন্তু এবার তাও হল না। আমি ছলনা করি।
‘ক্ষমা করো, আমাকে ক্ষমা করো। অভিমান হয়েছিল—অভিমানও কি করতে নেই?’
‘অভিমান করা আমি পছন্দ করি লুৎফা। কিন্তু বড় অসময়ে করেছিলে।’
‘কেন তুমি এই সাংঘাতিক আদেশ দিলে সিরাজ?’
‘দাদি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে না পেয়ে নিজে গিয়েছিলেন। হাজার কথা বলে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন। এ হত্যার জন্যে দাদি দায়ী, আমি নই। কিন্তু লোকে তো জানবে না। বদনাম আমারই হল। নবাব হবার আগেই আমার নামের সঙ্গে কলঙ্ক জুড়ে দিলাম। বড় আফশোস হয় লুৎফা।’
আমি চুপ করে শুনি। সে বলে, ‘হোসেন কুলিখাঁ সবার প্রিয় ছিল। সে আমারও প্রিয় ছিল। আমি যখন তাকে হত্যা করার আদেশ দিলাম সে বিশ্বাস করতে পারেনি। অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়েছিল। কিন্তু অবাকের রেশ না কাটতেই তার মাথা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। কেয়ামতের দিনে এজন্যে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হবে।’
সিরাজকে শুইয়ে দিয়ে তার পাশে বসি। মনের ভেতরের সংঘাতে সে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে—সে চায় সান্ত্বনা। আমি সান্ত্বনা দিতে যাই, কিন্তু পারি না। মুখে কথা আসে না। ভাবি, সিরাজে কথায় অতবড় একজন লোক হত হলেন। তার মুখের সামান্য একটা কথায় হোসেন কুলিখাঁ জগৎ থেকে চিরবিদায় নিলেন। তাঁর অপরাধ এই যে, তিনি দুজন বিকারগ্রস্ত নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। হয়তো তাঁর নিজের কোনো দুর্বলতাই ছিল না। নারীরা তাঁকে বাধ্য করেছে নিজেদের লালসাবৃত্তি চরিতার্থ করিয়ে নিতে।
.
সিরাজ ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি উঠি। বেগমসায়েবার ঘরে যেতে হবে। তাঁকে সোজা প্রশ্ন করব, কেন তিনি সিরাজকে দিয়ে এ কাজ করালেন। তাঁর হাতে অগাধ ক্ষমতা। একটা লোকের দেহ বিচ্ছিন্ন করতে তিনি সহস্র লোককে পেতে পারতেন। তবে কেন একজন ছেলেমানুষকে প্ররোচিত করে হীন মনোবৃত্তির পরিচয় দিলেন তিনি!
বেগমসায়েবার ঘরে তখন অন্য কেউ ছিল না। আমাকে দেখে উঠে বসেন তিনি। ‘এসো লুৎফা।’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম।’
‘জিজ্ঞাসা করার কিছু নেই। সিরাজ ঠিক কাজই করেছে।’
‘কিন্তু…’
‘কোনো কিন্তু নয়। নবাব হলে এর চেয়ে আরও অপ্রিয় কাজ তাকে করতে হবে। এখন থেকে অভ্যাস করুক। শক্ত হয়ে উঠুক।’
‘অসহায় লোককে হত্যা করা শক্ত হবার একমাত্র পথ নয়। বরং তাতে অন্য ফল ফলতে পারে।’
‘বেশ কথা বলতে শিখেছ তো এর মধ্যেই।’
বাধ্য হচ্ছি বেগমসায়েবা। নবাবজাদার ভার নিতে আপনিই বলেছিলেন। তাঁর মঙ্গল-অমঙ্গলের দিকে তাকাতে হবে বৈকি। এ যে আপনারই আদেশ।’ তাঁকে এভাবে বলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার যে কোনো লোকের পক্ষে ধৃষ্টতা। কিন্তু আমি তখন মরিয়া।
‘হুঁ। এতে তার অমঙ্গল কোথায় দেখছ?’
শত্রুপক্ষ তাঁর নামে কী রটায় আপনি জানেন? এতে সেটা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। প্রজারা জানল, রটনাটা মিথ্যে নয়।’
‘সে-ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে নির্মূল করতে হবে।’
‘তাহলে মহলের ভেতর থেকেই যে শুরু করতে হয়।’
‘বুঝলাম না তোমার কথা।’ বেগমসায়েবার ভ্রু কুঞ্চিত হয়।
‘শত্রুপক্ষ মহলেও রয়েছে বেগমসায়েবা।’
‘কে সে?’
‘ঘসেটি বেগম। নবাবজাদার যেসব দুর্নাম রটে তার জন্যে তিনিই দায়ী।’
‘প্রমাণ আছে?’
আছে। আমি জোগাড় করেছি। তবে আমি আপনার সামনে সে-প্রমাণ উপস্থিত করতে পারব না।’
‘কেন?’
‘দু’চারজন নিরপরাধী তাতে শাস্তি পাবে।’
‘হুঁ। তোমার কথা মেনে নিলেও ঘসেটির বিরুদ্ধে আমি কিছু করতে দেব না। মনে রেখো লুৎফা, সে আমার মেয়ে। একটা বেগম মরলে সিরাজ হাজারটা বেগম এনে শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে, কিন্তু একটা মেয়ে মরলে মেয়ে ফিরে পাওয়া যাবে না।’
‘সব আমি জানি, বেগমসায়েবা। প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সেজন্যে আপনাকে এতদিন কোনো কথা বলিনি।’
‘সিরাজ কোথায়?’
‘আমার ঘরে।’
‘সে তোমার ঘরে কি রোজই যায়?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা যাও।’
.
তাড়াতাড়ি চলে আসি নিজের কক্ষে। বেগমসায়েবার কথার গূঢ় অর্থ আমি বুঝেছি। তিনি আমার কাছ থেকে সিরাজকে সরিয়ে নিতে চান। কিন্তু কিছুতেই আমি দেব না সিরাজকে। কিছুতেই নয়। বাংলার বেগম বুঝুক লুৎফাও কম নয়, তারও শক্তি রয়েছে।
নিদ্রিত সিরাজকে ঠেলে তুলি। তার কোলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করি। কান্না ছাড়া গতি নেই।
‘কী হল লুৎফা?’
তুমি আমাকে একটা কথা দাও।’
‘হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়ে এমন কী কথার প্রয়োজন হল?’
‘বলো দেবে? না দিলে আমি আত্মহত্যা করব।’
‘দেব, বলো।’
‘তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারবে না—কোনোদিনও না।’
আমি তো দূরে যাইনি।
‘ভীষণ ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমার কাছে তারা তোমাকে থাকতে দেবে না।’
‘সে-ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে।’
‘যদি বেগমসায়েবা নিজে থাকেন সে-ষড়যন্ত্রে?’
‘তুমি বলছ কি লুৎফা?’
‘ঠিকই বলছি।’ বেগমসায়েবার সঙ্গে আমার কথোপকথনের সবটুকুই বলি তাকে।
‘ঘসেটি বেগম যে এর মধ্যে আছে, সে-প্রমাণ তুমি পেলে কী করে?’
‘ভাগ্যক্রমে।’
‘কী সে-প্রমাণ?’ তার কথায় আগ্রহ।
‘রাজবল্লভের কাছে মির.নজরালি মারফত একটুকরো চিঠি যাবার কথা ছিল। সেটা আমার
হস্তগত হয়েছে।’
‘ঘসেটি বেগম লিখেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার হাতে এল কী ভাবে?’
‘তোমার দিকে চেয়ে মহলের কিছু লোককে হাতে রেখেছি। অন্যায় হয়েছে নবাবজাদা?’
সিরাজ কিছু বলে না। আমি উঠে গিয়ে ঘসেটির হস্তাক্ষর নিয়ে এসে তার সামনে মেলে ধরি :
‘নবাব আলিবর্দি আর কতদিন বাঁচবেন। এরপর কি ওই উদ্ধত বালকের অধীন হতে মনস্থ করেছেন?’
সিরাজ চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে বলে, ‘আমার ভালো করতে গিয়ে মস্ত ভুল করে বসে আছ লুৎফা। চিঠিখানা যে ঠিক জায়গায় পৌঁছায়নি, সেটা বুঝতে ঘসেটি বেগমের বেশি দেরি হবে না। ফলে কয়েকজন হতভাগ্য শাস্তি পাবে। ঘসেটি বেগম আরও অনেক সাবধান হবে। তার পরবর্তী কার্যকলাপ জানতে পারব না।’
‘এতক্ষণে রাজবল্লভের কাছে চিঠি পৌঁছে গিয়েছে, নবাবজাদা।’
‘কী করে?’
‘এর নকল করে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘসেটি বেগমের আসল হস্তাক্ষর রেখে দিয়েছি নিজের কাছে।’
সিরাজ আমাকে চুমু খায়। হোসেন কুলিখাঁকে হত্যা করে অবসাদে তার মন ভেঙে গিয়েছিল। সে অবসাদ বিন্দুমাত্রও দেখা গেল না তার মধ্যে। সে আমাকে শূন্যে তুলে বলে, ‘তুমি আমার লুৎফাউন্নেসা।’
হঠাৎ তার আনন্দে ভাটা পড়ে। সে আমাকে নামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে চায়। মির্জা ইরাজ খাঁর কন্যা সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে আগুন জ্বলছে, মুখ রক্তাভ। হিংস্র জন্তুর মতো সে সিরাজের দিকে চেয়ে রয়েছে। ভাবি, বেগমসায়েবার ষড়যন্ত্র কি এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল?
সিরাজ বলে, ‘এ তোমার অনধিকার প্রবেশ জেবউন্নেসা।’
‘না।’ ইরাজ-দুহিতার কণ্ঠস্বর দৃঢ়।
‘কেন নয়?’
‘লুৎফাকে তুমি শাদি করোনি, আমাকে শাদি করেছিলে। দিনের পর দিন একা থেকে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। পঞ্চাশবার লোক পাঠিয়েছি তোমার খোঁজে, তবু পাইনি। তাই আজ নিজেই এসেছি ঘর ছেড়ে। তোমার জন্য যেখানেই যাই না কেন, সেটা অনধিকার হতে পারে না।’
জেবউন্নেসার জন্যে দুঃখ হল। সত্যিই তো, তার মনেও সাধ আছে, আহ্লাদ আছে। তাছাড়া আমার মতো জারিয়া থেকে সিরাজের এক কথায় বেগম হয়নি সে। ভালো বংশের মেয়ে। রীতিমতো জাঁকজমক আর অনুষ্ঠানের মধ্যেই তার শাদি হয়েছিল। সে কেন অবহেলা সহ্য করবে? আমি গিয়ে তার হাত ধরি। সে হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে, ‘ছুঁয়ো না। তোমার হাত আমার দেহ স্পর্শ করবার উপযুক্ত নয়। ও হাতে আমার পা টিপতে পারো’।
লজ্জায় অপমানে মাথা ঝিমঝিম করে আমার। সিরাজ হো-হো করে হেসে বলে, কিন্তু ও হাতের স্পর্শ যে আমার সর্বাঙ্গে। আমার দেহ কি তুমি ছুঁতে পারবে, জেবউন্নেসা?’
সে কোনো কথা বলে না।
আমি বলি, ‘নবাবজাদাকে তোমার ঘরেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘থাক দয়া দেখাবার প্রয়োজন নেই। আমার কাজ আমি নিজেই করে নিতে জানি। কেউ যদি তাতে বাধা সৃষ্টি করে তাকে কীভাবে সরিয়ে দিতে হয় তাও আমার জানা আছে।’
‘ও, জানো নাকি?’ সিরাজের মুখে বিদ্রুপের তারল্য। আমি দু’হাতে তার মুখ চেপে ধরি।
সিরাজ এগিয়ে যায় জেবউন্নেসার কাছে। দুই হাতে তার হাত দুটো তুলে নিয়ে নিজের গলায় মালার মতো রেখে বলে, ‘শুধু শুধু রাগ করছ তুমি। লুৎফাকে শাদি করিনি যখন, তখন সে তোমার অধিকার কী করে ছিনিয়ে নেবে?’
‘থাক, আর মন ভোলাতে হবে না।’ জেবউন্নেসা সিরাজের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।
‘বিশ্বাস করলে না? এই দেখো।’ সিরাজ নিজের গলা থেকে একটা বহুমূল্য হার খুলে নিয়ে বলে, ‘এর মূল্য নবাবের অর্থভাণ্ডারের প্রায় অর্ধেক অর্থের সমান। লুৎফা কোনোদিন এ-হার পেত না, অন্য কোনো বেগমও নয়, কিন্তু তুমি পেলে। তুমি যে আমার শাদি করা বেগম, জেবউন্নেসা।’
সিরাজ সযত্নে সে-হার পরিয়ে দেয় তার গলায়।
জেবউন্নেসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে চঞ্চল হয়। এ যেন তার কল্পনার অতীত। বিস্মিত হয়ে বলে, ‘আমাকে একেবারে দিয়ে দিলে!’
‘হ্যাঁ, এতে যে শুধু তোমারই অধিকার। হাজারটা লুৎফা এসে শতবর্ষ ধরে চেষ্টা করলেও এ জিনিস পেত না।’
সিরাজ তাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সে সিরাজের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে হাসতে হাসতে ছুটে চলে যায়।
হো-হো করে হেসে ওঠে নবাবজাদা। আর আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকি। এই বয়সে এত বুদ্ধি বুঝি শুধু নবাবদেরই হয়। নারী-চরিত্র চিনতেও তার বাকি নেই। নিজে নারী বলে লজ্জিত হই।
সিরাজ বলে, ‘জেবউন্নেসা তার অধিকার বুঝে পেয়েছে, লুৎফা। তোমাকে দিলাম না বলে কষ্ট হল না তো?’
কিছুমাত্র নয়। আমার বহুমূল্য হার আমার সামনে দাঁড়িয়ে। জেবউন্নেসা নকল হার নিয়েই ভুলল। সে মূর্খ।’ সিরাজের হাত দুটো তুলে নিয়ে নিজের গলায় জড়িয়ে দিই।
.