আমি সিরাজের বেগম – ৬

মেয়েটাকে হামিদার কাছে রেখে ধীরে ধীরে হীরাঝিলের ছাদে গিয়ে উঠি।

সিরাজ এখনও ফেরেনি চেহেল-সেতুন থেকে। কোনোদিন তো এত দেরি করে না, তাই ভাবনা হয়। এখন তার জন্যে ভাবনাটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে, প্রতিকারের উপায় নেই। আগের মতো আমার কাছে এলে কি একদিনও দেরি করে ফিরতে দিতাম? এখন লুৎফা নামে একজন নারী যে হীরাঝিলে বাস করে, একথা হয়তো তার মনেই নেই। তবু নেপথ্যে থেকে প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে তার গাড়ির ঘোড়ার খুরের আওয়াজের জন্যে উন্মুখ হয়ে বসে থাকি। সে ঠিক সময়ে না এলে চিন্তিত হই।

ছাদ থেকে গঙ্গার অপর পাড়ে মোতিঝিলের চূড়া দেখা যায়। ঘসেটি বেগম রয়েছে সেখানে।

হাসি পেল ঘসেটি বেগমের কথা মনে হওয়ায়। নওয়াজিসকে নবাব করার বহু চেষ্টাই সে করেছে, কিন্তু সবই ব্যর্থ হল।

গাড়ির আওয়াজ পাই। মন্থরগতিতে সিরাজের গাড়ি ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তার গাড়ির এমন ধীরগতি দেখে মন খারাপ হয়। অসুস্থ নয় তো সিরাজ? আস্তে গাড়ি চালানো মোটেই পছন্দ করে না সে। সর্বদাই সে চায় উল্কার বেগ।

ছাদ থেকে নেমে তার কক্ষের পাশে লুকিয়ে থাকি। ফৈজীর ঘরে প্রথমে না গেলে সে এখানেই আসবে। কান পেতে দাঁড়াই।

পায়ের শব্দ পাই। জানি, আমি তার সম্মুখে যাব না। তবু বুক দুরুদুরু করে। এত কাছ থেকে অনেকদিন দেখার অভ্যেস নেই তাকে। সিরাজ আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় তার গায়ের বাতাস এসে লাগবে আমার গায়ে। তখন তার শরীরের সুপরিচিত গন্ধ পাব আমি। কিন্তু যদি কেঁদে ফেলি?

একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। নিজের পায়ের ওপর নির্ভর করা এক্ষেত্রে নিরাপদ নয়।

সিরাজ আরও কাছে এগিয়ে আসছে। কেমন যেন ঢিমেতালে হাঁটছে—মোটেই স্বাভাবিক নয়। নিজের মহলের মধ্যেও সে হাঁটে যুদ্ধক্ষেত্রের বীর যোদ্ধার মতো দ্রুত এবং সমান তালে। তার সেই রকম চলন দেখতে সবাই অভ্যস্ত। নবাব আলিবর্দির কাছে তার শপথের কথা ভোলেনি তো? শরাব ধরল নাকি আবার?

উঁকি না দিয়ে পারি না। সিরাজের ফৈজী থাকতে পারে, থাকতে পারে তার হাজারটা বেগম—রাজত্ব থাকতে পারে, সৈন্যসামন্ত থাকতে পারে, কিন্তু সে যে একান্তই আমার। তাকে আর কেউ চিনবে না, কেউ বুঝবে না, ভালোবাসতেও পারে না তাই।

তার মুখের দিকে চেয়ে শিউরে উঠি। একি চেহারা হয়েছে, অসুখ করেনি তো? চোখদুটো লাল হলেও বুঝতে কষ্ট হল না যে নেশার লাল নয়।

নিজের অজ্ঞাতে কখন যে তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম জানি না। একেবারে তার সামনে গিয়ে খেয়াল হল। সিরাজও আগে আমাকে দেখতে পায়নি। যখন দেখল, তখন আর পালিয়ে যাবার উপায় নেই আমার।

‘কে?’ চমকে ওঠে সে।

আমি জবাব দিতে পারি না। লজ্জায়, দ্বিধায় সমস্ত শরীর মন জড়িয়ে আসে।

‘লুৎফা?’

‘হ্যাঁ, নবাব। এখনও বেঁচে আছি।’

জানি। আমার আগে তুমি মরতে পারো না।’ উদার কণ্ঠস্বর তার। তবু তার মধ্যে এমন একটা কিছুর স্পর্শ ছিল যা আমাকে আনন্দ দিল।

‘ক্ষমা করবেন, নবাব। আপনার মুখের দিকে চেয়ে স্থির থাকতে পারিনি। নইলে আড়ালেই থাকতাম। সে-চেষ্টা করেও ছিলাম।’

‘আমার চমকে ওঠা ভুল হয়েছিল। বোঝা উচিত ছিল, তুমি আজ আসবে।’

‘কেন নবাব?’

সুখের সময়ে আড়ালে থেকে নজর রাখো, আর দুঃখের সময় দেখা দাও। আর একজনও এমনি আছে। তবে সে নারী নয়, পুরুষ। সে মোহনলাল।’

দুঃখ! কীসের দুঃখ আপনার?’

‘সাধারণ দুঃখে নবাবদের ভেঙে পড়তে নেই, তাই না, লুৎফা? আমার পিতা নিহত হলে তুমিই একথা বলেছিলে একদিন।’

আমার কথার এতখানি গুরুত্ব দেয় সিরাজ! কবেকার কথা এখনও মনে রেখেছে? আনন্দে চোখ ছাপিয়ে জল আসতে চায়।

‘আপনার কী হয়েছে বলুন।’

‘এক্রাম মারা গেল।

স্তব্ধ হয়ে যাই। নওয়াজিস মহম্মদ এক্রামকে মানুষ করলেও ভাই-এর ওপর সিরাজের দরদ কারও অজানা নয়। কী সান্ত্বনা দেব ভেবে পাই না।

‘মোতিঝিলেই তাকে গোর দেওয়া হল।’ সিরাজ ধীরে ধীরে বলে।

‘আমি খবর পেলাম না?’

ইচ্ছে করেই তোমাকে জানাইনি। অসুখটা ছোঁয়াচে—বসন্ত। তোমার মেয়ে রয়েছে…’

মেয়ের কথা তাহলে সে ভোলেনি, আমাকেও ভোলেনি। তবু আমার সঙ্গে দেখা করে না। জন্মানোর পর মেয়ের মুখও দেখেনি এ পর্যন্ত। আশ্চর্য! নবাবরা সত্যিই সাধারণ মানুষ নয়।

‘ঘরে চলুন নবাবজাদা।’

‘তুমি যাবে?’

আপনি আপত্তি করলে যাব না। ফৈজী বেগমের কাছে খবর পাঠাব?’ মুখে ফৈজীর কথা বললেও মনে মনে নবাবের কাছে থাকতে চাইছিলাম। আজকের দিনে তাকে আর কারও কাছে রাখতে মন চাইল না।

সিরাজের জবাবের অপেক্ষায় তার মুখের দিকে চেয়েছিলাম। ভয় হল যে, আমার কথামতো হয়তো সে ফৈজীকে খবর পাঠাতে বলবে।

তুমি ফৈজীকে ডাকতে চাও, লুৎফা?’

‘আপনার অভিরুচি।’

‘আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই। তুমি এখানে না এলেও তোমার ঘরে যেতাম। এসব দিনে ফৈজীর কথা মনেও আসে না।’

মনে মনে বলি, জীবনেও তার কথা মনে আসা উচিত নয়। সে শয়তানি। সে ঘোর পাপিষ্ঠা। সে অবুঝ যুবকের মন নিয়ে সাংঘাতিক খেলায় মত্ত হয়েছে।

মুখে বলি, ‘মেয়েরা বড় নীচমনা, নবাব। আমাকে আপনার বিপদের দিনের প্রলোভন দেখাবেন না। শেষে হয়তো আল্লার কাছে শুধু সেইসব দিনেরই প্রার্থনা করব।’

সিরাজ গম্ভীর হয়ে বলে, ‘তুমি তা পারবে না। তবে প্রার্থনা করার আর প্রয়োজন হবে না, লুৎফা। সেদিন আসছে, আর একটু ধৈর্য ধরো।’

সিরাজের হাত ধরে ঘরে নিয়ে যাই।

.

মোতিঝিলের সুন্দর বাগিচার এক নির্জন কোণে মাটির নিচে সিরাজের ভাই এক্রামউদ্দৌলা একাকী শুয়ে রইল। কিশোর এক্রামের কিশোরী বেগম নাকি তার শিশুপুত্রকে নিয়ে প্রতিদিন তার স্বামীর কবরের পাশে কাঁদতে বসে। পিশাচি ঘসেটির প্রাণে কিশোরীর এই ব্যথা বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেছে বলে বোধ হয় না। তার সম্বন্ধে নানারকম গুজব হীরাঝিলের কঠিন পাহারা ভেদ করে এখনও আমার কানে আসে।

আজকাল মোতিঝিলে নাকি রাজবল্লভের ভারি আদর। হোসেন কুলিখাঁর মৃত্যু ঘটিয়ে ঘসেটির হাত পেকেছে।

নওয়াজিস মহম্মদের জন্যে কষ্ট হয়। সে তার বেগমের ঠিক বিপরীত। ঘসেটি হয়তো বাংলার মসনদের লোভ এখনও ত্যাগ করেনি। হয়তো কেন, সঠিকভাবেই একথা বলা যেতে পারে। কারণ, রাজবল্লভ যেখানে যায়, সেখানে ষড়যন্ত্র না হয়ে পারে না। কিন্তু বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেও বলা যায়, নওয়াজিস এ সবের মধ্যে নেই।

হামিদা একদিন এসে বলল যে, নওয়াজিস নাকি পাগলের মতো হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে হামিদা এরকম দু’চারটে খবর শুনে এসে আমাকে বলে।

সে বলল, এক্রামের বেগম কেঁদে ভাসায়, আর নওয়াজিস দুহাতে দিয়ে কবরের পাশের মাটি আঁচড়ায়। মাটি খুঁড়ে সে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চায়। তবু যদি নিজের ছেলে হত।

নওয়াজিস নাকি আর বাঁচবে না। তার ‘শোথ’ মারাত্মক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। হাকিম দেখাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। যার বেগম উদাসীন, তাকে আর দেখবে কে? তার কঙ্কালসার চেহারার প্রতি ঘসেটির আকর্ষণ থাকার কোনো কারণ নেই। তার চেয়ে রাজবল্লভ অনেক বেশি লোভনীয়। সে ষড়যন্ত্র করে, পরামর্শ দেয়। নওয়াজিসের মতো সরল-মূর্খ সে নয়। তার ওপর তার দেহ রক্তমাংসে ভরপুর, ঠিক হোসেন কুলিখাঁ যেমনটি ছিলেন।

মাঝে মাঝে ভাবি, ঘসেটি বেগম যদি মেয়ে না হয়ে নবাব আলিবর্দির পুত্র হয়ে জন্মাত, তাহলে দাদুর শত আদরের নাতি হলেও সিরাজ কখনও মসনদে বসতে সক্ষম হত না। যে ক্ষুরধার বুদ্ধি, প্রভাব বিস্তারের যে অপরিসীম ক্ষমতা, যে নিদারুণ কুটিলতা আর নির্মমতা ঘসেটির রয়েছে, তা যে কোনো পুরুষকে সার্থক নবাব হতে সহায়তা করে।

কিন্তু ঘসেটি নারী, তাই রক্ষা। সে পুরুষ হলে বাংলার ইতিহাস অন্যরকম হত। নবাব আলিবর্দি তাহলে শেষদিন পর্যন্ত মসনদে থাকতেন না নিশ্চয়ই। শাহজাহানের মতো কোনো দুর্ভেদ্য দুর্গে বসে সঙ্কীর্ণ গবাক্ষের মধ্য দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তাঁর জীবন শেষ হত।

পুরুষ হতে হতে নারী হয়ে জন্মেছে ঘসেটি, তাই নারী হতে হতে পুরুষ হয়ে জন্মানো নওয়াজিসের প্রতি শুধু বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু সঞ্চিত নেই তার হৃদয়ে। মনে হয়, প্রথম কৈশোরে সে যখন নওয়াজিসকে পছন্দ করে শাদি করেছিল, তখন তার মেয়েলি-মনের পুরুষোচিত কাঠিন্য নওয়াজিসের পুরুষ-মনের নারীসুলভ মিষ্টত্ব দেখে ভুলেছিল। তারপর যখন ঘসেটির দেহ যৌবনজলতরঙ্গে পরিপূর্ণ হল, তখন তার ভুল ভাঙল। সে বুঝল, তার দেহ-মনের পরিতৃপ্তির জন্যে আরও নিষ্ঠুর নির্মম শক্তিশালী পুরুষের প্রয়োজন।

মোতিঝিলের প্রাসাদ থেকে এক গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ছায়া পক্ষবিস্তার করে বাংলায় সৌভাগ্যসূর্যকে ধীরে ধীরে গ্রাস করার চেষ্টা করছে, সিরাজের মুখ দেখে সেকথা স্পষ্ট অনুমান করি। মুখে সে কিছু বলে না, কিন্তু অন্তরে সে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, তার মস্ত প্রমাণ হল এই যে, ফৈজীকে এখনও পর্যন্ত বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি। সৈয়দ মহম্মদ খাঁর ঘন-ঘন হীরাঝিল পরিদর্শনকে সে অস্বাভাবিক বলে মনে করতে পারেনি।

তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী সিরাজের দৃষ্টি এড়িয়ে এ সমস্ত ঘটনা কখনওই ঘটত না, যদি তার চিত্ত স্থির থাকত। বুঝলাম, বাংলার মসনদ নিয়ে তার মনে ঝড় বইছে। হারেমের বাইরে যাদের চিরকাল বন্ধু বলে আত্মীয় বলে জানে, তাদের ওপর এক ঘোর অবিশ্বাস তার মন ছেয়ে ফেলেছে—সে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই মনকে যেখানে মেলে দিয়েছে, সেখানে আর-একই বিষয়ে দেখতে সে চায় না। হারেমে সে শান্তি চায়। তাই দুর্বহ চিন্তাভারের মধ্যেও ফৈজীর কৃত্রিম হাসিতে এখনও সে মুগ্ধ, বিগলিত হয়। আগের মতোই হীরাঝিলের জলাশয়ে গভীর রাত পর্যন্ত এখনও তার বজরা ভাসে। সেই বজরা থেকে ফৈজীর নূপুরধ্বনি ভাসতে ভাসতে গঙ্গার ডিঙিনৌকার মাঝিমাল্লাদের কানে গিয়েও পৌঁছয়। বাইরের কাঠামোটুকু ঠিকই বজায় রয়েছে, কিন্তু ভেতরে মস্ত ফাটল। বাইরে আর ভেতরে সিরাজ সর্বস্বান্ত হতে বসেছে।

ভেবে ভেবে রাত্রে নিদ্রা নেই আমার। মেয়েটার ফুলের মতো ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে তারই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একের পর এক বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দিই।

.

ফৈজীর কথা সিরাজকে শত চেষ্টাতেও বলতে পারিনি। সে বড় আঘাত পাবে। শুধু আঘাত নয়, এমন কোনো কাণ্ড সে করে বসবে, যা হোসেন কুলিখাঁর মৃত্যুর চাইতেও ভয়ঙ্কর।

তবু ইচ্ছে করেই একদিন সিরাজের চলার পথের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফৈজীর ঘরের দিকে যাচ্ছিল সে। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। অবাক হল। এভাবে কখনও তার পথের মধ্যে এসে আমি দাঁড়াইনি। বিশেষ করে তার তনুমন যখন শুধু ফৈজীকেই চাইছে। কিন্তু এক্রামউদ্দৌলার মৃত্যুতে একদিনের জন্যেও আমাদের পূর্বের সম্পর্কের যেটুকু উন্নতি হয়েছিল তাতে আমার সাহস বেড়েছে। কারণ, সিরাজের মনটা বহুদিন পরে সেদিন আবার স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছিল আমার কাছে।

‘কিছু বলতে চাও, লুৎফা?’

‘তেমন কিছু নয়, পরেই বলব।’

‘না, এসেছ যখন বলো।’

ফৈজীর কথা নয়, মোতিঝিলের কথা বলার জন্যে প্রস্তুত হই। সেখানে রাজবল্লভ আর জগৎশেঠের প্রতিদিনের জলসা আমার ভালো লাগেনি। তবু সিরাজকে স্পষ্ট বলতে সঙ্কোচ হয়। সে হয়তো ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেবে, কিংবা বিরক্তি প্রকাশ করবে, এসব ব্যাপারে আমার মতো সামান্য নারীর মাথা ঘামানোর জন্যে।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে অধৈর্য হয়, ‘বলছ না কেন?

ঢোক গিলে বলি, ‘বলছিলাম মোতিঝিলের কথা।’

‘কী হয়েছে মোতিঝিলে?’

‘জগৎশেঠ আর রাজবল্লভ সেখানে যাতায়াত করেন শুনেছি। এটা কি ভালো?’

‘আশ্চর্য!’

‘ক্ষমা করবেন, নবাব। সন্দেহ হল, তাই না বলে থাকতে পারলাম না। কিছুই তো বুঝি না।’

‘তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি বোঝো। তাই অবাক হচ্ছি।’

বিদ্রূপ করছে নিশ্চয়ই। তার সামনে থেকে সরে যেতে পারলেই বাঁচি। বলি, ‘আমি যাই, নবাব।’

‘না, শোনো।

যেতে গিয়ে থেমে গেলাম। পা কাঁপতে শুরু করল। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করতে লাগলাম, এইবার সে রাগে ফেটে পড়বে। কী কুক্ষণেই যে এত কথা বলতে গিয়েছিলাম, তাও আবার সে যখন ফৈজীর কাছে যাবার জন্যে ছুটছে।

কিন্তু রাগের লক্ষণ দেখলাম না তার চোখে-মুখে। আমার কাছে এগিয়ে এসে সে আমার কাঁধের ওপর তার ডান হাত রেখে বলে, ‘তোমার দুটো চোখ ছাড়াও আর একটা চোখ আছে, লুৎফা। সে-চোখ সবার থাকে না। নবাব-বাদশাদের সে-চোখ থাকা ভাগ্যের কথা।’

এ তো বিদ্রূপ নয়। তার কথায় আর স্পর্শে অবশ হয় আমার দেহ-মন। শুধু মাথা নিচু করে প্রাণভরে আস্বাদ করি তার স্পর্শসুখটুকু। কতদিন সে নিজে থেকে আমার কাঁধে হাত দেয়নি এভাবে।

‘লুৎফা।’

‘বলুন নবাব।’

তুমি ঠিকই ধরেছ। এক্রামের ছেলেকে ওরা নবাব করতে চায়। কলকাতা আর কাশিমবাজারে ইংরেজদের কাছে খবর পাঠিয়েছে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে। তারা নাকি রাজিও হয়েছে।

‘কী সাংঘাতিক?’ আর্তনাদ করে উঠি।

‘সাংঘাতিক কিছুটা বৈকি। তবে, এ জাতীয় চক্রান্ত সব নবাবের জীবনেই আসে। ঘাবড়ালে তো চলবে না।’

‘তবু এত জেনেশুনেও চুপ করে আছেন আপনি?’

‘কারণ আছে। অনুমান করতে পারো নিশ্চয়ই।’

‘শেঠ আর রাজাকে ঘাঁটাতে চান না।’

‘শাবাশ!’ সিরাজ আমার দুই কাঁধের ওপর তার দুই হাত বিস্তৃত করে দিয়ে বলে, ‘ঠিক ধরেছ। কিন্তু আরও একজন রয়েছেন, সেখানেই বিপদ।’

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকি।

সে বলে, ‘এবারে অনুমান করতে পারবে না।’

সত্যি অনুমান করতে পারি না।

সিরাজ বলে, আরব দেশের নবাবের রক্ত যার ধমনিতে প্রবাহিত হচ্ছে।’

‘কে সে?’

‘মহামান্য মিরবক্‌সিকুল।

‘মিরজাফর? ‘

সিরাজ শুধু মাথা ঝাঁকায়।

কিছুক্ষণ পরে বলি, ‘তবু এ চক্রান্ত ভেঙে দেওয়া যায়, নবাব। ‘

‘হ্যাঁ জানি, তাই করব।’

‘ঘসেটি বেগম…’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ঘসেটি বেগমকে মোতিঝিল থেকে সরিয়ে আনব। সে থাকবে আমারই হীরাঝিলে, আমার চোখের সামনে। বড় বেশি লোভ তার। এক্রামের বাচ্চাটাকে নামে নবাব করে ক্ষমতালাভের আশা তাকে পেয়ে বসেছে। এত বেশি আশা করা ভালো নয়।’

সিরাজ আমার কাঁধ থেকে হাতদুটো তুলে নেয়। কাঁধ ব্যথা করে। অন্যমনস্ক হয়ে বড় বেশি ভর দিয়েছিল সে। ফৈজীর ঘরের দিকে না গিয়ে সে ফিরে যায় নিজের ঘরে। তার আজকের বৈকালের আনন্দ আমার জন্যে মাটি হল।

.

নওয়াজিস মহম্মদ খাঁ মারা গেল।

এক্রামকে আর একা থাকতে হবে না। নওয়াজিসকেও আর তার কবরের পাশের মাটি আঁচড়াতে দেখা যাবে না পাগলের মতো। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির পাশে সেও আশ্রয় নিল। ছেলেবেলায় বাপ-মায়ের স্নেহ সে পেয়েছে কি না জানি না, কিন্তু জীবনের বাকি সময়টা তার কেটেছে নিদারুণ অভিশাপের মধ্যে। তার তৃষিত হৃদয় আজীবন মরল শুধু ছটফট করে। স্ত্রীর ভালোবাসা কখনও সে পায়নি। কর্মচারীদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেনি সে। তার জীবন-মরুভূমির একমাত্র মরূদ্যান ছিল এক্রাম। সে-মরূদ্যান যখন শুকিয়ে গেল, তখন সব অবলম্বনই সে হারিয়ে ফেলল।

নওয়াজিসের দেহ মোতিঝিলের শীতল মাটির নিচে গিয়ে খুবই শান্তি পেয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও শান্তি পেল বোধহয় ঘসেটি নিজে। জীবনের একটা অযাচিত বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

তার স্বস্তির কথা ভেবে মনে মনে কৌতুক অনুভব করি। জানি, বেশিদিন আর তাকে মোতিঝিলে বাস করে সর্বনাশা চক্রান্তে লিপ্ত থাকতে হবে না। সিরাজ ইতিমধ্যে মতি স্থির করে ফেলেছে। অবসরমতো একটা দিন দেখে সে ঘসেটিকে হীরাঝিলে চলে আসবার জন্যে জানাবে আমন্ত্রণ। সে-আমন্ত্রণ যদি ঘসেটি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সামান্য একটু শক্তিপ্রয়োগ। শক্তিপ্রয়োগ করতে হত না যদি ঘসেটির টোপের নবতম মৎস্য মির নজরালির উদয় হত ইতিমধ্যে। রাজবল্লভের চেয়েও তার আদর নাকি এখন অনেক, অনেক বেশি মোতিঝিলে। রাজবল্লভের বেলায় কুর্নিশ, আর নজরালির বেলায় কদমকেশী—নফর আর জারিয়াদের প্রতি কড়া হুকুম ঘসেটির।

যোদ্ধা বলে নজরালির খ্যাতি আছে। সিরাজ বলেছিল, সামান্য কিছু সৈন্যও সে নাকি জমা করে রেখেছে মোতিঝিলে। কথাটা যদি সত্যি হয় তাহলে বুঝতে হবে, নজরালি শুধু যোদ্ধাই। ধূর্ততা বলে কিছু নেই তার মধ্যে। কিংবা এও হতে পারে যে, সে অতিরিক্ত ধূর্ত, ঘসেটির মন রেখে যতদিন মধুপান করা যায়। সেটাই সম্ভব। কারণ, নিজে যোদ্ধা হয়ে তার পক্ষে সিরাজের পরাক্রম না জানা অসম্ভব।

.

মোতিঝিল আক্রমণ যদি অনিবার্য হয়ে ওঠে, তাহলে দেখা যাবে, সে-ই সর্বপ্রথম সিরাজের পায়ের ওপর এসে পোষা কুকুরের মতো লুটিয়ে পড়েছে। ঘসেটি হীরাঝিলে চলে এলে মধুপান করা যখন আর সম্ভব হবে না, তখন কেন শুধু শুধু নবাবের সঙ্গে শত্রুতা করা। বিশেষত যে নবাব শৌর্য, বীর্য আর পরাক্রমে অসাধারণ। সিরাজের বাহুবল শত্রুদের জানতে বাকি নেই তাই তলে তলে এত আয়োজন। সে যদি সরফরাজ হত, তাহলে এই সমস্ত গোপনীয়তার প্রয়োজন হত না কখনওই।

দেশের যাঁরা মাথা, যাঁদের হাতে দেশের চাবিকাঠি, তাঁরা সকলে সিরাজের বিপক্ষে থেকেও সহজে কিছু করতে পারছেন না। মিরজাফর মিরবক্‌সিকুল না হয়ে আজ মোহনলাল যদি সে-পদে থাকতেন, তাহলে জগৎশেঠ আর রাজবল্লভ কেঁচোর মতো মাথা নিচু করে থাকত। ইংরেজরা তাহলে এতদিনে জাহাজে গিয়ে উঠত, কিংবা সমুদ্রে ডুবত।

.

নিজের শয়নকক্ষে মেয়েটিকে নিয়ে খেলা করছিলাম, আর এসব কথা ভাবছিলাম। হামিদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।

‘কী হয়েছে, হামিদা?’

‘নবাব আপনাকে ডাকছেন।’ তার চোখে-মুখে ভীতির চিহ্ন পরিস্ফুট।

‘তিনি চেহেল-সেতুন থেকে ফিরলেন কখন?’

‘এই মাত্ৰ।’

‘এ সময়ে তো ফেরেন না তিনি। কোথায় আছেন?’ মেয়েটিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্ৰশ্ন করি।

‘ফৈজী বেগমের ঘরে।’

‘সেকী! সেখানে আমাকে যেতে বলেছেন? ঠিক বলছ তো?’

‘হ্যাঁ, বেগমসায়েবা।’

‘কিন্তু সেখানে কেন যাব?’

‘ফৈজী বেগম ঘরে নেই।’

‘নেই!’ আমার পা কাঁপতে শুরু করে। তার সেখানে না থাকার গূঢ় কারণ রয়েছে। যদি সত্যি হয়, তাহলে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে যাবে অতি শিগগির। কেউ রোধ করতে পারবে না। ফৈজীর ঘরে এখন গেলে সিরাজ হয়তো আমাকেই হুকুম করবে তাকে খুঁজে বার করার জন্যে। আমি তা পারব না—কিছুতেই নয়। আমি অনুমান করতে পারি, ফৈজী এখন কোথায় রয়েছে, কার সঙ্গে রয়েছে। অনুমান করতে পারি বলেই আমি নবাবের হুকুম তামিল করব না।

নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘর ছাড়তে আমার দেরি হয়ে গেল। বাইরে সিরাজের পায়ের শব্দ পেলাম।

‘হামিদা মেয়েটাকে নিয়ে শিগগির দরজার আড়ালে যা।’

হামিদা লুকোতেই সিরাজ প্রবেশ করে। তার চেহারার বর্ণনা আমি দিতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি, অমন ভয়ঙ্কর মুখের চেহারা জীবনে দেখিনি।

‘তুমি নিশ্চয়ই জানো, লুৎফা?’ নবাব চেঁচিয়ে ওঠে।

‘কীসের কথা বলছেন, নবাব?’ চোখে-মুখে যতটা পারি অজ্ঞতা-ফুটিয়ে তুলি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিনয় আজ করতে হবে।

‘ফৈজী কোথায় রয়েছে?’

‘তার ঘরে নেই?’

‘না নেই। আর এ সময় সে কোনোদিন থাকে না, সে খবরও সংগ্রহ করেছি। কোথায় যায় সে? বেগম হয়ে আমার অজ্ঞাতে কোথায় যায় সে? হীরাঝিলের বাইরে?’ নবাব আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা করে।

‘আমি তো কিছু জানি না।’

তুমি সব জানো। লুৎফা বেগমের চোখের আড়ালে দেশে কিছু ঘটতে পারে না, হীরাঝিল তো দূরের কথা।

পা দুটো বড় বেশি কাঁপতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বসে পড়ি শয্যার ওপর। একটা কিছু জবাব সিরাজকে দিতেই হবে। জবাব না শুনে সে যাবে না। মিথ্যে বলে যে বিদায় করব, সেরকম মূর্খ সে নয়। অভিনয় করার দুরাশা ছাড়তে হল। ধীরে ধীরে বলি, ‘হীরাঝিলের বাইরে সে কখনওই যায় না। গেলে আমি জানতে পারতাম, নবাব।’

সিরাজ একটু সন্তুষ্ট হল বলে মনে হয়। তার চোখ-মুখের উত্তেজনা যেন অনেকটা প্রশমিত ছোট্ট একটা চৌকির ওপর তার ডান পা তুলে দিয়ে বলে, ‘কোথায় তবে সে?’

হীরাঝিলের ভেতরেই কোথাও আছে নিশ্চয়।’

‘খুঁজে দেখেছি সব, নেই।

মনে মনে বলি, সব খোঁজা হয়নি। একসময় আলিবর্দিকে যে প্রকোষ্ঠে আটকে রেখে অর্থ আদায় করা হয়েছিল, গোলকধাঁধার সেই ঘর কয়টি এখনও বাকি রয়েছে। ভালোবাসার পাত্রীকে সেই ঘরখানার রহস্য জানাতে যে তুমি বাদ রাখোনি সিরাজ।

মুখে বলি, ‘তাহলে বোধহয় ফৈজী বেগম আপনার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে মজা করে।’

‘লুৎফা!’

তার চিৎকারে ক্রোধ ফুটে উঠল না। বরং অসহায় আর্তনাদ বলে মনে হল সে-চিৎকার।

‘মাফ্ করবেন, নবাব। আমার হয়তো ভুল হয়েছে।’

‘ভুল নয়। তুমিই লুকোচুরি খেলে মজা দেখছ। মনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছ তুমি।’

স্তব্ধ হয়ে যাই।

সিরাজ বলে, ‘আসলে বলো ফৈজী কোথায় তা তুমি প্রকাশ করবে না। যে কোনো কারণেই হোক বলতে তুমি ভয় পাচ্ছ। কিন্তু সিরাজকে কি এখনও চিনলে না? ফৈজীর ধরন-ধারণ অন্যরকম মনে হত বলেই আজ আমি অসময়ে ফিরে এসেছি। যখনই তার কাছে যাই, মনে হয় সে যেন ক্লান্ত। আমার সম্মান রাখার জন্য শুধু নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো মন জুগিয়ে যায়। তাই সন্দেহ হয়েছিল। সিরাজকে সবকিছুতে ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু মনের ব্যাপারে ফাঁকি দেওয়া বড় কঠিন। সে ফাঁকি শুধু তুমি দাওনি, তাই চিরকাল তুমি লুৎফাই আছ।’

‘হ্যাঁ, হীরাঝিল থেকে তাড়িয়ে দেননি বটে।’

‘অভিমান করার যথেষ্ট কারণ তোমার রয়েছে। কিন্তু সবকিছু লক্ষ করে একটা জিনিস তোমার চোখ এড়িয়ে যায় কেন, লুৎফা? নবাব সিরাজউদ্দৌলা সব জায়গায় মাথা উঁচু করে থাকলেও, তোমার কাছে যখন আসে মাথা নিচু করেই আসে।’

‘বছরে একবার দু’বার এলে সেভাবেই আসেন বটে। তার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ বৈকি।’

‘অভিমান কোরো না। এটা নবাব সিরাজের দুর্ভাগ্য সে কিমা-পোলাও ছেড়ে সে শরাবের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। তাই তার এই দুর্দশা। কিমা-পোলাও নেশা ধরায় না বটে, কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে সেটারই দরকার।’

‘নবাব এসব জানেন দেখছি!’

‘জানি লুৎফা, সবই জানি। তবু নিজেকে সামলাতে পারি না। এবার বোধহয় সামলাবার দিন এসেছে। তুমি আমার জর্জ-বিরিঞ্জু, খিচুরী, সেব-বিরিঞ্জু—তুমি আমার কিমা-পোলাও, সওলা—তুমি আমার দম-পোক্ত, কালিয়া-কাবাব, দুনিয়াজা। ফৈজী শরাব—শুধু শরাব। তাকে আমি খুঁজে বার করবই। শরাবের পাত্র একদিন চূর্ণ করেছিলাম মনে আছে? আজ আবার সেদিন ফিরে এসেছে। তোমাকে আর বলে দিতে হবে না, কোথায় রয়েছে সে। আমি বুঝতে পেরেছি। হীরাঝিল আমার নিজের তৈরি। তার অতি গোপন স্থানও আমার কাছে উদ্‌ঘাটিত। সে ঘর ছেড়ে চলে যেতে চায়।

‘সিরাজ’। বহুদিন পরে তার গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখি। তার নাম ধরে ডাকি। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়ায় আমার। চেপে রাখার চেষ্টা করি না।

‘কী লুৎফা?’

‘তুমি জানো সে কোথায় রয়েছে?’

‘জানি বৈকি, তবে এতটা আশা করিনি।’

‘তাকে ক্ষমা করো, সিরাজ।’

‘না।’

‘তাকে দূর করে দাও হীরাঝিল থেকে—বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সীমানার বাইরে।’

‘তাহলে সত্যিই? কে রয়েছে তার সঙ্গে, লুৎফা?’

‘সৈয়দ মহম্মদ খাঁ।’

সিরাজ শক্ত হয়ে ওঠে।

‘তাকে ক্ষমা করো, সিরাজ।’

‘না-না, ক্ষমা করতে পারব না। তুমি এতদিন বলোনি কেন?’

‘তুমি ব্যথা পাবে বলে।’

‘আশ্চর্য! বেগম হয়ে বড় ভুল করেছ, লুৎফা। আমি যদি কৃষক হয়ে তোমাকে পেতাম, তাহলে বাংলার মসনদও চাইতাম না।’

‘ক্ষমা করলে তো ফৈজীকে?’

‘কথা দিতে পারি না।’ সে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

হামিদা শিশুটিকে নিয়ে আড়াল থেকে বার হয়ে আসে। সে বলে, ‘আমিও সব জানতাম, বেগমসায়েবা। ফৈজী বেগমের জন্যে এত করে বলা আপনার ভুল হল।’

‘ভুল হয়নি, হামিদা। অনেকদিন থেকে তো নবাব-পরিবারে আছ। চিরকাল হিংসা আর প্রতিহিংসাই দেখলে। মনও তোমার সেইভাবেই তৈরি হয়েছে। একটু ক্ষমা করতে ক্ষতি কি?’

মেয়েটিকে শুইয়ে দিয়ে হামিদা বার হয়ে যায়। হামিদার কোলেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

.

সিরাজের কথাগুলো মনে মনে রোমন্থন করি। সে শান্তির একটা ছোট্ট নীড় চায়। মসনদ ছেড়ে দিয়ে কৃষক হতে চায়, যদি কেউ তাকে প্রাণভরে ভালোবাসে। মসনদের চারিদিক ঘিরে অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের জন্যে তার কবি-মন বিষাক্ত!

আমিও একসময়ে বেগম হতে চাইতাম না। সাধারণ সৈনিকের বধূ হয়ে ছোট্ট সুখ আর ছোট্ট দুঃখে জীবন কাটিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্ন দেখতাম খড়ে-ছাওয়া কুটিরের, আর একটি পুরুষের একান্ত নির্ভরশীল প্রেমের। কোথা দিয়ে কী সব হয়ে গেল। পুরুষ-হৃদয়ের ভালোবাসা পেয়েছি, কিন্তু একেবারে একান্ত কি? আর একান্ত হলেও ভালোবাসা সর্বদা আমাকে ঢেকে রাখে না, শুধু অসময়ে আমার কাছে আশ্রয় আর সান্ত্বনা চায়। তাতে আমার বুভুক্ষু মন যে ভরে না। বাকি সময়টা যে আমি কেঁদে মরি।

সিরাজও হয়তো এই রকম একটা কিছু ভাবে। কৃষক-পরিবারে জন্মালে মনকে বিক্ষুব্ধ করার মতো নানা উপকরণ এসে জুটত না। ফৈজীর নাগাল পাওয়া যেত না। নিশ্চিন্তে আমারই মুখের দিকে চেয়ে জীবন কাটাতে পারত। কিন্তু সিরাজ কৃষক নয়, নবাব। সে চায় নবাবীর অপরিসীম ক্লান্তি অপনোদনের জন্য ফৈজীর মতো এত তীব্র নেশা। আর সবার ওপর সে প্রেমিক, তাই পদে পদে আঘাত পায়। ফৈজীর মন যে প্রেমিকার মন নয়।

সহসা চিৎকার শুনে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। হামিদা এসে বলে, ‘সর্বনাশ হয়েছে, বেগমসায়েবা।’

‘ফৈজীকে পাওয়া গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ, সৈয়দ মহম্মদ খাঁকেও?’

‘জানি।’

নবাব খেপে গিয়েছেন।’

‘জানি।’

‘আপনি না গেলে…’

‘যাব। সৈয়দ খাঁ এখনও আছেন?’

‘না, নবাব তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন।’

‘কিছুই বলেননি তাঁকে, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

জানতাম। ফৈজীর ওপরই নবাবের রাগ। আর রাগ নিজের অক্ষমতার ওপর। সাধারণ পুরুষের মতো সে যে সৈয়দের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠবে না, এ জানা কথা। সিরাজ ঘসেটি নয়।

.

হামিদাকে সঙ্গে নিয়ে যাই গোলকধাঁধার কাছে। সিরাজ একা দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরে। ভেতর থেকে ফৈজী চিৎকার করে তাকে গালাগালি দিচ্ছে। নিজের কবর নিজে খুঁড়ছে সে। ভুলে গিয়েছে যে, সিরাজ তার প্রেম-ভিখারি হলেও সে বাংলার নবাব।

‘শুনছ লুৎফা।’ কাছে গিয়ে দাঁড়াতে সিরাজ বলে। অদ্ভুত শান্ত তার কণ্ঠস্বর। কোনোরকম উত্তেজনা নেই। এত শান্তভাব ভালো নয়।

আমি বলি, ‘ফৈজী, চুপ করো। অন্যায় করেছ, তার জন্যে ক্ষমা চাও নবাবের কাছে।’

‘ও, তুমিও এসেছ? এতদিনে লুৎফা বেগমের দিকে নজর পড়েছে নবাবের? ভালো, খুব ভালো।’

‘পাগলামি করো না, ফৈজী। তুমি মোহনলালের বোন। শত অপরাধ করলেও ক্ষমা পেতে পার।’

চুপ কর্ বাঁদি, তোর কথা শুনতে চাই না।’

আমার গা গরম হয়ে ওঠে তার কথায়। আমি যে এককালে জারিয়া ছিলাম, সেকথা মনে করিয়ে দিতে চায় ও

এবার সিরাজ বলে, ‘আর তুমি নর্তকী। সম্মানের আসনে বসিয়েছিলাম, অথচ সে সম্মান রাখলে না।’

‘নর্তকীদের স্বভাবই তাই, নবাব। ভুলে যাচ্ছ কেন যে, সে কারও বন্দি নয়। আমি সেধে আসতে চাইনি। যেচে আমাকে দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছিলে। দয়া করে এসেছিলাম। নইলে তোমার মতো হাজারটা নবাবকে কিনতে পারে এমন লোকেরা আমার পা ধরে তুষ্ট করত।’

আমি চেঁচিয়ে উঠি, ‘ফৈজী, চুপ করো।’

কিন্তু সে তখন উন্মাদ। ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জা-শরমের আর বালাই নেই। তার ওপর সিরাজ তাকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে।

‘না, চুপ করব না। জারিয়ার হুকুম আমি মানি নে। আমাকে হীরাঝিলের বাইরে দিয়ে এসো, তবে চুপ করব।’

সিরাজ বলে, ‘তোমার অপরাধের ভালো রকম কৈফিয়ত না দিলে ছাড়তে পারি না। বাংলার নবাব দিল্লির বাদশার তুলনায় সামান্য হলেও এখন তুমি তারই আওতায়।’

‘কীসের কৈফিয়ত? আমি কোনো অন্যায় করিনি।’

‘আমার মন নিয়ে তুমি ছিনিমিনি খেলেছ।’

‘নবাব ভুলে যাচ্ছ কেন, ওটা আমাদের ব্যবসা।’

‘তুমি বেশ্যা।’

‘ঠিক বলেছেন, কিন্তু নবাবের মা তো বেশ্যা ছিলেন না। তিনি কেন হোসেন কুলিখাঁর সঙ্গে…’

‘ফৈজী!’ সিরাজ রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

‘সত্যি কথা বলতে ভয় পাই নে। তাঁর কেচ্ছা শুনলে আমারও লজ্জা হয়, নবাব।’

‘ফৈজী!’

‘ভয় দেখাচ্ছ কাকে, নবাব? বেশ্যা কারও ঘরে বন্দি থাকে না।’

‘কিন্তু তুমি বন্দি থাকবে। তোমার সুন্দর শরীরের মাংস গলে পচে যে-কঙ্কাল বার হয়ে পড়বে, সেই কঙ্কালও বন্দি থাকবে এই হীরাঝিলে। হীরাঝিলের মধ্যেই সে-কঙ্কাল একদিন মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।’

হঠাৎ দেখতে পাই, সিরাজের ইঙ্গিতে বাগিচা থেকে চার-পাঁচজন লোক ছুটে এসে ফৈজীর বন্দি-ঘরের সামনে দেওয়াল তুলে দিতে শুরু করে। ভয়ে আমার শরীর হিম হয়ে আসে। প্ৰথম থেকে সিরাজ তাহলে সব ঠিক করেই রেখেছিল। এতক্ষণ শুধু ফৈজীকে বাঁচবার সুযোগ দিচ্ছিল, আর সে হয়তো আমারই অনুরোধে।

সিরাজ যে সাংঘাতিক একটা কিছু করবে আমি জানতাম। কিন্তু সেটা যে এত অমানুষিক হবে কল্পনাও করিনি। আমি তার হাত চেপে ধরে বলি, ‘নবাব, এ শাস্তি ওকে দিও না।’

‘শুধু এই কথাটা তোমার আমি রাখতে পারব না। এরপর থেকে তোমার সব কথারই মৰ্যাদা আমি রাখব।’

‘নবাব, ওকে ছেড়ে দাও, ও দিল্লি চলে যাক।’

‘পাগল। ও ফিরে গেলে দু’মাসের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ আক্রান্ত হবে।

‘তাহলে ওকে হোসেন কুলিখার মতো হত্যা করো।’

‘না, ও বন্দি থাকবে হীরাঝিলে। চিরকাল… ‘

‘নবাব!’

‘ক্ষমা করো লুৎফা, শেষবারের মতো ক্ষমা করো।’

আমি ছুটে পালিয়ে আসি সেখান থেকে। পেছনে ফৈজীর ভীত আর্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। সে বুঝতে পেরেছে, বার হবার পথ চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। নবাবের কাছে আকুল মিনতি জানাচ্ছে এতক্ষণ পরে। জানি, তার সব আকুতি বৃথা হবে. . . সব বৃথা!

নিজের ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। এমন সময় সিরাজ এসে প্রবেশ করে। কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি, ‘কেন এই নিষ্ঠুর কাজ তুমি করলে, নবাব?

‘আমারও কম কষ্ট হচ্ছে না, লুৎফা। সে মোহনলালের বোন। ‘

‘শুধু তাই, আর কিছু না?’

‘ভালোও হয়তো বাসতাম। কিন্তু তার চেয়ে নেশাটাই বড় ছিল। তুমি নেই, একথা ভাবতে পারি না। অথচ ফৈজী নেই, বেশ ভাবতে পারছি।’

‘সে হয়তো এখনও বেঁচে রয়েছে। নিশ্বাস নেবার মতো যথেষ্ট বাতাস সেখানে অনেকক্ষণ থাকবে।’

‘হয়তো থাকবে।’

‘ওকে মুক্ত করে দাও।’

সিরাজ নিজের হাত দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নিজের চুল টেনে বলে, ‘না-না, কখনওই না।’

.

গবাক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। গঙ্গার জল রক্তবর্ণ, আকাশও লাল। চারিদিকে শুধু লাল… ফৈজীর রক্ত। অন্যদিন হলে মুগ্ধ হতাম, আজ ভীত হলাম। সিরাজ আর আমার মধ্যের বড় ব্যবধান আজ অপসারিত হয়েছে, অথচ আনন্দিত হতে পারছি না। সিরাজের কাজ শত নিষ্ঠুর হলেও খানিকটা চোখের জল ফেলে আমার নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হতে পারলাম কই? হীরাঝিলের বাগিচার মধ্যে দিয়ে মোহনলালকে হেঁটে আসতে দেখে সিরাজকে বলি সে-কথা। ‘হ্যাঁ, তাকে আসতে বলেছিলাম।’

‘তাঁকে তুমি কী বলবে, নবাব?’

‘সত্যি কথা সব বলব।’

‘তুমি বন্ধু হারাবে। হাজার হলেও সে ফৈজীর ভাই—একই মায়ের পেটের ভাই।’

‘তবু বলতে হবে লুৎফা, উপায় নেই।’

সিরাজের সঙ্গে আমিও পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াই। বাইরে তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। একে-একে জ্বলে উঠছে হীরাঝিলের আলো। ঝিলের জল সে আলোয় চকচক করছে, যেন ফৈজীর জন্যে কাঁদছে। ফৈজীকে নিয়ে বজরা আর ঝিলের জলকে মাতাল করে তুলবে না। বজরাটি এককোণে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ব্যথায় মূক যেন। নূপুরবাঁধা পায়ের তালে সে আর কখনও নাচবে না।

‘আমাকে ডেকেছিলেন, নবাব?’ কুর্নিশ করে মোহনলাল বলে।

‘হ্যাঁ, বিশেষ প্রয়োজনে ডেকেছি, মোহনলাল। তোমাকে আজ যে-খবর শোনাব, তা না বলতে পারলেই জীবনে আমি সব চাইতে খুশি হতাম।’

‘বলুন।’

‘কিন্তু সে তো এখানে বলা যাবে না, আমার সঙ্গে একটু ওদিকে আসবে?’

গোলকধাঁধার কাছে মোহনলালকে নিয়ে যাবে সিরাজ। তাড়াতাড়ি সবার অলক্ষ্যে আগে থেকে আমিও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই।

মোহনলালকে নিয়ে এসে সিরাজ বলে, ‘মোহনলাল, আমাকে ক্ষমা করো।’

‘সে কি নবাব!’ —মোহনলালের দৃষ্টিতে বিস্ময়।

হ্যাঁ। তুমি শুধু আমার সেনাপতি নও, তুমি আমার বন্ধু। নবাব হয়ে তোমার ওপর হুকুম আমি চালাতে পারি বটে, কিন্তু নবাবি আওতার বাইরে অনেক কিছু আছে। তোমার বোনকে আমি যখন দিল্লি থেকে নিয়ে আসতে চাই, তুমি বার বার আমাকে নিষেধ করেছিলে। তখন তোমার কথায় কান দিইনি, বরং বিরক্ত হয়েছিলাম তোমার ওপর। আজ বুঝছি, তুমি যা বলো অনেক ভেবেই বলো, যা করো আমার মঙ্গলের জন্যই করো। ক্ষমা করো আমাকে।’

‘এতে ক্ষমার কী আছে, নবাব?’

‘আছে। সেদিন যদি তোমার কথা শুনতাম, তাহলে আজ তোমাকে এত বড় আঘাত পেতে হত না। তুমি আমার মঙ্গল চেয়েছিলে, অথচ আমি তোমার সর্বনাশ করলাম।’ সিরাজের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

‘আপনার কথা কিছুই তো বুঝতে পারছি না, নবাব।’

‘বোঝাবার মতো করে বলতে আমার বাধছে। হয়তো আজ আমি তোমাকে হারাব, তবু বলতেই হবে।’

‘নবাব!’ মোহনলালকে এবার বিচলিত বলে মনে হল। সিরাজের কথায় হেঁয়ালির মধ্যেও তিনি আসল সত্য কিছুটা অনুমান করেছেন বোধ হয়।

‘ফৈজীকে আমি হত্যা করেছি।’

মোহনলাল একটু কেঁপে ওঠেন। তাঁর হাত-পা কেমন যেন শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘উচিত কাজ করেছেন, নবাব। ওর ব্যভিচার আপনার দেশের অমঙ্গল ডেকে আনত।’

‘সে কী মোহনলাল, তুমি মানুষ!‘

‘যোদ্ধাদের সহজে বিচলিত হতে নেই, নবাব। তাহলে কোন ভরসায় আপনি আমাকে পাঁচ-হাজারি সেনাপতি করবেন?’

নিষ্ঠুর! পুরুষ মাত্রেই নিষ্ঠুর। ওরা সব পারে। নতুন ওঠানো দেওয়ালের ওপর হাত রেখে সিরাজ বলে, ‘এরই পেছনে রয়েছে ফৈজী।’

‘ভালোই হয়েছে।’ মোহনলাল কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান। অনেকক্ষণ তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসে। এতক্ষণে যেন তিনি প্রথম বুঝতে পারেন, প্রকৃত কী ঘটেছে। দু’হাত দিয়ে নতুন দেওয়াল আঁকড়ে ধরে সজোরে ঠেলতে থাকেন।

‘ও কি করছ, মোহনলাল?’

ঝরঝর করে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে বাংলার সবচেয়ে সাহসী সেনাপতির। তিনি বলেন, ‘ছেলেবেলায় ও আমার বড় অনুগত ছিল, নবাব। মা মারা গেলে আমিই ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করি। কতদিন আবদার করে কত জিনিস চেয়েছে, দিতে পারিনি বলে আমার বুক ফেটে যেত। দেবার মতো যখন সামর্থ্য হল আমার, তখন তো সবকিছু খুইয়ে বসে থাকল। চিরদিন দুঃখই পেল ও।’

‘মোহনলাল, ভেঙে ফেলছি দেওয়াল। এখনও হয়তো বেঁচে আছে সে! মোহনলাল…’

‘না-না, থাক্। ওখানেই থাক্।’ ছুটতে ছুটতে চলে যান তিনি হীরাঝিল থেকে।

পর্দার আড়াল থেকে বার হয়ে এসে সিরাজের হাত ধরি।

‘লুৎফা, সবকিছুর মূলে আমি।’

‘না, ভাগ্য।’

.

সিরাজ মোতিঝিল আক্রমণ করল। ঘসেটি বেগম নবাবের সাদর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তার মতো সূক্ষ্মবুদ্ধির অধিকারিণীর পক্ষে সিরাজের মতলব বুঝতে কষ্ট হয়নি।

কিন্তু তার ভরসা নজরালি। সিরাজের বিরুদ্ধে সে বিন্দুমাত্র রুখে দাঁড়াল না। বরং নবাবকে তুষ্ট করবার জন্যে নানা উপঢৌকন পাঠাল।

হীরাঝিলের একটি কক্ষ ঘসেটির জন্যে নির্দিষ্ট হল। ভেবেছিলাম, রাগে আর লজ্জায় ঘসেটি হয়তো কোনো কাণ্ড করে বসবে, কিন্তু সিরাজ যখন নিজে বিচিত্র আয়োজনের মধ্যে হীরাঝিলে তাকে সাদর সংবর্ধনা জানাল, তখন তার মুখে হাসি ফুটতে দেখলাম।

আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলল, ‘আমার দিন এতদিনে সত্যিই ফুরলো।’

‘ও কথা বলছেন কেন?’

‘আর কিছু করার নেই আমার। ভাবছি কী করে সময় কাটাব। আমি আমিনা নই, লুৎফাও নই। বেগম মহলের হাজারটা বেগমের মতোও আমি নই। হীরাঝিলে আমার অসম্মান হবে না জানি, কিন্তু তৃপ্তি পাব না।’

‘জানি ঘসেটি বেগম। আপনি নবাব আলিবর্দির পুত্র হয়ে জন্মালে বাংলার মসনদে সিরাজ বসত না। আলিবর্দি তাঁর পুত্রের মধ্যেই নবাবের যোগ্য গুণাবলি খুঁজে পেতেন। হারেমের সুখ আর বিলাসিতায় তুষ্ট থাকা আপনার স্বভাবে নেই। আপনি চান বিস্তীর্ণ কর্মক্ষেত্র।’

ঘসেটি অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে। লজ্জিত হয়ে বলি, ‘অমন করে কী দেখছেন।’

‘না, কিছু না। ভাবছি তোমার সম্বন্ধে আমার ধারণা আদৌ নির্ভুল ছিল না।’ হেসে বলি, ‘মতিঝিল আক্রমণের ব্যাপারে আমারও পরামর্শ ছিল।’

‘এখন সে-কথা বিশ্বাস করি, তবু কি ঠেকাতে পারবে? বাইরে যে আগুন জ্বলছে।’

‘সে আগুন কি নিভবে না?’

‘খুব কঠিন।’

‘আপনার পরামর্শ যদি পাই।’

‘পরামর্শে সব সময়ে সবকিছু হয় না, লুৎফা। সিরাজের প্রতিটি নির্ভরযোগ্য লোক এখন মসনদের স্বপ্ন দেখে, যেমন আমি দেখতাম। কার ওপর বিশ্বাস করবে?’

চুপ করে থাকি।

ঘসেটি জিজ্ঞাসা করে, ‘আমিনা কোথায়?‘

‘উনি তো এখানে থাকেন না। তবে আজ আসবেন শুনেছি।’

‘ও এখানে থাকলে ঝগড়া হবে। আমিনা একেবারে মেয়েমানুষ।’

বুঝলাম, ঘসেটির দিন সত্যিই শেষ হয়েছে, যেমন আলিবর্দির বেগমের দিন শেষ হয়েছে। যাঁর পরামর্শে একদিন বাংলা বিহার উড়িষ্যার ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হতো তিনি জীবিত থাকলেও এখন তাঁর কোনো কথারই দাম নেই। তেমনি ঘসেটির গুণাবলিও এখন নিষ্প্রয়োজন। হীরাঝিলের অনেক মেয়েমানুষের মধ্যে সেও একজন।

.

ঘসেটির সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথা সিরাজকে বললাম।

সে বলল, ‘একটু দেরিতে বুঝল ঘসেটি। সে আমার যা ক্ষতি করেছে অন্য কেউ তা করেনি।’

‘কেন নবাব?’

‘সে মসনদের স্বপ্ন না দেখলে জগৎশেঠ আর রাজবল্লভ কখনও হাতছাড়া হত না। আর তারা আমার হাতে থাকলে মিরজাফর মাথা তোলার কথা ভাবতে পারত না।’

‘ইংরেজরা রয়েছে। তারা মিরবক্‌সিকুলের সহায় হত।’

‘ইংরেজ! জগৎশেঠ না থাকলে ইংরেজ সহায় হবে?’

‘তাদের রণকৌশল অনেক ভালো শুনেছি।’

‘কথাটা ঠিক। তবু তারা এদেশে আগন্তুক। এই তো শওকজঙ যুদ্ধ করতে আসছে। কই, সহায় হোক তো ইংরেজ? সাহস আছে?’

‘শওকৎজঙ যুদ্ধ করতে আসছে?’

‘হ্যাঁ, এইমাত্র সংবাদ পেলাম। নবাব হবার সাধ হয়েছে তার। সে সাধ ঘুচিয়ে দেব।’

‘কাকে পাঠালে তার বিরুদ্ধে?’

‘মিরজাফরকে।’

‘মিরজাফর!’

চমকে উঠলে বলে মনে হল।’

‘হ্যাঁ, কথাটা অদ্ভুত শোনাল কিনা, তাই।’

সিরাজ হেসে বলে, ‘কেন, মিরজাফর যুদ্ধ করতে পারে না?’

‘খুব ভালো পারে। শওকৎজঙের সৈন্য হাতে পেলে আরও ভালো পারবে।’

‘ভুল করলে, লুৎফা। বড় রকমের বিশ্বাসঘাতকতা করতে হলে ছোটখাটো ব্যাপারে নিজেকে একটু বেশি রকম বিশ্বস্ত বলে প্রমাণ করতে হয়। এ যুদ্ধে মিরজাফর সবচেয়ে বেশি বীরত্ব দেখাবে। তাই আমি নিশ্চিন্ত আছি। তবে তোমার কথাটা যে একেবারে ভাবিনি তা নয়। এর জন্যে তার সৈন্যের পেছনে মোহনলাল তার পাঁচ-হাজারি নিয়ে আত্মগোপন করে থাকবে।’

‘মোহনলাল এর মধ্যেই কি সামলে উঠেছেন।’

‘বড় গাছের ওপর দিয়ে কত ঝড়ঝাপটা যায়, তারা সামলেও ওঠে। বড় গাছ তো লতা নয় যে সামান্য ঝড়ে মাটিতে গড়াগড়ি যাবে।’

‘কিন্তু বড় গাছ যে এতখানি দৃঢ় হতে পারে, মোহনলালকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।’

‘আমাকে দেখে?’ সিরাজ মৃদু হাসে।

‘না।’ মুখ দিয়ে ফসকে বার হয় কথাটা।

‘আনন্দ হল, লুৎফা। অন্য বেগম হলে বলত, আপনি তো সবার ওপরে নবাব। আপনি গাছ নন, পর্বত। কী তোষামোদ!’

স্বস্তি পেলাম সিরাজের জবাব শুনে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *