আমি সিরাজের বেগম – ২

পরদিন বেগমসায়েবা ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে যাই। কারণ ডেকে তিনি কোনোদিনই পাঠান না। ডেকে পাঠাবার অর্থ তাই এখানে খুব সুস্পষ্ট। বেগমসায়েবা সম্ভবত জারিয়ার ধৃষ্টতার জন্যে শাস্তি দিতে প্রস্তুত হয়ে বসে রয়েছেন। ভবিষ্যৎ নবাবকে ছলনা করেছি বলে আমার শাস্তি। কিন্তু আল্লা তো জানেন, ছলনা আমি করিনি। সিরাজ যদি আজ বলে, তার দুর্বল মুহূর্তে কৌশল তার মুখ দিয়ে বেগম হবার স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছি, তাহলে মরতেও আপত্তি নেই, সে-মৃত্যু যত ভয়ংকরই হোক না কেন। কিন্তু সে কি সে কথা বলতে পারে? কাল তার চোখ-মুখ দেখে তো সে রকম মনে হয়নি।

ধীরে ধীরে বেগমসায়েবার ঘরে প্রবেশ করি।

‘এই যে লুৎফা, এসো।’ তাঁর আহ্বান আমাকে নাড়া দেয়। এ নাম তিনি কী করে জানলেন? সিরাজের দেওয়া নাম সে ছাড়া তো আর কেউ জানে না। কেউ শোনেওনি। তবে কি সত্যিই সে সবকিছু বলে দিয়েছে? বেগমসায়েবা কি বিদ্রুপ করছেন? দুরাশাকে মনে স্থান দিয়েছি বলে ব্যঙ্গ করছেন? একদিনের বেগমগিরি আজই তিনি খতম করবেন?

আমার গতি থেমে যায়। মাথাটা আপনা হতে নুয়ে আসে।

‘ওকী, থামলে কেন? আমার সিরাজের বেগমসায়েবাকে যে দেখতে সাধ হয়েছে। কাছে এসো, চোখ ভরে দেখি।’

মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়। কী কুক্ষণে যে কাল আড়ি পেতেছিলাম। অমন দুঃসাহস কেন যে হয়েছিল? সোফিয়ার মুখ দেখে ওঠার ফল যে এত সুদূরপ্রসারী হতে পারে কল্পনা করিনি। আমি কেঁদে ফেলি।

‘ওকী! ছিঃ, কাঁদছ কেন লুৎফা? কাছে এসো, তোমাকে একটু ভালো করে দেখব যে। এমন দিনে কি কাঁদতে হয়?’

এ স্বর তো ঠাট্টা-বিদ্রুপের নয়। এতে যে সত্যিই আগ্রহ আর মমতা মাখানো। ধীরে ধীরে চোখ তুলি। চোখের জলে বেগমসায়েবার মুখ ঝাপসা দেখা যায়। ওড়না দিয়ে জল মুছে ফেলি। দেখি, বেগমসায়েবা অধীর আগ্রহে আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন

তাঁর কাছে গেলে তিনি পালঙ্কের একপাশে বসতে বলেন। এতখানি সম্মান জারিয়াকে তিনি কখনও দেন না। ঠাট্টা করেও নয়। বুঝলাম, আমার জীবনের এক মহাসন্ধিক্ষণ আজ। আমি সত্যিই বেগম।

বেগমসায়েবার পাশে এসে বসি।

‘এতদিনে সত্যিই বড় হয়েছ তাহলে?’ তিনি আমাকে দু’বাহু দিয়ে বেষ্টন করেন।

ভীষণ লজ্জিত হই। বেগমসায়েবার দিকে চাইতে পারি না।

‘অত লজ্জা কেন? সিরাজের বেগমের সঙ্গে একটু তামাশাও করতে পারব না? তবে কার সঙ্গে করব? সিরাজ যে আমার নাতি।

সাহস হল তাঁর কথায়। বললাম, ‘এ রকম ঠাট্টা তো আগেও করতেন বেগমসায়েবা।’

‘আগে থেকে যে জানতাম, তুমি সিরাজের বেগম।’

‘সে কী!’

‘হ্যাঁ লুৎফা, হারেমে বেগম অনেক দেখেছি। সিরাজের তো এমন বেগম হলে চলবে না। তার এমন একজন দরকার, যে তার জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে থাকবে, নইলে সিরাজের যে মঙ্গল নেই। ও বড় জেদি, বড় দুঃসাহসী, বড় অবুঝ। তুমি ওর ভার নাও। হারেমের বেগমের মতো করে নয়, ওর জীবনের সঙ্গে তুমি মিশে এক হয়ে যাও। বেগমসায়েবার গলা ভারী হয়ে ওঠে। চোখ দুটো চকচক করে।

আনন্দে আমার মনের দুকূল প্লাবিত হয়ে যাচ্ছিল। বললাম, ‘তাই হবে বেগমসায়েবা। আমিও হারেমের বেগম হতে চাই না।’

‘লোক চিনতে আমার ভুল হয় না, লুৎফা। আমি তোমাকে চিনি।’

আজ বুঝলাম, কেন তাঁর আমার ওপরে অহেতুক পক্ষপাতিত্ব ছিল। আমার রূপের জন্যে নয়, আমার বয়সের জন্যেও নয়। আগে থেকেই আমি তাঁর আদুরে নাতির বেগম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। তাই তাঁর নিজের কক্ষের আশেপাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাকে ঘোরাফেরা করতে দেখেও তিনি কোনোদিন কিছু বলেননি।

‘সিরাজ যে তোমাকে চিনে নিতে পেরেছে, এতেই আজ আমার সব চাইতে বেশি আনন্দ। আমি বললে সে হয়তো শুনত না। তাকে যা বলা হয়, করে ঠিক তার বিপরীত। কিন্তু এখন বুঝলাম, সেও মানুষ চেনে।’

আমার জন্য স্বতন্ত্র কক্ষ নির্দিষ্ট হল। সেখানে গিয়ে দেখি, থরে থরে সাজানো রয়েছে বহুমূল্য পোশাক। এতদিনের জারিয়ার বেশ ছেড়ে ফেলি। সিরাজের পছন্দ হতে পারে এমন একটা পরিচ্ছদ বেছে নিয়ে পরি। আনন্দে কক্ষের চারিদিকে ঘুরে বেড়াই। আরশির সামনে নানাভাবে দাঁড়িয়ে নিজের রূপ যাচাই করি। মেহেদি রঙে আঙুল রাঙিয়ে তুলি। চোখে এঁকে দিই সুমা। কে বলে আমি জারিয়া! নিজের রূপ দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই। কিন্তু আমি যে বড় ছোট। হোসেন কুলিখাঁ ঠিকই বলেছিলেন, আমি ছোট। বেগমসায়েবাও যখন-তখন সে-কথা বলতেন। এখনও হয়তো মনে মনে বলেন।

দরজার কাছে এগিয়ে যাই। উঁকি দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখি, আশেপাশে কেউ আছে কি না। দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার আরশির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সমস্ত পোশাক খুলে ফেলি। আরশির ভেতরে আমার প্রতিবিম্বের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকি। আমি ছোট, সত্যিই ছোট। আমি হামিদার মতো নই। আমি ঘসেটির মতো নই। এমন কী সোফিয়ার মতোও আমি নই।

কী করে তাড়াতাড়ি বড় হব কে বলে দেবে? সোফিয়াকে জিজ্ঞাসা করব কি? কিন্তু সে যদি বিদ্রুপ করে? তার চোখের সামনে বেগম হয়েছি বলে মনে মনে সে নিশ্চয়ই আমাকে হিংসে করবে। যদি এমন কোনো পথ বলে দেয় যাতে আমার ক্ষতি হয়? কিন্তু সে তো এখনও জানে না। প্রাসাদের কেউই জানে না।

মনে মনে ভয় হয়, আমি ছোট বলে সিরাজ হয়তো আমাকে অবহেলা করবে। পরিত্যাগও করতে পারে।

শেষে সোফিয়ার কাছে যাওয়াই স্থির করলাম।

কিন্তু তার কাছে যেতে হলে জারিয়া সেজে যেতে হবে। ঘরের একপাশে ছেড়ে রাখা পোশাক পড়ে রয়েছে। সেগুলো তুলে নিলাম। বড় তুচ্ছ বলে এখন মনে হয় এ পোশাককে। পরতে ইচ্ছে হয় না, তবু পরতে হবে। নিজের স্বার্থের জন্যে আবার জারিয়া সাজতে হবে।

দরজায় ধাক্কা শুনি, সিরাজ এসেছে বোধহয়। জারিয়ার পোশাক একপাশে লুকিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি আবার নতুন পরিচ্ছদ পরে নিই।

দরজা খুলি।

ঘসেটি বেগম দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য, ঠিক আমারই পোশাকের মতো রঙের মসলিনে তার অঙ্গ আবৃত!

আমার দিকে চেয়ে তার চোখ জ্বলে ওঠে। আমি মনে মনে হাসি। এতদিনের অত্যাচারের উচিত প্রতিফল পাবে সে। সে জানে না, আমি সিরাজের বেগম। তার মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। চিৎকার করে, ‘বেগম সাজার শখ হয়েছে? লুকিয়ে লুকিয়ে বেগম সাজা হচ্ছে?’ চপেটাঘাত করে সে আমার গালে।

গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেলেও কিছু বলি না তাকে। দেখা যাক আজ কতদূর ওঠে এতদিন ঘরখানা মাঝে মাঝে ঘসেটিই ব্যবহার করত। কেন ব্যবহার করত, সে খবরও জানতে আর বাকি নেই। ঘরখানা একটু নিরিবিলিতে বলে সে হোসেন কুলিখাঁর সেবা করত এখানে সোফিয়া নিজে আমাকে বলেছে সেদিন!

‘কী করছিলি এখানে? ‘

‘একটু সাজগোজ করছিলাম।’

‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার পোশাক কেন পরেছিস? কত আস্পর্ধা?’ আর এক চপেটাঘাত।

বুঝলাম, সহজে ছাড়বে না। আমার মাথায় আগুন জ্বলছিল, তবু সহ্য করলাম। যদি লাথি দিতে আসে পালাতে হবে। নইলে বেগমগিরি আমার আজই শেষ হবে।

ঘরের রাশিকৃত পরিচ্ছদ দেখিয়ে বলি, ‘ওগুলো সবই কি আপনার বেগমসায়েবা?’

বিস্মিত হয়ে ঘসেটি ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে সব নাড়াচাড়া করে। আপন মনে বিড়বিড় করে কী যেন বলে। তারপর আমাকে প্রশ্ন করে, ‘এসব কোথা থেকে পেলি?’

‘সব বেগমের ঘর থেকে একখানা করে চেয়ে এনেছি।’

‘তারা দিলে?’

‘দেবে না কেন? আমাকে সবাই স্নেহ করেন যে।’

ঘসেটি যেন বোবা হয়ে যায়। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। আমার গাল জ্বলে যাচ্ছিল, বোধহয় রক্ত ফুটে বার হচ্ছে। তবু ঘসেটির মুখ দেখে কৌতুক অনুভব করছিলাম।

হঠাৎ সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কিন্তু আমার এই ঘরে কেন এসেছিস?’

‘এ ঘর আপনার? তা তো জানা ছিল না। আমি জানতাম, দক্ষিণ-পশ্চিমের ঘরখানাই আপনার।’

‘তর্ক হচ্ছে? আমার সঙ্গে তর্ক? দূর হয়ে যা এখান থেকে।’ সে এসে আমার চুল চেপে ধরে।

‘যাচ্ছি বেগমসায়েবা! হোসেন কুলিখাঁ কি আবার এসেছেন?’

‘কী বললি?’

‘বলছি হোসেন কুলিখাঁ কি ঢাকা থেকে আবার মুর্শিদাবাদে এসেছেন?’

ঘসেটি থ হয়ে যায়। কী বলবে ভেবে পায় না। তার দৃষ্টি দেখে মনে হয় যেন আমাকে সে গিলে খাবে।

আমি বলি, ‘অমন করে তাকাবেন না বেগমসায়েবা, ভীষণ ভয় পাই আমি। কিন্তু এমন ঘনঘন যাতায়াতে অর্থেরই অপচয় হয়, কোনো কাজ হয় না।’

এবারে ঘসেটি উন্মত্ত হয়ে ওঠে। বুঝলাম, পালাতে না পারলে এখানেই আমার জীবন শেষ সে যেভাবে আমার মাথার চুল ধরে রয়েছে, ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বেশিক্ষণ দেরি করাও উচিত নয়।

মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সুড়সুড়িতে ঘসেটির বড্ড ভয় আছে বলে জানি। বাঁ হাত দিয়ে তাকে সুড়সুড়ি দিই।

ছিটকে দূরে সরে যায় সে। একমুহূর্ত বিলম্ব না করে বেগমসায়েবার ঘরের দিকে ছুটতে থাকি। তিনি ছাড়া আমাকে রক্ষা করার দ্বিতীয় কোনো লোক নেই এখন। আর একজন যে পারে সে এখনও নবাব মহলের বাইরে রয়েছে। বাইরে না থাকলে এতক্ষণে অন্তত আমার কাছে একবার আসত।

ঘসেটি আমার পেছনে পেছনে বেগমসায়েবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়। সে ফেটে পড়ে। বলে, ‘অনুগ্রহ দেখিয়ে জারিয়াদের মাথায় তুলেছ তুমি। পায়ের তলায় না রাখলে ওরা কখনও ঠিক থাকে? এদের কীভাবে সিধে রাখতে হয় আজ তোমাকে দেখাব। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবের বেগম হয়েও এতদিনে এটুকু শিখলে না? কী করেই বা শিখবে! সাধারণ লোকের বিবি ছিলে, হঠাৎ বেগম হয়েছ তো।’

‘বাজে কথা থাক। কী হয়েছে বলো? ‘

‘কী হয়েছে? ওর দিকে চেয়ে দেখো কেমন অপ্সরী সেজেছে।’

‘ও অপ্সরী সাজায় তোমার কী এসে যায়?’

‘তা তো বলবেই। দাসী-বাঁদি সব বেগম সেজে বসে থাকবে। চমৎকার, এই না হলে বাংলার বেগম।’

‘উপদেশ দিও না ঘসেটি।’ বেগমসায়েবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে বোঝা গেল।

‘তোমার পেয়ারের জারিয়া আমার গায়ে হাত তুলেছে।’

‘সত্যি লুৎফা?’

‘না বেগমসায়েবা, ওঁকে সুড়সুড়ি দিয়ে পালিয়ে এসেছি। নইলে উনি আমাকে মেরে ফেলতেন।’

‘কেন?’

‘উনি আমার ঘরে গিয়ে আমাকে দূর হয়ে যেতে বলেন। আমি কেন তা যাব? তাতেই ওঁর রাগ।’ হোসেন কুলিখাঁর কথা ইচ্ছে করেই উল্লেখ করলাম না। বিপদে পড়লে সেটাকে শেষ অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের জন্যে তুলে রাখলাম।

‘তাই নাকি! আর তুমি তা সহ্য করলে লুৎফা? কাউকে হুকুম করলে না কেন, যাতে ঘসেটিকে বার করে দেয় ঘর থেকে।’ বেগমসায়েবা রীতিমতো উত্তেজিত।

‘তুমি বলছ কী মা?’ ঘসেটির চোখ বিস্ফারিত।

‘ঠিকই বলছি। ভবিষ্যৎ বাংলার বেগমের ঘরে ঢোকা তোমার পক্ষে ধৃষ্টতা। লুৎফা তোমাকে অপমান না করে দয়া দেখিয়েছে।’

ঘসেটির মুখের অবস্থা দেখে আমারই লজ্জা হল। সে কী করবে, কী বলবে, কিছুই বুঝতে পারে না। কেমন যেন একটা অসহায় ভাব। আমি গিয়ে তার হাত ধরি।

‘থাক! ঢের হয়েছে, ছেড়ে দাও।’ সে ঝট্‌কা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘একটা কথা বলি মা, ভবিষ্যৎ বাংলার নবাব অত সহজে ঠিক হয় না।’

‘ঘসেটি!’ বেগমসায়েবা অস্বাভাবিক জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন।

‘তোমার ধমকে বাংলাদেশ কাঁপতে পারে, কিন্তু ঘসেটি কাঁপবে না।’

তার ঔদ্ধত্যে আমার রাগ হয়। বলি, ‘বেগমসায়েবার ধমকে না কাঁপতে পারেন, কিন্তু আমি আপনাকে কাঁপিয়ে ছেড়ে দিতে পারি ঘসেটি বেগম।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে চলে যায়। বেগমসায়েবা আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলেন, ‘ব্যাপার কী লুৎফা? তোমার কথায় ও এমনভাবে পালিয়ে গেল কেন?’

‘আজ আমাকে কিছু বলতে আদেশ করবেন না, বেগমসায়েবা। যদি কোনোদিন প্রয়োজন হয় আমি নিজে থেকেই বলব।’

.

‘বেশ, তাই বলবে।’বেগম হয়েছি বলে আমার প্রিয় গবাক্ষ পরিত্যাগ করিনি। বেগম হয়ে ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকা আমার ধাতে নেই। তাই দিনের মধ্যে কতবার যে মহলের নির্জন স্থানে গিয়ে দাঁড়াই তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

সিরাজ আবার যুদ্ধে গিয়েছে। এবারে বর্গিদের একেবারে শেষ করে আসবেন প্রতিজ্ঞা করে নবাব যাত্রা করেছেন তাঁর নাতিকে সঙ্গে নিয়ে।

বর্গিদের দুঃসাহস সীমা ছাড়িয়েছে। জগৎশেঠের মধুগড়ের অগাধ জলরাশি না থাকলে বাংলার ধনদৌলত রক্ষা পেত না। নবাবের সাময়িক অনুপস্থিতির সুযোগে বর্গিরা কাশিমবাজার অবধি চলে এসেছিল। মধুগড়ের জলের মধ্যে ফেলা হল দেশের যত মণিমুক্তা হীরে জহরত আর সোনাদানা। তাই নিঃস্ব হল না বাঙালি বণিকেরা। তবু শোনা যায়, অনেকের ধনরত্ন আর উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না, অতল জলরাশির কোথায় গিয়ে যে লুকিয়েছে তার হদিশ নেই। বর্গিরা যে একেবারে খালি হাতে ফিরে গিয়েছে তাও নয়। সামনে যা কিছু পেয়েছে তুলে নিয়ে গিয়েছে।

সিরাজ নেই। শূন্য মনে দাঁড়িয়ে আছি। চেয়ে থাকি দূরে এমতাজমহলের গম্বুজের চূড়ার অস্তমিত সূর্যের রক্তবর্ণ রশ্মির দিকে।

হঠাৎ নীচে বাগিচার দিকে আমার দৃষ্টি পড়ে। চামেলি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সোফিয়া আর মহম্মদের প্রেমালাপ চলেছে।

সোফিয়া বেগম হবার দুরাশা ছেড়েছে দেখছি। বেচারা!

নিরাশ্রয় মহম্মদকে বেগমসায়েবাই আশ্রয় দিয়েছেন। লোকটিকে আমার ভালো লাগে না। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তাকে দেখে আমার ভয় হয়। কেমন একটা ক্রুর দৃষ্টি তার চোখে। কেন যে বেগমসায়েবা একে আশ্রয় দিয়েছেন জানি না।

সোফিয়া শেষে মহম্মদকে হৃদয় দিল, আর লোক পেল না? বেগমসায়েবাকে বলতে হবে সব ঘটনা। দু’জনার শাদি দিয়ে দেব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। শাদি হলে আর তারা মহলে থাকতে পারবে না। সোফিয়ার জন্য একটু কষ্ট হবে, কিন্তু মহম্মদ তো বিদায় নেবে। সিরাজ মহম্মদকে বড় বেশি পছন্দ করে। সে অসন্তুষ্ট হবে ভেবে আমি কিছু বলতে পারি না। হয়তো ভাববে, তার সব ব্যাপারেই নাক গলাতে চেষ্টা করি।

সিরাজের কোনো দোষ নেই। সে তোষামোদ পছন্দ করে। তোষামোদের ক্ষমতা মহম্মদের অদ্ভুত। অমন যে কর্কশ স্বভাব, কিন্তু বেগমসায়েবা আর সিরাজের কাছে একেবারে ভিজে বেড়ালটি। কেমন গলে পড়া ভাব। যে মানুষ এত সহজে তার ভোল পালটাতে পারে, সে কখনও ভালো হয় না। হতে পারে না।

সন্ধে হয়ে আসে। এমতাজমহলের গম্বুজ ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। মহলের চারিদিকে বাতি জ্বলে উঠেছে। নিজের ঘরে ফিরে যাব। নরম বিছানার ওপর গা এলিয়ে দেব এখন।

সিরাজ এ সময় হয়তো যুদ্ধ করছে। কিংবা শিবিরের মধ্যে বসে দাদুর সঙ্গে সারা দিনের যুদ্ধ সম্বন্ধে তার আলোচনা চলছে। কিংবা বোধহয় আহত, কিংবা….

আমার সারা দেহ শিউরে ওঠে। এমন অশুভ চিন্তা মাথায় আসে কেন? বাংলার ভবিষ্যৎ নবাব যুদ্ধক্ষেত্রে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক, এটাই তো গৌরবের। যুদ্ধ করে দেশের শত্রুকে বিতাড়িত করবে, প্রজাদের মঙ্গলের জন্যে জীবনপণ করবে, তবেই তো আদর্শ নবাব। তবে কেন নানা আশঙ্কায় মনটা ভরে ওঠে? যত ভাবি কোনো চিন্তা করব না, ততই যেন হাজার চিন্তা এসে মাথার মধ্যে জট পাকায়।

একা থাকব না। তার চেয়ে কোনো জারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আমার ঘরে যাই। তার সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলে সময় কাটাই। এখন তারা আর আমায় অবহেলা করে না। আমাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে তাদের মধ্যে এখন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে। ঘসেটির প্রতিপত্তি এই কয়দিনেই অনেকটা কমে গিয়েছে।

‘বেগমসায়েবা।’

পেছন ফিরে দেখি হামিদা দাঁড়িয়ে।

‘কী হামিদা?’

‘ঘসেটি বেগমের ঘরে যাবার কি সময় হবে আপনার? ‘

‘তিনি ডাকছেন?’

হামিদা ঘাড় নাড়ে।

‘চলো।’

ঘসেটি ছুটে এসে আমার হাত ধরে অভ্যর্থনা জানায়। বুঝলাম, সে উদ্‌দ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু কেন? তার এ পরিবর্তন একটু অস্বাভাবিক নয় কি?

‘ঘরে এসো লুৎফা। তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি বলে কিছু মনে করোনি তো?’

‘না।’ জবাবটা সংক্ষিপ্ত। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারলাম না। কারণ, মনের মধ্যে তখন হাজার জিজ্ঞাসা।

পালঙ্কের ওপর বসিয়ে ঘসেটি নিজের হাতে একপাত্র শরবত এনে দেয়। এতটা সৌজন্যের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাড়াতাড়ি হাত থেকে পাত্রটি নিয়ে বলি, ‘কেন মিছিমিছি ব্যস্ত হচ্ছেন?’

‘গরম পড়েছে, তাই ওটুকু তোমার জন্য আনিয়েছি।’

শরবত আমি খাই না।’ ঘসেটির পক্ষে কিছুই অস্বাভাবিক নয়। পানীয়ের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে। কৌশলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি।

‘তবে থাক।’ তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। সে অপমানিত বোধ করছে। দু’দিন আগে যে সবচেয়ে অবহেলিত একজন ক্রীতদাসী মাত্র ছিল, আজ সিরাজের অনুগ্রহে সে ঘসেটির নিজের হাতে দেওয়া শরবত পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে, একি কম বেয়াদবি!

‘আমাকে কেন ডাকছিলেন?’ শরবতের পাত্রটা একপাশে রেখে বলি।

‘এমনি, গল্প করার জন্যে। তোমার কি সময় নেই?’

‘আছে।’ মনে মনে ভাবি, শুধু গল্প করার জন্যে ডেকে আনার পাত্রী তুমি তো নও। নিশ্চয়ই কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে, তবে সে উদ্দেশ্য সহসা প্রকাশ করবে না ঘসেটি। ধীরে ধীরে ভাঙবে। আমি অপেক্ষা করি।

সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের গলা থেকে একটা বহুমূল্য মুক্তার মালা খুলে নিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দেয়।

‘এ কী করলেন!’ আমি আপত্তি করি।

‘তোমায় দিলাম। সিরাজ আমার স্নেহের পাত্র লুৎফা। তোমাকে তাই স্নেহ করি। সেদিন তোমার পরিচয় পাইনি, তাই অমন ব্যবহার করেছিলাম। কিছু মনে কোরো না।’

‘আমি কিছু মনে করিনি, বেগমসায়েবা।’

‘সে তোমার মহত্ত্ব। এই মালা তোমার প্রতি আমার স্নেহের নিশানি হয়ে থাক।’

‘বেগমসায়েবার অশেষ দয়া।’ মুখে বললেও মনে মনে দস্তুরমতো চঞ্চল হয়ে উঠি। ভাবি, কতক্ষণে উঠতে পারব।

ঘসেটি অনেক কথাই বলে চলে। বুঝতে কষ্ট হয় না, সবকিছুর উদ্দেশ্য একটাই, আমাকে তোয়াজ করা। ছোট ছোট কথায় আমিও সাধ্যমতো জবাব দিয়ে যাই।

‘সেদিন তুমি ওকথা বললে কেন লুৎফা? আমার মনে বড় লেগেছে।’

বুঝতে পারি এতক্ষণে আসল কথায় আসছে।

‘কী কথা?’ অবাক হবার ভান করি।

তুমি আমায় কাঁপিয়ে দিতে পারো।’

‘বেগমসাহেবাকে আপনি ওভাবে বললেন বলে আমার রাগ হয়েছিল। সেজন্যে আজ ক্ষমা চাইছি।’

‘না-না, ক্ষমা কেন? কাঁপাতে তো পারোই আমাকে। ভবিষ্যৎ বাংলার খাস বেগমের সেটুকু ক্ষমতা থাকবে না!’

‘অত ভেবে বলিনি।’

‘তবে কেন বলেছিলে?’

কথার প্যাঁচে হাঁপিয়ে উঠি। স্পষ্ট করে বলাই স্থির করলাম। ঘসেটির ঘরে যেন বাতাস বয় না। পুঞ্জীভূত পাপ আর অনাচার বহুকাল ধরে বাসা বেঁধে এ ঘরের বাতাসকে দূষিত করে দিয়েছে। তার সুন্দর মুখেও অনাচারের ছাপ। তার ছন্দায়িত দেহে উচ্ছৃঙ্খলতার শ্লথতা।

বলি, ‘হোসেন কুলিখার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী তা আমার অজানা নয়, বেগমসায়েবা। আমার চোখই আমার সাক্ষী। যেদিন আপনাকে মহলের সেই নির্জন জায়গায় গড়াগড়ি যেতে দেখে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম, সেদিন দু’হাত দূরের এক অন্ধকার কোণ থেকে সবই দেখেছিলাম। কাউকে একথা বলিনি, বলব না। কিন্তু আপনাকে এই প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, সিরাজের অমঙ্গল চিন্তা আপনি করবেন না।’

ঘসেটির মুখ সাদা হয়ে যায়। সে ভেতরে ভেতরে ভীত হয়ে পড়ে। আমার হাত দুটো তার দু’হাতে তুলে নিয়ে বলে, ‘বেশ, তাই হবে।’

.

বর্গি-সেনাপতি এতদিনে নিহত হয়েছে। কৌশলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু কোন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল, সে-কথা নবাব বললেন না। বেগমসায়েবার শত অনুরোধেও তিনি চুপ করে থাকলেন। তাঁর মুখ ব্যথায় থমথম করে। যুদ্ধ জয় করেও জয়ের আনন্দ নেই মুখে। প্রতিবার যুদ্ধের পর এসে পুরো একটা দিন বেগমসায়েবার সঙ্গেই অতিবাহিত করেন তিনি। এবারে ফিরে এসে সোজাসুজি চেহেল-সেতুনে চলে যান।

বেগমসায়েবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘সিরাজকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবে লুৎফা?’

‘আমি জিজ্ঞাসা করেছি, বেগমসায়েবা। তিনিও কিছু বললেন না।

‘ও, তুমি জানো দেখছি।’ তিনি চিন্তায় ডুবে যান।

নবাব আলিবর্দির এমন পরিবর্তন নাকি বহুদিন হয়নি। বেগমসায়েবা বললেন, ‘গিরিয়ার যুদ্ধের পর যখন তিনি মসনদ দখল করেন, তখন একবার এমন হয়েছিল। সরফরাজ ছিলেন ওঁর প্রভু। তাঁর অধীনে উনি সামান্য একজন কর্মচারী ছিলেন মাত্র। তাই প্রজাদের সমর্থন পেয়েও প্রভু- হত্যার ‘অপরাধবোধ’ ওঁর ঘাড়ে ভূতের বোঝার মতো বহুদিন চেপেছিল। আমি অনেক বুঝিয়ে সে-বোঝা ঘাড় থেকে নামিয়েছিলাম।’

নবাব আলিবর্দি খুব ধর্মভীরু। তাই বর্গি-সেনাপতিকে হত্যা করে আবার আগের মতো তিনি মন-মরা হয়ে পড়েছেন।

সিরাজও কিছু বলতে অস্বীকার করেছে শুনে বেগমসায়েবা একেবারে ভেঙে পড়েন। আতঙ্কগ্রস্ত হন তিনি।

‘সিরাজও তার দাদুর রোগ পেয়েছে। এ ভালো নয়, লুৎফা। ওকে তুমি শক্ত করে তোলো। এই বয়সে অমন ভাবপ্রবণ হলে তো চলবে না।’

‘আমি চেষ্টা করব, বেগমসায়েবা।’

‘শুধু চেষ্টা নয়, এ কাজ তোমাকে করতেই হবে।’

‘আচ্ছা।’ মুখে তাঁর কথায় সায় দিলেও মনে মনে আমি সিরাজকেই সমর্থন করি। যুদ্ধে মানুষ মারা এক কথা, কিন্তু হীন ষড়যন্ত্রকে আমিও যে ঘৃণা করি। কী করে সিরাজকে আমি শক্ত করব? তার চেয়ে সে নবাব আলিবার্দির মতো উপযুক্ত হোক। আল্লার কাছে প্রার্থনা করি, দাদুর রোগই যেন সিরাজ পায়। এ রোগ যার আছে সেই তো প্রকৃত বীর। আলিবর্দি বীর বলেই তাঁর মুখ আজ এত বিষণ্ণ।

বর্গিদের মাজা ভেঙে দিয়েও তাঁর মনে আজ কিছুমাত্র আনন্দ নেই। সিরাজও যেন অমন হয়। নইলে আল্লা নিজেই যে লানত করবেন তাকে। তিনি তো অন্যায় অবিচার সহ্য করেন না।

নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দেখি সিরাজ সেখানে বসে রয়েছে। তার স্বাভাবিক স্ফূর্তিভাব নেই। কাছে এগিয়ে গেলেও সে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল না। আমার মুখের দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

‘কী হল তোমার?’

‘না, কিছু না।’ ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জিত হয়েছে। একে পুরুষমানুষ, তার ওপর নবাবের উত্তরাধিকারী। তার কি কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া উচিত? নিজের বেগমের সামনেও নয়। তবু মাঝে মাঝে তার মনকে অরক্ষিত অবস্থায় এনে আমার কাছে হাজির করে। তাতেই আমার সুখ, আনন্দ। সে নবাবজাদা হয়ে আমার কাছে আসে না। আসে সিরাজ হয়ে—শুধু সিরাজ।

‘তোমার সেই সহচরটি কোথায়?’ প্রশ্ন করি আমি।

কার কথা বলছ?’

‘মহম্মদ।’

‘সহচরই বটে! কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়ে না। তাড়িয়ে তো দিতে পারি না। একটু ধমক দিলেই চোখ ছলছল করে ওঠে।

‘কুমিরের অশ্রু।’ অস্ফুট স্বরে বলি।

‘কী বলছ?’

‘না, কিছু না। তোমাকে বড় মন-মরা দেখাচ্ছে।’

‘কই, না তো!’

‘মন-মরা হওয়াই স্বাভাবিক। তুমি বীর, তাই এমন হয়েছে।’

‘কী বললে লুৎফা?’ সে আমার কথায় চমকে ওঠে।

‘বর্গি-সেনাপতিকে কৌশলে হত্যা করে তুমি আর তোমার দাদু দু’জনেই কষ্ট পাচ্ছ। কষ্ট তো পাবেই। শত অন্যায় করলেও সে বীর ছিল। বীরকে যুদ্ধে আহ্বান করে হত্যা করাই উচিত ছিল।’ একটু থেমে ভেবে নিয়ে আবার বলি, ‘কিন্তু এতে তো তোমার হাত নেই, নবাবজাদা। নবাবের হাত কিছুটা ছিল, তার জন্যে তিনি যথেষ্ট অনুতপ্ত। অবশ্য তোমার মন খারাপ হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু এখন তোমার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সময়। নিজে যখন ক্ষমতা পাবে তখন যাতে এমন না হয় তাই দেখো।’

সিরাজ ছুটে এসে আমাকে শূন্যে তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করে। একেবারে পাগল, সেইজন্যেই তো এত ভালোবাসি।

তুমি আমার লুৎফাউন্নেসা। তুমি না হলে এভাবে কে আমাকে সান্ত্বনা দিত!’

‘এবারে নামিয়ে দাও। হাত ফসকে গেলে ভবিষ্যতে কে সান্ত্বনা দেবে?’

‘আমার হাত থেকে পড়ে যাবে?’

‘কেন, তোমার হাত থেকে কি কেউ পড়ে না?’

‘না, দেখবে?’ সিরাজ তার কাবা-চাপকান সব খুলে ফেলে। খালি গায়ে শুধু একটা অন্তর্বাস পরে দাঁড়ায়। এভাবে সিরাজকে এই প্রথম দেখলাম। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। কী সুন্দর! বলিষ্ঠ দেহের স্থানে-স্থানে ক্ষতচিহ্ন এক বীরত্বব্যঞ্জক সুষমা দান করেছে তাকে।

‘কী দেখছ অমন করে?’ সিরাজ বলে।

‘তোমাকে।’

‘ও! আর দেখো না, ফুরিয়ে যাব।’ সিরাজ হেসে তার পোশাক পরে ফেলে।

‘এবারে বিশ্বাস হল লুৎফা যে, আমার হাত থেকে কেউ ফসকে যায় না।’

‘হুঁ।’ তৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে। সিরাজের ক্ষণপূর্বের বিষণ্নমুখে এখন যে আনন্দের জোয়ার এসেছে এ তো আমারই দান।

মহম্মদের সঙ্গে সোফিয়ার শাদি হয়ে গেল। নবাব মহল থেকে তারা বিদায় নিয়ে অদূরে এক জায়গায় বাসা বাঁধল।

সোফিয়া তবু মাঝে মাঝে এসে দেখা দিয়ে যায়। আমিই তাকে আসতে বলেছিলাম। মহলের বাইরের কিছু খবর জানার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। শুনতে পাওয়া যায়, সিরাজের সহচরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুনে বড় ভয় হয়। সে সরল বলেই আমার এত ভয়। খারাপ সহচরের হাতে পড়লে খারাপ হতে তার বেশি সময় লাগবে না। সে যে বাংলার পরবর্তী নবাব, এ বিষয়ে বড় বেশি সচেতন সে। তাই সেই রকম মর্যাদা দেখিয়ে তাকে দিয়ে সবকিছু করিয়ে নেওয়া সম্ভব। তার তোষামোদকারীরা হয়তো সেই সুযোগই নিচ্ছে।

সোফিয়া একদিন এসে মেহেদি নেশার খাঁ নামে একজনের কথা বলল। তার নামে সে অনেক কিছু বলে গেল। শুধু তার নামে নয়, আভাসে সিরাজের সম্বন্ধেও এমন কতকগুলি কথা বলল, যা কখনও কল্পনা করিনি। এ কথাও বুঝলাম, মেহেদি নেশার খাঁ যে-ই হোক না কেন, তোষামোদের ব্যাপারে মহম্মদের চেয়েও শক্তিমান। মহম্মদকে সে কোণঠাসা করেছে বলেই সোফিয়ার সব আক্রোশ তার ওপর

প্রস্তুত হই। সিরাজকে সামলাতে হবে। নবাব বংশের চিরাচরিত দোষগুলি তার মধ্যে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। এখন সাবধান না হলে পরে আমাকেই আপশোস করতে হবে। শরাব সে কোনোদিন পান করত না। আজকাল তার মুখে গন্ধ পাই। ভেবেছিলাম, শখ করে মাঝে মাঝে একটু-আধটু খায়। কিন্তু সোফিয়ার কথা শুনে বুঝলাম, ভালো রকম অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে সিরাজের।

কতটুকুই বা ক্ষমতা আমার? হারেমে বসে কী করে সামলাব? অস্থির হয়ে উঠি। বাইরের দিকে নজর পড়ল সিরাজের। তার সরল মুখের দিকে চেয়ে কখনও তো মনে হয় না যে, সে অমন হবে। কুসংসর্গ এভাবে তাকে দিনের পর দিন নিচে টেনে নিয়ে যাবে, আর আমি তাই অসহায়ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখব?

বেগমসায়েবাকে বলে লাভ নেই। তিনি কোনো গুরুত্বই দেবেন না। স্নেহের নাতিকে ছেলেবেলা থেকে সংযম শিক্ষা না দিয়ে তিনিই এমন করে তুলেছেন। এখন তাঁকে কিছু বললে তিনি তাঁর গাফিলতিকে ঢাকার জন্যে দু’পাঁচটা উপদেশ দিয়ে বসবেন। এ আমার অনুমান নয়। আর একদিন সামান্য একটা কথা বলতে গিয়ে আমি বুঝে ফেলেছি। অথচ তিনিই আমাকে তাঁর নাতির ভার দিয়েছিলেন সার্থক নবাব করে তুলতে।

তাই যা-কিছু করার আমাকেই করতে হবে। না পারলে নিজেকেই মাথা কুটতে হবে। কেউ সহায়তা করবে না।

সিরাজকে স্পষ্টভাবে বলতে পারি, কিন্তু তাতে ফল অন্যরকম হবে। তাকে বাধা দেবার সামান্য চেষ্টা করলে সে আরও দুর্দান্ত হয়ে উঠবে। কারণ, জীবনে সে কোনো কাজে বাধা পায়নি। রয়ে-সয়ে ভেবে-চিন্তে কিছু করতে না পারলে সব গোলমাল হয়ে যাবে।

সিরাজের কথা ভেবে যে সময় নিদ্রাহীন রজনী অতিবাহিত করছি, সে সময় হঠাৎ এক নিদারুণ দুঃসংবাদ সমস্ত নবাব পরিবারকে ভেঙেচুরে দুমড়ে দিয়ে গেল। বেগমসায়েবা রুদ্ধ কক্ষে অনাহারে দিন কাটাতে লাগলেন। মহলের কারও মুখে হাসি নেই। নবাব আলিবর্দি হঠাৎ অতিমাত্রায় বৃদ্ধ হয়ে পড়লেন। শুধু ঘসেটি বেগমের ঘরে কখনও কখনও হাসির আওয়াজ শোনা যেতে লাগল।

সিরাজের পিতা জৈনুদ্দিন হত হয়েছেন। পাটনার আফগানেরা তাঁকে কৌশলে হত্যা করেছে। খবরটা মুর্শিদাবাদে পৌঁছানোর পর থেকেই মহলের এই অবস্থা।

সিরাজকে খুঁজে পাচ্ছি না। জানি না সে এখন কোথায় আছে। এ সময়ে তাকে আমার বড্ড প্রয়োজন। পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পাগলের মতো একা-একা ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো। এ সময় তাকে যদি সান্ত্বনা না দিতে পারি, তবে আমি কীসের বেগম? আমার লুৎফা নামই মিথ্যে।

খবর আসার পর দু’দিন কেটে গেল। সন্ধ্যার সময় বেগমা সায়েবা তাঁর দরজা খুললেন। জারিয়ারা ছুটে গেল তাঁর কাছে। ঘসেটি বেগমকেও যেতে দেখলাম সেদিকে। ভিড় দেখে আমি আর গেলাম না। ফিরে এলাম নিজের ঘরে।

ঠিক সেই সময় সিরাজ এল। শিথিল দেহখানা কোনো রকমে টানতে টানতে এনে পালঙ্কের ওপর ছড়িয়ে দিল। তার চোখ রক্তবর্ণ। ভাবলাম, শরাব পান করে এসেছে। হয়তো পিতার মৃত্যুসংবাদ শোনবারও অবসর হয়নি তার

ভীষণ রাগ হল। প্রশ্ন করি, ‘কোথায় ছিলে দু’দিন?’ জবাব পাই না।

আমার কথা শুনতে পেয়েছ?

‘পেয়েছি লুৎফা।’ অবসন্ন কণ্ঠস্বর।

শরাব নিয়ে পড়েছিলে তো? এ দিকের খবর জানো?’

‘জানি। শরাব আমি খাইনি লুৎফা।’

আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। শরাব খায়নি অথচ এমন ভাঙা-ভাঙা গলা কেন সিরাজের? তবে কি শোকে এমন হয়েছে? এতবড় ভুল হল আমার? তার মুখের দিকে ভালোভাবে চেয়ে দেখি। সে-মুখে দুঃখ শোক আর বিষাদের ছায়া। নিজের টুটি চেপে ধরতে ইচ্ছে হল। এ আমি কী করলাম? একবার ভালোভাবে চেয়ে দেখলাম না পর্যন্ত।

সিরাজের কোলের মধ্যে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। ‘কেঁদো না লুৎফা।’ সে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। ‘আমাকে শাস্তি দাও।’

তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি লুৎফা। যে যেরকম, তাকে সেরকম ভাবাই স্বাভাবিক। ‘ ‘কিন্তু আমার এতবড় ভুল কেন হবে? তোমাকে চিনতেও আমার ভুল হবে?’

‘ক্ষতি কী? আমাকে তুমি ভালোবাসো বলেই ভুল হয়েছে। অন্য বেগমদের ভুল হবার বালাই নেই। কিন্তু এখন কী করি লুৎফা? আমার যে কিছুই ভালো লাগছে না।’

‘ছিঃ নবাবজাদা, ভেঙে পড়ছ কেন? যে-আঘাত তুমি পেলে, নবাবরাই সে-আঘাত পায়। তুমি তো সাধারণ মানুষ নও। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখও সাধারণ। তোমার সুখ যেমন অসাধারণ, দুঃখও তেমনি অসাধারণই তো হবে। তোমার বুক যেমন বিরাট, মন যেমন বিরাট, সহ্যশক্তিও তেমনি বিরাট হওয়া চাই। নইলে তুমি সিরাজদ্দৌলা কীসে?’

সিরাজের কোল থেকে মুখ তুলে দেখি, সে একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। তার চোখ জলে টলমল করছে।

‘লুৎফা!’ তার বলার হয়তো অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু আমার নামটুকু ছাড়া আর কিছুই সে উচ্চারণ করতে পারল না। বুঝলাম, পৃথিবীতে আমার সব চাইতে প্রিয়জনকে কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পেরেছি।

‘এ দু’দিন কোথায় ছিলে নবাবজাদা? তোমাকে আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান।’

‘রোশনিবাগে।’

‘একা ছিলে সেখানে?’

‘হ্যাঁ।’

‘রোশনিবাগে কি কোনো ঘর রয়েছে নবাবজাদা?’

‘একটা ছোটমতো আছে। কিন্তু আমি তো সেখানে ছিলাম না।’

তবে কোথায় ছিলে?’

‘একটা আমগাছের গোড়ায়।’

দু’দিন আমগাছের গোড়ায় বসেছিলে?’

‘হ্যাঁ লুৎফা।’

তুমি কি আমাকে পাগল করবে?’

‘ওতে আমাদের কষ্ট হয় না, লুৎফা। আমরা যে যুদ্ধ করি। বরং ভালোই হয়েছে ওতে। শরীরের কষ্ট যতটা হয়েছে, তাতে মনের কষ্ট কিছুটা কমেছে।

‘কিছু খাওনি তো দু’দিন?’

‘পাব কোথায়?’

‘তুমি শুয়ে থাকো, আমি এখনি আসছি।’

কিমা-সুররা সিরাজের প্রিয় খাদ্য। নিজের হাতে নিয়ে এলাম। এসে দেখি, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আহা! দু’দিন ঘুমোয়নি, ঘুমোক একটু।

কিন্তু একটু পরেই হঠাৎ সে জেগে উঠল। পেটে খিদে থাকলে ঘুমও হয় না।

‘খানা এনেছ?’

‘এনেছি।’

‘দাও।’ সে সাগ্রহে খেতে শুরু করে।

‘একটা কথা বলব নবাবজাদা?’ খাওয়া শেষ হয়ে আসার সময় প্রশ্ন করি।

‘বলো।’

‘একটা প্রার্থনা আছে।’

‘কী প্রার্থনা?’

‘পূর্ণ হবে তো?’

‘শুনিই না।’

‘এবার থেকে দু’বেলা আমার কাছেই খাবে, কেমন?’

সিরাজ খাওয়া থামিয়ে কী যেন ভাবে। তার মুখে মৃদু হাসির তরঙ্গ খেলে যায়। বলে, ‘আমাকে বন্দি করতে চাও লুৎফাউন্নেসা।’

‘যদি বলি তাই, ক্ষতি আছে?’

‘না, লুৎফাউন্নেসা সাধারণ বেগম নয়। সে আমার প্রাণের আধখানা। তার হাতে বন্দি হব এতে ক্ষতি কী, বরং লাভ।’

‘প্রার্থনা মঞ্জুর হল তো?’ আমার চোখের পাতা ভিজে ওঠে।

‘হুঁ। কিন্তু একেবারে রাশ টেনে ধরো না বেগমসায়েবা, ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা।’

‘আমি জানি নবাবজাদা। একেবারে রাশ টেনে ধরার মতো মূর্খ আমি নই। তাহলে এখুনি মেহেদি নেশার খাঁয়ের সঙ্গে মিশতে মানা করে দিতাম।

সে চমকে আমার দিকে দৃষ্টি ফেলে। তারপর হঠাৎ হেসে ওঠে, ‘তুমি বুদ্ধিমতী লুৎফা।’

আমি সে-কথার জবাব না দিয়ে শুধু হাসি।

.

সিরাজের মা আমিনা বেগম মুর্শিদাবাদে চলে এলেন। সিরাজের ভাই এক্রামউদ্দৌলাকে নওয়াজিস মহম্মদ খাঁ পুত্র হিসাবে গ্রহণ করলেন। নিঃসন্তান নওয়াজিসের বুভুক্ষু-প্রাণ শীতল হল এতদিনে। জীবনে এই প্রথম তিনি ঘসেটি বেগমের মতের বিরুদ্ধে গেলেন। এক্রামকে পুত্র হিসাবে নেবার ইচ্ছা ঘসেটির আদৌ ছিল না। সে নারী, কিন্তু নারীর সব কয়টি গুণ তার মধ্যে স্ফুটিত হয়নি। তার নারীত্বে মাতৃত্বের স্থান নেই, বধূত্বের স্থান নেই, সে শুধু প্রিয়া হতে চায়।

প্রথমে সে নওয়াজিস খাঁর প্রিয়া ছিল। এখন নওয়াজিস পুরোনো হয়ে গিয়েছে। অতি পরিচিত পুরুষের কাছে প্রিয়া হবার রোমাঞ্চ থাকে না। তাই বেগম হয়েও সে খাঁ সাহেবকে এড়িয়ে চলে।

এখন সে হোসেন কুলিখাঁর প্রিয়া। সম্ভবত হোসেন কুলিখাঁও পুরোনোর দলে যেতে বসেছে। হাবভাব দেখে তাই-ই মনে হয়। সেদিন আর একজনকে দেখলাম। মির নজরালি তার নাম। সঠিক না জেনে বলতে ভরসা হয় না, তবু মনে হয়, ঘসেটি নতুন টোপ ফেলেছে। মির নজরালি ঘসেটির চারের নতুন মাছ। দেখতে হবে কতদূর গড়ায়।

কিন্তু তার আগে একটা ভীষণ ব্যাপার সংঘটিত হতে দেখে আমি স্তম্ভিত হলাম। কী করব ভেবে পেলাম না। অথচ আমি আর জারিয়া নই, আমি বেগম। নবাব বংশের মঙ্গল, নবাব মহলের পবিত্রতা রক্ষার এক বিরাট দায়িত্ব আমার রয়েছে। ঘসেটি বেগম হলেও না হয় এড়িয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু ও যে ঘসেটি নয়। এ এমন একজন, যার কথা বলতে লজ্জায় আমার মুখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু কী করব? কর্তব্য বড় কঠিন জিনিস।

.

মাঝে মাঝে এখনো গিয়ে দাঁড়াই সেই গবাক্ষের সামনে। কাটরার আজানধ্বনি শুনি। বেশ লাগে। সেদিনও দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাইরে থেকে ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। একটু অন্যমনস্কই ছিলাম। হঠাৎ পদশব্দ কানে এল। কে যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে। জারিয়া-সুলভ ভীতি আমার আর নেই। তাই নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম।

হোসেন কুলিখাঁ! হ্যাঁ, তিনিই আসছেন। সরে যেতে হল। আমি বেগম, পর্দানশীন। পরপুরুষের সামনে মুখ দেখানো মানা। বেগম মহলে সঙ্গে বোরখা থাকে না, এখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই আড়ালে গেলাম। হোসেন কুলিখাঁর ওপর মনে মনে ভীষণ রাগ হল। তাঁর এই চৌর্যবৃত্তিই বোধহয় তাঁর চরিত্রের একমাত্র দুর্বলতা।

কিন্তু তিনি আবার এখানে কেন? তিনি না জানলেও ঘসেটি বেগম তো জানে, তাদের নোংরামি আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। ঘসেটি আর যাই হোক, মূর্খ নয়। বরং সে ভীষণ চতুর। সে কখনও আর এদিকে আসবে না। কৌতূহলে উদগ্রীব হয়ে সেই অন্ধকার গোপন জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে থাকি।

হোসেন কুলিখাঁ গবাক্ষের সামনে এসে থেমে গেলেন। চোরের মতো এদিকে ওদিকে তাকান। তাঁর মতো পুরুষের এই রকম চাহনি দেখে আমার কষ্ট হয়। একটু কৌতূহলও যে অনুভব না করি তা নয়।

মনে মনে প্রস্তুত হই। ঘসেটি আসার আগেই সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তার পশুত্ব বোধহয় চতুরতাকে জয় করেছে। তাই একই জিনিস আবার ঘটতে চলেছে।

লঘু পদশব্দ ভেসে আসে। আসুক, একেবারে কাছে আসুক। হোসেন কুলিখাঁর সামনে দাঁড়াক, তারপরে আত্মপ্রকাশ করব। ভেবেছে বেগম হয়ে বুঝি ঘর ছাড়ি না। কিন্তু আমি শুধু বেগম নই, আমি লুৎফা। আজ একটা চূড়ান্ত পরিণতি দেখে আমি নিশ্চিন্ত হব। ঘসেটি মুক্তোর মালা দিয়ে আমার ভেতরের মানুষটাকে কিনতে পারবে না। ওর কাছে আমার দেওয়া কথারও কোনো দাম নেই। কিন্তু একী! ঘসেটি তো নয়। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? চোখের ভুল নয় তো? বার বার চোখ রগড়াই। না, ভুল নয়। সিরাজ-জননী আমিনা বেগম এগিয়ে আসছেন। তাঁকে দেখে হোসেন কুলিখাঁর মুখে হাসি ফোটে। আমিনা বিবির মুখেও হাসি। ছি-ছি, তাঁর এই জঘন্য মনোবৃত্তি! আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হল—চোখ বন্ধ করি। না-না, কিছুতেই দেখতে পারব না। মরে গেলেও নয়।

‘এই মুহূর্তটার জন্যেই বোধহয় এতদিন বেঁচেছিলাম আমিনা।’ পুরুষের গম্ভীর স্বর।

‘ঘসেটিকেও এই কথা বলতে নিশ্চয়?

‘ছি-ছি, কী যে বলো তুমি!’

‘ঠিকই বলছি। পুরুষদের আমি চিনি।’

‘আমাকে তুমি চেনোনি এখনো। ঘসেটি বেগম আমার প্রভুপত্নী। তাঁর সঙ্গে এ সম্পর্ক হবে কেন?’

আমার সঙ্গেও তোমার সম্পর্ক সমানে সমানে নয় হোসেন কুলিখাঁ।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। হোসেন কুলিখাঁ নিশ্চয় আহত হয়েছে আমিনা বিবির কথায়।

‘দিলটাই আদত জিনিস আমিনা। ভালোবাসা কখনও সম্পর্ক বাছে না।’

‘শুধু ঘসেটি বেগম ছাড়া, তাই না?’ তিন সন্তানের জননী আমিনা বেগমের গলায় কিশোরীর খিলখিল হাসি। শুনে আমার গায়ে জ্বালা ধরে। আর শুনতে ইচ্ছে হয় না। এরপর যে কোনো শব্দ কানে এলে আমি মূৰ্চ্ছা যাব—আমি ধরা পড়ে যাব। দু’হাত দিয়ে দু’কান চেপে ধরে বসে পড়ি। চোখ বন্ধ করি।

বহুক্ষণ কেটে যায়। ধীরে ধীরে চোখ মেলি। কেউ নেই, দু’জনে চলেই গিয়েছে।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, বেগমসায়েবাকে আজই সব বলতে হবে। এরপরেও মুখ বুজে বসে থাকার অর্থ সর্বনাশ ডেকে আনা এবং এই সর্বনাশের জন্যে মূলত আমিই দায়ী হব।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *