আমি সিরাজের বেগম – ৪

যে অসন্তোষ সিরাজের মনে অল্প-অল্প ধূমায়িত হচ্ছিল, সেটা প্রচণ্ড আকারে দেখা দিল একদিন। মেহেদি নেশার খাঁ দিনের পর দিন ইন্ধন জুগিয়ে এ দশা করল। গোড়া থেকে জেনেও আমি বাধা দিতে পারলাম না।

বহুদিন থেকে সিরাজ জিদ ধরেছিল, সে পাটনায় গিয়ে থাকবে। কিন্তু নবাব আলিবর্দি বার বার বুঝিয়ে তাকে শান্ত করেছেন। এখন নবাব মুর্শিদাবাদে নেই। ছোটখাটো একটা যুদ্ধ বেধেছে রাজ্যের সীমান্তে, তিনি সেখানে গিয়েছেন।

নবাবের অনুপস্থিতিতে মেহেদি নেশার খাঁ পরিপূর্ণ সুযোগ পেল। সিরাজের মনে সে ধারণা এনে দিল যে, নবাব সিরাজকে তুষ্ট রাখার জন্যে নামে শুধু তাকে পাটনার শাসনকর্তা করেছেন, আসলে প্রকৃত শাসনকর্তা রাজা জানকীরাম।

কথাটা সিরাজ অনেকবার আমাকে বলেছে, আমি কোনো গুরুত্ব দিইনি। বরং আকারে, ইঙ্গিতে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, সে বাংলার মসনদে বসবে বলেই নবাব তাকে দুরে না পাঠিয়ে নিজের কাছে রাখতে চান। এতে অভিজ্ঞতা লাভ হবে। পাটনায় গিয়ে বসে থাকলে মুর্শিদাবাদের রাজনীতি সম্বন্ধে সে অজ্ঞ থেকে যাবে। তাছাড়া সেখানে থাকার বিপদও আছে অনেক। তার পিতা জীবন দিয়ে সে-প্রমাণ দিয়ে গিয়েছেন।’

কিন্তু সিরাজ নাছোড়বান্দা।

হঠাৎ একদিন আমার কাছে তার আদেশ এল, শিগগির প্রস্তুত হয়ে নিতে। কেন প্রস্তুত হব, কোথায় যাব, কিছুই না বুঝে যখন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, আমিনা বিবি তখন কাঁদতে কাঁদতে এসে বললেন, ‘শুনলে সিরাজের কাণ্ড!’

‘কিছুই বুঝছি না।’

‘ওর সঙ্গে যেতে হবে পাটনায়। পাটনা আক্রমণ করবে।

‘সে কী!’

‘আর বলো কেন? কে কী বুঝিয়েছে জানি না, গোঁ ধরে বসেছে।’

‘আপনিও যাবেন নাকি?’

‘নইলে আর বলছি কী!’

ভালোই হল। আমি ভেবেছিলাম আমাকেই বুঝি একা যেতে হবে।’

‘আমি মার কাছে চললাম। অতদূরে আমি আর যেতে পারব না। সে কি কম দূর?’

‘বেগমসায়েবার কাছে গেলে কি কোনো ফল হবে?’

‘দেখি, মা যদি ওকে বুঝিয়ে শান্ত করতে পারেন।’ আমিনা বিবি চলে যান।

আমি জানি, কারও কথাতেই কিছু হবে না। আমাদের দুজনেরই যেতে হবে সিরাজের সঙ্গে। গোছগাছ করে নিই।

আগে আর পেছনে সৈন্যের দল। তারই মাঝে চলেছে বলদদের গাড়ির সারি। মেহেদি নেশার খাঁ সামনের গাড়িতে রয়েছে। পরের গাড়িতে আমি আর সিরাজ। তার পরের গাড়িতে আমিনা বিবি। বেগমসায়েবার কাছে ধর্না দিয়েও তিনি মুর্শিদাবাদে থাকতে পারেননি।

আমিনা বিবির পরে আরও দুখানা গাড়িতে রয়েছে জিনিসপত্র না।

পথ আর শেষ হতে চায় না। একটু পরপরই গলা শুকিয়ে ওঠে। জল খেয়েও তৃষ্ণা মেটে

‘কোথায় নিয়ে চললে, নবাবজাদা? পৃথিবী যে শেষ হয়ে এল।’

‘এখনো কষ্ট শুরু হয়নি, লুৎফা। প্রকৃতির শ্যামলা রং দেখতে পাচ্ছ এখনো। এরপর শুরু হবে শুধু পাহাড় আর শক্ত মাটি।’

‘আমি মরে যাব, নবাবজাদা।’

‘এত অল্পেই? যুদ্ধ শুরু হলে কী করবে?’

যুদ্ধে কাজ নেই। এ তুমি জোর করে যুদ্ধ বাধাচ্ছ। চলো, ফিরে যাই।’

চুপ। বাজে কথা শুনতে চাই না। আত্মসম্মান কী জিনিস তা বোঝবার ক্ষমতা তোমার নেই।

‘এ আত্মসম্মান-বোধের ভিত্তিটা মিথ্যের ওপর।’

‘আর কথা বোলো না, গাড়ি থেকে ফেলে দেব।’ সিরাজের মুখের দিকে চেয়ে ভয় হল। তার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। যে ভূত তার ঘাড়ে চেপেছে, সেটা না নামা অবধি একটু সাবধানে কথা বলতে হবে। অন্তত তার পাটনা অভিযান সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করা চলবে না আর।

.

শেষে পথ ফুরোল।

দূর থেকে দেখা যায় আজমবাদের দুর্গ। কিন্তু ও-পক্ষের যুদ্ধের কোনো আয়োজন তো দেখা যাচ্ছে না। সিরাজ খুবই বিস্মিত হল। সে গাড়ি থেকে মাটিতে নামে। পর্দা সরিয়ে দেখলাম, মেহেদি নেশার খাঁও গাড়ি থেকে নেমেছে। কোনো গভীর পরামর্শ করতে করতে দু’জনে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে।

পাটনার প্রধান দরজার সামনে আমাদের সমস্ত সৈন্য দাঁড়িয়ে গেল। দরজা বন্ধ। একজন লোক শুধু একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার বাইরে। রাজা জানকীরামের চিঠি।

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সিরাজ মত্ত হাতির মতো ঘুরে বেড়াতে থাকে। জানকীরাম তাকে অপমান করেছে। লিখেছে যে, সিরাজ পাটনার শাসনকর্তা। সে একা এলে জানকীরাম তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে। যথাযথ সম্মান দেখিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে নগরীর ভেতরে। কিন্তু সৈন্যসামন্তকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। সৈন্যরা যেন ফিরে যায় মুর্শিদাবাদে।

সিরাজ ক্রোধে চিৎকার করে উঠল। সৈন্যদের ডেকে আক্রমণ চালাতে বলল। কিন্তু আক্রমণ করবে কাদের ওপর? বিপক্ষের তো কোনো সৈন্য নেই।

শেষে নগরীর দরজা ভেঙে ফেলার হুকুম দিল সে। সেই সময় সর্বপ্রথম বাধা পেল অপর পক্ষ থেকে। যারা দরজা ভাঙতে গিয়েছিল, তাদের কিছু লোক তিরের আঘাতে ধরাশায়ী হল। এবার মেহেদি নেশার খাঁ এগিয়ে যায় অর্ধেক সৈন্য নিয়ে। দরজা ভাঙাতেই হবে, এই হল সিরাজের পণ। তার মুখে হাসির আভাস দেখা গেল। ভাবখানা এই যে, জানকীরামের ওপর টেক্কা দিয়েছে সে। তিরের আঘাতে দু’চারজনকে মেরে ফেলে ভাবে, এবারে আর জানকীরাম পাটনা নগরী রক্ষা করতে পারবেন না।

কিন্তু মেহেদি নেশার খাঁ দরজার কাছে এগিয়ে যাবার আগেই হঠাৎ দেখা গেল, অজ্ঞাতস্থান থেকে একদল সৈন্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। বহুক্ষণ কিছু বুঝতে পারলাম না—শুধু অস্ত্রের ঝনঝনানি আর ঝলকানি। আমি আর আমিনা বেগম শিবির থেকে এই ভয়াবহ কাণ্ড দেখি, আর ভেবে মরি। আর সিরাজ আমাদেরই সামনে অস্থিরভাবে পায়চারি করে। কী যেন ভুল হয়ে গিয়েছে তার—মস্ত ভুল।

একজন ছুটে এসে বলে, ‘মেহেদি নেশার খাঁ হত হয়েছে।’ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সিরাজ। আর আমার বুক থেকে পাষাণভার নেমে যায়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, রাজা জানকীরামের যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছাই নেই। শুধু নগরী রক্ষার জন্যে যেটুকু না করলে নয়, সেটুকু করতে তিনি আদেশ দিয়েছেন তাঁর সৈন্যদের। অজ্ঞাতস্থান থেকে তাঁর সৈন্যদল যেভাবে মেহেদি নেশার খাঁর সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, ইচ্ছে করলে ওভাবে আমাদের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত। কিন্তু পরেনি, কারণ জানকীরামের আদেশ নেই। সিরাজ যাতে নিরাপদে থাকে, সেদিকে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে।

মেহেদি হত হবার পর সেদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ হল। সিরাজ রীতিমতো চিন্তিত হয়েছে। সে অন্য কোনো কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টায় রয়েছে।

.

পরদিন একজন অশ্বারোহী আমাদের শিবিরের সামনে এসে হাজির হয়। নবাব আলিবর্দির ঘোড়সওয়ারকে দেখে বিস্মিত হলাম। লোকটি সোজা এসে সেলাম দিয়ে সিরাজের সামনে দাঁড়াল।

‘কোথা থেকে আসছ?’ সিরাজ প্রশ্ন করে।

‘নবাব পাঠিয়েছেন।

‘তিনি জানলেন কী করে যে, আমি এখানে এসেছি?’

‘রাজা জানকীরাম তাঁর কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন।’

‘হুঁ, স্পর্ধা বটে জানকীরামের।’

লোকটাকে সিরাজ মেরে না ফেলে।

‘নবাব কী জন্যে তোমাকে পাঠিয়েছেন?’ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে সিরাজ প্রশ্ন করে।

লোকটি একখানা চিঠি দেয়।

সিরাজ বার বার সেটা পড়ে। তার মুখে আস্তে আস্তে একটা শান্ত ভাব ফুটে ওঠে। শেষে সারা মুখ জুড়ে হাসির রেখা দেখা দেয়। আমি স্বস্তি পাই। নবাব তাঁর নাতির মন ভালোভাবেই জানেন। সেই মন বুঝে তিনি কিছু লিখেছেন নিশ্চয়। নইলে সিরাজের মুখে এই পরিস্থিতিতে হাসি ফোটানো বড় সহজ কথা নয়। বৃদ্ধ হলেও নবাব আলিবর্দির তুলনা নেই।

সিরাজ চিঠিখানা নিজের সামনে রেখে লোকটির দিকে চেয়ে বলে, ‘নবাবকে নিশ্চিন্ত হতে বলো। তাঁর ইচ্ছেমতোই কাজ হবে।’

লোকটি বিদায় নিতেই আমি সিরাজের সামনে আসি। আমাকে দেখে সে বলে, ‘দেখছ লুৎফা, দাদুর কাণ্ড।’

কী কাণ্ড হল আবার?’

‘দাদুর জন্যে আমার কোনো কিছু করবার উপায় নেই। তিনি ভাবেন, যেন চিরকাল বেঁচে থেকে আমাকে বুকে করে নিয়ে বেড়াবেন।

‘অমন দাদু পাওয়া ভাগ্য, নবাবজাদা।’

‘সে আমি জানি। কিন্তু আমার সব কাজকে ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দেওয়া তাঁর অন্যায়। এবারে মুর্শিদাবাদে গিয়ে আমি ঝগড়া করব—ভীষণ ঝগড়া করব, তুমি দেখে নিও।’

‘যাক, তাহলে আর আমাদের পাটনায় থাকতে হবে না তো?’

সিরাজ ঘাড় নাড়ে।

অভিমান হয়েছে নাতির। মুখে বলি, ‘নবাব তোমাকে কী লিখেছেন?

‘এই দেখো।’

চিঠিখানা খুলি। লেখা রয়েছে : ‘যুদ্ধ করে সবাই বীরত্ব দেখাতে পারে, কিন্তু দাদুর ভালোবাসার অত্যাচার যে সহ্য করতে পারে, সেই তো প্রকৃত বীর। আমার সিরাজ সে রকম বীর কি না তারই পরীক্ষা আজ। জানকীরাম তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। সে তোমাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে প্রস্তুত। শুধু তোমার আদেশের অপেক্ষায় বসে রয়েছে। নিজের সৈন্যের সঙ্গে আবার যুদ্ধ করে নাকি? জানকীরাম তো তোমারই অধীনস্থ কর্মচারী। তাকে শুধু হুকুম করো।’

আমি বলি, ‘নবাব তো ঠিকই লিখেছেন। রাজার কাছে লোক পাঠাও এখুনি।’

কিছুক্ষণ পরেই জানকীরাম সশরীরে এসে উপস্থিত। সঙ্গে হাতি, ঘোড়া, পালকি আর বাদ্যযন্ত্র। সিরাজ হাসতে হাসতে উঠে গিয়ে রাজাকে জড়িয়ে ধরে। রাজাও হেসে দু’বাহু বাড়িয়ে দেন। সে-দৃশ্য দেখে আমার চোখ আনন্দে সজল হয়ে ওঠে। এমন সৌম্য চেহারার লোকের বিরুদ্ধে সিরাজ অভিযান চালিয়েছিল ভেবে লজ্জা হয়। তাঁর মতো এলেমওয়ালা লোক নবাবের অধীনে হয়তো দু’জনও নেই।

.

নবাব আলিবর্দির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তাঁর ঋজু বলিষ্ঠ চেহারা নুইয়ে পড়ল। বেগমসায়েবা রীতিমতো চিন্তিত হন। হাকিমদের মতামত শুনে তাঁর মতো মহিলার মুখও শুকিয়ে যায়।

কিন্তু নবাব শুনে হেসে বলেন, ‘এতে এত মনমরা হবার কী আছে? এই তো নিয়ম। স্বাস্থ্য একদিন সবারই ভেঙে যায়। তারপর ধীরে ধীরে শেষ সময় ঘনিয়ে আসে। এর জন্যে কান্নাকাটি করা বাতুলতা। বরং মনকে শক্ত করে প্রস্তুত থাকাই ভালো।’

বেগমসায়েবা বলেন, ‘এমন কথা বোলো না, তোমার বয়স এমন কিছু বেশি নয়।।‘

নবাব হেসে বলেন, ‘তোমার কাছে আমি কি কখনও বুড়ো হই? বাইরের লোককে জিজ্ঞাসা করো তাহলে বুঝবে।

তাঁর কথার ধরনে আমি গোপনে হেসে ফেলি। সে-হাসি বেগমসায়েবা দেখে ফেলেন। বুঝতে পারি তিনি রেগেছেন। ভয়ে আমি পালিয়ে যাই। মনে মনে ভাবি, মেয়েরা বড় অবুঝ হয়। সিরাজ যখন বুড়ো হবে, তখন আমিও হয়তো বেগমসায়েবার মতোই ভাবব।

এখন সিরাজই সব কাজ চালায়। নবাব শুধু পরামর্শ দেন। সিরাজকে তিনি বলেন, ‘ভালোই হলো রে দাদু, হাতেনাতে শিখে নে। এমন সুযোগ আর ক’জন পায়?’

‘এমন শেখায় আমার কাজ নেই।’ সিরাজের চোখ ছলছল করে।

‘সেকি রে, তুইও কাঁদছিস? হা আল্লা! এমন নরম মন নিয়ে নবাব হবি?’

‘আমি কাঁদছি কে বললে? রাগলে আমার চোখে জল আসে।’

‘আবার রাগ হল কেন?’

‘হবে না? স্বাস্থ্য তোমার একটু খারাপ হয়েছে। এমন হয়েই থাকে। তাতে অত মরার কথা কেন? ঘুরেফিরেই তো বেড়াচ্ছ। শয্যাশায়ী হলেও না হয় কথা ছিল।’

‘রোগটা বড় খারাপ রে! এই যে পা দেখছিস, কেমন ফোলা ফোলা ভাব, হাকিমরা বলে, এই পা পচে উঠবে।’

‘সে কী!’

‘হ্যাঁ। বর্গির সঙ্গে যুদ্ধের ফল। হাঁটুর নিচেটা কেটে গিয়েছিল। একজন অচেনা হাকিম এসে কতকগুলো লতাপাতা দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল জায়গাটা। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে ব্যথা হয় আর ফুলে যায়।’

‘ভালো করে চিকিৎসা করাও।’

‘চিকিৎসা গোড়া থেকেই হচ্ছে। এখন চিকিৎসার বাইরে চলে যাচ্ছে যে। তাই তো বলি, শিখে নে।’

সিরাজ গম্ভীর হয়ে বসে থাকে।

.

ঘসেটি হঠাৎ একদিন নবাব মহল ছেড়ে চলে যায়। সে মতিঝিলে গিয়ে ওঠে। সেখানেই বসবাস করবে।

মুর্শিদাবাদের বেহেস্ত মোতিঝিল। একবার শুধু গিয়েছিলাম সেখানে। কিন্তু সে-ছবি এখনো আমার মনের মধ্যে তেমনি স্পষ্ট, তেমনি উজ্জ্বল হয়ে আছে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি মোতিঝিলকে। তার সাজানো বাগিচা আর অশ্বপদক্ষুরাকৃতি ঝিল যেন বেহেস্তের মায়া রচনা করে স্বপ্নের মধ্যে। আবার দেখবার ইচ্ছা হয়েছে কতবার, কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ঘসেটি বেগম সেই মোতিঝিলকে নিজের করে নিল।

ইরাজ খাঁর কন্যা ভীষণ চটে গেল একথা শুনে। সবাইকে বলে বেড়াতে লাগল, ঘসেটির অধিকার নেই মোতিঝিলে বাস করবার। ওটা নবাবের প্রমোদ উদ্যান।—খাস নবাবের অধীনে। ইরাজ খাঁর কন্যা হয়তো ভুলে গিয়েছিল যে, সিরাজ সবকিছু করলেও বাংলার মসনদে এখনো নবাব আলিবর্দিই রয়েছেন। তিনি যদি তাঁর কন্যাকে মোতিঝিল দান করেন, কারও ক্ষমতা নেই কিছু বলার।

সিরাজ এসে বলে, ‘আমি এ রকমই অনুমান করেছিলাম, লুৎফা।’

‘কীসের অনুমান?’

‘নওয়াজিস আর ঢাকায় থাকতে পারবে না।’

‘কেন?’

‘সে হয়তো থাকত সেখানে, কিন্তু ঘসেটি বেগম তাকে থাকতে দেয়নি। টেনে নিয়ে এসেছে মুর্শিদাবাদে।’

‘এখানে টেনে নিয়ে এসে লাভ?’

‘তুমি বড় অল্প বোঝ, লুৎফা।’

‘আমাকে বুঝিয়ে দেবে না?’

‘দেব। দাদু অসুস্থ। ভালোমন্দ একটা কিছু যখন তখন হতে পারে। শেষ চেষ্টা করতে হবে না?’

‘কীসের চেষ্টা, নবাবজাদা?’

‘নাঃ, তোমাকে খুলে না বললে হবে না দেখছি।’

‘খুলেই বলো।’

‘ঘসেটি বেগম নওয়াজিসকে নবাব করার শেষ চেষ্টা করবে একবার।’

‘কী সর্বনাশ!’ আমার গলা কেঁপে ওঠে।

‘এতে আর সর্বনাশের কী হল? সবাই এমন করে থাকে। আমি নবাব না হতে পারলে আমিও করতাম। ঘসেটির দোষ কী হবে? সব দেশের মসনদের সঙ্গেই এ রকম ইতিহাস জড়িত। নতুনত্ব কিছু নেই। তবে ঘসেটি একটু বাড়াবাড়ি করছে। রাজবল্লভ আর জগৎশেঠকে দলে টানার চেষ্টা করছে। রাজবল্লভ বড় চতুর লোক। ঢাকায় নওয়াজিসের সমস্ত ক্ষমতা সে নিজের মুঠোয় নিয়েছে। নওয়াজিসকে নবাব করতে পারলে সেই হবে প্রকৃত নবাব। কিন্তু তবু তাকে আমি এতটা ভয় পাইনে, যতটা জগৎশেঠকে। ও লোকটা যদি ঘসেটির দলে যায়, তাহলে টাকা-পয়সা দিয়ে অনেক কিছু ঘটনা ঘটাতে পারে।’

‘সে রকম ঘটনা যাতে না ঘটে এখন থেকে সেই চেষ্টা করো।’ আমি উৎকণ্ঠিত হই।

‘চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। ওরা ভোলবার পাত্র নয়।’

‘মির বকসীকুলের খবর কী?’ তাঁর সম্বন্ধে কিছু কিছু কথা আমার কানে আসছিল।

সিরাজ বিস্মিত হয়ে বলে, ‘তুমি কী করে জানলে!’

‘হারেমে থাকলে কি কিছুই জানতে নেই?

‘সেটাই তো স্বাভাবিক। ‘

‘বেগমসায়েবা তো সব জানেন।’

দাদি অন্য ধাতুতে গড়া।’

‘আমিও সেই ধাতুতে নিজেকে ডুবিয়ে নেবার চেষ্টা করছি।’

সিরাজ হেসে বলে, ‘ভালো। পারলে সত্যিই ভালো। জাফর আলি খাঁর ওপর আমার নজর আছে, লুৎফা।’

‘কিন্তু…’

‘ওসব কথা থাক। এখন একটা কাজের কথা বলি। মোতিঝিল তো নওয়াজিস খাঁ নিয়ে নিল। আমার ও রকম একটা ঝিল না হলে যে চলবে না।’

‘কী করে নেবে ওটা?’

‘ওটা নেবার দরকার নেই। আমি নতুন ঝিল তৈরি করব নদীর ওপারে।’

‘টাকা?’

‘সে ব্যবস্থা করতে হবে। আদত কথা হল দাদুর সম্মতি আদায় করা। সেটা হয়ে গেলে টাকার জন্যে ভাবতে হবে না। এই পুরোনো জায়গায় থাকতে ইচ্ছা হয় না, লুৎফা। নতুন জায়গায় গিয়ে থাকব শুধু তুমি আর আমি।’

‘কবিত্বটা কি ঘসেটি বেগমের ওপর ঈৰ্ষাবশে?’

‘না, অনেকদিন থেকেই মনের মধ্যে সাধ ছিল। মোতিঝিল বেদখল হওয়ায় মনের সেই সাধ তাড়াতাড়ি বাস্তব রূপ নেবে।’

‘তোমার ঝিলের নাম কী রাখবে?’

‘লুৎফা-ঝিল।’ সিরাজ হেসে ওঠে।

‘না-না, আমি ঝিল হতে চাই না। আমি নির্জলা লুৎফাই থাকতে চাই।’

‘সম্রাট শাহজাহান মমতাজকে কেমন অমর করে রেখে গিয়েছেন।’

শাহজাহানের পুরুষোচিত বীরত্ব ছিল না বলে ওই পথ ধরেছিলেন।’

সিরাজ আমার কাছ থেকে ঠিক এ জাতীয় জবাব আশা করেনি। তাই কেমন একটা থতমত ভাব দেখলাম তার আচরণে।

আমি এগিয়ে গিয়ে তার বুকে মাথা রেখে বলি, ‘আমি চাই না, তুমি আর আমি লুৎফা-ঝিলের মধ্যে বেঁচে থাকি। তার চেয়ে তুমি এমন একজন নবাব হও, যাতে তোমাকে কেউ কোনোদিন না ভোলে। তুমি যদি সেভাবে অমর হও, তাহলে আমি তো তোমার সঙ্গেই বেঁচে থাকব। আমি যে তোমার প্রাণের আধখানা।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিরাজ বলে, ‘সেই ভালো লুৎফা, আমি সেইভাবেই অমর হবার চেষ্টা করব। কিন্তু ঝিলের একটা নাম তো রাখতে হবে।’

‘এপাড়ে রয়েছে মোতিঝিল, তোমারটা হবে হীরাঝিল।’

‘হীরাঝিল! হীরাঝিল! বাঃ, সুন্দর! কী সুন্দর নাম দিলে তুমি! তাই হবে—হীরাঝিল।’

সিরাজ ছুটতে ছুটতে চলে যায়। যেন এখনই তৈরি হয়ে যাবে হীরাঝিল। পাগলের দিকে চেয়ে তৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে।

.

হীরাঝিল তৈরি হয়ে গেল। মোতিঝিলের চেয়েও নাকি সুন্দর হয়েছে দেখতে।

মোতিঝিলের গর্ব খর্ব করার জন্যেই যেন তারই অপর পাড়ে উদ্ধত সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠল হীরাঝিল।

নবাব আলিবর্দিকে সিরাজ একদিন বলল, ‘দাদু, একটা কথা আছে।’

‘কী হল আবার?’

‘না, হয়নি কিছু। কিন্তু যা বলব তা কি তুমি মেনে নেবে?’

‘অসংগত না হলে মেনে নেব বৈকি।’

‘সেই ভরসাতেই তো এসেছি।’

‘ঢের হয়েছে। এখন কথাটা বলেই ফেলো তো ধন।’ নবাবের মুখে হাসি।

আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনি। আমি জানি, সিরাজ কী বলতে এসেছে। যা বলতে এসেছে তাতে আমার মত নেই। তবে ওর উৎসাহ দেখে বাধা দিতে পারিনি। বলেছিলাম, নবাবের সম্মতির প্রয়োজন। তাই সিরাজ এসেছে নবাবের কাছে। আমার ধারণা, নবাব কখনওই সম্মত হবেন না সিরাজের এই আবদারে।

সিরাজ বলে, ‘হীরাঝিল তৈরি হয়ে গিয়েছে।

‘শুনলাম। ঘসেটি তো রেগেই আগুন।’

‘অনেকেই রাগবে, তার জন্যে কিছু এসে যায় না। আমার দাদু না রাগলেই হল।’

‘এত ভেজা-ভেজা কথা কেন? শুনে যে বড় ভয় হচ্ছে। কী মতলবে এসেছ বলেই ফেলো?’

‘আমি হীরাঝিলে থাকব।’

নবাবের মুখ এতটুকু হয়ে যায়। তাঁর দৃষ্টিতে অসহায় ভাব। কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না, যেন তাঁর বুক শূন্য হয়ে যেতে বসেছে। সিরাজের কথার কোনো জবাব দিতে পারেন না তিনি

সিরাজ তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে বলে, ‘দাদু, হীরাঝিলে থাকতে আমারও খুব ভালো লাগৰে না। কিন্তু এত কষ্ট করে তৈরি করলাম থাকতে সাধ হয়।’

নবাব আরও অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসেন। বলেন, ‘হুঁ, বুঝলাম। বেশ, তুমি হীরাঝিলে থাকো, কিন্তু বুড়োর কথাটা মনে রেখো।’

কাজ হাসিল করে নিলেও দাদুর কথা শুনে সিরাজের চোখ সজল হয়ে ওঠে। সে বলে, ‘তোমাকে কষ্ট করে মনে রাখতে হয় না, দাদু। তোমার কথা মনের মধ্যে সব সময়ই গেঁথে থাকে।’

আলিবর্দির মুখে হাসি ফোটে। তিনি বলেন, ‘তাই নাকি? আমি জানতাম, বুড়োদের কথা কেউ মনে রাখে না। বুড়োদের স্নেহও লোকে বিদ্রুপের চোখে দেখে। তোমার কথা শুনে যেন বল পাচ্ছি মনে। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে সাধ হচ্ছে।’

‘কথায় কথায় অত মৃত্যুর কথা ভাব কেন? বেশ তো আছ, ভেবে-ভেবেই তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

‘না ভেবে করি কী? পায়ের অবস্থা দেখেছ? আলিবর্দি পায়ের ওপর থেকে একটা আলগা কাপড় তুলে নেন। চমকে উঠি দূর থেকে। কী বীভৎস চেহারা হয়েছে পায়ের! সিরাজ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

‘দেখলে তো? এরপরেও বলবে আমি বেঁচে থাকব?’

সিরাজ নিশ্চুপ। বলার কিছু নেই তার। দাদুর আয়ু সম্বন্ধে এতদিনে সে প্রথম সচেতন হল। আরও কিছুক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে চলে আসে।

.

শুধু আমাকেই সিরাজ হীরাঝিলে নিয়ে এল। অন্যান্য বেগমরা পড়ে থাকল পুরোনো মহলে। ভেবে সঙ্কুচিত হই আমি। সিরাজকে বলেছিলাম, ওদেরও নিয়ে আসতে। অন্তত ইরাজ খাঁর কন্যাকে। সে শোনেনি।

মাস দুয়েক না যেতেই আর এক সমস্যা দেখা দিল সিরাজের মনে। হীরাঝিল তৈরি করতে জলের মতো টাকা খরচ হয়েছিল। কিন্তু তার তত্ত্বাবধানের জন্যেও যে মোটা অঙ্কের টাকার প্রয়োজন, এ ধারণা তার ছিল না। অসংখ্য ঘরের অপূর্ব মহল তৈরি করে সিরাজ যে-আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল, সে এখন আর-এক গোলকধাঁধায় পড়ে ঘুরতে লাগল।

‘কী করি লুৎফা?’

‘আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘এ যে জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। কী ব্যবস্থা করি?’ সে অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। শেষে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলে, ‘ঠিক, পেয়ে গিয়েছি।

‘কী পেলে আবার?

‘উপায়।’

‘কীসের উপায়?’

‘হীরাঝিলকে টিকিয়ে রাখার উপায়।

তাই নাকি? শুনতে পাব কি?’

‘উঁহু, এখন না। কালকে নিজের চোখে দেখো। হীরাঝিলের গোলকধাঁধা আমার টাকার উপায় করবে।’

‘সে আবার কী কথা? একটা গোলকধাঁধা তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে অর্থের সমাধান কী করে হবে?’

‘এখন কিছুতেই ভাঙছি না। শোনো, কালই দাদুকে নিয়ে আসব এখানে। সেই সঙ্গে জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ সবাই আসবেন। আমার হীরাঝিল দর্শনের আমন্ত্রণ জানাব তাঁদের।’

‘হঠাৎ?’

‘বাঃ, কেউ তো দেখেনি এখনো। তাঁদের দেখাতে হবে তো।’

‘কিন্তু শুধু কি দেখানোর জন্যে তাঁদের ডেকে আনছ? তোমার চোখে কীসের এক অভিসন্ধি খেলে বেড়াচ্ছে যে।’

সিরাজ হেসে ওঠে, ‘ঠিক ধরেছ, লুৎফা। কিন্তু এমন কিছু দুরভিসন্ধি নয়, সামান্য কৌশলমাত্ৰ কালই জানতে পারবে।’

.

পরদিন সবাই এলেন। সিরাজ ঘুরে ঘুরে তাঁদের সব দেখাতে লাগল। ছাদের গুপ্তপ্রকোষ্ঠে বসে আমি দেখতে থাকি। তাঁদের হাবভাব আর হাত নাড়া দেখে বুঝলাম, সবাই খুব বিস্মিত হয়েছেন। নবাব আলিবর্দি খুঁড়িয়ে চলতে চলতেই যেভাবে হাসছেন আর সিরাজের পিঠ চাপড়াচ্ছেন তাতে অনুমান করলাম, তিনি খুশি হয়েছেন। ঝিল দেখার পর বাগিচার মধ্যে অনেকক্ষণ বেড়ালেন তাঁরা। তারপর সিরাজ তাঁদের মহল দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখানে নিয়ে আসে।

আমিও সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে গিয়ে একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে দাঁড়িয়ে থাকি। সিরাজ কী কৌশল প্রয়োগ করে দেখার জন্যে উদগ্রীব হই।

সবাইকে সিরাজ গোলকধাঁধার সামনে এনে হাজির করে। সবাই একসঙ্গে যেতে চাইলে সিরাজ বলে, ‘আপনারা অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। একে-একে ভেতরে যাবেন। নবাব থেকে শুরু হোক।’

‘বেশ, তাই হোক।’ নবাব হাসতে হাসতে প্রবেশ করলেন। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। সিরাজও। অনেকক্ষণ কেটে যায়, কিন্তু নবাব আর ফেরেন না। ওরা সবাই চঞ্চল হয়ে ওঠেন।

রাজবল্লভ প্রশ্ন করেন, ‘নবাব ফিরছেন না যে?’

সিরাজ বলে, ‘ধাঁধায় পড়েছেন বোধহয়।

জগৎশেঠ মুখ গম্ভীর করে বলেন, ‘তাঁকে বাইরে নিয়ে আসা উচিত। এটা গোলকধাঁধা জানলে আমি কিছুতেই তাঁকে প্রবেশ করতে দিতাম না।’

উনি নাতির কাছে এসেছেন আনন্দ করতে’, সিরাজ বলে।

তবু বুড়ো মানুষ। পায়ের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, সেটাও তো ভাবা উচিত।’

‘দেখাই যাক না, একা উনি বাইরে আসতে পারেন কি না। যদি বাইরে আসেন তাহলে

এ ঘর আবার ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা হবে।’

ইতিমধ্যে নবাবের উচ্চকণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে কানে ভেসে আসে, কই দাদু, আর তো পারি না। এবারে বার করে দাও আমাকে। ঘুরতে ঘুরতে যে তেষ্টা পেয়ে গেল।’

‘আর একটু চেষ্টা করো।’ বাইরে থেকে সিরাজ চেঁচায়।

‘অনেক চেষ্টা করেছি, এখন বসে পড়েছি। চেষ্টা করার আগে নবাব আলিবর্দি কথা বলে না।

‘তাহলে তুমি আমার কাছে বন্দি, একথা স্বীকার করো।’

জগৎশেঠ, উমিচাঁদ আর রাজবল্লভ সবাই চমকে ওঠেন। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নেন। রাজবল্লভের কোমরে খরশান ঝনঝন করে ওঠে। সিরাজ সে-শব্দ শুনে একবার বাঁকা চোখে সেদিকে চেয়ে হেসে ফেলে।

ভেতর থেকে নবাবের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘তোমার কাছে তো আমি চিরদিনই বন্দি।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, বন্দি।’

মুক্তিপণ দিলে মুক্তি পাবে।’

‘কী মুক্তিপণ চাও?’

হীরাঝিলের আশেপাশের গঞ্জ থেকে যে নজরানা আদায় হবে, সেই নজরানায় হীরাঝিলের খরচ চলবে।’

‘বেশ, তাই হবে। এবার ছেড়ে দাও।’

অত সহজে কি ছাড়া যায়, দাদু। ভবিষ্যতের ব্যবস্থা তো করলে, কিন্তু এখন কী দেবে?’

‘এখন আবার কী চাও?’

‘বাঃ! এত বড় যোদ্ধা হয়ে যুদ্ধের নিয়মকানুন ভুলে গেলে?’

‘তোমার মতলবটা তাড়াতাড়ি বলো, আমার পায়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে।’

সিরাজের ওপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কিছুদিন আগে নবাবের পায়ের যে ভয়াবহ অবস্থা দেখেছিলাম, এখন নিশ্চয়ই তার চেয়ে আরও অবনতি হয়েছে। এই অসুস্থ বৃদ্ধের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর খেলায় কেন যে সে মত্ত হল?’

সিরাজ বলে, ‘যুদ্ধশাস্ত্রে নগদ অর্থই একমাত্র মুক্তিপণ, দাদু।’

আমার কাছে কিছুই নেই।’ নবাবের কণ্ঠস্বর আর্তনাদের মতো শোনায়

বাইরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা রাগে কাঁপতে থাকেন। তবু সিরাজ অবিচল।

সে বলে, ‘তোমার সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁদের সঙ্গে কিছু অর্থ রয়েছে নিশ্চয়। তাঁদের বলো।’

‘আচ্ছা, তাই বলো তাঁদের।’

যাঁর কাছে যা ছিল, সবাই বার করে দিলেন সিরাজের সামনে। জগৎশেঠ তাঁর হাতের বহুমূল্য অঙ্গুরীয়টি পর্যন্ত খুলে দেন।

সিরাজের মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটে। সে ছুটে গিয়ে দাদুকে বার করে নিয়ে আসে। নবাব সিরাজকে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকেন। এতক্ষণ যেন মজার খেলা হচ্ছিল, হেরে গিয়েছেন তিনি নাতির কাছে।

নবাব বলেন, তুমি আজ জিতে গেলে। তাই যে গঞ্জের নজরানায় হীরাঝিলের খরচ চলবে তার নাম থাকবে মনসুরগঞ্জ।’

সিরাজ হাসে—খুব হাসে। তার কৌশল সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। আমার কিন্তু এ কৌশল ভালো বলে মনে হল না। এতে উপস্থিত যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এঁরা সবাই বাংলার এক-একটি দিকপাল। নবাব হবার আগেই তাঁদের এভাবে চটিয়ে দেওয়া সিরাজের পক্ষে উচিত হল না।

সিরাজ তাঁদেরও বলে গোলকধাঁধায় প্রবেশ করতে। কিন্তু তাঁরা সম্মত হলেন না। তাঁরা নবাবকে নিয়ে হীরাঝিল ছেড়ে চলে গেলেন।

থামের আড়াল থেকে সিরাজের সামনে গিয়ে হাজির হই। সহসা আমাকে দেখে সে চমকে ওঠে, ‘একি! কোথায় ছিলে তুমি?’

আঙুল দিয়ে থামটা দেখিয়ে দিই।

‘ও, তুমি সব দেখেছ। কেমন মজা দেখলে তো?’

‘দেখলাম। তোমার বুদ্ধি আছে বটে, কিন্তু কাজটা কি ঠিক হল?’

‘কেন? দাদু তো খুশি হয়েছেন।’

‘দাদু খুশি হয়েছেন জানি, কিন্তু সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা তো দাদু নন। তোমার কৌশলকে দাদুর দৃষ্টিতে তাঁরা দেখেননি।’

‘না দেখল তো বয়ে গেল।

‘না নবাবজাদা, বয়ে যাবে না। ওঁরাই তোমার আশা-ভরসা। এখন থেকে ওঁদের হাতে রাখো।’ তুমি মাঝে মাঝে কী যে বলো আমি বুঝতে পারি না, লুৎফা। ওরা বিরুদ্ধতা করলে ভয় পাবার কী আছে?’

‘সে আমি জানি না, কিন্তু নবাব যখন তাঁদের অত সম্মান করেন, তখন নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। নবাব মূর্খ নন। অপরিণামদর্শী তো ননই।’

আমার কথায় সিরাজ একটু গম্ভীর হল। আমার পিঠের ওপর আলগোছে একটি হাত রেখে বলে, ‘তোমার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ওসব ভাবনা পরে হবে। এখন এসো, একটু আনন্দ করা যাক। আজকে হীরাঝিলের বরাত খুলেছে।’

সে আমাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে। ঝিলের পাশে ফুলগাছের শোভা। ঝিলের জলে ছোট্ট একখানা রঙিন বজরা ঢেউ-এর তালে তালে দুলছে। সে আমাকে নিয়ে সেই বজরায় ওঠে।

স্বপ্নের ঘোরে সময় কাটে। তীরে গিয়ে যখন উঠলাম, তখন রাত অনেক। হীরাঝিলের মহলে তখন হাজার বাতির শোভা। কত বিচিত্র রং সে-আলোর। হীরাঝিলের স্রষ্টার মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকি।

কিন্তু বেশিদিন নয়।

নিদারুণ ভাবে ভেঙে যেতে শুরু হল হীরাঝিলের সুখস্বপ্ন। ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করায় বেগমসায়েবা সিরাজকে আমার কাছ থেকে একবার ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তিনি ব্যর্থও হয়েছিলেন। কিন্তু হীরাঝিলের তুষারধবল মহল, তার শ্যামল বাগিচা আর স্বচ্ছ জল, এক কুহকিনীর মায়া বিস্তার করে সিরাজকে বিপথে চালিত করল। হীরাঝিল শুধু নির্জীব পাষাণ নয়, তার মধ্যে আমি শুনতে লাগলাম ডাইনির অট্টহাসি।

আমার সিরাজ দূরে সরে যেতে থাকে। দূরে, অনেক দূরে…আমি নাগাল পাই না। এখানে আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। অথচ সিরাজ কতদিন আমার কাছে আসেনি। আমাকে সে ভুলে গিয়েছে।

পাষাণের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদি, মাথা কুটি, কিন্তু কোনো ফল হয় না। নবাব আলিবর্দির প্রভাব থেকে বাইরে চলে এসে সে এখন বেপরোয়া। সারা দিনরাত সে শুধু শরাব খায়, বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করে, নর্তকী নিয়ে এসে নাচ দেখে। আবার সেই নর্তকীর সঙ্গে রাতও কাটায়। প্রতিদিনের প্রতীক্ষা শুধু ব্যর্থ হয় আমার।

সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে হয়। বেগমগিরি আর ভালো লাগে না। আমি জারিয়া ছিলাম, আবার জারিয়া হব। আমি ঘসেটি বেগমের পদাঘাত সহ্য করব। আমি হামিদার অবহেলায় কিছু মনে করব না। আল্লা, আমাকে আবার জারিয়া করে দাও। আমি আর পারি না। আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব আর আমার নেই, এখন শুধু নিরাশার অন্ধকার।

তবু একদিন সিরাজ এল আমার কাছে। চোখ লাল, মুখে অনাচারের ছাপ, অঙ্গ শিথিল। আমি তার মুখের দিকে চাইতে না পেরে মাথা নিচু করি। সে বোধহয় আমাকে আজ তাড়িয়ে দেবে হীরাঝিল থেকে। আমি এখানে থাকায় তার অসুবিধা হচ্ছে। সে চায় নিশ্চিত হতে। আমি বাধা সৃষ্টি না করলেও, ওর অবশিষ্ট বিবেকটুকুর জন্যে মনের মধ্যে সম্ভবত খচখচ করছে, আমার চোখের সামনে অনাচারের স্রোতে এভাবে গা ভাসিয়ে দিতে।

হীরাঝিল থেকে বিদায় নেব। ‘হীরাঝিল’ নামটা আমিই দিয়েছিলাম না? সিরাজকে বলব নাকি সেটা পালটে দিতে? তাহলে বিবেকের আর কোনো দংশনই থাকবে না তার। ও নাম মুছে যাক মুর্শিদাবাদের বুক থেকে—বাংলার ইতিহাস থেকে। সেই সঙ্গে বেগম লুৎফার নামও মুছে যাক।

‘নবাবের ওখানে যেতে হবে, লুৎফা।’ গম্ভীর স্বর সিরাজের। গলাটা কেমন যেন ভারাক্রান্ত। শত হলেও সঙ্কোচ বলে একটা জিনিস আছে তো। এতদিন কত কথাই শুনিয়েছে—কত মধুর কথা।

নবাব মহলে যাবার জন্যে অনেকদিন থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সিরাজের মুখ থেকে স্পষ্ট শোনার পর আমার চোখের জল কিছুতেই বাধা মানল না। শত চেষ্টাতেও বন্ধ করতে পারলাম না সেই অবাধ্য জলরাশি। সে আমাকে চায় না, তার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদা বিড়ম্বনা। সিরাজ হয়তো ভাবছে, তার মন গলানোর জন্যে আমি চিরাচরিত পথ ধরেছি। কিন্তু আমি তো জানি তা নয়—কিছুতেই নয়। আমি চলে যেতেই চাই, বুক আমার ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। এখন আমার কাছে হীরাঝিলও যা, নবাব মহলও তাই। আমি তো তার মতো নিত্য নতুন লোক নিয়ে বুক ভরাতে পারব না। আমার বুকে যে শুধু একজনই রয়েছে, যার কাছে আজ আমার আর বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। আগে কেন আমি মরে যাইনি?

সিরাজ আবার বলে, ‘নবাব মহলে যেতে হবে, লুৎফা’

‘আমি তা জানি।’

‘জানো! কোথায় শুনলে?’

এত দুঃখেও হাসি পেল। এ জানতে কি আর মুখের স্পষ্ট কথা শুনতে হয়? অনেক কিছুই বলতে পারতাম। কিন্তু বলে কী লাভ? চুপ করে থাকি।

‘এখনই যেতে হবে, লুৎফা।’

‘এখনই? এত তাড়াতাড়ি? সমস্ত জিনিস এখানেই থাক, নবাবজাদা। সামান্য দু’একটা পোশাক নিয়ে যাচ্ছি।’

‘কিছুই নিতে হবে না।’ সে অধৈর্য হয়।

‘চলুন তাহলে, আমি তৈরি।’

তার সঙ্গে ঘর থেকে বাইরে আসি। আবার তাহলে জারিয়াই হতে চলেছি। মন্দ কী?

‘তুমি কার কাছে শুনলে, লুৎফা? খবরটা তো আমিই প্রথম পাই।’

‘আমি…আমি কোনো খবর পাইনি, নবাবজাদা।’

‘একটু আগেই যে বললে শুনেছ।’

‘কোনো খবরের কথা তো আমি বলিনি?’

‘দাদুর অবস্থা খারাপ, তুমি শোনোনি?’

আমি চমকে উঠি, বলি, ‘শুনিনি তো!’

‘ও বুঝেছি।’ কী বুঝল সেই জানে। ক্লান্ত পা ফেলে সে এগিয়ে চলে।

.

নবাবের ঘরের আবহাওয়া থমথমে। বেগমসায়েবা একপাশে বসে রয়েছেন। তিনজন হাকিম নবাবের শিয়রে। আট-দশজন জারিয়া ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করছে। হামিদাকে দেখলাম তাদের মধ্যে। সে দূর থেকে আমাকে দেখে একটু হেসে নত হল। আমিও হাসলাম। ভাবলাম, এরা কত সুখী!

সিরাজ ঘরে ঢুকেই ছুটে গিয়ে নবাবের শয্যার সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়ে। নবাব তার পিঠে হাত রেখে অল্প একটু হাসেন।

সিরাজ বলে, ‘এখন ভালো আছ, দাদু?’

‘হ্যাঁ।’ তিনি হাকিমদের দেখিয়ে বলেন, ‘এঁরা বলছেন, আমি এত তাড়াতাড়ি মরব না, আরও কিছুদিন ভুগব। তোমার নবাবি পেতে একটু দেরি হবে।’

‘এমন কথা বলো না, দাদু, আমি নবাবি চাই না, যাকে ইচ্ছে দাও। শুধু তুমি ভালো হয়ে ওঠো।’

নবাব আলিবর্দির চোখে জল দেখলাম। তিনি বললেন, ঠাট্টাও বুঝতে শেখোনি পাগল।’

‘তোমার জীবন নিয়ে ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না। অন্য কথা বলো।’

‘বেশ, কী কথা বলব?’

‘তোমার যা ইচ্ছে।’

‘কাল ফোর্থ সায়েব এসে পরীক্ষা করে যখন বলল যে, আমি আর বাঁচব না, তখন সত্যিই ভয় হয়েছিল। মরতে যে এত ভয় হয় জানতাম না।’

‘ফোর্থ সায়েব হঠাৎ এল কেন?’

‘কেন, সে তো রোজই আসে। অনেকক্ষণ বসে থাকে। খুব ভালো হাকিম যে।

‘সেইজন্যেই বলল বুঝি, তুমি মরে যাবে?’ সিরাজের স্বরে বিদ্রুপ। সে নবাবের শিয়রে উপবিষ্ট হাকিমদের বলে, ‘আপনাদের কী মত?’

একজন বলে, ‘আমরা তো বলেছি আরও কিছুদিন নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’

‘তবে ফোর্থ সায়েব একথা বলে কেন? তার সঙ্গে কি নবাবের রোগ সম্বন্ধে আপনাদের কোনো আলোচনা হয়েছে?’

‘না। সে কখন ও-কথা বলেছে তাও আমরা জানি না।’

‘বুঝলে দাদু?’ সিরাজ ঘুরে নবাবের দিকে চেয়ে বলে।

‘কী?‘

‘ফোর্থ সায়েবের কোনো উদ্দেশ্য আছে।’

‘নবাবিটা তুমি ঠিক চালাতে পারবে সিরাজ। ‘

‘এতদিন সন্দেহ ছিল নাকি?’

‘সন্দেহ এখনো সামান্য রয়েছে। তবে তোমার বুদ্ধি আর চতুরতার প্রমাণ এমন ছোটোখাটো ঘটনায় প্রায়ই প্রকাশ পায়।’

‘ফোর্থ সায়েবকে আর আসতে দিও না, দাদু। এখানে এসে হাকিমি করার অছিলায় নানান কথাবার্তা শোনার সুযোগ পায় সে। তুমি শয্যাশায়ী হলেও বাংলার নবাব। দেশের যাবতীয় আলোচনা এখানেই হয়।

শাবাশ!’ আলিবর্দি একটু জোর গলাতেই বলে ওঠেন।

‘এখনই এতটা প্রশংসা কোরো না। আর একটা কথা বলে নিতে দাও। তাতে তুমি যে সম্মতি দেবে না, তা আমি জানি। তবু বলা উচিত বলেই বলছি।

‘বলো।’

ইংরেজরা যে সোজা লোক নয়, সে-কথা তুমি বার বার বলেছ। তারা একদিন বাংলার বিপদ আনবে একথা তোমারই মুখে শোনা। আমারও বিশ্বাস তাই। ওদের বসতে দিলে ওরা শুতে চায়। তুমি বেঁচে থাকতেই তাই ওদের খতম করতে চাই। হুকুম দাও, আর পরামর্শ দাও।’

‘তোমার মত খুবই সুচিন্তিত সিরাজ, কিন্তু আমি সম্মতি জানাতে পারছি না। পারছি না বলে আমার দুঃখ তোমার চেয়েও বেশি। কিন্তু কী করব বলো। বর্গিদের মাথা ভেঙে দিলেও ওদের অত্যাচারের আগুন এখনো সম্পূর্ণ নিভে যায়নি। এর মধ্যে আবার সমুদ্রের জাহাজ থেকে অগ্নিবৃষ্টি হলে আর এক অশান্তি। তার চেয়ে বলি কি, দেশটা একটু সামলে উঠুক। কিছুদিন শান্তি ভোগ করুক সবাই। তাহলে শত্রুর ওপর নতুন শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারা যাবে। ততদিন আমি বাঁচব না, কিন্তু তুমি তো থাকবে।’

সিরাজ চুপ করে বসে থাকে। সে যেন নবাবের কথায় প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু নবাবের যুক্তি একেবারে উড়িয়েও দিতে পারে না। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বেশ, তাই হবে।

‘চললে কোথায়? ‘

সিরাজ থতমত খেয়ে আবার বসে পড়ে। বোকার মতো বলে, ‘না, এই একটু বাইরে যাচ্ছিলাম।’

নবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে তন্নতন্ন করে দেখেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘আমি জানি, তুমি কেন উঠেছিলে।’

‘জানো!’ সিরাজ অবাক হয়

‘হ্যাঁ। শোনো দাদু, বুদ্ধি আর সাহস অনেক নবাবের থাকে। আমার আগের নবাব সরফরাজের সাহসের অভাব ছিল না। কিন্তু তাঁর সময়ে দেশে কেন অশান্তি দেখা দিল? কেন প্রজারা তাঁকে চাইল না?’

‘কেন?’

‘বলছি।’ নবাব সকলকে ঘরের বাইরে যেতে ইঙ্গিত করলেন। সেখানে শুধু বসে থাকলাম আমি, বেগমসায়েবা, আর সিরাজ।’

নবাব বললেন, ‘সরফরাজ বিলাসিতায় বড্ড বেশি গা ভাসিয়েছিলেন। বেগমদের তুষ্ট করতেই তাঁর সময় চলে যেত। দেশের দিকে তাকাবার অবসর থাকত না।’

‘আমাকে তুমি সেরকম ভাবো নাকি?’ অভিমান করে সিরাজ।

‘আমার ভাবায় কী আসে যায়? তবে এ সবের মূলে একটা জিনিসই রয়েছে, সেটা হল শরাব। একবার যদি শরাব ধরা যায়, যদি তোমার ভেতরের আসল মানুষটিকে শরাব একবার কিনে নিতে পারে, তাহলে কোনো কিছুতেই আর ভেতরের সেই মানুষটিকে উদ্ধার করতে পারে না। তখন নানা দোষ এসে দেখা দেয়। সরফরাজের মধ্যেও সেই দোষগুলো প্রকট হয়ে উঠেছিল।’

আলিবর্দি হাঁপাতে থাকেন। তিনি দম নেন। ঘরে কোনো শব্দ নেই। সিরাজের মুখ ছাইয়ের মতো সাদা। সে কপালে হাত রেখে চুপ করে বসে থাকে।

নবাব আবার বলেন, ‘আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে।’

‘বলো।’

‘হীরাঝিলে তুমি কি করো, সে খবর আমি পাই। তোমাকে আজ একটা ভীষণ প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’

‘আমি প্রস্তুত দাদু।’ সিরাজের কথায় দৃঢ়তা।

নবাব তাঁর মাথার কাছ থেকে কোরানখানা সিরাজের হাতে দিয়ে বলেন, ‘এবারে বলো আর কোনোদিন শরাব স্পর্শ করবে না।’

‘পবিত্র কোরান ছুঁয়ে বলছি আর কোনোদিন শরাব স্পর্শ করব না।’ একটু হেসে সে আবার বলে, ‘কিন্তু দাদু, কোরানের প্রয়োজন ছিল না। তোমাকে কথা দেওয়া কি কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞার চেয়ে কম?’

নবাবের চোখে আনন্দাশ্রু দেখা যায়। তিনি কোনো কথা বলতে পারেন না। শুধু দু’হাতে সিরাজকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে আনেন। ছোট্ট ছেলের মতো সিরাজও তাঁর বুকের ওপর মাথা রেখে স্থির হয়ে থাকে।

আমার মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে। গা বমিবমি করে। ঘামে আমার কপাল ভিজে যায়। বেগমসায়েবা বসেছিলেন। শক্ত করে তাঁর হাত চেপে ধরি।

‘একি লুৎফা, অমন করছ কেন?’ তাঁর স্বরে বিরক্তি।

‘আমার শরীর কেমন করছে।’

‘সে কী! আমাকে ছাড়ো দেখি, কাউকে ডেকে আনি। তোমাকে বেগম মহলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেবে।’

‘হামিদাকে ডাকুন’, কোনো রকমে বলি। আগে হামিদা আমাকে হিংসে করলেও সে ভালো।

তার ভেতরে স্নেহ আছে।

হামিদার সঙ্গে বেগম মহলে গিয়ে বমি করে ফেলি, ‘আমি আর বাঁচব না, হামিদা।’

‘অমন কথা মুখে আনতে নেই। অসুখ হয়েছে সেরে যাবে।’

‘না-না, আমার যেন কেমন লাগছে।’ বুঝলাম, সিরাজের অবহেলায় অভিমানে অনেকদিন অর্ধাহারে থাকার ফল। শরীর ভেঙে পড়েছে।

‘আপনি স্থির হয়ে শুয়ে থাকুন, আমি একজন হাকিম ডেকে আনি। তাঁরা তো রয়েছেনই।’

হামিদা ঘর ছেড়ে চলে যায়। একদিন মৃত্যু কামনা করতাম, অথচ আজ সামান্য অসুখে মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে উঠলাম কেন? এতদিন কি তবে নিজেকে চিনতে পারিনি? কিংবা মৃত্যু হবে না জেনেই নিশ্চিন্ত মনে কামনা করতাম?

আজ হয়তো সিরাজের প্রতিজ্ঞা শুনে নতুন করে বাঁচবার সাধ হয়েছে আমার। সিরাজ আর শরাব খাবে না। শরাব না খেলে তার বন্ধুরাও আর এসে জুটবে না। বন্ধুরা না এলে সে আমার কাছে আসবে, আমার সাথে কথা বলবে, আমাকে আদর করবে। আমি মরতে চাই না। না, না…

হাকিম আসেন। বেগমসায়েবাও আসেন সেই সঙ্গে। উঠতে চেষ্টা করি আমি। বেগমসায়েবার সামনে শুয়ে থাকতে সঙ্কোচ বোধ হল।

উঠো না। তুমি এখন অসুস্থ।’ বেগমসায়েবা বলেন।

হাকিম অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা শেষ হলে উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসেন। ‘হাসলেন কেন, হাকিম সায়েব?’ বেগমসায়েবার প্রশ্ন।

‘ব্যাপারটা একটু হাসির বৈকি।’ বেগমসায়েবার সামনে হাকিমের উক্তি একটু বিসদৃশ। রোগ নির্ণয় করতে পারেনি বলে সে হয়তো উড়িয়ে দিতে চায়। নবাবের ব্যাপারেও এমন করছে না তো? আসলে ফোর্থ সায়েবের কথাই হয়তো ঠিক।

‘হাসির ব্যাপার!’ বেগমসায়েবা চমকে ওঠেন। তিনি সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকেন। আমার অসুখটা নিশ্চয় ভাঁওতা বলে মনে হয়েছে তাঁর কাছে। আমার কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে ভেবে তিনি হয়তো চিন্তিত হয়েছেন।

কী হয়েছে খুলে বলুন?’ আমি চেঁচিয়ে উঠি।

‘আপনি কিছু খেতে পারছেন না, তাই না?’ হাকিমের উক্তিতে ভয়ে কেঁপে উঠি। ঠিকই ধরেছে সে। কিন্তু আমার মতো যার মনের অবস্থা, খাওয়ার প্রতি তার কি কোনো রুচি থাকে?

মরিয়া হয়ে বলি, ‘হ্যাঁ।’

‘খুব স্বাভাবিক। এ সময়ে অমন হয়।’

‘কোন সময়?’ এবারে বেগমসায়েবা অধৈর্য হয়ে ওঠেন।

‘মা হবার আগে।’

ভয়ে আর আনন্দে আমি কেঁদে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত পৃথিবীর রং যেন পালটে যায়। সিরাজের সন্তান আমার গর্ভে! কবে এসেছিল আমার গর্ভে? ঝিলের মধ্যে সেই বজরাতে কি? বুঝে উঠতে পারি না। ঠিক সিরাজের মতো মুখ, তার মতো চোখ, হাত-পা। তিলে তিলে বড় হচ্ছে সে। আমার দেহ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে সিরাজের সন্তান বড় হচ্ছে—যে সিরাজ আমাকে চায় না।

চোখের জলে বিছানা ভিজে যায়।

বেগমসায়েবা বলেন, ‘কাঁদছ কেন? এ তো আনন্দের কথা।

‘আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে।’

‘ভয়ের কিছু নেই। চুপ করে শুয়ে থাকো।’ হামিদা ছাড়া সবাই চলে যায়। হামিদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

হামিদা, এ কি ভালো হল?’

‘সেকী! এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? বাংলার আর এক নবাব আপনার গর্ভে। আজ আপনার চেয়ে সুখী কেউ আছে?’

‘না হামিদা, আমার বড় ভয় হচ্ছে।’

‘অমন হয়। শরীর খারাপ তো? একটু সুস্থ হলে দেখবেন মনটা কেমন আনন্দে ভরে উঠবে।’ হামিদার চোখে-মুখে একটা মাতৃত্বের ভাব ফুটে ওঠে। বড় ভালো লাগে আমার।

‘তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব, হামিদা।’

‘বেশ তো, ভালোই হবে।’

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *